২০. নাদিয়া এখনো জানে না

নাদিয়া এখনো জানে না তার স্যার দু’টা আনারস নিয়ে তাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন। তাকে তোলা হয়েছে অতিবাড়িতে। তাকে চা দেওয়া হয়েছে। প্রণব তার দেখাশোনা করছেন।

প্রণব বললেন, আপনার স্বাস্থ্য আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। আমি মুসলমান হলে বলতম মাশাল্লাহ। মুসলমান না হওয়ার কারণে বলতে পারলাম না।

বিদ্যুত বললেন, আমি যে এসেছি নাদিয়া জানে?

প্রণব বললেন, আমি ছাড়া কেউ জানে না। যথাসময়ে জানবে। তাড়াহুড়ার কিছু নাই। জাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাড়াহুড়ার কারণে। সবকিছুতে তাড়া। আপনার চায়ে চিনি ঠিক আছে?

আছে।

এখন চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেশের অবস্থা কী বলেন?

ভালো।

এককথায় সেরে দিলেন? ভালোটা কোনদিকে? আপনি শিক্ষক মানুষ, বুঝয়ে বলেন।

ফিজিক্স দিয়ে বুঝাব?

প্রণব আগ্রহী গলায় বললেন, বুঝান।

বিদ্যুত বললেন, জগতে দুটা বিষয় আছে, শৃঙ্খলা এবং বিশৃঙখলা। এনট্রপি হলো বিশৃঙ্খলার সূচক। দেশের এনট্রপি এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ের। কিছু বুঝেছেন?

না।

ইচ্ছা করলে খুব সহজভাবে আমি আপনাকে বোঝাতে পারি। বোঝাতে চাচ্ছি না।

বুঝাতে চাচ্ছেন না কেন?

আপনি ধুরন্ধর মানুষ। ধুরন্ধর মানুষকে আমি কিছু বোঝাই না। এরা এমনিতেই বোঝে।

প্রণব অবাক হয়ে বললেন, আমি ধুরন্ধর আপনি কীভাবে বুঝলেন?

বিদ্যুত চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, এক ঘণ্টা সতেরো মিনিট হলো আমি এসেছি। আপনি আমাকে এই ঘরে নিয়ে এসেছেন। চায়ের ব্যবস্থা করেছেন। বলেছেন নাশতা আসছে। আমার আসার খবরটা কাউকে দেননি। কারণ গতবারে আপনি দেখেছেন আমাকে নাদিয়ার সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। নাদিয়ার বাবা আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেননি। এবার আপনি পরিস্থিতি আঁচ করার জন্যে সময় নিচ্ছেন। অতি ধুরন্ধররা এই কাজটা করে।

প্রণব পান মুখে দিলেন।

বিদ্যুত বললেন, আপনি যে ধুরন্ধর আমি কি প্রমাণ করতে পেরেছি?

প্রণব জবাব দিলেন না বিদ্যুত বললেন, আমাকে খবর দিয়ে আনা হয়েছে পদ্ম নামে একটা মেয়ের সমস্যা সমাধানের জন্যে। সে নাকি কারও সঙ্গে কথা বলে না। আপনি পদ্মকে নিয়ে আসুন। তার সঙ্গে কথা বলব। আমার হাতে সময় কম। দশটার ট্রেনে চলে যাব। আমার মা অসুস্থ।

প্রণব উঠে গেলেন। তিনি বিদ্যুতের কথায় খুব বিচলিত হয়েছেন এরকম মনে হলো না।

 

নাদিয়ার সঙ্গে প্রণবের দেখা হলো। প্রণব বললেন, না, কী করে?

নাদিয়া বলল, এই মুহূর্তে কিছু করছি না। তবে লেখা নিয়ে বসব। দাদিজানের জীবন কাহিনী।

কতদূর লেখা হয়েছে।

চল্লিশ পৃষ্ঠা।

আমাকে পড়তে দিবে না?

লেখা শেষ না হলে কাউকে পড়তে দিব না।

হোসনা মেয়েটা কোথায় জানো মা? একটু প্রয়োজন ছিল।

নাদিয়া বলল, সে নিশ্চয়ই ছাদে আছে। আরেকটা কথা, মেয়েটার নাম পদ্ম। আপনি হোসনা ডাকবেন না।

প্রণব বললেন, স্যার নাম রেখেছেন হোসনা। আমি হোসলাই ডাকব। পদ্ম ফদ্দ তুমি ডাকবে।

বাবা কি আপনার ঈশ্বর?

কাছাকাছি।

বাবাকে আপনি এত পছন্দ করেন কেন?

কারণ আছে। কারণ তোমার না জানলেও চলবে।

প্রণব ছাদে উঠে গেলেন। নাদিয়াকে বিদ্যুত স্যারের বিষয়ে কিছুই বললেন। নাদিয়া তার দাদির ঘরে খাতা-কলম নিয়ে ঢুকল। পোট্রেট পেইন্টাররা মডেল সামনে বসিয়ে ছবি আঁকে। নাদিয়া তার দাদির জীবনী লেখে দাদিকে সামনে রেখে। লেখার ফাঁকে ফাঁকে গল্পগুজব করে।

হাজেরা বিবি জেগে আছেন। তবে তার দৃষ্টি খানিকটা এলোমেলো। নাদিয়া বলল, কিছু লাগবে দাদি?

হাজেরা বিবি -সূচক মাথা নাড়লেন।

এদিক-ওদিক তাকাচ্ছ কেন?

হাজেরা বিবি হতাশ গলায় বললেন, আইজ তোর নাম বিস্মরণ হয়েছি। তোর নাম কী?

নাদিয়া।

ও আচ্ছা। এখন স্মরণ হয়েছে, তোর নাম তোজল্লী।

নাদিয়া লেখা শুরু করল। নাম ভুলে যাওয়ার অংশটা লিখল—

হাজেরা বিবির স্মরণশক্তি তীক্ষ্ণ। তিনি কোনো কিছুই ভোলেন না। ভর নাকের ডগায় যদি কোনো মাছি বসে, তিন বছর পরেও তিনি তা মনে রাখবেন। তবে ভুলে যাওয়ার খেলা তিনি খেলেন। তাঁর অনেক অস্ত্রের একটি অস্ত্র হলো, ভুলে যাওয়া অস্ত্র। মনে করা যাক তিনি ভয়ঙ্কর কোনো কথা বলেছেন। সংসারে বিরাট অশান্তি শুরু হয়েছে। তখন যদি তার পুত্র এসে বলে, মা, এমন একটা কথা কীভাবে বললে? সঙ্গে সঙ্গে হাজেরা বিবি চোখ কপালে তুলে বলবেন, এই কথা কখন বললাম? বিস্মরণ হয়েছি।

বিদ্যুতের সামনে পদ্ম বসে আছে। পদ্ম মাথা নিচু করে আছে। বিদ্যুত বললেন, তোমার নাম খুব সুন্দর, পদ্ম!

পদ্মের ভাবভঙ্গি পাথরের মূর্তির মতো। মনে হচ্ছে সে নিঃশ্বাস ফেলছে না।

বিদ্যুত বললেন, নাদিয়া লিখেছে তোমার জীবনে বিরাট একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। তুমি তারপর থেকে কথা বলা বন্ধ করেছ। ভালো করেছ। হড়বড় করে কথা বলার কিছু নেই। আমার সঙ্গে কথা বলতে হবে না। আমি যদি হা-না জাতীয় কিছু জানতে চাই মাথা নেড়ে জবাব দেবে। আমি নাদিয়ার শিক্ষক, কাজেই তোমারও শিক্ষক। শিক্ষকের কথা মানতে হয়। যে বিরাট দুর্ঘটনা তোমার জীবনে ঘটেছে, তা কি তোমার কারণে ঘটেছে?

পদ্ম না-সূচক মাথা নাড়ল।

অন্যের কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলেই তুমি অন্যদের ওপরে রাগ করে কথা বন্ধ করেছু। খুব ভালো করছ। গাছপালার ওপর তোমার কি কোনো রাগ আছে?

পদ্ম বিস্মিত হয়ে তাকাল। না-সূচক মাথা নাড়ল। বিদ্যুৎ বললেন, গাছপালার ওপর যখন রাগ নেই, তখন গাছপালার সঙ্গে কথা বলতেও বাধা নেই। যে দুর্ঘটনা তোমার জীবনে ঘটেছে, তুমি বাগানের গাছগুলিকে সেই দুর্ঘটনার কথা বলবে। গাছ কিন্তু মানুষের কথা শোনে। গাছের অনুভূতি আছে—এটা স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু বলে গেছেন। গাছ তোমার সব কথা শুনবে। তোমার রাগ দুঃখ কষ্ট তখন কমতে থাকবে। কথা বলবে গাছের সঙ্গে?

পদ্ম চুপ করে রইল। মাথা নাড়ল না। বিদ্যুত বললেন, আমি এখন তোমাকে একটা ম্যাজিক দেখাব। ম্যাজিকটা তোমার যদি পছন্দ হয়, তোমাকে শিখিয়ে দেব। তারপর তোমাকে একটা গাছের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আমি চলে যাব। তুমি প্রথমে গাছটাকে ম্যাজিক দেখাবে। তারপর তোমার কষ্টের গল্প তাকে বলবে।

বিদ্যুত পকেট থেকে এক টুকরা সাদা কাগজ বের করলেন। কাগজ উল্টেপাল্টে পদ্মকে দেখালেন। পদ্ম কাগজ হাতে নিয়ে দেখল। বিদ্যুত পদ্মের হাত থেকে কাগজ নিয়ে ফুঁ দিতেই কাগজটা পাঁচ টাকার একটা নোট হয়ে গেল। পদ্ম বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে—এটা বোঝা যাচ্ছে। সে টাকাটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছে। বিদ্যুত ম্যাজিকের কৌশল শেখালেন এবং লক্ষ করলেন, মেয়েটা বুদ্ধিমতী, কৌশলটা সুন্দর ধরতে পেরেছে।

পদ্ম, ম্যাজিকটা কি পছন্দ হয়েছে? পছন্দ হলে মাথা নাড়ো।

পদ্ম মাথা নাড়ল।

বিদ্যুত বললেন, নাদিয়াকে মাজিকটা দেখিয়ো। খুব ভালোমতো প্রাকটিস করার পর দেখাবে। হুট করে দেখাবে না। এখন চলো আমার সঙ্গে, একটা গাছের সামনে তোমাকে দাঁড় করিয়ে দেই। নাদিয়াদের বাগানে একটা বকুলগাছ আছে।

ওই গাছটা হোক তোমার প্রথম বন্ধু। আমার হাত ধরো। চলো যাই।

বিদ্যুতের হাত ধরে পদ্ম সহজ ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল।

 

প্রণব দেখলেন বিদ্যুত হোসনা মেয়েটাকে একটা বকুলগাছের সামনে দাঁড় করিয়ে চলে আসছেন। মনে হচ্ছে হোসনা গাছের সঙ্গে কথা বলছে। ব্যাপার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

বিদ্যুত প্রণবের কাছে এসে বললেন, আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমি চলে যাব। আমি যে এসেছি এই খবরটা মনে হয় নাদিয়াকে দেননি।

প্রণব জবাব দিলেন না। তার দৃষ্টি হোসনা মেয়েটার দিকে। বিদ্যুত বললেন, পদ্ম মেয়েটা হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। আমার ধারণা আজ সন্ধ্যা থেকে কথা বলা শুরু করবে।

প্রণব বললেন, আপনি কি এখনই রওনা হবেন? রওনা হওয়া উচিত। দশটা বাজতে আধঘণ্টা বাকি। ট্রেন অবশ্য সময়মতো আসে না। লেট হয়।

আমি এখনই রওনা হন।

প্রণব বললেন, যদি আপত্তি না থাকে আপনাকে রেলস্টেশনে দিয়ে আসি। স্যারের গাড়ি আছে। গাড়িতে করে নিয়ে যাব। আপনার কি আপত্তি আছে।

আমার আপত্তি নাই। তবে গাড়ি লাগবে না।

ট্রেন এক ঘণ্টা লেট। বিদ্যুত টি স্টল থেকে চা কিনেছেন, হেঁটে হেঁটে চা খাচ্ছেন। তাকে ছায়ার মত অনুসরণ করছেন প্রণব। বিদ্যুত বললেন, আপনি চলে যান। আমার জন্যে সময় নষ্ট করছেন কেন?

প্রণব বললেন, আমার প্রচুর সময়। নষ্ট করলে কারও কোনো ক্ষতি হয় না।

বিদ্যুত বললেন, আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করি।

আপনি আমাকে ধুরন্ধর বলেছেন। এটা সত্যভাষণ। সত্যভাষণের জন্যে ক্ষমা চাইতে হয় না।

আপনি দেশের অবস্থা জানতে চেয়েছিলেন। দেশের অবস্থা বুঝিয়ে বলি?

বলুন।

দেশ এখন চলে গেছে ছাত্রদের হাতে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশ চালাচ্ছে। তারা যা নির্দেশ দিচ্ছে সেইভাবে কাজ হচ্ছে। দেশ চালানোর অভিজ্ঞতা বা ক্ষমতা কোনোটাই তাদের নেই। তারা ভুল করা শুরু করবে। তখন বড় সমস্যা তৈরি হবে। এক ভুল থেকে আরেক ভুল। ভুলের চেইন রিঅ্যাকশান।

পূর্বপাকিস্তান কি আলাদা হয়ে যাবে?

না। পাকিস্তান সরকার দেশ ঠান্ডা করার ব্যবস্থা করবে। অবশ্যই দেশে মার্শাল ল আসবে। আয়ুব খান কোনো সহজ জিনিস না। সে নিউট্রন শোষক নামাবে। নিউট্রনের সংখ্যা কমাবে।

বিষয়টা বুঝলাম না।

অ্যাটমিক রিঅ্যাকটার থেকে বিদ্যুৎ তৈরি হয়। রিঅ্যাকটারে নিউট্রনের সংখ্যা বেড়ে গেলে বিস্ফোরণ হয়। পূর্বপাকিস্তান এখন অ্যাটমিক রিঅ্যাকটার। নিউট্রনের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বিস্ফোরণ বন্ধ করতে নিউট্রন শোষক লাগবে।

আয়ুব খান তা জানেন।

প্রণব বললেন, আপনার কথা বুঝতে পারি নাই। বুঝার কথাও না। জ্ঞানের কথা মূর্খ মানুষ বুঝবে না—এটাই স্বাভাবিক। যাই হোক, আমি স্টেশনে আপনার সঙ্গে এসেছি জ্ঞানের কথা শোনার জন্যে না। আপনাকে একটা বিষয় ব্যাখ্যা করার জন্যে।

কী বিষয়।

নাদিয়া মা’কে আপনার সঙ্গে কেন দেখা করতে দেই নাই সেই বিষয়।

ব্যাখ্যার প্রয়োজন নাই।

আপনার দিক থেকে হয়তো প্রয়োজন নাই। আমার দিক থেকে আছে।

বিদ্যুত বললেন, ব্যাখ্যাটা মনে হচ্ছে আমি জানি। তারপরেও আপনার কাছ থেকে শুনি।

প্রণব বললেন, নাদিয়া মা’কে আমি কোলেপিঠে করে বড় করেছি। তার পিতা তাকে যতটা স্নেহ করেন, ভগবান সাক্ষী আমি তারচেয়ে কম করি না। আমি চিরকুমার মানুষ। আমার কেউ নাই। নাদিয়া মাকে আমি কন্যা জ্ঞান করি।

মূল কথাটা বলুন।

নাদিয়া মা আপনাকে দেখলে পাগলের মতো হয়ে যেত। এটা আমি হতে দিতে পারি না। আপনি জ্ঞানী মানুষ। আপনি কি আমার কথা বুঝেছেন?

হ্যাঁ।

আমি কি অন্যায় করেছি?

উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ এবং না। বিজ্ঞানে কিছু কিছু সমস্যার উত্তর এরকম হয়। উত্তর আসে পজেটিভ এবং নেগেটিভ। দুটা উত্তরই সত্য। আপনি কাঁদছেন নাকি?

কাঁদছি না। চোখে ধুলাবালি কিছু পড়েছে।

বিদ্যুত বললেন, অনাত্মীয়া একটি মেয়ের প্রতি আপনার মমতা দেখে ভালো লাগল। অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি, নাদিয়াদের বাগানে মহিষের মতো বলশালী একজনকে দেখলাম। মানুষটা কে?

ওর নাম ভাদু। পাহারাদারের চাকরি করে।

লোকটা কিন্তু ভয়ঙ্কর। আমি পদ্মকে নিয়ে অনেকক্ষণ বাগানে ছিলাম। লোকটা একবারও আমার দিকে বা পদ্মের দিকে তাকায়নি। যেসব মানুষ কারও চোখের দিকে তাকায় না তারা অসুস্থ।

প্রণব বললেন, আপনি জ্ঞানী মানুষ কিন্তু একটা ভুল করেছেন। ভাদু মহা বোকা একজন মানুষ। ভালো মানুষ। ভালো মানুষেরা বোকা হয়।

বিদ্যুত বললেন, আমার ভুল হতেও পারে। মানুষ মাত্রই ভুল করবে এটাই স্বাভাবিক।

ট্রেন এসে গেছে। বিদ্যুত একটা খবরের কাগজ কিনে ট্রেনে উঠলেন। খবরের কাগজে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক ঘোষণা গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছে। তারা দেশ থেকে চোর-ডাকাত নির্মূল করতে বলছে। তারা চোর-ডাকাতের এই আইডিয়া হয়তোবা মাওলানা ভাসানীর কাছ থেকে পেয়েছে।

 

সময় দুপুর।

নাদিয়ার মাছ মারার শখ হয়েছে। সে বড়শি ফেলে পুকুরঘাটে বসে আছে। প্রণব বড়শির ব্যবস্থা করেছেন। চারের ব্যবস্থা করেছেন। পচা গুড় এবং পচা গোবরের চার। টোপ ফেলা হয়েছে পিঁপড়ার ডিমের। তিনি ট্রেনার হিসাবে নাদিয়ার পাশে বসে আছেন। পদ্ম এসে নাদিয়ার সামনে দাঁড়াল। নাদিয়াকে অবাক করে দিয়ে বলল, আপা ম্যাজিক দেখবেন? এটা কী? একটা কাগজ না? আমি দিলাম ফু। এখন কী? পাঁচ টাকার নোট।

হতভম্ব নাদিয়া বলল, তুমি তো ফড়ফড় করে কথা বলছ। বিদ্যুত স্যারের সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে? স্যার কি এসেছেন?

পদ্ম হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

নাদিয়া বলল, প্রণব কাকা! বিদ্যুত স্যার কোথায়?

প্রণব জবাব দিলেন না। বড়শিতে মাছ বেঁধেছে। বড়সড় মাছ। তিনি মাছ নিয়ে ব্যস্ত

নাদিয়া অস্থির ভঙ্গিতে বলল, কথা বলছেন না কেন? স্যার এসেছিলেন?

হুঁ। ঘণ্টা দুই ছিলেন।

আমি জানলাম না কেন?

প্রণব বললেন, উনার কারণেই জানতে পারো নাই। উনি বললেন, নাদিয়া আমাকে একটা বিশেষ কাজে আসতে বলেছে। কাজটা করে আমি চলে যাব। আমি যে এসেছি নাদিয়া যেন না জানে।

এমন কথা কেন বললেন।

প্রণব হতাশ গলায় বললেন, সেটা মা আমি কীভাবে বলব? আমি অন্তর্যামী। উনার মনের ভিতরে ঢোকার ক্ষমতা ঈশ্বর আমাকে দেন নাই।

নাদিয়ার চোখে পানি টলমল করছে। সে চোখের পানি আড়াল করার জন্যে দ্রুত বাগানের দিকে চলে গেল।

 

বিদ্যুত ট্রেন থেকে নামলেন সন্ধ্যার পর। স্টেশনের বাইরে পা দিতেই একজন বলল, বিদ্যুত ভাই না? তাড়াতাড়ি বাড়িতে যান। দৌড়ান। আপনার মহাবিপদ।

কী বিপদ?

কী বিপদে পরে শুনবেন, এখন দৌড় দেন।

বিদ্যুত দূর থেকে দেখলেন উঠানে অসংখ্য মানুষ। প্রত্যেকের হাতে বাঁশের লাঠি। কারও কারও হাতে মশাল। হল্লার শব্দ দূর থেকে কানে আসছে। তার বাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। বিদ্যুত হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ির উঠানে উঠলেন আর তার চোখের সামনে জ্বলন্ত আগুনে বিদ্যুতের বাবা হরিকান্তিকে ফেলে দেওয়া হলো। ঘটনা ঘটল চোখের নিমিষে। হরিকান্তি ও বউ গো, বউ’ বলে পশুর মতো আর্তচিৎকার করলেন। বিদ্যুত বাবাকে উদ্ধারের জন্যে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আর উঠতে পারলেন না।

চোর নির্মূল অভিযানের মাধ্যমে বিদ্যুত কান্তি দে উপাখ্যানের সমাপ্তি হলো। কোনো মহৎ আন্দোলনই ভুল-ভ্রান্তি ছাড়া হয় না। স্বর্ণের খাদের মতো ভুলগুলিও স্বর্ণেরই অংশ।

 

আশার কথা, মাওলানা ভাসানী চোর-ডাকাত নির্মূলের সংগ্রাম থেকে সরে এসেছেন। শেখ মুজিব প্যারোলে আয়ুব খানের গোলটেবিলে যাবেন—তার প্রবল বিরোধিতা শুরু করেছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, প্রয়োজনে ফরাসি বিপ্লবের কায়দায় জেলখানা ভেঙে মুজিবকে নিয়ে আসা হবে।

 

২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয়। শেখ মুজিব মুক্তি লাভ করেন। তিনি ছাত্রদের ১১ দফাকেই সমর্থন করেন এবং বলেন, ১১ দফার মধ্যেই আছে আওয়ামী লীগের ছয় দফা।

পরের দিন রেসকোর্সের ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়।

উনসত্তরের গণআন্দোলনের সবচেয়ে বড় অর্জন একজন নেতা খুঁজে বের করা। নেতাশূন্য দেশে একজন নেতার উত্থান হলো–বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *