তুতানখামেন
‘যিশুর জন্মের প্রায় তেরোশো বছর আগেকার কথা। হঠাৎ করে রাজা আখেনাতেনের মৃত্যুর পরে মিশরের মসনদে যে নতুন রাজা এলেন তাঁরর বয়স মাত্র নয়। ওঁর জন্মের সময়েই মা কিয়া মারা যান। বড়ো হয়ে ওঠা ধাইমা মাইয়ার কাছে। বালক রাজাকে সিংহাসনে বসিয়ে রাজত্ব চালাতে লাগলেন মন্ত্রী আই। ছোটোবেলা থেকেই সে-ছেলে দুর্বল। লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারত না, বার বার ম্যালেরিয়াতে ভুগত। নিজেরই সৎ বোন আনখেসেনামেনকে বিয়ে করে সে। দু-জন সন্তান হয়, কিন্তু তাদের দু-জনেই মারা যায় গর্ভাবস্থাতেই। রাজা নিজেও হঠাৎই মাত্র উনিশ বছর বয়সে মারা যান। সঙ্গেসঙ্গেই তড়িঘড়ি করে তাঁরকে সদ্য সদ্য বানানো একটা ছোট্ট সমাধিতে শুইয়ে নিজের দায়িত্ব সারেন মন্ত্রী ‘‘আই’’। তারপরেই নিজেকে মিশরের ফারাও বলে ঘোষণা করেন। যেখানে যেখানে এই বালক রাজার নাম লেখা ছিল তা মুছে ফেলা হয়। মন্দিরের দেওয়ালে খোদাই করা ছবি নষ্ট করে দেওয়া হয়। আই চেয়েছিলেন যাতে এই ফারাওকে কেউ আর মনে না রাখে। কিন্তু ইতিহাসের মজাটা এমনই যে আজকে আইকেই কেউ মনে রাখেনি। অন্যদিকে হেন মানুষ নেই যে সেই অতিসাধারণ রুগ্ন ফারাওয়ের নাম শোনেনি। তার নামের মানে ছিল সূর্যদেবতা আমেনের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। আমরা ওকে চিনি তুতানখামেন বলে।’
‘তার মানে বলছেন তুতানখামেন একজন খুব ইনসিগনিফিক্যান্ট ফারাও। তাহলে এত বিখ্যাত কেন?’
‘বিখ্যাত হওয়ার কারণটা তো খুবই সহজ, স্পন্দন ভাই। একমাত্র তুতানখামেনই সেই ফারাও যাঁর কবর প্রায় অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। সেই কবরের ঐশ্বর্যে তাক লেগে যায় গোটা পৃথিবীর। সঙ্গে এসে বসে একটা মিথ। ফারাওয়ের অভিশাপের! ব্যস, এর পরে মানুষ আর কিং তুতকে ভুলতে পারেনি।’
পিজি বলল,
‘হ্যাঁ, পড়েছিলাম বটে যে তুতানখামেনের সমাধি আবিষ্কারের সঙ্গে যে অভিশাপটার কথা আগে বলা হত তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।’
‘ঠিক বলেছ, একদমই নেই। তবে রহস্য জড়িয়েই আছে। আর আছে রাজনীতি, যে ব্যাপারে অনেকেই কথা বলে না।’
‘রাজনীতি? সেটা কীভাবে?’
ভবেশদা এতক্ষণ একটা টুথপিক দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে কথা বলছিলেন, মেসের মৌরির টুকরো আটকে গিয়েছিল মনে হয়। এবারে টুথপিকটাকে জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে বললেন,
‘তাহলে একদম গোড়া থেকেই গল্পটা বলি শোনো।
‘১৮৯১ সালের মে মাসের একটা দিন, ইংল্যান্ড। ইজিপ্টোলজিস্ট পার্সি নিউবেরি মিশরে যাবেন এক্সক্যাভেশনের কাজে। তাঁরর একজন এমন হেল্পারের দরকার যে খুব ভালো ছবি আঁকতে পারে। এই কথাটা বন্ধু উইলিয়াম আর্মহার্স্টকে বলার সঙ্গেসঙ্গেই সে বলল তার আরেক বন্ধুর এক ছেলে আছে বটে। পড়াশোনা তেমন কিছু হয়নি ছোটোবেলা থেকে। তবে খুব ভালো আঁকতে পারে সে। যা দেখবে চটজলদি একেবারে অবিকল এঁকে দেবে। ব্যস, মাত্র সতেরো বছর বয়সে সেই ছেলে বাড়ি ছেড়ে পাড়ি দিল ইজিপ্টে। সে-ই পরের মাত্র পনেরো বছরের মধ্যে হয়ে উঠল উত্তর ইজিপ্টের ডিপাৰ্টমেন্ট অফ অ্যান্টিকুইটির ম্যানেজার! ওর কথা ছাড়া মাটিতে বেলচা চালানোই যাবে না। এ-ই হল হাওয়ার্ড কার্টার।’
‘মানে, আর্কিয়োলজিস্ট নিজেই অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের হেড?’
‘তবে আর বলছি কী। কার্টার নিজেই ঠিক করতেন কাকে কোথায় এক্সক্যাভেশনের কাজ দেওয়া হবে। মিশরের রাজনৈতিক মানচিত্রটা তখন অদ্ভুত, বুঝলে। দেশ চালানোর দায়িত্ব মিশরের গভর্নমেন্টের থাকলেও আর্কিয়োলজির দিকটা পুরোপুরি ছিল ব্রিটিশদের দখলে। কায়রো হোটেলের লবিতে তখন প্রতিদিন দেখা যেত ইউরোপীয় ধনকুবেরদের। সবার একটাই লক্ষ্য। একটা ভালো জায়গায় খুঁড়তে দেওয়ার পারমিশন জোগাড় করা, তার পরে সেখানে একজন ভালো আর্কিয়োলজিস্ট লাগিয়ে কাজ করানো। তারপরে সেখান থেকে যা সম্পদ উঠবে তা নিয়ে দেশে ফেরা। কতটুকু মিশরের গভৰ্নমেন্টের হাতে থাকবে সেটাও ডিপাৰ্টমেন্ট অফ অ্যান্টিকুইটিই ঠিক করে দেবে। এইভাবেই কতশত ঐশ্বর্য যে ইউরোপের কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এইসব মিলিওনিয়ারদের একজন ছিলেন জর্জ হার্বার্ট, যাঁকে ছাড়া তুতানখামেনের সমাধি খুঁজে বের করা সম্ভব ছিল না।’
‘ইনি আবার কে? আমরা তো…’
‘লর্ড কার্নারভনের নাম শুনেছ তো? জর্জ হার্বার্ট ছিলেন ইংল্যান্ডের কার্নারভন শহরের পঞ্চম আর্ল। সেখান থেকেই এমন নাম।
‘নামে লর্ড হলেও সেইসময় লর্ড কার্নারভনের অবস্থা খুব একটা ভালো কিছু নয়। বাজারে বিশাল দেনা। যেকোনো দিন নিজের জমিজায়গা বিক্রি করতে হতে পারে। এই দেনা শোধ করতে যে টাকা লাগবে সেটা আনার পথ কী? একমাত্র জুয়ো খেলেই রাতারাতি সেই টাকা জোগাড় করা সম্ভব। লর্ড কার্নারভন নিজের শেষ সম্বল দিয়ে সেই জুয়ো খেললেন মিশরের ওপরে।
‘কায়রো আসার পরেই কার্নারভনের সঙ্গে দেখা হয় কার্টারের। কার্টার কার্নারভনকে বোঝান যে ভ্যালি অফ দ্য কিংসে তিন হাজার বছরের পুরোনো এক রাজার ঐশ্বর্য লুকিয়ে আছে। সেটা একবার খুঁজে পেতে পারলে কার্নারভনের দেনা হেসে-খেলে শোধ করে দেওয়া যাবে। বলা বাহুল্য, কার্টার এখানে তুতানখামেনের সমাধির কথাই বলছিলেন।’
‘কিন্তু ভবেশদা, এখানে একটা খটকা থেকে গেল। একটু আগে আপনি বললেন যে ভ্যালি অফ দ্য কিংসে এতবার খোঁড়াখুঁড়ি হয়ে এত কবর আবিষ্কার হয় যে সবাই ভেবেই নিয়েছিল যে সেখানে আর কিছু নেই। তাহলে হাওয়ার্ড কার্টার এত শিয়োর হলেন কী করে?’
‘ঠিক শিয়োর না বুঝলে, তবে একটা বড়োসড়ো অনুমান উনি করতে পেরেছিলেন। ভ্যালি অফ দ্য কিংস থেকেই পাওয়া ছোটো ছোটো ক্লু ওঁকে বলে দিয়েছিল যে কাছেপিঠেই কোথাও তুতানখামেনের সমাধি লুকিয়ে থাকলেও থাকতে পারে। যেমন ধরো, একটা ভাঙা কাপে আর একটা ছোটো কাঠের বাক্সে ফারাওয়ের নাম পাওয়া গিয়েছিল। আবার ওই ভ্যালিতেই একটা ছোটো গর্তে পাওয়া গিয়েছিল তুতানখামেনকে মমি বানানোর জন্য ব্যবহৃত মালমশলা।
১৯২২ সােলর ভ্যালি অফ দ্য কিংস। হাওয়ার্ড কার্টার তখন খোঁড়াখুঁড়ি করছেন।
প্রায় সােড় তিন হাজার বছর আগে ভ্যালি অফ দ্য কিংস-এ তুতানখামেনের সমাধিযাত্রা
‘তা যেটা বলছিলাম, কার্নারভনকে রাজি করিয়ে হাওয়ার্ড কার্টার নিজেই ভ্যালি অফ দ্য কিংসের আর্কিয়োলজির কাজ অথোরাইজ করলেন। নিজের নামই দিলেন চিফ আর্কিয়োলজিস্ট হিসেবে। তারপরে কাজ হল শুরু।
‘কার্টার কাজ শুরু করেন ১৯১৪ সালে। কিন্তু গোটা ভ্যালি অফ দ্য কিংস তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেলেও কিচ্ছু পাওয়া যাচ্ছিল না। শুধু পঞ্চম রামেসিসের একটা সমাধি খুঁজে পাওয়া গেল, সেটাও তেমন কিছু নয়। অন্যদিকে লর্ড কার্নারভনের ধৈর্য আর অর্থ দুইই ফুরিয়ে আসছিল। ১৯২২ ছিল কার্টারের জন্য শেষ সুযোগের বছর।
‘২৮ অক্টোবর, ১৯২২। হাওয়ার্ড কার্টার তখন আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। অন্যদিকে এতবার খোঁড়াখুঁড়ি চালাবার জন্য বিস্তর ময়লা জমা হয়েছিল গোটা ভ্যালি জুড়ে। একটা বড়ো ঢিপি তৈরি হয়েছিল সদ্য-খুঁজে-পাওয়া ষষ্ঠ রামেসিসের কবরের বাইরে। সেইখানটাই আবার ভ্যালিতে ঢোকার রাস্তা। সামনেই শীতকাল আসছে। দলে দলে টুরিস্ট আসতে শুরু করবে। ওই ময়লার ঢিপি পরিষ্কার না করলে তাঁররা ভ্যালিতে ঢুকবেন কী করে?
‘লেবাররা যখন ময়লা পরিষ্কারের কাজ করছে তখন হাওয়ার্ড নিজের তাঁবুতে বসে একটা সিগারেট ধরিয়েছেন। সেটা অর্ধেক শেষ হয়েছে এমন সময় একজন শ্রমিক হাঁফাতে হাঁফাতে ওঁর তাঁবুতে এসে ঢুকল। ময়লা পরিষ্কার করার সময়ে বালির নীচে নাকি একটা মসৃণ পাথরের স্ল্যাব দেখা গেছে, দেখে মনে হচ্ছে একটা সিঁড়ির প্রথম ধাপ! নেমে গেছে ষষ্ঠ রামেসিসের সমাধির নীচের দিকে।
‘দিন সাতেক পরে যখন আরও বালি, নুড়ি, পাথর সরানো সম্ভব হল তখন কার্টার দেখলেন এটা সত্যি একটা সিঁড়ি। দশ ফুট মতো নীচে নেমে গেছে। নভেম্বরের ৫ তারিখে কার্টার সেই সিঁড়ির শেষ ধাপে গিয়ে পৌঁছোলেন। ওঁর সামনে তখন একটা পাথরের দরজা! দরজার গায়ে লাগানো সিলে একটা কার্তুজ আঁকা। তাতে গোটা গোটা করে হায়রোগ্লিফে লেখা আছে আমেন-তুথ-আঁখ। মানে, এইটাই তুতানখামেনের সমাধি!!’
‘কার্টার দরজাটা খুললেন তখন?! কী পেলেন!’
‘না ভায়া, দরজা খোলার বদলে কার্টার ওঁর শ্রমিকদের নির্দেশ দিলেন সিঁড়িটা আবার নুড়িপাথর দিয়ে বুজিয়ে দিতে।’
‘অ্যাঁ, এ কীরকম উদ্ভট চিন্তাভাবনা।’
‘উদ্ভট চিন্তা নয়। কার্টারের কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা এটা। লর্ড কার্নারভনের সাহায্য ছাড়া তো এই সমাধি কার্টার আবিষ্কার করতে পারতেন না। তাই উনি চেয়েছিলেন কার্নারভনই যেন সেই সমাধিতে প্রথম পা রাখেন। রাতারাতি একটা ছোটো নৌকোয় চড়ে কার্টার চলে এলেন লাক্সরে। সেখানকার টেলিগ্রাম অফিস থেকে কার্নারভনকে একটা মেসেজ পাঠালেন। তার জবাবও এল জলদি।
‘পরের তিনটে সপ্তাহ কার্টারের কাটল অপেক্ষা করতে করতে। টেনশনে রাতের ঘুম চলে গেছে। যদিও মোটা টাকার বিনিময়ে শ্রমিকদের কাছ থেকে এই আশ্বাস আদায় করা গেছে যে তারা এই টুম্বের কথা কাউকে বলবে না, তবুও যদি কেউ একবার জেনে ফেলে! মরুভূমির মধ্যে ডাকাতদের আক্রমণের সামনে কার্টার কিচ্ছু করতে পারবেন না। অবশেষে নভেম্বরের ২৩ তারিখে কার্নারভন কায়রোতে এসে পৌঁছোলেন। সঙ্গে ওঁর একুশ বছরের মেয়ে লেডি এভিলিন। সেই দিনটা হোটেলে রেস্ট নিয়ে ২৪ তারিখের ভোরবেলায় চলে এলেন ভ্যালি অফ দ্য কিংসে। ততক্ষণে কার্টারের দলবল আবার সেই সিঁড়ির মধ্যের বালি সরানো শুরু করে দিয়েছে। আবার একটা গোটা দিন লাগল সেই পাথরের দরজাটা অবদি পৌঁছোতে।
তুতানখামেনের সমাধির প্রবেশপথ
‘২৫ নভেম্বর। কার্নারভন দাঁড়িয়ে সেই দরজার সামনে। ওঁর দিকে তাক করে থাকা ক্যামেরা অপেক্ষা করছে ঐতিহাসিক মুহূর্তটাকে ধরে রাখার জন্য। খোলা হল সেই দরজা আর সঙ্গেসঙ্গেই দেখা গেল…’
‘তুতানখামেনের ঐশ্বর্য!’
‘ধুস, দেখা গেল নীচে নেমে যাওয়ার আরেকটা সিঁড়ি। সেটা গিয়ে শেষ হয়েছে আরেকটা পাথরের দরজাতে। তার গায়েও তুতানখামেনের নাম লেখা সিলমোহর।
তুতানখামেনের সমাধির সামনে হাওয়ার্ড কার্টার ও লর্ড কার্নারভন
পাথরের দরজার গায়ে লাগানো সিলে হায়রোগ্লিফের লেখা
‘২৬ নভেম্বরের সকাল বেলায় আবার সবাই মিলে আগের দিনের খুঁজে পাওয়া দরজার সামনে উপস্থিত হলেন। এবারে কার্টার লোহার রড দিয়ে সেই দরজার গায়ে একটা গর্ত করলেন। তারপরে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে ভিতরে উঁকি
মারলেন।
অনেকদিনের জমে থাকা বাতাসে মোমবাতির শিখা প্রথমে কেঁপে উঠে শান্ত হল। ভেতরের অন্ধকারের সঙ্গে কার্টারের চোখের ধাতস্থ হতে সময় লাগল একটু। এবারে ওঁর চোখ দুটো খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল! পিছন থেকে লর্ড কার্নারভন ফিসফিস করে জানতে চাইলেন
‘ ‘‘কিছু দেখতে পাচ্ছ!?’’
‘উত্তরে কার্টার বলল,
‘‘ইয়েস, ওয়ান্ডারফুল থিংস!!’’
‘কার্টারের চোখের সামনে তখন সোনা চকচক করছে! আর মোমবাতির আলোয় যে ছায়া তৈরি হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে একটা অদ্ভুত জন্তুকে!
‘পাথরের দরজা পুরোপুরি সরিয়ে ফেলার পরে ব্যাপারটা ভালো করে বোঝা গেল। একটা ছোটো ঘর। তাতে ঠেসে বোঝাই করা আসবাবপত্র। গোটা তিনেক খাট, কাঠের তৈরি, সোনায় মোড়ানো। খাটগুলোর পায়ার জায়গায় জন্তুর মুখ বানানো। তার ছায়াই কার্টার দেখতে পেয়েছিলেন। সেই ঘরের পশ্চিমের দেওয়ালে পাওয়া গেল আরেকটা ছোটো ঘর। দুটো ঘর মিলিয়ে খাটগুলো ছাড়াও আর যা যা ছিল সেগুলো হল একটা রথ, বাক্স বোঝাই জামাকাপড়, পারফিউমের বোতল। আর পাওয়া গিয়েছিল কিছু শুকিয়ে যাওয়া ফল, রুটি আর মদের পাত্র।’
সেই মুহূর্ত !!
‘মানে, মৃত রাজার যাতে পরবর্তী জগতে কোনো প্রবলেম না হয় তার সব রকমের ব্যবস্থাই। এটা আগেও বলেছিলেন তো।’
‘হ্যাঁ, এরকমটা সব সমাধিতেই থাকত।’
‘কিন্তু, সেই আসল জিনিসটা কোথায়?! তুতানখামেনের মমি!’
তুতানখামেনের কবরের ঐশ্বর্য (দ্রষ্টব্য রঙিন ছবি পৃ. ১৭)
‘সবুর করো, বলছি। কার্টার এত বড়ো একটা ঐশ্বর্য পেয়েও নিজেকে আশ্চর্যরকম শান্ত রেখেছিলেন। গোটা মিশরের আর্কিয়োলজির ইতিহাসে এমন কিছু আর হয়নি। সেটা উনি খুব ভালোভাবেই জানতেন। তাই সমাধির প্রতিটা জিনিসকে যত্ন করে প্রিজার্ভ করার দিকে আগে মন দিলেন। ইউরোপ আর আমেরিকার সেরা এক্সপার্টদের ডেকে আনা হল। তাদের কাজ করার জায়গা হল আশেপাশের সমাধিগুলো। আর্কিয়োলজিকাল ফোটোগ্রাফার হ্যারি বার্টন সেই সময়ে ওখানেই ছিলেন, নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়ামের হয়ে কাজ করতে। তাঁরকে দলে নেওয়া হল। হ্যারির কাজ ছিল সমাধির প্রতিটা জিনিসের গায়ে হাত দেওয়ার আগে তার ছবি আগে তুলে রাখা। ছবিগুলো ডেভেলপ করার জন্য কে ভি ৫৫ বেছে নেওয়া হল, যেটা ছিল তুতানখামেনের ভাইয়ের সমাধি। আরও কয়েকটা টুম্বের মধ্যে তৈরি করা হল ল্যাবরেটরি আর ওয়ার্কশপ। এগুলো করতেই লেগে গেল দু-মাস।
‘বাইরের জগতে ততদিনে তুতানখামেনের সমাধি আর তাঁরর গুপ্তধনের কথা ছড়িয়ে গেছে। ভ্যালি অফ দ্য কিংসে তখন গিজগিজ করছে রিপোর্টার আর টুরিস্ট। সবাই রোজ ভোর বেলায় টিফিন বক্সে খাবার আর বোতলে জল নিয়ে চলে আসে, এসে জটলা করে সমাধির উলটোদিকের উঁচু পাঁচিলে। সারাদিন ধরে তারা হাঁ করে টুম্বের দরজার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। এই যদি একটা নতুন আবিষ্কার হওয়া জিনিস দেখা যায়! মাঝে মাঝে কার্টারের মনে হত এত লোকের চাপে ওই পাঁচিল না ভেঙে পড়ে। তাহলে আরেকটা নতুন সমাধি তৈরি হয়ে যাবে!
ভ্যালি অফ দ্য কিংস-এ তখন গিজগিজ করছে রিপোর্টার আর টুরিস্ট
দরজার দু-পাশে দাঁড় করানো মূর্তি
‘সেই যে ছোটো ঘরটার মধ্যে খাটগুলো পাওয়া গিয়েছিল তার উত্তরদিকের দেওয়ালে ছিল আরেকটা দরজা। দরজার দু-পাশে দাঁড় করানো ছিল দুটো প্রমাণ সাইজের তুতানখামেনের মূর্তি। যেন ওরা অতন্দ্র প্রহরীর মতো কিছু পাহারা দিচ্ছে। কার্টার বুঝতে পেরেছিলেন ওর পিছনেই আছে তুতানখামেনের সারকোফেগাস। একদিন রাতের অন্ধকারে কাউকে কিছু না বলে সেই দেওয়ালের গায়ে গর্ত করে কার্টার, কার্নারভন আর লেডি এভিলিন ঢোকেন। সামনে রাখা বিশাল সোনায় মোড়ানো একটা বাক্স দেখে ফিরে আসেন।
‘তিনমূর্তির এই রঁদেভুর কথা যদিও আর কাউকে জানানো হয়নি। ১৭ নভেম্বরে ঘটা করে বেশ কিছু আর্কিয়োলজিস্ট আর গভর্নমেন্টের অফিশিয়ালদের সামনে উত্তরের দরজাটা খোলেন কার্টার। দরজা খুলতেই দেখা গেল সেই সোনায় মোড়ানো বাক্সটাকে। তার সামনেই ছিল একটা দরজা। সেই দরজা খুলে বেরোল আরেকটা বাক্স। তার মধ্যে আরেকটা বাক্স।
‘এত অবধি কাজ এগোবার পরে কার্টারের মনে হল এই ক-মাসে অক্লান্ত পরিশ্রমের পরে একটু বিশ্রাম নেওয়ার দরকার। অন্তত দিন দশেকের জন্য। তারপরে না হয় আবার পুরোনো উদ্যমের সঙ্গে কাজ শুরু করা যাবে।
‘টুম্বের দরজায় লোহার গেট বসিয়ে বাইরে আঁটোসাটো গার্ডের ব্যবস্থা করা হল। কার্টার চলে এলেন লাক্সরের হোটেলে। লর্ড কার্নারভন মেয়ের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন আসওয়ানের উদ্দেশে। নীল নদের পথে। নিছকই টুরিস্ট হিসেবে।
তুতানখামেনের সারকোফেগাসকে ঘিরে একাধিক সোনায় মোড়ানো বাক্স
বর্তমানে কায়রো মিউজিয়ামে রাখা তুতানখামেনের সোনায় মোড়ানো কাঠের বাক্স
‘নৌকোতেই কার্নারভনের গলায় একদিন একটা মশা কামড়াল। খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু পরের দিন শেভ করার সময় সেই জায়গাটা আবার কেটে ফেললেন কার্নারভন। সঙ্গেসঙ্গে সেখানে আয়োডিন লাগালেও ঘা সারল না। রক্তে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ল। তার সঙ্গে হল নিউমোনিয়া। ওঁকে জলদি কায়রোতে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হলেও বাঁচানো গেল না। ৫ এপ্রিল, ১৯২৩-এ রাত ১.৪৫-এ মারা গেলেন জর্জ হার্বার্ট ওরফে লর্ড কার্নারভন। ঠিক সেই সময়েই নাকি ইংল্যান্ডে কার্নারভনের পোষা কুকুরটিও মারা যায়। এই ঘটনার ক-দিন আগে কার্টারের পোষা ক্যানারি পাখিরও নাকি একই পরিণতি হয় বিষাক্ত কোবরার ছোবলে।
হাওয়ার্ড কার্টারের তত্ত্বাবধানে তুতানখামেনের সমাধি থেকে ঐশ্বর্য বের করে আনা হচ্ছে
‘কয়েক সপ্তাহ পরে ইংল্যান্ডের বিকন হিলে যখন কার্নারভনকে কবর দেওয়া হচ্ছে তখন আকাশে খুব নীচু দিয়ে উড়ছিল মিডিয়ার ভাড়া করা এরোপ্লেন। লক্ষ্য একটাই, লর্ডের শেষ মুহূর্তের ছবি তুলে রাখা।
‘পরের দিনই সবকটা নিউজপেপারের প্রথম পাতার খবর ছিল একই। ফারাওয়ের অভিশাপেই নাকি কার্নারভনের মৃত্যু হয়েছে! হাওয়ার্ড কার্টার নিজে বার বার বলার চেষ্টা করলেন, যে তুতানখামেনের কবরে কোনো বিষ, কোনো অভিশাপ ছিল না। তাও কেউ ওঁর কথার পাত্তাই দেয়নি সেইসময়ে।’
কার্নারভনের মৃত্যু নিয়ে সংবাদপত্রের খবর
‘কিন্তু ভবেশদা, আমি শুনেছিলাম তুতানখামেনের কবরের গায়ে নাকি লেখা ছিল, যে এই সমাধির ভিতরে ঢুকবে, ফারাওয়ের অভিশাপ তাকেই গ্রাস করবে।’
‘ধুর, এরকম কিচ্ছু ছিল না আদৌ, গোটাটাই গুজব।’
‘কিন্তু শুধু তো কার্নারভনই নন, কার্টারের টিমের আরও দু-জন নাকি পর পর মারা যান ওই সময়েই।’
‘দেখো, সেটাও কোইন্সিডেন্স ছাড়া আর কিছুই নয়। তুতানখামেনের টুম্ব খুঁজে বের করার কাজে জড়িত ছিলেন সব মিলিয়ে ছািব্বশ জন। তাঁরদের মধ্যে মাত্র ছ-জন পরের দশ বছরে মারা যান। স্বয়ং হাওয়ার্ড কার্টার বহাল তবিয়তে বেঁচেছিলেন আরও ষোলো বছর। আর লেডি এভিলিন মারা যান ১৯৮০তে। তুতানখামেনের অভিশাপ একটা মিথ ছাড়া আর কিচ্ছু না। সেইসময় পপুলার কালচারে অবশ্য এর বেশ ভালো প্রভাব পড়েছিল। মমির অভিশাপ নিয়ে বেশ কিছু সিনেমা তৈরি হয় সেইসময়। অনেক নীচু মানের থ্রিলার বইও বেরোয় বাজারে।’
পিজি এবারে বলল,
‘হুম, আমিও ভেবেছিলাম এটা গুজবই। এই স্পন্দনের মতো ভূতে-ভয়-পাওয়া কয়েকটা লোকজনই নির্ঘাত এটা ছড়িয়েছিল। আপনি কার্টারের গল্পে ফিরে আসুন ভবেশদা। তুতানখামেনের মমির কী হল?’
অন্য সময় হলে পিজি আমার হাতে মার খেত। কিন্তু তখন ভবেশদার ইকুইলিব্রিয়ামটা নষ্ট করার কোনো ইচ্ছা ছিল না আমার। তাই চুপ রইলাম। ভবেশদা ঢকঢক করে আধ বোতল জল খেয়ে আবার শুরু করলেন,
‘১৯২৪-এর ফেব্রুয়ারি মাসে তুতানখামেনের সমাধিতে আবার কাজ শুরু করেন কার্টারবাবু। শেষ বাক্সটা খোলার পরেই দেখা যায় হলুদ কোয়ার্টজাইট পাথরের তৈরি একটা সারকোফেগাস। সেটা খোলার পরেই দেখা গেল কাঠের তৈরি কফিন। ফারাওয়েরই অবয়বে তৈরি। গলায় শুকনো ফুলের মালা। এরকম আরও দুটো কফিনের পরে পাওয়া গেল একদম সোনা দিয়ে তৈরি করা সেই কফিন, যার মধ্যে শোয়ানো আছে তুতানখামেনকে। ফারাওয়ের মুখের ওপরে বসানো সোনার তৈরি মুখোশ, যেটা কাঁধ অবদি নেমে এসেছে। তুতানখামেন বলতে এখন এই মুখোশটার ছবিই সবাই জানে। ফারাওয়ের কোমরের কাছে রাখা ছিল একটা সোনার তৈরি ছুরি। সারা শরীরে ছিল ১৪৩ পিস অ্যামুলেট, যাতে রাজা ঠিকঠাক অন্য জগতে যেতে পারে।
তুতানখামেনের মমি (উপরে),
তাঁর অবয়বে তৈরি একাধিক কফিন (পাশে)
কায়রো মিউজিয়ামে রাখা তুতানখামেনের চেয়ার, ছুির ও অ্যামুলেট (তাবিজ)
‘ফারাওয়ের মমির অবস্থা কিন্তু খুব একটা ভালো ছিল না, সমাধিস্থ করার সময় পুরোহিতরা মমির গায়ে যে রেজিনের প্রলেপ লাগিয়েছিল সেটা তিন হাজার বছরে অক্সিডাইজড হয়ে কালো চ্যাটচ্যাটে একটা পদার্থে পরিণত হয়। তুতানখামেনের মমিকে সাবধানে কফিন থেকে বের করতেই কালঘাম ছুটে গিয়েছিল সবার। এর মাঝে কার্টার নিজেও একটা ভুল করে বসেন। ফারাওয়ের মুখোশটা মমির গায়ে একদম চেপে বসেছিল। ছুরির ডগা গরম করে সেটা দিয়ে মুখোশটাকে আলাদা করেন কার্টার। তাতে তুতানখামেনের মুখের অনেক ক্ষতি হয়। এখন সেই মমি রাখা আছে তুতানখামেনের সেই সমাধিতেই। ভ্যালি অফ দ্য কিংসে, কে ভি ৬২।’
‘ভবেশদা, ছোটোবেলায় ‘‘আনন্দমেলা’’তে একটা আর্টিকল পড়েছিলাম, যে, তুতানখামেনকে নাকি খুন করা হয়, এটা কি সত্যি?’
‘সেটা বলা খুব মুশকিল ভায়া, তুতানখামেনের মৃত্যুটা বেশ রহস্যময়, বুঝলে। খুন না অ্যাক্সিডেন্ট, সেটা কেউ ভালো করে বুঝতে পারেনি এখনও।’
‘অ্যাক্সিডেন্ট? বুঝল কেমন করে?’
‘তুতানখামেনের মতো সেলিব্রেটেড ফারাও তো আর দুটো নেই। তাই ওর মমির ওপরেও বিস্তর পরীক্ষানিরীক্ষা চলেছে।’
পিজি যথারীতি গুগল খুলে বসে গিয়েছিল, ও এবারে বলল,
‘হ্যাঁ, এই তো দেখছি তুতানখামেনের মমির অনেকগুলো এক্স-রে, সিটি স্ক্যান হয়েছিল। বেশ কয়েকটা জন্মগত রোগও ছিল দেখছি।’
ভবেশদা বললেন, ‘এটা তোমাদের ডাক্তারির ব্যাপার, আমি ভালো বুঝব না, কী রোগ ছিল বলো তো?’
বর্তমানে ভ্যালি অফ কিংস, কে. ভি ৬২-তে রাখা তুতানখামেনের মমি
পিজি জ্ঞান দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে, আর ছাড়ে?
‘প্রথমত, তুতানখামেনের ছিল ক্লিপেল-ফেইল সিনড্রোম। ওর ঘাড়ের যে শিরদাঁড়ার হাড়, যাকে আমরা সারভাইকাল ভার্টিব্রা বলি, তার সবকটাই একটা আরেকটার সঙ্গে জোড়া লাগানো ছিল। মানে রাজা ঘাড় ঘোরাতে পারত না। তার সঙ্গে আবার সামান্য স্কোলিয়োটিক মানে কুঁজও ছিল। পায়ের পাতার হাড়ে আবার ক্ষয়ের চিহ্ন দেখা গেছে। একে বলে কোহলার সিনড্রোম। মানে ফারাও ভালোভাবে হাঁটতেও পারত না।’
‘এটা ঠিক বলেছ পিজি, তুতানখামেনের সমাধিতে বেশ কয়েকটা ওয়াকিং স্টিক পাওয়া যায়।’
‘হুম, ফারাওয়ের ডিএনএ-তে নাকি আবার বেশ কয়েকটা ম্যালেরিয়ার প্যারাসাইটের ডিএনএ-ও পাওয়া যায়। আপনি তো বলেইছিলেন ম্যালেরিয়াতে ভুগতেন তুতানখামেন। এরকমটা হলে তো এমনিতেই যেকোনো কারো ইমিউনিটি খুব উইক হয়ে যাবে।’
তুতানখামেনের থ্রি-ডি গ্রাফিক
এবারে আমি বললাম, ‘কিন্তু ভবেশদা, আপনি যে বললেন অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু?’
‘হ্যাঁ ভাই, সেটাও হতে পারে বলে অনেকেরই মত। ২০১৩ সালে একটা ব্রিটিশ টিম ফারাওয়ের এক্স-রে আর সিটি স্ক্যানগুলো আবার ভালো করে পরীক্ষা করে। তাতে দেখা যায় যে ওর বাঁ-পায়ের থাইয়ের হাড় ভাঙা।’
‘ফিমার?’
‘হ্যাঁ, তোমরা ওই হাড়টাকে তো তাই বল। এই ভাঙার ধরন দেখে এক্সপার্টরা প্রেডিক্ট করেছে যে খুব সম্ভবত রথ চালাবার সময় অ্যাক্সিডেন্ট হয়। তাতেই ফারাওয়ের পায়ের হাড় ভাঙে। সেখান থেকেই মৃত্যু। তবে এর এগেইনস্টেও যুক্তি আছে বুঝলে, যে ফারাও ঠিক করে হাঁটতেই পারত না সে কীভাবে রথ চালাবে? সুতরাং সব মিলিয়ে তুতানখামেনের মারা যাওয়ার কারণ এখনও একটা বড়ো মিস্ট্রি। আরেকটা ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট বলি তোমাদের। তুতানখামেনের সমাধিতে আরও দুটো মমি ছিল, এটা জানো?’
‘অ্যাঁ, বলেন কী?! এরকম তো আগে কখনো শুনিনি!’
‘হুম, ওই কে ভি ৬২-র সমাধিতেই একটা ছোটো বাক্স পাওয়া যায়। সেটা খোলার পরে দেখা যায় তাতে রাখা আছে ছোট্ট ছোট্ট দুটো কফিন। তার মধ্যে ছিল তিরিশ সেন্টিমিটার লম্বা দুটো মমি। তুতানখামেনের স্ত্রী দু-জন মৃত সন্তান প্রসব করেন বলেছিলাম না! এগুলো তাদেরই। ওরা বাবার কাছেই শুয়ে ছিল তিন হাজার বছর ধরে।’
‘আচ্ছা ভবেশদা, তুতানখামেনের স্ত্রী সেই আনখেসেনামেনের কী হল?’
‘ফারাও মারা যাওয়ার পরেই আনখেসেনামেন একটা বুদ্ধি বের করেন। মিশরের পাশে আনাতোলিয়াতে ছিল হিটাইট প্রজাতির রাজত্ব, তাদের রাজা একটা চিঠি পান। রাজার এক সন্তানকে নাকি রানি আনখেসেনামেন বিয়ে করতে চান। এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে নাকি! আনখেসেনামেনকে বিয়ে করা মানেই তো মিশরের ফারাও বনে যাওয়া। রাজপুত্র জিনাজা তাই মিশরের উদ্দেশে রওনা দেয়। কিন্তু সে মিশরে পৌঁছোতে পারেনি। মরুভূমির মধ্যেই কোথাও একটা তাকে খুন করা হয়। খুব সম্ভবত তুতানখামেনের মন্ত্রী আই-ই খুনটা করিয়েছিলেন। আই ফারাও হয়ে বসার পরে আনখেসেনামেনও মিশরের ইতিহাস থেকে হারিয়ে যান। ওর মমি আজও কেউ খুঁজে পায়নি।’
সেইদিন আড্ডা যখন শেষ হল তখন রাত বারোটা। ভবেশদা আমাদের রুমেই থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু যখন শুতে যাব ঠিক তার আগেই পিজি আমাকে হোস্টেলের করিডোরে বের করে নিয়ে এসে একটা অদ্ভুত কথা বলল,
‘ভবেশদা আমাদের মিথ্যে কথা বলেছেন, বুঝলি!’
‘মিথ্যে?’
‘হ্যাঁ, উনি বললেন না যে ও এই পনেরো দিন বাড়িতে ছিলেন, একদম ডাহা মিথ্যে বলেছে।’
‘তুই জানলি কী করে?’
‘আমি তোর মতো দুমদাম কাউকে বিশ্বাস করে নিই না। আর সবসময় ফাজলামি করি বলে এটা ভাবিস না যে প্রদীপ্ত ঘোষ বোকা।’
‘না না, সেটা কি আমি বলেছি নাকি? কিন্তু তুই ভাবছিস কী করে যে ভবেশদা মিথ্যে বলেছিলেন?’
‘আড্ডার মাঝে মনে আছে তুই একবার উঠে গেলি মেসে এক্সট্রা মিলের অর্ডার দিতে? ভবেশদাও সেইসময় একবার বাথরুমে গিয়েছিলেন। আমি সেই ফাঁকে ওঁর ওই নীল রঙের ব্যাগটা খুলে চেক করেছিলাম।’
‘বলিস কী! এটা কিন্তু ঠিক করিসনি তুই।’
‘আরে ধুর, ঠিক ভুলের নিকুচি করেছে। ওঁর ওই পনেরোদিন ধরে বাড়িতে বসে বই পড়াটাকে আমি মেনে নিতে পারিনি। তার ওপরে সঙ্গে ওরকম ঢাউস ব্যাগ নিয়ে কী করছিলেন? তাই খুলে দেখলাম।’
‘কী পেলি!’
পিজি এবারে খপ করে আমার হাতটা চেপে ধরল,
‘ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের টিকিট, ভবেশদা এই ক-দিন ইন্ডিয়াতে ছিলেন না, স্পন্দন!’
‘তাহলে কোথায় ছিলেন?’
‘ইজিপ্ট!’