২০
নতুন আফটার শেভ লোশনটা মাখবার পর কিছুক্ষণ যেন আকাশে ভেসে রইল হেমাঙ্গ। এত হালকা লাগল মেজাজ, এত ফুরফুরে লাগল নিজেকে, যেন তার কোনও ভার নেই। সে আকাশে মেঘের মতো ভেসে আছে। গন্ধ যে মানুষকে এমন গ্যাস বেলুন করে দিতে পারে তার কোনও ধারণাই ছিল না হেমাঙ্গর। হল। সুগন্ধ সম্পর্কে তার বরাবরই আগ্রহ আছে। দেশ-বিদেশের কম সেন্ট তার সংগ্রহে নেই। সেগুলো মাখবার জন্য নয়, কারণ বেশী সুগন্ধ মাখলে তার অনেকটা এলার্জির মতো হয়। কিন্তু সে মাঝে মাঝে সাবধানে শিশি খুলে বা বাতাসে একটু স্প্রে করে নিয়ে গন্ধ শোঁকে। তাতে মনটা ভাল হয়ে যায়। কিন্তু এবার চারুশীলার পতিদেবতাটি এই যে আফটার শেভ লোশনটি এনেছে এটা সবাইকে জুতিয়ে দিয়েছে। এরকম দার্শনিক গন্ধ সে কখনও পায়নি।
সকাল দশটায় নিজের অফিসের চেম্বারে বসে হেমাঙ্গ একজন বিষয়ী লোকের সঙ্গে কথা বলছে। বিষয়ী লোকদের সে একদম পছন্দ করে না, কিন্তু এরাই তার অন্ন-বস্ত্রের যোগানদার। রোজই বিষয়ী লোকদের সঙ্গেই তার শতেক কথাবার্তা হয়। সে এদের আয় ও সম্পদকর বিষয়ক পরামর্শদাতা ও ছোটখাটো একজন ত্রাতা। তার সামনে বসে-থাকা লোকটির নাম বিরজু প্রসাদ সাহা। পদবীটি বাঙালী হলেও লোকটি আসলে ইউ পি-ওয়ালা। স্ক্র্যাপ আয়রন কেনাবেচার ব্যবসাতে কয়েকশো কোটি টাকা খাটছে। লোকটি মোটেই লালাজীদের মতো বুদ্ধিমান, বিদ্যাহীন, ধূর্ত বিনয়ী, মোটা এবং হাত কচলানো টাইপের নয়। এর বাপ-দাদা অবশ্য তাই ছিল। কিন্তু এ রীতিমতো লেখাপড়া জানা স্মার্ট, ট্রিম এবং আধুনিক। ম্যানেজমেন্টে বিলিতি ডিগ্রি আছে। কিন্তু এর মনোজগতে কোথাও কোনও ভাবাবেগ, অলস-চিন্তা, বাহুল্য আনন্দ নেই। এ হল আদ্যন্ত ব্যবসায়ী। বাণিজ্যিক রোবট। এর যা পয়সা আছে তাতে হেমাঙ্গদের গোটা পরিবারকে অন্তত ষাট সত্তর বার কেনাবেচা করতে পারে। এইসব লোকদের খুব সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হয়। একটু বেচাল বেফাঁস কথা বললেই ধরে ফেলবে।
কিন্তু আজ হেমাঙ্গ কোনও কিছুতেই মন দিতে পারছে না। সকাল আটটায় সে দাড়ি কামিয়েছে। অবশ্য আফটার শেভটা সে দাড়ি কামানোর পরই মাখে না। স্নান করে খেয়ে বেরোনোর সময় মেখে নেয়। তাতে মদির গন্ধটা প্রায় সারাদিন তার মুখমণ্ডলে থেকে যায়। এয়ারকুলার লাগানো ঠাণ্ডা ঘরে গন্ধটা ঝিমঝিম করছে আর তাকে গ্যাস বেলুনের মতো ওপরে এক স্বপ্নরাজ্যে ঠেলে তুলে দিতে চাইছে। ওঃ, ফরাসীরা গন্ধ চেনে বটে। গন্ধও যে যুগপৎ, একটা বিজ্ঞান ও শিল্প সেটা যে এদেশের লোক কেন বোঝে না কে জানে! মিশরের মমিদের কবরে যেসব সুগন্ধের পাত্র পাওয়া গেছে তাতে নাকি এখনও সুগন্ধ পাওয়া যায়! হাজার দু’হাজার বছরেও যা নষ্ট হয় না তা কী জিনিস দিয়ে তৈরি কে বলবে?
এ গন্ধটা ততদূর দীর্ঘস্থায়ী নয়। কিন্তু সকাল ন’টা থেকে লেগে আছে এবং দুপুর গড়িয়ে বেলা তিনটে সাড়ে তিনটে অবধি থেকে যায়।
বিরজু প্রসাদ সাহা আয়কর সংক্রান্ত একটি বদখত ঝামেলায় পড়েছে, যা প্রতি বছরই পড়ে। মিটেও যায়। এই ঝামেলা ও তার সমাধানের মাঝখানে কয়েক হাজার বা কখনও লক্ষ টাকাও হেমাঙ্গর কোম্পানি তুলে নেয়। ফলে এরা—অর্থাৎ বি পি সাহার মতো লোকেরা—তাকে অর্থাৎ হেমাঙ্গর মতো লোকদের নিজেদের চাকরবাকর মনে করে। একটু ভদ্রস্থ চাকর—যাদের চোখ রাঙানো যায় না বা চটানো যায় না। তবে আক্ষরিক অর্থে চাকরই।
একজন মহাপুরুষ বলেছেন, কর মানে হাত। কর দেওয়া মানে হাতে হাত মেলানো। রাজা ও প্রজার করমর্দন। সরকার ও জনসাধারণের সহযোগিতার শুরু। তার বদলে হেমাঙ্গ বা হেমাঙ্গর মতো লোকরা যা করছে তা হল অনেকটা বেড়াল-কুকুরের মল বা মূত্রের ওপর ছাই চাপা দিয়ে রাখা, যেমনটা তার মাকে সে ছেলেবেলায় করতে দেখেছে। গত বছর প্রায় দেড় কোটি টাকা ট্যাক্স বাঁচাতে বি পি সাহাকে সাহায্য করেছে হেমাঙ্গর কোম্পানি। এবং কাজটা করে যথেষ্ট আত্মগৌরব বোধ করেছে। বি পি সাহার মতো ক্লায়েন্টদের সর্বমোট কত ট্যাক্স বাঁচিয়ে দিয়েছে তার কোম্পানি তার হিসেব করলে যে-কারও মাথা ঘুরে যাবে। আর এই ছাই-চাপা দেওয়ার কাজ দেশ জুড়ে যারা করছে তারা মোট কত ট্যাক্স সরকারের ঘরে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে তার হিসেব করলে গোটা কয়েক পাঁচসালা পরিকল্পনার মূল বিনিয়োগ উঠে আসবে না কি? হিসেবটা করা হয় না, এই যা।
খুব মনোযোগের ভান করে বি পি সাহার কাগজপত্র দেখছে হেমাঙ্গ। আদতে দেখছে না। গন্ধের বেলুনে চড়ে এখনও সে অনেক ওপরে। ইনস্যাট বি-এর কাছাকাছি ঘুরপাক খাচ্ছে। মাঝে মাঝে সে সাহার বিষয়ী মুখটার দিকে তাকাচ্ছে। মুখখানা গোলপানা, গোঁফ আছে, নাকটা একটু মোটা, ভ্রূ ঘন, কপাল ছোট এবং চুল খুব ঘেঁষ। বয়স পঁয়ত্রিশ ছত্রিশের মধ্যে। গত বছর তিন কোটি টাকার কাছাকাছি ট্যাক্স দিয়েছে। সাফল্য কি একেই বলে? অঘোষিত সাফল্য অবশ্য আরও অনেক বেশি।
বি পি সাহার মুখে হাসি নেই। আহা, এই লোকটা যদি এই আফটার শেভ লোশনটা একটু মাখত!
খানিকক্ষণ কাগজপত্র দেখার চেষ্টা করে হেমাঙ্গ বলল, ইটস্ ও. কে. মিস্টার সাহা।
বি পি সাহা একটা অস্পষ্ট থ্যাংক ইউ বলে উঠে গেল। দরজাটা বন্ধ হল। ঘরে হেমাঙ্গ একা।
মাঝে মাঝে কাজ করতে তার ভাল লাগে না। মাঝে মাঝে তার অনেক দিনের ছুটি নিয়ে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে মনে হয়, যথেষ্ট হয়েছে। আর নয়। কিছুক্ষণ চোখ বুজে চুপ করে বসে সে কোনও একটা সুন্দর বেড়ানোর জায়গার কথা ভাবল। কিন্তু তেমন আকর্ষক কিছুই মনে পড়ল না। পাহাড়, জঙ্গল, সমুদ্র সে কি অনেক দেখেনি? খুবই আশ্চর্যের বিষয় এবং লোকে শুনলে হয়তো হাসবেও—তার প্রিয় বেড়ানোর জায়গা হল বড় বড় দোকান, যেখানে অজস্র জিনিসের সম্ভার। নতুন নতুন জিনিস। গ্যাজেটস। ইলেকট্রনিকস্।
বেশীক্ষণ বিষয়কৰ্মকে প্রত্যাখ্যান করে থাকা গেল না। একটু বাদেই বেয়ারার চিরকুট। তার কিছুক্ষণ পরেই বি পি সাহার কার্বন কপি আর একজন বিষয়ী লোক। তারপর, আরও একজন। তারপর ইনকাম ট্যাক্স-এর একটা হিয়ারিং সেরে আসতে হল।
তিনটের পর কফি খাওয়ার সময় গন্ধটা সম্পূর্ণ লোপাট হয়ে গেল। অন্তত ততটা রইল না, যতটায় ইনস্যাট বি-এর কাছাকাছি উঠে থাকা যায়।
মেয়েটা এল বিকেলের দিকে। আর এক ঘণ্টা পরে এলেই হত। তখন থাকত না হেমাঙ্গ। দেখা না করেও উপায় নেই। তার এক জ্যাঠার চিঠি নিয়ে এসেছে। ভুনি জ্যাঠা তার বাবার খুড়তুতো দাদা। এক সময়ে কোলিয়ারি ছিল। এখন ব্যবসা না থাক, টাকা আছে।
মেয়েদের মুখের দিকে চট করে তাকায় না হেমাঙ্গ। তাকালেই নানা বখেরা। মুখটা নিচু রেখেই বলল, চাকরি চান? কোয়ালিফিকেশন কী?
আমি একটা অ্যাপ্লিকেশন এনেছি। বায়োডাটা দেওয়া আছে।
ভুনি জ্যাঠার ক্যান্ডিডেটকে খুব একটা হেলাফেলা করার উপায় নেই। এই জ্যাঠামশাইটি রাশভারী ব্যক্তিত্ববান মানুষ। তিন ছেলে পুলিশ ও প্রশাসনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করে। এই তিন দাদাই হেমাঙ্গকে প্রয়োজনে প্রচুর সাহায্য করে থাকে। ভুনি জ্যাঠা কারও অনুগ্রহ নেয় না বড় একটা। আত্মমর্যাদাজ্ঞান খুব টনটনে। কিন্তু এই মেয়েটিকে নিশ্চয়ই বিশেষ কারণেই পাঠিয়েছেন হেমাঙ্গর কাছে। হেমাঙ্গ তাই দরখাস্তটা পড়ল। ইলেকট্রিক টাইপ রাইটারে দামী হ্যান্ডমেড কাগজে ছাপা দরখাস্তটা থেকে জানা গেল, মেয়েটির বয়স কুড়ি এখনও পূর্ণ হয়নি। আর্টস গ্র্যাজুয়েট এবং কমপিউটার ট্রেন্ড।
হেমাঙ্গর জীবনে একটা মস্ত বড় ঘাটতির ব্যাপার হল, সে চট করে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বোধ হয় কতগুলো ব্যাপারে সে অত্যন্ত সতর্ক মানুষ বলেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে চারদিক বিচার বিবেচনা করে। মেয়েটির চেয়েও ভুনি জ্যাঠা তার কাছে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাকটর। তারা—অর্থাৎ হেমাঙ্গর গোটা পরিবারটিই আসলে পূর্ববঙ্গের। তবে দাদুর আমল থেকেই, অর্থাৎ দেশ ভাগের অনেক আগে থেকেই তারা কলকাতার বাসিন্দা বলে পূর্ববঙ্গের পরিচয়টা প্রায় মুছে যাওয়ার জোগাড়। কিন্তু কয়েকটা ব্যাপারে এখনও তারা বাঙাল। ঘোরতর বাঙাল। তার মধ্যে একটা হল, আত্মীয় বৎসলতা। লতায় পাতায় আত্মীয়দেরও উপেক্ষা করার জো নেই। এই ছোট পরিবারের যুগেও তাদের এই রীতিটি বজায় আছে। আত্মীয়দের উপেক্ষা করা যাবে না। সুতরাং এই মেয়েটির তাদের আত্মীয় হওয়ারই সম্ভাবনা।
হেমাঙ্গ মৃদু স্বরে বলল, কিছু মনে করবেন না, আপনি ভুনি জ্যাঠামশাইয়ের কোনও আত্মীয় নন তো!
এবারও হেমাঙ্গ মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল না। দরখাস্তর দিকে চোখ রেখেই বলল।
মেয়েটি জবাব দেওয়ার আগেই হঠাৎ পর পর দুটো হাঁচি দিল।
হেমাঙ্গ মুখ তুলে দেখল, মেয়েটা রুমালে মুখ চাপা দিয়ে ভীষণ লজ্জার ভঙ্গিতে বসে আছে। আর খুবই উদ্বেগের কথা যে, মেয়েটি আপাদমস্তক সপসপে ভেজা।
হেমাঙ্গ ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের কাচের শার্সির ভিতর দিয়ে দেখল, বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। বদ্ধ অফিসঘরে কৃত্রিম আলোয় এতক্ষণ বুঝতে পারেনি। ভেজা মেয়েটির নিশ্চয়ই ঘরের ঠাণ্ডাটা সহ্য হয়নি।
ইস, আপনি যে ভিজে গেছেন!
রোগা চেহারার মেয়েটি সলজ্জ মুখে মৃদু স্বরে বলল, হ্যাঁ। একটু ভিজেছি। ছাতাটা ভুল করে সঙ্গে আনিনি।
হেমাঙ্গ উঠে এয়ারকণ্ডিশনারটা বন্ধ করে দিল। বলল, সরি। আমি এতক্ষণ লক্ষ করিনি যে আপনি ভিজে গেছেন। তোয়ালে দেবো?
মেয়েটি মাথা নেড়ে ভীষণ লজ্জার সঙ্গে বলে, না, তার দরকার নেই।
মুখটা চেনা-চেনা লাগছে হেমাঙ্গর। কোথায় দেখেছে একে? তার স্মৃতিশক্তি চমৎকার। কিন্তু মনে করতে সময় লাগবে। মুখখানার মধ্যে একটা ধারাল সৌন্দর্য আছে। মাথায় মেঘের মতো চুল।
আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি বলুন তো!
দেখেছেন, তবে মনে থাকবার কথা নয়।
কোথায় বলুন তো!
নন্দনাদের বাড়িতে। সেদিন ওর ভাইয়ের জন্মদিন ছিল। আমি অবশ্য আপনাকে চিনি।
হেমাঙ্গর টক করে মনে পড়ল। এই মেয়েটি তাকে একটা কোল্ড ড্রিংক দিয়েছিল। সঙ্গে একটু হাসি। হেমাঙ্গর মাথায় একটা টিকটিকি ডাকছিল। সে বলল, ওদের বাড়িতে কি আপনার যাতায়াত আছে?
হ্যাঁ। আমরা প্রতিবেশী।
হেমাঙ্গ অবাক হয়ে বলে, কিন্তু ভুনি জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে আপনার পরিচয় হল কি করে? উনি তো সল্ট লেক-এ থাকেন।
মেয়েটি মাথা নেড়ে বলে, পরিচয় নেই তো।
তাহলে এই চিঠিটা?
ওটা তো চারুমাসী এনে দিয়েছে।
মাই গড! তাহলে তো আপনি আসলে আমার ওই বিচ্ছু দিদিটির রেফারেন্সেই এসেছেন। কিন্তু ও নিজে চিঠি দিল না কেন? ফোনও করতে পারত।
মেয়েটি সলজ্জ একটু হেসে বলে, উনি বলছিলেন আপনি ওকে বেশী পাত্তা দেন না। তাই কোন এক আত্মীয়ের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে এসে দিলেন। আপনি কিছু মনে করেননি তো! কনস্পিরেসিটায় কিন্তু আমি ছিলাম না।
বুঝেছি। আমার ওই দিদিটিকে আমি ভালই চিনি। এনিওয়ে, আমি দরখাস্তটা রেখে দিচ্ছি। এই ভেজা অবস্থায় আপনার আর বেশীক্ষণ থাকা উচিত নয়। তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যান।
মেয়েটি দরজার কাছ অবধি চলে গিয়েছিল। হেমাঙ্গ আর একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, বাইরেটা বৃষ্টির তোড়ে সাদা হয়ে গেছে। এ বৃষ্টিতে এ মেয়েটি তো কোথাও যেতে পারবে না। নিশ্চয়ই গাড়ি কমে এসেছে রাস্তায়। আর বাসে এখন সাঙ্ঘাতিক ভিড় হবে।
শুনুন। আপনি বরং একটু অপেক্ষা করে যান। এই বৃষ্টিতে বেরোতে পারবেন না।
আমি ঠিক চলে যেতে পারব।
পারবেন না। রাস্তায় জল জমে গেছে। বেশী বৃষ্টি হলে কলকাতার অবস্থা কী হয় তা আমি জানি।
আমি জল ভেঙেই এসেছি।
এইরকম দুর্যোগের দিনে না আসাই ভাল ছিল। বসুন। সর্দি তো বোধ হয় লেগেই গেছে। আর নতুন করে লাগবে না।
মেয়েটি জড়সড় হয়ে বসল। খুব সংকোচ।
আপনি কি খুব নিডি? চাকরি খুঁজছেন কেন?
নিডি। তবে আমার বাবা খুব ভাল চাকরি করেন। কিন্তু বাবার একটা হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল। ম্যাসিভ অ্যাটাক। এখন আমাদের অবস্থা কিছুটা আনসার্টেন। চাকরিটা সেই জন্যই দরকার।
মেয়েটা আর একবার হাঁচল এবং ভীষণ লজ্জা পেল। রুমালে নাক মুখ চাপা দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করা সত্ত্বেও আরও তিনবার হাঁচতে হল তাকে।
বাবার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের কথা সেদিন আরও একটা মেয়ে বলছিল না? হেমাঙ্গ একটু ভাবতেই বছর পনেরোর কিশোরীটিকে মনে করতে পারল। কিশোরীটি বড্ড বেশী স্মার্ট।
মৃদু হাসি মুখে হেমাঙ্গ বলে, সেদিন পার্টিতে কি আপনার একটি ছোট বোনও ছিল? নিয়ার অ্যাবাউট ফিফটিন!
নাক থেকে রুমাল সরিয়ে মেয়েটা মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ, অনু। আপনার সঙ্গে নাকি তার খুব ভাব হয়ে গেছে বলছিল।
ওটি আর একটি বিচ্ছু, তাই না!
মেয়েটি হাসল। কিছু বলল না।
হেমাঙ্গ দরখাস্তটা তার ব্যক্তিগত ফাইলে রেখে দিয়ে বলে, আমাদের কোম্পানি ছোট, আমরা চারজন পার্টনার এটা চালাই। আমাদের এখানে স্টাফ খুব কম দরকার হয়। কম্পিউটারেও লোক আছে। আপনার জন্য অন্য কোনও ক্লায়েন্টকে বলে একটা কিছু করার চেষ্টা করব। কম্পিউটার ট্রেনিং থাকলে কাজ পাওয়া সহজ।
মেয়েটা আবার হাঁচি দিতেই খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে হেমাঙ্গ। এর তো ভালরকম ঠাণ্ডা লেগেছে দেখা যাচ্ছে। অথচ বাইরে প্রবল থেকে প্রবলতর বৃষ্টি হচ্ছে। অকালেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। রাস্তায় বোধ হয় এখন হাঁটুজল এবং প্রবল জ্যাম। বৃষ্টি হলেই একটা দুটো গাড়ি ব্রেকডাউন হয়ে রাস্তা আটকে রাখে। কলকাতা অচল হয়ে পড়ে।
মেয়েটা আর একবার উঠবার চেষ্টা করতেই হেমাঙ্গ একটু কড়া গলায় বলে, কোথায় যাচ্ছেন?
বাড়ি যেতে হবে যে।
যেতে তো সবাইকেই হবে। কিন্তু কলকাতায় কেউ কখনও সময়মতো কোথাও পৌঁছোতে পারে কি? আপনি বরং টেলিফোনে বাড়িতে খবর দিতে পারেন। বাড়িতে কি টেলিফোন আছে?
আছে।
তাহলে টেলিফোন করে দিন। বলে হেমাঙ্গ যন্ত্রটা এগিয়ে দিল।
মেয়েটা এই বদান্যতায় যেন মরমে মরে যাচ্ছে। খুব সংকোচের সঙ্গে বোম টিপল। বারতিনেকের চেষ্টায় লাইন পেয়ে মৃদুস্বরে বলল, মা, বৃষ্টিতে আটকে গেছি। ফিরতে দেরি হবে একটু।
সংলাপটা শুনবে না বলেই হেমাঙ্গ উঠে এসে জানালার একটা পাল্লা খুলে দিল। এয়ার কন্ডিশনারটা বন্ধ করায় ঘরটা একটু ভেপে উঠছে। জানালা দিয়ে অবশ্য প্রবল বৃষ্টির ছাঁট এল। তবু উঁকি মেরে নিচের অবস্থাটা একটু দেখে নিল হেমাঙ্গ। পথঘাট দেখা যাচ্ছে না বৃষ্টিতে।
জানালাটা বন্ধ করে চেয়ারে এসে বসল হেমাঙ্গ।
মেয়েটা নিজের সর্দির নাক সামলাতে ব্যস্ত।
হেমাঙ্গর এবার মেয়েটির দিকে অকপটে তাকাতে বাধা হল না। সে বলল, আপনাদের সংসার কি বড়?
আমরা তিন ভাই বোন। মা আর বাবা।
ভাই কি করে?
পড়ছে।
আপনার বাবা এখন কেমন আছেন?
একটু ভাল। কাল বাবাকে বাড়িতে আনা হবে।
একটা কাজ করুন। রাস্তায় জল জমে আছে, আমার ছোট গাড়ি ফেঁসে যাবে। একটু যদি অপেক্ষা করেন তো আমি আপনাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আসতে পারি।
এই বদান্যতায় মেয়েটা ভীষণ হকচকিয়ে গিয়ে বলল, না না! তার দরকার নেই।
এই মধ্যবিত্ত সংকোচের কোনও মানেই হয় না। এটা হল সুযোগসন্ধানীদের যুগ। কোনও সুযোগ বা সুবিধা প্রত্যাখ্যান করতে নেই। কিন্তু এই মেয়েটির এখনও সেইসব কার্যকরী শিক্ষা হয়নি। কিংবা একা পুরুষের সঙ্গে গাড়িতে যাওয়া কি এর কাছে সতীত্ব বিরোধী ব্যাপার? কে জানে কি! মেয়েদের চরিত্র ভাল করে জানে না হেমাঙ্গ।
সে বলল, দরকার না থাকলেও বসুন। এই বৃষ্টিতে যেতে পারবেন না। বরং একটু গরম চা বা কফি খান। আপত্তি নেই তো?
মেয়েটি আবার হাঁচল। লজ্জা পেল। ফর্সা রংটা লালও হয়ে গেল একটু। বলল, দরকার নেই।
কেন যে এত সংকোচ করছেন! বলে বেল বাজিয়ে বেয়ারা ডেকে দু কাপ কফির কথা বলে দিল।
লজ্জায় মরে যাচ্ছে মেয়েটি। যেন চাকরির উমেদারিতে এসে এই আপ্যায়ন গ্রহণ করাটা অন্যায় হয়ে যাচ্ছে।
কফি এল। দেখা গেল মেয়েটি কফিটা খুব উপভোগ করছে। দু হাতে কাপটা ধরে আছে সাবধানে। লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু ওর মুখ বলছে, কফিটা ওর খুব দরকার ছিল।
বৃষ্টিটা ঝপ করে অনেকটা কমে গেল কফি খাওয়ার দশ মিনিট পর। ধরেনি অবশ্য। তবে ঝিরঝির করে পড়ছে। উদ্দাম নাগা-নৃত্যটা বন্ধ হয়েছে। আর একটু অপেক্ষা করতে পারলে রাস্তার জলও কিছুটা সরে যাবে। হেমাঙ্গর ভয় তার ছোট গাড়িটা নিয়ে। ইঞ্জিনে জল ঢুকে মোটর বন্ধ হয়ে গেলে ঠেলাঠেলির অনেক ঝামেলা।
কফি খেয়ে মেয়েটা সত্যিই উঠল, এবার আমি যাবো।
হেমাঙ্গ একটু হেসে বলল, ঠিক আছে। আসুন।
মেয়েটা চলে যাওয়ার পর হেমাঙ্গ তার কাজকর্মে একটু ব্যস্ত রইল। কয়েকটা বিষয়কৰ্মজনিত ফোন এল। পার্টনার চঞ্চল বোসের সঙ্গে একটু আড্ডা হল। ঘণ্টা দেড়েক বাদে বুঝতে পারল রাস্তার জল নেমেছে। যাওয়া যাবে।
গাড়ি স্টার্ট নিল একবারেই। রাস্তায় কোনও ঝঞ্ঝাট হল না।
ফোনটা এল রাত আটটার পর। বাইরে আবার বৃষ্টি পড়ছে। বিছানায় খুব আলস্যে এলিয়ে আধশোয়া হয়ে টি ভি-তে একটা সিরিয়াল দেখছিল হেমাঙ্গ।
ফোনটা কানে তুলতেই হ্যালোর বদলে মেয়েলী গলায় শোনা গেল, ছিঃ!
হেমাঙ্গ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হাঁচলি নাকি?
ছিঃ ছিঃ! তোর লজ্জা করে না?
কিসের লজ্জা?
একটা মেয়েকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে না দিয়ে বৃষ্টিতে ওভাবে ছেড়ে দিলি? জানিস ওর এখন একশ এক ডিগ্রি টেম্পারেচার!
হেমাঙ্গ অপ্রতিভ হয়ে বলে, ওই ঝুমকি মেয়েটার কথা বলছিস নাকি?
তবে আর কার কথা বলছি! তোর মনুষ্যত্ব যে এত কমে গেছে, তুই যে এত হৃদয়হীন হয়ে গেছিস তা তো জানতুম না।
ঝুমকি কি তাই বলেছে তোকে?
বলার আর কী আছে?
আমি ওকে লিফট অফার করিনি একথা বলেছে?
মোটেই তা বলেনি।
তাহলে আমার দোষটা কোথায় বল তো!
ও লজ্জা পেয়েছিল, তাই বলে তুই ওকে জোর করে তো পৌঁছে দিতে পারতিস!
হেমাঙ্গ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, জোরও করা যায় নাকি? মেয়েটা অমন ভ্যাবাগঙ্গারাম আর লজ্জাবতী লতা হলে আমার কি করার আছে? আমি হিউম্যান পয়েন্টে যতটুকু করার করেছি।
বেচারার কোল্ড অ্যালার্জি আছে। বৃষ্টিতে ভিজে বুকে কনজেশন হয়ে কী অবস্থা! তার ওপর ওর বাবা এখন নার্সিং হোমে। তুই কী বল তো!
হেমাঙ্গ একটু চটে গিয়ে বলে, তখন থেকে কেন যে টিকটিক করছিস। বললাম তো, মেয়েটাকে পৌঁছে দিতে চেয়েছি, ও রাজি হয়নি।
একটা ছাতা তো দিতে পারতিস?
আমার ছাতা কোথায়?
কারও কাছ থেকে ধার করেও তো দিতে হয়। তোর মতো সকলের তো গাড়ি নেই। গরিবদের কথাও দিনের মধ্যে কিছুক্ষণ ভাবতে হয়। পৃথিবীতে কত পারসেন্ট গরিব তা জানিস?
লেকচার দিস না। মেয়েটা মোটেই গরিব নয়। ছাতাটা ভুলে ফেলে এসেছিল। ওরকম আনস্মার্ট, ভুলো মন আর বোকা মেয়েকে আমি কোনও চাকরি দিতে পারব না। সরি।
আহা, চটছিস কেন?
মেয়েটা তোর কাছে গিয়ে চুকলি কেটেছে তো! ঠিক আছে, ওরকম মেয়েকে চাকরি দেওয়ার কোনও দায়িত্বই আমার নেই।
মোটেই চুকলি কাটেনি। ও সেরকম মেয়েই নয়। বোকা হাঁদাও নয়, আনস্মার্টও নয়। তবে লাজুক সেকথা ঠিক। আর তোর মতো ইডিয়ট ছাড়া সবাই জানে যে, লজ্জাই ললনার ভূষণ।
ভূষণ মানে জানিস?
কেন জানব না? তোর মতো মূর্খ নাকি? ভূষণ মানে গয়না।
ঠিক কথা। গয়না হল বাহুল্য জিনিস, এ যুগে চলে না। ওয়ার্কিং গার্লরা যেমন গয়না অ্যাভয়েড করে তেমনি লজ্জাও অ্যাভয়েড করতে হয়। নাচতে নেমে ঘোমটা টানলে তো চলবে না। চাকরিও করব, আবার নববধূর মতো মাথা নিচু করে থাকব তা কি চলে রে? ও হল অচল মাল।
তোর কথাবার্তাগুলো এত জংলি টাইপের। যাক গে, ক্ষমা করে দিচ্ছি। তোকে যে কেন এত ক্ষমা করতে হয় তা বুঝি না বাবা।
ভুনি জ্যাঠামশাইকে এর মধ্যে টেনে নামিয়ে তুই যে কাণ্ডটা করলি সেটা কিন্তু ক্ষমার যোগ্য অপরাধই নয়। জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে আমি জিজ্ঞেস করব ইদানীং তিনি কেন অন্যের কথায় অজ্ঞাতকুলশীল সম্পর্কে ফলস স্টেটমেন্ট এবং রেকমেন্ডেশন দিচ্ছেন।
মারব থাপ্পড়! কে অজ্ঞাতকুলশীল রে? ঝুমকিকে আমি খুব ভাল চিনি।
কিন্তু জ্যাঠামশাই চেনে না।
আমি চিনলেই হবে। ভুনি মামার চেনার তো দরকার নেই।
এইসব মিথ্যাচারের জন্য তোর নরকবাসের মেয়াদ কত বেড়ে যাচ্ছে তা জানিস? ভাল চাস তো এখনও অন্তরটা পরিষ্কার কর। ঝাঁটা বালতি নিয়ে লেগে যা। তোর মনে অনেক ময়লা জমে আছে।