২০
প্রায় ভোররাতই বলা যায়। অগোছালো নথিপত্রগুলিকে গুছিয়ে নিয়ে সব খুঁটিয়ে পড়ার সময় পেলেন না রবীন্দ্রনাথ। যতোটা পেরেছেন, পড়েছেন। বাকি পড়া হল না। কেউ পড়বে না কোনওদিন। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে দ্বারকানাথের বাণিজ্য, সাফল্য-অসাফল্য, পাপ-পুণ্যের সব বালাই পুড়ে ছাই হবে। বেঁচে থাকবে কিছু পরিচিত সত্য, কিন্তু কল্পিত মিথ আর সত্য-মিথ্যে মেশানো একটি মানুষের অবাস্তব অবয়ব।
আকাশের অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। তবু তারারা বিদায় নায়নি। দুর্বল ফ্যাকাশে চাঁদ লেগে আছে এখনও ভোররাতের কোণে। নথিপত্রগুলি যতটুকু পড়তে পেরেছেন রবীন্দ্রনাথ, তাতে তাঁর মনের মধ্যে এক আশ্চর্য কাণ্ড ঘটছে। পিতামহকে তিনি একই সঙ্গে দেখছেন ঘৃণায় ও মমতায়। কামিনী-কাঞ্চনের প্রতি কী প্রবল আকর্ষণ। পার্থিব ধনদৌলতের দিকে কী নিরন্তর দৌড়। যেখানে দৌলতের গন্ধ সেখানেই দ্বারকানাথ! ধনী তাঁকে হতেই হবে। অন্তহীনভাবে ধনী। জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য অর্থের সমারোহ। বিষয়-সম্পত্তির বৃদ্ধির জন্য হেন কাজ নেই তিনি করতে পারেন না। হেন নীচতা, শঠতা, নিষ্ঠুরতা, মতলববাজি নেই, যা তার নাগালের বাইরে।
কিন্তু তবু রবীন্দ্রনাথ চোখ বুজে এখন অন্য এক দ্বারকানাথকে দেখতে পাচ্ছেন, যিনি বঙ্গদেশের সব জমিদারের থেকে পৃথক। কোনও বাঙালি জমিদারই উদ্যোগী নন। বাণিজ্যের প্রতি, পরিশ্রমের প্রতি কোনও বাঙালি ধনীই উৎসাহী নন। তাঁদের বিলাসবহুল আলস্যের পাশে, তাঁদের অশিক্ষা ও কূপমণ্ডুকতার পাশে দ্বারকানাথ যেন এক অবিশ্বাস্য আলোকবর্তিকা। ক্লান্তিহীন শ্রম ও সমাজচেতনায় তিনি সারা জীবন দীপ্যমান। রবীন্দ্রনাথের ক্রমশ মনে হয়, দ্বারকানাথের মধ্যে আগাগোড়া কাজ করে চলেছে এক করুণ উভয়বলয়তা। তিনি এক ট্র্যাজিক চরিত্র। এবং এই ট্র্যাজেডির মূলে তাঁর পাপ নয়। তাঁর পুণ্য নয়। নয় তাঁর সাফল্য। বা অসাফল্য। তিনি ট্র্যাজিক। কারণ তিনি দ্বিখণ্ডিত। তিনি ট্র্যাজিক। কারণ তাঁকে ছিঁড়ে খাচ্ছে নিয়তিনির্ধারিত স্ববিরোধ। দ্বৈধ। অনিকেত অ্যামবিভ্যালেন্স।
রবীন্দ্রনাথ চোখ বুজলেন। তিনি পৌঁছে যান ১৭৯৪-তে। এইমাত্র জন্মেছেন জয়রামের প্রপৌত্র, নীলমণির পৌত্র, রামমণির পুত্র, রামলোচনের পোষ্যপুত্র, দেবেন্দ্রনাথের পিতা, রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, দ্বারকানাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, রামমণির দুই বিয়ে। প্রথম বিয়ের দুটি ফসল, রাধানাথ, দ্বারকানাথ। নীলমণির দুই পুত্র। দ্বিতীয় পুত্র রামলোচন সন্তানহীন। তাই তিনি দত্তক নিলেন ছোটোভাই রামমণির ছেলে দ্বারকানাথকে। দ্বারকানাথের মা যদিও মেনকাসুন্দরী। কিন্তু রামলোচনই হয়ে উঠলেন দ্বারকানাথের পিতা আর তাঁর স্ত্রী অলকাসুন্দরীই দ্বারকানাথের মা। নিজের বাবা-মাকে কোনওদিনই পেলেন না দ্বারকানাথ। এটাকে খুব একটা স্বাভাবিক অবস্থা বলা যায় কি? রবীন্দ্রনাথের মনে এই স্বাভাবিক প্রশ্ন। এই অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে বড়-হয়ে-ওঠা দ্বারকানাথের মনের মধ্যে তৈরি করল সারাক্ষণের এক অস্থিরতা, ভাবলেন রবীন্দ্রনাথ। কেন তিনি সারাক্ষণ এমন তাড়িতভাবে অর্থলিপ্সু? কারণ তিনি চান এই অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে, এই সামাজিক ‘অপরিচয়’ থেকে বেরিয়ে আসতে! তাহলে কি, অন্তত প্রথম যৌবনে, পরিচিতির সংকটে ভুগছিলেন দ্বারকানাথ? রবীন্দ্রনাথের মনে জাগে এই প্রশ্ন। পিতামহের প্রতি তিনি কিছুটা আর্দ্র বোধ করেন। আরও গহনভাবে বুঝতে চেষ্টা করেন তিনি দ্বারকানাথকে।
দ্বারকানাথের নিজের বাবা রামমণি ঠিক কেমন মানুষ ছিলেন, আমরা তেমনভাবে জানি না। তিনি কি রসবেত্তা ছিলেন? গান গাইতে বা বাজনা বাজাতে পারতেন? ছিলেন কি নারীপ্রবণ, অর্থলিপ্সু, বিলাসে ইচ্ছুক ও অতৃপ্ত? কোনও প্রশ্নেরই স্পষ্ট উত্তর নেই রবীন্দ্রনাথের কাছে। কিন্তু যে-মানুষটি দত্তক নিলেন দ্বারকানাথকে, সেই রামলোচন ছিলেন সম্পদ-শিকারি ধনী মানুষ। এবং বাণিজ্যের তাড়না তাঁর মধ্যে নষ্ট করে দেয়নি রসজ্ঞতা। তিনি ছিলেন ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের রসগ্রাহী। সংস্কৃতিতে উৎসাহী। মার্জিত পুরুষ বলতে যা বোঝায়, রামলোচন তা-ই। আবার বাস্তববোধ ও বিষয়-বুদ্ধিতে তিনি বিন্দুমাত্র কম নন। অর্থের সুরভি পান দূর থেকে। সম্পত্তির জন্যে ওতপেতে থাকেন। ঝাঁপিয়ে পড়েন অব্যর্থ শিকারে। রামলোচন নিজে কতদূর ইংরেজি জানতেন, জানা যায় না। কিন্তু তাঁর প্রখর বৈষয়িক বুদ্ধি তাঁকে দিল এই চেতনা যে বাণিজ্যে দাঁড়াতে ইংরেজের সাহচর্য ক্রমেই আরও-আরও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে। যে বাঙালি ইংরেজিতে তেমন সাবলীল হবে না, ইংরেজের সঙ্গে প্রাত্যহিক সংলাপে আড়ষ্ট, কুণ্ঠিত হয়ে থাকবে, তার পক্ষে ব্যবসা করে অর্থ উপার্জন ক্রমেই কষ্টকর হয়ে উঠবে। মোদ্দাকথা, ইংরেজি না জানলে ইংরেজের সঙ্গে বা ইংরেজের পাশাপাশি বাণিজ্যের সুযোগ মাঠে মারা যাবে। রামলোচন বুঝতে পেরেছিলেন, সময় বদলে যাচ্ছে। ইংরেজের প্রভাব বাড়ছে। বাণিজ্যের চরিত্র ইংরেজের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ফলে আমূল পাল্টে যাচ্ছে। এবং এইসব ভেবে চিন্তে তিনি দ্বারকানাথকে ভর্তি করলেন শেরবোর্ন সাহেবের স্কুলে। দ্বারকানাথ ছেলেবেলা থেকেই ‘ডিরেক্ট মেথডে’ ইংরেজি শিখলেন!
কিন্তু রামলোচন এইখানেই থামলেন না। তিনি জানেন, আইনের ভাষা এখনও আরবি ও ফার্শি। ধনী হতে গেলে মামলাবাজ হতেই হবে। তুখড় হতে হবে আইনে। দ্বারকানাথকে ভর্তি করলেন এক মৌলবির বিদ্যালয়ে আরবি ও ফার্শি ভাষায় পাঠ নেবার জন্য। রামলোচন খুব ভালভাবে জানেন, অধিকাংশ বাঙালি জমিদার গণ্ডমূর্খ। জমিদারি রক্ষার আইনকানুন কিছুই জানে না। তারা বাইজি-সংস্কৃতির বাইরে আর কীই বা জানে? আইনের ফাঁদে পড়ে তারা জমিদারি হারাচ্ছে ইংরেজের কাছে। দ্বারকানাথ যদি জমিদারি আইনে প্রখর হয়ে ওঠে, তাহলে বাঙালি জমিদারদের পক্ষে মামলা লড়েও তো সে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারবে!
রবীন্দ্রনাথ আরও জানতে পেরেছেন তাঁর পিতামহের বিদ্যাবুদ্ধি সম্পর্কে।
– কেমন ইংরেজি শিখছিস তুই শেরবোর্ন সাহেবের কাছে? জানতে চাইলেন দ্বারকানাথের কাছে রামলোচন।
তৃপ্ত হলেন না তিনি পুত্রের উত্তরে। ইংরেজি ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতি ইংরেজ জাতটির অনন্ত গৌরবের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল নয় কেন তাঁর পুত্র? না, শেরবোর্ন-কে দিয়ে হবে না। চাই আরও শিক্ষিত ইংরেজ। রামলোচনের মনে পড়ল কলকাতার তিন বিখ্যাত ইংরেজ গর্ডন, কল্ডার, অ্যাডম-এর কথা। তিনজনেই অভিজাত। এঁদের কাছে শিক্ষা না পেলে দ্বারকানাথ কেমন করে হয়ে উঠবে অভিজাত বাঙালি? বাঙালি অর্থে অভিজাত নয়। হতে হবে ব্রিটিশ সৌজাত্যের অধিকারী। দ্বারকানাথ যা হয়েছেন এবং যা হতে পারেননি, তার জন্য তাঁর শিক্ষাদীক্ষার দায়দায়িত্ব কম নয়। দ্বারকানাথকে তো ইংরেজের ইংরেজ করে বড় করেছেন রামলোচন। তাহলে তাঁর স্লেচ্ছ প্রবণতা কি স্বাভাবিক নয়? স্বাভাবিক নয় কি তাঁর পক্ষে ব্রিটিশ নটীর প্রেমে পড়া? স্বাভাবিক নয় কি অন্ধ ইংরেজ প্রীতি? এবং ইংল্যান্ডে বসবাস করার সিদ্ধান্ত? ভাবলেন রবীন্দ্রনাথ।
– মনে রেখো রবি, আমার পিতৃদেব বিনা কারণে আমার মাকে নানাভাবে অপমান করেছিলেন। সমাজের চোখে তাঁকে ছোটো করেছিলেন। এই অপরাধ ক্ষমার্হ নয়।
রবীন্দ্রনাথের বুকের মধ্যে বেজে ওঠে দেবেন্দ্রনাথের কণ্ঠ।
রবীন্দ্রনাথ বিচলিত বোধ করেন।
তাঁর সিদ্ধান্তে সংশয় দেখা যায়। তিনি আরও গভীর চিন্তায়, মূল্যায়নে নিবিষ্ট হন।
তাঁর চোখের পরদায় ফুটে ওঠে এই ছবি:
দ্বারকানাথ ষোলো।
তাঁর হাতে এসে পড়ল পারিবারিক সম্পত্তি দেখাশোনা করার দায়িত্ব। সহজ কাজ নয় একেবারেই। মনে রাখতে হবে, চারধারে ঘোরাফেরা করছে হাঙরের দল। ষোলো বছরের ধনীকে বাগে পেলে কেউ ছাড়বে না। ষোলো বছরের দ্বারকাকে সবচেয়ে কঠিন সমস্যায় ফেলল কর্ণওয়ালিস প্রবর্তিত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’। অনেক আইনি চোরাস্রোত আর মারপ্যাঁচ আছে এই ‘পারমানেন্ট সেটলমেন্ট’-এ। এর ফলে মূর্খ জমিদারদের জমিদারি নিলামে হাত বদলাতে লাগল।
কিশোর দ্বারকানাথ কিন্তু বুঝতে পারলেন, সম্পত্তি ও জমিদারি বাঁচাতে তাঁকে শিখতেই হবে রাজস্ব ও বিচারবিভাগের কাজ! নথিপত্র থেকে এইটুকু বুঝতে অসুবিধে হয়নি রবীন্দ্রনাথের, আলস্যের দুর্বলতা, অসাধুতাকে জীবনে বিন্দুমাত্র স্থান দেননি তাঁর পিতামহ। এবং তাঁর শরীর যে অল্প বয়েসে ধ্বংস হল, তার কারণ মদ্যপান বা সম্ভোগ নয়। তার কারণ অবিশ্বাস্য পরিশ্রম। হতে পারে সেই শ্রম ক্রমাগত অর্থ উপার্জনের।
কিশোর দ্বারকানাথ যাচ্ছেন বিভিন্ন জমিদারিতে সরেজমিনে খোঁজখবর নিতে। রোদ্দুরে পুড়ছেন। বৃষ্টিতে ভিজছেন। জঙ্গলে রাত কাটাচ্ছেন। প্রতিদিন নিচ্ছেন জীবনের ঝুঁকি। সেই জীবনে কোথাও নেই আলস্যে-আমোদে দিন কাটানোর সুযোগ।
আর ক্লান্তিহীন পরিশ্রমের সঙ্গে দ্বারকানাথ মিশিয়েছেন ইংরেজ ব্যারিস্টার রবার্ট কাটলার ফার্গুসন-এর কাছে ব্রিটিশ আইনে পাঠ নেওয়া। শুধু ব্রিটিশ নীতিই শিখছেন না। শিখছেন রীতিও।
সেই সঙ্গে আরও এক প্রভাব এসে পড়ল দ্বারকানাথের যৌবনের দিনগুলিকে ভিন্ন আদর্শে প্রণোদিত করতে। এই দীক্ষার সঙ্গে বাঙালি জীবনের রীতিনীতির কোনও মিল নেই। এই দীক্ষা রামমোহন রায়ের।
দ্বারকানাথ হয়ে উঠলেন রামমোহনের মন্ত্রশিষ্য। রবীন্দ্রনাথ ক্রমশ বুঝতে পারছেন, তাঁর পিতার সঙ্গে পিতামহের কোথায় পার্থক্য। পিতা দেবেন্দ্রনাথ রামমোহনের আধ্যাত্মিকতা, একেশ্বরবাদ, ঈশ্বর-এষণাকেই তাঁর জীবনব্রত হিসেবে গ্রহণ করলেন। কিন্তু দ্বারকানাথ আধ্যাত্মিক মানুষ নন। তাঁর মনের গঠনটাই ভিন্ন। তিনি ঐহিকবাদী। ইহলোকের সাফল্যই তাঁর কাছে সব। রামমোহনের অর্থ-সম্পদ ভোগবিলাসে প্রভাব পড়ল যুবক দ্বারকানাথের উপর।
দ্বারকানাথ সবে একুশ। ইতিমধ্যেই তিনি জমিদারি আইনব্যবস্থা সম্পর্কে বেশ অভিজ্ঞ।
– আমাদের জমিদারি ইংরেজরা আইনের প্যাঁচ মেরে লাটে তুলে দিচ্ছে। তুমি বাঁচাও বাবা।
বাপের বয়সি জমিদাররা প্রায় দ্বারকানাথের পায়ে এসে পড়তে লাগল। তারা জমিদারি আইনের কিছুই জানে না। গণ্ডমূর্খের দল।
– বাঁচাতে পারি, কত টাকা দেবেন?
– বাবা যা চাইবে, তাই দেব।
– চেষ্টা করে দেখছি।
বেশ কিছু চেষ্টায় সফল দ্বারকানাথ। ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে জমিদারি আইনে বিশেষজ্ঞ হিসেবে দ্বারকানাথের খ্যাতি।
সব সময়ে সৎ কথা, সত্যি কথা বলছেন না একুশ বছরের দ্বারকানাথ।
কত যে চতুরতার, শঠতার আশ্রয় নিচ্ছেন।
কিন্তু তাঁর উপর জমিদারদের আস্থা বাড়ছে।
আস্থা বাড়লে কী হবে, তাঁদের অন্যভাবে ঠকাচ্ছেনও দ্বারকানাথ। বেনামে কোনও কোনও মূর্খজমিদারের জমিদারি দখল করেও নিচ্ছেন তিনি।
আর একটি জিনিস লক্ষ করলেন রবীন্দ্রনাথ।
দ্বারকানাথ তাঁর উপার্জনের অর্থ তো উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
অন্তত যৌবনে অর্থকে রক্ষা করার বিষয়ে তিনি বিশেষ যত্নবান। কোনও প্রলোভনেই টাকা নষ্ট করেন না।
বরং নথিপত্র থেকে জানতে পারলেন রবীন্দ্রনাথ, বছরে জমিদারি থেকে অন্তত পঞ্চাশ হাজার টাকা তিনি জমিয়ে রাখেন।
সেই সময়ে পঞ্চাশ হাজার তো অনেক টাকা! ভাবেন রবীন্দ্র।
ঠিক, তেজারতি কারবারের নথিপত্রও পাওয়া গেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঝলকে বুঝেছেন, দ্বারকানাথ সুদে টাকা খাটান বেশিরভাগই সাহেব মহলে। তিনিই তাদের ভোগ-বিলাস-খরচের সহজ পথ দেখান।
তারপর হাসতে-হাসতে চড়া সুদে টাকা ধার দেন।
সুদে টাকা খাটিয়ে দিন দিন ধনী হচ্ছেন যুবক দ্বারকানাথ, এই প্রমাণও পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
ইংরেজ কখনও কখনও কী বোকা! দ্বারকানাথ সর্বদা কী চতুর! তিনি নির্ভুল ছকে সাজাতে পারেন দাবার চাল। একথা বারবার মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের। এমন একটি চরিত্র তিনি যদি আনতে পারতেন তাঁর কোনও একটি উপন্যাসে!
কিন্তু দ্বারকানাথকে উপন্যাসের চরিত্র করে তিনি তাঁকে নিজেই ম্যানেজ করতে পারবেন তো?
অত চাতুর্যের নাগাল তিনি নিজেও কি পাবেন?
রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত নন।
১৮২২ সাল।
দ্বারকানাথ ২৮।
তিনি এত টাকা উপার্জন করেও সন্তুষ্ট নন।
আশ্চর্য তাঁর অর্থতৃষ্ণা।
আরও টাকা চাই। আরও। আরও।
তিনি চব্বিশ পরগনায় আবগারি বিভাগে চাকরি নিলেন।
কীসের চাকরি?
রবীন্দ্রনাথ সবিস্ময়ে জানলেন, লবণ দফতরের সেরেস্তাদারের চাকরি।
মাস মাইনে ১৫০ টাকা।
দারুণ টাকাই বলা যায়।
কিন্তু উপরি পাওনা?
আবগারি বিভাগের চাকরিতে উপরি নেই?
তা-কি হতে পারে?
তা-কি হতে পারে যে পিতামহের কোনও মোহ ছিল না উপরির প্রতি?
তিনি কি একেবারেই উৎকচ-লোলুপ ছিলেন না?
মৃদু হাসি ফুটে ওঠে রবীন্দ্রনাথের ঠোঁটে।
২১
১৮২৮।
দ্বারকানাথ যেমন বাণিজ্যে, তেমনি চাকরিতে। জানেন উন্নতির পথ।
তিনি দেওয়ান হলেন।
অর্থাৎ ক্ষমতার অধিকারী।
ক্ষমতা কাজে লাগানো যাক।
দ্বারকানাথ রামমোহনের পাশে দাঁড়ালেন সতীদাহ-প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে।
একে ধনী। তায় ক্ষমতাবান। তার উপর আইনজ্ঞ চতুর মানুষ। এবং সবই দ্বারকানাথ পেয়েছেন তিরিশ বছর বয়েসের মধ্যে।
রামমোহন বিরোধী ও সতীদাহ-সমর্থক হিন্দুরা রে রে করে উঠল দ্বারকানাথের বিরুদ্ধে।
রবীন্দ্রনাথের মনে প্রশ্ন : পিতা একটিবারও কেন পিতামহের প্রশংসা করে তাঁর এই সমাজচেতনার কথা বললেন না?
রবীন্দ্রনাথ একটি জিনিস বিশেষভাবে লক্ষ করলেন।
দ্বারকানাথ অধিকাংশ বাঙালির মতো চাইলেন না চাকরি এবং মাস-মাইনের নিশ্চয়তা!
তিনি বেতননির্ভর বাঙালিদের একজন নন। তিনি হতে চেয়েছেন প্রবল ধনী।
প্রবল ধনী হতে গেলে বাণিজ্যের অনিশ্চয়তার মধ্যে যেতেই হবে। তাই করলেন তিনি।
১৮৩৪।
চাকরি ছাড়লেন চল্লিশ বছরের দ্বারকানাথ।
চল্লিশ বছর বয়েসে চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি ব্যবসা?
এ তো সুইসাইড। আত্মহত্যা।
এই পথই বেছে নিলেন দ্বারকানাথ।
কার সাহেবের সঙ্গে কার-টেগোর কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি।
কিন্তু ব্যবসা দ্বারকানাথের রক্তে। মনে রাখতে হবে, দ্বারকানাথের পূর্বপুরুষরা ব্যবসা করতেই কলকাতায় এসেছিলেন।
সাহেবদের সঙ্গে হাতমিলিয়ে উপার্জন।
অলস জমিদারি নয়। নিরলস বাণিজ্য।
চাকরির পাশাপাশি তেজারতি কারবার করছেন দ্বারকানাথ, সেই নথিপত্র দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ।
পিতামহ যে চাকরির আড়াল টেনে ইউরোপে রেশম ও নীল পাঠাচ্ছেন, তারও নথি দেখেছেন তিনি।
১৮২১ সালেই সাতাশ বছরের দ্বারকানাথ শিলাইদহে ‘রায়তি’ প্রথায় নীলের চাষ শুরু করেন।
‘রায়তি’ প্রথা মানেই তো অত্যাচার। চাষীদের মুখে রক্ত তুলে কাজ করানো। এবং কোনও ‘রেয়াত’ নেই।
রবীন্দ্রনাথের গা ঘিনঘিন করে ওঠে।
অন্যায়, ভারি অন্যায়! এ তো পাপ! তাঁর অন্তর চিৎকার করে ওঠে দ্বারকানাথের বিরুদ্ধে।
কিন্তু দ্বারকানাথের যে চাই আরও অর্থ।
তিনি শুরু করেছেন, নীল চাষের পাশাপাশি, রাম, জায়ফল, মৌরির ব্যবসা।
কোথায় যায় তাঁর মৌরি?
তিনি জাহাজ ভাড়া করেছেন। জাহাজের নাম ‘রেজোলিউশন’। সেই জাহাজ গোপন পণ্য নিয়ে ভেসে যায় বুয়েনস আইরেস-এর পথে।
১৮২১ সালে। একশো চার বছর পরে সেখানে যাবেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর দেখা হবে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে!
তখন রবীন্দ্রনাথ ৬৩।
সেদিন অনেক দূরের। রবীন্দ্রনাথ সেই ভবিষ্যতের কোনও আঁচ পাননি তখন।
এখন রবীন্দ্রনাথ মনের মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন একটি অভূতপূর্ব দৃশ্য- তাঁর পিতামহ একটি জাহাজ কিনেছেন।
তিনি মালিক হয়েছেন একটি গোটা জাহাজের!
জাহাজটির কী নাম?
রবীন্দ্রনাথের মোটেই ভাল লাগেনি এই নাম। ‘ওয়াটার উইচ’ নামটির মধ্যেই সাপের মতো কুণ্ডুলি পাকিয়ে আছে পাপ। সমুদ্রের ডাইনি!
একটি নয়। তিন-তিনটি আস্ত জাহাজের মালিক হলেন দ্বারকানাথ ধীরে ধীরে।
অন্য দুটি জাহাজের নাম ‘এরিয়েল’ ও ‘মাভিস।’
অ্যাতো জাহাজ কিনছেন কেন দ্বারকানাথ? তিনি যে আর পাঁচটা ধনী বাঙালির তুলনায় ঢের বেশি ধনী, তা প্রমাণ করবার জন্য?
ওটা তো আপাত আড়াল। ওই আড়ালের নীচে কী আছে? পরদা সরান রবীন্দ্রনাথ।
স্পষ্ট বুঝতে পারেন তিনি। দেবেন্দ্রনাথ ঠিকই বুঝেছেন। আফিমের ব্যবসা করেন দ্বারকানাথ।
চিন দেশের সঙ্গে আফিমের বাণিজ্যের খাটে তাঁর জাহাজ।
আফিম-বাণিজ্যের কোনও পাপবোধ, কোনও গ্লানি, কোনও অন্যায় দ্বারকানাথকে স্পর্শ করে না।
যে-পথেই লক্ষ্মীর আগমন হোক, সেই পথই শুদ্ধ তাঁর কাছে।
তবে শুধুমাত্র অহিফেনের বাণিজ্যই করেন না তিনি।
করেন কয়লার বাণিজ্য।
চিনির বাণিজ্যে তিনি রমরম করছেন। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় বারুইপুরে সমুদ্রের মতো জমিতে চলছে তাঁর আখের চাষ।
কী করবেন তিনি এত টাকা নিয়ে?
– কেন? শুধুই নিজের ভোগবিলাসে খরচ করেছেন! যে টাকা উপার্জন করেছেন, তার চেয়েও অধিক অর্থ উড়িয়ে দিয়েছেন নিজের ভোগ বিলাসে, জানিয়েছেন দেবেন্দ্রনাথ।
– কিন্তু তা-ই কি? রবীন্দ্রনাথ নথিপত্র ঘেঁটে নিজে জানতে পেরেছেন অন্য সত্য ও তথ্য।
১৮১৭ : হিন্দু কলেজ স্থাপনের কাজ শুরু করলেন দ্বারকানাথ।
১৮১৮ : ২৪ বছরের দ্বারকানাথ শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত প্রথম বাংলা কাগজ সমাচার দর্পণের প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
১৮৩৬ : মেডিকেল কলেজ স্থাপন করলেন।
এরপরই ভারতের প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র ‘বেঙ্গল হরকরা’- প্রধান পার্টনার দ্বারকানাথ।
১৮২১ : সাতাশ বছরের দ্বারকানাথ প্রতিষ্ঠা করলেন ‘সংবাদ কৌমুদী’।
সম্পাদক কে?
রামমোহন রায়!
এরপর বেরল বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘ইংলিশম্যান’।
কোনও ইংরেজের অর্থে নয়।
অর্থ দিলেন দ্বারকানাথ।
ঈশ্বর গুপ্ত বের করেছেন ‘সংবাদ প্রভাকর’?
টাকাটা কার?
কার আবার? দ্বারকানাথের!
এইসব সামাজিক কাজের জন্য যে আরও অর্থের প্রয়োজন। বাড়াতেই হবে জমিদারি।
দ্বারকানাথ কিনলেন কালীগ্রাম, সাহাজাদপুর, বিরাহিমপুরের কুমারখালি মৌজায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেশম কুঠি।
১৮৩৭।
দ্বারকানাথ ৪৩।
তাঁর একটি মূল কাজ এখন গঙ্গার মোহনা থেকে কলকাতার বন্দর পর্যন্ত জাহাজগুলিকে টেনে আনা।
এই কাজে বিপুল অর্থের উপার্জন।
এই বিশেষ কাজের একটি কোম্পানিও তৈরি করেছেন তিনি। ‘স্টিম টাগ অ্যাসোসিয়েশন।’
কেউ একজন দ্বারকানাথের কানে তুলল, স্টিমার মেরামতির একটি আধুনিক কারখানার প্রয়োজন।
– তা প্রয়োজন যখন, হোক কারখানা। দ্বারকানাথ স্টিমার মেরামতের কারখানা খুললেন খিদিরপুরে।
– তা এত স্টিমার চালাতে তো জ্বালানি লাগবে?
– তা তো লাগবে।
– কে দেবে এত জ্বালানি?
– ওটাই তো সমস্যা।
– আমি দেব। বললেন দ্বারকানাথ।
শুরু হল তাঁর স্টিমারের জ্বালানি সরবরাহের ব্যবসা।
– ভারত-ইংল্যান্ড জাহাজ-সংযোগের উন্নতির কথা ভেবে দেখেছ কখনও?
– ওরে বাবা। ওটা আমাদের কম্য নয়। সে তো আন্তর্জাতিক ব্যাপার। নাগালের বাইরে।
– কেন, নাগালের বাইরে কেন? আমি নামবো এই কাজে, বললেন দ্বারকানাথ।
আন্তর্জাতিক গৌরবে প্রতিষ্ঠিত পেনিনসুলার অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল জাহাজ কোম্পানি।
দ্বারকানাথ পার্টনার হলেন সেই কোম্পানির।
কিছুদিনের মধ্যেই ভারত-ইংল্যান্ড জাহাজ-সংযোগের ব্যাপারে শুরু হল সুয়েজ খননের কাজ।
অর্থই তো সব নয়। বাণিজ্যের জন্যে চাই ব্যাঙ্ক। আধুনিক ব্যাঙ্কিং। নিজের একটা ব্যাঙ্ক হলে কেমন হয়?
যেমন ভাবনা, তেমনি কাজ।
ষোল লক্ষ টাকা মূলধন বিনিয়োগ করে পঁয়তিরিশ বছরের দ্বারকানাথ নিজেই প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক’।
রবীন্দ্রনাথ কিছুটা বিস্মিত।
বাবামশায় তো পিতামহ সম্পর্কে এইসব কথার কিছুই জানাননি! তবে নথিপত্র থেকে জমিদার হিসেবে দ্বারকানাথের পরিচয় পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। এককথায় অত্যাচারী জমিদারই ছিলেন তিনি। খাজনা আদায়ের জন্য গরিব প্রজাদের উপর অকথ্য অত্যাচার করতে তাঁর বাধেনি। নিজে না পারলে কুঠিবাড়ির সাহেবদের দিয়ে অত্যাচার করিয়েছেন। কাঙাল হরিনাথের ছোট্ট একটি নোট পেয়েছেন তিনি। হরিনাথ প্রাচীন গ্রামবাংলার নির্ভীক সাংবাদিক। তাঁর কাগজের নাম ‘গ্রামবার্তা’। তিনি শিলাইদহ ঠাকুর-জমিদারদের প্রজা-পীড়ন সম্পর্কে লজ্জাকর সত্যের উদ্ঘাটন করেছেন। তাঁর দিনলিপিতেও ঠাকুর-জমিদারদের প্রজাপীড়নের বর্ণনা আছে। কাঙাল হরিনাথ লিখছেন : দ্বারকানাথ শিলাইদহ-জমিদারির মালিক হওয়ার পর ‘তাঁহারা তের হাজার টাকা রাজকর দান করিয়া এক্ষণে লক্ষ টাকার উপরেও লাভবান হইয়াছেন। অথচ প্রজা-শোষণের ইচ্ছা ক্রমেই বলবর্তী হইতেছে।’
কাঙাল হরিনাথের এই নোটটির কথা মনে হতেই রবীন্দ্রনাথের সমস্ত মন ঘৃণায় ঘিনঘিন করে ওঠে।
এখানেই থামেননি কাঙাল। আরও অনেক কিছু লিখেছেন যা দ্বারকানাথ, এমনকী দেবেন্দ্রনাথের পক্ষেও লজ্জাকর, বেদনাদায়ক। হরিনাথ লিখছেন যে কুমারখালির বাজারটি সেখানকার রেশমকুঠির কার্যাধক্ষ উইলিয়ম সাহেব দ্বারকানাথকে বিনামূল্যে হস্তান্তর করেন।
এই হস্তান্তরের আগে উইলিয়ম সাহেব কুমারখালির অন্ধ, আতুর, অনাথ বালক-বালিকাদের অন্তত কিছু সাহায্য করতেন। কিন্তু হস্তান্তরের পরে দ্বারকানাথ বিলাতের ব্লাইড ফান্ডে অর্থ সাহায্য করে নিজের গৌরব বৃদ্ধি করেন। হরিনাথ যে মনে করেন এই দানের পিছনে দ্বারকানাথের রাজসম্মান পাওয়ার অভিসন্ধি কাজ করে ছিল, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
দ্বারকানাথের পর যখন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, তখন কি অত্যাচার, অনাচার কমল? প্রজাদের উপর অত্যাচার কিছুটা নরম হল? রবীন্দ্রনাথ পড়লেন কাঙাল হরিনাথের বার্তা :
‘দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যে পর্যন্ত মহর্ষি নাম গ্রহণ করেন নাই, সে পর্যন্ত প্রজাগণ তাঁহাকে দুঃখ নিবেদন করিয়া কিছু কিছু ফল পাইয়াছে। কিন্তু তিনি মহর্ষি নাম পরিগ্রহ করিলে, তাহার পর প্রজার হাহাকার তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিতে অবসর পায় নাই। দূরবস্থা দেখিতে নির্মীলিত চক্ষু উন্মিলিত হয় নাই।’
এই নালিশের সব সত্য উড়িয়ে দিতে পারেন না রবীন্দ্রনাথ। তিনি জমিদারিতে গিয়ে এইটুকু উপলব্ধি করেছেন যে, বাবামশায় প্রজাদের জলকষ্ট দূর করবার জন্যে কিছুই করেননি। কোনও রকম উপকার কি তিনি আদৌ করেছেন? একথাও তো ঠিক প্রজাদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার হোক, তাও তো চাননি তিনি। তাঁর ভয়, ইংরেজি শিখলে প্রজাদের শাসনে রাখা সহজ হবে না। তারা দুর্বিনীত হয়ে উঠবে। হরিনাথ তো স্পষ্টই লিখেছেন:
‘ধর্মমন্দিরে ধর্মালোচনা আর বাহিরে আসিয়া মনুষ্যশরীরে নিরাপরাধে পাদুকা প্রহার, একথা আর গোপন করতে পারি না।’
অসম্ভব। মিথ্যা লিখেছেন কাঙাল হরিনাথ। বাবামশায়ের পক্ষে এই মিথ্যাচার, নীচতা সম্ভব নয়, রবীন্দ্রনাথের সমস্ত মন বলে ওঠে। মন্দিরে ধর্মালোচনা করে নিরাপরাধ প্রজাকে জুতো মারবেন বাবামশায়? মিথ্যা। মিথ্যা। মিথ্যা।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথকে বুঝতে পারা কাঙাল হরিনাথের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা বলতে তাঁর আটকায়নি তাই। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের পক্ষে যাঁরা জমিদারির ভার দিলেন, তিনিও তো আছেন তাঁদের মধ্যে, তাঁদের সম্পর্কেই বা কীসব লিখেছেন হরিনাথ!
‘মহর্ষি অবসর গ্রহণ করিলে, যাঁহারা জমিদারি শাসনের ভার পাইলেন, তাঁহারা যতোধিক ইংরাজিতে সুশিক্ষিত, ততোধিক কূট কৌশলবুদ্ধির অর্থাৎ ইংরাজ পোলিশির কৃতদাস। সুতরাং ব্রহ্মপরায়ণতা ও ধার্মিকতা দেশহিতৈষিতা চিহ্নস্বরূপ গীতিকবিতা রচনা করিয়া বাহিরে যতই কেন সাধুতা প্রদর্শন না করুন, অন্যায় শোষণ ও তজ্জন্য অত্যাচারে প্রজার শরীরে আর রক্ত থাকিল না, যতই কেন অত্যাচারিত না হউক, এতই দুর্বল যে কাহারও মাথা তুলিবার সাধ্য থাকিল না, তাহারা পূর্বে চিৎকার করিত, এক্ষণে ক্ষীণস্বরে হাহাকার করিয়া বক্ষস্থল কেবল সিক্ত করিতে লাগিল। এদিকে জমিদারের অট্টালিকা কোথায় বিলাসসুখের হাস্যধ্বনিতে ও কোথায় ব্রাহ্মধর্মের শ্রুতি স্তোত্রপাঠে ধ্বনিত হইল।’
রবীন্দ্রনাথ একটি কথাও বিশ্বাস করতে চান না। মনে মনে বলেন, বাবামশায় ঠিকই বলেছেন। এই মিথ্যার বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই।
পুড়িয়ে ফেলাই ভাল।
২২
১৮৪০।
দ্বারকানাথ ৪৬।
তিনি একটি চিঠি লিখেছেন পুত্র দেবেন্দ্রনাথকে। বিলেত থেকে। নথিপত্রের মধ্যে সেই সেই পত্রটি একটু আগে পড়েছেন রবীন্দ্রনাথ। এই মর্মে দেবেন্দ্রনাথকে পত্র লিখেছেন পিতা দ্বারকানাথ যে তাঁর মতো অপদার্থ পুত্রের হাতে জমিদারির ভার দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। দেবেন্দ্রনাথ অপদার্থ পুত্র কেন? কারণ তিনি জমিদারি না দেখে, খাজনা আদায়ের দিকে মন না দিয়ে, ক্রমাগত ধর্মীয় আলোচনায় সময় নষ্ট করছেন। দ্বারকানাথ যদি পারতেন বিলেত থেকে দেশে ফিরে তিনি নিজেই জমিদারি ও বিষয় সম্পত্তির হাল ধরতেন। কিন্তু সেই কাজটি করার তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ বাংলার কর্কশ জলবায়ু, প্রকৃতি পরিবেশ তাঁর শরীর সহ্য করতে পারে না। বিলেতের বাতাসে তাঁর শরীর ভাল থাকে।
দ্বারনাথ বিচক্ষণ।
তিনি বুঝতে পেরেছেন তাঁর বংশধরদের কেউই অর্থ উপার্জন করতে পারবে না। তাদের ওই জমিদারি ভাঙিয়েই চালাতে হবে। তিনি তাই ছেচল্লিশ বছর বয়েসেই একটি ট্রাস্টডিড করলেন। যার ফলে তাঁর ছেলেরা বাণিজ্য চালাতে না পারলেও সম্পত্তির কিছুটা অন্তত বেঁচে যাবে। তাঁরাও খেয়েপরে বাঁচবেন।
এই ট্রাস্টডিউটির অন্তর্ভুক্ত হল তাঁর কয়েকটি জমিদারি, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি, এবং দূরদর্শী দ্বারকানাথ এমন ব্যবস্থা করে গেলেন যে ব্যবসা পড়ে গেলেও তাঁর সম্পত্তি বংশধরেরা ভোগ করতে পারবেন।
যদি দ্বারকানাথ এই ব্যবস্থা না করে যেতেন? রবীন্দ্রনাথ নিজেকে প্রশ্ন করেন।
উত্তর ভেসে ওঠে তাঁর মনের মধ্যে। বারবার ভাবেন। তবু সেই একই উত্তর।
পিতামহ ট্রাস্টডিড না করে গেলে, আমরা তিন পুরুষ, বাবামশায় আমি, আমার পুত্র রথীন্দ্র, এই জমিদারি ও সম্পত্তি ভোগ করতে পারতাম না।
রবীন্দ্রনাথ মনে মনে বলেন, এই যে আমি ঘুরে বেড়াই, সাহাজাদপুর, বিরাহিমপুর, শিলাইদহ, কালীগ্রাম, উড়িষ্যার পাণ্ডুয়া, বালুয়া- সমস্তই তো দ্বারকানাথের উইলভুক্ত সম্পত্তি।
কোনও কিছুই তৈরি করেননি বাবামশায়। কোনও নতুন সম্পত্তি আমার পক্ষেও করা সম্ভব হয়নি।
এমনকী যে-বোটে আমি পদ্মার মুকে ভেসে বেড়াই, সেই পদ্মা-বোটও তো পিতামহের তৈরি।
শুধু ‘পদ্মা’-নামটি আমার অবদান।
রবীন্দ্রনাথ আরও একবার ভাবেন দ্বারকানাথকে। কী প্রবল পুরুষ। আমরা কেউ নই তাঁর মতো, একথা স্বীকার করতে তাঁর বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই মনে।
দ্বারকানাথ কি ভালবাসা পেয়েছিলেন?
তার পক্ষে কি সম্ভব ছিল পিতামহী দিগম্বরী দেবীকে ভালবেসে তাঁর সঙ্গে সারা জীবন কাটানো?
বছর তেইশের ব্রিটিশ অভিনেত্রী এসথার-এর প্রেমে পড়লেন আমার চল্লিশ বছরের পিতামহ!
সেটাও কি খুব অন্যায়?
বিচার করবে কে? আমি?
না কি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ?
১৮৪৬-এর ৯ মার্চ।
দ্বারকানাথ প্যারিস থেকে ফিরে এসেছেন লন্ডনে।
তাঁর হঠাৎ শরীর খারাপ কেন?
১৮৪৬-এর ৩০ জুন।
এক ডাচেস-এর পার্টি। কী সম্পর্ক দ্বারকানাথের সঙ্গে এই ডাচেসের?
দ্বারকানাথকে সুরা দিলেন স্বয়ং ডিউক।
সুরাপানের পরেই অসুস্থ কেন দ্বারকানাথ?
একেবারে ইংরেজ সমাজের শীর্ষে প্রিন্স দ্বারকানাথের মেলামেশা।
অনেক ইংরেজই তা সহ্য করতে পারেনি।
বিশেষ করে দ্বারকানাথের সঙ্গে অভিজাত ইংরেজ মহিলাদের সম্পর্ক। এবং স্বয়ং রানি ভিক্টোরিয়ার মধুর আদান-প্রদান, নেপথ্য ঘনিষ্ঠতা- এসব ক’দিন সহ্য করবে ইংরেজ?
অসুস্থ দ্বারকানাথকে নিয়ে যাওয়া হল ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলে।
ব্রাইটন থেকেও দূরে।
কেন এই গোপনীয়তা?
কারণ ওয়রদিং-সমুদ্র-তীরে আছে এক স্বাস্থ্যনিলয়!
লন্ডনে কি হাসপাতালের অভাব হল?
১৮৪৬-এর ২৭ জুলাই।
দ্বারকানাথ গভীর কোমায়! সম্পূর্ণ অচৈতন্য!
তিনি কোনও স্বাস্থ্যনিলয়ে নেই।
কোনও হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা হচ্ছে না।
তিনি শুয়ে আছেন সেন্ট জর্জ হোটেলের বিছানায়।
চারদিন পর। ৩১ জুলাই।
মারা গেলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ। বয়েস ৫২।
১৮৪৬-এর ১ অগাস্ট।
প্রিন্সকে সমাধিস্থ করা হল কেনসিল গ্রিন-এ!
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পরে ধস নামল ঠাকুরবাড়িতে। এই রকম সেই ধসের চেহারা :
১। দেড়বছরের মধ্যে উঠে গেল দ্বারকানাথ প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক। ১৮৪৭-এর ২৭ ডিসেম্বর।
২। দ্বারকানাথের মৃত্যুর তিন সপ্তাহের মধ্যে বন্ধ হল কার-টেগোর কোম্পানি। দেবেন্দ্রনাথ এবার একে একে বিক্রি করছেন দ্বারকানাথের সম্পত্তি-
৩। বিক্রি হল বেলগাছিয়া-ভিলা- স্বপ্নের মতো সম্পত্তি।
৪। বিক্রি হল কলকাতার সাহেব পাড়ায় ও বাঙালি পাড়ায় বহু অট্টালিকা ও সম্পত্তি।
৫। বিক্রি হল রানিগঞ্জের কোলিয়ারি ও জমি।
৬। বিক্রি করলেন দেবেন্দ্রনাথ বিভিন্ন জায়গার জমিদারি, কুঠিবাড়ি। এবং এই ধ্বংসের জন্য দায়ি করা হল দ্বারকানাথকেই। প্রতিবাদ করলেন অনেক পরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর :
‘কার-ঠাকুর পতনের মূল কারণ দ্বারকানাথের পুত্রগণের বৃহৎ কারবার চালাইবার অক্ষমতা। একটি বৃহৎ কারবার চালাইতে গেলে যে বুদ্ধি, যে দূরদর্শিতা, এবং সর্বোপরি যে সংযম আবশ্যক, সত্যের অনুরোধে বলিতে বাধ্য যে দেবেন্দ্রনাথ প্রভৃতি তিন ভ্রাতার কেহই তাহা প্রাপ্ত হন নাই।
পরিশ্রম করিয়া মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া অর্থোপার্জনের পক্ষে তাঁহারা তিন জনেই অসমর্থ ছিলেন বলিলে অত্যুক্তি হইবে না।’
ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর এইখানেই থামেননি। দ্বারকানাথের ঘাড়ে কী মিথ্যা অপবাদ দেবেন্দ্রনাথ চাপালেন, তা-ত তিনি বলে গেছেন:
‘দ্বারকানাথ জীবিত থাকিতে ইহার দেনা সম্বন্ধে একটি কথাও উঠে নাই। বাস্তবিক দেবেন্দ্রনাথের লেখা মত যদি ধরা যায় যে কারবারের দেনা এক কোটি ছিল এবং পাওনা সত্তর লক্ষ, অসংস্থান ত্রিশ লক্ষ। একটি বিস্তৃত চলতি কারবারের পক্ষে এই অসংস্থান যে অত্যন্ত ভয়াবহ ছিল তাহা তো বোধ হয় না। আরও দেখিতে হইবে যে দ্বারকানাথের মৃত্যুর পূর্বেই বা কি দেনা ছিল এবং তাঁহার মৃত্যুর পরে এক বৎসরের মধ্যেই বা কি দেনা হইল। দেবেন্দ্রনাথ গিরীন্দ্রনাথের কথায় সায় দিয়া তাঁহার হাতে কার্যভার সমর্পণ করিয়া ধর্মবিষয়ক চিন্তায় মনোনিবেশ করিবার প্রচুর অবসর পাইয়াছিলেন, তাহাতেই আনন্দিত। এই কারবার রক্ষা করা, পৈতৃক বিষয় প্রাণপণে রক্ষা করা যে একটা বিশেষ ধর্ম তাহা তাঁহার বুদ্ধিতে তখন প্রবেশ করে নাই। ঈশ্বরের কৃপায় তাঁহার পৈতৃক বিষয় যেন রক্ষা পাইয়া গেল। তাহা না হইলে, হাউসের দেনার দায়ে বিকিয়ে গেলে তাঁহার কি অবস্থা হইত?’
এরপর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে একটি মর্মান্তিক প্রশ্ন তুলেছেন নাতি ক্ষিতীন্দ্রনাথ!
‘তিনি (দেবেন্দ্রনাথ) যে ধর্মের প্রতিষ্ঠার জন্য সমস্ত জীবন অতিবাহিত করিলেন, তাহার কী যে অবস্থা হইত, তাহা ভাবিতে পারা যায় না। নির্ঝঞ্ঝাটে প্রয়োজন মতো টাকাকড়ি জমিদারি হইতে আসুক, তাহা হইলেই দেবেন্দ্রনাথ সুখী।
তিনি তাঁহার পিতাকে খুব অল্পই বুঝিতে পারিয়াছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ তাঁহার পিতার বিশ্বতোমুখী প্রতিভা যে আয়ত্ত করিতে পারেন নাই, তাহা কিছু আশ্চর্য নহে।’
২৩
ভোরের আলো এবার ফুটতে চলেছে।
আর দেরি নয়।
পিতার আদেশ অমান্য করা অন্যায়। পাপ।
রবীন্দ্রনাথ মনে মনে তৈরি, দ্বারকানাথের সমস্ত নথিপত্র, বাণিজ্যের সকল ইতিহাস ও প্রমাণ পুড়িয়ে ফেলার জন্য।
আর ভাবনার সময় নেই।
ভাবনা মানেই দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেয়া।
পিতামহের নথিপত্রে অগ্নিসংযোগ, এই আমার একমাত্র কর্তব্য।
জোড়াসাঁকোর বাড়ির ছাদের এক কোণে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটালেন রবীন্দ্রনাথ।
বেশিক্ষণ লাগল না।
সমস্ত নথি পুড়ে ছাই হয়েছে।
সম্পূর্ণ অবলুপ্ত।
ক্ষীণতম আশা নেই পুনরুদ্ধারের।
রবীন্দ্রনাথ ছাইগাদার উপর ঢেলে দিলেন গঙ্গাজল।
সুপ্ত হোক। শান্ত হোক। স্নিগ্ধ হোক অতীত।
এখন শুধু বর্তমান।
দ্বারকানাথের লুপ্তি ছাড়া পিতার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।
আর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠা ছাড়া নিজেকেও কি কোনও দিন আচার্যের আসনে ভাবতেন পারবেন?
পুবের আকাশে উঠছে রাঙা সূর্য।
ঠিক যেন ঈশ্বরের মুখ, মনে হল রবীন্দ্রনাথের।
সূর্যপ্রণাম করলেন তিনি।
তারপর প্রতিশ্রুত হলেন নিজের কাছে। সূর্যের কাছেও।
জোড়াসাঁকোর বাড়ির নাম দেব ‘মহর্ষি ভবন’।
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের লুপ্তি তাহলেই সম্পূর্ণ হবে।
পুণ্যের জয়।
পাপের পরাজয়।
এ তো চিরকালীন সত্য।
ভাবলেন প্রভাত সূর্যে স্নাত রবীন্দ্রনাথ।
তাঁর বুকটা বেশ হালকা লাগছে।
বেশ সংশয়হীন আর তৃপ্ত তিনি।
পিতার অমৃতদীক্ষায় শান্তায়িত!