মঞ্জু তাঁর স্ত্রী এবং ঝড়-তুফানকে নিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে গেছেন। লীলাবতীকে বলেছেন, মা, আমি তো ঘরজামাই না। ঘরজামাই হলে ভিন্ন কথা ছিল। আমি এখন একা না, আমার স্ত্রী আছে, দুই পুত্ৰ আছে।
লীলাবতী বলল, পরী কি আপনার সঙ্গে যেতে চায়?
মঞ্জু বিরক্ত হয়ে বললেন, তার আবার চাওয়া-চাওয়ি কী? আমি যেখানে যাব সেও সেখানে যাবে।
দেখা গেল পরীবানু শুধু যে একা যেতে চাচ্ছে তা-না জাইতরী-কইতরী দুই বোনও যেতে চাচ্ছে। লীলাবতী বলল, তোমরা কেন যাবে?
কইতরী জবাব দিল না। জাইতরী বলল, আমি যাব।
লীলাবতী বলল, কেন?
জইতরী মাটির দিকে তাকিয়ে রইল। জবাব দিল না। মঞ্জু বললেন, আমার অঞ্চলে ভালো স্কুল আছে। আমি তাদের স্কুলে ভর্তি করে দিব। চোখে চোখে রাখব। এইখানে তুই ছাড়া আর কে আছে? তুই নিজেও তো সারাজীবন থাকবি না। তোর বিয়ে হবে। তুই চলে যাবি স্বামীর সংসারে। এই দুই মেয়ে এত বড় জায়গায় একা একা ঘুরবে? এটা তোর কেমন বিবেচনা?
লীলাবতী চুপ করে গেল। তার একবার বলতে ইচ্ছা করছিল, মামা, তোমার যুক্তি মানলাম। কিন্তু আমি এখানে একা পড়ে থাকব এটা তোমার কেমন বিবেচনা? সে কিছু বলল না।
মঞ্জুর সঙ্গে যাবার জন্যে আরো দুজন তৈরি হলো। একজন বদু আরেকজন নিরঞ্জন। বদু বলল, আপনি যেখানে আমি সেখানে। এখন আমারে মারেন কাটেন আপনের বিষয়। নিরঞ্জন কিছু বলল না। সে বিনা প্রয়োজনে কথা বলে না। যাওয়া বিষয়ে কোনো কথা বলার প্রয়োজন সে বোধ করছে না। মঞ্জু ঠিক করেছেন, নিরঞ্জনকে নিয়ে তিনি একটা ভাতের হোটেল দিবেন। হোটেলের নাম দিবেন। হিন্দু-মুসলিম হোটেল। হোটেলের একজন বাবুর্চি নিরঞ্জন, আরেকজন তিনি নিজে। আগের মতো দিন কাটালে এখন হবে না। আয়-রোজগারের পথ দেখতে হবে। ছিলেন একা মানুষ, হুট করে সংসার বড় হয়েছে। সংসারে এখন আটজন মানুষ। ঝড়-তুফান। ঝড়-তুফানের মা। জাইতরী-কইতরী। বদু এবং নিরঞ্জন। এর মধ্যে বদু একাই তিনজনের ভাত খায়।
মঞ্জুর ভাতের হোটেল চালু হয়েছে। হোটেলের নাম হিন্দু-মুসলিম হোটেল না। পরীবানু এই নাম রাখতে দেয় নি। পরীবানুর যুক্তি হলো, হিন্দু-মুসলিম হোটেল নাম দিলে হিন্দুও সেই হোটেলে যাবে না, মুসলমানও যাবে না। মঞ্জু পরীবানুর যুক্তিতে মোহিত হলেন। হোটেলের নাম হলো আদর্শ হোটেল। মঞ্জু তার স্বভাব মতো এক সপ্তাহ হোটেল দেখেছেন। এখন আর কিছু দেখছেন না। এখন দেখছে পরীবানু। সে ভালোভাবেই দেখছে। হোটেল ভালো চলছে। হাটের দিনে তিনবার হাঁড়ি চড়াতে হয়। হোটেলের ভেতর কাস্টমারদের জায়গা দেওয়া যায় না। কাস্টমাররা থালা হাতে হোটেলের বাইরে বসে যায়। তিন আইটেম রান্না হয়— ভাজি, ডাল, মাংস। মাছের কোনো আইটেম এখনো চালু করা হয় নি। এর পেছনেও পরীবানুর হাত আছে। পরীবানুর যুক্তি— মাছ সবাই বাড়িতেই খায়। হোটেল-রেন্টুরেন্টে সবাই মাংস খেতে চায়।
হোটেলের বাজার এবং টাকা-পয়সার হিসাবের দায়িত্বে আছে বদু। আগে তার দিন কেটেছে শুয়ে-বসে, এখন সে নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসূতও পাচ্ছে না। রাত নটায় হোটেল বন্ধ করে সে ঘরে ফিরে। তার সঙ্গে হোটেলের এক কর্মচারীও। (মিলন হাওলাদার, ডাক নাম হাওলু মিয়া) আসে। যার কাজ হচ্ছে, বদুর গায়ে তেল ডলা। একসময় বদুর দিন কাটত অন্যের গায়ে তেল ডলাডলি করে, এখন অন্য একজন তার গায়ে তেল ডলাডলি করছে। জীবনের এই উত্থানে সে চমৎকৃত।
রাতে তেল ডলাডলির অংশটা সে বড়ই উপভোগ করে। হাওলু মিয়া কাজটা করেও চমৎকার। সরিষার তোলে রসুন দিয়ে জ্বাল দেয়। সেই তেলের বাটি হারিকেনের উপর দিয়ে রাখে। তেল থাকে গরম। গরম তেল গায়ে ডলা হয়। আরামে বন্দুর চোখ বন্ধ হয়ে আসে। চোখ বন্ধ করে নানান গল্প করতে তার বড় ভালো লাগে।
হাওলু মিয়া শোনো, কাজকর্মের চাপ একটু কমলে তোমারে আমাদের অঞ্চলে নিয়া যাব। আহারে কী জায়গা! কী বিরাট বাড়ি চাচাজির! মূল বাড়ি, উত্তর বাড়ি, শহর বাড়ি। তয় ভূতের উপদ্ৰব।
ভূতের উপদ্রব?
ছোট বাড়িতে ভূতের উপদ্ৰব থাকে না। বড় বড় সব বাড়িতে জিন-ভূত থাকে। অনেক ঘর থাকে খালি, এরা আশ্রয় নেয়।
আপনে জিন-ভূত দেখছেন?
চাচাজির বাড়িতে থাকব, জিন-ভূত দেখব না। এইটা হয়!
ভয় পাইছেন?
নাহ্। রোজ রাতে দেখলে ভয় থাকে না। দেখতে চাইলে তোমারে দেখাব। কোনো অসুবিধা নাই। বেশি ভয় পাইলে আয়াতুল কুরসি পইড়া ফু দিবা। আয়াতুন কুরসি জানো তো?
জি না।
শিখা নিবা। আয়াতুল কুরসি মুখস্থ না করলে তোমারে নিয়া যাব না। কখন কী বিপদ হয়! বিবাহ করেছ?
জি না।
ইচ্ছা করলে আমাদের অঞ্চলে বিবাহ করতে পারো। আমাদের অঞ্চলের মেয়ে অত্যধিক সুন্দর। তাদের আদব-লোহাজও ভালো। আমি ব্যবস্থা করে দিব। আমার এককথায় বিবাহ হয়ে যাবে। চাচাজির সঙ্গে কাজ করেছি। তো। আমাদের ইজ্জতই অন্যরকম। কেউ কোনো কথা ফেলব না।
হাওলু মুগ্ধ হয়ে শোনে। অতি আশ্চর্য সেই ভাটি অঞ্চলে তার যেতে ইচ্ছা করে।
মঞ্জু বাগদীর বাজারের হাট থেকে একটা ঘোড়া কিনেছেন! গাধা ধরনের ঘোড়া। সাইজে ছোট। গাধার মতোই লম্বা লম্বা কান। হাঁটা-চলার আগ্রহ খুবই কম। সে তার চার ঠ্যাঙ মাটিতে পুতে দাঁড়িয়ে থাকে। লাগাম ধরে টানাটানি, পিঠে বাড়ি কিছুতেই কাজ হয় না।
পরীবানু বিরক্ত। সে বেজার মুখে বলল, এটা কী ঘোড়া কিনেছেন। গাধা মার্কা ঘোড়া।
মঞ্জু বলেছেন, গাধা মার্কা ঘোড়াই দরকার। আমি গাধা মার্কা লোক। আমার ঘোড়াও গাধা মার্কা।
ঘোড়া কেনার আপনার দরকারটা কী ছিল?
দরকার আছে বলেই কিনেছি। বিনা দরকারে আমি কিছু করি না। ঘোড়া আমি তোমার জন্যেও কিনি নাই। আমার জন্যেও কিনি নাই। ঝড়-তুফানের জন্যে কিনেছি। এরা ঘোড়ায় চড়া শিখবে। এরা দুইজন হেজি-পেজি না। এরা সিদ্দিক সাহেবের নাতি।
ঘোড়া উঠানে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝড়-তুফান দুই ভাই মহানন্দে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকে। এদের আনন্দ দূর থেকে দেখে পরী। আনন্দে তার চোখেও পানি আসে। সে তার জীবনের আনন্দ-সংবাদ জানিয়ে লীলাবতীকে একটি চিঠিও লিখেছে—
বুবু,
শত সহস্ৰ সালাম। নিবেদন আমরা সকলে মঙ্গলমতো আছি। তুফান কিছুদিন কাশিতে কষ্ট পাইয়াছে। বাসক পাতার রস খাইবার পর আরোগ্য হইয়াছে। ঝড় মাশাল্লাহ ভালো আছে। অসুখ-বিসুখ তার তেমন হয় না।
এইদিকে আমি ঘর-দুয়ার গুছাইবার চেষ্টা করতেছি। আপনার মামাকে আপনি চিনেন। তিনি বিনা কাজের কাজি। সকাল হইতে নিশিরাত পর্যন্ত কর্ম ছাড়াই অতি ব্যস্ত। লাটিমের মতো ঘূর্ণনের মধ্যে আছেন। নিজের বিষয়-সম্পত্তি কী আছে কিছুই জানেন না। আমি এখানে না আসিলে সমস্তই দশভূতে লুটিয়া খাইত।
তাহার বিষয়-সম্পত্তি খারাপ না, ভালোই। বাড়ির পেছনের বাগানে সুপারি গাছ আছে একচল্লিশটা। কাঁঠাল গাছ সতেরোটা, আম গাছ সাতটা, পেয়ারা গাছ আঠারোটা।
আপনি নিশ্চয়ই আমার পত্র পাঠ করিয়া হাসিতেছেন এবং আপনার ধারণা হইয়াছে, আমার বর্তমান কাজ গাছ গোনা। ইহা সত্য। আমি এখন উনার কী আছে না আছে তাহা নিয়াই ব্যস্ত। উনার প্রতিটি জিনিসই মনে হয় আমার জিনিস। আপনাদের বিশাল ভূ সম্পত্তি দেখিয়া আসিয়াছি। তাহার কোনো কিছুই আমার আপন মনে হয় নাই। বুরু, আমার কথায় মনে কষ্ট নিবেন না।
আপনার মঞ্জু মামার মা মৃত্যুকালে প্রচুর গয়না রাখিয়া গিয়াছিলেন। উনি কিছুই জানিতেন না। পুরাতন বাক্স পোটলা পুঁটলি ঘাঁটিতে ঘাটিতে আমি তার সন্ধান পাই। স্যাকরা আনাইয়া গয়না ওজন করাইয়াছি। সর্বমোট ছাপ্পান্ন ভরি সোনার গয়না আছে।
বুবু, আপনি জাইতরী-কইতরীকে নিয়া কোনো দুশ্চিন্তা করিবেন না। দুইবোন ভালো আছে। আনন্দে আছে। আপনার মামা বাড়ির পেছনের বাগানে দুই বোনের জন্য দুইটি খড়ের চালা নির্মাণ করিয়াছেন। একটির নাম দিয়াছেন কইতর মহল। অন্যটির নাম দিয়াছেন জাইতর মহল। দুইবোন দিনের বেশিরভাগ সময় এই দুই চালাতে থাকে।
আপনার মঞ্জু মামার বাড়িতে পানির ভালো ব্যবস্থা ছিল না। আমি একটি টিউবওয়েল বসাইয়াছি। আল্লাহর মেহেরবানি, টিউবওয়েলের পানি অতি সুস্বাদু প্রমাণিত হইয়াছে। নিজেদের বাড়িতে টিউবওয়েল থাকা সত্ত্বেও অনেকে আমাদের টিউবওয়েলের পানি নিতে আসে। এই বাড়িতে একটি কুয়া ছিল। সংস্কারের অভাবে কুয়া বুজিয়া গিয়াছিল। আমি ঠিক করাইয়াছি এবং কুয়াতলা বাঁধাইয়া দিয়াছি। জায়গাটা এখন অতি মনোরম হইয়াছে।
বুবু, আপনাকে লেবু বাগানের কথা বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি। লেবু বাগান আমার শাশুড়ির নিজের হাতে করা। সারা বৎসর বাগানে লেবু থাকে। বাড়ির সামনের পুকুরের পাড়ে আমার শাশুড়ির হাতে লাগানো নারিকেল গাছ আছে ত্ৰিশটা। প্রতিটা গাছই ফলবতী। আগে ডাব-নারিকেল দশ ভূতে নিয়া যাইত। এখন আর হইতেছে না। পুকুরের চার দিকে কাঁটাতারের বেড়া দিবার সিদ্ধান্ত নিয়াছি। ইনশাল্লাহ আগামী বর্ষার আগেই কাৰ্য সমাধা করিব।
বুবু, অনেক কথা লিখিয়া ফেলিয়াছি। পত্রে কোনো ভুল-ত্রুটি করিয়া থাকিলে ক্ষমা দিবেন।
ইতি— আপনার স্নেহের হতভাগিনী
পরীবানু।
chapter 20 and chapter 21 repeat hoyeche. Ekta chapter missing ache boi theke.