বড় ডাক্তার দিনে দুবার রোগী দেখতে আসেন। সকালে আর সন্ধ্যায়। রাত্রে যেদিন থাকে সে, সকালে বড় ডাক্তারের আগমন পর্যন্ত অপেক্ষা করে। নয়তো দেবনন্দন থাকে। সন্ধ্যাবেলায়ও সে-ই ডাক্তারের আগমনকালে উপস্থিত থাকে।
বড় ডাক্তার শুধু নির্দেশ দিয়ে যান। আর কর্তব্যরত শিক্ষানবিশ ডাক্তাররা সারাদিনের ভরসা। বড় ডাক্তারের নির্দেশমতো তাঁরা কাজ করেন। সঙ্কটাপন্ন রোগীও তাঁরা সামলান। শুভদীপ একদিন দেখেছিল বাবার পাশের শয্যায় এক বৃদ্ধকে অক্সিজেনের নল পরাতে গিয়ে নাকাল হয়ে যাচ্ছেন এক শিক্ষানবিশ ডাক্তার। কফ, থুতু, মল, মূত্র, রক্ত ও রোগের এক বিচিত্র গন্ধ এই ঘরে। প্রায় গোটা হাসপাতাল জুড়ে।
বড় ডাক্তার রোগী দেখতে এলে হুড়োহুড়ি ঠেলাঠেলি পড়ে যায় রোগীর আত্মীয়দের মধ্যে। সে-ও সেই ঠেলাঠেলিতে শামিল হয়। নিজেকে তখন খুব ছোট, খুব অসহায় লাগে তার। বড় ডাক্তারবাবুর গাড়ি ঢুকছে। দেখলেই তারা প্রত্যেকে সন্ত্রস্ত। নিরাপদ দুরত্ব রেখে গাড়ি ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রত্যেকের মুখ প্রত্যাশায় পরিপূর্ণ কিন্তু আশঙ্কায় করুণ। যেন দেবতা নেমে অাসছেন সহস্রার হতে। বর দেবেন। একটুকরো করে প্রাণ ভিক্ষা দেবেন প্রত্যেককেই।
বড় ডাক্তার এই সমস্ত উপেক্ষা করে হেঁটে যান। মূল্যবান পরিপাটি পোশাক পরে হেঁটে যান। এই নোংরা, আবর্জনাময়, দুর্গন্ধে পুর্ণ হাসপাতালে ডাক্তারের মূল্যবান পোশাক বড় বেমানান লাগে।
এবং কিছুক্ষণ পর ডাক্তার আগের মতোই জনগণ উপেক্ষা করে গাড়ি চেপে চলে যান। তখন শিক্ষানবিশ ডাক্তাররা হাতে কাগজপত্র নিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বসে। সার সার বেঞ্চ পাতা একটি ফাঁকা ঘর। অল্প আলো। আর রোগীর আত্মীয়রা ছুটোছুটি করে ওইসব ছোট ডাক্তারদের ঘিরে ফেলে। এ ওকে ঠেলে এগিয়ে যেতে চায়। ডাক্তাররা রোগীর নাম ধরে চিৎকার করেন। বাড়ির লোক এগিয়ে গেলে কী কী ওষুধ কিনতে হবে, কী কী পরীক্ষা করা হবে, তার জন্য কিছু করতে হবে কিনা বুঝিয়ে দেন। আর তখন রোগীর আত্মীয়দের চারপাশে ভিড় কত্রে থাকে বিভিন্ন রোগ নির্ণয় কেন্দ্র, সেবাকেন্দ্র ও ডাক্তারের দালালরা। কম খরচে চমৎকার চিকিৎসা . পাইয়ে দেবার লোভ দেখিয়ে বহু রোগী তারা হস্তগত করে।
বারো দিন পার হয়ে গেল তাদের। জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলছে বাবা এখন। খাবার নল খুলে দেওয়া হয়েছে। চামচে করে গলা-গলা খাবার খাইয়ে দিয়ে যাচ্ছে শুচু আর মা। শুয়ে শুয়ে শয্যাক্ষত হয়ে গিয়েছে বাবার। মা দেবনন্দনের সাহায্যে প্রতিদিন বাবাকে কাত করে ধরে, আর শুচু ওষুধ লাগিয়ে দেয়। আর দু’চার দিন কেটে গেলেই তারা বাবাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
আজ রাত্রে শুভদীপের থাকার কথা ছিল না। বিশ্বদীপ সুস্থ নেই বলে সে এসেছে। খুব কাশছে বিশ্বদীপ। সঙ্গে জ্বর। সে-ই তাই চলে এসেছে একেবারে। জরুরি বিভাগের সামনের চাতালে এখন চাদর বিছিয়ে শোবার পালা চলছে। রোগীর আত্মীয়-স্বজন সব। কারও ভাই, কারও বন্ধু, কারও বাবা, স্ত্রী, বোন। সম্পর্কের অমোঘ টানে ভূমিশয্যায় শুয়ে রাতের পর রাত কাটাচ্ছে তারা। শুচু একটা ফোলানো বালিশ দিয়েছে। সে বালিশে! দিচ্ছে যখন, দেখল, রোজকার মতো টিফিন বাক্স খুলে ভাত খাচ্ছে ছেলেটা। বাচ্চু। উনিশ কুড়ি বছর বয়স। আলাপ হয়েছিল একদিন। বাবার দুটো শয্যা পরে বাচ্চুর বাবা আছে। কী হয়েছে ভদ্রলোকের সে জানে না। বাচ্চু রোজ দু’বেলা আসে। রাতে আসে। সকালে চলে যায়। দুপুরে আসে বিকেলে চলে যায়। আর প্রত্যেক দিন, বাবাকে খাওয়ানোর পর উদ্বৃত্ত ভাত নিজে খায় বসে বসে।
গোটা ব্যাপারটা ভাবলে গা গুলিয়ে ওঠে তার। বা কি বাড়ি থেকে খেয়ে আসে না? আসে। সে জিজ্ঞেস করেছিল। তারপরেও সে এই ভাত খায়।
বাচ্চু হাসে তাকে দেখে। সেও হাসে। মুখের ভাত গলাধঃকরণ করে তার বাবা কেমন আছে জানতে চায়। সে মাথা নাড়ে। ভাল। আর সে না জিজ্ঞেস করতেই পরবর্তী গ্রাস মুখে তোলার আগে সে জানিয়ে দেয়–তার বাবাও আছে। ভাল।
সে তখন বালিশের নীচে ব্যাগ বিছিয়ে নেয় এবং অন্য অনেকের সঙ্গে গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। আর শোবার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পায় ফোনবুথের আলো। এস টি ডি, আই এস ডি, পি সি ওঁ তার চোখের সামনে দুলতে থাকে। একটি দুর্দম ইচ্ছে তাকে অধিকার করে নেয়। সে ব্যাগ থেকে বার করে নেয় কার্ড। কত বার এই ইচ্ছে হয়েছে তার। কত বার। আর সে এরকম ভাবেই এই কার্ড বার করেছে। হাতে নিয়ে নিয়ে ময়লা হয়ে গেছে দিকে। ফুলীকে ঘৃণা কাবলী প্রবঞ্চক চারপাশ। রাগে কার্ডসমেত মুঠো পাকিয়েছে বলে ফাটল ধরে গেছে। এবং মুখস্থ হয়ে গেছে। তবুও সে আবার দেখছে। নাম দেখছে। কৃতিত্ব দেখছে। এবং ঢুকিয়ে রেখে দিচ্ছে। তার মনে পড়ে যাচ্ছে শেষ সাক্ষাৎ। চন্দ্রাবলীর সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ এবং শেষ ভ্রমণ। আর কখনও তারা একসঙ্গে কোথাও যাবে না। তাদের যৌথ পরিক্রমা শেষ হয়ে গেছে। কেন গেছে? কার জন্য? চন্দ্রাবলীর জন্য। চন্দ্রাবলী ঠগ। চন্দ্রাবলী প্রবঞ্চক। মিথ্যক। কদাকার এবং কদাচারী। সে চন্দ্রাবলীকে ঘৃণা করে। তীব্রভাবে ঘৃণা করে। সে ঘৃণা করে মালবিকাদিকে। ঘৃণা করে মহুলিকে। সে যে ঘোষণা করেছিল মহুলিকে ভালবাসে–সে ছিল বিভ্রম। সে যে মহুলির ছবি রাখত সঙ্গে
সে ছিল মোহ। এখন মোহ কেটে গেছে তার। বিভ্রম ঘুচে গেছে। সে একটিই মাত্র নারীকে জানে। একমাত্র সৎ নারী। একমাত্র নিরপেক্ষ আশ্রয়। তার ক্রোড়ে কোনও পক্ষাবলম্বন থাকে না, থাকে না কোনও প্রতারণা। সে হাসপাতালের বিচিত্র জনমণ্ডলীর মধ্যে শুয়ে, বিচিত্র গন্ধ ও শব্দসমূহের মধ্যে, নিরন্তর জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে শুয়ে সেই নারীকে কল্পনা করার প্রয়াস নেয়, তার কাছে পৌঁছনোর উপায় ভাবতে থাকে কিন্তু মন লাগে না। অতি আকাঙিক্ষত, অতি প্রিয় মৃত্যুতেও মন লাগে না। সমস্ত বাধা ঠেলে, বিরুদ্ধতা ঠেলে টেলিফোন যন্ত্রের কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করে। দূরভাষে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে আহ্বান। দূরে, দূরান্তরে। কত দুর সে জায়গা? সে উঠে বসে। ব্যাগ থেকে জলের বোতল নিয়ে জল খায়। নিঝুম হয়ে আসছে হাসপাতাল। যদিও শ্মশানের মতো এখানেও ঘুম নামে না সর্বত্র, আলো নেবে না।
শুতে ইচ্ছা করে না তার। বসতেও ইচ্ছা করে না। সে তখন দু’পা ভাঁজ করে জানুতে চিবুক রাখে। আর তার মনে পড়ে যায়। সে এভাবে বসলে চন্দ্রাবলী বলত দুঃখী লাগে। দেখতে দুঃখী লাগে। গালে হাত দিলে বলত দুঃখী লাগে। কপালে বাহু রেখে শুলে বলত দুঃখী লাগে। চন্দ্রাবলী তাকে দুঃখী দেখতে পারত না। দুঃখী সহ্য করতে পারত না। সে সংসারের কথা বলতে বলতে বিষণ্ণ হয়ে গেলে তার চোখ জলে উপচে উঠত। ভরসা দিত। তারা দুজনে থাকবে যখন, সম্মিলিত চেষ্টায় সংসারের অবস্থা ফিরে আসবে। শেষবার যখন বেড়াতে গিয়েছিল তারা, তিন দিনের জন্য, কী হাসিখুশি ছিল সে প্রথম দুদিন। কোণার্কের সূর্যমন্দিরে গিয়ে মৈথুনের বহু প্রকাশ দেখেছিল অপলক।
কোণার্ক। পুজোর সময় চন্দ্রাবলীই বেশি করে যেতে চেয়েছিল। গানের ইস্কুলের ছুটি চলছিল। টিউশ্যনও ছিল না। আগে থেকে প্রস্তুত ছিল
বলে মনোমতো কোথাও যেতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত একমাত্র কোণার্কতেই তারা থাকার জায়গা পেয়ে যায়।
দুর্গাপূজা চলছিল তখন। ঢাকঢোল বাজছিল। চমৎকার সাজানোগোছানো অতিথিনিবাসে উঠেছিল তারা। অষ্টমীর সকালে পৌঁছেই স্নান সেরে নেয় চন্দ্রাবলী। তার হাতে নতুন পাজামা পাঞ্জাবি ধরিয়ে দেয়। আর সে স্নান সেরে এসে দেখে জানালার কাছে বসে আছে চন্দ্রাবলী। ভেজা চুল খুলে ছড়িয়ে দিয়েছে পিঠময়। আকাশি রঙের কালো পাড় শাড়ি পরেছে। ঘন নীল শরতের আকাশে চোখ রেখে গান গাইছে গুন গুন। ক্রিম পাউডার ক্লিপ সেফিটিপিন–সমস্ত সাজিয়েছে ড্রেসিং টেবিলে। ব্যাগপত্র ঢুকিয়ে দিয়েছে দেওয়াল আলমারিতে। ঘরে মৃদু সুগন্ধ ছড়িয়ে গিয়েছে। সে তখন চুল আঁচড়ে, চশমা পরে, চন্দ্রাবলীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছে টান-টান। উঁচু মনে হয়নি কোল। ঘাড় টনটন করেনি।.শুতেশুতে কবে তার অভ্যাস হয়ে গেছে। সে তখন চন্দ্রাবলীর হাতে হাত রাখে, আকাশের দিকে তাকায়। গাঢ় নীল আকাশ দেখে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না। সে চন্দ্রাবলীকে দেখে। চন্দ্রাবলীর ভারী স্তন আলগোছে তার কপাল স্পর্শ করে যায়। তার শরীরে শিহরন লাগে। বাড়ির কথা তার মনে পড়ে না, সে যে মিথ্যে বলে এসেছে মাকে, মনে পড়ে না। বিত্তহীনতা মনে পড়ে না। প্রতিটি পয়সা হিসেব করে খরচ করতে হবে ভুলে যায় সে কথাও। সে চন্দ্রাবলীকে গান গাইতে বলে। চন্দ্রাবলী তার চশমা খুলে নেয়। তার কপাল চুম্বন করে। এবং গায়।
সুতল রহলু ম্যায় নিদ ভরি হো পিয়া দহলৈঁ জমায়।
চরণ বলকে অঞ্জন হে নৈনা লে লু গায়।
আসোঁ নিদিয়া ন আবৈ হো নহি তন অর্লসায়। পিয়াকে বচন প্রেম-সাগর হো চলু চলি হো নহয়।
–ঘুমে অচেতন হয়ে শুয়ে ছিলাম। প্রিয় আমাকে জাগিয়ে দিলেন। আমার চোখে লাগিয়ে নিয়েছি তাঁর চরণকমলের অঞ্জন। শরীরে আর আলস্য লাগবে না। ঘুম আসবে না আর। প্রিয়তমর কথা, সে যে প্রেমের সমূদ্র, আমি তারই মধ্যে অবগাহন করি।
জনম জনমকে পাপবা ছিনমেঁ ডারব ধোবায়।
যহি তনকে জগ দীপ কিয়ৌ প্রীত বতিয়া লগায় ॥
পাঁচ তত্ত্বকে তেল চুয়ায়ে ব্রহ্ম অগিনি জগায়।
প্রেম-পিয়ালা পিয়াইকে হো গিয়া পিয়া বৌরায় ॥
—জন্ম-জন্মান্তরের পাপ এক মুহূর্তে ধুয়ে ফেলব আমি। এ দেহকে করব জগতের দীপ। তাতে দেব প্রীতির সলতে। পঞ্চতত্ত্বের তেল দিয়ে ব্ৰহ্মাগ্নিতে জ্বালিয়ে নেব। আমাকে পেয়ালা ভরে প্রেমসুধা দিলেন প্রিয়তম এবং নিজেও মত্ত হয়ে পান করলেন।
বিরহ-অগিনি তন তলফৈ হো জিয় কছু ন সোহায় ॥
উচ অটারিয়া চঢ়ি বৈঠ লু হো জহঁ কাল ন জায়।
কহৈ কবীর চিচারিকে হো জম দেখ ডরায়।।
–বিরহের আগুনে দেহ জ্বলে-পুড়ে গেল। আর কিছুই ভাল লাগে। এমন উঁচু অট্টালিকার ওপর চড়ে বসেছি আমি, যেখানে কালের গতিও নেই। কবীর বলে, সেখানে আমার কাছে আসতে যমও সাহস পাচ্ছে না।
আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল সে। কখন সে চন্দ্রাবলীর মাথা নামিয়ে আনে নীচে আর ওষ্ঠে রাখে মুখ, কখন তার তার হাত চলে যায় স্তনে আর কালো পাড় আকাশি রঙের শাড়ি মাটিতে খসে পড়ে, কখন সে শয়ন করে শায়িত চন্দ্রাবলীর শরীরে এবং প্রবেশ করে সে জানে না। সে জানে, সেদিন ওই সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে রাত্রি পর্যন্ত তারা সফল সঙ্গম করেছিল সাতবার কেমন করে সে জানে না। গোটা একটি দিন তারা কাটিয়ে দিয়েছিল আহারে, নিদ্রায় আর মৈথুনে। খুব খুশি ছিল চন্দ্রাবলী। খুব আনন্দিত।
পরদিন সকালে প্রসন্ন ঝকঝকে ভোরে সে টের পায় তার বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে চন্দ্রাবলী। একমুঠো শিউলি ফুল হাতে। সে হঠাৎ চাপ বোধ করে। মনে হয় চন্দ্রাবলীর মাথা একটি হাতির মাথার মতো ভারী। সে চন্দ্রাবলীকে বুক থেকে সরে যেতে বলেচন্দ্রাবলী শোনে না। বরং হাসে। বরং নিবিড় হয় আরও। হাতের শিউলিফুল সে বিছানায় ছড়িয়ে দেয়। বলে ফুলশয্যা তাদের। বলে সারা শয্যাময় বিছানো শরৎ।
এই কাব্যিকতাকে তার বাহুল্য মনে হয়। আধিক্যতা মনে হয়। সে ঠেলে সরিয়ে দেয় চন্দ্রাবলীকে আর চন্দ্রাবলীর মাথা সজোরে খসে পড়ে। সে তখন তাকে অতিরিক্ত আদিখ্যেতা দেখাতে বারণ করে দেয়।
চন্দ্রাবলী চুপচাপ শুয়ে থাকে অনেকক্ষণ কথা বলে না। একটি দীর্ঘ নীরবতা তাদের মধ্যে বিরাজমান থাকে প্রায় সমস্ত দিন। প্রয়োজনীয় কথার বাইরে কথা হয় না। একবারও গুনগুন করে না চন্দ্রাবলী। শুধু পরিকল্পনা মতো তারা কোণার্কের সূর্যমন্দির দেখতে যায়। আর দেখতে দেখতে দু’জনে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বহু জনসমাগমে আবিল কোণার্ক সূর্যমন্দিরের স্থির বৃহৎ রথের চাকার সামনে সে যখন চন্দ্রাবলীকে আবিষ্কার করে তখন সে একমনে দেখে যাচ্ছিল মিথুন-মূর্তি। তার চোখের পলক পড়ছিল না। মৈথুনের বহু বিচিত্র ভঙ্গির সামনে সে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। তার কানে যায়নি যুবকেরা কটু মন্তব্য করছে। দু’চারজন। মধ্যবয়স্ক লোক এসে দাঁড়াচ্ছে তার গা ঘেঁষে। সে তখন চন্দ্রাবলীর হাত ধরে টানে এবং মন্দিরপর্ব শেষ করে শহরের উপান্তে নির্জন পথে চলে যায়। চন্দ্রাবলী তখন অদ্ভুত প্রশ্ন করে। জানতে চায়, সে মরে গেলে শুভদীপ খুশি হবে কিনা।
এ প্রশ্নে শুভদীপের বুকের মধ্যে টনটন করেছিল কষ্টে। হঠাৎই তার চন্দ্রাবলীকে বড় করুণ লেগেছিল। মহুলিকে সে যা বলেছিল, কোনও সচেতন উপলব্ধি থেকে নয়। কিন্তু কোণার্কের সেই নির্জনতায়, ছোট ছোট ঝোপ ঠেলা পথে যেতে যেতে সে চন্দ্রাবলীর অসহায়তাকে প্রত্যক্ষ করেছিল সর্বাংশে। সে করুণা করেছিল। সম্পূর্ণ করুণা করেছিল এবং অতিথিনিবাসে ফিরে সে যৌনতার তাগিদে নগ্ন করেছিল চন্দ্রাবলীকে। মন্দিরের মৈথুন দৃশ্য সেও দেখেছিল আড়চোখে এবং মনে মনে উত্তেজিত ছিল।
উত্তেজনার অবসান হলে তারা নীরবে জানালার কাছে বসে এবং দেখতে পায় আকাশে হাজার তারার ঢাকাই বুটি। চন্দ্রাবলী আলো নিবিয়ে দেয়। এবং তার গা ঘেঁষে বসে। মৈথুন তার বিষণ্ণতা হরণ করেছে। সে তখন গুনগুন সুর সাধে আর হঠাৎ আকাশ থেকে খসে পড়া নক্ষত্র দেখতে পেয়ে প্রার্থনা করে। চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করে। এবং চোখ খুলে প্রসন্ন হাসিতে মুখ ভরিয়ে দেয়। শুভদীপের কাঁধে হাল চেপে আদুরে গলায় জানায়–ঝরে-পড়া নক্ষত্রের আছে মনৰ্ম্মামনা পূরণের শক্তি। য চাওয়া যায় তার কাছে, তাই পাওয়া যায়।
শুভদীপ বলতে উদ্যত হয়েছিল যে পতনশীল নক্ষত্র আসলে হাজার বছর আগে ধ্বংস হয়ে যাওয়া জড়বস্তু ছাড়া কিছু নয় কিন্তু, তার বলার আগেই আকাশে এক আশ্চর্য আলোর ফুলঝুরি ওঠে। এবং একের পর এক উঠতেই থাকে। নানা আকারের, নানা বর্ণের ফুলঝুরি। আতসবাজির ফুলঝুরিতে আকাশ ছেয়ে যায়। আর তারা দু’জন, গায়ে গা লাগিয়ে স্তব্ধ বিস্ময়ে চেয়ে থাকে সেই আশ্চর্য সুন্দরের দিকে।