দৈনিক পাকিস্তান-এর সাহিত্যপাতায় শাহ কলিম-এর একটি গদ্যরচনা প্রকাশিত হয়েছে। রচনার শিরোনাম— শুদ্ধ প্ৰাণ পাকিস্তান। পঁচিশে মার্চের পর সে নতুন একটা নামে লেখালেখি শুরু করেছে। তার বর্তমান নাম গোলাম কলিন্দর। চেহারাও কিছু পাল্টেছে। দাড়ি, চুল দুটাই বড় হয়েছে। বাবরি চুল মিলিটারিরা সন্দেহের চোখে দেখে বলে রাস্তায় বের হবার সময় সে মাথায় সুচোর কাজ করা একটা রঙিন টুপি পরে। চোখে থাকে সানগ্লাস। সানগ্লাসটা তাকে এক পাকিস্তানি মেজর সাহেব (সিদিক সালেক) উপহার দিয়েছেন। এই মেজর সাহেব প্রেস সেকশনের দায়িত্বে আছেন। তিনি মাঝে-মাঝেই পত্রিকা অফিসে উপস্থিত হন। কলিমউল্লাহর সঙ্গে মেজর সাহেবের ভালো খাতির হয়েছে। তার জিপে কলিমউল্লাহকে মাঝে-মাঝে দেখা যায়। মেজর সাহেব একদিন তাকে আমি মেসে দুপুরের খানা খেতে দাওয়াত করেছিলেন।
দুপুরের খানা খাবার পর কলিমউল্লাহ মেজর সাহেবকে বলেছে, পাকিস্তান রক্ষার জন্যে শরীবের শেষ রক্তের ফোটোটাও সে দেবে। যে রাতে পাকিস্তান রক্ষা পেল, সেই রাতে সে বিশ রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করেছে। কিছু প্রাণহানী হয়েছে। কিছু নিরীহ মানুষও মৃত্যুবরণ করেছে। এটা হবেই। কিছু করার নাই। যে-কোনো মহৎ কাজের ধর্ম হলো, মহৎ কাজের সঙ্গে দুএকটা নোংরা কাজও হয়। আমরা দেখব মহৎ কাজটা।
মেজর সিদিক সালেক কলিমউল্লাহকে একটা পাস দিয়েছেন। পাসটা কলিমউল্লাহর খুব কাজে লাগছে। কারফিউ চলার সময় পাস দেখিয়ে সে রাস্তায় নামতে পারে।
কলিমউল্লাহ মিরপুর এলাকায় তিন রুমের একটি বাসা ভাড়া করেছে। ভাড়া বলা ঠিক হবে না, সে বিনা ভাড়াতেই থাকছে। বাড়িওয়ালা ঘর-বাড়ি ছেড়ে দেশের বাড়িতে চলে গেছেন। কলিমউল্লাহকে বলেছেন, কোনো ভাড়া দিতে হবে না। আপনি বাড়িটা দেখেশুনে রাখবেন। অনেক কষ্টে বাড়ি করেছি, হাতছাড়া যেন না হয়। গরিব মানুষ বড় কষ্টের পয়সায় বাড়ি। শুনেছি বিহারিরা বাড়িঘর নিয়ে নিচ্ছে।
কলিমউল্লাহ বলেছে, আপনি বে ফিকির থাকেন (তার কথাবার্তায় কিছু কিছু উর্দু শব্দ এখন ঢুকে পড়ছে।) এই বাড়ি কেউ নিতে পারবে না। আমি বিহারির বাবা। তাছাড়া বাড়ির গায়ে উর্দুতে লেখা থাকবে–ইহা মুসলমানের বাড়ি। কালো একটা তারা চিহ্নও থাকবে। এই চিহ্নটাই আসল । চিহ্ন দেখলে বিহারি মিলিটারি সবাই বুঝবে–সাচ্চা মুকাম। (আবার উর্দু। শুনতে খারাপ লাগে না।)
মিরপুরের এই বাড়িতে কলিমউল্লাহর দিনকাল খারাপ কাটছে না। বাচ্চু মিয়া নামে সে একজন বাবুর্চি রেখেছে। বাবুর্চির বয়স সর্তে রো-আঠারো। বাড়ি নেত্রকোনার রুয়াইলে। চাকরি নেবার সময় সে বলেছিল সব রান্না জানেদেশী, মোগলাই, ইংলিশ। সে আগে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে কিছুদিন কাজ করেছিল বলে টুকটাক চাইনিজও জানে।
কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, সে কোনো রান্নাই জানে না। তার সব তরকারির চেহারা রোগীর পথ্যের মতো। খেতেও রোগীর পথ্যের মতো। তবে তার সবচে বড় গুণ হলো সেই খাবার মুখে দিয়ে সে-ই প্রথম চিৎকার করবে—আস্তাগাফিরুল্লাহ, তরকারির কী অবস্থা! ভাইজান মুখে দেওন যায়? হলুদ খারাপ কিনেছি। হলুদের জন্যে এই অবস্থা। নতুন হলুদ কিনতে হবে।
নতুন হলুদ কেনার পরেও স্বাদ বা বর্ণের কোনো তারতম্য হয় না।
কলিমউল্লাহ আর কাউকে পাচ্ছে না বলে বাচ্চু মিয়াকে হজম করছে। শহরে লোক পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহর ফাঁকা। ২৭/২৮ তারিখের দিকে যারা পালিয়েছিল তারা ফেরে নি, বরং দফায় দফায় আরো লোকজন চলে যাচ্ছে। রেডিওতে অবশ্যি বলা হচ্ছে শহরের জীবনযাত্রী স্বাভাবিক। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, শীঘ্রই খুলে দেয়া হবে। ব্যাংকের কাজকর্ম চলছে। সরকারি অফিস-আদালত চলছে।
যারা দুষ্টলোকের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে কাজকর্ম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তারা কাজে যোগদান করলে তাদের সাময়িক কর্মবিরতি ক্ষমা করা হবে।
লোকজন মনে হয় রেডিওর খবরে বিশ্বাস করছে না। তারা বিশ্বাস করছে। গুজবে। কত ধরনের গুজব যে ছড়াচ্ছে তার কোনো মা-বাপ নেই। বাচ্চু মিয়া গুজব সংগ্রহ করে আনার ব্যাপারে অত্যন্ত দক্ষ। বাতাসে কোনো গুজব ভাসছে, বাচ্চু মিয়া সেই গুজব সংগ্রহ করে আনে নি। এটি কখনো হবে না। একদিন ভোরবেলা সে উধাও হয়ে গেল। সারাদিন তার কোনো খোঁজ নেই। ফিরল রাত আটটায়। তার মুখভর্তি হাসি।
ভাইজান, বলেন দেহি ঘটনা কী হইছে? দুই মিলিট সময়, দুই মিলিটের মধ্যে বলেন।
কলিমউল্লাহ বলল, তোকে আমি আর রাখব না। তুই চলে যা।
বাচ্চু মিয়া বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলল, না রাখলে নাই। কপালে যা আছে তাই ঘটব। কিন্তু আপনে কন দেখি আইজের ঘটনা। এক মিলিট সময়। (বাচ্চু মিয়ার ন উচ্চারণে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু মিনিট-কে সে বলবে মিলিট।)
কথা বলিস না, চুপ করে থাক।
ভাইজান, টিক্কা তো শেষ। শে-এ-এ-এ-এ-ষ।
কে শেষ?
টিক্কা। জেনারেল টিক্কা। চাইর গুলি খাইয়া উল্টাইয়া পড়ছে। বুনকা বুনিকা রক্ত। মিলিটারির অবস্থা ছেড়াবেড়া। তারার কমান্ডারই নাই।
তোকে কে বলেছে?
বেবাক শহরের লোক জানে। যদি মিথ্যা বইল্যা থাকি, তাইলে আমি বাপের ঘরের না। আমি জারজ সন্তান। স্বাধীন বাংলা খুইল্যা শুনেন কী ডিক্লার দিছে।
সন্ধ্যার পর স্বাধীনবাংলা বেতার থেকেও এই খবর বলা হলো। জেনারেল টিক্কা নিহত। অসমর্থিত খবরে বলা হয়েছে, পূর্বপাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত। ঢাকা শহরে তুমুল উত্তেজনা। মিলিটারি সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায়।
বাচ্চু মিয়া বলল, ভাইজান, এখন কী কন? গিরিবের কথা বাসি হইছে বইল্যা ফলছে। আল্লাহ। গরিব নাম দিয়া কী অদ্ভুত জাত বানাইছে। গরিবের টাটকা কথার উপরে বিশ্বাস নাই। বাসি কথার উপরে বিশ্বাস। এখন দেন দুইটা টেকা।
দুটাকা দিয়ে কী করবি?
পোলাও-এর চাল কিনব, ঘি, কিনব। আইজ মোরগপোলাও করব। আমি মোরগপোলাও রান্ধন শিখেছি মনা বাবুর্চির কাছে। একবার খাইয়া দেখেন। উস্তাদ আমায় বিরাট স্নেহ করতেন।
মনা বাবুর্চির মেহের শিষ্যের অতি অখাদ্য মোরগপোলাও খাবার সময়ই রেডিও ও টিভিতে জেনারেল টিক্কার ভাষণ প্রচারিত হলো। জেনারেল টিক্কা সশরীরে উপস্থিত হয়ে নতুন কিছু সামরিক নির্দেশ দিলেন। টিভিতে তাঁর মুখ হাস্যময়। যেন সামরিক নির্দেশ দিতে গিয়ে তিনি বড়ই আনন্দ পাচ্ছেন।
কলিমউল্লাহ বাচ্চু মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, এটা কী হলো? বাচ্চু মিয়া বলল, ভাইজান এইটা আসল টিক্কা না। এইটা নকল। মিলিটারিরে বুঝ দেওনের জন্যে আনছে। আসলটা শেষ। এইটা মনে হয় তার কোনো ভাই। ভাইয়ে ভাইয়ে চেহারায় মিল থাকে। আমার কথা যদি সত্যি না হয় তাইলে আমি বাপের ঘরের না, আমি জারজ সন্তান। মোরগপোলাও কেমন হয়েছে বলেন।
তুই বল কেমন হয়েছে।
অতি জঘন্য হয়েছে। ঘি ভালো ছিল না। ডালডার ভেজাল। ভেজাল ঘি দিয়া মোরগপোলাও আমার উস্তাদ মনা বাবুর্চিও পাকাবে না। লাখ টেকা দিলেও না।
চুপ থাক।
আচ্ছা যান। চুপ থাকলাম।
তুই তো রান্নার কিছুই জানিস না।
এইটা কী কইলেন ভাইজানি! আমি ছিলাম মনা বাবুর্চির এক নম্বর এসিসটেন। ওস্তাদ আমারে নিজের সন্তানের চেয়ে অধিক স্নেহ করতেন। এখন যুদ্ধের সময় রান্ধনে মন বসে না বইল্যা কিছু হয় না।
যুদ্ধ তুই কই দেখলি?
আরে কী কন? ঢাকার বাইরে ধুরুম ধারুম, গুরুম গারুম সমানে চলতাছে। বেঙ্গল রেজিমেন্ট খাবালা দিয়া ধরছে। মেজর জিয়া পাকিস্তান আমিরে কামড় দিয়া ধরছে। কচ্ছপের কামড়। জীবন যাবে কিন্তু কামড় ছাড়বে না।
চুপ থাক গাধা। কিছুই হচ্ছে না। যুদ্ধ যা হচ্ছে স্বাধীন বাংলা বেতারে হচ্ছে, जबई छूशा यूक।
বাচ্চু মিয়া আহত গলায় বলল, ভুয়া যুদ্ধ!
কলিমউল্লাহ পাইপ ধরাতে ধরাতে বলল (এই পাইপটাও সে মেজর সাহেবের কাছ থেকে সংগ্ৰহ করেছে। অবসর সময়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে পাইপ ধরাতে তার ভালো লাগে), শোন মন দিয়ে, যুদ্ধ হচ্ছে বেতারে। এই যুদ্ধে গোলাবারুদ লাগে না, শুধু লাগে গলার জোর। স্বাধীন বাংলা বেতার ভুয়া। তার সব খবর ভুয়া।
এইটা কী কন?
তারা খবর দিল শেখ সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আছেন। আদেশ নির্দেশ দিচ্ছেন। পরে পত্রিকার ছবি দেখলাম। উনি করাচি এয়ারপোর্টে। তারা খবর দিল, সুফিয়া কামাল, ড. নীলিমা ইব্রাহিম মারা গেছেন। আমরা পত্রিকায় উনাদের ছবি দেখলাম। মাশাল্লাহ দুজনেই ভালো আছেন। তারপর শুনলাম টিক্কা খান মারা গেছে। এখন তুই বল মারা গেছে?
অবশ্যই। যে টিক্কারে আপনে দেখছেন বিশ্বাস করেন ভাইজান, আপনের আল্লাহর দোহাই লাগে, এইটা নকল। আসলটা শেষ। আমার কথা যদি মিথ্যা হয়, আমার মাথায় যেন ঠাডা পড়ে।
তুই যা আমার সামনে থেকে।
বর্তমান জীবনটা কলিমউল্লাহর বেশ ভালো লাগছে। থাকার জায়গার কোনো অসুবিধা নেই। এই বাড়ি তো আছেই, এ ছাড়াও থাকার মতো বাড়ি আছে। ঝিকাতলার যে বাড়িতে কলিমুল্লাহ প্রাইভেট টিউশনি করত, সেই ভদ্রলোক দেশে চলে যাচ্ছেন। তিনিও কলিমউল্লাহকে তার বাড়ি দেখাশোনা করতে বলেছেন! একটা চাবিও দিয়ে গেছেন। ঝিকাতলার বাড়িটা বড়। জিনিসপত্রে ঠাসা। কলিমউল্লাহ ঠিক করেছে, কোনো এক সময় ঐ বাড়িতে উঠবে। এক জায়গায় বেশি দিন থাকতে নেই। তাতে শিকড় গজিয়ে যায়। যারা গদ্য লেখে শিকড় গজানো তাদের সমস্যা হয় না। কবিদের জন্যে হয় সমস্যা। কবিদের শিকড় থাকতে হয় না। চলমান ছন্দের মতো কবিদেরও হতে হয় চলমান।
তাছাড়া অবসর সময়ে অন্যের বাড়ির জিনিসপত্র নেড়েচেড়ে দেখতে তার ভালো লাগে। এখন যে বাড়িতে আছে সেই বাড়ির মূল শোবার ঘরের খাটের নিচে রাখা একটা ট্রাঙ্কের তালা খুলে সে খুবই আরাম পেয়েছে। অনেক টুকিটাকি জিনিস, চিঠিপত্র। ছবি। এর মধ্যে নায়লা নামের এক মেয়েকে লেখা কয়েকটা চিঠি আছে চূড়ান্ত অশ্লীল। নায়লার স্বামী নায়লাকে লিখেছে। এত অশ্লীল কোনো লেখা কলিমউল্লাহ আগে পড়ে নি। চিঠিগুলি সে নিজের সংগ্রহে রেখে দিয়েছে। ট্রাঙ্কের ভেতর দুশ একুশ টাকা পাওয়া গেছে (হরলিকসের কৌটাতে মুখবন্ধ করে রাখা)। এরা টাকা ফেলে চলে গেল কেন কে বলবো? হরলিকসের কৌটাসহ টাকাটা কলিমউল্লাহ নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। এখান থেকে সে টুকটাক খরচ করছে। তার তেমন খারাপ লাগছে না।
ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে কলিমউল্লাহ হাঁটছে। হাইকোর্টের সামনের রাস্তা ধরে হাঁটা। সে যাবে দৈনিক পাকিস্তান অফিসে। তার পকেটে নতুন আরেকটি গদ্যরচনা। শিরোনাম–
মহাকবি ইকবাল
একুশে এপ্রিল ইকবাল দিবস। সেই দিবসে রচনাটা প্রকাশিত হবে। বিশেষ বিশেষ দিবসের জন্যে লেখা পাওয়া দুষ্কর । এই লেখাও যাচ্ছে গোলাম কলিন্দর নামে। গোলাম কলন্দির নামটা ভালো পরিচিতি পাচ্ছে। ইংরেজি পত্রিকাগুলিতে কিছু লেখা দিতে পারলে ভালো হতো। কলিমউল্লাহর ইংরেজি একেবারেই আসে না। পেসিভ ভয়েস, একটিভ ভয়েস, টেন্স বড়ই ঝামেলার জিনিস।
হাঁটতে কলিমউল্লাহর ভালো লাগছে। প্রায় ফাঁকা রাস্তা। যারা হাঁটছে রাস্তার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাঁটছে।
আগে রিকশাওয়ালারা রিকশা চালাবার সময় প্রয়োজন না থাকলেও টুং-টাং করত। এখন টুং টাং বন্ধ! বেশিরভাগ রিকশাই খালি। যাত্রী নেই। আগে কাজ না থাকলেও লোকজন রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করত, এখন তা না। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ পথে নামছে না।
দেয়াল, বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কোথাও চিকা মারা নেই। সামরিক নির্দেশে সব তুলে ফেলা হয়েছে। গভীর রাতে চিকামারা পার্টি এসে চিকা মেরে যাবে সেই উপায় নেই। রাত নটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ। পথে কাউকে দেখা গেলেই গুলি।
কলিমউল্লাহ সিগারেট ধরাল। হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্যে হানিকর। এত স্বাস্থ্য স্বাস্থ্য করলে স্বাস্থ্য থাকে না। কোনো কিছু নিয়েই বাড়াবাড়ি করতে হয় না। হাইকোটের বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী সাহেবের কথাই ধরা যাক। উনি এমনই কঠিন লোক যে জেনারেল টিক্কাকে গভর্নর হিসাবে শপথ নেওয়াতে রাজি হলেন না। জয় বাংলা, জয় সিদ্দিকী। স্লোগান পর্যন্ত হয়ে গেল। সেই তিনি এখন সোনামুখ করে জেনারেল টিক্কাকে শপথ পাঠ করিয়েছেন। বল হরি হরি বল। আয় বাবা দেখে যা, দুটি সাপ রেখে যা।
ঢাকা এখন ঠিক আছে। ঢাকায় কোনো সমস্যা নেই। কোথাও প্যা পোর ভাব হলেই হেলিকপ্টার বোমা ফেলে আসছে। বোমারু বিমানও আছে। কোদাল খুন্তি নিয়ে যে বাঙালি দেশ স্বাধীন করে ফেলবে বলে ঠিক করেছিল, সেই বাঙালি আসমানী বালা মসিবতের কথা ভাবে নি। তাদের ফ্যাড়াফ্যাড়ানি বন্ধ। এখন বসে বসে আরবি হরফে বাংলা লেখা শিখ। ইয়াহিয়ার বিশেষজ্ঞ কমিটি সুপারিশ দিয়েছে–আরবি হরফে বাংলা লেখার। কী মজা! কী মজা! বে। জবর বা, নুন লাম আলিফ জবর লা। বানলা। মজা হচ্ছে না?
দৈনিক পাকিস্তান-এর সামনে এসে কলিমউল্লাহ শান্তি মিছিলের সামনে পড়ল। শান্তি মিছিল চলে ট্রাকে। তাদের শহরের নানান জায়গায় ঘুরতে হয়। হেঁটে এত জায়গা কাভার করা যাবে না। শান্তির দূতদের দিকে কলিমউল্লাহ আগ্রহ করে তাকাচ্ছে। এদের সঙ্গে পরিচয় থাকা ভালো। বিপদে কাজে আসবে। সবাইকে চেনা যাচ্ছে না। খান-এ-সবুর আছেন, খাজা খয়েরউদ্দিন, গোলাম আযম, বেনজির আহমদ। কলিমউল্লাহর মনে হলো–বাংলাদেশ যদি কোনোদিন (সম্ভাবনা নেই, তবু কথার কথা) স্বাধীন হয়ে যায়, তাহলে এদের কী হবে? শান্তির এই কপোতরা কি তখনো শান্তির বকম বকম করবেন?
কলিমউল্লাহকে দেখে দৈনিক পাকিস্তান অফিসে প্রায় অস্পষ্ট এক ধরনের উত্তেজনা দেখা গেল। দারোয়ান টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। অফিসে ঢোকার মুখে ছাপাখানার একজন বললেন, কলিম ভাই, কেমন আছেন? গতকাল আপনাকে দেখি নাই। শরীর খারাপ ছিল? আমাদের এখান থেকে এক কাপ চ খেয়ে যান।
এই খাতিরের কারণ মেজর সাহেবের সঙ্গে ঘোরাঘুরি। সূর্যের কাছাকাছি যারা থাকে তারাও আলো বিচ্ছুরণ করে। কলিমুল্লাহ ইকবাল-বিষয়ক রচনাটা জমা দিয়ে চা নিয়ে বসল। পত্রিকা অফিসের চা সবসময় ভালো হয়। প্রথম কাপ শেষ করার পর দ্বিতীয় কাপ খেতে ইচ্ছা করে।
কলিম ভাই, কেমন আছেন?
ক্যাশিয়ার সাহেব মনে হয় কোনো কাজে ঢুকেছিলেন। কলিমউল্লাহকে দেখে থিতামত খেয়ে গেলেন। তার চোখে স্পষ্ট ভীতি। ভয়ের চোখে তাকে কেউ দেখছে – বাহ, ভালো তো! কলিমউল্লাহর মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে গেল। তার জীবনটা মোটামুটি ভয়ের মধ্যেই কেটেছে। আজ পাশার দান পাল্টেছে। তাকেও লোকজন ভয় পাচ্ছে। কলিমউল্লাহ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আপনি ভালো আছেন?
জি। আপনার দোয়া।
আমার আবার দোয়ার টাইম কোথায়?
ঠিকই বলেছেন দোয়ার টাইম নাই। ইয়া নফসি, ইয়া নফসি।
ইয়া নফসি ইয়া নফসি হবে কী জন্যে?
কলিমউল্লাহ খুবই আনন্দের সঙ্গে লক্ষ করল ভদ্রলোকের মুখ শুকিয়ে গেছে। বেফাঁস কথাটা বলে তিনি এখন আতঙ্কে অস্থির। কলিমউল্লাহ ঠাণ্ডা গলায় বলল, আপনার সঙ্গে আমার কিছু প্ৰাইভেট কথা আছে।
অবশ্যই অবশ্যই।
আপনি আপনার ঘরে যান। আমি চা-টা শেষ করে আসি।
অবশ্যই অবশ্যই।
ঘরে যেন আর কেউ না থাকে।
জি জি জি।
আপনার নাম হেলাল না?
জি জি জি।
আপনি অপেক্ষা করুন, আমি আসছি।
হেলাল সাহেব জড়ানো পায়ে তার ঘরের দিকে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের কলিজা শুকিয়ে গেছে। এখন চলছে কলিজা শুকাবার কাল। ড্রাই লিভার ওয়েদার।
কলিমউল্লাহ চা শেষ করে আরেক কাপ চা নিল। হেলাল সাহেবের কাছে যত দেরি করে যাওয়া যায় ততই ভালো। টেনশনে ব্যাটার ঘাম বের হয়ে যাক। আমি আমার এক জীবনে অনেক টেনশন নিয়েছি। এখন তোরা খানিকটা নে।
কেমন আছেন হেলাল সাহেব?
জি ভালো আছি। চো
খমুখ শুকনা, ভালো তো মনে হয় না। রাতে ঘুম ভালো হচ্ছে না?
জি ঘুম হচ্ছে। কলিম ভাই, চা খাবেন?
না, চা দুকাপ খেয়েছি।
অন্য কিছু খাবেন? আনায়ে দেই।
না, কিছু খাব না। আচ্ছা শুনেন, কবি শামসুর রাহমান সাহেব অফিসে আসতেছেন না, ব্যাপারটা কী? যুদ্ধে চলে গেছেন না-কি?
জি-না। জি-না।
উনি আছেন কোথায়?
তা তো জানি না। ঢাকা শহরে কি আছেন?
জি-না।
কোথায় আছেন? আমি উনার কোনো খোঁজ জানি না।
ঢাকা শহরে যে উনি নাই সেটা তো আপনি জানেন। তাহলে আপনি কেন বলছেন তার খোঁজ জানেন না? কবির গ্রামের বাড়ি কোথায়? ঠিকানাটা দেন। আমি দেখা করে আসব। ইদানীং কী লেখালেখি করছেন–দেখব।
উনি কোথায় আছেন আমি কিছুই জানি না।
জেনে তারপর আমাকে জানান।
হেলাল সাহেব চুপ করে আছেন। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কলিমউল্লাহ বলল, একটা জর্দা দিয়ে পান আনার ব্যবস্থা করেন। চা খেয়ে মুখ মিষ্টি হয়ে গেছে।
অবশ্যই অবশ্যই।
আমাকে কাগজ আর কলম দেন। নিরিবিলি একটা ঘর দেন। কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে। শুধু মেজর সাহেব এলে খবর দিবেন।
অবশ্যই অবশ্যই।
দুপুরে আমার জন্যে কোনো খাবারের ব্যবস্থা করবেন না। মেজর সাহেবের সঙ্গে তাঁর মেসে খাবার কথা। (সম্পূর্ণ মিথ্যা। এই জাতীয় মিথ্যা বলতে কলিমউল্লাহর সবসময় ভালো লাগে।)
কলিমউল্লাহ ইজিচেয়ারে শুয়ে আছে। তার মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে। সে কবিতা লেখার চেষ্টা করছে। প্রথম লাইনটা চট করে মাথায় এসে গেছে। লাইনটা খারাপ না–
একটি ধবল বক এক একা উড়িতেছিল বাংলার করুণ আকাশে।
সে করুণ শব্দটা কাটল। করুণ আকাশ মানেই জীবনানন্দ। কারুণের জায়গায় বসালে মেঘলা। এই শব্দটা ভালো লাগছে না। মেঘলা আকাশ, মেঘলা আকাশ লিখে লিখে মেঘলা শব্দটাকে সবাই পচিয়ে ফেলেছে। মেঘলা কেটে সে লিখলা রূপালি। কবিতার বাকি কয়েক পঙক্তি সে দ্রুত লিখে ফেলল।
একটি ধবল বিক একাকী উড়িতেছিল বাংলার রূপালি আকাশে
সঙ্গিনী তার, মরিয়া গেছে বহুকাল বহুকাল আগে।
সঙ্গিনীর দীর্ঘশ্বাস বার মাস বকের পাখায় লাগে
উড়িতে পারে না সে, সঙ্গিনীর নিঃশ্বাসের ভারে,
সে বড় ক্লান্ত হয়
খুঁজে ফিরে ডানা দুটি মেলিবার নিশ্চিন্ত আশ্রয়।
কবিতা লেখার খুব আবেগ এসে গেছে। বাকি লাইনগুলি কিউ-এর মতো একজনের পিছনে একজন দাঁড়িয়ে আছে। তারা ঠেলা ঠেলিও করছে। এমন সময় হেলাল সাহেব ঘরে ঢুকে বললেন, মেজর সাহেব এসেছেন, আপনাকে ডাকেন।
সঙ্গে সঙ্গে কবিতা লেখা বন্ধ করে উঠে চলে গেলে মনে হবে সেও মিলিটারির ভয়ে আধমরা। এটা করা যাবে না। কলিমউল্লাহ হাতের ইশারা করল। যাতে মনে হয় সে বলছে, এখন লেখালেখি করছি। এই সময় বিরক্ত করা যাবে না। পরে আসুন।
ইশারার পরেও হেলাল সাহেব। আবারো বললেন, স্যার আপনাকে ডাকেন।
কলিমউল্লাহ এমন ভাব করে উঠল যেন সে খুবই বিরক্ত হচ্ছে লেখার মাঝখানে উঠতে হয়েছে বলে।
মেজর সাহেব তাকে দেখেই বললেন, Hello poet!
কলিমউল্লাহ বিনয় এবং লজ্জায় (লজ্জাটা অভিনয়) নিচু হয়ে গেল।
মেজর সাহেব বললেন, কী করছিলে? (কথাবার্তা হচ্ছে উর্দুতে। কাজ চালাবার মতো উর্দু এখন কলিমউল্লাহ বলতে পারে।)
পাকিস্তানকে নিয়ে একটা কবিতা লিখছিলাম স্যার।
ভালো। খুব ভালো। A poet in action.
স্যারের শরীরটা কি খারাপ?
আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে শরীর খারাপ?
ইয়েস স্যার। (মেজর সাহেবের চেহারা দেখে শরীর খারাপ মোটেই মনে হচ্ছে না। তারপরেও কলিমউল্লাহ এই ধরনের কথা বলে, যাতে উনি মনে করেন মানুষটা তাঁর শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত।)
আমার শরীর ঠিকই আছে। মন সামান্য অস্থির। যুদ্ধাবস্থায় মন অস্থির থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
যুদ্ধ কোথায় দেখলেন স্যার? পাটকাঠি দিয়ে যুদ্ধ হয় না। স্যারকে চা দিতে বলি?
না, চা খাব না। তুমি কি কিছু বাড়তি পয়সা রোজগার করতে চাও? তোমাকে আমি কাজ দিতে পারি।
স্যার, আপনার কোনো কাজের জন্যে অন্যরা পয়সা নিলে নিতে পারে। আমি কীভাবে নিব?
মেজর সাহেব বললেন, কাজ করে পয়সা নিবে। এমন এক কাজ যাতে দেশের সেবা হয়। শক্রর বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
কলিমউল্লাহর শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ব্যাটা বলে কী? যুদ্ধে যাব মানে? ছোটবেলায় গুলতি দিয়ে এক ছেলের মাথায় টং করে মার্বেল মেরেছিল। তার যুদ্ধ এই পর্যন্তই। বন্দুক দূর থেকে দেখেছে, হাত দিয়ে এখনো ছুঁয়ে দেখে নি। কলিমউল্লাহ ভােবল বলে–সব পারব স্যার, শুধু যুদ্ধটা পারব না। আমরা শাহ বংশ। শাহ বংশে মানুষ মারা নিষেধ! যা ভেবেছিল শেষ পর্যন্ত তা বলল না। মেজর সাহেব বললেই তো বন্দুক কাধে নিয়ে রওনা হতে হবে না। হাতে সময় আছে। সে বলল, জনাব। আপনি যা করতে বলবেন, আমি তাই করব। যুদ্ধ কী আমি জানি না। বন্দুক হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি নাই। কিন্তু আপনি বললে বন্দুক নিয়ে শক্রর মোকাবিলা করব। আল্লাহর কীরা, আমাদের নবিজীর কীরা।
মেজর সাহেব বললেন, যুদ্ধ মানেই যে বন্দুক নিয়ে গোলাগুলি তা তো না। যুদ্ধের অনেক ধরন আছে। এই যে আমি পত্রিকা অফিস, রেডিও-টেলিভিশন অফিসে ছোটাছুটি করছি এইটাও যুদ্ধ। তোমাকে আমি একজনের ঠিকানা দেব। তাকে আমি তোমার কথা বলেছি, সে তোমাকে কাজ দিবে।
আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ঠিকানা লিখে দেন। আমি আজই উনার কাছে যাব। উনার নাম কী?
তার নাম জোহর। পূর্ণিয়া জেলায় বাড়ি! খুব পড়াশোনা জানা লোক। তুমি যেমন কবিতা লেখ, সেও কবিতা লেখে।
বলেন কী? স্যার, আপনি আমাকে একটা চিঠি লিখে দেন। চিঠি নিয়ে উনার সঙ্গে দেখা করব।
চিঠি ফিটি কিছুই লাগবে না। তুমি তোমার নাম বলবে তাতেই হবে।
আপনার নাম কি স্যার বলব? আপনি পাঠিয়েছেন এটা বলব?
কিছু বলতে হবে না।
মেজর সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। অন্য কোথাও যাবেন। কলিমউল্লাহ বলল, স্যার, এক কাপ চা খেয়ে যান। আপনার সঙ্গে চা খাব বলে আমি এখনো চা খাই নাই।
মেজর সাহেব। আবারো বসলেন। কলিমউল্লাহ ছুটে গেল চা আনতে।
জোহর সাহেবকে দেখে কলিমউল্লাহর আশাভঙ্গ হলো। সে ভেবেছিল জোহর সাহেব খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজৎ, ব্যক্তি। তার চালচলন হাবভাব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মতো হবে। চেহারা ও কাজের গুরুত্বের সঙ্গে মানানসই হবে। কথায় আছে–পহেলা দর্শনধারি।
বাস্তবের জোহর সাহেব আধাবুড়া একজন মানুষ। মাথার চুল কালো ঠিক আছে, মুখভর্তি সাদা খোচা খোচা দাড়ি। চোখের নিচে কালি। চোখ গর্তে ঢুকে আছে। সেই চোখ। আবার গাজাখোরদের চোখের মতো লাল। এই গরমেও তার গায়ে চাদর। চাদরটা আধময়লা। লোকটা চেয়ায়ে পা তুলে বসে আছে। যেকোনো কাবাবের দোকানের এসিসটেন্ট হলে তাকে মানাত। কাবাবের মতোই আগুনে ঝলসানো চেহারা।
কলিমউল্লাহ বলল, মেজর সিদিক সাহেব আপনার কাছে আমাকে পাঠিয়েছেন।
জোহর সাহেব তার দিকে না তাকিয়ে শুদ্ধ বাংলায় বলল, আচ্ছা।
কলিমউল্লাহ বুঝতে পারল না এখন সে কী করবে। জোহর সাহেবের সামনের কাঠের চেয়ারটা টেনে বসবে? না-কি দাঁড়িয়েই থাকবে? জানালা বন্ধ ছোট্ট একটা ঘর। খালি চেয়ার বলতে একটাই, সেটাও অনেকটা দূরে। দুজন লোক বসলে বসবে মুখোমুখি। একজন এক কোনায় অন্য আরেকজন আরেক কোনায় বসবে না-কি! কে জানে হয়তো জোহর সাহেবের সঙ্গে কথা বলার নিয়মই এই। ঘরে সিগারেটের কটু গন্ধ। কলিমউল্লাহ নিজে সিগারেট খায়। তারপরেও সিগারেটের গন্ধে তার বমি এসে যাচ্ছে। ]
কলিমউল্লাহ বলল, মেজর সাহেব বলেছেন, আপনি একজন কবি। আপনাকে দেখার শখ ছিল।
জোহর বলল, আপনার ডানদিকে সুইচ আছে। সুইচটা জেলে দেন। ঘর আলো হোক। তারপর আমাকে ভালোমতো দেখেন।
কলিমউল্লাহ মনে মনে বলল, তুমি তো বাবাজি ত্যান্দির আছ। নিজেরে কি ভাবতেছ, টিক্কা খান?
মনের কথা কেউ শুনতে পায় না–এটা বিরাট সুবিধার একটা বিষয়! কলিমউল্লাহ বাতি জ্বালাতে জ্বালাতে বলল, স্যার, আমি কি চেয়ারটা এনে আপনার সামনে বসব?
জোহর বলল, আচ্ছা বসুন।
স্যার, আমি নিজেও একজন কবি। টুকটাক কবিতা লেখি। ইদানীং গদ্য লেখার চেষ্টা করছি।
ভালো। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। যুদ্ধের রাজ্যে পৃথিবী কী?
কলিমউল্লাহর মুখে চট করে কোনো উত্তর এলো না। এই বিহারি কাবাবওয়ালা সুকান্তের কবিতা জানে–খুবই আশ্চর্যের কথা। মেজর সাহেব অবশ্যি বলেছিলেন পড়াশোনা জানা লোক। সে চেয়ার টেনে জোহর সাহেবের সামনে বসতেই জোহর সাহেব বললেন, আপনি আরেকদিন আসুন। আজ আমার শরীরটা ভালো না।
কলিমউল্লাহ। সঙ্গে সঙ্গে বলল, জি আচ্ছা। স্যার, কবে আসব?
যে-কোনো দিন আসতে পারেন। আমি এই ঘরেই বেশিরভাগ থাকি। গর্তজীবী হয়ে গেছি।
স্যার তাহলে যাই। স্নামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম। আপনার সঙ্গে কাগজ-কলম আছে?
কলিমউল্লাহ উৎসাহের স্বরে বলল, জি স্যার আছে, আমি সবসময় সঙ্গে কাগজ-কলম রাখি।
একটা ঠিকানা লেখেন।
কলিমউল্লাহ ঠিকানা লিখল। জোহর সাহেব বললেন, ঠিকানাটা একজন পুলিশ ইন্সপেক্টরের বাসার, নাম মোবারক হোসেন।
স্যার, আমি কি উনার সঙ্গে দেখা করব?
উনার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হবে না। উনি পঁচিশে মার্চের রাতে মারা গেছেন। আপনি উনার পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে দেখা করবেন। ইন্সপেক্টর সাহেব যে মারা গেছেন–এই সংবাদ সম্ভবত তার পরিবারের লোকজন জানে না।
স্যার, আমি কি সংবাদটা তাদের দিব?
আপনাকে কোনো সংবাদ দিতে হবে না! ইন্সপেক্টর সাহেবের ফ্যামিলি কেমন আছে, তাদের কোনো সমস্যা আছে কি-না–এটা জেনে আসবেন। আমি এই পরিবারের জন্যে কিছু করতে চাই। ইন্সপেক্টর সাহেব একজন খাঁটি মানুষ ছিলেন। ভেজাল মানুষের যুগে খাঁটি মানুষ পাওয়া মুশকিল। দুএকটা খাঁটি মানুষ যখন দেখি, তখন ভালো লাগে।
স্যার, আপনার কথা কি উনাদের বলব?
আমার কথা বলার কোনো দরকার নাই। কলিমউল্লাহ সাহেব?
জি স্যার?
আপনি কেমন মানুষ? খাঁটি মানুষ, না ভেজাল মানুষ?
আমি স্যার ভেজাল।
ঠিক আছে আমাদের ভেজাল মানুষই দরকার। এখন যান।
স্যার স্লামালিকুম।
জোহর সাহেব সালামের জবাব না দিয়ে সিগারেট ধরালেন।
কলিমউল্লাহ মনে মনে বলল, শালা কাবাবওয়ালা!
হ্যালো কবি, মনে মনে কী ভাবছ?
কলিমউল্লাহ চমকে উঠল। এই শালা কি মনের কথা বুঝতে পারে? বিচিত্র কিছু না। পৃথিবীতে নানান কিসিমের মানুষ আছে। কলিমউল্লাহ বিনীত ভঙ্গিতে বলল, স্যার আমি কিছু ভাবছি না। কবিতার একটা লাইন মাথায় এসেছে। ঐটা নিয়ে নাড়াচাডা করছি।
বেশি নাড়াচাড়া করবেন না। ভেঙে যেতে পারে।
জি আচ্ছা স্যার।
বিদায় হন। ক্লিয়ার আউট।
জি আচ্ছা স্যার।
হুমায়নের লেখা পড়তে শুরু করলে শেষ না করে উঠতে পারিনা। অসাধারন সব লেখাজোখা।