1 of 2

২০. বড়বাজারে উগ্রপন্থীদের আক্রমণ

বড়বাজারে উগ্রপন্থীদের আক্রমণ, জাল ওষুধের কারখানা ধ্বংস, প্যারাডাইসের পর বড়বাজার। তিনটে খবরের কাগজের শিরোনাম সকালবেলায় ওদের চোখে পড়ল। শেষরাত্রে এই ফ্ল্যাটে ফিরে সুদীপ ঘুমাবার চেষ্টা করেছিল। আনন্দ চুপচাপ শুয়েছিল। বাবার চিঠিটার কথা অন্ধকার ঘরে কেবলই মনে পড়ছিল তার। একটা মানুষ কোন অবস্থায় অমন চিঠি লিখতে পারে? বারংবার বাবা এবং তার সেই বান্ধবীকে ভুলতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু সে আবিষ্কার করেছিল ওই ভদ্রমহিলার বিরুদ্ধে তার কোন বিরূপ মানসিকতা তৈরি হচ্ছে না। এমন কি হয়তো তিনি মায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী, তবুও। আর এইভাবেই ঘরের অন্ধকারটা মিলিয়ে গেল, জানলার বাইরে আলো ফুটল। শরীরে বেশ ক্লান্তি থাকায় শুয়ে থাকতে ভাল লাগছিল তার। ওপাশে কল্যাণ বোধ হয় ঘুমিয়েছে ওষুধের প্রভাবে। সুদীপ ঘুমিয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। যদিও সে কল্যাণের পাশে বিছানায় একইভাবে পড়ে আছে। পায়ের তলায় মোটা কার্পেট, দামী সোফা আর সুন্দর ছবিতে সাজানো ঘরটায় সকাল এল। জয়িতাদের কালা চাকরটা দামী পটে চা দিয়ে গেল। তারপর যখন জয়িতা এল কাগজ নিয়ে তখনও আলস্য পাক খাচ্ছে ঘরে। সুদীপ উঠে এসে শিরোনামগুলো পড়ল। পড়ে হাসল, উগ্রপন্থী বলে কেন রে কাগজগুলো? উগ্রপন্থী শব্দটা শুনলেই নরমপন্থী শব্দটাকে মনে পড়ে। ভারতবর্ষের সবকটা মানুষ নরমপন্থী হোক এটাই যেন ইঙ্গিতে থাকে। কিন্তু ওরা ধরেছে, প্যারাডাইসের পর বড়বাজার—তার মানে দুটো যে আমাদেরই কাজ তা বুঝতে পেরেছে। ধন্যবাদ। কি লিখেছে পড় তো!

তিনটে কাগজে খবরগুলো এক করলে ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায়, গতরাত্রে কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলের একটি ওষুধের কারখানায় উগ্রপন্থীরা আক্রমণ চালায়। সত্যনারায়ণ পার্কের পাশে মোহনলাল আগরওয়ালের এই ওষুধের কারখানাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ ছিল না। ব্যবসায়ী হিসেবে মোহনলালজীর খ্যাতি আছে। মধ্যরাত্রে কয়েকজন উগ্রপন্থী কোন এক সূত্রে কারখানার ভেতরে প্রবেশ করে। তারা কর্মচারীদের একপাশে সরে যেতে বাধ্য করে। তারপর অত্যন্ত শক্তিশালী গ্রেনেড এবং পেট্রল বোমা ছুঁড়ে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বিশাল কারখানাটিকে ধ্বংস করে দেয়। উগ্রপন্থীরা যখন পালাচ্ছিল তখন তাদের একজনকে জনসাধারণ ধরে ফেলতে গিয়েও পারে না। প্রকাশ, একজন মহিলা উগ্রপন্থী তাকে বাঁচিয়ে উধাও হয়। কোনরকম ডাকাতি হয়নি। দমকল এবং পুলিস দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। কিন্তু কারখানার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ক্ষতির পরিমাণ সঠিক না জানা গেলেও কয়েক কোটি টাকা বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কোন মানুষ যাতে মারা না যায় সে ব্যাপারে উগ্রপন্থীদের লক্ষ্য ছিল এটা বোঝা গেছে। তিনজন সামান্য আহত হয়েছেন বিস্ফোরণের ফলে। পুলিস সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শহরে জাল বিছিয়ে ফেলে—যে গাড়িটিতে উগ্রপন্থীরা অকুস্থল থেকে পালিয়েছিল সেটি ধরবার জন্যে। এই কপি প্রেসে দেবার সময় জানা যায় ইলিয়ট রোড এবং ওয়েলেসলির মোড়ে পুলিস পরিত্যক্ত গাড়িটিকে পেয়েছে। এই গাড়িটি একটি সিনেমা হলের সামনে থেকে চুরি গিয়েছিল কয়েক ঘন্টা আগে। পুলিস সন্দেহ করছে প্যারাডাইসের ঘটনাটির সঙ্গে এর যোগাযোগ আছে। উভয় ক্ষেত্রেই আক্রমণের কোন উদ্দেশ্য ধরা পড়েনি। এই দলে যে মহিলা আছে সে ব্যাপারে পুলিস নিঃসন্দেহ। এখন পর্যন্ত কেউ ধরা পড়েনি। জোর তদন্ত চলছে। পুলিসের একজন মুখপাত্র বলেছেন তারা সূত্র খুঁজে পেয়েছেন।

সংবাদটির মধ্যে একটি বক্স করে আর একটি সংবাদ দেওয়া হয়েছে তিনটি কাগজেই। তার ছোট শিরোনাম, এবার রেসকোর্স? ঘটনাটির পর আমাদের অফিসে টেলিফোনে উগ্রপন্থীদের একজন জানায় তারা এবার রেসকোর্স ধ্বংস করতে চাইছে। যেহেতু শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ওপর আর তাদের কোন আস্থা নেই তাই তারা জনস্বার্থবিরোধী বলে যাদের মনে করবে তাদেরই ধ্বংস করবে। বড়বাজারের ঘটনা জানিয়ে তারা বলে যে ওই কারখানায় মানুষের জীবননাশকারী জাল ওষুধ তৈরি হত। টেলিফোনে ওই কারখানার মালিকের গোপন গুদামের খবর আমাদের জানানো হয়। সূত্রটি ধরে পুলিস সেখানে হানা দিয়ে প্রচুর ওষুধ বাজেয়াপ্ত করেছে। এখন দেখা হবে এই ওষুধ আসল না জাল! সুনিপুণ অপারেশনের পরই উগ্রপন্থীদের খবরের কাগজের সঙ্গে এইভাবে যোগাযোগ করে খবর দেওয়া অভিনব বলে মনে হয়েছে।

সুদীপ চায়ের কাপটা তুলে নিল! খুব দামী চা খাস তো তোরা! আঃ।

আনন্দ সত্যি অবাক হল। এই সময় যে সুদীপ এত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে অন্য কথা বলতে পারবে তা তার ভাবনায় ছিল না। জয়িতা কথা বলল আনন্দর অভিব্যক্তি দেখে, তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য বিফল হয়নি? এই সব খবর পড়ে পাবলিক যা ভাববে তাই তো আমরা চেয়েছিলাম!

সুদীপ মাথা নাড়ল, কিন্তু হোয়াই উগ্রপন্থী! ওই শব্দটা শুনলেই পাবলিক ভয় পাবে। তবে রেসকোর্স-অপারেশন আর এখন হবে না। খামোকা তুরুপের তাস তুলে দিলি—ওরা অনেক বেশি প্রটেকশন নেবে আর আমরা কাছে ঘেঁষতে পারব না!

আনন্দ এবার কথা বলল, এখনই আমরা রেসকোর্সে যেতে পারতাম না। ব্যাপারটা অত সোজা নয়। কিন্তু এই খবরটার কি প্রতিক্রিয়া হয় সেটাই এখন দেখার।

এই সময় কল্যাণ বলল, আমি এখন কি করব?

জয়িতা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, মানে?

আমি যে ধরা পড়েছিলাম সেটা কাগজগুলো লিখেছে।

কি আশ্চর্য, ওরা তো তোর নাম লেখেনি! তাছাড়া আমিও তো জড়িয়ে গেছি। কাগজে লিখেছে এইদলে যে মহিলা ছিল সে ব্যাপারে পুলিস নিঃসন্দেহ—এমন করছিস না! জয়িতা মুখ ফেরাল।

দূর! কল্যাণ খিঁচিয়ে উঠল, আমি আমার কথা ভেবে বলিনি। আমার জন্যে তোদের বিপদ হোক এটাই চাইছি না। আমি কিছু করা দূরে থাক, দৌড়তে পারব কিনা তাই বুঝতে পারছি না।

আনন্দ বলল, তোকে কিছু বুঝতে হবে না। এখন যন্ত্রণা কেমন আছে?

নড়তে ভয় পাচ্ছি। কিন্তু বাথরুমে যাওয়া দরকার।

জয়িতা এগিয়ে এল, আমি কি তোকে সাহায্য করব?

কল্যাণ বলল, তুই হাতটা দে, ব্যালেন্স রেখে উঠলে যদি ওপাশটায় কম চাপ পড়ে! জয়িতা হাত বাড়িয়ে দিল। কল্যাণ শরীরের ভর তার ওপর রেখে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নামতে নামতে কয়েকবার অস্ফুট চিৎকার করল। তারপর দুর্বল পায়ে বাথরুমে ঢুকে গেল।

সেদিকে তাকিয়ে জয়িতা বলল, ওকে এখনই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত।

সুদীপ সিগারেট ধরাল, তোর বাবা তো কাল ঘোষণা করে গেছে, জিজ্ঞাসা কর।

জয়িতা সুদীপের দিকে বিরক্তি নিয়ে একবার তাকিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু আনন্দ বলল, দাঁড়া। তোদের কাল একটা কথা বলিনি, আমার হোস্টেলে পুলিস এসেছিল।

সুদীপ হাসল, বাঃ, কখন?

কাল বিকেলে। ওরা আমার জন্যে ওয়েট করছিল—খুব জোর বেঁচে গেছি।

মহাপ্রভুরা খবর পেলেন কি করে?

গ্রাম থেকে। আমরা যে গ্রামে গিয়েছিলাম তা ওরা জেনে গেছে। আজ এবং আগামীকাল ছুটি। কিন্তু এর মধ্যেই ওরা নিশ্চয়ই জেনে যাবে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু কারা। আমি জানি না সুদীপের বাড়িতে গেলে ওর বাবা বলবেন কিনা ও টাকা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। তবে গতকালের ঘটনা থেকে ওরা যখন জেনেছে একজন মহিলাও ছিল তখন তার বর্ণনাও নিঃসন্দেহে পেয়েছে। সেক্ষেত্রে আমার সঙ্গে তোর বন্ধুত্বের খবরটা জানতে পারা খুব স্বাভাবিক। আর সেটা হলেই তোর এইখানে পুলিস হাজির হবে। অতএব যতটা তাড়াতাড়ি এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে পারি ততই মঙ্গল। আমাদের হাতে সময় বেশি নেই।

সুদীপ বলল, তাহলে একটা কাজ করা যাক। তুই আর আমি এখনই ঠাকুরপুকুরে চলে যাই, এই সকালে রাস্তায় তেমন লোকজন নেই নিশ্চয়ই। কল্যাণকে জয়িতার বাবা ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধের ব্যবস্থা কিংবা প্লাস্টার করিয়ে রাখুন। রাত্রে জয়িতা ওকে নিয়ে বেহালার চৌরাস্তার মোড়ে চলে আসুক, ওখান থেকে আমরা নিয়ে যাব কল্যাণকে।

আনন্দ আপত্তি করল, না, এখন দু-তিনদিন জয়িতার আমাদের সঙ্গে রাস্তায় ঘোরাফেরা করার দরকার নেই। এই সময় কল্যাণ বেরিয়ে এল। এবং ওর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল বেচারা অনেক কষ্টে যন্ত্রণা চেপে রেখেছে। আনন্দ দ্রুত তাকে জানাল কি করতে হবে। বেহালার ট্রাম ডিপোর সামনে সুদীপ বাত দশটার সময় অপেক্ষা করবে। ও যেন বেশি দেরি না করে। তাহলে ঠাকুরপুকুরে যাওয়ার কোন বাস পাওয়া যাবে না।

কল্যাণ শুনল। তারপর বলল, তোরা ঠিকানাটা দে। আমি ডাক্তারের ওখান থেকেই সরাসরি চলে যাব।

সুদীপ প্রতিবাদ করল, দিনের বেলায় হাত প্লাস্টার করা কাউকে দেখলে ঠাকুরপুকুরেব সবাই মনে রাখবে। অতএব সন্ধ্যের পরেই যাওয়া ভাল।

অতএব সিদ্ধান্ত হল রাত দশটায় নয়, সন্ধ্যে সাতটার সময় সুদীপ কল্যাণের জন্যে অপেক্ষা করবে। জয়িতা চুপচাপ শুনছিল। এবার বলল, আমি কোথায় যাব?

সুদীপ বলল, তুই এখানেই থাক। পুলিস এলে পুরো ব্যাপারটা অস্বীকার করবি।

জয়িতার গলার স্বর শক্ত হল, সেটা যদি ওরা অবিশ্বাস করে? শোন সুদীপ, আমি মেয়ে বলে কি তোদের অসুবিধা হচ্ছে? আনন্দর কথায় হয়তো যুক্তি আছে, কিন্তু সেটা অপারেশনে নামবার আগে তোদের খেয়াল ছিল না কেন?

আনন্দ মাথা নাড়ল, সরি জয়ী, তুই কিছু মনে করিস না। কল্যাণের সঙ্গে তুইও আয়। যতটা পারিস মেয়েলি ব্যাপারগুলো পাবলিকের চোখে যাতে ধরা না পড়ে তা লক্ষ্য রাখিস।

দরজার বাইরে শব্দ হল। রামানন্দ রায় এসে দাঁড়ালেন। নির্বাক চারজনের মুখের দিকে খানিক তাকালেন। তারপর কল্যাণকে বললেন, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি। তুমি আমার ভাগ্নে, বাথরুমে পাড়ে গিয়ে ওই অবস্থা হয়েছে। তুমি কি একা আসবে, না কেউ এসকর্ট করবে?

কল্যাণ মাথা নাড়ল, আমি একাই যেতে পারব।

বেশ। এসো। ভদ্রলোক মুখ ফিরিয়ে এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন, আমি এইমাত্র রেডিওতে নিউজ শুনলাম। আমার অনুমান তোমরাই কাজটা করেছ। আমি তোমাদের কনডেম করতে পারছি না, আবার কনগ্রাচুলেশনও জানাতে পারছি না। আমরা কেউ রাস্তাটা চিনি না। ভারতবর্ষের মানুষের জটিল অবস্থায় পণ্ডিতদের কোন থিয়োরি কাজ করবে না। তবু ভুল পথটা তো বোঝা যায়। আই মাস্ট টেল ইউ, ইটস নট দ্য ওয়ে। তোমরা আত্মহত্যা করতে চাইছ—এক ধরনের হারাকিরি। এসো তুমি।

কল্যাণ একবার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে ওঁকে অনুসরণ করল। ওরা চোখের বাইরে গেলে সুদীপ বলল, বাঙালী মাইরি জ্ঞান দিতে পারলে আর কিছু চায় না! লেটস মুভ।

জয়িতা দেখছিল। হঠাৎ সে বলল, বাট হি ইজ হেল্পিং আস, ইজন ট ইট?

আনন্দ মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমি আগে যা শুনেছিলাম ওঁর ব্যবহার দেখে কিন্তু সেরকম মনে হচ্ছে না। যে মদ খায় খারাপ পাড়ায় যায় তারও তো বিপরীত চরিত্র থাকে। বাট উই আর রিয়েলি গ্রেটফুল টু হিম। জয়, তুই তাহলে কল্যাণকে নিয়ে ঠিক সময়ে চলে আসিস।

ওরা কোন জিনিস ফেলে রাখল না। সুদীপ বলল, এইসব মাল হটিয়ে কীটস বা রুকস্যাক কিনতে হবে। বেশ কয়েকটা জিনসের প্যান্টও দরকার।

জয়িতা হাসল, তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে কোন এক্সপিডিশনে যাচ্ছিস।

হু নোস! পেছনে ফেউ লাগলে ছুটে বেড়াতে হয়। টাকাকড়িগুলো কি তোরা ভাগ করে রাখবি?

না, আপাতত তোর কাছেই রাখ। আনন্দর হাতের ব্যাগের ওজন বেশি। সে খুব সাবধানে ওটা বহন করছিল। অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে মালগুলো যোগাড় করতে। এখন পর্যন্ত বিক্রেতা তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। ওরা দরজার দিকে এগোতেই পেছন থেকে গলা ভেসে এল, কি ব্যাপার?

সীতা রায় হলঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে। তার পরনে হাউসকোট, চুলগুলো চুড়ো করে বাঁধা, বোধ হয় ঘাড়ে হাওয়া লাগাতে চান। এই সকালেও তার মুখে হালকা প্রসাধন পড়েছে। জয়িতা জবাব, দিল, আমার এই দুই বন্ধু চলে যাচ্ছে। আর একজন, যাকে বাবা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে সে সন্ধ্যেবেলায় যাবে।

তোমার বাবা বলছিল ওরা এখানে থাকবে, দে নিড শেলটার!

আনন্দ সুদীপের দিকে তাকাল। শেলটার শব্দটা চট করে কানে লাগল। জয়িতা হাসল, না, আর তার দরকার নেই। ওরা কি যেতে পারে, না তোমার কিছু বলার আছে?

হ্যাঁ, তোমার নাম সুদীপ? কখনও যদি তোমার কোন সাহায্য দরকার হয় তাহলে জানাতে পার। আর হ্যাঁ, তোমরা, তোমরা কি ওই যাকে বলে নকশাল? সীতা রায় একই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

না। আমরা কংগ্রেস, সি পি এম, নকশাল বা কোন ফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত নই। আমাদের সঙ্গে কোন বাজনৈতিক দলের সম্পর্ক নেই। সাহায্য চাইতে বললেন বলে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সুদীপ দরজাটা খুলল।

সীতা রায় যেন কিছুই বুঝতে পারছিলেন না, হঠাৎ খেয়াল হতে বললেন, তোমরা কিছু না খেয়ে চলে যাচ্ছ কেন? দশ মিনিট অপেক্ষা কর, তোমাদের ব্রেকফাস্ট রেডি হয়ে যাবে।

এবার আনন্দ মাথা নাড়ল, সো কাইন্ড অফ ইউ কাকীমা। কিন্তু আমাদের এমনিতেই খুব দেরি হয়ে গেছে। আপনার এই কথাটা আমাদের ভাল লাগল। বাই জয়।

তবু জয়িতা ওদের সঙ্গে লিফট পর্যন্ত এল। আজ ছুটির দিন বলেই এই বিশাল ফ্ল্যাটবাড়িতে এখনও আলস্য জড়ানো। জয়িতা বলল, সাবধানে যাবি, কোন ঝুঁকি নিবি না।

লিফটের বোতাম টিপেছিল সুদীপ, থাক, আর ঠাকুমাগিরি করিস না। কল্যাণটার হাত ঠিক হয়ে গেলে বাঁচি। আর শোন, তোর মায়ের যেন কিছু হয়েছে, আমি যেদিন কথা বলেছিলাম সেদিন উনি খুব অ্যাগ্রেসিভ ছিলেন, আজ বড় সাধারণ মনে হচ্ছিল। তোর দিনটা কাটাতে খুব অসুবিধে হবে না, বুঝলি?

জয়িতা মাথা নাড়ল, ওই দুটো মানুষ নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকলে আমি স্বস্তিতে থাকব। সেটাই এতদিন হয়ে এসেছে, এবাড়িতে তার ব্যতিক্রম হলেই—I।

লিফট এসে গিয়েছিল। দরজা খুলে রবীন সেন নামলেন। তার চোখে বিস্ময় ফুটল। দুই তরুণের দিকে তাকিয়ে তার বিশাল মুখটা জয়িতার দিকে ফিরল, এই যে, গুডমর্নিং! চললে কোথায়?

জয়িতা মাথা নাড়ল, কোথাও তো যাচ্ছি না। আপনি?

ওই যে, মিসেস রায়ের সঙ্গে একটা ব্যাপারে আলোচনা করব, উনি আছেন?

আছেন। কিন্তু কথা বলার মত অবস্থায় আছেন কিনা জানি না।

রবীন সেনের বিশাল দেহ জয়িতার কাছাকাছি হল। মুখটা সামান্য নামল, কি হয়েছে বল তো? ক্লাবে যাচ্ছেন না, কাউকে মিট করছেন না—দার্জিলিং-এ কিছু হয়েছিল?

আপনি ভেতরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন। দরজা তো খোলাই আছে। বাই। শেষ শব্দটি সুদীপদের দিকে ছুঁড়ে ভেতরে পা বাড়াতে বাড়াতে জয়িতা দেখল সীতা রায় একই জায়গায় তেমনি দাঁড়িয়ে আছেন। সে নিচু গলায় বলল, তোমার গেস্ট এসেছেন। তারপর নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল।

 

বালিগঞ্জ পার্ক রোডে কোন ট্যাকসি নেই। রোদ উঠেছে কিন্তু এখনও ছায়া পালায়নি। রাস্তাটায় দোকানপাট বলতে একদম মোড়ের কাছাকাছি, লোকজনও নেই ফুটপাতে। সুদীপ বলল, সুটকেস হাতে কলকাতার রাস্তায় হাঁটলে নিজেদের যেন অন্যরকম লাগে। যাবি কি করে?

ট্রামরাস্তায় গেলে ট্যাকসি পাব। আনন্দ জানাল।

ওরা ট্রামরাস্তায় কিছুক্ষণ দাঁড়াল। ট্যাকসি নেই, মিনিবাসগুলো বোধ হয় এখনও বের হয়নি। সুদীপ বলল, খিদে পেয়ে গেছে জব্বর। ব্রেকফাস্টটা ছেড়ে আসা উচিত হয়নি।

এ সময় একটা ট্রাম আসছিল পার্ক সার্কাসের দিক থেকে। আনন্দ বলল, চলে আয় সুদীপ, এই ট্রামটায় উঠব।

সেকি রে! এইসব নিয়ে ট্রামে উঠব? সুদীপ প্রতিবাদ করল। কিন্তু ততক্ষণে আনন্দ হাত নেড়ে ট্রামটাকে থামিয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠল ওরা। কন্ডাক্টর ছাড়া কোন যাত্রী নেই।

আনন্দ বলল, হঠাৎ মনে হল বালিগঞ্জ পার্ক রোড থেকে ট্যাকসিটা না ধরলেই ভাল হবে। তাছাড়া গড়িয়াহাটার মোড় থেকে কিছু খেয়ে নিতে পারবি। শোন, তোর ওই বৃদ্ধা আত্মীয়াকে বিরক্ত করতে চাই না। ওখানে আমাদের খাওয়া-দাওয়ার কি হবে?

অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। যদি বুড়ি অফার করে তাহলে অ্যাকসেপ্ট করব।

আরও ঘন্টাখানেক পরে ওরা ট্যাকসিতে ঠাকুরপুকুরের দিকে যাচ্ছিল। কয়েক পাউন্ড পাঁউরুটি, জ্যাম, বিস্কুট কিনে নিয়েছিল আনন্দ। মোড়ের কাছাকাছি একটা দোকানে বসে চা আর ডিম-রুটি খেয়ে নিয়েছে ওরা। এবং তখনই জানতে পেরেছিল কলকাতার শরীরে উত্তেজনার আগুন লেগেছে। চায়ের দোকানের প্রতিটি টেবিলে এখন ওই একটাই আলোচনা। প্যারাডাইসের পর বড়বাজার-আললাচকরা একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে এটি নকশালদের কার্যকলাপ নয়। কেউ কেউ অবশ্য নকশাল-পরবর্তী কিছু উগ্রমতাবলম্বী দলের নাম করল। কিন্তু কেউ প্রমাণ না থাকায় অদ্ভুত অদ্ভুত কল্পনা করছে। এবার রেসকোর্স। একজন বলল, আমার পূর্ণ সমর্থন আছে। দেশ থেকে রেস তুলে দেওয়া উচিত। কংগ্রেস থেকে একবার রেস বন্ধ করার কথা ভাবা হয়েছিল।

রেস বন্ধ হলে কত বুকি-পেন্সিলারের ইনকাম বন্ধ হবে তা জানেন?

আপনি যে অত চেঁচাচ্ছেন, এর পর যদি ওরা বলে যারা ঘুষ নেয় তাদের খতম করব, তাহলে? আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? আমি কি ঘুষ নিই? কেউ প্রমাণ করতে পারবে?

বড়বাজারে জাল ওষুধ তৈরি হত কেউ প্রমাণ করেছে? বড় বড় কথা বলবেন না। এই পার্টি যদি পুলিসের চোখ এড়িয়ে কাজ চালায় তাহলে অনেক পাবলিকের জান কয়লা হয়ে যাবে।

যাই বল ভাই, ছোরাদের হিম্মত আছে। বড়বাজারে বোমা! আমার খুব ভাল লাগছে ওরা নিরীহ কর্মচারীদের আগেই সরে যেতে বলেছিল!

এটাকে কি বলবেন, বিপ্লব? সরকারের বিরুদ্ধে তো কিছুই করছে না। হরিদা, তুমি মাইরি আর দুনম্বর মাল চালিয়ে এক নম্বরের দাম নিও না, এই দোকানেও হামলা হতে পারে। চায়ের দোকানের প্রতিটি নিয়মিত খদ্দের হেসে উঠল।

ট্যাকসিতে বসে আনন্দ বলল, পুরো ব্যাপারটাই এই রকম হাসিঠাট্টার পর্যায়ে না পৌঁছে যায়! লোকগুলো কিরকম হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসছিল! এত তরলভাবে দেখছে কেন বল তো ব্যাপারটা?

ভাল খেলে মনটা ভাল থাকে। সুদীপ সিগারেট টানতে টানতে রাস্তা দেখছিল। আনন্দর কথায় হাসল, দূর! পৃথিবীর কোন দেশের পাবলিক কখনও সিরিয়াস হয়? কিন্তু আলোচনা হচ্ছে তো! দ্যাটস অল, এখনও ঠাট্টা চলছে কিন্তু এরকম কেস আরও কয়েকটা হলে ওই লোকগুলো আর হাসবে না, এখন চায়ের দোকানের মালিক দুনম্বর মাল এক নম্বর বলে চালাচ্ছে জেনেও কোন প্রতিবাদ করছে না। কিন্তু তখন করবে। তখন এরাই বাধ্য করবে ওই লোকটাকে ঘুষ না নিতে। আসলে পাবলিক এত দেখেছে যে কোন নতুন ব্যাপারে প্রথমেই আস্থা রাখতে পারে না। আমাদের কাজ আমরা করে যাব। পাবলিক জাগল তো বহুৎ আচ্ছা! ফলের জন্যে চিন্তা করো না, কাজ করে যাও।

ওর কথার ধরনে আনন্দ না হেসে পারল না। একটু চুপ করে বলল, রামানন্দ রায় আমার ধারণাটা বদলে দিল। ওই রঙিন মোড়ক দেওয়া লোকটা যে হঠাৎ এত চুপচাপ আমাদের সাহায্য করবে কে ভেবেছিল! আসলে সুদীপ, কোন মানুষকেই স্ট্যাম্প করে দেওয়া উচিত নয়। কে কখন কি ব্যবহার করে–।

মিডল ক্লাস, পাতি মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট। রামানন্দ রায় এখন মোটা মাল কামাচ্ছেন, ফ্যাট স্যালারির চাকরি করছেন। বালিগঞ্জ পার্ক রোডে ফ্ল্যাট, গাড়ি, চারটে ক্লাবের মেম্বারশিপ, দশটা বউ-এর সঙ্গে ঘুমানো ওই সূত্রেই এসে যাচ্ছে। লক্ষ্য কর এরা কোন মেয়ের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে বলে থাকেন আমি ওর সঙ্গে ঘুমিয়েছিলাম। সেই ঘুম কিন্তু চোখ বন্ধ করে নয়। কিন্তু বেসিকালি লোকটা এসেছে উত্তর কলকাতার এঁদো গলি থেকে। নিম্ন কিংবা মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্টগুলো গেঞ্জির মত শরীরে জাপটে আছে, ওপরে যতই পোশাক চাপুক। এঁরা খুব দ্রুত নিজেদের পালটাতে পারেন। হঠাৎ কোন ধাক্কা খেলে নড়বড়ে অবস্থায় বর্তমান চরিত্রের বিপরীত আচরণ করে ফেলেন। কিন্তু যারা বেশ কয়েক পুরুষ ধরে উচ্চবিত্ত, যাদের পেছনে কোন সেন্টিমেন্টাল অতীত নেই তারা এত সহজে টপকান না। শ্ৰীযুক্ত বাবু অবনী তালুকদার কখনই রামানন্দ রায়ের মত কল্যাণকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যেতেন না।

সকালবেলা বলেই বোধ হয় ট্যাকসিওয়ালা ঠাকুরপুকুরে যেতে আপত্তি করল না। গলিটার মোড়ে এসে ওরা গাড়িটাকে ছেড়ে দিল। কয়েক মিনিট ভেতরে ঢোকার পর জায়গাটা বেশ ফাঁকা হয়ে এল। এ দিকটায় প্রচুর গাছগাছালি, দুতিনটে পুকুর চোখে পড়ল। গলিটার মধ্যে দুটো মুদীর দোকান, একটা কয়লার এবং রেশনের। সুদীপের আত্মীয়ের বাড়িটিতে ঢোকার পথ দুটো। একটা ভাড়াটেরা ব্যবহার করেন, অন্যটায় সব সময় হুড়কো লাগানো থাকে। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা সেই অংশে উঠোন আছে, উঠোনের ওপর ঝাঁপড়া কাঁঠালগাছ। এখন দশটা বেজে গেছে। রোদ কড়া হয়েছে। একগাদা বাচ্চা তারস্বরে চিৎকার করছে বাড়িটার সামনে মার্বেল নিয়ে। সুদীপ বন্ধ দরজায় শব্দ করল। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের চিৎকার থেমে গেল। ওরা যেন এখনই কিছু ঘটবে এমন আশায় চেয়ে রইল সুদীপদের দিকে। সুদীপ সেটা লক্ষ্য করে বলল, কেসটা কি? এই খোকা, কি হয়েছে?

ওদের মধ্যে একটি ছেলে জবাব দিল, বুড়ি এবার খিস্তি করবে। আমরা দরজায় ধাক্কা দিলেই করে।

সুদীপ আনন্দর দিকে তাকিয়ে বলল, শুনলি! হার্ডলি আট দশ বছর বয়স কিন্তু কি স্বচ্ছন্দে খিস্তি শব্দটা উচ্চারণ করল! টেনে চড় মারব?

না। এখানে কোন ঝামেলা করব না আমরা। এমনিতেই ছেলেগুলোর নজরে পড়ে গেছি। টোটাল অবক্ষয়ের শিকার এরা। এই দেশের পরবর্তী প্রজন্ম। হয়তো যাকে চড় মারতে চাইলি সে-ই একদিন পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হবে। আর তখন খিস্তিটাই স্বাভাবিক ভাষা হবে। এককালে শালা শব্দটা বড়দের সামনে উচ্চারণ করা অপরাধ ছিল, এখন তো স্বাভাবিক। আনন্দ আবার দরজায় শব্দ করল।

আবার, আবার হাড়হাবাতের দল, গুখেগোর দল আমাকে জ্বালাচ্ছিস! তোদের মরণ হয় না? বাপ মা তোদের পৃথিবীতে আনল কেন? আমায় একটুও শান্তিতে থাকতে দেবে না গো! দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা—। দরজাটা খুলে গেল। আনন্দ বৃদ্ধাকে দেখল। খালি গা, থানকাপড়টি শরীরে জড়ানো। মুখের চামড়ায় অজস্র ভাজ। চুল ছেলেদের মত করেই কাটা। হাতে একটা ঝটা। তিনি অবশ্য থমকে দাঁড়ালেন। ক্রোধের বদলে বিস্ময় ফুটল মুখে। সুদীপ হাসল, আমরা এসে গেছি।

অবনীর ছেলে না? অ! আমি ভাবলাম–! জ্বলন্ত চোখে বৃদ্ধা দূরে দাঁড়ানো ছেলেগুলোর দিকে তাকালেন একবার। তারপর একটু সরে দাঁড়িয়ে বললেন, এসো। দরজা বন্ধ করতে হবে।

ওরা ভেতরে ঢুকতেই আবার বাচ্চাদের চিৎকার শুরু হল। দরজা বন্ধ করে বৃদ্ধা বললেন, বুঝতে পেরেছি, অবনীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। কিন্তু সেই অভাগীর কি দোষ? তাকে ছেড়ে এলে কেন?

মা নেই। সুদীপ খুব আস্তে শব্দ দুটো উচ্চারণ করল।

নেই? থমকে গেলেন বৃদ্ধা, কবে গেল? বেঁচে গেল। ভগবান এখনও মাথার ওপরে আছেন। তা অবনী তার কাজটাজ করেছে তো? এসেছ ভালই করেছ। সঙ্গে এটি কাকে জুটিয়েছ? দ্যাখো, আমি চিৎকার চেঁচামেচি একদম সহ্য করতে পারি না। কদিন থাকবে?

আসতে না আসতেই বিদায় করতে চাইছ! এই সেদিন এলাম তখন বললে কোন আপত্তি নেই।

আমি কি তাই বলেছি। যদ্দিন থাকবে থাকো কিন্তু তোমাদের খাটনের কি হবে? আমি বাবা রাত্রে চোখে দেখি না, মাছ মাংসের গন্ধ সহ্য করতে পারি না। তারপরে ও-পাশের যে ভাড়াটে কলেজে পড়াতো তার স্ট্রোক না কি বলে তাই হয়েছে। গত মাসের ভাড়া দেয়নি। আমার তো ওইটুকু সম্বল। দু-একদিন হলে ঠিক আছে, বেশিদিন আমি তোমাদের জন্যে হেঁসেল ঠেলতে পারব না।

বৃদ্ধার মাথাটা সবেগে দুলতে লাগল।

সুদীপ বলল, তোমাকে আমাদের জন্যে কিছুই করতে হবে না। আমার এই বন্ধু কবি। একটু নিরিবিলিতে কবিতা লিখতে চায় যেখানে কেউ ওকে বিরক্ত করবে না। তাই এখানে নিয়ে এলাম। খাবার-দাবারের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নেব। তুমি শুধু দেখো তোমার ভাড়াটেরা যেন ওপরে না যায়। কবিতা লেখা খুব সাধনার ব্যাপার তো!

কবিতা। তুমি কবিতা লেখো? বৃদ্ধা আনন্দর দিকে তাকাল, আমার কর্তা এককালে কবিতা লিখত! না, কেউ এ বাড়িতে ঢুকবে না। ভাড়াটেরা এদিকে আসে না, আসা নিষেধ। আর যত ধান্দাবাজ আত্মীয়দের বলে দিয়েছি মরে গেলে এই বাড়ি রামকৃষ্ণদেবের আশ্রমে যাবে। কেউ ভাগ পাবে না। যাও ওপরে চলে যাও। বিছানাপত্র নেই কিন্তু। সতরঞ্চি আছে। তোমাদের সঙ্গে কথা বলার সময় নেই আমার।

বৃদ্ধা ঝাঁটা হাতে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলেন। বারান্দার পাশ দিয়ে একটা সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে। সিঁড়ির গায়ে কোনকালে সিমেন্ট পড়েছিল কিনা সন্দেহ আছে। দেখলেই বোঝা যায় বাড়িটি তৈরি করার সময় মালিকের অনেক সাধ ছিল, কিন্তু সেটা কখনই পূর্ণ হয়নি। বিশাল ছাদটি ন্যাড়া। ছাদের একপাশে একটি ঘর, তার কাঠের দরজার অবস্থাও করুণ। ছাদ ডিঙিয়ে যেতে যেতে আনন্দ লক্ষ্য করল চারপাশের গাছগাছালি ছাদটাকে বেশ আড়াল করে রেখেছে। মাঝ-দুপুরের পরেই বোধ হয় এখানে ছায়া নামে। সুদীপ দরজার শেকল খুলল। একটা কবজা আলগা হয়ে গেছে। কিন্তু ঘরটি পরিষ্কার। বিশাল একটা সতরঞ্চি পাতা আছে। ওপাশে একটা কাঠের জানলা। ঘরের এক কোণে স্থূপ করা কিছু পুরনো জিনিসপত্র। সম্ভবত স্টোররুম হিসেবেই ব্যবহৃত হত। জিনিসপত্র নামিয়ে রেখে আনন্দ বলল, সব ঠিক আছে। কিন্তু ওরা এলে একটাই প্রব্লেম হবে। স্নান-পায়খানার জন্যে নিচে নামতে হবে। জয়িতাকে বুড়ি মানতে পারবে বলে মনে হয় না।

সুদীপ বলল, তুই লক্ষ্য করিসনি। এই ঘরের পেছনেই একটা ছোট ঘর আছে। সেটা বানানো হয়েছিল দোতলায় যারা ব্যবহার করবে তাদের জন্যে। তখন তো অ্যাটাচড বাথ বাড়িতে বোধ হয় করা হত না সংস্কারের জন্যে। দাঁড়া একবার নিজের চোখে অবস্থাটা দেখে আসি। সুদীপ শিস দিতে দিতে বেরিয়ে গেল।

এই ঘরে কোন ফ্যান নেই। কিন্তু ইলেকট্রিক কানেকশনও যে থাকবে না তা কে ভেবেছিল! আনন্দ উঠে জানলাটা খোলার চেষ্টা করল। দীর্ঘদিন একই অবস্থায় থাকায় সেটাকে বন্ধনমুক্ত করতে কসরত করতে হল। দুটো পান্না খুলে মরচে পড়া লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে তাকাতেই পুকুরটাকে দেখতে পেল আনন্দ। একদম এই বাড়ির লাগোয়া। পুকুরের চারপাশে বাগান। জল মোটেই পরিষ্কার নয়। বেলা বাড়লেও এখনও পুকুরের সর্বাঙ্গে রোদ পড়েনি। মনে মনে পাক খেতে লাগল লাইনগুলো। ধীরে ধীরে হাওয়া দিয়েছে,/টলমল করছে পুকুরের জল,/ঝিলমিল করছে বাতাবি লেবুর পাতা।/ চেয়ে দেখি আর মনে হয়/এ যেন আর কোন একটা দিনের আবছায়া/আধুনিকের বেড়ার ফাঁক দিয়ে/দূর কালের কার একটা ছবি নিয়ে এল মনে। যে মানুষটি চলে গেছেন প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগে তিনি কেমন করে যেন চলে আসেন আধুনিকতার আড়াল ভেঙে। এবং তখনই আনন্দর নজরে পড়ল মেয়েটিকে মার সাদা শাড়ির রাঙা চওড়া পাড় দুটি পা ঘিরে ঢেকে পড়েছে। মেয়েটি এঁটো বাসন ঘাটে রেখে অবাক হয়ে ওপরের দিকে তাকাতেই আনন্দ সরে এল। সে বুঝতে পারছিল না মেয়েটি খোলা জানলা দেখে অবাক হয়েছে, না তাকেও দেখতে পেয়েছে। দ্বিতীয়টি কিছুতেই কাম্য নয়। এই ঘরে কেউ আছে এটা যত কম মানুষ জানতে পারে ততই মঙ্গল। জানলাটা বন্ধ করে দিতে গিয়েও সে থেমে গেল। খোলা জানলায় মেয়েটি যদি অবাক হয় বন্ধ হলে সেটা আরও বেড়ে যাবে। আসলে সেই মহান বৃদ্ধটি তার সব গোলমাল করে দিলেন। কেন যে এইভাবে সব পরিবেশ সব মন নিয়ে এমন করে শব্দে শব্দে প্রতিমা গড়ে গেছেন!

সুদীপ হাসিমুখে ফিরে এল, জয়িতার জন্যে চিন্তা নেই। প্যানটা ঠিক আছে বলেই মনে হল। স্নান করতেও কোন অসুবিধে হবে না। শুধু আমাদের নিচ থেকে জল এনে দিতে হবে ওকে।

বুড়িকে কি কৈফিয়ত দিবি?

তোর কিংবা আমার পালা করে শরীর খারাপ হবে। জানলাটা খুলেছিস?

সুদীপ সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু আনন্দ বাধা দিল, ওখানে যাসনে সুদীপ।

কেন? কেউ আছে নাকি?

হ্যাঁ। একটি কৌতূহলী তরুণী। বাসন মাজতে এসেছে।

তাই! আহা কি দৃশ্য। কেমন দেখতে রে?

ভাল করে দেখিনি। আমরা এখানে এসেছি তা জানাজানি হোক নিশ্চয়ই চাস না!

তোর কিছু হবে না। শরৎচন্দ্রের নায়িকারা কখনই নায়কদের বিপদে ফেলত না। এই পুকুরঘাট, দোতলার জানলা নিয়ে এককালে কত রোমান্টিক কাহিনী লেখা হয়েছে বল।

বাংলা দেশের বেশির ভাগ লেখক পালিয়ে বাঁচতে ভালবাসেন। তারা গল্প উপন্যাস লেখেন নিজের সময়টাকে এড়িয়ে গিয়ে। ছেড়ে দে, এই ঘরটা তো বেশ ভাল। কিন্তু কয়েকটা বালিশ লাগবে। আর ওই বস্তুগুলো কোথায় রাখা যায়?

আনন্দ ঘরটাকে আর একবার জরিপ করল। তারপর একটা সুটকেস তুলে কোণার দিকে মালপত্র সরিয়ে আড়াল করল। তারপর বলল, এখানে সাপটাপ থাকা বিচিত্র নয়। চোখ খোলা রাখিস। তারপর জামা খুলে সতরঞ্চিতে শরীর এলিয়ে দিল, বড্ড ঘুম পাচ্ছে। দরজাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়।

হাতের ওপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল আনন্দ। সুদীপ ওর দিকে তাকাল। আনন্দর স্বাস্থ্য ভাল নয়, গায়ের রঙও ময়লা। কিন্তু এই বয়সেও ও যে কিভাবে একটা ব্যক্তিত্ব অর্জন করেছে যা তার চেহারা ছাপিয়ে উঠেছে। সুদীপেরও ঘুম পাচ্ছিল। কাল রাত্রের টেনসনের জেরে এতক্ষণ চলছিল। সতরঞ্চিতে বসার পর শরীর টানছে। সে জামা খুলল। তার সুন্দর দেহ, উজ্জ্বল রঙ নিয়ে কিছুদিন আগেও একটা গর্ব ছিল। এখন আর এসব নিয়ে ভাবে না। ময়দানে জুডো এবং পরে ক্যারাটে শিখেছিল কিছুদিন। ওই বয়সে শরীরটা তৈরি করতে বেশির ভাগ ছেলের মত সে যত্নবান ছিল। কিন্তু সিগারেট ধরার পর ওসব ছেড়ে দিয়েছে। টান টান হয়ে শুয়ে পড়তে শক্ত মেঝে পিঠে লাগল সতরঞ্চির আড়াল ভেদ করে। এইভাবে শোওয়ার অভ্যেস তার কোনদিনই ছিল না। দুতিনবার পাশ ফিরে একটু আরাম তৈরি করে নিচ্ছিল সে। শেষ পর্যন্ত সুদীপ উঠে বসল। একটা বালিশ দরকার। আনন্দ এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে। পারে বটে। কিন্তু সে এত দ্রুত মানাতে পারছে না। কিন্তু বালিশ ছাড়াই শুতে হবে ভাই তোমাকে। সুদীপ নিজের সঙ্গে কথা বলল। এবং তখনই জানলার দিকে নজর গেল। এবার ওখান দিয়ে বোদ ঢুকছে ঘরে। একটু অন্ধকার করে দিলে বোধ হয় ঘুম আসবে। উঠে জানলার কাছে সন্তর্পণে যেতেই পুকুরটাকে দেখতে পেল সে। পুকুরের ধারে কেউ নেই। আনন্দ যে মেয়েটার কথা বলেছিল সে বোধ হয় কাজ শেষ করে ফিরে গেছে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে গিয়েই তার চোখ আটকে গেল একটা গাছের তলায়। দুটি অল্পবয়সী ছেলে মেয়ে সেখানে মগ্ন হয়ে গল্প করছে। ওদের চেহারা, রকম এবং ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল সুদীপ। তারপর জানলাটা বন্ধ করে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। এখন অবধি কোন মেয়ের সঙ্গে সে প্রেমের কথা বলতে পারল না। সুদীপ কোন একটি মেয়ের মুখ মনে করতে চেষ্টা করল। কিন্তু অবয়ব তৈরি হবার আগেই জোয়ারের মত ঘুম এল শরীরে। এমন কি কোমরে গোঁজা ধাতব বস্তুটিও আর অস্বস্তি আনল না।

 

বেহালা ট্রাম ডিপোর সামনে দাঁড়িয়ে সুদীপ আর একবার হাই তুললো। আজ সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে কিন্তু তবু ঘুমঘুম লাগছে। আনন্দ যদি ডেকে না তুলতো তাহলে এখন এখানে দাঁড়াতে পারত না। তার সঙ্গী হতে চেয়েছিল আনন্দ কিন্তু সে নিষেধ করেছে। সুদীপ একাই ও-বাড়িতে আছে এই রকমই পাড়ার লোকের জানা ভাল। বুড়ি কাউকে বলতে যাচ্ছে না এরকম বিশ্বাস করা যেতে পারে। দুপুরে অবশ্য আর একবার উঠতে হয়েছিল। ঘরের দরজায় এসে তারস্বরে চিৎকার করছিলেন বুড়ি ঘুম ভাঙানোর জন্যে। কোন রকমে চোখ মেলতেই শুনেছিল, রাত জেগে চুরি করে এসেছে নাকি! এত ঘুম তো বাপের জন্মে দেখিনি! ভাত বেঁধেছি, গায়ে জল ঢেলে সেগুলো উদ্ধার কর এখন। একটা নিরামিষ তরকারি আর ভাত। কিন্তু অমৃত বলে মনে হয়েছিল সুদীপের। ঝি-চাকরের হাতে রান্না খেতে খেতে ভুলেই গিয়েছিল নিরামিষ কতটা সুস্বাদু হয়। তারপর আবার ঘুম। কখন যে দিনটা কেটে গেল তা টেরই পায়নি।

এর মধ্যে এখানে এসে দুটো কাজ করেছে সে। একটা ছোট ট্রাঞ্জিস্টার কিনেছে। খবরের কাগজ রোজ পাবে কিনা ঠিক নেই। বুড়ির তত সে-বালাই নেই। আনন্দই বলেছিল এটা কিনতে। আর ব্যাগ ভরতি করে খাবার কিনেছে, সিগারেট নিয়েছে, সঙ্গে মোমবাতি আর হাওয়ায় ফোলানো বালিশ।

সাতটা দশ। সাতটায় আসার কথা ওদের। কল্যাণটা কোনকালেই সময় ঠিক রাখে না। তার ওপর সঙ্গে রয়েছে জয়িতা। সুদীপ চারপাশে তাকাল। দেখে তো মনে হচ্ছে না কেউ তাকে নজর করছে কিন্তু বিশ্বাস কি! আজ বাড়ি থেকে বের হবার পরই ওই একটা অনুভূতি হচ্ছে। রাত দশটা বদলে সাতটা করা হয়েছিল সেটা খেয়াল আছে তো ওদের! একটার পর একটা ট্রাম আসছে আর চলে যাচ্ছে অথচ সে উঠছে না, যে কোন মানুষই তো সন্দেহ করতে পারে। সুদীপ এগিয়ে গেল। একজন পুলিশ বগলে লাঠি গুঁজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। লোকটাকে দেখে প্রথমে চমকে উঠে হেসে ফেলল সে। দূর, ওই পুলিশটাকে খুব দুঃখী-দুঃখী মনে হচ্ছে।

সাতটা পনেরো নাগাদ ট্যাকসিটা ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়াল। পেছনের জানলা থেকে কল্যাণ হাত নেড়ে ওকে ডাকছে সুদীপ দেখতে পেল। চটপট ড্রাইভারের পাশে উঠে বসে চালাতে নির্দেশ দিল সে। কল্যাণ বলল, পনেরো মিনিট লেট, কিন্তু কিছু করার ছিল না।

কেন? ট্যাকসি পাসনি?

না, ট্যাকসি নয়। ওরা জয়িতাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল।

সুদীপ ঠোঁট কামড়াল, কখন?

আমরা যখন বের হচ্ছি। খুব অল্পের জন্যে ওরা আমাদের মিস করেছে।

তোর হাতের খবর কি?

মেজর কিছু নয়। তবে ডাক্তার প্লাস্টার করে দিয়েছে। এখন ব্যথা টের পাচ্ছি না।

সুদীপ এবার জয়িতার দিকে তাকাল। তার চোখে মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। মাথার চুল একদম ছেলেদের মত হেঁটে ফেলেছে জয়িতা। কলার-উঁচু শার্ট পরেছে। এখন ওকে একটি সতেরো বছরের তরুণের মত দেখাচ্ছে। একটা রসিকতা করতে গিয়ে চেপে গেল সে।

গলিটার অনেক আগেই ট্যাকসি ছেড়ে দিল ওরা। এদিকে রাত হলে লোকজন কমে যায়। ওরা হেঁটে এল চুপচাপ। জয়িতার ব্যাগটা ওর কাঁধেই ছিল, কল্যাণেরটা সুদীপ বইছিল। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সুদীপ বলল, তোরা একপাশে দাঁড়া। বুড়ি দরজা খুললে প্রথমে আমি ভেতরে গিয়ে কথা চালাব। তারপর শিস দিলেই সোজা ভেতরে ঢুকে এগিয়ে গিয়ে একটা সিঁড়ি দেখতে পাবি, শব্দ না করে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে চলে যাবি তোরা। ওখানে আনন্দ আছে। তোরা এখন এলি বুড়ি তা জানতে না পারে। কথা শেষ করে দরজায় শব্দ করল সুদীপ। তৎক্ষণাৎ ভেতর থেকে আওয়াজ ছিটকে উঠল, কে, কে রে? এখন কে জ্বালাতে এল?

সুদীপ মৃদুগলায় বলল, আমি, আমি ফিরে এসেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *