২০. পিসির ঘাড়ে আর কতোদিন

তোমার পিসির ঘাড়ে আর কতোদিন থাকা হবে?

বললো সত্যবান দাস নামের ছেলেটা, শম্পা যাকে একটু বদলে নিয়ে বলে জান্ধুবান

সেই শব্দটাই ব্যবহার করলো শম্পা, থার্মোমিটারটা ঝাড়তে ঝাড়তে অকাতর কণ্ঠে বললো, তা হাতের কাছে যখন তোমার কোনো মাসি পিসির ঘাড় পাচ্ছি না, তখন উপায় কি?

আমার মাসি-পিসি? তারা ঘাড় পাতবে? সত্যবান হেসে ওঠে, ওই ভদ্রমহিলার মতো এমন বোকাসোকা মহিলা দুনিয়ায় আর আছে নাকি?

আছে, আরোও একটি আছে শম্পা বলে গম্ভীরভাবে, আপাতত একটা জাম্বুবানকে ঘাড়ে করে যার জীবন মহানিশা হয়ে উঠেছে

সত্যি শম্পা

আচ্ছা আচ্ছা, ভদ্রতা সৌজন্য আক্ষেপ ইত্যাদি ইত্যাদি পরে হবে, এখন টেম্পারেচারটা দেখে নেওয়া হোক একবার!

না।

না! না মানে?

না মানে-স্পট পরিষ্কার না। জ্বরফর ছেড়ে গেছে। তবু এখনো ওই বিচ্ছিরি জিনিসটা নিয়ে তাড়া করতে আসছ কেন শুনতে চাই।

আশ্চর্য! তোমার মতন বেহায়া তো আর দেখিনি! দু’দুবার পাল্টে পড়েছ কিনা!

দুবার পড়েছি বলেই যে বরাবরই পড়ব তার মানে নেই! আমি বেশ সুস্থবোধ করছি, কাল চলে যাবো।

শম্পা গভীরভাবে বলে, খুব ভালো কথা, তা বাসাটা যোগাড় হয়ে গেছে?

বাসা? বাঃ, সেটা আবার কখন করলাম?

তাহলে? কালই যাচ্ছ–

কী আশ্চর্য! আমার ঘরটা কি চলে গেছে নাকি? এ মাসের পুরো ভাড়া দেওয়া আছে।

ওঃ, তাহলে তো ভালোই, শম্পা যেন ভারী আশ্বস্ত হয়ে গেল এইভাবে বলে, মেসের মধ্যে মহিলা থাকায় আপত্তি করবে না তো তোমার ম্যানেজার?

‘মহিলা!’ সত্যবান আকাশ থেকে পড়ে, তুমিও যাবে নাকি?

শম্পাও আরো ও আকাশ থেকে পড়ে, ওমা! যাব না কোথায় থাকবো?

সত্যবান অবশ্যই বিপন্ন বিব্রত।

সত্যবান তাই সামলানোর গলায় বলে, আহা এখন কটা দিন তো এখানেই থাকতে পারো, তারপর

কী-তারপর?

তারপর বাসা-টাসা ঠিক করে—

শম্পা জোরে জোরে বলে, ওঃ, ওই আশায় বসে থাকবো আমি? তাহলেই হয়েছে। তোমার ভরসায় বসে থাকলে, রাধাও নাচবে না, সাত মণ তেলও পুড়বে না।

আমার উপর যখন এতই অবিশ্বাস, তখন আর আমাকে জ্বালাচ্ছো কেন? সত্যবান বলে ওঠে, কেটে পড়ো না বাবা!

তা তো বটেই, তাহলে তো বেঁচে যাও। কিন্তু সে বাঁচার আশা ত্যাগ করো। কুমীরে কামড় দিলে বাঘেও ছাড়িয়ে নিতে পারে না, বুঝলে?

বাঃ, নিজের প্রতি কি অসীম শ্রদ্ধা! সত্যবান বলে।

শম্পা গম্ভীরভাবে বলে, নিশ্চয়। শ্রদ্ধা আছে বলেই সত্যভাষণ করছি। যাক–এখন নাও এটা এগিয়ে দেয় যন্ত্রটা সত্যবানের দিকে।

সত্যবান আর প্রতিবাদ করতে ভরসা পায় না। হাত বাড়িয়ে থার্মোমিটারটা নিয়ে দেখে ফেরত দেয়।

শম্পা সেটাকে আলোর মুখে ধরে, জ্বরের পারার অবস্থান লক্ষ্য করে হৃষ্টচিত্তে বলে, যাক বাবা, এযাত্রা তবু আমার মুখটা রাখলে-

মুখ রাখলাম! সত্যবানের বোধ হয় কথাটা বুঝতে দেরি হয়, সত্যবান তাই কপাল কুঁচকোয়, মুখ রাখা মানে?

না, এই লোকটাকে বোধ হয় ইহজীবনেও মানুষ করে উঠতে পারা যাবে না! বলি ওই জ্বরের দাপটে টেসে গেলে, মুখটা থাকতো আমার? সেইটুকুর জন্যেই ধন্যবাদ জানাতে হচ্ছে তোমাকে।

বাঃ! তোমার মুখ থাকার জন্যেই শুধু আমার বেঁচে ওঠার সার্থকতা?

তবে না তো কি? এরপর যতবার ইচ্ছে মরো, কোনো আপত্তি নেই। শুধু এই যাত্রাটা যে কাটিয়ে দিলে তাতেই মাথাটা কিনলে।

এর পর যতবার ইচ্ছে মরতে পারি?

অনায়াসে।

উঃ,কী সাংঘাতিক মেয়ে। এখন ভাবছি তোমার সঙ্গে সটকে পড়ে খুব ভুল করেছি।

সেকথা আর বলতে-, শম্পা খুব সহানুভূতির গলায় বলে, একশবার। তোমার জন্যে দুঃখু হয় আমার।

ও, দয়ার অবতার একেবারে। কিন্তু সত্যি বলে দিচ্ছি, আর এভাবে পিসির ঘাড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না! এ কী, আমি একটা বুড়ো মদ্দ, একটু জ্বরের ছুতো করে কাজকর্ম ছেড়ে একজন অপরিচিতা মহিলার ঘাড়ের ওপর পড়ে আছি! ভাবলেই রাগ আসছে।

রাগ আসা ভালো। আমার দিদিমা বলে, রাগই পুরুষের লক্ষণ। তবু জানবো একটা পুরুষের গলা ধরেই ঝুলেছি। কিন্তু বিয়েটা কবে হবে?

বিয়ে!

হা, বিয়ে। যাকে শুদ্ধ বাংলায় বলে “বিবাহ”। যদিও আমার সেটা প্রহসন বলেই মনে হয়, তবু ওই প্রহসনটা না হলেও তো স্বস্তি নেই।

সত্যবান ওর মুখের দিকে একটু তাকিয়ে বলে, এখনো ভাববার সময় আছে শম্পা, ঝোঁকের মাথায় একটা কাজ করে বসে শেষে পস্তাবে।

সত্যবান সভ্য-ভব্য কথার ধার ধারে না, সত্যবান ওইভাবেই বলে, ছেড়ে দাও বাবা, আমিও বাঁচি, তুমিও বাঁচো।

শম্পা থার্মোমিটারকে দোলাতে দোলাতে বলে, তুমি বাঁচতে পারো, আমার কথা তুলছ কেন?

তুলছি তোমার দুর্গতির কথা ভেবে। কী যে আছে তোমার কপালে!

যা আছে তো ঠিকই হয়ে গেছে। স্রেফ একটি জাম্বুবান। তাও আমার এমনি কপাল, তাকেও হারাই হারাই করে মরতে হচ্ছে!

সত্যবান একটু কড়া গলায় বলে, সেই মরাটা মরতেই তো বারণ করা হচ্ছে।

পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ।

সত্যবান হতাশ গলায় বলে, কিছুতেই যদি তোমার সুমতি না করাতে পারি তো উপায় নেই। দুর্গতি তোমার কপালে নাচছে। আপাততঃ প্রথম দুর্গতি তো হচ্ছে অনশন। খেতে-টেতে পাবে না, সে-কথা প্রথমেই বলে রেখেছি, মনে আছে?

আছে।

তবে আর কী করা যাবে? দাও কোথায় কি খাবারটাবার আছে, দারুণ খিদে পেয়ে গেছে।

শম্পা সঙ্গে সঙ্গে পাক খেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে সিঁড়িতে উঠতে উঠতে চেঁচায়, পিসি, জ্বর বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কুম্ভকর্ণটা খাই-খাই শুরু করেছে।

পারুল একটা চিঠি লিখছিল, মুড়ে রেখে অন্যমনা গলায় বলে, কে কী শুরু করেছে?

ওই যে ওই হতভাগা–ইয়ে কাকে চিঠি লিখছো গো?

পারুল অন্যমনস্কতার রাজ্য থেকে নেমে এসে হালকা গলায় বলে, যাকেই লিখি না, তোকে বলতে যাবো কেন?

আহা তুমি তো আর ইয়ে, শম্পা একটু থেমেই ফট্‌ করে বলে বসে, তেমন কাউকে তো লিখছো না

তাই যে লিখছি না, কে বললো তোকে?

আহা!

শম্পা হেসে ফেলে, তা বলা যায় না বাবা, তুমি তো আবার কবিমানুষ, তা ছাড়া বয়েস হলেও বুড়ো-ফুড়ো হয়ে যাওনি

তবে? পারুল হেসে বলে, তা তুই যে দুমদাম করে উঠে এলি, সে কি এই কথাটা বলবার জন্যে?

এই সেরেছে–, শম্পা মা-কালীর মতো জিভ কাটে, একদম ভুলে মেরে দিয়েছি। জাম্বুবানটা বলছিল দারুণ খিদে পেয়েছে

এই দ্যাখো! আর তুই সে-কথা ভুলে মেরে দিয়ে পিসির চিঠি-রহস্য ভেদ করতে বসলি? চল্ চল্।

পারুল তাড়াতাড়ি কলম রেখে উঠে পড়ে।

পারুলের আত্মমগ্ন নিস্তরঙ্গ জীবনে এই মেয়েটা একটা উৎপাত, এই ছেলেমেয়ে দুটো একটা ভার, তবু পারুলের বিরক্তি আসে না কেন?

পারুলের ছেলেরা দেখলে কী বলতো?

ও বলছিলো কালই চলে যাবে–, শম্পা পিছু পিছু যেতে যেতে বলে, বলছে তোমার পিসির ঘাড়ে আর কতদিন থাকবো? আচ্ছা পিসি, এক্ষুণি ওকে একা ছাড়া যায়?

‘পাগল!’ পারুল উড়িয়ে দেওয়ার সুরে বলে, মাথা খারাপ?

তবে? তুমি এতো বুদ্ধিমতী, তুমিও যখন বলছে

আমি যেতে দিলে তো?

বাচলাম বাবা! শম্পা ছেলেমানুষের মতো আবার বলে ওঠে, কিন্তু বলো না গো পিসি, চিঠিটা তোমার ভাই-টাইকে লিখছো না তো?

পারুল সহসা গম্ভীর গলায় বলে, আমায় তুই সেই রকম বিশ্বাসঘাতক ভাবিস?

শম্পা ফট করে নিভে যায়। আস্তে বলে, না তা নয়, তারাও তো ভাবছেন-টাবছেন নিশ্চয়, সেই ভেবে যদি তুমি

নাঃ, আমি ওসব ভাবাটাবার ধার ধারি না, নিজে যা ভাবি তাই করি।

ইস পিসি! আমার মতন মনের জোর যদি আমার হতো। পারুল টোস্ট তাতাতে তাতাতে বলে, তোর মনের জোর আমার থেকেও বেশী।

শম্পা একটু চুপ করে থেকে নেভানেভা গলায় বলে, আগে তাই ভাবতাম, কিন্তু দেখছি–

কী দেখছিস?

দেখছি মন-কেমন-টেমন ব্যাপারটাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পিসির জন্যে এক-এক সময় এতো ইয়ে হয়। তখন নিজেকে ভীরু স্বার্থপর মনে হয়।

মানুষ মাত্রেই স্বার্থপর রে শম্পা, কেউ বুঝে-সুঝে, কেউ না বুঝেই। এই যে লোকে স্বার্থত্যাগী বলতে উদাহরণ দেয় সন্ন্যাসীদের, স্বার্থত্যাগী সন্ন্যাসী আসলে কি সত্যিই তাই? আমার তো মনে হয় ওনারাই সব থেকে স্বার্থপর

ধ্যাৎ?

ধ্যাৎ কি, সত্যি। অন্যের মুখ না চেয়ে, নিজের যেটি ভালো লাগছে, সেইটি করাই স্বার্থপরতা। কৃচ্ছসাধনে তার সুখ, তাই কৃচ্ছসাধন করছে। সংসারবন্ধন থেকে পালিয়ে প্রাণ বাচানোয় তার সুখ, তাই পালাচ্ছে। এতে নিঃস্বার্থতা কোথায়?

এই মরেছে! তুমি যে আমায় বসিয়ে দিলে গো।

চোখ খুলে যদি তাকাস পৃথিবীতে, দেখবি হরঘড়িই বসে পড়তে হবে।

তাই তো দেখছি। শম্পা অন্যমনষ্কের মতো বলে, আচ্ছা পিসি, আমি যেন কী বলতে এসেছিলাম তোমায়?

পারুক হেলে ফেলে, যা বলতে এসেছিলি তা তো এই প্লেটে সাজানো হচ্ছে।

ওহো-হো। দাও দাও। হায় রে, এতোক্ষণে ঘরবাড়িই খেয়ে ফেললো। দাও।

আমিই যাচ্ছি চল।

তুমি? হতভাগা ওতে আবার লজ্জা পায়!

পারুল মৃদু হেসে বলে, কেন, লজ্জা কিসের? মা-পিসিরা খেতে-টেতে দেয় না?

পিসি!

শম্পার গলাটা হঠাৎ বুজে আসে, আস্তে আস্তে বলে, তোমার বোনেরা, তোমাদের ভাইরা একেবারে দু’রকম!

তা সবাই কি এক রকম হয়? তুই তোর ভাইবোনদের মতো?

তা নয় কট। তবু, শম্পা একটু থেমে বলে, আচ্ছা পিসি, লোকেদের যদি ছেলেমেয়ে বিয়ে যায়, তারা কাগজে-টাগজে বিজ্ঞাপন দেয় তো?

পারুল ওর মুখের দিকে একটু তাকিয়ে দেখে, তারপর হালকা গলায় বলে, তা দেয়-টেয় তো দেখি।

কিন্তু শম্পার গলাটা যেন আরো ভারী-ভারী লাগে, আর যদি রাগ-ঝগড়া করে চলে যায়, এও তো লেখে, অমুক তুমি কোথায় আছে জানাও, আমরা অনুতপ্ত।

পারুল হেসে ফেলে, সেটা ছেলেকে বলে, মেয়েকে নয়!

ওঃ! কিন্তু কেন বল তো? মা-বাপের স্নেহটাও কি দু’তরফের জন্যে দু’রকম?

হয়তো তাই-ই–, পারুল অন্যমনা গলায় বলে, হয়তো তা নয়। কিন্তু মেয়ে হারিয়ে যাওয়ার খবর ঘোষণা করলে লোকলজ্জা যে! মেয়েদের হারিয়ে যাওয়ার একটাই মানে আছে কিনা–থাক ওসব কথা, ছেলেটার ক্ষিদে পেয়েছিল–

পারুল খাবারের থালা হাতে নিয়ে হালকা পায়ে দ্রুত নেমে যায়।

শম্পাও নামে। আস্তে আস্তে। শম্পার এই ভঙ্গীটা একেবারে অপরিচিত।

পঙ্গার একেবারে কিনারা ঘেষে একটা ভাঙা শিবমন্দির তার বিদীর্ণ-দেহ আর হেলে-পড়া মাথা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালের স্বাক্ষর বহন করে। কতকাল আছে কে জানে! স্থানীয় অতি বৃদ্ধ ব্যক্তিরাও বলেন, শৈশবকাল থেকেই তাঁরা মন্দিরটার এই চেহারাই দেখে আসছেন, এমনি পরিত্যক্ত, এমনি অশ্বথ গাছ গজানো।

এদিকে কেউ বড় একটা আসে না। কারণ এ ধরনের পরিত্যক্ত মন্দিরের ধারেকাছে সাপখোপ থাকার সম্ভাবনা প্রবল।

ডানপিটে ছেলেরা অবশ্য সাপের ভয় বাঘের ভয় কিছুই কেয়ার করে না, কিন্তু কাছাকাছির মধ্যে তেমন আকর্ষণীয় কোনো ফুলফলের গাছ নেই যা তাদের টেনে আনতে পারে। অতএব জায়গাটা নির্জন।

ওরা বিকেল থেকে একটু নির্জন ঠাঁই খুঁজে খুঁজে প্রায় হতাশ হবার মুখে হঠাৎ এই জায়গাটা আবিষ্কার করে ফেলে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো, যাক-এতক্ষণে পাওয়া গেল।

মন্দিরের পিছনের চাতালটা প্রায় গঙ্গার উপর ঝুলন্ত অবস্থায় বিরাজমান। তার সিমেন্টচটা সুরকি-ওঠা অঙ্গের মাঝখানে মাঝখানে খানিকটা খানিকটা অংশে পুরনো পালিশের কিছুটা চিহ্ন যেন যাই-যাই করেও দাঁড়িয়ে আছে। তেমনি একটুকরো জায়গা রুমাল দিয়ে ঝেড়ে নিয়ে বসে পড়লো ওরা।

শম্পা আর সত্যবান।

পড়ন্ত বেলায় গঙ্গার শোভা অপূর্ব, তার উপর এ জায়গায় তো প্রায় গঙ্গার ওপরেই। শম্পা বিগলিত কণ্ঠে বলে, মার্ভেলাস। তারপর দম নিয়ে বললো, এতক্ষণ জায়গা না পেয়ে রাগে হাড় জ্বলে যাচ্ছিলো বটে, এখন দেখছি ভালই হয়েছে।

তোমার অবশ্য হাড়টা একটু সহজেই জ্বলে! বলে হাসলো সত্যবান।

শম্পা এ কথায় পুরোপুরিই দপ করে জ্বলে উঠলো, সহজে মানে? চল্লিশ মিনিট ধরে খুঁজে মরছি না একটু বসে পড়বার মতন জায়গা? পাচ্ছিলাম? উঃ, পৃথিবীতে এত লোক কেন বলতে পারো? অসহ্য!

চমৎকার! পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আর লোক থাকবে না? বললে সত্যবান।

ওর থেকে সাজিয়ে-গুছিয়ে উচ্চাঙ্গের ভাষা দিয়ে কথা বলার ক্ষমতা ওর নেই তাই ওইটুকুই বলল। শম্পার বান্ধবীদের দাদারা বলে, এইটুকু প্রসঙ্গর উপর নির্ভর করেই অনেক কায়দার ভাষা আমদানি করে রীতিমত জমিয়ে ফেলতে পারতো। যা দেখতে দেখতে আর শুনতে শুনতে এত বড়োটি হয়েছে শম্পা। কিন্তু অনেক প্রেমে পড়ার পর আপাতত শম্পা এমন এক প্রেমের মধ্যে পড়ে বসে আছে, যে প্রেমের নায়ক একটা কারখানার কুলি বললেই হয়।

অতএব সে শুধু কথা কইতে পারে, কথা রচনা করতে জানে না।

তাই সে শুধু বলে ওঠে, বাঃ চমৎকার, তুমি ছাড়া আর লোক থাকবে না পৃথিবীতে?

শম্পা নিজের ভঙ্গীতে কাল, থাকবে না কেন, সম্ভবমতো থাকবে। এমন নারকীয় রকম বেশী লোক থাকবে কেন? এত লোক থাকা একরকম অশ্লীলতা।

অশ্লীলতা!

তাছাড়া আবার কি? দুটো মানুষে দুদণ্ডের জন্যে স্বস্তি করে একটু বসতে চাইলে ঘরে খিল বন্ধ করা ছাড়া গতি নেই, এটা অশ্লীলতা ছাড়া আর কী? বীভৎস বিশ্রী অশ্লীল!

অন্যরাও আমাদের দেখে এই কথাই ভাবে।

শুধু ভাবে নয়, বলেও। শম্পা বিরক্ত-তিক্ত হাসির সঙ্গে বলে শুনলে না তখন? সেই বুড়ী দুটো মন্তব্য করলো? উঃ, নেহাৎ তুমি প্রায় আমার মুখ চেপে ধরলে তাই উচিত জবাব দিয়ে আসতে পেলাম না, নইলে শিক্ষা দিয়ে দিতাম।

আহা বুড়ী দুটো নিশ্চয় তোমার ঠাকুমা-টাকুমার বয়সী।

হতে পারে। তাই বলে যা ইচ্ছে বলবার কোনো রাইট থাকতে পারে না। দু’দশদিন আগে জন্মেছে বলে মাথা কিনেছে নাকি? বলে কিনা, কী পাপ। কী পাপ! গঙ্গাতীরে বসে একটু জপ করবারও জো নেই! সর্বত্ত ছোড়া-ছুড়ির কেত্তন। এ দুটো আবার কোন্ চুলো থেকে এসে জুটলো?

সব কথা তুমি শুনতে পেয়েছিলে?

পাবো না মানে? আমাদের কান বাঁচিয়ে বলেছিল নাকি? বরং যাতে কানে ভালো করে প্রবেশ করে তার চেষ্টা ছিল।

আমি কিন্তু অতো সব কিছু শুনতে পাইনি।

তোমার কথা ছাড়া। মাথায় ঘিলু বলে কিছু থাকলে তো?

এটুকুর জন্যে ঘিলুর কোনো দরকার হয় নাকি?

হয় না তো কি! ঘিলু কম থাকলেই শ্রবণশক্তি কম হয়, বুঝলে?

বুঝলাম। সত্যবান হেসে ফেলে বলে, কিন্তু পরে আর এক বুড়ির মন্তব্য বোধ হয় তুমি শুনতে পাওনি। শুনলে নির্ঘাত তার ঘাড়ের মাংসে কামড় বসাতে।

বটে বটে, বটে নাকি?

সম্পা প্রায় লাঠির মতো সোজা হয়ে ওঠে, শুনি কথাটা?

শুনলে ক্ষেপে যাবে।

যাই যাব, বল তো শুনি। কথাটা আমার পক্ষে খুব আহ্লাদের নয়।

শম্পার প্রকৃতিতে ধৈর্যর বালাই নেই, তাই শম্পা ঝেঁজে ঝেকে ওঠে, তোমার পক্ষে আহ্লাদের না হলে, আমার পক্ষেও কিছু আহ্লাদের নয়, তবু শোনাই যাক।

শুনে লাভ কিছু নেই। ওদিকের ঘাটে সিঁড়ির কোণায় যে একটি সিঁদুর-টিদুর পরা বুড়ী বসেছিলেন, আমরা ওখানটায় ঢঁ মেরে সরে আসতেই বলে উঠলেন, আহা মরে যাই, বাছার পছন্দকে বলিহারি! একটা কাফ্রী ছোড়াকে জুটিয়ে–

সত্যবান হেসে উঠে বলে, শেষটা আর শুনতে পেলাম না।

শম্পা কড়া গলায় বলে, সেই বুড়ীকে আবার তুমি বসেছিলেন বলেছিলেন করে মান্য দিয়ে কথা বলছে? বুড়ীটা বলতে পারো না?

বলে লাভ? তেনার কানে তো পৌঁছচ্ছে না!

না পৌঁছক-শম্পা হাতের কাছ থেকে ঘাসের চাপড়া উপড়ে নিয়ে সেটাকে কুচি কুচি করতে করতে বলে, বুড়ীগুলো আমার দু’চক্ষের বিষ। একটু সভ্য করে কথা বলতেও জানে না। কেন “মেয়ে” বললে কী হয়? কী হয় “ছেলে” বললে? তা নয়-ছোঁড়াছুঁড়ি! শুনলে মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে!

ওদেরও আমরা বুড়ী বলছি। কেন মহিলা-টহিলা বললে কী হয়?

দায় পড়েছে মহিলা বলতে! ওরকম অসভ্যদের আমি বুড়ীই বলব।

ওঁরাও তোমাকে ছুড়ীই বলবেন। বলবেন, ছুঁড়ী একটা কাফ্রী ছোঁড়াকে জুটিয়ে

থাক থাক থামো। বাদাম খাও।

ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে এক ঠোঙা চিনেবাদাম বার করে ফেলে শম্পা। সত্যবানের হাতে কয়েকটা দিয়ে নিজে একটা ছাড়াতে ছাড়াতে বিরক্ত গলায় বলে, যখন কিনলাম এত গরম হাতে নেওয়া যাচ্ছিল না, আর জায়গা খুঁজতে খুঁজতে ঠাণ্ডাই হয়ে গেল।

অতএব বোঝা গেল এতক্ষণ ধরে মনের মতো জায়গা খুঁজে বেড়াবার কারণটা কি। মাত্র ওই বাদামের ঠোঙাটির সদ্ব্যবহার করা। যদিও সত্যবান বলেছিল, ধ্যেৎ এইমাত্র পিসির কাছ থেকে পেটটা পুরো ভর্তি করে বেরিয়ে এলাম, আবার এখন চিনেবাদাম কী?

কী তা তুমি বুঝবে না বুদ্ধ! বাদাম ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে খাওয়া আর খোলা ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলার মধ্যেই তো সমস্ত কিছু! ওটাই প্রেমের মাধ্যম!

তা হবে। সত্যবান হেসে উঠে বলে, তুমি অনেক-অনেকবার প্রেমে পড়েছে, তুমিই ভালো জানো।

তা সত্যি। তুমি যে একেবারে “র” মাল। বেচারা!

শম্পা ওর দিকে আর কয়েকটা বাদাম এগিয়ে দিয়ে বলে, আচ্ছা এইবার বলো তোমার কথা। সকাল থেকে তো শোনাচ্ছো একটা কথা আছে–

কথাটা অবশ্য নতুন কিছু নয়, যা বলছি প্রথম দিন থেকে। কাল আমি চলে যাই

শম্পা গম্ভীরভাবে বলে, বেশ। তারপর?

তারপর আবার কি? যেমন কাজ-টাজ করছিলাম—

ভালো, খুব ভালো একাই যাওয়ার সঙ্কল স্থির তাহলে?

তাছাড়া যে আর কী হতে পারে বুঝছি না তো!

তুমি কোনদিনই কিছু বুঝবে না। যা বুঝছি চিরটাকাল সব কিছু আমাকেই বুঝতে হবে। যেমন আমার কপালের গেরো। নিজের হাতে নিজে বিষ খেয়ে মরেছি!

‘শম্পা!’ সত্যবান গম্ভীর গলায় বলে, এই যা বললে, এটাই ঠিক। সমস্তক্ষণ ঠিক ওই কথাই ভাবছি আমি। ঝোঁকের মাথায় আমার সঙ্গে ঝুলে পড়া তোমার পক্ষে বিষ খাওয়ারই শামিল।

শম্পা হাতের বাদামের খোলাগুলো গঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গভীরতর গম্ভীর গলায় বলে, উপায় কি? অবস্থাটা তো ওইরকম। ওই খোলাগুলোকে আর তুলে আনতে পারবে?

ওটা তো তুলনা মাত্তর।

কোনটা কি সে বোধ থাকলে তো? যাক ঠিক আছে, যা করবার আমিই করবো। নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে। বেশ, এখন আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি না, তুমি দেখ গে গিয়ে তোমার সেই মহামূল্য চাকরিটি আছে কিনা, তারপর দেখা যাক, আমার বি. এ. পাসের ডিগ্রীটা কোনো কাজে লাগানো যায় না। কিন্তু সেটা পরের কথা। এখন কলকাতায় গিয়ে একটা কাজ তোমায় করাতে হবে। আমি একটা চিঠি লিখে রাখবো, সেটা নিয়ে পিসির হাতে পৌঁছে দিয়ে বলবে

বাঃ, তুমি যে বলেছিলে তোমাদের বাড়ার ছায়া অবধি যেন আমি কখনো না মারাই

সে হুকুম এখনো বলবৎ! বাড়ির বাইরে কোথাও দেখা করে– মানে হরদমই তো বাইরে বেরোতে হয় পিসিকে, তেমনি কোনোখানে–

সত্যবান হাতের খোসাগুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে ফেলে বলে ওঠে, বাঃ, সেটা কী করে সম্ভব হবে? তিনি কখনো আমায় দেখেননি, আমিও কখনো তাকে দেখিনি, চিনবো কেমন করে?

তিনি তোমায় দেখেননি কখনো, এটা ঠিক–, শম্পা প্রবলভাবে মাথা ঝাঁকায়, তুমি এমন একটা দ্রষ্টব্য বস্তু নও যে দেশশুদ্ধ লোক তোমায় দেখে বসে আছে। কিন্তু আমার পিসি? রাতদিন কাগজে ছবি বেরোচ্ছে! নাকি তাও দেখোনি কোনোদিন?

আস্তে আস্তে বেলা পড়ে আসছিল, গঙ্গার অপর পারে নেমে আসছে ছায়া, সত্যবানই সেই দিকে তাকিয়ে আস্তে বলে, জানোই তো আমি কাঠখোট্টা কুলীমজুর মানুষ, সাহিত্য-টাহিত্যর কী খবর জানবো? কম বয়সে যা কিছু পড়েছি-টড়েছি, তারপর আর কি? উচ্চ শিক্ষার উচ্চ আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে পেটের ধান্ধায় ঘুরছি। তবে হ্যাঁ, এখন ওই আকাশটার দিকে তাকিয়ে, কতকাল আগে পড়া সেই একটা পদ্য মনে পড়ছিল–মেঘের পরে মেঘ জমেছে রঙের পর রঙ, মন্দিরেতে কাসরঘণ্টা বাজলো ঢং ঢং। দেখ তাকিয়ে, ঠিক সেই রকমই কিনা? চারিদিকে মন্দিরে-ঐন্দিরে আরতি শুরু হয়ে গেছে কাসরঘণ্টা বাজছে, আর রঙ-টঙ তো–তুমিই ভাল বুঝবে। সত্যবান মৃদু হেসে কথা শেষ করে।

শম্পাও ওর কথা শুনে তাকিয়ে দেখে, শম্পার মুখটা এই পড়ন্ত বেলার আলোয় ঝকঝকে দেখায়। শম্পা সেই ঝকঝকে মুখটা সত্যবানের দিকে ফিরিয়ে বলে, তুমিও কিছু কম বোঝো না। বেলাশেষের আকাশ দেখে যখন রবীন্দ্রনাথের কবিতা মনে পড়ে যায় তোমার। এই আকাশকে আবার একসময় উনি চিতার সঙ্গেও তুলনা করেছেন, ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার তুলে দিনের চিতা! পড়েছ?

কি জানি, মনে পড়ছে না।

না পড়ুক, পরে তোমায় সব পড়াবো। রবীন্দ্রনাথ না পড়লে–আচ্ছা পরের কথা পরে হবে, এখন তুমি আমার ঠাকুর্দার সেই বাড়িটির বাইরে কোথাও ঠাকুর্দার কন্যের সঙ্গে দেখা করবো করে চিঠিখানা দিয়ে বলবে, শম্পা বলে দিয়েছে, আপনি যে ওর খবর পেলেন এটা যেন কাউকে জানিয়ে ফেলবেন না।

ঠিক আছে। কিন্তু উনি যদি জিজ্ঞেস করেন, তুমি কে হে বাপু? তখন?

তখন? শম্পা হেসে উঠে বলে, তখন বোলো “আমি জাম্বুবান”! তাহলেই পরিচয় পেয়ে যাবেন।

ওঃ, এই নামেই আমার পরিচয় দিয়ে রেখেছে তাহলে?

তবে আবার কী? যার যা পরিচয়। শুনে অবশ্য পিসি বলেছিল, একটি জাম্বুবান ছাড়া আর কিছু জুটলো না তোর ভাগ্যে? তা আমি বললাম, জাম্বুবানদের ঘাড়টা খুব শক্ত হয়, তাই পর্বতের চূড়োটি চাপাতে ওটাই সুবিধে মনে হলো!

ভালই বলেছে। এখন দেখবো তোমার হুকুম পালন করে উঠতে পারি কিনা।

পারবে না মানে? তোমার ঘাড় পারবে।

আহা বুঝছে না, ওনারা হলেন হাই সার্কেলের মানুষ, বাড়ির বাইরে মানে তোমার গিয়ে মিটিঙে-টিটিঙে তো–সেখানে আমায় ওঁর কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে দেবে কি? হয়তো আর্জি করলে বাইরে থেকেই খেদিয়ে দেবে।

আহা রে মরে যাই! খেদিয়ে দিলেই তুমি অমনি সখেদে ফিরে আসবে! ছলে বলে কৌশলে যেভাবেই হোক কার্যোদ্ধার করতে হয়, এটা হচ্ছে মহাভারতের শিক্ষা।

ঠিক আছে।..দ্যাখো একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল।

গেল তার কি?

আর এখানে বসে থাকা উচিত নয়, সাপটাপ আসতে পারে।

তবে ওঠো–, শম্পা ঝঙ্কার দিয়ে বলে ওঠে, কপাল আমার যে, এই হতচ্ছাড়া লোকের সঙ্গে প্রেম করতে বসেছি আমি! এমন গঙ্গার ধার, এমন নির্জন জায়গা, এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, আর তুমি কিনা সাপের চিন্তা করতে বসলে!

কী করবো বল? ওটাই চিন্তায় এসে গেল যে?

রাবিশ! যদি বা বাদামভাজার লোভটাভ দেখিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে এনে ফেললাম, তারপর কিনা শূন্যি।

অন্ধকার গম্ভীর হয়ে আসছিল, পরস্পরের মুখ দেখা যাচ্ছিল না, সত্যবানের গলাটাই শুধু অন্ধকারের মধ্যে গাঢ় হয়ে বেজে উঠলো, আমার সঙ্গে গাঁথলে তোমার সারা ভবিষ্যৎটাই তাই হবে শম্পা, ওই শূন্যি। দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি সেটা। তাই কেবলই তোমায় খোশামোদ করছি শম্পা, তুমি কেটে পড়ো। আমার মতো হতভাগার সঙ্গে নিজের অদৃষ্টকে জড়িও না।

শম্পা উঠে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলে, দ্যাখো, আর একবার যদি ও কথা উচ্চারণ করো, ঠেলে ওই জলের মধ্যে ফেলে দেবো। কেউ রক্ষে করতে আসবে না। যা শুনলেই মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে যায়, কেবল সেই কথা। পিসিকে যে চিঠিটা দেব, তার উত্তর আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করব, তারপর সোজা গিয়ে উঠবে তোমার মেসে, এই হচ্ছে আমার শেষ কথা। রেজিস্ট্রিটা একবার হলে হয়, তারপর দেখো কী দুর্গতি করি আমি তোমার।

সত্যবান হঠাৎ একটু ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধের ওপর একটা হাত রেখে বলে, আমার কিন্তু কী মনে হচ্ছে জানো? এত সুখ বোধ হয় সইবে না আমার কপালে। মনে হচ্ছে এই বুঝি শেষ, আর বোধ হয় কখনো আমরা দুজনে একসঙ্গে বসে কথা বলবো না।

বেপরোয়া শম্পার সাহসী বুকটাও হঠাৎ যেন কেঁপে ওঠে, ওরও যেন মনে হয় সত্যিই বুঝি তাই। কিন্তু মুখে হারে না ও, বলে ওঠে, হাতফসকে পালাবার তালে যা ইচ্ছে বানিয়ে বলো না, আমার কিছু এসে যাচ্ছে না। আমি পিসিকে হুকুম করেছি–অবিলম্বে আমাদের জন্যে একটা ক্ষুদ্র ফ্ল্যাট ঠিক করে রাখতে, আমার জন্যে একটা চাকরি যোগাড় করে রাখতে, আর আমাদের বিয়ের সাক্ষী হতে। ব্যাস!

সত্যবান হেসে ফেলে বলে, সাক্ষী হওয়াটা না হয় হলো। কিন্তু বাকি দুটো? সে দুটো তো গাছের ফল নয় যে ছিঁড়ে এনে তোমার হাতে তুলে দেবেন।

গাছের ফল নয় বলেই তো পিসিকে ভার দিচ্ছি। গাছের ফল হলে তো যে কোনো বন্ধুবান্ধবকেই বলতে পারতাম।

বেশ বাবা, তোমার ব্যাপার তুমিই বুঝবে। আমার ওপর হুকুম হয়েছে করবো।

ঠিক আছে। এসো মা গঙ্গাকে নমস্কার করো।

হাত জোড় করে শম্পা।

সত্যবানও অগত্যা।

তারপর দুজনেই নেমে আসে সেই ভগ্নদশাগ্রস্ত মন্দিরচত্বর থেকে।

কিছুক্ষণ অখণ্ড নিস্তব্ধতার মধ্যে যেন হারিয়ে যায় ওরা। শুধু ওদের পায়ের চাপে গুঁড়িয়ে পড়া শুকনো পাতার মৃদু আর্তনাদ ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

হঠাৎ একসময় সত্যবান বলে ওঠে, আমার ধারণা ছিল না তুমি এসব মানোটানো

শম্পা যেন অন্য জগতের কোথাও চলে গিয়েছিল, ওর কথায় চমকে উঠে বলে, কী সব?

এই মা গঙ্গা-টঙ্গা, নমস্কার-টমস্কার–

আমারই কি ধারণা ছিল ছাই। শম্পা কেমন একরকম হেসে বলে, নিজের থেকে অচেনা আর কেউ নেই।

খানিকক্ষণ নিস্তব্ধতায় কাটে, আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকে ওরা, একসময় শম্পা বলে ওঠে, বিয়ের পর আবার এখানে আসবো আমরা। সেজপিসির কাছে।

সত্যবান কোনো উত্তর দেয় না।

বিয়েটাই সত্যি হবে, এমন কথা নিশ্চয় করে যেন ভাবতেই পারছে না ও, সামনেটা তাকালেই কেমন ঝাপসা ঝাপসা লাগে। এই যে সুন্দরী সুকুমারী বিদুষী আধুনিকা নারীটি এখন তার পাশে পাশে চলেছে, সত্যিই কি সে চিরজীবন তার পাশে পাশে থাকবে? একসঙ্গে চলবে পায়ে পা মিলিয়ে?

ভাবতে গেলেই ভয়ানক একটা অবিশ্বাস্য অবাস্তবতার অন্ধকারে তলিয়ে যায় ভাবনাটা।

.

কিন্তু আরো একটা অন্ধকার গহ্বর যে অপেক্ষা করছিল সত্যবান নামের ছেলেটার জন্যে, তা কি জানতো ছেলেটা?

কলকাতায় ফিরে দেখলে যে আগুন অনেক দিন থেকে ভিতরে ভিতরে ধোয়াচ্ছিল, সে আগুন জ্বলে উঠেছে। ফ্যাক্টরীতে লক আউট, মালিকপক্ষ অনমনীয়। ওদিকে ইউনিয়নের পাতারাও ততোধিক অনমনীয়, অতএব আকাশ-ফাটানো চিৎকারে গলাফাটানো চলছে। ফ্যাক্টরীকে ঘিরে, সকাল সন্ধ্যে দুপুর।

সেই এক ধ্বনি, চলবে না, চলবে না।

সত্যবান দেখলো, ওকে দেখে ওর সহকর্মীরা মুখ বাকালো। শুধু ওর বন্ধু কানাই পাল বলে উঠলো, এতদিন কোথায় ঘাপটি মেরে ছিলে চাদু!

সত্যবান শুকনো গলায় বলে, ঘাপটি মারা আবার কি! অসুখ করেছিল।

অসুখ! আহা রে, লা লা চুক চুক! আর আমরা সবাই এখানে সুখের সমুদুরে ভাসছিলাম!

অবস্থা তো বেশ ঘোরালো দেখছি!

আরো কত দেখবি দাদু!

ফালতু কতকগুলো কথা হলো, তারপর ভাবতে ভাবতে চললো সত্যবান দাস, কেমন করে বাংলা সাহিত্যের সেই বিখ্যাত লেখিকা অনামিকা দেবীর সঙ্গে দেখা করা যায়।

মনটা বিষণ্ন লাগছে।

কানাই পালের গলায় যেন আগেকার সেই অন্তরঙ্গতার সুর শুনতে পেল না সত্যবান। এই দীর্ঘ অনুপস্থিতির মাঝখানে তার জায়গাটা যেন হারিয়ে গেছে।

আশ্চর্য, এই রকমই কি হয় তাহলে?

হৃদয়ভূমির দখলী স্বত্বটুকু বজায় রাখতেও নিয়মিত খাজনা দিয়ে চলতে হয়?

তাহলে অনামিকা দেবীর সেই ভাইঝিটির হৃদয় থেকে

কিন্তু সত্যবানের মতো এমন একটা তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর হতভাগার জন্যে কি সত্যিই সেই অলৌকিক আশ্চর্য হৃদয়ে জমির বন্দোবস্ত হয়েছে?

               রক্তের বদলে রক্ত চাই।
                       খুনের বদলে লাল খুন!
                       জুলুমবাজি বন্ধ করো
                       নিপাত যাও, নিপাত যাও?

গাড়িটা মোড় ঘুরতেই হঠাৎ যেন সমুদ্র গর্জে উঠলো। থেমে পড়লো গাড়ি।

রাস্তার এক ধার থেকে অন্য ধারে যাচ্ছে ওরা, একবার দম ফেলতে-না-ফেলতে আবার গর্জন করে উঠছে।

থেমেই থাকতে হলে গাড়িটাকে। কারণ ইতিমধ্যে সামনে গাড়ির এক বিরাট লাইন হয়ে গেছে।

যতক্ষণ না ওদের দীর্ঘ অজগর দেহ পথের শেষবাকে মিলিয়ে যাবে, ততক্ষণ অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

জ্যৈষ্ঠ মাসের বিকেল, আকাশ সারাদিন অগ্নিবৃষ্টি করেছে, পৃথিবী এখনো সেই দাহর জ্বালা ভিতরে নিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ছে। আকাশ হঠাৎ এখন গুম হয়ে গেছে।

নিশ্চল গাড়ির মধ্যে গরমে দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিরুপায় হয়ে তাকিয়ে আছেন অনামিকা ওই দীর্ঘ অজগর দেহটার ডিস্ক।

গাড়ির খোলা জানলা দিয়ে বাতাসের বদলে আসছে মাটি থেকে উঠে আসা একটা চাপা উত্তাপ। যতক্ষণ গাড়ি থেমে থাকবে, এই অবস্থাই চলবে। উত্তাপ বাড়তেই থাকবে।

কিন্তু উপায় কি?

গাড়িকে পিছিয়ে নিয়ে অন্য রাস্তায় গিয়ে পড়বার কথাও এখন আর ভাবা যায় না। পিছনে কম করে অন্তত খান-তিরিশ গাড়ি তালখেজুরের মতো গায়ে গায়ে লেপটে দাঁড়িয়ে পড়ে আছে। ট্যাক্সি, প্রাইভেট কার, লরি, রিকশা, ঠ্যালাগাড়ি। তবু বাস-ট্রাম নয় এই ভালো।

এই অভিজ্ঞতা নতুন নয়।

বাড়ি থেকে একটু দূরপথে পাড়ি দিতে হলে, নিত্যই পথে দু’একবার ওরকম অজগরের মুখে পড়তেই হয়। থেমে যেতে হয়। ওদের পথ তো অবারিত রাখতেই হবে, ওরা তো আর শনের পথ ছেড়ে দিতে থেমে যাবে না!

লাল খুন জিনিসটা কি তা জানেন না অনামিকা। আজকের দিনের কত কিছুই জানেন না তিনি। জানেন ‘খুন’ শব্দটাই ভয়ঙ্কর একটা লালের ইশারাবাহী।

কোন্ খুনের বদলে এই লাল খুনের ঘোষণা, সেটা ধরতে পারা যাচ্ছে না, কারণ ওদের বাকি কথাগুলো দ্রুত, অস্পষ্ট।

গর্জিত সমুদ্রের ঢেউ থেকে জলের যে বলয়রেখা শ্রবণযন্ত্রের উপর আছড়ে বক্ষে ড়ে এসে পড়ছে তা হচ্ছে–’রক্ত চাই’ আর নিপাত যাও।

কিন্তু কে কোথায় নিপাত যাবার অভিশাপে জর্জরিত হচ্ছে, তা শোনবার গরজ কারো নেই। সত্যিই যদি তেমন কেউ রাতারাতি নিপাতিত হয়, আগামী সকালের কাগজেই তো দেখা যাবে। এখন যে যার গন্তব্যস্থানে যেতে পারছে না, সেটাই হচ্ছে সব চেয়ে বড় কথা।

আর বোধ করি এই তিরিশ-চল্লিশখানা গাড়ির মধ্যে অনামিকা দেবীর গাড়িখানা আটকে পড়ে থাকাই হচ্ছে সব চেয়ে ভয়ানক কথা।

সাড়ে ছ’টায় সভা শুরু হবার কথা, অথচ এখানেই সাড়ে ছ’টা বাজলো। এখন পাকা চারটি মাইল যেতে হবে।

একেই তো যে ভদ্রলোক তার গাড়িখানি ওদের জয়ন্তী উৎসবের জন্যে ঘণ্টা দুইয়ের জন্যেউৎসর্গ করেছেন, তিনিই দেরি করে ফেলেছেন পাঠাতে, তার উপর আবার যে ছেলে দুটি সভানেত্রীকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে বলে এসেছিল, তাদের মধ্যে একজনের গরমে মাথা ঘুরে গিয়েছিল বলে রাস্তায় নেমে কোকোকোলা খেতে দেরি হয়ে গিয়েছিল।

ভেবেছিল মেক আপ করে নেবে, হঠাং এই বিপত্তি।

যম জানে প্রধান কর্মকর্তা নেপালদা কী করছেন এখন। এতক্ষণ তো পৌঁছে যাবার কথা তাদের সভানেত্রীকে নিয়ে। কী আর করছেন? মাথার চুল ছিঁড়ছেন নিশ্চয়।

চীফ গেস্ট বলেছিলেন ঠিক সময়ে সভা শুরু করতে হবে, আর তার ভাষণটি দিয়েই চলে যেতে হবে তাকে। কারণ মাত্র পঁয়ত্রিশ মিনিট সময় তিনি এই সবুজ শোভা সংঘ’কে দিতে পারেন, তার পরই দু-দুটো সভা রয়েছে তাঁর।

পৌর প্রধানকে প্রধান অতিথি করতে চাইলে এ ছাড়া আর কি হবে? আর কি হতে পারে? তাঁকে যে সবাই চায়।

অবশ্য কেন যে চায়, তা তিনি ভালই জানেন, কিন্তু সে কথা তো প্রকাশ করা যায় না। তাকে তে কষল তিনি বলেই চায়, এটুকু শুনতেও ভালো বলতেও ভালো। তিনি বিনয়ে

ভেঙে পড়ে বলবেন, আমার মতো অযোগ্যকে কেন বলুন তো? আমি কবি নই, সাহিত্যিক নই-

ফাংশানটা হাওড়া নবীনগর সবুজ শোভা পাঠাগারের..পাঠাগারের বয়েসও নেহাৎ কম নয়। কিন্তু নিজস্ব একটি বাড়ি তাদের নেই, একটুকরো জমি মুফতে পেয়ে গেলে বাড়িটা হয়ে যায়। সেই না থাকার বেদনাটি মুছে ফেলতে যত্নবান হচ্ছে পাঠাগারে কর্মীরা। সেই যত্নের প্রধান সোপান পৌরপ্রধানের গলায় পুষ্পমাল্য অর্পণ।

তা সেই পৌরপ্রধান এসেই তো গেছেন নিশ্চয়। মনে হচ্ছে আর্টিস্টরাও এসে গেছেন কেউ কেউ। কারণ তাদেরও তো দু’দশ জায়গায় বায়না।

মাসটা কী দেখতে হবে তো?

বাংলা পঞ্জিকায় জ্যৈষ্ঠ মাস হলেও আসল ক্যালেণ্ডারে তো মে মাস! তার মানে রবীন্দ্র জয়ন্তীর মাস। আবার ওদিকে বাংলা হিসেবের সুবিধেয় নজরুল জয়ন্তীটাও পাওয়া যাচ্ছে। দুটো বড় বড় করণীয় ফাংশান যদি একটি আয়োজনের মধ্যে সামলে ফেলা যায়, কম সুবিধে?

উদ্যোক্তারা ওই সুবিধেটা লুফে নিচ্ছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়ে আর নজরুলসঙ্গীত গাইয়ে, দু’দলকেই যোগাড় করে ফেলে একই খোঁয়াড়ে পুরে ফেলে কর্তব্যপালনের মহৎ আনন্দ অনুভব করছেন।

দুজনে কাছাকাছি তারিখে জন্মে সুবিধে করে দিয়েছেন ঢের। গাইয়ে দল দুটো লাগলেও, হল, প্যাণ্ডেল সভাপতি প্রধান অতিথি ফুলদানি ধূপদানি মাইক মঞ্চসজ্জা, এগুলো তো দু’ক্ষেপ লাগছে না? কম সুবিধে?

কিন্তু এ কী অসুবিধেয় ফেললো ওই শোভাযাত্রাকারীরা!

ছেলে দুটো গাড়িতে বসে হাত-পা আচড়াচ্ছে।

অনামিকা ঘামতে ঘামতে বলেন, কোনোরকমে অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যায় না?

পাগল হয়েছেন। সামনে পেছনে দেখুন না তাকিয়ে!

কিন্তু তোমরা তো বলেছিলে, মাত্র দু’ঘণ্টার জন্যে হলটা ভাড়া করেছ তোমরা, সাড়ে আটটার মধ্যে শেষ করতেই হবে, পরে ওখানে অন্য ফাংশান আছে, হল ছেড়ে দিতে হবে।

সে তো হবেই! দেরি করলে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দেবে!

আরে, কী যে বল? অনামিকা কষ্টের মধ্যেও হেসে ফেলেন।

ছেলে দুটো উদাস স্বরে বলে, আপনি জানেন না স্যার, সরি মাসিমা, ওরা কী ইয়ে লোক! সময় হয়ে গেলেই ফট করে আলোপাখা বন্ধ করে দেবে।

তাহলে তো দেখছি তোমাদের অনুষ্ঠান আজ আর হবেই না। এখানেই তো সওয়া-সাতটা বাজলো। ওদের দল তো দেখছি অফুরন্তু, আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে। ওরা চলে যাবে, তারপর সামনের ওই গাড়িগুলো পার হবে–তারপর আরো তিন-চার মাইল

সব ভাবছি মাসিমা, মাথার মধ্যে আগুন জ্বলছে। ইঃ, আমরা যদি ঠিক এর আগেরটায় পার হয়ে যেতে পারতাম। পুলিনবাবুই এইভাবে ডোবালেন?

পুলিনবাবু।

চিনবেন না। একটা ছেলে যেন কাঠে কাঠ বুকে কথা বলছে, আমাদের সাধারণ সম্পাদকের শালা, গাড়িটা দেবেন বলেছিলেন, তাই আর ট্যাক্সি-চ্যাক্সি করা হলো না। দিলেন, একেবারে লাস্ট মোমেন্টে। ওদিকে মেয়র এসে বসে আছেন।

অনামিকা মৃদু হেসে বলেন, তিনি কি আর সভানেত্রীর জন্যে বসে থাকবেন? এতক্ষণে ভাষণ শেষ করে চলে গেছেন।

তাই সস্তব। ওর তো আর আপনাদের মতন অগাধ সময়-মানে ইয়ে, ওর তো অনেক কাজ

অনামিকা মাল বার করে কপাল মুছতে মুছতে বলেন, সে তো নিশ্চয়।

ছেলেটা বলে, তবে আর কি, আপনাকে দিয়ে একটা প্রস্তাব তার কাছে পেশ করবার কথা ছিল তো–

ওঃ তাই বুঝি? কিসের প্রস্তাব?

ওই আর কি, জমি-টমির ব্যাপারে, শুনবেন গিয়ে। তাই ভাবছি আপনাকে নিয়ে গিয়ে ফেলতে না পারলে, নেপালদা আমাদের চামড়া ছাড়িয়ে নেবে।

অনামিকা এই মধুর ভাষার আঘাতে প্রায় চমকে উঠে বলেন, তোমাদের কী দোষ?

ওদের মধ্যে দ্বিতীয়জন উদাস গলায় বলে, সেকথা আর কে বুঝবে বলুন? বলবে তোমাদের তিনটের সময় পাঠিয়েছিলাম

তিনটের সময়? বল কী?

ওরা পরস্পরে মুখ-চাওয়াচাওয়ি করে বলে, ব্যাপারটা মানে উনি পাঠিয়েছিলেন পুলিনবাবুর বাড়িতে, পুলিনবাবু গাড়ি ছাড়লেন সাড়ে পাঁচটার সময়, তারপর আবার গরমে মাথা ঘুরে এ আবার শরবৎ খেতে নামলো। আর আপনার বাড়িটিও সোজা দূরে নয়!

অনামিকা আর কথা বললেন না, মৃদু হাসলেন। কার থেকে দূরে আর কার কাছাকাছি। হওয়া উচিত ছিল, সে প্রশ্ন করলেন না।

.

অবশেষে কোনো এক সময় পথ মুক্ত হলো, সামনের গাড়ি সরলো, গাড়ি নবীনগরের দিকে এগোলো।

ওরা যখন সভানেত্রীকে নিয়ে পৌঁছলো, তখন সমাপ্তি-সঙ্গীত গাওয়া হচ্ছে। সভানেত্রীর প্রতি আর কেউ বিশেষ দৃষ্টিপাত করলোনা, সম্পাদক মই থমথমে মুখে ওঁকে হলের পিছন দরজা দিয়ে নিয়ে মঞ্চে তুললেন একবার। ঘোষণা করলেন, অনিবার্য কারণে সভানেত্রী ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারেননি, এখন এসে পৌঁছুলেন।

সেই অনিবাৰ্যটা যে কার তরফের, সেটা ব্যক্ত হলো না।

গান চলতে লাগলো।

হলের মালিকের লোক তাড়া দিচ্ছে, সভানেত্রীর ভাষণ হবার সময় নেই, তবু তিনি যে সত্যিই তিনি, এইটুকু জানাতে মাইকের সামনে এসে দাঁড়াতেই হলো।

তার আগে অনামিকা প্রশ্ন করলেন, মানে শুধু একটু কথা বলার জন্যই বললেন, প্রধান অতিথি এসেছিলেন?

সম্পাদক বেজার মুখে বললেন, না, জরুরী কাজে আটকা পড়ে গেছেন-ফোন করে জানালেন।

হল ছেড়ে দিতে হলেও, অনামিকা ছাড়ান পেলেন না। লাইব্রেরীর ঘরে গিয়ে বসতে হলো ওকে। চা-সন্দেশ না খাইয়ে তো ছাড়বে না! তাছাড়া লাইব্রেরীর জন্মপত্রিকা দেখান থেকে তার এই তেইশ বছরের জীবনের ইতিহাস সমস্ত শোনানোও তো দরকার। অনামিকার সঙ্গে পৌরপ্রধানের আলাপ হয়েছে, উনি যদি অর্থাৎ এতটা পেট্রল খরচ করে এনে কোনো কাজে লাগাতে না পারলে-

রাস্তায় বিঘ্নের কথা উঠলো।

স্থানীয় এক ভদ্রলোক উদাত্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ওদের দোষ কি বলুন? ওদের সামনে আশা নেই, ভরসা নেই, ভবিষ্যৎ নেই-বেকারত্বের যন্ত্রণায় সর্বদাই খুন চেপে আছে ওদের মাথায়–জানেন, বাংলা দেশে আজ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কতো? চাকরি নেই একটা–

সাধারণতঃ এ ধরনের কথায় তর্ক করেন না অনামিকা, করা সাজেও না, এ কথার প্রতিবাদ করা মানেই তো সহানুভূতিহীন, অমানবিকতা, কিন্তু আজ বড় কষ্ট গেছে, বৃথা কষ্ট, তাই হঠাৎ বলে ফেললেন, খুন যে কার কখন চাপে, তার হিসেব কি রাখা যায়? চাকরি নেই বলে কি কিছুই করার নেই?

কী করবে?

উনি প্রায় ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ব্যবসা? মূলধন দেবে কে?

অনামিকা তর্কেই নামলেন, কারণ ভদ্রলোকের ভঙ্গী দেখে মনে করা যেতে পারে, এই বিপুলসংখ্যক বেকারের জন্য অনামিকাও বুঝি অনেকাংশে দায়ী।

অনামিকা বললেন, কেউ কাউকে কিছু দেয় না, বুঝলেন? সে প্রত্যাশা করাই অন্যায়। নিজের জীবনের মূলধন নিজেই সংগ্রহ করতে হয়।

হয় বললেই হয়! ভদ্রলোক প্রায় খিঁচিয়েই ওঠেন, একটা যুক্তিগ্রাহ্য কথা বলুন!

অনামিকা গম্ভীর হেসে বলেন, আমার কাছে একটাই যুক্তিগ্রাহ্য কথা আছে, আমাদের এই বাংলা দেশে অবাংলা প্রদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ বেকার এসে হাজির হয়, বছরে কে কোটি টাকা উপার্জন করে, তারা সকলেই দেশ থেকে রাশি রাশি মূলধন নিয়ে আসে এ বিশ্বাস আমার নেই। অথচ তারা যে ওই টাকাটা লোটে এটা অস্বীকার করতে পারেন না। এই বাংলা দেশ থেকেই লোটে। কী করে হয় এটা?

ভদ্রলোক এক মুহূর্ত চুপ করে থাকেন, তারপর আবার পূর্ণোদ্যমে বলেন, ওদের কথা বাদ দিন। ওরা একবেলা ছাতু খেয়ে, একবেলা একটু লঙ্কার আচার দিয়ে আটার রুটি খেয়ে কাটিয়ে বেবসা-বেবসা করে বেড়াতে পারে। আমাদের ঘরের ছেলেরা তো আর তা পারবে না!

কিন্তু কেন পারবে না?

ভদ্রলোক তীব্রকণ্ঠে বলেন, এ আর আমি কি বলবো বলুন? বাঙালীর কালচার আলাদা, রুচি আলাদা, শিক্ষাদীক্ষা আলাদা

তবে আর কি করা! হাসলেন অনামিকা।

ঠিক এই সময় একটি ছেলে এসে বলে ওঠে, একটা লোক আপনাকে খুঁজছে।

আমাকে? চমকে উঠলেন অনামিকা, কী রকম ছেলে?

মানে আর কি এমনি। খুব কালো, একটু ইয়ে ক্লাসের মতো।

খুব কালো! একটু ইয়ে ক্লাসের মতো!

অনামিকা এক মুহূর্তে আকাশপাতাল ভেবে নিলেন। বললেন, কী বলছে?

বলছে আপনার সঙ্গে একবার দেখা করবে

কারণ বলছে না কিছু?

বলেছে। বলেছে, আপনার কাছে কার একটা চিঠি পৌঁছে দিতে এসেছে।

কী চিঠি? কার চিঠি? সমস্ত মনটা আলোড়িত হয়ে উঠলো। আস্তে বললেন, আচ্ছা এখানেই য়ে এসো।

ঘরের মধ্যে একটা মৃদু গুঞ্জন উঠলো। এখানে কেন রে বাবা?

কে কী মতলবে খোঁজ করছে? দিনকাল খারাপ।

খোঁজ করলে ওঁর নিজের বাড়িতে করুক গে না, হঠাৎ এরকম জায়গায়?

অথচ সভানেত্রীকে মুখ ফুটে বলা যায় না, আপনি বাইরে বেরিয়ে গিয়ে দেখুন না। সকলেই তাই একটু শুধু ঠিক হয়ে বসেন।

লোকটা এসে দরজার কাছে দাঁড়ায়, বোধ করি সকলের উদ্দেশেই একটি নমস্কার করে, তারপর খুব সাবধানী গলায় বলে, আমাকে দেবার জন্য একটা চিঠি ছিল–

অনামিকা একবার ওর আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নেন, সঙ্গে সঙ্গে কে যেন বলে ওঠে, এ সেই!

না, কোনো দিন অনামিকা ওকে চোখে দেখেননি, তবু যেন চেনাই মনে হলো। চেয়ার থেকে উঠে একটু এগিয়ে এসে বললেন, কে দিয়েছে চিঠি?

প্যান্টের পকেট থেকে টেনে বার করে বাড়িয়ে ধরলো।

মুখ-আঁটা খাম!

কিন্তু খামের ওপরে লেখা অক্ষরগুলোর ওপরেই যে ভেসে উঠলো একখানা ঝকঝকে মুখ!

অনামিকা আস্তে বললেন, কোথায় আছে ও?

সবই লেখা আছে।

আচ্ছা তুমি একটু দাঁড়াও, চলে যেও না। ঘুরে দাঁড়ালেন অনামিকা। এদের বললেন, দেখুন একটু জরুরী দরকারে আমায় এক্ষুনি যেতে হবে, দয়া করে যদি গাড়িটা–

সে কি! আপনি তো চা-টা কিছুই খেলেন না?

থাক্, ইচ্ছে করছে না। গাড়িটা একটু

একটু!

তার মানে তাড়াতাড়ি?

কিন্তু সেটা হবে কোথা থেকে?

পুলিনবাবুর গাড়ি তো আর বসে নেই, সে তো সভানেত্রীকে পৌঁছে দিয়েই পুলিনবাবুর কাছে পৌঁছে গেছে।

অতএব?

অতএব ট্যাক্সি।

অতএব অনেকক্ষণ অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

চিঠিখানা হাতের মধ্যে জ্বলন্ত আগুনের মতো জ্বলছে।

কিন্তু এখানে কোথায় খুলবেন?

এ চিঠি কি এইখানে খুলে পড়বার?

যে ভদ্রলোক তর্ক ফেঁদেছিলেন, তিনি হতাশ হয়ে যান এবং বাইরে বেরিয়ে গিয়ে বুড়োদাকে বললেন, যত সব এড়ে তর্ক, বুঝলে বুড়োদা? এত বড় একটা সমস্যাকে উনি একেবারে এক কথায় নস্যাৎ করে দিতে চান! যেন বেকার সমস্যাটা একটা সমস্যাই নয়!

বলবেন না কেন ভায়া? বড়লোকের মেয়ে, বে-থা করেননি, বাপের অট্টালিকায় থাকেন, নিজে কলম পিষে মোটা মোটা টাকা উপায় করছেন, বেকারত্বের জ্বালাটা যে কী, বুঝবেন কোথা থেকে?

কিন্তু ওই নিগ্রো প্যাটার্নের ছোঁড়াটা কে বল তো? চিঠিটাই বা কার? হাতে নিয়েই মুখটা কেমন হয়ে গেল, দেখলে?

দেখলাম। অথচ খাম খুলে দেখলেন না, সেটা দেখলে।

দেখেছি সবই। তার মানে জানাই ছিল চিঠি আসবে আর কী চিঠি আসবে।

কিছু ব্যাপার আছে, বুঝলে? চিঠিটা দেখেই যাবার জন্যে কি রকম উতলা হলেন দেখলে? বলা হলো জরুরী দরকার! আরে বাবা, চিঠিটা তুমি খুললে না-লোকটাও কিছু বললো না, অথচ জেনে গেলে জরুরী দরকার, এক্ষুনি যেতে হবে?

বললাম তো জানা ব্যাপার। কে জানে কোনো পার্টির ব্যাপার কিনা, ভেতরে ভেতরে কে যে কি করে, জানবার তো উপায় নেই!

ছোঁড়াটার চেহারা মোটেই ভদ্রলোকের মত নয়।

যাক, এখন মানে মানে পৌঁছে দাও।

সঙ্গে যাচ্ছে কে?

স্বপন এনেছে, স্বপনই যাবে।

ছোঁড়াটাকে তো দাঁড়াতে বললেন, যতদূর বুঝছি, ওকেও সঙ্গে নেবেন।

তবেই তো মুশকিল! স্বপনকে সঙ্গে দেওয়াটা ঠিক হবে? কি জানি কোন পার্টি-ফার্টির যতক্ষণ না ট্যাক্সি আসে, চলতে থাকে গোপন বৈঠক এবং নিশ্চিত বিশ্বাসে ঘোষণা হয়, মহিলাটির ওপরের আবরণ যাই থাক্‌, কোনো পার্টির সঙ্গে যোগসাজস আছেই।

.

সন্দেহটা নিশ্চিত বিশ্বাসে পরিণত হলো যখন অনামিকা দেবী বললেন, গাড়িটা যখন ঘরের গাড়ি নয়, ট্যাক্সি, তখন আর এ ছেলেরা কষ্ট করে অত দূর যাবে কেন, ফিরতে অসুবিধে হবে, এই ছেলেটি আমার চেনা ছেলে, ওই দিকেই যাবে, ওর সঙ্গেই বরং

এরা গূঢ় অর্থপূর্ণ হাসি হাসলেন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে, তারপর সবিনয়ে বললেন, সেটা কি ঠিক হবে? আমরা নিয়ে এলাম–

তাতে কি, আমি তো নিজেই বলছি, চিন্তার কিছু নেই।

গাড়িতে উঠলেন। কাফ্রীর মত দেখতে ছেলেটাকে ডাকলেন, তুমি উঠে এসো।

গাড়িতে স্টার্ট দেওয়ার পর ওঁরা বললেন, দাঁড়ান একটু দাঁড়ান, আপনার ইয়েটা পকেটে হাত দিলেন।

অনামিকা বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে।

ওরা পকেটের হাত পকেট থেকে বার করে নিয়ে বললেন, না না, এ কী! আপনি নিজে কেন–

গাড়ি চলার শব্দে ওদের কথা মিলিয়ে গেল।

একটু সময় পার করে অনামিকা বললেন, তোমার নাম সত্যবান?

সত্যবান মাথা নিচু করে বললো, হ্যাঁ।

ওর সঙ্গে কোথায় দেখা হলো?

সে তো অনেক কথা

একটুখানি কথায় বুঝিয়ে দাও না?

সত্যবান হঠাৎ মাথাটা সোজা করে বসে।

স্পষ্ট গলায় বলে, রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে উনি আমার মেসে উঠেছিলেন, তার পর আমাকে নিয়ে চন্দননগরে সেজপিসির বাড়ি

চন্দননগরে! সেজপিসির বাড়ি! অনামিকা প্রায় আর্তস্বরে বলে ওঠেন, ওইখানেই আছে শম্পা?

আজ্ঞে হ্যাঁ। আমিও ছিলাম। ফিরে আসার উপায় ছিল না, খুব অসুখ করে গিয়েছিল

 .

আস্তে আস্তে শম্পার খবর জানা হয়।

অনামিকার হঠাৎ সেজদির উপর দারুণ একটা অভিমান হয়। কত কষ্ট পাচ্ছিল বকুল, সেটা কি খেয়ালে আসা উচিত ছিল না সেজদির?

মনের অগোচর কিছু নেই, স্বয়ংবরা শম্পার পছন্দর খুব তারিফ করতে পারছিলেন না অনামিকা। তবু মনের মধ্যে একটি প্রত্যয় ছিল শম্পা সম্পর্কে। তাই ওর সঙ্গে মমতার সঙ্গেই কথা বলছিলেন।

কি লিখেছে তুমি জানো?

না। এমনি বন্ধ খামই দিয়েছেন।

দিয়েছেন! অনামিকার একটু হাসি পেল।

এই সমীহ নিয়েই কি ওরা ঘর করবে? বাদশাজাদি ও কাফ্রী ক্রীতদাসের মত?

রাত হয়ে গিয়েছিল যথেষ্ট, ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি বেশ ভালই চলছিল, হঠাৎ আবার তখনকার মতই থামতে হলো। আবার শোভাযাত্রা।

না, এখন আর রক্তের বদলে রক্ত চাইছে না শোভাযাত্রীরা। আলোর রোশনাইয়ে চোখ ঝলসে দিয়ে ব্যাগপাইপ বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে।

বর যাচ্ছে বিয়ে করতে!

অনামিকার মুখে একটু হাসি ফুটে উঠলো। আজকের যাত্রাটা মন্দ নয়। যাত্রাকালে খুনের বদলে লাল খুন, ফেরার কালে বাজনা-বাদ্যি-আলো-বাতি।

তবে পথ আটকাচ্ছে দুটোতেই।

এই হচ্ছে কলকাতার চরিত্র।

ও এক চোখে হাসে, এক চোখে কাঁদে। এক হাতে ছুরি শানায়, অন্য হাতে বাঁশী বাজায়।

.

বাড়ির কাছাকাছি আসার আগেই সত্যবান বললো, আমি নেমে যাই!

কিন্তু চিঠিটা তো আমি এখনো পড়িনি। পড়ে দেখি যদি কিছু জবাব দেবার থাকে।

না না, সে আপনি চিঠিতেই দেবেন। আমি তো এখন আর যাচ্ছি না।

অনামিকা এবার সরাসরি প্রশ্ন করেন, তোমাদের বিয়েটা হয়ে গেছে?

ও মাথা নিচু করে, না।

তাহলে এভাবে এতদিন একত্রে ঘুরছো যে?

অনামিকার কণ্ঠ কঠোর।

আসামী মুখ তুলে তাকিয়ে বলে, আপনি কি বলেন, বিয়ে হওয়া উচিত?

আমার বলার উপর কিছু নির্ভর করছে না। সেজপিসি তোমাদের এ বিষয়ে কিছু বলেননি?

না।

সত্যবান হঠাৎ কিঞ্চিৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, উনি এক আশ্চর্য মানুষ। অদ্ভুত ভালো। আমি এ রকম উঁচুদরের মানুষ জীবনে দেখিনি। কোথা থেকেই বা দেখবো। গ্রামঘরের ছেলে, কুলিমজুরের কাজ করি–অবশ্য ওর মুখে আপনার কথাও শুনেছি–মানে শম্পা দেবীর মুখে–

অনামিকা হেসে ফেলেন, যাক, আমি তোমাদের সেজপিসিকে হিংসে করব না, তবে আমার মতে বিয়েটা তাড়াতাড়ি করে ফেলাই ভালো।

উনিও তাই বলেন-মানে, শম্পা দেবী। আমি ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে

কেন? তোমার মনস্থির নেই?

সত্যবান ম্লানমুখে বলে, সত্যিই বলেছেন। আমার ভয় করে। সত্যিই তো আমি যোগ্য নই।

নিজের যোগ্যতার বিচার সব সময় নিজে করা যায় না বাপু। অনিবার্যকে মেনে নিতেই হয়। মেয়েটা যখন বাড়ি থেকে চলে গিয়ে তোমাকে ধরেই ঝুলে পড়েছে, তোমার আর করার কিছু নেই। কিন্তু একটু বসে যাবে না?

ও, না না। আপনাদের ওই বাড়ির কাছাকাছি যাওয়া নিষেধ।

ও নেমে পড়ে। তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়।

অনামিকা আর একটু এগিয়ে এসে নামেন, ভাড়া মিটোন। আস্তে আস্তে বাড়ি ঢোকেন, তিনতলায় ওঠেন।

নিজে নিজেই ভারী অবাক লাগছে।

ওই ধরনের একটা ছেলেকে পাশে বসিয়ে গল্প করতে করতে আসছেন, আগে কখনো এমন ঘটেনি। অথচ বিতৃষ্ণা আসছিল না। তাছাড়া কেমন একটু স্নেহ-স্নেহ মমতা-মমতাই লাগছে। আহা বেচারী, ভয় পেতেই পারে।

কিন্তু শম্পার এ খেয়ালই কি টিকবে? আবার শম্পা নতুন হৃদয় খুঁজতে বসবে না তো?

চিঠিখানা হাতের মধ্যে থেকে ব্যাগে পুরেছিলেন, তবু যেন হাতটায় কিসের স্পর্শ লেগে রয়েছে। ভিতরে কী তোলপাড়ই চলছে! তবু শান্ত মূর্তির অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছেন, সারাজীবন ধরে যা রপ্ত করেছেন।

চিঠিটা কি পড়ে ফেলতে পারতেন না এতক্ষণ? রাস্তায় কি আলো ছিল না? কিন্তু পড়েননি। নিজেকে সংবরণ করেছেন এতক্ষণ।

কারণ চট করে ওই পরম পাওয়াটি ফুরিয়ে ফেলার ইচ্ছে হচ্ছিল না। ধীরেসুস্থে নিজের ঘরে বসে আস্তে আস্তে ওর আবরণ উন্মোচন করবেন, আস্তে আস্তে উপভোগ করবেন। তাই

অনুমান পর্যন্ত করতে চেষ্টা করছেন না কী লেখা আছে চিঠিতে! কী থাকতে পারে?

হয়তো ডাকে আসা চিঠি হলে এ ধৈর্য রাখতে পারতেন না, ভয় হতো কোথাও কোনোখানে বিপদের মধ্যে পড়েনি তো মেয়েটা।

কিন্তু ধৈর্য ধরতে পারছেন, কারণ চিঠিটা এসেছে একটা ভরসার হাত ধরে।

.

অক্ষরগুলো যেন পুরনো বন্ধুর মুখ নিয়ে হাসিতে ঝলসে উঠলো।

পিসিগো, একটা আস্তানার অভাবে বিয়ে করতে পারছি না, বল তো এমন হাড়দুঃখী
ত্রিজগতে আর আছে? যাক গে, এখন অগতির গতি তোমাকেই জানাচ্ছি, চটপট যাহোক একটা
কিছু ব্যবস্থা করে ফেলো। আর শোনো-একটা চাকরিও খুব তাড়াতাড়ি দরকার। মানে সামনের মাস
থেকেই জয়েন করতে চাই। জানো তো সবই, তাছাড়া দেখলেই বাকিটা বুঝতে পারবে (মানে
পত্রবাহকই তো সেই অবতার)। চালাতে পারবে না বলে রেজিস্ট্রি অফিসের ছায়া পর্যন্ত মাড়াতে
যেতে রাজী হচ্ছে না। বোঝ আমার জ্বালা!

বুঝে নিয়ে চটপট ওই দুটো ঠিক করে ফেলে খবর দাও, নইলে মুখ থাকবে না।

সেজপিসির বাড়িতেই রয়েছি এযাবৎ, বোঝ কী রকম বীরাঙ্গনা! বাপের ওপর তেজ দেখিয়ে
বাপের বোনর বাড়িতে গিয়ে ঠেলে উঠলাম! আবার একা নয়, সবান্ধবে! পিসি তাকে খাইয়ে শুইয়ে
ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ-পথ্য করিয়ে আবার চরতে ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু ছাড়া গরু পাছে হারিয়ে যায়
এই ভয়ে মরছি। তাড়াতাড়ি খোঁয়াড়ে পুরে ফেলা দরকার। তাই ওই খোয়াড়টাই আগে দ্যাখো,
বুঝলে? অবিশ্যি সঙ্গে সঙ্গে চাকরিটাও। নিজের স্বার্থেই কর বাবা, নচেৎ যতদিন না জুটবে, তোমার
ঘাড়ই তো ভাঙবো। শাখামৃগের মতো এ শাখা থেকে ও শাখা, এ পিসির ঘাড় থেকে ও পিসির
ঘাড়ে।

বলবে না তুমি অবিশ্যি, তবে বলতে পারতে, বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার সময় তো একবার
বলেও গেলি না, আর ডুব মেরে বসে আছিস তো আছিসই, এখন কোন্ লজ্জায় এতো জোর খাটাতে
এলি? অন্য কেউ হলে বলতো নির্ঘাত!

কিন্তু অন্য কেউ হলে কি জোরটা খাটাতে বসতাম? তুমি বলেই তাই। আচ্ছা পিসি,
সেজপিসি আর তুমি-ঠাকুর্দার এই দুটো মেয়ে পালিতা কন্যা-টন্যা নয় তো? কুড়নো টুড়নো?
নইলে ধমনীতে রাজরক্তের চিহ্ন দেখি না কেন? যাক, দেখা হলে অনেক গল্প হবে। এখন দেখার
যোগাড়টা যাতে হয় তাড়াতাড়ি করো। বাসাটায় একটু বারান্দা যেন থাকে বাপু, আর পার তো
দুটো বেতের মোড়া কিনে রেখো।…কী? ভাবছো তো, আহা যোগাড় করেছেন তো একটি নিধি!
চাষা কুলি, তার জন্যে আবাব বেতের মোড়ার চিন্তা! কী করবো বল? যেমন কপাল! ও ছাড়া তো
জুটলোও না আর। তবে চুপি চুপি বলি পিসি, মালটা খাঁটি। নির্ভেজাল। …তোমার ভাই-ভাজের
খবর কী? কন্যাহারা চিত্ত নিয়ে দুজনে পরস্পরের দোষ দিয়ে অহরহ ঝগড়া করছেন? এবার
তাহলে কলম রাখছি।

আর একবার কথা দুটো মনে করিয়ে দিচ্ছি। ভালবাসা নিও।
ইতি
সেই পাজি মেয়েটা

অনামিকার মনে হলো অনেকদিনের অনাবৃষ্টির পর বড় সুন্দর বড় একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেল।

নেমে এলেন।

আহ্লাদে মনটা কানায় কানায় ভরে উঠেছে। কী আনন্দ, কী মুক্তি।

অবিশ্যি এমন দুটি কাজের ভার দিয়ে বসেছে, যা গন্ধমাদন-তুল্য। তবু ভারী হাল্কা লাগছে।

কিন্তু এখন কী করা যায়?

ছোড়দা-ছোটবৌদিকে জানাবেন না?

আহা, তাই কী উচিত? বেচারীরা কী অবস্থায় রয়েছে।

তাছাড়া ছোড়দার কাছে কথা দেওয়া আছে। খবর এলেই জানাবো।

কথা দেওয়ার কথা আলাদা।

তবে শম্পার মা-বাপ খুব একটা খারাপ অবস্থায় নেই। যদিও খারাপের ভান করছেন।

আসলে কিন্তু মেয়ের খবর তারা অনেকদিনই পেয়েছেন। পারুলের ছেলে মোহনলাল জানিয়ে দিয়েছিল তার মামার বাড়িতে।

মামাদের সঙ্গে সাতজন্মে যোগাযোগ নেই। তাতে কি? এরকম এমার্জেন্সি কেস-এ সেসব মান-অভিমান মনে রাখা চলে না।

অবশ্য মামার বাড়িতে খবর দেবার উদ্দেশাটা ঠিক মামার দুশ্চিন্তা দূর করার জন্যে নয়, ভেবেছিল খবর পেলেই মামা মেয়েকে ঘাড় ধরে নিয়ে চলে আসবে, আর সেই অসভ্য বাঁদরটাকে পুলিসে ধরিয়ে দেবে।

বুদ্ধিমান মামা সেদিক দিয়ে যায়নি।

পারুলের কাছে আছে। এর পর আর কি আছে?

কিন্তু অনামিকা তা জানতেন না।

অনামিকা তাই ভাবতে ভাবতে নামলেন, কী ভাবে কথাটা উত্থাপন করবেন? ওরা যদি বলে, কই চিঠিটা দেখি?

নিচে এলেন।

খাবার ঘরের সামনে ছোটবৌদি দাঁড়িয়ে।

অনামিকাকে দেখেই বলে উঠলেন, এসেই ওপরে উঠে গেলে, একটা কথা বলার ছিল চকিত হলেন অনামিকা।

ব্যাপারটা কি? কি কথা বলার জনো উনি অমন মুখিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন? সত্যবানকে কেউ দেখেছে নাকি? অনামিকার সঙ্গে এক গাড়িতে আসতে? হয়ত তাই।

তার মানে কাঠগড়ায় তুলবেন ইনি ওঁর ননদিনীকে। অনামিকা শান্ত হাসি হেসে বললেন, কী বলো?’

বৌদি বললেন, আচ্ছা এখন থাক, খেয়ে নাও আগে।

বৌদির গলার সুরে যেন ঈষৎ করুণা।

 যেন যা বলবেন, খাইয়ে-দাইয়ে বলবেন।

অর্থাৎ বক্তব্যটা অন্য ধরনের। কিংবা ফাঁসিই দেবেন, তাই তার আগে

খেয়ে নেবার কী আছে? কী হয়েছে? হঠাৎ কী হলো? বললেন অনামিকা দাঁড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু কী হয়েছে, কী হলো, তা কি অনামিকার ধারণার ধারে কাছে ছিল?

অথচ একেবারে না থাকার কথা নয়। আশী বছর বয়েস হয়েছিল সনৎকাকার।

কিন্তু সেটাই কি সান্ত্বনার শেষ কথা? বয়েস হয়েছিল, অতএব পৃথিবীর ক্ষতির ইতিহাসের খাতায় আর তার নাম উঠবে না? তার চলে যাওয়ার দিকে উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে পৃথিবী?

পৃথিবীর হিসেবে তাই বটে। তাই অনামিকার কানের মধ্যে একটা ঘর্ঘর শব্দ যেন বলেই চলেছে, অবিশ্যি দুঃখের কিছু নেই, বয়েস হয়েছিল!

বয়েস হয়েছিল? অতএব তার আর পৃথিবীর কাছে কোনো পাওনা নেই। তার জন্যে যদি কোথাও কোনোখানে হাহাকার ওঠে, সেটা হাস্যকর আতিশয্য।

সোনা পুরনো হয়ে গেলে তার মূল্য কমে যায় না, অথচ ভালবাসার পাত্র পুরানো হয়ে গেলে তার মূল্য কমে যায়। কারণ সে আর প্রয়োজনে লাগছে না। বিচার করে দেখো, শোকের মূল কথা প্রয়োজনীয় বস্তু হারানো। যে যতো প্রয়োজনীয় তার জন্যে ততো শোক।

যে পৃথিবীর আর কোনো প্রয়োজনে লাগছে না, লাগবে না, তাকে অম্লানচিত্তে বিদায় দিয়ে বলল, বয়েস হয়েছিল! বলো, মানুষ তো চিরদিনের নয়। আর যদি কিছুটা সৌজন্যের আবরণ দিতে চাও তো বলো, মৃত্যু অমোঘ, মৃত্যু অবধারিত, মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যুর মতো সত্য আর কি আছে?

অতএব যার ভিতরে ঋণের বোঝা, যার চিত্তে মূল্যহ্রাসের প্রশ্ন নেই, তাকে সকলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে হবে, তা তো সত্যি!

তার আর বলা সাজবে না, ঠিক এই মুহূর্তে খাবার থালার সামনে বসা শক্ত হচ্ছে আমার।

তাছাড়া অনামিকা জানেন, ওই অক্ষমতাটুকু প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে মুঠো মুঠো সান্ত্বনার বাণী এসে হৃদয়ের গভীরতর অনুভূতিটির উপর হাতুড়ি বসাবে। সেই সঙ্গে আরো একবার স্মরণ করিয়ে দেবে লোকে, যার জন্যে তোমার এই অক্ষমতা তার বয়েস হয়েছিল।

তার থেকে অনেক ভালো খাবার পাত্রের সামনে নিঃশব্দে গিয়ে বসা, নীরবে যতোটুকু সম্ভব গলা দিয়ে নামানো। কিন্তু তাতেই কি পুরো মুক্তি পাওয়া যায়?

অনামিকাকে যারা ভালবাসে, অনামিকার জন্যে যাদের দরদ মমতা, তারা কি ব্যস্ত হয়ে বলবে না, এ কী হলো? একটা গ্রাসও তো মুখে দিলে না? সারাদিন পরে-বাইরেও তত কোথাও কিছু খাও না তুমি, ছি, ছি, ইস, সবই যে পড়ে রইলো! এই জন্যেই বলেছিলাম, খাওয়াদাওয়ার পরে শুনো। তুমিও ব্যস্ত হলে, আমিও বলে ফেললাম। আমারই অন্যায়, পরে বললেই হতো। আচ্ছা অন্ততঃ দুধটুকু খেয়ে নাও—

অনামিকাকে এমন করে মায়ামমতা দেখাবার সুযোগ সংসার কবে পায়? ভাগ্যক্রমে আবার অনামিকার স্বাস্থ্যটাও অটুট, কাজেই ওদিকে সুবিধে নেই। অথচ যারা ভালবাসে তাদের তো ইচ্ছে করে কখনো দুটো মমতার কথা বলি। তাই ছোটবৌদি, যে ছোটবৌদির ঠিকরে উঠে ছাড়া কথা বলার অভ্যাস নেই, তিনিও নরম গলায় বলেন, জানতামই এ খবর শুনে তোমার মনটা খারাপ হয়ে যাবে, সত্যি নিজের কাকার মতোই ভালবাসতেন তোমায়, আর তুমিও সেই রকমই ভক্তিশ্রদ্ধা করতে, কিন্তু আক্ষেপের তো কিছুই নেই। যেতে তো একদিন হবেই মানুষকে।

অনামিকাকে জ্ঞান দিচ্ছেন ছোটবৌদি। বয়সে অনামিকার থেকে ছোট হলেও, দাদার স্ত্রী হিসেবে সম্পর্কটা মর্যাদার। দুধটা এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেলে উঠে পড়লেন অনামিকা।

তারপর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, হ্যাঁ, তোমাকেও একটা খবর দেবার ছিল, সুখবর। শম্পার একটা চিঠি পেয়েছি আজ। ও চন্দননগরের সেজদির কাছে রয়েছে।

চন্দননগরের সেজদির বাড়িতে শম্পা রয়েছে এ খবরটা ছোটবৌদির কাছে আনকোরা কথা নয়, আকস্মিকও নয়, তবু সেটা দেখানো দরকার, পরিস্থিতি যখন সেইভাবেই সাজানো।

ছোটবৌদিকে তাই চমকে উঠতে হয়। বলে উঠতে হয়, তার মানে? সেজদির কাছে? আর আমরা মরে পড়ে আছি? তোমার ছোড়দা তো তলে তলে পৃথিবী ওটকাচ্ছেন?

অনামিকা শুধু বললেন, সেই তো।

যে খবরটির প্রত্যাশায় দিনরাত্রির সমস্ত মুহূর্তগুলি ছিল উন্মুখ হয়ে, যে খবরটির জন্যে সমস্ত মনটা যেন উথলে ওঠবার অপেক্ষায় উদ্বেলিত হয়েছিল, সেই খবরটা কী একটা ব্যর্থ লগ্নেই এসে পৌঁছলো!

আর এমন হাস্যকরভাবে পরিসমাপ্তি। এত উদ্বেগ, এতো উৎকণ্ঠা, এতো দুশ্চিন্তার পর এই! বাপের ওপর রাগ করে পিসির বাড়ি গিয়ে বসে আছেন মেয়ে! কী লজ্জা! কী লজ্জা! সত্যি যেন লজ্জাই করলো অনামিকার ওই হাস্যকর খবরটা দিতে। এর থেকে অনেক ভালো ছিলো শম্পা যদি একটা বিপদের মধ্যে গিয়ে পড়ে অনেক কষ্ট পাওয়ার খবর জানাত।

মনের অগোচর পাপ নেই, সত্যিই মনে হচ্ছিল অনামিকার-শম্পা কেন কোনোখান থেকে বিপন্ন হয়ে একটা চিঠি দিলো না! অথবা শম্পা কেন সগৌরবে খবর পাঠাতে পারলো না, পিসি! বিয়েটা মিটিয়ে ফেলেছি, এখন ভাবলাম তোমাদের সেই শুভ খবরটি জানানো দরকার। তোমাকে জানালেই সবাই জানবে।

তা নয়, এমন দীন-হীন একটা খবর পাঠিয়েছে যে অনামিকার সেটা পরিবেশন করতে লজ্জা করলো।

তবু ঠিক পরিবেশনের মূহুর্তে ওই খবরের ওপর যদি আর একটা হিমশীতল খবর এসে না পড়তো! এখন কার কথা ভাবতে বসবেন অনামিকা? যাঁর কাছে আকণ্ঠ ঋণের বোঝা, অথচ জীবনের কোনোদিনই শোধ করা যায়নি, অথবা যা শোধ করা যায় না, শুধু আপন চিত্তের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে স্মরণ করতে হয় মাথা নত করে, তার কথা? না ওই যে মেয়েটা দু’হাত বাড়িয়ে ছুটে আসতে চাইছে এক গভীর বিশ্বাসের নিশ্চিন্ততায়, তার কথা?

শম্পা জানে, সে যত দোষই করুক, যতো উৎপাতই ঘটাক, অনামিকার হৃদয়কোটরে তার অক্ষয় সিংহাসন পাতা।

ছোটবৌদি এবার স্বক্ষেত্রে নামেন, কিন্তু এও বলি ভাই, সেজদির কি উচিত ছিল না তলে তলে খবরটা আমাদের দেওয়া? আমরা কোন প্রাণে রয়েছি সেটা তিনি টের পাচ্ছিলেন না?

অনামিকার দাঁড়াতে ইচ্ছে করছিল না। ইচ্ছে হচ্ছিল এই আলো আর শব্দের জগৎ থেকে সরে গিয়ে একটু অন্ধকারের মধ্যে আশ্রয় নিতে, কিন্তু সে ইচ্ছে মিটবে কি করে? খাল কেটে, কুমীর তো নিজেই আনলেন!

অনামিকা কি বুঝতে পারেননি শম্পার খবরটা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই এই শব্দের কুমীরটা তাঁকে গ্রাস করতে আসবে, সহজে ছাড়িয়ে নিয়ে পালাতে পারবেন না?

বুঝতে পেরেছিলেন বৈকি, হয়তো সেই জন্যেই একটু ইতস্ততঃ করেছিলেন, ভেবেছিলেন আপাতত ভুলে যাওয়ার ভান করলে কী হয়? যদি আগামীকাল সকালে বলা যায়, দেখো বাড়ি আসতে-না-আসতেই ওই খবরটা পেয়ে শম্পার চিঠিটার কথা হঠাং ভুলে গিয়েছিলাম! তাহলে?

কিন্তু তাহলে কি আরো বহু শব্দের কাঁকের মুখে পড়তে হতো না? হিসেব হতো না অনামিকার কাছে কার মূল্য বেশী? যে হারিয়ে গেল, না যে হারিয়ে গিয়ে ফিরে এলো!

ভবিষ্যতের সেই শব্দের ঝাঁকের ভয়ে অনামিকা ইতস্ততঃ করেও এখনই খালটা কাটলেন। তাছাড়া মমতাবোধও কি কিছু কাজ করেনি? মনে হয়নি খবর পেয়ে বাঁচবে মানুষটা?

কিন্তু বেঁচে গেলেই কি বর্তে যাবে মানুষ? অন্যের উচিত অনুচিতের হিসেব নিতে বসবে না?

অনামিকা নিষ্প্রাণ গলায় বলেন, খুবই ঠিক। বোধ হয় শম্পাটা খুব করে বারণ করে দিয়েছিল।

বাঃ, বেশ বললে ভাই

ছোটবৌদির ক্ষণপূর্বের মমতাবোধটুকুর আর পরিচয় পাওয়া যায় না, তিনি রীতিমত ক্রুদ্ধ এবং ক্ষুব্ধ গলায় বলেন, তোমাদের বোনে বোনে এক অন্য বিধাতার গড়া বাবা! ও যদি বারণ করেই থাকে, করবেই তো, যে মেয়ে বাপের ওপর তেজ করে বাড়ি ছাড়ে, সে আর খবর দিতে বারণ করবে না? কিন্তু সেটাই একটা ধর্তব্যের কথা হলো?

হলো না, সেটা অনামিকাও মনে মনে স্বীকার না করে পারেন না। সেজদির ওপর দুরন্তু একটা অভিমানে তারও তো মনটা কঠিন হয়ে উঠেছিল। তবু সায় দেওয়ার একটা দায়িত্ব আছে। সেটা যেন গলা মিলিয়ে নিন্দে করার মতো মনে হলো অনামিকার। তাই আস্তে বললেন, মেয়েটা তো বড়ো জবরদস্তওলা কিনা!

ছোটবৌদি এতক্ষণে নিজস্ব ভঙ্গীতে ঠিকরে উঠতে সুযোগ পান।

বলে ওঠেন, বললে তুমি রাগ করবে ভাই, বাইরে তোমার কত নামডাক, কতো মান্য সম্ভ্রম, তোমার বুদ্ধি নিয়ে কথা বলা আমার মতো মুখ্যুর সাজে না, তবু না বলে পারছি না–পিসির আস্কারাতেই মেয়ে অতত দুধর্ষ হয়েছে।

এ অভিযোগ আজ নতুন নয়, সুযোগ পেলেই একথা বলে থাকেন ছোটবৌদি, বলে আসছেন চিরকাল, আজ তো একটা মোক্ষম সুযোগ পেয়েছেন, তাই চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই নামডাকগুলো মান্যগণ্য অনামিকা দেবীর।

ছোটবোদি আবারও শুরু করেন, এখন আবার আরো পৃষ্ঠবল বাড়লো। যে পিসিকে জন্মে চোখে দেখেনি, আবার তার সোহাগও জুটলো৷ তলে তলে চিঠিচাপাটি চলত নিশ্চয়, নইলে মেয়ের এতো দুঃসাহসই বা আসে কোথা থেকে, আর চট করে ওখানে গিয়েই বা ওঠে কেন? যাক, তোমাদের সব কি দেব, আমারই কপাল! নিজের মেয়েকে কখনো নিজের করে পেলাম না। তাই নিজের ইচ্ছেমত গড়তে পেলাম না।

হঠাৎ ধৈর্যচ্যুতি ঘটে যায়। যা নামিকার প্রকৃতিবিরুদ্ধ। তাই হয়ে যায়। হঠাং বলে বসে অনামিকা, মেয়েকে নিজের করে পেয়ে, নিজের ইচ্ছেমতো গড়ার নমুনাও তো দেখছি–

বলে ফেলেই নিজেকে নিজে ধিক্কার দিলেন অনামিকা, ছি ছি, এ তিনি কী করে বসলেন এই হঠাৎ অধৈর্য হয়ে পড়া মন্তব্যটির জন্যে ভবিষ্যতে কতো ধৈর্যশক্তি সংগ্রহ করতে হবে ছোটবৌদি কি একথা অপূর্ব-অলকার কানে না তুলে ছাড়বে?

তারপর? আর তো কিছু না, মারবে না কেউ অনামিকাকে, কিন্তু ওই শব্দ! শত শত শব্দের তীরের জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে অনামিকাকে।

যদিও নিজে ছোটবৌদি অহরহই এমন মন্তব্য করে থাকেন, তার ভাশুরপো-বৌ অলকা যে ফ্যাশান দেখাতে গিয়ে মেয়ের পরকাল ঝরঝর করেছে, একথা কারণে অকারণেই বলেন। আর হয়তো বা অকারণেও নয়! অলকার ওই মেয়ে, ডাকনাম যার অনেক রকম, ভালো নাম সত্যভামা, সে মেয়েটা সম্পর্কে অনেক রকম কথাই কানে এসেছে। প্রবোধচন্দ্রের এই পবিত্র কুলে, কালের ওই কন্যাটির দ্বারা নাকি বেশ কিছু কালি লেপিত হয়েছে, তবে মা বাপ তার সহায়, সে কালি তলে তলে মুছে ফেলা হয়েছে। আধুনিক সভ্যতা তো অসতর্কতার অভিশাপ বহন করে বেড়াতে বাধ্য করায় না।

তবে ইদানীং যা করাচ্ছে অলকা মেয়েকে দিয়ে, সেটা প্রবোধের কুলে কলঙ্ক লেপন করলেও অলকা সগৌরবেই প্রকাশ করছে। কিছুদিন এয়ার হোস্টেসের চাকরি নিয়ে অনেক ঝলমলানি দেখিয়ে এখন সত্যভামা আর এক ঝলমলে জগতের দরজা চিনে ঢুকে গিয়েছে। চিনিয়েছে ওর এক দূর সম্পর্কের মাসির মেয়ে, কিন্তু এখন নাকি সত্যভামা তাকে ছাড়িয়ে অনেক দূরে এগিয়ে গেছে।

সত্যভামা নাকি ক্যাবারে নাচছে হোটেলে হোটেলে। অলকাই সগর্বে বলে বেড়ায়, এক জায়গায় বাঁধা চাকরিতে ওকে নাকি তিষ্ঠোতে দেয় না লোকে, নানা হোটেল থেকে ডাকাডাকি করে টেনে নিয়ে যায়। গুণ থাকলেই গুণগ্রাহীরা তার সন্ধান পায় এটাও যেমন স্বাভাবিক, গুণীকে টানাটানি করাও তেমনি স্বাভাবিক। অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে অলকা এসব বানিয়ে বলে না।

অবশ্য প্রথম যখন সত্যভামার এয়ার-হোস্টেসের চাকরির খবরটা প্রবোধচন্দ্রের ভিটের সংসারভূমিতে এসে আছড়ে পড়েছিল, তখন মস্ত একটা ধূমকুণ্ডলী উঠে অনেকটা আলোড়ন তুলেছিল!

অনামিকা পর্যন্ত অলকাকে ডেকে জিজ্ঞেস না করে পারেননি, কথাটা কি সত্যি অলকা?

অনামিকা বিস্ময় প্রকাশ করেননি, বিস্ময় প্রকাশ করলো অলকা। বললো, সত্যি না হবার কী আছে পিসিমা? মেয়েরা তো আজকাল কত ধরনেরই চাকরি করছে। আর এ তো বিশেষ করে মেয়েদেরই চাকরি।

ওর ওই বিস্ময়টাই যে ওর বল, তা বুঝতে পেরে অনামিকা আর কথা বাড়াননি। শুধু কথার সতোর মুখ মুড়তেই বোধ হয় বলেছিলেন, তা বটে। তবে কষ্টের চাকরি। খাওয়া শোওয়ার টাইমের ঠিক নেই। নাইটডিউটি-ফিউটি দিতে হবে হয়তো–

সে তো হবেই। অলকা মুখটি মাজাঘষা মসৃণ করে উত্তর দিয়েছে, কন্ট্রাক্টে তো সেকথা আছেই। কিন্তু সে সমস্যা তো জগতের সব চেয়ে পবিত্র পেশার নার্সদেরও আছে।

অনামিকা আর কথা বলেননি, কিন্তু বলেছিলেন অনামিকার ছোড়দা। অলকাকে ডেকে নয়, অপূর্বকে ডেকে।

নিজেকে বংশমর্যাদার ধারকবাহক হিসেবে ধরে নিয়ে প্রবোধচন্দ্রের পরিত্যক্ত মশালটি তুলে ধরে তীব্র প্রশ্ন করেছিলেন, বাড়িতে এসব কী হচ্ছে অপূর্ব? তোমরা কি ভেবেছো বুকে বসে দাড়ি ওপড়াবে? বাড়িতে বসে যা খুশি করবে?

অপূর্ব খুব শান্ত গলায় বলেছিল, হঠাৎ কী নিয়ে এমন উত্তেজিত হচ্ছো ছোটকাকা বুঝতে পারছি না তো!

ছোটকাকা আরো উত্তেজিত হবেন, এতে আশ্চর্য নেই। সেটা হয়েই তিনি বলে ওঠেন, ন্যাকা সেজে না অপূর্ব! মেয়েকে এয়ার হোস্টেসের চাকরি করতে পাঠিয়েছো, একথা কী অস্বীকার করবে?

কেন? অস্বীকার করতে যাবো কেন? অপূর্ব বলেছিল, মেয়েকে তো আমি চুরিডাকাতি করতে পাঠাইনি! চাকরি করতেই পাঠিয়েছি। তাতে আপত্তি করলে–

ছোটকাকা ভাইপোর কথা শেষ করতে দেননি, প্রবোধচন্দ্রের উত্তরাধিকারীর কণ্ঠে বলেছিলেন, আমি বলবো চুরি করতেই পাঠিয়েছি। তোমরা–তোমরা দুই স্বামী-স্ত্রীতে মিলে নিঃশব্দে বসে সিঁদ কেটে কেটে এ বংশের মানসম্ভ্রম, সভ্যতা-ভব্যতা সব কিছু চুরি করেছ ওই মেয়েটিকে দিয়ে।

ও বাবা, ছোটকাকা যে খুব ঘোরালো উপমা-টুপমা দিচ্ছো দেখছি! তাহলে বলতে হয়, ডাকাতির ভারটা তুমি বোধ হয় তোমার নিজের মেয়ের ওপর দিয়েছো?

তখনো শম্পা পালায়নি।

কিন্তু উড়ছিল তো?

সেই আকাশে উড়ন্ত চেহারাটা সকলেরই চোখে পড়েছিল।

ছোটকাকা তথাপি বলেছিলেন, বাপ-কাকাকে অপদস্থ করার মধ্যে কোনো সভ্যতা নেই অপূর্ব! বললেন প্রবোধচন্দ্রের ছোট ছেলে। যৌবনকালে নিজের যার ওইটাতেই ছিল রীতিমত আমোদ।

কিন্তু যৌবনকাল তো চিরকালের নয়, যৌবনকাল কখন কোন্ ফাঁকে তার ঔদ্ধত্য আর উন্নাসিকতা, অহমিকা আর আত্মমোহ, প্রতিবাদ আর পরোয়াহীনতার পোর্টফোলিওটি ফেরত নিয়ে নিঃশব্দে সরে পড়ে। হৃতসর্বস্ব প্রৌঢ়ত্ব তখন আপন অতীতকে বিস্মৃত হয়ে যৌবনের খুঁত কেটে বেড়ায়, যৌবনের ঔদ্ধত্য দেখে ক্রুদ্ধ হয়।

অপূর্বর ছোটকাকা হলেন ক্রদ্ধ, বললেন, আমার মেয়েকে আমি কিছু আর প্রশংসা করে বেড়াচ্ছি না, আর প্রশ্রয়ও দিচ্ছি না তাকে। তাছাড়া বাড়ির মধ্যে নাচুক, কুঁদুক, যা হয় বরুক, বাইরে বংশের প্রেসটিজের প্রশ্ন আছে।

মেয়েরা চাকরি করলে বংশের প্রেটিজ চলে যায়, একথা এযুগে বড়ো হাস্যকর ছোটকাকা।

চাকরি করাটাই দোষের এ কথা তো তোমাকে বলিনি, ওই চাকরিটা ভদ্রলোকের মেয়ের উপযুক্ত নয়, সেটাই বলেছি।

ধারেকাছে কোথায় অলকা ছিলো, সে এসে পড়ে খুব আস্তে বলেছিল, একথা এখানে যা বললেন, বাইরে বলবেন না ছোটকাকা! বরং খোঁজ নিয়ে দেখবেন, যেসব মেয়েরা ওখানে রয়েছে, তারা কী রকম ঘর থেকে এসেছে।

ছোটকাকা একবার দিশেহারার মত চারিদিকে তাকিয়ে বোকার মত বলেন, তারা বাঙালী নয়।

বলা বাহুল্য এবার হেসে না উঠে পারেনি অলকা, বলেছিল, বাঃ, তাহলে আপনার মতে যারা বাঙালী নয়, তারা ভদ্রলোক নয়?

সেকথা হচ্ছে না, ছোটকাকা তীব্র হন, তোমার তো চিরকালই এঢ়েতর্ক, তাদের সমাজে যা চলে আমাদের সমাজে তা চলে না। বাঙালীর একটা আলাদা কালচার আছে–

ওই থাকার আনন্দেই আমরা মরে পড়ে আছি ছোটকাকা, কোন্ কালে মরে ভূত হয়ে যাওয়া কালচারের শবসাধনা করছি! আমি ওসব মানি না। আমি বিশ্বাস করি যুগের সঙ্গে পা ফেলে চলতে হবে।

কিন্তু পরে, এই অপূর্বই তবে ছোটকাকার মেয়ে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায় ব্যঙ্গ-হাসি না হেসে উদ্বিগ্নের ভূমিকা নিয়েছিল কেন? উদ্যোগী হয়ে পিসিকে জেরা করতে গিয়েছিল কেন, তার ঠিকানার সন্ধানে?

কারণ আছে, গূঢ় কারণ।

যুগের সঙ্গে পা ফেলে চলতে গিয়ে হঠাৎ পা ফসকে অপূর্বর মেয়ে সত্যভামা তখন আবার দিনকয়েকের জন্যে মামার বাড়ি বেড়াতে গেছে, ব্যঙ্গ-হাসির প্রতিক্রিয়াটা যদি সহসা সেই মামার বাড়ির ঠিকানাটা আবিষ্কার করে বসে।

কিন্তু মেয়ে যদি স্বাস্থ্যশক্তি উদ্ধার করে মামার বাড়ি থেকে ফিরে এসে আবার পরোয়াহীনতার ভূমিকা নেয়, অপূর্বর তবে আবার যুগের সঙ্গে পা মেলানো ছাড়া উপায় কি? নতুন এই পালা বদলের পালায় অপূর্বর মেয়ে ক্যাবারে নাচে রপ্ত হয়েছে। অপূর্ব কথাচ্ছলে লোককে শুনিয়ে বলে, মেয়ের ব্যাপারে ওর মা যা ভাল বুঝছে করছে, আমি ওর মধ্যে নাক গলাতে যাই না। আজকের সমাজে কী চলছে আর কী না-চলছে ওর মাই ভালো বোঝে।

অতএব অন্যেরাও ভালো বুঝে চুপ হয়ে গেছে। অপূর্বর মা’র ছেলে-বৌয়ের সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ অনেক দিন, মেয়েরা আসে, মায়ের ঘরে বসে মীটিং করে, চলে যায়, অলকা বলে, আমার শাপে বর। নইলে ওই চারখানি ননদিনীর হ্যাঁপা সামলাতে হতো বারো মাস।

অপূর্বও সেটা স্বীকার করে বৈকি।

সত্যভামার এই নৃত্য তো শুধুই ভূতের নেত্য নয়। ও থেকে পয়সা আসে ভালোই। তবে? এও তো একটা চাকরির বাজার আগুন, সংসারের চাল বেড়ে গেছে যথেষ্ট, একার উপার্জনে চাল বজায় রেখে চলেই না তো! মেয়ে এবং ছেলে যখন সমাজে সমান বলে স্বীকৃত, তখন বাপের সংসারের অচল রথকে সচল করে তোলার দায়িত্ব মেয়ে বহন করলেই বা লজ্জা কি?…কিন্তু প্রবোধচন্দ্রও তো লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে অন্তরীক্ষ থেকে বজ্র নিক্ষেপ করলেন না কোনো দিন? যাতে ভিটেটা তার কলঙ্ক সমেত চুর্ণ হয়ে যায়?

কিন্তু লজ্জা আশপাশের লোকের।

তাই অনামিকা তার ছোটবৌদির আক্ষেপের মুখে বলে ফেললেন, মেয়েকে নিজের মনের মতো করে মানুষ করার নমুনা তো দেখলাম!

বলেই বুঝলেন, খুব অসতর্ক হয়ে গেছে। এই অসতর্কতা ছোটবৌদিকে শক্রশিবিরে টেনে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু কী আর করা! হাতের ঢিল মুখের কথা একই বস্তু, এ তো চিরকালের কথা।

ছোটবৌদি অবশ্যই ফোঁস করে উঠলেন।

বললেন, সবাই সমান নয় ছোটঠাকুরঝি। রাগের সময় উনি ঠাকুরঝি শব্দটা ব্যবহার করেন। বললেন, অলকার সঙ্গে আমার তুলনা করো না। কিন্তু দেখাতে পেলাম না, এই আমার দুর্ভাগ্য!

অনামিকা এই আক্ষেপের মুখোমুখি কতোক্ষণ আর দাঁড়িয়ে যুঝবেন, বললেন, আচ্ছা খবরটা ছোড়দাকে দিও–

চলে যাবার জন্যে পা বাড়ালেন। ছোটবৌদি বললেন, চিঠিটা কই?

অনামিকা বললেন, চিঠিটা! সে তো আমার ঘরেই রয়েছে।

আচ্ছা তুমি যাও, তোমাকে আর নামতে হবে না-আমি গিয়ে নিচ্ছি। বললেন ছোটবৌদি।

অনামিকা প্রমাদ গুনলেন। বললেন, আর বোলো না, সে এক পাগলের চিঠি! মোট কথা, ওইটাই জানিয়েছে।

অর্থাৎ ধরে নাও চিঠিটা তিনি দেখাবেন না।

ছোটবৌদি কালি মুখে বলেন, ওঃ! কিন্তু চিঠিটা তুমি পেয়েছো কখন? আমি তো এই বিকেলের ডাকের পর পর্যন্ত লেটার-বক্স দেখে এসেছি–প্রসূনের চিঠি এসেছে কিনা দেখতে।

ও! ডাকে তো আসেনি। একটা লোক এসে হাতে দিয়ে গেল।

লোক? কি রকম লোক? ছোটবৌদির কণ্ঠে আর্তনাদ।

অনামিকা মিথ্যা ভাষণ দিলেন না, বললেন, রামকালো একটা লোক—

রামকালো। অতএব নিশ্চিন্ত হতে পার।

আবার কী ভেবে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন অনামিকা, ছোড়দা কি কাল চন্দননগরে যাবে?

চন্দননগরে? তোমার ছোড়দা?

ছোটবৌদি তীক্ষ্ণ হন, প্রাণ থাকতে নয়। আর যদিও হঠাৎ বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে যেতে চায়, আমি ঘরে চাবি দিয়ে আটকে রেখে দেব।

অনামিকার পাশ কাটিয়ে ছোটবৌদিই আগে তরতরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যান।

অনামিকা আস্তে আস্তে সিঁড়ি উঠতে লাগলেন। তিনতলা পর্যন্ত উঠতে হবে।

এসে চিঠিখানা আবার হাতে নিলেন, কিন্তু পড়লেন না। ভাবতে লাগলেন, সনৎকাকার বাড়িতে একবার যাবার দরকার আর এখন আছে কিনা।

শুনেই ভেবেছিলেন, তখুনি খবর এসেছে, ছুটে গেলে শেষযাত্রার কালেও দেখা যেতে  কিন্তু না, ছোটবৌদি বলে উঠেছিলেন, সে কি! এখন গিয়ে কি করবে? উনি তো কাল সকালে মারা গেছেন!

কাল সকাল! আর এখন আজ রাত্তির!

তার মানে আকাশে-বাতাসে কোথাও কোনখানে চিতার ধোঁয়াটুকুও নেই।

তবে আর ছুটোছুটিতে লাভ কী?

কিন্তু আগামী কাল? অথবা তার পরদিন? কি জন্যে? নীরুদার শোকে সান্ত্বনা দিতে? নাকি অভিযোগ জানাতে? অনামিকাকে কেন খবর দেওয়া হয়নি? অনামিকা পাগল নয় যে এই ধৃষ্টতাটুকু করতে যাবেন! না গেলে কী হয়! পরে কোনো একদিন দেখা হলে নীরুদা যদি বলে, কী, তুমি তো কাকাকে খুব ভালটাল বাসতে, কই মরে যাওয়ার খবর শুনেও তো এলে না একবার!

এই আক্রমণটুকু থেকে আত্মরক্ষা করতে?

দূর!

আগে, মানে অনেক দিন আগে হলে হয়তো এটা করতেন অনামিকা। নিজেকে ক্রটিশূন্য করবার একটা ছেলেমানুষী মোহ ছিল তখন। সেই ক্রটিশূন্য করবার জন্যে প্রাণপাত করেছেন, ইচ্ছার বিরুদ্ধে লড়েছেন, নিজের সম্পর্কে বিস্মৃত হয়ে থেকেছেন।

সেই ছেলেমানুষী মোহটা আর নেই।

ওই ব্যর্থ চেষ্টাটা যে শুধু নিজের ভিতরেই ক্ষয় ডেকে আনে, এটা ধরা পড়ে গেছে। অতএব নীরুদার সঙ্গে সৌজন্য করতে না গেলেও চলবে।

তবে?

তবে চলে যাওয়া যায় চন্দননগরে।

বহুদিনের অদেখা সেজদির কাছে গিয়ে দাঁড়ানো যায়। একটা আগ্রহ অনুভব করলেন, ডাযেরী বইয়ের পাতাটা খুলে দেখলেন আগামী কাল এবং পরশু-তরশু, এই দু-তিনদিনের মধ্যে কোথাও কোনো ফাঁদে পড়ে আছেন কিনা।

দেখলেন নেই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

কিন্তু বাড়িতে কি বলবেন কথাটা?

বলবো না ভাবতেও লজ্জা করছে, বলে কয়ে যাবো ভাবতেও খারাপ লাগছে। শম্পার মা বাপ স্থির হয়ে বসে রইলো, আর পিসি ছুটলো–এটা মেয়েকে আস্কারা দিয়ে নষ্ট করবার আর একটি বৃহৎ নজীর হয়ে থাকবে।

থাক! কী করা যাবে?

ঠিক এই মুহূর্তে কোথাও একটু চলে যাবার জন্যও মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।

গতকাল সকালে মারা গেছেন সনৎকাকা, এই শহরেরই এক জায়গায়, অথচ অনামিকা যথানিয়মে খেয়েছেন ঘুমিয়েছেন, ওই পাড়ারই কাছাকাছি রাস্তা দিয়ে গাড়ি করে বেরিয়ে গেছেন রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যা পালন করতে।

হঠাৎ আবার অনেক দিন আগের সেই একটা দিনের কথা মনে পড়লো। মানুষ কী পারে আর কী না পারে! সেদিনও তো সভা করেছেন অনামিকা, যেদিন নির্মলের খবরটা পেয়েছিলেন সভামণ্ডপে দাঁড়িয়ে।

সত্যদ্রষ্টা কবি বলে রেখেছেন, জানি এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে, কাটবে গো দিন যেমনি আজও দিন কাটে

পরম সত্য তাতে আর সন্দেহ কী! তবু সেই দিন কাটার অন্তরালে কোথাও কি একটু সুর কেটে যায় না?

নিঃশাস পড়লো মৃদু-গভীরে।

শুয়ে পড়লেন ঘরের আলো নিভিয়ে। আর হঠাৎ মনে হলো, তখন ছোটবৌদির সঙ্গে বৃথা কথায় সেই সুরের তার যেন ছিঁড়েখুঁড়ে ঝুলে পড়ে গেলো। অনামিকা একটি মধুর গভীর সুরের আস্বাদ থেকে বঞ্চিত হলেন।

শোকেরও একটি আস্বাদ আছে বৈকি। গভীর গম্ভীর পবিত্র।

পবিত্র মাধুর্যময় গভীর-গম্ভীর সেই আস্বাদনের অনুভূতিটি টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে গেল। সেগুলিকে কুড়িয়ে তুলে নিয়ে আর সম্পূর্ণতা দেওয়া যাবে না। আর ফিরে পাওয়া যাবে না সেই প্রথম মুহূর্তের স্তব্ধতা। এও একটা বড় হারানো বৈকি।

পারিবারিক জীবনে এমন কতকগুলো ব্যাপার আছে, যেগুলো নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও না করে উপায় নেই। না করলে পারিবারিক আইন লঙ্ঘন করা হয়।

আপন গতিবিধির নিখুঁত হিসেব পরিবারের অন্যান্য-জনের কাছে দাখিল করা তার মধ্যে একটি। তোমার হঠাৎ ইচ্ছে হলে কোথাও চলে যাবার ক্ষমতা তোমার নেই, মনের উপর চাপানো আছে ওই আইনভার।

চলে যাওয়াটাই তো শেষ কথা নয়। তার পেছনে ফিরে আসা বলে একটা কথা আছে। ফিরে আসার পর পরিজনেরা জনে জনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে শুধোবে না, কী আশ্চর্য, না বলে চলে গেলে? কোথায় গেলে কাউকে জানিয়ে গেলে না?

পারিবারিক শাস্ত্রে এটা খুব গর্হিত অপরাধ। যেন অন্যদের অবমাননা করা। যেন ইচ্ছে করে স্বেচ্ছাচারিতার পরাকাষ্ঠা দেখানো।

অতএব নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছোট সুটকেসটা গুছিয়ে নিচের তলায় নামতে হলো অনামিকাকে।

চাকরটাকে ডেকে বললেন, ছোটমা কোথায় রে?

ছোটমা? তিনি তো এখন পূজোর ঘরে

শুনে বিস্মিত হলেন অনামিকা, ছোটবৌদির এ উন্নতি কবে হলো? জানতেন না তো? যাক কতো কি-ই তো ঘটছে সংসারে, তিনি আর কতটুকু জানেন? এ একটা অদ্ভুত জীবন তার, না ঘরকা না ঘাটকা। এ সংসারে আছেন, কিন্তু এর সঙ্গে যেন সম্যক যোগ নেই। যেহেতু যথারীতি অন্য সংসারে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হননি, সেইহেতু অনামিকা যেন একটা বাড়তি বস্তুর মতো এখানে চেপে বসে আছেন। আজন্মের জায়গা, তবুজম্মগত অধিকারটুকু কখন যে চলে যায়। মেয়েদের জীবনে এ একটা ভয়ঙ্কর কৌতুক।

আচ্ছা, বাড়ির কোনো ছেলে যদি অবিবাহিত থাকে, এমন তো অনেকেই থাকে, আরো কি এই রকম কেন্দ্রচ্যুত হয়ে বাড়তিতে পরিণত হয়?

ভাবতে ভাবতে আবার দোতলায় চলে এলেন অনামিকা, ছোড়দার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ডাকলেন, ছোড়দা।

ছোড়লা সাড়া দিলেন না, চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন। কুঞ্চিত, অপ্রসন্ন মুখ।

অনামিকা ওঁর প্রশ্নের অপেক্ষা রাখলেন না, বললেন, ছোটবৌদি তো শুনেছি পুজোর ঘরে নাকি, ওকে একটা কথা বলার ছিলো, তুমি বলে দিও, আজ যেন আমার, মানে-আজ কাল পরশু এই দুটো-তিনটে দিন যেন আমার রান্না-টান্না করতে দেয় না। আমি একটু যাচ্ছি- বলেই মনে হলো কথাটা খুব বেখাপ্পা ভাবে বলা হলো।

ছোড়দা চায়ের পেয়ালা শেষ করে শ্লেষাত্মক গলায় বলেন, তিনদিনের জন্যে? সভাটা কোথায়?

ছোড়দা কি বুঝতে পারেননি, অনামিকা কোথায় যাচ্ছেন! অনামিকার মনে হলো বুঝতে পেরেও ছোড়দা যেন ইচ্ছে করেই প্রসঙ্গটাকে অন্যদিকে নিয়ে গেলেন।

অনামিকারই ভুল। গোড়াতেই স্পষ্ট পরিষ্কার গলায় বললেই ভালো হতো, ছোড়দা, আমি দিন তিনেকের জন্যে চন্দননগরে সেজদির কাছে বেড়াতে যাচ্ছি।

এবার বললেন, না, সভাটভা তো না, সেজদির কাছে একটু বেড়িয়ে আসতে যাচ্ছি।

সেজদির কাছে? মানে চন্দননগরে? ছোড়দা তিক্ত গলায় বলেন, আশা করি আহ্লাদ করে কাউকে নিয়ে আসবে না?

নিয়ে? কাকে? অনামিকাও এবার প্যাঁচ কষলেন, বললেন, নিয়ে আসার কথা কী বলছো?

কী বলছি, তুমি একেবারেই বুঝতে পারেনি এটা আশ্চর্যের কথা! তুমিই গতকাল জানিয়েছ তোমার সেই ধিঙ্গী ভাইঝি চন্দননগরে আর এক আশ্রয়দাত্রীর কাছে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। এবং বোঝা যাচ্ছে আজ তুমি সেখানে ছুটছে–

অনামিকা মৃদু হেসে বলেন, ছুটছি হয়তো এমনিই। মনটা ভালো লাগছিলো না তবে হয়তো অজানিতে তাকে দেখতেই ছুটছি, আনবার কথা ভাবতে যাবো কোন সাহসে ছোড়দা? কার বাড়িতে নিয়ে আসবো একটা বেয়াড়া দুষ্ট বুদ্ধিহীন মেয়েকে?

ছোড়দার কি একটু আগের চা-টা গলায় বেধেছিল? তাই হঠাৎ অমন বিষম খেলেন? কাসতে কাসতে সময় চলে গেল অনেকটা। তারপর বললেন, সেকথা বলতে পারো না তুমি, বাবা তোমার এ বাড়ির ওপর বেশ কিছু অধিকার দিয়ে গেছেন।

অনামিকা তেমনিই হেসে বলেন, আমি তো সেই অদ্ভুত বাজে ব্যাপারটাকে বাবার ছেলেমানুষী ছাড়া আর কিছুই ভাবি না ছোড়দা। নেহাৎ তোমাদের গোত্রেই রয়ে গেলাম, তাই তোমাদের বাড়িতেও থেকে গিয়েছি। যাক ওকথা, আমি তাহলে বেরুচ্ছি।

ছোড়দা এবার দাদাজনোচিত একটি কথা বলেন, একাই যাচ্ছো নাকি?

যদিও একা বেড়ানোর অভ্যাস অনামিকার আদৌ নেই, সভাসমিতির ব্যাপারে এখানে সেখানে যাচ্ছেন বটে সর্বদা, সে তো তারা গলবস্ত্র হয়ে নিয়েই যায়। যাবার ঠিক করে ফেলার আগে সামান্য একটু চিন্তা যে না করেছেন তাও নয়, তবু খুব হালকা গলাতেই উত্তর দিলেন, এই তো এখান থেকে এখান, সকালের গাড়ি, এর আর একা কি?

ছোড়দা আর কিছু বললেন না, ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন, আর ছোড়দার শুধু ঢিলে গেঞ্জি পরা পিঠটা দেখে অনামিকার মনটা হঠাৎ কেমন মায়ায় ভরে গেল। কী রোগা হয়েছে ছোড়দা! পিঠের হাড়টা গেঞ্জির মধ্যে থেকে উঁচু হয়ে উঠেছে। বেচারী! মুখে তেজ দেখিয়ে মান বজায় রাখে, ভিতরে ভিতরে তুষ হয়ে যাচ্ছে বৈকি।

রাগ, দুঃখ, অপমান, লজ্জা, দুশ্চিন্তা, মেয়ের প্রতি অভিমান~-সব কিছুর ভার আর জ্বালা। নিজের মধ্যেই বহন করে চলেছে ও।

একটু অন্তরঙ্গ গলায় একটু কিছু ভালো কথা বলতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু কী-ই বা বলবেন।

ছোড়দা যদি অন্য ধরনের রাগ দেখিয়ে বলতো, যাচ্ছিস যদি তো সেই পাজী মেয়েটার চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে চলে আয়–, তাহলে হয়তো সেই অন্তরঙ্গ হবার সুবিধেটা হতো।

কিন্তু যদি আর হয়তোগুলো চিরদিনই চিত্তচাঞ্চল্যের কারণ হওয়া ছাড়া আর কোনো কাজে লাগে না।

.

নিজ মনে ভাবনা করার পক্ষে রেলগাড়ি জায়গাটা আদর্শ। একগাড়ি লোকের মধ্যেও তুমি দিব্য নিশ্চিন্ত মনে একা থাকতে পারো। তোমার মুখ দেখে কেউ মনের ভাব পড়বার চেষ্টা করবে না।

অনামিকা দেবী এখন তাই ভাবতে পাচ্ছেন, সেজদির সঙ্গে প্রথম দেখার অবস্থাটা কেমন হবে! দেখেই কি উচ্ছসিত হয়ে ছুটে আসবে সেজদি? না শান্ত গম্ভীর অভ্যর্থনায় জমানো অভিমান প্রকাশ করবে?

অনামিকা কি তবে গিয়েই হৈ হৈ করবেন? উঃ সেজদি, কতোদিন পরে দেখলাম তোকে!…অথবা, কী রে চিনতে-টিনতে পারছিস, না চেহারাটা ভুলেই গেছিস? না, ও কথায় আবার উল্টো চাপ পড়তে পারে, সেজদি হয়তো ফট করে উত্তর দিয়ে বসবে, চেহারা ভোলবার জো কি? কাগজপত্রে তো মাঝে মাঝেই চেহারা দেখতে পাওয়া যায়?

অবিশ্যি কাগজপত্রে ছাপা চেহারা নিয়ে কিছু হাসাহাসি করা যায়, কিন্তু মনের চেহারাটা যেন তার অনুকূল নয়। যেন সেই মনটা শুধু সেজদি বলে ডেকেই চুপ করে যেতে চায়। আর কোনো কথা নয়।

কিন্তু এ তো গেল সেজদির কথা।

আর সেই মেয়েটা? তাকে কি বলবেন? সে কি বলবে?

সে নিশ্চয় ছুটে এসে জড়িয়ে পিষে গায়ে নাক ঘষে একাকার করবে।

হাওড়া থেকে চন্দননগর, ইলেকট্রিক ট্রেনের ব্যাপার, তবু যেন মনে হচ্ছে পথটা ফুরোতে চাইছে না! সেই মেয়েটার প্রথম আবেগের ঝড়টা কল্পনা করতে করতে ধৈর্য কমে আসছে!

কিন্তু গতকাল থেকে অনামিকার জন্যে বুঝি ভাগ্যের হাতের চড় খাওয়াই লেখা ছিল। তাই সেই ঝড়টা এসে আছড়ে পড়লো না।

সেজদি ওকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো, আস্তে বললো, তুই!

তারপর আরো আস্তে আস্তে বললো, তুই এখন এলি!

হঠাৎ ভয়ানক একটা ভয়ে বুকটা হিম হয়ে গেল অনামিকার। মনে হলো গত কালকের মতো আজও বুঝি নিদারুণ একটা সংবাদ তার জন্যে অপেক্ষা করছে।

অনামিকা কি সিঁড়িতেই বসে পড়বেন?

পারুল বোধ হয় মুখ দেখে মনের কথা বুঝলো, তাই আস্তে বললো, ভয় পাস নে, তবে খবরটা সত্যিই খুব খারাপ। সেই ছেলেটা, জানিস তো সবই, ক’দিন আগে চলে গিয়েছিল, সকালে হঠাৎ কে একটা লোক এসে খবর দিল–

সেজদি একটু থামলো, তারপর বললো, সেই ছেলেটা বুঝি কোন্ কারখানায় কাজ করতো, সেখানে বুঝি কার সঙ্গে কী গোলমাল হয়েছিল, বোমাটোমা মেরেছে নাকি, বেঁচে আছে কি নেই, এই অবস্থা ছেলেটার। শোনামাত্রই মেয়েটা এমন করে চলে গেল, ভালো করে বুঝতেই পারলাম না।

অনামিকা নিঃশাস ফেলে বললেন, সেই লোকটা চেনা না অচেনা?

চেনা আবার কোথায়? একদম অচেনা।

কী আশ্চর্য, কালই ছেলেটার সঙ্গে আমার দেখা হলো। খবরটা আদৌ সত্যি না হতে পারে, কোনো খারাপ লোক কোনো মতলবে–

বলেছিলাম রে সেকথা, কানেই নিলো না, উন্মাদের মত ছুটে চলে গেল তার সঙ্গে। আর তুইও এতোদিন পরে আজ এলি বকুল!

বকুল নিঃশাস ফেললো।

বকুলের মনে হলো কোথায় যেন একটা বাক্স ছিল তার ভরা-ভর্তি, সেই বাক্সটা হঠাৎ খালি হয়ে গেলো। কিসের সেই বাক্সটা? কী ভরা ছিল তাতে?

.

চল, বসবি চল।

বললো সেজদি, তারপর প্রাথমিক অভ্যর্থনা-পর্বও সারলো। কিন্তু এতদিন পরে দুটি ভালোবাসার প্রাণ এক হয়েও কোথায় যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে রইলো। সুরটা কেটে গেছে। মাঝখানে যেন একটা বোবা দেয়াল।

সেই একটা উন্মাদ মেয়ে বকুলের অনেক কষ্টের দুর্লভ আয়োজনটুকু ব্যর্থ করে দিয়ে চলে গেছে।

কিন্তু কোথায় গেল?

কোথায় খুজতে যাওয়া যাবে তাকে?

তা যে লোকটা খবর দিতে এসেছিল, সেই লোকটা যদি খাঁটি হয় তো খোঁজবার জায়গা আছে, এন্টালির কাছে একটা অখ্যাতনামা হাসপাতালের নাম করেছে সে। আর খাঁটি না হলে তো কথাই ওঠে না। যে মেয়েটা হারিয়ে যাবো প্রতিজ্ঞা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল, তবু হারিয়ে যেতে পারেনি, তার দুষ্ট নক্ষত্র এইবার সেই যোগাযোগটা ঘটিয়ে দিলো। এই অসংখ্য লোকের ভিড়ে ভরা পৃথিবীর কোন একখানে হয়তো হারিয়ে গেল সে।

অনেকক্ষণ পরে গঙ্গার ধারের সেই বারান্দাটায় বসলো দুজনে, আর এতক্ষণ পরে শম্পার কথা ছাড়া একটা কথা বললো বকুল। বললো, তুই যে কেন এখান থেকে একদিনের জন্যেও নড়তে চাস না তা বুঝতে পারছি সেজদি!

পারছিস?–সেজদি হাসে, তুই কাজের সমুদ্রে হাবুডুবু খাস, আর আমি অকাজের অবসরে গঙ্গাতীরে বসে বসে ঢেউ শুনি।

তোকে দেখে আমার হিংসে হচ্ছে সেজদি। মনে হচ্ছে যদি তোর মতো জীবনটা পেতাম।

পারুলের অভ্যস্ত কৌতুকপ্রিয়তা জেগে ওঠে। পারুল বলে, ওরে সর্বনাশ, বাংলাদেশ তাহলে একটি দুর্দান্ত লেখিকা হারাত না?

ক্ষতি ছিল না কিছু।

লাভ ক্ষতির হিসেব কি সব সময় নিজের কাছে থাকে? পারুল বলে, মেয়েটা কি বুঝলো, তার এই পাগলের মতো ছুটে চলে যাওয়ায় কোথায় কি লোকসান হলো?

অর্থাৎ ঘুরেফিরে সেই মেয়েটার কথাই এসে পড়লো।

অদ্ভুত মেয়ে! পারুল আবার বলে, দুর্লভ মেয়ে! ওকে ওর মা-বাপ বুঝতে পারলো না। অবশ্য না পারাই স্বাভাবিক। সাধারণতঃ যে মালমশলা দিয়ে আমাদের এই সংসারী মানুষগুলো তৈরী হয়, ওর মধ্যে তো সেই মালমশলার বালাই নেই। যা আছে সেটা সংসারী লোকেদের অচেনা।

তোর মধ্যেও তো তেমনি উল্টোপাল্টা মালমশলা, বকুল আস্তে হাসে, তোকেও তাই কেউ বুঝতে পারলো না কোনো দিন সেজদি।

আমার কথা ছেড়ে দে, নিজেকে নিয়ে নিজেই বইছি।

মোহন-শোভনের খবর কী রে সেজদি?

ভালো, খুব ভালো। প্রায় প্রায় আরো পদোন্নতির খবর দেয়, পুরনো গাড়ি বেচে দিয়ে নতুন গাড়ি কিনেছে, সে খবর জানায়।

বকুল একটু তাকিয়ে থেকে বলে, আচ্ছা সেজদি, পৃথিবীতে সত্যিকার আপন লোক বলতে তাহলে কি কিছুই নেই?

থাকবে না কেন? পারুল অবলীলায় বলে, তবে তাকে সম্পর্কের গণ্ডির মধ্যে খুঁজতে যাওয়া বিড়ম্বনা! দৈবক্রমে যদি জুটে যায় তো গেল!

ভেবেছিলাম দু’তিনদিন থাকবো, বকুল বলে, কিন্তু আমার ভাগ্যে অতো সুখ সইলে তো!

পারুল হৈ-হৈ করে ওঠে না, বলে, তাই দেখছি। কাল থেকে কত-শতবার যে আমি কলকাতায় চলে গিয়েছি, আর এই হাসপাতালটা খুঁজে বেড়িয়েছি তার ঠিক নেই। কিন্তু সত্যিকার কিছু করার ক্ষমতা নেই, তুই এলি, তোর সঙ্গে যেতে পারা যায়।

তুই যাবি?

ভাবছিলাম। ছেলেটা এতদিন থাকলো, অসুখে ভুগলো, মায়া-টায়া পড়ে গেল—

পারুল চুপ করে গেল।

আরো কিছুক্ষণ কথা হলো, লোকটা সত্যি কথা বলেছে কিনা এই নিয়ে। এইভাবে কত জোচ্চুরিই ঘটছে শহরে।

তবু শম্পা নামের সেই মেয়েটাকে তো হারিয়ে যেতে দিতে পারা যায় না! অনেকক্ষণ পরে বকুল বলে, তখনই যদি ওই ওর সঙ্গে চলে যেতিস!

পরে একশোবার তাই ভাবলাম রে, কিন্তু ব্যাপারটা এত আকস্মিক ঘটে গেল! কে ডাকছে বলে নিচে নামলো, তার দুমিনিট পরেই উর্ধ্বমুখ হয়ে উঠে এসে বলল, সেজপিসি, সত্যবানকে বোমা মেরেছে, বোধ হয় মরে গেছে, আমি যাচ্ছি।

যাচ্ছিস? কোথায় যাচ্ছিস? কে বললো?–এসব প্রশ্নের উত্তরই দিলো না, যেমন অবস্থায় ছিল তেমনি অবস্থায় নেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে নামলাম, দেখলাম লোকটাকে, কলকারখানার লোকেরই মত, গুছিয়ে কথা বলতেও জানে না। যা বললো তার মর্মার্থ ওই। …তাও যে একটু জেরা করবো তার সময়ই পেলাম না। পোড়ারমুখো মেয়ে বলে উঠলো, জিজ্ঞেস করবার সময় অনেক পাবে পিসি, এখনো যদি একেবারে মরে গিয়ে না থাকে তো গিয়ে দেখতে পাওয়া যাবে। বলে লোকটা যে সাইকেল-রিকশায় চেপে এসেছিল সেইটায় চড়ে বসলো। তার পাশাপাশি। চোখের সামনে গড়গড় করে চলে গেল রিকশাটা।

ওরা গড়গড় করে চলে যেতে পারে। নিঃশ্বাস ফেলে বলে বকুল, জল মানে না, আগুন মানে না, কাঁটাবন মানে না, গড়গড়িয়ে এগিয়ে যায়! এ শক্তি ওরা কোথা থেকে আহরণ করেছে কে জানে!

পারুল মৃদু হেসে বলে, তোদেরই তো জানবার কথা, সমাজতত্ত্ব আর মনস্তত্ত্ব, এই নিয়ে কাজ যাদের। তবে আমি ওই অকেজো মানুষ, গঙ্গার ঢেউ গুনে গুনে যেটুকু চিন্তা করতে শিখেছি, তাতে কী মনে হয় জানিস? সব ভয়ের মূল কথা হচ্ছে অসুবিধেয় পড়ার ভয়। সেই ভয়টাকে জয় করে বসে আছে ওরা।

বকুল আস্তে বলে, অসুবিধেয় পড়ার ভয়!

তা নয় তো কি বল? আমি বলছি অসুবিধের, তুই না হয় বলবি ‘বিপদে’র। তা ওই “বিপদ” জিনিসটাই বা কি? “অসুবিধে”ছাড়া আর কিছু আমাদের অভ্যস্ত জীবনের, আমাদের অভ্যস্ত দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কোথাও একটু চিড় খেলেই আমরা বলি “কি বিপদ”। তাই উচ্চ থেকে তুচ্ছ বিশৃঙ্খলা মাত্রেই আমাদের কাছে বিপদ। রোগশোকও যতটা বিপদ, ছেলের চাকরি যাওয়াও ততটাই বিপদ।…জামাইবাড়ির সঙ্গে মতান্তর, পড়শীর সঙ্গে মতান্তর, দরকারী জিনিস হারানো, দামী জিনিস খোয়া যাওয়া, বাজার দর চড়ে ওঠা, পুরনো চাকর ছেড়ে যাওয়া সবই আমাদের কাছে বিপদ! তার মানে ওই সব কিছুতেই আমাদের অসুবিধে ঘটে।…আবার মোহনের বৌ তো চাকরের একটু অসুখ করলেই “কী সর্বনাশ! এ কী বিপদ!” বলে “সারিডন” খেয়ে শুয়ে পড়ে।

হেসে ওঠে দুজনেই।

তারপর পারুল আবার বলে, এই সব দেখেশুনে অর্থাৎ এতোকাল ধরে মানবচিত্ত আর সমাজচিত্র অনুধাবন করে বুঝে নিয়েছি, সব ভয়ের মূল কথা ওই বিপদের ভয়। এই যে আমি কাল থেকে তো-শতবার সেই ‘না-দেখা’ হাসপাতালটার আশেপাশে ঘুরে মলাম, কই যা থাকে কপালে বলে বেরিয়ে পড়তে তো পারলাম না! ভয়ে হলো, কি জানি বাবা, কত রকম বিপদে পড়ে যেতে পারি! ওরা সেই ভয়টা করে না। ওরা শুধু ভেবে নেয়, এইটা আমায় করতে হবে, আর সেই করাটার জন্যে যা করতে হয় সবই করতে হবে। অসুবিধেয় পড়বে, বিপদ হবে, এ চিন্তার ধার ধারে না।

গঙ্গার খুব হাওয়া উঠেছে, গা শিরশির করে উঠছে, তবু বসেই থাকে ওরা।

বকুল অন্যমনস্ক গলায় বলে, আরো একটা বড় জিনিসের ভয় করে না ওরা, সেটা হচ্ছে লোকনিন্দের ভয়! “লোকে কি মনে করবে”, এ নিয়ে এ যুগ মাথা ঘামায় না। যেটা নাকি আমাদের যুগের সর্বপ্রধান চিন্তার বস্তু ছিল।

পারুল একটু হাসলো, তা বটে। আমার একজন সম্পর্কে দিদিশাশুড়ী ছিলো, বুড়ী কথায় কথায় ছড়া কাটতে, বলতো, যাকে বলো ছিঃ, তার বইলো কী? বলতো, যার নেই লোভয়, সে বড় বিষম হয়।

আমাদের কাল আমাদের ওই জুজুর ভয়টা দেখিয়ে দেখিয়ে জব্দ করে রেখেছে! বকুল বললো নিঃশ্বাস ফেলে, অথচ ওই মেয়েটা যেদিন চলে এলো কত সহজেই চলে এলো! বাপ বললো, আমার বাড়িতে এসব চলবে না

মেয়ে বললো, ঠিক আছে, তবে আমি চললাম তোমার বাড়ি থেকে। ব্যস হয়ে গেল। এক মিনিট সময়ও ভাবলো না, এই আশ্রয় ছেড়ে দিয়ে আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াব, একবারও ভাবলো না আমার এই চলে যাওয়াটা লোকে কি চক্ষে দেখবে। মেয়েমানুষ দৈব দুর্বিপাকে পড়েও যদি একটা রাত বাড়ির বাইরে থাকতো, তার জাত যেতো–এ তো এই সেদিনের কথা।

উলঙ্গের নেই বাটপাড়ের ভয়–, পারুল বলে, যারা জাত শব্দটাকেই মানে না, তাদের আর জাত যাবার ভয় কি? এরা দেখছে সুবিধাবাদীরা ধুনি জেলে জ্বেলে ধোয়ার পাহাড় বানিয়ে বলছে, এ হচ্ছে অলঙ্ঘ্য হিমালয়। ব্যস, অলঙ্ঘ্য। যেই না এ যুগ তাকে ধাক্কা দিয়ে দেখতে গেল, দেখলো পাথর নয়, ধোঁয়া,-পার হয়ে গেল অবলীলায়।

হুঁ, মেয়েটাও তাই চলে গেল, মিথ্যে পাহাড়টা ফুটা করে। যে মুহূর্তে জানলো, বাবার এখানে আমার যা কিছু থাক, মর্যাদা নেই, সেই মুহূর্তেই ঠিক করে ফেললো, অতএব এখানটা পরিত্যাগ করতে হবে।–এমন মনের জোর…আমাদের ছিল কোনো দিন? কতো অসম্মানের ইতিহাস, কত অমর্যাদার গ্লানি বহন করে আশ্রয়টা বজায় রেখেছি। এখনো রাখছি–এখনো স্থিরবিশ্বাস রাজেন্দ্রলাল স্ট্রীটের ওই ইটের খাঁচাখানার মধ্যেই বুঝি আমার মর্যাদা, আমার সম্মান। ওর গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এলেই লোকে আমার দিকে কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাকাবে। ওই খাঁচাটার শিকগুলোয় মরচে পড়ে গেছে, তবু তাই আঁকড়েই বসে আছি।

পারুল বলে, যার যেমন মনের গড়ন। তুই যদি সাহস করে বেরিয়ে আসতে পারতিস, দেখতিস সেটাই মেনে নিতে লোকে।

সেই কথাই তো হচ্ছে, সাহস কই?

পারুল একটু হেসে ফেলে, তুই এতো বড় লেখিকা-টেখিকা, তবু তোর থেকে আমার সাহস অনেক বেশী। এই দ্যাখ একা রয়ে গেছি। আত্মীয়জনের নিন্দের ভয় করি না, ছেলেদের রাগের ভয় করি না, চোরের ভয় ভূতের ভয় কিছুই করি না!

তেমনি সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছিস। সবাই তোকে ত্যাগ দিয়েছে– বললো বকুল ঈষৎ হেসে।

পারুল আবার হাসলো। বললো, যারা অতি সহজেই আমাকে ত্যাগ দিতে পারে, তাদের সঙ্গে বিচ্ছেদে ক্ষতিটা কোথায় বল? যেটা নেই, সেটা হারানোয় আবার লোকসান কি? সবটাই তো শূন্যের ওপর।

তোর হিসেবটাই কি সম্পূর্ণ ঠিক সেজদি? ও পক্ষেও তত এরকম একটা হিসেব থাকতে পারে? বকুল বলে, সোজাসুজি তোর ছেলেদের কথাই ধর, ওরাও তো ভাবতে পারে, মার মধ্যে যদি ভালবাসা থাকতো, মা কি আমাদের ত্যাগ করতে পারতো?

ব্যাপারটা ভারী সূক্ষ্ম রে বকুল, ও বলে বোঝানো শক্ত, অনুভবেই ধরা যায় শুধু। তুই তো আবার ওরসে বঞ্চিত গোবিন্দদাস! জগতের যে দুটি শ্রেষ্ঠ রস, তার থেকে দিব্যি পাশ কাটিয়ে কাল্পনিক মানুষদের দাম্পত্যজীবন আর মাতৃস্নেহ নিয়ে কলম শানাচ্ছিস। আমি ওদের মুক্তি দিয়েছি, ওরা বলছে, “মা আমাদের ত্যাগ করেছে”, আমি যদি ওদের আঁকড়াতাম ওর বলতো, ওরে বাবা, এ যে অক্টোপাশের বন্ধন! তবেই বল, মার মধ্যে যদি সত্যি ভালবাসা থাকে, তবে সে কী করবে? নিজের সুনাম-দুর্নাম দেখবে? না সন্তানকে সে অক্টোপাশের বন্ধন থেকে মুক্তি দেবে?

তোর কি মনে হয় সবাই ওই বন্ধনটাই ভাবে?

তোর কি মনে হয়?

কি জানি!

আরে বাবা সেটাই তো স্বাভাবিক। পারুল বলে, পাখির ছানাটা যখন ডিম থেকে বেরিয়ে আকাশে উড়তে যায়, তখন কি সে আহা এতোদিন এর মধ্যে ছিলাম ভেবে সেই ডিমের খোলাটা পিঠে নিয়ে উড়তে যায়? যদি বাধ্য হয়ে তাকে সেটাই করতে হয়, ওড়ার আকাশটা তার ছোট হয়ে যাবে না?

তবে আর দুঃখ করবার কি আছে?

কিছু নেই। এটা শুধু আলোচনা। আর এটা তো আজকের কথা নয় রে, চিরদিনের কথা। আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে, কই সে নিধি?

মনের মানুষ ওটা হচ্ছে সোনার পাথরবাটি, বুঝলি সেজদি! ও কেউ পায় না। বকুল বলে, তবু গোবিন্দভোগ না জুটলে খুদকুঁড়ো দিয়েই চালাতে হবে।

চালাক। যাদের চলতেই হবে, তারা তাই করুক। পারুল বলে, যে পথের ধারে বসে পড়েছে, তার সঙ্গে পথ-চলাদের মিলবে না। বসে বসেই দেখবে সে, চলতে চলতে তার জন্যে কেউ বসে পড়ে কিনা।

বাতাস জোরে উঠেছিল, পরস্পরের কথা আর শোনা যাচ্ছিল না। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গল্প করাটা হাস্যকর, সে চেষ্টা করলো না।

শীত করছিল, গায়ে আঁচল টেনে চুপ করে বসে দেখতে লাগলো ঝোড়ো হাওয়ায় গঙ্গার দৃশ্য।

কিন্তু ‘ঝড়ের মুখে থাকবোই’ বললেই কি আর সত্যি বসে থাকা যায়? কতক্ষণ পরে পারুল বললো, ঘরে চল।

পারুলের ঘরের অনাড়ম্বর সাজসজ্জা চোখটা জুড়িয়ে দিল বকুলের। কত স্বল্প উপকরণে চলে যায় পারুলের।

রাজেন্দ্রলাল স্ট্রীটের বাড়িটার কথা মনে পড়লো বকুলের। প্রয়োজনের অতিরিক্ত বস্তুর ভারে ভারাক্রান্ত সেই বাড়িখানা যেন কুশ্রীর পরাকাষ্ঠা দেখাতে ‘ডিবি’ হয়ে বসে আছে। ওকে হালকা করতে পারবে, এমন সাধ্য আর কারো নেই। অলকার ছিল সাধ্য, অলকা সে সাধ্যকে কাজে লাগিয়েছে। অলকা তার অংশের যতো ‘ডেয়ো ঢাকনা’ শাশুড়ীর ঘরে চালান করে দিয়ে নিজের অংশটুকু সাজিয়ে-গুছিয়ে সুখে কালাতিপাত করছে।

আর অলকার শাশুড়ী?

তিনি এই পুরনো সংসারের যেখানে যা ছিল, সব বুকে করে নিয়ে এসে নিজের ঘরের মধ্যে পুরে রেখেছেন। ছিরিছাঁদহীন সেই সব আসবাবপত্র কেবলমাত্র বড়গিন্নীর মূঢ়তার সাক্ষ্য বহন করছে।

সে ঘরে যে কী আছে আর কী নেই।

বকুল অবশ্য দৈবাৎই বাড়ির সব ঘরে দালানে পা ফেলবার সময় পায়, তবু যেদিন পায়, সেদিন বড় বৌদির ঘরে ঢুকলে ওর প্রাণ হাঁফায়।

বকুল জানে না বাড়িতে যত দেশলাই বাক্স খালি হয়, সেগুলো কোন্ মন্ত্রে বড়বৌদির ঘরে গিয়ে ঢোকে? আর বড় বৌদির কোন্ কর্মেই বা লাগে তারা? বকুল জানে না কোন কর্মে লাগে তার, বাড়ির ইহজীবনের যত তার-কেটে-যাওয়া ইলেকট্রিক বালব, সংসারের সকলের পচে ছিঁড়ে যাওয়া শাড়ির পাড়, যাবতীয় খালি হয়ে যাওয়া টিন কৌটো শিশি বোতল।

বৈধব্যের পর থেকে যেন বড় বৌদির এই জঞ্জাল জড়ো করার প্রবৃত্তিটা চতুগুণ বেড়েছে। একটা মাত্র বালিশেই তো চলে যায় তার, অথচ মাথার শিয়রে চৌকিতে অন্তত ডজনখানেক বালিশ জড়ো করা আছে তার ভাল-মন্দয় ছোটয়-বড়য়।

ওনার এই কুড়িয়ে বেড়ানো দেখে কেউ হাসলে খুব বিরক্ত হয়ে বলেন, রাখবো না তো কি সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভাসিয়ে দিতে হবে?…গেলে আমায় আর কেউ করে দিতে আসবে? একটা জিনিস দরকার পড়লে তক্ষুনি কেউ যোগান দিতে আসবে?

বড় বৌদির ছেলে মা সম্পর্কে উদাসীন বলেই কি এমন দুশ্চিন্তা ওঁর?

কিন্তু পারুলের ছেলেরা?

তারাই বা মা সম্পর্কে এত কি সচেতন?

অথচ পারুল কোনো দিন তাদের কাছ থেকে কিছুর প্রত্যাশা করে না। পারুল যেন সব কিছুতেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। মনে হয় দরকার নামক বস্তুটাকে পারুল জীবন থেকে নির্বাসন দিয়েছে।

পারুলের ঘরখানা তাই রিক্ততায় সুন্দর। যেমন সুন্দর পারুলের নিরাভরণ হাত দুখানা।

পারুলের ঘরে বাহুল্যের মধ্যে দেয়ালে একখানা বেশ বড় মাপের রবীন্দ্রনাথের ছবি। বাকী সমস্ত দেয়ালগুলোই শূন্য সাদা।

পারুলের ঘরটা দেখে বকুলের অবাক লাগছে, ভাল লাগছে। হেসে বললো, তোর ঘরবাড়ি দেখে আমার হিংসে হচ্ছে সেজদি!

আমার ঘর দেখে তোর হিংসে হচ্ছে?

হচ্ছে।

তাহলে কর হিংসে। তবে অতিবড় মুখ্যুরও এটা হতো না।

মুখ্যুর হয়তো হতো না। কিন্তু নিজেকে তো মুখ্যু ভাবি না।

পারুল বললো, কতদিন কারো খবর জানি না, বল শুনি, আমার অজ্ঞাতসারে এতোদিন কি কি ঘটেছে সংসারে?

বকুল হেসে উঠে উত্তর দেয়, ভাল লোককেই বলছিস! আমার জ্ঞাতসারের পরিধি বড় অল্প, সেজদি আমি বাড়িতে থেকেও কিছুই জানি না!

প্রসূন তো ফেরেনি?

ওই একটা দুঃখের ইতিহাস। শুনতে পাই চিঠির সংখ্যা কমতে কমতে ক্রমশই শুধু শূন্যের সংখ্যা।

ছোড়দার কথা ভাবলে বড় মন-কেমন করে। কেমন ডাঁটুসটি ছিল। নিজের ছেলেমেয়ে থেকেও যত যন্ত্রণা।

ওকথা থাক সেজদি, তোর কথা বল।

আমার? আমার আবার কথা কী রে? কথাকেই জীবন থেকে নির্বাসন দিয়ে বসে আছি আর সমাজ-সংসারের দিকে তাকিয়ে দেখছি।

দেখছিসটা কী?

দেখছি ওর বজ্রআঁটুনি থেকে কেমন গেরো ফস্কে পালিয়ে এসেছি!

ভাগ্যিস সেই “অ-কবি লোকটা” তোর জন্যে এমন একটা বাড়ি বানিয়ে রেখে গেছে, তাই না এত কবিত্ব তোর?

পারুল অকপটে বলে, তা সত্যি। শুধু এইটির জন্যেই এখন লোকটার প্রেমে পড়তে শুরু করেছি।

তারপর পারুল বললো, এবার তা হলে জিজ্ঞেস করি, বকুলের কাহিনীর কী হলো?

আমিও তো তাই ভাবি কী হলো। বকুল বললো।

তারপর আস্তে বললো, আর লিখেই বা কী হবে? নির্মল তো পড়বে না।

দুজনেই চুপ করে গেল।

হায়তো অনেকদিন আগে হারিয়ে যাওয়া নির্মল নামের সেই ছেলেটার মুখ মনে করতে চেষ্টা করলো।

অনেকক্ষণ পরে পারুল বললো, নির্মলের বৌ কোথায় আছে রে?

ঠিক জানি না, বোধ হয় ওর ছেলে যেখানে কাজ করে।

বকুল কি কোনো কারণেই কোনো দিন কারো সামনে নির্মলের নাম উচ্চারণ করেছে? কই মনে পড়ছে না! আজই হঠাৎ বলে বসলো, লিখেই বা কি হবে? নির্মল তো পড়বে না!

এই স্বীকারোক্তি বকুলের নিজের কানেও কি অদ্ভুত লাগলো না? বকুল নিজেই কি আশ্চর্য হয়ে গেল না? বকুল কি কখনো ভেবেছে লিখে কি হবে, নির্মল তো পড়বে না।

ভাবেনি, ওই ভাবনাটুকু ভাববার জন্যে যে একান্ত গভীর নিভৃতিটুকুর প্রয়োজন তা কোনো দিন বকুলের জীবনে নেই। বকুল হাটের মানুষ, কারণ কুল স্বেচ্ছায় হাটে নেমেছিল, তার থেকে কোনো দিন ছুটি মিললো না তার। তাই নিজেই সে কোনোদিন টের পায়নি অনেক গভীরে আজও একদার সেই ছদ্মবেশহীন বকুল উদাসীন মনে বসে ভাবে, সে-কথা লিখে কি হবে, নির্মল তো পড়বে না।

আজ এই নিতান্ত নির্জন পরিবেশ, এই গঙ্গার ধারের বারান্দার ঝোড়ো হাওয়া আর আবাল্যের সঙ্গিনী সেজদির মুখোমুখি বসে থাকা–সকলে মিলে যেন সেই কুণ্ঠিত সঙ্কুচিত লাজুক বকুলকে টেনে তুলে নিয়ে এলো তার অবচেতনের গভীর স্তর থেকে।

হয়তো শুধু এইটুকুও নয়, মস্ত একটা ধাক্কা দিয়ে গিয়েছে সেই মেয়েটার গড়গড়িয়ে চলে যাওয়া গাড়ির চাকাটা। ওই মেয়েটা বকুলকে ধিক্কার দিয়েছে, ধিক্কার দিয়েছে বকুলের কালকে। সেই কাল মাথা হেঁট করে বলতে বাধ্য হলো, তোমাদের কাছে আমরা হেরে গেছি। আমরা জীবনে সব থেকে বড়ো করেছিলাম নিন্দের ভয়কে, তোমরা সেই জিনিসটাকে জয় করেছে। তোমরা বুঝেছো ভালবাসার চেয়ে বড়ো কিছু নেই, তোমরা জেনে নিয়েছে, নিজের জীবন নিজে আহরণ করে নিতে হয়, ওটা কেউ কাউকে হাতে করে তুলে দেয় না। সেই জীবনকে আহরণ করে নিতে তোমরা তোমাদের রথকে গড়গড়িয়ে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারো কাটাবনের উপর দিয়ে।

বকুলের ছদ্মবেশটা অনেক পেয়েছে, অনেক পাচ্ছে, হয়তো আরো অনেক পাবে। সেখানে কতো ঔজ্জ্বল্য, কত সমারোহ, কিন্তু ছদ্মবেশ যখন খুলে রাখে বকুল, কী নিঃস্ব, কী দীন, কী দুঃখী!

কিন্তু শুধুই কি একা বকুল? ক’জনের জীবন ভিতর-বাহির সমান উজ্জ্বল?

সনৎকাকাকে তোর মনে পড়ে সেজদি? অনেকক্ষণ পরে বললো বকুল।

পারুলের সঙ্গে সনৎকাকার তেমন যোগাযোগ ছিল না, পারুল তো অনেক আগেই বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গিয়েছিল।

সনৎকাকার এক বিশেষ বন্ধু একদা মহা সমারোহে একখানি পত্রিকা খুলে বসেছিলেন, সেই পত্রিকার সূত্রেই বকুল পেয়েছিল একটি বিশাল বটছায়া। বকুল কি তার আগে কোনো দিন জেনেছিল জগতে ছায়া আছে? বকুল জানতো জগতে শুধু প্রখর রৌদ্র থাকে। বকুল কি জানতো জগতে আলো আছে? আকাশ আছে? ওসব জানবার অধিকার মুক্তকেশীর মাতৃভক্ত পুত্র প্রবোধচন্দ্রের সংসারভুক্তদের ছিল না।

সনৎ নামের সেই মানুষটি প্রবোধচন্দ্রের অচলায়তনের গণ্ডি ভেঙে বকুলকে আকাশের নিচে নিয়ে গিয়েছিলেন, নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য এক জগতে। সনৎকাকার সাহায্য না পেলে বকুলের জীবনের ইতিহাস অন্য হতো।

পারুল জানে, তবু হয়তো সবটা জানে না। তাই পারুল বললো, ওমা মনে থাকবে না কেন? বাবার সেই কি রকম যেন, ভাই না? অন্য জাতের মেয়ে বিয়ে করে জাতেঠেলা হয়েছিলেন? ওঁর সেই বন্ধুর কাগজেই তো তোর প্রথম লেখা বেরোয়? বাবা ওঁকে দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না, তাই না রে?

হ্যাঁ, সংসারে যারা একটু উদারতা নিয়ে আসে, কেউ তাদের দেখতে পারে না।

পারুল একটু হাসলো, আজ এই একটা পুরনো মানুষ দেখে তোর বুঝি যতো পুরনো মানুষদের মনে পড়ছে?

বকুল ঠিক ওই কথাটার উত্তর না দিয়ে আস্তে বললো, মারা গেছেন সনৎকাকা।

মারা গেছেন!

পারুল হঠাৎ ফট করে একটা বেখাপ্পা কথা বলে বসলো, বললো, ওমা এতোদিন বেঁচে ছিলেন নাকি?

তারপর বোধ করি বকুলের মুখটা দেখতে পেয়ে বললো, কারুর কোনো খবর তো জানতে পারি না, রাখিও না। অনেক দিনের মানুষ তো, তাই ভাবছিলাম–

বকুল শান্ত গলায় বললো, হ্যাঁ, অনেক অনেক দিনের মানুষ।

ছিলেন কোথায়?

কলকাতাতেই। নীরুদার কাছেই থাকতে হয়েছে শেষ জীবনে। দিল্লীতে থাকতেন, নীরুদা রিটায়ার করে কলকাতায় এলে-কলকাতাতেই চলে এসেছিলেন। দেখা করতে গেলে বলেছিলেন, নীরুর সংসারের মালপত্তরগুলোর মধ্যে আমিও তো একটা, আমায় নিয়ে আসা ছাড়া আর গতি কি ওদের?

পারুল একটু চুপ করে থেকে বলে, নীরুদা ভাইপো বলেই যে সনৎকাকাকে ওর সংসারের মালপত্রের সামিল হয়ে যেতে হয়েছিল, তা ভাবিস না বকুল। নীরুদা ওর নিজের ছেলে হলেও তফাৎ হতো না কিছু। খুব অবহেলার মধ্যে থাকতে হয়েছে বোধ হয়, না রে?

বকুল প্রায় হেসে উঠেই বলে, উঁহু, মোটেই না। আদর-যত্নের বহর দেখবার মতো। নীরুদার বৌ কোলের বাচ্চা ছেলের মত শাসন করে দুধ খাইয়েছে, ওষুধ খাইয়েছে, নীরু শহরের সেরা ডাক্তারদের এনে জড়ো করেছে।

অনেক টাকা ছিল বুঝি সনৎকাকার?: মুচকি হেসে বললো পারুল।

নাঃ, তুই দেখছি আগের মতই কুটিল আছিস, বকুল এবার গলা খুলে হেসে ওঠে, গঙ্গার এই পবিত্র হাওয়া তোর কোনো পরিমার্জনা করতে পারেনি। ঠিক আগের মতই কার পিছনের কারণটা চট করে আবিষ্কার করে ফেলতে পারিস।

তারপর আবার গম্ভীর হয়ে যায়, পারুলের মুখের সকৌতুকু রেখার দিকে তাকিয়ে বলে, ছিল বোধ হয় অনেক টাকা, মাঝে মাঝে গিয়েছি তো কখনো কখনো, একদিন বলেছিলেন, বরাবর ভাবতুম, সারাজীবন ব্যয়ের থেকে আয়টা বেশী হয়ে যাওয়ায় যে ভারটা জমে বসে আছে, মরার আগে সেট কোনো মিশনে-টিশনে গিয়ে দিয়ে যাবে, কিন্তু এখন দেখছি সেটা রীতিমত পাপকর্ম হবে। অতএব বরাবরের ইচ্ছেটা বাতিল করছি। তোর কি মনে হয়, এটাই ঠিক হলো না?

বললাম, আপনাকে আমি ঠিক-ভুল বোঝাবো?

সনৎকাকা বললেন, তা বললে কি হয়? শিশুদের তো বড়দের বুদ্ধি নেওয়া উচিত, আর আমার এখন দ্বিতীয় শৈশব চলছে।

বলেছিলাম, অবশ্য হেসেই বলেছিলাম, বোধ হয় এটাই ঠিক, কারো আশাভঙ্গের অভিশাপ লাগবে না।…কিন্তু ভারী দুঃখ হয়েছিল সেদিন। অনেক সমারোহের আড়ালে হঠাৎ যখন ভিতরের নিতান্ত দৈন্যটা ধরা পড়ে যায়, দেখতে কী করুণই লাগে! শুধু অনেক টাকা থাকলেও কিছু হয় না রে সেজদি, গদি বজায় রাখতে অনেক খাটতে হয়। ওদের দুজনের ছলনায় গড়া ওই উচ্চ আসনটি বজায় রাখতে কম খাটতে হয়েছে বুড়ো মানুষটাকে। ও-বাড়িতে গিয়ে বসলেই কী মনে হতো জানিস, যেন স্টেজে একটা নাটক অভিনয় হচ্ছে, সনৎকাকাও তার মধ্যে একটি ভূমিকাভিনেতা।

পারুল বলে, তোর এখনো এই সব নাটক-ফাটক দেখে আশ্চর্য লাগে, এটাই যে ভীষণ আশ্চর্যি রে!–মোহন শোভন মাঝে মাঝে দু’এক বেলার জন্যে বৌ ছেলে নিয়ে বেড়াতে আসে, দেখলে তোর নিশ্চয় খুব ভাল লাগতো। অভিনয়ের উৎকর্ষও তো একটা দেখবার মতো বস্তু।

তাহলে আর বলার কি আছে? বকুল বলে, এই রকমই হয় তাহলে?

ব্যতিক্রমও হয় বৈকি, নাহলে ইহসংসার চলছে কিসের মোহে? তবে তোর নিজের জীবনেই কি তুই দর্শকের ভূমিকায় থাকতে পেরেছিস! জানি না ঠিক, পরলোকগত প্রবোধচন্দ্রের সংসারমঞ্চের মধ্যে তোকে যারা দেখছে, দেখার চোখ থাকলে তারাও হয়তো তাই বলবে।

বকুল নিঃশ্বাস ফেলে বলে, হয়তো তা নয়; হয়তো তাই। ক’জন আর তোর মতো মঞ্চ থেকে সরে পড়ে দর্শকের চেয়ারে বসে থাকতে জানে?

বলেছিস হয়তো ভুল নয়, পারুল মৃদু হেসে বলে, ওই চেয়ারের টিকিটটা কাটতে তো দাম দিতে হয় বিস্তর। বলতে গেলে সর্বস্বান্ত হয়েই কিনতে হয়।

বকুল একটু চুপ করে থেকে বলে, তোর আর আমার মনের গড়ন চিরদিনই আলাদা। আমার হচ্ছে সব কিছুর সঙ্গেই আপন, আর তোর কোনোদিন কোনো অপছন্দর সঙ্গেই আপস নেই।

বহুদিন পরে কম বয়সের মতো প্রায় রাত কাবার করে গল্প করলো বকুল আর পারুল।

যখন ছোট ছিল, যখন মনের কোনো বক্তব্য তৈরী হয়নি, তখনো ওরা দুই বোন এমনি গল্প করেছে অনেক রাত অবধি, বাবার ঘুম ভাঙার ভয়ে ফিসফিস করে।

মা-বাবার ঘরের পাশেই তো ছিল ওদের দুই বোনের আস্তানা! সরু ফালিমতো সেই ঘরটায় এখন সংসারের যত আলতুফালতু জঞ্জাল থাকে। বকুল কোনো কোনো দিন ওদিকের ঘরে যেতে গেলে দেখতে পায়, ঘরটাকে এখন আর চেনা যায় না। অবশ্য তখনো যে একেবারেই শুধু তাদের দুই বোনের ঘর ছিল তা নয়, সে ঘরে দেয়াল ঘেষে ট্রাঙ্কের সারি বসানো থাকতো। থাকত জালের আলমারি, জলের কুঁজো। বকুল-পারুলের জন্যে খাট চৌকিও ছিল না, রাত্রে মাটিতে বিছানা বিছিয়ে শুতো দুজনে। তবু ঘরটাকে ঘর বলে চেনা যেতো, এখন আর যায় না।

যখন চেনা যেতো, তখন দুটি তরুণী মেয়ের অপ্রয়োজনীয় অবান্তর অর্থহীন কথায় যেন মুখর হয়ে উঠতো। রাত্রি না হলে তো পারুলের কবিতার খাতা উদঘাটিত হতো না। বকুলের খাতা তখনো মানসলোকে।

তারপর যখন বিয়ে-হয়ে-যাওয়া পারুল মাঝে মাঝে এসেছে, রাত ভোর করে গল্প করেছে। বকুলের খাতা তখন আস্তে আস্তে আলোর মুখ দেখছে।

আর পারুলের খাতা আলোর মুখ দেখবার কল্পনা ত্যাগ করে আস্তে আস্তে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। সন্দেহবাতিক অথচ একেবারে পত্নীগত প্রাণ স্বামী অমলবাবু’র পুঞ্জীভূত আক্রোশ যে ওই খাতাটারি উপরই, সেটা বুঝে ফেলে ঔদাসীন্যের হাসি হেসে খাতাটা বাক্সের নীচে পুরে ফেলেছে পারুল।

বকুল বলতো, ইস! এখানেও নিয়ে আসিসনি? আমি তো দেখতাম!

পারুল বলতো, দৃর! আর লিখিই না। কী হবে কতকগুলো বাজে কথা লিখে?

ওটা পারুলের বিনয়, লেখাটা ছাড়তে পারেনি সে, শুধু তাকে একেবারে গভীর অন্তরালের বস্তু করে রেখেছিল।

এখনো কি লেখে না মাঝে মাঝে?

বকুল বললল, লক্ষ্মীটি সেজদি, বার কর না, দেখি এই অনির্বচনীয় নিরালায় কি লিখেছিস তুই এতোদিন ধরে?

পারুল হাসলো, উঠলো, কিন্তু আলো জ্বালাতে গিয়ে দেখলো কোন্ ফাঁকে ফিউজড হয়ে বসে আছে।

দেখলি তো–, ছেলেমানুষের মত হেসে উঠলো পারুল, আমার জীরনের এবং কবিতার এটা হচ্ছে প্রতীক! আলো ফিউজড!

বকুল হাসলো না, একটু চুপ করে থেকে বললো, ভোরের গাড়িতে যাবার কথা, তোর তো অনেক আগে উঠে গুছিয়ে-টুছিয়ে নেওয়ার দরকার ছিলো, অন্ধকার হয়ে থাকলো-

পারুলের গলার সেই হাসির আমেজটা মুছে গেল, পারুল বললো, না রে, আমি আর যাচ্ছি না।

যাচ্ছিস না?

না! ভেবে দেখছি আমার এই যাওয়াটার কোনো মানে হবে না। তোর পায়ে পায়ে ঘুরে শুধু বাধাই সৃষ্টি করবে। তাছাড়া, একটু ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বললো, সেটা অবশ্য আমার ইচ্ছের ফসল, তবু ভাবছি, যদি মেয়েটা কোনো ঘটনার চাপে আবার ফিরে আসে আজকালের মধ্যে?

কথাটা অযৌক্তিক নয়।

বকুল বললো, তবে ঘুমো। আমি যাবার সময় ডেকে তুলে বলে যাবো।

পারুল বললো, তার থেকে তুই ঘুমো, আমিই তোকে ডেকে তুলে দেবো।

হেসে ফেললো আবার দু’জনই। জানে ঘুম কারুরই হবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *