২০. কালি-কলম অফিসে পুলিশের হানা

আমাদের পূর্বাগতদের প্রায় সকলেই স্পর্শ পড়েছিল কল্লোলে। ভারতী দল বলতে যাদেরকে বোঝায় তাদেরই মুখপাত্রদের। সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, নরেন্দ্র দেব। বিখ্যাত বারোয়ারী উপন্যাসের গৌরবদীপ্ত পরিচ্ছেদ। সৌরীন্দ্রমোহন ও নরেন্দ্র দেব উপন্যাস লিখেছেন কল্লোলে, হেমেন্দ্রকুমার কবিতা আর প্রেমাঙ্কুর গল্প। পুরানো চালে ভাত বাড়ে তারই আকর্ষণে ও-সব ভাণ্ডারে মাঝে-মাঝে হাত পাততে দীনেশরঞ্জন, স্বজনপালনের খাতিরে ওঁরাও কার্পণ্য করতেন না, অবারিত হতেন। তবু কল্লোলে ওঁদের লেখা প্রকাশিত হলেও ওঁদের লেখায় কল্লোল প্রকাশিত হয়নি।

সবার চেয়ে নিকট ছিলেন নরেনদা। প্রায় জলধারদাদারই দোসর, তারই মত সর্বতোভদ্র, তাঁরই মত নিঃশত্রু। আর-আমরা কল্লোল-আপিসে কদাচিৎ আসতেন, কিন্তু নরেনদাকে অমনি কালে-ভদ্রের ঘরে ফেলা যায়না। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, ওরফে বুড়োদা, খুব একজন কইয়ে-বইয়ে লোক, ফুর্তিবাজ গল্পে, হেমেনদা আবার তেমনি গম্ভীর, গভীরসঞ্চারী। মাঝখানে নরেনদা, পরিহাস প্রসন্ন, যে পরিহাস সব অবস্থায়ই মাধুর্যমার্জিত। কল্লোলে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাসে তিনি এক চমকপ্রদ উক্তি করেন। ঠিক তিনি করেন না, তাঁর নায়ককে দিয়ে করান। কথাটা আসলে নির্দোষ নিরীহ, কিন্তু সমালোচকরা চমকে ওঠে বলেই চমকপ্রদ। Cousins are always the best targets. সমাজতত্ত্বের একটা মোটা কথা, যার বলে বর্তমানে হিন্দু বিবাহ-আইন পর্যন্ত সংশোধিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু সেকালে ঐ সরল কথাটাই সমালোচকের বিচারে অশ্লীল ছিল। যা কিছু চলতি মতের পন্থী নয় তাই অশ্লীল।

শনিবারের চিঠি প্রতি মাসে ‘মণিমুক্তা’ ছাপত। খুব যত্ন করে আহরণ করা রত্নাবলী। অর্থাৎ কোনখানে কোথায় কি বিকৃতি পাওয়া যায় তাই বেছে বেছে কুড়িয়ে এনে সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিবেশন করা। বেশির ভাগই প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন, খাপছাড়া ভাবে খানিকটা শিথিল উদ্ধৃতি। ভাই ও সবকে শুধুমণি না বলে মধ্যমণিও বলা চলে। একখানা কল্লোল বা কালিকলম, প্রগতি বা ধূপছায়া কিনে কি হবে, তার চেয়ে একখানা শনিবারের চিঠি কিনে আনি। এক থালায় বহু ভোজ্যের আস্বাদ ও আঘ্রাণ পাব। সঙ্গে-সঙ্গে বিবেককেও আশ্বাস দিতে পারব, সাহিত্যকে শ্লীল, ধর্মকে খাঁটি ও সমাজকে অটুট রাখবার কাজ করছি। একেই বলে ব্যবসার বাহাদুরি। বিষ যদি বিষের ওষুধ হয়, কণ্টক যদি কণ্টকের, তবে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে অশ্লীলতাই বা ব্যবহার করা যাবে না কেন? আর কে না জানে, যদি একটু ধর্মের নাম একটু সমাজস্বাস্থ্যের নাম ঢোকানো যায় তবে অশ্লীলতাও উপাদেয় লাগে।

এই সময় হসন্তিকা বেরোয়। উদ্যোক্তা ভারতীর দলের শেষ রথীরা। শুনতে মনে হয় হাসির পত্রিকা, কিন্তু হসন্তিকার আসল অর্থ হচ্ছে ধুনুচি, অগ্নিপাত্র। তার মানে, সে হাসাবেও আবার দগ্ধও করবে। অর্থাৎ এক দিকে শনিবারের চিঠিকে ঠুকবে অন্য দিকে আধুনিক সাহিত্যের পিঠ চাপড়াবে। মতলব যাই থাক ফল দাঁড়াল পানসে। শনিবারের চিঠির তুলনায় অনেক জোলো আর হালকা। অত জোরালো তো নয়ই, অমন নির্জলাও নয়।

শনিবারের চিঠির মণিমুক্তার বিরুদ্ধে আক্ষেপ করছে হসন্তিকা:

আমরা সখের মেথর গো দাদা, আমরা সখের মুর্দ্দফরাস
মাথায় বহিয়া ময়লা আনিয়া সাজাই মোদের ঘরের ফরাস।
শকুনি গৃধিনী ভাগাড়ের চিল, টেক্কা কে দেয়, মোদের সাথ?
যেখানে নোংরা, ছো মারিয়া পড়ি, তুলে নিই ত্বরা ভরিয়া হাত।
গলা ধ্বসা যত বিকৃত জিনিস কে করে বাছাই মোদের মতো?
আমরা জহুরি পচা পঙ্কের যাচাই করা তো মোদের ব্রত!
মোদের ব্যাসাতি ময়লা-মাণিক আস্তাকুড় যে ক্ষেত্র তার,
নর্দ্দমা আর পগার প্রভৃতি লয়েছি কায়েমী ইজারা ভার!

আর যাই হোক, খুব জোরদার ব্যঙ্গ কবিতা নয়। আর, প্রত্যুত্তরে শনিবারের চিঠির ব্যঙ্গ হল কবিতাটাকেই মণি-মুক্তার নথিভুক্ত করা।

 

বুদ্ধদেবের চিঠি :

তোমার চিঠিখানা পড়ে ভারি আনন্দ হল। এক-একবার নতুন করে প্রগতির প্রতি তোমার যথার্থ প্রীতি ও শ্রদ্ধার পরিচয় পাই-আর বিস্ময়ে ও আনন্দে মনটা ভরে যায়। আমরা নিজেরা দুচারজন ছাড়া প্রগতিকে এমন গভীর ভাবে কেউ cherish করে না একথা জোর করে বলতে পারি। প্রথম যখন প্রগতি বার করি তখন আশা করিনি তোমাকে এতটা নিকটে পাওয়ার সৌভাগ্য হবে।

চিঠিতেই প্রায় one-third গ্রাহক ছেড়ে দিয়েছে; ভি পি তো সবে পাঠালাম-কটা ফেরৎ আসে বলা যায় না। আরম্ভ মোটেই promising নয়। তবু একেবারে নিরাশ হবার কারণ নেই বোধ হয়। নতুন গ্রাহকও দুচারজন করে হচ্ছে—এ পর্যন্ত চারজনের টাকা পেয়েছি—আরো অনেকগুলো promise পাওয়া গেছে। মোটমাট গ্রাহক সংখ্যা এবার বাড়বে বলেই আশা করি—গত বছরের সংখ্যার অন্তত দেড়গুণ হতে বাধ্য শেষ পর্যন্ত। তা ছাড়া advt.ও বেশ কিছু পাওয়া যাচ্ছে। ও বিজ্ঞাপনটা নরেন দেব দিয়েছেন—ওঁর নিজের বইগুলোর। আগে ইচ্ছে ছিল বিনি পয়সায় ছাপানোর–পরে মাসে পাঁচ টাকা দিতে রাজি হয়েছেন। মন্দ কি?

হসন্তিকা পড়েছি। তুমি যা বলেছ সবই ঠিক কথা। এক হিসেবে শনিবারের চিঠির চাইতে হসস্তিকা ঢের নিকৃষ্ট ধরনের কাগজ হয়েছে। শনিবারের চিঠি আর যা-ই হোক sincere—ওরা যা বলে তা ওরা নিজেরা বিশ্বাস করে। কিন্তু হসন্তিকার এই গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে আসার প্রবৃত্তিটা অতি জঘন্য। কিছু না বুঝে এলোপাথাড়ি বাজে সমালোচনা–কতখানি মানসিক অধঃপতন হলে যে এ সম্ভব জানিনে। তার ওপর, আগাগোড়া ওদের patronising attitudeটাই সব চেয়ে অসহ। আমাদের যেন অত্যন্ত কৃপার চোখে দেখে! এর চেয়ে শনিবারের চিঠির sworn enmity অনেক ভালো অনেক সুসহ।

 

হাসির কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে যায় দাঠাকুরকে। দা-ঠাকুর মানে শরৎ পণ্ডিত মশাই। যিনি কলকাতাকে ‘কেবল ভুলে ভরা’ দেখেছেন—সঙ্গে-সঙ্গে হয়তো জগৎ-সংসারকেও। নিমতলার ঘাটে নিমগাছটার কথা যিনি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন অবিরত। মাঝে-মধ্যে আসতেন কল্লোলের দোকানে। কথার পিঠে কথা বলার অপূর্ব দক্ষতা ছিল, আর সে সব কথার চাতুরী যেমন মাধুরীও তেমনি। তার হাসির নিচে একটি প্রচ্ছন্নদর্শন বেদনা ছিল। যে-বেদনা জন্ম নেয় পরিচ্ছন্ন দর্শনে। খালি গায়ে একটি চাদর জড়িয়ে আসতেন। প্রচণ্ড শীত, খালি গায়ের উপরে তেমনি একখানি পাতলা চাদর দা-ঠাকুরের। কে যেন জিগগেস করল আশ্চর্য হয়ে, এই একটা সামান্য চাদরে শীত মানে? ট্যাঁক থেকে একটা পয়সা বার করলেন দা-ঠাকুর, বললেন, পয়সার গরম!

চৌষট্টি দিন রোগভোগের পর তার একটি ছেলে মারা যায়। যেদিন মারা গেল, সেদিনই দা ঠাকুর কল্লোলে এলেন। বললেন, চৌষট্টি দিন ড্র রেখেছিলাম, আজ গোল দিয়ে দিলে।

রাধারাণী দেবী কল্লোলে লিখেছেন—তিনি কল্লোল যুগেরই কবি। ইদানীন্তন কালে তিনিই প্রথম মহিলা যাঁর কবিতায় বিপ্লব আভাত হয়েছে। তখন তিনি দত্ত, দেবদত্ত হননি। এবং রবীন্দ্রনাথের বিচিত্রাগৃহে আধুনিক সাহিত্যের যে বিচার-সভা বসে তাতে ফরিয়াদী পক্ষে প্রথম বক্ত রাধারাণী। সেদিনকার তাঁর সেই দার্ঢ্য ও দীপ্তি ভোলবার নয়।

হেমেন্দ্রলাল রায় ঠিক ভারতীর যুগে পড়েন না, আবার কল্লোল-এরও দলছাড়া। তবু কল্লোল-আপিসে আসতেন আড্ডা দিতে। স্বভাবসমৃদ্ধ সৌজন্যে সকলের সঙ্গে মিশতেন সতীর্থের মত। কল্লোল যখন মাঝেমাঝে বাইরে চড়াইভাতি করতে গিয়েছে, হয় বোটানিক্‌সে নয় তো কৃষ্ণনগরে, নজরুলের বা আফজলের বাড়িতে, তখন হেমেন্দ্রলালও সঙ্গ নিয়েছেন। উল্লাসে-উচ্ছ্বাসে ছিলেন না কিন্তু আনন্দে-আহ্লাদে ছিলেন। হৈ-হল্লাতে সামর্থ্য না থাকলেও সমর্থন ছিল। উন্মুক্ত মনের মিত্রতা ছিল ব্যবহারে।

কল্লোল-আপিসে একবার একটা খুব গম্ভীর সভা করেছিলাম আমরা। সেই ছোট, ঘন, মায়াময় ঘরটিতে অনেকেই একত্র হয়েছিল সেদিন। কালিদাস নাগ, নরেন্দ্র দৈব, দীনেশরঞ্জন, মুরলীধর, শৈলজা, প্রেমেন, সুবোধ রায়, পবিত্র, নৃপেন, ভূপতি, হরিহর এবং আরো কেউ-কেউ। সেদিন ঠিক হয়েছিল কল্লোলকে ঘিরে একটা বলবান সাহিত্য-গোষ্ঠী তৈরি করতে হবে। যার মধ্য দিয়ে একটা মহৎ প্রেরণা ও বৃহৎ প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্য সম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে। একটা কিছু বড় রকমের সৃষ্টি, বড় রকমের প্রজ্ঞা। সমস্ত বাধা বিপদ ও ব্যর্থ বিতর্ক উপেক্ষা করে একাগ্রসাধন।

দেখি সে সভায় কখন হেমেন্দ্রলাল এসে উপস্থিত হয়েছেন। নিঃশব্দে রয়েছেন কোণ ঘেঁসে। হেমেন্দ্রলাল কল্লোলের তেমন লোক যাকে কল্লোলের সভায় নিমন্ত্রণ না করলেও যোগ দিতে পারেন অনায়াসে।

মনে আছে সেদিনের সেই সভার চৌহদ্দিটা মিত্রতার মাঠ থেকে ক্রমে-ক্রমে অন্তরঙ্গতার অঙ্গনে ছোট করে আনা হয়েছিল। দীনেশদাকে ঘিরে সেদিন বসেছিলাম আমরা কজন। স্থির করেছিলাম, সাহিত্যিক সিদ্ধিও যোগজ সিদ্ধি—কেউ তাই বিয়ে করব না। অনন্যচেতা হয়ে বদ্ধপদ্মাসনে শুধু সাহিত্যেরই ধ্যান করব। শুধু তাই নয়, থাকব একসঙ্গে, এক ব্যারাকে, এক হাঁড়িতে! সকলের আয় একই লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে জড়ো হবে, দর বুঝে নয় দরকার বুঝে হবে তার সমান বাঁটোয়ারা। সুন্দর স্বপ্নের উপনিবেশ স্থাপন করব।

নৃপেন তো প্রায় তখুনি ব্যারাকের জায়গা খুঁজতে ছোটে। প্রেমেন গ্রামের পক্ষপাতী। দীনেশদা বললেন, যেখানেই হোক, নদী চাই, গঙ্গা চাই।

সুরতরঙ্গিনী পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গা।

এই সময়কার চিঠি একটা দীনেশদার :

আমরা কি প্রত্যেক দিন ভাবি না, আমি শ্রান্ত ক্লান্ত, আর পারি না। অথচ আমরাই প্রান্তিকে অবহেলা করে শান্তি লাভ করি।

সর্বতোমুখী প্রতিভা আমাদের—এ সবগুলিকে একাগ্র ও একায়ত্ত করে নিতে হবে। আমাদের আমাকে স্বীকার করতে হবে। নিজেকে পূর্ণ করে নিতে হবে। ঈশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণ হোক বলে আমাদের তৃপ্তি হয় না, আমরা তার ইচ্ছা পূর্ণ করব বলেই এই অসীম শক্তি নিয়ে এসেছি। আমরা কে? আমরা তারা যারা রণোন্মত্ত বীরের মত উন্মুক্ত অসি নিয়ে মরণকে আহ্বান করে না—তারা, যারা অসীম ধৈর্যে ও করুণায় অক্ষয় শক্তি ও আনন্দ নিয়ে মৃত্যুকে বরাভয় দেয়। আমরা অভয় অভয়ার সন্তান। অমর বলে আমরা বলীয়ান—আমরা এক—বহুর অনুপ্রেরণা। আমরা দুর্বলের ভরস—দুর্যোধনের ভীতি। মহারাজ্যেশ্বরের অমৃতলোকের রথী আমরা—আমরা তার কিঙ্কর-কিঙ্করী নই।

অবসাদ-অভিমান আমাদের আসে, কিন্তু সকলকে তাড়িয়ে নয়, এ সকলকে ঘাড়ে করে উঠে দাঁড়াই আমরা। যত দুৰ্বার পথ সামনে পড়ে তত দুর্জয় হই। তাই নয় কি? আমরা যে এসেছিলাম, বেঁচেছিলাম, বেঁচে থাকবও–এ কথা পৃথিবীকে স্বীকার করতে হয়েছে, করতে হচ্ছে, হবে-ও।

ছিন্নভিন্ন এই হৃদয় আমাদের সাতখানে ছুটে বেড়ায়। এই ঘোটার মধ্যেই আমারা সত্যের সন্ধান পাই। সত্যের মৃগয়া করে আমাদের মন আবার ধ্যানলোকে ফিরে আসে। আমরা হাসি-কাঁদি, জীবনকে শতধা করে আমরাই আবার ভাঙা হাড় জোড়া লাগাই। এই ভাবটাই আমার আজকের চিন্তা, তোমাকে লিখলাম। প্রকাশের অক্ষমতা মার্জনা করো।

চার দিকে প্রলয়ের মেঘ, অগ্নিকুণ্ডের মাঝখানে বসে আছি, তবু মনে হয়, আসুক প্রলয়, তার সহস্র আক্রোশের শেষ পাওনাও তো আমায়।

সকলে ভাল। আজ বিদায় হই। তোমরা খবর দিও। জেগে ওঠ, বেঁচে ওঠ, হেঁইয়ো বলে তেড়ে ওঠ-দেখবে কাঁধের বোঝা বুকে করে চলতে পারছ। D.R.

 

কিছুকাল পরে বুদ্ধদেবের চিঠি পেলাম :

হঠাৎ বিয়ে করা ঠিক করে ফেললে যে? আমার আশঙ্কা হয় কি জানো? বিয়ে করে তুমি একেবারে তৈলস্নিগ্ধ সাধারণ ঘরোয়া বাঙালী না বনে যাও। গৃহশান্তিনিকেতনের আকর্ষণ কম নয়, কিন্তু সেটা পার্থিব-এবং কবিপ্রতিভা দৈব ও শতবর্ষের তপস্যার ফল। বাঁধা পড়ার আগে এই কথা ভালো করে ভেবে নেবে তো?

 

কল্লোলে আসবার আগেই হেমেন্দ্রলালের দেখা পাই। প্রেমেন আর আমি দুজনে যুক্তভাবে প্রথম উপন্যাস লিখছি। কাঁচা লেখা বলেই বইর নাম বাঁকালেখা ছিল তা নয়, জীবনের যিনি গ্রন্থকার তিনিই যে কুটিলাক্ষর—ছিল এমনি একটা গভীর বক্রোক্তি। তখন হেমেন্দ্রলালের সম্পাদনায় মহিলা নামে এক সাপ্তাহিক পত্রিকা বেরুত, শৈলজা আমাদের নিয়ে গেল সেখানে। শৈলজার উপন্যাস বাংলার মেয়ে ছাপা হচ্ছিল মহিলায়—সেটা শেষ হইতেই শুরু হয়ে গেল বাঁকালেখা। ক্রমে বইটা গ্রন্থকারিত হল। মূলে সেই হেমেন্দ্রলালের সহযোগ।

সে সবদিন নায়ক নায়িকার জন্মপত্রের ছক কেটে-কেটে আমাদের দিন যেত-প্রেমেনের আর আমার। কোন কক্ষে কোন চরিত্রের স্থিতি বা সঞ্চার এই নিয়ে গবেষণা। বাড়িতে বৈঠকখানা থাকবার মত কেউই সম্ভ্রান্ত নই, তাই কালিঘাটের গঙ্গার ঘাটে কিংবা হরিশ পার্কের বেঞ্চিতে কিংবা এমনি রাস্তায় টহল দিতে দিতে চলত আমাদের কূটতর্ক। যত লিখতাম তার চেয়ে কাটাকুটি করতাম বেশি—আর যদি একবার শেষ হল, গোটা বই তিন-তিনবার কপি করতেও পেছপা হলাম না। প্রথম উপন্যাস ছাপা হচ্ছে—সে উৎসাহ কে শাসন করে!

কিছু টাকা-কড়ি পাব এ আশাও ছিল হয়তো মনে মনে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা আর হাতে এল না, হাওয়াতে মিলিয়ে গেল।

এমনি অর্থাভাব প্রত্যেকের পায়ে-পায়ে ফিরেছে। সাপের নিশ্বাস ফেলেছে স্তব্ধতায়। হাঁড়ি চাপিয়ে চালের সন্ধানে বেরিয়েছে—প্রকাশক বলেছে, কেটে-ছেঁটে ছোট করুন বই, কিংবা হয়তো বায়না ধরেছে ফেনিয়ে-ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে তুলুন। আয়ের স্থিরতা না থাকলে কাম্যকর্মে ধৈর্য আসবে কি করে? অব্যবস্থ মন কি করে একাগ্র হবে? সর্বক্ষণ যদি দারিদ্র্যের সঙ্গেই যুঝতে হয় তবে সর্বানন্দ সাহিত্যসৃষ্টির সম্ভাবনা কোথায়? কোথায় বা সংগঠনের সাফল্য?

শৈলজা খোলার বস্তিতে থেকেছে, পানের দোকান দিয়েছিল ভবানীপুরে। প্রেমেন ওষুধের বিজ্ঞাপন লিখেছে, খবরের কাগজের প্রুফ দেখেছে। নৃপেন টিউশানি করেছে, বাজারের ভাড়াটে নোট লিখেছে। আর-আরো কেউ নির্বাক যুগের বায়স্কোপে টাইটেল তর্জমা করেছে, রাজামহারাজার নামে গল্প লিখে দিয়েছে, কখনো বা হোমরাচোমরা কারুর সভাপতির অভিভাষণ। যত রকমের ওঁচা মামলা। যদি সুদিনের দেখা পাই—যদি মনের মুক্ত হাওয়ায় বসে গভীর উপলব্ধির মৌনে সত্যিকারের কিছু সৃষ্টি করতে পারি একদিন।

বুদ্ধদেবের একটা চিঠি এখানে তুলে দিচ্ছি :

এখানে কিছুই যেন করার নেই—সন্ধ্যা কি করে কাটবে এ সমস্যা রোজ নতুন বিভীষিকা আনে। সঙ্গীরা যে যার কাজে ব্যস্ত; এমন কি টুনুও পরীক্ষা নিয়ে লেগেছে। প্রথমত, টাকা নেই। রাত নটা নাগাদ বাড়ি ফিরি–দেখি সমস্ত পাড়াটাই নিঃঝাম হয়ে গেছে;–অন্ধকার এক ঘর; নিজহাতে আলো জ্বালাতে হয়;–ঠাণ্ডা ভাত, ঠাণ্ডা বিছানা। কাল রাতে স্বপ্ন দেখেছিলাম, আমি যেন পাগল হয়ে গেছি। ঘুমের ঘোরে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম;-পরে জেগে, যতক্ষণ আমার ঘুম না এল ভারি ভয় করতে লাগলো। মা নেই, সেইজন্যই বোধ হয় এত বেশি খারাপ লাগছে। নিজের হাতে চা তৈরী করতে হয়, সেইটে একটা torture. এদিকে আবার প্রেস সোমবারের মধ্যে নিদেন একশো টাকা চেয়েছে;-ওদের দোষ নেই, অনেকদিনের পাওনা, মোট ১৮০। এতদিন কোনোমতে আজ-কাল করে চালিয়ে আসছি;-এবারে না দিতে পারলে credit থাকবে না। কাগজের দোকানো ঢের পাবে; এমাসের কাগজ নগদ দাম ছাড়া আনা যাবে না। কি করে যে টাকার জোগাড় হবে কেউ জানে না। নিষ্কৃতির সহজ পন্থা হচ্ছে প্রগতির মহাপ্রয়াণ; কিন্তু প্রগতি ছেড়ে দেবো, এ কথা ভাবতেও আমার সারা মন যন্ত্রণায় মোচড় দিয়ে ওঠে। প্রগতির অভাব যেন প্রিয়ার বিরহের চেয়েও শত লক্ষ গুণে মর্মান্তিক ও দুঃসহ। একমাত্র উপায়—ধার;-কিন্তু আমাকে কে ধার দেবে? মার এমন কোনো গয়না-টয়নাও নেই যা কাজে লাগাতে পারি;-যা ছিলো আগেই গেছে। তবু চেষ্টার ত্রুটি করবে না, কিন্তু কোথাও পাবে কি-না, আমার এখন থেকেই সন্দেহ হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কি যে হবে, তা ভাবতেও আমার গা কালিয়ে আসে। যাক—এ বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পারলাম কিনা, পরের চিঠিতেই জানতে পাবে।

এই বিষাদ ও দুশ্চিন্তার মধ্যে এক-এক সময় ইচ্ছে করে, ভয়ানক desperate একটা কিছু করে ফেলি—চুরি বা খুন বা বিয়ে। কিন্তু হায়! সেটুকু সৎসাহসও যদি থাকতো।

 

প্রবোধ যখন কল্লোলে এল তখন কল্লোল আরো জমজমাট হয়েছে।

আমার প্রথম একক উপন্যাসের নাম বেদে, আর প্রবোধের যাযাবর। এই নিয়ে শনিবারের চিঠি একটা সুন্দর রসিকতা করেছিল। বলেছিল, একজন বলছে : বে দে, আর অমনি আয়েকজন বলে উঠছে : যা, যা বর। লোকটার বিয়ে শেষ পর্যন্ত হয়েছিল কিনা জানা যায়না, কিন্তু সভা ছেড়ে চলে যে যায়নি তাতে সন্দেহ কি। মুকুট না জুটুক, পিড়ি আঁকড়ে বসে আছে সে ঠিক।

এক দিকে যত ব্যঙ্গ, অন্য দিকে তত ব্যঞ্জনা। মিথ্যার পাশ কাটিয়ে নয়, মিথ্যার মূলোচ্ছেদ করে সত্যের মুখোমুখি এসে দাঁড়াও। শাখায় না গিয়ে শিকড়ে যাও, কৃত্রিম ছেড়ে আদিমে; সমাজের গায়ে যেখানে-যেখানে সিল্কের ব্যাণ্ডেজ আছে তার পরিহাসটা প্রকট করো। যারা পতিত, পীড়িত, দরিদ্রিত, তাদেরকে বাঙ্ময় করে তোলে। নতুনের নামজারি করো চারদিকে। কি লিখবে শুধু নয় কেমন করে লিখবে, গঠনে কি সৌষ্ঠব দেবে, সে সম্বন্ধেও সচেতন হও। ঘোলা আছে জল, স্রোতে-স্রোতে পরিশ্রুত হয়ে যাবে। শুধু এগিয়ে চলো, সন্তরণ সিন্ধুগমন অনিবার্য।

ওরা যত হানবে তত মানবে আমাদের। চলো এগিয়ে।

বস্তুত বিরুদ্ধ পক্ষের সমালোচনাও কম প্ররোচনা জোগাতনা। ভঙ্গিতে কিছু ত্বরা ও ভাষায় কিছু অসংযম নিশ্চয়ই ছিল, সেই সঙ্গে ছিল কিছুটা শক্তিময় স্বকীয়তা। প্রতিপক্ষ শুধু খোসাভুষিই কুড়িয়েছে, সার-শস্যের দিকে দৃষ্টি দেয়নি। নিন্দা করবার অধিকার পেতে হলে যে প্রশংসা করতেও জানতে হয় সে বোধ সেদিন দুর্লভ ছিল। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে এক চিঠি লেখেন। সে চিঠি তেরেশ চৌত্রিশের মাঘ মাসের শনিবারের চিঠিতে ছাপা হয়। তার অংশবিশেষ এইরূপ :

সাহিত্যের দোহাই ছেড়ে দিয়ে সমাজহিতের দোহাই দিতে পারো। আমার নিজের বিশ্বাস শনিবারের চিঠির শাসনের দ্বারাই অপর পক্ষে সাহিত্যের বিকৃতি উত্তেজনা পাচ্ছে। যে সব লেখা উৎকট ভঙ্গীর রান্না নিজের সৃষ্টিছাড়া বিশেষত্বে ধাক্কা মেরে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সমালোচনার খোঁচা তাদের সেই ধাক্কা মারাকেই সাহায্য করে। সম্ভবত ক্ষণজীবীর আয়ু এ-তে বেড়েই যায়। তাই যদি না হয়, তবু সম্ভবত এতে বিশেষ কিছু ফল হয় না। আইনে প্রাণদণ্ডের বিধান আছে, প্রাণহত্যাও থামছে না।

ব্যঙ্গরসকে চিরসাহিত্যের কোঠায় প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে আর্টের দাবী আছে। শনিবারের চিঠির অনেক লেখকের কলম সাহিত্যের কলম, অসাধারণ তীক্ষ্ণ, সাহিত্যের অস্ত্রশালায় তার স্থান-নব-নব হাস্যরূপের সৃষ্টিতে তার নৈপুণ্য প্রকাশ পাবে, ব্যক্তিবিশেষের মুখ বন্ধ করা তার কাজ নয়। সে কাজ করবারও লোক আছে, তাদের কাগজী লেখক বলা যেতে পারে, তারা প্যারাগ্রাফ-বিহারী।

আর একটা কথা যোগ করে দিই। যে সব লেখক বে-আব্রু লেখা লিখেছে, তাদের কারো কারো রচনাশক্তি আছে। যেখানে তাদের গুণের পরিচয় পাওয়া যায়, সেখানে সেটা স্বীকার করা ভালো। যেটা প্রশংসার যোগ্য তাকে প্রশংসা করলে তাতে নিন্দা করবার অনিন্দনীয় অধিকার পাওয়া যায়।

 

সঙ্গে-সঙ্গেই আবার রবীন্দ্রনাথ নবযৌবনের উদ্বোধন গাইলেন :

বাঁধন ছেঁড়ার সাধন তাহার
সৃষ্টি তাহার খেলা।
দস্যুর মতো ভেঙে-চুরে দেয়
চিরাভ্যাসের মেলা।
মূল্যহীনেরে সোনা করিবার
পরশ পাথর হাতে আছে তার,
তাইতো প্রাচীন সঞ্চিত ধনে
উদ্ধত অবহেলা।।
বলো ‘জয় জয়’, বলো ‘নাহি ভয়’–
কালের প্রয়াণ পথে
আসে নির্দ্দয় নব যৌব
ভাঙনের মহারথে।।

এই ভাঙনের রথে আরো একজন এসেছিলেন–তিনি জগদীশ গুপ্ত। সতেজ-সজীব লেখক, বৈশিষ্ট্য-সম্পন্ন। দুর্দান্ত সাহসে অনেক উদ্দীপ্ত গল্প লিখেছেন। বয়সে কিছু বড় কিন্তু বোধে সমান তপ্তোজ্জল। তারও যেটা দোষ সেটাও ঐ তারুণ্যের দোষ-হয়তো বা প্রগাঢ় পৌঢ়তার। কিন্তু আসলে যে তেজী তাকে কখনো দোষ অর্শে না। তেজীয়সাং ন দোষায়। যেখানে আগুন আছে সেখানেই আলো অলবার সম্ভাবনা। আগুন তাই অর্হনীয়।

জগদীশ গুপ্ত কোনো দিন কল্লোল-আপিসে আসেননি। মফস্বল শহরে থাকতেন, সেখানেই থেকেছেন স্বনিষ্ঠায়। লোককোলাহলের মধ্যে এসে সাফল্যের সার্টিফিকেট খোঁজেননি। সাহিত্যকে ভালোবেসেছেন প্রাণ দিয়ে। প্রাণ দিয়ে সাহিত্যরচনা করেছেন। স্বস্থান-সংস্থিত একনিষ্ঠ শিল্পকার।

অনেকের কাছেই তিনি অদেখা, হয়তো বা অনুপস্থিত। নদী বেগদ্বারাই বৃদ্ধি পায়। আধুনিক সাহিত্যের নদীতে তিনি একটা বড় রকমের বেগ। লম্বা ছিপছিপে কালো রঙের মানুষটি, চোখে বেশি পাওয়ারের পুরু চশমা, চোখের চাউনি কখনো উদাস কখনো তীক্ষ্ণ–মাথার চুলে পাক ধরেছে, তবু ঠোঁটের উপর কালো গোঁফজোড়াটি বেশ জমকালো। কালি-কলমকে তিনি অফুরন্ত সাহায্য করেছেন গল্প দিয়ে, সেই সম্পর্কে মুরলীদার সঙ্গে তার বিশেষ অন্তরঙ্গতা জমে ওঠে। যৌবন যে বয়সে নয়, মনের মাধুরীতে, জগদীশ গুপ্ত তার আরেক প্রমাণ।

বিখ্যাত জাপান বইর লেখক সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় পুরোপুরি ভারতীর দলের লোক। অথচ আশ্চর্য, পুরোপুরি কল্লোল-যুগের বাসিন্দা। একটি জাগ্রত সংস্কারমুক্ত আধুনিক মনের অধিকারী। কল্লোল বার হবার পর থেকেই কল্লোলে যাতায়াত করতেন, কালিকলম বেরুলে একদিন নিজের থেকেই সোজা চলে এলেন কালিকলমে। আধুনিক সাহিত্যপ্রচেষ্টায় তারা সক্রিয় সহানুভূতি—কেননা–কালি-কলমে নিজেই তিনি উপন্যাস লিখলেন চিত্রবহা—তা ছাড়া নবাগতদের মধ্যে যখন যেটুকু শক্তির আভাস দেখলেন অভ্যর্থনা করলেন। চারদিকের এত সব জটিল-কুটিলের মধ্যে এমন একজন সহজ-সরলের দেখা পাব ভাবতে পারিনি।

সঙ্গে এল তাঁর বন্ধু, প্রবোধ চট্টোপাধ্যায়। কাগজী-নাম আনন্দসুন্দর ঠাকুর। চেহারায় ও চরিত্রে সত্যিই আনন্দের। অন্তর-বাহিরে একটি রুচির পরিচ্ছন্নতা। রসঘন প্রবন্ধ লিখতেন মাঝে-মাঝে, প্রচ্ছন্নচারী একটি পরিহাস থাকত অন্তরালে। জীবনের গভীরে একটি শান্ত আনন্দ লালন করছেন তার মুখরুচি দেখলেই মনে হত। কিন্তু যখনই কল্লোলআপিসে ঢুকতেন, মুখে একটি করুণ আর্তি ফুটিয়ে শোকাচ্ছন্ন কণ্ঠে বলে উঠতেন–সব বুঝি যায়!

সব বুঝি যায়! সে এক অপূর্ব শ্লেষোক্তি। সেই বক্রোষ্ঠিকা অননুকরণীয়।

কথাটা বোধহয় কল্লোলের প্রতিই বিশেষ করে লক্ষ্য করা। সমালোচকের যেটা কোপ তাকেই তিনি কাতরতায় রূপান্তরিত করেছেন।

কিছুই যায় না। সব ঘুরে-ঘুরে আসে। শুধু ভোল বদলায়।

কিন্তু কে জানত ভারতীয় দলের একজন প্রবীণ লেখকের উপন্যাসকে লক্ষ্য করে কালি-কলম-আপিসে পুলিশ হানা দেবে। শুধু হানা নয়, একেবারে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা নিয়ে এসেছে। কার বিরুদ্ধে? সম্পাদক মুরলীধর বসু আর শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় আর প্রকাশক শিশিরকুমার নিয়োগীর বিরুদ্ধে। অপরাধ? অপরাধ অশ্লীল-সাহিত্য-প্রচার।

আমরা সার্চ করব আপিস। সার্চ-ওয়ারেন্ট আছে। বললে লাল-পাগড়ি।

দুষ্য লেখাটা কি?

লেখা কি একটা? দুটো। সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস চিত্রবহা আর নিরুপম গুপ্তর গল্প শ্রাবণ-ঘন-গহন-মোহে। নিন, বার করুন সংখ্যাগুলো–

মনে মনে হাসলেন মুরলীদা। নিরুপম গুপ্ত! সে আবার কে?

নিরুপম গুপ্ত ছদ্মবেশী। চট করে তাঁকে চিনে ফেলতে সকলেরই একটু দেরি হবে।

লেখরাজ সামন্ত শৈলজার ছদ্মনাম। কালিকলমে প্রকাশিত তার গল্প দিদিমণি আর প্রেমেনের গল্প পোনাঘাট পেরিয়ে সম্বন্ধে কাশীর মহেন্দ্র রায় আপত্তি জানান। তার আপত্তি, লেখা দুটো অশ্লীল, প্রকাশ-অযোগ্য। তেমনি তার আপত্তি নজরুলের মাধবী প্রলাপ ও মোহিতলালের নাগার্জুনের বিরুদ্ধে। এই নিয়ে মুরলীদার সঙ্গে পত্রে দীর্ঘকাল তাঁর তর্কবিতর্ক হয়। মুরলীদা বলেন, আপনার বক্তব্য গুছিয়ে প্রবন্ধ লিখুন একটা। মহেন্দ্র রায় আধুনিক সাহিত্যের উপর প্রবন্ধ লেখেন। তার পালটা জবাব দেন সত্যসন্ধ সিংহ। সত্যসন্ধ সিংহ ডক্টর নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের ছদ্মনাম।

শুধু প্রবন্ধ লিখেই তৃপ্তি পাচ্ছিলেননা মহেন্দ্রবাবু। তিনি একটা গল্পও লিখলেন। আর সেই গল্পই শ্রাবণ-ঘন-গহন-মোহে।

এ কি ভাগ্যের রসিকতা। যিনি নিজে অশ্লীলতার বিরোধী তারই লেখা অশ্লীলতার দায়ে আইনের কবলে পড়বে!

ভাগ্যের রসিকতা আরো তৈরি হচ্ছে নেপথ্যে। নিন, আপনাদের দুজনকে—মুরলীধর বসু ও শিশিরকুমার নিয়োগীকে–গ্রেপ্তার করলাম। ভয় নেই, নিয়ে যাব না দড়ি বেঁধে। আমার নিজের দায়িত্বে কয়েক ঘন্টার জন্যে আপনাদের বেল দিয়ে যাচ্ছি। কাল বেলা এগারোটার মধ্যে আপনারা হাজির হবেন লালবাজারে। ইতিমধ্যে শৈলজাবাবুকেও খবর দিন, তিনিও যেন কাল সঙ্গে থাকেন। ঠিক সময় হাজির হবেন কিন্তু, নইলে–বুঝছেনই তো—আচ্ছা, এখন তবে আসি।

কাছেই বেঙ্গল-কেমিক্যালের আপিসে সুরেশবাবু কাজ করতেন। খবর পেয়ে ছুটে এলেন। তখুনি খানা-তল্লাসি আর গ্রেপ্তারের খবরটা নিজে লিখে দৈনিক বঙ্গবাণী আর লিবার্টি পত্রিকায় ছাপাতে পাঠালেন।

আর মুরশীদা ছুটলেন কালিঘাটে, শৈলজাকে খবর দিতে।

সব বুঝি যায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *