বিনুর বাবা মারা গেছেন। মৃত্যুসংবাদ নিয়ে এসেছে বিনুর চাচাতো ভাই ইয়াকুব। ঢাকা শহরে সে এই প্রথম এসেছে। ঠিকানা লেখা কাগজ সঙ্গে ছিল, তারপরেও তার পুরো দেড় দিন লাগল বিনুকে খুঁজে বের করতে। বিনুর বাবা মারা গেছেন বুধবার দুপুরে, বিনু খবর পেল শুক্রবার সকালে।
মৃত্যু-সংবাদ দিয়েই ইয়াকুব প্রথম যে কথাটা বলল, গত রাইত থাইক্যা না খাওয়া। ভাত খাওনের জোগাড় আছে?
বিনু ভাই-এর জন্যে ভাত খাবার জোগাড় করতে গেল। সে কাঁদল না, চিৎকার করে শোকের কোনো প্ৰকাশ দেখাল না। ইয়াকুব তাতে খুব স্বস্তি বোধ করল। বিনু চিৎকার হৈচৈ শুরু করলে সমস্যা হত। কে তার ভাতের জোগাড় করত! ক্ষিধেয় তার শরীরে কাঁপুনি ধরে গেছে। চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করেছে।
জাহানারা বিছানায় শুয়ে ছিলেন। জানালার ওপাশ দিয়ে বিনুকে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, দোতলায় কে এসেছে?
বিনু শান্ত গলায় বলল, আমার চাচাতো ভাই।
তার নাম কী?
ইয়াকুব।
জানোলা দিয়ে কথা বলছি কেন বেয়াদবের মত? ঘরে ঢুকে প্রশ্নের জবাব দাও। বাবা-মা আদব কায়দা শিখায় নাই?
বিনু ঘরে ঢুকল। জাহানারা বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললেন, তুমি কোন সাহসে তোমার ভাইকে দোতলায় আনলে? এই সাহসের মানে কী? তুমি জান না। দোতলায় ওঠা নিষেধ? এক্ষুণি একতলায় পাঠাও!
জ্বি পাঠাচ্ছি।
ইয়াকুব চায় কী?
কিছু চায় না।
তুমি যেভাবে কাজ কর্ম করছ তাতে মনে হয় এই ঘর বাড়ি সবই তোমার। এ রকম মনে করার মত কিছু ঘটে নি। এ বাড়ির কাজের মেয়ে রাণীর মা তোমার চে উপরে আছে। রাণীর মা কাজ করে খায়। তুমি পরের উপর খাও। বুঝতে পারছ?
জ্বি।
ভাই এসেছে খুব ভাল কথা, এখন ভাই-এর হাত ধরে যেখানকার জিনিস দেখানে চলে যাও।
জ্বি আচ্ছা।
আজই যাবে।
জ্বি আজই যাব। দুপুরে চলে যাব।
যাবার আগে সুটকেস খুলে দেখিয়ে যাবে। আমার এখন শরীর ভাল না। কোনো দিকে নজর দিতে পারি না। কোনো জিনিস সুটকেসে ভরে নিয়ে গেলে বুঝতে পারব না।
বিনু সামনে থেকে সরে গেছে। কিন্তু জাহানারার মনে হচ্ছে বিনু এখনো সামনে দাঁড়িয়ে। মেয়েটাকে আরো অপমান করতে হচ্ছে। তার নিজের শরীর জ্বালা করছে। মেয়েটাকে কুৎসিত কিছু গালি দিতে পারলে জুলুনি হয়ত কমত। কুৎসিত গালি তিনি জানেন। বাড়ির পেছনে বস্তির পানির কল। পানি নিতে এসে এরা যে সব গালগালি করে তিনি শোবার ঘর থেকে শুনতে পান। এইসব গালাগালির মধ্যে সবচে ভদ্র গালি হল— খানকি মাগি। বিনুকে ডেকে খানকি মাগি গালি দিলে কেমন হয়? মেয়েটা এই গালি শুনে কী করবে? অনেকক্ষণ নিশ্চয়ই হা করে তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। জাহানারা কল্পনায় বিনুর বিস্মিত মুখ পরিষ্কার দেখলেন। তার হাসি পেয়ে গেল। হাসি চাপতে গেলেন, সেই হাসি আরো বাড়ল।
হাসার মত অবস্থা তার না। শুভ্র গত রাতে বাসায় ফিরে নি, তার আগের রাতেও ফিরে নি। আজ খুব ভোরে ম্যানেজার ছালেহ এসেছিল। তাঁর সঙ্গে তিনি অনেক রাগারগি করেছেন। এই বদমাশটাকেও কিছু কঠিন গালাগালি দিতে পারলে হত। খানকি মাগি ধরনের গালি। এই গালি পুরুষদের জন্যে প্রযোজ্য নয়। মেয়েরা বিশেষ অবস্থায় খানকি মাগি হয়— পুরুষরা কী হয়?
এক পর্যায়ে তাঁর ইচ্ছা করছিল বিছানা থেকে নেমে লাথি মেরে ম্যানেজারকে চেয়ার শুদ্ধ মেঝেতে ফেলে দিতে। হারামজাদা আবার কুচুর কুচুর শব্দ করে তাঁর সামনেই পান খায়। কত বড় অভদ্ৰ! তিনি অবশ্যি মনের রাগ প্রকাশ করলেন না। শান্ত মুখেই বললেন, খবর কী?
ছালেহ বলল, কোন খবর জানতে চান?
জাহানারার মুখ তেতো হয়ে গেল। মনে মনে বললেন- শুয়রের বাচ্চা, তুমি জানি না আমি কোন খবর জানতে চাই। তোমার কাছে কি আমি সৌদি আরবের বাদশার খবর জানতে চাই? তোমার কাছে জানতে চাই- আমার ছেলের খবর।
তিনি দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ সামলালেন। যদিও রাগ সামলানোটা খুবই কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে, কারণ হারামজাদা ম্যানেজারটা শুধু যে কুচুর কুচুর করে পান খাচ্ছে তাই না, পাও নাচাচ্ছে। পায়ে স্প্রীং ফিট করে এসেছে।
জাহানারা শান্ত গলায় বললেন, আসমানী মেয়েটার বিষয়ে কী করেছ? কী ব্যবস্থা নিয়েছ?
ব্যবস্থা নেয়া হবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন। আটঘাট বেধে এগুতে হবে। আমার যা করার আমি করব।
শুভ্ৰ কাল রাতে ঘরে ফিরে নি।
ও আচ্ছা।
গত পরশু রাতেও ফিরে নি। আমারতো এখন মনে হয় শুভ্ৰ বাড়ি ঘর ছেড়ে দিয়ে বেশ্যা বাড়িতেই থাকবে।
আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না।
আমি দুশ্চিন্তা করব নাতো দুশ্চিন্তাটা করবে। কে? তুমি করবে নাকি সৌদি আরবের বাদশা করবেন?
ছালেহ পানের পিক ফেলবার জন্যে বারান্দায় চলে গেল, আবার ফিরে এসে বসে পা নাচাতে লাগল। জাহানারা লক্ষ করলেন আগে সে একটা পা নাড়াচ্ছিল, এখন দুটা পা-ই নাড়াচ্ছে।
শুভ্ৰ এখন কী করছে তুমি জান?
সঠিক জানি না।
তার কাজকর্ম সম্পর্কে কিছুই জানি না?
বাড়ির মেয়েগুলিকে পনেরো হাজার করে টাকা দিয়ে নিজের নিজের বাড়ি পাঠানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। লাভ হচ্ছে না। কেউ যেতে চাচ্ছে না। এরা টাকাটা নিবে কিন্তু যেটা করবে সেটা হল – এক বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়িতে গিয়ে উঠবে। মাঝখান থেকে সবার নেট লাভ পনেরো হাজার টাকা।
টাকা দেয়া হয়ে গেছে?
শুনেছি দেয়া শুরু হয়েছে। সঠিক জানি না।
তুমি দেখি কোনো কিছুই সঠিক জান না। সবই বেঠিক জান। আমি বিছানায় শুয়ে থেকে যা জানি- তুমি শহরে বন্দরে ঘোরাঘুরি করে তার একশ ভাগের এক ভাগ জান না। পনেরো হাজার করে টাকা দিলে– সব কটা মেয়ের জন্যে কত টাকা লাগবে?
অনেক লাগবে।
সেই অনেকটা কত হিসাব করে বল। নাকি যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ ভুলে গেছ? আর শোন— পা নাচানোটা একটু বন্ধ করা। আমার সামনে পা না নাচিয়ে বাড়িতে গিয়ে নাচাও।
ছালেহ পা নাচানো বন্ধ করলেন। জাহানারা কঠিন গলায় বললেন, এত এত টাকা যে শুভ্ৰ দিচ্ছে তার কি এত টাকা আছে? তার অন্য ব্যবসার অবস্থা কী?
অবস্থা ভাল না।
ভাল না কেন?
এখনকার ব্যবসা হল বেশির ভাগই দু নম্বরি। উনার পক্ষে দু নম্বরি কাজ সম্ভব না।
উজবুকের মত কথা বলব না। তার পক্ষে বেশ্যাবাড়িতে পড়ে থাকা সম্ভব। আর দুনম্বরি ব্যবসা করা সম্ভব না। এটা কেমন কথা?
ছালেহ উদ্দিন চুপ করে রইলেন। জাহানারা বললেন, আমি শুনতে পাচ্ছি। সে এই বাড়ি বিক্রি করার চেষ্টা করছে। এটা কি সত্যি?
জ্বি, সত্যি। এই বাড়ি আর অফিস সবই তিনি বিক্রি করতে চান। দালাল ধরা হয়েছে। দালালেরা খোঁজখবর করছে।
বিক্রি করে সে খাবে কী? থাকবে কোথায়? সে কি তার মাকে নিয়ে ভিক্ষা করতে বের হবে? কমলাপুর রেল ষ্টেশনে মা-বেটায় ভিক্ষা করব? আর তোমরা ভিক্ষা দিবো; তোমার সঙ্গে ছিঁড়া ময়লা এক টাকার নোট আছে? থাকলে দিয়ে যাও— তোমাকে দিয়েই ভিক্ষা শুরু করি।
ছালেহ বিব্রত গলায় বললেন, আপনার শরীরটা খারাপ। আপনি শুয়ে থাকুন।
তুমি চলে যাচ্ছ?
জ্বি। আমি রোজই একবার এসে খোঁজ নিয়ে যাব।
তোমাকে রোজ আসতে হবে না। তোমাকে যেদিন দেখি সেদিন আমার দিনটা খারাপ যায়। তোমাকে যখন ডাকব তখন-ই আসবে। নিজ থেকে আসবে না।
জ্বি আচ্ছা।
ম্যানেজার চলে যাবার পর থেকে জাহানারা বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলেন নি। টেলিফোন বেজেছে, টেলিফোন ধরেন নি। টেলিফোন হয়ত শুভ্র করেছে, তারপরও ধরেন নি। ধরতে ইচ্ছা করে নি।
কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কোনো এক মেয়ে চাপা গলায় ফুপিয়ে কাঁদছে। এমনভাবে কাঁদছে যেন কেউ তার কান্না শুনতে না পায়। বিনু কি কাঁদছে! বিনু কেন কাঁদবে! কাদার মত এমন কী ঘটনা ঘটিল! ভাই নিতে এসেছে। এতো আনন্দের কথা। কাঁদবে কেন? জাহানারা রাণীর মাকে ডাকলেন। রাণীর মা কয়েকদিন হল এ বাড়িতে কাজ করছে। তার কাজকর্ম ভাল। চালচলন ভাল না। কেমন করে যেন শরীর দুলিয়ে হাঁটে। যে সব বাড়িতে যুবক পুরুষ থাকে সে সব বাড়িতে রাণীর মা ধরনের কাজের মেয়ে রাখতে নেই। মেয়েটাকে দুএকদিনের মধ্যেই বিদায় করে দিতে হবে। সবচে ভাল হয়। আজই বিদায় করে দিলে।
আম্মা ডাকছেন গো?
হ্যাঁ ডেকেছি। আহাদী করে কথা বলবে না। ডাকছেন গো আবার কী? যখন ডাকি— সামনে এসে দাঁড়াবে। গো বলে টান দিতে হবে না। কাঁদছে কে?
আফামনি কাঁদতেছে।
আফামনি আবার কী? বিনু আফামনি হল কবে? তুমি যেমন বিনুও তেমন। বিনুর থাকার জায়গা নেই, থাকতে দিয়েছি। সে কাঁদছে কেন?
উনার পিতা ইন্তেকাল করেছেন। ভাই খবর নিয়া আসছে। এই জন্যে কাঁদতেছেন।
বিনুর বাবা মারা গেছে?
জ্বি।
কবে মারা গেছে?
বুধবারে। সেই দিন উনার শইলটা ভাল ছিল। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে চাঁদর গায়ে দিয়া ঘুমাইতেছিলেন। ঘুমের মধ্যে ইন্তেকাল হয়েছে, কেউ বুঝতে পারে নাই।
তুমি এত কথা জানলে কী করে?
উনার ভাই বলেছেন।
তার সঙ্গে তোমার এত কথা বলার দরকার কী? পুরুষ মানুষ দেখলেই কথা না বলে থাকতে পার না? যাও বিনুকে ডেকে নিয়ে এসো।
আফামনি দরজা বন কইরা কাঁদতেছে। ডাকলে শুনবে না।
তুমি গিয়ে বল আমি ডাকছি। আমার কথা বললেই শুনবে।
জাহানারা অপেক্ষা করছেন। বিনু আসছে না। আশ্চর্য! মেয়েটা এত বেয়াদব? এতো দেখি ম্যানেজারের চেয়েও বেয়াদব। তিনি সব সহ্য করবেন, বেয়াদবি সহ্য করবেন না। মানুষ মারা যাবে, কেউ অনন্তকাল বাঁচবে না, তাই বলে বেয়াদবি করতে হবে? জাহানারা বিনুর সীমাহীন বেয়াদবির কথা ভাবতে ভাবতেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলেন নৌকায় করে তিনি কোথায় যেন যাচ্ছেন। তাঁর কোলে শুভ্ৰ। সে দুধের শিশু, কিন্তু তার চোখে চশমা। তিনি শুভ্রর বাবার সঙ্গে রাগীরাগি করছেন— বাচ্চাদের কত সুন্দর সুন্দর চশমা পাওয়া যায়, এইসব না কিনে বুড়ো মানুষদের মত কী চশমা কিনছ! সারা মুখ ঢেকে গেছে এত বড় চশমা। শুভ্রর বাবা বলছেন- হ্যাঁ চশমাটা বড়ই হয়েছে। এই বলতে বলতে তিনি নৌকার পাটাতনে শুয়ে পড়লেন। জাহানারা বললেন, তুমি করুছ কী ঘুমের মধ্যে গড়িয়ে নদীতে পড়ে যাবে তো! আমি সাঁতার জানি আমি তোমাকে তুলতে পারব। কিন্তু আমার কোলে শুভ্ৰ। আমি তাকে নিয়ে কীভাবে তোমাকে তুলিব? শুভ্রর বাবা বললেন- আমি পড়ব না। বলতেই নৌকা কাত হল। শুভ্ৰর বাবা গড়িয়ে পানিতে পড়ে গেলেন। চারদিকে খুব হৈচৈ হচ্ছে। এই হৈচৈ-এ জাহানারার ঘুম ভাঙিল। তিনি তাকিয়ে দেখেন তাঁর বিছানার পাশে বিনু দাঁড়িয়ে আছে। বিনুর হাতে সুটকেস। জাহানারা বললেন, তুমি কোথায় যাও?
বিনু বলল, দেশের বাড়িতে। চাচি, আমার বাবা মারা গেছেন।
জাহানারা বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললেন, আমাকে এত বড় বিপদে ফেলে তুমি চলে যাবার কথা ভাবতে পারলে? তুমি কেমন মেয়ে বল দেখি! তোমার চোখে লউ নাই? দুই রাত ধরে আমার ছেলের খোঁজ নাই। আমি অসুস্থ হয়ে পড়ে আছি, আমার হুঁশ জ্ঞান নাই। কী বলতে কী বলি তার ঠিক নাই, আর তুমি সুটকেস হাতে রওনা দিয়ে দিলে?
বিনু ক্ষীণ গলায় বলল, চাচি, আমার বাবা বুধবারে মারা গেছেন।
জাহানারা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, বুধবারে তোমার বাবা মারা গেছেন তার আমি কী করব। তোমার বাবার কপালে লেখা ছিল বুধবারে মৃত্যু। কপালে যদি বুধবারে মৃত্যু লেখা থাকে তাহলে বুধবারেই মৃত্যু হবে। সোমবারে হবে না। আজ শুক্রবার। তোমার বাবাকে কবর দিয়ে দিয়েছে! তুমি গিয়ে তোমার বাবার ডেড বডি দেখবে তার জন্যে তাকে তোমার মা নিশ্চয়ই আচার বানিয়ে রেখে দেয়। নাই। আমি যদি এখন মারা যাই তুমি বল কে আমাকে দেখবে? রাণীর মা দেখবে? কার হাতে তুমি আমাকে রেখে যাচ্ছ?
বিনু বলল, চাঁচি, আপনি একটা জিনিস বুঝতে পারছেন না—
জাহানারা বিনুকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি কিছু বুঝতে পারছি না তা ঠিক। আমার জায়গায় তুমি হলে দোতলা থেকে লাফ দিতে। বিনু শোন, আজ যদি এই অবস্থায় আমাকে রেখে তুমি চলে যাও তাহলে এমন অভিশাপ দিব যে তোমার জীবন কাটবে বেশ্যাখানায়, দুনিয়ারী-পুরুষ মানুষের সামনে গায়ের কাপড় খুলতে হবে। তুমি গায়ের কাপড় খুলে দাঁড়িয়ে থাকবে, পুরুষ মানুষ তোমাকে দেখে দরদাম ঠিক করবে। তুমি বলবে দুইশ টাকা ওরা বলবে পঞ্চাশ…
চাচি, আপনি কী বলছেন এইসব?
যা ঘটবে তাই বললাম। তারপর কী হবে শোন— দুইশ এবং পঞ্চাশের মাঝামাঝি রফা হবে…।
চাচি, আমি আপনার পায়ে পড়ি।
জাহানারা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমাকে আমার পায়ে পড়তে হবে না। আমি তোমার পায়ে পড়ি। তুমি আমার সংসারটা ঠিক করে দিয়ে যাও। আমার মাথা পুরোপুরি গেছে! আমি এখন কোনো কিছুই চিন্তা করতে পারি না। মাগো শোন, তুমি কাছে আসা। আমি তোমার পায়ে হাত দিব। পায়ে হাত দেবার পরেতো তুমি আর যাবে না?
জাহানারা চিৎকার করে কাদতে শুরু করেছেন। তিনি খাটের কোণায় নিজের মাথা ঠুকতে চেষ্টা করলেন। বিনু ছুটে গিয়ে তাকে ধরে ফেলে বলল, চাচি আপনি শান্ত হোন। আপনি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি যাচ্ছি না। জাহানারা সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে সহজ গলায় বললেন- বিনু কাউকে কাঁচাবাজারে পাঠাও তো। সজনে পাওয়া যায় কি-না দেখ। সজনের চচ্চড়ি খেতে ইচ্ছে করছে। আমি নিজে রাধব। তোমরা যেভাবে সজনের চচ্চড়ি কর আমি কিন্তু সে রকম করি না। আমার মার কাছ থেকে শিখেছি— শুধু কাঁচা মরিচ। আর সামান্য আদা। একবার খেলে কোনো দিন ভুলবে না। আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব। শুভ্রর বাবার খুব পছন্দের তরকারি। একবার কী হয়েছে শোনা— শুভ্রর বাবা ঘুমুচ্ছিল। রাত বাজে তিনটা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে সে উঠে বসল। আমাকে ডেকে তুলে বলল— শুভ্রর মা, বড় ক্ষিধা লেগেছে। ঘরে কি পাতে খাওয়ার ঘি আছে? আমি বললাম, আছে।
শুভ্রর বাবা বললেন, একটা কাজ করতে পারবে? গরম ভাত রোধে দিতে পারবে? ধোঁয়া ওঠা ভাতে ঘি ঢেলে দিয়ে খাব।
বিনু বলল, আপনি এতো কথা বলছেন কেন? আপনি চুপ করে শুয়ে থাকুন। আমি মাথায় পানি ঢালব।
কাউকে বাজারে পাঠাও সজনে আনুক। আর খোঁজখবর করে দেখা শুভ্ৰকে পাও কি-না। আজ আমরা তিনজন এক সঙ্গে খাব। একটা ইলিশ মাছ আনতে দিওতো। ইলিশ মাছের ভাজা শুভ্রর খুবই পছন্দ। একবার কী হয়েছে মা শোনশুভ্র তখন ক্লাস ফোরে পড়ে। সে স্কুলে টিফিন নিয়ে যায়। আমাকে বলল— আজ ইলিশ মাছ ভাজা টিফিন নিয়ে যাব। আমি হোসে বাঁচি না। সে ইলিশ মাছ ভজা না নিয়ে স্কুলে যাবে না। শেষে ইলিশ মাছ ভেজে টিফিন বক্সে দিয়ে রক্ষা। অসম্ভব জেদি ছেলে। অথচ তাকে দেখে মনে হয়। পৃথিবীর কিছুই বুঝে না।
চাচি, আপনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুনতো।
শুয়েইতো আছি।
কথা বলবেন না।
আচ্ছা যাও বলব না, শুধু শুভ্ৰর আরেকটা গল্প বলি– শুভ্র তখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। ওর বাবা শখ করে একটা জিপারওয়ালা প্যান্ট এনে দিয়েছে। জিপার টেনে বন্ধ করার সময় ছেলের জিনিস জিপারের সঙ্গে লেগে গেলো। জিনিস মানে বুঝতে পারছ তো? হিহিহি…।
জাহানারা হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়লেন। হাসতে হাসতেই গল্পের বাকি অংশ জড়ানো গলায় বলে যাচ্ছেন- বিনু কিছুই বুঝতে পারছে না। হাসির মাঝখানে তিনি কাঁদতেও শুরু করলেন। বিনু ডাক্তার আনতে পাঠাল।
শুভ্ৰ বাড়ি ফিরুল রাত এগারোটায়। তার মুখ থেকে ভকভক করে গন্ধ আসছে। পা সামান্য চলছে। চোখ সামান্য লাল। কিন্তু কথাবার্তা খুবই পরিষ্কার।
বিনু দরজা খুলে দিল। শুভ্র বলল, কেমন আছ বিনু?
বিনু বলল, ভাল।
মা কি ঘুমুচ্ছে?
হ্যাঁ।
বিনু শোন, তুমিও শুয়ে পড়। আমি রাতে কিছু খাব না।
আপনার কি শরীর খারাপ?
না, আমার শরীর খারাপ না। মাতাল হলে কেমন লাগে এটা পরীক্ষার জন্যে প্রচুর মদ্যপান করেছি। মাতাল হতে পারি নি।
কোনো মাতাল কি বুঝতে পারে সে মাতাল হয়েছে?
তা বুঝতে পারে না। তবে আমি বুঝতে পারব। আমার শরীর টলছে, কোনোদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারছি না। কিন্তু আমার লজিক পরিষ্কার। এ থেকেই বুঝছি আমি মাতাল হইনি। মনে মনে আমি বুলিয়ান এলজেব্রার জটিল একটা সলিউশনও করলাম। কোনো সমস্যা হয় নি।
আপনার কাছে লজিক পরিষ্কার মনে হচ্ছে, কিন্তু আসলে হয়তো লজিক পরিষ্কার না। আপনার শরীর কি খুব বেশি খারাপ লাগছে?
হু। প্রচণ্ড বমি ভাব হচ্ছে। কিন্তু বমি হচ্ছে না। কয়েকবার চেষ্টা করেছি।
লবণ-পানি এনে দেব? লবণ-পানি মুখে দিয়ে চেষ্টা করবেন?
আচ্ছা এনে দাও।
আপনি কি একণ একা বাথরুমে যেতে পারবেন? না। আমি ধরে ধরে নিয়ে যাবো।
তুমি ধরে ধরে নিয়ে যাও।
বিনু এসে শুভ্ৰকে ধরল। শুভ্র বলল, আমাকে বাথরুমে নেবার দরকার নেই। তুমি আমাকে বিছানায় শুইয়ে দাও।
বিনু শুভ্ৰকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উঠে যেতে চেষ্টা করল। শুভ্ৰ হাত ধরে তাকে আটকে দিল। অবাক হয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছ?
আপনার জন্যে লবণ-পানি নিয়ে আসছি।
লবণ-পানি লাগবে না। তুমি এখান থেকে নড়বে না।
মাথায় পানি ঢেলে দেব?
আপনার কি বেশি খারাপ লাগছে?
হ্যাঁ, খুবই খারাপ লাগছে! কী মনে হচ্ছে জান? মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি মারা যাবো। মৃত্যুর আগে মানুষের প্রচুর কথা বলতে ইচ্ছা করে। আমারাও কথা বলতে ইচ্ছা করছে।
কথা বলুন। আমি শুনছি।
মদ খেলে কী হয় জান বিনু? মদ খাবার পর যারা প্রিয় মানুষ তাদেরকে অসম্ভব প্রিয় মনে হয়। সুন্দর মনে হয়। যারা অপ্রিয় মানুষ তাদেরকে অনেক বেশি অপ্রিয় মনে হয়। অসুন্দর মনে হয়। যেমন তুমি। তোমাকে যে আজ কী সুন্দর লাগছে সেটা শুধু আমিই জানি।
একদিন মদ খেয়েই বুঝে গেলেন, মদ খেলে প্রিয় মানুষকে সুন্দর লাগে?
এটা আমার থিয়োরি না। আখলাক সাহেবের থিয়োরি। তবে আমার ধারণা থিয়োরি ঠিক আছে। তোমাকে খুবই সুন্দর লাগছে।
আপনি কি দয়া করে চোখ বন্ধ করে ঘুমুবার চেষ্টা করবেন?
না, চেষ্টা করব না। আমি জেগে থাকব; সারারাত তোমার সঙ্গে গল্প করব। বিনু একটা হাসির গল্প শুনবে? গল্পটা আমাকে আসমানী বলেছে। সে মজার মজার গল্প জানে। গম্ভীর মুখে গল্প বলে। গল্প শুনে হাসতে হাসতে প্ৰাণ যাবার মতো হয়। আসমানীর গল্পটা তোমাকে বলব?
বলুন।
এক বৃদ্ধা মহিলা ময়মনসিংহ থেকে বাসে উঠেছে। সে বাসে উঠেই কন্ডাক্টারকে বলল, বাবা, ভালুকা আসলে আমারে বলবা। কন্ডাক্টার বলল, জ্বি আচ্ছা বুড়ি মা, বলব। বাস চলতে শুরু করল। বুড়ি কিছুক্ষণ পর পর জানতে চায়- ভালুকা এসেছে? কন্ডাক্টর বলল, কেন বিরক্ত করেন? এর মধ্যে সতেরোবার জিজ্ঞেস করেছেন। ভালুকা আসুক বলব। এখন বুড়ি মা আপনার আল্লাহর দোহাই লাগে চুপ করে থাকেন। পানি খান। বুড়ি চুপ করে থাকে না। একটুপর জিজ্ঞেস করে— ভালুকা আসছে? ও বাবা ভালুকা আসছে? বাসের সবাই মহা বিরক্ত। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো ভালুক যখন এসেছে করোরই আর কিছু মনে নাই। বাস বুড়িকে নিয়ে ভালুকা ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে গেল। যখন খেয়াল হল তখন কন্ডাক্টর জিবে কামড় দিল। বাসের সব যাত্রী কন্ডাক্টারকে গালাগালি করতে লাগলো। ড্রাইভার বাস ঘুরিয়ে ভালুকার দিকে রওনা দিল। এক ঘণ্টা পরে ভালুকা এসে পৌঁছল। কন্ডাক্টার লজ্জিত গলায় বলল, বুড়ি মা নামেন, ভালুক এসেছে। বুড়ি এই শুনে বিরক্ত মুখে বলল, নামব কী জন্যে? ওষুধ খাবো। ডাক্তার সাব আমারে একটা ট্যাবলেট ময়মনসিংহে খাওয়াইয়া দিয়া বলেছে আরেকটা ট্যাবলেট ভালুকায় খাইতে। এখন আপনেরা এক গেলাস পানি দেন।
গল্প শেষ করে শুভ্ৰ হাসছে। কিছুতেই তার হাসি থামছে না। বিনু তাকিয়ে আছে। তার মুখে কোনো হাসি নেই। শুভ্র বলল, শব্দ করে হাসায় একটা উপকার হয়েছে- শরীর খারাপ ভাবটা সামান্য কমেছে।
আপনি রাতে খাবেন না? না। ক্ষিধে নেই।
চাচি আপনার জন্যে অসুস্থ শরীরে রান্না করেছেন। ক্ষিধা না থাকলেও একটু বসুন। ভাত নাড়াচাড়া করুন। উনি আপনার সঙ্গে খাবেন বলে রাতে খান নি।
ভাত নড়াচাড়া করতে ইচ্ছা করছে না। শুয়ে আছি, শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে। আচ্ছা বিনু, তুমি ভালো করে আমার দিকে তাকাও তো। আমার যে প্রচণ্ড মন খারাপ। আমাকে দেখে কি বোঝা যাচ্ছে?
না বোঝা যাচ্ছে না।
আমার খুবই মন খারাপ।
কেন?
তেমন কোনো কারণ নেই। শোন বিনু, মন ভালো হবার জন্যে কারণ লাগে। কিন্তু মন খারাপ হবার জন্য কোনো কারণ লাগে না। মাঝে মধ্যেই দেখবে সব ঠিকঠাক চলছে, সুন্দর সকাল, ঝকঝকে রোদ উঠেছে, নীল ঝলমলে আকাশ; তারপরেও এ মন খারাপ হয়ে গেল। তোমার এরকম কখনো হয় না?
আমি খুবই সাধারণ একটা মেয়ে।
সাধারণ মেয়েদের মন খারাপ হয় না?
সাধারণ মেয়েদের মন খারাপ হয় খুবই সাধারণ কারণে।
উদাহরণ দিয়ে বুঝাওতো।
একটা সাধারণ মেয়ে যদি হঠাৎ খবর পায়- তার বাবা মারা গেছেন। তখন তার মন খারাপ হবে।
শুভ্ৰ বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল, বিনু তোমার বাবা মারা গেছেন?
বিনু জবাব দিল না।