ফাল্গুনের আট চৈত্রের আট
সেই তিল দায়ে কাট।
ফাল্গুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ হইতে চৈত্রের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে তিল ফসল পাকিলে সেবার চূড়ান্ত ফসল হয়। সে তিল ফসল দা ভিন্ন কাস্তেতে কাটা যায় না। এবার তিল নাবি, সবে এই ফুল ধরিতেছে, পাকিতে বৈশাখের প্রথম সপ্তাহ। কাজেই ফসল ভাল হইবে না।
ভোরবেলায় মাঠ ঘুরিয়া চাষের জমির তদারক করিয়া দেবু ফিরিতেছিল। এ বৎসর মাঘ মাস হইতে আর বৃষ্টি হয় নাই। বৃষ্টির অভাবে এখনও কেহ আখ লাগাইতে পারে নাই। ময়ূরাক্ষীর জল একেবারে শীর্ণ ধারায় ওপারে জংশন শহরের কোল ঘেঁষিয়া বহিতেছে; বাঁধ দিয়া জল এপারে আনিতে পারিলে সি করিয়া চাষের কাজ চলিত। কিন্তু এ বধ বাধা বড় কষ্টসাধ্য। এপার হইতে ওপার পর্যন্ত ময়ূরাক্ষীর গর্ভে বাঁধ দিতে হইবে; অন্তত চার-পাঁচ হাত উঁচু না করিলে চলিবে না। সে করিবে কে? চার-পাঁচখানা গ্রামের লোক একজোট হইয়া না লাগিলে তাহা সম্ভবপর নয়। এখন আখ লাগাইলে সে আখের বিনাশ থাকিত না; বর্ষা পড়িবার পূর্বেই হাত দুয়েক না হোক অন্তত দেড় হাত উঁচু হইয়া উঠিত। পটল লাগানোও হইল না। পটল রুইলে ফাল্গুনে ফল বাড়ে দ্বিগুণে। শ্ৰীহরি কিন্তু সব লাগাইয়া ফেলিয়াছে। আপনার জমিতে দুই-তিনটা কাঁচা কুয়া কাটাইয়া, ঢেড়ায় জল তুলিয়া সিচনের ব্যবস্থা করিয়াছে। শ্ৰীহরির কুয়া হইতে জল লইয়া ভবেশ-হরিশও কাজ করিয়া লইয়াছে।
দেবু ভাবিতেছিল একটা কুয়া কাটাইবার কথা। পটল যাক, কিন্তু আখ না লাগাইলে কি করিয়া চলিবে? বাড়িতে গুড় না থাকিলে চলে? ময়ূরাক্ষীর চরভূমিতে অল্প খুঁড়িলেই জল অতি সহজেই পাওয়া যাইবে; আট-দশ হাত গর্ত করিলেই চলবে। টাকা পনের খরচ। কিন্তু এদিকে যে বিলুর হাতে মজুত টাকা সব শেষ হইয়া আছে। শ্ৰীহরির স্ত্রী গোপনে ধার দিয়াছে। দুর্গার মারফতে দোকানেও কিছু ধার হইয়া আছে। ধান এবার ভাল হয় নাই। মজুত যাহা আছে বিক্রি করিতে ভরসা হয় না। সম্মুখে বর্ষা আছে, চাষের খরচ সংসার খরচ অনেক দায়িত্ব। গম, যব তাও ভাল হয় নাই। গম দেড় মন, যব মাত্র তিরিশ সের। কলাই যাহা হইয়াছে সে সংসারেই লাগিবে। আর স্কুলের চাকরি নাই, মাস-মাস নগদ আয়ের সংস্থান গিয়াছে। এখন সে কি করিবে? অথচ এই অবস্থায় গোটা গ্রামটাই যেন তাহাকে টানিতেছে সহস্র সমস্যা হইয়া। যতীনের কথা মনে হইল; দ্বারকা চৌধুরীর কথা মনে হইল।
গ্রামে ঢুকিতেই দেখা হইল ভূপালের সঙ্গে। চৌকিদারি পেটিটা কাঁধে ফেলিয়া সে সকালেই বাহির হইয়াছে। ভূপাল প্রণাম করিল—পেনাম।
প্রতি-নমস্কার করিয়া দেবু চলিয়া যাইতেছিল, ভূপাল সবিনয়ে বলিলপণ্ডিতমশায়।
—আমাকে কিছু বলছ?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, গিয়েছিলাম বাড়িতে ফিরে আসছি।
–কি, বল?
–আজ্ঞে, খাজনা আর ইউনান বোর্ডের ট্যাক্স।
–আচ্ছা, পাবে।
ভূপাল খুশি হইয়া বলিল—এই তো মশায় মানুষের মতন কথা। তা না ডাক্তারবাবু তো মারতে এলেন। ঘোষালমশাই বলে দিলে—নেহি দেঙ্গা। আর সবাই তো ঘরে লুকিয়ে বসে থাকছে। মেয়েছেলেতে বলেছে—বাড়িতে নাই। এদিকে আমি গাল খাচ্ছি।
হাসিয়া দেবু বলিল না থাকলেই মানুষকে চোর সাজতে হয় ভূপাল।
-ই আপনি ঠিক বলেছেন।
ভূপাল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—কার ঘরে কি আছে বলুনঃ গোটা মাঠটার ধানই তো ঘোষমশাইয়ের ঘরে এসে উঠল গো। বর্ষার ধান শোধ দিতেই তো সব ফাঁক হয়। সত্যি, লোকে দেয় কি করে? কিন্তু আমিই বা করি কি বলুনঃ আমারই এ হইছে মরণের চাকরি!
বাড়িতে আসিয়া দেবু দেখিল—বিলু তাহার জন্য চা করিয়া বসিয়া আছে। সে আশ্চর্য হইয়া গেল। এ কি!
বিলু লজ্জিতভাবেই বলিল—দেখ দেখি হয়েছে কি না। কামার-বউকে শুধিয়ে এলাম, নজরবন্দির চা কামার-বউ করে কিনা!
—তা না হয় হল, কিন্তু করতে বললে কে?
–তুমি যে বললে—জেলে রোজ নজরবন্দিদের কাছে চা খেতে!
–হ্যাঁ তা খেতাম, কিন্তু তাই বলে এখনও খেতে হবে তার মানে কি? না, আর খরচ বাড়িয়ো না, বিলু।
—বেশ। এক কৌটো চা আনিয়েছি, সেটা ফুরিয়ে যাক, তারপর আর খেয়ো না।
–এক কৌটো চা আনিয়েছ?
–দুর্গা এনে দিয়েছে কাল সন্ধেবেলা।
দেবুর ইচ্ছা হইল চায়ের বাটিটা উপুড় করিয়া ফেলিয়া দেয়। কিন্তু বিলু ব্যথা পাইবে বলিয়া সে তাহা করিল না। বলিল-আজ করেছ কিন্তু কাল থেকে আর কোরো না। চায়ের কৌটোটা থাক, ভাল করে রেখে দাও। ভদ্রলোকজন এলে, কি বর্ষায়-বাদলায় সর্দি-টর্দি করলে খাওয়া যাবে।
–না।
দেবু বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিল–মানে?
–তোমার কষ্ট হবে।
–হবে না।
–হবে, আমি জানি।
–কি আশ্চর্য!
বিরক্তিতে বিস্ময়ে দেবু বলিল-আমার কষ্ট হবে কি না আমি জানব না, তুমি জানবে?
—বেশ। করব না চা।
মুহুর্তে বিলুর চোখ দুটি জলে ভরিয়া উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরাইয়া সে চলিয়া গেল।
দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। এই বোধহয় তাহাদের জীবনে প্রথম দ্বন্দ্ব। বিলুকে আঘাত দেওয়ার দুঃখ বড় মর্মান্তিক হইয়া দেবুর অন্তরে বাজিল।
—মুনিবমশায়! দেবুর কৃষাণ আসিয়া দাঁড়াইল।
–কি রে?
–আজ্ঞে, এবার তো একখানা কোদাল না হলে চলবে না।
–নতুন চাই? লোহা চাপিয়ে হবে না?
–না, আজ্ঞে। গেলবারই লাগত, আপুনি ছিলেন না। লোহা দিয়ে কোনোরকমে চালিয়েছি; ক্ষয়ে এই এতটুকুন হয়ে গিয়েছে। সার কেটে পালটানোই যাচ্ছে না।
–সার কাটছ নাকি? জল দিচ্ছ তো? চল দেখি।
চৈত্র মাসে সার প্রস্তুতের গর্তে সঞ্চিত আবর্জনাগুলিকে কোদাল দিয়া উপরের নূতন নাপচা আবর্জনা নিচে ফেলিয়া, নিচের পচা আবর্জনা যাহা সারে পরিণত হইয়াছে—সেগুলিকে উপরে দেওয়ার বিধি। সঙ্গে সঙ্গে ভারে ভারে জল। দেবুর বাড়ির সার কোনোমতে কাটিয়া পালটানো হইয়াছে। কৃষাণটি কোদালটা দেখাইল। সত্যই সেটা ক্ষয় পাইয়া ছোট হইয়া গিয়াছে, উহাতে চাষের কাজ চলিবে না। চাষের কাজে ভারী কোদাল চাই। সেকালে শক্তিমান চাষীরা যে কোদাল চালাইত, তাহার ওজন পাঁচ সেরের কম হইত না, সাত-আট সের ওজনের। কোদাল চালাইবার মত সক্ষম চাষীও অনেক ছিল।
দেবু বলিল—বেশ, কোদাল একখানা—কি করবে, বরাত দিয়ে করাবে, না কিনবে?
—কেনা জিনিস ভাল হয় না, তবে সস্তা বটে।
–কিন্তু কামার কোথা? অনিরুদ্ধ তো কাজের বার হয়েছে। অন্য কামার যাকেই দেবে–কাল দেব বলে দু মাসের আগে দেবে না।
—তবে তাই কিনেই দেন। আর শণ চাই। হালের জুতি চাই। রাখালটা বলছিল—গরুর দড়িও ছিঁড়েছে।
দেবু একটা কাজ পাইয়া খুশি হইল। শণ পাকাইয়া দড়ি করার কাজ-পল্লীগ্রামে নিষ্কর্মার কর্ম—বুড়োর কাজ। সে তখনই ড়ো-শণ লইয়া আসিল। দড়ি পাকাইতে পাকাইতে সে ভাবিতেছিল—কি করিবে সে?
কৃষাণ কিছুক্ষণ পরে আবার আসিয়া সাঁড়াইল।
–আর একটা কথা বলছিলাম যে মুনিবমশায়!
–কি, বল?
—পাড়ার লোকে সবাই আসবে আপনার কাছে। তা আমাকে বলেছে, তু বলে রাখিস পণ্ডিতমশায়কে।
—কি, ব্যাপার কি?
–আজ্ঞে চণ্ডীমণ্ডপে আটচালা ছাওয়াতে আমরা বেগার দি। তা এবার ডাক্তারবাবু, ঘোষাল—সব কমিটি করেছেন, ওঁরা বলছেন-পয়সা নিবি তোরা। বেগার ক্যানে দিবি? চণ্ডীমণ্ডপ জমিদারের, জমিদারকে খরচ দিতে হবে।
দেবু চুপ করিয়া রহিল। আপনার গৃহকর্মে মন দিয়া দড়ি পাকাইতে বসি সে ভবিষ্যতের কথা ভাবিতেছিল—ভাবিতেছিল একটা দোকান করিবে সে; এবং তার সঙ্গে ভাল করিয়া চাষ। প্রয়োজনমত সে নিজে লাঙল ধরিবে। এখন কিছু না করিলে সংসার চলিবে কিসে?
কৃষাণটা আবার বলিল-আমরা তাই ভাবছি। ডাক্তারবাবু কথাটি মন্দ বলেন নাই। চণ্ডীমণ্ডপে জমিদারের কাছারি হয়, ভদ্দনোকের মজলিস হয়, তোদর সঙ্গে চণ্ডীমণ্ডপের লেপচ (সংস্রব) কি? বিনি পয়সায় ক্যানে খাটবি? আবার ওদিকে ঘোষমশায় লোক পাঠাচ্ছেন-কবে ব্যাগার দিবি? ঘোষমশায় গাঁয়ের মাথার নোক; আবার গোমস্তা হয়েছেন। ওঁর কথাই বা ঠেলি কি করে? তার ওপর গ্রাম-দেবতাও বটে। তাই সব বলছে পণ্ডিতমশায়ের কাছে যাব। উনি যেমনটি বলবেন, তেমনটি শিরোধাব্য আমাদের!
দেবুর মন-প্ৰাণ ঠিক গতকল্যকার মত হাঁপাইয়া উঠিল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া কৃষাণটি ডাকিল—মুনিবমশায়?
—আমি এখন কিছু বলতে পারলাম না, নোটন।
–আপনি যা বলবেন আমরা তাই করব। সে আমাদের ঠিক হয়ে রইচে।
সে উঠিয়া গেল। দেবুর হাতের শণ-চেঁড়া নিশ্চল হইয়া গিয়াছিল—সে সম্মুখের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল।
চণ্ডীমণ্ডপে লোকজনের সাড়া উঠিতেছে। সেখানে খাজনা আদায় চলিতেছে; সঙ্গে সঙ্গে খাতকদের কাছে শ্ৰীহরির পাওনার হিসাবও চলিতেছে। আখেরি কিস্তি, বৎসরের শেষ। তামাদি যাহাদের, তাহাদের ওপর নালিশ হইবে। শ্ৰীহরির ধানের পাওনা হিসাব করিয়া উসুল বাদে যাহা থাকিবে, আগামী বৎসরে তাহার জের চলিবে; যাহার উসুল নাই, তাহার আসল-সুদ এক হইয়া আগামী বৎসরের জন্যে আসল হইবে।
শ্ৰীহরির গোয়ালঘরগুলি ছাওয়ানো হইতেছে। চালের উপর ঘরামিরা কাজ করিতেছে। চাষীদের ঘর ছাওয়ানোর কাজ প্রায় শেষ হইয়া গিয়াছে। সকলে নিজেরাই বাড়ির কৃষাণ-রাখাল লইয়া ঘর ছাওয়াইয়া লয়। দেবুরও অবশ্য ছাওয়ানোর কাজ না-জানা নয়। কিন্তু পণ্ডিতি গ্রহণ করিয়া আর সে এ কাজ করে না, এবার করিতে হইবে। তাহার ঘর এখনও ছাওয়ানো হয় নাই। সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
–সালাম পণ্ডিতজী!
ইছু শেখ পাইকার আরও দুই-তিন জনের সঙ্গে পথ দিয়া যাইতেছিল, দেবুকে দেখিয়া সে সম্ভাষণ করিয়া দাঁড়াইল। সঙ্গে তাহার সঙ্গীরাও সম্ভাষণ করিল—সালাম।
—সেলাম। ভাল আছ ইছু-ভাই? তোমরা ভাল আছ সব?
–হ্যাঁ। আপনি শরিফ ছিলেন?
–হ্যাঁ।
–তা আপনাকে আমরা হাজারবার সালাম করেছি। হ্যাঁ–মরদের বাচ্চা মরদ বটে। মছজেদে আমাদের হামেশাই কথা হয় আপনকার। মনু মিঞা, খালেক সায়েব, গোলাম মেজ্জা আসবে একদিন আপনকার সাথে মোলাকাত করতে।
দেবু প্রসঙ্গটা পাল্টাইয়া দিল—কোথায় এসেছিলে?
—এই গাঁয়েই বটে। কিস্তির সময় ছাগল, গরু দু-চারটে বেচবে তো। তা ধরেন-এ। হল আমার কেনাবেচার গাও—তাই টাকাকড়ি নিয়ে এসেছিলাম। আর কেনা তো উঠেই গিয়েছে। কিন্নেওয়ালা হয়ে গেল। আপনার তো একটা বলদ বুড়ো হয়েছে পণ্ডিতমশাই, আপনি ল্যান ক্যানে একটা বলদ!
–এবার আর হয় না, ইছু-ভাই।
–আপনি ল্যান, বুড়ো বলদটা দ্যান আমাকে, বাকি যা থাকবে দিবেন আমাকে ইহার পরে। না হয় কিছু ধান ছেড়ে দান, ধানের পাইকার আমার সাথে।
দেবু হাসিল।—না ভাই, থাক।
–আচ্ছা, তবে থাক।
ইছুর দল সেলাম করিয়া চলিয়া গেল। পাকা ব্যবসাদার ইচু, মানুষের টাকার প্রয়োজনের সময় সে টাকা লইয়া উপস্থিত হইবেই। কাহার বাড়িতে কোন্ জন্তুটি মূল্যবান সে তাহার নখাগে। কিন্তু মনু মিঞা, খালেক সাহেব, গোলাম মির্জা তাহার সহিত দেখা করিতে আসিবে কেন? সে মনে মনে অস্বস্তি অনুভব করিল। ইহারা সম্ভ্ৰান্ত লোক, বড় চাষী, ব্যবসায়ী।
রাখাল-ছোঁড়া আসিয়া দেবুর শিশুটিকে নামাইয়া দিয়া বলিল—আপনি একবার ল্যান, মুনিবমশায়। আমাকে কিছুতেই ছাড়ছে না। গরু চরাইতে যাবে আমার সাথে।
ছোঁড়াটা হি-হি করিয়া হাসিতে হাসিতে খোকাকে বলিল—নেকাপড়া কর বাবার কাছে। গরু চরাতে যেতে নাই, ছি!
দেবু সাগ্রহে থোকাকে বুকে তুলিয়া লইল।
ছেলেটাও তেমনি, বিলু তাহাকে বেশ তালিম দিয়াছে, সে গম্ভীরমুখে আরম্ভ করিল—ক–ল কলো, ক–ল কলো!
***
—কি হচ্ছে পণ্ডিত?
বলিয়া এই সময় অনিরুদ্ধ আসিয়া বসিল। এখন সে প্রকৃতিস্থ। মুখে মদের সামান্য গন্ধ উঠিতেছে, কিন্তু মাতাল নয়। হাতে একটা লোহার টাঙ্গি।
হাসিয়া দেবু বলিল—চেতন হয়েছে, অনি-ভাই?
কোনো লজ্জা বোধ না করিয়া অনিরুদ্ধ হাসিয়া বলিল—কাল একটুকু বেশি হয়েছিল বটে।
দেবু বলিল—ছি, অনি-ভাই! ছি!
অনিরুদ্ধ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল; তারপর অকস্মাৎ খানিকটা হাসিয়া বলিল–ও তুমি জান না, দেবু-ভাই। রস তুমি পাও নাই-তুমি বুঝবে না।
তিরস্কার করিয়া দেবু বলিল—তোমার জমি নিলামে উঠেছে, কি নিলাম হয়েছে, ঘরে পরিবারের অসুখ, আর তুমি মদ খেয়ে বেড়াও পয়সা নষ্ট কর!
–পয়সা আর বেশি খরচ আমি করি না, এখন পচাই মদ খাই। এখন জমি নিলামের কথাই তোমাকে বলতে এসেছি। আর পরিবারের অসুখ তো, আমি কত ভুগব বল?
—তুমি তো এমন ছিলে না অনি-ভাই!
—কে জানে? মদ তো আমি বরাবরই একটু-আধটু খাই। আমি তো অন্যায় কিছু বুঝতে পারি না।
–বুঝতে পার না! পৈতৃক ব্যবসা তুলে দিলে। ছোটলোকের মত পচাই ধরেছ। যেখানে সেখানে খাও—শো!
–কি করব? আনি কামারের দা, ক্ষুর, গুপ্তি—কিনবে কে? কোদাল-কুড়ুল-ফাল—তাও এখন বাজারে মেলে—সস্তা। গাঁয়ে কাজ করলে শালারা ধান দেয় না। কি করব? আর পচাই! পয়সায় কুলোয় না–কি করব?
—কি করবে! তোমার বোধশক্তিও লোপ পেয়েছে, অনি-ভাই?
–কে জানে?
–দুর্গার ঘরে খাও অনি-ভাই? তার ঘরে তুমি রাত কাটাও?
–দুর্গার নাম কোরো না পণ্ডিত। নেমকহারাম, পাজি, শয়তানের একশেষ, আমাকে আর ঘরে ঢুকতে দেয় না।
অনিরুদ্ধের এই নির্লজ্জ স্বীকারোক্তিতে দেবু চুপ করিয়া রহিল।
অনিরুদ্ধ বলিয়া গেল—জান পণ্ডিত, দুর্গার জন্যে আমি জান দিতে পারতাম; এখনও পারি। দুর্গাই আমাকে নিজে থেকে ডেকেছিল। তখন আমার পরিবার পাগল। মিছে কথা বলব না, সে সময় দুর্গা আমার পরিবারের সেবা পর্যন্ত করেছে, টাকাও দিয়েছে। দারোগা ওর এক কালের আশনাইয়ের লোক—দারোগাকে বলে নজরবন্দির জন্যে আমার ঘরখানি ভাড়া করিয়ে দিয়েছে। মাসে দশ টাকা ভাড়া। কিন্তু ওর সব চোখের নেশা! যাকে যখন ভালবাসে। এখন ওই নজরবন্দির উপর নজর পড়েছে।
—ছি, অনিরুদ্ধ! ছি!
–যতীনবাবুর দোষ আমি দিই না। ভাল লোক, উঁচু ঘরের ছেলে। পদ্মকে মা বলে। আমি পরখ করে দেখেছি। যাক গে ও-কথা। মরুক গে দুর্গা। এখন যা বলতে এসেছি, শোন। বাকি খাজনার ডিক্রি জারি হয়ে গিয়েছে, জমি এইবার নিলামে চড়বে। ও ঝাঁট আমি রাখব না। এখন বিক্রি করে দিয়ে যা পাই! তোমাকে ভাই দেখেশুনে আমার জোতটি বেচে দিতে হবে।
–বেচে দেবে? দেবুর বিস্ময়ের আর অধিক রহিল না।
–হ্যাঁ।
–তারপর?–সে যা হয় করব। ছিরে গোমস্তাকে আমি খাজনা দেব না।
–পাগলামি কোরো না, অনি-ভাই।
–পাগলামি? তবে যাক, এমনি নকড়া-ছকড়ায় নিলেম হয়ে যাক। আমার দ্বারা কিছু হবে না।
–বাকি খাজনার টাকাটা যোগাড় কর হয় খাজনার পরিমাণ দামের মত জমি বেচে দাও, নয় ধার পাও তো দেখ।
অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া অনিরুদ্ধ বলিল দেবু-ভাই, বাপুতি সম্পত্তি ছেড়ে দেব। মনে করলে বুক ফেটে যায়। জান পণ্ডিত, ওই চার বিঘে বাকুড়ি, আগে ঠাকুরদাদার আমলে সাতখানা টুকরো টুকরো জমি ছিল। কেটেকুটে সাতখানাকে ঠাকুরদাদা করেছিল তিনখানা। বাবা তিনখানাকে কেটে করেছিল দুখানা। সাড়ে তিন বিঘা বাকুড়ি—আর দশ কাঠা ফালি। দুখানাকে কেটে আমি করেছি একখানা চার বিঘে বাকুড়ি।
টপ টপ করিয়া বড় বড় কয় ফোটা জল তাহার চোখ হইতে ঝরিয়া পড়িল।
দেবু তাহার পিঠে হাত বুলাইয়া বলিল—কেঁদো না, অনি-ভাই। তুমি সক্ষম বেটাছেলে, তুমি মন দিয়ে কাজ করলে তোমার কিছুর অভাব হতে পারে না।
বিচিত্ৰ হাসিয়া অনিরুদ্ধ বলিল-হাজার মন পাতিয়ে কাজ করলেও কামারের কাজ করে আর অভাব ঘুচবে না, পণ্ডিত। উপায় এককলে কাজ। তাই দেখব এবার। দুর্গা আমাকে বলেছিল একবার আমি গা করি নাই। কেশব কামারের ছেলে, হিতু কামারের নাতি আমি কলের কুলি হব? ওইসব কি-না-কি জাতের মিস্ত্রিদের তাঁবেদার হয়ে থাকব? জান দেবু, এমন দা আমি গড়তে পারি যে এক কোপে শেলেদা বাঘের গলা নেমে যাবে!
অনিরুদ্ধকে শান্ত করিবার জন্যই রহস্য করিয়া দেবু বলিল—সেই তো তোমার ভুল, অনিভাই। ও দা নিয়ে লোকে করবে কি বল? বাঘ কাটতে যাবে কে?
অনিরুদ্ধ এবার হাসিয়া ফেলিল।
দেবু বলিল—টাকা যদি ধার পাও তো দেখ, অনি-ভাই। জমি রাখতেই হবে। তারপর মন দিয়ে কাজকর্ম কর। কলে-কলেই কাজ কর আপাতত। ক্ষতি কি?
অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া অনিরুদ্ধ বলিল—তুমি বলছ! আবার একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল–তাই দেখি।
পথে বাহির হইয়া অনিরুদ্ধ বাড়ি গেল না। বাড়ি হার ভাল লাগে না। পদ্ম তাহাকে চায় না, সেও পদ্মকে চায় না। নিক্তির ওজনে চরিত্রবান সে কোনোদিনই নয়; কিন্তু পদ্মের প্রতি ভালবাসার অভাব তাহার কোনোদিন ছিল না। চরিত্রহীনতার ব্যভিচার ছিল তাহার খেয়াল পরিতৃপ্তির গোপন পন্থা; উন্মত্ত দেহলালসার দাহ নিবৃত্তির জন্য পঙ্কস্নান।
অকস্মাৎ কোথা হইতে জীবনে একটা দুর্যোগ আসিয়া সব বিপর্যস্ত করিয়া দিল। সেই দুর্যোগের মধ্যে দুর্গা আসিয়া দাঁড়াইল মোহিনীর বেশে; শুধু মোহিনীর রূপ লইয়াই নয়—অফুরন্ত ভালবাসাও দিয়াছিল দুর্গা। সেবা-যত্ব—এমনকি নিজের পার্থিব সম্পদও সে তখন অনিরুদ্ধের জন্য ঢালিয়া দিতে চাহিয়াছিল, কিছু দিয়াছেও।
তা ছাড়া দুর্গার সঙ্গ তাহাকে যে তৃপ্তি দিয়াছে, পদ্ম তাহার সুস্থ সবল যৌবন-পরিপূর্ণ দেহ লইয়াও সেরূপ তৃপ্তি দিতে পারে নাই। তাহার বুকে আছে এক বোঝ মাদুলি; চিরদিন সে তাহাতে বেদনা অনুভব করিয়াছে। আচার-বিচার-ব্ৰত-বার পালনের আগ্রহে, শুচিতা-বোধের উগ্রতায় পদ্ম তাহাকে অস্পৃশ্যের মত দূরে ঠেলিয়া রাখিয়াছে। তাহার ভালবাসায় যত্নের আধিক্য, মমতার আতিশয্য অনিরুদ্ধকে পীড়া দিয়াছে। সঙ্কোচশূন্য অধীরতায় দুর্গার মত বুকে ঝাঁপ দিয়া পড়িতে সে কোনোদিনই পারে নাই। সমস্ত দিন আগুনের কুণ্ড জ্বালিয়া তাহারই সম্মুখে বসিয়া সর্বাঙ্গ ঝলসাইয়া, সে বাড়ি ফিরিয়া একটু করিয়া মদ খাইত। কিন্তু ওই দেহ-মন লইয়া পদ্মের সমুখে দাঁড়াইলেই তাহার নেশার আগ্রহ সব যেন হিম হইয়া যাইত।
দুর্গার মধ্যে আগুন ও জলদুই-ই আছে, একাধারে জ্বলিবার ও জুড়াইবার উপাদান। তাহার যৌবনে আছে আবেগময়ী মানবীয় ঈষদুষ্ণ স্বাদ;—তাহা অনিরুদ্ধকে উন্মত্ত করিয়া তুলিয়াছে। তাহার ভালবাসায় আছে সর্বস্ব ঢালিয়া দিবার আকুতি। কামারশালা অচল হইলে, কর্মহীন অনিরুদ্ধ বিশ্বগ্ৰাসী অবসাদ হইতে বাঁচিবার জন্য সস্তা মদ ধরিবার সময়টিতেই দুর্গা আক্রোশবশে ছিকে ছাড়িয়া তাহাকে সাগ্রহে জড়াইয়া ধরিয়াছিল। সেই চরম আত্মসমর্পণের মধ্যে দুর্গার নিকট সেও আপনাকে বিলাইয়া দিয়াছিল। কিন্তু দুর্গা সহসা একদিন তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া সরিয়া দাঁড়াইয়াছেনূতনের মোহে। দুর্গা তুষানল ও মরীচিকা দুই-ই। সে। পাষাণী, বিশ্বাসঘাতিনী, মায়াবিনী!
হঠাৎ সে চমকিয়া উঠিল। এ কি! এ যে অন্যমনস্কভাবে চলিতে চলিতে একেবারে বায়েনপাড়াতেই দুর্গার ঘরের সামনে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। দুর্গা উঠানে দুধ মাপিতেছে, রোজের দুধ দিতে যাইবে।
সে ফিরিল তাড়াতাড়ি। পাড়াটা পার হইয়া সে মাঠের ধারে আসিয়া দাঁড়াইল। দুর্গা তাহাকে পরিত্যাগ করিয়াছে, সেই-বা দুর্গার পিছনে ঘুরিবে কেন? সে-ও পরিত্যাগ করিবে। দেবু তাহাকে ঠিক কথাই বলিয়াছে। এখন সে বুঝিতে পারিতেছে—তাহার কত পরিবর্তন হইয়াছে! ছি ছি! কেশব কর্মকারের ছেলে—হিতু কর্মকারের নাতি—সে মুচির মেয়ের ঘরে পড়িয়া থাকে তাহার উচ্ছিষ্ট দেহখানার লোভে তাহার দুই-চারটি টাকা-পয়সার প্রত্যাশায়, ছি! সে না সক্ষম বেটাছেলে—একজন নামকরা লোহার কারিগর!
পরক্ষণেই সে হাসিল। লোহার কারিগরের আর মান নাই—নাম নাই। চার আনার বিলাতি চাকু-ছুরিতেই নামের গলা দু ফাঁক হইয়া গিয়াছে। সে এক দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। যাকনাম যাকমানও যাক, জানটাই থাকুক, চালকলে তেলকলে নাটবন্টু কষিয়া, হাতুড়ি চুকিয়া মিস্ত্রি হইয়াই বাঁচিয়া থাকিবে সে। জোটাকেও বাঁচাইতে হইবে। ঠাকুরদাদার মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া নিজের হাতে কাটা জমি, বাবার কাটা জমি, তাহার নিজের হাতে কাটা ওই বাকুড়ি তাহার সোনার বাকুড়ি-লক্ষ্মী-জোল, তাহার মা অন্নপূর্ণা!
আপন হইতেই তাহার দৃষ্টি সম্মুখের শস্যশূন্য মাঠের উপর দিয়া প্রসারিত হইয়া নিবন্ধ হইল চার বিঘার বাকুড়ির উপর। সে চলিতে আরম্ভ করিল; আসিয়া বাকুড়ির আইলের উপর বসিল। আইলের মাথায় একটা কয়েতবেলের গাছ। গাছটা লাগাইয়াছিল তাহার পিতামহ। বাল্যকালে তাহার বাপ চাষ করিত—সে আসিত বাপের ও কৃষাণের খাবার লইয়া, আসিয়া ওই। গাছতলায় বসিত। জ্বর-জ্বালার পর কতদিন এখানে আসিয়া নুন দিয়া কয়েতবেল খাইয়াছে। লক্ষ্মীপুজোতে পর্বে-পার্বণে এই ধানের চালে হইয়াছে অন্ন, ওই কয়েতবেল গুড়-নুন দিয়া মাখিয়া হইয়াছে চাটনি।
অনেকক্ষণ বসিয়া থাকিয়া অনিরুদ্ধ সংকল্প লইয়া উঠিল—এ জোত তাহাকে রাখিতেই হইবে!
সে চলিল আকুলিয়া গ্রামের কাবুলী চৌধুরীর কাছে। ফ্যালারাম চৌধুরী, কঙ্কণা ইস্কুলের মাস্টার, তাহার সুদি কারবার আছে। খুব চড়া সুদ ও ভয়ঙ্কর তাগাদার জন্যে অনেক লোকে বলে কাবুলী। অনেকে বলে অজগর—তাহার গ্রাসে পড়িলে নাকি আর বাহির হওয়া যায় না। অনেকে বলে খুনে। একবার একটা চোর ধরিয়া চৌধুরী চোরটাকে খুন করিয়া ফেলিয়াছিল।
চৌধুরীর জমির ক্ষুধা বড় প্রবল। ভাল সম্পত্তি হইলে চৌধুরী টাকা দিবেই। সে আকুলিয়া গ্রামের পথই ধরিল।
চৌধুরী লেখাপড়া জানা লোক, বি-এ পাস, এদিকে আবার সংস্কৃতেও কি একটা পরীক্ষা দিয়াছে, ইস্কুলে সে হেডপণ্ডিত। কিন্তু আসলে সে একজন প্রথম শ্রেণীর আঙ্কিক। সুদ কষিতে তাহার কাগজ-কলম দরকার হয় না। চক্রবৃদ্ধিহারে দশ-বিশ বৎসরের সুদ মুখে মুখে হিসাব করিয়া দেয়। তবে সুদকে আসলে পরিণত করিয়া সেটা উসুলের হিসাব আলোচনার সময় দুইচারিটা সংস্কৃত শ্লোক আওড়াইয়া অঙ্কগুলাকে রসারিত অথবা পারমার্থিক তত্ত্বমণ্ডিত করিয়া দেয়।
অনিরুদ্ধ বলিল-আমি ঠিক সময়ের মধ্যে টাকা শোধ করব, চৌধুরীমশাই আমি ফাঁকিবাজ নই। আর পালিয়ে বেড়িয়ে দেখা করব না, সে স্বভাবও আমার নয়।
চৌধুরী হাসিলফাঁকি দেবার উপায় নাই, বাবা। আর পালিয়েই বা যাবি কোথায়? বলিয়া সে একটা শ্লোক আওড়াইয়া দিল—গিরেী কলাপী গমনে চ মেঘো, লক্ষান্তরেহর্ক সলিলে চ পদ্মম্। বুঝলি অনিরুদ্ধ, মেঘ থাকে আকাশে আর ময়ূর থাকে পাহাড়ে, দূর অনেক। কিন্তু মেঘ। উঠলেই ময়ূরকে বেরিয়ে এসে পেখম মেলতেই হবে। আর সূর্যি থাকে আকাশে, জলে পদ্মের কুঁড়ি। কিন্তু সূর্যি উঠিলেই পদ্মকে বাপ বাপ বলে পাপড়ি খুলতেই হবে। খাতক-মহাজন সম্বন্ধ হলে যেখানে থাকিস না কেন, হাজির তোকে হতেই হবে পালাবি কোথা!
অনিরুদ্ধ কথাগুলো ভাল করিয়া বুঝিল না, পাত মেলিয়া শুধু নিঃশব্দে হাসিল। কথাগুলোয় রসের গন্ধ আছে।
চৌধুরী মুখে মুখেই হিসাব করিল—বিঘেতে চল্লিশ টাকা দিলে, তিন বছরে চল্লিশ তো ষাটে গিয়ে দাঁড়াবে। এতে নালিশের খরচা চাপলে মহাজনের থাকবে কি ব? তার ওপর খাতক আবার যদি বাকি খাজনা ফেলে যায়, তবে তো আমাকে রঘু রাজার মত ভাড়ে জল খেতে হবে।
অনিরুদ্ধ তাহার পায়ে ধরিয়া বলিল-আজ্ঞে, আমি আপনার পা ছুঁয়ে বলছি, এক বছরের মধ্যেই সব টাকা শোধ করব আমি।
পা টানিয়া লইয়া চৌধুরী বলিলপায়ে ধরিস না অনিরুদ্ধ, পায়ের ফাটে হাত-মুখ ছিঁড়ে যাবে তোর। ছাড়।
মিথ্যা বলে নাই, চৌধুরীর কালো কর্কশ চামড়ায়, কোনো ব্যাধির জন্যই হউক বা শরীরে কোনো উপাদানের অভাবহেতুই হউক, বার মাস ফাট ধরিয়া থাকে। শীতকালে সাদা ফাটগুলো রক্তাভ হইয়া ওঠে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, চৌধুরীর পায়ের তলাকার ফাট, শুষ্ক কঠিন চামড়া, ছুরির মত ধারালো।
পাটা ছাড়াইয়া লইয়া চৌধুরী তারপর সান্ত্বনা দিয়া বুলিল—এক বছরেই যখন শোধ করবি, তখন ছবিঘে কেন দশ বিঘে বন্ধক দিতেই বা আপত্তি কিসের তোর? কাগজে লেখা থাকবে বৈ তো নয়?
অনিরুদ্ধ চুপ করিয়া রহিল; সে ভাবিতেছিল দেহের গতিকের কথা, দেবতার গতিকের অর্থাৎ বৃষ্টি-অনাবৃষ্টির কথা।
–কিছু ভয় করিস না।
চৌধুরী তার মনের ভাব ধরিয়া ফেলিয়া বলিল—এক বছরেই শোধ করিস আর পাঁচ বছরে করিসতোকে মরতে আমি দেব না। সুদ আমি বাকি রাখি না, রাখবও না। বাকি থাকলে আসলই থাকবে; তাতে বেইমানি করি, তা হলে ব্রাহ্মণের গণ্ডুষ। চৌধুরী হাসিতে লাগিল।
অনিরুদ্ধ বলিল—সুদ আপনি মাসে মাসে পাবেন।
–ঠিক তো?
–তিন সত্য করছি আপনার চরণ ছুঁয়ে।
–তবে দিনতিনেক পরে আসি। আমি সব খোঁজখবর করে দেখি।
–খোঁজ করবেন? কি খোঁজ করবেন?
–আর কোথাও বন্ধক-টক দিয়েছিস কি না।
–আপনার চরণ ছুঁয়ে বলছি
চৌধুরী বলিল—এইবার চরণ দুটিকে আমাকে সিকেয় তুলতে হবে বাবা। তাতে তোরই। খারাপ হবে। রেজেষ্ট্রি অফিসে যাওয়া হবে না, তুইও টাকা পাবি না। খোঁজ না করে আমি টাকা কাউকে দিই না, দোবও না।
অনিরুদ্ধ তবু উঠিল না। শ্ৰান্ত ক্লান্ত দেশান্তরী উদাসীনের অকস্মাৎ প্রিয়জনকে মনে পড়িয়া যেমন বাড়ি ফিরিবার জন্য ব্যাকুল আগ্ৰহ জাগে, অনিরুদ্ধের আজ তেমনি ব্যাকুল আগ্রহ জাগিয়া উঠিয়াছে আবার সেই পূর্বের সংযত সচ্ছল জীবনে ফিরিবার জন্য। সেই ফিরিবার পথের পাথেয় চাই তাহার। চার বছরের বাকি খাজনা সালিয়ানা পঁচিশ টাকা দশ আনা হিসাবে একশত আড়াই টাকা; সিকি সুদ পঁচিশ টাকা দশ আনা—একুনে একশো আটাশ টাকা দু আনা, খরচা লইয়া একশো চল্লিশ কি পঁয়তাল্লিশ, দেড়শো টাকাই ধরিয়া রাখা ভাল। আরও একশো চাই। সে বলদ এক জোড়া কিনিবে। জমি ভাগে না দিয়া, একটি কৃষাণ রাখিয়া সে বাপঠাকুরদার মতই ঘরে চাষ করিবে। তাহার নিজের জমি তের বিঘা। তাহার সঙ্গে অন্য কাহারও বিঘাপাঁচেক জমি সে ভাগে লইতেও পারিবে। সঙ্গে সঙ্গে জংশন শহরের ধানকলে বা তেলকলে একটা চাকরিও লইবে। রাজি থাকিতে সে উঠিবে, গরু দুটাকে আপন হাতে খাইতে দিবে। কৃষাণ হাল লইয়া যাইবে, সেইসঙ্গে সে-ও বাহির হইবে একেবারে সারাদিনের মত সাজিয়া গুছাইয়া। জমিগুলি দেখিয়া-শুনিয়া ওই পথেই চলিয়া যাইবে সে জংশনে কলের কাজে। ফিরিবার পথে আবার একবার মাঠ ঘুরিয়া বাড়ি আসিবে। মদ খাইতে হয়—একটু না খাইলে সে বাঁচিবে না—বোতল কিনিয়া আনিয়া বাড়িতে রাখিবে, পদ্ম মাপিয়া ঢালিয়া দিবে–ব্যস! কলের মাইনে দৈনিক আট আনা হিসাবে চারিটা রবিবার বাদ দিয়া তের টাকা—বৎসরে একশো ছাপ্পান্ন টাকা নগদ আয়। ধান, কলাই, গুড়, গম, যব, তিসি, সরিষা হইবে চাষে। নজরবন্দির বাড়িভাড়া আছে মাসিক দশ টাকা। ওটা অবশ্য স্থায়ী আয় নয়। এ ছাড়াও সে বাড়িতে আবার কামারশালা খুলিবে। রাত্রে যাহা পারে, যতটুকু পারে করিবে; দৈনিক দু গণ্ডা পয়সা রোজগার হইলেও তাহাতেই তাহার দৈনিক নুন-তেলের খরচা তো চলিয়া যাইবে। ঋণ শোধ দিতে তাহার কয় দিন! ঋণ শোধ দিয়া সে আরম্ভ করিবে সঞ্চয়; সঞ্চয় হইতে সুদি কারবার। খৎ-তমসুকে নয়, জিনিস-বন্ধকী কারবার। ঘাটতি নাই পড়তি নাই, বৎসরে একটি টাকা দুটাকায় পরিণত হইবে। ইহার ওপর তাহার বাকুড়ির আরো আধ হাত মাটি তুলিয়া সে যদি গর্ত করিতে পারে—তবে বাকুড়িতে হাজাশুকা থাকিবে না। মাটি তুলিয়া গাড়ি-গাড়ি সার এবং মরা পুকুরের পাক ঢালিয়া দিবে। উনো ফসল দুনো হইবে।
চৌধুরী বলিল–বসে থাকলে তো টাকা মিলবে না, অনিরুদ্ধ। আমি খোঁজখবর করি, তারপর এদিকে বেলাও যে দশটা হল। আমার আবার ইস্কুল আছে।
অনিরুদ্ধ বলিল, আজই চলুন কঙ্কণা, রেজেস্টারি আপিসে খোঁজ করুন।
হাসিয়া চৌধুরী বলিল-আজই? তোর অশ্বতর যে পক্ষীরাজের চেয়েও জিন্দে দেখছি, থামতে চায় না। বেশ বস্তুই। আমি চান করে দুটো খেয়ে নি। চল্ আমার সঙ্গে। টিফিনের সময় খোঁজ করব।
টিফিনেও খোঁজ শেষ হইল না। চৌধুরী বলিল—আবার সেই শেষ ঘণ্টা, তিনটে দশের পর আবার অবসর। তুই তা হলে বস।
শেষ ঘণ্টায় হেডপণ্ডিত চৌধুরীর ধর্ম-সম্বন্ধীয় বক্তৃতার ক্লাস। এ ক্লাসটার সময় চৌধুরী প্রায়ই ছেলেদের স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার অবকাশ দিয়া রেজিস্ট্রি অফিসের কাজগুলি সারিয়া থাকে। দলিলদস্তাবেজ বাহির করে, কে কোথায় কি নিল, কি বেচিল, কে কি বন্ধক দিল ইত্যাদি সংবাদগুলি সংগ্রহ করিয়া রাখে।
অনিরুদ্ধ সেই অপেক্ষা করিয়া রহিল। সমস্ত দিন খাওয়া হয় নাই। সে খানকয়েক বাতাসা কি দুই টুকরা পাটালির প্রত্যাশায় পরাণ ময়রার দোকানে বসিয়া পরাণের তোষামোদ করিতে আরম্ভ করিল। পাটালি-বাতাসা মিলিল না, কিন্তু ক্ষুধাতৃষ্ণা সে ভুলিয়া গেল; পরাণের বিধবা ভাগ্নী দোকান করে, তাহার সঙ্গে বেশ আলাপ জমাইয়া ফেলিল। একটা হইতে তিনটা দুই ঘণ্টা সময় যেন মেয়েটার হাসির ছুঁয়ে উড়িয়া গেল!
চৌধুরী আসিয়া বলিল—দেখা আমার হয়ে গেল অনিরুদ্ধ, বুঝলি?
হয়ে গেল আজ্ঞে।
হ্যাঁ। তোকে আর ডাকি নাই। দেখলাম গল্পেতে খুব জমে গিয়েছিস, রসভঙ্গ করা পাপ, শাস্ত্রনিষিদ্ধ। বলিয়া চৌধুরী হাসিল।
অনিরুদ্ধ একটু লজ্জিত হইল।
–টাকা আমি দোব।
–দেবেন! উৎসাহে অনিরুদ্ধ উঠিয়া দাঁড়াইল।
–হ্যাঁ। কিন্তু তোর তো আজ সারাদিন খাওয়া হল না রে!
–তা এই বাড়ি গিয়ে এই তো কোশখানেক পথ আজ্ঞে।
আনন্দের আবেগে অনিরুদ্ধ কোনো কথাই শেষ করিতে পারিল না।
–আচ্ছা, পরশু আসি। তা হলে শিগগির বাড়ি যা। মেঘ উঠেছে। ঝড়-জল হবে মনে। হচ্ছে। চৌধুরী চলিয়া গেল।
মেয়েটি বলিল—তুমি খাও নাই এখনও?
—তা হোক। এই কতক্ষণ! বো বে করে চলে যাব।
–এই বাতাসা কখানা ভিজিয়ে জল খাও। খাও নাই—বলতে হয়!
বাতাসা ভিজাইয়া জল খাইয়া অনিরুদ্ধ যেন বাঁচিল। টাঙিটা হাতে করিয়া সে পথে নামিয়া হনহন করিয়া বাড়ি চলিল। কিন্তু কঙ্কণার প্রান্তে আসিয়া পৌঁছিতে-না-পৌঁছিতে ঝড় উঠিয়া পড়িল। পৌষের পর হইতে বৃষ্টি হয় নাই। চারিদিক রুক্ষ হইয়া উঠিয়াছিল। চৈত্র মাসের মাঝামাঝিতেই যেন বৈশাখের চেহারা দেখা দিয়াছে। অকালেই উঠিয়া পড়িয়াছে কালবৈশাখীর ঝড়। দেখিতে দেখিতে চারিদিক অন্ধকার হইয়া গেল; দুর্দান্ত ঝড়ের তাড়নায় পৃথিবী হইতে আকাশ পর্যন্ত পিঙ্গল ধুলায় ধূসর হইয়া উঠিল, তাহার ওপর ঘনাইয়া আসিল—দ্রুত আবর্তনে আবর্তিত পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের ঘন ছায়া দুয়ে মিলিয়া সে এক বিচিত্র পিঙ্গলাভ অন্ধকার। গো গোঁ শব্দ করিয়া ঝড়ের সে কি দুৰ্দান্তপনা!
অনিরুদ্ধ আশ্ৰয় লইল একটা গাছতলায়। শিলাবৃষ্টি বজ্ৰপাতও হইতে পারে। কিন্তু উপায় কি? আবার কে এখন এই দুর্যোগে গ্রামের মধ্যে ছুটিয়া যায়। আর মরণ তো একবার!
শোঁ শোঁ শব্দে প্রবল ঝড়। ঝড়ে চালের খড় উড়িতেছে, গাছের ডাল ভাঙিতেছে। বিকট শব্দে ওই কার টিনের ঘরের চাল উড়িয়া গেল। কিছুক্ষণ পরেই নামিল ঝনঝম করিয়া বৃষ্টি, দেখিতে দেখিতে চারিদিক আচ্ছন্ন করিয়া মুষলধারে বর্ষণ। আঃ, পৃথিবী যেন বাঁচিল! ঠাণ্ডা ঝড়ো হাওয়ায় ভিজা মাটির সোঁদা সোঁদা গন্ধ উঠিতে লাগিল।
বৈশাখের আগে এ অকালবৈশাখী ভাল নয়। চৈতে মথর মথর, বৈশাখে ঝড় পাথর, জ্যৈষ্ঠে মাটি ফাটে, তবে জেনো বর্ষা বটে! ভাগ্য ভাল, শিল পড়িল না। তবে একটা উপকার হইল, জমিতে চাষ চলিবে। এ সময়ে একটা চাষ পাঁচ গাড়ি সারের সমান। কাটা ধানের গোড়াগুলি উল্টাইয়া দিবে, সেগুলি মাটির ভিতর পচিতে পাইবে। রোদে বাতাসে মাটি ফোঁপরা নরম হইবে। হাতে তুলিয়া ধরিলেই এলাইয়া পড়িবে আদরিণী মেয়ের মত।
***
ঝড়-জল থামিতে সন্ধ্যা ঘুরিয়া গেল। অন্ধকার রাত্রি, ক্রোশখানেক দীর্ঘ মেঠো পথ, মাঠে কাদা হইয়া উঠিয়াছে, গর্তে জল জমিয়াছ। জায়গায় জায়গায় জলের স্রোতে ভাসিয়া আসিয়া স্থূপীকৃত হইয়া উঠিয়া জমিয়াছে খড়কুটা-পাতা—নানা আবর্জনা। চারিদিকে ব্যাঙগুলা জলের সাড়ায় ও স্বাদে মুখর হইয়া উঠিয়াছে। মধ্যে মধ্যে বিষধর সরীপূপের সাড়া পাওয়া যাইতেছে–সুদীর্ঘ দেহ লইয়া সরসর শব্দে চলিয়া যাইতেছে। কিন্তু অনিরুদ্ধের কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ নাই। টাঙ্গিটা হাতে করিয়া সে নিৰ্ভয়ে চলিতে চলিতে গান ধরিল। সাপ! সাপের প্রাণের ভয় নাই? উচ্চকণ্ঠে গান শুধু তাহার আনন্দের অভিব্যক্তি নয়, সরীসৃপদের প্রতি সরিয়া যাইবার নোটিশ। সে নোটিশ সত্ত্বেও যদি কাহারও দুর্নতি হয়—মাথা তুলিয়া গর্জন করে, তবে তাহার হাতে আছে এই টাঙ্গি। সাপ—সে হাসিল। যেবার সে দুইখানা জমি কাটিয়া একখানা বাকুড়িতে পরিণত করে, সেবারে একটা পুরনো পগার কাটিবার সময় কালকেউটে মারিয়াছিল বারটা। তাহার মধ্যে পাঁচটা ছিল চার হাত করিয়া লম্বা। সাপ কি অপর জানোয়ারকে সে ভয় করে না। ভয় তাহার মানুষকে। ছিকুকে আগে গ্রাহ্য করিত না, কিন্তু শ্রীহরি এখন আসল কালকেউটে! চৌধুরীও ভীষণ জীব!
ঝড়ে গ্রামটা তছনছ করিয়া দিয়াছে।
গাছের ডাল ভাঙিয়াছে, পাতায় খড়ে পথেঘাটে আর চলা যায় না। চণ্ডীমণ্ডপের ষষ্ঠীতলায়। বকুলগাছটার বড় ডালটাই ভাঙিয়া পড়িয়াছে। চালের খড় সকলেরই কিছু না কিছু উড়িয়াছে। হরেন্দ্র ঘোষাল একখানা ঘর করিয়াছিল গম্বুজের মত, উঁচুতে প্রায় মাঝারি তালগাছের সমান। সেইখানার চালটাকে একেবারে উপড়াইয়া হরিশ মোড়লের পুকুরের জলে ফেলিয়া দিয়াছে। বায়েনপাড়া, বাউরিপাড়ার দুর্দশার একশেষ হইয়াছে। তালপাতা এবং খড়ে ছাওয়ানো ঘরগুলির আচ্ছাদন বলিতে কিছু রাখে নাই। তাহার ওপর বর্ষণে দেওয়াল গলিয়া মেঝে ভিজিয়া কাদা সপ-সপ করিতেছে।
যাক, দেবু-ভায়ের কিছু যায় নাই। আহা, বড় ভাল লোক দেবু-ভাই। জগনের ডাক্তারখানার কেবল বারান্দার চালটা আধখানা উল্টাইয়া গিয়াছে। আশ্চর্য, শ্রীহরি বেটার কোনো ক্ষতি হয় নাই। টিনের ঘরে বেটা লোহার দড়ির টানা দিয়াছে। এই রাত্রেই রাঙাদিদি ঘরের খড়কুটা পরিষ্কার করিতে করিতে দেবতাকে গাল পাড়িতেছে।
আপনার বাড়ির সম্মুখে আসিয়া অনিরুদ্ধ দাঁড়াইল।
দাওয়ায় বসিয়া ছিল যতীন। সে বই পড়তেছিল, প্ৰশ্ন করিল–কে?
–আজ্ঞে, আমি। অনিরুদ্ধ।
–কোথায় ছিলেন সমস্ত দিন?
–কাজে গিয়েছিলাম বাবু।
কথাটা বলিয়া অনিরুদ্ধ অন্ধকারের মধ্যেও তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চালের দিকে চাহিয়া দেখিল।
যতীন একটু আশ্চর্য হইয়া গেল—অনিরুদ্ধ আজ সুস্থ কথাবার্তা বলিতেছে। এ অবস্থাটা যেন অনিরুদ্ধের পক্ষে অস্বাভাবিক। সে আবার প্রশ্ন করিল—শরীর ভাল আছে তো? কি দেখছেন?
দেখছি চালের অবস্থা। নাঃ, ওড়ে নাই কিছু। কেবল কোঠাঘরের পশ্চিমদিকের চালের খড়গুলা আতঙ্কিত সজারুর কাঁটার মত উপরের দিকে ঠেলিয়া উঠিয়াছে।
—আসছি বাবু। অনেক কথা আছে।
সে বাড়ির ভিতরে চলিয়া গেল। কিছু খাইতে হইবে। পেট হু-হু করিয়া জ্বলিতেছে।
পদ্ম বাড়ির উঠান হইতে পথঘাট পর্যন্ত সব ইহারই মধ্যে পরিষ্কার করিয়া ফেলিয়াছে। ওই যে ওপাশের দাওয়ায় বসিয়া রহিয়াছে, ওটা কে? একটা ছেলে! কে? ও-বাউণ্ডুলে তারিণীর সেই ছেলেটা! জংশনে ভিক্ষা করিতে করিতে এখানে আসিয়া জুটিল কি করিয়া? পদ্মের কাছে আসিয়া বলিল-ওটা কোথা থেকে এল?
অনিরুদ্ধকে সুস্থ দেখিয়া পদ্মও অবাক হইয়া গেল। অনিরুদ্ধ এবারে ছেলেটাকে বলিল–এখানে কোথা থেকে এসে জুটলি?
হাসিয়া পদ্ম বলিল নজরবন্দি নিয়ে এসেছে আজ জংশন থেকে, বাবুর চাকর হবে।
–হুঁ, যত মড়া গাঙের-ঘাটের জড়ো! দে, এখন খেতে দে দেখি। ঘরে কি আছে?
শুনিবামাত্র পদ্ম সঙ্গে সঙ্গেই উঠিল। যাইতে যাইতে বলিল-জংশন ইস্টিশানে কার কি চুরি করেছিল, লোকে ধরে মারছিল নজরবন্দি ছেলে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে।
অনিরুদ্ধ বিরক্ত হইয়া উঠিল। কোদিন আবার তাহার বাড়ির কিছু কিংবা ওই নজরবন্দির কিছু চুরি করিয়া না পালায় ছেলেটা। সে রূঢ়স্বরে বলিল—এই ছেড়া, কোথায় চুরি করেছিলি? কি চুরি করেছিলি?
ছোঁড়া ভীত অথচ ক্রুদ্ধ জানোয়ারের মত মাথা হেঁট করিয়া আড়চোখে তাহার দিকে চাহিয়া রহিল, কোনো উত্তর দিল না।
পদ্ম বলিল—কি ধারার মানুষ গো তুমি? নিয়ে এসেছে অন্য একজনা, তোমার বাড়িতে তো আসে নাই ও। তুমি বকছ কেনে বল তো? তা ছাড়া ছেলেমানুষ, অনাথ,ওর দোষ কি? যা রে বাবা, তুই উঠে তোর মুনিবের ওই দিকে যা।
ছোঁড়াটা কিন্তু তেমনি ভঙ্গিতে সেইখানে বসিয়াই রহিল, নড়িল না।