২০. কমল ছাদে

কমল ছাদে। সে বসেছে বেতের চেয়ারে। তাকে একটু দূর থেকে লক্ষ করছে। রহমত। কমলের উপর চোখ রাখার দায়িত্ব রহমতের। চোখ রাখার কাজটা এমনভাবে করতে হয় যেন কমল বুঝতে না পারে। রহমত সিঁড়িঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তার বাথরুমে যাওয়া প্রয়োজন। সে যেতে পারছে না।

কমল তাকিয়ে আছে লিফটরুমের ছাদের দিকে। ছাদে উঠার লোহার সিঁড়ি আছে। কয়েকটা কাক লোহার সিঁড়িতে বসে আছে। একটা কাক বসেছে তিন ধাপ সিঁড়িতে। দুটা কাক বসেছে চার ধাপে। তিন ধাপে বসেছে একটা কাক। তিন ধাপ সিঁড়ি আর একটা কাক হলো চার। জোড় সংখ্যা। চার ধাপে বসেছে। দুটা কাক। চার ধাপ যোগ দুটা কাক হলো ছয়। আবার জোড় সংখ্যা। একটা কাক রেলিং-এ বসে আছে। এই কাকটা যদি উড়ে আসে তাহলে কী হবে? সে কোথায় বসবে? তার বসা উচিত প্রথম ধাপে। কিংবা পঞ্চম ধাপে। কমল প্রবল উত্তেজনা বোধ করছে। একটা সমস্যাও আছে। সিঁড়ির ধাপের সঙ্গে কাক কি যোগ করা যায়? সিঁড়ির ধাপ এক জিনিস কাক অন্য জিনিস।

রেলিং-এ বসা কাকটা সিঁড়িতে বসল না, তবে সিঁড়ি থেকে একটা কাক উড়ে গেল। কী আশ্চর্য, তারপরেও জোড় সংখ্যা বজায় রইল। কারণ চতুর্থ ধাপ থেকে একটা কাক উড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে চতুর্থ ধাপের কাকটা বসেছে পঞ্চম ধাপে। তাহলে এমন কি হতে পারে, কাকরা অঙ্ক জানে? বিষয়টা নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করতে পারলে ভালো হতো। কমল তীক্ষ্ণ গলায় ডাকল, আঙ্কেল। ফলিয়া!

রহমত সিঁড়িঘরের দরজার আড়াল থেকে বের হলো। কমল বলল, আঙ্কেল ফলিয়া! কাক কি অঙ্ক জানে?

জানে না।

কমল বলল, তুমি কীভাবে জানো যে কাকরা অঙ্ক জানে না? তুমি তো কাকদের সঙ্গে কথা বলতে পার না।

রহমত সঙ্গে সঙ্গে বলল, তাও ঠিক।

তাহলে কীভাবে বললে কাকরা অঙ্ক জানে না?

ভুল হয়েছে ছোটবাবু। কাক অঙ্ক জানে। যোগ, বিয়োগ, গুণ-ভাগ সবই জানে!

কমল বলল, কাক যে অস্ক জানে সেটাই বা তুমি কীভাবে বললে?

রহমত দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। এই ছেলের সঙ্গে কথাবার্তা বলা খুবই বিপদজনক। সে কীভাবে কীভাবে যেন প্যাচ বাঁধিয়ে ফেলে। প্যাচ থেকে বের হবার কোনো উপায় থাকে না। আবার ডাকে আঙ্কেল ফলিয়া। এর মানে কী আল্লাখোদা জানেন।

আঙ্কেল ফলিয়া!

জি ছোটবাবু বলেন। ফুট জুস খাবেন? আনব?

ফ্রুট জুস আনতে হবে না। আপনি কাগজ-কলম আর স্টপওয়াচ নিয়ে আসুন। আমার ঘরের প্রথম ড্রয়ারে একটা ডিজিটাল স্টপওয়াচ আছে।

স্টপওয়াচ দিয়ে কী করবেন? কাকরা লিফটঘরের লোহার সিঁড়িতে বসছে। এটার হিসাব রাখব।

রহমত বলল, পশুপক্ষী কখন কোনখানে বসব তার হিসাব রাখনের কি দরকার আছে?

আছে, দরকার আছে।

রহমত স্টপওয়াচ আনতে গেল। তার যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। ছোটবাবুকে কখনো একা রাখা ঠিক না। ছাদের মতো একটা খোলামেলা জায়গায় তো কখনো না। ছোট ভাইজানের মাথার উপর দিয়ে কোনো অ্যারোপ্লেন কিংবা হেলিকপ্টার উড়ে গেলে বিরাট সমস্যা হবে। শব্দ সমস্যা করবে। বড় সাহেব যদি শুনেন সে ছোটবাবুকে একা ছাদে রেখে গেছে, তাহলে খুবই রাগ করবেন।

 

সালেহ ইমরান লাইব্রেরি ঘরে বসে আছেন। মিনিট দশেক আগে তিনি লাইব্রেরি ঘরে ঢুকেছেন। কী জন্যে ঢুকেছেন এখন মনে করতে পারছেন না। নিশ্চয়ই কোনো বইয়ের খোঁজে এসেছেন। সে বইটা কী? আজ ছুটির দিন। তার হাতে কোনো কাজ নেই। ছুটির দিনগুলিতে শরীরে আরামদায়ক আলস্য থাকে। তিনি সেই আলস্য বোধ করছেন না, বরং সারাক্ষণই মনে হচ্ছে, আজ কিছু করার নেই। মুনা বাড়িতে নেই। সে আলাদা বাস করতে শুরু করেছে। মুনার অনুপস্থিতিতে তিনি এখনো অভ্যস্ত হন নি। খাটে ঘুমুতে যাবার সময় এখনো একপাশে জায়গা রেখে শুচ্ছেন। একটা সময় আসবে যখন তিনি খাটের মাঝখানে ঘুমুতে শুরু করবেন। তখন বুঝতে হবে তিনি মুনার অনুপস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। মানুষ অতি দ্রুত অভ্যস্ত হয়, এটাই ভরসার কথা।

সালেহ ইমরান চোখ বন্ধ করে লাইব্রেরি থেকে একটা বই নিলেন। তিনি ঠিক করেছেন, হাতে যে বই উঠে আসবে সেটাই তিনি পড়বেন। পুরো বই পড়ার ধৈর্য তাঁর নেই, কাজেই পড়বেন একটা পৃষ্ঠা। চোখ বন্ধ করে বইটা মেলবেন, যে পৃষ্ঠা উঠে আসে সেটাই পড়বেন। একধরনের খেলা। বয়স্ক মানুষরাও গোপনে শিশুদের মতো কিছু খেলা খেলে।

সালেহ ইমরানের হাতে একটা কবিতার বই উঠে এলো। 100 Poems by 100 Poets. তিনি ভুরু কুঁচকালেন। কবিতা তাঁর বিষয় না। তিনি কখনো। কবিতা পড়েন না। বইটি রেখে কি আরেকটি বই নেবেন? না-কি আগে যেভাবে ঠিক করা ছিল সেইভাবেই এগুবেন? চোখ বন্ধ করে পাতা উল্টাবেন, যে কবিতাটি উঠে আসে সেটাই পড়বেন। তিনি পাতা উল্টালেন। একটা কবিতা বের হলো, যার শিরোনাম–Ecce Puer, এর মানে কী? কবির নাম জেমস। জয়েস। অতি বিখ্যাত নাম। কিন্তু ইব্ধি পিউ-এর মানে কী?

Of the dark past
A child is born;
With joy and grief
My heart is torn.

এই কবিতারই বা মানে কী? অন্ধকার অতীত থেকে একটি শিশুর জন্ম হলো। আমি তাতে আনন্দিত এবং দুঃখিত। প্রবল আনন্দ এবং শোকে আমার কলিজা ছিঁড়ে আছে।

একটা কবিতা একই সঙ্গে আনন্দের এবং শোকের হবে কীভাবে? Born এর সঙ্গে মিল দেবার জন্যেই কি torn শব্দটা এসেছে?

সালেহ ইমরান কবিতার বই জায়গামতো রেখে দিলেন। গলা উঁচিয়ে রহমতকে ডাকলেন। তখন মনে পড়ল, রহমত কমলকে নিয়ে ছাদে গেছে।

তিনি কি এখন ছাদে যাবেন? কমলের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করা হবে? তাদের অবশ্যি আজ রাতে ছবি দেখার প্রোগ্রাম আছে। ছবির নাম Stalker. সায়েন্সফিকশান।

সালেহ ইমরান ছাদের দিকে রওনা হলেন। ছাদি পর্যন্ত লিফট নেই। লিফট তিনতলা পর্যন্ত। তাকে কিছু সিঁড়ি ভাঙতে হলো। তাঁর মাথায় এখনো কবিতাটা ঘুরছে–Of the dark past a child is born, কবি কি শিশুর মাতৃগর্ভের অন্ধকারের কথা বলছেন?

 

কমল স্টপ ওয়াচ হাতে মূর্তির মতো বসে। তার দৃষ্টি কাকগুলির দিকে। কোনো একটা পরীক্ষা হচ্ছে–এই বিষয়টা মনে হচ্ছে কাকরা টের পেয়েছে। তারা এখন আর নড়াচড়া করছে না। স্থির হয়ে আছে।

সালেহ ইমরান ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, কোনো পরীক্ষা হচ্ছে না। কি রে?

কমল হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। সালেহ ইমরান বললেন, কী পরীক্ষা?

কমল বাবার দিকে না তাকিয়েই বলল, এখন বলব না।

এখন বললে তোমার পরীক্ষায় আমি সাহায্য করতে পারতাম। যে-কোনো পরীক্ষায় একজন অ্যাসিসটেন্ট লাগে। শার্লক হোমসের সঙ্গে থাকেন ওয়াটসন।

রহমত স্যারের জন্যে চেয়ার নিয়ে এসেছে। গার্ডেন ছাতা এনেছে। মাথার উপর ছাতা ধরবে।

সালেহ ইমরান বললেন, আমার মাথার উপর ছাতা ধরতে হবে না। তুমি, চা নিয়ে এসো। চা খাব।

কমল বলল, আমিও চা খাব।

সালেহ ইমরান বললেন, তুমি চা খাও নাকি?

কমল বলল, যখন আমি বড় হয়ে যাই তখন চা খেতে ইচ্ছা করে। মাঝে মাঝে আমি বড় হয়ে যাই।

সালেহ ইমরান বললেন, বড় হয়ে যাই কথাটা ঠিক বলছ না। তোমার বলা। উচিত–মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমি বড় হয়ে গেছি। তখন চা খাই।

কমল বলল, তুমি ঠিক বলেছ।

সালেহ ইমরান বললেন, তোমার অ্যাক্সপেরিমেন্ট কি শেষ হয়ে গেছে?

হ্যাঁ।

ফলাফল কী?

ফলাফল ভালো না।

অ্যাক্সপেরিমেন্ট ফেল করেছে?

হুঁ।

তোমার মন খারাপ লাগছে?

না।

তোমাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে তোমার মন খারাপ

মন খারাপ না।

চল নিচে যাই, একটা ছবি দেখি।

এখন তো ছবি দেখার সময় না।

সালেহ ইমরান ছেলের পিঠে হাত রাখলেন। কমল সেই হাত সরিয়ে দিল। এটা বিস্ময়কর ঘটনা। সালেহ ইমরান নরম গলায় বললেন, চল একটা ছবি দেখি।

কমল বলল, আজ ছবি দেখার তারিখ না।

সালেহ ইমরান বললেন, সবকিছু দিন-ক্ষণ দেখে হয় না। কঠিন নিয়মকানুনে মানুষ চলতে পারে না। মাঝে মাঝে তাকে নিয়মের বাইরে যেতে হয়।

কেন?

কারণ মানুষ যন্ত্র না। যন্ত্রই নিয়মের ভেতর থাকে। মানুষ থাকে না।

আমার নিয়মের ভেতর থাকতে ভালো লাগে। আমি এখন ছবি দেখব না। ছাদে বসে থাকব। কাক দেখব।

সালেহ ইমরান বললেন, নিয়মের ভেতর থাকতে তোমার ভালো লাগে কিন্তু তুমিও সবসময় নিয়মের ভেতর থাক না। তোমার নিয়ম ঘরে বসে থাকা। তুমি বসে আছ ছাদে। ঠিক বলেছি?

হুঁ।

কেউ তোমার গায়ে হাত দিলে তুমি হাত সরিয়ে দাও। আমি অনেকক্ষণ তোমার পিঠে হাত দিয়ে আছি, তুমি হাত সরিয়ে নাও নি।

কমল গা ঝকাল। সালেহ ইমরান হাত সরিয়ে নিতে নিতে বললেন, তুমি কি তোমার মার সঙ্গে দেখা করতে যাবে?

না।

যাও ঘুরে এসো। ছাদে একা একা বসে না থেকে মার সঙ্গে দেখা করে আসি।

কমল বলল, না। একা ছাদে বসে থাকতে আমার ভালো লাগছে।

এখন তো তুমি একা না। আমি আছি তোমার সঙ্গে।

কমল আকাশের দিকে তাকাল। তার শরীর সামান্য কাঁপছে। উত্তর দিক থেকে হেলিকপটারের শব্দ আসছে। ঢাকা শহরের ছাদের উপর দিয়ে আজকাল প্রায়ই হেলিকপ্টার উড়ে। কমলের মুখ ফ্যাকাশে। সে দুহাত দিয়ে তার কান চেপে ধরল। তার ঠোঁট কাঁপছে। চোখ ভিজে আসছে। সালেহ ইমরান ছেলের মাথায় হাত রাখলেন। প্রচণ্ড শব্দ করে হেলিকপ্টার প্রায় তাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল।

কমল ক্ষীণ গলায় ডাকল, বাবা!

সালেহ ইমরান বললেন, বলো শুনছি। এখন তুমি কান থেকে হাত সরাতে পার, হেলিকপ্টার উড়ে চলে গেছে।

থ্যাংক য়্যু।

আমাকে থ্যাংকস দেবার কিছু নেই। আমি কিছু করি নি।

তুমি আমার মাথায় হাত রেখেছ। আমার ভয় কমেছে। বাবা, মানুষ ভয় পায় কেন?

সালেহ ইমরান ছেলের সামনে রাখা বেতের টেবিলে সাবধানে বসলেন। মানুষ ভয় পায় কেন এই জটিল বিষয় ছেলেকে বুঝিয়ে বলতে হবে। বোঝাতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। তিনি নিজে কখনো এই বিষয় নিয়ে ভাবেন নি। ভেবে ভেবে বলতে হবে। যুক্তি দুর্বল হলে চলবে না।

মানুষ ভয় পায়, কারণ সে নিজেকে খুবই ভালোবাসে। তার নিজের কোনো ক্ষতি হবে ভাবলেই সে ভয় পায়। মানুষ সাপ দেখলে ভয় পায়, কারণ তার ধারণা সাপ তার ক্ষতি করবে। মানুষ প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি দেখলে ভয় পায়, কারণ তার ধারণা ঝড় তার ক্ষতি করবে। তুমি হেলিকপ্টার দেখে ভয় পেয়েছ, কারণ তোমার ধারণা, হেলিকপ্টারের শব্দ তোমার ক্ষতি করবে।

কমল বলল, এখন উল্টো করে বলো।

সালেহ ইমরান বললেন, উল্টো করে কী বলব বুঝতে পারছি না।

কমল বলল, ভয়ের উল্টো হলো আনন্দ। মানুষ আনন্দ পায় কখন? যখন সে মনে করে এই জিনিসটা তার ক্ষতি করবে না তখন সে আনন্দ পায়?

হতে পারে।

আমি যখন অঙ্ক করি তখন আনন্দ পাই। অঙ্ক আমার ক্ষতি করবে না এইজন্যে কি আনন্দ পাই?

সালেহ ইমরান কী বলবেন ভেবে পেলেন না, বিষয়টা যথেষ্ট জটিল হয়ে যাচ্ছে।

বাবা!

বলো।

তুমি এখন নিচে চলে যাও। আমি ভয় এবং আনন্দ নিয়ে ভাবব।

আমি সামনে বসে থাকি, তুমি ভাব।

না।

সালেহ ইমরান উঠে দাঁড়ালেন। কমল বাবার দিকে না তাকিয়ে বলল, তুমি মতিনকে জিজ্ঞেস করো–মানুষ কেন ভয় পায়, কেন আনন্দ পায়। সে বলতে পারবে।

সালেহ ইমরান বললেন, বয়স্ক মানুষকে নাম ধরে ডাকা ঠিক না। তুমি তাকে মতিন চাচা বলবে।

উনি তো আমার চাচা না। তাকে কেন চাচা ডাকব!

চাচা ডাকতে না চাইলে স্যার বলো।

স্যার বলব না। উনি আমার টিচার না। উনি আমার বন্ধু। বন্ধুকে আমি নাম ধরে ডাকি।

আচ্ছা ডেকো।

তুমি আজই তাকে জিজ্ঞেস করবে, মানুষ কেন ভয় পায় মানুষ কেন আনন্দ পায়।

আচ্ছা।

আর মাকেও জিজ্ঞেস করবে।

আচ্ছা।

এখনই জিজ্ঞেস করবে। কে কী বলল কাগজে লিখে ফেলবে।

Ok.

কমলের চোখ ঝলমল করছে। নতুন এই খেলায় সে আনন্দ পাচ্ছে। সালেহ ইমরান ছাদ থেকে নেমে যাওয়া মাত্রই সে ডাকল–আঙ্কেল ফলিয়া!

রহমত সিঁড়ি ঘরের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো। কমল বলল, তুমি কি বাবাকে ভয় পাও?

রহমত বলল, অবশ্যই ভয় পাই, যমের মতো ভয় পাই। কেন ভয় পাও? উনি আমার রুটিরুজির মালিক এইজন্যে ভয় পাই। আমাকেও ভয় পাও? অবশ্যই পাই।

রহমত যুতসই জবাবের জন্য মাথা চুলকাচ্ছে। জবাব মাথায় আসছে না। কমল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে।

 

সালেহ ইমরান অনেকবার চেষ্টা করেও মুনাকে ধরতে পারলেন না। টেলিফোনে রিং হয়, কেউ ধরে না। সে হয়তো এখনো ঘুমুচ্ছে। মাঝে মাঝে মুনা অনেক বেলা পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে থাকে। আবার মাঝে মাঝে কাকডাকা ভোরে জেগে উঠে মিউজিক সিস্টেম চালু করে। অদ্ভুত অদ্ভুত বাজনা বেজে উঠে। মুনার কল্যাণে পৃথিবীর নানান দেশের বিচিত্র সব বাজনা তিনি শুনেছেন। একবার শুনলেন পাথরভাঙা মিউজিক। একদল মানুষ তালে তালে হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভাঙে। সেই পাথর গড়িয়ে দেয়। বিচিত্র বাজনা। পাখি উড়ে চলে গেলে পাখির পালক পড়ে থাকে। মানুষ উড়ে চলে গেলেও সঙ্গে করে সবকিছু নিয়ে যেতে। পারে না। তাকে স্মৃতি ফেলে রেখে যেতে হয়।

মুনাকে পাওয়া না গেলেও প্রথমবারেই তিনি মতিনকে মোবাইল টেলিফোনে পেয়ে গেলেন। মতিন বিস্মিত হয়ে বলল, স্যার, আপনি আমার টেলিফোন নাম্বার কোথায় পেলেন?

সালেহ ইমরান বললেন, আমার টেলিফোন বইয়ে তোমার নামে তোমার নাম্বার এন্ট্রি করা আছে।

এন্ট্রি কে করেছে? আপনি?

এটা কি ইম্পোর্টেন্ট?

জি স্যার, ইম্পোর্টেন্ট। আমার মতো অভাজনের টেলিফোন নাম্বার আপনি আপনার টেলিফোন বুকে নিজের হাতে এন্ট্রি করেছেন, এটা কি ইম্পোর্টেন্ট না?

সালেহ ইমরান বললেন, তোমার সঙ্গে একটা জরুরি বিষয় নিয়ে আলাপ করতে চাই। টেলিফোনে আলাপটা ভালো হবে না। তুমি কি আসতে পারবে।

অবশ্যই পারব। জরুরি বিষয়টা কী?

মানুষ ভয় পায় কেন? আবার আনন্দই বা পায় কেন?

বিষয়টা আপনি জানতে চাচ্ছেন, না কমল জানতে চাচ্ছে?

কমল। তবে আমি নিজেও জানতে চাচ্ছি।

স্যার আমি যে-কোনো একদিন চলে আসব। আমার নিজের মতামতটা বলব, আবার নদ্দিউ নতিম সাহেবের মতামতটাও জেনে আসব।

আজ আসতে পারবে না?

জি-না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের মামলাটা কোর্টে উঠবে। আমার যদিও কিছু করার নেই, তারপরেও থাকা দরকার।

তোমার কিসের মামলা?

মামলাটা ঠিক আমারও না। নিশুর মামলা। একটা রেপ কেস। পত্রিকায় এই নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে।

সালেহ ইমরান বললেন, আমি দেশী কোনো পত্রিকা পড়ি না। টাইম পড়ি, নিউজ উইক পড়ি। দেশী পত্রিকা মানে খুন-খারাবি, ধর্ষণ।

ঠিক বলেছেন। তবে স্যার আমাদের দেশের পত্রিকাগুলি রেপ কেইস নিয়ে যেমন মাতামাতি করে টাইম, নিউজ উইকের মতো দামি পত্রিকা তারচেয়ে বেশি মাতামাতি করে। তারপরেও সাহেবদের পত্রিকা বলে কথা।

সালেহ ইমরান বললেন, তোমার কথায় সত্যতা আছে। টাইম, নিউজ উইকও খুন ধর্ষণ নিয়ে বিরাট হৈচৈ করে। দেশী পত্রিকা নিয়ে আমি যে কমেন্ট করেছি তার জন্যে সরি।

স্যার, সরি হবার কিছু নেই।

আছে। অবশ্যই আছে।

স্যার, আমি এখন কোর্ট রুমে ঢুকে যাব। আপনার সঙ্গে পরে কথা হবে।

সালেহ ইমরান বললেন, গুড লাক।

 

জজ সাহেবের মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে আছে। তার বিরক্তির কারণ দুটি মাছি। মাছি দুটি যুক্তি করে কাজে নেমেছে বলে তাঁর বিশ্বাস। এদের একটি যখন তাঁর সামনে রাখা কাগজপত্রে বসে অন্যটি তখন তাঁর নাকে বসার চেষ্টা করে। জজ সাহেব কঠিন দৃষ্টিতে মাছি দুটিকে দেখছেন মাথা নেড়ে নাকের মাছি সরাতেই সে উড়ে যাচ্ছে আবার সঙ্গে সঙ্গেই নথিপত্রে বসা মাছি উড়ে আসছে। জজ সাহেব চেয়ারে বসেও তেমন আরাম পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। তিনি একবার চেয়ারের ডান দিকের হাতলে কাত হয়ে বসছেন আবার কিছুক্ষণ পরেই বাম দিকের হাতলে কাত হয়ে বসছেন।

মতিন তাকিয়ে আছে জজ সাহেবের দিকে। যদিও তার তাকিয়ে থাকা উচিত নিশুর দিকে। নিশুকে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে। আসামিপক্ষের উকিল তাকে প্রশ্ন করা শুরু করেছেন। আসামিপক্ষের উকিলের ভাবভঙ্গি এমন যে সে কোনো প্যাকেজ নাটকে মহাজ্ঞানী ব্যারিস্টারের ভূমিকায় অভিনয় করছে। কঠিন কঠিন যুক্তি দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। একেকটা প্রশ্ন করে সে, আবার দর্শকদের দিকে তাকিয়ে মিচকা খালি হাসে। সেই হাসির অর্থ–কেমন, বুঝতেই কিছু প্যাকেজ নাটক হলে এই হাসিগুলি ক্লোজ-আপে ধরা হতো।

উকিল : আপনার নাম নিশু?

নিশু : জি।

উকিল : আপনি অবিবাহিতা?

নিশু : জি!

উকিল : কুমারী? [ মিচকা হাসি ]

নিশু : তার মানে? আমি তো একবার বলেছি আমি অবিবাহিতা।

উকিল : (মিচকা হাসি এখনো চলছে) অবিবাহিতা এক কথা, কুমারী ভিন্ন কথা। জগৎ সংসারে অনেক মেয়ে আছে যারা অবিবাহিতা, কিন্তু কুমারী না।

নিশু : আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?

উকিল : ম্যাডাম, তেমন কিছু বলতে চাচ্ছি না। আপনি যে ফ্ল্যাটে থাকেন সেখানে আপনার সঙ্গে কে থাকেন?

নিশু : কেউ থাকে না, আমি একা থাকি। আগে বাবা থাকতেন, বাবার মৃত্যুর পর একা থাকি।

উকিল : (মিচকা হাসির পর) একা থাকতে ভয় লাগে না?

নিশু : ভয় লাগবে কেন?

উকিল : ভয় লাগবে নাইবা কেন? ঢাকা শহর ভালো জায়গা না। চোর আছে, ডাকাত আছে, সন্ন্যাসী আছে, রেপিস্ট আছে। অনেকে বলে ভূত-প্রেতও আছে। রাতে যখন একা ঘুমাতে যান তখন ভয় লাগে না?

নিশু : না।

উকিল : তাহলে কি আমরা ধরে নেব রাতে কেউ না কেউ আপনার সঙ্গে রাত্রি যাপন করে বলেই আপনি ভয় পান না?

[ নিশুর পক্ষের উকিল এই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে উঠে বলল—]

নিশুর উকিল : মাননীয় আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি–আমার মক্কেলকে অবান্তর প্রশ্ন করা হচ্ছে।

জজ সাহেব ফিরেও তাকালেন না।

তার সমস্ত মনোযোগ এই মুহূর্তে মাছি দুটিতে সীমাবদ্ধ। কারণ দুটি মাছিই এখন তার চেয়ারের ডান হাতলে বসে আছে। তিনি ইচ্ছা করলেই তার সামনে রাখা ফাইলটা দিয়ে একটা মোক্ষম বাড়ি দিয়ে মাছি দুটির অবস্থা কাহিল করে ফেলতে পারেন। এটা করা ঠিক হরে কিনা তিনি বুঝতে পারছেন না।

উকিল : ম্যাডাম, আমি সরাসরি মূল বিষয়ে চলে যাই। আপনি ফ্ল্যাটবাড়িতে একা বাস করতেন, কারণ দেহব্যবসার জন্যে একা থাকাই উত্তম।

নিশু : এইসব কী বলছেন!

উকিল : দীর্ঘ দিন আপনি ঐ ফ্ল্যাটে দেহব্যবসা চালাতেন, এটা তো অস্বীকার করতে পারবেন না। আপনাকে উচ্ছেদ করার জন্যে থানায় জিডি এন্ট্রি করা হয়েছে, এটা তো আপনি জানেন?

নিশু : পরে শুনেছি। জিডি এন্ট্রির বিষয়টা সাজানো।

উকিল : ম্যাডাম, আপনাকে কোনো ব্যাখ্যায় যেতে হবে না। আপনি শুধু হা-না বলে আমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন। Yes or No। আপনি কি সম্পূর্ণ একা। থাকেন?

নিশু : ইয়েস।

উকিল : আপনার খোঁজখবর করার জন্যে আত্মীয়স্বজনরা কখনো এসেছেন?

নিশু : না। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল না।

উকিল : ভালো না থাকার কারণ কি এটা যে, তারা আপনার দেহব্যবসা সমর্থন করতেন না?

নিশু জবাব দিল না। তার চোখ-মুখ লাল। ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। চোখের দৃষ্টিতে হতাশা। সে তাকাল মতিনের দিকে। মতিন মনে মনে বলল, নিশু এটা একটা খেলা। প্রশ্ন প্রশ্ন খেলা। খেলাতে রেগে যেতে নেই, ধৈর্য হারাতে নেই। খেলায় রেগে যাওয়া মানেই হেরে যাওয়া।

আসামিপক্ষের উকিল কালো কোটের পকেট থেকে ধবধবে সাদা রুমাল বের করে মুখ মুছতে মুছতে বললেন–

আসামি পক্ষের উকিল : মিস নিশু, আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না। তার মানে কি এই যে, আপনার দেহব্যবসার প্রতি আপনার আত্মীয়স্বজনদের পরোক্ষ সম্মতি ছিল?

[ নিশু কাঠগড়ার হাতল শক্ত করে চেপে ধরল। তার হাত কাঁপছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ]

আসামীপক্ষের উকিল : আপনি আমার কোনো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না। শেষ প্রশ্নটির জবাব কি দেবেন? আপনার ফি কত? অর্থাৎ কাস্টমারদের কাছ থেকে আপনি কত টাকা নিতেন?

নিশু মাথা ঘুরে কাঠগড়ার ভেতর পড়ে গেল। উকিল সাহেব দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বিজয়ীর হাসি হাসলেন। রাজনীতিবিদদের মতো এই হাসি অনেকক্ষণ ধরে রাখলেন। কেউ যদি ছবি তুলতে চায় তাহলে যেন তুলতে পারে। ক্যামেরাম্যান জুম করতে চাইলে সে সুযোগও আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *