২০
মল্লভূমের রাজকন্যার জন্মগ্রহণের পর ছয়মাস অতিবাহিত হয়েছে। মহারানী শিরোমণি পুরোপুরি সুস্থ। বংশের নিয়ম অনুযায়ী মা ও কন্যাকে একমাস অতিক্রান্ত হতেই সাড়ম্বরে অন্তঃকুটি থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। তারপর থেকে রানীর ছোট্ট শিশুটিকে নিয়ে রানীর ব্যস্ততার শেষ নেই। কন্যাই এখন তাঁর পৃথিবী।
আদরের বোনকে নিয়ে মনোহরারও বড় আহ্লাদ। সারাদিন তার বোনকে নিয়েই কেটে যায়।
আজ এক বিশেষ শুভদিন। সকাল সকাল স্নান সেরে মনোহরা সেজেগুজে ছুটে বেড়াচ্ছে। মাথায় গুঁজেছে লাল টকটকে দুপুরমণি ফুল। মিশমিশে কালো চুলের মধ্যে সেই ফুলকে মনে হচ্ছে গনগনে আগুনের হলকা।
মনোহরা তো বটেই, মেনকা ও অন্যান্য দাসীরাও আজ অতি ব্যস্ত। আজ রাজজ্যোতিষী দেবনাথ বাচস্পতি রাজকন্যাকে দেখতে আসবেন। তিনি শুধু নবজাতিকাকে আশীর্বাদই করবেন না, তার গ্রহকুণ্ডলীও বিচার করবেন। সঙ্গে আসবেন মহারাজ, রাজমাতা ও রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যেরা।
মহারানীর নিজস্বমহলের বাইরের ঘরে বসে রয়েছেন ভট্টঠাকুর। তাঁর সামনে নানা উপাচার সাজানো। একটি কুলোয় এক টুকরো কাগজ কালি কলম, সোনা, রুপো ও দস্তামিশ্রিত ধাতুতে তৈরি একটি আংটি, ধান, চাল, দুধ, জবা ফুল, ঘি, মধু, ইত্যাদি। তিনি অপেক্ষা করছেন বাচস্পতিমহাশয়ের জন্য।
মাঝে-মাঝেই তিনি কোনো একটি বস্তুর অভাব বোধ করছেন, এবং মেনকা বা অন্যান্যরা ছুটে যাচ্ছে।
বিপরীতে কন্যাকে কোলে নিয়ে নতুন বস্ত্র ও অলঙ্কার পরে বসে আছেন রানী শিরোমণি। নতুন মাতৃত্বের তৃপ্তি, আনন্দ ঝলমল করছে তাঁর মুখে। তিনি নির্নিমেষে তাকিয়ে আছেন মেয়ের দিকে।
শিশুটি আধো ঘুম আধো জাগ্রত অবস্থায় ঠোঁট ফাঁক করে বিজাতীয় কিছু শব্দ উচ্চারণ করছে! শিরোমণি প্রাণভরে উপভোগ করছেন, দুই চক্ষু দিয়ে দৃশ্যগুলো উপভোগ করছেন একটু একটু করে।
এখনও পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে, শিশুটির সঙ্গে মাতার মুখের সাদৃশ্যই বেশি, গাত্রবর্ণ অবশ্য পিতার মতো উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ হবে। ওইটুকু হলে কী হবে, টানা টানা অক্ষিপল্লব তার চোখে। নিজের মনে হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে শূন্যদৃষ্টি মেলে যখন সে তাঁর দিকে তাকায়, আলতো করে উঠে বসে, আদো আদো শব্দ ছড়ায়, শিরোমণির মনে হয় জীবন সার্থক হয়ে গেল।
দরজায় শব্দ পেয়ে শিরোমণি শশব্যস্তে উঠে দাঁড়ালেন। রাজমাতা স্বর্ণময়ী ঢুকছেন ঘরে। সঙ্গে মেজরানী সুলক্ষণার পুত্র শীতল। শীতল প্রায় প্রতিদিনই এসে বোনের সংবাদ নিয়ে গিয়েছে।
স্বর্ণময়ীই একদিনের বেশি আসেননি। কন্যার জন্মের দ্বিতীয় দিনে তিনি অন্তঃকুটীতে এসেছিলেন, মায়ের দিকেই তাঁর মনোযোগ ছিল। শিরোমণির শারীরিক অবস্থা নিয়ে বাইরে রাজবৈদ্যের সঙ্গে কথা বলে চলে গিয়েছিলেন।
আজ দুজনের মুখোমুখি হওয়ার দ্বিতীয় দিন।
শিরোমণি নীচু হয়ে প্রণাম করলেন। স্বর্ণময়ী সামান্য মাথা হেলিয়ে আশীর্বাদের ভঙ্গি করলেন। তাঁর পেছনে এসেছেন মেজ ও ছোটরানী সুলক্ষণা ও কাঞ্চনমণি। সঙ্গে স্বর্ণময়ীর পুত্র জগত কুমারের স্ত্রী অহল্যা। এবং আরও দুই কুমারের স্ত্রী। সকলে এসে বসলেন শিরোমণির দুই পাশে। মনোহরা ব্যস্তভঙ্গীতে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।
স্বর্ণময়ী বললেন, ‘ভট্টঠাকুর, কন্যার নামকরণের তিথি কিছু নির্দিষ্ট হল?’
ভট্টঠাকুর বললেন, ‘হ্যাঁ মাতা। আগামীকাল পূর্ণিমা। তখনই মহারাজা আনুষ্ঠানিকভাবে রাজকুমারীর নামকরণ করবেন।’
স্বর্ণময়ী অস্ফুটে বললেন, ‘প্রথম কন্যা। আমি সুন্দর ও উপযুক্ত নাম ভেবে রেখেছি। লাবণ্যপ্রভা।’
মনোহরা ফিক করে হেসে ফেলল, ‘ওমা! মহারাজা তো রাজকুমারীর নাম ঠিক করে ফেলেছেন। শ্যামাকুমারী। আগামীকাল শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হবে।’
তিন রানী পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। রাজবংশের নিয়ম অনুযায়ী নবজাতকের নাম রাখার অধিকার বংশের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির। সুতরাং স্বর্ণময়ীরই নামকরণ করার কথা। রাজবংশে এই প্রজন্মে যত সন্তান জন্মেছে, প্রত্যেকের তিনিই নামকরণ করেছেন।
স্বর্ণময়ী মুখে কিছু প্রকাশ করলেন না। তাঁর সুন্দর বাঁকানো ভ্রূ দুটি সামান্য বক্র হয়েই থেমে গেল।
দরজার কাছে মেনকা শঙ্খধ্বনি করে উঠল।
রাজজ্যোতিষী দেবনাথ বাচস্পতি এবং মহারাজা বীরহাম্বীর উপস্থিত হয়েছেন। রাজজ্যোতিষী শিশুকন্যাকে আশীর্বাদ করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান আরম্ভ করে দিলেন। নানাধাতুর অঙ্গুরীয়টি দক্ষিণহস্তে ধরে শিশুর কপালে ঠেকিয়ে চোখবুঁজে প্রার্থনা করলেন। তারপর মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে ঝিনুক দিয়ে ফেলতে লাগলেন মধু।
সকলে করজোড়ে বসেছিলেন। মাঝে মাঝে শঙ্খধ্বনি দিচ্ছিল মেনকা ও আরেক দাসী। প্রায় দুই দণ্ড অতিবাহিত হওয়ার পর বাচস্পতি মন্ত্রোচ্চারণ শেষ করে অপেক্ষমান মহাদণ্ডের দিকে তাকালেন।
মহাদণ্ড মল্লরাজ্যের এক বিশেষ উপাধিপ্রাপ্ত আধিকারিক। তাদের কাজ হল পূজাপার্বণ বা আনন্দানুষ্ঠানে তোপধ্বনির সংকেত দেওয়া।
বাচস্পতিমহাশয়ের ইঙ্গিতে মহাদণ্ড বাইরে চলে গেল নির্দেশ দিতে। একটু পরেই বাইরে থেকে ভেসে এল তোপধ্বনি।
বীরহাম্বীর হাসিমুখে কন্যাকে দেখছেন। সে এখন দিব্যি চোখ পিটপিট করে চারদিক দেখছে। স্বস্তিতে রাজা একটা লম্বা শ্বাস লম্বা নিলেন। যাক, সব নির্বিঘ্নেই মিটেছে।
‘পণ্ডিতমশাই এবং মাতা, আপনাদের দুজনের সম্মতি নিয়ে আজ একটি আনন্দসংবাদ দিতে চাই। আমি আর মহারানী যৌথভাবে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ বীরহাম্বির বললেন, ‘এই ঘনিষ্ঠ পরিসরে আগে জানালে আপনাদের সম্মতি তো পাবই, মেজরানী সুলক্ষণাও আজ আছেন। তিনিও জানতে পারবেন।’
স্বর্ণময়ী কিছু বললেন না। দেবনাথ বাচস্পতি বললেন, ‘কী সিদ্ধান্ত?’
মনোহরা ঘরের মধ্যে শ্যামাকুমারীকে কোলে নিয়ে আদর করছে। বীরহাম্বীর বললেন, ‘মনোহরা মা, তুই একটু বাইরে যা তো!’
মনোহরা একটু বিস্মিত। বোনকে মায়ের কোলে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
রাজমাতা স্বর্ণময়ীর মুখে সামান্য এক প্রশান্তি ফুটে উঠল। মন্ত্রীতনয়া মনোহরাকে নিয়ে সর্বক্ষণ আহ্লাদ, রাজপরিবারের প্রতিটি বিষয়ে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা তাঁর ঘোর অপছন্দ। বীরহাম্বীর ও মহারানী শিরোমণি তার প্রতি স্নেহে অন্ধ। তাই আজ বীরহাম্বীরের মনোহরাকে গৃহত্যাগ করতে বলায় তিনি ভারি প্রীত হলেন।
বীরহাম্বীর স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বললেন, ‘আপনারা জানেন, মনোহরাকে মহারানী নিজের কন্যা বলেই মনে করেন। আমি তাকে সেই চোখেই দেখি। শ্যামাকুমারীর জন্মের পরেও সে আমাদের জ্যেষ্ঠাকন্যার মতো। সামনের ফাল্গুনে সে পনেরো পূর্ণ করবে। কিছুদিন ধরেই মনোহরার জন্য এক সুপাত্রের সন্ধান করছিলাম। জীমূতবাহন সেই ভার আমাদের ওপরেই ন্যস্ত করেছেন। বেত্রগড়, সিমলাপাল এমনকী মানভূমের সামন্তরাজার পক্ষ থেকেও সম্বন্ধ এসেছে। কিন্তু অনেক ভেবে মহারানী বলেছেন, মনোহরাকে ছেড়ে তিনি থাকতে পারবেন না।’
‘সে বললে কী করে হয়?’ রাজমাতা স্বর্ণময়ী বললেন, ‘মেয়েকে পরের ঘরে পাঠাতে সবারই কষ্ট হয়, তাই বলে বিবাহ দিতে হবে না?’
‘না মাতা, বিবাহ দেব না তা তো বলিনি।’ বীরহাম্বীর বললেন, ‘বলেছি তাকে কাছছাড়া করতে চাই না। তাহ মেজোরানী সুলক্ষণার পুত্র শীতলের সঙ্গে তার বিবাহ দিতে চাই। শীতল আমার প্রিয় পুত্র, ভাবী মহাসেনাপতি। মনোহরা তার স্ত্রী হলে সবদিকে ভালো হবে।’
মেজরানী সুলক্ষণা এই শুনে চমকে উঠলেন, চকিতে দৃষ্টি বিনিময় হল শ্মশ্রুমাতার সঙ্গে। শীতল তাঁর গর্ভজাত পুত্র হলেও বিমাতা শিরোমণি ও বৈমাত্রেয় ভ্রাতা রঘুনাথের সঙ্গে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। আসলে মেজরানী সুলক্ষণা ও ছোটরানী কাঞ্চনমণি বেশি মাত্রায় রূপসচেতন। একটা বড় সময় তাঁদের রূপচর্চা ও প্রসাধনেই অতিবাহিত হয়।
স্বর্ণময়ী নিরুত্তর দেখে বীরহাম্বীর বললেন, ‘কিছু বলছেন না যে মাতা?’
‘কী বলব বীর?’ স্বর্ণময়ী বললেন, ‘তুমি তো আমার মতামত চাওনি। নিজেদের সিদ্ধান্তটা জানাচ্ছ মাত্র।’
‘এভাবে বলছেন কেন মাতা?’ বীরহাম্বীর বিব্রত হয়ে বললেন, ‘আপনার কি এই বিয়েতে মত নেই? মনোহরা কোন দিক দিয়ে রাজপরিবারের পুত্রবধূ হওয়ার অযোগ্য?’
স্বর্ণময়ী বললেন, ‘বিষয়টা যোগ্য-অযোগ্যর নয় বীর। যদি আমার মতামত শুনতে চাও, তাহলে বলব, মল্লরাজ্যে বিবাহও একটা কূটনৈতিক কৌশল। মনোহরা মন্ত্রীকন্যা, সে আমাদের বংশের কেউ নয়। তার বিবাহ কোথায় দেবে, তা নিয়ে আমার কৌতূহল নেই। কিন্তু শীতল হল রাজকুমার, তার প্রথম বিবাহ নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। সিমলিপাল, বেত্রগড় বা অন্য সামন্তরাজার কন্যাকে পুত্রবধূ করে আনলে সেই রাজ্যের দিক থেকে বিদ্রোহের আর কোনও আশঙ্কা থাকত না। এভাবেই অনেক আঞ্চলিক শাসককে নিজপক্ষে এনেছিলেন তোমার পিতা।’
‘জানি মাতা।’ বীরহাম্বীর বললেন, ‘কিন্তু কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য আমার বাকি চার পুত্র তো রয়েছে। শীতল আঠারো পূর্ণ করেছে। এই তো বিবাহের উপযুক্ত বয়স! তাছাড়া আরও একটি কারণ রয়েছে। আপনি তো জানেনই, আমার কনিষ্ঠ পুত্র রঘুনাথ দিনদিন চঞ্চল হয়ে উঠছে। একটা দিনও যায় না, যেদিন ওর সম্পর্কে কোনও অভিযোগ কানে আসে না। সে নিজের মা’কেও ভয় পায় না। একমাত্র শীতল ছাড়া দাদাদের মধ্যে কাউকে মানেও না। যে-কোনওদিন নাকি সে কাউকে না-বলে রাজ্যত্যাগ করবে, শীতলের কাছে সে অনেকবার এরকম বলেছে। আমি খুবই চিন্তিত। মনোহরা তার বউদিদি হলে হয়ত দিদির শাসনে ভালোবাসায় তার অশান্তভাব কমবে।’
‘এটা কোনও কারণ হল?’ ব্যঙ্গের ছলে বললেন স্বর্ণময়ী।
বীরহাম্বীর অস্থির হয়ে বললেন, ‘তাছাড়া শীতল পরে আরও বিবাহ করুক না, ক্ষতি কী!’
‘ক্ষতি কিছুই নেই বীর! তোমাকে এত জবাবদিহি করতে হবে না। তবে তোমার কাছে রাজবংশের কৌলীন্য, মর্যাদা—এইগুলোর গুরুত্ব নেই দেখে আশ্চর্য হলাম।’ স্বর্ণময়ী ধীরগতিতে উঠে দাঁড়ালেন, ‘পণ্ডিতমশাই, আসি। আমায় পুজোর সময় হয়েছে।’
সবাই বেশ কিছুক্ষণ নিরুত্তর। আবহাওয়া হঠাৎ ভারী হয়ে উঠেছে।
বীরহাম্বীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘রঘুকে নিয়ে আমার বড় চিন্তা। ও কিছুতেই সাংসারিক জীবনে থাকতে চায় না। কী করি বলুন তো জ্যোতিষীমশাই?’
দেবনাথ বাচস্পতি বললেন, ‘রঘুনাথের কুষ্ঠিও তাই বলছে মহারাজ। সম্ভবত কোনও অতৃপ্তি ওকে সারাজীবন ব্যথা দেবে। সেই অতৃপ্তি হয়তো ওকে পরিণত বয়সে কোনও বড় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবে।’
বীরহাম্বীর বললেন, ‘কী সিদ্ধান্ত? শুভ না অশুভ?’
‘শুভ-অশুভ আপেক্ষিক মহারাজ।’ বাচস্পতিমহাশয় চোখ বন্ধ করলেন, ‘আপনার কাছে যা শুভ অন্যের কাছে তা অশুভ হতেই পারে। আবার গোটা দেশ যেটাকে মঙ্গলময় ভাবছে, সে আপনি নাও চাইতে পারেন। শ্রীনিবাস আচার্য মহাশয়ের সেদিনের কথা স্মরণ করুন। শ্রীচৈতন্য সারা দেশে প্রেমরসের জোয়ার এনেছিলেন। তাঁর সন্ন্যাসগ্রহণ গোটা দেশের কাছে কল্যাণকর। কিন্তু তাঁর মায়ের কাছে? সন্তানের গৃহত্যাগ করে চলে যাওয়াটা কি আনন্দের?’
‘চৈতন্য বলতে কি নিমাইপণ্ডিতের কথা বলছেন?’ রানী শিরোমণি প্রশ্ন করলেন।
‘হ্যাঁ মহারানী।’ বাচস্পতিমহাশয় বললেন, ‘তিনি দেহরক্ষা করেছেন প্রায় ত্রিশ বছর হল। কিন্তু শ্রীনিবাস আচার্যর কাছ থেকে তাঁর সম্পর্কে যত জানছি, তত মুগ্ধ হচ্ছি। অনেকেই এখন একমত, তিনি স্বয়ং ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ।’
ভট্টঠাকুর উৎসুকভাবে শুনছিলেন। এতদিন তাঁর কানেও কানাঘুষো আসছিল যে মহারাজ বীরহাম্বীর ইদানীং বৈষ্ণবরসে মজেছেন, সেইজন্যই রাজকন্যার নাম দিয়েছেন শ্যামাকুমারী। কিন্তু দেবনাথ বাচস্পতি নিজে শাক্ত পূজারী ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও শ্রীনিবাস আচার্যের ঘনিষ্ঠ হয়েছেন?
ওই বৃদ্ধ বৈষ্ণবের মধ্যে কী এমন সম্মোহনী শক্তি আছে যে সকলেই আবিষ্ট হয়ে পড়ছেন? রাজপণ্ডিত শ্রীব্যাস আচার্যের অসন্তোষ অমূলক নয়। বিরক্তিতে ভট্টঠাকুরের হৃষ্টপুষ্ট মুখখানি ক্রমশ গম্ভীরতর হয়ে উঠছিল।
২১
রুদ্রাক্ষ বসেছিল অমাত্যদের ঠিক পিছনের একটি আসনে। সে রাজঅতিথি নিবাসে রয়েছে, কাজেই সাধারণ দর্শনার্থীদের মত একেবারে পিছনে তার স্থান হয়নি।
মহারাজা এখনও আসেননি। অন্য প্রতিটি আসনেই পদমর্যাদা অনুসারে প্রশাসকমণ্ডলী বসে রয়েছেন। শুধুমাত্র কিছু দূরের একটি বেদীর উপরের আসন ফাঁকা।
ওই আসন কি বিশেষ কারো জন্য নির্ধারিত?
রুদ্রাক্ষ আগ্রহভরে গোটা রাজসভায় চোখ বুলিয়ে দেখছিল। রাজধানী বিষ্ণুপুরে সে এসেছে অনেকদিন হল। ইচ্ছাকৃতভাবে সে বেশ কিছুকাল রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে অতিবাহিত করেছে। এখানকার নগরশৈলী ও পরিকল্পনা দেখে সে মোহিত হয়ে গিয়েছে। অসাধারণ সব মন্দির, অনবদ্য তাদের স্থাপত্য। তুলনায় রাজসভা আড়ম্বরহীন, নিজেদের জাঁকজমক যেন ইচ্ছা করেই প্রচ্ছন্ন রাখা হয়েছে। সুন্দর ছিমছাম আসন এবং দেওয়ালচিত্র দিয়ে অলংকৃত করা হয়েছে সভাটি।
এই কমাসে ছোট রাজকুমার রঘুনাথের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। দুজনে ঘুরে বেড়িয়েছে শহরের নানাপ্রান্তে। রঘুনাথ ছেলেটি খুব চঞ্চল, অনুসন্ধিৎসা প্রবল। ইতিমধ্যেই গোটা চৌহদ্দির মন্ত্রী-অমাত্য আবাস, হস্তীশালা, অশ্বশালা, মন্দির সবকিছুর অবস্থান সে দেখে নিয়েছে।
মনে মনে ভাবছিল রুদ্রাক্ষ, মল্লরাজ্যের রাজসভা সত্যিই অদ্ভুত। একটি চৌহদ্দির মধ্যে রাজবাড়ি, মন্ত্রী-অমাত্যবর্গের বাড়ি এবং রাজসভাগৃহ রয়েছে। এতে দৈনন্দিন রাজকার্য পরিচালনায় সুবিধা হয়, কিন্তু শত্রুদের কথা বিবেচনা করলে চরম নির্বুদ্ধিতা। একে তো রাজদুর্গে প্রবেশ করতে গেলে পরিখা জাতীয় বাধা নেই, শুধু কিছু প্রতিহারী রক্ষক রয়েছে। তার ওপর শত্রু যদি একবার রাজদরবার দখল করে ফেলতে পারে, তাদের পক্ষে তখন রাজবাড়ি ও রাজাকে বন্দী করা কোন সমস্যাই হবে না।
অদ্ভুত! পরিত্যক্ত রাজধানী প্রদ্যুম্নপুরেও সুগভীর পরিখা রয়েছে, এখানে কেন নেই?
জয়ধ্বনিতে ওর চিন্তাপ্রবাহ ছিন্ন হল। উঠে দাঁড়িয়ে মহারাজাকে অভিবাদন জানাতে গিয়েই সে চমকে উঠল।
রাজাকে অনুসরণ করে যিনি ধীর পায়ে গিয়ে অনতিদূরের স্বতন্ত্র আসন গ্রহণ করলেন, তাঁকে রুদ্রাক্ষ বিলক্ষণ চেনে।
বিষ্ণুপুর আসার সময় ব্রীড়াবতী নদীর তীরে পরিচয় হওয়া সেই জ্ঞানী ব্রাহ্মণ। নিজের নাম বলেছিলেন শ্রীনিবাস ভট্টাচার্য। ওঁর পরিচয়েই রুদ্রাক্ষের আশ্রয় নেওয়ার কথা ছিল রামনাথ ঘোষালের বাড়ি প্রদ্যুম্নপুরে। অবশ্য সেই রাতে প্রদুম্নপুরের রাজদুর্গেই সে রাত্রিযাপন করেছিল। বৃদ্ধ রাজকুমার মাধব মল্লের অনুরোধে।
কিন্তু ইনি তো গৌড় যাচ্ছিলেন বলেছিলেন! ইনি কি রাজসভার সম্মানীয় সদস্য? নিশ্চয়ই তাই। না-হলে অমন উচ্চাসন তিনি পাবেন না।
এক অমাত্যকে সে পিছন থেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, উনি কি রাজপণ্ডিত?’
‘না-না!’ অমাত্যটি মুখ ফিরিয়ে অসন্তুষ্টস্বরে বললেন, ‘রাজপণ্ডিত কেন হতে যাবেন? বামদিকের অলিন্দের সামনের আসনে বসে আছেন যে ব্রাহ্মণ, উনিই আমাদের রাজপণ্ডিত শ্রীব্যাস আচার্য। যেমন জ্ঞানী তেমনই সজ্জন ব্যক্তি।’
‘তবে উনি কে?’
অমাত্যর কণ্ঠে আরও অসন্তোষ ঝরে পড়ল, ‘উনি সম্প্রতি রাজ্যে এসেছেন, বৃন্দাবনের এক বৈষ্ণব পণ্ডিত। যাচ্ছিলেন গৌড়ে, কিন্তু কেন জানিনা এখানেই রয়ে গিয়েছেন। রাজামশাই ওঁকে খুবই শ্রদ্ধা করেন।’
রুদ্রাক্ষের অস্বস্তি বাড়ছিল। আজ সে এখানে এসেছে কিছু অনুরোধ নিয়ে। ব্যবস্থাপনা দেখে মনে হচ্ছে সকলের সামনেই মহারাজাকে নিজের আর্জি পেশ করতে হবে।
তখন কি তার পূর্বপরিচয়ের কথা ওই ব্রাহ্মণ মহারাজাকে জানিয়ে দেবেন?
জানিয়ে দিলেই বা কি! সে তো সেদিন সত্য কথাই বলেছিল। হ্যাঁ, একটা ছোট মিথ্যা বলেছিল বটে। নিজেকে পরিচয় দিয়েছিল সুলতানের সেনাদলের প্রাক্তন সৈন্য হিসেবে। ব্রাহ্মণের কি অত বিশদে মনে আছে?
না, অত ভেবে লাভ নেই। ভবিতব্যে যা আছে তাই হবে! লক্ষ্য করল, মহারাজা বীরহাম্বীরের বয়স বেশি না হলেও তিনি বেশ স্থিতধী, শান্ত। প্রত্যেকের বক্তব্য শুনছেন, প্রয়োজনীয় আদেশ দিচ্ছেন। মুখমণ্ডলে মধুর হাসি।
সভার কাজকর্ম শুরু হল। কিছুক্ষণের মধ্যে মহাসেনাপতি উঠে দাঁড়ালেন। অভিবাদন জানিয়ে বললেন, ‘রাজামশাই, মল্লরাজ্যে এসে উপস্থিত হয়েছেন মাননীয় সুলতান সুলেমান কররাণীর বিশেষ সচিব রুদ্রাক্ষ লাহিড়ী।’
রুদ্রাক্ষ সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল, ‘প্রণাম মহারাজ।’
বীরহাম্বীর মাথা নাড়লেন, করজোড়ে নমস্কার জানালেন। তারপর বললেন, ‘আপনাকে স্বাগত। আপনার আতিথেয়তার ব্যবস্থা হয়েছে তো?’
‘হ্যাঁ রাজামশাই। আমি অতিথিভবনেই রয়েছি।’
‘উত্তম।’ বীরহাম্বীর স্মিতমুখে রুদ্রাক্ষের দিকে তাকালেন, ‘সুলতানের সব কুশল?’
‘আজ্ঞে।’ রুদ্রাক্ষ বিনম্রভাবে উত্তর দিল, ‘সুলতানের এখন বয়স হয়েছে। তাঁর পরিকল্পনা সংক্রান্ত সবকিছু দেখছেন জামাতা মহম্মদ ফারমুলী। তাঁর পুত্ররাও আছেন।’
বীরহাম্বীর মাথা নাড়লেন, তারপর বললেন, ‘বেশ।’ এক অমাত্যকে আদেশ করলেন, ‘মহাশয়কে নিভৃতকক্ষে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি সভাশেষে যাচ্ছি।’
সভা ছেড়ে বেরোবার সময় রুদ্রাক্ষ আড়চোখে শ্রীনিবাস আচার্যর দিকে তাকিয়ে দেখল, তিনি স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন মহারাজের দিকে। এখনও পর্যন্ত রুদ্রাক্ষের সঙ্গে তাঁর দৃষ্টিবিনিময় হয়নি।
বীরহাম্বীর নিভৃতকক্ষে এলেন প্রায় একদণ্ড পর। বাইরের প্রহরী ছাড়া কাছেপিঠে কেউ নেই। এই ঘরেও মহারাজের বসার জন্য একটি সিংহাসন রয়েছে। আর তার সামনে রয়েছে সুদৃশ্য পাঁচটি আসন।
প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর রুদ্রাক্ষ কোনও গৌরচন্দ্রিকা না করে বলল, ‘মহারাজ! আমাকে পাঠিয়েছেন সুলতান কররাণীর সেনানায়ক মহম্মদ ফারমুলী। তিনি আপনাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ও আপনার কাছে অনুমতিপত্র চেয়েছেন।’
‘অনুমতিপত্র! আমার কাছে?’ বীরহাম্বীরের ভ্রূ কুঞ্চিত হয়েই আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল।
এই অভিব্যক্তি স্বাভাবিক। মল্লভূম একটি বিচ্ছিন্ন নাতিবৃহৎ অরণ্যরাজ্য, সেই রাজ্যের অধিপতির কাছে তামাম বাংলা ও বিহারের মহাশাসকের অনুমতি চাওয়া অবশ্যই বিস্ময়কর।
রুদ্রাক্ষ মৃদু হেসে ভুর্জপত্র এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
বীরহাম্বীর পত্রটি পড়ে ফেললেন। তারপর বললেন, ‘উনি দূতকে দিয়ে এই পত্র না পাঠিয়ে আপনাকে দিলেন কেন?’
রুদ্রাক্ষ প্রস্তুত ছিল, বলল, ‘ফারমুলী দৌত্যপ্রথায় বিশ্বাস করেন না মহারাজ। তিনি মনে করেন ওতে তেমন আন্তরিকতার স্পর্শ নেই।’
বীরহাম্বীর কিছু একটা চিন্তা করলেন, তারপর হেসে বললেন, ‘বেশ। আমি আপনার হাত দিয়ে শীঘ্রই পাঠাব এই পত্রের উত্তর। ততদিন আপনি নিঃসঙ্কোচে আমার রাজ্যের অতিথি হয়ে থাকুন। সামনে আমাদের বেশ কিছু উৎসব রয়েছে। আপনি থাকলে আমরা আনন্দিত হব।’
‘ধন্যবাদ মহারাজ। আমার আরও একটি আনুরোধ ছিল।’
‘বলুন!’
রুদ্রাক্ষ আরও কিছুটা গুছিয়ে নিল। এই বিষয়টিতে রাজসহায়তা নেওয়ার পরিকল্পনা তার ছিল না, নিরুপায় হয়েই নিতে হচ্ছে। পবনের সঙ্গে লাহিড়ীপাড়ায় গিয়ে সে অনেক খুঁজেছে, সন্ধান মেলেনি।
‘আমি এক আত্মীয়কে খুঁজছি। তিনি বহুকাল আগে দুই কন্যাকে নিয়ে মল্লরাজ্যে চলে এসেছিলেন। নাম রাধামোহন লাহিড়ী। আপনি কি কোনওভাবে তাঁর হদিশ দিতে পারবেন?’
২২
‘ছ্যাঃ ছ্যাঃ! এতবছরের ঐতিহ্য আমাদের মল্লবংশের, উনপঞ্চাশতম প্রজন্ম চলছে, কোনওদিন কেউ অধস্তন কর্মচারীর থেকে বউ এনেচে? রাজবংশের বধূ মানেই রাজকন্যা। নিদেনপক্ষে সামন্তরাজাদের মেয়ে।’ জগতকুমার বিরক্তমুখে বললেন।
কেশব মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘বাজে কথা! মহারানী শিরোমণি আবার কোন রাজ্যের কন্যা ছিলেন?’
‘আহা, ওইরকম দুটো একটা হতদরিদ্র ঘরের সুন্দরী যে আসেনি তা নয়, এসেচে। তারা কৌলীন্যে, মার্যাদায়, অন্য রানীদের নখের যোগ্য না হলেও তবু চলে যায় কিন্তু তাই বলে নিজের অমাত্যের সঙ্গে কুটুম্বিতা? এর প্রভাব কত খারাপ হবে ভাবতে পারচিস?’
উমাপতি জগৎকুমারের পায়ে তৈলমর্দন করতে করতে বলল, ‘কীরকম কর্তা?’
‘কীরকম আবার? প্রধানমন্ত্রী কি আর প্রধানমন্ত্রী থাকবে? রাজপুত্রের সম্বন্ধী হয়ে মাথায় চড়ে বসবে! ছেলেপুলে হওয়ার পর রাজরক্তেও ভেজাল হবে। লজ্জা লজ্জা! রাজ্যের শাসন থেকে শুরু করে যুদ্ধবিগ্রহ, সবেতেই নাক গলাবে তখন।’
কেশব ছড়াকার একটা খড়কে কাঠি দিয়ে কান খোঁচাচ্ছিল। বেশ কিছুটা খোল বের করে মাটিতে ফেলে বলল, ‘সব ব্যাটা ওই বোস্টম পণ্ডিতের জন্য। ওই রাজার মাতায় এসব বুদ্ধি ঢোকাচ্চে। বোস্টমরা আবার ভদ্দরলোক নাকি?’
‘বটেই তো।’ সায় দিলেন জগতকুমার, ‘কথায় আছে না, ভর যুবতীর কোল, মাগুর মাছের ঝোল, বল হরি বোল!’
‘এর মানে কী কত্তা?’ উমাপতি জিগ্যেস করে।
‘মানে যথেচ্ছ নারীসঙ্গ করে, মাছ-মাংস খায়। এদিকে দিব্যি হরিবোল করে যায়। শুদ্ধ অশুদ্ধের কোন ব্যাপার নেই। কতটা ভণ্ডামি ভাবতে পারিস?’ জগতকুমার বললেন।
‘একেবারে নচ্ছার যাকে বলে!’
জগতকুমার উদ্যানে বসেছিলেন। তাঁর জীবন পুষ্করিণীর মতো নিশ্চল। নামেই তিনি নাটকাঞ্চন মৌজার জমিদার, বছরে দুবারের বেশি সেই মৌজা সশরীরে পরিদর্শনে যাওয়ার সময় বা ইচ্ছা তাঁর হয় না। তাঁর শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনী সেখানে থাকে।
তাঁর জীবনের প্রতিটি দিন অতিবাহিত হয় একই ভাবে। সূর্যদেব যখন পূর্ব আকাশ থেকে মধ্যমাকাশে অনেকটাই উঠে আসেন, তখন দিন শুরু হয় তাঁর। মধ্যাহ্ন ভোজন পরে জগতকুমার উদ্যানে এসে বসেন। তারপর চলে উমাপতির সেবা।
মহলের সামনের এই নাতিদীর্ঘ উদ্যানের পরোক্ষ তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তাঁর স্ত্রী অহল্যার। অবশ্য তিনি বেশ কয়েক বছর হল এই মহল ছেড়ে দিয়ে থাকেন মহারানীর অন্দরমহলে। তাতে জগতকুমার খুশি।
কেশব আবার কিছুটা খোল বের করে বলল, ‘তা ওই তিলকধারী বামুনের মতিগতি কিচু বুঝচেন নাকি, হিকিমমশাই?’
জগতকুমার লঘুস্বরে বললেন, ‘মতিগতি কী বুঝব? বোকা রাজার মাতাখানা চেবাচ্চে।’
কেশব বলল, ‘এই বোস্টম পণ্ডিতগুলো কিন্তু মহা ঘোড়েল হয়। উপরে হরি হরি, ভিতরে ডিঙলা চুরি।’
‘বলিস কী?’ জগতকুমার কৃত্রিম বিস্ময়ের ভান করে বললেন, ‘নৌকো চুরি করে?’
‘নৌকো চুরি তো অনেক তুচ্ছ হিকিমমশাই! ধীরে ধীরে রাজামশাই থেকে শুরু করে মল্লভূমটাকে চুরি করে নিচ্চে দেখছেন না?’ কেশব বলল, ‘দেখবেন, মল্লেশ্বর শিবমন্দিরের কাজ হয়তো মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাবে, সেখানে মাথা তুলবে শ্যামরাইয়ের মন্দির।’
কেশবের অতিরঞ্জনের স্বভাব জগতকুমারের জানা। তিনি মুখে বললেন, ‘বটে?’
‘আজ্ঞে, হিকিমমশাই। রাজামশাই দীক্ষা নেওয়ার পর ওই বামুনের আঙুল ফুলে আরও কলাগাছ হয়েচে। দিনরাত্রি কানে ফুসমন্তর ঢালছেন। অমাত্যরা তো বটেই, প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ক্ষুব্ধ!’
জগতকুমার একখানা পেয়ারায় কামড় বসিয়ে বললেন, ‘সবাই রেগে রয়েচে? তাহলে এখন যদি কালাপাহাড় হঠাৎ করে মল্লভূম আক্রমণ করে, তবে কি সবাই চুপ করে বসে মজা দেকবে বলচিস?’
‘কালাপাহাড়!’ কেশব থমকে গেল। তার দু-চোখে একরাশ কৌতূহল।
‘যাহ বাবা, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব খবর নাকি তোর কাছে থাকে, আর যে কিনা বাংলার সব রাজাকে নাচিয়ে এখন উড়িষ্যার দিকে পা বাড়াচ্চে, তাকেই তুই চিনিস না?’ জগতকুমার রসিকতার ঢঙে কথাটা বলে কেশবের দিকে ইষৎ ঝুঁকলেন, ‘মহম্মদ ফারমুলী। সুলতানের পেয়ারের হিঁদু জামাই। কলমা মুসলমান তাই হিঁদুদের দেকতে পারে না। সে আসছে মল্লভূমে! তোদের রাজার দিন ফুরোল বলে!’
‘তবে কার দিন শুরু হবে, আপনার?’ কেশব খোঁচা দিল, ‘আপনি চালাবেন রাজ্য? চলতে ফিরতে অষ্টপ্রহর, চড়বেন কী করে হাতির ওপর?’
জগতকুমার রাগলেন না। মিটিমিটি হেসে পেয়ারায় কামড় দিয়ে বললেন, ‘গর্দভ, তুই খালি ছড়া কাটতেই শিকেচিস, মাতা খাটাতে নয়। হাত-পা চালানো, হাতি চড়া, ঘোড়া চড়া, যুদ্ধবিগ্রহের কাজ তো সেনারাই করবে। রাজা হতে গেলে চাই একটি শক্তপোক্ত সরেস মস্তিষ্ক, যা সহজেই কোনও মিয়ানো পণ্ডিত এসে গুলিয়ে দিতে পারবে না, বুঝলি! এমন বোকা বোকা কতা কইলে তুই আমার চাণক্য হবি কী করে?’
‘আমি আপনার চাণক্য!’
জগতকুমার তাকিয়ায় হেলান দিলেন, ‘তা নয়তো কে হবে? তোর মতো এমন শয়তান আর দুটো আছে নাকি রাজ্যে?’
‘আর আমি কী হব, কর্তামশাই?’ উমাপতি সাগ্রহে জিগ্যেস করল।
‘তুই?’ জগতকুমার হাসতে হাসতে বললেন, ‘দেখা যাক, কী করা যায় তোকে!’
‘যাই করুন, মেনকাকে যদি পাইয়ে দেন, তাতেই আমি খুশি।’
উমাপতি যে মেনকার জন্য পাগল, তা কেশব বা জগতকুমারের অজ্ঞাত নয়। কেশব কোনওদিনও কাউকে বুঝতে দেয়নি বা জানতে দেয়নি মেনকার সঙ্গে তার গোপন সম্পর্কের কথা। মেনকার সেই গুরুত্ব তার কাছে আর আর নেই।
জগৎকুমারের অশ্লীল হাসির মাঝেই কেশব ভাবলেশহীন ভঙ্গীতে কান খোঁচাতে লাগল।
২৩
রুদ্রাক্ষ মাগরিবের নামাজ পড়ছিল। আজ সারাদিন খুব পরিশ্রম গিয়েছে। লাহিড়ীপাড়ায় গিয়ে দশাবতার খেলার পাকা খেলোয়াড় কামদারঞ্জন লাহিড়ীর সঙ্গে পরিচয়ের ছুতোয় ঘুরেছে প্রায় প্রতিটি বাড়ি। ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে, সেখানেই এক বাড়িতে সেরেছে মধ্যাহ্নভোজন। কিন্তু লাভ হয়নি। রাধামোহন লাহিড়ীর সন্ধান পাওয়া যায়নি।
সূর্যাস্তকাল। গোধূলির নরম আলো অতিথি ভবনের পিছনের উদ্যানে এসে পড়েছে। বাতায়নের দিকে পেছন করে থাকলেও, সেখানে কেউ একজন এসে উপস্থিত হওয়ামাত্র বন্ধ চোখের সামনের আলো কমে গেল। রুদ্রাক্ষ ত্বরিতে চোখ খুলল।
রুদ্রাক্ষের জন্য যে ভৃত্য নির্দিষ্ট করা রয়েছে, তাকে কয়েকটি সময় ছাড়া আসতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে রুদ্রাক্ষ। তবে কে এল?
বাতায়নের ওপাশে কেউ নেই। তবু রুদ্রাক্ষের অভিজ্ঞ চোখ বুঝতে ভুল করেনি, কেউ একজন সেখানে ছিল।
‘আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহ।’ রুদ্রাক্ষ নামাজের শেষ রাকাত পড়ল। তারপর মৃদুস্বরে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে দাঁড়িয়ে দ্রুতগতিতে ঘর থেকে বেরল। ঘর থেকে বেরিয়ে ডানদিকে গেলেই বাইরের উদ্যানে যাওয়ার পথ।
বিদ্যুৎগতিতে মোড় ঘুরেই সে কেশব ছড়াকারকে দেখতে পেল। কেশব এখন একটা আমগাছের নীচে রুদ্রাক্ষের দিকে পিছন করে দাঁড়িয়ে আছে। তার বাম স্কন্ধে রয়েছে একটি ধুসর রঙের ঝোলা।
রুদ্রাক্ষ গিয়ে কাঁধে হাত রাখতেই কেশব ভূত দেখার মতো চমকে উঠল।
রুদ্রাক্ষ বুঝতে পারল, ধরা পড়ে গিয়ে কেশব থরথর কাঁপছে। অনেক কষ্টে অস্ফুটে সে বলে, ‘আপনি…!’
‘হ্যাঁ, শান্ত হন।’ নরম স্বরে বলল রুদ্রাক্ষ, ‘ভয় পাবেন না, আমি এখন মুসলিম। কিন্তু আমার আগের নাম রুদ্রাক্ষ ছিল! কৌলিক উপাধি ছিল লাহিড়ী।’
কেশব তীক্ষ্নচোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তবে…?’
রুদ্রাক্ষ বলল, ‘এখন যাকে আপনারা কালাপাহাড় নামে চেনেন, সেই মহম্মদ ফারমুলীও তো হিন্দু ব্রাহ্মণসন্তান ছিল। আমি ছিলাম তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাই আমারও একই গতি হয়। আমি সম্পূর্ণ একঘরে হয়ে গিয়েছিলাম। ওদিকে তন্দা থেকেও আসছিল নানারকম চাপ। ধর্মান্তরিত হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না আমার! আমার এখনকার নাম রহমান।’
‘তবে এখানে মিথ্যা কথা বললেন কেন?’ কেশব ক্ষুব্ধভাবে বলল, ‘এমন তো নয় যে, মুসলিম হলে আপনি আতিথ্য পেতেন না! আমাদের মহারাজ হিন্দু-মুসলিমে ভেদাভেদ করেন না।’
‘জানি।’ রুদ্রাক্ষ বলল, ‘তা সত্ত্বেও আমাকে কেন এই ছলনার আশ্রয় নিতে হয়েছে, তা আপনাকে অন্য একদিন বলব। এখন বলুন, আপনি কোন দলে?’
‘মানে?’
‘মানে পরিষ্কার। আপনি আমাদের দলে, না বীরহাম্বীরের দলে?’
কেশব কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর ক্রুরচক্ষে বলল, ‘আপনি আমাদের রাজার আশ্রয়ে থেকে তাঁরই ক্ষতি করতে চাইছেন? এই আপনার বিবেক?’
‘রাজনীতিতে বিবেকের স্থান নেই, কেশব।’ রুদ্রাক্ষ নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল, ‘আপনি আপনার অবস্থান স্পষ্ট করুন।’
কেশব এবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আপনাদের দলে গিয়ে আমার লাভ?’
‘ওই দলে থেকেই বা কী লাভ হচ্ছে?’
‘যেটুকু লাভ হওয়ার সে তো এই দলেই হয়েছে।’ কেশব বলল, ‘মহারাজ আমায় মহাদানী করেছেন, সম্মান, নিষ্কর ভূমি, বসতবাড়ি সব দিয়েছেন। রাজানুকূল্যে অর্থের অভাবও নেই। আপনারা কী দেবেন?’
‘অর্থ যা দিতে পারে না, আমরা আপনাকে তাই দেব।’ রুদ্রাক্ষ বলল, ‘ক্ষমতা।’
‘ছদ্মক্ষমতায় কেশব ছড়াকার সন্তুষ্ট হবে না। অপদার্থ জগতকুমারের ডান হাত হয়ে আমি থাকতে পারব না। আমি আসল ক্ষমতা চাই।’
রুদ্রাক্ষ তীক্ষ্নচোখে চেয়ে রইল কেশবের দিকে। তারপর তার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, ‘ভেতরে আসুন।’
২৪
রুদ্রাক্ষ হেমনলিনীকে আবার দেখতে পেল রাজ্যের শীতলকুমারের বিবাহের শেষদিনে। শ্রেতশুভ্র তসর পরিহিতা নিরাভরণা হেমনলিনীকে দেখে তার হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল। তার মনে হল, এই সেই রমণী, যার জন্য সে এতদিন পর্যন্ত কৌমার্য পালন করে এসেছে।
এরই মধ্যে ঘটেছে বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বীরহাম্বীর মল্লরাজ্যের সীমানা দিয়ে কালাপাহাড়ের উড়িষ্যা অভিযানে সম্মতি দিয়েছেন, অনুমতিপত্রে পড়েছে রাজ সীলমোহর। সেই অনুমতিপত্র নিয়ে দূত তন্দায় চলে গিয়েছে ঘোড়া ছুটিয়ে।
কিন্তু রুদ্রাক্ষের যাওয়া হয়নি। মহারাজ বিবাহ কাটিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছেন। সেও আপত্তি করেনি। কারণ তার কাজ এখনও বাকি।
বিবাহ রাজবাড়িতেই হচ্ছে। দুপক্ষের অনুষ্ঠানই এখানে, তাই রাজদরবারের বাইরে খাটানো হয়েছে প্রকাণ্ড শামিয়ানা। সেখানে একপক্ষকাল ধরে চলছে মানুষের ভোজন। রাজদরবারের ভেতরে অন্তর্বর্তী ভোজনকক্ষে আয়োজন করা হয়েছে রাজপরিবার ও অমাত্যদের সপরিবার আনন্দোৎসব। নানা মৌজা থেকে এসেছেন জ্ঞাতিরাও। এসেছেন কুমাররা। মাধব মল্ল ও তাঁর কন্যা হেমনলিনীর থাকার ব্যবস্থাও রাজবাড়িতে হয়েছে।
মল্লরাজপরিবারের প্রাচীন নিয়ম, পারিবারিক অনুষ্ঠানের সময় সকলকে প্রথম পাতে পরমান্ন পরিবেশন করবেন নববধূ। সেইমত বীরহাম্বীর, তাঁর তিন রানী, পুত্ররা, বয়োজ্যেষ্ঠ জ্ঞাতিকূল এবং প্রধানমন্ত্রী, মহাসেনাপতিসহ উচ্চ অমাত্যবর্গরা সম্মুখ আসনে বসে রয়েছেন। বীরহাম্বীরের ডান পাশে সদ্যবিবাহিত শীতলকুমার এবং বামপাশে শ্রীনিবাস আচার্য।
সকলে নিজেদের মধ্যে কুশল আলোচনা করছেন। বিবাহ নির্বিঘ্নে সমাপ্ত হয়েছে। আগামীকাল থেকে শুরু হয়ে যাচ্ছে রাঢ়ভূমির অন্যতম বড় উৎসব ভাদুপুজো।
কিছুটা পিছনে বসেছিল রঘুনাথ আর পবন।
রঘুনাথ আজ একটি দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছে। পবনকে নিজের পোশাক পরিয়ে নিয়ে এসেছে এই মধ্যাহ্নভোজে। পবনের মাথায় রয়েছে রাজকর্মচারীর পরিবারের উষ্ণীষ। উষ্ণীষের পুচ্ছটা এমনভাবে পবনের মুখের সামনে রাখা রয়েছে যে, কেউ পবনকে সহজে চিনতে পারবে না।
কিন্তু তা হলেও পবনের মুখ ভয়ে পাংশুবর্ণ হয়ে রয়েছে, থেকে থেকে সে কেঁপে উঠছে। মহারাজের থেকে মাত্র কয়েকহাত পেছনে বসে একাসনে সে খাবে, এই অচিন্ত্যনীয় স্পর্ধা তাকে সুস্থির থাকতে দিচ্ছে না।
রঘুনাথ চাপা স্বরে বলল, ‘ওরকম কাটা পাঁঠার মতো কাঁপছিস কেন রে হতভাগা? লোকে বুঝতে পেরে যাবে তো!’
পবন অস্ফুটে বলল, ‘ধরা পড়লে কী হবে বুঝতে পারছিস? শীতলদাদা দেখতে পাননি, দেখতে পেলে তিনিও রুষ্ট হবেন।’
‘আহ!’ রঘুনাথ বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বলল, ‘ধরা পড়বিটা কী করে শুনি? এখানে কি কেউ তোকে চেনে? এখানে কি কেউ চতুষ্পাঠীতে পড়ে? না কোতোয়ালখানায় কার ফাঁসি হচ্ছে, তা উঁকি মেরে দেখতে যায়? ওরে, এখানে যারা রয়েছে তাঁরা রাজপ্রাঙ্গণের প্রবেশদ্বার পেরোয় না, পেরোলেও ঘোড়ায় চড়ে বা শিবিকায়। তোর মতো তুচ্ছ বালকের দিকে তাদের নজর পড়বে না। আর দাদা তোকে দেখলে খুশিই হবেন।’
পবন তবু স্থির হতে পারে না। কোনওমতে বলে, ‘তুই জোর করে আনলিই বা কেন? বাইরেও কত ভালো খাচ্ছিলাম।’
রঘুনাথ চুপ করে থাকে। সব কথা মুখ ফুটে বলা যায় না। সে পবন ওর যত ঘনিষ্ঠ বন্ধুই হোক না কেন। গোটা ঘটনাটা এখনও ভাবলে ওর গা রি-রি করছে, মনে হচ্ছে গিয়ে এখুনি সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়!
প্রথম যেদিন ও জানতে পারল, মেজদাদার সঙ্গে মনোহরার বিয়ে হবে, ও বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। ওরকম একটা মুখরা মেয়ে কিনা হবে ওর বৌদিদি? কথায় কথায় ওকে শাসন করবে? এত বড় অনর্থ কোনওভাবেই হতে দেওয়া যায় না, এই মনস্থির করে ও তখন সটান গিয়ে উপস্থিত হয় মহারাজের কাছে।
‘পিতা, আপনি এই বিয়ে বন্ধ করুন। শীতলদাদা রাজি নয়।’
তখন সন্ধ্যাবেলা। বীরহাম্বীর সারাদিনের ক্লান্তিশেষে রাজপ্রাসাদের এক উন্মুক্ত অলিন্দে একাকী বসে বাতাসসেবন করছিলেন। আগে চুপচাপ বসে থাকতেন। সঙ্গীতজ্ঞরা পরিবেশন করত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত।
কিন্তু এখন তাঁর হাতে থাকে বৈষ্ণব পুঁথি, কিংবা কোনও ভূর্জপত্র। কখনও তিনি পড়েন, কখনও লেখেন। কখনও আবার নীরবে তাকিয়ে থাকেন দূর-দিগন্তের দিকে।
কনিষ্ঠ এই পুত্রটি মাত্রাতিরিক্ত দুষ্ট বলেই তাকে তিনি অতিরিক্ত স্নেহ করেন। রঘুনাথের কথায় বিস্মিত হয়ে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘শীতলদাদা রাজি নয়? কে বলল তোকে! শীতল তো কবেই তার মা’কে জানিয়েছে এই বিবাহে সে সম্মত।’
রঘুনাথ গুম হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। তার মনে ক্রোধ, অভিমান, হতাশা একসঙ্গে আন্দোলন করছিল। শীতলদাদা ওর এত ঘনিষ্ঠ, ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা নাকি তার উথলে ওঠে। কই এত বড় কথাটা তো সে তার ভাইকে বলেনি!
অপ্রস্তুত হতে হতে রঘুনাথ নিজেকে সামলে নিয়েছিল, ‘না মানে, আমি বলতে চাইছি, এই বিয়ে শীতলদাদার করা উচিত নয়।’
‘উচিত নয়?’ বীরহাম্বীরের বিস্ময় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল, ‘কেন?’
রঘুনাথ গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর বলেছিল, ‘মনোহরা একদম ভালো মেয়ে নয় পিতা। রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে শিবিকা থেকে বেরিয়ে জোরে জোরে কথা বলে, হাসে।’
‘কথা বলে, হাসে?’ বীরহাম্বীর বলেছিলেন, ‘সে তো তুইও কথা বলিস, হাসিস। ওতে দোষের কী হল?’
‘বাহ, রাজপরিবারের মেয়েরা ওরকম করে বুঝি?’ রঘুনাথ প্রতিবাদ করেছিল, ‘তারা তো কী যেন বলে…অসূর্যম্পশ্যা!’
শ্রীধর এসেছিল। সান্ধ্যকালীন মিষ্টান্ন নিয়ে। পরিবেশন করেছিল পাত্রপূর্ণ মৌক্তিকাক্ষ।
বীরহাম্বীর ছদ্মগাম্ভীর্য নিয়ে বলেছিলেন, ‘দিন পাল্টাচ্ছে রঘু। তুমি পুরুষ বলে যেখানে ইচ্ছা যাবে, যা খুশি করবে, আর মেয়েরা কিছুই করতে পারবে না, সেটা কি ঠিক? এতদিন যাবত তো রাজপরিবারের মেয়েদের কোনও অক্ষরজ্ঞানই হত না, কিন্তু আমি স্থির করেছি তোমার ভগ্নীকে শিক্ষিত করে তুলব। এমন তো হতেই পারে, কয়েক প্রজন্ম পরে মল্লভূমের সিংহাসনে আরোহণ করবেন আমাদের বংশেরই কোনও নারী। শ্রীনিবাস আচার্য মহাশয় নিজে বলেছেন, শ্যামাকুমারীকে শিক্ষাদান করবেন।’
‘আপনি বুঝতে পারছেন না!’ প্রসঙ্গ অন্যদিকে চলে যাচ্ছে দেখে রঘুনাথ দ্রুত বলেছিল, ‘মনোহরা খুব দজ্জাল প্রকৃতির!’
‘সেকী!’ বীরহাম্বীর এবার কৃত্রিম বিস্ময়ে ভ্রূ উত্থিত করেছিলেন, ‘তার মিষ্ট আচরণ তো সর্বজনবিদিত!’
‘ওসব লোক দেখানো।’ রঘুনাথ তখন ধৈর্য হারিয়ে বলেই ফেলেছিল, ‘ও আমাকে খুব হেয় করে পিতা। প্রকাশ্য দিবালোকে আমাকে অসম্মান করে।’
‘হা হা হা হা!’ বীরহাম্বীর অট্টহাস্যে ফেটে পড়েছিলেন, ‘এইবার বুঝেছি। তাই তো। খুবই অন্যায় কথা। তোর মতো মানী মানুষকে অসম্মান করে? আচ্ছা, আমি মনোহরা মা’কে বলে দেব’খন, আর সে এমন করবে না। তবে কিনা সে এবার তোর বড় বৌদিদি হবে। আর বড় বউদিদি মায়ের সমান, তাই তুই দুষ্টুমি করলে তো একটু কান-টান মলে দিতেই পারে…!’
প্রায় দুই পক্ষকাল আগের কথা। তবু স্মৃতিপটে ভেসে ওঠামাত্র রঘুনাথের কর্ণমূল লাল হয়ে উঠল। মনোহরা নাকি তার কান মুলে দেবে! সেদিন পিতার কাছে বিফলমনোরথ হয়েও সে ক্ষান্ত হয়নি। বড়মা থেকে শুরু করে শীতলদাদা, সকলকেই বোঝানোর চেষ্টা করেছে।
কিন্তু লাভ হয়নি। সকলে মনোহরার প্রতি স্নেহে অন্ধ।
ইতিমধ্যে একদিন প্রভাতে মুখোমুখি ওর দেখা হয়ে গিয়েছিল মনোহরার সঙ্গে।
মনোহরা সোজা রঘুনাথের পথ আটকে বলেছিল, ‘এই যে, কী ব্যাপার? তুমি সব জায়গায় আমার বিয়ের ভাংচি দিয়ে বেড়াচ্ছ কেন?’
‘মানে?’ রঘুনাথ গম্ভীরকণ্ঠে বলেছিল, ‘আমি কী করলাম? পথ ছাড়ো।’
‘না। ছাড়ব না।’ মনোহরা ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতো গর্জে উঠেছিল, ‘তোমার দাদা আমায় বিয়ে করে কৃতার্থ করছেন না, বুঝলে? তিনি তো কোনওদিনও রাজা হতে পারবেন না। কত রাজবাড়ি থেকে আমার সম্বন্ধ এসেছিল, তা জানো?’
‘ভালো তো! তা সেসব জায়গায় রানী না হয়ে আমার ভালোমানুষ দাদাটার গলায় ঝুলতে আসছ কেন?’ রঘুপতি নিজের মনে বিড়বিড় করেছিল।
মনোহরা শুনতে পায়নি, একই লয়ে বলছিল, ‘কিন্তু নেহাত মহারাজ আর মা-র সঙ্গে আজীবন থাকতে পারব, সেই লোভে অন্য কোথাও গেলাম না। আর তুমি কিনা এইসব করছ!’
যেখানে ওরা দাঁড়িয়েছিল, সেটা প্রকাশ্য পথ। ভৃত্যরা চলাচল করছিল। উচ্চঃস্বরে কথা বললে তখনই অন্দরমহলে সংবাদ পৌঁছে যেত। রঘুনাথ তাই অতিকষ্টে নিজেকে সংবরণ করে বলেছিল, ‘শোনো, আমি চাই না তোমার মতো হিংসুটে মেয়ে আমার দাদার স্ত্রী হোক।’
‘কী? আমি হিংসুটে?’
‘অবশ্যই। আমি শীতলদাদার কাছে পিটুনি খেলে তুমি আনন্দ পাও। বাইরের লোকের সামনে আমায় অপমান করো।’
‘সে তো এমনি রসিকতা করেছিলাম। তুমি যে সেদিন বধিলাদের ওই ছেলেটার সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিলে, কাকপক্ষীতে টের পেয়েছে? কাউকে আমি বলেছি?’
‘মানে?’ রঘুনাথ ভড়কে গিয়েছিল, ‘তুমি কী করে জানলে পবন বধিলাদের ছেলে?’
‘আমি সব জানি। পবন ভাদ্রচন্দ্র বধিলার ভাইপো।’ মনোহরা বিজ্ঞের মতো মাথা দুলিয়েছিল, ‘তবু আমি কাউকে বলিনি। কারণ, আমি জানি তাতে তোমার হাড়গোড় আর আস্ত থাকবে না। ভয় পেওনা, বলবও না। তুমি কিনা আমার প্রাণাধিক প্রিয় দেবর হচ্ছ। তুমি পেটানি খেলে আমার কি ভালো লাগবে?’
‘হ্যাঁ লাগবে।’ রঘুনাথ ফুঁসে উঠেছিল, ‘তুমি তাই চাও। শোনো মনোহরা, আমি হলাম রঘুনাথ মল্ল। ক্ষত্রিয়। আমি কাপুরুষ নই।’
‘তাই নাকি? তো সাহস থাকলে রাজবাড়ির সকলের সামনে পবনকে নিয়ে ঘুরে দেখিও, দেখব তুমি কেমন বীরপুরুষ!’ মনোহরা যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। ‘আর হ্যাঁ। আর কয়েকদিন পর থেকে আমার নাম ধরে ডাকবে না। বৌদিদি বলবে। নইলে বেশ করে কান মুলে দেব। হি হি।’
সেইদিন থেকে রঘুনাথ অপমানে জর্জরিত হয়ে ছটফট করেছে। দিনরাত ভেবেছ কীভাবে উচিত প্রমাণ দেওয়া যায় নিজের সাহসের, বীরত্বের।
অবশেষে আজ এসেছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। চরম সাহসে ভর করে পবনকে বিন্দুমাত্র না জানিয়ে নিয়ে এসেছে এখানে। রঘুনাথ জানে, পবন ওকে প্রাণাধিক ভালোবাসে। ওর মুখের ওপর কিছুতেই সে ‘না’ করতে পারবে না।
পবন হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট পশুর মতো কম্পিত স্বরে বলে উঠল, ‘একিরে! কী সর্বনাশ!’
চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায় রঘুনাথের। চমকে উঠে দেখে নববধূ মনোহরা ইতিমধ্যেই প্রথম সারিতে মহারাজসহ সবাইকে পরমান্ন পরিবেশন সমাপন করেছে, এবার ধীরে ধীরে আসছে এদিকে। রঘুনাথ মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তোলে। কিছুটা যে ভয়ও হয় না তা নয়, তবে নিজের বীরত্ব প্রমাণের দৌড়ে তাকে জিততেই হবে।
সে চাপা স্বরে বলে, ‘ভয় পাস না পবন। মনোহরা আমাদের পায়েস পরিবেশন করবে। তুই স্বাভাবিক থাকবি!’
আর স্বাভাবিক, পবন ঠকঠক করে কাঁপছে। কি অকল্পনীয় অপমান তার জন্য অপেক্ষমান, ভেবেই ওর কান্না পাচ্ছে। সে বলল, ‘তোকে তো খুব ভালোবাসি ভাই! এইভাবে তুই আমার সর্বনাশ করলি!’
‘বাজে কথা বলিস না। কিচ্ছু হবে না।’ রঘুনাথ পবনের হাতে হাত রাখে, ‘মনে বল আন। ঋজু হয়ে বোস। পবন, মনে রাখিস, এটা তোর বন্ধুর সম্মানের লড়াই!’
‘মানে? কীসের সম্মান?’
রঘুনাথ অতিসংক্ষেপে পুরো ঘটনাটা ফিসফিস করে বলে। শুনতে শুনতে পবন কিছুটা স্বাভাবিক হয়। অতিকষ্টে সোজা হয়ে বসে। ওর দৃষ্টি চলে যায় সভার মধ্যমণি মনোহরার দিকে।
মনোহরা এদিকে এগিয়ে আসছে। যে-কোনও মেয়েকেই সীমন্তিনী হওয়ার পর অনেক পরিণত লাগে। বহুমূল্য বস্ত্রে, সুদীর্ঘ অবগুণ্ঠনে, সালংকারা মনোহরাকেও মনে হচ্ছিল পূর্ণযৌবনা নারী। তার মুখমণ্ডল অবগুণ্ঠনে আবৃত, রত্নখচিত বস্ত্রের মধ্য থেকে উন্মুক্ত হয়ে রয়েছে তার দক্ষিণ হস্ত। সেই হাত ধরে আছে একটি হাতা। সঙ্গে সঙ্গে চলেছে এক সৌম্যদর্শন বালক, তার হাতে ঝুলছে একটি সুবৃহৎ করঙ্গ। মনোহরা সেই পাত্র থেকে হাতায় পরমান্ন তুলে নিয়ে পরিবেশন করছে।
পবন আর রঘুনাথের সামনে এসে মনোহরা তার আড়াল থেকে সামান্য হাসল, তারপর হাতাটা পার্শবর্তী বালককে ধরতে বলে অবগুন্ঠন সামান্য তুলে ধরল।
পবন দেখল, মনোহরা তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। রক্তিম অধরে আলতো হাসি। সীমন্তের সিঁদুর যেন তার পদ্মপাতার মতো মুখখানাকে আরও লাবণ্যময় করেছে।
রঘুনাথ ফিসফিস করে বলল, ‘দেখলে? বলেছিলাম না, আমি কাপুরুষ নই!’
‘দেখলাম। তবে আর বেশি সাহস দেখিও না। দেওয়ালেরও কান আছে।’ মনোহরা পরমান্ন পরিবেশন করে যাওয়ার আগে পবনের দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসল, ‘ভালো করে খেও। দেখা হবে।’
মনোহরা চলে যেতে হৃষ্ট রঘুনাথ বলল, ‘দেখলি, কেমন হেরে গেল? দাম্ভিক মেয়ে একটা। শীতলদাদার ভাগ্যটা বড়ই মন্দ! আচ্ছা, রুদ্রাক্ষদাদা কোথায় বল তো?’
পবন মুগ্ধ দৃষ্টিতে মনোহরার প্রস্থান দেখছিল, রঘুনাথের কথায় সংবিত ফিরে পেয়ে বলল, ‘অ্যাঁ! কী জানি!’
রুদ্রাক্ষ বসেছিল কিছুটা পিছনের সারির এক পাশে। তার বামপাশে বসে রয়েছেন মাধব মল্ল। নববধূ পরমান্ন পরিবেশন করার পর তিনি দক্ষিণ হস্ত তুলে আশীর্বাদ করলেন। তারপর প্রায়ান্ধ দৃষ্টি পাশে নিবদ্ধ করে অনুচ্চস্বরে বললেন, ‘কবে আসছে ফারমুলী?’
রুদ্রাক্ষ মুখ ঘোরাল না। বলল, ‘উড়িষ্যা এবং কামরূপ জয় সময়ের অপেক্ষা। কেশব ছড়াকার আমাদের পক্ষে রয়েছে। রাজপ্রাঙ্গণ থেকে শ্মশান তার কাছে অবারিত দ্বার। কেউ সন্দেহও করবে না। তাকে কৌশলে কাজে লাগাতে হবে।’
‘উত্তম। প্রদ্যুম্নপুরের পদাতিক সৈন্যরা প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। রাজ্যের অনেকেই সেদিকে চলে যাচ্ছে। জগত কী বলছে? তার নাটকাঞ্চনের লাঠিয়ালরা থাকবে তো?’
রুদ্রাক্ষ বলল, ‘তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ এখনও হয়নি, তবে পত্রালাপে কথা হয়েছে। তাঁর অধীনে থাকা পুরো লাঠিয়াল বাহিনীই এদিকের পক্ষ নেবে।’
‘তা যথেষ্ট নয়।’ মাথা নাড়লেন মাধব মল্ল, ‘বীরহাম্বীরের সবচেয়ে বড় শক্তি তাঁর কামানঢালায় নির্মাণ হওয়া কামান। গোলন্দাজও রয়েছে প্রায় দশ সহস্র। তাছাড়া সামন্তরাজারা তো বটেই, সাঁওতালরা বীরহাম্বীরকে খুবই ভক্তি করে। সামান্য আহ্বানেই তারা তির, বর্শা, কুঠার, টাঙ্গি নিয়ে উপস্থিত হবে।’
‘আপনি কালাপাহাড়ের শক্তি সম্পর্কে জানেন না! তার সামরিক পরিকল্পনার কাছে এগুলো কিছু নয়।’ রুদ্রাক্ষ বলতে বলতে হঠাৎ স্থির হয়ে গেল। নববধূর পরে একে রাজপরিবারের মহিলারা এসে একেকটি পদ পরিবেশন করে। আজকের ভোজনের নাকি এই রীতি।
মিষ্টান্নের পাত্র হাতে যে শ্বেতবস্ত্রপরিহিতা রমণী এসে ওর থালায় মিষ্টান্ন তুলে দিতে লাগল, তার বাম স্কন্ধের ওপরে লাল রঙের তিল ওর চোখে পড়ে গেল।
এবারেও ও ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠল।
পাশেই বসে রয়েছেন মাধব মল্ল, অন্ধ হলেও যার অন্যান্য ইন্দ্রিয় অত্যন্ত প্রখর। রুদ্রাক্ষ তাঁকে কিছু টের পেতে দিল না।
রুদ্রাক্ষ বা মাধব মল্ল, কিংবা সামনের সারিতে বসে থাকা রঘুনাথ বা পবন জানতেও পারল না, এক অবগুণ্ঠিতা নারী ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ্য করছে, কথোপকথনও শুনে চলেছে।
সে মেনকা, মহারানী শিরোমণির খাস পরিচারিকা।
২৫
প্রায়ান্ধকার অলিন্দ। রুদ্রাক্ষ সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে প্রথমে কিছু দেখতে পেল না। রাজপ্রাঙ্গণের দক্ষিণ দিকের এই হিকিমমহলে সে এই প্রথম এল। কিছুটা বিচ্ছিন্ন এই মহল হতশ্রী। চারদিকে ইতস্তত ছড়ানো উচ্ছৃঙ্খল পৌরুষ। নাকে এসে ঝাপটা দিচ্ছে কটু গন্ধ।
রুদ্রাক্ষ পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। তারপর প্রকাণ্ডবপু জগতকুমারকে দেখামাত্র যুক্তকরে মাথা নত করল।
‘আসুন। বসুন। মল্লভূমের হিকিমমহলে আপনাকে সুস্বাগতম।’ জগতকুমার লঘু স্বরে ডাকলেন, ‘উমাপতি!’
রুদ্রাক্ষ সামনে রাখা গদিতে বসল। দুপাশে দুই তাকিয়া। সামনের স্থানে রয়েছে দুটি বড় পাত্র। দেখলেই বোঝা যায়, সুরাপাত্র। কক্ষ জুড়ে মদির গন্ধ। ভৃত্যটি প্রস্তুত হয়েই ছিল, প্রভুর ইঙ্গিতমাত্র সুরাপাত্র থেকে সে পানীয় ঢালতে উদ্যত হল।
‘না।’ রুদ্রাক্ষ বাধা দিল, ‘আমি মদ্যপান করি না।’
‘সেকি কথা! সুলতানের দেশের লোক হয়ে মদিরাপ্রেমী নন? আশ্চর্য তো!’ জগতকুমার বিস্মিত, ভৃত্যকে বেরিয়ে যেতে বললেন।
‘হ্যাঁ। আশ্চর্যের বইকি! আমার সহ্য হয় না।’
‘ও হো বেশ, বেশ। তারপর বলুন, বিবাহে কেমন আনন্দ করলেন?’
‘ভালোই লাগল।’ রুদ্রাক্ষ সরাসরি কাজের কথায় চলে এল, ‘হিকিম মহাশয়, সেনাপতি ফারমুলী খুব শীঘ্রই মল্লভূম আক্রমণ করবেন। আপনি এবং মাধব মল্ল পূর্ণ সহযোগিতা করলেও মহাসেনাপতি কুম্ভের অধীনে রয়েছে কামানঢালা। তাঁকে কোনওভাবে দলে আনতে পারবেন কি?’
‘অসম্ভব! বীরহাম্বীরের অত্যন্ত বশংবদ কুম্ভ। তাছাড়া তার দক্ষিণহস্ত মধ্যম রাজকুমার শীতল। সবকিছু তার নখদর্পণে। তবে গোপগ্রামে যে কামান তৈরি হয়, সেখানকার লোহারদের মধ্যে আমার কিছু চর আছে।’ জগতকুমার থেমে বললেন, ‘আর সম্প্রতি যে বৈষ্ণব এসে রাজার মাথা খাচ্ছে, তার ওপর প্রধানমন্ত্রী নাকি খুবই অসন্তুষ্ট। দেখছি কী করা যায়।’
রুদ্রাক্ষ বলল, ‘যদি অভয় দেন, একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারি?’
‘নিশ্চয়ই! আপনি হলেন সুলতানের প্রতিনিধি!’
‘ফারমুলীর আক্রমণের পরে মল্লভূম ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। বীরহাম্বীর বেঁচে থাকুন বা নিহত হন, সিংহাসনে যে আসীন থাকবেন না, সে নিশ্চিত। তাহলে কে রাজা হবেন? আপনি না মাধব মল্ল?’
জগতকুমারের ঠোঁটের হাসি অদৃশ্য। বললেন, ‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’
‘কৌতূহল বলতে পারেন।’
জগতকুমার ধীরেসুস্থে সুরা পান করলেন। প্রদীপের ক্ষীণ আলোকে বোঝা যাচ্ছে, তাঁর চোখ রক্তাভ হয়ে আসছে। তারপর বললেন, ‘মাধব মল্লের অনেক ক্ষোভ, সেই ক্ষোভ ন্যায়সঙ্গতও বটে। কিন্তু তাঁর কি আর সিংহাসনে আরোহণের বয়স আছে বলে আপনার মনে হয়?’
রুদ্রাক্ষ উত্তর দিল না। নির্নিমেষে চেয়ে রইল জগতকুমারের দিকে।
‘সোমত্থ ওই বিধবা কন্যা ছাড়া আর কী আছে মাধব মল্লের?’ জগতকুমার অশ্লীল হাসলেন, ‘নিশ্চয়ই বিয়ের সময় দেখেছেন? রস একেবারে কানায় কানায়।’
রুদ্রাক্ষর বুকে আচমকা তির এসে বিঁধল। ওর মনে হল, ওর শরীরে মুহূর্তে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠছে। জগতকুমারের লাম্পট্য সম্পর্কে এই কয়েকদিনে সে জেনেছে, কিন্তু বিধবা জ্ঞাতিভগ্নীর প্রতিও যে সে কুনজর দেবে, তা রুদ্রাক্ষের কল্পনার অতীত ছিল।
সে কোনওমতে বলল, ‘আপনার তো বোন হয় সে।’
‘বোন? আমার বোন হতে যাবে কোন দুঃখে? ওই হেমনলিনী মাধব মল্লের পালিতা কন্যা জানেন না?’
পালিতা হলেও যে সে কন্যাই, তা এই কামুককে বোঝানো অর্থহীন। রুদ্রাক্ষ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল, ‘ফারমুলী মল্লভূম আক্রমণ করে কি শুধু আপনাকে সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে যাবে ভেবেছেন? সঙ্গে এখানকার মৃন্ময়ী মন্দির থেকে রাসমঞ্চ, এমনকী নির্মীয়মাণ মল্লেশ্বর শিব মন্দিরও গুঁড়িয়ে দিয়ে যাবে।’
‘যাবে তো যাবে!’ জগতকুমার একটা লম্বা চুমুক দিলেন পাত্রে, ‘প্রতি বছর রাজকোষ ফাঁকা করা ছাড়া এত মন্দির কোন উপকারে আসছে শুনি? গণ্ডা গণ্ডা পুরোহিত আরাম করছে, চাট্টিখানি অলস প্রজা দিনরাত রাজকোষের অর্থে খাচ্ছে। দূর হোক সব!’
রুদ্রাক্ষ বলল, ‘কিন্তু মাধব মল্ল যদি আপনাকে সিংহাসন ছাড়তে সম্মত না হন?’
জগতকুমার খ্যাকখ্যাক হাসলেন। বললেন, ‘যেদিন মল্লভূমের গদি উল্টোবে, সেদিন তিনি থাকবেন কিনা আগে দেখুন!’
২৬
বিষ্ণুপুরের তিন-চার ক্রোশ দূরত্বে ধরাপাট গ্রামে বীরহাম্বীর যেদিন শ্যামচাঁদ মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে গেলেন, সেদিনই জগতকুমারের সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করলেন প্রধানমন্ত্রী জীমূতবাহন।
উমাপতি অবশেষে জীমূতবাহনকে হিকিমমহলে নিয়ে আসতে পেরেছে। কারণ, জগত কুমারের কাছে নির্ভুল সংবাদ ছিল, প্রধানমন্ত্রী জীমূতবাহন রাজার আকস্মিক ভক্তিপ্রীতি, একের পর এক রাধাকৃষ্ণের মন্দির স্থাপন পছন্দ করছেন না।
জগতকুমার চষক থেকে মুখ সরিয়ে কোন গৌরচন্দ্রিকা না করে ধীরগতিতে বললেন, ‘পালা বদলানোর সময় এসেছে, জীমূতবাহন। মল্লবংশের সেই রাজারাই শৌর্যে বীর্যে বীরত্বে শ্রেষ্ঠ, যাদের শরীরে রয়েছে দুর্ধর্ষ চেতুয়া বরদা বংশের রক্ত। আমার মাতাও ছিলেন চেতুয়া বরদার কন্যা, পিতার প্রিয়তমা মহিষী। তবু আমি সিংহাসনে আরোহণ করিনি। সুযোগ দিয়েছি বীরকে। কিন্তু তার ফল তো দেখছেন? দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। রাজ্যে অসন্তোষ পুঞ্জীভূত। দ্রুত পরিস্থিতি সামলাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনি সিদ্ধান্ত নিন, কী করবেন।’
‘কী করব মানে?’ জীমূতবাহন বিমুঢ়। এতদিন উমাপতির অনুরোধে সাড়া না দিলেও আজ মহারাজের অনুপস্থিতির সুযোগে তিনি কিছুটা কৌতূহলের বশেই এসেছেন হিকিমমহলে। অন্য অমাত্যদের মতো তিনিও রাজ্যের হিকিম জগতকুমারের প্রতি কোনও উচ্চভাবনা পোষণ করেন না। কামুক, বিলাসী, অকর্মণ্য এই রাজপুরুষটিকে তিনি অপদার্থই মনে করেন।
কিন্তু আজ জগতকুমারের কথাগুলো তাঁর কাছে প্রহেলিকাময় লাগল। জগতকুমার অর্ধশায়িত অবস্থা থেকে ধীরেসুস্থে উঠে বসলেন। বললেন, ‘রাজা উল্টোলে তার আশপাশের মন্ত্রী-সান্ত্রী, সেনাপতি সবাই উল্টোবে। সেটাই নিয়ম। নতুন রাজা নতুন অমাত্য নেবেন। তাই তার আগেই যদি আপনি অন্য তরফে চলে আসেন, আপনি থেকে যাবেন।
‘রাজা…উল্টোবেন কেন?’
জগতকুমার এবার দাঁত মুখ খিঁচিয়ে উঠলেন, ‘উল্টোবেন নাই বা কেন! রাজ্যের রাজা যদি রাজ্যশাসনের বদলে দিনরাত কৃষ্ণ কৃষ্ণ করে কেঁদে বুক ভাষায়, কাব্যি লেখে, বোষ্টম পণ্ডিতের পায়ে পড়ে আর হরিনাম জপে, রাজ্যের প্রজারা কি মেনে নেবে?’
কথাটা ভুল নয়। বস্তুত যে মুহূর্তে জগতকুমার এই বিষাক্ত কথাগুলো বলছিলেন, সেইমুহূর্তে শ্যামচাঁদ মন্দিরের সিঁড়ির ধাপে নতমস্তকে বসেছিলেন রাজা বীরহাম্বীর।
তাঁর দুই হাত জোড়বদ্ধ, চোখ গর্ভগৃহের বিগ্রহের দিকে।
মন্দিরের সামনে প্রশস্ত প্রাঙ্গণ। কিছু তফাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে ধরাপাট গ্রামের মানুষজন। অধিকাংশই সাধারণ কৃষক, জীবদ্দশায় যাদের কোনওদিনই রাজধানী বিষ্ণুপুরে যাওয়া হয়ে ওঠে না, মহারাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ তো দূর অস্ত। সেখানে স্বয়ং মল্লরাজ এসেছেন তাদের গ্রামে, এই নিয়ে তাদের আনন্দ ও উত্তেজনার শেষ নেই।
বৃদ্ধরা তো বটেই, মহিলা ও শিশু ক্রোড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অবগুণ্ঠন টেনে।
তাদের একেবারে সম্মুখে রাম দে। জাতিতে সে দ্বাদশ তিলি, তবু কয়েক পক্ষকাল আগে এসে তাকেই মন্দির নির্মাণের তদারকির দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন শ্রীনিবাস আচার্য। সচেতনভাবেই মল্লরাজ্যের জাতিভেদ তিনি ভাঙতে চান।
শ্রীনিবাস আচার্য মৃদু স্বরে বললেন, ‘ওঠো বীর। রাধাকৃষ্ণকে দর্শন করো!’
বীরহাম্বীর যেন বহু যুগের নিদ্রা থেকে জেগে উঠলেন। আবিষ্ট চোখদুটি মেলে তাকালেন নিজের ধর্মগুরুর দিকে। সেই মানুষটিকে প্রাণভরে দেখলেন, যিনি এসে তাঁর জীবনের গতিপথটাকেই পরিবর্তিত করে দিয়েছেন। আগে বীরহাম্বীর কথায় কথায় উত্তেজিত হয়ে পড়তেন, লুণ্ঠন থেকে শুরু করে অন্যায় আগ্রাসন, এই সব কিছুকেই মনে করতেন ক্ষাত্রতেজের সঠিক প্রকাশ।
এখন তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন, তিনি ভুল ছিলেন। অন্যকে বঞ্চিত করে ক্ষত্রিয়ধর্ম পালন করা যায় না। মানবপ্রেমের চেয়ে বড় রাজধর্ম আর কিছুই নেই। প্রেম সর্বোত্তম শক্তি।
আর কৃষ্ণের চেয়ে বড় প্রেমিক কে আছে?
চকিতে তাঁর মনে হল, কয়েকমাস আগের সেই গ্রীষ্মের নির্জন দুপুরে দেবনাথ বাচস্পতি মোটেই ভুল গণনা করেননি। সত্যিই তো সেই লুণ্ঠন মল্লাধিপতির জীবনকে আমূল পরিবর্তিত করে দিল!
‘কী ভাবছ বীর?’
শ্রীনিবাস আচার্যের কথায় বীরহাম্বীর বর্তমানে ফিরে আসেন। ধীরে ধীরে বলেন, ‘আচার্যমশাই, গতকাল সন্ধ্যায় একটা পদ বেঁধেছিলাম। আজ এই পুণ্যভূমিতে বড়ই শোনাতে ইচ্ছা করছে। শুনবেন?’
শ্রীনিবাস আচার্য স্নেহার্দ্রকণ্ঠে বললেন, ‘অবশ্যই!’
বীরহাম্বীর সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন। বিনতভঙ্গিমায় গিয়ে দাঁড়ালেন গর্ভগৃহের বাইরে। তারপর করজোড়ে উদাত্তকণ্ঠে উচ্চারণ করতে লাগলেন,
রাধা পদে সুধা রাশি
সে পদে করিলা দাসী
গোরা পদে বাঁধি দিলা চিত।
শ্রীরাধিকাগণসহ
দেখাইলা কুঞ্জ গেহ
জানাইলা দুঁহু প্রেম রীত।।
যমুনার কূলে যাই
তীরে সখী ধাওয়া ধাই
রাধা কানু বিলসয়ে সুখে।
এ বীরহাম্বীর হিয়া
ব্রজপুর সদা ধীয়া
যাহা অলি উড়ে লাখে লাখে।।
শেষ করতে পারলেন না, তার আগেই স্কন্ধে স্পর্শ! শ্রীনিবাস আচার্য। চোখে জল। মুখে হাসি। জড়িয়ে ধরলেন তিনি শিষ্যকে।
সেইমুহূর্তে রাজপ্রাসাদের হিকিমমহলে দাঁড়িয়ে জীমূতবাহন দ্রুত অঙ্ক কষছিলেন। জগতকুমার যদি এই ডামাডোলে সিংহাসনে বসার সুযোগও পান, তবে তা হবে অতি সাময়িক। জগত কুমারের মতো অপদার্থ অলস রাজাকে সিংহাসন থেকে উপড়ে ফেলে দিতে জীমূতবাহনের তিনমাসের বেশি সময় লাগবে না। জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র ধাত্রীকে তার আগেই সরিয়ে দেবেন।
তারপর? না, জীমূতবাহন নিজে রাজা হয়ে প্রজাদের বিরাগভাজন হবেন না। রাজা হবে তাঁর একমাত্র জামাতা, রাজ্যের মধ্যম রাজকুমার শীতল। যোগ্যতায় সে-ই শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকারী। অথচ বীরহাম্বীর সিংহাসনে থাকলে সে রাজা হতে পারবে না, শীতল রাজা হলে তাঁর কন্যা মনোহরা হবে রাজ্যের মহারানী। ভবিষ্যতের রাজমাতাও বটে।
কন্যা-জামাতার কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন জীমূতবাহন।
২৭
শান্ত অরণ্যরাজ্যে ষড়যন্ত্রের জাল দ্রুত নিপুণভাবে বোনা হচ্ছিল। একদিকে প্রদ্যুম্নপুরের মাধব মল্ল, অন্যদিকে জগতকুমার। সমান্তরালে হাঁটছেন প্রধানমন্ত্রী জীমূতবাহন ও কেশব। এদের সকলেরই চোখ চকচক করছে সুখস্বপ্নে, ক্ষমতার শিখরে বসার। ‘কালাপাহাড়’ মন্ত্র তাদের অতিসক্রিয় করে তুলেছে।
বীরহাম্বীরের বিরুদ্ধে তাদের সম্মিলিত শক্তি জয়ী হলেও শেষপর্যন্ত জিতবে কে?
মধ্যযাম। পালঙ্কে শয়ান হয়ে শীতল অপেক্ষা করছিল। সে অতি গভীর প্রকৃতির, তার চরিত্রে ধৈর্য ও স্থৈর্য দুই-ই অগাধ। তাই হয়তো, নতুন বিবাহের পরেও শয্যায় নববধূর অনুপস্থিতিতে সে বিরক্ত হচ্ছিল না।
সে আঁকিবুঁকি কাটছিল ভূর্জপত্রে। তার নেশা হল যুদ্ধে সৈন্যদের অবস্থান ও মানচিত্র আঁকা ও তাই নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। এই বিষয়ে সে নিয়মিত গবেষণা করে। মহাভারত খুঁজে বের করে নানা অজানা ব্যুহের নাম ও সজ্জাকৌশল। চিন্তা করে কীভাবে সেসব শেখানো যায় নিজেদের সেনাবাহিনীকে। তার প্রিয়তম সুহৃদ হল সহকারী উপসেনাপতি রমজান।
রমজানও তারই মতো যুদ্ধ করার থেকে বেশি আগ্রহী যুদ্ধের কৌশলে। তাই প্রায়ই দুজনে এই আলোচনায় মেতে থাকে।
মহাভারতে যে সমস্ত অস্ত্রের উল্লেখ রয়েছে, তার অনেকগুলোই দৈবী অস্ত্র। শীতল প্রায়ই স্বপ্ন দেখে, একদিন তাকেও মা মৃন্ময়ী বা বাবা মল্লেশ্বর স্বপ্নে এসে দান করেছেন দৈবক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র।
এই বিষয়ে তার বিচিত্র চিন্তাধারাও আছে। অস্ত্র প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে। ঘায়েল কি শুধু শারীরিকভাবেই করা যায়? এমন কোনও অস্ত্র কি আবিষ্কার করা যায়, যা দিয়ে আঘাত করলে শত্রুর মন পরিবর্তন হয়ে যাবে? হিংসার বদলে সখ্যতার আবেগ সঞ্চারিত হবে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে? সঞ্চারিত হবে সত্ত্বগুণ? এমন দৈবী অস্ত্র কি পাওয়া যায় না?
রমজান শুনে হাসে। বলে, ‘বলেন কী রাজকুমার, তেমন আবার হয় নাকি? অস্ত্র কখনও মানুষের মন বদলাতে পারে?’
মনোহরা এল আরও অর্ধেকদণ্ড পর। বিবাহের পর যে আড়ষ্টতা নববধূর থাকে, তা তার ক্ষেত্রে অনেকটাই কম। কারণ কুমারী অবস্থায় যে অলিন্দে সে গল্প করেছে, খেলেছে, ছুটে বেড়িয়েছে, এখনও সেখানেই সে রয়েছে সালংকারা ও রঞ্জিত সিমান্তিনী হয়ে। তাই তার প্রতি দাসীদের সম্ভ্রম কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেলেও সে নিজে পরিবর্তিত হয়নি।
মনোহরা এসেই জিভ কেটে বলল, ‘এহে, অনেক দেরি হয়ে গেল! তুমি এখনও ঘুমোওনি?’
শীতল মুখ তুলে হাসল। ফুলশয্যার রাতে স্ত্রীর সঙ্গে ‘আপনি’-র পরিবর্তে ‘তুমি’র চুক্তিটা সে আগেই করেছিল। মনোহরাও আপত্তি জানায়নি। এই গভীর রাতে এক সদ্যতরুণীর মুখে ‘তুমি’ সম্বোধন শুনে তার হৃদয় কেঁপে উঠল। রোমাঞ্চে।
মনোহরাকে অসামান্য রূপসী লাগছে, শীতল চোখ ফেরাতে পারে না। সে আগে অবিবাহিতাদের মত লইয়া পরত, এখন অন্দরমহলের রানীমারা ওকে সুন্দর করে শাটিকা পরতে শিখিয়েছেন।
অন্তঃপুরচারিণীরা বস্ত্রের বিষয়ে খুবই শৌখিন। তাঁত, রেশম কাপড় তো বহুলপ্রচলিতই, কয়েকবছর আগে মহারাজা বীরহাম্বীর পশ্চিম থেকে কয়েকজন পাটরা তন্তুবায় পরিবার আনয়ন করেছেন, তারা গাছগাছড়ার ছাল, লতাপাতার নির্যাস পাটে মিশিয়ে ভারি সুন্দর পাটরঙা বস্ত্র তৈরি করে।
মনোহরা এখন পরে আছে নীল রঙের একটা বহুমূল্য শাটিকা। তার ওপর হালকা গোলাপি পাটরাঙা দোলাই। বেচারি এখনও শাটিকা সামলানোর অভ্যেস রপ্ত করতে পারেনি।
মনোহরা বেশ হাঁপাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে ছুটতে ছুটতে সে এসেছে।
শীতল রসিকতার সুরে বলল, ‘যাক! আজ তাও একটু তাড়াতাড়ি খেলা শেষ হল মনে হচ্ছে। আমি তো ভাবলাম বুঝি আরও এক প্রহর পরে আসবে। তা কে জিতল? আজও কি তুমিই?’
মনোহরা গর্বের হাসি হেসে বিছানায় বসল, ‘আজ্ঞে। আমি প্রায় রোজই জিতি, বুঝলেন মশাই!’
‘তাই? আচ্ছা, তুমি আমার সঙ্গে একদিন খেলবে?’
‘তোমার সঙ্গে?’ মনোহরা বিস্মিত, ‘ওমা তুমি খেলা জানো? কই, এতদিন বলোনি তো!’
‘একটু আধটু জানি।’ শীতল সলজ্জমুখে বলল, ‘তবে রঘু আরও ভালো খেলে। আর ওর এক বন্ধু আছে, সে তো দশাবতার ওরক নিয়ে আর্যাই লিখে ফেলেছে। তাদের সঙ্গে তাস খেলতে বসলে তুমি হেরে ভূত হয়ে যাবে।’
‘তাই বুঝি?’ ভ্রূ কুঞ্চিত করে বলল মনোহরা, ‘হুঁঃ! ওরকম খেলোয়াড় অনেক দেখেছি। মনোহরা দেবীর সামনে সবাই কুপোকাত হয়ে যায়।’
‘বটে?’ শীতল স্ত্রীকে কাছে টানল। বিবাহের পর থেকে তার মন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে। মনোহরার মতো সপ্রতিভ নারীকে যে সে স্ত্রী হিসেবে লাভ করেছে, এটা সে এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছেনা। মনোহরা জড়সড় নয়, সব বিষয়ে তার অসীম কৌতূহল। এমনকী মাঝে-মাঝেই শীতলের সঙ্গে বসে সে যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কেও জানে।
শীতল ঠিক এমনটাই চেয়েছিল। যত প্রয়োজনই থাকুক, সে যে একের বেশি বিবাহ করবে না, তা ঠিক করে নিয়েছিল কৈশোরেই। স্ত্রী অর্থাৎ অর্ধাঙ্গিনী। তার দেহের অর্ধেক অধিকার কী করে একাধিক নারীর হতে পারে?
শীতল রঘুনাথের মতো উচ্ছল প্রগলভ নয়, সে অন্তর্মুখী স্বভাবের। ছোট ভাই ছাড়া তার তেমন কোন বন্ধুও নেই। ছোট থেকে এই স্বপ্নই মনে মনে লালন করে এসেছে সে, যে তার একমাত্র জীবনসঙ্গিনী শুধুই তার ধর্মপত্নী হবে না, হবে প্রকৃত বন্ধু, যার সঙ্গে নির্দ্ধিধায়, নিঃসঙ্কোচে সে সবকিছু ভাগ করে নিতে পারবে।
নিজের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন এইভাবে পূরণ হওয়ায় সে প্রত্যহ দু’বার মা মৃন্ময়ীকে প্রণাম জানায়। স্ত্রী সকলেরই থাকে, হয়ত একাধিকও। কিন্তু স্ত্রীর মধ্যে প্রিয় বন্ধু লুকিয়ে থাকে ক’জনের?
এখন যেমন সে স্ত্রীর কর্ণমূলে মৃদু দংশন করে বলল, ‘বুঝলে তোমাকে একদিন আমাদের সেই খেলার আসরে নিয়ে যাব।’
‘নিয়ে যাবে?’ মনোহরা আবিষ্ট হয়ে চোখ বুজে ফেলে। স্বামীর বুকে মাথা রেখে বলে, ‘কোথায় বসে গো সেই আসর?’
‘সে আছে এক গোপন আস্তানা। কেউ তার সুলুক সন্ধান জানেনা। আমি রঘু আর রঘুর সেই বন্ধু মাঝেমধ্যে সেখানে খেলতে যাই।’
কথা বলতে বলতে শীতল দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করল স্ত্রীকে। তার সারা দেহে উষ্ণতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। কয়েকদিন আগে পর্যন্তও রমণকার্যে সে ছিল একেবারে অনভিজ্ঞ। মল্লরাজ্যের রক্ষণশীল সমাজে সে অভিজ্ঞ কোনও বন্ধু পায়নি, যে তাকে আগে থেকে বুঝিয়ে দেবে নরনারীর শরীরের গূঢ় রহস্য।
অসহায় হয়ে সে তখন শরণাপন্ন হয়েছিল কাব্যের। খুঁজে বের করেছিল কালীদাসের কুমারসম্ভব। আগে পড়া পংক্তিগুলো তখন সম্পূর্ণ অন্য আঙ্গিকে ধরা দিয়েছিল তার কাছে।
অনোন্যমুৎপীড়য় দুৎপলাক্ষ্যাঃ স্তনদ্বয়ং পাণ্ডু তথা প্রবুদ্ধম
মধ্যে যথা শ্যামমুখস্য তস্য মৃণাল—সূতর্নরমপ্যল ভ্যাম।।
ভালো বুঝতে পারেনি। তখন সে হাতে তুলে নিয়েছিল একশো বছর আগের মৈথিলী কবি বিদ্যাপতির লেখা।
উরহি অঞ্চল ঝাঁপি চঞ্চল আধ পয়োধর হেরু।
পবন পরভাবে শারদ ঘন জনু বেকত করল সুমেরু।
তারপর কিছু কালিদাস, কিছু বিদ্যাপতি এবং অনেকখানি হৃদয়ের অনুভূতি মিশিয়ে শীতল প্রথম রাত্রে ঘনিষ্ঠ হয়েছিল পত্নীর। দুই দণ্ড পরে ক্লান্ত তৃপ্ত স্ত্রীর নরম বক্ষের ওপর মাথা রেখে গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল সে।
এই কয়েকদিনে রতিক্রীড়ায় দুজনেই বেশ পোক্ত হয়ে উঠেছে। এক দণ্ড পরে শীতল যখন প্রতিরাতের মতো মনোহরাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোনোর উদ্যোগ করছে, তখন মনোহরা স্বামীকে আলতো ঠেলা দিয়ে ফিসফিস করল, ‘কিগো, কবে নিয়ে যাবে?’
‘উঁ?’ জড়ানো গলায় সাড়া দেয় শীতল, ‘কোথায়?’
‘ওই যে বললে, খেলার আসরে?’
শীতল স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে পাশ ফেরে, ‘যাব যাব। এখন ঘুমোও।’
মনোহরা আর কিছু বলে না। পিদিমের তেজটা কমিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তার রতিক্লান্ত মুখের ঘামের ওপর পিদিমের আলো পড়ে গর্জন তেল মাখানো প্রতিমার মতো দেখায়।
২৮
আকাশে আজ সকাল থেকে গুরুগম্ভীর কালো মেঘ। ছোট থেকে বড়, প্রতিটি গাছের পাতা স্থির। বর্ষা আসার আগে গ্রীষ্ম তীব্র দাবদাহে জ্বালিয়ে দিচ্ছিল, আজকের এই কালো আকাশ কিছুমাত্র শীতলতা আনেনি। গরম আরও বেড়েছে।
বিকেল পড়ে আসছে। দূরের ক্ষেত থেকে কৃষকেরা পরিশ্রান্ত হয়ে বাড়ি ফিরছে। পাখিরা ঝড়ের পূর্বাভাসে তড়িঘড়ি উড়ে যাচ্ছে যাচ্ছে নিজেদের বাসায়। চারপাশ থম হয়ে রয়েছে।
ছড়াকার কেশব হন্তদন্ত হয়ে কোথাও চলেছিল। অবশ্য আশ্চর্যের কিছু নয়, সারাদিনই সে নগরের নানাপ্রান্তে ঘুরে বেড়ায়। কার বাড়িতে ছেলে বখে যাচ্ছে, কার বিধবা মেয়ে পোয়াতি হয়ে পড়েছে, কার বাড়িতে আজ সাতদিন হল পুঁইশাক ছাড়া কিছু রান্না হয়নি, এই সব খবর তার নখদর্পণে থাকে।
নবরত্ন মন্দির পেরিয়ে দক্ষিণের কাঁচা রাস্তা ধরতেই কেশব হাঁটু অবধি ধুতি পরিহিত একজনকে হেঁটে আসতে দেখল। লোকটাকে সে চেনে। ভাদ্রচন্দ্র বধিলা। আগে রাজদরবারের হয়ে আসামীদের কোতল করার কাজ করত। কোতোয়ালখানায় ফাঁসি এখনও হয়, কিন্তু ভাদ্রচন্দ্র আর ওই কাজ করতে পারে না, কয়েকবছর আগে এক দুর্ঘটনায় সে পঙ্গু হয়ে গিয়েছে। মারাই যেত, নেহাত রাজকর্মচারী বলে রাজবৈদ্য কৃষ্ণবল্লভ ওর ভার নিয়েছিলেন তাই ফিরে এসেছে।
ভাদ্রচন্দ্র নিজে এখনও কোতল না করলেও তার জ্ঞাতিরা সেই কাজ করে। ওরা সকলে বাস করে মহারাজের দান করা জমিতে, বধিলাপাড়ায়।
ভাদ্রচন্দ্রকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে কেশবের মুখেচোখে একটা ভাব খেলে গেল, সে যেন দেখতেই পায়নি এইভাবে হাঁটতে শুরু করল।
ভাদ্রচন্দ্র গরুকে ঘাস খাইয়ে ঘরে ফিরছিল। তার মুখ সবসময়েই বিষণ্ণ। কিছু মানুষ আছে, যারা বর্তমানে বাঁচে না। ভাদ্রচন্দ্রও তেমনই। বছরকয়েক আগেও তার শরীরে কী শক্তি বল ছিল, সে ফাঁস কেটে মুহূর্তে আসামীকে ঝুলিয়ে দিত! আর আজ? ভাগ্যের পরিহাসে সে এক বিকলাঙ্গ মানুষ। টুকটাক কৃষিজমি থেকে পেট চালায়। দিনরাত তাই তার মন দুঃখে পরিপূর্ণ হয়ে থাকে।
কেশবকে দেখতে পেয়ে ভাদ্রচন্দ্র বলে উঠল, ‘পেন্নাম হই মহাদানী মশাই! এদিকে কোথায় চললেন?’
কেশব অবাক হওয়ার ভান করে বলে ওঠে, ‘ভাদ্দরচন্দর যে! কোথায় যাওয়া হয়েছিল?’
‘আর কোথায় দা’ঠাকুর!’ গরুটিকে দেখায় ভাদ্রচন্দ্র, ‘মঙ্গলাকে একটু মাঠে নিয়ে গিয়েছিলাম। তা আকাশ এমন অন্ধকার করে আসচে, বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।’
‘হ্যাঁ রে। জোরে বৃষ্টি আসছে।’ কেশব আকাশের দিকে তাকাল। তারপর বলল,
‘এল রে কালো বীর, বসল রে ডালে
এমন কারো সাধ্য নেই, টেনে ফেলতে পারে!’
ভাদ্রচন্দ্র দাঁত বের করে বলল, ‘বটে, আপনার কিছু প্রতিভা আছে বটে দা’ঠাকুর। সেবার রাজবাড়িতে ছেরাদ্দ অনুষ্ঠানে কেমন সুন্দর ছড়াটা বানিয়ে ফেললেন! কী যেন…?’ ভাদ্রচন্দ্র মনে করতে করতে বলল, ‘যার জন্য খেতে আসা, সে কোথা আছে বসা…।’
‘ধুর গর্দভ!’ কেশব মুহূর্তে চটে উঠল। নিজের বানানো ছড়ার বিকৃতি সে দু’চক্ষে দেখতে পারেনা। প্রতিটা ছড়া তার কাছে সন্তানের মতো, সে সযত্নে তাদের সৃষ্টি করে, লালন করে। বলল,
‘যার জন্য খাই, সে কোথা রে ভাই?
যার খাই, তার খবর রাখি নাই।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ।’ ভাদ্রচন্দ্র বিগলিত হাসল, ‘আপনি হলেন গিয়ে বিষ্ণুপুরের গর্ব।’
‘ঠিক আচে, সেই আনন্দে আবার ছায়াটা মাড়িয়ে দিসনি, এই অবেলায় চান করতে হবে।’ কেশব সরে গিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ রে, তোর ভাইপো’টার কি খবর?’
ভাদ্রচন্দ্রের মুখ মুহূর্তে ম্লান হয়ে গেল। বলল, ‘খবর আর কি দা’ ঠাকুর! বাপ-মা মরে যাওয়ার পর থেকে আমার কাচেই রয়েছে। চেষ্টা-চরিত্তির করচি কোতোলখানায় ঢোকানোর জন্য। সে’ছেলের ওসবে মতিগতি নেই। তাও তর্কালঙ্কারমশাই টোলের কাজে নিয়েচেন, তাই।’
‘হুম।’ কেশব কৃত্রিম দুঃখে মাথা নাড়ল, ‘আমিও নাহয় কথা বলব প্রতিহারীর সঙ্গে।’
‘আজ্ঞে আপনি বলবেন?’ ভাদ্রচন্দ্রর মুখ মুহূর্তে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, ‘তবে তো বড্ড ভালো হয় মহাদানীমশাই। সংসার আর চলছে না। আমার নিজের চারটে মেয়ে। ভাইপোটা দিনরাত আকাশের দিকে চেয়ে আকাশপাতাল ভাবে!’
‘তা ভালো।’ কেশব মহাদানী গম্ভীরমুখে বলল, ‘ভাবুক হওয়া ভালো। বাবা মল্লেশ্বর সবাইকে তো ভাবার মতো মাথা দেন না, তোর ভাইপোকে দিয়েচেন, ভালো কথা। কিন্তু, তবে সেই মাথাটাই যদি না থাকে, তখন ভাববেই বা কী করে বল!’
ভাদ্রচন্দ্র হতভম্ব হয়ে বলল, ‘আজ্ঞে, আমি ঠিক বুঝলাম না মহাদানীমশাই!’
‘না বোঝার মতো তো কিছু বলিনি!’ কেশব বলল, ‘তোর ভাইপো যে দিনরাত ছোট রাজকুমারের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করচে, ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে যাচ্চে, এইসব কথা রাজামশাই ছেড়ে দে, রাজবাড়ির কারুর কানে উঠলে কী হবে ভেবে দেকেচিস? তোদের গুষ্ঠির এখানকার পাট চুকে যাবে। শুনলাম, কে নাকি ওদের হেড়ে পাহাড়ে যেতে দেখেচে। কী বুঝলি?’
ভাদ্রচন্দ্র ঢোঁক গিলল। হ্যাঁ, কানাঘুষোয় শুনেছে যে তর্কালঙ্কারের চতুষ্পাঠী শেষ হলেই পবন ছোটরাজপুত্রের ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। ও তখন বিশেষ পাত্তা দেয়নি। কিন্তু এখন বুঝছে বিষয় সরল নয়। কেশব অবধি যখন পৌঁছেছে, তখন আরও ওপরে কানাকানি হতে দেরি নেই।
সে বলল, ‘আজ্ঞে মহাদানীমশাই, আমি কী করব বলুন তো! এই বয়সের উঠতি ছেলে, অষ্টপ্রহর চোকে চোকে রাখা সম্ভব?’
‘না রাখলে মরবি। আচ্ছা, তুই কি জানিস, মেজকুমারের বিয়ের দিন তোর ভাইপো লুকিয়ে রাজবাড়ির ভেতরে খেতে গিয়েচিল? সবার সঙ্গে এক আসনে বসে খেয়েচে, অপবিত্র করেচে।’ কেশব ঠাণ্ডা গলায় বলে যায়, ‘চলি। আমার আবার দেরি হয়ে যাচ্চে।’
ভাদ্রচন্দ্র একলহমা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর কেশবের পায়ের কাছে পড়ে গেল। বলল, ‘দোহাই মহাদানীমশাই, আপনি কিচু ব্যবস্থা করুন। রাজবাড়িতে জানাজানি হলে আমার সব্বোনাশ হয়ে যাবে।’
কেশব থমকে দাঁড়াল। মাছ টোপ গিলেছে। ভাদ্রচন্দ্রের আর কিছু থাক না থাক, একটা জিনিষ সরেস আছে!
কেশব গম্ভীর গলায় বলল, ‘ঠিক আচে ঠিক আচে। অত উতলা হওয়ার কিচ্চু নেই, পথ ছাড় দিকিনি।’
‘না মহাদানীমশাই। আপনি বুঝতে পারচেন না। আপনি নেহাত ভালো মানুষ, তাই দেখে কিচু বলেননি। যদি অন্য কেউ জানতে পারে, আমি মারা পড়ব।
কেশব প্রচণ্ড বিরক্ত হচ্ছে যেন, এইভাবে বলল, ‘আহ…পথ ছাড় ভাদ্দর। আমি দেখচি কী করা যায়। ছোট রাজকুমারটা বড় বিচ্ছু, তোর ভাইপো যতটা না ওর কাছে ঘেঁষে, ও বেশি টানে। আমি দেখচি ওকে বুঝিয়েসুঝিয়ে পথে আনা যায় কিনা!’ তারপর কিছু মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘ভালো কতা, তোর এই গরুটা তো ভালোই দুধ-টুধ দেয়। তোর বড় মেয়েটাও তো বেশ ডাগর হয়েচে, কী যেন নাম?’
ভাদ্রচন্দ্র ধীরে ধীরে মাটির ওপর উঠে বসল। ঘরপোড়া গরু সে, আকাশে সিঁদুরে মেঘ দেখলেই বুকের ধুকপুক করে ওঠে। একটু থেমে বলল, ‘কমলা, মহাদানীমশাই।’
‘বেশ বেশ।’ কেশব এগোতে এগোতে বলল, ‘কমলাকে দিয়ে রোজ এট্টু দুধ, ঘি পাঠিয়ে দিতেও তো পারিস। একা মানুষ থাকি, শরীরটা দিনদিন ভেঙে যাচ্চে দেকতে পাস না? আর ওসব নিয়ে ভাবিস না, আমি দেখচি।’
ক্লিষ্টচোখে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে ভাদ্রচন্দ্র। চোখেমুখে ঘৃণা ফুটে ওঠে। এই একটা গরুর ওপর নির্ভর করে সাতটা পেট চালাতে হয় তাকে, সেখানেও এই কেশবটা নজর দিতে চায়। আবার কমলাকে দিয়ে পাঠাতে বলছে! লম্পট কোথাকার! কিন্তু কিছু করার নেই, নিজেরা না খেয়েও ওর পেট ভরাতে হবে, নইলে কোথায় কী চুকলি করবে তার ঠিক আছে!
ভাদ্রচন্দ্রের হঠাৎ করে সব রাগ গিয়ে পড়ে বাপ-মা মরা পবনের ওপর। মাথায় খুন চেপে যায় ওর। কাঁপতে কাঁপতে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
২৯
উত্তরপল্লীর শিবমন্দিরের নাটমঞ্চ অতিক্রম করে পুষ্করিণীর দিকে যাওয়ার আগেই একটি ভগ্নপ্রায় মন্দির। রুদ্রাক্ষ আগেও লক্ষ্য করেছে মন্দিরটি। সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা ওপরে উঠে দরজা। ভিতরে এতটাই অন্ধকার যে দেখা যায় না কী বিগ্রহ রয়েছে।
কিন্তু আজ দেখতে পেল, পরিত্যক্ত সেই মন্দিরের ভগ্নপ্রায় সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন শ্রীনিবাস আচার্য।
চোখাচোখি হতে রুদ্রাক্ষ এগিয়ে গিয়ে সহাস্যে ব্রাহ্মণের পদস্পর্শ করল, ‘প্রণাম হই আচার্যমশাই। অনেকদিন পর দেখা হল। আছেন কেমন?’
‘ভালো আছি। তা তোমার বন্ধু কবে পদধূলি দিচ্ছেন মল্লরাজ্যে?’
রুদ্রাক্ষের মেরুদণ্ড দিয়ে বিদ্যুৎ স্রোত বয়ে গেল। বুঝতে না দিয়ে ও কৌতুকপূর্ণ চোখে বলল, ‘আমার বন্ধু! হা-হা, আচার্যমশাই, হেঁয়ালি বোঝা কি আমার মতো মূর্খের কর্ম?’
‘সেকি কথা!’ শ্রীনিবাস আচার্য হাসলেন, ‘বন্ধুকৃত্য করতেই এতকাল মল্লভূমে রয়েছ, সেই বন্ধুকে না চিনতে পারা তো অকৃতজ্ঞতা হে!’
শুনতে শুনতে রুদ্রাক্ষর চোয়ালের পেশি কঠিন হয়ে উঠছিল, সে বুঝতে পারছিল, ইনি তার প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছেন। সে নৈর্ব্যক্তিক মুখে বলল, ‘ফারমুলীর আমি বন্ধু নই, বেতনভুক কর্মচারী মাত্র। মল্লরাজ্যের সীমান্ত ব্যবহার করার জন্য অনুমতি চাইতে এসেছিলাম, সেই কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তারপর রাজকুমারের বিবাহ উপলক্ষে মহারাজের থাকার অনুরোধ গ্রহণ করতে পেরে ধন্য হয়েছি। যে-কোনওদিন বিদায় নেব।’
‘মিথ্যাচারণ করো না রুদ্রাক্ষ!’ অকস্মাৎ শ্রীনিবাস আচার্য গর্জে উঠলেন, ‘মহারাজের অনুরোধ গ্রহণের ছদ্মবেশে তুমি এখানে যে কীসের বীজ বপন করছ, তা আমি জানি। পরিতাপের বিষয়, তোমার মতো দুর্জনকে বীরহাম্বীর পরম মিত্র মনে করে আর তার সেই সারল্যের সুযোগ নিয়ে তুমি জঘন্য এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছ।’
‘এসব কী বলছেন আপনি, পণ্ডিতমশাই? আমি আপনাকে এত শ্রদ্ধা করি, আর আপনি আমাকে এত কটূক্তি করছেন?’
শ্রীনিবাস আচার্য জ্বলন্ত চোখে বললেন,
‘দুর্জনঃ প্রিয়বাদী চ নৈতদ্বিশ্বাসকারণম
মধু তিষ্ঠতি জিহ্বাগ্রে হৃদয়ে তু হলাহলম।
যে ব্যক্তি দুর্জন, মিষ্ট কথা বললেও তাকে বিশ্বাস করতে নিষেধ করেছেন চাণক্য। কারণ মধু তার জিহ্বাগ্রে রয়েছে, অন্তরে শুধু বিষ!’
রুদ্রাক্ষ বিষাক্ত হাসল, ‘তা এই কয়েকপক্ষকালের মধ্যে মল্লরাজ্যে এসে মহারাজকে সম্মোহিত করে আপনি কি নিজেকে চাণক্যর সমগোত্রীয় ভাবছেন নাকি? যে আপনি আমাকে বলেছিলেন, গোপালপুর চটিতে রাত্রিটুকু যাপন করেই আপনারা যাত্রা করবেন গৌড়ের উদ্দেশ্যে, সেই আপনি এখানে ঘাঁটি গেঁড়ে বসলেন কী উদ্দেশ্যে? নাকি চাণক্য নয়, আপনার আকাঙ্ক্ষা স্বয়ং চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য হয়ে মল্লরাজ্যের সিংহাসন অধিকার করার!’
‘সেই সংকল্প যদি আমার থাকত, প্রথমেই সব বিনাশ করতাম। কিন্তু বীরহাম্বীর অতি সজ্জন, রাজা হওয়া সত্ত্বেও তার সারল্য, মহানুভবতা, উদারতা আমাকে মুগ্ধ করে। হয়ত সত্যযুগে রাজা এমনই ছিল। রাজা এমনই হওয়া উচিত।’
শ্রীনিবাস আচার্য আরও কী বলতে যাচ্ছিলেন, সেই সময় মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল একটা লোক।
‘ঠাকুরমশাই, এই মন্দির সংস্কার করেও লাভ হবেনা। পেছনদিকের দেওয়াল নোনায় ভর্তি, কতকাল যে এভাবেই পড়ে রয়েচে!’
‘সেকি কথা কার্তিক? তবে তুমি কী বলো?’
কার্তিক ফৌজদার হাত কচলাতে কচলাতে বলল, ‘তার চেয়ে এখানে নতুন মন্দির করা ভালো। সে মন্দির আমি মনপ্রাণ ঢেলে বানাব’খন!’
‘বেশ। বীরহাম্বীরকে আমি তেমনটাই বলব!’ শ্রীনিবাস আচার্য এদিকে ফিরলেন। বললেন, ‘একটা কথা জেনে রাখো রুদ্রাক্ষ, উৎকল ধূলিসাৎ হলেও এই মল্লভূম ধ্বংস হবেনা। কারণ এখানে স্বয়ং আমি বর্তমান রয়েছি।’
রুদ্রাক্ষ চোখ না সরিয়ে বলল, ‘আর প্রাচীন শিবমন্দির ভেঙে সেখানে বৈষ্ণব মন্দির করার ফলও ভালো হবে না পণ্ডিতমশাই!’
শ্রীনিবাস আচার্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর প্রস্থানোদ্যত হয়ে বললেন, ‘ফলাফল কী হবে, তা তো ভবিষ্যৎ বলবে। তোমার বন্ধুকে আমি চিনি। কেন সে উন্মত্ত দৈত্যের মতো ছুটে আসছে, তার কারণও আমার অজ্ঞাত নয়। তবে গুরুর বুদ্ধিকে অতিক্রম করে মল্লভূম ধ্বংস করবে, তত ক্ষমতা রাজুর এখনও হয়নি।’
‘রাজু!’ নিজের অজান্তেই শব্দটা রুদ্রাক্ষের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল।
শ্রীনিবাস আচার্য হাঁটতে শুরু করেছেন। বললেন, ‘বীরহাম্বীর আমার দীক্ষিত শিষ্য, শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে আমি এই পবিত্র মন্দিররাজ্যকে রক্ষা করব। আর কোনো বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞ লোভীও সাহায্য করতে পারবে না। সম্ভব হলে কথাটা তাকে বলে দিও।’
রুদ্রাক্ষ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।