মাশুল বন্দোবস্ত আর টাকা আমদানির হরেক ফিকির
ফৌজদারি নিয়ে আমার যা বয়ান করার ছিল করেছি। এবার আমি আমার পাঠকদের সিয়াসতের মাশুল দপ্তর নিয়ে কিছু বলতে চাই। দেখবেন পুলিশ আর এই দপ্তরের লোকেরা আপনার দহলিজে (dahliz) কোনও-না-কোনও সময় এসে খাড়া। পাটোয়ারি বন্দোবস্ত, মহকুমা কমিশনার ক্রোক, কানুনগো, সাজোয়াল, তহশিলদার, পেশকার, সেরেস্তাদার আর তাদের মদতগারদের সবারই এক্তিয়ার আছে নোটিশ লটকানোর। মাশুল বন্দোবস্ত মোতাবেক হুজুরিরা নানা বাঁকা আর সিধা রাস্তায় টাকা করে। উল্টোদিকে জমিদার বা পাট্টাদারদের হাত থেকে চলে যায় তার তালুক-মুলুক। এসব কোন ফিকিরে হয় তা জানানো দরকার। খোদ আমিই ছিলাম একজন মামুলি রায়ত। আমাকেও দপ্তরের মাতব্বরদের জবরদস্তি সইতে হয়েছে। আমার ছিল এক টুকরো জোত জমি। আমি, আমার জরু আর বাচ্চারা সেখানে বেহদ মেহনত করতাম ফসল ফলাতে। সেই জমিটাও ছিনিয়ে নিয়ে বেচে দিল। হাকিমের দরবারে আমি কম আর্জি জানাইনি। এখন আমি নাজিরের আর্দালি। অনেক আজব আজব ঘটনা আমার নজরে পড়ে। হরদম আমি চেষ্টা করি কী করে আমারই মতো বেসাহারা রায়তদের বাঁচানো যায়, কানুনি ঢঙে যে জুলুমবাজি চলে তার থেকে তাদের রেহাই দেওয়া যায়। আমার ইশারায় যদি জবরদস্তি কিছুটা কমে সেটাই অনেক। আমার মালিকদের হুঁশিয়ার করাটা আমার ফর্জ। কোম্পানি বাহাদুরের নিমকপরওয়াদা হওয়ার সুবাদে সাফ সাফ কবুল করাটাই হবে আমার ওয়াফাদারি। সাহেবান আলিসান তো তাঁর খোয়াবেও ভাবতে পারেন না কত ফিকিরে এই জবরদস্তি চলে। হুজুর হরবখত হুঁশিয়ার থাকবেন সেটা আশা করা যায় না। তাই একটু বেখেয়াল হলেই দেশি জম্মতদারেরা তাঁকে ধোঁকা দেয়। তাদের এই ফেরেব্বাজিই পুরো কানুনি বন্দোবস্তকে নকারা করে তুলেছে। লোকের কথা না শুনে আরও ভাল হত যদি তঁারা নিজেরাই সবটা দেখার তকলিফ করতেন। আপনি তো তা হলে চটে যাবেন, সওয়াল করবেন, তেমনটা আবার হয় নাকি? সরকারের সিভিল সার্ভেন্টরা কি ইংল্যান্ডের হুরমত নয়? কারও হিম্মত থাকলে বলুক হিন্দুস্তানে তাঁদের থেকেও চৌখশ আদমি আছে। এঁদের থেকেই না দুনিয়া পেয়েছে কয়েকজন হুনহার মুদব্বির! আলবাত আমি আপনার কথায় সহমত। কিন্তু আপনাকেও বুঝতে হবে দিনভর কাম করতে করতে কালেক্টর সাহেবও ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আমিই দেখেছি তাঁকে কোনও কোনও মামলা কেবল পিছনে ঠেলতে। তাঁর ইচ্ছে থাকে সুযোগ মিললে সেই মামলাগুলোর ঠিকঠাক বিচার করার। হায়। কোথায় সেই সময়। তাঁর তাঁবে যে সব ইংরেজ অফিসার তাদেরও একই হাল। তা হলে এত তাজ্জব হওয়ার কী আছে যদি বলি চাপের মুখে তাঁরা বেসামাল হয়ে পড়তেন আর তার থেকে রেহাই পাওয়ার কোনও রাস্তাও ছিল না। এবার বলুন এই জনাবরা কেমন করে আরও মুয়াস্সর (muyassar) কোনও নকশা বোর্ডের সামনে পেশ করবেন? আমি বলব, হুজুরদের জরুরত কিছু মদতগারের যারা পরদার আড়াল থেকে তাঁদের মদত জোগাবে।
মুবারকপুর গ্রামে বিঘা পাঁচেকের একটা জোত জমি ছিল আমার দখলে। পনেরো বছর ধরে আমি সেই জমিতে চাষ করি আর আমার পরদাদারা করেছে আরও পঞ্চাশ বছর। জমিদারকে আমরা বিঘা পিছু দু’টাকা বা সালিয়ানা দশ টাকার বেশি খাজনা কখনওই কবুল করিনি। আমাদের হেপাজত করত কানুন-ই-সরকার (kawaneen-i-sircar) সেখানে সাফ বলা ছিল, কোনও খুদকস্তা, ছাপ্পরবন্ধ আসামির খাজনা বাড়ানো চলবে না, যদি না আইন সময় মাফিক তা বাড়ায়। সরকারের এই ইনসাফকে আমি ভরসা করতাম। কিন্তু বলভদ্র সিং গোপনে পুরো গ্রামটা খরিদ করে। তারপর আসামিদের হাতে নোটিশ ধরিয়ে দেয়, হয় জমি ছাড় না হলে বিঘা প্রতি চার টাকা করে খাজনা দাও। নোটিশ মিলতেই আমি ছুটলাম ডিপটি সাহেবের দরবারে। জমা করলাম ওজরদারি (oozerdaree) দুই তরফের আর্জি শোনার পর ডিপটি সাহেব রায় দিলেন, যেহেতু বলভদ্র সিং হচ্ছে স্রেফ একজন কাবালাদার (kibaladar) বা বলা ভাল জমিদারের একজন মামুলি কায়েম মুকাম (kaem-mukam) তাই এরকম আদমির কোনও এক্তিয়ারই নেই খুদকস্ত রায়তের কাছ থেকে বাড়তি মাশুল আদায় করার।
বলভদ্র যেখানে নিলামদার বাইল্লত বাকি (baillut baqee) সেখানেও সে আটকে যায় ১৮১২-র ৫ নম্বর রেগুলেশন আর ১৮৪৫-র ১ নম্বর অ্যাক্ট মোতাবেক। কানুনে বলা ছিল, নিলাম খরিদদারের কোনও এক্তিয়ার নেই খুদকস্তা ছপ্পরবন্ধ আসামিদের কাছ থেকে বাড়তি খাজনা দাবি করার।
শোন! শোন! কী বলছে শোন! একেই বলে আক্কেল! কানুনই হল রায়ত পরওয়ার (ryut purwur)! হায় রে! কোথায় কী! যেই না ফসল পেকেছে, কাটার সময় হল, এক ব্যাটা এসে হাতে ধরিয়ে দিল নোংরা একটা চিঠঠা। নাগরি হরফে তাতে কিছু লেখা। মুখে বলল, পাটোয়ারির উসুল বাকি (wasil-baqee)। বলভদ্র সিং নাকি আমার কাছ থেকে দশ টাকা পায়। আমি তো জাহিল। ছুটলাম পাশের গ্রামে এক লালার কাছে। সে আমাকে চিঠঠা পড়ে যা বলল তা হচ্ছে:
সন ১২৫৩ ফসলি (fusilee) জমা খরচের হিসাব, পাঁচকড়ি আসামি মৌরসি।
পাঁচ বিঘা জোতের বিঘা প্রতি চার টাকা হিসাব ধরলে সালিয়ানা দাঁড়ায় মোট কুড়ি টাকা।
শুরুর আধা সাল ১৫ রুপিয়া বাকি— মিলেছে স্রেফ ৫ রুপিয়া।
আদায় বাকি— — — ১০ ০ ০
১৫ দিনের সুদ— — — ০ ২ ০
মরশুম (বাকি) পাটোয়ারি— ০ ০ ৬
বলভদ্র সিং-র কাছে মোট বাকি, ১০ ২ ৬
(দস্তখত) গজবলাল পাটোয়ারি
আগের বার কেমন জলদি ইনসাফ মিলেছিল ডিপটি সাহেবের কাছে তাই এবারও ছুটলাম। চিৎকার করে বলতে লাগলাম, দোহাই! ডিপটি সাহেব! দোহাই কোম্পানি বাহাদুর! জবাব দিলেন ডিপটি সাহেব, বুদ্ধু! এত শোরগোল কীসের? স্ট্যাম্প পেপারে আর্জি না জানালে আমি মজবুর। আমি তখন নাছোড়। বলতেই লাগলাম হুজুর আমার ফসল আটকে রেখেছে। জলদি কোনও বন্দোবস্ত না করলে আমার পরিবার ভুখা মরবে। আমি স্ট্যাম্প পেপারের পয়সা কোথা থেকে জোগাড় করব। লাভের লাভ হল একটাই, বেয়াদবির ওয়াস্তে আমার জুটল ঘাড় ধাক্কা।
কোথাও কোনও মদত মিলবে না বুঝতে পেরে পাগড়ি বেচে দিয়ে খরিদ করলাম স্ট্যাম্প পেপার। লেখা হল আর্জি। আমার মনে হল ওই আর্জি পড়লে কোনও পাত্থর দিল ইনসানও দুখি হয়ে যাবে। আর্জি জমা পড়লে, ডিপটি সাহেব হুকুম করলেন, “যে আর্জি জানাচ্ছে মর্জি হলে সে তার যত টাকা লোকসান হয়েছে বলে মনে হয় সেই পরিমাণ টাকা জামিন আমানত হিসাবে কাবালাদারের কাছে জমা রাখতে পারে কিংবা রাখতে পারে সরকারি তোশাখানায়। এরপর চাইলে সে বেজা ক্রোকের (beja koorkee) মামলা করতে পারে; তারপর হুকুম দিলেন আর্জি, দাখিল দফতর (dakhil duftur) করা হোক।”
কিন্তু জনাব-ই-আলি, আমি বলতে বসলাম পাগড়ি বেচে আমি স্ট্যাম্প কাগজের পয়সা জোগাড় করেছি, তারপর একে আপনি সুরাহা বলবেন? খোদা জানেন এটা বেইনসাফ হচ্ছে। আমাকে বলা হল পনেরো টাকা জমা দিতে। “আল্লার কসম! এই টাকা আমি কোথায় পাব?” ডিপটি সাহেব সাফ জানিয়ে দিলেন তিনি যেমন হুকুম দিয়েছেন তেমন না করলে তাঁর কিছু করার নেই। মালুম হল আমি কতটা লাচার (lachar)। গেলাম মহাজনের কাছে। ধার নিলাম পনেরো টাকা। কবুল করতে হল টাকা প্রতি মাসে চার পয়সা সুদ। মানে এক শো রুপিয়াতে সালিয়ানা ৭৫ টাকা। (নাফাখোর খাবিসরা এই জায়গাটা একবার পড়ে নিয়ো তা হলেই মালুম হবে ওই হিন্দু মহাজনের কাছ থেকে তালিম নেওয়াটা কত জরুরি)। টাকা জমা দিলে ছাড়াতে পারলাম ফসল। তখনকার মতো সামাল দেওয়া গেল কিয়ামত।