২০
তরুর ধারণা ছিল সে এখানে এসে থাকতে পারবে না। তা থাকতে পারতোও না। তাকে থাকার জন্য যে ঘর দেয়া হয়েছে, তা আশপাশের বাড়ি-ঘরের তুলনায় ভালো। ঘরখানা ইটের দোতলা। বড় বড় দু খানা জানালা। জানালার বাইরে সবুজ ধানক্ষেতে। ফুরফুরে হাওয়া। সবই ঠিক আছে। তবে সমস্যা হচ্ছে, এই বাসার দোতলার ছাদ ঢালাই দেওয়া হয়নি। কোনো কারণে পাকা ছাদের পরিবর্তে টিনের চাল দিয়েই কাজ সারা হয়েছে। ফলে সন্ধ্যা নামতে না নামতেই চালের ফাঁক ফোকর দিয়ে হুড়মুড় করে পোকা-মাকড়-মশা দল বেঁধে ঢুকতে থাকে। তখন মশারি না টানিয়ে এক মুহূর্ত থাকার উপায় নেই। এমনকি খাবারও খেতে হয় মশারির ভেতরে বসেই। নাহলে হুটহাট সব খাবারের প্লেটে এসে পড়ে। এ এক ভীষণ বিড়ম্বনা।
রোগীদের নিয়েও নানা সমস্যা। তারা দূর-দূরান্ত থেকে ডাক্তার দেখাতে এলেও রোগের কথা ঠিকঠাক বলতে পারে না। লজ্জা কিংবা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকে। সম্ভবত ডাক্তারদের সামনে কথা বলতে ভয় পায়। এ কারণে তরু চেষ্টা করেছে যতটা সম্ভব রোগীদের সামনে সহজ হওয়া যায়। কিন্তু তাতে লাভ বিশেষ হয়নি। কথা বলতে গেলেই তাদের জিভ জড়িয়ে যায়। একটা বলতে গিয়ে অন্যটা বলে ফেলে। মহিলারা ভীষণ লজ্জা পায়। বিশেষ করে মেয়েলি কোনো রোগের কথা বলতে গেলে তাদের মুখে কথাই ফুটতে চায় না। অথচ এ অঞ্চলে বেশির ভাগ রোগীই মেয়ে। তাদের নানা সমস্যা। সেসব সমস্যা গোপনে পুষে রেখে তারা বরং মৃত্যু বরণ করবে, তবুও কারো কাছে বলবে না।
আগের পুরুষ ডাক্তারদের তুলনায় মেয়ে ডাক্তার হিসেবে তরু অবশ্য খানিক সুবিধাও পেয়েছে। সে এসেছে খুব বেশি দিন হয়নি। তবে এর মধ্যেই মহিলা রোগীদের মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে শুরু করেছে। এলাকার মানুষদের সঙ্গেও তার যোগাযোগটা ভালো। রূপগঞ্জ বাজারের পাশেই একটি অনাথ আশ্রম আছে। সেখানে কিছু এতিম ছেলে-মেয়ে থাকে। তাদের বয়স আট থেকে দশ। তারা আগে সময় সুযোগ পেলেই দূর থেকে দাঁড়িয়ে তাকে দেখত। এর অবশ্য কারণও রয়েছে। সম্ভবত এ এলাকায় এর আগে কোনো নারী ডাক্তার আসেনি। ফলে সে যখন গায়ে অ্যাপ্রোন, গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে তার বাসা থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র অবধি যায়, তখন ছেলে-বুড়ো সবাই একটু আড় চোখেই তাকায়।
তবে অনাথ আশ্রমের ওই ছেলে-মেয়েগুলো অত আড় চোখের ধার ধারে না। তারা বেশ আগ্রহ নিয়েই তাকে দেখে। সেদিন বাসায় ফেরার পথে হঠাৎ অদ্ভুত একটা ব্যাপার চোখে পড়ল তরুর। বাচ্চাগুলো রাস্তার ধারে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মাঝখানে কেউ একজন শুয়ে আছে। সে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার সেই কান্না দেখে উপস্থিত দু-একজন বিলাপও করছে। কৌতূহলী তরু এগিয়ে গেল। গিয়ে দেখল ছেলেটার দুই পায়েই রক্ত। পেটেও খানিকটা। সে পেট চেপে ধরে গোঙাচ্ছে। কী হয়েছে তার?
কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মেয়েটাকে চোখে পড়ল তার। সে বসে আছে। আহত ছেলেটার পাশে। তার গলায় দড়ির মতো কিছু একটা ঝোলানো। সেই দড়ির মাথায় আবার কচি কলাগাছের গোড়ার দিকটা কেটে বানানো চাকতির মতো গোল ছোট্ট একটা টুকরো জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সে সেই চাকতিটা আহত ছেলেটার বুকে চেপে চেপে কিছু বোঝার চেষ্টা করছে।
তরু হঠাৎ ফিক করে হেসে উঠল। ছেলেটা আসলে আহত নয়। তার পায়ে, বুকে পানের পিক ফেলে লাল করা হয়েছে। আর সে ইচ্ছে করেই গোঙাচ্ছে। তার পাশে গলায় দড়ি ঝোলানো মেয়েটা মূলত ডাক্তার আপা সেজে তাকে চিকিৎসা দিচ্ছে। পুরো ব্যাপারটাই অভিনয়। রোগী আর ডাক্তার সেজে তারা খেলছে। উপস্থিত অন্যরা সবাই রোগীর আত্মীয়-স্বজনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
অতি সামান্য ঘটনা। কিন্তু এই সামান্য ঘটনাটিই তরুর রূপগঞ্জ বসবাসটাকে খানিক আনন্দময় করে তুলল। রাতে বাসায় ফিরে তার হঠাৎ মনে হলো, সে তো চাইলে ওই বাচ্চাগুলোকে পড়াতে পারে। এরা নামেই কেবল অনাথ আশ্রমের শিক্ষার্থী। আদতে সেখানে তাদের কোনো পড়াশোনা শেখানো হয় না। এমনকি তিনবেলা খাবার দেয়ার কথা থাকলেও নিয়মিত তাও দেয়া হয় না। বরং অর্ধাহারে অনাহারে বড় হচ্ছে তারা। আর সারাদিন রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়। এর ওর ফুটফরমায়েশ খাটে। পরদিনই সে আশ্রমের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলল। বিষয়টা শুনে তিনি খুবই খুশি হলেন। বললেন, ম্যাডাম, দোষটা আসলে আমাদেরও না। এই আশ্রম যিনি করেছিলেন, তিনি মারা গেছেন বছর তিনেক হয়। এরপর তার ছেলেরা আর এটা চালাতে চাইছে না। এমনকি হুট করে এটা বন্ধও করে দিতে পারছে না। তাহলে এলাকার লোকের চোখে লাগবে। এই কারণে ধীরে ধীরে বন্ধ করছে। আর এগুলো হলো সেই বন্ধ করার প্রক্রিয়া। আপনি যদি ওদের পড়াতে চান, তাহলে এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে!
তা তরুর জন্য বিষয়টা ক্রমশ আনন্দেরই হয়ে উঠতে লাগল। এর অবশ্য কারণও আছে। বাচ্চাগুলো তাকে অসম্ভব পছন্দ করে। বিকেলে কাজ শেষে সে যখন নদীর ধারের সবুজ মাঠটাতে গিয়ে বসে, তখন একে একে কোথা থেকে এসে যেন জড় হয় তারা। তারপর তাকে ঘিরে ধরে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে গান গাইতে থাকে। তরুর শেখানো ছড়া কাটতে থাকে। সেই ছড়া তাদের সহজ, অকৃত্রিম কণ্ঠে এত মধুর শোনায় যে তরুর মন ভালো হয়ে যায়। মনে হয়, জীবনের বাকিটা সময় যদি এই মুহূর্তটার মতো এমন আনন্দময় হয়ে উঠত, তাহলে মন্দ হতো না।
তবে খারাপ ব্যাপারও যে কম আছে, তাও নয়। যেমন মহিতোষ মাস্টারের সঙ্গে যোগাযোগের সমস্যাটা। এটিই এখন তার সবচেয়ে খারাপ লাগার বিষয়। সে এসেছে মাস দুয়েক হয়ে গেলেও এখনো মহিতোষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। তবে মইনুল কয়েকবার চিঠি পাঠিয়ে তার অবস্থা জানিয়েছে। সে-ই এখন যতটুকু পারছে মহিতোষের দেখা-শোনা করছে। আগের চেয়েও দুর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। আজকাল আর কারো সঙ্গেই কথা বলেন না। তবে সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো, মইনুলের কিঞ্চিৎ সন্দেহ যে মহিতোষ মাস্টার আজকাল হুট করে কাউকে চিনতে পারেন না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। দীর্ঘসময় পর হতাশ গলায় বলেন, আমাকে মাফ করবেন, আমি আপনাকে চিনতে পারছি না।
কথাটা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল তরুর। সে মইনুলকে পরের চিঠিতে লিখে পাঠাল যে সে যেন অতিসত্বর মহিতোষের যশোরের আত্মীয়ের ঠিকানায় চিঠি পাঠাবার ব্যবস্থা করে। অন্তত তারা যেন জানতে পারেন যে তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন। এই কাজটা আরো আগেই দায়িত্ব নিয়ে করা উচিত ছিল তরুর। কিন্তু নানা কারণেই হয়ে ওঠেনি।
প্রথমত, পারুর ঘটনা নিয়ে মহিতোষ মাস্টার এতটাই বিমর্ষ ছিলেন যে এ বিষয়ে কারো কোনো কথাই তিনি গ্রাহ্য করেননি। তারপর তিনি নিজেও চাননি এই খবর কাউকে জানাতে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অসুস্থতা। দ্বিতীয়ত, এরমধ্যেই মহিতোষ নাকি একবার চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেই চিঠির কোনো জবাব আসেনি। এরপর নিজের নানাবিধ ঝামেলায় আর বিষয়টা মাথায়ও ছিল না তরুর।
সমস্যা হচ্ছে, মইনুল তাকে পরের চিঠিতে জানাল, মহিতোষ মাস্টার কিছুতেই তার সঙ্গে কথা বলেননি। আর তিনি এখন যে অবস্থায় আছেন তাতে কোনোভাবেই চিঠি পাঠানোর ওই ঠিকানাটুকুও কাউকে দিতে পারবেন বলে মনে। হয় না। সব শুনে মনে মনে ভীষণ শঙ্কিত হয়ে পড়ল তরু। তার মনে হলো, কয়েকটা দিনের জন্য ছুটি পেলেও সে একবার ঢাকা যেতে চায়। তার অনুপস্থিতিতে মানুষটার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না সে।
কিন্তু সহসাই যাওয়া হলো না তরুর। পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল তার। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দারোয়ান আনারুল রুদ্ধশ্বাসে ছুটে এসে তার ঘুম ভাঙিয়ে দিল। তারপর উত্তেজিত গলায় বলল, “ইমার্জেন্সি রুগী আসছে ম্যাডাম। রক্তারক্তি অবস্থা। আচানক ব্যপার হইল, রুগী আসছে বহুদূরের গ্রাম থাইকা। তাও একলা সারা রাইত ট্রলার চালাইয়া।
ঘটনা শুনে একটু অবাকই হলো তরু। সে বলল, কী হয়েছে?
কী হইছে তাতো বলতে পারব না। তয় রুগীর ডাইন দিকের গাল নাই।
‘গাল নেই মানে?
‘দেইখা মনে হইতেছে কেউ তার গাল কোদাল দিয়া কোপাইয়া ফালা ফালা কইরা ফালাইছে। গালের চামড়া দাড়ির থুতনির লগে ঝুলতেছে। ভেতরের হাড় মাংস দেখা যাইতেছে। চোখটা অল্পের জইন্য বাঁচছে। কিন্তু ফুইলা ঢোল হইয়া প্রায় বন্ধ হইয়া আছে।
এখানে এসে এখন পর্যন্ত যত রোগী তরু পেয়েছে, তার বেশির ভাগই সাধারণ ডায়রিয়া, আমাশয়, জ্বর, সন্তান ধারন বা প্রসবসংক্রান্ত জটিলতার। কিন্তু আজকের মতো এমন ঘটনা এর আগে ঘটেনি। ফলে একটু কৌতূহলীই হয়ে উঠল সে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গেল। কিন্তু লোকটাকে দেখে গা শিউরে উঠল তার। যতটা ভেবেছিল, তার চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা রোগীর। তারপরও রাতভর দীর্ঘ পথ একা ট্রলার চালিয়ে এসেছে। ফলে শরীর হয়ে পড়েছে দুর্বল। পঁড়িয়ে থাকার মতো অবস্থাও নেই। তরু তারপরও এটা-সেটা জিজ্ঞেস করল। কিন্তু সেসবের উত্তর দিতে পারল না সে।
সমস্যা হচ্ছে এখানে এর কী চিকিৎসা দেবে তরু? এই কেন্দ্রে খুব জটিল ধরনের চিকিৎসা সেবা দেয়ার সুযোগ নেই। যা আছে তাও নেহাই অপ্রতুল। তারপরও হাল ছাড়ল না সে। জেলা শহর থেকে সার্জারির একজনকে আনানোর ব্যবস্থা করল। কিন্তু তিনিও রোগীর অবস্থা দেখে ভড়কে গেলেন। তবে শেষ অবধি ঝুঁকিটা নিলেন তারা। সেলাই দিয়ে কোনোভাবে জায়গাটা জোড়া লাগানো হলো। তবে তাতে লোকটার মুখমণ্ডল স্থায়ীভাবে এক ধরনের ভয়ানক বিকৃতি লাভ করল। সেই মুখের দিকে তাকালে বুকের ভেতরটা আচমকা কেঁপে ওঠে। দিন পনেরো বাদে খানিক কথা বলার মতো অবস্থা হলো তার। তরু তখন জিজ্ঞেস করল, এই অবস্থা কীভাবে হলো আপনার?
লোকটা জবাব দিল না। পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল তরুর চোখের দিকে। তরু জানে না কেন, কিন্তু লোকটার ওই চোখ দেখে তার গা শিরশির করে উঠল। মনে হলো ওই চোখের সামনে সে বসে থাকতে পারছে না। নার্স বলল, “আপনে কথা বলছেন না কেন? ম্যাডাম কী জিজ্ঞেস করছে শুনতে পাচ্ছেন না?
লোকটা তাও জবাব দিল না। কেবল তাকিয়েই রইল। তরু বলল, আপনার নাম কী? নামটাই তো জানা হয়নি এখনো?
লোকটা জবাব দিল, ফজু।
‘শুধু ফজু?
‘ফয়জুল। লোকে ফজু বইলা ডাকে।
তরু বলল, তা ফজু সাহেব, আপনার গালটা এভাবে কাটল কীভাবে?
ফজু আবার চুপ করে রইল। কিন্তু হাসপাতালের ওই মৃদু আলোতেও তার চোখজোড়া যেন জ্বলজ্বল করে উঠল।
২১
নুরুন্নাহার বললেন, আপনে তো জীবনভর কোনোদিন আমারে গুরুত্ব দেন নাই। আমার কথা শোনেন নাই। চলছেন নিজের মনমতো। কিন্তু ওপরে ওপরে ভাব দেখাইছেন, আমার কথা ছাড়া এক পাও কোথাও দেন নাই।
ওহাব ডাক্তার কথা বললেন না। নুরুন্নাহার বললেন, আর আমিও বলদের বলদ। আপনের ওই সহজ-সরল অসহায় মুখোন দেইখা ভাবতাম, আহারে, ভাজা মাছ উল্টাই খাইতে জানে না। কিন্তু আপনে যে মাছ কাটাকুটা সহই খাইয়া ফালান, সেইটা তো আগে বুঝি নাই।
‘কী হইছে নুরুন্নাহার?
এবার যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন নুরুন্নাহার। বললেন, আপনের জন্যই আইজ আমার আছমার এই দশা। আপনেই ফরিদরে লাই দিয়া মাথায় তুলছেন। তার কোনোকিছুতে কোনো বাধা দেন নাই। যদি দিতেন তাইলে আর এই পরিস্থিতি হইত না। তলে তলে যা করার সব আপনে করছেন। সে আপনের কারণেই এতবড় সাহস পাইছে। না হলে জীবনেও তার এই রকম কিছু করার সাহস হইত না। তারে আমি এইটুক বয়স থেইকা পালতেছি। আমি জানি না?
‘আমি কী করছি?
‘আপনে কী করছেন তা আপনেই ভালো জানেন। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া এমনিতেই তো আর আপনেরে সন্দেহ করে নাই। নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কারণ আছে। সে তো আর আমার মতো বলদ না।
ওহাব ডাক্তার কথা বললেন না। বিকেলের আলো পড়ে আসছে। আকাশ এখনো পরিষ্কার। তিনি উঠানের একপাশে বসে বাঁশের কঞ্চি চাছছেন। কবুতরের জন্য নতুন বাসা বানাবেন। তার প্রস্তুতি। নুরুন্নাহার গত কদিন ধরে বেশ জ্বালাতন করছেন। কারণে-অকারণে সারাক্ষণ কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করছেন। বিষয়টা নিয়ে তিনি বিরক্ত। কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না। ফরিদকেও না। নুরুন্নাহারের ধারণা, তিনি বললেই ফরিদের মাথা থেকে পারুর ভাবনা চিরতরে বিদায় নেবে। কিন্তু তার সন্দেহ, ওহাব ডাক্তার সেটা বলতে চান না। তিনি বরং মনে মনে চান, পারু ফিরে আসুক। ফরিদ তাকে নিয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দিক। যদিও তার এই ভাবনার পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ নুরুন্নাহার খুঁজে পান না। নিজের মেয়ের সুখ-শান্তির চেয়ে অন্যের মেয়ের সুখ-শান্তি কেন তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে?
নুরুন্নাহার বললেন, ফরিদ যে এই কয়দিনেই অনেক সুস্থ হইয়া গেছে, এইটা কি আপনের চোখে পড়ছে?
হুম।
হুম কী? বলেন পড়েছে কি না?
‘পড়ছে।
‘সে কেন সুস্থ হয়ে উঠছে, সেটা কি বুঝেছেন?
“কেন?”
‘আছমার জন্য। এই সময়ে পুরুষ মানুষের দরকার একটু যত্ন। একটু আদর ভালোবাসা। যাতে আগের স্মৃতি তার মনে না থাকে। এইজন্য সারাক্ষণ তারে আগলাই রাখতে হয়। এখন সেইটা তো আর আমার পক্ষে পুরাপুরি সম্ভব না। সম্ভব?
‘কেন সম্ভব না?”
‘আপনের কি বোধ বুদ্ধি বলতে কিছু নাই? আল্লাহয় কি আপনেরে বিবেক বিবেচনা বলতে কিছু দেয় নাই?’ এবার ঝঝিয়ে উঠলেন নুরুন্নাহার। আছমা সেয়ানা মাইয়া। বিয়া দিলে এতদিনে পোলা-মাইয়ার মা হইয়া যাইত। সে এখন পুরাপুরি ফরিদের যত্ন করব কেমনে? তার কি ফরিদের সঙ্গে বিয়া হইছে? তারা কি। স্বামী-স্ত্রী?
“ওহ। না, তারা তো স্বামী-স্ত্রী না।’
‘তাহলে এখন কী করতে হবে?
তাদের বিয়া দিতে হবে। তাই তো?”
‘জি। এই তো আপনে যে কিছু বোঝেন না, তা না। এখন তো নিজেই প্রমাণ দিলেন। আপনে বোঝেন তো সবই। খালি ভান ধরে থাকেন। এখন বলেন, বিয়ার বিষয়ে আপনের মত কী?
‘এইখানে তো আমার মত গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ ফরিদ আর আমার মত। আমার মত গুরুত্বপূর্ণ হলে তো এই বিয়া হবে না।
‘কেন? হবে না কেন?
কারণ, এদের আমি ভাই-বোনের মতো দেখছি। ছোটবেলা থেকে এরা একসঙ্গে বড় হইছে। যদিও আমাদের ধর্মমতে এদের বিয়াতে কোনো অসুবিধা নাই। তারপরও আমার চোখে বিষয়টা…।’
ওহাব ডাক্তার কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগে মুখ ঝামটা দিয়ে উঠে নুরুন্নাহার বললেন, আপনে তো সবকিছুর ঊর্ধ্বে না। ধর্মে যদি অসুবিধা না থাকে, তাইলে আপনের কী অসুবিধা? আপনের তো অসুবিধা থাকার কথা না। আপনে এই বিয়ার ব্যবস্থা করেন। সময় থাকতে থাকতে করেন। ফরিদ এখন আছমার ওপর দুর্বল। দেখেন না, সে আছমারে ছাড়া কিছু বোঝে না। খাইতে গেলে আছমা, নাইতে গেলে আছমা। একটা সেকেন্ড সে আছমারে ছাড়া থাকতে পারে না।’
‘কিন্তু নুরুন্নাহার, পারুর কোনো অবস্থা একদম নিশ্চিত না হয়ে কি এইটা করা ঠিক হবে?
কী অবস্থা পারুর?
‘সে যদি বেঁচে গিয়া থাকে?
আপনেও তো দেখি সেই আজগুবি মার্কা কথা বললেন। সে কীভাবে বেঁচে থাকবে, কোন যুক্তিতে, আপনে বলেন?
‘এইখানে যুক্তির চেয়ে সম্ভাবনা নিয়া চিন্তা করা ভালো নুরুন্নাহার। পৃথিবীর সবকিছু যুক্তি দিয়া চিন্তা করলে হয় না। আবার এইখানে যুক্তিও আছে। ধরো কোনোভাবে সে বেঁচে থাকল। তারপর ধরো এমন কোনো জায়গায় আটকা পড়ে রইল যে সে ফিরতে পারতেছে না। কিন্তু যদি কোনোদিন সে ফিরে আসে, তখন কী করবা? একবার ভাবো তো, আছমার পরিস্থিতি তখন কী দাঁড়াবে? বা ফরিদের?
এই কথায় যেন খানিক দমে গেলেন নুরুন্নাহার। তবে সঙ্গে সঙ্গেই আবার ফুঁসে উঠলেন তিনি। বললেন, ‘আসলে আসব। আপনে মনে হয় একটা কথা ভুলে। যাইতেছেন।
কী কথা?
‘পারুরে ফরিদ বিয়া করে নাই। তারা এক সঙ্গে কয় মাস ছিল, এইটা যেমন সত্যি। তেমনি এইটাও সত্যি যে তাদের মধ্যে বিয়া হয় নাই। তাদের দুজনের ধর্ম আলাদা। এখন পারু যদি কোনোদিন ফিরাও আসে, সে তো আর ফরিদের বিয়া করা বউ না যে কাগজপত্র নিয়া এসে হাজির হয়ে স্বামী দাবি করব?
সবকিছুর দাবিই কি কাগজপত্রে হয় নুরুন্নাহার?
তাইলে কীসে হয়?
‘পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দাবির জন্য কিন্তু কাগজপত্র লাগে না। ওই দাবি লেখা থাকে মনে। আছমার প্রতি আমাদের যে দাবি, সেইটা তো কোথাও কাগজপত্রে লেখা নাই, আছে?
নুরুন্নাহার এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তিনি বোঝার চেষ্টা করছেন তার স্বামীর উদ্দেশ্য কী? ওহাব ডাক্তার বললেন, ফরিদের ওপর পারুর কাগজপত্রের কোনো দাবি নাই, তারপরও সে ফরিদের জন্য যা করছে, বাবা, মা, পরিবার, ধর্ম কোনোকিছুরই তোয়াক্কা করে নাই। সব ছেড়েছুঁড়ে এক মুহূর্তে চলে আসছে। ফরিদও। সে কী করে নাই পারুর জন্য? সব করছে। এখনো ছেলেটা সুস্থ না। তুমি হয়তো বোঝে না। ভাবতেছো সে মনে হয় আমার জন্য হাবুডুবু খাইতেছে। কিন্তু বিষয়টা তেমন না। তার আসলে এখনো পুরোপুরি মাথা কাজ করতেছে না। সে আছে একটা ঘোরের মধ্যে। সেই ঘোর থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত তুমি তারে দিয়া কিছুই করাইও না। যতই কাগজপত্রের সম্পর্ক, অধিকার লিখাই নাও না কেন, সেইটা তার মন পর্যন্ত পৌঁছাবে না। আর এই সব সম্পর্ক কাগজপত্রের চাইতেও মনেরপত্রে লেখা বেশি জরুরি।’
নুরুন্নাহার খানিক চুপ করে থেকে বললেন, এত বড় বড় কথা বোঝার আমার দরকার নাই। যত বেশি বুঝব, সমস্যা তত বেশি। আপনেরে যেটা বলছি, আপনি সেটা করেন। আর ফরিদ-পারুর বিষয়টা কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবেন যে পারু তার বাবার সঙ্গে ইন্ডিয়া চলে গেছে।’
ফরিদ আসছে এইটা কিন্তু এখনো কেউ জানে না। জানলে এইটা নিয়া না আবার গণ্ডগোল শুরু হয়।
হবে না। তারে একদিন মসজিদে নিয়া তওবা পড়াইয়া নিতে হবে। তারপর যত দ্রুত সম্ভব আছমার সঙ্গে বিয়া দিয়ে দিলেই দেখবেন কেউ আর কোনো কথা বলবে না। বরং গ্রামের সবাই খুশিই হবে। সবাই ভাববে শেষ পর্যন্ত সে নিজের ভুল বুঝতে পারছে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরা আসছে। ধর্মের ছেলে ধর্মে ফিরা আসছে। কিন্তু এইটা না হইলে ফরিদরে কিন্তু আপনে ভুবনডাঙায় রাখতেও পারবেন না। মানুষ থাকতে দেব না। এই কথা মনে রাইখেন।
নুরুন্নাহারের কথা মিথ্যে নয়। এই প্রথম ওহাব ডাক্তারের মনে হলো, নুরুন্নাহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছেন। ফরিদকে যদি এই গ্রামে থাকতে হয়, আবার স্বাভাবিক একটি জীবন যাপন করতে হয়, তবে এটিই সবচেয়ে কার্যকর উপায়। একমাত্র এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারলেই সে আবার একটি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে। নতুবা সেটা এই ভুবনডাঙায় আর কখনো সম্ভব নয়।
বিষয়টা নিয়ে তিনি ভাবলেন। তবে হুট করে ফরিদের ওপর কোনো সিদ্ধান্তও তিনি চাপিয়ে দিতে চান না। আগে তার মনের অবস্থা বুঝতে চান। তার সঙ্গে কথা বলতে চান। কথা বলতে চান আছমার সঙ্গেও।
সেদিন রাতেই তিনি ফরিদের সঙ্গে বসলেন। ফরিদ বলল, “মামা, আপনে আর ফার্মেসিতে যান না?
যাই। কম।
“কেন?
কারণ তুই চলে যাওয়ার পর আমাকে অনেক ঝামেলার মধ্যে পড়তে হইছিল। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া তোর আর পারুর বিষয়টা নিয়ে খুব সমস্যা করেছিল।
কী সমস্যা?
‘অনেক কিছু। সেসব তোর শোনার দরকার নাই।
‘আপনে কি এই কারণেই আমারে বাড়ির বাইরে যাইতে দেন না?’
হুম।
‘কেন?
‘তুই বিষয়টা বুঝতে পারছিস না?
এই প্রশ্নে ফরিদ খানিক চুপ করে রইল। তারপর বলল, বুঝতে পারছি। আজকাল মাথা ঠিকঠাক কাজ করে না মামা। আমি তো জানতামই পারুরে নিয়া গেলে আমি আর কোনোদিনও এই গ্রামে ফিরতে পারব না।’
‘তুই চলে যাওয়ার পর গাঁয়ের লোকজন আমার ওপরও খুব ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ধর্মীয় একটা বিষয় তো আছেই। মুসলমানের ছেলে হয়ে তুই হিন্দুর মেয়ের সঙ্গে চলে গেলি। এইটা তো লোকজন সহজে নেবে না, তাই না?
‘কিন্তু তাতে আপনের দোষ কী?
‘আমার দোষ, লোকে মনে করছে আমি এর পেছনে ইন্ধন দিছি। মহিতোষ মাস্টারের সম্পদের লোভে। অবশ্য বিষয়টা ভূঁইয়া সাব সবাইরে বুঝাইছে। এখন তুই যে ফিরে আসছিস, এই কথা যদি গাঁয়ের লোকজন জানে, বুঝতে পারছিস কী হবে?’
‘জি, মামা।’ বলে মাথা নিচু করে রইল ফরিদ।
‘তুই যাওয়ার পর এমনও হইছে যে আমার বাড়িতে ভাঙচুর করার হুমকিধমকি দিছে লোকজন। মসজিদে যাইতে দেয় নাই। গ্রাম থেকে বের করে দেয়ার পরিস্থিতি হইছে। তারপর একপ্রকার গৃহবন্দিই ছিলাম। বাড়ি থেকেই বের হওয়া নিষেধ ছিল। এই ভুবনডাঙায় আমি বড় হইছি, এইখানে আমার জন্ম, অথচ সেই গাঁয়ে আমি ছিলাম গৃহবন্দি। এর চাইতে অপমানের কিছু কি আছে?
ফরিদ কথা বলল না। সে ধীরে ধীরে যেন উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে তার জন্য এই পরিবারটার ওপর দিয়ে কী ঝড়ই না বয়ে গেছে। কী অপমানটাই না সহ্য করেছেন তারা।
ওহাব ডাক্তার বললেন, এখন তোর প্ল্যান-পরিকল্পনা কী, সেটা আমারে বল। তুই কী করতে চাস?
‘আমি জানি না মামা। ফরিদ ভেঙে পড়া গলায় বলল। আমি সত্যিই জানি। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমার মাথা কাজ করে না। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় আমি সুস্থ আছি। সবকিছু ঠিকঠাক চিন্তা করতে পারছি। কিন্তু তখন আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না মামা। ওই সুস্থ অবস্থাটা ফিরে পেলে আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না। মরে যেতে ইচ্ছা করে। সবকিছু শূন্য মনে হয়।
হুম।’ বলে খানিক গম্ভীর হয়ে রইলেন ওহাব ডাক্তার। তারপর বললেন, ‘গ্রামের কাউরে কেন জানতে দিই নাই যে তুই এইখানে, তোরে কেন বাড়ির বাইরে যেতে দিই না, এইটা তো বুঝছিস?”
ফরিদ মাথা নিচু করে রইল। কথা বলল না। আব্দুল ওহাব বললেন, তুই কারো চোখে পড়লে একটা অঘটনও ঘটে যেতে পারে। সেইটা সামাল দেওয়ার সাধ্য আমার নাই। এখন তুই ই বল, তুই কী চাস?
‘আমি কী তাহলে চলে যাব মামা?
‘কই যাবি?
এই প্রশ্নে চুপ হয়ে গেল ফরিদ। আসলেই তো কই যাবে সে? এই পৃথিবীতে তার তো আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। ওই এক বালুর মাঠের পাশের বটগাছটা ছাড়া আর কোথায় যাবে সে? আর ওখানেই গিয়েই বা কী করবে?
যখন তার মাথা কাজ করে না, একটা তুমুল জলোচ্ছ্বাসের মতো এলোমেলো চিন্তার বান তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় দিগ্বিদিক, তখন তার মনে হয়, সব ঠিক হয়ে যাবে। ওই বুঝি পারু এলো। ওই বুঝি সে তাকে ডাকছে। কিংবা সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন আর কোনো যুক্তি বুদ্ধিই কাজ করে না। কিন্তু ওই সময়টা কেটে যেতেই এক নিদারুণ শূন্যতা, এক সীমাহীন যন্ত্রণার অনভূতি তাকে গ্রাস করে ফেলে। অবশ, আচ্ছন্ন করে ফেলে। তখন মনে হয় পারু আর কখনো ফিরে আসবে না। এই বিশ্ব চরাচরে সে একা। নিঃসঙ্গ, যন্ত্রণাকাতর এক মানুষ। এই জীবন থেকে তার মুক্তি চাই। যেকোনো উপায়ে মুক্তি চাই। কিন্তু সেই উপায়টাই তার জানা নেই।
ওহাব ডাক্তার বললেন, ‘বল, কই যাবি?
ফরিদ হঠাৎ দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বলল, আমি জানি না মামা। আমি সত্যি জানি না। তুমি বলো আমি কী করব?
কথাটা বলতে ওহাব ডাক্তার একটু সময় নিলেন। তারপর বললেন, মানুষের জীবনে কত দুর্ঘটনা ঘটে না ফরিদ?
ফরিদ জবাব দিল না। ওহাব ডাক্তার তার একখানা হাত আলতো করে ফরিদের কাঁধে রাখলেন। তারপর বললেন, আমার কথাগুলা মন দিয়ে শোন।
হুম।’ বলল ফরিদ।
‘সেই সব দুর্ঘটনা সামলেও কিন্তু মানুষ বেঁচে থাকে। থাকে না?
ফরিদ চুপ। সে মামার কথা শোনার চেষ্টা করছে। বোঝারও। ওহাব ডাক্তার বললেন, ‘পারুর জন্য কি তুই কম কিছু করছিস? এমন তো না যে তুই তোর দায়িত্বে কোনো অবহেলা করছিস। বা তারে ঠকাইছিস। মিথ্যা বলছিস। এমন কিছুই কিন্তু তুই করিস নাই। করছিস?
নাহ। মাথা নাড়ল ফরিদ।
‘তাইলে…। এখন বাকিটা জীবন তুই কী করবি? ওই নদীর পাড় গিয়া বসে থাকবি? রাস্তার পাগলের মতো, ওইখানে গিয়া পড়ে থেকে বিনা খাবারে, সিকৎসায়, রোদ-বৃষ্টিতে মরবি? তোর লাশটাও তো আমরা কেউ খুঁজে পাব না। পাব?
ফরিদ কথা বলল না। ওহাব ডাক্তার বললেন, তুই তো বুঝিস, বুঝিস না?
কী?
‘পারুর যদি ফিরে আসার সুযোগ থাকত, তাইলে সে এতদিনে আসত। আসত না?
ফরিদ কথা বলল না। ওহাব ডাক্তার বললেন, সময় কিন্তু কম হয় নাই ফরিদ। সাত-আট মাস কিন্তু কম সময় না! এতটা দিন একটা মানুষ কই গিয়া, কার কাছে গিয়া লুকাই থাকব? একবার ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা কর?
ফরিদ যে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার চেষ্টা করেনি, তা নয়। কিন্তু সেই চেষ্টার ফলাফল শূন্য। প্রতিবারই ওই চিন্তা করতে গিয়ে যে নৃশংস, রুঢ় সত্য তার সামনে এসে দাঁড়ায়, সেই সত্য সে মেনে নিতে পারে না। ওহাব ডাক্তার বললেন, এখন সিদ্ধান্ত তোর, তুই বাকিটা জীবন কীভাবে বাঁচতে চাস? কোথায় গিয়ে বাঁচতে চাস? এই গাঁয়ে থাকতে হলে তোরে সবার সামনে যেতে হবে। আর সবার সামনে যেতে হলে তোর কিছু নিয়ম-কানুনও মানতে হবে। আমি কিন্তু তোরে কিছুই করতে বলছি না। শুধু তোরে চিন্তা করতে বলছি, একটু ঠাণ্ডা মাথায়। যা বললাম, সেইগুলা এক এক করে একটু ভাব। সিদ্ধান্ত নে। এইখানে কিন্তু বেশিদিন তোরে আমি লুকাই রাখতে পারব না। তা ছাড়া…।’
কথা শেষ না করেই থেমে গেলেন ওহাব ডাক্তার। ফরিদ বলল, তা ছাড়া কী মামা?
‘আছমারও বয়স হইছে। ওরে বিয়া-শাদি দিতে হবে। ওর জীবনেও তো কম ঝড় যায় নাই ফরিদ। ওই ঘটনার পর থেইকা এই বাড়িতে কোনো ভালো সম্বন্ধ পর্যন্ত আসে না। তারে নিয়াও মানুষ নানা উল্টাপাল্টা কথা বলে। তোর মামি এই নিয়া যে কত কান্নাকাটি করে। আর আছমার কথা কী বলব? তারে তো তুই চিনসই। তার বুক ফাটবে, কিন্তু মুখ ফুটবে না।
ফরিদ বলার মতো আর কোনো কথা খুঁজে পেল না। তবে সেইদিনের পর থেকে তার মাথায় নানা এলোমেলো ভাবনা ঘুরতে লাগল। মামার জন্য প্রচণ্ড অপরাধবোধও কাজ করতে লাগল। অপরাধবোধ কাজ করতে লাগল আছমার জন্যও। নিজের জন্য কতগুলো মানুষের জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে সে! তার জন্য গ্রামসুদ্ধ লোকের কাছে কী অপদস্থই না হতে হয়েছে তাদের। আছমার মতো অসাধারণ এক মেয়ে কী ভয়ানক জীবনই না কাটাচ্ছে!
.
পরের কটা দিন খুবই খারাপ কাটল ফরিদের। যতই সে গুছিয়ে চিন্তা করার চেষ্টা করে, ততই যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। অসংখ্য জটিল ভাবনার অন্তহীন এক চোরাগলিতে ক্রমাগত ঘুরে বেড়াতে লাগল সে। কিন্তু সেখান থেকে বের হয়ে আসার কোনো পথ খুঁজে পেল না। ফলে কখনো সে কেঁদে বুক ভাসাল। আবার পরক্ষণেই হয়ে উঠতে লাগল রুঢ়, উগ্র, ধ্বংসাত্মক। এই সময়টাতে আছমা চেষ্টা করল যতটা সম্ভব তাকে আগলে রাখতে। তার কাছাকাছি থাকতে। কিন্তু দুদিন আগের খানিক নমনীয়, অনুমেয় ফরিদ হঠাৎই যেন অনুনমেয়, বেপরোয়া হয়ে উঠতে লাগল। সে আর কারো সঙ্গে কথা বলতে চায় না। খেতে চায় না, ঘুমাতে চায় না। সারাক্ষণ দরজা বন্ধ করে একা বসে থাকে। নুরুন্নাহারের ধারণা, ফরিদের ওপর পারুর মৃত আত্মা ভর করেছে। এই ভর থেকে তাকে মুক্ত করতে হবে।
পঞ্চম দিন দুপুরে বাড়িতে এক পকূকেশ থুথুরে বৃদ্ধা এসে হাজির হলেন। তার বাড়ি নুরুন্নাহারের বাপের দেশে। দুঃসম্পর্কের হলেও কোনো না কোনোভাবে নুরুন্নাহারদের সঙ্গে তার আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। নারী মহলে তিনি দারুণ জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্য। বিশেষ করে তাদের নানাবিধ সাংসারিক সমস্যা সমাধানে তার পরামর্শ যেন অভেদ্য অস্ত্র। ধর্মীয় নানা ঘটনা, উদাহরণ বিচার-বিশ্লেষণ করে তিনি পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ফরিদের বিষয়েও দিলেন। এ বাড়িতে দিন তিনেক থেকে তিনি ফরিদকে বিচার-বিশ্লেষণ করলেন। তার সঙ্গে যতটুকু সম্ভব কথাবার্তা বললেন। তারপর যাওয়ার আগের দিন ওহাব ডাক্তার আর নুরুন্নাহারকে ডেকে সামনে বসিয়ে বললেন, ‘বুঝলি নুরুন্নাহার, এই পোলার সমস্যার সমাধান তো অতি সহজ।
কী সমাধান খালা?
‘এর বিবাহ দরকার। অতি সত্বর এর বিবাহ দরকার। কিন্তু…।’
কিন্তু কী?
‘এর বিবাহ দিতে হবে নেককার মেয়ের সঙ্গে। মেয়ের মন হইতে হবে শান্ত, সফেদ। কুপি বাতি জ্বালাইলে যে ওপরে কালি পড়ে, এক ঘসা দিলেই উইঠা যায়, ওইরকম কালিও যেন তার মনে না থাকে।’
‘এমন মেয়ে পাব কই?
বৃদ্ধা সঙ্গে সঙ্গেই কথা বললেন না। নুরুন্নাহার রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ডাক্তার ওহাব যেন জানেন তিনি কী বলবেন! তারপরও তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন।
বৃদ্ধা বললেন, সমাধান তোর ঘরেই আছে। তোর মেয়ে আছমা। তার চাইতে সফেদ, ভালো মনের মেয়ে আর দশগ্রামে কে আছে? ওহাব, যাও এখনই মসজিদ থেইকা ইমাম সাবরে ডেকে নিয়া আসো।
ইমাম সাবরে? এখন?
হুম।
কী বলেন আপনে? ফরিদ যে গ্রামে, এই কথা এখনো কেউ জানে না।
‘জানবে, আগামী শুক্রবার জুমার নামাজের পর মসজিদে তারে তওবা পড়ানো হবে। তওবার পরে আমার সঙ্গে তার বিবাহ দেয়া হবে। ইমাম সাবরে আজই এই কথা জানাইতে হবে। এই কথা শুনলে সে খুশিই হবে। নিজ থেইকাই সে সব ব্যবস্থা করবে। এতে তার কৃতিত্বও বাড়বে। বিপথে চলে যাওয়া এক ছেলেরে সে পথে নিয়া আসতে পারছে, এইটা কি কম কথা? দশজনের কাছে তার মান ইজ্জতও বাড়বে। বুঝলা ওহাব। যাও ইমাম সাবরে খবর দিয়া নিয়াসো।
‘এখনি যাব?
হুম, এখুনি যাবা। আমার হাতে সময় নাই। আমি চলে যাব। যাওয়ার আগে তারে সব বুঝাই দিয়া যাব। আর…।’
আর কী?
‘আগামী শুক্রবার জুমার নামাজের পর তোমার কন্যা আছমার সঙ্গে তার বিবাহ। এই কথার যেন অন্যথা না হয়। তাইলে কিন্তু বিপদ। কথাটা মনে রাইখো। আর শোনো…।
‘জি।’
‘শুভ কাজে দেরি করতে নাই, এইটাও মনে রাখবা।
‘জি, আচ্ছা।’
২২
গত তিন দিন ধরে পারু এক প্রকার সংজ্ঞাহীন অবস্থায় কাটাচ্ছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তার মুখ নীল হয়ে আছে। মাসখানেক আগের এক রাতে সে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়েছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেয়া। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বিষয়টা টের পেয়ে যায় সালমা। সে বহু কষ্টে তাকে ফিরিয়েছিল। কিন্তু সেই থেকে একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল পারু। তার ধারণা, যার কারণে সে এত যন্ত্রণা সইছে, মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর এক জীবন বয়ে বেড়াচ্ছে, সেই সন্তানটি আর বেঁচে নেই। জন্মের আগেই সে তার গর্ভে মারা গেছে। এমন অভিশপ্ত জীবন পুষে রেখে কী লাভ?
তাবারন বিবিও ইদানীং পারুকে নিয়ে একটু বিরক্ত। রক্তের সম্পর্কহীন, অনাত্মীয় একজনকে এমন যত্ন করে কতদিন পেলে পুষে রাখা যায়? তাও যদি সে সহজ-স্বাভাবিক হতো। পারু সহজ স্বাভাবিকতো নয়ই, বরং ক্রমশই সে হয়ে উঠছে আরো দুর্বোধ্য। ইচ্ছে হলে সে কথা বলে। না হলে বলে না। সারাক্ষণ ঘরবন্দি হয়ে অন্ধকারে শুয়ে থাকে। তার কিছু আচার-আচরণও ইদানীং রহস্যজনক মনে হচ্ছে তাবারন বিবির কাছে।
যে রাতে সে তাবারন বিবির ঘরের দাওয়ায় এসে অচেতন হয়ে পড়েছিল, সেই রাতে দু-একবার সে ঠাকুমা ঠাকুমা বলে ডেকেছিল। বিষয়টা তাবারন বিবির আবছা মনে আছে। কিন্তু সেদিন বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দেননি তিনি। সমস্যা হচ্ছে, গত মাসখানেক ধরে এমন নানা কিছু তিনি লক্ষ করেছেন। পারুর কথাবার্তা, আচার-আচরণ বেশ সন্দেহজনক। কাশেম কি তবে হিন্দুর ঘরের মেয়ে বিয়ে করে নিয়ে এলো?
আর সবকিছু মেনে নেয়া গেলেও এটি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তাবারন বিবি। এর আগে কাশেম যখন পারুকে প্রথম ট্রলারে করে বাড়ি নিয়ে এলো, তখন নানা গল্প ফেঁদেছিল সে। বলেছিল, এই মেয়ে তার বিয়ে করা বউ নয়। তাকে সে মেলার মাঠ থেকে আসার সময় ট্রলারের ছাদে পেয়েছে। এই কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। রাজিয়াও না। তাবারন বিবি তখন রাজিয়াকে একবার জিজ্ঞেসও করেছিলেন। তিনি আসলে পারু আর কাশেমের আসল ঘটনা জানতে চাইছিলেন। রাজিয়া তখন বলেছিল যে পারু ইচ্ছে করেই মাঝেমধ্যে হিন্দুদের মতো কথা বলে। বিভিন্ন শব্দ, সম্বোধন বলে। তার ধারণা, এসবই কাশেম পূর্বপরিকল্পনা মতো পারুকে শিখিয়ে দিয়েছিল। যাতে পারুর এ বাড়িতে আগমনের কারণ হিসেবে কাশেমের বানানো গল্পটাই প্রতিষ্ঠিত করা যায়। এবং রাজিয়ার সঙ্গে অন্তত কিছুদিন সে নিরাপদে বসবাস করতে পারে।
কিন্তু তাবারন বিবি অভিজ্ঞ মানুষ। পারুর এসব আচরণ আর তার কাছে অভিনয় বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সহজাত, অকৃত্রিম আচরণ। বরং সে যখন এসবের বাইরে কিছু করতে বা বলতে যায়, তখন সেগুলোকেই আরোপিত মনে হয়। খট করে চোখে বাঁধে। অনভ্যস্ততা ধরা পড়ে। এ নিয়ে পারুর সঙ্গে তিনি কথাও বলেছেন। পারু অবশ্য স্পষ্ট করে কোনো জবাব দেয়নি। বেশির ভাগ সময়ই সে শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে চুপ করে থেকেছে। বাকি সময়ে যা বলেছে, তা তাবারন বিবিকে আরো বিভ্রান্ত করে ফেলেছে।
সেদিন যেমন প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতর পারু নিজের অজান্তেই অস্ফুটে বলল, ‘আমার জন্য ভগবান এ কী জীবন রেখেছে, আমি জানি না। আর পারছি না আমি।’
কথাটা খট করে কানে বিধল তাবারন বিবির। তিনি বললেন, “তওবা করো তওবা। ভগবান কী গো মেয়ে? আল্লাহ বলো আল্লাহ।’
তা পারু বললও। তবে তার সেই বলার ধরনে অনভ্যস্ততাটা স্পষ্ট ফুটে উঠল। সেই থেকে তাবারন বিবির মনটা খচখচ করছে। খানিক অসন্তুষ্টিও। কোথাও না কোথাও একটা রহস্য আছেই। কাশেম প্রথমবার আত্মগোপনে যাওয়ার আগেই তাকে বলে গিয়েছিল যে তিনি যেন মাঝেমধ্যে গিয়ে পারুকে একটু দেখে আসেন। সে কারণেই তিনি যেতেন। খোঁজখবর নিতেন। কিন্তু এরপর ছেলেটা আর একবারও তার কাছে এলো না? তা কাশেমকে তিনি পছন্দ করেন। তার বিপদে-আপদে সে সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত। কিন্তু এখন এমন একটা ধোঁয়াশা পূর্ণ বিষয়ে নিজেকে জড়িয়ে কেমন অস্বস্তি লাগছে তার। সমস্যা হচ্ছে পারুর বর্তমান যা অবস্থা, তাতে কাশেম না আসা অবধি কোনো সিদ্ধান্তও নেয়া যাচ্ছে না।
তাবারন বিবি অবশ্য এর মধ্যে দুয়েকবার কাশেমের বাড়িতে গিয়েছিলেন। রাজিয়ার মা সাহেরা বানু আবার এসেছেন। তিনি এখন মেয়ের সঙ্গেই থাকেন। তাবারন বিবি ইচ্ছে করেই তাকে বললেন, ‘তা তোমার মেয়ের না হয় মাথাখান গরম, তোমার তো আর গরম না। বয়স হইছে। তুমি তারে ভালো-মন্দ কিছু বোঝাবা না?
সাহেরা বানু বললেন, কী বোঝাবো মাওই মা?
কী বোঝাব মানে? সে যে রাইতের আন্ধারে কাশেমের ছোট বউটারে মারতে লইছিল। তার পেটে সন্তান, এই সময়ে যদি সত্য সত্যই কিছু একটা হইয়া যাইত, তখন? তখন তুমি কী করতা? বাঁচাইতে পারতা রাজিয়ারে? না তোমরা বাঁচতা?
‘এই সব আপনে কী বলেন মাওই মা! যেন আকাশ থেকে পড়লেন সাহেরা বানু। আমার রাজিয়া তারে মারতে যাইব কোন দুঃখে? সে আরো নিজের সবকিছু তারে দিয়া দিছে। রাইন্ধা-বাইড়া খাওয়াইছে। আসলে কি জানেন, আমার মাইয়াটার কপাল পোড়া। এইজন্য ভালো করলেও তারে কেউ দেখতে পারে না। বাজা মাইয়া মানুষের আবার ভালো মন্দ কী? আমার উচিত আছিল জন্মের সময়ই তার মুখে নুন দিয়া মাইরা ফালান।
বলে কাঁদতে লাগলেন সাহেরা বানু। তাবারন বিবি তার অবস্থা দেখে একটু অপ্রস্তুতই হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, ‘কিছু যদি না-ই করব, তাইলে অত রাইতে ছোট বউ কেন আমার বাড়িতে গিয়া হাজির হইব?
‘আমরা বললে কি আর আপনে বিশ্বাস করবেন? করবেন না। কান্না থামিয়ে বললেন সাহেরা বানু।
‘কী বিশ্বাস করব না?
‘আসল ঘটনা।
‘আসল ঘটনা কী?
“ছিঃ ছিঃ ছিঃ। ওই কথা আমি মুখেও আনতে পারব না। আনলে মানুষে বলবে আমি আমার মেয়ের সতিনের নামে বানাই বানাই মিছা কথা বলতেছি। থাক মাওই মা, আমি কিছু না বলি। তার যে ফজুর লগে ফষ্টিনষ্টি ছিল, এইটা বললে কেউ বিশ্বাস করবে কন?’
এই কথায় তাবারন বিবি সামান্য দমে গেলেন। সাহেরা বানু যে এদিক দিয়ে প্যাঁচ খেলবেন, এটা তিনি আশা করেননি। তিনি বললেন, এইটা কী কথা বলো তুমি?
‘সেইটাই। আমি জানতাম, এই কথা কেউ বিশ্বাস করব না। মাঝখান থেইকা দোষ হইব আমার মেয়ের। এইজন্যই তারে আমি বলছি, তুই কিছু বলবি না। ভালোও না, মন্দও না। যা বলবি, তাতেই সমস্যা। এত যত্ন-আত্মী কেউ কোনোদিন সতিনরে করে? আপনে দেখছেন? কিন্তু লাভ হইল কি? শেষ পর্যন্ত তো বদনামেরই ভাগিদার হইল। এইজন্যই আমি মানা করছি, আপনের বাড়িতেও তার খোঁজ-খবর নিতে না যাইতে। দেখা গেল, খোঁজ নিতে গিয়া আবার কোন দোষে পড়বে? তার চাইতে বোবা থাকনই ভালো। বাবার শত্রু নাই।
তাবারন বিবি কথা বললেন না। তবে মা-মেয়ে যে ঘটনার পর আটঘাট বেঁধেই সব ঠিক করে রেখেছে, তা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠল।
সাহেরা বানু বললেন, রাইতে ফজু আসছে তার জানালার কাছে। ফিসফিস ফিসফিস কথা। প্রতি রাইতেই চলে। তো সেইদিন তো আর ফিসফিসানিই না, ওই অবস্থায়, পেটে ছয়-সাত মাসের বাচ্চা। ওই অবস্থায় সে ফজুর সঙ্গে বাইর হইছে ঘরের বাইরে। জোছনা দেখতে। নদীতে নাকি জোছনার আলো দেখার খুব শখ তার। তা তোর যখন এতই শখ, তখন রাজিয়ারে বললেই তো হইত। সে তো আর তোর শত্রু না। অন্য সতিনগো মতো না। সে তোর আপন বইনের মতোন। কিন্তু চোরের মনে পুলিশ পুলিশ বুঝলেন মাওই? ওই মাইয়া ঘরে নাই টের পাইয়া রাজিয়া বাইর হইছে তারে খুঁজতে। কিন্তু কোথাও নাই। শেষে সে গেছে নদীর পাড়। কিন্তু তারে দেইখাই দুজন দুই দিকে দৌড়। এখন ওই খানে কী করতেছিল কে জানে! এদিকে রাজিয়াও তো ভয়ে দৌড়াই আইসা ঘরে ঢুকছে। পরদিন আমি আসলাম। সব শুনে বললাম, থাক। তোর আর কিছু করার দরকার নাই।
.
পারু ফজুর বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলেনি তাবারন বিবিকে। কেবল এটুকুই বলেছিল যে রাজিয়া আর ফজু মিলে তাকে জোর করে নদীর ঘাটে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে একখানা ট্রলারও ছিল, সেই ট্রলারে করে কোথাও নিয়ে যেতে চেয়েছিল তাকে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ফজুকে ধাক্কা মেরে পানিতে ফেলে পালিয়ে এসেছে সে। পারুও অবশ্য তখনো জানে না, ফজুর সত্যিকারের অবস্থা কী? সে কতটুকুই বা আহত হয়েছে। তবে ওই ঘটনার পর ফজুকে আর কোথাও দেখা গেল না। অনেকেই বলছে যে সে রাতের অন্ধকারে ট্রলারের ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে মুখে ভয়াবহ আঘাত পেয়েছে। ট্রলারভর্তি ছিল রডের চালান। সেই রডের বেরিয়ে থাকা ফলার ওপর পড়ে তার মুখ ফালাফালা হয়ে গেছে। এ কারণে রূপগঞ্জ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি আছে। সে। তার দীর্ঘদিনের চিকিৎসা দরকার।
.
সবকিছু মিলিয়ে তাবারন বিবি একটা তীব্র মানসিক অস্থিরতা অনুভব করতে শুরু করলেন। তার কেবলই মনে হতে লাগল, পারু মেয়েটাকে তিনি যতটা সহজ ভাবছেন, সে ততটা সহজ নয়। তার কোথাও বড় ধরনের কোনো জটিলতা আছে। রহস্য আছে। সেই রহস্য তিনি উদঘাটন করতে পারছেন না। আবার চারপাশে যা শুনছেন তারও সব বিশ্বাস করতে পারছেন না। সমস্যা হচ্ছে পুরোপুরি অবিশ্বাসও করতে পারছেন না। ফলে এক প্রবল দ্বিধার দোলাচালে সময় কাটছে তার।
.
এই দ্বিধা নিয়েই পারুর দেখভাল করতে হচ্ছে তাকে। দীর্ঘদিন পেটের সন্তানের কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে সে। দিন যত যাচ্ছে, ততই তার শরীরও খারাপ হচ্ছে। কারো সঙ্গে কথাও বলতে চাইছে না। নিজের ভয়ানক কোনো অসুবিধা হলেও না। যেন শামুকের মতো চারপাশে দেয়াল তুলে দিয়ে তার ভেতরে গুটিয়ে গেছে সে। আরো শঙ্কার বিষয় হলো, এখন তার শারীরিক যে অবস্থা, তাতে প্রসবের সময় হয়ে এলে বড় ধরনের কোনো বিপদও ঘটতে পারে। কিন্তু সেই বিপদ মোকাবেলায় কোনো প্রস্তুতিও তাদের নেই। এ নিয়ে পারুর সঙ্গে কথা বলারও চেষ্টা করেছিলেন তাবারন বিবি। তার সুবিধা-অসুবিধা জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে কথা বলেনি। কেবল সারাটা সময় এক দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল বাইরে। * গত কয়েক দিন ধরে পারুর যে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, তা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবে সেটা যে প্রসব বেদনা নয়, তাও বুঝতে পারছেন তাবারন বিবি। সমস্যা হচ্ছে, হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তাও যেমন তেমন বৃষ্টি না, আষাঢ়ে বৃষ্টি। গত কয়েক দিন ধরে একটানা বর্ষণ। নদীর পানি যেন দু কূল উপচে উঠছে। সেই সঙ্গে ডুবিয়ে দিচ্ছে দু পাশের ধানক্ষেত। এর মধ্যেই একটা দুঃসংবাদ এলো। এলাকার মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে যে কাশেম পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ঢাকায়। এই খবরের পর থেকে তাবারন বিবির ঘরখানাও যেন থমথমে হয়ে গেল। পারুর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলেন তিনিও। তবে ঘটনার দিন তিনেক বাদে এক সন্ধ্যায় পারু হঠাৎ তাবারন বিবিকে ডাকল। তারপর স্পষ্ট গলায় বলল, আপনাকে যদি আমি ঠাকুমা বলি, তাহলে কি আপনার খুব খারাপ লাগবে?
তাবারন বিবি কথা বললেন না। পারু বলল, আমার জীবনে যে কজন মানুষের জন্য আমি আমার মৃত্যু পর্যন্ত কাঁদব, তাদের একজন হলো আমার ঠাকুমা। তার নাম ছায়ারাণী। সে সত্যি সত্যিই ছায়ারাণী। তার আশপাশে থাকলে আপনার ছায়ার অভাব হবে না। সে আপনারে দুনিয়ার সব ছায়া আর মায়া দিয়ে আগলাই রাখবে। আপনারে আমার তার মতো মনে হয়। এইজন্য যদি আপনি। আমার ওপর রুষ্ট হন, আমি আপনার কাছে দুই হাত জোড় করে ক্ষমা চাই।
বলে সে সত্যি সত্যিই হাত জোড় করে ক্ষমা চাইল। তারপর বলল, আরেকটা কথা।
তাবারন বিবি কোনো কথা বললেন না। তবে পারুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। পারু বলল, আমি কাশেম ভাইয়ের বউ না। আমার গর্ভে যেই সন্তান আছে, সেই সন্তানও কাশেম ভাইয়ের না। সন্তানের বাবার নাম ফরিদ। সে মুসলমান। আমি হিন্দু। তার সঙ্গে মেলা দেখতে এসে আমি হারাই গেছি। ঘটনাচক্রে কাশেম ভাইর নৌকায় আমার ঠাই হয়। এই কথা সত্য। এর একবিন্দুও মিথ্যা না। আমি আমার পেটের সন্তানের কসম করে বলছি।’
তাবারন বিবি আচমকা আবিষ্কার করলেন পারুর ঠোঁট ফুলে গেছে। তার হাত পায়েও পানি চলে এসেছে। চোখ রক্তশূন্য। এই বিষয়গুলো তিনি এতক্ষণ কেন বুঝতে পারেননি কে জানে!
পারু বলল, কিছু মানুষ পৃথিবীতে জন্মায় শাস্তি পাওয়ার জন্য। কিন্তু তারা সেই শাস্তির কারণ জানে না। আমিও জানি না। বা যেটা জানি, সেটা এত বড় শাস্তির কারণ হতে পারে কি না আমার জানা নাই। তবে আপনার মতো কিছু মানুষ সেই শাস্তির মধ্যেও বিরাট বড় সন্ত্বনা, শান্তি। ঠাকুমা…।’
সে তাবারন বিবিকে ডাকল। তাবারন বিবি তার সেই ডাকে সাড়া দিলেন। তিনি পারুর মাথাটা তার কোলে তুলে নিলেন। পারু বলল, আমার শরীর ভালো না। আমার ধারণা আমি মারা যাব। কিন্তু আমি এমন এক সময়ে এমন এক জায়গায়, এমন অবস্থায় মারা যাচ্ছি যে আমি চাই না পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষটারও এমন মৃত্যু হোক। এইখানে আমার কেউ নাই। আমার বাবা, মা, বোন, ফরিদ, কেউ না। তবে ভগবান কেমন কেমন করে যেন আমার ঠাকুমাকে আমার পাশে এনে দিলেন। কেন এনে দিলেন জানেন?
তাবারন বিবি তাকিয়েই রইলেন। পারুর শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। এই এতক্ষণে তিনি লক্ষ্য করলেন, পারুর পানি ভাঙতে শুরু করেছে। তার নিম্নাংশের কাপড়, বিছানা ভিজে গেছে। তার মানে তার প্রসবের সময় আসন্ন?
তিনি অস্থির হয়ে সালমাকে ডাকতে লাগলেন। কিন্তু পারু তাকে হাতের ইশারায় নিরস্ত করল। তারপর খুব ধীরে, ভাঙা গলায় বলল, আমার গায়ের নাম ভুবনডাঙা। সেখানে আমাদের একটা বাড়ি আছে। আমার ধারণা ওটা স্বর্গের চাইতেও শান্তির। ওই বাড়িটাতে, ওই ঘরটাতে এত মায়া! ওই বাড়ির একটা গাছ, পাতা, রোদ-ছায়া এমনকি একটা ঘাসফুলেও মায়া। এই মায়ার সবটাই আমার বাবার কারণে। কিন্তু আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে মনে হচ্ছে, আমার বাবার ওই সব মায়ার উৎসও আমার ঠাকুমা। তিনি হলেন মাটি। তার থেকেই সব মায়ার জন্ম।
বলে একটু থামল পারু। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে অতিকষ্টে বলল, ‘ভগবান সম্ভবত এই জন্যই এত দূরের এক গাঁয়েও পরিবার-পরিজনহীন আমার মৃত্যুর সময়ে আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। প্রথম যখন আপনাকে দেখেছিলাম, তখনই আপনাকে আমার ঠাকুমার মতো মনে হয়েছিল। আপনার গায়ের গন্ধও।
বলে আবার থামল পারু। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তার। সে বাতাসের অভাবে হাঁপাতে লাগল। তবে সেই অবস্থায়ই সে বলল, আমি যদি মরে যাই, তাহলে আমার লাশটা আপনারা কী করবেন?
তাবারন বিবি পারুর এই কথার উত্তর দিতে পারলেন না। তবে তিনি হঠাৎ আবিষ্কার করলেন তার চোখে বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে। তিনি সেই জল দু ফোঁটা আটকালেন না। তবে পারুও আর তার কথা শেষ করতে পারল না। তাবারন বিবির উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে পারল না। তার হঠাৎ মনে হলো, তার চারপাশের পৃথিবীটা ক্রমশই অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। গাঢ়, গভীর অন্ধকার। সেই অন্ধকারের ভেতর থেকে আর ফিরে আসার ক্ষমতা রইল না তার।
২৩
ছায়ারাণী মারা গেলেন ভোর রাতের দিকে। সকালে তাকে ডাকতে গিয়েছিলেন অঞ্জলি। দু-একবার ডাকতেই যেন তিনি বুঝলেন, ছায়ারাণী নেই। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এই নিয়ে কোনো হইচই করলেন না তিনি। কান্নাকাটি করলেন না। কেবল চারুকে ডেকে বললেন, তোর বড় মামার বাসায় যা। গিয়ে বল যে ঠাকুমা মারা গেছে। তার সৎকারের ব্যবস্থা করতে হবে। তোর জ্যাঠা, পিসিদের সবাইকে খবর দিতে হবে।’
মায়ের কথা শুনে চারু হতভম্ব হয়ে গেল, ঠাকুমা নেই! অথচ মা এমন। অবলীলায়, এমন সহজভাবে কথাটা বললেন যেন কিছুই হয়নি। অবশ্য মা বেশ কিছুদিন ধরেই যেন কেমন হয়ে গেছেন। সারাক্ষণই অন্য কোনো জগতে ডুবে থাকেন। একটা আশ্চর্য নির্লিপ্ততার জগৎ। যেন চারপাশে কোথায় কী হচ্ছে, তার কিছুতেই কোনো আগ্রহ নেই তার।
চারু দীর্ঘ সময় ঠাকুমার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। কী শান্ত, সমাহিত। যেন এখনো ঘুমাচ্ছেন। একটু শব্দ করলেই জেগে উঠবেন। তারপর খ্যানখ্যানে গলায় বলবেন, “এই দ্যাশে ঘুমাইয়াও শান্তি নাই। রাইতের বেলা ঠাণ্ডা, দিনের বেলা গরম। আর আমার দেশের বাতাস, আহা হা হা। উত্তর ভিটার আমগাছটার তলায় বইলেই চোখ বুইজা আসত ঘুমে। পুষ্করিণীর পারের শান বাঁধানো ঘাটে শইল ছাইড়া দিলে পরান জুড়াই যাইত। আর আমি সেই সব ছাইড়া এই দ্যাশে আইসা পইরা রইছি। ওরে আমার মহি রে খবর দে। তারে বল, আমারে আমার বাংলাদেশে নিয়া যাইতে। আমার ভুবনডাঙায় গিয়া রাইখা আসতে। কপালে যদি মরণ থাকে, আমি ওইখানে গিয়াই মরব। আমার চিতাভস্ম ভুবনডাঙা নদীতে না ভাসলে আমার শান্তি মিলব না।’
ঠাকুমার চিতাভস্ম কোন জলে ভাসবে? চারু জানে না। তার কেবল মনে হয়, মানুষ কেন এমন হয়? তারা তো গাছ নয়, তাহলে শিকড়ের মায়া কেন ভুলতে পারে না তারা? আর তারা যদি গাছের মতোই শিকড় ছড়িয়ে রাখে মাটিতে, মায়ায়, তাহলে সেই শিকড় ছেড়ে কেন আবার এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতে হয় তাকে? কেন তবে সে ওই গাছের মতো তার নিজের মাটিটুকুতেই শিকড় বিছিয়ে মৃত্যু অবধি রয়ে যায় না? কী আশ্চর্য, শিকড় ওপড়ানোর অসহ্য যন্ত্রণা পুষেও তাকে বেঁচে থাকতে হয়!
তারচেয়ে বৃক্ষের জীবনই বরং নিশ্চিন্ত। অন্তত শিকড় ওপড়ালে তাকে আর বেঁচে থাকার যন্ত্রণা পোহাতে হয় না।
ছায়ারাণীর সকার হয়ে গেল দ্রুত। যেন সকলের মধ্যেই এই অনিবার্য আনুষ্ঠানিকতাটুকু পালনের তাড়া ছিল। তারপর দিন চলে যেতে লাগল দ্রুত কিংবা ধীরে। অবশ্য তা নিয়ে আর কেউ ভাবে বলে মনে হয় না। কেবল একটা ঝিম ধরা ক্লান্ত দুপুরের মতো সবকিছু স্থির কিংবা চলমানই হয়ে রইল। কিন্তু তা আর আলাদা করা গেল না। তবে এর মধ্যেও মাঝে মাঝে যশোরে অরবিন্দু দাদুকে চিঠি লেখে চারু। আগে মা লিখত, এখন সে লেখে। বাবার কোনো খবর আছে কি না? কিংবা দিদির?
কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই অরবিন্দু বাবুর আর কোনো চিঠি আসে না। কে জানে, হয়তো তারা বাসা বদলেছেন, আগের ঠিকানায় আর নেই। ফলে চারুর চিঠি আর তিনি পান না। কিংবা বাবা আর দিদির কোনো খবর পান না বলেও হয়তো লেখেন না। কত আর মিথ্যে সান্ত্বনা দেয়া যায়! চারুর ধারণা, মাত্র এই কয়েক মাসেই তার বয়স বেড়ে গেছে প্রায় দ্বিগুণ। সে এখন আর অকারণে কাঁদে না। ভীষণ মন খারাপের মেঘ এসে তার বুকের ভেতরটা থমথমে করে রাখলেও না। বলেও না কাউকে কিছু। নিজেকে নিজের কাছে গোপন রাখতে শিখে গেছে সে। হয়তো বয়সই এসব শেখায়।
আজকাল বরং মাকে বোঝায় সে। দেখেশুনে রাখে। তারপর যখন এ বাড়ি, ও বাড়ি সবাই ঘুমিয়ে যায়, তখন চুপিচুপি নিজের লুকানো ডায়েরির পাতাটা খোলে সে। সেখানে লিখতে থাকে নিজের সব কথা। সেই কথায় কেবল ঘুরে ফিরে আসে পারুদি। আচ্ছা, পারুদি কোথায়? তার কি এখন মনে হয় যে সে ভুল করেছে? তাদের কাছে ফিরে আসতে ইচ্ছে হয়? আর বাবা? তিনিই বা কোথায়? পারুদির খোঁজ না পেলে তিনি কি আর কোনোদিন ফিরে আসবেন না?
বাবা আর পারুদি, দুজনকেই আলাদা আলাদা চিঠি লেখে সে। সেখানে কত কত অভিমানের কথা, অভিযোগের কথা। এই যে অন্য একটা দেশ, সেই দেশটা ক্রমশই নিজের দেশ হয়ে উঠছে। কিংবা ভাবতে হচ্ছে। সেই দেশ নিয়েও নিজের অনুভূতির কথা, ফেলে আসা সেই ভুবনডাঙা, ভুবনডাঙার রোদ, ছায়া, ফুল, পাতা, জলের আয়নার পুকুর, শান বাঁধানো ঘাট, টিনের চালের বৃষ্টি, শীতের কুয়াশা, ডাহুক পাখির চোখ কত কিছুর কথা যে সে লেখে। তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কেবল এই সময়টুকুই তার নিজের বলে মনে হয়। বেঁচে থাকা মনে হয়। অকপট, ভানহীন বেঁচে থাকা। আর বাকি পুরোটা সময়জুড়েই যেন কেবলই অভিনয়। কিন্তু মানুষ কি সারাটা জীবন কেবল অভিনয় করে বেঁচে থাকতে পারে? নাকি এই-ই তার নিয়তি!
চারুর মাঝে মাঝে একটা দুঃসাহসী ইচ্ছেও হয়। তার মনে হয়, সে কী কখনো একা একা সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে যেতে পারবে? তারপর অরবিন্দু দাদুর বাড়ি খুঁজে বের করবে। তারপর সেখান থেকে বাবা আর পারুদিকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়বে সে।
কিন্তু তাহলে মায়ের কী হবে? মা যে তাহলে ভীষণ একা হয়ে যাবে! এখন তো ঠাকুমাও নেই। এই ভাবনাই তাকে কিছু করতে দেয় না। সে ডায়রিখানা বন্ধ করে তার গোপন ট্রাংকের ভেতর লুকিয়ে রাখে। তারপর মায়ের কাছে এস চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ে। আহা, মা। কেমন বিবর্ণ, মলিন আর নিস্তেজ হয়ে গেছেন। অথচ ভুবনডাঙার সেই আলো ঝলমলে, প্রাণবন্ত মানুষটিকে এখন কল্পনার মানুষ বলে মনে হয়। মনে হয়, সেই মানুষটা অন্য কেউ ছিলেন। আর এই মানুষটাও অন্য, অচেনা।
এসবের মধ্যেও অরবিন্দু বাবুকে নিয়ম করে চিঠি লিখতে ভোলে না সে। কিন্তু তার আর কোনো জবাব মেলে না। কী হয়েছে অরবিন্দু বাবুর? তার ছেলে-মেয়েরা না হয় তাদের পছন্দ করত না, কিন্তু তিনি তো অসম্ভব পছন্দ করতেন! তাহলে? কী এমন হলো? এমনকি ছায়ারাণীর মৃত্যু সংবাদেরও কোনো জবাব এলো না। সময় চলে যেতে লাগল। ধূসর, বিবর্ণ, মলিন সময়। নিস্তরঙ্গ। সেই নিস্তরঙ্গ সময়ের ভেতর থেকে হঠাৎ একদিন একখানা চিঠি এলো চারুদের ঠিকানায়। সেই চিঠি পেয়ে যতটা আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর উত্তেজনা নিয়ে চারু খুলল, ঠিক ততটাই মন খারাপ হয়ে গেল চিঠি পড়ে।
অরবিন্দু বাবু মারা গেছেন প্রায় মাস পাঁচেক আগে। এ কারণেই তাদের কোনো চিঠির জবাব আসেনি। চারুরা যে চিঠিগুলো পাঠিয়েছিল, সেসবও গিয়েছিল তার অফিসের ঠিকানায়। ফলে বাড়িতেও সবসময় পৌঁছায়নি। বা পৌঁছালেও তাদের চিঠি দেখে কেউ হয়তো অত আগ্রহ নিয়ে পড়েনি। উত্তরও পাঠায়নি।
খবরটা শুনে চারুর কেমন মন খারাপ হয়ে গেল। মনে হলো বাবা বা পারুদির কোনো খবর না পেলেও ওই অরবিন্দু দাদুর কারণে হলেও যেন বাংলাদেশের সঙ্গে একটা সরব সম্পর্ক, যোগাযোগের সুতো ঝুলে ছিল। আজ যেন সেটুকুও ছিঁড়ে গেল। এই প্রথম তার সত্যি সত্যিই নিজেকে শিকড়হীন, বিচ্ছিন্ন, বিরান প্রান্তরের গৃহহীন নিঃসঙ্গ এক মানুষ মনে হতে লাগল।
২৪
কামাল ভাত খেতে বসেছে। তার সামনে রুই মাছের বিশাল মাথা। পুঁই শাক আর আলু দিয়ে রুই মাছের মাথা তার পছন্দ। কিন্তু বাড়িতে পুঁই শাক নেই। এ কারণে তাকে শুধু মাথা খেতে হচ্ছে। কামাল খেতে খেতে বলল, ‘এত ভোরে এই মাছ কই থেকে আসল দুলাভাই? এত ফ্রেশ মাছ!
‘পুষ্করিণীরতে।’
‘পুষ্করিণীরতে? এত ভোরে?
হুম।
‘এত ভোরে মাছ ধরলেন কী করে?
‘তুই ঘরে ঢুইকাই গোসল করতে বাথরুমে গেলি। আমি এই ফাঁকে এছাহাকরে বললাম মতি মিয়ারে দিয়া পুষ্করিণীরতে জাল ফেলতে। তোর তো আবার রুই মাছের মাথা খুব পছন্দ। মতি মিয়া আইসা জাল ফেলল। তুই গোসল কইরা বাইর হওনের আগেই মাছ ধরা সারা।
কী বলেন!
হুম। তবে পুঁই শাকটা নাই। আর এত সকালে বাজারেও কিছু পাওন যাইব না।’
‘আপনি তো দেখি মারাত্মক কাজের লোক। কিন্তু এত আদর তো এর আগে কখনো করেন নাই দুলাভাই। আজ হঠাৎ এত আদরের কারণ কী? ঘটনা বলেন?
কামালের কথা শেষ হওয়ার আগেই জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া কাঁদতে শুরু করলেন। আজ যেন তার কান্নারই দিন। তবে এই কান্না দুঃখের না, আনন্দের।
ফজরের আজানের আগে আগে কামাল এসেছে। দরজা খুলে তাকে দেখে প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার। মনে হচ্ছিল তিনি স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু কামাল যখন বলল, এই বাড়ির সবাই কি কুম্ভকর্ণের আত্মীয়-স্বজন নাকি? এতবার দরজা ধাক্কালাম, কেউ দরজাই খুলতেছেন না! কী আশ্চর্য!’
তখন যেন সংবিৎ ফিরল তার। তবে তারপরও তিনি কথা বললেন না। দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন না। কামালের এখন থাকার কথা থানাহাজতে। তিনি যতদূর জানেন, কামালকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এই খবর পত্র-পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছে। এছাহাক শুনে এসে তাকে জানিয়েছিল। তাহলে? এই ভোর রাতে কামাল কোথা থেকে এলো? তিনি কি তবে স্বপ্ন দেখছেন? নাকি অধিক দুশ্চিন্তায় তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আজ রাতেও তিনি কামালের কথাই ভাবছিলেন। হতে পারে তার সেই ভাবনাই এখন তাকে বিভ্রান্ত করছে। চোখের সামনে তৈরি করছে গভীর বিভ্রম।
কামাল বলল, কী হলো? আমি ফেরারি আসামি বলে কি আমাকে ঘরেও ঢুকতে দেবেন না? আগে ঘরে ঢুকতে দেন। খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করেন। আজ তিন দিন ধরে ঠিকমতো খাওয়া-খাদ্য নাই। খিদায় পেটের ভেতর ইঁদুর নাচতেছে। এত বড় সন্ত্রাসী শালাকে আশ্রয় না দিতে চাইলে দেবেন না। তবে বিদায় দেওয়ার আগে ভালো-মন্দ কিছু খাওয়াবেন তো? নাকি?”
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন। কামাল ঘরে ঢুকল। তার পায়ে কিছু একটা হয়েছে। সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটছে সে। ভূঁইয়া বললেন, তুই… সত্যই তুই?
হাত দিয়া দেখেন শরীরে। কেন? কোনো সন্দেহ আছে?
‘তোরে নাকি পুলিশে ধরছে?”
‘প্রায় ধরেই ফেলছিল। একটুর জন্য বেঁচে গেছি। এই দেখেন না পায়ের অবস্থা?
‘পায়ে কী হইছে?
সে এক বিশাল কাহিনি দুলাভাই। অত আর ডিটেলস বলতে পারব না। সংক্ষেপে বলি। সেইদিনের ঘটনার পর আমি গা-ঢাকা দিলাম গাজীপুর। কিন্তু পুলিশ কেমনে কেমনে জানি খোঁজ পেয়ে গেল। আমি পালাই গেলাম গাজীপুরের জঙ্গলে। সেইখানেও পুলিশ তাড়া করল। গুলিও ছুঁড়ল। সেই গুলির ফলাফল পায়ের এই অবস্থা। তবে শেষ পর্যন্ত ধরা তো পড়ি নাই। হা হা হা। কামাল তো সহজ জিনিস না দুলাভাই। শালাটা কার, দেখতে হবে না?
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া কামালের হাসিতে যোগ দিতে পারলেন না। তিনি বরং তাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর কাঁদতে লাগলেন হাউমাউ করে।
কামাল বলল, কী আশ্চর্য, আপনি কাঁদতেছেন কেন? আমি তো ধরা পড়ি নাই, পুলিশের গুলিতে মারাও যাই নাই। বেঁচে ফিরা আসছি। এতদিনে তো আমার লাশ কবরে পচতে পারত। বা আমি জেলেও থাকতে পারতাম। সেইসবের কিছুই তো আমার হয় নাই। তা আপনি কাঁদতেছেন কেন?’
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, সেই সন্ধ্যার ঘটনার পর থেকে তোর চিন্তায় আমার পাগল হওয়ার দশা। তুই কই আছিস, কেমন আছিস। তারপর এছাহাক আইসা বলল যে খবরের কাগজে তোর ছবিসহ খবর ছাপা হইছে। তুই নাকি পুলিশের হাতে ধরা পড়ছস?
‘ওহ, এই কথা!’
হুম।’ .
‘এই খবরও চাউর হইছিল। দু-একটা কাগজে ভুল করে এই সংবাদ ছাপাও হইছিল। কিন্তু ধরা যে পড়ি নাই, তাতো দেখতেই পাইতেছেন। শোনেন দুলাভাই, কামাল এত সহজ জিনিস না। এইটা পুলিশও জানে, আপনিও জানেন। জানেন না?’
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া কথা বললেন না। তিনি কামালকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেই থাকলেন। তার এই জীবনের এমন আনন্দের ঘটনা খুবই কমই ঘটেছে।
কামাল বলল, আপনি তো গ্রামে কাউরে ঢাকার ওই ঘটনা বলেন নাই? বলছিলেন?
‘কোন ঘটনা?
‘আমার আর পুলিশের ঘটনা? মানে এছাহাক ছাড়া আর কেউ কিছু জানে?
তুই কি পাগল হইছিস? কান্না থামিয়ে বললেন ভূঁইয়া। পারু-ফরিদের ঘটনাই কাউরে বলি নাই। আর তোর ঘটনা বলব? এতদূর গ্রামে তো পত্র পত্রিকাও আসে না। মানুষ জানব কেমনে? শোন…।
‘কী?’
‘এমনকি ওহাব ডাক্তারও জানে না যে তার ভাইগ্না কই আছে, কী সমাচার। এই সব কিছুই আমি কাউরে বলি নাই। কাক-পক্ষীরেও না।’
‘ভালো করছেন। তা পারু, ফরিদ, মহিতোষ মাস্টারদের আর কোনো খবর আছে?”
আরে নাহ! পুলিশের তাড়া খাইয়া আমি তো সেইদিনই ভুবনডাঙার বাস ধরছি। আর ওই মুখো হই নাই।
‘ভালো করছেন। ওই সময়ে ঢাকায় থাকলে কখন কী বিপদে পড়তেন বলা যায় না। আর আমিও এমন বিপদে ছিলাম যে আপনার খোঁজখবর নিতে পারি নাই।’
সমস্যা নাই ভাই। এই যে এতদিন বাদে হইলেও তুই ফিরা আসছস, এইটা যে আমার কী শান্তি, তোরে বুঝাইতে পারব না। আর মহিতোষ মাস্টার, পারুরে আমার যেই কারণে দরকার ছিল, সেই কারণ তো ফাস।
ফাঁস মানে?
মানে মহিতোষ মাস্টার ওই জমি বিক্রি কইরা গেছে উত্তর পাড়ার আশরাফ খাঁর কাছে। আরো বহু ঘটনা আছে। শুনলে তোর মাথা খারাপ হইয়া যাবে।
হুম।’ বলে গম্ভীর হয়ে গেল কামাল। তারপর বলল, আসছি যখন, সবই শুনব। কিন্তু এখনই যেন কেউ না জানে যে আমি এইখানে। খুব সাবধান।’
‘কেউ জানব না।’
.
ভাত খাওয়ার পর লম্বা ঘুম দিল কামাল। ঘুম থেকে উঠল বিকেলে। তারপর জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার সঙ্গে বসল। ভূঁইয়া একে একে সব ঘটনা তাকে বর্ণনা করতে লাগলেন। ঘটনার শেষে এসে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, এখন আমি কী করব তুই ই বল, এখন কী করব আমি?
তার আগে একটা কথা বলেন, আশরাফ খাঁর সঙ্গে আপনার এত শত্রুতা কী নিয়ে? সে কেন আপনার ওপর এত ক্ষ্যাপা?
এই প্রশ্নে চুপ করে গেলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। বেশ খানিকটা সময় পর বললেন, ‘সে অনেক কাহিনি। সাত-আট বছর আগের পুরনো হিস্টিরি।
বলেন, শুনি। শোনার দরকার আছে।’
‘এই অঞ্চলে সবচাইতে বড় চাল-ডালের আড়ত ছিল কার, জানস?
আপনার না?
নাহ। আশরাফ খাঁর। এইটা ছিল তাদের বংশানুক্রমিক ব্যবসা। তার আপন কোনো ভাই নাই। সৎভাই আছে। তো তার বাপ মৃত্যুর আগে ওই আড়তখান তার নামে লিখে দিয়ে গেছিল।
‘কেন? শুধু তার নামেই কেন?
কারণ সে ছিল সবার বড়। তার বাপ দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিল। ফলে অল্প বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হইছিল তার।
‘আচ্ছা। এই কারণেই তারে দিয়ে গেছিল?
হুম। কিন্তু সম্ভইরা এইটা মানতে পারে নাই। এদিকে জমিজমা যা ভাইদের মধ্যে ভাগ হইল, সেগুলারও বড় একটা অংশ নদীভাঙনে চইলা গেল। বাকি যা ছিল, তা নিয়া শুরু হইল ভাইদের মধ্যে ঝামেলা। এর মধ্যে শুরু হইল যুদ্ধ। যুদ্ধের সময় সে সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাপোর্ট করত।
‘আচ্ছা।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিভিন্ন জায়গায় গোপনে মণকে মণ চাল-ডাল পাঠাইত। তারে তো কেউ সন্দেহ করত না, যেহেতু তার আড়ত আছে। এইটাই তার ব্যবসা। তো এই সুযোগটা নিল তার ভাইরা। একদিন তারা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসল। আইসা বলল, এই ঘটনা।’
‘আপনের কাছেই কেন আসল?
বুঝস না কেন? তুই আমার ওই সময়ের আসল ঘটনা জানস না?’
‘তাতো জানিই। কিন্তু এমন তো না যে আপনি একাই পাকিস্তান আর্মির পক্ষে কাজ করতেন। ওই এলাকায়তো কেউ না কেউ ছিল রাজাকার, আলবদর, আলশামস ছিল না?
‘ছিল।’
তাইলে? তাদের কাছে না গিয়া এতদূর আপনের কাছেই কেন আসল?
‘এইখানে একটা ঘটনা আছে।’
কী ঘটনা?
‘প্রথমত, তারা চায় নাই, তাদের কেউ সন্দেহ করুক। একই গ্রাম তো, বুঝছিস না?
হুম।
আরেকটা ঘটনা ছিল। আশরাফ খাঁর ওপর আমার একটা পুরানা ক্ষোভ ছিল। এইটারে তারা কাজে লাগাইতে চাইছিল।
কী ক্ষোভ?
আমার খুব শখ আছিল, খ-গো সঙ্গে সম্বন্ধ করার। বিয়া-শাদির সম্বন্ধ।
মানে কী? আপনি কি আপারে রেখে আবার বিয়া করতে চাইতেছিলেন না কি দুলাভাই?
‘আরে নাহ।’ বলে হাসলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। আসলে লিয়াকতের সঙ্গে আশরাফ খাঁর ছোটো মেয়ের বিয়ার সম্বন্ধ নিয়া গেছিলাম। আমরা ভূঁইয়ারাও তো এই অঞ্চলে একদম ফালাই দেওয়ার মতো বংশ না। হ্যাঁ, খ-গো তখন প্রতিপত্তি বেশি, আশপাশের কয়েক অঞ্চলে নাম-ডাক আছে। আর এই অঞ্চলের সবচেয়ে সুবিধামতো জায়গায় সবচেয়ে বড় আড়তটা থাকার কারণে তার ব্যবসা-বাণিজ্যও ফুলে-ফেঁপে উঠছিল।’
আচ্ছা, আচ্ছা। বলে হাসল কামাল। বলল, এইবার বুঝছি। মূলত ওই আড়তের লোভেই আপনার খুব ইচ্ছা হইল তার সঙ্গে সম্বন্ধ করার?
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া জবাব দিলেন না। তবে সমর্থনসূচক মৃদু হাসলেন।
কামাল বলল, “তো? বংশে যেহেতু আপনারাও ছোট না। তাহলে সে রাজি হয় নাই কেন?’
‘হইছিল।
তাহলে সম্বন্ধ হয় নাই কেন?
‘আমার জন্য।
‘আপনার জন্য? অবাক হলো কামাল।
‘হুম। আমি চাইছিলাম যে বিয়ার সময়ই সে আড়তখান লিয়াকতের নামে লিখা দেবে। তার আড়তের যা পজিশন, ওইখানে বড় নদীর মোহনা, বিভিন্ন জায়গা থেইকা বড় মালবাহী জাহাজ, কার্গো, এই সব আসে। এইজন্য তার আড়তের সঙ্গে ব্যবসা কইরা কেউ পারে না। তো তুই তো আমারে জানসই। আমার খুব শখ আছিল যে ওই আড়তখান আমার হইব। লিয়াকতরে তো সে জামাই হিসেবে লিখাই দিতে পারত। পারত না?
‘বিয়ের একদম আগেই লিখে দেবে? বলে হাসল কামাল। বিরাট যৌতুক, হ্যাঁ?’
‘ধর তাই। তা আমার লিয়াকত কি ছেলে হিসেবে খারাপ?
না, খারাপ না। এখনো তো সে শ্বশুরের ব্যবসাই করতেছে। তারপর?
কথাবার্তা মোটামুটি পাকা। তো দশ জোড়া ইলিশ, শচীন ঘোষের এক মণ দই-মিষ্টি, পান-সুপারি নিয়া এলাকার গণ্যমান্য তিন চারজন লোকসহ আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে গেলাম বিয়ার তারিখ ঠিক করতে। সেইখানে আমি কথাটা তারে সরাসরিই বললাম।’
তারপর?
তারপরের ঘটনা ভয়াবহ। কথা শেষ করার আগেই সে রেগে আগুন হয়ে গেল। যেন মাথায় রক্ত উঠে গেছে। কাছারি ঘরভর্তি মানুষ। সবার সামনে সে আমাদের একপ্রকার ঘর থেইকাই বের কইরা দিল। মানে ধর… তোর কাছে তো আর বলতে লজ্জা নাই… কেবল ঘাড় ধাক্কাটা দিতেই বাকি রাখছিলেন। এইটা যুদ্ধের বছরখানেক আগের ঘটনা।
‘কী বলেন! এত বড় ঘটনা আমি জানি না?
না। কারণ, আমি ওই ঘটনা মনে করতে চাই নাই আর। কাউরে বলিও। নাই। নিজের ভেতর চাইপা রাখছিলাম। আর পুড়তে ছিলাম তুষের আগুনের মতন।
‘আপনি কিছুই করলেন না? চুপচাপ চলে আসলেন?’
কী করব? তখন তো আর আমার অত ক্ষমতা নাই যে কিছু করব। কিন্তু তক্কে তক্কে ছিলাম। সুযোগ পাইলে আমি ছাড়ব না।’
‘সেই সুযোগ আসল যুদ্ধের সময়?
হুম। আর তার সম্ভইরা যেহেতু ঘটনা জানত, তারা সুযোগটা নিল। আমারে আইসা উসকাইয়া দিল।
আপনি কী করলেন?
‘আমি বকপক্ষীর মতো ধ্যান কইরা বইসা থাকলাম। একটা সুযোগের অপেক্ষায়। এর মধ্যেই একদিন খবর আসল, তার আড়তে নাকি মুক্তিযোদ্ধাগো একটা দল মাঝেমধ্যে রাইত-বিরাতে আসে। থাকেও। চাল-ডাল রাখার জন্য আন্ডারগ্রাউন্ডে গোডাউনও ছিল। সেই গোডাউনে। খুবই নিরাপদ জায়গা। বস্তার পর বস্তা চাল-ডাল মসলাপাতি। কে সন্দেহ করবে?
হুম। তারপর?
‘আমি আর্মি খবর দিলাম। কিন্তু কপাল খারাপ, ভেতরে কাউরেই পাইলাম না। তারেও না। তবে একটা বড় ট্রলার ভেড়ানো ছিল আড়তের পেছন দিকের নদীর ঘাটে। সেই ট্রলারভর্তি বস্তা বস্তা চাল-ডাল। অত রাইতে ওই চাল-ডাল কই যায়? সেও তো তখন ছিল না। ধরা হইল ট্রলারের মাঝিরে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হইল। কিন্তু মাঝি কিছুতেই কিছু স্বীকার করে না। এইটা সেইটা নানা কথা বলে। অমুক বাজারের খুচরা দোকানের অর্ডার ছিল। তমুক বাজারের পাইকারি চালানের মাল। এই সব। মিলিটারিরা তার কথা প্রায় বিশ্বাসই কইরা ফেলছিল। কিন্তু আমার সন্দেহ তো আর যায় না। আমি আবার ট্রলারে গেলাম। প্রত্যেকটা বস্তা আলাদা আলাদা খুইলা দেখতে শুরু করলাম। তারপর হঠাৎ দেখি নিচের বস্তার চাল-ডালের ভেতরে অস্ত্র।
‘অস্ত্র! অবাক গলায় বলল কামাল।
হুম। আশরাফ খাঁ আসলে বিভিন্ন জায়গায় তার এই চাল-ডালের চালান পাঠানোর আড়ালে মুক্তিযোদ্ধাগো অস্ত্র সাপ্লাই দিত। মানে একদল তার কাছে আইনা পৌঁছাই দিত। আর সে সেইগুলা বিভিন্ন অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাগো কাছে। পৌঁছাই দিত। সঙ্গে নানা খবরা-খবর তো ছিলই।
মিলিটারিরা তখন কী করল?
‘আড়ত সিলগালা কইরা দিল। আর চাল-ডালসহ ওই ট্রলার নদীতে ডুবাই দিল।
কী বলেন?
হুম।
‘মিলিটারিরা তারে কিছু করে নাই? তার তো বেঁচে থাকারই কথা না।
তারে তো আর ওইদিন পায় নাই। ওদিকে ওই সময়ে এই অঞ্চলের মিলিটারিদের অবস্থাও বেশি ভালো না। মুক্তিযোদ্ধারা মুহূর্মুহূ গেরিলা আক্রমণ করতেছে। সেদিনও হঠাৎ এমন জরুরি খবর আসল, কোনো ক্যাম্পে বড়সড় অ্যাটাক হইছে। সবাইর মধ্যেই তাড়াহুড়া লেগে গেল। ফলে আমার হাতে দায়িত্ব দিয়া তারা চলে গেল।
আপনি কী করলেন?
তক্কে তক্কে অপেক্ষায় রইলাম তার বাড়ি ফেরনের। আর এর মধ্যে আস্তে ধীরে রাইতের অন্ধকারে তার আড়তের মাল সরাইতে লাগলাম।
আপনের এইখানকার আড়তে?
হুম। এরমধ্যে এক রাইতে সে বাড়ি ফিরল। গোপন খবরের ভিত্তিতে গিয়া ধরলাম। আমার তো তখন মাথায় খুন উইঠা গেছে। হয়তো শেষ কইরাই ফেলতাম। কিন্তু তার সম্ভইরা আবার খুন-খারাবি চায় নাই। হাজার হোক, বড় ভাই… ছোটবেলা থেইকা তাদের পাইলা পুইষা মানুষ করছে। বুঝসই তো।’
কিন্তু কিছুই করলেন না?
‘কিছু না করলে কি ওই ঘটনার এতদিন পরও সে তোর মতো এক পা খোঁড়াই খোঁড়াই হাঁটে?
“ওহ! অস্ফুটে বলল কামাল। এত দেখি বিরাট ঘটনা। তো সে যে এখনো আপনার ওপর আরো বড় কোনো শোধ উঠায় নাই, এইটা কিন্তু আপনের ভাগ্য দুলাভাই।’
ভাগ্য না, বুদ্ধি। বুদ্ধি থাকলে ভাগ্য বানান যায়।’ বলে হাসলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তারপর বললেন, “তোর কি মনে হয়, ক্ষমতা থাকলে কি সে আমারে ছাইড়া দিত? দিত না। কিন্তু সে তখন ছিল অসুস্থ। আর আমি তো এই ফাঁকে যুদ্ধের পরপরই ভোল পাল্টাইলাম। ক্ষমতার মধ্যে ঢুইকা গেলাম। সে দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার কারণে আর ঘর থেকেই বের হইতে পারল না। তারপর যখন সুস্থ হইল, ততদিনে আমি পরিস্থিতি আমার দিকে আইনা ফেলছি।’
হুম। কিন্তু দুলাভাই, সেও কিন্তু সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিল। সুযোগ পাওয়া মাত্রই লুফে নিছে। আর এখন দাবার গুটি কিন্তু তার হাতে।
এই কথায় জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বিচলিত হলেন না। বরং শান্ত, স্থির গলায় বললেন, ‘এতদিন ছিল। এখন আর নাই।’
নাই কেন?
কারণ এখন তুই আছস।’
‘আমি আসলে কী?
‘তুই আসলে?’ পাল্টা প্রশ্ন করলেন ভূঁইয়া।
হুম।
‘গুটিতো গুটি, পুরা কোর্টই এখন আমার দখলে। বলে ঠোঁট বাঁকা করে হাসলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তারপর বললেন, এখন আর আমি কিছুই ভয় পাই না। পাই?
কামাল দুলাভাইয়ের দিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে হাসল। মৃদু হাসি। তার সেই হাসি শীতল, ভয়ংকর।