কুড়ি
রাত্রে ঘুমের মধ্যে অস্পষ্ট কথা বলে পাশ ফিরল শাশ্বতী। মৃদু একটু হাসল স্বপ্নের ভিতরে।
হৈমন্তীর গায়ের ওপর তার পা। হৈমন্তী ঠেলা দিয়ে বলল, এই, ঠিক হয়ে শো। আমার গায়ে ঠ্যাং তুলে দিচ্ছিস।
শাশ্বতী ঘুমের মধ্যেই তাকায়, তারপর বিড়বিড় করে অস্পষ্ট কথা বলে একটু। বোধ হয় বলে, তোমরা সবাই শাশ্বতীকে ক্ষমা কোরো। আমি কি ছাই বুঝি আমার মন! তোমাদের কাউকে যদি দুঃখ দিয়ে থাকি, ক্ষমা কোরো।
শাশ্বতী ভেবে রেখেছে, খুব শিগগিরই সে একদিন ললিতের সঙ্গে দেখা করবে। জিজ্ঞেস করবে, এতে আপনার কী স্বার্থ ছিল? কেন আপনি এমন কাজ করতে গিয়েছিলেন?
ললিতের সঙ্গে ঝগড়া করার মতো অনেক কথা শাশ্বতীর মনে পড়ে। কেন আমাকে মন বোঝার সময় দিল না! কেন ধরে-বেঁধে নিয়ে গেল ম্যারেজ-রেজিস্ট্রারের কাছে! কী স্বার্থ তোমার ললিত! না, অত পুরুষমানস মিলে জোর করে কোথাও ধরে নিয়ে যেয়ো না শাশ্বতীকে। বরং তাকে আর একটু সময় দিয়ো। আর-একটু মায়া কোরো শাশ্বতীকে। শাশ্বতী কি ছাই বোঝে তার মন! আর তুমি! শুনেছি, আজ টেলিফোন ডিরেক্টরির পাতা ওলটাতে তোমার হাত কেঁপেছিল। তুমি দু’ আঙুলে সিগারেট ধরে রাখতে পারছিল না! আমার ওপর কীসের প্রতিশোধ তোমার! তুমি তো জানতেও না তুমি কী করে ফেলতে যাচ্ছ! তবু তুমি জোর করে কেন ঘটাতে চাইছিলে ওই অঘটন! তোমার মায়া দয়া নেই!
অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিল সঞ্জয়। সামনে একটা গ্রিল দেওয়া ছোট বারান্দা আছে। সেখানে ইজিচেয়ারটা টেনে নিয়ে পাশে খুদে টেবিলে হুইস্কি নিয়ে বসে ছিল। গরম লাগছিল খুব, শুতে ইচ্ছে করছিল না। তা ছাড়া তলপেটের ব্যথাটা কেমন একটা টানা দপদপানিতে দাঁড়িয়ে গেল। নড়তে-চড়তে লাগে। এ-রকম ব্যথা নিয়ে ঘুমোনো যায় না। তা ছাড়া ঘুম সামান্য একটু কমে গেছে সঞ্জয়ের। স্বাভাবিকভাবে বড় একটা ঘুম আসতে চায় না, কেবল হাই ওঠে, শরীর ম্যাজ ম্যাজ করে। চিন্তায় ভার হয়ে যায় মাথা। ঘুম এলেও অস্বাভাবিক সব স্বপ্ন দেখা দেয়। তার চেয়ে হুইস্কিই ভাল। শরীরে ব্যথা বেদনা আস্তে আস্তে মৃদু ঝিমঝিমির মধ্যে ডুবে যেতে থাকে। গাঢ় চুম্বনের মতো আঠা হয়ে লেগে আসে চোখের পাতা। আঃ, শান্তি। ঠিক বটে যে সেটা আসলে চুম নয়, অজ্ঞান হয়ে থাকা। কারণ, সকালে উঠে কখনও ঠিক ঘুমিয়ে ওঠার তৃপ্তি টের পায় না সে। মনে হয়, অজ্ঞান অবস্থা থেকে জ্ঞান ফিরল। সারা দিন আবার হুইস্কির জন্য শরীর সাপের মতো ফোঁসে, ছোবলায়।
বারান্দায় হাওয়া ছিল। স্নান এবং সামান্য একটু রুটি মাংসের পর হুইস্কির স্বাদই আলাদা। ধীরে ধীরে সময় নিয়ে খাচ্ছিল সঞ্জয়। রিনি আগে ধমকাত, কাঁদত, আজকাল গা করে না। শুধু বলে, বাথরুমে সাবধানে যেয়ো, আমার কাচের তলমারির গায়ে পাতো না। রাতে বিনি, পিকলু ঘুমোবার পর কয়েক মুহুর্তের জন্য এসে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। বলল, কী আজ কতক্ষণ চলবে?
শোওয়ার সময়েও রিনির ঠোঁটে লিপস্টিক। সঞ্জয়ের ইচ্ছে হল বলে, ঠোঁট ধোও না কেন? সবসময়ে লিপস্টিক মেখে থাকলে রঙের তলায় ঠোঁটের চামড়া সাদা হয়ে যাবে! কুষ্ট-ফুষ্ট কত কী হতে পারে, আজকালকার কেমিকালে বিশ্বাস কী
কিন্তু সঞ্জয় কিছু বলল না। উত্তরে রিনি তা হলে অনেক কথা বলবে, মদটদ খাওয়া নিয়ে, তার অতীত জীবন নিয়ে— ঝগড়াই লেগে যাবে হয়তো। দরকার কী? ও ওর মনে থাক। একটু লিপস্টিক বই তো নয়। মা সারা দিন পান খায়, তাই সকালে মুখটুখ ধোয়ার পর ঠোঁটের দু’পাশের কষে সাদা দাগ দেখা দেয়। ঘেন্না করে সঞ্জয়ের। রিনির লিপস্টিক থেকেও ও-রকম কিছু দাগ-ফাগ হওয়া বিচিত্র নয়।
ছিপছিপে শরীর, আঁট করে খুন-খারাপি রঙের শাড়ি পরেছিল রিনি, শরীরটা ওর এত সতেজ যে যেন চারপাশটাকে আক্রমণ করছে। চলায়-ফেরায় একটা ধনুকের মতো ছিটকে ওঠার ভাব আছে। আট-ন’মাস আগে ও যখন পোয়াতি ছিল তখনও ওর সতেজ ভাবখানা ছিল লক্ষ করার মতো। এখনও বোঝা যায় না যে বাচ্চা হয়েছে। কপালে লিপস্টিকেরই একটা গোল ফোঁটা দেয় রিনি, চুলের মধ্যে কোন অতল অরণ্যে ক্ষুদ্র একটু সিঁদুরের বিন্দু ছোঁয়ায়, বাইরে থেকে বোঝা যায় না। মাঝে মাঝে কত কসমেটিক আনতে বলে সঞ্জয়কে, কখনও বলে না, সিঁদুর এলো। একদিন সঞ্জয় ঠাট্টা করে বলেছিল, আমার একটা খরচ বেঁচে গেছে, বাবা৷ সিঁদুরের। শুনে রিনি ম্লান মুখে বলেছিল, তুমি মেয়েদের ব্যাপারে কেন মাথা গলাও? স্বামীকে সিঁদুরের কথা বলতে নেই জানো? বিয়ের পর বছরে বোধ হয় সেরখানেক সিঁদুর লাগত রিনির। মাথা এ-ফোঁড়, ও-ফোঁড় করে কুড়ুলের কোপের মতো জমে থাকত সিঁদুর, সুন্দর টিকলো নাকের ওপর গুঁড়ো ঝরে পড়ত। আমি আর কুমারী নই, তোমরা কেউ আর আমাকে যাচ্ঞা কোরো না—এই কথা ঘোষণা করত সগর্বে। এখন আবার অনেকটা কুমারী হয়ে গেছে রিনি, সিঁদুর লুকোয়।
জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, কারও প্রেমে পড়োনি তো? তোমাকে গিটার শেখাতে এক মাস্টার আসে না ছোকরা মতো? তাকে আমি দেখিইনি। রেডিয়োতে হিন্দি কিংবা রবীন্দ্রসংগীত বাজায় বলে শুনেছি। দেখতে কেমন? উম্যান-ইটার! দুপুরবেলায় আসে তো, না?
টিজ করতে ইচ্ছে করে। টিজ তবু কিছুই করেনি সঞ্জয়। তলপেটে আদিত্যর লাথিটা তখনও জমে আছে। কেন যে শালা বেড়েছিল লাথিটা কে বলবে! রোগা আধমরা ললিতটাকে চড়টা কষিয়েছিল জুতমতোই। কেন যে তা কে জানে? কী যেন নাম সেই কালো কালো মেয়েটার? শাশ্বতী না কী যেন, এমন কিছু সুন্দর নয় সে, বিয়ের বাজারে চালাতে গেলে নগদ দু’-তিন হাজারের ধাক্কা, তবু তার জন্যই খেপে গেল পাগল আদিটা। দুর শালা। রিনিকে বরং দেখে যা। দেখে যা উঁচু-নিচু কাকে বলে! কী রকম মোলায়েম ফরসা চামড়ায় বাঁধানো আমার বউ, দেখে যা। ওই কালো মেয়েটার জন্য কি খুব বেশি হুজ্জুত করা যায়! তবু মাইরি তুই কতকালের সব পুরনো দোস্তদের না-হক মাস্তানি দেখিয়ে গেলি! কোনও মানে হয়? ললিত বাগড়া দিচ্ছে? তো দিয়ে দে না ওই আধমরা ছেলেটাকে ওই কালো মেয়েটা! দু’-চারদিন ভোগ করে নিক। তারপর তো মরেই যাচ্ছে ও। ও মরে গেলে, মানুষের তো তখন আর কোনও স্বত্ব থাকে না, তখন ওর স্থাবর অস্থাবর আমরাই তো পাব রে! একটু উদার হলে দ্যাখ, কত ঝগড়া কাজিয়া এড়ানো যায়। তোরা কী রে!
রিনি এগিয়ে গিয়ে গ্রিল ধরে কিছুক্ষণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। ফাঁকা রাস্তা। হিন্দুস্থান পার্কে এ সময়টায় ভূত নামে। কেবল ও-ধারে একটা গ্যারাজের সামনে খাটিয়া পেতেছে এক বুড়ো দারোয়ান, নিশুত রাত চিরে পাতকুড়ুনিদের অপার্থিব চিৎকার ভেসে আসে, মা গো—।
রিনি মুখ ফিরিয়ে বলে, শুনছ?
কী?
ওই যে চিৎকার! বড্ড ভয় করে।
রিনি অপ্রস্তুত হাসি হাসে। তারপর বোধ হয় একটু চালাক হওয়ার চেষ্টা করে বলে, কী রকম যেন শাপ-শাপান্তের মতো শুনতে লাগে। এমন বিচ্ছিরি গলা করে ডাকে যেন সর্বস্ব চলে গেছে—
খামোখাই দামি লিপস্টিক মাখে রিনি। বাজে খরচ! সঞ্জয় জানে গিটার শেখানোর মাস্টারের সঙ্গে রিনি প্রেম করে না। আঙুলে আঙুলে ছুঁয়ে গেলে সতীত্বের ভয়ে কুঁকড়ে যায়। ধুস।
সঞ্জয় সামান্য হেসে বলল, আমি এক সময়ে ওদের কাছাকাছি থাকতাম। কত রাত চিৎপুরের ফুটপাথে শুয়ে কেটেছে বইয়ের দোকানের তক্তার তলায়। দুই-এক বার অনেকটা ভিক্ষের মতো করে লোকের কাছে হাত পেতেছি। ওর একটা মজা আছে।
কী মজা?
আছে। এখন আর সেটা বোঝাতে পারি না। তবে সর্বস্ব চলে যাওয়া একটা আনন্দ আছে।
রিনি চুড়ির ঝনন শব্দ করে রাস্তায় মুখ ফেরাল। তারপর হঠাৎ বলল, আবার ও-রকম হতে পারো?
সঞ্জয় মাথা নাড়ল, না।
রিনি মৃদু হাসি-মুখ ফিরিয়ে বলে, পারো না? তবে যে বলো মজা আছে! আমাকে খ্যাপানো অত সোজা, না?
সঞ্জয় বলল, এখন পারি না তার কারণ অন্য। এখন যদি লুঙ্গি পরে খালি গায়ে গিয়ে ফুটপাথে মাদুর পেতে শুয়ে থাকি, তবু মনে হবে, রাতে চোর এসে আমার কী একটা চুরি করে নেবে। কী একটা যেন খোয়া যাবে আমার। কিছু খোয়া না গেলেও ওই রকম মনে হবে। স্বস্তি পাব না। কিন্তু যদি কোনও দিন সত্যিই সর্বস্ব চলে যায়, তা হলে—
রিনি হাই তুলল। তারপর পরিপূর্ণ শরীরখানা একটু আলসেমি জড়ানো ভঙ্গিতে মুচড়ে সঞ্জয়ের সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরে একখানা ড্রিম-ল্যাম্প জ্বলছে। তার আলো পড়ল ওর গায়ে। সাধু সন্ন্যাসীর মতো পবিত্র মুখ করল সঞ্জয়। বলল, তোমার গিটারটা একটু বাজাও না, শুনি! নতুন কী শিখেছ?
ঘুম পাচ্ছে।
ওঃ! তা হলে বরং গিয়ে ঘুমোও।
সঙ্গে সঙ্গে বেঁঝে ওঠে রিনি, আহা, আমি ঘুমোতে চাইলাম, আর উনি ঘুমোতে দিলেন। কেন, হুকুম করতে পারো না—না, আমি এক্ষুনি গিটার শুনতে চাই, নিয়ে এসো গিটার, আমার পায়ের কাছে বসে বাজাও—
সঞ্জয় হাত তুলে বলল, আস্তে। এ সময়ে জোরালো শব্দ শুনলে নেশা কেটে যায়।
অভিমানী মুখ করে রিনি বলে, যাও, বাজাব না।
শান্ত গলায় সঞ্জয় বলল, গিটারটা আনো।
সামান্য একটু আদর-কাড়া ঝগড়া করল রিনি। কিন্তু এতকাল পরে এই প্রথম তার বাজনা শুনতে চেয়েছে বলে সে চাপা আনন্দে একটু ঝলমলে মুখে সত্যিই গিটার নিয়ে সঞ্জয়ের পায়ের কাছে বসল। পিকলুকে যেমন কোলে নেয় রিনি তেমনই কোল দিল যন্ত্রখানাকে।
কী বাজাব?
দেহাতি গান জানো?
রিনি হাসে, গাঁইয়া কোথাকার।
তা হলে যা খুশি বাজাও।
একটু টুংটাং করে রিনি সত্যিই বাজাতে লাগল। বিভোর হয়ে।
একটু আশ্চর্য হয়ে সঞ্জয় শুনছিল। সেই ওঠা-পড়াহীন বিষণ্ণ মেয়ে-কান্নার সুরে গান, ঠিক যেমন দেহাতি গান হয়। রিনি তাই বাজাচ্ছে। সঞ্জয় গানটা একটুও ধরতে পারল না। কিন্তু পড়ন্ত বেলায় এক পাহাড়ি নদী পার হয়ে রংচঙে কাপড় পরে মানুষ মেলায় যাচ্ছে। সাজপরা গোরু টেনে নিয়ে যাচ্ছে রঙিন গাড়ি। এ-রকম দৃশ্য তার চোখে ভেসে উঠছিল।
রিনি থামলে জিজ্ঞেস করল, এটা কি হিন্দি ছবির গান?
দূর!
তবে?
ছেলেবেলায় গানটা শুনেছিলাম। সেবার দেওঘরে বেড়াতে গিয়ে। সুরটা মনে ছিল, সেই থেকে বাজালাম।
কথাগুলো কী বলো তো।
রিনি হাসল।
গার্ডবাবু, গার্ডবাবু, সিটি না বাজা না, ঝান্ডি না দিখানা, পিলাটফারম ম রহ গৈল গাঁটারিয়া… গুনগুন করে গাইল রিনি।
হাসতে হাসতে সঞ্জয় টের পাচ্ছিল পেটের নীচে একটা ভারী বস্তু ঝুলছে। তলপেটটা। প্ল্যাটফর্মে গাঁটরি পড়ে রইল—হায় ঈশ্বর, গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে! হে গার্ডবাবু, তোমার পায়ে পড়ি, সর্বস্ব পড়ে আছে আমার প্ল্যাটফর্মে—
রিনি!
উঁ।
আজা, আর কিছু বাজিয়ো না। শুনতে ভাল লাগবে না। তুমি খুব সুন্দর শিখেছ, খুব সুন্দর—
রিনি হঠাৎ গলা বাড়িয়ে বলল, তবে প্রাইজ দাও।
প্রাইজ দিতেই যাচ্ছিল সঞ্জয়, হঠাৎ রিনি মুখ আচমকা সরিয়ে নিয়ে বলল, ইস ছাইপাঁশের গন্ধ! কী স্বাদে যে খাও—
রিনি উঠে চলে গেলে একা একা একটা ডিঙি নৌকোর মতো চেতনা ছেড়ে অচেতনতার দিকে ভেসে গিয়েছিল সঞ্জয়। কাল রাতে।
রাত প্রায় একটা পর্যন্ত বিমান গীতা পড়েছে। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা তার কাছে। পড়তে পড়তে হুঁশ হল যখন মাথার পিছন দিকে একটা তীব্র যন্ত্রণা দেখা দিল হঠাৎ। চোখের ডিম দুটো টনটন করে উঠল। তখন বই রেখে বাতি নিবিয়ে দিল বিমান। কিন্তু শুতে গিয়ে বুঝল ঘুম আসবে না। ঘুম সম্পূর্ণ অসম্ভব একটা ব্যাপার এখন। মাথার ব্যান্ডেজটার ওপর দিয়ে সে একটা রুমাল শক্ত কটকটে করে বেঁধে গিঁট দিল। তারপর খোলা হাওয়ায় ঘুরবে বলে দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
বট গাছের তলায় কতগুলো ছেলেছোকরা বসে আছে। তাদের পরনে সরু প্যান্ট, গায়ে রংচঙে শার্ট, মুখে সিগারেট আর হাতে মাটির ভাঁড়। রাস্তার আবছা আলোয় তাদের দেখা যায়। চা খাওয়ার মতো করে চুমুক দিচ্ছে ভাঁড়ে। একটু চা খেতে বিমানেরও ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সে কাছাকাছি কোনও চায়ের দোকান দেখতে পেল না। অল্প দূরে একটা পানের দোকান খোলা আছে কেবল। সে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করছিল অমনি একটা ছেলে উঠে এসে কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল, কী চাই!
বিমান একটু ইতস্তত করে বলল, একটু চা কোথায় পাওয়া যায়!
ছেলেটা খুব অবাক হয়ে বলল, চা!
পিছন থেকে কে একজন জিজ্ঞেস করল, কে রে?
ছেলেটা মুখ ফিরিয়ে বলল, চা চাইছে।
খ্যা-অ্যা-অ্যা করে একটা হাসির শব্দ হল। আর একজন বলল, নিয়ে আয়, চা খাইয়ে দিচ্ছি।
আর একজন বলল, হ্যাঁ, খাওয়াও আর কী! এমন পয়সার মাল কোথাকার কোন মড়াকে—
যাঃ, মদ কাউকে রিফিউজ করতে নেই, পাপ হয়। শচে, নিয়ে আয় ভদ্রলোককে—
মাথার মধ্যে তখন এমন একটা দপদপ রক্ত বওয়ার শব্দ হচ্ছে, আর এমন টনটন করছে দুটো চোখ যে বিমান ব্যাপারটা খুব ভাল বুঝতে পারল না। এরা তাকে মদ খাওয়াতে চাইছে। সে কখনও খায়নি। কিন্তু মাথা আর চোখের এই অসহ্য যন্ত্রণায় কিছু একটা করা দরকার। যদি খুব নেশা হয় তা হলে সে হয়তো ঘুমিয়ে পড়বে।
ছেলেগুলো খুব খারাপ নয়, সে এগোতেই বাঁধানো বেদির ওপর একটু সরে বসে তার জন্য জায়গা করে দিল। বসার পর বিমান দেখলে এদের দলে, কী আশ্চর্য, একটা মেয়েও রয়েছে। মেয়েটার মুখ অন্য দিকে ফেরানো, তবু এক পলক দেখলেই বোঝা যায় মেয়েটা একেবারে রদ্দি। মুখে অতিরিক্ত পাউডার, খুব সস্তা ঝলমলে একটা শাড়ি। ছেলেগুলো ওর দিকে তাকাচ্ছেও না, খুব সম্ভবত আসর গরম করার জন্য ওকে নিয়ে এসেছে ভাড়া করে, তারপর সবাই ঠান্ডা মেরে গেছে। বিমান চোখ ফিরিয়ে নিল।
ভাঁড়ে প্রথম চুমুকটা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার সমস্ত শরীর পেট থেকে জিব পর্যন্ত যেন নিঃশব্দে চেঁচিয়ে উঠল, না না, এ-জিনিস আমরা নেব না, এ-জিনিস আমাদের সঙ্গে খাপ খায় না। বিমান মুখের মধ্যে ঢোঁকটাকে রেখে বসে রইল, গিলতে পারল না। ফেলতেও না।
তার পাশ ঘেঁষে বসে আছে সেই সমবেদনাশীল ছেলেটা, যে তাকে ডেকে বসিয়েছে এইখানে। সে ছেলেটা তেমনই আদর করার মতো গলায় জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে?
বিমান ঢোঁকটা গিলে ফেলল। কাশির দমকে চোখে জল এসে গেল তার। অস্ফুটভাবে বলল, ভীষণ ঝাঁঝ আর তেতো-তেতো। এতে কী আছে?
কী জানি! শালারা কত কিছু মেশায়। কারবাইড থাকতে পারে কিংবা যে-কোনও পয়জন। কিন্তু ও-সব সয়ে যায়, ইম্যুনিটি ফর্ম করে গেলে কিছুই আর হয় না। আমি তো বিলিতি জিনিস কত খেয়েছি কিন্তু বাংলা মালের তুলনা হয় না। আহা, বাংলার মাটির জিনিস, বাঙালির হাতে তৈরি—
বলতে বলতে ছেলেটা কথা থামিয়ে গুনগুন করে গাইতে লাগল, বঙ্গ আমার জননী আমার ধাত্রী আমার, আমার—
ও আমার সোনার বাংলা, আর-একজন আধ-চেতন সুরে গায়, তারপর হেসে ওঠে।
সেই সমবেদনাশীল ছেলেটা নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে, কোথায় বেরিয়েছিলেন?
আমার বড্ড মাথা ধরেছিল।
খেয়ে নিন। মাথা যে আছে টেরই পাবে না।…কোথায় থাকেন?
কাছেই।
একা?
হুঁ।
ছেলেটা হাসল। তারপর কানের কাছে মুখ এনে বলল, তা হলে আপনার জন্য আরও ফাস্ট ক্লাস বন্দোবস্ত করতে পারি। ওই যে মেয়েটা, ওকে ঘরে নিয়ে যান। ও আপনার মাথা টিপে দেবে, পদসেবা করবে, ঘুম পাড়াবে। দারুণ এক্সপার্ট মেয়ে, নেবেন সঙ্গে? ভয় নেই, ওকে কিছু দিতে হবে না। টাকা-পয়সা যা দেওয়ার আমরা দিয়ে রেখেছি।
মেয়ে! মেয়ে দিয়ে বিমান কী করবে! শুনে সে ভীষণ চমকে ওঠে, ভয় পেয়ে বলে, না, না, তার দরকার নেই।
শুনে ছেলেটা ভীষণ হতাশ হয়। বলে, নিল না। মেয়েদের যা যা থাকে ওর সব আছে, বয়সও এমন কিছু বেশি হয়নি। কেবল আমাদের কাছে একটু পুরনো হয়ে গেছে। রোজ আসে তো, তাই। কিন্তু আপনার কাছে বেশ নতুন লাগবে। নিয়ে যান। বলে ছেলেটা মুখ ফিরিয়ে মেয়েটাকে ডেকে বলে, পারুল, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে যাবে? যাও না, খুব ভাল লোক।
মেয়েটা ফিরেও দেখে না। আর বিমানের ভীষণ ভয় করে। সেই ছেলেটা বলে, নিন না। আপনার ভালর জন্যই বলছি।
বেদিটাকে ঘিরে আরও সাত-আটজন বসে দাঁড়িয়ে ছিল। অন্ধকারে তাদের কারও মুখই ভাল দেখা যায় না। তাদের মধ্যে কেউ একজন চেঁচিয়ে বলল, কে নেবে পারুলকে? কোন শালা? আজ পাল আমার।
এই কথা বলে ছেলেটা ও-পাশ থেকে উঠে পারুলের সামনে দাঁড়ায়। খস করে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে এক হাতে ধরে অন্য হাতে মেয়েটার থুতনি তুলে ধরে মুখ দেখার চেষ্টা করে। বলে, তুমি আমার নও?
মেয়েটা ঝটকা মেরে ছেলেটার হাত সরিয়ে দেয়। ছেলেটা তখন দেশলাইয়ের কাঠি ফেলে দু’ হাত বাড়িয়ে খিমচে ধরে মেয়েটাকে। রে-রে করে হাসে মেয়েটা ডানা ঝাপটানোর মতো শব্দ করে।
প্রকাশ্যে, একটু আধো-অন্ধকারে ব্যাপারটা চলতে থাকে। এ-পাড়াটায় ভদ্রলোক কেউ থাকে না, বটগাছের উলটো দিকে একটা পোড়ো মাঠ, তার ও-পাশে বস্তি। আশেপাশে দু’-একটা গরিব-গুরবোর দীন-দরিদ্র বাসা রয়েছে। কিন্তু কোনওখান থেকেই কোনও প্রতিবাদ আসে না, দূর থেকে ছুটে আসে না লোক। হয়তো ওই সব বাসায় যারা থাকে তারা অন্ধকারে জানালায় খড়খড়ি খুলে দৃশ্যটা দেখার চেষ্টা করছে নিঃশব্দে, হয়তো বউকে ফিসফিস করে বলছে, কী কাণ্ড হচ্ছে দেখেছ, সেই বদ ছেলেগুলো গো—একটা মেয়েকে। বউ হয়তো চাপা রাগের স্বরে বলছে, তা তোমার ওখানে দরকার কী? দিনকাল ভাল না, জানালা বন্ধ করে চলে এসো…
এবার ভাঁড়ের তরল পদার্থটার কোনও তেতো-কটু স্বাদ পেল না বিমান। ঢকঢক করে জলের মতো খেয়ে নিল। কিন্তু সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ চমকে মেঘ ডেকে উঠল যেন। কান মুখ চোখে ঝমঝম বাজনা বেজে উঠল। মনে পড়ে গেল বিকেলে সে একটা মেয়েকে বাঁচিয়েছে। সরল শিশুর মতো একটি মেয়েকে। মেয়েটা কাঁদছিল। সব মেয়েই কাঁদে। কেননা, মানুষের জন্মের রহস্য বাঁধা থাকে তারই আঁচলে। সে জানে, তাকেই সন্তানের ভার বহন করতে হবে, বহু কষ্টে জন্ম দিতে হবে। তবে সে কেন বহন করবে যেমন তেমন সন্তান? সে কেন চাইবে যে খুশি সন্তান দিয়ে যাক তার গর্ভে? বরং সে মনে মনে অপেক্ষা করে শ্রেষ্ঠ একজন পুরুষের, যাকে সে হয়তো কখনও পায়, কখনও পায় না, কিন্তু অপেক্ষা করে থাকে। যদি শত পুরুষেও তার দেহ ছিঁড়ে খায় তবু সে স্বভাবে থাকে একগামী, যাকে সে হয়তো কখনওই দেখেনি সেই শ্রেষ্ঠ একজন পুরুষ তার অন্তরে স্বামী হয়ে থাকে। তাই মেয়েমানুষকে না চিনলে তাকে কখনও ছুঁতে নেই। কিন্তু মূর্খ চাষার মতো বহুগামী পুরুষ মাটি না-চিনে বীজ ছড়িয়ে যায়। পৃথিবীতে কত মানুষ তাদের বিবাহিতা স্ত্রীদের বলাৎকার করে যায় নিজের অজান্তে। কখনও বোঝে না একটি প্রতিক্রিয়া কত দূর সর্বনাশ নিয়ে আসে।
বট গাছ ছাড়িয়ে একটু দুরেই অন্ধকারে বাতি নেবানো একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। ট্যাক্সিটা বোধ হয় এদেরই। ছেলেটা পারুলকে সেই দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। অনিচ্ছায় যাচ্ছে পারুল, তাকে যেতে হবে বলে। সে টাকা নিয়েছে। অন্য ছেলেগুলো চুপচাপ বসে থাকে।
মাথার মধ্যে তীব্র যন্ত্রণায় হঠাৎ কেমন ভোঁতা হয়ে আসে। এক ডেলা মাটির মতো অর্থহীন লাগে মাথাটাকে। বিমানের হাত-পা অবশ হয়ে আসে। মাথা ঝিমঝিম করে। সে হঠাৎ পাশের ছেলেটাকে ফিসফিস করে বলে, আমি ওকে, ওই পারুলকে নিয়ে যাব।
ছেলেটা হেসে ওঠে। চেঁচিয়ে বলে, গদা, পারুলকে ছেড়ে দে, এই ভদ্রলোক রাজি আছেন।
ছেলেটা বলে, ফোট, শালা। আজ পারুল আমার। আমার হাত কামড়ে দিয়েছে পারুল, খিমচে দিয়েছে গালে, তবু আমি ভালবাসায় জ্বলে যাচ্ছি।
শুনলেন তো, ও ছাড়বে না। আপনি যান, না, ওর সঙ্গে লড়ে কেড়ে নিন পারুলকে। যদি পারেন তবে আমরা সবাই ক্ল্যাপ দেব। যান না!
ছেলেটা তাকে ঠেলে তুলে দেয়।
বিমান উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু ঠিকমতো দাঁড়াতে পারে না। পা অবশ হয়ে আসে। সে আবার পড়তে পড়তে সামলে নেয়। এমন অশালীন, কুৎসিত একটা দৃশ্য সে আর কখনও দেখেনি। বহু পুরুষের মধ্যে একটি মেয়েকে নিয়ে টানাটানি। আজ বিকেলে সে একটি মেয়েকে বাঁচিয়েছে। যে-মেয়েটা বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু হায় ঈশ্বর, এই নষ্ট মেয়েটা যে জানেও না সময়মতো কেঁদে উঠতে। একটু পরেই ওর জোর নষ্ট হয়ে যাবে, আর তারপর—
হঠাৎ দু’হাত ওপরে তুলে বিমান চেঁচিয়ে উঠল, বাঁচাও—বাঁচাও—
কিন্তু কিছু হল না। গলার স্বর ফুটল না তেমন। হতাশভাবে ভীত চোখে বিমান দেখল অন্ধকারে ছেলেগুলো সবাই তার দিকে মুখ ফিরিয়েছে। তাদের সিগারেট জ্বলছে।
কিন্তু কেউ কিছু করার আগেই বিমান খুব ক্লান্তভাবে মাটিতে পড়ে গেল। চোখ বোজার আগের মুহূর্তে তার মনে হল, সে একা বড় অসহায়। বিপক্ষের শত্রুদল বড় প্রবল। এখন খুব শক্তিমান, খুব প্রকাণ্ড কেউ যদি তার পাশে থাকত!
তারপর আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল বিমান।
খুব ভোরে তার ঘুম ভাঙল, সূর্যের প্রথম আলোটি চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে। দ্বিগুণ বেগে দপদপ করছে মাথার শিরা। ভাল করে চোখ খুলতে সময় লাগল অনেক। চেয়ে দেখল সে গাছতলায় পড়ে আছে। তার চারদিকে ভাঙা মাটির ভাঁড়, শালপাতা, কয়েকটা দেশি মদের বোতল, ধুলোয় জুতোর ছাপ। দু’-একজন কৌতূহলী লোক পথ চলতি না-থেমে তাকে দেখতে দেখতে চলে যাছে।
ঘরে ফিরে তালা খুলে ভিতরে ঢুকতেই সে একটা জিনিস টের পেল। বহুকাল বাদে তার মাথার ভিতরটা আবার ফাঁকা লাগছে। সে মাথা ঝাঁকাল, কিন্তু স্পষ্ট টের পেল মাথার ভিতরে আকাশের একটা অংশ ঢুকে আছে। বেরোচ্ছে না। আস্তে আস্তে বেলা বাড়তে লাগল, আর সে টের পেতে লাগল কোন সুদূর থেকে আকাশের শূন্যতা তুষারপাতের মতো নিঃশব্দে তার মাথার ভিতরে খসে পড়ছে।
খুব বিষন্ন গেল বিমান। আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরেই সে আবার কিছু দিনের জন্য পাগল হয়ে যাবে। পাগল হয়ে যাওয়ার আগে এই লক্ষণগুলো তার খুব চেনা। এখন পরিচিত সবাইকে এই খবরটা তার জানিয়ে দিতে হবে। তোমরা সবাই সাবধান থেকো, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।
একুশ
আর-একবার ব্যর্থতার স্বাদ পেল ললিত। গভীর হতাশায় ডুবে যেতে লাগল। সে আর কোনও ঘটনাই ঘটাতে পারে না পৃথিবীতে।
দুপুরে খাওয়ার পর তীব্র অম্বল বর্শার ফলার মতো বুক চিরে উঠে আসছিল। একটু পরেই বমি হয়ে যাবে। ললিত কাত হয়ে শুয়ে, শরীরটাকে মুচড়ে, বালিশে মুখ ঠেসে বমিটা ঠেকানোর চেষ্টা করছিল। হাতে জ্বলে যাচ্ছে বৃথা সিগারেট, ঠোঁট পর্যন্ত আনতে পারছে না সে। বালিশে মুখ গুঁজে সে একটা অস্ফুট ‘অঃ ক’ শব্দ করে।
মা বাসায় নেই। কারও বাড়িতে গিয়ে বসেছে আড্ডয়। বুকের ভিতরটা ভরদুপুরে একা কেমন খাঁ খাঁ করে। দুপুর তার কোনও দিন কাটতে চায় না। কেমন ঝিম ধরে যায় মনে, বড় একা লাগে। দুপুরেই তার মিতুর কথা মনে পড়ে কিংবা মরবার কথা।
জানালার শিকের ভিতর দিয়ে ঘরে এসে মুখ বাড়িয়েছে পেয়ারা গাছের কয়েকটি পাতা। হাওয়ায় নড়ছে। সবুজ, কচি। নতুন জন্মেছে তারা, এখনও ধুলো বালি পড়েনি তাদের গায়ে। শিশুর মতোই নিস্পাপ দেখাচ্ছে। শিশুর মতোই যেন এক মুখশ্রী রয়েছে তাদের। ললিতের ইচ্ছে করে উঠে গিয়ে সে একটু ওদের আদর করে আসে।
পেয়ারাপাতার শিশুমুখ লক্ষ করে সে বড় অবাক হয়। বড় ভাল লাগে তার। সেই দিকেই স্থির চোখে চেয়ে থেকে, ক্লান্ত হয়ে ক্রমে তার চোখ বুজে আসে। তন্দ্রা এসে যাচ্ছিল তার। বমিট হয়তো শেষ পর্যন্ত হবে না।
এমন সময় টের পায়, খোলা দরজা দিয়ে কে যেন নিঃসাড়ে ঘরে এল। মা কি? না তো, মায়ের গন্ধ সে চেনে। চোখ খুলল না ললিত। অপেক্ষা করতে লাগল। মনে হচ্ছিল, মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে কে যেন তাকে দেখছে। শ্বাশ বন্ধ করে রইল সে। যে এসেছে সে বোধ হয় পৃথিবীর কেউ নয়। সে এসেছে ওইপার থেকে, যে-পারে তাকে শিগগিরই যেতে হবে। চোখ খুললেই সে দেখবে একজন একটা টিকিট এগিয়ে ধরে রেখেছে তার দিকে, সে বলবে, তোমার টিকিট হয়ে গেছে, জাহাজ ছাড়তেও আর দেরি নেই।
কিংবা, যে এসেছে সে হয়তো আদিত্য। ললিত চোখ চাইলেই বলবে, ট্রেটার! শাশ্বতীকে ফিরিয়ে দে।
ললিত!
চমকে চোখ খুলল ললিত। আস্তে আস্তে উঠে বসল। ক্লান্ত গলায় বলল, বোসো বিমান।
বিমানের চোখ লালচে, রুক্ষ চুল, স্নান-না-করা ধুলোটে চেহারা। সে নিবিড়ভাবে ললিতের দিকে চেয়ে ছিল। শ্বাস ফেলে বলল, ললিত, আমি আবার পাগল হয়ে যাচ্ছি।
সে কী? ললিত অবাক হয়ে বলে, কী হয়েছে?
কী জানি! মাঝে মাঝে এমনিই এটা হয়, কোনও কারণ থাকে না। আবার কখনও কোনও একটা ধাক্কা খেলে এটা হয়। কাল অনেক রাতে আমি একটা ভাড়াটে মেয়েকে কয়েকজন গুন্ডা ছেলের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলাম।
একটু চুপ করে থেকে বিমান বলে, কয়েক দিনের মধ্যেই আমার পাগলামি শুরু হবে। আমি টের পাচ্ছি।
ললিত নড়েচড়ে বসল। বলল, কাল বিকেলেও তুমি একজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলে, না বিমান?
মাথা নিচু করে একটু বসে থাকে বিমান। তারপর বলে, একে বাঁচানোটা তার চেয়ে শক্ত ছিল। কারণ এ বাঁচতে চায়নি। ওই যে বটগাছতলায় বাঁধানো বেদি আছে, ওখানে কয়েকজন ছেলের সঙ্গে সে বসে ছিল, অনেক রাতে, অন্ধকারে আমি তার মুখও দেখিনি।
ললিত বড় বড় চোখে চায়। বলে, আই বাপ, বিমান, ওটা যে শচীনদের আড্ডা, ওরা ওখানে চোলাই খায়।
বিমান মাথা নাড়ে, বলে, জানি। মেয়েটাকেও ওরা ভাড়া করে এনেছিল, আমি জানতাম। চা খেতে বেরিয়ে আমি ওদের পাল্লায় পড়ে গিয়েছিলাম! কিন্তু তারপর যখন একটা ছেলে সেই মেয়েটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তখন— বুঝলে—তখনই আমার সব গোলমাল হয়ে গেল। জানি মেয়েটা নিজের ইচ্ছেয় এসেছে, ওটাই তার কাজ তার রুজি-রুটি, তবু মনে হল সে যেন ভিতরে ভিতরে বেঁচে যেতে চাইছে, সেটা কেউ বুঝতে পারছে না।
ললিত জিব দিয়ে চুকচুক করে একটা আফসোসের শব্দ করে বলে, রাতারাতি তুমি পৃথিবী পালটে দিতে চাও?
বিমান একটা শ্বাস ফেলে বলল, আমার এ-রকম হয়। আগে আমি কত, নিরীহ ছিলাম, যা-কিছু চোখে পড়ত তা থেকেই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজের ভাবনা-চিন্তার মধ্যে ডুবে যেতাম। জানি তো আমি কেমন দুর্বল মানুষ! কিন্তু কাল রাতে আমি চেঁচিয়ে লোক ডাকছিলাম, বলছিলাম, বাঁচাও, কে কোথাও আছো—। কেউ এল না, কেউ সাড়াও দিল না। কিন্তু নিশ্চয়ই অনেকে সেই ডাক শুনেছিল। তবু কেউ আসেনি। কেন জানো? তারা সবাই আমারই মতো নিরীহ, চোখের সামনে অন্যায় দেখলে চোখ ফিরিয়ে নেয়, কেউ ‘বাঁচাও’ বলে চিৎকার করলে কানে হাত চাপা দেয়। আমি এতকাল সবাইকেই আমার চেয়ে সাহসী আর শক্তিমান ভেবেছি। কিন্তু বৃথা, কেউ তা নয়।
ললিত একটু হেসে বললে, কিন্তু আমি তোমার ডাক শুনতে পাইনি।
পেলে কী করতে? যেতে?
নিশ্চয়ই।
আর যখন গিয়ে দেখতে যে আমি কতকগুলো বাজে ছেলের হাত থেকে একটা নষ্ট মেয়েকে উদ্ধার করার চেষ্টা করছি, তখন কী করতে? লড়াই করতে ওদের সঙ্গে?
না
বিমান উত্তেজিতভাবে ললিতের একটা হাত ধরে ঝাঁকুনি দেয়, না! না। কেন
সেটা পণ্ডশ্রম হত। ওই ছেলেগুলো ওইরকম, মেয়েটাও ওইরকম, সেখানে আমাদের কী করার আছে?
নেই! বিমান হতাশ হয়, নেই কেন! তুমি কি ওদের সমর্থন কর
ললিত ভ্রূ কুঁচকে উত্তেজিত বিমানকে একটি দেখল। তারপর বলল, না, সমর্থন করি না। কিন্তু ওরা যে খুব একটা অন্যায় করছিল তাও তো নয়! কেউ যদি নিজের পয়সায় মদ খায়, ভাড়াটে মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করে তাতে আমার কী? মদ খাওয়া বারণ নয়, প্রস্টিটিউটদেরও লাইসেন্স আছে—
ঠিক। কিন্তু তোমার মন কী বলে। কাল বিকেলে দেখছিলাম তুমি আদিত্য আর শাশ্বতীর বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছ। মেয়েটা বিয়ে করতে রাজি নয়, যে-কোনও কারণেই হোক সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। তবু তুমি তাকে গায়ের জোরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলে। তুমি মনে মনে বুঝতে পারছিলে এটা অন্যায়, তবু তুমি তোমার অহংকার আর নিরপেক্ষতা বজায় রাখছিলে। আমি এখনও জানি না ওই মেয়েটার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কী! তবু আমার বিশ্বাস তুমি ওর ওপর একটা ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নিতে চাইছিলে। তাই অত জোর দেখিয়েছিলে তুমি। নিরপেক্ষতার ভান করেছিলে। তবু তোমার মুখ সাদা হয়ে যাচ্ছিল, তোমার হাত কাঁপছিল। কাল শাশ্বতীর জন্য আমার ততটা কষ্ট হয়নি, যতটা তোমার জন্য হচ্ছিল।
ললিত চোখ নামিয়ে বলল, তার সঙ্গে এ-ঘটনার সম্পর্ক কী?
বিমান মৃদু হাসল। বলল, কাল যদি আমিও তোমার মতো নিরপেক্ষ থাকতাম তা হলে আজ তুমি হাত কামড়াতে, চুল ছিঁড়তে, গাল দিতে নিজেকে। তুমি অত নিরপেক্ষ থেকো না, তা হলে একদিন তোমার ঘরে চোর ঢুকবে আর তুমি দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকবে।
ললিত মাথা নাড়ল, কিন্তু বলো, কালকের মেয়েটাকে তুমি বাঁচাতে চেয়েছিলে কেন?
বিমান নিজের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, যখন ওই ইতর ছেলেটা নষ্ট মেয়েটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন মেয়েটার কোনও উপায় ছিল না। সে সতী নয়, ঘরের বউ নয়, চল্লিশ কি পঞ্চাশ টাকায় সে কেনা হয়ে গেছে, তার পছন্দ-অপছন্দ নেই, যে কিনবে সে তার। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যে, সে-মেয়েটা এ রকম চাইছিল না। কেউ তাকে কিনে জিনিসপত্রের মতো যেমন খুশি ব্যবহার করুক, এটা কে চায়! আমার মনে পড়েছিল, বিকেলে শাশ্বতীকেও ভোমরা টেনে নিয়ে যাচ্ছিলে, সেও যাচ্ছিল, সে হয়তো সইও করত, কারণ সে বুঝতে পারছিল যে, তার উপায় নেই। না, না, তুমি রাগ কোরো না, শাশ্বতীর সঙ্গে আমি সে-মেয়েটার তুলনা করছি না। কিন্তু আমার কাছে দুটোই অনেকটা এক ব্যাপার। বিকেলে শাশ্বতীকে যেমন দেখেছি, রাত্রিবেলায় ওই মেয়েটাকেও ঠিক ওই রকম দেখেছিলাম, উপায়হীন বলে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কিছু লোক।
ললিত একটা গভীর শ্বাস ফেলে বলল, তুমি পাগল।
বিমান গম্ভীরভাবে বলল, ঠিক। ললিত, যেদিন আমি দুটো ছিনতাইবাজ লোকের কাছ থেকে আমার ঘড়ি আর মানিব্যাগ কেড়ে নিলাম, সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমি এ-রকম কাজ আবার করব এবং করতে থাকব। আমার স্বভাবের নিয়ম পালটে গেছে। কিন্তু তার ফল এই হবে যে, একদিন কেউ আমাকে নিঃশব্দে সরিয়ে দেবে, কাজের বাধা হচ্ছে বলে। কে আমাকে রক্ষা করবে তখন? কে আমার সহায় হবে? মানুষের মধ্যে তেমন শক্তিমান কাউকে দেখি না। তার চেয়ে এই ভাল যে, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি…আঃ, কিছু দিনের জন্য নিশ্চিন্ত।
বিমান একটুক্ষণ চোখ বুজে বসে রইল। মুখে মৃদু একটু হাসি। তার মাথার মধ্যে চমৎকার নীলাভ আকাশখানা আস্তে আস্তে ঢুকে যাচ্ছে। মাথার ভিতর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সব চিন্তা, স্মৃতি, ক্ষোভ।
ললিত অস্বস্তি বোধ করে। দাঁতে নখ কামড়ায়। তারপর একসময়ে বিমানের গায়ে হাত দিয়ে বলে, কী ভাবছ?
আকাশ। ধীর স্বরে এই কথা বলে চোখ খুলে বিমান একটু হাসে, বলে, আকাশের চিন্তাই ভাল। আর দু’-এক দিনের মধ্যেই আমার ভিতরটা আকাশে ভরে যাবে। চারদিকে কিছুই আর চোখে পড়বে না। তখন যে খুশি এসে কেড়ে নিক আমার ঘড়ি কিংবা মানিব্যাগ, যার খুশি জোর করে বিয়ে করুক শাশ্বতীকে, সেই বদ ছেলেগুলো যেমন খুশি বেলেল্লাপনা করুক পারুলের সঙ্গে, তাতে আমার আর কিছু যাবে আসবে না।
হঠাৎ ললিতের বড় লজ্জা করে। সে মুখ নিচু করে বলে, আমরা কী করতে পারি বলো!
বিমান মাথা নাড়ল। বলল, কিছু না। কাল রাতে আমার মনে হয়েছিল একজন খুব শক্তিমান মানুষের বড় দরকার, যিনি মানুষের এক ডাকে ছুটে আসবেন। ওই ছেলেগুলো বোমা মারে, ছোরা চালায়, আর ওই মেয়েটা ভাড়াটে। কে আসবে ওদের হাত থেকে ওই ন্যাকা ঢঙি মেয়েটাকে বাঁচাতে! সেটা হবে একটা হাস্যকর কাজ। কারণ, মদ খাওয়া বারণ নয়, বেশ্যাদেরও লাইসেন্স আছে। কাজেই আসতে চাইলেও বউ দরজা আটকে দাঁড়াবে, বাধা হবে ভয়, দুর্বলতা, কিংবা নিরপেক্ষ থাকার ইচ্ছা। কাজেই একমাত্র সেই লোকই ছুটে আসতে পারে যার ঘর-সংসার নেই, পরিবার পরিজন নেই। মানুষ ডাকলে সে নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। তেমন একজন মানষকে বড় দরকার—সবাই তেমন একজন মানুষের অপেক্ষা করছে—যার দিকে নির্ভর করে দু’হাত বাড়িয়ে বলা যায়, বাঁচাও—আমি শাশ্বতী—আমি পারুল—আমি ললিত—আমি বিমান—আমাকে বাঁচাও…
ললিত হাসে, কোথায় পাবে?
বিমানের চোখ চিকমিক করে, হঠাৎ বলে, যদি না-থাকে, তবে একজন কাউকে তৈরি করে নিতে হবে।
পাগল।
বিমান আস্তে আস্তে আবার অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তারপর করুণ মুখ করে বলে, আমার একটা উপকার করবে?
কী?
পকেট থেকে অপর্ণাকে লেখা চিঠিখানা বের করে বিমান। বলে, এই ঠিকানায় মেয়েটাকে চিঠিটা পৌঁছে দেবে? ডাকে দিতে পারতাম, কিন্তু ওদের বাড়ির অভিভাবকেরা মেয়েদের নামে চিঠি এলে খুলে পড়ে, তারপর দেয়। তুমি দিয়ে আসবে ওর হাতে?
ললিত অবাক হয়, বলে, কী করে! আমি একটা অচেনা লোক, ওদের বাড়িতে—
বিমান বাধা দিয়ে বলে, না, বাড়িতে নয়। চিঠিতে একটা ফোন নম্বর দেওয়া আছে। আগে ওকে ফোন করো, কিন্তু নিজে কোরো না, পুরুষের গলা শুনলে ওরা অপর্ণাকে ডেকে দেবে না! তুমি বরং কোনও মেয়েকে দিয়ে ফোন করিয়ে। অপর্ণা ফোন হাতে নিলে তুমি কথা বলবে। বাড়ির বাইরে কোথাও একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিয়ো। খুব শক্ত না, তবে একটু ঝামেলার ব্যাপার। পারবে?
তুমি নিজে গেলে না কেন?
দূর! ওরা আমাকে ঢুকতেই দেবে না।
কেন
বাঃ, আমি—আমি পাগল না!
ললিত একটু ইতস্তত করল। তারপর হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিল। বিমান বলল, চারটের পরে যেয়ো, তখন ও কলেজ থেকে ফিরবে।
চারটের একটু আগেই ললিত ঘরে তালা দিয়ে বেরোল। শম্ভুর ছোট ভাইটা একা একা সিঁড়িতে বসে সিগারেটের কুড়ানো প্যাকেট গুনছে। তাকে ডেকে বলল, মা কোন বাড়িতে গেছে জানিস?
ওই তো, হালদারদের বাড়ি।
ঘরের চাবিটা দিয়ে আসবি? বলিস, ফিরতে একটু দেরি হবে।
ঘাড় হেলিয়ে চাবিটা নিয়ে দৌড়ে গেল ছেলেটা।
ললিত খানিক দূর হাঁটল। তখনও গলা বুক ঢকঢক করছে অম্বলে। হাঁটতে গেলে পাঁ কাঁপছে। শ্বাস ফেটে যাচ্ছে মাঝে মাঝে আমি কি পারব শেষ পর্যন্ত? ভাবল ললিত। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে সে আনোয়ার শা রোড় পর্যন্ত হেঁটে গেল। বেরিয়ে এসে বাইরের রোদে হাওয়ায় চমৎকার লাগছে তার। কিন্তু শরীর দিচ্ছে না।
একটু দূরে ফিল্ম-স্টুডিয়োটার সামনে একটা ট্যাক্সি খালি হচ্ছে। পকেটে হাত দিয়ে সে টাকা কয়টা গুনে দেখল। পাঁচ টাকা আর কিছু খুচরো আছে। হয়ে যাবে। তারপর দূর থেকে অসহায়ভাবে দুর্বল হাত তুলল ললিত। মনে মনে বলল, হে ভগবান, ট্যাক্সিওয়ালাটা যেন আমাকে দেখতে পায়, আর অন্য কেউ যেন ওটাকে ধরে না-ফেলে।
ট্যাক্সিওয়ালাটা দেখতে পেয়েছিল তাকে। ধীর গতিতে সামনে এসে দাঁড়াল। ট্যাক্সিতে উঠে নিশ্চিন্তে ঘাড় হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে হঠাৎ তার মনে পড়ল একটু আগে ট্যাক্সিটার জন্য সে ভগবান—অর্থাৎ ভগবান নামে একটা অলীক বস্তুকে ডেকেছে। সে একটু মৃদু হাসল। ট্যাক্সিটা সে পেয়েছে, তবে এবার কি ভগবানকে বিশ্বাস করবে? করতে মাঝে মাঝে বড় ইচ্ছে হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত করা যায় না। বিশ্বাস করুক আর না করুক, তবু যদি ভগবানের ইচ্ছেয় সে ট্যাক্সিটা পেয়ে থাকে তবে তাকে তার একটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। তাই সে ফিসফিস করে বলল, ধন্যবাদ। তারপর নিজের কাছেই লজ্জা পেল।
গড়িয়াহাটার কাছে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিল ললিত।
চারদিকে অনেক টেলিফোন করার জায়গা রয়েছে। কিন্তু এখন দরকার একজন মেয়েকে।
কিন্তু এখন মেয়ে কোথায় সায় ললিত! একটি বেশ ভদ্র, সভ্য, শান্ত এবং চালাক মেয়ে! ললিত আপন মনে একটু হাসল। তারপর মনে মনে বলল, মাইরি, ভগবান, একটা মেয়ে জুটিয়ে দাও দেখি, যে-মেয়ে কথা বলতে গেলেই ভ্রূ কোঁচকাবে না, তেড়ে আসবে না, বেশ দয়ালু গোছের একজন…
আশ্চর্যের বিষয়, পেট্রল পাম্পের জানালা দিয়ে টেলিফোন টেনে এনে বাইরে দাঁড়িয়ে ফোন করছে একটা মেয়ে। চোখে চশমা, হাতে বটুয়া, হলদে শাড়ি পরা, বেশ ধারালো বুদ্ধির চেহারা মেয়েটির। কথা বলতে বলতে হাসছে। মিষ্টি হাসিটি। ললিত নিঃশব্দে তার অদূরে গিয়ে বশংবদভাবে দাঁড়াল। অপেক্ষা করতে লাগল।
মেয়েটা বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল, তারপর এক সময়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে এক পলক দেখে টেলিফোনে বলল, এই ছেড়ে দিচ্ছি, পিছনে লোক অপেক্ষা করছে… আচ্ছা!
মেয়েটি পয়সা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই ললিত পথ আটকাল।
প্লিজ যদি একটু উপকার করেন।
একটুও ঘাবড়াল না মেয়েটা। নরম মুখে বলল, বলুন।
একটি মেয়েকে একটু টেলিফোনে যদি ডেকে দেন। ওর গার্জিয়ানরা— মেয়েটি ঝিলিক দিয়ে হাসল, বলল, বুঝেছি। নাম্বারটা দিন। আর নামটা।
ললিত বলল, তারপর শ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল। মেয়েটা দ্রুত অভ্যস্ত হাতে ডায়াল ঘুরিয়ে মিষ্টি গলায় বলল, হ্যালো—অপর্ণা আছে?…আমি মীরা ওর সঙ্গে…
মেয়েটি মাউথপিসে হঠাৎ হাত চাপা দিয়ে ললিতকে তীক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করল, কলেজে পড়ে তো!
হ্যাঁ।
কোন কলেজে?
‘হে ভগবান’, ললিত মনে মনে দ্রুত বলল, ‘কোন কলেজে?’ হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ে গেল, সুবল বলেছিল লেডি ব্র্যাবোর্ন।
লে—লেডি ব্রাবোর্ন।
মেয়েটি মিষ্টি গলায় টেলিফোনে বলল, হ্যাঁ আমরা এক ক্লাসের মাসিমা।…কে, অপর্ণা? এই যে ভাই, কথা বলুন—আমি কিন্তু মীরা—
মিষ্টি একটু হাসল মেয়েটি। ললিত হাত বাড়িয়ে টেলিফোনটা নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল, ধন্যবাদ। মেয়েটি ঘাড় হেলিয়ে চলে গেল।
ও-পাশ থেকে খুব সতর্ক সরু একটা মেয়ে-গলা বলল, কী রে—মীরা?
ললিতের গলা কাঁপছিল, সে ঘাবড়ে যাচ্ছিল। বলল, আমি বিমান রক্ষিতের বন্ধু, আমার নাম ললিত।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বল না।
বিমান একটা চিঠি দিয়েছে আপনাকে। সেটা কোথাও এসে আপনাকে নিতে হবে।
ইস, দ্যাখ তো, কী বিচ্ছিরি সময়ে বললি, চারটে বেজে গেছে, বিকেলে আবার আমার মিউজিক ক্লাস। কোথা থেকে ফোন করছিস?
অস্বস্তি বোধ করে ললিত বলল, গড়িয়াহাটা।
আচ্ছা, শোন মীরা, আমি যাচ্ছি তোর বাসায়, আর আধ ঘণ্টা পর, মিউজিক ক্লাসে যাওয়ার পথে।…ইস, তুই আজই লক্ষ্নৌ যাচ্ছিস আগে বলিসনি তো! হঠাৎ ঠিক হয়ে গেল?…ফোন করে ভাল করেছিস পি এস-এর নোটটা না হলে একদম প্রিপ্যারেশন হত না…
ললিত হঠাৎ বুঝতে পারলে মেয়েটা তাকে সময় দিচ্ছে। এবার তাকে একটা জায়গার নাম বলতে হবে। সে দ্রুত চিন্তা করে বলল, হিন্দুস্থান মার্টের ভিতরে যে চায়ের দোকানটা আছে, ওইখানে। সাড়ে চারটে।
ইস, তোকে কি আর চিনতে পারব, যা মুটিয়ে ফিরবি লক্ষ্ণৌ থেকে!
ললিত ইঙ্গিত বুঝল। বলল, আপনার পোশাকটা বলুন। আমিই আপনাকে চিনে নেব।
পরশুদিন যা একখানা শাড়ি কিনেছি না রে, দেড়শো টাকাও বলবি সস্তা। জামদানির ওপর পিঙ্ক বাটিকের কাজ। আজ পরে যাব, দেখিস…আচ্ছা ছাড়ছি…কেমন!
টেলিফোন রাখার পর ললিত টের পেল তার কপাল ঘামছে।
আরও আধঘণ্টা সময় আছে। কিন্তু একটু যে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াবে ললিতের সে সাধ্য নেই। তাই সে আস্তে আস্তে হেঁটে হিন্দুস্থান মার্টের নির্জন চায়ের দোকানটায় এসে বসল। এক কাপ চা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। হঠাৎ তার মনে পড়ল একজনের একটা পাওনা সে এখনও চুকিয়ে দেয়নি। ঠিক সময়ে সে ঠিক মেয়েটিকে পেয়ে গিয়েছিল টেলিফোন করার জন্য, আর অপর্ণার কলেজের নামটাও মনে পড়েছিল ঠিক সময়ে। মৃদু একটু হাসল ললিত আপনমনে, তারপর একদম ফাঁকা রেস্টুরেন্টটায় একটু চোখ বুলিয়ে অনুচ্চ ফিসফিস স্বরে বলল, ধন্যবাদ, তুমি খুব ভাল।
উত্তেজনাটা বড় চমৎকার লাগছিল ললিতের। এখন তার ইচ্ছে করছে আরও বহুবার এইরম রহস্যময়ভাবে সাংকেতিক ভাষায় অচেনা মেয়েদের ফোন করে দুপুরবেলায় এ-রকম রোজ এসে বসে থাকে এ-রকম রেস্তরাঁয়, কারও জন্য অপেক্ষা করে। এ-রকম কত কিছু হতে পারত জীবনে, ঠিক যেন অলৌকিক কাণ্ড সব!
একটু অন্যমনস্ক ছিল ললিত। হঠাৎ সিগারেট ধরিয়ে মুখ তুলে দেখল চমৎকার শাড়ি পরা একটি রোগা ফরসা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। মুখখানা লম্বাটে একটু কিশোরীর মতো মুখশ্রী। চোখ দুটো বড়, কিন্তু একটু ভারী। খুব কাঁদলে যেমন চোখের চেহারা হয়। তবে এ-মেয়েটি কাঁদেনি, চোখ দুটোই ও-রকম। মুখের হাসিটুকু দেখে মনে হয় এ খুব বেশি হাসে না কখনও। আঁচল ডান ধার দিয়ে ঘুরিয়ে এনে সমস্ত শরীরটা ঢেকেছে।
একটু হেসে বলল, আপনিই ললিত?
ললিত মাথা নেড়ে বলল, বসুন।
বসল। তারপর একটু বিব্রত হেসে বলল, টেলিফোনে আমার কথা শুনে খুব হেসেছেন, না? কী করব বলুন, আমাদের বাড়ির ওইরকম নিয়ম।…কই, চিঠিটা দেখি।
দেড়-দুই লাইনের চিঠি, তবু বুকের কাছে তুলে নিয়ে ললিতের চোখের আড়াল করে গভীরভাবে পড়ল অপর্ণা। মুখখানা হঠাৎ বড় ম্লান হয়ে গেল। চিঠিটা ধরে রইল একটুক্ষণ। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, আপনি ওর কীরকম বন্ধু? পুরনো?
যদিও মিথ্যে কথা, তবু ললিত বলল, অনেক দিনের। সেই কলেজ-লাইফ থেকে। মাঝখানে দেখাশোনা ছিল না, এখন কাছাকাছি বাসা।
ওঃ। ওকে কেমন দেখলেন?
খুব শকড।
কেন? মেয়েটা হঠাৎ ঝুঁকে তীক্ষ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল।
বলা উচিত হবে না, তাই গতকালের ঘটনা কিছু বলল না ললিত, শুধু বলল, ও অল্পেই উত্তেজিত হয়।
মেয়েটা একটু চুপচাপ থেকে হঠাৎ বলল, কিছুদিন আগে কে যেন টেলিফোন করে বাবাকে ওর নামে যা-তা কথা বলেছে। বলেছে ও নাকি আমাকে নষ্ট করে দিচ্ছে, কে বলুন তো!
ললিত সামান্য শিউরে ওঠে মনে মনে। সুবলের কালো চকচকে মুখখানা মনে পড়ে, সে মাথা নেড়ে বলল, কী জানি!
হঠাৎ অপর্ণার চোখে জল এসে যাচ্ছিল। স্খলিত গলায় বলল, ওকে যন্ত্রণা দিয়ে কার কী লাভ! আমার বাবা ইচ্ছে করলে ওর চাকরি খেয়ে ফেলতে পারেন, নানা রকম ট্রাবল দিতে পারেন। কাজেই বাবাকে যে জানিয়েছে তার কী লাভ? আমি ওকে এইটুক বেলা থেকে জানি, ওর মতো ভাল হয় না।
একটু চা বলে দিই!
না। অপর্ণা মাথা নাড়ল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, আমি বাবার একমাত্র সন্তান। বাবার সব সম্পত্তি আমার। কিন্তু তাতে কারও কোনও লাভ নেই, আমি ওকেই ভালবাসি। আর কাউকে কখনও
ললিত হঠাৎ বলল, এ-সব কথা কেন বলছেন?
মেয়েটা চোখ নামিয়ে নেয়, টেবিলের নুনের কৌটোটা একটু নাড়াচাড়া করে। বলে, কী জানি! আমার কেবলই মনে হয় আমাদের যেন একটা বিপদ আসছে
বাইশ
ললিত একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কীসের বিপদ?
অপর্ণা প্রথমে উত্তর দিল না। নতমুখে টেবিলের কাছে তার সাদা প্রায় রক্তশূন্য একটি আঙুল দিয়ে কয়েকটা গোল চিহ্ন আঁকল। তারপর তার বয়সের তুলনায় ভারিক্কি বিষণ্ণ মুখখানা তুলে বলল, কয়েক দিন ধরে দেখছি আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে একটা কালোমতো ছেলে ঘুরে বেড়ায়। যেতে যেতে আমাদের বাড়ির ব্যালকনি কিংবা খোলা জানালার দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে। আমি যখন কলেজে যাই তখন দেখি সে চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। কয়েক দিন তাকে কলেজের গেটের সামনেও দেখেছি।
চা খাওয়ার পর ললিতের অম্বলের ভাব বেড়ে যাচ্ছিল। ব্যথা করছিল বুক আর পিঠ। কেমন একটা ঘুম-ঘুম ভাব, শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে।
অপর্ণার কথা শুনে সে একটু হাসল। বলল, তাতে কী? ও-রকম কত ছেলে পিছু নেয় মেয়েদের, তারপর বোধবুদ্ধি হলে আবার সরেও যায়। ওকে বেশি পাত্তা দেবেন না।
এ-কথা যখন বলছিল ললিত তখন তার অমোঘভাবে মিতুর কথা মনে পড়ছিল। মিতুও হয়তো নিজের বাবা মার কাছে বলত যে একটা ফরসামলতা রোগা ছেলে যাতায়াতের পথে দাঁড়িয়ে থাকে, কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো চেয়ে থাকে তাদের বাড়ির দিকে।
মেয়েটি ললিতের উপদেশ শুনল কি না বলা যায় না, বলল, পিছু-নেওয়া। ছেলে আমি অনেক দেখেছি। কিন্তু এ-ছেলেটা ভীষণভাবে আমার কাছে আসার চেষ্টা করছে। একদিন দেখি আমাদের দারোয়ানের কাছ থেকে দেশলাই চেয়ে সিগারেট ধরাল, আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী একটু কথাও বলে গেল। পরে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ছেলেটা নাকি তার কাছ থেকে কয়েকটা ফুলের চারা চেয়েছিল। আমি দারোয়ানকে বারণ করে দিয়েছি ওর সঙ্গে কথা বলতে।
ললিত সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, তাতে কী? ওতে ভয় পাবেন না। মেয়েটির মুখে-চোখে একটু রক্তাভা দেখা যায়; নিশ্বাস চেপে খুব আস্তে আস্তে বলল, ছেলেটি আমাকে লক্ষ্য করে আমাদের মোটরগাড়ির মধ্যে একটা কাগজের দলা ছুড়ে দেয়। খুলে দেখি চিঠি। ভুল বানানে লেখা অজস্র আজেবাজে কথা। আমি কাউকে বলিনি৷ তা ছাড়া আমার বিশ্বাস এই ছেলেটাই টেলিফোন করেছিল আমার বাবাকে। আমার কেমন যেন ভয় করে। এমন অবস্থা যে বাড়ি থেকে একা বেরোতে পারি না, ছেলেটা ভীষণ ডেসপারেট, কী জানি কী করে বসে! টেলিফোনে বাবাকে বলেছিল যে ওর বাসার কাছেই নাকি থাকে, একই পাড়ায়। সেটা জানার পর থেকে আমি আর ওর কাছেও যাই না।
পেটের মধ্যে কলকল শব্দ হচ্ছে। ছুঁচের মুখের মতো গলার কাছে খোঁচা দিচ্ছে অম্বল। হঠাৎ পেটের মধ্যে শব্দটা এত জোরে হল যে ললিতের ভয় হচ্ছিল মেয়েটা শুনতে পাচ্ছে।
ললিত উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, আমিও ওই পাড়ায় থাকি। যদি একা যেতে ভয় করে তবে আমার সঙ্গে চলুন, কোনও ভয় নেই। আপনি গেলে বিমান খুশি হবে।
মেয়েটা ম্লান হেসে বলল, কিন্তু ও যে বারণ করেছে।
ললিত বলল, কিন্তু একটু আগেই ও আমার কাছে এসেছিল। তখন দেখেছি ও নর্মাল। কথাবার্তা ভালই বলছিল। এখনও ভয়ের কিছু নেই।
মেয়েটি একটু চিন্তা করে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলুন।
অপর্ণাই তার অভিজাত ভঙ্গিতে কেবলমাত্র একটি তর্জনীর সংকেতে খালি ট্যাক্সিটা দাঁড় করাল।
দু’জন দু’ কোণে বসল। মাঝখানে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। অপর্ণা বাইরের দিকে তাকিয়ে। আর ললিত তার বুক আর পেটের অস্বস্তিটা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য একটু গা এলিয়ে সিটের পিছনে মাথা রেখে। বমিটা হয়তো হবে। এক গ্লাস জলের পর এক কাপ চা খেয়েছে ললিত। খাওয়াটা ঠিক হয়নি।
অপর্ণা মুখ ফিরিয়ে ললিতকে দেখে বলল, আপনার কি শরীর খারাপ? না।
একটু অন্যমনে চুপ করে থেকে অপর্ণা বলল, এখন আমাদের সময় ভাল যাচ্ছে না। কিছু দিন আগেই বাবার কারখানার কর্মচারীরা বাড়ির সামনে এসে জমায়েত হয়েছিল একদিন, বোনাস আর কাজের সিকিউরিটির জন্য। ইউনিয়নের লিডার এক ছোকরা এল বাবার সঙ্গে কথা বলতে। সে আমাদের বৈঠকখানায় বসে বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাঁর সামনেই সিগারেট খাচ্ছিল। ফলে বাবা সেদিন ভীষণ রেগে যায়, আর নার্ভাস হয়ে পড়ে। সেই ঘটনার পরেই বিকেলের দিকে বাবার ব্লাড প্রেশার অসম্ভব বেড়ে যায়। রাত্রে। একটা স্ট্রোকের মতো হয়।
ললিত বলে, সে কী! ছেলেটা সিগারেট খেয়েছিল বলে?
অপর্ণা মৃদু একটু হাসল, উনি পুরনো আমলের লোক। কর্মচারীরা সামনে সিগারেট খাবে এটা উনি বরদাস্ত করতে পারেননি।
ললিতের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল, তবু সে বলল, কিন্তু এ-রকম হওয়াই তো স্বাভাবিক। দীর্ঘকাল পেটমোটা, অসৎ, অতিরিক্ত মুনাফাখোর মালিকদের সম্মান করতে করতে ওরা এই ম্যানারিজমকে আর বিশ্বাস করছে না।
এই অপ্রিয় কথাগুলো একজন মালিকের মেয়েকে তার বলার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু কথাগুলো এমনিতেই বেরিয়ে এল। তাই একটু লজ্জা করছিল ললিতের।
অপর্ণা বাইরের দিকেই চেয়ে ছিল। ট্যাক্সিটা একটা ডবলডেকারের পিছু পিছু আস্তে আস্তে যাচ্ছে। অপর্ণা মুখ না-ঘুরিয়েই বলল, ইউনিয়নের ওই ছেলেটা আমাদের এক জ্ঞাতির ছেলে। যখন সে চাকরি চাইতে এসেছিল তখন বাবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিল। তা ছাড়া আমার বিশ্বাস সে সিগারেট খাওয়ার দরকার বলেই সিগারেট খায়নি, সে খেয়েছিল ইচ্ছে করে, বাবাকে চটিয়ে দেওয়ার জন্যই।
ললিত একটু উত্তেজনা বোধ করে বলে, কিন্তু আমি কাগজে ছবি দেখেছি কুড়ি-একুশ বছরের বাচ্চা নিগ্রো ছেলে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাদের দাবিদাওয়ার কথা বলছে। তার হাতে সিগারেট, সামনে মদের গ্লাস, খুব ইজি ভঙ্গি—
অপর্ণা হাসল, বলল, আমি ও-সব জানি না। আমি ছেলেবেলায় আমাদের কারখানার কর্মচারীদের কাকা কিংবা দাদা বলে ডেকেছি, তারাও বাবাকে কখনও জ্যাঠামশাই কখনও অন্য কোনও আত্মীয়তার সম্পর্কে ডেকেছে। আমাদের মধ্যে খুব একটা দূরত্ব ছিল না। কিন্তু ওই ছেলেটা বাবার সামনে সিগারেট খেয়ে সেই দূরত্ব তৈরি করে দিল।
ললিত ভিতরে উত্তেজিত হয়েছিল, সেই উত্তেজনা তার গলার স্বরকে অজান্তে তীব্র করে দিল। বলল, দূরত্ব ছিলই। হয়তো বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছিল না। দুটো শ্রেণী, তাদের পরস্পরবিরোধী স্বার্থ, কী করে তারা পরস্পরের কাছের লোক হয়?
অপর্ণা এ-কথার উত্তর দিল না। অনেকক্ষণ বাইরের দিকে চেয়ে রইল। তারপর বিষন্ন মুখখানা ফিরিয়ে বলল, হলে ভাল হত।
ললিত হাসতে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ে তার পেটের ভিতর থেকে একটা ‘ওয়াক’ উঠে আসছিল। সে তাড়াতাড়ি সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়ার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল।
অপর্ণা ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকায়। বড় সুন্দর দেখায় তাকে। বলে, আপনার কি কোনও কষ্ট হচ্ছে?
ললিত বলল, না, না। আপনি কথা বলুন।
অপর্ণা বলল, বাবাকে নিয়েই আমার ভয়। এখন বেশি উত্তেজনা তাঁর পক্ষে ভাল না। গতকাল রাত থেকে তাঁর কর্মচারীরা হাওড়ার কারখানায় তাঁকে আটকে রেখেছে। এখন পর্যন্ত তাঁর কোনও খবর আমরা পাইনি।
ললিত জিজ্ঞেস করল, কেন আটকে রেখেছে?
অপর্ণা মৃদু হাসিমুখে বলে, তিনি প্রায় নব্বইজনকে ছাঁটাই করেছেন।
ললিত একটু চমকে ওঠে, নব্বইজনকে! এই অভাব-কষ্টের দিনে!
অপর্ণা মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু ভয়ের কিছু নেই। বাবা নব্বইজনকে ছাঁটাই করতে চান না। ওই যে ইউনিয়নের ছেলেটা আর ও-রকম আরও জনাচারেক, এই মোট পাঁচ জনকেই বাবা তাড়াতে চাইছেন। কিন্তু সরাসরি ওই পাঁচ জনকে সরানো খুব মুশকিল। তাই নব্বই জনকে ছাঁটাইয়ের নোটিশ দিয়েছেন তিনি। এখন আন্দোলন হবে, তর্কাতর্কি হবে, স্ট্রাইক চলবে। আর বাবা আস্তে আস্তে তাদের দাবির কাছে হার স্বীকার করতে থাকবেন। নব্বই জনের জায়গায় আশি জন, তারপর সত্তর জন, এভাবে সংখ্যা কমতে থাকবেন। শেষ পর্যন্ত পঁচাশি জনকেই আবার কারখানায় ফেরত নেবেন, তারপর বলবেন তোমাদের দাবিদাওয়া প্রায় সবই মেনে নিলাম, কেবল ওই শেষ পাঁচ জনকে বাদ দাও। ওদের নিতে পারব না। তখন ইউনিয়ন দেখবে যে তারা মালিকের কাছ থেকে প্রায় সবটাই আদায় করে নিতে পেরেছে, তাদেরই জয় হয়েছে, আর স্ট্রাইক চালিয়ে যাওয়ার মানে হয় না, ছেলেপুলে পুজোর আগে না খেয়ে আছে, নতুন জামা-কাপড় কিনতে পারছে না, কাজেই তারা মিটমাট করে নেবে। কিন্তু বাবা ঠিক যে-পাঁচজনকে ছাঁটাই করতে চেয়েছিলেন, তাদেরই ছাঁটাই করবেন, কর্মচারীরা সেই ব্যাপারটা বুঝতেই পারবে না। তারা বৃহত্তর স্বার্থে নব্বইজনের জায়গায় পাঁচজনের ছাটাই মেনে নেবে।
ললিত একটু ছটফট করছিল ভিতরে ভিতরে। বলল, এটা তো শত্রুতা।
অপর্ণা হাসল, হ্যাঁ, ভীষণ শত্রুতা। আমাদের মধ্যে আর একটুও আত্মীয়তার ভাব নেই। কিন্তু আপনাকে এত কথা বলা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না।
ললিত মুখ ফিরিয়ে নিল।
অপর্ণা মৃদু গলায় বলল, তবু বলছি, কারণ আমার মন একদম ভাল নেই। বাবার হাই ব্লাডপ্রেশার, তার ওপর এইসব উত্তেজনা। এখন যদি তাঁর একটা কিছু হয়ে যায়, আমি সেই কথাই ভাবছি—
ললিত চাপা গলায় বলল, তখন আপনি মালিক হবেন!
অপর্ণা শান্ত গলায় বলল, ঠিক। কিন্তু তখন আমি আর মা কী ভীষণ একা হয়ে যাব! তখন ওই সব কর্মচারীরা যদি আমাদের ঘেরাও করে রাখে! যদি বাসায় এসে হামলা করে! মা গো, সে-কথা ভাবতেই বুকের ভিতরটা শুকিয়ে যায়।
অপর্ণা আবার অন্যমনস্ক হয়ে যায় একটুক্ষণের জন্য। তারপর খুব সংকোচে লাজুক গলায় বলে, তাই বাবা প্রাণপণে আমার বিয়ের জন্য চেষ্টা করছেন। বুঝতেই তো পারছেন কেমন পাত্র খুঁজছেন আমার বাবা! ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, বংশপরম্পরায় যাদের মালিক হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে, এমন পাত্র। সে-ছেলে চরিত্রহীন বা মাতাল হলেও কিছু যায় আসে না, বাবা ও-সব বাছবিচার করবেন না। আর দু’-তিন মাসের মধ্যেই আমার বিয়ের ডেট ঠিক হয়ে যাবে। আর যদি ও-রকম ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হয় তা হলে কোনও দিনই আর কর্মচারীর সঙ্গে আমাদের শত্রুতা মিটবে না।
ললিত বলল, আপনি কী চান?
অপর্ণা একটুও না-ভেবে বলল, আমি চাই আমাদের মালিক আর শ্রমিকদের মধ্যে একই স্বার্থ কাজ করুক। পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়া আর ভালবাসা থাক।
ললিত প্রাণপণে তার বমির ভাবটা আটকে রাখার চেষ্টা করছিল। সেই চেষ্টায় তার চোখে জল এসে গেল। সে একটু হাঁফাতে লাগল।
অপর্ণা জিজ্ঞেস করল, আপনার কী হয়েছে?
ললিতের ইচ্ছে হল অপর্ণার আগের কথাটার উত্তর দিয়ে বলে, এই দেখুন, এতকাল একসঙ্গে বাস করেও আমার শরীরটার সঙ্গে বোঝাপড়া বা ভালবাসা হয়নি, এ কেবল আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য জন্মেছে। এর সঙ্গেও আমার স্বার্থের মিল নেই।
কিন্তু সে-কথা না বলে ললিত বলল, শরীরটা ভাল নেই। কিন্তু আপনি কিছু ভাববেন না, ও ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আপনি শ্রমিক-মালিকের এক স্বার্থের কথা কী যেন বলছিলেন! কী যেন, বোঝাপড়া আর ভালবাসার কথা!
অপর্ণা লাজুক মুখে মাথা নামিয়ে বলল, ওটা আমার একটা এমনিই খেয়াল। আসলে বোধ হয় আমাদের সঙ্গে কর্মচারীদের শত্রুতা কোনও দিন মিটবে না। কিন্তু ওদের শত্রু ভাবতে আমার ভাল লাগে না। ইচ্ছে করে ওদের সব দাবিদাওয়া মিটিয়ে দিই। কিন্তু ভেবে দেখেছি, শত্রুতাটা এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, দাবি মিটিয়ে দিলেও ওরা খুশি হবে না। ভিতরে ভিতরে গুমরে উঠবে, কেন একজন লোক আমাদের মালিক হয়ে আছে! কেন তাকে আমরা সম্মান করব? কেন তার সামনে আমরা সিগারেট খাব না? একজন মানুষ এখন আর কিছুতেই অন্য একজন মানুষের অধীন হতে চায় না। কেননা মানুষ তারই অধীন হতে পারে যাকে সে ভালবাসে।
ললিত একটু অবাক হয়েছিল অপর্ণার কথা শুনে। একটি অল্পবয়সি মেয়ের কাছে সে এ-রকম কথা আশাই করেনি। কে জানে, এ-সব কথা হয়তো ওকে বিমান শিখিয়েছে, এ-কথা হয়তো ওর নয়। সে মৃদু গলায় বলল, ব্যক্তিগত মালিকানার ওটাই তো দোষ। মালিকানা যদি রাষ্ট্রের হাতে যায়, যে-রাষ্ট্র সকলের স্বার্থে কাজ করে, তবে সেই রাষ্ট্রে এ-ব্যাপার হবে না।
অপর্ণা হাসল, আপনি কি কমিউনিস্ট?
ললিত উত্তর দিল না।
অপর্ণা মৃদু গলায় বলল, কমিউনিস্ট কি না এই প্রশ্ন করলে আজকাল অনেকেই চুপ করে থাকে। কিন্তু আমি জানি আপনি কমিউনিস্ট।
ললিত হাসল, কী করে জানলেন?
অপর্ণা বলল, অবশ্য আমার ভুল হতে পারে। তবু মনে হয় অনেক দিন আগে আপনার বন্ধু বিমানের কাছে আপনাদের কয়েকজনের কথা শুনতাম।
ললিত অবিশ্বাসের সুরে বলল, তাই নাকি?
অপর্ণা মৃদু হাসল, এক সময়ে ও আমাকে পড়ত। তখন ও কলেজের ছাত্র। খুব ভাল ছাত্র ছিল, কিন্তু কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারত না। বাবা ওকে অনেক বলে কয়ে আমাকে পড়াতে রাজি করিয়েছিলেন। প্রথম প্রথম ও পড়াত না, চুপচাপ বসে থেকে বইপত্র নাড়াচাড়া করে উঠে যেত। কিন্তু আমি তখন বাচ্চা মেয়ে, ফ্রক পরি কাজেই বোধ হয় আমাকে ও বেশি দিন লজ্জা করল না। আস্তে আস্তে কথা বলতে শুরু করল, কিন্তু পড়ার কথা নয়। তখন ও মাঝে মাঝে ললিত নামে একজনের কথা বলত। সেই ললিত ছিল কমিউনিস্ট ইউনিয়নের নেতা, খুব চালাকচতুর চৌকস ছেলে। তাই যখন টেলিফোনে আপনি নাম বললেন, তখনই আমার সেই ললিতের কথা মনে পড়েছিল, তা ছাড়া আপনিও তো ওর কলেজের বন্ধু, কাজেই মনে হচ্ছে আপনি সেই ললিত। না?।
ললিত একটা অদ্ভুত শিহরিত আনন্দ বোধ করল। আশ্চর্য, কত দূরে কোথায় চলে গেছে তার পরিচয়। এই মেয়েটাও মনে রেখেছে তাকে! ললিতের বড় জানতে ইচ্ছে করে আরও কত দূরে। আরও কোথায় কোথায় লোকে তাকে মনে রেখেছে!
অপর্ণা ঘাড় হেলিয়ে তাকে একটু দেখল। তারপর রহস্যময় একটু হেসে বলল, আপনার বন্ধু একসময়ে আপনার খুব প্রভাবে পড়েছিল। প্রায়ই ব্যক্তিগত মালিকানা তুলে দিয়ে রাষ্ট্রগত মালিকানার কথা বলত। আমাকে বলত, তোমাদের কারখানার সব ক্যাপিটাল শেয়ারে ভাগ করে শ্রমিকদের মধ্যে বিলিয়ে দাও। নইলে একদিন শ্রমিকদের রাষ্ট্রে তোমাদের বিচার হবে…এইসব কথা। আমি তখন ছোট মেয়ে, ওর কথা শুনে হাঁ করে চেয়ে থাকতাম, কখনও হাসতাম। কিন্তু মনে মনে ওর সব কথাই আমার সত্য বলে মনে হত—
কেন? ললিত হঠাৎ জিজ্ঞেস করে।
অপর্ণা সামান্য একটু রাঙা হয়ে বলে, খুব ছেলেবেলায় ওর সঙ্গে একবার আমার বিয়ের কথা হয়েছিল। ওরা আমাদের জ্ঞাতি, দেশে আমাদের বাড়ি ছিল ওদের বাড়ির পাশে। এ-সব ক্ষেত্রে অনেক সময়ে যেমন হয়, বাবা-মায়েরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বিয়ে ঠিক করে রাখেন, আবার বড় হলে ভুলে যান, অনেকটা তেমনি। কাজেই ও যখন পড়াতে এল তখন আমি জানতাম যে এই লোকটাই একদিন আমার যথাসর্বস্ব।
বলেই চুপ করে গেল অপর্ণা।
ললিত হাসি চেপে বলল, বলুন।
অপর্ণা একটু ঘোর লাগা চোখে চেয়ে থেকে বলল, তাই ওর সব কথা আমি মনের মধ্যে গেঁথে নিতাম। কিচ্ছু ভুলতাম না। দেখুন না, আপনার নাম আমি আজও মনে রেখেছি।
ঠিক। ললিত ঘাড় নাড়ল।
অপর্ণা মৃদু হাসি হেসে বলল, আপনাকে দেখে ও একেবারে কমিউনিস্ট হয়ে গিয়েছিল। আমার কাছে আবার বাবার নিন্দে করত। বলত, আমাদের রক্তের মধ্যে বিষ থেকে যাবে এই মালিক স্বার্থের। তাই একদিন নাকি আমাদের মেরে ফেলা হবে!
শুনে আপনি রাগ করতেন না?
অপর্ণা মাথা নাড়ল, না। বরং ভয় হত খুব। ভাবতাম ও যা বলছে ঠিকই বলছে। আমার ইচ্ছে হত বাড়ি ছেড়ে, মা-বাবা ছেড়ে ওর কাছে চলে যাই। ও যেন আমাকে বাঁচায়। কিন্তু ওর এই মনোভাব বেশিদিন রইল না।
টালিগঞ্জ রেলব্রিজ পার হয়ে ট্যাক্সিওয়ালা মুখ ফেরাল, কোন দিকে যাবেন?
ললিত বলল, আর-একটু ভাই, তারপর আনোয়ার শা রোড—
অপর্ণার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, তারপর?
অপর্ণা বলল, ও তখন আর-একজন বন্ধুর প্রভাবে পড়েছে। সেই বন্ধুটি ছিল জমিদার, পূর্ববাংলা কোথাকার যেন, পার্টিশানের পর সব ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছে, তার নামটা কী যেন—
ললিত সাগ্রহে বলল, রমেন? রমেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী?
ঠিক। অপর্ণা উজ্জ্বল মুখে বলল, রমেন। সেই বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর একদিন আমাকে এসে বলল, দেখো, আমার এই বন্ধুটি বড় অদ্ভুত। কলকাতায় ওর যেসব প্রজা-ট্রজা আছে তারা এখনও ওকে খুব সম্মান করে, ওর বাসায় যায়, ওর খোঁজখবর নেয় ঠিক যেন আত্মীয়ের মতো। রাস্তায়-ঘাটে দেখা হলে প্রণাম বা নমস্কার করে, ট্রামে-বাসে সিট ছেড়ে দেয়। অথচ ওরা পুরুষানুক্রমে প্রজাদের শোষণ করে আসছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাতে কী হল? ও উত্তরে বলত, হয় ওর প্রজাগুলো দীর্ঘকাল ওদের সম্মান করতে করতে নিজেদের একেবারে দাস বানিয়ে ফেলেছে, নয়তো ওরা সত্যিই ওকে ভালবাসে। তারপর এসে বলল, না, ওর প্রজারা ওর সঙ্গে আন্তরিক ব্যবহার করে। এটা ঠিক ম্যানার্স নয়। মোটর অ্যাকসিডেন্ট করে ও বুকের একটা হাড় ভেঙেছে, সেই শুনে ওর এক প্রজা মা কালীর কাছে কালো পাঁটা মানত করেছে। কোন স্বার্থে সেটা সে করবে? এখন তো আর ওর জমিদারি নেই যে সেই প্রজার একটু সুবিধে করে দেবে! ওরা সত্যিই ভালবাসে ওকে। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না কী করে দুটো শ্রেণী তাদের স্বার্থ ভুলে, এবং সমাজ-বিপ্লব ছাড়াই একে অন্যকে ভালবাসছে।
ললিত সামান্য গম্ভীরমুখে বলল, ওটা হয়তো একটা একসেপশন। হয়তো রমেনরা বেশি চালাক ছিল, প্রজাদের প্রিয় হয়ে তাদের আরও বেশি এক্সপ্লয়েট করার চেষ্টা করেছিল।
অপর্ণা মাথা নেড়ে বলল, সে যাই হোক। ও কিন্তু আপনার প্রভাব কাটিয়ে উঠল। আমাকে বোঝাত, ব্যক্তিগত মালিকানা জিনিসটা খারাপ নয়। যদি এ-রকমভাবে দুটো শ্রেণী একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে থাকে, যদি তারা পরস্পর পরস্পরের স্বার্থ হয়ে দাঁড়ায়, আর যদি ভালবাসে, ভালবাসা পায়, তা হলে জমিদার আর তার প্রজা চমৎকার কমিউন গড়ে তুলতে পারে। আমি তখন ওর কাছ থেকেই থা বলতে শিখেছি। বললাম, আর রাষ্ট্রের মালিকানার কী হবে! ও ঠোট উলটে বলল, দুর, রাষ্ট্র তো এটা যন্ত্র। যন্ত্র কি কখনও ভালবাসতে পারে! মানুষ ভাতকাপড়ের চেয়েও মানুষের ভালবাসা বেশি চায়। রমেন আর তার প্রজাদের মধ্যে সম্পর্ক দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি। এখনও ওর প্রজাদের কেউ কেউ ছোট কর্তাকে না বলে মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করে না। জমি কিনবার সময়ে, চাষবাসের ব্যাপারে, রোগ-বালাইতে আগে আসে রমেনের কাছে তারপর উকিল ডাক্তার বা সরকারি লোকের কাছে যায়। রাষ্ট্র কি এতটা ভালবাসতে পারে! জমিদারের জায়গায় একদিন আসবে কমিউন বা ব্লকের অফিসার, কারখানায় আসবে সরকারি ডিরেক্টর, তাতে কি শ্রমিক বা প্রজারা খুশি হবে! তখনও তাদের একজন লোক চাই শোকে দুঃখে বিপদ বালাইয়ে কিংবা কেবল মন খারাপ হলেই যার কাছে ছুটে যাওয়া যায়, যাকে দেখলে বা যার কথা শুনলে বুক জুড়িয়ে যায় এমন কেউ একজন ভালবাসার লোক। রমেনরাও কি প্রজাদের কাছে তাই ছিল!
শুনে ললিত খুশি হল না, আস্তে করে বলল, কিন্তু অর্থনৈতিক শ্রেণীবৈষম্য থেকে গেলে শেষ পর্যন্ত এ ভালবাসা কি টেকে? কে গ্যারান্টি দিতে পারে যে রমেনের ছেলে রমেনের মতো হবে! তা ছাড়া মালিক-শ্রমিক সম্পর্কটাই তো ভয়াবহ, একে অন্যকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না।
অপর্ণা একটু গম্ভীর হয়ে বলল, সেই জন্যই আমি এমন একটা স্বার্থ খুঁজছিলাম যাতে আমি আর আমার কর্মচারীরা সেই রমেনের মতো একে অন্যের প্রয়োজন হয়ে উঠি। আমি জোর করে মালিক হব না, কিন্তু ওরা আমাকে ওদের প্রয়োজনে ভালবেসে মালিক করে রাখবে, আমি ওদের সে-রকম স্বার্থ হয়ে উঠতে পারি কি না, এ-রকম একটা খ্যাপাটে ইচ্ছে আমার মাঝে মাঝে হয়!
ললিত হাসতে থাকে। বুক থেকে বমির ভাবটা সরে যাচ্ছে এখন। সে বলে, আপনার খুব মালিক হবার ইচ্ছে!
অপর্ণা ম্লান হাসে, না। আমার কেবল ওইটা পরীক্ষা করার ইচ্ছে যে, দুটো শ্ৰেণীকে তুলে না দিয়ে একে অন্যের স্বার্থ হওয়া যায় কি না! আসলে আমার এখন ওই রমেনের মতো একজন হতে ইচ্ছে করে।
অম্বলে ললিতের বুক জ্বলে যায়। সিগারেটে ডুবে থাকে সে। ট্যাক্সিটা ধীরে ধীরে আনোয়ার শা রোডে ঘুরে ঢুকে যাচ্ছে।
ললিত ধীরে ধীরে বলল, ওটা বোধ হয় আপনার দুর্বলতা। আপনি চাইছেন মালিকানা চলে গেলেও যেন আর-এক ধরনের মালিকানা এসে যায় হাতে। একটা শেষ সম্বল রেখে দিতে চান, তাই না?
অপর্ণা একটু উদ্ভ্রান্তের মতো চেয়ে থেকে বলে, রমেনও কি তাই চেয়েছিল?
ললিত ঘাড় নাড়ে, বোধ হয় রমেনের ব্যাপারটাও তাই। ওর মধ্যে বংশানুক্রমিক একটা জমিদারির ভাব থেকে গেছে। ওটা হেরিডিটারি, এড়ানো যায় না। জমিদারি কিংবা মালিকানা চলে গেলে মানুষ তখন নেতা হবার চেষ্টা করে। ভারতবর্ষের অনেক নেতাই এসেছেন অভিজাত সমাজ থেকে। মানুষ তাদের ত্যাগের মহিমা কীর্তন করেছে, কিন্তু কখনও ভেবে দেখেনি তারা সেই বংশানুক্রমিক আভিজাত্যের কাছেই নতুন রকমে মাথা বিকিয়ে দিল।
অপর্ণা অবাক হয়ে বলে, তা কেন? যে ভাল তাকে ভালবাসতে দোষ কী?
ললিত অধৈর্যের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে, তা হবে না। এমন সমাজ হয়তো তৈরি হবে যখন মানুষ মালিক বা জমিদারের এই ভালবাসাকে ঠিক বিশ্বাস করবে না। তাদের কাছ থেকে একটুও সম্মান পাবেন না আপনি। তখন যে-কেউ সিগারেট খাবে আপনার সামনে, ইচ্ছে হলে সেই ছোকরা আপনার কাছে—
বলেই থেমে গেল ললিত। সে বলতে যাচ্ছিল ‘আপনার কাছে প্রেম নিবেদন করবে। নির্ভয়ে।’ কিন্তু সে-কথাটা বড় নিষ্ঠুর। বলার নয়।
অপর্ণার মুখ এখন নানা রঙে রঙিন। মুখের রেখা কেমন পালটে যাচ্ছে। হঠাৎ সে রুদ্ধশ্বাসে বলল, আমি সব ছেড়ে দিতেই তো চাই। আমার এ-সব একটুও ভাল লাগে না। এই কারখানা, স্ট্রাইক, কর্মচারীদের সঙ্গে শত্রতা, এ-সব মনে হলেই আমার বুক কাঁপে। ইচ্ছে করে চলে যাই কোথাও।
ললিত শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবেন?
অপর্ণা আস্তে করে বলে, সেই ছেলেবেলায় যেমন ওর কথায় ভয় পেয়ে ইচ্ছে হত এর সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে চলে যাই, ঠিক তেমনিই একটা ইচ্ছে হয় আমার। ও আমাকে এই সব গোলমাল থেকে টেনে নিয়ে যাক। কিন্তু ও কেন পাগল হয়ে যাচ্ছে—ও কেন—বলতে বলতে ঠোঁট কেঁপে গেল অপর্ণার।
ব্যথিত মনে ললিত চুপ করে থাকে। সে নিজে যে কথাগুলো বলেছে সেগুলো অত্যন্ত নিষ্ঠুর। না বললেও হত।
কিন্তু এ-কথাটা সে কিছুতেই মনে মনে সহ্য করতে পারছিল না যে এই মেয়েটার রমেনের মতো হতে ইচ্ছে করে। কেন, রমেনের মতো কেন? এ-মেয়েটা তো রমেনাকে চেনেও না।
হঠাৎ খুব হীনের মতো একটা কাজ করল ললিত, যার জন্য পরে সে অনুতাপ করেছিল। সে হঠাৎ অপর্ণাকে বলল, রমেন তার প্রজাদের কাছে হয়তো দেবতা ছিল। কিন্তু নিজের স্ত্রীর কাছে? আপনি কি জানেন যে ওর বউ পালিয়েছিল বলে ও হঠাৎ সন্ন্যাসী হয়ে গেছে?
ভীষণ অবাক হল অপর্ণা। বলল, নিশ্চয়ই বাজে মেয়ে! নইলে ও-রকম লোকের কাছ থেকে পালায়!
ট্যাক্সিটা এসে দাঁড়াল সেই বট গাছটার তলায় যার চার দিকে বাঁধানো বেদি, যেখানে বিমান কাল ছেলেদের পাল্লায় পড়েছিল। ট্যাক্সি এই পর্যন্ত আসে, এরপর হেঁটে যেতে হয়। ললিত ভাড়া দেওয়ার জন্য পকেটে হাত দিয়েছিল, অপর্ণা ভীষণ রাঙা হয়ে বলল, না, না, ট্যাক্সিটা আমিই ডেকেছিলাম… খুব লজ্জা আর সংকোচের সঙ্গে বাধা দিয়ে অপরাধীর মতো নিজেই ভাড়াটা দিয়ে দিল।
করুণা! ললিত মনে মনে হাসল।
বিমান শুয়ে ছিল। ললিতকে দেখে উঠে বসবার চেষ্টা করে বলল, চিঠিটা দিয়েছ?
ললিত দরজায় দাঁড়িয়ে, পিছনে অপর্ণা। হেসে বলল, দিয়েছি। আর উত্তরটাও নিয়ে এসেছি।
কই? বলে হাত বাড়াল বিমান।
ললিত সরে গেল, তারপর জোরে হেসে উঠল।
কিন্তু ললিত বুঝতে পারল হাসিটা ওদের স্পর্শও করেনি। ধীর পায়ে অপর্ণা ঘরে এসে দাঁড়াতেই বিমানের সঙ্গে অপর্ণার চোখ পরস্পর গেঁথে গেল। নিস্পন্দ হয়ে রইল দু’জনে। কিন্তু সেই নিথরতার মধ্যেও তাদের মুখে যেন কয়েকটা রূঢ় কর্কশ রেখা কোমলতায় বেঁকে গেল। ইঙ্গিতময় ভাববাহী হয়ে গেল ঘরের বাতাস। ললিত বুঝল ওরা কথা না-বলে, চেষ্টাহীনভাবে পরস্পরকে গভীর ভালবাসা জানাতে পারে।
কষ্ট হল ললিতের। বিমানটা পাগল। আর এ একজন কারখানা-মালিকের মেয়ে। কিন্তু মনে হয়, ওরা দু’জনেই ভিখিরি—অকিঞ্চন—ওদের দু’জনের ওরা দু’জন ছাড়া আর কিছু নেই। দুটোই পাগল।
তার ইচ্ছে হল অপর্ণাকে ডেকে বলে, যদি কোনও দিন ভবিষ্যতের সমাজ মালিক পক্ষকে অবলুপ্ত করতে চায়, সেদিন আপনাকে ক্ষমা করা হবে, কেননা আপনি এই পাগলকে ভালবেসেছিলেন।
ললিত দু’জনকে ওই অবস্থায় রেখে বেরিয়ে এল। বাইরে থেকে দরজাটা টেনে ভেজিয়ে দিল সাবধানে।
তেইস
সেদিনের পর শাশ্বতী বেশ কয়েক দিন কলেজে গেল না। সে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘরের কাজ করল, কোমরে আঁচল বেঁধে বাবার জমি কোপাল, বাচুর সঙ্গে ইচ্ছে করে করল ঝগড়া। প্রতি মুহুর্তেই তার ভয় হচ্ছিল, যে-কোনও দিন আদিত্য এসে হাজির হবে।
কিন্তু আদিত্য এল না। তিন দিন পর একদিন সন্ধেবেলা কালীনাথ অফিস থেকে ফিরে তাকে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁরে, আদিত্যর সঙ্গে তোর দেখা হয়?
না।
কী হল, ক’দিন আফিসে আসছে না!
খবরটা শুনে বুকটা একটু ধক করল শাশ্বতীর। কী জানি, যদি সুইসাইড বা এ-রকম কোনও পাগলামি করে থাকে আদিত্য! ও কি অতখানি ভালবেসেছিল শাশ্বতীকে! কে জানে! যদি ও-রকম কিছু করে থাকে তবে চেনা লোকেরা এখন শাশ্বতীকে দেখিয়ে বলবে, এই বাজে মেয়েটাই যত নষ্টের গোড়। শাশ্বতী তাই সারাক্ষণ মনে মনে বলে, আমি খুব সাধারণ বোকা মেয়ে একটি। আমার জন্য কেউ যেন আত্মহত্যা না করে, কেউ যেন বিবাগী না হয়—হে ভগবান!
কলেজে যাচ্ছে না বলে কেউ কোনও প্রশ্ন করে না। তাদের বাড়ি থেকে শাসন উঠে গেছে, কমে গেছে কৌতুহল। এখন যে যা খুশি করে, অন্যেরা দেখে নিস্পৃহভাবে। কেবল মাঝে মাঝে হৈমন্তী তাকে খোঁচায়, কী রে, ঝগড়া-টগড়া করেছিস নাকি!
না।
হৈমন্তী জিজ্ঞেস করে, তাদের তো দেখা হচ্ছে না কয়েক দিন।
শাশ্বতী উত্তর দেয় না।
হৈমন্তী কখনও কখনও আরও কৌতূহল দেখায়। বলে, তোরা যে রেজিস্ট্রি করবি বলেছিলি, তার কী হল?
শাশ্বতী মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্যমনস্কতার ভান করে।
একদিন বিকেলে কলেজ ফেরত সবুজ হেরাল্ড গাড়িখানা নিয়ে রাকা এসে হাজির। সঙ্গে তার দাদা সুমন্ত ছিল না, বাড়ির ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে এনেছে।
গাড়িওয়ালা লোক এ-বাড়িতে কখনও আসেনি। তাই একটু চাপা উত্তেজনা দেখা দিল বাড়িতে। বাচ্চু গায়ে জামা দিয়ে মিষ্টি আনতে গেল দোকান থেকে।
অবশ্য খাবারের প্লেট রাকা ছুঁলও না। তার মুখখানা খুব গম্ভীর, বিষণ্ণ। সাধারণত হাসি-খুশি থাকে বলে বিষণ্ণ রাকাকে বড় অচেনা লাগছিল। এবং সেজন্য মনে মনে ভয়-পাওয়া হরিণের মতো চঞ্চল, অস্থির বোধ করছিল শাশ্বতী।
যাওয়ার সময় বাগানের আগলটার কাছে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাকা বলল, তুই যে এনগেজ্ড তা তো কই আমাকে বলিসনি! কলেজের অনেকেই জানে দেখলাম, কেবল আমি ছাড়া। শুনলাম ভদ্রলোকের নাম আদিত্য রায়, কলেজে এসে প্রায়ই দেখা করেন তোর সঙ্গে!
শাশ্বতী আঙুলে আঁচল জড়ায়, মুখ নিচু করে থাকে। উত্তর দেয় না।
রাকা দুঃখিত গলায় বলে, দাদা শুনে খুব দুঃখ পেয়েছে। বলছিল, তুই নাকি ওকে কিছু ঠিক করে বলিসনি! রাকা উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে অনেকক্ষণ, তারপর মৃদুস্বরে বলে, কয়েক বছর আগে ওকে আর-একজন মেয়ে রিফিউজ করেছিল— তারপর খুব ড্রিঙ্ক করত দাদা, ষাট-সওর মাইল স্পিডে গাড়ি চালাত। একদিন সইতে না-পেরে ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল। স্বাস্থ্য ভাল বলে বেঁচে যায়। কিন্তু এবার ও খুব সিওর ছিল। প্রথমেই জেনে নিয়েছিল, তুই এনগেজ্ড কি না। এখন নতুন ধাক্কা খেয়ে ওর আবার কী হবে কে জানে! কয়েক দিন খুব অন্যমনস্ক দেখছি ওকে—
শাশ্বতী উত্তর দেয় না। কিন্তু তার ঠোঁট কাঁপে। বড় মায়া হতে থাকে তার সেইসব পুরুষের জন্য যাদের সে ভালবাসেনি। কেন ওরা তাকে অবহেলা করেনি! তোমরা কেমন পুরুষ! পৃথিবীতে কত কাজ আছে পুরুষের, কত রহস্যমোচন, কত আবিষ্কার, কত আদর্শ-প্রচার— তবু কেন একটি মেয়ের। জন্য— সামান্য, কালো, সাধারণ একটি মেয়ের জন্য সব দিয়ে দাও! এবং উদাসীন থেকো তোমরা, উদাসীন থেকো, মন বুঝতে সময় দিয়ো।
পাঁচ-ছ’ দিন কেটে গেলে একদিন শিবানী এসে বলল, আজও কলেজে যাবি না! এস-বির ক্লাসে আজ পলিটিক্সের নোট দেবে।
একটু ইতস্তত করল শাশ্বতী। বাইরে যেতে এখন বড় ভয় করে তার। মনে হয়, অনেক রাগী, প্রতিশোধকামী পুরুষ তার অপেক্ষায় চারদিকে ওঁত পেতে আছে।
একটু চিন্তা করে শাশ্বতী বলল, চল যাই।
তারপর অনিচ্ছায় সে তৈরি হয়ে নিল।
বাসে বসে শিবানী জিজ্ঞেস করল, তুই তো রোজ কলেজ থেকে কাটিস, খুব সিনেমা-রেস্টুরেন্টে যাস, না?
শাশ্বতী উত্তর দেয় না।
খুব উড়ছিস! শিবানী দুঃখ করল। নিশ্বাস ফেলে বলল, আর দ্যাখ, অলক যে সেই চাকরি করতে গৌহাটি গেল, একটা চিঠি পর্যন্ত দিল না। পুরুষমানুষদের বিশ্বাস নেই।
শাশ্বতী চুপ করে রইল।
কলেজের স্টপেজ এসে গেল। নামবার জন্য বাসের পা-দানিতে নেমে একটু মুখ বাড়াতেই শাশ্বতী দেখতে পেল, কলেজের সামনে বড় রাস্তায় কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলায় লম্বা রোগামতো একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে সেদিন ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে আদিত্য অপেক্ষা করছিল।
ওই লম্বা লোকটা কি আদিতা? দূর থেকে ঠিক বোঝা যায় না। আদিত্য হওয়া অসম্ভব নয়। তার হাত-পা অবশ হয়ে গেল, বুক কাঁপল ভীষণ।
শাশ্বতী পিছিয়ে আসে। বলে, আমি নামব না।
সে কী!
না। শাশ্বতী মাথা নাড়ে, আমি একটু অন্য জায়গায় যাব। কাজ আছে। কোথায়?
কোথায় তা শাশ্বতী তাড়াতাড়িতে ঠিক করতে পারল না। বলল, আছে।… তুই পলিটিক্সের নোটটা আমাকে দিস, আমি টুকে নেব।
আবার বাসের মধ্যে ফিরে এসে বসল শাশ্বতী। পয়সা বের করে কন্ডক্টরকে বলল, আমি রাসবিহারীর মোড়ে নামব।
মনে মনে ঠিক করল শাশ্বতী যে, রাসবিহারীর মোড় থেকে ফিরতি বাস ধরে বাড়িতে ফিরে যাবে। কিন্তু রাসবিহারীর মোড়ে এসে তার খেয়াল হল, এখান থেকে দক্ষিণমুখো কিছুটা গেলেই ললিতের বাসা। ঠিকানা জানে না শাশ্বতী, কিন্তু বাসাটা তার মনে আছে। সেদিন থেকেই ললিতের ওপর একটা রাগ তার রয়ে গেছে। সেই রাগটা থাকতে থাকতেই বোঝাপড়াটা মিটিয়ে আসবে নাকি শাশ্বতী! বেশি দেরি করার দরকার কী? বেশি দেরি করলে শাশ্বতীর রাগ থাকে না, সাহস কমে যায়।
কী করছে তার বিচার করল না সে। দক্ষিণ দিকে উনত্রিশ নম্বর ট্রাম ফাঁকা যাচ্ছে। শাশ্বতী উঠে পড়ল।
ললিতের জন্য বড় ভয় করে ললিতের মায়ের। দিন দিন কেমন ঘরছাড়া বিবাগীর মতো হয়ে যাচ্ছে ওর ভাবখানা। এক দিকে তাকিয়ে থাকে তো তাকিয়েই থাকে, বেলা বয়ে যায়।
সেই কবে একটা মাস্টারির চাকরি জুটিয়েছিল ললিত, এখনও তাতেই রয়ে গেল। উন্নতির কোনও চেষ্টা নেই। শুয়ে বসে সময় কাটায়, চায়ের দোকানে গিয়ে আদ্দেক দিন কাটিয়ে আসে। এই বয়স—এখন উদ্যোগী হয়ে, ছোটাছুটি করে কত কিছু করে ফেলে মানুষ! তা করবে না। কিছু বললেই বলে, আমরা তো দু’জন, ঠিক চলে যাবে দেখো। বাপের স্বভাব। ওর বাপ সারাটা জীবন খেলা-খেলা করে পাগল ছিল, বাড়ির মানুষকে চিনতেই পারত না। সে-লোকটা সারাটা জীবন কেবল আপ্তবাক্য বলে গেল।— পয়সাকড়ি দিয়ে কী হয়! ছুঁচের ফুটো দিয়ে বরং হাতি গলে যায়, তবু কোনও বড়লোক স্বর্গে যায় না। বাপ ছেলে দু’জনেরই ধারণা যে বড়লোক হওয়াটার মধ্যে কিছু নেই। তার চেয়ে এই ভাল, যেভাবে চলছে চলুক। ললিতের বন্ধুরা কিন্তু ওর মতো বোকা নয়। তারা সময় থাকতে যে যারটা গুছিয়ে নিচ্ছে। কেমন গাড়ি করে ফেলল সঞ্জয়, বিয়ে করল তুলসী! ললিতটাই মুখচোরা। কোথাও গিয়ে নিজের জন্য দাঁড়াতে পারে না, কেড়ে-কুড়ে আনতে পারে না নিজের ভাগেরটা। অথচ খুব অহংকারী। দেশের বাড়িতে যখন হরির লুঠ পড়ত, তখন ললিত দাঁড়িয়ে থাকত দূরে। ওর চোখের সামনে অন্য সব ছেলেমেয়ে মাটিতে পড়ে কাড়াকাড়ি করে বাতাসা কুড়োত। ও পারত না। কিন্তু দূরে দাঁড়িয়ে এমন ভাবখানা করত যেন ও-সব ছোটলোকির মধ্যে নেই।
কেন ওর লোভ-টোভ এত কম! টাকাকড়ির দিকে ঝোঁক নেই কেন? রাস্তায়, গলিতে কত বয়সের মেয়ে হেঁটে যায়, ললিত চোখ তুলে তাকায় না। কিন্তু এ-বয়সে ও-রকম হওয়া কি ভাল! তরতাজা বয়স, এ-বয়সে বয়সের গুণ থাকবে না!
এইসব সারা দিন ভাবে ললিতের মা। বড় ভয় করে তার। আপনমনে বিড়বিড় করে।
শোওয়ার ঘরে হলুদের গুঁড়ো খুঁজতে এসেছিল মা। এমন সময়ে খুট খুট করে খুব ভয়ে ভয়ে কে যেন কড়া নাড়ল।
দরজা খুলতেই দেখা গেল ভিতু জড়সড় এক মেয়ে। হাতে বইখাতা, পরনে চমৎকার একখানা জয়পুরি ছাপা শাড়ি। শ্যামলা রং, সুন্দর মুখখানা। প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ললিত…ললিতবাবু এইখানে থাকেন?
আহা, ললিতের সঙ্গে বড় মানায়। ভাবে ললিতের মা।
তুমি কোত্থেকে আসছ?
মেয়েটি লাজুক মুখে বলল, যাদবপুর। ললিতবাবু নেই?
এই বেরোল। তুমি ঘরে এসে একটু বোসো। ডেকে পাঠাচ্ছি। বেশি দূরে যায়নি।
চপ্পল জোড়া বাইরে ছেড়ে ঘরে এল শাশ্বতী। ললিতের মায়ের ছোট্ট চৌকিটার একধারে এতটুকু হয়ে বসল। বাস-স্টপ থেকে অনেকটা হেঁটে আসতে হয়েছে রোদে, শাশ্বতী ছোট্ট দলা পাকানো রুমালে কপালের ঘাম মুছছিল।
ললিতের মা আদরের গলায় জিজ্ঞেস করল, গরম লাগছে?
লজ্জায় মাথা নাড়ল শাশ্বতী, না।
ললিতের মা একটু হেসে পাখাটা খুলে দেয়।
ললিতের মা দেখল, এখন যেখানে মেয়েটি বসে আছে ঠিক সেইখানে অনেক দিন আগে একদিন দুপুরে মিতু বসেছিল। ললিতের বড় পছন্দ ছিল তাকে। কিন্তু ওইখানে বসে মিতু কেঁদেকেটে অস্বীকার করে গেল। ললিতকে বিয়ে করতে রাজি হল না। এই ঢৌকিটা যেখানে মেয়েটি এখন বসে আছে, ওটা অলক্ষুণে চৌকি।
ললিতের মা বলল, তুমি এখানটায় ললিতের চৌকিতে এসে বোসো। এখানে বেশি হাওয়া লাগবে।
শাশ্বতী বাধ্য মেয়ের মতো উঠে ললিতের চৌকিতে গিয়ে বসল।
ললিতের মা মনে মনে বলল, ঠাকুর, ঠাকুর, দেখো এ যেন সেই হয় যাকে ললিত বিয়ে করবে। আহা, বড় লক্ষ্মীমন্ত মুখখানি। ললিতটা বড় মুখচোরা। কই, এত দিন বলেনি তো এমন একটা মেয়ের সঙ্গে তার ভাবসাব, চেনা-জানা হয়েছে? বোকা ছেলে, তুই কাউকে পছন্দ করলে আমি কি রাগ করব? তোর পছন্দ জেনেই তো মিতুকে আমি ডেকে এনেছিলাম। মিতু রাজি হল না, আমাকে কত অপমান করে গেল! কিন্তু তাতে আমি দুঃখ পাইনি। তোর বুকের ভিতরটা যে পুড়ে গিয়েছিল, তার চেয়ে কি ওইটুকু অপমান বেশি? আহা, ললিত এবার বেশ পছন্দ করেছিল। মিতু সুন্দর ছিল কিন্তু এর মতো লক্ষ্মীমন্ত ছিল না। বেশ রে ললিত, বেশ!
একটু চা খাও মা, সঙ্গে আর কী খাবে—দুটো চিঁড়ে ভেজে দিই!
না, না। লজ্জায় মাথা নাড়ে শাশ্বতী। কানের মাকড়ি ঝিকিয়ে ওঠে, কপালের ওপর এক থোকা চুল দোল খায়।
ছেলেমানুষ! কচি। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে ললিতের মা।
শাশ্বতী এই ছোট্ট ঘরখানা দেখছিল। নির্জন সুন্দর ঘরখানা, বাইরের কোনও শব্দ আসে না। জানালার ওপর ঝুঁকে আছে সবুজ, সতেজ একটা পেয়ারার ডাল। পাখি ডাকছে। ভিতরে ছোট্ট একটু উঠোন, এক পাশে তুলসীমঞ্চ। ঘরে আসবাবপত্র বেশি নেই। যা আছে তাতে বোঝা যায় এদের অবস্থা অনেকটা শাশ্বতীদের মতোই। তাই এই ঘরে বসতে খুব একটা অস্বস্তি হয় না। সমান অবস্থার মানুষের সঙ্গে মিশতেই স্বস্তি বোধ করে সে। এ-কথা ঠিক, শাশ্বতী কোনও দিন খুব বড়লোকের ঘরে বউ হয়ে যেতে চায়নি। বিশাল ঘরদোর, অনেক অদেখা আসবাব, বেশি চাকর-বাকর, এ-সব কোনও দিন ভাবতে ভাল লাগে না তার। মন খারাপ হয়ে যায়। কোনও দিন বড়লোকের ঘরে গেলে শাশ্বতী হাঁফিয়ে উঠবে। সেখানে অনেক চকচকে জিনিসপত্রে চোখ ধাঁধিয়ে যায়, মানুষগুলোকে পুতুলের মতো লাগে। যে-ঘরে আসবাবপত্র কম সেইখানে মানুষগুলোর ওপর বেশি করে চোখ পড়ে, সহজ লাগে।
ওপর দিকে চেয়ে শাশ্বতী দেখল বুড়োর মাথার মতো নড়বড়ে ফ্যানটা দুলছে। ওটার নভা দেখে একটু হাসল শাশ্বতী। ভুলে গেল যে সে ঝগড়া করতে এসেছে।
একটা বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে গণেশের দোকানের দরজায় মুখ বাড়িয়ে বলল, ললিতদা, মাসিমা ডাকছে, একজন বসে আছে আপনার জন্য।
ললিত উঠল, বোধ হয় তুলসী-ফুলসী কেউ এসেছে।
ঘরের দরজায় পা দিয়েই শাশ্বতীকে দেখতে পেল ললিত। লাফিয়ে মোচড় দিয়ে উঠল বুক ধড়াস শব্দ হল শরীরের মধ্যে। হঠাৎ যেন বন্ধ হয়ে গেল বাতাস। পায়ের নীচে দুরদুর করে কেঁপে উঠল মাটি।
আপনি!
শাশ্বতী উঠে দাঁড়িয়েছিল। ললিতের ধারালো উজ্জ্বল মুখখানা একপলক দেখেই চোখ নামিয়ে নিল শাশ্বতী। কোনও রকমে বলল, আমি… আমি একটু এলাম।
তারপরেই সে অবাক হয়ে টের পেল তার আর কোনও কথা বলার নেই। কথা শেষ।
আস্তে আস্তে নিজেকে সামলে নিল ললিত। ঘরে এসে সন্তর্পণে মায়ের চৌকিটাতে বসল।
শাশ্বতীর খুব ঝগড়া করার কথা। সে বলতে এসেছিল, কেন আপনি ওই কাণ্ড করতে গেলেন? তাতে আপনার কী স্বার্থ ছিল?
কিন্তু সে-কথা না বলে সম্পূর্ণ অন্য কথা বলল শাশ্বতী। বলল, সেদিন আমি ওখান থেকে চলে গিয়েছিলাম। আপনি তাতে রাগ করেননি তো!
উত্তরে ললিতের বলার কথা, কেন আপনি ও-রকম করলেন? ছিঃ ছিঃ, আদিত্য খেপে গিয়ে সঞ্জয়ের পেটে লাথি মেরেছে, আমাকে চড় মেরেছে। কেন আপনি আমাদের ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের সামনে বে-ইজ্জত করলেন?
কিন্তু সে-কথা বলল না ললিত। বরং অপরাধীর মতো মুখ নামিয়ে বলল, না, আপনি ঠিকই করেছিলেন।…
শাশ্বতী হাসল। তার সাদা ছোট ছোট দাঁতে সকালের সতেজ রোদ আর পেয়ারা পাতার সবুজ রঙের একটা আভা ঝিকমিক করে গেল।
চায়ের কাপ আর চিঁড়ে ভাজার প্লেট হাতে মা ঘরে ঢুকল। মায়ের মুখে চোরা হাসি। বলল, ললিত, তুই একটু চা খাবি? করে দেব?
ললিত বলল, দাও।
মা শাশ্বতীকে চা-টা দেয়। বলে, একটু খাও। এবাড়িতে প্রথম এলে। খাও।
চা রেখেই ললিতের মা তাড়াতাড়ি চলে যায়। মনে মনে বলে, ঠাকুর, ঠাকুর…
মুখ নিচু করে বসে ছিল শাশ্বতী। হঠাৎ মুখখানা তুলে বলল, দেখবেন, আপনার অসুখ সেরে যাবে। আমার মেসোমশাইয়ের একদম সেরে গেছে…
যাবে! সেরে যাবে! হঠাৎ যেন বুকের মধ্যে জল ছলছলিয়ে ওঠে ললিতের। আহা, যদি সত্যিই সেরে যায়!
শাশ্বতীর ছেলেমানুষের মতো সতেজ মুখখানা আত্মবিশ্বাসে কঠিন হয়ে যায়। সে বলে, দেখবেন…
ও-রকমভাবে যদি কেউ চায়, ও-রকমভাবে যদি কেউ বলে তা হলে কীভাবে মরবে ললিত? কীভাবে?
ঠোঁট কেঁপে ওঠে ললিতের। চোখে জল এসে যায়। দুর্বলতা! কই, এতকাল তো এ রকম দুর্বল লাগেনি নিজেকে?
নিজেকে সামলে নেয় ললিত। একটু চোরা-হাসি হেসে বলে, শুনলাম আপনার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে!
শাশ্বতী ভ্রূ তোলে, আমার! সে কী?
শুনেছি। ললিত শ্বাস ছাড়ে। মৃদুস্বরে বলে, খুব আনন্দের খবর।
শাশ্বতী বুঝতে না পেরে বলে, কার কাছে শুনলেন? কার সঙ্গে ঠিক হল আমার বিয়ে?
ললিত একটু সন্দেহের গলায় বলে, আদিত্য বলছিল, আপনার কে এক বন্ধু, রাকা না কী যেন নাম, তার দাদার সঙ্গে।
শাশ্বতী থমকে যায়। সুমন্তর কথা তার মনেই ছিল না। কিন্তু সে-কথা কী করে আদিত্য জেনেছিল! সে-কথা কেন এল ললিতের কানে!
বড় লজ্জা করল শাশ্বতীর। সুমন্তর সঙ্গে সে একা গিয়েছিল গঙ্গার ঘাটের রেস্তরাঁয়, কথা বলেছিল অনেক। প্রশ্রয় দিয়েছিল। কিন্তু এ-কথা সে কাকে বোঝাবে যে দু’ দিন আগেও সে ছিল বড় ছেলেমানুষ! সে কি ছাই বুঝতে পেরেছিল তার মন? এখন মনে মনে শাশ্বতী ক্ষমা চাইল, তোমাদের কাউকে যদি দুঃখ দিয়ে থাকি, তবে ক্ষমা কোরো। আমি বড় বোকা মেয়ে। আমাকে ক্ষমা কোরো।
মুখ নিচু করে শাশ্বতী বলল, ওটা ভুল খবর। ওই ভদ্রলোক চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি চাইনি।
কে জানে কেন, কথাটা শুনে হঠাৎ বুক হালকা লাগে ললিতের। এক দুর্বোধ্য আবেগে বুক ভেসে যেতে থাকে। সে অপলক চোখে তার সামনে জীবন্ত, তরতাজা এক দৃশ্য দেখে। ঘন চুলের ভিতর থেকে ঝিকমিক করছে কানের রিং, পরনে কালো-হলুদে মেশানো সুন্দর একখানা জয়পুরি শাড়ি, নিকোনো উঠোনের মতো পরিষ্কার ব্রণহীন মুখখানা। এখন যদি ললিত ওকে ভালবাসার কথা বলে! তবে কি ও লাজুক মুখ নামিয়ে সম্মতির হাসি হাসবে?
আত্মবিস্মৃত ললিত মুহূর্তকাল পরে নিজের সংবিতে ফিরে এল। শোষ-কাগজের মতো এক বিষাদ হঠাৎ শুষে নিল তার হৃদয়। সে চোখ ফিরিয়ে নিল।
শাশ্বতী মৃদুস্বরে বলল, শুনুন, আমার একটু কথা আছে।
কী
শাশ্বতী ইতস্তত করে বলে, আপনার বন্ধুকে আমি অনেক দুঃখ দিয়েছি। ওকে একটু বুঝিয়ে বলবেন, আমি কোনও দিন ওকে ভালবাসিনি।
ও জানত। অন্য দিকে চোখ রেখে ললিত বলে।
শাশ্বতী একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমি খুব অন্যায় করেছি, না?
ললিত মাথা নাড়ল। না।
শাশ্বতী বিষন্ন গলায় বলে, ও হয়তো রেগে যাবে। শোধ নেবে। কিন্তু আমার যে কিছু উপায় ছিল না।
কথাটায় ললিত একটু বিচলিত হয়। তারপর সোজা তাকায় শাশ্বতীর দিকে। বলে, আপনি ঠিকই করেছিলেন।
শাশ্বতী মৃদুস্বরে বলে, ওকে একটু বুঝিয়ে বলবেন, ও যেন কোনও পাগলামি না করে। আমার দাদার কাছে শুনেছি, দু’ দিন ও অফিসে আসছে না। বড় ভয় করেছিল শুনে। যদি ও সুইসাইড বা ও-রকম কিছু করে—
ললিত হাসে। মাথা নেড়ে বলে, করবে না। ওকে আমি চিনি। আমি ওর বাড়িতে খবর নিয়েছি। ও কলকাতায় নেই। কিছুদিনের জন্য বেড়াতে গেছে।
শাশ্বতী ছলছলে চোখে বলে, যদি কিছু করে! তা হলে লোকে আমাকে দেখিয়ে বলবে, ওই বাজে মেয়েটাই যত নষ্টের গোড়া। এ-রকমই তো হয়, লোকে না জেনে নিন্দে করে। ওকে বলবেন, আমি খুব সাধারণ একটি মেয়ে, আমার মতো তুচ্ছ একজনের জন্য পাগল হওয়ার মানে হয় না। ও অনেক ভাল মেয়ে পাবে।
ললিত সরল, বোকা মেয়েটির দিকে তাকায়। তারপর বলে, সেদিনকার ব্যাপারটার জন্য আমিই দায়ী। আপনি কোনও বন্ধুর দাদাকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন শুনে আমি রেগে গিয়েছিলাম।
শাশ্বতী একপলক ললিতের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়ে হাসল। বলল, হ্যাঁ, সেদিন আপনাকে খুব ভয়ংকর দেখাচ্ছিল। মাথার চুল উড়ছে, লাল টকটক করছে মুখ, চোখ জ্বলছে— আপনাকেই আমি সবচেয়ে ভয় পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, রেগে গেলে আপনি ভয়ংকর কাণ্ড করতে পারেন। সেই ভয়ে আর-একটু হলে আমি হয়তো সই করে ফেলতুম।
ললিত লাজুক মুখে হাসল। বলল, মানুষ তো নিজের মুখ দেখতে পায় না, সেদিন আমাকে কীরকম দেখাচ্ছিল কে জানে! কিন্তু আমি চেয়েছিলাম বলেই আপনি সই করতেন? আপনার নিজের ইচ্ছের জোর নেই?
শাশ্বতী মৃদুস্বরে বলে, অতগুলো পুরুষ ঘিরে ধরলে ভয় লাগে না! কেমন অচেনা পরিবেশ, রাগী সব মানুষ, আর ওই বিশ্রী দম-আটকানো ঘর! এ-সব থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য হয়তো শেষ পর্যন্ত আপনারা যা বলতেন, তাই করতাম। আমার মাথা গুলিয়ে গিয়েছিল। আপনাদের সেই ব্যান্ডেজ বাঁধা বন্ধু বের করে আনার পরও অনেকক্ষণ আমি বুঝতে পারিনি আমি সত্যিই সই করে এসেছি কি না।
বড় মায়া হয় ললিতের। সে একটু চিন্তা করে আস্তে আস্তে বলল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমিও চাইনি যে, আপনাদের বিয়েটা ওইভাবে থোক। আপনি চলে যাওয়ার পর আমি চেয়েছিলাম যেন আপনি আর ফিরে না আসেন।
বলেই একটু ইতস্তত করল ললিত। বলল, কিন্তু আপনি কি আমাকে বিশ্বাস করছেন?
শাশ্বতী হাসছিল। মৃদু চিকমিকে হাসি। মাথা নেড়ে বলল, বিশ্বাস করেছি। তারপর আচমকা বলল, কিন্তু কেন তা চেয়েছিলেন?
সত্যিই তো! সে কেন চেয়েছিল! তার তাতে কী লাভ? তবু তার মন চায়নি বিয়েটা হোক। বিশেষত ওইভাবে, ধুলোটে এক অফিসঘরে, সরকারি ভাষায় আধুনিক মন্ত্রপাঠ করে। সে চায়নি এই কাটাকাটা মুখের, শ্যামলা মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাক। কিন্তু কেন? কী লাভ তার?
ললিত মিনমিন করে শুধু বলল, আমি ভেবেছিলাম, আপনি অন্য কাউকে ভালবাসেন।
সেকথার উত্তর দিল না শাশ্বতী। ব্যাগ আর কলেজের খাতা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল, বলল, এবার আমি যাব।
বিদায়ের সময়ে কেউই জিজ্ঞেস করল না আবার দেখা হবে কি না। কিংবা কবে দেখা হবে!
ফেরার সময়ে বাসে একা একটি মন নিয়ে বসে ছিল শাশ্বতী। কত ভাবল সে। সে শুনেছে, ক্যানসার হলেও কেউ বেঁচে যায়, যেমন তার মেলোমশাই বেঁচে আছেন। ললিত তা হলে কেন মরে যাবে? মৃত্যুর মুখোমুখি ললিত কি এখন বড় একা! একা বলেই মাঝে মাঝে রেগে যায় নিজের ওপর! সেদিন ওকে লক্ষ করেছে শাশ্বতী। একদম পাগলের মতো দেখাচ্ছিল ওকে। ওর মন চাইছিল না, তবু জোর করে শাশ্বতীকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কেন ওর এত অহংকার? কেন শাশ্বতীকে অবহেলা করেছিল? মরে যাবে বলে? মৃত্যুরও কি অহংকার হয়! কিন্তু শাশ্বতীর আর ওর ওপর একটুও রাগ নেই। এখন পুরুষমানুষকে অনায়াসে বুঝতে পারে শাশ্বতী। সেদিন অতসব গন্ডগোলের মধ্যেও ললিতকে সে বুঝে গিয়েছিল।
মাঝে মাঝে শাশ্বতীর ভিতরটা ধক করে ওঠে আজকাল। ও কি মরে যাবে! কেন মরে যাবে! ক্যানসারের তো ওষুধ বেরিয়েছে, শাশ্বতী পড়েছে কাগজে! বেরোয়নি? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বেরিয়েছে। তার মন বলছে। সে জানে।
দুপুরেই ললিতের মা গেল প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি। বুড়িদের আড্ডায় বিন্তি কিংবা লুডো খেলতে খেলতে বলল, কেমন সুন্দর লক্ষ্মীমন্ত একটা মেয়ে এসেছিল আজ তাদের গরিবের ঘরে। ওই মেয়েই হয়তো আসছে একদিন বউ হয়ে।
সারা ঘর খুঁজে দেখে ললিত। শাশ্বতী কিছু কি ফেলে গেছে! যার জন্য সে আবার কখনও ফিরে আসবে এই ঘরে! না, কিছুই না। ললিত স্থির হয়ে দাঁড়ায়। বিড়বিড় করে প্রশ্ন করে, কোনও দিন আসবে না আর!
তারপর সংবিৎ ফিরে পায়। বিন্দু বিন্দু জলের মতো এইসব পার্থিব দুর্বলতা লেগে আছে তার গায়ে। সে একদিক, সব জলকণা ঝেড়ে ফেলে মায়াবি হাঁসের মতো উড়ে যাবে।
উড়ে যাবে! ফিরবে না আর! দেখবে না অপরাহ্নের উঠোনে সেই অদ্ভুত হলুদ আলোটি! সতেজ পেয়ারাপাতায় শিশুর মুখের ছবি! মানুষের মুক্তির কথা ভাববে না আর। ভালবাসবে না!
কেবলই কি জড়বস্তু থেকে জন্ম নিয়ে জড়ে ফিরে যাওয়া! কিছু নেই আর! হায়, তবু কেন যে কেবলই মনে হয় ললিতের, এখনও তার জীবন অপরিমেয় বাকি রয়ে গেছে!
চব্বিশ
বর্ধমানের কয়েক স্টেশন আগে ডাউন লাইনের ধারে এক নিরালা জায়গায় সোঁদাল গাঁয়ের একজন লোক কলকাতার গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। দুঃখী লোকটা। পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে সে বেঁচে আছে, পৃথিবীতে, আজ তার শেষ দিন। রেল লাইন বাঁক নিয়ে চলে গেছে পশ্চিমের দিকে উদোম মাঠের ভিতর দিয়ে। নিস্ফলা মাঠের ও-পাশে প্রকাণ্ড সূর্য ডুবে যাচ্ছে। পূবে বহু দূর থেকে হরেন সাঁইয়ের ধানকলের শব্দ আসছে ঝকঝক। নাবাল জমিতে এখনও জমে আছে গত বর্ষার জল, ব্যাঙ ডাকছে। একটু আগে হালকা একটা মেঘ বৃষ্টি দিয়ে গেল। বেশ বিকেলটি, জলে-ভেজা মাঠঘাটে পড়ন্ত রোদ পাকা ফসলের মতো দেখায়। দুঃখী লোকটা দেখে। কাঁধের গামছাখানা দিয়ে চোখের জল মুছে নেয়। শেষ বিকেলটা বড় সুন্দর। যদি এমন সুন্দর হত জীবন, এমন ভর-ভরন্ত নিস্তব্ধ বিকেলটির মতো! কিন্তু তা তো হয়নি। বাবার ঋণ ছিল অনেক, জমি চলে গেল মহাজনের ঘরে। ভাগচাষে চলছিল দিন, কিন্তু পর পর দু’ বছর অজন্মা। ধানের দর পড়ে গেল। হরেন সাঁইয়ের কলে ঝাড়াই হচ্ছে তারই রোয়া-কাটা ধান। এখন আর তার কোনও দুঃখ নেই, এক্ষুনি রেলগাড়ি চলে আসবে, বাড়বাড়ন্ত হোক সাঁইমশাইয়ের। ঝাড়া হাত-পা তার, কাঁদবার কেউ নেই, এক যদি বারুইপুরে মেয়েটার কাছে খবর যায়। তা সে-খবরও যাবে দুলকি চালে৷ পৌঁছতে পৌঁছতে মাসখানেক। তত দিনে হাওয়া-বাতাসে জলে-মাটিতে মিশে কোথায় চলে যাবে সে! তার খানিকটা চলে যাবে আকাশে, মেঘ হয়ে চোখের জল ফেলবে, তার আর খানিকটা মাটিতে মিশে বুকে করে নেবে সেই জল, তার আর খানিকটা হু-হু বাতাসের সঙ্গে ছুটে এসে ধানের আগা ছুঁয়ে চলে যাবে কোথায়! দুঃখী লোকটা তার চারধারে অলৌকিক বিকেলটা দেখে নেয়। ফলিডল কেনারও পয়সা ছিল না বলে সে আড়াই মাইল হেঁটে এসেছে রেলরাস্তা পর্যন্ত। উঁচু জমিতে দাঁড়াতেই ফুরফুরে হাওয়া লাগছে। বাতাসে এখন বড় আদর। সেই আদুরে বাতাসটাই একটা শব্দ নিয়ে আসে। গুরুগুরু শব্দ। দুরে রেলব্রিজে উঠে এল গাড়ি। তারপর পায়ের নীচে মাটি চড়াইয়ের বুকের মতো কাঁপে। মাইলখানেক দূরে বাঁকের মুখে পিঁপড়ের মতো কালো ট্রেনখানা উদোম মাঠের উপর দিয়ে চলে আসছে। ড্রাইভার সাহেব দেখে ফেলবে। লোকটা দু’কদম নেমে যায় ঢালু বেয়ে। উবু হয়ে বসে একটা বিড়ি ধরায়। খুব জোরে টানতে থাকে। বাঁকের ওপর দিয়ে পাক মেরে আসছে গাড়িখানা। বিড়ি ফেলে লোকটা উঠে দাঁড়ায়। গামছাখানা জড়িয়ে নেয় মুখে, তারপর দুই লাফে উঠে আসে ঢালু বেয়ে। গামছার আবছায়ার ভিতর থেকে এক বার কালো ট্রেনখানা দেখে, মার মার ঝোড়ো শব্দের মধ্যে চেঁচিয়ে মেয়ের নাম ধরে ডেকে বলে, ব-কু-ল, যা-আ-ই! বাতাসের একটা ধাক্কা লাগে জোর।
অনেক হিজিবিজি দেখতে পায় লোকটা। দেখে কোমরের ওপর দাঁড়িয়ে আস্ত একটা রেলগাড়ির কামরা। কিন্তু খুব ভার লাগে না। তার শরীরের ভিতর দিয়ে কুলকুল করে একটা নদী বয়ে যাচ্ছে, ভিজে যাচ্ছে ঘাস মাটি। সে জলের জন্য একবার হাঁ করে। দু’বার তিন বার। মুখে কথা ফোটে না। ঘাড়টা কাত হয়ে যায়। অনেক মানুষের পা বৃষ্টির মতো মাটিতে পড়ছে। অনেক লোক—অনেক লোক—কথা বলছে। কিন্তু সে কেবল অঝোরে নদীর শব্দটা শোনে। তার শরীরের ভিতর থেকে কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে। সে জলের জন্য হাঁ করে। কেউ তার কথা বুঝতে পারে না। আস্তে আস্তে বৃষ্টির জলে যেন ধুয়ে যাচ্ছে মুখগুলো! সে ভয়ে চেঁচায়, জল! কিন্তু কেউ বুঝতে পারে না। হঠাৎ আবছায়ার মধ্যে কোথা থেকে সুন্দর একখানা মুখ তার মুখের ওপর নেমে আসে। বড় সুন্দর মুখ, দয়াল দু’টি জলভরা চোখ। লোকটা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। এইরকম, এইরকম একজন মানুষকেই সে তো সারা জীবন নিজের অজান্তে খুঁজছে! কখনও আলপথে লণ্ঠন হাতে যেতে যেতে, কিংবা যখন বর্ষার একবুক জলে নেমে ট্যাঁটায় গাঁথা বস্তুটি শোলমাছ না কেউটে না জেনে হাত ডুবিয়েছে জলে, কিংবা কখনও দিকশূন্য বৈশাখী দুপুরের ধু-ধু মাঠ আর অনন্ত আকাশের দিকে চেয়ে পৃথিবী ও আকাশের প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারেনি, কিংবা কখনও যখন বাইরের দাওয়ায় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় হঠাৎ অস্পষ্টভাবে নিজের পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ি-পড়ি করেও পড়েনি, তখন সেইসব সময়ে সে তো আবছাভাবে একেই খুঁজে বেড়িয়েছে এত দিন! এই দয়ালু মুখখানা—আহা, যা পরের জন্য কাঁদে, সময়ে দেখা হল না গো, এ ঠিক নিয়ে যেত তাকে সেইখানে যেখানে ঈশ্বর আছেন। কচু পাতায় জল মুখ ভরে ঢেলে দিচ্ছে মানুষটা, চোখে-মুখে পড়ছে জলের ছিটে। লোকটা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে, তুমি কি অচেনা মানুষ! না গো। দুঃখী মানুষ তোমাকে দেখলেই চিনে নেবে। অন্ধকার নেমে আসে। সূর্যের মুখ ঢেকে দয়ালু মুখখানা তার দিকে চেয়ে থাকে। এই একজন মানুষ, যে তার জন্য কাঁদছে। লোকটা নিশ্চিন্তে চোখ বোজে।
আস্তে আস্তে তার মাথাটা কোল থেকে মাটির ওপর নামিয়ে দেয় রমেন। তারপর উঠে দাঁড়ায়। ঢালু বেয়ে আস্তে আস্তে নেমে আসে নাবাল জমিতে যেখানে জল জমে আছে। হাতের রক্ত ধোয়, ধুতিটা ভিজিয়ে নেয়, মুখে জলের ছিটা দেয়। উঠে আসবার সময়ে দেখে লোকটার কাটা ডান হাতখানা পড়ে আছে। যত্নে তুলে নেয় সেটা, ভিড় ঠেলে মৃতদেহের কাছে রেখে দেয়। তারপর একটু দূরে এসে দাঁড়ায়। দিগন্তে নীল মেঘের রঙের একটা আস্তরণ, সূর্য দু’-আধখানা হয়ে অস্ত যাচ্ছে। রমেন নিঃশব্দে হেঁটে এসে নিজের কামরায় ওঠে।
কামরার ভিতরে ভিড়ের মানুষেরা তাকে রাস্তা করে দেয়। অন্যমনে সে এসে দাঁড়ায় তার পুরনো জায়গায় দুই বেঞ্চের মাঝখানে। শান্তভাবে।
সভয়ে তার কাছ থেকে সরে দোল একজন লোক, বলল, আপনার কাপড়ে এখনও রক্ত!
বেঞ্চ জুড়ে হোল্ড-অলের বিছানা পেতে বসে আছে একজন খিটখিটে চেহারার লোক। সঙ্গে তিনটে বাচ্চা আর গোলগাল বউ। রমেন প্রথম গাড়িতে উঠতে এই লোকটা তাকে জায়গা দিতে চায়নি, বলেছে, দেখছেন তো কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছি, এর মধ্যে কোথায় বসবেন! সেই লোকটা এখন রমেনকে জিজ্ঞেস করল, লোকটা মরে গেছে?
রমেন মাথা হেলায়।
ইস। লোকটা বলে, তারপর হোল্ড-অলের একটা অংশ উলটান দিয়ে জায়গা করে দিয়ে বলে, আপনি বসুন।
আমি…মানে… আমার কোলেই লোকটা মারা গেছে। আপনার বিছানাপত্র ছোঁয়া যাবে।
তাতে কী? বৃহৎ কাষ্ঠাসনে দোষ নেই
রমেন বসল না।
দুর্গাপুর থেকে গাড়ি ছাড়ার শেষ সময়ে একটা পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের ছেলে দৌড়ে এসে গাড়িতে উঠেছিল। ওর দৌড় দেখে বোঝা গিয়েছিল যে, ছেলেটা দৌড়তে জানে। তার গায়ে হ্যান্ডলুমের চমৎকার একটা চেক শার্ট পরনে কর্ডের প্যান্ট পায়ে হান্টিং বুট, কাঁধ থেকে একটা মাঝারি কিট ব্যাগ ঝুলছে। গায়ের রং ফরসা, একটু নিষ্ঠুর চৌকো ধরনের মুখ, চোখ দু’টি স্থির। স্থির কিন্তু শান্ত নয়। বরং একরোখা। একটি কিংবা দু’টি খুন করার পর মানুষের চোখ ও রকম স্থির হয়ে আসে। তখন চোখের পাতার একটা গাঢ় ছায়া পড়ে চোখের মণিতে। আর সেখানে, চোখের গভীরে ধিক ধিক করে একটা চোরা আলো।
ছেলেটা গাড়িতে ওঠার পর থেকেই হোল্ড-অলওলা লোকটার সঙ্গে তার ঝগড়া হচ্ছে। ছেলেটা বসার জায়গা চাইতেই লোকটার বউ বলল, কী করে জায়গা হবে? আমাদের বাচ্চা-কাচ্চা… এত জিনিসপত্র… ওঁর শরীর খারাপ। ছেলেটা মুখ বিকৃত করে ঘেন্নার চোখে, লোকটা তার বউ আর তিনটে বাচ্চাকে দেখেছিল একটু, কিছু বলেনি। ট্রেন ঘণ্টাখানেক লেট চলছিল, তাই হোল্ড-অলওলা লোকটা এক বার রমেনকে বলেছিল, গেরো দেখেছেন? পৌঁছতে প্রায় রাত হয়ে যাবে। আমি আবার থাকি বাঘাযতীনে, এলাকাটা ভাল নয়। অত রাতে ছিনতাই-ফিনতাই, তা ছাড়া ট্যাক্সিওয়ালাকেই বিশ্বাস কী? তখন দুর্গাপুরের ছেলেটি একটু আত্মপ্রত্যয়ের হাসি হেসে বলল, আমিও ওই দিকেই যাব। আমাকে সঙ্গে নেবেন? আমি সঙ্গে থাকলে ভয় নেই। লোকটা বিব্রত চোখে ছেলেটাকে একটু দেখে মাথা নেড়ে বলল, না, না, তার দরকার নেই। ছেলেটা ঠাট্টার গলায় বলল, কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না? লোকটা বলল, না, তা নয়। ভগবান দেখবেন। ঠিক পৌঁছে যাব। ছেলেটা একটু হাসল, ভগবান তো একটু আগেও ছিলেন, যখন আপনি ভয়ের কথা বলছিলেন! লোকটা সে-কথার উত্তর দেয়নি, রমেনের দিকে তাকিয়ে অন্য প্রসঙ্গ আনবার চেষ্টা করে বলেছে, আজ আমার আসার কথা ছিল না, জানেন! ঠিক ছিল পরশুদিন আসব। কিন্তু পঞ্জিকায় দেখেছি অমৃতযোগ ছিল আজ… যাত্রার সময়ে। তারপর একটু স্মান হেসে বলল, কাশীতে সেবার ভৃগুবিচার করালাম— দুর্ঘটনায় মৃত্যুর যোগ। তাই পঞ্জিকা না দেখে বেরোই না বড় একটা…। দুর্গাপুরের ছেলেটা দু’দিকে ব্যাঙ্কে দু’খানা লম্বা কেঠো হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, একটু ঝিলিক দিল তার হাসি। বলল, কেটে পড়ুন দাদা, কেটে পড়ুন। পৃথিবীতে জায়গা বড় কমে যাচ্ছে। ছ’জনের জায়গা দখল করে বসে আছেন, কুড়িজনের খাবার টেনে নিচ্ছেন…
ঠিক সেই সময়ে ইঞ্জিন থেকে তীব্র বাঁশি বেজে ধীরে ধীরে থেমে আসছিল গাড়ি।
সেই ছেলেটা এখন রমেনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। একটু অন্যমনস্ক ছিল রমেন, ছেলেটা তার কানের কাছে মুখ এনে বলল, কেমন দেখলেন?
কী।
লোকটা যে মরে গেল! কোনও কষ্ট পেল না। ইনস্ট্যান্ট।
রমেন উত্তর দিতে পারল না। তার ঠোঁট একটু কেঁপে গেল মাত্র।
ছেলেটা নিচু গলায় বলল, আপনি খুব শক্ড্? প্রথম প্রথম ও-রকম হয়। কলকাতায় নেমে একটা বড় ব্র্যান্ডি খেয়ে নেবেন। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি মানুষকে মরতে অনেক দেখেছি।
খুব ধীর চাপা গলায় রমেন বলল, জানি।
ছেলেটা খুব সামান্য একটু চমকে উঠল।
রমেন সরে এসে গাড়ির খোলা দরজার সামনে দাঁড়ায়। দরজায় মুখে ভিড়ে। দুটো লোক একে অন্যের বিড়ি থেকে আগুন ধরিয়ে নিচ্ছে, তাদের দু’জনের মুখের ঠিক মাঝখান দিয়ে ডুবে যাচ্ছে সূর্য।
মেঝেতে উবু হয়ে বসেছিল বেঁটে মতো একটা লোক। এত বেঁটে যে, আর দু’-এক ইঞ্চি ছোট হলেই বামনবীর হয়ে যেত। পরনে ময়লা হাফশার্ট আর ধুতি। সে ভিড়ের মধ্যে একটা ফাঁক দিয়ে রমেনকে দেখছিল। হ্যাঁ, ওই তো সেই লোক, যে ট্রেনে কাটা-পড়া মানুষটার মাথা কোলে করে বসে ছিল, অচিন মানুষের জন্য কেঁদেছিল, ওই তো সেই লোক! লম্বা লোকটা, ফরসা, গায়ে হাফ-হাতা পাঞ্জাবি—হ্যাঁ, ওই লোকটা। মরন্ত মানুষটা ওই মুখখানার দিকে চেয়ে মরে গেল। মরন্ত মানুষ লোক চেনে, ভুল হয় না। এ লোকটাকে দুঃখের কথা বলা যায়, এ বুঝবে ঠিক। সে একে বলবে গতবার তার কোলের ছেলেটা কীভারে মারা গেল। মিঠিপুর তার গাঁ, চব্বিশ পরগনায়। গতবার বান ডাকল রাত দুটোয়। ঘরে সে, তার বউ আর দেড় বছরের ছেলে। জলের শব্দে ঘুম ভেঙে দেখে ঘরের মেঝেয় হাজার সাপের মতো জলের খেলা। মুহুর্মুহু জল বেড়ে ওঠে, সে বউকে ডাকে, সামাল! গরিব মানুষ, জিনিসপত্র তেমন কিছু। ছিল না, যায় তো সেগুলো যাক, কিন্তু মানুষগুলো বড় আপন। বউকে বলল, আমার কোমর প্যাচায়ে ধর। বউ ধরল। ছেলে কোলে করে জলে নামল সে। ঘরে তখন তার কোমর-জল, বাইরে নামতেই গলা পর্যন্ত। তখন মাঠঘাট কিছু ঠাহর হয় না, অন্ধকার, অঝোর বৃষ্টি, বাতাস ডাকে, উথালপাথাল গাঁই-গাঁই জলের ডাক। লোকটা জলের মধ্যে টালমাটাল ছুটছিল, সঙ্গে কোমর-ধরা বউ, বুকে ছেলে। পশ্চিম দিকে বুড়ো বটের তলায় মহাবীরের থান, সেই জায়গাটাই সবচেয়ে উঁচু, সেখানে বাঁধানো বেদি আছে। শতখানেক গজ দূর। এই এক শ’ গজ রাস্তা তার বুকে ধরা ছিল ছেলেটা, জলের তলায়। গলা-জল ভেঙে যখন গিয়ে উঠল বাবার থানে তখন খেয়াল করে দেখে, আরে, এ আমি করেছি কী? আঁ! বুকের মধ্যে জোরে চেপে ধরেছি ছেলে, দেখি তার মুখ ডুবে রয়েছে জলের মধ্যে! ছেলে শ্বাস নেয় নাই। অ্যাঁ?
লোকটা আপনমনে বিড়বিড় করল, এরে কবো? হ্যাঁ, এরে কওয়া যায়।
লোকটা হাত বাড়িয়ে রমেনের পা ছুঁয়ে ডাকে, ও কর্তা।
রমেন নিচু হয়ে লোকটাকে দেখে। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, জল-টসটসে চোখ। একে দেখেছে রমেন। যখন ট্রেনে কাটা-পড়া লোকটা রমেনের কোলে মাথা রেখে মরে যাচ্ছে তখন এ-লোকটাই দৌড়ে গিয়ে কচু পাতায় জল এনে দিয়েছিল, রমেনের কানের কাছে বিড়বিড় করে বলেছিল, বাঁচিয়ে দিন, কর্তা, বাঁচিয়ে দিন। আপনি পারেন। হে ঠাকুর—
রমেন নরম গলায় বলে, কী?
লোকটা একটা বিড়ি বাড়িয়ে ধরে। তার আর কিছুই দেওয়ার নেই।
রমেন বিড়িটা নেয়। লোকটার মুখোমুখি উবু হয়ে বসে বিড়িটা ধরায়। লোকটা গলে যায় এই সোহাগে। বিড়বিড় করে তার দুঃখের কথা বলে। তারপর আস্তে আস্তে রমেনের বুকের কাছে ঝুঁকে আসে লোকটার মাথা, তীব্র, ফিসফিসানির সুরে লোকটা বলে, বলেন কর্তা, কেন বুদ্ধি নষ্ট হয়ে গেল! কী হয়েছিল আমার! কাঁধে তুলে নিলেই ছেলেটা বেঁচে যেত, কিন্তু কেন বুদ্ধি হয় নাই?
হাতে কচলে চোখের জল মোছে লোকটা। রমেনের সুন্দর মুখ স্তব্ধ হয়ে দেখে। তারপর বলে, তারপর থেকেই আমি বন্ধকি কারবার ছেড়ে দিলাম, ধর্মে-কর্মে মন দিয়েছি, তীর্থে যাই মাঝে মাঝে, ভিখিরিরে ভিক্ষে দিই, মানুষের বিপদ দেখলে মন কেমন করে, ছুটে যাই। কিন্তু আর লাভ কী? বুদ্ধিনাশে ছেলেটা মরে গেল। তার ওপর দেখেন আমি ঈশ্বরেচ্ছায় বামনবীর, আপনার মতো লম্বা হলে পর—কিন্তু ভগবান চান নাই—
মনে মনে মৃদু হাসে রমেন। লোকটা জানে না বামনবীরের মতো তার চেহারায় রূপ ঝরে পড়ছে। সত্য বটে, কখনও-সখনও আমাদের প্রিয়জন চলে যায়, তার শূন্যস্থানে অন্তরে চলে আসে দয়া, মায়া, কিংবা বিস্তার। লোকটা এখনও টের পায়নি। ছেলে না থাকায় দুঃখই ছেলে হয়ে তার কাছে আছে।
রমেন তার কাঁধে হাত রেখে চুপ করে বসে।
লোকটা বিড়বিড় করে, আপনার বড় দয়ামায়া। মরন্ত মানুষটার ভুল হয় নাই।
গাড়ির গতি কমে আসে। অনেক লাইনের জটিল ইয়ার্ডের ওপর দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। হোন্ড-অলওলা লোকটা গলা বাড়িয়ে ডাকল, ও দাদা।
রমেন তাকাতেই হাতের প্লাস্টিকের জলের বোতলটা বাড়িয়ে দিয়ে ম্লান মুখে বলল, বারবার আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি। সামনেই বর্ধমান, একটু জল এনে দেবেন দাদা, কাইন্ডলি! আপনি ইয়ংম্যান, ছুটে গিয়ে আনতে পারবেন, আমার সায়াটিকা—
আসানসোলে একে একবার জল এনে দিয়েছিল রমেন।
অভ্যাসবশত বোতলটার জন্য হাত বাড়িয়েছিল রমেন, কিন্তু হাতটা ফেরত নিল। দুর্গাপুরের ছেলেটা শিথিল চোখে তাকে দেখছিল। রমেন ছেলেটাকে দেখিয়ে লোকটাকে বলল, এঁকে দিন। ইনি এনে দেবেন। আমি মড়া ছুঁয়েছি।
লোকটা ইতস্তত করে। হঠাৎ ঘেন্নায় ছেলেটার মুখ বেঁকে যায়। রমেনের চোখে স্থির চোখ রাখে ছেলেটা। মৃদু একটু হাসল রমেন, বন্ধুত্বের হাসি। ছেলেটা হাসিটুকু ফেরত দিল না। রমেন মনে মনে বলল, আমি তোমার শত্রু নই।
ছেলেটা চোখ সরিয়ে নিয়ে লোকটার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, দিন। এনে দিচ্ছি।
গাড়ি বর্ধমান পার হয়ে গেল। দুর্গাপুরের ছেলেটা জল এনে হোন্ড-অলওলার বেঞ্চে জায়গা পেয়ে গেছে।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রমেন দেখে অপরাহ্নের আলোয় প্রকাণ্ড একখানা আদি-অন্তহীন মাঠ দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে তাদের রেলগাড়ি। চষা জমির ছায়ার মতো আকাশে ফুটে আছে কোদালে মেঘ।
জানালার ধারে একটেরে সিটটিতে বসে ছিল বুড়ো একটা লোক। সে রমেনের ধুতিতে রক্তের ছোপ দেখছিল, লক্ষ করল রমেনের বিষন্ন মুখ। তারপর বলল, লোকটা বাঁচল না, না?।
রমেন মাথা নাড়ল।
লোকটা একটু চুপ করে থেকে বলল, চার দিকেই লোক মরে যাচ্ছে খুব। খাদ্যসমমা। এই বাজারে মানুষ বাঁচে?… আপনি কোথায় যাবেন?
কলকাতায়।
কলকাতায় কোথায়?
ঠিক নেই।
ঠিক নেই। সে কী? বাড়ি-বাসা নেই সেখানে?
রমেন একটু ইতস্তত করে বলে, ছিল, কাশীপুরে গঙ্গার ধারে আমাদের একখানা বাড়ি ছিল। শুনেছি সেটা উদ্বাস্তুরা দখল করে নিয়েছে। আমি কোনও বন্ধুর বাসায় উঠব।
ইস, বাড়িটা বেদখলে চলে গেল! আপনি এতকাল করছিলেন কী? আজকাল কি একটা বাড়ি করা সহজ! গঙ্গার ধারে ওই জায়গায় এখন বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা কাঠা!
লোকটা উদ্বিগ্ন হয় খুব। বলে, আদি বাড়ি ওইটাই?
না, রমেন বলে, আদি বাড়ি ময়মনসিং।
ময়মনসিং! লোকটা নড়ে-চড়ে বসে। ময়মনসিঙের কোথায়?
কালীবাড়ির কাছে।
কার বাড়ি?
রায় হরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী।
লোকটা সোজা হয়ে বসে, তিনি আপনার কে হন?
দাদু।
লোকটা অনেকক্ষণ অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে দেখে। স্থির চোখে। তারপর হঠাৎ ফিসফিস করে বলে, ছোটকর্তা! আপনি আমাদের ছোটকর্তা না?
বুড়ো লোকটার খোলা চোখে জল চলে আসে সে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়, বসেন, বসেন—
রমেন তার কাঁধে হাত রাখে। লোকটা বিহুলভাবে বসে পড়ে। সে বুঝতে পারে না এর মানে কী! ছোটকর্তার ময়লা ধুতিতে রক্তের ছোপ, একটু আগে কাটা-পড়া লোকটাকে বুকে করে ধুলোয় বসে ছিল! গালে না-কামানো দাড়ি! মেঝেয় বসে একটা ভিখিরি মানুষের সঙ্গে বিড়ি খেল? কী করে হয়! সে ছোটকর্তাকে ঘোড়ায় চড়তে দেখেছে, বন্দুক চালাতে দেখেছে, সে দেখেছে ছোটকর্তা তেরো বছর বয়সে একা মোটর গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায়। সেই বাড়ির দেউড়ির ওপর সিংহের মূর্তি, মাঠে পেখম-ধৱা ময়ূর, বড় কর্তা বারান্দায় দূরবিন হাতে বসে আছে, ছোটকর্তা বুট পরে চামড়ার বল মারছে দেয়ালে। কী করে হয়!
আয় হায় রে, এ আপনার কী চেহারা ছোটকর্তা! জমি নাই—বাড়ি বে-দখল—আয় হায় রে—
রমেন তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়, কী বলবে ভেবে পায় না রমেন। কেবল তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
লোকটা কত বার সেই বাড়িতে ছুটে গেছে দায়ে দফায়! মুশকিল-আসান ছিল সেই বাড়ি। পাকিস্তানের পর যখন খালি হয়ে গেল বাড়িটা, লুট পড়ে গেল, তখন কত দিন তার বুক ব্যখিয়ে উঠেছে। কলকাতায় এসে কত বার অভাবে দুঃখে তার মনে পড়েছে ময়মনসিঙের সেই বড় বাড়ির কথা। ইচ্ছে হয়েছে, কাশীপুরে এক বার ছোটকর্তার কাছে যায়। আপনারাই চিরকাল আমাদের দেখেছেন, আমরা আর কোথায় যাব? কিন্তু আয় হায় রে— ছোটকর্তার এখন আর কিছু নাই। কেমন শূন্য লাগে তার, নিঃস্ব ভিখিরির মতো লাগে নিজেকে। কাশীপুরে ছোটকর্তা আছেন, এই বিশ্বাস নিয়েই সে এতকাল অনেক দুঃখে সান্ত্বনা পেয়েছে। কিন্তু এখন সে কী ভেবে সান্ত্বনা পাবে!
আমি মুকুন্দ ঘানিওয়ালা। মনে নাই? রমেন মাথা নাড়ে, মনে আছে।
সৎ জমিদার পিতার মতো। শাসনে রাখেন, সোহাগও করেন। নিষ্কর জমি দিয়ে দেন, বসত করান, ধর্মে-কর্মে মতি আনেন মানুষের। কী মানুষ ছিল সব, মাথা নুয়ে আসত আপনা থেকেই। তার চেয়ে কি এখনকার বি ডি ও-রা ভাল! না কি সরকারি লোকেরা! অনেক হয়রানির পর মুকুন্দ বুঝে গেছে, সব জোচ্চোর, ঠক। এখন আর সেইসব স্বপ্নের মানুষেরা জন্মায় না, যাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই দুঃখের কথা নিঃশব্দে বলা হয়ে যেত।
নীরবে রমেনের হাতে বে-খেয়ালে হাত বুলোয় মুকুন্দ। বলে, সব চলে গেল, ছোটকর্তা! আমরা তবে কার কাছে গিয়ে দাঁড়াব?
রমেন ঠিক বলতে পারে না। কিন্তু বলতে ইচ্ছে করে, মুশকিলে পড়লে আমি আছি। আমার কাছে এসো।
কিন্তু সে বড় অহংকারের কথা। রমেনের মুখ ফুটে বেরোয় না। সে কেবল মুকুন্দের হাতে হাত রেখে ছোট্ট জায়গাটিতে ঘেঁষাঘেঁষি করে ওর পাশে বসে থাকে।
মাঝে মাঝে একটা বুড়ো ময়ূর, আর একটা পুরনো মোটর গাড়ির কথা রমেনের মনে পড়ে। কচ্ছপের পিঠের মতো ঢালু, সবুজ মাঠে ধূসর রঙের ময়ূরটা এক বোঝা পেখম টেনে আস্তে আস্তে চরে বেড়াচ্ছে, এই দৃশ্য মনে পড়ে। কিংবা লজঝড়ে পুরনো, ক্যাম্বিসের হুডওয়ালা তাদের গাড়িটা বৃষ্টির দিনে পাম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ভিজছে।
কখনও বা মনে একটি-দু’টি ভিন্ন ছবি ভেসে ওঠে। প্রকাণ্ড একটা ভাঙা পিয়ানোর ওপর ধুলোর আস্তরণ, তার ওপর আঙুল দিয়ে রমেন তার নাম লিখছে, রায় রমেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। কিংবা মনে পড়ে প্রকাণ্ড দেউড়ির ওপর পুরনো জং-ধরা লোহার আর্চ, তাতে একটা চৌকো কাচের বাতি ঝুলছে, আর লোহার ফ্রেম বেয়ে লতিয়ে উঠেছে মাধবীলতা। কিংবা সেই নোনা-ধরা, শ্যাওলায় সবুজ দেয়ালগুলি, যা তাদের বাড়ির সীমানা ছিল, যার ওপর দিয়ে দু’ হাত দু’ দিকে পাখনার মতো ছড়িয়ে টাল খেতে খেতে চোখ বুজে কত দিন হেঁটেছে রমেন! কিংবা মনে পড়ে তাদের ভূতগ্রস্তু, প্রকাণ্ড বাড়িটার পশ্চিমের ভিতের কাছে একটা আতসকাচ হাতে দাদু বসে আছে।
এখন সেই বৃষ্টির দিন, আর পাম গাছের তলায় দাঁড়ানো তাদের সেই বুড়ো ভাঙা গাড়িটার ভিজে যাওয়ার কথা মনে পড়ল। তারপর আস্তে আস্তে সেই বুড়ো ময়ূরটার পেখমের বোঝা টেনে টেনে সতর্ক চলা, গ্র্যান্ড পিয়ানোর গায়ে লেখা তার পুরনো নাম, আর আতসকাচ হাতে বাড়ির পশ্চিমের ভিতের কাছে দাদুর বসে থাকার দৃশ্য মনে পড়ে গেল। তার চারধারে এখন একবার তাকিয়ে দেখলে কিছুতেই মনে হয় না যে, সে-সব সত্যিই একদিন ছিল, সেই ময়ুর, পুরনো গাড়ি, সেই গ্র্যান্ড পিয়ানো, কিংবা সেই দাদু। যেমন, মনে হয় না ছেলেবেলায় সত্যিই তাকে ওইভাবে তার নাম লিখতে বা বলতে শেখানো হয়েছিল, রায় রমেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী।