1 of 2

২০. জমিদারির কাজ তদারকির জন্য শিলাইদহ

রবিকে আবার জমিদারির কাজ তদারকির জন্য শিলাইদহে যেতে হবে, তার উদ্যোগ আয়োজন চলছে। তাঁর স্ত্রী সঙ্গে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাকে না নিয়ে যাওয়াই সাব্যস্ত হয়েছে। মৃণালিনী আবার সন্তান-সম্ভবা। তার গর্ভে রবির পঞ্চম সন্তান।

রথী ধরে বসে আছে, সে এবার বাবার সঙ্গে যাবেই। রথীর যদিও খুব ইচ্ছে ছিল দার্জিলিং বেড়ানোর, বিবিদিদির কাছে দার্জিলিং-এর অনেক গল্প শুনে পাহাড় দেখার খুব আগ্রহ তার, কিন্তু বাবামশাইকে যেতেই হবে শিলাইদহে। তা সেখানে গিয়ে নদীবক্ষে বজরায় বাস করাও কম আকর্ষণীয় নয়।

সকালবেলা রবি খাজাঞ্চিখানায় বসে শিলাইদহ-পতিসরের খাজনা পত্র আদায়ের হিসেব বুঝে নিচ্ছেন। এমন সময় এক ভৃত্য এসে খবর দিল মহিম ঠাকুর নামে এক ব্যক্তি তাঁর দর্শনপ্রার্থী। কাজ ফেলে রবি ব্যস্ত হয়ে চলে এলেন বৈঠকখানায়।

উঠে দাঁড়িয়ে দু হাত তুলে নমস্কার জানিয়ে মহিম বলল, রবিবার, আমি মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্যের দূত হয়ে এসেছি।

রবি খানিকটা বিস্মিত হয়ে বললেন, মহারাজ এখনও কলকাতায় আছেন? শুনেছিলাম যেন তিনি ফিরে গেছেন ত্রিপুবায়।

মহিম বলল, মহারাজ বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তাই ফেরা হয়নি। এখন ডাক্তাররা পরামর্শ দিয়েছেন কোনও স্বাস্থ্যকর স্থানে বায়ু পরিবর্তনের জন্য। ত্রিপুরায় রাজকার্যের কিছু জটিলতাও আছে, সেখানে গেলে তিনি আবার উত্তেজিত হয়ে পড়বেন, চিকিৎসকরা সেটাও চান না। তাই কিছুদিনের জন্য মহারাজকে কার্শিয়াং নিয়ে গিয়ে রাখা হবে ঠিক হয়েছে।

রবি বললেন, কার্শিয়াং অতি উত্তম জায়গা। সেখানকার শোভার কোনও তুলনা হয় না।

মহিম বলল, মহারাজের আন্তরিক অভিপ্রায়, এ যাত্রায় আপনি যদি তাঁর সঙ্গী হন। মহারাজ বারবার বলেন, রবীন্দ্রবাবুর গান শুনলে তাঁর মস্তিষ্ক জুড়িয়ে যায়। রেলের কামরা রিজার্ভ করা আছে, আপনার কোনও অসুবিধে হবে না।

রবি বললেন, মহারাজ আমাকে বিশেষ স্নেহ করেন, সে জন্য আমি ধন্য বোধ করি। এমন আমন্ত্রণ আমার পক্ষে পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু আমাকে যে পূর্ববঙ্গে যেতে হবে, সব ঠিক হয়ে আছে!

মহিম বলল, মহারাজ আরও জানিয়েছেন যে সমগ্র বৈষ্ণব পদাবলীর একটি সংকলন প্রস্তুত করার ব্যাপারে যে প্রস্তাব উঠেছিল, ওখানে বসে তিনি সেই আলোচনা পাকাপাকি সেরে ফেলতে চান। একটি উন্নত ধরনের বাংলা প্রেস স্থাপনের খুব ইচ্ছে তাঁর, এ বিষয়েও আপনার পরামর্শ দরকার।

রবি একটুক্ষণ চুপ কবে থেকে দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন। জমিদারি তো বয়েইছে, তার কাজ পরেও করা যায়। বৈষ্ণব পদাবলীর একটি সংকলন প্রকাশের শখ তাঁর অনেক দিনের। এর প্রকাশনা ব্যয়বহুল, মহারাজে সাহায্য পেলে অনেক সুবিধে হবে। একটি উন্নত, আধুনিক বাংলা প্রেসেরও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে। মহারাজ চান রবিব সমগ্র রচনাবলীর একটি শোভন সংস্করণ ছাপা হোক।

কিন্তু শিলাইদহ যাত্রা বাতিল করতে গেলে পিতার অনুমতি নিতে হবে। তিনি আছেন ইচছোয়। তিনি অনুমতি দেবেন কিনা তাতে সন্দেহ আছে। জমিদারির কাজে অবহেলা প্রদর্শন করলে তিনি বিরক্ত হন। এই কারণে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন।

একমাত্র উপায় আছে, বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের কাছে আর্জি পেশ করা। তিনি যদি রবির বদলে তাঁর পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দেন, তা হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়।

মহিমকে বসিয়ে বেখে রবি দ্রুত উঠে এলেন বড়দাদার মহলে।

সাদা ও কালো রঙের চক মেলানো পাথরের বারান্দায় একটি তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আধ-শোওয়া হয়ে রয়েছেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। কার্পেট বা মাদুর পাতা নেই, খালি ঠাণ্ডা মেঝেই তাঁর পছন্দ। তিনি গরম সহ্য করতে পারেন না বলে বাড়িতে অধিকাংশ সময়ই গায়ে জামা রাখেন না। শুধু ধুতি পরা, মাথার চুল অবিন্যস্ত, হাতে আলবোলার নল। তাঁর সামনে ছড়ানো তিনখানা বই ও অনেক কাগজপত্র। আপনভোলা এই মানুষটি সব সময় লেখা কিংবা পড়া নিয়েই থাকেন। তবে কোনও একটা বিষয়ে মনঃসংযোগ করতে পারেন না। একটা বই খানিক পড়তে পড়তে শুরু করেন আর একটা বই। একটা লেখা অসমাপ্ত রেখে বসে যান অন্য লেখায়। তাঁর লেখা ছাপা হল কিনা কিংবা কেউ পড়ল কিনা, তা নিয়েও মাথাব্যথা নেই। কখনও বাতাসে তাঁর লেখা কাগজ উড়ে যায় অনেক দৃরে, তিনি সেই দিকে তাকিয়ে হাসেন। উঠে গিয়ে কাগজটা কুড়িয়ে আনতেও তাঁর আলস্য।

রবি তাঁর সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসতেই তিনি সকৌতুকে বললেন, বাংলা সাহিত্য গগনের মেঘনাদ, না, এটা ঠিক হল না, সাহিত্য রণক্ষেত্রের তরুণ সব্যসাচীর হঠাৎ এই গুহাবাসীর নিকট আগমনের কারণ? ওহে ভ্রাতঃ, আর যাই বলো, টাকা-পয়সা চেয়ো না যেন। আমার ভাঁড়ে মা ভবানী। সে প্রয়োজন থাকলে সত্যপ্রসাদকে ধরো, সতু আমাদের ব্যাঙ্কার।

রবি তাঁর বক্তব্য নিবেদন করলেন।

দ্বিজেন্দ্রনাথ অট্টহাসি করে উঠে বললেন, তুই বঁচালি আমাকে রবি? এ তো অতি উত্তম প্রস্তাব। দিপুটা আমার ওপর বড় খবরদারি করে। সব সময় বলে, বাবা, আপনি এটা খাবেন না, ওটা আপনার স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ, কী মুশকিল বল তো! ইচ্ছে মতন খেতেও পারব না? দিপুকে কিছুদিনের জন্য বাইরে সরিয়ে দিলে তো অামারই উপকার হবে রে। কিন্তু এখনও বৃষ্টি বাদলা নামেনি, এই সময়ে তুই পাহাড়ে যাবি কেন? তোরা এত পাহাড়ে যাস, সেখানে গিয়ে কী আনন্দ পাস? পাহাড় মোটেই সুবিধের জায়গা নয়, অতখানি পথ ঠেঙিয়ে যেতে হয়, যখন তখন পালন হতে পারে।

দ্বিজেন্দ্রনাথ একেবারেই ভ্রমণ বিলাসী নন, তাঁকে অনেক বলে বলেও বাইরে কোথাও নিয়ে যাওয়া যায় না। তিনি ভ্রমণ কাহিনী পড়েন, মানস-ভ্রমণেই তাঁর আনন্দ। ভ্রমণের জন্য শারীরিক পরিশ্রম তাঁর ঘোর অপছন্দ।

পাহাড় সম্পর্কে তিনি নানা কথা বলতে বলতে হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, এক গ্রাম্য কবি পাহাড় সম্পর্কে ঠিক আমার মনের কথাটা লিখে গেছেন, শুনবি?

কী যে সুখ পাহাড়ে থাকা
বিলোড় আর পিপসে জোকা
বিছানায় কুটকি পোকা
লাফায় তিড়িং তিড়িং
বলে গোঁসাই হারাধনে
তোরা দার্জিলিঙে এলি কেনে
সদাই করে সেখেনে
শীতে মার্গ সিড়িঙ সিড়িঙ

শেষ পঙক্তিটি শুনে রবি মাথা নিচু করলেন, দ্বিজেন্দ্রনাথ হাসতে লাগলেন আপন মনে। তাঁর হাসি থামলে রবি জানালেন ত্রিপুরার মহারাজের আমন্ত্রণের কথা।

দ্বিজেন্দ্রনাথ বললেন, তবে তো যেতেই হবে, রাজেন্দ্র সঙ্গমে দীন যথা যায় দূর তীর্থ দরশনে…এই ধরনের কী যেন লিখে গেছেন না মাইকেল? রাজা-মহারাজা বলে কথা! ফিরে এসে আমায় গল্প বলিস।

রথীর মহা আহ্লাদ, শেষ পর্যন্ত পাহাড়েই যাওয়া হচ্ছে, যেন তার ইচ্ছের জোরেই এটা হল। কিন্তু মুশকিল হল বিবিকে নিয়ে। মহিমকে রবি জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি সত্ৰক যাবেন, বিকেলবেলা বিবি এসে সব শুনে বলল, রবিকা, আমায় নিয়ে যাবে না? আমি মহারাজকে দেখব।

রবি সহসা উত্তর দিতে পারলেন না। বিবির কোনও আবদার, উপরোধ ঠেলতে পারেন না তিনি। নিজের উদ্যোগে গেলে বিবিকে তিনি অবশাই নিয়ে যেতেন, কিন্তু অন্যের আমন্ত্রণ, সেখানে তিনি রথীকে নিয়ে যাচ্ছেন এই তো যথেষ্ট, আরও কারুর জন্য কি বলা যায়? তা ছাড়া বিবি এখন পূর্ণ যুবতী, তার শয়নের জনা পৃথক ঘরের প্রয়োজন। মহিমের কাছে তিনি জেনেছেন, মহারাজের সঙ্গে এবারে তাঁর রানিরা কেউ নেই। একা বিবির জন্য আলাদা বন্দোবস্ত করতে হবে।

বিবি আয়ত চক্ষু মেলে উৎসুকভাবে তাকিয়ে আছে, রবি দুর্বল কণ্ঠে বললেন, না রে, বিবি, তোকে এ বার নিতে পারছি না। আমরা আর একবার…

বিবির দু চোখে অশ্রুবিন্দু এসে গেল সঙ্গে সঙ্গে। সে রবির পিঠে কিল মারতে মারতে ধরা গলায় বলতে লাগল, যাও, যত দিন ইচ্ছে গিয়ে থাকো,আমি তোমার সঙ্গে আর কথা বলব না, কোনওদিন কথা বলব না—

দৌড়ে চলে গেল সে, আর ডাকাডাকি করেও ফেরানো গেল না। এ বারের অন্যরকম ভ্রমণের আকর্ষণে রবি যে-উদ্দীপনা অনুভব করছিলেন, তার মধ্যে পড়ল একটা বিষাদের রেখা। ইদানীং রবির হাত দিয়ে বেরুচ্ছে ছোট ছোট সনেটর আকারের কবিতা। কার্শিয়াং যাত্রার আগের রাত্রে লিখলেন :

ওরে যাত্রী, যেতে হবে বহুদুর দেশে
কিসের করিস চিন্তা বসি পথ শেষে
কোন দুঃখে কাঁদে প্রাণ। কার পানে চাহি
বসে বসে দিন কাটে শুধু গান গাহি
শুধু মুগ্ধ নেত্ৰ মেলি। কার কথা শুনে
মরিস জ্বলিয়া মিছে মনেব আগুনে…

কার্শিয়াঙ এ বার আগে আগেই শীত পড়ে গেছে জব্বর। সেই সঙ্গে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি। বাড়ি থেকে বেরুবাব উপায় নেই, ঘবের মধ্যেও আগুন জ্বেলে বসতে হয়। রথীর সমবয়েসী কেউ নেই, সে বেচারি ঘরের মধ্যে ছটফট কবে। পাহাড়ের দেশে এসেও বৃষ্টি আর কুয়াশার জন্য পাহাড় দেখাই যায় না। অবশ্য মহিম তাকে কথা দিয়েছে, বৃষ্টি একটু ধরলেই তাকে দার্জিলিং ঘুরিয়ে নিয়ে আসা হবে।

প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যা থেকে অনেক রাত্রি পর্যন্ত ওপরতলার বড় ঘরটিতে গান বাজনা ও গল্পের আসর বসে। মহারাজের ব্যবহার খুবই স্বাভাবিক ও আন্তরিক, তবু তাঁর সামনে রবি কিছুতেই সহজ হতে পারেন না। রাজতন্ত্র সম্পর্কে রবিব মনে যেন একটা রোমান্টিক মোহ আছে। চোখের সামনে যিনি বসে আছেন, তাঁকেই রবি দেখেন ইতিহাস ও রূপকথা মিশ্রিত এক আদর্শ রাজা হিসেবে। যে রাজা স্বার্থশূন্য, দেশপ্রেমিক, প্রজার মঙ্গলের জন্য নিবেদিত প্রাণ, আবার তিনিই কাব্য-শিল্প-সঙ্গীতেব পৃষ্ঠপোষক। বীরচন্দ্র মাণিক্যের চরিত্রে এ রকম কিছু কিছু গুণ আছে অবশ্যই। কিন্তু রবি তাঁব কল্পনাব নেত্রে যে-মহান রাজাকে দেখতে পান, সেই রাজা আর এই বাস্তবের মানুষটি এক হতে পারেন না।

গান গাওয়ার ব্যাপারে রবিব কোনও সঙ্কোচ নেই, বড় বড় সভা-সমিতিতে, কংগ্রেসের অধিবেশনেও তিনি গান কবেন। কিন্তু মহারাজের সামনে গান গাইতে বসলেই তিনি কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে যান। যেন বিশাল এক বাজদরবারে তিনি সভা-গায়ক। আকবরের দরবারে তানসেন। এ রকম ভাবলেই সঙ্কোচ এসে যায়।

মহারাজের মতন এমন মুগ্ধ শ্রোতা অবশ্য খুবই দুর্লভ। কার্শিয়াঙে এসে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এই ভিজে আবহাওয়া তাঁব সহ্য হচ্ছে না, কিন্তু রোগের কষ্টের কোনও চিহ্ন তাঁর মুখে ফোটে না। তামাক খেতে খেতে সোজা হয়ে বসে তিনি একাগ্র হয়ে গান শোনেন, এক এক সময় তামাক টানতেও ভুলে যান। গানের প্রতিটি শব্দ তিনি বুঝে নিতে চান বলে, একই গান গাইতে বলেন বারবার।

উচ্ছ্বল করো হে আজি এ আনন্দ রাতি
বিকশিয়া তোমার আনন্দ মুখ ভাতি
সভা-মাঝে তুমি আজ বিরাজো হে রাজরাজ
আনন্দে রেখেছি তব সিংহাসন পাতি…

মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন, রবিবাবু, কাল যে গানটি গেয়েছিলেন, ‘মধুর রূপে বিরাজো হে বিশ্বরাজ’, তাতে বলেছিলেন বিশ্বরাজ, আর এ গানটিতে আছে রাজ রাজ, এ দুইয়ের মধ্যে তফাত আছে কি কিছু?

রবি বললেন, না, অর্থ একই। তবে একই শব্দ বারবার ব্যবহার না করে ভিন্ন শব্দ বসালে ভাল

মহারাজ বললেন, আর একটি গান গেয়েছিলেন, ‘আজি রাজ-আসনে তোমারে বসাইব হৃদয় মাঝারে’, তাতেও আছে, তোমারে বিশ্বরাজ, অন্তরে রাখিব তোমার ভেতরেই এ অভিমান…’, এখানে আবার ‘বিশ্বরাজ’ রয়েছে।

রবি চমৎকৃত হলেন। মহারাজ এত খুঁটিয়ে শোনেন এবং পদগুলি মুখস্থ রাখেন? এমন শ্রোতা পাওয়া যাবে কোথায়?

আরও একটা ব্যাপার খেয়াল হওয়ায় ঈষৎ লজ্জা বোধ করলেন রবি। মহারাজের সামনে গাইতে বসলেই সেই সব গান মনে আসে, যার মধ্যে রাজা শব্দটি আছে।

গানে গানে অনেক রাত হয়ে যায়, অসুস্থ মহারাজকে বিশ্রাম নেবার জন্য তাড়া দেয় মহিম। মহারাজ তা গ্রাহ্য না করে মহিমের গায়ে চাপড় মেরে বলেন, তুই থাম। ক দিন বাঁচব ঠিক নেই। এ রকম সঙ্গীত সুধা পান না করে গেলে জীবনটাই ব্যর্থ হবে।

মহিম তখন রবিকে ইঙ্গিত করে গান থামাবার জন্য।

রবি এবং রথীর স্থান হয়েছে নীচের একটি প্রশস্ত ঘরে। রাত্রে আসর ভঙ্গ হবার পর মহারাজ রবিকে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসেন। তাতে রবির বড় অস্বস্তি হয়, তিনি বলেন, মহারাজ, আপনি অসুস্থ শরীর নিয়ে আবার এতটা আসছেন কেন? আপনি আসবেন না।

মহারাজ সামান্য হেসে বলেন, রবিবাবু, পাছে অলসতা এসে কর্তব্যে ক্রটি ঘটায়, আমি সে ভয় করি। আমায় বাধা দেবেন না।

সকালের আসরে গানের বদলে হয় বৈষ্ণব শাস্ত্রের আলোচনা। এ বিষয়ে রাধারমণের জ্ঞান অসামান্য। পদাবলী সংকলনটিতে কোন কোন পদকর্তাদের রচনা নেওয়া হবে এবং বইটি কত বড় হবে, তা ঠিক হয়ে গেছে। মহারাজ বলেছেন, এ বইয়ের জন্য প্রকাশক খোঁজার দরকার নেই। তিনিই দেবেন এক লক্ষ মুদ্রা। ছাপাখানার জন্য মেশিনপত্র কেনার খরচও দেবেন তিনি, আগে একটি বাড়ি দেখতে হবে, উপযুক্ত কোনও ব্যক্তিকে ম্যানেজার করা দরকার, এই সব আলোচনা হতে হতে মহারাজ হঠাৎ একদিন জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়লেন।

স্থানীয় একজন চিকিৎসক এসে কিছুক্ষণের চেষ্টায় তাঁর জ্ঞান ফেরালেন বটে, কিন্তু দেখা গেল যে মহারাজের শরীর এমনই দুর্বল যে তিনি আর হাঁটতে পারছেন না। এই অবস্থায় আর কার্শিয়াং থাকা মোটই সঙ্গত নয়। অসুস্থ মহারাজকে নিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে সবাই ফিরে এল কলকাতায়।

মহারাজের জীবনীশক্তি অদমা। কলকাতার বড় ডাক্তারদের ওষুধ খেয়ে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলেন তিনি। কুমার রাধাকিশোর তাঁকে ত্রিপুরায় চলে আসার জন্য তার পাঠালেন, কিন্তু মহারাজ এখনই ত্রিপুরায় ফিতে চান না, তিনি ডেকে পাঠালেন কুমার সমরেন্দ্রকে।

কার্শিয়াং থাকার সময় ‘রাজর্ষি’ উপন্যাস ও ‘বিসর্জন’ নাটক সম্পর্কে কথা হয়েছে অনেকবার। রবি ‘বিসর্জন’-এর কিছু অংশ পাঠ করেও শুনিয়েছেন। তাঁর সুললিত কণ্ঠে সেই পাঠ শুনে মহারাজ বলেছিলেন, আপনাদের ঠাকুর বাড়িতে অনেক নাটকের অভিনয় হয় শুনেছি। আমাদের ত্রিপুরার এই কাহিনীটির অভিনয় একবার হতে পারে না?

কলকাতায় ফিরে রবি ঠিক করলেন, বিসর্জন একবার মঞ্চস্থ করে মহারাজকে দেখানো উচিত। বাড়ির ছেলেমেয়েরা সবাই রাজি। দুই ভ্রাতুস্পুত্র গগন আর অবন বেশ ছবি আঁকে, ওরা মঞ্চের সাজসজ্জা বানাতে লেগে গেল। মহড়া দিতে শুরু করে রবি নিজে নিলেন রঘুপতির ভূমিকা।

তার আগে অবশ্য বিবির মান ভাঙাতে হল। বিবি জেদ ধরে বসেছিল সে এই নাটকে অংশগ্রহণ করবে না। কিন্তু বিবি না-থাকলে নেপথ্যে হারমোনিয়াম বাজারে কে? বিবির আঙুলে জাদু আছে, তার স্পর্শে হারমোনিয়াম যেন কথা বলে।

আগে একবার বিসর্জন পালা অভিনীত হয়েছিল, পার্ট অনেকেরই মুখস্থ আছে। আর একবার ঝালিয়ে নিতে বেশিদিন লাগল না। ঠাকুর বাড়িতে প্রায়ই কিছু না কিছু নাটক হয়, মঞ্চ একটা তৈরিই থাকে, অভিনয়ের তারিখ ঘোষণা করতে তাই দেরি হল না।

মহারাজ বীরচন্দ্র সুস্থ হলেও তাঁর পা-দুটি দূর্বল হয়ে গেছে, বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটতে হয়। কিন্তু আজ তাঁকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে যেতে হবে রাজকীয় মর্যাদায়, বাইরের লোকদের তিনি কোনও রকম শারীরিক অক্ষমতা দেখাতে চান না। ওপরটা হাতির দাঁতে বাঁধানো একটা রোজউডের ছড়ি কিনে আনা হল, সেই হুড়ি হাতে নিয়ে তিনি কিছুক্ষণ হাঁটা অভ্যেস করলেন।

ঠাকুর বাড়ি তিনি পৌঁছে গেলেন অভিনয় শুরুর বেশ কিছুক্ষণ আগে। আসন গ্রহণ না করে তিনি চলে এলেন গ্রিন রুমে। গোবিন্দ মাণিক্য, নক্ষত্র রায়দের পোশাক দেখতে লাগলেন খুঁটিয়ে। ঠাকুর বাড়ির নাটকে পোশাকের তেমন বাহুল্য থাকে না। রাজা-রাজড়ারাও সাধারণ পোশাক পরে, কিন্তু এ বারে কস্টিউম ড্রামা হচ্ছে, মহড়ার সময় মহিম এসে পোশাক সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে গেছে। মহারাজ তার পরেও কিছু অদল বদল করে দিচ্ছেন, অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি আসবেন আজ, তাঁরা প্রত্যক্ষ করবেন ত্রিপুরার রাজবংশের কাহিনী, তাই মহারাজ কোনও রকম ত্রুটি রাখতে চান না।

অন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, রবিবাবু কোথায়? তাঁকে দেখছি না।

মহিম বলল, ওই তো আপনার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন।

মহারাজ ঘুরে তাকিয়েই দারুণ বিস্মিত হলেন। রঘুপতির ভূমিকায় রবি পরেছেন একটা লাল টকটকে কাপড়, ঊধ্বাঙ্গে শুধু একটা নামাবলি জড়ানো। দীর্ঘকায় পুরুষ, চওড়া বুক যেন শ্বেতমর্মরের মূর্তির মতন, ভুরু দুটি গাঢ় করে আঁকা, চন্দন চৰ্চিত ললাট, মাথায় জটাজুটের পরচুলা। রবি মিটিমিটি হাসছেন, মহারাজ বললেন, একেবারে চিনতেই পারিনি।

মঞ্চে একটিই সেট। এক কোণে বেশ বড় আকারের একটি করালবদনা কালীর মৃন্ময়ী মূর্তি। সামনেই হাঁড়িকাঠ, সেখানে পুরনো রক্ত জমে আছে। মঞ্চের অন্য কোণে রাজবাড়ির অন্দর মহলের আভাস।

প্রথম দৃশ্য থেকেই নাটক জমে গেল। কুর, ক্রোধী রঘুপতির ভূমিকায় রবি যেন অন্য মানুষ। শান্ত, মিষ্ট স্বরে যিনি সব সময় কথা বলেন, গলা কখনও চড়ে না, এখন তাঁর কণ্ঠেই ঘন ঘন হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে।

এই নাটকের বিষয়বস্তু মহারাজের মনঃপূত, তিনি নিজেও বৈষ্ণব। পশুবলি তিনি দেখতে পারেন, জঙ্গলে গিয়ে পশু শিকারের রাজাচিত শখও তাঁর অনেকদিন ঘুচে গেছে। নাটক দেখতে দেখতে তিনি মাঝেমাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে অন্য দর্শকদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছেন। এ নাটকের সার্থকতায় যেন তাঁরই গর্ব। তাঁর ত্রিপুরাকে প্রত্যক্ষ করছে কলকাতার মানুষ।

অভিনয় করার সময় রবির মধ্যে সত্যিই যেন রূপান্তর ঘটে যায়। তাঁর নিজেরই লেখা নাটক, এর আগেও অভিনয় করেছেন, তবু প্রতিবারই অভিনয় চলার সময় তাঁর মনে হয়, এই সব ঘটনা যেন সত্যি সত্যি এখনও ঘটছে।

জয়সিংহের আত্মহত্যার পর তিনি যখন আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘জয় সিংহ! জয় সিংহ! নির্দয়। নিষ্ঠুর! এ কী সর্বনাশ করিলি রে— তখন সমস্ত মঞ্চ যেন কেঁপে উঠল। যেন শোকে সত্যিই তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে!

দুটি দৃশ্যের পর, একা কালী মুর্তির সঙ্গে কথা বলছেন রঘুপতি। অভিনয় করতে করতে সাঙ্ঘাতিক উত্তেজিত হয়ে গেলেন রবি। যেন এই মাটির মূর্তিটি সত্যিই রক্তলোলুপ, জীবজগতের রক্ত পান না করলে এর তৃষ্ণা মেটে না। স্থান কাল বিস্মৃত হয়ে রবি একটা বিপজ্জনক কাণ্ড করে ফেললেন।

নাটকে আছে যে গোমতী নদীতে কালী প্রতিমাকে নিক্ষেপ করা হবে। মঞ্চে তো সত্যি সত্যি তা দেখানো যায় না। আগে থেকে ঠিক ছিল যে রঘুপতিবেশী রবি কালী প্রতিমাটা তোলার ভান করবেন, সেই প্রতিমার কাঠামোর পেছনে দড়ি বাঁধা আছে, অবন আর গগন আড়াল থেকে দড়ি টেনে মুর্তিটিকে উইংসের মধ্যে নিয়ে যাবে। সংলাপ বলতে বলতে রবি ভুলে গেলেন সে কথা।

 দে ফিরায়ে রাক্ষসী পিশাচী!
শুনিতে কি পাস?
আছে কর্ণ? জানিস কী করেছিস?
কার রক্ত করেছিস পান? কোন পুণ্য
জীবনের?

দু হাতে মূর্তিটা ধরে নাড়া দিতে লাগলেন রবি। তারপর বললেন :

কার কাছে কাঁদিতেছি
তবে দূর, দূর, দূর; দূর করে দাও
হৃদয় দলনী পাষাণীরে! লঘু হোক
জগতের বক্ষ!

বলতে বলতেই অত বড় মূর্তিটাকে তুলে নিলেন শুন্যে। দর্শকরা সবাই ভয়ের শব্দ করে উঠল। রবি এমনিতেই বলশালী পুরুষ, এখন তার শরীরে যেন অসুরের শক্তি এসেছে। মূর্তিটা নিয়ে ঘুরতে লাগলেন সাবা মঞ্চ। তারপর একদিকের উইংসের কোণে সেটাকে ছুঁড়ে চুরমার করে দিতে গেলেন। যেন শুধু রঘুপতির নয়, কালীমুর্তির প্রতি রবির নিজস্ব যে বিরাগ আছে সেটাই এখন প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে।

উঁচু করে ছুঁড়তে গিয়ে রবি দেখলেন, সেই উইংসের পাশে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে আছে বিবি। সে বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে চেয়ে আছে রবিকাকার দিকে। ওই মূর্তিটা আছড়ে পড়ঙ্গে বিবির আর বাঁচার আশা থাকবে না। শেষ মুহূর্তে রবির চৈতন্য ফিরে এল, তিনি কেঁপে উঠলেন, দ্রুত অন্য পাশে সবে গিয়ে আস্তে আস্তে নামিয়ে রাখলেন সেই মূর্তি।

সমস্ত প্রেক্ষাগৃহ করতালি ধ্বনিতে ফেটে পড়ল।

অভিনয়ের শেষে নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেককে একটি করে মোহর উপহার দিলেন মহারাজ। কিন্তু আর বেশি দেরি করলেন না, নিজেই আগে আগে গিয়ে উঠলেন জুড়ি গাড়িতে। ফেরার পথে তাঁকে গম্ভীর মনে হল।

বাড়িতে এসেও মহিম যখন উচ্ছ্বসিতভাবে নাটকটির প্রশংসা করছে, তাকে বাধা দিয়ে মহারাজ বললেন, চুপ কর! কলকাতার লোক সব কিছু ভাল পারে, আমরা পারি না কেন? ত্রিপুরাতে এমন নাটক হয় না কেন? আমরা কম কীসে?

মহিম থতমত খেয়ে বলল, আমাদের ওখানে যে চচা নেই। কলকাতায় এঁরা সব কিছুই অনেক আগে শুরু করেছেন।

মহারাজ আবার ধমক দিয়ে বললেন, আমাদের ওখানে চর্চা শুরু করিসনি কেন! তোরা লেখাপড়া শিখেছিস কী কম্মে? যা, আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা!

মহারাজের মেজাজ বিগড়ে গেলে তখন আর কোনও কথা বলা চলে না। তিনি দূর হয়ে যেতে বললেও দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, চলে গেলে আর বকুনি দেবেন কাকে?

নিজের বুকে হাত বুলাতে বুলোত তিনি আরও কয়েকবার ওই একই কথা বলতে লাগলেন। তারপর বললেন, সব ব্যবস্থা কর, আমি দু একদিনের মধ্যেই ত্রিপুরায় ফিরে যেতে চাই। আমার প্রাসাদে আমি একখানা স্টেজ বানাব। এই বিসর্জন নাটক দিয়েই শুরু হবে। কে কে পার্ট করবে?

মহিম বলল, আজ্ঞে সে রকম লোক খুঁজলে পাওয়া যাবে।

মহারাজ বললেন, খুঁজলে পাওয়া যাবে মানে কী? কোথায় গরু খোঁজা খুঁজবি? নিজের দিকে চাইতে জানিস না? তুই সাজবি জয় সিংহ। আমি রঘুপতি। রাধারমণ গোবিন্দ মাণিক্য। না, বড় রোগা, ওকে মানাবে না। ও মন্ত্রী হোক বরং, নরজকে দিয়ে ট্রাই করতে হবে। বাড়িতে বিসর্জন বই আছে না? নিয়ে আয়! দ্যাখ, রবিবাবুর চেয়ে আমি ভাল পারি কি না!

বুকে হাত বুলোত বুলোতে মহারাজ পায়চারি করতে লাগলেন ঘরের মধ্যে। মহিম দৌড়ে গিয়ে নাটকটি নিয়ে এল। মাঝখানের একটা পৃষ্ঠা খুলে মহারাজ বললেন, আমাদের এখানে অভিনয় হবে, কলকাতার লোক দেখতে যাবে। সবাইকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে আমাদের ত্রিপুরা কোনও অংশে কম নয়। এইখানটা শুনে দ্যাখ;

সত্য
কেন না বলিব? আমি কি ডরাই সত্য
বলিবারে? আমারি এ কাজ। প্রতিমার
মুখ ফিরায়ে দিয়েছি আমি। কী বলিতে
চাও, বলো…

বইটা হাত থেকে খসে পড়ে গেল আগে, তারপর দুলতে দুলতে মহারাজও ঝুপ করে মুখ থুবড়ে পড়লেন মাটিতে।

মহিম ছুটে এসে দেখল, মহারাজের নাক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, ঠোঁটের পাশে ফেনা।

মহারাজ ফিসফিস করে বললেন, বুক ফেটে যাচ্ছে। আমাকে শিগগির ত্রিপুরায় ফিরিয়ে নিয়ে চল, মহিম। নইলে আর বুঝি আমার ফেরা হবে না।

সত্যিই আর ফেরা হল না। এরপর কয়েকদিন যমে-মানুষে টানাটানি চলল। পাঁচজন বিখ্যাত চিকিৎসক পালা করে বসে রইলেন তাঁর শিয়রের পাশে। কেউই আর ভরসা দিতে পারছেন না।

মহারাজের গুরুতর পীড়ার সংবাদ শুনেও রবি আসতে পারলেন না। সেদিন অত বড় একটা কালীমূর্তি হ্যাঁচকা টানে ভোলার জন্য তাঁর কোমরে চোট লেগে গেছে, তিনিও শয্যাশায়ী, সারা গায়ে ব্যথা।

মহারাজ আচ্ছন্ন অবস্থায় রইলেন দিনের পর দিন। মাঝে মাঝে নিজের মনে কথা বলেন। তাঁর প্রথমা বানি ভানুমতীকে যেন চোখের সামনে দেখতে পান, ডাকেন তাঁর নাম ধরে। রাধাকিশোরের কাছে খবর গেছে, তিনি এখনও এসে পৌঁছতে পারেননি, কুমার সমরেন্দ্র আগেই রওনা দিয়েছিলেন বলে এসে গেছেন। তিনি পিতার পাশে বসে থাকেন। মহারাজ মাঝে মাঝে তার মাথায় হাত দিয়ে বিকারের ঘোরে বলেন, তোর মাকে কথা দিয়েছিলাম, তুই রাজা হবি। সিংহাসন ছেড়ে উঠবি না!

সতেরো দিন পর মহারাজের অবস্থার আবার খানিকটা পরিবর্তন হল। পুরো চোখ খুলে তাকালেন, নিশ্বাসও স্বাভাবিক। পাত্র-মিত্ররা উৎফুল্ল হয়ে ভাবল, মহারাজ তা হলে আবার সঙ্কট কাটিয়ে উঠবেন। কিন্তু সাহেব ডাক্তার বলে গেল, এই সময়টায় বেশি সাবধানে থাকবেন। যে কোনও মুহূর্তে বিপদ হতে পারে।

অনেকগুলি বালিশে ঠেসান দিয়ে বসে মহারাজ ফলের রস খেলেন চুমুক দিয়ে। একটু তামাক খেতে চাইলেন।

মহিমকে বললেন, হ্যাঁ রে, আমি ত্রিপুরায় ফিরতে পারব না আর? আমার জীবনে আমি অনেক সাধই মিটিয়েছি। বৃন্দাবন দর্শন করে এসেছি। দাঙ্গা-হাঙ্গামা দমন করে রাজ্যে শান্তি এনেছি। পিতৃপুরুষের সিংহাসন কলঙ্কিত করিনি। আমি যে ফোটোগ্রাফগুলো তুলেছি, সেগুলো যত্ন করে রাখিস। মহিম, আমার ছোটরানি এখনও নেহাত বালিকা, দেখিস যেন তার অযত্ন না হয়।

কথা বলতে বলতে থেমে গিয়ে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন মহিমের দিকে। তার দু চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল। একটু পরে তিনি আবার ধরা গলায় বললেন, শুধু দুটো অতৃপ্তি রয়ে গেল, যদি ত্রিপুরার মাটিতে শুয়ে শেষ নিশ্বাস ফেলতে পারতাম… আর, আর, সেই যে দাসীটি, কী যেন নাম, শুয়ে শুয়ে তার গান শুনতে চেয়েছিলাম, সে কিছুতেই রাজি হল না, আমি কী দোষ করেছি? তোরা তাকে আনতে পারলি না।

মহিমের চোখে জল এসে গেল। তখনই সে ছুটে গেল অর্ধেন্দুশেখরের কাছে।

এমারালড থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় সর্বাস্বান্ত অবস্থায় অর্ধেন্দুশেখর আপাতত বেকার হয়ে বসে আছেন বাড়িতে। নয়নমণিকে দু তিনটে থিয়েটার থেকে ডাকাডাকি করলেও সে কোনওটিতেই যোগ দেয়নি এখনও পর্যন্ত।

অর্ধেন্দুশেখরকে সঙ্গে নিয়ে মহিম এল নয়নমণির বাড়িতে। দুজনে মিলে তাকে বোঝাতে লাগল, টাকাপয়সা কিংবা জোর জবরদস্তির প্রশ্ন নয়, একজন মৃত্যুপথযাত্রীর শেষ ইচ্ছা কি সে পূরণ করতে পারে না? মুমূর্ষ অবস্থাতেও মহারাজ নয়নমণির কথা মনে রেখেছেন, তার গান শুনতে চেয়েছেন। অত বড় মানুষটা কাঁদছেন এ জন্য।

এ বারে আর নয়নমণি না বলতে পার না। একটা গরদের শাড়ি পরে সে ওদের সঙ্গে গিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে উঠল।

মহারাজের নিশ্বাস আবার ক্ষীণ হয়ে এসেছে। তবু নয়নমণিকে দেখে তাঁর মুখখানি যেন আলোকিত হয়ে উঠল। স্পষ্ট খুশির ভাব দেখা দিল তাঁর ওষ্ঠে। রাজারাজড়ার জেদ, এক নারীর সান্নিধ্য তিনি চেয়েছিলেন, তাকে না পেয়ে তিনি পৃথিবী ছেড়ে যেতে পারছিলেন না।

মহারাজকে প্রণাম করে নয়নমণি বসল তাঁর মাথার কাছে একটা চেয়ারে।

মহারাজ ফিসফিস করে বললেন, যখন তোমাকে চেয়েছিলাম, তখন তুমি যদি আসতে, তা হলে হয়তো আমি বেঁচে থাকতাম আরও অনেকদিন। তুমি কেন চলে গিয়েছিলে ?

এ প্রশ্নের উত্তর দেবার এখন সময় নয়। নয়নমণি বলল, কী গান শোনাব ? মহারাজ বললেন, তুমি বেঁচে থাকো, ভূমিসূতা। তুমি সুখী হও। আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে টের পাচ্ছি। তোমার যা ইচ্ছে হয় সেই গান শোনাও !

নয়নমণি হাত জোড় করে গান ধরল :

দেখ সখী মোহন মধুর সুবেশং
চন্দ্রক চারু মুকুতাফলমণ্ডিত
অলি কুসুমায়িত কেশং
তরুণ অরুণ করুণাময় লোচন
মনসিজ তাপ বিনাশং…

 পুরো গানটি শেষ হল না, তার আগেই ডুকরে উঠল মহিম।

মহারাজের শেষ সময়েও রবি উপস্থিত থাকতে পারেননি, সেই সময় তাঁর স্ত্রীর প্রসববেদনা উঠেছিল। পরদিন মৃণালিনী একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। পুত্র মুখ দর্শন করার পর তিনি দ্রুত রওনা দিলেন। কেওড়াতলার শ্মশান ঘাটে মহীশুরের রাজার দাহকার্যের পর যে স্থানটি আলাদা করে ঘিরে রাখা হয়েছে, সেখানে সাজানো হচ্ছে মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্যের চিতা। রবি মৃতদেহের বুকের ওপর একটি ফুলের স্তবক রাখলেন। একটা কথা বারবার তাঁর মনে হতে লাগল, মানুষ কত কাজ। অসমাপ্ত রেখে চলে যায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *