মান
মান ।। ভাটিয়ারি ।।
রামা হে কি আর বলিব আন।
তোহারি চরণে শরণ সো হরি
অবহুঁ না মিটে মান।।
গোবর্দ্ধন গিরি বাম করে ধরি,
যে কৈল গোকুল পার।
বিরহে সে ক্ষীণ, করের কঙ্কণ
মানয়ে গুরুয়া ভার।।
কালীয় দমন করল যেমন,
চরণ যুগল বরে।
এবেসে ভুজঙ্গ, ভরমে ভুলল,
হৃদয়ে না ধরে হারে।।
সহজে চাতক না ছাড়য়ে প্রীত,
না বৈসে নদীর তীরে।
নব জলধর, বরিখন বিনু,
না পিয়ে তাহার নীরে।।
যদি দৈব দোষেম অধিক পিয়াসে,
পিবয়ে হেরিয়ে থোর।
তবহুঁ তাহারি নাম সোঙরিয়া,
গলয়ে শতগুণ লোর।।
চণ্ডীদাস বাণী, শুন বিনোদিনি,
কি আর করহুঁ মান।
তুয়া অনুগত, শ্যম মরকত,
তো বিনু ভাবে না আন।। (১) *
——————-
(১) পাঠান্তর—
চণ্ডীদাস ভনে, শুন বিনোদিনী, কি আর বলিব তোয়।
শ্যাম রতন, জগত জীবন, না ঠেল মানেতে মোয়।।
* হস্তলিখিত প্রাচীন গ্রন্থ।
মান ।। সুহই ।।
শুনলো রাজার ঝি।
লোকেনা বলিবে কি?
মিছই করসি মান।
তোবিনু জাগল কান।।
আনত সঙ্কেত করি।
তাহা জাগাইলা হরি।।
উলটি করসি মান।
বড়ু চণ্ডীদাস গান।।
—————-
মান ।। বসন্ত ।।
এ ধনি মানিনি মান নিবার।
আবীরে অরুণ শ্যাম অঙ্গ মুকুর পর,
নিজ প্রতিবিম্ব নেহার।।
তুহুঁ এক রমণী, শিরোমণি রসবতী,
কোন্ ঐছে জগমাহ?
তোহারি সমুখে, শ্যাম সহ বিলসব,
কৈছন রস নিরবাহ?
ঐছন সহচরী বচন হৃদয়ে ধরি,
সরমে ভ্রমে মুখ ফেলি।
ঈষৎ হাসি সনে, মান তেয়াগল,
উলসিত দুহেঁ দোঁহা হেরি।।
পুন সব জন মেলি করয়ে বিনোদ কেলি,
পিচকারি করি হাতে।
দ্বিজ চণ্ডীদাস* আবীর যোগাওত,
সকল সখীগণ সাথে।।
——————-
নিবার – নিবারণ কর; ত্যাগ কর। নেহার – দেখ।
*গীতরত্নাবলী এবং পদসমুদ্র গ্রন্থে দ্বিজ হরি দাসের ভণিতাযুক্ত দৃষ্ট হয়।
মান ।। ধানশী ।।
আপন শির হাম, আপন হাতে কাটিনু,
কাহে করিনু হেন মান?
শ্যাম সুনাগর, নটবর শেখর,
কাঁহা সখি করল পয়ান?
তপ বরত কত, করি দিন যাপিনী,
যো কানু, কো নাহি পায়।
হেন অমূল ধন, মঝু পদে গড়ায়ল,
কোপে মুঞি ঠেলিনু পায়।।
আরে সই! কি হবে উপায়?
কহিতে বিদরে হিয়া, ছাড়িনু সে হেন পিয়া।
অতি ছার মানের দায়।।
জনম অবধি মোর, এশেল রহিবে বুকে,
এ পরাণ কি কাজ রাখিয়া?
কহে বড়ু চণ্ডীদাস কি ফল হইবে বল,
গোড়া কেটে আগে জল দিয়া?
——————-
কাহে – কাকে। কাঁহা সখি করল পয়ান – সখী কোথায় গমন করিল? যো – যে। কো – কেহ। মঝু – আমার।
মান ।। শ্রীরাগ ।।
রাই মুখে শুনল ঐছল বোল।
সখীগণ কহে ধনি নহ উতরোল।।
তুয়া মুখ দরশন পায়ল সেহ।
কৈছে আছল কছু সমুঝল এছ।।
তুঁহু কাহে এত উৎকণ্ঠিত ভেল।
তোহে হেরি সো আকুল ভৈ গেল।।
ঐছে বিচার করত যাঁহা রাই।
তুরিতহি এক সখী মিলল তাই।।
এ ধনি পদুমিনি কর অবধান।
তোহারি নিয়ড়ে মুঝে ভেজল কান।।
চণ্ডীদাস কহে বিধুমুখী রাই।
অতিশয় ব্যাকুল ভেল কানাই।*
——————-
নহে উতরোল – ব্যাকুল হইও না। ভৈ গেল – হইয়া গেল। পদুমিনি – পদ্মিনী। নিয়ড়ে – নিকটে।
* হস্তলিখিত প্রাচীন গ্রন্থ।
মান ।। ধানশী ।।
রাইক ঐছন সকরূণ ভাব।
শুনি সখী আয়ল কানুক পাশ।।
কহইতে সকল সম্বাদ।
গদ গদ করই বিষাদ।।
চল চল নাগর রস শিরোমণি।
তুয়া বিনু রাধিকা অধিক সাপিনী।।
চণ্ডীদাস কহে বিনোদ রায়।
ঝাট চল রাইক মাঝ হৃদয়।।*
——————-
* হস্তলিখিত প্রাচীন গ্রন্থ।
মান ।। শ্রীরাগ ।।
আসি সহচরী, কহে ধিরি ধিরি,
শুনহ নাগর রায়।
অনেক যতনে, ঘুচাইলাম মানে,
ধরিয়া রাইয়ের পায়।।
তবে যদি আর, মান থাকে তার,
মানবি আপন দোষ।
তোমার বদন, মলিন দেখিলে,
ঘুচিবে এখনি রোষ।।
তুরিত গমনে, এস আমা সনে,
গলেতে ধরিয়া বাস।
সো হেন নাগর, হইয়া কাতর,
দাঁড়াইলা রাইয়ের পাশ।।
রাই কমলিনী, হেরি গুণমণি,
বঁধুয়া লইল কোলে।
দুহুঁক হৃদয়ে আনন্দ বাড়িল,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে বলে।
—————-
মান ।। ধানশী ।।
ললিতার বাণী, শুনি বিনোদিনী
প্রসন্ন বদনে কয়।
আমিত কেবল তোদের অধীন,
যা বল শুনিতে হয়।।
সখি তোরা মোর কর এহি হিতে!
আর যেন কখন, না করে এমন,
পুছ উহায় ভাল মতে।।
পুন যদি আর এমত ব্যাভার
করয়ে এ ব্রজ ভূমে।
উহার প্রণতি শ্রবণ গোচরে
না করিব এ জনমে।
এত শুনি হরি গলে বাস ধরি
কহয়ে কাতর বাণী!
শুন বিনোদিনি জনমে জনমে
আমি আছি প্রেমে ঋণী।।
এত শুনি গোরি, দু বাহু পসারি
বঁধুয়া করিল কোলে।
এই খানে হয়, রসামৃত ময়,
চণ্ডীদাসে ইহা বলে।।
—————-
মান ।। ধানশী ।।
ছিছি মানের লাগি, শ্যাম বঁধুরে,
হারাইয়া ছিলাম।
শ্যামল সুন্দর, মধুর মূরতি,
পরশে শীতল হৈলাম।।
শ্রীমধুমঙ্গলে, আন কুকূহলে,
ভুঞ্জাও ওদন দধি।
হারাধন যেন, পুনহি মিলল,
সদয় হইল বিধি।।
নিজ সুখরসে, পাপিনী পরশে,
না জানে পিয়াক সুখ।
কহে চণ্ডীদাসে, এ লাগি আমার,
মনেতে উঠয়ে দুখ।।
——————-
শ্রীমধুমঙ্গল :–
“বিশেষ রহস্যকারী বিদূষক দল। তার মধ্যে বিশেষতঃ শ্রীমধুমঙ্গল।।
শ্রীকৃষ্ণ থাকেন যবে প্রিয়গণ সনে। তথায় যাইতে নারে নর্ম্ম সখাগণে।।”
—ভক্তমাল।
ভুঞ্জাও – ভোজন করাও। ওদন – অন্ন।
মান ।। সুহই ।।
ছিছি দারূণ, মানের লাগিয়া,
বন্ধুরে হারাইয়া ছিলাম।
শ্যাম সুন্দর, রূপ মনোহর,
দেখিয়া পরাণ পেলাম।।
সই! জুড়াইল মোর হিয়া।
শ্যাম অঙ্গের, শীতল পবন,
তাহার পরশ পাইয়া।। ধ্রূ।
তোরা সখিগণ, করাহ সিনান,
আনিয়া যমুনা নীরে।
আমার বন্ধুর, যত অমঙ্গল,
সকল যাউক দূরে।।
শ্রীমধু মঙ্গলে, আহন সকলে,
ভুঞ্জাহ পায়স দহি।
বন্ধুর কল্যাণে, দেহ নানা দানে,
আমার সদয় বিধি।।
কহে চণ্ডীদাস, শুনহ নাগর,
এমত উচিত নয়।
না দেখিলে যুগ, শতেক মানয়,
ইথে কি পরাণ রয়।।
——————-
শ্রীমধুমঙ্গল :–
“বিশেষ রহস্যকারী বিদূষক দল। তার মধ্যে বিশেষতঃ শ্রীমধুমঙ্গল।।
শ্রীকৃষ্ণ থাকেন যবে প্রিয়গণ সনে। তথায় যাইতে নারে নর্ম্ম সখাগণে।।”
—ভক্তমাল।
ভুঞ্জাও – ভোজন করাও। দেহ নানা দানে – না প্রকারে দান কর।
মান ।। শ্রীরাগ ।।
রাইয়ের বচন, শুনি সখীগণ,
আনল যমুনা বারি।
নাগর সুন্দর, সিনান করল,
উলসিত ভেল গোরি।।
ললিতা আসিয়া, হাসিয়া হাসিয়া,
পরায়ল পীত বাস।
পরিয়া বসন, হরষিত মন,
বসিলা রাইয়ের পাশ।।
রাই বিনোদিনী, তেড়ছ চাহনি,
হানল বন্ধুর চিতে।
নাগর সুন্দর, প্রেমে গর গর,
অঙ্গ চাহে পরশিতে।।
মনে আছে ভয়, মানের সঞ্চয়,
সাহস নাহিক হয়।
অতি সে লালসে, না পায় সাহসে,
দ্বিজ চণ্ডীদাস কয়।।
——————-
উলসিত ভেল গোরি – শ্রীরাধিক পুলকিত হইলেন।