২০. কাহিনি (অপারেশন ওয়ারিস্তান)

২০. কাহিনি (অপারেশন ওয়ারিস্তান)

হেল্পিং হ্যান্ড থেকে রি-লাইফ। ২ অক্টোবর।

দুপুর সওয়া তিনটে থেকে দুপুর সাড়ে তিনটে।

.

প্রথমে এল দর্শনের অনুভূতি। চোখ খুলে প্রথমা দেখল, সে একটা চেয়ারে বসে। ঘাড়ে অসম্ভব ব্যথা। ওখানেই পিস্তলের বাঁট দিয়ে মেরেছিল তার সৃষ্টিকর্তা। তার বিনাশকারী। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রথমা দেখল, তার একপাশে, চেয়ারে বসে রয়েছে গণেশদা আর সিন্টু। অন্য পাশে বসে রয়েছে ষষ্ঠী। সামনের চেয়ারে বসে রয়েছে মেঘনাদ। মেঘনাদের পাশে বসে রয়েছে লাল হ্যাচব্যাকের ড্রাইভার, সেই বয়স্ক লোকটা। দুজনের হাতে দুটো আগ্নেয়াস্ত্র। বালাজি আর বুনোকে দেখা যাচ্ছে না। বয়স্ক লোকটা আর মেঘনাদ নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।

দর্শনের পরে এল শ্রবণের অনুভূতি। প্রথমা শুনল বয়স্ক লোকটা বলছে, ‘থ্যাঙ্ক ইয়ু ডক্টর লাহিড়ি। আপনি না থাকলে অরগ্যান ডোনার পাওয়া যেত না।’

প্রথমা শিউরে উঠে গণেশের দিকে তাকাল। গণেশের চোখ মেঝের দিকে। মেঘনাদ বলল, ‘রকি চৌধুরী থাকতে আমাকে প্রবলেম সলভ করতে হল? আমি বিজ্ঞানী। আপনি ওয়ারিস্তানের সেনাপ্রধান। আপনার কাজ আমি করে দিলে আপনি তো বেকার হয়ে যাবেন!’

‘রকি চৌধুরী?’ গর্জন করে ওঠে গণেশ। ‘ওয়ারিস্তানের আর্মি চিফ? আপনার সঙ্গে এই শয়তানটার কী দরকার? ওয়ারিস্তানের কোন যুদ্ধবাজের জন্য প্রথমাকে বলি চড়ানো হচ্ছে? রাজু মণ্ডল? যার আত্মগোপনের খবরে আজ সারাদিন টিভি সরগরম?’

রকি চিবুকে তর্জনী টকটক করে বলল, ‘ইয়োর ডায়াগনসিস ইজ স্পট অন, বাডি।’

রকির কথা না শুনে গণেশ চেঁচিয়ে যাচ্ছে, ‘ডক্টর লাহিড়ি। আপনি জিনিয়াস, আমি জানি। আপনি উন্মাদ, আমি জানি। ম্যাড সায়েন্টিস্টের কোনও তালিকা বেরোলে ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন, ডক্টর মোরো, ফাউস্ট আর ডক্টর স্ট্রেঞ্জলাভের আগে আপনার নাম বসবে। কিন্তু ইতিহাসের এত বড় ভিলেন আপনি হবেন না, প্লিজ! প্রথমার অরগ্যান দিয়ে যুদ্ধবাজকে বাঁচাবেন না। তাহলে ভারত-ওয়ারিস্তানের যুদ্ধ বাঁধবেই। সেটাই হবে থার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার। ভারত, ওয়ারিস্তান, ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট সাউথ ইস্ট এশিয়া—সব ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রথমা মরলে ভারত মরবে। প্রথমা বাঁচলে ভারত বাঁচবে। আপনি ভারতীয় নন?’

মেঘনাদ মন দিয়ে গণেশের কথা শুনছিল। কোল্টের নল গণেশের রগে ঠেকিয়ে বলল, ‘ফাউস্টের সঙ্গে আমার তুলনা কেন? সে নিজের আত্মা শয়তানকে বিক্রি করেছিল। আমি অত কিছু করিনি। আমি নিজের মতো করে বিজ্ঞানচর্চা করেছি। সেই চর্চায় ইন্ডিয়া আমাকে কোনও সাহায্য করেনি। সাহায্য করেছে ওয়ারিস্তান। ওই দেশটা আমায় ফান্ডিং না করলে আমার স্বপ্ন অসম্পূর্ণ থাকত। আমি সময়ের থেকে এগিয়ে থাকলে সেটা আমার দোষ নয়। ওয়ারিস্তান সময়ের থেকে এগিয়ে থাকলে সেটা ওয়ারিস্তানের দোষ নয়। ইন্ডিয়ার এথিকস, ইন্ডিয়ার মর‌্যালিটি, ইন্ডিয়ার লিগ্যাল সিস্টেম এখনও মান্ধাতার বাবার আমলে পড়ে থাকলে সেটা ইন্ডিয়ার দোষ। কে যেন বলেছিল, ”হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস টুডে, ইন্ডিয়া উইল থিঙ্ক টুমরো।” আমি বলি, ”হোয়াট মেঘনাদ লাহিড়ি অ্যান্ড ওয়ারিস্তান থট ডে বিফোর ইয়েস্টারডে, হোল ওয়ার্ল্ড উইল থিঙ্ক ডে আফটার টুমরো।” বুঝলি?’

রকি চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। বলল, ‘আমরা সময় নষ্ট করছি। ফ্লাইটের আর দেড় ঘণ্টা বাকি। আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত। এতজনকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। কয়েকজনকে ডিসপোজ অফ করতে হবে।’

রকির কথা শুনে মেঘনাদ গণেশের পাশে গেল। গণেশ চমকে উঠে প্রথমার দিকে তাকাল। ষষ্ঠী চেঁচিয়ে বলল, ‘আপনি কী করছেন?’

মেঘনাদ প্রথমার দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর গণেশের রগে কোল্ট ঠেকিয়ে গুলি করল।

প্রথমা চিল চিৎকার করে উঠল। জলজ্যান্ত গণেশদা এক লহমায় রক্তমাংসের তালে পরিণত হয়েছে। মাথার ঘিলু, হাড়ের টুকরো, রক্তের ফোঁটা এসে লেগেছে প্রথমার সালোয়ার কামিজে। চেয়ার থেকে উঠে সে গণেশকে জড়িয়ে ধরে।

গুলির আওয়াজ শুনে ঘরে ঢুকেছে বালাজি আর বুনো। বুনো প্রথমাকে চেয়ারে বসিয়ে হাতদুটো পিছমোড়া করে ধরেছে। প্রথমার নড়ার উপায় নেই। প্যান্টের পকেট থেকে অ্যাম্পুল আর সিরিঞ্জ বার করে মেঘনাদ বলল, ‘এনি লাস্ট উইশ, শিম্পাঞ্জির বাচ্চা?’

শিম্পাঞ্জির বাচ্চা। নিজের উৎস জেনে ভালো লাগছে প্রথমার। শিম্পাঞ্জি! যার স্মৃতিশক্তি মানুষের থেকে অনেকগুণ বেশি। হিপনো-সেরামের বিন্দু রক্তে প্রবেশ করতে শুরু করলেই নিজের ওপরে আর কোনও কনট্রোল থাকবে না প্রথমার। রকি আর মেঘনাদের হাতের পুতুল হয়ে সে পৌঁছে যাবে কলকাতা বিমানবন্দর। সেখান থেকে কেরালার রি-সাইকল মেডিক্যাল সেন্টারে। তার শরীর থেকে সমস্ত অরগ্যান খুবলে নিয়ে হাড়, মাংস আর চামড়া ফেলে দেওয়া হবে। মৃত্যুর আগের মুহূর্তে প্রথমার মনে পড়ে যায় আজকের সারা দিন। ২ অক্টোবর! অন্ধকারে জ্ঞান ফেরা…আশেপাশে পড়ে আছে ট্রাক, অ্যাম্বুল্যান্স আর মৃতদেহ…খবরের কাগজ দেখে সাল ও তারিখ জানা, উমার সঙ্গে আলাপ…

‘কোনও শেষ ইচ্ছে?’ ইঞ্জেকশন দেওয়ার আগে আবার প্রশ্ন করেছে মেঘনাদ।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রথমা। ছলছল চোখে বলল, ‘আমি আসব বলে ষষ্ঠী পায়েস বানিয়েছিল। ওই যে, টেবিলের ওপরে রাখা রয়েছে। গণেশদা আর নেই। আমি ষষ্ঠী আর সিন্টুকে পায়েস খাওয়াতে চাই।’

‘ফেয়ার এনাফ!’ এক পা পিছিয়ে বলে মেঘনাদ। ‘এক চামচ করে খাইয়ে দাও। তবে তুমি খাবে না। তুমি এম্পটি স্টম্যাকে থাকবে।’

‘ক্যান ইট বি পয়জন?’ উত্তেজিত রকি প্রশ্ন করেছে।

‘আই ডোন্ট থিঙ্ক সো। ইভন ইফ ইট ইজ, দ্য ডোনার ইজ নট হ্যাভিং ইট।’ রকিকে আশ্বস্ত করে মেঘনাদ।

বুনো প্রথমাকে ছেড়ে দিয়েছে। সে চেয়ার থেকে উঠে টেবিলের কাছে গেল। পায়েসের বাটি আর চামচ নিয়ে ষষ্ঠীর সামনে দাঁড়াল। ষষ্ঠীর চোখ মেঝের দিকে। ঠোঁট টিপে বন্ধ করা। এক চামচ পায়েস ষষ্ঠীর ঠোঁটে ঠেকিয়ে প্রথমা বলল, ‘খাও।’

ষষ্ঠী চোখ তুলল না। মুখও খুলল না। মেঘনাদ বলল, ‘হারি আপ। নাটক বন্ধ করো।’

প্রথমা সিন্টুর কাছে গেল। ছেলেটা ভ্যাবলার মতো মুখ করে বসে আছে। এক চামচ পায়েস তার মুখের কাছে ধরে প্রথমা বলল, ‘পালা!’

সিন্টু এইরকম কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল। চেয়ার থেকে তিড়িং করে উঠে দৌড় দিল দরজার দিকে। কিচেনের ল্যাচ খুলে বাঁদরের মতো লাফিয়ে বাইরে বেরোতে যাবে, এমন সময় রকির গ্লক থেকে একচিলতে আগুন বাতাস চেটে ধেয়ে গেল দরজার দিকে। বাতাসে শিসের শব্দ হল। সিন্টুর শিশুকণ্ঠের চিৎকারে ঝনঝন করে উঠল কিচেন। ‘ওরে বাবারে। মেরে ফেলল রে!’

বালাজি এগিয়ে গিয়ে কিচেনের দরজা বন্ধ করল। সিন্টুর ঘেঁটি ধরে আবার চেয়ারে বসাল। গুলি লেগেছে বাঁ-হাঁটুর নীচে। ঝরঝর করে রক্ত বেরিয়ে মেঝে লাল করে দিচ্ছে। ষষ্ঠী এতক্ষণে মুখ তুলে তাকিয়েছে। সে অবাক হয়ে প্রথমার দিকে তাকাল।

‘এনাফ ড্রামাবাজি হয়েছে। এবার চেয়ারে বোসো।’ গ্লক নেড়ে প্রথমাকে বলে রকি। ‘মানুষ মারা আমার কাছে রুটিন জব। বাচ্চাটাকে ইচ্ছে করে মারিনি। বডি ডিসপোজ করতে অসুবিধে হবে, তাই। তোমরা সবাই মরবে। তবে এখানে নয়, রি-লাইফে। আর আমাদের ডোনার তো অনেক বড় কাজের জন্য বলিপ্রদত্ত।’

পেট্রিডিশে জন্মমুহূর্ত থেকে প্রথমা বলিপ্রদত্ত। ভাড়াটে জরায়ুতে ভ্রূণ হিসেবে বড় হওয়ার সময় থেকে বলিপ্রদত্ত। রি-লাইফ অনাথ আশ্রমে বড় হবার সময় থেকে বলিপ্রদত্ত। ক্রায়োনিকসের জটিল এক্সপেরিমেন্টে পাঁচবছর একটানা ঘুমনোর সময়েও বলিপ্রদত্ত।

সেই বলির সময় এসে গেছে। পায়েসের বাটি কিচেনের টেবিলে রেখে চেয়ারে বসতে বসতে প্রথমা ভাবল, বলির পাঁঠার আপত্তির কথা কেউ শোনে না। হাড়িকাঠে মাথা দিয়ে পাঁঠা কি কিছু ভাবে? পাশবিক আর্তনাদ ছাড়া তার কাছে প্রতিবাদের আর কোনও ভাষা থাকে না। কিন্তু প্রথমা পশু নয়। মানুষও নয়। আধা মানুষ-আধা শিম্পাঞ্জির কাইমেরা। তার আর কিছু নেই। শুধু স্মৃতি আছে। স্মৃতিই তার অস্ত্র!

মেঘনাদ এগিয়ে এল। বুনো আবার প্রথমার হাত চেপে ধরল। প্রথমার হাতের ধমনীতে ইনজেক্ট করল নীল তরল।

আশ্চর্য এক মিষ্টি অনুভূতি হচ্ছে প্রথমার। মনে হচ্ছে, সে যেন নিজের শরীর থেকে বেরিয়ে বাতাসে উড়ছে। উড়তে উড়তে ওপর থেকে দেখছে, তিনটে চেয়ারে বসে রয়েছে, প্রথমা, ষষ্ঠী, আর সিন্টু। দাঁড়িয়ে মেঘনাদ, বালাজি, বুনো আর রকি। রকির নির্দেশে প্রথমাকে চ্যাংদোলা করে কিচেন থেকে বার করছে বালাজি আর বুনো। পিছন পিছন হাঁটছে ষষ্ঠী আর সিন্টু। তাদের পিছনে গ্লক হাতে রকি। মেঘনাদ মোবাইলে বলছে, ‘লুসি, ওটির জন্য রাজুকে প্রিপেয়ার করো। তোমার ডোনার ছ’ থেকে সাত ঘণ্টার মধ্যে রি-সাইকলে পৌঁছে যাবে।’ রকি ট্যাব থেকে ফোন করে বলছে, ‘হ্যালো! আমি রকি চৌধুরী বলছি…’

প্রথমার মাথা জুড়ে, হৃদয় জুড়ে, শরীর জুড়ে সাত রঙের রামধনু, সাত সুরের সিমফনি, আনন্দের সপ্তম স্বর্গ! তারপর সব অন্ধকার!

বুনো ছাড়া সবাই হেল্পিং হ্যান্ড ছেড়ে চলে গেল। বালাজি গাড়ি চালাচ্ছে। সামনের সিটে বসে রকি ট্যাবে কথা বলছে। পিছনের সিটের লেগস্পেসে শুইয়ে রাখা আছে প্রথমাকে। পিছনের সিটে বসে ষষ্ঠী, সিন্টু আর মেঘনাদ। মেঘনাদের কোল্ট ষষ্ঠীর পেটে ঠেকানো। হেমারেজ হয়ে সিন্টু প্রায় অজ্ঞান। মেঘনাদ ফোনে লুসির সঙ্গে কথা বলছে…

হেল্পিং হ্যান্ডে রয়ে গেছে বুনো। মলিনা আর গণেশের বডির গতি করতে হবে। মেঘনাদের পরামর্শ মেনে দুটো বডিকেই কেটে টুকরো করে রাখতে হবে। রি-লাইফ থেকে কাল সকালে সুজাতা এলে তার বডিটাও পিসপিস করে রাখতে হবে। পরে ছোট বস্তায় ভরে আলাদা আলাদা প্যাকেটে রি-লাইফে আনা হবে। অ্যাসিডে তিন-চার দিন চুবিয়ে রাখলে হাড় ছাড়া কিছুই থাকবে না। সেগুলো মেডিক্যাল কলেজের ডোমদের দিয়ে দিলেই হল। মলিনা বা সুজাতার বাড়ির লোক যাতে পুলিশে না যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। মেঘনাদ অলরেডি বুনোকে বলে রেখেছে, তাকে হেল্পিং হ্যান্ড সামলাতে হবে। যেসব মহিলারা জরায়ু ভাড়া দেয়, তাদের রাখার জন্য ওই জায়গাটা ব্যবহার করা হবে। বিনায়ক বাগচি আর মোহন দাসের খোঁজপাত্তা খুব বেশি লোক করবে না। কাজের প্রয়োজনে যারা আসত, তারা বুনোর কাছ থেকে কাজ বুঝে নেবে।

আগামীকাল যোগাযোগ করতে হবে হেস্টিংস থানার বড়বাবুর সঙ্গে। বিনায়ক বাগচি আর মোহন দাসের নামে মিসিং পার্সনস ডায়রি করতে হবে।

উফ! কত কাজ। আপাতত বিশ্রাম নেওয়া যাক। কিচেনে ঢুকে পায়েসের বাটি নিয়ে বসে এক চুমুকে অনেকটা মেরে দেয় বুনো। বেড়ে খেতে হয়েছে কিন্তু!

.

ওয়ারিস্তান। আশিকানা প্রাসাদ। ২ অক্টোবর।

দুপুর সাড়ে তিনটে থেকে বিকেল তিনটে পঞ্চাশ।

.

ক্রেডেলে রাখা রিসিভার তুলে চেনা গলা শুনতে পেল জিয়া। ‘হ্যালো! অমি রকি চৌধুরী বলছি।’

ফোন-সংলগ্ন কম্পিটার তথ্য দিচ্ছে, মোবাইল নম্বর ৯৪৩৩০। এয়ারটাইম প্রাোভাইডার—বিএসএনএল। কানট্রি—ইন্ডিয়া। সার্কল—ওয়েস্ট বেঙ্গল। টাওয়ার লোকেশান—দার্জিলিং। নাম—অপূর্বকুমার রায়।

জিয়া বলল, ‘তুমি যে রকি তার প্রমাণ কী?’

‘হৃদয় বদল।’ সংক্ষিপ্ত জবাব ভেসে এল। জিয়া ঘাড় নাড়ল। যাবতীয় গণ্ডগোলের সূত্রপাত যে ঘটনা থেকে, যে ঘটনার কথা রকি, জিয়া আর নিসিম ছাড়া কেউ জানে না, সেই গোপন কথা বলে দিয়েছে এই কণ্ঠস্বর। নি:সন্দেহে এ গলা রকির। জিয়া চুপ করে থাকে।

রকি বলে, ‘যা করেছ, ভুল করেছ।’

‘আমি মনে করি ঠিক করেছি। আমি ওয়ারিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। আমি যা বলব, তাই-ই হবে।’

‘মানুষকে বোকা বানানোর সেরা উপায়, তার হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া। হাতে ক্ষমতা পেয়ে তুমি গাম্বাট হয়ে গেছ জিয়া। ফিউচার দেখতে পাচ্ছ না।’

‘তুমি আগে তোমার ফিউচার সামলাও। বাই দ্য ওয়ে, তুমি ভুলে যেয়ো না যে তোমার ভালোর জন্যেই আমি যুদ্ধঘোষণা করেছি। গ্রিনবার্গ বলেছে বলে ইন্ডিয়ার কাছ থেকে দু’ঘণ্টা চেয়ে নিয়েছি। তার মধ্যে আমরা শান্তিপ্রস্তাব না দিলে ওরা অ্যাটাক করবে। এই পরিস্থিতিতে আমাকে বোকা বলো কোন সাহসে?’

‘ইন্ডিয়া করবে যুদ্ধঘোষণা? আমার হাসিয়ো না। এটা গাঁধীজির দেশ। অহিংসার দেশ। এরা এক গালে চড় খেলে অন্য গাল বাড়িয়ে দেয়। আজ আবার গাঁধীজির জন্মদিন। তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো, ইন্ডিয়া নিজে থেকে আক্রমণ করবে না। দু’ঘণ্টা হতে আর কতক্ষণ বাকি?’

‘পনেরো মিনিট।’

‘ঠিক আছে। আমি রাখছি।’ ফোন কাটে রকি। রি-লাইফ মেডিক্যাল সেন্টার এসে গেছে। মেঘনাদ, বালাজি, ষষ্ঠী, সিন্টু গাড়ি থেকে নামল। প্রথমাকে ঘাড়ে তুলে নিল বালাজি।

ফোন ক্রেডলে রেখে জিয়া চেয়ার থেকে ওঠে। মায়াকে আন্ডা সেলে একবার দেখে আসা উচিত। কোথাও কোনও আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না কেন?

তাতিয়ানা সোফায় বসে ঢুলছিল। জিয়াকে চেয়ার থেকে উঠতে দেখে নাচতে শুরু করল। জিয়া বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আর নাচতে হবে না। এবার ঘরে যাও।’

‘নো মাদাম।’ আপত্তি করে তাতিয়ানা। ‘ইতস মাই দিউতি তু দান্স।

‘শাটাপ!’ তাতিয়ানার গালে থাপ্পড় কষায় জিয়া। চাচাম চানানকে বলে, ‘প্যাক ইয়োর ইনস্ট্রুমেন্টস অ্যান্ড লিভ।’

‘ক্যায়সে যায়ে ম্যাডাম। আপকা ফওজি লোগ বাহার জানে নহি দে রহা হ্যায়।’

‘কে বাইরে যেতে দিচ্ছে না?’ হুঙ্কার ছেড়ে দরজার কাছে যায় জিয়া। আশিকানার দরজার বিশাল কড়া ধরে টান মারে। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ।

‘কওন হ্যায়!’ হাঁক পাড়ে জিয়া। কেউ উত্তর দেয় না। জিয়া দ্রুত ঘরের অন্য দরজার সামনে গিয়ে কড়া নাড়ে। এই দরজাও বন্ধ। জিয়া আবার চ্যাঁচায়, ‘কওন হ্যায়?’

কোনও উত্তর নেই। নিজের বসার ঘরে, আজারবাইজানের নাচনি আর সুফি গাইয়েদের সঙ্গে জিয়া এখন বন্দি।

ওয়ারিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে আটকে রাখবে, এত সাহস কার? ইন্ডিয়া অ্যাটাক শুরু করে দিল নাকি?

এই ঘরে অজস্র জানলা। জানলার বাইরে দু’ফুট চওড়া কার্নিশ। আরামসে হাঁটা যায়। ঘর থেকে বেরোনো জিয়ার বাঁয়ে হাত কা খেল। এম সিক্সটিন গলায় ঝুলিয়ে জানলা টপকে কার্নিশে পা রাখে সে।

‘জিয়া, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। ডোন্ট ট্রাই টু লিভ দ্যাট রুম। আদার ওয়াইজ আই উইল শুট ইয়ু।’ মাইক্রোফোনে শোনা গেল মায়ার গলা। আঁতকে উঠে জিয়া ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। উঁকি মেরে দেখল, আশিকানার কোর্টইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে রয়েছে মায়া। তাকে ঘিরে, এ কে ৪৭ হাতে, ওয়ারিস্তানের সেনারা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে।

মায়া বলল, ‘ওয়ারিস্তান জিন্দাবাদ।’ সৈন্যরা স্যালুট করে বলল, ‘প্রধানমন্ত্রী মায়া মল্লিক জিন্দাবাদ!’

মায়া হাত নেড়ে সবাইকে শান্ত করল। কোর্টইয়ার্ডে নীরবতা। মায়া বলল, ‘গত কয়েক ঘণ্টায় কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেছে। সেসব নিয়ে আলোচনা করার সময় এটা নয়। ওয়ারিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং সেনাপ্রধান হিসেবে আমি বলছি যা হয়েছে, ভুলে যান। সবার আগে আমি ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাই। ওয়ারিস্তানে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরির জন্য যে বা যারা দায়ী, তাদের ন্যায্য বিচার হবে।’ তারপর সেনাদের নিয়ে কোর্টইয়ার্ড থেকে আশিকানার অন্দরে ঢুকল।

কোর্টইয়ার্ড এখন ফাঁকা। আবার কার্নিশে পা রাখল জিয়া।

‘গো ইনসাইড দ্য রুম।’ মাইক্রোফোনে হিশহিশে গলায় বলল মায়া। কোথা থেকে বলল, জিয়া দেখতে পেল না। এটুকু বুঝল, এখান থেকে পালানো যাবে না। জানলা থেকে সরে এসে হতাশ হয়ে চেয়ারে বসতে যাবে, এমন সময় দরজা খুলে গেল। আঁতকে উঠল মিউজিক্যাল ব্রাদার্স অফ ওয়ারিস্তান, আঁতকে উঠল তাতিয়ানা, আঁতকে উঠল জিয়া।

দরজায় মায়া। তার হাতে এ কে ৪৭। ঠান্ডা গলায় সে বলল, ‘আমাকে সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান কার? তোমার না রকির?’

‘আমি সেনাপ্রধানের আদেশ পালন করেছি।’ এম সিক্সটিন সামান্য তুলে বলে জিয়া।

‘সেনাপ্রধানের কথা না অস্ত্র দালালের কথা?’

‘মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গোয়েজ, বিচ!’ মায়ার দিকে এম সিক্সটিন তাক করে জিয়া। ঘর জুড়ে কিট কিট কিট কিট করে শব্দ হয়। অন্তত পনেরো জন্য সৈন্য বিভিন্ন দিক থেকে জিয়ার মাথায় একে ৪৭-এর নল ঠেকিয়েছে। জিয়া ট্রিগারে হাত ঠেকালেই তার ব্রেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। নিজের অসহায় অবস্থা বুঝতে পেরে সে এম সিক্সটিন নামিয়ে নিল।

মায়া বলল, ‘আমি ভায়োলেন্স পছন্দ করি না। কিন্তু কখনও কখনও উপায় থাকে না। গুডবাই জিয়া।’

মায়ার চোখের ইশারায় এক সৈন্য পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে জিয়ার কপালে গুলি করল। বলল, ‘জয় ওয়ারিস্তান!’

মিউজিক্যাল ব্রাদার্স অফ ওয়ারিস্তান তাদের বাদ্যযন্ত্র ফেলে রেখে ঘর ছেড়ে দৌড় মারল।

মায়া ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। এক সৈন্য অত্যাধুনিক ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে ঘর পরিষ্কার করতে লাগল। জিয়ার ছিন্নভিন্ন মগজ, রক্তের ফোয়ারা, হাড়ের কুচি, ছেঁড়া মাংসপেশী ধীরে ধীরে সাফ হয়ে গেল।

২১

রাষ্ট্রপতি ভবন। গেট নম্বর পঁয়ত্রিশ।

প্রকাশ বীর শ্রাস্ত্রী অ্যাভিনিউ, নতুন দিল্লি, ভারতবর্ষ।

২ অক্টোবর। বিকেল পৌনে চারটে থেকে চারটে।

.

ঘড়ি দেখে রাকেশ বলল, ‘তাহলে রেসপেক্টেড প্রেসিডেন্ট। অনুমতি দিন।’

অরুণ মাথা নীচু করে বসেছিলেন। মাথা তুলে তাকালেন ঘরে উপস্থিত সবার দিকে। আর্মির ইউ কে নায়ার, নেভির যশপাল নেগি, এয়ার ফোর্সের অরূপ রাহা তাঁর দিকে তাকিয়ে। অরুণ ‘হ্যাঁ’ বললে, ইউ কে নায়ারের নির্দেশে পাঁচ মিনিটের মধ্যে পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রি, কুমায়ুন রেজিমেন্ট, মাদ্রাস রেজিমেন্ট, রাজপুতানা রাইফেলস, রাজপুতানা রেজিমেন্ট, জাঠ রেজিমেন্ট, শিখ রেজিমেন্ট, আসাম রেজিমেন্ট, বিহার রেজিমেন্ট, ডোগরা রেজিমেন্ট, গাড়ওয়াল রাইফেলস, গোর্খা রাইফেলস, নাগা রেজিমেন্টের জওয়ানরা ভারতবর্ষের সীমা বরাবর দাঁড়িয়ে পড়বে। অরুণ ‘হ্যাঁ’ বললে, যশপাল নেগির নির্দেশে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আন্তর্জাতিক জলসীমা পাহারা দেবে আইএনএস বিরাট নামের অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ, আইএনএস চক্র নামের নিউক্লিয়ার অ্যাটাক সাবমেরিন, ক্লাব-এসএস-এন সেভেন নামের ক্রুইজ মিসাইল, সাগরিকানা নামের সাবমেরিন লঞ্চড ব্যালিস্টিক মিসাইল, অ্যান্টিশিপ মিসাইল সিস্টেম ধনুষ, যার মাথায় নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড লাগানো আছে। অরুণ ‘হ্যাঁ’ বললে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে অরূপ রাহার নির্দেশে ভারতবর্ষের আকাশে উড়বে এয়ারবোর্ন আর্লি ওয়ার্নিং অ্যান্ড কনট্রোল সিস্টেম বা অ্যাওঅ্যাকস, মাল্টিরোল ফাইটার অ্যান্ড স্ট্রাইকস এয়ারক্র্যাফট, ট্যাঙ্কার অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফট, আনম্যানড এয়ারিয়াল ভেহিকল, ধ্রুব বা চেতকের মতো হেলিকপটার।

ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে যুদ্ধ মানায় না। এর ফলে দেশটা একশো বছর পিছিয়ে যাবে। কিন্তু, সে সব কে শুনবে? সবাই অপেক্ষা করে আছে রাস্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য। অরুণ কী বলবেন?

অরুণ টেবিলে রাখা টেলিফোনের দিকে তাকালেন। তাকালেন হরভজনের দিকে। হরভজনের দৃষ্টিতে শূন্যতা। তিনি জানেন এই যুদ্ধের পরিণতি কী! কিন্তু, এখন আর কিছু করার নেই। দু’ঘণ্টার সময়সীমা অতিক্রান্ত। এখন ভারত অ্যাটাকে না গেলে বড়সড় ক্ষতি হয়ে যাবে। অরুণ মাথা নীচু করে বললেন, ‘ইন্ডিয়া শুড অ্যাটাক ফার্স্ট।’

‘ইয়েস স্যার!’ একসঙ্গে স্যালুট করল নায়ার, নেগি আর রাহা। মিলিটারি শু-এর খটখট শব্দ তুলে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। নীচের ঠোঁট মুচড়ে ক্রুর হেসে রাকেশ বলল, ‘যুদ্ধ ঘোষণা নিয়ে ট্যাগোরের কোনও পোয়েট্রি নেই?’

এই সময় ফোনটা বাজল।

অস্বাভাবিক তৎপরতায় চেয়ার থেকে উঠে অরুণ রাকেশকে বললেন, ‘নায়ার নেগি আর রাহাকে ডাকো।’

‘কার ফোন আগে দেখুন।’ রাকেশ বলে।

‘ডোন্ট ক্রস ইয়োর লিমিট।’ ব্রাহ্মণসন্তানের চোখ লাল। ‘যা বলছি শোনো। যাও।’ অরুণের চিৎকারে কেঁপে উঠে রাকেশ দৌড়ে বাইরে বেরোয়। পাশের ঘর থেকে ভাণ্ডারী দৌড়ে এসে ফোন ধরে। অরুণ আবার চেয়ারে বসে হরভজনের দিকে তাকান। কার ফোন? কী বার্তা আসছে?

ওয়ারিস্তান। আশিকানা প্রাসাদ। ২ অক্টোবর।

বিকেল চারটে থেকে সওয়া চারটে।

আব্রাহাম স্পিকার ফোন অন করে বলল, ‘দিস ইজ আব্রাহাম, ফ্রম প্রাইম মিনিস্টারস অফিস ইন ওয়ারিস্তান। দিস কনভার্সেশান ইজ বিয়িং রেকর্ডেড। আই অ্যাম হ্যান্ডিং ওভার দ্য লাইন টু রেসপেক্টেড প্রাইম মিনিস্টার।’

স্পিকার ফোনে শোনা গেল, ‘সেম প্রাোসিজিয়োর ইজ বিয়িং ক্যরিড ওভার হিয়ার। থ্যাঙ্কস।’ আব্রাহাম ইশারায় মায়াকে কথা শুরু করতে বলল। ওপ্রান্ত থেকে শোনা গেল ‘হ্যালো, আমি কি প্রধানমন্ত্রী জিয়া চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলছি?’

‘না। আপনি প্রধানমন্ত্রী মায়া মল্লিকের সঙ্গে কথা বলছেন। গুড আফটারনুন হরভজন।’

‘মায়া?’ হরভজনের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়। পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কেমন আছেন? কী হয়েছিল?’

‘ভালো আছি। খুব ভালো আছি। আমাদের এখানে একটা আভ্যন্তরীণ সংকট তৈরি হয়েছিল। সেই সংকটের জন্য আমি দায়ী। সারা বিশ্বের কাছে ক্ষমা চেয়ে এই কথা আমি ঘোষণা করব।’

‘সারা বিশ্ব জানে আসল ঘটনা কী। ক্যু’র পরে জিয়া প্রথম যে কাজটা করেছিল, তা হল, সাংবাদিক সম্মেলন করে বিশ্বকে জানায় যে, সে এখন ওয়ারিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তা, আপনি ওকে সরালেন কী করে?’

‘আমার দেশে একটা আভ্যন্তরীণ সংকট তৈরি হয়েছিল।’ পুরোনো কথা আবার বলেন মায়া। এবার ‘আভ্যন্তরীণ’ শব্দটিতে জোর। অর্থাৎ অপ্রসাঙ্গিক কথা বলবেন না।

ইঙ্গিত বুঝে হরভজন প্রসঙ্গ পালটান। ‘ওয়ারিস্তানের তৎকালীন সরকার ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। আমরা তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী জিয়া চৌধুরীকে বলেছিলাম, ওয়ারিস্তানের তরফ থেকে দু’ঘণ্টার মধ্যে শান্তিপ্রস্তাব না এলে আমরা যুদ্ধে যাব। দু’ঘণ্টা শেষ হয়ে গেছে মায়া।’

‘সেই সরকার যখন নেই, তখন সেই যুদ্ধ পরিস্থিতিও আর নেই। তবুও আমি, মায়া মল্লিক, ওয়ারিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, ঘোষণা করছি যে, আমরা যুদ্ধে যেতে চাই না। ওয়ারিস্তান একটি উন্নয়নশীল দেশ। তার অর্থনীতির সঙ্গে ইন্ডিয়ার অর্থনীতি প্রতিটি বর্গইঞ্চিতে জড়িত। আমি ইন্ডিয়ার দিকে শান্তি, বন্ধুত্ব আর মৈত্রীর হাত বাড়িয়ে দিলাম। আশা করি ইন্ডিয়া আমার প্রস্তাব গ্রহণ করবে।’

ওপারে নীরবতা। শব্দহীন টেলিফোন। মায়া চুপ করে বসে। কী বলবেন ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী? শান্তিপ্রস্তাব গ্রহণ করবেন তো?

‘আমি আপনার শান্তিপ্রস্তাব গ্রহণ করলাম মায়া। ভুলে গেলে চলবে না, আজ ২ অক্টোবর। জাতির জনক মহাত্মা গাঁধীর জন্মদিন। শান্তি ও সৌহার্দ্য আমাদের রক্তে।’

‘আমাদেরও তাই হরভজন। ইন্ডিয়ার সঙ্গে ওয়ারিস্তানের কোনও তফাত নেই। খানাপিনা, জীবনযাপন, পোশাকআশাক—সবেতে আমরা এক রকম। শুধু বিদেশি বানিয়ার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মাঝখানে আন্তর্জাতিক জলসীমানার কাঁটাতার তুলে দিয়েছি। কোনওদিন আমরা এক হলে যে নতুন দেশ তৈরি হবে, তার অর্ধেক ইন্ডিয়া আর অর্ধেক ওয়ারিস্তান। সারা পৃথিবী অবাক হয়ে দেখবে সেই জোড়কলম দেশের সুপারপাওয়ার।’

‘দিবাস্বপ্নে লাভ নেই মায়া। ওটা কোনওদিনও হবার নয়। বাই দ্য ওয়ে, ফোন রাখার আগে একটা প্রশ্ন করি। যুদ্ধের এই বাতাবরণ তৈরির পিছনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল কি?’

মায়া চুপ। আব্রাহাম তাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলছে।

‘মায়া। লাইনে আছেন?’ হরভজন প্রশ্ন করলেন। মিথ্যে বলতে মায়ার বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু কোনও উপায় নেই। তিনি বললেন, আম…আমার কোনও হিডন অ্যাজেন্ডা নেই।’

‘গুডবাই মায়া। ভালো থাকবেন।’ হরভজনের লাইন কেটে গেল।

ফোনলাইন কেটে আব্রাহাম বলল, ‘আপনি এক সময় হরভজনকে চাইতেন, তাই না?’

‘চাইতাম মানে? ভালোবাসতাম?’ জানতে চায় মায়া। এখন প্রধানমন্ত্রী আর প্রাইম মিনিস্টারস অফিসের টেকনিক্যাল স্টাফ কথা বলছে না। কথা বলছে মাঝবয়সি দুই নারীপুরুষ।

‘চাওয়া মানে ভালোবাসা কেন হবে ম্যাডাম? ভালোবাসা কি কিছু চায়? ভালোবাসা তো না চাওয়ার মধ্যে। ভালোবাসা তো না পাওয়ার মধ্যে। আপনি হরভজনকে কোনও দিনও পাবেন না, এটাই তো ভালোবাসা, তাই না?’

মায়া মাথা নামিয়ে বসে থাকেন। আব্রাহাম বলে, ‘দেশের স্বার্থে আজ আপনি মিথ্যাচার করলেন। রকি যে এই মুহূর্তে রাজুকে নিয়ে ইন্ডিয়ায়, এই কথা হরভজনকে বলেননি। ইন্ডিয়ার ইন্টেলিজেন্স, আর্মি বা স্টেট পুলিশ এখনও রকির কথা জানে না। কিন্তু জানতে পারবেই। আপনার আর হরভজনের সম্পর্কের ইতি ঘটল। তাই না ম্যাডাম?’

‘এভরি রিলেশানশিপ কামস উইথ অ্যান এক্সপায়ারি ডেট।’ চোখ মুছে বলেন মায়া।

আব্রাহামের চোখে জল। সেলাম ঠুকে সে বলল, ‘জয় ওয়ারিস্তান!’ আর্মি বুটের খটখট শব্দ তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

রাষ্ট্রপতি ভবন। গেট নম্বর পঁয়ত্রিশ।

প্রকাশ বীর শাস্ত্রী অ্যাভিনিউ, নতুন দিল্লি, ভারতবর্ষ।

২ অক্টোবর। বিকেল চারটে থেকে সওয়া চারটে।

‘গুডবাই মায়া। ভালো থাকবেন।’ ফোন কেটে দিলেন হরভজন। প্রধানমন্ত্রী-সুলভ গাম্ভীর্য ত্যাগ করে আকাশের দিকে ফিস্ট পাম্পিং করে বললেন, ‘ইন্ডিয়া উইনস অ্যানাদার ওয়ার!’

ফোনালাপ শুনছিলেন অরুণ চ্যাটার্জি। শুনছিল ইউ কে নায়ার, যশপাল নেগি, অরূপ রাহা আর রাকেশ জৈন। রাকেশ বলল, ‘কী করে?’

অরুণ বললেন, ‘যুদ্ধ কি শুধু জলে, স্থলে আর আকাশে হয়? যুদ্ধ কি শুধু বোতাম টিপে, ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুঁড়ে, লাখ লাখ মানুষ মেরে হয়?’

‘রাকেশ বলল, ‘অন্য কীভাবে যুদ্ধ হয়?’

অরুণ কিছু বলার আগে নায়ার বলল, ‘যুদ্ধ প্রাইমারিলি মাইন্ড গেম। ভারত এই মাইন্ড গেম গত পাঁচদশক ধরে খেলে আসছে। এইবারের যুদ্ধে আমরা অত্যন্ত সফল ভাবে জিতলাম।’

রাকেশ বলল, ‘শুধু ধমক দিয়ে কি যুদ্ধে জেতা যায়?’

যশপাল বলল, ‘যায় স্যার। তার প্রমাণ এক্ষুনি আমরা পেলাম।’

‘কীভাবে?’ রাকেশ বিরক্ত হয়ে বলল।

অরুণ বললেন, ‘আপনি বোধ হয় বেঙ্গলের এক সিদ্ধপুরুষের নাম শোনেননি। শ্রীশ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ…’

‘মাই গড! অ্যানাদার বং ইন দিস স্যুপ!’ দাঁতের ফাঁকে কিশকিশ করে বলে রাকেশ।

রেণুকা মান্ডি আর মেধা ধাবোলকার অফিসে ঢুকেছে। রেণুকা বলল, ‘আমি রামকৃষ্ণের নাম শুনেছি স্যার।’

‘শুনে খুশি হলাম।’ বললেন, অরুণ। ‘উনি একটা কথা বলেছেন। সেটা হল, ”ছোবল মারতে হবে না। শুধু ফোঁস করো।” মানে বুঝতে পারলে?’

‘বুঝেছি, সায়লেন্ট ওয়ারিয়র!’ মুচকি হেসে বলে মেধা। প্রাোটোকল ভাঙা কথায় কেউ কিছু মনে করল না।

হরভজন বললেন, ‘তাহলে আর দেরি কেন? যাও, সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করো। আমাকে মিডিয়ার মুখোমুখি হতে হবে। তোমরাও থাকবে। ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগারস রেডি করো।’

‘আর আপনি কী করবেন?’ জানতে চায় রেণুকা। পাশের টেবিল থেকে একটা ছোট বই তুলে নিয়ে অরুণ বলেন, ‘আমি বৃদ্ধ মানুষ। বসে বসে ঠাকুরের নাম নেব।’

‘ঠাকুর?’ মেধা অবাক। সে খুব ভালো করে জানে রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসে এই ব্রাহ্মণসন্তান কখনও ধর্মের কথা বলেন না।

‘আমার তো একজনই ঠাকুর। বইটা মেধার দিকে বাড়িয়ে দেন অরুণ। মেধার চিনতে অসুবিধে হল না। ওই হলুদ মলাট, ওই বাইন্ডিং, ওই সাক্ষর তার চেনা। রাষ্ট্রপতির হাতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘গীতাঞ্জলি’।

মেধা বলে, ‘সং অফারিংস?’ আমি ইংরিজিতে পড়েছি। একটু প্রিচি। কিন্তু নাইস।’

‘মতামতের জন্য ধন্যবাদ। আমার এখনও পড়া হয়নি। তাই কিছু বলতে পারলাম না।’

‘আপনি এখনও পড়েননি?’ রাকেশ অবাক। ‘আমি যখনই আসি, ওই বইটাই পড়তে দেখি। এখনও পড়া হল না?’

অরুণ হাসলেন। ‘না। এখনও পড়া হল না। এ জন্মে পড়া শেষ হবে বলে মনে হয় না। এনিওয়ে, তোমরা এখন যাও।’

সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে। গীতাঞ্জলি টেবিলে রেখে অরুণ হরভজনকে বললেন, ‘মায়ার সঙ্গে কথা বলে কী মনে হল?’

‘ও কিছু একটা লুকোচ্ছে। ভাণ্ডারী আমায় রিপোর্ট সাবমিট করেছে।’ টেবিলে রাখা কাগজ তুলে হরভজন বললেন, ‘উত্তর দিতে দেরি করেছে। গলার আওয়াজের পিচ বদলে গেছে। গলা কাঁপছিল। মোস্ট প্রব্যাবলি, শি ওয়াজ লায়িং।’

‘আমারও তাই মনে হয়।’ গীতাঞ্জলিতে তর্জনি ঠকঠক করে বলেন অরুণ, ‘কিন্তু কেন? কী সেই হিডন অ্যাজেন্ডা, যাকে লুকিয়ে রাখতে গিয়ে মায়া তোর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নষ্ট করল?’

হরভজন এতক্ষণ শান্ত ছিলেন। অন্য লোকের অনুপস্থিতিতে হঠাৎ আবেগের স্টপকক খুলে গেল। চোখের জল মুখে পাঞ্জাব দা পুত্তর বললেন, ‘মায়ার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু ও আর আমি এই পৃথিবীতে একই সময়ে বেঁচে আছি, এটা ভাবলেই মনে শান্তি হত। আজ থেকে সেই জায়গাটা চলে গেল।’

‘আমায় যে সব দিতে হবে, সে তো আমি জানি। আমার যত বিত্ত প্রভু আমার যত গ্লানি।’ গুণগুন করে গান গাইছেন অরুণ। হরভজন চোখ মুছে বলেন, ‘স্টপ দোজ বোরিং টেগোর সংস। তোর কী মনে হয়, ওরা আমাদের দেশে কোনও সিক্রেট অপারেশান করতে চায়?’

‘হয়তো হ্যাঁ…হয়তো না…’ গীতাঞ্জলীর মলাটে তর্জনী দিয়ে টকটক আওয়াজ করে অরুণ বলেন, ‘ওয়ারিস্তান আর্মি মায়াকে আটকে রেখে এমন কোনও ড্যামেজ করেছে, ক্ষমতায় ফিরে এসে মায়া যেটা কনট্রোল করতে পারছে না। তাই মিথ্যে বলতে বাধ্য হচ্ছে।’

‘যদি তাই হয়, তাহলে আমরা কী করব?’

দু’হাত ওপরে তুলে অরুণ বললেন, ‘সব কিছু আমরা করব কেন?’

‘মানে?’ হরভজন অবাক, ‘কে করবে?’

‘ভারতবর্ষ চালানোর দায়িত্ব কি শুধু সরকারের? শুধু পলিটিক্যাল পার্টির? শুধ ব্যুরোক্র্যাট, আর্মি, নেভি, এয়ারফোর্সের? শুধু পুলিশের? সাধারণ মানুষের কোনও ভূমিকা নেই? দেশজোড়া কোটি কোটি মানুষের ওপরে ভরসা রাখ হরভজন। তাদের থেকে বড় সৈন্যবাহিনী আর কে আছে?’

‘বলছিস?’ হরভজনের কপালে একাধিক লাইন জমা হয়েছে। অরুণ দরাজ কণ্ঠে গান ধরলেন,

‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার—

জানি জানি তোর বন্ধনডোর ছিঁড়ে যাবে বারে বার…’

হরভজন মাথা নীচু করে ধীরে ধীরে হলঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তাঁকে ঘিরে ধরল নিরাপত্তারক্ষীরা। বুলেটপ্রুফ গাড়ি চড়ে, সামনে পিছনে অজস্র গাড়ির মোটরকেড নিয়ে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বেরোলেন। এখন তাঁকে সাংবাদিক সন্মেলন করতে হবে। মাথা উঁচু করে, বুক ফুলিয়ে, দাপটের সঙ্গে ভারতবর্ষের সাফল্যের কথা বলতে হবে।

ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি অরুণ নীরব যোদ্ধা চ্যাটার্জি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছেন। নীরব যোদ্ধা জানেন, বড় এক সমস্যা থেকে তিনি ভারতবর্ষকে এবারের মতো বাঁচিয়ে দিলেন। সারা জীবন তিনি দেশের জন্য লড়েছেন। আজও লড়াই জারি আছে। কিন্তু আজ আর তিনি একা পারবেন না। আজ কোনও এক ভারতবাসীর সাহায্য লাগবে। নামহীন, পদবিহীন, কোনও আম আদমির সাহায্য লাগবে।

.

রিসাইকল মেডিক্যাল সেন্টার। ডক্টর লুসি লাহিড়ির চেম্বার। মুন্নার। ২ অক্টোবর। দুপুর সাড়ে তিনটে থেকে পৌনে চারটে।

‘লুসি, ওটির জন্য রাজুকে প্রিপেয়ার করো। তোমার ডোনার আট থেকে ন’ঘণ্টার মধ্যে রিসাইকলে পৌঁছে যাবে।’ ফোনে বলল মেঘনাদ। শুনে লুসির বুক থেকে পাথর নামল। সে বলল, ‘ডোনারকে কোথা থেকে পেলে?’

‘সে লম্বা গপপো। ওখানে গিয়ে বলব। দমদম থেকে সওয়া পাঁচটায় কানেক্ট-জেটের ফ্লাইট। আমি নেটে টিকিট কেটে ওয়েব চেকইন করে নেব। একটু দেরি করে দমদম এয়ারপোর্ট পৌঁছোলেও চলবে। কোচি পৌঁছোতে পৌঁছোতে রাত এগারোটা বাজবে। ওখান থেকে মুন্নার একশো চল্লিশ কিলোমিটার। তার মানে অ্যারাউন্ড সাড়ে তিন ঘণ্টা। আমরা রাত আড়াইটে নাগাদ পৌঁছোব।’

লুসি খসখস করে কাগজে তথ্যগুলো লিখছিল। লেখা শেষ করে বলল, ‘রাজু ছাড়াও চার্লস জ্যাকসন আর জন কিংকে ওটির জন্য প্রিপেয়ার করতে হবে।’

‘তুমি কোচি এয়ারপোর্টে অ্যাম্বুল্যান্স আর গাড়ি পাঠিয়ে দিয়ো।’ বলল মেঘনাদ। লুসি ফোনে কথা বলতে বলতে চেম্বার থেকে বেরিয়ে আইসিসিইউ-তে ঢুকল। পাঁচ বেডের ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে একজন মাত্র পেশেন্ট রয়েছে। বেডের সংখ্যা কম, কেন না, এই সেন্টারে ইমার্জেন্সি ডিল করা হয় না। এটা ব্যাক আপ। কিন্তু এই ব্যাক আপ রাজু মন্ডলের ক্ষেত্রে অসম্ভব সফল। বেডের পাশে দাঁড়িয়ে রাজুকে দেখল লুসি। হালকা নীল পোশাক পরা মোটা, মাঝবয়সি লোকটা চোখ বুঁজে শুয়ে। আইভি লাইনে ফ্লুইড চলছে। অক্সিজেন মাস্কে মুখ ঢাকা। হাতের আঙুলে অক্সিজেন স্যাচুরেশান মাপার যন্ত্র লাগানো। কার্ডিয়াক মনিটরে ফুটে উঠছে হৃদযন্ত্রের গতিবিধি। অকেজো হার্ট ভালোই—কোনওমতে কাজ চালাচ্ছে। বহুদিনের অভিজ্ঞতা থেকে লুসি জানে, হার্ট ট্রানসপ্ল্যান্ট হলেই রাজু ভালো হয়ে যাবে। এর থেকে খারাপ রুগিকেও লুসি চাঙ্গা করে বাড়ি পাঠিয়েছে। লুসি ফোনে বলল, ‘তোমার কাছাকাছি রকি চৌধুরী আছেন?’

‘আছে। কেন?’ মেঘনাদ জানতে চায়।

‘দরকার আছে। ওঁকে ফোন দাও।’

‘আচ্ছা।’ মেঘনাদ রকির হাতে ফোন দেয়। রকি বলে, ‘বলুন ডক্টর লাহিড়ি।’

হালকা হেসে লুসি বলে, ‘সব যখন ঠিকঠাক চলছে, তখন আপনি আমার প্রফেশনাল ফি’র বাকি ফিফটি পার্সেন্ট জমা করে দিন।’

‘ওখানে গিয়ে দিলে হত না? আমাদের প্লেন ধরার তাড়া আছে।’

‘ওভারসিজ অ্যাকাউন্টে টাকা জমা না পড়লে ওটি হবে না কিন্তু।’ কাঠকাঠ গলায় বলে লুসি। ‘আমি চ্যরিটেবল ট্রাস্ট খুলে বসিনি। ইটস আ বিজনেস। মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসা। আর ব্যবসার মূল কথা হল মুনাফা। তাই, শো মি দ্য মানি, হানি!’

মেঘনাদ কম্পিউটারের সামনে বসে কানেক্ট-জেটের কলকাতা-কোচি ফ্লাইটের চারটে টিকিট কেটে ফেলেছে। ই-টিকিটের প্রিন্টআউট নিয়ে ওয়েব চেকইন সেরে ফেলেছে। ই-টিকিট রকিকে ধরিয়ে বলল, ‘মানি ট্রান্সফারের জন্য আপনি আমার কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারেন। এটা সিকিয়োরড মেশিন।’

‘আমার ট্যাব অনেক বেশি সিকিয়োরড। চলুন বেরোই। গাড়িতে যেতে যেতে ওয়্যার ট্রান্সফার করে দেব।’

লুসি যখন চার্লস জ্যাকসনের অ্যানাস্থেটিক চেকআপ করছে, তখন একটা অ্যাম্বুল্যান্স রি-লাইফ মেডিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে বেরিয়ে দমদম বিমানবন্দরের দিকে রওনা হল।

২২

রি-লাইফ মেডিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ২ অক্টোবর।

দুপুর সাড়ে তিনটে থেকে সাড়ে চারটে।

.

‘হ্যালো কিয়ারা!’ ট্যাবে ফিসফিস করে বলল রকি। তার গলার আওয়াজ শুনে চিল চিৎকার করে উঠল কিয়ারা, ‘রকি? হোয়্যার হ্যাভ ইউ বিন? এতদিন কোথায় ছিলে?’

কিয়ারের পাখির নীড়ের মতো চোখদুটি মনে পড়ে রকির। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ভাবল, সারা জীবন অনেক দৌড়ঝাঁপ হল। এবার থিতু হবার পালা। ডোনারকে রি-সাইকল মেডিক্যাল সেন্টারে পৌঁছে দিয়ে গ্রিনবার্গের সঙ্গে কথা বলতে হবে। নির্দিষ্ট অ্যামাউন্টের ডলার বাহামা আইল্যান্ডের ব্যাঙ্কে ওয়্যার ট্রান্সফার হয়ে গেলেই রকির কর্মজীবনের শেষ। কোনও একটা প্লেনে পাকড়ে সে বাহামা উড়ে যাবে। জিয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনা হয়েছে। সেনাপ্রধান থাকার বাসনা হয়েছে। জিয়া ওইসব নিয়ে থাকুক। শুধু রকিকে ছেড়ে দিক।

অ্যাম্বুল্যান্স চালাচ্ছে বালাজি। তার পাশের সিটে বসে রকি কিয়ারার সঙ্গে কথা বলছে। তখনই অ্যাম্বুল্যান্সের ভিতরের কামরায় বসে মেঘনাদ ফোনে তনয়ার সঙ্গে কথা বলছে। ‘এভরিথিং অলরাইট, তনয়া?’

‘হ্যাঁ। বাচ্চাটার পায়ে স্টিচ দিয়েছে এখানকার জুনিয়র ডাক্তার। ও এখন ঘুমোচ্ছে।’

‘ঘুমোচ্ছে? গুড।’

‘আমাদের দুটো স্পেশাল অ্যাম্বুল্যান্স ছিল। একটা অ্যাক্সিডেন্টে নষ্ট হয়ে গেল। আর একটাই আছে। খড়গপুরে ফোন করে সেটাকে আমি আসতে বলছি। সিন্টু আর ষষ্ঠীকে ওতে করেই নিয়ে যাব। আপনি মুন্নার থেকে ফিরে, নতুন অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য টাকা স্যাংশান করবেন।’

‘ঠিক আছে।’ ফোন কেটে অ্যাম্বুল্যান্সের জানলা দিয়ে বাইরে তাকায় মেঘনাদ। রি-লাইফ থেকে বেরিয়ে তারা এখন পার্ক সার্কাস সাত মাথার মোড়ে। এখানে নিত্যিদিন জ্যাম লেগেই থাকে। সামনের সিটে বসে থাকা কাইমেরার দিকে তাকায় মেঘনাদ।

কাইমেরার পরনে সালোয়ার কামিজ। জানলা দিয়ে সে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। হিপনো-সেরামের প্রভাবে মুখটা হাসি হাসি। চোখ ঈষৎ ঢুলুঢুলু। মেঘনাদ বলল, ‘প্রথমা…’

কাইমেরা চুপ।

মেঘনাদ বলল, ‘তোমার নাম প্রথমা লাহিড়ি।’

‘প্র-থ-মা-লা-হি-ড়ি।’

‘আমার নাম মেঘনাদ লাহিড়ি।’

‘আ-মা-র-না-ম-মে-ঘ-না-দ…’

‘বাবা। বাবা। বাবা।’ কাইমেরাকে শেখায় মেঘনাদ।

‘বা-বা।’

কাইমেরার প্রগ্রেসে খুশি হয়ে মেঘনাদ শিক্ষার পরের ধাপে যায়। ‘তোমার নাম কী?’

কাইমেরা চুপ। পরমা আইল্যান্ডে পৌঁছে বাঁ-দিকে ঘুরে অ্যাম্বুল্যান্স উলটোডাঙ্গার মোড়ের দিকে এগোচ্ছে। সেখান থেকে ডানদিকে ঘুরলেই ভিআইপি রোড। এয়ারপোর্ট পৌঁছোতে আরও মিনিট চল্লিশ। ততক্ষণে সব শিখিয়ে নেওয়া যাবে। মেঘনাদকে চমকে দিয়ে কাইমেরা বলল, ‘আ-মা-র-না-ম-প্র-থ-মা-লা-হি-ড়ি।’

‘তোমার বাবার নাম কী?’

‘মে-ঘ-না-দ-লা-হি-ড়ি।’

‘আমি তোমার বাবা। আমি মেঘনাদ লাহিড়ি।’ নিজের বুকে আঙুল ঠোকে মেঘনাদ। ‘বলো, আমি কে?’ কাইমেরার থুতনি চেপে বলে, ‘বল, আমি কে?’

কাইমেরা নিরুত্তর। মেঘনাদ এক থাপ্পড় কষায় গালে। কাইমেরার চোখ জলে ভরে ওঠে। টুপটুপ করে অশ্রু ঝরে পড়ে। গালে পাঁচ আঙুলের দাগ। কাইমেরা বলে, ‘আমার নাম প্রথমা লাহিড়ি। আমার বাবা মেঘনাদ লাহিড়ি।’ সামনে ঝুঁকে মেঘনাদের কোলে মাথা রাখার চেষ্টা করে সে। কাইমেরাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় মেঘনাদ। মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সারের জামা। কাইমেরার বডি ফ্লুইড লাগলে নষ্ট হয়ে যাবে। কাইমেরা সোজা হয়ে বসেছে। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলছে, ‘আমার বাবা মেঘনাদ লাহিড়ি।’

উলটোডাঙ্গার মোড়ে অ্যাম্বুল্যান্স দাঁড়াতে রকি পিছনে চলে এল। মেঘনাদকে বলল, ‘একটা জিনিস খেয়াল করেছেন, রাস্তাঘাট আর ফাঁকা নেই। লোকে আবার রাস্তায় বেরিয়েছে। যুদ্ধ নিয়ে কিছু জানেন?’

‘না।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর মেঘনাদের। সে এখন কাইমেরাকে শেখাতে ব্যস্ত। ‘বলো, আমার ডাউনস সিনড্রোম আছে।’

‘আমার ডা-ডা-ডা…’

এক থাপ্পড় মেরে মেঘনাদ বলল, ‘ডাউনস সিনড্রোম।’

‘ডা ডা-উ-ন-স-সি-ন-ড্রো-ম।’

‘গুড!’ কাইমেরার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে আদর করে মেঘনাদ রকিকে বোঝাল, ‘এদের ট্রেনিং প্রসেসটা কুকুর ট্রেনিং এর মতো। না পারলে তিরস্কার, পারলে পুরস্কার। খুব কুইকলি পিকআপ করে।’

রকি মেঘনাদের কথা শুনছে না। বাইরে তাকিয়ে রাস্তাঘাট দেখছে। বাজারদোকান খুলে গেছে। লোকজন দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে টিভি দেখছে। সকালের সেই ভয়ের পরিবেশ আর নেই। জিয়া কি এখনও ইন্ডিয়াকে চাপে রাখতে পেরেছে?

এইসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যে ট্যাবের সাহায্যে ইন্টারনেটের খবরের দুনিয়ায় প্রবেশ করল রকি।

‘ওয়ার্ল্ড এসকেপস অ্যানাদার নিউক্লিয়ার ওয়ার।’ বিবিসির ব্রেকিং নিউজের ক্যাপশান।

‘ইন্ডিয়া উইনস মাইন্ডগেম!’ ফক্স নিউজ।

‘মায়া মালিক ইজ প্রাইম মিনিস্টার আগেইন।’ আবু ধাবি টিভি।

‘অ্যানাদার ক্যু ইন ওয়ারিস্তান।’ কাতারের আল জাজিরা।

‘নো নিউজ অফ এক্স প্রাইম মিনিস্টার জিয়া চৌধুরী।’ ইউরো নিউজ।

তাহলে ওয়ারিস্থানে আবার মায়া ক্ষমতায়? যুদ্ধের জুজু আর নেই? জিয়া কোথায়? রকিকে সতর্ক হতে হবে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল সে। আর্মির ট্রাক রাস্তায় ঘুরছে। আর্মির জওয়ানরা ফ্ল্যাগমার্চ করছে।

আর্মি কেন? এক্সটার্নাল থ্রেট ছাড়া আর্মিকে ডিপ্লয় করে না ইন্ডিয়া। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি না থাকলেও এই কাজ কেন? ইন্ডিয়া কি বুঝে গেছে যে রকি এখন এখানে? তার জন্যেই কি এই ম্যানহান্ট? তাহলে কী হবে? আতঙ্কিত রকি ট্যাব থেকে জিয়াকে ফোন করল। ফোন সুইচড অফ। এখন আর কাউকে ফোন করা যাবে না। গ্রিনবার্গকেও না। সে এখন কী অবস্থায় কে জানে! চিন্তিত মুখে আবার বাইরে তাকাল রকি। আর্মি ট্রাক থেকে মাইকে ঘোষণা হচ্ছে। জাতিদাঙ্গার আশঙ্কায় কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। আর্মি ও পুলিশ সবাইকে অনুরোধ করছে বাড়ির ভিতরে থাকতে।

রকি নিশ্চিন্ত হল। সে অকারণে ঘাবড়ে গিয়েছিল। ইন্ডিয়া তাকে নিয়ে এখনও বদারড নয়। সে অপূর্ব কুমার রায়ের পাসর্পোট দেখিয়ে প্লেনে উঠবে। তার চিন্তা কীসের?

মেঘনাদ বলল, ‘এয়ারপোর্ট এসে গেছে।’

পাউচ আর ট্যাব ছাড়া রকির কাছে কিছু নেই। ন্যাপস্যাকটা লাল হ্যাচব্যাকে রয়ে গেছে। ওটার মধ্যে এমন কিছু নেই যা থেকে পুলিশ তাকে ট্রেস করতে পারবে। পাউচে উঁকি মেরে পাসপোর্ট আর কার্ডগুলো দেখে নেয় রকি। লুজ ক্যাশ যথেষ্ট আছে। কোমরে গোঁজা গ্লক পিস্তল অ্যাম্বুল্যান্সে রেখে দেয়। কানেক্ট-জেটের ফ্লাইটের কোচিতে অ্যারাইভাল টাইম জানিয়ে ট্যাব থেকে দিপুকে এসএমএস করে দিল। দিপু গাড়ি নিয়ে কোচি এয়ারপোর্টের বাইরে অপেক্ষা করবে।

কার পার্কিং-এ অ্যাম্বুল্যান্স পার্ক করে বালাজি নেমেছে। ফোনে বুনোকে নির্দেশ দিচ্ছে, সে যেন এসে অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে যায়। পিছনের দরজা খুলে মেঘনাদ প্রথমার হাত ধরে নামাচ্ছে। রকি নিজের ই-টিকিট নিয়ে এয়ারপোর্টের প্রধান দরজার দিকে এগোল।

রকির সামনে একটা বাচ্চা ছেলে। হাতে ছোট কাগজের পতাকা আর টিনের কৌটো। এর সঙ্গেই সকালে মোলাকাত হয়েছিল না? ছেলেটা রকির টি শার্টে পতাকা লাগানোর আগেই রকি খুচরো একটাকা টিনের কৌটোয় ফেলে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইয়ু।’

.

এয়ারপোর্টের চেক-ইন কাউন্টারে বসে সিআইএসএফ-এর জওয়ান বলবিন্দর সিং হিন্দি কাগজ পড়ছিল। পঁচিশ বছরের বলবিন্দর ছয় ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা, তাগড়াই চেহারা, একগাল দাড়ি। মাথায় পাগড়ি। ফ্লাইট চালু থাকলেও যুদ্ধের আশঙ্কায় দুপুর থেকে যাত্রী নেই। একটু আগে টিভিতে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনে দেশবাসী আশ্বস্ত। তবে এখনও এয়ারপোর্ট ফাঁকা।

সিকিয়োরিটির কাজ। অথচ ফ্রিস্কিং-এর জন্য যাত্রী নেই। সারাদিন ধরে বলবিন্দর কাগজ পড়ছে আর টিভি দেখছে। এয়ারপোর্টে খবরের কাগজের অভাব নেই। আজকের বাংলা, ইংরিজি আর হিন্দি কাগজের বান্ডিল শেষ করে বলবিন্দর গতকালের বাংলা কাগজে হাত দিয়েছে। দমদম এয়ারপোর্টের অনেক কোলিগ বাঙালি, বলবিন্দারের প্রেমিকা রিনা বাঙালি, ভাষাটা না শিখে সে যায় কোথায়? ইনফ্যাক্ট তার প্রেমিকা রিনা এখন স্ক্যানারের সামনে বসে মোবাইলে গেম খেলছে। মেয়েটার বাড়ি মধ্যমগ্রামে। ন্যাশনাল লেভেলের সুইমার ছিল। স্পোর্টস কোটায় চাকরি পেয়েছে।

‘আজ সকাল’ কাগজের হেডলাইন, ‘সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে হবে, বললেন রাষ্ট্রপতি।’ এই বাঙালি রাষ্ট্রপতিটিকে কেন যে চেয়ার দেওয়া হয়েছে কে জানে! বছরে একবার বা দু’বার ছাড়া দেখতে পাওয়া যায় না। মিডিয়ার নাগালের বাইরে থাকে। এইসব লোককে রেখে কী ফায়দা? যাকগে! খবরে চোখ রাখে বলবিন্দর। ‘গাঁধী জয়ন্তীর প্রাক্কালে, আমদাবাদের বণিকসভার এক ভাষণে রাষ্ট্রপতি অরুণ চ্যাটার্জি জানিয়েছেন যে প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্র ওয়ারিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার পাশাপাশি সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে হবে…’ এইসব বেফালতু খবর পড়ে কোনও লাভ নেই। বলবিন্দার পাতা উলটোয়।

কানেক্ট-জেটের ফ্লাইটের ঘোষণা হয়ে গেল। এক এক করে যাত্রীরা আসছে। কানেক্ট-জেটের কাউন্টারে ই-টিকিট দেখিয়ে বোর্ডিং পাস নিচ্ছে, হ্যান্ড লাগেজ আর বোর্ডিং লাগেজে ট্যাগ লাগাচ্ছে। টুকটুক করে আসছে ফ্রিস্কিং কাউন্টারে। মেটাল ডিটেক্টার নিয়ে বলবিন্দার ছেলেদের বডি ফ্রিস্ক করছে, রিনা করছে মেয়েদের। মেয়েদের ফ্রিস্কিং-এর জন্য পরদা ঢাকা কিউবিকল আচ্ছে। একইসঙ্গে তারা স্ক্যানারে হ্যান্ড লাগেজ দেখছে। বলবিন্দর শুনেছে, ভারতের সব এয়ারপোর্টে বডি স্ক্যানার বসানোর কথা হচ্ছে। তখন এই আদ্দিকালের মেটাল ডিটেক্টর উঠে যাবে। বলবিন্দরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বেঁটে একটা লোক। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। একপলক দেখেই বলবিন্দর বুঝল, এ ফ্রিকোয়েন্ট ফ্লায়ার। এদের নিয়ে ঝামেলা সবচেয়ে কম। লাগেজ থাকে না, প্লেনে উঠে ঘুমিয়ে পড়ে, ফোনে বকবক করে না, সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে।

লোকটা ই-টিকিট আর ভোটার কার্ড এগিয়ে দিয়েছে। নাম পড়ল বলবিন্দর। অপূর্ব কুমার রায়। হ্যান্ডলাগেজ বলতে পাউচ আর ট্যাব। এইরকম ট্যাব কেনার খুব ইচ্ছে বলবিন্দরের। কবে যে পারবে!

গায়ে ডিটেক্টার বুলিয়ে কোনও আওয়াজ হল না। ট্যাব আর পাউচ ছোট্ট ঝুড়িতে রেখেছে অপূর্ব। স্ক্যানার মেশিনের সামনে দিয়ে কনভেয়র বেল্টে চেপে ঝুড়ি চলে এসেছে ও পাশে। রিনা ঘাড় নেড়ে ‘ও কে’ করে আবার গেম নিয়ে ব্যস্ত। পাউচ আর ট্যাব তুলে নিয়ে অপূর্ব কফির কিয়স্কে চলে গেল।

পরের যাত্রী, বিশাল চেহারার ছোকরা। বলবিন্দর ই-টিকিট দেখল। নাম বালাজি মিশ্র। কোনও লাগেজ নেই। সন্দেহের চোখে বলবিন্দর বলল, ‘ফোটো আইকার্ড?’

‘আইকার্ড দিয়ে কী হবে?’ ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, বালাজি।

বলবিন্দর ঠান্ডা গলায় বলল ‘ফোটো আইকার্ড।’ ই-টিকিট থাকলে ফোটো আইকার্ড দেখানো বাধ্যতামূলক। বালাজি সেটা দেখাতে না পারলে বলবিন্দর তাকে প্লেনে উঠতে দেবে না।

বালাজি কী একটা বলে তর্ক করতে যাচ্ছিল। পিছন থেকে একটা লোক বলল, ‘তর্ক কোরো না। দেখিয়ে দাও।’

বলবিন্দর বাংলা বোঝে। ভাষার সূক্ষ্ম দিকগুলোও বোঝে। বলবিন্দর বুঝল, এরা পরস্পরের চেনা। তা না হলে লোকটা ‘কোরো না’ বা ‘দেখিয়ে দাও’ বলত না। বলত, ‘করবেন না’। বলত, ‘দেখিয়ে দিন।’

বালাজি শার্টের পকেট থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স বার করে দেখাল। বলবিন্দর দেখে ফেরত দিল। ঠিকঠাক ডকুমেন্ট। তার কিছু করার নেই। তবে একে একটু রগড়ালে ভালো হত। মেটাল ডিটেক্টার শরীরে বুলিয়ে বালাজিকে সিকিয়োরিটির বেড়া পার করে দেয় বলবিন্দর। বালাজি কফির কিয়স্কে চলে যায়।

সামনে একটা মেয়ে। হুইল চেয়ারে বসে। ঘুমঘুম চোখে ফিকফিক করে হাসছে। হুইল চেয়ারের পিছনে দাঁড়ানো লোকটার দিকে তাকাল বলবিন্দর। লোকটা বলল, ‘আমার নাম ডক্টর মেঘনাদ লাহিড়ি। এ আমার মেয়ে।’ সে দুটো পাসপোর্ট আর দুটো ই-টিকিট এগিয়ে দিয়েছে।

বলবিন্দর মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপকা নাম?’

‘প্র-থ-মা-লা-হি-ড়ি। বা-বা-র না-ম মে-ঘ-না-দ লা-হি-ড়ি।’ মুখ তুলে মেঘনাদের দিকে তাকায় প্রথমা। মেঘনাদ বলে, ‘ওর একটা অসুখ হয়েছে। চিকিৎসা করাতে কোচি নিয়ে যাচ্ছি।’

আ-মা-র ডা ডা-উ-ন-স সি-ন-ড্রো-ম আ-ছে।’ হাসছে প্রথমা। বলবিন্দর মেঘনাদকে বলল, ‘ইসকো খড়া হোনা পড়ে গা।’

মেঘনাদ বলল, ‘শিয়োর! প্রথমা, তুমি উঠে দাঁড়াও। প্রথমা কথা না বুঝে বলল, ‘আ-মা-র বা-বা। মে-ঘ-না-দ লা-হি-ড়ি।’ মেঘনাদ প্রথমার হাত ধরে বলল, ‘মা, একবার উঠে দাঁড়াও।’

ভাসাভাসা চোখে বলবিন্দরের দিকে তাকিয়ে প্রথমা বলল, ‘ডা-ডা-উ ন-স সিনড্রোম। ডা-ডা-উ-ন-স সিনড্রোম…’

বলবিন্দর আড়চোখে রিনার দিকে তাকাল। রিনা গেমস বন্ধ রেখে উঠে এল। মেটাল ডিটেক্টর নিয়ে পরদা ঘেরা ঘরে প্রথমাকে নিয়ে ঢুকে গেল। প্রথমা আঙুল নেড়ে বাইরের দিকে দেখাচ্ছে, ‘আ-মা-র বা-বা! বা-বা!’

ক্যাজুয়ালি প্রথমার পায়ে মেটাল ডিটেক্টার বোলাচ্ছে রিনা। পা থেকে কোমর, পেট…পিঠ…মেটাল ডিটেক্টর ঘুরছে। দুই হাত, বুক… ট্যাঁ…ট্যাঁ…ট্যাঁ…ট্যাঁ…

‘কী হল?’ বাইরে থেকে মেঘনাদ জিজ্ঞাসা করল। ‘পতা নহি!’ শ্রাগ করে বলবিন্দর। রিনাকে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘ব্রায়ের হুক?’

‘না।’ ভিতর থেকে স্পষ্ট গলায় বলে রিনা। পরদাঘেরা ঘর থেকে প্রথমাকে নিয়ে বেরিয়ে মেঘনাদকে বলে, ‘আপনি ওকে স্ক্যানারের সামনে দাঁড় করান।’

মেঘনাদ ভুরু তুলে বলে, ‘স্ট্রিপ সার্চ? সে তো ইন্ডিয়াতে এখনও চালু হয়নি।’

রিনা বলে, ‘আপনি আপত্তি করলে আপনার অসুস্থ মেয়েকে অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে আলাদা করে আমি সার্চ করব।’

মেঘনাদ বলে, ‘আমি একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী। আমার কথার কোনও গুরুত্ব নেই?’

‘আমাদের কাছে একমাত্র গুরুত্বপুর্ণ জিনিস আপনাদের সিকিয়োরিটি। তার জন্যই এই সার্চ। আপনার মেয়ে একবার স্ক্যানারের সামনে দাঁড়ালেই হবে। স্ট্রিপ করার কোনও প্রশ্নই নেই।’

মেঘনাদ গলা চড়িয়ে বলে, ‘দাঁড়াচ্ছে দাঁড়াক। কিন্তু কিছু না পাওয়া গেলে আমি আপনাদের নামে এয়ারপোর্ট অথরিটির কাছে কমপ্লেন করব। আমার হাত কতদূর লম্বা, আপনাদের কোনও ধারণাই নেই।’

বলবিন্দর আড়চোখে দেখে, বিশাল চেহারার ছেলেটা কফি কিয়স্ক থেকে গুটি গুটি এদিকেই আসছে। প্রথমা স্ক্যানার মেশিনের সামনে দাঁড়াল। লাইনে আরও লোক দাঁড়িয়ে। তারা অধৈর্য হয়ে চেঁচামেচি করছে। মেঘনাদের শরীরে মেটাল ডিটেক্টর বোলানো শুরু করে বলবিন্দর।

‘বলবিন্দর!’ রিনা তাকে ডাকছে। ঘাড় ঘুরিয়ে বলবিন্দর দেখল রিনার ভুরু কুঁচকানো। সে অবাক হয়ে স্ক্যানারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেঘনাদকে ফ্রিস্ক করা ছেড়ে বলবিন্দর রিনার পাশে এসে দাঁড়ায়। দেখে পরদায় প্রথমার শরীর দেখা যাচ্ছে। কামিজের পকেটে কিছু টাকা আর একটা কাগজ আছে। ঊর্ধ্বাঙ্গে ব্রায়ের হুক ছাড়া অন্য একটা জিনিস রয়েছে।

দুই স্তনের মাঝখানে রয়েছে একটা চামচ।

বলবিন্দর অবাক হয়ে রিনার দিকে তাকায়। রিনা পাশে পড়ে থাকা ‘আজ সকাল’ কাগজটা তুলে বিদেশের খবরের পাতায় একটা খবরের দিকে আঙুল দেখায়। খবরে চোখ বোলায় বলবিন্দর। ‘লন্ডনে বসবাসকারী অনাবাসী ভারতীয় মেয়েদের পনেরো-ষোলো বছরে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কম বয়সে বিয়ে লন্ডনে বেআইনি বলে মেয়ের বাড়ির লোক জোর করে তাদের ভারতে নিয়ে যাচ্ছে। এই প্রবণতা রুখতে লন্ডন পুলিশ মেয়েদের পরামর্শ দিয়েছে, তারা যেন প্লেনে ওঠার আগে পোশাকের মধ্যে স্টিলের চামচ লুকিয়ে রাখে। সিকিয়োরিটি চেকিঙের সময় ধাতব চামচ স্ক্যানারে দেখা যাবে। তাহলেই দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক বুঝে যাবে যে, মেয়েটিকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাচার করা হচ্ছে।’

‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়!’ ঘোষণা করে বলবিন্দর। মেঘনাদকে বলে, ‘আপ মেরে সাথ আইয়ে।’

‘কোথায়? কেন?’ এক-পা এক-পা করে পিছোচ্ছে মেঘনাদ। প্রথমা তার হাত ধরে বলে, ‘আ-মা-র বা-বা! মে-ঘ-না-দ লা-হি-ড়ি!’

‘আইয়ে মেরে সাথ!’ ধমক দেয় বলবিন্দর। ‘অফিসারকে পাস চলিয়ে। ইয়ে লড়কিকে চোলি কে অন্দর চামচ রখা হুয়া হ্যায়।’

‘এক মিনিট ভাই। ঝামেলা করছ কেন?’ বলবিন্দরের কাঁধে টোকা মেরে বলছে বালাজি। রাগে গনগন করতে করতে বলবিন্দর বলল, ‘আববে ! হাথ হঠা! এই রিনা, কল ফোর্স ইমিডিয়েটলি!’

ফোর্সের নাম শুনেই মেঘনাদ প্রথমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে বলে, ‘ফোর্স ডাকছেন? জানেন, আমি কে?’

‘জানি না। তবে এবার জানব।’ মেঘনাদের হাত ধরে বলে বলবিন্দর। বালাজি এগিয়ে এসে বলবিন্দরের মুখ লক্ষ্য করে ঘুষি চালায়। ছ’ফুটের ওপর লম্বা, জিম করে মাসল বানানো বালাজির ঘুষির অভিঘাতে বলবিন্দরের ঠোঁট কেটে দরদর করে রক্ত পড়ছে। ডান হাতের উলটো পিঠ দিয়ে রক্ত মোছে ছ’ফুট তিন ইঞ্চির বলবিন্দর। বালাজির দিকে না তাকিয়ে বিনীতভাবে মেঘনাদকে বলে, ‘আপ মেরে সাথ আইয়ে!’

বালাজির ব্যবস্থা করার জন্য অন্য লোক আছে। রিনা অলরেডি বালাজির কলার ধরে মেঝেতে পেড়ে ফেলেছে। সিআইএসএফ-এর জনাবিশেক জওয়ান গণ্ডগোল দেখে এখানে চলে এসেছে। আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে তারা বালাজিকে ঘিরে ফেলেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *