অধ্যায় ২০
তদন্ত রিপোর্ট, কোর্টের নথি, সাক্ষীদের ভাষ্য ইত্যাদি নিয়ে বহুদিন কাজ করার অভিজ্ঞিতার ফলে এখন খুব দ্রুতই তা বুঝতে পারে ক্যামিল।
কেসটা শুরু হয় অজ্ঞাতনামা এক লোকের ফোনের মাধ্যমে। লোকটার কথায় কোন আবেগ কিংবা উৎকণ্ঠা ছিলো না। সহজ সরলভাবেই খুনের ব্যাপারে পুলিশকে জানিয়েছে।
এদিকে খুন হওয়া এক নারীর ব্যাপারে খোঁজ পাওয়া গেছে। ম্যানুয়েলা কন্সটানজা, পেশায় বেশ্যা, বয়স চব্বিশ, বিভিন্ন হোটেলে যেয়ে পুরুষের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত থাকতো। আর কাস্টমার এনে দেয়ার কাজ করতো চর্বিওয়ালা পাছার অধিকারী হেনরি ল্যামবার্ট, অনেকটা দালালই বলা চলে। একান্ন বছর বয়সি লোক, যার নামে চারটা খুনের মামলা রয়েছে। এছাড়াও জেলে গিয়েছে সতেরো বারের মত। ক্যামিলের নির্দেশে তাকেও ধরে আনা হয়েছে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সত্যি বলে সে, ২০০১ সালের ২১শে নভেম্বর তুলুজে ঘটা ডাকাতির ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। এরইসাথে দুটো জিনিস উপহার পায়-আটমাসের কারাদণ্ড আর হত্যাকাণ্ডের দিন নিজের পক্ষে শক্ত অ্যালিবাই! দ্রুত ফাইলটা পড়ে গেলো ক্যামিল।
বেশ কিছু তথ্যের পর হুট করেই কয়েকটা সাদা কালো ছবি চোখে পড়ে-কোমরের নিচ থেকে দুইভাগ হওয়া নারীর লাশ।
প্রথম ছবি : শরীরের নিচের ক্ষতবিক্ষত অংশ, পা দুটো ছড়ানো। বাম উরু থেকে মাংসের বড় একটা ছিঁড়ে নেয়া হয়েছে, রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে, কোমর থেকে যৌনাঙ্গ পর্যন্ত যার বিস্তৃতি। পা দুটোর অবস্থান দেখেই বোঝা যাচ্ছে হাঁটু থেকে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। পায়ের একটা আঙুলে কালো কালি দিয়ে করা আঙুলের ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এটাই খুনির স্বাক্ষর, ঠিক যেমনটা পাওয়া গিয়েছে ক্যুবেভুয়ার অ্যাপার্টমেন্টে।
দ্বিতীয় ছবি শরীরের উপরের অংশ। স্তন জুড়ে সিগারেটের পোড়া ক্ষত। ডানদিকের স্তন কোনমতে লেগে আছে চামড়ার সাথে। আর বামদিকেরটার অনেকাংশ কামড়ে ছিঁড়ে নেয়া হয়েছে। স্তনের ক্ষত একদম হাড় অবধি চলে গিয়েছে। রশি দিয়ে শক্ত করে বাধা হয়েছিলো তা গায়ে পড়া কালশিটে দেখলেই বোঝাস্বরuu.com
তৃতীয় ছবি : মাথার খুব কাছ থেকে তোলা একটা ছবি। মুখটা দেখে মনে হচ্ছে কোনো একটা গর্ত, নাক একদম থেতলে গেছে, এক কান থেকে আরেক কান অবধি রেজর দিয়ে কাটা। দাঁতগুলোও ভাঙ্গা। মুখে রয়ে গেছে বীভৎস আর বিকট এক হাসি। ক্যামিল এর বেশি সহ্য করতে পারলো না।
নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। হুট করেই বমি বমি ভাব হলো। রুমে একটু হাঁটাহাটি করে আবারো ছবিতে মনোযোগ দিলো। নৃশংসভাবে খুন হওয়া এই নারীর জন্য মায়া হলো তার। মুখের এক কোণা থেকে শুরু করে কানের লতি অবধি কাটা হয়েছে রেজর দিয়ে।
ছবিগুলো রেখে জানালা খুললো সে, বাইরে তাকিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোজনের ব্যস্ততা দেখছে। ট্রেম্বলের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে আজ থেকে প্রায় আঠারো মাস আগে, কিন্তু নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই যে এটাই প্রথম কিংবা এটাই শেষ। আর কতজনের লাশ দেখতে হবে কে জানে? স্বস্তি আর অস্বস্তির মাঝে দোল খেতে লাগলো সে।
শত হতাশার মাঝেও আশার আলো দেখাচ্ছে খুনির হত্যাকাণ্ডের ধরণ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে শহরে নতুন কোন মানসিক বিকারগ্রস্থ খুনির আবির্ভাব ঘটেছে, যা তদন্তে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। যদিও পুরো হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত ছিলো, তবে অনেক জিনিস পরিবেশের সাথে খাপ খায় না : দামি জিনিসপত্র স্পর্শও করা হয়নি, উদ্ভট উপায়ে হত্যা করা, কেমন জানি একটা আমেরিকান ক্রাইম থ্রিলার ভাব, টেলিফোন থাকলেও তাতে কোন সংযোগ ছিল না…
ঘণ্টাখানেক পর তার চিন্তা আরো বেড়ে গেলো। ট্রেম্বলে কেসের ভিক্টিম কিংবা খুনি দুজনেই অজ্ঞাতনামা। উদ্ভট আর বেখাপ্পা তথ্যের কোন অভাব নেই ট্রেম্বলে কেসেও। এরইসাথে বোঝা গেলো বর্তমানের কেসের এক ভিক্টিমের উত্তরাধিকারী ম্যানুয়েলা কন্সটানজা পুরোপুরি নির্দোষ। ফরেনসিক বিভাগ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে লাশ খুঁজে পাওয়ার দুই ঘণ্টা আগে তা আপেলের সুগন্ধিযুক্ত শ্যাম্পু দিয়ে ধোয়া হয়েছিলো। কিন্তু হত্যা করা হয়েছে। প্রায় আট ঘণ্টা আগে। তার মানে হত্যা করার পর খুনি শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে দেয়। ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক। এছাড়াও ভিক্টিমের শরীরের কিছু অংশ পাওয়া যায়নি। পাকস্থলী, অন্ত্র, কলিজার কোন খোঁজ নেই। আর দশটা মানসিক বিকারগ্রস্থ খুনিদের সাথে এই খুনির তেমন একটা মিল নেই, বিশেষ করে ট্রফি সংগ্রহ করার দিকটা বেশ ভাবিয়ে তুললো ক্যামিলকে। তবে ক্যুবেভুয়ার হত্যাকাণ্ডের সাথে এর কতটুকু মিল আছে তা জানতে কালকের অটোপসি রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
তবে দুই কেসেই নকল আঙুলের ছাপ একই খুনির দিকে ইঙ্গিত করে।
শুধু একটাই পার্থক্য ট্রেলে হত্যাকাণ্ডের ভিক্টিম ধর্ষিত হয়েছিলো কিনা তা জানা যায়নি। তবে খুন হওয়ার এক সপ্তাহ আগে ভিক্টিম কারো সাথে শারীরিক ভাবে মিলিত হয়েছিলো, অটোপসি রিপোর্ট থেকে এতোটুকু নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ট্রেম্বলের ভিক্টিমকে চাবুক দিয়ে পেটানো হয়েছে, যা দুটো খুনকে একদিক থেকে মিলিয়ে দেয়।
দুটো খুনের যোগসূত্র : ট্রেম্বলের ভিক্টিমকে ‘পাশবিক উপায়ে খুন করা হয়েছে (দুটো পা বেসবল ব্যাটের মত ভোলা কিছু দিয়ে ভাঙ্গা হয়েছে, হত্যার আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে থেকেই তার উপর অত্যাচার শুরু হয়, আর কসাইয়ের ছুরি দিয়ে শরীর দুইভাগ করা হয়েছে। কিন্তু সবকিছুর পরেও অনেক যত্ন নিয়ে সারা শরীর থেকে রক্ত পরিস্কার করেছে খুনি। অথচ ক্যুবেতুয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায় দেয়ালে আর সিলিঙয়ে রক্ত লেগে আছে।
ফাইল বন্ধ করে শোবার ঘরে ঢুকলো ক্যামিল।
রাত আড়াইটার বেশি বাজে, এখনও জেগে আছে আইরিন। সতর্কভাবে তার পেটে হাত রাখলো। তার পেট যেন বিস্ময়কর কোন জিনিস। এই নারীর সুগন্ধ নাকে লাগছে, যার সুগন্ধে তার জীবন ফুলের বাগানে রূপ নিয়েছে।
আজকের মত প্রায় রাতেই ক্যামিল তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে। স্ত্রীকে অসাধারণ রূপবতী মনে হয় তার। কিন্তু আসলেই কী তাই? এই প্রশ্ন নিজেকেও বেশ কয়েকবার করেছে। প্রথমবার করেছে যখন তারা একসাথে ডিনারে গিয়েছিলো তিন বছর আগে। আইরিনের পরনে ছিলো মিডনাইট-ব্লু রঙের জামা যার গলা থেকে পা অবধি বোম লাগানো। এটা সেই ধরনের জামা যার বোম খোলার স্বপ্ন প্রতিটি পুরুষই দেখে, ঠিক এই কারণেই তারা এমন জামা পড়ে।
দ্বিতীয়বার এই প্রশ্ন মাথায় এসেছিল সাত মাস আগে, সেবারও একই জামা পড়েছিলো আইরিন, শুধু গয়নাগুলো ছিলো ভিন্ন। এছাড়াও ক্যামিলের কিনে দেয়া ব্রোচ আর মেকআপও ছিলো।
“তুমি কি বাইরে যাচ্ছো?” বাসায় ফিরে প্রশ্ন করেছিলো ক্যামিল।
“না। যাচ্ছি না,” বলল আইরিন।
“তুমি আসলেই অনেক সুন্দর, ম্যাডাম ভেরহোভেন,” আইরিনের বুকে হাত রেখে বলল ক্যামিল।
“আগে একটু গলা ভিজিয়ে নাও,” আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে বলল আইরিন।
“অবশ্যই। তা আজকের উপলক্ষ্য কী?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।
“তোমার জন্য একটা খবর আছে।”
“কিসের খবর?”
“সাধারণ খবরই।”
“মনে হচ্ছে কোন সুসংবাদ দিবে।”
“আশা করি তাই হবে।”
“তুমিও নিশ্চিত না?”
“আমি পুরোপুরি নিশ্চিত না। তবে আমি চাচ্ছিলাম তোমার কাজ কম থাকবে এমন দিনে খবরটা দিতে।”
“না, না। আমি একটু ক্লান্ত। একটা লম্বা ঘুম দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে,” অনুতাপের সুরে বলল ক্যামিল।
“ভাল খবরটা হচ্ছে আমি ক্লান্ত না হলেও তোমার সাথে ঘুমাতে যাবার জন্য প্রস্তুত।”
সবকিছু বুঝে পরিবেশ ঠিক করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে আইরিনের। সে জানে কীভাবে ক্যামিলের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হয়, কীভাবে তার মন শান্ত করতে হয়। বিছানায় যাওয়ার পরপরই ক্যামিলের চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো। একসময় আইরিনের কথাও স্পষ্ট শুনতে পেলো না।
“আচ্ছা, চলো খেয়ে নেই,” বলল আইরিন।
ওঠার আগে কিছু একটা মনে পড়লো তার।
“ভুলে যাওয়ার আগে দুটো কথা ছিলো। আসলে তিনটা।”
“বলে ফেলল,” সামনে থাকা মগ হাতের কাছে টেনে নিলো ক্যামিল।
“১৩ তারিখে ফ্রাঁসোয়া ডিনারের দাওয়াত দিয়েছে। যেতে পারবে?”
“পারবো। সমস্যা নেই, কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলো ক্যামিল।
“ভাল। দ্বিতীয় কথা আমার অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য তোমার কিছু কাগজপত্র লাগবে।”
“আজ রাতেই তো খুলবে না, তাই না? এমনিতেই আজকে ঝামেলার মাঝ দিয়ে যেতে হয়েছে,” মানিব্যাগ থেকে কাগজ বের করতে করতে বলল ক্যামিল।
“অবশ্যই আজকে না। চলো, ডিনার সেরে নেই।”
“তোমার একটা কথা এখনো বাকি আছে তো।”
ঘুরে দাঁড়ালো আইরিন, এমন ভাব করলো যেন কিছুই মনে পড়ছে না।
“ওহ, হ্যাঁ-আরেকটা কথা, বাবা হতে তোমার কেমন লাগবে?”
রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আইরিন। তার দিকে বোকার মত তাকিয়ে আছে ক্যামিল। আইরিনের চোখে স্বর্গীয় হাসি দেখতে পেলো। এতো আলোচনার মূলে ছিলো একটা বাচ্চা। কেউই তা মেনে নিতে চাইছিলো না। ক্যামিল সময়ের পক্ষে বাজি ধরলেও একগুঁয়েমিকে বেছে নিয়েছিলো তার স্ত্রী। প্রথমবারের মত ক্যামিলের চোখে পানি চলে এলো, আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়লে গাল বেয়ে।
অধ্যায় ২১
মঙ্গলবার, ৮ই এপ্রিল
মেট্রোতে বসে পত্রিকা পড়ছে সে, তার আশঙ্কাই আজকে বাস্তবে রূপ নিলো। মিডিয়ার লোকজন ইতিমধ্যেই ট্রেম্বলের হত্যাকাণ্ডের সাথে নতুন কে জুড়ে দিয়েছে। খবরটা এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে যে তা থামানো অসম্ভব। স্থানীয় পুলিশ স্টেশনের কোন অফিসারই যে এই খবর সাংবাদিক মহলকে দিয়েছে তা আর বুঝতে বাকি রইলো না। তবুও ক্যামিল মনে মনে এর উৎস সম্পর্কে চিন্তা করার চেষ্টা করলো, কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারলো এরচেয়ে খড়ের গাদায় সুই খোঁজা আরো সহজ কাজ। তারা আরো লিখেছে, ‘পুলিশ ট্রেম্বলের হত্যাকাণ্ডের সাথে কবেভুয়ার ঘটনার অনেক মিল খুঁজে পেয়েছে’। তাদের হেডলাইনগুলোও রোমাঞ্চকর আর আকর্ষণ জাগানিয়া-’ছিন্ন আঙুলের মালা’, ‘ট্রেম্বলের কসাইয়ের নতুন আঘাত ক্যুবেভুয়ায়’, ‘ক্যুবেভুয়ার হত্যাকাণ্ডে ট্রেম্বলের ভূতের আগমন।
মর্গে পা রাখলো সে।
এভলিন রুভ্রের মাকে দেখতে অনেকটা গেঁয়ো ভূতের মত লাগছে। জামাটাও তার সাইজের চেয়ে বড়। দেখতে অনেক বয়স্ক মনে হচ্ছে, গা থেকে অ্যালকোহলের গন্ধ আসছে।
“খুব বেশি সময় লাগবে না,” বলল ক্যামিল।
লাশের কাছে চলে গেলো তারা। টেবিলের উপর সাদা চাদর দিয়ে লাশ ঢেকে রাখা হয়েছে, তবে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটা মানবদেহ। এভলিনের মাকে হাত ধরে সামনে নিয়ে গেলো ক্যামিল, দায়িত্বে থাকা লোকটাকে ইশারা করলো চাদর সরিয়ে শুধু মুখটা দেখাতে। কেননা এর নিচে দেখার মত কিছুই অবশিষ্ট নেই।
শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে এভলিনের মা, ভাবলেশহীন মুখভঙ্গি। “হ্যাঁ…এটাই…এটাই আমার মেয়ে,” বলেই অজ্ঞান হয়ে পড়লো সে।
অধ্যায় ২২
করিডরে একজন অপেক্ষা করছে।
অন্য সবার মতই লোকটার মতিগতি বোঝার চেষ্টা করলো ক্যামিল। খুব বেশি লম্বা মনে হলো না তার কাছে সম্ভবত পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি। তবে সবার আগে নজর কাড়লো তার চোখ। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, নিজের খেয়াল রাখে, যারা সকালে উঠে জগিং করতে যায় তাদের স্বাস্থ্যই এত ভাল থাকে। পরণে বেশ সুন্দর পরিপাটি পোশাক। দুই হাতেই চামড়ার ব্যাগ; খুব ধীরস্থির হয়ে বসে আছে।
“ড, এডোয়ার্ড ক্রেস্ট,” পরিচয় দিয়ে ক্যামিলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো সে। “জাজ দেশম আমাকে নিয়োগ দিয়েছে।”
“তাড়াতাড়ি আসার জন্য অনেক ধন্যবাদ। খুনির সাইকোলজিকাল প্রোফাইল তৈরি করার জন্য আপনাকে দরকার। খুনির আসল উদ্দেশ্যটা কী…প্রাথমিক রিপোর্ট ফটোকপি করে রাখা হয়েছে আপনার জন্য, এই বলে তার দিকে ফাইল বাড়িয়ে দিলো ক্যামিল, একইসাথে তাকে খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করতে লাগলো। ফাইলে মনোযোগ দেখে বুঝতে পারলো তার যেমন লোক দরকার ছিলো ঠিক তেমনই পেয়েছে।
“কতদিনের মাঝে করতে হবে?” জিজ্ঞেস করলো সে।
“অটোপসি রিপোর্ট পাওয়ার পর আপনাকে জানাবো। কতটুকু প্রমাণ জোগাড় করতে পারি তার উপর নির্ভর করে।”
অধ্যায় ২৩
তাৎক্ষণিকভাবেই ক্যামিল বুঝতে পারলে সামনে ভয়াবহ কিছু অপেক্ষা করছে। এভলিন রুভ্রের বীভৎস মৃতদেহ দেখা এক জিনিস, কিন্তু অটোপসি করা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস, অনেকটা জটিল জিগস পাজল সমাধান করার মত।
মর্গের ফ্রিজ থেকে লাশ বের করাটা খুব কষ্টের কাজ, কিন্তু তা উপলব্ধি করার জন্য জীবিত কাউকে প্রয়োজন। রুভ্রের লাশটা প্রায় গলে গিয়েছে। কয়েকটা প্যাকেটে আলাদা আলাদা করে শরীরের বিভিন্ন অংশ রাখা হয়েছে অনেকটা মাছের বাজারে টুনা মাছের টুকরা যেভাবে রাখা হয়।
ড. ক্রেস্ট আর ড, ওয়েন এমনভাবে হাত মেলালো যেন তারা কোন সম্মেলনে এসেছে। খ্যাপাটে স্বভাবের প্রতিনিধি স্বাগতম জানাচ্ছে বেয়াড়াপনার প্রতিনিধিকে। এরপর চশমা পড়ে নিলো ড, ওয়েন, টেপ রেকর্ডার কাজ করে কিনা দেখলো, তারপর পাকস্থলী দিয়ে পরীক্ষা শুরু করলো।
“লাশটা ককেশিয়ান নারীর, বয়স আনুমানিক…”
অধ্যায় ২৪
ফিলিপে বুসন দে শেভেন এই পেশায় অন্যতম সেরা না হলেও, কাজের পিছনে লেগে থাকায় তার জুরি মেলা ভার। “তদন্তের এমন অবস্থায় কম্যান্ড্যান্ট ভেরহোভেন সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়,” এমন কথাতেও তাকে খুব একটা আশাহত মনে হলো না।
“আমি কোন আনুষ্ঠানিক বিবৃতি চাচ্ছি না। শুধু কয়েক মিনিট কথা বলেই চলে যাবে।”
রাত থেকে কল দেয়া শুরু করেছে। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে সকাল থেকে আবারো কল দেয়া শুরু করলো। সকাল ১১টার দিকে ক্যামিলকে এই ফোনের ব্যাপারে জানানো হলো।
নিজের নাম নিয়ে বেশ গর্বিত বুসন, যদিও সে কোন তারকা সাংবাদিক নয়। কিংবদন্তি সাংবাদিক হওয়ার কোন লক্ষণ তার মাঝে নেই, তবে নিজের পেশায় বেশ সফল। সহজাত প্রবৃত্তির বশেই নিজের উপযোগী সংবাদ খুঁজে নিতে পারাটাই তার সাফল্যের মূল কারণ। নিজের শক্তি আর দুর্বলতা দুটোই খুব ভাল বুঝতে পারে। বেছে বেছে রোমাঞ্চকর অপরাধ নিয়ে কাজ করে যা তার বিচক্ষণতার প্রমাণ। বেশ কয়েকটা স্পর্শকাতর কেসে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সূত্র বের করতে পারায় তার সফলতার ঝুলি দিন দিন পূর্ণ হয়েছে, যা একইসাথে তাকে এনে দিয়েছে খ্যাতি। ট্রেম্বলে হত্যাকাণ্ডের পর সবার আগে মূল উদ্দেশ্য আঁচ করে তা নিয়ে রিপোর্ট করেছে। এই কেসে শুরু থেকে শেষ অবধি লেগে ছিলো, তাই ক্যুবেভুয়ার হত্যাকাণ্ডের পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়।
মেট্রো থেকে নামার পরপরই তাকে দেখতে পেলো ক্যামিল। বেশ লম্বা, চেহারায় ধূর্ত একটা ভাব, তবে বুদ্ধিমত্তার ছাপ স্পষ্ট।
হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো ক্যামিল।
“আমাকে কয়েকটা মিনিট সময় দিলেই চলবে…” বলল বুসন।
“যদি আমার হাতে দুই মিনিট সময় থাকতো, আমি দিতাম…”
“সময় দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে, ইন্সপেক্টর। নয়তো আমরা যে কোন কিছু লিখে দিতে পারি…”
এই কথা শুনে থেমে গেলো ক্যামিল।
“আপনি সময়ের থেকে পিছিয়ে আছেন, বুসন। আমি আর এখন ‘ইন্সপেক্টর নেই। আর যে কোন কিছু লেখার কথা যে বললেন সেটা কি এমনি নাকি হুমকি?”
“কোনটাই না-সত্যি বলছি, দুইটার একটাও না,” বলে হেসে দিলো বুসন।
থামাটাই ভুল হয়েছে, মাত্রই তা বুঝতে পারলো ক্যামিল। একে অপরের দিকে তাকালো তারা।
“আপনি জানেন সাংবাদিকরা কেমন হয়। কিছু না পেলে তারা মনগড়া জিনিস লিখতে পছন্দ করে।”
বুসনের চোখের দিকে তাকিয়ে ক্যামিলের সন্দেহ হলো এই লোক যে কোন কাজই করতে পারে। একজন ভাল শিকারি আর কিংবদন্তি শিকারির মধ্যে মূল পার্থক্যই হচ্ছে তার প্রবৃত্তি। এই পেশার জন্য প্রয়োজনীয় সব গুণই আছে বুসনের।
“ট্রেম্বলে কেসের কথা যেহেতু আবার উঠেছে…”
“খবর দেখা যাচ্ছে বাতাসের আগে ছুটছে…” এই বলে তাকে থামিয়ে দিলো ক্যামিল।
“দেখুন ট্রেম্বলে কেস আমি কভার করেছি, তাই এই কেস নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক।”
“আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছি, তার বাইরে একটা কথাও বের করতে পারবেন না আমার মুখ থেকে। আর কিছু জানতে চান? অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করুন…”
“আপনি উচ্চপদস্থ কারো কথা বলছেন, তাই না?” এই কথা বলে চোখ নামিয়ে নিলো বুসন।
একে অপরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, সম্পর্কের মাঝে এই ফাঁটল নিয়ে দুজনেই কিছুটা বিস্মিত।
“আমি দুঃখিত,” মিনমিন করে বলল বুসন।
এদিকে ক্যামিল কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মাঝে মাঝে ছোটখাট অপমানও কিছুটা স্বস্তির বাতাস ছড়িয়ে দেয়।
“দেখুন, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত…ভুলে বলে ফেলেছি…”
“সমস্যা নেই, তাকে থামিয়ে দিলো ক্যামিল।
এই বলে হাঁটা শুরু করলো সে। তার পিছনে দৌড়াতে লাগলো ধূর্ত সাংবাদিক।
“কিছু একটা তো বলুন আমাকে। এখন অবধি কী কী জানা গেলো?”
“এই ব্যাপারে কিছুই বলা যাবে না। আমরা তদন্তের কাজ নিয়ে এগুচ্ছি। আর কিছু জানার থাকলে লা গুয়েনের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।”
“মঁসিয়ে ভেরহোভেন, মিডিয়ার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে এই কেস। সব সম্পাদক একটা মুখরোচক সংবাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি আপনাকে বাজি ধরে বলতে পারি এই সপ্তাহের মাঝেই যে কোন ট্যাবলয়েড কিছু না কিছু ছেপে দেবে। আপনি যদি কিছুই না বলেন, তাহলে কিন্তু জনগণের মাঝে মিথ্যা একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে যাবে।”
“যদি পুরো দায়িত্ব আমার হাতে থাকতো, তাহলে খুনি গ্রেফতার হওয়ার আগে কেউ কিছুই জানতো না।”
“তার মানে আপনি মিডিয়ার স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে চাইছেন?”
“আমি আতঙ্ক ছড়ানো থেকে বিরত রাখতাম, অথবা লেম্যানের মত বলতে গেলে বলতে হয়, ছাইপাঁশ ছাপতে দিতাম না।”
“ক্রিমিনাল ব্রিগেড থেকে আমরা কিছুই পাবো না?”
“আপনারা তো চান আমরা খুনিকে ধরি।”
“তার মানে আপনি মনে করেন মিডিয়ার কোন সাহায্য লাগবে না?”
“আপাতত, আমি এটাই বুঝাতে চাচ্ছি।”
“আপাতত? আপনি আসলে কী বলতে চাইছেন?”
“আমি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলি।” কিছু একটা চিন্তা করলো বুসন।
“দেখুন, যদি আপনি চান তাইলে আপনার জন্য কিছু করতে পারি। তবে বিষয়টা ব্যক্তিগত।”
“তাই নাকি!”
“হ্যাঁ, তাই। আপনাকে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে দেবো। একটা পত্রিকায় সাপ্তাহিকভাবে বিভিন্ন মানুষের ব্যক্তিগত প্রোফাইল নিয়ে লিখি, বুঝতেই পারছেন, বিশাল কলেবরের লেখা, বড় ছবি, আরো নানা জিনিস। আপাতত আমি খুনির একটা প্রোফাইল তৈরি করছি…কিন্তু আপনি চাইলে এটা পেছানো যাবে। তো, আপনার কী মত…”
“বাদ দিন, বুসন।”
“আমি মজা করছি না। আপনি এমন খ্যাতি পাবেন যা কল্পনাও করতে পারবেন না। বিনিময়ে আমাকে কেসের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সাহায্য করবেন।”
“আমি আবারও বলছি, বাদ দিন।”
“আপনি তো দেখা যায় খুব কঠিন লোক, ভেরহোভেন…”
“মঁসিয়ে ভেরহোভেন!”
“ছোট একটা উপদেশ দেই, এতো উচ্চস্বরে কথা বলবেন না মঁসিয়ে ভেরহোভেন।”
“কম্যাড্যান্ট ভেরহোভেন!”
“আচ্ছা, মানলাম। আপনি যেভাবে শুনতে ইচ্ছুক সেভাবেই বলবো।”
অধ্যায় ২৫
উচ্চতাজনিত সমস্যার কারণে ক্যামিল দাঁড়িয়ে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। যেহেতু সে দাঁড়িয়ে থাকে, তাই অন্যরাও বসার সাহস পায় না। নতুন সবাই এটাকে একরকম নিয়ম হিসেবে মেনে নিয়েছে ক্রিমিনাল ব্রিগেডে সব মিটিং হয় দাঁড়িয়ে।
গতকাল সন্ধ্যায় ম্যালেভাল আর আরম্যান্ড মিলে প্রতিবেশিদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। সেখান থেকে আশাবাদী হওয়ার মত কিছু পাওয়া যায়নি, কেননা প্রতিবেশির কোন চিহ্নই নেই। রাতের বেলা পুরো জায়গাটা যেন স্বর্গের অপ্সরীদের আড্ডাখানা হয়ে উঠে। নিচে সংকেতের জন্য অপেক্ষারত জোসে রিভেইরোও কাউকে দেখেনি। তবে পরে কেউ আসলেও আসতে পারে, সে ব্যাপারে তার কোন ধারণা নেই। দুই কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দেবার পর জনমানুষের চিহ্ন পাওয়া গেলো। কয়েকজন ছোট দোকানদার টুকিটাকি জিনিসপত্র নিয়ে বসে আছে, তবে তারা কেউই অস্বাভাবিক কিছু দেখেনি সেদিন। তাদের কথা শুনে মনে হলো কোন প্রেতাত্মা এসে মেয়েদের হত্যা করেছে।
“আমাদের খুনি খুব সতর্কতার সাথে হত্যাকাণ্ডের জন্য এই জায়গা বেছে নিয়েছে,” বলল ম্যালেভাল।
ম্যালেভালকে খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করলো ক্যামিল। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ানো ম্যালেভাল আর পাশের ডেস্কে বসা লুইস, হাতদুটো ভাজ করা, সামনে নোটবুক। এই দুজনের মাঝে তুলনা করার চেষ্টা করলো।
দুজনেই বেশ পরিপাটি পেপাশাক পড়ে আছে, দেখতেও সুদর্শন। তাদের মাঝে মূল পার্থক্যটাই হচ্ছে সেক্সয়াল। মেয়েদের বিছানায় নেয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে ম্যালেভলের। তার আকাঙ্খ যেন কখনোই পূরণ হবার নয়। তবে ক্যামিলের মনে হয় দোষ শুধু একা ম্যালেভালের নয়, এমন অনেক মেয়েও আছে যারা তার মতই আনন্দ খোঁজে। মেয়েদের কখনোই মন থেকে ভালোবাসে না সে। নতুন শিকার পেলেই তার পেছনে ছুটে যায়। অপরদিকে লুইসের যৌন জীবনের ব্যাপারে খুব কমই জানে ক্যামিল।
ম্যালেভালের কণ্ঠ শুনে তার চিন্তায় ছেদ পড়লো।
“লাশের কিছু অংশের ছবি সংবাদপত্র আর ম্যাগাজিনে চলে এসেছে। মিডিয়াও এই খবর লুফে নিয়েছে। আর ওই গরুর চামড়ার কথা ভুলে যান। চামড়া কে বা কেন এনেছে তা বের করা অসম্ভব। বাথরুমের দেয়ালের ওই ওয়ালপেপার নতুন হলেও কোথা থেকে কেনা হয়েছে তা খুঁজে বের করা বেশ কষ্টসাধ্য। ওয়ালপেপার প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা বলতে হবে…” খুব দ্রুত বলে গেলো ম্যালেভাল।
“শুনে তো মনে হচ্ছে খড়ের গাদায় সুই খোঁজার কাজ অপেক্ষা করছে কারো জন্য,” লুইস বলল।
“তাই নাকি! তো কী করা যায় বলো দেখি। ওই মডেলের ছবি কয়েক মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। সিরিয়াল নাম্বারও নেই। ল্যাবরেটরিতে পাঠানোর পর জানা গিয়েছে এসিড দিয়ে তা তুলে ফেলা হয়েছে। সত্যি বলতে, আমি খুব একটা আশাবাদী না এই কেস নিয়ে।”
এই বলে আরম্যাণ্ডের দিকে তাকালো ম্যালেভাল।
“আমিও তেমন কিছু পাইনি…”
“ধন্যবাদ, আরম্যান্ড। চেষ্টার জন্য তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আমরা। অনেক সাহায্য করেছে।”
“কিন্তু কম্যাড্যান্ট…” লজ্জায় লাল হয়ে আছে আরম্যান্ড।
“আরে আমি মজা করলাম।”
উপস্থিত সবাই বেশ অবাক হয়ে গেলো। কেননা ক্যামিলের মুখে এই কথা শুনে কেউ অভ্যস্ত নয়।
আরম্যান্ড এখনো ভয়ে কাঁপছে। মাঝে মাঝে তার জন্য খুব করুণা বোধ করে ক্যামিল।
“তো…তুমি কিছুই খুঁজে বের করতে পারলে না…?” আরম্যান্ডকে সাহস দেয়ার চেষ্টা করলো ক্যামিল।
“আসলে, আমি কিছু পেয়েছি। কিন্তু আহামরি কিছু না। অ্যাপার্টমেন্টের বিছানার চাদর খুবই উন্নতমানের, এখন অনেক দোকানেই পাওয়া যায়। তবে…”
“তবে কী?”
“এটার আলাদা নাম আছে, ফোটন…”
“আমার মনে হয় তুমি ফুটন বলতে চাচ্ছো?” সাহায্য করলো লুইস।
“হ্যাঁ। হ্যাঁ। তুমি ঠিক বলেছো, ফুটন।”
“তো, এই ফুটনের কাহিনীটা কী?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।
“এটাই তো মূল বিষয়-এটা সরাসরি জাপান থেকে আমদানি করা হয়েছিলো।”
“জাপান থেকে? জাপান থেকে জিনিস আমদানি করা মোটেও অস্বাভাবিক কিছু না, আশা করি তুমি তা জানো।”
“হ্যাঁ, তা জানি। কিন্তু…” বলল আরম্যান্ড।
“কিন্তু কী? যা বলতে চাও খুলে বলল,আরম্যান্ড।”
“আচ্ছা বলছি। এই মডেল কিটোর একটা ফ্যাক্টরি থেকে এসেছে। তারা সাধারণত ফার্নিচার, চেয়ার, টেবিল, খাট এ ধরনের জিনিস তৈরি করে…”
“বুঝলাম,..”
“তো, যাই হোক। ফুটন ওখানে তৈরি করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো সোফাটাও ওখান থেকে বানানো।”
পুরো রুম জুড়ে নীরবতা নেমে এলো।
“এটা বেশ বড়। খুব বেশি বিক্রিও হয়নি। তারা সাইত্রিশটার মত বিক্রি করতে পেরেছে। তার মানে আমাদের খুনি এই সাইত্রিশ জনের মাঝে কেউ হবে। কাস্টমারদের একটা লিস্টও জোগাড় করে ফেলেছি।”
“শালা আরম্যান্ড, এই কথাটা সোজাসুজি বললে কী ক্ষতি হতো?”
“আস্তে, আস্তে, এখনো তো শেষ হয়নি। ওই সাইত্রিশের মাঝে ছাব্বিশজন এখনো ব্যবসা করে। মেইল অর্ডার দিয়েও কেউ কেউ কিনেছে। আর ওখান থেকে তিনটা চলে গিয়েছে ফ্রান্সে। নিজের কাস্টমারের জন্য প্রথমটা অর্ডার করেছিলো পাকিস্থানি এক ব্যবসায়ী, সিলভেন সিগেল। এই দেখুন…”
পকেট থেকে সোফার একটা ছবি বের করলো আরম্যান্ড, যা দেখতে পুরোপুরি ক্যুবেড়ুয়ার সোফার মত।
“মঁসিয়ে সিগেল আমাকে ছবি পাঠিয়েছে। কালকেই তার বাসায় যাবো।”
“আর বাকি দুটো?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।
“এখানেই তো আসল মজাটা। বাকি দুইটা ফ্যাক্টরি থেকে অনলাইনের মাধ্যমে অর্ডার করা হয়েছিলো। পুরো প্রক্রিয়া কম্পিউটারের মাধ্যমে হওয়ার কারণে আসল লোকটাকে খুঁজে বের করা কিছুটা কঠিন। প্রথমটা অর্ডার করেছিলো ক্রেস্পি নামের একজন আর দ্বিতীয়টা ডানফোর্ড। দুটোই প্যারিস থেকে করা হয়েছিলো। ক্রেস্পির সাথে এখনো যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি, তবে আমি বেশ কিছু টেক্সট দিয়ে রেখেছি তাকে। কালকের মাঝে কোন খবর না পেলে আমি নিজেই ওখানে যাবো। আমার মনে হয়, ওখান থেকে বেশি কিছু পাবো না।”
“তা তোমার ‘গুরুত্বপূর্ণ মতামত কী শুনি?” বিদ্রূপ করে বলল ম্যালেভাল।
নিজের চিন্তার ডুবে রইলো আরম্যান্ড, ম্যালেভালের সাথে কোন তর্কে গেলো না। ম্যালেভালের দিকে একটু কড়া দৃষ্টিতে তাকালো ক্যামিল যেন বলতে চাইছে এখন মজা করার সময় না।
“আমি তার বাসার কাজের লোকের সাথে কথা বলেছি। সোফাটা এখনো ওই বাসাতেই আছে। রইলো শুধু ডানফোর্ড-আমাদের সম্ভাব্য খুনি। কিন্তু তার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। জেনেভিলারস কোম্পানিতে সোফা ডেলিভারি করা হয়েছিলো। ম্যানেজার জানালো সোফা তাদের হাতে আসার পরদিনই একজন লোক ভ্যান নিয়ে এসে তা নিয়ে যায়। তার সম্পর্কে তেমন কিছু বলতে পারেনি সে। তবে আমি কালকে যাবো ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে যদি কোন তথ্য পাওয়া যায়।”
“কিন্তু এতে করে কোনভাবেই বলা যায় না ডানফোর্ডই আমাদের খুনি,” বলল ম্যালেভাল।
“তা ঠিক আছে। কিন্তু সামনে এগুবার একটা সূত্র তো পাওয়া গেলো, ম্যালেভাল। তুমি কালকে আরম্যান্ডের সাথে জেনেভিলারসে যাবে।”
উপস্থিত চারজনের মাথায় একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। এই সূত্র ধরে তদন্ত কোন দিকে যাবে সে সম্পর্কে কারো কোন ধারণা নেই।
“খুঁটিনাটি সবকিছুর দিকে নজর রাখতে হবে। তথ্য যতই সামান্য হোক
কেন তা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। কেননা এছাড়া আমাদের সামনে কোন পথ খোলা নেই। একইসাথে এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে খুনির উদ্দেশ্য কী সেটা জানা। আর কিছু?”
“জোসাইন ডেবেফ, আমাদের দ্বিতীয় ভিক্টিম, প্যান্টিনে থাকতো। আমরা তার অ্যাপার্টমেন্টেও খোঁজ নিয়েছি, কিন্তু সেখানে কেউ নেই। যেখানে কাজ করতো সেখানেও খবর নিয়েছি, তার সম্পর্কে কেউই তেমন কিছু জানে না। যতদূর জেনেছি কোন বয়ফ্রেন্ড ছিলো না তার। মোট কথা কাজে লাগার মত কিছু জানা যায়নি,” একনাগাড়ে বলে গেলো লুইস।
ক্যামিলের দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিলো লুইস।
“ওহ, হ্যাঁ, একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। প্রায় সময়ই ভ্রমণ করে এমন ব্যবসায়ীর সুটকেসে যা যা থাকে তার সবই পাওয়া গেছে খুনির রেখে যাওয়া সুটকেসে,” বলল ক্যামিল।
“খুনি তত বেশ রুচিসম্পন্ন মনে হচ্ছে,” বিদ্রূপ করে বলল লুইস।
“তাই নাকি?” দ্বিধান্বিত সুরে বলল ক্যামিল।
“আমার তাই মনে হয়। আরম্যান্ড একটু আগে কী বলছিলো মনে করে দেখুন। শুধুমাত্র দুইজনকে হত্যা করে শরীরের খণ্ডিত অংশ সাজানোর জন্য এতো বড় আর দামি সোফা সেই জাপান থেকে অর্ডার করেছে। এছাড়াও তিনশ ইউরোর রালফ লরেনের সুটকেস ফেলে গিয়েছে। এর ভিতরের দামি জিনিসপত্রের কথা না হয় বাদই দিলাম। রিচার্জেবল ইলেকট্রিক রেজার, ফসিলের ঘড়ি, চামড়ার মানিব্যাগ…সব মিলে বেশ ভাল খরচ হওয়ার কথা…”
“আচ্ছা,” এই বলে নীরবতা ভাঙ্গলো ক্যামিল। “তাহলে আমাদের হাতে আঙুলের ছাপ ছাড়া আর কিছুই রইলো না, যদিও তা রাবার স্ট্যাম্প দিয়ে করা। কিন্তু এই মুহূর্তে এরচেয়ে ভাল কোন সুত্র আমাদের হাতে নেই। লুইস, তুমি কি ইউরোপিয়ান ডাটাবেজে একটু চেক করে দেখবে?”
“ওটা আরো আগেই করা হয়ে গেছে। ৪ ডিসেম্বর, ২০০১, টেম্বলে হত্যাকাণ্ডের তদন্তের সময়ই করা হয়েছিলো। কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি।”
“ঠিক আছে। তবে আমার মনে আরেকবার দেখা উচিত। তুমি কি ইউরোপোল এর সাথে প্রয়োজনীয় দেন দরবার করতে পারবে?”
“কিন্তু এটা তো…”
“এটা তো কী?”
“কিন্তু এক্ষেত্রে তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি লাগবে।”
“আমি সেটা জানি। তুমি ওদেরকে এখনি জানিয়ে দাও। বাকিটা আমি দেখছি।”
ট্রেম্বলে কেসের মূল বিষয়গুলো আবারো খাতায় লিখে এনেছে ক্যামিল। সাক্ষীদের সাক্ষ্য পুনরায় নেয়ার জন্য লুইসকে দায়িত্ব দিলো। যদি হত্যার শিকার পতিতার সম্পর্কে নতুন কোন তথ্য পাওয়া যায় এই আশায়।
“কিন্তু আমাদের লোকবল অনেক কম।”
“তোমার কাছ থেকে আমি ভাল কোন উত্তর আশা করছিলাম।”
ঘড়ির দিকে তাকালো লুইস।
“লা গুয়েনের সাথে কথা হয়েছে, আজ রাতের মাঝেই রিপোর্ট পেয়ে যাবো। টিভিতে আর পত্রিকায়, যখন থেকে একনাগারে খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তখন থেকেই যেন অস্থির হয়ে উঠেছে জুজেঁ দ্য ইন্সট্রাকসো।
“মানে?” জিজ্ঞেস করলো ম্যালেভাল।
“মানে হচ্ছে আজ বিকাল পাঁচটার মধ্যে উনার অফিসে উপস্থিত থাকবে হবে সবাইকে। “
“ওহ…বুঝতে পেরেছি…তো আমরা কী আপডেট দেবো উনাকে?”
“এটাই তো সমস্যা। বলার মত তেমন কিছুই নেই। তবে এইবার তাকে একটু অন্যভাবে মানানো যাবে। ডা. ক্রেস্ট সাইকোলজিকাল প্রোফাইল আর গুনেন প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে কাজ করছে, আগামিকালকেই সব পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু সামনে এগুনোর জন্য কিছু খুঁজে বের করতে হবে আমাদের।”
“কোন আইডিয়া?” জানতে চাইলো আরম্যান্ড।
“এই ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, আরম্যান্ড। তবে একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত, আমাদের সামনে ভয়াবহ কিছু অপেক্ষা করছে।”
অধ্যায় ২৬
আরম্যান্ডকে নিয়ে তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো ক্যামিল। লুইস আর ম্যালেভাল কাজ শেষ করে তাদের সাথে যোগ দেবে বলে জানালো।
“দেশমের সাথে কখনো দেখা হয়েছে?” আরম্যাণ্ডের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো ক্যামিল।
“মনে পড়ছে না।”
“তার মানে তার সাথে তোমার দেখাই হয়নি।”
“আর আপনার?”
“তার কথা বেশ ভালভাবেই মনে আছে আমার।”
আরম্যান্ড আর ক্যামিল তার অফিসে গিয়ে দেখলো লা গুয়েন আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত। কিছুক্ষণের মাঝেই লুইস আর ম্যালেভালও চলে এলো। ডেস্কের পেছনে বসে আছে সে, বয়স যেন কিছুটা কমে গিয়েছে আর স্বাস্থ্যও, অন্তত ক্যামিলের কাছে তাই মনে হলো।
এরইমাঝে ডা. ক্রেস্ট চলে এলো। ক্যামিলের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট হাসি দিয়ে দরজার পাশে একটা চেয়ারে বসে পড়লো যেন প্রয়োজনের বাইরে এক মুহূর্তও এখানে থাকতে রাজি নয়।
“এই কেসে সবার দক্ষতার একশভাগ চাই আমি। আপনারা টিভি দেখেছেন, পত্রিকা পড়েছেন সবখানে এই খবর ছড়িয়ে পড়েছে। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমি বলছি না আপনারা অসম্ভবকে সম্ভব করুন, কিন্তু চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখবেন না। আর তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রতিদিন আমাকে জানাবেন। তবে একটা জিনিস ভুলে গেলে চলবে না সাংবাদিকরা আপনাদের পেছনে মৌমাছির মত ঘুরছে, তাই কাজের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যারা এই আইন লঙ্ঘন করবেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। মিডিয়ার লোকজন বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তাই আমি তদন্তের বর্তমান অবস্থা জানতে চাইছি আর কতটুকু তাদের বলা যাবে সে ব্যাপারে আপনাদের মতামত দিন। আশা করি পরিস্থিতি কিছুদিনের মাঝেই শান্ত হয়ে যাবে,” বলল দেশম।
নড করলো লা গুয়েন, যেন সব বুঝতে পেরেছে।
“খুব ভাল। ডা, গুয়েন, আপনি বলুন।”
কাশি দিয়ে গলা পরিস্কার করে নিলো সে।
“সম্পূর্ণ রিপোর্ট পেতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে। তবে অটোপসি থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। শরীরের ক্ষতগুলো দেখে মনে হচ্ছে খুনি একজনই।”
সবাই যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো এই ভেবে যে একজনের পেছনে ছুটতে হবে।
“সম্ভাব্য সবদিক বিবেচনা করে বলা যায় খুনি পুরুষ কেউ হবে। বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছে সে-রাজমিস্ত্রির কাজে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক ড্রিল মেশিন, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, ইলেকট্রিক চেইন স, নেইল গান, বেশ কয়েকটা ছুরি, একটা লাইটার। তবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কোন সময়ে কী ঘটেছিলো তা বলা কঠিন; কিছু জিনিস আমাদেরকে বলতে গেলে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে। সত্যি বলতে, দুইজন ভিক্টিমের শরীরেই আমরা শারীরিক মিলনের চিহ্ন পেয়েছি-ওরাল, অ্যানাল, ভ্যাজাইনাল-একে অপরের সাথে আর অজ্ঞাত একজন পুরুষের সাথে, যে আমাদের সম্ভাব্য খুনি। তবে সবচেয়ে অবাক করার মত বিষয় হলো আমরা কনডম ব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছি। এমনকি রাবারের ডিলডোও ছিলো সেখানে। এতোসব তথ্যের সমাহারের কারণে ঘটনা এখনো ক্রমানুসারে সাজানো সম্ভব হয়নি। তবে কিছু ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি। যেমন; ভিক্টিমের মাথা না কেটে খুলির মাঝে স্পার্ম ফালানো খুনির পক্ষে অসম্ভব।”
সবাই যেন কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। চশমাটা ঠিক করে আবারো বলতে শুরু করলো গুয়েন।
“সম্ভবত ভিক্টিমদের চোখে মুখে বেশ কয়েকবার বিষাক্ত গ্যাস স্পে করা হয়েছিলো। দুজনেই স্তব্ধ ছিলো-ইলেকট্রিক ড্রিল অথবা নেইল গানের ব্যবহারে হয়তো এমনটা হয়েছিলো। দুজনের মাথায় একই বল নিয়ে আঘাত করা হয়েছিলো, যদিও তা তাদেরকে খুব বেশি সময় অজ্ঞান করে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিলো না। অন্যভাবে বলতে গেলে তারা এমন অবস্থায় ছিলো যে সবই বুঝতে পারা সত্ত্বেও কিছুই করার ছিলো না।”
একটু থেমে কী যেন ভাবলো গুয়েন।
“এই ব্যাপারে আমার রিপোর্টে বিস্তারিত তথ্য পাবেন। প্রথম ভিক্টিমের শরীরে কামড়ের দাগ ছিলো। প্রচুর রক্তক্ষরণও হয়েছিলো মনে হয়। নেইল কাটার দিয়ে এভলিন রুভ্রের ঠোঁট কেটে নেয়া হয়েছে। উদর আর পায়ের দিকে গভীর ক্ষত ছিলো তার, পাকস্থলি আর যৌনাঙ্গ ঘন হাইড্রোক্লোরিক এসিড দিয়ে পোড়ানো। ভিক্টিমের মাথা পাওয়া গিয়েছিলো বাথরুমে। মুখে স্পার্মের প্রমাণও পাওয়া গেছে, আমার ধারণা তা মৃত্যুর পরই ভিক্টিমের মুখে দেয়া হয়েছে। জোসাইন ডেবেফের ব্যাপারে যাওয়ার আগে আরো কিছু তথ্য…”
“আরো আছে?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।
“হ্যাঁ, আরেকটু বাকি আছে। জোসাইন ডেবেফকে বিছানায় ছয় জোড়া দড়ি দিয়ে বেধে রাখা হয়েছিলো যা আমরা ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করেছি। খুনি প্রথমে তার ভু আর চোখের পাপড়ি আগুন দিয়ে পোড়ায়। এরচেয়ে ভয়াবহ কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত হন…খুনি ভিক্টিমের গলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দেয়, আর হাতের নাগালে যা পেয়েছে তাই টেনে বের করেছে মুখ দিয়ে। জোসাইন ডেবেফের রক্ত দিয়েই দেয়ালে ‘আই অ্যাম ব্যাক’ লেখা হয়েছে।
সবাই যেন কথা বলতে ভুলে গিয়েছে।
“কারো কোন প্রশ্ন আছে?” জিজ্ঞেস করলো লা গুয়েন।
“এর সাথে ট্রেম্বলে কেসের কী সম্পর্ক?” ক্যামিলের দিকে তাকালো দেশম।
“আমি গতকাল রাতেই কেস ফাইলটা পড়েছি। কিছু জিনিস এখনো মিলিয়ে দেখা বাকি, কিন্তু দুই কেসেই আঙুলের ছাপ রাবার স্ট্যাম্প দিয়ে করা হয়েছে। দুই ক্ষেত্রেই খুনি তার স্বাক্ষর রেখে গেছে।”
“এটা মোটেও কোন শুভ লক্ষণ নয়। তার মানে খুনি বিখ্যাত হতে চায়।”
“ক্লাসিক সোসিয়োপ্যাথের সব লক্ষণই আছে তার মাঝে,” হুট করে বলে উঠলো ভা, ক্রেস্ট। এতে আলাপচারিতার মাঝে এই প্রথম কথা বলল সে, সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে।
“বাঁধা দেয়ার জন্য দুঃখিত…” কণ্ঠে অনুনয়ের ছাপ সুস্পষ্ট।
“না। না, আপনি বলুন, দেশম এমনভাবে বলল যেন তার অনুমতির অপেক্ষায় ছিলো ডা, ক্রেস্ট।
ক্রেস্টের পরনে দামি স্যুট। নামের প্রথমাংশ এডোয়ার্ড, একদম তার সাথে মানিয়ে যায়, রুমে ঢোকার সময় ক্যামিলের তাই মনে হয়েছে। তার বাবা-মা উপযুক্ত নামটাই বাছাই করেছে।
“সাইকোলজিকাল দিক দিয়ে দেখলে আমরা ক্লাসিক একটা কেস নিয়ে কাজ করছি যার গাথুনি একদম অকৃত্রিম, যদিও প্রয়োগের ধারাটা গতানুগতিক নয়। আদতে খুনি এক ধরনের মানসিক বিষণ্ণতায় ভুগে। হত্যার ধরন দেখে মনে হয় খুন করাটা তার মূল উদ্দেশ্য নয়। সে চায় প্রাধান্য বিস্তার করতে, যার শেষটা হয় ধ্বংসাত্মক। নারীদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করেও তার রাগ কিংবা ক্ষোভ বিন্দুমাত্র কমে না। তাই সে অত্যাচার শুরু করে। যখন এতেও শান্তি পায় না, তখন তাদেরকে হত্যা করে। এমনকি হত্যা করার পরেও তার আশা পূরণ হয় না। বিশেষ কোন কাজ শেষ করার তাগাদা অনুভব করে সে। নিজের ভেতরে আরেকটা সত্তাকে লালন করে, আর বিশ্বাস করে তার জীবনে কখনো শান্তি আসবে না। সে কখনোই থামবে না, কেননা তার আকাঙ্খিত শান্তি কখনোই আসবে না। দিনে দিনে তার ভেতরে নারীর প্রতি এক তীব্র ঘৃণা জন্ম নিয়েছে। একারণে নয় যে তারা নারী, আসলে নারীরা তাকে কখনো শান্তি দিতে পারবে না। তবে তার আসল সমস্যা হলো সে খুবই একাকী বোধ করে। এমন নয় যে সে যৌনতায় অক্ষম, আর দশটা স্বাভাবিক পুরুষের মত সব কিছুই ঠিক আছে, কিন্তু যৌনতৃপ্তির ক্ষেত্রে তার রুচি আলাদা। আদতে খুনির জীবনে এমনটা কখনো হয়নি। যদি হয়েও থাকে, তাহলে এখন না চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা দরজার মত যার চাবি হারিয়ে গিয়েছে। তখন থেকেই এই চাবির পেছনে ছুটছে সে। নারীদের উপর এমন অত্যাচার করে কেননা সে নিজেও অত্যাচারিত।”
“আমাদের খুনি কেমন হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।
“সাদা চামড়ার, ইউরোপিয়ান, শিক্ষিত। খুব বেশি বুদ্ধিমান যে হতে হবে তা নয়, তবে খুব মাথা খাঁটিয়ে কাজ করে। বয়স ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের মাঝামাঝি। একা থাকে। হয়তো ডিভোর্সড কিংবা বিপত্নীক…তবে আমার মনে হয় অবিবাহিত।”
“তার কাজের কোন দিকগুলোতে আমাদের নজর রাখা প্রয়োজন?” লুইস প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো।
“এটা বলা বেশ কঠিন। আমার মতে, এটাই তার প্রথম অপরাধ নয়। আর কাজের ধরন বৃত্তের বাইরে থেকে কেন্দ্রের দিকে আসার মত। সম্ভবত প্রথমে শুধু ধর্ষণ দিয়েই তার কর্মকাণ্ড শুরু করেছে, এরপর অত্যাচার আর সবশেষে হত্যা। যার মাত্রা আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে একটা জিনিস বলা যায়, ভিক্টিম দুজনেই পেশায় পতিতা, বয়সে তরুণী। এছাড়াও…”
“মানসিকভাবে অসুস্থ রোগির ইতিহাস ঘাটলে তাকে পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?”
“পাওয়া যেতে পারে। নিজেকে ধোঁকা দেয়াতে যে লোক এততটা দক্ষ, অন্যকে ধোঁকা দেয়া তার কাছে খুব বেশি কঠিন কিছু না। কেউই তাকে শান্তি দিতে পারেনি। তাই নারীই তার শেষ ভরসা। আর এই পৈশাচিক শান্তির খোঁজে সে ততদিন অবধি হত্যা করে যাবে, যতদিন না আপনারা তাকে গ্রেফতার করেন। নিজের প্রত্যেকটা কাজের পেছনে আলাদা যুক্তি দাঁড় করিয়েছে সে। অপরাধস্থলে প্রতিটি কাজ এতো সূক্ষভাবে করা যেন তা আগেও বেশ কয়েকবার মহড়া দিয়ে নিয়েছিলো। আপাতত দুটো বিষয় নিশ্চিত করে বলা যায়, প্রথমত সে হত্যা করবে আর অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন আরো বাড়াবে।”
পুরো রুম জুড়ে নীরবতা নেলে এলো।
“আর কিছু?” জিজ্ঞেস করলো দেশম।
অধ্যায় ২৭
“উন্মাদ”
আইরিন গর্ভবতি হওয়ার পর অনেকদিন পার হয়ে গেছে। তার মুখ আর পেট ফুলে উঠেছে, চলাফেরার গতিও অনেকটা কমে গেছে। কিন্তু ক্যামিলের কাছে এই পরিবর্তন বেশ আকস্মিক, অনেকটা সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মত।
“ডার্লিং…পরিবর্তনটা হুট করে হয়নি। আসলে আমরা একসাথে ডিনার করি না অনেকদিন হয়ে গেছে, তাই তোমার এমনটা মনে হচ্ছে।”
দুঃখের তিক্ত অনুভূতি তার মনের মাঝে খচখচ করতে লাগলো। আইরিনের মলিন মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো-স্বামীর জন্য আজন্ম অপেক্ষায় বসে থাকা এক নারী। এক অজানা বিষাদে ছেয়ে গেল তার মন। আইরিনের কথা এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলে থাকতে পারতো না, দিনে কম করে হলেও একশবার মনে পড়তো তার কথা। শুরুর দিকে দুজনে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও মাঝে মাঝেই কথা হতো। একটু বিরতি পেলেই প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে চলে যেতো। ইচ্ছে হলেই লেট নাইট মুভি অথবা বাইরে ডিনার করতে যাওয়া। সবমিলিয়ে ছোট ছোট আনন্দ দিয়ে জীবনটা পূর্ণ ছিলো তার। কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে সবকিছু কেমন জানি বদলে গেছে। এই ভেবে কিছুটা অপরাধবোধ হলো তার। অনেক ভেবেচিন্তে লুইসকে ফোন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
“দেখো, রেস্টুরেন্টের ব্যাপারে পরামর্শ দরকার আমার। একটু ভাল মানের হতে হবে। আমার বিবাহ বার্ষিকীর জন্য।”
“শে মিসেতে যেতে পারেন। এটা অসাধারণ।”
কত খরচ করতে পারে তা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও নিজের আত্মসম্মানবোধের কথা ভেবে থেমে গেলো ক্যামিল।
“অথবা লাসিয়েটেও দেখতে পারেন,” বলল লুইস।
“ধন্যবাদ লুইস। আমার মন হয় শে মিসেই ভাল হবে।”
অধ্যায় ২৮
আইরিন আগে থেকেই তৈরি হয়ে বসে ছিলো। ঘড়ি দেখার তীব্র ইচ্ছা দমন করলো ক্যামিল।
“চিন্তার কিছু নেই,” হেসে বলল আইরিন, “তুমি দেরি করেছ, কিন্তু তাতে সমস্যা নেই।”
গাড়ির দিকে যাওয়ার সময় ক্যামিল খেয়াল করলো আইরিনের জামাকাপড় বেশ ভারি : অনেকটা হাঁসের মত হাঁটছিলো সে, পিঠটা কেমন জানি বাঁকা হয়ে গিয়েছে, ব্যাপারটা ভাবিয়ে তুললো তাকে।
“তুমি ঠিক আছে তো?”
থামলো সে। ক্যামিলের হাতে হাত রেখে মুচকি হাসলো।
“আমি ঠিক আছি, ক্যামিল।”
স্ত্রীর দিকে এমন বেখেয়ালিপনার কারণে নিজেকে অভিশাপ দিলো। নিজের উপর বিরক্তবোধ করলো। যদিও সে আইরিনকে ভালোবাসে, তবুও একজন ভালো স্বামী হতে পারেনি। দুজনে বাকিটুকু পথ কোন কথা ছাড়াই পার করলো। সকল শব্দ যেন ব্যর্থ হয়ে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। সিনেমা হলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওয়েন্ডালিন প্লাইন নামক অভিনেতার নামের দিকে চোখ পড়লো তার। মাথায় কিছু একটা আসতে চেয়েও যেন এলো না।
আইরিন গাড়িতে উঠলো। এখনও দুজন নিশ্চুপ। পরিস্থিতি আঁচ করতে করতে পেরে ক্যামিলের এক হাত টেনে নিয়ে নিজের নিতম্বের উপর রাখলো, আরেক হাত ক্যামিলের ঘাড়ের পেছনে দিয়ে তাকে কাছে টেনে এনে চুমু খেলো। শূন্যতার যে বেড়াজালে ‘জনে আটকা পড়ে ছিলো মুহূর্তের মাঝেই তা দূর হয়ে গেলো।
“আমি তোমাকে ভালোবাসি, মঁসিয়ে ভেরহোভেন,” বলল আইরিন।
“আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি, মিসেস ভেরহোভেন, চোখের দিকে তাকিয়ে বলল ক্যামিল।
শে মিসে। সত্যিই অসাধারণ যেমনটা লুইস বলেছিলো। দেয়ালজুড়ে আয়না, ওয়েটারদের পরনে কালো টাইজার আর সাদা কোর্ট। আইরিনের পরনে আছে লাল আর হলুদের সংমিশনের একটা জামা, যদিও কেনার সময় সবচেয়ে বড় সাইজটাই কিনেছিলো, কিন্তু পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠা পেটের সাথে তা কুলিয়ে উঠতে পারছে না।
রেস্টুরেন্ট জুড়ে প্রচন্ড ভিড়, কিন্তু এই কোলাহল তাদেরকে কিছুটা গোপনিয়তাও দিয়েছে। মাতৃত্বকালীন ছুটির জন্য আইরিনের ছেড়ে দেয়া ছবির ব্যাপারে কথা বলল তারা আর আইরিন ক্যামিলকে তার বাবার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো।
“গতকালকেই কথা হয়েছে। এখন ভাল আছে,” বলল ক্যামিল।
আইরিন খাবার খেতে লাগলো।
“লুইসকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলো না,” ক্যামিলের দিকে তাকিয়ে বলল সে।
“হ্যাঁ, অবশ্যই। দেখা হলে আমি ওকে বিলটা ধরিয়ে দিতে ভুলবো না।”
এই শুনে হেসে উঠলো আইরিন।
“তা তোমার কেসের কী অবস্থা? রেডিওতে তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রটের কথা শুনলাম আজকে…নাম কী তার? দেশম, তাই না?”
“হ্যাঁ। তা নিজের পক্ষে কী সাফাই গাইলো সে?”
“তেমন কিছু না। কিন্তু কেসটা তত মনে হচ্ছে ভয়াবহ।”
ক্যামিলকে কিছু বলতে না দেখে আরো বলল, “সে বলেছে ক্যুবেভুয়ায় দুইজন তরুণী খুন হয়েছে। বিস্তারিত কিছু বলেনি, কিন্তু এতোটুকু শুনেই আমার গা শিউরে উঠেছে,..”
“ঠিক তাই।”
“ট্রেম্বলে নামে আরেকটা পুরনো কেসের সাথে এর মিলের কথাও বলল। তুমি কি ওই কেসেও কাজ করেছিলো নাকি?”
“না। আমি ওই কেসে ছিলাম না। তবে এখন আমার অধীনেই পড়েছে।”
কেস নিয়ে আলোচনা করতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না ক্যামিল। বিশেষ করে নিজের বিবাহবার্ষিকীতে গর্ভবতি স্ত্রীকে সামনে রেখে নশংসভাবে খুন হওয়া দুই তরুণীর ব্যাপারে আলাপ করাটা বেখাপ্পা মনে হচ্ছে তার কাছে। কিন্তু আইরিন ঠিকই খেয়াল করেছে গত কয়েকদিন যাবত ক্যামিল এই বিষয় নিয়ে খুবই চিন্তিত, তবে যখনই সে চিন্তা দূর করার চেষ্টা করেছে কেউ না কেউ সেটা আবারো মনে করিয়ে দিয়েছে। কেস সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা দিলো ক্যামিল।
“খুনি তো পুরোপুরি মানসিক বিকারগ্রস্থ…” তার কথা শুনে আইরিনের প্রতিক্রিয়া এমনই হলো।
ক্যামিল তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে একশতে একজন অফিসারের কপালে এমন কেস পড়ে না যা তাকে সামলাতে হচ্ছে, এমনকি হাজারে একজন অফিসার এই ধরনের কেসের দায়িত্ব নিতে চাইবে। কোন ক্রাইম নভেল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এমনটা হতে পারে বলে আইরিনকে জানালো সে।
“তুমি আমাকে কখনো ক্রাইম নভেল পড়তে দেখেছো? আমি ওগুলো সহ্য করতে পারি না।”
“কয়েকটা তত কমপক্ষে পড়েছে!”
“ছোটবেলায় ‘অ্যান্ড দেয়ার ওয়ার নান পড়েছিলাম। তাও আমার বাবার চাপে বাধ্য হয়ে।”
“আমিও যে খুব ভক্ত তা নয়,” বলল ক্যামিল।
“আমার কাছে সবসময় মুভিই ভাল লাগে, হাসি দিয়ে বলল সে।
“আমি জানি…” বলে ক্যামিলও হাসলো। একে অপরকে বেশ ভালভাবেই জানে তারা। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে একটা ছোট বাক্স বের করলো সে।
“শুভ বিবাহবার্ষিকী।”
আইরিন অনেক আগে থেকেই মেনে নিয়েছে তার স্বামীর কল্পনাশক্তি কম। বিয়ের দিন থেকে শুরু করে যে কোন বিশেষ উপলক্ষে ক্যামিল তাকে শুধু অলংকারই দিয়েছে। এর বাইরে কিছুই নয়। এটা নিয়ে সে মোটেও অসন্তুষ্ট নয়। বরং সেইসব স্ত্রীদের তুলনায় নিজেকে ভাগ্যবতিই মনে করে যাদের স্বামী এতোটুকুও করে না। কিন্তু সে সম্পূর্ণ বিপরীত, স্বামীর জন্য প্রতিবারই নতুন কোন কিছু কেনাটা তার স্বভাব। র্যাপিং পেপার দিয়ে মোড়ানো বড় একটা কিছু ক্যামিলের হাতে তুলে দিলো সে।
“তোমাকেও শুভ বিবাহবার্ষিকী।”
প্রতিবার নতুন ধরনের উপহার পেয়ে কিছুটা লজ্জিত বোধ করে ক্যামিল। র্যাপিং পেপার খুলে দেখে ভেতরে একটা বই : ‘দ্য কারাভাগ্যিও মিস্ট্রি।
“তোমার পছন্দ হয়েছে?”
“অনেক বেশি পছন্দ হয়েছে।”
অধ্যায় ২৯
ডিনার শেষ করে বাইরে হাঁটতে বের হলো, হাতে হাত রেখে দুজনে ঘুরছে। ক্যামিল এর আগে শুধুমাত্র একবারই আইরিনের হাত ধরে বাইরে হেঁটেছে। তবে অন্য সব পুরুষের মত তারও ইচ্ছে করে স্ত্রীর কাঁধে হাত রাখতে, কোমরে হাত বুলিয়ে দিতে। আর তা করতে না পারার যন্ত্রণা প্রায়ই তাকে পীড়া দেয়। যদিও তা সময়ের সাথে অনেকটা মলিন হয়ে গেছে। হুট করেই আইরিনের হাঁটার গতি কমে গেলো।
“ক্লান্ত?”
“হ্যাঁ, একটু,” মুচকি হাসি দিয়ে বলল সে।
“আচ্ছা, আমি গিয়ে গাড়ি নিয়ে আসছি।”
“আরে না, তোমার তা করতে হবে না।” কিন্তু এছাড়া আর উপায়ও নেই। রাত অনেক গম্ভীর হয়ে যাওয়াতে লোকজনের আনাগোনা এখন একটু কম। দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলো পাশে রাখা একটা চেয়ারে বসবে আইরিন, এর মধ্যে ক্যামিল গাড়ি নিয়ে আসবে।
কোণায় গিয়ে ক্যামিল ঘুরে দাঁড়ালো স্ত্রীকে দেখার জন্য। আইরিনের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে, ভয়ের শীতল স্রোত তার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেলো, হুট করেই দুজনের মাঝের দূরত্বটুকু অসীম মনে হলো। পেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার স্ত্রী। স্ত্রীর মাঝে নতুন এক অস্তিত্ব গড়ে উঠছে যা তার জীবনকে কিছুদিনের মাঝেই আনন্দে পরিপূর্ণ করে তুলবে। ভয় কিছুটা কেটে গেলো তার।
এসব ভাবতে গিয়ে ক্ষণিকের জন্য আইরিন ষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলো, পাশে দাঁড়ানো এক লোকের কারণে ঠিকমত দেখতেও অসুবিধা হচ্ছে। “ইদানীংকালের তরুনেরা বেশিই লম্বা হচ্ছে,” মনে মনে ভাবলো ক্যামিল। সম্প্রতি পড়া একটা আর্টিকেলের কথা মনে পড়লো যেখানে বলা হয়েছে পৃথিবীর সব মানুষের গড় উচ্চতা দিনে দিনে বাড়ছে, এমনকি জাপানিদেরও।
গাড়ির চাবির জন্য পকেট হাতড়ানোর সময় এতোক্ষন মাথায় ঘুরপাক খাওয়া সমস্যাটার সমাধান মিললো, ওয়েন্ডালিন প্লইন দেখে তার মনে পড়েছে ভিক্টর হুগোর ‘দ্য ম্যান হু লাফস’ বইয়ের মূল চরিত্র ওয়েনপ্লেনের কথা।
অধ্যায় ৩০
“প্যালেট নাইফ ছবির গভীরতা বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। দেখো…”
স্বপ্নের মাঝে মায়ের উপদেশ শুনছিলো ক্যামিল।
ভোর চারটার দিকে তার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। পাশে ঘুমন্ত আইনের দিকে একটু ঝুঁকে গেলো, কিছুক্ষণের জন্য নিঃশ্বাস বন্ধ রাখলো যেন প্রিয়তমা স্ত্রীর শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়। শরীরের উষ্ণতা অনুভব করার জন্য আলতো করে স্ত্রীর পেটে হাত রাখলো। আধোঘুমন্ত অবস্থায় জেগে ওঠার পর অন্ধকার তাকে গ্রাস করে নিয়েছে। পাগলা ঘোড়ার মত চলতে থাকা হৃৎপিণ্ডকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। সু দিয়ে নেমে আসা ঘামের রেখা তার দৃষ্টিকে কিছুটা ঘোলাটে করে দিলো।
বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো। ঠাণ্ডা পানির ঝাঁপটা দিলো চোখেমুখে।
এমনিতে সে খুব বেশি স্বপ্ন দেখে না। ফ্রিজ থেকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা দুধ বের করে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। পা দুটো কেমন জানি ভারি হয়ে আছে, ঘাড়টাও নাড়াতে পারছে না। এদিকে মাথা থেকে ক্যুবেভুয়ার ওই দুই নারীর বীভৎস লাশের ছবিও দূর করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘুরেফিরে চিন্তাগুলো এখানে এসে থেমে যাচ্ছে।
“তোমার সমস্যাটা কী?” নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো। “থামো, আর কত? সামনের দিকে তাকাও। বড় করে একটা শ্বাস নাও। একবার ভেবে দেখো এরচেয়ে কত বীভৎস কেস নিয়ে তুমি কাজ করেছে। হতে পারে এই কেসের লাশ দুটো অতীতের সব নৃশংসতাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে, কিন্তু মনে রেখো এটাই শেষ না। তুমি তোমার কাজ করো। তুমি যা করতে পারো তাই করো। তোমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করো, অপরাধীকে খুঁজে বের করো, কিন্তু জীবনকে এভাবে এড়িয়ে চলার মানে কী?”
হুট করেই স্বপ্নে দেখা একটা ছবি তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। দেয়ালে তার মায়ের আঁকা একটা ছবি, ক্যুবেভুয়ার সেই মৃত মেয়েটার মুখের ছবি। ছবিটা যেন জীবনে হয়ে উঠেছে,আস্তে আস্তে যেন ফুল ফোঁটার মত করে নিজের রূপ উন্মোচিত করছে। ক্রিসেনথিয়াম ফুলের মত গাঢ় লাল বর্ণের পাপড়ি মেলে দিয়েছে।
ক্যামিল নড়াচড়া করতে ভুলে গেলো। রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু একটা সে জানে, যদিও নাম মনে পড়ছে না কিন্তু তার ভেতরে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে দেয়ালে গেঁথে থাকা মাথাটার কথা কল্পনা করার চেষ্টা করলো। আসল রহস্য তার স্বপ্নের মাঝে না, এই ফুলের মাঝেই। চিন্তার সোতগুলো তার কাছে এসেও যেন ভিড়ছে না।
“শিট…?”
মেয়েটাকে দিয়ে কোন ফুল নির্দেশ করা হচ্ছে। কিন্তু কোন ফুল? ক্যামিলের মগজ যেন আলোর বেগে কাজ করছে। ক্রিসেনথিয়ামের মত অনেকগুলো পাপড়ি।
হুট করেই তার চিন্তার সোতধারার মাঝে কিছু একটা খুঁজে পেলো। নিজের ভুল বুঝতে পারলো সে। তার স্বপ্নটা ক্যুবেভুয়ার হত্যাকাণ্ড নিয়ে ছিলো না, আদতে ছিলো ট্রেম্বলের মেয়েটাকে নিয়ে।
“এটা অসম্ভব,” ভাবলো সে, কিন্তু নিজেও জানে এটাই সত্যি।
পড়ার রুমে ছুটে গেলো, ট্রেম্বলে কেসের ফাইলে পাগলের মত কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর কাঙ্খিত ছবিটা পেয়ে গেলো। মেয়েটার মুখের দিকে খেয়াল করলো, হাসিটা এক কান থেকে আরেক কান অবধি বিস্তৃত করা হয়েছে রেজার দিয়ে। আরেকটা ছবিতে দেখতে পেলো শরীরটাকে দুইভাগ করে…।
“না। এটা হতে পারে না। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না…”
পড়ার রুম ছেড়ে বুকশেলফের সামনে এসে দাঁড়ালো। স্তূপ হয়ে জমে থাকা সংবাদপত্র সরিয়ে নিলো। এখনো পুরো সূত্র মিলানোর চেষ্টা করছে মাথার ভেতরে : ওয়েনপ্লেন, দ্য ম্যান হু লাফস। এক নারীর বিচ্ছিন্ন মাথা, বিস্তৃত হাসি, দ্য ওম্যান হু লাফস।
ফুলটাও টকটকে রঙের না…
বুকশেলফের সামনে থাকা ছোট সিঁড়ি বেয়ে উঠলো, প্রতিটি বইয়ে হাত বুলিয়ে নাম দেখে নিচ্ছে। কয়েকটা ইংলিশ লেখকের বই, ঠিক পাশেই আছে জেমস হ্যাডলি চেজের ‘দ্য ফ্লেস অফ দ্যা অর্কিড’।
“না, কোন অর্কিড না…” মনে মনে বলল সে, বইয়ের উপরে আঙুল দিয়ে তা বের করে আনলো। “ডালিয়া। অবশ্যই লাল রঙের না।”
সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে হাতে থাকা বইটার দিকে তাকালো সে। প্রচ্ছদে কালো চুলের অধিকারিণী এক নারীর ছবি, চুলের স্টাইল দেখে মনে হয় ১৯৫০ সালের কোন এক ছবি। সাথে সাথে স্বত্ত্বাধিকারের পেজ চেক করলো; ১৯৮৭।
পেছনের পাতায় দেখলো :
১৯৮৭ সালের জুন মাসের ১৫ তারিখে লস অ্যাঞ্জেলেসের এক পরিত্যক্ত স্থানে ছিন্নভিন্ন লাশ খুঁজে পাওয়া যায়, বাইশ বছর বয়সি এক তরুণীর মৃতদেহ : বেটি শর্ট, ডাকনাম “দ্য ব্ল্যাক ডালিয়া…”
কাহিনীর বেশিরভাগ অংশই তার মনে আছে। দ্রুততার সাথে কয়েকটা পাতায় চোখ বুলিয়ে নিলো, ৮৭ নাম্বার পাতায় এসে থামলো :
কোমরের দিক থেকে দুইভাগ করা ছিন্নভিন্ন এক তরুণীর লাশ পড়ে আছে। শরীরের নিমাংশ উপরাংশ থেকে কয়েক ফিট দূরে, পা দুটো ছড়ানো। বাম উরু থেকে ত্রিকোণাকার করে মাংসের বেশ বড় একটা অংশ কেটে নেয়া হয়েছে। নাভীর নিচ থেকে পিউবিক হেয়ারের উপরাংশ অবধি গভীর ক্ষত। ক্ষতের আশপাশ থেকে চামড়া টেনে তোলার চিহ্ন স্পষ্ট, ভিতরে কোন অঙ্গই নেই। শরীরের উপরাংশের চিত্র আরো ভয়াবহ : স্তনে সিগারেটের পোড়া ক্ষত, ডান পাশেরটা ঝুলে আছে, বাম পাশেরটা থেতলে আছে। সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র অপেক্ষা করছে মেয়েটার মুখে।
“তুমি কী করছো, ঘুমাবে না?”
ক্যামিল মুখ তুলে তাকালো, নাইটড্রেস পড়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আইরিন। বইটা রেখে স্ত্রীর দিকে এগিয়ে গিয়ে তার পেটে হাত রাখলো।
“তুমি যাও, আমি এক্ষুণি আসছি।”
আইরিনকে দেখে মনে হলো কোন বাচ্চা মেয়ে, দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছে।
“আমি চলে আসবো তোর তুমি যেয়ে শুয়ে পড়ো,” বলল সে।
আবারো বই নিয়ে বসলো। বেশ বড় রক্ত বর্ণের একটা ক্ষত, নাকটা মুখের সাথে এমনভাবে থেতলে দেয়া হয়েছে যে তার অস্তিত্ব বোঝা দায়, মুখটা এক কান থেকে থেকে আরেক কান অবধি রেজার দিয়ে কেটে দেয়া হয়েছে যেন বিশাল এক হাসি দিয়ে কেউ তাকিয়ে আছে। জানতাম এমন বিস্তৃত হাসি নিয়েই কবরে যাবো আমি।
“জিসাস ক্রাইস্ট…”
চোখ বন্ধ করার পর ম্যানুয়েলা কন্সটানজার ছবি ভেসে উঠলো, গোড়ালির দিকে রশির দাগ…
আবারো বইটা পড়া শুরু করলো।
…কালো চুলগুলোতে এক ফোঁটা রক্ত লেগে নেই, যেন খুনি তা শ্যাম্পু দিয়ে পরিস্কার করে দিয়েছে।
বইটা রেখে দিলো। ছবিগুলো আরেকবার দেখার তাগিদ অনুভব করলো সে।
অধ্যায় ৩১
বুধবার, ৯ই এপ্রিল
“ক্যামিল, এসব গাঁজাখুরি গল্প তুমি অবশ্যই বিশ্বাস করো না, তাই না?”
সকাল নয়টার দিকে কমিশনার লা গুয়েনের অফিসে উপস্থিত হয়েছে ক্যামিল।
লা গুয়েনের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো এমন কী বলেছে যা তার বস হজম করতে পারলো না।
“কিছুটা বিস্ময়কর হলেও সত্যি ব্যাপারটা নিয়ে এভাবে কেউ ভাবেনি। এটা আপনাকে মানতেই হবে।”
ক্যামিলের কথা নীরব তোর মত শুনে গেল লা গুয়েন। পড়া শেষ হলে চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রাখলো। লা গুয়েনের অফিসে এসে সাধারণত দাঁড়িয়ে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে। একবার বসার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু চেয়ারে বসার পর উঠতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তার।
বইটা হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখলো লা গুয়েন। “এর নাম তো কখনো শুনিনি।”
“যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বলি, এটা একটা ক্লাসিক বই।”
“ওহ, আচ্ছা।”
“আপনি পড়ে দেখুন…” বলল ক্যামিল।
“দেখো, ক্যামিল, এমনিতেই পরিস্থিতি বেশ ঘোলাটে। তারমাঝে তুমি যা দেখালে-আমি কী বলবো নিজেই বুঝতে পারছি না।”
“খুনি এই বইয়ের কাহিনী চিত্রায়ন করেছে। জিজ্ঞেস করবেন না কেন করেছে, কেননা আমি তা জানি না। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আমি বেশ কয়েকবার পড়েছি। প্রথমবার তদন্তের সময় যে ছোট ছোট বিষয়গুলো গুরুত্বহীন মনে হয়েছে তার সবকিছুই আছে এখানে। কোমর থেকে ভিক্টিমের শরীর দুইভাগ করা ছিলো। সিগারেটের পোড়া ক্ষত, গোড়ালিতে রশির দাগের কথা নাই বা বললাম। তখন কেউই বুঝতে পারেনি খুনি কেন ভিক্টিমের চুল পরিস্কার করেছিলো, কিন্তু এখন তা সুস্পষ্ট। অটোপসি রিপোর্ট আবার পড়ে দেখুন। লিভার, স্টমাক গল-ব্লাডার কেন ছিলো না, তার উত্তর কেউ দিতে পারেনি। কিন্তু আমি জানি কেন পাওয়া যায়নি। কারণ এই বইতে এভাবেই বর্ণনা করা আছে। শুধু এগুলোই নয় প্রতিটা খুঁটিনাটি বিষয় এই বইয়ের মত করেই করা হয়েছে।”
মাঝে মাঝে ক্যামিলের দিকে একটু অন্য ভঙ্গিতে তাকায় লা গুয়েন। তার বুদ্ধিমত্তায় বেশ মুগ্ধ সে। “তুমি কি পুরো ব্যাপারটা দেশমের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবে?”
“আমি? না…না…আপনিই বলুন।”
অসহায় দৃষ্টিতে ক্যামিলের দিকে তাকিয়ে রইলো লা গুয়েন।
“তোমার তাই মনে হয়?” ডেস্কে রাখা ব্রিফকেস থেকে কিছু একটা বের করলো।
“এই জগাখিচুড়ি অবস্থার পর আমি তার কাছে যাবো?” পত্রিকার খবর দেখিয়ে বলল ক্যামিলকে।
খবরটা পড়ার সাথে সাথেই তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত চলতে শুরু করলো, হাত পা কেমন যেন অবশ হয়ে এলো।
অধ্যায় ৩২
লা মাটিনের পেছনের পেজের পুরোটা জুড়ে একটা ছবি।
উপর থেকে নেয়া ক্যামিলের ছবি। একটু অস্বস্থিকর অবস্থায় উপরের দিকে তাকিয়ে আছে সে। সম্ভবত সাংবাদিক সম্মেলনের সময় ভোলা হয়েছে। ছবিটা ফটোপশ দিয়ে এডিট করা। তার মুখটা স্বাভাবিকের চেয়ে বড় দেখাচ্ছে।
ছবির নিচে বড় ফন্টে লেখা হেডলাইন :
আগুন নিয়ে খেলা
কবেভুয়ার নারকীয় হত্যাকাণ্ডের রহস্য নতুন মোড় নিয়েছে। তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট দেশমের সাথে কথা বলে জানা গেছে রাবার স্ট্যাম্প দিয়ে করা নকল আঙুলের ছাপ পুরনো আরেক কেসের সাথে মিলে গেছে। ২০০১ সালের ২১শে নভেম্বর ট্রেম্বলেতে ঘটা ওই হত্যাকাণ্ড কুভেয়ার চেয়ে কোন অংশে কম নশংস নয়।
তবে কম্যান্ড্যান্ট ভেরহেভেনের জন্য এটা সুসংবাদই বটে। এই কেসের প্রধান অফিসার হিসেবে নিজের দক্ষতা প্রমাণের আরেকটা সুবর্ণ সুযোগ তার সামনে। নিজের নাম উজ্জ্বল করার এই সুযোগ কে হারাতে চাইবে!!
‘কথা কম কাজ বেশি নীতিতে বিশ্বাসী ক্যামিল ভেরহোভেন। মাঝে মাঝে সাংবাদিকদের মনঃক্ষুণ্ণ করলেও নিজের অবস্থান থেকে এক চুলও নড়ে না। এসব বিষয় তার কাছে তুচ্ছ, যার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে নিজের সুনাম বজায় রাখা। নিজস্ব নিয়মনীতি আর আদর্শ আছে তার, যা তার অন্য কোন সহকর্মীদের মাঝে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অবশ্য তার মতো এমন অসাধারণ মানুষের রোল মডেলও অসাধারণ কেউই হবে-শার্লক হোমস, জুল ম্যাগ্রিট, স্যাম স্পেড কিংবা রুলেটবিল। সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রথমজনের মত বুদ্ধির খেলা খেলতে পছন্দ করে, দ্বিতীয়জুনের মত জেদী, তৃতীয়জনের মত ভবঘুরে স্বভাব তার, আর গ্যাস্তো লিরো’র নায়কের সব গুণাবলিই অর্জন করেছে সে। তার বিচক্ষণতা কিংবদন্তীতুল্য, কিন্তু যারা তার সান্নিধ্য পেয়েছে তারা খুব দ্রুতই বুঝতে পেরেছে যে রুপকথার নায়ক হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা লালন করে সে।
তার আকাঙ্ক্ষা কিছুটা আজগুবি হলেও এর ভিত্তি বেশ শক্ত।
মা বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হওয়ার কারণে ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির প্রতি ঝোঁক ছিলো তার। কিন্তু একসময় নিজের সীমাবদ্ধতা অনুভব করতে পেরে আইনশাস্ত্র নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
যদিও তার বাবা আশা করেছিলো ক্যামিল ডাক্তারি পেশায় নিয়োজিত হবে, কিন্তু তরুণ ক্যামিল তার বাবার মনের ইচ্ছা পূরণের কোন প্রয়োজনিয়তা অনুভব করেনি। এসব কিছুর তোয়াক্কা না করে আইনশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে। সে যে অত্যন্ত মেধাবী তাতে কোন দ্বিমত নেই : বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ওকালতি পেশায় অনায়াসে ঢুকে যেতে পারতো। কিন্তু তা না করে যোগ দেয় ক্রিমিনাল ব্রিগেডে।
চিন্তিত ভঙ্গিতে বলেছিল তার বাবা, “তার এ সিদ্ধান্ত আমাকে বেশ অবাক করেছে, কিন্তু ক্যামিল ছোটবেলা থেকেই একটু অননুমেয়।”
সবার ধারণা ভুল প্রমাণ করে সকল বাঁধা অতিক্রম করেছে সে। অপ্রত্যাশিত কিছু করতে পারাতে তার উৎসাহ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তার উচ্চতা দেখে মনে হতে পারে বোর্ডের লোকজন তাকে বিশেষ বিবেচনায় নিয়োগ দিয়েছে, যদিও তা সত্য নয়। কেননা প্রতিটি পরীক্ষাতেই তার অভাবনীয় সাফল্য তাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে সবাইকে। এক অসাধারণ ক্যারিয়ারের জন্য সেখান থেকেই।
ক্রিমিনাল ব্রিগেডে যোগদানের পর কিছু বিপদজনক অভিযান চালানোর সময় তার দক্ষতা লা গুয়েনকে মুগ্ধ করে। একসময় এই ব্রিগেডের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পায়।
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত কেসটির দায়িত্বও তার কাঁধে। কিন্তু পুরো হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে সে একটা শব্দ দ্বারাই ব্যাখ্যা করেছে ‘পাশবিক। এরচেয়ে বেশি কিছু তার মুখ দিয়ে বের হয়নি। আজ থেকে এক মাস পরে আমাদের কম্যান্ড্যান্ট বাবা হতে চলেছেন।
অধ্যায় ৩৩
সাবধানের সাথে পত্রিকাটা ভাঁজ করে রাখলো ক্যামিল। বন্ধুর এমন আচরণে কিছুটা বিচলিত মনে হলো লা গুয়েনকে।
“ওরা যা খুশি লিখে যাক, ক্যামিল, আমার কথা বুঝতে পারছো?”
ক্যামিল কিছুই বলল না।
“তুমি এই সাংবাদিককে চিনো?”
“গতকাল আমাকে জেরা করেছে। আমি এর সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না, তবে আমার সম্পর্কে ভালোই জানে দেখছি…”।
“তোমাকে খুব একটা পছন্দ করে বলে তো মনে হচ্ছে না।”
“এসব আমি.গ্রাহ্যই করি না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে স্নো বল ইফেক্ট-এখন তো সব সাংবাদিক এই খবরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।”
“তাছাড়া দেশমকেও নাখোশ মনে হলো গতকালকে রাতে টিভিতে প্রচারিত খবরের ব্যাপারে। কেস আলোর মুখ দেখতে না দেখতেই তুমি তো খবরের শিরোনাম হয়ে গেলে। আমি জানি এতে তোমার কোন দোষ নেই, কিন্তু এই আর্টিকেল…”
পত্রিকাটা আবারো হাতে নিয়ে দেখলো লা গুয়েন। এমনভাবে ধরে রেখেছে যেন এটা পবিত্র কোন কিছু অথবা কুকুরের পঁচা বিষ্ঠা।
“পুরো এক পৃষ্ঠা জুড়ে লিখেছে! তোমার ছবি সহ কী সব যে লিখেছে,..”
লা গুয়েনের দিকে তাকালো ক্যামিল।
“এখন শুধু একটাই উপায় আছে আমাদের কাছে। ক্যামিল, আশা করি তুমি বুঝতে পারছে। যত দ্রুত সম্ভব এই কেস সমাধান করতে হবে। ট্রেম্বলে কেসের সাথে এর সম্পর্কের কারণে কিছুটা হলেও সাহায্য পাওয়া যাবে।”
“ট্রেম্বলে কেসের ফাইল পড়েছেন আপনি?”
“হ্যাঁ, আমি জানি, সামনে এগুনোর মত তেমন কিছু নেই সেখানে, গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল লা গুয়েন।
“তেমন কিছু নেই? হাসালেন আমাকে। আদতে কিছুই নেই সেখানে। ছোটখাটো যা আছে তা এতোটাই রহস্যময় যে তা নিয়ে কাজ করাও কষ্টকর। আমরা এতোটুকু ধারণ করতে পারি যে দুটো খুনই একজন করেছে, কিন্তু তা নিতান্তই অনুমান। ক্যুবেভুয়ায় নৃশংসভাবে ভিক্টিমকে ধর্ষণ করেছে কিন্তু টেম্বলেতে তেমন কোন লক্ষণই পাওয়া যায়নি-কোন মিল পাচ্ছেন? ক্যুবেভুয়ায় কসাইয়ের ছুরি আর ইলেকট্রিক ড্রিল দিয়ে ভিক্টিমের শরীরের ক্ষত বিক্ষত করেছে, কিন্তু ট্রেম্বলেতে ক্ষুদ্রান্ত পরিস্কার করার ঝামেলা নিয়েছে সে। কোন মিল খুঁজে পেলে দয়া করে আমাকে বলবেন। ক্যুবেভুয়ায়…”
“আচ্ছা, আচ্ছা…” দীর্ঘশ্বাস ফেললো লা গুয়েন। “দুটো কেসের মাঝে সরাসরি কোন মিল নেই, মানে কাজে লাগার মত কিছু নেই, তাই তো?”
“না। সরাসরি নেই।”
“কিন্তু তার মানে তো এই না যে বই নিয়ে তুমি যে থিয়োরি দিয়েছো…” বইটা উলটে নাম দেখে নিলো লা গুয়েন। “দ্যা ব্ল্যাক ডালিয়া।”
“আপনার কাছে এরচেয়ে ভালো থিয়োরি আছে, তাই না?” বলল ক্যামিল। “বলুন, আমি শুনছি,” জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা নোটবুক বের করলো সে। “যদি কিছু মনে না করেন তাহলে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো লিখে নিবো আমি।”
“এতো উত্তেজিত হবার কিছু নেই, ক্যামিল।”
কিছু সময়ের জন্য দুজনেই যেন বোবা হয়ে গেলো। লা গুয়েন বইয়ের প্রচ্ছদের দিকে তাকিয়ে আছে আর ক্যামিল তার কপালের দিকে।
“দেখো,” ক্যামিলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল সে। “আমার কাছে এরচেয়ে ভাল কোন থিয়োরি নেই ঠিকই, কিন্তু তাই বলে তোমারটাই যে সঠিক তা কিন্তু না। তুমি বইয়ের কাহিনীর সাথে মিল খুঁজে পেয়েছে। তাতে কী? সষ্টির শুরু থেকেই পুরুষ নারীকে হত্যা করছে। তুমি তা অস্বীকার করতে পারবে না…যাই হোক অনেক সাধনার পরে দুই কেসের মাঝে মিল খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছ তুমি। এর জন্য তো আর লাইব্রেরি অবধি যাওয়ার দরকার পড়ে না।”
একে অপরের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
“এতোটুকু যথেষ্ট নয়, ক্যামিল। যত রকমের সাহায্য লাগে আমি করবো। কিন্তু আমি তোমাকে আগেই সতর্ক করে দিচ্ছি দেশমের সামনে এই নিয়ে টিকতে পারবে না।”
অধ্যায় ৩৪
“জেমস এলরয়। যদিওবা এই বিষয় কিছুটা অপ্রত্যাশিত।”
“আর কিছুই বলার নেই তোমার?”
“না। না,” প্রতিবাদের স্বরে বলল লুইস, “আমিও আপনার সাথে একমত, কিন্তু…”
“…বেমানান? হ্যাঁ, আমি জানি, কেননা লা গুয়েন এমনটাই বলেছিলো। শুধু তাই না, সৃষ্টির শুরু থেকে পুরুষ যে নারীকে হত্যা করে আসছে এমন অসাধারণ গল্পও শুনিয়েছে। তাতে আমার কিছুই আসে যায় না।”
এরইমাঝে পকেটে হাত ঢুকানো অবস্থায় দরজার সামনে হাজির হলো ম্যালেভাল। তার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে ঘুমের রেশ পুরোপুরি কাটেনি। গভীর মনোযোগ দিয়ে জুতার দিকে তাকিয়ে আছে আরম্যান্ড। পাতলা লিলেনের জ্যাকেট, ক্রিম কালারের শার্ট আর টাই পড়া অবস্থায় উপস্থিত লুইস। ক্যামিলের আদেশ মেনে কেস সংক্রান্ত কিছু কাগজ পড়ছে।
লুইসের পড়ার ভঙ্গিমা কমিশনারের থেকে কিছুটা ভিন্ন। তার আচার আচরণ ক্যামিলকে কোন এক পেইন্টিংয়ের কথা মনে করিয়ে দিলো।
“কী কারণে আপনার ‘দ্য ব্ল্যাক ডালিয়ার কথা মনে হলো?”
“বলাটা মুশকিল।”
“আপনার মনে হয় যে ট্রেলে হত্যাকাণ্ড ওই বইয়ের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য করা হয়েছে?
“সম্মান? তুমি যা বললে…খুনি মেয়েটার শরীরকে দুইভাগ করেছে, চুল শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে দিয়েছে এরপর লাশটা আবর্জনার মাঝে ছুঁড়ে ফেলেছে! এই যদি হয় সম্মানের নমুনা, তাহলে আমি কখনোই চাইবো না এই খুনি নিজেই লেখা শুরু করুক।”
“না, তা না। আমি আসলে বলতে চাইছিলাম যে…” কথাটা শেষ করলো না লুইস। পুরো রুম জুড়ে অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো।
ক্যামিলের হুট করে মনে হলো ক্ষতি যা হবার তা হয়েই গেছে। এরইমাঝে লা মার্টিনে প্রকাশিত খবরমন্ত্রী থেকে শুরু করে তার অফিসের বস, সহকর্মী সবার কানে চলে গেছে। গুজব বাতাসের আগে ছড়ায়, অনেকটা ক্যান্সারের কোষের মত। তার সহকর্মীরা কী ভাবছে? তাদের নীরবতা মোটেও শুভ লক্ষণ নয়। যদি তার কষ্ট বাকিদেরকে স্পর্শ করতে তাহলে তারা অবশ্যই সমবেদনা জানাতে ছুটে আসততা। পুরো দুনিয়াটাই যেন তাকে ছেড়ে চলে গেছে, রয়ে গেছে শুধু বিষণ্ণতা আর হতাশার জাল।
“এটা হতে পারে,” উত্তেজিত কণ্ঠে বলল ম্যালেভাল।
“মানে কী? আমি বলতে চাইছি ক্যুবেভুয়ায় আমরা যা পেয়েছি তার সাথে এর কী সম্পর্ক?” জিজ্ঞেস করলো আরম্যান্ড।
“আমার কোন ধারণা নেই, আরম্যান্ড! আমি শুধু এইটুকুই জানি আঠারো মাসের এক পুরনো কেসের সাথে এই বইয়ের প্রতিটি ঘটনা মিলে যায়।”
“তুমি একদম ঠিক বলেছো,” ক্যামিল বলল।
“তাহলে, আমরা এখন কী করবো?” জিজ্ঞেস করলো ম্যালেভাল।
“একজন নারীর মতামত জানতে হবে।”
অধ্যায় ৩৫
“মানতেই হবে, বিষয়টা বেশ চমকপ্রদ…”
অবাক করার মত ব্যাপার হলো ক্যামিল ফোন দেয়ার পর জাজ দেশমের কণ্ঠে সন্দেহের সুর আশা করছিলো, কিন্তু তা পায়নি। সে এমনভাবে ক্যামিলের কথায় সম্মতি জানালো যেন তার মনেও একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিলো।
“যদি তোমার কথা ঠিক হয়, তাহলে ক্যুবেভুয়ার হত্যাকাণ্ডের বর্ণনাও এলরয়ের বইয়ে কিংবা অন্য কোন বইয়ে থাকা উচিত। এটা দেখা দরকার…”
“তার আর দরকার হবে না,” বলল ক্যামিল। এরয়ের বই সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। ১৯৪৭ সালের দিকে বেটি শর্ট নামে এক তরুণী একই পদ্ধতিতে খুন হয়েছিলো আর বইটা এর উপর ভিত্তি করেই লেখা। ১৯৫৮ সালে তার মা খুন হয় আর বইটা তাকেই উৎসর্গ করে সে…অনেক কিছুই থাকতে পারে এই খুনের পেছনে…”
“ঠিক আছে, কেস অন্য দিকেও মোড় নিতে পারে।”
চিন্তা করার জন্য কিছুটা সময় নিলো জাজ দেশম।
“শোনো, আমার মনে হয় না ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টাকে খুব একটা গুরুত্ব দেবে। আমি এটাও মানি যে তোমার পাওয়া সূত্র একদম ফেলে দেবার মত নয়। একগুঁয়ে গোয়েন্দারা মিলে পুরো ক্রিমিনাল ব্রিগেডের অফিসকে লাইব্রেরি বানিয়ে ফেলবে, এটা আমি মেনে নিতে পারবো না।”
“তা তো অবশ্যই,” সম্মতি জানালো ক্যামিল। আসলে এই মুহূর্তে এছাড়া অন্য কোন জবাব তার মাথায়ও আসেনি।
জাজ দেশম আদতে একজন ভাল মানুষ। তার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হলো এই বিষয়ে আর কোন পরামর্শ দিতে না পারায় কিছুটা কষ্ট পেয়েছে সে।
“দেখো, যদি তুমি এই থিয়োরির স্বপক্ষে আরো প্রমাণ জোগাড় করতে পারো তাহলে আমি তোমার বিষয়টা ভেবে দেখবো, কিন্তু আপাতত গতানুগতিক ভাবে এগুলেই খুশি হবো, বুঝতে পারলে?”
“হ্যাঁ, পেরেছি।”
“এটা তোমাকে মানতেই হবে যে…এখন প্রেক্ষাপট কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। যদি কেসটা শুধু আমার আর তোমার মাঝে থাকতো তাহলে তোমার এই থিয়োরি মেনে অনায়াসে তদন্ত চালানো যেত, কিন্তু আমরা তো আর একা নই…”।
ক্যামিল-মনে মনে এটাই ভাবছিলো। আরো একবার আঘাতের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলো না। আজ তার পাশে কেউ নেই। তার থিয়োরিকে কেউ এতটুকুও মূল্যায়ন করছে না। লা মাটিনের লেখা এখনো তার চোখে ভাসছে, কানের কাছে কেউ যেন চিৎকার করে পড়ছে প্রতিটি লাইন। কেউ একজন তার ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলিয়েছে, তার স্ত্রী, আত্মীয়স্বজনের সাথে কথা বলেছে। নিজের ছোটবেলার কথা, মায়ের কথা সবকিছুই উঠে এসেছে ওই রিপোের্ট।
সকাল সাড়ে এগারোটার দিকে লুইস ফোন করলো তাকে।
“কোথায় তুমি?” বিরক্তি সহকারে জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।
“চ্যাপেলের এদিকে আছি।”
“ওখানে কী করছো?”
“সেফারিনির সাথে দেখা করতে এসেছি।”
গুস্তাভ সেফারিনিকে বেশ ভালোমতোই চেনে ক্যামিল। একটা পরামর্শ প্রতিষ্ঠান চালায়। যার মূল কাজ টাকার বিনিময়ে অপরাধীকে বিভিন্ন ধরণের সাহায্য করা। টার্গেটকে হত্যা করার জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজে বের করায় তার জুড়ি মেলা ভার। বিশ বছর এমন ব্যবসা চালানোর পরেও পুলিশ রেকর্ডে তার নাম নেই বললেই চলে।
“যদি আপনার সময় থাকে তাহলে এদিকে আসলে ভাল হতো।”
“খুব জরুরি কোন কিছু?” এই বলে ঘড়ির দিকে তাকালো ক্যামিল।
“হ্যাঁ, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে হয় না এতে খুব বেশি সময় লাগবে।”
অধ্যায় ৩৬
রাস্তার পাশেই একটা ছোট ঘরে থাকতো সেফারিনি। সামনে দিয়ে চলে গেছে আট লেনের সুবিশাল রাস্তা। ক্রমাগত যানবাহনের শব্দ আর ধূলোবালিতে সামনের বাগানের অবস্থা ভয়াবহ। বাড়ির অবস্থা আর সামনে পড়ে থাকা পুরনো মডেলের জরাজীর্ণ গাড়ি দেখেই যে কারো মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে তার এতো টাকা যায় কোথায়।
ক্যামিল এমনভাবে ঢুকে পড়লো যেন বাড়িটা তার নিজের।
ফ্যাকাশে বর্ণের টেবিল ক্লথ মোড়ানো টেবিলের পাশে লুইস আর অন্যান্য সহকর্মীকে দেখতে পেলো। তাকে দেখে সেফারিনি মোটেও খুশি হলো না। এদিকে কফির মগ হাতে নিয়ে বসে আছে লুইস, খাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেলো না তার মাঝে।
“তো, কী অবস্থা?” এই বলে একটা চেয়ার টেনে বসলো ক্যামিল।
“গুস্তাভকে আমি যমেওনটা বলছিলাম,” এই বলে সেফারিনির দিকে তাকালো লুইস, “উনার মেয়ে অ্যাডেলের ব্যাপারে।”
“ওহ, হ্যাঁ। তা আপনার মেয়ে কোথায়?” জিজ্ঞেস করলো ক্যামিল।
প্রথম তলার দিকে আঙুল তাক করলো সেফারিনি, এরপরই চোখ নামিয়ে নিলো।
“আমি উনাকে অ্যাডেল সম্পর্কিত গুজবের ব্যাপারে বলছিলাম,” বলল লুইস।
“উঁহু, একটু চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকালো ক্যামিল।
“আসলে…গুজব খুবই ভয়াবহ জিনিস। অ্যাডেলের ব্যাপারে আমার চিন্তার কারণটাই গুস্তাভকে বললাম। বিষয়টা নিয়ে আমি বেশ চিন্তিত। অসংযত ব্যবহার, অজাচার…যদিও এসব গুজবো সপক্ষে শক্ত কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এরইমাঝে ক্যামিলকে চোখের ইশারায় কিছু একটা ইঙ্গিত দিলো লুইস।
“অবশ্যই না…” এই বলে সম্মতির আশায় লুইসের দিকে তাকালো ক্যামিল।
“কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি আর না করি, সমাজের মুখ তো আর থামানো যাবে না। যাই হোক, আমরা গুস্তাভকে চিনি, সে অবশ্যই একজন ভাল বাবা, কিন্তু তাদের কী কুব্রার আছে? তাদের কাছে তোত চিঠি আছে।”
“এমন চিঠি যা একজনের জীবন দুর্বিষহ করে তোলার জন্য যথেষ্ট।”
“সেটা তো আপনারাই করছেন,” চিৎকার করে বলল সেফারিনি।
“এখন কিন্তু সীমা অতিক্রম করছেন গুস্তাভ। কথাবার্তা আরো সংযত করুন, হাজার হলেও আপনি একজন পিতা,” বলল ক্যামিল।
“তো, যাই হোক, আমি এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। হুট করেই মনে হলো গুস্তাভের সাথে দেখা করে যাই। চা খাওয়া হবে, এরমাঝে কথাও বলা যাবে। অ্যাডেলকে বিশেষ যত্নে রাখতে হবে, আমি তাকে এটাই বুঝানোর চেষ্টা করছিলাম। মানে আমি বলতে চাইছি যে এটা তো তেমন কোন সমস্যা না, মাস দুয়েকের ব্যাপার। যদিও আমি নিশ্চিত না এবার তারা ক্রিস্টমাস একসাথে উদযাপন করতে পারবে কী না…”
ক্যামিলকে যেন কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নিলো।
“এ কী গুস্তাভ! কমান্ড্যান্ট ভেরহোভেনকে সব খুলে বলুন। আমি নিশ্চিত উনি কিছু না কিছু করতে পারবে অ্যাডেলের জন্য-তাই না, বস?”।
“হ্যাঁ, সেটাই। কোন একটা ব্যবস্থা করা যাবে আশা করি, মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো ক্যামিল।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে গুস্তাভ।
“বলে ফেলো গুস্তাভ, সেই মোটা পাছার অধিকারী ল্যাম্বার্টের কথা…”
তুলুজের শপিং মলে ঘটে যাওয়া সেই কাহিনীর পুরোটা বলল সেফারিনি। কাকতালিয়ভাবে ওই একইদিনে ম্যানুয়েলা কন্সটানজা খুন হয়। হাজার হলেও সে একমাত্র লোক যে নিরাপত্তা ব্যবস্থার ফাঁকফোকর খুঁজে বের করে তার পরিকল্পনা সাজিয়েছে।
“এসব তথ্য দিয়ে আমি কী করবো?” জিজ্ঞেস করল ক্যামিল।
“কারণ ল্যাম্বার্ট সেখানে ছিলো না।”
“তাহলে নিশ্চয় এমন কোন শক্ত মোটিভ আছে যার কারণে অপরাধী হয়েও অপরাধ স্বীকার করেছে সে।”
গাড়িতে উঠার সময় লুইসের ফোন বেজে উঠলো।
“ম্যালেভালের কল ছিলো। ল্যাম্বার্ট প্যারোলে মুক্তি পেয়েছে দুই সপ্তাহ আগে।”
“আমাদের খুব দ্রুত যেতে হবে। খুবই দ্রুত।”
“আমি দেখছি বিষয়টা,” ফোনে নাম্বার ডায়াল করতে করতে বলল লুইস।
অধ্যায় ৩৭
ডেলাগি রোডের মোলো নাম্বার বাড়ি, কোন লিফট নেই এতে।
সিঁড়িতে মোম পালিশের গন্ধ। ক্যামিলের বাবা পুরোটা জীবন কাটিয়েছে ফার্মেসিতে যেখানে ঔষধের গন্ধ আর তার মায়ের শরীরে ছিলো তাৰ্পিন আর তিসির তেলের ঘ্রাণ। এই গন্ধ দিয়েই বাবা মাকে আলাদা করতো সে।
চিন্তিতবোধ করলো ক্যামিল। বাবাকে কী বলার আছে? কিছু বলবে নাকি নিজের মত চলতে দেবে এই নিয়ে দ্বিধায় ভুগলো।
মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবা অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে নিরিবিলি এক জায়গায় বাসা নিয়েছে। একাকী নিঃসঙ্গ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। দরজা খুলে দেয়ার পর দুজনে বিব্রতকর অবস্থায় কোলাকুলি করলো। এই অস্বস্তির কারণ বাবা এখনো তার সন্তানের চেয়ে লম্বা।
“তারপর, কেমন আছো তুমি?” জিজ্ঞেস করলো তার বাবা।
“এইতো চলছে। আপনি কেমন আছেন?”
ঘরে ঢোকার সময়েই ক্যামিল খেয়াল করেছে টেবিলের উপরে লা মাটিনের একটা কপি পড়ে আছে।
“পত্রিকার ওই সংবাদের ব্যাপারে…আসলে আমি বলে বোঝাতে পারবো না আমি কতটুকু দুঃখিত…”
“এটা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।”
“সাংবাদিক হুট করেই চলে এসেছিলো। আমি তোমাকে কল দেয়ার চেষ্টা করেছি।”
“আমি জানি বাবা। এটা নিয়ে এতো ভাবতে হবে না।”
“…কিন্তু তোমার ফোনে কল ঢুকছিলো না। তার কথাবার্তা শুনে মনে হলো তোমাকে বেশ পছন্দ করে, তাই আমার কোন সন্দেহ হয়নি। আমি ওই পত্রিকার সম্পাদকের কাছে উপযুক্ত জবাব জানতে চেয়ে চিঠি দিবো!”
“বোকার মত কাজ করো না, বাবা। ওখানে ভুল কিছুই লেখেনি। হিতে বিপরীত হতে পারে। বাদ দাও এই ব্যাপারটা।”
“তুমি এমনিতেই যা ক্ষতি করার করে ফেলেছে,” এই কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলো সে। কিন্তু তার বাবা যেন এমন উত্তরই আসা করে বসে ছিলো।
“আমি খুবই দুঃখিত…তোমাকে নতুন ঝামেলায় জড়ানোর জন্য, বিড়বিড় করে বলল তার বাবা।
“তোমার নাতির সাথে দেখা করতে কবে যাচ্ছো?” প্রসঙ্গ বদলে পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করলো সে।
“আমাকে নিয়েই ছাড়বে দেখা যাচ্ছে …”
“তোমার নাতির টানে ছুটে আসতেই হবে।”
“কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো তোমার মেয়েই হবে। হয়তোবা অনেকদিন নারী সঙ্গ থেকে দূরে থাকার কারণেই এমনটা মনে হচ্ছিলো।”
ক্যামিলের মনে ক্ষীণ সন্দেহ তার মায়ের মৃত্যুর পরে অন্য কোন নারী তার বাবার জীবনে প্রবেশ করেছে। প্রায়ই সে কয়েকদিনের জন্য গায়েব হয়ে যায়। তখন থেকেই তার মনে এমন সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে।
“নাম কী রাখবে ঠিক করেছো?” জিজ্ঞেস করলো তার বাবা।
“এখনও ঠিক করিনি। আইরিন আর আমি এখনো দ্বিধায় ভুগছি।”
“পিসারোর সাথে মিলিয়ে তোমার নাম রেখেছিলো তোমার মা। এই নামটা তার খুব পছন্দের ছিলো।”
“হ্যাঁ, আমি জানি।”
“এই বিষয় নিয়ে আমরা পরে কথা বলবো, আগে বলো আইরিন কেমন আছে?”
“বাসায় একা থাকতে বিরক্তবোধ করে।”
“এই সময়ে এমনটা হয়…কিন্তু আমার তো ওকে বেশ ক্লান্ত মনে হলো।”
“কবে দেখা হলো তোমার সাথে?”
“গত সপ্তাহে এসেছিলো। আমি খুবই লজ্জিত ওর কাছে। এমন অবস্থায় আমারই দেখতে যাওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু তুমি তো জানোই আমি একটু ঘরকুনো স্বভাবের। কোন কিছু না জানিয়ে হুট করে এসেছিলো ওইদিন।”
“কফম্যান…তোমার কফম্যানের কথা মনে আছে?” জিজ্ঞেস করলো তার বাবা।
“ভাল মতই মনে আছে।”
“কয়েক সপ্তাহ আগে দেখা করতে এসেছিলো আমার সাথে।”
“তাহলে তো অনেকদিন পরে দেখা হলো।”
“হ্যাঁ, তোমার মা মারা যাওয়ার পর এক দুইবার দেখা হয়েছিলো।”
অস্পষ্ট কিছু স্মৃতি মনে পড়লো ক্যামিলের। মায়ের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং একইসাথে তার প্রিয় চিত্রশিল্পী সে।
“কেন এসেছিলো?”
“দেখো, ক্যামিল, যদি সম্ভব হতো তাহলে এই বিষয়টা আমি উল্লেখ করতাম না। কিন্তু কফম্যানই আমাকে বলেছে তোমার সাথে এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে।”
“আমি শুনছি।”
“আমি হলে না করতাম, কিন্তু পুরো সিদ্ধান্ত আমার হাতে …কফম্যান স্টুডিও ছেড়ে দিচ্ছে। জায়গাটা নাকি ওর জন্য খুব ছোট হয়ে যাচ্ছে-এখন বড় ক্যানভাস নিয়ে কাজ করছে সে।”
“আর…”
“আরো জিজ্ঞেস করলো তোমার মায়ের স্টুডিও বিক্রি করার পরিকল্পনা আছে কিনা।”
ক্যামিল জানতো এমন দিন আসবেই, কিন্তু তা যে এতো দ্রুত আসবে ভাবতে পারেনি।
“আমি জানি তুমি কী বলবে…”
“না, তুমি জানো না,” বাবাকে থামিয়ে দিলো সে।
“আচ্ছা, মানলাম আমি জানি না। কিন্তু অনুমান করতে পারছি। আমি কফম্যানকে বলে দিয়েছি তুমি কখনোই রাজি হবে না।”
“কিন্তু ব্যাপারটা তো সামনে চলেই এসেছে…”
“তোমাকে বলছি কেননা আমি কফম্যানকে কথা দিয়েছি আমি ওর প্রস্তাবে রাজি। তাছাড়া আরো কিছু বিষয় আছে…”
“কী বিষয়?”
“কফম্যান বেশ ভাল দাম বলেছে। সামনে নতুন অতিথি আসছে তোমার ঘরে, তুমিও চাইবে আরেকটু ভাল জায়গায় থাকতে, তাই না…”
নিজের প্রতিক্রিয়ায় নিজেই বিস্মিত হয়ে গেলো ক্যামিল।
“আমি ভেবে দেখবো।”
“যেটা তোমার ভাল লাগে। কেননা শেষমেশ টাকাটা তোমার কাছেই যাবে। তোমার ছেলের জন্যই কাজে লাগবে।”
এরইমাঝে ক্যামিলের ফোনে একটা টেক্সট এলো। লুইস পাঠিয়েছে।–ল্যাম্বার্ট ওর আস্তানায় নেই।
“আমার যেতে হবে,” এই বলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো ক্যামিল।
তার বাবা মুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে যেটা সবসময়ই করে ক্যামিল যাওয়ার সময়। ক্যামিল এই দৃষ্টিতে অভ্যস্ত। তাই তাকে খুব স্বাভাবিক দেখা গেলো।
“সাংবাদিকের সাথে ওই…”
“বাদ দাও বাবা।”
দুজনে আবারো অস্বস্তিকর অবস্থায় কোলাকুলি করে বিদায় নিলো। রাস্তায় নেমে একবার উপরের দিকে তাকালো ক্যামিল। প্রত্যাশা মত তার বাবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে। মাঝে মাঝেই তার মনে হয় এই বুঝি বাবার সাথে শেষ দেখা।
অধ্যায় ৩৮
লুইসকে ফোন করলো ক্যামিল।
“ল্যাম্বার্ট সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য পেয়েছি। প্যারোলে মুক্তি পেয়েই সোজা বাড়ির পথ ধরে। তার সহকারীদের সাথে কথা বলে বোঝা গেলো বেশ ভাল মেজাজেই আছে। মাদক ব্যবসার এক সহকারীর সাথে কথা বলে জানা গেছে মঙ্গলবার ব্যবসায়িক কাজে কোথাও যাওয়ার কথা তার।
ড্যানিয়েল রয়েট নামে একজন থাকবে তার সাথে। তাকে খুঁজে বের করতে পারিনি। এরপর আর কিছুই জানা যায়নি। তবে ল্যাম্বার্টের বাড়ির আশেপাশে সার্বক্ষণিক নজরদারি চলছে।”
“গুস্তাভ বেশ চতুরতার সাথে নিজের গা বাঁচিয়ে চলছে। আমাদের হাতে দুইদিন সময় আছে। এরইমাঝে কিছু একটা করতে হবে। এরপর আর ল্যাম্বার্টকে খুঁজে পাওয়া যাবে না…”
দুই দলে ভাগ হয়ে গেলো ক্রিমিনাল ব্রিগেডের পুরো টিম। এক দলের কাজ হলো ল্যাম্বার্টের বাড়ির সামনে পাহাড়া দেয়া, আরেকদল পুরো শহর তন্নতন্ন করে খুঁজবে।
অধ্যায় ৩৯
টেবিলের উপর বইয়ের স্তূপ জমা হয়েছে; ব্রাউনের রেকুয়েম, ক্ল্যান্ডেস্টাইন, কিলার অন দ্য রোড, সুইসাইড হিল, ডিক কন্টিনোর বুজ। আরেক সারিতে দ্য ব্ল্যাক ডালিয়া, দ্য বিগ নোহোয়ার, এল.এ. কনফিডেন্সিয়াল, হোয়াইট জাজ আর সবশেষে আমেরিকান ট্যাবলয়েড।
‘হোয়াইট জাজ’ বইটা তুলে নিলো সে। প্রচ্ছদে থাকা নারীর প্রতিকৃতি অনেকটা দ্য ব্ল্যাক ডালিয়ার প্রচ্ছদের মত। পার্থক্য বলতে এই নারীর মুখ কিছুটা গোলাকার, চুলগুলো বেশ বড় আর একটু ভারি মেকআপের ছোঁয়া
স্পষ্ট। দ্য ব্ল্যাক ডালিয়ার প্রচ্ছদশিল্পী যেখানে স্বতঃস্ফূর্ততার দিকে নজর রেখেছে, হোয়াইট জাজের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। ভিক্টিম তিনজন দেখতে কেমন তা নিয়ে এর আগে মাথা ঘামায়নি ক্যামিল। যদিও ক্যুবেভুয়ার এভলিন রুভ্রে, জোসাইন ডেবেফ আর ট্রেম্বলের ম্যানুয়েলা কন্সটানজার মাঝে কী মিল আছে তা খুঁজে বের করা তার জন্য কষ্টকর কিছু নয়।
“এটা বেশ কষ্টসাধ্য কাজ…”
“কষ্টসাধ্য?…” মাঝে মাঝে লুইসের কথার মানে খুঁজে পায় না সে।
“ওপাশের স্তূপ তোমার আর এই পাশেরটা আমার।”
“বিশাল একটা অ্যাপার্টমেন্ট, দুজন নারী নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও খুনের শিকার হয়েছে, এমন একটা দৃশ্যের খোঁজে আছি আমরা।”
আগের বইগুলোর মাঝে কেমন যেন একটা চিরন্তন আবেদন রয়েছে। শখের গোয়েন্দা, যার টেবিলে অপরিশোধিত বিলের স্তূপ জমে আছে কিন্তু ভাঙ্গা এক চেয়ারে বসে সে কফিতে চুমুক দিচ্ছে আর ডোনাট চিবুচ্ছে। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত কোন ভয়ংকর খুনির আবির্ভাব ঘটে এবং তাকে ধরার জন্য সবাই উঠেপড়ে লাগে। কিন্তু সবাই ব্যর্থ হওয়ার পর তাদের ত্রাতা হয়ে আগমন করে সেই শখের গোয়েন্দা। প্রায় বইগুলোতেই এমন কাহিনী পাওয়া যায়।
এরইমাঝে দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে এলো। প্রত্যাশিত তথ্য না পেয়ে ক্যামিল কিছুটা হতাশ। তাই হাঁটাহাঁটি করার জন্য বাইরে বেরোনোর সিদ্ধান্ত নিল। যাওয়ার পথে লুইসের রুমের সামনে থামলো। তার উপস্থিতি টের পেয়ে লুইস বইয়ের জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এলো। দৃষ্টি বিনিময় হলো দু’জনার। মুখে কোন কিছু না বললেও লুইস যে কিছু খুঁজে পায়নি তা ঠিকই বুঝে গেলো ক্যামিল।
“যাই হোক, আমার মনে হয় যথেষ্ট হয়েছে,” লুইসকে উদ্দেশ্য করে বলল সে।