২০. ছোট্ট ইভা

২০. ছোট্ট ইভা

এই ঘটনার দুদিন পর অ্যালফ্রেড ক্লেয়ার তাঁর ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। প্রাণচঞ্চল কিশোর হেনরিকের নিরলস সাহচার্যে উৎসাহিত হয়ে ইভা এই ক’দিনে তার শক্তির যা কিছু সঞ্চয় একেবারে নিঃশেষ করে ফেলেছে। সেই জন্যে হেনরিক চলে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ইভা ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়তে লাগল। ফলে সেন্ট ক্লেয়ারকে বাধ্য হয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হলো। এই ব্যাপারটাকে উনি এতদিন সযত্নে এড়িয়েই চলতে চেয়ে ছিলেন, কেননা ডাক্তার ডাকা মানেই অবাঞ্ছিত সত্যটাকে স্বীকার করে নেওয়া।

দুএকদিনের মধ্যে ইভা এমন অসুস্থ হয়ে পড়ল যে আর ঘর থেকেই বের হতে পারল না। ডাক্তার এসে দেখে গেলেন।

দিন দিন মেয়েটার স্বাস্থ্য যে ক্রমশ ভেঙে যাচ্ছে, মেরি সেন্ট ক্লেয়ার কোনোদিন সেদিকে ফিরেও তাকায় নি। অবশ্য মেরির সে অবকাশ ছিল না। সম্প্রতি দু-তিনটে নতুন উপসর্গ এসে জোটায় ও খুবই মুষড়ে পড়েছে। ওর ধারণা ওর মতো এরকম অসুস্থ এর আগে কেউ কখনো হয় নি এবং কোনোদিন হবেও না। সুতরাং ওর আশেপাশের কেউ কখনো অসুস্থ হলে মেরি সেটাকে আমলই দিত না।

মিস ওফেলিয়া বেশ কয়েকবার ইভা সম্পর্কে মেরিকে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কোনো ফল হয় নি।

কখনো কখনো কিছুটা বিরক্তির সঙ্গেই মেরি বলত, ‘মেয়েটা তো দিব্যি হেসে-খেলে বেড়াচ্ছে। ওর আবার অসুখ কিসের?’

‘আমি ওর কাশিটার কথাই ভাবছি।’

‘কাশি! কাশির কথা আমাকে আর বলবেন না। ইভার মতো বয়সে আমারও কাশি হয়েছিল। সবাই বলত আমার নাকি যক্ষ্মা হয়েছ। আমার মাতো রাতের পর রাত জেগে আমার পাশে বসে থাকতেন সেই তুলনায় ইভার কাশি তো কিছুই নয়।

‘আমারও ঠিক ওইরকম হয়েছিল। ওটা স্নায়ুবিক দুর্বলতা ছাড়া আর কিছুই নয়।’

‘রাত্তিরে ঘাম হয়।’

‘আমারও এই দশ বছর ধরে রাত্তিরে ঘাম হচ্ছে। এক-একদিন রাতের পোশাক ভিজে একদম সপ্ সপ্ করে। ইভা তো সেই তুলনায় ঘামে না বললেই চলে।’

মিস ওফেলিয়া আর একটা কথাও বলেন নি। কিন্তু ইভা শয্যাশায়ী হয়ে পড়তেই মেরি হঠাৎ কেমন যেন বদলে গেল! এখন ও বলতে লাগল, এমনটা যে ঘটবে ও আগে থেকেই জানত। মায়ের এমনি পোড়া কপাল যে নিজে যখন অসুস্থ, ওর একমাত্র সন্তান তখন চোখের সামনে মরতে বসেছে!

‘ছিঃ, মেরি, এভাবে বলা উচিত নয়!’ সেন্ট ক্লেয়ার বললেন। ‘তাছাড়া এত সহজেই বা হাল ছেড়ে দিচ্ছ কেন?’

‘মার মনের মধ্যে যে কী হয়, সে তুমি কোনোদিনও বুঝতে পারবে না, আগাস্টিন।’

‘তবু তোমার এভাবে বলা উচিত নয়, মেরি।’

‘তুমি ব্যাপারটাকে যত সহজে এড়িয়ে যেতে পার, আমি মা হয়ে তা কখনো পারি না আগাস্টিন।’

‘কিন্তু ডাক্তার তো বলছেন, এখনই এত ভয়ের কোনো কারণ নেই।’

‘ডাক্তারদের আমি আদৌ বিশ্বাস করি না।’

এরপর তর্ক করা অর্থহীন ভেবে সেন্ট ক্লোয়ার নীরবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

দু-এক সপ্তাহর মধ্যে ইভার শারীরিক অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি ঘটল, এমন কী ও হেঁটে চলেও বেড়াতে লাগল। বাগান থেকে আবার ভেসে আসতে লাগল ওর মিষ্টি হাসি। সবাই খুশি হলো, শুধু আশ্বস্ত হতে পারলেন না ডাক্তার আর মিস ওফেলিয়া। ওঁরা বুঝতে পারলেন প্রদীপ নেভার আগে যেমন শেষবারের মতো জ্বলে ওঠে, কালব্যাধিগ্রস্থ মানুষও কখনো কখনো মৃত্যুর আগে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো আনন্দে হেঁটে-চলে ঘুরে বেড়ায়।

যা কিছু প্রাচুর্য আর জীবনের উজ্জ্বলতা সত্ত্বেও ইভাও যে মৃত্যুর খুব কাছাকাছি, সম্ভবত সেটা ওর অজানা ছিল না। তবু ওর মনে নিজের জন্যে এতটুকুও দুঃখ বা অনুতাপ ছিল না। বাইরে থেকে ওকে দেখে মনে হতো সূর্যাস্তের রঙিন আলোরই মতো শান্ত, শরতের নিটোল নিস্তব্ধতারই মতো উজ্জ্বল। ওর শুধু একটাই মাত্র দুঃখ, এ পৃথিবীতে যারা ওর সবচাইতে প্রিয়, বিশেষ করে বাবা, মা আর সেই সব ক্রীতদাস-দাসী, একদিন যারা ওর জীবনে আনন্দ দান করেছিল, আজ তাদের ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে বলে।

ইভা শিশু হলেও, মনের দিক থেকে ও আশ্চর্য পরিণত। প্রতিটা দাসদাসীকে ও সূর্যের আলোর মতোই ভালোবাসত। শুধু যে ওদেরকেই ভালোবাসত তা নয়, ভালোবাসত ওদের নিপীড়িত জীবনের দৈন্যতা আর কদর্যতাকেও। ওদের জন্যে কিছু একটা করার, অন্তত ওদের জীবনে একটু আলো আর আনন্দ আনার জন্যে ইভা তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভব করত।

একদিন টমকে বাইবেল পড়ে শোনাতে শোনাতে ইভা হঠাৎ বলল, ‘যিশু কেন আমাদের জন্যে মৃত্যুবরণ করতে চেয়েছিলেন, এখন আমি বুঝতে পারছি, টম চাচা।’

‘কেন, মিস ইভা?’

‘আমি তোমাকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না, তবে আমি যেন তা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছি। সেদিন স্টিমারে করে আসার সময়, তোমার সঙ্গে যে হতভাগ্য দলটাকে দেখেছিলাম, যাদের মধ্যে কেউ হারিয়েছে তার মাকে, কেউ তার স্বামীকে, কোনো মা আবার তার সন্তানকে হারিয়ে কাঁদছে … আর যারা নির্যাতনের ফলে মারা গেছে, উঃ, কী ভয়ঙ্কর! আমার জীবন দিলে যদি এদের দুঃখ শেষ হয়, আমি আনন্দের সঙ্গেই সে মৃত্যুকে বরণ করে নেব।

কথাটা বলে ইভা ক্লান্তিভরে ওর শীর্ণ হাতখানা রাখল টমের হাতের ওপর। টম শঙ্কাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইভার মুখের দিকে। বাবার ডাকে ইভা চলে যাবার পর টমের দুচোখ ছাপিয়ে নেমে এল অশ্রুধারা।

‘ওকে আর এ পৃথিবীতে কেউ ধরে রাখতে পারবে না।’ চোখ মুছতে মুছতে টম নিজের মনেই ভাবল। ‘আমি ওর কপালে দেখতে পাচ্ছি ঈশ্বরের স্নেহ-চিহ্ন!

ইভা বাবার হাত ধরে বারান্দায় সিঁড়িতে এসে দাঁড়াল। মেয়ের জন্যে কিনে আনা সুন্দর পাথরের মূর্তিটাকে দেখাবেন বলেই সেন্ট ক্লেয়ার ইভাকে ডেকে এনেছিলেন। তখন বিদায় গোধূলিবেলা। অদ্ভুত একটা রাঙা আলো এসে পড়েছে ওর সর্বাঙ্গে। ধবধবে সাদা পোশাক, ছোট্ট মাথাটা ঘিরে একরাশ সোনালি চুল, প্রদীপ্ত চিবুক, চোখ দুটো আশ্চর্য উজ্জ্বল, সব মিলিয়ে ইভাকে মনে হচ্ছে অনেক দূরের ঐশ্বরিক একটা জ্যোতির মতো। ইভার চোখ-ধাঁধানো সেই দীপ্তি এমনই দুর্লভ অথচ ভঙ্গুর যে হাহাকার করে উঠল। হঠাৎ উনি এমনভাবে ইভাকে দুহাতে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরলেন যে, যে-কথাটা বলবেন বলে ডেকে এনে ছিলেন, সেটাই বলতে ভুলে গেলেন।

‘ইভা, মা আমার, আজকাল তুমি একটু ভালো আছ, তাই না?’

‘বাপিসোনা’, কোমল অথচ জড়তাবিহীন স্বরেই ইভা বলল, ‘অনেকদিন ধরেই কয়েকটা কথা তোমাকে বলব বলব করেও বলতে পারি নি। আমি আরো দুর্বল হয়ে পড়ার আগে সেই কথাগুলো তোমাকে বলতে চাই।’

‘কী কথা, মামণি?’

‘তেমন একটা দরকারি কিছু নয়, বাবা। তোমাকে ছেড়ে আমার চলে যাবার সময় হয়ে এসেছে। আমি চলে যাব, আর কোনোদিনও ফিরে আসব না …’

‘না না, ও কথা বলো না, মা।’ কেঁপে উঠল সেন্ট ক্লেয়ারের কণ্ঠস্বর। মেয়েকে উনি আরো নিবিড় করে বুকের মধ্যে চেপে ধরলেন। ‘তুমি দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাই ওরকম মনে হচ্ছে। ওসব আজে-বাজে চিন্তা একদম মনেও এনো না। দেখো, তোমার জন্যে কেমন সুন্দর একটা পাথরের মূর্তি কিনে এনেছি।’

‘না, বাপী; ওসব এখন আমার আর চাই না। আমি ভালো করেই জানি, আমি খুব শিগগিরই চলে যাচ্ছি। আমার মন দুর্বল নয়, আমার একটুও ভয় করছে না। শুধু তোমাকে আর আমার বন্ধুদের ছেড়ে যেতে না হলেই আমি সবচেয়ে সুখী হতাম। নইলে আমি চলে যেতেই চাই, বাপী।’

‘কেন, মামণি, তোমার এত দুঃখ কিসের? সুখী হওয়ার তো তোমার কোথাও কোনো অভাব নেই।’

‘না বাপী, আমি কেবল আমার বন্ধুদের জন্যেই বেঁচে থাকতে পারতাম। কিন্তু এখানে এমন জিনিস আছে, যা দেখে আমার খুব ব্যথা লাগে, বড় ভয়ঙ্কর মনে হয়। আমার বরং চলে যাওয়াই ভালো। কিন্তু তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার কিছুতেই ইচ্ছে করছে না, সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছে, বাবা।’

‘কিসে তোমার ব্যথা লাগে, কী তোমার ভয়ঙ্কর মনে হয়?’

‘আমাদের এই হতভাগ্য ক্রীতদাস-দাসীদের জন্যে আমার খুব ব্যথা লাগে। ওরা সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে, আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে। আমার ইচ্ছে ওরা সবাই দাসত্ব থেকে মুক্তি পাক।’

‘কেন, ইভা মা, তোমার কি মনে হয়, ওরা সবাই আমাদের এখানে বেশ ভালো নেই?’

‘হ্যাঁ, বাপী, আছে। কিন্তু ধরো, হঠাৎ যদি তোমার কিছু হয়, তখন ওদের কী দশা হবে? সবাই তো আর তোমার মতো ভালো নয়। অ্যালফ্রেড চাচা, হেনরিক, এমন কী মামণিও তোমার মতো নয় …’

‘তোমার মনটা অসম্ভব নরম, ইভা, তাই তোমার অমন মনে হয়।‘

‘না, বাপী, তুমি আমাকে কখনো কষ্ট দাও নি। কিন্তু আমি জানি, ওদের জীবনে দুঃখ, কষ্ট, হতাশা ছাড়া আর কিছু নেই। ওদের কথাই আমি বেশি করে ভাবি, ওদের দুঃখই আমাকে কষ্ট দেয়। আমার সব সময়েই মনে হয় এ অন্যায়, এ ভয়ঙ্কর অন্যায়। এমনটা হওয়া কখনই উচিত নয়। আচ্ছা বাবা, যত ক্রীতদাস-দাসী আছে, সবাইকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করার কি কোনো পথ নেই?’

স্তব্ধ বিস্ময়ে মুখের দিকে তাকিয়ে সেন্ট ক্লেয়ার যেন মুহূর্তের জন্যে বোবা হয়ে গেলেন।

‘এটা খুবই কঠিন প্রশ্ন, মামণি। আমি জানি আমাদের দেশের এই রীতিটা খুব খারাপ। আমি আন্তরিকভাবে কামনা করি যে আমাদের দেশে যেন কোনো ক্রীতদাস না থাকে। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব, তা আমি নিজেই জানি না।’

‘তুমি সত্যিই খুব ভালো, বাবা। আর সবকিছু এমন সুন্দর করে বলো, আমার শুনতে খুব ইচ্ছে করে। আচ্ছা বাপী, যার সঙ্গে তোমার দেখা হবে, তাদেরকে তুমি বলতে পার না, এটা অন্যায়, এটা করা উচিত নয়? আমি যখন এ পৃথিবীতে থাকব না, তখন তুমি নিশ্চয়ই আমার কথা ভাববে আর আমার জন্য কষ্ট করেও এই কাজটা করার চেষ্টা করবে

‘না না, ইভা না…আর কখনো এভাবে বলো না মা।’ বেদনার্ত স্বরে সেন্ট ক্লেয়ার বলে উঠলেন। ‘তুমি যখন এ পৃথিবীতে থাকবে না, তখন আমারও নিজের বলতে আর কিছু থাকবে না। এ পৃথিবীতে তুমিই আমার সব।’

‘ক্রীতদাস-দাসীরাও তাদের সন্তানদের ভালোবাসে, বাপী। টম চাচা তার সন্তানদের তোমারই মতো ভালোবাসত। একসময়ে মামিরও দুটো ছেলেমেয়ে ছিল, যাদের জন্যে আজো সে লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জল ফেলে। কিন্তু তারা সব আজ কোথায় গেল? তাদের কি ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় নি? আমি শুধু তোমার কাছে ছোট্ট একটা অনুরোধ করব, বাপী। তুমি আমাকে কথা দাও, আমি যখন এ পৃথিবীতে থাকব না, টম চাচাকে তুমি মুক্তি দেবে।’

‘নিশ্চয়ই। তুমি যা বলবে, আমি তাই করব?’

‘আঃ বাপী।’ নিজের উত্তপ্ত চিবুকটা বাবার চিবুকের ওপর রেখে ইভা অস্ফুটে বলল, ‘আমরা দুজনেই যদি একসঙ্গে চলে যেতে পারতাম!’

‘কোথায় মামণি?’

‘আমাদের পরিত্রাতা যেখানে বাস করেন, সেখানে চিরটাকাল প্রেম আর শান্তি বিরাজ করে।’ অনেকটা স্তব্ধস্বরে ইভা এমনভাবে কথাগুলো বলে চলল, যেন জায়গাটা অত্যন্ত চেনা। ‘তুমি সেখানে যেতে চাও না, বাপী?’

কোনো জবাব না দিয়ে সেন্ট ক্লেয়ার মেয়েকে বুকের আরো কাছে টেনে নিলেন।

ইভা শান্তস্বরে, যেন নিজের অজ্ঞাতেই বলল, ‘আমি জানি তুমি আমার কাছে যাবেই, বাপী।

‘আমি যাব তোমার ঠিক পরেই, মামণি। তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।’

ওদের দুজনকে ঘিরে সন্ধ্যার ছায়াগুলো গাঢ় থেকে আরো গাঢ়তর হয়ে উঠল। সেন্ট ক্লেয়ার ইভার নিষ্পাপ, ভঙ্গুর দেহটাকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে নীরবে বসে রইলেন। এখন উনি উজ্জ্বল, গভীর চোখ দুটোকে দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু শুনতে পাচ্ছেন অতলস্পর্শী স্বর্গীয় একটা কণ্ঠস্বর। শুনতে শুনতে হঠাৎ তাঁর মার কথা মনে পড়ে গেল, মনে পড়ে গেল নিজের শৈশবের দিনগুলোর কথা। ভাবতে ভাবতে হঠাৎই একসময়ে তাঁর মনে হলো, এই মুহূর্তে তিনি যেন অনেককিছু দেখতে পাচ্ছেন, অনুভবও করতে পারছেন। কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না। বেশ কিছুক্ষণ পর অন্ধকার যখন আরো গাঢ় হয়ে উঠল, বিশ্রামের জন্যে মেয়েকে তিনি শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন, নিজের হাতে শয্যায় শুইয়ে দিলেন, তারপর ইভা ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত চুপচাপ ওর পাশে বসে রইলেন।

২১. মৃত্যু

বাংলো বাড়ির অন্যান্য ঘরগুলোর মতো ইভার ঘরটাও বেশ খোলামেলা আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ইভার ঘরের সঙ্গে সুসংলগ্ন দুপাশের ঘর দুটোর একটা বাবার, অন্যটা মার একদিকে চওড়া বারান্দা, উল্টো দিকের ঘরটা মিস ওফেলিয়ার। ইভার চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই সেন্ট ক্লেয়ার রুচিসম্মতভাবে ঘরটাকে সাজিয়েছেন। জানলায় গোলাপি আর সাদা মসলিনের পর্দা, মেঝেতে পাতা রয়েছে পারি থেকে আনানো গালিচা, যার চারপাশে নকশাতোলা গোলাপ-কুঁড়ি আর পাতার মাঝখানে বেশ বড় একটা প্রস্ফুটিত গোলাপ। খাট, চেয়ার, টেবিল, সোফা থেকে শুরু করে সবকিছুই সুন্দর কারুকার্য করা বেত-বাঁশের তৈরি। বিছানার সামনে দেবদূতের সুন্দর একটা প্রতিমূর্তি। দেবদূতের ডানা দুটো প্রায় গুটিয়ে নেওয়ার ভঙ্গিতে অনেকটা ঝুলে পড়েছে, হাতে ধরা রয়েছে চিরহরিৎ লতাগুল্মের মুকুট। বিছানার এপাশে নিচু টেবিলটার ওপর রয়েছে সুন্দর ঢাকনা-দেওয়া একটা বাতিদান, সাদা একটা পদ্মের আকারে তৈরি দুর্লভ কারুকার্য করা ফুলদানি যেটাকে টম নিজের হাতে রোজ নানা ধরনের ফুল দিয়ে সাজিয়ে রেখে যায়। বাতিদানের নিচে রয়েছে ইভার অত্যন্ত প্ৰিয় বাইবেল। সব মিলিয়ে ইভার ঘরটা শুচীস্নিগ্ধ একটা ছবির মতোই শান্ত, নিস্তব্ধ। দিন দিন ইভার শক্তি ক্রমশই নিঃশেষ হয়ে আসছে। ফলে আজকাল বারান্দায় ওর পদশব্দ প্ৰায় শোনা যায় না বললেই চলে। শুধু মাঝে মাঝে দেখা যায় খোলা জানলা দিয়ে ও নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রয়েছে দূরের সমুদ্রের দিকে।

তখন মধ্যদিন। বিছানায় আধ শোয়া অবস্থায় ইভা বাইবেলের পাতা উল্টে চলেছে, হঠাৎ বারান্দায় মার তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর শুনতে পেল।

‘ফের শয়তানি শুরু করেছিস? তোকে না কতদিন ফুল তুলতে নিষেধ করেছি!’ পরক্ষণেই শোনা গেল ঠাস করে একটা চড়ের শব্দ।

‘সত্যি বলছি, মিসিস ফুলগুলো আমি মিস ইভার জন্যে তুলে ছিলাম। করুণ একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল। কন্ঠস্বরটা যে টপসির সেটা বুঝতে ইভার কোনো অসুবিধে হলো না।

‘আহাঃ মিস ইভার জন্যে তুলে ছিলাম!’ বিদ্রূপে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল মেরির কণ্ঠস্বর। ‘তাহলে তো সাতখুন মাপ! ও কি চেয়েছিল তোর ফুল, যা, বেরিয়ে যা এখান থেকে, নোংরা পেত্নী কোথাকার!’

ইভা সেই সময় বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।

‘না মা, ওকে তুমি বকো না। ওর ফুলগুলো সত্যিই খুব সুন্দর! ওগুলো আমাকে দাও।

‘কেন ইভা, তোমার ফুলদানি তো একদম ভর্তি হয়ে রয়েছে?’

‘আরো বেশি হলেই বা ক্ষতি কী, মামণি? ফুল তো আমার খুব ভালো লাগে। টপসি, ওগুলো আমাকে দাও।’

টপসি এতক্ষণ নতমুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, ইভার কথায় যেন সম্বিৎ ফের পেয়ে অত্যন্ত দ্বিধার সঙ্গেই সে ফুলগুলো এগিয়ে দিল।

ইভা তোড়াটার দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘বাঃ, খুব সুন্দর হয়েছে!’

তোড়া বলতে অবশ্য উজ্জ্বল গাঢ় লাল রঙের একটা জিরেনিয়াম আর পাতাসহ ধবধবে সাদা একটা জাপোনিকা। কিন্তু বিপরীতধর্মী দুটো রঙের সহাবস্থান সত্যিই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

ইভার প্রশংসায় টপসির চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

‘তোমার সাজানোটাই আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে!’ ইভা বলল। ‘এবার থেকে রোজ ফুল তুলে তুমি আমার ঘরে নিজে সাজিয়ে দিয়ে যাবে

মেরি টপসিকে বলল, ‘তোর মনিবানি কী বলল মন দিয়ে শুনেছিস?’

টপসি মাথা হেলিয়ে নীরবে সায় দিল। নতমুখে ফিরে যাবার সময় ইভা স্পষ্টই দেখতে পেল ওর মসৃণ, কালো চিবুক বেয়ে গড়িয়ে এসেছে দুফোঁটা অশ্ৰু।

টপসি চলে যাবার পর মেরি বলল, ‘এসবের কিন্তু সত্যিই কোনো দরকার ছিল না, ইভা।’

‘আসলে কি জানো মা, টপসির ইচ্ছে, এ বেচারিও আমার জন্যে কিছু একটা করে।’

‘ওটা ওর একটা শয়তানি করার ছুতো। ও জানে আমি ফুল তুলতে বারণ করেছি, তাই যেকোনো ছুতোয় ফুল তুলতেই হবে। অবশ্য তোমার যখন ইচ্ছে ও ফুল তুলুক, আমি আর বাধা দিতে চাই না।’

‘এটা ঠিক, টপসি আর পাঁচ জনের মতো নয় মা। তবে ও কিন্তু আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়ে গেছে।’

মেরি হাসতে হাসতে বলল, ‘ওরা কোনোদিনই ভালো হয় না। ওদের জাতটাই আলাদা।’

‘কিন্তু মামণি, ঈশ্বর তো আমাদের সবারই পিতা?’

‘হ্যাঁ, ঈশ্বর আমাদের সবাইকে তৈরি করেছেন, কিন্তু তবু … আমার নির্যাসের শিশিটা কোথায়?’

‘আর একটা কথা মামণি’, গলার স্বর নামিয়ে নিয়ে ইভা মিষ্টি করেই বলল। ‘আমি আমার কিছু চুল কেটে ফেলতে চাই।’

মেরি অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকাল। ‘কেন?’

‘শক্তি ফুরিয়ে আসার আগে কিছু চুল কেটে আমি নিজের হাতে আমার বন্ধুদের দিয়ে যেতে চাই। তুমি ওফেলিয়া ফুপুকে বলো না আমার চুলগুলো একটু কেটে দিয়ে যাবে।

আপত্তি করে কোনো লাভ হবে না জেনেই মেরি ওফেলিয়াকে ডাকতে গেল। ইভা আবার ফিরে এল ওর শয্যায়! ওফেলিয়াকে ঘরে ঢুকতে দেখেছি ইভা বালিশ থেকে মাথা তুলে দীর্ঘ কোঁকড়ানো সোনালি চুলগুলো এলিয়ে দিয়ে দুষ্টুমির সুরে হাসতে হাসতে বলল, ‘এসো, এসো ওফেলিয়া ফুপু, চুলগুলো একটু কেটে দাও তো দেখি।’

মিস ওফেলিয়া কাঁচি নিয়ে আবার ফিরে এলেন।

ঠিক সেই সময় সেন্ট ক্লেয়ারও মেয়ের জন্যে কিছু ফল নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। ব্যাপার, এটা আবার কী হচ্ছে?’

‘আমি ফুপুকে কিছু চুল কেটে দেওয়ার কথা বলেছি, বাপি। এত বড় বড় হয়ে গেছে যে ভীষণ অস্বস্তি লাগে, তাছাড়া কিছু চুল আমি নিজ হাতে আমার বন্ধুদের দিয়ে যেতে চাই।’

‘কিন্তু ওফেলিয়া, লক্ষ্মীটি, খুব সাবধানে, একদম ভেতরে থেকে, যাতে বাইরে থেকে কিছু বোঝা না যায়। সেন্ট ক্লেয়ার বললেন। ‘তুমি হয়তো ঠিক জানো না ওফেলিয়া, ইভার এই নরম সোনালি চুলগুলো আমার একটা গর্বের বস্তু। তাছাড়া আমি মনে মনে ঠিক করেছিলাম খুব শিগগিরই ইভাকে অ্যালফ্রেডদের ওখানে বেড়াতে নিয়ে যাব। চুল কেটে ফেলার জন্যে হেনরিকের কাছে ইভাকে তখন খারাপ দেখাক, সেটা আমি কিছুতেই চাই না।’

কথাটা বলে সেন্ট ক্লেয়ার দুষ্টুমির ভঙ্গিতে মুচকি মুচকি হাসলেন।

আমি তার ওখানে কোনোদিনও যাব না, বাপী। আমি ওর চাইতে অনেক অনেক একটা ভালো দেশে যাচ্ছি।’ ম্লানস্বরে ইভা বলল। ‘দেখতে পাচ্ছ না, দিন দিন কী ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ছি?’

‘না না, ইভা! কেন এই নিষ্ঠুর জিনিসটাকে তুমি বারবার আমাকে বিশ্বাস করতে বলো।’

মিষ্টি করে ইভা বলল, ‘এটা তো সত্যি, বাপী।’

কোনো কথা না বলে সেন্ট ক্লেয়ার ইভার কেটে ফেলা গুচ্ছগুচ্ছ সোনালি চুলগুলোর দিকে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলেন।

ইভার ইচ্ছানুসারে ওফেলিয়া প্রতিটা চাকর-বাকরদের ইভার ঘরে আসার নির্দেশ দিলেন। একে একে দাস-দাসীরা সবাই ভিড় করে দাঁড়াল ইভার ঘরের একপাশে। শীর্ণ হাতে ভর রেখে ইভা বালিশের ওপর একটু উঠে বসল। প্রদীপ্ত চিবুক, বড় বড় উজ্জ্বল দুটো চোখ মেলে ইভা খানিকক্ষণ গভীর আগ্রহে তাকিয়ে রইল ওদের মুখের দিকে। আবেগের আকস্মিকতায় ওরা তখন একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছে। স্বর্গীয় সুষমামাখা মুখে ইভা ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, সুন্দর সোনালি চুলের গুচ্ছগুলো পড়ে রয়েছে ওর পাশে। বাবা উদাস চোখে তাকিয়ে রয়েছেন, মা রুমালে মুখ ঢেকে কাঁদছে। সারা ঘরে বিরাজ করছে কবরের একটা নিটোল নিস্তব্ধতা। দাসদাসীরা একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে, কেউ নিজের মনেই মাথা নাড়ছে, কেউ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে, কেউ আবার নীরবে কাঁদছে।

‘তোমাদের ডেকে পাঠিয়েছি, যেহেতু তোমাদের সবাইকেই আমি ভালোবাসি। ম্লানস্বরে ইভা বলে চলল। ‘আজ তোমাদের কয়েকটা কথা বলতে চাই, আশা করি তোমরা সেটা কোনোদিন ভুলবে না। আর কয়েকদিনের মধ্যেই আমি তোমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি … তোমরা আর কোনোদিনও আমায় দেখতে পাবে না।’

হঠাৎ ফুঁপিয়ে ওঠা কান্না আর বিলাপের শব্দের ইভার কোনো কথাই শোনা গেল না। একটু অপেক্ষা করার পর ও আবার ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল, ‘তোমরা যদি আমাকে সত্যিই ভালোবেসে থাক, তাহলে আমার কথাটা নিশ্চয়ই মনে রাখবে। যে পৃথিবীতে বাস করছ, তোমরা শুধু তার কথাই ভাব। কিন্তু ঈশ্বর যেখানে বাস করেন, সেটা ওর চাইতেও সুন্দর। আমি সেখানে যাচ্ছি, তোমরাও একদিন যাবে। কিন্তু সেখানে যেতে গেলে অলস, উদাসীন হলে চলবে না। এর জন্যে লেখাপড়া শিখতে হবে, তাঁর কাছে প্রার্থনা করতে হবে। ইচ্ছে করলে তোমরাও এক-একজন দেবদূত হতে পারো। তোমরা প্রত্যেকে যদি লেখাপড়া শিখতে নাও পার, প্রতিদিন তাঁর কাছে প্রার্থনা করবে, তাঁকে বলবে সাহায্য করতে। উনি নিশ্চয়ই তোমাদের সাহায্য করবেন আর সময় পেলেই বাইবেল পড়বে, কেননা আমি তোমাদের সবাইকেই স্বর্গে দেখতে চাই।’

টম আর মামি ছাড়া, যারা ব্যাপারটা সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করতে পারল না, তারা সবাই কেঁদে উঠল। ইভা বলল, ‘আমি জানি, তোমরা সবাই আমাকে ভালোবাস।’

সবাই প্রায় একইসঙ্গে বলে উঠল, ‘নিশ্চয়ই। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।’

‘তোমরা প্রত্যেকেই আমার প্রতি সদয় ছিলে। তাই তোমাদেরকে আমি কিছু দিয়ে যেতে চাই, যা দেখলে তোমাদের আমার কথা মনে পড়বে। আমি তোমাদের সবাইকে আমার মাথার চুল দেব, যা দেখলে তোমাদের মনে পড়বে, আমি একদিন তোমাদের ভালোবাসতাম এবং তোমাদের সবাইকেই স্বর্গে দেখতে চেয়েছিলাম।’

.

এর পরের দৃশ্য এমনই মর্মস্পর্শী যে ভাষায় প্রকাশ করা সত্যিই খুব কঠিন। চোখের জলে সবাই তখন ছোট্ট ইভাকে ঘিরে ধরেছে, বেদনায় রুদ্ধ হয়ে এসেছে তাদের কণ্ঠস্বর। হাত বাড়িয়ে ওরা গ্রহণ করছে ইভার ভালোবাসার শেষ দান। কেউ দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে, কেউ হাঁটু মুড়ে বসে প্রার্থনা করছে, কেউবা নিচু হয়ে ঝুঁকে চুমু দিচ্ছে ইভার পোশাকের প্রান্তে।

একসময় মিস ওফেলিয়া ইঙ্গিতে টম আর মামি ছাড়া আর সবাইকে চলে যেতে বললেন।

‘এই যে টম চাচা, তোমার জন্যে একটা গুচ্ছ রেখেছি, নাও। মিষ্টি হেসে ইভা বলল। ‘সত্যি, তোমাকে স্বর্গে দেখতে পাব বলে যে আমার কী আনন্দ হচ্ছে! আমি জানি, নিশ্চয়ই ওখানে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে। আর মামি … আমার ছোট্ট, সুন্দর মামি …’ নরম হাত দুটো দিয়ে ইভা দীর্ঘ দিনের পুরনো ধাত্রীর গলাটা জড়িয়ে ধরল। ‘আমি জানি, সেখানে তোমার সঙ্গেও আমার দেখা হবে।’

‘ওঃ, মিস ইভা, তুমি চলে গেলে কী নিয়ে বাঁচব আমি নিজেই জানি না!’ মামি আর কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, কথাটা বলেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ‘বিশ্বাস করো, তুমি চলে গেলে সব অন্ধকার মনে হবে।’

মিস ওফেলিয়া টম আর মামিকে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বার করে দিলেন, কিন্তু দরজাটা ভেজিয়ে দিতে গিয়েই দেখলেন টপসি এককোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে।

‘কী ব্যাপার, তোর আবার কী চাই?’

ওফেলিয়ার সে প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে টপসি চোখ মুছতে মুছতে ইভার দিকে এগিয়ে গেল, তারপর করুণস্বরে বলল ‘আমি খারাপ বলে তুমি বুঝি আমাকে কিছু দেবে না?’

‘কে বললো তুমি খারাপ, টপসি?’ ইভা ওর হাত দুটো জড়িয়ে ধরল। আমি জানি তুমি খুব ভালো মেয়ে, এবং আরো ভালো হবে। তুমি এই চুলের গুচ্ছটা রেখে দাও। যখনই এটার দিকে তাকাবে, মনে পড়বে, আমি তোমাকে ভালোবাসতাম, আমি চাই তুমি আরো ভালো মেয়ে হও।’

সজল চোখে টপসি বলল, ‘আমি জানি, মিস ইভা, আমি খুব খারাপ, আমি কোনোদিনও আর ভালো হব না।’

‘ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো, উনি নিশ্চয়ই তোমাকে সাহায্য করবেন।

চুলের গুচ্ছটাকে বুকের মধ্যে গুঁজে রেখে টপসি মন্থর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সবাই চলে যাবার পর ওফেলিয়া দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। ইতোমধ্যে ওফেলিয়াকেও বেশ কয়েকবার গোপনে চোখের জল মুছতে হয়েছে। তবে অন্য সকলের তুলনায় ওঁর মন অনেক বেশি শক্ত।

চোখে হাত চাপা দিয়ে সেন্ট ক্লেয়ার একই ভঙ্গিতে সারাক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলেন। এ দৃশ্য সহ্য করা তাঁর পক্ষে খুব একটা সহজ ছিল না।

‘বাপী!’

ইভা ওর নরম ছোট্ট হাতখানা রাখল বাবার হাতের ওপর। সেন্ট ক্লেয়ার চমকে উঠলেন। তারপর হঠাৎ ভেঙেপড়া মানুষের মতো আর্তস্বরে বলে উঠলেন, ‘পারছি না, আমি আর কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না। সর্বশক্তিমান আমাকে সত্যিই বড় কঠিন আঘাত দিয়েছেন।’

ওফেলিয়া তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন, ‘আগাস্টিন! ঈশ্বর কি তাঁর নিজের জিনিস নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারেন না?’

‘নিশ্চয়ই পারেন। কিন্তু আঘাতটা সহ্য করা খুবই কঠিন।’

‘না না, বাপী, আমার জন্যে তুমি এমন কষ্ট পেও না।’ সোজা হয়ে বসে ইভা বাবার বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল এবং তাঁর ভাবনাগুলোকে এলোমলো করে দেওয়ার চেষ্টা করল।

সেন্ট ক্লেয়ার শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। পরক্ষণে নিজেই মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন, ‘চুপ! চুপ করো, লক্ষ্মীটি … মামণি আমার, আমিই ভুল করেছি। আমার ওভাবে বলাটা ঠিক হয় নি। আমি আর কখনো ওসব কথা বলব না। তুমি শুধু কেঁদো না। তোমার মনে এভাবে আঘাত দেওয়াটা আমার কখনই উচিত হয় নি।’

ইভা বাবার কোলে মাথা রেখে চুপটি করে শুয়ে রইল আর বাবা ওর ওপর ঝুঁকে পড়ে সব চাইতে কোমল শব্দগুলোই মৃদুভাষে বলে যেতে লাগলেন। একসময় ম্লান হেসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘মামণি, তুমি তো আমাকে কোনো চুলের গুচ্ছ দিলে না?’

‘এগুলো সবই তোমার আর মামণির। ফুপু যদি চান, যতগুলো খুশি নিতে পারেন। আমি নিজের হাতে ওদের দিয়ে গেলাম এই কারণে, আমি চলে গেলে ওদের কেউ কোনোদিন মনে রাখবে না, বাপী।’

.

এই ঘটনার পর থেকে ইভা দ্রুত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। ও যে খুব শিগগিরই এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে, তাতে আর কারো সামান্যতমও সন্দেহ রইল না। মিস ওফেলিয়া দিনরাত অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ইভার শুশ্রূষা করে যান। এখন থেকে টমের অধিকাংশ সময়ই কাটে ইভার ঘরে। বেচারি ইভা সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকতে খুবই অস্বস্তি বোধ করে, কেউ একটু বাইরে নিয়ে গেলে অসম্ভব আনন্দ পায়। টমও এই কাজটা করতে পারলে সব চাইতে খুশি হয়। বালিশের ওপর ইভার হালকা দেহটাকে শুইয়ে দুহাতে দোলাতে দোলাতে ঘরময় পায়চারি করে, বারান্দায় নিয়ে যায়। কখনো কখনো সকালে সমুদ্রের দিক থেকে যখন ঝিরঝিরে মিষ্টি বাতাস বয়ে আসে, টম ওকে বাগানে কমলা গাছের তলায় সেই পরিচিত আসনটা পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যায়। সেখানে ওকে কোলের ওপর বসিয়ে একের পর এক ওর সব চাইতে প্রিয় স্তোত্রগুলোকে গেয়ে শোনায়।

কখনো কখনো সেন্ট ক্লেয়ারও ওইভাবে মেয়েকে নিয়ে পায়চারি করেন। কিন্তু যেহেতু তাঁর দেহের শক্তি টমের চাইতে অনেক কম, কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। সেইরকম কোনো মুহূর্তে ইভা বলে, ‘বাপী, তোমার কষ্ট হচ্ছে, এবার টম চাচাকে দাও। বেচারি এই কাজটা করতে পারলে খুব খুশি হয়।

‘আমিও তো খুশি হই, মামণি।’

‘তুমিতো আমার জন্যে সব, সবই করো বাপী। আমার পাশে রাত জেগে বসে থাক, আমাকে বই পড়ে শোনাও। কিন্তু টম চাচা তো ওসব কিছু করতে পারে না’ শুধু এই কাজটাই করতে পারে আর গান শোনাতে পারে। আমার জন্যে এটুকু করতে পারলে ও খুব আনন্দ পায়।’

শুধু টম নয়, এ বাড়ির প্রতিটা দাস-দাসীই ইভার জন্যে কিছু করতে পারলে কৃতার্থ মনে করত। বেচারি মামি সবসময়ই চাইত ওর সব চাইতে প্রিয়পাত্রী ইভার জন্যে কিছু করতে, কিন্তু মেরি দিন রাত ওকে অসম্ভব ব্যস্ত রাখত। আসলে চাকর-বাকররা বিশ্রাম নেবে, এটা মেরি আদৌ সহ্য করতে পারত না। রাতে অন্তত কুড়িবার মামিকে উঠতে হবে, হয় পা টেপা, নয়তো মাথায় হাত বুলানোর জন্যে। এ ছাড়াও আছে, বার বার রুমাল খোঁজ, দেখে এসো ইভার ঘরে কিসের শব্দ হলো, বড্ড উঁচু হয়ে গেছে, পর্দা একটু নামিয়ে দাও কিংবা বড্ড অন্ধকার লাগছে, পর্দাটা সরিয়ে দাও। এই ধরনের হাজার কাজ। কখনো ইভার ঘরে আসতে গেলে দিনের বেলায় বেচারিকে লুকিয়ে চুরিয়ে আসতে হতো।

মামি কখনো একটু ছুটি চাইলেই মেরি বলত, ‘অসম্ভব, এখন আমার যা শরীরের অবস্থা, যত্ন না নিলে মেয়েটার দেখাশোনা করব কেমন করে?’

শুনতে পেলে সেন্ট ক্লেয়ার জবাব দিতেন, ‘সে কী! আমার তো ধারণা ছিল ওফেলিয়া এই দায়িত্বটা থেকে তোমাকে মুক্তি দিয়েছে।’

‘বাঃ, এই না হলে পুরুষ মানুষের মতো কথা। মেয়ের এইরকম একটা অবস্থায় কোনো মাই তার দায়িত্ব কারো কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে স্বস্তিতে থাকতে পারে না। আমার মনের মধ্যে যে কী হয়, সেটা তোমরা জানবে কেমন করে? আমি তো আর তোমার মতো মায়া-মমতাহীনভাবে সমস্ত দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি না।’

স্ত্রীর কথা শুনে সেন্ট ক্লেয়ার অতি দুঃখের মধ্যেও একটু ম্লান না হেসে পারলেন না। বন্ধুদের মধ্যে ইভার সব চাইতে অন্তরঙ্গ ছিল মা, বাবাকে বিব্রত না করে মাকে ও নিজের মনের কথা সব বলতে পারত। আর টমও উপলব্ধি করতে পারত ওর প্রতিটা ভাবনা, ওর রহস্যময় প্রতিটা উক্তি।

আজকাল টম রাতে নিজের ঘরে না ঘুমিয়ে বারান্দাতে শোয়, যাতে ইভার সামান্যতম প্রয়োজনেও সে সঙ্গে সঙ্গে উঠতে পারে।

ওফেলিয়া ঠাট্টা করে বললেন, ‘কী ব্যাপার টম, তুমি আবার এখানে শুতে শুরু করলে কেন?’

‘আস্তে, মিস ওফেলিয়া; স্যার শুনতে পাবেন!’ ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে টম সতর্ক করে দিল, তারপর নিচু গলায় বলতে শুরু করল, ‘ধর্মশাস্ত্রে আছে, গভীর রাতে ঈশ্বর তাঁর প্রিয়তমের দরজায় দেবদূতকে পাঠান। আমি তাঁরই প্রতীক্ষায় রাতে ঘুমাতে পারি না, পাছে তিনি এসে ফিরে যান আর আমি দেখতে না পাই। আমি জানি মিস ইভা যখন স্বর্গে প্রবেশ করবে, দেবদূতেরা স্বর্গের দ্বার এতখানি উন্মুক্ত করে দেবেন যে আমরাও তাঁর মহিমা দেখতে পাব।’

‘কেন টম, ইভা কি তোমাকে বলেছে ও আজ খুব অসুস্থ অনুভব করছে?’

‘না, মিস ওফেলিয়া, ও শুধু আমাকে বলেছে কাল খুব ভোরে দেবদূতের রথ আসবে ওকে নিতে।’

টম আর ওফেলিয়ার মধ্যে যখন এই কথাবার্তা হয়, তখন রাত দশটা কি এগারোটা। সারা দিনের সমস্ত কাজ মিটিয়ে উনি এবার বিশ্রাম নেবেন। অন্যান্য দিনের তুলনায় ইভা আজ বেশ ভালোই ছিল। সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলেছে, নিজের সবচেয়ে প্রিয় ছোট ছোট দামি জিনিসগুলো গুছিয়েছে, অনেকগুলো আবার বন্ধুদের দিয়েও দিয়েছে, সারাটা সন্ধ্যে বাপীর সঙ্গে গল্প করেছে। ইভাকে তাঁর এত স্বাভাবিক মনে হয়েছে যে তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, এবার ও খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে। বহুদিন পরে মেয়েকে চুমু দিয়ে শুভরাত্রি জানিয়ে তিনি হালকা মন নিয়ে শুতে গিয়েছিলেন।

সারা রাত মিস ওফেলিয়া ইভার শয্যার পাশে জেগেই বসেছিলেন। কিন্তু গভীর রাতে, যখন রহস্যময় অথচ সব চাইতে দুর্লভ শুভক্ষণটি এল, উনি হয়তো একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন, নইলে স্পষ্টই দেখতে পেতেন ভঙ্গুর বর্তমান আর চিরন্তন ভবিষ্যতের মাঝের যবনিকাটা কীভাবে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়ে গেল আর রাজকীয় দীপ্তিতে স্বর্গের দূতরা প্রবেশ করল ঘরের ভেতরে।

ভেতরে কাদের যেন অস্পষ্ট পায়ের শব্দে ওফেলিয়ার তন্দ্রা ছুটে গেল। চকিতে চমকে উঠে আলোটা বাড়িয়ে দিতেই পরিবর্তনটা ওঁর চোখে পড়ল। তাড়াতাড়ি বাইরের দরজা খুলে উনি টমকে ডাকলেন। টম শুধু জেগে নয়, বাইরে দাঁড়িয়ে তখন এই ডাকটার জন্যেই প্রতীক্ষা করছিল।

ওফেলিয়া বললেন, ‘টম, একটা মুহূর্তও দেরি না করে ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এসো।’ কথাটা বলেই উনি আবার ফিরে এসে সেন্ট ক্লেয়ারের দরজা ধাক্কাতে লাগলেন। ‘আগাস্টিন! আগাস্টিন! শিগগির একবার এসো।’

ওফেলিয়ার শব্দগুলো ভারি একটা কফিনের মতো সেন্ট ক্লেয়ারের বুকে এসে আছড়ে পড়ল। পরক্ষণেই তিনি দৌড়ে এসে ইভার ওপর ঝুঁকে পড়লেন। ইভা কিন্তু তখনো ঘুমাচ্ছে।

ইভার মুখে যন্ত্রণা বা গ্লানিমার কোথাও কোনো ছায়া নেই, বরং সুস্থ স্বাভাবিকের চাইতে আরো উজ্জ্বল টলটলে মুখখানা যেন ঐশ্বরিক একটা দীপ্তিতে ঝলমল করছে।

সবাই নিস্পন্দ হয়ে এমন অপলক চোখে ইভার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে যে ঘড়ির টিকটিক শব্দকে মনে হচ্ছে অসহ্য। কয়েক মিনিটের মধ্যেই টম ডাক্তারকে নিয়ে ফিরে এল। ডাক্তার শুধু একবার তাকিয়ে দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর অত্যন্ত চাপা গলায় মিস ওফেলিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই পরিবর্তনটা কখন ঘটেছে?’

‘একটু আগে, ঠিক মাঝ রাত্তিরে।’

এমন সময় মেরি পাশের ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল। ‘কী ব্যাপার, আগাস্টিন! কী হয়েছে?’

‘চুপ! ইভা …!’

কথাটা শুনতে পেয়ে মামি চাকর-বাকরদের খবর দিল। নিমেষের মধ্যে সারা বাড়ি জেগে উঠল। আলো হাতে ওদের ছুটে আসতে দেখা গেল। শোনা গেল পায়ের শব্দ, বারান্দার দরজা-জানলা ঘিরে সবাই ভিড় করে দাঁড়াল। সেন্ট ক্লেয়ার ওসব কিছুই দেখেন নি বা শোনেন নি, তাঁর দৃষ্টি তখন নিবদ্ধ ফুলের মতো নিষ্পাপ মুখটাকে ঘিরে যে ভাব ফুটে উঠছে, কেবল তারই দিকে।

‘হায়, ও যদি একটিবার জাগত … একটা কথাও বলত!’ তারপর ঝুঁকে ইভার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে মৃদুস্বরে ডাকলেন, ‘ইভা, মামণি আমার!’

ইভার নীল টানাটানা চোখ দুটো যেন ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হলো, অস্পষ্ট একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল সারা মুখে। মাথাটা একটু তোলারও চেষ্টা করল।

‘তুমি আমাকে চিনতে পারছ, মামণি?’

‘বাপী!’ কথাটা বলে ইভা কোনোরকমে সেন্ট ক্লেয়ারের গলাটা জড়িয়ে ধরল, কিন্তু পরমুহূর্তেই তা শিথিল হয়ে খসে পড়ল।

সেন্ট ক্লেয়ার দেখলেন গভীর যন্ত্রণায় রেখাগুলো আবার স্পষ্ট হয়ে উঠছে ইভার সারা মুখে, শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। তিনি আর কিছুতেই সহ্য করতে পারলেন না, অদূরে নিশ্চল প্রতিমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা টমের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন, ‘উঃ, কী ভয়ঙ্কর! আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে টম!’

বালিশে মাথা রেখে যেন অসম্ভব ক্লান্তিতে ইভা ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে, স্থির হয়ে রয়েছে দীর্ঘায়ত চোখের নীলাভ মণি দুটো। যার সঙ্গে পার্থিব যন্ত্রণার এতটুকুও সম্পর্ক নেই। হাসি-হাসি মুখের অভিব্যক্তিতে জড়িয়ে রয়েছে আশ্চর্য রহস্যময় একটা দীপ্তি।

ইভার শয্যা ঘিরে সবাই নিস্পন্দ নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

সেন্ট ক্লেয়ার মৃদুভাষে ডাকলেন, ‘ইভা।’

ইভা সাড়া দিল না।

‘ইভা, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ আমাদের, বলবে না?’

অদ্ভুত স্নিগ্ধ একটা হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটের কোণে, অস্ফুটস্বরে ও বলল, ‘আনন্দ প্রেম … শান্তি!’ তারপর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে চলে গেল মৃত্যুর ওপারে।

দুহাতে মুখ ঢেকে সেন্ট ক্লেয়ার আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘বিদায় মামণি আমার, চিরকালের মতো বিদায়! তোমার সুন্দর মুখখানা আমি আর কোনোদিন দেখতে পাব না, তোমার মিষ্টি গলার স্বর আমি আর কোনোদিনও শুনতে পাব না। আমাদের সবাইকে ছেড়ে তুমি চিরকালের মতো চলে গেলে, তোমাকে আর কখনো দেখতে হবে না দৈনন্দিন জীবনের ধূসর আকাশ। বিদায় সোনামণি আমার, চিরকালের মতো বিদায়!’

২২. পুনর্মিলন

ইভার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া মিটে যাবার কয়েক দিন পরেই সেন্ট ক্লেয়ার সপরিবারে ফিরে এলেন নিউ অর্লিয়েন্সে। পেছনে পড়ে রইল সমুদ্রের ধারের বাংলো বাড়ি, গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা বাগান আর সেই ছোট্ট কবরটা।

খাওয়া, পরা, ঘুমানো থেকে শুরু করে সব কিছু আবার স্বাভাবিক গতিতেই বয়ে চলেছে। শুধু সেন্ট ক্লেয়ারের জীবনেই যা একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। যদিও তিনি সবার সঙ্গেই কথা বলেন, হাসেন, খবরের কাগজ পড়েন, রাজনীতি নিয়ে বির্তকের ঝড় তোলেন, ব্যবসায়িক ব্যাপারেও মন দেন, তবু তাঁর বুকের ভেতরটা সামুদ্রিক ঝিনুকের মতো একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। মাথায় শোকের চিহ্ন, কালো টুপিটা না থাকলে কেউ কখনো বুঝতেই পারত না যে তাঁর জীবনে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।

তাঁর এই নির্লিপ্ততা শুধু বাইরের লোক কেন, মেরিও কখনো বুঝতে পারে নি। তাই ও কখনো কখনো মিস ওফেলিয়ার কাছে অভিযোগ করত, ‘একটা জিনিস ভাবতে আমার খুব অবাক লাগে, এতদিন যে লোকটা ছিল মেয়ে বলতে একেবারে অজ্ঞান, আজ সেই লোকটা মেয়েকে এত তাড়াতাড়ি কী করে ভুলে যেতে পারল, আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না! বললে আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না, আজকাল ও ভুলেও কখনো ইভার কথা উচ্চারণ করে না!’

ওফেলিয়া আস্তে আস্তে বলতেন, ‘কিন্তু আমি জানি ও সবসময়ই ইভার কথা ভাবে। আসলে ওর ভাবনাটা ফল্গুস্রোতের মতো, ওপর থেকে কিছু বোঝা যায় না।’

‘কী জানি বাবা, আমার তো তা বিশ্বাস হয় না! লোকের মনে দুঃখ হলে কোনো না কোনোভাবে সে প্রকাশ করবেই। এই তো, আমার দুঃখকে কি একটা মুহূর্তের জন্যে চেপে রাখতে পারছি?’

‘স্যার কিন্তু আগের চাইতে অনেক রোগা হয়ে গেছেন’, মামি প্রতিবাদ না করে পারত না। ‘উনি আজকাল আর কিছু মুখে দেন না।’

‘কিন্তু আমাকেও তো ও দুএকটা সান্ত্বনা দিতে পারত? আমি মা, আমার বুকের মধ্যে যে কী হয়, সেটা ও কোনোদিনই বুঝতে পারে না।’

অথচ কেউ একটু চোখ মেলে দেখলে স্পষ্টই বুঝতে পারত, সেন্ট ক্লেয়ারের জীবনের যা কিছু স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা, সবই ছিল ইভাকে ঘিরে। যা কিছু কিনতেন, গড়তেন, সাজাতেন, সবই ইভার জন্যে। এখন ও নেই, তাই তারও কোনো ভাবনা নেই, কিছু করারও নেই।

সেন্ট ক্লেয়ারের জীবনে যা কিছু পরিবর্তন সেটা ঘটেছে খুব ধীরে ধীরে এবং সম্পূর্ণ ভেতর থেকে। উদাস চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাঁর মনে হয় ইভা যেন ঊর্ধ্বাকাশ থেকে ডাকছে, যেন ওর ছোট্ট হাত দিয়ে জীবনের পথটাকে দেখিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তিনি চিরকাল নিজেরই চেতনা আর বিচার-বুদ্ধি দিয়ে সকল কিছু ব্যাখ্যা করেছেন, কখনো ধর্মের বাধ্যবাধকতা দিয়ে জীবনকে পরিচালনা করেন নি। ফলে ধর্মের অলীক মোহকে তিনি যেমন কোনোদিন প্রশ্রয় দিতেন না, তেমনি মানবিক ধ্যান-ধারণা আর মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব দিতেন অপরিসীম। তা সত্ত্বেও আকজাল তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে ইভার বাইবেলটা পড়েন, ওর প্রতিটা কথা নিজের মনে তন্নতন্ন করে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন।

নিউ অর্লিয়েন্সে ফিরে আসার পরেই সেন্ট ক্লেয়ার ইভার কাছে প্রতিশ্রুতি মতো টমকে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে আইনের প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থাই গ্রহণ করেছিলেন, আশা করা যাচ্ছে খুব শিগগিরই অনুমতি পাওয়া যাবে। ইতিমধ্যে, যত দিন গেছে, সেন্ট ক্লেয়ার তত বেশিই টমের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। টমের মতো এমন বিশ্বস্ত, ইভার প্রতি এমন অনুরক্ত মানুষ তিনি আর একজনও দেখেন নি। টম যেমন তার তরুণ মনিবকে অনুক্ষণ ছায়ার মতো অনুসরণ করত, সেন্ট ক্লেয়ারেরও ঠিক তেমনি, টমকে দেখলেই তাঁর প্রিয়তমা কন্যা ইভার কথা মনে পড়ে যেত।

টমকে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে আদালতে আবেদন জানানোর পরেই সেন্ট ক্লেয়ার একদিন বললেন, ‘টম, আমি তোমাকে মুক্তি দেবার কথা ভেবেছি। সুতরাং বাক্স -প্যাঁটরা গুছিয়ে তুমি কেন্টাকিতে রওনা হবার জন্যে প্রস্তুত হতে পারো।’

অপ্রত্যশিত আনন্দের আলোয় টমের সারা মুখ ঝলমল করে উঠল। প্রার্থনার ভঙ্গিতে আকাশের দিকে হাত তুলে সে বলল, ‘ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন, কর্তা!’

টমের কথায় সেন্ট ক্লেয়ার প্রচ্ছন্ন একটা বেদনা অনুভব না করে পারলেন না। কেননা টম যে তাঁকে ছেড়ে যাবার জন্যে এতটা উন্মুখ হয়ে রয়েছে, তিনি তা জানতেন না। তাই কিছুটা ক্ষুণ্ণ স্বরেই তিনি বললেন, ‘কিন্তু, টম, তুমি এখানে এমন একটা কিছু দুরবস্থার মধ্যে ছিলে না যে চলে যাবার জন্যে একেবারে ব্যস্ত হয়ে উঠেছ?

‘ঠিক তা নয়, স্যার। স্বাধীন মানুষ হব, সেই জন্যেই নিজের আনন্দকে চেপে রাখতে পারি নি।’

‘কেন টম, স্বাধীন না হয়েও তুমি কি এখানে স্বাধীন মানুষের চাইতে সুখে ছিলে না?’

টম বিনীতভাবেই জবাব দিল, ‘না, স্যার।’ কেন টম, আমি তোমাকে যে ধরনের পোশাক-পরিচ্ছদ, থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি, তোমার নিজের উপার্জনে কী কখনো তা করা সম্ভব হতো?’

‘সবই বুঝি, স্যার। আপনি খুবই দয়ালু কিন্তু অপরের ভালো জিনিস খাওয়া পরার চাইতে নিজের জিনিসেই বেশি সুখ, তা সে যত খারাপই হোক না কেন। আমার ধারণা এটাই স্বাভাবিক, কর্তা।’

‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, টম। আশা করছি মাসখানেকের মধ্যেই তুমি এখান থেকে চলে যেত পারবে।

‘না স্যার তা হয় না। আপনি একটা মানসিক অশান্তির মধ্যে রয়েছেন। আপনি যতদিন চাইবেন আমি এখানে থাকব।’

‘না না টম, আমার জন্যে তোমাকে এখানে ধরে রাখতে চাই না। অনুমতি পাবার পরের দিনই তুমি এখান থেকে চলে যাবে, আর বাড়িতে গিয়ে তোমার ছেলেমেয়েদের আমার ভালোবাসা জানাবে।’

ইভার মৃত্যুতে মেরি বা মামি, কেউই কম আঘাত পায় নি। মামি তো আজো দিনরাত লুকিয়ে লুকিয়ে কেবল কাঁদে। কিন্তু মিস ওফেলিয়া ইভার মৃত্যুতে শোকের চাইতে জীবনের সত্যিকারের শিক্ষা পেয়েছেন অনেক বেশি। যে জংলি টপসিকে উনি শাসন করে, শিক্ষা দিয়েও মানুষ করতে পারেন নি, সেই টপসিকে ইভা বশ করতে পেরেছিল অন্তরের গভীর ভালোবাসা দিয়ে। এই ভালোবাসার শিক্ষাই ওফেলিয়ার হৃদয়কে একেবারে আলোকিত করে দিয়েছিল। তাই ইভার অসমাপ্ত কাজগুলোকে উনি নিজের কাজ বলেই মনে করতেন।

সেদিন বিকেলে চায়ের পর ওফেলিয়া হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘চাকর-বাকরদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তুমি কিছু ভেবেছ, আগাস্টিন?’

আগে না ভাবলেও, এখন তিনি প্রায়ই ভাবেন। তবু মুখে বললেন, ‘না।‘

‘কিন্তু এখন থেকেই ওদের সম্পর্কে তোমার ভাবা উচিত আগাস্টিন।’

‘কেন?’

‘বলা যায় না, হঠাৎ যদি তোমার মৃত্যু হয় তখন ওদের কী হবে?’

‘মৃত্যু’ শব্দটা যেন ছুরির ফলার মতো বিঁধল তাঁর বুকে। কাগজটা সরিয়ে রেখে তিনি উদাস চোখে তাকিয়ে রইলেন ফোয়ারাটার দিকে, পড়ন্ত আলোয় যার উৎক্ষিপ্ত জলধারা অজস্র চুনী-পান্নার মতো ঝিকমিক করছে। আপন মনেই তিনি আবার উচ্চারণ করলেন, ‘মৃত্যু’! শব্দটা কত সহজ অথচ কী ভয়ঙ্কর! এর আগে শব্দটার গুরুত্ব তিনি কখনো এমন গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন নি, এখন মনে হচ্ছে সবার জীবনেই এটা অবশ্যম্ভাবী।

ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ওফেলিয়া বললেন, ‘আমি তোমাকে আঘাত করার জন্যে বলি নি, আগাস্টিন।‘

‘আমি জানি, ওফেলিয়া, তুমি ইভার কথা ভেবেই বলেছ। আমি যে ওদের কথা আদৌ ভাবি নি, তা কিন্তু নয়। ভেবেছি একটু একটু করে ওদের সবাইকে মুক্তি দেব। টমের জন্যে ইতোমধ্যে আদালতে আবেদনও করেছি। মুক্তির পরেও টপসি থাকবে তোমার কাছে। ওর তো আর দেখাশোনা করার কেউ নেই, কোথায় থাকবে বলো?’

‘টপসি এখন ভালো হয়ে গেছে, ও আরো ভালো হবে।’

‘সবচেয়ে মুশকিল কী জানো, ওফেলিয়া … আমি অনেক ভেবে দেখেছি, শুধু মুক্তি পেলেই হবে না, ওদের দরকার সুশিক্ষা আর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। নইলে টপসি মুক্তি পেয়ে কী করবে বলো, যদি নিজের রুটিটুকু ও নিজে না উপার্জন করতে পারে? আমরা এমনই অলস আর স্বার্থপর যে কখনো কখনো ওদের প্রতি সদয় হয়ে ভালো ব্যবহার করেছি, কিন্তু কখনো শিক্ষিত করে তোলার কথা ভাবি নি।’

খুশির চোখে ওফেলিয়া ভাইয়ের দিকে তাকালেন। ‘সত্যি আগাস্টিন, আগের চাইতে তুমি এখন অনেক বদলে গেছ!’

‘হ্যাঁ ওফেলিয়া, এখন আমি অনেক দুঃসাহসী হয়ে উঠেছি। আগে আমার ভয় ছিল, কিন্তু এখন আমার হারাবার মতো আর কিছুই নেই। তাই ভেবেছি নতুন করে আর একবার চেষ্টা করে দেখব গোড়া থেকে শুরু করা যায় কি না।’

‘আগাস্টিন!’

‘হ্যাঁ ওফেলিয়া, হাঙ্গেরিয়ানরা যদি তাঁদের লক্ষ লক্ষ ভূমিদাসদের মুক্তি দিতে পারেন, আমিই বা এই কটা ক্রীতদাসকে মুক্তি দিতে পারব না কেন? সারাটা দেশের তুলনায় তা কিছু না হলেও, নতুন করে শুরু করব। শুধু মুক্তি নয়, শিক্ষারও ব্যবস্থা করব।’

‘যদি তুমি বল, আমি জেন, রোসা, আর টপসির লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব নিতে পারি।’ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওফেলিয়া বলে উঠলেন।

‘এ সম্পর্কে পরে আমি তোমাকে বিস্তারিত সব বলব, ওফেলিয়া। এখন আমি রাস্তা থেকে একটু ঘুরে আসব। কেন জানি না, আজ সারাদিন মনটা খুব খারাপ হয়ে রয়েছে। কেবলই আমার অতীত দিনগুলোর কথা স্পষ্ট মনে পড়ছে।’

টুপি আর ছড়ি নিয়ে মনিবকে বের হতে দেখে টম দ্রুত পায়ে আঙিনা পেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল সে তার সঙ্গে যাবে কিনা।

সেন্ট ক্লেয়ার বললেন, ‘না টম, তোমার আসার দরকার নেই। একটু ঘুরে আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে আসব।’

টম বারান্দায় বসে রইল। সায়াহ্নের অন্ধকার সরিয়ে ফুটফুটে জ্যোৎস্না উঠেছে। ফোয়ারার কৃত্রিম উৎসধারার দিকে তাকিয়ে সে জলের মৃদু কলতান, শুনতে লাগল। শুনতে শুনতেই টম ভাবতে লাগল নিজের বাড়ির কথা, শিগগিরই সে যে একজন স্বাধীন মানুষ হবে এবং স্বেচ্ছায় নিজের ঘরে ফিরে যেতে পারবে, তার কথা। কীভাবে নিজে পরিশ্রম করে স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের কিনে নেবে, তাও সে কল্পনা করল। আনন্দের সঙ্গে অনুভব করল নিজের সবল পেশিগুলো, যা দিয়ে সে স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের স্বাধীনতা কিনে নিতে পারবে।

এক সময়ে সে তার মহৎ-হৃদয় তরুণ মনিবের কথাও ভাবতে লাগল, শেষে তার ভাবনার সবটুকু অধিকার করে নিল মূর্তিময়ী ইভা। তার কেনই যেন মনে হলো দেবদূতের মতো উজ্জ্বল মুখ, সোনালি চুল নিয়ে ইভা এখন ফোয়ারার জলধারার ওপার থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভার কথা ভাবতে ভাবতেই একসময় তন্দ্রা নামল তার চোখের পাতায় আর স্বপ্নে সে দেখল ফুলসাজে ইভা ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুখখানা আশ্চর্য উজ্জ্বল, দুচোখে স্বর্গীয় দীপ্তি, মাথার চারপাশে ঘিরে স্বর্ণীল বর্ণচ্ছটা। টম কাছে এগিয়ে যেতেই ও অদৃশ্য হয়ে গেল। ঠিক তখনই সে অস্পষ্ট শুনতে পেল অনেকগুলো পায়ের শব্দ আর মিলিত কণ্ঠস্বর।

ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠতেই সে দেখতে পেল, কতকগুলো লোক চাদরে ঢাকা একটা দেহকে বয়ে আনছে। মুখের ওপর লণ্ঠনের আলো পড়তেই টম স্তম্ভিত বিস্ময়ে আর্তনাদ করে উঠল, তার সেই বুকফাটা হাহাকার ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল সারা বাড়ি। ওফেলিয়া যেখানে বসে বুনছিলেন, বৈঠকখানার সেই খোলা দরজার দিকে লোকগুলো দেহটাকে বয়ে নিয়ে গেল।

উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে সেন্ট ক্লেয়ার একটা ক্যাফেতে ঢুকে ছিলেন সান্ধ্যপত্রিকাটা পড়ার জন্যে। তিনি যখন পড়ছিলেন, হঠাৎ দুই ভদ্রলোকের মধ্যে মারামারি বাধে। আসলে দুজনেই তখন প্রায় সম্পূর্ণ মাতাল। সেন্ট ক্লেয়ার এবং আরো কয়েকজন ভদ্রলোক তাঁদের ছাড়িয়ে দিতে যান। একজনের হাত থেকে ধারালো ছোরাটা কেড়ে নিতে যাবার সময় লোকটা প্রতিদ্বন্দ্বীকে আঘাত করতে না পেরে সেন্ট ক্লেয়ারের পাঁজরে মারাত্মকভাবে আঘাত করে।

চিৎকার চেঁচামেচি আর করুণ বিলাপে সার বাড়ি ভরে উঠেছে। আলো হাতে দাসদাসীরা পাগলের মতো ছুটছে, কেউ মাটিতে পড়ে আছাড় খাচ্ছে, কেউবা আর্তস্বরে ককিয়ে মাথার চুল ছিঁড়ছে। খবরটা শোনা মাত্র মেরি তো মূৰ্চ্ছাই গেছে। সেই তুলনায় টম আর ওফেলিয়া অনেক বেশি শান্ত। ওফেলিয়ার নির্দেশেই বৈঠকখানায় দ্রুত শোয়ানোর ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু শয্যাটা রক্তে ভিজে যেতে খুব একটা সময় লাগল না। যন্ত্ৰণা এবং অজস্র রক্তপাতের ফলেই সেন্ট ক্লেয়ার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু ওফেলিয়া নিপুণ তৎপরতা ও শুশ্রূষায় একটু পরেই আবার তিনি ধীরে ধীরে চোখে মেললেন এবং এমন অবাক হয়ে সবার মুখের দিকে তাকালেন, যেন কী ঘটেছে কিছুই বুঝতে পারছেন না।

ডাক্তার এসে খুব ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলেন। কিন্তু ওঁর মুখের অভিব্যক্তি দেখে স্পষ্টই বোঝা গেল কোনো আশা নেই। তা সত্ত্বেও সবাইকে ঘর থেকে বার বার দিয়ে, টম আর ওফেলিয়ার সাহায্যে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে ওষুধ দিয়ে বেঁধে দিলেন।

ঘর থেকে বার করে দিলেও চাকর-বাকরেরা কেউ বারান্দা থেকে নড়ল না। প্রতিটা দরজা-জানালায় ওরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে রইল। ওফেলিয়াকে অনেক কষ্টে বোঝাতে হলো যে ওদের চুপ করে থাকার ওপরেই মনিবের মরা-বাঁচা নির্ভর করছে।

সেন্ট ক্লেয়ার অতিকষ্টে বললেন, ‘হায়রে, ওদের জন্যে আমি কিছুই করতে পারলাম না!’ তাঁর চোখে-মুখে ফুটে উঠল আত্মধিক্কারের যে তিক্ত বেদনা তা সহ্য করা সত্যিই খুব কঠিন। অসহ্য যন্ত্রণায় কিছুক্ষণের জন্যে তিনি চোখ বন্ধ করে রইলেন। তারপর শয্যার পাশে নতজানু হয়ে বসে থাকা টমের হাতে হাত রেখে কোনোরকমে উচ্চারণ করলেন, ‘টম! আহারে বেচারি!’

সাগ্রহে টম বলে উঠল, ‘কিছু বলছেন, স্যার?’

‘আমি চলে যাচ্ছি টম … প্রার্থনা করো।’ ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি কোনো পাদরির কথা বলছেন?’

সেন্ট ক্লেয়ার মাথা নেড়ে নিষেধ করলেন, তারপর টমের হাতে চাপা দিয়ে অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘তুমি প্রার্থনা কর, টম।’

হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধা, একাগ্রতা উজাড় করে দিয়ে টম প্রার্থনা করতে লাগল, আধবোজা চোখের প্রান্ত থেকে গড়িয়ে এল অশ্রুধারা।

প্রার্থনা শেষ হবার পর হাত বাড়িয়ে সেন্ট ক্লেয়ার টমের হাতটা আঁকড়ে ধরলেন, ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে রইলেন তার মুখের দিকে, কিন্তু কোনো কথা বলতে পারলেন না। একটু পরে ধীরে ধীরে বুজে এল তাঁর চোখের পাতা, তবু তিনি টমের হাতটা ঠিক তেমনিভাবেই আঁকড়ে আছেন, কেননা স্বর্গের সিংহ-তোরণে সাদা-কালোর কোথাও কোনো প্রভেদ নেই। থেকে থেকে তাঁর বিশীর্ণ ঠোঁট দুটো শুধু নড়ছে, কিন্তু কোনো শব্দই তেমন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।

ডাক্তার বললেন, ‘উনি প্রলাপ বকছেন।’

সেন্ট ক্লেয়ার মাথা নাড়লেন, ‘না, বহুকাল পরে আমি নিজের ঘরে ফিরে চলেছি!’

কথা বলার ক্লান্তিতে তাঁর মুখে ঘনিয়ে উঠল মৃত্যুর ছায়া, কিন্তু সে শুধু ক্ষণিকের জন্যে। ছায়াটা সরে যেতেই তাঁর মুখ ঘুমিয়ে থাকা কোনো শিশুর মতোই সুন্দর মনে হলো। ঠিক ওভাবেই খানিকক্ষণ থাকার পর সহসা তিনি যেন পরিপূর্ণ আলোয় চোখ মেললেন, যন্ত্রণাবিহীন অসীম তৃপ্তিতে শুধু ছোট্ট করে বললেন, ‘মা!’ তারপর সব শেষ হয়ে গেল।

২৩. জীবন্ত পণ্যগুলি

যে কথাটা প্রায়ই শোনা যায়, দয়ালু মনিবের মৃত্যুতে নিগ্রো ক্রীতদাস-দাসীরা অসম্ভব অসহায় হয়ে পড়ে কথাটা যে কী নির্মম সত্যি, সেন্ট ক্লেয়ারের মৃত্যুর পরেই তা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হলো। সেন্ট ক্লেয়ার আর মেরির মাঝখানে চাকর-বাকরদের জন্যে যে আড়ালটুকু ছিল, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হতে না হতেই তা চোখের নিমেষে উধাও হয়ে গেল।

সেদিন মিস ওফেলিয়া নিজের ঘরে কী যেন একটা কাজে ব্যস্ত ছিলেন, হঠাৎ দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দ শুনতে পেলেন। দরজা খুলে দেখলেন রোজা দাঁড়িয়ে রয়েছে। চুলগুলো আলুথালু, সুন্দর। মুখখানা শুকিয়ে গেছে, চোখ দুটো জলে ভেজা।

‘কী ব্যাপার রোজা, তুমি কাঁদছ কেন?’

‘ও, মিসিস …’ মেঝেতে আছড়ে পড়ে রোজা ওফেলিয়ার পা দুটো জড়িয়ে ধরল। ‘আপনি আমাকে বাঁচান … আপনি নিজে মিস মেরিকে একটু বলুন … উনি আমাকে চাবুক মারার জন্যে পাঠাচ্ছেন …’

‘সে কী!’

‘এটা দেখলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন।’ ভাঁজ করা এক টুকরো কাগজ রোজা ওফেলিয়ার হাতে দিল।

ইতালিয় ধাঁচে মেরির নিজের হাতে লেখা ওটা একটা নির্দেশ। চাবুক-ঘরের রক্ষকের কাছে লেখা হয়েছে, এই পত্রবাহককে যেন পনেরো ঘা চাবুক মারা হয়।

চিরকূটটা পড়ে ওফেলিয়া বিস্ময়ে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, ‘কেন, তুমি কী করেছিলে?’

‘আমার কী অপরাধ আমি নিজেই জানি না মিসিস। মিস মেরির জামাকাপড় গোচ্ছাছিলাম, হঠাৎ উনি ঠাস করে আমার গালে একটা চড় মারলেন। জানি না, হয়তো আমার গোছানোটা ওঁনার ঠিক পছন্দ হয় নি। কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকাতেই উনি রেগে উঠে বললেন, ‘আমি নিজে কিছু দেখি না বলে তোরা আজকাল বড্ড বেড়ে উঠেছিস!’ তারপরেই এটা লিখে দিয়ে বললেন, ‘নিয়ে যা। আমার হুকুমের একটুও নড়-চড় হলে একদম খুন করে ফেলব।’

কাগজটা হাতে নিয়ে ওফেলিয়া স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন, কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না।

চোখ মুছতে মুছতে রোজা বলল, ‘যদি মিস মেরি বা আপনি আমাকে চাবুক মারতেন, আমি কিছু মনে করতাম না। কিন্তু চাবুক-ঘরের ওই লোকটা যে কী ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর … আর সে যে কী লজ্জা, আপনি কল্পনাও করতে পারলেন না, মিসিস!’

চাবুক মারার ঘরে মেয়েদের, বিশেষ করে তরুণীদের পাঠানোর অর্থ যে কী কুমারী ওফেলিয়া খুব ভালো করেই জানতেন, তবু মুখে কোনোরকম উদ্বিগ্নতা প্রকাশ না করে শান্ত স্বরেই বললেন, ‘তুমি এখানে একটু বস, আমি মেরির সঙ্গে একবার দেখা করে আসি।

নিজের ঘরে মেরি আরাম-কুর্সিতে বসে রয়েছে, মামি পাশে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে দিচ্ছে আর জেন মাটিতে বসে পা টিপছে।

ওফেলিয়ার পায়ের শব্দে মেরি চোখ মেলল। ওফেলিয়া কোনোরকম ভূমিকা না করেই বললেন, ‘রোজার ব্যাপারে তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে এলাম, মেরি।’

‘বলুন!’

‘নিজের ত্রুটির জন্যে ও সত্যিই খুব অনুতপ্ত।’

‘ওর ঔদ্ধত্য আমি অনেক সহ্য করেছি, আর নয়।’

‘তুমি অন্য কোনোভাবে ওকে শাস্তি দিতে পার না, অন্তত চাবুক-মারার ঘরে পাঠানোর মতো লজ্জাকর …’

‘লজ্জাকর!’ মেরি হেসে উঠল। ‘ওর ঠিক এই শিক্ষাটা অনেকদিন আগেই পাওয়া উচিত ছিল। শুধু ও নয়, এবার থেকে আমি ঠিক করেছি, কোথাও এতটুকু বেহায়াপনা দেখলেই কালো পেত্নীগুলোকে সোজা চাবুক-মারার ঘরে পাঠিয়ে দেব … দেখি ওরা ঠিক হয় কিনা।’

‘এ এক ধরনের নিষ্ঠুরতা, মেরি!’

‘আপনার কাছে মনে হলেও, এ ধরনের শাস্তি ওদের কাছে আদৌ নিষ্ঠুরতা নয় এবং এসব না করলে ওরা একেবারে মাথায় চড়ে বসবে।’

এর পরেও তর্ক করা অর্থহীন ভেবে ওফেলিয়া চলে এলেন, কিন্তু ফিরে গিয়ে রোজাকে কী বলবেন কিছুই বুঝতে পারলেন না।

এই ঘটনার কয়েকদিন পর টম আনমনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, অ্যাডলফ তার পাশে এসে দাঁড়াল। সেন্ট ক্লেয়ারের মৃত্যুর পর ও-ই মুষড়ে পড়েছে সবচাইতে বেশি। কেননা অ্যাডলফ ভালো করেই জানত মেরি তাকে আদৌ পছন্দ করে না, কিন্তু মনিব যতদিন বেঁচে ছিলেন, ব্যাপারটাকে ও তেমন গুরুত্ব দেয় নি। অথচ এবার ওর-কপালে কী ঘটবে, সেই অজানা আশঙ্কাতেই বেচারি একেবারে কাঁটা হয়ে রয়েছে। সেন্ট ক্লেয়ারের ভাই অ্যালফ্রেডের সঙ্গে যোগাযোগ করে আইনজ্ঞের পরামর্শ মতোই মেরি এখানকার যাবতীয় সম্পত্তি, তার সঙ্গে সমস্ত ক্রীতদাসদেরও বিক্রি করে দিয়ে বাবার কাছে ফিরে যাবে বলে স্থির করেছে।

‘আমাদের সবাইকে যে বিক্রি করে দেওয়া হবে, তুমি কি জানো, টম?’

‘জানি।‘

‘তুমি কেমন করে জানলে?’

‘মিসিস যখন উকিলের সঙ্গে কথা বলছিলেন, আমি তখন পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে সব শুনেছি। দু-একদিনের মধ্যেই আমাদের সবাইকে নিলামে পাঠানো হবে।’

গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টম বলল, ‘ঈশ্বরের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক!

‘এমন মনিব আমরা আর কোনোদিনও পাব না।’ অ্যাডলফ বলল। ‘তবে মিসিসের কাছে কাজ করার চাইতে আমি নিলামে বিক্রি হতেও রাজি আছি।’

অ্যাডলফ চলে যেতেই টমের হৃদয় বিষণ্নতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। বন্দরের প্রায় কাছে এসে ভরাডুবি হলে নাবিকের চোখের সামনে যেমন শেষবারের মতো ভেসে ওঠে গির্জার চূড়া, তার প্রিয় জন্মভূমির পরিচিত ঘর-বাড়ির দৃশ্যাবলি। ঠিক তেমনিভাবে টমেরও চোখের সামনে ভেসে উঠল অতিপরিচিত একটা স্মৃতি। স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে আর তার স্বাধীনতা। হৃদয়ের গহীন নিভৃতে এই স্বাধীনতাই ছিল তার চিরকালের স্বপ্ন, তার অতি গর্বের বস্তু। এত কাছে পেয়েও এভাবে হারাতে হবে সে স্বপ্নেও ভাবি নি। তাই কোনোরকমে চোখের জল চেপে রেখে বেদনার্ত স্বরে সে আবার বলে উঠল, ‘তোমার ইচ্ছা পূৰ্ণ হোক, ঈশ্বর!

তবু টম যেন কিছুতেই স্বস্তি পেল না। ইভার মৃত্যুর পর থেকে যিনি তাকে কিছুটা করুণার চোখে দেখতেন, টম মনে মনে ভাবল সেই মিস ওফেলিয়ার সঙ্গে একবার দেখা করবে।

‘কী ব্যাপার টম, তুমি কি আমাকে কিছু বলবে?’ দরজার সামনে তাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওফেলিয়া জিজ্ঞেস করলেন।

‘হ্যাঁ, মিস ওফেলিয়া। ভেতরে প্রবেশ করার পরেও টম চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ‘সংকোচ কী, বলো?’

‘ইভার ইচ্ছা অনুযায়ী মাস্টার সেন্ট ক্লেয়ার আমাকে মুক্তি দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী তিনি আদালতে আবেদনও করেছিলেন। আপনি যদি অনুগ্রহ করে এ ব্যাপারে মিসিসের সঙ্গে একবার কথা বলেন, উনি হয়তো মনিবের ইচ্ছা পূরণ করতে পারেন।’

কুমারী ওফেলিয়ার চোখে ফুটে উঠল দুশ্চিন্তার ছায়া, তবু মুখে বললেন, ‘আমি নিশ্চয়ই কথা বলব, টম। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে মিসেস সেন্ট ক্লেয়ারের ওপর। উনি তোমার জন্যে তেমন একটা কিছু করবেন বলে আমার মনে হয় না। তবু আমি নিশ্চয়ই চেষ্টা করব টম।’

রোজার সম্পর্কে সেই তিক্ত ঘটনার পর থেকে মিস ওফেলিয়া নিজেকে একরকম গুটিয়েই নিয়েছিলেন এবং নিজের বাড়িতে ফিরে যাবার জন্যে প্রস্তুতও হচ্ছিলেন। কিন্তু টমের ব্যাপারে কিছু না বলাটা অন্যায় হবে ভেবেই উনি মেরির সঙ্গে দেখা করলেন।

মেরি তখন কী রকম কাপড়ে পোশাক তৈরি করলে ঠিকমতো শোক প্রকাশ করা হবে, তাই নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ওফেলিয়াকে দেখে বলল, ‘এই কাপড়টাতে আমাকে কেমন মানাবে বলে আপনার মনে হয়?’

‘আমার চাইতে সেটা তুমি নিজেই ভালো যাচাই করতে পারবে বলে আমার মনে হয়, মেরি।

‘আসলে কী জানেন, বিদেশে পরে যাবার মতো আমার আদৌ ভালো কোনো পোশাক নেই।

ওফেলিয়া অবাক হলেন। ‘কেন, তুমি বিদেশে যাচ্ছ নাকি?’

‘হ্যাঁ, সপ্তাখানেকের মধ্যেই বাবার কাছে চলে যাব ঠিক করেছি।

‘এত তাড়াতাড়ি কি তোমার পক্ষে চলে যাওয়া সম্ভব হবে?’

‘চিঠিতে অ্যালফ্রেড জানিয়েছে, উকিলের পরামর্শ মতো ও আসবাবপত্র আর ক্রীতদাসদের নিলামে বিক্রি করে দিতে পারবে। বাড়িটা আপাতত উকিলের জিম্মাতেই থাকবে।’

‘তুমি যখন চলেই যাচ্ছ, তোমাকে একটা কথা বলি। আগাস্টিন টমকে মুক্তি দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং সেই মতো আদালতে আবেদনও করেছিল। আশা করি তুমি বাকি কাজটুকু শেষ করে যাবে।’

‘আদৌ না।’ মেরি স্পষ্টই জানিয়ে দিল। ‘এ বাড়ির যত দাসদাসী, তার মধ্যে টমের দামই সবচাইতে বেশি। সুতরাং ওকে আমি কোনোমতেই ছাড়তে পারব না। তাছাড়া ও স্বাধীনতা নিয়ে বা করবেই কী? ও তো বেশ সুখেই আছে।’

‘ও কিন্তু মনেপ্রাণেই স্বাধীনতা চায়, আর আগাস্টিনও ওকে তা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।’

‘ওরা তো স্বাধীনতা চাইবেই। আসলে ওরা কোনো কিছুতেই সন্তুষ্ট নয় এবং যা নেই তা পাবার জন্যে একেবারে উদ্গ্রীব। আমি কিন্তু ওদের স্বাধীনতা দেওয়ার বিরুদ্ধে। একটা নিগ্রোকে কোনো মনিবের অধীনে রেখে দিলে সে ভদ্রভাবে জীবনযাপন করবে, কিন্তু স্বাধীনতা দিলেই সে হয়ে উঠবে উচ্ছৃঙ্খল, মাতাল আর কুড়ের বেহদ্দ। স্বাধীনতা দেওয়াটা ওদের কোনোমতেই উচিত নয়।’

কিন্তু টম অধ্যবসায়ী আর ধার্মিক। বিক্রি করলে ওর ভাগ্যে হয়তো কোনো খারাপ মনিব জুটতে পারে।’

‘ওটা বাজে কথা। প্রায় সব মনিবই ভালো হয় এবং তারা চাকর-বাকরদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে।’

ওফেলিয়া দেখলেন এরপর তর্ক করা বৃথা, তবু টমের মুখ চেয়েই উনি শেষ চেষ্টা করলেন। ‘তবু তোমাকে না বলে পারছি না, মেরি, তোমার স্বামী ওকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল এবং আকস্মিক মৃত্যু না ঘটলে সে নিশ্চয়ই তা করত, কেননা ইভার মৃত্যুশয়্যার পাশেই সে এই প্রতিজ্ঞা করেছিল। আমি আশা করেছিলাম তুমি তার সে ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখাবে।’

সহসা রুমালে মুখ ঢেকে মেরি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘বুঝতে পেরেছি, আপনারা সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন। কেউ আমার দুঃখের দিকে একবার ফিরেও তাকাচ্ছেন না।’

এরপরেও দাঁড়িয়ে থাকা অর্থহীন ভেবে ওফেলিয়া চলে এলেন এবং নিজের পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব ছিল, ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে মিসেস শেলবিকে চিঠিতে জানালেন যদি উনি টমের মুক্তির কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন খুব ভালো হয়।

পরের দিনই টম, অ্যাডলফ এবং আরো পাঁচ-ছয় জন ক্রীতদাসদাসীকে সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে নিলামের জন্যে ক্রীতদাস রাখবার গুদামঘরে নিয়ে যাওয়া হলো এবং নিলাম শুরু না হওয়া পর্যন্ত এখানেই এদেরকে অপেক্ষা করতে হবে।

২৪. ক্রীতদাস গুদামঘর

ক্রীতদাস-দাসী জমা রাখার গুদামঘরের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে পাঠকের মনকে আর ভারাক্রান্ত করে তুলতে চাই না। তবে গুদামঘরের তুলনায় নিলামের জায়গাটা অনেক বেশি সুন্দর। চমৎকার একটা গম্বুজের নিচে, মর্মর পাথর-বাঁধানো প্রকাণ্ড চত্বরে নানা দেশ থেকে আসা বহু লোকের সমাগম হয়েছে। পর পর দুটো সারিতে বিপরীতমুখী বসে থাকা ক্রীতদাস-দাসীদের ঘিরে ক্রেতারা ঘুরছে, পণ্যগুলিকে যাচাই করে দেখছে, মনে মনে হিসেব করছে কিংবা চুরুট ফুঁকতে ফুঁকতে ইংরেজি আর ফরাসিতে পরিচিত সহব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করছে। এ ছাড়া আরো এক ধরনের লোক রয়েছে, যারা কিনুক না কিনুক, সময় কাটানো আর মজা লোটার জন্যেই ভিড় জমিয়েছে, যারা ক্রীতদাসের চাইতে ঘোড়ার গুণাগুণ সম্পর্কে আলোচনা করতেই বেশি ভালোবাসে।

টম, অ্যাডলফ আর সেন্ট ক্লেয়ারের অন্যান্য চাকর-বাকররা যেখানে রয়েছে, সেখানেই ভিড় জমেছে সবচাইতে বেশি। ওই দলটার সঙ্গে সুসান আর এমিলিন নামে অন্য একটি পরিবার থেকে আসা মা-মেয়েও রয়েছে। দুজনকেই বেশ ভদ্র, সুন্দর দেখতে, বয়সেও অল্প।

চশমার ফাঁক দিয়ে অ্যাডলফকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাকপরা একজন তরুণের কাঁধ চাপড়ে বয়স্ক এক ভদ্রলোক হঠাৎ উল্লাসে বলে উঠলেন, ‘আরে, অ্যাডলফ যে, কী ব্যাপার, এখানে আবার কী মনে করে?’

তরুণ সপ্রতিভ ভঙ্গিতে জবাব দিল, ‘ঘরের কাজের জন্যে আমার একজন চাকর দরকার। মিস্টার সেন্ট ক্লেয়ারের চাকর-বাকরদের নিলাম করা হচ্ছে শুনে ভাবলাম একবার দেখে আসি ….’

তরুণের কথা শুনে ভদ্রলোক চোখ কপালে তুললেন। ‘তুমি কি পাগল হলে নাকি! সেন্ট ক্লেয়ারের লোকজনদের কিনতে যাবে কোন দুঃখে? এক-একটা কুড়ের বেহদ্দ!’

শোভন ভঙ্গিতে তরুণ ঠোঁট চেপে মুচকি মুচকি হাসল। ‘আমি জানি। কিন্তু ওরা তো আর জানে না কার পাল্লায় পড়ছে। দুদিনেই বাছাধনদের টের পাইয়ে দেব কত ধানে কত চাল।’ অ্যাডলফকে দেখিয়ে তরুণ বলল, ‘ওই লোকটার দেহের গঠন আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। ভাবছি ওটাকেই কিনব।’

অলক্ষে টম প্রতিটা ক্রেতার মুখই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করছিল যদি ওদের মধ্যে এমন কাউকে খুঁজে পায়, যাকে সে তার মনিব হিসেবে ভাবতে পারে। কিন্তু ওদের মধ্যে সে একজন সেন্ট ক্লেয়ারকেও দেখতে পেল না।

বেঁটের ওপর, প্রশস্ত বুক, অত্যন্ত বলিষ্ঠ চেহারার একজন লোক, যাকে দেখলে স্পষ্টই বোঝা যায় এই ব্যবসায় রীতিমতো পোড়খাওয়া মানুষ, কনুই দিয়ে ভিড় ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে আসছে এবং প্রতিটা ক্রীতদাসকেই অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করছে। লোকটার পরনে নোংরা পালুন আর গায়ে ডোরা-কাটা শার্ট, বুকের কাছে বোতামগুলো সব খোলা। লোকটাকে দেখামাত্র টম মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে উঠল এবং ধীরে ধীরে লোকটা যতই তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল, টমের আতঙ্কের মাত্রা ততই বৃদ্ধি পেতে লাগল। বেঁটে হলেও লোকটা নিঃসন্দেহে অমিত শক্তির অধিকারী। বুলেটের মতো নিরেট গোল মাথা, ধূসর দুটো চোখ খসখসে ঝাঁকড়া ভ্রূ, মাথার চুলগুলো এলোমেলো আর খাড়া খাড়া। বিরাট রুক্ষ মুখ, বলিষ্ঠ লোমশ হাতের নখগুলো বড় বড় আর বিশ্রী রকমের নোংরা।

টমকে দেখেই লোকটা মুহূর্তেই জন্যে থমকে দাঁড়াল। তারপর মুখ ফাঁক করে দাঁতগুলো দেখার পর হঠাৎ টমের চোয়াল চেপে ধরল। পেশিগুলো টিপে পরীক্ষা করে দেখাবার জন্যে টমকে জামার আস্তিন গোটাতে হলো। এমন কী পেছন ফিরিয়ে দাঁড় করিয়ে পদক্ষেপ পরীক্ষা করার জন্যে টমকে দিয়ে লাফও দেওয়াল। সব শেষে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় মানুষ হয়েছিস?’

‘কেন্টাকিতে।’

‘কী কাজ করতি?’

‘মনিবের খামারবাড়ি দেখাশোনা করতাম।’

‘হুঁ, দেখে আমারও তাই মনে হয়েছে।’

তামাক-পাতা চিবানো বেশ খানিকটা থুতু ফেলে লোকটা মা আর মেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মার দিকে একবার মাত্র তাকিয়ে হঠাৎ লোমশ হাত বাড়িয়ে খপ করে মেয়েটাকে ধরে টেনে টেনে নিয়ে এল নিজের কাছে। বয়সে এমিলিনিকে নিতান্ত কিশোরীই বলা চলে, তবু ওর কাঁধ, বুক, হাত ভালো করে টিপে টিপে পরীক্ষা করে দেখল, তারপর নিতান্ত হেলা ভরেই ঠেলে দিল মার দিকে।

লোকটার অমন কদাকার চেহারা দেখে এমিলিন এমনিতেই ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিল, এবার যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল। আর ঠিক তখনই শোনা গেল জোরে জোরে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ :

‘চুপ চুপ … সবাই চুপ কর!

পরক্ষণেই নিলামের হাঁক-ডাক শুরু হয়ে গেল।

অ্যাডলফ চড়া দামে বিক্রি হয়ে গেল এবং সুন্দর দেখতে সেই তরুণই তাকে কিনে নিল। সেন্ট ক্লেয়ারের অন্যান্য চাকর-বাকরদেরও বিভিন্ন ক্রেতারা কিনে নিল। বাকি ছিল কেবল টম।

নিলামদার তাকে বলল, ‘এই যে, শুনছ? এবার তুমি ওঠ।’

কাঠের পাটাতনের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে টম উদ্বিগ্ন চোখে চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। কিন্তু চিৎকার-চেঁচামেচি আর জটপাকানো একটা ভিড় ছাড়া আলাদা করে সে আর কিছুই উপলব্ধি করতে পারল না। নিলামদার ফরাসি আর ইংরেজিতে তার গুণ বর্ণনা করে নিলাম ডাকতে শুরু করল এবং শুধু শেষের ‘… ডলার’ শব্দগুলো টমের কানে এসে পৌঁছতে লাগল। ডাক শুরু হবার অল্পক্ষণের মধ্যে শেষ হাতুড়ির ঘা শোনা গেল। নিলামদার টমের সর্বোচ্চ দাম এবং মনিবের নাম ঘোষণা করে দিল।

কাঠের পাটাতন থেকে ঠেলে নামিয়ে দিতেই দেখা গেল বুলেটের মতো নিরেট মাথা, কদাকার দেখতে সেই বেঁটে লোকটাই টমের মনিব। লোমশ হাতে টমের কাঁধটা চেপে ধরে রুক্ষস্বরে সে বলল, ‘এই, এপাশে সরে দাঁড়া!’

টম স্পষ্ট করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবার হাতুড়ি পিটিয়ে নিলাম ডাকা শুরু হলো ফরাসি আর ইংরেজি ভাষায় শোনা গেল সুসানের গুণ বর্ণনা করতে। শেষ হাতুড়ির শব্দে সুসানও বিক্রি হয়ে গেল। পাটাতন থেকে নেমে দাঁড়িয়েই ও মেয়েকে খুঁজল। এমিলিন হাত বাড়িয়ে মাকে আঁকড়ে ধরল। বয়স্ক সেই ভদ্রলোক, যিনি মাকে কিনলেন, বেদনাকাতর চোখে তাকাল তাঁর মুখের দিকে।

সুসান মিনতি করল, ‘স্যার, দয়া করে আপনি আমার মেয়েকেও কিনে নিন! ও খুব ভালো আর অসম্ভব কাজের …’

‘পারলে আমি নিজেই খুশি হতাম’, ভদ্রলোক সহানুভূতির সঙ্গেই বললেন, ‘কিন্তু আমার সাধ্যে কুলোবে বলে মনে হচ্ছে না। তবু দেখি একবার চেষ্টা করে …’

তাঁর কথা শেষ হবার আগেই এমিলিনের ডাক শুরু হয়ে গেল। লজ্জায় বেদনায় ওর চিবুকের পাশ দুটো আরক্তিম হয়ে উঠেছে, চোখের পাতায় ফুটে উঠেছে ভয়-চকিত একটা আর্তি। মুহূর্তের জন্যে সুসানের মনে হলো মেয়েকে বুঝি এর চাইতে সুন্দর আর কোনোদিনও দেখায় নি।

বয়স্ক ভদ্রলোক আন্তরিকভাবেই চেষ্টা করেছিলেন এমিলিনকে কিনে নেবার, কিন্তু দেখলেন মেয়েটির দাম তাঁর সাধ্যকে অতিক্রম করে চলে গেছে। তাঁর প্রতিপক্ষ, বুলেটের মতো নিরেট মাথা সেই লোকটার জেদের কাছে তাঁর হার না মেনে কোনো উপায় ছিল না। অবশেষে কদাকার দেখতে সেই বেঁটে লোকটাই এমিলিনকে কিনে নিল।

লোকটার নাম সাইমন লেগ্রি। রেড নদীর ধারে তার তুলো চাষের আবাদ আছে। টম আর অন্য দুজন ক্রীতদাসের সঙ্গে এমিলিনকে নিয়ে লেগ্রি জাহাজঘাটের পথ ধরল।

মা আর মেয়ে। দুজনেই কাঁদছে, নিলামে এ তো হামেশাই দেখা যায়। তবু বয়স্ক ভদ্রলোক মনে মনে অনুতপ্ত না হয়ে পারলেন না। সুসানকে নিয়ে তিনি পাড়ি দিলেন অন্য পথে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *