পারস্য-সম্রাট শাহ তামাস্প এবং রাজ্যহারা হুমায়ূন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। পারস্য-সম্রাট তাঁর জাঁকজমক দেখিয়ে হুমায়ূনকে অভিভূত করতে চাইছেন। অপূর্ব বেশভূষায় সজ্জিত খোজারা পুষ্পবৃষ্টি করল। সামরিক বাদ্যবাজনা হচ্ছে। ঘোড়সওয়ার বাহিনী সালাম জানিয়েছে। এগিয়ে আসছে হন্তীবাহিনী। চারদিকের হইচইয়ের মধ্যে হুমায়ূনকে দীনহীন দেখাচ্ছে।
শাহ তামাস্প বললেন, তৈমুরের বংশধর সম্রাট বাবরের পুত্র হিন্দুস্থানের অধিপতির এই দশা কেন?
হুমায়ূন বললেন, আমার ভাইদের কারণে এই দশা।
সিংহাসনে বসেই ভাইদের হত্যা করলেন না কেন?
সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না।
শাহ তামাস্প বললেন, সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না বলেই কেউ সম্রাট, কেউ পথের ভিক্ষুক। আপনি আমার কাছে কী চান?
হুমায়ূন বললেন, আমি আপনার করুণা চাই না। আমি শুধু পারস্যের ভেতর দিয়ে মক্কা চলে যাওয়ার অনুমতি চাচ্ছি।
আমি যতদূর জানি আপনি সুন্নী মতাবলম্বী।
ঠিকই জানেন। আমার স্ত্রী হামিদা বানু শিয়া।
আপনার স্ত্রী চাইলেই মক্কা যেতে পারবেন। আপনাকে মক্কা যেতে হলে শিয়া মতাবলম্বী হতে হবে। আপনি হয়তো জানেন না, আমি পারস্য সুন্নিমুক্ত করার পরিকল্পনা করেছি। যেসব সুন্নি শিয়া-মতবাদ গ্রহণ করছে না তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে।
হুমায়ূন বললেন, আমাদের নবিজি। (দঃ) বিদায় হজের ভাষণে ধর্মবিষয়ে সহনশীল হতে বলেছেন।
তামাস্প বললেন, এই ধরনের কোনো কথা হযরত আলী বলেন নি। আমরা শিয়ারা হযরত আলীর মতামতকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকি। যাই হোক, এখন আমি ধর্মবিষয়ে আলোচনায় উৎসাহী না। পথশ্রমে আপনি ক্লান্ত। ক্লান্তি দূর করুন। সন্ধ্যাবেলা আপনার সম্মানে রাজকীয় ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছে। আপনার শিয়া-মতবাদ গ্ৰহণ বিষয়ের আলোচনা তখন হবে। আপনার পরিধেয় বস্ত্রের যে অবস্থা তা পরে রাজকীয় ভোজসভায় যেতে পারবেন না। আপনার জন্যে পোশাক সরবরাহ করা হবে।
হুমায়ূন বিষণ্ণ মনে তাঁর জন্যে খাটানো তাঁবুতে ঢুকলেন। হামিদা বানুর জন্যে আলাদা তাঁবু খাটানো হয়েছে। তামাস্প’র হেরেমের নারীরা তার দেখভাল করছে।
শাহ তামাস্প নিজের তাঁবুতে বিশ্রাম নিচ্ছেন। তাঁর সামনে দমীহ নামের পারস্যের বিখ্যাত সুরা। মাঝে মাঝে তিনি সুরার পাত্রে চুমুক দিচ্ছেন। বৈরাম খাঁকে ডেকে আনা হয়েছে। বৈরাম খাঁ তার সামনে দাঁড়িয়ে। তাঁকে বসার অনুমতি দেওয়া হয় নি।
আপনি হুমায়ূনের প্রধান সেনাপতি?
জি আলামপনা। আপনাকে দেখে প্রধান সেনাপতি মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আপনি
মেষপালক।
আপনার কথায় সম্মানিত বোধ করছি। আমাদের নবিদের সবাই কোনো-না-কোনো পর্যায়ে মেষপালক ছিলেন।
আপনি শিয়া মতাবলম্বী?
জি জাহাঁপনা।
আপনার মাথায় শিয়াদের লম্বা টুপি নেই কেন? মাথার চুলও তো শিয়াদের মতো কাটা না। রাজকীয় ভোজসভায় আপনি উপস্থিত থাকবেন, তখন যেন মাথায় শিয়াদের টুপি থাকে।
বৈরাম খাঁ বললেন, এই কাজটা আমি মহান সম্রাট হুমায়ূনের অনুমতি ছাড়া করতে পারব না।
তামাস্প কঠিন গলায় বললেন, আপনার মহান সম্রাট হুমায়ূন নিজেই শিয়া টুপি পরে ভোজসভায় আসবেন। তাঁকে পরিধেয় বস্ত্রের সঙ্গে এই টুপিও পাঠানো হয়েছে।
বৈরাম খাঁ বললেন, আমার সম্রাট ভোজসভাতে যদি মাথা ন্যাড়া করে আসেন, আমি মাথা ন্যাড়া করেই যাব।
আপনার মতো এত অনুগত সেনাপ্রধানের কারণেই হয়তো হুমায়ূন সব কয়টি যুদ্ধে হেরেছেন। শুনেছি প্ৰাণে বাঁচার জন্যে হুমায়ূনকে কয়েকবার পানিতেও ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে। তখন আপনি নিশ্চয়ই তার সঙ্গে সাঁতার কেটেছেন?
বৈরাম খাঁ বলল, এই সৌভাগ্য আমার হয় নি।
তামাস্প হাত ইশারায় বৈরাম খাঁকে চলে যেতে বলে পানিপাত্রে মনোযোগ দিলেন। তাকে অত্যন্ত বিরক্ত দেখাচ্ছে।
ভোজসভায় পারস্য সাম্রাজ্যের শানশওকত দেখানোর সব চেষ্টাই শাহ তামাস্প করেছেন।
বিশাল তাঁবুতে ভোজসভা বসেছে। চারদিক আলো ঝলমল করছে। নর্তকী এবং বাদ্যযন্ত্রীরা প্ৰস্তুত। সম্রাটের ইশারা পেলেই গানবাজনা শুরু হবে।
রান্না হচ্ছে দুটি আলাদা রন্ধনশালায়। একটিতে পারস্যের রান্না। অন্য রন্ধনশালায় হিন্দুস্থানি বাবুর্চি তৈরি করছে খোসাকা পোলাও।
শাহ তামাস্প এবং হুমায়ূন মুখোমুখি বসেছেন। তামাস্পের সঙ্গে তাঁর আমীর এবং সেনাপতিরা। হুমায়ূনের সঙ্গে তার চারজন আমীর এবং বৈরাম খাঁ। হুমায়ূন শাহের পাঠানো শিয়া টুপি পরেন নি। শাহ তাতে খুব অসন্তুষ্ট এমন মনে হচ্ছে না, বরং তাকে হাসিখুশি দেখাচ্ছে। শাহের নির্দেশে হুমায়ূনের সামনে একটি সোনার থালা রাখা হলো। থালায় মহামূল্যবান মণিরত্ন।
শাহ বললেন, পারস্যের পক্ষ থেকে সামান্য উপহার। ভোজসভায় উপহার বিনিময়ের রেয়াজ আছে। তবে আপনার অবস্থা আমরা অনুমান করতে পারছি। আপনার কাছ থেকে উপহার হিসেবে শুভেচ্ছা পেলেই আমরা সন্তুষ্ট। শাহের উপস্থিত আমীররা এ কথায় হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। কারও কারও ঠোঁটে বিন্দ্ররূপের হাসি দেখা গেল।
হুমায়ূন বললেন, মহামান্য শাহ তামাস্পের জন্যে আমার পক্ষ থেকে সামান্য উপহার। এই উপহার গ্রহণ করলে আমি এবং আমার সঙ্গীরা আনন্দিত হব।
হুমায়ূন সবুজ রেশমি রুমালে ঢাকা একটি পাথর এগিয়ে দিলেন।
শাহ তামাস্প রুমাল খুলে তাকিয়ে রইলেন। কয়েক মুহুর্ত তাঁর মুখে কোনো কথা ফুটল না। শাহের আমীররা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন। তাদের মধ্যে নিচুস্বরে ফিসফিস শুরু হলো।
তামাস্প বললেন, এইটিই কি সেই বিখ্যাত কোহিনূর?
বৈরাম খাঁ বললেন, আলমপনা, এইটি সেই কোহিনূর যা তরবারি দিয়ে পেতে হয় অথবা ভালোবাসার উপহার হিসেবে পেতে হয়।
কোহিনূরের উপর আলো পড়েছে। মনে হচ্ছে সবুজ রেশমি রুমালের মাঝখানে আগুন ধরে গেছে।
শাহ তামাস্পের নির্দেশে খাবার পরিবেশন শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে নৃত্যগীতের আসর বসেছে। সাতজন নর্তকী নাচছে। তাদের সঙ্গে বাদ্যবাজনা। বাদ্যবাজনার সুর করুণ কিন্তু নাচের ভঙ্গি উচ্ছল। দুই বিপরীত ধারা চমৎকার মিল খেয়ে গেছে।
হুমায়ূন মুগ্ধ হয়ে নাচ দেখছেন। শাহ তামাস্প বললেন, এইসব নর্তকীকে আমি উপহার হিসেবে আপনাকে দিলাম। আপনার তাঁবুর পাশেই এদের তাঁবু। আপনি ইচ্ছা করলেই নর্তকীদের ব্যবহার করতে পারেন। তবে মক্কায় গেলে এদের নিয়ে যেতে পারবেন না। হা হা হা।
শাহ নিজের রসিকতায় হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছেন। আমীররাও হাসছেন। সুরা তার প্রভাব বিস্তার শুরু করেছে।
নিশিরাত পর্যন্ত পান ভোজন চলল। শাহ তামাস্প পরদিন তার সঙ্গে বাঘ শিকারে যাওয়ার জন্যে হুমায়ূনকে আমন্ত্রণ জানালেন। ভোজসভায় শিয়া প্রসঙ্গ উঠল না।
মীর্জা কামরান ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছেন। তাঁর শরীর ঘামে ভেজা। পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছে। দুঃস্বপ্নে তিনি দেখলেন, তাকে ঢোকানো হয়েছে গাধার চামড়ায়। চামড়া সেলাই করে দেওয়া হয়েছে। একটা খোলা ঘোড়ার গাড়ির পাটাতনে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ঘোড়ার গাড়ির চালক রুপার ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে বলছে, মহান মোঘল সম্রাট হুমায়ূনের নির্দেশে মীর্জা কামরানকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। ঘোড়ার গাড়ির পেছনে শত শত শিশু। তাদের খিলখিল হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
মীর্জা কামরান সুরাইভর্তি পানি খেলেন। তাতেও তাঁর তৃষ্ণা মিটাল না। তিনি তৎক্ষণাৎ চিঠি লিখতে বসলেন। এই চিঠি যাবে পারস্য-সম্রাট শাহ তামাস্প’র কাছে।
মীর্জা কামরানের পত্ৰ
মহান পারস্য-সম্রাট
পৃথিবীর সূর্য, জগতের সৌন্দর্য, সর্বশক্তির আধার
শাহ তামাস্প,
আমার বড়ভাই, মোঘল সাম্রাজ্যের কলঙ্ক হুমায়ূন বিষয়ক কিছু কথা।
জাহাঁপনা, আমার এই ভীরু কাপুরুষ বিচার বুদ্ধিহীন ভ্রাতার কারণে আমরা দিল্লীর সিংহাসন হারিয়েছি। হাজার হাজার সাহসী মোঘল সেনার প্ৰাণনাশ হয়েছে।
তার কাপুরুষতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, তিনি তার শিশুসন্তানকে ফেলে পালিয়ে গেছেন। পারস্যে। সেই শিশুসন্তানকে এখন আমরা আদর এবং মমতায় প্রতিপালন করছি।
রাজ্যশাসনে আমার এই ভ্রাতা সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। সবসময় আফিমের নেশায় আচ্ছন্ন থাকেন বলে তার জগৎ বাস্তবতার বাইরের জগৎ।
আপনি নিশ্চয়ই অবগত যে, আমার এই ভ্রাতা আধাবেলার জন্যে একজন মিসকিন ভিসতিওয়ালাকে দিল্লীর সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। এতে তিনি নিজে হাস্যম্পদ হয়েছেন, মোঘলদের ছোট করেছেন।
আপনার কাছে আমার অনুরোধ, আপনি আমার এই অযোগ্য অকৰ্মণ্য ভ্রাতাকে আমার হাতে তুলে দিন। বিনিময়ে আমি কান্দাহার আপনার হাতে তুলে দেব।
বর্তমানে দিল্লীর শাসনভার শের শাহ পুত্র ইসলাম শাহ’র হাতে। আমি নিশ্চিত আল্লাহপাকের হুকুমে আমি তাকে পরাজিত করে হিন্দুস্থানে মোঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত করব। অৰ্কমণ্য নেশাগ্রস্ত হুমায়ূন জীবিত থাকা অবস্থায় এটা সম্ভব হবে না।
এই পত্র আমি আমার তিন ভাইয়ের সম্মতিতে লিখছি। রাজমহিষীরা আমার সঙ্গে আছেন।
ইতি
মীর্জা কামরান
ফজরের নামাজের পরপরই মীর্জা কামরানের দেহরক্ষী দলের প্রধান সুলতান মুহাম্মদকে পারস্য পাঠিয়ে দেওয়া হলো। গোপন এই চিঠির খবর মীর্জা আসকারিও জানল না।
দুপুরে মীর্জা কামরান একটি দুঃসংবাদ পেলেন। কান্দাহার থেকে মীর্জা হিন্দাল পালিয়েছেন। তিনি হুমায়ূনের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্যে পারস্যের দিকে যাত্রা করেছেন।
মীর্জা কামরান ফরমান জারি করলেন, যে হিন্দালকে জীবিত বা মৃত তার কাছে নিয়ে আসতে পারবে তাকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার দেওয়া হবে।
মীর্জা হিন্দাল যে দুজনের সাহায্যে পালিয়েছিলেন তারাই তাঁকে ধরে এনে সন্ধ্যার মধ্যে মীর্জা কামরানের কাছে হাজির করল। তারা এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কারের দাবিদার।
মীর্জা কামরান দুজনের প্রত্যেককেই পাঁচ শ স্বর্ণমুদ্রা দিতে খাজাঞ্চিকে হুকুম দিলেন। পুরস্কার পাওয়ার মতো কাজ তারা করেছে, তবে একজন শাহজাদার বিশ্বাসভঙ্গ করার মতো অপরাধও তারা করেছে। এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে দুজনের স্বর্ণমুদ্ৰাই বাজেয়াপ্ত হবে। একই সঙ্গে তিনি দুজনকেই অন্ধ করার নির্দেশ দিলেন।
হিন্দালকে পাঠানো হলো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের যেখানে রাখা হয়। সেখানে। মীর্জা কামরান হিন্দালকে মৃত্যুদণ্ড দিলেন। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে হাতির পায়ের নিচে হিন্দালের মাথা চূৰ্ণ করে।
মীর্জা কামরান নির্দেশ দিলেন কাবুল থেকে জল্লাদ হাতি ছোট কুমারকে আনতে। মীর্জা কামরান তওবা করে হিন্দালকে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হতে বললেন।