২০. প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে

প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে বলেই সে তার শ্রেষ্ঠ সন্তান মানুষকে নানান রহস্য দিয়ে পৃথিবীতে পাঠায়। সারাজীবন প্রতিটি মানুষ তার রহস্যের খেলা খেলে। প্রকৃতি দাড়িপাল্লায় মেপে সবাইকে সমান রহস্য দেন না। কাউকে বেশিমাত্রায় দেন, যেমন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান পাওয়া এই মেধাবী মানুষটির চেহারা রাজপুত্রের মতো। সম্মোহনী ক্ষমতার জন্যেই হয়তোবা গান্ধিজির চেয়েও উঁচুস্থানে আসীন। কংগ্রেসের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। প্রকাশ্যে এই কথা বহুবার বলেও যখন কংগ্রেসের সভাপতি পদের জন্যে ভোটে দাঁড়ান, তিনি ভোটে জিতেন। গান্ধিজি অসহায় বোধ করেন। কারণ তার সমর্থিত প্রার্থী সিতারামাইয়া বিশাল ব্যবধানে পরাজিত।

সুভাষচন্দ্র অতি রহস্যময় মানুষ হলেও তাঁর চিন্তাভাবনায় কখনো রহস্য ছিল না। তার এককথা— ইংরেজ আপনা-আপনি ভারত ছেড়ে যাবে সেই চিজ না। গান্ধিজির সত্যাগ্ৰহ কিংবা অনশনে তারা টলবে না। বিপ্লবীদের এদিক-ওদিক খুটখাট গুলিবোমাতেও কিছু হবে না। ভারতকে স্বাধীন করতে হলে সশস্ত্ৰ বিপ্লবের ভেতর দিয়ে তা করতে হবে। অহিংসা দুৰ্বলের অস্ত্র। সুভাষচন্দ্ৰ বসু নিজেকে এবং জাতিকে দুর্বল ভাবতে অভ্যস্ত না।

কংগ্রেসের সঙ্গে তার বিরোধ চরমে পৌঁছল। তিনি কংগ্রেসের সভাপতির পদ ছেড়ে ফরওয়ার্ড ব্লক নামে নতুন রাজনৈতিক দল করলেন। শেরে বাংলা ফজলুল হক যোগ দিলেন তাঁর সাথে। শেরে বাংলাও চাচ্ছিলেন। অখণ্ড ভারত। মুসলিম লীগের সঙ্গে এই কারণেই তাঁর বনছিল না।

সুভাষচন্দ্রের কর্মকাণ্ড ইংরেজ সরকারের মোটেই পছন্দ হচ্ছিল না। তাদের মাথায় বিশ্বযুদ্ধের ঝামেলা, এই ঝামেলায় সুভাষচন্দ্ৰ বসুর রণাহুঙ্কার অসহ্য বোধ হবারই কথা। ইংরেজ তাঁকে গৃহবন্দি করল। তিনি পালিয়ে গেলেন (১৭ জানুয়ারি, সন ১৯৪১)। প্রথমে গেলেন আফগানিস্তান। সেখান থেকে ছদ্মবেশে রাশিয়া, রাশিয়া থেকে জার্মানি।

জার্মানির চ্যান্সেলর হিটলার এই বাঙালির কথাবার্তায় মুগ্ধ। কী তেজ! হিটলারের শত্রু ইংরেজ, এই যুবকের শত্রুও ইংরেজ। একে অবশ্যই সাহায্য করা যায়। সুভাষচন্দ্ৰ বসু সাহসী এক প্রস্তাব করে বসলেন। যে সব ভারতীয় সৈনিক জার্মানদের হাতে বন্দি হয়েছে, তাদের নিয়ে তিনি এক সৈন্যদল গঠন করবেন। এবং এই সৈন্যবাহিনী নিয়ে ভারত বিজয়ের উদ্দেশে রওনা হবেন।

হিটলার প্রস্তাবে রাজি হলেন। বন্দি ভারতীয় সৈন্যদের মুক্তি দেয়া হলো। তারা হিটলারের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিল।

এদিকে মালয়ে কাকতালীয় এক ঘটনা ঘটল। জাপানিদের তাড়া খেয়ে ব্রিটিশ বাহিনী দ্রুত পশ্চাদপসরণের চেষ্টা করছে। তাদের নাস্তানাবুদ অবস্থা। ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে ছিলেন মোহন সিং। হঠাৎ তার মাথায় এলো ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে পালিয়ে না গিয়ে জাপানি সেনাদের হাতে ধরা দেয়া। তাদের রাজি করিয়ে বন্দি ভারতীয়দের নিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। এই যুদ্ধ হবে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ। জাপান রাজি হয়ে গেল। ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদের তুলে দিল মোহন সিং-এর হাতে। মোহন সিং ৪৫,০০০ ভারতীয় সৈন্য নিয়ে গঠন করলেন আজাদ হিন্দ সেনাবাহিনী।

 

আজাদ হিন্দ সেনাবাহিনীর এক সদস্য সিপাহি বৃন্দাবন পাল। তাঁর বাড়ি বান্ধবপুরে। বৃন্দাবন পালের বাবা আনন্দ পাল জানতেন, ছেলে জাপানিদের হাতে বন্দি হয়েছে। হলুদ জাপানিরা ছেলেকে অমানুষিক যন্ত্রণা করছে। যুদ্ধক্ষেত্রে খাবারের অভাব হলে জাপানিরা না-কি প্রায়ই বন্দিদের মেরে তাদের কলিজাও খাচ্ছে। তিনি জাপানিদের ধ্বংস কামনা করে মন্দিরে জোড়া পাঠা বলি দিলেন। পটপরিবর্তনের খবর তিনি জানতেন না।

হলুদ জাপানিরা আমাদের বন্ধু হয়ে গেছে, নেতাজি জার্মান ইউ বোটে করে জাপানের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছেন। ঠিক হয়েছে জাপানের সেনাবাহিনী এবং মােহন সিং-এর নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনী একসঙ্গে বাৰ্মা আক্রমণ করে বাংলা ভূখণ্ডের দিকে আসতে থাকবে।

জাপান যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ব্রিটেন এবং আমেরিকার বিরুদ্ধে। আজাদ হিন্দ বাহিনীও পিছিয়ে নেই। তারাও যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ব্রিটেন এবং আমেরিকার বিরুদ্ধে।

এদিকে খবর রটেছে জার্মানির বিজ্ঞানীরা ভয়াবহ এক বোমা বানানোর কর্মকাণ্ড শুরু করেছে। বোমার নাম অ্যাটম বোমা। সামান্য অ্যাটমের ভেতর না-কি লুকিয়ে আছে দৈত্য। সেই দৈত্যকে বের করে আনার চেষ্টা।

আমেরিকানরা গুপ্তচরদের এই খবরে বিচলিত। সত্যি কি এমন কিছু ওরা ঘটাতে যাচ্ছে? জার্মানি থেকে পালিয়ে আসা পদার্থবিদ্যার রথি-মহরথিদের আশ্রয় এখন আমেরিকা। অ্যাটম বোমার গবেষণায় তারা এগিয়ে আসতে পারেন, তবে তার জন্যে রাষ্ট্রের সাহায্য দরকার। আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে বুঝাতে হবে যে, অ্যাটম বোমার মতো মারণাস্ত্র প্রয়োজন। বুঝানোর দায়িত্ব নিলেন পদার্থবিদ্যার গুরুদেব আলবার্ট আইনষ্টাইন। তিনি নিজে শুধু যে দায়িত্ব নিলেন তা-না, তিনি পৃথিবীর জ্ঞানী-গুণী মানুষদেরকে দিয়েও রুজভেল্টকে বোঝানোর চেষ্টা চালালেন। মহাশান্তির জন্যে প্রয়োজন মহাঅশান্তি অ্যাটম বোমা।

আইনস্টাইনের কারণেই হয়তো কবিগুরু রবীন্দ্ৰনাথ ঠাকুরও শান্তির প্রয়োজনে অ্যাটম বোমা বানানো উচিত বলে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে অনুরোধ করে চিঠি পাঠালেন। আমেরিকায় শুরু হলো দৈত্য বানানোর প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়ার নাম—ম্যানহাটন প্রজেক্ট।

 

ম্যানহাটন প্রজেক্টে অ্যাটম বোমা বানানো চলতে থাকুক, আমরা ম্যানহাটন থেকে ফিরে আসি বান্ধবপুরে। সেখানে কার্তিক মাস। দিন শুরু হচ্ছে ঘন কুয়াশায়। এই বৎসর কুয়াশার একটু বাড়াবাড়ি আছে। এক-এক দিন এমন কুয়াশা হয় যে, একহাত সামনের মানুষও দেখা যায় না। ভরদুপুরে আকাশের দিকে তাকালে যে সূর্য দেখা যায় তা চাঁদের মতো। কুয়াশা সেই সূর্যের তেজ কেড়ে নিয়েছে।

এমনই এক কুয়াশার মধ্যদুপুরে মাওলানা ইদরিস টিউব কল থেকে খাবার পানি নিয়ে ফিরছেন। বাড়ির উঠানে পা দিয়েই শুনলেন বিড়াল কাঁদছে। শোবার ঘরের ভেতর থেকে বিরামহীন বিড়ালের কান্না ভেসে আসছে— মিয়াউ মিয়াউ মিয়াউ। তাঁর বাড়ি কুকুর-বিড়ালশূন্য। তিনি কুকুর-বিড়াল খুবই অপছন্দ করেন। কুকুর অপছন্দ করেন, কারণ আমাদের নবী (দঃ) কুকুর অপছন্দ করতেন। এই যুক্তিতে বিড়াল তাঁর পছন্দ করার কথা। কারণ নবীজির পছন্দের প্রাণী বিড়াল। কিন্তু মাওলানা ইদরিস কুকুরের চেয়েও বেশি অপছন্দ করেন বিড়াল।

মাওলানা বিরক্ত মুখে কিছুক্ষণ উঠানে দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে ঢুকলেন। পলকহীন চোখে তাঁকে বিছানার দিকে তাকিয়ে থাকতে হলো। বিছানার ঠিক মাঝখানে কথা দিয়ে পুঁটলির মতো করে জড়ানো একটা শিশু। তার দু’পাশে দুটা বালিশ। তার মাথার কাছে ফিডিং বোতলে এক বোতল দুধ। শিশু হাতপা ছুড়ছে এবং কাঁদছে ওয়াউ ওয়াউ। কান্নার এই শব্দকেই মাওলানা বিড়ালের মিয়াউ মিয়াউ ভাবছিলেন।

ইদরিস গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, জুলেখা! জুলেখা! কেউ জবাব দিল না। তবে শিশুটি কান্না থামিয়ে দিল। মাওলানা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন। পৃথিবী এবং বেহেস্ত দুই জায়গাতেই সবচে’ সুন্দর বস্তু ফুল। ফুল যত সুন্দরই হোক সে হাসতে পারে না, কাঁদতে পারে না। মুহুর্তে-মুহুর্তে নিজেকে বদলাতে পারে না। সেই অর্থে অবশ্যই মানবশিশু ফুলের চেয়ে সুন্দর। মাওলানা বললেন, এই! এই!

শিশুটি হাত নাড়ল। তার চোখ ঘন কালো এবং গরুর চোখের মতো বড়। চোখের মণিতে আলোছায়ার খেলা। মাওলানা বললেন, নাম কিগো?

শিশু এবার পা নাড়াল।

মাওলানা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ছেলে না মেয়ে? প্রশ্নটিতে শিশু সম্ভবত অপমানিত বোধ করল। সে কান্দতে শুরু করল। তার গলার স্বর এবার আগের চেয়েও উঁচুতে।

তার কি ক্ষিধে লেগেছে? ফিডিং বোতল মুখে ধরলে কি খাবে? দুধ কি বিছানায় শুইয়েই মুখে ধরবেন? না-কি আগে তাকে কোলে নিয়ে মুখে ধরবেন? কচি শিশুরা মাছের মতো পিচ্ছিল হয় বলে তার ধারণা। কোলে নিতে গেলে পিছলে পড়ে যাবে না তো! তিনি তাঁর এই দীর্ঘজীবনে কখনো কোনো শিশু কোলে নিয়েছেন এরকম মনে করতে পারলেন না। আহারে, বেচারা হাত-পা নেড়ে কী কান্নাই না। কাঁদছে!

মাওলানা বিসমিল্লাহ বলে অনেক আয়োজন করে শিশু কোলে নিলেন। তার মুখের সামনে ফিডিং বোতল ধরামাত্রই তার কান্না থামলো। সে চুকচুক করে দুধ টানছে। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। ঘুমিয়ে পড়ছে না-কি? সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লে দুধ খাওয়ানো কি বন্ধ করে দেবেন? সেটাই তো যুক্তিযুক্ত। ঘুমের মধ্যে কেউ খাদ্য গ্রহণ করে না। মানবসন্তান কেন করবে?

পবিত্ৰ কোরান পাঠ করার সময় মাওলানা যেভাবে দোলেন এখনো তিনি মনের অজান্তে সেভাবেই দুলছেন। শিশুটির দিকে তাকিয়ে মিল দিয়ে দিয়ে বিচিত্র সব কথা বলে যাচ্ছেন–

এই বাবু!
দুধ খারু?
মজা পাবু?
কই যারু?
এই বাবু!
তুমি হাবু।
এবং হাবা
মজা পাবা
কই যাবা?
বলে বাঘ।
ও আল্লা
বাবুর কী রাগ!

মাওলানার কথাবার্তা মনে হয় শিশুটির পছন্দ হচ্ছে। দুধ খেতে খেতেই সে হাসল। মাওলানা অস্পষ্ট গলায় বললেন, আহারে! আহারে! মাওলানার চোখ অশ্রুসিক্ত হলো। তিনি গভীর আবেগে বললেন, হে রাব্ববুল আলামিন, হে গাফুরুর রাহিম! তোমার প্রতি নাদান বান্দা ইদরিসের সালাম।

সন্ধ্যার মধ্যে অনেকেই জেনে গেল জুলেখা তার কন্যাসন্তানকে মাওলানার বাড়িতে ফেলে চলে গেছে। মাওলানা মহাবিপদে পড়েছেন। মাওলানা নিজে থাকেন। একবেলা খেয়ে। সেই খাওয়াও সবদিন জোটে না। বাচ্চাটাকে খাওয়াবেন কী?

কয়েকজন আগ্রহ করে বাচ্চা দেখতে গেল। দূর থেকে দেখল, কাছে গোল না, কোলেও নিল না। এই শিশু অপরূপ রূপবতী হলেও সে মূর্তিমান পাপ ছাড়া কিছু না। তাকে দূর থেকে দেখা যায়, কোলে নেয়া যায় না।

জুলেখা এক বোতল দুধ রেখে গিয়েছিল। সন্ধ্যার আগেই সেই দুধ শেষ হয়ে গেল। বাচ্চা কাঁদতে শুরু করল। তার জন্যে খাবার কীভাবে জোগাড় করবেন। মাওলানা ভেবে পেলেন না। তাকে বাড়িতে রেখে খাবারের সন্ধানে কোথাও যাওয়া যাবে না। তিনি যেখানেই যান, তাকে কোলে নিয়েই যেতে হবে। বাচ্চাটার জন্যে কাঁথা দরকার, কাপড় দরকার। সেসবইবা কোথায় পাবেন? বাচ্চ ঘনঘন পিসাব করছে। কাপড় বদলাতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে মাওলানা তাকে নিজের একটা পাঞ্জাবি দিয়ে জড়িয়ে রেখেছেন। বাবু সেই পাঞ্জাবিও ভিজিয়ে ফেলেছে। মাওলানা অস্থির বোধ করলেন। সর্বপ্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব পরম করুণাময় আল্লাহপাকের। নিম্নশ্রেণীর প্রাণের জন্যে তা একশ’ ভাগ সত্যি। প্রতিটি পিপড়ার খাবারের ব্যবস্থা তিনি করে রেখেছেন। মানুষকে তিনি অস্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে পাঠিয়েছেন বলে তার খাবার তাকেই সংগ্ৰহ করতে হয়।

ক্ষুধায় অস্থির হয়ে শিশু খুবই কাঁদছে। মাওলানার চোখ দিয়েও পানি পড়ছে। তার মন বলছে, আল্লাহপাক তাঁকে জটিল এক পরীক্ষায় ফেলেছেন। এই পরীক্ষা থেকে তিনি কীভাবে পরিত্রাণ পাবেন বুঝতে পারছেন না। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েই তাকে বের হতে হবে। দেরি করা যাবে না।

উঠানে লণ্ঠন হাতে কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে। ইদরিস বাচ্চা কোলে নিয়ে বারান্দায় এসে দেখেন লাবুস।

লাবুস বলল, বোনকে দেখতে এসেছি। তার নাম কী?

মাওলানা বললেন, নাম জানি না। তার মা কী নাম রেখেছে বলে যায় নাই। তবে তার ইচ্ছা ছিল মেয়ে হলে নাম রাখবে মীরা।

লাবুস বলল, বোনকে আমার কোলে দিন।

বাচ্চা কাঁদছিল। লাবুসের কোলে উঠে কিছুক্ষণের জন্যে তার কান্না থামল। সে কৌতূহলী হয়ে নতুন মানুষটাকে দেখছে। লাবুস বলল, আমি আমার বোনের নাম রাখলাম পুষ্পরানি।

মাওলানা বললেন, তুমি কি এর খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবে? এ ক্ষুধায় অস্থির হয়েছে।

লারুস বলল, আমি সব ব্যবস্থা করেই আপনাকে নিতে এসেছি।

কী ব্যবস্থা করেছ?

লাবুস বলল, একটা মেয়ে রেখেছি যে পুষ্পারানির দেখাশোনা করবে। আমার বোনের যা যা লাগবে তার সব ব্যবস্থা করেছি।

মাওলানা বললেন, ব্যবস্থা করেছি, ব্যবস্থা করেছি— এমন কথা বলব না। এতে অহঙ্কার প্রকাশ হয়। ব্যবস্থা করেছেন আল্লাহপাক। তোমার মাধ্যমে করেছেন।

লাবুস বলল, আমার ভুল হয়েছে। এখন আমার সঙ্গে চলেন।

মাওলানা বললেন, আল্লাহপাকের হিসাব সাধারণ মানুষের বোঝা সম্ভব না। আমি বাচ্চাটাকে কী খাওয়াব কী পরাব ভেবে খুব অস্থির হয়ে ছিলাম। কাঁদতে ছিলাম। আমার একবারও মনে হয় নাই যে, আল্লাহপাক সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

পুষ্পরানি আবার কাঁদতে শুরু করেছে। লাবুস পুষ্পরানিকে কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে রওনা হয়েছে। হারিকেন হাতে নিয়ে মাওলানা আগে আগে যাচ্ছেন। আয়াতুল কুরসি পড়তে পড়তে যাচ্ছেন। ছোট শিশুদের দিকে ভূত-প্রেতের নজর থাকে বেশি। সেই শিশু যদি রূপ নিয়ে আসে তাহলে সমস্যা আরো বেশি হয়। জিনরা সুন্দর মানবশিশু তাদের দেশে নিয়ে যেতে আগ্রহী থাকে বলে তিনি শুনেছেন। মানুষ জিনের বাচ্চা পালতে পারে না, কিন্তু জিন মানুষের বাচ্চা পালতে পারে— এটাও এক রহস্য। জগৎ রহস্যময়।

 

জামে মসজিদের ইমাম করিম সাহেবের স্ত্রী শরিফা আজ সারাদিন অভুক্ত। এমন না যে ঘরে খাবার নাই। খাবার আছে, কিন্তু সে খেতে পারছে না। ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া তার একশ’ টাকা চুরি গেছে। চুরি কখন হয়েছে। সে অনেক চিন্তা করেও বের করতে পারছে না। গত রাতে চুরি হয়েছে এটা পরিষ্কার। তবে চোর একশ’ টাকা ছাড়া আর কিছুই নেয় নি। টাকাটা সে রেখেছিল অতি গোপন জায়গায়— শুকনা বড়ুই-এর হাঁড়িতে। টাকার ওপর শুকনা বড়ুই বিছানো। চোর এই গোপন জায়গা থেকে টাকা বের করে নিয়ে গেল কীভাবে কে জানে!

শরিফা ঘটনোটা তার স্বামীকে বলতে পারছে না। তার ধারণা ঘটনা শুনলেই তার স্বামী খুব রাগ করবেন। স্বামীর কাছ থেকে ধমক বা কড়া কথা শুনতে তার একেবারেই ভালো লাগে না। একবার ধমক, শুনলে তার কয়েকদিন মন খারাপ থাকে। শরিফা আজ সারাদিনই একমনে পাঠ করেছে— ‘ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন।’ কারো মৃত্যুসংবাদ শুনলে এই দোয়া পাঠ করতে হয়, আবার কিছু হারিয়ে গেলে এই দোয়া পড়লে হারানো বস্তু ফিরে আসে। এই দোয়া পড়ে সে একবার তার হারিয়ে যাওয়া সোনার নাকফুল খুঁজে পেয়েছিল। উঠান ঝাড়ু দিতে সে শলার ঝাড়ু নিয়ে উঠানে গেছে। হঠাৎ দেখে রোদ পড়ে ঝাড়ুর ভেতর কী যেন ঝকমক করে উঠল। নাকফুল ঝাড়ুর শলায় আটকে ছিল।

রাতে খেতে বসে করিম বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ? চোখ-মুখ শুকনা। জ্বর উঠেছে?

শরিফা বলল, শরীর ঠিক আছে।

কোনো বিষয় নিয়া কি চিন্তাযুক্ত?

আপনারে নিয়া চিন্তাযুক্ত।

করিম ভুরু কুঁচকে বললেন, আমারে নিয়া কী চিন্তা?

শরিফা বলল, জিন খোররম যে আপনারে ত্যক্ত করতেছে এই নিয়া চিন্তা।

করিম বললেন, এইসব নিয়া তুমি চিন্তা করব না। আমার সমস্যা আমি সমাধান করব। এর মধ্যে সমাধান কিছুটা হয়েছে— মসজিদ থেকে বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা বন্ধন দিয়েছি। ভূত-প্ৰেত-জিন-পরী এইটুক রাস্তায় আর আসবে না।

বন্ধন দেওনের পরে তার আর দেখা পান নাই?

দুই দিন দেখেছি- জংলায় হাঁটতেছে, রাস্তায় উঠতে পরে নাই। চেষ্টা নিয়েছে, পারে নাই।

শরিফা বলল, একবার বন্ধন দিলে কতদিন থাকে?

চন্দ্র তারিখ হিসাবে থাকে। শুক্লপক্ষের প্রথম দিনে বন্ধন দিলে পূর্ণিমা পর্যন্ত থাকে। যাই হোক, কথা চালাচালি বন্ধ। খাওয়া হলো ইবাদত। ইবাদতের সময় कशी बळी यांट्र না।

শরিফা বলল, ইবাদতের জন্য পুণ্য আছে না?

করিম বললেন, অবশ্যই আছে।

শরিফা বলল, যে শুকনা মরিচভর্তা দিয়া ভাত খাইতেছে তার পুণ্য বেশি, না-কি যে দশ পদ পোলাও-কোৰ্মা খাইতেছে তার পুণ্য বেশি?

করিম বললেন, মরিচভর্তা দিয়া যে খাইতেছে তার পুণ্য অনেক অনেক বেশি।

শরিফা বলল, আমার মনে হয় যে দশ পদ দিয়া খাইতেছে তার পুণ্য বেশি। আরাম কইরা মনের আনন্দে সে খাইতেছে। বইলাই পুণ্য বেশি। শুকনা মরিচভর্তা দিয়া যে খাইতেছে সে বোজার হইয়া খাইতেছে। ‘

করিম বিরক্ত হয়ে বললেন, যা জানো না তা নিয়া বাহাস করব না।

আচ্ছা আর করব না।

বারান্দায় পাটি দেও, জায়নামাজ দেও। আজ রাতে ঘুমাব না। সারারাত ইবাদত বন্দেগি করে কাটাব। ফজরের নামাজ শেষ করে ঘুমাতে যাব।

কেন?

করিম বিরক্ত হয়ে বললেন, কেন কী? ইবাদত বন্দেগি করে রাত কাটানোর মধ্যে কোনো কেন নাই। ইবাদত বন্দেগি না করার মধ্যে কেন আছে।

রাত মন্দ হয় নাই। বাজারের কোলাহল বন্ধ হয়েছে। রাত বারোটায় গোয়ালন্দ থেকে শেষ লঞ্চ আসে। সেটাও চলে এসেছে। করিম বারান্দায় জায়নামাজে বসে আছেন। তার হাতে তসবি; জায়নামাজের এক কোনায় কেরোসিনের কুপি। কুপির লাল আলো করিমের মুখে পড়েছে। করিমকে ভীত দেখাচ্ছে। তিনি বারবারই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। আজ একটা বিশেষ রাত। তিনি মজুকে একশ’ টাকা দিয়েছেন। মজু বলেছে, সে যেভাবেই হোক আজ রাতেই কার্য সমাধা করে খবর দিয়ে যাবে। তখন তাকে আরো পঁচিশ টাকা দিতে হবে। করিমের পাঞ্জাবির পকেটে পঁচিশ টাকা আছে।

মজু এখনো আসছে না। সে কখন কাৰ্য সমাধা করবে তাও তাঁকে বলে নি। এখন মনে হচ্ছে কাৰ্য সমাধা হবে শেষরাতে। দরজায় খুঁট করে শব্দ হলো। করিম বিরক্ত হয়ে তাকালেন।

শরিফা ক্ষীণ গলায় বলল, আপনি কি সত্য সত্যই সারারাত জাগবেন?

দরজার ফাক দিয়ে শরিফাকে দেখা যাচ্ছে। করিম অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। রাগী গলায় বললেন, ঘুমাইতে যাও, ইবাদত বন্দেগি করতেছি। এই সময় ত্যক্ত করবা না।

শরিফা ঘুমুতে গেল। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে না। আসা পর্যন্ত সে একমনে হারানো জিনিস ফিরে পাওয়ার দোয়া পড়তে লাগল। ভাইজানের দেয়া একশ’টা টাকায় কত কিছুই সে কিনতে পারত।

 

লাবুস তার বোনের সব ব্যবস্থা ভালোমতোই করেছে। বাগদি পাড়ার এক মেয়েকে আনিয়েছে। তার বয়স ষোল-সতেরো। নাম কালী। কালীর নিজের একমাস বয়েসি মেয়ে গতকাল মারা গেছে। মৃত সন্তানের শোকে সে কাতর। পুষ্পরাণীকে সে লাবুসের হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে নিল। বিস্মিত গলায় বলল, হা ভগবান, আমার তুলসির চেহারার মতো চেহারা। হেই মুখ হেই চউখ। একটাই বেশিকম- তুলসি ছিল কালা, আর এ চাঁদের মতো ফকফইক্যা।

চুকচুক করে দুধ খাচ্ছে। কালীর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। এই অশ্রু আনন্দের कों (दानन्दू (द यक्षद?

মাওলানা ইদরিস লাবুসের কাছে হিন্দু মেয়ের বুকের দুধ খাওয়া নিয়ে ক্ষীণ আপত্তি তুললেন। লাবুস বলল, দুধের কোনো হিন্দু-মুসলমান নাই। হিন্দুমুসলমান মানুষের চিন্তায়। দুধের চিন্তার শক্তি নাই।

লাবুসের কথায় মাওলানা হ’কচাকিয়ে গেলেন। ধর্ম নিয়ে এইভাবে তিনি কোনোদিন চিন্তা করেন নি। এই দিকে চিন্তা করা যেতে পারে।

পাকা দালানের দক্ষিণের সর্বশেষ ঘরটায় মাওলানার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। খাটে জাজিমের বিছানা। বিছানায় ফুলতোলা চাদর। খাটের পাশের টেবিলে কাঁসার জগভর্তি পানি, একটা কাঁসার গ্রাস। সবই ঝকঝকি করছে।

হাদিস উদ্দিন মাওলানাকে খুবই খাতির-যত্ন করছে। গোসলের জন্যে গরম পানি করে দিয়েছে। মাওলানার সঙ্গে সে কলঘরে সাবান এবং ‘ফোড়ল’ নিয়ে ঢুকেছে, গায়ে সাবান ডলে দিবে।

মাওলানা বললেন, বাবা, আমি অন্যের সেবা নেই না। আমার নবীজি অন্যের সেবা নিতেন না। আমিও নেই না।

হাদিস বলল, আপনে তো নবী না। আপনে কেন সেবা নিবেন না? মাওলানার সব আপত্তি অগ্রাহ্য করে সে তার মাথায় আধাবালতি গরম পানি ঢেলে সাবান দিয়ে গা ডালা শুরু করল।

গোসল সেরে মাওলানা ঘরে ঢুকতেই সে হুক্কা নিয়ে উপস্থিত। মাওলানা বললেন, আমি তামাক খাই না।

হাদিস উদ্দিন বলল, খান না, আইজ খাইবেন। শরীর আরাম চায়। এইটা শরীরের একটা আরাম।

মাওলানা হুক্কায় টান দিলেন। তামাকটা ভালো লাগছে না, কিন্তু গুড়ুক গুড়ক শব্দটা কানে মধুর হয়ে বাজছে।

হাদিস উদ্দিন বলল, খানা কখন খাইবেন বইলেন। ভাত বসাব। ধোঁয়া উঠা ভাত খাওয়ার আলাদা মজা। খিচুড়ি খাইতে চাইলে বলবেন, খিচুড়ি রানব।

মাওলানা বললেন, লাবুস যা খায়। তাই খেতে দিও। সে যখন খাবে আমিও তার সাথে খাব।

ছোটকৰ্তা তো রাইতে কিছু খায় না।

কেন?

জানি না কেন। উনার হিসাব বোঝা বড়ই কঠিন। অনেক রাইত পর্যন্ত ঘাটিলায় বইসা থাকে। এক রাইতে দেখি জঙ্গলায় হাঁটতাছে।

এখন সে কোথায়?

ঘাটিলায় বসা। তাঁর বিষয়ে আরেকটা কথা আছে। সময় সুযোগ হইলে আপনারে বলব।

এখনই বলো।

জে-না, এখন বলব না। গোপন একটা বিষয়। হুজুর, পায়ে একটু তেল দিয়া দেই?

মাওলানা বললেন, না-না, পায়ে হাত দিও না।

হাদিস উদ্দিন তেল মাখানো শুরু করল। বাটিতে করে তেল সে সঙ্গে করে নিয়েই এসেছে।

 

শ্বেতপাথরের ঘাটলায় লাবুস বসে আছে। তার দৃষ্টি আকাশের দিকে। আকাশে প্রচুর মেঘ। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। তখন যে খুব একটা আলো হচ্ছে তা-না। কারণ আজও ঘন হয়ে কুয়াশা পড়েছে।

কুয়াশার ভেতর দিয়ে চাদর গায়ে মজু আসছে। চাদরের নিচে শার্টের বুক পকেটে সে একটা ক্ষুর নিয়ে এসেছে। তবে ক্ষুর সে ব্যবহার করবে না। ক্ষুর ব্যবহার করলেই চিৎকার শুরু হবে। এই ধরনের মৃত্যুর আগে মানুষ ভয়ঙ্কর চিৎকার করে। মজু ঠিক করেছে, সে পেছন থেকে গলা চেপে ধরবে। শব্দ করার কোনো সুযোগই মানুষটা পাবে না। মজু চাদরের আড়াল থেকে হাত বের করল। থাবার মতো বলশালী লোমশ হাত। দেখতেই ভালো লাগে। মজু বিড়ালের মতো নিঃশব্দে হাঁটতে শুরু করল। সে ছাতিম গাছের নিচে দাঁড়াবে। সেখান থেকে বাঘের মতো ঝাঁপ দিয়ে পড়বে।

মাজু খবর নিয়েই এসেছে যে লাবুস নামের মানুষটা অনেক রাত পর্যন্ত পুকুরঘাটে বসে থাকে। আজও সে বসে আছে এটা মজুর জন্যে ভালো। কাজ সহজ হয়ে গেছে। কুয়াশাটাও আজ ভালো সুবিধা দিচ্ছে। সব হচ্ছে হিসাবমতো। মজু ছাতিম গাছের নিচে চলে এলো। তার দৃষ্টি লাবুসের দিকে। হঠাৎ সেই দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। মজু দেখছে, একজন লাবুস বসে নেই, দু’জন বসে আছে। সিঁড়ির দুই ধাপে দু’জন।

মজু চোখ বন্ধ করল। তাকে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকতে হবে। সে বুঝতে পারছে তার চোখে ধান্ধা লেগেছে। অতিরিক্ত উত্তেজনায় চোখে এ ধরনের ধান্ধা লাগে। মজু জানে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে খোলার পরপরই ধান্ধা কেটে যাবে। সে দেখবে মানুষ একটাই বসে আছে।

সে চোখ খুলল। মানুষ এখনো দু’জন। যে দৃশ্য সে দেখছে তা চোখের ধান্ধা না, অন্যকিছু। অন্যকিছুটা কী সে বুঝতে পারছে না। মজুর মন বলছে আর এক মুহুৰ্তও এখানে থাকা ঠিক না। তাকে চলে যেতে হবে। এখনই যেতে হবে। মজু অনেক চেষ্টা করেও পা নাড়াতে পারল না। তার মনে হচ্ছে পায়ের প্রতিটি মাংসপেশি সীসার মতো হয়ে গেছে। সে কি চিৎকার করে সাহায্যের জন্যে কাউকে ডাকবে?

ছাতিম গাছের নিচে কে?

দু’জন মানুষের একজন কুয়াশায় মিলিয়ে গেছে। একজন শুধু আছে। সে তাকিয়ে আছে মজুর দিকে। তাকে একটা প্রশ্ন করেছে। তাকে প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।

আপনি কে?

আমার নাম মজু। আমি লঞ্চঘাটে কুলির কাম করি।

এত রাতে এখানে কী?

মজু জবাব দিল না। লাবুস বলল, আপনার সঙ্গে একটা ক্ষুর আছে। ক্ষুর নিয়ে কেন এসেছেন?

মজু এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। ক্ষুর তার পকেটে। সে গায়ে একটা চাদরও দিয়েছে – এই মানুষটার ক্ষুরের কথা জানার কোনোই কারণ নেই।

লাবুস বলল, যান বাড়িতে যান।

মজু রওনা হলো। পা ফেলতে এখন আর তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

 

ইমাম করিমের স্ত্রী শলার ঝাড়ু দিয়ে উঠা ঝাঁট দিচ্ছে। করিম সারারাত ইবাদত বন্দেগি করে এখন শুয়ে ঘুমাচ্ছে। মনে হয়। দুপুর পর্যন্ত ঘুমাবে। শরিফার মাথায় গোপন এক ইচ্ছা কিলবিল করছে। বোরকা পরে কিছুক্ষণের জন্যে সে কি বের হবে? মূলসড়ক পাশে রেখে জংলার ভেতর দিয়ে চলে যাবে। হরিচরণ বাবুর কবরের (যার বর্তমান নাম মোহাম্মদ আহম্মদ) পাশের আমগাছে মাথার এক গাছি সুতা বেঁধে বলবে- আল্লাহপাক দয়া কর। একশ’ টাকার নোটটা পাওয়ায়ে দাও। যেতে আসতে বেশি সময় লাগার কথা না। এর মধ্যে করিমের ঘুম ভাঙলে খুব সমস্যা হবে না। সে বলবে খাওয়ার পানি আনতে গিয়েছিল। বান্ধবপুরে দুটা টিউবকল। একটা মুসলমানদের জন্যে, একটা হিন্দুদের জন্যে।

হিন্দু টিউবকলটা ঘরের কাছে। মুসলমান টিউবকল একটু দূরে। পানি আনতে দেরি হতেই পারে। উঠান ঝাট অসমাপ্ত রেখেই শরিফা অতি দ্রুত ঘরে ঢুকে বোরকা পরল। এলুমিনিয়ামের কলসি হাতে বের হয়ে গেল।

বনের ভেতর দিয়ে পথ। শরিফা ঝড়ের গতিতে যাচ্ছে। তার ভয় ভয় করছে, আবার ভালোও লাগছে। মনে হচ্ছে তার বয়স কমে গেছে। শরীর নিয়ে বিব্রত থাকার মতো বয়সও হয় নি। ইচ্ছা করলেই সে বোরকা খুলে ফেলতে পারে।

শরিফা আমগাছের ডালে সুতা বাধল। চোখ বন্ধ করে বলল, আল্লাহপাক, দয়া কর। আমি দরিদ্র মেয়েমানুষ। ভাইজান আমাকে আদর করে একশ’টা টাকা দিয়েছেন। কতকিছু কিনব শখ করে আছি। তুমি টাকাটা মিলায়ে দাও।

সুতা বেঁধে শরিফা ফিরছে। জঙ্গলের ভেতর ঢুকেই সে বোরকার মাথার পর্দা সরিয়ে দিল। জঙ্গলােভর্তি গাছপালা। গাছপালার সামনে পর্দা করার কিছু নাই।

মা, এখানে কী করেন? শরিফা চমকে উঠল। বঁদিকে শিমুল গাছের নিচে লাবুস দাঁড়িয়ে আছে। শরিফার উচিত দ্রুত বোরকার পর্দা ফেলে দেয়া। কিন্তু তার হাত-পা কেমন শক্ত হয়ে গেছে।

মা, আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন? আমি লাবুস। এক রাতে আপনি আমাকে আদর করে খানা দিয়েছিলেন।

শরিফা ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আমি যাই। আমি যাই।

লাবুস বলল, আমি আপনাকে জংলী পার করায়ে দেই?

শরিফা বোরকার পর্দা ফেলে দিয়ে ভীত গলায় বলল, লাগবে না লাগবে না।

শরিফা দৌড়াচ্ছে। যে-কোনো সময় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে এমন অবস্থা।

বাড়ির উঠানে ঢুকে শরিফা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বাড়ি সুনসান। করিমের ঘুম এখনো ভাঙে নি। ঘুম ভাঙলে সে শরিফাকে না দেখে চিন্তিত হয়ে উঠানে বসত।

শরিফা ঘরে ঢুকল। করিম চাদর গায়ে ঘুমাচ্ছে। শরিফা বোরকা খুলে উঠানে এসে অসমাপ্ত ঝাড়ু শুরু করল। কলাপাতার বেড়ার ওপাশ থেকে কেউ একজন গলাখ্যাকারি দিয়ে বলল, ইমাম সাহেব আছেন? উনার সঙ্গে বিশেষ প্রয়োজন ছিল। শরিফা জবাব দিল না। জবাব দেবার অর্থ পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলা।

বেড়ার ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো, আমার নাম মজু। ইমাম সাহেব একটা কাজে আমাকে একশ’ টাকা দিয়েছিলেন। কাজটা হয় নাই। আমি টাকাটা ফেরত দিব। এখনই ফেরত দিতে হবে। আমি লঞ্চে উঠব। কইলকাতা याद।

শরিফা দাঁড়িয়ে আছে। একশ’ টাকার কথা উঠেছে। ব্যাপারটা কী? করিম একশ’ টাকা কোথায় পেয়েছে?

মজু বলল, আপনে বাড়ির ভিতরে যান। আমি উঠানে টাকা রাইখা যাব। জলচৌকির উপর রাখব।

শরিফা ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। তার বুক ধ্বক ধ্বক করছে। ঘটনাটা কী?

জলচৌকির ওপর পাথর চাপা দেয়া নোটটা যে শরিফার এই বিষয়ে শরিফা নিশ্চিত। নোটের এক কোনায় হলুদের দাগ। গাছে চুল বাধায় কাজ হয়েছে। আল্লাহপাক শরিফার টাকা শরিফাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তবে এখন শরিফার মনে হচ্ছে কাজ না হলেই ভালো হতো। কিছু জিনিস গোপন থাকাই ভালো।

শরিফা!

শরিফা চমকে তাকাল। ঘুমন্ত মানুষ জেগে উঠেছে। তার গলায় বিরক্তি।

ফজর ওয়াক্ত পার হয়েছে, তুমি আমারে ডাকলা না— এটা কেমন কথা! তুমি নিজে কি নামাজ পড়েছ?

পড়েছি।

নিজে ঠিকই পড়লা, আমারে ডাকলা না?

আপনে সারা রাইত জাগনা ছিলেন এই জন্যে ডাকি নাই।

বিরাট অন্যায় করেছ শরিফা। বিরাট অন্যায়। তাড়াতাড়ি অজুর পানি দেও।

করিম অজু করছেন। শরিফা জলচৌকিতে বসা করিমের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে চোখ ফেরাতে পারছে না। এই মানুষটা তার একশ’ টাকা চুরি করেছে? এই মাওলানা মানুষ। তার স্বামী। হাদিস কোরান জানা স্বামী। তাকে কি শরিফা সরাসরি প্রশ্ন করবে? না-কি চুপ করে থাকবে?

করিম অজুর শেষে গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, কী দেখো?

আপনারে দেখি।

আমারে দেখার কী আছে?

শরিফা বলল, আইজ আপনারে সুন্দর লাগতেছে। চেহারায় নুরানি ফুটছে। আপনারে একটা প্রশ্ন করব। নামাজের আগে করব না। পরে করব বুঝতেছি না।

কর, এখনই কর। আর একটা কথা, সব সময় মাথার মধ্যে প্রশ্ন নিয়া ঘুরবা না। বলো প্রশ্নটা কী?

শরিফা বলল, হাদিস কোরান মতে চুরির শাস্তি কী?

হাদিস কোরান মতে চুরির শাস্তি ভয়ঙ্কর। প্রথমবার যে চুরি করবে। তার ডান হাত কেটে ফেলতে হবে। তারপরেও চুরি করলে বাম হাত।

আপনার ডান হাত কাটা গেলে আপনে চলবেন কীভাবে?

কী বললা?

শরিফা চুপ করে রইল। করিম বলল, একশ’ টাকা হারায়া তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এখন আমারে চোর ভাবতেছ। আল্লাহপাক এই কারণে তোমারে কঠিন শাস্তি দিবেন। শাস্তি থেকে বাঁচার একটাই পথ। তওবা করা। আমার সঙ্গে তিনবার বলো- তওবা আস্তাগাফিরুল্লা।

তাওবা আস্তাগাফিরুল্লার।

আবার বলো তওবা আস্তাগাফিরুল্লা।

শরিফা আবার বলল, তওবা আস্তাগাফিরুল্লা। বলতে বলতে সে কী মনে করে হেসে ফেলল। মাওলানা ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, হাসো কেন? কিছুই বুঝলাম না, এখানে হাসির কী আছে!

শরিফা বলল, আমার হারানো টাকা আমি খুঁজে পেয়েছি, এইজন্যে মনের আনন্দে হাসতেছি। এই দেখেন টাকা। এক কোনায় হলুদের দাগ।

শাড়ির আঁচল খুলে শরিফা টাকা বের করেছে। মেলে ধরেছে।

টাকা কই পাইলা?

আপনে একজনেরে টাকাটা দিয়েছিলেন, সে ফিরত দিয়া গেছে।

তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? তুমি এইসব কী বলতেছ?

টাকা আপনে আমার বরই-এর হাঁড়ি থাইকা চুরি করেন নাই?

কী বলো তুমি!

শরিফা ঠান্ডা গলায় বলল, আপনে নামাজ শেষ কইরা স্থির হয় বসেন। আমি আপনের হাত কাটব। কুড়াল দিয়া এক কোপ দিব।

নাউজুবিল্লাহ। নাউজুবিল্লাহ।

নাউজুবিল্লাহ, বইলা লাভ নাই। আমি সত্যি হাত কাটব। বিসমিল্লাহ, বইল্যা এক কোপ দিব।

হঠাৎ শরিফার হাসি পেয়ে গেল। মানুষটা ভয় পেয়েছে। মনে হয়। সতি্যু সত্যি বিশ্বাস করছে তার হোত কাটা যাবে। শরিফার সামান্য মায়াও লাগছে।

করিম বলল, শরিফা তুমি পাগল। আমি পাগল স্ত্রীর সঙ্গে সংসার করব না। আমি ঠান্ডামাথায় পশ্চিমমুখী হইয়া তোমারে তালাক দিতেছি। তালাক তালাক তালাক।

শরিফ বিড়বিড় করে বলল, আমারে তালাক দিলেন?

হ্যাঁ  দিলাম। শুনতে না পাইলে আরেকবার বলতেছি— তালাক তালাক তালাক। শুনেছ?

শুনেছি।

শরিফা বড় করে নিঃশ্বাস নিল। সে ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছে। চারপাশে কী ঘটেছে বুঝতেও পারছে না। গরম বোধ হচ্ছে। কপাল ঘামছে। ইচ্ছা করছে দিঘির ঠান্ডা পানিতে গলা ড়ুবিয়ে শুয়ে থাকে।

করিম বলল, আমি যে তোমারে তালাক দিয়েছি। এটা কি বুঝেছ?

বুঝেছি।

খোরপোষের টাকা এখন দিতে পারব না। ধীরে সুস্থে দিব। হাতে টাকা নাই।

আচ্ছা।

আমি এখন বেগানা পুরুষ। আমার দিকে এইভাবে তাকাবা না। মাথায় ঘোমটা দাও। ঘরে যাও। ভাটির দেশে তোমারে পাঠাইবার ব্যবস্থা নিতেছি। ভাই বেরাদরের সঙ্গে থাকিবা।

আমি কোনোখানে যাব না। এইখানেই থাকব।

অসম্ভব।

করিম জয়নামাজে দাঁড়ালেন। নামাজ দ্রুত শেষ করে খোঁজ নিতে হবে ঘটনা কী ঘটেছে। কিছুক্ষণ আগে তিনি স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন। এই নিয়ে তার মনে তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আপদ বিদায় করতে হবে। কেরায়া নৌকায় করে বদ মেয়েটাকে বাপের দেশে পাঠিয়ে দিতে হবে। ভাগ্য ভালো মেয়েটার পেটে সন্তান নাই। সন্তান থাকলে ইন্দাতের সময়ের জন্যে অপেক্ষা করতে হতো।

শরিফা কাঁদছে। শব্দ করে কাঁদছে। করিম নামাজে মন দিতে পারছেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *