২০. নিউট্রিনো
আমাদের চারপাশে আমরা যা কিছু দেখছি বলা যায় তার প্রায় পুরোটুকু তৈরি মাত্র তিনটি কণা দিয়ে। সেগুলো হচ্ছে ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন। আমরা বস্তু বলতে যা বোঝাই তার সবগুলো তৈরি হয়েছে অণু দিয়ে আর সব অণু তৈরি হয়েছে পরমাণু দিয়ে। পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস, সেই নিউক্লিয়াস তৈরি হয় প্রোটন আর নিউট্রন দিয়ে। এর মাঝে প্রোটনের চার্জ হচ্ছে পজিটিভ, নিউট্রনের কোনো চার্জ নেই। প্রোটনের পজিটিভ চার্জে আটকা পড়ে তাকে ঘিরে ঘুরতে থাকে নেগেটিভ চার্জের ইলেকট্রন। সবচেয়ে সহজ পরমাণু হচ্ছে হাইড্রোজেন তার মাঝে একটা প্রোটন এবং তাকে ঘিরে ঘুরছে একটা ইলেকট্রন। হাইড্রোজেন এত সহজ পরমাণু যে তার নিউক্লিয়াস শুধু একটা প্রোটন কোনো নিউট্রন পর্যন্ত নেই। পরমাণুর কেন্দ্র নিউক্লিয়াসে যখন প্রোটনের সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন বাইরে ইলেকট্রনের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। যেমন লোহার পরমাণুর কেন্দ্রে 26টা প্রোটন (এবং তিরিশটা নিউট্রন) বাইরে 26টা ইলেকট্রন। বিখ্যাত পরমাণু ইউরোনিয়ামের কেন্দ্রে 92টা প্রোটন (এবং 146টা নিউট্রন!) এবং তাকে ঘিরে ঘুরছে 92টা ইলেকট্রন। ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রনের মাঝে সবচেয়ে হালকা ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রনের ভর ইলেকট্রন থেকে প্রায় দুই হাজার গুণ বেশি। কাজেই কোনো কিছুর ভর আসলে সেই বস্তুটার মাঝে থাকা প্রোটন আর নিউট্রনের ভর।
এতক্ষণ যতটুকু বলা হয়েছে কেউ যদি সেটা মনোযোগ দিয়ে পড়ে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই সে একধরনের বিস্ময় নিয়ে বলবে, আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কী সহজ এবং সরল–মাত্র তিনটি কণা দিয়ে পুরোটা তৈরি! মাত্র তিনটি কণা দিয়ে তৈরি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড–এই আনন্দটা উপভোগ করার আগেই বিজ্ঞানীদের এক সময় ভুরু কুঁচকাতে হলো। তারা আবিষ্কার করলেন একটা প্রোটনকে রেখে দিলে সেটা প্রোটন হিসেবেই থেকে যায় কিন্তু নিউট্রনকে আলাদা করে রেখে দিলে সেটা কিন্তু নিউট্রন হিসেবে অনির্দিষ্টকাল থাকতে পারে না। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ করে নিউট্রনটা একটা প্রোটনে পাল্টে যায়। নিউট্রনের কোনো চার্জ নেই কিন্তু প্রোটনের চার্জ পজিটিভ, হিসেবের গোলমাল হয়ে যাবার কথা, বিজ্ঞানীরা শ্বাস বন্ধ করে থেকে আবিষ্কার করলেন নিউট্রন যখন প্রোটনে পাল্টে যায় তখন তার সাথে একটা ইলেকট্রনও বের হয়। ইলেকট্রনকে বলা হয় বেটা, তাই এই প্রক্রিয়ায় একটা গালভরা নাম আছে, সেটা হচ্ছে বেটা ডিকে। ইলেকট্রনের চার্জ নেগেটিভ প্রোটনের পজিটিভ তাই এই দুই মিলে মোট চার্জ আবার শূন্য–গোড়াতে নিউট্রিনের যা ছিল।
বিজ্ঞানীরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন কিন্তু খুবই সাময়িকভাবে, কিছুদিনের ভেতরেই তারা আবিষ্কার করলেন নিউট্রনের এই পাল্টে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় মোট চার্জের কোনো পরিবর্তন হয় নি সেটা সত্যি কিন্তু মোট শক্তি বা মোট ভরবেগের পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। গোড়াতে যেটুকু শক্তি ছিল শেষে সেই পরিমাণ শক্তি নেই, গোড়াতে যেটুকু ভরবেগ ছিল শেষে সেই ভরবেগে নেই। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে আগে কখনো এরকম ব্যাপার ঘটে নি।
বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের উপর বিশ্বাস রাখলেন, তারা ধরে নিলেন শক্তি কিংবা ভরবেগ হচ্ছে অবিনশ্বর। সেটা হঠাৎ করে কমে যেতে পারে না, কিংবা বেড়ে যেতে পারে না। কাজেই নিশ্চয়ই কোনো একটা অদৃশ্য কণা এই শক্তি এবং ভরবেগ নিয়ে চলে যাচ্ছে। 1931 সালে উলফগ্যাঙ্গ পাউলি প্রথম এই অদৃশ্য কণাটির অস্তিত্ব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, পরের বছর এনরিকো ফারমি এই কণাটির নামকরণ করলেন নিউট্রিনো–যার অর্থ চার্জহীন ছোট কণা!
শুরুতে ছিল তিনটি কণা–ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন, তার সাথে যুক্ত হলো নিউট্রিনো। ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রিনো বিজ্ঞানীরা তাদের ল্যাবরেটরিতে রুটিন মাফিক পরীক্ষা করতে পারেন, কিন্তু নিউট্রিনো তারা কেউ খুঁজে পেলেন না। কারণটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, নিউট্রিনো জন্মলগ্ন থেকেই বিচিত্র একটা কণা, তার চার্জ নেই, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় কোনো ভর নেই, সেটা বিক্রিয়া করে খুব দুর্বলভাবে (আক্ষরিকভাবে বলা হয় উইক ইন্টার একশান যেটা ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক বা নিউক্লিয়ার শক্তি থেকে অনেক দুর্বল) কাজেই বিজ্ঞানীদের চোখে ধরা দেয় নি। কিছুদিনের মাঝেই বিজ্ঞানীরা বুঝে গেলেন সাধারণ একটা নিউট্রিনোকে থামাতে প্রায় এক আলোকবর্ষ লম্বা সিসার পাত দরকার! (এক আলোকবর্ষ হচ্ছে সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল বেগে আলো এক বছরের যেটুকু দূরত্ব অতিক্রম করে!) যে কণাকে থামানো এত কঠিন সেই কণাকে কেউ সহজে দেখতে পাবে কেউ আশাও করে নি। 1956 সালে সেই অসাধ্য সাধন হলো, প্রথমবারের মতো একটা নিউট্রিনো ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানীদের হাতে ধরা দিল । যে বিজ্ঞানীরা সেই অসাধ্য সাধন করেছিলেন 1995 সালে তাদের সেই চমৎকার কাজের জন্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
নিউট্রিনোর অস্তিত্বটুকু নিশ্চিত করার পর পরই বিজ্ঞানীরা নিউট্রিনোর বিশাল একটা ভাণ্ডার খুঁজে পেলেন। সেটা হচ্ছে আমাদের চিরপরিচিত সূর্য। সূর্যের ভেতরে শক্তির জন্ম হয় নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া দিয়ে এবং তার প্রতিফল হিসেবে সেখানে প্রতিমুহূর্তে অসংখ্য নিউট্রিনো তৈরি হচ্ছে। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু শুধু আমাদের চোখের ভিতর দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে 70 বিলিয়ন নিউট্রিনো চলে যাচ্ছে–আমরা যেটা কোনোদিন অনুভব করা দূরে থাকুক কল্পনাও করতে পারি না।
সূর্যের ভেতর নিউট্রিনোর এত বড় একটা ফ্যাক্টরি আছে আবিষ্কার করার পর খুব স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানীদের আগ্রহ হলো পৃথিবীতে বসে সেগুলো গুনে দেখবেন–ঠিক তার সাথে সাথেই একটা বিপত্তি দেখা গেল। বিজ্ঞানীরা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত সূর্যের গঠনটা তারা বুঝতে পেরেছেন, সেটা যদি সঠিক হয়ে থাকে তাহলে তারা সেখান থেকে কতগুলো নিউট্রিনো বের হচ্ছে সেটাও সঠিকভাবে অনুমান করতে পারবেন। কিন্তু সমস্যা হলো ল্যাবরেটরিতে সূর্য থেকে আসা নিউট্রিনোর সংখ্যা দেখা গেল অনেক কম, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। কিছুতেই তারা সেই হিসাব মিলাতে পারছিলেন না এবং সেটা সূর্যের নিউট্রিনো সমস্যা নামে বিখ্যাত একটা সমস্যা হিসেবে পরিচিত হয়ে রইল।
আমাদের পরিচিত জগতের প্রায় সবকিছুই যদিও ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন দিয়ে তৈরি (এবং তার সাথে যুক্ত হয়েছে নিউট্রিনো) কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে জেনে গেছেন সৃষ্ট জগতে আরো অসংখ্য কণা আছে সেগুলো কখনো আসে বাইরের জগৎ থেকে কসমিক রে হিসেবে, কখনো তৈরি হয় এক্সেলেটরে। সবগুলোকে গুছিয়ে একটা তত্ত্বের মাঝে আনা সোজা কথা নয়! যেমন পরিচিত ইলেকট্রনের মতোই আছে মিউওন–যেটার সকল ধর্ম ইলেকট্রনের মতো, শুধু তার ভর বেশি। মিউওনকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে বিজ্ঞানীরা নূতন এক ধরনের নিউট্রিনো আবিষ্কার করলেন যেটার নাম দেয়া হলো মিওন নিউট্রিনো। 1962 সালে সেই নিউট্রিনো খুঁজে পেলেন বিজ্ঞানীরা। তার জন্যে তারা নোবেল পুরস্কার পেলেন 1988 সালে। প্রথমে ছিল শুধু ইলেকট্রন এবং তার সাথে ইলেকট্রন নিউট্রিনো। তারপর এলো ঠিক ইলেকট্রনের মতো একটা কণা, যার নাম মিউওন এবং তার সাথে পাওয়া গেল মিউওন নিউট্রিনো। 1975 সালে ইলেকট্রন এবং মিউওনের মতো পাওয়া গেল তৃতীয় একটা কণা–যার নাম দেয়া হলো টাও। বিজ্ঞানীদের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে ধরেই নেয়া হলো এর সাথেও পাওয়া যাবে একটা নিউট্রিনো এবং তার নাম দেয়া হলো টাও নিউট্রিনো। তাত্ত্বিকদের ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হলো 2000 সালে যখন সত্যি সত্যি এই নিউট্রিনোকে খুঁজে পাওয়া গেল!
তিন ধরনের নিউট্রিনো নিয়ে যখন পদার্থবিজ্ঞানীদের ভেতর নানা ধরনের উত্তেজনা তখন একই সাথে সবার ভেতরে আরেকটা প্রশ্ন কাজ করছে। সেটা হলো, নিউট্রিনোর কী ভর আছে? একটা কণা যার কোনো ভর নেই কল্পনা করা শক্ত। আমরা সে রকম একটা কণাকেই জানি, সেটা হচ্ছে আলোর কণা, তার কোনো ভর নেই বলে সেটা ছুটে আলোর গতিতে। নিউট্রিনোর যদি ভর না থাকে তাহলে সেটাও ছুটবে আলোর গতিতে। নিউট্রিনোর ভর যদি থেকেও থাকে সেটা হবে খুবই কম–এত কম যে ল্যাবরেটরিতে সেটা খুঁজে বের করা রীতিমতো দুঃসাধ্য একটা কাজ।
দুঃসাধ্য হলেও বিজ্ঞানীরা থেমে থাকেন না। কাজেই সারা পৃথিবীতে বিজ্ঞানীরা নিউট্রিনোর ভর আছে কী নেই সেটা বের করার কাজে লেগে গেলেন। 1998 সালে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা সন্দেহাতীতভাবে দেখালেন যে নিউট্রিনোর ভর আছে, ভরটি খুবই কম, তারা যেরকম কল্পনা করেছিলেন কিন্তু শূন্য নয়।
একই সাথে সূর্যের নিউট্রিনো সমস্যাটির সমাধান হয়ে গেল। নিউট্রিনোর যদি ভর থাকে তাহলে এক ধরনের নিউট্রিনো অন্য ধরনের নিউট্রিনোতে পাল্টে যেতে পারে। কাজেই সূর্য থেকে যে নিউট্রিনোগুলো বের হচ্ছিল পৃথিবীতে আসতে আসতে তারা অন্য ধরনের নিউট্রনোতে পাল্টে যাচ্ছিল–বিজ্ঞানীরা তাই সেগুলোকে আর খুঁজে পাচ্ছিলেন না। নিউট্রিনোর ভর খুঁজে পেয়ে ত্রিশ বছর ধরে বিজ্ঞানীদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখা সূর্যের নিউট্রিনো সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার জন্যে সেই পদার্থবিজ্ঞানীদের নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় 2002 সালে!
রহস্যময় নিউট্রিনো সত্যিই রহস্যময় তাই প্রায় অদৃশ্য এই রহস্যময় কণাকে বোঝার জন্য বুঝি এতগুলো বিজ্ঞানীকে নোবেল প্রাইজ দিতে হয়েছে!