কলকাতা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত ছড়ানো রয়েছে যে সেনাবাহিনী, তার নাম বেঙ্গল আর্মি। কোম্পানির এই সেনাবাহিনীর মধ্যে অবশ্য বাঙালী সৈনিকের সংখ্যা অতি নগণ্য। বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের পেশাদার সিপাহীরা ইংরেজদের অধীনে সুশিক্ষিত হয়ে একই ক্যান্টনমেণ্টে সুশৃঙ্খলভাবে অবস্থান করে। এখন ব্রিটেনের রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর একটি অংশও হিন্দুস্তানে নিযুক্ত।
বিনা রক্তপাতে অযোধ্যা রাজ্যের পতন হয়েছে ইংরেজের কাছে, এখন উত্তর ও পূর্ব ভারতে কোথাও কোনো সংঘর্ষ নেই। এখন শান্তির সময়, সিপাহীরা সকালে বিকালে নিয়মমাফিক কুচকাওয়াজ করে ও অন্য সময় জটলা ও হৈ-হল্লায় মেতে থাকে। সৈন্যরা মধ্যে মধ্যে স্থান থেকে স্থানান্তরে বদলি হয় বলে সারা ভারতবর্ষের সংবাদ মোটামুটি তারাই কিছুটা জানে। তাছাড়া, সম্প্রতি বিলাতের অনুকরণে এ দেশেও কোনো কোনো স্থলে রেল নামে বাষ্পশকট চালু হয়েছে এবং টেলিগ্রাফ নামক এক আশ্চর্য যন্ত্রে তার মারফৎ সংবাদ আদান প্ৰদান করা যায়।
ভারতীয় সিপাহীরা নিমকহারাম নয়। তারা কোম্পানির বেতনভুক, সেইজন্য তারা কোম্পানির জন্য প্ৰাণ দিতেও সর্বদা প্ৰস্তুত। বহুদিনের সুসম্পর্কের জন্য ঝানু ইংরেজ অফিসাররা ভারতীয় সিপাহীদের সঙ্গে খোলাখুলি মেলামেশা করে, তাদের সুখ দুঃখের অংশীদার হয়, তাদের উৎসবেও অংশগ্রহণ করে। আবার বিলাত থেকে সদ্য আগত তরুণ অফিসাররা সেনাবাহিনীতে নতুন রীতি নীতি প্রবর্তনের পক্ষপাতী। নতুন নতুন অস্ত্ৰ আবিষ্কৃত হচ্ছে, সেই অনুযায়ী বাহিনীকেও উপযুক্ত হয়ে উঠতে হবে। ভারতে ইংরেজ শাসনাধীন এলাকা যত বাড়ছে, সুদৃঢ় ও সুসংঘবদ্ধ সেনাবাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা ততই বাড়ছে।
এখন শান্তির সময়, এখন এইসব জল্পনায় অনায়াসেই সময় কাটানো যায়।
একটি ব্যাপার নতুন ব্রিটিশ অফিসারদের কাছে বড়ই দৃষ্টিকটু লাগে। তারা খ্ৰীষ্টান সৈন্যবাহিনী দেখায় অভ্যস্ত, আর ভারতীয় সিপাহীদের মধ্যে হাজার রকম জাতি ভেদ। একজন রিশালদার পদমর্যাদায় অনেক উচ্চ হয়েও উদি পরিধান করে না থাকা অবস্থায় একজন সামান্য লস্করকে দেখে ভুলুন্ঠিত হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্ৰণাম করে, কারণ লস্করটি ব্ৰাহ্মণ, রিশালদারটি জাতে গোয়ালা। সেনাবাহিনীতে কখনো এমন চলে? একজন হিন্দু সিপাহী একজন মুসলমান সিপাহীর হুকুম তামিল করতে সর্বদা প্ৰস্তুত, কিন্তু মুসলমান সিপাহী তার খাদ্য একটু স্পর্শ করলেই সে ঘৃণাভরে সম্পূর্ণ খাদ্য ফেলে দেবে। শ্বেতাঙ্গ অফিসারদের একটিই রন্ধনশালা আর ভারতীয় সিপাহীদের মধ্যে কত রন্ধনশালা, তার ইয়ত্তা নেই। বিরক্ত হয়ে কোনো নতুন রীতির প্রবক্তা ইংরেজ এক এক সময় বলে ওঠে, এর বদলে মধ্যপ্ৰাচ্য, মালয়, চীন, এমনকি লাতিন আমেরিকা থেকে খ্ৰীষ্টানদের ভাড়া করে এনে ভারতীয় সেনাবাহিনী গড়লে হয় না?
কয়েক বৎসর আগে ব্ৰহ্মদেশের কিছু অংশ জয় করা হয়েছে। সে সময় সিপাহীদের এক অংশ ব্ৰহ্মদেশে যেতে অস্বীকার করেছিল, কারণ তারা কালাপানি পার হবে না, তাতে তাদের ধর্ম নষ্ট হবে। এ তো বিদ্রোহেরই নামান্তর। লর্ড ক্যানিং গভর্নর জেনারেল হয়ে এসে এর প্রতিবিধান করতে উদ্যোগী হলেন। তিনি বিধান জারি করলেন যে, এর পর থেকে নতুন সৈন্য নিয়োগের সময় তাদের যে-কোনো স্থানে, যে-কোনো পরিবেশে লড়াইতে রাজি হওয়ার স্বীকৃতি দিয়ে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে।
এখন শান্তির সময়, এখন কুচকাওয়াজের শেষে কোনো কোনো ব্রিটিশ অফিসার সিপাহীদের কাছে খ্ৰীষ্টধর্মের মহিমার কথা সরলভাবে ব্যাখ্যা করে শোনায়। খানা টেবিলে অফিসাররা আলোচনা করে। আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ দোসরা সকলেই তাদের প্রভুর ধর্ম গ্রহণ করে খ্ৰীষ্টান হয়েছে। ভারতীয় দাসরাও খ্ৰীষ্টত্ব গ্ৰহণ করলেই তো বহু সমস্যার অবসান হয়।
এখন শান্তির সময়, এখন সিপাহীদেরও বিশ্রাম্ভালাপের প্রচুর অবকাশ। তাদের কানেও নানারকম কথা আসে। কোথাকার ব্যারাকের ফটকে হিন্দুর উচ্ছিষ্ট পাত্ৰে নাকি মুসলমানকে খাদ্য দেওয়া হয়েছে। কানপুরে গোরুর হাড় চূর্ণ করে রুটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে না? নতুন টোটা ব্যবহার করতে হবে খোলসটা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে, সেই খোলসটা গোরু ও শুয়োরের চবি মিশিয়ে তৈরি নয়? সিপাহীর বেতন আট টাকা। কিন্তু ব্রিটিশ এলাকার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করলে বাট্টা দেবার কথা আরও চার টাকা। কিন্তু সেই এলাকা জয় হয়ে গেলেই বাট্টা বন্ধ হয়ে যাবে। এ কেমন নিয়ম? সিপাহী প্ৰাণপণে লড়াই করে নতুন দেশ জয় করবে, আর তার ফলে তার আয় কমে যাবে? বেতনই সিপাহীর নিমকি, কিন্তু যে নিমক দেবে তার কেন কথার ঠিক থাকবে না? হালালখোর ইংরাজ শুধু বোঝে নিজের স্বার্থ। পলাশীর যুদ্ধের পর ঠিক একশত বৎসর কাটলো, এর পরও কি সাহেবজাতি এদেশে রাজত্ব করতে পারবে? আরে ভাই, দমদমার ছাউনিতে এই সেদিন কী হয়েছিল শুনিসনি? এক ব্যাটা লস্কর এক ব্ৰাহ্মণ সিপাহীর কলসী থেকে পানি ঢেলে নিতে গিয়েছিল, ব্ৰাহ্মণ ঠিক সময় দেখতে পেয়ে সেই হারামী দুসাদটার মুখে মেরেছে এক লাথ। সেই লাথি খেয়ে সেই নিচা আদমি লস্করটা কী বলেছিল জানিস? বলেছিল, আর জাতের বড়াই করো না, নতুন টোটা দাঁত দিয়ে ছিড়বে। আর হিন্দু মুসলমান সবার জাত যাবে। সব সিপাহী এক পতিত জাত হয়ে যাবে।
গঙ্গার কুলে, কলকাতা থেকে কিছুটা উজানে, এক অঞ্চলের জঙ্গল সাফ করে কোম্পানি বাহাদুর এক খুব বড় ক্যান্টনমেন্ট স্থাপন করেছে। একসঙ্গে অতগুলি সিপাহী ব্যারাক দেখে কাছাকাছি গ্রামের লোকেরা ঐ স্থানটির নাম দিয়েছে ব্যারাকপুর। দলিলে ডেসপ্যাচে এখন সেই নামটিই চালু। সম্প্রতি অন্যত্র থেকে চৌত্ৰিশ নং দেশী পদাতিক বাহিনীকে সরিয়ে এনে রাখা হয়েছে সেখানে। মার্চ মাসের শেষের দিকে এক সকালে সেই রেজিমেণ্টের সার্জেণ্ট মেজর হিউসন শুনতে পেলেন প্যারেড গ্ৰাউণ্ডে কে যেন বীভৎস গলায় চিৎকার করছে। ভুরু কুঁচকে গেল হিউসনের। কিছুদিন থেকেই এই রেজিমেন্টের ভাবভঙ্গী সন্দেহজনক, এর সিপাহীরা ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কথা বলে, শ্বেতাঙ্গ কোনো অফিসার দেখলেই হঠাৎ থেমে যায়। এখন উৎকট গলায় চিৎকার করছে কে?
সার্জেণ্ট মেজর হিউসন ছোট-হাজারি খেতে খেতে বিরক্ত হলেন। তিনি পাঠালেন তাঁর আদলিকে। একটু পরেই, তখনো দূরে চিৎকার বন্ধ হয়নি, আদলির সঙ্গে এলো একজন দেশী অফিসার। তার মুখের বার্তা শুনে হিউসন সাহেব তৎক্ষণাৎ খানার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন এবং তাঁর অ্যাডজুটান্ট লেফটেনাণ্ট ব-কে সংবাদ দিতে বলে, চললেন প্যারেড গ্ৰাউণ্ডের দিকে।
সেখানে জনা কুড়িক সিপাহী নিঃশব্দ এবং স্থিরভাবে দণ্ডায়মান। তাদের নেটিভ অফিসারের নাম ঈশ্বরী পাণ্ডে। সেও অল্প দূরে নিথর। আর একজন মাস্কেটধারী সিপাহী তাদের সামনে লাফিয়ে লাফিয়ে হিন্দুস্থানী ভাষায় কী যেন বলছে।
হিউসন কঠিন মুখ করে এগিয়ে গেলেন মাস্কেটধারী সিপাহীটির দিকে। সে সাহেবকে দেখেই বড় একটি কামানের পাশে গিয়ে সুবিধেমত জায়গা গ্ৰহণ করলো এবং চেঁচিয়ে বললো, ভাইয়ো, দাগবাজ দুশমনকো খতম কর দো। খতম কর দো।
বোঝা যায় অনেকক্ষণ ধরেই চিৎকার করছে সেই সিপাহীটি, তার কণ্ঠস্বর খসখসে, পদক্ষেপ নেশাখোরের মতন। সে অন্য সিপাহীদের বলছে সাহেবদের বিরুদ্ধে অস্ত্ৰধারণ করতে। বাকি সিপাহীরা কেউ এসে তার পাশেও দাঁড়াচ্ছে না, আবার তার কথার প্রতিবাদও করছে না।
হিউসন ঈশ্বরী পাণ্ডেকে ধমক দিয়ে প্রশ্ন করলেন, হুইজ দ্যাট বাগার? হোয়াই ইজ হি শাউটিং?
ঈশ্বরী পাণ্ডে সাহেবকে দেখে স্যালুট ঠুকলো না, সে প্রশ্নের কোনো উত্তরও দিল না।
হিউসন আবার বললেন, ক্যাপচার হিমা!
কামানের পাশে লুকোনো সিপাহীটির নাম মঙ্গল পাণ্ডে। তার চক্ষু দুটি রক্তবর্ণ, উত্তেজনায় তার সর্বশরীর কম্পিত হচ্ছে, সে মাস্কেট তুললো হিউসনের দিকে।
তারপর সেই ব্যাপারটি সংঘটিত হলো। ইংরেজের সৈন্য-ব্যারাকের মধ্যে দাঁড়িয়ে একজন দেশী সিপাহী আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে সত্যি সত্যি গুলি চালালো তার শ্বেতাঙ্গ প্ৰভুদের এক প্রতিনিধির দিকে। এ এক অভাবনীয় কাণ্ড।
গুলি হিউসনের গায়ে লাগলো না, তবু আত্মরক্ষার জন্য তিনি দাঁড়াম করে পড়ে গেলেন মাটিতে। ভয়ের চেয়ে তাঁর চোখে মুখে গভীর বিস্ময় মাখা। বিশজন সিপাহীর সামনে এক উন্মাদ গুলি ছোঁড়ার সাহস করলে তাঁর দিকে, তবু কেউ বাধা দিল না? দেশী অফিসার তাঁর হুকুম শুনেও অমান্য করলো!
মঙ্গল পাণ্ডে মাস্কেটে আবার গুলি ভরছে, হিউসন তার মধ্যে গড়িয়ে দূরে সরে যাবার চেষ্টা করলেন। তার মধ্যেই ঘোড়া ছুটিয়ে এসে উপস্থিত হলেন লেফটেনাণ্ট বা। মঙ্গল পাণ্ডে দ্বিতীয় গুলি ছুড়লো সেই লেফটেন্যান্টের দিকে। এবারেও সামান্য দিকভ্ৰষ্ট হলো, লেফটেন্যাণ্টের গায়ে না লেগে লাগলো ঘোড়ার গায়ে। ঘোড়া সুদ্ধ লেফটেনাণ্ট বা পড়ে গেলেন মাটিতে, সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি কোমরবন্ধ থেকে টেনে বার করলেন তলোয়ার, মঙ্গল পাণ্ডেও তলোয়ার নিয়ে ছুটে এলো। এবং দেশী সিপাহীই প্রথম অস্ত্ৰাঘাত করলো রাজসৈনিকের ওপর। মঙ্গল পাণ্ডের তলোয়ার দুবার আঘাত হানলো লেফটেনাণ্ট ব-এর মাথায় এবং ঘাড়ে। ততক্ষণে হিউসনও তলোয়ার নিয়ে তাড়া করে এলেন। চললো তিনজনের লড়াই, এর মধ্যে মঙ্গল পাণ্ডেই বেশী শক্তিশালী এবং উন্মত্তবৎ।। দুপক্ষই চিৎকার করছে। যুদ্ধরত অবস্থায়, মঙ্গল পাণ্ডে বলছে, ভাইয়ো, দুশমনকো খতম করো। চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে না। তোমাদের অস্ত্ৰ কেড়ে নেবে, তার আগে তোমরা কেড়ে নাও। আংরেজের দিন শেষ হয়ে এসেছে। আর হিউসন-ব চিৎকার করছে, গার্ড, ক্যাপচার হিম। ডিজার্ম হিম।
সিপাহীরা এই আবেদন বা আদেশের মধ্যে কোনোটাই শুনলো না। তারা দ্বিধাগ্ৰস্ত অবস্থায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সাহেব দুজনের ওপরেই তলোয়ারের আঘাত বেশী পড়ছে দেখে সিপাহীদের মধ্যে একজন, শেখ পন্তু এগিয়ে এসে সাহেব দুজনকে উদ্ধার করে নিয়ে এলো, কিন্তু মঙ্গল পাণ্ডেকে বন্দী করার কোনো চেষ্টাই করলো না। মঙ্গল পাণ্ডে আবার আশ্রয় নিল বড় কামানটির আড়ালে।
ইতিমধ্যে হুড়োহুড়ি করে আরও অনেক ব্রিটিশ অফিসার এসে পড়েছে। প্রবল গোলমাল ও দিশাহারা অবস্থা। কোনো ইংরেজই আর মঙ্গল পাণ্ডের দিকে এগিয়ে যেতে সাহস করছে না। সে কামানের আড়ালে এমনভাবে লুকিয়ে আছে যে দূর থেকে তাকে গুলি করে হত্যা করা যাবে না। পুনঃপুনঃ আদেশ দেওয়া সত্ত্বেও সিপাহীরা কেউ মঙ্গল পাণ্ডেকে ধরতে গেল না।
ব্যারাকপুরের সম্পূর্ণ ডিভিশনের কমাণ্ডার, প্রৌঢ় জেনারেল হিয়ারসে-ও এসে পড়লেন অবিলম্বে। তাঁর অশ্ব একেবারে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ায় একজন ব্রিটিশ অফিসার সাবধান করে দিল, স্যার, ওর মাস্কেট কিন্তু লোড করা আছে।
ক্ৰোধে হিয়ারসের মুখখানি লাল। তিনি দাঁত নিষ্পেষণ করে বললেন, ড্যাম হিজ মাস্কেট।
তারপর নিজের পিস্তল তুলে সিপাহীদের উদ্দেশ্যে বললেন, যে প্রথম আমার হুকুম অমান্য করবে, সে একজন মৃত সৈনিক। ঐ উন্মাদটিকে ধরবার জন্য আমার সঙ্গে এসো।
কয়েক মুহূর্তের জন্য সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা।
তারপর মঙ্গল পাণ্ডে কান্নার সুরে কী যেন বলে উঠলো, অসীম সাহসী জেনারেল হিয়ারসে কয়েক কদম এগিয়ে গেলেন কামানটার দিকে, সিপাহীরাও দ্বিধা ত্যাগ করে এবার অনুসরণ করলো জেনারেলকে। জেনারেলের আদেশ যেন মন্ত্র, কয়েক পুরুষ ধরে ভারতীয় সিপাহীরা এ মন্ত্র অগ্রাহ্য করতে ভুলে গেছে।
একটি বিস্ফোরণ, একটি গুলি উড়ে যাওয়ার শিসের মতন শব্দ, ধোঁয়া। কেউ একজন পড়ে গেল মাটিতে। ধোঁয়া সরে যাবার পর দেখা গেল, জেনারেল নন, মাটিতে পড়ে আছে মঙ্গল পাণ্ডে। তার চেষ্টা ব্যর্থ হলো দেখে এবং ইংরেজের হাতে ধরা না দেবার চেষ্টায় শেষ মুহূর্তে সে মাস্কেটের নল নিজের বুকের দিকে ফিরিয়ে ঘোড়া টিপেছিল।
তৎক্ষণাৎ ইংরেজ সৈনিকরা সেই কুড়িজন সিপাহীকে ঘিরে ফেলে নিরস্ত্র করে ফেললো এবং হাতে পায়ে লোহার বেড়ি পরিয়ে বন্দী করা হলো তাদের। মঙ্গল পাণ্ডে গুরুতর আহত হয়েও তখনও জীবিত। তার পায়ে শিকল বেঁধে একটি অশ্বের সঙ্গে সেই শিকল জুড়ে দিয়ে সমস্ত কুচকাওয়াজের মাঠটিতে ছাঁচড়ানো হলো। তবু সে মরে না।
যথানিয়মে কোর্টমাশাল হলো মঙ্গল পাণ্ডের এবং বিচারে তার ফাঁসীর হুকুম হলো। সেই কুচকাওয়াজের মাঠেই গ্যারিসনের সমস্ত সৈনিকদের উপস্থিতিতে মুমূর্ষু মঙ্গল পাণ্ডেকে বহন করে এনে বুলিয়ে দেওয়া হলো ফাঁসীর দড়িতে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে গালি-গালাজ করে গেল ইংরেজদের বিরুদ্ধে। সিপাহীদের উদ্দেশে বললো, দগাবাজ দুশমন আংরেজকো খতম কর দো, ভাইয়োঁ, সিপাহীয়োঁ–
বিশজন সিপাহীর কোয়াটার গার্ডের অধিনায়ক ঈশ্বরী পাণ্ডেও ফাঁসীর হুকুম থেকে রেহাই পেল না। বাকি সিপাহীদের কারাদণ্ড।
সামরিক ছাউনিতে এ অতি তুচ্ছ ঘটনা। কোর্টমাশালে দু-একজন সিপাহীর ফাঁসী দেওয়া নতুন কিছু ব্যাপার নয়। এমন কি ব্রিটিশ সৈনিকরাও কোনো অপরাধ করলে তাদেরও কোর্টমাশাল হয়। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় না অবশ্য, তবে কিছু না কিছু শাস্তি পায়। কিন্তু মঙ্গল পাণ্ডের প্ৰেতাত্মা যেন ভাসতে লাগলো ব্যারাকপুর সেনানিবাসের বাতাসে। চৌত্ৰিশ নং ইনফ্যানট্রির সিপাহীদের সকলকেই নিরস্ত্ৰ করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে উত্তর ভারতে। বাকি সিপাহীদের মুখগুলিও যেন থমথমে মনে হয়। যদিও তারা সকলেই সমবেতভাবে নতুন করে আনুগত্যের শপথ নিয়েছে। তবু ইংরেজ অফিসাররা তাদের মুখের দিকে যখন তখন ভ্রূ-কুঞ্চিত করেন। অদ্ভুত এই এসিয়াটিকদের মুখ। এমন ভাবলেশহীন যে কিছুতেই মনের কথা টের পাওয়া যায় না। অফিসারদের কোয়াটারে অতি বিশ্বস্ত আন্দলি, সহিস ও বাবুৰ্চিদেরও যেন আর তেমন বিশ্বস্ত মনে হয় না এখন। এতদিন পর মনে হয়, ওদের প্রত্যেকের মুখের সঙ্গেই মঙ্গল পাণ্ডের মুখের যেন কিছুটা মিল আছে। ওরা কি গোপনে নিজেদের মধ্যে কিছু বলাবলি করে? ওদের ওষ্ঠে কি গোপনে ফুটে ওঠে ব্যঙ্গের হাসি? দুজন উচ্চপদস্থ ইংরেজ সেনানী হিউসন ং বা মিলিতভাবে মাত্র একজন দেশী সিপাহীকে লড়াইতে পর্যুদস্ত করতে পারেনি, বহুলোক এ দৃশ্য দেখেছে। এর পর নেটিভরা যদি মনে করে শ্বেতাঙ্গ মানেই অজেয় নয়?
এই ঘটনা গোপন রইলো না, ব্যারাকপুর থেকে ক্ৰমে কলকাতাতেও ছড়ালো। মঙ্গল পাণ্ডেকে সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসী দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ঈশ্বরী পাণ্ডের ফাঁসী কার্যকর করতে কয়েকদিন দেরি হলো। ফাঁসীর হুকুম দেবার এক্তিয়ার ঠিক কার, তাই নিয়ে একটা প্রশ্ন দেখা দিল। আর যত দেরি হয়, ততই গল্প ছড়ায়। কলকাতায় বসে এই সংবাদ জেনে বিরক্ত হলেন গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং। কঠিন শাস্তি যদি দিতেই হয়, তবে তা অতি দ্রুত সমাধা করাই উচিত। বিলম্ব হলে দুর্বলতাই প্রকাশ পায়। দেশী লোকদের সব সময় বুঝিয়ে দেওয়া দরকার, ইংরেজ শাসনে কোনো প্রকার অস্থিরচিত্ততা বা সংশয়ের স্থান নেই।
খবরটি প্রথম সীমাবদ্ধ রইলো কলকাতার ইংরেজদের মধ্যে। সুখী, বিলাসী ইংরেজ সমাজে গোপন মৃদু ত্রাসের স্রোত প্রবাহিত হয়ে যায়। কেউ সহজে মুখে কিছু বলে না, কিন্তু চোখে চোখে কথা হয়। সত্যি একজন দেশী সিপাহী ইংরেজ সেনানায়কদের হত্যা করার জন্য গুলি ছুঁড়েছিল? মনুষ্যাধম এই জাতির কোনো একজনের এমন সাহস হয়? অন্য সিপাহীরা নিশ্চেষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করেনি? একশো বছর আগে বাংলার নবাব সিরাজদৌল্লা আক্রমণ করেছিল কলকাতা, তখন সব ইংরেজকেই এই শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। ঠিক একশো বছর আগে।
ক্রমে এই গোপন ত্ৰাস আর শুধু মনের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না, কানাকানি হয়। হিন্দুস্থানে, কোম্পানির রাজ্যসীমা বড় বেশী বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। এত বড় রাজ্য শাসনের জন্য দেশী সিপাহী নিয়ে সৈন্য গড়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু কতখানি বিশ্বাস করা যায়। তাদের? মঙ্গল পাণ্ডে হয়ে গেল এক বিভীষিকার প্রতীক। মঙ্গল বাদ দিয়ে শুধু পাণ্ডে, তাও ইংরেজরা পাণ্ডে ঠিক মতন উচ্চারণ করতে পারে না। হলো পাণ্ডি। এই পাণ্ডর মতন দুশমন ভারতীয় সিপাহীদের মধ্যে কতজন আছে? যদি সহস্ৰ সহস্ৰ হয়?
মঙ্গল পাণ্ডের ঘটনার পর কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে, ঈশ্বরী পাণ্ডেরও ফাঁসী হয়ে গেছে, তারপর আর কোনো রকম গোলযোগ দেখা যায়নি। তবু ঘটনাটি ভোলা গেল না। রাজধানী কলকাতার সুরক্ষার জন্য জোরদার ব্যবস্থা গ্ৰহণ করা উচিত নয়? ইংরেজ সমাজের অনেকের মধ্যেই এ কথা গুঞ্জরিত হতে লাগলো।
খবরটি কিছুদিনের মধ্যে বাঙালীদের মধ্যেও ছড়ালো। প্রতিক্রিয়া হলো মিশ্র ধরনের। কারুর কাছে ঘটনাটি অত্যন্ত বিস্ময়কর, কারুর কাছে এমন কিছুই না। মঙ্গল পাণ্ডে কী তীব্র নেশাগ্ৰস্ত কিংবা উন্মাদ ছিল? একমাত্র কোনো বিকৃতমস্তিষ্ক ব্যক্তির পক্ষেই এমন নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেওয়া সম্ভব। কিন্তু বাকি সিপাহীরাও নীরব এবং নিষ্ক্রিয় ছিল কেন? মঙ্গল পাণ্ডে ব্যর্থ হলেও এর পেছনে কোনো পরিকল্পনা ছিল কি?
একটি তথ্য অবশ্য বেশ মনে দাগ কাটলো বাঙালী সমাজে। পলাশী যুদ্ধের পর ঠিক একশো বছর কেটেছে। এ কথা ইংরেজরাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। ঠিক একশো বছর, এর কি কোনো গূঢ় মর্ম আছে? ঠিক একশো বছর পার হয়ে আবার কোনো গুরুতর ঘটনা ঘটবে?