২০.
কলকাতা মহানগরীর কোনও কোনও অঞ্চলে মধ্যরাত্রে যে নৈস্তব্ধ্য উপভোগ করা যায় গ্রামাঞ্চলে অতখানি সহজলভ্য নয়। যদ্যপি কবিরা ভিন্নমত পোষণ করেন। জনপদবাসী দুপুররাত্রে কেমন যেন নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুতে জানে না। এ বাড়ি থেকে নিদ্রাহীন বৃদ্ধের কাশির শব্দ, ও-বাড়ি থেকে চোর সম্বন্ধে মাত্রাধিক সচেতন মরাই-ভরা ধানের গেরেমভারি মালিকের গলাখারি, চিকিৎসাভাবে কাতর জ্বরাতুর শিশুর নির্জীব গোঙরানো এসব তো আছেই, তার ওপর পশুপক্ষীর নানা রকমের শব্দ। তারা যেন মধ্যরাত্রে একাধিক শত্রুর অতর্কিত আক্রমণের ভয়ে আতঙ্কিত। অথচ বেশ লক্ষ করা যায়, এদের ভিতর তখন একরকমের অপ্রত্যাশিত সহযোগিতা দেখা দেয়। হঠাৎ মোরগটা ভয় পেয়ে ডেকে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে উঠল, ছাগলটা মা মা করল, সর্বশেষে পাশের গোয়ালের গাইটা একটুখানি ঘড় ঘড় করল –খুব সম্ভব চেক্ অপ্ করে নিল, অধুনা প্রসবিত তার বাছুরটি পাশ ছেড়ে কোথাও চলে যায়নি তো!
একমাত্র ব্যত্যয় আমার আলসেশিয়ান মাস্টার। সে ওই ঐকতানে কস্মিনকালেও যোগ দেয় না, যদিও তার কণ্ঠই এ অঞ্চলে সর্বাপেক্ষা গ্ৰাম্ভারি। সোজা বাঙলায়, গম্ভীর অম্বরে যথা নাদে কাদম্বিনী। তার কারণ সে তার আচার-আচরণে অনুকরণ করে আমাকে। আমি নীরব থাকলে সে-ও নিশ্চুপ। আমিও তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করি– সর্বোপরি তার ধৈর্য আর সহিষ্ণুতা। কিন্তু এ-শীলে সে আমাকে রোজই হার মানায়।
হুঃ! ঠিক। শহর-ইয়ারকে আমি একটি আলসেশিয়ান-ছানা সওগাত দেব।
হঠাৎ একটা লোক আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললে, হুজুর, মাফ করবেন। এই তো আমাদের বাড়ি।
ওঃ হো! তাই তো। আমি এ বাড়ি ছাড়িয়ে বেখেয়ালে কহাঁ কহাঁ মুলুকে চলে যেতুম, কে জানে।
অর্থাৎ এই লোকটিকে মোতায়েন করা হয়েছে, আমি যদি রাত সাড়ে তেরটার সময় বাড়ির সামনে চক্কর খাই তখন সে যেন আমাকে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু এই লোকটাকে মোতায়েন করল কে? ডাক্তার? তার তো অতখানি কম সেন্স নেই। শহর-ইয়ার? সে তো পীরের আস্তানা থেকে ফেরে অনেক রাতে।
দীর্ঘ চত্বর পেরিয়ে যখন বাড়িতে ঢুকলুম, তখন দেখি আরও দুটি লোক জেগে বসে আছে। স্পষ্টত আমার-ই জন্য। আমি লজ্জা পেলুম। তিন-তিনটে লোককে এ রকম গভীর রাত অবধি জাগিয়ে রাখা সত্যই অন্যায়।
এ পাপ আর বাড়ানো নয়। চুপিসাড়ে আপন ঘরে ঢুকে অতিশয় মোলায়েমসে খাটে শুয়ে পড়ব। আলোটি পর্যন্ত জ্বালাব না। সুইচের ক্লিক-এ যদি ডাক্তার, শহর-ইয়ারের ঘুম ভেঙে যায়, আর আমার ঘরে হামলা করে।
এককথায়, মাতাল যে রকম গভীর রাত্রে বাড়ি ফেরে।
অতিশয় সন্তর্পণে দরজার হান্ডিলটি ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকে আমি অবাক! ঘর আলোয় আলোময়। আমার খাটের পৈথানের কাছে যে কেদারা তার উপর বসে আছে শহর-ইয়ার।
কিছু বলার পূর্বেই সে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, আপনি আমাকে আর কত সাজা দেবেন?
আমার মুখে কোনও উত্তর জোগাল না। কিসের সাজা? ওকে দেব আমি সাজা! ওর মতো আমার আপনজন এদেশে আর কে আছে?
এস্থলে সাধারণজন যা বলে, তাই বললুম, বসো!
কিন্তু শহর-ইয়ার যেন লড়াইয়ে নেমেছে।
তার চেহারা দেখে কেচ্ছা-সাহিত্যের দুটি লাইন আমার মনে পড়ল :
রানির আকৃতি দেখি বিদরে পরান।
নাকের শোওয়াস যেন বৈশাখী তুফান ॥
কিন্তু আমি কোনও মতামত প্রকাশ করার পূর্বেই সে বললে, আমি খুব ভালো করেই জানি, কলকাতার রাস্তাঘাট আপনি একদম চেনেন না। ওদিকে গাড়ি-ড্রাইভার দিলেন ছেড়ে। এদিকে রাত একটা। তখন কার মনে দুশ্চিন্তা হয় না, বলুন তো!
এসব অভিযোগ সত্ত্বেও আমার হৃদয় বড় প্রসন্ন হয়ে উঠেছে। কারণ, এতক্ষণে আমার কাছে বেশ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, কাল রাত্রে, আজ সকালে তার চোখে অর্ধসুপ্ত, আচ্ছন্ন-আচ্ছন্ন যে ভাবটা ছিল সেটা প্রায় অন্তর্ধান করেছে। সেই প্রাচীন দিনের শহর-ইয়ারের অনেকখানি– সবখানি না– যেন ফিরে এসেছে। এর কারণটা কী? তখনও বুঝতে পারিনি। পরে পেরেছিলুম। সে-কথা আরও পরে হবে। কিন্তু উপস্থিত তার এই অবস্থা পরিবর্তনের পুরোপুরি ফায়দাটা ওঠাতে হবে।
আমি গোবেচারি সেজে বললুম, তা তো বটেই। আমি যে কলকাতার রাস্তাঘাট চিনিনে সে তো নসিকে সত্য কথা। এই তো, আজ সন্ধ্যায়ই, আমি ট্যাকসি ধরে গেলুম ধর্মতলা আর চৌরঙ্গির ক্রসিং-এ। আমি জানতুম, সেখানে ঠঠনের কিংবা কালীঘাটের মা-কালীর মন্দির। ও মা! কোথায় কী! সেখানে দেখি টিপ্পু সুলতানের মসজিদ। কী আর করি। ওজু করে দু রেকাৎ নফল নামাজ পড়ে নিলুম। তার পর বেরুলুম দক্ষিণেশ্বর বাগে। সেখানে তো জানতুম, মৌলা আলীর দরগা–
এতক্ষণে শহর-ইয়ারের ধৈর্যচ্যুতি হল।
তবু, প্রাচীন দিনের মতো শান্ত কণ্ঠে বললে, দেখুন, আপনারা সাহিত্য সৃষ্টি করেন। আপনাদের কল্পনাশক্তি সাধারণজনের চেয়ে অনেক বেশি, ভাষা আপনাদের আয়ত্তে, স্টাইল আপনাদের দখলে। সেই ক্ষমতা নিয়ে আপনারা অনেক কিছু করতে পারেন– লোকে ধন্য ধন্য করে। কিন্তু আমাদের নিতান্ত ব্যক্তিগত জীবনে আপনি সেসব শস্ত্র ব্যবহার করেন কেন? সেটা কি উচিত? আমরা কি তার উত্তর দিতে পারি? আমরা–
প্রাচীন দিনের শহর-ইয়ার যেন নবীন হয়ে দেখা দিচ্ছে। আমি তারই সুযোগ নিয়ে মন্তব্য করলুম, বড় খাঁটি কথা বলেছ, শহর-ইয়ার। এ কর্ম বড়ই অনুচিত!… আমি তোমারই পক্ষে একটি উদাহরণ দিই :
আমাদের শান্তিনিকেতনে কয়েক বৎসর পূর্বে একটি অপ্রিয় ঘটনা ঘটে। তার জন্যে কে দায়ী আমি সঠিক জানিনে। হয় জনৈক অধ্যাপক, নয় ছাত্ররা। তখন শান্তিনিকেতনবাসী জনৈক প্রখ্যাত লেখক ছাত্রদের বিরুদ্ধে একটা কঠোর কঠিন মন্তব্যপূর্ণ পত্র খবরের কাগজে প্রকাশ করেন … তুমি এখখুনি যা বললে, তারই সপক্ষে আমি এ ঘটনার উল্লেখ করছি।… তখন ছাত্ররা করে কী? সেই প্রখ্যাত সাহিত্যিকের শাণিত তরবারির বিরুদ্ধে লড়তে যাবে কে? তারা ফোর্থ-ইয়ার ফিফথ-ইয়ারের ছাত্র। তাদের ভিতর তো কেউ সাহিত্যিক নয়।… সিংহ লড়বে সিংহের সঙ্গে, বাঁদর।
আমি থেমে গেলুম। কিন্তু শহর-ইয়ার চুপ করে রইল।
ইতোমধ্যে আমি আস্তে আস্তে আপন মনে বুঝে গিয়েছি, শহর-ইয়ার কেন আপন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে।
অবশ্য নিঃসন্দেহ, নির্ঘ কোনও কিছু বলা কঠিন।
সে ভয় করেছিল, তার পীরেতে-আমাতে লাগবে লড়াই!
ফলে সে হারাবে পীরকে, নয় আমাকে।
এই দ্বন্দ্বের সামনে পড়ে কাল সন্ধ্যায় সে ডুব মেরেছিল ধ্যানের গভীরে। সেই ধ্যানের পথ সুগম করার জন্য অনেকেই বহুক্ষণ ধরে জপ-জিক করেন। শহর-ইয়ার তাই কাল রাত্রে লতিফ সুন্দরের নাম জপ করেছিল। শুনেছি বহু গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাধক জপ করতে করতে দশা (আরবিতে হাল) প্রাপ্ত হন।
এ নিয়ে তো দিনের পর দিন আলোচনা করা যায়, এবং আমি কিছুটা করেছিও, শহর-ইয়ারের পীরের সঙ্গে বরোদায়। কিন্তু এসব করে আমার কী লাভ? আমি চাই শহর-ইয়ারের মঙ্গল, ডাক্তারের মঙ্গল এবং আমরা তিনজন এতদিন যে-পথ ধরে চলেছি– সুখেদুঃখে হাসিকান্নার ভিতর দিয়ে সে-পথ দিয়েই যেন চলতে পারি। এরই মধ্যে একজন ছিটকে পড়ে যদি স্বয়ং পরব্রহ্মকেও পেয়ে যায় তাতে ডাক্তারের কী লাভ, আমারই-বা কী লাভ? বুদ্ধদেব বৈরাগ্য আর সন্ন্যাস দিয়ে বিশ্বজয় করেছিলেন; কিন্তু সে ধন কি পিতা তথা রাজা শুদ্ধোধনকে আনন্দ দান করতে পেরেছিল? তিনি তো কামনা করেছিলেন, পুত্র যেন যুবরাজরূপে দিগ্বিজয় করে। এবং গোপা-যশোধরা? তিনিও তো চেয়েছিলেন, একদিন রাজমহিষী হবেন, তাঁর পুত্র যুবরাজ রাহুলের রাজমাতা হবেন।
কিন্তু যে-কথা বলছিলুম :
পীরেতে-আমাতে কোনও ঝগড়া-কাজিয়া তো হলই না, বরঞ্চ প্রকাশ পেল, দু জনকার বহুদিনের হৃদ্যতা। শহূরুইয়ারের যেন একটা দুঃস্বপ্ন কেটে গেল, তার যেন দশ দিশি ভেল নিরদ্বন্দা।
***
হঠাৎ না ভেবে-চিন্তেই বলে ফেললুম, আচ্ছা, শহর-ইয়ার, এখন রবীন্দ্রনাথের ধর্মসঙ্গীত তোমাকে আনন্দ দেয়? এখন শব্দটাতে বেশ জোর দিলুম। আগে তো তুমি পছন্দ করতে না।
একটুখানি ম্লান হাসি হেসে বলল, না।
আমি বললুম, সে কী? এখন তুমি যে-পথে চলেছ সেখানে তো তাঁর ধর্মসঙ্গীত তোমাকে অনেককিছু দিতে পারে, তোমার একটা অবলম্বন হতে পারে।
মাথা নিচু করে বলল, হল না। কাল দুপুরেই আপনি তখন বাড়িতে ছিলেন না– আবার কিছু রেকর্ড বাজালুম। অস্বীকার করছিনে, খুব সুন্দর লাগল। ভাষা, ছন্দ, মিল সবই সুন্দর। এমনকি আল্লাহকে নতুন নতুন রূপে দেখা, নতুন নতুন পন্থায় তার কাছে এগিয়ে যাবার প্রচেষ্টা সবই বড় সুন্দর। আমার মন যে কতবার নেচে উঠেছিল, সে আর কী বলব!… কিন্তু, কিন্তু, আমার বুকের ভিতরে কোনও সাড়া জাগল না।
আমি বললুম, আমার কাছে, কেমন যেন হেঁয়ালির মতো ঠেকছে। বুঝিয়ে বল।
এবারে একটুখানি মধুরে উচ্চহাস্য করল– আপনাকেও বোঝাতে হবে?
উঠে দাঁড়িয়ে দক্ষিণের জানালা খুলে দিল।
আহ্। বাইরে কী নিরঙ্কু নৈস্তব্ধ্য। গ্রামে নয়, কলকাতাতেই এটা সম্ভবে।
বন্ধ জানালা খুলে দিলে বাইরের বাতাস যেরকম কামরাটাকে ঠাণ্ডা করে দেয়, হুবহু সেইরকম বাইরের নিস্তব্ধতা যেন আমাদের তর্কালোচনাটাকে শীতল করে দিল।
শহর-ইয়ার বললে, জানালার কাছে আসুন। আরাম পাবেন।
আমি শয্যাত্যাগ করে সেই প্রশস্ত জানালার অন্য প্রান্তে দাঁড়ালুম।
শহর-ইয়ার ধীরে ধীরে আমার কাছে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়াল। আমার দু হাত তখন জানালার আড়ের উপর। সে তার ডান হাত আমার বাঁ হাতে বুলোতে বুলোতে বললে, এই নিচের আঙিনার দিকে তাকান। এখানে ভোর-সঁজ ভিখিরি-আতুর আসে। তাদের জন্য ব্যবস্থা আছে এ বাড়ি পত্তনের সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু এ আঙিনায় সবচেয়ে বেশি আদরযত্ন কারা পায় জানেন? খঞ্জনি-হাতে বোষ্টমি, একতারা-হাতে বাউল, সারেঙ্গি-হাতে ফকির। আপনি হয়তো ভাবছেন, এরা সদাই শুধু আধ্যাত্মিক পারলৌকিক, এ সংসার নশ্বর, এইসব নিয়েই গীত গায়।
আমি বাধা দিয়ে বললুম, মোটেই না, এরা বহু ধরনের গীত জানে।
ভারি খুশি হয়ে বললে, ঠিক ধরেছেন। অবশ্য আমি ভালো করে জানতুম, আপনার কাছে এ তত্ত্ব অজানা নয়। তাই আপনাকে একটুখানি খুঁচিয়ে আমি সুখ পাই। কিন্তু সে-কথা থাক।
আমার বিয়ের রাত্রে, গভীর রাত্রে, এই আঙিনাতেই তারা অনেক মধুর মধুর গান আমাকে-ডাক্তারকে শুনিয়ে গিয়েছিল। তারই একটি ছত্র আমার কানে এখনও বাজে :
শ্যামলীয়াকে দরশন লাগি পর কুসুম্বী সাড়ি
বুঝুন, কী অদ্ভুত কালার-কন্ট্রাস্ট-সেনস। শ্রীকৃষ্ণ শ্যামল। তাই শ্রীরাধা তার শ্যামবর্ণের কন্ট্রাস্ট করার জন্য হলদে রঙের– কুসুম্বী রঙের শাড়ি পরে অভিসারে বেরিয়েছেন।
কিন্তু মোদ্দা কথাটা এইবারে আপনাকে বলি।
আমি সেই বিয়ের রাত্রির পর থেকেই এখানে দাঁড়িয়ে শতসহস্র বার এদের গীত বিশেষ করে ধর্মসঙ্গীত শুনেছি। বরঞ্চ এদের এই সরল, অনাড়ম্বর, সর্ব অলঙ্কার বিবর্জিত ভক্তিগীতি মাঝে মাঝে আমার বুকে সাড়া জাগিয়েছে, এমনকি তুফান তুলেছে– মনে হঠাৎ-চমক লাগায়নি শুধু। তার কারণ, অন্তত আমার মনে হয়, এদের অভাবের অন্ত নেই, এরা গরিব-দুঃখী অনাথ-আতুর। খুদাতালা ছাড়া এদের অন্য কোনও গতি নেই। তাই এদের গীতে থাকে আন্তরিকতা, ডিপেস্ট সিনসিয়ারিটি।
কিন্তু বিশ্বকবি, আবার বলছি, সর্ববিশ্বের কবি রবীন্দ্রনাথ তো এই হতভাগাদের একজন নন। তিনি তো অনাথ-আতুর নন। তাঁর ভক্তিগীতিতে ওদের মর্মান্তিকতা, ঐকান্তিকতা, সর্বাঙ্গীণ আত্মসমর্পণের সুর বাজবে কী করে? তিনি
আর আমি থাকতে পারলুম না। বাধা দিয়ে বললুম, এ তুমি কী আবোল-তাবোল বকতে আরম্ভ করলে শহর-ইয়ার! অন্নাভাব, বস্ত্রাভাব, আশ্রয়াভাব– এইগুলোই বুঝি ইহজীবনের পরম দুর্দৈব, চরম বিনষ্টি? রবীন্দ্রনাথের বয়স চল্লিশ হতে-না-হতেই তার যুবতী স্ত্রীর মৃত্যু হল, তার পাঁচ বছরের ভিতর গেল তার এক ছেলে, এক মেয়ে। তাদের বয়স তখন কত? এগারো, তেরো। অত্যন্ত অপ্রয়োজনীয় অকাল মৃত্যু। তাঁর বাল্য-কৈশোরের কথা তুলতে চাইনে। সেই-বা কিছু কম? ছেলেবেলায়ই ওপারে গেলেন তার মা। সেই মায়ের আসন নিলেন তার বউদি। শুধু তাই নয়, সেই মহীয়সী নারীই কিশোর রবিকে হাতে ধরে নিয়ে এসে প্রবেশ করালেন জহান্-মুশায়েরায়, বিশ্বকবি-সম্মেলনাঙ্গনে।… আজ যদি আমাকে কেউ শুধায়, রবীন্দ্রনাথ কার কাছে সবচেয়ে বেশি ঋণী, তবে নিশ্চয়ই বলব, তার অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলব, তার চেয়েও বেশি ঋণী তিনি তার বউদির কাছে।… সেই বউদি আত্মহত্যা করলেন একদিন। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন কত? বাইশ, তেইশ! এই নারীই ছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাব্যদর্শিকা। তাঁর রুচি, তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ কাব্য রচনা করেছেন তার জীবনের প্রথম বারো বৎসর ধরে।
অন্নাভাব, বস্ত্রাভাব সব মানি। কিন্তু আবার শুধাই, এগুলোই কি শেষ কথা? আত্মহত্যা, পরপর আত্মজনবিয়োগ এগুলো কিছুই নয়?
এই যে তুমি বার বার অনাথ আতুর, অনাথ আতুর বলছ, এই সমস্যাটি তুমি কোত্থেকে নিয়েছ, জানো? তোমার জানা-অজান্তে?
সে-ও রবীন্দ্রনাথের।
শুনেছে তোমার নাম অনাথ আতুর জন–
এসেছে তোমার দ্বারে, শূন্য ফেরে না যেন ॥
এ গীতে কি রবীন্দ্রনাথ বিধাতার প্রধানমন্ত্রী?– তিনি যেন হুজুরকে বলছেন, মহারাজ, এই অনাথ আতুর জনকে অবহেলা করবেন না। তিনি তখন স্বয়ং, নিজে, ওই অনাথ-আতুরদের একজন। অবশ্য তাঁর অন্নবস্ত্র যথেষ্ট ছিল, কিন্তু প্রভু খ্রিস্ট কি সর্বাপেক্ষা সার সত্য বলেননি মানুষ শুধু রুটি খেয়েই বেঁচে থাকে না। ঈশ্বরের করুণাই (ওয়ার্ড) তার প্রধানতম আশ্রয়।
আর এ-ও তুমি ভালো করে জানো, রবীন্দ্রনাথকে তার অর্ধেক জীবন– ১৯০১ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে বিশ্বময় ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল। বিশ্বভিখারিদের তিনি ছিলেন ওয়ার্নড় চ্যামপিয়ন নম্বর ওয়ান। পৃথিবীর হেন প্রান্ত নেই যেখানে তিনি ভিক্ষা করতে যাননি। তাঁর পূর্বে স্বামীজি। এবং দু জনাই ফিরেছিলেন, ওই গানের শূন্য ফেরে না যেন প্রার্থনায় নিষ্ফল হয়ে।
রবীন্দ্রনাথ বেরিয়েছিলেন বিশ্বভারতীর জন্য। তিনি বিশ্বপ্রেম, বিশ্বভারতী– বিশ্ব শব্দ দিয়ে একাধিক সমাস নির্মাণ করেছেন; আমি, অধম, তাঁরই সমাস নির্মাণের অনুকরণে তাঁকে খেতাব দিয়েছি বিশ্বভিক্ষুক। এ হক্ক আমার কিছুটা আছে : রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উপাধি ঠাকুর। কিন্তু তার বংশপরিচয় পীরিলি বা পীর + আলী দিয়ে। আম্মো আলী। আমারও পীর বংশ। কিন্তু থাক, এসব হালকা কথা।
তুমি হয়তো বলবে তুমি কেন, অনেকেই বলবে– এসব শখের ভিখিরিগিরি। আমি এ নিয়ে তর্কাতর্কি করতে চাইনে। কারণ স্বয়ং কবিই গেয়েছেন
এরে ভিখারী সাজায়ে
কী রঙ্গ তুমি করিলে,
হাসিতে আকাশ ভরিলে ॥
কিন্তু এহ বাহ্য।
আমি বারবার জোর দিতে চাই তার মাথার ওপর দিয়ে যে আত্মহত্যা, যেসব অকালমৃত্যুর ঝড় বয়ে গেল, তারই ওপর। সেখানে তিনি অনাথের চেয়েও অনাথ, আতুরের চেয়ে আতুর।
শহর-ইয়ার বড় শান্ত মেয়ে। কোনও আপত্তি জানাল না দেখে আমার উৎসাহ বেড়ে গেল। বললুম, আচ্ছা, রাশার সম্রাট জার নিকোলাসের নাম শুনেছ?
না তো।
কিছু এসে-যায় না। এইটুকুই যথেষ্ট যে তাঁর কোনও অভাব ছিল না। ইয়োরোপের রাজা-ম্রাটদের ভিতর তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বিত্তশালী। দোর্দণ্ড প্রতাপ। তাঁরই রচিত একটি কবিতার শেষ দুটি লাইন আমার মনে পড়ছে, আবছা আবছা। ভুল করলে অপরাধ নিয়ো না। সত্যেন দত্তের অনুবাদ :
কাতরে কাটাই
সারা দিনমান
কাঁদিয়া কাটাই নিশা।
সহি, দহি, ডাকি
ভগবানে আমি
শান্তির নাহি দিশা।
এর চেয়ে আন্তরিকতা-ভরা, হৃদয়ের গভীরতম গুহা থেকে উচ্ছ্বসিত কাতরতা-ভরা আৰ্তরব তুমি কী চাও?
না হয় রাশা-র জার-এর কথা থাক।
কুরান শরিফে এবং এদিক-ওদিক নানা কেতাবে রাজা দাউদের–King David-এর কাহিনী নিশ্চয়ই কিছু কিছু পড়েছ? ইনি শুধু প্রবল পরাক্রান্ত বাদশাহই ছিলেন না, তিনি বাইবেল-কুরান উভয় কর্তৃক স্বীকৃত পয়গম্বর।
ভগবৎ-বিরহে কাতর এই রাজার Psalms বাইবেলে পড়েছ?
কতদিন ধরে, এমন করিয়া
ভুলিয়া রহিবে প্রভু?
Why standest thou afar off, O Lord? Why hidest thou thyself in times of trouble?
আরও শুনবে?
শহর-ইয়ার মাথা না তুলেই বললে, আমার একটা কথা আছে—
আমি বললুম, অনেক রাত হয়েছে। কাল সেসব হবে।
তার পর ছাড়লুম আমার সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বশেষ অগ্নিবাণ :
তোমারও তো ধনদৌলতের কোনও অভাব নেই। তবে তুমি কেন সকাল-সন্ধ্যা ছুটছ পীরসাহেবের বাড়িতে? ভেবেচিন্তে কাল বুঝিয়ে বোলো।
.
২১.
কী একটা স্বপ্ন দেখে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠলুম।
স্বপ্ন কী, তার অর্থ কী, সে ভবিষ্যদ্বাণী করে কি না, এসব বাবদে এখনও মানুষ কিছুই জানে না। অনেক গুণী-জ্ঞানী অবশ্য অনেক কিছু বলেছেন। আঁরি বের্গস থেকে ফ্রয়েড সাহেব পর্যন্ত। পড়ে বিশেষ কোনও লাভ হয়নি– অন্তত আমার।
তবে এ বাবদে একটি সাত বছরের ছেলে যা বলেছিল সেটা সব পণ্ডিতকে হার মানায়। অন্তত, স্বপ্ন জিনিসটা কী, সে-সম্বন্ধে তার আপন বর্ণনা। ডাক্তার তাকে শুধিয়েছিলেন, সে স্বপ্ন দেখে কি না? পুট করে উত্তর দিল, ও, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সিনেমা দেখা? না?
বেশ উত্তর। কিন্তু এখানেই শেষ কথা নয়। আমি এর থেকে একটা তত্ত্বও আবিষ্কার করেছি– কারণ একাধিক শাস্ত্রগ্রন্থ বলেছেন, স্বর্গরাজ্যে সর্বপ্রথম প্রবেশাধিকার শিশুদের। সেই তত্ত্বটি সূত্ররূপে প্রকাশ করলে দাঁড়ায় : আজকের দিনের বাঙলা ফিলম দেখে যেমন আসছে বছরে বাঙলার ভবিষ্যৎ কী হবে সে-সম্বন্ধে কিছু বলা যায় না, ঠিক তেমনি আজ রাত্রে আমি যা স্বপ্ন দেখলুম, তার থেকে তিন মাস পরে আমার কী হবে, সে-হদিস খোঁজা সম্পূর্ণ নিষ্ফল।… তার চেয়ে অনেক নিরাপদ, তাস ফেলে ভবিষ্যৎ নির্ণয় করে সেই অনুযায়ী কার্য করা, কিংবা তার চেয়েও ভালো, অচেনা বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় ধাপের সংখ্যা জোড় না বেজোড়, গুনে গুনে সেটা বের করে আপন কর্তব্য নির্ধারণ করা। জোড় হলে মোলায়েম কায়দায় কাজ হাসিল করার চেষ্টা বেজোড় হলে লোকটার মাথায় সুপুরি রেখে খড়ম পেটানোর মতো শুশান-চিকিৎসায়।
কিন্তু আমি স্বপ্নটা দেখেছিলুম একটু ভিন্ন পদ্ধতিতে।
সেই বাচ্চাটার মতো সিনেমা দেখিনি। আমার ফিলটা যেন যান্ত্রিক গোলযোগে (অবশ্য তার অন্য প্রোগ্রাম শেষে মরমিয়া ভণ্ডস্বরে কেউ ক্ষমা চায়নি) কেটে যায়। কিন্তু সিনেমার বাক্যন্ত্রটি বিকল হয়নি। সে যেন সাথিহারা বিধবার মতো একই রোদন বার বার কেঁদে যাচ্ছিল : সবই বৃথা, সবই মিথ্যা, সবই বৃথা, সবই মিথ্যা।… বোধ হয় ফিলমটা বাইবেলের কোনও কাহিনী অবলম্বন করে তার রূপ-বাণী পেয়েছিল। কারণ, তারই সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজিতে ঠিক ওই একই সন্তাপ কানে আসছিল, ভ্যানিটি অব ভ্যানিটিজ; অল ইজ ভ্যানিটি। যেন বৌদ্ধদের সেই সর্বং শূন্যং, সর্বং ক্ষণিকম্।
এবং সঙ্গে সঙ্গে কী আশ্চর্য! বহু বহু বৎসর পূর্বে দক্ষিণ ভারতের অরুণাচলে শোনা একটি সংস্কৃত মন্ত্র কানে আসছিল :
কর্তৃরাজ্ঞয়া
প্রাপ্যতে ফলম্।
কর্ম কিং পরং
কর্ম তজ্জড়ম্ ॥
এর বাঙলা অনুবাদ আমার এমনই সুপরিচিত যে, স্বপ্নশেষে সেটিও আমার স্মৃতিপটে ধরা দিল :
ঈশ্বরাজ্ঞাধীন কর্ম ফলপ্রসূ হয়।
জড় কর্ম সেই হেতু ঈশ বাচ্য নয় ॥
অর্থাৎ কর্ম জিনিসটাই জড়।… ওই একই কথা– তুমি যে ভাবছ, তোমার যে অহংকার, তুমি কর্ম করছ এবং সেই কর্ম থেকে ফল প্রসবিত হচ্ছে সেটা সর্বৈব মিথ্যা, সেটা ভ্যানিটি (অহংকার)।
বলতে পারব না, কটা ভাষাতে, গদ্যে-পদ্যে, পদ্যে-গদ্যে মেশানো ভাষায়, কত সুরে এই ফিলারমনিক অর্কেস্ট্রা চলেছিল।
কিন্তু তখনও স্বপ্ন শেষ হয়নি।
শেষ হল সেই অরুণাচলমের আরেকটি শ্লোক দিয়ে :
ঈশ্বরার্পিতং
নেচ্ছয়া কৃতম।
চিত্তশোধকং
মুক্তিসাধকম্ ॥
পাজরে যেন গুত্তা খেয়ে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠলুম।
স্বপ্নলব্ধ প্রত্যাদেশে আমি বিশ্বাস করিনে। কিন্তু এবারে আমার ঘাড়ে হুড়মুড়িয়ে আস্ত একটা ট্রাকের চল্লিশ মণ হঁট যেভাবে পড়ল তাতে অত্যন্ত বিমূঢ় অবস্থায়ও আমি হৃদয়ঙ্গম করলুম, আমার কর্ম দ্বারা কোনওকিছুরই সমাধান হবে না, শহর-ইয়ার, ডাক্তার, পীরসাহেব– এদের জট ছাড়ানো আমার কর্ম নয়, আমার কর্ম ঈশ্বর-অর্পিত নয়।
অতএব এ পুরী থেকে পলায়নই প্রশস্ততম পন্থা।
***
তখনও ফজরের নামাজের আজান পড়েনি। চন্দ্র অস্তে নেমেছে, কিন্তু তখনও রাত রয়েছে। পূর্ব দিকের অলস নয়নে তখনও রক্তভাতি ফুটে ওঠেনি।
প্রথম একটা চিরকুট লিখলুম। তার পর হাতের কাছে যা পড়ে, নুনময়লা ধুতি-কুর্তা পরে, গরিবের যা রেস্ত তাই পকেটে পুরে চৌর এবং অভিসারিকার সম্মিলিত নিঃশব্দ চরণক্ষেপে নিচের তলার সদর দরজার কাছে এসে দেখি, দরজা খোলা। আল্লা মেহেরবান্। তখন দেখি, বৃদ্ধ দারওয়ান শূন্য বদনা দোলাতে দোলাতে দরজা দিয়ে ঢুকছে। পরিষ্কার বোঝা গেল, বৃদ্ধ ফজরের নামাজের পূর্বেকার তাহাজ্জুদের নামাজও পড়ে।
মনে পড়ল, বহু বহু বৎসর পূর্বে, ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথের বাসভবনের অতি কাছে, নূতন বাড়িতে কয়েক মাসের জন্য আমার আশ্রয় জুটেছিল। তখন অনিদ্রাকাতরতাবশত অনিচ্ছায় শয্যাত্যাগ করে আমলকি গাছের তলায় পায়চারি করতে করতে দেখেছি, শুভ্রতম বস্ত্রে আচ্ছাদিত গুরুদেব পূৰ্বাস্য হয়ে উপাসনা করছেন। পরে তাঁর তঙ্কালীন ভত্য সাধুর কাছে শুনেছি, তিনি আগের সন্ধ্যায় তোলা বাসি জলে কি শীত কি গ্রীষ্মে স্নানাদি সমাপন করে উপাসনায় বসতেন। তাঁর সর্বাগ্রজ, তার চেয়ে একুশ বছরের বড় দ্বিজেন্দ্রনাথকেও আমি শান্তিনিকেতনের অন্য প্রান্তে ওই একই আচার-নিষ্ঠা করতে দেখেছি। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ষাট; বড়বাবুর একাশি।
কোথা থেকে কোথা এসে পড়লুম। কিন্তু এসব প্রাচীন দিনের কাহিনী বলার লোভ সম্বরণ করা বড় কঠিন। অনেকে আবার শুনতেও চায় যে।
***
ঘটিদের একটা মহৎ গুণ, তারা অহেতুক কৌতূহল দেখায় না। যদিও আড়ালে-আবডালে বসে তক্কে তক্কে থেকে আপনার হাঁড়ির খবর, পেটের খবর, যে সাদামাটা পোর্টফোলিও নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন, বেরুলেন তার ভিতরকার খবর সব জেনে নেয়। আর বাঙালরা এ বাবদে বুন্ধু। বেমক্কা প্রশ্ন করে অন্য পক্ষকে সন্দিহান করে। তোলে। ঘটি তখখনি জিভে-কানে ক্লফর্ম ঢেলে, ঠোঁটদুটো স্টিকিং প্ল্যাটার দিয়ে সেঁটে নিয়ে চড়চড় করে কেটে পড়ে।
তদুপরি এ বৃদ্ধ দারওয়ান এ বাড়ির অনেক কিছুই দেখেছে। বেশিরভাগই দুঃখের। যে বাড়ি একদা গমগম করত, সে এখন কোথায় এসে ঠেকেছে! ভুতুড়ে বাড়ি বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। সে জানে, প্রশ্ন জিগ্যেস করলে যেসব উত্তর শুনতে হয়, তার অধিকাংশই অপ্রিয়।
আমি তার দিকে চিরকুটটি এগিয়ে দিয়ে বললুম, সাহেব, বেগম-সাহেবকো দেনা। খুদা-হাফিজ অভি আয়া (সেটা হবে মিথ্যে) এ সব তো বললুমই না বখশিশ দিলে তো এক মুহূর্তেই সব ক্যামুফ্লাজ ভণ্ডুল হয়ে যাবে।
চিরকুটে লেখা ছিল, আমি বোলপুর চললুম; সময়মতো আবার আসব।
যঃ পলায়তি স জীবতি। আমি ম্লেচ্ছ, দেব-ভাষা জানিনে। স জীবতি না, হয়ে যুবতীও হতে পারে। সতীত্ব রক্ষা করতে হলে যুবতাঁকে পলায়ন করতে হয় বইকি!
***
প্রথম হাওড়াগামী ট্রামের জন্যে মনে মনে অপেক্ষা করতে করতে কদম কদম বাড়িয়ে হাওড়াবাগে এগিয়ে চললুম।
ট্রাম এল। উঠলুম। পাঁচ কদম যেতে না যেতেই বুঝলুম, তে হি নো দিবস গতাঃ। আমাদের ছেলেবেলায় ট্রামগাড়ির কী-সব যেন থাকত স্ত্রিঙিং, শ-এব জরবার আরও কত কী। গাড়ি এমনই মোলায়েম যেত যে, মনে হতো ওয়াই এম সি এর বিলিয়ার্ড টেবিল পেতে এখানে ওয়ার্লড় চ্যাম্পিয়নশিপ দিব্যি খেলা যেতে পারে। বস্তুত তখনকার দিনে এরকম আরামদায়ক নিরাপদ বাহন কলকাতায় আর দ্বিতীয়টি ছিল না। আর আজ! প্রতি আচমকা ধাক্কাতে মনে ভয় হল, কাল রাত্রি যা খেয়েছি তারা বুঝি সব রিটার্ন টিকিট নিয়ে গিয়েছিল, এই বুঝি সবাই একসঙ্গে হুড়মুড়িয়ে মোকামে ফেরত এসে কন্ডাকটরের কাছে গুহ কমিশনের রিপোর্ট পেশ করবেন, আমি ভোরবেলাকার বেহেড মাতাল।
০৬.৫০-এ বারাউনি প্যাসেঞ্জার ধরে নির্বিঘ্নে বোলপুর ফিরলুম।
কিন্তু বর্ধমানে চা জুটল না। বর্ধমানে চা যোগাড় করার ভানুমতী খেল গুণী একমাত্র শহর-ইয়ারই নব নব ইন্দ্রজালে নির্মাণ করে দেখাতে পারেন। সে তো ছিল না।
ট্রেনে মাত্র একটি চিন্তা আমার মনের ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছিল।
এই যে আমি কাউকে কিছু না বলে-কয়ে সরে পড়লুম, এটাকে ইয়োরোপের প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব পণ্ডিতেরা নাম দিয়েছেন পলায়ন-মনোবৃত্তি না কী যেন বোধ হয় এসকেপিজম–রাজভাষায়। এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা তাঁদের সংস্কৃত পাণ্ডিত্যের দ্বিরদরদস্তম্ভের উচ্চাসনে বসে যে তত্ত্ব প্রচার করেন–ইংরেজ পণ্ডিতরা তো বটেনই এবং তাদেরই নুন-নেমক-খেকো হনুকরণকারী জর্মন-ফরাসি পণ্ডিতেরও একাধিক জন– সে তত্ত্বের নির্যাস : ভারতীয় সাধুসন্ত, গুণীজ্ঞানী, দার্শনিক-পণ্ডিত সবাই, সক্কলেই অত্যন্ত স্বার্থপর, সেলফিশ। তারা শুধু আপন আপন মোক্ষ, আপন আপন নির্বাণ-কৈবল্যানন্দ লাভের জন্য অষ্টপ্রহর ব্যতিব্যস্ত। বিশ্বসংসারের আতুর কাতরজনের জন্য তাদের কণামাত্র শিরঃপীড়া নেই, নো হিউমেন সিপেথি, নো পরোপকার প্রবৃত্তি। এই ভারতীয়দের দর্শন– কি সাংখ্য, কি বেদান্ত, কি যোগ– সর্বত্রই পাবে এক অনুশাসন, আত্মচিন্তা কর, আপন মোক্ষচিন্তা কর। মোসট সেলফিশ এগোইষ্টিক ফিলসফি।
এসব অর্ধভুক্ত বমননিঃসৃত আপ্তবাক্য যুক্তিতর্ক দ্বারা খণ্ডন করা যায় না। ভূতকে বন্দুকের গুলি ছুঁড়ে ঘায়েল করা যায় না। সেখানে দরকার– জৈসনকে তৈসন– তেজি সরষে, আঁজালো লঙ্কা পোড়ানো।
সে মুষ্টিযোগ রপ্ত ছিল একমাত্র বঙ্কিমচন্দ্রের। এ স্থলে তিনি প্রয়োগ করলেন ঝাঁজালো লঙ্কা-পোড়া। অর্থাৎ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। অতিশয় সিদ্ধহস্তে। অথচ সে পুণ্যশ্লোক রচনা এমনই সুনিপুণ প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত তথা সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা-ভরা যে, আজও, অর্ধশতাব্দাধিক কাল পরও, এখনও কোনও কোনও ভারতপ্রেমী হিন্দু সভ্যতা তথা মর্যাদা রক্শাকরুনেওয়ালা বামনাবতার মড়লী বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যঙ্গ বুঝতে না পেরে বঙ্কিম মুর্দাবাদ, বঙ্কিম মুর্দাবাদ জিগির তুলে গগনচুম্বী লক্ষপ্রদানে উদ্যত হন।
বঙ্কিমের সেই রামায়ণ সমালোচনার কথা ভাবছি।
অবশ্য এসব ব্যঙ্গ ছাড়াও এদেশের পণ্ডিতগণ দার্শনিক পদ্ধতিতেও ইয়োরোপীয় পণ্ডিতদের মুখ-তোড় উত্তর দিয়েছেন। কিন্তু হায়, দর্শনশাস্ত্রে আমার আলিফের নামে ঠ্যাঙা। আমি অন্য দৃষ্টি অন্য দর্শনের আশ্রয় নিই।
অপবাদটা ছিল কী? আমরা নাকি বড্ডই স্বার্থপর, নিজের মোক্ষচিন্তা ভিন্ন অন্য কারও কোনও উপকার বা সেবার কথা আদৌ ভাবিনে।
এস্থলে আমার বক্তব্যটি তার মূল্য অসাধারণ কিছু একটা হবে না জানি– সামান্য একটি পর্যবেক্ষণ দিয়ে আরম্ভ করি। এই বাঙলা দেশে সবচেয়ে বেশি কোন গ্রন্থখানা পড়া হয়? অতি অবশ্যই মহাভারত। মূল সংস্কৃত, মহাত্মা কালীপ্রসন্নের অনুবাদ, বা রাজশেখরীয়, কিংবা কাশীরামের বাঙলায় রূপান্তরিত মহাভারত কিছু-না-কিছু-একটা পড়েনি এমন বাঙালি পাওয়া অসম্ভব। এই হিসাবের ভিতর বাঙালি মুসলমানও আসে। প্রমাণস্বরূপ একটি তথ্য নিবেদন করি। দেশ-বিভাগের প্রায় পনেরো বৎসর পর আমি একটি পাকিস্তানবাসিনী মুসলিম ইন্সপেকট্রেস্ অব স্কুলকে শুধোই, আমাদের দেশে কাচ্চা-বাচ্চাদের ভিতর এখন কোন কোন বই সবচেয়ে বেশি পড়া হয়? ক্ষণমাত্র চিন্তা না করে বললেন, রামায়ণ-মহাভারত বরঞ্চ বলা উচিত মহাভারত-রামায়ণ– কারণ মহাভারতইকাচ্চাবাচ্চারা পছন্দ করে বেশি। তবে তারা প্রামাণিক বিরাট মহাভারত পড়ে না। গ্রামাঞ্চলে হিন্দু পরিবারে এখনও কাশীরাম, কিন্তু বাচ্চারা পড়ে মহাভারতের গল্প এই ধরনের সাদা-সোজা চটি বই। তার পর একটু চিন্তা করে বললেন, অবশ্য ব্যত্যয়ও আছে। আমার বারো বছরের ছেলেটা ইতোমধ্যেই তার মামার মতো পুস্তক-কীট হয়ে গিয়েছে। তাকে কালীপ্রসন্ন আর রাজশেখর দুই-ই দিয়েছিলুম। মাস দুই পরে আমার প্রশ্নের উত্তরে বললে, রাজশেখর বাবুর ভাষাটি বড় সহজ আর সুন্দর। কিন্তু সবকিছুর বড় ঠাসাঠাসি। কালীপ্রসন্নবাবুটা বেশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লেখা। আরাম করে ধীরে ধীরে পড়া যায়। এর পর মহিলাটি একটু হেসে বললেন, জানেন, বয়স্ক মুসলমানদের কথা বাদ দিন, তারা তো দেশ-বিভাগের পূর্বেই কারিকুলাম-মাফিক রামায়ণ-মহাভারত অন্নদামঙ্গল মনসামঙ্গল এসবেরই কিছু কিছু পড়েছিলেন কিন্তু পার্টিশনের এই পনেরো বৎসর পরও, আমাদের মুসলমান বাচ্চারা দাতাকর্ণ-কে চেনে বেশি, কর্ণের অপজিট নাম্বার আরব দেশের দাতাকর্ণ হাতিম তাঈ-কে চেনে কম।
এই মহাভারতটি যখন বালবৃদ্ধবনিতার এতই সুপ্রিয় সুখপাঠ্য, তখন দেখা যাক, এ মহাগ্রন্থের শেষ অধ্যায়ের শেষ উপদেশ কী– ভুল বললুম, উপদেশ নয়, আপন আত্মবিসর্জনকর্ম দ্বারা দৃষ্টান্ত-নির্মাণ, আদর্শ নির্দেশ– সেটি কী?
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের প্রাণাধিক প্রিয় চারি ভ্রাতা, মাতা কুন্তীর পরই যে নারী তার জীবনে সর্বাপেক্ষা সমাদৃতা, যার শপথ রক্ষার্থে এই শান্তিপ্রিয় যুধিষ্ঠির নৃশংস কুরুক্ষেত্রের সমরাঙ্গনে অবতীর্ণ হলেন, সেই নারী, এবং পরপর তাঁর চার ভ্রাতা মহাপ্রস্থানিকপর্বে বর্ণিত হিমালয় অতিক্রম করার সময় একে একে যখন মৃত্যুমুখে পতিত হলেন, তখন পরম স্নেহশীল যুধিষ্ঠির তাঁদের জন্য ক্ষণতরেও শোক করেননি, কারও প্রতি মুহূর্তেক দৃষ্টিপাত না করে সমাহিতচিত্তে অগ্রসর হতে লাগলেন। এ সময় সে-ই কুকুর, যে হস্তিনাপুর থেকে এদের অনুগামী হয়েছিল, সে-ই শুধু যুধিষ্ঠিরের পশ্চাতে।
এমন সময় ভূমণ্ডল নভোমণ্ডল রথশব্দে নিনাদিত করে দেবরাজ স্বর্গরাজ ইন্দ্র যুধিষ্ঠিরের সম্মুখে সমুপস্থিত হয়ে বললেন, মহারাজ, তুমি অবিলম্বে এই রথে সমারূঢ় হয়ে স্বর্গারোহণ কর।
এর পর উভয়ে অনেক কথাবার্তা হল। আমার ভাষায় বলি, বিস্তর দরকষাকষি হল। শেষটায় সমঝাওতা ভি হল। ওই যে রকম দেশ-বিভাগের পূর্বে কংগ্রেস-লীগে হয়েছিল। কিন্তু সে তুলনার এখানেই সমাপ্তি। ইতোমধ্যে চতুর্থ পাণ্ডব এবং দ্ৰৌপদী স্বর্গারোহণ করেছেন।
এর পর, পুনরায় আমার নগণ্য ভাষাতেই বলি, বখেড়া লাগল সেই নেড়ি কুত্তাটাকে নিয়ে। যুধিষ্ঠির ফরিয়াদ করে বলেছেন, এ কুত্তাটা আমার সঙ্গে সঙ্গে এত দীর্ঘদিন ধরে এসেছে। একে ওখানে ছেড়ে গেলে আমার পক্ষে বড়ই নিষ্ঠুর আচরণ হবে।
সরল ইন্দ্র মনে মনে ভাবলেন, এ তো মহা ফ্যাসাদ। এই যুধিষ্ঠিরটা তো আপন স্বার্থ কখনও বোঝেনি, এখনও কি আপন কল্যাণ বোঝে না? প্রকাশ্যে বললেন, ধর্মরাজ, আজ তুমি অতুল সম্পদ, পরমসিদ্ধি, অমরত্ব ও আমার স্বরূপত্ব লাভ করবে (এই স্বরূপত্ব লাভটা আমি আজও বুঝতে পারিনি; মরলোকের ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তো স্বর্গলোকে তার স্বরূপত্ব লাভ করবেন স্বর্গের যম-রাজার অস্তিত্বে বিলীন হয়ে ইন্দ্রের স্বরূপত্ব লাভ করবেন তো তাঁর পুত্র অর্জুন!)। এসব বিদকুটে বয়নাক্কা কর না। আমার এই অতি পূত, হেভেনলি বেহেশতের রথে ওই নেড়ি, ঘেয়ো অতিশয় অপবিত্র কুকুর আর হাইড্রফবিয়া থাকাও কিছুমাত্র বিচিত্র নয়– কী করে ঢুকতে পারে?
***
এসব তাবৎ কাহিনী সকলেরই জানা। আমি শুধু আমার আপন ভাষাতে কাহিনীটির পুনরাবৃত্তি করার লোভ সম্বরণ করতে পারলুম না। কেউ যেন অপরাধ না নেন। যুগ যুগ ধরে আসমুদ্রহিমাচল সবাই আপন আপন ভাষাতে মহাভারত নয়া নয়া করে লিখেছে। আমি যবন। আপ্তবাক্য বেদে আমার শাস্রাধিকার নেই। কিন্তু মহাভারতে অতি অবশ্যই আছে। সাবধান! বাধা দেবেন না। ক্যুনাল রায়োট লাগিয়ে আপন হক কেড়ে নেব।
কিন্তু এহ বাহ্য।
ইয়োরোপীয়রা বলে আমরা স্বার্থপর। তবে আমাদের এই যে সর্বপরিচিত সর্বজনসম্মানিত গ্রন্থে যুধিষ্ঠির বলছেন, তাঁর স্বর্গসুখের তরে কোনও লোভ নেই, তিনি মোক্ষলুব্ধ নন, এমনকি স্বর্গে না যেতে পারলে তিনি যে তাঁর ভ্রাতৃবর্গ, কুন্তী, পাঞ্চালীর সঙ্গসুখও পাবেন না, তাতেও তার ক্ষোভ নেই– কিন্তু, কিন্তু, তিনি—
এই ভক্ত শরণাগত কুকুরটিকে কিছুতেই পরিত্যাগ করতে পারবেন না।
***
ট্রেনে কলকাতা থেকে আসতে আসতে এইসব কথা ভাবছিলুম। স্বপ্নে যে শুনেছিলুম, যার মোদ্দা ছিল,
ওরে ভীরু, তোমার উপর নাই ভুবনের ভার।
হালের কাছে মাঝি আছে, করবে তরী পার ॥
তুই কলকাতা ছেড়ে পালা। না, যুধিষ্ঠিরকে সামনে রেখে সেই পন্থা অবলম্বন করব? অবশ্য আমি যুধিষ্ঠির নই বলে, আমার যেটুকু সঙ্গতি আছে সেইটুকু সম্বল করে নিয়ে।
হজরত নবী প্রায়ই বলতেন, আল্লার ওপর নির্ভর (তওয়াক্কুল) রেখো। একদা এক বেদুইন শুধাল, তবে কি, হুজুর, দিনান্তে উটগুলোকে দড়ি দিয়ে না বেঁধে মরুভূমিতে ছেড়ে দেব– আল্লার ওপর নির্ভর করে? পয়গম্বর মৃদুহাস্য করে বলেছিলেন, না। দড়ি দিয়ে খুঁটিতে বেঁধে আল্লার ওপর নির্ভর রাখবে। অর্থাৎ বাঁধার পরও ঝড়ঝঞ্ঝা আসতে পারে, দড়ি ছিঁড়ে যেতে পারে, চোর এসে দড়ি কেটে উট চুরি করে নিয়ে যেতে পারে– ওই সব অবোধ্য দৈব-দুর্বিপাকের জন্য আল্লার ওপর নির্ভর করতে হয়।
তে রয়ে গিয়ে যেটুকু করার সেইটুকু করাই উচিত ছিল আল্লার ওপর নির্ভর করে অর্থাৎ মা ফলেষু কদাচন করে?
***
শুতে যাবার সময় হঠাৎ একটি কথা মনে পড়ে যাওয়াতে আপন মনে একটু হাসলুম।
সেই পাকিস্তানি মহিলাকে শুধিয়েছিলুম, বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ এই নাপাক কুকুরটা মহাভারতে ঢুকল কেন?
তিনি বলেছিলেন, আমি ভেবে দেখেছি কথাটা।… আসলে কী জানেন, মহাভারত সব বয়সের লোকের জন্যই অবতীর্ণ হয়েছে বাচ্চাদের জন্যও।
তারা কুকুর-বেড়াল ভালোবাসে। তাই তারা কুকুরের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ দেখে মুগ্ধ হয়। ওইটেই তাদের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মত্যাগ।
.
২২.
কলকাতা
হাজার হাজার আদাব তসলিমাৎ পর পাক জনাবে আরজ এই,
সৈয়দ সাহেব,
আমি ভেবেছিলাম, দু একদিনের ভিতর আপনাকে সবকথা খুলে বলার সুযোগ পাব, কিন্তু আপনি হঠাৎ চলে গেলেন। আপনার ডাক্তার বিস্মিত ও ঈষৎ নিরাশ হয়েছেন। কিন্তু আমি চিন্তা করে দেখলুম, এই ভালো। আপনার সামনে আমার বক্তব্য রাখার সঙ্গে সঙ্গে আপনি এমন সব আপত্তি, প্রতিসমস্যা তুলতেন যে, শেষ পর্যন্ত আমার কোনওকিছুই বলা হয়ে উঠত না। তাই চিঠিই ভালো। কে যেন আপন ডায়েরি লেখার প্রারম্ভেই বলেছেন, মানুষের চেয়ে কাগজ ঢের বেশি সহিষ্ণু।
অবশ্য একথা আবার অতিশয় সত্য যে পত্র লেখার অভ্যাস আমার নেই। ভাষার ওপর আমার যেটুকু দখল সে-ও নগণ্য। তাই যা লিখব তা হবে অগোছালো। তবে তার সঙ্গে সঙ্গে এ কথাটিও বলি, আমার ভাবনা-চিন্তা সবই এমনই অগোছালো যে অগোছালো ভাষাই আমার অগোছালো মনোভাবকে তার উপযুক্ত প্রকাশ দেবে। তদুপরি আমি জানি, আপনি গোছালো-অগোছালো সব রাবিশ সব সারবস্তু মেশানো যে ঘাট, তার থেকে সত্য নির্যাসটি বের করতে পারেন।
আপনি হয়তো অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। আমি মোদ্দা কথায় আসছি না কেন? সেটাতে আসবার উপায় জানা থাকলে তো অনেক গণ্ডগোলই কেটে যেত।
আপনার গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের ধর্মসঙ্গীত আমার বুকে তুফান তোলে না, সেকথা আপনাকে আমি বলেছি। এখনও ফের বলছি– আপনার সে-রাত্রের দীর্ঘ ডিফেনসের পরও। অথচ এস্থলে আমাকে তারই শরণ নিতে হল।
গানটি আপনি নিশ্চয়ই জানেন :
যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা
তোমায় জানাতাম।
এস্থলে আমি এটা স্বীকার করে নিচ্ছি, যে, কবিগুরুর তুলনায় আমি শোকদুঃখ পেয়েছি অনেক অনেক কম। আপনি সে-রাত্রে তার একটার পর একটা দুর্দৈবের কাহিনী বলার পূর্বে আমি সেদিকে ওভাবে কখনও খেয়াল করিনি। আপনার এই সুন্দুমাত্র তথ্যোল্লেখ আমার মনে গভীর দাগ কেটেছে। আমি ভাবছিলুম, রবীন্দ্রনাথ পরপর এতগুলো শোক পাওয়ার পরও কি জানতে পারলেন না, তার কিসের ব্যথা, তাঁর শোকটা কোন দিক থেকে আসছে?
তাই অসঙ্কোচে স্বীকার করছি, আমি এখনও ঠিক ঠিক জানিনে, আমার কিসের ব্যথা, আমার অভাব কোনখানে, যার ফলে বিলাসবৈভবের মাঝখানেও যেন কোনও এক অসম্পূর্ণতার নিপীড়ন আমাকে অশান্ত করে তুলেছিল।
কিন্তু এখানে এসেই আমার বিপত্তি– এতদিন ধরে আমার সঙ্গে সঙ্গে আছে। আপনার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিন থেকে। এবং সত্য বলতে কি, তার অনেক আগের থেকেই কিশোরী অবস্থায় যখন প্রথম পরপুরুষের সঙ্গে আলাপ হয় তখন থেকেই। পুরুষ কথাটার ওপর আমি এখানে জোর দিচ্ছি।
আমার বিপত্তি, আমার সমস্যা– পুরুষমানুষ কি কখনও নারীর মন বুঝতে পারে, চিনতে পারে, হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারে? সাহিত্য সমালোচক পণ্ডিতরা বলেন, সার্থক সাহিত্যিকের ওই তো কর্ম, ওই তো তার সত্যকার সাধনার্জিত সিদ্ধি। জমিদার রবীন্দ্রনাথ গরিব পোস্টমাস্টার, ভিনদেশি কাবুলিওলার বুকের ভিতর প্রবেশ করে তাদের হৃদয়ানুভূতি স্পন্দনে স্পন্দনে আপন স্পন্দন দিয়ে অনুভব করে তাঁর সৃজনীকলায় সেই অনুভূতিটি প্রকাশ করেন। যে কবি, যে সাহিত্যিক আপন নিজস্ব সত্তা সম্পূর্ণ বিস্মরণ করে, অপরের সত্তায় বিলীন হয়ে যত বেশি গ্রহণ করে আপন সৃজনে প্রকাশ করতে পারেন তিনিই তত বেশি সার্থক কবি, সাহিত্যিক।
এ তত্ত্বটা আমি স্বীকার করে নিচ্ছি। কিন্তু আমার দৃঢ়তর বিশ্বাস, পুরুষ কবি, পুরুষ সাহিত্যিক কখনও, কস্মিনকালেও নারীর হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারেনি, পারবেও; তার কারণ কী, কেন পারে না, সে নিয়ে আমি অনেক চিন্তা করেছি, কিন্তু কোনও সদুত্তর পাইনি।
যদিও কিঞ্চিৎ অবান্তর তবু এই প্রসঙ্গে একটি কথা তুলি। নারী-হৃদয়ের স্পন্দন এবং পুরুষ-হৃদয়ের প্রতিস্পন্দনের আলোচনা নয়; নারী-পুরুষের একে অন্যকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করার যে চিন্ময় প্রেম সেটাও নয়। আমি নিতান্ত মৃন্ময়, শারীরিক যৌন সম্পর্কের কথা তুলছি। আজকাল সাহিত্যিক, তাদের পাঠক সম্প্রদায়, খবরের কাগজে পত্র-লেখকের দল সবাই নির্ভয়ে এসব আলোচনা সর্বজনসমক্ষে করে থাকেন। আমার কিন্তু এখনও বাধোবাধো ঠেকে। কত হাজার বৎসরের না, না-র taboo আজ অকস্মাৎ পেরিয়ে যাই কী প্রকারে?
তবে আমার এইটুকু সান্ত্বনা, যার আপ্তবাক্যের শরণ আমি নিচ্ছি, তিনি আপনার গুরুর গুরু দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
যে দেশ পত্রিকার সঙ্গে আপনি বহু বৎসর ধরে বিজড়িত সেই পত্রিকাতেই বেরিয়েছিল তাঁর একখানা চিঠি। আমার শব্দে শব্দে মনে নেই। তবে মূল তত্ত্বটি আমার মনে জ্বলজ্বল করছে।
কে যেন তাকে শুধিয়েছিল, পুরুষ যখন কখনও কোনও রমণীকে দেখে কামাতুর হয় (এখানে দেহাতীত স্বর্গীয় প্লাতনিক প্রেমের কথা হচ্ছে না), তার কামকে উত্তেজিত করে রমণীর কোন কোন জিনিস?
তার মুখমণ্ডল, তার ওষ্ঠাধর, তার নয়নাগ্নি, তার কৃচদ্বয়, তার নিতম্ব, তার উরু।
এইবারে প্রশ্ন, কোনও পুরুষকে দেখে যখন কোনও রমণী কামাতুরা হয় তখন কী দেখে তার কামবহ্নি প্রজ্বলিত হয়?
যে-ভদ্রলোক দার্শনিক দ্বিজেন্দ্রনাথকে এ প্রশ্ন শুধিয়েছিলেন তাঁর পত্র দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু দেশে প্রকাশিত দ্বিজেন্দ্রনাথের পত্রোত্তর থেকে সে প্রশ্নের মোটামুটি স্বরূপ অনুমান করা যায়।
আবার বলছি, দ্বিজেন্দ্রনাথ কী উত্তর দিয়েছিলেন সেটি আক্ষরিক, হুবহু আমার মনে নেই। তিনি যা লিখেছিলেন তার মোদ্দা তাৎপর্য ছিল; তিনি যে এ সম্বন্ধে কোনও চিন্তা করেননি তা নয়। কিন্তু কোনও সদুত্তর খুঁজে পাননি।
তার পর ছিল ইংরেজি একটি সেন্টেন্স। যতদূর মনে পড়ছে, তিনি লিখলেন, But why ask me? Ask Rabi. He deals in them. অর্থাৎ বলতে চেয়েছিলেন, তিনি দার্শনিক, এসব ব্যাপারে তিনি বিশেষজ্ঞ নন; তবে লাকিলি তাঁর ছোট ভাইটি এ বাদে স্পেশালিস্ট; তিনি প্রেম, কাম, নিষ্কাম প্রেম সম্বন্ধে সুচিন্তিত অভিমত দিতে পারেন।
কিন্তু সৈয়দ সাহেব, পীর সাহেব, আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস কনিষ্ঠ ভ্রাতাটিও এ বিষয়ে খুব বেশি ওয়াকিফহাল ছিলেন না। প্রথম যৌবনে তিনি এসব নিয়ে কবিতা লিখেছেন, কিন্তু বোলপুরে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করার পর তিনি যাকে বলে হট-স্টাফ– সেটাকে তাঁর গানের বিষয়বস্তু করেননি। বোধ হয় ভেবেছিলেন, তাঁর রচিত হট-স্টা গান আশ্রমের ব্রহ্মচারী-ব্রহ্মচারিণীরা দিনের পর দিন শুনবে, এটা কেমন যেন বাঞ্ছনীয় নয়। এবং এগুলো তো আর ওয়াটার-টাইট কমপার্টমেন্টে বন্ধ করে খাস কলকাতার বয়স্কদের কনজাম্পশনের জন্য চালান দেওয়া যায় না। ওগুলোর বেশকিছু ভাগ বুমেরাঙের মতো ফিরে আসবে সেই বোলপুরেই প্রথম যুগে গ্রামোফোন রেকর্ডের কল্যাণে, পরবর্তী যুগে বেতার তো ঘরে ঘরে।
অ্যথা বিনয় আমার সয় না। আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত বেশ ভালো করেই চিনি, অবশ্য বিশ্বভারতীয় প্রকাশন বিভাগের মতো তার গানের ফুলস্টপ-কমা স্পেশালিসট নই। তাই অহ্যানড় বলছি তার শেষের দিকের গানের একটিতে হট-স্টাফের কিঞ্চিৎ পরশ আছে :
বাসনার রঙে লহরে লহরে
রঙিন হল।
করুণ তোমার অরুণ অধরে
তোলো হে তোলো।
আর বার বার বলছেন, পিয়ো হে পিয়ো। সর্বশেষে বলছেন, আমার এই তুলে-ধরা পান-পাত্র চুম্বনের সময় তোমার নিশ্বাস যেন (আমার) নিশ্বাসের সঙ্গে মিশে যায়।
এই যে প্রিয়ার নবীন উষার পুষ্পসুবাসের মতো নিশ্বাস, একে নিঃশেষে শোষণ করার মতো সালাইম্ কাম আর কী হতে পারে?
কিন্তু আপনার মুখেই শুনেছি, রবীন্দ্রভক্তদের ভিতর এ গানটি খুব একটা চালু নয়। অথচ দেখুন, সিনেমা এটা নিয়েছে, গ্রামোফোন এটা রেকর্ড করেছে। মাফ করবেন, আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, এইসব তথাকথিত রবীন্দ্রভক্তদের চেয়ে ব্যবসায়ী সিনেমা, গ্রামোফোন কোম্পানি রবীন্দ্রনাথকে বহু বহু বার অধিকতর সম্মান দেখিয়েছে, নিজেদের সুরুচির পরিচয় দিয়েছে।
হ্যাঁ, আগে ভাবিনি, এখন হঠাৎ মনে পড়ল আরেকটি গানের কথা। এটি অবশ্য হট স্টাফ নয়, কিন্তু আমার মূল বক্তব্যের সঙ্গে এর যোগ রয়েছে।
ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো।
আমার মুখের আঁচলখানি।
ঢাকা থাকে না হায় গো,
তারে রাখতে নারি টানি ॥
আমার রইল না লাজলজ্জা,
আমার ঘুচল গো সাজসজ্জা–
তুমি দেখলে আমারে
এমন প্রলয়-মাঝে আনি
আমায় এমন মরণ হানি ॥
আচ্ছা, চিন্তা করুন তো এ গানটি কোন সময়ের রচনা? ভাষার পারিপাট্য, স্বতঃস্ফূর্ত মিলের বাহার, আরও কত না কারুকার্য যেগুলো চোখে পড়ে না, কারণ প্রকৃত সার্থক কলার ভিতরে তারা নিজেদের এফার্টলেসলি বিলীন করে দিয়েছে– এগুলো তো ওই গানের পরবর্তী শ্লোকের ভাষায় আকাশ উজলি লাগিয়ে বিজুলি আমাকে পরিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে, গানটি কবির পরিপক্ক বয়সের অত্যুকৃষ্ট সৃজন। নিশ্চয়ই এ শতাব্দীর দ্বিতীয় বা তৃতীয় দশকে।
কিন্তু যে গুণী আমাকে এ গানটি শুনিয়েছিলেন এবং শেখাবারও চেষ্টা করেছিলেন তিনি গীতবিতানে যে মুদ্রিত পাঠ আছে তার থেকে মাত্র একটি শব্দ পরিবর্তন করে গানটি গেয়েছিলেন। ছাপাতে আছে, ঝড়ের দুর্দান্ত বাতাসে কে যেন আর্ত রব করছে, তবে মুখের আঁচলখানি উড়ে যাচ্ছে।
গুণী বলেছিলেন, ১৯২০-১৯৩০-এ মুখের আঁচল উড়ে যাওয়াতে কোন মেয়ে এরকম চিল-চাঁচানো চেল্লাচেল্লি পাড়া-জাগানো হৈ-হুঁল্লোড় আরম্ভ করবে? তার নাকি সাজসজ্জা লাজলজ্জা বেবাক কর্পূর হয়ে গেল। (এস্থলে বলি, ওই গুণীটি আপনার ভাষার অনুকরণ করেন।) আর শুধু কি তাই? তাকে প্রলয় মাঝে আনি/এমন মরণ হানি।- তুমি দেখলে আমারে!
গুণী বললেন, এটা হতেই পারে না। আসলে গানটি কী ছিল জানেন? সে যখন ভূমিষ্ঠ হয় সে ছিল তখন উলঙ্গ। সে গান ছিল,
ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো
আমার বুকের
বসনখানি
অর্থাৎ ঝড়ে মুখের আঁচলখানি যায়নি, গেছে বুকের বসনখানি।
কিন্তু গানটি প্রথমবার গাওয়া মাত্রই যাঁরা সে নিতান্ত ঘরোয়া জলসাতে উপস্থিত ছিলেন, তারা কেমন যেন অস্বস্তি অস্বস্তি ভাব প্রকাশ করে কেউ-বা জানালা দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করতে লাগলেন, কেউ-বা পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ খুঁটতে লাগলেন। রবীন্দ্রনাথ নতুন গান প্রথমবার সর্বজনসমক্ষে গাওয়া হয়ে যাওয়ার পরই আপন প্যাঁসনে চশমাটি পরে নিয়ে সকলের মুখের দিকে একনজর চোখ বুলিয়ে নিতেন এবং বুঝে যেতেন, নতুন গানটি শ্রোতাদের হৃদয়-মনে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এবারে তিনি বুঝে গেলেন, কোনওকিছুতে একটা খটকা বেধেছে– যেটা অবশ্য ছিল বড় বিরল। তাই কাকে যেন শুধালেন–আমার ঠিক ঠিক মনে নেই– ব্যাপারটা কী? কারণ আজ আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, গানটি অপূর্ব।
তখন কে যেন একজন সভয়ে বললেন, ওই বুকের বসন কেউ কেউ মিসআন্ডারস্টেন্ড করতে পারে হয়তো।
রবীন্দ্রনাথ এসব রসের আসরে তর্কাতর্কি করতেন না। চুপ করে একটুখানি ভেবে বললেন, আচ্ছা দেখছি।
আশ্রমে রাত্রের খাবার ঘণ্টা পড়ে গেল। সভা ভঙ্গ হল।
তার পরদিনই টেলিগ্রাম পেয়ে কলকাতায় ফিরে আসতে হল। তার কিছুদিন পরে ছাপাতে দেখি, গানটি কোথায় যেন বেরিয়েছিল– বুকের বসনের বদলে মুখের আঁচল এই বিরূপ নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে।
গুণী কিছুটা সহানুভূতিমাখা সুরে আপন বক্তব্য শেষ করলেন এই বলে, অর্থাৎ সেই নগ্ন নবজাত শিশু গানটির উপর রবীন্দ্রনাথ পরিয়ে দিলেন চোগাচাপকান পাঁচজনের পাল্লায় পড়ে।… এ সম্বন্ধে আমার মতামত তো বললুম কিন্তু কবি, সুরকার, নব নব রাগরাগিণীর সৃষ্টিকর্তা রবীন্দ্রনাথকে সমালোচনা করার নিন্দাবাদ দূরে থাক– আমার কী অধিকার! আমার অতি নগণ্য রসবোধ যা বলে, সেইটেই প্রকাশ করলুম মাত্র।
***
কিন্তু প্রিয় সৈয়দ সাহেব, এই যে মুখের আঁচল, বুকের বসন নিয়ে কাহিনীটি ওই গুণী কীর্তন করেছিলেন সেটা নসিকে লিজেন্ডারি বা আপনাদের রকের ভাষায় গুলও হতে পারে, কিংবা এর ভিতর সিকি পরিমাণ সত্যও থাকতে পারে। কারণ ওই গুণী প্রধানত গাইতেন শাস্ত্রীয় সংগীত। সেখানে তাকে ক্রমাগত ইম্প্রভাইজ করতে হয়, নব নব রস সৃষ্টি করার জন্য নব নব কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়। সেটা পরে অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। তাই তো সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ওস্তাদদের নিয়ে এত গণ্ডায় গণ্ডায় লিজেন্ড। হয়তো তিনি সেটা নিছক কল্পনা দিয়ে রঙে-রসে জাল বুনেছেন, এবং বার বার একে-ওকে সেটা বলে বলে, সেই রেওয়াজের ফলস্বরূপ নিজেই এখন সে-কাহিনী সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করেন।
আপনিই না একদিন বলেছিলেন, পরিপূর্ণ পাক্কা মিথ্যেবাদী হওয়ার পথে যেতে যেতে যারা উত্তম সুযোগ না পেয়ে দড়কচ্চা মেরে গেল, অর্থাৎ যাদের গ্রোথু স্টানটে হয়ে গেল, তারাই আর্টিস্ট, সাহিত্যিক, কবি, আরও কত কী!
তবে ওই যে-লিজেন্ডটির কাহিনী এইমাত্র বললুম, সেটা সত্য না হলেও হওয়া উচিত ছিল এবং যাই হোক, যাই থা– কাহিনীটি ক্যারেক্টারিস্টিক এবং টিপিকাল।
কিন্তু আপনি এতক্ষণে নিশ্চয়ই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন– আবার ভাবছেন, আপনাকে আমার এ চিঠি লেখার উদ্দেশ্যটা কী? এখুনি বলছি।
আমার বক্তব্য, কি রবীন্দ্রনাথ, কি কালিদাস, কি বুদ্ধদেব– কেউই রমণীরহস্য এ যাবৎ আদৌ বুঝে উঠতে পারেননি। সহস্র বৎসরের এই সাধনার ধন পুরুষমানুষ অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে শুধু খুঁজেছে কিন্তু সন্ধান পায়নি।
প্রশ্নটা তো অতি সরল। যা দিয়ে আমি এ চিঠি আরম্ভ করেছি। উপস্থিত কঠিনতর সমস্যা, রহস্যগুলো বাদ দিন। সেই যে অতিশয় সাদামাটা প্রশ্ন : পুরুষের কী দেখে রমণী কামাতুর হয়? এবং সেটা শুধু নারী-পুরুষেই সীমাবদ্ধ নয়। পশুপক্ষী, কীটপতঙ্গেও সেটা সমানভাবে বিদ্যমান। অর্থাৎ অবজেকটিভ, স্টাডি করারও পূর্ণ সুযোগ রয়েছে।
অথচ কিমাশ্চর্যমতঃপরম! হাজার হাজার বৎসর চেষ্টা করেও পুরুষজাত যখন এর সমাধান বের করতে পারেনি, তখন এই ভেড়ার পাল, এই পুরুষজাত অপরাধ নেবেন না– বের করবে স্ত্রীচরিত্রের রহস্য, তাদের প্রেমের প্রহেলিকা– যেটা শারীরিক সম্পর্কের বহু বহু ঊর্ধ্বে– তাদের হৃদয়ের আধা-আলো অন্ধকারের কুহেলিকা!
তাই নিবেদন, এই পুরুষজাতকে আমার কোনও প্রয়োজন নেই। ডাক্তার না, পীর না, আপনিও না।
পুরুষজাতটা যে মেয়েদের তুলনায় মূর্খ এবং আপন মঙ্গল কোন দিকে সেটা না বুঝে বাঁদরের মতো যে-ডালে বসে আছে সেই ডালটাই কাটে কুড়িয়ে-পাওয়া করাত দিয়ে। নইলে এই সাত হাজার বছর ধরে এত যুদ্ধ, এত রক্তপাত! আমার নিজের বিশ্বাস, স্ত্রীজাতি যদি এ সংসারের সর্ব গবর্নমেন্ট চালাত, কিংবা এখনও চালায় তবে ওরকম-ধারা হবে না। আজও যদি ইউনাইটেড নেশনস্ থেকে সবকটা পুরুষকে ঝেটিয়ে বের করে দিয়ে নারীসমাজকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, তবে তারা ন মাস দশ দিনের ভিতর মার্কিন-রুশ-মৈত্রী প্রসব করবে! আমি আপনার মতো দেশবিদেশ ঘুরিনি; যেটুকু দেখেছি তার মধ্যে সবচেয়ে মুগ্ধ হয়েছি, শিলঙের খাসিয়া সমাজে বাস করে কারণ সে-সমাজ চালায় মেয়েরা। শুনেছি বর্মার সমাজব্যবস্থাও বড়ই সহজ-সরল পদ্ধতিতে গড়া।
আরেকটা কথা : হজরত মুহম্মদ নবী ইসলাম স্থাপনা করেন। এবং সে শুভকর্মের প্রারম্ভিক মঙ্গলশঙ্খ কাকে দিয়ে বাজালেন? কাকে তিনি সর্বপ্রথম এই নবীন ধর্মে দীক্ষিত করলেন? তিনি তো বিবি খাদিজা– নারী। তার পর আসেন পুরুষ সম্প্রদায়, হজরত আলী, আবু বকর, ওমর ইত্যাদি। তা হলে দেখুন, আপনি মুসলমান, আমি মুসলমান, অন্তত আমাদের স্বীকার করতে হবে যে সর্বজ্ঞ আল্লাতালা– যিনি সত্যং জ্ঞানমনন্তং তিনিই তার শেষ-ধর্ম প্রচারের সময় একটি নারীকে সর্বোচ্চ আসন দিয়েছিলেন। ফাতিমা জিন্নাহ্ যখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হবার জন্য আইয়ুব সাহেবের বিরুদ্ধে দাঁড়ান তখন কলকাতার কোনও কোনও মুসলমান আপত্তি জানিয়ে বলেন, তিনি নারী। আমি তখন বলেছিলুম, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার চেয়ে মুসলিম জাহানে সর্বপ্রথম মুসলমানরূপে দীক্ষিত হওয়ার শ্লাঘাগৌরব অনেক অনেক বেশি– কোনও তুলনাই হয় না। সেই সম্মান যখন একটি নারী তেরশো বছর পূর্বে পেয়েছেন তখন আরেকটি আজ প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না কেন?
তখন তারা তর্ক তোলেন, কিন্তু হজরত নবী তো পুরুষ।
আমি বলি, তিনি তো আল্লার বাণী– যার নাম ইসলাম আল্লার কাছে মিশন রূপে পেয়ে বিবি খাদিজাকে সেইটি দিলেন। স্বয়ং নবী তো এ হিসেবের মধ্যে পড়েন না। (এ স্থলে আমার মনের একটি ধোঁকা জানাই। উত্তর চাইনে। কারণ পূর্বেই বলেছি, আপনাদের কাউকে দিয়ে আমার কোনও প্রয়োজন নেই। এ চিঠির উত্তর আপনাকে লিখতে হবে না, কারণ সেটি আমি পাব না।… ব্রাহ্মধর্মের সর্বপ্রথম ব্রাহ্ম কে? প্রাতঃস্মরণীয় রাজা রামমোহন? তবে তাকে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত করল কে?… কিংবা নিন বুদ্ধদেব। তিনি স্বয়ং কি বৌদ্ধ? তাকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করল কে? অন্যদের বেলা, যেমন খ্রিস্ট, রামমোহনের বেলা অনুমান করতে পারি, স্বয়ং গড় য়াভে বা পরব্রহ্ম খ্রিস্টকে খ্রিস্টধর্মে, রামমোহনকে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত করেন, কিন্তু বুদ্ধের বেলা? তিনি তো ভগবান সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন, এবং বলেছেন তিনি, তাঁরা [দেবতারা] থাকলেও তারা মানুষকে সাহায্য করার ব্যাপারে অশক্ত। তা হলে?… এবং আজকের দিনের ভাষায় মার্কস্ কি মার্কসিস্ট? লেনিন অবশ্যই মার্কসিস্ট, কিন্তু লেনিন কি লেনিনিস্ট)
কিন্তু একটা কথা পুরুষমাত্রকেই স্বীকার করতে হবে।
আল্লার হুকুমেই দৃশ্য অদৃশ্য সব-লোকই চলে, কিন্তু মানুষের কৃতিত্বও তো মাঝে মাঝে স্বীকার করতে হয়।
অদ্যাপিও মধ্যে মধ্যে পুণ্যবান হয়।
নারীরে স্বীকার করি জয় জয় কয়।
হজরত নবী এঁদেরই একজন। বড় বিরল, বড় বিরল, হেন জন যে নারীকে চিনে নিয়ে তার প্রকৃত ন্যায্য স্বীকৃতি দেয়। তাই হজরত বলেছিলেন,
বেহেশত মাতার চরণপ্রান্তে।
এবং নিশ্চয়ই তখন একাধিক দীক্ষিত মুসলমানের অমুসলমান মাতা ছিল। হজরত এ স্থলে কোনও ব্যত্যয় করেছেন বলে তো জানিনে। এবং একথাও জানি হজরত শিশুকালেই তার মাকে হারান।
আমি হাড়ে হাড়ে অনুভব করতে পারছি, আপনি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন।
আমি করজোড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করছি এবং সঙ্গে সঙ্গে নিবেদন করছি, আপনার উদ্দেশে লেখা এই চিঠিই আমার শেষ চিঠি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। পূর্বেই বলেছি, এ চিঠির উত্তরও আপনাকে লিখতে হবে না।
আপনিই আমাকে একদিন বলেছিলেন, যখন আপনার কোনও পাঠক বহু সমস্যাবিজড়িত, নানাবিধ প্রশ্নসম্বলিত দীর্ঘ পত্র লিখে, দফে দফে তার প্রতিটি প্রশ্নের সদুত্তরসহ দীর্ঘতর উত্তরের প্রত্যাশা করে তখন আপনি মনে মনে স্মিতহাস্য করে বলেন, ভদ্রলোক যা জানতে চেয়েছেন, সেগুলো একটু গুছিয়ে রম্যরচনাকারে দেশ বা আনন্দবাজারে পাঠিয়ে দিলে তো আমার দিব্যি দু পয়সা হয়। আর লেখা জিনিসটা নাকি আপনার পেশা। ওটা আপনার নেশা নয়। এবং পেশার জিনিস তো কেউ ফ্রি বিলিয়ে বেড়ায় না। আমি তাই আপনার কাছ থেকে কোনওকিছু মুফতে চাইনে।
(শহর-ইয়ারের চিঠি এতখানি পড়ার পর অকস্মাৎ শংখচূড়ের ডংশনের মতো আমাকে সে-চিঠি স্মরণে এনে দিল, আমি এমনই পাষণ্ড যে, যবে থেকে, পোড়া পেটের দায়ে লেখা জিনিসটাকে পেশারূপে স্বীকার করে নিয়েছি, সেই থেকেই শহর-বর্ণিত ওই কারণবশতই আপন বউকে পর্যন্ত দীর্ঘ প্রেমপত্র লিখিনি। স্তম্ভিত হয়ে ভাবলুম, সেই যে স্যাকরা যে তার মায়ের গয়নায় ভেজাল দিয়েছিল আমি তার চেয়েও অধম। স্যাকরা তবু ভালো মন্দ যাহোক মাকে একজোড়া কাকন তো দিয়েছিল, আমি সেটিও প্রকাশক সম্পাদককে পাঠাচ্ছি!…এই অনুশোচনার মাঝখানে আমার মনে যে শেষ চিন্তাটির উদয় হল সেটি এই : এ হেন নির্মম আচরণে হয়তো আমিই একা নই। নেইবনে হয়তো আমি একাই খাটাশ হয়েও বাঘের সম্মান পাচ্ছিনে। আরও দু চারটে খাটাশ আছেন। কিন্তু হায়, তারা তো আমাকে পত্র লিখে তাদের হাঁড়ির খবর জানাবেন না!)
***
আত্মচিন্তা স্বদেহ-ডংশন স্থগিত রেখে আবার শহর-ইয়ারের চিঠিতে ফিরে গেলুম। এবং সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করছি, নির্লজ্জের মতো স্বীকার করছি, অকস্মাৎ পুরুষবিদ্বেষে রূপান্তরিত এ রমণীর জাতক্রোধে পরিপূর্ণ এই পত্রখানা আমার খুব একটা মন্দ লাগছিল না।
এর পর ইয়ার লিখছে–
আদিখেত্তা, না, আদিখ্যেতা? কিন্তু আপনি এই মেয়েলী শব্দটি বুঝবেন। আপনি ভাবছেন, আমি আদিখেত্তা, বা আপনাদের ভাষায় আধিক্যতা করছি। কিন্তু আপনি তো অন্তত এইটুকু জানেন যদিও, অপরাধ নেবেন না, স্ত্রী-চরিত্রে আপনার জ্ঞান এবং অনুভূতি ঠিক ততটুকু, যতটুকু একটা অন্ধ এস্কিমোর আছে, হুগলি নদীর অগভীর বিপদসঙ্কুল ধারায় পাইলট জাহাজ চালাবার আপনি নিশ্চয়ই জানেন, এ হাহাকার দৈন্যের মরুভূমিতে আমি একা নই, আমার মতো বিস্তর রমণী রয়েছে যাদের জীবন শূন্য। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েই। কিন্তু তাদের অধিকাংশই বিশেষ করে হিন্দু রমণী– সেটা জীবনভর এমনই আশ্চর্য সঙ্গোপনে রাখে যে তাদের নিকটতম আত্মজনও তার আভাসমাত্র পায় না। গুরুর গানে আছে তার বেদনার
ভরা সে পাত্র তারে বুকে করে
বেড়ানু বহিয়া সারা রাতি ধরে।
আর এই রমণীদের বেলা তাদের বেদনার
ভরা সে পাত্র তারে বুকে করে
বেড়ানু বহিয়া সারা আয়ু ধরে।
ওই যে আপনার ভক্ত খানের ঠাকুরমা। তিনি যে তাঁর সমস্ত জীবন শূন্যে শূন্যে কাটিয়েছেন তার আভাস কি তার জাদু ভূতনাথ (হোয়াট এ নেম! আমার বিশ্বাস ওর বাপ-মা তার নাম রেখেছিলেন অনিন্দ্যসুন্দর খান এবং বড় হয়ে, অ্যাজ এ প্রটেস্ট, সে অন্য একসট্ৰিমে গিয়ে, এফিডেভিট দিয়ে ভূতনাথ নাম নেয়) পর্যন্ত পেয়েছে?
ওই ঠাকুরমার শূন্যতা এবং আমার শূন্যতা যেন হংসমিথুনের মতো আমাদের একে অন্যকে কাছে টেনে নিয়ে আসে। ওদিকে উনি নিষ্ঠাবতী ব্রাহ্মণী এবং আমিও গরবিনী মুসলমানী। শুনেছি, প্রলয়ঙ্করী বন্যার সময় একই গাছের গুঁড়ির উপর ঠাসাঠাসি করে সাপ, ব্যাঙ, ইঁদুর, নকুল, গোসাপ নিরাপদ তীরের আশায় ভেসে ভেসে যায়। কেউ তখন কারও শত্রুতা করে না, এমনকি আপন অসহায় ভক্ষ্য প্রাণীকেও তখন আক্রমণ করে না। আর আমাতে-ঠাকুমাতে তো পান্না-সোনায় মিটি মানানসই। আমরা দু জনা বসে আছি একই নৌকায়। একমাত্র রাজনৈতিক সুবিধাবাদীরা বলে, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কটা অহি-নকুলের আজকের দিনের ভাষায় বুর্জুয়া প্রলেতারিয়ার। আর আমাদের উভয়ের সামনে,
ঢেউ ওঠে পড়ে কাদার, সম্মুখে ঘন আঁধার
পার আছে কোন দেশে …
হাল-ভাঙা পাল-ঘেঁড়া ব্যথা।
চলেছে নিরুদ্দেশে।
পথের শেষ কোথায় শেষ কোথায়
কী আছে শেষে!
ওই তো আমার দোষ। কোনও-কিছু বলতে গেলেই আমার রসনায় এসে আসন নেন রবিঠাকুর, কালিদাসের রসনায় যে রকম বীণাপানি আসন জমিয়ে মধুচক্র গড়তেন। আর লোকে ভাবে হয়তো ঠিকই ভাবে আমার নিজস্ব কোনও ভাব-ভাষা নেই, আমি চিত্রিতা গর্দভী–রবিকাব্যের গামলার নীল রঙে আমার ধবলকুষ্ঠের মতো সাদা চামড়াটি ছুপিয়ে নিয়ে নবজলধরশ্যাম কলির মেকি কেষ্ট হয়ে গিয়েছি!
কিন্তু আপনি জানেন, আপনাকে অসংখ্য বার বলেছি, আমি রাজা পিগমালিয়োন– এস্থলে রবীন্দ্রনাথ নির্মিত মর্মরমূর্তি। বরঞ্চ তারও বাড়া। পিগমালিয়োন তার গড়া প্রস্তরমূর্তিতে প্রাণসঞ্চার করতে অক্ষম ছিলেন বলে দেবী আফ্রোদিতেকে প্রার্থনা করেন, তাঁর সেই মূর্তিটিকে জীবন্ত করে দিতে। দেবীরা পূর্বের কথা স্মরণ করে দিয়ে আবার বলছি, পুরুষের তুলনায় তারা চিরন্তনী করুণাময়ী। ধন্য মা মেরি, তুমি, মা, পূর্ণ করুণাময়ী সর্বদেবীর সর্বশেষ সর্বাঙ্গসুন্দরী মা-জননী– দেবী আফ্রোদিতে রাজার বর পূর্ণ করে দিলেন। এ স্থলে দেবীর এমন কী কেরামতি, কী কেরানি! পক্ষান্তরে দেখুন, আমার এই মূর্তদেহ নির্মাণের জন্য, প্রশংসা হোক, নিন্দা হোক, সেটা পাবেন আমার জনক-জননী। কিন্তু সে-দেহটাকে চিন্ময় করল কে? গানে গানে, রসে রসে, রামধনুর সপ্তবর্ণের সঙ্গে মিশিয়ে তার ভিতর দিয়ে উড়ে-যাওয়া নন্দনকানন-পারিজাত রঙে রঞ্জিত প্রজাপতির কোমল-পেলব ডানা দুটির বিচিত্রবর্ণে, নবীন উষার পুস্পসুবাসে, প্রেমে প্রেমে, বিরহে বিরহে, বেদনা বেদনায় কে নিরমিল আমার হৃদয়, আমার স্পর্শকাতরতা, কোণের প্রদীপ যেরকম জ্যোতিঃসমুদ্রে মিলিয়ে যায় হুবহু সেইরকম সৌন্দর্যসাগরে ক্ষণে ক্ষণে দিনে দিনে আমার নিজের সত্তাকে বিলীন করে দেবার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত আকুলতা– এটি নির্মাণ করল কে? মহাপ্রভুর বর্ণ দেখে কে যেন রচেছিলেন– শব্দে শব্দে মনে নেই–
চাঁদের অমিয়া সনে চন্দন বাটিয়া গো,
কে মাজিল গোরার দেহখানি!
ভারি সুন্দর! আকাশের চাঁদ আর পৃথিবীর চন্দন অর্থাৎ স্বর্গের দেবতা চন্দ্র আর এই মাটির পৃথিবীর চন্দন দিয়ে, ক্রন্দসী দ্বারা স্বৰ্গমর্তের সমন্বয়ে মাজা হল গৌরাঙ্গের দেহখানি! কিন্তু মহাপ্রভুর ভাষাতেই বলি এহ বাহ্য। দেহ তো বাইরের বস্তু।
বার্নার্ড শ রাজা পিগমালিয়োনকে অবশ্যই ছাড়িয়ে গিয়েছেন। তিনি তাঁর মূর্তি এলাইজাকে দিলেন সুমিষ্ট ভাষা এবং সুভদ্র বিষয় নিয়ে সর্বোকৃষ্ট সমাজে আলোচনা করার অনবদ্য দক্ষতা।
শ’কে ছাড়িয়ে বহু বহু সম্মুখে এগিয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। আমার চিত্ময় স্বময় জগৎ নির্মাণ করে তিনি আমাকে যে বৈভব দিয়েছেন, শর সৃষ্টি তার শতাংশের একাংশও পায়নি।
আপনাদের ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে আপনার সম্মুখে শেষবারের মতো আমার শেষ গুরুদক্ষিণা নিবেদন করে গেলুম।
***
কিন্তু মেয়েদের এই শূন্যতা, দীনতা, ফ্রাসট্রেশনের জন্য দায়ী কে?
নারী হয়েও বলব, তার জন্য সর্বাগ্রে দায়ী রমণীকুল। প্রধানত।
আপনারই গুরু স্বৰ্গত ক্ষিতিমোহন সেনের দেশে প্রকাশিত রচনাতে একটি সুভাষিত পড়েছিলুম–
কুঠারমালিনং দৃষ্টা
সর্বে কম্পান্বিতা দ্রুমাঃ।
বৃদ্ধ দ্রমো বক্তি, মা ভৈঃ
ন সন্তি জ্ঞাতয়ো মম ॥
কুঠারমালাধারীকে দেখে সমস্ত গাছ যখন কম্পান্বিত তখন বৃদ্ধ একটি গাছ বললে, এখনই কিসের ভয়? এখনও আমাদের (জ্ঞাতি) কোনও গাছ বা বৃক্ষাংশ ওর পিছনে এসে যোগ দেয়নি।
শহর-ইয়ার লিখছে, বড় হক্ কথা। কামারের তৈরি কুড়োলের সুন্দুমাত্র লোহার অংশটুকুন দিয়ে কাঠুরে আর কী করতে পারে, যতক্ষণ না কাঠের টুকরা দিয়ে ওই লোহায় ঢুকিয়ে হ্যাঁন্ডিল বানায়। পুরুষজাত ওই লোহা; সাহায্য পেল মেয়েদের সহযোগিতায় কাঠের হ্যাঁন্ডিল। তাই দিয়ে যে-মেয়েরই একটু বাড় হয় তাকে কাটে, আর যেগুলো নিতান্ত নিরীহ চারাগাছ বা যেসব বছর-বিয়ানীরা গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা বিইয়ে বিইয়ে জীবন্ত তাদের রেহাই দেয়।
এইসব অপকর্মে যুগ যুগ ধরে সাহায্য করেছে মেয়েরাই। শুনেছি, সতীদাহের পুণ্যসঞ্চয় করার জন্য বিধবাকে প্ররোচিত করেছে সমাজাগ্রগণ্যা নারীরাই।
এতদিন বলিনি, এইবারে আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নেবার বেলা বলি, এই কলকাতার মুসলমান মেয়েরা– দু চারটি হিন্দুও আছেন আপনার সঙ্গে আমার অবাধ মেলামেশা দেখে টিডিট্টকার দেয়নি? বেহায়া বেআব্রু বেপর্দা বেশরম, তওবা তওবা বলেনি? তবে কি না, আপনি বিলক্ষণ অবগত আছেন, চাঁদের অমিয়া সনে চন্দন বাটিয়া হয়তো আমার দেহ এমনকি হৃদয়ও মাজা হয়েছে, কিন্তু আমার মস্তিষ্ক, তজ্জনিত বুদ্ধি এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে অবহেলা করার মতো আমার গণ্ডারচর্মবিনিন্দিত দার্চ নির্মিত হয়েছে, সুইডেনের প্যোর স্টেনলেস স্টিল ও সাউথ আফ্রিকার আন্-কাট ডায়মন্ড মিশিয়ে। আর আছেন, ভূতনাথের ঠাকুমা। যাকে বলতে পারেন আমার টাওয়ার অব্ পাওয়ার।
তদুপরি আমার অভিজ্ঞতা বলে, এইসব আজ-আছে-কাল-নেই জিভের লিকলিকিনি অনেকখানি বিঘ্নসন্তোষমনা পরশ্রীকাতরতাবশত। ইলিয়েট রোডের সায়েব-মেমরা বড়দিনে যখন নানাবিধ ফুর্তির সঙ্গে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ধেই ধেই করে নৃত্য করে তখন আমরা হিন্দু-মুসলমানরা– প্রাণভরে ছ্যা ছ্যা করি বটে, কিন্তু তখন কসম খেতে হলে ধোওয়া তুলসীপাতাটির পার্ট প্লে করা বন্ধ করে স্বীকার করতে হবে, মনের গোপন কোণে হিংসেয় মরি, হায়! আমাদের রদ্দি বুড়া সমাজ এ আনন্দ থেকে আমাদের বঞ্চিত করল কেন? নয় কি? সত্য বলুন। কিন্তু আপনার কথা আলাদা। আপনি বিদেশে বিস্তর নেচেছেন, আর এখন, আমাদের মতো নিরীহদের মৃদুমন্দ নাচাচ্ছেন। আহা! গোস্সা করলেন না তো? শুনেছি, সৈয়দরা বড্ড রাগী হন। তবে সঙ্গে সঙ্গে একটা সান্ত্বনার বাণীও পেয়েছি; ওয়াদের রাগ নাকি খড়ের আগুনের মতো ধপ করে জ্বলে আর ঝাপ্ করে যায় নিভে– সঙ্গে সঙ্গে।
অবশ্য একটা জিনিস আমাকে গোড়ার দিকে কিছুটা বেদনা দিয়েছিল– এইসব নগণ্য ক্ষুদে ক্ষুদে, কিন্তু বিষেভর্তি চেরা-জিভ যখন আমার স্বামী, আপনার বন্ধু ডাক্তারের বিরুদ্ধে হি হি করে বিষ বমন করত। সেখানে আমি যে নাচার। আমি কীরকম জানেন? আপনার ডাক্তার যখন কোনও রুগীকে ইনজেকশন দেয় তখন আমি সেদিকে তাকাতে পারিনে। আমার বলতে ইচ্ছে করে, না হয় দাও না, বাপু, ইনজেকশনটা আমাকেই।
অবশ্য আল্লার মেহেরবানি। ডাক্তারের কাছে এসব হামলা পৌঁছয় না। তার রিসার্চ ক্লফরম দিয়ে তিনি তার পঞ্চেন্দ্রিয় অবশ অসাড় করে রেখেছেন।
আপনাকে বলেছি কি সেই গল্পটা? এটি আমি শুনেছি বাচ্চা বয়সে আমাদের বাড়ির এক নিরক্ষরা দাসীর কাছ থেকে। তাই এটা হয়তো লোকমুখে প্রচলিত আঞ্চলিক কাহিনী মাত্র– কেতাব-পত্রে স্থান পায়নি বলে হয়তো আপনার অজানা।
এক বাদশা প্রায়ই রাজধানী থেকে দূরে বনের প্রান্তে একটি নির্জন উদ্যান-ভবনে চলে যেতেন শান্তির জন্য। সেখানে বালক যুবরাজের ক্রীড়াসঙ্গী নর্মখা-রূপে জুটে যায় এক রাখাল ছেলে। তাদের সখ্যে রাজপুত্র-কৃষকপুত্রের ব্যবধান ছিল না।
বাদশা মারা গেলে পর যুবরাজ বাদশা হলেন। দীর্ঘ কুড়ি বৎসর ধরে যুবরাজ আর সুযোগ পাননি সেই উদ্যান-ভবনে আসার। যখন এলেন তখন সন্ধান নিলেন তার রাখাল বন্ধুর স্বয়ং গেলেন তার পর্ণকুটিরে। রাখাল ছেলে পূর্বেরই মতো মোড়ামুড়ি দিল। যুবরাজ শুধোলেন, তোমার বাপকে দেখছি না যে?
তিনি তো কবে গত হয়েছেন! আল্লা তার আত্মার মঙ্গল করুন।
গোর দিলে কোথায়?
ওই তো হোথায়, খেজুরগাছটার তলায়। বাবা ওই গাছের রস আর তাড়ি খেতে ভালোবাসত বলে আমাকে আদেশ দিয়ে গিয়েছিল তাকে যেন ওরই পায়ের কাছে গোর দিই। (নাগরিক বিদগ্ধ ওমর খৈয়ামও দ্রাক্ষাকুঞ্জে সমাধি দিতে বলেছিলেন, না?)
রাখাল ছেলে জানত, আগের বাদশা গত হয়েছেন। তাই শুধাল, আর হুজুর বাদশার গোর কোথায় দেওয়া হল?
ঈষৎ গর্বভরে নবীন রাজা বললেন, জানো তো রাজা-বাদশারা বড় নিমকহারাম হয়, বাপের গোরের উপর কোনও এমারৎ বানায় না।…আমি, ভাই, সেরকম নই। বাবার গোরের উপর বিরাট উঁচু সৌধ নির্মাণ করেছি, দেশ-বিদেশ থেকে সর্বোত্তম মার্বেলপাথর যোগাড় করে।…এই বনের বাইরে গেলেই তার চুড়োটা এখান থেকেও স্পষ্ট দেখা যায়।
রাখাল ছেলে বললে, সে আর দেখিনি? কিন্তু তুমি, ভাই, করেছ কী? শেষবিচার কিয়ামতের দিন, আল্লার হুকুমে ফিরিশতা ইসরাফিল যখন শিঙে বাজাবেন তখন কত লক্ষ মণ পাথর খুঁড়ে খুঁড়ে ভেঙে ভেঙে উঠতে হবে বেহেশত বাগে। তাঁর জন্য এ মেহেন্নতি তৈরি করলে কেন?… আর আমার বাবা তার গোরের উপরকার আধ হাত মাটি এক ধাক্কায় ভেঙে ফেলে হুশ হুশ করে চলে যাবে আল্লার পায়ের কাছে।
***
প্রিয় সৈয়দ সাহেব, আমাকে দিয়েছে জ্যান্ত গোর বিরাট ইট-সুরকির এই বাড়িতে। বধূ হয়ে যে-সন্ধ্যায় এ বাড়িতে প্রথম প্রবেশ করি তখনই আমার শরীরটা কেমন যেন একটা শীতলতার পরশে সিরসির করেছিল, যদিও আমার পরনে তখন অতি পুরু আড়ি-বেল বেনারসি শাড়ি, কিংখাপের জামা আর সর্বাঙ্গ জড়িয়ে আপনার ডাক্তারের ঠাকুমার কাশ্মিরি শাল– যার সাচ্চা জরির ওজনই হবে আধসের।
আপনি এ বাড়ির অতি অল্প অংশই চেনেন। এ বাড়ির পুরো পরিক্রমা দিতে হলে ঘন্টাটাক লাগার কথা। আমাকে কয়েকদিন পরপরই এ পরিক্রমা লাগাতে হয়। প্রথম প্রথম খুব একটা মন্দ লাগত না– প্রাচীনদিনের কতশত সম্পদ, টুকিটাকি, নবীন দিনের সঞ্চয়ও কিছু কম যায় না এস্তেক কার যেন প্রেজেন্ট দেওয়া একটা টেলিভিশন সেট– যদিও কবে যে এটা কাজে লাগবে, সেটা ভবিষ্যতের গর্ভে! যেন যাদুঘরে এটা-ওটা দেখছি, ঘুরে বেড়াচ্ছি।
কিন্তু চিন্তা করুন, যদি আপনাকে যাদুঘরে আহারন্দ্রিা দাম্পত্য-জীবন যাপন করতে হয়, তবে কীরকম হাল হয়!
তবু বলি, এ-ও কিছু নয়। সামান্য ইট-পাথর, প্রাচীনদিনের সঞ্চয়– এরা প্রাণহীন। এরা আমার মতো সজীব প্রাণচঞ্চল জীবকে আর কতখানি সম্মোহিত করবে?
কিন্তু এরা যে সবাই সর্বক্ষণ চিৎকার করে করে আমাকে শোনাচ্ছে,
ট্র্যাডিশন! ট্র্যাডিশন!! ঐতিহ্য! ঐতিহ্য!!
সবাই বলছে, সাত পুরুষ ধরে এই খানদানি পরিবারে যা চলে আসছে, সেইটেই তোমাকে মেনে চলতে হবে, বাঁচিয়ে রাখতে হবে, এবং মরার সময়ও তার ভবিষ্যতের জন্য পরিপাটি ব্যবস্থা করে যেতে হবে।
আর যারা জ্যান্ত? নায়েব, তাঁর পরিবারবর্গ, এ বাড়ির দারওয়ান ড্রাইভার বাবুর্চি চাকর হালালখোর, পাশের মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিন সক্কলের চেহারাতেই ওই একটি শব্দ নিঃশব্দে ফুটে উঠছে : ট্র্যাডিশন। বিগলিতাৰ্থ : বেগমসাহেবা যদি খানদানি প্রাচীন পন্থা মেনে চলেন তবে আমরা তার গোলামের গোলাম, আমরা নামাজের পর পাঁচ বেকৎ আল্লার পদপ্রান্তে লুটিয়ে বলব, ইয়া খুদা, এই শহর-ইয়ার বানু জিললুল্লা, এই দুনিয়ায় আল্লার ছায়া। তাঁরই সুশীতল ছায়াতে আমাদের জীবন, আমাদের সংসার, আমাদের মৃত্যু, আমাদের মোক্ষ। তুমি তাকে শতায়ু কর, সহস্ৰায়ু কর! আমেন!
আমি সিনিক নই। তাদের এ প্রার্থনায়, তাদের ঐতিহ্যরক্ষার্থ-কামনায় প্রচুর আন্তরিকতা আছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আছে সেই আদিম ইনসটিনকট, জীবনসংগ্রামে কোনওগতিকে টিকে থাকবার, কোনওগতিকে বেঁচে থাকবার প্রচেষ্টা।… আজ যদি কালীঘাটের মন্দির নিশ্চিহ্ন করে পুরুৎ-পুজোরিদের আদেশ দেন চরে খাও গে! তবে তারা যাবে কোথায়? বর্তমান যুগোপযোগী জীবনসংগ্রামে যুদ্ধ করার মতো কোনও ট্রেনিং তো এদের দেওয়া হয়নি। এদের অবস্থা হবে, খাঁচার পাখিকে হঠাৎ ছেড়ে দিলে যা হয়। খাঁচার লৌহদুর্গে দীর্ঘকাল বাস করে সে আত্মরক্ষার কৌশল ভুলে গিয়েছে, দু বেলা গেরস্তের তৈরি ছোলা-ফড়িং খেয়ে খেয়ে ভুলে গিয়েছে আপন খাদ্য সংগ্রহ করার ছলা-কলা।
আবার আমার লোক-লস্করের কথায় ফিরে আসি। এদের সবাইকে যদি আমি কাল ডিসমিস করে দিই– সে এক্তেয়ার ডাক্তার আমাকে দিয়েছেন– তবে কী হবে? অধিকাংশই না খেয়ে মরবে। তারা শুধু জানে ট্র্যাডিশন। তাদের জন্ম হয়েছে এ শতাব্দীতে, কিন্তু মৃত্যু হয়ে গিয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়াতেই।
আমি একাধিকবার চেষ্টা দিয়েছিলুম এ বাড়িতে ফ্রেশ ব্লাড় আমদানি করতে। চালাক-চতুর দু একটি ছোকরাকে বয় হিসেবে নিয়ে এসেছি। জানেন কী হল? পক্ষাধিক কাল যেতে না যেতেই তারা ভিড়ে গেল প্রাচীনপন্থি দারওয়ান-বাবুর্চির সঙ্গে। বুঝে গেল, রুটির ওই-পিঠেই মাখন মাখানো রয়েছে। সিনেমা যাওয়া পর্যন্ত তারা বন্ধ করে দিল। অক্লেশে হৃদয়ঙ্গম করলুম, দেড়শো কিংবা তারও বেশি বছরের ট্র্যাডিশনের মায়াজাল ছিন্ন করার মতো মোহমুর আমি রাতারাতি– রাতারাতি দূরে থাক, বাকি জীবনভর চেষ্টা করলেও নির্মাণ করতে পারব না।
অবশ্য আমার দেবতুল্য স্বামী আমাকে বাসরঘরেই সর্বস্বাধীনতা দিয়েছিলেন, সর্ব বাবদে– সে-কথা আমি আপনাকে পূর্বেই বলেছি। কিন্তু স্বাধীনতা দিলেই তো সব মুশকিল আসান হয়ে যায় না। স্বাধীনতা পেয়ে খাঁচার পাখিটার কী হয়েছিল? অনাহারে যখন ভিরমি গিয়ে চৈত্রের ফাটাচেরা মাঠে পড়ে আছে, তখন শিকরে পাখি তাকে ছো মেরে তুলে নিয়ে গাছের ডালে বসে কুরে কুরে তার জিগর-কলিজা খেল।
***
সে-কথা জানে বলেই এ বাড়ির লোক আমাকে প্রথম দিনই খাঁচাতে পুরতে চেয়েছিল। ওরা সবাই ট্র্যাডিশনের খাঁচাতে। খাঁচার ভিতরকার নিরাপত্তা, অন্নজল বাইরে কোথায় পাবে? আমাদের এক সমাজতত্ত্ববিদ নাকি বলেছেন, ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা না পেলেই নাকি আমাদের পক্ষে ভালো হত। ওঁর বক্তব্য, ইংরেজ আমলে নাকি আমাদের ঘৃতলবণতৈলতলবস্ত্র-ইন্ধনের দুশ্চিন্তা ছিল অনেক কম।
এইবারে মোদ্দা কথা বলি। সেই রাখাল ছেলের বন্ধুর পিতা বাদশা তাঁর সমাধিসৌধের প্রস্তর ভেঙে ভেঙে উঠতে যত না হিমসিম খাবেন, তার সঙ্গে আমার এই উকট সঙ্কটের কোনও তুলনাই হয় না। জ্যান্ত গোরের মানুষ আপন ছটফটানিতে নিরুদ্ধ-নিশ্বাস হয়ে প্রাণবায়ু ত্যাগ করে।
তথাপি আমি ওই খানদানি পাষাণদুর্গে থাকতে চাইনি। ঠিক মনে নেই, তবে গল্পটি খুবসম্ভব সার্থকা সাহিত্যিকা শ্রীযুক্তা আশাপূর্ণা দেবীর; একটি বালিকা স্বাধীনতা আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি যুবকের সংস্পর্শে এসে স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শে উদ্দীপ্ত হয়। অহেতুক যোগাযোগের ফলে তার কিন্তু বিয়ে হয়ে গেল এক অতি দুর্ধর্ষ কৃষাণরক্তশোষক জমিদারের ছেলের সঙ্গে। আমার মনে নেই, মেয়েটি হয়তো-বা অনিচ্ছায় বিয়ে করেছিল, কিংবা হয়তো বলদৃপ্ত পদে স্বামীগৃহে প্রবেশ করেছিল, কঠোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে যে এ জমিদার পুরুষক্রমে যা করেছেন, যেটা দু ছত্রে বলা যায়,
পাকা রাস্তা বানিয়ে বসে দুঃখীর বুক জুড়ি
ভগবানের ব্যথার পরে হাঁকায় সে চার-ঘুড়ি।
(আবার রবীন্দ্রনাথ! এই মুহম্মদি মামদোর ওপর তিনি আর কত বত্সর ভর করে থাকবেন!) সেই পিচেশি রক্তশোষণ সে চিরতরে বন্ধ করবে–আপ্রাণ সগ্রাম দিয়ে, প্রয়োজন হলে পরমারাধ্য স্বামীকে পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ দিয়ে, ডিফাই করে।
এবং দিয়েও ছিল সে মোক্ষম লড়াই তার খাণ্ডারনি শাশুড়ির বিরুদ্ধে তিনিই ছিলেন এই প্রজা-শোষণ-উচাটনের চক্রবর্তিনী।
সংক্ষেপে সারি। তার বহু বৎসর পরে কী পরিস্থিতি উদ্ভাসিত হল? সেই পূর্বেরটাই। যথা পূর্বং তথা পরং! যদ্বৎ তদ্বৎ পূর্ববৎ। ইতোমধ্যে শাশুড়ি মারা গিয়েছেন এবং সেই বিদ্রোহী তনুদেহধারিণী বধূটি দশাসই গাড়গুম কলেবর ধারণ করে হয়ে গেছেন সে-অঞ্চলের ডাকসাইটে রক্তশোষিণী!
ট্র্যাডিশন! ট্র্যাডিশন!! সেই দ’ থেকে বাঁচে কটা ডিঙি?
কিংবা রবীন্দ্রনাথের সেই কথিকাটি স্মরণে আনুন :
বুড়ো কর্তার মরণকালে দেশসুদ্ধ সবাই বলে উঠল, তুমি গেলে আমাদের কী দশা হবে।… দেবতা দয়া করে বললেন… লোকটা ভূত হয়েই এদের ঘাড়ে চেপে থাক না। মানুষের মৃত্যু আছে, ভূতের তো মৃত্যু নেই।
সেই ভূতই হল ট্র্যাডিশন!
তার পর মনে আছে সেই ভূত-ট্র্যাডিশনের পায়ের কাছে দেশসুদ্ধ সবাইকে কী খাজনা দিতে হল?
শ্মশান থেকে মশান থেকে ঝোড়ো হাওয়ায় হা হা করে উত্তর আসে (খাজনা দেবে] আব্রু দিয়ে, ইজ্জত দিয়ে, ইমান দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে।
সৈয়দ সাহেব, আমি ট্র্যাডিশন ভূতের খপরে সে-খাজনা দিতে রাজি ছিলুম না। তার কারণ এ নয় যে আমি কৃপণ। কিন্তু এ মূল্য দিলে যে আমার সর্বসত্তা লোপ পাবে, আমার ধর্ম আমার ইমান যাবে।
সুভদ্রা আশাপূর্ণার সেই বন্ধুর মতো দিনে দিনে আপন সত্তা হারিয়ে হারিয়ে আমি আমার শ্বশুরবাড়ির অচলায়তনে বিলোপ হতে চাইনি। সেইটেই হতো আমার মহতী বিনষ্টি।…
কিন্তু তবু জানেন, সৈয়দ সাহেব, হাসিকান্না হীরাপান্না রান্নাবান্না নিয়ে আমার দৈনন্দিন জীবন কেটে যাচ্ছিল। আমাদের কচিকাঁচা বয়সে একটা মামুলি রসিকতার কথোপকথন ছিল, কী লো, কীরকম আছিস? কেটে যাচ্ছে, কিন্তু রক্ত পড়ছে না। আমার বেলা কিন্তু দিন কাটার সঙ্গে সঙ্গে হৃৎপিণ্ড কেটে কেটে রক্ত ঝরে ঝরে ফুসফুসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে সেগুলোকে বন্ধ করে দিয়ে আমার স্বাসপ্রশ্বাস নিরুদ্ধনিশ্বাস করে তুলছিল। সর্বশেষে একদিন আমাকে ডুবে মরতে হত, আমার আপন দিল-ঝরা খুনে। আমি কর্তার কাছে শুনেছি, যুদ্ধের সময় বুলেটের সামান্যতম এক অংশ যদি হৃৎপিণ্ডে ঢুকে সেটাকে জখম করতে পারে তবে তারই রক্তক্ষরণের ফলে সমস্ত ফুসফুস ফ্লাডেড় হয়ে যায়, এবং বেচারা আপন রক্তে ড্রাউনড় হয়ে মারা যায়।
অবশ্য আমার বেলা বুলেটের টুকরো নয়। ওই ভুতুড়ে বাড়ির ট্র্যাডিশনের একখানা আস্ত চাই।…
আপনি অবশ্যই শুধোবেন, অকস্মাৎ তোমার এ পরিবর্তন এল কী করে?
পরিবর্তন নয়। জাগরণ। নব জাগরণ।
***
রূপনারাণের কূলে
জেগে উঠিলাম।
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ…
আমার নব জাগরণের পর আমি এ কবিতাটি নিয়ে অনেক ভেবেছি। স্পষ্টত এখানে রূপনারাণ রূপকার্থে। অবশ্য এর পিছনে কিছুটা বাস্তবতাও থাকতে পারে। শুধু পদ্মায় নয়, কবি গঙ্গাতেও নৌকোয় করে সফরে বেরুতেন। হয়তো বজবজ অঞ্চলে কোথাও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন; হঠাৎ ঘুম ভাঙল ডায়মন্ড হারবারের একটু আগে যেখানে রূপনারায়ণ নদী গঙ্গার সঙ্গে এসে মিশেছে। জেগে উঠলেন রূপনারাণের কূলে, কোলেও হতে পারত। স্বপ্ন দেখছিলেন এতক্ষণ। অর্থাৎ তার আশি বৎসরের জীবন স্বপ্নে স্বপ্নে, স্বপ্নের অবাস্তবতায় কাটাবার পর হঠাৎ রূপনারাণের কূলে পরিপূর্ণ বাস্তবের অর্থাৎ রূপের সম্মুখীন হলেন। এক আলঙ্কারিক রূপের ডেফিনিশন দিতে গিয়ে বলেছেন, ভূষণ না থাকলেও যাকে ভূষিত বলে মনে হয় তাই রূপ। অর্থাৎ পিওর, নেকেড রিয়ালিটি। তার কোনও ভূষণ নেই।
আর নারায়ণ অর্থ তো জানি; নরনারী যার কাছে আশ্রয় নেয়।
আমি অন্তত এই অর্থেই কবিতাটি নিয়েছি।
তাই আমি জপ করি সেই আল্লার (নারায়ণ) আশ্রয় নিয়ে, তার রূপস্বরূপকে স্মরণ করে, যার নাম লতিফ (সুন্দর)। এবং তিনি শিব এবং সত্যও বটেন।
কারণ আমি যখন আমার রূপনারাণের তীরে পৌঁছলুম, রূঢ়তমরূপে আমার নিদ্রাভঙ্গের দ্বিজত্বের সম্মুখীন হলুম তখন শুধু যে আমার পূর্ববর্ণিত
ট্র্যাডিশন। ট্র্যাডিশন!!
ট্র্যাডিশনের পাষাণপ্রাচীর নির্মিত অচলায়তন দেখতে পেলুম, তাই নয়।
আতঙ্ক, বিস্ময়, এমনকি নৈরাশ্যে প্রায় জীবনূতাবস্থায় আমি আরও অনেক অন্ধপ্রাচীর, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের চতুর্দিকে যেরকম চার দফে ইলেকট্রিফাইড লোহার কাঁটাজাল থাকে সেগুলোও দেখতে পেলুম।
এবং তার চেয়েও মারাত্মক বিভীষিকাময় : ভুল আদর্শ, ভুল মরালিটি, বেকার পরোপকার, মহাশূন্যে দোদুল্যমান আলোকলতার উপর স্তরে স্তরে ফুটে-ওঠা সঙ্গীতের ক্ষণস্থায়ী আকাশকুসুম, কবি বায়রনের ভাষায়–
এ যেন জীর্ণ প্রাসাদ ঘেরিয়া
শ্যামা লতিকার শোভা,
নিকটে ধূসর জর্জর অতি
দূর হতে মনোলোভা।
আর কী সব ভুল দেখেছিলুম তার ফিরিস্তি আপনাকে দিতে গেলে পুরো একখানা মোহাম্মদি পঞ্জিকা লিখতে হবে। এককথায় দেহের ভুল, হৃদয়ের ভুল, মনের ভুল পঞ্চেন্দ্রিয়ের ভুল। অর্থাৎ কিশোরী অবস্থা থেকেই শুরু করেছি ভুল এবং চলেছি ভুল পথে।
আমি নিরাশাবাদী নই, অতএব ঢেলে সাজাতে হবে নতুন করে। জীবনের সঙ্গে রিটানম্যাচের এখনও সময় আছে– প্রস্তুতি করবার।
***
কিন্তু পন্থা কী?
শিশু যেমন মায়ের হাতে মার খেয়ে মায়ের কোলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমি তেমনি রূপনারাণের কূলে নয় রূপনারায়ণের কোলে আছাড় খেয়ে পড়লাম।
বিশ্বরূপের অতিশয় রূঢ় প্রকাশ এই পৃথিবীতে আমরা যাকে সৌন্দর্য বলি, তার সঙ্গে আমার কিছুটা পরিচয় ছিল। অতিক্ষুদ্র কীট ও তার জীবনস্পন্দনে অন্তহীন গ্রহ-সূর্য-তারায়-তারায় যে জীবনস্পন্দন আছে তার লক্ষাক্ষৌহিণী অংশ যতখানি অন্ধভাবে অনুভব করে, ঠিক ওই অতি অল্পখানি। সেই-ই প্রচুর। পর্যাপ্তরও প্রচুরতর অপর্যাপ্ত! আরব্য রজনীর অন-নশার একঝুড়ি ডিম দিয়ে কারবার আরম্ভ করে উজিরবানুকে বিয়ে করবার প্ল্যান কষেছিল। তার হিসাবে রত্তিভর ভুল ছিল না– ভুল ছিল তার হঠকারিতায়। আর আমার হাতে তো কুল্লে সর্বসাকুল্যে মাত্র একটি ডিম। কার্ডিনাল নিউম্যান কী গেয়েছিলেন– স্মৃতিদৌর্বল্যের জন্য ক্ষমাভিক্ষা করছি আমি তো যাত্রা-শেষের দূরদিগন্তের কাম্যভূমি দেখতে চাইনে; আমাকে, প্রভু; একটি পা ফেলার মতো আলো দেখাও। আই ডু নট ইয়োন্ট টু সি দ্য ডিসটেন্ট সিন! ওয়ান স্টেপ ইনাহ্ ফর মি। তাই আমি বিশ্বরূপ লতিফের সন্ধানে বেরোলুম।
এরপর আমার যেসব নব নব অভিজ্ঞতা হল তার বর্ণনা দেবার ভাষা আমার নেই, কখনও হবে না, কারণ আমি তাপসী রাবেয়া নই। আমি সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা দেখছি। তাই আপনি আমার চোখ কেমন যেন কুয়াশাভরা ফিলমে-ঢাকা দেখেছিলেন।
অতএব অতি সংক্ষেপে সারছি।
প্রথমেই আপনার কথা মনে পড়েছিল। কিন্তু চিন্তা করে দেখলুম, আপনি স্বপ্নমগ্ন না হলেও রূপনারাণের তীরে আপনি এখনও পৌঁছননি। প্রার্থনা করি, কখনও যেন না পৌঁছতে হয়।
সবাইকে যে পৌঁছতে হবে এমন কার, কোন মাথার দিব্যি? যদি রূপনারাণে পৌঁছতেই হয় তবে যেন পৌঁছেন আপনার শুরুরই মতো আশি বছর বয়সে। আমার কপাল মন্দ (মুনিঋষিরা হয়তো বলবেন ভাগ্যবন্ত আমি অখণ্ডসৌভাগ্যবতী), আমি যৌবনেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছি। কোনও ইয়োরোপীয় বিলাসরভসে নিমজ্জিত এক ধনীর সন্তান যৌবনে বলেছিলেন স্যালভেশন, মুক্তি, মোক্ষ? নিশ্চয়ই চাই, প্রভু। কিন্তু not just yet অর্থাৎ একটু পরে হলে হয় না, প্রভু? আমার বিলাসবাসনা তেমন কিছু একটা নেই, কিন্তু আমার যে ভয় করে।… আপনার কাছে যাওয়া হল না।
তখন পেলুম পীর সাহেবকে। আমার বড় আনন্দ, আপনি তাকে ভুল বোঝেননি। তিনি কখনও আদৌ আমার ওপর কোনও প্রভাব বিস্তার করতে চাননি। বরঞ্চ তিনি যেন হলেন এমবারাসট– যেন একটা ধন্ধে পড়লেন। বুঝে গেলুম, তাঁর যেন মনে হয়, যৌবনের কাম-বাসনা ইত্যাদি খানিকটে পুড়িয়ে নিয়ে তার পর ধ্যানধারণার ক্ষেত্রে নামা প্রশস্ততর।
***
আপনি জানেন, যদিও ধর্মেকর্মে আমার আসক্তি ছিল সামান্যই, তবু আমি শ্রীঅরবিন্দের আধা-ধর্ম-আ-কালচারাল লেখাগুলো সবসময়ই মন দিয়ে পড়েছি। বুঝেছি অবশ্য সিকি পরিমাণ। তাঁর কথা আমার মনে পড়ল সর্বশেষে। কৃপণ যে-রকম তার শেষ মোহরটির কথা স্মরণ করে সব খতম হয়ে যাওয়ার পর।
তার সে-লেখাটির নাম বোধ হয় উত্তরপাড়া ভাষণ।
আলিপুরের বোমার মামলা তখন সবে শেষ হয়েছে। সমস্ত বাঙলা দেশ উদগ্রীব, এবারে শ্রীঅরবিন্দ বাঙলা দেশকে কোন পথে নিয়ে যাবেন। আর বাঙলা দেশের সঙ্গে বিজড়িত রয়েছে সমস্ত ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ।
কী গুরুতর দায়িত্ব! মাত্র একটি লোকের স্কন্ধে!
তখন তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন তার মূল কথা একটি বাক্যে বলা যেতে পারে– তিনি আপন ভবিষ্যৎ কর্তব্য সম্বন্ধে কিছুদিনের জন্য নির্জনে চিন্তা করতে চান।
আর আমি তো সামান্য প্রাণী। আমার এ ছাড়া অন্য কোনও গতি আর আছে কি?
আমি খুব ভালো করেই জানি, আমার স্বামীর অত্যন্ত কষ্ট হবে। এরকম ফেরেশতার মতো স্বামী কটা মেয়ে পায়! তাই জানি, যখন তাঁর কাছ থেকে বিদায়ের অনুমতি চাইব তিনি আমাকে বাধা দেবেন না। তিনি নিজে ধার্মিক–তাই বলে যে তিনি আমার ধর্মজীবনের অভিযানে বাধা দেবেন না, তা নয়। আমি যে দিনের পর দিন বাড়িতে বসে বসে ঝুরে মরব সেটা তিনি কিছুতেই সইতে পারবেন না।
হায় আল্লাতালা! আমাকে তুমি এ কী নির্দেশ দিলে যার জন্য আমার এই প্রাণপ্রিয় স্বামী, আমার মালিককে ছেড়ে যেতে হচ্ছে! সৈয়দ সাহেব, আমি জানি আর আমার স্বামী জানেন, আমাদের আজও মনে হয়, আমাদের বিয়ে যেন সবেমাত্র কয়েকদিন আগে হয়েছে। আমরা যেন এইমাত্র বাজগতি (বাঙলায় কী বলে? দ্বিরাগমন?) সেরে স্টিমারের কেবিনে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একে অন্যকে চিনে নিচ্ছি। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, আমি কী ভাগ্যবান! লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল। মাথায় ঘোমটা টেনে তার পদস্পর্শ করে বললুম, আপনি এ কী করলেন? আমি যে এখনই এই কথাটিই বলতে যাচ্ছিলুম।
তিনি হো হো করে হেসে উঠে বলেছিলেন, পাগলী!
ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। আজ প্রমাণ হতে চলল, আমি পাগলিনী। নইলে আমি আমার এমন মনিব ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছি কেন?
কত বলব? এর যে শেষ নেই।
***
আপনাকে ছেড়ে যেতে আমার নিজের জন্য কষ্ট হয় আপনি কতখানি বেদনা পাবেন, সে-কথা আমি ভাবছিনে। যাবার বেলা শেষ একটি কথা বলি। যবে থেকে আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় (আল্লা সে-দিনটিকে রোশূনিময় করুন!) তখন থেকেই লক্ষ করেছি, আপনার ভক্ত-চেলার সংখ্যা খুব নগণ্য নয়। হয়তো আপনার চেয়ে কাঁচা লেখকের ভক্তের সংখ্যা আরও বেশি। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ করে আমি আশ্চর্য হয়েছিলুম এবং অতিশয় পুলকিত হয়েছিলুম। আপনার ভক্তা নেই, আপনার কোনও রমণী উপাসিকা নেই। আমিই তখন হলুম আপনার অদ্বিতীয়া সখী, নমসহচরী– যে নামে ডাকতে চান, ডাকুন। এ হেন গৌরবের আসন ত্যাগ করে যেতে চায় কোন মুখী! তবু যেতে হবে।
সর্বশেষে আপনাকে, নিতান্ত আপনাকে একটি কথা বলি :
ওই যে কবিতা–কবিতা বলা ভুল, এ যেন আপ্তবাক্য রূপনারাণের কোলে/ জেগে উঠিলাম-এর শেষ দুটি লাইনকে আমি অকুণ্ঠ স্বীকার দিতে পারছিনে। লাইন দুটি :
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে।
মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।
এখানে আমি কুষ্টিয়ার লালনফকিরের আপ্তবাক্য মেনে নিয়েছি। তিনি বলেছেন, এখন আমার দেহ সুস্থ, মন সবল, পঞ্চেন্দ্রিয় সচেতন। এ অবস্থায় যদি আল্লাকে না পাই তবে কি আমি পাব মৃত্যুর পর?– যখন আমার দেহমন প্রাণহীন, অচল অসাড়? আমি সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে মৃত্যু দিয়ে সকল দেনা শোধ করব না।
আমার যা পাবার সে আমি এই জীবনেই, জীবন্ত অবস্থাতেই পাব।
খুদা হাফিজ! ফি আমানিল্লা!!
আপনার স্নেহধন্য কনিজ
শহর-ইয়ার
হাত থেকে ঝরঝর করে সবকটি পাতা বারান্দার মেঝেতে পড়ে গেল।
এতক্ষণ আমার (এবং শহর-ইয়ারেরও) আদরের আলসেশিয়ান কুকুর মাস্টার আমার পাশে শুয়ে মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছিল।
এখন হঠাৎ বারান্দার পূর্ব প্রান্তে গিয়ে নিচের দু পায়ের উপর বসে উপরে দু পা আকাশের দিকে তুলে দিয়ে চিৎকার করে ডুকরে ডুকরে আর্তরব ছাড়তে আরম্ভ করল। সম্পূর্ণ অহেতুক, অকারণ।
তবে কি মাস্টার বুঝতে পেরেছে, তার-আমার প্রিয়বিচ্ছেদ। আল্লাই জানেন সে গোপন রহস্য।
***
অবসন্ন মনে মৃত দেহে শয্যা নিলুম। ঘুম আসছে না।
দুপুররাত্রে হঠাৎ দেখি মাস্টার বিদ্যুৎবেগে নালার দিকে ছুটে চলেছে। হয়তো শেয়ালের গন্ধ পেয়েছে।
তার খানিকক্ষণ পরে ওই দুপুররাত্রে কে যেন বারান্দায় উঠল। উঠুক। আমার এমন কিছু নেই যা চুরি যেতে পারে।
হঠাৎ শুনি ডাক্তারের গলা। আমার কামরার ভিতরেই।
এক লক্ষে দাঁড়িয়ে উঠে তাকে আলিঙ্গন করলুম। বাতি জ্বাললুম।
এ কী! আমি ভেবেছিলাম তাকে পাব অর্ধ-উন্মত্ত অবস্থায়। দেখি, লোকটার মুখে তিন পোচ আনন্দের পলেস্তরা।
কোনও প্রকারের ভূমিকা না দিয়ে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বললে,
নাম্বার ওয়ান : আমাদের বসতবাড়ি পরশুদিন পুড়ে ছাই।
নাম্বার টু : আমরা আগামীকাল যাচ্ছি সুইডেনে। আমার রিসার্চের কাজ সেইখানেই ভালো হবে।
নাম্বার থ্রি : (কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন) শহর-ইয়ার অন্তঃসত্ত্বা।
নাম্বার ফোর :–
আমি বাধা দিয়ে বললুম, সে কোথায়?
বারান্দায়। মাস্টারকে খাওয়াচ্ছে।
***
বারান্দায় এসে শহর-ইয়ারকে বললুম, সুইডেনে তুমি নির্জনতা পাবে।
তার পর শুধালুম, আবার দেখা হবে তো?
সে তার ডান হাত তুলে দেখি, আমি তাকে ঢাকা থেকে এনে যে শাখার কাকন দিয়েছিলুম সেইটে পরেছে সে-হাত তুলে আস্তে আস্তে ক্ষীণকণ্ঠে বললে, কী জানি, কী হবে।
*** আমার এক বন্ধু রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুশয্যায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন। তিনি আমাকে বলেন, রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর পূর্বে তার দুর্বল হাত তুলে বলেন তখন তার চৈতন্য ছিল কি না জানিনে কী জানি, কী হবে।