২০. ব্যাঙ্কের ভেতরে কর্মব্যস্ততা

অধ্যায় ২০

ব্যাঙ্কের ভেতরে কর্মব্যস্ততা এখন তুঙ্গে। মতিঝিলের মতো বাণিজ্যিক এলাকায় বৃহস্পতিবার সেটা আরেকটু বেড়ে যায়।

রাহিদ হাসান নিজের কিউবিকলে কাজ করছে, এমন সময় নুরু নামের এক আরদার্লি এসে হাজির।

“ম্যানেজারস্যার আপনেরে ডাকছে।”

“আসছি,” বলল সে।

আরদার্লি চুপচাপ চলে গেলে গভীর করে শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ালো রাহিদ। তাদের ওয়ার্কস্টেশনের একেবারে শেষ মাথায় অবস্থিত ম্যানেজারের রুমটা, সেদিকে যেতে যেতে ভাবলো, ব্যাঙ্কে কিছু ছাঁটাইয়ের কথা শুনছে। এই হারামজাদা ম্যানেজার যদি তাকে সেরকম তালিকায় রাখে তো তাকেই চিরকালের জন্য ছাঁটাই করার ব্যবস্থা করে ফেলবে!

“মে আই কাম ইন, স্যার?” ম্যানেজারের রুমের দরজা বেশির ভাগ সময় আনলক থাকে, দরজা একটু ফাঁক করে সে বলল। সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়লো অপরিচিত দু-জন ভদ্রলোক বসে আছে ম্যানেজারের সামনে।

“কাম ইন,” ম্যানেজার রিশাদ কবীরের চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। ইশারা করলো তাকে সামনের একটা সিটে বসার জন্য।

রাহিদ হাসান বুঝতে পারলো পরিস্থিতি বেশ সিরিয়াস। ব্যাঙ্কিং সেক্টরে প্রায়শই এমন আবহাওয়া বিরাজ করে। কিন্তু ম্যানেজারের সামনের একটা চেয়ারে বসে পড়তেই অবাক হয়ে দেখলো, অপরিচিত দু-জন লোকের একজন উঠে দরজাটা লক করে দিচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারলো না সে। বসে থাকা লোকটার দিকে তাকালো। গভীরভাবে নিরীক্ষণ করছে তাকে তবে তার চাহনিতে সেটা প্রকট নয়। দরজা লক করে অন্য লোকটি চুপচাপ নিজের সিটে এসে বসে পড়লো।

“কি হয়েছে, স্যার?” উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো রাহিদ হাসান।

ম্যানেজার গভীর করে নিশ্বাস নিলো। “উনারা আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।”

“উনারা কারা? কোত্থেকে এসেছেন?” অজানা আশঙ্কায় রাহিদ হাসানের বুক কেঁপে উঠল।

অধস্তনের প্রশ্নের জবাব দিলো না ম্যানেজার, অপরিচিত দু-জনের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলো কেবল। “ইউ ক্যান প্রসিড।”।

“আমি হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর…জেফরি বেগ।”

রাহিদ হাসানের মাথায় বাজ পড়লো। হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট যে খুন খারাবি নিয়ে কাজ করে সেটা সে জানে। তারা কি চায় আমার কাছে?! মনে মনে বলে উঠল।

“আপনি এখানে কতো দিন ধরে কাজ করছেন, মি. হাসান?” শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো জেফরি বেগ।

“প-পনেরো বছরের মতো হবে,” নিজের নার্ভাস ভাবটা লুকানোর চেষ্টা করলো জোর করে।

“এখন এইচআর ডিভিশনে আছেন?”

“হ্যাঁ।” একটা ঢোক গিলে আবার বলল সে, “এক্সিউজ মি, আমি কি জানতে পারি, আপনারা কী নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন?”

জেফরি বেগ তাকালো ম্যানেজারের দিকে।

ভদ্রলোক দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “আপাতত আপনি শুধু উনাদের প্রশ্নের জবাব দেবেন, পাল্টা কোনো প্রশ্ন করবেন না। আর ভুলেও মিথ্যে বলবেন না, ঠিক আছে?”

ফ্যাল ফ্যাল চোখে ম্যানেজারের দিকে তাকালো রাহিদ হাসান।

তার দিকে হাত বাড়ালো হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর। “আপনার ফোনটা দিন।”

ইনভেস্টিগেটরের কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো সে। ম্যানেজারের দিকে ফিরে বলল, “আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, স্যার?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিশাদ কবীর। “একটু পর সবই বুঝতে পারবেন। ফোনটা দিয়ে দিন উনাকে।”

ঢোক গিলল এসএসবি ব্যাঙ্কের কর্মকর্তা। হুট করেই তার মনে হচ্ছে, দুনিয়াটা বদলে গেছে, একটা দুঃস্বপ্নের ভেতরে ঢুকে পড়েছে সে।

“আপনার সেলফোনটা?” আবারো তাড়া দিলো জেফরি।

“আজব! আমি কেন আমার ফোন দেবো? কি হয়েছে সেটা আগে বলবেন তো?” চেঁচিয়ে উঠল রাহিদ হাসান।

“ফোনটা উনাদেরকে দিয়ে দিন,” দাঁতে দাঁত পিষে আদেশের সুরে বলল ম্যানেজার।

বুকে সাহস সঞ্চয় করে নিলো রাহিদ। “স্যার, আমি কী অপরাধ করেছি সেটা না জানা পর্যন্ত ফোন দেবো না। এটা জানার অধিকার নিশ্চয়ই আমার আছে?”

ম্যানেজার কিছু বলার আগেই জেফরি বেগ বলে উঠল, “আপনি ব্ল্যাক রঞ্জুর লোক।”

“কী!?” যার পর নাই বিস্মিত রাহিদ হাসান। “মাথা খারাপ হয়েছে। আপনাদের?”

জেফরি বেগ কিছুই বলল না, লোকটার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো।

“কে বলেছে এসব কথা?” জোর গলায় জানতে চাইলো সে।

“জামান?” পেছনে ফিরে সহকারির দিকে তাকালো জেফরি। “উনাকে শোনাও।”

জামান তার ফোনটা মুখের সামনে তুলে ধরলো। ফোনের স্পিকার থেকে ভেসে এলো একটি টেলিফোন সংলাপ :

কই তুই?

কিসমত আরারে ডাক্তার দেখায়া বনশ্রীতে দিয়া আইতাছি

কি হইছে ওর?

মাইয়া মানুষের কি সমস্যার অভাব আছে…গাইনোকলোজিস্টের কাছে আইছিল।

.

রাহিদ হাসানের চোখেমুখে অবিশ্বাস। যদিও ফোনে চল ভাষায় কথা বলছে, তবে কণ্ঠটা শুনে চেনা যাচ্ছে পরিস্কার।

.

কাম শ্যাষ কইরা ফ্ল্যাটে আয়…বহুত দিন মাস্তি করি না।

আইজকা?

হ।

জেনি তো নাটকের শুটিং করতে গেছে কক্সবাজারে।

আবার নাটক করাও চো*দাইতাছে!

এইসব না করলে ডিমান্ড বাড়েনি? এইসব কইরাই তো হাজার টাকার ছেরিরা লাখ টাকা ডিমান্ড করে।

রুমানারে ক না, ওর কাছে তো দুনিয়ার মাইয়া।

আচ্ছা, দেখি…কিসমত আরারে তো আবার দিয়া আইতে হইবো…লেট হইবো একটু।

ফ্রি হইবি কখন?

সাতটা-আটটা বাজবো।

সমস্যা নাই…দশটার দিকে আয়।

.

পুরো আলাপটি শোনার সময় বার কয়েক চমকে উঠল রাহিদ হাসান। টের পেলো গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কী বলবে বুঝতে পারলো না।

“এই কিসমত আরা হলো ব্ল্যাক রঞ্জুর বোন,” জেফরি বলল।

রাহিদ হাসান কিছুই বলল না, ড্যাব ড্যাব চোখে চেয়ে রইলো কেবল।

“এমন না যে, আপনি যার সাথে কথা বলছেন কেবল সে-ই চেনে কিসমত আরাকে, আপনাদের কথাবার্তা শুনে বোঝা যাচ্ছে, আপনিও তাকে চেনেন।” একটু থেমে আবার বলল, “আপনি যেখানে থাকেন এক সময় রঞ্জুও সেখানেই থাকতো দীর্ঘদিন, ওখান থেকেই ওর উত্থান। আপনি রঞ্জুকে ভালোমতোই চেনেন। শুধু চেনেন না, ওর হয়ে কাজও করেন।”

রাহিদ হাসান নিশ্চপ। দৃষ্টিতে বিহ্বলতা।

“উনারা যা বলছে তা কি সত্যি?” দাঁতে দাঁত পিষে বলল ম্যানেজার। ঠাণ্ডা মাথার মানুষ হিসেবে তার খ্যাতি আছে-আজকের এই মুহূর্তটার আগে পর্যন্ত তাকে এমন রূপে দেখেনি কেউ। “বলুন! দয়া করে সত্যি বলবেন, মিথ্যে বললে আপনি রক্ষা পাবেন না।”

রাহিদ হাসান টের পেলো তার নিশ্বাস বেড়ে গেছে, ভন ভন করছে মাথার ভেতরটা। কানের দু-পাশে চাপ অনুভব করতে শুরু করছে।

“আপনি কিন্তু কিছু বলছেন না,” তাড়া দিলো জেফরি বেগ।

একবার ম্যানেজার, আরেক বার হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটরের দিকে উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালো রাহিদ হাসান। এ জীবনে কখনও এমন প্রশ্নের জবাব দিতে হবে, ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। কয়েক মুহূর্তেই অসংখ্যবার ভেবে গেল, ব্ল্যাক রঞ্জুকে সে চেনে কিংবা চেনে না-কোন জবাবটি তার জন্য বেশি ভালো হবে। শেষ পর্যন্ত রাহিদ হাসান বুঝতে পারছে, এমন প্রশ্ন যারা করতে পারে, তারা ভালোমতো খোঁজখবর নিয়েই এসেছে।

“জ-জি!” অবশেষে ঢোক গিলে বলল সে।

এমন জবাব শুনে হোমিসাইডের দু-জন মোটেও অবাক হলো না, হতবাক হলেন কেবল ম্যানেজার রিশাদ কবীর। রাগেক্ষোভে ক্ষিপ্ত ষাড়ের মতো তার নাকের পাটা দুটো ফুঁসে উঠল।

“কতদিন ধরে চেনেন?” জেফরি বেগ জানতে চাইলো।

রাহিদ হাসান টের পেলো তার হাত-পা কাঁপছে। জবাব দেবার সময় বুঝতে পারলো ঠোঁটদুটোও কাঁপছে। “ব্‌-বিশ-বাইশ বছর…” তোতলানোটা থামাতেই পারছে না।

ম্যানেজারের চোখদুটো বিস্ফারিত হলো যেন।

“রঞ্জু গ্রুপকে আপনি ধনী ক্লায়েন্টদের তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন,” জেফরি এমনভাবে বলল যেন এটা কোনো প্রশ্ন নয়। “সেই ইনফো পেয়ে ঐ ক্রিমিনাল গ্রুপটা চাঁদা চায় তাদের কাছে। চাঁদা না পেলে হুমকি দেয়, বাড়িতে ককটেল মারে, গুলি করে ভয় দেখায়।”

রাহিদ হাসান টের পেলো তার চোখ ঠেলে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে।

“কাউকে কাউকে হত্যাও করা হয়।”

রাহিদ হাসান নিজের বুকের হাতুড়িপেটা শুনতে পেলো।

“আপনার ফোনটা দিন,” আবারো হাত বাড়ালো জেফরি বেগ।

ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো রাহিদ হাসান। এ সময় জামান উঠে এসে তার কাঁধে হাত রেখে তাড়া দিলো। একান্ত অনিচ্ছায় পকেট থেকে মোবাইলফোনটা বের করে দিয়ে দিলো জেফরির সহকারির হাতে।

“না জানি কতো ক্লায়েন্টকে আপনি এভাবে বিপদে ফেলেছেন!” একটু থেমে আবার বলল জেফরি বেগ, “দীর্ঘদিন রঞ্জুর দলটা নিষ্ক্রিয় ছিল কিন্তু তিন-চার মাস ধরে আবার তারা সক্রিয় হয়ে উঠেছে।” একটু সামনের দিকে ঝুঁকে এলো এবার। “আমরা ভালো করেই জানি, রঞ্জু বহু আগেই মারা গেছে।”

ঢোক গিলল রাহিদ হাসান। তার চোখেমুখে বিস্ময়। “এখন আমাকে বলুন, কে রঞ্জুর দলটা চালাচ্ছে?”

রর সাথে তার সম্পর্কের কথা কখনও কেউ জানবে, ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। এটা কেবলমাত্র রঞ্জুর খুব ঘনিষ্ঠ অল্প কিছু মানুষ জানে।

“প্রশ্নের জবাব দিন!” রেগেমেগে বলল ম্যানেজার। “আমাদের সব শেষ করে দিয়েছেন!…আপনি একটা মাদারফাঁকার!”

“র-রঞ্জু তো…” আবারো ঢোক গিলল এসএবি ব্যাঙ্কের অফিসার। “…বেঁচে আছে…মরেনি।”

“রঞ্জু বেঁচে আছে?” ভুরু কুঁচকে গেল জেফরির।

মাথা নেড়ে সায় দিলো রাহিদ হাসান। মুখ দিয়ে শব্দ বের করতে পারছে না, সারা শরীর কাঁপছে এখন।

“এটা অসম্ভব!” জোর দিয়ে বলল জেফরি বেগ। “দিল্লিতে ওকে পুড়িয়ে মেরেছে…” সঙ্গে সঙ্গে শুধরে নিলো কথাটা, “…মারা হয়েছে।”

রাহিদ হাসান কিছুই বলল না, ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো।

“আপনি কি ব্ল্যাক রাঞ্জুর সাথে দেখা করেছেন? তাকে দেখেছেন?”

কিছুই বলল না এসএসবি ব্যাঙ্কের অফিসার।

“কথা বলুন!” ধমকের সাথে বলল ম্যানেজার। “ইউ স্কাউলে!”

“দ্‌-দেখেছি…কথা হয়েছে,” কথাটা বলার সময় তোতলালো।

ভুরু কপালে উঠে গেল জেফরির। এর আগে যে দু-জন বলেছে, তারা কেউ রঞ্জুকে সামনাসামনি দেখেনি। কিন্তু এই লোক বলছে, দেখেছে।

“কোথায় দেখা করেছেন?” গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইলো জেফরি।

“ভিডিও কলে কথা হয়েছে।”

আশাহত হলো জেফরি। এই লোকও সচক্ষে দেখেনি। অথচ সে রঞ্জু গ্রুপের খুবই ঘনিষ্ঠ সার্কেলের একজন।

“ঢাকায় আসার পর রঞ্জু এখন খুব সাবধানে থাকে, কারো সাথে দেখা করে না।”

রাহিদ হাসান ফোনে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করলেও সঙ্গত কারণেই নিজের অফিসে প্রমিত বাংলা বলছে।

“তার বর্তমান কন্ডিশান কেমন? আমি তার স্বাস্থ্যের কথা জানতে চাচ্ছি,” বলল জেফরি বেগ।

“এমনভাবে আগুনে পুড়ে গেছে যে তাকে দেখে চেনা যায় না।”

স্থির দৃষ্টিতে তাকালো ইনভেস্টিগেটর।

“বিদেশে গিয়ে ট্রিটমেন্ট করিয়েছে দীর্ঘ দিন। এখন অনেকটাই সুস্থ।”

গভীর করে নিশ্বাস নিলো জেফরি। “আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, তাতে আমরা জানি, ব্ল্যাক রঞ্জু মারা গেছে, কিন্তু তার ঘনিষ্ঠ লোকজন চাঁদাবাজি করার জন্য দাবি করে রঞ্জু বেঁচে আছে এখনও।”

রাহিদ হাসান মুখ তুলে তাকালো। তার দুচোখে অশ্রু ছলছল। “রঞ্জু যদি বেঁচে না থাকতো তাহলে আমি তার হয়ে কখনওই কাজ করতাম না!”

ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকালো জেফরি।

“ও বেঁচে আছে বলেই আমি ওর হয়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি।”

মাথা দোলালো ইনভেস্টিগেটর। বার বার কেন মিথ্যে বলছেন??” তার কণ্ঠে বিরক্তি আর রাগ। “রঞ্জু মারা গেছে…অনেক আগে! তার নাম ভাঙিয়ে কিছু লোকজন এখন চাঁদাবাজি করছে। চাঁদা না দিলে ভয় দেখাচ্ছে, খুনখারাবি করছে। বোঝাতে চাইছে, রঞ্জু ফিরে এসেছে। ঐ ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসির ফোন পেয়ে যেন চুপচাপ সবাই চাঁদা দিয়ে দেয় তার জন্যেই এসব করা হচ্ছে।”

মাথা নিচু করে ফেলল রাহিদ হাসান নামের এসএসবি ব্যাঙ্কের অফিসার।

“স্যার!”

জেফরি আরো কিছু বলতে যাবে, অমনি পেছন থেকে জামান বলে উঠল। পেছন ফিরে সহকারির দিকে তাকালো সে। “কী হয়েছে?”

ম্যানেজার ভদ্রলোক কৌতূহলি দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তাদের দিকে। রাহিদ হাসানের ফোনটার ডিসপ্লে জেফরির দিকে মেলে ধরলো জামান।

ছবিটা দেখে চমকে উঠল ইনভেস্টিগেটর। সেই সাথে তার চোখেমুখে অপার বিস্ময়।

অধ্যায় ২১

“আপনি কী করে জানলেন আমি এখানে আছি…বেঁচে আছি?”

নিজের কৌতূহল দমাতে পারলো না বাবলু। এ লোকের বুদ্ধি আর ক্ষমতার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তারপরও এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাচ্ছে না।

বাবলুর বিস্মিত মুখটা দেখে ভালোই লাগছে অমূল্য বাবুর। “কেউ যদি মনে করে ঢাকা থেকে কক্সবাজার অনেক দূর, ওখানে চলে গেলে দুনিয়া থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারবে, তাহলে তাকে বোকা ভাববো আমি।”

মুচকি হাসলো বাবলু। “বুঝতে পেরেছি। আপনার পরিচিত কেউ আমাকে দেখে ফেলেছে।”

“আমার সাথে তোমার সম্পর্কের কথা আমার পরিচিত কেউ জানে না।”

“তাহলে কিভাবে জানতে পারলেন আমি বেঁচে আছি…এখানে আছি?”

একটু চুপ থেকে বাবু বলতে শুরু করলো। খুব বেশি কথা বলার লোক সে নয়, তাই কতো কম কথায় বলা যায় তাই একটু গুছিয়ে নিলো। প্রথম থেকেই আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল, তুমি বেঁচে আছে। যখন লাশ খুঁজে পাওয়া গেল না তখন আমি অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে গেলাম। বুঝতে পারছিলাম, তুমি নিজেকে আড়ালে রাখতে চাইছো…যোগাযোগ করছে না।” একটু থেমে আবার বলল, “বেঁচে থাকলে তোমার টাকার দরকার হবে, অন্যদের চেয়ে বেশিই হবে, কারণ তুমি আহত হয়েছিলে। ব্যাঙ্কে তোমার টাকা আছে, দেশের যেকোনো জায়গা থেকে এটিএম কার্ড ব্যবহার করে সেটা তুলবে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবলু। তার অনেকগুলো অ্যাকাউন্টের মধ্যে দুটো অ্যাকাউন্টের খবর অমূল্য বাবু জানে। ঐ দুটো অ্যাকাউন্টে বেশ কিছু কন্ট্রাক্টের টাকা বাবু নিজেই ডিপোজিট করেছিল।

“তোমার অ্যাকাউন্টটা যে ব্যাঙ্কে, সেখানকার এক বড় কর্মকর্তা আমার পরিচিত।”

বাকিটা আর বলতে হলো না, বুঝে গেল সে। অমূল্যবাবুর বিশেষ একটি অনুরোধ ফেলতে পারেনি ঐ ব্যাঙ্কার। তার মানি ট্রানজ্যাকশনের তথ্যগুলো দিয়ে দিয়েছে। আরো অনেক কিছুই হয়তো দিয়েছে। আর সে যে নিয়মিত মহাকাল পড়ে, এটাও বাবুর জানা ছিল। সত্যি বলতে, এখানে এসে রোজ রোজ পত্রিকা পড়া হতো না। তবে কাকতালীয়ভাবে দু-তিন ধরে পড়েছে, নইলে বাবুর এই কৌশলটা ব্যর্থ হয়ে যেতো।

প্রসংশার দৃষ্টিতে ভুরু তুলে বাবুর দিকে তাকালো সে। “আপনি তো দেখি জেফরি বেগের চেয়েও এক কাঠি উপরে।”

নিঃশব্দে হাসলো অমূল্য বাবু। এটিএম বুথের সিসিক্যামের ফুটেজও সে দেখেছে, প্রায় কয়েক মাস ধরে কক্সবাজারের বুথ থেকে টাকা তুলেছে বাবলু। শেষবার অবশ্য টাকা তোলার সময় তার সঙ্গে অন্য একজনকে দেখে অবাক হয়েছিল।

“কিন্তু এতোদিন পর কেন এলেন?”

অমূল্যবাবু গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো। “তুমি বেঁচে আছো জেনে নির্ভার হয়েছিলাম। তুমি যদি নিজেকে আড়ালে রেখে ভালো থাকো, তাহলে সেটাই হোক। সেজন্যেই কিছু করিনি।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো বাবলু।

“কিন্তু এখন যে এলাম, তার কারণ আছে, বলবো সেটা। তার আগে বলো, ঐ ছেলেটা কে।”

অবাকই হলো বাবলু। “এখানকার এক ছেলে।” ছোট্ট করে বলল।

অমূল্যবাবু বুঝতে পারলো, এ নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাইছে না সে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তার দিকে।

অধ্যায় ২২

রাহিদ হাসানের ফোনে বাস্টার্ডের ছবি দেখে জেফরি বেগ আর জামান যার পর নাই বিস্মিত।

অনেক দিন পর পেশাদার খুনির ছবি দেখলো সে। এই ছবিটা হোমিসাইডই সংগ্রহ করেছিল, বিলি করে দিয়েছিল ঢাকার বিভিন্ন থানায়। বাস্টার্ড তখন ব্ল্যাক রঞ্জুকে হত্যা করার জন্য একের পর এক তার দলের লোকজনকে হত্যা করে কলকাতায় পৌঁছে গেছে। এই থানাগুলোর কোনোটায় রঞ্জুর হয়ে কাজ করে এমন কেউ রঞ্জুকে ছবিটা সরবরাহ করেছে নিশ্চয়ই।

জামানের দিকে তাকালো জেফরি। সে ফোনটা হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে আছে। তার হাতে বাস্টার্ড গুলিবিদ্ধ হয়েই মেঘনা রিসোর্টের লেকে পড়ে গেছিল কিন্তু তার লাশ আর পাওয়া যায়নি। সম্ভবত লেক থেকে ভেসে মেঘনা নদীতে পড়ে গেছিল লাশটা।

ওর ছবি এই লোকের কাছে কেন? প্রচণ্ড আগ্রহি হয়ে উঠল জেফরি। “এই লোকটা কে?” রাহিদ হাসানের কাছে জানতে চাইলো সে।

ঢোক গিলে ফোনের ডিসপ্লের দিকে তাকালো লোকটা। ছবিটা দেখে একটু ভড়কে গেল, কী বলবে ভেবে পেলো না।

“এই লোক কে? এর ছবি আপনার ফোনে কেন?” ধমক দিলো এবার।

ম্যানেজার রিশাদ কবীর বুঝতে পারছে না কিছু, চোখ দুটো পিটপিট করে দেখছে তাদেরকে।

পুরোপুরি নার্ভাস এখন রাহিদ হাসান।

“আরে, তুই কথা বলছিস না কেন!” দাঁতে দাঁত পিষে ম্যানেজার বলে উঠল। অধৈর্য শোনালো তাকে।

“ব্‌-বাস্টার্ড।”

“কী?!” রিশাদ কবীরের চোখদুটো বিস্ফারিত হলো যেন।

ভদ্রলোক রেগেমেগে কিছু বলার আগেই জেফরি হাত তুলে তাকে বিরত করলো। “আপনাকে বলেনি…ওটা একজনের নাম,” একটু থেমে আবার বলল, “আন্ডারওয়ার্ল্ডে এক খুনিকে এ নামে ডাকে সবাই।”

ভুরু কুঁচকে ফেলল ম্যানেজার। খুনি-আন্ডারওয়ার্ল্ড এসব শব্দ তাকে আরো বেশি ভয়ার্ত করে তুলল। তার ব্যাঙ্কের ভেতরে এসব কী ঢুকে পড়েছে।

“ওর ছবি আপনার কাছে কেন?”

জেফরির প্রশ্নটা শুনে আবারো ঢোক গিলল রাহিদ হাসান। কোনোমতে বলতে পারলো : “-রঞ্জু দিয়েছে।”

এবার হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটরের চোখ বিস্ফারিত হবার জোগাড় হলো। “কেন?”

“দুই মাস আগে সবাইকে এই ছবিটা দিয়েছে রঞ্জু…কোথাও কেউ একে দেখলে যেন ওকে জানায়।”

জেফরি বেগের বিশ্বাসই হচ্ছে না, লোকটা কী বলছে! বাস্টার্ড কি বেঁচে আছে?! “এই লোককে রঞ্জু খুঁজছে কেন?” জবাবটা সে জানে, তারপরও রাহিদ হাসানের কাছ থেকেই জানতে চাইছে।

“শুনেছি, রঞ্জুকে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছিল, তাই…” কথাটা আর শেষ করলো না।

জেফরি স্থিরচোখে চেয়ে রইলো রাহিদ হাসানের দিকে। এই প্রথম তার মনে হচ্ছে, ব্ল্যাক রঞ্জু সত্যি সত্যি বেঁচে আছে।

বেঁচে আছে বাস্টার্ডও!

অধ্যায় ২৩

মেডিকক্স নামের নতুন হাসপাতালটির সামনে সাদা রঙের প্রাইভেটকারটি থামতেই তায়েবের বুক ঢিপঢিপ করতে শুরু করলো। তার বড়ভাই এরইমধ্যে পিস্তলে ম্যাগাজিন ভরে কোমরে গুঁজে নিয়েছে। গাড়িটা যে চালাচ্ছে তার কাছেও একটি বিদেশি পিস্তল আছে কিন্তু সে একেবারে খালি কিছু নেই। তাহলে এই অ্যাকশনে তাকে সঙ্গে নেবার কোনো মানে আছে? সে তো ঢাল নেই তলোয়াড় নেই নিধিরাম সর্দার! তাছাড়া আন্ডারওয়ার্ল্ডে থাকার সময়েও কখনও অ্যাকশনে যায়নি। তার কাজ-কারবার ছিল একেবারেই অন্যধরণের।

তায়েব দ্রুত ভেবে নিলো। তাকে এখন বুদ্ধির উপরে ভরসা রাখতে হবে। “ভাই, আমি কইলাম গাড়ি চালাইতে পারি। এই জায়গাটাও ভালা কইরা চিনি। এইখানকার সব পথ-ঘাট আমার চিনা। আমি গাড়িতে থাকলেই মনে হয় ভালা হইবো, কি কন?”

মুচকি হাসলো সানগ্লাস। “তুই কি ডরাইতাছোস নাকি?”

ঢোক গিলল তায়েব। “না, মাইনে…লগে তো মেশিন নাই, আমি গিয়া কী করুম?”

“সমস্যা কি, আমার লগে তো আছে,” সানগ্লাসের মুখে বাঁকা হাসি।

গাড়ি চালাচ্ছে যে লোকটা সে-ও হাসতে হাসতে পেছন ফিরে বলল, “আরে মিয়া, চিন্তা করতাছো ক্যান? আমরা দুইজনেই কাম করুম, তুমি গাড়িতেই থাকবা। ওই শুয়োরের বাচ্চার লাইগা আমরাই কাফি।”

“শোন্, গুলির সাউন্ড পাইলেই গাড়ি স্টার্ট দিয়া রাখবি,” সানগ্লাস যোগ করলো।

খুশিতে চওড়া হাসি দিলো তায়েব। দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো সে। “আপনে কুনো চিন্তা কইরেন না, ভাই। এইখান থেইকা আপনেগো বাতাসের আগে বাইর কইরা নিয়া যামু আমি।”

সানগ্লাস আর সময় নষ্ট না করে ড্রাইভার গোলামকে নিয়ে ঝটপট নেমে পড়লো গাড়ি থেকে। এখানে আসার আগে পথে গাড়ি থামিয়ে এক কেজি কমলা আর মাল্টা কিনে নিয়েছে তারা, ফলগুলোর নেটব্যাগটা সালামের হাতে। সানগ্লাস আর গোলাম এমন সহজ ভঙ্গিতে হাসপাতালের দিকে হেঁটে গেল যেন রোগি দেখতে এসেছে তারা।

তায়েব পেছনের সিট থেকে বের হয়ে ড্রাইভিং সিটে এসে বসলো। এইসব গোলাগুলি আর খুনখারাবি করার চাইতে গাড়ি চালানো অনেক নিরাপদ কাজ। তার ধারনা, যা ঘটার দশ মিনিটের মধ্যেই ঘটবে, এর বেশি সময় লাগবে না। হাসপাতালটা বেশ নিরিবিলি জায়গায়, গোলাগুলির আওয়াজ শুনে খুব বেশি লোকজনও ছুটে আসবে না। এখান থেকে থানার দূরত্বও অনেক। পুলিশে খবর দিলে দশ মিনিটের আগে আসতে পারবে না তারা। ছোটো শহরের হাসপাতাল, নিজস্ব সিকিউরিটি বলতে ভগ্নস্বাস্থ্যের কিছু দারোয়ান। ওরা গুলির আওয়াজ পেলে বাথরুম খুঁজবে নয়তো উল্টোদিকে দৌড় দেবে। কারোর বাড়ি যদি আশেপাশে থাকে, এক দৌড়ে সেখানেই চলে যাবে।

ইগনিশানে চাবিটা লাগানোই আছে। মুচকি হেসে তায়েব ইঞ্জিন স্টার্ট করে গাড়িটা ডান দিক দিয়ে ঘুরিয়ে এনে মেইনগেট বরাবর রাখলো। কাজ একটু এগিয়ে রাখা আর কি। এখন তাকে অপেক্ষা করতে হবে, এই ফাঁকে একটা সিগারেট ধরাবে কি না সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না সে।

*

“তুমি গিয়া জিগাও,” হাসপাতালের রিসেপশন ডেস্ক থেকে একটু দূরে এসে সঙ্গিকে বলল সানগ্লাস।

গোলাম সায় দিয়ে চুপচাপ চলে গেল রিসেপশনের দিকে। বেশ আত্মবিশ্বাসি হয়ে রিসেপশন ডেস্কের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে, তার হাতে কমলা আর মাল্টার ব্যাগ। একজন ভিজিটর সে।

সানগ্লাস তাকে শিখিয়ে দিয়েছে কী বলতে হবে : সঙ্গের একজনকে হাসপাতালে যেতে বলে ফল কিনতে গেছিল, এখন এসে দেখে রিসেপশন ডেস্কের কাছে সে নেই। সমস্যা হলো, তার সঙ্গির ফোনটাও বন্ধ পাচ্ছে। সম্ভবত হাসপাতালের ভেতরে নেটওয়ার্ক খারাপ। তাদের রোগি কতো নাম্বার ওয়ার্ড-কেবিনে ভর্তি সেটাও তার জানা নেই। একটু সমস্যায় পড়ে গেছে।

সানগ্লাস দেখতে পেলো গোলাম হোসেন রিসেপশন ডেস্কের অল্পবয়সি ছেলেটার সঙ্গে কথা বলছে। সব শুনে ছেলেটা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে সিঁড়ির দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলো সালামের বর্ণনা দেয়া লোকটি কতো নাম্বার কেবিনে গেছে। তার মানে খবর পাওয়া গেছে। গোলাম ডেস্ক থেকে ঘুরে সোজা চলে গেল সিঁড়ির দিকে, যাবার আগে শুধু সানগ্লাসের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো।

“কয় তলায়?” সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় সালামের পেছন এসে বলল সানগ্লাস।

“চাইর তলায়…” পেছনে না ফিরেই বলল গোলাম হোসেন।

“কয় নাম্বার কেবিনে গেছে?”

“৪১৪। নতুন হাসপাতাল…এখনও লিফট লাগায় নাই, কষ্ট কইরা সিঁড়ি দিয়াই উঠতে হইবো।”

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মাথা নেড়ে সায় দিলো সানগ্লাস। “এক্কেবারে নিরিবিলি, কোনো ঝামেলাই হইবো না।”

উঠতে উঠতে আশেপাশে তাকালো গোলাম। “নতুন হাসপাতাল, সিসি ক্যামেরাও লাগায় নাই।”

সানগ্লাসের হাসিটা আরেকটু চওড়া হলো।

অধ্যায় ২৪

এনামুল হক বুঝতে পারছে না আজ কেন মহাকাল পত্রিকাটা হকার দিয়ে যায়নি।

তার এই হোটেলে মোট পাঁচটি পত্রিকা রাখা হয়-এক একটি কম করে হলেও দশ থেকে বারো কপি। তার মধ্যে ইংরেজি পত্রিকা বাংলাদেশ গেজেট আর মহাকাল রাখা হয় পঁচিশ থেকে ত্রিশ কপি করে। তাদের এখানে কিছু লাক্সারি সুটে নিউজ পেপার দেয়া হয় হোটেলের পক্ষ থেকে। এ দুটো পত্রিকা বেশি জনপ্রিয় বলে বেশি রাখা হয়। হোটেলের গেস্টদের রেজিস্ট্রেশন করার সময়ই জেনে নেয়া হয় তাদের পছন্দের পত্রিকার নাম। কক্সবাজারে তারাই প্রথম এই নিউজপেপার সার্ভিস চালু করে। তাদের দেখাদেখি এখন অনেক ফোরস্টার-ফাইভস্টার হোটেল এটার প্রচলন করেছে। এই পেপার সার্ভিস চালু করার আইডিয়াটি পুরোপুরি এনামুল হকের। এ নিয়ে তার মধ্যে এক ধরণের তৃপ্তিও কাজ করে।

ঝড়বৃষ্টি কিংবা হরতাল না থাকলে সকাল আটটার মধ্যে পত্রিকাগুলো হকার দিয়ে যায়, রুম সার্ভিসের কর্মিরা সেগুলো গেস্টদের রুমে দিয়ে আসে। আজ সকালেও হকার পত্রিকাগুলো যথারীতি দিয়ে গেছে, সেগুলো রুমসার্ভিসের লোকজন ডিস্ট্রিবিউটও করেছে। তবে মহাকাল দেয়া হয়নি। অবশ্য এটা এমন বড় কোনো সমস্যা নয় যে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে জানাতে হবে। সে যখন ফ্রন্টডেস্কে গিয়ে বসলো তখনই তার সহকারি ম্যানেজার জানিয়েছিল, আজ হকার মহাকাল দিয়ে যায়নি, তার বদলে অন্য একটি পত্রিকা দিয়ে গেছে।

মহাকাল দিতে পারেনি কেন?

কী যেন একটা সমস্যা হয়েছে?

পত্রিকাটি নাকি আজ ঢাকা থেকে আসেনি। এনামুল আর এ বিষয় নিয়ে মাথাও ঘামায়নি। এটা হতেই পারে। অনেক সময়ই এরকম হয়। সে ক্ষেত্রে গেস্টদেরকে অপারগতার কথা জানিয়ে দেয়া হয়। সহকারি ম্যানেজারও তাই করেছে।

তো আয়েশ করে ফ্রন্টডেস্কে বসে চা খেতে খেতে কয়েকটি পত্রিকার দিকে চোখ বোলাচ্ছিল সে, এমন সময় এক গেস্ট বাইরে থেকে ফিরে এসে ফ্রন্টডেস্ক থেকে চাবি নেবার সময় অনুযোগের সুরে জানান, মহাকাল পত্রিকাটি তিনি কষ্ট করে বাইরে থেকে কিনে আনলেন। ওখানে নাকি আজ তার একটি লেখা ছাপা হয়েছে। ভদ্রলোক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, মাঝেমধ্যে শিক্ষা-রাজনীতি নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখি করেন।

অধ্যাপকের হাতে মহাকাল দেখে এনামুল হক যারপরনাই বিব্রত বোধ করে, তারপরই রেগেমেগে হকারকে ফোন দেয় সে কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে হকার জানায়, আজ নাকি ঢাকা থেকে মহাকাল-এর কোনো কপিই আসেনি। এটা তো বিশ্বাস করা যায় না। এই কক্সবাজারে সবাই পত্রিকাটি পাচ্ছে, বাইরে থেকে তার গেস্ট কিনে আনতে পারছে অথচ হকার বলছে অন্য কথা। হকারকে ধমক দিয়ে যখন সে জানালো মহাকাল তাদের হোটেলের বাইরে পাওয়া যাচ্ছে তখন বেচারা কাচুমাচু খেয়ে রীতিমতো। তোতলাতে শুরু করে।

এখন নিজের অফিসে এসে ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে যাচ্ছে সে। গতকাল এই হোটেলের একজন মালিক মহাকাল-এর স্থানীয় প্রতিনিধির সঙ্গে মিটিং করলো নিজের রুমে আর আজ সকালে সেই পত্রিকা সবখানে পাওয়া গেলেও তার হোটেলে দেয়া হলো না!

না, না, এটা কাকতালিয় ব্যাপার নয়। এই দুটো ঘটনার মধ্যে নিশ্চয়ই। কোনো কানেকশান আছে। একটু আগে একজন স্টাফকে দিয়ে পত্রিকাটি কিনে আনতে পাঠিয়েছে সে। তার ধারনা সব রহস্যের জবাব পত্রিকাতেই আছে।

কিছুক্ষণ পর তার কর্মচারি পত্রিকাটা তাকে দিয়ে গেলে নিজের অফিসে চলে গেল সেটা নিয়ে। মহাকাল-এর শেষ পৃষ্ঠায় এককলামের একটি বক্স নিউজে চোখ আটকে গেল তার।

আমাদের মালিক গুলিবিদ্ধ! আর আমি কিছুই জানি না!

আজ সকালে যে লোকটা সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় নাস্তা করে বাইরে চলে গেল সে কি-না গতকাল সন্ধ্যার দিকে সন্ত্রাসিদের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মেডি কক্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে।

অবিশ্বাসে মাথা দোলাতে লাগলো এনামুল হক।

ঢাকা থেকে একজন ব্যবসায়ি জমি কিনতে এসেছে কক্সবাজারে! গতকাল দুপুরে স্থানীয় সন্ত্রাসি-চাঁদাবাজরা তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা চাইলে তিনি দিতে অস্বীকার করেন, এ-কারণে সন্ধ্যার দিকে সন্ত্রাসিরা তাকে গুলি করে পালিয়ে যায়?! তিনি এখন মেডি কক্স হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন!!

নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না এনামুল হক। হতভম্ব হয়ে বসে রইলো কয়েক মুহূর্ত। সে জানতো পত্রিকাগুলো অনেক আজগুবি খবর ছাপে কিন্তু এমন খবরও ছাপে তার জানা ছিল না। এসব খবর ছাপানোর উদ্দেশ্য কি?

সে এতোটা মূর্খ নয় যে এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাবে না। এসব কিছুর পেছনে আছে তাদের মালিক নিজেই! মহাকাল-এর স্থানীয় প্রতিনিধিকে ডেকে এনে তিনিই এ ধরণের সংবাদ ছাপানোর ব্যবস্থা করেছেন। আরো বুঝতে পারছে হকার কেন আজ সকালে মহাকাল দিয়ে যায়নি-তার চোখে যেন খবরটা না পড়ে।

তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে বিরাট কোনো ঘাপলা আছে। নিজের রুম থেকে বের হয়ে এলো এনামুল হক। সহকারি ম্যানেজারকে ডেকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে দিলো। তাকে চোখকান খোলা রাখার কথা বলে নিজের অফিসে আবার ফিরে এলো সে, লক করা একটি ড্রয়ার খুলে ম্যাগাজিন ভর্তি পিস্তল কোমরে খুঁজে নিলো। ঠিক করলো তাদের মালিক ফিরে না আসা পর্যন্ত নিজে ফ্রন্টডেস্কে বসে থাকবে। কড়া নজর রাখতে হবে চারপাশে।

অধ্যায় ২৫

তোমাকে দেখে আমার খুবই ভালো লাগছে-এমন কথা মুখে বলতে পারলো না অমূল্যবাবু।

বাবলুও চুপ থাকলো। সে-ও খুব সহজে নিজের শক্তপোক্ত খোলসের বাইরে যায় না।

“ভেবেছিলাম, আর বোধহয় দেখা হবে না, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল বাবু।

আসলে গুলিবিদ্ধ হবার পরই বাবলু বুঝে যায়, প্রাণঘাতী কিছু নয়, এ যাত্রায় সে বেঁচে যাবে। বলতে গেলে লেকের পানিতে ভাসতে ভাসতে মেঘনার বুকে পড়ার সময়ই বুদ্ধিটা তার মাথায় আসে-জেফরি বেগদের কাছে সে মৃতই থেকে যাক! তার লাশ পাওয়া না গেলে খুব বেশি অবাক হবে না ঐ ইনভেস্টিগেটর। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে লেকের স্রোতে ভেসে গিয়ে কোনো লাশ যদি মেঘনায় গিয়ে পড়ে, সেটা খুঁজে না পাওয়াই স্বাভাবিক।

সে কেন এমনটা চেয়েছিল? ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল জেফরি বেগের সাথে চোর-পুলিশ খেলতে খেলতে? হাঁপিয়ে উঠেছিল? এসব থেকে মুক্ত হয়ে দু দণ্ড শান্তি চাচ্ছিল? ছোট্ট একটা বিরতি? নাকি যে জীবন সে বয়ে বেড়িয়েছে এখন পর্যন্ত, তার সমাপ্তি চায়? কিন্তু জানে না কিভাবে-তাই অনেকটা বৈরাগ্যে আক্রান্ত হয়েছিল?

সত্যিটা সে-ও জানে না। অতো কিছু ভেবে এটা করেওনি। কেবল মনে হয়েছিল, নিজের মতো করে নির্ভার কিছু সময় কাটানো দরকার, আর এটা করতে হলে একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যেতে হবে। এমন কি অমূল্যবাবুর সঙ্গেও কোনো রকম যোগাযোগ রাখবে না, কারণ বাবুর সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টি জেনে গেছে জেফরি বেগ, তাকে ধরার জন্য এই মানুষটার উপরে নজরদারী করবে। তাদের দুজনের ভালোর জন্যেই কয়েকটা মাস বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ না রাখাই ভালো হবে।

“আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতাম…” আস্তে করে বলল সে। “ …কয়েকটা মাস পর।”

“ঐ পা-টা পুরোপুরি বিকল হয়ে গেলে?” দীর্ঘশ্বাস ফেলে আক্ষেপে মাথা দোলালো। “এতোদিনেও তো ঠিক হয়নি।”

পায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল সে। “এটা ওই পা না।”

অবাক হলো বাবু।

ডান পা-টা দেখিয়ে বলল, “গুলিটা এই পায়ে লেগেছিল। এটা ক’দিন আগের ঘটনা।”

“এখানে…?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো। ট্রলারে করে মাছ ধরা দেখতে গেছিল সমুদ্রে, মহেশখালির ঘাটে নামতে গিয়ে যে পা পিছলে পড়ে গেছিল, এসব আর বলল না।

“এখানে আসার সময় ক্ৰাচটা সঙ্গেই ছিল, গোড়ালিটা মচকে যাবার পর আবার ইউজ করছি ক-দিন ধরে।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বাবু। “অন্তত আমাকে জানাতে পারতে!”

“আমি আসলে-”

“বাস্টার্ড!”

কথাটা আর শেষ করতে পারলো না বাবলু, অমনি একটা কণ্ঠ বলে উঠল। চমকে দরজার দিকে তাকালো তারা দুজন। আর দৃশ্যটা পুরোপুরি ভড়কে দিলো তাদেরকে।

অস্ত্র হাতে দু-জন লোক দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।

অমূল্যবাবু অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো অস্ত্রধারীদের দিকে। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ।

হায় ভগবান! মনে মনে বলে উঠল সে।

অধ্যায় ২৬

রঞ্জু তাহলে বেঁচে আছে?

এই চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না জেফরি বেগ। যদি সে না-ই বেঁচে থাকতো, যদি অন্য কেউ তার দলটা চালাতো, তাহলে বাস্টার্ডকে হত্যা করার জন্য এতোটা মরিয়া হতো না, তার ছবি দলের সবাইকে দিয়ে বেড়াতো না।

এসএসবি ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের রুমে কয়েক মুহূর্ত নিরবতা নেমে এসেছে। জামান ছাড়া বাকি দু-জনের ধারনাই নেই, এই ছবি দেখে জেফরি বেগের কী অনুভূতি হচ্ছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, রঞ্জুর দলের পুরনোরা সংগঠিত হয়ে তার নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করছে আজকাল। এখন সেই দৃঢ় বিশাস টলে গেছে।

সন্ত্রাসি চক্রের নেতা মরে গেলে তাকে নিয়ে ভাবার মতো কেউ থাকে না। তার হয়ে প্রতিশোধ নেবার প্রশ্নই ওঠে না। বরং অনেক সময়ই দেখা যায়, যারা বেঁচে আছে তারা আগেরজনের শত্রুর সঙ্গে আপসরফা করে ফেলে, হাত মেলায়। এমন নয় যে মৃত নেতার শত্রুদের সঙ্গে একেবারেই কোনো রকম যুদ্ধ বাঁধে না। এরকম কিছু হয় কেবলমাত্র স্বার্থের আঘাত লাগলে। সাধারণত যে মরে গেছে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সে বিস্মৃত হয়ে পড়ে। নতুন একজন আসে, তার নামেই দলের নাম হয়। নয়তো অন্য দলে ভিড়ে যায় কেউ কেউ।

ম্যানেজার রিশাদ কবীর আর রাহিদ হাসানের দিকে তাকালো জেফরি। তারা দুজনেই কিছু বুঝতে না পেরে চেয়ে আছে তার দিকে। মাথা থেকে রঞ্জুর চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে যে বিষয় নিয়ে কথা বলছিল, তাতে ফিরে গেল সে।

“আপনি আমেরিকান টোব্যাকোর ম্যানেজিং ডিরেক্টর মুনেম চৌধুরীর অ্যাকাউন্টের সব তথ্য দিয়ে দিয়েছেন রঞ্জুর দলকে। আপনার কাছ থেকে তথ্য পেয়েই ভদ্রলোকের কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা চাওয়া হয়,” থুতনি চুলকে কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিলো সে। “ভদ্রলোক পুলিশকে জানালে রঞ্জুর লোকজন তাকে গুলি করে, মি. চৌধুরী পরে হাসপাতালে মারা যান।”

এসব কথা ইচ্ছে করেই বলল জেফরি, যাতে অপরাধী বুঝতে পারে, তার অপরাধটি কতো গুরুতর, কতো বড় অন্যায় করেছে।

“উনার বাবা সরকারি দলের একজন এমপি,” যোগ করলো সে। “পিএমের খুবই কাছের লোক।”

মাথা নিচু করে রাখলো রাহিদ হাসান। রঞ্জুর লোকজন এভাবে লোকটাকে গুলি না করলেই পারতো। সত্যি বলতে এই হত্যাকাণ্ডটি তার কাছে বাড়াবাড়ি বলেই মনে হয়েছে। আনাড়ি ছেলেপেলে দিয়ে কাজ করালে যা হয়। পায়ে না করে বুকে আর মাথায় গুলি করে বসেছে হারামজাদারা! তাদের ভুলের মাশুল এখন দিতে হচ্ছে তাকে।

মাথা দোলালো ম্যানেজার রিশাদ কবীর। রাগে তার গা কাঁপছে। “পিএমের খুবই ঘনিষ্ঠ লোক উনি…এবার বোঝ, কী করেছিস বানচোত!”

“আপনি আমাদের কো-অপারেট না করলে ভীষণ বিপদে পড়ে যাবেন,” বলল জেফরি বেগ। “এখন বলুন, আর কার কার তথ্য দিয়েছেন রঞ্জুকে?” সঙ্গে সঙ্গে শুধরে নিলো একটু। “…রঞ্জুর দলকে?”

ঢোক গিলল রাহিদ হাসান। সে কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।

ম্যানেজার উদগ্রীব হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। প্রশ্নের জবাবে নিশ্চুপ আছে বলে অধৈর্য হয়ে উঠল। “আরে বানচোত, জবাব দে!”

ধমক খেয়ে মুখ খুলল রাহিদ হাসান। “হা-হারুনুর রশীদ…” কথাটা বলতে গিয়ে তোতলালো আবারো।

“কোন হারুনুর রশীদ?!” বিস্ফারিত চোখে জানতে চাইলে রিশাদ কবীর। “সুরমা গ্রুপের হারুনসাহেব?!”

মাথা নিচু করে ফেলল রাহিদ হাসান।

“মাই গড!” রাগে বিস্ময়ে বলে উঠল ম্যানেজার। “এই বানচোত করেছেটা কী! এই লোক আমার সবচেয়ে বড় ক্লায়েন্ট। তার চেয়েও বড় কথা, উনিও একজন এমপি!” তুই আমার ব্যাঙ্কের সর্বনাশ করে ফেলেছিস! ক্লায়েন্টরা যদি এসব জানতে পারে…” কথাটা আর শেষ করতে পারলো না, দাঁতে দাঁত পিষতে লাগলো।

জেফরি বেগ তার দিকে তাকিয়ে শান্ত হবার ইশারা করলো।

রাগে-ক্ষেভে হাতের মুষ্টিটা সজোরে ডেস্কে আঘাত করলো রিশাদ কবীর। “শিট!”

রাহিদ হাসান একটু চমকে উঠে আবারো মাথা নিচু করে রাখলো। একটা ব্যাপার চট করেই ধরতে পেরেছে সে, আর এটাই তাকে আশার আলো দেখাতে শুরু করছে এই কঠিন পরিস্থিতিতে। নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো এবার। নার্ভটা শক্ত রাখা দরকার, এভাবে ভেঙে পড়লে হবে না। গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো। “রঞ্জুর কথামত কাজ না করলে ও আমাকে মেরে ফেলবে,” কথাটা খুব শান্ত হয়েই বলল সে।

“এইসব অজুহাত দিয়ে কোনো লাভ হবে না,” জেফরি বেগ বলল। “আপনি যে ক্রাইম করেছেন তার জন্যে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাহিদ হাসান। নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য এটা করেছি। আমার কিছু করার ছিল না। আপনারা আমার অবস্থায় পড়লে বুঝতেন।”

মাথা দোলালো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। ম্যানেজার রিশাদ কবীর ঘৃণায় মুখ বিকৃত করে রেখেছে।

“আপনি বলতে চাইছেন, এসব কাজ করে আপনি লাভবান হতেন না?”

জেফরি বেগের দিকে তাকালো এসএসবি ব্যাঙ্কের হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা। এই প্রথম ইনভেস্টিগেটরের চোখে চোখ রেখে দৃঢ়ভাবে বলল, “না। টাকার জন্য এটা করিনি, নিজের জীবন বাঁচাতে করেছি।”

মুচকি হাসলো জেফরি। “টাকা-পয়সা পেতেন না?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাহিদ হাসান। “রস্তুর জন্য কাজ করলে সবাই টাকা পায়…না চাইলেও পায়।”

স্থিরচোখে চেয়ে রইলো জেফরি বেগ। পলিগ্রাফ মেশিন না থাকলেও তার প্রশিক্ষণ বলছে, লোকটার কথা সত্যি।

এবার ম্যানেজারের দিকে তাকালো রাহিদ হাসান। “রঞ্জু যদি আপনাকেও ধরে তাহলেও কিছু করতে পারবেন না। ওর ক্ষমতা সম্পর্কে আপনাদের আসলে কোনো ধারনাই নেই।”

রাগে ক্ষোভে গজ গজ করে উঠল রিশাদ কবীর। “চুপ কর! ফালতু কথা বলবি না। আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস!”

“আমি জেলে যাবার পরই বুঝতে পারবেন, আমার কথাটা সত্যি না কি মিথ্যা।”

“এর সাহস তো কম না!” ম্যানেজার জেফরির দিকে ফিরে বলল। নিজের ভয়ার্ত অভিব্যক্তি লুকানোর চেষ্টা করলো সে। “আপনার সামনে ভয় দেখাচ্ছে আমাকে!”

আক্ষেপে মাথা দোলালো রাহিদ হাসান, আর কিছু বলল না।

ম্যানেজার কিছু বলতে যাবে, অমনি জেফরি বেগ হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো। “আপনি মিথ্যে বলছেন। আপনার জেনে রাখা ভালো, আমি মিথ্যে কথা ধরতে পারি।”

ম্যানেজার মাথা নেড়ে সায় দিলো, মুখে হাসিও দেখা গেল এবার। তবে সেটা জোর করে হাসার লক্ষণ। যেন একটু আগের ভয়কে জয় করার উসিলা পেয়ে গেছে। “মিথ্যে বলে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে…কত্তো বড় হারামি!”

“রঞ্জু এখন কোথায়?” শান্তকণ্ঠে জানতে চাইলো জেফরি।

“জানি না। এটা মনে হয় না দুয়েকজন বাদে কেউ জানে।”

মুচকি হাসলো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। “সহজে বলবেন না মনে হচ্ছে।”

“আপনার কি ধারনা, রঞ্জু এভাবে কাজ করে?” বলল রাহিদ হাসান। “এভাবে কাজ করলে বহু আগেই ও পুলিশের কাছে ধরা পড়ে যেত।”

“আপনি কি বুঝতে পারছেন, আমাদের সাথে সহযোগিতা না করলে কী হতে পারে?” চোয়াল শক্ত হয়ে গেল জেফরির।

“আমি সবই বুঝতে পারছি কিন্তু আপনারা বুঝতে পারছেন না আমার অবস্থাটা।”

ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো জেফরি বেগ।

“তোর আবার কী অবস্থা, অ্যাঁ?” ম্যানেজার রেগেমেগে বলল। “শালার সন্ত্রাসির চ্যালা!”

গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো রাহিদ হাসান। “রঞ্জু কোথায় আছে আমি জানি না। যদি জানতাম, বিশ্বাস করুন, সেটা বলে দিতাম আপনাকে।” একটু থেমে আবার বলল, “নিজে জীবন বাঁচানোর জন্যই বলে দিতাম। ও না থাকলে আমি মুক্ত হয়ে যাবো।” তার চোখদুটো ছলছল করে উঠল।

জেফরি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো লোকটার দিকে।

“আমি যে আপনাদের হাতে ধরা পড়ে গেছি এটাও যদি রঞ্জু জানতে পারে, আমাকে আর বাঁচিয়ে রাখবে না।”

কয়েক মুহূর্তের জন্য ঘরে নেমে এলো নিরবতা।

“আমি বুঝে গেছি আমার পরিণতি কী হবে,” একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে বলল রাহিদ হাসান। “খুব দ্রুত রঞ্জু জেনে যাবে সব কিছু। তার পর…” কথাটা শেষ করলো না আর, জোর করে কান্না আটকে রাখছে যেন।

“কেউ কিচ্ছু জানতে পারবে না,” আশ্বস্ত করে বলল জেফরি বেগ। “এ ঘর থেকে কোনো কথা বাইরে যাবে না, আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন।”

ম্যানেজার রিশাদ কবীরও মাথা নেড়ে সায় দিলো। “একদম ঠিক। এখান থেকে কোনো কথা লিক হবে না।”

ভদ্রলোকের দিকে তাকালো রাহিদ হাসান। “আপনার কোনো ধারনা আছে, এই ব্যাঙ্কে কয়জন রঞ্জুর হয়ে কাজ করে?”

ম্যানেজার যেন বিরাট বড় একটা ধাক্কা খেলো। চোখদুটো বিস্ফারিত হবার জোগাড় হলো তার।

অধ্যায় ২৭

পান্না!

অস্ত্রহাতে যে দু-জন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে তাদের একজনকে চিনতে পেরে মনে মনে বলে উঠল বাবলু। এমন একজনকে এখানে দেখে যার পরনাই বিস্মিত সে। নিয়তির নির্মম পরিহাস, এই জঘন্য লোকটাকে এতোদিন মৃত ভেবে আসছিল, ঠিক যেমনটা তার বেলায়ও অনেকে ভেবেছে!

“কী রে বাস্টার্ড, আমারে চিনবার পারছোস?” অস্ত্রটা বাবলুর দিকে তাক করে দাঁতে দাঁত খিচে বলল পান্না। এক সময় পুরান ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদার মোল্লাভাইয়ের ঘনিষ্ঠ লোক ছিল সে।

লোকটার দিকে স্থিরচোখে তাকিয়ে রইলো বাবলু।

“তর মাথা তো খুব ভালা, মেমোরিও খুব কড়া…না চিনোনের কথা না।”

অমূল্যবাবু চুপচাপ পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করছে।

“তর লাইগা শামীম মরছে, চিকা মরছে…আমিও গেছিলাম আরেকটু হইলে,” রাগে ঘেন্নায় থুতু ফেলল ঘরের মধ্যে।

“শামীম আর চিকা আমার জন্যে মরেনি,” শান্ত কণ্ঠে বলল বাবলু। “আপনারা নিজেরাই নিজেদের কবর খুঁড়েছিলেন।”

ভুরু কুঁচকে গেল পান্নার।

“মোল্লাভায়ের সাথে বেঈমানি করেছিলেন আপনারা।”

অমূল্যবাবু এবার বুঝতে পারলো, বহুকাল আগে বাবলুর আন্ডারওয়ার্ল্ডে থাকাকালীন পুরনো শত্রুতার ব্যাপার এটি।

পান্নার মুখ শক্ত হয়ে গেল, নাকের পাটা ফুঁসতে শুরু করলো। “আমরা কুনো বেঈমানি করি নাই!”

অস্ত্রধারীর সাথে আর এ নিয়ে তর্কে গেল না বাবলু।

“আমরা তিনজনে একটু বাইরে গেছিলাম, এরমইদ্যে কততগুলা পোলাপান আইসা ভায়েরে গুলি করলো। গোলাগুলির সাউন্ড পাইয়া-ই আমরা দৌড়ায়া আইছিলাম কিন্তু তুই…” রেগেমেগে দম ফুরিয়ে গেল পান্নার, “…ভায়েরে চিল্লায়া চিল্লায়া কইতে লাগলি, আমরা বেঈমানি করছি! আমাগো তিনজরে বেঈমান বানায়া দিলি, তুই!”

“তাহলে আপনারা আমাকে আর মোল্লাভাইকে গুলি করলেন কেন?”

“আমরা তগো গুলি করি নাই!” চেঁচিয়ে বলল কথাটা। “…মার্কেটের উপরে শাহাদাঁতের একটা পোলারে দেইখা গুলি করছিলাম।”

“অতো দূর থেকে কিভাবে বুঝলেন ওরা শাহাদাঁতের পোলাপান ছিল? এটা তো ঘটনা ঘটার পরে জেনেছি সবাই।”

পান্না বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “চুপ, শুয়োরের বাচ্চা!” রাগে কাঁপতে লাগলো পান্না। “একদম চুপ!”

অস্ত্রহাতের কাউকে রাগানোর মতো বোকা নয় বাবলু। আর সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক তাকে যুক্তি দিয়ে ঘায়েল করতে যাওয়া। এরইমধ্যে সে এই ভুলটা করে ফেলেছে।

“তুই আসলেই একটা জাউরার বাচ্চা! দেশে ফিরা তরে অনেক খুঁজছি, পাই নাই। হুনছি, তুই না কি অনেক বড় কিলার হয়া গেছোস!”

এ কথার কোনো জবাব দিলো না বাবলু।

“এই বুইড়াটা কে?” বেডে শোয়া অমূল্যবাবুকে দেখিয়ে জানতে চাইলো পান্না। “কী হয় তর?”

“আমার দূরসম্পর্কের কাকা।”

“হা-হা-হা!” বিচ্ছিরি হাসিতে পান্নার হলদেটে দাঁত বের হয়ে গেল। “তর তো বাপেরই ঠিক নাই, কাকা পাইলি কইখন?”

অমূল্য বাবু ভয়ের সাথে বাবলুর দিকে তাকালো। সে কিছু করার চেষ্টা করলেই দু-জন অস্ত্রধারীর গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়ে যাবে। যেকোনো সময় ওকে গুলি করবে লোকগুলো। বহু পুরনো একটি শক্রতা। আর এরা আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিছক কোনো গানম্যান ছিল না। এরা সেইসব অপরাধী যারা সারাটা জীবনভর অপরাধ করে বেড়ায়-সময় কিংবা বয়স এদেরকে বদলাতে পারে না। মৃত্যুই ওদেরকে এ জগত থেকে অবসরে পাঠায়। প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষগুলো আজ এতোদিন পর বাগে পেয়ে গেছে। বাবলুকে এমন বিপদে ফেলার জন্য নিজেকেই দায়ি করতে লাগলো সে। যদি ওকে এভাবে খুঁজে বের না করতো তাহলে হয়তো আজ এতো বড় বিপদে পড়তো না।

“বললাম তো, দূরসম্পর্কের কাকা…রক্ত সম্পর্কের কেউ না,” নিজেকে অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করে বলল।

সঙ্গে থাকা অস্ত্রধারী লোকটার দিকে তাকালো পান্না। “তায়েব তো ঠিকই কইছে, খানকির পোলায় ল্যাংড়া হয়া গ্যাছে।”।

পান্নার সঙ্গি তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো, যেন ওদের বদদোয়াতেই এমনটা হয়েছে।

“ল্যাংড়া হইলি কেমনে, অ্যাঁ?”

বাবলু কিছু বলল না।

জবাব না পেয়ে প্রসঙ্গ পাল্টালো পান্না। “এই বুইড়ার কি হইছে?”

“এখনও কিছু জানা যায়নি। অনেকগুলো টেস্ট করতে দিয়েছে ডাক্তার।”

বাঁকা হাসি দিলো অস্ত্রধারী। “ডাক্তার মাদারচোদেরা চান্স পাইলেই টেস্ট মারায়, কমিশন খায় হালারপুতেরা।” তারপর একটু বিরতি দিয়ে আবার বলল, “বিয়া করছোস তুই?”

মাথা দোলালো বাবলু।

“তাইলে তরে মাইরা ফালাইলে কেউ বিধবা হইবো না!” হেসে বলল পান্না। “কিন্তু শামীম আর চিৎকার বউ কইলাম বিধবা হইছে!” সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেল তার হাসি। জান্তব এক অভিব্যক্তি ফুটে উঠল চোখেমুখে। “আমার এক ভাইগ্নারেও পঙ্গু করছিল মোল্লা। আর মুন্নিরে…” তার নাকের পাটা আবারো ফুলে উঠল প্রচণ্ড ক্রোধে, সেই সাথে যেন পুরনো একটা দীর্ঘশ্বাসও বের হয়ে এলো বুকের ভেতর থেকে।

চট করেই একটা কথা মনে পড়ে গেল বাবলুর। পান্নার সাথে মুন্নি নামের এক মেয়ের সম্পর্কের কথা সে জানতো। পরে শুনেছে, মোল্লাভাই ঐ মেয়েকে আটকে রেখে পান্নার কাছে খবর পাঠিয়েছিল সে যেন ধরা দেয়, কিন্তু জীবনের ভয়ে পান্না সেটা করেনি। মোল্লাভাই মেয়েটাকে শেষ পর্যন্ত কী করেছিল কখনও জানতে পারেনি তারা। কানাঘুষা ছিল, পুরান ঢাকার শত বছরের প্রাচীন পতিতালয় কান্দুপট্টিতে ঠাঁই হয়েছিল মেয়েটির, মোল্লাভাইয়ের তিন কি চার নাম্বার স্ত্রী ওটা চালাতো তখন।

“মুন্নির কিছু হয়নি, সে ভালোই আছে,” কথাটা বেশ শান্তকণ্ঠে জোর দিয়ে বলল বাবলু।

সঙ্গে সঙ্গে ভুরু কুঁচকে গেল পান্নার। “মুন্নির খবর তুই জানোস ক্যামনে?”

“দেড়-দুই মাস আগে ওর সাথে আমার দেখা হয়েছিল।”

পান্নার চোখেমুখে অবিশ্বাস।

“বসুন্ধরায় শপিং করতে গেছিল, তখনই দেখা হয়। একেবারে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে গেল। “বেশিক্ষণ কথা হয়নি, তবে দেখে মনে হলো ভালোই আছে, একটা বাচ্চাও দেখলাম সাথে।”

অবিশ্বাসে মাথা দোলাতে লাগলো পান্না। “মিছা কথা!”

কাঁধ তুলল বাবলু। “যা দেখেছি তা-ই বললাম। বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার।”

“মুন্নি ঢাকায় থাকলে আমার লগে দেখা করতো।”

“আমার মনে হয় ও ভালোই আছে। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে আছে তাই পুরনো কারোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চায় না। আমাকে দেখেও না চেনার ভান করেছিল। আমার কথা বিশ্বাস না হলে ও যেখানে থাকে সেখানে গেলেই বুঝতে পারবেন।”

“মুন্নি কই থাকে তুই জানোস?!” অবিশ্বাসে বলে উঠল পান্না।

“আরে ভাই, আপনে পাগল হইলেনি?” আক্ষেপে মাথা দুলিয়ে বলে উঠল গোলাম। “মুন্নির লগে যদি ওর দেখা হইয়াও থাকে সে কি ওরে। কইবো, কই থাকে?”

পান্না অবিশ্বাসে তাকালো বাবলুর দিকে। “ঠিকই তো, মুন্নি তরে এইটা কইবো না। জীবনেও কইবো না!”

“আমি কি বলেছি মুন্নি এটা আমাকে বলেছে? তবে মুন্নি কোথায় থাকে সেটা খুব সহজেই বের করতে পারবেন।”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো পান্না।

“মুন্নি যে দোকান থেকে কেনাকাটা করছিল সেই দোকানদার ওর পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে। ওদের কথাবার্তা শুনে আমি বুঝতে পেরেছি।”

পান্না এবার আরো বেশি উদগ্রীব হয়ে উঠল। “দোকানের নাম কি? ওই দোকানদারের নাম কি?!” অনেকটা চিৎকার করেই জানতে চাইলো।

“আরে ভাই, আপনে তো দেহি আসলেই পাগল হইয়া গেলেন!” আক্ষেপে আবারো বলে উঠল গোলাম। “এই মাদারচোদ্দ বেলাফ মারতাছে, নাটক করতাছে, যে আপনে ওরে না মারেন!”

দাঁতে দাঁত পিষে বাবলুর দিকে তাকালো পান্না।

বাঁকা হাসি দিলো বাবলু। “মনে হচ্ছে আপনার এই চ্যালা একটু বেশি সিনেমা দেখে। এসব বলে যে আমি বাঁচতে পারবো না সেটা ভালো করেই জানি।”

পান্নার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। কথাটা মিথ্যে নয়, তার চেলা গোলাম হোসেন সত্যি সত্যিই সিনেমাখোর। সপ্তাহে দুই-তিনটা হিন্দি বাংলা সিনেমা না দেখলে তার পেটের ভাত হজম হয় না।

“তবে এটাও ঠিক, আমি এ কথাটা বলেছি একজনকে বাঁচাতে।”

“কারে?!” পান্না বিস্মিত কিন্তু আগ্রহি।

আক্ষেপে মাথা দোলালো গোলাম হোসেন। পান্নার উপরে মহাবিরক্ত এখন।

অমূল্যবাবুর দিকে ইশারা করলো বাবলু।

পান্না আর গোলাম স্থিরচোখে চেয়ে রইলো বেডে শোয়া রোগির দিকে।

“আপনি যদি উনার কিছু না করেন তাহলে আমি মারা যাবার আগে ঐ দোকানের নাম আপনাকে বলে যাবো।”

বাবলুকে খুব সহজে এ কথা বলতে দেখে অমূল্যবাবু অবাকই হলো।

“ওই বুইড়ারে আমি কিছু করুম না, ঠিক আছে?”

মাথা দোলালো বাবলু। “আপনি হয়তো কিছু করবেন না কিন্তু আপনার এই লোককে বিশ্বাস করতে পারছি না।”

গোলাম হোসেন রেগেমেগে তাকালো বাবলুর দিকে।

“ওয় আমার লোক, ওরে আমি যা কমু ও তাই করবো। পাদ দিতে কইলে পাদ দিবো…হাগতে কইলে হাগবো! ওরে নিয়া তর চিন্তা করতে হইবো না।”

কথাটা গোলাম হোসেনের পছন্দ হলো না, চোখমুখ তিক্ত হয়ে গেল।

“ঠিক আছে,” বাবলু ক্ৰাচটা ছাড়াই হাত দুটো উপরে তুলে এক পায়ে ভর দিয়ে আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো। “তাহলে আমাকে এই রুমের বাইরে নিয়ে গিয়ে মারেন।”

কয়েক মুহূর্তের জন্য পান্না আর গোলাম ধন্দে পড়ে গেল।

“এই কেবিনের বাইরে, লিফটের যে জায়গাটা আছে, ওটা এখনও খালি…ওখানে নিয়ে গিয়ে গুলি করে ফেলে দেবেন আমাকে।”

পান্না ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো। কিভাবে ওকে মারতে হবে তা-ও বলে দিচ্ছে! এমন অভিজ্ঞতা তার কাছে একদমই নতুন। মৃত্যু নিশ্চিত জানার পর কান্নাকাটি করে জীবনভিক্ষা চাওয়া লোকজন দেখেছে কেবল এই জীবনে।

“তার আগে আমার এই কাকাকে ছেড়ে দিতে হবে। উনি এই রুম থেকে বের হয়ে যাবার পর আমি বলবো ঐ দোকানের নাম।”

“ভাই, এই হালার কথা হুইনেন না…গুলি করেন!”

বিরক্ত হয়ে গোলামের দিকে তাকালো পান্না। “তুই একটু চুপ থাকবি।”

হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল পান্নার সহযোগি, চোখেমুখে বিরক্তি। বার বার দরজার বাইরে তাকিয়ে দেখছে কেউ আসছে কি না।

“ঠিক আছে, গেঞ্জিটা উপরে তোল! আগে দেখি তুই ভারি হয়া আইছোস কি না।”

আন্ডারওয়ার্ল্ডে ভারি’ বলতে সঙ্গে অস্ত্র রাখা বোঝাতো তারা। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বাবলু আস্তে করে টি-শার্টটা একটু উপরে তুলল। তার কোমরটা দৃশ্যমান এখন।

সেখানে কিচ্ছু নেই।

এবার বাঁকাহাসি ফুটে উঠল পান্নার ঠোঁটে। গোলামের দিকে তাকালে সেও মুচকি হাসলো। “এইবার ঘুর! পিছন দিকটাও দেহা!”

যেন কথাটা বুঝতে পারেনি এমনভাবে চেয়ে রইলো বাবলু।

“এই বানচোত সব সময় মাল রাখতো লগে, বুঝছোস,” সঙ্গিকে বলল পান্না। “হালায়, পায়খানায় গেলেও মাল নিয়া ঢুকতো, কাউরে বিশ্বাস করতো না।”

গোলাম মুচকি হাসলো।

“ঘুর! পিছনটা দেখা! আমার বাঙলা বুঝেস না তুই?”

আস্তে আস্তে ঘুরলো বাবলু, ভালো করেই জানে তার কোমরে এখন কিছু নেই।

হাসি ফুটে উঠল পান্নার মুখে। “তর পিস্তল কই রে, বাস্টার্ড! এহন কি ঐসব লগে নিয়া ঘুরোস না?”

আবার মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়ালো বাবলু। “ওসব নিয়ে ঘোরাফেরা করা খুব রিস্কি এখন।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো পান্না। আজকাল পুলিশ-র্যাব পিস্তলসহ ধরতে পারলে সোজা ক্রশফায়ারে দিয়ে দেয়। কিন্তু তরে মাইরা ফালাইলেও তো হিসাবটা মিলবো না!” মাথা ঝাঁকালো সে। “তর লাইগা আমার পুরা জীবনটা আউলা-ঝাউলা হইয়া গেছে। তুই আমার অনেক বড় ক্ষতি করছোস। “ একটু থেমে আবার বলল, “তুই যদি অহনই ওই দোকানের নামটা না কস্, তাইলে এই বুইড়াটারে মাইরা ফালাইমু আমি।”

“আমি তো বলেছি, দোকানের নাম বলবো কিন্তু তার আগে আপনাকে কথা দিতে হবে, উনার কোনো ক্ষতি করবেন না,” বাবলু হাত দুটো উপরে তুলেই বলল।

“যার হাতে মেশিন থাকে তার কথা হুনতে হয়। তর লগে মেশিন নাই, তার উপরে তুই আবার ল্যাংড়া…তর কথা আমি কেমনে রাখি!”

এমন সময় বাবলু কিছু একটা টের পেলো, পান্না আর তার সঙ্গির দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সে। দু-জন অস্ত্রধারীর মনোযোগ সরানো সম্ভব না।

“ভাই, জলদি করেন,” গোলাম হোসেন তাগাদা দিয়ে বলল। “বেশি দেরি করলে তায়েব আবার ডরায়া-মরায়া গাড়ি নিয়া ফুটতে পারে। নিজের পিস্তলটা নামিয়ে রাখলো সে। আরেক বার পাশ ফিরে খোলা দরজার বাইরে তাকালো কেউ আসছে কি না দেখতে।

কথা বলার সময় পান্নার পিস্তলটা একটু নেমে গেছিল, এখন পিস্তল ধরা হাতটা আবার উঠে আসছে! “নাম ক শুয়োরের বাচ্চা!”

বাবলু মাথা নেড়ে সায় দিলো দ্রুত। “বলছি,” ঢোক গিলে নিলো সে, তারপরই বেশ শান্তকণ্ঠে বলল, “ফায়ার!”

এক সেকেন্ডের মতো অস্ত্রধারী কিছুই বুঝতে পারলো না-দোকানের নাম ফায়ার?

তার পরই গুলির শব্দ!

পর পর দুটো।

সামান্য বিরতি দিয়ে আবারও দুটো!

ছোট্ট কেবিনটা কেঁপে উঠল।

অধ্যায় ২৮

গাড়িতে বসে থাকা তায়েব পর পর চারটা গুলির শব্দ ঠিকমতোই শুনতে পেয়েছে।

হাসপাতালের ভেতরের প্রাঙ্গনে পান্নার গাড়িতে বসে আছে সে অনেকক্ষণ ধরে। ভেবেছিল পান্না আর তার লোক হাসপাতালে ঢোকার পর দশ মিনিটের মধ্যেই কাজটা হয়ে যাবে। পনেরো মিনিট পরও যখন কিছু হলো না তখন মনে মনে প্রবোধ দিয়েছিল, এই দেরি হবার কারণ সম্ভবত বাস্টার্ডকে খুঁজে পেতে সমস্যা হচ্ছে। এই হাসপাতালে বিরাট একটি ওয়ার্ড আছে, আছে অনেকগুলো কেবিন, বাস্টার্ড কোটায় ঢুকেছে সেটা তো তারা জানে না। নার্স আর কর্মচারিদেরকে হাতে ক্রাচ আছে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে এ রকম এক পঙ্গু লোকের কথা বলে খুঁজতে হবে। কাজটা এমন কঠিন কিছু না। একে-ওকে জিজ্ঞেস করলে কেউ না কেউ ঠিকই বলে দিতে পারবে ক্রাচ হাতের লোকটাকে কোন্ ওয়ার্ডে কিংবা কেবিনে যেতে দেখা গেছে।

গাড়িতে বসে বসে যখন অস্থির হয়ে উঠল সে তখনই বলা নেই কওয়া নেই পর পর চারটা গুলি। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালের ভেতরে বাইরে শুরু হয়ে গেল দৌড়াদৌড়ি। আবারো দুটো গুলির শব্দ হাসপাতালে অভাবনীয় দৃশ্যের অবতারণা করলো।

একজরে মারতে এতো গুলি করনের দরকার কি! একটা-দুইটাই তো কাফি। গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট দেবার সময় মনে মনে গজরাতে গজরাতে বলেছিল তায়েব। পান্নাভায়ের কি মাথা খারাপ হইয়া গেল নাকি?

ইঞ্জিন স্টার্ট করে বসে আছে প্রায় তিন-চার মিনিট ধরে, পান্না আর গোলামের টিকিটাও দেখতে পেলো না। তায়েব গাড়িতে বসে বসে লোকজনের হুড়োহুড়ি দেখছে। এতো দেরি করলে তো পুলিশ এসে পড়বে। থানাটা না-হয় দূরে কিন্তু হাসপাতালের কাছে পুলিশের কোনো টহলগাড়ি থাকতে পারে না? গুলির আওয়াজ পেলে তো সোজা এখানে চলে আসবে তারা।

ধুর! রাগেক্ষোভে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের উপর চাপড় মারলো সে। পুরো হাসপাতালে লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে গেছে, আর কতোক্ষণ এভাবে বসে থাকবে?

একবার মনে হলো গাড়িটা নিয়ে সটকে পড়বে কিন্তু এক্সলেটরে পা দিয়েও দিলো না। এটা করলে বিরাট বড় অন্যায় হয়ে যাবে। রীতিমতো বেঈমানি করা হবে। সময় যতোই লাগুক, তাকে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু মনের মধ্যে খচখচানিটা চলতেই লাগলো। পান্না আর গোলামের কি হয়েছে সেটা জানতে হবে। ওরা কোথায়? এতোগুলো গুলিই বা করলো কেন?

একটু পরই দেখতে পেলো হাসপাতালের মেইন ভবন থেকে একজন ডাক্তার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে আসছে। তার বাঁ-হাতে একটা ক্ৰাচস্টিক। দূর থেকে দেখলেও তায়েব চিনতে পারলো।

বাস্টার্ড!

মোল্লাভায়ের দলের সঙ্গে যখন ছিল তখন প্রতিদিনই দেখতো একে। অনেক দিন পর গতকাল আবারো এই মুখটা দেখেছিল কলাতলি বিচে। একটু তাজা বাতাস খেতে বিচে গেছিল তায়েব, সেখানেই দেখতে পায় নির্জন সমুদ্র সৈকতে এক পিচ্চির সাথে কথা বলতে বলতে ক্রাচ নিয়ে বাস্টার্ড হাঁটছে। তায়েবের পাশ দিয়ে গেলেও তাকে খেয়াল করেনি। এতো বছর পর তাকে দেখে চেনারও কথা নয়। তার চাচাতো-মামাতো ভায়েরাই অনেকদিন পর দেখে তাকে চিনতে পারে না এখন। আগের চেয়ে তার শরীর দ্বিগুন ভারি হয়ে গেছে। তখনকার ক্লিনশেভ মুখে এখন ঘন চাপদাড়ি। মাথার সেই ঘন আর ঝাকড়া চুল নেই, পাতলা হয়ে গেছে, সব সময় ছোটোছোটো করে ছেটে রাখে সেগুলো।

কিন্তু বাস্টার্ডকে দেখেই চিনতে পেরেছে সে। এতোগুলো বছরেও খুব একটা বদলায়নি, বয়সের ছাপও তেমনভাবে পড়েনি। বিচে ওকে দেখে খুবই অবাক হয়েছিল তায়েব। আন্ডারওয়ার্ল্ডে হাতেগোণা যে কয়জন বাস্টার্ডকে চেনে, তারা বলাবলি করতে পুলিশের গুলিতে নাকি মারা গেছে সে। কেউ কেউ অবশ্য বলতো, হারামজাদা বিদেশে চলে গেছে, আর দেশে ফিরে আসবে না।

সবাই আসলে ভুল জানে, এই খুনি কক্সবাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একদম একা!

এত বড় মওকা নষ্ট করতে দেয়া যায় না। তায়েব জানতো, পান্নাভাই এখন ঢাকায়। আরো জানতো, এই বানচোতটাকে হাতের মুঠোয় পাবার জন্য কতোটা মুখিয়ে আছে পান্না। এরপর দুরত্ব বজায় রেখে বাস্টার্ডকে ফলো করতে শুরু করে সে। বিচের খুব কাছে একটা হোটেলে ঢুকতে দেখে তার মুখে ফুটে ওঠে হাসি। এই হোটেলে তার পরচিতি এক লোক যাতায়াত করে, হোটেলের লোকদের সাথে ওর বেশ খাতির। বাস্টার্ড কোন রুমে থাকে সেটা জানা একদম সহজ কাজ হবে। কিন্তু ফোনটা ভুল করে নিজের রুমে রেখে বের হয়ে গেছিল, তাই দ্রুত চলে আসে হোটেলে, পান্নাভাইকে ফোন করে সবটা জানিয়ে দেয়।

এখন তায়েব দেখতে পাচ্ছে বাস্টার্ড খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে যাচ্ছে হাসপাতালের মেইন গেটের দিকে।

ভড়কে গেল সে। পান্না আর তার লোকটার তাহলে কী হয়েছে? প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়ে তায়েব দেখতে পেলো, তার পাশ দিয়ে যাবার সময়ও তাকিয়ে দেখলো না বাস্টার্ড। হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কয়েক মুহূর্ত পর রিয়ার-মিরর দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু বাস্টার্ডকে দেখতে পেলো না।

মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেছে!

কেঁপে উঠল তার অন্তরাত্মা। ভুরু কুঁচকে আবারো ভালো করে দেখলো-বাস্টার্ডের টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। ল্যাংড়া একজন মানুষ এতো দ্রুত মেইনগেট দিয়ে কিভাবে বের হয়ে গেল? তাহলে কি হারামজাদা ল্যাংড়া সাজার ভাণ করে ছিল? অসম্ভব! বিচে কেউ একা একা ঘোরার সময় এটা কেন করবে? দরকার কী!

হঠাৎ বাঁ-চোখের কোণায় কিছু একটা ধরা পড়লে চমকে সেদিকে তাকাতেই তায়েব দেখতে পেলো সাদা অ্যাপ্রোন পরা দুর্ধর্ষ খুনি তার ড্রাইভিং ডোরের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে! হাতের পিস্তলটা তায়েবের দিকে তা করা।

“কেমন আছেন, তায়েব ভাই?” খুবই স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল বাস্টার্ড।

কোনো রকমে ঢোক গিলল তায়েব। হায় আল্লাহ!

অধ্যায় ২৯

এসএসবি ব্যাঙ্কের ম্যানেজার আতঙ্কিত আর অস্থির হয়ে উঠেছে তার ব্যাঙ্কে আর ক-জন রঞ্জুর লোক আছে সেটা জানার জন্য।

“যারা যারা রঞ্জুর হয়ে কাজ করে তাদের সবার নাম বলুন!” দুর্বল কণ্ঠে ধমক দেবার চেষ্টা করলো রিশাদ কবীর। তুই-তোকারি থেকেও যে সরে এসেছে বুঝতে পারলো না। সব কটাকে আমি…” দাঁতে দাঁত পিষে বলল কিন্তু শেষ করলো না কথাটা।

“শান্ত হোন, মিস্টার কবীর,” জেফরি বলল। “ও মিথ্যে বলছে, খেলতে চাইছে আমাদের সঙ্গে।”

জেফরির দিকে তাকালো রাহিদ হাসান। হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।

“আপনি বলতে চাইছেন, ও মিথ্যে বলছে?” ম্যানেজার অবাক।

“হুম। এসব বলে বিভ্রান্ত করতে চাইছে আমাদেরকে।”

রিশাদ কবীরের চোখেমুখে সন্দেহ। তাকে খুবই নাভাস দেখাচ্ছে এখন। “কিন্তু বাই অ্যানি চান্স…কোনোভাবে যদি ওর কথাটা সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে? যদি আরো অনেকে থাকে আমার ব্যাঙ্কে, যারা রঞ্জুর সাথে কানেক্টেড?”

“সে রকম কেউ থাকলে, ওকে যেভাবে ধরেছি ওদেরকেও ধরে ফেলবো আমরা।”

কথাটা শুনে ম্যানেজারের মধ্যে একটু স্বস্তি ফিরে এলো।

“রঞ্জুর সাথে তো আপনার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, আপনি কেন তার ভয়ে বাধ্য হয়ে কাজ করবেন?” জানতে চাইলো জেফরি বেগ।

গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো রাহিদ হাসান। “অনেক দিন আগে রঞ্জু আমাদের মহল্লায় ভাড়া থাকতো, তখন থেকে ওকে চিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হলে এখানে জয়েন করি। আমি যে এই ব্যাঙ্কে চাকরি করি রঞ্জু সেটা জানতো।”

জেফরি এবং ম্যানেজর রিশাদ কবীর কিছুই বলল না, চুপচাপ শুনে যাচ্ছে তারা।

“পরে সে আমাদের এলাকা ছেড়ে চলে যায়। শুনতে পাই, বিরাট বড় সন্ত্রাসি হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন আমার সাথে আর দেখা হয়নি। ওর কথা ভুলেই গেছিলাম আমি।” একটু থেমে আবার বলল, “আমার এক কাজিন বাড়ি বানাতে গেলে রঞ্জুর লোকজন ওর কাছ থেকে চাঁদা চায়। কাজিন জানতো, রঞ্জুর সাথে আমার পরিচয় আছে। আমাকে সে ধরলো, আমি যেন রঞ্জুকে ম্যানেজ করি। রঞ্জুর ফোন নাম্বার জোগাড় করে অনুরোধ করি তাকে। আমার রিকোয়েস্টটা সে রেখেছিল, কাজিনের কাছ থেকে আর চাঁদা নেয়নি। এভাবে দীর্ঘদিন পর ওর সাথে আমার আবার যোগাযোগ হয়।” একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলো রাহিদ হাসান। এরপর মাঝেমধ্যে ইন্ডিয়া থেকে আমাকে ফোনে দিতো, টুকটাক কথাবার্তা হতো কিন্তু সে-সবই ব্যক্তিগত আলাপ। এরপর দীর্ঘ দিন আর যোগাযোগ করেনি। কয়েক বছর আগে শুনতে পেলাম, ইন্ডিয়াতে সে মারা গেছে।”

“আপনাকে কে বলল রঞ্জু মারা গেছে?” জেফরি জানতে চাইলো।

“এলাকার লোকজন বলাবলি করতো এসব।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ইনভেস্টিগেটর।

“কিন্তু তিন-চার মাস আগে হঠাৎ করেই অপরিচিত একটি নাম্বার থেকে আমাকে ফোন করে রঞ্জু। তার ফোন পেয়ে খুবই অবাক হই। ও আমাকে জানায়, দীর্ঘদিন চিকিৎসা করিয়ে দেশে ফিরে এসেছে, আমি যেন ওর সঙ্গে দেখা করি।” একটু চুপ থেকে আবার বলল রাহিদ হাসান, “বিশ্বাস করুন, আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে চাইনি। কিন্তু একদিন অফিস ছুটির পর ব্যাঙ্ক থেকে বের হতেই কয়েকজন লোক আমাকে সালাম দিয়ে ঘিরে ধরে, তারা জানায়, এক্ষুণি যেতে হবে তাদের সঙ্গে, রঞ্জু আমার সাথে কথা বলবে।”

এ কথা শুনে রিশাদ কবীর আনমনেই ঢোক গিলল। কিছুটা ভড়কেও গেছে মনে হয়।

“আপনি তাহলে গেলেন ওদের সঙ্গে?”

জেফরির কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলো রাহিদ হাসান, আক্ষেপে বলে উঠল, “না যেয়ে উপায় ছিল না আমার।”

“আপনাকে কোথায় নিয়ে গেল ওরা?”

“একটা মাইক্রোতে করে তুলে নিয়ে গেছিল।”

“তার পর?”

“গাড়িটা চলতে শুরু করার পরই ভিডিও কলে কথা হয়। ওর শরীর আর মুখ পুড়ে গেছে।”

“একটু আগে বলেছিলেন, তাকে দেখলে চেনা যায় না?”

জেফরির কথায় সায় দিলো লোকটা। “কথা বলে বুঝতে পেরেছি।”

“সেটা কী রকম?”

“ভয়েসটা, কথার বলার ভঙ্গি… রঞ্জুর মতোই মনে হয়েছে,” একটু ঢোক গিলে নিলো সে। “স্টুডেন্ট লাইফে আমি টিউশনি করতাম…ও আমাকে মাস্টর’ বলে তবে ডাকত…ভিডিও ফোনেও মাস্টর বলে ডেকেছে।”

গভীর করে শাস নিয়ে বলল জেফরি বেগ। অপ্রীতিকর বিষয় হলো, তার কাছে, মনে হচ্ছে না, লোকটার এ কথাগুলো মিথ্যে! “ও কী বলল আপনাকে?”

“আমার খোঁজখবর নিলো, নিজের কথা বলল। কিভাবে অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে, প্রচুর টাকা খরচ করে চিকিৎসা করিয়েছে, এইসব।”

“কোন দেশে চিকিৎসা করিয়েছে?”

“আমাকে দুবাইর কথা বলেছে।”

জেফরি জানে, বর্তমানে দুবাইর চিকিৎসা ব্যবস্থা এশিয়ার সবচেয়ে আধুনিক আর উঁচুমানের। নামকরা বেশ কয়েকটি হাসপাতাল হয়েছে ওখানে।

“এসব কথাবার্তার পরই সে আমাকে বলল, তার হয়ে কাজ করার জন্য।”

ম্যানেজার রিশাদ কবীর আর জেফরি বেগের ভুরু কুঁচকে গেল।

“আমার ব্যাঙ্কের বড় ক্লায়েন্টদের ইনফর্মেশন দিতে হবে তাকে। আমি বলেছিলাম, এটা আমার পক্ষে করা সম্ভব না। ধরা পড়লে আমার চাকরি থাকবে না।” একটু থেমে আবার বলল, “রঞ্জু এ কথা শুনে বলেছিল, চাকরির চেয়ে জীবন বেশি জরুরি। বিশাস করুন, ওর কাছ থেকে এ কথা শোনার পর আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল, খুব ভড়কে গেছিলাম। আমি তো জানি, মানুষ খুন করা ওর কাছে কোনো ব্যাপারই না।”

“আপনি বলতে চাইছেন, তিন-চার মাস আগে থেকে আপনি তার হয়ে কাজ করতে শুরু করছেন?”

“হ্যাঁ।”

“ও মিথ্যে বলছে না, মি. বেগ?” জেফরির দিকে তাকিয়ে বলল ম্যানেজার।

“রঞ্জু গ্রুপ সম্পর্কে আপনি কিছুই জানেন না,” রিশাদ কবীরকে বলল রাহিদ হাসান। “ও যদি আপনাকে ধরে, কিছু করতে পারবেন না।”

ম্যানেজার চোখ বিস্ফারিত হলো, সেটা রাগে না কি আতঙ্কে বোঝা গেল না।

“আপনার সম্পর্কেও ওর কাছে সব তথ্য আছে। আপনার ছেলেমেয়ে ক জন, কোথায় তারা পড়ে, কোথায়-”

“থামুন!” চিৎকার করে বলে উঠল জেফরি বেগ। চেয়ার ছেড়ে উঠে তার কলার চেপে ধরলো, সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে এসে রাহিদ হাসানের চুল মুঠি করে ধরে ঝাঁকি দিলো জামান।

“একদম চুপ!” ধমক দিয়ে বল জেফরির সহকারি।

“ও আমাকে হুমকি দিচ্ছে!” অবিশ্বাসে বলে উঠল রিশাদ কবীর। “আই কান্ট বিলিভ ইট!”

“ওকে আমাদের অফিসে নিয়ে যেতে হবে। অনেক কথা আছে ওর সঙ্গে।”

“অফিসে মানে?” আৎকে উঠল ম্যানেজার।

“হোমিসাইডে…ইন্টেরোগেট করবো ওকে।”

রাহিদ হাসানের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল, ভয়ে ঢোক গিলল সে। জীবনে কখনও পুলিশের কাছে ধরা পড়েনি, রিমান্ড তো বহু পরের কথা। হোমিসাইডে নিয়ে গিয়ে তাকে কী ধরণের টর্চার করবে বুঝতে পারছে না। পুলিশ রিমান্ড নিয়ে অনেক কথা শুনেছে। ডিম থেরাপির কথাটাই সবচেয়ে আগে মনের মধ্যে উঁকি দিলো। গা গুলিয়ে উঠল তার।

জামানকে ইশার করলে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলো সে।

নিজেকে ধাতস্থ করতে গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো রাহিদ হাসান, ম্যানেজারের দিকে তাকালো সে। “স্যার, এই ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে ব্যাঙ্কের সুনামের বারোটা বাজবে।”

ম্যানেজারের চোখে আতঙ্ক ফুটে উঠল এবার।

“আমি যা করেছি বাধ্য হয়ে করেছি। এখন যদি আপনি আমাকে এদের হাতে তুলে দেন তাহলে এই ঘটনাটা সবাই জেনে যাবে, পত্রিকার খবর হবে। এটা চাপা দিয়ে রাখা যাবে না।”

‘মাই গড!” পুরোপুরি ভড়কে গেল এসএসবি ব্যাঙ্কের ম্যানেজার রিশাদ কবীর।

“এ রকম কিছু হবে না,” আশ্বস্ত করে বলল জেফরি। “ট্রাস্ট মি।”

ইনভেস্টিগেটরের দিকে ফিরে তাকালো রাহিদ হাসান। “এই ব্যাঙ্কে রঞ্জুর আরো লোকজন আছে, তারা যখন এই খবরটা ওকে জানিয়ে দেবে তখন ও এটা নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করবে।”

“রঞ্জু কী করবে না করবে সেটা নিয়ে আপনার মাথা না ঘামালেও চলবে,” একটু থেমে আবার বলল জেফরি, “আরেকটা কথা জেনে রাখুন, ব্ল্যাক রঞ্জু যদি বেঁচেও থাকে, ওকেসহ ওর দলের সবাইকে আমরা ধরে ফেলবো…খুব দ্রুত।”

“আমাকে রিমান্ডে নিলেও লাভ হবে না,” রাহিদ হাসান বলল অনেকটা চিৎকার করে। আমি জানি না রঞ্জু কোথায় আছে। কেউই জানে না রঞ্জু কোথায় থাকে। কেউ না! ওর সঙ্গে কেউ সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে না। র‍্যাব-পুলিশ, গোয়েন্দা ওকে ধরতে পারেনি, আপনারাও পারবেন না। মাঝখান থেকে আমাদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবেন শুধু।”

ভয়ে কাঠ হয়ে গেল রিশাদ কবীর।

“চুপ!” ধমক দিয়ে বলল জামান। পেছন থেকে কলারটা ধরে টান দিলো সে।

গভীর করে শ্বাস নিলো জেফরি বেগ। “এখন পর্যন্ত কেউ ধরতে পারেনি মানে এই নয় যে, কাল বা পরশু তাকে ধরা যাবে না।”

রাহিদ হাসান কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো।

“আমরা জানি রঞ্জুর হদিস কে দিতে পারবে।”

হঠাৎ করেই রাহিদ হাসানের সব নাটকীয়তা থমকে গেল।

“আর তাকে আমরা আজ রাতেই গ্রেফতার করতে পারবো আশা করি।”

ইনভেস্টিগেটরের কথাটা বুঝতে একটু বেগই পেলো মি. হাসান।

কার কথা বলছে লোকটা? তারপরই মনে পড়ে গেল, ইমরুলের সঙ্গে ওর ফোনালাপটা টেপ করেছে এরা। সর্বনাশ!

মুচকি হাসি জেফরি বেগের মুখে। আপনি কী করেন না করেন সবই আমরা জেনে গেছি। আজ রাতে কে জানি কী সব নিয়ে আসবে…? ধরে নিন, ঐ লোক আমাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে।”

“ঘটনা কি?” উন্মুখ হয়ে জেফরির কাছে জানতে চাইলো রিশাদ কবীর।

“লম্বা গল্প, পরে বলবো আপনাকে,” একটু থেমে আবার বলল সে, “এখন ওকে হোমিসাইডে নিয়ে যাবো আমরা।”

“এখন?” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল ম্যানেজার। “এভাবে ওকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যেতে দেখলে সবাই বুঝে যাবে, ফিসফাস শুরু হয়ে যাবে।”

জেফরি বেগ মাথা নেড়ে সায় দিলো। “আপনার ব্যাঙ্কে ব্যাকডোর আছে।?… ফায়ারস্কেপ?”

“হ্যাঁ, তা তো আছেই।”

বিস্ফারিত চোখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো রাহিদ হাসান।

“তাহলে আমরা ওটা-ই ব্যবহার করবো।” এবার পেছনে ফিরে জামানের দিকে তাকালো জেফরি বেগ। “লোকাল থানাকে বলো তিন চারজনের একটা টিম পাঠাতে…গাড়িসহ।”

“ওকে, স্যার,” জামান পকেট থেকে ফোনটা বের করলো সঙ্গে সঙ্গে।

হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট সব সময় স্থানীয় থানার পুলিশের সহায়তায় গ্রেপ্তারের কাজটি করে থাকে। এ কাজের জন্য তাদের নিজস্ব লোকবল নেই।

“স্যার?” সাহায্যের আশায় করুণ স্বরে বলল রাহিদ হাসান।

“চুপ! একদম চুপ!” রেগেমেগে বলল ম্যানেজার। “কিচ্ছু বলবি না তুই।”

রাহিদ হাসান করুণ মুখে চেয়ে রইলো।

“এ জীবনে তুই দুনিয়ার কোনো ব্যাঙ্কে জব করতে পারবি না, আমি সেই ব্যবস্থা করবো, বানচোত! জেলে পচে মরবি, হারামখোর বেঈমান! আর এই ব্যাঙ্কে তোর যে অ্যাকাউন্ট আছে সেটাও সিজ করা হবে। ইউ সান অব অ্যা বিচ!”

দুচোখ ভিজে এলো রাহিদ হাসানের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *