1 of 2

২০. প্রায় হাজারখানেক নারী-পুরুষ

প্রায় হাজারখানেক নারী-পুরুষ বড় রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে পড়ে বাস থামালো। এমন ভাবে থামাবার দরকার ছিল না, এখানে এমনিই বাস স্টপ আছে, তবু সবাই বাসটাকে ঘিরে লাফিয়ে লাফিয়ে চিৎকার করতে লাগলো, জয় বাবা কালাচাঁদ! জয় বাবা কালাচাঁদ! অন্যান্য বাসযাত্রীরা হারীত মণ্ডলকে দেখে ভাবলো, তার নামই বুঝি কালাচাঁদ!

হারতের মুখে এখন ঘন চাপ দাড়ি। মাথার চুল, এখন কিছুটা পাতলা হয়ে গেলেও সে কাটে না কখনো, কাঁধ ছাড়িয়ে নেমেছে। পরনে একটি গেরুয়া রঙে ছোপানো লুঙ্গি ও ফতুয়া, হাতে একটি তেল চুকচুকে লম্বা বাঁশের লাঠি। কলোনির দুঃখী মানুষেরা প্রত্যেক পরিবার থেকে আট আনা করে চাঁদা তুলেছে হারীতের জন্য, তার গলায় পরিয়েছে তিনখানা মোটা মোটা গাঁদা ফুলের মালা, তাদের নেতাকে তারা পাঠাচ্ছে মুক্তির সন্ধানে।

হারীত সঙ্গে নিতে চেয়েছিল শুধু যোগানন্দকে, একজন কেউ সঙ্গে থাকা ভালো, সে নেতা হলেও ফিরে এসে তার লোকজনকে যে-সব খবরাখবর শোনাবে, তার একজন সাক্ষী থাকা দরকার। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জোরজার করে বাসে উঠে পড়লো গোলাপীর ছেলে নবা, সে কিছুতেই হারীতকে ছেড়ে থাকবে না। বাস ছাড়তে দেরি হয়ে গেল সেইজন্য। নবার যাওয়া ব্যাপারে জনমত দ্বিধা বিভক্ত, কিন্তু সকলেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে কথা বলছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। গোলাপী বাসে উঠে এসে টানাটানি করতে লাগলো নবাকে, সে দু’হাতে হারীতের হাঁটু ধরে আছে শক্ত করে। শেষপর্যন্ত হারীত বললো, আচ্ছা, থাক, ও আমার সাথে যাক, তোরা চিন্তা করিস না!

বাসুদেব একটু দূরে একটা জানলার ধারে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে। গোলাপীর দিকে একবারও তাকাবার পর্যন্ত সাহস নেই তার। বুকের মধ্যে ট্রেনের ইঞ্জিনের মতন আওয়াজ হচ্ছে। এখনও সে বিশ্বাস করতে পারছে না হারীত মণ্ডলকে। হয়তো এই কলোনি থেকে অনেকটা দূরে চলে গিয়ে হারীত আর যোগানন্দ তার হাত-পা ভেঙে দেবে!

বাসে যেতে হবে রায়পুর, সেখান থেকে ট্রেন।

হারীর গলা থেকে মালাগুলো খুলে ফেললো। এমন অসহ্য গরম যে গায়ে কিছু রাখতে ইচ্ছে করে না। বাসে ভিড় বেশী নেই, হারীত নবাকে ভালো করে পাশে বসালো। টাকাকড়ি যা উঠেছে, তা সে দিয়েছে যোগানন্দের কাছে। নোট নেই, খুচরো পয়সার একটা তোড়া।

কন্ডাকটর সামনে আসতেই হারী যোগানন্দকে বললো, টিকিট কাট।

কন্ডাকটর বিগলিত মুখে বললো, নেহি সাধুবাবা, আপনোগকো টিকিট নেহি লাগে না।

একটু নিচু হয়ে সে ভক্তিভরে হারীতের দুই হাঁটু স্পর্শ করলো।

সাধুদের টিকিট লাগে না! হারীত সাধুর ভেক ধরেছে পুলিশের নজর এড়াবার জন্য। কলকাতা ও চব্বিশ পরগণায় তার প্রবেশ নিষেধ, পুলিশের এই আদেশ এখনও জারি আছে কিনা সে জানে না, তবু সে ঝুঁকি নিতে চায়নি। সাধু সাজলে টিকিটের পয়সাও বাঁচানো যায়? তা হলে কি ট্রেনে টিকিট কাটতে হবে না? মাত্র দু শো বাইশ টাকা সম্বল করে তারা তিনজন চলেছে পশ্চিমবাংলায়।

হারীত কন্ডাক্টটির মাথায় হাত ঠেকিয়ে আশীবাদ জানালো, জিতা রহো! ভগবান তুমহারা মঙ্গল করে গা!

হারীতের একটা বিড়ি খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু এই সাধুবেশে বিড়ি ধরানো ঠিক হবে না। অন্যদের বিড়ি-সিগারেটের গন্ধে তার চিত্ত চঞ্চল হচ্ছে, তাই চোখ বুজে রইলো সে।

প্রায় আট ঘণ্টার পথ, এই গরমের মধ্যে শুধু বসে বসে ঝিমোনো ছাড়া আর কিছুই করার নেই। মাঝখানে কোনো একটা জায়গায় চা খেতে নেমে বাসুদেবের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল। নবার। নবাকে সে জিলিপি খাওয়ালো। যোগানন্দ পাশে এসে দাঁড়াতে তাকেও সে কুণ্ঠিত ভাবে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কিছু খাবেন? আমি দশ টাকার নোট দিয়েছি, খুচরো দিতে পারছে না…

সাধু-সুলভ সংযম দেখিয়ে হারীত চা বা জিলিপি কিছুই খেল না।

রায়পুর স্টেশনেও অপেক্ষা করতে হবে পাঁচ ঘণ্টা। ট্রেন আসবে রাত তিনটের সময়। যোগানন্দর জন্য একখানা ও নবার হাফ টিকিট কাটা হয়েছে, নিজের জন্য টিকিট না কিনে হারীত পরীক্ষা করে দেখতে চায়। যদি সে নিজের টিকিটের পয়সাটা বাঁচাতে পারে, তা হলে ফেরার সময়ে যোগানন্দ আর নবাকেও গেরুয়া রঙের কাপড় পরিয়ে আনবে। আর যদি ধরে, টিকিট চেকারের দয়া না হয়, তা হলে আর এমন কী হবে, বড় জোর নামিয়ে দেবে মাঝখানের কোনো স্টেশনে। তখন দেখা যাবে!

বাসুদেব ওদের নির্দিষ্ট প্লাটফর্মে নিয়ে এসেছে, সে প্লাটফর্ম এখন নিঝুম, নির্জন। যোগানন্দ আর নবা ঘুমিয়ে পড়লো একটু বাদেই। হারীতদের সঙ্গে কোনো মালপত্র নেই। শুধু দুটি ঝোলা। বাসুদেব টিনের সুটকেস ও সতরঞ্চি জড়িয়ে বাঁধা বেডিং এনেছে, তার ওপরে সে বসে আছে একটু দূরে, ক্ষীণ আলোয় একটা খাতা খুলে কিছু পড়ছে।

সেদিকে একটুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হারীত বললো, ছোটবাবু, একটু শুনেন!

সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো বাসুদেবের। ফ্যাকাসে মুখোনি ফিরিয়ে সে হারীতকে দেখলো। বয়েস হলেও হারীতের শরীরটি এখনও বেশ মজবুত, টানটান। প্রকৃত সাধুর ভঙ্গিতে সে জোড়াসনে সিধে হয়ে বসেছে, পাশে রাখা লাঠিখানা, এখন সে একটা বিড়ি ধরিয়েছে বটে কিন্তু সেটিকে মুঠোর মধ্যে নিয়ে সে টানছে গাঁজার কল্কের মতন। হারীতের মাথার পেছনেই, খানিকটা দূরে জ্বলজ্বল করছে সিগন্যালের লাল আলো।

এখন হারীত লাঠিটা ঘুরিয়ে একবার মারলেই বাসুদেবের মাথাটা ছাতু হয়ে যাবে!

সে প্রায় লাফিয়ে এসে হুমড়ি খেয়ে হারীতের পায়ের ওপর পড়ে বললো, আমাকে দয়া করুন, আমাকে দয়া করুন! আমি ক্ষমা চাইছি, আমি আপনার শিষ্য হবো!

হারীত বিব্রত ভাবে পা সরিয়ে নিয়ে বললো, এ কী! আপনে ব্রাহ্মণ হয়ে আমার পায়ে হাত দ্যান ক্যান? ছি ছি, এতে আমারই পাপ হবে!

–আপনি সাধু পুরুষ, সাধুদের কোনো জাত নেই। জয় বাবা কালাচাঁদ! জয় বাবা কালাচাঁদ!

–আপনে ভালো করেই জানেন যে আমি আসল সাধু না! বসন রাঙাইলেই কি যোগী হওন যায়? আমি মুখ মানুষ, তন্ত্রমন্ত্র কিছুই জানি না!

–আপনি আমাকে দয়া করুন!

–শোনেন, ঠিক হয়ে বসেন। আপনেরে একটা কথা জিগাই, সঠিক উত্তর দেবেন। আপনে আমার মাইয়া গোলাপীরে রাইতের বেলা আপনার বাসায় ডাকছিলেন পদ্য শুনাবার জইন্য? সত্য কথা বলেন!

–আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনি বিশ্বাস করুন। অন্য সময় এলে লোকে পাঁচ কথা বলতো, তাই ভেবেছিলুম, রাত্তির বেলা, যখন অন্য কেউ জানতে পারবে না, তখন নিরিবিলিতে তাকে একটু কবিতা শোনাবো!

–আপনের অন্য কোনো মতলেব ছিল না? রাত্তিরবেলা একজন সামর্থ্য মেয়েরে ডেকে এনে তার গায়ে হাত দ্যান নাই?

–আমি তার পায়ে হাত দিয়েছি। মা কালীর দিব্যি, আমি শুধু তার পা দু’খানা ধরে—

–কী পদ্য তারে শুনায়েছিলেন, আমারেও শুনান!

–আজ্ঞে?

–আমারেও সেই পদ্য শুনান।

–সে এমন কিছু নয়, আপনার ভালো লাগবে না। আমার লেখা দেখে অনেকেই ঠাট্টা বিদ্রূপ করে। কোনো মেয়ে কখনো আমার লেখা পড়েনি, তাই আমি ভেবেছিলুম…

–এখন পড়েন তো দেখি।

বাসুদেব খাতাটা নিয়ে আসতে বাধ্য হলো। পাতা উল্টে যেতে লাগলো, গোলাপীকে যে কয়েকটা কবিতা সে শুনিয়েছিল, সেগুলি হারীতকে শোনাতে তার সাহস হলো না। সেগুলি নারী বিষয়ক। সে কাঁপা কাঁপা গলায় অন্য একটি কবিতা পড়তে শুরু করলো :

শুকনো নদী শূন্য মাঠ নিরানন্দ গাঁ।

যেখানে যাই যেদিকে চাই তোমাকে দেখি মা….

সমস্ত মনোযোগ ভুরুতে এনে চুপ করে শুনলো হারীত। সে লেখাপড়া বিশেষ শেখেনি বটে কিন্তু সেও একজন শিল্পী। সে এক সময় মাটি দিয়ে ঠাকুর দেবতার মূর্তি গড়েছে। এখনও সে ভালো মতন একটা কাঠের টুকরো পেলে পুতুল বানাতে পারে। তার চোখের সামনে কোনো মূর্তি লাগে না, তার আঙুলের খেলায় অবিকল মানুষের মূর্তি ফুটে ওঠে।

একজন শিল্পী অন্য শিল্পের তরঙ্গও ঠিকই অনুভব করে। কবিতার সব শব্দ ব্যবহার সে ঠিকমতন না বুঝলেও কাব্যরস তার মন স্পর্শ করলো। ক্যাম্প অফিসের একজন কেরানী, যার কাজ টাকা-পয়সা, চাল-ডালের হিসেব রাখা, এই কবিতাগুলির মধ্যে সে যেন একেবারে একজন অন্য মানুষ।

খানিকক্ষণ শোনার পর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হারীত বললো, আপনে একজন দুঃখী, তাই না? আমার মেয়েটাও বড় দুঃখী, ছোটবাবু! তার কোনো দোষ নাই, যেমন মনে করেন। মাটি, মাটির কি কোনো দোষ আছে, তবু মানুষে মাটির জন্য কামড়াকামড়ি করে। আমি কইলকাতায় যাইতাছি, ছোটবাবু, যদি কোনো কারণে আর না ফিরি, যদি পুলিশে আমারে ধইরা রাখে, আপনে আমার মেয়েটারে দ্যাখবেন। লোকে যা কয় কউক, আপনে তারে বুঝাইয়া। সুঝাইয়া রাইখেন!

এরপর হারীত অনেকক্ষণ গল্প করলো বাসুদেবের সঙ্গে। এক সময়ে ঝমঝমিয়ে এসে গেল ট্রেন। থার্ড ক্লাস কামরায় প্রচণ্ড ভিড়, তার মধ্যে কোনো ক্রমে উঠে পড়লো ওরা। সারা রাস্তায় কেউ টিকিট দেখতে এলো না।

বাসুদেব নেমে গেল খড়গপুরে। ট্রেনও ফাঁকা হয়ে যেতে লাগলো। হারীত বেশী বেশী সাধু সেজে ধ্যানে বসে রইলো চোখ বুজে। যদিও অনেক লোক উঠে দাঁড়িয়ে থাকছে দরজার কাছে, আবার নেমে যাচ্ছে দু-এক স্টেশন পরে, তাদের টিকিটের কোনো ব্যাপারই নেই মনে হয়। নবা খুব অবাক হয়ে গেছে চতুর্দিকে এত বাংলা কথা শুনে। স্টেশনের নাম বাংলায় লেখা, ট্রেনের মধ্যে উঠে হকাররাও চ্যাঁচাচ্ছে বাংলায়।

হাওড়া স্টেশনে এসে ওরা পৌঁছোলো সকাল দশটায়। এই সময় অফিসযাত্রীর এমনই ভিড় ও ঠেলাঠেলি যে টিকিট দেখার যেন প্রশ্নই নেই, ওরা সেই জনস্রোতে প্রায় ভাসতে ভাসতেই বেরিয়ে এলো বাইরে।

নবা বললো, এঃ, আমরা ক্যান টিকিট কাটলাম? রেলে টিকিট লাগে না!

হারীতও একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এত সহজে পয়সা বাঁচানো যাবে সে আশা করেনি। ফেরার সময়ে তা হলে আর চিন্তা নেই। ট্রেনে ভালো খাওয়া হয়নি, এখন আগে পেট ভরে খেয়ে নিতে হবে।

হাওড়া ব্রীজ পেরিয়ে আসবার পর কলকাতার মাটিতে পা দিয়ে হারীতের বুক নয়, সমস্ত শরীর টনটন করে উঠলো। এখানে সে কম মার খায়নি। পুলিশের চোখে সে মাকামারা হয়ে গিয়েছিল, পুলিশ তাকে যখন তখন মেরেছে। মেরে মেরে তাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল। সেইসব পুলিশের লোকেরা এখনও কি তাকে চিনতে পারবে?

ছেলেটার খবর নিতে হবে। রাস্তার নাম মনে আছে, মোহনবাগান লেন। সে রাস্তা অনেক দূরে। তার আগে বোধহয় পড়বে তালতলা। রাত্তিরে থাকার জন্য তালতলার মা জননীর কাছে আশ্রয় চাইলে পাবে না?

নবার কাঁধ চাপড়ে হারীত বললো, চল, তোগো আইজ একটা নতুন জিনিস খাওয়ামু। এই কইলকা শহরে খাওনের অনেক মজা।

মাঠ-জঙ্গলের তুলনায় কলকাতার পিচের রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটা বেশী কষ্টকর, কলকাতার গরমে ঘামও বেশী হয়, তবু ওদের যেন কোনো কষ্টই হচ্ছে না। এটা কলকাতা, এই নামটার মধ্যেই একটা জাদু আছে।

লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে ওরা এসে উপস্থিত হলো মনুমেন্টের কাছে। আগে কয়েকবার এসপ্লানেড-ডালহাউসি অঞ্চলে মিটিং-মিছিলে এসে হারীত কিছু শস্তার খাওয়ার জায়গা খুঁজে বার করেছিল। সে জেনেছিল যে কলকাতার রিকশাওয়ালা-ঠেলাওয়ালারাই সব চেয়ে শস্তায় খায়। সে খাবার এমন কিছু খারাপও নয়।

মনুমেন্টের পায়ের কাছে ওরা এক দোকানীর সামনে বসে পড়লো। ঝকমকে কাঁসার থালাভর্তি ছাতু, সঙ্গে নুন আর কাঁচালঙ্কা। আর এক ঘটি জল। হারীত আগে দেখে গিয়েছিল, এই খাদ্যের দাম আশী পয়সা, এখন একটাকা কুড়ি পয়সা হয়েছে। আরও কিছু পয়সা দিলে খানিকটা চিনিও দেয়। আট আনার চিনি কিনে নিয়ে সে নবার ছাতুতে জল ঢেলে, চিনি মিশিয়ে কয়েকটা গোল্লা পাকিয়ে বললো, এবার খাইয়া দ্যাখ, নতুন রকমের মিঠাই।

সেই ছাতুর গোলা খুব আগ্রহের সঙ্গে মুখে দিল নবা, খুব যে ভালো লেগেছে তা তার চোখ মুখ দেখে বোঝা গেল না, তবু অল্প বয়েসের ক্ষুধায় খেতে লাগলো একটা একটা করে। যোগানন্দ নুন-কাঁচালঙ্কা দিয়েই পুরো ছাতুটা উড়িয়ে দিল, হারীত নিজেই ভালো করে খেতে পারলো না, তার গলায় আটকে আটকে যাচ্ছে। তিন ঘটি জলই শেষ করে ফেললো সে।

কলকাতার রাস্তাঘাট ভালো করে জানা নেই হারীতের, তবু সে আন্দাজে আন্দাজে পৌঁছে গেল তালতলায়। ত্রিদিবের বাড়ির সামনের দিকটা অনেকটা বদলে গেছে, লোহার গেট বসেছে, সেখানে একজন নেপালী দারোয়ান। সেই দারোয়ান হারীতের কোনো কথায় পাত্তাই দিতে চাইলো না। বাড়ির ভেতর থেকে একজন অবাঙালী ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কেয়া হুয়া, সাধুবাবা? আইয়ে, অন্দর আইয়ে, কৃপয়া বৈঠকে যাইয়ে!

হারীত ভেতরে গেল না, কিন্তু সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বুঝলো, তিনি ত্রিদিব-সুলেখার নাম শোনেননি। এ বাড়ি তারা মাত্র গত বছরই কিনেছেন, সেই বাড়িওয়ালাও বাঙালী ছিল না।

হারীত খুব ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেল। তবে কি তার বাড়ি চিনতে ভুল হচ্ছে? সে গলি দিয়ে হেঁটে এগিয়ে গেল অনেকখানি। পুলিশের তাড়া খেয়ে আহত অবস্থায় দৌড়ে এসে যে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে ত্রিদিবের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় হয়েছিল, সেই বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালো। দেয়ালে নোনা ধরেছে, তাছাড়া বাড়িটার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ত্রিদিবেরই কোনো এক আত্মীয়ের বাড়ি এটা। প্রায় পা মেপে মেপে সেখান থেকে হারীত আবার ফিরে এলো, এখানে সে অনেকবার এসেছে, তার ভুল হবার কথা নয়। ত্রিদিবের বাড়ি থেকেই সে গ্রেফতার হয়েছিল। দু পাশের দুটো বাড়ি অবিকল এক আছে, মাঝখান থেকে ত্রিদিব-সুলেখার বাড়িটাই অদৃশ্য হয়ে গেছে!

পাশের দোতলা বাড়ির বারান্দা থেকে একজন খালি-গায়ে, লুঙ্গি পরা মাঝবয়েসী লোক বললো, আপনি ত্রিদিববাবুকে খুঁজছেন? উনি তো এ বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন অনেকদিন! তারপর দু বার এ বাড়ি হাতবদল হয়ে গেল।

হারীত মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলো, ওনারা কোথায় গেছে? ঠিকানাটা বলতে পারেন?

লোকটি বললো, প্রথমে তো দিল্লি চলে গেলেন। তারপর কোথায় গেছেন জানি না। ও হ্যাঁ, একবার মাঝখানে ত্রিদিববাবু এলেন বাড়ি বেচবার সময়, তখন উনি বললেন, উনি শিগগির বিলেত যাচ্ছেন। হ্যাঁ। আরও কে যেন বললো একদিন, ত্রিদিববাবু বিলেতেই থাকেন!

–বিলাতে চলে গেছেন? ওনার ইস্ত্রীও গেছেন কি?

–ওঁর স্ত্রী তো… কী যেন হয়েছিল…

লোকটি পেছনে মুখ ফিরিয়ে ঘরের মধ্যে কাকে যেন জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁগো, সুলেখাবৌদির কী যেন হয়েছিল?

ঘরের ভেতর থেকে একজন কী উত্তর দিল তা বোঝা গেল না। লোকটির চোখ-মুখ কুঁচকে গেল, কী যেন চিন্তা করে বললো, নাঃ, সুলেখাবৌদির কী হয়েছে আমরা জানি না!

আগ্রহ হারিয়ে লোকটিও ঢুকে গেল ঘরের মধ্যে। হারীত তবু তাকিয়ে রইলো সেই বারান্দার দিকে। সুলেখার সঙ্গে দেখা হবে না? জগদ্ধাত্রীর মতন রূপ সেই নারীর, হারীত তাকে মা জননী বলে ডেকেছিল। সেরকম দয়াবতী রমণী আর কখনো দেখেনি হারীত। কলকাতা শহরটাই শূন্য মনে হলো।

ওয়েলিংটন স্কোয়ারে এসে কিছুক্ষণ বসলো হারীত। যোগানন্দ কোনো কথা বলছে না, কিন্তু নবা ছটফট করছে। সে কখনো ট্রাম দেখেনি, সিনেমার পোস্টার দেখেনি। এত বড় বড় বাড়ি দেখেনি। আইসক্রিমওয়ালা দেখেনি। তাকে আট আনা দিয়ে একটি লাল রঙের কাঠি আইসক্রিম কিনে দিতেই হলো। এই প্রথম বরফ স্পর্শ করলো তার জিভ।

এবার যেতে হবে মোহনবাগান লেনে। কিন্তু সুলেখাকে দেখবার জন্য হারীত যতখানি উৎসাহ নিয়ে এসেছিল, নিজের ছেলের কাছে যাবার জন্য তেমন উৎসাহ বোধ করছে না। ছেলে যদি লেখাপড়া শিখে ভদ্রলোক হয়ে গিয়ে থাকে, সে কি তা হলে চিনতে পারবে বাবাকে? ছেলে এতদিন কোনো খোঁজ তো নেয়নি, চেষ্টা করলে কি খোঁজ নেওয়া যেত না? হারীত দু’বার পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিল, তারও কোনো উত্তর আসেনি। হয়তো ঐ ঠিকানায় এখন ওরা থাকে না।

যে-মহিলার কাছে ছেলেকে রেখে গিয়েছিল হারীত, আশ্চর্য ব্যাপার, তার নামটা মনে আসছে না। কোথায় যেন নাম-ঠিকানা লেখা ছিল, সে কাগজ হারিয়ে গেছে এতদিনে। মহিলাকে কেমন দেখতে ছিল তাও মনে আসছে না হারীতের। শুধু সুলেখার মুখখানাই চোখের সামনে ভাসছে। সহজে ভেঙে পড়ে না হারীত, এখন তার চোখ ফেটে জল আসছে।

ওয়েলিংটন স্কোয়ার থেকে শ্যামবাজারের দিকটা হারীতের মনে আছে, ট্রাম লাইন ধরে সোজা হাঁটা পথ। নবা ট্রামে ওঠবার জন্য বায়না ধরলেও হারীত কর্ণপাত করলো না। নিঃস্ব মানুষদের চাঁদার পয়সা, যেমন তেমন ভাবে খরচ করা যায় না। মে মাসের রোদে পিচ গলে যাচ্ছে, পায়ে সেই পিচ লেগে যাওয়ায় নবা বেশ মজা পাচ্ছে। সে ইচ্ছে করে আরও পিচ মাখছে।

মোহনবাগান লেনের বাড়িটাও পাওয়া গেল একসময়ে। এ রাস্তায় তেমন কিছু পরিবর্তন হয়নি। বাড়িটার সামনে একটা চাঁপা ফুলের গাছ। ঘোর দুপুরে সুনসান করছে পাড়া। বড় পালাওয়ালা কাঠের দরজাটায় ধাক্কা দিতেই একজন কিছুটা ফাঁক করে হারীতের আপাদমস্তক দেখে বললো, এখন ভিক্ষেটিক্ষে হবে না, যাও যাও!

বিশ্রী মানসিক অবস্থার মধ্যেও হারীত ক্লিষ্ট ভাবে হাসলো। কলকাতার মানুষ সাধু-সন্ন্যাসীর ভড়ং দেখলেও সহজে ভোলে না। সাধু দেখলে ভিখিরি মনে করে। সে যোগানন্দর দিকে একবার তাকালো। যত অসহায় অবস্থার মধ্যেই পড়তে হোক, এ পর্যন্ত তাদের কখনো ভিক্ষে করতে হয়নি। তারা বাস্তুহারা, কিন্তু ভিক্ষুক নয়।

প্রকৃত সাধুর মতনই হারীত হুংকার দিয়ে বললো, জয় বাবা কালাচাঁদ! জয় বাবা কালাচাঁদ! দরজা আবার ফাঁক করে লোকটি বিরক্তির সঙ্গে বললো, আরে বলছি যে এখানে কিছু হবে না! অন্য জায়গায় যাও বাবা!

হারীত বললো, এই বাড়িতে আসছি, অইন্য জায়গায় যাবো কেন? তোমার বাবুদের ডাকো। সুচরিতবাবু কোথায়?

লোকটি ভুরু কুঁচকে বললো, সুচরিতবাবু? সে আবার কে? ভুল জায়গায় এসেছে, সাধুবাবা, এ বাড়িতে ঐ নামের কেউ নেই!

–সুচরিত এই বাড়িতে নাই?

–বললুম তো, তোমার ঠিকানা ভুল হয়েছে।

হারীত অতি কষ্টে অপ্রস্তুত ভাবটা দমন করলো। সেই মহিলার নাম এখনও তার মনে পড়ছে না। এ বাড়িতে আর কে কে থাকতেন, তাও সে জানে না। হঠাৎ বিদ্যুতের মতন একটা নাম মাথায় এসে গেল। অসমঞ্জু! এই মাস্টার ভদ্রলোকই প্রথম তার ছেলের ভার নিয়েছিল। তার ঠিকানাও হারীতের জানা নেই। এই বাড়ি থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলে ছেলের সন্ধান পাবার আর কোনো সূত্রই থাকবে না হারীতের।

সে বললো, অসমঞ্জুবাবু এ বাড়িতে আসেন না? তাঁর সাথে আমার দেখা করার যে খুব প্রয়োজন ভাইডি!

একটা চেনা নাম শুনে লোকটির মুখ থেকে সন্দেহের ভাব ঘুচে গেল। দরজাটা পুরো খুলে দিয়ে বললো, ভেতরে ছায়ায় এসে বসো! মাস্টারদাদাকে খুঁজতে এসেছো তো আশ্রমে যাওনি কেন?

–আশ্রম মানে, কিসের আশ্রম? কোথায়?

দোতলার জানলা খুলে আনন্দমোহন জিজ্ঞেস করলেন, কে রে বীরু?

আনন্দমোহনকে মাত্র একবারই দেখেছিল হারীত কিন্তু এখন মুখ তুলে তাকিয়েই চিনতে পারলো। যাক, তাহলে ত্রিদিব-সুলেখার মতন ব্যাপার এখানে হবে না।

সে বললো, আজ্ঞে, আমরা অনেক দূর থিকা আসতেছি!

আনন্দমোহন হাত তুলে অপেক্ষা করতে বলে নিচে এলেন। সামনের চত্বরটা পার হয়ে এরা তিনজনে এসে বসলো একতলার বারান্দায়।

ধুতি ও ধপধপে গেঞ্জি পরা আনন্দমোহন ভেতরের দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দুহাত জোড় করে বললেন, নমস্কার! আপনারা কোন আশ্রম থেকে আসছেন বললেন?

হারীত তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করতে যেতেই তিনি চমকে বললেন, আরে একী একী, আপনি সাধু মানুষ, আমার পায়ে হাত দিচ্ছেন!

হারীত বললো, আপনি ব্রাহ্মণ। আমি সাধু না, আমি একজন সামান্য রিফিউজি। সরকার আমাগো দণ্ডকারণ্যে নির্বাসন দিছে। সাহস কইরা আবার কইলকাতায় আইয়া পড়ছি একটা সংবাদ নিতে।

আনন্দমোহন অস্ফুট স্বরে বললেন, হারীত মণ্ডল!

–আজ্ঞে আপনের সাথে আমার একবার দেখা হইছিল, অনেক বৎসর আগে, আপনার নিশ্চয় মনে নাই–

–আপনার চেহারা দেখে চিনতে পারিনি। কিন্তু হারীত মণ্ডল নামটা ঠিকই মনে আছে।

–আপনে আমাকে তুমি করে বলেন। গেরুয়া পরেছি ময়লা কম হয় তাই, আমি অতি নগণ্য মানুষ। আমার পোলাডারে, মানে আমার ছেলেরে আপনাগো কাছে রেখে গেছিলাম, বাপ। হয়েও এতদিন তার কোনো খবর নিতে পারি নাই, সে কেমন আছে?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনন্দমোহন বললেন, আমি জানতাম, আপনি একদিন ফিরে আসবেন। আপনার ছেলে আপনার ছেলে, সে অনেকদিন হলো এখানে থাকে না।

–অন্য জাগায় বাসা ভাড়া নিছে?

আনন্দমোহন দ্বিধা করতে লাগলেন। হারীতকে দেখে পুরনো অপরাধবোধটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। সুচরিতের বাবাকে তিনি কী উত্তর দেবেন, সুচরিত বেঁচে আছে কি না তাও তিনি জানেন না।

চন্দ্রা গেছে নৈহাটির আশ্রমে, কালই তার ফেরার কথা। যা কিছু বলার চন্দ্রাই বলবে। তিনি ভাসা ভাসা ভাবে হারীতকে উত্তর দিলেন, সে যেন কোথায় আছে, আমি ঠিক জানি না, আমার মেয়ে জানে, আপনারা আসুন, ভেতরে এসে বসুন। ওরে বীরু, চা করতে বল তো!

চা খেতে খেতে হারীত চন্দ্রার আশ্রম বিষয়ে অনেক কথা শুনলো। তার ছেলের কথা যে এই ভদ্রলোক এড়িয়ে যাচ্ছেন তা বুঝতে হারীতের দেরি হলো না। হ্যাঁ, চন্দ্রা, নামটা মনে পড়েছে এবার, চেহারাটাও ফিরে এসেছে স্মৃতিতে। সেই ঠোঁটে রংমাখা, সিগারেট ফোঁকা মেয়েছেলেটি সন্ন্যাসিনী হয়েছে, এ তো ভারি আশ্চর্যের কথা!

আনন্দমোহন হারীতকে চন্দ্রার আশ্রমের ঠিকানা দিয়ে দিলেন। সেখানে অতিথিশালা আছে, হারীতরা রাত্তিরে থেকে যেতেও পারবে। কিন্তু হারীত পাতিপুকুরের দিকে গেল না। সে গেল কাশীপুরে।

সরকারদের যে বাগানবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিল হারীত, সে বাড়িটি কিন্তু এখনো উদ্বাস্তুদের দখলেই। সে বাড়ির ভাঙা পাঁচিলের বাইরে দাঁড়িয়ে পড়লো হারীত। যোগানন্দ এই বাড়ি দেখেনি, সে প্রথম থেকেই আশ্রয় পেয়েছিল কুপার্স ক্যাম্পে আর নবার তো জন্মই বাংলার বাইরে।

এখনকার রিফিউজি কলোনির চেহারা অনেকটা বদলেছে। প্রত্যেকটি পরিবারের টুকরো টুকরো জমিতে বেড়া দেওয়া আলাদা বাড়ি। কারুর কারুর বাড়িতে ইটের দেওয়াল। গাছ কাটা পড়েছে অনেক, মাঝখানের নাচঘরটি ধসে পড়েছে প্রায়। ভেতরে যে-সব বাচ্চাকাচ্চারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারা একেবারে রোগা ডিগডিগে নয়। একটি রাজনৈতিক দলের পোস্টার পড়েছে অনেকগুলি দেয়ালে। ডান দিকের কোনের বাড়িটি ছিল হারীতের, সে বাড়ির চালে লকলক করছে লাউ ডগা, একটা বড় লাউয়ের গায়ে চুন লেপা। কে থাকে এখন ঐ বাড়িতে?

এই বাগান বাড়িটি হারীতের নেতৃত্বেই দখল করা হয়েছিল, এখন হারীতেরই এখানে স্থান নেই। পুলিশ তাকে কলকাতার সীমানার মধ্যেই ঢুকতে নিষেধ করেছিল!

নবার হাত ধরে হারীত বললো, আয় যোগা! অ্যারাও আমাগো মতন রিফুজি, আমাগো থিকা অ্যারা অনেক ভালো আছে মনে হয় না? আয় দেইখ্যা আসি!

যোগানন্দ বললো, বড়কর্তা, অরা কইলকাতায় থাকার জায়গা পাইলো, আর আমাগো অত দূরে খেদাইয়া দিল ক্যান?

উত্তর না দিয়ে হারীত হাসলো। জীবনে অনেক কেনরই উত্তর পাওয়া যায় না, তবু মানুষ। জিজ্ঞেস করে, কেন, কেন, কেন?

কলোনির ভেতরে ঢুকে একটা আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে হারীত হাঁক দিল, জয় বাবা কালাচাঁদ! জয় বাবা কালাচাঁদ!

প্রথমে দৌড়ে এলো বাচ্চারা, ঘিরে দাঁড়ালো হারীতদের। তারপর কয়েকটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো মেয়ে বউদের দল। একজন মাঝবয়সী স্ত্রীলোক হারীতের সামনে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ও বাবা, আমার ভাগ্যটা একটু দেখে দাও। আমার ছেলেটা

কৌতুক করার জন্য হারীত তার হাতের রেখা দেখার ভান করে বললো, তোগো বাড়ি আছিল খুলনার বাঘমারা গেরামে, ঠিক কইছি না? তোর বাপ মরছিল জলে ডুইব্যা। তোর স্বামীর নাম বরদাকান্ত, না? সে কোথায়?

স্ত্রীলোকটি বিমূঢ়ভাবে বললো, সে তো বাজারে দোকান দিছে। কিন্তু আমার ছেলেটা—

হারীত অন্য একজনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, কী পীর মা, তোমার বাতের ব্যামো কমছে? আর তোমার বড় পোলা সুবল, সে ঘুমের মইধ্যে চিকখৈর দ্যায় এখনো?

সন্ন্যাসীর বেশে হারীতকে কেউ চিনতে পারছে না। সন্ন্যাসীর পূর্ব পরিচয় জানবার জন্য সহসা কেউ কৌতূহলও প্রকাশ করে না। হারীতের কথা শুনে সবাই হকচকিয়ে যাচ্ছে।

বিকেল পড়তে ফিরলো পুরুষেরা। তাদের মধ্যে একজন শুধু হারীতের কণ্ঠস্বর শুনে বিস্ময়ের সঙ্গে চিৎকার করে উঠলো, সোনাকাকা? তুমি সাধু হইছো?

হারীত তার কাঁধে চাপড় মেরে বললো, নারে নেপু, আমি সাধু হই নাই। আমি সাধক কালাচাঁদের ভাবশিষ্য। তোরা সগগলডি এক সাথে আমার লগে লগে বল, জয় বাবা কালাচাঁদ! জয় বাবা কালাচাঁদ! তোরা যশোরের ত্রিকালজ্ঞ সাধক কালাচাঁদ জীউয়ের নাম শুনেছিস তো? তেনার একশো বৎসরের উপর বয়স, তিনি আমারে স্বপ্নে দেখা দিছিলেন, তিনি আমাগো কথা চিন্তা করেন। তিনি কইছেন, ওরে হারীত, তোগো সুদিন আসবে আবার!

এখানকার কেউই সাধক কালাচাঁদের কথা আগে শোনেনি বটে, কিন্তু এই অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন পুরুষের কথা বিশ্বাস করতে কারুর দ্বিধা হলো না। তারা হারীতের কাছ থেকে তার গুরুর মাহাত্ম শুনলো।

তারপর অনেক সুখ-দুঃখের গল্প হলো। কে কে আছে, কে কে নেই। দণ্ডকারণ্যের অবস্থা কেমন? আন্দামানে যারা গেছে, তারা নাকি সত্যিই ভালো আছে? এই কলোনির উদ্বাস্তুদের অবস্থা মোটেই ভাল না, এখনও তাদের উৎখাতের চেষ্টা চলছে, সরকারি সাহায্য আর মেলে না। নিজেরাই কোনোক্রমে জীবিকার ব্যবস্থা করছে, তবে এখন পাশাপাশি কলোনির উদ্বাস্তুরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে…

গোপাল নামে একজন একটু আড়ষ্ট হয়ে বসেছিল, হারীত একসময় তার হাত ধরে বললো, তোর ভয় নাই রে, তোর ঘর আমি দখল করতে আসি নাই। আমরা আবার ফিরা যাবো।

গোপাল সঙ্গে সঙ্গে বললো, না, না, আপনে আইস্যা থাকেন না, যতদিন ইচ্ছা থাকেন।

হারীত বললো, না রে, আইলে আমি একা আমু না! পাকিস্তানে নাকি যুদ্ধ লাগছে আবার, তোরা শোনছোস কিছু? বর্ডারে নাকি আর পাহারা দেয় না?

নেপু লাফিয়ে উঠে বললো, সোনাকাকা, আমি গেছিলাম, আমি যশোরের মধ্যে ঢুকছিলাম! ঐ ধার থিকা দলে দলে মানুষ এদিকে আসত্যাছে, আমি গেছিলাম উল্টা দিকে।

স্বভাবনীরব যোগানন্দ এবার চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলো, তুমি যশোরে ঢুকছিলা? দ্যাশের মাটি ছুঁইছো? কেউ কিছু কইলো না?

নেপু বললো, না, কেউ কিছু কইলো না। মোছলমানেরা পর্যন্ত খাতির করলো। হ্যাঁরা পাকিস্তান আর্মির নামে গালি দ্যায়, ইন্ডিয়ার প্রশংসা করে। এক মোছলমানের বাড়িতে বইস্যা খাইলাম।

যোগানন্দ চোখ বড় বড় করে বললো, আমি যাব। বড় কত্তা, আমি একবার আমাগো দ্যাশের মাটি ছুঁইতে যাবো! ভাবি নাই যে আর কোনোদিন…

হারীত বললো, হ, যামু, আমিও যামু, কাইল সকালেই, যশোরের মাটিতে একবার পা দিয়া কমু, জয় বাংলা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *