২০
দ্বারকানাথের সঙ্গে আলাপ পরিচয় মিটলে উপেন্দ্রকিশোর তাকে নিয়ে গেল বাড়ির ভেতরে। লম্বা উঠোন, ঘরের পর ঘর। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে উপেন্দ্রকিশোর বলল, ‘আমি আর আমার স্ত্রী থাকি দোতলার কয়েকটি ঘর নিয়ে। তুমি অবশ্য থাকবে তিনতলায়। তিনতলায় আমাদের নিয়মিত আসর বসে। তোমার ভালোই লাগবে। চলো আলাপ করিয়ে দিই।’
সৌরেন্দ্র বলল, ‘তোমার স্ত্রীকে দেখছি না?’
উপেন্দ্রকিশোর তিনতলার একটি কক্ষে প্রবেশ করতে করতে বলল, ‘সে ইস্কুলে গিয়েছে। এলে পরিচয় করাব’খন। তুমি এদিকে এসো।’
ঘরটি আয়তনে বেশ বড়, কিছুটা লম্বাকৃতি।
ঘরের এককোণে একটি কাঠের টেবিলে মুখোমুখি চেয়ারে বসে রয়েছে দুই যুবক।
তাদের মধ্যে একজনের দিকে প্রথমেই দৃষ্টি চলে যায়। যুবকটি অত্যন্ত সুদর্শন, বয়স সাতাশ-আঠাশ হবে। ঋজু দোহারা চেহারা। উজ্জ্বল চোখদুটিতে বুদ্ধিদীপ্ত ছোঁয়া। তার হাতে একটি খাতা ও কলম। কিন্তু সে লিখছে না, অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে রয়েছে বাইরের জানলার দিকে।
জানলার গরাদে লেজ ঝুলিয়ে বসে রয়েছে একটি রঙিন পাখি। সে গলা বাড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছে। ঘরের ভেতরে ঝুলছে একটা টিয়াপাখির খাঁচা। খাঁচার সেই টিয়াপাখি বাইরের রঙিন পাখির দিকে একবার তাকাচ্ছে, পরক্ষণেই মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। রঙিন পাখিটিও বেশ ঠারেঠরে তাকাচ্ছে টিয়ার দিকে।
বেশ মনোরম দৃশ্য।
টেবিলের বিপরীত প্রান্তে বসে থাকা দ্বিতীয় যুবকটি ভীষণ ব্যস্ত। সে নাকের ওপর চশমা এঁটে একটা জাবদা হিসাবের খাতা থেকে কী সব লিখছে আর হাতের কর গুণে হিসেব করছে।
উপেন্দ্রকিশোর টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে দ্বিতীয় যুবকটির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, ‘আলাপ করিয়ে দিই। ইনি গগনচন্দ্র হোম। পরিচয়ে শুধু ব্রাহ্ম নেতা বললে ভুল হবে, এ-ই সেই আপদ যার পাল্লায় পড়ে আমি ব্রাহ্ম হই এবং ঠিক তোমারই মতো বংশের কুলাঙ্গার হওয়ার গুরু অপরাধে আমার পিতৃদেব আমায় সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেন।’
‘বা হে বাহ। আচ্ছা অকৃতজ্ঞ তো তুমি?’ গগনচন্দ্র হিসাব থেকে মুখ তুলে খেঁকিয়ে উঠল, ‘পিতৃদেব বঞ্চিত করেছিলেন, সেই কথা ফলাও করে বলছ, আর পরে যে বিমাতা তোমায় প্রাপ্য অংশের পুরোটা দিয়েছেন, সেটা তো বলছ না হে! কপালগুণে অমন বিমাতা পাওয়া যায়।’
উপেন্দ্রকিশোর হাসতে লাগল, ‘আহ ঠাট্টা বোঝো না কেন ভায়া? ভাগ্যিস সেই সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের মেসে থাকতে গিয়েছিলাম। তবেই তো তোমার মতো বন্ধু পেলাম।’
গগনচন্দ্র মুখে একটি বিচিত্র ভঙ্গি করে আবার খাতায় মনোনিবেশ করল।
উপেন্দ্রকিশোর এবার তাকালেন প্রথম যুবকটির দিকে। সে তখনো উদাসচোখে তাকিয়ে রয়েছে জানলার পাখিটির দিকে।
‘ইনি দেবেন ঠাকুরের ছোট ছেলে। নাম রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ নিজেও একজন সুকবি ও গীতিকার হিসেবে ইদানিং বেশ নাম করেছেন। আমাদের কাছে অবশ্য ও শুধুই রবি। সে গান লেখে, আর আমি তার সেই গানের সঙ্গে বেহালা বাজাই।’
‘নাম নয়, বদনাম বলো।’ রবি চমক ভেঙে এদিকে তাকাল, ‘তোমাদের সঞ্জীবনীতে আমার লেখা নিয়ে যা বিদ্রুপ হয়, তাতে বদনাম বলাটাই যুক্তিযুক্ত।’
‘হাঃ হাঃ হাঃ কেন ভাই? সঞ্জীবনীতে আমার শ্বশুরমশাই তোমার সাধ কবিতাটির কত প্রশংসা করেছিলেন, তা কি ভুলে গিয়েছ?’ উপেন্দ্রকিশোর লঘু হেসে সৌরেন্দ্রর দিকে ফিরল, ‘ইনি সৌরেন্দ্র ঘোষাল, আমাদের ব্রাহ্ম স্কোয়াডের নতুন সদস্য। গতবছর বি এ পাশ করেছেন।’
গগনচন্দ্র ও রবি দুজনেই সৌরেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে নমস্কার করল।
সৌরেন্দ্র স্মিতমুখে বলল, ‘আপনার লেখা আমি পড়েছি। ভারতী পত্রিকায়। যখন ‘বৌ ঠাকুরানীর হাট’ বলে যে উপন্যাসটি সেখানে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হত। খুব ভালো লেগেছিল পড়তে। বিশেষত, মোহনলাল আর মঙ্গলা, এই দুটি চরিত্রকে যা সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছিলেন, অনবদ্য!’
রবি লজ্জায় মুখ নামিয়ে ফেলল। এই তার এক দোষ। ছাব্বিশ বছরের যুবা সে, তরুণ কবি হিসেবে বেশ খ্যাতিও ছড়িয়েছে এদিক ওদিক, পত্রপত্রিকায় নিজের লেখার প্রশংসা পড়তে তার প্রচণ্ড আনন্দ হয়। কিন্তু সাক্ষাতে কেউ প্রশংসা করলেই কোথা থেকে যেন একরাশ লজ্জা এসে জড়ো হয় তার মুখে। আরক্ত মুখখানি তখন সে লুকোবার পথ পায় না।
কথা ঘোরানোর জন্য সে দ্রুত বলে উঠল, ‘তোমার কি এখন আর সময় হবে উপেন্দ্রকিশোর? নাহলে বলো, আমি এবার উঠব। একটু কাজ আছে।’
‘কেন, বেশ তো পাখিটার দিকে তাকিয়ে গান লিখছ। লেখো, আমায় একটু সময় দাও। সৌরেন্দ্রকে এখানে থিতু করেই বেহালাটা নিয়ে আসছি।’
রবি আবার খাতার দিকে তাকাল। উপেন্দ্রকিশোর তার বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু বাকিদের সামনে নিজেকে জাহির করতে তার কুণ্ঠা হচ্ছিল। তবু সে বলে ফেলল, ‘গান নয়। কবিতা। লেখা শেষ। শুনবে?’
‘শুনি শুনি।’ পরম উৎসাহে মুখ তুলল গগনচন্দ্র।
রবি একটু গলা খাঁকারি দিল। তারপর কাগজটা তুলে পড়তে লাগল,
খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে বনের পাখি ছিল বনে।
একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে, কী ছিল বিধাতার মনে।
বনের পাখি বলে, ‘খাঁচার পাখি ভাই, বনেতে যাই দোহেঁ মিলে।’
খাঁচার পাখি বলে, ‘বনের পাখি, আয় খাঁচায় থাকি নিরিবিলে।’
বনের পাখি বলে, ‘না, আমি শিকলে ধরা নাহি দিব।’
খাঁচার পাখি বলে, ‘হায়, আমি কেমনে বনে বাহিরিব।’
‘আহা! সাধু! সাধু! আমি বলে দিচ্ছি, বিদ্যাসাগর মশাইয়ের ওই নাতি তোমার যতই দুর্নাম করুক, এই ছেলে একদিন বাংলা সাহিত্যের চূড়ায় অবস্থান করবে। সেদিন হয়ত আমি থাকব না। কিন্তু আমার কথা মিলিয়ে নিও।’
ঘরের অন্যকোণ থেকে উচ্চকিত প্রশংসা ভেসে আসতে সৌরেন্দ্র চমকে সেদিকে তাকাল। এতক্ষণ খেয়াল করেনি, সেদিকে ঘরের একেবারে ভেতরের দিকে একটি জানলার সামনে মুখোমুখি পদ্মাসনে ব্যাঘ্রচর্মের ওপর বসে রয়েছেন এক ভদ্রলোক। পরনে রক্তাভ আলখাল্লা। কপালে লম্বাটে রক্ততিলক। চুল বেশ লম্বা, নেমেছে ঘাড়ের নীচ পর্যন্ত। মধ্যবয়স্ক, কিন্তু চেহারা সুঠাম ও মেদবর্জিত।
সৌরেন্দ্র লক্ষ করল, ভদ্রলোক চোখ বন্ধ করে কথাগুলো বললেন এবং এখনো চোখ বুজেই রয়েছেন।
উপেন্দ্রকিশোর ডাকল, ‘ভটচাযমশাই! ভটচাযমশাই!’
বারকয়েক হাঁকাহাঁকির পর ভদ্রলোক চোখ খুললেন।
‘বলো।’
‘আপনাকে কাল বলছিলাম না, আপনার একজন সঙ্গী আসবে। এই যে, আপনার ঘরের নতুন বাসিন্দা।’ কথাটা বলে উপেন্দ্রকিশোর সৌরেন্দ্রর দিকে তাকাল, ‘সৌরেন্দ্র, তুমি এঁর নাম শুনে থাকবে। ইনি বিখ্যাত পণ্ডিত রামকুমার ভট্টাচার্য বিদ্যারত্ন। আমাদের সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের গ্রন্থ কুলিকাহিনি ইনিই লিখে থাকেন। ভবঘুরে মানুষ, আজ এখানে তো কাল সেখানে। যতদিন সাহচর্য পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছ, ছেড়ো না। সংস্কৃতটা ভালো করে শিখে নাও। বুঝলে?’
রামকুমার ভট্টাচার্য বিদ্যারত্ন স্থিরচোখে কিছুক্ষণ আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলেন সৌরেন্দ্রকে। তারপর বললেন, ‘কী করা হয়?’
‘আজ্ঞে, গতবছর বি এ পাশ করেছি। এবার ইচ্ছে আছে ডাক্তারি পড়ার।’ সৌরেন্দ্র নতমুখে বলল।
‘বাহ! অতি উত্তম।’
গগনচন্দ্র অমনি ওদিক থেকে ফুট কাটল, ‘উত্তম কীসের পণ্ডিতমশাই? আপনি তো আয়ুর্বেদচর্চা করেন, অ্যালোপ্যাথি দু’চোক্ষে দেখতে পারেন না।’
রামকুমার ভট্টাচার্য বিদ্যারত্ন বললেন, ‘দু’চোক্ষে দেখতে পারব না কেন? পিতা সন্তানকে দেখতে পারবে না? আয়ুর্বেদ হল সবার পিতামহ। ঠিকমতো আয়ত্ত করলে আয়ুর্বেদের ওপর কোনো চিকিৎসাবিদ্যা নেই। থাকা সম্ভব নয়।’
‘ওসব কথা এখনকার দিনে অচল পণ্ডিতমশাই।’ গগনচন্দ্র আবার বলল, ‘ধরুন আপনার কিডনিতে পাথর হল। কিংবা পেটে টিউমার। ছোটখাটো নয়, বড় আকারের। আপনার ওই গাছগাছড়া দিয়ে কি পারবেন সেগুলো সারাতে? পারবেন না। তার জন্য দরকার অ্যালোপ্যাথির অপারেশন।’
রামকুমার ভট্টাচার্য বিদ্যারত্ন এবার ভ্রু কুঞ্চিত করে বললেন, ‘অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী গগনচন্দ্র। আগে আয়ুর্বেদ কী সেটা জানো। তারপর তুচ্ছতাচ্ছিল্য কোরো। মহর্ষি সুশ্রুত কী লিখেছিলেন জানো? আয়ুরস্মিন বিদ্যতে অনেন বা আয়ুবিন্দত্যায়ুর্ব্বে। অর্থাৎ যার দ্বারা আয়ু লাভ করা যায় এবং যার দ্বারা আয়ুকে জানা যায়, তাই হল আয়ুর্বেদ। এই আয়ুর্বেদ আটভাগে বিভক্ত, যার প্রথম ভাগই হল শল্যতন্ত্র। তোমাদের ভাষায় ‘অপারেশন’। শুধু টিউমার অপারেশনই নয়, সুশ্রুত বা বাণভট্ট প্লাস্টিক সার্জারির বর্ণনাও দিয়ে গিয়েছেন। এই বাড়িতেও একজন হবু ডাক্তার রয়েছেন। তিনি এগুলো জানেন। এবং মানেন।’
‘আরে পণ্ডিতমশাই।’ উপেন্দ্রকিশোর এবার বলল, ‘আপনি বোঝেন না কেন, গগন আপনাকে রাগাতে ভালোবাসে। ওর কথায় আপনি উত্তেজিত হবেন না।’
‘উত্তেজিত হইনি উপেন্দ্র। না জেনে না শুনে নিজের জাতিকে নিজেদের ঐতিহ্যকে অকারণ হেয় করাটা আমার কাছে রসিকতা মনে হয় না। তবে এই হয়ত তোমাদের কাছে আধুনিকতার সংজ্ঞা। সে যাই হোক।’ রামকুমার ভট্টাচার্য বিদ্যারত্ন সৌরেন্দ্রর দিকে তাকালেন, ‘তুমি অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের সার্থক উত্তরসূরি হও, এই আশীর্বাদ করি বাবা।’
সৌরেন্দ্র নীচু হয়ে প্রণাম করতে যেতে ভদ্রলোক বিনাবাক্যব্যয়ে পা দুটি সামনে এগিয়ে দিলেন।
মহাপণ্ডিত মানুষটির পদধূলি নিতে নিতে সৌরেন্দ্রর বুকের ভেতরটা কাঁপছিল। আসন্ন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের উত্তেজনায়। প্রবলভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে ইচ্ছা করছিল জন্মদাতা পিতাকে।
ভাগ্যিস তিনি সৌরেন্দ্রকে ত্যাগ করলেন, তাই সে এমন পরিবেশে থাকার সুযোগ পেল।
মনে মনে সে বিলক্ষণ বুঝতে পারছিল, শাপে তার বর হয়েছে। গঙ্গোপাধ্যায় বাড়ির এই পরিবেশ তাকে আরো মুক্তমনা, আরো যুক্তিবাদী, আরো মানবিক হয়ে উঠতে সাহায্য করবে।
২১
কেটে গিয়েছে প্রায় ছয়মাস।
মহাকালের হিসেবে ছয়টি চান্দ্রমাস বা অর্ধবৎসর একটি সামান্য পর্যায় হলেও নশ্বর মনুষ্যজীবনে এই সময় নেহাত কম নয়।
কৃষ্ণসুন্দরদের জাহাজ অশান্ত আটলান্টিক মহাসাগরের প্রবল ঝড় পেরিয়ে পৌঁছেছে অজানা দেশ সুরিনামে। জাহাজের প্রতিটি বন্দীর ওপর দিয়েও গিয়েছে অনেক কালবৈশাখীর ঝঞ্ঝা।
যাত্রা শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই জাহাজের থার্ড অফিসার জোহাম সাহেবের অত্যাচারে সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ওলন্দাজ সহ-নাবিক জোহাম দেশীয় ‘নেটিভ’দের মানুষ বলে আদৌ গণ্য করে না। কারণে অকারণে সে জ্বলন্ত চুরুট চেপে ধরে অর্ধাহারে খোলের মধ্যে গাদাগাদি করে বসে থাকা শীর্ণ ক্লিষ্ট শ্রমিকদের ওপরে। পান থেকে চুন খসলেই সে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে তার বুটখানা চেপে ধরে মানুষের ওপরে।
তার ওপর তার সবচেয়ে বড় দোষ ছিল, রাতে পেটে দু-পাত্র তরল পড়লে সে আর মানুষ থাকত না। সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় তখন তার তলপেট পৌরুষের মাস্তুল প্যান্ট ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইত।
টলতে টলতে সে তখন এসে সিঁড়ি দিয়ে নামত জাহাজের খোলে। সামনে যে মেয়েকে পেত, তাকে টানতে টানতে নিয়ে চলত নিজের কেবিনে। সারারাত তার শরীরটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ভোররাতে ফেলে দিয়ে যেত জাহাজের ডেকে।
পরপর দুজন মেয়ের ওই দশা হওয়ায় অন্ধকার খোলের মধ্যেও বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল।
জাহাজের খালাসি, গাঙ সারেঙরা আগে থাকতেই জানত তাদের ‘যম’সাহেবের এই বদস্বভাব। তাই তোতারাম, পরেশ কৈবর্ত, জিতুপাগলা, চামেলিরা যখন রুখে দাঁড়াল, তখন তারা মুখে রা না কাটলেও কোনো প্রতিবাদ করল না।
সেদিন রাতে জোহাম সাহেব যখন সিঁড়ি বেয়ে খোলের মধ্যে নামছিল, তখন তার পা টলছিল না। হাতে সাপের মতো হিলহিলে একটা চাবুক।
মাথায় সেদিন তার আগুন চেপে গেছে। তোতারামেরা সেদিন বিকেলে গিয়ে নালিশ করেছিল জাহাজের প্রধান নাবিক গ্ল্যাডস্টোন সাহেবের কাছে। জোহাম ওলন্দাজ হলেও গ্ল্যাডস্টোন ক্যাথলিক খ্রিস্টান। গ্ল্যাডস্টোন সাহেব বন্দীদের প্রতি খুব বেশি সদয় না হলেও চক্ষুলজ্জাটুকু আছে। এইটুকু অন্তত ভালোভাবেই বোঝেন যে, ইনডেনচারড কুলিদের আখের খেতে যেভাবেই খাটানো যাক না কেন, মেয়েদের শরীরের ওপর অধিকার খাটে না।
তিনি সম্ভবত জোহামকে ডেকে মৃদু তিরস্কার সহযোগে বুঝিয়েছিলেন যে, কাজটা ঠিক হচ্ছে না।
জোহাম চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিল, ‘দে আর আওয়ার স্লেভস। ব্লাডি স্লেভস। কার বাপের কী বলার আছে?’
গ্ল্যাডস্টোন সাহেব জাহাজের দুলুনিতে কেবিনে বসে টাল সামলাতে সামলাতে বলেছিলেন, ‘এটা ফিফটিনথ সেঞ্চুরি নয় জোহাম। ওরা কন্ট্রাক্টে কাজ করতে যাচ্ছে, লাইফ টাইমের জন্য নয়।’
‘হুররর!’ জোহাম তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে একটা শব্দ করে বলেছিল, ‘ওসব খাতার বুলি কপচে কোনো লাভ নেই গ্ল্যাডস্টোন। আমার কাছে ওরা শুধুই স্লেভ। এখন তিনমাস ধরে জলে থাকব। বউ দেশে। এতগুলো মেয়ে যাচ্ছে, একটু ফুর্তি না করলে হয়?’
গ্ল্যাডস্টোন থেমে গিয়ে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন মদ্যপ জোহামের দিকে। তারপর ব্রহ্মাস্ত্র ছুড়েছিলেন, ‘বছর কয়েক আগে ব্রিটিশ গিয়ানা যাওয়ার জাহাজের ঘটনাটা মনে আছে?’
‘কোন ঘটনা?’ জোহাম কেবিন থেকে দূরবীন দিয়ে দূরের অন্ধকার মহাসমুদ্র দেখতে দেখতে লালচোখে তাকায়।
‘কুলি মেয়েদের রেপ করার জন্য দুশোজন কুলি একসঙ্গে চড়াও হয়েছিল জাহাজের ক্যাপ্টেন আর বাকি অফিসারদের ওপর। নেতৃত্বে ছিল হনুমান আর লক্ষ্মণ বলে দুই কুলি। জাহাজটা যখন বন্দরে পৌঁছয়, আমাদের কেউ বেঁচে ছিল না। ঘটনাটা একেবারেই জানাজানি করা হয়নি, মিডিয়ার মুখ বন্ধ করা হয়েছিল মোটা পাউন্ড দিয়ে। কারণ এই ঘটনা চাউর হলে কুলিদের সাহস অনেক বেড়ে যাবে।’ গ্ল্যাডস্টোন পানীয়তে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, ‘আজ ওরা আমায় নালিশ করেছে, কাল এসে গলা টিপবে। আমরা আট-দশজন, ওরা দেড়শ জন। খেপলে কী হবে বুঝতে পারছ?’
জোহাম সেদিন রাতেই সে খোলের ভেতর ঢুকে তোতারাম ও জিতু পাগলাকে গুনে গুনে পঞ্চাশ ঘা চাবুক মেরেছিল। কেউ আত্মরক্ষা করার সুযোগটুকু পায়নি, সবাই তখন গাদাগাদি করে ঘুমোচ্ছিল।
সেই প্রচণ্ড মারে তোতারাম বেঁচে গেলেও জিতু পাগলার জ্বর এসে গিয়েছিল। তিনদিন পর সে ঢলে পড়েছিল মৃত্যুর কোলে। তারপর একটা মরা পাখির মতই তার লাশটা জাহাজ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল ছুড়ে।
চাবুক মেরে হাতের সুখ করে নেওয়ার পর থেকে কেন কে জানে, জোহাম আর মেয়েদের দিকে হাত বাড়ায়নি। হয়ত জিতু মরে যাওয়ায় সত্যিই সে ভয় পেয়েছিল। কিন্তু সেই ভয়ের কম্পন গিয়ে পৌঁছয়নি তোতারামদের কাছে।
তাই তারাও কাঁপছিল যমসাহেবের ভয়ে। মৃত্যুভয় বড় ভয়।
ওদের পালতোলা জাহাজ যেদিন সুরিনামে গিয়ে নোঙর করল, সেদিন বেশ কয়েক মাস আগে স্বপ্নে দেখা অভিজ্ঞতাটা মনে পড়ে গেল কৃষ্ণসুন্দরের। না, তাঁর স্বপ্নের মতো অতটা ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে হল না তাঁকে। বন্দর থেকে এই কয়েকমাসে সমুদ্রযাত্রায় ক্লিষ্ট কুলিদের প্রায় দু’ঘণ্টা হাঁটিয়ে উপস্থিত করা হল আখের খেতে।
যেদিকে চোখ যায়, সবুজ শ্যামল দিগন্তবিস্তৃত খেত। সেই খেতে মাথা নাড়িয়ে বাতাসের সঙ্গে দুলছে প্রায় দুই মানুষ লম্বা আখগাছের সারি। একঝলক দেখলে হাজার মাইল দূরের স্বদেশের কথা মনে পড়ে যায় সকলের।
আখগাছের খেত থেকে প্রায় ক্রোশখানেক দূরে কিছুটা জঙ্গল পরিষ্কার করে বানানো হয়েছে সার দিয়ে একতলা ছোট ছোট কাঠের বাড়ি। বন্যপ্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই বোধ হয় সেই বাড়িগুলো মাটি থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়।
বহুদিন পর কৃষ্ণসুন্দরের হরিহর আড়কাঠির কথাটা মনে পড়ে গেল।
‘প্রত্যেকের জন্য আলাদা কোঠাবাড়ি। আপনি হলেন গিয়ে বামুন মানুষ, আপনার জন্য সবকিচুই আলাদা থাকবে। নিজেরা থাকবেন, বাজারদোকান করবেন, রেঁধে খাবেন, আর কি?’
বাজার দোকান? কৃষ্ণসুন্দর ধূসরচোখে চারপাশে তাকালেন। এই জনশূন্য অরণ্যপ্রান্তরে কোথায় বাজার কোথায় হাট?
ব্রহ্মময়ী কিন্তু কৃষ্ণসুন্দরের মতো মনমরা নেই। এই কয়েকমাস যে নারকীয় পরিবেশের মধ্যে দিনরাত কেটেছে জীবন, সেই তুলনায় নিজেদের জন্য পৃথক এক কাঠের বাড়ি তো স্বর্গসম। নাই বা হল স্বদেশ!
এই কয়েক সপ্তাহে তিনি আগের চেয়ে অনেক কৃশকায় হয়ে গিয়েছেন, তবু অশেষ উৎসাহে তিনি নতুন বাড়ি গোছাতে শুরু করলেন। ঘর মোটে একখানা, তা হোক। প্রাণীও তো এখন সাকুল্যে তিনজন। প্রতি সপ্তাহে নাকি চাল, ডাল আর কিছু সবজি পাওয়া যাবে। তাই দিয়েই চালাতে হবে।
দিব্যসুন্দরও বহুদিন পর উন্মুক্ত প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে উচ্ছল হয়ে উঠেছে। আনন্দে সে তাদের বাড়ির চারপাশে ছোটাছুটি করতে লাগল।
কৃষ্ণসুন্দর বসেছিলেন বাড়ির সামনের জমিতে। তোতারাম, বিনয়, পরেশ কৈবর্তও বসে ছিল উদাসমুখে। এই মহাদেশে এখন বেশ গরম। রোদের হলকায় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কারুরই সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
একটা কচি ঘাস ছিঁড়ে মুখে পুরে চিবোতে চিবতে তোতারাম বলল, ‘আইজকের দিনডা আমাগো ছুটি। কাল থিকা কাম শুরু হবে। পাঁচিলের ধারে যে হুমদো মতো লোকখান খাড়ায়ে ছিল, তারে জিগালাম। সে কী বলল জানেন ঠাকুর মশাই?’
‘কী?’ কৃষ্ণসুন্দর জিজ্ঞেস করলেন।
‘এই বাগিচার মালিকানা দুজন সাহেবের। তাঁরা দুজনেই থাকেন কাছে, রোজ দু’বেলা ঘোড়ায় চইড়া আখ খেত দ্যাখতে আসেন।’
বিনয় বলল, ‘আমিও ওই লম্বা লোকটাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। লোকটা মুলাটো।’
‘মুলা?’ তোতারাম হাঁ হয়ে গেল, ‘দিব্যি দেখতাসি একটা লম্বা চওড়া জোয়ান মরদ, মুলা কোত্থিকা পেলা তুমি?’
‘মুলা নয়। মুলাটো। এদেশের আদিমানুষরা তো কালো। তাদের বলে নিগ্রো। ইংরেজরা নিগ্রো মেয়েদের সঙ্গে সহবাস করায় একধরনের বর্ণসংকর জাত উদ্ভব হয়েছে। তাদেরই বলে মুলাটো। গায়ের রঙ দেখো, ফর্সাও নয়, কালোও নয়, মাঝারি। চুলগুলো আবার এদেশের লোকেদের মতো কোঁকড়ানো।’ বিনয় কৃষ্ণসুন্দরের দিকে ফিরে বলল, ‘জানেন ঠাকুরমশাই, এই দেশে এত আখের খেত, এই সব খেতে আগে নাকি কাজ করত নিগ্রোরা। একেবারে মুফতে ক্রীতদাস হয়ে। কিন্তু বেশ কয়েক বছর আগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কড়া আইন করে এই দাসপ্রথা বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু দাস না হলে আখের খেতে কাজ করবে কে? তাই আমাদের মতো গরিব দেশের ওপর নজর পড়েছে।’
‘তারাই তো তার মানে এই দেশের আসল বাসিন্দা। তারা কোথায়?’ কৃষ্ণসুন্দর প্রশ্ন করলেন।
‘নিশ্চয়ই থাকে দূরের কোন গ্রামে।’ বিনয় বলল, ‘পড়েছিলাম তারা এখন আর ইংরেজদের ভয় পায় না। নিজেদের মতো থাকে। সাহেব খামারমালিকরাও আইনের ভয়ে তাদের ঘাঁটায় না।’
কথায় কথায় দিনের আলো মুছে গিয়ে রাত আসে। ভারতবর্ষ হোক বা সুরিনাম, সূর্যদেব নিজের কর্তব্যে সদা অবিচল।
সেদিন রাতে কৃষ্ণসুন্দর বা ব্রহ্মময়ী কারুরই ঘুম এল না। এতগুলো দিনের পর অপেক্ষাকৃত সুস্থ পরিবেশে তাঁরা পাশাপাশি থাকার সুযোগ পেলেন। তবু কারুরই যেন মনে কোনো খুশি নেই।
এককোণে অকাতরে ঘুমোচ্ছে দিব্যসুন্দর। তার ঘুমন্ত চোখের ওপর আলতো করে বিলি কাটছিলেন ব্রহ্মময়ী। ডিপোর দিনযাপন, তারপর জাহাজের খোল। কতদিন পর তিনি সন্তানকে নিজের করে পেলেন।
কী রোগা হয়ে গেছে তাঁর ছেলেটা। ভরাট গালগুলোর মাংস খসে গিয়ে তুবড়ে গিয়েছে, রঙও ময়লা হয়ে গিয়েছে অনেক।
তিনি অস্ফুটে বললেন, ‘ওদের কী খবর বলো তো!’
কৃষ্ণসুন্দর চিত হয়ে শুয়েছিলেন। বললেন, ‘সব ঠিকঠাক চললে তারা হয়ত দ্বারকার কাছেই আছে। ভালোই আছে নিশ্চয়ই।’
ব্রহ্মময়ীর গলার কাছে কী যেন দলা পাকাচ্ছিল। তিনি চুপ করে রইলেন।
কৃষ্ণসুন্দরও কোনো কথা বললেন না।
পাশেই গরাদহীন ছোট্ট একফালি জানলা। সেখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূরের জঙ্গল। রাতের আকাশ। সেই আকাশে মিটমিট করছে নক্ষত্র। জ্বলজ্বল করছে চাঁদ। পাশাপাশি শুয়ে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নরনারী প্রত্যক্ষ করছেন প্রকৃতির এই চিরাচরিত সুন্দর রূপ।
অনেকক্ষণ পর কৃষ্ণসুন্দর অস্ফুটে বললেন, ‘কাল থেকে আমি পাকাপাকিভাবে একজন কুলি হব কৃষ্ণা!’
ব্রহ্মময়ী বললেন, ‘সত্যিই কি তোমাকে দিয়ে ওরা খেতের কাজই করাবে? এও তো হতে পারে, এখানে কোন মন্দির আছে, সেই মন্দিরের …!’
‘কী যে বলো!’ ম্লান হাসলেন কৃষ্ণসুন্দর, ‘এখানে আবার মন্দির কোথায় পাবে তুমি? ওসব ওই হরিহর আড়কাঠির ফাঁদে ফেলার চাল ছিল।’
‘এখানে কতদিন থাকবো আমরা?’
‘চুক্তিনামাতে তো লেখা রয়েছে পাঁচবছর। কিন্তু তারপরেও কী ফিরতে পারব?’ বিড়বিড় করলেন কৃষ্ণসুন্দর, ‘জানি না। অনেককে তো শুনছি এখানে পিটিয়েই মেরে ফেলে। তারপর পুঁতে দেয় বালির চরে। কাকপক্ষীতেও টের পায় না। আমি তো কখনো এসব পরিশ্রমের কাজ করিনি, আমার ভাগ্যেও হয়ত সেটাই লেখা আছে।’
‘এসব কী বলছ তুমি?’ আর্তনাদ করে উঠলেন ব্রহ্মময়ী, ‘ওসব কিচ্ছু হবে না। আমি বাবা বিশ্বনাথকে দিনরাত ডাকছি। সব ভালো হবে। আমরা ঠিক ফিরব, দেখো। ততদিনে আমাদের মেয়েদুটো কত বড় হয়ে যাবে!’
কৃষ্ণসুন্দর কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। হঠাৎ করে উপলব্ধি করলেন, মশাট গ্রামের যে বিশ্বনাথ মন্দিরের তিনি একনিষ্ঠ পূজারি ছিলেন, সেই বিগ্রহটিও তাঁর এখন পরিষ্কার মনে পড়ছে না।
নিষ্ঠুর বাস্তব তাঁকে সেসব স্মৃতি ভুলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।
তাঁর স্মৃতির কুঠুরি জুড়ে এখন শুধুই অত্যাচার, বঞ্চনা আর অপমান।
২২
ভুবনমণি পায়ে পায়ে এগিয়ে এল, অনুযোগের সুরে বলল, ‘নতুনদাদা, আপনি যে আমায় নতুন একটা কলম কিনে দেবেন বলেছিলেন? কই দিলেন না?’
‘কলম দেব না ছাই।’ দ্বারকানাথ মহাভারতে মুখ গুঁজে বসেছিলেন। বললেন, ‘এখনো ঠিক করে এ থেকে জেড লিখতে শিখলি নে, কলমের শখে গড়াগড়ি! বিধুর পুরোনো কলমেই লেখ।’
হিমানী মাটিতে বসে পুতুল খেলছিল। গত কয়েকদিন সে খুব অসুস্থ ছিল, বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারেনি। নতুন কিছু নয়, সে প্রায়ই অসুখে ভোগে। মেডিকেল কলেজের বড় ডাক্তারদের দেখানো হয়েছে, কিন্তু কোনো ওষুধেই সেভাবে কাজ হয়নি।
আজ শরীর কিছুটা ভালো হলেও সে খুব দুর্বল। চোখমুখও বসে গিয়েছে। তবু সে হঠাৎ দুই হাতে জোরে হাততালি দিয়ে বলে উঠল, ‘এ বাবা, পিছি লিকতে পালে না, পালে না। দিদি পালে, মা পালে, বাবা পালে, পিছি পালে না। হি হি।’
ভুবনমণি ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তার ভ্রু-দুটো কুঁচকে গিয়েছে। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি বলেছিলেন গড়গড় করে বাংলা পড়তে পারলেই কলম দেবেন। কই, ইংরেজির কথা তো তখন হয়নি? এতো কথার খেলাপ হচ্ছে। তুমিই বলো নতুন বউদিদি, আমি মিছে কতা কইছি? নতুনদাদা সেদিন একথা বলেননি? এখন উল্টো কথা কইছেন আর বাচ্চাটার কাছে আমার অপমান হচ্চে।’
কাদম্বিনী অদূরে বসেছিলেন। তার হাতে ক্রুশ আর কাঁটা। অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় তাঁর হাতদুটো লেসের নকশা বুনে চলেছে। ভুবনমণির কথায় এবার তিনি হেসে ফেললেন। কপট গম্ভীর হয়ে হাতের কাজ থামিয়ে স্বামীকে তিরস্কার করে বললেন, ‘ঠিকই তো। তুমি হিমুর কাছে ওর পিসিমা’কে ছোট করছ কেন?’
‘ছোট আমি কেন করব? ও নিজে কিছু জানলে তবে তো বড় হবে!’ দ্বারকানাথ চশমার ফাঁক দিয়ে তাকালেন, ‘বল তো, নারাচ মানে কী?’
ভুবনমণি ঠোঁট উলটে বলল, ‘কে না জানে! রাজি না হওয়াই হল নারাজ।’
‘সেই তো। তোমার মত গর্দভই এই কথা বলবে।’ দ্বারকানাথ কটমট করে তাকালেন, নারাজ নয়, নারাচ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ব্যবহৃত লোহার অস্ত্র। নর’কে গ্রাস করে, তাই নারাচ।
নারাচ বরিষে কত অতি খরসান,
অর্ধচন্দ্র ক্ষুরপাদি আর নানা বাণ।
এই সেদিন বললি, কালীপ্রসন্ন সিংহীর মহাভারত নাকি বিধু রোজ পড়ছিল, তুই শুনে শুনে সব জেনে গিয়েছিস। মিথ্যেবাদী কোথাকার!’
ভুবনমণি দমল না, রীতিমতো ফুঁসে উঠে বলল, ‘আচ্ছা বউদিদি তুমিই বলো, নতুন দাদা এখন মহাভারত পড়চেন আর সেখান থেকে পড়া ধরচেন। তেমন তো কথা হয়নি?’
‘সেই তো।’ কাদম্বিনী তৎক্ষণাৎ সায় দিলেন, ‘মহাভারতের কথা আসছে কোথা থেকে? তুমি তো সেদিন নিজেই বললে ভুবন বাংলা পড়তে পারলে তাকে কলম দেবে।’
‘বলেছিলাম বুঝি?’ দ্বারকানাথ স্ত্রী ও বোন মিলে একজোট হয়ে যেতে একটু ঘাবড়ে গেলেন। মুহূর্তে অপ্রস্তুত ভাব কাটাতে তর্ক জুড়লেন, ‘তা সেটাও ও পারবে নাকি? দুটো কথা বলতে গিয়ে তিনবার হোঁচট খায়। ওই তো, কাগজ পড়ে আছে, পড়ে দ্যাখাক দেখি!’
‘হ্যাঁ , দেখিয়ে দে তো তোর দাদাকে, ভুবন।’ কাদম্বিনী বললেন, ‘একেবারে উচিত জবাব দে। কলম না দিয়ে কোথায় যায় দেখব।’
ভুবনমণি গটগট করে হেঁটে গেল, তারপর তুলে নিল সংবাদপত্রটা। জোরে জোরে পড়তে শুরু করল, ‘স্বনামধন্য আয়ুর্বেদাচার্য শ্রী জটাপ্রসন্ন কবিরাজ প্রণীত শকুন্তলা তৈল। প্রত্যহ মাখিলে কেশ হইবে পুরাণের ঋষিতনয়া শকুন্তলার কেশের ন্যায় সুদীর্ঘ, সুবিন্যস্ত ও সুন্দর। আজই ক্রয় করুন। মূল্য দুই পয়সা প্রতি শিশি মাত্র।’
‘দেখলে? দেখলে ভুবন কী সুন্দর পড়ল? এবার ওকে কলম দাও।’ কাদম্বিনী ঝুঁকে পড়ে এমন ভঙ্গিতে হাত বাড়ালেন, যেন তাঁর স্বামী রাশি রাশি কলম নিয়ে বসে রয়েছেন, চাওয়ামাত্র দিয়ে দেবেন একখানা।
কিন্তু দ্বারকানাথ ভাঙবেন, তবু মচকাবেন না। বললেন, ‘ও তো বিজ্ঞাপন। প্রতিদিনই এক লেখা বেরোয়। আগেই পড়া ছিল, তাই এখন আর আটকায়নি। নতুন কোনো খবর পড়ুক দেখি, তবে তো বুঝব।’
তিতিবিরক্ত ভুবনমণি এবার আর অপেক্ষা করে না। বিজ্ঞাপনের পাশের সংবাদটি জোরে জোরে পড়তে শুরু করে,
‘শ্রীমতী কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় এবার কলিকাতা মেডিকেল কলেজের বি. এ. এম.বি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে পারিলেন না। মিরর বলেন, স্ত্রীলোকদিগের জন্য পরীক্ষা কিছু সহজ হওয়া আবশ্যক। কিন্তু নিম্ন পরীক্ষাগুলিতে স্ত্রীলোকগণকে অধিক অনুগ্রহ করা হয় বলিয়া উচ্চ পরীক্ষাতেও সেইরূপ করিতে হইবে, তাহার কোনো কথা নাই। বাস্তবিক ডাক্তারির মতো উচ্চশিক্ষায় স্ত্রীলোকদিগের উপর এত অধিক অনুগ্রহ দেখাইলে সুশিক্ষিতা স্ত্রীলোক অল্পই মিলিবে।’
ভুবনমণি প্রথমেই তার নতুন বউদিদির নাম পেয়ে আরো বেশি উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়তে শুরু করেছিল, কিন্তু আনকোরা পাঠাভ্যাসের দরুন পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ঙ্গম করার সমান্তরাল বিদ্যাটা সে এখনো সেভাবে আয়ত্ত করতে পারেনি।
যখন পারল, তখন বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে যে কারণে বাড়ির পরিবেশ কিছুটা নিস্তব্ধ, নিজের অজান্তেই সে আবার সেই বিষাদসাগরে ঢিল ছুড়েছে। অনেকদিন বাদে ইদানীং কাদম্বিনী একটু সহজ হয়েছিলেন, অবসাদ কাটিয়ে হাসিঠাট্টা করছিলেন কাছের মানুষদের সঙ্গে।
ভুবনমণির অত্যুৎসাহে তাঁর সেই হাসিমুখে আবার মেঘ জমল।
কাদম্বিনী যে মুহূর্তে উপলব্ধি করেন তাঁর অশ্রুগ্রন্থি কাজ শুরু করতে চলেছে, স্বভাবসিদ্ধ দৃঢ়তায় তিনি মনোনিবেশ করেন লেস বোনায়। তবু, না চাইতেও তাঁর মনে পড়ে যায় অনেক কিছু।
তিন বছর আগে যখন কাদম্বিনী আইনের ফাঁক গলে ডাক্তারিতে ভর্তি হয়েছিলেন, বহুদিক থেকে ধেয়ে এসেছিল বিরোধিতা।
বিরোধিতার মূল কারণ নারী-পুরুষের একইসঙ্গে মেলামেশা। তার কিছু আগে কাদম্বিনীর সহপাঠিনী অবলা কলকাতায় সুযোগ না পেয়ে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলেন মাদ্রাজে। সেখানে এক সার্জারির অধ্যাপক কীভাবে একটি মেয়েকে মানব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান দেবেন, তাই নিয়ে অনেক ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।
বোম্বাইয়ের অবস্থা তো আরো করুণ। সেখানে ছাত্রীরা পড়ার সুযোগ পেলেও সহপাঠী ছাত্রদের ক্রমাগত টিটকিরি, শিস দেওয়া, ঢিল ছোড়ায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। অসভ্যতা করার জন্য এক ছাত্রকে কলেজ কর্তৃপক্ষ বিতাড়ন করলে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হয়।
আর কলকাতায়? মেয়েদের ডাক্তারি শিক্ষায় মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডঃ কোটস সম্মতি দিলেও একাধিক অধ্যাপক এর বিরোধিতা করেন। আর তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন মেডিসিনের অধ্যাপক ডঃ রাজেন্দ্র চন্দ্র চন্দ্র। তিনি নিজে বিলেত থেকে পাশ করে আসা চিকিৎসক এবং পুরোপুরি পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়েও মেয়েদের ডাক্তার হওয়ার ব্যাপারে তাঁর পুরুষতান্ত্রিক অহংবোধ যেন ‘কালাপাহাড়’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নানারকম অদ্ভুত যুক্তি দেখিয়ে তিনি কাদম্বিনীকে আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অধ্যক্ষ কোটস এবং সিন্ডিকেটের যুগ্ম সিদ্ধান্তে তাঁর সেই উদ্দেশ্য ফলপ্রসূ হয়নি।
এই তিন বছরেও কাদম্বিনী লক্ষ্য করেছেন, ডঃ চন্দ্র তাঁর প্রতি যেন অসম্ভব রূঢ়। অন্যান্য ছাত্ররা কোনো প্রশ্ন করলে ডঃ চন্দ্র উৎসাহের সঙ্গে বোঝাতেন, আর কাদম্বিনীর প্রশ্নে কেমন যেন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে পাশ কাটিয়ে যেতেন। কারণে অকারণে হেয় করতেন তাঁকে।
আর আশ্চর্যভাবে অন্যান্য সমস্ত পেপারে কাদম্বিনী ভালো মার্কস পেলেও মেডিসিনের প্র্যাকটিকাল পরীক্ষায় মাত্র এক নম্বরের জন্য উত্তীর্ণ হতে পারলেন না। যে পেপারের পরীক্ষক ছিলেন স্বয়ং ডঃ চন্দ্র।
কী আশ্চর্য সমাপতন! যে সংবাদপত্ররা এতদিন কাদম্বিনীর মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করে এসেছে, তাঁর এন্ট্রান্স, এফ.এ, বি.এ, একটার পর একটা বাধা টপকাতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ভূষিত করেছে ‘সরস্বতী’ অভিধায়, তারাই এখন মাঠে নেমে পড়েছে ‘মেয়ে মাত্রই বুদ্ধিহীন’ প্রমাণ করতে।
তারা একবারও এটা জানার চেষ্টা করল না যে, এই তিন বছরে মেডিসিনে কাদম্বিনীই গোটা ক্লাসের মধ্যে সেরা ছিলেন।
আর যাই হোক, মেডিসিনে তিনি কিছুতেই অকৃতকার্য হতে পারেন না।
দ্বারকানাথ মুহূর্তে বুঝে ফেললেন ব্যাপারটা। বললেন, ‘এইসব খবরের কাগজগুলোর কোনো মর্যালিটি নেই। লোকজনের বাহবা কুড়নোর জন্য যাহোক তাহোক লিখে দিলেই হল।’
‘ভুল তো কিছু লেখেনি।’ মৃদুস্বরে বললেন কাদম্বিনী, ‘অনুগ্রহ তো সত্যিই করা হল আমাকে। এম.বি হলাম না ঠিকই, কিন্তু ডঃ কোটস আর সিন্ডিকেট তো যৌথভাবে আমাকে এল.এম.এস সার্টিফিকেট দিয়েছেন। তা দিয়েও আমি প্র্যাকটিস করতে পারব। এটা তো অনুগ্রহই।’
‘মোটেই নয়।’ দ্বারকানাথ কড়াসুরে বললেন, ‘এটা হল নিজেদের একজন অধ্যাপকের কুকীর্তি ঢাকতে তড়িঘড়ি ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা। ডঃ চন্দ্র যে তোমার প্রতি অন্যায় করেছেন, সেটাকে একটা জঘন্যমানের প্রতিহিংসা বলা চলে। তুমি কতটা মনোযোগী ছাত্রী ছিলে, সেটা গোটা মেডিকেল কলেজ জানে। এই তিনবছরে হিমু বারবার রোগে ভুগেছে। তুমি সেইজন্য সারারাত জেগে থাকলেও একদিনও কামাই করোনি। নির্মল আর নিরুপমা হয়েছে। তাদের জন্মের সময়েও তুমি আগেরদিন পর্যন্ত কলেজ করেছ। প্রসবের তিন-চারদিনের মাথায় আবার ফিরে গিয়েছ কলেজে। মেডিকেল কলেজ তার একমাত্র ছাত্রীর জন্য একটা আলাদা ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা পর্যন্ত করতে পারেনি। কমন রুম তো ছেড়েই দাও। দুই ক্লাসের গ্যাপে তোমাকে শয়ে শয়ে কৌতূহলী চোখের মাঝে কাঠফাটা রোদ্দুরে গাছতলায় বসে থাকতে হয়েছে। কেউ ভাবতে পারে? গোটা তিনবছরের কোর্সে তোমার মাত্র তেরোদিন কামাই। কটা ছাত্র তোমার মতো সিনসিয়ার ছিল, দেখাও দেখি আমায়?’
কাদম্বিনী নিরুত্তর রইলেন। কিছু প্রশ্নের সত্যিই কোনো জবাব হয় না।
ভুবনমণি অপরাধীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মুহূর্তের ভুলে হাস্যোজ্জ্বল পরিবেশটা বাড়ি থেকে মুছে গেল। তার জন্য নতুন বউদিদি আবার কষ্ট পেল।
কী প্রয়োজন ছিল তার, কলমের প্রসঙ্গ তোলার? নিজের পূর্বজন্মের অসীম পুণ্যের ফলে সে যে এমন একটি বাড়ির সদস্য হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, মশাট গ্রামের সেই অন্ধকারে নিমজ্জিত ভয়ঙ্কর দিনগুলোর অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে, এ-ই কি তার পক্ষে পরম পাওয়া নয়?
সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বলল, ‘আজ মোহনভোগ করব ভাবচি। হিমুটা ক’দিন খালি সাগু খেয়েচে, মুখের রুচিটা কাটবে। কী করে করব, এট্টু বলে দাও না নতুন বউদিদি?’
কিন্তু দ্বারকানাথ আর কাদম্বিনী যেন শুনতেই পেলেন না ওর প্রশ্নটা। হতাশ ভুবনমণি হিমানীকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
দ্বারকানাথ বললেন, ‘আর তোমাকে অধ্যক্ষ যে ডিগ্রিটা দিয়েছেন, সেটা ওঁর ক্ষমতার মধ্যেই পড়ে। উনি তোমাকে উপযুক্ত মনে করেন বলেই ডাক্তারি করার অধিকার দিয়েছেন এবং ইডেন হাসপাতালে চাকরিটাও দিয়েছেন।’
কাদম্বিনী ম্লান মুখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘সেসব কেউই বুঝবে না গো। সবাই শেষ ফলাফল দেখে। আর সেখানেই আমি হেরে গিয়েছি। ইডেন হাসপাতালে ক’দিন চাকরি করলাম, এখন লেডি ডাফরিন হাসপাতালেও করছি। কিন্তু আমার মনের খিদে কী মিটছে বলো? নামেই আমি ডাক্তার, কাজ তো করছি নার্সের! এ যে কত বড় অপমান, তা আমিই জানি।’
দ্বারকানাথ এইবার চুপ করে গেলেন। কাদম্বিনীকে উজ্জীবিত করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই তার সবচেয়ে ব্যথার স্থানে আঘাত করে ফেলেছেন তিনি।
কথাটা মর্মন্তুদ হলেও অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।
গভর্নর জেনারেল লর্ড ডাফরিনের স্ত্রী লেডি ডাফরিনের নামে গোটা দেশে যে বারোটি মহিলা হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছে, তাতে যে কয়েকজন হাতে গোনা মহিলা চিকিৎসক রয়েছেন, কাদম্বিনী ছাড়া তাঁরা সকলেই ইংরেজ বা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। এবং তাঁরা কিছুতেই একজন নেটিভ মহিলাকে সমমর্যাদা দিতে রাজি নন। যতই কাদম্বিনীর এম.বি ডিগ্রি না থাকাটাকে অজুহাত হিসেবে তুলে ধরা হোক না কেন, তা একেবারেই ঠুনকো। কারণ এগারোজন বিদেশিনীর মধ্যে কয়েকজনের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা ছাড়া কোনো প্রথাগত ডিগ্রিই নেই, কাদম্বিনীর মতো তিনবছর ক্লাস করে এল.এম.এস পাওয়া তো দূরের কথা। তবু তাঁরা রোগ বিশ্লেষণ করে চিকিৎসা করছেন। আর কাদম্বিনীকে দিয়ে করানো হচ্ছে সেবিকার কাজ। মাসিক মাইনেও তুলনায় তাঁকে দেওয়া হচ্ছে অনেক কম।
দাঁতে দাঁত চেপেন কাদম্বিনী। সার্জারিতে কত ভালো হাত ছিল তাঁর। ছাত্রী থাকাকালীনই কয়েকটি অপারেশনে সার্জনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দারুণ সুন্দর কাজ করেছিলেন তিনি। তবু ঘটনার পাকেচক্রে সেই শল্যচিকিৎসাই ভুলতে বসেছেন তিনি।
দ্বারকানাথ বললেন, ‘তুমি বলেছিলে হাসপাতাল কমিটিকে কী একটা প্রোপোজাল দেবে। সেটার কী হল?’
‘দিয়েছিলাম।’ কাদম্বিনী বললেন, ‘বলেছিলাম, আমাকে যে কোনো একটি ওয়ার্ডের পুরো দায়িত্ব দেওয়া হোক, আমার কোনো মাইনেও চাই না, আমি এমনিই সেই দায়িত্ব পালন করব। তাতে অন্যান্য ডাক্তারদের সঙ্গে ক্ল্যাশও হবে না, আবার আমিও ভালভাবে প্র্যাকটিস করতে পারব।’
‘তাতে ওঁরা কী বললেন?’ দ্বারকানাথ চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘মাইনে দিতে হবে না শুনেও বরফ গলল না?’
‘না।’ কাদম্বিনী দুদিকে মাথা নাড়ালেন, ‘মিস ফিগো ওয়ার্ড ইন চার্জ। উনি কমিটিতেও আছেন। আমাকে ও যদি অন্য কোনো ওয়ার্ডের ইন চার্জ করে দেয়, তবে তো আমি ওঁর অধীনে থাকব না। একজন ভারতীয় হয়ে ব্রিটিশ উপনিবেশে আমি কী করে স্বাধীনভাবে কাজ করব!’
‘আশ্চর্য! অথচ ডাফরিন হাসপাতালের ফান্ডের অবস্থা খারাপ, সব জায়গায় গ্রান্ট চাইছে। কোথায় তুমি বিনা মাইনেতে কাজ করতে চাও শুনে ওরা উৎসাহী হবে, তা নয়…!’ দ্বারকানাথ নিজের উষ্মা চাপতে পারলেন না।
‘কিছু করার নেই।’ কাদম্বিনী আবার একটা চাপা নিঃশ্বাস ফেললেন, ‘এইভাবেই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। ডাক্তার যখন হয়েছি, রুগি আমি দেখবই। সেটা হাসপাতালে না হোক, প্রাইভেটে।’
‘সে তো আমি তোমাকে আগেই বলেছি। বাড়িতেই চেম্বার করো। রুগিরা সঠিক চিকিৎসা পেলে নাম আপনা থেকেই ছড়িয়ে পড়বে।’ কাদম্বিনীর অনমনীয় জেদে দ্বারকানাথ আবারও মুগ্ধ হলেন, ‘তবে হ্যাঁ । একটা কথা আবারও বলছি। যতই সুনাম হোক, তোমাকে এখানে থেমে গেলে চলবে না কাদম্বিনী। বিলেত তোমায় যেতেই হবে। আনতে হবে বিলিতি ডিগ্রি। ঝামা ঘষে দিতে হবে ওই চন্দ্রর মুখে। দেখিয়ে দিতে হবে, মেডিকেল কলেজের একচোখোমিতে তোমার কিচ্ছু যায় আসে না, তার চেয়ে অনেক বড় ডিগ্রি নিয়ে তুমি ফিরেছ। এযে আমার কত বড় স্বপ্ন, তা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না!’
কাদম্বিনী কিছু না বলে তাকিয়ে রইলেন তাঁর আঠারো বছরের বড় স্বামীর দিকে।
ব্রাহ্মসমাজের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা, বাইশ বছরের শিক্ষিতা সুন্দরী কাদম্বিনী যখন বিপত্নীক দ্বারকানাথকে বিবাহ করেছিলেন, তখন বহু যুবকের হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল। অসবর্ণ সেই বিবাহে সমাজে উঠেছিল নানারকম নিন্দার ঝড়। রাগে অনেক ব্রাহ্ম যুবক বিবাহের নিমন্ত্রণে পর্যন্ত আসেননি।
তারপর থেকে আজ এতবছর কেটে গিয়েছে। দ্বারকানাথের তিন-তিনটি সন্তানের জননী হয়েছেন তিনি। পেরিয়েছেন ডাক্তারি শিক্ষার মহাসমুদ্র। প্রতিনিয়ত এসেছে নানা প্রতিকূলতা, ঝঞ্ঝা, বিরোধ।
দ্বারকানাথকে জীবনসঙ্গী হিসেবে না পেলে তিনি কি পারতেন এত যুদ্ধ করতে? তিনি যখন রাত জেগে পড়েছেন, দ্বারকানাথ বাচ্চাদের দেখাশোনা করেছেন, রান্না করেছেন।
তিনি যখন পরীক্ষা দিয়েছেন, দ্বারকানাথ একা হাতে সামলেছেন এত বড় পরিবারের দায়দায়িত্ব।
‘কী ভাবছ কাদম্বিনী?’ দ্বারকানাথ হঠাৎ কাদম্বিনীর নীরবতায় কাতর হয়ে পড়েন, ‘তুমি আমার স্বপ্ন সত্যি করবে না? আমি যে সেইজন্য এখন থেকে সঞ্চয় করে চলেছি। তুমি পড়তে যাবে না বিলেতে? ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভেবো না। আমি আছি। বিধু আছে। আমরা সব সামলে নেব।’
কাদম্বিনী তখনো নিজের ভাবনায় ডুবেছিলেন। গোটা ভূভারতে এমন স্বামী ক’জন আছেন, যিনি স্ত্রীকে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে পাঠাতে এত উদগ্রীব?
সেদিন যারা তাঁদের বিবাহে গেল গেল রব তুলেছিল, প্রেমজ এই বিবাহের নিন্দায় মুখর হয়েছিল, তাঁরা আজ নীরব। দ্বারকানাথ-কাদম্বিনী এক আশ্চর্য আদর্শ দম্পতি। অদ্ভুত সমতায় মোড়া তাঁদের জীবন। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ভরা অদ্ভুত তরঙ্গে প্রবহমান তাঁদের সম্পর্ক।
যে সম্পর্কের সবচেয়ে শক্ত সুতো নিঃশর্ত ভালোবাসা।
তিনি স্বামীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলেন। তারপর বললেন, ‘যাব। নিশ্চয়ই যাব। আগে যে আসছে, সে ভালোভাবে পৃথিবীতে আসুক! সে যে আমাদের চতুর্থ সন্তান।’
২৩
বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন পার্সি সমাজসংস্কারক মালাবারি পশ্চিম ভারত থেকে শুরু করেছিলেন, অচিরেই সেই জোয়ারের ঢেউ এসে ভাসিয়ে দিয়ে গেল আসমুদ্রহিমাচল সহ রাজধানী কলকাতাকে।
আন্দোলনকারীদের চাপে পড়ে বড়লাট ডাফরিন গোটা বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য একটা অনুসন্ধান কমিটি গঠন করলেন। কমিটি রিপোর্ট দিল, নতুন কোনো আইন প্রণয়ন না করা হলে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব নয়।
কিন্তু সতীদাহ, বিধবা বিবাহের পর সমাজ সংস্কার সংক্রান্ত কোনো আইন প্রণয়নে ব্রিটিশ সরকার এখন বেশ দ্বিধাগ্রস্থ। তারা একটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝেছে, এই দেশের মানুষ নিজেদের চলে আসা ঐতিহ্য, তা সে যতই অভিশাপসম হোক, পুণ্যের দোহাই দিয়ে সেগুলোর লোপ চায় না। রে রে করে ওঠে।
এক্ষেত্রেও তাই হল। রক্ষণশীলরা ধর্মনাশের আশঙ্কায় হইচই শুরু করে দিলেন। কেউ কেউ এগিয়ে এলেন শাস্ত্রীয় প্রমাণ নিয়ে।
রাণাঘাটের সুরেন্দ্রনাথ পালচৌধুরী বলে এক ভদ্রলোক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটা বাংলা বই ছাপিয়ে বিতরণ করতে শুরু করলেন। সেই নাতিদীর্ঘ পুস্তকের ছত্রে ছত্রে সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করে লেখা কীভাবে স্ত্রীর প্রথম ঋতুকালে এবং অন্তত একটি পুত্রসন্তান না হওয়া পর্যন্ত সহবাস না করলে পুরুষের পাপ হয়। বিবাহের পূর্বে কোনো কন্যা রজঃস্বলা হলে তা কত বড় পাপ ইত্যাদি আরো নানা বক্তব্য।
নবদ্বীপের এক ব্রাহ্মণ বললেন, ‘ভারত গ্রীষ্মপ্রধান দেশ। এখানকার মেয়েরা নয়দশ বছরেও ঋতুমতী হয়ে পড়ে। সাহেবদের দেশের সঙ্গে তুলনা করলে তো চলবে না। ল্যাপল্যান্ড বলে ওদের যে দেশ, তাতে তো শুনি মেয়েদের মাসিক হয় কুড়ি বছর বয়সে। তাহলে এখানেও কি তাই করতে হবে? হিন্দু শাস্ত্র বলে, পুষ্পিত নারীতে যে পুরুষ গমন করে, অচিরেই তার বুদ্ধি, তেজ, বল, পরমায়ু নষ্ট হয়ে যায়। সাহেবরা দেশ চালাচ্ছে, সেটাই চালাক, আমাদের ধর্মে বারবার নাক গলানো কেন?’
মনোমোহন ঘোষ নিশ্চুপ বসে থাকলেন না। তিনি ব্রাহ্ম যুবকদের একত্রিত করে ডাক দিলেন এই আইন প্রণয়নের স্বপক্ষে পা মেলানোর। তাঁর মামাতো বোন কাদম্বিনী ও দ্বারকানাথ তাঁকে সর্বতোভাবে সমর্থন করলেন।
সেই কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ল সৌরেন্দ্রও। সে এখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র। থাকে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতেই। পড়ার সময় বাঁচিয়ে আইনের স্বপক্ষে সে কড়া কড়া প্রবন্ধ লিখতে লাগল নরেন্দ্রনাথ সেনের ‘ইন্ডিয়ান মিরর’-এ।
একদল গ্র্যাজুয়েট আইনের বিরুদ্ধে স্টার থিয়েটারে সভা ডাকল, সেই সংবাদ পেয়ে সৌরেন্দ্র লিখল, ‘এই সভা বাংলার লজ্জা। আরো লজ্জাজনক, সভায় মেডিকেল ও ল’ গ্র্যাজুয়েটদের উপস্থিতি।’
কিন্তু সহবাস সম্মতি আইনের সম্ভাবনা যত উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগল, ততই বিরোধীরা গলা তুলতে লাগল।
প্রতিবাদে গলা তুললেন বিখ্যাত মারাঠা নেতা বাল গঙ্গাধর তিলকও।
‘যা একান্তভাবে আমাদের ঘরের ব্যাপার, তাতে বিদেশি সরকারকে টেনে আনা কেন? আমরা চাইছি বিদেশিদের দেশ থেকে তাড়াতে, এদিকে সমাজ সংস্কারের জন্য তাদেরই আইনের শরণাপন্ন হচ্ছি। এটা অপমানজনক।’
তিলকের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না আরেক নেতা রাণাডে।
‘সতীদাহ, চড়কে বানফোঁড়া এইসব অনাচারও তো আইন করেই বন্ধ হয়েছে। তাহলে বাল্যবিবাহই বা আইন করে নিষিদ্ধ করা যাবে না কেন? এতো আর বিদেশিদের চাপিয়ে দেওয়া কোনো আইন নয়, দেশের মানুষের ভালোর স্বার্থে আইন।’
কিন্তু ব্রিটিশ সরকার দ্বিধাগ্রস্থ। যারা নিজেরাই নিজেদের ভালো চায় না, আলোকপথে হাঁটতে চায়û না, বিদেশি শাসক হিসাবে তাদের কী দায় পড়েছে তেমন সমাজের সংস্কার করার?
সরকার তাই নতুন আইনের দিকে সেভাবে এগোলেন না, মালাবারিকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে অপেক্ষা করতে বললেন।
কিন্তু মালাবারি নিশ্চুপ বসে থাকার মানুষ নন। একের পর এক প্রতিবাদেও যখন কিছু হচ্ছে না, তিনি সটান চললেন বিলেতে, খোদ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে নিজের আর্জি নিয়ে। বিলেতে বসেই লিখলেন তাঁর বিখ্যাত আবেদন, ‘Appeal on behalf of the daughters of India.’
ওদিকে মালাবারির আরেক সহযোগী দয়ারাম গিডুমল আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন দেশে বসে। তিনি ১৮৬০ সালের একটি পুরোনো আইন তুলে আনলেন জনসমক্ষে। সেই আইনে বলা ছিল, দশ বছরের কম বয়সি কোনো মেয়ের সঙ্গে সহবাস করলে তা হবে দণ্ডনীয় অপরাধ।
গিডুমল বললেন, নতুন আইনের ঝামেলায় না গিয়ে এই আইন সংশোধন করে দশের বদলে বারো করলেই তো মিটে যায়। বিবাহ হোক বা না হোক, বারোবছরের কম হলে সহবাস করা চলবে না।
ইংরেজ সরকার ভাবলেন, হ্যাঁ , এই বেশ। এতে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। প্রতিরোধও কম হবে।
কিন্তু বাস্তবে তা হল না। পেনাল কোড সংশোধন করে সহবাসের ন্যূনতম বয়স বারো হওয়ার সংবাদে আবার ‘গেল গেল’ রব উঠল চারপাশে। ‘বিপন্ন হিন্দুধর্ম’ স্লোগানে ভরে গেল দেশ। সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধ বাংলায় আর মহারাষ্ট্রে।
মহারাষ্ট্রে এই আইনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন স্বয়ং তিলক। তাঁর ‘মারাঠা’ এবং ‘কেশরী’ পত্রিকায় তিনি মালাবারির দাবির বিরুদ্ধে লিখতে শুরু করলেন।
বাংলাতে ঝড়ের তীব্রতা আরো বেশি।
কেউ লিখল,
‘ওহে লর্ড ল্যান্সডাউন! কেন কেন তুমি ভ্রমেতে ডুবিয়া।
করিলে ধর্মের লোপ নীরবে বসিয়া।।
গর্ভধানে ধর্মনাশ হইবে দেখিয়া,
মন দুঃখে কাঁদে সব কাতরে ডাকিয়া।।’
দৈনিক সমাচার চন্দ্রিকা লিখল, ‘সহবাস সম্মতি আইন পাশ হলে ধর্মলোপ পাবে। হিন্দু মেয়েরা পাপে প্ররোচিত হবে। হিন্দুদের কাছে ঐহিক জীবনের চেয়ে মরণোত্তর জীবন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যবান সন্তানলাভই কী সব হল?’
কাগজে লেখালেখি তো বটেই, প্রহসনে ছেয়ে গেল বাংলা। বউবাবু নামে একটি ব্যঙ্গাত্মক প্রহসনে লেখা হল, ‘কিশোরীর বদলে যুবতী স্ত্রী বারবনিতা বিবাহের সামিল। কেননা, প্রাপ্তবয়স্কা হইলে কন্যা দূষিত হইতে বাধ্য।’
আইনের স্বপক্ষেও যে গান লেখা হল না তা নয়।
ডুবিল সোনার দেশ পাপের সাগরে
পরিপূর্ণ দশ দিক ঘোর অন্ধকারে
মহাপাপ শিশু বিয়ে এদেশে প্রবেশ পেয়ে
ছারখার করিল রে স্বর্ণভারতেরে।
তবে রক্ষণশীলরা সংখ্যায় অনেক ভারী। জনাই গ্রামের পাঁচকড়ি মুখোপাধ্যায়ের মতো ব্রাহ্মণরা মুহুর্মুহু সভার আয়োজন করতে থাকলেন। সেখানে প্রাচীন কবিরাজদের দিয়ে উদ্ধৃত করা হতে থাকল নানা শাস্ত্রীয় বচন।
হিন্দু প্যাট্রিয়টে লেখা হল, সহবাস সম্মতিতে মেয়েদের কোনো মূল্যই নেই, কারণ হিন্দু বিবাহে পিতা স্বামীর হাতে কন্যাকে সম্প্রদান করেন।
সৌরেন্দ্র সেদিন ঘরে বসে হিন্দু প্যাট্রিয়টের ওই প্রবন্ধের প্রতিবাদে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় একটা সমালোচনা লিখছিল।
‘হায়! ভাগ্যে হরিশচন্দ্র জীবিত নেই, নিজের সংবাদপত্রের এই লজ্জাজনক অবস্থানে তিনি আঁতকে উঠতেন।’
এখুনি তার বন্ধু রবি আসবে। সে এলে তাকে দিয়ে সে একবার সংশোধন করিয়ে নেবে লেখাটা। রবি মূলত কবি হলেও তার লেখার ভাষা খুবই সুললিত। একইসঙ্গে শাণিত। আজকাল তাদের মধ্যে বেশ সখ্যতা হয়েছে। অবসর পেলেই দুই বন্ধু নানা বিষয় নিয়ে গল্পে মেতে ওঠে। বাংলা সাহিত্যজগতে রবি উল্কার গতিতে উদিত হচ্ছে। এর মধ্যেই তার অসংখ্য গুণমুগ্ধ অনুরাগী।
কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে তার বিরোধীপক্ষও। রবির কোনো একটা কবিতা বা উপন্যাস প্রকাশিত হলেই স্বনামে বা বেনামে তা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে যায়। সেই সমালোচনার অধিকাংশই ব্যক্তিগত আক্রমণ বা কুৎসা।
বিশেষত গতবছর রবির কন্যা মাধুরীলতা জন্মানোর একমাসের মধ্যেই ‘কড়ি ও কোমল’ নামে যে কাব্যসংকলনটা প্রকাশিত হয়েছে, তা নিয়ে সাহিত্যমহলে উপহাস, ব্যঙ্গোক্তির শেষ নেই। রবির কবিতায় তৎসম শব্দের সঙ্গে তৎভব ও ইংরেজি শব্দের মিশ্রণে ছদ্মনামের আড়ালে বিদ্রূপ তো বটেই, আক্রমণও চলছে প্রবলভাবে। অসংখ্য ছোটবড় পত্রিকার যেন বেঁচে থাকার কারণই রবিকে আঘাত করা।
কেউ সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মালে সেটা কি তার দোষ? কিন্তু সেটা লোকে মেনে নিতে পারে না। রবির সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে তারা প্রায়ই তার বংশকেও কটাক্ষ করে।
রবি নরম স্বভাবের। বিদ্রূপাত্মক সমালোচনা প্রকাশিত হলেই তার মনখারাপ হয়ে যায়। কখনো কখনো যে সেই সমালোচনার প্রত্যুত্তর পাঠায় না, তা নয়, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৌন থেকে ভেতরে গুমরোয়।
সৌরেন্দ্র তার এই গুণী বন্ধুটিকে বোঝায়, ‘পথে পড়ে থাকা প্রতিটি নুড়ির ঠোক্করে কষ্ট পেলে হবে? তোমাকে যে অনেকদূর যেতে হবে রবি! এরা একসময় চুপ হয়ে যাবে। কিন্তু রবিকে যে আকাশে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে হবে।’
সৌরেন্দ্রর এই সব কথায় রবি কখনো কখনো উজ্জীবিত হয়। কখনো আবার কিছুই না বলে উদাস হয়ে বসে থাকে।
ভুবনমণি এসে ডাকল, ‘শুনছেন?’
‘কী?’ মুখ না তুলেই বলল সৌরেন্দ্র।
‘নতুন বউদিদি বললেন, উনি ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের বক্তৃতা শুনতে যাবেন বিকেলে। ওই কি নতুন আইন আসছে, তাই নিয়ে। তা আপনি কি সঙ্গে যাবেন? পাস আছে।’
সৌরেন্দ্র উজ্জ্বল মুখে তাকাল।
কাদম্বিনী ডাক্তারি পাশ করার পর এখন শহরের অন্যতম এক আলোকবর্তিকা। ছোটবড় সভায় তিনি নিজে আমন্ত্রিত হন একমাত্র মহিলা হিসেবে। এই কয়েকমাসে সৌরেন্দ্রর সঙ্গে তাঁর অদ্ভুত এক সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। শুধু কলেজের সিনিয়র হিসাবেই নয়, কাদম্বিনীর সমাজ, রাজনীতি, জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সহজ অথচ দৃঢ়প্রত্যয়ী চিন্তাভাবনা দেখে সৌরেন্দ্র মুগ্ধ হয়।
দ্বারকানাথও অতুলনীয়, কিন্তু তিনি যেন অনেক দূরের এক গ্রহ, অন্য উচ্চতায় অবস্থান করেন। তাঁর কাছে যাওয়া অত সহজ নয়। তুলনায় কাদম্বিনী অনেক বেশি প্রাণখোলা। অনেক বেশি মনের কাছাকাছি।
মনে মনে ইতিমধ্যেই সৌরেন্দ্র কাদম্বিনীকে নিজের দিদির আসনে বসিয়ে ফেলেছে।
সে উৎসাহিত কণ্ঠে বলল, ‘ডাঃ সরকারের বক্তৃতা? দিদি যাচ্ছেন বুঝি? আমি অবশ্যই যাব।’
‘তবে আমি গিয়ে বলে দিচ্চি। বিকেলে তৈরি হয়ে থাকবেন।’
ভুবনমণি প্রস্থানোদ্যত হতেই সৌরেন্দ্র ডাকল, ‘ভুবন।’
‘কী?’ ভুবনমণি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
সৌরেন্দ্র একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘তুমি কি জানো, আমরা কীসের ওপর বক্তৃতা শুনতে যাচ্ছি?’
ভুবনমণি ভ্রূ কুঞ্চিত করল, ‘আমি কেমন করে জানব?’
‘অনুমান থেকেই বলো না কিছু।’
ভুবনমণি খানিক ভেবে বলল, ‘ডাক্তারির কোনো বিষয় নিয়ে? কোনো কঠিন অসুখের ওষুধ আবিষ্কার নিয়ে হয়ত।’
সৌরেন্দ্র চমৎকৃত হল। প্রথম যেদিন সে এই বাড়িতে পা রেখেছিল, সেদিন এই সদ্যতরুণী বিধবাটিকে দেখেছিল দ্বারকানাথের পায়ের কাছে বসে ইংরেজি অক্ষরচর্চা করতে। মেয়েটির অতীত সম্পর্কে সে বিশেষ কিছু জানে না। শুধু উপেন্দ্রকিশোরের কাছে শুনেছিল, সম্পর্কে ভুবনমণি দ্বারকানাথের বোন হয়।
তারপর এই কয়েকমাসে প্রতিদিন একাধিকবার দুজনের সাক্ষাৎ হয়েছে। কখনো ভুবনমণি এসে ঘরে খাবার দিয়ে গিয়েছে, কখনো বৈঠকখানায় কাদম্বিনীর সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে সে দেখেছে ভুবনমণি নিজের খেয়ালে ঘরের এককোণে বসে বই পড়ছে। পড়তে পড়তে কখনো কোনো প্রশ্ন করছে, কাদম্বিনী বা দ্বারকানাথ তা সহজ করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন তাকে। কাদম্বিনী কোথাও ‘কল’ পেয়ে রুগি দেখতে গেলে তাঁর ব্যাগ হাতে ভুবনমণি সঙ্গী হচ্ছে।
কিন্তু আজ সে উপলব্ধি করল, এই অমরাবতীসম বাড়িতে স্থান পেয়ে শুধু তারই উত্তরণ হয়নি, উত্তরণ হয়েছে এই মেয়েটিরও। স্বভাবচাপল্য কমে গিয়ে তার মধ্যে একটি স্থিতধী ভাব এসেছে, চোখের মধ্যে প্রচ্ছন্নবুদ্ধির আভাষ। ভুবনমণি বক্তৃতার বিষয় সম্পর্ক অবগত না হলেও ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের নাম ও তাদের দুজনের আগ্রহ থেকে এইটুকু অনুমান করেছে সম্ভবত সেটি কোনো ডাক্তারিবিদ্যার বক্তৃতা।
‘না। ডাক্তারি নয়। আমাদের দেশে সম্প্রতি একটা আইন নিয়ে খুব গন্ডগোল হচ্ছে। এক দল বলছে আইনটা পাশ হোক, অন্য দল তা কিছুতেই হতে দেবে না। ডাঃ সরকার আজ সেখানে আইন পাশের স্বপক্ষে বক্তৃতা দেবেন।’ সৌরেন্দ্র একটু থেমে বলল, ‘আমরাও ডাঃ সরকারের পক্ষে। তাই আমরা তাঁর বক্তব্য শুনতে যাব।’
ভুবনমণি মনোযোগ সহকারে শুনছিল। সৌরেন্দ্র থামতেই বলল, ‘কী নিয়ে আইন?’
‘সরকার আইন করে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে চাইছেন।’ সৌরেন্দ্র চেষ্টা করেও সহবাস সম্মতির কথাটা বলতে পারল না, ঘুরিয়ে বলল, ‘মেয়েদের যাতে বারোবছর বয়সের আগে বিয়ে দেওয়া না হয়, সেই ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আনা হবে আইনে।’
‘বারো বছরের নীচে বিয়ে দেওয়া যাবে না?’ ভুবনমণি বিস্মিতচোখে তাকাল, ‘কেন?’
সৌরেন্দ্র বলল, ‘কারণ, বারো-তেরো বছরের আগে মেয়েদের শরীর সেইভাবে সন্তান উৎপাদনের জন্য তৈরি হয় না। ফলে তার নিজেরও শরীরের ক্ষতি হয়, সন্তানও দুর্বল জন্মায়। তাছাড়া অশিক্ষা, কুসংস্কার আরো বিভিন্ন কারণ আছে। সংখ্যাটা চোদ্দ হলেই ভালো হত, কিন্তু আপাতত বারো করতে গিয়েই যা বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, আইনটা পাশ হলে হয়!’
ভুবনমণি বলল, ‘এই আইন পাশ হলে কেউ যদি কমবয়সি মেয়েকে বিয়ে করে, তবে কী হবে?’
‘তার শাস্তি হবে। হাজতবাস হতে পারে।’ সৌরেন্দ্র বলল।
‘ঠগ বাছতে তো গাঁ উজাড় হয়ে যাবে!’ ভুবনমণি হেসে ফেলল, ‘আমাদের গ্রামে বারো বছরের ওপরের মেয়েকে বিয়ে না দিলে তাকে একঘরে করা হত। আমি তো গ্রামে থাকার শেষ দিন পর্যন্ত তেমন কাউকে দেখিনি।’
‘অথচ দেখো, আমাদের পুরাণ কিন্তু অন্য কথা বলে। দুষ্মন্ত-শকুন্তলা পড়ো, কিংবা নল-দময়ন্তী, কোথাও তুমি ষোল সতেরো বছরের নীচে মেয়ে দেখতে পাবে না। ষোল সতেরো বছর বয়স হল প্রকৃত যৌবন, ওইসময় স্বামীসহবাস শাস্ত্রসিদ্ধ। অথচ দেখো, আমাদের এই গৌরীদানের চোটে কীভাবে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলোকে কিছু জানার বোঝার আগেই পার করে দেওয়া হচ্ছে। গোটা সমাজটা রসাতলে যাচ্ছে এই করে! আমরা সেগুলোকে বন্ধ করব।’
সৌরেন্দ্র বলতে বলতে খেয়াল করল, সে উৎসাহের আতিশয্যে একটু বেশিই অসংযত হয়ে পড়েছে ভুবনমণির কাছে। কথার তোড়ে যৌবন, সহবাস এইসমস্ত শব্দোচ্চারণ করে ফেলায় তার আশঙ্কা হল, এখুনি বুঝি লজ্জায় মুখে আঁচলচাপা দিয়ে ছুটে চলে যাবে ভুবনমণি।
হাজার হোক, সে ভুবনমণির কাছে এক অনাত্মীয় স্বল্পপরিচিত পুরুষ।
‘খাতায় কলমে বন্ধ করে কি আদৌ কিছু হয়?’ তাকে ভুল প্রমাণিত করে ভুবনমণি বলল, ‘আমার বিয়ে হয়েছিল আট বছর বয়সে। ভালো করে মনেও পড়ে না। বিধবা হলাম নয় বছরে। তারপর থেকে তো আট-নয় বছর পেরিয়ে গেল। কিছু কি হয়েছে?’
‘আহা!’ সৌরেন্দ্র বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘তখনও তো আইনটা পাশ হয়নি ভুবন। আইন পাশ হলেই দেখবে সব বন্ধ হয়ে যাবে।’
‘এই আইন পাশ না হোক, আরেকটা আইন তো প্রায় ত্রিশ বছর আগেই বিদ্যাসাগরমশাই পাশ করিয়েছিলেন। বিধবাবিবাহ আইন। আগে জানতুম না। এখন জানি। বইয়ে পড়েছি। তখনো নাকি তুমুল আন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু শেষে আইন পাশও হয়েছিল। কিন্তু তাতে কী হয়েছে?’ ভুবনমণি সৌরেন্দ্রর চোখে চোখ রেখে বলল, ‘স্বামী সহবাস তো দূর, কোনোদিনও স্বামীর সঙ্গে একদণ্ড কথা বলেছি বলেও মনে পড়ে না। তবু আমি এখনো সাদা থান পরে একাদশী করছি। করেও যাব চিরজীবন। শুধু আমি নয়, গ্রামবাংলার লক্ষ লক্ষ মেয়েরই এই ভবিতব্য। আইন আইনের জায়গায়, সমাজ সমাজের জায়গায়। তাই না?’
সৌরেন্দ্র বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল এই তরুণীর দিকে।
ভুবনমণি একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আপনি নারাচ অস্ত্রের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল? ভীষ্ম এক একটা নারাচে একাধিক শত্রুনিধন করতেন। রক্ষণশীল সমাজের বিরুদ্ধে চাই ওইরকম একেকটা নারাচের মতো মানুষ! যার তীব্র ধারালো আঘাতে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাবে সমাজের সব পাপ। কিন্তু তেমন মানুষ বিদ্যাসাগর মশাইয়ের পর আর ক’জন এসেছেন? বলুন তো আপনি?’
সৌরেন্দ্রর মুখে কথা সরছিল না। সাম্প্রতিককালে এমন তেজস্বী নির্দ্বিধায় মতামত দিতে পারা কোনো মেয়েকে সে প্রত্যক্ষ করেনি। কাদম্বিনীর কথা আলাদা, তিনি ইতিমধ্যে অনেক দুর্গম শৃঙ্গ অতিক্রম করেছেন।
কিন্তু ভুবনমণি? সে তো সামান্য একজন গ্রাম্যবিধবা। বাল্যবিবাহের লক্ষ লক্ষ শিকারের মধ্যে একজন। অশিক্ষিতা।
সে মহাভারতের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা কী করে জানল? এত স্পষ্ট চিন্তাই বা কীভাবে করতে শিখল? কবে শিখল?
সৌরেন্দ্র বিহ্বলচোখে বলল, ‘তুমি যাবে আজ সভায় বক্তৃতা শুনতে? চলো না। তোমার মতো মেয়েদের এখন খুব দরকার ভুবন!’
২৪
সারারাত ভালো ঘুম হয়নি চন্দ্রনাথের। বারবার এপাশ-ওপাশ করে ছটফট করেছে। আবহাওয়া এখন বেশ মনোরম, না ঠান্ডা না গরম। কিন্তু তবু চন্দ্রনাথ দরদর করে ঘেমেছে। শেষে ভোররাতে আজানের ডাক ভেসে আসতে আর শুয়ে থাকেনি, উঠে ভালো করে মুখেচোখে ঝাপটা দিয়েছে। বাইরের দালানে ফণি বলে তার কিশোর ভৃত্যটি ঘুমোচ্ছিল, তাকে জানিয়ে শেষে নেমে পড়েছে পথে। হালকা শীতে একটা পাতলা চাদর গায়ে জড়িয়ে।
ভোররাতের মেটিয়াবুরুজ ভারি অন্যরকম। চওড়া পথের দু’পাশের সব দোকানগুলির ঝাঁপ বন্ধ। জনশূন্য প্রান্তরে শুধু কয়েকটা বাড়ির ভেতরে জ্বলতে থাকা প্রদীপ অস্পষ্ট আলো বিকিরণ করছে চারদিকে।
অন্ধকারের মধ্যেও আলো থাকে। চোখ অন্ধকারে সয়ে গেলে সেই আলো ঠিক খুঁজে নেয়। চন্দ্রনাথও পাতলা হয়ে আসা চাঁদের আলোয় হেঁটে চলেছিল।
রাস্তার একপাশে গ্যাসের হ্যাজাক লাগানোর পরিত্যক্ত লাইন। নবাব নাকি বছরদুয়েক আগে গ্যাসের আলোয় সাজাতে চেয়েছিলেন গোটা মেটিয়াবুরুজকে। কিন্তু সব আয়োজন সম্পূর্ণ হওয়ার পর গ্যাসের গন্ধে তিনি বাতিল করে দেন ওই ব্যবস্থা। তারপর থেকে সেই লাইন একপাশে অবহেলায় পড়ে রয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে চন্দ্রনাথ গঙ্গার ধারে চলে এল। জেটি জনশূন্য, শুধু একপাশে একটা স্টিমার নৌকো নোঙর করে রয়েছে। তার খালাসিরা বোধ হয় সব ভেতরে গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে।
অন্ধকারে মিশমিশ করছে গঙ্গার জল, যেন মহাকালের অমোঘ অন্ধকার সামনে!
জেটির সামনে একটা বহু প্রাচীন তেঁতুল গাছ। চন্দ্রনাথ গিয়ে সেই তেঁতুল গাছের নীচে বসল। তারপর দু-হাতে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
খোলা আকাশের নীচে নির্জন স্থানে কাঁদতে কাঁদতে তার মুখ দিয়ে শব্দ বেরোতে লাগল, ‘আহ! আহ!’
যেন তার শরীরে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
প্রায় মিনিট দুয়েক এইভাবে কাঁদার পর সে একটু শান্ত হল। গায়ের পশমিনাতে চোখ মুখ মুছে ধূসরচোখে তাকাল গঙ্গার দিকে।
ভোররাতে প্রকৃতির দৃশ্যপট খুব দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রতি মুহূর্তে যেন পূর্বদিকের আকাশ ফর্সা হতে থাকে, সূর্যদেব দ্রুত উঠে আসতে থাকেন ওপরে, অন্ধকারও সরে গিয়ে স্থান করে দেয় আলোকে।
এর মধ্যেই চারদিক বেশ আলোকিত হয়ে উঠেছে। নদীতে অনেক দূরে কোনো একটা পালতোলা জাহাজ যাচ্ছে। মেটিয়াবুরুজেরই এক পাশে বালুঘাট। সেইখানে এইসব পালতোলা জাহাজ আসে। এদেশের শ্রমিক বোঝাই করে সেগুলো রওনা দেয় দূরদেশে।
চন্দ্রনাথ প্রায় অস্পষ্ট মাঝনদীতে ভেসে চলা পালতোলা জাহাজটার দিকে তাকিয়ে ভাবল, এতে করে হয়ত চলে যাচ্ছে আরো এক প্রস্ত মানুষ। স্বদেশ, স্বজনদের ছেড়ে। বুকে একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে। কিছু করার নেই। পেট বড় বালাই।
যে কারণে এদের চলে যেতে হয় নির্বাসনে, যে কারণে চন্দ্রনাথকে নিজের গ্রাম ছেড়ে এসে পড়ে থাকতে হয় এই অজানা শহরে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও ভাবল, সেই কারণেই মোতিকে সহ্য করতে হয় অমন যন্ত্রণা। স্বেচ্ছায় শরীর পেতে দিতে হয় মার খাওয়ার জন্য।
শেষ বাক্যটা মনে আসা মাত্র ওর দু’চোখ আবার জলে ভরে গেল। না চাইতেও ওর মনে পড়ে গেল, কাল সন্ধেবেলায় দেখে ফেলা সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা।
গতকাল সারাদিনটা কেটেছিল নবাবের সঙ্গে আলিপুরে। ইংরেজ সাহেবদের আমন্ত্রণে কাল নবাব গিয়েছিলেন তাদের চিড়িয়াখানা পরিদর্শনে। নিজের পালকি ‘বুচা’য় চড়ে গোটা চিড়িয়াখানাটা সোৎসাহে ঘুরছিলেন নবাব, সঙ্গে সঙ্গী ছিল চন্দ্রনাথ। রামব্রহ্ম সান্যাল নিজে সব ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন। নবাব দেখছিলেন, টুকটাক পরামর্শও দিচ্ছিলেন।
নবাবের বপু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দিনদিন স্ফীত হচ্ছে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে তার শক্তি। একটুতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তখন হাঁটা তো দূর, দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয়ে ওঠে।
তাই গোটা বেলা আলিপুর ঘুরে যখন মেটিয়াবুরুজে ফেরত এসেছিলেন, বলাই বাহুল্য তিনি ছিলেন অতিরিক্ত পরিশ্রান্ত। ইঙ্গিতে চন্দ্রনাথকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, আজ গানবাজনা বা আত্মকথন কিছুই হবে না। আজ তিনি গোটা দিন বিশ্রাম করবেন। তাই চন্দ্রনাথের ছুটি। তারপর ইঙ্গিতপূর্ণভাবে বলেছিলেন, ‘বেটা তু আজ উয়ো লেড়কিকে পাস যা। নেহি তো বেচারি ফিরসে মেরে পাস আ যায়েগি। হা হা!’
নবাবের কথাতেই হোক বা অন্য কোনো কারণে, সন্ধ্যাবেলায় চন্দ্রনাথ ঘুরতে ঘুরতে সত্যিই চলে গিয়েছিল মোতির বাড়িতে। এই কয়েকমাসে মোতির সঙ্গে তার একটা সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। শুধু সেতারের শিক্ষক হিসাবেই নয়, বন্ধুত্বের তাগিদে।
মোতি মেয়েটা রূপোপজীবিনী হলেও তার একটা শিশুর মতো মন আছে। সেই মন দিয়ে সে আকাশ দেখে, নদী দেখে, গান করে। আর নিজের সেই এলোমেলো ভাবনার ঝাঁপি নির্দ্বিধায় খুলে বসে চন্দ্রনাথের কাছে। চন্দ্রনাথ কিছু কথা মন দিয়ে শোনে, কিছু কথা শুনে রসিকতা করে, আবার কিছু কথা শুনে কী বলবে ভেবে পায় না।
তবু যত ঘনিষ্ঠতাই হোক না কেন, না বলে সে কোনোদিন মোতির বাড়ি যায়নি।
গিয়েছিল শুধু গতকাল। আর সেইজন্যই তাকে পেতে হল নিদারুণ আঘাত।
গতকাল সন্ধ্যাবেলা মোতির বাড়ির গলি দিয়ে ঢোকার সময়ই চন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছিল, নবকিশোর দত্তের জুড়িগাড়িটা বেরিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল ও। যাক, মোতির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাওয়া যাবে।
আশ্চর্যজনকভাবে মোতির বাড়ির সদরদরজাটাও খোলা ছিল। ছুটকিকেও দেখতে পায়নি কাছেপিঠে। বেশি কিছু না ভেবে ও ঢুকে পড়েছিল বাড়ির মধ্যে। পরিচিত গলি দিয়ে গিয়ে ঢুকেছিল মোতির ঘরে।
আর তখনই প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনি খেয়ে নিঃস্পন্দ হয়ে গিয়েছিল ও।
ঘরের মেঝেতে মোতি উপুড় হয়ে শুয়েছিল। পরনে কোনো কাঁচুলি নেই, নিম্নাঙ্গের ঘাগরা কোমরের নীচ থেকে গায়ে এলিয়ে রয়েছে। গোটা পৃষ্ঠদেশ উন্মুক্ত। সেই পৃষ্ঠদেশে লাল সরু এক ধরনের দাগ। একাধিক।
সেই দাগগুলো বরাবর মোতির পেলব ত্বক ফুলে উঠেছে। কিছু কিছু স্থানে রক্তও জমাট বেঁধে রয়েছে।
ছুটকি উবু হয়ে বসে রয়েছে মোতির পাশে। হাতে ধরা একটি পাত্র থেকে কিছু একটা লাগাচ্ছে মোতির পিঠের সেই বীভৎস আঘাত বরাবর। যতবার লাগাচ্ছে, মোতির চাপা অথচ করুণ আর্তনাদে কেঁপে উঠছে গুমোট একফালি ঘরটা।
ঘটনার আকস্মিকতায় চন্দ্রনাথের মুখ দিয়ে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এসেছিল, ‘ইয়ে ক্যা হুয়া!’
মোতি অমনি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে বসেছিল, আলোর চেয়েও দ্রুতগতিতে আড়াল করেছিল নিজের উন্মুক্ত অঙ্গ। তারপর তীক্ষ্নস্বরে বলেছিল, ‘আপ? ইস ওয়াক্ত কিঁউ?’
চন্দ্রনাথ কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি।
সত্যিই তো, এই অসময়ে সে কেন?
অপ্রস্তুত মুখে পেছন ফিরতেই মোতি আবার ডেকেছিল, ‘রুকিয়ে। বৈঠিয়ে।’
তারপর চন্দ্রনাথের উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে গিয়েছিল ভেতরে।
চন্দ্রনাথ কতক্ষণ চুপচাপ জাজিমের ওপর বসেছিল কে জানে, আবার চমক ভেঙেছিল মোতির ডাকে, ‘লিজিয়ে। ঠান্ডি মালাই।’
ফিরে আসা মোতির মুখে একটু আগের দেখা সেই যন্ত্রণার কোনো ছাপই তখন আর ও খুঁজে পায়নি। সেই একইরকম প্রাণোচ্ছল তরুণী। গোলাপি গাল, চোখে নিখুঁত সুর্মা, ঠোঁটে পান, দাঁতে মিশি। হাসিমুখে ঈষৎ ঝুঁকে হাতে শরবতের পাত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যেন কিছুই হয়নি।
কিন্তু চন্দ্রনাথ স্বাভাবিক হতে পারেনি। বলবে না বলবে না করেও ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, ‘ওগুলো কীসের দাগ মোতি?’
আর তারপরই সে শুনেছিল নবকিশোর দত্তের বিকৃত খেয়ালখুশির কথা। সঙ্গিনীর দেহে হিলহিলে চাবুকের আঁচড় না কাটতে পারলে তাঁর নাকি তৃপ্তি হয় না।
শুনতে শুনতে ও শিউরে উঠেছিল। প্রচণ্ড রাগে, ক্ষোভে বলেছিল, ‘কিন্তু তুমি কেন করছ এসব? তুম এক কলাকার মোতি! তোমার কাজ গান গাওয়া, একটা জন্তুর অত্যাচার সহ্য করা নয়।’
মোতি ম্লান হেসে তখন বলেছিল, ‘শুধু গান গেয়ে তো পেট ভরে না বাবু।’
‘কিন্তু তুমি তো নবাবের থেকে মাসোহারা পাও!’
মোতি এবার প্রচণ্ড জোরে হেসে উঠেছিল। হাসির দমকে ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছিল তার সরু দেহটা। হাসতে হাসতে বিচিত্র মুখভঙ্গি করে বলেছিল, ‘মাসোহারা? হাসালেন আপনি! নবাবের এই গোটা মেটেবুরুজে শয়ে শয়ে মুতআ বিবি আর তাদের গন্ডা গন্ডা বালবাচ্চা, নবাব নিজে তো ফতুর হয়ে যাবে তাহলে। যা টাকা তহবিল থেকে ফি মাহিনায় দেওয়া হয়, তাতে দু-দিন ভালো করে চলে না বাবুজি! বাকি মাহিনা চলে ওই চিড়িয়াবাবুর রুপেয়াতে। চিড়িয়াবাবুর জুলুম না বরদাস্ত করলে খাব কী?’
চন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ কোন কথা খুঁজে পায়নি। তারপর বলেছিল, ‘আচ্ছা, আমি যদি তোমাকে প্রতিমাসে যথেষ্ট টাকা দিই, তুমি এসব ছেড়ে দেবে?’
এবার মোতি সত্যিই অবাক হয়েছিল। গালে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে বলেছিল, ‘হায় আল্লা! আপনি দেবেন কোত্থেকে? আপনি নিজেই তো কোনো মাহিনা পান না!’
‘না মানে।’ চন্দ্রনাথ দ্রুত বলেছিল, ‘আ-আমি নবাবকে বলতে পারি। আমি বললে নবাব নিশ্চয়ই শুনবেন।’
মোতি এবার তার হরিণীর মতো কাজলকালো চোখে কিছুক্ষণ একভাবে তাকিয়ে ছিল চন্দ্রনাথের দিকে। সেই দৃষ্টি যেন অন্তর্ভেদী। সংকোচে চন্দ্রনাথ নতনেত্র হয়েছিল।
‘আমি বাহারুন্নিসা বেগমের বেটি বাবু। রন্ডির বেটি হতে পারি, কিন্তু নিজে সাধ করে রন্ডিবাজি করি না, পেটের জ্বালায় করি। বুঝলেন?’ মোতি বলেছিল, ‘নবাব আমার বাপ। বাপের নিজেরই হুঁশ নেই, আপনি আনজান আদমি, কী করবেন?’
শুনতে শুনতে চন্দ্রনাথের কী হয়েছিল, মুহূর্তের দুর্বলতায় না তাৎক্ষণিক আবেগে, তা ও জানে না, মোতিকে আকর্ষণ করে টেনে নিয়েছিল নিজের বুকে।
গাঢ়স্বরে বলেছিল, ‘আমি যা করার করব। তুমি ওই লোকটাকে আর কোনোদিনও বাড়িতে ঢুকতে দেবে না।
মোতি বিস্মিতচোখে দেখছিল চন্দ্রনাথকে। যে শান্ত, ভীরু, গানপাগল ছেলেটা ঠিকমতো চোখে চোখ রেখে কথা বলতে আড়ষ্টবোধ করে, সে আজ এত সাহস পেল কোথা থেকে?
বুকের মধ্যে প্রচণ্ড জোরে শব্দ হচ্ছিল চন্দ্রনাথেরও। তার এই তেইশ বছরের জীবনে এই প্রথম এত কাছে একটি নারী। মোতির শরীরের সুগন্ধে নিজের অজান্তেই তার ঠোঁট নেমে এসেছিল মোতির ঠোঁটে।
তারা দুজন গভীর আশ্লেষে পান করছিল একে অন্যের অধরসুধা। আবছা অন্ধকার একফালি ঘরে উষ্ণ আলিঙ্গনে পিষে যাচ্ছিল দুটো শরীর।
মোতিও পরম নির্ভরতায় জড়িয়ে ধরেছিল চন্দ্রনাথকে। সে বহুভোগ্যা, কিন্তু সেদিন অনুভব করছিল, এই আলিঙ্গন শুধুই কামনা চরিতার্থের নয়, এই আলিঙ্গন নির্ভরতার। এই আলিঙ্গন ভালোবাসার। আর এই অভিজ্ঞতা ওর জীবনে প্রথম।
একেবারে কাছে কি একটা পাখির ডাক শুনে মুহূর্তে বাস্তবে ফিরে এল চন্দ্রনাথ। চমকে তাকিয়ে দেখল, বেশ ভালো রোদ উঠে গিয়েছে চারদিকে। জেটিতে ভিড়েছে একটা বড় জাহাজ। সেখান থেকে ভাসানো হচ্ছে ছোট নৌকো।
দুজন রোগা লিকলিকে ছেলে বেশ খানিকটা উঁচু থেকে লাফ দিচ্ছে নদীতে। ঝাঁপিয়ে পড়েই আবার হইহই করে ডাঙায় উঠছে তারা।
চন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়াল। তারপর জলের কাছে গিয়ে ভালো করে মুখে চোখে ঝাপটা দিল। নদীর জলে ধুয়ে গেল মুখে লেগে থাকা কান্নাটা।
তারপর হাঁটতে লাগল সুলতানখানার দিকে।