কুড়ি
বাড়িটির সামনে প্রশস্ত গাড়ি বারান্দা, সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই একজন ভৃত্য আমাদের আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চেয়ে একটি স্লিপে নাম লিখতে বলল। কয়েক ধাপ শ্বেতপাথরের সিঁড়ির পর দু’দিকে দুটি ঘর, মাঝখান দিয়ে কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। দু’-এক মিনিট বাদেই ডানদিকের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এক দীর্ঘকায় ব্যক্তি, খুবই হৃষ্টপুষ্ট, স্থূলকায়ই বলা উচিত, ঢোলা পা-জামা ও পাতলা সাদা পাঞ্জাবি-পরা, ইনিই স্বয়ং গৃহকর্তা দিলীপকুমার গুপ্ত। প্রথমে তাঁর দৃষ্টি চলে গেল আমাদের মাথার ওপর দিয়ে, আমাদের মতন মলিন পোশাক পরা, ধুলো মাখা পা, প্যান্টের সঙ্গে চটি, অকিঞ্চিত্বর চেহারার দুটি ছোকরাকে তিনি দর্শনার্থী হিসেবে ভাবতে পারেননি। কিন্তু আর কেউ নেই দেখে, ‘আপনি’ সম্বোধন করে সহৃদয়ভাবে বললেন, আসুন, আসুন।
ঘরটি বেশ বড়, তার একদিকে কয়েকটি সোফা ও নিচু টেবিল, অন্যদিকে লম্বা উঁচু টেবিল ও অনেকগুলি চেয়ার এবং প্রচুর বই। এর আগে উত্তর কলকাতায় দু’-একটি বনেদি বড়লোকের বাড়িতে আমার প্রবেশ ঘটেছে বটে, কিন্তু এরকম আধুনিক ধনী গৃহ দেখার সুযোগ এই প্রথম। সব কিছুই অতি ছিমছাম, নিখুঁতভাবে সাজানো, যেন একটু নড়াচড়া ঘটলেই ছন্দপতন ঘটবে, তাই আড়ষ্ট হয়ে বসতে হয়। কার্পেট পাতা মেঝেতে চটি পরে আসাও যে উচিত হয়নি, তা তখন বুঝিনি। সত্যজিৎ রায়ের মতনই ডি কে’র কণ্ঠস্বরও ভরাট ও উদাত্ত, মুখখানি সদা হাস্যময়। আগে অনেক বাঙালিরই বেশ গমগমে গলার আওয়াজ হত, এখন আর তেমন শোনাই যায় না, অন্য অনেক কিছুর মতন বাঙালির কণ্ঠস্বরও সরু হয়ে গেছে!
ডি কে অতিশয় ব্যস্ত মানুষ। সাহেবি কোম্পানিতে উচ্চ চাকরি করেন এবং প্রকাশক হিসেবেও শীর্ষস্থানীয়। রবিবার সকালে তাঁর কাছে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি ও উমেদার আসার কথা, যদি সে রকম ভিড় থাকত, তিনি আমাদের মাত্র পাঁচ-দশ মিনিট সময় দিতেন, তা হলে পরবর্তী ঘটনাগুলি কিছুই ঘটত না। কোনও বিস্ময়কর কারণে সেদিন লোকজন আসেনি, শেষের দিকে কেউ এলেও ডি কে দেখা না করে ফিরিয়ে দিয়েছেন, আমাদের সঙ্গে তিনি কথা বললেন সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে! এর মধ্যে আমাদের জন্য প্লেটে সন্দেশ ও কাজুবাদাম এবং সুদৃশ্য ফ্রস্টেড গ্লাসে পাকা বেলের সরবত এসেছে, তারপর কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর চা। আমাদের দিকে তিনি গোল্ড ফ্লেকের টিন এগিয়ে দিয়েছেন। (সে সময়ে দামি ব্র্যান্ডের সিগারেট পঞ্চাশটি একসঙ্গে একটি টিনের কৌটোয় পাওয়া যেত, কৌটোগুলি বেশ মজবুত, অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের রান্না ঘরে সেইসব কৌটোয় রাখা হত নানা ধরনের মশলা, এখন সারা পৃথিবী থেকেই সিগারেটের সেই কৌটো-প্রথা উঠে গেছে।)
বলাই বাহুল্য, দীপকই মুখপাত্র, আমি প্রায় নিঃশব্দ। দীপক আমাদের দ্বৈত কাব্যগ্রন্থ ছাপার প্রস্তাব জানিয়ে, সত্যজিৎ রায়কে দিয়ে মলাট আঁকাতে যে প্রায় রাজি করে ফেলেছে, তা উল্লেখ করতেও দ্বিধা করল না। ডি কে এ-প্রস্তাব হেসে উড়িয়ে দিলেন না। তাচ্ছিল্য প্রকাশ করলেন না, বরং প্রশ্ন করতে লাগলেন, আমরা কোথায় থাকি, কোন কলেজে পড়ি, কবে থেকে কবিতা লেখা শুরু করেছি, কবিতা লেখার জন্য বাড়ির মানুষদের প্রশ্রয় আছে কি না, কোথায় কবিতা ছাপা হয়। বাংলা সাহিত্যের বর্তমান লেখকদের লেখা পড়ি কি না ইত্যাদি। অনেকটা আড্ডার মতন পরিবেশ হওয়ায় আমার আড়ষ্টতা খানিকটা কেটে যায়, এবং শেষোক্ত বিষয়টিতে দীপকের চেয়েও আমি স্বচ্ছন্দভাবে অংশ নিতে পারি, কারণ দীপক আমার মতন পড়ুয়া ছিল না।গোপাল হালদার যে শুধু প্রাবন্ধিক নন, যেমন সঞ্জয় ভট্টাচার্য নন শুধু কবি, এঁরা যে উপন্যাসও লিখেছেন, তা দীপক জানে না।
আলোচনার মধ্যপথে ডি কে বললেন, আপনারা কবিতার বই ছাপবেন, তার এত ব্যস্ততা কীসের? তার চেয়ে এক কাজ করুন না, আপনাদের বন্ধুবান্ধব, সমসাময়িক কবিদের অনেকের লেখা একসঙ্গে ছাপুন, যাতে বোঝা যায়, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব, সুভাষ, নীরেন্দ্রনাথ, সুকান্তর পর বাংলা কবিতা কোনও বাঁক নিয়েছে, না একই রকম লেখা হচ্ছে। বাংলা কবিতার তারুণ্যের ধারাটি অনুধাবন করার আর কী উপায় আছে? অর্থাৎ নতুন একটি কবিতার পত্রিকা, যাতে শুধু তরুণ বয়স্কদেরই রচনা মুদ্রিত হবে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে রাজি, কিছু আলোচনার পর নামও ঠিক হয়ে গেল, ‘কৃত্তিবাস’। ডি কে বললেন, বাংলা কবিতার আদি কবিদের মধ্যে প্রধান কৃত্তিবাস, তাঁর নামের পত্রিকায় থাকবে অতি সাম্প্রতিক কবিতা, অর্থাৎ ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হবে আধুনিকতা। তিনিই প্রেস ঠিক করে দিলেন, পরদিন থেকেই আমরা মেতে উঠলাম রচনা সংগ্রহের কাজে।
তখন তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত কবির নাম শঙ্খ ঘোষ। সিটি কলেজের বাংলা ক্লাসে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এই কবির কবিতা পাঠ করে শুনিয়েছেন। ‘পরিচয়’ পত্রিকায় শঙ্খ ঘোষের কবিতা পড়ে আমরাও মুগ্ধ। তাঁর কবিতা তো পেতেই হবে। শঙ্খ ঘোষের কবিতা ভর্তি একটা আস্ত খাতা পেয়ে আমাদের কী উল্লাস! যাকে বলে ‘মুক্তোর মতন’ হস্তাক্ষর, প্রতিটি কবিতাতেই হীরকদীপ্তি। সম্ভবত সেই খাতায় তিনি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করছিলেন, প্রথম পৃষ্ঠায় শুধু ‘শ্রী’ লেখা, সেই খাতা থেকে দীর্ঘতম কবিতাটি, ‘দিনগুলি রাতগুলি’ মুদ্রিত হল প্রথম সংখ্যার প্রথম কবিতা হিসেবে। সেই কবিতাটি একালের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিতাবলীর অন্যতম। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তও অল্প বয়েস থেকে কবিতা লিখছেন, সে সময় স্বনামধন্য। তিনি থাকেন সুদূর দক্ষিণ কলকাতায়, তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ হয়নি, ডাকে পাঠিয়েছিলেন ‘অবিনশ্বর’ নামে একটি চমৎকার লেখা। দক্ষিণ কলকাতা নিবাসী আরও দু’জন কবি আলোক সরকার এবং অরবিন্দ গুহ তরুণদের মধ্যে সুপরিচিত, তাঁরাও আমাদের অনুরোধে সাড়া দিলেন। আলোক সরকার দুটি কবিতা পাঠালেন এ ছাড়া অন্যান্যদের সঙ্গে আনন্দ বাগচীর দীর্ঘ কবিতা এবং দীপকের দুটি কবিতা, তার মধ্যে একটি শামসুর রাহমানকে উৎসর্গ করা। আমার কবিতাটিই সবচেয়ে দুর্বল, সেটি ছাপা হয়েছিল একেবারে শেষে। অকারণে আভিধানিক শব্দ প্রয়োগের লোভ সংবরণ করতে পারিনি। সে কবিতার নাম ‘নীলিরাগ’, তার মধ্যে একটি শব্দ ছিল ন্যগ্রোধ পরিমণ্ডলা, পরবর্তী কালে লজ্জায় আমি সে কবিতাকে কোনও কাব্যগ্রন্থে স্থান দিইনি।
প্রথমে ঠিক ছিল দীপক ও আমার নামই সম্পাদক হিসেবে ছাপা হবে। দীপকের নাম তবু কেউ কেউ জানে, আমি প্রায় অজ্ঞাতকুলশীল। শুধু আমাদের নাম থাকলে কেউ গুরুত্ব দেবে কি না এই সন্দেহে আমরা দীপকের সহপাঠী আনন্দ বাগচীর নামও যুক্ত করে নিই। প্রথম প্রকাশ, শ্রাবণ ১৩৬০, তখন বাংলায় সন-তারিখ লেখাই রীতি ছিল। মোট চল্লিশ পৃষ্ঠা, মূল্যবান কাগজ, মুদ্রণও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, প্রত্যেক পৃষ্ঠায় ওপরে-নীচে দুটি করে ঢেউ খেলানো রুল দিয়ে এর আগে কোনও কবিতা পত্রিকা ছাপা হয়নি। লিট্ল ম্যাগাজিনের অন্যতম লক্ষণ এই যে শুধু রচনায় নতুনত্ব নয়, ছাপাতেও চোখে পড়ার মতন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অন্য পত্রিকা থেকে স্বাতন্ত্র রক্ষা করতে হবে।
প্রথম সংখ্যাটি এখন হাতে নিয়ে দেখছি, সম্পাদকদের পক্ষ থেকে সবকটি গদ্য রচনাই আমার, নিয়মাবলী, সম্পাদকীয় এবং শেষে ‘কাব্যসভা’ নামে একটি প্রতিবেদন। অন্য সম্পাদকদ্বয় গদ্যে কলম ধরেননি। অবশ্য কৃত্তিবাসেরও আগে পত্রিকা সম্পাদনার কিছুটা অভিজ্ঞতা আমার ছিল, কলেজের প্রথম বর্ষে এসে, স্কুলের বন্ধুদের সহযোগিতায় আমি একটি ক্ষণস্থায়ী পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলাম। প্রথমে সে পত্রিকার নাম ছিল ‘আগামী’, পরে জানা গেল ওই নামে অন্য পত্রিকা আছে, তাই ‘সাহিত্য’ জুড়ে দেওয়া হল। সে পত্রিকার অধিকাংশ গদ্য-পদ্যই আমার কপোল কল্পিত এবং কলম-নির্গত। অর্থাৎ যেসব বন্ধু জীবনে এক লাইনও কবিতা লেখেননি, আমার নিজের কবিতা ছাপিয়ে দিয়েছি তাদের নামে। দুটি সংখ্যার পরই সেই কৃশ পত্রিকাটি সাধনোচিত ধামে প্রস্থান করে। কৃত্তিবাস কিন্তু প্রথম সংখ্যা থেকেই জয় পতাকা তুলে ধরেছিল।
প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে এই নতুন পত্রিকা প্রকাশের যৌক্তিকতা বর্ণনার সঙ্গে এমন একটা প্রসঙ্গও যুক্ত হয়েছিল, যা এখন বিস্ময়কর মনে হয়। সেই ১৯৫৩ সালে আমি লিখেছিলাম, “বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে পাকিস্তানের (অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের) কবিদের স্থান প্রায় অনুল্লেখ্য। তাতে কোনও দুঃখ থাকত না—যদি না তাঁদের কেউ কেউ আশ্চর্য সার্থক কবিতাও লিখতেন। বাংলাদেশের শারীরিক মানচিত্রের মতোই কাব্যের মানচিত্র খণ্ডিত হয়েছে। কিন্তু উভয় বঙ্গে বাংলা ভাষার পূর্ণ অধিকার সম্বন্ধে যেন আমাদের কখনও সন্দিগ্ধ না হতে হয়। পাকিস্তানের তরুণ কবিরা আমাদের সমদলীয়, সহকর্মীও। এ সংখ্যায় তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হল না, কিন্তু আগামী সংখ্যায় আমরা নিশ্চয়ই সক্ষম হবো।” সেই সময় থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে আসছে, সে জন্য আমার মনে যে বেদনাবোধ ছিল, এই লেখায় তারই প্রতিফলন।
আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কৃত্তিবাসে কবিতা লিখবে শুধু তরুণ কবিরা, কিন্তু প্রবন্ধ প্রার্থনা করা হবে প্রবীণদের কাছ থেকে। প্রথম সংখ্যাতেই আমরা দু’জন প্রবীণ কবির প্রবন্ধ সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম। এঁদের মধ্যে অতিশয় বিখ্যাত সমর সেন হঠাৎ কবিতা লেখা ছেড়ে দেবার কথা ঘোষণা করে বসে আছেন, বাংলা ভাষাতেই আর কিছু লিখবেন না এমন একটা যেন প্রতিজ্ঞা, তাঁর কাছ থেকে রচনা জোগাড় করা কম কঠিন ব্যাপার নয়। লেখাটি ছোট, কিন্তু মূল্যবান। নতুন কবিদের স্বাগত জানিয়েও তিনি লিখেছিলেন, “দেশের মাটির, দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় বলতে গেলে সবে মাত্র শুরু হয়েছে, আত্মীয়তায় এখনও পরিণত হয়নি। ফলে নতুন প্রভাবে বাগাড়ম্বরের দিকে বাঙালির স্বাভাবিক ঝোঁক আরও প্রখর হতে পারে, মানবিকতার নামে কীর্তনের ভাবালুতা আবার আসতে পারে এবং কবিরা ভুলে যেতে পারেন যে বুদ্ধি ও আবেগের সমন্বয়ই সার্থক কবিতার উৎস।” অপর কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র পরে গায়ক ও আই পি টি এ’র কিছু গানের সুরকার হিসেবেই বেশি পরিচিত হয়েছিলেন, কিন্তু সেই সময় তাঁর বিখ্যাত দীর্ঘ কবিতা “মধুবংশীর গলি” শম্ভু মিত্রের আবৃত্তিতে খুবই জনপ্রিয়। তাঁর প্রবন্ধের বক্তব্য, আধুনিক কবিতা থেকে সুর ও গীতিময়তা বিদায় নিয়েছে, তার বদলে পশ্চিমি কায়দায় বিচিত্র বাগবিন্যাস ও আঙ্গিক সর্বস্বতা এসে পড়ায় এই সব কবিতা সাধারণ জনমানস থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। “কবিদের হাতে আশ্চর্য পেকে উঠল (সেই বাগ বিন্যাস)। কিন্তু সে পাকা হাতের ফল প্রাকৃত জনের আস্বাদনের বস্তু হল না। বিশেষ করে আমাদের দেশের অর্ধশিক্ষিত নিরক্ষর জনসাধারণের নাগালের বাইরে সৌখিন বাবুদের কাব্য-কাননের মাকাল ফলের মতই তা ঝুলে রইল। এই ভাব-সমাধি অবশ্য কিছু পরিমাণে ঘা খেল গত দশ-বারো বছরের প্রগতি আন্দোলনের ঢক্কা নিনাদে। কিন্তু তথাকথিত প্রগতিবাদী ও মার্কসমন্য ভাবধারার চাপেও এই সংকট থেকে ত্রাণের উপায় পাওয়া গেল না।’’
প্রথম সংখ্যায় কয়েকটি বইয়ের বিজ্ঞাপন ছাড়া অন্য কোনও বিজ্ঞাপন গ্রহণ করা হয়নি। মলাটের পরেই পৃষ্ঠা জোড়া সিগনেট প্রেসের ‘বনলতা সেন’, যার ওপরে লেখা, ‘—১৩৫৯-এর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ—নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনের নির্বাচন’। ওই নির্বাচন অনুযায়ী জীবনানন্দ দাশ একশো এক টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন, তাঁর জীবিতকালে একমাত্র পুরস্কার।
কৃত্তিবাস ত্রৈমাসিক পত্রিকা, প্রতি সংখ্যার দাম আট আনা। আমরা ঘাড়ে করে পত্রিকাগুলি বিভিন্ন স্টলে দিয়ে এসেছিলাম, ছাপা হয়েছিল পাঁচশো, কয়েকদিনের মধ্যেই সমস্ত কপি নিঃশেষ। কিন্তু বিক্রি হলেই যে দাম পাওয়া যাবে তার কোনও ঠিক নেই, প্রধান বিক্রেতা কলেজ স্ট্রিটের পাতিরাম। সে দোকান থেকে আমরা নিয়মিত পত্র-পত্রিকা কিনি, মুখ চেনা, অতি মধুর ব্যবহার, কিন্তু টাকা চাইলেই বলে, সোমবার আসবেন। সে এক অনন্ত সোমবার। দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-এর মোড়ের এক স্টলেও অনেক কপি কাটতি হয়েছিল, কিন্তু সেখানে টাকা চাইতে গিয়ে ট্রাম ভাড়া দিতে দিতেই আমরা ফতুর! কখনও সখনও দু’পাঁচ টাকা পেলেও তা পরবর্তী সংখ্যার জন্য জমিয়ে রাখা যায় না, তাই প্রতি সংখ্যাতেই নতুন করে অর্থ সংগ্রহ করতে হয়। দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হল যথাসময়ে হেমন্তকালে, এবারে অন্যান্যদের সঙ্গে যুক্ত হল দু’জন অতি তরুণ, উৎপলকুমার বসু ও প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়। আমার সহপাঠী মোহিত চট্টোপাধ্যায়, ফণিভূষণ আচার্য ও শিবশম্ভু পালকেও নিয়ে আসা হল, আগের বারের বিশিষ্ট কবিরা তো রইলেনই। শঙ্খ ঘোষ কবিতার সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণু দে’র ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’ নামের কাব্য গ্রন্থটির এক সাহসী সমালোচনাও লিখলেন এ সংখ্যায়।
তখন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর ঠিক বারো বছর কেটেছে, অর্থাৎ এক যুগ। আমরা দাবি করছি এটাই আধুনিক যুগ, কিন্তু সেই সময়েও রাবীন্দ্রিক ও আধুনিকদের দ্বন্দ্ব শেষ হয়নি। মুশকিল হচ্ছে এই যে, এই দ্বন্দ্বে রবীন্দ্রনাথকে অনাধুনিক আখ্যা দিতে হয়, সেটাও ঠিক নয়। আধুনিক কবি হিসেবে যারা মার্কামারা, সেই প্রধান কবিরা সকলেই তখন জীবিত এবং সৃষ্টিশীল, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের কিছু কিছু বাহবা ও পিঠ চাপড়ে দিলেও আধুনিক কাব্য নিয়ে ঠাট্টা তামাসাও করতেন। যে-কোনও আন্দোলনই প্রথম দিকে উগ্র হয়, রবীন্দ্রনাথ সেই উগ্র আধুনিকতা ঠিক মেনে নিতেও পারতেন না। রবীন্দ্র-অনুসারী কবিদের মধ্যে কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, যতীন্দ্রনাথ বাগচী প্রমুখ বুদ্ধদেব-বিষ্ণু দে-অমিয় চক্রবর্তীদের তুলনায় কম জনপ্রিয় ছিলেন না, বরং বেশিই ছিলেন। মোহিতলাল মজুমদার ও যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ছিলেন মাঝামাঝি অবস্থানে।
আধুনিক কবিরা পাঠকদের কাছে বারবার আধুনিকতা নিয়ে সরব হতেন, হতে বাধ্য ছিলেন, কারণ অধিকাংশ বাঙালি পাঠকই তখনও এই আধুনিকতার মর্ম স্পর্শ করার জন্য প্রস্তুত ছিল রবীন্দ্র অনুসারী কবিরা এর মধ্যেই অনেকে পাঠ্য পুস্তকে স্থান পেয়ে গেছেন, কিন্তু আধুনিক কবিরা অপাঙক্তেয়। তবে সিগনেট প্রেসের মতন এত বড় শক্তিশালী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আধুনিক কবিরা নব বলে বলীয়ান হয়েছিলেন। ডি কে আধুনিক কবিতার প্রবল সমর্থক, শুধু এই সব কবিতার বই ছাপতেনই না, প্রচারও করতেন বহু অর্থ ব্যয়ে।
সেই আধুনিকতার প্রচারের অঙ্গ হিসেবেই তিনি আয়োজন করলেন এক বিশাল কবি সম্মেলনের। তার আহ্বায়ক আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। এরই সমসময়ে এঁরা দু’জন ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’ নামে একটি চমৎকার কাব্য সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন, তাতে ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত আমার ‘তুমি’ নামে কবিতাটি গ্রহণ করা হয়েছিল দৈবাৎ। সে সংকলনের প্রথম কবিতা রবীন্দ্রনাথের, সব শেষটি আমার, ‘রবীন্দ্রনাথ থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত’, কোনও এক বিজ্ঞাপনে এ রকম ঘোষণা দেখে আমার তো রোমাঞ্চিত হবারই কথা। এই কবি সম্মেলনেও কৃত্তিবাসের বেশ কয়েকজন কবি আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন, দীপক এবং আমিও। হয়তো তাতে ডি কে’র খানিকটা পক্ষপাতিত্ব ছিল, এখানেও জন্মসাল হিসেবে আমিই সর্ব কনিষ্ঠ, তালিকায় সবার শেষে নাম।
১৯৫৪ সালে ২৮-২৯ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে সেই কবি সম্মেলন বাংলা কবিতায় একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে গণ্য হবার যোগ্য। এর আগে এতবড় কবিদের সমাবেশের কোনও বিবরণ পাইনি, পরেও এ পর্যন্ত আর দেখিনি। তখনও রবীন্দ্রসদন হয়নি। সিনেট হলটিই কলকাতার সর্ববৃহৎ সভাকক্ষ, তার সম্মুখভাগ ক্লাসিকাল গাম্ভীর্যমণ্ডিত, কোনও মূর্খের দল কিছুদিন পরেই সেটি ভেঙে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। অত বড় হলঘরটি ভর্তি করে শ্রোতারা দু’দিন ধরে কবিতা পাঠ শুনেছে। সে যেন আধুনিকতার সমর্থকদেরই মিলন স্থান। সেখানেই জীবনানন্দ দাশের স্বকণ্ঠে কবিতা পাঠ প্রথম ও শেষবার শুনেছি। এই কবি সম্মেলনের বিস্তৃত বিবরণ ‘কৃত্তিবাস’-এ লিখেছিলেন প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত।
আগেই লিখেছি যে সিগনেট প্রেসের দিলীপকুমার গুপ্তের সঙ্গে প্রথমবার দেখা হওয়ার পরই আমার জীবনের একটা পট পরিবর্তন হয়, তা শুধু কৃত্তিবাসের জন্যই নয়, আরও কারণ ছিল, তবে কৃত্তিবাস পত্রিকা প্রকাশও আমার পক্ষে অবশ্যই একটা বড় ঘটনা। এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে আমার মধ্যে যে উদ্দীপনার সঞ্চার হয়, তাতে আমার মনের অনেক মেঘ কেটে যায়। এর কিছুদিন আগে যে অস্থিরতা ছিল, এক একটি বিকেলে কারুর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে হত না, মনে হত জীবনটাই অর্থহীন, মরে গেলেই বা ক্ষতি কী, এই সব উটকো চিন্তা একেবারে দূর হয়ে গেল, পত্রিকার জন্য লেখা জোগাড় করা, প্রেসে যাওয়া, প্রুফ দেখা, বিজ্ঞাপনের জন্য ঘোরাঘুরি, এ সবই মনে হয় খুব প্রিয় কাজ। যখনই আমি কোনও তৃপ্তিজনক কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি, তখনই আমার যৌন আবেগ বৃদ্ধি পায়। তখন অপর্ণা নাম্নী মেয়েটির সঙ্গে আমার প্রণয় পর্বও খুব গাঢ় হয়ে উঠেছে, যদিও তাতে যৌনতার স্থান বা অবকাশ বা সুযোগ ছিল না। সেই অবরুদ্ধ যৌন আবেগ মুক্তি পায় কবিতার খাতার পৃষ্ঠায়।
‘কৃত্তিবাস’ প্রকাশের প্রধান কৃতিত্ব দীপকের। আবার সেই দীপকের হাতেই এই পত্রিকা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে বসেছিল। মাত্র তিনটি সংখ্যা বার করার পরই দীপকের উৎসাহ হঠাৎ অন্তর্হিত হয়ে যায়। সারা জীবনে কোনও ব্যাপারেই সে বেশিদিন মন বসাতে পারেনি। মাঝে মাঝেই সে বলতে শুরু করল, শুধু শুধু অন্যদের লেখা ছাপাবার জন্য আমরা এত খাটা-খাটুনি করতে যাব কেন? দীপক বলছে ‘অন্যদের লেখা’, আমার মতে তা ‘আমাদের লেখা’, আমাদের বয়সি অনেকে মিলেই তো নতুন ন্যায্য আন্দোলনের সূত্রপাত করতে হবে। দীপকের মতে, অন্যরা শুধু লেখা দিয়েই খালাস, আমাদের দু’জনকে টাকা জোগাড়, স্টলে স্টলে ঘোরা ও প্রেসের অন্ধকারে বসে প্রুফ দেখে সময় খরচ করতে হয়! আমার মতে, সম্পাদকদেরই এই ভার নেওয়া স্বাভাবিক। দীপকের সঙ্গে তর্ক শুরু হয়, একদিন সে বলেই ফেলল, পত্রিকা বন্ধ করে দাও! আমার তখন নেশা ধরে গেছে, সব সময় ভাবি, খেতে পাই বা না পাই, জামা-জুতো কিনতে পারি বা না পারি, কৃত্তিবাস বেরোবেই! প্রথম থেকেই পত্রিকার দফতরের ঠিকানা মহারানী হেমন্তকুমারী স্ট্রিটে দীপকের বাড়ি। এক সকালে দীপক হঠাৎ টেবিল থেকে ফাইলগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, দুর ছাই! এগুলো দেখলেই আমার রাগ হয়! ফাইলগুলো কুড়িয়ে আমি নিয়ে এলাম আমাদের বাড়ি। পরের সংখ্যা থেকেই কৃত্তিবাসের সম্পাদকীয় দফতরের ঠিকানা বদল হয়।
ততদিনে আমাদের বাসা বদলও করতে হয়েছে, বাড়িওয়ালার সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমায় পেরে না উঠে গ্রে স্ট্রিট ছেড়ে উঠে আসতে হয়েছে বাগবাজারের বৃন্দাবন পাল লেনে। এ বাড়িটাও খুবই পুরনো ও স্যাঁতসেঁতে হলেও একতলায় আমাদের ঘরের সংখ্যা তিনটি, তার মধ্যে একটা ঘর একেবারে বাইরের দিকে। সেই ঘরটি আমার ও কাকার দখলে। হাসপাতালের খাটের মতন দুটি লোহার খাট পাতা। আমার কাকা সাহিত্যের ধার ধারেনি। তার আড্ডার বৃত্ত আলাদা, দিনের বেলা সে প্রায় বাড়িতে থাকে না, তখন খাট দুটির বিছানা গুটিয়ে আমার বন্ধুদের আড্ডা চলে। এর আগের বাড়িতে বন্ধুদের এনে বসাবার মতন কোনও জায়গা ছিল না, এবারে কোনও ক্রমে একটা বৈঠকখানা হল। সেই ছোট্ট ঘরটিতে এক একদিন কী করে পনেরো-কুড়ি জনের স্থান সঙ্কুলান হয়ে যেত, তা ভাবলে এখনও বিস্ময় জাগে। পুরনো আমলের বাড়িগুলিতে জানালার পাদদেশে অনেকখানি চওড়া বেদি মতন থাকত, তাতেও বসতে পারত দু’তিন জন। তারাপদ রায়ের নাচানাচিতেও যে আমাদের সেই জরাজীর্ণ খাট ভেঙে পড়েনি, সেটাও কম বিস্ময়ের নয়। তারাপদ অবশ্য এসেছিল কয়েক বছর পর, তার আগে শক্তি ও শরৎকুমার।
কৃত্তিবাসের পরবর্তী সংখ্যাগুলিতে রচনা সংগ্রহ থেকে প্রুফ দেখা পর্যন্ত সব কাজই আমাকে করতে হয়, দু’তিনবার প্রুফ দেখতাম বলে অধিকাংশ লেখাই আমার মুখস্থ হয়ে যেত। চতুর্থ সংখ্যাটি হাতে নিয়ে দেখছি, এখনও অনেক কিছু মুখস্থ আছে, এমনকী গদ্য পর্যন্ত। পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতন এই সংখ্যায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে সালেহ আহমদ ও সৈয়দ শামসুল হক-এর কবিতা সংগ্রহ করা গিয়েছিল। সে সংখ্যায় প্রবন্ধ লিখেছিলেন অম্লান দত্ত, ‘ভাষার সাধনা’। তার অবিস্মরণীয় প্রথম দুটি লাইন: “সব ভালোবাসারই দুঃখ আছে; ভাষাকে ভালোবাসার দুঃখ কম নয়। ভাষাকে যে ভালোবাসে না, এ দুঃখ সে বুঝবে না।”
খুবই আফসোসের কথা এবং বাংলা কবিতার বিরাট ক্ষতি, ভাষার প্রতি দীপকের ভালোবাসা এই সময় থেকে স্তিমিত হতে শুরু হয়। সে সময় সে ঝুঁকেছিল নাটক-অভিনয়ের দিকে, তার মুখে সর্বক্ষণ “বহুরূপী”, শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্রের নাম, তার উপাস্য দেবতা মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, ইনি মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের প্রখ্যাত ও শ্রদ্ধেয় অভিনেতা। কোনও একটা নাটকে বাল্মীকি-র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বলে এঁর ডাক নামই হয়ে যায় মহর্ষি, বহুরূপী নাট্যদলেরও ইনি প্রধান উপদেষ্টা।
কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের অভিলাষ নিয়ে দীপক সিগনেট প্রেসের দিলীপকুমার গুপ্তর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল, সারা জীবনেই তার একটিও কবিতার বই প্রকাশিত হল না। আর সিগনেট প্রেসের ওই বাড়ির সকলের সঙ্গে আমার পরিচয়, সংযোগ ও ঘনিষ্ঠতা রয়ে গেল সুদীর্ঘকাল।
একুশ
কৃত্তিবাস পত্রিকার সূত্রে কয়েকবার দিলীপকুমার গুপ্তর কাছে যাতায়াতের পর একদিন তিনি প্রস্তাব দিলেন, পত্রিকা ছাড়াও তরুণদের নিয়ে একটা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়লে কেমন হয়? যেখানে গান, কবিতা পাঠ, সাহিত্য-বিতর্ক ও নাটক অভিনয়ের ব্যবস্থা হবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি। আগে প্রতিষ্ঠানের একটি নাম দরকার, যেমন-তেমন নাম হলে চলবে না, বাংলার সেরা বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে নির্বাচন করতে হবে অভিনব একটি নাম। সে জন্য তিনি আমাকে পাঠালেন নীহাররঞ্জন রায়, আবু সয়ীদ আইয়ুব, বুদ্ধদেব বসু, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শম্ভু মিত্র প্রমুখ কয়েকজনের কাছে। এঁরা সবাই বাংলার সংস্কৃতি জগতের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, আমার পক্ষে অতি দূরের মানুষ, কয়েকজনকে চর্মচক্ষে দেখিইনি, দু’-একজনকে সভা-সমিতিতে শ্রোতার আসনে বসে দেখলেও কথা বলার সুযোগ ঘটেনি। ডি কে-র প্রস্তাবটি যে অদ্ভুত, তা মানতেই হবে। আমরা একটা ক্লাব খুলতে যাচ্ছি, তা নিয়ে ওই সব বিখ্যাত ব্যক্তিরা মাথা ঘামাতে যাবেন কেন? ওঁরা সবাই ব্যস্ত, শুধু আমার নাম শুনলে নিশ্চিত দেখাই করতেন না, কিন্তু সিগনেট প্রেসের দিলীপ গুপ্ত পাঠিয়েছেন শুনে কেউ প্রত্যাখ্যান করেননি, আমি তাঁদের সামনে লাজুক মুখে বিনম্রভাবে বক্তব্যটি জানাতে প্রায় সকলেই অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে বলেছিলেন, ক্লাবের নাম? আচ্ছা, পরে ভেবে দেখব। শুধু শম্ভু মিত্র আমাকে অতি তুচ্ছ জ্ঞান করে ব্যঙ্গের সুরে বলেছিলেন, আমরা নাম দেনেওয়ালা নই! যারা নিজেদের ক্লাবের নাম নিজেরা ঠিক করতে পারে না, তাদের নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাই না।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়েছে ঠিক বারো বছর আগে, তিনি বেঁচে থাকলে ডি কে আমাকে তাঁর কাছেও পাঠাতেন অবশ্যই, এবং রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত নাম দিয়ে দিতেন, নাম দিতে ভালোবাসতেন তিনি। যাই হোক, আমি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পর, ডি কে নিজেই ক্লাবটির নাম দিলেন, ‘হরবোলা’। পরে অনেকেই স্বীকার করেছেন, কোনও সঙ্গীতনাটক-আবৃত্তির প্রতিষ্ঠানের এই নাম অতি যথার্থ। হরবোলার সভাপতি দিলীপকুমার গুপ্ত, আমি সম্পাদক, বন্ধু-বান্ধব অনেককেই চটপট এর সদস্য করে নেওয়া হল। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাবু কালচারের যুগে যে-সব ধনী পৃষ্ঠপোষকের সমিতির কথা শোনা যেত, হরবোলা সম্ভবত তারই শেষতম উদাহরণ। সদস্যদের কোনও চাঁদা নেই, প্রত্যেক অধিবেশনে প্রচুর খাওয়া-দাওয়া, এক একদিন কলকাতার এক একটি নাম করা দোকানের সন্দেশ, বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে প্রস্তুত করা সিঙ্গাড়া বা চপ, বারবার সুদৃশ্য কাপে দামি দার্জিলিং চা, অনেকগুলি গোল্ড ফ্লেকের টিন ছড়ানো, কোনও কোনও সদস্য এক একবার তার থেকে মুঠো করে পাঁচ-সাতটা সিগারেট তুলে পকেটে ভরে নিত। বেশি রাত হলে ডি কে নিজে গাড়ি চালিয়ে সেই এলগিন রোড থেকে শ্যামবাজার পৌঁছে দিতেন আমাদের কয়েকজনকে, যাদের বাড়ি হাওড়া কিংবা বরানগর, চুপি চুপি তাদের পকেটে গুঁজে দিতেন ট্যাক্সির ভাড়ার টাকা।
হরবোলার প্রথম অধিবেশনে ডি কে এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি হবেন নাট্য পরিচালক। গায়ের রং একেবারে চকচকে পালিশ করা কালো, ধপধপে সাদা কলিদার পাঞ্জাবি ও ধুতি পরা, তার সঙ্গে বেমানান হাতের একটা চটের থলে ও পান খাওয়া লাল ঠোঁট। এঁর মুখের ভাষাও চমকপ্রদ, আমাদের জনে জনে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, বাবুটির নাম কী? বাবুটির কী করা হয়? নিবাস কোথায়? এই নাট্য পরিচালকের নাম কমলকুমার মজুমদার। আমি এই নাম আগে শুনিনি, এঁর সম্পর্কে তখনও কিছুই জানতাম না। যদিও কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের একটি বিশেষ মহলে তিনি সুপরিচিত এবং ইংরেজিতে যাকে বলে এনিগম্যাটিক ক্যারেকটার। কমলকুমারের স্কুল-কলেজের কোনও ডিগ্রি নেই, অথচ অনেক বিষয়ে জ্ঞানী, আচার-আচরণ খাঁটি বাঙালির মতন, অথচ ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ জ্ঞান, চটের থলিটির মধ্যে থাকে দুর্লভ ফরাসি গ্রন্থ, অনেক আই সি এস এবং আই এ এস অফিসারদের ফরাসি শিখিয়েছেন, বঙ্কিমচন্দ্রের বিশেষ ভক্ত, অথচ নিজের মুখের ভাষা কাঁচা বাংলা, তাতে আদিরসাত্মক শব্দের ছড়াছড়ি, ছবি আঁকেন, কাঠ খোদাই করেন, অনেক প্রখ্যাত শিল্পী সম্রম করেন তাঁকে, এবং কোনও রহস্যময় কারণে সে সময় তিনি নিজের বাসস্থানের কথা কাউকেই জানান না।
এবং কমলকুমার একজন লেখক। বিষ্ণু দে, নবযুগ আচার্য সম্পাদিত ‘সাহিত্যপত্র’তে তাঁর ‘জল’ নামে একটি গল্প প্রকাশিত হয়েছে, সে রকম ভাষা ও আঙ্গিকের তুলনা বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই। এ সবই অবশ্য জেনেছি আস্তে আস্তে এবং কৃত্তিবাসের দলবলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলেই কমলকুমার মজুমদারের সাহিত্য সৃষ্টির মূলধারা শুরু হয়। প্রথম দর্শনে মানুষটিকে শুধু বিচিত্র মনে হয়েছিল।
প্রথম নাটক ঠিক হল, সুকুমার রায়ের ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’, কারণ বাংলা প্রহসনের প্রবাহটি শুকিয়ে আসছে, সেটিকে আবার জাগানো দরকার এবং সুকুমার রায়ের এই রচনাটি প্রহসনের চেয়েও আরও অনেক কিছু। প্রথমেই কমলকুমার ঘোষণা করলেন, ভূমিকা বণ্টন ও মহড়া শুরু করার আগে প্রত্যেককে উচ্চারণ চর্চা ও গান শিখতে হবে। গানের জন্য ডি কে নিয়ে এলেন দু’জনকে, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র এবং সন্তোষ রায়। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র শুধু কবি নন, গায়ক ও সুরকার, আই পি টি এ-র উদ্বোধন সঙ্গীত ‘এসো মুক্ত করো, মুক্ত করো, অন্ধকারের এই দ্বার’ গানটির লেখক ও সুরকার এবং তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড আছে। সন্তোষ রায় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের গুরু, তিনি ওস্তাদ ফৈয়াজ খানের কাছে নাড়া বেঁধেছিলেন। পুনরুক্তি দোষ হলেও সন্তোষ রায় সম্পর্কে এই কাহিনীটি এখানেও বলা দরকার। অসাধারণ উদাত্ত কণ্ঠের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি কখনও প্রকাশ্য অনুষ্ঠান-জলসায় গান করতেন না কিংবা গান রেকর্ড করেননি, কারণ ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ তাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন যে অন্তত দশ বছর রেওয়াজ না করে তিনি প্রকাশ্য আসরে গাইতে পারবেন না। সেই দশ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ফৈয়াজ খান দেহরক্ষা করেন, সন্তোষ রায় তাই আজীবন গুরুর কাছে দেওয়া সেই শপথ ভঙ্গ করেননি। এসব শুনলে এখন গল্প বলে মনে হয় না?
প্রথম কিছুদিন সন্তোষ রায়ের কাছে সা-রে-গা-মা সাধতে হল। তাও হারমোনিয়ামের সা-রে-গা-মা নয়, এক দমে যতক্ষণ সম্ভব শুধু সা বলতে হবে, গলা কাঁপালে চলবে না, তেমন ভাবেই রে, গা, মা, পা ইত্যাদি। তারপর জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র সকলকে একযোগে শেখাতে লাগলেন একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত, ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’।
কয়েক মাস এরকম চলার পর শুরু হল নাটকের মহড়া। মঞ্চস্থ করার কোনও ব্যস্ততা নেই, আগে সব কিছু নিখুঁত হওয়া দরকার। ডি কে সব কিছুতেই পারফেকশনিস্ট। আমার কাছে নাটকের মহড়ার চেয়েও অনেক বেশি আকর্ষণীয় ওই সব মহারথীদের কাছে গল্প শোনা। কমলকুমার ও জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের অফুরন্ত গল্পের ভাণ্ডার, প্রধানত সাহিত্য ও সাহিত্যিক সম্পর্কিত, তা ছাড়াও অসাধারণ সব রসিকতায় পরস্পর টক্কর দিতেন, আর সন্তোষ রায় জানতেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মহীরুহ সদৃশ শিল্পী ফৈয়াজ খান, আবদুল করিম খাঁ, ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, গহর জান, হীরাবাঈ বরোদেকার, আলাউদ্দীন খাঁ সম্পর্কে কত না কাহিনী, প্রায় আক্ষরিক অর্থেই এসব কাহিনী আমি হাঁ করে গিলতাম। সন্তোষ রায়ের কাছে এসব গল্প, এবং মাঝে মাঝে তিনি ওই সব শিল্পীদের গান গাইতেন দু’-চার লাইন, সে সব শুনে শুনেই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সম্পর্কে আমার আগ্রহ ও নেশা ধরে যায়। (পরে অমিয়নাথ সান্যাল রচিত অনবদ্য ভাষায় এই ধরনের কাহিনী ‘স্মৃতির অতলে’ পাঠ করেও মুগ্ধ হয়েছি। অনেক কাল পরে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রণীত ‘কুদরত্ রঙ্গিবিরঙ্গী’ এই ধারারই একটি অসাধারণ গ্রন্থ।)
ডি কে যদিও বাংলা সাহিত্যের সুষ্ঠু প্রকাশনা ও প্রচারের উদ্যোগী ছিলেন, বিদেশি সাহিত্যও তাঁর খুব ভালো পড়া ছিল। আড্ডায় প্রসঙ্গক্রমে তিনি ডস্টয়েভস্কি কিংবা জেম্স জয়েসের কথা বলতেন। তাঁর মুখেই আমি প্রথম ফ্রান্ৎস কাফকার ‘মেটামরফসিস’ কাহিনীটি শুনি। কাফ্কা তখনও বাঙালি লেখকদের মধ্যে সুপরিচিত ছিলেন না, কমলকুমার ও জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রও প্রথম সে গল্পটি শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। ডি কে-র গল্প বলার বিশেষ একটা ভঙ্গি ছিল। একদিন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’র ‘দা শর্ট অ্যান্ড হ্যাপি লাইফ অফ ফ্রান্সিস ম্যাককম্বার’ গল্পটি পুরোপুরি এমনভাবে বললেন, যা ঠিক কথকতা নয়, সাহিত্যগুণ অক্ষুণ্ণ রইল, তবু কাহিনীর দৃশ্যগুলি যেন চোখের সামনে জাজ্বল্যমান। একটু ইচ্ছে প্রকাশ করলেই ডি কে এই সব বই পড়তেও দিতেন, আলবিয়ার কামুর ‘দা আউটসাইডার’ উপন্যাসটি তিনি উপহার দিয়েছিলেন আমাকে।
ডি কে যদিও বাংলা সাহিত্যের সুষ্ঠু প্রকাশনা ও প্রচারের উদ্যোগী ছিলেন, বিদেশি সাহিত্যও তাঁর খুব ভালো পড়া ছিল। আড্ডায় প্রসঙ্গক্রমে তিনি ডস্টয়েভস্কি কিংবা জেম্স জয়েসের কথা বলতেন। তাঁর মুখেই আমি প্রথম ফ্রান্ৎস কাফকার ‘মেটামরফসিস’ কাহিনীটি শুনি। কাফ্কা তখনও বাঙালি লেখকদের মধ্যে সুপরিচিত ছিলেন না, কমলকুমার ও জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রও প্রথম সে গল্পটি শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। ডি কে-র গল্প বলার বিশেষ একটা ভঙ্গি ছিল। একদিন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’র ‘দা শর্ট অ্যান্ড হ্যাপি লাইফ অফ ফ্রান্সিস ম্যাককম্বার’ গল্পটি পুরোপুরি এমনভাবে বললেন, যা ঠিক কথকতা নয়, সাহিত্যগুণ অক্ষুন্ন রইল, তবু কাহিনীর দৃশ্যগুলি যেন চোখের সামনে জাজ্জ্বল্যমান। একটু ইচ্ছে প্রকাশ করলেই ডি কে এই সব বই পড়তেও দিতেন, আলবিয়ার কামুর ‘দা আউটসাইডার’ উপন্যাসটি তিনি উপহার দিয়েছিলেন আমাকে।
স্কুল বা কলেজে আমি যা শিখেছি, তার চেয়ে ঢের বেশি শিক্ষা পেয়েছি হরবোলার আসরে। এতদিন আমার কোনও দিক নির্দেশ ছিল না। পারিবারিক পরিবেশ কিংবা যাদের সঙ্গে চলাফেরা করেছি, সে সব থেকে এখানকার পরিবেশ কত আলাদা। এরা সব বিদগ্ধ, সুরুচিসম্পন্ন মানুষ, অথচ খুব সহজ-স্বাভাবিক ব্যবহার। এর আগে আমি পাড়ার লাইব্রেরি থেকে এবং বন্ধুবান্ধবদের কাছে চেয়েচিন্তে বাংলা বই প্রচুর পড়েছি। ইংরিজিও কিছু কিছু, কিন্তু বিশ্ব সাহিত্যের প্রধান প্রধান কীর্তিগুলি সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না, এখানে কমলকুমারের কাছ থেকে জানতে পারি ফরাসি সাহিত্যের রেখা চিত্র, ডি কে ঠিক ধারাবাহিকভাবে না হলেও রুশ-জার্মান-ইংরেজি সাহিত্য থেকে নানা রকম দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতেন, সেই সব শুনে শুনে আমার খিদে বেড়ে যেত, আমি আরও জানতে ও পড়তে চাইতাম। একদিন কথায় কথায় ডি কে বলেছিলেন, হ্যাঁ পড়বেন, অনেক কিছু পড়তে হবে, লেখার চেয়েও পড়ার জন্য বেশি সময় দেওয়া দরকার, তবে যা পড়বেন, তা নিজের লেখায় যতদূর সম্ভব উল্লেখ না করাই ভালো। অনেক বাঙালি লেখকের লেখায় দেখি, অকারণে বিদেশি বই বা লেখকদের নাম মাঝে মাঝে ফুটে বেরোয়, তখন বুঝি যে পড়াশুনো ঠিক হজম হয়নি এই সব লেখকদের। লেখা মানে তো নিজের কথা, তা যত সরল ও আন্তরিক হয়, ততই তা মানুষের মনে দাগ কাটে। আধুনিকতা মানে মৌলিক কিছু চিন্তা করা, তা বলে হাতঘড়ি পায়ে বাঁধা আধুনিকতা নয়! ডি কে-র এই কথাগুলি অক্ষরে অক্ষরে আজও মনে পড়ে। কথাগুলি কিন্তু একজন লেখকের প্রতি প্রকাশকের উপদেশ বলে গণ্য করা ঠিক হবে না, উনি বলেছিলেন সাধারণভাবে সব লেখক সম্পর্কেই, আমি তখনও লেখক হইনি, আমার বয়েস সে সময় কুড়িরও কম। অনেক বছর অতি ঘনিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও ডি কে-র কাছে আমার কোনও বই ছাপার প্রসঙ্গই ওঠেনি, সে সাহসই আমার ছিল না। যখন সিগনেট প্রেসের একেবারে শেষ দশা, ডি কে হাল ছেড়ে দিয়েছেন, তখন আমার একটি মাত্র উপন্যাস, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ওই গৌরবময় প্রকাশনীর নামাঙ্কিত হয়ে বেরোয়।
যে-ঘরে হরবোলার মহড়া চলত, তার বিপরীত দিকের একটি ঘরে আসতেন নরেশ গুহ, তিনি সিগনেট প্রেসের আংশিক কর্মী ছিলেন, ‘টুকরো কথা’ লিখতেন। সিগনেট প্রেসের এরকম আংশিক কর্মী ছিলেন আরও অনেকে, শুনেছি। এক প্রখ্যাত কবিকে একটি বৈষ্ণব পদাবলী সঙ্কলনের সম্পাদনার ভার দেওয়া হয়েছিল, তিনি যেদিন থেকে, কাজ শুরু নয়, ও বিষয়ে চিন্তা করতে শুরু করেন, সেদিন থেকেই মাইনে পেতেন। সে-চিন্তা শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি৷ কমলকুমারও বেতন পেতেন, তাঁর কাজটি ছিল ভারী মজার। সিগনেট প্রেসের দুটি দোকান ছিল কলেজ স্ট্রিট ও রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-এ, দুটি দোকানেরই সামনের দিকে লম্বা র্যাকে নতুন নতুন বই সাজানো থাকত, যাকে বলে ডিসপ্লে। প্রতি সপ্তাহে বদলে যেত বইগুলি। কমলকুমার ছিলেন রঙের উপদেষ্টা, অর্থাৎ কোন রঙের মলাটের পাশে অন্য বই রাখা হবে, তিনি তার নির্দেশ দিতেন। আমরা তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকবার গেছি কলেজ স্ট্রিটের দোকানে, তিনি কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বলতেন, আরেঃ ওই ক্যাটকেটে হলদে বইটা ছাই রঙের পাশে রেখেছে, সরাও, সরাও, চোখে লাগছে, এক কোণে নিয়ে এসো, লাল রং একেবারে তলায়… এই রকম। সব মিলিয়ে বড় জোর পাঁচ মিনিট, তার জন্য মাইনে?
হরবোলার সূত্রে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের সামনাসামনি দেখার সুযোগ ঘটেছে। হঠাৎ বাইরে বাজখাঁই গলা শুনলেই বোঝা যেত, এসেছেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। বুদ্ধদেব বসু আসতেন নিঃশব্দে, প্রেমেন্দ্র মিত্রের কণ্ঠ আনুনাসিক। জীবনানন্দ দাশকে দেখেছি মাত্র একবার, সত্যজিৎ রায় আসতেন প্রায়ই, সে সময় তিনি শুধুই একজন মলাট-শিল্পী, এবং নীহাররঞ্জন রায়ের আবির্ভাব ছিল রাজকীয়। আমাদের দ্বিতীয় নাটকের মহড়ার সময় আবু সয়ীদ আইয়ুব আসতেন ঘন ঘন, দারুণ রূপবান পুরুষ। নাটকটির অন্যতম নায়িকা তখন তাঁর প্রেমিকা! সেই গৌরী দত্ত পরবর্তীকালে হন গৌরী আইয়ুব, বিয়ের পর বেশ কয়েক বছর তিনি নিজের নাম লিখতেন গৌরী আইয়ুব দত্ত।
সত্যজিৎ রায়কে তখনও আমরা ঘনিষ্ঠভাবে পাইনি, নিজের কাজ নিয়ে আসা-যাওয়া করতেন। যদিও হরবোলার ছাপানো প্যাডে তাঁর নাম উপদেষ্টা মণ্ডলীর অন্যতম, কিন্তু সম্ভবত সেই সময় থেকেই তিনি ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণ নিয়ে ব্যস্ত, আমাদের নাটকের ব্যাপারে তিনি মন দিতে পারেননি। শুধু মঞ্চ সজ্জা পরিকল্পনার জন্য তাঁর সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। কমলকুমারের সঙ্গে একদিন কথা বলার পর তিনি জানালেন যে কমলবাবু যে রকম ভেবেছেন, তার ওপরে তাঁর আর কিছু বলার নেই। সত্যজিৎ রায়কে কমলকুমার আড়ালে ডাকতেন ঢ্যাঙাবাবু। তাঁর শারীরিক দৈর্ঘ্য নিয়ে নানান রঙ্গ রসিকতাও হত, যদিও সেই বয়সের সত্যজিৎ রায়ের মতন সুপুরুষ সারা পৃথিবীতেই দুর্লভ। তাঁর সঙ্গে কমলকুমারের এক বিশেষ ধরনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পাবার পর কমলকুমার ব্রত পার্বণ, বাস্তু সাপ ইত্যাদি খুঁটিনাটির কিছু ভুল ধরেছিলেন, তাতে সত্যজিতের অপ্রসন্ন হবারও কথা, হয়েওছিলেন, যদিও পরবর্তীকালে তিনি স্বীকার করেছিলেন, কমলবাবুকে খুশি করার মতন বাংলার সামাজিক জ্ঞান তাঁর নেই। কমলকুমার কিন্তু অন্য কারওর মুখে সত্যজিতের নিন্দে সহ্য করতে পারতেন না। সব বিখ্যাত ব্যক্তিদেরই বিরূপ সমালোচনা কিংবা অকারণ কটু-কাটব্য করার মতন কিছু লোক থাকে, একবার এক ব্যক্তি কমলকুমারের সামনে সত্যজিৎ সম্পর্কে অযৌক্তিক নিন্দে শুরু করতেই কমলকুমার চটে গিয়ে বললেন, ও কথা বলো না, বলো না। একটা পেঁপেগাছের তলায় দাঁড়িয়ে বললে পেঁপেগুলো পর্যন্ত তেতো হয়ে যাবে!
হরবোলার সদস্যরা প্রায় সবাই আমারই বয়েসি, অল্পকালের মধ্যেই কমলকুমার হয়ে যান কমলদা, তেমনই সন্তোষদা, আর জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র বটুকদা নামেই সর্বজনপরিচিত ছিলেন। কিন্তু দিলীপকুমার ওঁদের চেয়ে বয়েসে কিছু ছোট হলেও আমাদের দিলীপদা হননি, তিনি শুধু ডি কে। এঁরা সকলেই আমাদের সঙ্গে ব্যবহারে বয়েসের কোনও বিভেদ বুঝতে দিতেন না। ডি কে সাহেবি কোম্পানির বড় সাহেব, কিন্তু আমাদের সঙ্গে কথা বলার সময় পারতপক্ষে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন না, তাঁর বাংলা পরিশীলিত, রসিকতার সময়েও একটিও অপ-শব্দ থাকে। না, ওদিকে কমলকুমারের প্রায় সব রসিকতাই আদিরসাত্মক, ডি কে তা উপভোগ করেন উচ্চহাস্যে। বটুকদাও রসের গল্পের ভাণ্ডারী, বিশেষত তাঁর ভূতের গল্পের প্রচুর স্টক, সবই নাকি তাঁর নিজের দেখা বা শোনা, সেইসব মজাদার ভৌতিক কাহিনীগুলি তিনি লিখলে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমতুল্য হতে পারতেন।
কমলদা পরনিন্দা খুব ভালোবাসতেন। বলা যায়, পরনিন্দা ব্যাপারটাকে তিনি উন্নীত করতেন আর্টের পর্যায়ে। সমাজে যাঁরা অতি প্রসিদ্ধ ও শ্রদ্ধেয়, তাঁদের ভাবমূর্তি ভাঙার জন্য তাৎক্ষণিক গল্প বানানোর দারুণ দক্ষতা ছিল তাঁর, ইংরিজিতে যাকে বলে ডিবাংকিং, কিন্তু বিন্দুমাত্র তিক্ততা থাকত না, শুধুই রঙ্গরস। বঙ্কিমচন্দ্র আর শ্রীরামকৃষ্ণ ছাড়া কাউকেই বাদ দিতেন না, মৃত বা জীবিতও সমতুল্য। সে সব অনেক গল্পই আমার মনে আছে, কিন্তু এখানে লেখা উচিত হবে না, কারণ কমলকুমার মজুমদারকে যা মানায়, আমার মতন ক্ষুদ্র ব্যক্তির তো তা সাজে না! তাঁর এই রকম তামাসা-প্রবণতা বোঝাবার জন্য একটি তুলনামূলকভাবে নিরীহ উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।… রানাঘাট স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনি জমিদার ও বিরাট বিখ্যাত ব্যক্তি, তাঁকে দেখা মাত্র অনেক লোকের পদধূলি নেবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা, কিন্তু সেখানে কেউ তাঁকে চিনতে পারছে না। তিনি একজন লোকের কাঁধে চাপড় দিয়ে বললেন, ওহে, আমি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর! লোকটি পাশের অন্য একটি লোকের দিকে ফিরে বলল, আমাদের অনেকেরই অর্শ আছে, তা বলে এমন জাহির করে বেড়াই না!
বাইশ
হরবোলা ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমার আর একটি বড় প্রাপ্তি, একজন নতুন বন্ধু। আমার বন্ধুভাগ্য সারাজীবনই খুব ভালো, তাদের সাহচর্যে শুধু যে আনন্দ পেয়েছি তাই-ই নয়, প্রত্যেকের কাছ থেকেই কিছু না কিছু শিখেছি। অনেক সময়ই মনে হয়েছে, আমার বেশ কয়েকজন বন্ধুর ভালোবাসার ক্ষমতা আমার চেয়ে অনেক বেশি, কেউ কেউ বেশি প্রশ্রয় দিয়ে আমাকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছে, যাতে অনেক ক্ষুদ্রতার মুখোমুখি হতে হয়নি। প্রথম যৌবনের বন্ধু নির্বাচনের ওপর মানুষের পুরো জীবনের গতি অনেকটা নির্ভর করে, এ কথা ঠিকই। সুনন্দ গুহঠাকুরতা অর্থাৎ বুড্ঢা সঙ্গে বন্ধুত্ব না হলে আমার জীবন অনেকটা অপূর্ণ থেকে যেত।
কলেজ স্ট্রিটে সিগনেট প্রেসের দোকানটিতে বই কেনা ছাড়াও এমনিই মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগত। ছোট্ট দোকান, চমৎকারভাবে সাজানো, যে-কোনও নতুন বই হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখা যায়। সব রকম কবিতার বইয়ের স্টক এই দোকানেই সবচেয়ে বেশি, কর্মচারীদের ব্যবহার বিনীত ও ভদ্র, মাঝে মাঝে কিছু উপহারও পাওয়া যায়, যেমন ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’ প্রকাশ উপলক্ষে দোকানে আগত প্রত্যেককে একটি করে কারনেশান দেওয়া হয়েছিল মনে আছে। সেই দিনটিতে ওই দোকানে শিবরাম চক্রবর্তীকে প্রথম দেখি, গোলাপ ফুলটি হাতে নিয়ে তিনি বললেন, আমি অকৃতদার, এটা নিয়ে এখন কী করি বলো তো? পয়সা খরচ করে বাসে চেপে সেই দক্ষিণ কলকাতায় গিয়ে কাবেরীকে এটা উপহার দিতে হবে! (কাবেরী অর্থাৎ পরবর্তীকালের কাবেরী বসু, বাংলা চলচ্চিত্রে অসাধারণ সুন্দরী নায়িকা হয়েছিলেন কয়েক বছরের জন্য)
মাঝে মাঝে স্বয়ং ডি কে দাঁড়াতেন কাউন্টারের ওধারে, উপন্যাস-ক্রেতাকেও কবিতার বই কেনার জন্য পেড়াপিড়ি করতেন। অন্যান্য দিনে দোকান কর্মীদের যে মধ্যমণি, সেই যুবকটিও অতীব দর্শনীয়। বাঙালিদের তুলনায় বেশি ফর্সা, খুবই সুঠাম, সুগঠিত শরীর, অনেকটা গ্রিসিয়ান, ব্যবহারের শিষ্টতায় বৈষ্ণবদেরও হার মানায়। পরে জেনেছিলাম, সে আসলে অতি দুর্দান্ত প্রকৃতির ছেলে, কিন্তু কাউন্টারে যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ যেন ভিজে বেড়ালটি। হরবোলা শুরু হবার পর জানলাম, এর নাম সুনন্দ গুহঠাকুরতা, সম্পর্কে দিলীপকুমার গুপ্তের শ্যালক, একই বাড়িতে থাকে। দু’দিন আলাপের পরই তার সঙ্গে আমার তুই তুই সম্পর্ক হয়ে গেল। এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, বন্ধুত্বের গাঢ়তার তারতম্যের ওপর তুই-তুমি-আপনি সম্বোধন নির্ভর করে না, সে সময় কফি হাউস-বান্ধবদের সঙ্গে ব্রাহ্ম কায়দায় আপনি আপনি করার রেওয়াজ ছিল, শক্তি বিশ্বসুদ্ধু সকলকে তুই-তুকারি করত, কিন্তু আমার সঙ্গে তুমি’র নীচে নামেনি।
আমার অন্যান্য বন্ধু সকলের সঙ্গেই বুড্ঢা পরিচয় হয়েছিল একই সময়ে, কিন্তু আমার সঙ্গেই তার ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল সবচেয়ে বেশি। কেন, তা ব্যাখ্যা করা যায় না। আপাতভাবে আমাদের দু’জনের কোনও মিলও নেই। বুড্ঢা যেমন রূপবান, তেমনই গুণবান এবং ধনী পরিবারের সন্তান, আর আমার চেহারা পাঁচপেঁচি ধরনের, ছাত্র হিসেবে অতি সাধারণ এবং পারিবারিক অবস্থা আগেই ব্যক্ত করা হয়েছে। তবু পরবর্তী বহু বছর সে আমার সঙ্গে এমন সম্পর্ক রেখেছে, যেন আমরা দু’জনে অবিচ্ছেদ্য। বুড্ঢা একটি জীবনী আমার আলাদাভাবে লেখার ইচ্ছে আছে, এখানে সংক্ষেপে কিছু কথা জানানো দরকার।
তার মতন এমন মেধাবী মানুষ আমি আর এ পর্যন্ত দেখিনি। তখনকার দিনে ইংরিজি মিশনারি স্কুলগুলো সম্ভবত ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল, সিনিয়র কেমব্রিজ পরীক্ষায় সারা এশিয়ার মধ্যে বুড্ঢা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল। সচ্ছল পরিবারের এরকম ভালো ছাত্ররা সবাই এর পরে বিলেত যায়, বুড্ঢাকে যেতে দেওয়া হয়নি, কোনও উচ্চশিক্ষার দিকেও সে যেতে পারেনি, ঘোর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে পড়তে বলা হয়েছিল বি কম। সে পারিবারিক পুস্তক প্রকাশনার ভার নেবে, তখন হিসেব-নিকেশের এই জ্ঞান তার কাজে লাগবে, এরকমই ভেবেছিলেন তাঁর অভিভাবকরা। প্রবল ক্ষোভ ও অনিচ্ছায় এবং তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বি কম পরীক্ষা দিয়ে সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়। পড়াশুনোর দিকে তার ঝোঁক অদম্য, ইংরিজি তো সে খুব ভালো জানেই, কিছুদিন পর সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষার এম এ ক্লাসে ভর্তি হল, সেটা সন্ধেবেলা পড়া যায়, এই ছিল সুবিধে, আমাকেও সেখানে টেনেছিল। কিছুদিন পরই আমার ধৈর্যচ্যুতি হয়, এখানেও ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দিই, বুড্ঢা যথারীতি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হল। পরবর্তীকালে, মুম্বই ও বিদেশে থাকার সময় বুড্ঢা সর্বমোট একুশটি ভাষা শিখেছিল, গ্রিক ও সোয়াহিলি সমেত। প্রতিটি ভাষা শুধু লেখা ও বলা নয়, তার ব্যাকরণ ও উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যও জানত পুরোপুরি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পর আমাদের দেশে এরকম বহু ভাষাবিদ আর কেউ নেই বোধহয়, অথচ বুড্ঢ়ার কথা ক’জন জানে? তার জীবনটাই একটা কক্ষচ্যুত গ্রহের মতন।
বুড্ঢার বন্ধুবাৎসল্যও অসাধারণ। সিনিয়ার কেমব্রিজ পড়া তার সহপাঠী অন্য একটা বন্ধুদল ছিল নিশ্চিত, যারা ইংরিজি গান শোনে, হোটেলে গিয়ে নাচে, গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভে যায়, বান্ধবীদের নিয়ে কানামাছি খেলে। বুড্ঢার সেই বন্ধুদের আমি দেখিনি, কেন সে তাদের থেকে দূরে সরে গিয়ে আমাদের মতন নিছক বাংলা-বলা উত্তর কলকাতার কয়েকটি যুবকের দিকে ঝুঁকলো তাই বা কে জানে! ইংরিজি মাধ্যমে শিক্ষিত হয়েও সে বাংলা সাহিত্য পড়েছিল গভীরভাবে। একথা লিখতে লিখতে ভাবছি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটা এমন অদ্ভুতভাবে বদলে গেল কী করে? তখন ইংরিজি মাধ্যমে পড়া, ইংরিজি আবহাওয়ায় মানুষ হয়েও তো অনেক বাঙালি ছেলেমেয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে জড়িয়ে রাখত জীবনের সঙ্গে। এখন সেরকম আর দেখা যায় না কেন? তখনও তো ওই সব ছেলেমেয়েদের বাংলা জ্ঞান জীবিকার কোনও কাজে লাগত না, বাংলা পড়ত মাতৃভাষার গর্বে, ভালোবাসার টানে। আফ্রিকার সুদূর প্রান্ত থেকেও বুড্ঢা বহু বছর পরে আমাকে চিঠি লিখেছে, যেমন সুন্দর হাতের লেখা, তেমনই নিখুঁত বাংলা। অনেক বাংলায় এম এ পাশ করা ছেলেমেয়েরও বানান ভুল দেখেছি, কেউ কেউ শূন্য না লিখে শূণ্য লেখে, আমারও মাঝে মাঝে ভুল হয়, কিন্তু বুড্ঢার একটি বানানও ভুল দেখিনি। কখনও।
হরবোলার আসর বসত শনি আর রবিবার, কিন্তু বুড্ঢ়ার সঙ্গে সম্পর্ক এমন হয়ে দাঁড়াল যে প্রতিদিনই দেখা হওয়া চাই। সন্ধে সাড়ে সাতটায় দোকান বন্ধ করে সে আড্ডায় বসতে চায়। বুড্ঢ়ার আড্ডার নেশা পাগলামির পর্যায়ে পৌঁছে যেত এক একদিন। আগেই লিখেছি, বুড্ঢার সূত্রে আমি ওর খুড়তুতো ভাই-বোন মুনা আর ভাইয়াকে পড়াতে শুরু করি। তারপর দক্ষিণ কলকাতায় আরও টিউশানি করতে হয়, সেটাই আমার জীবিকা, তাই অধিকাংশ সন্ধেতেই আমি বাধ্যতামূলকভাবে আড্ডায় অনুপস্থিত। একদিন রাত সাড়ে আটটায় টিউশানি সেরে বাসে চেপে ফিরছি, হঠাৎ এলগিন রোগের মোড়ে শুনতে পেলাম, রাস্তায় কে যেন খুব জোরে জোরে চিৎকার করে সুনীল, সুনীল বলে ডাকছে। সুনীল নাম তো কতজনেরই হতে পারে। ভিড়ের বাসে দাঁড়িয়ে আমি জানলা দিয়ে কিছু দেখতেও পাচ্ছি না, তবু যেন চুম্বকের টানে, সবাইকে ঠেলে ঠুলে চলন্ত বাস থেকেই নেমে পড়লাম। দেখি যে, আমার দেবকান্তি বন্ধুটি সহাস্য মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম, তুই কী করে বুঝলি যে আমি এই বাসেই ফিরব? বুড্ঢা বলল, আধ ঘণ্টা ধরে আমি এখানে দাঁড়িয়ে যত বাস আসছে, প্রত্যেকবার তোর নাম ধরে ডাকছি, জানি যে একটা না একটাতে তুই থাকবিই!
এরকমভাবে কোনও বন্ধুকে ক’জন বন্ধু ডাকে?
সেই সময় দোলের দিন সারা কলকাতা জুড়ে বীভৎস কাণ্ড হত, জল-কাদা, আলকাতরা, বাঁদুরে রং ছোঁড়াছুঁড়ি, মারামারিও হত, বিকেল পর্যন্ত সমস্ত গাড়ি ঘোড়া বন্ধ। সেরকমই এক দোলের দিন সকালে আমাদের বৃন্দাবন পাল লেনের বাড়ির রাস্তার দিকে জানলায় দেখি বুড্ঢার মুখ। কী করে এলি? কেন, হেঁটে! ভোরবেলা রওনা হয়ে এলগিন রোড থেকে সে বাগবাজার পর্যন্ত হেঁটে এসেছে শুধু আড্ডার টানে! তখন কয়েক বছর আমাদের খুব তাস খেলার নেশা ধরেছিল, ভাস্কর দত্তর বাড়িতে দু’খানা বৈঠকখানা, সেখানে খেলা চলে, এক একদিন দুপুর বারোটা-একটা থেকে শুরু হয়ে রাত দশটা পর্যন্ত। ভাস্করের দাদারা খুব সহৃদয়। তাঁরা আপত্তি করেন না, বরং ভেতর থেকে অনবরত চা ও জলখাবার আসে। ভাস্কর ও আমি ছাড়া আশু, উৎপল রায়চৌধুরী, শুভেন্দু দত্ত এইরকম ক’জন খেলুড়ে। দীপক ও শক্তি তাস খেলা একেবারে সহ্য করতে পারে না, তারা বিরস মুখে কিছুক্ষণ বসার পর সরে পড়ে। একসময় বুড্ঢা, এসে যোগ দিল এই আসরে। তারপর আমরা জানতাম, খেলার দিন আর কেউ আসুক বা না আসুক, ঝড়-বাদল, ভূমিকম্প, পুলিশের গুলি, বন্ধ (তখন হরতাল বা ধর্মঘট বলা হতো) যাই-ই হোক না কেন, বুড্ঢা আসবেই! সে সবচেয়ে বেশি জোরে চিৎকার করবে, ইংরেজি বাংলায় নানারকম রসিকতা শোনাবে, হঠাৎ হঠাৎ গান গেয়ে উঠবে। এরই মধ্যে সে সন্তোষ রায়ের কাছে নাড়া বেঁধে অতি অল্প সময়ে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে দক্ষ হয়ে উঠেছে, যে-কোনও গানের আধলাইন শুনেই বলে দিতে পারে রাগ রাগিণী। এ ছেলের যে অনেক গুণ!
তখনও আমরা শুধু ব্রিজ খেলতাম, তিন তাসের জুয়া ধরেছি অনেক পরে। গোপনে মদ্যপানও শুরু হয়নি।
বুড্,ঢাই আমাকে মদ্যপানে প্রকৃত দীক্ষা দেয়। ততদিনে বেশ কিছু বিদেশি সাহিত্য এবং লেখক ও শিল্পীদের জীবনী পাঠ করে মদ্যপান সম্পর্কে ভীতি ও নৈতিক আপত্তি অনেকটা কেটে গেছে, বরং বেশ কৌতূহল জন্মেছে। এ দেশে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শিল্পী গোপাল ঘোষ সম্পর্কেও নানা গল্প প্রচলিত। বুড্ঢাদের সামাজিক পরিবেশে প্রকাশ্যে মদ্যপান গর্হিত কোনও ব্যাপার নয়, সন্ধের পর কোনও পরিচিত অতিথি এলে চায়ের বদলে অন্য কোনও কঠিন পানীয়ে রুচি আছে কিনা জিজ্ঞেস করা হয়। আমার বন্ধুদের মধ্যে দীপক ও শক্তি ছাত্র বয়েসেই অনেকবার মদ্যপান ও সিগারেট টেনেছে বলে জানিয়েছিল। আমি বিমান মল্লিকের সঙ্গে লাইট হাউসের সেই সরবত ছাড়া কিছু খাইনি। প্রথম সিগারেটে টান দিয়েছি জীবনানন্দ দাশের শ্মশান যাত্রায়। আমাদের অনভিজ্ঞতার কথা শুনে বুড্ঢা বলল চল, তোদের একদিন ভালো জায়গায় খাওয়াব।
সে আমাদের নিয়ে গেল এ্যান্ড হোটেলে! এ যেন রূপকথার মতন অবিশ্বাস্য। গ্র্যান্ড হোটেলে যে আমাদের মতন সাধারণ মানুষদের প্রবেশ অধিকার থাকে, সেটাই তো জানতাম না। সেই পঞ্চাশের দশকেও কলকাতায় প্রচুর সাহেব-মেমের ভিড় ছিল, অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সংখ্যাও প্রচুর, ওসব বড় বড় হোটেলে পোশাক পরিচ্ছদেরও নিয়মকানুন থাকা সম্ভব, আমি তো প্যান্টের ওপর দিয়ে না-গোঁজা শার্ট আর চটি পরি। পোশাক নিয়ে আমার হীনম্মন্যতাবোধ। উড়িয়ে দিয়ে বুড্ঢা বলল, ধ্যাৎ, পয়সা দিয়ে খাব, কে কী বলবে!
আশু, ভাস্কর, উৎপল রায়চৌধুরী ও আমি বুড্ঢার সঙ্গে গিয়ে বসলাম বার কাউন্টারে,উঁচু টুলে, একেবারে ইংরিজি সিনেমার মতন। সোডা-মেশানো হুইস্কিতে প্রথম চুমুক দিয়ে বেশ বাজে গন্ধ লাগল, কিন্তু মুখের রেখায় তা প্রকাশ করলে চলবে না, সঙ্গে কাজুবাদাম ও কাবাব-টাবাব দিয়ে পরবর্তী চুমুকগুলি সামলে নিতে হল। সেই প্রথম দিনটিতেই মজা হয়েছিল বেশ। বুড্ঢা ধরেই নিয়েছিল, আমাদের একেবারেই অভিজ্ঞতা নেই, এক-দু’ পেগেই কাত হয়ে যাব। কিন্তু নেশার মর্ম যারা বোঝে না, তাদের সহজে নেশা হতেও চায় না। নভিসরা হয় আগে থেকেই ভয় পায়, অথবা অকুতোভয়। বুড্ঢা যে-ই জিজ্ঞেস করছে, আর একটা? আমরা মাথা নাড়ছি। পেগের পর পেগ উড়ে যেতে লাগল। চার পেগের পর আমি টয়লেটে যেতেই বুড্ঢা আমার পাশে এসে ফিসফিস করে বলল, আমি ভেবেছিলাম, তোরা বেশি খেতে পারবি না, তাই খুব বেশি টাকা আনিনি, এবার তুই বলবি, তুই আর পারছিস না! সে আমলে গ্র্যান্ড হোটেলেও স্কচের পেগ পাঁচ-ছ’টাকার বেশি ছিল না, একশো টাকা খরচ করা রীতিমতো বিলাসিতা। শুরুর দিনেই চার পেগ করে খেয়ে আমরা সিঁড়ি দিয়ে নামলাম, কারোর পা টলল না, নেশার ব্যাপারটা বোঝাই গেল না। গ্র্যান্ড হোটেলেও জল মেশাত নাকি?
আমাদের মদ্যপানের দ্বিতীয় দীক্ষাগুরু কমলকুমার মজুমদার, সে এক দৃশ্যান্তর বটে। গ্র্যান্ড হোটেলের স্কচের পরই খালাসিটোলায় টিনের চালের শুঁড়িখানায় ধেনো! সেই বাংলা মদের ডাক নাম ছিল মা-কালী, কেউ কেউ ঠোঁট বেঁকিয়ে ইংরিজি করে বলত মেকলে! অনেক বছর পর উত্তমকুমারের দৌলতে তার নাম হয় অমানুষ।
লক্ষ্মণের শক্তিশেল নাটকে বুড্ঢা সেজেছিল রাম। ভূমিকা বন্টনের আগে কমলদা সকলের পরীক্ষা নিয়েছিলেন। সকলে তাতে উৎরোয়নি, যেমন শক্তি ও ভাস্কর, দু’জনেই এমনিতে কথাবার্তায় চৌকশ, কিন্তু মঞ্চে অনড়। আমি মনোনীত হয়েছিলাম কোনওক্রমে। নাটকের অভিনয়ের ব্যাপারে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতাগুলি শোচনীয়। কলেজে পড়ার সময়ও একবার নাটক করেছিলাম,গলসওয়ার্দির ‘অ্যান ইন্সপেকটর কল্স’ নাটকটির ভাবানুবাদ, তাতে আমার সহ-অভিনেতা ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সিটি কলেজে সে ছিল আমাদের চেয়ে এক বছরের জুনিয়ার। সৌমিত্র তখনও সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে আহ্বান পায়নি, অতি সুদর্শন, বুদ্ধিমান ও নরম স্বভাবের ছেলে, কবিতা লেখে। সৌমিত্রর তুলনায় আমার ভূমিকাটি বড়ই ছিল, আমিই ইন্সপেকটর, পার্ট ঠিকঠাক মুখস্থ করেছিলাম, কিন্তু সৌমিত্র ও অন্যান্যরা ভালো অভিনয় করলেও আমার জন্যই নাটকটি ডুবে যায়। যেখানে হাসির কথা নয়, সেখানেও দর্শকরা আমাকে দেখে হাসছিল। আসলে, আমার হাতে একটি মেয়ের বড় সাইজের ফটোগ্রাফ থাকার কথা, যেটি দেখিয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করতে হবে, তারা মেয়েটিকে চেনে কি না! নাটক শুরু হবার আগেও সেরকম একটি ফটোগ্রাফ জোগাড় করে রাখা হয়নি, শেষ মুহূর্তে কাছাকাছি একটা ফোটগ্রাফির দোকানের শো-কেস থেকে সুচিত্রা সেনের একটি ছবি খুলে আনা হয়। উল্টো দিক থেকেও সে ছবি দেখে হেসে গড়াচ্ছিল দর্শকরা।
হরবোলার নাটকে অবশ্য কোনও রকম ভুলত্রুটি হবার উপায় নেই। সিগনেট প্রেসের সেই বাড়ির সামনে মস্ত বড় লন, সেখানে কলকাতার সবচেয়ে নামী ডেকরেটরদের দিয়ে মঞ্চ বাঁধা হয়েছে দেড়মাস আগে, প্রত্যেকদিন তার ভাড়া কয়েক শো টাকা, আমাদের যাতে কোনওরকম মঞ্চভীতি না থাকে সে জন্য দেড়মাস ধরে প্রতিদিন স্টেজ রিহার্সাল। পশ্চাৎপটে ছবিটবি কিছু নেই, শুধু পর্দাটি হালকা বেগুনি ও লেবু-হলুদ রঙে সমানভাবে বিভক্ত, অর্থাৎ চরিত্রগুলি মঞ্চের এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করলে তাদের পটভূমিকার রং বদলে যাবে। শুধু ফুটলাইট, ফোকাসের ব্যবস্থা রাখেননি কমলদা, অর্থাৎ তিনি খানিকটা যাত্রার আঙ্গিক মেশাতে চেয়েছিলেন। পোশাকের অভিনব পরিকল্পনাও তাঁর নিজস্ব। যেমন বনবাসী রামের অঙ্গে শুধু গাছের পাতার তৈরি বসন, সবুজ রঙের অয়েল ক্লথ কেটে কেটে সেই পাতার পোশাক বানানো হয়েছিল। বিভীষণের কোনও পোশাকই নেই। শুধু একটা আলোয়ান গায়ে জড়িয়ে গলায় কাঁধে গিট বাঁধা, যাতে ঠিক বকধার্মিকের মতন দেখায়, সে ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছিল উৎপল রায়চৌধুরী। দীপক মজুমদার লক্ষ্মণ, গানগুলিতে জমিয়ে দিয়েছিল সে। আর হনুমান সেজেছিল রমেন গুহ, এখন সে কলকাতা বইমেলার অন্যতম কর্তাব্যক্তি, চমৎকার তার অভিনয়। ছোট ছোট ছেলেরা বানর সেনা, তাদের অন্যতম নীলাক্ষ গুপ্ত, যে এখন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রখ্যাত সমালোচক, রবিশঙ্করের সঙ্গেও তর্কযুদ্ধে নামতে দ্বিধা করে না। আমার ভূমিকা জাম্বুবানের, হাতে সবসময় হুঁকো, কোনওরকমে কাজ চালিয়ে দিয়েছি বলা যেতে পারে।
কমলকুমারের পরিচালনায় এরকম নাটক জমে যেতে বাধ্য। টিকিট ছিল না, আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল শুধু কলকাতার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের, সমস্ত পত্র-পত্রিকাতেই প্রশংসিত হয়েছিল। সৈয়দ মুজতবা আলী স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে একটি পত্রিকায় অনেকখানি লিখেছিলেন।
পরের নাটকটি খুবই কঠিন, রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’। এ নাটকটিকে মঞ্চসফল করা বেশ দুষ্কর, কোনওদিনই এ নাটকটির পূর্ণাঙ্গ অভিনয় হয়নি, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের আমলেও কিছু চরিত্র ও গান বাদ দেওয়া হত। কমলকুমার রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন না, তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ- বিবেকানন্দপক্ষীয়, শ্রীরামকৃষ্ণ রবীন্দ্রনাথকে চিনতেন কি না জানা যায় না। বিবেকানন্দ চিনতেন, অল্প বয়েসে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা করলেও শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথের কবিতা সম্পর্কে নাকি বিদ্রুপবাক্য উচ্চারণ করেছেন, কমলকুমারেরও মতামত সেইরকম। কিন্তু ‘মুক্তধারা’ নির্বাচিত হবার পর নাট্য-পরিচালক হিসেবে তিনি ঘোষণা করলেন, নাটকের একটিও শব্দ বা চরিত্র বাদ দেওয়া যাবে না, অন্তত ঐতিহাসিকভাবে ‘মুক্তধারা’র সম্পূর্ণাঙ্গ অভিনয়ের কৃতিত্ব যেন ‘হরবোলা’ দাবি করতে পারে। এ নাটকে বহু চরিত্র, তাই আরও অনেক বন্ধুবান্ধব, চেনাজানাদের নিয়ে আসা হল, আগেরটি ছিল স্ত্রীভূমিকা বর্জিত, এবারে ডাকা হল দু’ একজন বন্ধুর বোনকে, অতি রূপসী গৌরী দত্ত এসেছিলেন ডি কে-র আহ্বানে। তবু, ধনঞ্জয় বৈরাগীর গান গাইবার মতন কেউ ছিল না আমাদের মধ্যে। ডি জে কিমার কোম্পানি থেকে ডি কে-র দু’জন সহকর্মী এসে যোগ দিলেন। একজন শ্যাম গুহ, মৃদুভাষী ও রসিক, তিনি শিল্পী, কৃত্তিবাসের প্রথম সংখ্যার নাম-লিপি তাঁরই আঁকা। অন্যজন চুণীলাল শীল, অত্যন্ত সজ্জন ও সুপুরুষ, উদাত্ত গানের গলা।
হরবোলায় মাঝে মাঝে গান ও সাহিত্যবাসর হত বটে, কিন্তু নাটকের রিহার্সালেই ছিল বেশি আকর্ষণ। আগেরটির মতন এটারও রিহার্সাল চলে এক বছর ধরে। কমলকুমার এর মধ্যে আবার সাহিত্যরচনা শুরু করেছেন, আমরা কয়েকজন দিনের বেলাতেও তাঁর ছায়াসঙ্গী। একদিন অকস্মাৎ একটি নাম-না-জানা পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ আমাদের পড়তে দিলেন। সে উপন্যাসের ভাষায় আমরা মন্ত্রমুগ্ধ।
নাটক পরিচালনার সময় তাঁর নির্দেশের ভাষাও চমকপ্রদ। একরকম বিশেষ গলার আওয়াজ বার করতে হবে। তিনি বললেন, মনে করো ট্রেনে চেপে দূরে কোথাও যাচ্ছ, সারা রাত ধরে। মাঝে মাঝে ঘুম আর জাগা, ভোরবেলা কোন একটা ছোট স্টেশনে ট্রেন থেমেছে, চোখ মেলে দেখলে, প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা, শুধু দুরে একটা ডাক শোনা যাচ্ছে, চা-গরম! ওইরকম চা-গরমের গলার আওয়াজটা চাই! একজনকে বিশেষভাবে হাঁটার নির্দেশ দিতে গিয়ে বললেন, মনে করো, মা এইমাত্র ঘর মুছে গেছেন, সেই ভিজে ঘরে কিছুক্ষণ হাঁটা বন্ধ রাখতে হয়, তুমি হঠাৎ ঢুকে পড়েছ, তখন মায়ের বকুনির ভয়ে পুরো পা না ফেলে, আঙুলের ডগা দিয়ে তাড়াতাড়ি যেমন যাও…। অভিজিতের একটা সংলাপে আছে, সুন্দর এই পৃথিবী, কমলদা নির্দেশ দিতে গিয়ে বললেন, এ কথাটা কোন্ দিকে তাকিয়ে বলবে? পৃথিবী কি শুধু তোমার সামনে? পেছনে নয়, ডানদিকে নয়, বাঁদিকে নয়? চতুর্দিকে ঘুরে বললে যাত্রা হয়ে যাবে। নিজের বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলো, সুন্দর এই পৃথিবী…।
এ নাটকে তিনি আমায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দিয়েছিলেন, যন্ত্ররাজ বিভূতি৷ আপাতত ভিলেন, আবার ট্র্যাজিক চরিত্রও বটে। একটা নীল-সাদা ডোরাকাটা আলখাল্লা আমার পোশাক, গলায় মস্ত বড় একটা ফুলের মালা। পার্ট ভোলার কোনও প্রশ্নই নেই, কারণ এতদিন ধরে রিহার্সাল চলেছে যে পুরো নাটকটি প্রত্যেকের মুখস্থ। দর্শকরা সবাই বিশিষ্ট, কারণ প্রবেশ আমন্ত্রণপত্রভিত্তিক, সমস্ত লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী ও খ্যাতনামা নাগরিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দু’দিন অভিনয় হয়েছিল, একটিও দর্শক-আসন খালি ছিল না। হরবোলার কিছুটা নাম হয়েছে। সিগনেট প্রেসের প্রতিপত্তিশালী দিলীপকুমার গুপ্তর আমন্ত্রণ ক’জন অগ্রাহ্য করতে পারে! তা ছাড়া উচ্চপদস্থ রাজপুরুষরা অনেকেই কমলদার চ্যালা। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রে’রও বামপন্থীদের মধ্যে প্রচুর অনুরাগী, সে জন্য কার্ডের খুবই চাহিদা। অনেক মঞ্চ-চলচ্চিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রের দু’জন প্রধানা নায়িকা, সুচিত্রা সেন ও অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়। এঁদের মধ্যে অরুন্ধতী আগে ছিলেন গুহঠাকুরতা, বুড্ঢাদের আত্মীয়, ইনি এসেছিলেন প্রথম দিনেই। সুচিত্রা সেন এসেছিলেন কি না মনে নেই, তবে অরুন্ধতীর মুখখানা যেন নীলাভ আলো মাখা, তাঁর দু’পাশে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও বিকাশ রায়। অতিথিদের তদারক করছেন সত্যজিৎ রায়। প্রথম সারির এক কোণে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও রাজেশ্বরী দেবী, তাঁদের সঙ্গে গল্প করছেন বুদ্ধদেব বসু। নাটক শুরুর আগে উইংসের আড়াল থেকে আমরা জুলজুল চোখে দেখছি এঁদের, আমাদের মতন অকিঞ্চিৎকর ছেলেমেয়েদের অভিনয় দেখতে এসেছেন বাংলার শ্রেষ্ঠ মানুষেরা!
প্রথম দিনে আমি একটা কাণ্ডই করে ফেলেছিলাম। আমার ওপর নির্দেশ ছিল, শেষ দৃশ্যে বিভূতি ‘আমার বাঁধ কে ভাঙলে, বাঁধ কে ভাঙলে’, এই কাতর আর্তনাদ করতে করতে গলার মালাটা ছিঁড়ে ফেলবে, যাতে ফুল ছড়িয়ে যায় সারা মঞ্চে। আমি অত্যুৎসাহে এত জোরে ছিঁড়লাম যে আধখানা মালা উড়ে গিয়ে পড়ল অরুন্ধতী দেবীর কোলে! পরে অনেকে বলেছিল, ও রকম আমি ইচ্ছে করে করেছি, কিন্তু তা সত্যি নয়!
তেইশ
পঞ্চাশের দশকের বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতের ইতিহাস যদি অনুসরণ করতে যাই, তা হলে মনে হবে এমন সমৃদ্ধ দশক আর হয় না! শিল্পের প্রতিটি শাখাই উন্নত। বাংলার সাহিত্যিকরা ভারতে অবিসংবাদিতভাবে শ্রেষ্ঠ। এই দশকের গোড়াতেই বিভূতিভূষণ চলে গেলেও তাঁর খ্যাতি বাড়ছে দিন দিন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় প্রথম দিকে ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণ ধারার প্রভাব থাকলেও ক্রমশ তিনি ঝুঁকে পড়েন মার্কসবাদের দিকে, তারাশঙ্কর বিশাল পটভূমিকায় ফুটিয়ে তুলছেন জনমানসের প্রতিচ্ছবি। বনফুল ও সতীনাথ নিয়ে আসছেন বর্হিবঙ্গ। কল্লোল যুগের লেখকরা প্রায় সবাই সক্রিয়, বুদ্ধদেব বসুকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি লেখক গোষ্ঠী, প্যারিস শহরে যেমন জ্যাঁ ককতো, কলকাতায় তেমন বুদ্ধদেব বসু, যদিও তিনি মার্কসবাদ বিরোধী ছিলেন বলে তখনকার বামপন্থী হাওয়ায় তাঁর নিন্দুকের সংখ্যাও কম ছিল না। বিষ্ণু দে-কে ঘিরে বাম মনোভাবসম্পন্ন তরুণরাও একটা গোষ্ঠী তৈরি করে ফেলছে আস্তে আস্তে, জীবনানন্দের প্রস্থান এই দশকের মধ্য পথে, কিন্তু তার পরেই তাঁর কবিতার প্রকৃত মর্ম উদঘাটিত হতে লাগল। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও অমিয় চক্রবর্তী কবিতা লিখছেন সম্পূর্ণ বিপরীত স্বাদের। অরুণ মিত্র লিখছেন এলাহাবাদ থেকে, সমর সেন ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় দারুণ জনপ্রিয়।
শিল্প ও ভাস্কর্যেও বাঙালিরা শীর্ষস্থানীয়, রয়েছেন নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, অসিতকুমার হালদার, রামকিঙ্কর, চিন্তামণি কর, পূর্ব পাকিস্তানে জয়নাল আবেদিন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর করছেন কুটুম কাটাম। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে আলাউদ্দিন খাঁ এবং রবিশঙ্কর ও আলি আকবর। বেশ মনে আছে, একটি অনুষ্ঠানে আলাউদ্দিনের দু’পাশে বসে বাজাচ্ছিলেন রবিশঙ্কর ও আলি আকবর, এঁরা দুজনেই তখন ভারত-প্রসিদ্ধ, হঠাৎ এক সময় আলাউদ্দিন শ্রোতাদের উদ্দেশে বললেন, আমার পোলাডা আর জামাইডা সবে শিখতাছে, আপনেরা ক্ষমা-ঘেন্না করে নিবেন! আলাউদ্দিন মঞ্চে নাটকীয় কিছু করতে পছন্দ করতেন, সেদিন তবলায় সঙ্গত করছিলেন আল্লারাখা, হঠাৎ আলাউদ্দিন তাঁকে এক চড় মেরে বসলেন, আল্লারাখা নাকি লয় ঠিক রাখছিলেন না। তখন আলাউদ্দিন শিল্পীসমাজে সর্বমান্য, আল্লারাখা ক্ষমা চেয়ে নিজের দু’কান মুলে ফেললেন। অনেক বছর পর আমি ওস্তাদ আমির খাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আলাউদ্দিন সঙ্গীতগুরু হিসেবে তো তুলনাহীন, কিন্তু নিজে শিল্পী হিসেবে বড় ছিলেন? আমির খাঁ বিশেষ কোনও ঘরানা থেকে আসেননি। নিজস্ব মতামত প্রকাশে দ্বিধাহীন, আমার প্রশ্নের উত্তরে বললেন, হাঁ, বহুৎ মোটা (ইন্দোর অঞ্চলের ভাষায় মোটা মানে মহান), লেকিন লয় জেরা কম থা। ব্যাপারটা মজার লেগেছিল বলে মনে আছে।
পঞ্চাশের দশকে রবীন্দ্রসঙ্গীতে আমাদের মাতিয়ে রেখেছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র ও রাজেশ্বরী দত্ত, শুধু গুণ নয়, রূপের জন্যও এই তিনজনকে আনায়াসে বলা যায় থ্রি গ্রেসেস। পুরুষ কণ্ঠে দেবব্রত বিশ্বাস, সুবিনয় রায়কে ভালো করে পাই আরও পরে। আধুনিক গানে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। তবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রসঙ্গীতেও সমান পারঙ্গম৷ রবীন্দ্রসঙ্গীতকে প্রথম জনপ্রিয় করেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, প্রত্যেক রবিবার সকালে রেডিয়োতে তিনি গান শেখান, সেই অনুষ্ঠানটিকে মনে হত জাতীয় জীবনের অঙ্গ। পঙ্কজ মল্লিক অবাঙালিদের কাছেও পরিচিত ছিলেন, নিউ থিয়েটার্সের অনেক হিন্দি ছবিতেও তিনি গাইতেন। পঙ্কজ মল্লিকের পর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রসঙ্গীতকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যান, অন্য অনেক ধরনের গানও তিনি গাইতেন, সলিল চৌধুরীর সুরে ও বাণীতে ‘কোনো এক গায়ের বঁধূ’ গানটির রেকর্ড জনপ্রিয়তার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়, যেখানেই যাই সেখানেই ওই গান, দু’পিঠ জোড়া বড় গানটি মুখস্থ না করে উপায় নেই। তেমনই জনপ্রিয় হয় সুকান্তর ‘রানার’, সত্যেন দত্তর ‘পাল্কি চলে’, সলিল চৌধুরীরই সুরে। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য এসব গাইতেন না, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছিলেন, তারপর চলে গেলেন শ্যামাসঙ্গীতে। প্রথম যে তিন গায়িকার কথা বলেছি, তাঁদের মধ্যে কণিকা ও রাজেশ্বরী থাকতেন অন্তরালে, কিন্তু সুচিত্রা জনসভায়, মিছিলে অংশগ্রহণ করে মাতিয়ে রাখতেন জনসাধারণকে। আব্বাসউদ্দিনের পর লোকসঙ্গীতের দিকটা কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছিল, হঠাৎ আবির্ভূত হলেন নির্মলেন্দু চৌধুরী নামে এক নতুন শিল্পী। কী জোরালো, উদাত্ত তাঁর গলা। সারা ভারতে নৃত্যজগতের সম্রাট তখন উদয়শঙ্কর, বাংলার মঞ্জুশ্রী চাকী ও সেবা মিত্র নামে দুটি তরুণীও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
১৯৫৫ সালের ২৬ আগস্ট সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ এসে যুগান্তর ঘটিয়ে দিল বাংলা শুধু নয়, ভারতীয় চলচ্চিত্রে। উপেন্দ্রকিশোরের নাতি ও সুকুমার রায়ের ছেলে হয়েও সত্যজিৎ রায় প্রথম যৌবন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কোনও খোঁজখবর রাখতেন না। ডি জে কিমার কোম্পানিতে চাকরি করতে যাবার পর সেখানকার ম্যানেজার ডি কে তাঁর বাংলা জ্ঞানের বহর দেখে জোর করে বাংলা বই পড়াতে শুরু করেন। তিনি সত্যজিৎকে প্রথম যে বইটি উপহার দিয়েছিলেন, সেটি তারাশঙ্করের ‘কবি’। তারপর সত্যজিৎ অতি দ্রুত বাংলা সাহিত্যে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন, নিজেই নতুন স্বাদের কিশোর বাংলা সাহিত্য রচনায় অত্যন্ত সার্থক হন, ছড়া ও গানও লিখেছেন চমৎকার। সেগুলির ছন্দ-মিলে ত্রুটি নেই। এসব নাকি রক্তে থাকে। সিগনেট প্রেসের বইগুলির মলাট আঁকতে আঁকতে ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের কিশোর সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেঁপু’ পড়েই প্রথম তাঁর এই কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা মনে আসে। ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তির দু’বছর পর ফরাসি দেশের ক্যান চলচ্চিত্র উৎসবে সেটি ‘শ্রেষ্ঠ মানবিক দলিল’ হিসেবে সম্মানিত হয়, তার আগেই কিন্তু কলকাতার লেখক-কবি-শিল্পীরা সিনেট হলে সত্যজিতের সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল, তার উদ্যোক্তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর। এই দশকেই পর পর মুক্তি পায় ‘অপরাজিত’, ‘পরশ পাথর, ‘জলসাঘর’, ‘অপুর সংসার’ আর ‘দেবী’। সেসব ছবি, প্রথম দেখার উন্মাদনার রেশ যেন এখনও রয়ে গেছে। পথের পাঁচালী দেখে কী কান্নাই কেঁদেছিলাম, সে কান্না অতি বিশুদ্ধ, মনকে পরিশ্রুত করে দেয়। এই দশকের মধ্যেই এসে যান মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার আর তপন সিংহ। মৃণাল সেনের ‘নীল আকাশের নীচে’ আর ‘বাইশে শ্রাবণ’ দেখেই মনে হয়েছিল, ইনি জয় করতে এসেছেন। সারা ভারত তখন বাংলার চলচ্চিত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবনত। এর আগেও প্রমথেশ বড়ুয়া আর দেবকীকুমার বসু আনেক ভালো ছবি উপহার দিয়েছেন, কলকাতা ছিল হিন্দি ছবিরও বড় কেন্দ্র, নিউ থিয়েটার্স থেকে দ্বিভাষী ছবি তৈরি হত। কুন্দনলাল সায়গল কলকাতা থেকেই সর্ব ভারতীয় খ্যাতি পেয়েছিলেন, যতদূর জানি, রাজ কাপুর-শশী কাপুরদের বাবাও জড়িত ছিলেন কলকাতার চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে।
এক কালের বিখ্যাত ব্যবসায়িক থিয়েটারগুলির রমরমা তখন অনেকটা কমে গেছে বটে, কিন্তু গড়ে উঠেছে অনেকগুলি নাট্যদল। চলচ্চিত্রে সত্যজিতেরই মতন বাংলা নাট্যমঞ্চে যুগান্তর এনে দেন শম্ভু মিত্র, ‘পথিক’, ‘ছেঁড়া তার’ ও তারপর ‘রক্তকরবী’। একেবারে সম্পূর্ণ নতুন উপস্থাপনা। বহুরূপীর মতনই আরও কয়েকটি দল বিশেষ ছাপ ফেলেছিল, যেমন গণনাট্য সঙঘ, লিট্ল থিয়েটার গ্রুপ, থিয়েটার সেন্টার। আগেকার কালের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা শিশিরকুমার ভাদুড়ীর তখন নিজস্ব কোনও মঞ্চই নেই, তাঁকে পদ্মভূষণ খেতাব দেওয়া হলে তিনি অবজ্ঞার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, এর বদলে একটা জাতীয় নাট্যশালা গড়ে দিলে খুশি হতাম। রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার সে আক্ষেপে আমল দেয়নি।
শুধু শিল্প সাহিত্য নয়, জ্ঞানচর্চাতেও তখন বাঙালিদের প্রাধান্য। বিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছেন মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু; প্রথম জনের নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হলেও পাননি পৃষ্ঠপোষকদের ধরাধরি করার অভাবে, আর দ্বিতীয়জনের নাম আইনস্টাইনের একটি থিয়োরির সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে। ঐতিহাসিকদের মধ্যে ছিলেন যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুশোভন সরকার প্রমুখ, ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, মুক্তচিন্তার আদর্শের নেতা আবদুল ওদুদ। বঙ্গের আকাশ ভরা এরকম বহু নক্ষত্র। এমনকী খেলাতেও কলকাতা দারুণ কৃতিত্ব দেখিয়েছিল, ১৯৫১ সালে ফুটবলের এশিয়ান গেমসের ফাইনালে ইরানকে হারিয়ে চাম্পিয়ন হয় ভারতীয় দল, এই দলের ন’জন খেলোয়াড়ই কলকাতার ক্লাবের, একমাত্র গোলটি দিয়েছিলেন মেওয়ালাল।
সামাজিকভাবে এই দশকে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কয়েকটি বিরাট পরিবর্তন ঘটেছিল, যার কৃতিত্ব অনেকটাই প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর, আবার আংশিক ব্যর্থতার দায়ও তাঁরই। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হবার পর সমস্ত নাগরিকদের জন্য সমানভাবে একই রকম সিভিল ও পিনাল কোড জারি হওয়া স্বাভাবিক ছিল। ধর্মনির্বিশেষে একই রকম বিবাহবিধি ও নারী-পুরুষের সমান উত্তরাধিকার এবং ধর্মীয় বিভেদ, জাতি ভেদ ও অস্পৃশ্যতাকে কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আইন প্রযুক্ত হলে ভারত ভবিষ্যতের অনেক সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পারত, নেহরুর পরিকল্পনাও ছিল সে রকম। কিন্তু তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের মতন দুঃসাহস ও মানসিক দৃঢ়তা তাঁর ছিল না। রক্ষণশীলরা তো আপত্তি করবেই, তাদের সংখ্যাও অনেক সময় বেশি হয়। প্রগতিপন্থীরা সব সময়ই সংখ্যালঘু, তবু তারাই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বিদ্যাসাগর মশাই যখন বিধবাবিবাহ বিলের সমর্থনে স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধপক্ষীয়দের স্বাক্ষর ছিল অনেক বেশি। জওহরলাল নেহরু মূল আদর্শ থেকে খানিকটা পিছিয়ে এলেন, মুসলমান ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে স্পর্শ করলেন না, ভারতীয় কোড বিলের বদলে তিনি লোকসভায় উপস্থিত করলেন হিন্দু কোড বিল। হিন্দু রক্ষণশীলরা তা নিয়েও কম বিরোধিতা ও বাধার সৃষ্টি করেনি, কিন্তু এ ব্যাপারে নেহরু বামপন্থী দল ও নারী সংগঠনগুলির সমর্থন পেয়েছিলেন। যাই হোক, হিন্দু সভ্যতার ইতিহাসে এই প্রথম নিষিদ্ধ হল বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ। মেয়েদের ক্ষেত্রে বিবাহের নিম্নতম বয়স ১৫ আর ছেলেদের ১৮, আর দু’জনেই ২১ বছর পূর্ণ করলে তারা ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের হলেও ধর্মান্তরিত না হয়ে বিয়ে করতে পারবে। স্বীকৃত হল বিবাহ বিচ্ছেদ, অত্যাচারিত হিন্দু নারীদের যে অধিকার ছিল না কখনও, এখন পৈতৃক সম্পত্তিতেও তাদের অধিকার জন্মাল। পরের দু’বছরে এরকম কয়েকটি আইনের সঙ্গে অস্পৃশ্যতা বিরোধী আইনও পাস হয়ে গেল।
এর ফলে যত ব্যাপকভাবে সামাজিক পরিবর্তন হতে পারত, ততটা সম্পূর্ণ হতে পারেনি, কারণ কঠোরভাবে আইনগুলির প্রয়োগ হয়নি সর্বত্র, বিশেষত উত্তর ভারতে। বাল্যবিবাহ ও অস্পৃশ্যতার মতন কুৎসিত প্রথা এখনও রয়ে গেছে বহু জায়গায়। সমস্ত ভারতীয়দের জন্য সমান আইন প্রণয়নে ব্যর্থতার জন্যই দিন দিন জটিল হয়েছে কাশ্মীর সমস্যা, ক্রমশ মাথাচাড়া দিয়েছে হিন্দু মৌলবাদ। রাষ্ট্রটি ধর্মনিরপেক্ষ হলেও প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা কাকে বলে তা বোঝানোই হয়নি সাধারণ মানুষদের। আইন প্রণয়ন করে সমাজ বদলানো যায় না, আমূল পরিবর্তনের জন্য চাই বিপ্লব, এরকম একটা মতবাদ তখন খুব চালু ছিল, আমরাও বিশ্বাস করতাম, কিন্তু বিপ্লবের পরেও জোরজবরদস্তি কিংবা সামরিক ধাঁচের শাসন ছাড়া অন্য কোনও দৃষ্টান্ত দেখাতে পারেনি এ পর্যন্ত কোনও দেশ।
হিন্দু কোড বিল মান্য করা ও অস্পৃশ্যতা নিবারণের ব্যাপারে অনেকটাই অগ্রণী পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে এত জ্ঞানী-গুণীর সমাবেশ হওয়া সত্ত্বেও সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বাঙালিদের কোনও গুরুত্বই ছিল না। সেই কারণে পশ্চিমবাংলার দুর্গতিও শুরু হয় এই দশকে। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় শক্ত ধাতুতে গড়া মানুষ বলে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু খণ্ডিত বাংলায় তিনি একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মাত্র, কেন্দ্রীয় সরকার তাঁর বহু দাবি ও প্রতিবাদে কর্ণপাত করেনি। স্বাধীনতার পরের বছরেই কমিউনিস্ট পার্টিকে বে-আইনি ঘোষণা করা হয়েছিল, অনেক নেতাই তখন চলে যান আন্ডারগ্রাউন্ডে, দু’বছর পর কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে এই পার্টি আবার বৈধতার স্বীকৃতি পায়। প্রকাশ্যে প্রচার শুরু করে ও নির্বাচনে অংশ নেয়। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিতান্তই শহরভিত্তিক, কলকাতাতেই প্রধান শক্তি, গ্রামাঞ্চলে কোনও প্রভাবই ছিল না বলতে গেলে। বিরোধীপক্ষ হিসেবে তাদের কর্মসূচী ছিল সরকারকে নানাভাবে ব্যতিব্যস্ত ও অপদস্থ করা, ক্ষমতা দখল সে সময় তাদের দিবাস্বপ্নেও ছিল না। একবার খাদ্য আন্দোলনে দারুণ বিক্ষোভ ও হাঙ্গামা সৃষ্টির পর রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি অতুল্য ঘোষ বলেছিলেন, শহরটা কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা দখল করে নিয়েছে, ঠিক আছে, আগামী নির্বাচনে গ্রাম থেকে সংখ্যা গরিষ্ঠ হয়ে এসে ওদের দেখে নেব। সেবারে তিনি জিতেছিলেন বটে, কিন্তু এই উক্তির মাত্র আট বছর পরই নির্বাচনে অতুল্য ঘোষ সমেত বহু কংগ্রেসী নেতা গ্রামাঞ্চলেই ধরাশায়ী হন।
পঞ্চাশের দশকে শিল্প-সাহিত্যের এমন বিস্ময়কর বিকাশের পাশাপাশি অর্থনৈতিক অবনতি ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার চিত্রটি অতি ভয়াবহ। মাথা পিছু উৎপাদন ও আয়ে পশ্চিমবাংলা ছিল শীর্ষে, কারখানার সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি, হঠাৎ শুরু হয়ে গেল অধঃপতন। কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যনীতি তার জন্য অনেকখানি দায়ী তো বটেই। পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তুদের স্রোত বেড়েই চলেছে, জনসংখ্যার এই অস্বাভাবিক স্ফীতি সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে রাজ্য সরকার, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার দিল্লি-সন্নিধানে পঞ্জাবি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য যতটা তৎপর, সে তুলনায় দূরবর্তী বাঙালি উদ্বাস্তুদের ব্যাপারে দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে অনেকখানি। পঞ্জাবি উদ্বাস্তুরা বসতি পেয়েছে এদিককার পঞ্জাবে ও দিল্লিতে। যে-জন্য দিল্লি পঞ্জাবি-প্রধান শহর হয়ে ওঠে, আর বাঙালি উদ্বাস্তুদের পাঠানো হতে লাগল দণ্ডকারণ্যের প্রতিকূল পরিবেশে। সেখানে তারা কখনও স্বাবলম্বী হতে পারেনি। কিছু উদ্বাস্তু প্রেরিত হয়েছিল আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে, সেখানকার চাষবাস ও মাছ ধরা জীবিকা বাঙালিদের অনুকূল, কিন্তু কোনও দুর্বোধ্য কারণে আন্দামানে উদ্বাস্তু পাঠানোর প্রবল বিরোধিতা করল বামপন্থীরা, তাদের বিক্ষোভে এ প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেল। আরও কয়েক লক্ষ বাঙালি উদ্বাস্তুদের আন্দামানে বসতির অধিকার দিলে সে দ্বীপপুঞ্জটি বাঙালি-প্রধান হয়ে যেতে পারত, সেই উদ্বাস্তুরা সরকারি ডোলের ওপর নির্ভরতা বর্জন করে নিজেরাই জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করে নিত।
ব্রিটিশ আমলেও বিভিন্ন রাজ্যে রাজস্ব বণ্টনের একটা নির্দিষ্ট নীতি ছিল। কলকাতা ও মুম্বই শহর পেত সমানভাবে কুড়ি শতাংশ। স্বাধীনতা ঘোষণার রাতেই কলকাতার প্রাপ্য রাজস্ব কমিয়ে করা হয় পনেরো শতাংশ, মুম্বইয়ের বেড়ে যায়, কুড়ি থেকে একুশ শতাংশ হল। মাদ্রাজের পনেরো থেকে বেড়ে হল আঠারো। কলকাতার প্রাপ্য কমিয়ে দেবার সম্ভাব্য কারণ এই যে, এখন কলকাতা একটি ছোট রাজ্যের রাজধানী, কিন্তু এই শহর ও বন্দরের ওপরে যে উত্তর-পূর্ব ভারতের কয়েকটি রাজ্য নির্ভরশীল এবং খণ্ডিত বাংলায় জনসংখ্যার চাপ যে দারুণভাবে বেড়ে যাবে, তা বিবেচনা করা হল না, তা কতটা কেন্দ্রীয় সরকারের দূরদৃষ্টির অভাবে আর কতটা বাঙালির রাজনৈতিক শক্তির অভাবে, তা বলা শক্ত। আগে পাট উৎপাদন ও পাট শিল্পের রাজস্বের আশি ভাগ পেত কলকাতা, কেন্দ্রীয় সরকার তারও অনেকখানি কেড়ে নেয়। যে-কলকাতা এক সময় ছিল প্রাচ্যের উজ্জ্বলতম নগর, এই সময় থেকে তাকে জোর করে ঠেলে দেওয়া হয় অবনতির দিকে।
একদিকে শিল্প-সংস্কৃতির আকর্ষণ, অন্য দিকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়, এর মাঝখানে আমার মতন হাজার হাজার বেকার যুবক। আমাদের দু’কান ধরে যেন দু’দিকে টানাটানি চলছিল।
গ্র্যাজুয়েট হবার পর বাবা বেশ জোর দিয়েই বলেছিলেন, এবার আমাকে চাকরি খুঁজতেই হবে, আর উচ্চশিক্ষার দরকার নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আকাঙ্ক্ষা কার না থাকে? এ পর্যন্ত আমাকে কোনও কো-এডুকেশনাল কলেজে পড়তে দেওয়া হয়নি। কিন্তু ইউনিভার্সিটির ক্লাসে তো তা আর আটকানো যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রেমকাহিনী নিয়ে লেখা হয় অনেক গল্প-উপন্যাস। কিন্তু ততদিনে অ্যাকাডেমিক পড়াশুনো সম্পর্কে আমার নিজেরও মোহ ঘুচে গেছে। চার বছরের কলেজজীবনে আমি যতটুকু শিখেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি শিখেছি নিজে অন্য বই পড়ে। একটার পর একটা ক্লাসে বসে অধ্যাপকদের বক্তৃতা শোনার কোনও আকর্ষণ ছিল না। তা ছাড়া ভগ্নস্বাস্থ্য বাবার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সাহায্য করা উচিত, এই বোধটাও ততদিনে জেগেছে। কিছু কিছু সহপাঠী চলে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমি শুরু করলাম চাকরি খুঁজতে।
কিন্তু কোথায় চাকরি? হু হু করে বাড়ছে বেকারের সংখ্যা, সেই সঙ্গে চলেছে বিভিন্ন অফিসে ছাঁটাই। নতুন কোনও পদই তৈরি হয় না। বেকারদের এরকম করুণ অবস্থা নিয়েও নানা রকম রসিকতা চালু হয়েছিল। যেমন, কিছু কিছু বেকার ছেলে বিভিন্ন শ্মশানঘাটে গিয়ে বসে থাকত, কোনও মাঝবয়সি মড়া এলেই তারা শববাহকদের গিয়ে জিজ্ঞেস করত, দাদা, ইনি কোন অফিসে চাকরি করতেন? কী পোস্ট ছিল? তারপরই ছুটে গিয়ে বাড়িতে বসে দরখাস্ত লিখত, স্যার লারনিং ফ্রম দা বার্নিং ঘাট দ্যাট এ পোস্ট ইজ লাইয়িং ভেকান্ট ইন ইয়োর অফিস ……। আর একটি এই রকম, চিড়িয়াখানায় একটি ওরাংওটাং মারা গেছে, বিদেশ থেকে আর একটি আমদানি করতে সময় লাগবে, তাই একটি এম এ পাস ছেলে সেই স্টপ গ্যাপ চাকরি নিয়েছে, মৃত ওরাংওটাং-এর ছাল পরে সেজে থেকে সে লাফালাফি করে দর্শকদের আমোদ দেয়। যত বেশি নাচানাচি করে, তত খুচরো পয়সা পড়ে, সেটা তার উপরি পাওনা। একদিন অত্যুৎসাহে সে তারের জাল ধরে লাফালাফি করতে গিয়ে পড়ে গেল পাশের বাঘের খাঁচায়। বাঘটা গুটিগুটি এগিয়ে আসছে তার দিকে, ভয়ে তো তার প্রাণ উড়ে যাবার উপক্রম। বাঘটি খুব কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, দাদা ভয় পাবেন না, আমিও বাংলার এম এ!
আমি যে কত চাকরির জন্য দরখাস্ত ও ইন্টারভিউ দিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। সবই নিদারুণ প্রহসন। হয়তো দুটি মাত্র পদ আছে, দরখাস্ত পড়েছে দশ-বারো হাজার, তার মধ্যে থেকে বেছে দুশো জনকে ডাকা হয়েছে ইন্টারভিউতে। সেখানে ইন্টারভিউ বোর্ডের চার-পাঁচজন সদস্য সেইসব অসহায় বেকার যুবকদের নিয়ে নিষ্ঠুর ঠাট্টা-তামাসা করতেন। কারণ, তাঁদেরই কারও ভাইপো-ভাগ্নের জন্য পদ দুটি তো আগেই ঠিক হয়ে আছে। কত উদ্ভট প্রশ্নই না তাঁরা বানাতেন। একবার রেলের এক কেরানির পদের জন্য লিখিত পরীক্ষায় আমি প্রথম হয়েছিলাম। তাতে কী, ভাইবা অর্থাৎ মৌখিক পরীক্ষায় বাতিল করে দেবার সুযোগ তো রয়েছেই! পাবই ধরে নিয়ে আমি ইন্টারভিউ দিতে গেছি, প্রশ্নগুলির উত্তরও পেরে যাচ্ছি, একজন প্রশ্নকর্তা কিছু জিজ্ঞেস না করে আমার জামার একটা বোতামের দিকে চেয়ে আছেন, সেখান দিয়ে একটা সুতো বেরিয়ে আছে, হঠাৎ এক সময় তিনি ঝুঁকে বোতামটা ধরে জোরে টান দিলেন, বোতামটা খুলে এল। তিনি ভৎর্সনার সুরে বললেন, এমন আলগা বোম রাখতে হয়? নিশ্চয়ই তোমার মনোযোগের অভাব আছে। ব্যস, নাম খারিজ! তারপর থেকে সারাজীবন আমি রেল-কর্মচারী দেখলেই তাঁদের বোতামের দিকে নজর করি। আলগা-বোতাম কিংবা বোতাম-বিহীন জামা পরা রেল-কর্মী মোটেই দুর্কভ নয়। আর এক জায়গায় নানান প্রশ্নের পর একজন বোর্ড সদস্য আমায়িকভাবে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি গল্প-কবিতা পড়ো, একটা কবিতা মুখস্থ বলতে পারো? আমি গড় গড় করে একটা কবিতা মুখস্থ বললাম তো বটেই, তাঁকে কবিতাপ্রেমিক ভেবে জানালাম, আমি নিজেও কবিতা লিখি। সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠে তিনি বললেন, কবিতা, লেখো? তা হলে তো তুমি একাজ পারবে না। কবিদের দায়িত্বজ্ঞান থাকে না।
তবু আমি স্বপ্ন দেখতাম। একটা ভালো ইন্টারভিউ দেবার পরই আশা করে থাকতাম, একটা লম্বা খাঁকি খামে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এসে যাবে। রোজ ডাক বাক্স দেখি, সে চিঠি আসে না। কিন্তু কল্পনার খেলা চলতেই থাকে। রেলের কেরানির ইন্টারভিউয়ের পর আমি কল্পনায় নিজেকে বলতাম মনিহারি ঘাট কিংবা রাজা-ভাত-খাওয়া’র মতন ছোট্ট কোনও স্টেশনে, দেখতে পেতাম দূরের পাহাড়। ফরেস্ট রেঞ্জারের পদের ইন্টারভিউ দিয়েই আমি মনে মনে ঘুরে বেড়াতাম কোনও গহন অরণ্যে, পায়ে গামবুট, কাঁধে রাইফেল। পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষা দিয়ে হয়ে যেতাম রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের নায়ক।
সিগনেট প্রেস ও হরবোলার সংসর্গে আমাদের ক্রিয়াকর্মের খবর মাঝে মাঝে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হত। আমাদের আত্মীয়স্বজনদের কেউ কেউ বলতেন, তুই অত সব বড় বড় লোকদের চিনিস, দিলীপ গুপ্ত কত বড় কোম্পানির ম্যানেজার, নিজেদের পাবলিকেশন, ওঁদের কাছে চাকরির জন্য বলতে পারিস না? দিলীপ গুপ্ত ইচ্ছে করলেই… আজকাল তো চেনাশুনো বা ধরাধরি ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না! আমি মনে মনে নিজের কাছে কঠোর প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ডি কে বা অন্যদের কাছে কক্ষনও কিছু চাইব না। ডি কে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করতেন না, আমিও নিজের দৈন্যদশার কথা ঘুণাক্ষরেও জানাইনি। চরম আর্থিক সঙ্কটের মধ্যেও কি নরেন দত্ত কালী ঠাকুরের কাছে গিয়ে চাকরি কিংবা চাল-ডালের সমস্যা ঘোচাবার জন্য কিছু চেয়েছিলেন? ডি কের অধীনে চাকরি নিলে কি আমি তাঁর সঙ্গে নিয়মিত সাহিত্য-শিল্প আলোচনায় কিংবা রঙ্গ-রসিকতায় সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারতাম? পেটের খিদের চেয়েও আমার ওইদিককার খিদেটা বেশি ছিল।
চব্বিশ
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার আগে শুধু কবিতা সমন্বিত আর কোনও পত্রিকা বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে কি না ঠিক জানি না, দুটি-একটি প্রকাশিত হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে ইতিহাসে স্থান রাখতে পারেনি। ‘কবিতা’ পত্রিকা সগৌরবে চলেছে পঁচিশ বছর, তারপরেও অন্যদের সম্পাদনায় অনিয়মিতভাবে কিছুদিন। সারা পৃথিবীতেই শুধু কবিতার পত্রিকা অতি দুর্লভ, বুদ্ধদেবের ‘কবিতা’ পত্রিকা ইংরিজি পোয়েট্রি ম্যাগাজিনের সঙ্গে তুলনীয়। ‘কবিতা’র দৃষ্টান্তে বাংলায় বেশ কয়েকটি এরকম পত্রিকা বেরোতে শুরু করে, কিছু কিছু স্বল্পজীবী, কিন্তু বহুবছর ধরে চলেছে প্রধানত ‘শতভিষা’ এবং ‘কৃত্তিবাস’, পরবর্তীকালে ‘কবিপত্র’; একক’ নামে একটি পত্রিকা বয়েসের হিসেবে অন্য সব কটিকে ছাড়িয়ে গেলেও আধুনিক বাংলা কবিতায় সে পত্রিকাটি বিশেষ কোনও ভূমিকা নিতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
কৃত্তিবাস পত্রিকার সুনামের চেয়ে দুর্নামই ছিল বেশি, আমরা সেটাই খুব উপভোগ করতাম। আমাদের ঝোঁক ছিল ভাঙচুর করার দিকে, প্রথা ভাঙা, ছন্দ ভাঙা, নৈতিকতা ভাঙা, মূল্যবোধ ভাঙা। শব্দ নির্বাচনে বেপরোয়া। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, ওগুলো সব চেঁচামেচির কবিতা, অশ্লীল, রক্তমাংসের বাড়াবাড়ি, সূক্ষ্ম রস নেই, বিশুদ্ধ কবিতা নয়, এবং মূল কবির দলটি উচ্ছ্বঙ্খল, অসামাজিক। এসব নিন্দে গায়ে মাখতাম না, কারণ সত্যি তো আমরা সে রকম, ‘বিশুদ্ধ কবিতা’ শুনলেই আমাদের হাসি পেত। না, আমরা নিরামিষ শব্দের ভক্ত ছিলাম না।
আমরা কোনও ইস্তাহার ছাপিয়ে নতুন কাব্য আন্দোলন শুরু করিনি, একটি পত্রিকায় অনেকেই লেখে, যেমন শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত কিংবা আলোক সরকার প্রমুখ বহু বছর ধরে কৃত্তিবাসে নিয়মিত লিখছেন, কিন্তু তাঁদের শব্দ ব্যবহার উচ্চকিত কিংবা জীবনযাত্রায় উচ্ছ্বঙ্খল এরকম কোনওক্রমেই বলা যাবে না, বিশেষত শঙ্খ ঘোষ অপ্রত্যক্ষভাবে কৃত্তিবাসের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন এমনও দাবি করা যেতে পারে। তবু একটা পত্রিকাকে ঘিরে আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠী গড়ে ওঠে, যাদের কবিতার আঙ্গিক পরস্পরের থেকে একেবারেই আলাদা, তবু কোথাও যেন মানসিকতার একটা মিল থেকে যায়, জীবনযাপন আহার-বিহারও চলতে থাকে একসঙ্গে। যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও তারাপদ রায়ের কবিতার অবস্থান যেন সম্পূর্ণ দুই বিপরীত মেরুতে, তবু কৃত্তিবাসের সূত্রে দু’জনের গভীর সখ্য গড়ে ওঠে।
সেই সময়ে কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে ছিল অল্পবয়সি কবি, লেখক, শিল্পী, গায়ক, সত্যজিৎ রায়ের দৃষ্টান্তে নতুন চলচ্চিত্র-পরিচালক হবার স্বপ্ন-দেখা তরুণদেরই আধিপত্য। কফি হাউস কালচার নামে একটা ব্যাপার ছিল, পরবর্তীকালে যা অনেকটাই বদলে যায় শুনেছি। এসপ্লানেডের কাছে সেন্ট্রাল এভিনিউ কফি হাউসেও একটা আড্ডা ছিল, প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীদের, সেখানে কমলকুমার মজুমদার, সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, বিনয় ঘোষ প্রমুখ যেতেন। তৃতীয় সংখ্যার পর কৃত্তিবাসের দফতর আমার বাড়ির ঠিকানায় হলেও অধিকাংশ কাজকর্ম চলে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে, এক একটা পত্রিকার এক একটা টেবিল, কবি ও গল্প লেখকদের টেবিলও আলাদা। সমবয়সি গল্প-লেখকদের সঙ্গে তখনও আমাদের বিশেষ সংস্রব নেই, যদিও আমি নিজে টুকটাক শখের গল্প লিখি। শুনেছিলাম আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় পৃষ্ঠায় ছোট গল্প ছাপা হলে পনেরো টাকা পাওয়া যায়, বেকার অবস্থায় শুধু টিউশানির টাকায় চলে না, কৃত্তিবাসের জন্যও খরচ আছে, তাই উপার্জন বাড়াবার জন্য আমি পরীক্ষামূলকভাবে একটি ছোট গল্প ডাকযোগে পাঠিয়ে ছিলাম রবিবাসরীয় বিভাগে। ছাপা হয়ে গেল। তারপর থেকে মাঝে-মাঝেই পাঠাই, একটাও ফেরত আসেনি, বরং মানি অর্ডার আসে৷ টাকা রোজগারের আর একটা নিশ্চিত উপায় ছিল, আনন্দমেলার পৃষ্ঠায় ছোট পদ্য বা ছড়া ছাপা হলেই পাঁচ টাকা। সেগুলি মনোনীত হবার একটি রহস্যও এক বন্ধু শিখিয়ে দিয়েছিল, এমনি যে-কোনও বিষয়ে ছড়া পাঠালে দেরি হতে পারে, কিন্তু কোনও মহাপুরুষের জন্মদিন উপলক্ষে ছড়া -কবিতা লিখে পাঠালে নির্দিষ্ট দিনটিতে ছাপা হবেই। আমি বিদ্যাসাগর, মাইকেল, রামকৃষ্ণ প্রমুখের জন্ম-তারিখ একটা খাতায় লিখে রেখে, দিন দশেক আগে একটি করে স্তুতিমূলক কবিতা লিখে পাঠাতাম, কোনও কোনও মাসে দুটোও প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের দেশে তো মহাপুরুষের অভাব নেই।
যাই হোক, রবিবাসরীয়তে আমার নিয়মিত গল্প ছাপা হলেও আমি গল্প-লেখক হিসেবে কল্কে পাইনি, বরং আমাদের দলের শংকর চট্টোপাধ্যায় গল্প এবং কবিতা দুটোই লেখে। স্বাস্থ্যবান, ফর্সা, সুপুরুষ শংকর নিমেষের মধ্যে সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিতে পারে। এমন দরাজ গলায় হাসতে ও নিঃস্বার্থভাবে অন্যের প্রশংসা করতে আমি আর কারওকে দেখিনি। শংকর আমাদের টেবিলে কিছুক্ষণ বসে, আবার গল্প লেখকদের টেবিলে উঠে যায়। তার গল্প লেখক বন্ধুরা তাকে ঠাট্টা করে বলে, দু’ নৌকোয় পা দিয়ে আর কতদিন চলবি রে, শংকর! কবিতা-টবিতা ছাড়! তবু শংকর নিয়মিত যোগ দিত আমাদের টেবিলে, পরবর্তীকালে তাদের ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ির বৈঠকখানার আড্ডায় সে কবি ও গল্পকারদের মিলিয়ে ছিল, কয়েকজন শিল্পীও যোগ দিত সেখানে। সম্ভবত শংকরের সূত্র ধরেই সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আমাদের দলে যোগ দেয়। এক লাইনও কবিতা লেখে না সন্দীপন, কিন্তু কবিতার প্রতিই তার চুম্বক টান, এক একটি শব্দের রহস্য নিয়ে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে যেতে পারে। বাকবৈদগ্ধে সন্দীপনের তুলনা নেই। জীবনানন্দের অনেক কবিতা তার মুখস্থ। কিছুদিন পর সে আর গল্প লেখকদের কাছে যায়ই না, আমাদের সঙ্গেই সর্বক্ষণ তার ওঠা-বসা। এ কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে বছরের পর বছর সন্দীপন কৃত্তিবাসে এক লাইনও লেখেনি, তবু সে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। অন্য কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত তার গল্প পাঠ করে আমরাও বিমোহিত যাকে বলে, প্রথম থেকেই তার গদ্য ভাষা নিজস্ব ও নতুন। পরের দিকে সন্দীপন কৃত্তিবাসের অনেক ভার নেয়।
আমাদের পাশের টেবিলে প্রেসিডেন্সি কলেজের কয়েকটি ছাত্র নিয়মিত বসে, তারা কে কী লেখে জানি না। তাদের মধ্যে একজনের মুখে দাড়ি-গোঁফ, মাথায় পাতলা চুল, সে সর্বক্ষণ বিড়ি খায়। বিড়ি বিষয়ে একটি তত্ত্বও সে শোনাত, বিড়ি হচ্ছে অভিমানী প্রেমিকার মতন, তাকে ঘন ঘন চুম্বন দিতে হয়, চুমু দিতে দেরি হলেই সে মুখ কালো করে ফেলে…ইত্যাদি। ক্রমশ জানা গেল, এই দাড়িওয়ালা ছেলেটি স্ফুলিংগ সমাদ্দার ছদ্মনামে ছোটখাটো গদ্য লেখে, ওর আসল নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ‘কুয়োতলা’ নামে শক্তি একটি ছোট উপন্যাসও লিখেছিল, তার ভাষা ব্যবহার তুলনাহীন। টেবিল বদল করতে শক্তির বেশি দিন লাগেনি। শক্তি অল্প বয়সে কিছু হাত মক্সো করা কবিতা লিখেছিল, ছাপাও হয়েছিল, সেগুলি অকিঞ্চিৎকর। পরে কবিতা ছেড়ে সে গদ্যই লিখত শুধু। প্রথম দিকে সে গদ্য-লেখক হিসেবেই পরিচিত ছিল, কৃত্তিবাসের দলে যোগ দিয়ে তার কবিতা লেখার জোয়ার আসে। কৃত্তিবাসে তার প্রথম কবিতা ‘সুবর্ণরেখার জন্ম’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দারুণ সাড়া জাগিয়েছিল। শক্তি বাগবাজারে আমার প্রায় প্রতিবেশী, অচিরকালের মধ্যেই আমরা প্রতিদিনই দুপুর থেকে মধ্য রাত্রি একসঙ্গে কাটাতে শুরু করি।
শক্তি ও সন্দীপনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হবার পর আমার প্রায়ই মনে হত, আমার চেয়ে ওদের দু’জনেরই জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা বেশি। যদিও ওদের তুলনায় আমাকে পরিশ্রম করতে হয় অনেক বেশি, ওরা বাড়ি থেকে হাত-খরচ পায়, আমাকে দু’বেলা টিউশানি করে খেটে খেতে হয়, পূর্ব বাংলার গ্রাম, নদী ও মাইল মাইল পাটখেত দেখার অভিজ্ঞতা ওদের নেই, দীপকের সঙ্গে আমি ভারতের নানা প্রান্তে যেমন ঘোরাঘুরি করেছি, যেমন ঝুঁকিবহুল দিন কাটিয়েছি, তেমনভাবে ওরা বিশেষ কোথাও যায়নি, তবু যেন জীবন সম্পর্কে ওদের কিছু কিছু স্পষ্ট ধারণা আছে, যা আমার নেই। অনেক ব্যাপারে আমি ওদের তুলনায় অনভিজ্ঞ। খানিকটা সরলও হয়তো। ওরা স্কুল বয়স থেকেই বিড়ি-সিগারেট খায়, আমি খানিকটা দ্বিধার সঙ্গে সদ্য দু’-একটা টানতে শুরু করেছি। বিশেষত মেয়েদের সম্পর্কে ওদের মন্তব্য শুনে আমি রীতিমতো হীনম্মন্যতায় ভুগতাম, ওরা শরীরটরির সম্পর্কে অনেক কিছুই যেন জেনে গেছে, ওসব যেন জলভাত, আর আমি তখন পর্যন্ত মাটির প্রতিমা ছাড়া কোনও নারীর বুকও স্পর্শ করিনি, আমার গোপন প্রেমিকার শুধু হাত ধরে থাকি, দু’-একবার ঝটিতি চুম্বন করেছি মাত্র, তাতেই হৃৎকম্প হয়েছে। শুধু ওরা দুজন নয়, অন্য কোনও কোনও বন্ধুর কথা শুনে মনে হত, বিছানা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না হলে জীবনকে চেনাই যায় না, তা হলে আমি তো নিতান্ত শিশু। সাহিত্য সম্পর্কেও ওরা স্পষ্ট মতামত দেয়, অনেক লেখাই পছন্দ করে না, উড়িয়ে দেয়, অথচ আমার অনেক লেখাই ভালো লাগে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভালো লাগে বলে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর যতনবিবি সিরিজের গল্পগুলি কেন নস্যাৎ করে দিতে হবে, কিংবা জীবনানন্দ দাশের কবিতা সম্পর্কে মুগ্ধতা থাকলে কেন যে অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা পড়বই না, তা আমি বুঝতে পারি না। ফ্রাণ্ৎস কাফকাকে ভালোবাসলে কেন বাদ দিতে হবে শেখব কে?
বেশ কয়েক বছর আমি বোধহয় এই বন্ধুমণ্ডলীর নেতা গোছের ছিলাম। অবোধ নেতা! কৃত্তিবাসের সম্পাদক হিসেবেও ছিলাম বেশ কড়া, যে যা লেখা দিয়েছে তাই-ই ছাপিনি। অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুরও কোনও কোনও লেখা ফিরিয়ে দিয়ে বলেছি, আর একটা দাও। লেখা ছাড়াও, অন্যান্য সময়ের দৌরাত্ম্যে, কখনও খুব বাড়াবাড়ি হলে আমি সন্দীপন ও শক্তিকে প্রচণ্ড ধমকেছি, শক্তিকে তো বেশ কয়েকবার চড়চাপড় মেরেও ধাতস্থ করতে হয়েছে, শক্তি একমাত্র আমাকেই কিছুটা ভয় পেত। বন্ধুদের কাছে আমি ব্যক্তিত্ব ফলাবার চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে যে আমি ওদের চেয়েও অনেক দুর্বল তা হয়তো ওরা কখনও টেরও পায়নি।
এক সন্ধেবেলা বৃন্দাবন পাল লেনের বাড়ির বাইরের ঘরে বসে আড্ডা ও পত্রিকার প্রুফ দেখাটেখা চলছে, রাস্তার দিকে জানলার কাছে এসে দাঁড়াল এক যুবক, পুরোদস্তুর সুট-টাই পরা অফিসার-সুলভ চেহারা, তিনি জানালেন যে কৃত্তিবাস পত্রিকার ঠিকানা খুঁজে খুঁজে এসেছেন, একটি কবিতা জমা দিতে চান। কবিতার তলায় নাম লেখা, নমিতা মুখোপাধ্যায়। এ নাম আমাদের অপরিচিত নয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়, কবিদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা গুনতে এক আঙুলও লাগে না, সুতরাং সকলেরই নাম মনে থাকে। (অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বলতেন, বাঙালি কবিদের সংখ্যা কত? সতেরো শো একষট্টি, এই মুহুর্তে আর একজনের জন্ম হল, সংখ্যাটা লিখুন, লিখুন, এখন কিন্তু সতেরো শো তেষট্টি হয়ে গেছে!) তখন বড় বড় পত্রিকাগুলির শারদীয় সংখ্যায় সুযোগ পাওয়া সার্থকতার চরম বলে গণ্য হত, নমিতা মুখোপাধ্যায়ের কবিতা সম্ভবত ‘যুগান্তর’ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যাতেও ছাপা হয় ।
হাত বাড়িয়ে কবিতা নিতে গেছি, কিন্তু যুবকটি বললেন, তিনি কবিতাটির বাহক মাত্র নন, তিনিই ওই ছদ্মনামে লেখেন, তাঁর নিজের নাম শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, আমরা অট্টহাস্য করে উঠলাম। প্রায় আক্ষরিকভাবেই, যেমন শরৎকুমারকে ঘরের মধ্যে এনে গলার টাই খুলে ফেলানো হল, তেমনই ছাড়িয়ে নেওয়া হল ছদ্মনাম। এ ব্যাপারে শক্তিরই উৎসাহ ও উদ্যোগ সবচেয়ে বেশি। মেয়েরা কবিতা লিখতে পারে, এটাই মনে মনে বিশ্বাস করে না শক্তি, একবার লিখেও ফেলেছিল সে কথা, মেয়েদের ছদ্মনামে কেউ লিখবে এটা তার কাছে অসহ্য। শরৎকুমার আমাদের চেয়ে দু’-তিন বছরের বড়,চ্যার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, বিদেশি কোম্পানিতে উঁচু চাকরি করেন। আমরা সবাই তখন দলকে দল বেকার, শুধু সন্দীপন এম এ পাঠ সম্পূর্ণ না করেই চাকরি পেয়ে গেছে করপোরেশনে কোনও এক সূত্রে। আমাদের তুলনায় শরৎকুমার জীবনে প্রতিষ্ঠিত যাকে বলে।
কথায় কথায় জানা গেল, শরৎকুমার থাকে দেশবন্ধু পার্কের পাশে, অর্থাৎ আমাদের কাছাকাছি, এরপর থেকে তার সঙ্গে প্রায় প্রতি সন্ধেতেই দেখা হয়। দিনেরবেলা সে গম্ভীর, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন অফিসার, হাতে গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ, সন্ধেবেলায় অফিস থেকে বেরিয়েই সে গলার টাই খুলে ফেলে অন্য মানুষ। আমি তখন পর্যন্ত সুট তো দূরের কথা কোটই গায়ে দিইনি, শীতকালে সোয়েটার বা আলোয়ান জড়িয়ে চালিয়ে দিই, টাই পরার প্রশ্নই ওঠে না, অন্যদেরও বেশবাস একই রকম। সুতরাং টাই পরা বন্ধু একেবারেই বেমানান। বুড্ঢা যখন সিগনেটের দোকান ছেড়ে এয়ার ফ্রান্সে বড় চাকরি নেয়, তখনও সে একদিনও টাই পরে আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে আসেনি। টাই খুলে ফেললেই শরতের যেন সম্পূর্ণ রূপান্তর হয়ে যেত, রবীন্দ্রলাল রায়ের গল্প আছে, ‘দিনের খোকা রাতে’, অনেকটা সেইরকম। শরতের মতন এমন বন্ধুবৎসল ও সুরসিক মানুষ অতি দুর্লভ। তার সমস্ত রঙ্গরসই স্বতঃস্ফূর্ত ও তাৎক্ষণিক। কারও কারও রসিকতায় শ্লেষ থাকে, অন্যদের প্রতি খোঁচা থাকে, কিন্তু শরতের হাস্য-পরিহাস একেবারে নিষ্কলুষ, যেন সে নিজের আনন্দেই মজে আছে। স্বনামে লিখতে শুরু করে তার যেন জন্মান্তর ঘটে, কবিতায় নিজস্ব আভা আসে, তার ‘খুকি-সিরিজ’-এর কবিতাগুলি আজও সমানভাবে স্মরণীয়। সে র্যাঁবো ও ভের্লেনের কিছু কবিতার অনুবাদ করেছিল, সেগুলির সঙ্গে নিজের কবিতা মিলিয়ে বেরোয় তার বই, ‘র্যাবোঁ, ভের্লেন ও নিজস্ব’, আমিই সেটির প্রকাশক। ততদিনে কৃত্তিবাস প্রকাশনী চালু হয়ে গেছে, কবিরা নিজেরাই খরচ দেয়, আমরা কয়েকজন প্রেসে যাওয়া-আসা, প্রুফ দেখা ইত্যাদি কাজ করে দিই। আনন্দ বাগচীর ‘স্বগত সন্ধ্যা’-ই সম্ভবত এখানকার প্রথম বই। ফণিভূষণ আচার্যের ‘ধূলি মুঠি সোনা’-ও কৃত্তিবাস থেকে বেরিয়ে বহু কাব্য-প্রেমিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। শেষ পর্যন্ত গ্রন্থ সংখ্যা কম হয়নি। পয়সার অভাবে আমার নিজের কোনও কাব্যগ্রন্থ তখন কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে বেরোয়নি, শক্তিরও না।
প্রণব মুখোপাধ্যায় একেবারে প্রথম দিক থেকেই কৃত্তিবাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল, তখন সে প্রচুর কবিতা লেখে, তার স্বভাবে এমনই স্নিগ্ধতা ও আন্তরিকতা আছে যে খুব সহজেই তার সঙ্গে সকলের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এমনকী সন্দীপনকে তখন খানিকটা উন্নাসিক মনে করা হত, অনেককেই সে মেশার যোগ্য বলে গণ্য করত না, সেই সন্দীপনের সঙ্গেও প্রণবের সুসম্পর্ক হয়ে যায়, শরতের সঙ্গেও তার গভীর বন্ধুত্ব খুব স্বাভাবিক ছিল। প্রণব নিজে তো চমৎকার লিরিকধর্মী কবিতা লিখতই, কবিতার প্রতিই তার এত ভালোবাসা ছিল যে সকলেরই কবিতা পড়ে মুখস্থ করে ফেলত। আমাদের কারও কবিতা হারিয়ে গেলে প্রণবের শরণাপন্ন হতাম, প্রণব সে কবিতা কবে, কোন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে এবং অনেকগুলো পঙ্ক্তি বলে দিত ঝরঝর করে। অসাধারণ তার স্মৃতিশক্তি। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সে পিসতুতো ভাই, নীরেনদারও স্মৃতিশক্তি কত ভালো সবাই জানে, কিন্তু প্রণবের স্মৃতিশক্তি বোধহয় তার দাদার চেয়েও বেশি। বাংলা ব্যাকরণ ও বানান জ্ঞানও তার গভীর, কখনও কখনও সে আমার তো বটেই, এমনকী. শক্তিরও, যার ব্যাকরণ জ্ঞান নিয়ে গর্ব ছিল, ভুল সংশোধন করে দিত। একবার ‘মীনাক্ষী’ শব্দটি নিয়ে শক্তি ও আমি দু’জনেই সংশয়ে পড়েছিলাম। মৎস্য আকারের চক্ষু, মীন+অক্ষি, সাধারণ নিয়মে মীনাক্ষি হওয়া উচিত, দীর্ঘ ঈ কার কেন হবে? প্রণব বুঝিয়ে দিল যে ব্যাকরণের সব উদাহরণই পুরুষ-প্রধান, মূল কথাটা মীনাক্ষ, তার স্ত্রী লিঙ্গে মীনাক্ষী। এই মীনাক্ষী নাম্নী এক তরুণী যে পরে শক্তির স্ত্রী হবে, তা কিন্তু তখনও ঠিক ছিল না। বুদ্ধদেব বসুর কন্যা মীনাক্ষীর কথাই আমাদের বেশি মনে পড়ত। আমরা কেউ তার কাছাকাছি যাবার আগেই জ্যোতির্ময় দত্ত তাকে হরণ করে নিয়ে যায়।
সম্ভবত প্রণবের বন্ধু হিসেবেই উৎপলকুমার বসু কৃত্তিবাসের দলে যোগ দেয়। সে প্রণবেরই সমবয়সি, আমাদের চেয়ে কিছু ছোট। উৎপল খুবই সুদর্শন এবং বেশ লাজুক ও মৃদুভাষী। আড্ডার সময় সে বেশি কথা বলে না, কিন্তু মাঝে মাঝে এমন এক-আধটা মন্তব্য করে যে তাতেই ফুটে ওঠে তার রসবোধ ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। উৎপল বিজ্ঞানের ছাত্র, কিন্তু বিদেশি সাহিত্য পড়েছে প্রচুর, প্রথম থেকেই তার কবিতায় ফুটে ওঠে পরাবাস্তবতা। প্রথম থেকেই সে অনন্য। উৎপলের মা ও বাবা দু’জনেই চলে যান অকালে, আমাদের সঙ্গে পরিচয়ের কিছুদিন পরেই জানা গেল, উৎপল পৈতৃক বাড়িতে সম্পূর্ণ একা থাকে। আমাদের আড্ডাস্থলের খুব অভাব, মাঝে মাঝেই দল বেঁধে গেছি ওর বাড়িতে, বহু উপদ্রব করেছি, উৎপলও আড্ডার নেশায় এমনই মেতে যায় যে লাজুকতা খসিয়ে সে নিজেই অন্যদের ডাকাডাকি করে ও যথেচ্ছাচারে মেতে ওঠে। তারপর সেই বাড়ি বিক্রি হয়ে গেল, উৎপল ফ্ল্যাট ভাড়া নিল রয়েড স্ট্রিটে, প্রায় সাহেব পাড়ায়, বাবুর্চি তার রান্না করে দেয়, এও যেন সাহেবি ধরনধারণ, আমাদের কাছে ঈর্ষণীয়। এক সময় সত্যিকারের এক ইংরেজ সাহেব উৎপলের ওই ফ্ল্যাটে আশ্রয় নিয়েছিল, ঘর-মোছা, বাসন মাজার মতন কাজ করতেও তার দ্বিধা ছিল না। কয়েক বছর বাদে, ভাস্কর দত্তের প্ররোচনায় উৎপল নিজেই চলে গেল সত্যিকারের সাহেবদের দেশে। ভাস্কর প্ররোচনা দিয়েছিল, না উৎপলই ভাস্করকে লন্ডনে পাড়ি দেবার জন্য ভজিয়েছিল, তা ঠিক মনে নেই। অবশ্য, ওদের আগেই যে আমি বিদেশে যাব, তা তখন আমার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল!
সম্ভবত অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তই পরিচয় করিয়ে দেন প্রণবেন্দু দাশগুপ্তর সঙ্গে। পদবীর মিল থাকলেও ওদের মধ্যে আত্মীয়তা নেই, তবে প্রতিবেশী এবং গুরু-শিষ্যের মতন সম্পর্ক। অচিরকালের মধ্যেই প্রণবেন্দুর কবিতায় নিজস্বতার আভা দেখা দেয়। মানুষটিও মৃদুভাষী কিন্তু আড্ডাপ্রিয়। পরবর্তীকালে প্রণবেন্দুর যখন আমেরিকান স্ত্রী হয়, বাড়িতে খেতে হত সুপ ও স্যান্ডুইচ, তখন মাঝে মাঝেই বাংলা ভাত-ডাল-চচ্চড়ি খাবার টানে সে সুদূর যাদবপুর থেকে প্রায়ই নাগেরবাজারে আমাদের বাড়িতে আসত দুপুরের দিকে। মেম-বউয়ের আপত্তিতে তাকে নস্যি নেওয়া ও পান খাওয়া ছাড়তে হয়েছিল, তবু ভীতু ভীতু সেজে সে বাড়ির বাইরে এক সঙ্গে দুটি পান খেয়ে মুখ ধুয়ে ফেলত, গোপনে নস্যিও চালু রেখেছিল অনেক দিন।
একটা সময়ে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিল তন্ময় দত্ত। আমাদের চেয়ে চার-পাঁচ বছরের ছোট, প্রেসিডেন্সি কলেজের নাম করা ছাত্র, কিন্তু এক কবিতার জন্য এমনই একটা ঘোরের মধ্যে পড়েছিল যে প্রায় ছাড়তে বসেছিল পড়াশুনো, কলেজে যাওয়া বন্ধ করে মেতে ওঠে বোহেমিয়ান জীবনযাত্রায়। শক্তির সঙ্গেই তার সখ্য হয়েছিল বেশি এবং শক্তির চেয়েও তার এক একটি কবিতা বেশি মুগ্ধ করে দিত সবাইকে। তন্ময়ের কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপিও তৈরি হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছাপা হল না। কোনও এক কারণে প্রবল অভিমান নিয়ে সে হঠাৎ কবিতার জগৎ ছেড়ে চলে যায়। পরে সে বড় বড় কম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হয়ে দেশ-বিদেশে সুনাম অর্জন করেছে, সাহিত্য গোষ্ঠীর সঙ্গে কোনও সংস্পর্শ রাখেনি।
কবিদের মধ্যে রমণীদের সংখ্যা তখন ছিল ভয়াবহ রকমের কম। প্রথম দিকে শুধু কবিতা সিংহ, বেশ কিছু পরে, দেবারতি মিত্র, বিজয়া মুখোপাধ্যায় ও নবনীতা দেবসেনকে পাওয়া যায়। বিজয়ার সঙ্গে শরৎকুমারের পরিচয়ের পর সে আমাদের ঘরের মানুষ হয়ে যায়, আর নবনীতা বেশ কিছু বছরের জন্য বিদেশে অদৃশ্য হয়ে গেলেও কবিতাকে ভোলেনি, পারিবারিক ট্র্যাজেডি সত্ত্বেও গদ্য ও কবিতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে প্রবল ভাবে।
কৃত্তিবাস পত্রিকাকে কেন্দ্র করে তরুণ কবি ও লেখকদের সঙ্গে যখন বন্ধুত্ব জমে ওঠে, তখন আস্তে আস্তে অন্যান্য বাল্যবন্ধু, স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে একটু একটু দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়, আর নিয়মিত দেখা কম হয়। কিন্তু একমাত্র ভাস্কর, জীবনে এক লাইনও কবিতা না লিখে চলে এল এই দিকে, সারা জীবনের মতন কৃত্তিবাসের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়ে গেল। লেখক বন্ধুদের সকলেরই খুব আপন মানুষ ভাস্কর, ভাস্কর না থাকলে কোনও আচ্ছা বা দৌরাত্ম্যপনাই জমে না। ভাস্কর বহু বছর বিলেতে গিয়ে রইল, কিন্তু এদিককার প্রতি তার টান একটুও কমেনি। দশ বছর পরেও শক্তি বা সন্দীপনের সঙ্গে দেখা হলে এমনভাবে কথা বলেছে, যেন গতকালই উঠে গেছে আড্ডা ছেড়ে।
আমরা অনেকেই তখন উত্তর কলকাতায় থাকি, শুধু সন্দীপন হাওড়ায়, কয়েকজন মধ্য কলকাতায়, দক্ষিণ কলকাতার সঙ্গে যোগসূত্র ছিল শংকর চট্টোপাধ্যায়। দেশপ্রিয় পার্কের এক কোণে, সুতৃপ্তি নামে চায়ের দোকানে রবিবার সকালের আড্ডায় মাঝে মাঝে যোগ দিয়ে আলাপ হয় অরবিন্দ গুহ, আলোক সরকার, দীপংকর দাশগুপ্ত প্রমুখের সঙ্গে। শংকরের দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিমল রায়চৌধুরী ও শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, এরা এক লাইনও কবিতা লেখে না, কিন্তু এদের ব্যক্তিত্ব যে-কোনও মানুষকে এক ঘণ্টার মধ্যে কাবু করে ফেলতে পারে। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তখনই ছোট গল্পকার হিসেবে বিখ্যাত, বিমল রায়চৌধুরীও কবিশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ছদ্মনামে কয়েকটি অসাধারণ গল্প লিখেছিল। বন্ধুদের মধ্যে সকলের চেয়ে কম বয়সে বিমল বিয়ে করে কবিতা সিংহকে। স্ত্রীর নাম ও বন্ধুর নাম মিলিয়ে তার ছদ্মনাম কবিশঙ্কর। দুঃখের বিষয় হঠাৎ সে গল্প লেখা ছেড়ে দেয়, তাতে বাংলা সাহিত্যের ক্ষতিই হয়েছে। পরবর্তীকালে তার পরিচয় ছিল কবিতা সিংহের স্বামী, তাতে তার আপত্তিও ছিল না। ক্ষুরধার বুদ্ধি ছিল বিমলের, দারুণ বাকচাতুর্য, কথায় কথায় রসিকতা। তবে তার রসিকতা শরৎকুমারের বিপরীত, তাতে কারও না কারও প্রতি দংশন থাকত, আবার উপভোগ্যও হত বটে। তবে অরবিন্দ গুহ উপস্থিত থাকলে আর কেউ পাত্তাই পেত না। আমার চেনা সব মানুষদের মধ্যে রসিকতার সম্রাট হলেন অরবিন্দ গুহ। বিরল কেশ, ছোটখাটো মানুষটি, বাক্য যেমন তেজী, ভেতরটা তেমনই রসে টইটম্বুর। অরবিন্দ যেমন তৎক্ষণাৎ কথার পিঠে কথার খেলা বানাতে জানে, তেমনই তার দেশ-বিদেশের রসিকতার সংগ্রহও প্রচুর। নাঃ, তারাপদ রায়ও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কখনও পারেনি। অরবিন্দ ইন্দ্ৰমিত্র ছদ্মনামে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অসাধারণ ও জনপ্রিয় জীবনী লিখেছে, সেই বিদ্যাসাগর নিয়েই তার একটি রসিকতা আমার আজও মনে আসে। … স্বর্গে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের কোলে বসে আছে মেরিলিন মনরো, দু’জনে গলা জড়াজড়ি৷ পাশ দিয়ে যেতে যেতে তা দেখে লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। বিদ্যাসাগর তাঁকে ডেকে বললেন, এই লজ্জা পাচ্ছিস কেন, এদিকে আয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আমতা আমতা করে, বিবসনা মেরিলিন মনরো’র দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললেন, গুরুদেব, আপনি দেশের জন্য কত কী করেছেন, কত কৃচ্ছ্রসাধনা, সেই পুণ্যফলে আপনার এরকম একটি সুন্দরী নারী তো এখানে প্রাপ্য হতেই পারে! বিদ্যাসাগর মশাই দু’আঙুলে হরপ্রসাদের পেটে চিমটি কেটে বললেন, ওরে, তুই আজও মূর্খ রয়ে গেলি? বুঝলি না, এটা কি আমার পুণ্যফল, না এই মেয়েটির পাপের শাস্তি!
অরবিন্দ গুহ তখন কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন এবং লিখতেন খুব রোমান্টিক প্রেমের কবিতা।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় রসিকতা জানে না, একটাও অ্যানেকডোট বলতে পারে না, সে নিজেই। জীবন্ত কৌতুক। তখন শ্যামলের কী সুন্দর চেহারা, (এখনও তেমন মলিন হয়নি), ফিনফিনে সাদা আদ্দির পাঞ্জাবি ও ধুতি পরা, মাথার ঈষৎ কোঁকড়া চুল পাট করে আঁচড়ানো, সরল, নিস্পাপ মুখখানি দেখলে মনে হয় যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না, কথা বলে মিষ্টি গলায়, এবং অনর্গল মিথ্যে বলে যায়। যেমন তার পিসতুতো দাদা অমুক ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর, মাসতুতো ভাই জওহরলালের প্রাইভেট সেক্রেটারি, জ্যাঠতুতো দিদি কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর স্ত্রী, খুড়তুতো বোন বম্বে ফিল্মের নায়িকা, সেজো পিসেমশাই দুর্গাপুর স্টিলের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ইত্যাদি। এর সবগুলি মিথ্যে নয়, ওদের পরিবারটি বিশাল, তার মধ্যে কয়েকজন সত্যিই উচ্চ পদে আসীন, কিন্তু শ্যামলের অম্লান বদন দেখে ধরা যেত না, কোনটি সত্যি আর কোনটি মিথ্যে! শ্যামল হঠাৎ আফগানিস্তান বেতারের পুস্তু ভাষায় সংবাদ শোনাতে পারে, উর্দু ভাষায় শোনাতে পারে লখনউ-এর এক বারবনিতার কাহিনী, রাইটার্স বিল্ডিংয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে, হলঘর ভর্তি কেরানিদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একদিন বলেছিল, আমার এখানে স্নেক ড্যান্স দেখাতে ইচ্ছে করছে, নাচব? এবং শ্যামলের পক্ষেই সত্যি নাচ শুরু করা সম্ভব।
আমরা সবাই মিলে প্রায় সর্বক্ষণ এই ধরনের মজা ও হাস্য-পরিহাসের মধ্য দিয়ে জীবনটাকে হালকা করে দেখতে চেয়েছি। চারপাশের পরিবেশ যতই সঙ্কটজনক ও ভয়াবহ হয়ে উঠছে, ততই আমরা অগ্রাহ্য করে চলেছি সেসব। অনেক প্রতিকূল অবস্থাতেও হার স্বীকার করিনি, যোগ দিইনি ইঁদুর দৌড়ে। দাঁতে দাঁত চেপে সাহিত্য করতে চাইনি, তাচ্ছিল্য করেছি অমরত্বের হ্যাংলামিকে।
শ্যামলের সঙ্গে খুব অল্প দিনেই আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায় এবং প্রায় প্রথম দিন থেকেই সে আমাকে তুই সম্বোধন করে। কৃত্তিবাসে শ্যামলের লেখার খুব শখ, অথচ সে কবিতা লেখে না। একবার ‘সুন্দর’ নামে তার একটি ছোট কাব্যময় রম্যরচনা ছাপা হল। তারপর সে একদিন আমার বাড়িতে এসে পড়ে শোনাল ‘বিদ্যুৎচন্দ্র পাল বিষয়ে কয়েকটি জ্ঞাতব্য তথ্য’ নামে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিক ও স্বাদের একটি গল্প, কবিতা পত্রিকার সমস্ত রীতিনীতি অগ্রাহ্য করে আমি সেটা ছেপে দিলাম। সে জন্য কৃত্তিবাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আমাকে ভর্ৎসনা করেছিল, কিন্তু গল্পটির তারিফ করেছিল অনেকেই। বহু বছর পর শ্যামল আবার বিভিন্ন ভূমিকায় ফিরে আসে কৃত্তিবাসে।
সমরেন্দ্র সেনগুপ্তও দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা, তবে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল অনেক পরে। দীর্ঘদেহী সমরেন্দ্রকে দেখে মনে হত যেন বয়স্ক বালক, কারণ দায়িত্ববান, বন্ধুবৎসল, সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন হলেও সে তার বিশুদ্ধ সারল্য বজায় রাখতে পেরেছে, যা আমরা অনেকেই ক্রমশ হারিয়েছি। বিশাল তার হৃদয়, নিঃশব্দে কত জনকে যে সে সাহায্য করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। দেশভাগ ও স্বাধীনতার প্রত্যাশা পূরণের ক্ষোভ ফুটে উঠেছে তার কবিতায় এবং রয়েছে বিশ্ব-পরিপ্রেক্ষিত। অবশ্য রসিকতাতেও সমরেন্দ্র অন্যদের চেয়ে কম যায় না, এবং প্রাণ খুলে হাসতে পারে। কৃত্তিবাসে সে দেরি করে যোগ দিলেও এক সময় সে অন্যতম প্রধান হয়ে ওঠে, আমি ছেড়ে দেবার পর কয়েক বছর সমরেন্দ্রই হয়েছে কৃত্তিবাস পত্রিকার সম্পাদক।
তারাপদ রায়েরও বাড়ি দক্ষিণে, কিন্তু তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় আমার সেই বৃন্দাবন পাল লেনের বাড়িতে। এক সকালের আড্ডায় অকস্মাৎ এসে হাজির, ছিপছিপে, অনতিদীর্ঘ শরীর, শরতের মতন এরও পরনে প্যান্ট-কোট, তবে সুট নয়, অনেকটা সার্কাসের পোশাকের মতন, হলুদ রঙের প্যান্ট, সবুজ রঙের কোট, সবচেয়ে আকর্ষণীয় তার কণ্ঠস্বর, মাইকের চেয়েও জোরালো বলে অনেকে বলত অমায়িক, আমি বলতাম কম্বুকণ্ঠ। তারাপদ তখন হাবড়ায় একটা স্কুলে মাস্টারি করে, সেখানেও তার একটি বাসস্থান আছে, শনি-রবিবার আসে কলকাতায়, সঙ্গে পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে। তার আগমনের মিনিট দশেক পরেই মনে হল, এ ছেলেটি এতদিন বাইরে ছিল কেন? কৃত্তিবাসের দলে এর স্থান অবধারিত। যে-কোনও আড্ডায় তারাপদই মধ্যমণি। নিজের সব কবিতা তার মুখস্থ থাকে, অন্যদেরও কবিতা অনর্গল বলে যেতে পারে। তারাপদকে ভালোবাসে না এমন মানুষ নেই, আবার তার গান শুনে ভয় পায় না, এমন মানুষও কেউ আছে কি না সন্দেহ। কৃত্তিবাসের কোনও এক সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কবিতা ছাপার রেকর্ড তারাপদ রায়ের, একবার তার ‘সপ্তদশ অশ্বারোহী ও একটি’ নামে আঠেরোটি কবিতা ছাপা হয়েছিল। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ছিলাম ভালোবাসার নীল পতাকাতলে স্বাধীন’ বেরোয় কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে।
প্রথম দিন এসেই তারাপদ হাসি-ঠাট্টা-আমোদে জমিয়ে দিয়ে একটু পরে তার গায়ের কোটটি খুলে ফেলল। গরমের জন্য সার্টও। তারপর সে একটা খাটের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি প্যান্টটাও খুলে রাখতে চাই, নইলে ইস্তিরি নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা নির্বাক ও সন্ত্রস্ত, তারাপদ অট্টহাস্য করতে করতে খুলতে লাগল প্যান্টের বোতাম। তখন দেখা গেল, তলায় রয়েছে একটা পুরো পা-জামা। এর পরেও সে জানাল, পা-জামাটাও খুলে রাখতে পারি, কোনও অসুবিধে নেই। এবারে সমবেত নানা শুনে সে লাফিয়ে নেমে পড়ে বলল, দারুণ খিদে পেয়েছে। এ বাড়ির লোকরা বুঝি খুব কৃপণ, খাবারটাবার কিছু দেয় না?
এইভাবেই বৃদ্ধি পেতে থাকে কৃত্তিবাসের নিজস্ব পরিবার।
পঁচিশ
আমাদের গ্রামের একটা রাস্তার ধারে ছিল এক বিশাল বনস্পতি, সেটি অশ্বত্থ গাছ, বাল্যস্মৃতিতে মনে হয় যেন অত ডালপালা ছড়ানো বড় গাছ পৃথিবীতে আর নেই। তাতে অনেক রকম পাখির বাসা, মগডালে বসে থাকে শকুন, মাঝে মাঝে পাতার আড়াল থেকে ডেকে ওঠে তক্ষক। মহাভারত পড়ে মনে হত, তক্ষক একটি অতি বিষধর সর্প, তাই ডাক শুনলেই ভয় লাগত, আসলে যে সেটি গিরগিটির মতনই প্রায় নিরীহ প্রাণী, তা জানতে লেগে গিয়েছিল অনেকদিন।
বট কিংবা অশ্বথের মতন দুই মহাদ্রুমেরই ফল খুব ছোট ছোট। দুপুর রৌদ্রে এরা অনেকখানি ছায়া দেয়, পথিকেরা সেই ছায়ায় বিশ্রাম করে, ঘুমোয়। তাদের শরীরে যাতে আঘাত না লাগে সেইজন্যই এরা বড় আকারের ফল ফলায় না। এ রকম একটা বিশ্বাস প্রচলিত আছে। যত বড় গাছ, তত বড় ফল হবে, এরকম নিয়ম প্রকৃতিতে নেই। আমাদের দেখা সবচেয়ে বড় ফল কলার কাঁদি ও কাঁঠাল, এ দুটো গাছই আকারে বট-অশ্বথের তুলনায় শিশু।
এই অশ্বত্থ গাছটির ছায়ায় কোনও পথিককে বিশ্রাম নিতে দেখিনি, অশ্বখের একটা ডাল হঠাৎ নিচু হয়ে এসে খুব পিটিয়েছিল এক ডাক্তারকে। আমাদের ইস্কুলে যেতে হত অশ্বত্থ গাছটির পাশের রাস্তা দিয়ে, দিন-দুপুরেও একা থাকলে ঢিপ ঢিপ করত বুক, মেঘলা বিকেল কিংবা সন্ধে হলে তো কথাই নেই, চোখ বুজে দৌড় লাগাতাম, আর অনবরত বলতাম, রাম, রাম, রাম, রাম। রাম স্বয়ং ভগবান, তাঁর নাম শুনলেই ভূত-পেত্নীরা ভয়ে কাছে আসে না, এটা বহুদিনের সংস্কার। যদিও সূর্পণখা নামে এক পেত্নী রামকে বিয়ে করতে চেয়ে বেশ কাছে এসেছিল।
ইস্কুল-বয়স ছাড়াবার আগেই আমি জেনে গিয়েছিলাম, রাম পদ্যে লেখা একটি উপন্যাসের চরিত্র, মোটেই ভগবান নয়। রামায়ণের গল্প আগে অন্যদের মুখে শুনেছি, বারাণসীতে কথকরা এই কাহিনীর সঙ্গে নিজস্ব টীকা-টিপ্পনী ও ভক্তিরস জুড়ে দিতেন, নিজে কয়েকবার পাঠ করার পর রামায়ণ অন্যভাবে ভালো লাগে। কিন্তু অবতারতত্ত্ব আমার মনে কখনও দাগ কাটেনি। স্বর্গের দেব-দেবীদের আমার খুব আকর্ষণীয় সব গল্পের চরিত্র বলেই মনে হয়েছে। ভগবান বা ঈশ্বর নামে এক সর্বশক্তিমান সত্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে কুয়াশা মাখা সংশয় ছিল আরও কিছুদিন, তবে ভূত-প্রেতের ব্যাপারটা বুঝে গিয়েছিলাম। মৃত্যুর পর মানুষকে পুড়িয়ে ফেললে সব শেষ হয়ে যায়, কঙ্কাল শরীর নিয়ে খটখটিয়ে কারওকে ভয় দেখানো আর তার পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়, ওই সব গল্পে বহুদিনের সংস্কারের জন্যই রোমহর্ষণ হয়। মানুষের প্রাণবায়ু বহির্গত হবার পরেও অবিনশ্বর আত্মার অস্তিত্ব চমৎকার কল্পনা হতে পারে, তবে নিছকই কল্পনা মাত্র।
বসুমতী সংস্করণের সস্তায় খণ্ডে খণ্ডে উপনিষদের অনুবাদ পাওয়া যেত, সেগুলি পড়তে ভালো লেগেছে, কিন্তু তার মধ্যে ঈশ্বরকে পাইনি। রমেশচন্দ্র দত্তের অনুবাদে বেদও পড়া হয়ে গেল। তখন ধর্মগ্রন্থগুলির পৃষ্ঠায় ঈশ্বরকে খোঁজার নেশা আমাকে পেয়ে বসেছিল। চৌরঙ্গিতে ‘বাইবেল সোসাইটি’ নামে একটি বাড়ি আছে। সে বাড়ির ভেতরে কী হয় জানি না, আমি কখনও প্রবেশ করিনি, তবে বাইরের দিকে একটা কাচঘেরা জানলায় খোলা থাকত একটি বাইবেল, প্রতিদিন তার এক পৃষ্ঠা উল্টে যেত, আমি ওদিক দিয়ে যাবার পথে সেই পৃষ্ঠাটি পড়ে নিতাম। বড় বড় হোটেলের প্রত্যেক ঘরে একটি করে বাইবেল রাখা থাকে, কোনও একটি প্রতিষ্ঠান সেগুলি বিনা পয়সায় দেয়। সে বাইবেলের কপি সুটকেসে ভরে নিয়ে এলে তা চুরি করা হয় না। উৎসাহী প্রচারকরা খুশিই হয়। আমি তখনও পর্যন্ত কোনও বড় হোটেলে থাকিনি, কিন্তু আমার এক বন্ধুর দাদা দিল্লির হোটেল থেকে একখানা গিডিয়ন বাইবেল নিয়ে এসেছিলেন ও পড়তে দিয়েছিলেন আমাকে। এর পর একটা দুর্বোধ্য, কষ্টকল্পিত ভাষায় বাংলা বাইবেলও জোগাড় করা গিয়েছিল।
বি এ পরীক্ষা দেবার পর, মাঝখানের সাড়ে তিন মাস বাদ দিয়ে, আমি টানা পাঁচ বছর বেকার ছিলাম। এই পাঁচটা বছর আমার কী যে আনন্দে কেটেছে, তা বোঝানো শক্ত। বলা যেতে পারে, এক হিসেবে এই পাঁচ বছর আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। অর্থাভাব ছিল খুবই। পেটে জ্বলত ধিকিধিকি খিদে, তবু স্বাধীনতা ছিল অগাধ। এখনও আমি বেকারদের ঈর্ষা করি।
বেকাররা দুপুরবেলা বাড়িতে শুয়ে-বসে কাটালে সকলের করুণার পাত্র হয়। চাকুরিজীবীদের মতনই দশটা-সাড়ে দশটায় গরম গরম ডাল-ভাত খেয়ে আমি বেরিয়ে পড়ি, তারপর সামনে থাকে সুদীর্ঘ দুপুর ও বিকেল, এর মধ্যে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করার দুর্লভ সুযোগ ঘটে কোনও কোনওদিন মাত্র এক-আধ ঘণ্টার জন্য। কয়েকজন বন্ধু চাকরি পেয়েছে, তাদের অফিসে দেখা করতে গেলে তারা ডিম সেদ্ধ ও চা খাওয়ায়, কিন্তু কয়েকবার যাওয়ার পরই উপলব্ধি হয় যে ব্যাপারটা হ্যাংলামির পর্যায়ে পড়ে যাচ্ছে। অনেক বন্ধু এম এ পড়ছে, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়েও মাঝে মাঝে তাদের ক্লাসে যোগ দিয়েছি। কোনও বাধা ছিল না, অধ্যাপকরা আপত্তি করতেন না, তবু অস্বস্তি বোধ করতাম। কত সুন্দর সুন্দর মেয়ে, তারা আমাকে আড় চোখে দেখে, কথা বলে না। নিজেকে মনে হয় হংসদের মধ্যে বক, কিংবা পাখির খাঁচার পাশে ক্ষুধার্ত বিড়াল!
সবচেয়ে ভালো সময় কাটে কোনও লাইব্রেরিতে। ন্যাশনাল লাইব্রেরি আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে, যেতে বাস ভাড়া লাগে। কিন্তু কোনওক্রমে পৌঁছতে পারলে বড় পবিত্র আরাম হয়। বাড়িটি ঐতিহাসিক, চারপাশের বড় বড় গাছপালা ও মখমলের মতন সবুজ ঘাসে ভরা মাঠ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। চার পয়সার ট্রাম ভাড়া দিয়ে এসপ্লানেড পর্যন্ত এসে, তারপর ময়দানের মধ্যে দিয়ে কোনাকুনি হেঁটে পৌঁছে যেতাম সেখানে। সদস্যপত্র না থাকলেও একটা কিছু পরিচয়পত্র দেখালেই পাওয়া যেত এক দিনের ছাড়পত্র, তারপর ভেতরে ঢুকে অবাধ বিচরণ। অনেক মানুষ বসে আছে। কিন্তু পড়ুয়ারা কেউ কথা বলে না, নিস্তব্ধ হলঘরে শুধু শোনা যায় কাগজের খসখস শব্দ। ইচ্ছে অনুযায়ী যে কোনও বই পড়া যায়, সেখানেই প্রথম এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা স্বচক্ষে দেখি, এবং সেই বিস্ময়কর জগতে প্রবেশ করি।
এ ছাড়া ছিল ইউ এস আই এস এবং ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরি। সেখানে বই নিয়ে পড়তে কিংবা বসে থাকতে পয়সা লাগে না। কিছুদিনের মধ্যেই বাড়ি থেকে পায়-হাঁটা দূরত্বে একটা খুব নিরিবিলি লাইব্রেরি আমি আবিষ্কার করে ফেললাম। কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের ওপরে ব্রাহ্মসমাজের মন্দির, তার সঙ্গে যুক্ত একটি গ্রন্থাগার। মাঝে মাঝে চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়া ছাড়া অধিকাংশ দুপুরই কাটতে লাগল এখানে। এমন সুন্দর পরিবেশ ও বহু দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংগ্রহ, তবু পাঠকের সংখ্যা খুবই কম, প্রায় দিনই আমি ও গ্রন্থাগারিক ছাড়া আর তৃতীয় কোনও মনুষ্যের মুখ দেখা যেত না। গ্রন্থাগারিক মহাশয়টি কৃশ চেহারার প্রৌঢ়, আমাকে তিনি সস্নেহদৃষ্টিতে দেখতেন। তাঁর কাছে কোনও একটি বইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি প্রাসঙ্গিক দশখানি বইয়ের কথা জানাতেন সবিস্তারে।
এখানে ভাই গিরিশচন্দ্র সেন অনূদিত কোরান গ্রন্থ পড়ার সুযোগ পেলাম। এবং ইসলাম ধর্ম বিষয়ক নানা প্রবন্ধ। ঈশানচন্দ্র ঘোষের জাতক কাহিনী এবং ত্রিপিটকের অংশবিশেষ। গৌতম বুদ্ধের জীবনকথা। আমার আগ্রহ বুঝে গ্রন্থাগারিক মহোদয় সমস্ত ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ জোগান দিয়ে যেতে লাগলেন। আমিও গিলতে লাগলাম ক্ষুধার্তের মতন।
বছর দু’-একের মধ্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম-বিষয়ক গ্রন্থগুলি মোটামুটি পড়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও ধর্ম সম্পর্কে আমার পুরোপুরি অবিশ্বাস জন্মে যায়। সবগুলিই সুখপাঠ্য, কবিত্বপূর্ণ, ব্যঞ্জনাময়, কিন্তু কোনও অলৌকিক মুখ-নিঃসৃত শুধু এটুকু না মানলে, সবই সুললিত উপদেশাত্মক বাণী ও উদাহরণস্বরূপ কাহিনী, সেগুলি আচরণ ও পালন করা ব্যক্তিগত রুচির ব্যাপার। যেহেতু আমি জন্মান্তর ও স্বর্গ-নরকের বিশ্বাস আগেই বরখাস্ত করে ফেলেছি, তাই অলৌকিক উচ্চারণও মানতে পারি না।
এইসব পড়তে পড়তে একটা ব্যাপার আবিষ্কার করে ফেললাম! বড় বড় ধর্মগুলির যাঁরা প্রবক্তা, তাঁরা কেউ লেখা-পড়ার ধার ধারেননি! গৌতমবুদ্ধ কিছু লিখে যাননি, যিশুও না। হজরত মহম্মদও না, এমনকী একালের শ্রীচৈতন্যদেব বা শ্রীরামকৃষ্ণও না। কিছু লেখেননি, পড়াশুনোও কতটা করেছেন তা সঠিকভাবে জানা যায় না, তবে সূর্য যে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে না এবং নক্ষত্রগুলি চুমকির মতন আকাশের গায়ে সাঁটা নয়, মহাকাশ সম্পর্কে এই প্রাথমিক জ্ঞান যে ওঁদের কারও ছিল না, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এই প্রাথমিক জ্ঞানই কিন্তু মানুষের চিন্তাজগতে বিবর্তন এনে দিয়েছে।
পড়াশুনোর সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও ধর্মের প্রবক্তাদের কী বিপুল খ্যাতি! বুদ্ধ-যিশু-মহম্মদের বিশ্বব্যাপী খ্যাতির তুলনায় শেক্সপিয়ার-টলস্টয়-গ্যেটে-রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি প্রায় তুচ্ছই বলা যায়। ওই সব প্রবক্তারা প্রেরিত পুরুষ হোন বা না হোন, অসাধারণ পুরুষ ছিলেন আবশ্যই, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উধের্বও জীবনের যে উপলব্ধি, তার অধিকারী ছিলেন এবং পালন করে গেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা।
হিন্দুধর্মের কোনও ঐতিহাসিক প্রবক্তা নেই। শ্রীকৃষ্ণ কিংবা রাম, কারওই অস্তিত্ব ইতিহাস-স্বীকৃত নয়। ত্রিপিটক-কোরান-বাইবেলের মতন হিন্দুধর্মের কোনও সর্বমান্য ধর্মগ্রন্থ নেই। অনেক হিন্দুর মতে অবশ্য বেদই সেই গ্রন্থ। কিন্তু বেদ কী? যেসব হিন্দু বেদকে হিন্দুধর্মের আকরগ্রন্থ বলে মানেন, তাঁদের মতে বেদ অপৌরুষেয়, অর্থাৎ কোনও মানুষের রচনা নয়, ঈশ্বরের বাণী। আবার, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত বলেছেন, বেদ হচ্ছে বিভিন্ন ঋষির মুখে মুখে রচনা করা কতকগুলি কবিতার সংকলন, পলগ্রেভ সম্পাদিত ‘গোল্ডেন ট্রেজারি’র মতন। (এক সময় এই ইংরিজি কবিতা সংকলনটি এদেশেও কলেজপাঠ্য ছিল।) আমি হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতটাই মানি। তা হলে তো দেখা যাচ্ছে, হিন্দুধর্ম সৃষ্টি করেছেন কবিরা, বেদ-উপনিষদ-মহাভারত-রামায়ণ-গীতা-পুরাণ সমূহ সব তো কবিদেরই রচনা, এগুলি থেকে যে জীবনযাপনের সূত্র ফুটে ওঠে তাই-ই তো হিন্দু ধর্ম,ধর্মের বদলে জীবনদর্শনও বলা যায়। কবিদের সৃষ্টি, তাই কিছু অযৌক্তিক উচ্ছ্বাস এবং বৈপরীত্যও আছে। এবং যেহেতু অনেকে মনে করে কবিতা লেখা খুব সোজা, অকবিরাও কবিতা লিখতে চায়, সেজন্য একালেও অনেক অকবি হিন্দুধর্মের শাখা-প্রশাখা বাড়িয়েই চলেছে, সৃষ্টি করা হচ্ছে নতুন নতুন দেব-দেবী, যেমন বিশ্বকর্মা, সন্তোষীমা, শান্তিনিকেতনে টুরিস্টলজের কাছে লজেশ্বর শিব! মুসলমানদের ‘হাদিস’-এর মতন হিন্দুদের মধ্যেও ‘মনুসংহিতা’নামে একটি গ্রন্থ প্রচারিত হয়েছিল, কিন্তু গ্রন্থটি একে তো অর্বাচীন, তার ওপরে এমন কবিত্বহীন, পরস্পর বিরোধী, অতি রক্ষণশীল, নারীবিরোধী কথা-বার্তায় পূর্ণ যে ইদানীং শিক্ষিত হিন্দুরা সে বইটির কথা উচ্চারণ করেন না।
যে কোনও বিশেষ ধর্মাবলম্বী মানুষরা মনে করে যে তাঁদের ধর্মের প্রেরিত পুরুষই সর্বশ্রেষ্ঠ মুক্তিদাতা, তাঁর নির্দেশিত আচরণগুলি ভক্তিভরে অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই জীবনের সার্থকতা। কিন্তু সেই প্রেরিত পুরুষের কথা কিংবা সেই ধর্মের আচরণবিধির কথা কিছুই না জেনে পৃথিবীর অন্য প্রান্তের বহু সংখ্যক মানুষও তো সার্থক জীবনযাপন করতে পারে। অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতির কাছে ধর্মীয় সারসত্য বলে কিছু নেই। তবু, এক ধর্মের মানুষ, বাকি মানুষদের মনে করে পাপী বা পতিত। যাজক, মোল্লা ও পুরোহিত শ্রেণী এরকমই প্রচার করে থাকে অনবরত। শ্রীরামকৃষ্ণ ‘যত মত তত পথ’ উচ্চারণ করে অতি বাস্তব সত্য কথা বলেছিলেন, কিন্তু কোনও মতাবলম্বী লোকেরাই তা মানতে পারে না, এমনকী শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত হিন্দুরাও না। অন্য ধর্মকেও সমান উপযোগী মনে করলে নিজের ধর্মের বিস্তার হবে কী করে? তা হলে তো দীক্ষাদান প্রথাটাই উঠে যাওয়া উচিত। যে কোনও ব্যবসায়ীই যেমন তার সহব্যবসায়ীদের সমকক্ষ মনে করে তৃপ্ত হতে পারে না, ছলে-বলে-কৌশলে অন্য ব্যবসায়ীদের দমন করতে চায়, ধর্মপ্রচারেরও সেই একই নীতি। ব্যবসায়ীরা যেমন তাদের ইচ্ছেমতন মূল্যমান নির্ধারণ করে, সাধারণ মানুষ তাদের কাছে অসহায়, ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রচারিত মূল্যবোধের কাছেও সাধারণ মানুষের সেই একই অবস্থা, অনেকে বিবেক-বুদ্ধি পর্যন্ত বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়।
ধর্ম সম্পর্কে এত রকম চিন্তাভাবনা করেও আমি একবার অতি ছেলেমানুষী করে ফেলেছিলাম। অর্থাৎ আমার অকালপক্ক মস্তিষ্কে এই সব জ্ঞানের কথা ঠিক হজম হয়নি আরকী!
ব্রাহ্মসমাজের গ্রন্থাগারে আমি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী পড়ি, তখন বইটি দুর্লভ ছিল। রামমোহন রায়ের জীবনী, রাজনারায়ণ বসু ও শিবনাথ শাস্ত্রীর আত্মজীবনী, কেশবচন্দ্র সেনের রচনাবলী পড়তে পড়তে আমি যেন ফিরে যাই উনবিংশ শতাব্দীর গৌরবময় দিনগুলিতে, ওই সব মানুষদের দেখতে পাই স্বচক্ষে, একা একা রোমাঞ্চিত হই, সেই নির্জন লাইব্রেরিঘরে শুনতে পাই ব্রাহ্মসমাজের তরুণ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর। হঠাৎ একদিন ঠিক করলাম আমার জন্মসূত্রে হিন্দু পরিচয়টা মুছে ফেলতে হবে, আমি ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হব। যার কোনও ধর্মেই আস্থা নেই, তার ধর্মান্তর গ্রহণ যে চরম মূর্খতা বা পাগলামি, সেটা তখন আর মাথায় আসেনি। আমার ঘোর লাগার মতন অবস্থা, যেন ব্রাহ্মসমাজভুক্ত হলেই আমি দেবেন্দ্রনাথ-কেশবচন্দ্র-শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখের সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে বসার অধিকার পাব।
কী করে ব্রাহ্ম হতে হয় জানি না। চোখের সামনে শুধু একজন ব্রাহ্মকেই দেখি, এখানকার গ্রন্থাগারিক। ঝোঁকের মাথায় তাঁর কাছে গিয়ে আমার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম খুব আবেগের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারেন? তিনি শান্তভাবে আমার সব কথা শুনে বললেন, হ্যাঁ, সাহায্য করতে পারি। কিন্তু এত ব্যস্ততার কী আছে? আরও চিন্তাভাবনা করো, তোমার নিজের ধর্মে কী কী অভাব বোধ করছ, অন্য ধর্মে এসে নতুন কী পাবে আশা করছ, সেটা ঠিক মতন উপলব্ধি করো, তারপর না হয় দেখা যাবে। বছরখানেক সময় নাও। এখন বই পড়ছ, আরও পড়ো!
সেই গ্রন্থাগারিক মহোদয় আমার দারুণ উপকার করেছিলেন, আমার ঘোর কাটিয়ে দিয়েছিলেন। মানুষ যেমন আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এক বছর অপেক্ষা করতে পারে না, ততদিনে তার ইচ্ছেটাই অন্তর্হিত হয়ে যায়, আমারও সেই অবস্থাই হল, আমি আর কখনও ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাইনি, ধর্মবিদ্বেষীও হইনি। নাস্তিকতাও প্রচার করিনি, এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকাই শ্রেষ্ঠ মনে হয়েছে। তবে, ধর্মান্ধতার নানান উদাহরণ কিংবা যুক্তিহীন আচার-বিচার মান্য করার ঝোঁক যখন চতুর্দিকে দেখি, তা নিয়ে মনে মনে হাসাহাসি করার অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না।
চাকরির জন্য বহু ইন্টারভিউ দিয়ে ব্যর্থ হতে হতে একবার আমার একটা কাজ জুটে গেল। আমাদের দেশে শিক্ষা বিস্তারের জন্য ইউনেস্কো থেকে একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। খানিকটা অভিনব, এই কার্যক্রমটি শুধু বয়স্ক মানুষের জন্য। গ্রামের ‘দিন আনি দিন খাই’ শ্রেণীর অজস্র মানুষের অক্ষরজ্ঞান পর্যন্ত নেই, অঙ্ক জানে না বলে মহাজনরা অনবরত তাদের ওপর ঋণের ভার চাপিয়ে দেয়, এরা কোনওদিনই ইস্কুলে যাবে না, সান্ধ্য বিদ্যালয় খুলে জোর করে টেনে আনলেও এদের উপযোগী পাঠ্যপুস্তক তো নেই। অক্ষরজ্ঞান না থাকলেও এরা অশিক্ষিত তো নয়, প্রকৃতি থেকে অনেক রকম পাঠ নিয়েছে, জীবন থেকে সঞ্চয় করেছে প্রচুর অভিজ্ঞতা, দুধের শিশুদের প্রথম পড়াবার মতন অজ, আম, ইট দিয়ে শুরু করলে এরা উৎসাহ পাবে কেন?
সুতরাং বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য আলাদা ধরনের পাঠ্যপুস্তক রচনা করা প্রয়োজন, এবং সেজন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরে এইসব মানুষদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে হবে, এরা কোন ভাষায় অভ্যস্ত, প্রতিদিনের জীবনে কী কী শব্দ ব্যবহার করে। ইউনেস্কোর পরিকল্পনাটি সে রকম। সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেখে কাজটি পেয়ে গেলাম আমি।
হাবড়া-অশোকনগরের কাছে বাণীপুরে একটি বেসিক ট্রেনিং কলেজ আছে, আমাদের আস্তানা হল সেখানে। পরিবেশটি ভারী সুন্দর, চতুর্দিকে অজস্র ফুল, চতুর্দিকে ছাত্র-ছাত্রীদের আনন্দ কোলাহল। ইউনেস্কোর প্রজেক্টে আমার মতন কাজ পেয়েছে কুড়ি জন, আমাদের থাকতে দেওয়া হল একটি লম্বা ডরমেটরিতে, মেঝেতে খড় বেছানো, তার ওপর শতরঞ্চি-চাদর বিছিয়ে শয্যা, মাথার কাছে সুটকেস, এই এক একজনের এলাকা। সৌভাগ্যবশত আমার এলাকাটি দেয়াল ঘেঁষে, এক কোণে।
এর আগে অনেকবার ভ্রমণে গিয়েছি বটে, কিন্তু বাড়ির বাইরে এই প্রথম আমার স্থায়ীভাবে থাকা। বাচ্চা ছেলের মতন বাবা আমাকে বাক্স-প্যাঁটরা সমেত সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে দিতে এলেন। যে-হেতু তিনি বয়েজ স্কাউট মাস্টারও ছিলেন, তাই খড়ের বিছানা দেখে তাঁর মোটেই আপত্তি হল না, প্রথম জীবনে তো কষ্ট করতেই হবে। (সেই খড় থেকে একদিন একটা সাপ বেরিয়েছিল, বাড়িতে সে কথা জানাইনি।) বাবা খুব আশা করেছিলেন, এই অভিজ্ঞতা থেকেই আমার পরে স্থায়ী চাকরি হবে, নিয়োগপত্রে সে-রকম ইঙ্গিত ছিল। এখন অবশ্য স্টাইপেন্ড বা হাতখরচ মাসে মাত্র পঁচাত্তর টাকা, তার থেকেই রোজ খেতে হবে ক্যান্টিনে। সে যাই হোক, তবু তো চাকরি, বাবা তাঁর স্কুলের সহকর্মীদের কাছে সগর্বে বলতে পারবেন, অজস্র বেকার যুবকদের মধ্যে তাঁর ছেলে একটা চাকরি পেয়ে গেছে। কয়েকখানা পোস্ট কার্ড রেখে গেলেন, নিয়মিত চিঠি লেখার জন্য।
এই প্রকল্পটির পরিচালক ছিলেন বিশিষ্ট গাঁধীবাদী সমাজ সেবক বিজয়কুমার ভট্টাচার্য, তখনই তাঁর বয়েস সত্তরের বেশি, কিন্তু উদ্দীপনায় ভরপুর, এবং কঠোর আদর্শবাদী হলেও বেশ আধুনিকমনস্ক ও রসিক। বর্ধমানের কলা নবগ্রামে তাঁর নিজস্ব একটি আশ্রমের মতন প্রতিষ্ঠান ছিল, সেটাও আমাদের দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন একবার। গ্রাম-উন্নয়নের জন্য তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড খুবই প্রশংসনীয়। কিন্তু একটা ব্যাপারে খুব মজা পেয়েছিলাম। সব কিছুই কাজে লাগানো যায়, এমনকী মানুষের মল ও মূত্র পর্যন্ত বাজে খরচ না করে সার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, এই নীতি অনুযায়ী সেখানকার শৌচাগারে এক জায়গায় মূত্র ত্যাগ আর পৃথক আর এক জায়গায় মলত্যাগ করার ব্যবস্থা, দুটো মিশিয়ে ফেললেই মুশকিল! কাজটা কিন্তু সহজ নয় মোটেই!
সকালবেলা কিছুক্ষণ ওয়ার্কশপ, তারপর বিজয়দা আমাদের নিয়ে যেতেন কাছাকাছি গ্রামগুলিতে। মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে লাঙল চালনারত কৃষকের সঙ্গে কথা বলে বুঝে নিতে হবে, তার পরিচিত শব্দভাণ্ডার কতখানি। মোটামোটা অভিধানে যতই শব্দ থাকুক, অধিকাংশ মানুষ আড়াইশো-তিনশো শব্দ ব্যবহার করে চালিয়ে দেয় সব কাজ। প্রতিশব্দ কিংবা সমার্থক শব্দের ব্যবহার প্রায় নেই-ই বলতে গেলে। যেমন মাটিকে মৃত্তিকা বললে কৃষকটি বুঝবে না। জমি সে চেনে, ভূমি চেনে না, আবার কিছু কিছু স্থানীয় শব্দ সে ব্যবহার করে, যার অর্থ আমরা বুঝি না।
আমার সবচেয়ে চমক লেগেছিল, তাদের ছবি বিষয়ে অজ্ঞতা দেখে। যে ব্যক্তি জীবনে কোনওদিন একটি বইয়েরও পৃষ্ঠা উল্টে দেখেনি, সে বইতে ছাপা ছবি দেখে চিনতে পারে না। আমরা বাচ্চা বয়স থেকে বইতে ছাপা ফুল, পাখি, গাছ, মানুষ, বেড়াল-কুকুর দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, বাস্তব চেহারার চেয়ে ছবিতে যে আকৃতি সঙ্কোচন হয়, তা আমরা এমনি এমনি লিখে যাই, অর্থাৎ বাঘ দেখলে বেড়াল মনে হয় না। হাতিকে মনে হয় না ইঁদুর। কিন্তু যে কখনও ছাপা ছবি দেখেনি, সে এই আকৃতি সঙ্কোচনে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। আমি একজন চাষাকে বইতে ছাপা একটি বটগাছের ছবি দেখিয়েছিলাম, সে চিনতে পারেনি, কাছেই একটা সত্যিকারের বটগাছ, সে দিকে আঙুল নির্দেশ করলেও সে অবিশ্বাসের সঙ্গে মাথা নাড়তে থাকে। অর্থাৎ বয়স্ক-শিক্ষা মানে শুধু অক্ষরজ্ঞান বা শব্দ পাঠ নয়। ছবি দেখিয়ে শেখানো দরকার, যদিও প্রকল্পটিতে তার কোনও উল্লেখ নেই।
পূর্ব বাংলার জ্ঞানের বাল্যস্মৃতি ছাড়া এই প্রথম আমার গ্রামের সঙ্গে খানিকটা প্রত্যক্ষ পরিচয় হল। যতই দরিদ্র হক, গ্রামের যে কোনও মানুষের বাড়িতে গেলেই কিছু না-কিছু খেতে দেবেই। মুড়ি, চিঁড়ে, কলা, এক বাড়িতে দেবার মতন কিছুই ছিল না, শুধু উঠোনের মাচায় ঝুলছিল কচি শশা, তাই কয়েকটা ছিঁড়ে এনে দিল। খোসাসুদ্ধ সেই শশা কচকচিয়ে চিবিয়ে পরম তৃপ্তি পেয়েছিলাম। এক গ্রামের এক কবির সঙ্গেও পরিচয় হল। তিনি সেদিন এক মেথরকে নেমন্তন্ন করে এনে নারায়ণজ্ঞানে পুজো করে খাওয়াবেন ঠিক করেছিলেন, মেথরটির প্রায় প্রাণান্তকর অবস্থা, মুখখানি অতি করুণ, পালাতে পারলে বাঁচে। সেই কবির সঙ্গে আমার দীর্ঘদিন পত্রালাপ ছিল।
বেশ ভালোই দিন কাটছিল, এই ক্যাম্পাসে মেয়েরাও থাকত, তাদের সঙ্গে চোখাচোখি ও ভাবসাব হয়ে গেল, এরা সবাই ভাবী-শিক্ষিকা, কিন্তু তখনও ছিল ছাত্রী-সুলভ উচ্ছলতা। আমার বন্ধুদেরও ভালো একটা বেড়াবার জায়গা হয়ে গেল, তারা শনি-রবিবার আসে আড্ডা দিতে। আর প্রাণের বন্ধু বুঢ্ঢা— সে পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে পারে না, সে সপ্তাহের মাঝখানেও বিকেলবেলা ট্রেন ধরে চলে আসে, সঙ্গে আনে প্রচুর খাবারদাবার, আমরা কোনও মাঠে গিয়ে বসি। কলকাতা খুব দূর নয়, কিন্তু আমি একবারও যাইনি, কল্পনায় দেখি কফি হাউসের আড্ডা, বেশ একটা নির্বাসিত নির্বাসিত ভাব উপভোেগই করি। বুঢ্ঢা কথাবার্তায় খুব তুখোড় হলেও মেয়েদের কাছে ভিজে বেড়াল, তার সঙ্গে এখানকার একটি তেজী যুবতীর আলাপ করিয়ে দেবার পর সে এমনই মুগ্ধ হয়ে গেল যে তার যখন-তখন চলে আসার কারণ আমি না সেই যুবতীটি, তা বোঝা শক্ত হয়ে পড়ল। প্রেম প্রেম হয় আর কী, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর এগোলো না।
একটা ব্যাপারে খুব কৌতুক বোধ করতাম। সপ্তাহে দু’দিন ওয়ার্কশপে কলকাতা থেকে ডেকে আনা হত এক শিশু সাহিত্যিককে, তিনি আমাদের বাংলা বাক্য গঠন শেখাবেন। আমি ততদিনে রীতিমতো একখানা কবি, গদ্যও লিখেছি এদিক সেদিক, আমাকে বাংলা শেখাবে এক শিশু সাহিত্যিক? অত্যন্ত সব কূট প্রশ্ন করে তাঁকে নাস্তানাবুদ করে দিতাম। পরে অবশ্য সেই শিশু সাহিত্যিকটির সঙ্গে আমার বেশ সৌহার্দ্য হয়ে যায়।
কথা নেই, বার্তা নেই, দু’ মাস বাদে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে গেল! সম্ভবত ইউনেস্কোর প্রস্তাব ছিল, প্রথম দু মাস অর্থ সাহায্য করা হবে, তারপর ভারত সরকার বা রাজ্য সরকারকে ভার নিতে হবে। ইউনেস্কোর অর্থস্রোত বন্ধ হতেই সরকার চোখ বুজে মুছে ফেলল পুরো প্রকল্পটি। আমরা আবার বেকার।
এই দু’মাসের মধ্যে আমাদের কয়েকজনকে দিয়ে বই লেখাবার ব্যবস্থাও হয়েছিল। গ্রামের মানুষ সারা দেশের অনেক খবরই জানে না। তাদের জন্য বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বই লিখতে হবে, গল্পচ্ছলে, সরল ভাষায়। তখন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নিয়ে খুব হইচই চলছে, (হিন্দিতে বলা হত পাঁচশালা পরিকল্পনা, তা নিয়ে রসিকতাও কম ছিল না।) আমার ওপর ভার পড়ল সেই বিষয়টি বুঝিয়ে একটি পুস্তিকা রচনার। ও লিখতে আমার আর কতক্ষণ লাগবে, বড় জোর দু’তিন ঘণ্টা! সে পুস্তিকাটি ছাপাও হয়েছিল, নাম শুধু ‘পরিকল্পনা’, গোটা গোটা অক্ষরে, ষোলো পৃষ্ঠা, হলুদ মলাটে আমার নামটি জ্বলজ্বল করছে। আমার জীবনের সেটিই প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ। শুনেছি ছাপা হয়েছিল পনেরো-বিশ হাজার কপি, বিতরিত হয়েছিল বিনা মূল্যে। সে বই কেউ পড়েছে কি না, কিংবা কারও কোনও উপকারে লেগেছে কি না, তা জানি না। অচিরেই সে পুস্তিকা মিলিয়ে গেছে কালের অতলে।
ছাব্বিশ
স্বাধীনতার সাত বছর পর ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগুলির সীমানা পুনর্গঠনের জন্য একটি কমিশন হয়। দেশভাগের পর খণ্ডিত পশ্চিমবাংলা ধনে-মানে হীনবল, মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের অনেক দাবিই দিল্লির প্রভুরা আমল দেয় না। বিহারের পূর্ণিয়া ও মানভূম জেলায় বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রচুর, সেইসব অঞ্চল পশ্চিমবাংলার অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠেছিল, কমিশনের রিপোর্টে তার অনেকটাই নস্যাৎ করা হল। অসম রাজ্য থেকে এই প্রথম শুরু হল বাঙালি বিতাড়ন, বিহার এবং ওড়িশাতেও বাঙালি বিদ্বেষের কালো কালো ধোঁয়া উড়ছে, সব দোষ উদ্বাস্তুদের নামে, কিন্তু সে বেচারিরা যাবে কোথায়, তা কেউ বলে না।
এরই মধ্যে বিধানবাবু হঠাৎ পশ্চিমবাংলা ও বিহার, এই রাজ্য দুটি জুড়ে দেবার প্রস্তাব আনলেন। তিনি কী কী যুক্তি দিয়েছিলেন, তা ঠিক মনে নেই, কিন্তু প্রস্তাবটি অনেকের কাছেই অদ্ভুত ও অবাস্তব মনে হয়েছিল। বিহার খনিজ সম্পদে ধনী, মাটির নীচে কয়লা, লোহা ও তামার আকর প্রচুর, আর পশ্চিমবাংলায় রয়েছে নানান কলকারখানা, এই সংযুক্তিতে তাই সুফল হবে ভাবা হয়েছিল? কিন্তু ভাষার কী হবে? একটু আগেই ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যের সীমানা নির্ধারিত হয়েছে, তা হলে এই যুগ্ম রাজ্যটিতে কোন ভাষা প্রধান হবে? এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন হয় পশ্চিমবঙ্গেই, বিহার চুপ করে ছিল, তার অর্থ কি বিহারবাসীদের কাছে প্রস্তাবটি ছিল লোভনীয়? বিধানবাবু কি ভেবেছিলেন, পশ্চিমবাংলা থেকে বাংলা ভাষা মুছে যায় তো যাক! তা অসম্ভব কিছু নয়, তাঁর সাহিত্যবোধ কিংবা বাংলা ভাষার প্রতি দরদের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তিনি অনর্গল ভুল বাংলায় বক্তৃতা দিতেন।
কলেজ ছাড়ার পর আমি ঠিক করেছিলাম, আর কখনও মিছিলে হাঁটব না, কিন্তু তখন আমি বাংলা ভাষা নিয়ে এমনই স্পর্শকাতর যে কেউ বাংলা সম্পর্কে সামান্য কটূক্তি করলেও গায়ে যেন ছ্যাঁকা লাগে, এই প্রসঙ্গে কয়েকবার মারামারিও করেছি, সুতরাং এই সংযুক্তি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে নেমে পড়লাম রাস্তায়। পুলিশের লাঠি-গুলি খেতেও অরাজি নই।
তখন যে কলকাতাকে মিছিলনগরী আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, তা মোটেই অসত্য নয়। খাদ্য আন্দোলন, ট্রামের ভাড়া বৃদ্ধি, শিক্ষকদের বেতন, ছাত্রদের বেতন, এরকম নানা উপলক্ষ ছাড়াও রাজনৈতিক কারণেও দিনের পর দিন মিছিল লেগেই থাকত, এই সব মিছিলের ওপর পুলিশের লাঠি ও গুলি চালনা ছিল ব্রিটিশ আমলের চেয়েও বেশি। শিক্ষক আন্দোলনের মিছিলে আমার বাবাকেও যোগ দিতে দেখেছি। চুয়ান্ন সালে শিক্ষকরা টানা চল্লিশ দিন ধর্মঘট করেন এবং তাঁদের এক মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছ’জন আরও বহুজন আহত। শিক্ষক হত্যার কলঙ্ক ইংরেজদেরও হাতে লাগেনি।
বিহার-বাংলা সংযুক্তির বিরুদ্ধে একটি বিশাল জনসভা হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে, তার পরবর্তী আন্দোলন শুধু কলকাতায় নয়, ছড়িয়ে পড়ে জেলায় জেলায়। সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত-ভাবে যোগ দিতে আসে। বন্ধু-বান্ধবদের ডেকে নিয়ে আমি প্রায় প্রতিদিনই বিক্ষোভ মিছিলে গিয়ে লাফালাফি করেছি। আমার খুব শখ ছিল একবার অন্তত জেলে যাবার। কত রকম কারাবাসের কাহিনী পড়েছি, স্বদেশি আমলে আমার জেলে যাবার সুযোগ ছিল না, না হয় স্বাধীন দেশেই একবার জেলের অভ্যন্তর দেখে আসব, খেয়ে আসব লপ্সি! একদিন মিছিলের সামনের দিক থেকে পৌঁছে গেছি ওয়েলিংটন স্কোয়ার পর্যন্ত, বিধান রায়ের বাড়ির সামনে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ধরে ধরে তুলতে লাগল কালো গাড়িতে, আমি ঠেলেঠুলে তাদের দিকে এগোচ্ছি, কিন্তু পুলিশগুলো এমনই পাজি যে হঠাৎ এক জায়গায় থেমে গিয়ে রাস্তা কর্ডন করে দিল, আমি সেই কর্ডন ভেদ করে যাবার চেষ্টা করতেই একজন প্রবল ধাক্কায় ফেলে দিল মাটিতে। সম্ভবত প্রিজ্ন ভ্যান ভর্তি হয়ে যাওয়ায় তারা এর পর লাঠি চালাবার সিদ্ধান্ত নেয়। আমার আর জেলে যাওয়া হল না।
অবশ্য এই আন্দোলনের তীব্রতায় বিধান রায় যে শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হলেন, তাতে ব্যক্তিগত কৃতিত্ব বোধ করেছিলাম, যদিও এতে আমার ভূমিকা সেতুবন্ধে কাঠবিড়ালির মতন।
পূর্ব পাকিস্তানে যে-রকম ভাষা আন্দোলন চলছিল, পশ্চিমবাংলায় সেরকমভাবে কোনও রাজনৈতিক দলই বাংলা ভাষা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেনি, প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু প্রয়োজন খুবই ছিল। তাদের দূরদৃষ্টির অভাবে ক্রমশ পশ্চিমবাংলায়, তথা সারা ভারতেই বাংলা ভাষার স্থান সঙ্কুচিত হতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় সরকার যোগাযোগের ভাষা হিসেবে হিন্দি ও ইংরেজিকে গ্রহণ করেছে, রাজ্য সরকারও সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের উদ্যোগ নিল না, তা হলে বাংলা ভাষার গুরুত্ব বা মর্যাদা রইল কোথায়? হিন্দি ভাষার প্রচার ও প্রসারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ বাড়তে লাগল প্রতি বছর, অন্যান্য ভারতীয় ভাষাগুলির সমৃদ্ধির জন্য দাবি জানাল না কেউ। বাংলার বাইরে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি প্রভৃতি অনেক রাজ্যেই বাংলা মাধ্যম স্কুল চলত গৌরবের সঙ্গে, সেগুলি দুর্বল হয়ে যেতে লাগল, প্রবাসী বাঙালি ছেলেমেয়েরা আর বাংলা শিখতে আগ্রহ বোধ করে না। হিন্দি ফিল্মের আগে তেমন দাপট ছিল, না এখন সেগুলি প্রবল হয়ে তেড়ে এসে দখল করে নিতে লাগল পশ্চিমবাংলার অধিকাংশ সিনেমা হল, আকাশবাণীতেও ‘বিবিধ ভারতী’ নামে এক অদ্ভুত তরঙ্গে অনবরত প্রচারিত হতে লাগল লঘু রুচির হিন্দি গান। বাংলার চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত জগতের অনেক প্রতিভাবানদের লোভনীয় হাতছানি দিয়ে টেনে নিয়ে গেল হিন্দি ফিল্মের জগৎ।
‘হরবোলা’-র যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আমি বর্ধিত হচ্ছিলাম, তা লুপ্ত হয়ে গেল অকস্মাৎ। অর্থাভাবের কোনও প্রশ্নই ছিল না, উৎসাহেরও অভাব ছিল না, তবু এই সংস্থাটি বন্ধ হয়ে গেল কমলকুমার মজুমদার ও দিলীপকুমার গুপ্ত নামে দুই প্রবল ব্যক্তিত্বের সংঘর্ষে। এরকম ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষরা বেশিদিন অন্যদের সঙ্গে সহযোগিতা চালাতে পারেন না, সহ্য করতে পারেন না বিরুদ্ধ মত বা সমালোচনা। যেমন রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “দুই বনস্পতি মধ্যে রাখে ব্যবধান/লক্ষ লক্ষ তৃণ একত্রে মিশিয়া থাকে বক্ষে বক্ষে লীন।” আমাদের মতন তৃণদলের মাঝখানে কমলকুমার ও ডি কে ছিলেন দুই বনস্পতি, কিছুদিনের জন্য দু’জনের গাঢ় বন্ধুত্বও ছিল, কিন্তু নাটক পরিচালনার ব্যাপারে অতি সামান্য কারণে এঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। একটিও কটু বাক্য উচ্চারিত হয়নি, তবু এক সন্ধেবেলা দু’জনে দু’দিকে মুখ ফিরিয়ে চলে গেলেন। ওঁদের মধ্যে মিলন ঘটাবার অনেক চেষ্টা করেছি আমরা, পলাতক ও আত্মগোপনকারী কমলকুমারকে ধরে এনে ডি কে-র সামনে দাঁড় করিয়েছি, দু’জনেই দারুণ ভদ্রতার সঙ্গে সহাস্যে আলিঙ্গন করলেন, কিন্তু মাঝখানের ফাটল আর জোড়া লাগল না। ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’, ‘মুক্তধারা’ নাটক বেশ সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ করার পর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘লম্বকর্ণ পালা’-র রিহার্সাল দিতে দিতে মাঝপথে ‘হরবোলা’ ভেঙে গেল।
তারপর ডি কে-র সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ কমে গেলেও আমরা রয়ে গেলাম কমলকুমারের প্রায় প্রতিদিনের সঙ্গী, বা ছায়াসঙ্গী বা অনুচর বা চেলা। ‘কৃত্তিবাস’ প্রকাশের ব্যাপারে সিগনেট প্রেসের কর্ণধার হিসেবে ডি কে অনেক সাহায্য করেছিলেন, তারপর একটি পত্রিকাকে স্বাবলম্বী হতেই হয়। স্বাবলম্বী হওয়া মানে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, এ ব্যাপারে দীপকের যথেষ্ট যোগ্যতা ছিল, সে হোমরাচোমরা ব্যক্তিদের বশীভূত করে ফেলতে পারত কথাবার্তায়। কিন্তু দীপক কৃত্তিবাস থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিলে আমি খানিকটা বিপদে পড়েছিলাম ঠিকই, বিজ্ঞাপন জোগাড় করার ব্যাপারে আমি একেবারেই অযোগ্য। আমার চরিত্রের প্রধান দুর্বলতা এই যে, আমি কোথাও নিজেকে জোর করে উপস্থাপিত করতে পারি না এবং প্রত্যাখ্যান একেবারে সহ্য করতে পারি না। যেখানে প্রত্যাখ্যানের সামান্য সম্ভাবনা থাকে সেখানে কিছু চাই না, সেখানে যাই না। এমনকী নিশ্চিত সম্মতির আভাস না পাওয়া পর্যন্ত আমি কোনও মেয়ের কাছেও চুম্বন প্রার্থনা করিনি। তা হলেও কি জীবনে কখনও আমাকে প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে হয়নি? হয়েছে অবশ্যই, অনেক সময় নিজের অনিচ্ছায় বা অন্যের তাড়নায় মানুষকে অনেক জায়গায় যেতে হয়, কিছু চাইতে হয়। সংস্কৃতে একটা কথা আছে, যাজ্ঞা মোঘা বরমধি গুণে নাধমে লব্ধকামা। অর্থাৎ, অধমদের কাছে কিছু চেয়ে লব্ধকাম হওয়ার বদলে গুণসম্পন্ন কারও কাছে কিছু চেয়ে ব্যর্থ হওয়াও ভালো। কিন্তু এ যুগে অধমদের হাতেই যে বেশি ক্ষমতা! এবং তারা কিছু দেবার আগে ক্ষমতা দেখাতে চায়।
সে যাই হোক, বিজ্ঞাপন সংগ্রহই তো কঠিন ব্যাপার, তার টাকা আদায় করারও অনেক ঝামেলা। আমি আর ওসব ঝকমারির মধ্যে যেতাম না। আমি টিউশানি-নির্ভর বেকার, সেই টিউশানির টাকা কিছু লুকিয়ে রাখতাম, সন্ধেবেলার একটা টিউশানির কথা বহুকাল গোপন রেখেছিলাম বাড়িতে, কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত যেতাম হেঁটে হেঁটে, ট্রাম-বাসের ভাড়া বাঁচাবার জন্য, বন্ধু-বান্ধবরা কিছু কিছু সাহায্য করতেন, তাতেও কুলোত না, তাই একটি অসৎ উপায়ও অবলম্বন করতে হত। প্রতি সংখ্যার জন্য কাগজ কিনতে হত নগদ, দপ্তরিখানাতে পুরো টাকা না মেটালে বাঁধানো পত্রিকা দেয় না, কিন্তু প্রেসে ধার রাখা যায়। সেই জন্যই প্রেস পাল্টাতাম ঘন ঘন। কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে ফর্মা ছাপিয়ে নিয়ে সেই যে গা-ঢাকা দিতাম, আর সে প্রেসের রাস্তাও মাড়াতাম না। বাংলা কবিতার জন্য সেইসব প্রেস মালিকগণ কিছু স্বার্থ ত্যাগ করছেন, এই রকমই ধরে নেওয়া হত। অবশ্য কোনও কোনও প্রেস-মালিকের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ও বোধহয় ছিল, অন্তত একজন প্রেস মালিকের কাছে বছর দু’-এক বাদে দৈবাৎ ধরা পড়ে যেতেও তিনি আমার গলা চেপে ধরেননি, আমি সেই ধারের কথা উত্থাপন করতেই তিনি হেসে হাত নেড়েছিলেন। অনেক বছর বাদে তরুণ প্রেসের মালিক গণেশচাঁদ দে কবিতা লেখা ও পত্রিকা প্রকাশের মতন সম্পূর্ণ অলাভজনক কাজে কয়েকটি শিক্ষিত যুবক এত সময় ও উদ্যম ব্যয় করে দেখে এমনই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে তিনি আমাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়েছিলেন স্বেচ্ছায়।
কোনও রহস্যময় কারণে কমলদা সেসময় তাঁর বাসস্থানের কথা গোপন রাখতেন। রাত্তিরের দিকে শ্যামবাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎ চলি বলেই লাফিয়ে উঠে পড়তেন একটা চলন্ত বাসে। পরে অবশ্য, ডি কে-র সঙ্গে বিবাদের সময় আমরা গোয়েন্দাগিরি করে তাঁর বাড়ি খুঁজে বার করেছিলাম। সেই সময় তিনি থাকতেন পাতিপুকুরে, নিজের স্ত্রীকে করে রেখেছিলেন অন্তরালবর্তিনী এবং তাঁকে সম্বোধন করতেন বড় বউ! কথাবার্তার মাঝখানে একসময় তিনি বলতেন, বড় বউ, এদের চা-টা দাও! তখন পর্দার আড়াল থেকে একটি ফর্সা হাত ওমলেট ও চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিত। আমাদের মতন ছোটদের কাছেও কমলদা তাঁর স্ত্রীকে কেন লুকিয়ে রাখতেন, তা কোনওদিনই জানতে পারিনি। বহুকাল পরে বউদি দয়াময়ী মজুমদারকে সামনাসামনি দেখি, তিনি অত্যন্ত রূপসী তো বটেই, বুদ্ধিমতী ও বিদুষী, শেষ জীবনে লিখতেও শুরু করেন।
ওই পাতিপুকুরের বাড়িতেই কমলদার ছোট ভাই, বিখাত শিল্পী নীরদ মজুমদার ও তাঁর ফরাসি স্ত্রীকে প্রথম দেখি। দুই ভাইয়ে যেমন গলাগলি, তেমনই আদি রসাত্মক ঠাট্টা-ইয়ার্কিতেও কোনও আড় নেই। নীরদ মজুমদার সদ্য ফরাসি দেশ থেকে দামি দামি সব আসব নিয়ে এসেছেন, আমরা কয়েকজন হঠাৎ উপস্থিত হওয়ায় আমাদেরও একটু একটু স্বাদ নিতে দিলেন। পাতিপুকুরে খুব মাছির উপদ্রব, গায়ে এসে তো বসেই, গেলাসের সুরার মধ্যেও ঢুকে পড়ে, পাখার বাতাসেও তারা যায় না। নীরদ মজুমদারের স্ত্রী মাছির উৎপাতে সন্ত্রস্ত, আমরাও খুব লজ্জা বোধ করছি, একসময় তাঁর স্বামী এক বুদ্ধি বার করে বললেন, দাঁড়াও জব্দ করছি মাছি ব্যাটাদের। এক প্রকার মিষ্টি মদ তিনি ফোঁটা ফোঁটা করে ছড়িয়ে দিলেন মেঝেতে, বললেন, এইবার দ্যাখো মাতাল মাছি! সত্যিই, সেই ঝাঁক ঝাঁক মাছি মদের ফোঁটার ওপর বসে, একটু বাদেই নেশার ঝোঁকে উল্টে উল্টে পড়ে যেতে লাগল, আর তাদের ওড়ার ক্ষমতা রইল না। অনেক জন্তুজানোয়ার, কীটপতঙ্গ, এমনকী মাছিও মদ ভালোবাসে। মাছের চারে মদ মিশিয়ে দিলে যে বেশি মাছ ধরা পড়ে, তা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। ডি কে-র ভাই মানিক গুপ্ত তাঁর পোষা একটি অ্যালসেশিয়ান কুকুরকে প্রতি সন্ধেবেলা হুইস্কি না দিলে সে এমন রাগারাগি করত যে শেষ পর্যন্ত সে কুকুরকে তিনি গুলি করে মেরে ফেলতে বাধ্য হন। চিনে পাড়ায় দেখেছি একটি মাতাল বাঁদর, আর উত্তরবঙ্গের চা-বাগানে একটি এমনই লোভী হাতি দেখেছি, যে কুলি বস্তিতে ঢুকে পড়ে হাঁড়িয়া নামে মদ শুঁড় দিয়ে চোঁ চোঁ করে টেনে নিয়ে দারুণ নেশাগ্রস্ত হয়ে আর চলতে পারত না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলতে দুলতে মার খেত!
নীরদ মজুমদার কলকাতায় এসে পাকাপাকি থাকবার সময় আমাদের সঙ্গে ভালো পরিচয় হয়। শক্তি ও আমার যুগ্ম কাব্যগ্রন্থ ‘সুন্দর রহস্যময়’-এর জন্য তিনি কয়েকটি চমৎকার ছবি এঁকে দিয়ে আমাদের ধন্য করেছিলেন।
আমরা কমলদার পাতিপুকুরের বাড়ি আবিষ্কার করায় তিনি খুশি হননি, অচিরেই বাসস্থান বদল করে তিনি আবার অজ্ঞাত স্থানে চলে যান। এরকমভাবে তিনি বহুবার বাড়ি বদল করেছেন, শুনেছি। সুতরাং, তাঁর সঙ্গে দেখা করার একমাত্র উপায় ছিল খালাসিটোলার পানশালায় হানা দেওয়া। এটা ‘হরবোলা’ ভেঙে যাবার পরের কথা।
কমলকুমারের সঙ্গে ভালোমতো পরিচয় হবার আগে যারা প্রথম প্রথম তাঁর বাক্যালাপ শুনবে, তাঁরা আঁতকে আঁতকে উঠবে। যেমন, কথায় কথায় তিনি উঁচু জাত, নিচু জাতের প্রসঙ্গ তোলেন, ছোটলোক-ভদ্রলোকের তফাত করেন, কোনও মুসলমানের মুখের ওপর বলেন ব্যাটা মোছলমান, দেশ স্বাধীন হবার বদলে ইংরেজ আমল ভালো ছিল, এখনও আবার ইংরেজদের ডেকে এনে এ দেশ শাসন করার কন্ট্রাক্ট দেওয়া উচিত, এরকম মতামত ব্যক্ত করতে দ্বিধা করেন না। এ সবই যে এক ধরনের তির্যক রসিকতা, তা বুঝে উঠতে সময় লাগে। খালাসিটোলায় একাধিক মুচি, মেথরের সঙ্গে তাঁর গলাগলি, অনেক বিখ্যাত, উচ্চবংশীয়দের নাম শুনলেই তিনি নাক সিঁটকোন, হুমায়ুন কবীর, আতাউর রহমান কিংবা বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর দারুণ বন্ধুত্ব! তিনি রামকৃষ্ণ ভক্ত বলেই ব্রাহ্মদের বিরোধী, সে কারণেই রবীন্দ্রনাথকেও ‘বেহ্ম’ বলে অবজ্ঞার ভাব দেখান, অথচ ‘মুক্তধারা’ অভিনয়ের সময় তিনি স্থির করেছিলেন, একটি শব্দও বাদ বা বদল করা চলবে না! একাত্তর সালে বাংলাদেশ যুদ্ধ শুরু হবার সময়ে তিনি গভীর বিস্ময়ে ভুরু তুলে বলেছিলেন, অ্যাঁ, মোছলমানরাও বাঙালি হতে চায়, বলে কী? তাঁর মতে, শুধু পশ্চিমবাংলার কায়স্থরাই বাঙালি, হিন্দু ব্রাহ্মণরাও বাঙালি হবার যোগ্য নয়! বলাই বাহুল্য, এর সঙ্গে ইতিহাস-ভূগোলের কোনও সম্পর্ক নেই, এসব কথা সেভাবে গ্রহণ করাও উচিত নয়, এসব কমলকুমার মজুমদার নামে এক সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত, অসাধারণ মানুষের চমকপ্রদ উক্তি! অন্য কারওর সঙ্গেই তাঁর তুলনা চলে না। সঙ্গী-সাথীদের কাছ থেকে শ্রদ্ধাভক্তি আদায়ের বিন্দুমাত্র বাসনা তাঁর ছিল না, কেউ সেরকমভাব দেখালেই তিনি হা হা করে হেসে উঠে একটা অতি আদি রসাত্মক রসিকতা করে বসতেন। বাঙালি মুসলমানদের সম্পর্কে ওই ধরনের উক্তি করা সত্ত্বেও এ তথ্য এখানে জানিয়ে রাখা ভালো যে মুক্তিযুদ্ধের সময় ওদিক থেকে আগত অনেক লেখক-বুদ্ধিজীবীকে তিনি সাদর আলিঙ্গন দিয়েছিলেন এবং অন্য অনেক সময় কথাপ্রসঙ্গে বারবার বলতেন, মুসলমানদের মতো আতিথেয়তা দিতে হিন্দুরা জানে না।
কমলকুমারের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ছিল না, তিনি সম্পূর্ণ স্বশিক্ষিত, বহু বিষয়ে ছিল গভীর জ্ঞান, তাঁর মুখের ভাষা ও লেখার ভাষায় আকাশ-পাতাল তফাত বলতে গেলে। তাঁর কথ্যরীতি খুবই চটুল, তারই মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ ঝলসে উঠত প্রজ্ঞা, ইংরিজি করে বলতে গেলে প্রফাউন্ড ও প্রফেনের এমন সংমিশ্রণ অতি দুর্লভ। মানুষটি সব সময় জীবনরসে ভরপুর, তাকে কখনও গম্ভীর কিংবা সত্যি সত্যি ক্রুদ্ধ হতে দেখিনি। তাঁর আর একটি বৈশিষ্ট্য, তিনি কোথাও বসতে চাইতেন না, খালাসিটোলায় টেব্ল-বেঞ্চ থাকলেও কমলকুমার মদ্যপান করতেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আগাগোড়া। তখনকার খালাসিটোলা ছিল কলকাতার সবচেয়ে শস্তা দিশি মদের পানশালা, টিনের ছাদ ঘেরা বিশাল জায়গা, বাইরে থেকে কিছু বোঝাই যেত না। পরবর্তীকালে কোনও কোনও সাহেব, যেমন বিখ্যাত কোনও ফরাসি শিল্প সমালোচক কিংবা ইংরেজ কবি কমলকুমারের সম্পর্কে জেনে তাঁর সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করলে তাঁদের আসতে হত ওই খালাসিটোলাতেই, কমলকুমার গেলাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতেন তাঁদের সঙ্গে। এরা কেউ কেউ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, একসঙ্গে এত মানুষকে এক জায়গায় শুধু মদ্যপান করতে তাঁরা আর কোথাও দেখেননি। পৃথিবীর অন্য সব জায়গার মদ্য পানশালায় খাবারদাবারেরও ব্যবস্থা থাকে, আমাদের দেশেও সেই একই নিয়ম, খালাসিটোলায় সেই নিয়মের চোখে ধুলো দেবার জন্য পাওয়া যেত অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিকের থালায় কিছুটা আদা আর কয়েকটি ছোলা, ওটাই খাদ্য। মুচি-মেথর-মুদ্দোফরাস, চোর-পকেটমার-গুণ্ডা, কেরানি ও বেয়ারা, কবি ও সম্পাদক, সবাই সেখানে সমান। এক নম্বরের বাংলা মদ অতি কড়া, যাকে বলে তরল-গরল, তা এক গেলাস ভর্তি করে, জল বা সোডা এক বিন্দু না মিশিয়ে, কমলকুমার আগে তাঁর হাতের একটি আংটি গেলাসে ছুঁইয়ে নিতেন, (সে আংটিতে শ্রীরামকৃষ্ণের নাম লেখা!) তারপর ঢক ঢক করে এক চুমুকে শেষ করে ফেলতেন সবটা। আমাদের মধ্যে শক্তিই একমাত্র কমলদার এই দৃষ্টান্তের অনুসরণ করত, আমি দু’-একবার চেষ্টা করেও পারিনি, আমায় সোডা মেশাতে হতই। এক গেলাস শেষ করার পর দ্বিতীয় গেলাস নেবার আগে কমলদা একটা কলে খুব ভালো করে মুখ কুলকুচো করতেন। তাঁর মতে, এতে নাকি দাঁত ঠিক থাকে। লিভারের কী হবে, তার চিন্তা নেই, দাঁতের জন্য চিন্তা!
খালাসিটোলা রাত ন’টায় বন্ধ হবার পর বাইরে বেরিয়ে সরষের তেলে ভাজা গরম গরম ওমলেট খাওয়া ও তার পরেও বহুক্ষণ ওয়েলিংটনের মোড়ে পুরনো বইয়ের দোকানগুলির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা। এক প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে, পৃথিবীর বহু বিষয়ে কথা বলতেন কমলদা, আমরা মুগ্ধ শ্রোতা। সক্রেটিস যেমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিংবা চলতে চলতে তাঁর ভক্তদের জ্ঞানের কথা বলতেন, তাঁর অনুগামীদের বলা হত পেরিপাটেটিক ফিলোজফার, কমলকুমারও সেরকম, তিনিই আমাদের সক্রেটিস। তিনি দার্শনিক তো অবশ্যই।
কমলকুমার শারীরিকভাবেও বেশ শক্তিশালী পুরুষ। অত মদ্যপান করেও কখনও তাঁকে বেচাল হতে দেখিনি। তিনি উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান হলেও তখন তাঁর আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, অনিশ্চিত উপার্জন, তবু আমরা বয়েসে অনেক ছোট বলে মদের বোতল কেনার টাকা তিনিই জোর করে দেবেন। তিনি টাকা রাখতেন তাঁর হাতে ধরা বইয়ে, প্রতিদিনই কোনও না কোনও ফরাসি বই থাকত, সেই বইয়ের ভাঁজে। আড্ডার শেষে তিনি একাই ট্রামে চেপে চলে যেতেন তাঁর অজ্ঞাত বাসস্থানে। পরের দিকে অবশ্য তা জানা হয়ে যায়। তখন ইন্দ্রনাথ মজুমদার, কমলদার আপত্তি সত্ত্বেও, জোর করে ট্যাক্সিতে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসত। কমলদা নিঃসন্তান, ইন্দ্রনাথ মজুমদার শেষের কয়েক বছর যেভাবে নিঃস্বার্থভাবে কমলদার দেখাশুনো করেছে, তা অনেকের নিজের সন্তানও করে না।
কমলদার চরিত্রের আর একটি বৈপরীত্যের উদাহরণও দেওয়া দরকার। সিগনেট প্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ হবার পর জীবিকার জন্য তিনি ‘তদন্ত’ নামে একটি গোয়েন্দা-রহস্য পত্রিকা বার করেছিলেন, তাতে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘দারোগার দপ্তর’-এর মতন পুরনো লেখা পুনর্মুদ্রিত হত, অনেক লেখা কমলদা নিজে লিখতেন, আমরাও দু’-একটা লিখেছি কাঁচা হাতে। অতি দীনভাবে ছাপা, বাজে কাগজ, মলাটে রগরগে ছবি নেই, সেরকম রহস্য পত্রিকা চলবে কেন? পুরোটাই লোকসান, বন্ধ হয়ে গেল অচিরে। কয়েক বছর পর তিনি আর একটি পত্রিকার সম্পাদক হন, নাম ‘অঙ্ক ভাবনা’, এরকম পত্রিকা প্রকাশের কথা এ দেশে আগে কেউ চিন্তাই করেনি, এর বিষয় গাণিতিক দর্শন, অতি দুরূহ সব প্রবন্ধ। বহু লেখক অঙ্ক জিনিসটাকেই ভয় পায়, তার ওপর তার দর্শন! এ পত্রিকার পাঠক যেমন দুর্লভ, লেখক পাওয়াও তেমনই কঠিন। কয়েক সংখ্যা পরেই পত্রিকাটির পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হল। ‘অঙ্ক ভাবনা’-র সমস্ত দায়দায়িত্ব বহন করেছিল ইন্দ্রনাথ মজুমদার। একই ব্যক্তি একবার অতি লঘু রহস্য পত্রিকার সম্পাদক হন, আবার অতি গুরুগম্ভীর দর্শন-পত্রিকার, এর উদাহরণ কমলকুমারই একমাত্র!
এক রবিবার সকালে কমলদা তাঁর প্রথম উপন্যাস উপহার দিলেন আমাদের। উপন্যাসটি সম্পূর্ণ ছাপা হয়েছে একটি সাধারণ পত্রিকায়, আমি তার নামও জানতাম না, কমলদা পত্রিকাটি ছিঁড়ে, শুধু তাঁর উপন্যাসের অংশটুকু সেলাই করে দিয়েছিলেন, নাম ‘অন্তর্জলী যাত্রা’, প্রথম লাইনটি আজও মনে আছে, “আলো ক্রমে আসিতেছে, আকাশ মুক্তাফলের ন্যায় হিম নীলাভ।” সে উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতা, জীবনের কিছু কিছু ঘটনার মতন সম্পূর্ণ নতুন ও চিরস্থায়ী। ততদিনে সাধু বাংলা বিসর্জন দিয়েছে সমস্ত লেখক, কমলকুমারের রচনা শুধু সাধু বাংলায় নয়, তার বাক্যগঠনও আমাদের অপরিচিত, কোথাও কোথাও তা কঠিন দেওয়ালের মতন যেন অগম্য, তবু সেই দেওয়ালের ওপাশে যেন রয়েছে কী রহস্য, তাই বারবার পড়তে ইচ্ছে হয়, গোটা উপন্যাসটি অন্তত তিনবার পাঠের পর তার প্রকৃত মর্ম ও সৌন্দর্য হৃদয়ঙ্গম হয়। হীরক-উদ্ধারের জন্য যেমন অনেক মাটি খুঁড়তে হয়, সেই রকমই কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাস পাঠের পরিশ্রম সার্থক।
তাঁর মুখের ভাষা হাটে-বাজারের, আর সাহিত্যের ভাষা এত জটিল কেন, এ প্রশ্ন অনেকবার করেছি। তিনি যা উত্তর দিয়েছেন, তা অভিনব ও চমকপ্রদ হতে পারে, ব্যাখ্যা নয়। তিনি বলতেন, সাহিত্য হচ্ছে বাগ্,-দেবী সরস্বতীর সঙ্গে কথা বলা। আমরা যে ভাষায় মাছের বাজারে, মদের দোকানে, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কথা বলি, সে ভাষায় শব্দের অধিষ্ঠাত্রীর সঙ্গে কথা বলা যায় না, সে জন্য নতুন ভাষা তৈরি করে নিতে হয়। এই উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে ছাপা হয়েছিল একটি ছোট প্রকাশনী থেকে, কমলকুমার রসিকতা করে বলেছিলেন, এক বছরে আমার বইটা বিক্রি হয়েছে পনেরো কপি, আর সতেরো জন ফেরত দিয়ে গেছে! তবু, যতই ছোট গোষ্ঠীর মধ্যে পরিচিত হোন না কেন, এই সময় থেকে তিনি একজন পুরোপুরি লেখক।
কমলকুমার কবিতা লেখেন না, আমরা কৃত্তিবাস পত্রিকায় তাঁর কোনও রচনা ছাপতে পারি, না কারণ তখনও কৃত্তিবাসকে বিশুদ্ধ কবিতা পত্রিকা হিসেবে রাখতেই বদ্ধপরিকর। সন্দীপনের মতন বন্ধুও কৃত্তিবাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তবু সে এ পত্রিকার লেখক নয়। হঠাৎ আমার মস্তকে এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা এসে গেল। একই সঙ্গে দুটি আলাদা পত্রিকা বার করা হবে, পৃথক মলাট, কিন্তু দুটিরই নাম কৃত্তিবাস, একটি কবিতা, অন্যটি গল্পের। কয়েকজন বন্ধু এতে সমর্থন জানাল। আমার স্কুলের ও বাল্য-বন্ধুরা, যেমন আশুতোষ ঘোষ, উৎপল রায়চৌধুরী, ভাস্কর দত্ত প্রমুখ, এরা কেউ লেখে না কিন্তু গোড়ার দিকে কৃত্তিবাসকে অনেক সাহায্য করেছে, অন্যরা আস্তে আস্তে সরে গেলেও ভাস্কর রয়ে গেল আজীবন কবি-লেখকদের সঙ্গী। ভাস্করের বাড়িতে দুটো বৈঠকখানা, তারই একটিতে হল কৃত্তিবাসের নতুন কার্যালয়, কয়েকজনের চাঁদায় গড়া হল একটা তহবিল, শুরু হল দুই কৃত্তিবাসের কাজ। গল্পসংখ্যার জন্য নির্বাচিত হল দুটি মাত্র গল্প, কমলকুমার মজুমদারের ‘ফৌজ-ই-বন্দুক’ এবং সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘ক্রীতদাস- ক্রীতদাসী’, দুটিই অসাধারণ গল্প এবং বাংলা সাহিত্যে নতুন স্বাদের। শক্তি চট্টোপাধ্যায় স্বেচ্ছায় গল্প পত্রিকার দায়িত্ব নিতে চেয়েছিল, তার নাম মুদ্রিত হল সম্পাদক হিসেবে, কিন্তু সে এমনই অস্থির স্বভাবের যে সম্পাদকীয় পর্যন্ত লিখে উঠতে পারল না। সে সম্পাদকীয়ও লিখতে হল আমাকেই। সে সম্পাদকীয় থেকে কিছু কিছু বাক্য পরে অনেকে উদ্ধৃত করেছে দেখেছি। যথাসময়ে প্রকাশিত হল দুটি পত্রিকা, দুটির নাম কৃত্তিবাস, দু’রকম চেহারা, দুটিই পরিচ্ছন্নভাবে সুমুদ্রিত। পাঠক মহলে খুবই বিস্ময়ের সঞ্চার হয়েছিল। বাংলা ভাষাতে তো বটেই, আর কোনও ভাষাতেও এরকম অভিনব ব্যাপার ঘটেছে কি না জানি না।
দ্বিতীয় সংখ্যার জন্য কমলকুমার লিখে দিলেন ‘গোলাপ সুন্দরী’, এ ছাড়া দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, মতি নন্দী প্রমুখ বন্ধুরা গল্প দিয়েছিলেন স্বেচ্ছায়, কিন্তু গল্প- কৃত্তিবাসের আর দ্বিতীয় সংখ্যা বেরোতে পারেনি। কিছুটা অর্থাভাবে, কিছুটা বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে মতান্তরে ও কিছুটা আমার পারিবারিক দুর্যোগের কারণে এই উদ্যোগ আর নেওয়া যায়নি। কবিতার কৃত্তিবাসও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায় বছরখানেকের জন্য। খুবই দুঃখের সঙ্গে কমলকুমারের ‘গোলাপ সুন্দরী’-র মতন অমর গল্পটি আমি ‘এক্ষণ’ পত্রিকার জন্য তুলে দিয়েছিলাম নির্মাল্য আচার্যের হাতে।
অবশ্য কয়েক বছর পর, আগেকার নিয়ম ভেঙে, কবিতার কৃত্তিবাসেই প্রকাশিত হয়েছিল কমলকুমারের সম্পূর্ণ উপন্যাস, ‘সুহাসিনীর পপেটম’।
সাতাশ
দক্ষিণ কলকাতায় রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে এক সন্ধেবেলা তিনটি উজ্জ্বল যুবতী ওপরের দিকে মুখ করে ডাকছিল, এই বিশ্ব, বিশ্ব! কয়েক মুহূর্ত পরে তিনতলার ঝুল বারান্দায় একটি গেঞ্জি পরা যুবক এসে বলল, দাঁড়া আসছি!
দৃশ্যটি আমার কাছে এমনই চমকপ্রদ লেগেছিল যে আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। ঈর্ষা হয়েছিল, টনটন করেছিল বুক। মেয়েরা ডাকছে একটি ছেলেকে? পাড়াপ্রতিবেশী উঁকিঝুঁকি মারছে না, ছেলেটির বাড়ির লোক চোখ গরম করছে না? আমায় কোনও তরুণী কখনও এমনভাবে ডাকেনি, উত্তর কলকাতায় এরকম ঘটনা সম্ভবই নয়।
উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার জীবনযাত্রায় স্পষ্ট প্রভেদ ছিল পঞ্চাশ ও ষাট দশক পর্যন্ত। অনেক পরিবারে মহিলারা পর্দানশীন, কখনও বাড়িতে কোনও অনাত্মীয় আগন্তুকের সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য হলে মাথায় ঘোমটা টেনে, মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে রাখতেন। একই পরিবারের দুটি বালক বালিকা এক সঙ্গে বর্ধিত হচ্ছে, স্কুলে যাচ্ছে, কিন্তু যেই তাদের বারো-তেরো বছর বয়স হয়ে গেল অমনি ছেলে ও মেয়ের শাসন প্রণালী ভিন্ন হয়ে যাবে। ওই বয়সের ছেলেরা বারমুখো হতে শুরু করে, ইস্কুলের গণ্ডি ডিঙিয়ে কলেজে গেলেই বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা, দল বেঁধে বাইরে যাওয়া, একটু রাত করে বাড়ি ফেরার ছাড়পত্র পেয়ে যেত। ওই একই বয়সি মেয়েরা বিকেলের আলো ফুরোবার আগেই বাড়িতে ফিরতে বাধ্য, অভিভাবকদের সঙ্গে ছাড়া সিনেমা-থিয়েটারে যাবার স্বাধীনতা ছিল না, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোনও যুবকের সঙ্গে বাক্যালাপ করলে টি টি পড়ে যেত। ঋতুমতী হবার পর থেকেই তাদের অপেক্ষা করতে হয় বিয়ের জন্য। এবং বিয়েতেই জীবনের পরাকাষ্ঠা। বিবাহ-পূর্ব প্রেম করার অভিজ্ঞতা থেকে তারা বঞ্চিত হলেও যৌন অভিজ্ঞতা যে একেবারে হত না তা নয়। মামাতো-পিসতুতো দাদা ও যুবক কাকার দল সুযোগ পেলেই দলাইমলাই করত তাদের শরীর। নিকট আত্মীয়দের দ্বারা আধা-ধর্ষিতা হয়নি, এমন নারী এ সমাজে দুর্লভ। কোনও নারীই মুখ ফুটে এর প্রতিবাদও করেনি, গোপন রেখেছে সারা জীবন।
কিছু ধনী পরিবারে ব্যতিক্রম হলেও দক্ষিণ কলকাতায় নারী-স্বাধীনতা ছিল অনেক বেশি। আমি অনেকগুলি বছর উত্তর কলকাতায় বাস করলেও ছাত্র বয়স থেকে যাতায়াত করেছি দক্ষিণ কলকাতায়, টিউশানির সূত্রে প্রবেশ অধিকার পেয়েছি অনেক পরিবারের অন্তঃপুরে। উত্তর কলকাতার অধিকাংশ মেয়ের মুখে যেন সব সময় ভীতু ভীতু ভাব, পুরুষদের দিকে স্পষ্ট চোখ মেলে তাকায় না, পারিবারিক শাসন তাদের মাথায় এমন গেঁথে গেছে, যেন রাস্তায় যে- কোনও সময় বাঘ-সিংহ তাদের খেয়ে ফেলবে। সেই তুলনায় দক্ষিণ কলকাতার মেয়েদের মুখগুলি স্বচ্ছ, ব্যবহার সাবলীল, তারা ছেলেদের চোখে চোখ রেখে কথা বলে। রাস্তায় স্বচ্ছন্দভাবে চলাফেরা করে। এই জন্যই বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, পৃথিবীর অনেক দেশ ঘোরার অভিজ্ঞতা তাঁর থাকলেও বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েদের দেখা যায় গড়িয়াহাটের মোড়ে!
দক্ষিণ কলকাতায় আর একটি অভিজ্ঞতাও হয়েছিল। কে যেন বলেছিলেন যে বিদ্যাসাগর মশাই নারীশিক্ষার প্রচলন করেছিলেন, কিন্তু তার ফল হল এই, এখনকার মেয়েদের সব ইস্কুল-কলেজই অফিসারদের বউ বানাবার কারখানা। কথাটা মর্মে মর্মে সত্যি। আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষিত মহিলাই সমাজজীবনে কোনও রকম অংশগ্রহণ করেন না। দক্ষিণ কলকাতায় অনেক বিদুষী মহিলাকে দেখেছি, বিয়ের পর ছেলেমেয়েদের পরিচর্যা ও স্বামীর আন্ডার গারমেন্ট ও মোজা যথা সময়ে এগিয়ে দেওয়া ও পার্টিতে যাওয়া ছাড়া তাঁদের নিজস্ব কোনও পরিচয় নেই। এককালের সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞানের নাম করা ছাত্রী হয়েও সে বিদ্যার কোনও প্রয়োগ হয় না বাকি জীবনে। অনেকের পড়াশুনোর অভ্যেসও চুকেবুকে গেছে। বড় বড় অফিসার কিংবা ব্যবসায়ীদের স্ত্রীদের কোনও চাকরি, এমনকী শিক্ষা-পেশা নেওয়ারও আগ্রহ দেখা যেত না, সেটা ঠিক সম্মানের ছিল না। এখন অবশ্য সে অবস্থা বদলেছে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মেধাবী পুরুষের দল পশ্চিম গোলার্ধে পাড়ি দিতে শুরু করে। প্রথম দিকে তারা কেউ কেউ মেম বিয়ে করে ফেলত, এখন তারা স্বদেশ থেকে বাছাই করা রূপসী ও বিদুষী বাঙালি মেয়েদের হরণ করে আনে। বিদেশে এসে সেই সব রমণীকুল চাকরি নিতে বাধ্য হয়। কত রকমের যে চাকরি!
অপর্ণা উত্তর কলকাতার মেয়ে হলেও, সে নিছক প্রথার অনুগামিনী ছিল না, বরং খানিকটা প্রতিবাদী। তখনও নারীবাদী আন্দোলন শুরু হয়নি বটে, কিন্তু তার মধ্যে ওই চিন্তার বীজ ছিল। অবশ্য প্রেমেও বিশ্বাস ছিল খুব। সে প্রচুর কবিতা পড়ত এবং তার মন ছিল মূলত রোমান্টিক। বিয়ের চিন্তা করত না, তার বাসনা আরও অনেক পড়াশুনো করে অধ্যাপিকা হবে। তাদের বৃহৎ ক্ষয়িষ্ণু বনেদি পরিবারে শাসনব্যবস্থা শিথিল, কেউ যেন কারওকে নিয়ে মাথা ঘামায় না।
শাসন না থাকলেও কিছু সামাজিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করা সহজ নয়। কোনও পুরুষ যখন তখন সে বাড়ির কোনও মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারে না। তিন মহলা বাড়ি, সবাই থাকে ওপরে, একতলা খালি, সেখানে গিয়ে কাজের লোকদের বলতে হয় খবর দিতে। ও-বাড়ির কাজের লোকেরা কর্তাবাবু কিংবা দাদাবাবুদের খবর দিতে অভ্যস্ত, কোনও দিদিমণিকে ডেকে দাও বললে তারা বিচিত্র চোখে তাকাবে, তারপর সেই যে অদৃশ্য হয়ে যাবে, আর ফিরবে না। আমি অবশ্য সে রকম চেষ্টাও কখনও করিনি, যেতাম বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে, বিকেলে। অপর্ণার সঙ্গে আমার সব রকম ভাব বিনিময় হত গোপনে হস্তান্তরিত চিঠিতে।
আমি যখন বেকার অবস্থায় ঘোরাঘুরি করছি, অপর্ণা তখন প্রস্তুত হচ্ছে বি এসসি পরীক্ষা দেবার জন্য। আগে তবু তার কলেজে যাবার পথে কিংবা গানের ইস্কুলের সামনে চকিতে দেখা হত, এখন কলেজ নেই, গানের ইস্কুলেও যায় না। আমি কল্পনায় দেখতে পাই, তাদের বিডন স্ট্রিটের প্রকাণ্ড বাড়িটার একতলার একটি ঘরে অপর্ণা ফিজিক্সের অঙ্ক কষছে, তার কলম ধরা আঙুলে কালি লেগেছে, মাথার কোঁকড়া কোঁকড়া চুল ছেয়ে আছে পিঠ। কী পোশাক পরে আছে সে? দিনের পর দিন দেখা না হলে শুধু বুক নয়, তলপেটে ব্যথা হয়। ওদের বাড়ির সদর দরজা সব সময় খোলা থাকে। বাইরে বসে ঝিমোয় এক বুড়ো দারোয়ান, সে আমাকে চেনে, আমি ভেতরে যেতে চইলে বাধা দেবে না। একতলার ঘর, তাই চাকরবাকরদের সাহায্য নিতে হবে না, আমি যদি দুপুরবেলা তার ঘরে গিয়ে অন্তত দশ মিনিট কথা বলে আসি, তাতে পৃথিবীর কী এমন ক্ষতি হয়! জানি, ও-বাড়ির কাকা-দাদারা আমার সঙ্গে প্রকাশ্যে দুর্ব্যবহার করবে না, কেউ হয়তো দেখতেও পাবে না, তবু, তবু আমার যাওয়া হয় না। আমি যদি সপ্রতিভ, সাহসী যুবক হতাম, তা হলে অনায়াসে অপর্ণার পড়ার ঘরে ঢুকে পড়া যেত, কিন্তু আমি যে সেরকম নই, দুর্মর লজ্জা বা সঙ্কোচ কাটাতে পারি না, কেউ যদি দেখে ফেলে সামান্য ভ্রূকুটিও করে তা সহ্য করতে পারব না।
এমনিই বিডন স্ট্রিটে অপর্ণাদের বাড়ির সামনে দিয়ে একবার হেঁটে যাই প্রতি দুপুরে, যেন চুম্বকের টানে। আগের রাতে লেখা কবিতাটা তাকে দেখাতে ইচ্ছে হয়। একদিন লক্ষ করলাম, তাদের বাড়ির পাশে একটা সরু গলি আছে, সেদিকে দুটি জানলার মধ্যে একটি বন্ধ, একটি খোলা। চুপি চুপি সেই জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঘরের মধ্যে কয়েকটা বড় বড় আলমারি, অনেকগুলি চেয়ার ও দুটো টেবিল, তার মধ্যে দূরবর্তী টেবিলটার সঙ্গের চেয়ারে বসে আছে অপর্ণা, এদিকে পিঠ ফেরানো। আমি সেদিকে ভিখারির মতন, তৃষ্ণার্তের মতন তাকিয়ে রইলাম নিঃশব্দে। শুধু একটা পিঠ, শাড়ি খসে পড়া, গোলাপি রঙের ব্লাউজে অনেকখানি ঢাকা পিঠ, দুই কাঁধ ও মাথার পেছনটা, তাতে এতই মায়া, এতই টান।
প্রথম দিন কথা না বলেই ফিরে এসেছি, দ্বিতীয় দিন নাম ধরে ডাকলে অপর্ণা দূরের চেয়ারে বসেই কথা বলেছে, তৃতীয় দিনে আমার অনেক কাকুতি-মিনতিতে একবার উঠে এসেছে জানলার কাছে। চিঠির ভাষা ও স্পর্শের ভাষার মধ্যে কোনটা কার চোখে বেশি জোরালো তা বলা কঠিন, তবে দ্বিতীয়টি বাদ দিলে প্রথমটা ক্রমশ দুর্বল হয়ে যায়। শুধু হাতে হাত ধরা, সান্নিধ্যের সুগন্ধ, মাঝখানে জানলার গরাদ, খুবই কাটছাঁট করা রোমিও-জুলিয়েটের দিশি সংস্করণ বলা যেতে পারে।
পঞ্চম দিনে হঠাৎ পেছনে দেখি কয়েকটি কালো ছায়া। গোটা চারেক ছেলে কোমরে হাত দিয়ে আমাকে ঘিরে দাড়িয়েছে, তাদের একজনের গলায় রুমাল বাঁধা। আমার বুক কেঁপে উঠল, চোখের ইঙ্গিতে অপর্ণাকে জানলা বন্ধ করে দিতে বলে আমি সরে এলাম সেখান থেকে। আমার প্রধান চিন্তা হল, ওরা আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছে করুক, অপর্ণার বাড়ির লোক যেন কিছু জানতে না পারে। গলায় রুমাল বাঁধা ছেলেটি আমার চুলের মুঠি চেপে ধরে প্রাকৃত ভাষায় যা বলল, তার একটাই অর্থ, বে-পাড়ার কোনও ছেলের এ পাড়ার কোনও মেয়ের সঙ্গে প্রেম করা তারা সহ্য করবে না। আমার প্রধান অযোগ্যতা আমি বে-পাড়ার ছেলে। ওরা পাড়ার সব মেয়ের সনিযুক্ত অভিভাবক। আমি বীরপুরুষ নই। চারজন পাড়ার মাস্তানের সঙ্গে যুঝে যাবার সাহসও আমার নেই। বিনা প্রতিবাদে মার খেলাম, একটাও শব্দ উচ্চারণ করিনি বলে অল্প সময়ের মধ্যে দু’চারটে লাথি-চড় মেরে ছেড়ে দিল। ঘন দুপুর, রাস্তায় বেশি লোক নেই, অপর্ণাদের বাড়ির ওপরের জানলায় কেউ দাঁড়ায়নি, টের পাইনি কেউ।
জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ারদের সীমানা নির্ধারিত থাকে। বাঘ-সিংহরা নিজস্ব সীমানা অতিক্রম করে না। শহরের কুকুরাও কারওকে তাড়া করে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ থেমে যায় এক জায়গায়। যেন ঠিক তার পরেই অন্য পাড়ার কুকুরদের এলাকা। মানুষের মধ্যেও এরকম গণ্ডি রয়ে গেছে দেখা যাচ্ছে।
সেই পাড়ার মাস্তানরা আমার কোনও ক্ষতি করতে পারেনি, বরং উপকারই করেছে। এ ধরনের শারীরিক অপমান ছাড়াও নানান ধরনের অপমান তো প্রায়ই সহ্য করতে হয়। সামনা সামনি যে-গুলির উত্তর দেওয়া যায় না, সেগুলির জন্য ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ জমা হয়, সেই ক্ষোভ থেকে জমাট বাধে বাষ্প, যেমন মেঘ, যেমন ধারাবর্ষণ, সেই রকমই, অপমান ও ক্ষোভের থেকে কান্নাকাটি নয়, তার মুক্তি হয় শব্দ ও ধ্বনিতে। সেই রাত্রেই আমি লিখেছিলাম একটা প্রতিশোধের কবিতা, ‘মহারাজ, আমি তোমার’, তাতে এই প্রসঙ্গের উল্লেখ নেই, আছে অন্য রকম ভাষা ব্যবহার, ওই মাস্তানদের গালাগালিকে আমি অর্থহীন শব্দে রূপান্তরিত করেছিলাম।
বাড়িতে আমার নিজস্ব ঘর নেই, দিনের বেলা কবিতা লেখা যায় না, এক ঘরে ভাই-বোনরা ও ছোট কাকা লেখাপড়া করে, আমি অন্য লোকজন থাকলেও কিংবা নানা কলরবের মধ্যেও গদ্য লিখে যেতে পারি, কিন্তু কবিতা লেখার সময় নিস্তব্ধতা ছাড়া আর কারওর সঙ্গ সহ্য করতে পারি না। সুতরাং কবিতার খাতা খুলে বসি সকলে ঘুমিয়ে পড়ার পর। তখন স্তব্ধ নগরী, শুধু মাঝে মাঝে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে রাস্তার কুকুর, আর সামনের বাড়ির ছাদে প্রায়ই একটা পেঁচা এসে বসে। চরকা ঘোরানোর শব্দের মতন সে খ্যা-র-র খ্যা-র-র করে ডাকে। এক এক রাত্রির তৃতীয় প্রহরে বাবা জেগে উঠে বাথরুমে যাবার পথে আমার ঘরে আলো জ্বালা দেখে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে বলেন, পরীক্ষার আগে তো কোনও দিন এত রাত জেগে লেখাপড়া করতে দেখিনি!
কবিতা লিখে যে কিছুই পাওয়া যায় না, তা তো সবাই জানি। অর্থ, খ্যাতি, কীর্তি, কোনও কিছুই পাবার সম্ভাবনা নেই, তবু রাত জেগে কেন এই আয়ুক্ষয় তার কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। এ এক সাঙ্ঘাতিক গুপ্ত নেশা, সেইজন্যই অনেকে কৈশোর-যৌবনে দু’চার বছর কবিতা লেখার হাত মকসো করে, তারপর লেখালেখি ফেলে বহুদূরে সরে যায়।
আমার বেকারত্বের তৃতীয় বছরে অবস্থাটা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যেতে লাগল। বেকার মানে আমি অকর্মণ্য তো নই, সকাল সন্ধ্যায় তিনটে টিউশানি করি, লেখালেখি ও একটি পত্রিকা সম্পাদনার কাজেও ব্যস্ত, তবু যে দশ-পাঁচটায় কোথাও নিযুক্ত নই, সেটাই যেন উপহাসের বিষয়। অনেকে জেনেশুনেও জিজ্ঞেস করে, কীরে, এখনও কোনও চাকরি পেলি না? আমি একজন সুস্থ-সমর্থ যুবক, মোটামুটি শিক্ষিত, তবু আমার স্বাধীন দেশ যে আমাকে কোনও কাজ দিতে পারছে না, সেটা কি আমার দোষ? আমার চেষ্টার তো কোনও ত্রুটি নেই।
বেকার অবস্থার সবচেয়ে খারাপ দিক, আস্তে আস্তে হীনম্মন্যতা জন্মে যায়। বেকাররা মনে করতে থাকে, তারা অপদার্থ, তাদের দ্বারা কোনও কাজই হবে না, তারা সমাজের বোঝা। এই হীনম্মন্যতা কাটাবার জন্যই কেউ কেউ চুরি, ডাকাতি, জালিয়াতির মধ্যে ঢুকে পড়ে, রাজনৈতিক দলের পোষা গুণ্ডা হয়।
এর মধ্যে অবশ্য আমি আর একটি লোভনীয় কাজের সুযোগ পেয়েও হারিয়েছি নিজের দোষে। আমার বন্ধু আশু নিউ ইন্ডিয়া অ্যাসিওরেন্স কোম্পানির অফিসার্স ট্রেনি হিসেবে যোগ দিয়েছিল, সেখানে সে আমাকেও একটা ব্যবস্থা করে দিল। তখনও জীবন বিমা জাতীয়করণ হয়নি, সবই প্রাইভেট কোম্পানি, তার মধ্যে নিউ ইন্ডিয়া বেশ নামজাদা। এই ট্রেনিং সম্পূর্ণ করলে উচ্চ বেতনে নিযুক্ত করা হবে। ভারতের যে-কোনও প্রান্তে পাঠাবে। এমনকী বিদেশেও যাবার সম্ভাবনা আছে। ট্রেনিং-এর সময়ও এরা ভালো টাকা দেবে।
বেহালার কাছে একটি বাগানওয়ালা বড় বাড়িতে এই কোম্পানির ট্রেনিং সেন্টার। একদিন বাক্স-বিছানা নিয়ে উপস্থিত হলাম সেখানে। মোট দু’ মাসের প্রশিক্ষণ, তার মধ্যে সতেরো দিনের বেশি কোনওক্রমেই আমার পক্ষে তা সহ্য করা সম্ভব হয়নি। ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠে পি টি অর্থাৎ সারিবদ্ধভাবে ব্যায়াম, তারপর ছুরি কাঁটা ধরে ব্রেক ফাস্ট, তারপর ক্লাস, মধ্যে একবার লাঞ্চ, আবার ক্লাস, আবার ক্লাস। সারাক্ষণ প্যান্ট-শার্টের সঙ্গে জুতো মোজা পরে থাকতে হবে, এবং গলায় টাই (আশু আমাকে একটাই ধার দিয়েছিল) এবং সর্বক্ষণ ইংরিজি বলতে হবে, এমনকী পাশের বন্ধুর সঙ্গে ফিসফিস করেও বাংলা কথা চলবে না, এমন নির্দেশ ছিল। এ সব তবু যদিও বা মান্য করা যায়, কিন্তু ক্লাসের পর ক্লাসে শুধু টাকাপয়সার কথা, লাইফ টার্ম আর এনডাউমেন্ট, অ্যাকসিডেন্ট বেনিফিট, যার বয়স পঁচিশ তার পনেরো হাজার টাকার কুড়ি বছরের এনডাউমেন্টে কত সুদ, অ্যাকচুয়ারিরা কী পদ্ধতিতে মানুষের আয়ুর গড় করে, এসব শুনতে শুনতে আমার মাথা খারাপ হবার জোগাড়। দু’সপ্তাহেই বুঝে গেলাম যে এ অফিসার হবার মতন প্রতিভা আমার নেই। বোধহয় ট্রেনিং-এর মধ্যপথে ছাড়া চলবে না, এরকম একটা শর্ত ছিল, আমি পেছনের বাথরুমের দরজা দিয়ে, বাক্স-বিছানা মাথায় নিয়ে বাগানের মধ্য দিয়ে দৌড়ে পালালাম এক শেষ রাতে, আশুকেও না জানিয়ে। বাড়িতে পৌঁছবার পর আমাকে দেখে নিশ্চয়ই সকলের মনে পড়েছিল পাগলা দাসুর কথা। আবার সে এসেছে ফিরিয়া!
হাবড়ায় বয়স্ক শিক্ষা প্রকল্পের চাকরি চলে যাওয়ার ব্যাপারে আমার কোনও ভূমিকা ছিল না, সে প্রকল্পটাই মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। বেহালার চাকরিটা রাখতে পারিনি নিজের দোষে। সবাই তো সব কিছু পারে না।
আমার জ্যাঠামশাই উদ্বাস্তু হয়ে এসে অনেক কষ্ট করার পর কোনওক্রমে একটি চাকরি জুটিয়েছিলেন মার্টিন অ্যান্ড বার্ন কোম্পানিতে। তিনি জানালেন, তাঁর এক সহকর্মী কিছু কিছু নতুন ছেলেকে চাকরিতে ঢোকাচ্ছে। সেই ব্যক্তিকে খুশি করতে পারলেই আমার চাকরি হয়ে যাবে। বাবা যেন আশার আলো দেখতে পেলেন। এক রবিবার সন্ধেবেলায় বাবা ও জ্যাঠার সঙ্গে সুবোধ বালকের মতন আমি বেলেঘাটায় গেলাম সেই ব্যক্তিটির বাড়িতে। মানুষের কতরকম পরিচয় থাকে, প্রেমিকার চোখে আমি উদীয়মান কবি, কফি হাউসের বন্ধুদের কাছে কড়া সম্পাদক, প্রেসের মালিকের কাছে চতুর প্রতারক আর এখন আমি ভিজে বেড়াল বেকার সেজে যাচ্ছি গুরুজনদের সঙ্গে।
অন্ধকার অন্ধকার সরু গলি, বেলেঘাটা তখন ঠিক শহরের অন্তর্গত ছিল না, শহরতলী, প্রকৃত শহরবাসীদের কাছে বেশ একটা ভয়ের জায়গা, দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময় বেলেঘাটায় অনেক বীভৎস খুনোখুনির কাহিনী শোনা গেছে। কেউ কেউ বলত, বাপের ব্যাটা বেলিয়াঘাটা। এখানকার বস্তিতে অনেক নামকরা গুণ্ডা পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ঘাপটি মেরে থাকে। আমরা যার কাছে গেলাম, সে খুনী বা গুণ্ডা নয়, তাদের চেয়েও অনেক নিষ্ঠুর ও নির্লজ্জ, কথা বলে ঠাণ্ডা গলায়। সিড়িঙ্গে চেহারা, খালি গা। জ্যাঠামশাই বিগলিতভাবে লোকটির নানারকম তোষামোদ করতে করতে, আমাদের পারিবারিক অবস্থার কথা জানিয়ে, তার হাত চেপে ধরে বললেন, অমুকবাবু, আপনাকে এর একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতেই হবে, আপনি দয়া করলে ঠিকই পারবেন। লোকটি জ্যাঠামশাইয়ের ওসব কথায় কানই দিল না, আমার আপাদমস্তক এমনভাবে চোখ বুলোতে লাগল, যেন হাটে গিয়ে গোরু-ছাগলের স্বাস্থ্য দেখছে। তারপর আমাকে সংক্ষিপ্ত দুটি প্রশ্ন করলেন। আমি রাজনীতি করি কি না, এবং আমি বার্নপুরে যেতে রাজি আছি কি না। আমি সজোরে মাথা নেড়ে প্রথমটিতে না এবং দ্বিতীয়টিতে হ্যাঁ জানালাম। লোকটি এবার বাবা-জ্যাঠার দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে হয়ে যাবে। সামনের মাসেই পয়লা তারিখে জয়েন করুক। মাইনে আপাতত সব মিলিয়ে দেড়শো৷
আমার বুকটা ধক করে উঠল, ঝলমলিয়ে উঠল বাবা-জ্যাঠার মুখ। কয়েক মুহূর্তের জন্য মাত্র, এর পরেই লোকটি জানাল যে আঠারো শো টাকা সেলামি দিতে হবে, টাকা জোগাড় করে আনলেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাওয়া যাবে।
এক সঙ্গে আঠারো শো টাকা মানে অনেক টাকা! আমাদের বাড়ি ভাড়া তখন পঁয়তাল্লিশ টাকা, ভালো ইলিশ মাছের সের তিন টাকা, সিনেমার টিকিট আট আনা, এক টাকায় যোলোটি রসগোল্লা ও একটি ফাউ। জ্যাঠামশাই হতাশভাবে বিড়বিড় করতে লাগলেন, এক বছরের মাইনে! লোকটি তখন খানিকটা দয়া দেখাবার ভঙ্গিতে বললেন, ঠিক আছে ন’শো টাকা নগদ দিয়ে যান, তারপর এক বছর প্রতি মাসে মাইনে পেলে আমাকে পঁচাত্তর টাকা দিয়ে যাবেন। কথার খেলাপ করবেন না তো?
জ্যাঠামশাই জিভ কেটে বললেন, ছি ছি, কী যে বলেন, আমরা ব্রাহ্মণ, আমরা না খেয়ে মরে গেলেও সত্য রক্ষা করি।
এর উত্তরে লোকটি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন যে, আজকাল অনেক বামুনের ছেলেও অফিসের পিওন কিংবা জুতোর দোকানের কর্মচারী হয়। কথার খেলাপ করলে কীভাবে ছ’মাসের মধ্যে চাকরি খেয়ে নিতে হয় তাও তিনি জানেন।
ন’শো টাকা জোগাড় করার জন্য বাবা এক মাসের সময় চাইলেন।
বাইরে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাবা ও জ্যাঠা কী ভাবে ন’শো টাকা জোগাড় করা যায়, কার কাছে ধার পাওয়া যেতে পারে, এই সব আলোচনা করতে লাগলেন নিচু গলায়। আমি কোনও দিন বাবার মুখের ওপর কথা বলার সাহস পাই না, কিন্তু এমনই গা জ্বলছিল যে বেশ উঁচু গলায় বলে উঠলাম, বাবা, এ চাকরি আমি করতে চাই না।
এই প্রথম বাবা আমার কথা সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিলেন। ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, ঠিকই বলেছিস, এরকম চশমখোরের কাছে চাকরি নেওয়া যায় না।
অত্যাশ্চর্য ব্যাপার এই যে, এর কিছুদিন পর, একই সঙ্গে ডাকযোগে আমি দুটি চাকরির নিয়োগপত্র পেয়ে গেলাম। কয়েক বছর ধরে যে প্রচুর পরীক্ষা ও ইন্টারভিউ দিয়েছি, তারই অপ্রত্যাশিত সুফল। দুটিই একই রকমের চাকরি, সমান মাইনে, একটি হায়ার সেকেন্ডারি বোর্ডে, অন্যটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য দফতরে। এর মধ্যে কোনটি নেওয়া যায় তা নিয়ে বাবা অনেকের সঙ্গে পরামর্শ করতে লাগলেন, আমাদের দমদমের দাদু, যিনি আত্মীয়গোষ্ঠীর প্রধান, তিনি পরামর্শ দিলেন, সরকারি চাকরিটিই নেওয়া উচিত, কারণ সরকারের চাকরি হচ্ছে লক্ষ্মী, একবার পেলে সারাজীবনের জন্য নিশ্চিন্ত, চাকরি যাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই আর ধাপে ধাপে কিছু উন্নতি হবেই।
মৌলালির মোড়ের কাছে কয়েকটি বিশাল আকারের গুদাম আছে, তার অফিসের নাম সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্স, সংক্ষেপে সি এম এস, এর কাজ ওষুধ কোম্পানিগুলির কাছ থেকে টেন্ডার ডেকে এক সঙ্গে অনেক ওষুধ কেনা, তারপর সেই ওষুধ রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে, অনাথ আশ্রমে, জেলখানায় নিয়মিত জোগান দেওয়া। সেই অফিসে আমি যোগ দিলাম কনিষ্ঠ কেরানি হিসেবে। যতই সাধারণ চাকরি হোক, তবু কারওকে ধরাধরি করে কিংবা ঘুষ দিয়ে পেতে হয়নি। এইটুকু শ্লাঘা অন্তত বোধ করা যায়। এবং সেই সরকারি চাকরিও আমি এক সময়ে ছেড়ে দিয়েছি স্বেচ্ছায়।
আঠাশ
পঞ্চাশের দশকে কলকাতায় শীত ঋতুর প্রধান আকর্ষণ ছিল ক্রিকেট খেলা ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর। কোনওটাই গরিব লোকদের জন্য নয়, অথচ গরিবেরও তো ঘোড়া রোগ হয়।
ফুটবল খেলা নিয়েও উত্তেজনা ছিল প্রচুর, কিন্তু ওই খেলা আমাকে কখনও তেমন আকৃষ্ট করেনি। ইস্কুলে পড়ার সময় ফুটবল টিমে কখনও কখনও দ্বাদশ ব্যক্তি হয়েছি, তা শুধু ছুটি পাবার জন্য। ময়দানে মহারথীদের ফুটবল খেলা দেখতে গেছি কয়েকবার মাত্র। ক্রিকেট আর ফুটবলের দর্শক একেবারে আলাদা, ফুটবল খেলা গরিব লোকরাও দেখতে যেতে পারে ছ’ আনার টিকেট কিনে এবং ইচ্ছেমতো গালাগাল করা যায়। এমনকী টিকিট না কিনেও ফুটবল খেলা দেখা যায়, মাঠের বাইরে উঁচু র্যামপার্টে দাঁড়িয়ে, কেউ কেউ পেরিস্কোপও বানিয়ে নিত ভাঙা আয়না দিয়ে।
আমি ফুটবল মাঠে গিয়ে স্বস্তি বোধ করিনি অশ্রাব্য-কুশ্রাব্য গালাগালির জন্য। শব্দ ব্যাপারে আমার এমন স্পর্শকাতরতা ছিল যে খারাপ ভাষা একেবারে সহ্য করতে পারতাম না। যদিও আমি কোনও শব্দেরই শ্লীলতা-অশ্লীলতা বিচার করি না, অপছন্দ করি অপপ্রয়োগ। অকারণ খিস্তি-খেউড় আমার গায়ে যেন বেঁধে। গল্প-উপন্যাসে, বাস্তবতার খাতিরে আমি কোনও-কোনও চরিত্রের সংলাপে এরকম কিছু শব্দ বসিয়েছি কখনও, কিন্তু নিজের মুখে শালা পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারি না। হয়তো এটা আমার দুর্বলতা।
ফুটবলের ভক্তরা সব মার্কামারা। আমার পূর্ব বাংলায় জন্ম, সুতরাং আমাকে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সমর্থক হতেই হবে। মুসলমান হলেই মহামেডান ক্লাবের পক্ষে, আর মোহনবাগানের সমর্থকরা সব ঘটি। মোহনবাগানের কাছে ইস্টবেঙ্গল তিন গোলে হেরেছে, রাস্তায় চেনাশুনো লোকেরা সেদিন আমাকে দেখেই বলেন, কীরে, দিলুম তো তোদের…হজম করতে পারবি তো…। অথচ আমি সেদিনের খেলার খবরই রাখি না। ইস্টবেঙ্গল হারলে আমার মন খারাপ হবেই, সবাই ধরে নেয়। পরবর্তীকালে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও দিব্যেন্দু পালিতের মধ্যে খেলা সম্পর্কে যেরকম আগ্রহ ও উত্তেজনা দেখেছি, আমার সেরকম ছিল না কোনওদিন। খেলা দেখতে যাই না, কিন্তু খেলা সম্পর্কিত লেখা পড়তে ভালো লাগে। সে নেশা ধরিয়ে দিয়েছে মতি নন্দী।
ফুটবলই আসল উত্তেজনার খেলা, সে তুলনায় পাঁচ দিনের ক্রিকেট টেস্ট প্রায় স্পন্দনহীন। ক্রিকেট মাঠের পরিবেশটাই ছিল আকর্ষণীয়, সেখানে সবাই সেজেগুজে যায়, সঙ্গে ওয়াটার বটল ও টিফিন ক্যারিয়ার, মেয়েরা নিয়ে যায় উলবোনার সরঞ্জাম ও সানগ্লাস, কেউ চেঁচিয়ে কথা বলে না, এক ঘণ্টা ধরে একটাও রান হচ্ছে না, কিন্তু মুস্তাক আলির লেট কাটের বাহার দেখে হাততালি দিতে হয়।
ক্রিকেট টিকিটের দাম বেশি, আমার সাধ্যের বাইরে। টিকিট দুর্লভও বটে, ক্ষমতাশালী ও উচ্চবিত্তদের মধ্যে বণ্টিত হয়ে যায় আগেই। ক্রিকেটের মাঠে কে যাচ্ছে আর কে যাচ্ছে না, তাতেই নির্ণয় হয় সামাজিক অবস্থানের তারতম্য। আমাদের মধ্যে বুঢ্ঢাই সবচেয়ে বিত্তশালী পরিবারের ছেলে, তার তো টিকিট থাকবেই, কিন্তু এমনই তার বন্ধুপ্রীতি, পাঁচদিনের মধ্যে দিন দু’-এক সে আমাকে জোর করে পাঠিয়ে দিত মাঠে। শুধু টিকিট নয়, সঙ্গে কেক-পেস্ট্রির বাক্স ও ওয়াটার বটলে জলের সঙ্গে জিনের ভেজাল। আমি লেটকাট, গ্লান্স ও কভারড্রাইভের মর্ম বুঝতাম না, অন্যদের দেখাদেখি হাততালি দিতাম। ডন ব্র্যাডম্যানকে স্বচক্ষে দেখিনি, তবে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে গারফিল্ড সোবার্সের সাবলীল খেলা। আমার মতে, তিনিই ক্রিকেট দুনিয়ায় সর্বশ্রেষ্ঠ। একবার প্লেনের গোলমালে তিনি পৌঁছলেন একেবারে খেলার দিন সকালে, এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ইডেন গার্ডেনে, সামান্যতম ক্লান্তির চিহ্ন নেই, হাসতে হাসতে পঁচাত্তর রান করলেন, উইকেট নিলেন পাঁচটা।
ক্রিকেট মাঠের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ সুন্দরী রমণীদের দেখা। সেজন্য চোখ অধিকাংশ সময় সামনের দিকে নয়, এদিক-ওদিক ঘোরে। একবার আমার অদূরবর্তী এক রমণী রোদ-চশমায় চোখ ঢেকেছিলেন সর্বক্ষণ, অকস্মাৎ সেটা খুললেন, তাতেই আমার হৃৎস্পন্দন অনেক দ্রুত হল, যেন কোনও নিষিদ্ধ সৌন্দর্য দৈবাৎ দেখে ফেললাম! যেন আগাগোড়া কালো বোরখায় ঢাকা কোনও ইরানি রমণীর গোলাপের পাপড়ির মতন ওষ্ঠাধর হঠাৎ দেখার রোমাঞ্চ। ঘটনাটির উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, এই রকমই ছিল আমাদের তৎকালীন সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয় সুখ।
সারা শীতকাল জুড়ে অনেকগুলি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের জলসা হত, তার অধিকাংশই উত্তর কলকাতায়। উত্তরেই বনেদি বড়লোকদের বাস, দক্ষিণে বসতি স্থাপন করছে নব্য ধনীরা। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাবু কালচারের কিছুটা রেশ পরের শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত রয়ে গিয়েছিল। সেইসব বনেদি বাবুদের আর যত দোষই থাক, তাঁদের অনেকে ছিলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষক। বাঙালিদের মধ্যে বড় খেলোয়াড় বিশেষ জন্মায় না। কিন্তু বাঙালিরা খেলাপাগল। সেরকমই, রবিশঙ্কর-আলি আকবরের আগে সর্বভারতীয় মার্গসঙ্গীতের জগতে বাঙালি শিল্পী তেমন ছিল না। কিন্তু সমঝদার হিসেবে বাঙালিদের সুনাম ছিল। অনেক পরে ওস্তাদ আমির খানের কাছে শুনেছি, তাঁদের আমলে কলকাতার শ্রোতাদের কাছে সমাদর না পেলে সর্বভারতীয় সুনাম অর্জন করা যেত না। যেজন্য তিনি প্রথম যৌবনে কারও আহ্বান ছাড়াই ইন্দোর থেকে চলে এসেছিলেন কলকাতায়, ধনী পরিবারের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন সুযোগ পাবার জন্য, রাত কাটিয়েছেন বাইজিপল্লীর এক দারোয়ানের খাটিয়ায় ফুটপাতে শুয়ে।
আমার সঙ্গীতরুচি একটু বিচিত্রই বলতে হবে। খুব ভালোবাসি পল্লীগীতি এবং উচ্চাঙ্গসঙ্গীত, মাঝখানের গানগুলি সম্পর্কে তেমন প্রাণের টান নেই। রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথা আলাদা, তা জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রধানত ভাষার মাধুর্যে। শ্যামপুকুরের মিত্র-বাড়িতে টিউশানি করতাম, সেই সূত্রে ওদের আত্মীয়, পাথুরেঘাটার বিখ্যাত ঘোষদের প্রাসাদে, ঘরোয়া আসরে ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলির গান সামনাসামনি বসে শুনেছি কয়েকবার। আমার যদি কোনও উপাস্য দেবতা থাকত, তা হলে বড়ে গুলাম আলিকে সেই আসনে বসাতাম।
উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের জলসার টিকিটের দামও বড় বেশি। আমরা রঙ্গালয়ের সামনের রাস্তায় খবরের কাগজ পেতে, গায়ে কম্বল জড়িয়ে সারারাত জেগে গান শুনতাম দল বেঁধে, একজন কেউ ঘুমিয়ে পড়লে অন্যরা তার কানে কু দিত। সেই সময় জনতার দাবিতে বাইরে মাইক দেওয়া হত, অর্থাৎ রঙ্গালয়ের মধ্যে যদি শ্রোতার সংখ্যা হয় হাজারখানেক, বাইরের শ্রোতা হাজার হাজার।
বাইরে বসে কিছুটা শীতের কষ্ট হলেও গান-বাজনা শোনার কোনও অসুবিধে নেই, শুধু বিস্বাদ লাগত নাচের সময়। নাচ তো দেখার জিনিস, শোনার নয়। ভেতরে লাস্যময়ী রোশনকুমারীর দুর্দান্ত নাচের সঙ্গে তবলায় লড়ে যাচ্ছেন শামতাপ্রসাদ, বাইরে বসে শুধু রুমু ঝুমু আর চটাং পটাং শব্দ শুনে তার কতটুকু উপভোগ করা যায়?
টিকিট কেনার ক্ষমতা ছিল বুঢ্ঢার, প্রত্যেক জলসায়ই একখানা টিকিট থাকত তার, কিন্তু গান শুনত আমাদের সঙ্গে ফুটপাতে বসে। তার টিকিটে আমরা পালা করে এক একজন ভেতরে গিয়ে দেখে আসতাম শিল্পীদের সশরীরে। বড়ে গুলাম আলির মুখের এক দিকে একটা আলুর মতন বড় আঁব ছিল, এক বছর দেখলাম, সেটা অপারেশন করিয়ে গোল মুখ নিয়ে এসেছেন। হীরাবাঈ বরোদের প্রত্যেক বছর বেহাগ গাইবেনই। এবং সে গানের সময় তাঁর আগাগোড়া চোখ বোজা থাকে। বাইরে বসে তো আর এসব বোঝা যায় না।
কিন্তু নাচের সময় কে ভেতরে যাবে? বুঢ্ঢার এমনই বন্ধুপ্রীতি, সে সুযোগও সে একা নিতে চায় না। ঠিক হল, লটারি হবে, সেই অনুযায়ী এক একজন পনেরো মিনিট করে ভেতরে ঘুরে আসবে। প্রথম সুযোগ পেল দীপক, মধ্যরাত্রে সেই যে সে টিকিট নিয়ে ঢুকল, বেরোল ভোরবেলা। দীপককে তো কিছু বলবারও উপায় নেই। যতই তাকে বকাঝকা করো, সে শুধু প্রবল হাসতে-হাসতে দুদিকে মাথা দোলাবে।
আমাদের মধ্যে সত্যিকারের গানের গলা ছিল দু’জনের, দীপক ও বুঢ্ঢার। বুঢ্ঢার কণ্ঠস্বর ফৈয়াজ খাঁর ধরনের, সুমিষ্ট নয়, উদাত্ত, যাকে বলে দানাদার। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে তালিম নিয়ে সে রাগ-রাগিণী গুলে খেয়েছিল, অনেক রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক লাইন শুনেই বলে দিত কোন রাগের ওপর ভিত্তি করা। এই গানের জগৎ ছেড়ে সে একসময় চলে গেল আফ্রিকায়। দীপক প্রথাগতভাবে গান শেখেনি, কিন্তু সে ছিল স্বভাবগায়ক। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তার দক্ষতা ছিল না, কিন্তু অন্য বহু ধরনের গান সে একবার-দু’বার শুনেই ধারণ করে নিত কণ্ঠে। প্রচুর রবীন্দ্রসঙ্গীত তো সে জানতই, তা ছাড়াও আই পি টি এ-র অনেক গান, সঙের গান, যাত্রার গান, এসব তার কাছে বারবার শুনে শুনে আমারও মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল, আমাদের ‘হরবোলা’র সঙ্গীতশিক্ষক জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র বলতেন, দীপক ভবিষ্যতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে জনপ্রিয় হবে। এবং সেটাই হতে পারে তার জীবিকা। দীপক আমেরিকায় গিয়ে তার জীবনটাকেই ঘুরিয়ে দিল অন্য দিকে।
আমি সরকারি অফিসে কাজ পাওয়ার পর প্রথম প্রথম কিছুদিন ঠিক দশটার সময় হাজিরা দিই ও সারাদিন ভক্তিভরে ফাইলপত্রে চোখ ডুবিয়ে রাখি। কয়েক মাসের মধ্যেই হয়ে উঠলাম সহকর্মীদের কাছে উপহাসের পাত্র। একটা লম্বা হলঘরে প্রায় শ’খানেক কেরানির বসবার জায়গা, বেলা এগারোটা পর্যন্ত শতকরা ষাট-পঁয়ষট্টিটি চেয়ারই শূন্য থাকে এবং বিকেল চারটের পর দশ-বারোটির বেশি মুণ্ড দেখা যায় না। একজন সুপারিনটেন্ডেন্ট বসেন সেই কেরানিদের সঙ্গেই, সামনের দিকে ছোট ছোট কয়েকটি খোপে অফিসারদের স্থান। অফিসটি মৌলালির মোড়ে, রাইটার্স বিল্ডিংসে আমাদের সদর দফতর, সেখানে যাবার সুযোগ বা সৌভাগ্য আমার হয়নি কখনও। পাশের সহকর্মীটি একদিন আমাকে বললেন, সারাক্ষণ চেয়ারে বসে থাকেন, আপনার যে পায়ে বাত ধরে যাবে ভাই! এত কী কাজ করেন বলুন তো? কথাটা সত্যি, আমার ওপর যে কাজের বরাদ্দ, তা শেষ করতে বড়জোর মাত্র দু’ঘণ্টা লাগে। সরকারি কর্মচারীরা কাজে ফাঁকি দেয় বলে যে বদনাম আছে, তার মূল কারণ আমি বুঝে গেলাম কয়েক মাসের মধ্যে। এঁরা কাজে ফাঁকি দেন না, এঁদের কাজই কম, সাত ঘণ্টা পরিশ্রমের উপযুক্ত কাজই নেই, তাই অধিকাংশ সময় এঁরা নিজের চেয়ার ছেড়ে অন্যত্র ঘোরাঘুরি করেন। কাজ কম থাকলেই কাজে আলস্য আসে বেশি, এক সপ্তাহের কাজ ইচ্ছে করলে একদিনেই শেষ করে ফেলা যায় বলে, কেউ কেউ চার-পাঁচদিন ফাইলে হাতই ছোঁয়ান না। মাত্র পাঁচ-সাতজন বিকেল পাঁচটার পরেও বাড়ি যেতে চান না, তাঁদের আকর্ষণ অন্য। তাও বুঝেছি অনেক পরে।
একজন সহকর্মীর কথা বিশেষভাবে মনে আছে। ছিপছিপে চেহারা, মাথার চুল কাঁচা-পাকা, মুখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ছাপ, কিন্তু হাসি মাখা। প্রথম প্রথম তাঁর নামটাই বুঝতে পারতাম না, অন্যরা তাঁকে রণকালী সাহেব বলে ডাকতেন। রণকালী কী করে পুরুষের নাম হয়, আবার তার সঙ্গে সাহেব? যথাসময়ে জানা গেল, তাঁর প্রকৃত নাম রওনক আলি, বেলা এগারোটা আন্দাজ অফিসে এসে চেয়ারে কোটটা ঝুলিয়ে একটু পরেই বেরিয়ে যান, ফেরেন বিকেল চারটের দিকে। অন্য সহকর্মীদের কাছে জানা গেল, ইনি-দুপুরে চার ঘণ্টা বড়বাজারের একটি দোকানে পার্ট টাইম অ্যাকাউনট্যান্টের কাজ করেন। একদিন’রওনক আলি আমাকে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, আমি তো মাইনরিটি কমিউনিটি, তাই আমাকে কেউ ঘাঁটাতে সাহস করে না। মানুষটি ভারী রসিক। কোটের পকেটে পানের ডিবে থাকে, তার থেকে অন্যদের অকাতরে পানের খিলি বিতরণ করেন এবং কক্ষনও একা চা পান করেন না। চা-ওয়ালা ছোকরা এলেই তিনি আশেপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, আর কে কে চা খাবেন? অফিসারদের সম্পর্কে তাঁর ছিল দারুণ তাচ্ছিল্যবোধ, একদিন আমায় বলেছিলেন, অফিসাররা কোন শ্রেণীর মানুষ বলুন তো? রাইটার্স বিল্ডিংসে যান, দেখবেন, পাশাপাশি তিনখানা করে বাথরুম থাকে, তাতে লেখা, মেল, ফিমেল আর অফিসার্স! এটা সত্যি কি না, আমি কখনও মিলিয়ে দেখিনি।
বন্ধুরা মাঝে মাঝে দেখা করতে আসে। শক্তি কোনও আত্মীয়ের সুবাদে এক সাহেবি নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষানবিশ অফিসার হয়েছে, বাড়ি থেকে প্যান্ট-কোট ও টাই পরে বেরোয়। কিন্তু স্যুট-পরা, ইংরিজি বলা অফিসার হওয়া শক্তির নিয়তিতে নেই, সে কর্মক্ষেত্রে না গিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়, খুব গরমের দুপুরে আমার টেবিলের সামনে বসে থাকে, নানারকম চক্ষুর ইঙ্গিতে আমাকে বেরিয়ে পড়বার জন্য প্ররোচিত করে। তখনও অফিস ফাঁকি দেবার মতন সাহস সঞ্চার করে উঠতে পারিনি, তাই ওকে পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলি। একদিন শক্তি অতি দ্রুত পকেট থেকে একটি ছোট্ট বোতল বার করে আমার জলের গেলাসে কিছু মিশিয়ে দিল। আমি আঁতকে উঠলাম, চতুর্দিকে এত সহকর্মীর চোখ, তার মধ্যে অফিসে বসে প্রকাশ্যে মদ্যপান? শক্তি থাকে মামার বাড়িতে, আমার পারিবারিক অবস্থা অনেক খারাপ, এ চাকরি আমাকে রক্ষা করতেই হবে! এরপর শক্তি এলেই তাকে নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়ি, দেড়-দু’ঘণ্টা বাইরে থাকা তবু কম অপরাধ।
প্রণবেন্দু দাশগুপ্তও আসে মাঝে মাঝে, সে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের ভালো ছাত্র, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর স্নেহাশিত, গম্ভীরভাবে কথাবার্তার মধ্যে অনেক আভিধানিক শব্দ মিশিয়ে দেয় এবং চা খেতে খেতে প্রায়ই আমাকে প্রশ্ন করে। কবিতা বিষয়ে নতুন কী ভাবছেন? এর উত্তর আমি খুঁজে পাই না। কারণ আমি তো কবিতা বিষয়ে কিছুই ভাবি না, কবিতা লিখি, যা মনে আসে, পাগলের মতন, রাত-জাগা মস্তিষ্কে, কবিতার তত্ত্ব নিয়ে মাথা ঘামাইনি, সেইজন্যই বোধহয় প্রতিটি কবিতা লিখে ফেলার পরই মনে হত, ঠিক হল না, আবার কাটাকুটি, আবার লেখা, যেন সবটাই অর্থহীন প্রয়াস। ছাপার আগে নিজের লেখা বন্ধুদের শোনাবার ব্যাপারেও আমার সঙ্কোচ ছিল খুবই৷
একদিন দীপক এসে বলল, বসব না, সময় নেই, শোনো, আজ সন্ধেবেলা কোনও কাজ রেখো না, টিউশানি থাকলেও যেও না, সাতটার মধ্যে চলে আসবে আমার বাড়িতে। আমি আজ বিয়ে করছি।
তখন লক্ষ করলাম, দীপকের এক হাতের কব্জিতে একটা হলুদ সুতো বাঁধা।
এর থেকেও বেশি চমক আমার জন্য অপেক্ষা করছিল বিবাহ বাসরে।
স্কটিশ চার্চ কলেজ-আমল থেকেই দীপকের এক বান্ধবী ছিল, তার সঙ্গে প্রকাশ্যে ঘোরাঘুরি করত, যে সৌভাগ্য আমাদের অনেকেরই ছিল না। সে মেয়েটি বড়ই নরম ও মধুর স্বভাবের, এমনই একনিষ্ঠ তার প্রেম যে অন্যদের দিকে ভালো করে তাকাতই না, সে অনেক সময় দীপকের হাতখরচ জোগাত, নিয়মিত বই কিনে উপহার দিত দীপককে।
সন্ধেবেলা গিয়ে দেখি, পাত্রী বদল হয়ে গেছে! শুধু তাই নয়, বধূবেশিনী এই মেয়েটিকে দেখেও যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করা যায় না। এই মেয়েটিকে আবার আমাদের আর এক যাদবপুরের কবি-বন্ধুর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বলেই জেনে এসেছি এতদিন। সেই বন্ধুটির সঙ্গে এই মেয়েটির বিয়ে হবে, এটা ছিল যেন অবধারিত ব্যাপার, কয়েকদিন আগেও ওদের দু’জনকে দেখেছি একসঙ্গে। হঠাৎ দীপক কী করে সব ওলটপালট করে দিল এবং এত তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করতেই বা চাইছে কেন, তা জানতে পারিনি। কিন্তু দীপকের এই কাণ্ডটি সংশ্লিষ্ট চারজন নারী-পুরুষের জীবনেই সুখকর হয়নি। পরবর্তী কয়েক বছরের হতাশা, যন্ত্রণা ও তিক্ততার ইতিহাস আমি লিখতে চাই না।
বিবাহবাসরের আয়োজনটি ছিল অনাড়ম্বর ও সংক্ষিপ্ত। কুড়ি-পঁচিশজন বন্ধু ও নিকট আত্মীয়, পুরুতের বদলে একজন ম্যারেজ রেজিস্ট্রার এবং মন্ত্রের বদলে রবীন্দ্রসঙ্গীত। নববধূ ও বরের দুটি গান মনে দাগ কেটে আছে, কারণ তা যেন এই অনুষ্ঠানের ঠিক উপযোগী ছিল না। নববধূটি খুবই ভালো গায়িকা, সে গাইল, ‘এরে ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে’—শেষের দিকে তার চোখের কোণে চিকচিক করছিল অশ্রুবিন্দু। আর দীপক গাইল তার প্রিয় ‘তাসের দেশ’-এর গান, যাবোই আমি বাণিজ্যেতে যাবোই।
কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানে আবদ্ধ না থেকে বুঢ্ঢা কাজ নিয়েছিল এয়ার ফ্রান্স নামে বিমান সংস্থায়। অসাধারণ গুণী ও বাকপটু হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার ব্যাপারে বুঢ্ঢা অস্বাভাবিক রকমের লাজুক, দীপকের ঠিক বিপরীত, একথা আগেই উল্লেখ করেছি। অফিসে এক সহকর্মিণীর সঙ্গে পরিচয় হবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বুঢ্ঢা আমাকে জানাল যে মেয়েটিকে সে বিয়ে করবে বলে কথা দিয়ে ফেলেছে।
বিবাহ দু’জন মানুষের নিজস্ব ব্যাপার এবং বুঢ্ঢা যখন কথা দিয়ে ফেলেছে, তখন অন্যদের মতামত জানাবার প্রশ্নই ওঠে না। মেয়েটি বাঙালি ক্রিশ্চিয়ান, কিন্তু তাদের পরিবারের ধরন-ধারণ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মতন, তাঁরা কেউ বাংলায় কথা বলেন না। দিলীপকুমার গুপ্ত এবং গুহঠাকুরতাদের যৌথ পরিবারটি তখন বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান, সেই পরিবারের সবচেয়ে উজ্জ্বল সন্তানের স্ত্রী হয়ে যিনি এলেন, তাঁর সঙ্গে বাংলা সংস্কৃতির কোনও সংযোগ নেই, কিছু জানতেও চান না।
বিবাহের প্রথম অনুষ্ঠানটি হল ক্যাথলিক মতে, রাইটার্স বিল্ডিংসের পাশের চার্চটিতে। এরকম অনুষ্ঠান দেখার অভিজ্ঞতা আমার প্রথম, ভাবগম্ভীর পরিবেশে যন্ত্রসঙ্গীত ও বাইবেল-উচ্চারণ, বরযাত্রীদেরও মাঝে মাঝে নিলডাউন হতে হয়। তারপর গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে রিসেপশান, তখন হোটেলটি বেশ সুখ্যাত ও জমকালো ছিল, বিশাল হলে অগণিত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই হাতে হাতে লাল রঙের সুরা, বর-বধূর প্রকাশ্য চুম্বন ও পরবর্তী নাচ, আমার মতন ভেতো বাঙালিরা এসব সাতজন্মেও দেখেনি।
আমাদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করে বুঢ্ঢাও যাতে ভেতো বাঙালি না হয়ে যায়, সে বিষয়ে তার স্ত্রী সতর্ক ছিল প্রথম থেকেই। ক্রমশ আমাদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। কিছুদিন পরেই বুঢ্ঢা চাকরি বদল করে চলে যায় মুম্বই, সেখান থেকে আফ্রিকা। কলকাতার সাহিত্য-শিল্পের জগৎ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পুরোপুরি। একসময় ডি কে অসুস্থ হয়ে পড়লে সিগনেট প্রেসও দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে, বাংলা প্রকাশনাগোষ্ঠীর শীর্ষস্থান থেকে নেমে যায় নীচে। বুঢ্ঢার মতন একজন হৃদয়বান ও প্রতিভাবান বন্ধুকে হারাবার কষ্ট আমি সারাজীবনেও ভুলতে পারিনি।
অপর্ণা নাম্নী মেয়েটির সঙ্গে আমার গোপন প্রণয় কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তীর্ণ হয়েছিল অনেকখানি। একসময় বিয়েটিয়ে করার প্রশ্ন আসবেই। আমি টানা পাঁচ বছর বেকার ছিলাম, তারপর যে চাকরি পেয়েছি তাও সামান্য ধরনের, এর মধ্যে সংসারী হওয়া খুবই অবাস্তব ব্যাপার। সে রকম কোনও ইচ্ছেও আমার জাগেনি, কিন্তু মেয়েটির প্রতি চাপ আসছিল নানারকম। সে সুশ্রী তো বটেই, তা ছাড়া স্নাতকোত্তর পড়াশুনো করছে, তার পাণিপ্রার্থীরা আশেপাশে ঘুর ঘুর করে। অনেক সুযোগ্য পাত্র ও ধনীপুত্রদের অগ্রাহ্য করেও সে আমার মতন একজন দীনহীনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে আমাকে বিশেষ মান দিয়েছিল। কিন্তু তাদের। পরিবারে বিশৃঙ্খলা ছিল নানারকম। সে পরিবেশ থেকে সে বেরিয়ে আসতে চাইছিল পড়াশুনো শেষ করার জন্য। একটি যুবক তাকে বিয়ে করার শর্তে সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। একদিন খুবই বিপন্ন অবস্থায় অপর্ণা আমাকে জানাল যে, আমি ডাক দিলে সে যে-কোনওদিন এক বস্ত্রে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আমার সঙ্গে থাকতে রাজি আছে। অথবা আমি কি তাকে অনুমতি দেব অন্য একজনকে বিয়ে করার জন্য?
আমি সেই ডাক দিতে পারিনি। অনুমতির ব্যাপারটাও অবান্তর মনে হয়েছিল। ভালোবাসা কি বন্ধন? তার ওপর আমার কি কোনও অধিকারবোধ ছিল? তাকে জীবনসঙ্গিনী করার মতন যোগ্যতাই ছিল না আমার। আমার রুগ্ণ বাবা, মা, ছোট ছোট ভাইবোনের সংসারে তাকে টেনে আনা হত নিষ্ঠুরতা, আর ওঁদের ছেড়ে অপর্ণাকে নিয়ে আলাদা বাসা বাঁধার চিন্তাও করতে পারি না। অপর্ণাও যে অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছে, তার পক্ষে আর অপেক্ষা করাও সম্ভব নয়, তাও আমি বুঝি।
গঙ্গার ধারে সান্ধ্য নিরালায় আমার হাত চেপে ধরে অপর্ণা বলেছিল যে, তার বিবাহে নিশ্চিত আমার নিমন্ত্রণ হবে, আমি যেন সেদিন না যাই, কিছুতেই যাব না, কথা দিতে হবে।
তার সঙ্গে আর সারাজীবনেও দেখা হবে না, এ কথাও দিয়েছিলাম।
তখনও পর্যন্ত আমাদের দেশে ব্যর্থ প্রেমিকদের আদর্শ ছিল শরৎচন্দ্রের দেবদাস। পানশালায় কেউ কমলদার সামনে ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী শোনাবার চেষ্টা করলেই তিনি বলতেন, এবার তোমার লিভারটি দেবদাস হয়ে যাবে। আমার জীবনের এই পর্বটি আমি বন্ধুবান্ধবের কাছে সযত্নে গোপন রেখেছিলাম, সুতরাং আমাকে কেউ ব্যর্থ প্রেমিক বলে সন্দেহও করেনি। কিন্তু গোপনীয়তার একটা বোঝা আছে। সে গোপনীয়তা সিন্ধবাদের কাঁধের বৃদ্ধের মতন ক্রমশ ভারী হয়ে চেপে বসে। তখন নিজেকে প্রকাশ করতেই হয়। প্রকাশ করার একমাত্র উপায় কবিতায়।
একদিন বিকেলে কলেজ স্ট্রিটে এক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গেলাম। দিকভ্রান্তের মতন ছুটোছুটি করছে মানুষজন, পুলিশের গাড়ি ও টিয়ার গ্যাস, চিৎকার ও ধাক্কাধাক্কি, গণ্ডগোলের উপলক্ষটা কী তা জানি না, তবু এসব গা-সহা ব্যাপার, টুক করে পাশ কাটিয়ে কোনওক্রমে কফি-হাউসে ঢুকে পড়তে পারলেই হল, সেখানে বন্ধুরা কেউ-না-কেউ থাকবেই। কিন্তু এগুনো যাচ্ছে না, পলায়মানদের স্রোত বিপরীত দিকে, হঠাৎ দেখি প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে বন্দুক উঁচোনো পুলিশ, তাদের নির্দেশে কাছাকাছি লোকজন মাথার ওপর হাত তুলে হাঁটছে। আমাকেও হাত তুলতে হল, এদিক-ওদিক চেয়ে দেখি, সবাই যেন চৈতন্যদেবের শিষ্য। আমার মধ্যে অসহ্য রাগ পুঞ্জীভূত হতে লাগল, কেন আমাকে হাত তুলতে হবে, কেন আমাকে কফি হাউসের দিকে যেতে দেওয়া হবে না? কেন আমাকে মিশে যেতে হবে স্রোতের সঙ্গে? আমি থমকে দাঁড়াতেই অন্যরা ঠেলাঠেলি করতে লাগল, তবু আমার হুঁস নেই। যেন আমি এই দুনিয়ায় চরমতম একা, আমার কোনও বন্ধু নেই, পরিজন নেই, এই কলেজ স্ট্রিট থেকেও সবাই অদৃশ্য হয়ে গেছে, পুলিশরাও উধাও, একটাও বাতি জ্বলেনি, দোকানপাট বন্ধ, অন্ধকারে নিথর হয়ে পড়ে আছে রাস্তা। আমি ও রাস্তা, রাস্তা ও আমি, আমি দুলছি, রাস্তাটাও দুলছে।
কয়েক মুহূর্তের এই ঘোর, তারপর রুমাল দিয়ে নাকের রক্ত মুছতে মুছতে মনে হল, অপর্ণার সঙ্গে আর কোনওদিন দেখা হবে না। সেই বিচ্ছেদের শূন্যতা যে এতখানি, আগে টের পাইনি তো!
উনত্রিশ
কৃত্তিবাস পত্রিকার তরুণ কবি গোষ্ঠীর ডাক পড়ে ছোটখাটো নানান কবি সম্মেলনে। তাদের যে খুব কবিত্বের খ্যাতি ছড়িয়েছে তা নয়, তবে নানান রকম গল্প ছড়িয়েছে, এবং আর একটা সুবিধে, একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই এক ঝাঁককে পাওয়া যায়। এখন যেমন মফস্বলের ছোট ছোট শহরেও যখন-তখন কবি সম্মেলন হয়, পঞ্চাশের দশকের আগে এর তেমন রেওয়াজ ছিল না। তার আগে, কবিদের বদলে বেশি খাতির ছিল কথা সাহিত্যিকদের, তাঁরা মুগার পাঞ্জাবি পরে, গলায় চাদর দিয়ে বিভিন্ন সভার সভাপতি ও প্রধান অতিথি হতেন। উদ্যোক্তাদের শ্রদ্ধা ও অবহেলা দুই-ই তাঁদের সহ্য করতে হত। নিয়ে যাওয়ার সময় এক রকম, ফেরার সময় আর এক রকম। এ নিয়ে অনেক মজার ঘটনা সেকালের লেখকরা অনেকেই লিখেছেন। শুনেছি, দুই বিভূতিভূষণই ফেরার ট্রেন ভাড়া অগ্রিম হাতে না-নিয়ে কোথাও যাবার জন্য সম্মতি দিতেন না।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও অকালমৃত সুকান্ত ছাড়া অন্য সব কবিই একটি ছোট বৃত্তের বাইরে অজ্ঞাত ছিলেন। সেইজন্যই সবান্ধব অরুণকুমার সরকার কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে ‘আরও কবিতা পড়ুন’ আন্দোলন শুরু করেন।
সম্ভবত সিগনেট প্রেসের দিলীপকুমার গুপ্তর উদ্যোগে সিনেট হলে যে-বিরাট আকারের কবি সম্মেলন হয় এবং তা বহুল প্রচারিত হয় বলেই তারপর থেকে পাড়ায় পাড়ায় কবিতা পাঠের আসর বসাতে ক্লাবগুলি উৎসাহ পায়। মফস্বলেও কিছু একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বাসনা হলে কবি সম্মেলনই সবচেয়ে সুবিধেজনক। গান-বাজনার আসরে একজন তবলচিকেও কিছু পয়সা দিতে হয়, কবিদের ক্ষেত্রে সে-বালাই নেই, এমনকী বাস ভাড়া-ট্রেন ভাড়াও না দিলে চলে, গোটা দুয়েক ঠাণ্ডা নিমকি-সিঙ্গাড়া ও ভাঁড়ের চা-ই আপ্যায়নের পক্ষে যথেষ্ট। কবিদের মতন হ্যাংলা প্রাণী আর হয় না, তারা ডাকলেই যায়।
মফস্বলের কবি সম্মেলনের জন্য অন্তত পনেরো জন কলকাতার কবি চাই, তার সঙ্গে স্থানীয় কবিযশোপ্রার্থীরা তো আছেই। আমন্ত্রিতদের মধ্যে একজন-দু’জন বয়স্ক, আর বাকিদের কেউ নাম জানুক বা না-জানুক, কলকাতার ছাপ থাকাই যথেষ্ট। এক সঙ্গে আট দশজনকে পাওয়া যায় বলে কৃত্তিবাসের দলের বেশ চাহিদা ছিল।
আমরা যে-কোনও জায়গা থেকে ডাকলেই সাড়া দিতাম, একসঙ্গে যাওয়া, অনবরত আড্ডা ও হুল্লোড়ের আকর্ষণে। সবচেয়ে আগ্রহ ছিল শক্তির, যে কোনও ছুতোয় কলকাতার বাইরে যাবার জন্য সে ছটফট করত। একা নয়, সঙ্গে বন্ধুদেরও চাই। আমরা কেউ কেউ কখনও অন্য কাজে ব্যাপৃত থাকলেও শক্তি জোর করে টেনে নিয়ে যাবেই। এবং যেসব মফস্বলের উদ্যোক্তারা কম খরচে সংস্কৃতির হোতা হিসেবে তৃপ্তি বোধ করতেন, তাঁদের নাস্তানাবুদ করে ছাড়ত শক্তি। কবিতা পাঠ শেষ হতে-না-হতেই সে ঘোঘাষণা করত, আমরা কয়েকজন এখানে রাত্তিরে থাকব! নৈহাটি কিংবা চন্দননগর থেকে রাত্রে ফিরে আসার কোনও অসুবিধে নেই, তবু শক্তি ফিরবে না। উদ্যোক্তারা এ জন্য প্রস্তুত নয়, কিন্তু সদ্য চেনা কারওকে কয়েক মিনিটে বংশবদ করে ফেলার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল শক্তির, আমি যেমন লোকের কাছে মুখ ফুটে কিছু চাইতে পারি না, শক্তি ঠিক তার বিপরীত, চারিদিকে আদেশ ছড়াতে তার কোনও দ্বিধা নেই। ওদের মধ্যে সবচেয়ে নধর চেহারার ব্যক্তিটির কাঁধে চাপড় মেরে বলত, আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করো, রাত্তিরে খাব, মাংস রাঁধবে, আর আনুষঙ্গিক আনাও! তারপর সারা রাত্রিবাণী তাণ্ডবে সবাই তটস্থ। কেউ কেউ মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাকিয়ে থাকত তার দিকে, শক্তিকে গুরু মেনে দীক্ষা নিত, জীবনে প্রথম স্পর্শ করত কারণ বারি। এক সময় সারা বাংলা, এপার বাংলা-ওপার বাংলা, শক্তি অনুকারী ক্ষুদে-শক্তিতে ভরে গিয়েছিল, যাদের আচার-আচরণ শক্তির মতন কিন্তু লেখার বেলায় ঢুঁ ঢুঁ। শক্তির বাউণ্ডুলেপনা অনেকেই দেখেছে, সে যে লেখার জন্য কত পরিশ্রম করেছে, তা অনেকেই জানে না। শক্তির প্রস্তুতিপর্ব সুদীর্ঘ। পরিণত বয়েসে শক্তি পরিশ্রম বিমুখ হয়ে পড়ে, সম্ভবত শারীরিক কারণে।
শুধু কবি-সম্মেলন উপলক্ষেই নয়, এমনিতেও প্রতি মাসে একবার দু’বার আমরা বেরিয়ে পড়তাম কোনও অদেখা জায়গার উদ্দেশে। ছাত্রজীবন শেষ করার পর বন্ধুরা অনেকেই ছড়িয়ে পড়েছে নানা জায়গায়। তারা কে কোথায় চাকরি পেয়েছে জেনেই আমরা হঠাৎ কিছু না-জানিয়ে হাজির হতাম সেখানে। দীপক দূরে সরে যাবার পর শক্তি আর আমি ভ্রমণসঙ্গী। আমরা দু’জনেই যখন বেকার ছিলাম, তখন চাকরিপ্রাপ্ত বন্ধুদের কাছে গিয়ে হামলা করার অধিকার বোধ ছিল আমাদের। এইভাবে পশ্চিম বাংলার এমন কোনও জেলা, মহকুমা, ছোট শহরও নেই, যা আমরা দেখিনি। সারা বাংলা আমাদের হাতের তালুর মতন চেনা। এমনকী ভারতের কোনও রাজ্যই আমরা অদেখা রাখিনি।
শ্রীরামপুর শহরের একটি কবি সম্মেলনে বেশ মজার ব্যাপার ঘটেছিল। তখন সবেমাত্র আমার কবিতা ছাপা শুরু হয়েছে, শক্তি তখনও কবিতার জগতে আসেনি।
সেখানে সভাপতিত্ব করার কথা ছিল প্রেমেন্দ্র মিত্রের। তিনি কল্লোল যুগের ডাকসাইটে কবি ছিলেন, ক্রমশ কবিতার জগৎ থেকে সরে যান, বা তখনও লেখেন, কিন্তু তাঁর কবিতার ভাষা পিছিয়ে পড়েছে। তিনি ছোট গল্পের লেখক হিসেবেই বেশি বিখ্যাত এবং ছোটদের জন্যও চমৎকার লেখেন। তারপর সিনেমা পরিচালনায় মেতে ওঠেন। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ও প্রেমেন্দ্র মিত্র, এই দু’জন লেখক চলচ্চিত্র-পরিচালক হিসেবে বেশি ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। সেই সময় প্রেমেন্দ্র মিত্র অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো-র একজন সহকার না কী যেন, অর্থাৎ উপদেষ্টা।
সভাপতির জন্য সবাই অপেক্ষা করছে, তিনি আসছেন না, আসছেন না, এক সময় তাঁর আশা ছেড়ে দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। প্রেমেন্দ্র মিত্রের আকর্ষণেই সম্ভবত শ্রীরামপুর লাইব্রেরি হলে জনসমাগম হয়েছিল প্রচুর, বাইরে প্রবল বৃষ্টি, ঘণ্টা দেড়েক পরে আমার নাম ঘোষিত হল। আমি দু’ চার লাইন পাঠ করেছি মাত্র, হঠাৎ বাইরে শোনা গেল গোলমাল, কিছু লোক সেদিকে ছুটে গেল, প্রেমেন্দ্র মিত্র শেষ পর্যন্ত এসেছেন, কলকাতা থেকে সোজা ট্যাক্সিতে। তাঁকে সমাদর করার জন্য উদ্যোক্তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ল, আনা হল মঞ্চে, তারপরেও চলতে লাগল কথাবার্তা। আমি মাইক্রোফোনের কাছে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি চুপ করে। এ রকম অবস্থায় যে-কোনও তরুণ কবির সর্বাঙ্গে রাগের জ্বালা শুরু হবেই, যদিও প্রেমেন্দ্র মিত্রের কোনও দোষ নেই, কোনও অনিবার্য কারণে তিনি মাঝপথে আটকে পড়তেই পারেন। উদ্যোক্তাদের আদিখ্যেতা চলছেই দেখে আমি দূর ছাই বলে মাইক ছেড়ে সরে এলাম। কোলাহল খানিকটা প্রশমিত হবার পর অনুষ্ঠান আবার শুরু হলে নাম ডাকা হল পরবর্তী কবির। কিন্তু প্রেমেন্দ্র মিত্র আমার মধ্যপথে থেমে যাওয়া লক্ষ করেছিলেন, যদিও তাঁর সঙ্গে আমার কখনও পরিচয় হয়নি, তিনি আমার মুখ চেনেন না, নামও না জানারই কথা। পরের কবি মঞ্চে ওঠার আগে প্রেমেন্দ্র মিত্র আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে ডাকলেন। আমি দূর থেকে হাত নেড়ে জানালাম, আমি আর পড়তে চাই না। অত জোর বৃষ্টি না পড়লে ততক্ষণে আমি হল ছেড়েই চলে যেতাম। অত বিখ্যাত ও ব্যস্ত মানুষ হওয়া সত্ত্বেও প্রেমেন্দ্র মিত্র অনুভব করেছিলেন এক সদ্য তরুণের অভিমান, তিনি সভাপতির আসন ছেড়ে নেমে এসে আমার হাত ধরে বলেছিলেন, আমার অনুরোধে আর একবার পড়ো।
এরপর আর একজন প্রবীণ কবির সামনে ঔদ্ধত্য দেখানো চলে না। কোনওক্রমে একটি কবিতা পড়ে দিলাম। তিনি আমার কাছ থেকে কবিতার পাণ্ডুলিপিটি চেয়ে নিলেন এবং ফেরার সময় প্রায় জোর করেই তাঁর ট্যাক্সিতে তুলে নিলেন আমাকে।
এটা একটা আকস্মিক ঘটনা, কিন্তু এর ফল হল এই, দিন দশেক পরে রেডিয়ো-র এক কবি সম্মেলনে আমি আমন্ত্রণ পেয়ে গেলাম। অনেকের মতে, এ খুব সৌভাগ্যের বিষয়। কারণ, সে সময়ে রেডিয়োতে সুযোগ পাওয়া ছিল দুর্লভ ব্যাপার, রেডিয়োতে একবার যে গান গেয়েছে, সে ‘রেডিয়ো আর্টিস্ট’ হিসেবে গর্বের সঙ্গে কলার উঁচিয়ে হাঁটত, বহু কবি নিজেদের কবিতা সমেত আবেদন পত্র জমা দিয়ে মাসের পর মাস দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষা করত এবং অনেকেই নিরাশ হত। আমার বয়েসি কোনও কবির সুযোগ পাওয়ার প্রশ্নই ছিল না। হঠাৎ আমি নিজে কোনও চেষ্টা না করেই রেডিয়ো আর্টিস্ট হয়ে গেলাম।
সে কবি সম্মেলনটি ছিল অভিনব। রেডিয়ো-র অনুষ্ঠান শুধুমাত্র শ্রাব্য, কিছু দেখা যায় না, কিন্তু সেই অনুষ্ঠানটি যুগপৎ দেখার ও শোনার। তখনও ময়দানে নতুন রেডিয়ো অফিস খোলা হয়নি, ডালহাউসি স্কোয়ারের কাছে গারস্টিন প্লেস নামের রাস্তায় (অনেকে বলত ডাস্টবিন প্লেস) ছিল পুরনো বেতার কেন্দ্র। এখানেই নজরুল ইসলাম তাঁর শেষ অনুষ্ঠানের মধ্যপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এখানেই নাকি সায়গল অন্যের হাত থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে মাঝপথে নিজে গান ধরেন। সেই বাড়ির ছাদেই মঞ্চ বেঁধে কবিতা পাঠের ব্যবস্থা, দু’-তিনশো জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল শ্রোতা হিসেবে, এবং একই সঙ্গে অনুষ্ঠানের জ্যান্ত সম্প্রচার চলছিল। আমি ছিলাম কনিষ্ঠতম কবি। পরদিন সব সংবাদপত্রে বেশ করে ছবি ছাপা হয়েছিল এই অনুষ্ঠানের, সেই ছবিতে কেউ কেউ নাকি চিনতে পেরেছিল আমাকে। খুব সম্ভবত সংবাদপত্রে সেই আমার প্রথম ছবি।
এরপর প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে আমার সারাজীবনের মতন একটা যোগাযোগের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।
সত্যজিৎ-পূর্ব বাংলা ছায়াছবিতে প্রেমেন্দ্র মিত্র অনেকগুলি ছবির পরিচালক ও কাহিনীকার ছিলেন, সেগুলির নামও কেউ মনে রাখেনি। তাঁর স্বভাবটাই ছিল অগোছালো ও ঢিলেঢালা। এ রকম একটা গল্প প্রচলিত ছিল যে, একবার তিনি ‘ডাকিনীর চর’ নামে একটি ফিল্মের শুটিংয়ের জন্য নায়িকা ও অন্য কয়েকজন শিল্পীকে নিয়ে চলে গেলেন সুন্দরবনের কোনও দ্বীপে। কিন্তু ক্যামেরা ও ক্যামেরাম্যানকেই সঙ্গে নিয়ে যেতে ভুলে গেলেন। সম্ভবত এটা গল্পই। তবে তিনি অনেক প্রযোজকদের জন্য চিত্রনাট্য লিখে দেবার প্রতিশ্রুতি ও অগ্রিম নিয়েও কতবার যে তাদের ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দিতেন, তা অনেকেই বলেছেন। তিনি গল্প-উপন্যাসও লিখতেন খুব কম, কিন্তু সম্পাদকরা বিশেষ পছন্দ করতেন তাঁর লেখা, বহু শারদীয় সংখ্যার সম্পাদককে তিনি নাকানি-চোবানি খাইয়েছেন। যখন তাঁর পর্যায়ের অন্য লেখকরা শারদীয় সংখ্যায় লেখার জন্য বিষম ব্যস্ত, তখন প্রেমেন্দ্র মিত্র বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে অন্য কোথাও সারাদিন তাস খেলে কাটাচ্ছেন। আমিও কয়েকবার তাঁর সঙ্গী হয়েছি ব্রিজ খেলায়। কালবার্টসনের থিয়োরির ওপর তিনি তাঁর নিজস্ব আজবার্টসন থিয়োরি প্রয়োগ করতেন।
অনেক ফিল্মের মধ্যে তাঁর ‘ভাবীকাল’ নামে একটি ফিল্মে কিছু আধুনিক আঙ্গিকের পরীক্ষা ছিল। পরবর্তীকালের কোনও আলোচনায় তাঁর এই ছবি একটুও স্বীকৃতি পায়নি বলে তাঁকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুনেছি। তাঁর ‘কালো ছায়া’ নামে একটি ফিল্ম নিয়ে একটি অপ্রীতিকর বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বুদ্ধদেব বসু অভিযোগ করেন যে তাঁর লেখা একটি কিশোর রহস্যকাহিনী থেকে ওই ফিল্মের গল্প স্বীকৃতি না-দিয়ে গ্রহণ করা হয়েছে। এ নিয়ে মামলা মোকদ্দমারও উদ্যোগ হয়েছিল, তখন প্রেমেন্দ্র মিত্র সংবাদপত্রে একটা মজার বিবৃতি দেন, হ্যাঁ, কাহিনীটি আমার নিজস্ব নয় ঠিকই। তবে বুদ্ধদেব যেখান থেকে নিয়েছে, আমিও নিয়েছি সেখান থেকেই।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর ‘কল্লোল যুগ’ পাঠ করে জেনেছিলাম, অচিন্ত্য-প্রেমেন্দ্র-বুদ্ধদেব এই তিনজন লেখক পরম বন্ধু। সেই ছবিটিই আমার মনে গেঁথে ছিল। তবে, তাঁদের যৌবনের সেই বন্ধুত্বে মধ্য বয়সে ফাটল ধরে, বেশ দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। অচিন্ত্যকুমার ও প্রেমেন্দ্র তবু পাশাপাশি থাকতেন, বুদ্ধদেব আলাদা হয়ে যান অনেকখানি। একবার কিছু একটা উপলক্ষে মহাবোধি সোসাইটিতে এক সভায় তিনজনেই উপস্থিত ছিলেন, উদ্যোক্তারা তাঁদের পাশাপাশি বসার ব্যবস্থা করেন প্রথম সারিতে। বাংলা সাহিত্যের সেই বিখ্যাত ত্রয়ীকে একসঙ্গে দেখে আনন্দে বুক ভরে গিয়েছিল। তখন তাঁদের ব্যবহারে কোনও আড়ষ্টতা ছিল না, গল্প করছিলেন সহাস্যে।
একবার বুদ্ধদেব বসুর বাড়ির আড্ডায় কয়েকজন তরুণ ওঁকে খুশি করার জন্য, প্রেমেন্দ্র-অচিন্ত্যর সঙ্গে ওর সম্পর্ক ভালো নয় জেনে, বক্রভাবে কথা বলছিল শেযোক্ত দু’জন সম্পর্কে। হঠাৎ বুদ্ধদেব সাংঘাতিক রেগে উঠে তীব্র গলায় বললেন, তোমরা অচিন্ত্যর ‘দুইবার রাজা’ পড়েছ? পড়েছ প্রেমেনের ‘সংসার সীমান্তে’? কথায় কথায় তোমরা বিদেশি লেখকদের নাম করো। এঁদের লেখা তাঁদের অনেকের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।
পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এঁরা নিজের বন্ধুদের নিন্দা করতেন না কখনও, শুনতেও চাইতেন না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও বুদ্ধদেব বসু দুই বিপরীত মেরুর লেখক, তবু বুদ্ধদেবের মুখে আমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা শুনেছি। এঁদের মধ্যে কখনও বন্ধুত্ব ছিল কি না জানি না, ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লেখক সংঘে এঁরা একত্র হয়েছিলেন, পরে রাজনৈতিক বিশ্বাসে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। বুদ্ধদেব বসুর ‘শেষ পাণ্ডুলিপি’ উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রের অনেকখানি আদল আছে।
এই ত্রয়ীর মধ্যে সবচেয়ে কম লিখেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, তবু বেশ কিছু বছর তাঁর খ্যাতি ও প্রতিপত্তি ছিল অনেক বেশি। লেখার ব্যাপারে এমন অলস অথচ তিনি যে কী বিষম পড়ুয়া ছিলেন তার পরিচয় পেয়ে বারবার বিস্মিত হয়েছি। দেখা হলেই তিনি আমার বা অন্যান্য তরুণ লেখকদের রচনার উল্লেখ করতেন। যখন তাঁর চক্ষু খারাপ হতে শুরু হয়, তখনও তিনি ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে পড়তেন। এত কষ্ট করেও পড়েন কেন প্রেমেনদা? জিজ্ঞেস করলে বলতেন, পড়ার নেশা যে ছোটবেলা থেকে, কিছু-না-কিছু না পড়লে ভাত হজম হয় না। যখন ম্যাগনিফায়িং গ্লাসেও কুলোত না, তখন মাইনে করা লোক রেখেছিলেন, যিনি শুধু খবরের কাগজ নয়, পত্র-পত্রিকার নতুন গল্প-উপন্যাস-কবিতাও পড়ে শোনাতেন তাঁকে।
আমি যেবারে প্রথম বিদেশে যাই, সেবারে প্রেমেন্দ্র মিত্রও আমেরিকা সফরের সরকারি আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। আমি অনেকদিন নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্টে থাকব, নিজে রান্না করে খাব, তাই ওঁকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করেছিলাম, একবার আমার ওখানে যেতে। উনি সাগ্রহে রাজি হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, প্রথমেই আমার কাছে যাবার ব্যবস্থা করবেন। তারপর মাসের পর মাস কেটে গেল, বছর ঘুরে গেল, তিনি এলেন না। কোনও খবর নেই। ফিরে এসে তাঁকে প্রশ্ন করে জানা গেল, নিউ ইয়র্কে নেমেই তিনি টের পেলেন, দারুণ শীত, অত শীত তার সহ্য হবে না, তাই কয়েকদিনের মধ্যেই সফর বাতিল করে ফিরে এসেছিলেন। যিনি কত রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী লিখেছেন, সেই লেখক তুচ্ছ শীতের ভয়ে আমেরিকা দেখলেন না। এটা বেশ মজার ব্যাপার!
তিনি আরও গল্প বলেছিলেন যে, কিছুদিনের জন্য তাঁকে বম্বে নিয়ে গিয়েছিলেন বিখ্যাত প্রযোজক বিমল রায়। তখন বম্বের ফিল্ম মহলে বাঙালি লেখকদের গল্প ও চিত্রনাট্যের খুব কদর ছিল। যেমন বাংলা ফিল্মের স্বর্ণযুগে অনেক লেখকই চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। প্রবোধকুমার সান্যাল কিংবা সমরেশ বসুর মূল উপার্জন বই বিক্রি থেকে নয়, সিনেমার কাহিনী ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে। বম্বেতে উপার্জন আরও বেশি। প্রেমেনদাকে আলাদা ফ্ল্যাট ও অনেকরকম সুযোগ-সুবিধে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন থাকার পরেই প্রেমেনদা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন, কারণ বম্বের সব মাছেই কেমন যেন আঁশটে গন্ধ, তিনি খেতে পারেন না। মাছেরই যদি স্বাদ না পাওয়া যায়, তা হলে আর টাকা রোজগার করে লাভ কী! তিনি এক বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ, চলেও আসতে পারেন না মধ্যপথে, একদিন বেপরোয়া হয়ে কারওকে কিছু না জানিয়ে চুপি চুপি কলকাতার ট্রেনে উঠে বসলেন।
কিছুদিন আমরা দু’জনেই ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভ্লপমেন্ট কর্পোরেশনের জুরি বোর্ডের সদস্য ছিলাম। একদিন মিটিং সেরে নিচে নেমে এসে আমি প্রেমেনদার জন্য ছুটোছুটি করে ট্যাক্সি ধরার চেষ্টা করছি, কোনও ট্যাক্সিই যেতে রাজি হচ্ছে না, তিনি বললেন, চলো, খানিকটা হেঁটেই যাই। এত বিখ্যাত একজন লেখকের পাশে আমি হাঁটছি, ভেবেই আমার রোমাঞ্চ হচ্ছিল। প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়েও তাঁর সুন্দর চেহারা, দৈর্ঘ্যে কিছুটা কম, ফর্সা রং ও মাথা ভর্তি কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। এক সময় বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা প্রবর্তনের জন্য ইনি এবং এঁর বন্ধুরা কী তুলকালাম কাণ্ডই না করেছেন! ইনি হাঁটছেন রাস্তা দিয়ে, লোকে চিনতে পারছে না?
আমার খানিকটা অপরাধবোধও হচ্ছিল। জীবনে একবারই আমি ওর সঙ্গে অপব্যবহার করেছি। সেবারে রবীন্দ্র পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল এমন এক ব্যক্তিকে, যাকে কোনওক্রমেই লেখক বলা চলে না। তিনি ছিলেন ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি, একটি প্রকাণ্ড বিদ্যালয়ের মালিক, অনেককে নাকি দাক্ষিণ্য বিতরণ করতেন। তখন অন্য কোনও পুরস্কারের প্রবর্তন হয়নি। সরকারি রবীন্দ্র পুরস্কার বিশেষ সম্মানের, বিচারকদের মধ্যে প্রেমেন্দ্র মিত্রও ছিলেন। তিনি কী করে এমন ব্যক্তিকে মনোনীত করলেন? সম্ভবত এটাও ওঁর ঢিলেঢালা স্বভাবের জন্য, কেউ এসে অনেক করে ধরেছে, উনি না বলতে পারেননি। রবীন্দ্র-নামাঙ্কিত পুরস্কারের এমন অপব্যবহারে অনেকেই খুব ক্ষুব্ধ। এক বন্ধুর বাড়িতে সন্ধেবেলা আড্ডা দিতে দিতে ঠিক হল, প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাছে কৈফিয়ৎ চাওয়া হোক। টেলিফোনের ওপর একটা কাপড় চাপা দিলে কণ্ঠস্বর বদলে যায়, আমি মিথ্যে করে বললাম, প্রেমেনদা, আমার নাম অবনী বন্দ্যোপাধ্যায়, উত্তরপাড়া কলেজে পড়াই, আপনার বাড়িতে অনেকবার গেছি, চিনতে পারছেন? যে-নামের কোনও অধ্যাপকের অস্তিত্ব নেই, সে নাম শুনেও উনি বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কেন চিনতে পারব না? কেমন আছে অবনী? তোমার মা বাবা সব ভালো তো? অবনী বলল, একদিন আপনার বাড়িতে তিলের নাড়ু নিয়ে গিয়েছিলাম, অনেকদিন আগে, আপনার মনে থাকবার কথা নয়। উনি বললেন, ও হ্যাঁ, হ্যাঁ অবশ্যই মনে আছে, চমৎকার স্বাদ ছিল। অবনী বলল, প্রেমেনদা, আমি আপনার কত ভক্ত তা তো জানেন, একটা ব্যাপারে মনে বড় আঘাত পেয়েছি, আপনি ওমুককে রবীন্দ্র পুরস্কার কেন দিলেন? উনি বললেন, দেখো, সাহিত্যের বিচার খুব শক্ত, আজ যেটা তোমাদের ভালো লাগছে না, ভবিষ্যতের পাঠক হয়তো—। অবনী বলল, তা হলে যে ওই খগেনকুমার, যে পাতলা পাতলা গোয়েন্দা কাহিনী লেখে তাকেও রবীন্দ্র পুরস্কার দেবেন? কেন না, ভবিষ্যতের বিচারে—। আমার এ রকম ইনি-বিনুনি কথা দু’একজন বন্ধুর পছন্দ হয়নি। একজন আমার হাত থেকে রিসিভার কেড়ে নিয়ে বলল, অ্যাই শালা প্রেমেন! সঙ্গে সঙ্গে আমি কানেকশান কেটে দিই।
প্রেমেনদার সঙ্গে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে হল, এখন সেই দোষ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করাই উচিত। তাঁকে সব খুলে জানাতে তিনি খুব হাসলেন। তারপর বললেন, হ্যাঁ, মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যায়, তবে একলা আমাকে দোষ দিচ্ছ কেন, বিচারকদের মধ্যে আরও তো তোমাদের চেনা কয়েকজন ছিল। তারা আমাকে এমন বোঝাল—সেদিন শালাটা কে বলেছিল? অমুক, তাই না? ওর লেখাও আমি খুব পছন্দ করি।
একটি সভায় আমি বলেছিলাম, প্রেমেনদা, আপনি রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বড়। উনি হকচকিয়ে তাকাতেই আবার বলেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ একাশি বছরে মারা গেছেন, আপনার বয়েস এখন চুরাশি।
আর একটি সভায় উনি খুব লজ্জায় ফেলে দিয়েছিলেন আমাকে। ‘একালের কবিতা’ নামে একটি সংকলন সম্পাদনা করেছিলাম, অধিকাংশ বাংলা কবিতা সংকলন শুরু হয় রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে, আমি ঠিক করেছিলাম রবীন্দ্রনাথ তো বটেই, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব, সুধীন্দ্রনাথের মতন বহু ব্যবহৃত কবিদের বাদ দিয়ে শুরু করা হবে জীবিত প্রধান কবি অরুণ মিত্র থেকে, যাতে শেষের দিকে অনেক তরুণ কবিকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। বইটির উদ্বোধন হবে বইমেলার মঞ্চে। পাশের টেবিলে বসে আছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, তিনিও একটি কিশোর সংকলন সম্পাদনা করেছেন। সভা শুরু হবার আগে তিনি আমাকে বললেন, দেখি, তুমি কী বই বার করছ? পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে তিনি সবিস্ময়ে বললেন, এ কী, তুমি আমার কবিতা নাওনি? স্বয়ং একজন প্রধান কবি এ প্রশ্ন করলে কী উত্তর দেওয়া যায়? আমি আমতা আমতা করে বললাম, প্রেমেনদা, এটা একটু অন্যরকম, আপনার সমসাময়িক অনেককেই, যেমন বুদ্ধদেব, জীবনানন্দ এঁদেরও নেওয়া হয়নি। প্রেমেনদা অসহিষ্ণুভাবে হাত নেড়ে বললেন, আরে, ওরা তো সব মরে গেছে। আমি এখনও বেঁচে আছি, বেঁচে আছি।
আমি লজ্জায় অধোবদনে বলেছিলাম, আমারই ভুল হয়ে গেছে, ক্ষমা করুন, পরের সংস্করণে অবশ্যই—। এর কয়েকমাস পরেই তিনি পৃথিবী ত্যাগ করেন। তাঁকে শেষবার দেখতে গিয়ে ওই কথাটাই মনে পড়ছিল বারবার, আমি তো এখনও বেঁচে আছি, বেঁচে আছি!