তিথি অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছে। হাঁটতে তার ভাল লাগছে। আকাশ ঘন নীল। ঝলমল করছে। রোদে শিশুদের গায়ের ওম। এমন সময় হঁটিতে ভাল লাগারই কথা। তিথির কোনো গন্তব্য নেই। একটা ফুলওয়ালীর কাছ থেকে সে ফুল কিনল। একজন ভদ্রলোক তার কাছে জানতে চাইলেন, দিলু রোড কোন দিকে? সে ভদ্রলোককে খুব ভাল করে দিলু রোডে যাবার পথ বলে দিল। ভদ্রলোক কৃতজ্ঞচোখে চলে যাচ্ছেন। সে হাঁটছে। বড় ভাল লাগছে হাঁটতে।
একেকটা দিন এ রকম হয়। হাঁটতে ভাল লাগে। বিশেষ করে যখন গন্তব্য বলে কিছু থাকে না। যাবার কোনো বিশেষ জায়গা না থাকার মানেই হচ্ছে সব জায়গায় যাওয়া যায়।
তিথি বিকেলের দিকে নিতান্ত ক্লান্ত ও বিরক্ত হবার পরই নাসিমুদ্দিনকে দেখতে গেল। সে অনেক’দিন ধরে হাসপাতালে পড়ে আছে। তাকে দেখতে যাওয়া হয় না। বিশেষ কোথাও যেতে তিথির ইচ্ছা করে না। নাসিমুদ্দিন যদি রাস্তায় থাকত বেশ হত। অনেকবার দেখা হত।
নাসিম বত্ৰিশ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দায় পড়ে আছে। তিথিকে দেখে উজ্জ্বল চোখে তাকাল, এস তিথি এস। একমাত্র তুমিই আসি। আর কেউ আসে না। আমার স্ত্রীও আসে না।
আপনি কেমন আছেন?
ভাল না। পায়ে কী যেন হয়েছে, কেউ কিছু বলে ও না। পা না-কি কেটে বাদ দিতে হবে। পাপে ধরেছে, বুঝলে তিথি পাপ। এই জীবনটা মহাপাপ করতে করতে কাটালাম।
খুব ব্যথা হয়?
আমার কথা বাদ দাও। তুমি কেমন আছ?
ভাল আছি।
তোমার ভাইয়ের ব্যবসা না-কি ভাল হচ্ছে?
হ্যাঁ।
তোমাকে সহ্য করে তো। একবার টাকা-পয়সার মুখ দেখলে পুরোনো কথা কেউ মনে রাখে। না। তোমার ভাই কী তোমাকে হাতখরচ দেয়?
দেয়।
ভাল। খুব ভাল। শুনে খুশি হলাম। তোমার মুখ এমন শুকনো লাগছে কেন তিথি? কিছু খাবে? একটা কলা খাও। এরা হাসপাতাল থেকে কলা ডিম এইসব দেয়, খেতে পারি না। তুমি কলাটা খাও।
তিথি বিনা বাক্যব্যয়ে কলা খেল। তার ক্ষিধে পেয়েছে। আসলেই সারাদিন কোনো খাওয়া হয়নি।
তিথি।
জি।
তোমার যে একটা বোন কোথায় চলে গিয়েছিল তাকে কী পাওয়া গেছে?
জি না।
ঢাকা শহর হল অদ্ভুত শহর। এই শহর হঠাৎ মানুষ গিলে খেয়ে ফেলে। আর খোঁজ পাওয়া যায় না।
আমি উঠি?
না-না বস। আর একটু বস। কেউ আসে না। তুমি মাঝে-মধ্যে আস ভাল লাগে। পাপের শাস্তি হচ্ছে। মহাপাপ করেছিলাম।
আপনি কোনো পাপ করেননি। আপনি না থাকলে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতাম? আপনার কাছে আমার অনেক ঋণ।
এইটা ভুল কথা বললে তিথি। খুব ভুল কথা। আমাদের কারোর কাছে কারার কোনো ঋণ নাই।
যাই এখন?
বস। আরেকটু বস।
তিথি বসে। তার তো যাবারো তেমন জায়গা নেই। বসে থাকতেই বা অসুবিধা কী? রাত বাড়ে ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষটার মাথার কাছে তিথি বসে থাকে। এক সময় নাসিম বলে এখন চলে যাও। রাত হচ্ছে। তিথি বলে–আরেকটু বসি। কোনো অসুবিধা নেই।
জালালুদিনের চোখের অপারেশন হল প্রাইভেট ক্লিনিকে। হীরু দরাজ গলায় বলল, ফাদার-মাদারের জন্য টাকা খরচ করব না তো কোন শালার জন্যে করব? টাকা-পয়সা হচ্ছে আমার কাছে তেজপাতা। অপারেশনের পর ডাক্তার চোখে হলুদ আলো ফেলে বললেন, কিছু দেখতে পাচ্ছেন, কাঁটা আঙুল বলুন তো?
পরিষ্কার বলতে পারছি না। মনে হচ্ছে তিনটা।
তার মানে কিছু দেখছেন না।
কে বলল দেখছি না? পরিষ্কার দেখছি। আপনার আঙুল হচ্ছে দু’টা ঠিক না?
ডাক্তারের মুখ বিমর্ষ হয়ে যায়। কিন্তু জালালুদ্দিন বড়ই আনন্দ বোধ করেন। এতগুলি টাকা শুধু তার জন্যই খরচ হচ্ছে–এটা কী কম কথা? দরকার হলে আরো খরচ হবে। হীরু তো বলেছে।–টাকা-পয়সা তার কাছে তেজপাতা। এ হচ্ছে তার শ্রেষ্ঠ সন্তান। শুরুতে বুঝতে পারেননি। শুরুতে আসলে কিছুই বোঝা যায় না। মর্নিং শোজ দা ডে। কথাটাই ভুল। দেখা যায় সকালে ঝলমলে আলো, দুপুর হলেই চারদিক অন্ধকার করে ঝড়।
এসব কথা সব বদলে ফেলা দরকার; কোমলমতি শিশুদের ভুল কথা শেখানো হচ্ছে। উচিত না। কাজটা খুবই অনুচিত হচ্ছে।
ও বাবা হীরু।
জি।
চোখটা তো মনে হয় সেরেই গেল। ডাক্তারের হাতের আঙুলগুলি পরিষ্কার দেখলাম। গুণতে পারলাম না। দেখা এক জিনিস আর গোণা এক জিনিস। ঠিক কী-না। বাবা বল।
তা তো ঠিকই। এখন চল বাড়ি যাই।
আরো কয়েকটা দিন থাকি। এদের আদর-যত্ন অসাধারণ। একটা নার্স আছে নাম রুচিতা। ভাবছি। এই মেয়েটাকে ধর্ম মেয়ে বানিয়ে ফেলব। অসাধারণ একটা মেয়ে।
পহেলা শ্রাবণ হীরু নতুন বাড়িতে উঠল। সেই উপলক্ষে কাঙালি ভোজ হল। মিলাদ হল। বাড়ি বিশাল কিছু না, তবে ভবিষ্যতে বড় হবে। তিনতলা ফাউন্ডেশন। নতুন বাড়িতে ঢুকে আনন্দে ঘুমুতে পারেন না জালালুদ্দিন। ঘন ঘন এ্যানাকে ডাকেন।
ও বৌমা বৌমা।
এ্যানার হাতে শতেক কাজ তবু সব বিরুক্তি মুছে পাশে দাঁড়ায়। জালালুদ্দিন ধরা গলায় বললেন, সব তোমার জন্যে হচ্ছে গো মা–সবই তোমার জন্য। তোমার একটা ছবি বড় করে বাঁধিয়ে আমার ঘরে সাজিয়ে রাখি তো মা।
সাজিয়ে রাখলে কী হবে? আপনি তো আর দেখতে পারবেন না?
আমি না পারলাম। অন্যে দেখবে। যেই আসবে তাকেই বলব, এই দেখ গো সবই আমার বৌমার ভাগ্যে হল। এই হচ্ছে আমার বৌমা।
আপনি বড় বেশি কথা বলেন। কথা কম বলবেন। চা খেতে চাইলে বলেন চা এনে দিচ্ছি।
একটু কফি দাও। কফির কাছে চা দাঁড়ায় না গো মা। কফির মজাই অন্য।
এ্যানা কফি আনতে যায়। আপনমনে কথা বলেন জালালুদ্দিন। নিজের মনে কথা বলতে তার বড় ভাল লাগে। জীবনটা বড়ই মধুর মনে হয়। বড়ই সুখের বলে বোধ হয়। গুনগুন করে আজকাল গানও গান–ওগো দয়াময়। বড় দয়া তোমার মনে ওগা। দয়াময়–সবই তার স্বরচিত গান। তিনি যে একজন স্বভাবকবি এই তথ্য আগে জানা ছিল না। হীরুর বেশ কিছু কর্মচারীও এই বাড়িতে থাকে। তাদের সাথেও তার বড় মধুর সম্পর্ক। জীবন কী? জীবনের অর্থ কী? এসব গূঢ় কথা তিনি তাদের বলেন। খুব আগ্রহ নিয়ে বলেন–
ভাগ্য–সবই ভাগ্য। এই জিনিসটা তোমরা খেয়াল রাখবা। আজ যে রাজা কাল সে পথের ফকির। এর কারণ কী? এর কারণ ভাগ্য। এখন ভাগ্য কী…
তিনি সবাইকে ভাগ্য কী তা ব্যাখ্যা করেন। সবাই মন দিয়ে শোনে না। আশ্চর্যের ব্যাপার মন দিয়ে শুনে টুকু। টুকু কেন এত আগ্রহ নিয়ে বাবার কথা শোনে তা জালালুদ্দিনও ঠিক বুঝতে পারেন না।
টুকুর ঘুরে বেড়ানোর স্বভাব আরো বেড়েছে। মাঝে মাঝে মাসের পর মাস তার কোনো রকম খোঁজ পাওয়া যায় না। তারপর হঠাৎ এক’দিন মুখ ভর্তি দাড়ি-গোঁফ নিয়ে উদয় হয়। হীরু ভীষণ বিরক্ত হয়, আমার আপনা ভাই ঘরে আর আমার কি-না তিন হাজার টাকা বেতন দিয়ে ম্যানেজার রাখতে হয়। আফসোস। বড়ই আফসোস। এখন আমার দরকার নিজের লোক।
হীরুর নিজের লোকের অভাবে সত্যি সত্যি অসুবিধা হয়। অনেক টাকার লেন-দেন। সব একা সামলাতে হয়। মাথার ঠিক থাকে না। টুকু লেখালেখির চেষ্টা করে। তার খুব ইচ্ছা করে নিজেদের জীবনের কথাটাই সুন্দর করে লিখে ফেলতে। দুঃখ, বেদনা ও গ্লানির মহান সংগীতকে স্পর্শ করতে ইচ্ছা করে। পারে না। তবে মনে হয় পারবে। এক’দিন না এক’দিন জনম জনমের গল্প বের হয়ে আসবে।
হীরু নিজেদের ব্যবহারের জন্যে রিকন্ডিসান্ড টয়োটা সন্টারলেট একটা কিনেছে। সেই গাড়িতে রোজ জালালুদ্দিন সাহেব খানিকক্ষণ হাওয়া খান। রোজ খানিকটা ফ্রেশ অক্সিজেন না নিলে তার নাকি রাতে ভাল ঘুম হয় না।
এই পরিবারের একজন মাত্র মানুষ রাতে এক ফোঁটা ঘুমুতে পারেন না। তিনি মিনু। চোখ মেলে তিনি সারারাত তিথির পাশে শুয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে একটা হাত রাখেন। তিথির গায়ে। তিথি সেই হাত সরিয়ে দিয়ে কঠিন গলায় বলে–গায়ে হাত দিও না মা।
এত আদর করে গায়ে হাত রাখি তুই এমন করিস কেন মা?
তিথি কঠিন গলায় বলে, গায়ে হাত দিলেই মনে হয় পুরুষ মানুষের হাত। কেমন গা ঘিনঘিন করে।
মা-রে তুই শুধু আমাকে শাস্তি দিচ্ছিস কেন?
আমি কাউকে শাস্তি দিচ্ছি না মা।
এত সখা করে হীরু গাড়ি কিনেছে একবার চড়ে দেখবি না?
চড়ব। কালই চড়ব। এখন ঘুমাও। মিনু ঘুমুতে চান। ঘুমুতে পারেন না। রাত বাড়ে।