অধ্যায় ২০
ডক্টর আজফার বলেননি রোজ রোজ তার বাড়িতে এসে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করতে হবে, তারপরও নিয়মিত ব্রিফিং করার ব্যাপারে নিজে থেকেই এক ধরণের তাড়না অনুভব করে চারু। মায়াও নিশ্চয় একই রকম চিন্তা করে। যদিও এ নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি।
চারু এখন বসে আছে ডক্টরের স্টাডি-কাম-ড্রইংরুমে। মায়া এখনও এসে পৌঁছায়নি। সম্ভবত জ্যামে আটকা পড়েছে। চারু আজ তার বন্ধুর বাইকটা ব্যবহার করেছে বলে জ্যাম থেকে নিস্তার পেয়েছে। সে জানতো, আজ ঢাকায় মারাত্মক জ্যাম হবে। গতকালও জ্যামের মধ্যে পড়তে হয়েছিলো তাকে।
সৌম্যকান্তির ডক্টর অভিজাত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকলেন। যথারীতি আজও পরে আছেন ফিটফাট পোশাক। ডক্টরের প্রিয় রঙ যে সাদী তাতে কোনো সন্দেহ রইলো না চারুর।
“মায়া ফোন দিয়েছিলো একটু আগে,” ঘরে ঢুকেই বললেন আজফার হুসেন। একটা সোফায় বসে পড়লেন তিনি। “জ্যামে আটকা পড়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে। তুমি কি একদফা চা খেয়ে নেবে?”
কাঁধ তুললো চারু। খাওয়া যেতেই পারে।
“গুড।” ডক্টর আর কিছু না বলে নিজের হাসি হাসিমুখটা ধরে রাখলেন কয়েক মুহূর্ত। “কাজ কেমন চলছে?”
“বলতে পারেন, প্রাইমারি স্টেজে আছি।”
“ইন্টারেস্টিং লাগছে তো?”
“হুম। বেশ ইন্টারেস্টিং।”
“আমিও অনেক ভেবেছি এই কেসটা নিয়ে কিন্তু কোনো কিছু বুঝে উঠতে পারিনি,” অকপটে বলে ফেললেন আজফার হুসেন। “ছোটবেলা থেকেই আমি ধাঁধা, পাজল, এসব ভালো পারি না। আমার আগ্রহ আছে কিন্তু এগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে গেলেই কেমনজানি জট পাকিয়ে যায়।”
চারু কেবল সৌজন্যমূলক হাসি দিলো।
“সবাই সব কিছু পারে না। আমি পছন্দ করি ঘুরতে, দেখতে। রহস্য নিয়ে মাথা ঘামাতে গেলেই তালগোল পাকিয়ে ফেলি। ব্যাপারটা হয়তো অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইবে না।”
“এটা খুব স্বাভাবিক,” আস্তে করে বলল চারু আহসান। “আমাদের যুক্তিবাদি সমিতিতেও এমন অনেক সদস্য আছে যারা এসব নিয়ে খুব আগ্রহি কিন্তু সমাধানের কাজটা করতে পারে না। এর মানে এই নয়, তাদের মেধা নেই।”
মুচকি হাসলেন ডক্টর। “তোমাদের সোসাইটিতে কি তুমি একাই এইসব ইনভেস্টিগেট করো নাকি আরো অনেকে আছে?”
“মূলত আমি-ই করি, তবে আমাকে কয়েকজন সদস্য বেশ ভালোমতো সহযোগিতা করে থাকে।”
“তোমার আগে এ কাজটা কে করতো?”
“জুয়েল আইচ।”
ভুরু কপালে তুললেন ডক্টর। “আমাদের সেই বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ান?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো যুক্তিবাদি সমিতির সাধারণ সম্পাদক।
“ভদ্রলোক এখন আর তোমাদের সাথে নেই?”
“আছেন, তবে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে অলৌকিক ঘটনাগুলো এখন আর তিনি চ্যালেঞ্জ করেন না। উনার ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকে এটা আমি করি।”
“উনার ক্যান্সারের কি অবস্থা?”
“এখন পুরোপুরি সুস্থই বলা যায়। তবে সুস্থ হবার পর উনি এ কাজ বাদ দিয়েছেন। ম্যাজিক শো-ও কমিয়ে দিয়েছেন।”
“হুম…বুঝেছি।”
এমন সময় টোটা চায়ের ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে ঘরে ঢুকলো।
মায়ার অনুপস্থিতিতে টোটা-ই চা পরিবেশনের কাজটা করে যথারীতি ঘর থেকে চলে গেলো চুপচাপ।
“তুমি কি ড্রাইভিং জানো?” চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে জানতে চাইলেন ডক্টর।
“না।”
“আমার গ্যারাজে আরেকটা গাড়ি আছে, ড্রাইভিং জানা থাকলে ওটা ব্যবহার করতে পারতে। আমার আবার একজনই ড্রাইভার, তাই সব সময় ওকে ধার দেয়া সম্ভব হবে না।”
চারু আহসান কিছু না বলে চুপচাপ চায়ে চুমুক দিয়ে গেলো।
ডক্টরও কয়েক মুহূর্ত কিছু বললেন না। তাদের এই সংক্ষিপ্ত নিরবতা ভাঙলো মায়ার আগমনে।
“সরি, প্রচন্ড জ্যামে আটকা পড়েছিলাম,” ঘরে ঢুকেই বলল সে।
“ইটস ওকে,” হেসে বললেন ডক্টর আজফার হুসেন।
চারু কেবল সৌজন্যমূলক হাসি দিলো। মেয়েটা আজ সাধারণ সালোয়ার-কামিজ পরে এসেছে বলে তাকে দেখতে একেবারেই অন্যরকম লাগছে। একে নিশ্চয় শাড়িতে আরো ভালো লাগবে। ভাবনাটা ভাবতেই তার চোখের সামনে দৃশ্যটা ভেসে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে জোর করে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলো নিজেকে।
“আমি ঠিক করেছি, তোমাদের কর্মকাণ্ডগুলো একটি অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে পরিচালিত হলেই বেশি ভালো হয়,” বললেন ডক্টর। “তোমরা দু জনসহ আরো অ্যাসোসিয়েট থাকবে, তাদের প্রত্যেকের কাজ ভাগ করে দেয়া হবে। বাজেট, বেতন-ভাতা, বিভিন্ন ধরণের সুযোগ-সুবিধাসহ যাবতিয় সবকিছু সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত করা হবে।”
“তাহলে তো ভালোই হয়,” বলে উঠলো মায়া। চারু অবশ্য নির্বিকার রইলো।
“তোমাদের কেসস্টাডিগুলোর সমস্ত রেকর্ড সংরক্ষণের জন্য একটি আকাইভ করা হবে। আমার এই বিশাল বাড়িটা খামোখাই পড়ে আছে। এখানে অনেক রুম, ওখান থেকে দু-তিনটাকে অফিস হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।”
“হঠাৎ আপনার এই আইডিয়াটা মাথায় এলো কেন?” চারু জানতে চাইলো।
“বয়স হয়েছে, যেকোনো সময় মরেটরে যেতে পারি,” কথাটা বলেই বিষণ্ণভাবে হাসলেন আজফার হুসেন। “আমি মরে গেলে এই জের কি হবে? আমরা বাঙালিরা ব্যক্তিনির্ভর, প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে জানি না। তৈরি করলেও সেটা টিকিয়ে রাখতে পারি না, আর সেজন্যেই আমাদের কোনো লিগ্যাসিও তৈরি হয় না। সব হারিয়ে যায় এক সময়।
চারু আর মায়া কিছু বলল না।
“একটা অর্গানাইজেশন দাঁড় করাতে না পারলে স্বাভাবিকভাবেই এটাও শেষ হয়ে যাবে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু।
“কিন্তু আমি তা চাই না। আমি চাই আমার মৃত্যুর পরও তোমরা এটা অব্যাহত রাখবে। সেজন্যে একটা ফাউন্ডেশন করার কথা মাথায় এলো।”
“এই ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য কি হবে?” চারু কাজের কথায় চলে এলো দ্রুত।
“এখন যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সেটাই। অলৌকিক আর অতিপ্রাকৃত ঘটনাগুলোর মীমাংসা করা। রহস্যের অতলে ডুব দিয়ে সত্যকে তুলে আনা।”
“সেটা তো আমাদের র্যাশনালিস্ট সোসাইটি অনেকদিন ধরে করে যাচ্ছে, আমি নিজেও এখন এই কাজটা-”
“মাই ডিয়ার চারু, তার কথার মাঝখানে বলে উঠলেন ডক্টর, “তুমি…মানে, তোমরা যেটা করছে সেটা কিন্তু একটা পক্ষ নিয়ে করছে।”
চারুর কপালে হালকা ভাঁজ পড়লো।
“তোমরা ধরেই নিয়েছো, যুক্তি দিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা করা সম্ভব। বিজ্ঞান আর অতিপ্রাকৃত-এ দুয়ের মধ্যে তোমরা বিজ্ঞানের পক্ষে আছে।”
“যে জিনিসের অস্তিত্ব নেই সেটা কি করে পক্ষ হয়?” যুক্তি দিলো চারু। “অতিপ্রাকৃত বলে তো কিছু নেই, ডক্টর।”
স্মিত হেসে মাথা দোলালেন আজফার হুসেন। “তুমি বিশ্বাস করো সাদাকাক নেই। জগতে কেবল কালো কাকই আছে। এটা তোমার বিশ্বাস। এই বিশ্বাস জন্মেছে তোমার অভিজ্ঞতা থেকে। তুমি কখনও শোনোনি সাদাকাকের কথা। দেখোওনি। তাই তুমি ধরে নিয়েছে কামাত্রই কালো, কিন্তু হঠাৎ করে একদিন একটা সাদাকাক দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে তোমার বিশাস বদলে যাবে। তাই নয় কি?”
“সব প্রাণীর মধ্যেই অ্যালবিনো আছে। মানে, সাদারঙের একটি প্রজাতি থাকে…সংখ্যায় খুব কম। বলতে পারেন বিরল। এটা একেবারেই ব্যতিক্রমি ঘটনা।”
প্রসন্নভাবে হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডক্টর। “ঠিক।”
“অ্যালবিনোর ব্যাপারটা কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়,” চারু বলল।
“অবশ্যই যায় কিন্তু আমার কথা সেটা নয়, আমি বলতে চাইছি, যেকোনো বিশ্বাসই খুব নাজুক হয়ে থাকে। খুবই নাজুক। এ জগতে একমাত্র সন্দেহই দৃঢ়ভাবে জেঁকে বসে থাকে সব সময়।”
চারুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। যুক্তিবাদি আর বিজ্ঞানমনস্ক হিসেবে সব কিছুকে সন্দেহ করাটাই তার ধর্ম। সন্দেহ শব্দটা তার জন্য স্বস্তিদায়ক।
“আমি জানি ধর্মে তোমার বিশ্বাস নেই। তোমার বই পড়েই জেনেছি এটা। আমার মনে হয় না, তুমি নিজেও স্বীকার করতে কুণ্ঠিত।”
“হুম। আমি এটা প্রকাশ্যেই বলি।”
স্মিত হাসি দিলেন ডক্টর।
মায়া নির্বিকার রইলো এ কথা শুনে।
“আমি নিজে অবশ্য অজ্ঞেয়বাদী।”
“এখানেও আপনি পেন্ডুলামের মতো দুলছেন?” হালকাচালে বলল চারু।
হেসে ফেললেন ডক্টর। “আলবৎ।”
“কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, দৃঢ়কণ্ঠে বলল মায়া।
কথাটা শুনে চারু অবাক হলো না। “ওটা বিশ্বাস না করলে তো অলৌকিক ব্যাপারগুলো ধোপেই টিকবে না।”
“হুম। একদম ঠিক বলেছেন,” মায়াও তার সাথে একমত পোষণ করে বলল। “আর এটা আপনারা যুক্তিবাদিরাও ভালোমতোই প্রতিষ্ঠিত করেছেন।”
ভুরু কুচকে গেলো চারুর। “আমরা প্রতিষ্ঠিত করেছি!?” মাথা নেড়ে সায় দিলো সাবেক আর.জে। “আপনি একটু পরিস্কার করে বলবেন কি?”
ডক্টর আজফার চুপচাপ তাদের দুজনের কথাবার্তা উপভোগ করতে লাগলেন।
“এ জগতের সৃষ্টি কিভাবে হয়েছে বলে মনে করেন?”
“এটা এখন স্কুলের ছেলেপেলেরাও জানে।”
“হ্যাঁ…তো সেটা বলুন না?”
“বিগ ব্যাং-এর মাধ্যমে।”
“মানে, শূণ্য থেকে হঠাৎ করে একদিন মহাবিশ্বের সৃষ্টি হলো”
মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু।
“শূণ্য থেকে!” মায়ার কণ্ঠে বিস্ময়।
“পদার্থবিজ্ঞান তাই বলে।”
“আর আপনি কি বলেন, মি. চারু আহসান বাঁকাহাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে। “আমিও সেটা বিশ্বাস করি।”
“দারুণ। তাহলে তো আপনি এ বিশ্বের সবচাইতে বড় অতিপ্রাকৃত ঘটনায় বিশ্বাস করেন। সবচেয়ে বড় অলৌকিকতায় বিশ্বাস আপনার!”
“এটা অতিপ্রাকৃত নয়…বিজ্ঞানীরা–”
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো মায়া। “বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যাটা আমি জানি, বলার কোনো দরকার নেই।”
স্থিরচোখে মেয়েটার দিকে চেয়ে রইলো চারু আহসান।
“আমি শুধু বলতে চাচ্ছি, তাদের মহান বৈজ্ঞানিক সত্য কতোটা অলৌকিক, কতোটা অতিপ্রাকৃত, কতোটা অবিশ্বাস্য!” একটু থেমে আবার বলল সে, “এ কথা যদি আমি বাস্তবে প্রয়োগ করি তাহলে আপনি আমাকে পাগল বলবেন। আমি যদি বলি, এই বাড়িটা শূণ্য থেকে হুট করে জন্ম নিয়েছে, আপনি ভাববেন আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি যদি বলি, আমার পকেটে শূণ্য থেকে টাকা চলে আসে, আপনি আমাকে উন্মাদ ছাড়া কিছু ভাববেন?”
“বিষয়টা এরকম না, আপনি পদার্থবিজ্ঞান-”
“আমি ওসব জানি,” আবারো চারুকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিলো মেয়েটি।
ডক্টরকে হাসতে দেখে ভুরু তুলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো চারু।
“তুমি এখনও জানো না, মায়া পদার্থবিজ্ঞান থেকে অনার্স করেছে?” আজফার হুসেন খুব মজা পাচ্ছেন যেন।
চারুকে দেখে মনে হলো বজ্রাহত। অবিশ্বাসে তাকালো মায়ার দিকে।
“এটা কি বলার মতো কিছু?” মায়া বলল।
পদার্থবিজ্ঞানের এক স্নাতককে সে সারফেস টেনশন বুঝিয়েছে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। তা-ও আবার ড্রায়াগ্রাম এঁকে! নিজেকে খুব হাস্যকর লাগলো চারুর। তারচেয়ে বেশি মনে হলো প্রতারিত। মেয়েটা তার সাথে মজা করে গেছে। ভান করেছে কিছু বোঝে না।
“কি হলো?” মায়ার কথায় সম্বিত ফিরে পেলো চারু আহসান। “না… কিছু না।।”
মুচকি হেসে সাবেক রেডিও-জকি বলতে শুরু করলো, “আমি বলতে চাইছি, আপনার যে যুক্তি দাঁড়িয়ে আছে বিজ্ঞানের উপর, সেই বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে শূণ্যের উপরে! এ বিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে তারা এমন এক তত্ত্বের কথা বলছে, যেটা কোনোভাবেই যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে মেলানো যায় না। তারা মহাবিশ্বের সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় অলৌকিক ঘটনার অবতারণা করছে!”
“মনে হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞানেও আপনার আস্থা নেই। আপনার জন্য অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। তাহলে বলুন, আপনি কিভাবে মহাবিশ্বের সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করবেন?”
মায়া হেসে ফেলল। “এক্ষেত্রে আপনার আর আমার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমিও বলবো, এ জগতের সৃষ্টি হয়েছে সবচেয়ে বড় অলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে। অলৌকিক আর অতিপ্রাকৃত শক্তিই সবকিছুর শুরু করেছে। সবকিছুর শেষেও ঐ শক্তির দেখা পাবেন। কেবল মাঝখানে যে ধূসর এলাকা সেখানে আপনি বিচরণ করছেন। সেটাতেই আপনার যতো আস্থা!”
ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো যুক্তিবাদি।
অনেকক্ষণ পর বললেন ডক্টর, “আমার যৌবনে আমি ইনফিনিটি বিষয়টা নিয়ে খুব ভাবনায় পড়ে গেছিলাম। কোনোভাবেই এটা আমার বোধগম্য হয়নি। যদি অসীম বলে কোনো কিছু থেকে থাকে তাহলে তার কি শুরু আছে?” কারো জবাবের অপেক্ষা না করেই আবার বললেন, “এর যদি শুরু থেকে থাকে তাহলে তো অসীম পর্যায়ে পৌঁছাতে অসীম সময় লাগবে! আমরা কি করে তাকে অসীম হিসেবে ডিফাইন করবো? কখন করবো?”
চারু আহসান ভাবনায় পড়ে গেলো কথাটা শুনে।
“আর যদি অসীমের শুরু না থাকে তাহলে কি হবে?” আবারো নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই দিলেন, “শুরু নেই মানে তো ঐ জিনিসটা জন্মায়ইনি! যার জন্ম নেই, শুরু নেই, সেটা কি?”
ঘরে নেমে এলো নিস্তব্ধতা।
“আমি স্বীকার করছি, এই ভাবনাটা আমাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলো। আমি আমার ক্ষুদ্রমস্তিষ্ক দিয়ে এটার কোনো সুরাহা করতে পারিনি। সসীম এবং অসীম দুটোরই অস্তিত্ব আছে। সসীম হলো আমাদের বোধের জগত। যুক্তি দিয়ে যেটা আমরা ডিফাইন করতে পারি, বুঝতে পারি, ব্যাখ্যা করতে পারি। আর অসীম হলো আমাদের বোধবুদ্ধির বাইরে কিছুক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে এটাকে উপলব্ধি করা যায় না। এটা যুক্তি-বুদ্ধির বাইরে অবস্থান করে। সম্ভবত এটাই হলো সেই অতিপ্রাকৃত শক্তি।” ডক্টর চুপ মেরে গেলেন কয়েক মুহূর্তের জন্য।
“আমার মনে হয় সব মানুষই জীবনের কোনো না কোনো সময় এরকম দোদুল্যমনতার শিকার হয়,” আস্তে করে বলল মায়া। “কেউ বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে সমাধান টানে, কেউ বিজ্ঞানের মধ্যে এর জবাব খুঁজে পেতে চায়।”
“আবার কেউ আমার মতো দুলতেই থাকে,” হেসে বললেন ডক্টর। চারুকে চুপ থাকতে দেখে একটু অবাকই হলেন তিনি।
“পুরোপুরি বিজ্ঞানমনস্ক না-হলে এরকমটা হতে পারে,” অবশেষে বলল যুক্তিবাদি।
মায়া কিছু বলতে যাবে কিন্তু তার আগেই ডক্টর বলে উঠলেন, “তাই?”
দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু।
“তাহলে তোমাকে এক নাস্তিক শিক্ষক আর ঈশ্বরে বিশ্বসি এক ছাত্রের গল্প বলি,” ডক্টর বললেন। “বিজ্ঞান কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না সেটা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছিলেন, “আমরা পাঁচটি ইন্দ্রিয় দিয়ে আমাদের চারপাশের জগতকে পরখ করতে পারি, অবজার্ভ করতে পারি। তাহলে তুমি এখন বললো, আমরা কি ঈশ্বরকে দেখতে পাই? ছাত্রের সহজ-সরল জবাব, ‘না, স্যার।’ “ ডক্টর একটু থেমে বললেন, “শিক্ষক এরপর জানতে চাইলেন, তাহলে কি তুমি ঈশ্বরের কথা শুনতে পেয়েছে কখনও? এবারও ছাত্র জবাবে না বলল। সে কখনও ঈশ্বরের কাছ থেকে কোনো কিছু শুনতে পায়নি। শিক্ষক তখন বললেন, তাহলে কি তুমি কখনও তোমার পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অনুভব করতে পেরেছো?’ এবারও ছাত্র জানালো, এরকম কোনো কিছু সে অনুভব করতে পারেনি।”
চারু আর মায়া কিছু না বলে চেয়ে আছে ডক্টরের দিকে।
‘তারপরও তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো?’ প্রশ্ন করলেন শিক্ষক। ছাত্র কোনো রকম দ্বিধা না করেই জবাব দিলো, হ্যাঁ। সে বিশ্বাস করে। ‘গবেষণা, পরীক্ষণযোগ্য এবং ডেমনস্ট্রেশন ছাড়া বিজ্ঞান কোনো কিছুকে মেনে নেয় না। সেদিক থেকে দেখতে গেলে তোমার ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত নয়। এ ব্যাপারে তুমি কি বলবে?’ শিক্ষক জানতে চাইলেন তার ছাত্রের কাছে। ছাত্র আবারো সরাসরি জবাব দিলো, কোনো প্রমাণের ভিত্তিতে নয়, সে কেবলই বিশ্বাস করে ঈশ্বর আছে। শিক্ষক তখন বলে। উঠলেন, “ঠিকই বলেছো। বিশ্বাস। এটাই বিজ্ঞানের সমস্যা। তখন সেই ছাত্র তার শিক্ষককে পাল্টা প্রশ্ন করলো : প্রফেসর, উক্ত বলে কি কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে?’ প্রফেসর বললেন, ‘অবশ্যই আছে।’
“ ‘তাহলে শীতলতাও আছে?’ শিক্ষক গ্রেধারও সায় দিয়ে বললেন, ‘আছে। কিন্তু ছাত্র বলল, “এরকম কিছু আসলে নেই।’ তার এ কথার পর পুরো ক্লাসে পিনপতন নিরবতা নেমে এলো। সে বলতে লাগলো তার শিক্ষকের উদ্দেশ্যে ‘স্যার, আপনি সামান্য থেকে প্রবল উত্তাপ পেতে পারেন, কিংবা উত্তাপহীনতাও পেতে পারেন কিন্তু ঠাণ্ডা বলে কোনো কিছু পাবেন না। আমরা ৪৫৮ থেকে শূন্য ডিগ্রি পর্যন্ত উত্তাপ পেতে পারি, এরচেয়ে বেশি সম্ভব নয়। কিন্তু ঠাণ্ডা বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। এটা আমরা ব্যবহার করি উত্তাপের অনুপস্থিতিকে বোঝানোর জন্য। উত্তাপ একটি শক্তি, ঠাণ্ডা কিন্তু উত্তাপের বিপরীত কিছু নয়। কেবলমাত্র এটার অনুপস্থিতি।” একটু থেমে ডক্টর চারুর দিকে তাকালেন। যুক্তিবাদির মুখ পাথরে খোদাই করা ভাস্কর্যের মতো হয়ে আছে। ডক্টর আবার বলতে লাগলেন, “ ‘অন্ধকার কি জিনিস, স্যার? অন্ধকার বলে কি আদৌ কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে?’ সেই ছাত্র আবার জিজ্ঞেস করলো।
“শিক্ষক জবাব দিলেন, অবশ্যই আছে। যদি না থাকে তাহলে রাত বলে কোনো কিছু থাকতো না। ছাত্র জোর দিয়ে বলল, “স্যার, আপনি আবারও ভুল বলছেন। অন্ধকার হলো আলোর অনুপস্থিতি। আলো বলে একটা শক্তি আছে কিন্তু অন্ধকার কোনো শক্তি নয়, এটা কেবলই আলো নামের একটি শক্তির অনুপস্থিতি।
“শিক্ষক এবার রেগেই গেলেন। তিনি জানতে চাইলেন তার ছাত্র আসলে কি বলতে চাচ্ছে। ছাত্র বলল, “স্যার আমি কেবল আপনার দর্শনের ভুলটা ধরিয়ে দিতে চাইছি।’ এ কথা শুনে শিক্ষক নিজের রাগ দমন করে জানতে চাইলেন, সে যেন পুরো বিষয়টা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয়। ছাত্র বলল, ‘স্যার, আপনি বলতে চাইছেন জীবন আছে যেহেতু মৃত্যুও আছে। আপনি ঈশ্বরকে সসীম সত্তা হিসেবে ভাবছেন। এমন কিছু যা পরিমাপ করা যায়। কিন্তু বিজ্ঞান সামান্য চিন্তাকেও ব্যাখ্যা করতে পারে না। বিজ্ঞান বলে এটা নিছক ইলেক্ট্রিসিটি আর চুম্বকিয় ব্যাপার-স্যাপার তবে সেটা কখনও দেখা যায়নি। পুরোপুরি বোধগম্য নয়। মৃত্যুকে জীবনের বিপরীত কিছু ভাবাটা অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু না। কারণ মৃত্যু হলো জীবনের অনুপস্থিতি মাত্র। এটা জীবনের বিপরীত অবস্থা নয়। এবার আমাকে বলুন, স্যার…আপনি কি আপনার ছাত্রদেরকে বলবেন, তারা সবাই বানর থেকে বিবর্তিত হয়ে মানুষে পরিণত হয়েছে?
“শিক্ষক জবাবে বললেন, ‘তুমি যদি বিবর্তনবাদ আর প্রাকৃতিক নির্বাচনের কথা বলে, তাহলে অবশ্যই সেটা বলবো।’ ছাত্র তখন বলে উঠলো, ‘আপনি কি কখনও সেটা নিজের চোখে দেখেছেন, স্যার?’ শিক্ষক মুচকি হেসে মাথা দোলালেন। তিনি বুঝতে পারলেন তার ছাত্র কোন যুক্তি ব্যবহার করতে চাইছে। ছাত্র তখন বলল, ‘যেহেতু বিবর্তন বিষয়টি কেউ চোখে দেখেনি, এমনকি এখনও চোখের সামনে হতে দেখছে না তাহলে কি আপনি আপনার অভিমত জানাচ্ছেন না? আপনি কি তাহলে বিজ্ঞানের কথা না বলে ধর্মযাজকদের মতো কথা বলছেন না?’ এ কথা শুনে পুরো ক্লাসে শোরগোল পড়ে গেলো। ছাত্র আরো বলতে লাগলো, এই ক্লাসের কেউ কি আমাদের শিক্ষকের মস্তিষ্কটি নিজের চোখে দেখেছে?’ ক্লাসের সবাই হেসে ফেলল কথাটা শুনে। আমাদের মধ্যে কেউ কি প্রফেসরের মস্তিষ্কটি স্পর্শ করে দেখেছে? অনুভব করতে পেরেছে? অথবা এর গন্ধ নিতে পেরেছে? না। কেউই তা করতে পারেনি। সুতরাং একটু আগে প্রফেসরের বলা বিজ্ঞানের তিনটি নিয়মের আওতায় ফেললে, তার কোনো মস্তিষ্কই নেই। বেয়াদপি মাফ করবেন, স্যার। তাহলে আপনি আপনার লেকচারের উপরে কি করে আস্থা রাখেন? পুরো ক্লাসে নিরবতা নেমে এলো। ছাত্রের দিকে তাকালেন প্রফেসর। আমার মনে হয় এটা তোমাকে বিশ্বাস করে নিতে হবে।’ ছাত্র সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, “ঠিক স্যার! মানুষ আর ঈশ্বরের মধ্যে যে সংযোগ সেটা হলো বিশ্বাস। এটাই সবকিছুকে জীবন্ত রেখেছে, সচল রেখেছে।’ ” ডক্টর আজফার অনেকক্ষণ একটানা বলার পর একটু সময়ের জন্য থামলেন। গভীর করে নিঃশ্বাস নিলেন তিনি। “ছাত্রটি কে ছিলো জানো?”
মাথা দোলাল চারু।
“আইনস্টাইন।”
“এরকম গালগল্প ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই, সোজাসুজি বাতিল করে দিলো যুক্তিবাদি। “কে খুঁজতে যাবে আইনস্টাইন এরকম কথা আসলেই বলেছিলো কিনা? কিভাবে খুঁজবে? সব বোগাস!”
ডক্টর মুচকি হাসলেন। “গল্পের সেই ছাত্র আদতেই আইনস্টাইন ছিলো কিনা সে নিয়ে কিন্তু আমিও নিশ্চিত নই। হতে পারে এটা কারোর মনগড়া গল্প।”
“আইনস্টাইনের মতো বিখ্যাত কাউকে ব্যবহার করা হয়েছে সর্বসাধারণের কাছে সহজেই বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য। বিশ্বাসিরা সব সময় এরকম গল্প ফেঁদে থাকে।”
মিটিমিটি হাসলেন ডক্টর। “হুম। বিখ্যাত মানুষজনকে নিয়ে এরকম অনেক গল্পই প্রচলিত আছে। সবগুলো যে সত্যি সে কথা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই।”
চারুর ঠোঁটে বাঁকাহাসি দেখা গেলো।
বেশ গম্ভির কণ্ঠে বললেন আজফার হুসেন, “তবে গল্পটা কিন্তু তুমি অস্বীকার করতে পারো না।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো যুক্তিবাদি।
“ধরো এই গল্পের ছাত্র সাধারণ কেউ। আর শিক্ষক হলে তুমি। এখন বলল, তোমার কাছে কী জবাব আছে?”
চারু এমন প্রশ্নের জন্য মোটেও প্রস্তত ছিলো না। সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চেয়ে রইলো ডক্টরের দিকে।
ডক্টর আজফার আস্তে করে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। থুতনিটা বুকের উপর ঠেকিয়ে নিচু করে রাখলেন মাথাটা।
“ডক্টর, আপনি ঠিক আছেন তো?” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠলো মায়া। এবার চারু লক্ষ্য করলো ডক্টরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে।
মুখ তুলে তাকালেন ডক্টর হুসেন। “আমি ঠিক আছি। ডোন্ট ওরি। আই জাস্ট নিড মেডিকেশন।” বলেই উঠে দাঁড়ালেন। “সরি…কিছু মনে করবে না…আমাকে একটু রেস্টও নিতে হবে। তোমাদের সঙ্গে পরে কথা হবে।”
আস্তে করে উঠে অভিজাত ভঙ্গিতে হেঁটে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন ডক্টর আজফার হুসেন।
.
অধ্যায় ২১
“একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
মায়ার কথায় ফিরে তাকালো চারু। ডক্টর চলে যাবার পরও তারা দু জন বসে আছে সুবিশাল স্টাডিতে।
“কিছু মনে করবেন না তো?”
“বলুন…কিছু মনে করবো না।”
“আপনি যে ধর্মে বিশ্বাস করেন না তার নিশ্চয়ই কারণ আছে। আমাকে কি সেটা বলা যাবে?”
“আপনার কেন এটা মনে হলো?”
মায়া আলতো করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “কী জানি। আমার শুধু মনে হচ্ছে গভীর এক দুঃখবোধ থেকে আপনি…” কথাটা শেষ করলো না সে।
মেয়েটার দিকে চেয়ে রইলো চারু আহসান। “বলতে না চাইলে থাক,” তাকে চুপ থাকতে দেখে বলল মায়া।
“বলতে কোনো সমস্যা নেই।” কথাটা বলেই গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে নিলো সে। “যদিও ঘটনাটা আমি কাউকে কোনোদিন বলিনি।”
এ সময় দেখা গেলো মায়ার চোখদুটো ছলছল করে উঠেছে, কিন্তু কেন, চারু বুঝতে পারলো না।
“আমি বেশ অল্প বয়স থেকে ধর্মে বিশ্বাস করি না। অনেকটা ঘোষণা দেবার মতো করে বলল সে। “সম্ভবত ক্লাস সিক্স থেকে।”
বিস্মিত হলো মায়া। “এতো অল্পবয়স থেকে?!”
মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু আহসান।
“বলেন কি? ঐ বয়সে তো এসব বোঝারই কথা নয়।
“হুম, বোঝার কথা নয়। আমিও বুঝতাম না, যদি আমার বাবা মারা না যেতো।”
মায়া স্থিরচোখে চেয়ে রইলো তার দিকে।
“সিক্সে পড়ার সময় আমার বাবা ক্যান্সারে মারা যায়।” আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল চারু। “বাবার মৃত্যুর সময় কিছু ঘটনা আমার মনে খুব দাগ কেটেছিলো। আমাদের পরিবার…বিশেষ করে আমার বাবা খুবই অন্যরকম মানুষ ছিলো। কোনো রকম কুসংস্কারে বিশ্বাস করতো না। একটু বামপন্থি রাজনীতির দিকে ঝুঁকেছিলো যৌবনে, তো সেটার প্রভাব রয়ে গেছিলো তার মধ্যে। নকশাল আন্দোলনের নেতা চারু মজুমদারের ভক্ত হিসেবে আমার নাম রাখে ‘চারু’। পরিবারের অনেকে আপত্তি জানালেও বাবা কারো কথা কানে তোলেনি।”
“আপনার বাবা কি নাস্তিক ছিলেন?
“না। অবশ্য ধর্মকর্মও খুব একটা করতো না। প্রতি শুক্রবার আর ঈদে নামাজ পড়তে দেখেছি, তবে কখনও রোজা রাখতো না। একটু থেমে আবার বলল, “তবে বাবা একদম কুসংস্কারমুক্ত ছিলেন। ভুত-প্রেতে বিশ্বাস করতো না। আমি একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ভুত কোথায় থাকে, বাবা আমার মাথায় টোকা মেরে বলেছিলো, এখানে থাকে। যারা ভুতে বিশ্বাস করে ভুত কেবল তাদের মাথাতেই বাসা বাধে। অনেক পরে আমি এ কথাটার মানে বুঝেছিলাম।” হেসে ফেলল চারু। একটু থেমে আবার বলল, “আমার বাবা-মায়ের পরিবার খুবই রক্ষণশীল, প্রচণ্ড ধার্মিক বলতে পারেন। কিন্তু বাবা আমাকে কখনও ধর্ম নিয়ে ভালোমন্দ কিছুই বলতো না। অবশ্য আমার বয়স তখন খুবই কম, বড় হলে বলতো কি-না আমি জানি না।”
মায়া কিছু বলল না, সে গল্পটা শুনতে চাচ্ছে।
“আচমকা বাবার ক্যান্সার ধরা পড়লে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে আমার মা। চিকিৎসার পাশাপাশি পীড়-ফকির, কামেল লোজন, সবার কাছেই ছুটে যেতো। খুব ডেসপারেট হয়ে পড়েছিলো। মা যখন খালা, ফুপু, চাচি, মামিদের সাথে ওসব জায়গায় অলৌকিক কিছুর আশায় ছুটে যেতে আমিও তখন সঙ্গে থাকতাম। সেই অল্পবয়সেই আমি ওসব বুজরুকি চোখের সামনে দেখেছি। তাদের সমস্ত কেরামতি যে অসাড় সেটা বুঝতে খুব বেশি দেরি হয়নি।” একটু গম্ভির হয়ে গেলো সে। “অনেক চেষ্টার পরও বছরখানেকের মধ্যেই বাবা মারা গেলো।”
“এরপরই ধর্মের উপর থেকে আপনার বিশ্বাস চলে গেলো?”
মায়ার কথায় মাথা দোলাল চারু। “ঠিক তার পর পর নয়…আরো পরে।”
চুপ মেরে রইলো মায়া, যদিও সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
“বাবা যখন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে তখন প্রতি সন্ধ্যায় মাগরেবের পর পর আমাকে নিয়ে দোয়া-দুরুদ পড়তো। মা বলতো এসব করলে বাবাকে বাঁচানো যাবে। আমি সেই অল্পবয়সে বাবার জন্য নামাজ পড়তাম, রোজা রাখতাম। তারপরও কোনো কিছুতেই বাবার মৃত্যু ঠেকানো গেলো না। তার মৃত্যু আমাকে নতুন একটি সত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো-ধর্মকর্ম কোনো কাজের না। তখন থেকেই আমার ধর্মবিশ্বাস ফিকে হয়ে যেতে শুরু করলো।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো মায়া।
“আসলে আমার মধ্যে ধর্মিয়বিশাস পুরোপুরি চলে গেলেও মুখে কিন্তু সেটা বলতাম না। কলেজে ওঠার পর থেকে আর কোনো কিছু পরোয়া করিনি।”
“আপনি বলছেন ধর্মিয়বিশ্বাস চলে গেছিলো…কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাস? সেটা কি ছিলো তখনও?” মায়া জানতে চাইলো আস্তে করে।
ঠোঁট ওল্টালো চারু। ধর্ম আর ঈশ্বর যে আলাদা বিষয় সেটা সে জানে। যদিও অনেকেই গুলিয়ে ফেলে। ধর্ম মানে না এমন অনেক মানুষ যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে সেটা ধর্মান্ধ আর নাস্তিকেরা বুঝতেও চায় না।
“কঠিন প্রশ্ন করে ফেললাম নাকি? যদি বলতে না চান তাহলে বলার দরকার নেই।”
মায়ার কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকালো চারু আহসান। “না বলার কিছু নেই। আমি আমার অবস্থান সম্পর্কে কোনো লুকোছাপা করি না। কিন্তু…”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো মায়া।
“সত্যি বলতে ঈশ্বরের ব্যাপারে আমি এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নই। আমার মনে হয় ধর্মগুলো যে ঈশ্বরের কথ; বলে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে ইউনিভার্সাল ফোর্স হিসেবে…এই বিব্রহ্মাণ্ডের চিফ কমান্ডার হিসেবে হয়তো কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকলেও থাকতে পারে।”
“চিফ কমান্ডার?!” অবাক হলো মায়া।
মুচকি হাসলো যুক্তিবাদি। “এটা আমার নিজের দেয়া নাম।”
মায়াও হেসে ফেলল কথাটা শুনে। তারপরই ঘরে নেমে এলো নিরবতা। দুজনের কেউ কোনো কথা বলল না।
“আপনি আপনার বাবাকে খুব মিস করেন, না?” অবশেষে বলল মায়া।
“হুম।”
“আমিও,” আস্তে করে বলল সাবেক রেডিওজকি। “বাবাকে খুব মিস্ করি। এই একটা জায়গায় অন্তত আপনার আর আমার মধ্যে মিল আছে।”
মায়ার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো চারু।
“আমার মনে হয় অন্যদের সঙ্গেও আমাদের কথা বলা দরকার, হুট করে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল মেয়েটা। “ঐদিন হ্যালোউইন পার্টিতে যারা ছিলো তাদের কথা বলছি।”
প্রসঙ্গ পাল্টানোতে চারুও খুশি হলো। বাবার মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে তার ভালো লাগে না।
“মারজানা নামের একজনের সাথে কথা বলা যেতে পারে। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি মেয়েটা র্যাম্পে কাজ করেছিলো দু-বছর আগে।”
“আপনার সাথে ওর পরিচয় আছে?”
“না। তবে যে মডেল এজেন্সির হয়ে ও র্যাম্পে কাজ করেছিলো সেখানকার অনেকের সাথে আমার বেশ ভালো পরিচয় আছে। মনে হয় ওর সাথে কালকে একটা মিটিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারবো।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু আহসান। “সেটা করতে পারলে তো ভালোই হয়।”
.
অধ্যায় ২২
হঠাৎ করেই গতকাল থেকে ডক্টর আজফারের শরীর খারাপ করেছে, এখন ইউনিভার্সাল হাসপাতালে ভর্তি আছেন তিনি।
গতকাল তার বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর মায়া রাতে ফোন করে তার শরীরের খবর নিতে গিয়ে জানতে পারে সন্ধ্যার পর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে চারুকে ফোন করে জানায় এটা। তারা ঠিক করে পরদিন হাসপতালে যাবে ডক্টরকে দেখতে।
এখন ইউনিভার্সাল হাসপাতালের করিডোরে বিরসমুখে বসে আছে মায়া। তার বাড়ি থেকে এটা খুব বেশি দূরে নয়। একটা রিক্সা নিয়ে চলে এসেছে। একটু আগে চারু ফোন করে জানিয়েছে সে-ও আসছে। পথে আছে এখন। কিন্তু এসেই বা কী করবে, হাসপাতালের লোকজন ডক্টরের সাথে দেখা করতে দিচ্ছে না। মায়া জানতে চেয়েছিলো, রোগির শরীর বেশি খারাপ কি-না, ডাক্তার জোর দিয়ে বলেছে, রোগি বিপদমুক্ত আছে, কিন্তু এ মুহূর্তে ভিজিটর অ্যালাউ করা ঠিক হবে না। তার হার্ট মনিটরিং করা হচ্ছে। চব্বিশঘণ্টা পর ডাক্তাররা ঠিক করবেন ডক্টরকে হাসপাতালে রাখার দরকার আছে নাকি ওষুধপত্র দিয়ে রিলিজ করে দেয়া হবে।
“কি খবর?” মায়া মুখ তুলে দেখলো চারু দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে, হাতে একটা হেলমেটটা ধরা।
“দেখা করা যাবে না,” বলল মেয়েটি, “তবে উনার শরীর ভালোই আছে…ডাক্তার আমাকে সেরকমই বলল।”
“হার্ট অ্যাটাক হয়েছিলো নাকি?”
“সেরকম কিছু না। উনার বুকে খুব পেইন হচ্ছিলো, সেজন্যে চব্বিশ ঘন্টা অবজার্ভেশনে রাখা হয়েছে।”
আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ মায়ার পাশে একটা চেয়ারে বসে পড়লো চারু। “উনার সেন্স তো আছে, নাকি
মাথা নেড়ে সায় দিলো সাবেক আর.জে। “নার্স বলল উনি বই পড়ছেন।”
“বই পড়ছেন?” অবাক হলো চারু।
“হুম। অ্যাডভেঞ্চার অব টিন টিন।”
ভুরু কুচকে তাকালো র্যাশনালিস্ট সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারি। “টিন টিন?!”
“কেন, উনি কি এটা পড়তে পারেন না?”
বাঁকাহাসি দেখা গেলো চারুর ঠোঁটে। “এখন তো মনে হচ্ছে অসুখটা উনার হার্টের না…মাথার!”
কটমট চোখে তাকালো মায়া। “এক্সকিউজ মি?!” তার কণ্ঠে ক্ষোভ। “আমি কিন্তু এখনও টিন টিন পড়ি।”
বাঁকাহাসি দিলো চারু। “এটা না বললেও চলতো।”
“মানে?”
“কিছু না।”
“বুলশিট!” বলেই মুখ ঝামটা দিয়ে অন্যদিকে তাকালো মায়া।
মুখ টিপে হাসলো চারু। অপেক্ষা করলো মেয়েটা কখন তার দিকে ফিরে তাকায়। “আশ্চর্য, আমি তো মজা করলাম…এটাও বোঝেন না?”
এবার মায়া তার দিকে তাকালো। “আপনি মোটেও মজা করেননি। সব সময় খোঁচা মেরে কথা বলা আপনার বদঅভ্যাস।”
ভুরু কপালে তুলল যুক্তিবাদি।
“এটা নিয়ে ঘুরছেন কেন?” চারুর হাতের হেলমেটটার দিকে ইঙ্গিত করলো।
মুচকি হাসলো সে। “বাইক নিয়ে এসেছি আজ।”
“আপনার বাইক?”
“আমার রুমমেটের বাইক। ও সামনের মাসে গাড়ি পাচ্ছে অফিস থেকে, বাইকের আর দরকার হবে না। আমি ভাবছি ওর বাইকটা কিনে নেবো। আগে থেকে চালিয়ে দেখে নিচ্ছি জিনিসটা কেমন।”
“আপনি কি আশা করছেন আমাকে আপনার বাইকে চড়িয়ে মারজানার সাথে দেখা করতে যাবেন?”
চারু অবাক হয়ে তাকালো মেয়েটা দিকে। “ওহ্, ভুলেই গেছিলাম…আজ তো ঐ মেয়েটার সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা।” অভিনয়টা নিজের কাছেই দুর্বল মনে হলো তার।
“আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনি এটা ভুলে গেছেন?”
“হুম। একদমই খেয়াল ছিলো না।”
“ও,” মায়া বলল। কিন্তু তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো সে কথাটা বিশ্বাস করেনি।
“এক কাজ করি,” বলল চারু আহসান। “আপনি একটা সিএনজি নিয়ে রওনা দিয়ে দেন, আমি আপনার সাথে সাথে বাইক নিয়ে আসছি।”
চারুর দিকে তাকালো মায়া। “সেটার কোনো দরকার নেই, আমরা একসাথেই যাবো।”
অবাক হয়ে চেয়ে রইলো যুক্তিবাদি। “আমাকে বাইক নিয়ে যেতে হবে। বাইকটা এখানে রেখে যেতে পারব না। আজকাল বাইক চুরি অনেক বেড়ে গেছে।”
“স্টুপিড!” নিচুকণ্ঠে বলেই গটগট করে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গেলো মায়া।
তার পেছন পেছন চলে এলো চারু। বাইরের প্রাঙ্গনে পার্কিংএরিয়ার কাছে এসে একটা বাইকের সামনে থেমে গেলো মেয়েটা।
“এটাই কি আপনার বাইক?”
“হুম।”
কথাটা শুনে মুচকি হাসলো মায়া। “প্রস্তুতি দেখি ভালোই নিয়েছেন!”
বুঝতে না পেরে হা করে চেয়ে রইলো চারু। “কী?”
সাবেক আর.জে মুখ টিপে হাসলো শুধু।
তখনই চারু দেখতে পেলো জিনিসটা। বাইকের পেছনের সিটের পাশে আরেকটা হেলমেট লক করে রেখেছে সে। একটু কাচুমাচু খেলো এবার।
“শুনুন, বাইকে চড়ার পর দ্রভাবে চালাবেন, ওকে?” শাসন করার মতো ভঙ্গি করে বলল। “আর আমি আপনার কোমর জড়িয়ে ধরতে পারবো না।”
কৗধ তুললো চারু। “পড়ে টরে গেলে কিন্তু আমি দায়ি থাকবো না।”
“হাহ!” হাত নেড়ে কথাটা উড়িয়ে দিলো মায়া।
.
অধ্যায় ২৩
মারজানা মেয়েটি প্রচণ্ড নাভাস আর ভীতু প্রকৃতির। চারু ওকে দেখামাত্রই বুঝে গেছিলো এই মেয়ের পেট থেকে কথা বের করা সহজ হবে না। খুব বেশি সতর্ক। সামান্য নির্দোষ প্রশ্ন শুনেও দশবার ভেবে জবাব দেয়। ভীত হরিণীর মতো চঞ্চল তার দৃষ্টি।
চারু নিশ্চিত, হ্যালোউইন পার্টিতে এই মেয়ে ড্রাগ নিয়ে কিংবা অ্যালকোহল পান করে বেসামাল ছিলো। মিসকাতের খুনের আগে-পরে কোনো ঘটনাই তার পরিস্কার মনে নেই। তার বেশিরভাগ কথার সূত্র হলো বাকিরা।
চারু, মায়া আর মারজানা বসেছে বনানীর একটি ফাস্টফুড রেস্টুরেন্টে।
“বাইকার-বাবুর আচরণ নাকি কেমনজানি ছিলো, কোকের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল সে।
“কেমন?” মায়া জানতে চাইলো।
চারু অবশ্য আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এ কথা অ্যাঞ্জেল তাকে বলেছে।
“ইয়ে মানে,” আবারো কোকে চুমুক দিলো মারজানা। “আমি ঠিক বলতে পারবো না। অ্যাঞ্জেল, মুস্তফি…ওরা বলেছে।”
আরেকটা দীর্ঘশ্বাস জোর করে আটকে রাখলো চারু। আজকের মিটিংটা যে একদমই অনর্থক আর নো-ইউজ সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। মায়াকে বাইকে করে গুলশান থেকে বনানীর সংক্ষিপ্ত পথ পাড়ি দেয়া ছাড়া আর কোনো সার্থকতা নেই বললেই চলে। মেয়েটার সাথে পাঁচ মিনিট কথা বলার পরই তাকে প্রশ্ন করার আগ্রহ হারিয়ে ফলেছে সে। যা করার মায়াই করে যাচ্ছে। আর সেটা যেমন খাপছাড়া তেমনি অদরকারি।
“তুমি বাবুকে, মানে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে দেখোনি ঐদিন?” মায়া উদগ্রিব হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
মাথা দুলিয়ে কোকে চুমুক দিলো মারজানা। “না। আমি যেন কী একটা কাজে ব্যস্ত ছিলাম তখন…মনে নেই।”
বয়ফ্রেন্ডের সাথে ইয়ে করছিলি…শালি! মনে মনে বলল চারু।
“আচ্ছা, আমাকে অন্য একটা কথা বলো তো,” মায়া প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলো, “মিসকাতের সাথে কি কারোর কোনো ঝামেলা ছিলো, বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে?”
“না-হ! এরকম কিছু হবার প্রশ্নই ওঠে না।” মাথা দুলিয়ে সরাসরি বাতিল করে দিলো মেয়েটি।
আবারো বাঁকাহাসি দেখা গেলো চারুর ঠোঁটে। ফেরেস্তাদের গ্রুপ! মনে মনে বলে উঠলো সে। শুধু মওজ-ফুর্তি করে..ঝগড়া-ঝাটি করে না!
“এটা কিন্তু আমার কাছে খুবই আনইউজুয়্যাল ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে,” মায়া দ্বিমত পোষণ করে বলল।
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো মারজানা। “কোনটা?”
“এই যে, তোমাদের মধ্যে কোনো ঝগড়া-ঝাটি হয়নি কখনও।”
“এটা কিন্তু সত্যি। আমাদের মধ্যে আসলেই ওরকম কিছু হয়নি কখনও।”
চারুর ইচ্ছে করলো মেয়েটার গালে কষিয়ে একটা চড় মারতে।
“তবে…”
নড়েচড়ে উঠলো যুক্তিবাদি।
“তবে কি?” আগ্রহি হয়ে জানতে চাইলো মায়া।
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো মারজানা। “না, মানে…” তার মধ্যে আবারো দ্বিধা, জড়তা, অনিশ্চয়তা। কিছুটা নার্ভাসও সে।
“কি হলো, বলো?” তাড়া দিলো সাবেক আর.জে।
“আসলে তেমন কিছু না…ক্লোজ-সার্কেলে এমনটা তৈ হতেই পারে?”
আক্ষেপে মাথা দোলাল চারু। “সেটা তো হতে পারে…কিন্তু আমরা সেরকম কিছুই জানতে চাইছি।”
“বলো, কোনো সমস্যা নেই। আমরা এটা কাউকে বলবো না,” আশ্বস্ত করলো মায়া।
ঢোক গিললো মারজানা। “আমাদের গ্রুপে একটা পেইন ইন অ্যাজ আছে…চারু আর মায়ার দিকে তাকালো সে। “নাথিং সিরিয়াস…বাট, আমি ওকে ঠিক লাইক করতো না।”
“অমি মানে মিসকাতের গার্লফ্রেন্ড?” চারু জানতে চাইলো।
“হুম।”
“তুমি কার কথা বলছো?” মায়া উদগ্রিব হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
“অ্যা-অ্যাঞ্জেল,” আস্তে করে বলল মারজানা।
চারুর কপালে ভাঁজ পড়লো। “ওকে নিয়ে কি হয়েছিলো?”
মাথা দোলাল মেয়েটা। “না-না, কিছু হয়নি। আপনি যেরকম ভাবছেন সেরকম কিছু না।”
বিরক্ত হয়ে উঠলো চারু কিন্তু সে কিছু বলার আগেই মায়া মুখ খুললো।
“মিসকাতের গার্লফ্রেন্ড অ্যাঞ্জেলকে কেন লাইক করতো না? ওকে নিয়ে ঝগড়া হয়েছিলো?”
“ওরকম কিছু হয়নি। ও খুব হেল্পফুল…খুবই ফ্রেন্ডলি…কিন্তু…”
“কিন্তু কি?”
ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালো মেয়েটা। “অমি ওকে একদমই সহ্য করতে পারতো না।”
“কেন?”
এবার চারু আর মায়া দু-জনের দিকে পালাক্রমে তাকালো মারজানা। “মিসকাত সারাক্ষণ অ্যাঞ্জেলকে সঙ্গে রাখতো।”
“তো?”
“এটা অমি লাইক করতো না।”
কাঁধ তুললো চারু। “একটা গ্রুপে এরকম লাইক-ডিজলাইক থাকতেই পারে। এটা আর এমন কী ব্যাপার?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো মারজানা। “হুম, সেটাই বলছি… নাথিং সিরিয়াস। অমি জাস্ট লাইক করতে না অ্যাঞ্জেলকে।”
“শুধু আমি নাকি তোমরাও ওকে লাইক করতে না’।
মায়ার এমন প্রশ্নে বিব্রত বোধ করলো মেয়েটা। “আসলে…” আবারো নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো সে। “ওরকম একজনকে…ইউ নো…সার্কেলের অনেকেরই আনইজি লাগতো। কিন্তু মিসকাতের কারণে এ নিয়ে কেউ কিছু বলতো না। মিসকাত সব সময় অ্যাঞ্জেলের পক্ষ নিতো, ওকে আগলে রাখতো। তার সামনে অ্যাঞ্জেলকে নিয়ে বাজে কথা বললে কিংবা হাসাহাসি করলে ভীষণ ক্ষেপে যেত। এ নিয়ে একবার পিজ্জাহাটে পাশের টেবিলের এক ছেলেকে খুব মেরেছিলো মিসকাত।”
হঠাৎ মেয়েটার হাত ধরে ফেলল মায়া। “তুমি কিছু একটা লুকাচ্ছো, মারজানা। আমাকে সেটা বলো, প্লিজ।”
মায়ার এমন আচরণে চারুও বেশ অবাক হলো।
ঢোক গিললো মেয়েটা।
“অমি একটা কিছু সন্দেহ করতে অ্যাঞ্জেলকে নিয়ে, তাই না?”
মায়ার দিকে কয়েক মুহূর্ত ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলো মারজানা।
“কি নিয়ে সন্দেহ করতো?” উদগ্রিব হয়ে জানতে চাইলে চারু।
গ্লাসের বাকি কোকটুকু দ্রুত শেষ করে ফেলল মেয়েটা, তারপর গভীর করে দম নিয়ে বলল, “অমি ডাউট করতো মিসকাত বাইসেক্সুয়াল!
.
অধ্যায় ২৪
মিসকাত বাই-সেক্সয়াল ছিলো!
তথ্যটা আগ্রহি করে তুলেছে চারু আহসানকে। মিসকাতের গার্লফ্রেন্ড অ্যাঞ্জেলকে নিয়ে সন্দেহ করতো। মেয়েটা ধারণা করতো, মিসকাত আর অ্যাঞ্জেলের মধ্যে কিছু একটা চলছে। এই সন্দেহের কারণ, মিসকাত যতোটা না তার গার্লফ্রেন্ড অমির সাথে থাকতো তারচেয়ে অনেক বেশি থাকতো অ্যাঞ্জেলের সাথে। বলতে গেলে সার্বক্ষণিক সঙ্গি হিসেবে রাখতে অ্যাঞ্জেলকে।
চারু ভেবেছিলো মারজানার সাথে কথা বলে কোনো কিছু জানতে পারবে না কিন্তু এই একটা তথ্য সামান্য হলেও তাকে পথ দেখাচ্ছে। হ্যালোউইন পার্টির রহস্যময় হত্যাকাণ্ডটি যে সহজ কিছু হবে না সেটা সে জানতো। কিন্তু তদন্তে নেমেই বুঝে গেছিলো, ধারনার চেয়েও বেশি কঠিন হতে যাচ্ছে কাজটা।
“এটা এমন কী,” মায়া বলল। মারজানাকে বিদায় দিয়ে তারা বসে আছে রেস্তোরাঁয়। “মিসকাত যে আসলেই বাই-সেক্সয়াল ছিলো সেটা কিন্তু প্রমাণিত হচ্ছে না। এটা স্রেফ ওর গার্লফ্রেন্ডের সন্দেহ।
মাথা দোলাল চারু। “মিসকাত আসলেই বাই-সেক্সয়াল ছিলো কি-না সেটা নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না।”
“তাহলে?”
“মেয়েটা যদি ভুল সন্দেহও করে থাকে তাতেও কিছু এসে যায় না। যেটা গুরুত্বপূর্ন সেটা হলো, এরকম একটা সন্দেহ করতো মিসকাতের গার্লফ্রেন্ড।”
“বুঝলাম না?”
“ওরা বলছে ওদের গ্রুপে কোনো রকম ঝগড়া-ঝাটি হতো না। কোনো ঝামেলা হয়নি কখনও…ব্যাপারটা কিন্তু অস্বাভাবিক ঠেকেছিলো আমার কাছে।”
“হুম।” মায়া আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো।
“কিন্তু আমি ভালো করেই জানতাম, কিছু একটা সমস্যা ছিলো ওদের গ্রুপে। কিছু বাঙালি একসাথে হ্যাঁঙআউট করবে আর ঝামেলা হবে তা হতেই পারে না।”
“স্বজাতি সম্পর্কে ধারণা দেখি বেশ ভালোই রাখেন,” টিপ্পনি কেটে বলল মায়া।
“এটা আমার ধারণা নয়, প্রতিষ্ঠিত সত্য। বড় বড় কবি-সাহিত্যিক আর মহারথিদের বই পড়লেই বুঝতে পারবেন।”
“জোকস অ্যাপার্ট, বাবা…আসল কথা বলুন,” মোহনীয় কণ্ঠে বলল মায়া।
মাথা দোলাল চারু। কাজের সময় এই মেয়ের মনে পড়ে যায় জীবনে রঙ্গ-রসিকতা করাটা খুব জরুরি। আবার কাজের কথায় ফিরে গেলো সে, “শুনুন, ওদের মধ্যে কিছু একটা ঝামেলা অবশ্যই ছিলো, নইলে পার্টিতে একজনকে খুন করা হবে কেন?”
সায় দিলো মায়া। “তাহলে কি মিসকাতের প্রেমিকা নিছক সন্দেহের বশে মিসকাতকে-”
“আরে না,” মেয়েটার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠলো চারু। “সেটা যদি হতো তাহলে মিসকাত নয়, ঐদিন খুন হতো অ্যাঞ্জেল।”
“হুম, তা ঠিক।”
“তাছাড়া খুনি যে-ই হোক, আমার মনে হয় না সে ওদের গ্রুপের কেউ ছিলো।”
“আপনি বলতে চাইছেন বাইরের কেউ করেছে কাজটা?”
“অবশ্যই। তবে ওদের গ্রুপের কেউ এটা করিয়েছে।”
“আপনার এরকম মনে হবার কারণ?”
“আমার ধারনা ওদের গ্রুপে বিরাট কোনো ঝামেলা ছিলো। মানে, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, ক্ষোভ, এইসব। তবে সেটা প্রকাশ হয়নি কখনও। এর কারণ হতে পারে, মিসকাতের মা একজন ক্ষমতাবান মহিলা। আবার এমনও হতে পারে, যারা ক্ষুব্ধ ছিলো তারা ইচ্ছে করেই ব্যাপারটা চেপে রেখেছিলো যাতে পরবর্তিকালে তাদেরকে কেউ সন্দেহ করতে না পারে।”
“ঝামেলাটা কি নিয়ে হতে পারে?”
কাঁধ তুললো চারু। “এ মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। তবে একটা ঝামেলা যে ছিলো সেটা তো প্রমান পেলেনই-মিসকাতের গার্লফ্রেন্ড অ্যাঞ্জেলকে সহ্য করতে পারতো না। নিশ্চয় এরকম আরো অনেক কিছু ওদের গ্রুপে ছিলো। এখন সেটা বের করতে হবে।”
“এটা আপনি কিভাবে করবেন?” মায়া কৌতূহলি হয়ে উঠলো।
“অ্যাঞ্জেলকে নিয়ে আরেকটু নাড়াচাড়া করতে হবে। এখন বুঝে গেছি, এই রহস্যের কূল-কিনারা করতে হলে সবার আগে ঐ ফিফটি-ফিফটিটাকেই বাগে আনতে হবে। ও-ই আমাদের বলতে পারবে এটা।”
“এটা আর এমন কী কঠিন কাজ, বাঁকাহাসি দিলো মায়া, “আপনি একটু প্রশ্রয় দিলেই দেখবেন ও সব বলে দিচ্ছে।”
“আশ্চর্য, আমরা একটা মিস্ট্রি তদন্ত করছি, ফান করছি না।” দীর্ঘশ্বাস ফেলল চারু। “এইসব ঠাট্টা-তামাশা বাদ দিয়ে একটু সিরিয়াস হোন। আমাকে হেল্প করুন।”
“আমি তো হেল্প করছিই…আজব। এই যে মারজানার সাথে মিটিংয়ের ব্যবস্থা করে দিলাম, তার আগে বাইকার বাবুর সাথেও মিট করিয়ে দিয়েছি, ভুলে গেছেন?”
চারু কিছু বলল না।
“আমি বলতে চাচ্ছি, ঐ বনলতাকে আপনি সামলালেই ভালো হয়। এখানে আমাকে জড়ালে কোনো লাভ হবে না।” কথাটা বলেই মুখ টিপে হেসে ফেলল মায়া।
আক্ষেপে আবারও মাথা দোলাল চারু। এই মেয়েকে এ ব্যাপারে যত নিষেধ করবে ততই বেশি বলবে। তারচেয়ে বরং এই প্রসঙ্গটা আর না তোলাই ভালো। তবে মনে মনে সে মায়ার সাথে একমত না হয়েও পারছে না। ঐ অ্যাঞ্জেলের পেট থেকে যদি কথা বের করতে হয় তাহলে তার নিজেরই সেটা করা ভালো।
.
অধ্যায় ২৫
অ্যাঞ্জেল যে ভেতরে ভেতরে বেশ খুশি সেটা তার অভিব্যক্তি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আর এই ব্যাপারটা চারুকে এক ধরণের অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিলো।
কাজ করতে গেলে অনেক ঝক্কি ঝামেলাই পোহাতে হয়, কিন্তু এর আগে কখনও এমন অবস্থায় পড়েনি। ছোটবেলা থেকেই চারু অ্যাঞ্জেলদের মতো মানুষজনের সংস্পর্শে একটু অস্বস্তিবোধ করে।
“ওয়াও!”
“কি?” অ্যাঞ্জেলের কথা বুঝতে না পেরে বলল সে।
“ইউ লুক গেট টুডে,” কথাটা বলেই ভ্রু নাচালো।
কাষ্ঠহাসি দিলো চারু। “থ্যাঙ্কস।”
“স্পেশালি ইউর শার্ট…” চারুর শার্টের দিকে ইঙ্গিত করে বলল। “দারুণ লাগছে আপনাকে।”
আবারো কাষ্ঠহাসি দিতে বাধ্য হলো চারু। বুঝতে পারছে দ্রুত কাজের প্রসঙ্গে চলে না গেলে তাদের এই দ্বিতীয় মোলাকাতটি আরো বেশি বিব্রতকর হয়ে উঠবে।
“কি খাবে?” জানতে চাইলো সে।
“জাস্ট অ্যা ড্রিঙ্ক…স-ফ্ট ড্রিঙ্ক, মোহনিয় ভঙ্গিতে বলল অ্যাঞ্জেল। বিশেষ করে সফট’ শব্দটি।
মনে মনে প্রমাদ গুনলো চারু। দ্রুত ওয়েটার ডেকে দুটো ড্রিঙ্কসের অর্ডার দিয়ে দিলো। “আচ্ছা, মিসকাতের গার্লফ্রেন্ডের সাথে কি তোমার কোনো সমস্যা আছে?” একেবারে সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসলো এবার। সময় নষ্ট করতে চাচ্ছে না।
“হোয়াট!” অ্যাঞ্জেল একটু বিস্মিত হলো কথাটা শুনে। “কে বলেছে এটা?”
“কেউ বলেনি। তবে মিসকাতের গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলে আমার মনে হয়েছে সে তোমাকে ঠিক পছন্দ করে না। একটা টোপ দিলো অ্যাঞ্জেলের পেট থেকে কথা বের করার জন্য। অবশ্য আমার ভুলও হতে পারে।”
তেতে উঠলো অ্যাঞ্জেল। “ঐ বিচটা কি বলেছে, ঠিক করে বলেন তো? চান্স পেলেই মানুষের কাছে আমার সম্পর্কে বাজে কথা বলে। আই হেইট দ্যাট বিচ!”
চারু খুশি হলো। এই আগুনে ঘি ঢালতে হবে। “নাহ, তেমন কিছু না। আমার মনে হয়েছে ও তোমাকে ঠিক পছন্দ করে না। একটু থেমে আবার বলল, “কিন্তু কেন? মানে, তুমি তো খুবই মিশুক, ভদ্র একটা…” কথা শেষ করতে পারলো না সে। ছেলে’ শব্দটা ব্যবহার করলে অ্যাঞ্জেল খুশি হবে নাকি হবে না বুঝতে পারছে না।
“ইউ নো, আমি সব সময় মিসকাতের সাথে থাকতাম…ওর সুখে-দুঃখে আমিই থাকতাম ওর পাশে। এটা অমি লাইক করতো না। খুব হিংসে করতো।”
“শুধু এজন্যে? নাকি অন্য কোনো কারণও ছিলো?”
চারুর দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অ্যাঞ্জেল। “হোয়াট ডু ইউ মিন?”
একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেলো যুক্তিবাদি। “না, মানে…তোমার মতো একটা গর্জেস…” আবারো ছেলে’ শব্দটা মুখে চলে আসার আগেই থেমে গেলো। “…যা হয় আর কি। গার্লফ্রেন্ডরা খুবই পজেসিভ হয়ে থাকে। বুঝতে পারছো নিশ্চয়।
হাত নেড়ে কথাটা উড়িয়ে দিলো অ্যাঞ্জেল। “অমি আমাকে নিয়ে শুধু হিংসাই করতো না, অনেক উল্টাপাল্টাও ভাবতো। আমিও জানতাম সে কী ভাবতো, কিন্তু সত্যি হলো, মিসকাতের সাথে আমার সম্পর্কটা জাস্ট ফ্রেন্ডশিপের ছিলো, আর কিছু না। বিলিভ মি।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু। “আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি। তুমি মিসকাতের সবচাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলে, এটাই হয়তো অমি সহ্য করতে পারতো না।”
সফট ড্রিঙ্কস চলে এলে অ্যাঞ্জেল তার গ্লাসটা নিয়ে স্ট্র-তে এমনভাবে দুই ঠোঁটের মাঝখানে চেপে ধরলো যে, চারু অন্য দিকে না তাকিয়ে পারলো না। তারপরই চুম্বন দেবার ভঙ্গি করে ধীরে ধীরে পান করতে লাগলো। এক মুহূর্তের জন্যেও চোখ সরালো না চারুর উপর থেকে। রেস্টুরেন্টের কাঁচের দেয়াল দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলো র্যাশনালিস্ট সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারি। যেন বাইরে পার্ক করে রাখা বাইকটা ঠিক আছে কিনা দেখছে।
“অমির জন্য আমার খুব করুণা হয়, ইউ নো।”
চারু ফিরে তাকালো অ্যাঞ্জেলের দিকে। “কেন?”
“ও একটা বোকা। শুধু শুধু উল্টাপাল্টা ভেবে কষ্ট পেয়েছে। ও কখনও জানতেই পারবে না মিসকাত ওকে কতোটা ভালোবাসততা।”
চারু কিছু না বলে নিজের গ্লাসটা তুলে নিয়ে চুমুক দিতে লাগলো।
“অমির সাথে ইনভল্ভ হবার আগে মিসকাত প্লে বয় টাইপ ছিলো। বাট, অমির ব্যাপারে অনেক কমিটেড ছিলো ও।”
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গেলো চারু আহসান।
“অমির উচিত আমার কাছে গ্রেটফুল থাকা। কতো বড় বিপদ থেকে আমি মিসকাতকে বাঁচিয়েছি। ওর জন্যে কতো বড় মিথ্যে বলেছি, ঐ বিচটা কি সব ভুলে গেছে?”
“কিসের বিপদের কথা বলছো?” একটু নড়েচড়ে বসলো চারু। “মিথ্যে কথাটাই বা কি?”
স্ট্র দিয়ে জোরে চুমুক দিয়ে গ্লাসটা এক পাশে সরিয়ে রাখলো অ্যাঞ্জেল। “অনেক বড় বিপদ ছিলো ওটা। ইউ কান্ট ইমাজিন। উফ! ভাবলেই আমার গুজ বাম্প হয় এখনও।” কথাটা বলেই দু-হাত টেবিলের উপর প্রসারিত করে রাখলো। “দেখুন, দেখুন হাত দিয়ে…এখনও গুজ বাম্প হচ্ছে।”
চারু বুঝতে পারলো না কী করবে। কিন্তু কাজের স্বার্থে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আলতো করে অ্যাঞ্জেলের ডানহাতটা স্পর্শ করলো। তার সামান্য স্পর্শ পেয়ে অ্যাঞ্জেল যে রকম শিহরিত হবার ভঙ্গি করলে তাতে করে নিজের চুল ছেঁড়ার ইচ্ছে জাগলো তার।
“ঘটনাটা কি ছিলো?” দ্রুত কাজের কথায় চলে এলো সে।
“কী আর বলবো, হরিবল একটা অবস্থা ছিলো।” কথাটা বলেই আবার গলা ভিজিয়ে নিলো। “আমি মিসকাতকে অনেক বলতাম, ড্রিঙ্ক করে ড্রাইভ না করার জন্য। কিন্তু ও আমার কথা শুনতোই না। হি ওয়াজ অ্যা হেভি ড্রিঙ্কার, ইউ নো?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু।
“একদিন বেশ ড্রিঙ্ক করে ড্রাইভ করছিলো ও, আমি ছিলাম ওর পাশেই। উফ! কী যে ভয় পেয়েছিলাম। মিসকাতকে অনেক বলছিলাম, প্লিজ, স্লো ডাউন করো, কিন্তু ও আমার কথা শুনছিলো না। বেসামাল হয়ে পড়েছিলো। ঢাকা শহরে লং ড্রাইভ করার মতো তো তেমন রোড নেই, পথেঘাটে প্রচুর গাড়ি, মানুষজন গিজ গিজ করতে থাকে সব সময়। কুড়িল রেললাইন ক্রশ করার পরই অ্যাকসিডেন্ট করে বসলো মিসকাত।”
“বলো কি?”
“হুম। ছেলেটা সাইকেল চালাচ্ছিলো…উফ! যা তা অবস্থা।”
“ছেলেটা মানে, কোন ছেলেটা?”
“ঐ যে…যার উপর দিয়ে গাড়ি তুলে দিয়েছিলো মিসকাত।”
“একটা ছেলের উপর গাড়ি তুলে দিয়েছিলো?”
“হুম…আর বলছি কি।” হাফ ছাড়লো যেন অ্যাঞ্জেল।
“তারপর?”
“আর কি…ভাগ্য ভালো আমাদের, ছেলেটা অল্পের জন্য বেঁচে গেছিল। নইলে যে কী হতো।” একটু থেমে আবার বলল, “বস্তির কাছে ছিলো জায়গাটা…ইউ নো, কতো আজেবাজে লোকজন থাকে ওখানে। চারপাশ থেকে লোকজন ছুটে আসার আগেই আমরা কেটে পড়েছিলাম।”
“ওহ্,” চারু বলল। ভেতরে ভেতরে সে হতাশ। বড়লোক ছেলেপেলেদের হাতে অল্পবয়সে গাড়ির স্টিয়ারিং তুলে দিলে এমন দুর্ঘটনা হরহামেশাই হয়ে থাকে। সে ভেবেছিলো কাউকে বুঝি গাড়িচাপা দিয়েছিলো মিসকাত। এখন দেখতে পাচ্ছে সামান্য একটা দুর্ঘটনা ছিলো ওটা। বিরাট বড় কোনো ঘটনা নয়।
“ঘটনাটা যে এত বড়সর ঝামেলা হয়ে যাবে সেটা কিন্তু আমরা বুঝতেই পারিনি।”
“বিরাট বড় ঝামেলা!?” অবাক হলো চারু।
“আরে বাবা, যে ছেলেটাকে অ্যাকসিডেন্ট করেছিলো সে তো কেস করে দিলো মিসকাতের বিরুদ্ধে। ভাবতে পারেন, সে গাড়ির নাম্বার মনে রেখে দিয়েছিলো। কিভাবে সম্ভব এটা? মান্ ওভাবে অ্যাকসিডেন্ট করার পর কেউ গাড়ির নাম্বার মুখস্ত রাখতে পারে, বলেন? আমি তো অনেকবার চেষ্টা করলেও একটা নাম্বার মুখস্ত করতে পারি না। সে কিভাবে পারলো এত অল্প সময়ে?”
“ছেলেটার মুখস্ত করার ক্ষমতা ভালো ছিলো মনে হয়।”
“অফকোর্স,” চারুর কথার সাথে সায় দিলো অ্যাঞ্জেল। শুধু তাই-ই না, খুব অ্যাডামেন্টও ছিলো। আন্টি কতো চেষ্টা করেছেন কিন্তু মামলা তুলে নেয়নি।”
“কিসের মামলা করেছিলো ছেলেটা? তুমি তো বললে অ্যাকসিডেন্টে তার কিছু হয়নি?”
“আমি বলেছি মারা যায়নি, বেচে গেছিলো…দ্যাট ডাজেন্ট মিন যে, কিছুই হয়নি।”
“কি হয়েছিলো ছেলেটার?” চারু আগ্রহি হয়ে উঠলো একটু।
“মিসকাত তো ওর পায়ের উপর গাড়ি তুলে দিয়েছিলো, ইউ নো?”
“বলো কি?”
“হুম। দুটো পা-ই ভেঙে গেছিলো। যা তা অবস্থা।”
“আচ্ছা, মিসকাতের মা মামলা তুলে নেবার জন্য বলেছিলো কেন?” জানতে চাইলো সে। “ছেলেটাকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিলেই তো হতো, তাই না?”
“হাহু,” মুখ দিয়ে হতাশা প্রকাশ করলো অ্যাঞ্জেল। “আন্টি কি সেটা করেননি ভেবেছেন? বলেছিলেন, ট্রিটমেন্টের সব খরচ দেবেন, কিন্তু ছেলেটা মামলা তুলে নিতে রাজি হয়নি।”
“তাই নাকি?” একটু থেমে আবার বলল চারু, “ছেলেটার রাজি হওয়া উচিত ছিলো।”
“হুম। আমিও সেটাই মনে করি। বোকার মতো গোয়ার্তুমি করে লাভটা কি হলো, অ্যাঁ? ক্ষতি যা হবার তোরই তো হলো।”
“ক্ষতি মানে? ছেলেটার পা কি ভালো হয়নি আর?” এ।
“কিভাবে হবে? প্রচুর টাকার দরকার ছিলো না? ওদের কি অতো টাকা ছিলো নাকি।”
“গরীব ছিলো ছেলেটা?”
“হুম। কুড়িল বস্তিতে থাকতো…এক সিএনজি ড্রাইভারের ছেলে, বুঝতেই পারছেন। বিদেশে নিয়ে গিয়ে যে ট্রিটমেন্ট করাবে সেই অ্যাবিলিটি ছিলো না তো।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু। “আচ্ছা, ওই মামলাটার কি হয়েছিলো?”
“কি আর হবে…ড্রাইভারের দু-বছরের জেল হয়েছিলো।”
“ড্রাইভারের?” বুঝতে পারলো না চারু। “তুমি না বললে, মিসকাত গাড়ি চালাচ্ছিলো?”
অ্যাঞ্জেল রহস্য করার চেষ্টা করলো চোখেমুখে, কিন্তু সেটা হয়ে গেলো হাস্যকর। “আন্টির ল-ইয়ার কোর্টে বলেছে গাড়িটা তখন চালাচ্ছিলো ওদের ড্রাইভার। আমি আর মিসকাত ছিলাম প্যাসেঞ্জার সিটে।”
“বলো কি?” অবাক হলো চারু। “ড্রাইভার এটা মেনে নিলো?”
“আরে না, ল-ইয়ার বলেছে, ড্রাইভার পলাতক। আর আমি কোর্টে গিয়ে সাক্ষি দিয়ে সেটাকে স্ট্যাবলিশ করেছি। উফ! মিথ্যেটা বলতে আমার যে কী কষ্ট হয়েছিলো, ইউ নো?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু।
“আমি আবার ছোট থেকেই মিথ্যে বলি না, তাই ভীষণ সমস্যা হয়েছিলো। তারপরও, শুধু মিসকাতের জন্য আমি ওটা করেছি।”
চারু বুঝতে পারলো পুরো ব্যাপারটা। ড্রাইভারের কথা বলে, তাকে পলাতক দেখিয়ে, সেই ভুয়া-পলাতক ড্রাইভারকে দুই বছরের সাজা খাঁটিয়ে খুব সহজেই মামলা থেকে মিসকাতকে মুক্ত করা হয়েছিলো।
“মিসকাত কিন্তু রেগেমগে কাজটা করেছিলো…ওর এটা করা উচিত হয়নি,” বলে যেতে লাগলো অ্যাঞ্জেল। “অনেক ড্রিঙ্ক করলে ওর এই সমস্যা হতো, মাথা ঠিক থাকতো না।”
“মিসকাত রেগেমেগে অ্যাকসিডেন্ট করেছে মানে?” চারু আবারো নিজের সিটে নড়েচড়ে বসলো। বুঝলাম না?”
“প্রথমে তো ছেলেটার সাইকেলে হিট করে মিসকাত…ছেলেটা সাইকেল নিয়ে পড়ে যায়, তখনও তেমন কিছু হয়নি, সামান্য ব্যথা পেয়েছিলো। তারপর ছেলেটা যখন মাটিতে পড়ে রেগেমেগে মিসকাতকে গালাগালি করতে শুরু করলো তখনই ও মাথা গরম করে গাড়িটা তুলে দিলো…উফ! কী ভয়ঙ্কর অবস্থা।” গ্লাসের বাকি সফট ড্রিঙ্ক শেষ করে ফেলল স্ট্র দিয়ে। “আমি ওকে অনেক বাধা দিয়েছিলাম, কিন্তু ড্রিঙ্ক করলে মিসকাতের মাথা ঠিক থাকতো না। তাছাড়া ছেলেটা বাপ-মা তুলে গালাগালি করেছিলো, বড়লোক নিয়েও যা-তা কথা বলেছিলো। এসব শুনে মিসকাত আর মাথা ঠিক রাখতে পারেনি।”
দৃশ্যটা চারু কল্পনা করে নিতে পারলো। বড়লোকের ছেলের গাড়ি বস্তির এক গরীব ছেলের সাইকেলে মেরে দিলো, ছেলেটা মাটিতে পড়ে গিয়ে ইচ্ছেমত গালাগালি করলো। মদ্যপ ধনীর দুলাল মাথা গরম করে গাড়িটা তুলে দিলো ছেলেটার উপরে। এ দেশের বাস্তবতায় খুবই সাধারণ ঘটনা। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের এমপির সন্তানের জন্য।
“ছেলেটার জন্যেও আমার মায়া হয় খুব।”
অ্যাঞ্জেলের দিকে তাকালো চারু। “কার কথা বলছো?”
“ঐ যে, বস্তির ছেলেটা…ও তো পঙ্গু হয়ে গেছিল। বেচারা।” অ্যাঞ্জেলের চোখেমুখে করুণ অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো। “সাক্ষি দিতে আমাকেও কয়েকবার কোর্টে যেতে হয়েছে, তখন ছেলেটাকে দেখেছি। খুবই মায়া হয়েছিলো আমার। মিসকাত আর আমার দিকে বাপ-ছেলে কেমন করে যেন তাকিয়েছিলো।”
ঐ ছেলে আর তার বাপের ক্ষোভের কারণ বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না চারুর। গরীব ঘরের ছেলে, বাবা সামান্য সিএনজি ড্রাইভার, একজন এমপির ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করে যে সুবিধা করতে পারবে না সেটা বলাই বাহুল্য।
হঠাৎ একটা কিছু মনে পড়তেই চারুর ভাবনা ধাক্কা খেলো।
সিএনজি ড্রাইভারের ছেলে।
.
অধ্যায় ২৬
“এটা কতদিন আগের ঘটনা?” মায়া জিজ্ঞেস করলো।
অ্যাঞ্জেলের সাথে কথা বলে যা জানতে পেরেছে সেটা গতকালই মায়াকে ফোনে বিস্তারিত জানিয়ে দিয়েছে চারু। এখন তারা ডক্টর হুসেনের বিশাল ড্রইংরুমে বসে আছে। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর ডক্টর রেস্টে আছেন বলে তাকে আর বিরক্ত করা হয়নি।
“প্রায় দু-বছর আগের,” একটু আগে টোটার দেয়া চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল চারু। “অ্যাঞ্জেলের কাছ থেকে যখন শুনলাম ছেলেটার বাবা সিএনজির ড্রাইভার ছিলো তখনই আমার মনে পড়ে গেলো, অ্যাকসিডেন্টের পর বাবুকে এক সিএনজি ড্রাইভারই নিয়ে গেছিলো হাসপাতালে। আবার ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সেজে যে গেছিলো হ্যালোউইন পার্টিতে সে-ও একটা সিএনজিতে করেই ওখানে গেছিলো। এটা কোনভাবেই কাকতালিয় হতে পারে না।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো মায়া। সে-ও চায়ের কাপে আস্তে আস্তে চুমুক দিচ্ছে।
“একবার ভাবুন, মিসকাতের কারণে লোকটার ছেলে পঙ্গু হয়ে গেছে, সঠিক বিচারও পায়নি…এর চেয়ে বড় মোটিভ আর কী হতে পারে?”
“হুম, মিসকাত যা করেছে সেটাকে অ্যাকসিডেন্ট বলা যায় না। ও ইচ্ছে করে, সজ্ঞানে গাড়িটা তুলে দিয়েছে।”
“মিসকাত তখন ড্রাঙ্ক ছিলো,” শুধরে দিলো চারু। সজ্ঞানে ছিলো বলা যাবে না।”
“যাই হোক, এটাকে আমি অ্যাটেম্প টু মার্ডারই বলবো।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু।
“তাহলে আপনি মনে করছেন, মিসকাতের এই অ্যাকসিডেন্টটা ধরে এগোলেই আসল সত্যটা জানা যাবে?”
মায়ার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো চারু। “আসল সত্য জানা যাবে কিনা জানি না, তবে আমি এই ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে চাইছি। বাইকার বাবুকে একজন সিনজি ড্রাইভার হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেলো। মনে রাখবেন, সে বাবুর মোবাইলফোন আর ব্যাগটাও নিয়ে গেছিলো। আর ওই ব্যাগেই ছিলো ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ড্রেস আর মুখোশটা।”
“তাহলে ঐ সিএনজি ড্রাইভারকে খুঁজে বের করতে হবে এখন?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু। “কিন্তু কাজটা কিভাবে করবেন?”
“এটা করতে খুব বেশি ঝক্কি পোহাতে হবে বলে মনে হচ্ছে না। অ্যাঞ্জেল বলেছে, কুড়িল বস্তিতে থাকে ঐ লোক। নামটাও বলেছে। আমাকে-চাঁন মিয়া। তাছাড়া ঐ কেসটার কাগজপত্র জোগাড় করলেও ওর ঠিকানাসহ অনেক কিছু জানা যাবে।”
“কিন্তু এতদিন পর কি লোকটা ওখানে আছে?”
“হুম, এটা একটা সমস্যা। যদি না থেকে থাকে তাহলেও ওখান থেকেই তাকে খুঁজে বের করার কাজটা শুরু করতে হবে।”
“গুড আইডিয়া,” একটু থেমে মায়া আবার বলল, “তাহলে কি মিসাতের অন্য বন্ধুদের সাথে এখন আর কথা বলবেন না?”
“আগে এটা খতিয়ে দেখি, তারপর দরকার হলে ওদের সাথে কথা বলবো।”
মায়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। “সিএনজি ড্রাইভারের পক্ষে কি এরকম একটা খুন করা সম্ভব?” অবশেষে নিরবতা ভাঙলো সে।
কাঁধ তুলল চারু। “একেবারে অসম্ভবও তো নয়।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো মায়া। কিন্তু মোবাইলফোন আর ব্যাগটা তো অ্যাকসিডেন্টের পর পর অন্য কেউ-ও সরিয়ে ফেলতে পারে, পারে না? মানে, সিএনজির ড্রাইভার ঘটনাস্থলে আসার আগেই সেগুলো চুরি হয়ে গেছিল কিনা কে জানে?”
“ওগুলো তখন চুরি হয়নি, সিএনজি ড্রাইভারই চুরি করেছে। কারণ হাসপাতালে নিয়ে আসার পর বাবুর মোবাইলফোন থেকে কল করে ওর বাসায় অ্যাকসিডেন্টের কথাটা জানানো হয়েছিলো।”
“কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। ঐ লোক কিভাবে জানতে পারলো বাবুর বন্ধু হয় মিসকাত?” একেবারে মোক্ষম প্রশ্নটা করলো মায়া।
“এটা আসলে এখনও বুঝতে পারছি না। এই একটা খটকা রয়ে গেছে। আশা করছি আরেকটু তদন্ত করলে এই প্রশ্নটার জবাবও পেয়ে যাবো।”
“তাহলে সিএনজি ড্রাইভার কোনো না কোনোভাবে বাবুর পরিচয় জানতে পেরে দ্রুত খুনের পরিকল্পনা করে ফেলেছিলো?”
“হুম। সেটাই তো মনে হচ্ছে।”
“কিন্তু হ্যালোউইনের ব্যাপারটা জানলো কিভাবে? আর কোথায় হচ্ছে সেটাই বা কিভাবে জানতে পারলো? বাবু নিশ্চয় তাকে এসব বলেনি?”
“এখন মনে হচ্ছে, বাবু সেটা বলেনি। তবে বাবু যে মিসকাতের বন্ধু এই পরিচয়টা সে যেভাবেই জেনে থাকুক, ওখান থেকেই বাকি তথ্যগুলো জানতে পেরেছিল। আমি অন্তত সেটাই মনে করছি।”
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল মায়া “ধরে নিলাম, সিএনজি ড্রাইভার যেভাবেই হোক জেনে গেলো গাজীপুরের কোথায় হ্যালোউইন পার্টি করছে মিসকাতরা, কিন্তু ওরকম একজন বয়স্ক মানুষের পক্ষে কি এ কাজটা করা সম্ভব হবে? পার্টিতে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সেজে যে গেছিলো তাকে দেখে কিন্তু কেউ সন্দেহ করেনি ওটা বাবু নয়।”
“ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মুখোশ আর ড্রেসের আড়ালে কে ছিলো এটা কেউ জানে না। আর এটা না জানলে বয়সের আন্দাজ কিভাবে করা সম্ভব?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো মায়া। তাকে দেখে মনে হলো সে এই ব্যাখ্যাটায় সন্তুষ্ট।
“মনে রাখবেন, ফ্রাঙ্কেনস্টাইন কিন্তু কারো সাথে কথা বলেনি। অদ্ভুত আর অস্বাভাবিক আচরণ করেছিলো।”
“হুম। সেটা অবশ্য সত্যি।”
“ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যে-ই সেজে থাকুক সে নিশ্চয় জানতে, কথা বললে ধরা পড়ে যাবে। তাই বাধ্য হয়েই অমন আচরণ করেছিলো।
“ঠিক।”
“মুখোশ আর পোশাকের আড়ালে থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলো সে। কিন্তু ওদের সাথে কথাবার্তা বললে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো তাই স্বাভাবিক আচরণ করেছে।”
“হ্যালোউইন পার্টিতে অবশ্য এমন আচরণকে ড্রামাটিক হিসেবেই দেখেছে সবাই। এ নিয়ে খুব একটা সন্দেহ করেনি কেউ।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু।
এমন সময় টোটা ঘরে ঢুকলো। এই বামনকে দেখে এখন আর সাকাসের জোকার বলে মনে হয় না। ডক্টরের সাথে থেকে থেকে বেশ গুরুগম্ভির ব্যক্তিত্ব অর্জন করে ফেলেছে। তার ভাবসাব দেখলে চারুর অবশ্য হাসিই পায়।
“আপনাদেরকে এখানেই লাঞ্চ করতে বলেছেন ডক্টর, টোটা বলল অনেকটা হুকুম জারি করার মতো ভঙ্গি করে। কিন্তু বামনদের নাকিকণ্ঠের কারণে সেটা ইচরেপাকা ছেলেপেলেদের কথার মতোই শোনালো।
“ডক্টর কি ঘুম থেকে উঠেছেন?” মায়া জানতে চাইলো।
“না। উনি ঘুমানোর আগেই আমাকে বলে দিয়েছিলেন।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
বামনটা চলে যাবার পর মায়া ফিরে তাকালো চারুর দিকে। “একজন সিএনজি ড্রাইভারের পক্ষে এতটা স্মার্টলি কাজ করা কেমন জানি বেখাপ্পা বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। তার ছেলে হলেও এটা মেনে নেয়া যেত।”
“আপনি কি করে নিশ্চিত হলেন কাজটা ঐ ড্রাইভার একাই করেছে?”
অবাক হলো মেয়েটি। “আপনি বলতে চাচ্ছেন কাজটা বাবা-ছেলে দু জনে মিলে করেছে?”
“সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেয়া যায় না। বরং এটাই বেশি যৌক্তিক বলে মনে হয়।”
“তাই নাকি।”
“হুম। আমরা কিন্তু জেনে গেছি, গাজীপুরে যে সিএনজিতে করে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন গেছিলো সেই সিএনজিটা নিয়েই সে খুন করার পর চলে যায়। ঐ সিএনজির একজন ড্রাইভারও ছিলো। প্রথমে ভেলেছিলাম ওটা নিছক ভাড়া করা সিএনজি হবে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অন্য কিছু। একজন ড্রাইভার আর অন্যজন খুনি। সুতরাং সিএনজি ড্রাইভার আর তার ছেলের ব্যাপারটা উড়িয়ে দেয়া যায় না।”
মাথা দোলাল মায়া। “আপনি তো বললেন ঐ ছেলেটা অ্যাকসিডেন্টের পর পঙ্গু হয়ে গেছিলো, তার পক্ষে কী করে এটা করা সম্ভব হবে?”
কাঁধ তুলল চারু। “দু-বছর আগের ঘটনা সেটা। এখন ছেলেটা কি অবস্থায় আছে সেটা কিন্তু আমরা জানি না। তাছাড়া প্রস্থেটিক পা ব্যবহার করতে পারে সে।”
ভুরু কুঁচকে ফেলল মায়া। “আমাদের ডক্টরের মতো?”
“হুম। আর ডক্টরকে প্রথম দিন দেখে আমরা কিন্তু বুঝতে পারিনি তার একটা পা প্রস্থেটিক।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সাবেক আর.জে। “হুম। উনি দেখানোর আগে আমরা একদমই বুঝতে পারিনি।”
“সেটাই। আপনি যদি খুব দ্রুত রপ্ত করতে পারেন তাহলে একটা প্রস্থেটিক পা দিয়ে একেবারে স্বাভাবিক মানুষের মতো হাঁটতে পারবেন। হয়তো দৌড়াতে গেলে সমস্যা হবে, কিন্তু হাটাচলা করলে ধরার উপায় থাকবে না।”
“তা ঠিক। তাহলে বাবা বাইরে ছিলো, ছেলে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ড্রেস আর মুখোশ পরে মিসকাতদের বাড়িতে ঢুকে কাজটা করে সবার নজর এড়িয়ে চলে গেছে?”
“হুম, এরকমটাও হতে পারে আবার উল্টোটা হতে পারে। ছেলেটা সিএনজি চালিয়েছে, কাজটা করেছে বাবা।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো মায়া। এখন আমাদের কাজ হলো ঐ সিএনজি ড্রাইভারকে খুঁজে বের করা।”
“ড্রাইভার আর তার ছেলেকে,” শুধরে দিলো চারু।
“হুম। আমরা তাহলে লাঞ্চ করার পর ওখানে যাচ্ছি?”
মায়ার দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাল ন্যাশনালিস্ট সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারি। “এখন গেলে কোনো লাভ হবে না।”
“কেন?”
“লোকটা সিএনজি চালায়, এখন নিশ্চয় বাসায় নেই। আমার ধারণা রাত বারোটার আগে ঐ লোককে তার ঘরে পাওয়া যাবে না।”
“কিন্তু ছেলেকে তো পেতে পারি?”
“বাবা আর ছেলেকে একসঙ্গে পেতে হবে,” বলল চারু। “নইলে যেকোনো একজন সতর্ক হয়ে যাবে। গা ঢাকাও দিতে পারে।”
“তাহলে আমরা অত রাতেই যাচ্ছি ওখানে?”
আবারো মাথা দোলাল চারু। “শুধু আমি যাচ্ছি, আপনি না।”
ভুরু কুচকে তাকালো মেয়েটি।
“অত রাতে ওরকম বস্তিতে একজন মেয়েকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।”
“রাবিশ!” ঝট করে বলে উঠলো মায়া। যেন তাকে মেয়ে বলাতে চটে গেছে। “আমার সিকিউরিটি আমি দেখবো, আপনাকে ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।”
“আশ্চর্য, আপনি অতো রাত পর্যন্ত বাইরে থাকবেন? আপনার বাসা এটা অ্যালাউ করবে?”
“অ্যালাউ করবে মানে?” রেগেমেগে বলল সে। “আমি একা থাকি। উইথ অ্যা হাউজমেইড। হাজব্যান্ড কিংবা বাবা-মা’র সাথে না।”
“ওহ্,” চারু আর কিছু বলল না।
“নেক্সট টাইম আপনি আর কখনও মেয়ে মেয়ে’ করবেন না। আই হেইট দিস্।”
দু-হাত তুলে আত্মসমপর্নের ভঙ্গি করলো চারু আহসান। “ওকে ওকে…করবো না! আপনি শান্ত হোন।”
“তোমরা চাইলে আমি সিকিউরিটির ব্যবস্থা করে দিতে পারি।” ডক্টরের ভরাট আর ক্লান্ত কণ্ঠটা শুনে চমকে উঠলো তারা দুজন।
একটা হুইলচেয়ারে নাইটড্রেস পরে বসে আছেন ডক্টর হুসেন, পেছনে দাঁড়িয়ে আছে টোটা। বামনটাকে দেখা যাচ্ছে না, তবে হুইলচেয়ারের নিচে তার পা দুটো বলে দিচ্ছে চেয়ারটা সে-ই ঠেলে এনেছে।
তারা দু-জন উঠে দাঁড়ালো।
“আপনার শরীর কেমন, ডক্টর?” জানতে চাইলো মায়া।
“বেশ ভালো। রেস্ট নিতে নিতে হাপিয়ে উঠেছি। কিন্তু ঐ নচ্ছার ডাক্তার বলেছে আমাকে আরো দুটো দিন এভাবে থাকতে হবে। ও মাশাল ল জারি করেছে। এরজন্যে ওকে আমি শাস্তি দেবো। কঠিন শাস্তি।”
মায়া হেসে ফেলল। “ডাক্তার কি আপনার পরিচিত?”
“হুম। বয়সে আমার চেয়ে দশ-বারো বছরের ছোট, কিন্তু বন্ধুই বলতে পারো। আমরা একসাথে দাবা খেলি, তাসও পিটাই। ব্যাটা আবার ধুরন্ধর গ্যাম্বলার। কোনো কোনো দিন আমাকে ফতুর করে দেয়।”
ডক্টর আজফার জুয়াখেলার কথা অকপটে বলে দেয়ায় মায়া খুবই অবাক হলো।
আজফার হুসেন তাদের দুজনকে ইশারা করলেন বসে পড়ার জন্য। “যা বলছিলাম, তোমরা চাইলে আমি কিন্তু সিকিউরিটি প্রোভাইড করতে পারবো।”
“সেটার কোনো দরকার দেখছি না,” চারু বলল। “তারচেয়ে বরং আপনি ওকে বলুন, অত রাতে আমার সাথে ঐ বস্তিতে যেন না যায়।”
মায়া কটমট চোখে তাকালো চারুর দিকে। “স্টুপিড!” দাঁতে দাঁত পিষে, ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো সে।
কথাটা শুনে চারু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে।
“শোনো,” হুইলচেয়ারটা এবার নিজেই চালিয়ে একটু সামনে চলে এলেন ডক্টর। টোটা চুপচাপ ঘর থেকে চলে গেলো। “মায়াকে বাদ দিয়ে তুমি কোথাও যেতে পারো না। তোমরা এক টিমে কাজ করছে, এটা ভুলে গেলে চলবে না।”
চারু কিছু বলল না। ডক্টর যে মায়ার পক্ষ নেবেন সেটা তার জানাই ছিলো।
“আমি তোমাদের সিকিউরিটির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কখন যাবে বলো?”
ডক্টরের দিকে চেয়ে রইলো চারু। “সিকিউরিটি মানে? কি ধরণের সিকিউরিটি?”।
“দু-জন সশস্ত্র বডিগার্ড হলে চলবে? নাকি আরো বেশি?”
“দু-জন হলেই চলবে।”
“গুড। এছাড়া যেখানে যাবে সেখানকার লোকাল থানায় বলে দেয়া থাকবে। চাইলে ওদের সাপোর্টও নিতে পারবে।”
“দ্যাটস এনাফ।” মায়ার দিকে তাকালেন ডক্টর। “ঠিক আছে?”
“থ্যাঙ্কস, ডক্টর। আসলে সিকিউরিটি না থাকলেও আমার কোনো সমস্যা হতো না। আমি অন্যদের মতো অতোটা ভীতু নই।”
কথাটা খোঁচা হিসেবেই নিলো চারু, তবে কিছু বলল না।
“গুড।” ডক্টর হেসে বললেন। “আমি সাহসিদের পছন্দ করি। বিশেষ করে সাহসি মেয়ে। প্রকৃতিতে দেখবে নারীরাই বেশি সাহসি। পশুপাখি, জীবজগতে স্ত্রী প্রজাতিটি যে সাহস রাখে সেটা কি পুরুষ প্রজাতিটির মধ্যে দেখা যায় না।”
মায়ার চোখেমুখে হাসির ঝিলিক দেখা গেলো।
“শুধু সাহসই না…সেই সাথে রেসপন্সিবিলিটিও।”
আলতো করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল চারু।
“কিন্তু তোমরা ওখানে যাচ্ছো কেন, সেটা কি আমি জানতে পারি?”
চারু কিছু বলতে যাবে তার আগেই মায়া বলে উঠলো, “এক সিএনজিওয়ালা আর তার ছেলেকে সাসপেক্ট হিসেবে দেখছেন উনি। ঐ লোকটা কুড়িল বস্তিতে থাকে।”
ডক্টরের কপালে ভাঁজ পড়লো। যেমন বিস্মিত তেমনি সন্দেহগ্রস্ত তার অভিব্যক্তি। “সিএনজিওয়ালা?”
“বছর দুয়েক আগে মিসকাত কুড়িল বস্তির এক সিএনজি চালকের ছেলেকে অ্যাকসিডেন্ট করেছিলো। ছেলেটা মামলা করলেও হেরে যায়। আমরা জানতে পেরেছি ছেলেটা পঙ্গু হয়ে গেছে।”
চারুর দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন ডক্টর আজফার। যারপরনাই বিস্মিত বোঝাই যাচ্ছে। এ কারণে সে মিসকাতকে খুন করবে?”
“ওই লোক আর তার ছেলে কাজটা করেছে কিনা জানি না, কিন্তু বাইকার বাবুকে এক সিএনজিচালক হাসপাতালে নিয়ে গেছিলো…ঐ একই লোক বাবুর ব্যাগ আর ফোনটা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। সেই ব্যাগে ছিলো কস্টিউম আর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মুখোশ…ওসব পরেই খুনটা করেছে খুনি।” একটু থামলো যুক্তিবাদি। “কিন্তু একজন সিএনজিওয়ালা কেন এসব জিনিস চুরি করে মিসকাতকে খুন করবে-অনেক ভেবেও এ প্রশ্নের জবাব পাইনি এতদিন। এখন সবকিছু জানার পর মনে হচ্ছে সিএনজিওয়ালার ব্যাপারে একটু খতিয়ে দেখা দরকার।”
অনেকক্ষণ চুপ মেরে রইলেন ডক্টর। “তাহলে কখন যাচ্ছো?” জানতে চাইলেন অবশেষে।
“রাত বারোটার পর,” বলল চারু আহসান।
“ঠিক আছে। আমি সিকিউরিটির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
.
অধ্যায় ২৭
সিকিউরিটির ব্যাপারটা প্রথমে মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও সঙ্গে থাকা দু-জন সশস্ত্র বডিগার্ড নিয়ে কুড়িল বস্তিতে যাবার সময় নিজেকে ভিআইপি বলে মনে হচ্ছে চারুর।
মায়ার সাথে গাড়ির পেছনের সিটে বসে আছে সে। গাড়িটা চালাচ্ছে বডিগার্ডদের একজন, মাথায় ক্যাপ পরা কালোমতো এক যুবক। ছয়ফুট দুই ইঞ্চির কম হবে না। পোলো শার্টের আড়ালে পেশিবহুল শরীরটা স্পষ্ট বোঝা যায়। তার কোমরে, বেল্টের পাশে দৃশ্যমান একটি অটোমেটিক পিস্তলের হোলস্টার। তার সঙ্গি বসে আছে তার পাশেই। পুরোপুরি ন্যাড়া মাথা। শ্যামবর্নের লোকটার ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি-গোঁফ চেহারায় জাঁদরেল একটি ভঙ্গি দান করেছে। সঙ্গির মতো সে-ও পেশিবহুল, তবে উচ্চতায় একটু কম। ছয়ফুটের কাছাকাছি হবে। মুহিদ নাম বলেছে সে। ক্যাপওয়ালার নাম আলম। মায়া আর চারুর সাথে খুব বেশি কথা বলেনি তারা। যেন প্রোগ্রাম করা রোবট। দরকারের বাইরে একটা হু-হা-ও করছে না।
চারু নিশ্চিত, এরা কোনো সিকিউরিটি এজেন্সির লোক। ডক্টর ওদেরকে আজকের জন্য ভাড়া করেছেন।
এই নিশুতি অভিযানের জন্য মায়া তার রেগুলার ড্রেসকোড থেকে বেরিয়ে এসেছে। তার পরনে এখন কালো প্যান্ট সাদাশার্ট আর ধূসর রঙের ব্লেজার। একেবারে অফিস এক্সিকিউটিভদের মতো লাগছে তাকে। চুলগুলো ব্যাব্রাশ করে পেছনে খোঁপা করে রেখেছে। চোখে পরেছে চশমা। চারুর ধারণা এই চশমার কোনো পাওয়ার নেই।
“মাইনাস না প্লাস?” মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল সে।
“কি?”
“আপনার চশমার কথা বলছি।”
“প্লেইন।” বলেই সামনের দিকে তাকালো মায়া।
সে-ও দুটো রোবটের উপস্থিতিতে রোবোটিক আচরণ করছে। তবে চারুর মনে হচ্ছে, ভেতরে ভেতরে এখনও রেগে আছে মেয়েটি।
“চশমা পরলে অবশ্য আপনাকে অন্য রকম লাগে।”
চারুর দিকে তাকালো মায়া। “কি রকম লাগে?”
“অঙ্কের ম্যাডামদের মতো।” কথাটা বলেই মুচকি হাসলো।
“হুম,” বলেই সামনের দিকে তাকালো আবার। যেন বিষয়টা খুবই স্বাভাবিক।
“অবশ্য আমাদের কলেজের বায়োলজির ম্যাডামকেও চশমা পরলে ঠিক এরকম দেখাতো।”
“আর আপনি ক্লাশের পড়া বাদ দিয়ে সেই ম্যাডামের দিকে হা করে চেয়ে থাকতেন, তাই না?” রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকে নির্বিকারভাবে বলল মায়া।
“আমি হা করে তাকিয়ে থাকতাম?”
“হুম। ঠিক এখন যেমন আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।”
কিছু বলতে গিয়েও বলল না চারু। শুধু মুখটা ঘুরিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলো। সত্যি বলতে গাড়িতে ওঠার পর সে মায়ার দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছিলো।
“বস্তির বাইরে গাড়ি থামাবো, ম্যাডাম?” মুহিদ নামের লোকটা জানতে চাইলো।
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মায়া তাকালো চারুর দিকে।
“হুম। বাইরেই রাখেন।”
তাদের গাড়িটা বস্তির বাইরে থামলে কিছু নিশাচর আর নেশাখোর দূর থেকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। বিড়ি-সিগারেট ফুঁকতে থাকা কিছু লোক এখানে ওখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে। একটা চায়ের টঙে বসে আছে অল্পবয়সি তিনজন ছেলে। তাদের সবার হাতে সিগারেট আর চা। পরনের জামা-কাপড় দেখে মোটেও বস্তির বলে মনে হচ্ছে না। এরা সম্ভবত মাদকের সন্ধানে এখানে এসছে। গাঁজা-ফেন্সিডিল খেয়ে প্রচুর চিনি দিয়ে মিষ্টি চা খাচ্ছে এখন। টঙের দোকানিও ভয়ার্ত আর সতর্ক চোখে চেয়ে আছে গাড়িটার দিকে।
“আপনারা কেউ গাড়ি থেকে নামবেন না,” বলেই দরজা খুলে বের হয়ে গেলো চারু।
এমনিতেই সে বেশ সাহসি, সঙ্গে সশস্ত্র ঠেডিগার্ড থাকায় তার সাহস এখন তুঙ্গে। গটগট করে টঙ দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
সঙ্গে সঙ্গে ভদ্র পোশাকের অল্পবয়সি তিনজন ছেলে চায়ের কাপ রেখে সটকে পড়লো আস্তে করে। চারু ফিরে তাকালো পেছনে পার্ক করা গাড়ির দিকে। মায়া আর মুহিদ গাড়ি থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারলো, ওদের দেখে ছেলেগুলো অন্য কিছু ভেবেছে। বিশেষ করে মুহিদের কোমরে পিস্তল আর মায়ার এক্সিকিউটিভ ড্রেস এক ধরণের ভীতি আর রহস্য তৈরি করেছে।
চারু হাত তুলে মায়া আর মুহিদকে যেখানে আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকার ইশারা করলো। এরপর ভয়ার্ত দোকানিকে জিজ্ঞেস করলো সে, “নাম কি আপনার?”
“হু-হু-হুরা…হুরা মিয়া, তোতলালো লোকটা।
“সিএনজি চালায় যে চাঁন মিয়া সে কোন ঘরে থাকে?”
দোকানি একটু ভেবে জবাব দিলো, “অয় তো ভিতরে থাহে,” আঙুল তুলে বস্তির ভেতরের দিকে ইঙ্গিত করলো লোকটা। “র্যাললাইনের ধারে।”
“এখন কি ঘরে আছে?”
“কইবার পারুম না, ছার,” ঢোক গিলল হুরা মিয়া। “সারাদিন তো দেহি নাই।”
“ওর ঘরটা চেনে এরকম কেউ আছে আশেপাশে?” একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অপেক্ষাকৃত সাহসি কিছু লোকজনকে দেখিয়ে বলল সে।
“ওই ট্যাপা…এদিকে আয়।” বিড়ি ফুঁকতে থাকা হ্যাংলা মতোন এক লোককে ডাকলো হুরামিয়া।
হ্যাংলাটা বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে কাছে চলে এলো। তাকে দেখে কম বয়সি বলে মনে হলেও সত্যিকারের বয়স মনে হয় বেশিই হবে। চারুদের দেখে সে মোটেও ভয় পাচ্ছে না।
“কি হইছে?”
“ছারেরে চাঁন মিয়ার ঘরটা দেখাইয়া দিয়া আয় তো।”
চারুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলো ট্যাপা নামের লোকটা। “আমার লগে আহেন,” বলল সে।
হনহন করে বস্তির দিকে এগিয়ে গেলো ট্যাপা। তাকে অনুসরণ করলো চারু। একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো মায়া আর মুহিদও আসছে তাদের পেছন পেছন।
এখানে আসার আগেই মুহিদ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, তার দৃষ্টির আড়ালে থাকা যাবে না। তবে চাইলে তারা দূরত্ব বজায় রাখবে। এর কোনো ব্যত্যয় করা যাবে না।
দু-পাশে বস্তির ঘুপচি ঘরগুলোর মাঝখান দিয়ে একটি সরু কাঁচা পথ থাকলেও ট্যাপা তাদেরকে বস্তির ডানপাশ দিয়ে নিয়ে চলল। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। পাশ দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। কিছুদূর যাবার পর বামে মোড় নিয়ে বস্তির পেছন দিকে চলে এলো তারা। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে বস্তিটা শেষ হবার পর এক চিলতে মাঠের মধ্যে একটি জায়গা আছে এখানে, ভাঙ্গারির জিনিসপত্রের স্তূপ, সারি করে চেইন দিয়ে বাধা কিছু রিক্সা আর পুরনো টায়ার পড়ে আছে। এই এক চিলতে জায়গাটার পরই বাঁক নিয়ে চলে গেছে রেললাইন। প্রায় অর্ধবৃত্তাকারের রেললাইন আর তার বিপরীত দিকে কুড়িল সড়ক, এর মধ্যেই গড়ে উঠেছে এই বস্তি।
ইনফর্মার ট্যাপা থমকে দাঁড়ালো একটা টিনশেডের ঘরের সামনে এসে। “এইযে…এইটা চাঁন মিয়ার ঘর।”
“ঠিক আছে,” চারু বলল।
ট্যাপা নামের লোকটা আর কিছু না বলে চারুর পেছনে আসতে থাকা মায়া আর মুহিদকে আড়চোখে দেখে চলে গেলো চুপচাপ।
“এই ঘরে থাকে?” কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো মায়া।
“হুম,” বলল চারু।
মুহিদ বিশ-ত্রিশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার বামকানে ব্লুটুথ ইয়ারফোন লাগানো। সেটাতে কারো সাথে কথা বলছে। সম্ভবত আলমের সাথে। সে গাড়ি পাহারা দিচ্ছে। এরকম বস্তির বাইরে গাড়ি রেখে আসাটা বুদ্ধিমানের কাজ হতো না।
টিনশেডের ঘরটার দরজা আর একমাত্র জানালা বন্ধ আছে। তবে জানালার কপাটের ফাঁকফোকর দিয়ে লালচে বাতির আলো দেখা যাচ্ছে ভেতরে। কেউ আছে কিনা সেটা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না।
দরজায় টোকা দিতে গিয়ে থেমে গেলো চারু। ভেতরে কেউ কথা বলছে বেশ নিচু কণ্ঠে। কণ্ঠটা বেশ জড়ানো। শব্দগুলো বাইরে থেকে। একটুও বোঝা যাচ্ছে না। তবে একটাই মাত্র কণ্ঠ কথা বলছে কারোর সঙ্গে।
মোবাইলফোনে?
ছেলেটার সঙ্গে?
বেলিফুলের হালকা গন্ধ নাকে আসতেই চারু টের পেলো মায়া তার খুব কাছে চলে এসেছে। মেয়েটা আজ জেসমিন ফ্লেভারের বডিস্প্রে ব্যবহার করেছে।
মেয়েটা দরজার খুব কাছে এসে কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে। তাদের দুজনের চোখাচোখি হলো। মায়াও কিছু বুঝতে পারেনি কথাগুলো।
বাপ-ছেলে কথা বলছে?
.
অধ্যায় ২৮
বেশ কয়েক বার দরজায় টোকা দেবার পর আস্তে করে সেটা খুলে গেলো।
চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে দরজার একটা কপাট খুলে বাইরে তাকালো মাঝবয়সি এক লোক। মাঝারি উচ্চতা, মুখে বাড়ন্ত দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো। লুঙ্গি পরা খালি গায়ের শরীরটা বেশ শুকনো। মেদহীন বলা যেতে পারে আবার রোগাপটকা বললেও ভুল বলা হবে না। গায়ের রঙ রোদেপোড়া। একহাতে কপাটটা ধরে রেখেছে। অন্যহাতটা পেছনে।
“আপনি কি চাঁন মিয়া?” জানতে চাইলে চারু।
পাঁচফুট এগারো ইঞ্চির উচ্চতার চারু আহসান পাঁচফুট চার ইঞ্চির লোকটার মাথার উপর দিয়ে এক নজর ঘরের ভেতরটাও চোখ বুলিয়ে নিলো। কিন্তু ভেতরে কাউকে দেখতে পেলো না। তার মানে, ফোনে কথা বলছিলো এতক্ষণ। মৃদু লালচে আলোতেও ঘরের এককোণে দুটো ক্রাচ নজরে পড়লো। তার ধারনাই ঠিক, ছেলেটা এখন আর ক্রাচ ব্যবহার করে না, সম্ভবত প্রস্থেটিক পা ব্যবহার করে।
চাঁন মিয়া প্রশ্নের জবাব দেবার আগে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মায়াকে ভালো করে দেখে নিলো। তার হিসেব মিলছে না। রাতের এ সময় তার সামনে যে দু-জন দাঁড়িয়ে আছে তারা না পুলিশ, না বস্তির লোক।
“হ, আস্তে কলে বলল চাঁন মিয়া। কপালে ভাঁজ পড়লো তার। “আপনেরা কারা?”
“আমাদেরকে চিনবেন না, আমরা…” কথা খুঁজে পেলো না চারু।
“আমরা একটা এনজিওতে কাজ করি,” পেছন এগিয়ে এসে বলল মায়া। “যেসব মানুষজন সুবিচার পায় না তাদের সাহায্য করি আমরা।”
মেয়েটার এমন কথায় মুগ্ধই হলো চারু।
চাঁন মিয়া বুঝলো কী বুঝলো না কে জানে, সন্দেহগ্রস্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।
চাঁন মিয়াকে সরাসরিই বলল চারু, “আপনার ছেলে কোথায়?”
লোকটার সন্দেহ এবার প্রকট হলো। “ওরে ক্যান চান?” বাজখাই গলায় বলল সিএনজি ড্রাইভার।
“আপনার ছেলে অ্যাকসিডেন্ট করেছিলো, কিন্তু সুবিচার পায়নি,” মায়া বলতে লাগলো, “আমরা সেটা খতিয়ে দেখতে চাচ্ছি। সেজন্যেই আপনাদের সাথে একটু কথা বলতে চাই।”
চোখেমুখে আরো গভীর সন্দেহ ফুটে উঠলো চাঁন মিয়ার। “এত রাইতে এই বস্তিতে আইছেন কথা কওনের লাইগ্যা??”
“আপনি তো সিএনজি চালান,” চারু বলল, “দিনের বেলায় আপনাকে পাওয়া মুশকিল…তাই…”।
মায়া আর চারুর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে বার কয়েক তাকালো সিএনজি ড্রাইভার। “কি কথা কইবার চান, আমারে কন?”
“আপনার ছেলে থাকলে বেশি ভালো হতো। আপনাদের দুজনের সাথেই কথা বলা দরকার। সে কখন আসবে?”
“কহন আসে কহন যায় আমি কী জানি। রোজ রোজ তো আসেও না।”
“ও কি অন্য কোথাও থাকে?” মায়া জানতে চাইলো।
“না, এই মোকামেই থাকে। কই আর যাইবো! তয় রোজ রোজ বাড়িত আসে না। তার যহন ইচ্ছা আসে, আবার চইলা যায়।”
অবাক হলো চারু। পঙ্গু একটা ছেলে কোথায় থাকে, কী করে সেটা তার বাবা জানে না! “মামলায় হেরে যাবার পর আপনারা তো আর উচ্চ আদালতে যাননি, তাই না?” এটা সে অ্যাঞ্জেলের কাছ থেকেই জেনে নিয়েছিলো।
“গিয়া কি কুনো লাভ হইতো?” পাল্টা বলল চাঁন মিয়া। “খামাখা উকিলের পকেটে ট্যাকা ঢাইল্যা কী লাভ।”
“আপনার ছেলে চায়নি উচ্চ আদালতে যেতে? শুনেছি সে খুবই শক্তভাবে মামলাটা লড়েছিলো।”
চোখেমুখে বিষণ্ণভাব ফুটে উঠলো চাঁন মিয়ার। “নাহ্…মামলায় হারনের পর ও আর কিছু চায় নাই। বুইঝা গেছিল, কুনো লাভ হইবো না।”
“আপনার ছেলে এখন কি করে?”
চারুর দিকে তাকিয়ে রইলো চাঁন মিয়া। তার চোখমুখ কেমন উন্মাদগ্রস্ত। চোখের মণিদুটো যেন শূন্যে দুলতে থাকা দুটো বিন্দু। “কী আর করবো…ওর আর এহন কিছু করনের নাই।”
আস্তে করে পাশ থেকে মায়ার দীর্ঘশ্বাসটা শুনতে পেলো চারু আহসান। “আপনি কি জানেন, যে ছেলেটা আপনার ছেলেকে গাড়িচাপা দিয়েছিলো সে খুন হয়েছে গত বছর?”
কথাটা শোনামাত্র চাঁন মিয়ার চেহারা মুহূর্তে পাল্টে গেলো। চোখেমুখে কেমন ক্ষুব্ধ একটা অভিব্যক্তি এনে বলল, “আপনেরা আসলে কারা?…পুলিশ?”
“আরে না,” চারু জোর দিয়ে বলল। “বললাম না, আমরা একটা…এনজিও থেকে এসেছি।”
“আমাদের দেখে কি পুলিশ মনে হচ্ছে আপনার?” হেসে বলল মায়া।
“কে খুন হইছে না হইছে সেইটা আমারে কইতে আইছেন ক্যান, অ্যাঁ?” সিএনজি ড্রাইভার চেঁচিয়ে বলল। “বড়লোকের নেশাখোর পোলাপান মরলো না বাঁচলো তাতে আমার কী!”
মিসকাত নেশা করতো কথাটা শুনে অবাক হলো চারু। এই সিএনজি ড্রাইভার এটা কিভাবে জানলে? “আপনি কিভাবে জানলেন ঐ ছেলেটা নেশা করতো?” প্রশ্নটা না করে পারলো না সে।
“নেশা কইরা গাড়ি চালাইয়াই তো আমার পোলাটারে মারছে কুত্তারবাচ্চায়!”
চারু এবার বুঝতে পারলো। মিসকাত অ্যাকসিডেন্ট করার সময় যে মদ্যপ ছিলো চাঁন মিয়া সেটা জানে।
“আপনেগো মতলব কি, অ্যাঁ?” বাজখাই গলায় জানতে চাইলো লোকটা।
“আমি তো বললামই আমরা একটা এনজিও থেকে—”
চারুর কথা শেষ হবার আগেই ধমক দিয়ে বলে উঠলো সুরুজের বাপ, “রাখেন আপনের এনজিও!” তারপর গভীর করে দম নিয়ে বলল, “হুনেন, আমার পোলার মনে অনেক দুকখু, ওরে আর ডিসটাব কইনে না। ওরে ওর মতোন থাকবার দেন। আমার মনেও অনেক কষ্ট, আমারেও জ্বালায়েন না। আমি কইলাম ভালার ভালা আবার খারাপের খারাপ। বেশি জ্বালাইলে…
চারু খেয়াল করলো চাঁন মিয়ার ভাবভঙ্গি মুহূর্তে উন্মাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। চোখদুটো দিয়ে যেন আগুনের হলকৗ বের হচ্ছে এখন।
হঠাৎ পেছনে থাকা বামহাতটা সামনে চলে এলো তার। সেই হাতে একটা দা।
ভয়ে এক পা পিছিয়ে গেলো চারু। মায়া সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুটস্বরে কিছু বলেই চারুর বামহাতটা ধরে ফেলল আনমনে।
দায়ের চেয়েও ভীতিকর ব্যাপার হলো সিএনজি ড্রাইভারের চোখেমুখের অভিব্যক্তি। তার লাল টকটকে চোখ দুটো যেন ঠিকরে বের হয়ে যেতে চাইছে। যে হাতে দা-টা ধরা সেটা তার সমস্ত শরীরের সাথে মৃদু কাঁপছে।
কয়েক মুহূর্তের জন্য চারু কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না। তার সাহায্যে এগিয়ে এলো বডিগার্ড লোকটা। মুহূর্তে হাতে পিস্তল তুলে নিয়েছে সে। বোঝাই যাচ্ছে নিজের কাজে বেশ দক্ষ।
“উল্টাপাল্টা কিছু করার কথা চিন্তাও করবেন না!” দৃঢ়ভাবে বলল মুহিদ। চারুর ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে পিস্তলটা তাক করে রেখেছে চাঁন মিয়ার দিকে।
সিএনজি ড্রাইভার মুহিদকে পাত্তাই দিলো না। দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো, “এইহানে যদি আর আইছোস…তাইলে মাথা নিয়া আর বাড়িত যাওন লাগবো না! ঘ্যাচাং কইরা একটা কোপ মাইরা দিমু!”
মুহিদ আস্তে করে একহাতে পিস্তলটা তাক করে রেখে চারুর কাঁধে হাত রাখলো। মায়া আর চারুকে পিছিয়ে যাওয়ার জন্য ইশারা করলো সে।
চারু আর মায়া কয়েক পা পিছিয়ে গেলে মুহিদও পিস্তল তাক করে পিছু হটলো।
চাঁন মিয়ার সাথে দূরত্বটা বাড়িয়ে তোলার পর নিশ্চিত হলো, এখন আর বিপদের কোনো সম্ভাবনা নেই।
তারা যখন ত্রিশ গজ দূরে চলে এসেছে তখনই চাঁন মিয়া আবার নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।
“মাই গড!” অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো মায়া। যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলল সে। “কী ভয়ঙ্কর লোক।”
মুহিদ পিস্তলটা কোমরে খুঁজে বলল, “লোকটা মেন্টালি সুস্থ না। এরকম মানুষ কখন কী করে বসে কোনো ঠিক নেই।”
চারু কিছু বলল না।
এরইমধ্যে বস্তির কিছু বাসিন্দা জড়ো হতে শুরু করেছে। উৎসুক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত। তাদের সবার দৃষ্টি এক নারী আর দু-জন। পুরুষের দিকে-যাদেরকে দেখেই বলে দেয়া যায় এই বস্তির কেউ না।
“কেউ যদি কিছু জিজ্ঞেস করে কোনো কথা বলবেন না,” মুহিদ ইন্সট্রাকশন দিলো তাদেরকে। “চুপচাপ আমার সাথে আসুন। কোনো সমস্যা নেই।”
চারু চুপচাপ মুহিদের কথা মেনে নিলো। বস্তি থেকে তারা বের হতে যাবে এমন সময় ভুতের মতো নাজেল হলো ট্যাপা নামের সেই লোকটি, যে
তাদেরকে চাঁন মিয়ার ঘরটা চিনিয়ে দিয়েছিলো।
“কেসটা কি, ছার?” কৌতূহলি হয়ে জানতে চাইলো সে। “চাঁন মিয়া কুনো আকাম করছেনি?”
ভুরু কুচকে লোকটার দিকে তাকালো চারু। “না।” তারপর লোকটাকে অবজ্ঞা করে মায়াকে নিয়ে মুহিদের কাছে এগিয়ে গেলো।
“কিছু একটা তো করছেই…” তাদের পেছন পেছন আসতে আসতে বলল ট্যাপা।
চারু কোনো জবাব দিলো না। ছেলেটাকে সুবিধার বলে মনে হচ্ছে না।
“কিছু না করলে এত রাইতে আপনেরা ওরে ক্যান খুঁজতে আইবেন? আমি এই বস্তির ইনফর্মার…এইহানে কি অয় না অয় সব আমারে রিপুট করন লাগে পুলিশের কাছে। আপনে আমারে খুইল্যা কইলে হেল্পও করবার পারি।”
“আচ্ছা, তুমি তাহলে এই বস্তির সব খবর রাখো?” চারু আগ্রহি হলো ছেলেটার ব্যাপারে।
নোংরা দাঁত বের করে হাসলো ইনফর্মার। “রাখি দেইখাই তো ওসিসাব আমারে ইনফর্মার বানাইছে।”
“বেশ ভালো,” চারু বলল। “তাহলে আমাদের জন্যে একটা কাজ করে দিতে পারবে?”
“কন দেহি কি কাম।” ট্যাপা খুশিই হলো কাজের কথা শুনে। তার নোংরা দাঁত বের হয়ে আছে খামোখা।
“এরজন্যে অবশ্য তোমাকে টাকা দেবো আমি, তবে কাজটা করতে হবে গোপনে।”
“কুনো সমস্যা নাই। পুরা গোপন থাকবো।”
“চাঁন মিয়ার ছেলে কোথায় থাকে, কখন আসে সেটা আমাদের জানাতে পারবে? আমি তোমাকে আমার মোবাইল নম্বরটা দিয়ে দিচ্ছি, তুমি শুধু ফোন করে আমাকে জানিয়ে দেবে ছেলেটা কখন আসে।”
ট্যাপা এমনভাবে তাকিয়ে রইলো চারুর দিকে যেন তার সাথে মশকরা করছে সে। “কার কথা কইতাছেন, কিছুই তো বুঝবার পারতাছি না?”
“চাঁন মিয়ার ছেলে…সুরুজ। ঐ যে, অ্যাকসিডেন্ট করে পঙ্গু হয়ে গেছিলো?”
ট্যাপা চোখ পিটপিট করে চেয়ে রইলো।
“চাঁন মিয়া বলেছে, তার ছেলে কখন আসে কখন যায় সে নাকি কিছুই জানে না। আমার মনে হয় সে মিথ্যে বলেছে।”
“মিছা কইছে মাইনে…ডাহা মিছা কইছে,” জোর দিয়ে বলল ইনফর্মার। “ব্যাটার মাথা তো পুরাই গেছে! কী কয় না কয়।”
চারু আহসান সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ছেলেটার দিকে। “আরে, হের পোলায় তো কবেই মইরা ভুত।”
.
অধ্যায় ২৯
চাঁন মিয়ার ছেলে সুরুজ মারা গেছে।
সত্যি হলো, ছেলেটা নিজের জীবন নিজেই নিয়েছে।
ট্যাপা একটু আগে যা বলেছে সেটা বিশ্বাস না করার কোনো কারণ নেই। ঘটনাটা বস্তির সবাই জানে। আজ থেকে বছরখানেক আগেই চাঁন মিয়ার ছেলে সুরুজ আত্মহত্যা করেছে।
মিসকাতের গাড়ির নিচে চাপা পড়ার পর উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে তার পায়ের অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে শুরু করে, অবশেষে গ্যাংরিন পেয়ে বসে। বাধ্য হয়ে জীবন বাঁচানোর জন্য হাটুর নিচ থেকে একটা পা কেটে বাদ দিতে হয়, পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে যায় ছেলেটা। তার সার্বক্ষণিক সঙ্গি হয় ক্রাচ। এর কিছুদিন পরই মিসকাত বেকসুর খালাস পেয়ে যায় তার করা মামলা থেকে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে ছেলেটা। অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে, এক রাতে সবার অলক্ষ্যে সুরুজ চলে যায় বস্তির পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রেললাইনের কাছে, ক্রাচ দুটো ফেলে শরীরটা পেতে দেয়
রেললাইনের উপরে।
“এই যে, ঠিক এইহানে…” ট্যাপা নামের লোকটি রেললাইনের একটি জায়গা দেখিয়ে বলল। “এইহানেই মাথাটা পাইত্যা দিছিলো।”
মায়ার গা গুলিয়ে উঠলো কথাটা শুনে।
“এক্কেবারে বাঙ্গির মতোন ফাইট্যা গেছিল মাথাটা। চিননের কুনো উপায়ই আছিলো না।”
চারু হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো রেললাইনের দিকে।
“পোলাটার মাথা কইলাম ভাল আছিল। পড়ালেখা করতো। সব সময় ফাস্ট হইতো। ওর বাপে ওরে লইয়া অনেক আশা করছিলো। আদব-লেহাজও ভালাই আছিলো। নিজের বাপেরেও লেখাপড়া শিখাইছে। চাঁন মিয়া তো বকলম আছিলো, পোলাই আছিলো ও মাস্টর।”
চুপ মেরে কথাগুলো শুনে গেলো চারু।
তাদের বডিগার্ড মুহিদ নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
“পোলাটা মইরা যাওনের পর থিকাই চাঁন মিয়ার মাথাও খারাপ হয়া গেছে। দিন দুনিয়ার দিকে তার আর কুনো খেয়াল নাই।”
“চাঁন মিয়া কি এখন আর সিএনজি চালায় না?” চারু জানতে চাইলো।
“হের যহন ইচ্ছা হয় তহন চালায়। নিজের সিএনজি তো…ক্যাঠায় কি কইবো। তয় আর বেশিদিন চালাইবার পারবো না, পাগলা গারদে যাওনের টাইম হয়া গেছে মনে হইতাছে।”
চারু আর মায়া চুপচাপ শুনে যাচ্ছে।
“আয়রোজগার কইলাম ভালাই আছিলো, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ট্যাপা। “মানুষটা কেমনজানি হয়া গেছে এহন। কারোর লগে কথা কয় না। কহন বাইর হয় কহন ঘরে আসে কেউ জানে না। কাউলকা তারে আমি জিগাইলাম, ও চাঁন মিয়া, কইথেন আইলা…আমার দিকে তাকাইলোও না। এই বস্তির কেউ ওরে ঘাঁটায় না। হের মিজাজ-মর্জির কুনো ঠিক নাই।”
“একটু আগে চাঁন মিয়াকে কারো সাথে কথা বলতে শুনেছি,” চারু বলল, “সম্ভবত ফোনে কারো সাথে কথা বলছিলো…কার সাথে কথা বলছিলো?”
বিজ্ঞের মতো বলল ইনফর্মার, “মরা পোলার লগে কথা কয়।”
চারুর কপালে ভাঁজ পড়লো।
“কইলাম না, মাথার ইস্কুরু দিন দিন ঢিলা হইয়া যাইতাছে।”
ট্যাপা কথা বলেই যাচ্ছে, চারু আর মায়া তার কথা শুনছে কি শুনছে না পরোয়া না করেই। তারা দুজন একে অন্যের দিকে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত।
লোকটার কথা শেষ হলে চারু তাকে বলল, “তুমি কি একটা কাজ করে দিতে পারবে? এরজন্য আমি তোমাকে বখশিস দেবো।”
বিগলিত হাসি দিলো ইনফর্মার। “কি কাম?”
“চাঁন মিয়ার সিএনজির নাম্বার আমাকে জোগাড় করে দিতে পারবে?”
“এইটা কুনো কাম হইলো…” হাসতে লাগলো ট্যাঁপা।
“আমার ফোন নাম্বারটা রাখো…” বলেই নিজের ফোন নাম্বারটা বলে দিলো ট্যাপাকে।
ইনফর্মার তার সস্তা চায়নিজ ফোনে সেটা তুলে নিলো। “একটা মিস কল দিতাছি…আপনে আমার নম্বরটা সেভ কইরা রাখেন…” চারুকে কল দিলো সে। “…কলটা আবার ধইরেন না যে।”
মুচকি হাসলো চারু।
.
“প্যাথেটিক!”
পরদিন মায়া আর চারু ডক্টরের বাড়িতে এসে আগের রাতের ঘটনাটা বিস্তারিত বলার পর অবশেষে গুরুগম্ভির মুখে বলে উঠলেন ডক্টর আজফার হুসেন।
চারু বলল, “চাঁন মিয়াকে প্রাইম সাসপেক্ট হিসেবে ধরে নিয়ে তদন্ত করলে মনে হয় ভালো ফল পাওয়া যাবে। মিসকাতকে খুন করার ব্যাপারে তার পক্ষে শক্তিশালি মোটিভ রয়েছে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডক্টর।
“ডিবি-পুলিশের এক্সপার্টরা ভিক্টিমের ইনজুরি দেখে খুনির যে উচ্চতা আন্দাজ করেছে সেটার সাথে চাঁন মিয়ার উচ্চতা মিলে যায়।”
আগ্রহি হয়ে উঠলেন আজফার হুসেন। “তুমি এটা কোত্থেকে জানতে পারলে?”
মুচকি হাসলো চারু। “মিসকাতের কেসের তদন্তকারি কর্মকর্তার সাথে আমি কথা বলেছি।
“ও।” আর কিছু বললেন না ডক্টর। মায়া চুপচাপ শুনে যাচ্ছে, কোনো কথা বলছে না।
“পুলিশের ধারণা মিসকাতের খুনি বাঁ-হাতি। আমি লক্ষ্য করেছি, চাঁন মিয়া বাঁ-হাতেই দা-টা ধরেছিলো।”
অবাক হলেন আজফার হুসেন।
“ভাবুন একবার, একমাত্র ছেলে অ্যাকসিডেন্ট করলো, পঙ্গু হয়ে গেলো ধনী আর ক্ষমতাবানের এক ছেলের কারণে, আবার সেই ঘটনার বিচারও পেলো না। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ছেলেটা আত্মহত্যা করে বসলো…একেবারেই ক্লাসিক্যাল রিভেঞ্জ সিনারিও।”
“তাহলে কি মিসকাতের খুনের পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই করেছিলো ঐ লোক?” জানতে চাইলো মায়া।
“হুম।”
“যেভাবে খুন করা হয়েছে তাতে তো মনে হচ্ছে, হুট করে ঘটনাচক্রে দারুণ একটা সুযোগ পেয়ে গেছিলো।”
মেয়েটার প্রশ্ন ধরতে পারলো চারু। “সম্ভবত চাঁন মিয়ার পরিকল্পনা ছিলো আগে থেকেই, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলো না। বাইকার বাবুর অ্যাকসিডেন্টের সময় ঘটনাচক্রে সেখানে চলে আসে সে। বাবুকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর কোনোভাবে বুঝতে পারে, এই ছেলেটা মিসকাতের বন্ধু হয়। তারপরই দীর্ঘদিনের পরিকল্পনাটা বাস্তবায়ন করে সে।”
“কিন্তু মিসকাতরা যে ঐদিন গাজীপুরে হ্যালোউইন পার্টি করছিলো সেটা কিভাবে জানতে পারলো?”
চারু আর মায়ার এই কথোপকথন বেশ আগ্রহভরে শুনে যাচ্ছেন ডক্টর আজফার। আপাতত প্রশ্ন করা থেকে নিজেকে বিরত রাখছেন তিনি।
“মনে রাখবেন, সিএনজি ড্রাইভার বাইকার বাবুর মোবাইলফোনটা হাতিয়ে নিয়েছিলো, আর এ যুগে মোবাইলফোন হলো পারসোনাল ইনফর্মেশনের সবচেয়ে বড় রিসোর্স।”
কথাটার সাথে সায় দিলো ডক্টর আর মায়া।
“আমার ধারনা…মানে, অনুমাণ বলতে পারেন…বাবুর মোবাইলফোন থেকেই পার্টির কথাটা জানতে পেরেছে ঐ লোক। এর ফলে দারুণ একটা সুযোগ পেয়ে যায় চাঁন মিয়া। তার দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটে। তাই এমন সুযোগ আর হাতছাড়া করেনি।”
“বাহ,” ডক্টর নিজের মুগ্ধতা প্রকাশ করলেন। “একটা কথা না বলে পারছি না, তোমার যুক্তির চেয়ে কিন্তু কল্পনাশক্তি কোনো অংশেই কম নয়।”
চারু বুঝতে পারলো না ডক্টর টিটকারি মারছেন কিনা।
“আইনস্টাইন কিন্তু জ্ঞানের চেয়ে কল্পনার উপরেই বেশি জোর দিয়েছিলেন। এরকম কল্পনাশক্তি না থাকলে হাইপোথিসিস দাঁড় করানোটা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। আর হাইপোথিসিস দাঁড় করাতে না পারলে যুক্তি দিয়ে এগোনোটাও সহজ হয় না।”
“হাইপোথিসিস কিন্তু যুক্তিবুদ্ধি দিয়েই করতে হয়,” বলল চারু। “এটা নিছক কল্পনা নয়।”
মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডক্টর আজফার। “আই কুডেন্ট মোর এগ্রি উইথ ইউ।”
এমন সময় চায়ের ট্রলি নিয়ে ঘরে ঢুকলো টোটা। চা পরিবেশন করে সে চলে যাবার পর ডক্টর আবার মুখ খুললেম। “তাহলে তুমি ঐ সিএনজি ড্রাইভারের ব্যাপারে জোরেসোরে তদন্ত শুরু করবে?”
“হুম।”
“এরপর কিভাবে তদন্তটা এগিয়ে নেবেন?” জানতে চাইলো মায়া।
একটু ভেবে জবাব দিলো চারু আহসান। “এটা নিয়ে একটু ভাবতে হবে।”
চাঁন মিয়া যেভাবে মারমুখি হয়ে উঠেছিলো তারপর যে ওর ধারেকাছেও যাওয়া ঠিক হবে না সেটা সে জানে। তাকে এখন বিকল্প কিছুর কথা ভাবতে হবে। ট্যাপা নামের ইনফর্মারকে কাজে লাগানোর কথা বস্তিতে থাকার সময়ই তার মনে হয়েছে। লোকটাকে একটা কাজও দিয়েছে সে। ভালো বখশিস পেলে ইনফর্মার তাকে হয়তো আরে বেশি সাহায্য করতে পারবে।
“টেক ইউর টাইম।”
ডক্টরের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকালো চারু।
“তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আমার মনে হচ্ছে তোমরা সঠিক পথেই এগোচ্ছো।”
মায়া চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে।
চারুর মুখে থ্যাঙ্কস’ শব্দটা প্রায় চলে এসেছিলো, কিন্তু শেষ মুহূর্তে এক ধরণের সঙ্কোচের কারণে বলল না। চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে চুমুক দিলো সে।
“ভালো কথা, সিকিউরিটিদের পারফর্মেন্স কেমন ছিলো?” জানতে চাইলেন ডক্টর।
“ভালো।” ছোট্ট করেই বলল মায়া।
“ওরা কিন্তু বেশ প্রফেশনাল…তিনজনেই।”
“তিনজন?” অবাক হলো চারু। “আপনি ভুল বলছেন, ওরা দুজন ছিলো।”
স্মিত হাসি দিলেন ডক্টর আজফার হুসেন। “একজনকে তুমি দেখোনি। ও তোমাদের আশেপাশেই ছিলো,” বললেন তিনি। “যত দক্ষই হোক না কেন, আমি নিশ্চয় দু-জন মানুষের জন্য একজনের ব্যবস্থা করবো না।”
“তাহলে গাড়ি যে ড্রাইভ করেছে সেই লোকটা…?”
“সিকিউরিটি সার্ভিসের ড্রাইভার। দরকার পড়লে অ্যাকশনে যাবার মতো ট্রেনিং ওর আছে।”
চারু কিছু বলল না, চুপ মেরে গেলো। কথাটা ওকে আগেই বলে দিতে পারতেন ডক্টর। এরকম লুকোছাপা তার পছন্দ নয়। তবে সেটা প্রকাশও করলো না। তার এখন বাড়ি ফিরে যেতে হবে। এই তদন্তটা পরবর্তিতে কিভাবে এগিয়ে নেবে সেজন্যে একটু চিন্তাভাবনা করা দরকার। সে ভালো করেই বুঝতে পারছে ডক্টরের দেয়া সিকিউরিটি নিয়ে এই তদন্ত এগিয়ে নেয়া যাবে না। আবার তার পক্ষে এর চেয়ে বেশি কিছু করাও সম্ভব নয়। তাকে এমন একটা উপায় বের করতে হবে যাতে করে চাঁন মিয়ার ব্যাপারে ভালোভাবে তদন্ত করা যায়। লোকটার বিরুদ্ধে শক্তিশালি প্রমাণ জোগাড় করা লাগবে এখন। নইলে তার সন্দেহটা নিছক সন্দেহ হিসেবেই থেকে যাবে।
“কি ভাবছেন?”
“না…কিছু না,” বলল সে। “আমাকে একটু বাসায় যেতে হবে। একটা কাজ আছে।”
“আমিও বেরোবো…চলুন তাহলে।”
ডক্টরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারা চলে গেলে আজফার হুসেন উদাস হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। একটা চিন্তা ঘটনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
একজন সিএনজি ড্রাইভার!