২০. মধুসূদনের রোয়াকে বিরাট জটলা

২০

পরের দিন সকালবেলাই মধুসূদনের রোয়াকে বিরাট জটলা বসলো। দুনিকাকা এসেছে, মধুসূদনের বড়দা এসেছে, পঞ্চাদা, দলের সবাই হাজির, সবারই মুখ গম্ভীর।

দুনিকাকা খবরের কাগজটা নিয়ে আর ছাড়তে চায় না। বললে–এবার আর রক্ষে রাখবে না মাইরি, এবার আগুন জ্বলবে–দেখে নিস্–উঃ–কী সাংঘাতিক–

অন্য কারো মুখে কথা নেই। দীপঙ্কর উঁকি মেরে দেখলে–খবরের কাগজের মাথায় বড় বড় হরফে লেখা রয়েছে–ডালহৌসী স্কোয়ারে কলিকাতার পুলিস কমিশনার চার্লস টেগার্টকে লক্ষ্য করিয়া বোমা নিক্ষিপ্ত। মিস্টার টেগার্ট অল্পের জন্য বাঁচিয়া গিয়াছেন। বোমা নিক্ষেপকারী বলিয়া বর্ণিত অনুজা সেন গুরুতররূপে আহত হইয়া প্রাণত্যাগ করে। এ সম্পর্কে ডাক্তার নারায়ণ রায় ও ডাক্তার ভূপাল বসুকে পুলিস গ্রেপ্তার করিয়াছে।

সে এক অদ্ভুত যুগ। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের তখন প্রথম ভাঙন ধরতে শুরু করেছে। পাড়ায় পাড়ায় জটলা হয় সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত। অঢেল সময়। চায়ের দোকানে এক কাপ চা নিয়ে বসে থাকে ছেলেরা। গল্প করে, গালাগালি দেয়, আর স্বপ্ন দেখে। আর ওদিকে আর এক দল অন্ধকারের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে ষড়যন্ত্র করে। সমস্ত বাংলাদেশ যেন আগুন হয়ে উঠেছে। পুলিস যেন হন্যে হয়ে উঠেছে। খবরের কাগজ খুললেই কেবল বোমা আর পিস্তল। বাপ-মায়েরা ছেলেদের সাবধান করে দেয়। মাস্টার সাবধান করে ছাত্রকে। প্রতিবেশীরা সাবধান করে দেয় প্রতিবেশীকে। এক একটা খবর বেরোয় আর সমস্ত লোক যেন চমকে উঠে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই খবরের কাগজে মুখ দিয়ে পড়ে থাকে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। হিজলীর হত্যাকাণ্ড। যতীন দাস। রোজ একটা না একটা লেগেই আছে। আই-জি লোম্যান হত্যা, রাইটার্স বিল্ডিং-এ কর্নেল সিমসনের ওপর গুলি–

দুনিকাকা ভিড় দেখলেই চিৎকার করে উঠতো। বললো–এই এখান থেকে যা তো বাবা, সরে যা তো সব–

পঞ্চাদা বলতো–কী ডেঞ্জারাস, কাণ্ড, দুনিকাকা, শেষকালে রাইটার্স বিল্ডিং-এর মধ্যে ঢুকে গুলি চালালে মাইরি–

মধুসূদনের বড়দা বলতো–দেখছি রোয়াকের আড্ডা এবার উঠিয়ে দিতে হবে দুনিকাকা–এবার সব পুলিসের নজর পড়ছে এদিকে–শেষকালে কোনদিন আমাদের মতো ছাপোষা লোককে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে–

দুনিকাকা বলতো–আমি আর আসছি না বাবা তোদের আড্ডায়, কোন্ দিন কোন্ শর্মা দেখে ফেলবে তখন আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে–কিন্তু যা কাণ্ড চলছে ভাই, না-এসেও পারি না–উঃ–

–এই দীপঙ্কর, শোন, শোন্ ইদিকে–

পঞ্চাদা ডাকলে। দীপঙ্কর কাছে এল। পঞ্চাদা বললে–এই এত রাত্তিরে কোথায় গিয়েছিলি রে? বাড়ি যা, বাড়ি যা শিগির–

দুনিকাকা বললে–ওরে তোদের এই লাইব্রেরীটা তুলে দে বাবা, পাড়ার মধ্যে ও আগুনটাকে আর রাখিস্ নি–সমস্ত পাড়ায় একেবারে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দেবে–চাকরি হলো তোর?

সমস্ত প্রশ্নগুলো এড়িয়ে বাড়ির কাছে আসতেই মনে পড়লো। সতী হয়তো বাড়িতেই আছে। সতী তো ইচ্ছে করলেই টাকাটা দিয়ে দিতে পারে। সতী যদি ইচ্ছে করে বাবার কাছে চাইলেই পেয়ে যাবে! ওদের কাছে ছ হাজার টাকা কী! কিছুই না। ছ হাজার টাকা পেলে এখনি দাতারবাবু নতুন করে আবার ব্যবসা আরম্ভ করতে পারে। লক্ষ্মীদির আবার সুখ হবে। লক্ষ্মীদি তাহলে আবার বেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।

–কাকীমা!

কাকীমা পাশেই ছিলেন। বললেন–কে? দীপু? কাকাবাবু তো বাড়িতে নেই–

–কোথায় গেছেন?

–এখনি বাড়ি এসে আবার চলে গেছেন, আপিসের কাজে আসতে রাত হবে–

তারপর একটু থেমেই বললেন–তোমার মা আজকে সব বলে গেছেন তোমার কাকাবাবুকে–বলেছেন, তোমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করবেন–

আসল কথাটা জিজ্ঞেস করতে কেমন সঙ্কোচ হচ্ছিল দীপঙ্করের। বললে

— আচ্ছা কাকীমা, লক্ষ্মীদির বাবার আসবার কথা ছিল, আসবেন না?

কাকীমা বললেন–না, তিনি আর এখন আসতে পারবেন না, তাঁর শরীর খুব খারাপ

–শরীর খারাপ? লক্ষ্মীদির কথা শুনে শরীর খারাপ হয়েছে বুঝি?

কাকীমা বললেন–হ্যাঁ, সতী চলে যাচ্ছে।

–সতী চলে যাচ্ছে। বর্মায়? সতী আর পড়বে না এখানে?

কাকীমা নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আবার। দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–সতী কোথায় কাকীমা?

–ওপরে, খুব মন খারাপ হয়ে গেছে ওর–যাও–

দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলো। সতী চলে যাবে! কথাটা সত্যিই যেন বিশ্বাস হয়নি সেদিন। অথচ ভুবনেশ্বরবাবুরই তো আসবার কথা ছিল কলকাতায়। এ কী হলো হঠাৎ। দীপঙ্করের মাথার ভেতরে সব যেন গোলমাল হয়ে গেল। লক্ষ্মীদির এই বিপদের সময়ে সতী চলে যাবে! তাহলে টাকা কেমন করে যোগাড় হবে! আর টাকা না পেলে যে দাতারবাবুর জেল হয়ে যাবে!

সতী দরজার দিকে পেছন ফিরে তখন ট্রাঙ্ক খুলে কী যেন করছিল। জুতোর আওয়াজ পেয়েই পেছন ফিরেছে।

দীপঙ্কর বললে–তুমি চলে যাবে নাকি? কাকীমা বলছিলেন, সত্যি?

সতী বললে–হ্যাঁ

–কবে?

সতী বললে–আর দু’চার দিনের মধ্যেই–

–কিন্তু তুমি চলে গেলে যে মহা মুশকিল হবে!

–মুশকিল?

সতী যেন কিছু বুঝতে পারলে না। অবাক হয়ে চাইলে দীপঙ্করের মুখের দিকে।

–আমি চলে গেলে তোমার কী মুশকিল হবে? বা রে–

দীপঙ্কর বললে–না, তুমি যেও না এত তাড়াতাড়ি–আর কিছুদিন অন্তত কলকাতায় থাকো–খুব মুশকিল হবে চলে গেলে–

–কেন? আমার আবার কী মুশকিল হবে?

–তোমার নয়, আমার মুশকিল! তুমি বিশ্বাস করো সতী তুমি চলে যাও তো বড্ড মুশকিলে পড়বো আমি। আমার আর কোনও উপায় থাকবে না।

সতী দাঁড়িয়ে উঠলো। কিছুই বুঝতে পারলে না যেন। হাঁ করে চেয়ে রইল দীপঙ্করের মুখের দিকে।

দীপঙ্কর বললে–আমার দিকে অমন করে চেয়ে দেখছ কী? এখন এই অবস্থায় বর্মায় গেলে তোমার চলবে না–

–তার মানে?

দীপঙ্কর বললে–তোমাকে অনেক কথা বলবার আছে আমার, এই আমি বউবাজার থেকে আসছি–

–বউবাজার? বউবাজারে কী করতে গিয়েছিলে তুমি?

–সেই কথা বলতেই তো তোমার কাছে আসা। সেখানে এক ভীষণ কাণ্ড ঘটে গেছে। আর একটু হলে আমাকেও আর দেখতে পেতে না তুমি–এতক্ষণ হয়তো দেখতে হাসপাতালে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছি কিংবা রাস্তায় মরে পড়ে আছি। অথচ আমি যে বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছি এ-ও বলতে পারো আমার ভাগ্য, নইলে কী যে হতো বলা যায় না–তুমি শোননি কিছু?

সতী বললে–শুনলাম ওখানে নাকি স্বদেশীরা বোমা ফেলেছে–কিন্তু তুমি বউবাজারে গিয়েছিলে কেন?

দীপঙ্কর বললে–সেই কথা বলতেই তো তোমার কাছে এসেছি–শুনলাম তোমার বাবা নাকি কলকাতায় আসছেন না

–না, বাবার শরীর খারাপ, তিনি আসতে পারবেন না–

–কাকীমা তাই বলছিলেন তোমার নাকি খুব মন খারাপ হয়ে গেছে?

সতী কিছু উত্তর দিলে না। আবার ট্রাঙ্কে কাপড়গুলো গুছোতে লাগলো।

দীপঙ্কর বললে–সত্যি বলো না, মন খারাপ হয়ে গেছে তোমার!

সতী তবু উত্তর দিলে না। নিজের কাজই করতে লাগলো।

দীপঙ্কর বললে–কাজটা না-হয় একটু পরেই করলে–এখন আমার কথাটারই উত্তর দাও না

অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে কাজ করতে করতেই সতী বললে–উত্তর আমি কী দেব, উত্তর আমার নেই–

–উত্তর নেই মানে? নিজের মন খারাপ হয়েছে কিনা তাও নিজে বুঝতে পারো না?

সতী যেন বিরক্ত হলো। বললে–কী যে তুমি বিরক্ত করছো কেবল–তুমি এখন যাও তো–তুমি যাও এখান থেকে–

দীপঙ্কর বললে–কেন? আমি চলে গেলে কি তোমার মন ভালো হয়ে যাবে? –না তা বলছি না, এখন অনেক রকম ভাবনা রয়েছে মাথায়, এখন কিছু ভালো লাগছে না আমার

–তা ভালো লাগছে না কেন, বলবে তো?

সতী বললে–তা সব কথা তোমাকে বলতে হবে, এমন কড়ার আছে নাকি তোমার সঙ্গে? মানুষের মন-মেজাজ খারাপ হতে নেই? আর তাছাড়া, আমার যদি মন খারাপ হয়েই থাকে তো তাতে তোমার কী?

–বা রে, কী কথা থেকে কী কথা, আমি কি তাই বলেছি। আমি এসেছিলাম তোমার সঙ্গে একটা পরামর্শ করতে–আমি একলা ভেবে কিছু ঠিক করতে পারছিলাম না, তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করা–

–কিসের পরামর্শ?

দীপঙ্কর বললে–তোমার বাবা এলে অবশ্য ভালোই হতো, কিন্তু তিনি যখন এলেন না, তখন তুমিও কিছু সাহায্য করতে পারো। আমার নিজের জন্যে বলছি না, বলছি আর একজনের জন্যে–

–কে? কার জন্যে বলছো? কী সাহায্য?

দীপঙ্কর বললে–টাকা–

–টাকা?

–হ্যাঁ, কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করতে হবে।

–কাকে?

দীপঙ্কর বললে–মনে আছে একদিন বহুকাল আগে তুমি যেদিন প্রথম এলে কলকাতায় তুমি আমাকে বাড়ির চাকর মনে করে চারটে পয়সা দিতে গিয়েছিলে? তোমার সেদিন কোনও অন্যায় হয়নি। কিন্তু সেদিন মনে খুব কষ্ট হয়েছিল সত্যি! সেদিন রাত্রে ভালো করে ঘুমও হয়নি আমার! মনে একটু কষ্ট হলেই আমার ঘুম হয় না–কিন্তু …

–তা সে-কথা তোমার এখনও মনে আছে নাকি?

–মনের আর কী অপরাধ বলো না, সে বেচারী বড় নিরীহ জীব, কিন্তু নিরীহ জীব হলেও তারও তো ভালো-লাগা মন্দ-লাগা বলে একটা জিনিস থাকতে পারে!

সতী এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বললে–অত দিন আগের সব কথা আমার মনে নেই–আর তারপরে কত কী বদলে গেল, সে-আমিই আর আমি নেই, আর সে তুমিই কি সেই-তুমি আছো?

–আমি সেই আমিই আছি সতী! নইলে সে-সব কথা আমার মনে রইল কী করে! বাইরেই শুধু বয়েস বেড়েছে, কিন্তু লক্ষ্মীদি আজ এখানে থাকলে তার কাছে শুনতে পেতে আমি সেই রকমই আছি কি না। লক্ষ্মীদি জানতো তুমি আসবার আগে থেকেই তোমার সম্বন্ধে আমার কী-রকম আগ্রহ ছিল! তাই লক্ষ্মীদিকে তোমার কথা বার বার জিজ্ঞেস করতাম বলে লক্ষ্মীদিও আমায় খুব ক্ষেপাতো–

সতী হাসতে লাগলো।

দীপঙ্কর বললে– হাসি নয়, সত্যি বলছি–এখন তুমি চলে যাচ্ছো এখন আর বলতে দোষ কী! ছোটবেলায় ভাবতাম, তুমি কলকাতায় এলে আমার তবু একটা খেলার সঙ্গী জুটবে! চিরকাল আমার একটা দুঃখ ছিল আমার ভাইবোন কেউ নেই বলে–

সতী বাধা দিয়ে বললে–তা এইসব কথা বলবার জন্যেই তুমি এখন এসেছ নাকি?

-–না, তুমি চলে যাচ্ছো শুনলাম কি না, তাই পুরোন কথাগুলো সব মনে পড়ে গেল।–আসলে আমি তোমার কাছে এসেছি অন্য কারণে–

–কী কারণে?

দীপঙ্কর বললে–তুমি চলে যাচ্ছে শুনে তাই আরো ভয় হয়ে গেল–তোমার কাছে কিছু সাহায্য চাইতে এসেছি–আমার জন্যে নয়। আর একজনের জন্যে। তার ভীষণ বিপদ, সে-বিপদে একমাত্র তুমিই সাহায্য করতে পারো–কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করতে হবে!

–তা আমারই তুমি টাকা দেখলে? টাকার জন্যে আর কাউকে পেলে না?

দীপঙ্কর বললে–টাকা তো কম-বিস্তর সকলের কাছেই আছে, কিন্তু অল্প টাকাতে যে হবে না, তাই তোমার কাছেই চাইছি, আর তুমি ছাড়া আমি আর কাকে বলবো? আমার নিজের থাকলে আমি তোমার কাছে চাইতাম না–

সতী কিছু কথা বললে না।

দীপঙ্কর বললে–দেবে? বড় উপকার হয় দিলে। টাকা না পেলে হয়তো বেচারী জেলে যাবে, আত্মহত্যা করবে

–কে সে? তোমার কে হয়?

দীপঙ্কর বললে–দেবে তুমি? সত্যিই দেবে? আমার বিশেষ আপনার লোক। তার বিপদ আমার নিজের বিপদেরই সমান

–কিরণ? তোমার সেই বন্ধু কিরণ নাকি? যে লাইব্রেরী করেছে?

দীপঙ্কর বললে–না, কিরণ আপনার লোক বটে, কিন্তু এ কিরণ-টিরণের চেয়েও আপন–আমি সেখান থেকেই সোজা তোমার কাছে আসছি–

সতী হাসলো আবার। বললে–অনেকদিন ধরেই আমার একটা ধারণা হয়েছিল যে, তুমি একদিন একটা-না-একটা কিছু আমার কাছে চাইবেই অন্তত তোমার হাব-ভাব দেখে আমার তাই আন্দাজ হয়েছিল– কিন্তু ….

–কিন্তু কী?

–কিন্তু সেটা যে টাকা, তা সত্যিই আমি কল্পনা করতে পারিনি–

–তা টাকা ছাড়া তোমার কাছে আর কী চাইতে পারি? আর কী চাইবার সাহস আমার থাকতে পারে, বলো?

সতী এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, এবার বসলো চেয়ারের ওপর। চোখটা নামিয়ে বললে–শেষকালে তুমি টাকাই চাইলে?

দীপঙ্কর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বললে–টাকা চাওয়া অন্যায় হলো?

–অন্যায় নয়?

–কীসে অন্যায় শুনি? চাকরি চাইতে অন্যায় হয় না, গয়না চাইতে অন্যায় হয় না, স্নেহ প্রেম ভালোবাসা কিছু চাইলেই অন্যায় হয় না, আর সামান্য ….

সতী থামিয়ে দিলে। বললে– থামো তুমি–

দীপঙ্কর বললে–কেন থামবো? টাকাও তো চাওয়ার মতো একটা জিনিস! চেয়ে চেয়েই তো অঘোরদাদুর এত টাকা! কেউ চেয়ে টাকা নেয়, কেউ জিনিস বেচে টাকা নেয়–ও তো একই কথা! তাছাড়া, তোমার কাছে চাইব তাতে লজ্জা কী?

সতী বললে–তা আমিও তো তাই ভাবছি, তুমি আর কিছু চাইতে পারলে না?

–তা আর কী চাইবো বলো? তুমি না বললে আমি বুঝবো কী করে?

সতী উঠলো এবার চেয়ার ছেড়ে। উঠে হাসলো আবার। সতীর হাসিটা যেন কান্নার মতন। কান্নার মতই মুখটা করুণ হয়ে উঠলো। বললে–তোমাকে আর বোঝাতে হবে না দীপু, তুমি যাও এখন–তুমি বাড়ি যাও দিকি

দীপঙ্কর বুঝতে পারলে না যেন। বললে–বাড়ি যাবো?

–হ্যাঁ বাড়ি যাও, তোমায় কিছু বুঝতেও হবে না, তোমায় কিছু চাইতেও হবে না—

দীপঙ্কর হঠাৎ সতীর এই ব্যবহারে কেমন অবাক হয়ে গেল। এতক্ষণ যে-মেয়ে ভালো করে কথা বলছিল, সে হঠাৎ এমন ব্যবহার করছে কেন?

বললে–তাহলে টাকা দিতে পারবে না তুমি?

সতী বললে–তুমি আর আমায় বেশি জ্বালিও না দীপু, তুমি যাও–

এতক্ষণে যেন আঘাত লাগলো দীপঙ্করের মনে। বললে–তা তো যেতে বলবেই, টাকা চাইলে সবাই অমন দূর-দূর করে দেয়, বোঝা গেল পৃথিবীতে টাকাটাই সব, একলা শুধু অঘোরদাদুরই বদনাম দেখছি–

সতী এবার সোজাসুজি চাইলে দীপঙ্করের দিকে।

অনেকক্ষণ চেয়ে রইল একদৃষ্টে।

বললে–আমার কাছ থেকে টাকা পেলেই তোমার সব মনস্কামনা পূর্ণ হবে?

সতীর চেহারা দেখে যেন ভয় পেয়ে গেল দীপঙ্কর। তবু ভয় পেলে চলবে না। টাকার লক্ষ্মীদির ভীষণ দরকার। টাকার অভাবে দাতারবাবুর জেল হয়ে যাবে!

দীপঙ্কর বললে–হ্যাঁ হবে–

–কত টাকা?

দীপঙ্কর বললে–তোমরা বড়লোক বলেই তোমার কাছে টাকা চেয়েছিলাম– নইলে…

সতী বললে–আমরা বড়লোক সেইটেই বুঝি তোমার চোখে পড়লো–আর বুঝি কিছু চোখে পড়তে নেই?

তারপর একটু থেমে বললে–যাগে, কত টাকা তোমার চাই–বলো–

–অনেক টাকা সতী, এক টাকা দু টাকা নয়–অনেক টাকা–

–হোক অনেক টাকা! একশো? দুশো…আমি বর্মায় গিয়ে বাবার কাছ থেকে চেয়ে টাকাই তোমায় পাঠিয়ে দেব…কত টাকা বলো শুনি?

দীপঙ্কর বলল–ছ হাজার–!

সতী চুপ করে রইল। একটু চমকেও উঠলো না টাকার অঙ্কটা শুনে।

দীপঙ্কর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললে–টাকাটা একটু বেশিই সতী, কিন্তু তোমাদের কাছে কিছুই নয়–আর আমি যদি কখনও চাকরি পাই, তোমার এ-টাকা আমি মাসে মাসে শোধ করে দেব–আমি কথা দিচ্ছি, আমার কথা তুমি সত্যি বলে বিশ্বাস করতে পারো, আমি কখনও মিথ্যে কথা বলি না–

–তুমি এখন যাও, আমি দেব টাকা!

–দেবে?

দীপঙ্কর আনন্দে আরো কাছে সরে এল।

–দেবে তুমি? সত্যি দেবে?

–হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি দেব, যেমন করে পারি যোগাড় করে দেব, বাবার কাছে যদি না-ও পাই আমার নিজের গয়না বেচেও দেব

দীপঙ্কর বললে–কবে দেবে? একটু তাড়াতাড়ি দিতে পারো না?

সতী তখনও গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। সতীর দিকে চাইতে যেন ভয় করছিল দীপঙ্করের। বললে–আজকে দিতে পারো না, কিংবা কাল?

সতী বললে–আবার কথা বলছো? বলেছি না তুমি যাও এখান থেকে?

–কিন্তু কবে দেবে সেটা বলবে তো? আমার যে ভীষণ দরকার!

সতী বললে–আমি বর্মায় ফিরে গিয়ে তোমার নামে পাঠিয়ে দেব, তার আগে নয়– হলো তো? যাও এখন

–কিন্তু কবে যাবে তুমি সেখানে?

–খুব শিগগির। দু’চারদিনের মধ্যেই।

–কিন্তু কাল যেতে পারো না? কাল গেলেই তো সেখানে আরো আগে পৌঁছুতে পারব। তাহলে টাকাটা পাঠাতে পারবে–

সতী এবার সোজা চাইলে দীপঙ্করের দিকে। বললে–এখনও তুমি দাঁড়িয়ে আছো আমার কাছে? বলেছি তো টাকা আমি দেব তোমাকে–

–আচ্ছা, তাহলে আমি যাই?

–হ্যাঁ যাও, আর কখনও এসো না আমার কাছে–যাও এখন

দীপঙ্কর নির্বোধের মতো তবুও খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেখানে।

–তোমার পায়ে পড়ি দীপু তুমি যাও, যাও তুমি–আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যাও–

দীপঙ্কর আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। পুরোপুরি যেন নিশ্চিন্ত হতে পারা গেল না। তবু সতী যখন বলেছে টাকা দেবে–তখন দেবে নিশ্চয়ই! কিন্তু আর একটু আগে পাওয়া গেলেই তো ভালো হতো! লক্ষ্মীদির হাতে তো মাত্র দু’গাছা চুড়ি আছে–তাতে আর ক’দিন চলবে! কতদিনই বা চালাতে পারবে তাতে! শেষে যদি সতী টাকা না পাঠায়! না পাঠালে তো পুরোপুরি সর্বনাশ হয়ে যাবে। দাতারবাবুরও জেল হয়ে যাবে। তখন লক্ষ্মীদি কোথায় থাকবে? তখন লক্ষ্মীদির সে-লজ্জা সে-অপমান কে ঢাকবে?

সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসতেই কাকীমা বললেন–কী দীপু, খুব মন খারাপ বুঝি

সতীর?

দীপঙ্কর বললে–হ্যাঁ কাকীমা, খুব মন খারাপ হয়ে গেছে, আমার সঙ্গে ভালো করে কথাই বললে না–আমাকে তাড়িয়েই দিলে ঘর থেকে–

কাকীমা বললেন–আমিও তাই ওর সামনে যাচ্ছি না–চিঠিটা আসার পর থেকেই খুব মন-মরা হয়ে গেছে–

–কিন্তু কবে যাচ্ছে সতী? কিছু ঠিক হয়েছে?

–মঙ্গলবার।

দীপঙ্কর হিসেব করে দেখলে মনে মনে। বললে–এত দেরি? আর একটু আগে যেতে পারে না?

কাকীমা বললেন–কেন? আগে গেলে লাভ কী? এই সেদিন এল, এর মধ্যে চলে যেতে কি ভালো লাগে কারো? আসলে যে কলকাতাটা ওর ভালো লেগে গিয়েছিল– ইচ্ছে ছিল আরো লেখা-পড়া করবে!

দীপঙ্কর বললে–না কাকীমা, ওর বাবার অসুখ, তিনি একলা আছেন, সতীর তাড়াতাড়ি সেখানেই চলে যাওয়া উচিত–

কাকীমা দীপঙ্করের কথাটা ভালো বুঝতে পারলেন না। তবু বললেন–তা তো উচিত–তবু ছেলেমানুষ তো, সেখানে একলা একলা পড়ে থাকতে কি ভালো লাগে–সে তো কলকাতার মতোন নয়, বন-জঙ্গলের দেশ, কেবল কাঠ আর করাতকল, আমি তো ছিলুম সেখানে, আমি দেখেছি–

তারপর একটু থেমে বললেন–আর তাছাড়া, দু বোনে একসঙ্গে পড়াশুনা করতো, লক্ষ্মীর জন্যেই ওর এখানে আসা, সেই লক্ষ্মীই চলে গেল–

–আচ্ছা কাকীমা, ধরুন লক্ষ্মীদি কোথাও খুব কষ্টে আছে, টাকার অভাব কিংবা অসুখই হয়েছে, এমন অবস্থায় যদি বাবাকে লেখে টাকা পাঠাতে তো টাকা পাঠাবেন না তিনি?

–তার মানে? লক্ষ্মীদি কোথায়?

–না, ধরুন যদি এমন অবস্থা হয় কোনও মেয়ের তো বাপ কি সে মেয়েকে ফেলতে পারে?

কাকীমা কাছে সরে এলেন আরো। বললেন–লক্ষ্মী খুব কষ্টে আছে? দেখা হয়েছে নাকি তোমার সঙ্গে?

কথাটা বলেই দীপঙ্কর থতমত খেয়ে গিয়েছিল একটু। কাকীমার কথায় বললে– জানেন কাকীমা, অনেক ছেলে-মেয়ে লক্ষ্মীদির মতোন রাগ করে বাড়ি থেকে তো চলে যায়, তারপর বিপাকে পড়ে আবার একদিন ফিরেও আসে, এমন তো দেখছি! লক্ষ্মীদিও সেই রকম হয়তো একদিন বাড়ি ফিরে আসতে পারে–তখন আপনারা জায়গা দেবেন না তাকে?

কাকীমা নিশ্চিন্তের নিঃশ্বাস ফেললেন–তাই বলো, আমি ভাবলাম বুঝি তোমার সঙ্গে কোথাও দেখা হয়েছে তার। আমিও তাই ভাবছিলাম, সে কি আর কলকাতায় আছে–অন্য কোথাও চলে গেছে নিশ্চয়ই। নইলে তোমার কাকাবাবু সারা কলকাতা চষে ফেলেও তো কোনও কূল-কিনারা পেলেন না!

দীপঙ্কর বললে–সেইজন্যেই তো বলছি সতীর একটু শিগির-শিগির বাবার কাছে যাওয়া উচিত–

–তা তো যাওয়াই উচিত, আমাদেরও আর এখানে সতীকে রাখতে ভরসা হয় না–বাবার কাছে চলে যাওয়াই ভালো–এখন তো সতীও বড় হচ্ছে–

–আচ্ছা আমি আসি কাকীমা। সতীকে একটু তাড়াতাড়ি পাঠাতে চেষ্টা করবেন বাবার কাছে।

বলে দীপঙ্কর বাইরে চলে গেল। পুরোপুরি যেন নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না দীপঙ্কর। তবু সতী যখন বলেছে টাকাটা দেবে–তখন দেবে নিশ্চয়ই। কিন্তু আর একটু আগে কেন দিতে পারে না! আগে দিলেই তো ভালো হতো! লক্ষ্মীদির হাতে তো মাত্র দু’গাছা চুড়ি আছে! তাতে আর ক’দিন চলবে! ক’দিনই বা চালাতে পারবে তাতে! শেষে যদি সতী টাকা না পাঠায়? না পাঠালে যে লক্ষ্মীদির একেবারে সর্বনাশ হয়ে যাবে। দাতারবাবুর যে জেল হয়ে যাবে। তখন? তখন লক্ষ্মীদি কোথায় যাবে? কোথায় থাকবে? তখন লক্ষ্মীদির সে-লজ্জা সে-অপমান কে ঢাকবে?

 বাড়িতে ঢুকতে গিয়েই দীপঙ্করের আর একটা কথা হঠাৎ মনে পড়লো। কথাটা একদম মনে ছিল না।

আবার ফিরলো দীপঙ্কর।

টাকাটা তো পাঠাবে না-হয় সতী! কিন্তু কোন্ ঠিকানায় পাঠাবে! মনি-অর্ডার করে পাঠানোই ভালো। কিন্তু হঠাৎ মনি-অর্ডারে ছ হাজার টাকা আসা দেখে মা-ও তো অবাক হয়ে যাবে! মা কেন, সবাই অবাক হয়ে যাবে! ডাকপিওনও অবাক হয়ে যাবে! বলা নেই কওয়া নেই–ছ হাজার টাকা একেবারে দীপঙ্কর সেনের নামে এসে হাজির হলো! মা জিজ্ঞেস করবে–এ-টাকা কোত্থেকে পেলি রে? কে পাঠালে তোকে? সতী তোকে টাকা পাঠালে কেন? এত লোক থাকতে সতী তোকে টাকা পাঠালে কেন? হাজার কৈফিয়ত দাও, হাজার কথা বলো তখন। তখন বলতে হবে টাকাটা নিজের জন্যে নয়–লক্ষ্মীদির জন্যে! লক্ষ্মীদি কোথায়? কী হয়েছে তার? হ্যাঁন্-ত্যান্ অনেক কথা অনেক ঝামেলা তখন পোয়াতে হবে তাকে। পঁচিশটা টাকার জন্যে মা নৃপেনবাবুকে ঘুষ দিতে পারছে না, পঁচিশটা টাকার জন্যে তার চাকরি হচ্ছে না, আর একেবারে ছ হাজার টাকা উড়ে এসে গেল!

দীপঙ্কর আবার সতীদের বাড়ির দরজায় গিয়ে উঠলো।

তার চেয়ে দরকার নেই। টাকাটা কিরণের বাড়ির ঠিকানায় পাঠালেই হয়! তাহলে আর কেউ-ই জানতে পারে না। সোজা কিরণের বাড়ির ঠিকানায় এসেই পিওন মনি অর্ডার দিয়ে যাবে। কিরণকে আগে থেকে বলে রাখলেই হলো।

–কী গো দীপুবাবু, আবার ফিরলে যে!

দীপঙ্কর বললে–না কাকীমা, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি সতীকে, তাই আবার ফিরে এলুম

সিঁড়ি দিয়ে উঠে দীপঙ্কর আবার দোতলার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। সতীকে গিয়ে ঠিকানাটা বলে আসা ভালো। অর্থাৎ কোন্ ঠিকানায় পাঠাবে। বাড়িতে দীপঙ্করের নামে পাঠানো যা আর দীপঙ্করের নামে কিরণের ঠিকানায় পাঠানোও তাই। পিওন এলেই কিরণ এসে তাকে খবর দেবে আর দীপঙ্কর গিয়ে নিয়ে আসবে টাকাটা। সেই ভালো, সেই ভালো। উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন-এর বদলে তেরো নম্বর নেপাল ভট্টাচার্যি লেন লিখলেই চলে আসবে!

সতী যদি জিজ্ঞেস করে–কিরণ তোমার টাকা যদি নিয়ে নেয়?

দীপঙ্কর বলবে–কিরণ সে-রকম ছেলেই নয়, কিরণদের তুমি চেনো না-কিরণরা সাহেব খুন করতে পারে, কিন্তু হাজার অভাবেও পরের টাকা নেবে না–নিলেও নিজের জন্যে নেবে না। আর তাছাড়া, নেবে কী করে? মনি-অর্ডার করবে তো আমার নামে

কিন্তু সতীর ঘরের সামনে গিয়েই দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল।

ট্রাঙ্কটা তেমনি খোলাই পড়ে রয়েছে। সতী তার বিছানার ওপর মুখ গুঁজে শুয়ে। মনে হল যেন কাঁদছে সতী। ফুলে ফুলে উঠছে শরীরটা। হঠাৎ এমন মন-মরা হয়ে গেল সতী যে কাঁদবে তা বলে?

কাছে গিয়ে দীপঙ্কর ডাকলে–সতী,–একটা কথা বলতে এলাম, কথাটা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম–

কথাটা বলে দীপঙ্কর একটু থামলো। সতী তবু মুখ তুললো না!

দীপঙ্কর আবার বললে টাকাটা তুমি আমার ঠিকানায় পাঠিও না, বুঝলে? টাকাটা কোথায় পাঠাবে জানো–

তবু সতী মুখ তুললে না।

দীপঙ্কর আবার বলতে লাগলো–টাকাটা তো তুমি মনি-অর্ডার করে পাঠাবে? তাহলে তুমি এক কাজ করো–তুমি টাকাটা উনিশের একের বি-র বদলে তেরো নম্বর নেপাল ভট্টাচার্যি…..

হঠাৎ সতী উঠে দাঁড়িয়ে ঠাস্ করে একটা চড় মারলে দীপঙ্করের গালে। সতীর চড়টা দীপঙ্করের গালের ওপর পড়ে ফেটে চৌচির হয়ে গেল। দীপঙ্করের মনে হলো তার গালটা যেন ফেটে রক্ত পড়ছে। আচমকা চড় খেয়ে দীপঙ্কর এমনিতেই থতমত খেয়ে গিয়েছিল, তার ওপর সতীর মুখের চেহারাটা দেখে আরো অবাক হয়ে গেল।

সতী বোধহয় পাগল হয়ে গেছে হঠাৎ। চিৎকার করে বলতে লাগলো–বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও এখনি–বেরিয়ে যাও আমার সামনে থেকে–বেরোও, দূর হও

সতীর রুদ্রমূর্তি দেখে দীপঙ্করের আর কোনও কথা বলবার সাহস হলো না। খানিকক্ষণ সতীর দিকে চেয়ে থেকে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

সিঁড়ির কাছে কাকীমার সঙ্গে দেখা হলো। তিনি ওপরে উঠছিলেন। তিনি বললেন– কী দীপু, কী হলো?

দীপঙ্কর কাকীমাকে এড়িয়ে চলে যাচ্ছিল, কাকীমা আবার বললেন–সতী অমন বকছিল কাকে? কী হয়েছিল কী?

দীপঙ্কর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলে। কোনও কথার উত্তর না দিয়ে তর্ তর্ করে নিচে নেমে গেল। কাকীমার দৃষ্টি থেকে দূরে পালিয়ে যেতে পারলেই যেন বাঁচে। আর তারপর এক নিঃশ্বাসে নিজের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছেছে।

বাড়িতে ঢুকে দীপঙ্কর ঘরের দিকে যেতেই দেখলে ঘরে তালা ঝুলছে। ঘরের দরজা বন্ধ। মা কোথায় গেল! উঠোনের ওপর দাঁড়িয়ে চারদিকে চেয়ে দেখলে। এমন সময় তো মা কোথাও যায় না। রান্নাঘরেও নেই। বিন্তিদির ঘরের ভেতর টিম্ টিম্ করে আলো জ্বলছে। সে-ঘরেও উঁকি মেরে দেখলে। ঘরের ভেতর বিন্তিদি বসে বসে সলতে পাকাচ্ছে। তাহলে বোধহয় মা অঘোরদাদুর কাছে বাজারের টাকা আনতে গেছে। দীপঙ্কর বারান্দা পেরিয়ে দক্ষিণের দিকে গেল।

–কে র‍্যা মুখপোড়া? কে? কার পায়ের শব্দ শুনছি–

দীপঙ্কর গলার আওয়াজ পেয়েই ফিরে এল। অঘোরদাদু তখনও চিৎকার করছে– মুখপোড়া কথা বলে না, কে তুই? তুই কে রে মুখপোড়া–

নিচে আসতেই দেখে মা উঠোনে ঢুকছে। বেশ ফরসা থান পরেছে। কোথাও গিয়েছিল হয়তো। দীপঙ্করকে দেখেই

মা বললে–তুই এখন এলি? কোথায় গিয়েছিলি সারাদিন? তোর জন্যে বসে বসে আমি বেরোতে পারি না কোথাও শেষে তালা দিয়ে বেরোলাম

–তুমি কোথায় গিয়েছিলে মা!

–আবার কোথায়? নৃপেনবাবুর কাছে–তোমায় দিয়ে তো একটা কাজ হবার নয়, এইসব বলে কয়ে এলুম, বার বার না বললে কি কথা মনে থাকে কারো?

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–তুমি বুঝি আজ সতীদের বাড়ি গিয়েছিলে মা?

-–তোমার চাকরির জন্যে কি আমার ঘুম আছে! সকলকেই তো বলছি,–যেখানে হয় একটা হলেই হলো, আমি আর পারছি না টানতে–

ক্রমে আরো রাত হলো। মা’র মুখে যেন দিন দিন কান্তির ছাপ পড়ছে। দীপঙ্করের মায়া হলো মা’কে দেখে ৷

মা বললে–আমি আজ পালা-কীর্তন শুনতে যাবো–খুব সাবধানে থাকবে—বুঝলে–

দীপঙ্কর বললে–আমিও যাবো মা–

–তুমি গেলে কী করে চলবে! সারারাত ঘর খালি পড়ে থাকবে নাকি? তোমাদের জন্যে কি আমি একটু ধর্মকর্মও করতে পারবো না- পরের বাড়ি খাটতে এসেছি বলে কি সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়েছি–

খাওয়া-দাওয়ার পর চন্নুনীকে নিয়ে মা বেরোল। যাবার সময় বিন্তিদিকে বলে গেল–খুব সাবধানে থাকবে মা, ঘরের হুড়কোটা বন্ধ করে দাও–আমি দেখে যাই–

বিন্তিদি ঘরে ঢুকে খিল বন্ধ করে দিলে।

মা বাইরে থেকে বললে–হুঁড়কো দিয়েছ? বিন্তিদি বললে–দিয়েছি দিদি–

মা বললে–এবার আলোটা নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ো–রাত্তিরে যেন দরজা খুলো না–কেউ ডাকলেও খুলবে না–বুঝলে

দীপঙ্করকেও বার বার সাবধান করে দিলে। সদর দরজাটা বন্ধ করে ঘরে গিয়ে হুড়কোটা বন্ধ করে যেন শোয় দীপঙ্কর। ছিটে-ফোঁটার ভাত-তরকারি যথাস্থানে ঢাকা আছে। রাত্রিবেলা যেন ঘর খোলা রেখে কোথাও না বেরোয়। বাড়িতে কেউ রইল না।

–চল্‌ চন্নুনী, চল্ বাছা–

মা চলে গেল। সদর দরজায় খিল দিয়ে দীপঙ্কর নিজের ঘরের দরজাতেও খিল তুলে দিলে। গালে হাত বুলিয়ে দেখলে দীপঙ্কর। যেন ফুলে উঠেছে জায়গাটা। সামান্য সামান্য ব্যথাও করছে। আর একটু দাঁড়ালেই হয়তো সতী আরো মারতো। কেন যে অমন ক্ষেপে গেল সতী হঠাৎ কে জানে! দীপঙ্কর তো কোনও অন্যায় করেনি। সতী তো এমন ছিল না আগে। প্রথম প্রথম যেমনই হোক, পরে তো কত হেসে কথা বলেছে। কত ভালো ব্যবহার করেছে দীপঙ্করের সঙ্গে। হয়তো মন খারাপ ছিল সত্যিই। লক্ষ্মীদির জন্যে মেজাজ আগে থেকেই খারাপ ছিল, তারপর হঠাৎ আবার ফিরে যেতে হবে বৰ্মায়। মন তো খারাপ হবারই কথা। তার ওপর অতগুলো টাকা চেয়েছে। অতগুলো টাকা! কী যে হলো! সব যেন একাকার হয়ে গেল সংসারের। কোথায় সেই ছোটবেলাকার জীবন। এখন মনে হয় সেইটেই যেন ছিল ভালো। সেই ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল স্কুল। সেই রোহিণীবাবু, সেই প্রাণমথবাবু। সেই ফটিক মধুসূদন নির্মল পালিত লক্ষ্মণ সরকার। সবাই-ই যেন বদলে গেছে। অঘোরদাদুও যেন বদলে গেছে ভেতরে ভেতরে। অঘোরদাদুও সেই আগেকার মতো আর মুখপোড়া বলে যখন-তখন গালাগালি দেয় না। গালাগালি দেবার মতো শরীরের ক্ষমতাই আর নেই। বুড়োমানুষ রিক্সাটার ওপর বসে বসে ঝিমোয়–আর বিড় বিড় করে আপন মনে বকে যায়। এখন আর চোখে মোটে দেখতেই পায় না। এক-একদিন এক আনির বদলে ভুল করে সিকি দিয়ে দেয় রিক্সাওয়ালাকে। তারপর যখন ভুল ধরা পড়ে তখন হৈ-চৈ করে, চিৎকার করে। বলে–মুখপোড়া মেরে ফেললে আমাকে, মুখপোড়া খুন করে ফেললে একেবারে

একটা সিকির শোকে অঘোরদাদু এক-একদিন খেতে পারে না, ঘুমোতে পারে না–

আর বিন্তিদি! এক-একদল বিন্তিদিকে দেখতে আসে আর খাবার খেয়ে চলে যায়। বলে–পরে খবর দেব। সেজেগুজে দেখতে আসে। নানান রকম প্রশ্ন করে বিন্তিদিকে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্রশ্ন। রান্না করতে পারে কিনা, সেলাই করতে পারে কিনা, গান গাইতে পারে কিনা। বিন্তিদি সত্যি কথাই বলে। সব কথার উত্তরে বলে–না। আর ভদ্রলোকেরা চলে গেলেই চুপি চুপি কাঁদে। নিঃশব্দে কেঁদে ভাসিয়ে দেয়। বলে–আমি যে মিথ্যে কথা বলতে পারি না দিদি–

আর কিরণ! কোথায় গেল সেই আগেকার কিরণ। এখন আর সেই লাইব্রেরীর বাতিক নেই। অন্য দলে মিশছে। এক-একদিন বাড়িতেই থাকে না। আর অক্ষয় পরমায়ু কিরণের বাবার। আরো ফুলে উঠেছে গলাটা। আরো কুঁজো হয়ে বসে থাকে দাওয়ার ওপর। দীপঙ্কর উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালেই কিরণের বাবা তার দিকে চেয়ে কেমন করে হাসে। অন্তত হাসবার চেষ্টা করে। হাসলে আরো ভয় করে দীপঙ্করের। আর সঙ্গে সঙ্গে গলা দিয়ে ঘড় ঘড় শব্দ বেরোয় সেই আগেকার মতো। আর কেবল থুতু ফেলে।

কিরণের মা জিজ্ঞেস করে–কিরণের কিছু খবর জানো বাবা?

দীপঙ্কর বলে–কিরণকে খুঁজতেই তো এসেছি আমি মাসীমা-কিরণ নেই?

কিরণের মা’র অভিযোগও নেই, আবার অভাবও নেই যেন পৈতে কাটা ছেড়ে দিয়েছে তখন কিরণের মা। কাঁথা সেলাই করে পরের বাড়ির কাজ করে সংসার চলছে তাদের। কিরণের মা বলে–তোমার সঙ্গে দেখা হলে তাকে একবার বাড়িতে আসতে বোলো তো বাবা।

আর সেই প্রাণমথবাবু পান খান ঠিক তেমনি করে। বলেন–তোমার নামটা ভুলে গেছি বাবা

–আমি দীপঙ্কর!

–ও, কেমন আছ বাবা? তোমার মা কেমন আছে? পঞ্চানন সিংহী মশাইকে আমার কথা বলো, বুঝলে?

সেই সদাহাস্য মুখ, সেই সহানুভূতি-মেশানো দৃষ্টি, সেই দেশসেবা। নিজের হাতে টাকা ক’টা দিতেই দীপঙ্কর আবার প্রণাম করতো পায়ে হাত দিয়ে। আর তারপরেই প্রাণমথবাবু তাঁর নিজের কাজের মধ্যে ডুবে যেতেন। কলকাতার বড় বড় কংগ্রেসের নেতারা এসে তাঁর চারদিকে ঘিরে থাকতেন। মাঝে মাঝে মামীমাও থাকতেন। এই সমস্ত ভালো-মন্দ নিরপেক্ষ সমস্ত চরিত্রের মধ্যে দীপঙ্কর যেন মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলতো। মনে হতো কোন্‌টা ঠিক, কোন্ পথটা আসল। লক্ষ্মীদি না দাতারবাবু, না কিরণ, না অঘোরদাদু, না প্রাণমথবাবু! কে? কে সবচেয়ে সত্যি? কে সবচেয়ে আসল?

কালীঘাটের বাজারের কাছ থেকে পালা-কীর্তনের খোলের শব্দ আসছে। দক্ষিণ দিক থেকে শ্মশানের চিৎকারও মাঝে মাঝে ভেসে আসে। কাল লক্ষ্মীদির কাছে গিয়ে খবরটা দিয়ে আসতে হবে। সতী টাকা পাঠাবে বলেছে। গিয়েই পাঠিয়ে দেবে। কিরণের ঠিকানায় মনি-অর্ডার করে পাঠিয়ে দেবে। আর কিছুদিন সবুর করতে হবে। মাত্র আর ক’টা দিন। তারপর থেকে দাতারবাবুকে আর লুকিয়ে লুকিয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে না, তখন পাওনাদারদের ভয়ে লক্ষ্মীদিকে আর দরজার খিল বন্ধ করে থাকতে হবে না–। আর তারপর সন্ধ্যেবেলা কিরণ আসবে। কিরণের ভজুদা এসেছে নেপাল থেকে। সেই ভজুদা। সেই ভজুদার কাছে কিরণ নিয়ে যাবে দীপঙ্করকে।

হঠাৎ মনে হলো দরজায় কে যেন টোকা দিলে।

–কে?

সাড়া নেই।

দীপঙ্কর বললে– কে?

সদর দরজায় তো খিল দেওয়া। এত রাত্রে কে দরজা ঠেলবে!

–কে?

–আমি!

দীপঙ্কর বললে–আমি! আমি কে?

আর কোনও সাড়াশব্দ নেই। দীপঙ্কর বিছানা ছেড়ে উঠলো। তারপর অন্ধকারের মধ্যেই হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে গিয়ে দরজার খিলটা খুলে দিলে।

খিলটা খুলতেই দীপঙ্কর বললে–সতী!

সতী সেই অন্ধকারের মধ্যেই যেন সঙ্কুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বেশ কুণ্ঠিত ভাব। যেন বাধ্য হয়েই সে অত রাত্রে এস দীপঙ্করের দরজা ঠেলেছে। দরজা ঠেলে যেন সে অপরাধ করে ফেলেছে।

–সতী, তুমি? মা তো নেই বাড়িতে–মা যে যাত্রা শুনতে গেছে–

সতী চাইল দীপঙ্করের দিকে মুখ তুলে। বেশ মনে আছে সে রাত্রে সতী যেন বড় সোজাসুজি তার দিকে চেয়ে ছিল খানিকক্ষণ। সেই ছায়াচ্ছন্ন রাত–হ্যাঁজি কাশিমের বাগানের নারকেল গাছটার আড়ালে একটা খণ্ড চাঁদ তখন সবে আত্মগোপন করছে। দীপঙ্করের যেন ভয় ভয় করতে লাগলো। সতীর সামনে দীপঙ্কর কতবার এ-রকম মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এমন ভয় কখনও হয়নি আগে।

দীপঙ্কর আবার বললে–মা’র সঙ্গে বুঝি তোমার কোনও কথা ছিল?

সতী মাথা নাড়লো। বললে–না, তোমার সঙ্গে–

–আমার সঙ্গে?

সতী বললে–তোমার খুব লেগেছে, না? দেখি?

দীপঙ্করের যেন কান্না পেতে লাগলো হঠাৎ। বললে–হ্যাঁ এই দেখ না, ফুলেছে কেমন, খুব ব্যথা করছে–

–তুমি কিছু মনে কোর না যেন দীপু, আমার মাথার ঠিক ছিল না। আমার খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল তখন–

বলে সতী থামলো। তারপর বললে–আমার তখন থেকে মোটে ঘুম আসছিল না– এই কথাটা বলতেই এসেছিলাম, আমি যাই–

বলে সতী সত্যি সত্যিই বারান্দা দিয়ে নিচে উঠোনে গিয়ে নামলো। অন্ধকারে ছায়া ছায়া মূর্তিটা উঠোন পার হয়ে আমড়া গাছের তলা দিয়ে কাকাবাবুদের খিড়কির দিকে এগোচ্ছিল। দীপঙ্কর প্রাণপণে ডাকতে গেল–সতী–সতী

হঠাৎ নিজের চিৎকারে নিজেরই ঘুম ভেঙে গেছে দীপঙ্করের। আগস্ট মাসের গুমোট। সমস্ত বিছানাটা ঘামে ভিজে গেছে। দীপঙ্কর বিছানার ওপর শুয়ে শুয়েই চারদিকে চেয়ে দেখলে। আশ্চর্য তো! অথচ একটু আগেই তার স্পষ্ট মনে হয়েছিল যেন সতী এসেছিল তার ঘরে! এখনও যেন ঘরের ভেতরে সতীর গায়ের পাউডারের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। আশ্চর্য তো! এমন আশ্চর্য স্বপ্নও মানুষে দেখে!!

২১

ঘুম ভেঙে গেছে তখন। বাইরে বেশ যেন রোদ উঠেছে। তবু চোখ খুলতে দীপঙ্করের বড় কষ্ট হচ্ছিল। বেশ চোখ বুজে প্রথম রাতের স্বপ্নটা আবার দেখতে যেন ইচ্ছে করছিল। যেন সত্যিই সতী এসেছে। যেন সতী এসে দরজায় টোকা দিলে। যেন দীপঙ্কর আবার তেমনি জিজ্ঞেস করলে-কে? আবার যেন একটা উত্তর এল- আমি।

–আমি, আমি কে?

আবার যেন দীপঙ্কর দরজা খুলে দিলে। আর সামনেই যেন মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল সতীর সঙ্গে। আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত যেন আবার স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগলো। আবার চোখ বুঝলো দীপঙ্কর। মনে হলো কেন এত সকাল-সকাল ঘুম ভেঙে যায় ৷ কেন রাত এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। দীপঙ্কর চোখ বুজে বুজেই জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। যদি এখনও সেই পাউডারের গন্ধটা ভেসে বেড়ায়?

–দীপু, ও দীপু–দীপু–কত বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছিস–ওঠ–ওঠ–

দরজা খুলে বাইরে এসে সেদিন যেন একেবারে বাস্তব জগতের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল। রাত্রের জগতের সঙ্গে কী বিরাট তফাত! রোদ উঠে খাঁ-খাঁ করছে সারা উঠোন। সামনেই সতীদের বাড়িটা। জানলাগুলো বন্ধ। রোদের জন্যে বোধহয় বন্ধ করে দিয়েছে। ও বাড়িটার দিকে চাইতেই আবার রাত্রের স্বপ্নের কথাটা মনে পড়লো। মনে পড়লো আগের সন্ধ্যেবেলার ঘটনাটাও। লক্ষ্মীদির কথাটাও মনে পড়লো। ছ হাজার টাকা চাওয়ার কথাটাও মনে পড়লো। এক ঘুমে যেন দীপঙ্কর এক যুগ অতিক্রম করে এসে গেছে। যেন অনেক বড় হয়েছে দীপঙ্কর। এক রাত্রের মধ্যেই যেন অনেক অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে সে।

মা বললে–শিগগির শিগির তৈরি হয়ে নাও, আজ তোমাকে যেতে হবে–আমি ন’টার মধ্যে ভাত করে দিচ্ছি–

দীপঙ্কর তখনও জানতো না যে, সেইদিনই তার চাকরি হবে।

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কিন্তু টাকা! পঁচিশটা টাকা তুমি দিয়েছ নাকি নৃপেনবাবুকে মা?

মা বললে–টাকার কথা তোমায় ভাবতে হবে না, সে–ভাবনা আমার–

তারপর আপন মনেই মা গজ্ গজ্ করতে লাগলো–রেলের চাকরি, রেলে উঠতে পয়সা লাগবে না, সেই চাকরিও ছেলের পছন্দ নয়–কত লোক পঞ্চাশ-ষাট টাকা দিতে তৈরি, নেহাত গরীব বিধবার ছেলে বলে চাকরি করে দিচ্ছেন–তাতেও ছেলের গরজ নেই–যেন যত গরজ আমার–

তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া করে নিতেই মা বললে–চলো, এখন আমার সঙ্গে চলো– মা-ও একটা ফরসা কাপড় পরে নিয়েছে। একেবারে সোজা অঘোরদাদুর ঘরে। মা গিয়ে বললে–বাবা, আজ আপনার দীপু চাকরি করতে যাচ্ছে–

অঘোরদাদু কুশাসনের ওপর বসে মালা জপ করছিলেন। বললেন–কই? মুখপোড়া কই? কোথায় গেল সে?

দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি গিয়ে একেবারে পায়ে হাত ঠেকিয়ে মাথায় ঠেকালে। বললে– এই যে অঘোরদাদু

–চাকরি হলো মুখপোড়ার? মুখপোড়ার গতি হলো তাহলে?

–বলে অঘোরদাদু হাতটা বাড়িয়ে যেন দেখতে চাইলেন তার মুখটা।

মা বললে–আশীর্বাদ করুন বাবা, দীপু যেন আমার চাকরিতে টিকে থাকে, সায়েবদের মন পায়–

অঘোরদাদুর কী হলো কে জানে! হঠাৎ যেন আর্তনাদ করে উঠলেন। বললেন– ওরে, আমি দেখতে পাচ্ছি না চোখে, মুখপোড়ার মুখ দেখতে পাচ্ছি না যে—

-–তা হোক, আপনি হাতখানা দীপঙ্করের মাথায় ঠেকিয়ে দিলেই হবে—

অঘোরদাদু বলে উঠলেন–তাই কখনও হয় মেয়ে, দেখতে না পেলে কি আশীর্বাদ ফলে? মুখপোড়া মেয়ে কী যে বলে!

তারপর দীপঙ্করের মাথাটা টেনে নিয়ে বলতে লাগলেন–কেন বড় হলি মুখপোড়া! কেন বড় হলি? বেশ তো ছিলিস, ছোট ছিলিস, কেন বড় হতে গেলি, এবার চাকরিতে ঢুকছিস্, বুঝবি বড় হওয়ার ঠেলাটা–যা মুখপোড়া যা–

মা বললে–আপনি আশীর্বাদ করলেন না?

অঘোরদাদু বললেন–মুখপোড়া মেয়ের কথা দেখ, আমার আশীর্বাদ কি ফলে? চোখের সামনে জলজ্যান্ত দেখছিস না, জ্বল জ্বল করছে আশীর্বাদ দুটো–এর পরেও মুখপোড়াকে আশীর্বাদ করতে বলিস, তুই? আশীর্বাদ করে মুখপোড়ার সর্বনাশ করবো বলতে চাস?

খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে দীপঙ্কর কথাগুলো শুনলো। আজকাল অঘোরদাদুর কথাগুলো যেন কেমন ভিজে ভিজে লাগে। কথাগুলো মুখ খিঁচিয়ে বলেন অঘোরদাদু, কিন্তু মনে হয় যেন নিজেকেই মুখ খিঁচোচ্ছেন। সংসারের এতদিনকার যত জমানো বিরাগ সমস্তযেন অঘোরদাদু আজকাল নিজের দিকেই ছুঁড়ে মারছেন।

নৃপেনবাবুর সঙ্গেই আপিসে যেতে হলো। তিনি নিজে নিয়ে গেলেন। বাস থেকে নেমে আপিসটার চেহারা দেখেই কেমন যেন সমস্ত শরীর সির সির করে উঠলো। এত বড় বাড়ি, লাল রং। বাড়িটার কোটরে কোটরে অসংখ্য মানুষের মাথা দেখা যাচ্ছে বাইরে থেকে। লম্বা লম্বা বারান্দা, জানলার ওপারে আরো অনেক মানুষ আছে নিশ্চয়ই। বাড়িটা দেখেই মানুষের সংখ্যা কল্পনা করা যায়। পাগড়ি-পরা চাপরাশী বেয়ারারা এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছে। হঠাৎ যেন দীপঙ্করের বড় ভয় করতে লাগলো। সারাজীবন, প্রতিদিন, প্রতিটি দুপুর এইখানেই কাটাতে হবে। এর ভেতরে! তার চাকরি হচ্ছে, মা’র অনেক দিনের সাধ-আশা পূর্ণ হতে চলেছে, যে-সে আপিস নয়, সরকারী আপিস, গবর্নমেন্ট আপিস–একবার যেখানে ঢুকতে পারলে সারা জীবনের জন্যে আর চাকরি যাবার ভাবনা থাকে না-তার তো আনন্দ হওয়াই উচিত ছিল সেদিন! মনে আছে নৃপেনবাবু তার দিকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন–কী হলো তোমার? পায়ে ফোস্কা হয়েছে নাকি?

–আজ্ঞে না।

–তাহলে শরীর খারাপ?

–কই, না তো!

–তাহলে, অমন মন-মরা দেখাচ্ছে কেন? একটা কথা তোমায় বলে রাখছি, এই বাবুরা, কিম্বা চাপরাশী, কী কম্পাউন্ডার যদি কিছু চায় তো দেবে না–

দীপঙ্কর বললে–কী চাইবে?

–এই ধরো টাকাটা সিকেটা যদি চায় পান খেতে কি চা খেতে তো আমার নাম করে দেবে, বুঝলে?

সমস্ত জিনিসটা যেন একটা যান্ত্রিক নিয়মে হয়ে গেল। এস্ট্যাবলিশমেন্ট সেকশন থেকে শুরু করে হাসপাতাল, মেডিক্যাল একাজামিনেশন পর্যন্ত অনেকবার নিজের নাম ধাম-কুলুজির পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়ে গেল। সবাই এক-একবার করে জিজ্ঞেস করলে– কার লোক আপনি?

দীপঙ্কর বললে–নৃপেনবাবুর। ট্রাফিক আপিসের সুপারভাইজার

আর কিছু বলতে হলো না। নৃপেনবাবু দুদিন বাদেই রিটায়ার করবেন। অনেক দিনের লোক! যখন ঢেঁড়া পিটিয়ে কেরানী আনতে হতো, সেই আমলের। তখন রেলের আপিসে ভদ্রলোক ঢুকতো না। ওখানে বিদ্যার তেমন দরকার নেই, বুদ্ধি না থাকলেও কাজ চলে। ওখানকার ইংরিজী আলাদা, ওখানকার চালচলন আলাদা। কারোর সঙ্গে মেলে না। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে কবে ক’টা কোম্পানী মাটি আর পাথর কেটে কেটে দেশের বুক চিরে লোহার লাইন বসিয়ে মোটা মুনাফার পাকা বন্দোবস্ত করতে এসেছিল–সাদা চামড়ার সেই সব কর্মচারীরা এদেশের লোকদের হাতে খড়ি দিলে, অ-আ-ক-খ শেখালে, কবে সব ঘটনা ঘটলো, তার কোনও হদিস-হিসেব কোনও মিউজিয়ামে পাওয়া যাবে না। কিন্তু পাওয়া যাবে রেল আপিসে রেকর্ড সেকশনে। একদিন কোন্ সাহেব ড্রাফট লিখেছিল খাগের কলমে–কোন্ সাহেব মোটা পেন্সিল দিয়ে দুর্বোধ্য নোট দিয়েছিল কোন্ ফাইলে, রেলের আপিসে তা চিরস্থায়ী বেদ-বাক্য হয়ে আছে, রেলের বিধানে তা গীতা, গীতার মতোই অবশ্যপাঠ্য, গীতার মতোই তা অবশ্যপালনীয়! ইংরিজী গ্রামারের আইন-কানুন রেলের জন্যে ভারি উদার। নেসফিল্ড সাহেব যদি রেলের আপিসে চাকরি পেতেন তো হয়তো ঘেন্নায় আত্মহত্যাই করতেন–কারণ রেলের বৈয়াকরণেরা খাস বিলেতের জাত রেলওয়েম্যান–আর নেসফিল্ড সাহেব নেহাতই ইংরিজী-নবিস!

প্রথম প্রথম দীপঙ্কর একটু ঘাবড়ে যেত কে-জি-দাশবাবু ডি গ্রেডের সুপারভাইজার তখন। বলতেন–ওহে, এ তোমার ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি নয়, এ হলো রেল কোম্পানী–

দীপঙ্কর বলতো–তা রেল কোম্পানী বলে কি ইংরিজীটাও আলাদা?

কে-জি-দাশবাবু ভয়ানক চটে যেতেন তর্ক করলে। বলতেন–আবার তর্ক করছো তুমি? দেখছো অস্ব সাহেবের নিজের হাতে ড্রাফট–এই দ্যাখ–বল কে-জি-দাশবাবু ফাইলের তলায় তিরিশ বছর আগের ফোলিও বার করে অর সাহেবের দেব-হস্তের লেখা দেখিয়ে দিতেন। আর সগর্বে সগৌরবে লেখাটার দিকে চেয়ে থাকতেন খানিকক্ষণ হস্তলিপি দেখছেন না তিনি, যেন দুর্লভ দেব-দর্শন করছেন। তারপর বলতেন–তোমরা তো কিছু পড়াশোনা করবে না। কেন, ছুটির পর এগুলো পড়তে পারো না-ছুটির পর বাড়ি না গিয়ে একটু লেট্‌ আওয়ার্স থেকে যদি এই ফাইলগুলো পড়ো তো তাতেও কত উপকার হয়, কত জিনিস শিখতে পার–কিন্তু তা তো করবে না তোমরা

নৃপেনবাবুর কাছে যেতেই তিন বললেন–কী হলো? খাতায় নাম উঠে গেছে?

দীপঙ্কর বললে– হ্যাঁ–জার্নাল সেকশনে বসিয়ে দিয়েছে–

–চেয়ার টেবিল পেয়েছ?

–হ্যাঁ, কিন্তু বড্ড ছারপোকা চেয়ারগুলোতে–

নৃপেনবাবু রেগে গেলেন। বললেন–ওই তোমাদের বড় দোষ, একটু ছারপোকাও থাকবে না? আর ছারপোকা থাকলেই বা, এখানে তো শুতে আসছো না! তোমার চাকরি করে দিতে হবে আবার ছারপোকাও মেরে দিতে হবে নাকি আমাকে?

নৃপেনবাবু রাগ করে মুখটা গম্ভীর করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন–যাও, রেকর্ড সেকশন থেকে একটা পিচবোর্ড নিয়ে পেতে বোসোগে যাও–

প্রথম দিন কে-জি-দাশবাবুর কী দয়া হলো কে জানে! বললেন–আজকের দিনটা সকাল-সকাল বাড়ি যান–কাল সাড়ে দশটায় ঠিক আপিসে আসবেন–

প্রথমে মনে হলো কথাটা যেন শুনতে ভুল হয়েছে। কিন্তু পাশের গাঙ্গুলীবাবু বললেন –যান না সেনবাবু, বড়বাবু যখন বলছেন বাড়ি যান না–

সাত-সকালে আপিসে ঢোকা থেকে শুরু করেই দীপঙ্করের মনটা কেমন বিষিয়ে ছিল। এই এত বড় বাড়ি, এই এত লোক, এই এত ফাইল, তারপর এই এত ছারপোকা–সমস্ত কিছু যেন দম বন্ধ করে দিয়েছিল তার। এই এর জন্যেই এতদিন পরিশ্রম করেছে নাকি সে? এই চাকরির জন্যেই এত কার্লাইল, এত শেকস্পীয়র, এত জর্জ দি ফোর্থ পড়েছে নাকি? এতদিন ধরে এর যোগ্যতা অর্জন করতেই তার মাকে দাসীবৃত্তি করতে হয়েছে? তেত্রিশ টাকা! তেত্রিশ টাকার যোগ্যতার জন্যে এত পরীক্ষা, এত পাশ, এত নোট লেখ! কোথায় গেল সেই রুশো, সেই কার্ল মার্ক্স, সেই কান্ট হেগেল নিটশে সোপেনহাওয়ার! তারা সবাই যেন এখানে এসে এই ছারপোকার রাজ্যে মরে পচে পিষে থেঁতলে গুঁড়িয়ে গেছে। তাদের সব আত্মারাই যেন এখানে এসে অর্ন সাহেব, কে-জি-দাশবাবু, গাঙ্গুলীবাবুতে পরিণত হয়ে গেছে এক মুহূর্তে। মনে হলো অমলবাবুর অত লেকচার, প্রাণমথবাবুর সব টাকা যেন এক নিমেষে জল হয়ে গেল। দীপঙ্কর জার্নাল সেকশনের চারটে দেয়ালের মধ্যে বসে বসে কাঁদতে লাগলো। মনে পড়লো সক্রেটিসের কথাটা– To a good man, whether alive or dead, no evil can happen, nor are the gods indifferent to his well being. দীপঙ্কর তো কারো কোনও ক্ষতি করেনি, কারো ওপর কখনও কোনও অন্যায় করেনি। তাহলে কেন সে এই জার্নাল সেকশনে এল, কেন সে এত জায়গা থাকতে রেল কোম্পানীর এই আড়তে এসে হাজির হলো। কোথায় রইল তার ভগবান, কোথায় রইল তার ভালত্ব।

কাজ করতে করতে গাঙ্গুলীবাবু একবার বললেন–আপনি তো বি-এ পাস, না? ভদ্রলোকের ছেলে হয়ে এখানে এলেন?

দীপঙ্কর কেমন অবাক হয়ে গেল। বললে–তা আপনি কেন এলেন?

–আমার কথা আলাদা–

দীপঙ্কর বললে–আলাদা কেন?

গাঙ্গুলীবাবু বললেন–সে আর একদিন বলবো- আপনি ছুটি পেয়ে গেছেন, বাড়ি চলে যান–

প্রথম দিন। চাকরির প্রথম দিনটা দীপঙ্করের মনে থাকবে। যেমন মনে থাকবে লুকিয়ে লুকিয়ে লক্ষ্মীদির নাচ দেখা। যেমন আরো মনে থাকবে সতীর চারটে পয়সা ছুঁড়ে দেওয়া। সমস্ত জায়গাটা যেন গম্ গম্ করছে। পুরোন ফাইল আর জার্নালের গন্ধ। গন্ধ নয় দুর্গন্ধ। আর তার সঙ্গে ধুলো। একশো বছরের ঘুমন্ত ধুলো। দীপঙ্কর দৌড়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। কয়েকটা গুর্খা দারোয়ান পাহারা দিচ্ছে উর্দি পরে। এত জাঁকজমক করে পাহারা দিচ্ছে কাদের? ওই সাদা চামড়া সাহেবদের, না ওই ফাইল ধুলো আর ছারপোকাদের! না ওই কেরানীদের?

আশ্চর্য, মাত্র একটা দাসখতে দীপঙ্কর হাজার হাজার লাখ লাখ কেরানীর একজন হয়ে গেল এক মুহূর্তে।

দুপুর বেলা। রাত্রের স্বপ্নটার কথা আবার মনে পড়লো। সতী নিজে এসেছিল। নিজে ক্ষমা চেয়ে গেছে। চড় মেরেছে বলে মাফ চেয়ে গেছে। সেই দুপুর বেলার পিচ গলানো রাস্তার ওপরেই যেন হঠাৎ গভীর রাত নেমে এল। ঝাঁ-ঝাঁ-করা রোদ্দুর যেন এক নিমেষে মিলিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। দীপঙ্করের মনে হলো দক্ষিণের হাওয়ার সঙ্গে সতীর গায়ে মাখা পাউডারের গন্ধ আবার ভেসে এল হঠাৎ।

মোড়ের মাথায় হঠাৎ একটা চিৎকারে যেন চমক ভাঙলো দীপঙ্করের।

–ধরমতলা, বৌবাজার, শেয়ালদা, শ্যামবাজার।

দীপঙ্কর চেঁচিয়ে উঠলো–রোকে, রোকে

বাসটা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল আর-একটু হলে। দৌড়ে উঠে ভেতরে গিয়ে বসলো দীপঙ্কর। এতক্ষণ মনেই ছিল না। সমস্ত দিনটা যেন বিশ্রী কেটেছে। সেই নৃপেনবাবু, নৃপেনবাবুর উপদেশ, আর কে-জি-দাশবাবুর ড্রাফ্ট আর বস্তপচা ফাইল আর জার্নাল। ইস্কুল-কলেজও এত খারাপ লাগেনি কখনও। সেখানে ভাঙা ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল ইস্কুল, কালীঘাট হাই স্কুল, সাউথ সাবার্বন কলেজ–বাড়ি হিসেবে কোনওটাই ভালো নয়। সেখানেও লক্ষ্মণ সরকার ছিল, ফটিক ছিল, কলেজের মধেও কত ছেলে ছিল। তারা হাজরা পার্কের ভেতরে বসে পশ্চিম দিকের বাড়িগুলোর দিকে চেয়ে কত রকম মন্তব্য করতো সিগারেট খেতে বিড়ি খেত। চার বছরের কলেজ জীবনে কারো সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা করতে পারেনি দীপঙ্কর। ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল ইস্কুলের পরে আর কোনও ইস্কুলকেই ভালোবাসতে পারেনি।

মনে আছে প্রফেসাররা লেকচার দিয়ে যেতেন আর ক্লাস শেষ হয়ে গেলেই চলে যেতেন। কারো সঙ্গেই তেমন ব্যক্তিগত আলাপ হয়নি। এক অমলবাবু ছাড়া। বড় লজ্জা করতো। বড় লজ্জা করতো ক্লাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে। ক্লাসের এক কোণ থেকে লেকচার শুনে আবার সকলের শেষে বেরিয়ে চলে আসতো। কিন্তু সেদিন অনেক দ্বিধা-সংকোচ এড়িয়ে লাইব্রেরীর মধ্যে ঢুকেছিল দীপঙ্কর। ওদিকে জগৎহরিবাবু তখন ছেলেদের কাছ থেকে মাইনে নিচ্ছেন।

–স্যার!

অমলবাবু ফোর্থ ইয়ারের ক্লাস করে এসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলেন তখন। এদিকে নজর ছিল না। দীপঙ্কর ডাকতেই চোখ তুললেন।

বললেন–কী চাও?

দীপঙ্কর বললে–আমার নাম দীপঙ্কর সেন, আপনি আমায় দেখা করতে বলেছিলেন লাইব্রেরীতে–

কিছুই মনে পড়লো না অমলবাবুর। বললেন–কী জন্যে বলো তো? আমার তো কিছু মনে পড়ছে না–

দীপঙ্কর সমস্ত খুলে বললে। কেন ভালো লোক, সৎ লোক কষ্ট পায় সংসারে। জানাশোনা যত লোক আছে, তাদের মধ্যে যারা ভালো লোক, সবাই কষ্ট পাচ্ছে স্যার। অত্যাচার, অন্যায়, পীড়ন সব সহ্য করতে হচ্ছে। তবে কি সক্রেটিসের কথা সব মিথ্যে?

অমলবাবু কথাটা শুনে দীপঙ্করের আপাদমস্তক আবার দেখে নিলেন।

বললেন–মনে পড়েছে, কিন্তু এতদিন কলেজে পড়াচ্ছি, কেউ আগে আমাকে এ প্রশ্ন করেনি! তুমি এর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা চাও, না ইকনমিক ব্যাখ্যা চাও?

দীপঙ্কর চুপ করে রইল।

অমলবাবু বললেন–বুঝেছি–তবে শোন–

অমলবাবু লাইব্রেরীর সেই অন্ধকার ঘরে বসে সেদিন যে-ব্যাখ্যা করেছিলেন সেটা আজও মনে আছে দীপঙ্করের। আজ অমলবাবু মারা গেছেন। কোথায় গেছেন অমলবাবু, কোথায় গেছে সেই সাউথ সাবার্বন কলেজ। সে-বাড়িও নেই, সে-কলেজও নেই আর। তবু কথাগুলো মনে আছে।

সে দক্ষিণেশ্বরের কথা। পরমহংসদেব তখন বেঁচে। এগারো শ’ ক্রোশ দূর থেকে এক সাধু এসেছেন। দক্ষিণেশ্বরে এসে স্বামী বিবেকানন্দকে জিজ্ঞেস করলেন–আচ্ছা বলুন তো ভক্তের এত দুঃখ কেন?

বিবেকানন্দ বললেন–The scheme of the universe is devilish, I could have created a better world–

সাধু বললেন–তা দুঃখ না থাকলে সুখ বুঝবেন কী করে?

তখন বিবেকানন্দ বললেন–Our only refuge is in Pantheism–সবই ঈশ্বর–এই বিশ্বাসটুকু হলেই সব ল্যাটা চুকে যায়–আমিই সব করছি–

অমলবাবু বললেন–আমি ইতিহাস পড়াই, ইতিহাসেরও একটা দিক আছে, ভারি ইম্পর্ট্যান্ট দিক–সেটা শোন–

–এ তার অনেক পরের কথা। উনিশশো পাঁচ সালের কথা। একদিন কয়েক হাজার লোক সবিনয়ে এক দেশের রাজার বাড়ির সামনে গিয়ে দরবার করলে। গেটের সামনে বন্দুক নিয়ে পাহারা দিচ্ছিল সেপাই-সান্ত্রী–তারা জিজ্ঞেস করলে–কী চাই?

লোকরা বললে–হুঁজুরের কাছে আমরা একটা দরখাস্ত পাঠাতে চাই–

দরখাস্তখানা রাজার কাছে নিয়ে গেল তারা। অতি বিনীত দরখাস্ত। দরখাস্তে লেখা ছিল–

“We come to thee Sire, to seek truth and redress. We have been oppressed, we are not recognised as human beings, we are treated as slaves, who must suffer their bitter fate and keep silence. The limit of patience has arrived, Sire, is this in accordance with the divine law, by grace of which thou reignest? It is not better to die, better for all the toiling people, and let the capitalist, the exploiters of the working class live? Do not refuse assistance to thy people. Destory the wall between thyself and thy people and let them rule the country with thyself.”

খানিক পরেই ওপরের বারান্দা থেকে, বলা নেই কওয়া নেই তাদের ওপর গুলি চলতে লাগলো। গুলির ওপর গুলি। সেই হাজার হাজার নিরীহ লোকের ওপর লক্ষ লক্ষ গুলির ঝাঁক এসে পড়তে লাগলো। হাজারে হাজারে মরে পড়লো লোক, কাতরাতে লাগলো, ছটফট করতে লাগলো যন্ত্রণায়–

আর মজা এই, ঠিক তার বারো বছর পরে ঠিক সেই বারান্দা থেকেই ১৯১৭ সালে একদিন আর একজন লোক হাজার হাজার লোকের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন– Comrades-Feeding people is a simple task. We will take from the rich and give to the poor. Take milk from the rich and give to the childeren of the workers. He who does not work shall not eat. Workers receive cards. Cards bring food.

আগের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যিনি গুলি ছুঁড়েছিলেন, তিনি হলেন রাশিয়ার জার আর শেষে যিনি বললেন, তিনি লেনিন।

আরো অনেক কথা কী-সব বলেছিলেন অমলবাবু, সব ভালো বুঝতে পারেনি দীপঙ্কর। বেশি সময়ও ছিল না। ক্লাসের ঘন্টা পড়তেই অমলবাবু চলে গিয়েছিলেন। যাবার সময় বলে গিয়েছিলেন–পরে তোমাকে এ-সম্বন্ধে আরো অনেক কথা বলবো কিন্তু তখন কী দীপঙ্কর জানতো সেই অমলবাবু এত শিগগির চলে যাবেন– কিন্তু আর একদিন মাত্র এ-নিয়ে কথা হয়েছিল অমলবাবুর সঙ্গে। তখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর নতুন বি-এ ক্লাসে ঢুকছে। চুপ করে বসেচিল দীপঙ্কর এক কোণে।

–রোল সেবেনটি-থ্রি-রোল সেবেনটি-থ্রি–দীপঙ্কর সেন—

দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে উঠে উত্তর দিলে–ইয়েস স্যার–

অমলবাবু হঠাৎ প্রশ্ন করলেন–তুমি তোমার সেই কোশ্চেনের উত্তর পেয়েছ?

দীপঙ্কর কী বলবে ঠিক করতে না পেরে বললে–এখনও ঠিক পাইনি স্যার—

অমলবাবু বললেন–পাবে পাবে, এর উত্তর কারো কাছে জিজ্ঞেস করলে পাবে না, জীবন দিয়ে ওর সন্ধান করতে হবে–তবে পাবে–

২২

–লক্ষ্মীদি!

বউবাজারের ঠিকানাটার সামনে এসে দীপঙ্কর ডাকলে–লক্ষ্মীদি–

ভেতর থেকে কেউ সাড়া দিলে না। ভেতরে নিশ্চয়ই কেউ আছে, নইলে খিল বন্ধ কেন? আস্তে আস্তে কড়াটা নাড়তে লাগলো। বললে–লক্ষ্মীদি, দরজা খোল, আমি দীপু–

তবু সাড়া নেই।

অনেকক্ষণ পরে, মনে হলো খুট্ করে যেন একটা শব্দ হলো। আর দরজাটা খুলে গেল সঙ্গে সঙ্গে। দীপঙ্কর ভেতরে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু লক্ষ্মীদির চেহারা এ কী হয়েছে! একদিনের মধ্যেই এমন হয়ে গেল!

লক্ষ্মীদি দরজাটা খুলে দিয়েই টলতে টলতে গিয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়লো। ময়লা বিছানা। ময়লা-চিট্‌ বালিশ। মাথার চুলগুলো রুক্ষ। যেন বড় ক্লান্ত–বিছানায় পড়েই ওপাশে মুখ ফিরিয়ে রইল!

দীপঙ্কর আস্তে আস্তে বিছানার কাছে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। লক্ষ্মীদি কিছু বললে না তো!

ডাকলে আস্তে আস্তে–লক্ষ্মীদি—

–উঁ–

-–তোমার কী হলো? শরীর খারাপ? জ্বর হয়েছে?

দীপঙ্কর লক্ষ্মীদির ফরসা কপালের ওপর হাত দিয়েই চমকে উঠেছে। বললে–একি? তোমার যে ভীষণ জ্বর লক্ষ্মীদি? এখন কী হবে?

লক্ষ্মীদি শুয়ে শুয়েই উঃ-আঃ করতে লাগলো। কোনও উত্তর দিলে না।

দীপঙ্কর বললে–তুমি তো দেখছি সর্বনাশ বাধিয়ে বসলে! এই একগা জ্বর নিয়ে এইরকম ভাবে পড়ে থাকবে এইখানে? কী হবে? কে দেখবে এখন?

–আমার কপালটা একটু টিপে দে তো দীপু–

দীপঙ্কর খাটের ওপর বসে লক্ষ্মীদির কপালটা টিপে দিতে লাগলো।

যেন খুব আরাম হতে লাগলো লক্ষ্মীদির। চোখ বুঝে বললে–আঃ, খুব আরাম হচ্ছে রে–

অনেকক্ষণ ধরে দু’হাত দিয়ে দীপঙ্কর কপালটা টিপতে লাগলো। আর লক্ষ্মীদি চোখ বুজে পড়ে রইল। এক সময়ে দীপঙ্কর বললে–দাতারবাবু আর আসেনি লক্ষ্মীদি?

লক্ষ্মীদি বললে–এসেছিল–কাল–অনেক রাত্তিরে–

তোমার অসুখের খবর জানে?

–দেখেছে, জ্বর এল তখন!

–কিন্তু তোমাকে এই অবস্থায় ফেলে চলে গেলেন? খুব তো আক্কেল? আজকেও আসবেন নাকি?

–কি জানি! কিন্তু সে-মানুষটাই বা কী করবে বল্–আঃ

দীপঙ্কর বললে–বাঃ, দাতারবাবুরই তো দোষ, তুমি মেয়েমানুষ, তোমাকে এখানে এই জ্বর অবস্থায় ফেলে তিনি চলে গেলেন। আমি হলে কিন্তু জেলই হোক আর পুলিসে ধরুক, তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারতুম না–তোমার অসুখ, এই সময়ে পুলিসের ভয়টাই বড় হলো–

লক্ষ্মীদি শুধু একটা শব্দ করলে মুখ দিয়ে। বললে–ছিঃ–

–তুমি ছিঃ বলছো, কিন্তু আমি এখন কী করি? কোথায় ডাক্তার, কোথায় ওষুধ, এ-সব কে করে? কে টাকা দেয়?

লক্ষ্মীদি কাঁদতে লাগলো। চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগলো। দীপঙ্কর সেই দিকে চেয়েই থেমে গেল। বললে–আমি দাতারবাবুর সম্বন্ধে আর কিছু বলবো না লক্ষ্মীদি, তুমি কেঁদো না, কিন্তু এখন আমি কী করি, বলো?

–তোকে কিছু করতে হবে না; তুই যেখানে থাকিস, সেখানে চলে যা, আমার যা হয় হবে।

দীপঙ্কর বললে–তুমি তো বললে বেশ, বলা তো সহজ, তোমাকে এই রকম একলা ফেলে চলে যেতে পারি?

-–তুই যা, যা তুই এখান থেকে, তোকে মাথা টিপতে হবে না–

বলে লক্ষ্মীদি দীপঙ্করের হাতটা ধরে ঠেলে দিলে।

দীপঙ্কর খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। বললে–তোমরা দুই বোনই দেখছি সমান– আচ্ছা বেশ, মাথা টিপবো না, বেশ তো যন্ত্রণা হোক না, আমার কী! তোমারই কষ্ট হবে!

তারপরে একটু চুপ করে থেকে বললে–যাকগে, কাল থেকে আমি আসবোই না আর–আমি তো না-আসতে পেলেই বেঁচে যাই–ভালো কথা বললেও যদি রাগ হয় তো আমি কী করতে পারি! এই যে কাল তোমার বোন আমাকে চড় মারলে–আমি সহ্য করলুম, কী করবো–

–বকর বকর করিস নি দীপু, একে আমার জ্বর, তার ওপর– দীপঙ্কর উঠলো। বললে–তাহলে আমি চলে যাই?

–যা–

–এবার গেলে কিন্তু আর আমি আসবো না বলে দিচ্ছি, তোমার অসুখ যদি বাড়াবাড়িও হয়, তবু দেখতে আসবো না এই বলে রাখলুম–

বলে দীপঙ্কর খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। দরজার দিকে এগিয়েও গেল। আবার বললে–যাই?

তবু লক্ষ্মীদি কিছু উত্তর দিলে না। দীপঙ্কর এবার কাছে সরে এল। বললে–তুমি দেখছি সত্যিই মুশকিলে ফেললে আমাকে! এদিকে আমি তোমার জন্যে সতীকে টাকার কথা বলে রাখলুম, তার জন্যে খুব দু’কথা শুনতেও হলো–শেষকালে অনেক কষ্টে রাজী হলো ছ’ হাজার টাকা দিতে–

–টাকা দেবে সতী?

–হ্যাঁ।

–তুই আমার কথা বলেছিস নাকি?

পাগল হয়েছ, তোমার কথা কখনও বলি! কিন্তু এখান থেকে তো দিতে পারবে না, বর্মায় পৌঁছে মনি-অর্ডার করে পাঠিয়ে দেবে, এই তো সামনের মঙ্গলবার চলে যাচ্ছে কিনা, সেখানে গিয়ে বলেছে যেমন করে হোক গয়না বেচেও টাকা পাঠিয়ে দেবে–

লক্ষ্মীদির মুখে যেন একটা ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠলো। বললে–দেবে বলেছে সত্যি?

–হ্যাঁ লক্ষ্মীদি। আমি তো অনেক করে রাজী করিয়েছি কালকে। রাজী কি সহজে হতে চায়! বলেছি ছ’ হাজার টাকা কোনরকমে দিতেই হবে। তোমার বোন তো সোজা লোক নয়! সন্দেহ করেছিল তোমাকে কিন্তু ওদের ধারণা হয়েছে তুমি আর কলকাতায় নেই–এদিকে আমারও এক মুশকিল হয়েছে–দিনের বেলা আর সময় পাবো না, চাকরি হয়েছে একটা আবার

–হয়েছে?

–হ্যাঁ, তেত্রিশ টাকা মাইনের চাকরি। সেইখানে থেকেই তো আসছি, সে এক বিচ্ছিরি চাকরি, তাই খুব মন খারাপ হয়ে আছে সকাল থেকে–একে চাকরির ঝঞ্ঝাট, তার ওপরে তোমার এই সময়ে জ্বর হলো, এখন কী করি বলো তো?

তারপর আরো কাছে সরে এল আবার। বললে–এখন জ্বরটা কেমন আছে দেখি?

কপালে হাত দিয়ে আবার দেখলে দীপঙ্কর। যেন একটু জ্বর কমেছে মনে হলো। বললে–একটু কম মনে হচ্ছে, কিন্তু যদি রাত্রে আবার বাড়ে?

এতক্ষণে লক্ষ্মীদির হাতের দিকে নজর পড়লো। বললে লক্ষ্মীদি, তোমার চুড়ি? হঠাৎ বাইরে একবার কড়া নাড়বার শব্দ হতেই

লক্ষ্মীদি বললে–ওই শম্ভু এসেছে, দরজা খুলে দে–

আশ্চর্য! দীপঙ্করও অবাক হয়ে গেল। লক্ষ্মীদি কী করে বুঝতে পারলে! তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিতেই দাতারবাবু ঢুকলেন। লক্ষ্মীদি বললে–তুমি? এমন সময়?

দীপঙ্কর কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দাতারবাবু সোজা এসে ঘরে ঢুকলেন। একবার দীপঙ্করের দিকেও চেয়ে দেখলেন। তারপর লক্ষ্মীদির দিকে এগিয়ে গেলেন। বললেন– তুমি কেমন আছ?

লক্ষ্মীদি বললে–কেন তুমি এলে? কেউ দেখতে পায়নি তো?

দাতারবাবু দীপঙ্করের দিকে চাইলেন আবার। বললেন–দীপুবাবু, তুমি কতক্ষণ?

দীপঙ্কর বললে–আপনি তো আমাকে বলেন নি লক্ষ্মীদি এখানে আছে–আপনার এ কি চেহারা হয়েছে?

দাতারবাবু হাসলেন কথাটা শুনে। দীপঙ্করের মনে পড়লো সেই আগেকার কোটপ্যান্টপরা চেহারাটা। এক মুখ দাড়ি গজিয়েছে। অনেক রোগা দেখাচ্ছে। গলার শিরগুলো যেন বেরিয়ে গেছে। সমস্ত চেহারাটায় যেন অভাব আর উদ্বেগের স্পষ্ট ছাপ। এমন তো হওয়া উচিত নয়।

লক্ষ্মীদি বললে–কিছু ব্যবস্থা হলো? কিছু খবর পেলে?

দাতারবাবু বললেন–তুমি ভেবো না, একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে দু-একদিনের মধ্যে। এক-এক করে আমি পার্টিদের সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করছি। বর্মায় আমার পুরোন পার্টিদের চিঠি লিখেছি–

দীপঙ্করের মনে আছে দাতারবাবুকে যেন বড় উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল সেদিন। যে-লোক বর্মায় একদিন ব্যবসা করতে গিয়ে সাফল্যের শিখরে উঠেছিল, সেই দাতারবাবুই আবার এখানে এই কলকাতায় এসে পথে বসতে চলেছে। এতদিনকার সমস্ত অভিজ্ঞতা, সমস্ত সঞ্চয় যেন তার নিঃশেষ হয়ে গেছে। বর্মায় ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আমল। পাঁচ গুণ দাম দিয়ে, দশ গুণ দাম দিয়ে তখন মাল বিক্রী করেছেন দাতারবাবু, তারপর এখানে এই ১৯৩০ সালের কলকাতায় পৃথিবীজোড়া হাহাকারের অবস্থা। ১৯২৯ সাল থেকেই শুরু হয়েছিল। জাহাজ আর আসে না কলকাতার জেটিঘাটে। যদিই-বা আসে, মাল নেই তাতে। কেনা-বেচা হয় সামান্যই। বড় বড় মার্চেন্ট আপিসে মাথায় হাত দিয়ে বসলো। মোটা মোটা ডিউটি বসলো মালের ওপর। আপিসে আপিসে লোক-ছাঁটাই হতে লাগলো। চাকরি যেতে লাগলো বহু লোকের। তার ওপর চাকরি আর হয় না করো ৷ চাল-ডালের দাম হু-হুঁ করে কমছে। কমবার সঙ্গে সঙ্গেই মাল বেচা বন্ধ করলে আড়তদার। ওদিকে ইংরেজদের দেশে পাউন্ডের বাজার দর কমিয়ে দিয়েছে। আমেরিকার শেয়ার মার্কেটে লগ্নীর কারবার হু-হুঁ করে পড়ছে। তখন বেচবার পালা। টাকা নেই, মাল নেই, কেনাবেচা নেই–সবাই হাত উঁচু করে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে বসে আছে। আকাল– আকাল এসেছিল পৃথিবীতে, সেই উনিশ শো তিরিশ সালে। সমস্ত ডালহৌসী স্কোয়ারের মার্চেন্ট আপিসগুলো কারবার গুটোবার কথা ভাবছে তখন। পটাপট্ ব্যাঙ্কের দরজায় তালা পড়ছে। অথচ ঠিক সেই সময়ে দীপঙ্কর যে কীভাবে হঠাৎ চাকরি পেয়ে গিয়েছিল সেইটেই এক আশ্চর্য ঘটনা।

দাতারবাবু বললেন–শেয়ারের দর হঠাৎ না পড়লে আমার এমন হতো না–আমি বুঝতেই পারিনি–

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কিন্তু এখন লক্ষ্মীদির কী হবে তা হলে? লক্ষ্মীদির এই জ্বর, আর ওদিকে আপনি বাড়িতে আসতে পারছেন না–বাড়িভাড়া খাওয়া-খরচ কোত্থেকে আসবে সব?

লক্ষ্মীদি ধুঁকতে ধুঁকতেই বকে দিলে। বললে–দেখছিস ভাবনায় অস্থির হচ্ছে মানুষ, তার ওপর তুই আবার ওই কথা বলছিস

দীপঙ্কর বললে–কিন্তু তোমাকে এখানে কে দেখবে বলো?

–তোকে অত ভাবতে হবে না।

লক্ষ্মীদি খুব রেগে গেল। দাতারবাবুকে বললে–তোমার নিজের শরীরটার দিকে নজর দিও–তোমার জন্যে আমার ভয় হচ্ছে–

দাতারবাবু আবার হাসলেন। কিছু বললেন না। বলবার যেন তাঁর আর মুখ নেই।

দীপঙ্কর বললে–আপনি হাসতে পারছেন দাতারবাবু, কিন্তু লক্ষ্মীদির অবস্থার কথাটা একবার ভাবুন, আসলে তো আপনিই দায়ী এর জন্যে!

–দীপঙ্কর!

দীপঙ্কর আরো গলা চড়িয়ে দিলে। বললে–তুমি আমাকে থামতে বোলো না লক্ষ্মীদি, আমি থামবো না দাতারবাবু জানেন না, কী সর্বনাশ তোমার করলে–এখন বাড়িতে যাওয়ার উপায়ও নেই, এখানে থাকারও উপায় নেই–এখন কী করবে তোমরা শুনি?

কথার উত্তরে দুজনেই কিছু বললে না। দীপঙ্কর দুজনের মধ্যে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলে–বলো শুনি, কী করবে তোমরা? আমি শুনে তবে যাবো এখান থেকে।

লক্ষ্মীদি কী যেন একটা বলতে যাচ্ছিল, দাতারবাবু থামিয়ে দিলেন– তোমাদের একদিন আমিই কত উপদেশ দিয়েছি, কত সান্ত্বনা দিয়েছি–কিন্তু আজ আমি স্বীকার করছি আমার ভুল হয়েছে–

–কিন্তু ভুল হয়েছে বললেই সব মিটে যাবে? একটা উপায় বার করতে হবে না? জানেন তো লক্ষ্মীদি কত বড়লোকের মেয়ে, কত আদরে কত আরামে মানুষ, এখন আপনার জন্যেই তো এই সর্বনাশ হলো!

দাতারবাবু ম্লান হাসি হাসতে লাগলেন। বললেন–সর্বনাশ কি শুধু আমাদেরই? সারা পৃথিবীর সর্বনাশ হয়ে গেছে যে, তার তো খবর রাখো না–জানো আমেরিকায় পাঁচ হাজার ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে গেছে, ইংল্যান্ডে পাঁচ লক্ষ লোক বেকার হয়েছে। ইটালীতে ছেলেরা চাকরি পাচ্ছে না বলে রাস্তায় রাস্তায় টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে–

দীপঙ্কর কোনও উত্তর দিতে পারলে না কিছুক্ষণের জন্যে।

লক্ষ্মীদি যেন সান্ত্বনা দেবার সুরে বললে–তুমি ওর কথায় কান দিও না, ও ছেলেমানুষ, ওর কথায় তুমি কিছু মনে কোরো না–দীপু, তুই যা এখন–

দীপঙ্কর বললে–কিন্তু তোমরা এখন কী করবে, তাই বলো?

লক্ষ্মীদি বললে–আমরা মরবো, না খেয়ে মরবো, তোর কী! তোর কী দরকার জেনে?

দাতারবাবু বললেন–না না, দীপু শোন, আমিও ভাবছি কী করা যায়, এ-রকম বিপদ এই প্রথম নয় জীবনে, আরো অনেক বিপদের জন্যেই তৈরি হয়ে আছি, তোমারও সামনে বড় জীবন পড়ে আছে, তোমারও অনেক ঝড়-ঝাঁপটা আসবে,–আমি টাকার চেষ্টায় আছি, টাকাটা যোগাড় করতে পারলেই সব বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে যাব, তোমার লক্ষ্মীদির জন্যে আমারও কম ভাবনা নেই–তোমার লক্ষ্মীদিকে আমি কোনও কষ্ট দেব না–

দীপঙ্কর বললে–আমি তো সেই টাকার কথা বলতেই এসেছিলাম

–টাকা? তুমি টাকা দেবে?

দীপঙ্কর বললে–দেব! আমার নিজের কোনও টাকা নেই, কিন্তু লক্ষ্মীদির জন্যে আমি সব-রকম চেষ্টা করেছি, কিন্তু একটু দেরি হবে। সতী বর্মায় যাচ্ছে, সেখান থেকে গিয়ে পাঠিয়ে দেবে বলেছে–

লক্ষ্মীদি বলে উঠলো–কবে যাচ্ছে সতী বৰ্মায়?

–মঙ্গলবার যাচ্ছে, আমি তোমার কথা কিচ্ছু বলিনি–শুধু বলেছি আমার দরকার।

দাতারবাবু বললেন–কে? সতী!

লক্ষ্মীদি বললে–হ্যাঁ, সতী ইচ্ছে করলে দিতে পারে, আর দীপুকে সতী একটু পছন্দও করে দেখেছি, দীপুর মা’র সঙ্গেও ভাব–আর সতীর নিজের গয়নাই যা আছে, তার দামই অনেক

দীপঙ্কর বললে–আর সতী যদি না-ও দেয় তো আমাদের অঘোরদাদুরও অনেক টাকা আছে, আর সিন্দুকটাও আমাদের ঘরেই থাকে–

কথাটা শেষ হবার আগেই দরজায় আবার কড়া নড়ে উঠলো। লক্ষ্মীদি ভয় পেয়ে গেল। দাতারবাবু বললেন–ওই, এসেছে–

বলে দাতারবাবু সোজা উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। একটা কোট-প্যান্ট পরা ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন।

দাতারবাবু তাকে নিজের মহারাষ্ট্রীয় ভাষায় কী যেন সব জিজ্ঞেস করলেন। দু’জনে সেই ভাষাতেই কিছুক্ষণ গড় গড় করে কথা হতে লাগলো। ভদ্রলোক এসে বসলেন একটা চেয়ারে, একবার দীপঙ্করের দিকে চেয়ে দেখলেন। দাতারবাবুরই স্বজাতি হয়তো। দাতারবাবুরই হয়তো বন্ধু কিংবা ভাই। বড় আড়ষ্ট হয়ে উঠলো দীপঙ্কর। এবার উঠে গেলেই ভালো হয়। সন্ধ্যেবেলা কিরণ আসবে। তার সঙ্গে যেতে হবে ভজুদার কাছে। এখনই বোধহয় বিকেল পার হয়ে গেছে বাইরে। লক্ষ্মীদি যেন একটু সুস্থ হয়েছে এখন। মুখ চোখ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। দীপঙ্কর লক্ষ্মীদির আরো কাছে সরে এল। বললে–লক্ষ্মীদি, এখন তোমার জ্বরটা কেমন?

লক্ষ্মীদি একমনে ওদের দিকে চেয়েই কথা শুনছিল। ওদের ভাষাও লক্ষ্মীদি বুঝতে পারে নাকি? দীপঙ্করের হঠাৎ বড় নিঃসঙ্গ মনে হতে লাগলো।

— লক্ষ্মীদি!

লক্ষ্মীদি এতক্ষণে মুখ ফেরাল। বললে–কী রে?

–এখন তোমার জ্বর আছে নাকি, দেখি?

দীপঙ্কর লক্ষ্মীদির কপালে হাত দিলে। জ্বরটা একটু কম মনে হলো। বললে–আর দিন কতক তুমি দাতারবাবুকে মুখ বুজে থাকতে বলো না, তার মধ্যে টাকাটা ঠিক এসে যাবে, সতী কথা দিয়েছে, সতী কথার খেলাপ করবে না,–টাকাটা এলেই আমি নিজে হাতে করে এনে দিয়ে যাব তোমাকে–

লক্ষ্মীদি বললে–শম্ভুও চেষ্টা করছে, তা তুই যদি এনে দিতে পারিস তো খুব উপকার হয় আমাদের–

দাতারবাবু এবার মুখ ফেরালেন এদিকে। বললেন–আচ্ছা দীপুবাবু তুমি তাহলে এখন এসো–তোমার দেরি হয়ে গেল–

দীপঙ্কর উঠলো। বললে–আমি আবার আসবো কিন্তু দাতারবাবু, আমি এসে দেখে যাব লক্ষ্মীদিকে–

নতুন ভদ্রলোকটিও দীপঙ্করের দিকে চেয়ে দেখছিল। লোকটাকে মোটে ভালো লাগছিল না দীপঙ্করের। যে-সে যখন-তখন লক্ষ্মীদির কাছে আসবে নাকি! ওরা তো জানে না লক্ষ্মীদি কত বড়লোকের মেয়ে। কত আরামের মধ্যে মানুষ, কত আদরের মধ্যে মানুষ! আজ লক্ষ্মীদির দুর্দশার মধ্যেই যে-সে দয়া দেখাতে আসছে। আর অত যদি দয়া তো ছ’হাজার টাকা দিয়ে দিলেই হয়। দীপঙ্কর যেমন চেষ্টা করছে, তেমনি চেষ্টা করো না, দেখি। তোমাদের কত দরদ, কত মুরোদ, তোমরা তো দীপঙ্করের চেয়ে বয়সে অনেক বড় অনেক বড়, চাকরি করো, তা এই বিপদের সময় সাহায্য করো না লক্ষ্মীদিকে! তা তো পারবে না, কেবল যখন-তখন ঘরের মধ্যে এসে গজর-গজর করতে পারবে। বাড়িভাড়াটাও দাও না দেখি মাসে মাসে।

–তাহলে আমি আসি লক্ষ্মীদি–

–আয়

রাস্তায় বেরিয়েও যেন কিছু ভালো লাগলো না। আরো অনেকক্ষণ থাকতে ইচ্ছে করছিল লক্ষ্মীদির কাছে। লক্ষ্মীদির কপাল টিপে দিতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ওই ওরা আসবার পর আর ভালো লাগলো না। দাতারবাবুই বা আসে কেন লক্ষ্মীদির কাছে। এখানে না এসে টাকার চেষ্টা করলেই হয়। তাতে কিছু কাজ হয় অন্তত! সবাই খারাপ! সত্যিই দাতারবাবু লোকটা ভালো নয়। একটু যদি আক্কেল থাকে। দীপঙ্করের চোখের সামনে সমস্ত ডালহৌসী স্কোয়ারটা যেন হঠাৎ অন্ধকার ঠেকলো। আগের দিন যেন অনেক ভালো লাগছিল।

সেই কিড স্ট্রীট। কিড স্ট্রীট দিয়েই টেগার্ট সাহেবের গাড়িটা আসছিল, এমন সময় বোমাটা ফেটেছে। জায়গাটায় তখনও কয়েকটা পুলিস দাঁড়িয়ে আছে। সকাল থেকে খারাপ লাগছিল। সেই আপিস যাওয়ার পর থেকে। সেই কে-জি-দাশবাবু আর জার্নাল সেকশন। মনে পড়লেই যেন মাথাটা খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় এত বড় খোলা পৃথিবী, এখান থেকে যেন চিরকালের জন্যে তার নির্বাসন হয়ে গেছে।

বাড়ির কাছে আসতেই দূর থেকে দুনিকাকা ডাকলে–এই দীপু, শোন–কী রে, তোর নাকি চাকরি হলো আজ?

দীপঙ্কর কাছে গিয়ে বললে– হ্যাঁ দুনিকা–

–ভালো ভালো, খুব ভালো খুব ভালো–তোর যে মতি-গতি ফিরেছে এও ভালো–এবার থেকে একটা কাজ করবি জানিস,–একটা কাজ করবি

–কী কাজ?

দুনিকাকা বললে–যদি চাকরিতে উন্নতি করতে চাস তো, এক কাজ করবি, রোজ আপিসে গিয়ে তোদের সাহেবদের আয়াদের একবার করে সেলাম করবি, জানিস–

পঞ্চাদা বললে–কেন?

–আরে, আমাদের আপিসের কী হলো, আমাদের সুপারিন্টেন্ডেন্টে হথর্ন সাহেব বিলেত চলে গেল, যাবার সময় তার আয়ার ছেলেকে সেই চাকরিতে বসিয়ে দিলে! কিন্তু আমাদের চোখে তো ধুলো দিতে পারলে না–দেখলাম এক রং, এক মুখ, এক সব।– তা সে আয়াটারও কপাল মাইরি, সেও বিলেত চলে গেল সাহেবের সঙ্গে–

–তা দীপঙ্করের বাহাদুরি আছে দুনিকা, ট্রেড-ডিপ্রেশনের আমলে চাকরি তো একটা যোগাড় করলে!

–দেখিস বাবা, সাহেবদের মন যুগিয়ে চলবি, বুঝলি, বাপ-মা তুলে গালাগালি দিলেও যেন মন খারাপ করিসনি। বুঝলি? বলবি–ইয়েস স্যার। মেয়েমানুষের সিঁথের সিঁদুর আর বেটাছেলের চাকরি, একবার ঘুচলে আর সহজে জোটে?

সত্যিই সে-সব কথা এখন যেন কল্পনাও করা শক্ত। সেই ১৯২৯, ১৯৩০, ৩১, ৩২ সালের জীবন। সমস্ত পৃথিবীটাই যেন অন্যরকম ছিল। খবরের কাগজের মাথায় সেদিন যাদের নাম বড় বড় ছাপার অক্ষরে উঠতো–সেই চিয়াং-কাকইশেক। অত বড় লীডার আর হয় না। ১৯২৮ সালে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে পিকিং দখল করে বসেছে। তোলপাড় হয়ে গেল পৃথিবীতে। বীরের বাচ্চা বটে। সাচ্চা মানুষ। সবাই বলতে লাগলো–ইন্ডিয়ার যদি চিয়াংকাইশেকের মতো একটা লীডার থাকতো তো আমাদের ভাবনা। ওদিকে চোখের সামনে রয়েছে কামাল পাশা। সারা দেশটাকে একেবারে শায়েস্তা করে দিয়েছে ঢেলেসেজে। আর ডেমোক্রসী-টেসী সব বাজে কথা, আসল কথা হলো ন্যাশন্যালিজ্‌ম্–। ন্যাশনালিজ্‌ম্-এর ঢেউ লেগেছে ইটালীতে, জার্মানীতে, টার্কিতে, সর্বত্র। সবাই চায় ডিক্টেটর। যাদের দেশের অবস্থা ভালো তারা ‘ডেমোক্রেসী’ চালাক, কিন্তু গরীব দেশের জন্যে চাই ডিক্টেটর। সেই ডিক্টেটর হলো ফ্রাঙ্কলিন-ডি-রুজভেল্ট আমেরিকায়, হিটলার হলো জার্মানীতে, মুসোলিনী হলো ইটালীতে, আর রাশিয়াতেও হলো তাই। যেখানেই অরাজক, সেখানেই গজিয়ে উঠলো বীর, চিয়াং-কাইশেকের মতো বীরের বাচ্চা। বাহবা পড়ে গেল পৃথিবীতে। কোথাও খাবার নেই, চাকরি নেই, টাকা নেই। ছোট ব্যবসা, বড় ব্যবসা, আড়তদার গোলদার, মহাজন, কারখানার মালিক সবাই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে। কী হবে–কী হবে! ডালহৌসী স্কোয়ারের আপিসে কেরানীরা দুর্গা নাম জপ করতে করতে আপিসে যায়। তারপর হঠাৎ গিয়ে শোনে একদিন তার নোটিশ হয়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফেরে আর ভগবানের নাম করে সান্ত্বনা খোঁজে। চিকেন-পক্সে একমাস ছুটির পর আপিসে গিয়ে দেখে তার চেয়ারে আর একজন বসে আছে। কম মাইনের লোক। সাহেব দুঃখ করলেন। সরি হলেন, রিগ্রেট করলেন। আর ভবিষ্যতে খোঁজ নিতে বললেন। লোকে মার্চেন্ট আপিসের কেরানীকে জামাই করতে আর চায় না। বলে–ওতে চাকরির স্থিরতা নেই। আজ আছে কাল নেই। আর ঠিক এই সময়েই ইন্ডিয়ায় সাইমন কমিশন এসে ফিরে গেছে। ‘গো ব্যাক সাইমন’। এই সময়েই ব্যারন আরউইন ভাইসরয় হয়ে এসেছে দিল্লীতে; এই সময়েই লাহোরে সুভাষ বোসের দল ২৬শে জানুয়ারীকে ‘স্বাধীনতা দিবস’ বলে ঘোষণা করেছে, এই সময়েই গান্ধীজী বে-আইনী নুন তৈরি করতে মার্চ শুরু করেছেন। সবাই জেলে। লাঠি পড়েছে সত্যাগ্রহীদের মাথায়। খবরের কাগজে সব খবর ছাপানো বন্ধ। ঠিক এই সময়ে একদিন এক ক্লাবে সাহেব-মেমদের খুব ভিড়। ডিনার খাওয়া চলেছে। নাচ-গান পান-ভোজন চলেছে পুরোদমে। বাইরে নেটিভ পাহারাদার চিৎকার করে উঠলো– Halt! Who comes there?

–Friends!

আর সঙ্গে সঙ্গে একটা গুলি এসে বিঁধলো পাহারাদারের বুকে। ক্লাবের ভেতরে তখন গুলির শব্দ শুনে হৈ-চৈ পড়ে গেছে। খবর পেয়ে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট উইলসন সাহেব এসে পড়লো। সঙ্গে পুলিস সুপার। সার্জেন্ট মেজর ফ্যারেল খেতে খেতে মেমসাহেবকে রেখে বাইরে আসতেই বুকে গুলি লেগে টলে পড়লো। বিবি-ফ্যারেল ছোট বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে সামনে এসে কেঁদে পড়লো– For God’s sake, don’t, don’t! আর তারপর দু’দিন ধরে টেলিগ্রাফ নেই, টেলিফোন নেই, ট্রেন নেই, কিছু নেই। সেদিন কয়েকটা বাঙালীর ছেলের কাছে ভারতবর্ষের একটি এলাকা দু’দিনের জন্যে একেবারে স্বাধীন হয়ে গেল। চট্টগ্রাম! ১৯৩০ সালের চট্টগ্রামের সঙ্গে আয়ার্ল্যান্ডের প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণার তারিখটাও একাকার হয়ে গেল। ১৮ই এপ্রিল ১৯৩০।

আর আশ্চর্য, ঠিক এই সময়েই দীপঙ্করও রেল আপিসের চাকরি হয়ে গেল।

বাড়িতে ঢুকতেই মা এগিয়ে এল। বললে–এত দেরি হলো যে বাবা?

মা’র হাতে বোধহয় পুজোর ফুল প্রসাদ ছিল। বললে–মুখ হাত ধুয়ে নে, প্রসাদ দেব–

আজ যেন একটু বেশি আদর, একটু বেশি খাতির মা’র কাছে। আজ যেন অন্যরকম। আজ যেন দীপঙ্করের মূল্য বেড়ে গেছে মা’র কাছে। তার তেত্রিশ টাকার যোগ্যতা যেন সংসারের কাছে কাগজে-কলমে প্রমাণিত হয়ে গেছে! আর কী চাই–মানুষে এর চেয়ে বেশি আর কী-ই বা চায়!

মা বললে–হ্যাঁরে, ও-বাড়ির কাকীমাকে প্রণাম করিসনি?

–এখন যাবো মা?

-–যা, যা, এখুনি যা, শুনে খুশী হবে–

দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি উঠলে। কাকীমাকে অবশ্য প্রণাম করতে হবে। আর কাকাবাবুকেও। কিন্তু কাকাবাবু কি এত সকাল সকাল বাড়িতে ফিরেছেন? আজকাল রোজই প্রায় কাকাবাবু দেরি করে বাড়ি ফেরেন। অনেক সময়ে বিকেলবেলা একবার বাড়ি ফিরে জামা-কাপড় বদলে আবার চলে যান। কাকাবাবুর আপিসে বোধহয় খুবই কাজ পড়েছে। আর সতী! আগের রাত্রের স্বপ্নটার কথাও মনে পড়লো! আশ্চর্য! বড় আশ্চর্য স্বপ্নটা! এমন আশ্চর্য স্বপ্নও মানুষে দেখে! হয়তো দেখা হলে ক্ষমা চাইবে সতী! অত জোরে চড় মেরেছিল–রাত্রেও ব্যথাটা ছিল। টন্‌ টন্‌ করছিল গালটা! সত্যিই কেন যে চড় মারলে–অকারণে–কোনও কারণই ছিল না তার। টাকাটা চাওয়া কি তার এতই অন্যায় হয়ে গিয়েছে? ছ’হাজার টাকা আর সতীর কাছে কতটুকু! কিছুই না।

দীপঙ্কর সতীদের বাড়িতেই ঢুকলো আস্তে আস্তে–

দীপঙ্করবাবু!

দীপঙ্কর পেছন ফিরে দেখলে। বেশ অন্ধকার গলি। তবু সিঁড়ির ধাপ কটা নেমে এসে দীপঙ্কর চিনতে পারলে। সেদিনের সেই ছেলেটা। সাউথ সাবার্বান কলেজের সামনে যাকে ‘কিরণ’ বলে একদিন ভুল করেছিল। দীপঙ্কর বললে–আমাকে ডাকছেন!

ছেলেটা বললে– হ্যাঁ, কিরণ আপনাকে ডাকছে–

–কিরণ? কোথায় কিরণ?

–চলুন না, দাঁড়িয়ে আছে ওখানে।

ছেলেটা আগে আগে চলতে লাগলো। দীপঙ্কর চললো সঙ্গে সঙ্গে। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন দিয়ে বেরিয়ে, নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীটের শেষাশেষি একটা গলির মুখে অন্ধকারের আড়ালে কিরণ চুপ করে তখন দাঁড়িয়ে ছিল!

–ওই যে, ওই যে কিরণ!

সামনে এগিয়ে গিয়ে দীপঙ্কর বললে–কিরণ, তুই কী রে, তুই বাড়ি যাস্ না মোটে, তোর মা সেদিন খুঁজছিল–

–বাড়ির কথা থাক্, চল্ এখন ভজুদার সঙ্গে দেখা করবি চল, তোকে দেখতে চেয়েছেন

ভজুদা! সেই ভজুদা তার মতো লোকের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে! বিগলিত হয়ে গেল দীপঙ্কর। নিজেকে হঠাৎ বড় বড় মনে হলো। কিরণের জন্যেও তার গর্ব হলো। খবরের কাগজে যে-সব বড় ঘটনা ঘটে, কিরণ সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। কিরণ ম্যাট্রিক ফেল, আর দীপঙ্কর বি-এ পাশ। তবু কিরণের যেন নাগাল পাওয়া আর সম্ভব নয়।

দীপঙ্কর বললে–তোর ঠিকানায় একটা মনি-অর্ডার আসবে আমার নামে, তোর বাড়ির ঠিকানায়

–কিন্তু আমি যে বাড়িতেই থাকি না রে, আমার তো কোন ঠিক-ঠিকানাই নেই– যদি নাও থাকি তো আমার মাকে তুই বলে রাখিস। পিওন এলে মা তোকে ডেকে দেবে! যে-ছেলেটা দীপঙ্করকে ডেকে এনেছিল সে এক ফাঁকে চলে গেছে। কখন চলে গেছে টেরও পায়নি দীপঙ্কর। হঠাৎ খেয়াল হলো নেপাল ভট্টাচার্যি লেনের তেলের আলোটার নিচে দীপঙ্কর একলা কিরণের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আশে-পাশে কেউ কোথাও নেই। অস্পষ্ট আলোয় এতক্ষণ যেন দীপঙ্কর কিরণের মুখখানা ভালো করে দেখলে। আগের দিন সেই ডালহৌসী স্কোয়ারের গণ্ডগোলের মধ্যে যেন ভালো করে দেখা হয়নি। হঠাৎ দীপঙ্করের মনে হলো অনেক দিনের অনেক সুখ দুঃখের সঙ্গীর সঙ্গে যেন এই কয়েক মাসের মধ্যেই তার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। কিরণ যেন কত বড় হয়ে গিয়েছে। কিরণের মুখে দাড়ি-গোঁফ উঠেছে। সেই ফরসা নরম মুখখানা যেন কর্কশ হয়ে উঠেছে এই ক’মাসের মধ্যেই। শুধু বিচ্ছেদই নয় যেন কিরণ তাকে অতিক্রম করে অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। গলির ভেতর দিয়ে চলতে চলতে কিরণ কোনও কথা বলছিল না। এদিক-ওদিক ভালো করে তাকাচ্ছিল।

দীপঙ্কর বললে–কোথায় যাচ্ছি আমরা রে?

কিরণ বললে–তোকে তো বলেছি ভজুদার কাছে–

–ভজুদা কোথায়?

–চল না, নিয়ে যাচ্ছি আমি!

কিরণের সঙ্গে চলতে চলতে যেন নিজেকে আবার বড় ছোট মনে হচ্ছিল দীপঙ্করের। সে তো সামান্যই ছিল, কিন্তু রেলে চাকরি নেবার সঙ্গে সঙ্গে যেন আরো যৎসামান্য হয়ে গেছে। আরো তুচ্ছ, আরো অকিঞ্চিৎকর। সব কথা শুনে কিন্তু কিরণ নিরুৎসাহ করলে না। বললে–ঠিক আছে, চাকরি তুই কর, চাকরি করতে ক্ষতি নেই, কিন্তু দাসত্ব করিসনি যেন–

–কিন্তু চাকরি মানেই তো দাসত্ব?

কিরণ বললে–দূর তা কেন–মনটাই হচ্ছে আসল, মনটাকে স্বাধীন রাখবি–

যেতে যেতে অনেক কথাই বললে কিরণ। দেহের সঙ্গে মনটাকেও গড়ে তুলতে হবে। আয়ার্ল্যান্ডে কী হয়েছিল? ইটালীতে কী হয়েছিল? রাশিয়াতে কী হয়েছে? সব বই তো পড়িয়েছে কিরণ দীপঙ্করকে! সেই রকম করতে হবে আমাদের দেশেও।

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে হঠাৎ–টেগার্ট সাহেবকে তুই যে মারলি–তোর ভয় করলো না?

কিরণ বললে–বেটা বড় জ্বালাচ্ছিল ভাই, রোজ আমার বাড়ির সামনে ঘুর-ঘুর করছিল, ও-বেটাকে না মারতে পারলে কিছুই হবে না, সেদিন বড় জোর ফসকে গেছে, একটুর জন্যে বেঁচে গেল–এবার দেখে নেব–

আবার মারবি?

–চুপ!

মনে হলো যেন একজন লোক তাদের দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টি দিচ্ছে। সব রাস্তায় প্রায় আধো-অন্ধকার। কিরণ কোথা দিয়ে কোন্ গলির ভেতরে, কার বাড়ির উঠোনের পাশ দিয়ে একেবারে হাজরা রোডের মোড়ে নিয়ে এনে ফেললে। এ-সব রাস্তা দীপঙ্করের চেনা। এই সব রাস্তা দিয়েই এককালে দু’জনে কত ঘুরেছে, দু’জনে লাইব্রেরীর জন্যে চাঁদা আদায় করে বেড়িয়েছে, পৈতে বিক্রী করেছে কিরণ। তবু যেন আজ এ-রাস্তাগুলো বড় রহস্যময়, বড় রোমাঞ্চময় মনে হলো দীপঙ্করের কাছে। সকাল থেকে আপিসের জন্যে মনটা বিষিয়ে উঠেছিল, এখন সেই মনটাই আবার যেন তার চাঙ্গা হয়ে উঠলো। এখনও যেন আশা আছে। চাকরি করলেই মনুষ্যত্ব একেবারে চলে যায় না। চাকরি করেও অনেক কাজ করা কাজ করা যায়। চাকরি করেও দেশ-সেবা করা সম্ভব।

মনে আছে তখনকার দিনে বাংলা দেশের ছেলেরা যেন অন্যরকম ছিল। এদিকে ইস্কুলের প্রাণমথবাবু বলতেন–চরিত্র গঠন করতে। পার্কে পার্কে বক্তৃতায় স্বদেশী প্রচার চলতো। সত্য কথা বলতে হবে, সত্য আচরণ করতে হবে। মাতৃভূমির সেবা করতে হবে। অনেক কথা তখন ছেলেদের কাছে বেদ-বাক্য হয়ে উঠেছিল। স্বদেশীর সঙ্গে সঙ্গে ছিল বিলিতি বয়কট। সিগারেট খাওয়া, চা খাওয়াও পাপ মনে হতো তখন। আরো মনে আছে আর একজনের কথা। গোপীনাথ সাহা।

কিরণ বললে–ছোট বেলায় গোপীনাথ সাহার কথা মনে আছে তোর? সে-ও পারেনি, ফসকে গিয়েছিল

সি আর দাশ মারা যাবারও আগের কথা। দুপুর তখন দুটো কি আড়াইটে। ১৯২৪ সালের ১২ই জানুয়ারীর দুপুর। চৌরঙ্গী রোডের ওপর দিয়ে চার্লস টেগার্ট আসছে মোটরে চড়ে। গাড়িটা হল্ এন্ড এন্ডারসনের দোকানের সামনে আসতেই গোপীনাথ ফুটপাতের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। আর তারপরেই সোজা টিপ করে গুলি ছুঁড়লে সাহেবকে লক্ষ্য করে। গুলিটা গিয়ে লাগলো সোজা ফুসফুসের ওপর। সাহেব মোটরের মধ্যে ঢলে পড়লো।

কিন্তু গোপীনাথ তখন পার্ক স্ট্রীট দিয়ে সোজা দৌড়তে শুরু করেছে। হৈ-হৈ শব্দ করে লোক ছুটলো পেছনে-পেছনে। কে মেরেছে? কে গুলি ছুঁড়েছে? ধর, ধর, পাকড়ো! পাড়ার এধার-ওধার থেকে দারোয়ান, চাপরাশী, খানসামা, বয়, বাবুর্চি সব দৌড়লো।

আর টেগার্ট সাহেব!

কিরণ বললে–আসলে গোপীনাথেরই ভুল হয়েছিল। টেগার্ট সাহেব নয়, গাড়িতে যাচ্ছিল কিলবার্ন কোম্পানীর একজন বড়সাহেব।

দীপঙ্কর বললে–তুই একটু সাবধানে থাকিস্ কিরণ, আজকাল বড় স্পাই ঘোরাঘুরি করছে চারদিকে–

কিরণ হাসলে। কিরণের হাসি দেখে দীপঙ্করের আরও ভয় হলো। কিরণ বললে– দূর, তোর মতোন অত ভীতু হলে চলে না–

মনে আছে গোপীনাথ সাহার ফাঁসি হলো ১লা মার্চ তারিখে। কিন্তু আশ্চর্য! সেই ক’দিনেই তার ওজন আরো পাঁচ পাউন্ড বেড়ে গেছে।

হাজরা রোড-এর চৌমাথাটা পেরিয়ে খানিকক্ষণ সোজা পুব দিকে চললো কিরণ। তারপর প্রিয়নাথ মল্লিক রোড। তারপর বেলতলা, বকুলবাগান, তারপর রামময় রোড। কত রাস্তা, কত গলি পেরিয়ে সোজা গিয়ে পড়লো ম্যাডক্স স্কোয়ারে। পার্কটার চারদিকে বড় বড় বাড়ি। বেশি লোকজন আসে না ভেতরে। মাঝখানে পাম গাছের একটা গ্ৰোভ ৷ ভেতরে অন্ধকারে কয়েকটা বেঞ্চি পাতা। কিরণ বললে–আয় এখানে বোস–

দীপঙ্কর বললে–ভজুদা কোথায় তোর?

কিরণ বললে–আসবে এখুনি–

দীপঙ্কর আবার বললে–নেপাল থেকে কবে এল রে ভজুদা?

কিরণ বললে–নেপাল নয়, ভজুদা গিয়েছিল চাটগাঁয়–

–চাটগাঁয়? এই সময়ে চাটগাঁয়ে অত গণ্ডগোল চলছে, গুলি চলছে, এখন ওখানে কেন?

কিরণ বললে–সব ব্যবস্থা শেষ করে এল আর কি! সূর্যদা তো পালিয়েছে, ভজুদা ওখান থেকে চন্দননগরে ছিল, আজকে এসেছে কলকাতায়–

আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে এল চারিদিক। দু-একটা করে সবগুলো আলো জ্বলে উঠলো পার্কের ভেতরে। আশে-পাশের বাড়িতেও আলো জ্বলছে। দীপঙ্করের মনে হলো সমস্ত দেশের এই এক বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে তারও যেন কিছু একটা ভূমিকা আছে। সে-ও যেন এই কিরণ, ভজুদা, এই গোপীনাথ সাহা, দীনেশ মজুমদার, সকলের গৌরবের একজন অংশীদার। কোথায় কোন্ সাত সমুদ্র পরপারের কোন্ বিদেশী শাসক এখানে এই দীপঙ্করদের দেশের বুকে অত্যাচার চালাচ্ছে, তার প্রতিবাদ করবার শুভ সঙ্কল্প যেন দীপঙ্করেরও আছে। সে-ও যেন এদের একজন।

দীপঙ্কর আবার বললে–কখন আসবে রে ভজুদা?

সমস্ত পার্কটা যেন হঠাৎ বড় মুখর হয়ে উঠলো। অন্ধকার ঝাপসা গ্রোভের তলায় দীপঙ্কর আর কিরণ নিঃশব্দে বসে আছে। অসংখ্য কলকাতার লোক অসংখ্য কাজে ব্যস্ত। তারই মধ্যে আরো কত অসংখ্য লোক এমনি করে অন্ধকারের ছায়ার আড়ালে এমনি অটুট সঙ্কল্প নিয়ে কাজ করে চলেছে কিরণের মতো। বাড়িতে অভাব, বাবার অসুখ, মায়ের দুঃখ, কিছুই গ্রাহ্য করে না তারা।

দীপঙ্কর আবার বললে–বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে কিরণ, কালকে আবার আমাকে সকাল সাড়ে দশটায় আপিসে যেতে হবে–

–আর একটু বোস না, আপিস তো তোর পালিয়ে যাচ্ছে না–

দীপঙ্কর বললে–কিন্তু, যদি কেউ দেখতে পায় আমাদের?

–দেখতে পেলে ধরবে!

কিরণ অবলীলাক্রমে কথাটা বলে হাসলো।

দীপঙ্কর বললে–কিন্তু যদি ধরে জেলে পুরে ফাঁসি দিয়ে দেয়?

–তা তো দেবেই। ধরতে পারলেই তো ফাঁসি দিয়ে দেবে। অনেকগুলো খুন তো করেছি! ফাঁসির ভয় করলে চলে! দলে দলে আমাদের ফাঁসি হলে তবেই বেটারা ভয় পাবে–

মনে আছে কিরণের কথাগুলো শুনতে শুনতে দীপঙ্করের ভয়ও হচ্ছিল, আনন্দও হচ্ছিল। কেমন করে এত সাহস হলো কিরণের! কোথা থেকে এই সাহস পেলে। এই কিরণই একদিন এই উৎসাহ নিয়ে পৈতে বিক্রী করেছে, এই উত্তেজনা নিয়েই মিটিং শুনতে গেছে। যেদিন ভূপেন বাঁড়ুয্যেকে গুলি মারলে তাদের চোখের সামনে সেদিনও এই কিরণ আর সে দৌড়তে দৌড়তে বাড়ি এসেছে। তারপর ম্যাট্রিক দেওয়া হলো না, একটা পয়সা নেই পকেটে, খাওয়া নেই, নিদ্রা নেই, কেবল লাইব্রেরী নিয়ে মেতেছে– আবার সেই কিরণ আজ এই ম্যাডক্স স্কোয়ারে বসে ফাঁসির কথা হাসিমুখে বলে চলেছে।

দীপঙ্কর বললে–বড় দেরি হয়ে গেল ভাই, আমি যাচ্ছিলাম সতীদের বাড়িতে খবরটা দিতে এমন সময়ে তুই ডাকলি–

–কিসের খবর?

দীপঙ্কর বললে–চাকরির খবরটা তো কাকাবাবু কাকীমাকে দিতে হবে,

মা বলেছিল কাকীমাকে প্রণাম করে আসতে–

কিরণ বললে–দেখ, তুই ওদের বাড়ি আর যাসনি–

–কার কথা বলছিস?

–ওই তোর কাকাবাবু! লোকটাকে আমি প্রথমে ভালো ভেবেছিলাম–লাইব্রেরীতে মাসে মাসে দু’টাকা করে চাঁদা দিত–

সত্যিই কাকাবাবু অনেকদিন ধরে চাঁদা দিয়ে এসেছেন। কিরণের সঙ্গে মিশতে বারণ করতেন বটে, কিন্তু চাঁদাও দিতেন। শুধু লাইব্রেরীতেই নয়। সব জায়গায়। পাড়ার সরস্বতী পুজো হবে। কোথায় মহিম হালদার স্ট্রীটের ছেলেরা সরস্বতী পুজো করবে–তার চাঁদাও কাকাবাবুর কাছে চাইতে আসতো। শ্মশান-কালী পুজো এখানকার বহুদিনের। শা’নগরের পাণ্ডারা বাড়ি-বাড়ি আসতো চাঁদা চাইতে। অঘোরদাদু চাঁদার নাম শুনলে হাঁকিয়ে দিত। দীপঙ্কর নিয়ে যেত তাদের কাকাবাবুর কাছে। পাঁচ টাকা করে প্রতি বছরে কাকাবাবু চাঁদা দিতেন।

কিরণও আগে বলতো–তোর কাকাবাবু লোকটা ভালো মাইরি–

শুধু কিরণই নয়। আশে-পাশের সর্বত্র কাকাবাবুর খুব সুনাম ছড়িয়ে গিয়েছিল। কাকাবাবুর কাছে গিয়ে কেউ ফিরে আসতো না। কাকাবাবু বলতেন–শেষে কম পড়লে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও তোমরা–

কাকাবাবুর আপিস যাবার কোনও বাঁধাধরা সময় ছিল না। তবু বেশির ভাগ দিনই সকাল-সকাল খেয়ে-দেয়ে বেরিয়ে যেতেন। কোট-প্যান্ট পরে পাথরপটি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে হাজরা রোডে ট্রাম ধরতেন। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন, নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীট দিয়ে ঘুরে পাথরপটি দিয়ে তারপর মন্দিরের পাশের গলি দিয়েও কোনও-কোনও দিন বেরোতেন। তারপর যখন সদানন্দ রোডটা হলো, তখন আরো সোজা হয়ে গেল রাস্তা। পাড়ার ছেলেরাও কাকাবাবু বলে ডাকতো।

–কাকাবাবু, কাকাবাবু!

কাকাবাবু যেতে যেতে দাঁড়িয়ে যেতেন। ছেলেরা বলতো–আমাদের ফুটবল ক্লাবের চাঁদা দিতে হবে কাকাবাবু–

–চাঁদা? তা কোথায় বাড়ি তোমাদের? ছেলেরা বলতো–হালদার পাড়ায়–

–হালদার পাড়ায় থাকো তো এতদূর এসেছো চাঁদা চাইতে?

ছেলেরা বলতো–আপনাকে দিতেই হবে কাকাবাবু, আপনি নেপাল ভট্টাচার্যি লেনের ছেলেদের দিয়েছেন!

বাড়িতে কাকীমা বলতেন–এখন তো তিনি আপিস থেকে আসেন নি, এলে বলবো

কালীঘাটের সবাই জানতো এ-বাড়িতে চাঁদা চাইতে এসে কেউ ফিরে যাবে না। কাকাবাবুও বলতেন–ছেলেদের কাউকে ফিরিয়ে দিও না, ওরা চাইলে দু-চার আনা যা চায় দিয়ে দিও–

তারপর শুধু চাঁদা দেওয়া নয়, শুধু চাঁদা দিয়ে সাহাগয্য করা নয়। মাঠেও যেতে হবে। যেখানে খেলা হবে, গিয়ে দাঁড়াতে হবে মাঝে মাঝে। অন্তত ফাইনাল খেলার দিন। তিনিও একটা মেডেল দেবেন। মোটা সোনার মেডেল কিংবা জার্মান সিলভারের কাপ। ছেলেরা খেলার শেষে সেই কাপ নিয়ে চিৎকার করতে করতে মিছিল করে যাবে!–থি চিয়ার ফর কালীঘাট ফুটবল ক্লাব–হিপ্ হিপ্ হুররে–ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের ভেতর দিয়ে চিৎকার করতে করতে যাবে। উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের সামনে একবার দাঁড়াবে। ছেলেদের চিৎকার শুনে কাকাবাবু বেরিয়ে আসবেন, কাকীমা বেরিয়ে আসবে। সতী বেরিয়ে আসবে। লক্ষ্মীদি যখন ছিল, তখন লক্ষ্মীদিও বেরিয়ে আসতো। ছেলেরা মেয়েদের দেখে আরো জোরে-জোরে চিৎকার করতো। যেন আরো উত্তেজিত হয়ে উঠতো। লক্ষ্মী, সতী দুই বোনকে দেখে তাদের বীরত্ব যেন গলার জোরে ফেটে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইত। তারপর ছিল দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষের সময়, বন্যার সময় দল বেঁধে হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে কোরাস গান গাইতে গাইতে আসতো একদল। ওপর থেকে লক্ষ্মীদি আর সতী ঝুঁকে পড়ে দেখতো। কাকাবাবু রঘুর হাত দিয়ে চাঁদা পাঠিয়ে দিতেন। ছেঁড়া কাপড় কি চাল, তা-ও পাঠানো হতো। দীপঙ্কর দেখতো ভিড়টা একটু বেশিই হতো তাদের বাড়ির সামনে। কাকাবাবুরা আসবার আগে তেমন ভিড় হতো না বিশেষ। কিন্তু লক্ষ্মীদিরা আসবার পর থেকেই চাঁদা আদায়ের হিড়িকটা বেড়ে গিয়েছিল। প্রথম প্রথম দীপঙ্কর কিছু বুঝতে পারতো না। পরে ব্যাপারটা বুঝলে।

তারপর থেকেই প্রায়ই লোকে জিজ্ঞেস করতো–তোদের বাড়িতে এসেছে কারা রে?

পাড়ার মোড়ে বাড়ির রোয়াকে বসে কেউ কেউ গান জুড়ে দিত। ‘বাঁধ না তরীখানি আমারি এ নদীকূলে’। কিংবা ‘কালা তোর তরে কদমতলায় বাজায় বাঁশী’। আঙ্গুরবালার নতুন টাকা রেকর্ড বেরিয়েছে তখন। সেই সব গান।

কাকীমা বলতেন–ও-সব দিকে তোমরা কান দিও না যেন লক্ষ্মী–

কিন্তু লক্ষ্মীদির সামনে কিংবা সতীর সামনে কিছু বলবার সাহস ছিল না কারো। তারা জুতো পায়ে গট গট্ করতে করতে গিয়ে বাসে উঠতো। ঠিক ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের পক্ষে যেন বড় বেশি নির্ভীক, বড় বেশি অসামাজিক।

কাকাবাবু বলতেন–ও-রকম সব পাড়াতেই আছে। নিজেরা ঠিক থাকলেই হলো–

কাকীমা বলতেন–তুমি তো সারাদিন বাইরে বাইরে থাকো, পরের মেয়ে নিয়ে আমার যে ভয় করে–

কাকাবাবু বলতেন–যে-পাড়াতেই যাবে, সেখানেই ভয় করবে–

কিন্তু তবু কাকাবাবু পাড়ার লোকদের, পাড়ার ছেলেদের কিছু বলতেন না। চাঁদা দিতেন হাসিমুখে। ফুটবল খেলার কাপ দিতেন, শীল্ড দিতেন। তাদের মাঠে খেলা দেখতেও যেতেন। সেই কাকাবাবুর সম্বন্ধেই কিরণ যখন বিরূপ মন্তব্য করলে, তখন দীপঙ্করের ভালো লাগলো না।

দীপঙ্কর বললে– জানিস কিরণ, আমার সেই লক্ষ্মীদি? লক্ষ্মীদিকে মনে আছে তো তোর? সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে রে–

কিরণ অন্যমনস্ক ছিল। কথাটা শুনে কিছুক্ষণ পরে বললে–কী বললি তুই?

–লক্ষ্মীদি বাড়ি থেকে লুকিয়ে পালিয়ে গিয়েছে, পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে একজনকে–

কিরণ বললে–তা তো যাবেই–

–কেন?

কিরণ বললে–ওর ছোট বোনটাও পালিয়ে যাবে দেখিস, দেখবি বাপ-মা ভাই বোন কারো সঙ্গে আর সম্পর্ক থাকবে না–কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না যে, কেউ কাউকে ভালোবাসছে না যে! ভালো না বাসলে ঘর-সংসার তো ভাঙবেই–এই দেখ না, আমিও বাবা-মা’কে আর ভালোবাসি না, আমিও বাড়ি ছেড়ে দিয়েছি–

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কিন্তু এতদিন তো ছিল, এতদিন তো ছিল সবই ঠিক—

কিরণ বললে–ওই ইংরেজদের জন্যেই এ-সব ভেঙে যাচ্ছে। মেয়েরা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে, বাপ ছেলেকে তাড়িয়ে দেবে বাড়ি থেকে, বউ স্বামীকে বিষ খাইয়ে খুন করবে। এ-সব আরো বাড়বে। এ-সব ইংরেজরা না গেলে আরো খুন-জখম হবে, পালিয়ে যাওয়া আরো বাড়বে, এই সবে শুরু হলো। যখন ইংরেজদের তাড়িয়ে দেব, দেখবি তখন সব ভালো হবো আমরা, আবার সেই সত্যযুগ ফিরে আসবে–আমরা সত্যযুগ আবার ফিরিয়ে আনবো–

দীপঙ্কর বললে–কিন্তু তা হোক, সতী সে-রকম নয়, সতী যাবে না দেখিস– সতীকে তুই জানিস না, সতীর খুব ভগবানে বিশ্বাস আছে, সতী কখনও বাবাকে না-বলে কোথাও যাবে না–বাবাকে সতী খুব ভালোবাসে–

–কিন্তু যখন বিয়ে হবে?

দীপঙ্কর বললে–বিয়ে হলে সতী স্বামীকে খুব সেবা-যত্ন করবে

কিরণ বললে–তা তুই কি এখনও দিন-রাতই ওই ওদের কথা ভাবিস? তোর কি আর কোনও ভাবনা নেই? তোর কি একবারও ভাবনা হয় না, কী করে দেশ স্বাধীন করা যায়? কী করে ইংরেজদের তাড়ানো যায়? কেন মিছিমিছি মেয়েদের কথা ভাবিস্ বল তো? এতে কী লাভ হয়? ও-ভাবনা একবার ঢুকলে কিন্তু মাথা থেকে আর দূর করতে পারবি না!

দীপঙ্কর কেমন যেন লজ্জায় পড়লো একটু।

কিরণ আবার বলতে লাগলো- তোকে এত বই পড়তে দিলুম, এত লেখা-পড়া করবার পরও তোর এই সব বাজে চিন্তা মাথায় ঢুকছে? তুই কী রে?

দীপঙ্কর বললে–না, বেশি তো ভাবি না–

–বেশি ভাবিস না কী রে, তখন থেকে দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুই তো কেবল ওই মেয়েদের কথাই বলছিস?

–না, এবার আর ভাববার সময় পাবো না। এবার তো সকাল সাড়ে দশটায় আপিস যাবো, তারপর সন্ধ্যেবেলা বাড়ি আসবো, ভাববো কখন? আর তাছাড়া লক্ষ্মীদি তো চলেই গেছে, সতীও মঙ্গলবার চলে যাচ্ছে–

-–কোথায় চলে যাচ্ছে?

দীপঙ্কর বললে–বর্মায়, বাবার কাছে। চলে যাওয়াই ভালো, জানিস। যত শিগগির চলে যায়, ততই ভালো। আমারও ভাবতে আর ভালো লাগে না ও-সব। তাছাড়া, আমাদের তো খেটে খেতে হবে! আমরা গরীব লোক, ওদের মতন তো বড়লোক নই, ওদের কথা ভাবলে চলবে কেন?

কিরণ বললে–তোকে একটা বই দেব, সেটা পড়লেই মেয়েদের কথা দেখবি একেবারে মন থেকে পালিয়ে যাবে–

–দে ভাই বইটা, কী বই ৷

–স্বামী বিবেকানন্দর লেখা–’ব্রহ্মাচর্য’। ব্রহ্মার্য পালন না করলে কোনও কাজই করতে পারবি না জীবনে। আমরা আমাদের দলের সব ছেলেকে ওই বইটা প্ৰথমে পড়তে দিই। পড়লে দেখবি মনটা পবিত্র হয়ে যাবে। মন আর শরীর এই দুটোকে যদি কন্ট্রোল করতে পারিস তো কাউকে কেয়ার করবার দরকার নেই–

মনে আছে শুধু ব্রহ্মচর্যই নয়, আরো কত রকম পন্থা আবিষ্কার করতে হয়েছিল দীপঙ্করকে। কাউকে মনে রাখবে না দীপঙ্কর। ও-সতীকেও নয় লক্ষ্মীদিকেও নয়। সামান্য রেলের চাকরি, তার মধ্যে দিয়েই জীবনে উন্নতি করতে হবে। ওদের কথা মনে রাখলে কোনও লাভ হবে না তার। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সাদা দেয়ালের গায়ে একটা গোল দাগ দেওয়া ছিল, সেই গোলের মধ্যে ছিল একটা বিন্দু। পয়েন্ট। সেই পয়েন্টটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতো। চোখের পাতা ফেলতে পারবে না, নড়তে চড়তে পারবে না। প্রথমে এক সেকেন্ড, তারপর অভ্যেস করতে করতে এক মিনিট পর্যন্ত চোখের পলক পড়তো না। সতীকে ভুলতে হবে। সতীকে সম্পূর্ণ ভুলে যেতে হবে। রাত্রে যদিও বা স্বপ্ন দেখে সতীকে তো সকাল বেলা তার কোনও চিহ্ন থাকবে না মনে। পৃথিবীতে শুধু সতীই নেই, আরো অসংখ্য মানুষ আছে। অনাহার আছে, দারিদ্র্য আছে, লোভ, মোহ, হিংসা সবই আছে। উন্নতি আছে, অবনতি আছে। সারা পৃথিবী জুড়ে বিরাট মানুষের মিছিল আছে, সেখানে সতী কতটুকু। কতটুকু তার অস্তিত্ব। কে সতী! অমন কত মেয়ে কত পুরুষকে প্রলোভন দেখিয়ে জয় করেছে, আবার একদিন কালের অমোঘ নিয়মে নিঃশেষে হারিয়েও গিয়েছে। ইতিহাস খুঁজলে তাদের কোনও চিহ্নই পাওয়া যাবে না আজ। মিছিমিছি সেই সতীকে মনে করে রেখে কেন কষ্ট পাবে দীপঙ্কর। তার চেয়ে ওই ভালো। সাদা দেয়ালের গায়ে কালির গোল দাগটায় আরো কালি বুলিয়ে স্পষ্ট করে তুলতো দীপঙ্কর। তার ভেতরের লাল পয়েন্টটার ওপর অপলক দৃষ্টি দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতো। যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়তো যখন সবাই চুপ হয়ে যেত–যখন মা-ও বিন্তিদির কাছে গিয়ে শুতো, তখন একলা ঘরে সেই বিন্দুটার দিকে চেয়ে চেয়ে নিজের মনটাকে দৃঢ় করতে চেষ্টা করতো দীপঙ্কর। এক সেকেন্ড, দু সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড–তারপর এক মিনিট। চোখ টন্‌ টন্‌ করতো ব্যথায়। মনে হতো সে বুঝি সব জয় করে ফেলেছে। স্বর্গ মর্ত্য পাতাল সব হেরে গেছে তার কাছে। তখন, ঠিক তখন, হঠাৎ কোথা থেকে একটা পাউডারের গন্ধ ভেসে আসতো–বেশ মিষ্টি মৃদু গন্ধ! আর হঠাৎ নিজের অজ্ঞাতেই অন্যমনস্ক হয়ে যেত দীপঙ্কর! আর চারিদিকে চেয়ে দেখতো–সতী আবার চুপি চুপি তার ঘরে এসেছে নাকি!

কিন্তু সে-সব অনেক পরের কথা। দীপঙ্করের তখন চাকরিতে উন্নতি হয়ে গেছে। মাইনে বেড়েছে, খাতির বেড়েছে। নৃপেনবাবু তখন রিটায়ার করে গেছে। কে-জি দাশবাবু তখন আপিস-সুপারিন্টেন্ডেন্ট হয়ে গেছেন। গাঙ্গুলীবাবু তখন…..কিন্তু গাঙ্গুলী বাবুর কথা যথাসময়েই বলা ভালো।

দীপঙ্কর হঠাৎ বললে–আমি ভুলে যাব ভাই, ঠিক বলেছিস, তোর কথাই ঠিক—

কিরণ বললে–আর একটু ভালো করে ভেবে দেখলে বুঝতে পারবি মেয়েরা পৃথিবীতে শুধু কর্মনাশ করতে আসে–কর্মনাশা–

দীপঙ্কর বললে–ঠিক বলেছিস, কাল রাত থেকে কেবল ভাবছি ওদের কথা, আপিসে গিয়েও ভেবেছি, ট্রামে উঠেও ভেবেছি–এবার আর ভাববো না–

কিরণ বললে–চুপ কর–ওই ভজুদা আসছে–

দীপঙ্করের সমস্ত শরীরটা যেন থর থর করে কেঁপে উঠলো। পার্কের পূর্ব দিকের ছোট ফটকটা দিয়ে সাদা জামা-কাপড়-পরা কে যেন ভেতরে ঢুকলো। ঢুকে হন্ হন্ করে তাদের দিকে আসছে। অন্ধকারের মধ্যে চেহারাটা ভালো করে দেখা যায় না। কিন্তু দীপঙ্করেরর মনে হলো এই সামান্য একটা মানুষ, এই মানুষটার জন্যেই সারা দেশে এত কাণ্ড হচ্ছে। এই মানুষটার জন্যেই দুর্দান্ত টেগার্ট সাহেব এত জাল পেতেছে চারিদিক। এই সামান্য মানুষটার জন্যেই এই সেদিন চট্টগ্রামে এত বড় কাণ্ড ঘটে গেল। সেই ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল। আয়ার্ল্যান্ডের বিদ্রোহ ঘোষণার বিখ্যাত দিনটাকে বেছে নিয়ে এই মানুষটাই চট্টগ্রামের জালালাবাদে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। এই লোকটাই সেই!

ওদিকে সুভাষ বোস আর কিরণশঙ্কর রায়ের তখন জেল হয়েছে। ১৯৩০ সাল থেকে ২৬শে জানুয়ারীকে ‘স্বাধীনতা দিবস’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে লাহোর কংগ্রেসে। সঙ্গে সঙ্গে ভগৎ সিং-এর মামলাও চলছে। দিল্লীর পার্লামেন্ট হাউসের ভেতর বোমা ফেলেছিল ভগৎ সিং আর বটুকেশ্বর দত্ত। যে-ট্রেনে সাইমন কমিশন আসার কথা, সেই ট্রেনটাই ডিনামাইট্ দিয়ে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কও লুট হয়েছে। যতীন দাস চৌষট্টি দিন ধরে জেলের মধ্যে উপোস করে মারা গেছে। আর এদিকে মহাত্মা গান্ধী নিজে গেছেন ডান্ডি মার্চে। ১৯৩০ সালের মার্চ। বেআইনী নুন তৈরি করতে গিয়ে ইংরেজরা তাঁদের পুরেছে জেলে। চারিদিকে উত্তেজনা। কত ইতিহাস গড়া চলেছে। আর ঠিক সেই সময় বাঙালীর ছেলেরা দল বেঁধে মিলিটারি পোশাক পরে জালালাবাদের আর্মারীতে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো একদিন। সমস্ত ভারতবর্ষের লোক শুনে হতবাক হয়ে গেল। ব্রিটিশ রাজত্বের একটা এলাকা বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে বাঙালীরা একেবারে পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে।

সমস্ত ঘটনাগুলো ভাবতেই তখন রোমাঞ্চ হতো। দীপঙ্কর বেঞ্চির ওপরে স্থির হয়ে বসে রইল। একেবারে নড়বার ক্ষমতাও নেই যেন, মনে হলো এইবার যেন তার এতদিনের বাসনা পূর্ণ হবে। সেই চট্টগ্রাম, সেই ডালহৌসী স্কোয়ার, সেই লাহোর, সেই বেতিয়া, সব জায়গার সব মানুষগুলো যেন তাকে ডাকছে। সামান্য একটা স্বপ্ন, সামান্য একটু পাউডারের গন্ধ সামান্য একটা চাকরি, সামান্য ছ হাজার টাকাই নয়। এবার আরো বেশি কিছু নিতে হবে, এবার আরো বেশি কিছু দিতেও হবে। মা’র কথা ভেবে বিষণ্ণ হলে চলবে না, লক্ষ্মীদির কথা ভেবে দুঃখ পেলে চলবে না, সতীর কথা ভেবে ভেবে স্বপ্ন দেখা চলবে না। দীপঙ্করেরও একটা দায়িত্ব আছে, দীপঙ্করের একটা কর্তব্য আছে–

কিরণ হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। চুপি চুপি বললে– কী হলো?

যে এসেছিল, সে একবার দীপঙ্করের দিকে দেখে নিলে। বেশ সাদাসিধে শার্টপরা চেহারা। এতক্ষণে স্পষ্ট দেখা গেল চেহারাটা। খুব তাড়াতাড়ি যেন এসেছে মনে হলো। একেবারে দৌড়তে দৌড়তে।

কিরণ বললে–ভজুদা এল না?

লোকটা কিরণকে আড়ালে ডেকে নিয়ে কী যেন বললে। দীপঙ্কর কান পেতেও কিছু শুনতে পেলে না। ফিস্ ফিস করে কথা বলতে লাগলো দুজনে। তারপর লাকটা আবার হন্ হন করে যেদিক দিয়ে এসেছিল, সেই দিক দিয়েই চলে গেল।

কিরণ কাছে এসে বললে–চল্‌, দীপু চল্‌–

দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে উঠলো। বললে–ভজুদা আসবে না?

কিরণ বললে–না, এখন আসতে পারবেন না, সি-আই-ডি লেগেছে পেছনে, টের পেয়ে গেছে ওরা–চল তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি–

অনেকক্ষণ কিরণ কোনও কথা বললে না। এবার আর সেই এক পথ নয় ৷ অন্য এক ঘোরাপথ দিয়ে আবার বাড়ির দিকে চলেছে। একটা জায়গা বেশ অন্ধকার মতন। কিরণ হঠাৎ চারদিকে দেখে নিলে। বললে–এবার তুই বাড়ি যা দীপু–

–তুই যাবি না?

–না, আমার অন্য কাজ আছে–

কিরণ চলে যাচ্ছিল। দীপঙ্কর চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ ডাকলে–কিরণ, শুনে যা–

বলে দীপঙ্কর নিজেই এগিয়ে গেল কিরণের কাছে। বললে–তুই ঠিক বলেছিস কিরণ, আমি আর ও-সব ভাববো না, জানিস–

কিরণ বললে–বেশ ভালো কথা তো–

–হ্যাঁ, তুই সেই বইটা দিস। ব্রহ্মচর্য! আর দেখ, আর-একটা দিন শুধু যাবো সতীর কাছে, বুঝলি, একটা কাজের কথা শুধু বলেই চলে আসবো–একটা দিন, তারপরে তো সতী চলেই যাচ্ছে–তখন আর কে কাকে মনে রাখে, কী বল!

কিরণ সে-কথার কোনও উত্তর না দিয়ে চলে গেল। দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে–কিরণের চেহারাটা বেলতলা রোডের অন্ধকার গাছের ছায়ার মধ্যে মিলিয়ে গেল। কিরণের কাছে যেন ছোট মনে হলো নিজেকে। কিরণ কত কাজ করছে। কত কাজের মানুষ। আর সে কেবল চাকরির ঘানিতে ঘুরবে সারাজীবন। সকাল দশটা থেকে বিকেল সন্ধ্যে পর্যন্ত। কে-জি দাশবাবু আর গাঙ্গুলীবাবু আর নৃপেনবাবুর মতো। সমস্ত জীবনটা, সমস্ত পরমায়টা অপচয় করবে রেলের আপিসে। জার্নাল সেকশনের চিন্তা করতে করতে সকালবেলা তার সূর্য উঠবে আর সন্ধ্যেবেলা ডুববে। কিন্তু পৃথিবী আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে। পৃথিবীর সমস্ত লোক এগিয়ে যাবে–দীপঙ্করকে অতিক্রম করেই সবাই এগিয়ে যাবে। দীপঙ্কর তার লক্ষ্যকে কেটে-ছেঁটে ছোট করেছে বলে সকলের পেছনে সে পড়ে থাকবে। সকলের দয়ার, সকলের অনুকম্পার পাত্র হয়ে যাবে। সেই বেলতলার অন্ধকারের মধ্যেই দীপঙ্কর শিরদাঁড়া শক্ত করে দাঁড়াল। না, মানুষের সঙ্গে মিশতেই হবে তাকে। মিশতে গিয়ে যদি তার অহঙ্কারে ঠেকে, অবিবেচনায় ঠেকে, অহমিকায় ঠেকে, কিম্বা অর্থাভাবে ঠেকে, তাতেও সে নিচু হবে না আর। অমলবাবুর কথাই ঠিক। জীবন দিয়েই তার সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে এবার থেকে সে। সস্তা সমাধানের সহজ পথ আর মাড়াবে না।

মনে আছে দীপঙ্কর ঠিক করেছিল সোজা বাড়িতেই আসবে। রাত তখন অনেক হয়ে গেছে। একা-একা রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে এই কথাটাই ঠিক করলো যে, এবার থেকে অন্য মানুষ হয়ে যাবে সে। একদিন এই জীবন থেকেই কত কী দেখেছে দীপঙ্কর, কত কী ভেবেছে। সমস্ত জীবন ধরে শুধু ভাবতেই শিখেছে সে। ভেবে ভেবে ভালো-মন্দর তুল্য-মূল্যও বিচার করছে। কিন্তু শেখা হয়নি কিছুই। ছোটবেলায় ছেলেমেয়েদের ভাষা শেখার মতো সেগুলো সে শুনে শুনেই আয়ত্ত করেছে, কিন্তু ব্যাকরণের মধ্যে দিয়ে আয়ত্ত করে সেগুলোকে পাকা করে নেওয়া হয়নি। সহজ পাওয়াকে নিয়ম-শৃঙ্খলা দিয়ে বেঁধে কাজের মধ্যে পরখ করিয়ে নিতে হয়–তাতেই স্থায়ী ফল পাওয়া যায়। সেটাই হয়নি। এবার থেকে দীপঙ্করের অন্য পথ। অন্য মানুষ হয়ে যাবে সে।

.

ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে ঢুকে উনিশের একের বি বাড়িটার সামনে এসেও তার প্রতিজ্ঞা অটুট ছিল। সতীদের দরজা পেরিয়ে নিজেদের সদর দরজাটা দিয়েই বাড়ির ভেতর ঢুকতো, কিন্তু কী যে হলো। কাকীমাকে প্রণাম করার কথাটা মনে পড়লো। যত সামান্য চাকরিই হোক, আজ তার চাকরি হয়েছে। সে-চাকরির সংবাদটা দিয়ে আসা উচিত। কাকীমা কাকাবাবু তার শুভাকাঙ্খী। গিয়ে চলে এলেই হলো। সতীর সঙ্গে দেখা না করলেই হলো। সতীর সঙ্গে কথা না-বললেই হলো। তাতে আর দোষ কী!

–কাকীমা!

কাকীমা রান্নাঘরেরর মধ্যেই ছিলেন। ঠাকুরের সঙ্গে বোধহয় রান্নাঘর তদারক করছিলেন। দীপঙ্কর একেবারে সোজা জুতো জোড়া বাইরে খুলে ভেতরে ঢুকে গেল।

–এ কী দীপু? ওমা, প্রণাম করছো কেন হঠাৎ? কী হলো আবার?

দীপঙ্কর হাত বাড়িয়ে কাকীমার পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকালে। কাকীমা অবাক হয়ে হাসলেন। বললেন–এত ভক্তি কেন হঠাৎ?

দীপঙ্কর বললে–আমার আজ চাকরি হলো কিনা কাকীমা, তাই–

কাকীমা আশীর্বাদ করলেন। বললেন–হয়েছে? আশীর্বাদ করি বাবা চাকরিতে তোমার উন্নতি হোক, মায়ের মুখ উজ্জ্বল করো, তোমার মা যে কষ্ট করে মানুষ করেছে তোমাকে–তা….

তারপর বললেন–যাও, ওপরে যাও, সতী আছে–

–না কাকীমা, অনেক রাত হয়ে গেল, বাড়ি যাই–

বলে দীপঙ্কর সোজা বাইরে চলে আসছিল। বললে–কাকাবাবুর বোধহয় আসতে অনেক রাত হবে, কাল বরং সকালেই আসবো–

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে উঠোন। উঠোন পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে রোয়াকে উঠতে হয়। রোয়াকটা ঘুরে সোজা সদর দরজায় গিয়ে ঠেকেছে। রোয়াকের কাছে দাঁড়িয়ে একবার ভাবলে ওপরে একবার যাবে কিনা। এক মুহূর্তের দ্বিধাও হলো। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে একটু ভাবলে। কিন্তু না, থাক।

হঠাৎ সামনে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো। সতীর একজোড়া পা। একেবারে সোজা সামনে দাঁড়িয়ে।

দীপঙ্কর চোখ তুলতে পারলে না। চোখ তুললেই মুখোমুখি দেখা হয়ে যাবে। একজোড়া ফরসা পায়ের ওপর রঙিন শাড়িটা ঝুলছে। পা জোড়া নড়েও না, সরেও যায় না। অথচ সতীকে এড়িয়ে যাবার রাস্তাও নেই আর। সদর দরজার দিকে যেতে গেলেই সতীকে ঠেলে যেতে হবে।

দীপঙ্কর চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল তখনও। কিন্তু তবু সতী নড়ে না। কী করবে দীপঙ্কর বুঝতে পারলে না। অথচ সরতে বললে কথা বলতে হয়। দীপঙ্কর শেষ পর্যন্ত চোখ তুললো। দেখলে সতীও তার দিকে চেয়ে রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে দীপঙ্কর চোখ নামিয়ে নিলে। তেমনি করেই দাঁড়িয়ে রইল আরো কিছুক্ষণ।

তারপর এক সময় দীপঙ্কর হঠাৎ আবার মুখ তুলে বললে–সরে যাও–বা রে—

সতী কিন্তু সরলো না। তেমনি করেই দাঁড়িয়ে রইল তার দিকে চেয়ে।

দীপঙ্কর আবার বললে–সরে যাও–আমি যাবো যে–

সতী তখনও নড়লো না। দাঁড়িয়ে রইল। মুশকিলে পড়লো দীপঙ্কর। সতীকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েই যেতে হবে নাকি? অথচ সতী কী যে বলতে চায়, তখনও বোঝবার উপায় নেই, তার দিকে গম্ভীর হয়ে শুধু চেয়েই দেখছে। কী যে করতে চায়, তারও ঠিক নেই।

–তা সরবে তো? না সরলে আমি যাবো কী করে?

সতী পাথরের মতো চুপ করে তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে।

দীপঙ্কর বললে–এবার না সরলে আমি কিন্তু তোমাকে ঠেলে সরিয়ে চলে যাবো তবু নিশ্চিল নিথর মূর্তি সতীর।

দীপঙ্কর ঠিক করলে সতীকে গায়ের জোরে ঠেলে চলে যাবে। আর কোনও লজ্জা-সম্ভ্রম দেখালে চলবে না ৷

দীপঙ্কর হাত তুলতেই যাচ্ছিল–হঠাৎ ওদিকে একটা বিকট শব্দ হলো রান্নাঘরের টিনের চালের ওপর। সবাই চমকে উঠেছে। দীপঙ্করও চমকে উঠেছে, সতীও চমকে উঠেছে। কাকীমা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন–ও কী পড়লো রে রঘু?

রঘুও বেরিয়ে এসেছে। একটা আধ-ভাঙ্গা ইঁটের টুকরো টিনের চাল থেকে গড়াতে গড়াতে উঠোনে পড়লো ধপ্ করে। ইঁট কে ফেললে? সঙ্গে সঙ্গে আর-একটা ইঁট। এবার পড়লো উঠোনের পুব দিকে। প্রায় আস্ত ইঁট। দুম করে শব্দ হলো। তারপর আর-একখানা। পর পর তিনখানা ইঁট পড়তেই কাকীমা বললেন–রঘু, বাইরে গিয়ে দেখ না, কে ইঁট ফেলছে

রঘুকে আর বাইরে যেতে হলো না। বাইরের দিক থেকেই অসংখ্য লোকের গলা শোনা গেল। তারা চিৎকার করছে। কাকীমা সতী দুজনেরই মুখ শুকিয়ে গিয়েছে যেন। রঘু সদর দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল। তার আগেই সবাই ভেতরে ঢুকে পড়েছে। একজন-দুজন নয়–ঢুকতে ঢুকতে ষাট, সত্তর, একশোজন ঢুকে পড়লো বাড়ির ভেতর। আরো অনেক লোক তখন যেন বাইরে গোলমাল করছে। সামনের কয়েকজন লোক একেবারে মুখোমুখি এগিয়ে এল।

রঘু বললে–কী চান আপনারা? বাবু নেই

দীপঙ্কর যেন চিনতে পারলে কয়েকজনকে। কালীঘাটের পাড়াতেই থাকে সব হাতে লাঠি আছে কারো কারো।

দীপঙ্কর বললে–কাকে চাই? ইঁট ফেলছিলেন আপনারাই?

লোকগুলো যেন মারমুখো হয়ে এসেছে সবাই। বললে–সেই সি-আই-ডি লোকটা কোথায়?

সি-আই-ডি! দীপঙ্কর বললে–সি-আই-ডি কেউ নেই এখানে–আপনারা বেরিয়ে যান এখান থেকে, বেরিয়ে যান, নইলে এখনি পুলিসে খবর দেব–

কোথা থেকে যেন দীপঙ্করের অসীম সাহস এল মনে। এগিয়ে যাচ্ছিল সামনের দিকে। সামনের একজন পান্ডা মতন লোক আরো এগিয়ে এল। বললে–ভদ্রলোকের পাড়ার মধ্যে সি-আই-ডি রাখা, আর জায়গা হলো না কোথাও

–কে সি-আই-ডি?

দীপঙ্করও সমান গলার জোরে উত্তর দিলে।

সামনের লোকটা লাঠিটা ঠুকে এগিয়ে এসে বললে–আপনি কে? আপনি কে শুনি? আপনি এ-বাড়ির কে?

পেছন থেকে কে একজন বললে–ওরে, ও পাশের বাড়ির লোক, অঘোর ভট্টাচার্যির বাড়িতে থাকে–

বাকি লোকগুলো তখন হৈ-হৈ করে উঠেছে। একজন বলে উঠলো–বন্দে মাতরম। আর তুমুল চিৎকার উঠলো সমস্বরে–বন্দে মাতরম্। আর সঙ্গে সঙ্গে সে এক পৈশাচিক কাণ্ড শুরু হলো। পেছনের যত লোক সব ঢুকে পড়লো উঠোনের মধ্যে। বাড়ির উঠোনে, সিঁড়িতে, রোয়াকে সর্বত্র গুণ্ডাদের দল ছেয়ে ফেললে। রঘু যত বলে–বাবু বাড়ি নেই, সে-কথায় কেউ কান দেয় না। কেউ কেউ ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়তে চায়। সিঁড়ি দিয়ে দোতলার ওপরে উঠে পড়লো ক’জন। কাকীমা থর থর করে কাঁপতে লাগলেন এক কোণে দাঁড়িয়ে।

–আপনারা কী চান কী? দেখছেন ভদ্রলোকের বাড়ি?

–ভদ্রলোক না ছাই, সি-আই-ডি, সি-আই-ডি এসেছে কালীঘাটের মধ্যে। বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা!

দীপঙ্কর তবু বুঝতে পারলে না। বললে–কে সি-আই-ডি, কার কথা বলছেন? কোথায় সি-আই-ডি?

–ওরে বন্দুক আছে বাড়িতে, বন্দুক ছুঁড়বে– সাবধান!

যে-লোকটা লাঠি হাতে সামনে এগিয়ে এসেছিল, সে হঠাৎ বন্দুকের নাম শুনেই লাঠিটা ঘোরাতে লাগলো। একেবারে দীপঙ্করের মুখের সামনে এগিয়ে এল। সতী দেয়ালের একটা কোণ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। লোকটা সেই দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল। দীপঙ্কর সামনের দিকে যেতেই সতী তার হাতটা টেনে ধরলে–দীপু সরে এসো–

–বন্দে মাতরম্, বন্দে মাতরম্–

তুমুল শব্দে সমস্ত বাড়িটা গম্ গম্ করে উঠলো।

দীপঙ্কর বললে–আপনারা কালীঘাটের ছেলে হয়ে কালীঘাটের বদনাম করছেন? লজ্জা করে না আপনাদের?

–লজ্জা! লোকটা তাকে যেন আঘাত করবার জন্যে লাঠিটা উঁচিয়ে ধরলো। দীপঙ্করের মনে হলো যেন লাঠিটা সোজা সতীর মাথার ওপরেই পড়বে। দীপঙ্কর হুঙ্কার করে উঠলো—খবরদার–

কিন্তু ঠিক সময়েই দীপঙ্কর সামলে নিয়েছে। লাঠিটা পড়বার আগেই দীপঙ্কর এক লাফে সতীকে জড়িয়ে ধরে লাঠির আঘাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আর লাঠিটা এসে পড়েছে দীপঙ্করের পিঠে। পিঠটা যেন ভেঙে গেল দীপঙ্করের। কিন্তু তবু রক্ষে, সতীর গায়ে ওটা পড়েনি। পড়লে সতী মাথা ফেটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেত। কিন্তু যদি আবার লাঠি পড়ে সতীর গায়ে! আবার যদি আঘাত করে! দীপঙ্করের তখন আর কোনও দিকে জ্ঞান নেই। ঘরের ভেতরের জিনিপত্র ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে। চায়ের কাপ, কাঁসার বাসন, কাঁচের আলমারি, দামী দামী সব জিনিস দুম-দাম পড়ছে আর ভাঙছে। কোথা থেকে পিল পিল করে অসংখ্য লোক ঢুকে আসছে বাড়ির ভেতরে। মুহূর্মুহূ চিৎকার করে উঠছে–বন্দে মাতরম্, বন্দে মাতরম্–! যে-যেখানে পারছে ঢুকে পড়ছে। রান্নাঘরের থালা-বাসন, রান্না-জিনিস উঠোনে ছত্রাকার করে ছড়িয়ে দিচ্ছে। সমস্ত বাড়িটা যেন অসংখ্য গুণ্ডার হাতে নিস্তেজ হয়ে পড়লো। আর মনে হলো সতীর ওপরেই যেন সকলের বেশি আক্রোশ! সতী থর থর করে কাঁপছে। দীপঙ্কর প্রাণপণে সতীকে জড়িয়ে ধরে আছে। দীপঙ্কর যেন সতীর হৃৎপিণ্ডের ওঠা-পড়ার শব্দও শুনতে পাচ্ছে। যে-যেখানে যা ইচ্ছে যা-খুশি করুক, সতীর গায়ে যেন কারো ছোঁয়া না লাগে। কারো অশুচি স্পর্শ না ঠেকে। সতীকে সে অশুচি হতে দেবে না, সতীর পবিত্রতা সে জীবন দিয়েও অম্লান রাখবে।

দীপঙ্কর তখনও প্রাণপণে সতীকে সজোরে জড়িয়ে ধরে আছে। কিন্তু সতী যেন দীপঙ্করের আলিঙ্গনের মধ্যেও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। তাই ভয়ে ভয়ে দীপঙ্করের শক্ত আশ্রয়ের মধ্যে সতীও নিজেকে সমর্পণ করতে প্রাণপণে চেষ্টা করলে। দীপঙ্করের বুকের মধ্যে মাথাটা লুকিয়ে রেখে নিশ্চিন্তে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করলে

হঠাৎ দোতলার ওপর আবার একটা চিৎকার উঠলো–বন্দে মাতরম্–

২৩

সমস্ত কালীঘাটটাই যেন সেদিন ভেঙে পড়েছিল ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন-এর বাড়িটাতে। কয়েকজন লোকের মুখ হয়তো চিনতো দীপঙ্কর, কিন্তু নাম জানতো না। কাকাবাবু বাড়িতে নেই। তাঁর অবর্তমানেই সমস্ত লোক বাড়িটা তছনছ করে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলে। কোথায় কে কোন্ দিকে কাকে সামলাচ্ছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। রঘু, ঠাকুর, তারা দুজনে বোধহয় ভয়ে ভয়ে কিছুই বলতে পারছে না। আর তারা যা খুশি তাই করে চলেছে। ওপরের একখানা চেয়ার সোজা উঠোনে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গৈল। কাকাবাবু আর কাকীমার একটা জোড়া ছবি দেয়ালে টাঙানো ছিল, সেটাও কে যেন ছুঁড়ে মারলে ওপরে থেকে। কাঁচটা সিমেন্টের ওপর পড়ে ঝন্‌ঝন্ শব্দ করে ছত্রখান হয়ে গেল।

হঠাৎ সেই ভিড়ের মধ্যে কে যেন ডাকলে–দীপু–

দীপু তখনও সতীকে আড়াল করে রয়েছে। ফিরে চেয়ে দেখলে। বললে–এই যে আমি, মা–

আশ্চর্য! সেই ভিড়ের মধ্যে মা কেমন করে এল? একটুও ভয় করলো না! মা’র মাথার চুলগুলো এলিয়ে পড়েছে, আলুথালু, চেহারা।

–এসো মা এসো, চলো, ভয় কি–চলো আমার সঙ্গে–

কাকীমা সতী দুজনকে নিয়ে মা খিড়কির দরজা দিয়ে সোজা একেবারে তাদের নিজেদের বাড়িতে এনে তুলছে। শোবার ঘরের মধ্যে দুজনকে ঢুকিয়ে দিয়ে মা দরজাটা বন্ধ করে দিলে। সতীর চেহারার দিকে চেয়ে দেখলে দীপঙ্কর। অবস্থাটা যেন তখনও ভালো করে বুঝতে পারেনি সে।

মা বললে–আপনারা এখানে বসুন দিদি, কোনও ভয় নেই–

বাইরে থেকে তখনও শব্দ আসছে গোলমালের। অঘোরদাদু চিৎকার করছে নিজের ঘর থেকে–বাড়িটা ভেঙে ফেললে মুখপোড়ারা, আমার বাড়ি ভেঙে ফেললে–

কিন্তু তুমুল হট্টগোলের মধ্যে অঘোরদাদুর গলার শব্দটা বড় ক্ষীণ শোনালো, বাতাসে যেন মিলিয়ে গেল সে শব্দ। কেউ শুনতে পেল না।

আর খানিক পরেই অনেকগুলো মোটরগাড়ির শব্দ হলো গলির ওপর। চিৎকার উঠলো চারদিক থেকে। দুমদুম্ করে পিস্তলের গুলির আওয়াজ শোনা গেল। যারা এতক্ষণ লুটপাট করছিল তারা সবাই যে-যেখানে দিয়ে পারলে পালিয়ে গেল। উঠোনের ওপর দিয়ে দৌড়ে পালাবার শব্দ হচ্ছে। আর তাদের পেছনে যেন পুলিসের হল্লা। সার্জেন্ট পুলিসে ছেয়ে গেল বাড়ি। দেখতে দেখতে খাঁ খাঁ করতে লাগলো সমস্ত জায়গাটা। সব যেন চুপচাপ। দরজা বন্ধ ঘরের মধ্যে চারটে প্রাণী চুপ করে নিঃশব্দে সমস্ত শুনতে লাগলো।

কাকীমার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল।

মা বললে–কাঁদছেন কেন দিদি, আমরা তো রয়েছি।

দীপু রয়েছে, ভয় কী– কাকীমা বললেন–উনি যে বাড়ি নেই–

মা বললে–পুলিস এসে গেছে, আর ভয় কী–

কাকীমা আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন। বললেন–সব জিনিস-পত্তোর আমার চোখের সামনে ওরা ভেঙে দিলে দেখলাম–

মা জিজ্ঞেস করলে–আপনাদের তো কারো খাওয়াও হয়নি বোধহয়?

কাকীমা বললেন–আর খাওয়া-খাবার তৈরি করছিলুম সবে–

মা বললে–আমাদেরও কারো হয়নি দিদি, দীপুর জন্যে বসে ছিলুম আমি, এমন সময়–

সে-রাতটা যে কোথা দিয়ে কেমন করে কাটলো! দীপঙ্করের মনে আছে সে-রাত্রে সে স্তম্ভিত হয়ে ছিল অনেকক্ষণ ধরে। অনেকক্ষণ তার ভাবনা-চিন্তা যেন জট পাকিয়ে গিয়েছিল। সকাল-বিকেলের সমস্ত সংকল্পের সৌধ যেন তার হটাৎ এক মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। এতদিন যেন সে অন্ধের মতোন পৃথিবী সম্বন্ধে একটা ভুল ধারণা করে এসেছে। এতদিন পরে বোঝা গেল–কেন সেদিন কাকাবাবু কিরণের সঙ্গে মিশতে বারণ করেছিলেন। কেন কাকাবাবুর ঘরে দূরবীন থাকতো, কেন পাড়ার ছেলেদের চাঁদা দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতেন। কেন এত জায়গা থাকতে তাদের ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের বাড়িতে এসে ঘরভাড়া নিয়েছিলেন। কেন সময়ে-অসময়ে নানা জাতীয় নানা পোশাকে দেখা যেত কাকাবাবুকে। এতদিন সত্যিই যেন দীপঙ্করের একটা চোখ অন্ধ ছিল। পৃথিবীকে এক চোখে দেখার ফলই বোধ হয় এই। মানুষকে তবে কী দিয়ে বিচার করবে দীপঙ্কর? কেমন করে বিচার করবে সংসারকে? তবে কি মানুষকে সে এতদিন দু-চোখ দিয়ে দেখেনি? মানুষের বিচার করেছে কি শুধু স্বার্থ দিয়ে, সংস্কার দিয়ে? তাইতেই তার এই ভুল? মানুষ তো কত রকম আছে। পরিবারের মানুষ আছে, প্রয়োজনের মানুষ আছে, অজ্ঞাত-পরিচয় মানুষও আছে। মানুষের সেই পরিচয়টা কি তবে মিথ্যে? কেন তবে এতদিন কেউ জানায়নি তাকে খবরটা? কেন এতদিন বিশ্বাস করে এসেছিল দীপঙ্কর? বিশ্বাস করে ভালোবেসেছিল সবাইকে? ভালোবেসেছিল কাকাবাবুকে, ভালোবেসেছিল কাকীমাকে, লক্ষ্মীদিকে, এমন কি সতীকেও! দীপঙ্করের মনে হলো ওদের সবাইকে ভালোবেসে যেন নিজের অগোচরেই এতদিন একটা মহা লোকসান বুকের মধ্যে বয়ে বেড়িয়েছে! যে-লোকসানের আর কোনও খেসারত নেই কোথাও। কেন ওরা এতদিন বলে নি? কেন তবে এতদিন কেউ জানায়নি খবরটা?

চারিদিকে যখন পুলিসে-পুলিসে ছেয়ে গেছে বাড়িটা, যখন কয়েকজনকে ধরে ফেলেছে পুলিসে, কয়েকজন গুলির আঘাতে মরেছে, চোট খেয়েছে, তখনও দীপঙ্কর মন থেকে ভাবনাটাকে দূর করতে পারছে না। অনেক রাত্রে কাকাবাবুও এলেন। পাড়ার কোনও লোক ভয়ে এগোয়নি এদিকে। কাকীমা আর সতী পুলিসের হেপাজতে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। কাকাবাবুর মুখখানার দিকে চেয়ে দেখলে দীপঙ্কর। এই-ই কি সংসারের মানুষ? এই-ই কি প্রয়োজনের মানুষ, স্বার্থের মানুষের চেহারা? কিরণরা তো এদের বিরুদ্ধেই প্রাণ দিতে সঙ্কল্প করেছে। কিরণরা তো এদের জন্যেই বাড়ি-ঘর-সংসার ত্যাগ করে লুকিয়ে লুকিয়ে মৃত্যুর সাধনা করতে শুরু করেছে। ঘেন্নায় সমস্ত বুকখানা ছি ছি করে উঠলো দীপঙ্করের।

রাত তখন অনেক। মা নিজে খাওয়ালে কাকীমাকে। সতীকেও খাওয়ালে। সঙ্গে দীপুও খাচ্ছিল। কিন্তু গলা দিয়ে কিছু যেন তার নামছিল না। সমস্ত কালীঘাট নিষুতি। শুধু ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের উনিশের একের বি-তে তখন বাইরে পুলিসের গাড়ি পাহারা দিচ্ছে। চারদিকে টহল দিচ্ছে। কয়েকজনকে গাড়িতে করে ধরে নিয়ে গেছে থানায় কয়েকটা কুকুর তখনও শুধু ফাঁকা চিৎকার করছে রাস্তায়।

–দিদি?

বিন্তিদি ঘরের ভেতর থেকে একবার ডাকলে।

মা বললে–তুমি কিছু ভাবনা কোর না, ঘুমোও তুমি–

বিন্তিদি বললে–এবার দরজা খুলবো?

–না না, দরজা খুলো না। খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে, তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোও এবার।

বিন্তিদি আবার জিজ্ঞেস করলে–ওঁরা চলে গেছেন?

–না, ওঁদের জন্যেই বাইরে রয়েছি, ওঁদের খাওয়াচ্ছি,–তোমায় কিছু ভাবতে হবে না মা।

বিন্তিদি আবার ডাকলে–দিদি একবার শোন তো আমার কাছে–

মা কাছে গেল। জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলে–কী বলছো মা?

বিন্তিদি গলাটা নিচু করে বললে–ডাকাতরা চলে গেছে?

–হ্যাঁ, তুমি ঘুমোও, আর কথা বোলো না, অনেক রাত হয়েছে, শুয়ে পড়, শুয়ে পড়–

সমস্তক্ষণ কাকীমাও একটা কথা বলেন নি, সতীও একটা কথা বলেনি। দীপঙ্করও একটা কথা বলেনি। অনেক রাত্রে যখন রঘু এসে ডেকে নিয়ে গেল, পুলিস এসে পাহারা দিয়ে দুজনকে আবার বাড়ি নিয়ে গেল, তখনও কিছু কথা বলেনি কেউ। বাড়িতে আলো জ্বলল না। দরজা জানালা ভেঙেছে, আসবাবপত্র ভেঙেছে, বাসন-কোসন ভেঙেছে। আলমারিতে ট্রাঙ্কে যা কিছু ছিল সব তছনছ করে ফেলে দিয়েছে, লুটপাট করেছে। ওদিকে হালদারপাড়া, আর পশ্চিমে পাথরপটি, দক্ষিণে শা’নগর আর পুব দিকে হাজি কাশিমের বাগান–সমস্ত এলাকায় শোরগোল উঠে গেছে। সমস্ত অঞ্চলের অধিবাসীরা যে-যার বাড়ির মধ্যে দরজায় খিল বন্ধ করে প্রহর গুনছে।

–মা!

রাত্রের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দীপঙ্করের গলাটা কেঁপে উঠলো হঠাৎ।

–কী রে দীপু?

–কাকাবাবু পুলিসের সি-আই-ডি, তুমি জানতে? এতদিন ধরে এ-বাড়িতে আছে ওরা, এতদিন ওদের ওখানে যাচ্ছি, লক্ষ্মীদি সতী ওরা কেউ একদিনও বলেনি কাউকে! ভদ্রলোকের পাড়ার মধ্যে সি-আই-ডি-দের কেউ জেনেশুনে বাড়ি ভাড়া দেয়? তুমিই বলো তো! শোনবার পর থেকেই আমার খুব খারাপ লাগছে, জানো মা! এত বড় আশ্চর্য ঘটনা, অথচ কেউ বললে না আমাদের, আমরা জানতেই পারলুম না–

মা বললে–চুপ কর–

–চুপ করবো কেন? আমি সকালবেলাই বলবো কাকাবাবুকে। এ তো আমাদের ঠকানো, আমরা জানি না বলে, আমাদের ভালোমানুষ পেয়ে ঠকিয়েছেন আপনারা! আমরা যদি জানতুম তো ওদের সঙ্গে কি মিশতুম ভেবেছ?

-–তোর অত কথায় দরকার কী শুনি! ওরা পুলিসের লোক হোক আর যা-ই হোক, সে নিয়ে তোর অত মাথা ঘামাবার দরকার কী! ওই সব নিয়ে যেন কিছু আবার বলতে যেও না তুমি। অনেক কষ্টে তোমার চাকরি হয়েছে, শেষকালে ওই নিয়ে যদি মাথা ঘামাও তো চাকরি নিয়েই টানাটানি পড়বে তোমার! খুব সাবধান!

তারপর যথারীতি সকাল হলো। রোজকার মতো চন্নুনী উঠে সদর দরজা খুলে উঠোন ঝাঁট দিয়েছে। গোবর-ছড়া দিয়েছে। বাড়ির উঠোনে গতরাত্রের ইঁট-পাটকেল জমা হয়ে ছিল। জঞ্জাল জমেছিল বাড়ির চারদিকে। যেন ছোট-খাটো যুদ্ধ হয়েছে উঠোনে। জানালার ভাঙা কাঁচ, আলমারির পাল্লা, চেয়ারের পায়া সর্বত্র ছড়ানো। অঘোরদাদু ভোর না হতেই গালাগালি দিতে শুরু করেছে। বিন্তিদি অনেক বেলা করে দরজা খুলেছে। সমস্ত ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনটারই যেন ছন্নছাড়া মূর্তি। ভোরবেলাই বাজারে যেতে হয়েছে দীপঙ্করকে। এ দিকটার লোকজন কম। নেপাল ভট্টাচার্যি লেনের মোড়ে যেতেই ছোট ছোট জটলা জমেছে জায়গায় জায়গায়। সবাই জিজ্ঞেস করলে–কাল কী হয়েছিল ভাই তোমাদের বাড়িতে?

কেউ কেউ বললে–অঘোর ভট্টচার্যি শেষকালে সি-আই-ডি ভাড়াটে বসালে?

পাথরপটিতেও তার দিকে দু’একজন আঙুল দিয়ে দেখালে। এক-একজন ডাকলে–আপনাদের বাড়িতে রাত্তিরে কী হয়েছিল মশাই?

মধুসূদনের রোয়াকে সেদিন আর কারো চিহ্ন নেই। সবাই চুপি চুপি কথা বলছে। সবাই ফিস্ ফিস্ করে আড্ডা দিচ্ছে। রাস্তায়, রোয়াকে, দোকানে, বাজারে সর্বত্র ওই একই আলোচনা। এক রাত্রে ঘটনায় রাতারাতি উনিশের একের বি বাড়িটা বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। বাজারের থলি নিয়ে আসবার পথেও ওই এক আলোচনা। সবাই আজ তার দিকে নজর দিয়ে দেখছে। সে-ও যেন বাড়িটার সঙ্গে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে পড়েছে। সে-ও যেন সকলের আলোচনার বিষয়-বস্তু হয়ে উঠেছে রাতারাতি। বাড়ির কাছে আসতেই আবার সেই নির্জনতা। শুধু কয়েকটা লাল-পাগড়ি পুলিস বাড়ির সদর দরজার সামনে পাহারা দিচ্ছে লাঠি হাতে। কাল রাত্তিরে সেই যে পুলিস এসে ঘাঁটি করেছে, তারপরে আর নড়েনি তারা। বাজারে গিয়ে শোনা গেল নাকি পুলিস এসে পঞ্চাশজনকে ধরে নিয়ে গেছে। হাসপাতালে পাঠিয়েছে দশজনকে একজনের অবস্থা নাকি মরো মরো।

আজকে আর কাকাবাবুদের বাড়ির ভেতরে ঢোকা যাবে না। ঢুকতে গেলে পুলিস বাধা দেবে। পুলিসের অনুমতি নিতে হবে, তবে ঢুকতে পারবে। দীপঙ্কর পাশের দরজা দিয়ে নিজের বাড়িতে ঢুকে পড়লো। ভাত খেতে বসেও দীপঙ্কর একবার দোতলার দিকে চাইলে। আজ জানালা-দরজা সব বন্ধ। সব নিস্তব্ধ। কোথাও কোনও প্রাণস্পন্দনের চিহ্নটুকু নেই যেন বাড়িতে। বার বার চোখ তুলে দেখতে লাগলো দীপঙ্কর। কোথাও কোনও জানালা যদি একবার খুলে যায়; যদি চকিতে একবার দেখে ফেলে সতীকে।

সমস্ত যেন গোলমাল হয়ে গেল দীপঙ্করের।

খেয়ে-দেয়ে আপিস বেরোবার পথেও একবার দাঁড়াল রোয়াকের ওপর। শার্টের কলারটা একটু উঁচু করে দিলে। ধুতির কোঁচাটা ঠিক করলে বার বার।

–কী রে, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? দেরি হয়ে গেল যে! আপিসে যা

মা’র কথাতে যেন সম্বিৎ ফিরে এল। ন’টা বেজেছে। মা সকাল-সকালই ভাত করে দিয়েছে। এখনও দেড় ঘণ্টা হাতে। এখনও অনেক সময় আছে। মা’রই যেন তাড়া বেশি তার আপিসের জন্যে। মা’রই যেন ঘুম হচ্ছে না।

দীপঙ্কর বললে–এই তো যাচ্ছি মা, এখনও সময় আছে অনেক–

মা বললে–তা একটু সময় থাকাই ভালো, নতুন চাকরি, ঠিক সময়ে যাবে–

দীপঙ্কর আর একবার ঘরে গেল। পেন্সিল কলম নিতে ভুল হয়ে গিয়েছিল। আর একবার প্রণাম করলে ঠাকুরকে। তারপর আবার এসে দাঁড়াল বারান্দায়। মা তখন রান্নাঘরে ঢুকে গেছে। বিন্তিদি মা’র কাছে দাঁড়িয়ে আছে দরজায় হেলান দিয়ে। আমড়া গাছটার ভেতরে একটা ডালে সেই কাকটার দিকে হঠাৎ নজর পড়লো দীপঙ্করের। অনেক দিন দেখেইনি ওটাকে। এতদিন ভুলেই গিয়েছিল। সেই জোড়াটা মারা যাবার পর থেকেই ওইখানে এসে বসততা। দীপঙ্কর একদিন লক্ষ্মীদির দেওয়া চকোলেট দিয়েছিল ওকে। গপ্ গপ্ করে কাকটা সবগুলো চকোলেট খেয়ে ফেলেছিল সেদিন। আবার এতদিন পরে সব মনে পড়লো। সে-লক্ষ্মীদি নেই, সে-লক্ষ্মীদিও আর এখন সে লক্ষ্মীদি নেই। কত বিপদের মধ্যে দিন কাটছে লক্ষ্মীদির। খেতে পাচ্ছে না, ভয়ে ভয়ে একলা দরজা-বন্ধ ঘরে কাটিয়ে জ্বর বাধিয়ে ফেলেছে সেই লক্ষ্মীদি! আর সতী! সতীরও বড় খারাপ চলছে দিনগুলো। কাল সমস্ত শক্তি দিয়ে দীপঙ্কর সতীকে জড়িয়ে ধরে বাঁচিয়েছে। নইলে কী সর্বনাশ যে হতো কল্পনা করা যায় না।

দীপঙ্কর টিফিনের কৌটাটা খুলে তার ভেতর থেকে একটা পরোটা বার করলে। তার পর হাত বাড়িয়ে কাকটার দিকে ছুঁড়ে দিলে। বললে–আঃ আঃ-আঃ আঃ–

কাকটা টপ্ করে নেমে এল উঠোনের ওপর। তারপর গপ্ গপ্ করে পরোটটা খেতে লাগলো। পুরোপুরি যেন নিজের সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছে না। বার বার এদিক ওদিক চাইছে আর মুখে পুরছে–

দীপঙ্কর বললে−খা, খা, কেউ কিছু বলবে না–খেয়ে নে, পেট ভরে খেয়ে নে– পৃথিবীতে খাওয়া নিয়েই যত গণ্ডগোল, খাওয়া নিয়েই যত মারামারি, খাবার যোগাড় করতেই তো চাকরিতে ঢুকেছি, নইলে….

হঠাৎ একটা শব্দ হতেই দীপঙ্কর ওপর দিকে মুখ তুললে। দীপঙ্কর অবাক হয়ে চেয়ে দেখলে সতীদের বাড়ির দোতলার একটা জানালার একটা পাখি হঠাৎ উঁচু হলো। কে দেখছে ভেতর থেকে দেখা গেল না। হয়তো সতী, কিংবা হয়তো সতী নয়। সতীর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হলে কিছু বলতে পারতো। বলতে পারতো–সকাল থেকেই তোমাদের বাড়ি যাবার জন্যে খুব ইচ্ছে করছে, কিন্তু যাবো কী করে? চারদিকে যে পুলিস ঘিরে রয়েছে?

হঠাৎ জানালার পাখিটা আবার বন্ধ হয়ে গেল।

দীপঙ্কর খানিকক্ষণ হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল সেইদিকে চেয়ে। তারপর পাখিটা বন্ধ হয়ে যেতেই উঠোন পেরিয়ে সদর দরজা দিয়ে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে গিয়ে পড়লো।

২৪

নৃপেনবাবুর সঙ্গে আপিসেই দেখা। নৃপেনবাবু চাপরাশী দিয়ে ডাকে পাঠালেন। দীপঙ্কর ঘরে যেতেই নৃপেনবাবু বললেন–কী হয়েছিল তোমাদের পাড়ায়? কাল রাত্তিরে? শুনলাম নাকি পুলিস-টুলিস এসেছিল সব?

নৃপেনবাবুর ঘরটা ভালো। ছোট পার্টিশন-ঘেরা ঘর। এক-মানুষ মাথা পর্যন্ত কাঠের পার্টিশন। পাশেই অনেকগুলো ট্রে। ফাইল ভর্তি ট্রেগুলো। বাতাসা আর মুড়ি খাচ্ছিলেন ঠোঙায় করে। সব শুনে বললেন–তাই বলো, তোমাদেরই বাড়িতে? তা সি-আই-ডি কে কখনও ঘর-ভাড়া দিতে আছে!

তারপর আর এক গাল মুড়ি মুখে পুরে বললেন–তা এখনও পুলিস আছে নাকি?

দীপঙ্কর বললে–আপিসে আসবার সময় পর্যন্ত তো দেখে এলাম আছে–

–খুব সাবধান, আজকাল স্বদেশীওয়ালাদের সঙ্গে মোটে মেলামেশা নয়, বুঝলে, আমি তো স্বদেশীওয়ালাদের সঙ্গে মিশিনে, আবার পুলিসের সঙ্গেও মিশিনে, দুটোই সমান জিনিস–তা হ্যাঁ, ভালো কথা–

বলে নৃপেনবাবু গলা নিচু করলেন–একটা কথা বলে দিই তোমাকে শোন-কাছে এস–

দীপঙ্কর আরো কাছে সরে এল। নৃপেনবাবু মুড়ি খাওয়া থামিয়ে বললেন–দেখ, তোমার মা’কে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, তোমার চাকরির জন্যে যে তেত্রিশটা টাকা খরচা করতে হয়েছে, সেটা যেন কাউকে না বলে তোমার মা, বুঝলে? তুমি না হয় বেটা ছেলে, সেয়ানা ছোকরা, তুমি বলবে না জানি-কিন্তু তোমার মা তো মেয়েমানুষ, হয়তো কথায় কথায়…

সমস্ত শরীরটা দীপঙ্করের যেন গরম হয়ে উঠলো। মনে হলো এখনি এক ঘুষি মেরে নৃপেনবাবুর দাঁত ক’টা একেবারে ভেঙে উপড়ে দেয় ৷

–মনে থাকবে তো? ভুলো না যেন বলতে!

হঠাৎ বাইরের দিকের সুইং-দরজাটা ফাঁক করে কে যেন মুণ্ডু বাড়ালে। নৃপেনবাবু চমকে উঠে বললেন–কী রে? কী এনেছিস?

মুণ্ডুটা বললে–চপ্–নেবেন নাকি?

–কিসের চপ্?

মুণ্ডুটা বললে–পাঁঠার চপ–

–আর কী আছে?

–পাঁঠার চপ্, কালি ঘুগনিদানা, পরোটা, আলুর দম আর হাঁসের ডিমের কালিয়া–

মুণ্ডুটা এতক্ষণে ভেতরে এল। আপিসেরই চাপরাশী। খাকি উর্দি পরা। মাইনে নেয় আপিস থেকে, কিন্তু আসলে এই টিফিনের ব্যবসা করে। দাম নগদ দিতে হয় না। মাইনের দিন মাসকাবারি শোধ করলেই হয়ে যায়। লোকটা ঘরে ঢুকে পোঁটলাটা মেঝের ওপর নামালো। ময়লা ন্যাকড়ায় বাঁধা অ্যালুমিনিয়মের ডেকচি। একটার ওপর আর একটা সাজানো। নৃপেনবাবু চেয়ার বসে ঝুঁকে দেখতে লাগলেন। কালো আবলুস কাঠের মতো ডিমের ঝোল, তার নিচে আর একটা ডেকচিতে কাবুলি মটরের ঘুগনি, তার নিচে আলুর দম্ তার নিচে পাঁঠার চপ, তার নিচে থাক্ থাক্ পরোটা….

নৃপেনবাবু বললেন–চপ্ গরম আছে? দেখি, হাতে-গরম?

বলে ময়লা বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে চপগুলো ছুঁয়ে দেখলেন। দীপঙ্করের মনে হলো নৃপেনবাবুর জিভে জল আসছে এবার। আর চার দিন আছে রিটায়ার করতে, এগারোটা ছেলে-মেয়ের বাপ। দীপঙ্করেরই কেমন লজ্জা করতে লাগলো!

নৃপেনবাবু বোধ হয় বুঝতে পারলেন। মুখ তুলে বললেন–তা হলে তুমি যাও ভাই, ওই কথাই রইল, মাকে বলে দিও ঠিক

তারপর যেন সাফাই গাইবার সুরে বললেন–এই তো শেষ, আর চার দিন, তখন এ সব তো আর কেউ খাওয়াবে না হে–

দীপঙ্কর সবটা না-শুনেই বাইরে চলে এল। দীপঙ্কর দেখলে তাদের জার্নাল সেকশনেও ঠিক তাই। সদর-গেটে গুর্খা দারোয়ান রয়েছে, তবু কোথা থেকে দলে দলে ফেরিওয়ালারা আসতে আরম্ভ করেছে। একজন বাঁকে করে কী সব নিয়ে ঢুকলো। চিৎকার করে হাঁকতে লাগলো–চাই রসগোল্লা, পান্তুয়া, সিঙাড়া, নিম্‌কি

নতুন মুখ দেখে লোকটা একেবারে দীপঙ্করের কাছে এসে হাঁকলে–গরম সিঙাড়া আছে, নেবেন নাকি বাবু?

তারপর বিরাট এক কেটলি নিয়ে ঢুকে পড়লো এক চা-ওয়ালা। গরম চা, গরম চা হাঁকতে লাগলো সারা আপিসময়। হঠাৎ জার্নাল ঘাঁটতে ঘাঁটতে দীপঙ্করের যেন খেয়াল হলো। একবার চারদিকে চাইলে। কেউ নেই চেয়ারে। কে-জি-দাশবাবু একলা কাজ করছেন, আর বিড়ি খাচ্ছেন, আর সব চেয়ার ফাঁকা। কোথায় গেল সব? ছুটি নাকি? দীপঙ্করের কেমন অবাক লাগলো। তারপর আবার জার্নাল ঘাঁটতে শুরু করে দিলে। পাঁচটার মধ্যে এক বছরের জমানো জার্নাল সট করতে হবে। খানিক পরে সবাই ফিরে এল আবার। গাঙ্গুলীবাবু বললেন– বড়বাবু, চা এসেছে গেলাস দিন

এক গ্লাস চা এনেছেন গাঙ্গুলীবাবু। তা-ই চার ভাগ করা হলো। চার জনের গ্লাসে সমান মাপে ঢেলে দিলেন গাঙ্গুলীবাবু।

গাঙ্গুলীবাবু বললেন–আপনার গেলাস?

দীপঙ্কর বললে–গেলাস তো নেই আমার–

–সে কি? এখনও গেলাস পান নি? যান, স্টোর থেকে গেলাস নিয়ে আসুন। বড়বাবুকে দিয়ে ইনডেন্ট স্লিপ করিয়ে নিয়ে যান, হাতে হাতে গেলাস নিয়ে আসুন– নইলে লোপাট হয়ে যাবে–

এ-সব সেই কোম্পানীর যুগের ইতিহাস। রেলওয়ের হোম বোর্ড থাকে বিলেতে। সেখানে ডিরেক্টরদের মিটিং বসে। এখানে রেলওয়ে বোর্ড আছে। নিয়ম করে রিপোর্ট যায় বোর্ডের আপিসে। রেলের লোকদের সুখ-সুবিধের জন্যে একুনে এত কোটি টাকা খরচ হলো হাল সনে। আসছে বাজেট-ইয়ারে আরো এত কোটি টাকা খরচ করতে হবে। কিন্তু আসলে রেলওয়েম্যানদের সুখ-সুবিধের কথাটা গৌণ। শুধু রেলওয়েম্যান কেন, ইন্ডিয়ার একত্রিশ কোটি পাঁচ লক্ষ লোকের সুখ-সুবিধের কথাটাও গৌণ, আসল কথা হলো মুনাফা। পৃথিবীর বাজারে ইংলন্ডের পাউন্ডের তখন বড় খাতির। ফ্রান্সের কাছে খাতির, আমেরিকার কাছে খাতির, জার্মানির কাছে খাতির, রাশিয়ার কাছেও তখন খাতির। তখন নর্থ আমেরিকা আর রাশিয়া হলো ইংরেজদের ক্ষেত, চিকাগোতে হলো খামার, কানাডায় হলো অরণ্যসম্পদ, অস্ট্রেলিয়াতে মাংস, সাউথ আমেরিকায় ষাঁড়। পেরু থেকে রূপা আসে লন্ডনে, আর ক্যালিফোর্নিয়া আর অস্ট্রেলিয়া থেকে সোনা আসে, চায়না থেকে আসে চা, মালয় জাভা থেকে আসে চিনি আর মশলা। ফ্রান্স হলো ইংলন্ডের আঙুরের তে, মেডিটারেনিয়ন হলো ফলের বাগান, আর তুলো তো তখন সব জায়গাতেই জন্মায়। আর বাকি রইল ইন্ডিয়া। ইন্ডিয়া হলো কামধেনু। অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের দু’কোটি লোকের জন্যে কিছু খরচ করা বরং ভালো–কারণ তারা সাদা চামড়া, স্বজাতি। কিন্তু একত্রিশ কোটি পাঁচ লক্ষ ইন্ডিয়ানদের জন্যে কিছু করে লাভ নেই। তারা নেটিভ। নেটিভদের জন্যে একখানা করে জানালাহীন কোয়ার্টার করলেই চলবে। ট্রেনে নেটিভদের কামরায় পায়খানা না করলেও চলবে, আপিসের ক্লার্কদের জন্যে ভাঙা একটা টেবুল, আর ছারপোকাওয়ালা একটা চেয়ার হলেই যথেষ্ট। আর মাইনে? ব্রিটিশ অফিসার যাঁরা, অর্থাৎ ডাইরেক্ট অ্যাপয়েন্টমেন্ট, তাঁদের গ্রেড যদি হয় বারো শ–তাহলে নেটিভ কেরানীদের মাইনে হওয়া উচিত তিরিশ, কিন্তু দেওয়া হচ্ছে নব্বুই। যথেষ্ট, যথেষ্ট! সাফিসিয়েন্ট

একদিন রবিন্‌সন সাহেব ডেকে পাঠিয়েছিলেন। চাপরাশী এসেই বললে–সেনবাবু, সা’ব বোলায়া–

কে-জি দাশবাবু অসন্তুষ্টই ছিলেন আগে থেকে। বললেন–যান, এখন সাহেবকে কী বোঝাবেন বোঝান গিয়ে–

দীপঙ্কর একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বললে–কেন, কী হয়েছে কে-জি-দাশবাবু?

–আপনি ড্রাফ্ট পাঠিয়েছেন সোজা সাহেবের কাছে? আমাকে একবার দেখিয়ে পাঠাতে পারলেন না? এখন ঠেলা বুঝুন–কী লিখেছেন সাপ ব্যাং কে জানে, লেখাপড়া জানা লোক নিয়ে এই হয় মুশকিল-অস্ব সাহেবের নিজের হাতের লেখা ড্রাফ্ট রয়েছে ফাইলের তলায়, একবার চোখ তুলে দেখতেই আলস্য?

দীপঙ্কর সোজা সাহেবের ঘরে গেল। সুইং-ডোর খুলে ঢুকতেই একটা কানঝোলা কুকুর জিভ বার করে বসে আছে। কামড়াবে নাকি? দীপঙ্কর একটু পেছিয়ে এল।

সাহেবের গলা শোনা গেল–কাম্ ইন্‌–ভেতরে চলে এসো–

দীপঙ্কর টিপি টিপি পায়ে ভেতরে গিয়ে বিরাট ঘরজোড়া টেবলটার সামনে ফাঁসির আসামীর মতো দাঁড়াল। সাহেব চুরোট খাচ্ছিলেন। চুরোট মুখে দিয়ে বললেন–

কিন্তু কী বললেন তার এক বর্ণও বোঝা গেল না। বোবার মতো দীপঙ্কর সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল। গা দিয়ে তখন দর দর করে ঘাম ঝরতে শুরু করেছে। হঠাৎ মনে হলো যেন পায়ের তলা থেকে তার মাটি সরে যাচ্ছে। এ কোন্ ইংরেজী! কলেজে তো ইংরিজী লেকচার বুঝতে পেরেছে, ইংরিজী বই পড়লে তো বুঝতে পারে, লিখতেও তো পারে। কলেজ ম্যাগাজিনে তো দীপঙ্কর ‘এসে’ লিখেছে। কিন্তু এ কী হলো! সাহেবের মোটা ঠোঁট, তার ওপর চুরোট ধরিয়েছে–একটা কথা বোঝা যাচ্ছে না। শুধু গোটাকতক হাউ হাউ শব্দ বেরাচ্ছে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে। সাহেব আবার কথাটা বললে। আবার সেই হাউ হাউ শব্দ! সাহেব আবার বললে। আবার হাউ হাউ শব্দ।

শেষে হাত নেড়ে বললে–গো–যাও–

দীপঙ্কর হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো তার। সেক্‌শনে আসতেই সাহেবের ঘর থেকে চাপরাশী কে-জি-দাশবাবুকে ডেকে নিয়ে গেল। কে-জি দাশবাবু খুলে রাখা কোটটা গায়ে দিয়েই দৌড়লেন। দীপঙ্কর নিজের চেয়ারে বসেই তখন ঘামছে। ছি, এত বড় লজ্জা, ইংরিজী ভাষাটা বুঝতেই পারলে না সে! লোকে কী ভাববে! ইংরিজী বুঝতে না-পারার লজ্জায় সেদিন দীপঙ্করের যেন মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল একেবারে।

মিনিট পনেরো পরে হাসতে হাসতে কে-জি-দাশবাবু ফিরে এলেন। আবার কোট খুলে রেখে দিলেন চেয়ারে।

–কী হলো, আপনি সাহেবের কথা বুঝতেই পারলেন না? সে কি মশাই?

গাঙ্গুলীবাবু বললেন–তা সেনবাবুকে ডেকেছিল কেন রবিন্‌সন্ সাহেব?

কে-জি-দাশবাবু বললেন–আপনাদের নিয়ে মশাই, আমার হয়েছে জ্বালা, কিছু পড়বেন না, শিখবেন না, সাহেবের ইংরিজী কথাও বুঝতে পারবেন না, তাহলে কাজ চলবে কী করে?

গাঙ্গুলীবাবু দীপঙ্করকে চুপি চুপি বললে–কী বললে আপনাকে সাহেব?

দীপঙ্কর বললে– সাহেবের কথা আমি কিছুই বুঝতে পারলুম না–

গাঙ্গুলীবাবু বললেন–রবিন্‌সন সাহেবের কথা একটু জড়ানো, একটু অভ্যেস হলেই বুঝতে পারবেন, প্রথম প্রথম আমারও অসুবিধে হতো–আসলে সাহেব লোক ভালো, ওই কুকুরটা দেখলেন, ওই কুকুরই হলো সাহেবের ছেলেমেয়ে যা-বলুন সব–

দীপঙ্কর বললে–সাহেব বোধহয় আমার ওপর খুব চটে গেছে–

–তা চটলে আপনি আর কী করবেন?

দীপঙ্কর বললে–এখানেই তো সারাজীবন কাটাতে হবে, এই রকম চটে থাকলে চাকরি করবো কী করে? কেউ আমার ওপর মুখ ভার করে থাকলে আমার যে মোটে ভালো লাগে না

এতদিন পরে প্রথম দিনের ঘটনাটা যেন আজো স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন দীপঙ্করের মনে হয়েছিল তার মাথার ওপর কে যেন সংসারের সমস্ত অগৌরবের বোঝা, সমস্ত লজ্জা উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে। সামান্য ইংরিজী না-বোঝার কলঙ্ক যেন তাকে একেবারে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। যেন মাথা তুলে তাকাবার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত কে তার হরণ করে নিয়েছে। আবার মনে হয়েছিল কেন সে এল এখানে? এখানে না এলে সে তো তার লজ্জা-সম্ভ্রম বাঁচিয়ে চলতে পারত। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের সরু গলিটার গণ্ডীর মধ্যে লক্ষ্মীদি সতী বিন্তিদি আর অঘোরদাদুর আওতার ভেতরে সে তার দারিদ্র্য ঢেকে রাখতে পারত। কেন ধরা পড়তে গেল এমন করে? কেন তাকে রবিন্‌সন সাহেব ডেকে পাঠালো?

পরের দিনই কিন্তু বোঝা গেল সব। কে-জি-দাশবাবু সাহেবের ঘর থেকে এসেই কোট খুলতে খুলতে বললেন–যান মশাই, এ-সেকশনে আপনাকে আর রাখবে না–

–কেন?

সেকশন সুদ্ধ লোক অবাক হয়ে চাইলে কে-জি-দাশবাবুর দিকে। কে-জি-দাশবাবুর হাতে একটা স্লিপ। স্লিপটার দিকে চেয়ে একমনে যেন কী পড়তে লাগলেন তিনি। বুকটা ভয়ে দুর দুর করতে লাগলো। আবার এ কোন্ বিপত্তি! আসতে-না-আসতেই এ-সব কী ঝঞ্ঝাট! এ-সেকশনের সবাই এই সেকশনেই ঢুকেছে, এই সেকশনেই রয়েছে।

কে-জি-দাশবাবু বললেন–যান্, দোতলায় ট্র্যানজিট্ সেকশনে আপনাকে ট্র্যান্সফার করে দিয়েছে সাহেব

গাঙ্গুলীবাবুই জিজ্ঞেস করলেন–কেন? হঠাৎ এমন অর্ডার দিলে যে সাহেব?

–আর কেন, সেই কালকের ব্যাপার। কথা না-বুঝতে পারলে সাহেব ক্ষেপে যাবে না?

কোথায় ট্র্যানজিট্ সেকশন, কেমন মানুষ সেখানকার বড়বাবু, কিছুই জানা নেই। এখানে এক দিনের মধ্যেই বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। একদিন যে-রেলের প্রত্যেকটি নাড়ী-নক্ষত্রের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, এ তারই সূত্রপাত তখন। একটি সেকশন থেকে আর একটি সেকশন। যে-বাড়িটায় একদিন ঢোকবার প্রথম দিনে। বিতৃষ্ণা হয়েছিল, তার সঙ্গেই যে আবার একদিন এত ঘনিষ্ঠ পরিচয় হবে, তাই-ই কি সে তখন ভাবতে পেরেছিল! তখন জাপানের সঙ্গে ভারি ভাব ইংরেজদের। জাপান তখন আয়রন-ওর কিনছে ইন্ডিয়া থেকে। জাপান ভালো খদ্দের, নগদ টাকা দেয়। হাজার-হাজার ওয়াগন ভর্তি আয়রন-ওর চালান যায় জাপানে। লোহার গুঁড়ো। ইন্ডিয়ান খনি থেকে লোহার গুঁড়ো ওয়াগনে ঢেলে, সেই ওয়াগন চালান দিতে হবে কলকাতা আর ভাইজাগাপটম্-এর পোর্টে। যেখানে যত ওয়াগন আছে সব জড়ো করেছে রেল-কোম্পানী। কাজের আর কামাই নেই রেল আপিসে। দিন-রাত জেগে কন্ট্রোলারলা ওয়াগন ডেলিভারি দিচ্ছে। আর হেড-আপিসে তার হিসেব রাখতে হয়। ট্র্যানজিট্ সেকশনে স্টেটমেন্ট তৈরি হয় কত ওয়াগন লোহা রোজ জেটিঘাটে ডেলিভারি দেওয়া হলো। আসলে জাপান তখন সভ্য হয়েছে। জাতে উঠছে। রাশিয়াকে যুদ্ধ করে হারিয়ে দিয়েছে। কোরিয়া দখল করে নিয়েছে, মাঞ্চুরিয়াও নিয়েছে। ইংরেজরা কিছু বলছে না। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই তখন। চীনের লীগ অব্ নেশানস্-এর কাছে দরখাস্ত করেও কিছু লাভ হয়নি। তুমি যত ইচ্ছে চীনেদের মারো, বোমা ফেলে মেরে ফেল সবাইকে, কিছু বলবো না। আমার সাংহাইতে হাত না-পড়লেই হলো। তা ছাড়া জাপানকে লোহা বেচে অনেক মুনাফা। চারদিকে যখন ডিপ্রেশন তখন কাঁচা টাকা কে দেয়? এ সুযোগ ছাড়া চলবে না। রেল আপিসগুলো রাত নেই দিন নেই, লোহাই পাঠাচ্ছে কেবল। জাপান-ট্র্যাফিক নিয়ে তখন রেল-কোম্পানীর মস্ত মাথা-ব্যথা। সকাল বেলাই ঘুম থেকে উঠে রবিন্‌সন সাহেব কোয়ার্টার থেকে টেলিফোন করে আপিসে–জাপান-ট্যাফিকের ফিগার আজ কত?

তখন ভোর বেলা আপিসে যেতে হয় দীপঙ্করকে। ঘুম থেকে উঠেই আপিস। বেলা করে বাড়ি ফেরা। ট্রানজিট সেকশনের কেরানী আর তখন নয় দীপঙ্কর। সোজা একেবারে রবিন্‌সন সাহেবের খাস কর্মচারী। সারাদিন সেকশনে সেকশনে ঘুরে ফিগার আদায় করতে হয়। সেই ফিগার আবার টোট্যাল করতে হয়। ডিস্ট্রিক্ট থেকে টেলিফোনে ফিগার নিয়ে পোস্ট করতে হয়। তারপরে সেই ফিগার জড়ো করে স্টেটমেন্ট তৈরি হবে। স্টেটমেন্টের এক কপি যাবে রেলওয়ে বোর্ডে, আর এক কপি যাবে বিলেতের হোম বোর্ডে। আসল মালিকের কাছে। যারা দেশকে বোঝে না, যারা বোঝে শুধু পাউন্ড শিলিঙ-পেনস্। কাজ করতে করতে দীপঙ্করের মাথা থেকে পা পর্যন্ত একেবারে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তো। স্টেটমেন্ট দিতে একটু দেরি হলেই ওদিক থেকে ঘোষাল সাহেব হুমকি দিতো। কিন্তু আশ্চর্য, সেদিন রবিন্‌সন সাহেব তো জানতো না যে, সেই লোহার গুঁড়োই আবার বোমা হয়ে একদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মাথার ওপরেই এসে পড়বে। সিঙ্গাপুর, মালয়, বর্মা থেকে শুরু করে একেবারে কলকাতার হাতিবাগানই নয়, খাস লন্ডনের ওপরেই পড়ে ফেটে চৌচির হবে! আর শুধু রবিন্‌সন সাহেবও নয়, ঘোষাল সাহেবও নয়, রেল কোম্পানীও নয়, দিল্লীর রেলওয়ে বোর্ডও নয়, এমন কি, বিলেতের হোমবোর্ডও নয়; ইন্ডিয়ার ভাইসরয় ব্যারন আরউইন সাহেবও জানতো না, ইংল্যান্ডের প্রাইম মিনিস্টার ম্যাকডোন্যাল্ড সাহেবও জানতো না।

অথচ সেদিন সেই লোহার ওয়াগন পাঠাতে দীপঙ্করকে কত খাটুনি খাটতে হয়েছে। সারা আপিসে বহু লোক হিমসিম খেয়ে গেছে একেবারে। ট্র্যানজিট সেকশনের ভেতরে ঢোকবার মুখে এক-একদিন দেখা হয়ে যেত গাঙ্গুলীবাবুর সঙ্গে। বলতেন–কেমন আছেন সেনবাবু?

দীপঙ্কর বলতো–আর মাথা তোলবার সময় নেই গাঙ্গুলীবাবু–

গাঙ্গুলীবাবু বলতেন–তা না-ই বা পেলেন, এত তাড়াতাড়ি গ্রেড তো পেয়ে গেলেন–

দীপঙ্কর বললে–সে তো জাপান-ট্র্যাফিকের জন্যে, নইলে স্পেশ্যাল পোস্ট তৈরি হতো কী আর?

–আসলে তা নয় মশাই, আপনার ড্রাফট্ রবিনসন সাহেবের ভালো লেগেছিল, তাই এত লোক থাকতে আপনাকে নিয়েছে–

দীপঙ্কর বললে–তাই নাকি?

গাঙ্গুলীবাবু বললেন–হ্যাঁ, কে-জি-দাশবাবু যে বললে। বললে–ছোকরা সাহেবের ইংরিজী বুঝতে পারে না বটে, কিন্তু ছোকরার ইংরিজী ড্রাফট্ দেখে রবিন্‌সন্ সাহেব তারিফ করেছে হে–ছোকরা একদিনেই সাহেবের নেক নজরে পড়ে গেছে–

যাবার সময় গাঙ্গুলীবাবু বলে গেলেন–সবই ভাগ্য সেনবাবু, সবই ভাগ্য, নইলে দেখুন না বারো বছর চাকরি করার পর পঁচাত্তর টাকা হাতে পাই, কো-অপারেটিভ্ ব্যাঙ্কের লোন নিয়েছিলাম বউ-এর অসুখের সময়, তাই আজ চার বছর ধরে কাটছে–

দীপঙ্কর বললে–আপনি একদিন বলেছিলেন আপনার সব হিস্ট্রি বলবেন–

গাঙ্গুলীবাবু বললেন–আজ নয়, আর একদিন বলবো, তবে বড় হয়ে গেলে আমাদের মনে রাখবেন ভাই, এই বলে রাখছি, তখন যেন আবার ঘোষাল সাহেবের মতো হয়ে যাবেন না

কথাটা শুনে দীপঙ্করের হাসি পেয়েছিল সেদিন। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের পরের গলগ্রহ, নগদ তেত্রিশ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি হওয়া জীবন, সে হবে বড়, সে ভুলে যাবে! যেন দীপঙ্কর গরীব হওয়ার দুঃখ বোঝে না, যেন দীপঙ্কর অর্থাভাব কাকে বলে জানে না! যেন তার মা পরের বাড়ির রান্না করে, মুড়ি ভেজে, কাঁথা সেলাই করে তাকে মানুষ করেনি! তার চাকরি হওয়া যে কী জিনিস তা গাঙ্গুলীবাবু কে-জি-দাশবাবু কেমন করে বুঝবে!

সন্ধ্যার অনেক পরে ড্রয়ারের ভেতর কলম পেন্সিল অ্যালুমিনিয়ামের গেলাস সব কিছু পুরে চাবি দিয়ে তখন বেরিয়ে আসতে হয় ফাঁকা আকাশের তলায়। এতক্ষণ যেন পৃথিবী ভুলে গিয়েছিল দীপঙ্কর। রেলের আপিসের মধ্যে এতক্ষণ যেন তার নিজের সত্তা বলতে কিছু ছিল না। পৃথিবীটা যে এত বড়, পৃথিবীতে যে এত গোলমাল তা-ও যেন ভুলে গিয়েছিল। শুধু মনে ছিল হোম বোর্ড, শুধু মনে ছিল রেলওয়ে বোর্ড, শুধু মনে ছিল রবিন্‌সন সাহেব আর ঘোষাল সাহেব। আর তার চেয়েও বেশি করে মনে ছিল জাপান-ট্র্যাফিক! খবরের কাগজে সকাল বেলা দেখা যায় বড় বড় হরফে লেখা আছে–জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ। সাংহাইতে আর চাপেইতে অমানুষিক বোমাবর্ষণ। হাজার হাজার নিরীহ অধিবাসীর ওপর জাপানের নৃশংস অত্যাচার। আর আপিসে এসেই রবিন্‌সন সাহেবের প্রথম প্রশ্ন–হাউ ইজ্ দি জাপান-ট্র্যাফিক টো-ডে?

রাস্তায় বেরিয়ে সেই সন্ধ্যেবেলায় কিন্তু সে-খবর কিছুক্ষণের জন্যে ভুলে যায় দীপঙ্কর। তখন মনে পড়ে লক্ষ্মীদির কথা। তখন মনে পড়ে সতীর কথা। লক্ষ্মীদির কী করে চলবে? দাতারবাবুর যদি সত্যিই জেল হয়ে যায়? আর সতী? সমস্ত কালীঘাটসুদ্ধ লোক যখন বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল তখন সত্যিই যদি সতীর গায়ে হাত তুলতো তারা? দীপঙ্কর নিজের সমস্ত শরীরটা নিজের হাত দিয়ে অনুভব করলে। তার এই শরীরের সঙ্গে সতীর শরীরটাও একাকার হয়ে গিয়েছিল তখন। সতী তার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে নিশ্চিন্তে নির্ভর করে ছিল। বাইরের সমস্ত ঝড়-ঝাঁপটা থেকে যেন একমাত্র দীপঙ্করই তাকে বাঁচাতে পারে। দীপঙ্করের মনে হচ্ছিল যেন আরো অত্যাচার হোক, আরো লুটপাট হোক, তবু সতীকে সে তো বুকের মধ্যে পেয়েছে। তারপর কখন পুলিস এল, কখন সবাই পালিয়ে গেল, সব যেন স্বপ্নের মতো ঘটে গেছে।

দীপঙ্কর রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াল। কোন্ দিকে যাবে? লক্ষ্মীদির বাড়ির দিকে, না ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে। কালকের ঘটনার পর সতী যদি বর্মায় চলে যায়। তা ছাড়া লক্ষ্মীদির তো অনেক লোক আছে। তারা এসে লক্ষ্মীদির সঙ্গে বসে বসে গল্প করে। সে ভাষাও বোঝে না দীপঙ্কর। ওখানে এখন না-গেলেও ক্ষতি নেই। সতীর সঙ্গেই আগে দেখা করা দরকার। সতীদের বাড়ির জিনিসপত্র ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে–কাকাবাবু থাকলে কী এসব হতে পারতো!

সকালে আপিসে আসবার সময়ই কয়েকজন তার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে।

আশ্চর্য, যেন সেই-ই অপরাধী! যেন সি-আই-ডি’কে বাড়ি ভাড়া দেওয়া তারই অপরাধ। অথচ তখন সবাই চাঁদা নিয়েছে মোটা মোটা টাকার কাকাবাবুর কাছ থেকে। শ্মশান-কালী পুজো, সরস্বতী পুজো, দুর্গা পুজো, কালীঘাট বাজারের রক্ষে-কালী পুজো–কোন্ জয়গায় চাঁদা দেননি কাকাবাবু! হালদার পাড়া লেন থেকে ফুটবল ক্লাবের চাঁদা চাইতে এসেছে কাকাবাবুর কাছে। অথচ এক মুহূর্তে সব ধূলিসাৎ হয়ে গেল। সেই কিরণ, কিরণই আজ কাকাবাবুর সম্পর্কে বলে-ভালো লোক নয়। সমস্ত কালীঘাটের লোকের কাছেই এখন কাকাবাবুরা রাতারাতি খারাপ লোক হয়ে গেল। আশ্চর্য!

সংসারে এমনিই হয় বোধহয়। এইটেই বোধহয় নিয়ম!

দলে দলে লোক চলেছে ফুটপাথ দিয়ে। এই সেদিন কিড্ স্ট্রীটের ধার দিয়ে চলতে চলতে বোআ ফাটিয়েছিল কিরণদের দল। তাড়াতাড়ি রাস্তাটা পার হয়ে এল দীপঙ্কর। আজকাল কাউকেই বিশ্বাস নেই, সমস্ত কলকাতা শহরটা সি-আই-ডি’তে ভরে গেছে। বাড়ির গয়লা, ধোপা–তারাও ইনফরমার হয়েছে। দুধ দেবার নাম করে বাড়িতে বাড়িতে খবর নিয়ে বেড়ায়। ট্রামের ভেতরেও মন কুলে কথা বলা বিপদ। আশে-পাশের সমস্ত লোকগুলোর দিকে চেয়ে দেখলে দীপঙ্কর। এদের মধ্যেই হয়তো কত লোক সি আই-ডি। কত লোক ইনফরমার। সত্যিই ইংরেজ-রাজত্ব না-গেলে আর উপায় নেই। গান্ধী যখন ভাইসরয় হয়ে বসবে, অন্তত একটা সুবিধে হবে, মন খুলে কথা বলা যাবে। এমন ঘরে ঘরে সি-আই-ডি আর থাকবে না তখন। এত যে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে এর কারণ কী? কালীঘাট বাজার থেকে এই সেদিনও চাল কিনে এনেছে। ভালো বাঁকতুলসী চাল ছ’টাকা মণ। আর এমনি সাধারণ চাল চার-পাঁচ টাকা। তা চালের দাম ও কমবে বৈ কি! তখন তো আর সব টাকা বিলেতে চলে যাবে না! দেশের টাকা দেশেই থাকবে। দুনিকাকারা বলে–কংগ্রেস গভর্নমেন্ট হলে নাকি তিন টাকা মণ চাল হয়ে যাবে। তখন প্রাইম মিনিস্টারের মাইনে হবে পাঁচশো টাকা। পাঁচশোর বেশি কারো মাইনে হবে না। কিন্তু ইংরেজরা কি অত সহজে যাবে! চিয়াংকাইশেক যেমন চায়নাকে স্বাধীন করে দিয়েছে, এই রকম একটা লোক ইন্ডিয়ায় থাকলে কবে স্বরাজ এসে যেত দেশে। চীনেম্যানরা সত্যিই ভাগ্যবান।

কালীঘাট ট্রাম ডিপোয় নেমে অলি-গলি দিয়ে রাস্তা।

–শুনুন, ও দীপঙ্করবাবু, শুনুন

দীপঙ্কর সামনে এগিয়ে গেল। লোকটা বললে–কালকে কী হয়েছিল মশাই? আপনাদের বাড়িতে?

সেই একই প্রশ্ন, সেই একই উত্তর। সকাল থেকে একই উত্তর দিতে হয়েছে সকলকে।

দীপঙ্কর বললে–আমরা তো জানতাম না, জানলে কী আর কেউ বাড়ি ভাড়া দেয় সি-আই- ডি’কে?

রাস্তায় আসতে আসতে ঘটনাটা আবার মনে পড়লো। সতী কী তেল মাখে মাথার চুলে? দীপঙ্করের বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিল মাথাটা। অদ্ভুত একটা গন্ধ বেরোচ্ছিল চুল থেকে। গন্ধটা ভারি মিষ্টি। গন্ধটা যেন মন জুড়িয়ে দেয়। সেদিনকার পাউডারের গন্ধটার চেয়েও মিষ্টি গন্ধ। সতীর কাছে তেলটার নাম জেনে নিতে হবে। খানিকটা হাতেও লেগেছিল। মাথাটা এই হাত দিয়েই দীপঙ্কর চেপে ধরেছিল। দীপঙ্কর হাতের আঙুলটা নাকের কাছে এনে ধরলে। যেন কালকের গন্ধটা এখনও একটু একটু আঙুলে লেগে আছে। কী চমৎকার গন্ধ!

বাড়ির কাছে আসতেই দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল!

বাড়ির সামনে যেন এইমাত্র একটা ট্যাক্সি এসে থামলো। ঠিক উনিশের একের-বি র সামনে। অনেক দূর থেকে বোঝা গেল ঠিক তাদেরই বাড়ির সামনে। তখনও পুলিস দাঁড়িয়ে আছে। একজন সার্জেন্ট টুলের ওপর বসে আছে–আর কয়েকজন লালপাগড়ী পরা পুলিস। কালকে ঘটনা ঘটে গেছে, আর এখন পর্যন্ত পুলিস। দীপঙ্কর দেখলে-ট্যাক্সিটা আসতেই ভেতর থেকে রঘু দৌড়ে এসেছে। ট্যাক্সি থেকে নামলো একজন ভদ্রলোক। চমৎকার চেহারা ভদ্রলোকের। সামান্য একটু ছুঁচলো দাড়ি কোঁকড়ানো মাথার চুল। ট্যাক্সি থেকে বিছানা-বাক্স মাল-পত্র নামলো। কাকীমা বাইরে এসেছে। সতীও এসেছে। কাকাবাবু হেসে হেসে কথা বলতে বলতে ভদ্রলোকের সঙ্গে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন। ট্যাক্সিতে আরো দু’জন লোক ছিল। তারাই জিনিসপত্র নামাতে লাগলো। মাল অনেক, নামাতেও সময় লাগবার কথা। কে এল? বর্মা থেকে যদি হয় তো বাবা নাকি! অনেকটা তো সতীর মতই চেহারা, বেশ লম্বা ফর্সা কোঁকড়ানো চুল!

দীপঙ্কর বাড়ির মধ্যে ঢুকছিল। কিন্তু একটু সঙ্কোচ হলো। সমস্ত বাড়িটা পুলিসে পাহারা দিচ্ছে। কাল রাত থেকেই বসে আছে সবাই। সার্জেন্টের কোমরে পিস্তল ঝুলছে। পুলিসের হাতেও লম্বা লম্বা লাঠি। একটু সরে এসে দাঁড়াল। দূর থেকেই দেখতে লাগলো। হোল্ড-অল নামলো, ট্র্যাঙ্ক, সুটকেস নামলো। হ্যাট, ছাতা ছড়ি, অ্যাটাচি কেস, ব্যাগ–নানা রকম জিনিস বোঝাই হয়ে গেল।

–রঘু!

রঘু পেছন ফিরে চাইল দীপঙ্করের দিকে।

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কে এল তোমাদের বাড়িতে রঘু?

রঘু বললে–বড়বাবু, বর্মা মুলুক থেকে এসেছে–

লক্ষ্মীদির বাবা! সতীর বাবা! ভুবনেশ্বর মিত্র!

কথাটা বলেই রঘু জিনিসপত্র নিয়ে ভেতরে চলে গেল। দুজনে, যারা এসেছিল ভুবনেশ্বরবাবুর সঙ্গে তারাও ভেতরে ঢুকে গেল। ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলে। বাইরে একটা বেঞ্চিতে পুলিসরা লাঠি নিয়ে বসে আছে। সার্জেন্টটা বসে আছে পিস্তল নিয়ে। এ-রাস্তা দিয়ে আ লোক চলাচল বন্ধ হয়ে গেলেও ওদিকের নতুন সদানন্দ রোড দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে সবাই।

বাড়িতে ঢোকবার মুখেও ভালো করে দেখে নিলে দীপঙ্কর। সারা রাতই আজ ওরা পাহারা দেবে হয়তো। ভাড়াটেদের বাড়িটার জানলার কাঁচাগুলো ভেঙে গেছে। একদিনেই যেন হতশ্রী হয়ে গেছে বাড়িটার চেহারা। এই বাড়িতেই ছোটবেলা থেকে তার অধিকার ছিল অবারিত। এই বাড়ির সঙ্গেই তার ছোটবেলার জীবনটা জড়িয়ে গিয়েছিল। সেই সবে একদিন লক্ষ্মীদি এসেছিল। অঘোরদাদু তখন শক্ত-সমর্থ মানুষ। তখন চীৎকার করে করে গালাগালি দিত। তখন থেকে সুখে-দুঃখে ছোট থেকে বড় হওয়ার বিবর্তনে দীপঙ্করের জীবনে এ-বাড়িটাও যেন নির্দিষ্ট একটা স্থান দখল করে নিয়েছিল। আরও নানান রকম সংস্পর্শের সঙ্গে এরও একটা নিজস্ব দান ছিল যেন। সেই ফটিক, সেই রাখাল, সেই কিরণ, সেই নির্মল পালিত, সেই লক্ষ্মণ সরকারদের সঙ্গে এই বাড়িও ছোটবেলা থেকে তাকে এই বর্তমান অবস্থায় এনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ-বাড়িটা যেন তার অস্তিত্ব থেকে পৃথক নয়, বিচ্ছিন্ন নয়। এ-বাড়িটাও যেন তারই একটা নিজস্ব সৃষ্টি। ইচ্ছে দিয়ে, কল্পনা দিয়ে, আকাঙ্খা-আনন্দ দিয়ে যেন একে একদিন তিলে তিলে সৃষ্টি করেছিল দীপঙ্কর। ওই লক্ষ্মীদি যেন শুধু ভুবনেশ্বরবাবুর মেয়েই নয়, দীপঙ্করেরও একটা অপরিপূর্ণ বাসনা যেন। সতী লক্ষ্মীদির বোনই শুধু নয়, সতী যেন দীপঙ্করেরও অপরিহার্য একটা আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। আর শুধু কি লক্ষ্মীদি? শুধু কি সতী? এই কালীঘাট, কালীঘাটের মন্দির, ওই সোনার কার্তিকের ঘাট, ওই হাজি কাশিমের বাগান, বাজার, টিপু সুলতানের বাড়ি, এই নতুন রাসবিহারী এভিনিউ–এই হরিশ মুখার্জি রোড শেতলাতলা, কাকাবাবু, কাকীমা, ওই আমড়া গাছের নিঃসঙ্গ কাকটা পর্যন্ত যেন এর ব্যতিক্রম নয়। দীপঙ্করের অদম্য ইচ্ছেই যেন তার চারিদিকে এত ভাবে এত রূপে প্রকাশ হয়েছে। সবই যেন দীপঙ্করের জীবনের পক্ষে অপরিহার্য, সবাই যেন দীপঙ্করের অস্তিত্বের পক্ষে অনিবার্য। এখানকার সবটাই যেন তার ইচ্ছের, তার প্রয়োজনের তালুক। নিজের সৃষ্টি করা সেই তালুকদারির যেন দীপঙ্করই একমাত্র মালিক। এ তালুকদারিতে যেন আর কারো হস্তক্ষেপ সে সহ্য করবে না! তাই বোধহয় সবাই যখন সতীদের বাড়িতে কাল হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছিল, তখন সতীকে সে অমন করে জড়িয়ে ধরেছিল। অমন করে সতীকে রক্ষা করেছিল সকলের অশুচি ছোঁয়াচ থেকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *