২০. গ্রামের সামনের মাঠ

২০

গ্রামের সামনের মাঠ পরিষ্কার করে রান্নার জায়গা করা হয়েছে। এখন কাটা হচ্ছে উনুন। খড়ি জোগাড়ে চলে গেছে একদল। বাচ্চারা আনন্দে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে চারপাশে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে এই কদিনে চাল-ডাল সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো কয়েকটা ধামায় ভরে রাখা হয়েছে পরিষ্কার জায়গাটায়। একটু পরে শুরু হবে রান্নাবান্না। গ্রামের সবাই মিলে হবে একসাথে খাওয়া দাওয়া।

আজ পৌষ সংক্রান্তি। পৌষ সংক্রান্তিতে এই উৎসব হয় এলাকাজুড়ে সব গ্রামেই। এই উৎসবের নাম স্থানীয়ভাবে পুষুরে। পৌষ-পার্বণ বলতে যা বোঝায় এই এলাকায় সেটাকেই বলে পুষুরে।

দুধের ঘাটতি ছিল। দলেবলে হাজারি চারটা কলস নিয়ে জামালপুর বাজারে গেছে দুধ কেনার জন্য সেই ভোরবেলায়। দূর থেকেই দেখা গেল তারা ফিরছে। বাচ্চারা আনন্দে হৈ হৈ করে ছুটল সেদিকে। আজ অকারণেই আনন্দ। কথায় আনন্দ, ছোটায় আনন্দ। সবকিছুতেই আনন্দ। আনন্দেরই দিন আজ।

হাজারি দুধের কলস এনে পরিষ্কার জায়গাটায় নামিয়ে রাখল। পায়েস হবে এই দুধে। আর হবে বিভিন্ন তরকারি দিয়ে লাবড়া। লাবড়া দিয়ে খিচুড়ি খাওয়ার স্বাদই আলাদা।

কত করে আনলি দুধ? ম্যালা দাম পড়িচে লিশ্চয়। আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে মাধব কাকা।

না কাকা, যা ভাবছিলাম তারচে কমই পড়িছে। আমরা তো রাত থাকতিই চলে গিছিলাম। তাই এট্টু কমেই পায়ে গিছি। আত্মতৃপ্তি নিয়ে বলে হাজারি।

তা চাল-ডাল উটিচে কীরকম?

ভালোই পাওয়া গেছে। ইবারের পুশুরে ডা জমে যাবি বুলে মনে হচ্চে।

বলাই ততক্ষণে চারটে উনুন তৈরির কাজ শেষ করে এনেছে। খড়িও জোগাড় হয়ে গেছে।

সারা পৌষ মাস ধরেই চলে পুযুরের প্রস্তুতি। মাসের পয়লা দিন থেকেই দলবেঁধে গান গেয়ে ছেলেরা মানে বের হয়। মাঙনের সময় দলের নেতা গান ধরে। অন্যরা দোহার হিসেবে কাজ করে। উঠোনে তারা গোল হয়ে নেচেনেচে গান গায়। তাদের হাতে থাকে রং-বেরঙের রুমাল। গানের তালে তালে সেই রুমাল নাড়তে থাকে। এভাবেই এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরে ঘুরে গান করে তারা। এক এক দিন এক এক গান। কোনোদিন তারা সোনাহারের বিয়ে দেয়। গানের নামও তাই সোনাহারের বিয়ে। সবাই মিলে গায় :

ওরে এক দিবসে সোনাহার নল কাটিতে যায়,
ওরে নল কাটিতে যাইয়ারে সে খাট পালংক পায়
ওরে খাট পালংক পাইয়ারে সে শুইয়া নিদ্রা যায়।
ওরে দেবপরীর কন্যা আসে গায়ে বাতাস দেয়।

ওরে গায়ে বাতাস দিলে কন্যা, তোমায় করবো বিয়া
ওরে আমি হলাম ব্রাহ্মণ কন্যা, তুমি সোনাহার
ওরে আমারে যে করতে বিয়া লাগবে একটা ফুল
ওরে আনলো রে তোর বড় গাঁদার ফুল ডালা সাজাইয়া
ওরে এও ফুলেতে হলো না রে সোনাহারের বিয়া।
ওরে আবার যাওরে, যাওরে মালী ফুলের লাগিয়া
ওরে আনলো রে তোর বিন্যের ফুল চাদরে পেঁচাইয়া ওরে
এই ফুলেতেই হবে রে সোনাহারের বিয়া।

ওরে আইলো রে তোর নিমে নাপিত ভাঙা খুরখান নিয়া
ওরে এই খুরে তো হলো না রে সোনাহারের খেউরি
ওরে আইলো রে তোর নবা নাপিত ভালো খুরখান নিয়া
ওরে আইলো রে তোর ভূশ্যাম ঠাকুর ছেঁড়া পইতা নিয়া
ওরে এই পইতায় হলো না রে সোনাহারের বিয়া
ওরে আইলো রে তোর কার্তিক ঠাকুর নতুন পইতা নিয়া
ওরে এই পইতায় হলো রে সোনাহারের বিয়া ॥

কোনোদিন তারা গায় রাধা-কৃষ্ণ লীলার উপরে নানা ধরনের গান, ‘কানাই-রাধার মিলন’, ‘রাধার মান ভঞ্জন’ বা ‘কানুর (গোপাল) ননী খাওয়া’–। এসব গান তারা একের পর এক পালা করে গায়—

১.

কাঠের দ্যাশে থাকো কানাই, কাঠের করো সুর
কানাই খেওয়া বায়
ভাঙা নৌকায় খেওয়া দিয়ে কিবা পেলে সুখ
কানাই খেওয়া বায়
ভাঙা নয় রে, চুরো নয় রে শ্যামলেরই সুর
কানাই খেওয়া বায়
হস্তী-ঘোড়া পার করি হে রাধা কত ভার
কানাই খেওয়া বায়
সব সখী রে পার করিতে নিব আনা আনা
কানাই খেওয়া বায়
শ্রী রাধিকা পার করিতে নিব কানের সোনা
কানাই খেওয়া বায়
এক আনার জন্যে তুমি চাও হে কানের সোনা
কানাই খেওয়া বায়
ঐ কথা শুনিয়া হালেতে মারে কাছা
কানাই খেওয়া বায়
ছিড়লো পারস্যের দড়ি, হায়রে ভাঙলো নায়ের পাছা
কানাই খেওয়া বায়
আগা ডোবে, পাছা ডোবে, মধ্যে মাচাইল ভাসে
কানাই খেওয়া বায়
শ্রী রাধিকারে কোলে নিয়ে কানাই জলে ভাসে
কানাই খেওয়া বায়
ভাসিতে ভাসিতে রাধে যখন পাইলো কূল
কানাই খেওয়া বায়
কূল ও না পাইয়ারে রাধে ঝাইরা বাঁধে চুল
কানাই খেওয়া বায়
চুল ও না বান্ধিয়া রাধে, মাথায় দ্যায় রে হিয়া (সিঁদুর)
কানাই খেওয়া বায়
মথুরা তে চললো রাধে উলুধ্বনি দিয়া
কানাই খেওয়া বায়…!

২.

ধান নাড়ো, ধান নাড়া রাধে আউলে মাথার চুল
বলো হরি বোল
জল পিপাসায় জীবন গেল, ইডা কেমন দেশ
বলো হরি বোল
এই কথা শুনিয়া রাধের কিঞ্চিৎ দয়া হলো
বলো হরি বোল
কংকেতে (কাঁখে) কলসি নিয়ে যমুনায় চলিল
বলল হরি বোল
মাঠে ছিল শ্রীদাম-সুবোল কলসি ভাঙ্গিল
বলো হরি বোল
ওপাড় ছিল কুমোর ভাই রে, বলে হরি হরি
বলো হরি বোল
হরি হরি বলে কুমোর মাটিখানি ছ্যানে
বলো হরি বোল
মাটিখানি ছেনে কুমোর তুলে দিল চাকে
বলো হরি বোল
শ্রী রাধিকার মান কলসি হলো আড়াই পাকে
বলো হরি বোল
সোনার দিও পেটিখানি, রুপার দিও কাঁধা
বলো হরি বোল
কাদার উপর লিখে দিও কলংকিনি রাধা
বলো হরি বোল… ॥

৩.

নন্দ যায় রে বাথানেতে, যশোদা যায় ঘাটে
শূন্য গৃহ পেয়ে গোপাল সকল ননী লোটে।
ও করিলি কি রে গোপাল, ও করিলি কি
কংসের যোগানো ননী সকলে খাইলি
আমি তো খাইনি রে ননী, খাইছে বলাই দাদা
আমি যদি খাইতাম ননী, ভাণ্ডে থাকতো আধা।
বলাই দাদা খাইছে ননী, ভাণ্ড হলো সাদা
ছড়ি হাতে নন্দরাণী ধায় গোপালের পিছে
লম্ফ দিয়ে উঠলো গোপাল কদম্বেরই গাছে
পাতায় পাতায় ফেরে গোপাল, ডালে না দেয় পাও
তাই দেখে নন্দরাণীর ভয়ে কাঁপে গাও।
নামো নামো নামো গোপাল পেড়ে দেই তোর ফুল
কদম্বেরও ভাল ভাঙ্গিয়া হারাবি তোর কুল।
একো সত্য করো মাগো, দুয়ো সত্য করো
নন্দঘোষ তোমার পিতা যদি আমায় মারো।
দুয়ো সত্যি করি গোপাল, তিনো সত্যি করি
নন্দঘোষ তোমার পিতা যদি আমি মারি।
নালা ভোলা দিয়ে রাণী গোপালকে নামালো
গাভী বাঁধা দড়ি দিয়ে গোপালকে বাঁধিল।
কি না বান্ধন বাঁধলি মাগো, পিষ্ঠে দিয়ে মোড়া
বান্ধনের তাপে মাগো ছুটলো হাড়ের জোড়া।
ঐ কথা শুনে রাণীর কিঞ্চিৎ দয়া হল
হস্তের বাঁধন খুলে দিয়ে গোপালরে কোলে নিল।
আসুক আজ নন্দ বাড়ি, বেচে ফেলুক ধেনু
নগরে মাঙিয়া খাব, কোলে সোনার কানু ॥

কখনও বা গায় তারা নিমাই সন্ন্যাস। বিল সিংহনাথ এলাকায় এই গান অতি জনপ্রিয়। মূল গায়ক একটি করে লাইন গায়; তার পিছে-পিছে প্রতিটি লাইনের পরে দোহাররা গাইতে থাকে ‘নিমাই যেও না সন্ন্যাসে…’

শচীমাতার আকুতি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মনকে খুব সহজেই স্পর্শ করে–

নিমাই যেও না সন্ন্যাসে…
ঘরে তোমার শচীমাতা বাঁচিবে কেমনে।
ওরে একো মাসের কালে নিমাই নিয়া রে হিয়া
দুয়ো মাসের কালে নিমাই হলেন জানি জানি রে
তিনো মাসের কালে নিমাই রক্তে হলেন ঘোনা
চারো মাসের কালে নিমাই হাড়ে মাংস জোড়া
পঞ্চো মাসের কালে নিমাই পঞ্চ ফুল ফোটে
ছয়ো মাসের কালে নিমাই মাথায় চুল ওঠে
সাত মাসের কালে নিমাই সাথে অন্ন খায়
অষ্টো মাসের কালে নিমাই মামা বাড়ি যায়
নয়ো মাসের কালে নিমাই নব গণস্থিতি
দশো মাসে দশো দিনে হলো পূর্ণতিথি
নিমাই চাঁদ যে জন্ম নিলো নিম্বতরু তলে
বাইছা বাইছা নাম রাখিলাম নিমাই চাঁদ তোমারে
বড় হইয়া নিমাই সন্ন্যাসে যায় জননী রে ছাড়িয়া।
ঘরে বধূ বিষ্ণুপ্রিয়া জ্বলন্ত অগিনি (অগ্নি)
আর কতকাল রাখবো তারে দিয়া মুখের বাণী
দেখ দেখ নদীয়ার লোক, দেখ রে চাহিয়া
নিমাই চাঁদ যে সন্ন্যাসে যায় জননী ছাড়িয়া
লেখাপড়া করে নিমাই পণ্ডিত হলেন বড়
জগৎকে তুমি বুঝাইতে পারো, জননী কেন ছাড়ো
নিমাই যেও না সন্ন্যাসে…!

এসব গান গেয়ে তারা পাড়ায় পাড়ায় ঘোরে, আশেপাশের গ্রামে চলে যায়। সাথে থাকে হারমোনিয়াম, খোল, করতাল, কাসি। ধামা নিয়ে দুই-তিনজন পেছনে থাকে। গান শেষ হলে তারা ধামা নামিয়ে হাঁক দেয়–কৈ গো মা নক্ষী, মাঙন দ্যান গো…

মা লক্ষ্মীরা চাল দেয়, ডাল দেয়, তরি-তরকারি এনে দেয়। দুই-চার পয়সাও দেয় কেউ কেউ। কোনো জোর নাই, জবরদস্তি নাই। যে যা দেয় তাই সই।

পুষুরের আগের দিন চেঁচড়ার বিলে পলো নামে। এলাকার ছেলে-বুড়ো হাজার হাজার মানুষ সূর্য ওঠার আগেই চেঁচড়ার বিলে গিয়ে জড়ো হয়। লাইন দিয়ে তারা পলো নিয়ে দাঁড়ায়। টিনের চোঙা নিয়ে দুই দিকে কমিটির লোকজন দাঁড়ানো থাকে। চোঙা ফুকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার সাথে সাথে সার বেঁধে তারা পলো নিয়ে জলে ছাপ দিতে দিতে সামনের দিকে এগোয়।

চেঁচড়ার বিল এই এলাকার সংরক্ষিত বিল। এই বিলে পুযুরের আগে মাছ ধরা নিষেধ। পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন একসাথে সবাই মিলে নামে বিলে। তারপর উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। তখন ইচ্ছেমতো মাছ ধরতে পারে সবাই। এই নিয়ম কবে চালু হয়েছে তা বলা মুস্কিল। তবে এলাকার সবাই এটা নিষ্ঠার সাথে পালন করে। এই বিলে নানারকম মাছ পাওয়া যায়। তবে বড় বড় শোল আর বোয়াল মাছের জন্যেই মূলত চেঁচড়া বিলের খ্যাতি।

মাছ মেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর। এরপর শুরু হয় মেয়েদের কাজ। আগে থেকেই আঁশবটিতে ধার দিয়ে রাখা হয়। উঠোনে সারিসারি ফেলে রাখা মাছ তারা ছাই দিয়ে দক্ষ হাতে একের পর এক কুটে ফেলতে থাকে। এভাবেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে। লবণ-হলুদ মাখিয়ে সামান্য তেলে নাড়াচাড়া করে সিদ্ধ অবস্থায় মাছগুলো রেখে দেয়া হবে কালকের জন্য। একে বলে ঘেঁই দিয়ে রাখা। হেঁই দেয়া মাছ রান্না হবে পুষুরের সকালে। পিঠে খাবার পর ঝালমুখ হবে এই মাছে।

এজন্যে আজ মেয়েদের কোনো অবসর নাই। সারা রাত ধরে চলবে পিঠে বানানো। সরা, কুলি, দোলো, চিতই, পাটিসাপটা ইত্যাদি হরেক রকমের পিঠে। বাচ্চারাও আজ রাত জাগবে, যতক্ষণ পারে। চাদর গায়ে উনুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে পিঠে বানানো দেখবে। মাঝেমধ্যে উনুনে খড়িটা ঠেলে দেবে আর গরম গরম পিঠে খাবে। তারপর একসময় তারা ঘুমিয়ে পড়বে। চোখে তাদের লেগে থাকবে স্বপ্ন স্বপ্ন ভাব।

২১

সকাল থেকেই ছুটাছুটি করছে নৃপেন।

বাহিরচর গ্রাম থেকে তার মেয়েটাকে আজ দেখতে আসবে ছেলে পক্ষ। নৃপেনের বড় ভায়রার বাড়ি বাহিরচরের পাশের গ্রাম ইশেলবাড়ি। পাত্রপক্ষের লোকজন নিয়ে দুপুরের মধ্যেই তার চলে আসার কথা।

নৃপেন অতিশয় দরিদ্র। জায়গা-জমি বলতে তার এই ভিটেটুকুই সম্বল। মাঠে এক ছটাক জমিও নাই। অন্যের বাড়ি পরেত বেচে সংসার চালায়। সবসময় কাজও থাকে না। মাঝেমধ্যেই উপোস দিতে হয় ছেলেমেয়ে নিয়ে। বড় মেয়েটার বিয়ে সে অনেক কষ্টে দিয়েছে। সেই ধারদেনা আজও শোধ করে উঠতে পারেনি। তার পিঠাপিঠি এই মেয়েটাও। গায়ে-গতরে সেয়ানা হয়ে উঠেছে অনেক আগেই। গ্রামের সবার নজরে পড়ে। বারবার তাগিদ আসে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার জন্যে। না-হলে মেয়ে আইবুড়ো থেকে যাবে।

বিষয়টা সত্য। একবার যদি এলাকায় প্রচার হয়ে যায় যে, মেয়ের বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে তাহলে ঘোর বিপদ। সহজে আর পাত্র মিলবে না। সেই ভয় ঢুকে গেছে নৃপেনের মনের মধ্যে। এলাকার প্রথা হলো, বারো বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মেয়ে বিয়ে দিয়ে দেয়া। তারা মনে করে, দশ-এগারোতে মেয়েদের রজঃপ্রাপ্তি ঘটে। বারোতে হয় পূর্ণ সাবালিকা। তার আগেই মেয়ের বিয়ে দেয়া উচিত। গৌরি দানের চলও আছে এ এলাকায়। অর্থাৎ আঁ বছর বয়সে কন্যাদান করতে পারলে পুণ্যের ভাড় হয় কানায় কানায় পূর্ণ। সেটা অবশ্য নির্ভর করে ভালো সম্বন্ধ পাওয়ার উপর।

হাজারিকে বলে রেখেছে নৃপেন। মেয়ে দেখার সময় যেন উপস্থিত থাকে সে। এরকম অনুষ্ঠানে শিক্ষিত একজন মানুষ থাকলে কথাবার্তায় অনেক সুবিধে হয়। এলাকার মধ্যে কলেজে পড়ে সে একাই। সে হিসেবে হাজারির বেশ নামডাক। তার উপস্থিতি ছেলে পক্ষের মন নরম করতে ভূমিকা রাখবে খানিকটা।

কিন্তু মন স্থির হচ্ছে না নৃপেনের কিছুতেই। ছেলেপক্ষ তো পণ চাইবে। কেমন হবে তার পরিমাণ! কোথায় পাবে সে পণের টাকা! এতসব চিন্তার ভিতরেও সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জোগাড়যন্ত্রের। একটা বড় মাছের আইটেম রাখতে পারলে বেশ হত। ইলিশ হলে সবচেয়ে ভালো হয়। কিন্তু সে সামর্থ্য তার কোথায়?

নৃপেন ভালো করেই জানে, মেয়ে যদি পছন্দ না হয়, আর পণের টাকার হিসেব যদি না মেলে তাহলে কিছুতেই কিছু হবে না। তবু কোনো খুঁত রাখতে চায় না সে। সর্বতোভাবে চেষ্টা তার ছেলেপক্ষের মন নরম রাখার।

ওরা এলো দুপুরের দিকে। সূর্য তখন মাথার উপরে। উঠোনের এক কোনায় ছোট্ট জলচৌকি। সামনে পিতলের বদনা আর বালতি ভরা জল। একে একে ছেলেপক্ষের লোকজন জলচৌকিতে এসে বসছে। নৃপেনের ছেলে তাদের পা ধুইয়ে ঘাড়ের উপরে রাখা গামছা দিয়ে অতি যত্নে মুছিয়ে দিচ্ছে। অতিথি হলো নারায়ণ। তাদের যথাযথ সেবা-যত্ন হওয়া দরকার। গ্রামের মানুষ যেন বলতে না পারে, নৃপেন তোমার এই ত্রুটির কারণে বিয়েটা ভেঙে গেল।

নৃপেন আগে পাত্রপক্ষের লোকজনের খাওয়া-দাওয়া করিয়ে দিতে চায়। ভরা পেটে মনটা দরাজ থাকে।

এই দায়িত্বটা সে হাজারির উপরে দিয়ে রেখেছে। সুচারুভাবে সেটা পালিতও হয়েছে। ছেলেপক্ষ চেয়েছিল আগে মেয়ে দেখে নিতে।

হাজারি বিনয়ের সাথে বলল–অনেক দূর থেকে আইছেন আপনারা। আপনারা হলেন অতিথি, নারায়ণ। এদিক বেলাও গড়ায়ে গেছে। তাই আগে দুটো সেবা নিয়ে নিতি হবে। শাস্ত্রে আছে, আগে অতিথি সেবা, তারপর অন্য কিছু। দয়া করে আমাদের অপরাধী বানাবেন না। বলেই সে হাতজোড় করে ফেলে।

একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করে আর মেয়ে? সে তো দেখবেনই। ফর্সা, মুখের কাটিং ভালো। আপনাদের পছন্দ হবে। রান্নাবান্না, হাতের কাজ সব জানে, একেবারে সাক্ষাৎ লক্ষ্মী।

হাজারির কথার মধ্যে যথেষ্ট আন্তরিকতা ছিল। সেটা স্পর্শ করল ছেলেপক্ষকে।

বারান্দায় লম্বা করে বড় বড় কাঠের পিঁড়ি পাতা হয়েছে। তারা খেতে বসল। নৃপেন আয়োজন মন্দ করে নাই। ইলিশ মাছ সে বাজারে পায় নাই। তবে চন্দনা নদীতে বিশাল এক বোয়াল ধরা পড়েছিল। ওজন নাকি সোয়া মণ। জামালপুর বাজারে অত বড় মাছ কেনার খরিদ্দার নাই। শেষমেশ কেটে ভাগা দেয়া হলো। আঁ আনা দিয়ে তার এক ভাগা নিয়ে এসেছে নৃপেন। পেটির মাছ বেশি নাই। তবু নৃপেন চেষ্টা করেছে ছেলে, ছেলের বাবা আর মামার পাতে যাতে বোয়ালের পেটি পড়ে।

রান্না ভালোই হয়েছে। নৃপেন পাশের গ্রাম গোপীনাথপুর থেকে গোপালের মাকে হাতে-পায়ে ধরে রান্নার জন্যে নিয়ে এসেছিল। সেটা যে বেশ কাজে লেগেছে তাতে কোনো সন্দেহ নাই।

বড় একটা ঢেঁকুর তুলে ছেলের মামা বললেন নিয়ে আসেন মিয়াডারে।

দুই-তিনজনে মিলে ক্ষেন্তিকে বারান্দায় নিয়ে এলো। পানের থালাটা সামনে রেখে সবার উদ্দেশে গড় হয়ে প্রণাম করল। তারপর মাথা নিচু করে বসল সে। ক্ষেন্তি যথেষ্ট সুশ্রী। গায়ের রং ভালো। হাজারির কথাই সত্যি। এক দেখাতেই মেয়ে পছন্দ হয়ে গেল ছেলেপক্ষের। ছেলের বাবা তাকালেন ছেলের মামার দিকে, মামা তাকালেন ছেলের দিকে। ইশারায় কথা হয়ে গেল। হাজারি বুঝল, প্রথম পর্ব সফলভাবেই উতরে গেছে তারা। কিন্তু আসল পর্ব তো সামনে। সেটা পার হবে কি করে নৃপেন!

মা, তুমার নাম কী? মামা মোলায়েম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন।

কুমারী ক্ষেন্তি রাণী মন্ডল।

বেশ বেশ। তা মা রান্নাবান্না কিছু জানো?

মাথা নাড়াল ক্ষেন্তি।

সিলাই-টিলাই পারো কিছু?

ক্ষেন্তি বাঁয়ে তাকাল। দরজায় দাঁড়ানো পিসি ইঙ্গিত করতেই সে আবার মাথা নাড়ল।

বাঃ, বেশ ভালো। তা মা নক্ষ্মীরা, এট্টু কি জল নিয়ে আসতি পারেন?

জলটুকু মাটিতে ঢেলে দিয়ে মামা বললেন–এট্টু হাঁটো তো মা। এই জাগায় বাম পা ডা এট্টু ফেলো তো।

খেন্তি উঠে দাঁড়াল, হাঁটল এবং বেশ দক্ষতার সাথে আস্তে করে জলের উপরে পা ফেলল। এই পা ফেলা তার কাছে নতুন নয়। ছেলের মামা সন্তোষ প্রকাশ করলেন। মেয়ের পায়ের ছাপ লক্ষ্মীমন্ত।

আচ্ছা মা, ইবার এট্টা প্রশ্ন করি। চিন্তা-ভাবনা করে উত্তর দিবা কিন্তক। দ্যাকপো তোমার বুদ্ধি কেমুন। বললেন সাথে আসা প্রবীণ মুরুব্বি।

ক্ষেন্তি মাথা নাড়ল। সে জানে প্রশ্নটা কী। তাই উত্তর কীভাবে দেবে তার প্রস্তুতি মনে মনে নিতে লাগল।

আচ্ছা মা, ধরো তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। সংসার করতেছো। তোমার বাবা আইচে তুমার বাড়ি বেড়াতি। এদিক তুমার স্বামীও আইচে সে সুমায়। মাঠের তে। দুইজনেই একসাথে জল খাতি চালো তোমার কাছে। তহন তুমি কী করবা? কারে আগে জল আনে দিবা?

ক্ষেন্তি এর আগে পাঁচবার এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়েছে। কিন্তু বিয়ে তার হয়নি। প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই সে উত্তর দিতে পারত। কিন্তু পিসি বারবার করে শিখিয়ে দিয়েছে সাথে সাথে কথা না বলতে। সময় নিতে হবে। যাতে পাত্রপক্ষ বোঝে যে, অনেক ভেবে-চিন্তে সে এই কঠিন প্রশ্নের সমাধান বের করেছে। ক্ষেন্তি তাই করল।

বেশ খানিকটা সময় ক্ষেপণ করে সে। দক্ষ অভিনেত্রীর মতো উত্তর হাতড়ায়। তারপর ইতস্তত করে ধীরে ধীরে বলে–স্বামীর জন্যিই আগে জল নিয়ে যাব। তিনি জলডা খাতি থাকপেন। আর আমি তারে তালপাখার শীতল বাতাস দিতি থাকপো। স্বামীর শরীলডা জুড়োলি তার অনুমতি নিয়ে বাবার জন্যি জল আনতি যাব, যত্ন করে বসায়ে খাতি দেব।

কিন্তু কেন? বাবারে আগে দিবা না ক্যান? তিনি হলেন তোমার জন্মদাতা পিতা।

পিতা ধম্ম, পিতা সগগো–অতি সত্য কথা। কিন্তু আজ্জ্য নারীর বিয়ে হয়ে গিলি স্বামীই তার সবকিছু। স্বামীই জীবন, স্বামীই মরণ। সগৃগলের মাতার উপরে স্বামী। তারপর অন্য কিছু।

সাবাস মা। তুমার তো ম্যালা বুদ্ধি। আয়ুষ্মতি হও মা। যাও, ভেতরে যাও। ওরে নিয়ে যান মা লক্ষ্মীরা।

ছেলের বাবাকে খুশি খুশি দেখায়। ক্ষেন্তি আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে চলে যায়।

হাজারি ভিতরে ভিতরে বড়সড় একটা ধাক্কা খেল। মেয়ে দেখার অনুষ্ঠানে এর আগেও সে অনেকবার উপস্থিত থেকেছে। স্বামীকে জল খাওয়ানোর এই প্রশ্ন এই এলাকায় মেয়ে দেখার অনুষ্ঠানে একেবারে কমন। তারপরও ছেলেপক্ষের লোকজন মনে করে, এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর যে মেয়ে দিতে পারে সে অতিশয় বুদ্ধিমতী। যেন এক পাতানো খেলা। এতদিন সে বাবা অথবা স্বামীকে জল খাওয়ানোর বিষয়টা নিয়ে তেমন করে ভাবেনি।

কিন্তু আজ হাজারির মনে নতুন প্রশ্নের জন্ম হলো, তাই তো! বাবাকে আগে নয় কেন? এ তো রীতিমতো অসভ্যতা। কোনো ভদ্র-সভ্য সমাজে কি এই নিয়ম থাকতে পারে? একে জন্মদাতা পিতা, তার উপরে অতিথি। অতিথি যদি নারায়ণ হয়, তাহলে সেবা তো তারই আগে প্রাপ্য। কোনো নিয়মেই স্বামীর হয় না। বাবা-মার উপরে কারো স্থান কোনো যুক্তিতেই থাকা উচিত নয়।

বিষয়টা নিয়ে হাজারি অন্যভাবে ভাবার চেষ্টা করে। একই ঘটনায় বাবার স্থানে যদি অন্য কেউ থাকে, তখন কী হবে? না, ধারণাগুলো বদলাতে হবে। এক দিনে তো আর হবে না। তার জন্যে নিজেকে তৈরি করতে হবে আগে।

পান মুখে পুরে মামা খোশ মেজাজে গল্প করতে লাগলেন। হাস্যরসও মন্দ হলো না।

হাজারি দম বন্ধ করে বসে আছে কখন তারা দেনা-পাওনার প্রসঙ্গটা তুলবে। সে ভালো করেই জানে, এসব গালগল্প, হাস্যরস হচ্ছে ভূমিকা মাত্র। অবশেষে এসে পড়ে অপেক্ষার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মামা গলা খাকারি দিয়ে এমনভাবে অবতারণা করলেন যেন বিষয়টা অতি সামান্য। বলতে ভুলে গিয়েছিলেন, হঠাৎ মনে পড়ে গেছে। এই কায়দাটাও সবারই জানা। তারাও কোন জায়গায় মেয়ে দেখতে গেলে এভাবেই যৌতুকের বিষয়টা উত্থাপন করে।

ও আচ্ছা, এট্টা বিষয় তো কতি ভুলেই গিচিলাম। সব তো ভালোয় ভালোেয় হয়ে গেল। মিয়াও আমাগের তেমন অপছন্দের না। তয় কতা হলো, দেনা-পাওনার বিষয়ডা এট্টু ঠিক করে নিলি ভালো হত না? কী কন আপনেরা?

তা তো বটেই। তয় নিপেনের আর্থিক অবস্থার কতা তো জানেন আপনেরা। গরির মানুষ, জাগা-জমি নাই। পরের জমিতি পরেত বেচে কোনোমতে ছাওয়াল মিয়ারে বাঁচায়ে রাহিছে। আপনেরা বিজ্ঞজন, সেই মতো বিবেচনা করবেন। দেবেন খুড়ো বিনয়ের অবতার সেজে বলল।

নৃপেন হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে রইল। সে কোনো কথা বলবে না। এই আসরে কনের বাপের এটাই করণীয়।

তা বুজতি পারিচি। তয় নাকের আর কানের তা দুয়ার কতা তো আর কওয়া লাগে না। উতা সবাই দেয়। আংটি তো সোনা-কাপড়ের সুমায় দিবিই। সাথে ওজনমতো এট্টা গলার তা যদি থাহে, তালি আর এসব নিয়ে আমি কিছু কতি চাই নে। আমার কতা হলো, নগদে কত দুয়া-থুয়া হবি সিডা নিয়ে। আর কতার মদ্যি ছাওয়ালের ছোট্ট এট্টু শখ ছিল। এট্টা রেডিও আর একখান রেলি সাইকেল। সামান্য এইটুক নিষ্পত্তি হলি বিয়ের দিন-তারিক নিয়ে কথাবার্তা কওয়া যায়। কঠিন হয়ে ওঠে ছেলের মামার মুখ।

থমথমে স্তব্ধতা নেমে আসে সভায়। আশা ছিল ভালো খাওয়া-দাওয়া, যত্ন-আত্তি, মেয়ের ফর্সা গায়ের রঙ, মুখের কাটিং সব মিলিয়ে ভালো প্রভাব ফেলবে। কিন্তু কাজে লাগিল না তেমন।

হাজারি ভাবে, সমাজ থেকে কবে উঠে যাবে এই পণপ্রথা!

কেউ কোনো কথা বলে না। অনেকক্ষণ পরে জ্ঞানেন্দ্র মাস্টারমশাই মুখ খুললেন। এসব আসরে তিনি কারো কাছেই কাম্য নন। তিনি ঠোঁটকাটা। নির্দ্বিধায় উচিত কথা বলে ফেলেন। বিয়ের আসরে তো আর উচিত কথা চলে না!

তা বাপু, কায়দা করে তোমাগের চাওয়া তো বেশ চায়ে ফেলালে। ইবার কও তো, মিয়াডারে তোমরা কী দিয়ে আশীৰ্বাদ করবা?

সিডা আমাগের ঠিক করাই আছে।

ঠিক করা আছে, ভালো কথা। কিন্তু, জিনিসটা কী জানতি পারলি আমাগের এট্টু সুবিদে হত। আমার তো মনে হয়, তোমাগের যখন বড় অবস্থা, তখন যে সোনার হার দিয়ে মিয়ার সোনা-কাপড় করবা সিডার ওজন কমপক্ষে আড়াই-তিন ভরি তো হওয়াই লাগবি। তারপর কানের জন্যি ধরো এক ভরি আর আংটি এট্টা আঁ আনা না হলি চলৰি ক্যাম্বা? টিকলি তো বিয়ের কনেরে দুয়াই লাগে। নালি তোমাগের সম্মান থাকপি কীরম করে?

ছেলের মামার মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। ছেলের বাবারও।

হাজারি মনে মনে খুব খুশি। একেবারে ধন্বন্তরি ওষুধ। যেন চিনে জোকের মুখে নুন পড়েছে। এবার সে আগ বাড়িয়ে হাল ধরল।

জ্যাঠা, উনারা হলেন আমাদের অতিথি। কথাডা ঠিক হলেও এরম করে বললি তো উনাদের মান থাকে না। দেনা-পাওনার কথা ছেলেপক্ষই তোলে। এটাই রেওয়াজ। কোনো জাগায় মেয়ে দেখতে গিলি আমরাও কি দেনা পাওনার কথা তুলি নে? তয় উনারা বলিছেন, তা হচ্ছে কথার কথা। সত্যি সত্যি দিতে হবে, তাতে আর উনারা বলেন নাই। ঠিক না?

হ, তাই তো। আমরা চাইছি। এখন কী দিতি পারবেন সিডা আপনাগের বিবেচনা। ছেলের মামা যেন অকূলে কূল পেলেন।

ঠিক কথা বলিছেন। দেখিছেন জ্যাঠা, উনারা কত সজ্জন মানুষ। কতখানি ভদ্রতা উনাগের মদ্যি। অন্য কেউ হলি তো রাগ করে উঠে চলে যাতি পারতেন।

কথার মারপ্যাঁচে একটু কায়দা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে হাজারি।

সময় না দিয়ে আবার বলতে শুরু করে সে-জীবন-মৃত্যু-বিয়ে, ভগবানের হাত দিয়ে। এই জুটি ভগবান ঠিক করেই রাখিছেন। আমাদের কাজ হলো ঠিকমতো জোড়া লাগায়ে দেওয়া। না দিতি পারলি, আমাদের অপমান। উনাদেরও অপমান। বিয়ে এখন কীরম করে দেওয়া যায়, সেই পথ খুঁজে বার করতি হবি। কী কন? হাজারি ছেলের মামার দিকে জিজ্ঞাসুনেত্রে তাকায়।

লাক কতার এক কর্তা। এই কতার উপর আর কোনো কতা হবি নে। আমাগের ছাওয়ালের জন্যি এই মিয়াই আমরা নিলাম। দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা দেন মামা।

তালি নিপেন দা, এখন তুমার পালা। উনাদের বড় মনের পরিচয় উনারা দিয়ে ফেলিছেন। এখন কও তুমি কী করবা। মেয়ে তো আর খালি হাতে বিয়ে দেয়া যাবি নে। উনাদের সম্মান তো রাখতি হবি।

তুমি হাজারি যিড়া কবা, সিডাই করব। মিয়া আমি উনাগের দিয়ে দিলাম। তয় গরিব মানুষ, পরেত বেচে খাই। আমার পর অল্যাজ্য জুলুম জ্যান না হয়, সিডা এট্টু দেকপা–এই আমার আজ্জি।

তা বললে তো চলবে না নিপেন দা। উনারা হলেন এলাকার সম্মানী মানুষ। উপযুক্ত সম্মান তো দিতে হবি। নালি উনারাই বা সমাজে মুখ দেখাবি কীরম করে?

ঠিক কথা। আমাগের সম্মানডা যাতে থাকে সেদিকটা এট্টু দ্যাপেন। ছেলের মামা উদার হয়ে বলেন।

এই সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিল হাজারি। ওষুধ কাজে লেগে গেছে। তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে গলায় যতটা সম্ভব বিনয় ঢেলে বলল–তবে নিপেন দা সত্য কথাই বলিছে। এক ছটাক জমিও তার নাই। পরেত বেচেই সংসার কোনোমতে ঠ্যাকা দিয়ে রাখিছে। আত্মীয় যখন হয়েই গেছেন, তখন সবার সম্মানের দিকই বিবেচনায় রাখতি হবি। নিপেন দা তুমিই কও, কী কী দিতি পারবা?

মিয়ার এক জোড়া কানের দুল আর ছাওয়ালের আংটি আমি য্যাম্বা পারি দিবা নে। আর ছাওয়াল যহন শক করিচে এট্টা রেডিও আমি কষ্টে ছিষ্টে দেবো। আর যদি কিছু কও, মারে ফেলালিউ পারবা না।

তা বললি কী হয়? সোনার না পারো রুপার দিবা। দুল আর আংটি দিবা সোনার। গলার হার আর কপালের টিকলি দিবা রুপার। আর ছেলে যখন শখ করিছে, তখন রেডিও না, দিবা একখান সাইকেল। না বললি কিন্তু হবে না। তাহলে এই সাব্যস্ত হলো। কী বলেন সবাই!

কেউ কোনো উত্তর দেবার আগেই দম না ফেলে সে বলে–এখন তাহলে দিন-তারিখট ঠিক করে ফেলা যাক। এই পঞ্জিকাটা নিয়ে আয় তো।

এক নিশ্বাসে সবকিছু করে ফেলল হাজারি। সে কোনো সুযোগ দিতে চায়। দিলেই ঘটনার মোড় আবার অন্যদিকে ঘুরে যেতে পারে।

২২

আঁ মাসের বেতন বাকি। সাথে অন্যান্য ফি।

সব মিলিয়ে ফর্ম ফিল-আপের টাকার অংকটা নেহায়েত কম নয়। যতিশংকর স্যার যদিও বলেছেন টাকা জোগাড় হয়ে যাবে। কিন্তু হয়নি এখনও। হাতে আছে আর মাত্র তিনটে দিন। চিন্তায় অস্থির হাজারি। কী করবে সে!

স্যারের বাড়িতে থাকা-খাওয়ার সমস্যা নেই। মাসিমার মনও জয় করে ফেলেছে সে। শুধু ফেলেছে বললে ভুল হবে, মাসিমা এখন হাজারি ছাড়া কিছুই বোঝেন না। সে বিলের মানুষ, অনেক ভারী ভারী কাজ করে অভ্যস্ত। শহরের বাড়ির এসব কাজ তো নস্যি তার কাছে। তবে, মাসিমা সবচেয়ে বেশি খুশি তার গাইটার যত্নের বহর দেখে। নিয়মিত হাজারি মাঠ থেকে ঘাস কেটে আনে। খড় সাইজ করে কেটে কুড়ো মেশানো জলে ভিজিয়ে খাওয়ায়। নদী থেকে স্নান করিয়ে আনে। দুদিনেই গাইটার গায়ে চেকনাই লেগে গেছে।

বিএ-এর শেষ ক্লাস আজ। ক্লাসশেষে চিন্তিত হাজারি হাঁটতে লাগল উদ্দেশ্যহীনভাবে। সামনে যে মৃন্ময়ী দিদি দাঁড়িয়ে, তা সে খেয়ালই করেনি।

কী ব্যাপার হিমাংশু?

চমকে উঠে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সে।

তুমি দেখো নি আমাকে!

স্যরি দিদি। খেয়াল করি নাই। আপনি ভালো আছেন তো? দিদির সামনে হাজারি সতর্ক থাকে। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা করে।

তা আছি। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা কী? দেখাও করো না। খোঁজও নাও না আমার।

ঝামেলার মধ্যে আছি দিদি। তাই সময় করে উঠতে পারি নাই।

কী ঝামেলা?

তেমন কিছু না। বন্যায় আমাদের বিল তলায়ে গেছে। বাড়ি থেকে টাকা পাঠাতে পারে নাই। তাই একটু সমস্যার মধ্যে আছি। ভাববেন না দিদি। মিটে যাবে সব।

তাই নাকি? ফর্ম ফিল-আপ করে ফেলেছো?

না মানে, এখনও ঠিক করে উঠতে পারি নাই। তবে হয়ে যাবে। কায়দা বায়দা করে একভাবে হয়েই যাবে।

হ্যাঁ, তা নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু কীভাবে হবে সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।

স্যার বলেছেন, একটা ব্যবস্থা তিনি করে ফেলবেন।

শোনো, যতিশংকর স্যার বড় মনের মানুষ। তোমার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু ধনী নন। তার উপরে চাপ দেয়া কি ঠিক হবে?

না দিদি, তা ঠিক হবে না।

কিন্তু, তাই তো করছো তুমি। স্যার হন্যে হয়ে এখানে-ওখানে ঘুরছেন। টাকার জন্য।

আপনি কেমন করে জানলেন দিদি?

তুমি তো শুধু মুখেই ডাকো। আসলে তো দিদি মনে করো না আমাকে।

ভগবান সাক্ষী দিদি। আপনারে আমি মায়ের পেটের বোনের চাইতেও বেশি সম্মান করি।

তার কোনো নমুনা তো তোমার আচরণে দেখি না।

কেন দিদি, কী অপরাধ করলাম আমি। বলেন। এখনই প্রায়শ্চিত্ত করব।

অনেক বড় অপরাধ করেছো তুমি। তোমার এত বড় বিপদ। কিন্তু আমাকে একবার জানানোরও প্রয়োজন মনে করোনি।

আসলে ঠিক তা না দিদি। আপনার কথা বারবার মনে হয়েছে। কিন্ত লজ্জায় আর বলে উঠতে পারি নাই।

ধন্য করেছ আমাকে। কৃতার্থ করেছ। এসো আমার সাথে।

কোথায়?

জাহান্নামে। আবার কোথায়? বলে মৃন্ময়ী হাঁটতে শুরু করে।

হতভম্ব হাজারি তার পেছন পেছন এগোতে থাকে। প্রশাসনিক ভবনের বারান্দা পার হয়ে বাম-পাশের কক্ষে ঢুকতেই ক্লার্ক উঠে দাঁড়ায়।

দিদি, সব রেডি করে রেখেছি। শুধু একটা সই লাগবে। হিমাংশু, এখানে একটা সই দাও তো। তাহলেই তোমার বিএ পরীক্ষার ফর্ম ফিল-আপ শেষ।

কিন্তু টাকা? হাজারি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে।

টাকা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। দিদি সব পরিশোধ করে রেখেছেন। তুমি যে দিদির ভাই হও, তা বলবে না! তাহলে কি দিদিকে এত কষ্ট করতে হয়?

মৃন্ময়ীর দিকে তাকায় হাজারি। চোখে তার স্নেহের ঘন মেঘ। ইঙ্গিতে বলল, সই করো। সে নির্দেশ অমান্য করার ক্ষমতা হাজারির নেই।

ফর্মটা টেনে নেয় হাজারি। দুচোখ বেয়ে তার টপটপ করে জল পড়ছে। বাম হাতে চোখ মুছে সে আবার কলম চালায়।

মৃদু একটা ধমক দিয়ে দিদি বলল–আগে সইটা শেষ করো। তারপরে ইচ্ছেমতো কেঁদো। তবে পুরুষ মানুষের কান্নাকাটি মানায় না। কেমন ন্যাকান্যাকা লাগে। খেয়েছে কিছু দুপুরে?

আমি তো দিদি সকালে একবারেই ভাত খেয়ে চলে আসি।

উদ্ধার করেছে। সকালে ভাত খেয়ে আসার সৌভাগ্য তো আর আমার হয়নি। খিদেয় পেট চো চো করছে। কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করো।

সবকিছু শেষ করে ওরা ইটের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে কলেজ গেটের বাইরে চলে এলো। একটা রিকশা ডেকে মৃন্ময়ী উঠে পড়ল। তারপর আদেশ করল–এসো।

আমি! তুমি না তো আর কে আছে এখানে?

হাজারি অতি সংকোচে গা বাঁচিয়ে মৃন্ময়ীর পাশে বসে। কোনো মেয়ের সাথে এক রিকশায় চড়েনি সে কখনও। ভীষণ অস্বস্তি ভিতরে ভিতরে উসখুস করছে। হেঁটে চলাফেরা করতেই অভ্যস্ত সে। রিকশায় চড়ে বাবুয়ানী করার সামর্থ্য কোথায় তার? কেমন যেন স্বপ্নের ঘোরে ঘটে যাচ্ছে সবকিছু। বিশ্বাস হতে চায় না। রিকশা চলতে শুরু করল।

কোথায় যাচ্ছি দিদি?

গেলেই দেখতে পাবে। গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দেয় মৃন্ময়ী দিদি।

মনের ভিতরে কৌতূহল। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না আর কিছু।

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সরকারি বাংলোর সামনে গিয়ে রিকশাটা দাঁড়ায়। গাছগাছালির ছায়াঢাকা বাড়ি। হাজারি ভয়ে ভয়ে লাল রঙের বাড়িটার দিকে তাকায়। গেটের ভেতরেও বেশ খানিকটা পথ। পথের দু-ধারে চমৎকার ফুলের বাগান। বাগান পার হয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকল তারা। নিচের একটা ঘরে হাজারিকে বসিয়ে মৃন্ময়ী সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল।

একটু পরে বেয়ারা এসে বলল–দিদিমণি উপরে ডাকছেন।

আড়ষ্ট ভঙ্গিতে হাজারি সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে যায়। ডাইনিং টেবিলে মুনায় বসে আছে। পাশে আর একজন মহিলা দাঁড়ানো। শান্ত-সৌম্য-সিগ্ধ। একটা মা মা ভাৰ চেহারায়।

এসো। ওইখানে হাত ধুয়ে টেবিলে এসে বসো।

তারপর মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বলল–বুঝলে বৌদি। এই হলো হিমাংশু। ওর কথাই তোমাকে বলেছিলাম।

হ্যাঁ, তোমার কথা শুনেছি। ভালো করে বসো। তা তোমাদের বাড়ি কোথায়? মুখে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন তিনি।

আমাদের বাড়ি বালিয়াকান্দি থানায়। নলিয়াগ্রাম রেল স্টেশনে নেমে মাইল দুয়েক হেঁটে যেতে হয়।

থাক বৌদি। সারাদিন অনেক ধকল গেছে বেচারার উপর দিয়ে। আগে চারটে খেয়ে নিয়ে সুস্থির হোক। কাল থেকে ও তো বুবলি আর বাবাইকে পড়াবে। তখন না-হয় ওর হাঁড়ির খবর একে একে জেনে নিও।

জিজ্ঞাসুনেত্রে হাজারির দিকে তাকিয়ে দিদি বলে–কী, পারবে না?

উত্তরের অপেক্ষা না করেই মৃন্ময়ী আবার বলতে শুরু করে–যতি স্যারের বাড়িতে আছো, ওখানেই থাকো। তবে প্রতিদিন বিকেলে এসে এদেরকে পড়িয়ে যাবে। তাহলে বাড়ি থেকে তোমাকে আর টাকা-পয়সা আনতে হবে না। নাও এখন শুরু করে খাওয়া।

গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের গন্ধে ম ম করছে চারদিকটা। সেই গন্ধে হাজারির পেটে খিদে চাড়া দিয়ে উঠল। কিন্তু কেন যে পোড়া চোখ দুটো আবার জ্বালা করে ওঠে…

মাথা নিচু করে কান্নার বেগ সামলানোর চেষ্টা করতে লাগল হাজারি।

মৃন্ময়ী অন্যদিকে তাকিয়ে বলল–যাও, চোখ-মুখটা ভালো করে ধুয়ে এসো। আরাম লাগবে।

বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় হাজারি। দুহাতে জল ভরে বেশ কয়েকবার চোখে ঝাঁপটা দেয়। কিন্তু চোখ আবার জলে ভরে আসে। মা-মরা, বাপ-মরা অনাথ হাজারি নিজেকে সামলাতে পারছে না কিছুতেই। এত আদর, এত স্নেহ কোনোদিন সে পায়নি। তার মতো তুচ্ছ এক হাজারির জন্য ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বোন এত ভাবে। তার খোঁজখবর রাখে। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না সে।

মৃন্ময়ী দিদিকে সে দেবীর আসনে বসিয়েছে। সেটা যে কতখানি যথার্থ, হৃদয় দিয়ে সে উপলব্ধি করল আজ।

২৩

মাঘ মাস।

বিল সিংহনাথ এলাকার মেয়েদের কাছে এই মাস আড়ম্বরপূর্ণ পার্বণের মাস। বাড়ি বাড়ি ভিটে কুমারীর পুজোয় মেতে ওঠে তারা। তুলসীতলায় মাটি দিয়ে তৈরি করে গোলাকার বেদি। সেখানে গোবর লেপে অধিষ্ঠান করে ভিটে কুমারী ঠাকুরাণীর আসন। প্রতি সন্ধ্যায় পাড়ার কুমারী মেয়েরা বুনো ফুল, মেঠো ফুল সংগ্রহ করে বেদি সাজায়।

বিকেল গড়িয়ে কখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। উঠোনের এক কোনে টুলের উপরে বসে আছে হাজারি। চেয়ে চেয়ে দেখছে মেয়েদের ভিটে কুমারীর আসন সাজানো। কী উৎসাহ আর উদ্দীপনা মেয়েগুলোর মধ্যে। তাদের কলকাকলিতে তুলসীতলা মুখরিত হয়ে উঠেছে। বেদির চারপাশটা মাটির প্রদীপ জ্বেলে সাজানো। ধূপ-ধুনোর গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে সারাটা উঠোনজুড়ে। ভীষণ ভালো লাগছে হাজারির।

কী রে! তোরা গান শুরু করবি কোন সময়? আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে সে।

এই তো হাজরা দা, আর এট্টু গুছায়ে নেই। তারপর গান শুরু হবি। পদ্ম পেছন ফিরে বলল।

তাড়াতাড়ি কর। তোদের গান শুনে একটু পুব পাড়ার দিকে যাব।

এহন তো তুমি টাউনির মানুষির মতোন কথা কও। আমাগের এই গাঁও গিরামের মিয়া মানষির গান কি তুমার ভালো লাগবে নে? লক্ষ্মী কৌতুক করে।

কী কথা বললি এটা? সেই জন্মের তে ভিটে কুমারীর গান শুনে আসতেছি। ভালো লাগবি নে, মানে? শহরে গিছি বলে কি আমার কী দুটো ডানা গজায়ে গেছে?

হিঃ হিঃ হিঃ, হাজারি কাহা কয় কী, তার বলে ডানা গজাইচে, হিঃ হিঃ…

ছোট্ট কাজলি হাততালি দিতে দিতে বলল।

আর পাকামো করতে হবে না। এবার গান ধর।

মেয়েরা সবাই দলবেঁধে ভিটে কুমারীর বেদির চারপাশে গোল হয়ে বসল। তারপর সমস্বরে একসুরে গাইতে শুরু করল

ভিটে কুমোরীর মা লো ভিটে বেঁধে দে
তোর ছাওয়ালে করবি বিয়ে সাজনা এনে দে।
বুড়ি গেলো রে সাজনা আনতি পথে পড়ল খেয়া
সেই খেয়া ধুয়ে নিল চেতেন পুরীর দেয়া।
চেতেন পুরীর দেয়া না রে হাঁড়ে খালির বর
বর আস্‌বি বর আস্‌বি কুমোর খালি ঘর

ওপার তে দাদার বউ পাও দ্যাখাইছে
এ পারে তে আমার দাদা মল গড়াইছে।
ও বালীর পাও তো চিকন চাকন মল গড়াইছে বিলক্ষণ। দুর্গা ঠাকুরাণীর জামাই গো বালীর জন্য আর কী আনিছে?

ঝাঁকে ঝাঁকে ছাওয়াল পাল, জাংলা ভরা তরু
গোলাভরা চাল ডাল, গোয়াল ভরা গরু।
ওপারের তে দাদার বউ কান দ্যাখাইছে
এ পারে তে আমার দাদা পাশা গড়াইছে।
ও বালীর কান ও তো চেকন চাকন
পাশা গড়াইছে বিলক্ষণ।
দুর্গা ঠাকুরাণীর জামাই গো
বালীর জন্যে আর কি আনিছে?

গান শেষ করে মেয়েরা উঠে পড়ল। এবার চলল তারা দলবেঁধে পাশের বাড়িতে। তারপর একে একে গ্রামের সব বাড়িতেই যাবে তারা। দলবেঁধে একই গান বারবার গাইবে। সারা মাঘ মাস ধরে চলবে তাদের এই আসর। গোটা সন্ধ্যাজুড়ে তুলসীতলা মুখরিত থাকবে ভিটে কুমারীর গানে।

মাঘের শেষ দিনে ভিটে কুমারীর বেদিগুলো উঠোন থেকে তুলে ফেলা হবে। নিয়ে যাওয়া হবে মাঝমাঠে। রাখা হবে কোনো এক বৃক্ষতলে। তারপর গড়িয়ে যাবে ফাল্গুন। শেষ ফাগুনের গোধূলীলগ্নে সেই বৃক্ষতলে গ্রামের সমস্ত কিশোর-কিশোরী এসে জড়ো হবে, বনভোজনের আয়োজনে মেতে উঠবে তারা। এই ভোজনে মাঠের সব রাখালদের নিমন্ত্রণ করা হবে। আদর করে ডেকে ডেকে খাওয়ানো হবে তাদের। ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রাণের টানে গড়ে উঠবে বন্ধুত্বের সম্পর্ক, ভাই-বোনের সম্পর্ক, গড়ে উঠবে আত্মীয়তা।

হাজারির মনের গভীরে সম্পর্কের সেই সুর রিনঝিন করে বাজতে থাকে। মেয়েগুলোকে বড় আপন মনে হয় তার।

বুকের মধ্যে ফুরফুরে একটা ভাব নিয়ে হাজারি পুব পাড়ার দিকে রওনা দেয়।

২৪

বুবাইকে পড়া বুঝিয়ে দিয়ে হাজারি শেষ করল তার জীবনের প্রথম টিউশন।

পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। রেজাল্টও বের হয়েছে। পাস করেছে হাজারি। তবে সেকেন্ড ক্লাস তার হয়নি। না হোক। সে যে গ্রাজুয়েট হতে পেরেছে, এটাই তার জন্য অনেক। ভীষণ খুশি সে।

এখানকার পাঠ তার আপাতত শেষ। চাকরির কথাবার্তা হয়ে গেছে এলাকার একটা হাই স্কুলে। বাড়ি চলে যাবে হাজারি। এসেছে সবার নিকট থেকে বিদায় নিতে।

মৃন্ময়ী চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হাজারির মুখোমুখি বসল। হাজারির চায়ের অভ্যাস নেই। কিন্তু এই বাসায় এলে এক কাপ তাকে খেতেই হয়। হয় মৃন্ময়ী দিদি, না হয় বৌদির অনুরোধে। কোনো কথা না বলে টেবিলের উপরে তার জন্যে রাখা চায়ের কাপটা সে উঠিয়ে নিল।

বইপড়া চলছে তো ঠিকমতো?

হ্যাঁ দিদি। এখন বঙ্কিম পড়ছি। বেশ কঠিন তো, তাই সময় একটু বেশি লাগছে। মাঝখানে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল-দর্পণ শেষ করেছি।

বাঃ ভালো। যত বেশি পড়বে, ততই মনের জানালা খুলে যাবে। তা তোমার সেই খটকার সমাধান কি বের করেছো?

কোনটা দিদি?

ঐ যে, নমশূদ্র জাতির জন্ম বৃত্তান্তের বিষয়ে।

হ্যাঁ দিদি। মোটামুটি একটা দাঁড় করিয়েছি।

দেখি তোমার লজিক। শুরু করো। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন তিনি।

স্বয়ং ব্রহ্মার মানস-নন্দন মরীচির পুত্র মহামুনি কশ্যপ। তাই নমশূদ্রদের গোত্রের নাম কাশ্যপ। তার পুত্র মুনিবর নমস। তার দুই যমজ পুত্র কীর্তিবান ও উরুবান। তাদের বাস ছিল মথুরায়। এ পর্যন্ত কোনো সমস্যা নাই। মা সুলোচনা সতী সন্তান প্রসবের ছয় মাসের মাথায় মারা গেলেন। মাতৃহারা শিশুদের প্রতিপালন করে আল্লারা ও নৈধ্রুব নামে দুইজন ব্রাহ্মণ। যারা ছিলেন কশ্যপ মুনির প্রিয় শিষ্য এবং মুনিবর নমস-এর যজ্ঞসঙ্গী। এ পর্যন্তও ঠিক আছে। খটকা এর পরে।

কী রকম? মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলল মৃন্ময়ী।

আপ্সারা ও নৈধ্রুব দুইজনই ব্রাহ্মণ এবং নমস্ মুনির যজ্ঞসঙ্গী ছিলেন। তারা কীর্তিবান ও উরুবানকে লেখাপড়া শেখাল, জ্ঞানবান করল, কিন্তু তাদের উপনয়ন সংস্কার করাল না। আঙ্গারা ও নৈধ্রুব ব্রাহ্মণ হয়েও জানত না যে চৌদ্দ বছর বয়স পার হওয়ার আগেই ব্রাহ্মণ সন্তানের উপনয়ন করাতে হয়–এটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

পয়েন্টটা ভালো। কী হলে যৌক্তিক হত? মজা করেই বলল মৃন্ময়ী।

আমার মনে হয়, আঙ্গারা ও ঞ্চৈব ব্রাহ্মণ ছিল না, শূদ্র ছিল। ব্রাহ্মণ হলে শিশু দুটির ভরণপোষণের জন্য তারা সাপ খেলা দেখানো বা ভিক্ষাবৃত্তি করত না। ব্রাহ্মণের স্বাভাবিক পেশা পূজা-অর্চনা বা শিক্ষকতা–এসবের মধ্যেই থাকত। শূদ্র ছিল বলেই যথাসময়ে শিশু দুটির উপনয়ন সংস্কারের কথা তাদের মাথায় আসেনি। ছেলে দুটি শূদ্রের হাতে খেয়েছে, শূদ্রের কাছে মানুষ হয়েছে, সে কারণে সমাজের ব্রাহ্মণরা তাদের উপনয়ন সংস্কার করাতে রাজি হননি।

গুড। তারপর?

তারপর কীর্তিবান ও উরুবান পিতার সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে শিলিগুড়িতে সীমন্ত রাজার কাছে আশ্রয় পেলেন। রাজার দুই মেয়েকে বিয়ে করে সুখে সংসার করতে লাগলেন। তাদের সন্তান-সন্ততি হলো। এ পর্যন্ত কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু গোল বাধছে সীমন্ত রাজা শূদ্র হওয়াতে। এখানে প্রশ্ন ওঠে, সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে কোনো শূদ্রের পক্ষে রাজা হওয়া বা রাজকার্য পরিচালনা করা সম্ভব ছিল কি না? অন্যদিকে কীর্তিবান ও উরুণের স্ত্রী শিপিকা ও সপত্রিকা দুজনই ছিলেন পরমা সুন্দরী। শাস্ত্রে তৎকালীন শূদ্রের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে শূদ্রা নারীদের পরমাসুন্দরী হওয়ার কথা নয়।

তাহলে এখানে তোমার বক্তব্য কী? কৌতূহলী প্রশ্ন মৃন্ময়ীর।

আমার মনে হয়, সীমন্ত রাজা শুদ্র ছিলেন না। তখন যোদ্ধা জাতি হিসেবে ক্ষত্রিয়রা রাজ্য শাসন করত। সীমন্তও ছিলেন সেরকম ক্ষত্রিয় রাজা। না হলে, প্রতাপশালী ক্ষত্রিয় রাজা সাগর তার পুত্র অসমঞ্জকে সামাজিক কারণে কিছুতেই শূদ্রের আশ্রয়ে থাকতে দিতেন না। সুতরাং শূদ্রা কন্যা বিয়ে করে নয়, নমস মুনির ছেলেরা সমাজে পতিত হয়েছিলেন তাদের উপনয়ন সংস্কার না হওয়াতে।

তারপর?

ব্রাহ্মণের মূল স্রোত থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিল। তবে দেবল ব্রাহ্মণ হিসেবে তাদের পরিচিতি ছিল। নমস মুনি এটা মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি তপস্যা করতে নয়, মনের দুঃখে দুই সন্তানসহ দেশ ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন এবং শিলিগুড়িতে সীমন্ত রাজার দেশে গিয়ে স্থিতি হন। ঘটনাটা এরকম হলে যৌক্তিক বলে বিবেচনা করা যায়।

বাহ্ বেশ। এগিয়ে যাও…

উপনয়ন না হওয়ায় কোনো ব্রাহ্মণ নমস মুনির ছেলেদের সাথে তাদের কন্যা বিয়ে দিতে রাজি হন না। তাই ক্ষত্রিয় সীমন্ত রাজার দুই কন্যাকে বিয়ে করেন তারা। একইভাবে তাদের সন্তানদের বিয়ে হয় অসমঞ্জ-এর কন্যাদের সাথে। এখন প্রশ্ন, তাহলে শূদ্র শব্দের যোগসূত্র কী? একটা হতে পারে, শূদ্রদের কাছে নমস মুনির সন্তানরা প্রতিপালিত হয়েছে সে কারণে অথবা শূদ্ররা তার সন্তানদের মানুষ করেছে বলে কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে নমস মুনি শূদ্রদের জীবনধারা সংস্কারে ব্রতী হন। সেটাই হয় তার তপস্যা। নমস-এর সাথে সবাই তাই শূদ্রকে পরিপূরক হিসেবে ধরে নমস মুনির বংশধরদের নমশূদ্র বলে অভিহিত করতে থাকেন।

বিকল্প অন্য কোনো চিন্তা?

অন্যভাবে দেখলে দেখা যায়, নমশূদ্রদের শ্রাদ্ধ, বিবাহ, আচার-অনুষ্ঠান সবই ব্রাহ্মণদের অনুরূপ। এতে বোঝা যায়, ব্রাহ্মণদের জীবনধারাই তারা অনুসরণ করে আসছিলেন। তবে নমস মুনির বংশধর হিসেবে নম জাতি হিসেবেও তাদের পরিচিতি ছিল। রাজার সাথে নমস মুনির বিরোধের যে কাহিনি ছোটবেলায় শুনেছিলাম, ইতিহাসের আলোকে সেই অত্যাচারী রাজাকে যদি বল্লাল সেন বিবেচনা করি, তাহলে ঘটনার পরম্পরা সহজতর হয় এবং ইতিহাসটা প্রতিষ্ঠিত হয়।

কেমন? কৌতূহল নিয়েই বলে মৃন্ময়ী।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বল্লাল সেন অত্যাচারী ও ব্যভিচারী দুটোই ছিলেন। তার রাজত্বকালে (খ্রি. ১১৫৬-১১৭৮) তিনি একটি ডোমের মেয়েকে বিয়ে করেন। কিন্তু, তখনকার সমাজব্যবস্থায় রাজা হয়ে ডোমের মেয়ে বিয়ে করে রাজত্ব ধরে রাখা মুস্কিল ছিল। বিষয়টা এরকম হলে যৌক্তিক হয়। ডোমের মেয়ের গর্ভে রাজার একটি অবৈধ পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। রাজার কোনো পুত্রসন্তান না থাকায় তিনি সেই অবৈধ পুত্রকে শাস্ত্রসম্মতভাবে বৈধ উত্তরাধিকার করার জন্য ভোজসভার আয়োজন করেন। নম জাতি তার অন্তরায় হওয়াতে তারা রাজরোষে পড়েন।

ক্ষিপ্ত বল্লাল সেন নম জাতিকে শূদ্র গণ্য করে ভদ্রসমাজে তাদের ওঠাবসা, শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ বন্ধ করে দেয়। সব শাস্ত্র থেকে তাদের নাম মুছে দেন। অত্যাচারে জর্জরিত নমশূদ্ররা বন-জঙ্গল, হাওড়-বিল, জলাভূমিতে পালিয়ে বেড়াতে থাকে। বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে ক্রমে সেখানেই তারা বসতি গড়ে তোলে। জীবন জীবিকার তাগিদে চাষাবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। জ্ঞানার্জনের সময় আর থাকে না তাদের। কালের বিবর্তনে একদিন অশিক্ষিত জাতিতে পরিণত হয় নমশূদ্ররা…

তোমরা কী শুরু করলে এটা, মৃন্ময়ী। হিমাংশু আজ বাড়ি চলে যাচ্ছে। কোথায় দুটো সুখ-দুঃখের আলাপ করব, তা না, কঠিন তত্ত্ব আলোচনায় মেতে উঠেছে। বৌদি কপট রাগ দেখিয়ে বলেন।

স্যরি বৌদি। নাও ভালো করে কথা বলো।

কথা আর কী বলব। তোমার দাদা হিমাংশুর জন্যে নিচে অপেক্ষা করছেন।

শশব্যস্ত হাজারি উঠে পড়ে। স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তার জন্যে অপেক্ষা করছেন। ধন্য মনে হয় নিজেকে। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি ভেঙে নিচের দিকে রওনা দেয় সে।

২৫

হাজারি এখন আর সেই হাজারি নেই। গোটা এলাকার মধ্যে একমাত্র বিএ পাস হিসেবে তার পরিচিতি।

তাকে ‘তুই-তোকারি’ করতে মুখে বাধে। আপনি করে বলেন বেশিরভাগই। এমনকি বড়দাও আজকাল তাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেন।

সমাধিনগর হাই স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে হাজারি কর্মজীবন শুরু করেছে। সে কখনও ধুতি কুঁচি দিয়ে পরে, কখনও পরে ফুলশার্ট আর ঢোলা প্যান্ট। রাগী শিক্ষক হিসেবেই তাকে জানে সবাই। কিন্তু মনটা তার বড় উদার। গরিব বা মেধাবী ভালো ছেলেমেয়ে পেলে বিনা পয়সায় তাদেরকে পড়ায়। এই শ্রমে তার কোনো ক্লান্তি নাই। নমশূদ্র সমাজকে জাগিয়ে তুলতে হবে। লেখাপড়া শেখাতে হবে। এই তার চাওয়া।

আজ শনিবার। হাফ স্কুল। বিকেলে হাজারির বাড়ি যাবার কথা।

কিন্তু কিছুতেই মন টানছে না। ভৈর ডাক্তারের আসার কথা সমাধিনগর বাজারে। জনসভায় বক্তৃতা করবেন তিনি। দিকনির্দেশনা দিবেন নমশূদ্র সমাজকে।

হাজারি তাঁর নাম শুনেছে। গল্প শুনেছে অনেক। এলাকাজুড়ে হাজারো কাহিনি তার নামে প্রচলিত আছে। সবগুলোই যে বিশ্বাসযোগ্য তা অবশ্য হাজারির মনে হয় না। কিন্তু অনেকগুলো তার নিজেরই জানা। সেবার মন্বন্তরের সময় গোটা ফরিদপুরজুড়ে অনেক লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল। সেগুলো পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন স্বয়ং ভৈরব ডাক্তার। নিজের গ্রামের বাড়িতেও খুলেছিলেন একটা। প্রতিদিন শত শত বুভুক্ষ মানুষ সেখানে খেত দুই বেলা। সেই লঙ্গরখানার সমস্ত ব্যয় তিনি নিজের টাকায় মেটাতেন। কোনো সরকারি সাহায্য নিতেন না।

সারা ফরিদপুর চষে বেড়াতেন তিনি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে খোঁজ নিতেন কেউ অনাহারে আছে কি না!

ভৈরব ডাক্তারের দক্ষ ম্যানেজমেন্টে সেবার দুর্ভিক্ষে ফরিদপুরে না খেয়ে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল নিতান্তই হাতে গোনা। খুব সুনাম হয়েছিল তাঁর। রাজেন্দ্র কলেজের ক্যাম্পে হাজারিরা কাজ করত। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ভৈরব ডাক্তারের সাথে দেখা হয়নি কখনও।

তাঁকে দেখার, তার সামনে বসে দুটো কথা শোনার বড় সাধ হাজারির। তাই, গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকা সত্ত্বেও সে আজ বাড়ি যাবে না ঠিক করেছে।

সিদ্ধান্তটা নিতে পেরে ভালো লাগছে তার। মনটা অনেকখানি হালকা হয়ে গেছে। বাড়িতে লোক মারফত খবর পাঠিয়ে দিল। অপেক্ষায় রইল, কখন এসে পৌঁছুবেন তার স্বপ্নের রাজকুমার।

ঠিক তখন চওড়া হালট বেয়ে টগবগ করে রাজকীয় ভঙ্গিতে ছুটে আসছে। লাল রঙের বিশালকায় একটা ঘোড়া। মাথার কাছটায় কালো রঙের ছোপ। ঘোড়ার পিঠে যিনি সওয়ার তার বেশ তাড়া আছে বোঝা যায়। সওয়ারীর গায়ে সাদা শার্ট। পরনে খাকি হাফ প্যান্ট। মাথায় শোলার হ্যাট। পায়ে গামবুট। বিশাল এই ঘোড়াটিকে এলাকার সবাই চেনে। জানে মানুষটিকেও। মাঝেমাঝেই তিনি ঘোড়ায় চেপে বের হন। কখনও চিকিৎসা দিতে, কখনও মিটিঙে, কখনও বা কারো আপদে-বিপদে পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। তিনি ভৈরব ডাক্তার। হোমিও চিকিৎসক। এলাকায় কথিত আছে ভৈরব ডাক্তার সামনে এসে দাঁড়ালেই রোগী অর্ধেক ভালো হয়ে যায়।

ভৈরব ডাক্তার নামেই ডাক্তার। আসল পরিচয়, তিনি রাজনীতিবিদ। এলাকার বিত্তশালী মানুষ। হাজার পাখির উপরে তার জমি। পদ্মার বাঁক ইজারা নেন প্রতি বছর। গোয়ালন্দ বন্দরের ইলিশ মাছের সবচেয়ে বড় আড়তটিও তার। আরো আছে রাখিমালের ব্যবসা, হোটেল।

শেরে বাংলা ফজলুল হকের পার্টি করেন ভৈরব ডাক্তার। তিনি ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের মেম্বর। ফরিদপুরের জমিদার মোহন মিয়া তার বন্ধু মানুষ। মোহন মিয়া এলাকার জনদরদি নেতা। প্রজাদের পক্ষ নিয়ে তিনি ইংরেজদের সাথে লড়েছিলেন। এজন্য তাকে জেলে যেতে হয়েছিল।

গোটা এলাকার হিন্দু সমাজের সমর্থন তিনি পান ভৈরব ডাক্তারের মাধ্যমে। হিন্দু ভোটের নিরানব্বই ভাগই নমশূদ্র। মূলত কৃষিজীবী তারা। তাদের মধ্যে লেখাপড়ার চল নেই। অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর নানারকম কুসংস্কারে আচ্ছন্ন তারা। আছে স্বার্থপরতা, ক্ষুদ্রতা, নীচতা। আবার এরাই ঝাঁপিয়ে পড়ে একে অপরের আপদে-বিপদে। অন্যের কষ্টে কেঁদে বুক ভাসায়। তাদের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, আশা-নিরাশা, হাসি-আনন্দ সবকিছুর সাথেই মিলেমিশে একাকার হয়ে আছেন ভৈরব ডাক্তার। বুক দিয়ে আগলে রাখেন। চেষ্টা করেন তাদের ভালো করার। সবসময় ভাবেন কীভাবে নমশূদ্র সমাজের উন্নতি করা যায়।

সমাধিনগর স্কুলের মাঠে মিটিং। সন্ধ্যায় সেখানকার মঠে হবে গীতা পাঠ। সমাবেশ শেষে সেই অনুষ্ঠানেও যোগ দেবেন তিনি। মঠের গোঁসাইজি দরাজ গলায় চমৎকার গীতা পাঠ করেন। শুনে মন ভরে যায়।

বিল পাড়ি দিয়ে বাঁধের উপরে উঠে এলেন ভৈরব ডাক্তার। এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া গড়াই নদীর পাড় ধরে বাঁধের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছেন তিনি। ছুটতে ছুটতে ঘোড়া তার ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্রাম দেয়া দরকার। কিন্তু হাতে সময় কম।

ঘোড়ার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে আপন মনেই বলে ফেলেন–এই তো সামনেই। আর একটু জোরে পা চালা বাবা। তারপরই জিরোতি পারবি।

ঘোড়াটাও যেন বুঝে ফেলেছে তার কথা, এমন ভঙ্গিতে অতিদ্রুত গতি বাড়িয়ে দেয় সে।

সমাধিনগর বাজার লোকে লোকারণ্য। এলাকার গণ্যমান্য মাতব্বররা মঞ্চের বাইরে অপেক্ষা করছেন ভৈরব ডাক্তারকে সাদর সম্ভাষণ জানানোর জন্য।

আজ বেশ কটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জানা যাবে। ভারতবর্ষ নাকি ভাগ হয়ে যাচ্ছে। মুসলমানদের জন্য হবে পাকিস্তান আর হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্থান। শোনা যাচ্ছে, ফরিদপুর নাকি পাকিস্তানের ভাগে পড়বে। এই জেলায় হিন্দুদের বাস বেশি। তাহলে ফরিদপুর পাকিস্তানের সাথে যাবে কেন?

এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন একমাত্র ভৈরব ডাক্তার। তার মুখ থেকেই আসল সত্যটা জেনে আশ্বস্ত হতে চায় সবাই। এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। যাদের, তারাও অনেকে বসে আছে। শুধু ভৈরব ডাক্তারকে একনজর দেখার জন্যে।

তাঁকে দেখলে নাকি দেব-দর্শন হয়। পুণ্য অর্জন হয়।

ঘোড়ার খুরের শব্দ ভেসে আসে।

সবাই একটু এগিয়ে রাস্তার সামনে এসে দাঁড়ায়। লাগাম টেনে ঘোড়াটাকে দাঁড় করিয়ে নামলেন ভৈরব ডাক্তার।

আসলেই সুদর্শন তিনি। লম্বা দোহারা চেহারা। একমাথা কোকড়া চুল।

মুখে হাসি টেনে ভৈরব ডাক্তার বললেন–ভালো আছেন তো সব?

আছি ভালোই। তয় আমাগের আর থাকা। দ্যাশের কী অবস্থা হবি তাই নিয়ে বড় চিন্তার মদ্যি আচি। বৃদ্ধ মতিলাল আগ বাড়িয়ে বলেন। অন্যরা মাথা নাড়িয়ে সমর্থন জানায় তাকে।

ধৈর্য ধরেন কাকা। মাথার উপরে ভগবান আছে। যা করার তিনিই করবেন। আমি আর আপনি চিন্তা করে কী করব! ভৈরব ডাক্তার বললেন।

সিডা তো একশ বার ঠিক কথা। ভগমানের ভরসাতেই তো আচি। তয় ডাক্তার বাবু আসল কথা হলো, আমরা হিন্দুস্থানের সাথে থাকতি চাই। সে। ব্যবস্থা আপনেরই করে দুয়া লাগবি। আমাগের হয়ে আবেদনডা সরকারের কাছে পৌঁছোয়ে দিতি হবি। আপনি হলেন গে আমাগের মা-বাপ।

অধৈর্য হবেন না। আমরা চেষ্টায় আছি। স্টিমার ধরে কালকেই ঢাকা যাচ্ছি। তয়, সব তো আর আমাগের হাতের মদ্যি না। তারপরও দেখি কতদূর কী হয়। আশা ছাড়বেন না। ভৈরব ডাক্তার বলেন।

বিজায় আরাম পালাম মনের মদ্যি। ডাক্তার বাবু, আপনার সাথে একজনের পরিচয় করায়ে দিতি চাই। ইনি হিমাংশু শেখর বিশ্বাস। সমাধিনগর ইসকুলির সহকারী হেড মাস্টার। নিজিগের ছাওয়াল তো। আমরা হাজারি কয়েই ডাকি। বিল সিংহনাথ ইলাকার মদ্যি পেরতম বিএ পাস করিচে। উনি আসার পরের তে ইসকুলির খুবই উন্নতি হইছে। নমশূদুরির মঙ্গলে দিনরাত পরিশ্রম করে।

হাজারি এতক্ষণ মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়ে ছিল ভৈরব ডাক্তারের মুখের দিকে। মানুষটার এত নামডাক, অথচ কী সহজ, সরল, নিরহঙ্কার। মুখখানা যেন ভোরের শিশির ধোয়া নিষ্পাপ প্রতিমূর্তি।

সাধারণ বাঙালির তুলনায় বেশ খানিকটা লম্বা। ছয় ফুটের কাছাকাছি। উজ্জ্বল ফর্সা গায়ের রং। কাঁচা হলুদ বর্ণ। এত ফর্সা মানুষ এর আগে কখনও দেখেনি হাজারি। মুখখানা কার্তিক ঠাকুরের মতো। দেখেই মনে হয় স্বর্গ থেকে সত্যিকারের দেবতা যেন নেমে এসেছে মাটির ধরায়।

প্রচলিত ধারার দেব-দেবতায় বিশ্বাস নেই হাজারির। কিন্তু তারপরেও দেবতাদের একটি কল্পিত মূর্তি তার মনের মধ্যে গেঁথে আছে সেই ছোটবেলা থেকেই।

শ্রদ্ধায় হাজারির মাথা নত হয়ে আসে। তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ভক্তিভরে প্রণাম করে ভৈরব ডাক্তারকে।

ডাক্তার বাবু মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। তাকালেন ছেলেটির মুখের দিকে। উজ্জ্বল শ্যামল কান্তি। উচ্চতা মাঝামাঝি। চোখে-মুখে বুদ্ধির দীপ্তি। চেহারায় স্নিগ্ধতা আর সরলতা।

বেশ লাগল ছেলেটিকে। স্নেহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–তোমার সাথে বাবা আর একদিন ভালো করে আলাপ করব। আজ মনটা বড় অস্থির। এতদিনির ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে যাচ্ছে গুটিকয়েক রাজনীতিবিদের স্বার্থে। ইংরেজরা স্বাধীনতা দিয়ে যাচ্ছে বটে, তয় এমন করে দিল যাতে আমরা হিন্দু মুসলমান পরস্পরের শত্রু হয়ে যাই। সারাজীবন যেন আমাদের যুদ্ধ করেই কাটে। বারবার যেন বলতি বাধ্য হই, ব্রিটিশ আমলই ভালো ছিল। বুঝলে তো! অবস্থা বেশি সুবিধের না। পরশু কনফারেন্স, তাই কালই ঢাকা চলে যাতি হবি।

একটু দম নিয়ে ভৈরব ডাক্তার আবার বললেন–তা তুমি বিএ পাস করিচো। মুখ উজ্জ্বল করিচো নমশূদ্র সমাজের। বড় আনন্দ পালাম। তার চেয়েও বড় কথা, তুমি শিক্ষকতা পেশা বেছে নিয়েছো। তুমি বাবা, সময় পালি আমার সাথে দেখা করবা।

মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় হাজারি। দেখা করবে। নিশ্চয়ই দেখা করবে সে।

মিটিং তেমন জমল না। কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। কোনোমতে বক্তৃতা শেষ করে গোসাইজির গীতা পাঠের আসরে গিয়ে বসলেন ভৈরব ডাক্তার। ধূপের ধোয়ার গন্ধ আর প্রদীপের নরম আলোয় অন্য রকম এক

স্বর্গীয় আবহ তৈরি হয়েছে মঠের আঙিনায়।

অস্থির মন একটু একটু করে শান্ত হয়ে আসে।

২৬

রামায়ণ গানের আসর বসেছে কুমোদদের বাড়ির উঠোনে।

চিত্ত সরকার এলাকার নামকরা রামায়ণ গাতক। গায়ককে এলাকার মানুষ বলে গাতক। অনেক আগে থেকেই তাকে বায়না করে রাখতে হয়। তবে চিত্ত সরকার টাকার কাঙাল নয়। তার বাড়ির অবস্থা ভালো। গান করে শখে। যারা তাকে সমীহ করে, সম্মান দেয় শুধুমাত্র সেখানেই সে গান করতে যায়।

কুমোদ গত বোশেখ মাসে চিত্ত সরকারের বাড়ি গিয়েছিল। অতি বিনয়ের সাথে হাত কচলে বলেছিল–আমি গরিব মানুষ। আমার পরিবারের বড় শখ হইছে, আমার উঠোনের পর আপনি এক রাত রামায়নের সীতার বনবাস পালা গাবেন। যদি দয়া করে পায়ের ধুলো দেন আমার বাড়ির পর, তালি কিতার্ত হই। বেশি কিচু দিতি থুতি পারবান না। তয় আপনার সম্মান ষোল আনা করব, ইডা আমি বুক ঠুকে কয়ে দিতি পারি। আপনের মতো রামায়ণ গাতক শুধু এই ইলাকার মধ্যি ক্যান, গুটা ফরেতপুর, যশোর, কুষ্টে জিলার মদ্যি কোনো জাগায় আছে বুলে মনে করি নে।

তো চিত্ত সরকার প্রীত হয়ে উদার কণ্ঠে কুমোদকে বলেছিল–ঠিক আছে, তোমার বাড়ি যায়ে আমি গান গাবো। কোন টাকা-পয়সা দিতি হবি নে। চিত্ত সরকার শিল্পী। সে গানের ব্যাসাতি করে না।

দিন-তারিখ তখনই ঠিক হয়ে গিয়েছিল।

চিত্ত সরকারের গলাখানা বড়ই মধুর। সবটুকু দরদ ঢেলে সে অশোক বনে বন্দি সীতার দুঃখের বর্ণনা করতে লাগল। গলার সুর কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে অনেক উঁচুগ্রামে নিয়ে ছেড়ে দিল। করুণ সেই সুর মধুপুরের নিশুতি রাতের কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে ছড়িয়ে পড়তে লাগল সামনের খোলা প্রান্তরে। আসরে বসা মেয়েরা বারবার আঁচলে চোখ মুছতে লাগল। ছেলেদের মনও ভিজে এসেছে। কিন্তু অলৌকিক কোনো কৌশলে কষ্ট বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখে তারা চোখের জল গোপন করে ফেলছে।

পুরুষ মানুষের চোখের জল এত সহজ হলে চলবে কেন! কথায় কথায় মেয়েরা কাঁদতে পারে। ব্যাটা মানুষের কি তা মানায়?

এছাড়া আছে যাত্রাপালা, আছে কবি গানের আসর। মধুপুর ঘোট গ্রাম। প্রায় সবাই গরিব। তাই যাত্রা বা কবিগানের আয়োজন করা তাদের সামর্থে কুলোয় না। এসব পালা দেখতে হলে তাদেরকে দূরে যেতে হয়। মেয়েদের পক্ষে তো সেটা সম্ভব নয়। তাই কৃষ্ণ যাত্রা, পদাবলি কীর্তন বা রামায়ণের আসরই মেয়েদের ভরসা।

আর চলে লাঠি খেলা। এই খেলা সব ছেলেদেরকেই শিখতে হয়। এটা মূলত আত্মরক্ষার তাগিদে। সব নমশূদ্র গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে আছে ঢাল, সড়কি, রামদা। যদি ডাকাতের আক্রমণ হয়, অথবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের সাথে গণ্ডগোল বাধে, তখন রে… রে… রে… করে হাঁক দিলেই এলাকার সব মানুষ একজোট হয়ে ঢাল-সড়কি নিয়ে মাঠে নেমে আসে। তখন বোঝা যায় নমশূদ্রদের একতার জোর কতখানি। কিন্তু এরাই আবার ছোটখাটো সামান্য বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাঁটি, মারামারি বাঁধিয়ে দেয়। তখন ভীষণ স্বার্থপর মনে হয় এদের।

পৌষ থেকে ফাল্গুন পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে ওস্তাদ রেখে চলে লাঠি, সড়কি খেলার প্রশিক্ষণ। প্রতি বছর এই আয়োজনের আগে থেকেই তেলাই কলাই লাঠি আর সড়কি বানানোর ধুম পড়ে যায়। এই খেলায় বয়সের কোনো সীমারেখা নেই। সাত থেকে সত্তর সবাই মেতে ওঠে লাঠি খেলায়, লাঠির পরিচর্যায়।

মাঘ-ফাল্গনে পাড়ায় পাড়ায় শুরু হয়ে যায় মহড়া। মাঘী পূর্ণিমার আড়ং-এ লাঠি খেলার প্রতিযোগিতাও হয় কোথাও কোথাও।

২৭

বাড়ৈডাঙ্গা গ্রাম। নিজের বাড়ির উঠোনে বসে আছেন ভৈরব ডাক্তার।

বাড়ৈ বংশের সবাইকে নিয়ে ছোটখাটো সভায় বসেছেন তিনি। বাড়ৈ বংশের ভালো-মন্দ দেখাশুনার দায়িত্ব তাঁর। ছেলেমেয়ের বিয়ে, আচার অনুষ্ঠান আয়োজন সব ব্যাপারে তাঁর কথাই শেষ কথা।

নিজেই বিয়ের কথাবার্তা চূড়ান্ত করে ছেলে বা মেয়ের বাপকে ডেকে বলে দেন–অমুক গ্রামের তমুকের ছেলের সাথে তোর মেয়ের বিয়ে ঠিক করে আইচি। জোগাড়যন্তর দ্যাখ।

আজকের বৈঠকে অখিলের মেয়ের বিয়েটা কীভাবে সুসম্পন্ন হবে, তাই নিয়ে আলোচনা চলছে। অখিল গরিব মানুষ। তার মেয়ের গায়ের রঙ কালো। মুখের কাটিংও তেমন সুবিধার না। ভৈরব ডাক্তার অতি কষ্টে কুষ্টিয়া জেলার খোকসা গ্রামে বিয়ে ঠিক করে এসেছেন। ছেলের বাপ রাজি ছিল না। কিন্তু এলাকার লোকজন মিলে তাকে বাধ্য করেছে। বলেছে–ডাক্তার বাবু নিজি আসে প্রস্তাব দেছেন, মান তার রাকতিই হবি।

আমতা আমতা করে ছেলের বাপ বলেছিল–ছাওয়াল তো বিকার, কাজকাম করে না কিছুই।

ভৈরব ডাক্তার সাথেসাথেই কথাটা লুফে নিয়ে বলেছিলেন–সে চিন্তা আমার। আপনি দয়া করে শুধু আপনার ছেলেডারে দ্যান।

ভৈরব ডাক্তার মনে মনে ঠিক করে ফেললেন, গোয়ালন্দ বাজারে তার মাছের আড়তে ছেলেটাকে কাজে লাগিয়ে দেবেন।

ভৈরব ডাক্তারের উপার্জনের মূল উৎস মাছের আড়ত। রাতভর জেলেরা পদ্মা নদীতে ইলিশ ধরে। ভোররাতে মাছবোঝাই নৌকা এসে ভেড়ে গোয়ালন্দ ঘাটে। জেলেদের প্রথম টার্গেট ভৈরব ডাক্তারের আড়ত। দাম যেমন ভালো পাওয়া যায়, তেমনি বাকিও পড়ে না। প্রয়োজনে ধার দেন, বিপদে পড়লে সাহায্য করেন। জেলের কাছে তিনি দ্যাব্‌তা হিসেবে পরিচিত।

গোয়ালন্দ ঘাট থেকে হাজার হাজার মন মাছ ট্রেনে করে চলে যায় কলকাতা, যশোর, খুলনা, রাজশাহী। স্টিমারে যায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ। এমনকি বরিশালেও। পদ্মার ইলিশ বলে কথা। এর স্বাদই আলাদা।

নবীন হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল–কাহা, ম্যালা মানুষ আসতেছে তোমার সাথে দ্যাহা করতি। গুসাই আছে একজন। সাথে তার ভক্তবৃন্দ। ভৈরব ডাক্তার তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন–কৈ, কোথায়! চল তো দেখি।

উঠোন পেরিয়ে পুকুর ঘাটের পাস দিয়ে ভৈরব ডাক্তার সামনের রাস্তায় নেমে এলেন। হ্যাঁ, সত্যিই তো একদল গেরুয়া বসনধারী মানুষ এদিকেই আসছে।

তাদেরকে সমাদর করে নিয়ে এলেন ভৈরব ডাক্তার। বাড়ির বিশাল বৈঠকখানায় যত্ন করে বসালেন। ব্যস্তসমস্ত হয়ে শুরু করলেন হাঁকডাক। কোথায় পা ধোবার জল, কোথায় ফলাহার। রান্নাবান্নার জোগাড়যন্তর এসব সম্পন্ন করে ভৈরব ডাক্তার এসে বসলেন গোঁসাইজির পদতলে। ভক্তিভরে প্রণাম করে বললেন–বাবা আপনাদের যথার্থ সমাদর করার সামর্থ্য আমার নাই। যৎসামান্য যা আছে, তাই একটু মুখে দিয়ে গ্রামের সগোলরে ধন্য করেন।

স্মিত হাসলেন গোঁসাইজি। বললেন–আমাকে সবাই স্বামী পরমানন্দ বলেই জানে। বাবা ভোলানাথের সামান্য একজন সেবক মাত্র। বলে তিনি ঊর্ধ্বমুখে দুই হাত তুলে সেই তার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালেন।

তারপর বললেন–চলেছি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের মেলায়। ট্রেন ফেল করে স্টেশনেই বসেছিলুম। যার কাছে জিজ্ঞেস করি, সেই বলে আপনার কথা শুনে বড় সাধ হলো, একনজর দেখে যাই। তা এসে ভালোই করেছি। হয়তো পরমেশ্বরের এরকমই ইচ্ছে ছিল। না হলে আর ট্রেন ফেল হবে কেন? বড় ভালো হলো, বাবা বড় ভালো হলো। এমন একজন মানুষের দেখা পেলাম। এলাকার হিন্দু-মুসলমান সবার মুখে একই নাম। আহা, এমনটি কি হয় ভবে! যে এটা পারে, সে-ই তো মহামানব। জীবে প্রেম করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর। আপনি বাবা সংসারে থেকে সকলের সেবা করছেন। আপনার চেয়ে বড় ভক্ত আর আছে কে এ জগতে! আপনাকে ভক্তি দিয়ে ধন্য হই আমি।

করজোড়ে উপস্থিত সকলের দিকে তাকালেন গোঁসাইজি। প্রণাম জানালেন ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে। তারপর হঠাৎই ভৈরব ডাক্তারের পদতলে নত হয়ে পড়লেন।

করেন কী, করেন কী বাবা… হাত ধরে গোঁসাইজিকে টেনে তুলে ভৈরব ডাক্তার কেঁদে ফেললেন। উল্টো তাকে আবার প্রণাম করে বললেন–আমারে অপরাধী করবেন না বাবা। আমি অতি সামান্য মানুষ। আপনাগের পদধূলির যুগ্যিও না।

গোসাইজি কিছুই বলেন না। শুধু শিষ্যদের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করলেন। শিষ্যরা একে একে উঠে এসে ভৈরব ডাক্তারকে প্রণাম করতে শুরু করল। ভৈরব ডাক্তার কী করবেন বুঝতে না পেরে গোঁসাইজির দিকে তাকান। তিনি স্মিতহাস্যে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত উঁচু করে তাকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন–বাবা, যা হচ্ছে তা হতে দ্যান। এটাই হয় তো পরম গুরুর ইচ্ছা।

উঠোনজুড়ে তখন সমবেত কণ্ঠে মুহূর্মুহু ধ্বনি। জয় জয়, ভৈরব ডাক্তারের জয়। হরি, হরি, হরিধ্বনি বলো…

২৮

ফাল্গুন শেষে এসে গেছে চৈত্র মাস। চৈত্র সংক্রান্তির পুজোয় মেতে উঠেছে বিল সিংহনাথের সব নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো। এ এক আদিম পুজো উৎসব। এই এলাকায় এটি গাজন নামেই পরিচিত। এই পুজো ছাইভস্ম মাখা শিব গৌরীর পুজো। চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহে নিদাঘ রৌদ্রে রুদ্র ঢাক-কাঁসির কড়া উল্লাসে এরা দলে দলে গায়ে কালিঝুলি মেখে বিভিন্ন সাজে সেজে দিনভর মাগন মেঙে বেড়ায় গ্রামে গ্রামে।

পাশের গ্রাম শিবপুর থেকে গাজনের সঙ এসেছে। একজন ঢাকি নেচে নেচে ঢাক বাজিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে আছে কাঁসি আর হারমোনিয়াম। গ্রামের মধ্যে বাড়ি বলতে গেলে বড় মন্ডলের বাড়ি। মাটির ঘর, টিনের চাল, কাঠের বেড়া। নাচের তালে তালে মন্ডল বাড়ির আসর বেশ জমে উঠেছে। মেয়েরা বাড়ির ভিতর থেকে চাল, ডাল, তরি-তরকারি বেতের আধলায় করে নিয়ে এসেছে।

দলের মাঝে আছে জটাধারী শিব আর লাল পেড়ে টিয়া রঙের টিস্য শাড়ি পরা পার্বতী। পার্বতীরূপী হারাধন বড় বিপদে আছে। তার ঘনঘন বিড়ি খাওয়ার অভ্যেস। কিছুক্ষণ পরপর বিড়িতে টান দিতে না পারলে দম বন্ধ হয়ে আসে। পকেটে বিড়ির আস্ত একটা প্যাকেটও আছে।

কিন্তু মুশকিল হলো, বিড়ি ধরালেই ছেলেমেয়েরা সব তার পিছনে লাগে। হিঃ হিঃ করে হাসতে শুরু করে। আর চারপাশ ঘিরে নাচতে নাচতে বলতে না, এ দিকি বিড়ি খাওয়া পাব্বতী গো… মা দুগ্গা বিড়ি খায় হিঃ হিঃ হিঃ…

সেই সাথে থাকে রুদ্ৰাক্ষির মালাধারী সারাদিন উপবাসী একদল সন্ন্যাসী। আর থাকে মন্ত্রজপের একজন বালা ঠাকুর। বালাঠাকুরই এই পুজো নিয়ন্ত্রণ করে। এ পুজোর মন্ত্রগুলো আদিম এবং ভয়ঙ্করও বটে…

১.

স্বর্গে দেখি মেঘের জটা
যম গিয়েছে দূর,
বৈশাল বলেরে বেটা
তুই বড় নিষ্ঠুর।
এক পথে আসি আমি
আরেক পথে যাই,
ঘাড় ভাঙ্গিয়া রক্ত খাই
আর পোয়াতি চাই।
নামটা আমার নিশিচোরা
বৈশাল বলে ডাকে,
মোর সঙ্গে দেখা হলে
যাবি শোন ঘাটে।
শ্মশানঘাটের মাটিখানি
অঞ্চলেতে ভরে,
বৈশাল গঞ্জ চলে এসো
এই ধূপেরই পরে ॥

২.

জানি রে জানি বেটা
তুই বড় জানি,
শুনে রাখ তোর সেই
জন্মেরও কাহিনি।
তোর মা শশ্মশানঘাটে
ফেলেছিল যার,
ছয়কুড়ি ছয়টি তার
পাটনি ভাতার।
পাটনি ভাতারের ছাওয়াল
শীঘ্র করে আয়,
তোর মা আমার সাথে
শ্মশান ঘাটে যায় ॥

৩.

ডাকিনী যুগিনী মোরা
খাই রক্ত রুধি,
পথে পথে চলি মোরা
শনি মঙ্গল বুধি।
জন্ম মোদের শ্মশানঘাটে
শ্মশানবাসীর উদোর,
হাড় মস্তক রক্ত খাই
খাই পোয়াতির জঠর।
ড্যাও খাই, দৈত্য খাই
গড়াই গাঙের কূল,
আয় আয় নিশিচোরা
উল্টো মাথার চুল।
এ ডাল ভেঙে ও ডাল ছিঁড়ে
মুড়ো করলাম সার,
মুড়োর উপর পাও তুললাম
কই যাবি তুই আর।

এছাড়া আছে ভাসান পুজো। শিবপুর আর গোপিনাথপুরের মধ্যিখানের ফাঁকা জায়গাটায় হয় ভাসান পুজোর আয়োজন। চারপাশ ঘিরে মোট নয়টা বেদি। এক একটিতে এক এক দেবতার আসন। মাঝখানে বিশাল মাটির কুমির। হাঁ করে গিলে খেতে আসছে যেন। বড় বড় ধারালো দাঁত বের হয়ে আছে। কুমিরটাকে দেখে মনে হয় একেবারে জীবন্ত। সারা চৈত্র মাস ধরে কুমির আর বেদিগুলোতে সন্ধ্যায় পুজো দেয়া হয়। পুজোর পর থেকে ভোর পর্যন্ত এই পথে চলাচল নিষেধ। কথিত আছে গভীর রাতে নাকি কুমিরটি জীবন্ত হয়ে রাস্তায় বের হয়ে পড়ে। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে দেখে কে কেমন আছে। কে ভালো কাজ করে, কে খারাপ কাজ করে। এ সময়ে কেউ সামনে পড়লে মৃত্যু নির্ঘাৎ তার।

নয়টা বেদির জন্য নয় জনকে ঠিক করা হয়। পুরো চৈত্র মাস ধরে তারা সন্ন্যাব্রত পালন করবে। ওদের সাথে থাকে তেল-সিঁদুর মাখানো একটা করে কাঠের দেউল। সেই দেউল মাথায় নিয়ে সারাদিন তারা বাড়ি বাড়ি ঘোরে। উঠোনে নামানোর পর গৃহবধূরা যত্ন করে দেউলে তেল-সিঁদুর মাখায়, শঙ্খ বাজায়, উলুধ্বনি দেয়। ভক্তিভরে প্রণাম করে। তারপর মাটির সরায় করে চাল এনে দেয়। সাথে থাকে দু-একটা আলু, বেগুন, পটল। পুরো মাস ধরে চলে এই প্রক্রিয়া। এ সময়ে সন্ন্যাসীরা এক কাপড়ে থাকে, গায়ে-মাথায় তেল সাবান দেয় না।

সূর্যাস্তের পর শুরু হয় ভাসান পুজা। নয়জন সন্ন্যাসী নয়টা বেদির সামনে বসে। পুরোহিত ঘুরে ঘুরে মন্ত্র পড়তে থাকে। বাজতে থাকে ঢোল, কাঁসর। নয়টা বেদি প্রদক্ষিণ শেষে পূজাপর্বের সমাপ্তি। এবার সন্ন্যাসীদের দিন শেষে উপোস ভাঙার পালা। আহার মাত্র এক মুঠো আতপ চালের ভাত আর সিদ্ধ তরকারি।

চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন সন্ন্যাসীরা খেজুর গাছের মাথা ভাঙে। এ এক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। শত শত নারী-পুরুষ এসে ভিড় করে খেজুর গাছের তলায়। একে একে সন্ন্যাসীরা কাঁটা উপেক্ষা করে একেবারে খেজুর গাছের মাথায় উঠে যায়। কিন্তু গায়ে তাদের কাঁটা বেঁধে না। এই কায়দাটা অনেক প্র্যাকটিস করে রপ্ত করতে হয়। তবে এদের বিশ্বাস এই সন্ন্যাসীদের মধ্যে যে যত সংযমী সে তত সহজে খেজুর গাছের মাথায় উঠে যেতে পারে। সন্ন্যাসীরা এ সময়ে উপস্থিত দর্শকদেরকে আনন্দ দিতে ভোলে না। কাঁদি থেকে হলুদ হলুদ কাঁচা খেজুর ছিঁড়ে চারদিকে ছুঁড়ে দিতে থাকে। লোকজন কাড়াকাড়ি করে সেই খেজুর কুড়োয়। এই খেজুর খেলে পুণ্য হবে। তাই নিজে খায়, বাড়ির লোকজনের জন্যে কোচড়ে ভরে নিয়ে যায়।

পাঁচ মাইল দূরে বালিয়াকান্দির শ্মশানে এর চেয়েও ভয়ঙ্কর সব খেলা হয়। সেখানে সন্ন্যাসীদের পিঠের শিরদাঁড়ায় বড় বঁড়শি গেঁথে ঝুলিয়ে ঘোরানো হয়। এতে পুণ্যের উপরে পুণ্য, ডাবল পুণ্য। তিন দিন ধরে চলে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা।

মেলায় মাটির হাঁড়ি-পাতিল, পুতুলই বিক্রি হয় বেশি।

আর বিক্রি হয় বেতের, বাঁশের তৈরি নানা রকম ব্যবহার্য জিনিসপত্র। লোহার দা, বঁটি, ছুরি, কাঁচিও কম বিক্রি হয় না।

২৯

সোনাগাছির পাশেই একটা হোটেলে নিজের কক্ষে বসে আছে ভবানী, ভবানী শঙ্কর বিশ্বাস। সে ভৈরব ডাক্তারের বড় ছেলে। হোটেলটি টিনশেডের। মেঝে আর দেয়াল অবশ্য পাকা। পরশু রাতে ভবানী এই কম দামি হোটেলে এসে উঠেছে।

প্রায় এক মাস হলো সে কলকাতায়। বাড়ি থেকে টাকা-পয়সা যা বাবার পকেট মেরে নিয়ে এসেছিল তা প্রায় শেষ। তাই এই ব্যবস্থা। এতদিন বেশ ছিল বড় আর দামি হোটেল। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ভালো। বয়-বেয়ারা সবাই তাকে চেনে, সেলাম ঠোকে। ম্যানেজারও খায় খাতির করে। তার কারণও আছে যথেষ্ট। ভবানী দরাজ হাতে টাকা ওড়ায়। কথায় কথায় বকশিশ দেয়। ম্যানেজারকে ক্যাপেস্টান সিগ্রেট অফার করে।

টাকা ফুরিয়ে গেছে এই কথা তো আর বলা যায় না। তাই বাড়ি চলে যাচ্ছি–বলে সেই হোটেল ছেড়ে এই কমদামি হোটেলে উঠে এসেছে। কারণ তার আসল কাজই এখনও বাকি। আনন্দ-ফুর্তিতেই কেটে গেছে দিনগুলো। যে কাজে কলকাতায় আসা সেটাই এখনও করা হয়নি।

ভবানী কলকাতায় এসেছে বড় পুজোয় থিয়েটারের জন্য মেয়ে ভাড়া করতে। এটা তার খুব পছন্দের কাজ। এই অজুহাতে সে সোনাগাছি ঘুরে বেড়াতে পারে। কী সব বাহারি পোশাকে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েগুলো। কী তাদের রঙঢঙ। দেখে মুগ্ধ হয় ভবানী। এবারে পাড়ার মাসি তাকে নয়া জিনিস উপহার দিয়েছে। চুমকির চমকে সে আত্মহারা। তাকে ছেড়ে বাড়ি ফিরতে কিছুতেই মন চায় না।

ভবানীর একান্ত ইচ্ছা পুজোর সময় চুমকিকেই থিয়েটারের জন্য নিয়ে যায়। তাতে রথ দেখা, কলা বেচা দুই-ই হয়। কিন্তু কিছুতেই রাজি হচ্ছে না চুমকি। তার এক কথা–দেখো বাপু আমি নাচ-গান একটু-আধটু পারি বটে, কিন্তু থেটারে অভিনয়? সে আমাকে দিয়ে হবে না কিছুতেই।

কথা সত্য। কিন্তু ভবানীর মন মানে না। এখনও পর্যন্ত তাই যাত্রার মেয়ে ঠিক করা হয়নি।

এদিকে সময় বয়ে যাচ্ছে। এরপরে হয়তো ভালো মেয়ে আর পাওয়াই যাবে না। ভবানী ভাবতে লাগল, এবার যে থিয়েটার হবে তাতে নারী চরিত্র দুইটা। তার সাথে নাচের মেয়ে হিসেবে চুমকিকে নিয়ে গেলে কেমন হয়? মনটা তার খুশ হয়ে উঠল। হাতের কাছে ভরা কলস তৃষ্ণা মেটে না। এত সহজ সমাধান তার নিজের হাতে, আর অকারণে সে এতদিন কলকাতায় বসে আছে। গোয়ালন্দে এখন তার কত কাজ। পুজোর বিশাল আয়োজন। তার সাথে রাতে থিয়েটারের রিহার্সাল আর বাঈজী পাড়ায় নাচ-গানের আসর। বিলাতি বোতল আর ঘুঙুরের ঝুমঝুম শব্দের মাদকতায় বিভোর হয়ে কী জমজমাট সময়ই না সে কাটাতে পারত। যাক, দেরিতে হলেও সমাধান যে একটা বের করা গেছে তা-ই যথেষ্ট। খুশিমনে হোটেলের খাবার ঘরে গিয়ে কাঁঠাল কাঠের পিঁড়িতে বসে পড়ল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *