২০. কন্যা দিবস
কত কিছুর দিবস যে পালিত হচ্ছে। শুনলাম কাল নাকি ‘কন্যা দিবস’ ছিল। জানিনা পুত্র দিবস বলে কোনও দিবস আছে কিনা। আসলে পুত্র দিবস তো প্রায় প্রতিদিনই পালিত হয়। কন্যা যেহেতু অনেক সংসারেই অবহেলিত, তাই কন্যাকে মূল্য দেওয়ার জন্য, আমার ধারণা, একটি দিবস তৈরি করা হয়েছে। আমার কন্যাও নেই, পুত্রও নেই। যৌবনে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিলেও সন্তান না জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্তটি আমার সঠিক ছিল। ৭৮০ কোটি লোকে পৃথিবী উপচে পড়ছে, এই দুঃসময়ে জনসংখ্যা বাড়ানোর কোনও প্রয়োজন নেই। যারা জন্মেছে তারা কি সবাই খেতে পরতে পাচ্ছে, শিক্ষা স্বাস্থ্য পাচ্ছে?
ইতর প্রাণীর মধ্যে বংশ বিস্তারের ইচ্ছেটা কিলবিল করে, এই কিলবিল ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করতে তারা পারেনা। মানুষের মধ্যেও এই ইচ্ছেটি আছে, তবে এটি আরোপিত। আরোপিত বলেই এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। অনেকে সন্তান জন্ম দেওয়ার ইচ্ছে নেই বলে সন্তান জন্ম দেয় না। কিছু মানুষ, আমার অবাক লাগে, মনে করে সন্তান জন্ম না দিলে তাদের জীবনই ব্যর্থ, অর্থহীন। তারা সন্তানের জন্য ইতর প্রাণীদের মতো কিলবিল করা ইচ্ছের আমদানি করে। আমার এক বোন উচ্চশিক্ষিতা, নামী কলেজের অধ্যাপিকা, কিন্তু সন্তান নেই বলে এমনই দুঃখে কষ্টে ডুবে থাকে যে তার জীবনটিই সে উপভোগ করে না। তার এমন অর্থপূর্ণ জীবনটিকে সে যে অর্থহীন মনে করছে, এ দোষ কার বা কাদের? তার কানের কাছে যারা শৈশব থেকে গুনগুন করেছে সন্তান না জন্মালে জীবনের কোনও মানে নেই, দোষ নিশ্চয়ই তাদের অনেকটা, বাকি দোষ তাদেরও যারা যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে নারীবিদ্বেষী রীতিগুলোকে ভাঙার কোনও চেষ্টা করে না।
প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যদি প্রজননের প্রয়োজন পড়তো, কথা ছিল। এখন তো দেখা যাচ্ছে মানুষের আধিক্য একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। লক্ষ কোটি অরণ্য-নির্ভর প্রাণীর আবাসস্থল উড়িয়ে দিয়ে মানুষের জন্য শহর নগর বানাতে হয়েছে। পৃথিবীর কত প্রজাতি যে আমাদের মানুষ-প্রজাতির হিংস্রতা আর বোধবুদ্ধিহীনতার কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই গ্রহে আমাদের যতটা অধিকার, ততটা অধিকার তো তাদেরও। অস্ত্রের জোরে কী অরাজকতাই না আমরা চালিয়েছি! আমরা পৃথিবীর বন জঙ্গল ধ্বংস করেছি, নদী সমুদ্র আকাশ বাতাস দূষিত করেছি আমাদের স্বার্থান্ধ জীবন যাপন এবং আমাদের অর্থহীন জনসংখ্যা দিয়ে। অনেকে মনে করেন, জ্ঞানীগুণীদের সন্তান জন্ম দেওয়া উচিত। কিন্তু বারবার প্রমাণিত হয়েছে, জ্ঞানীগুণীদের সন্তান জ্ঞানীগুণী হয় না। আর কত প্রমাণ দরকার! মৃত্যুতেই জীবনের চিরকালীন সমাপ্তি। বংশ রয়ে গিয়ে, রক্তের ছিটেফোঁটা রয়ে গিয়ে কারও কোনও লাভ হয় না।
আজ এতকাল পরও নিজেকে আরেকবার ধন্যবাদ দিই, না পুত্র না কন্যা কিছুই জন্ম না দিয়ে আমি একটি স্বাধীন এবং অর্থপূর্ণ জীবনযাপন করেছি বলে। তুমি সন্তান জন্ম দিয়ে জীবনকে অর্থপূর্ণ করার চেষ্টা কোরো না। তুমি তোমার কাজ দিয়ে জীবনকে অর্থপূর্ণ করো। তুমি কে, তুমি কী সেটাই বড়। সন্তান যে কেউ জন্ম দিতে পারে, যে কোনও গণ্ডমূর্খই, এ কোনও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার নয়।
২ ১. শার্লি আবদো
ফ্রান্সের শার্লি আবদো কার্টুন ম্যাগাজিনের কথা মনে আছে? পয়গম্বরের কার্টুন ছাপিয়েছিল বলে পয়গম্বরের এক পাল সশস্ত্র সন্ত্রাসী অনুসারী ম্যাগাজিনের অফিসে ঢুকে যাকে পেয়েছে তাকেই খুন করে এসেছে! সেই ম্যাগাজিন মহাসমারোহে বাকস্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করছে, এই উপলক্ষে বিশাল একখানা সংকলন ছাপিয়েছে, এতে যে প্রবন্ধ নিবন্ধ জায়গা পেয়েছে, তার মধ্যে আমার একখানা নিবন্ধ আছে। আজ সকালে শার্লি আবদোর এই উপহারটি পেয়ে আমার আনন্দে নাচলো মন। বাকস্বাধীনতার জন্য চল্লিশ বছর লড়ছি। বাংলা আমাকে স্বীকৃতি কোথায় দেবে, বরং আবর্জনায় ছুঁড়ে ফেলেছে। দূরের কোনও দেশে যাঁরা বাকস্বাধীনতার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তো বটেই এমনকি জীবন বিসর্জন দিয়ে লড়াই করছেন, স্বীকৃতি তাঁদের কাছ থেকেই এলো।
২২. কমপ্লেইন
কমপ্লেইনের শেষ নেই। ইসলাম নিয়ে লিখলে হিন্দু ধর্ম নিয়ে লেখো না কেন। হিন্দু ধর্ম নিয়ে লিখলে ইসলাম নিয়ে লেখো না কেন। ইউরোপ নিয়ে লিখলে আফ্রিকা নিয়ে লেখো না কেন। ইলিশ নিয়ে লিখলে উমর খালিদ নিয়ে লেখো না কেন। নারীর সমস্যা নিয়ে লিখলে পেঁয়াজের দাম নিয়ে লেখো না কেন। কমপ্লেইন চলছেই। যেন আমাকেই দুনিয়ার সব সমস্যা নিয়ে লিখতে হবে। যখন ক সমস্যা নিয়ে লিখেছি, আমাকে খ সমস্যা, গ সমস্যা থেকে শুরু করে চন্দ্রবিন্দু সমস্যা পর্যন্ত লিখতেই হবে, তা না হলে আমি ভালো লোক নই। আমি জানি সবাইকে খুশি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আসলে কাউকে খুশি করতে আমি লেখালেখি করি না।
বাপু, তোমরা লেখো তোমাদের মনে যা উদয় হয় সেইসব নিয়ে। আমি চল্লিশ বছরের বেশি হল লিখছি। বইও চল্লিশটার ওপরে। আমার জ্ঞান বুদ্ধিতে যতটা কুলোয় ততটাই তো লিখবো। ছোট একখানা মস্তিষ্কে আর কত বিষয় ধরে!
২৩. ঘরকন্না
সাত মাস আমি ঘরের বার হচ্ছি না, ঘরে কাউকে ঢুকতেও দিচ্ছি না। সংসারের সমস্ত কাজ একা হাতে করছি। কী করে পারছি? পারছি কারণ এক যুগ আমি ইউরোপে ছিলাম। ইউরোপে বাস করার সুফল এটাই, কোনও কিছুর জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করার দরকার হয় না। একাই সব কাজ এমনকি নোংরা কাজ বলে যে কাজগুলোকে ভাবা হয়, যেমন টয়লেট পরিষ্কার, ডাস্টবিন পরিষ্কার, বেড়াল কুকুরের গু-মুত পরিষ্কার, কোনওরকম নাক না সিঁটকে করে ফেলা যায়। ঘর ঝাড়ু দাও ঘর মোছো বাসন মাজো কাপড় কাচো—কিছুতে তো অনীহা নেই। একবারও তো মনে হয় না, এই কাজগুলো গরিব লোকের কাজ, আমাদের কাজ খাটে বসে বা সোফায় বসে আরাম করা? এই যে গরিব লোকদের মানুষ বলে মনে করা, তাদের সমীহ করে কথা বলা, তাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাওয়া, এটি আমার মনে হয় না ইউরোপে দীর্ঘকাল না কাটালে সম্ভব হত। সমতার সমাজে বাস করলে সমতা অনুশীলন করতে হয়, ওই করতে করতেই একসময় চরিত্রে গেঁথে যায় সমতার বোধ। শুধু বই পড়ে, সমতা সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করেই সমতার জীবনযাপন করা যায় না। সমতার দিশি পণ্ডিতদের দেখেছি গরিবদের তুই তোকারি করতে, চাকরবাকরদের সঙ্গে ঘেউ ঘেউ করতে।
বাঙালি পুরুষ যারা কোনওদিন রান্নাঘরে ঢোকেনি, কী চমৎকার এক একজন রাঁধুনী বনে যায় বিদেশে গিয়ে। দেশে বাস করলে তারা লজ্জা পায় রান্না করতে, কারণ রান্না তো মেয়েদের কাজ, ছোটলোকদের কাজ! কিন্তু বিদেশ-জীবনে তারা গর্ব করে বলে তারা কী কী রান্না জানে, তারাও ঘরবাড়ি পয় পরিষ্কার করাটা লজ্জার বলে মনে করে না।
ইউরোপ কতদিন তাদের আদর্শ সমাজ টিকিয়ে রাখতে পারবে জানি না। তবে ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়েও যতটুকুই গড়েছে ওরা, তারই স্পর্শে আমাদের চরম বৈষম্যে ঠাসা নষ্ট ভ্রষ্ট পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানুষগুলো সবটা না হলেও কিছুটা মানুষ তো হয়েছে। কিছুটা উপকৃত তো আমিও হয়েছি।
২৪. চক্ষু কর্ণ হীন বোধ হীন বিবেক হীন
আদিবাসী একটি মেয়েকে ৯ জন বাঙালি পুরুষ ধর্ষণ করেছে। শুনে কি আমি অবাক হয়েছি? মোটেও না। আমি অবাক হব যেদিন শুনবো বাংলাদেশে পুরুষেরা আর ধর্ষণ করে না। এদের পবিত্র গ্রন্থই যখন বলে স্ত্রীকে ধর্ষণ বৈধ, দাসিকে ধর্ষণ বৈধ; এরা যে সমাজ তৈরি করেছে, সেই সমাজই যখন বলে পতিতালয় নামের বাড়িতে অসহায় মেয়েদের ধর্ষণ করা বৈধ; এরা শৈশব পার করেই যখন শোনে দরিদ্র অনেক মেয়ের নাম বেশ্যা, যাদের এরা যখন খুশি ধর্ষণ করতে পারে, কারণ বেশ্যাদের ধর্ষণ করা বৈধ—তাহলে রাস্তাঘাটে কোনও মেয়ে দেখলে কেন এদের মনে হবে না এটিকেও ধর্ষণ করা বৈধ, এটিরও আছে বেশ্যাদের মতো নাক চোখ মুখ বুক পেট যৌনাঙ্গ?
আসলে এদের সব মেয়েকেই ধর্ষণের যোগ্য বলে মনে হয়। স্ত্রীকে তো বটেই, বোন, কন্যা, বৌদি, মা, মামী, কাকী, নাতনি, পুত্রবধূ কাকে ছেড়েছে এরা? এরা তো পুরুষ নয়, এরা পুরুষাঙ্গ। এরা স্বর্গে গিয়েও ধর্ষণ করবে, সে রকমই টোপ দেওয়া হয়েছে এদের। তাই শর্টকাট স্বর্গে গিয়ে ধর্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়তে এরা খুনখারাবি পর্যন্ত করতে দ্বিধা করছে না। যদি কোনও পুরুষ ধর্ষণ থেকে বিরত রাখে নিজেকে, সে রাখে আইনে ফেঁসে যাবে বা লোকে পেটাবে— এই ভয়ে। আজ এমন আইন হোক, যে আইনে পুরুষেরা যা খুশি করুক শাস্তি পাবে না, তাহলে দেখবে বিশ্ব একটি পুরুষও ধর্ষণ না করে একটি দিনও বসে থাকবে না।
আমাদের দুঃখ এই, আমরা সংখ্যাগুরু হই, সংখ্যালঘু হই আমরা কেউ নিরাপদ নই। কারণ আমরা বাস করি চক্ষুকর্ণহীনবোধহীনবিবেকহীণ লক্ষকোটি পুরুষাঙ্গের সঙ্গে।
২৫. কুকুর
চারটে কুকুরকে করোনা ভাইরাস শনাক্ত করার প্রশিক্ষিণ দেওয়া হয়েছে। শুধু শুঁকেই বলে দিতে পারবে শরীরে করোনা ভাইরাস আছে কী নেই। ফিনল্যান্ডের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এখন কুকুরেরা করোনায় আক্রান্ত যাত্রীদের শনাক্ত করার কাজে ব্যস্ত। বোমা, মাদক দ্রব্য, নানারকম রাসায়নিক পদার্থ এভাবেই তো শনাক্ত করে কুকুর। হারিয়ে যাওয়া মানুষের ব্যবহৃত কিছু একটা শুঁকিয়ে দাও, সে মানুষটিকে মুল্লুক খুঁজে বের করবে। সাধারণ একজন মানুষের ঘ্রাণশক্তি যত, তার চেয়ে কুকুরের ঘ্রাণশক্তি ১০ হাজার থেকে ১ লাখ গুণ বেশি। ২০ কিলোমিটার দূরের জিনিসের গন্ধ পায় কুকুর। মানুষকে কুকুরেরা বারো হাজার বছর আগে সাহায্য করা শুরু করেছে, এখনও করছে। ফারাও-এর আমলে মিশরে কুকুরকে দেবতা মানা হত। কুকুরের মন্দির ছিল। লক্ষ লক্ষ কুকুরের মমী পাওয়া গেছে মিশরের কবরখানায়। আমরা কুকুরকে দেবতা না মানি, কুকুরকে তো তার প্রাপ্য ভালোবাসা দিতে পারি। তা কেন করবো, বিশ্বস্ত এই প্রাণীটির নাম আমরা গালি হিসেবে ব্যবহার করি। কুকুর নিশ্চয়ই জানে, মানুষের মতো এত নিকৃষ্ট এ জগতে আর কোনও প্রাণী নেই।
২৬. আল্লামা
বাংলাদেশে একটা আল্লামা মরছে, মনে হইতাছে আল্লাহ মরছে। এলাহি কাণ্ড শুরু হইয়া গেছে। জানাজায় ১০ প্লাটুন পুলিশ দিতাছে সরকার। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী তো আছেই বেবাক মন্ত্রী আমলা কান্দাকাটি শুরু করছে। আল্লামার বয়স হইছিল ১০৪। অথচ ডায়বেটিস হাইপারটেনশান সব ছিল। এত রোগ থাকতে বাঁচে কেমনে এত বছর? ওইসব রোগ মানুষের থাকলে আয়ু অর্ধেক কইমা যায়। তার কেন বাড়লো? মানুষকে রোগশোকে পল্যুটেড পড়াপানি খাওয়াইলেও সে নিজের অসুখবিসুখ সারাইতে বিদেশের বড় বড় ডাক্তারের কাছে বড় বড় হাসপাতালে উইড়া উইড়া গেছে। ভালো ট্রিটমেন্ট পাইছে তাই বাঁচছে। এখন তো মরছে, আপদ বিদায় হইছে। কিন্তু এলাহি কাণ্ড কেন? কার জন্য? ওই লোক কী ভালো কাজটা করছে জীবনে? মৌলিবাদী তৈরির কারখানা মাদ্রাসা বানাইসে, যেই মাদ্রাসায় মগজধোলাই কইরা দেশের ভবিষ্যতের সর্বনাশ করা হয়। আর কী করছে? যে আল্লাহ বিশ্বাস করে না তারে মাইরা ফেলার কথা কইছে। মানুষরে খুনী সন্ত্রাসী হওয়ার ইন্ধন জুগাইছে। আর? মেয়েদের ফাইভ ক্লাসের বেশি পড়তে না করছে, স্বামীর বান্দিগিরি কইরা জীবন পার করতে কইছে আর এক পা ঘরের বাইর হইলে বোরখায় আপাদমস্তক ঢাকতে কইছে কারণ মেয়েরা নাকি তেঁতুল, খোলা থাকলে পুরুষলোকের লালা ঝরবে, খালি খাইতে ইচ্ছা করবে। বড় মাপের নারীবিদ্বেষী, সমাজ-ধ্বংসকারী কুলাঙ্গারের জন্য হাহাকার করতাছে দেশের লক্ষ লক্ষ ছোট মাপের নারীবিদ্বেষী, সমাজ-ধ্বংসকারী কুলাঙ্গাররা। আল্লামার দেখাইয়া দেওয়া পথে হাঁটবে তারা। মেয়েদের তেঁতুল মনে কইরা চাটবে, খাবে। মেয়েদেরে কীভাবে ভোগের বস্তু, চাকরবাকর আর ইতর জাতীয় নোংরা কিছু ভাবতে হবে, এবং ঘৃণা করতে হবে তা ব্যাটা সুন্দর কইরা গুছাইয়া শিখাইয়া দিয়া গেছে পুরুষজাতরে। এই শিক্ষকরে হারাইয়া পুরা দেশবাসী চোখের পানি ফেলবে, কানবে, চিল্লাইয়া কানবে—এ তো নিউ নরমাল।
২৭. বাড়ি
আমাদের বাড়ি ছিল সেক্যুলার বাড়ি। শিল্প সাহিত্যের বাড়ি। সেই বাড়ি এখন কট্টর মুসলমানের বাড়ি। হাদিস কোরানের বাড়ি। আমার বড় মামা পাঁড় নাস্তিক তো ছিলেনই, নামী কমিউনিস্ট ছিলেন। তাঁর ছেলেমেয়েরা সবাই ধার্মিক। কেউ কেউ তো পাঁচ বেলা নামাজ পড়ে, বোরখা পরে। কেউ হজ্বে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। আমার এক মামা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ধর্ম কর্মের ধার ধারতেন না। তাঁর সবকটা কন্যা শুধু বোরখা নয়, নিকাব, হাতমোজা, পা-মোজা সবই পরে। আমার বাকি মামারাও বদলে গেছে আমূল। যাদের সঙ্গে শৈশব কেটেছে, তারা আমার নাম উচ্চারণ করাও মনে করে পাপ।
আমার কোনও সন্তান নেই। কিন্তু পরিবারে নতুন জেনারেশন বেশ আছে। আমার বড় দাদার দুই ছেলে। ছোট দাদার এক ছেলে এক মেয়ে। আর আমার বোনের এক মেয়ে। এরা কেউ কি আমার লেখা পড়ে? জানে আমি কী লিখি? না। জানার একফোঁটা আগ্রহ নেই কারো।
আমার লেখা আমার বাবা মা, আমার দাদারা পড়তো। কেউ নেই এখন। বোন পড়ে লেখা। তাছাড়া আত্মীয়স্বজনের বাইরের মানুষই পড়ে। তাদের অনেকে আমাকে জানে, বোঝে। তারাই আমার আপন।
২৮. জিন্নাহ
জিন্নাহ বিয়ে করেছিলেন একজন অমুসলিমকে। জিন্নাহর একমাত্র সন্তান দিনাও বিয়ে করেছিলেন এক অমুসলিমকে। দিনা তো ভারত ছেড়ে পাকিস্তানেই যাননি। জিন্নাহর নাতি নাতনি কেউই মুসলমান নয়, নাতি নাতনিদের বংশধরও কেউ মুসলমান নয়। জিন্নাহ নামাজ রোজা করতেন না, সম্ভবত নাস্তিক ছিলেন, অথচ ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করেছিলেন এত বড় দেশটাকে। অবশ্য একা তো ভাগ করা যায় না, নেহরুর ষোলো আনা না হলেও এগারো আনা সম্মতি ছিল। জিন্নাহ যদি দেখতে পেতেন কী হাল হয়েছে তাঁর বানানো দেশটার, নিশ্চয়ই গভীর অনুশোচনা করতেন। দেশ ভাগের পর তো ঠিকই বুঝেছিলেন দ্বিজাতিতত্ত্ব ভুল তত্ত্ব, তাই এর বিপক্ষে জনতাকে দাঁড়াতে বলেছিলেন। পাকিস্তানের হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবাইকে এক জাতি হিসেবে এক দেশে শান্তি, সম্প্রীতি, সৌহার্দ বজায় রেখে বাস করার আহবান জানিয়েছিলেন।
জিন্নাহ যদি দেখতে পেতেন, কী দেখতেন আজ? দেশ ফের ভাগ হয়েছে দেখতেন। ধর্মবাদ, মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদে ছেয়ে গেছে দেশের দুটো অংশ দেখতেন। অনুশোচনা তো করতেনই।
বোম্বের মালাবার হিলে তাঁর কী সুন্দর বাড়িটিই না তিনি ছেড়ে গিয়েছিলেন! বাড়িটি তো তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকারী দিনাও নেননি। ‘জিন্নাহ হাউজ’কে ‘জিন্নাহ মিউজিয়াম’ বানানো যায় না? যে মিউজিয়ামে থাকবে দেশভাগের ভুল সিদ্ধান্তের নথিপত্র, ধর্মান্ধতা থেকে বাঁচাবার বদলে দূরদৃষ্টিহীন রাজনীতিকরা উপমহাদেশকে ধর্মান্ধতার নরককুণ্ড বানাবার যে নীল নকশা এঁকেছিলেন সেই নীল নকশা, হিন্দু মুসলমান পরস্পরকে যেন চিরকালীন শত্রু ভাবতে পারে সেই বন্দোবস্তটি যে মস্তিষ্ক থেকে এসেছিল সেই মস্তিষ্কটি। ভুক্তভোগীরা দেখতে যাবো সেসব! শুনেছিলাম ইতিহাস থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়। শিক্ষা কি আদৌ নেয়? নাকি একই ভুল বারবার করে!
২৯. বোরখা
বোরখা নারীনির্যাতনের একটি প্রতীক। কিন্তু একদা সেক্যুলার বাংলাদেশের ভয়াবহ বাস্তবতা এই যে অধিকাংশ মেয়ে মগজধোলাই হয়ে হোক, পারিবারিক চাপে হোক, সামাজিক চাপে হোক হিজাব বা বোরখা পরে। এখন কী করা উচিত মেয়েদের? গৃহবধূ হয়ে যাও, স্বামী সন্তানের সেবা করো আর পরকালে জান্নাতবাসী হওয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে মাথা ঠুকতে থাকো? জান্নাতে বসে অসংখ্য হুরের সঙ্গে স্বামীর দিবারাত্তির সঙ্গম দেখতে দেখতে নিজের বুড়ো আঙুল চুষতে হবে অনন্তকাল। না, ওইপারে মেয়েদের জন্য কোনও লোভনীয় জীবন অপেক্ষা করে নেই। ইহজগতই তাদের ভরসা। খাঁচা থেকে মেয়েদের বেরিয়ে আসতে হবে। হিজাব বোরখা পরো বা না পরো, শেকল ছিঁড়তে হবে পায়ের। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে, স্বাবলম্বী হতে হবে, স্বাধীনতা উপভোগ করতে হবে, অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে। এই না করলে মেয়েদের ওকূল তো গেছে, একূলও যাবে।