২০
ওই ঘটনার পর প্রিয় অনেক বদলে গেছে। বিয়ের প্রথম দিকে যেমন ছিল, অবস্থা এখন তার চেয়েও খারাপ? শুদ্ধ ছাড়া কারও সঙ্গে কথা বলে না। নিজের কাজ নিজে করে, নিজের জিনিস নিজে খুঁজে নেয়। নিকিতা কিছু জিজ্ঞেস করলে স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেয়, যেন কিছুই হয় নি। সেদিন নিকিতা অ্যাসাইনমেন্ট করায় হেল্প চাইলে বলল, ‘নীলক্ষেতে এসব অ্যাসাইনমেন্ট বিক্রি করে। টপিক না মিললেও বললে করে দেয়। ওখান থেকে করাও, টাকা যা লাগে নিয়ে যেয়ো।’ অথচ আগে পুরো অ্যাসাইনমেন্টই নিজে করে দিত। প্রেজেন্টেশন থাকলে সব রেডি করে বুঝিয়ে দিত। আর সেই প্রিয় আজ এই কথা বলল! মানুষটা হাসতেও ভুলে গেছে। হাসির সিনেমা দেখলেও হাসে না এখন। সুন্দর একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল। ছুটির দিনগুলোতে রান্না শেখাত, ঘুরতে নিয়ে যেত। সময় পেলেই এটা-ওটা নিয়ে গল্প করত। কতটা কাছাকাছি চলে গিয়েছিল! একটামাত্র ভুল সব তছনছ করে প্রিয়কে হাজার মাইল দূরে নিয়ে গেছে। আজকাল প্রিয় বাসায়ই থাকে না। ছুটির দিনগুলোতে সকালবেলা শুদ্ধকে নিয়ে বাইরে চলে যায়, অনেক রাতে ফেরে। সব হাসি হারিয়ে গেছে। কোনো কিছুতে আজকাল খুব রেগেও যায় না। প্রিয়র এই অবস্থা দেখে। প্রচণ্ড কষ্ট হয় নিকিতার।
.
পেট্রা বালিশে হেলান দিয়ে এক পা ছড়িয়ে বসে আছে নিজের বিছানায়। স্মরণ ও স্মরণের মা সামনেই বসে আছে। এর চেয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি আর কী হতে পারে? সপ্তাহখানেক আগে অফিসের এক কন্ট্রাকশন বিল্ডিংয়ে গিয়েছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত এক দুর্ঘটনার মাঝে পড়ে পা ভেঙে গেছে তার। অনেক বড় ক্ষতি হতে পারত কিন্তু ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছে। অফিস অবশ্য চিকিৎসার সব খরচ বহন করছে এবং সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত পেইড ছুটি দিয়েছে। প্লাস্টার করা পা নিয়ে দিনরাত সে এখন বাসায় বসে থাকে। স্মরণ প্রতিদিন তাকে ফোন করে। আজ সকালেও ফোন করেছিল। হুট করেই বলল তাকে দেখতে আসতে চায়। এভাবে কেউ বাসায় আসতে চাইলে কি নিষেধ করা যায়? ঠিকানা দিল, আসতে বলল। কিন্তু এই পাগল ছেলে সাথে করে তার মাকে নিয়ে এসেছে।
পেট্রাকে দেখে, কথাবার্তা বলে তারা ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসল। পেট্রা ভাবতে লাগল, স্মরণ ওর মাকে কেন নিয়ে এল? তাকে দেখাতে? তার অনুমতি ছাড়াই!
.
রাতে শুদ্ধ ঘুমের ভান করে পড়ে ছিল। উদ্দেশ্য আন্টি ও বাবা ঘুমালে, বাবার ফোন নিয়ে অন্য রুমে গিয়ে মাকে কল করবে। হঠাৎ টের পেল, নিকিতা আন্টি ফিসফিস করে বাবাকে বলছে, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?
একটা কথা বলতাম।’
বাবা বলল, বলল।
‘শুদ্ধ তো এখন বড় হচ্ছে। ওকে একটা আলাদা ঘর দেওয়া উচিত না?
কোনো প্রয়োজন নেই। আমার ছেলে আমার সাথেই ঘুমাবে। ও আমাকে ছেড়ে ঘুমাতে পারে না।
‘হ্যাঁ, তা ঠিক, কিন্তু ও তো বড় হচ্ছে। একা ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে তো। কত দিন আমাদের সাথে ঘুমাবে? তা ছাড়া বিছানায় জায়গাও হচ্ছে না।
‘জায়গা না হলে বিছানা চেঞ্জ করব। বড় খাট বানাব। আর তাতেও না হলে তুমি পাশের ঘরে চলে যেতে পারো। চাইলে ঘরটা নিজের মতো করে সাজিয়েও নিতে পারো।
‘আসলে…’
বাবা আন্টিকে কথাটা শেষ করতে দিল না। বাধা দিয়ে বলল, এ নিয়ে আর একটাও কথা না। আমি চাই না এসব কথা শুদ্ধর কানে যাক।
‘শুদ্ধ তো ঘুমিয়ে আছে।
‘তোমাকে কী বলেছি, তুমি বোঝো নি?
এরপর আন্টি চুপ হয়ে গেল। ঘুম আসছে না শুদ্ধর। ঘুরেফিরে ওর মাথায় একটাই প্রশ্ন জেগে উঠছে। আন্টি কেন তাকে আলাদা ঘর দিতে চায়? একদিন আন্টি তাকেও বলেছিল আলাদা ঘরের কথা। কিন্তু কেন?
.
পেট্রার জীবনে এমন বোরিং সময় আর কখনো আসে নি। ভাঙা পা নিয়ে কিছু করার নেই। সারাক্ষণ বসে থাকো। একটা বই পড়ছিল। শিখা ঘরে ঢুকে বলল, ‘পেট্রা, তোর কি কোনো আক্কেল নাই? এই বয়সেও না হলে আর কবে হবে?
পেট্রা বইটা রেখে অবাক হয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার, মা? এত রেগে আছ কেন?
‘বিয়ে হচ্ছে না বলে কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর?’
‘মা প্লিজ, যা বলার সরাসরি বলো, কী করেছি আমি?
‘ওই যে তোর কলিগ ছেলেটা, কী যেন নাম?
‘স্মরণ।
‘হ্যাঁ, ওর মা বিয়ের প্রস্তাব দিতে এসেছিল। প্রিয়াঙ্কার জামাই বাসায় ছিল বলে কাল এবং আজ এতক্ষণ চুপ করে ছিলাম। তুই আবার একটা মুসলিম ছেলে ধরেছিস! নিজের ধর্মের কোনো ছেলে তোর চোখে পড়ে না? একবার ধাক্কা খেয়ে তার শিক্ষা হয় নি? তুই আবার সেই একই ভুল করলি কীভাবে? একবারও ভাবলি না আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখাব কীভাবে?
মা একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে যাচ্ছিল। পেট্রাকে কিছু বলার সুযোগই দিচ্ছে না। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। পেট্রা মাকে থামিয়ে বলল, ‘মা, তুমি নিজেই বলে যাচ্ছ। আমাকে সুযোগ তো দেবে!
‘কী সুযোগ দেব? একবার তুই আমার মুখ পুড়িয়েছিস। আবার এমন কিছু করবি, আমি ভাবতেও পারি নি। এসবের আগে আমি মরলাম না কেন?
‘মা, প্লিজ, আমার কথা শোনো। ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
‘নেই মানে? না থাকলে কি ওরা বিয়ের প্রস্তাব দিত?
‘তা আমি জানি না। স্মরণ আমাকে প্রপোজ করেছিল, আমি মানা করে দিয়েছি। তারপরও কেন প্রপোজাল নিয়ে এসেছে, আমি তা জানি না। যাই হোক, তোমার কাছে যখন প্রস্তাব দিয়েছে তুমি মানা করে দাও।’
‘সত্যি সম্পর্ক নেই?
‘না রে বাবা নেই। কোনো সম্পর্ক নেই। স্মরণ কেন, কারও সাথে নতুন করে কোনো সম্পর্কে যাওয়া আমার পক্ষে আর সম্ভব না। কোনো
অনুভূতি কাজ করে না আমার।
প্রথমে যখন বিয়ের প্রস্তাব দিল, আমি তো খুশিমনে রাজি হয়ে গেলাম। কত মেহমানদারি করলাম! পরে শুনি ওরা মুসলিম। ইশ, তোর ওপর যে কী রাগ উঠেছিল পেট্রা, মন চাচ্ছিল তোকে খুন করি।
‘রাজি হয়েছ মানে? পরে মুসলিম জানার পর মানা করে দাও নি?
‘মাত্রই হ্যাঁ বললাম, আবার এখনই না বলি কীভাবে?
‘আমার সাথে তো খুব পারো, বাইরের মানুষের সাথে পারবে না কেন?
‘তুই আমার পেটের মেয়ে, পেট্রা। তোর সাথে তো পারবই।
‘সবার সাথে পারতে হবে। যেটা সত্যি, সেটাই বলে দাও। বলো যে তুমি ভেবেছিলে ওরাও খ্রিষ্টান।
মা কাঁচুমাচু হয়ে বসে রইল। পেট্রা বলল, তুমি বলতে না পারলে রায়ানকে দিয়ে বলাও। ও এসব ব্যাপারে ওস্তাদ। ভাই আমার অনেক বড় হয়েছে।
‘ইশ, আমাদের ধর্মের কেউ যদি তোকে এমন করে পছন্দ করত!’
‘উফ মা, প্লিজ থামো তো।’
‘আচ্ছা, থামলাম। শোন, রায়ানের কথা ওঠায় মনে পড়ল, কদিন ধরেই বলব ভাবছিলাম কিন্তু তোকে একা পাচ্ছিলাম না। তুই বাসায় ফেরার আগেই তো রায়ান ফিরে আসে।
‘কী কথা? বলো।’
‘এই যে তুই রায়ানকে মেডিকেলের জন্য কোচিং করাচ্ছিস, মেডিকেলে পড়ার এত খরচ কোত্থেকে দিবি, শুনি? তার ওপর যদি চান্স
পায়? প্রাইভেটে তো আর পড়াতে পারবি না, ওদিকে তুই তো ওকে আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখাচ্ছিস!”
‘মা, এসব নিয়ে তুমি ভেবো না তো। আমি যেভাবে হোক, ম্যানেজ করব।’
‘কীভাবে?
‘অফিস আমার কাজে এবং ব্যবহারে খুব সন্তুষ্ট। আমার প্রমোশনের কথা চলছে। হয়ে গেলে আমার স্যালারি অনেক বেড়ে যাবে। প্রাইভেটে পড়ানো লাগলে অফিস থেকে লোন নেব। লাগলে সাভারের বাড়ি, জমি সব বিক্রি করে দেব।’
‘তুই পাগল হয়েছিস! তোর বাবার বানানো বাড়ি। এত কষ্টে কেনা জায়গাজমি সব হাতছাড়া করব?
‘দুই রুমের একটা একতলা বাড়ি। ওটার এমন কোনো দাম উঠবেও। বাড়ি তুমি রেখে দিয়ো। জমি বিক্রি করলেই হবে। আর এসব হাতছাড়া হয়েও রায়ান যদি ডাক্তার হতে পারে, তাহলে বাবাই সবচেয়ে বেশি খুশি হবে, মা।’
‘ঠিকাছে, যেটা ভালো হয় কর।
মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই পেট্রার একটা কল এল। মা উঠে চলে গেলেন। পেট্রা কলটা না ধরে অবাক হয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ, কলটা প্রিয়র বাবার নম্বর থেকে এসেছে। কিন্তু তিনি কেন এখন পেট্রাকে ফোন করবেন? তা ছাড়া ও তো নম্বর বদলেছে। নতুন নম্বর তিনি কোথায় পেলেন? পরক্ষণেই খেয়াল হলো, এটা তো তার নতুন নম্বর না। এটা ওর অফিশিয়াল নম্বর। সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ে গেল, নিজের নম্বর অনেক সময় বন্ধ থাকলেও এটা কখনো বন্ধ থাকে না। তাই সে ক্রিসমাসের দিন শুদ্ধকে এই নম্বরটাই লিখে দিয়েছিল। শুদ্ধ! এতক্ষণে কলটা কেটে গেল। সঙ্গে সঙ্গে পেট্রা কলব্যাক করল। সে হ্যালো বলার আগেই শুদ্ধর গলা শোনা গেল, ‘মা…’
পেট্রার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। কান্না পেল। বলল, আমার বাবা কেমন আছ বাবা তুমি?
‘ভালো আছি, মা। তুমি কেমন আছ?
‘ভালো, এখন আরও ভালো। আমার বাবা ফোন করেছে যে আমাকে। কিন্তু বাবা, দাদার ফোন কী বলে এনেছ?
‘কিছু বলে আনি নি, মা। চুরি করে এনেছি।
‘ওহ গড! দাদা টের পেয়ে যাবে না তো? তুমি কোথায়?
‘আমি ছাদের গার্ডেনে লুকিয়ে কথা বলছি।
‘এত রাতে ছাদে ভয় করছে না তোমার?
‘না, আমার একটুও ভয় করে না, মা। তোমার সাথে কথা বলার জন্য আমি ভূতের বাড়িতেও যেতে পারব।
এ কথা শুনে পেট্রার চোখে জল এল। এতটুকু একটা বাচ্চা স্বাভাবিক সব অনুভূতির বাইরে। প্রচণ্ড অসহায় লাগল। কী করবে সে? শুদ্ধ বলল, ‘মা, একটা কথা জানতে চাই।’
‘বলো না বাবা কী জানতে চাও?
‘আচ্ছা মা, আমি কি অনেক বড় হয়ে গেছি?
‘নাহ তো বাবা। এই তো সেদিন তুমি জন্মালে। তুমি তো আমার ছোট্ট বাবা।
‘আমি কি এখন আর বাবার সাথে ঘুমানোর মতো ছোট নেই?
পেট্রার মনে সন্দেহ হলো। ছেলেটা এসব কেন বলছে? তাই জিজ্ঞেস করল, ‘কেন এ কথা বলছ, বাবা?
‘নিকিতা আন্টি বাবাকে বলছিল আমাকে অন্য একটা রুমে দিতে। আমার নিজের রুম।
পেট্রা চমকে উঠল! তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি জানলে কীভাবে?
‘কাল রাতে আন্টি বাবাকে বলছিল।
‘তোমার সামনেই বলছিল?
‘না, আমি ঘুমের ভান করে ছিলাম। ভেবেছিলাম আন্টি-বাবা ঘুমালে বাবার ফোন চুরি করে তোমাকে ফোন করব।’
‘বাবা চুরি শব্দটা কখনো আর বলবে না। এই যে তুমি দাদার ফোন এনেছ, বাবার ফোন আনো–এসব তো তুমি আমার সাথে কথা বলেই আবার যার যার জায়গায় রেখে দাও। এটাকে বলে গোপনে বা লুকিয়ে নেওয়া। লুকিয়ে নিয়ে আর ফেরত না দেওয়াকে বলে চুরি। চুরি খুব খারাপ বাবা। চুরি কখনো করবে না, এই শব্দটা বলবেও না।
‘ঠিকাছে মা, তুমি যা বলবে, আমি তা-ই করব।’
‘এই তো আমার লক্ষ্মী বাবা।
‘আচ্ছা মা, এবার বলো না বড় হলে কি আর বাবার সাথে ঘুমানো যায় না? আমি কি সত্যিই বড় হয়ে গেছি? আমার কি নিজের অন্য রুমে চলে যাওয়া উচিত?
এ ব্যাপারে বাবা যে সিদ্ধান্ত নেবে, তুমি সেটা মেনে নেবে, আচ্ছা?
‘বাবা বলেছে বড় দেখে বিছানা বানাবে, যাতে জায়গার সমস্যা না হয়। তারপরও সমস্যা হলে আন্টিকে অন্য রুমে যেতে বলেছে।
‘আচ্ছা বাবা, দেখো কী হয়। বাবা যা করতে বলবে, সেটাই করবে। এসব নিয়ে আর ভেবো না। একটা কথা মনে রাখবে, বাবা সব সময় তোমার ভালো চায়। বাবা যেটা করতে বলবে, সেটা তোমার ভালোর জন্যই বলবে।
‘আচ্ছা।’
পেট্রা চিন্তায় পড়ে গেল। ছেলেটা কীসের মধ্যে বড় হচ্ছে? তার ছেলেটা অন্য আর দশটা ছেলের মতো বড় হতে পারছে না। নিকিতা ওকে আপন ভাবতে পারছে না। ছেলে যে নিকিতাকে খুব আপন ভাবে, তা-ও তো না। বেচারি মেয়েটা পরের ছেলেকে পালছে কিন্তু মা ডাক শুনছে না, এটাও কম কষ্টের না। এসব ভেবে পেট্রা বলল, ‘আমি তোমার বাবার কে হই, বলো তো?
‘ওয়াইফ।
‘তুমি আমাকে কী বলে ডাকো?
‘মা।’
‘নিকিতা আন্টি তোমার বাবার কে হয়?
‘ওয়াইফ।’
‘তাকে তুমি কী বলে ডাকো?
‘নিকিতা আন্টি।’
‘কেন, আন্টি কেন ডাকো? মা বলে ডাকো না কেন?’
‘সে তো আন্টিই হয়। আমি কি তার পেট থেকে হয়েছি? আমি তো তোমার পেট থেকে হয়েছি। তাই তোমাকে মা ডাকি।
‘পেট থেকে হলেও যেমন মা ডাকতে হয়, না হলেও ডাকতে হয় যদি সেই মানুষটা বাবার ওয়াইফ হয়। এটাই নিয়ম, বাবা।
‘সত্যি! আমি আগে জানতাম না। সবাই আমাকে বলেছে, এটা তোমার নতুন মা। তার জন্যই তো রাগ করে মা ডাকি নি। নতুন মা। আবার কেমন কথা! তুমিই বলো, মা? কেউ তো আর বলে নি বাবার ওয়াইফকেও মা ডাকতে হয়।’
‘ঠিকই তো। না বললে তুমি বুঝবে কীভাবে?
‘আমাকে বললেই আমি সব বুঝি।’
‘আচ্ছা বাবা, নিকিতা তোমাকে আদর করে না?
‘হ্যাঁ, অনেক আদর করে। আমাকে খাইয়ে দেয়। তোমার মতো গল্পও শোনায়। ঘুমানোর সময় মাথায় হাতও বুলিয়ে দেয়।
‘বাহ, তাহলে তো আমার মতোই।
‘নাহ, তুমি বেস্ট।
‘আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু নিকিতা আন্টিও তো ভালো, তাই না?
‘হ্যাঁ।
‘তাহলে আজ থেকে তুমি ওকে কী বলে ডাকবে?
‘মা ডাকব। কিন্তু ভুলে যদি আন্টি ডেকে ফেলি?
‘প্রথম প্রথম এমন হতে পারে। কিন্তু মা বলতে বলতে অভ্যাস হয়ে যাবে।’
‘আচ্ছা মা।
‘এখন নিচে চলে যাও, বাবা। কল হিস্ট্রি থেকে আমার নম্বর ডিলেট করে দাও।
‘ওকে মা।’
‘আই লাভ ইউ, বাবা।’
‘আই লাভ ইউ, মা।
২১
নিকিতার পড়াশোনা করতে একদম ভালো লাগে না। প্রিয়র জোরাজুরিতে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। যদিও অনেক বন্ধু পেয়েছে, তবু ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে খাল কেটে কুমির এনেছে সে। দুদিন পরপরই পরীক্ষা। আর ভালো লাগে না। ধুর, ফেল করলে করবে, এই ভেবে পড়াশোনা বন্ধ করে টেবিল থেকে উঠে গেল। প্রিয় একটু পরই অফিস থেকে ফিরবে, তাই সামান্য সাজগোজ করল। গোছানো ঘরটা আবারও গোছাল। এর মধ্যেই শুদ্ধ ঘরে ঢুকে বলল, ‘মা, খুব খিদে পেয়েছে। কিছু খাব।
‘দিচ্ছি দাঁড়াও।
হঠাৎ নিকিতা খেয়াল করল শুদ্ধ ওকে মা বলে ডাকল। চমকে গেল, বুকের ভেতর কেমন জানি করে উঠল। নিকিতা বলল, ‘কী বললে? কী বলে ডাকলে আমাকে?
শুদ্ধ একগাল হাসি দিয়ে বলল, ‘মা বলেছি।
‘ভুল করে মা বলেছ?
‘না তো। তুমি তো আমার মা-ই হও। তাই ইচ্ছা করেই মা বলে ডেকেছি। এখন থেকে আমি তোমাকে মা বলে ডাকব।’
অজানা একটা খুশির অনুভূতি নিকিতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরল। শুদ্ধর সামনে বসে বলল, আবার বলো।’
শুদ্ধ আবার হাসল।
‘মা, আমি তোমাকে এখন থেকে মা বলে ডাকব।’
নিকিতা শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরল। শুদ্ধও ধরল। শুধু একটা মা ডাক যে এমন অনুভূতি এনে দিতে পারে, তা জানা ছিল না ওর। তারপর নিকিতা শুদ্ধর হাত ধরে ডাইনিং রুমে গেল। বলল, ‘কী খাবা বলো?
‘উম, কী যে খাব! আচ্ছা স্যান্ডউইচ খাব।
‘এক্ষুনি বানিয়ে দিচ্ছি।
নিকিতা স্যান্ডউইচ এনে দিল। শুদ্ধ খাওয়া শুরু করল। নিকিতা বলল, ‘আচ্ছা বাবা, তুমি হঠাৎ আমাকে মা ডাকার সিদ্ধান্ত কেন নিলে?
‘কেন আবার? বাবার ওয়াইফকে তো মা-ই বলতে হয়।
কে বলেছে তোমাকে এই কথা?
‘আমার মা বলেছে। মা সব সময় সত্যি কথা বলে।
‘তোমার মা!’
‘হ্যাঁ, আমার পেট্রা মা।
‘মায়ের সাথে তোমার দেখা হয়? কথা হয়?
‘না তো।’
‘তাহলে কীভাবে বলেছে এই কথা?
‘অনেক আগে বলেছিল।
শুদ্ধ সাধারণত মিথ্যা বলে না। কিন্তু যেহেতু মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা নিষেধ, তবু ও লুকিয়ে যোগাযোগ করে, তাই এই ব্যাপারটা ও সব সময় গোপন রাখে। মুখ ফসকেও কখনো কাউকে বলে না।
নিকিতা আজ বুঝতে পারছে পেট্রা কতটা বড় মনের মানুষ। ও শুধু শুধুই পেট্রাকে ভুল বুঝেছিল। ইশ, কত গালাগালি করেছিল। আজ ওর নিজেরই খারাপ লাগছে।
ওদিকে প্রিয় খেয়াল করছে, শুদ্ধ নিকিতাকে মা বলে ডাকছে। খুব অবাক লাগছে। শুদ্ধ মায়ের ব্যাপারে অনেক পজেসিভ। সে অন্য কাউকে মা ডাকবে, এটা অসম্ভব। তবু কেন ডাকছে? অনেকবার জিজ্ঞেস করার পরও তেমন কিছুই বলল না। শুধু বলল, ‘নিকিতা মাকে মা বলতে ভাল্লাগে, বাবা।’ কিন্তু এই শুদ্ধই একসময় বলত, একটা মানুষের কী করে দুইটা মা হয়, বাবা? শুদ্ধর এই আমূল পরিবর্তনের পেছনের রহস্য জানে না প্রিয়। তাবে রহস্য যা-ই হোক, ব্যাপারটাতে একটা লাভ হয়েছে। নিকিতা শুদ্ধকে এখন আরও বেশি আদর-যত্ন করে। মনেপ্রাণে শুদ্ধকে নিজের ছেলে বলে ভাবে। শুদ্ধর কোনো কাজে তার এখন আর ভুল হয় না।
.
এক পায়ে প্লাস্টার করা নিয়ে একা একাই মুভ করে পেট্রা। দেয়াল ধরে ধরে বাথরুমে যায়। বারবার মাকে ডাকতে ইচ্ছা করে না। যদিও একা একা বাথরুম পর্যন্ত যেতে একটু কষ্টই হয়। কষ্ট করে বাথরুমে গিয়ে ঢুকতেই হঠাৎ মনে পড়ল, ও একবার পায়ে ব্যথা পেয়েছিল। মচকায়ও নি, সামান্যই ব্যথা পেয়েছিল। দু-তিন দিন পর্যন্ত প্রিয় ওকে কোলে করে বাথরুমে নিয়ে যেত, আবার কোলে করে নিয়ে আসত। আর আজ পা ভেঙে দুই সপ্তাহ ধরে বাসায় বসে আছে। প্রিয় তা জানতেও পারল না। মনে পড়তেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে একটা কান্না উঠে এল। বন্ধ দরজার ভেতর নিজেকে সামলানোর কোনো প্রয়োজন মনে করল না পেট্রা, কাঁদল। ইচ্ছা করেই কাদল। কান্নাকাটির পর সে কিছুটা ভারমুক্ত হলো। পেট্রা মানুষকে বলে বেড়ায় ওদের বিচ্ছেদটা ও মেনে নিয়েছে। হেসেখেলে দিন পার করছে। মায়ের পছন্দ করা অনির্দিষ্ট কোনো ছেলেকে বিয়ে করার জন্য সে প্রস্তুত। প্রিয়র জন্য কোনো কিছুই আটকে থাকছে না ওর। সবাই ওকে দেখে অবাক হয়। কারও সামনে দুফোঁটা চোখের জল ফেলতে ওর আত্মসম্মান বাধা দেয়। তাই সারা পৃথিবীর কাছে ও এক কঠিন হৃদয়ের মানবী। কিন্তু আজও আয়নার সামনে দাঁড়ালে সে দেখতে পায় পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে প্রিয়। হয়তো এক্ষুনি কোমরটা জড়িয়ে ধরবে। কিংবা মুখ ডোবাবে চুলে। আজও রিকশায় বসলে মনে হয় পাশে আছে প্রিয়, শক্ত করে ধরে রেখেছে ওকে। আজও বৃষ্টি নামলে মনে হয় প্রিয় আছে, ছাতাটা হয়তো ও-ই ধরবে। আজও অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে মনে হয় প্রিয় আছে। পাশ ফিরে এক্ষুনি হয়তো বুকে টেনে নেবে। কিন্তু এসবের কোনোটাই হয় না। এখন প্রিয় আছে শুধুই স্মৃতিতে, কল্পনাতে। কেউ জানে না, তবে একলা রাতে ওরও বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে ও কাটিয়ে দেয় অজস্র গভীর কালো রাত। কেউ না জানলেও ওর চোখেও জল গড়ায়।
.
কয়েক মাস পর একদিন বিকেলবেলা প্রিয়কে বাসায় ফিরতে দেখে নিকিতা অবাক হলো। কারণ, এই সময় প্রিয় কখনো বাসায় ফেরে না। শুদ্ধকে নিয়ে শুয়ে ছিল নিকিতা। প্রিয় ঘরে ঢুকেই বলল, তোমার ফোন কোথায়? ১০০টা কল দিয়েছি।
নিকিতা বলল, ‘কী জানি, রান্নাঘরে বা ডাইনিংয়ে বোধ হয়। আসলে তুমি তো কখনো ফোন করো না। তাই…কিন্তু কী হয়েছে, এতবার কল করেছ কেন?
ততক্ষণে প্রিয় শুদ্ধকে ঘুম থেকে উঠাল। অতি দ্রুত বলল, ‘শুদ্ধ, তাড়াতাড়ি একটা টি-শার্ট পরে নে।’
‘কেন বাবা, আমরা কি কোথাও যাচ্ছি?
‘হ্যাঁ।
‘কোথায়?
ততক্ষণে প্রিয় তাড়াহুড়া করে একটা টি-শার্ট নিয়ে এল। পরাতে পরাতে বলল, ‘উফ শুদ্ধ, সব সময় এত প্রশ্ন করতে হয় না। চল টি-শার্ট পর।
‘কোথায় যাচ্ছি, বললে কী হয়, বাবা? আমি তো বেশি কথা বলছি। শুধু একটা কথাই জানতে চাইছি।
‘আমরা নানুবাড়ি যাচ্ছি।’
‘সত্যি?
চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক বয়ে যাচ্ছে শুদ্ধর। কিন্তু প্রিয়কে দেখে কেন যেন নিকিতার মনে হচ্ছিল খারাপ কিছু। তাই কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না। প্রিয় ও শুদ্ধ গাড়িতে উঠতেই নিকিতা বলল, আমিও যাব।’
প্রিয় বলল, ‘দরকার নেই। শুনলে তো পেট্রার বাসায় যাচ্ছি।’
শুদ্ধ বলল, ‘চলো না বাবা-মাকেও নিয়ে যাই।
কথা বাড়ানোর মতো সময় নেই, তাই প্রিয় বলল, ‘আচ্ছা চলো।’
নিকিতাও গাড়িতে উঠে বসল। প্রিয় যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি চালাচ্ছে, কিন্তু পথ যেন শেষ হচ্ছে না।
২২
খবর পাওয়ামাত্রই প্রিয় এসেছিল। কিন্তু লাশ দেখতে পারে নি। শিখা গতকাল রাতে স্ট্রোক করে মারা গেছেন। এর আগেও স্ট্রোক হয়েছিল। সুস্থ মানুষটা হঠাৎ করে চলে গেলেন। পেট্রার বিয়ের খুব চেষ্টা করছিলেন। সম্প্রতি একটা বিয়ে ঠিক হয়েছিল পেট্রার। দিন-তারিখও ঠিক। তারপর হঠাৎ দুদিন আগে বিয়েটা ভেঙে গেল। হয়তো ব্যাপারটায় খুব কষ্ট পেয়ে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি।
তিন ভাইবোন মেঝেতে জড়ো হয়ে বসে খুব কাঁদছে। আত্মীয়স্বজন বেশির ভাগ কবরস্থান থেকেই চলে গেছে। কাছের আত্মীয়রা কেউ কেউ ছিল, তারাই ওদের সামলাচ্ছিল। শুদ্ধ দূর থেকে মাকে কাঁদতে দেখেই দৌড়ে গেল।
‘মা, তুমি কাঁদছ কেন? খালামণি, মামা, তোমরা সবাই কেন কাঁদছ?
শুদ্ধর চোখে পানি এসে গেছে। সে এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। পেট্রা কাঁদতে কাঁদতেই শুদ্ধকে কাছে এনে বসাল! শুদ্ধও কিছু না জেনেই মায়ের কান্না দেখে কাঁদতে শুরু করেছে। প্রিয় নিকিতাকে গাড়িতেই থাকতে বলেছে, নামলেও কারও কাছে পরিচয় দিতে নিষেধ করেছে। আসলে নিকিতাকে আনাই উচিত হয় নি। কিন্তু তখন দুশ্চিন্তায় মাথা কাজ করছিল না। এদিকে পেট্রার আত্মীয়স্বজন প্রিয়কে দেখে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন নিকৃষ্ট কোনো জন্তু দেখছে। তাদের সবার দৃষ্টি যেন একটাই কথা বলছে, ‘তোমার জন্যই আজ এই অবস্থা সবার।’ কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, রাগ -অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে থাকা রায়ান প্রিয়কে দেখামাত্র জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। পাশেই বসা পেট্রা ও প্রিয়াঙ্কা, ওরাও কাঁদছে।
রায়ান কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘প্রিয়দা, মা চলে গেল। কী হবে আমাদের?
সান্তনা দেওয়ার ভাষা জানা নেই প্রিয়র। তবু কোনোরকমে বলল, ‘শান্ত হ ভাই। বোনদের তোরই তো দেখতে হবে। কান্নাকাটি করলে মা ফিরে আসবে না। দোয়া কর মায়ের জন্য।
এবার প্রিয় এক হাতে রায়ানকে জড়িয়ে ধরেই অন্য হাতে পেট্রার হাতে হাত রাখল। পেট্রা প্রিয়র দিকে অসহায়ভাবে তাকাল। পেট্রাকে এভাবে কাঁদতে দেখে নি সে কখনো। পেট্রার কান্না দেখে তার নিজেরই কান্না পাচ্ছিল। কী বলবে বুঝতে পারছিল না। শুদ্ধ বলল, ‘বাবা, মাকে কাঁদতে মানা করো প্লিজ, কিছু বলো, বাবা।’
পেট্রা হঠাৎ প্রিয়র গলা জড়িয়ে ধরল। এতক্ষণ সে চুপচাপ কাঁদছিল। এবার চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। তাকে এভাবে কাঁদতে দেখে রায়ানের কান্নাটা একটু কমে এল। সরে গিয়ে শুদ্ধকে কোলে নিল। সে জানে এই সময় প্রিয়দাকেই তার দিদির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ওদিকে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। অনেকেই প্রিয়কে চিনত। অনেকে আজ চিনল। প্রত্যেকে প্রিয়কে এখন আসামির চোখে দেখছে। পেট্রার চাচা কিছু বলতে চাচ্ছিল। প্রিয়াঙ্কা ও প্রিয়াঙ্কার স্বামী তাকে থামিয়ে অন্য ঘরে নিয়ে গেছে।
ওদিকে নিকিতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে। কেউ তাকে জিজ্ঞেস করছে না সে কার সঙ্গে এসেছে বা কেন এসেছে। মরা বাড়ি বোধ হয় এমনই। তার কী করা উচিত, ঠিক বুঝতে পারছে না। সে কি গাড়িতে গিয়ে বসবে, নাকি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে?
কিন্তু সবচেয়ে বেশি অবাক হচ্ছে স্মরণ। প্রিয়কে যেভাবে জড়িয়ে ধরে পেট্রা কাঁদছে, তাতেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে সব। উনিই তাহলে পেট্রার প্রাক্তন স্বামী! কিন্তু তাহলে প্রিয়কে যার সাথে দেখেছিল, সেই মেয়েটা কে? প্রিয় কি আবার বিয়ে করেছে? যে স্বামী তার ভালোবাসাকে ভুলে আবার বিয়ে করতে পারে, তার জন্য পেট্রা মনের মধ্যে এত ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছে। শালার এই রকম মানুষগুলার জন্যই মেয়ে জাতির যত ভালোবাসা হঠাৎই নিকিতার দিকে চোখ পড়ল স্মরণের। আরে বউকে নিয়ে এসেছে দেখা যাচ্ছে। কেউ প্রাক্তন শ্বশুরবাড়িতে বর্তমান বউ নিয়ে আসে নাকি? অদ্ভুত ব্যাপার! সব মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে পেট্রাকে একটা সান্ত্বনাবাক্যও দিতে পারল না প্রিয়। বুকের ভেতর শক্ত করে ধরে রেখেছে শুধু। পেট্রা পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদছে। প্রিয় যদিও পেট্রার মতো চিৎকার করছে না, তবে কাঁদছে। শুদ্ধ মামার কোলে বসে অসহায় চোখে মা-বাবার কান্নাকাটি দেখছে।
২৩
সেদিনের কথা খুব মনে পড়ছে আজ প্রিয়র। যেদিন ডজনখানেক প্রতিজ্ঞা করে পেট্রাকে প্রপোজ করেছিল। তার জন্য মেয়েটার জীবন থেকে সব চলে গেল। মানসম্মান, বাবা-মা, সন্তান–সব হারিয়ে আজ পেট্রা নিঃস্ব। ছোট-ভাইয়ের দায়িত্ব ছাড়া আর কিছুই রইল না মেয়েটার জীবনে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই হোক, এসবের জন্য দায়ী তো প্রিয়ই। কীভাবে সে পেট্রাকে এই ক্ষতিপূরণ দেবে? যদি নিজের বাবাকে খুন করে, তাহলে কি ক্ষতিপূরণ হবে কিছুটা? মানুষ খুন করা মহাপাপ। কিন্তু একজন খুনিকে খুন করা নিশ্চয়ই মহাপাপ হবে না?
নিকিতার ঘুম আসছে না। কারণ, প্রিয় বারান্দায় বসে নীরবে কাঁদছে। প্রথমে সে বুঝতে পারে নি। গিয়ে শুতে ডেকেছিল, প্রিয় ধমক দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে তাকে। তখনই খেয়াল করেছে, প্রিয়র চোখে পানি। প্রিয় ও পেট্রার জড়িয়ে ধরে কান্নার দৃশ্য এখনো নিকিতার চোখে ভাসছে। সমস্ত শরীরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। পেট্রার না হয় মা মারা গেছে, তাই মাথা ঠিক নেই। আর তা ছাড়া পেট্রা নিকিতাকে দেখেও নি। কিন্তু প্রিয় তো জানে যে নিকিতা আছে এখানে। তার সামনেই এই সিনটা না করলে কি হতো না? অবশ্য প্রিয় তো তাকে স্ত্রী বলে মানেই না। সে সামনে থাকলেও প্রিয়র কোনো কিছু আটকে থাকার কথা নয়। জানালা দিয়ে প্রিয়র দিকে তাকাল নিকিতা। প্রিয় এখনো চুপচাপ বসে আছে, হয়তো কাঁদছে। প্রিয়র এই কান্না নিকিতার মনে একবার মায়া সৃষ্টি করছে, পরক্ষণেই প্রচণ্ড ক্ষোভ। অসহ্য লাগছে সবকিছু। এত দিন হয়ে গেল পেট্রা নেই প্রিয়র জীবনে, তবু প্রিয় এখনো পেট্রার ঘোর থেকে বের হতে পারে নি। তাহলে নিকিতা এত কিছু কার জন্য করছে? কিসের আশায় করছে? ভালো হয়ে থেকে যখন কোনো লাভ নেই, তখন সে কেন ভালো হয়ে থাকবে? ভালোবাসা পাওয়ার চেষ্টা করেছে এত দিন, এখন থেকে স্ত্রীর অধিকার আদায় করার চেষ্টা করবে। নিজের জীবনের তিনটা বছর নষ্ট করে এখন হাল ছেড়ে দেবে? কক্ষনো না। হয় মরবে, নাহয় প্রিয়র সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে সংসার করবে। কিছু তো একটা করতেই হবে। অনেক শক্তিশালী একটা অস্ত্র আছে তার কাছে, সেটাতে তো এখনো হাতই দেওয়া হয় নি।
.
অফিস থেকে ফিরে প্রিয়র শরীরটা খারাপ লাগছিল। তাই জিমে গেল না। শরীরের থেকে আসলে মনটাই বেশি খারাপ। কদিন ধরে ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতেই হালকা ঘুম এল এবং প্রিয় কখন ঘুমিয়ে পড়ল, টেরও পেল না। তারপর যখন ঘুম ভাঙল, তখন রাত গভীর। নিজেকে আবিষ্কার করল নিকিতার বুকে। প্রিয় লাফিয়ে উঠে সরে গেল। ছি ছি, সে নিকিতাকে জড়িয়ে ধরল কখন? নাকি নিকিতাই তাকে ধরেছে? উফ, কী করবে এই মেয়েকে নিয়ে। তারপর খেয়াল হলো, শুদ্ধ বিছানায় নেই। আরে, শুদ্ধ কোথায় গেল? ঘর থেকে বের হয়ে খুঁজতে লাগল। ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখল কাজের মেয়ে এত রাতে বসে বসে টিভি দেখছে। প্রিয় জিজ্ঞেস করল, ‘শুদ্ধকে দেখেছ?
‘জি ভাইজান, বাবু আজকে খালুজানের লগে ঘুম দিছে। খালুজান কিসসা হুনাইতাছিল, হুনতে হুনতে বাবু ঘুমাই গ্যাছেগা।’
প্রিয় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল, ‘এত রাতে টিভি দেখছ যে? ঘুম নাই?
‘ভাইজান, খুব ভালা একটা ছবি দেহাইতাছে। শ্যাষ হইলেই ঘুম দিমু।
প্রিয় নিজের ঘরে ফিরে এল। নিকিতা ঘুমাচ্ছে। শাড়ি হাঁটু পর্যন্ত উঠে আছে। যে শাড়ি সামলাতে পারবে না, সে শাড়ি পরবে কেন? এইসব দৃশ্য শুদ্ধ দেখলে কী হবে? যত্তসব!
রাত বাড়ছে। ঘুমটা কেটে গেছে প্রিয়র, আর বোধ হয় আসবে না। বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরাল। পরপর দুটো সিগারেট শেষ করে ঘরে ঢুকল সে। ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ারে চাবি ঘোরাল। ওপরের ড্রয়ারটা খুলেই হতভম্ব হয়ে গেল। ড্রয়ার ফাঁকা। পেট্রার দেওয়া ব্যক্তিগত সব জিনিসপত্র এবং তাদের দুজনের স্মৃতিবিজড়িত কত কিছু ছিল এখানে। দ্বিতীয় ড্রয়ার খুলে দেখল সেটাও ফাঁকা। এরপর প্রতিটা ড্রয়ার খুলল। সব ফাঁকা, কিছু নেই। কিন্তু চাবি তত আর কারও কাছেই নেই! প্রিয়র সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। সে নিকিতার চুল খামচে ধরতে যাবে, তখনই মনে পড়ল, এর আগে সে নিকিতার ওপর অত্যাচার করেছিল, পরে বুঝেছিল ভুল হয়েছে। তাই এবার স্বাভাবিকভাবে ডেকে তুলল।
নিকিতা ঘুম থেকে উঠে বলল, ‘কী হয়েছে?
প্রিয় খুব স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘আমার ঘরে কে এসেছিল? ওয়ার্ডরোবের জিনিসপত্র কে সরিয়েছে?
নিকিতা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। ভয় করছে তার, কিন্তু ভয়টা সে প্রকাশ করতে চায় না। চুপি চুপি বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ‘আমি সরিয়েছি। আমার ঘরে আমি অন্য মেয়ের জিনিসপত্র সহ্য করব না আর। অনেক হয়েছে।
প্রিয় স্তব্ধ হয়ে গেল। কী বলছে নিকিতা! রাগে ইচ্ছা করল এই মুহূর্তে নিকিতাকে খুন করবে সে। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল। কারণ, চিঠি
ও জিনিসগুলো আগে উদ্ধার করতে হবে। স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘কোথায় রেখেছ?
‘চিঠিগুলো বাগানে নিয়ে আগাছার সাথে পুড়িয়ে ফেলেছি। বাকি জিনিসগুলো ফেলে দিয়েছি। ওগুলো এখন কোনো ডাস্টবিনে।
এবার প্রিয় তার ভয়ংকর রূপে চলে গেল। নিকিতাকে বিছানার ওপর ফেলে গলা টিপে ধরল। তারপর বলল, ‘এত সাহস হয় কী করে তোমার? জানের মায়া নেই?
নিকিতার মনে হচ্ছিল এক্ষুনি সে মরে যাবে। সে জানত এমন হবে। এমন কিছুর জন্য মনে মনে প্রস্তুত ছিল। সে মরার জন্য এসব করে নি। সব পরিকল্পনা করেই মাঠে নেমেছে। পরিকল্পনামাফিক প্রিয়র হাতে শরীরের সব শক্তি দিয়ে খামচি দিল। হাত একটু আলগা হতেই কামড় দেওয়ার চিন্তাও আছে। কিন্তু প্রিয় একটুও হাত আলগা করল না। বরং আরও জোরে গলা টিপে ধরল। নিকিতা এবার লজ্জা-সংকোচ বিসর্জন দিয়ে নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য প্রিয়র ট্রাউজার ধরে টান দিয়ে খুলে ফেলতে চাইল। অর্ধেকটা খুলতেই প্রিয় ভ্যাবাচেকা খেয়ে নিকিতাকে ছেড়ে দিল। নিকিতা উঠে কাশতে কাশতে দৌড়ে গিয়ে পানি খেলো। ততক্ষণে প্রিয় নিজের ট্রাউজার ঠিক করে বলল, ‘তোমার মতো নির্লজ্জ মেয়ের দিকে তাকাতেও আমার ঘৃণা হয়, ছি!’
নিকিতা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি তোমার মোবাইল-ল্যাপটপ থেকেও পেট্রার এবং তোমাদের সব কাপল ছবি ডিলিট করে দিয়েছি। এগুলার জন্যই তুমি পেট্রার ভালোবাসা থেকে বের হতে পারো না।
প্রিয় সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল-ল্যাপটপ চেক করল। নেই, কিছু নেই। এমনকি পেট্রার পাঠানো অনেক আগের মেসেজগুলোও নেই!
.
প্রিয় মোবাইল-ল্যাপটপে কিছু না পেয়ে রাগে ফেটে পড়ছিল। ওদিকে নিকিতাও রাগে ফোঁস ফোঁস করছিল। নিকিতার ড্যামকেয়ার ভাব দেখে প্রিয় নিকিতাকে ধরে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বলল, ‘যাও, জাহান্নামে যাও। জীবন ভিক্ষা দিলাম। এই জীবনে আর কখনো আমার চোখের সামনে আসবা না। যদি আর কখনো আমার চোখের ত্রিসীমানায় দেখি, তোমার বুকটা ফেঁড়ে কলিজাটা বের করে টুকরো টুকরো করব আমি।’
নিকিতাকে বের করে দিয়ে যখন প্রিয় ফিরছিল, তখন নিকিতা বলল, ‘যদি তুমি আমাকে বের করে দাও, আমি সবাইকে বলে দেব যে শুদ্ধ তোমাদের ছেলে না। ও তোমাদের পালক ছেলে। সবার আগে বলব শুদ্ধকে। আমার কাছে প্রমাণস্বরূপ পেট্রার চিঠি আছে।
প্রিয় এ কথা শুনে অবাক হয়ে পেছনে তাকাল। কোথা থেকে নিকিতা এত সাহস পাচ্ছিল, এবার বুঝতে পারল প্রিয়! কিছু বলতে পারল না, চুপ করে রইল।
প্রিয়র মুখ দেখে নিকিতাই অবাক হয়ে গেল। প্রিয় এতটা ভয় পাবে, তা সে ভাবতেও পারে নি। একদম জেঁকের মুখে নুন পড়েছে। নিকিতার সাহস এবার আরও বেড়ে গেল। বলল, আমি তোমার চোখের সামনেই থাকব, তোমার ঘরে, তোমারই বিছানায়! তুমি শুদ্ধকে আলাদা ঘরে পাঠাবে। আমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে। নাহলে সব ফাঁস করে দেব।
প্রিয়র চোখের সামনে দিয়ে নিকিতা ঘরে ঢুকে গেল। প্রিয় ঘরে না ঢুকে উল্টো ঘুরে বাবর খানের ঘরে গেল। শুদ্ধ দাদার সঙ্গে ঘুমালে দরজা ভেতর থেকে লাগানো হয় না। সাবধানে ছেলেকে কোলে তুলে নিল প্রিয়। সে ঘুমে বেহুঁশ। তারপর প্রিয় নিজের ঘরে ঢুকল। শুদ্ধকে কোলে নিয়েই গাড়ির চাবি, মোবাইল, মানিব্যাগ ও ল্যাপটপের ব্যাগটা নিল। নিকিতা অবাক হয়ে গেল। বলল, ‘কোথায় যাচ্ছ তুমি?
প্রিয় নিকিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পুরোটা জানো না নিকিতা। শুদ্ধ ভাইজানের ছেলে। যদিও সে এই বাড়ির ভবিষ্যৎ মালিক, এই বংশের একমাত্র বংশধর। তবু এই বাড়িতে সে নিরাপদ নয়, আজ বুঝতে পারছি। তাই তাকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি। থাকো তুমি আমার ঘরে, আমার বিছানায়।
প্রিয় দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। শুদ্ধ ভাইজানের ছেলে জেনে নিকিতা অবাক হওয়ারও সুযোগ পেল না। কারণ, এখন অবাক হওয়ার সময় নেই। প্রিয়কে আটকাতে হবে। নিকিতা দৌড়ে প্রিয়কে ধরার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। কারণ, প্রিয় বাইরে দিয়ে দরজা আটকে রেখে গেল। নিকিতা বের হতে না পেরে বাবর খানকে ফোন করল। রাত বাজে আড়াইটা। তিনি ফোন ধরলেন না। সম্ভবত তিনি ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমান। নিকিতা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
২৪
ঘুম থেকে উঠে নিকিতার মিসড কল দেখে কলব্যাক করলেন। নিকিতা সারা রাত ঘুমাতে পারে নি। শ্বশুরের ফোন পেয়ে আবারও কেঁদে ফেলল সে। বলল, ‘বাবা, আমার ঘরের দরজাটা বাইরে থেকে লাগানো। একটু খুলে দিন প্লিজ।’ বাবর খান বুঝতে পারলেন কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। ফোনে কথা না বাড়িয়ে তিনি গিয়ে নিকিতার ঘরের দরজা খুলে দিলেন। অবশ্য সকাল সকাল এমন কান্নাকাটি দেখে তিনি কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন, কী ব্যাপার? কী হয়েছে? এভাবে কাঁদছ কেন?
‘বাবা, আপনার ছেলে কোথায় যেন চলে গেছে। ওর ফোনটাও বন্ধ পাচ্ছি।’
‘কোথায় আর যাবে? অফিস করে চলে আসবে দেখো।
‘বাবা, ও শুদ্ধকে সাথে নিয়ে গেছে।
এবার চমকে উঠলেন বাবর খান। খেয়াল করলেন শুদ্ধ তার বিছানায় ছিল না। তিনি উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইলেন, হুট করে চলে গেল? তোমার সাথে রাগারাগি হয়েছিল?
নিকিতা মাথা নিচু করে বলল, হ্যাঁ, বাবা। রাগ করেই তো চলে গেল। ও-ই তো আমাকে আটকে রেখে গেছে।
নিকিতা বুঝতে পারছে না শ্বশুরের মনোভাব।
বাবর খান কবিরকে ফোন করলেন। কবিরকে প্রায় গত পাঁচ বছর আগে গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন তিনি। উল্টোপাশের বাসায় তাকে একটা ফ্ল্যাটও দিয়েছেন থাকার জন্য, যাতে সারাক্ষণই প্রিয়র ওপর নজর রাখা সম্ভব হয়। এই পাঁচ বছরে প্রিয়কে ফলো করে সব খবরাখবর বাবর খানকে দিয়েছে সে। কবির ঘুমিয়ে ছিল। মন্ত্রী সাহেবের ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি করে উঠল। ফোন ধরতেই বাবর খান জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবির, প্রিয় কোথায়?
‘ঘুমুচ্ছে স্যার।
‘তাহলে শুদ্ধ কোথায়?
‘সেও হয়তো ঘুমুচ্ছে স্যার। তবে আজ প্রিয় স্যারের ঘরে ঘুমোন নি। তিনি। কেন স্যার কী হয়েছে?
‘তোমার এত বড় সাহস, তুমি আমাকে প্রশ্ন করছ? তোমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রিয়র ওপর দিনরাত নজর রাখার জন্য।
‘মাফ করবেন, স্যার। আমি তো তা-ই করছি, স্যার। কোনো ভুল হয়েছে আমার?
‘কালকে রাতে প্রিয় শুদ্ধকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। আর তুমি বলছ সে ঘুমুচ্ছে? এ রকম আন্দাজে কথা বলার সাহস হয় কী করে তোমার? মাস গেলে তো মোটা অঙ্কের টাকাটা নাও, কাজটা ঠিকভাবে করছ না কেন?’
‘সরি স্যার। আমি তো ঠিকই নজর রেখেছি। প্রিয় স্যার তো সন্ধ্যাবেলা বাসায় ঢুকেছে। ওনার গাড়িটা তো এখনো গ্যারেজে।
‘তাহলে গাড়ি নিয়ে যায় নি।
‘কিন্তু স্যার, কখন গেল, আমি তো সারাক্ষণই নজর রাখছি।
‘খবরদার, আমাকে প্রশ্ন করবে না। এক্ষুনি প্রিয়কে খুঁজে বের করো। গাড়ি যখন নেয় নি খুব বেশিদূর যেতে পারে নি। প্রিয়কে খুঁজে বের করতে না পারলে তোমার লাশও কেউ খুঁজে পাবে না।
‘প্রথমে আন্দাজে ঘুমুচ্ছে বলেছি বলে মাফ করবেন, স্যার। আসলে প্রিয় স্যার তো অনেক দিন ধরেই পেট্রার সাথে দেখা করে না। স্বাভাবিক আছে, তাই আমি ভেবেছি বুঝি সব ঠিকই আছে। আমি এক্ষুনি সব খবর আপনাকে দিচ্ছি, স্যার। আপনি চিন্তা করবেন না।’
‘আমার মাথা গরম কোরো না, কবির। এক্ষুনি কাজে নামো।
‘জি স্যার।
ফোন রেখেই বাবর খান নিকিতার দিকে বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী নিয়ে রাগারাগি হয়েছিল তোমাদের?
নিকিতা মাথা নিচু করে বলল, আসলে আমি একটা ভুল করেছিলাম, বাবা। তাতেই ও রেগে যায়।’
‘কী করেছিলে, সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।
নিকিতা মাথা নিচু করে সব বলে দিল। বলতে বলতে কাঁদছিল। শ্বশুরের দিকে তাকাতে লজ্জা, ভয় দুটোই লাগছিল। সব শুনে বাবর খান হুংকার দিয়ে উঠলেন, ‘তোমার মাথায় কি ঘিলু নেই? এটা কেন করতে গেলে? তুমি জানো তুমি কী করেছ? তোমার বাবার ধৈর্যশীলতায় মুগ্ধ হয়ে তোমাকে বউ বানিয়ে এনেছিলাম। ভেবেছিলাম তুমি তোমার বাবার মতোই হবে। তা না হলে তোমাদের মতো ঘরে আমার ছেলের বিয়ে কখনোই করাতাম না। অথচ এখন দেখছি তুমি সম্পূর্ণ উল্টো, গর্দভ মহিলা! দেখছ তো আমি সবটা হ্যাঁন্ডেল করছি। এর মধ্যে তোমার এই গাধামিটা না করলে হতো না? তোমাকে এক শ বার বলেছি, প্রিয়-পেট্রার কোনো যোগাযোগ নেই, তাহলে তোমার এত জ্বলছে কেন?
নিকিতা আর কিছু বলার সাহস পেল না। বাবর খান আবার বললেন, ‘পেট্রার মা মারা যাওয়ার পর প্রিয় গিয়েছিল, তা নিয়েই কি তোমার এত ক্ষোভ?
নিকিতা চুপ করে রইল। উনি বললেন, ‘শত্রু মারা গেলেও সেখানে যেতে হয়। আর প্রিয়র প্রাক্তন স্ত্রীর মা মারা গেছে, ও যাবে না? সে তো সেখানে প্রেম করতে যায় নি! বোকামি কমাও, না হলে তুমিও ডুববে, আমাকেও ডোবাবে। প্রিয় অন্যসব ছেলেদের মতো না। চরম ঘাড়ত্যাড়া সে। যাও চোখের সামনে থেকে দূর হও।’
কবির কিছুই করতে পারছে না। প্রিয়র মোবাইল বন্ধ। তাকে ট্রেস করা সম্ভব হচ্ছে না। টেনশনে আছেন বাবর খান। অনেক চিন্তাভাবনার পর পেট্রাকে ফোন করলেন তিনি। পেট্রা তার নম্বর দেখে একটু অবাক হলো। এই নম্বর তিনি কোথায় পেলেন? অবশ্য তাঁর মতো মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব।
সব শুনে পেট্রা বলল, ‘আঙ্কেল, আমি সত্যি বলছি, আমি কিছু জানি না। আপনার ছেলের ওপর সব দাবি তো ছেড়েই দিয়েছি। আমি যে তার কোনো খোঁজখবর রাখি না, এটা আপনার জানার কথা।
‘আমি জানি, পেট্রা। তবু যেহেতু শুদ্ধকে নিয়ে গেছে, তাই তোমার সাথে যোগাযোগ করতেও পারে। সে জন্যই জিজ্ঞেস করা।
‘করে নি। যদি করে, আমি আপনাকে জানাব।’
‘দেখো, কোনো কিছুই তো গোপন থাকবে না। তাই পরে যদি জানতে পারি তোমার সাথে যোগাযোগ করেছে, তার ফল কিন্তু কারও জন্যই ভালো হবে না।’
‘জি আঙ্কেল, আপনার আর কোনো থ্রেট থাকলে তাড়াতাড়ি দিয়ে শেষ করুন, প্লিজ। আমি অফিসে কাজ করছি।
বাবর খান আর কিছু বললেন না। মেজাজ খারাপ করে ফোন রেখে দিলেন। ওদিকে পেট্রা প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। প্রিয় কোথায় গেল ছেলেটাকে নিয়ে? আর কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারল না সে।
.
শুদ্ধ ঘুম থেকে উঠে দেখল, সে খুব বড় এবং সুন্দর একটা ঘরে শুয়ে আছে। পাশে বাবা ঘুমাচ্ছে। নিঃশব্দে এসি চলছে। শুদ্ধ চারপাশে সবকিছু দেখতে লাগল। ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো। বেড, বেড কভার, কম্বল, বালিশ, আলমারি, সোফা, পর্দা–সব সাদা রঙের। তার মনে পড়ল কাল রাতে সে দাদার সঙ্গে ঘুমিয়েছিল। এখানে কী করে এল? এটা কাদের বাসা? যাদের বাসাই হোক, বাবা যখন সঙ্গে আছে, চিন্তা নেই। শুদ্ধ বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে গেল। বাথরুমটা দেখে সে খুব অবাক হলো। তার ধারণা ছিল, তাদের ঘরের বাথরুমটাই সবচেয়ে সুন্দর। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত করেছে এই বাথরুমটা। এটা ওদেরটার চেয়েও সুন্দর। বেসিনের ওপর দেখতে পেল দুটো নতুন ব্রাশ, নতুন টুথপেস্ট। দাঁত ব্রাশ করে বাইরে এসে পর্দা সরিয়ে দিতেই শুদ্ধ অবাক হয়ে দেখল পুরো দেয়ালটা কাঁচের, সামনেই সমুদ্র। বড় বড় ঢেউ আসছে একটু পরপর। খুশিতে মনটা নেচে উঠল। তার মানে এটা কোনো বাসা না, এটা হোটেল। তারা কি কক্সবাজারে? দেখে তো কক্সবাজারই মনে হচ্ছে।
শুদ্ধ দৌড়ে বাবার কাছে গেল। দুবার ডাকল, সে উঠল না। বাবা বোধ হয় অনেক দেরি করে ঘুমিয়েছে। তা না হলে এক ডাকেই উঠে যেত। অবশ্য গায়ে হাত দিয়ে ডাকলে উঠবে। দরকার নেই। বাবা একটু ঘুমাক। কিন্তু খিদে পেয়েছে যে! ইন্টারকমের কাছে গিয়ে দেখল ওখানে রুম সার্ভিসের একটা চার্ট আছে। সেখানে রেস্টুরেন্টের নম্বরও আছে। ফোন করে কিছু অর্ডার করতেই পারে। কিন্তু সে তো নিজেদের রুম নম্বরই জানে না। সব হোটেলের দরজার বাইরেই রুম নম্বর থাকে, দেখে এলেই তো হয়। কিন্তু শুদ্ধ কেন জানি দরজাটা খুলতে পারল না। ফিরে এল আবার। ঘুরে ঘুরে এদিক-ওদিক দেখতে লাগল বাবা কোনো খাবার কিনেছে কি না! খাবার না পেলেও মিনি ফ্রিজটা চোখে পড়ল। ফ্রিজটা খুলল, কিছু নেই। একদম ফাঁকা। তারপর অন্যদিকে তাকাতেই দরজা খোলার পাঞ্চ কার্ড দেখতে পেল। এবার বুঝল কেন দরজাটা খুলতে পারে নি। কার্ডে রুম নম্বর দেখতে পেয়ে ফোন করে খাবার অর্ডার করে খেলো।
দুপুর নাগাদ প্রিয়র ঘুম ভাঙল। চোখ মেলে দেখল শুদ্ধ কাঁচের দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখছে। বিছানা থেকে নামতেই এঁটো প্লেট দেখতে পেল। সোজা গিয়ে শুদ্ধকে কোলে নিয়ে বলল, ‘কী রে বাপ আমার, খাবার পেলি কোথায়?
শুদ্ধ একগাল হেসে বলল, ‘রুম সার্ভিসে ফোন করে অর্ডার করেছি।’
‘বাহ! আমার ছেলে দেখছি অনেক স্মার্ট!
হুম, তোমার ছেলে না আমি? মা বলত বাপ কা বেটা, সিপাহি কা ঘোড়া, মনে নেই?
‘খুব আছে। মায়ের বলা কোনো কথাই বাবা ভোলে না।
‘ছেলেও ভোলে না।
প্রিয় হাসল। শুদ্ধও হেসে বলল, ‘আচ্ছা বাবা, আমরা কক্সবাজার কেন এসেছি?
প্রিয় শুদ্ধর মুখটা ধরে গালে ঠোঁট চেপে ধরে চুমু দিয়ে বলল, ‘ঘুরতে।
‘কই, কালকে তো বললে না?
‘সারপ্রাইজ!
‘কিন্তু বাবা, আমার স্কুল?
‘স্কুলে যাওয়া লাগবে না কয় দিন। মাস্তি কর।
‘পরে যেদিন স্কুল যাব, অনেক বকা খাব, বাবা।
‘ওটা আমি ম্যানেজ করব।’
শুদ্ধ বাবার গলা জড়িয়ে ধরল, ‘আমার বাবা পৃথিবীর সেরা বাবা।
‘হয়েছে হয়েছে, বেশি পটাস না।
শুদ্ধ হেসে বলল, আচ্ছা বাবা, নিকিতা মাকে কেন আনি নি আমরা?
‘No women! It’s a men’s tour.’
‘ওয়াও! অনেক মজা হবে বাবা।
২৫
পেট্রা প্রিয়র সবগুলো গোপন নম্বরে ফোন করেছে, সব বন্ধ। অফিসে ফোন করে জানল সে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। সব বন্ধুবান্ধবের কাছেও খোঁজ নিয়েছে। কেউ কিছু জানে না। অদ্ভুত মানুষ একটা। যেহেতু ছেলেটা সাথে আছে, সেহেতু যেখানেই যাক, তাকে তো বলে যাওয়া উচিত ছিল। নানা রকম দুশ্চিন্তা মনে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। ওরা যেখানেই থাকুক, যেন ভালো থাকে।
.
মোবাইল ও ল্যাপটপে পেট্রার যত ছবি ও কল রেকর্ডিং ছিল, সবকিছুর ব্যাকআপ ছিল। প্রিয় সব রিকভার করে নিল। আফসোস লাগছে, চিঠি এবং ওর সাথে কাটানো মুহূর্তের অসংখ্য স্মৃতিবিজড়িত জিনিসগুলোর জন্য।
প্রিয় শুদ্ধকে নিয়ে কক্সবাজার সিটিতে গিয়ে দুজনের জন্য কিছু কাপড়চোপড় কিনে আনল। প্রতিদিন বাবা-ছেলে মিলে সমুদ্রে গোসল করে, ইচ্ছেমতো ডাব খায়, সন্ধ্যা হলেই কাঁকড়া আর গলদা চিংড়ি খেতে যায়, অনেক রাত পর্যন্ত বার্মিজ মার্কেটে ঘোরে। এভাবে ওদের দিন ভালোই কাটছিল। খুব খুশি শুদ্ধ। প্রিয়র মনে হলো নানান ঝামেলায় শুদ্ধকে নিয়ে অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয় নি কিন্তু যাওয়া উচিত ছিল। এটুকুতেই ছেলেটা এত খুশি!
ঢাকা থেকে আসার সময় ৫০ হাজার টাকা তুলে এনেছিল প্রিয়। একদিন লাঞ্চ করে রেস্টুরেন্টে বিল দিতে গিয়ে সে আবিষ্কার করল টাকা প্রায় শেষ। হোটেলে আজকের বিল দেওয়া হয় নি। তাই এটিএম বুথ থেকে কিছু টাকা তুলল। টাকা তুলে হোটেলের উদ্দেশে রিকশা নিতেই খেয়াল হলো একটা বড় রকমের ভুল করে ফেলেছে। বাবর খান তার ক্ষমতার বলে বের করে ফেলবে কোন বুথ থেকে টাকা তোলা হয়েছে। কক্সবাজারে আছে জানলে ওদের বের করা তার দুই মিনিটের কাজ। তা তিনি যেখানেই থাকুক না কেন।
রিকশা ঘুরিয়ে ব্যাংকে গেল প্রিয়। আরও ৫০ হাজার টাকা তুলল। আজই কক্সবাজার ছাড়তে হবে। সে জানে তার বাবার হাত ও মাথা দুটোই তার থেকে বেশি লম্বা। যাতে বিয়ে না করতে হয়, সে জন্য একবার সে দেশের বাইরে চলে যেতে চেয়েছিল। বাবর খানের জন্য ভিসা পেল না। পরেরবার জাল পাসপোর্ট বানিয়ে যেতে চাইল। এয়ারপোের্ট থেকে বাবর খানের লোকজন ধরে আনল। তাই এবার আর সেই ভুল করবে না। দেশেই থাকবে। ধরা তো পড়তেই হবে, তবে এবার বাবাকে ভালো করে ঘোল খাইয়ে ছাড়বে।
রেন্ট-এ-কার থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করল প্রিয়। হোটেলে ফিরে যাবতীয় বিল পরিশোধ করল। তারপর ল্যাপটপ, মোবাইল, কাপড়চোপড় নিতে রুমে গেলে শুদ্ধ জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, এত তাড়াহুড়া করছ কেন? কী হয়েছে?
‘বাপ প্লিজ, কিছুক্ষণ চুপ করে থাক। কক্সবাজার ছেড়ে তোর সব প্রশ্নের উত্তর দেব।
শুদ্ধ বুঝল সিরিয়াস কিছু হয়েছে। সব গুছিয়ে শুদ্ধকে নিয়ে নিচে নামতেই ধাক্কা খেলো প্রিয়। সঙ্গে সঙ্গে বড় একটা পিলারের পেছনে লুকিয়ে পড়ল। রিসেপশনে কয়েকজন লোক ওদের খুঁজছে। কথাবার্তায় সেটাই বোঝা যাচ্ছে। লোকগুলো সরাসরি রুমে যেতে চাচ্ছে। হোটেলের ম্যানেজার তাদের ওয়েটিং রুমে বসতে বলছে। এই নিয়ে তর্কাতর্কি চলছে। বের হতে হলে ওদের সামনে দিয়েই বের হতে হবে। ইশ, কেন সে আবার হোটেলে ফিরতে গেল! নিজের ওপর নিজেরই রাগ লাগছে এখন। হঠাৎই প্রিয়র মাথায় এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার একটা বুদ্ধি এল। আবার ফিরে গেল নিজের রুমে গিয়ে রিসিপশনে কল করে বলল, ‘আমার খোঁজে কেউ এসেছে?
‘জি স্যার। আমি এতক্ষণ ফোন করছিলাম আপনাকে।
‘হ্যাঁ, আসলে আমি ছেলেকে গোসল করাচ্ছিলাম। তাই ফোন ধরতে পারি নি। আপনি ওনাদের রুমে পাঠিয়ে দিন।
‘সরি স্যার, বাইরের গেস্টদের রুমে যাওয়ার অনুমতি নেই। আমি তাদের বলেছি ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে কিন্তু তারা রিসিপশন থেকে নড়ছেনই না। দয়া করে আপনি একটু আসবেন?
‘শিওর। আমি আসছি।’
ফোন রেখে প্রিয় ভাবতে লাগল কী করবে সে এখন। সে ভেবেছিল ওই লোকগুলোকে রুমে পাঠালে, রিসিপশন ফাঁকা হবে এবং সে বেরিয়ে যাবে।
এবার তো পড়ল মহাবিপদে। এত সহজে ধরা পড়ে যাবে? এসব আবোলতাবোল ভাবছিল যখন, তখনই রুম সার্ভিসের লোক এল।
‘স্যার, আপনাকে একটু নিচে যেতে হবে।’
প্রিয় ছেলেটার হাতে দশ হাজার টাকা দিয়ে বলল, ‘যেভাবে হোক, আমাকে হোটেল থেকে বের করে দাও। ভয় পেয়ো না, আমি কোনো অসৎ কাজ করি নি। বাড়ি থেকে পালিয়েছি। তাই বাবা লোক পাঠিয়েছে ধরে নেওয়ার জন্য। তুমি নিচে গিয়ে বলবে আমরা রুমে নেই। ভয় পেয়ো না, তুমি ফাঁসবে না।
বাবার কথা শুনে শুদ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিন্তু কিছু বলল না। রুম সার্ভিসের ছেলেটা বলল, ‘স্যার, পুরো হোটেল সিসি ক্যামেরার আওতায়। আমি অবশ্যই ফেঁসে যাব।’
‘রুমের মধ্যে তো আর সিসি ক্যামেরা নেই। তুমি টাকাটা নাও আর আমাকে বের হওয়ার কোনো রাস্তা বলে দাও।’
ছেলেটা কিছুক্ষণ ভেবে টাকাটা নিল। তারপর বলল, এই রুম থেকে বের হয়ে ডান দিকের একদম শেষপ্রান্তে একটা ইমার্জেন্সি সিঁড়ি আছে। ওটা দিয়ে নামলেই হোটেলের লন পড়বে। ঘোরাঘুরি করছেন, এমন ভাব করে বেরিয়ে যাবেন।
‘থ্যাংকস আ লট।
‘কিন্তু স্যার, আরেকটা সমস্যা রয়ে গেল। এতক্ষণ খেয়াল ছিল না আমার।
‘কী?
‘আমি যে রুমে ঢুকেছি, সেটা তো সিসি ক্যামেরায় রেকর্ড হয়েছে। আপনি বের হবেন, ওটাও রেকর্ড হবে। পরে তো জানাজানি হবেই যে আপনার পালানোর সাথে আমি জড়িত ছিলাম। আমাকে ছেড়ে দিন। স্যার।’
‘ঠিকাছে, আমি তোমাকে বেঁধে রেখে যাই। তাহলে আর কেউ তোমাকে সন্দেহ করবে না।
ছেলেটা অবাক হয়ে বলল, ‘জি স্যার?
নিজের শার্ট দিয়ে প্রিয় ছেলেটার মুখ বাঁধতে বাঁধতে বলল, তোমার কোনো ভয় নেই, আমি হোটেলের সব বিল একটু আগেই শোধ করে এসেছি। হোটেল ক্ষতিগ্রস্ত না হলে ব্যাপারটা নিয়ে অত মাথা ঘামাবে না। তা ছাড়া আমি কোনো উগ্রপন্থী নই। খারাপ লোকও নই। কোনো অন্যায় করেও আসি নি।
হোটেলের বিছানার চাদরটা তুলে সেটা দিয়ে ছেলেটার হাত দুটো জানালার গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে দিল প্রিয়। তারপর ছেলেটার বলা রাস্তা দিয়ে শুদ্ধকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
.
ভাড়ার গাড়িটা দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে। কক্সবাজারের থেকে বেরিয়ে এসেছে অনেকক্ষণ হলো। শুদ্ধ চুপ করে আছে। সে কিছুক্ষণ আগে অল্প সময়ের মধ্যে বাবাকে অনেকগুলো অন্যায় কাজ করতে দেখেছে। অথচ তার বাবাই বলে, কখনো অন্যায় কাজ করবে না। এতকিছু কেন হলো তাকে জানতে হবে। সে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, আমরা বাড়ি থেকে পালিয়েছি এটা আমাকে আগে বললে না কেন?
‘বললে তুই কারণটা জানতে চাইবি আর জানলে কাঁদবি, তাই বলি নি।
বলো, আমি কাঁদব না।’
ছেলেটা হয়তো এসব দেখে তাকে ভুল বুঝছে তাই প্রিয় ভাবল, কষ্ট পেলে পাক। সত্যিটা জানার অধিকার ওর আছে। তাই বলল, ‘নিকিতার ওপর রাগ করে বেরিয়েছি। তোর দাদা আমাদের খুঁজছে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। তাই পালাচ্ছি।’
‘নিকিতা মার ওপর রাগ করেছ কেন বাবা? নিকিতা মা তো ভালো। আমাকে অনেক আদর করে।’
‘তোর মায়ের চিঠিগুলোর কথা মনে আছে তোর?
‘হ্যাঁ, এত্ত এত্ত চিঠি। কী সুন্দর হ্যান্ডরাইটিং!
‘আর ড্রয়ারে রাখা জিনিসগুলো? যেগুলো আমরা দুজন মিলে দেখতাম?
‘হ্যাঁ, সব মনে আছে তো বাবা। মায়ের গন্ধমাখা সব জিনিস।
‘নিকিতা সব পুড়িয়ে দিয়েছে। এখন তুই বল, যেখানে নিকিতা থাকবে সেখানে কি আমাদের থাকা উচিত?
কথা শেষ করে উত্তরের জন্য ছেলের দিকে তাকাল প্রিয়। শুদ্ধ উত্তর দিতে পারল না। সে কাঁদছে।
২৬
পেট্রা অফিস থেকে বের হতে গিয়ে দেখল, লিফটে কোনো সমস্যা হয়েছে। লিফট বন্ধ। নয়তলার উপর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বড় ক্লান্ত লাগছিল। আসলে তার এই ক্লান্তি কি শারীরিক নাকি মানসিক? তার স্বামী এবং ছেলে নিখোঁজ। কোথায় আছে কেমন আছে কেউ জানে না। পরক্ষণেই খেয়াল হলো, ভুল ভাবছে সে। প্রিয় এখন আর তার স্বামী নয়। প্রাক্তন হয়ে গেছে। অনুভূতিগুলো প্রাক্তন হয় না কেন? অবশ্য প্রিয় তার স্বামী থাকুক বা না-থাকুক তাতে খুব একটা কিছু যায় আসে না তার। সে আর প্রিয়কে কখনোই চায় না। তবু কেন এই মায়া থেকে এখনো বের হতে পারে না?
কদিন আগেই মা চলে গেলেন। তিনি দিনরাত ভর্ৎসনা করতেন, কিন্তু বটবৃক্ষ হয়ে তিনিই ছিলেন। আগের মতো মায়ের বুকে পড়ে কাঁদতে না পারলেও বাসায় ফিরে মাকে দেখে শান্তি লাগত। সেই শান্তিটুকু হারিয়ে গেছে। প্রিয়াঙ্কা কিছুদিন ছিল, এখন আবার শ্বশুরবাড়িতে চলে গেছে। ওর বাচ্চা ছোট, একা সামলাতে পারছে না এখানে। রায়ান সারা দিন ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখে নিজেকে। হঠাৎ হঠাই কেঁদে ওঠে। সকালে রান্না করে রেখে আসে পেট্রা, ফিরে দেখে রায়ান কিছুই খায় নি। রাতে সে নিজে জোর করে মুখে তুলে দিয়ে একটু খাওয়াতে পারে। ভাইয়ের এমন অবস্থা দেখে তার হতাশ লাগে। মা কেন এভাবে চলে গেলেন? বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল তাতে কী হয়েছে? একটা মানুষের জীবনে বিয়েটা কি এতই জরুরি?
চারপাশটা এত অন্ধকার লাগছে কেন? সিঁড়ির সব আলো কি নেভানো? সন্ধ্যা হয়ে গেছে এখনো আলো জ্বালায় নি কেন? আরে ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি? বিল্ডিংটা এত নড়ছে কেন? মাথাটা ঘুরছে! দুহাতে মাথা চেপে ধরে সিঁড়িতেই বসে পড়ল পেট্রা।
.
প্রিয় কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম গিয়ে ভাবতে লাগল, কোথায় যাওয়া যায়? সে জানে এখানে থাকাটা নিরাপদ নয়। স্বাভাবিকভাবেই যে-কোনো মানুষ কক্সবাজার থেকে বেরিয়ে প্রথমে চট্টগ্রামই আসবে। এটা সবাই বোঝে। এই গাড়ি নিয়ে যাওয়াটাও বিপজ্জনক। তাই গাড়ি ছেড়ে দিল। আলীকদম বা লামার ওদিকে গেলে নিরাপদ ছিল, কিন্তু ওখানে তো কোনো হোটেল নেই। আদিবাসীদের ঘর ভাড়ায় পাওয়া যায়। কিন্তু বাথরুম নেই, খাওয়াদাওয়ার সমস্যা, পানির সমস্যা, কোনো সুযোগ-সুবিধাই নেই। শুদ্ধ থাকতে পারবে না, দুদিনে অসুস্থ হয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা–হাঁটতে হবে, শুদ্ধ তো এত হাঁটতে পারবে না। আবার লামাতে নাকি এখন গন্ডগোল চলছে।
অন্যকোথাও গেলেও ভালো হোটেলে ওঠা যাবে না আর। বাবর খান এখন পুরো বাংলাদেশের ভালো হোটেলগুলোতে চিরুনি তল্লাশি চালাবে। আর যেমন তেমন হোটেলে শুদ্ধর জন্য সমস্যা হবে। অনেক ভেবে প্রিয়। খুলনার এসি বাসের দুটো টিকিট কাটল। তারপর আরও বেশ কিছু টাকা তুলল। খুলনা গিয়ে আর টাকা তোলা যাবে না। এখনো ব্যাংকে তার যা টাকা আছে তাতে দু-তিন বছর বাপছেলের অনায়াসে কেটে যাবে। তারপর নিজের মনেই হেসে উঠল–বাবার হাত থেকে সে দু-তিন বছর কেন দু তিন মাসও পালিয়ে বাঁচতে পারবে না। বাংলাদেশ বাবার জন্য অনেক ছোট একটা জায়গা।
শুদ্ধর কান্না থেমেছে তবে মন খারাপ করে বসে আছে। সমস্যা নেই, এক্ষুনি ওর মন ভালো করে দিতে পারে প্রিয়। বাস ছাড়তে এখনো দেড় ঘণ্টা বাকি। একটা শপিংমলে গিয়ে শুদ্ধ এবং নিজের জন্য কিছু জামাকাপড় কিনল সে। হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় ঝামেলায় পড়ে কাপড়ের ব্যাগটা আনা হয় নি। শুধু ল্যাপটপের ব্যাগটা এনেছে। জামাকাপড় কেনা শেষ হলে সাধারণ একটা কমদামি মোবাইল কিনল। কেনাকাটা শেষ করে কাউন্টারে যেতে যেতে দেখে বাস এসে পড়েছে। কিছু খাবার কিনে বাসে উঠে গেল তারা। বাস ছাড়তেই প্রিয় নতুন মোবাইলে পুরোনো গোপন একটা সিম চালু করল। তারপর শুদ্ধকে বলল, এখন আমরা পেট্রার সাথে কথা বলব।’
শুদ্ধর চোখেমুখে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ।
‘সত্যি বাবা!
হুম সত্যি। কিন্তু কিছু শর্ত আছে।
‘কী বাবা? তাড়াতাড়ি বলো আমি সব মানব।’
‘মাকে বলা যাবে না আমরা কোথায় আছি, কোথায় যাচ্ছি। ঠিকাছে?
‘আচ্ছা বাবা। কিন্তু মা জানলে কী হবে?
‘কাউকে জানাব না আমরা।’
‘মাকেও না?
‘না। থাক তোর বোধহয় কথা বলার ইচ্ছে নেই।’
‘সত্যি বলছি বাবা, আমি কিছু বলব না। প্লিজ কথা বলতে দাও।’
পেট্রার নতুন নম্বর জানে না প্রিয়। পেট্রা অফিসের নম্বরও দেয় নি। একমাত্র উপায় রায়ান। অনেক দোনোমনা করে রায়ানকে ফোন করল প্রিয়। রায়ান মায়ের কথা বলতে বলতে বাচ্চাদের মতো কাঁদল। প্রিয়র মনে হলো, রায়ান যে কারও কাছে গিয়ে কাঁদবে এমন মানুষও নেই কেউ। দুই ভাইবোন হয়তো পরস্পরের কথা ভেবেই কান্নাকাটি করতে পারে না। রায়ানকে অনেকক্ষণ ধরে সান্তনা দিল প্রিয়। অনেককিছু বোঝাল। তারপর পেট্রার কথা জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারল সে এখনো অফিস থেকে ফেরে নি। পেট্রার নম্বর চাইলে বলল, ‘প্রিয়দা, রাগ কোরো না। পেট্রাদি ফিরলে আমি তোমাকে ফোন করব। ওর কাছ থেকেই নম্বরটা নিয়ো।
‘বুঝেছি। মনে করে ফোনটা দিস ভাই। শুদ্ধ অনেক কান্নাকাটি করছে, ওর সাথে কথা বলতে চাচ্ছে।
‘ও কি কাছেই আছে? দাও না একটু কথা বলি।
প্রিয় ফোনটা শুদ্ধর কাছে দিতেই বলল, ‘মামা, তুমি আর মা কি এখনো কান্না করো?
রায়ান হেসে ফেলল।
.
ভোরবেলা প্রিয় ও শুদ্ধ খুলনায় পৌঁছাল। প্রিয় চালক ও গাইডসহ একটা স্টিমার ভাড়া করেছে, এক সপ্তাহের জন্য। স্টিমারের বিছানার ওপর যে তোশক ছিল সেটা দেখে গা ঘিনঘিন করে উঠল প্রিয়র। বাজারে গিয়ে নতুন তোশক, বালিশ, বিছানার চাদর, কম্বল, বালিশের কভার ইত্যাদি কিনল। এক সপ্তাহের জন্য চাল, ডাল, মসলা, মুরগিও কিনে নিল। গাইড বলল, নদী থেকে মাছ ধরে নেবে আর কিছু লাগলে কাছের কোনো বাজারে নেমে কিনে নেওয়া যাবে।
সকাল আটটার দিকে স্টিমার ছাড়ল সুন্দরবনের উদ্দেশে।
শুদ্ধ বলল, আচ্ছা বাবা, মামা যে বলল মা ফিরলে কল দেবে, কই আর তো কল করল না!’
‘কী জানি বাবা! আমি তো রাতে তোর মামাকে আবার কল করলাম। ধরল না তো।
‘এখন আরেকবার কল করো না বাবা, প্লিজ।
প্রিয় আবার কল করল, কিন্তু রায়ান ধরল না। প্রিয় শুদ্ধকে কোলের মধ্যে নিয়ে বসল। তারপর বলল, ‘চিন্তা করিস না বাবা। মা যখন শুনবে আমরা কল করেছিলাম তখন নিজেই কল করবে। হয়তো মামা ভুলে গিয়েছিল বা মা বাসায় না ফিরে প্রিয়াঙ্কা আন্টির বাসায় চলে গিয়েছিল।
‘তাও ঠিক।’ কিন্তু ছেলেকে এসব বলে বোঝালেও প্রিয়র মন এসব মানতে চাইছিল। মনে হচ্ছিল কোথাও কিছু-একটা ঠিক নেই। ওদিকে শুদ্ধ ভাবছিল, মায়ের নম্বরটা তো তার মুখস্থ আছে। বাবাকে কি বলবে? না থাক, মা তো মানা করেছিল।
২৭
পেট্রা ঘুম থেকে উঠে দেখল সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। হাতে ক্যানোলা লাগানো, স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। বেডের পাশেই চেয়ারে বসে বসে স্মরণ ঘুমাচ্ছে। পায়ের কাছে রায়ান কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। উঠে বসল পেট্রা। প্রচণ্ড দুর্বল লাগছে। কী হয়েছে তার? সে হাসপাতালে। কেন? কয়েক সেকেন্ড কিছু মনে করতে পারল না। মনে করতে চেষ্টা করতেই মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো। এর মধ্যেই শুনতে পেল রায়ানের ফোন বাজছে। পেট্রা রায়ানের গায়ে হাত রেখে ডাকল, ‘রায়ান, ফোন বাজছে।
রায়ান ধড়মড় করে উঠে বসল। তারপর পকেট থেকে ফোন বের করে একবার তাকিয়ে পেট্রার দিকে এগিয়ে দিল। বলল, ‘প্রিয়দা।
পেট্রা চমকে উঠল। এতদিনে ফোন করার কথা মনে হলো! স্মরণ ও রায়ান যে এখানেই আছে সেই হুঁশও তার ছিল না। ফোন ধরেই ধমক দিল, ‘হ্যালো প্রিয়, তোর কি আমাকে মানুষ বলে মনে হয় না? আমার ছেলেকে নিয়ে কোন জাহান্নামে গিয়ে পড়ে আছিস তুই? আমাকে জানানোর প্রয়োজনও মনে করলি না? ছেলের ওপর সব অধিকার তোর একার?
পেট্রার ধমকের শব্দে স্মরণের ঘুম ভেঙে গেল। স্মরণ তখন অবাক হয়ে এই অচেনা পেট্রার দিকে তাকিয়ে রইল।
যখন পেট্রার অভিমান উপচে পড়ে তখন সে এভাবেই ধমকায়। আর পেট্রার এই অভিমানী ধমক খেতে প্রিয়র বরাবরই ভালো লাগে। ধমক খেয়ে নিজের অজান্তেই প্রিয় হেসে উঠল। পেট্রা বলল, ‘খবরদার হাসবি না, হাসলে দাঁত ভেঙে দেব।’
ওদিকে রায়ান স্মরণকে বলল, ‘স্মরণ ভাইয়া, চলেন আমরা ডক্টরকে ডেকে আনি?
স্মরণ রায়ানের সঙ্গে বের হয়ে গেল। প্রিয় বলল, ‘বাবা তোর কাছে গিয়েছিল?
‘ফোন করেছিল।
‘আচ্ছা। তোর গলার স্বর এমন লাগছে কেন? তুই কি অসুস্থ?
‘অসুস্থ হই বা মরে যাই আমি, খবর নেওয়ার তুই কে?
প্রিয় নরম গলায় বলল, ‘এত রাগ করিস না দোস্ত। তখন আমি বাসা থেকে বের হয়ে না গেলে খুনোখুনি হয়ে যেত।
‘কেন, কী এমন হয়েছিল?
‘নিকিতা তোর সব চিঠি পুড়িয়ে দিয়েছে। সাথে আর যা যা ছিল সব।’
‘ওহ।’
পেট্রা চুপসে গেল। বুকের ভেতরটা হঠাৎ ফাঁকা ফাঁকা লাগল। প্রিয়। বলল, আমার মোবাইলে ল্যাপটপে তোর ছবি, কল রেকর্ডিং যা যা ছিল সব ডিলিট করে দিয়েছিল।
‘ব্যাকআপ ছিল না?
‘তা ছিল, রিকভার করে নিয়েছি পরদিনই। কিন্তু চিঠিগুলো তো আর কখনো পাব না। তা ছাড়া ঘটনা এখানেই শেষ না। এসব করেছে বলে রাগ করে নিকিতাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর সে এমন একটা কথা বলল যে আমিই বের হয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি।’
‘কী এমন বলেছে?
‘বলছি। তুই আগে শুদ্ধর সাথে কথা বলে নে। নিকিতা তোর জিনিসগুলো নষ্ট করেছে এটা শুদ্ধ কাল জেনেছে। তারপর থেকে মন খারাপ, অনেক কেঁদেছে।’
‘তুই এসব ওকে বলতে গেছিস কেন? এখন তো ও নিকিতাকে সহ্যই করতে পারবে না।’
‘শুদ্ধ বড় হচ্ছে। তা ছাড়া ওর আমার সম্পর্ক যা-ই হোক, সবার আগে আমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে উঠতে চাই। তাই ওর জানার অধিকার আছে এমন কিছুই ওকে লুকাব না আমি।
‘শুদ্ধকে দে।’
শুদ্ধ ফোন ধরেই বলল, ‘মা, আই মিস ইউ।
‘আই মিস ইউ টু বাবা। বুকে আয়।
‘আসছি মা।’
কিন্তু মাকে না পেয়ে শুদ্ধ বাবার বুকের মধ্যে ঢুকে গেল। পেট্রার চোখে পানি এসে গেল। বলল, আমার বাবাটা নাকি কাল অনেক কেঁদেছে?
‘হ্যাঁ। নিকিতা আন্টি খুব পচা। তোমার সব জিনিস নষ্ট করে দিয়েছে। আই হেট হার। আর কক্ষনো মা বলব না। মেরে ফেললেও মা বলব না।
‘এত রাগ করতে হয় না বাবা। আমি তো তোমার বুকের মধ্যে আছি। কেউ সেখান থেকে আমাকে দূরে নিতে পারবে বলে?
‘কক্ষনো না। কোনোদিনও না।
‘তাহলে আর রাগ কোরো না। মা, তোমাকে অনেক অনেক চিঠি লিখব।’
‘কিন্তু বাবারগুলো?
‘বাবার কাছে আমার আরও অনেক কিছু আছে সোনা।
‘সত্যি? কই বাবা আমাকে দেখায় নি যে?
‘ওগুলো তো দেখানো যায় না বাবা।
‘বুঝতে পেরেছি।
‘মাকে একটা কথা বলো তো। কোথায় আছ তোমরা?
‘সরি মা, এটা তো বলা যাবে না।’
পেট্রা অবাক হয়ে গেল। ছেলেকে ট্রেনিং দিয়ে নিজের মতো বানিয়েছে প্রিয়! বলল, আমাকে বলো। আমাকে বললে কোনো সমস্যা নেই।
‘না মা। বাবা মানা করেছে। সরি মা। মাফ করে দাও আমাকে। তুমি যা যা বলতে মানা করেছিলে একটাও বাবাকে বলি নি।
‘ঠিকাছে বাবা, বলতে হবে না। যেখানে আছ, ভালো আছ তো?
‘অনেক ভালো আছি মা। আমরা অনেক সুন্দর জায়গায় আছি। এখানে সবকিছু খুব সুন্দর।
শুদ্ধকে বেশ উত্তেজিত লাগছে। কোথায় আছে ওরা? যেখানেই থাক, ভালো থাকলেই ভালো। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘ব্রেকফাস্ট করেছ?
‘হ্যাঁ মা। বাবা এত্ত সুন্দর করে খিচুড়ি রান্না করেছিল। আর সাথে ডিমভাজি। কী যে মজা হয়েছিল মা! তুমি যদি খেতে তাহলেই শুধু বুঝতে।’
হ্যাঁ, তোমার বাবা তো অনেক ভালো রান্না করে।’
‘আচ্ছা মা, তুমি বাবার সাথে কখনো পালিয়েছ?
কথাটা শুনে পেট্রার বুকের মধ্যে দামামা বাজতে লাগল। মনে পড়ে গেল ছোট্ট শুদ্ধকে কোলে নিয়ে গভীর রাতে প্রিয়র হাত ধরে কীভাবে পালিয়ে গিয়েছিল এককালে। নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে বলল, এ কথা কেন বলছো বাবু?
‘বাবার সাথে পালানো অনেক মজা। বাবার কত বুদ্ধি! একদম সুপার হিরোদের মতো করে পালায়। আমরা কক্সবাজারে একটা লোককে বেঁধে রেখে পালিয়ে এসেছি। হি হি হি।’
শুদ্ধর এমন মনখোলা হাসি শুনে পেট্রার মনটা ভরে গেল। হেসে বলল, আমিও তোর বাবার সাথে একবার পালিয়েছিলাম। সাথে তুইও ছিলি।’
‘কই আমার তো কিছু মনে নেই!
‘তুই তো তখন ইটুখানি ছিলি বাবা। কোলের মধ্যে থাকতি সারাক্ষণ।
‘হি হি…’
পেট্রা এবার আরও হেসে বলল, ‘তোর বাবা তো এর আগেও দুবার তোকে নিয়ে পালিয়েছিল।’
‘সত্যি? কই আমি তো জানি না।’
‘ছোট ছিলি তো, বুঝতে পারিস নি। তুই ভেবেছিস ঘুরতে গেছিস।
‘এবার কিন্তু বুঝে ফেলেছি মা।
ছেলের খুশি দেখে প্রিয়র মনটা আনন্দে ভরে গেল। মা-ছেলে প্রায় ঘণ্টাখানেকের মতো গল্প করল। তারপর প্রিয় শুদ্ধকে গাইডের সঙ্গে রেখে স্টিমারের অন্যপ্রান্তে চলে গেল। গিয়ে বলল, ‘নিকিতা জেনে গেছে শুদ্ধ আমাদের ছেলে নয়। গ্রেটও দিয়েছে শুদ্ধকে নাকি সব বলে দেবে।
পেট্রা আঁতকে উঠে বলল, ‘নিকিতা কীভাবে জানল?
‘তোর চিঠি পড়ে।
‘ও কি সব চিঠি পড়েছে?
‘কে জানে!
‘ছি ছি, কত চিঠিতে কত কিছু লিখেছি! কী লজ্জার ব্যাপার হলো।’
‘তো? স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ওসব কথা হতেই পারে। সে পড়ে অন্যায় করেছে। লজ্জা পেলে তার পাওয়া উচিত। আমরা কেন লজ্জা পাব?
‘নিকিতা চাবি পেল কোথায়?
‘জানি না। কোনোভাবে চুরিটুরি করেছিল বোধহয়। আর আমার মহান পিতা তো আছেনই।’
‘যা গেছে তা গেছে। কিন্তু আমার ভয় লাগছে শুদ্ধকে নিয়ে। ও যে অভিমানী ছেলে! ও আমাদের ছেলে না জেনে যদি কিছু করে বসে? তোর মনে নেই, একবার প্রিয়াঙ্কা দুষ্টুমি করে বলেছিল–তোকে তো পেট্রা টোকাইদের থেকে নিয়ে এসেছে। তারপর শুদ্ধ আমাদের কেউ না এটা ভেবে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল?
‘আমার ভয়টাও সেখানেই। নিকিতা যখন বলল শুদ্ধকে সব বলে দেবে, ভয়ে আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। তার মতো মেয়ে বলতেই পারে। অতিরিক্ত সাহস তার। তাকে যে ধোলাই দিয়েছিলাম তার পরে সে তোর চিঠি পোড়ায় কোন সাহসে ভেবেই পাচ্ছি না।’
‘একটা কাজ কর না।
‘কী?
‘তোর বাবা তো আমার কাছে শুদ্ধকে রাখতে দেবে না। কিন্তু হোস্টেলে রাখলে তো তার কিছু বলার থাকবে না। কোনো ক্যাডেট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দে। কিংবা ইন্ডিয়াতে কোনো ভালো বোর্ডিং স্কুলে?
‘আমি শুদ্ধকে ছাড়া থাকতে পারব না। আমার জীবন ও।
‘ওর ভালোর জন্য প্রিয়! সব সময় ও নিকিতার চোখের সামনে না থাকলে নিকিতা ওকে নিয়ে ভাববে না।’
প্রিয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি পারব না শুদ্ধকে ছাড়া থাকতে।
পেট্রা এবার ম্লান হেসে বলল, ‘শুদ্ধর সাথে তোর রক্তের সম্পর্ক, আমার সাথে রক্তের না। কিন্তু জন্মের পর থেকে ওকে বুকে করে বড় করেছি। আমি আছি কী করে ওকে ছাড়া? তোকে ছাড়াও তো আছি। বাবা-মা সবাইকে ছাড়া আছি। আমি তো ভালোই আছি। সবাইকে ছাড়াই থাকা যায়। কারও জন্য জীবন থেমে থাকে না প্রিয়।
প্রিয় কী বলবে বুঝতে পারল না। পেট্রার ওপর রাগও হচ্ছিল, মায়াও হচ্ছিল! দুজনই কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ রইল। তারপর পেট্রাই বলল, ‘তাহলে বরং প্রিয় তুই নিকিতাকে অবহেলা করা বন্ধ কর। দেখবি তোর একটু অ্যাটেনশন পেলেই সে এসব উল্টাপাল্টা কথাবার্তা বলবে না, উল্টাপাল্টা কাজও করবে না।’
‘তুই আসলে কী বলতে চাচ্ছিস পেট্রা? আমি কেন ওকে অ্যাটেনশন দিতে যাব? আমি কি ওকে শখে বিয়ে করেছি? কাউকে ভালোবাসা এত সোজা?
‘ভালোবাসতে না পারলে বাসিস না। কিন্তু অন্তত ওর পাওনাটুকু ওকে দে। দেখবি ওর মাথা একদম ঠান্ডা হয়ে যাবে তাহলে।
‘তুই এখন আমার সামনে থাকলে থাপ্পড় মেরে তোর দাঁত ফেলে দিতাম। অসভ্য মেয়ে কোথাকার!’
‘রাগ করিস না প্রিয়। এভাবে জেদ খাঁটিয়ে তুই শুদ্ধকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছিস। আজ নিকিতা হুমকি দিয়েছে, কাল যদি সত্যিই বলে দেয়? এই জেদ করে কী পাবি তুই?
‘আমি বাবর খানের কাছে হার মানব না।’
‘ইলজিক্যাল ইগো! তুইও ঠিক তোর বাবারই মতো। সেও ইগো দেখিয়ে ছেলেদের জীবন নষ্ট করেছে, তুইও করতে যাচ্ছিস। তোের বাবার সাথে তোর চুল পরিমাণ ফারাক নেই।’
‘পেট্রা!
প্রিয়র ধমক খেয়ে থেমে গেল পেট্রা। পরক্ষণেই ভাবল থামবে কেন সে! সে তো ভুল বলে নি। তাই মাথা ঠান্ডা রেখেই আবার বলল, ‘রাগ করিস না। ছেলেটার কথা ভাব। আর ঠান্ডা মাথায় চিন্তা কর, নিকিতার সাথেই তো থাকতে হচ্ছে। তোর নিকিতার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই সেটা তোর বাবা জানে না। হলেও তোর বাবা জানবে না। কিন্তু তুই এটা দিয়ে নিকিতাকে চুপ করিয়ে রাখতে পারবি? ওই মেয়েটাও তো তোকে শখে বিয়ে করে নি। বিয়ের আগে তো সে জানতই না কোন ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে। জানলে নিশ্চয়ই বিয়ে করত না। স্বামী অবহেলা করলে সেটা একটা মেয়ের জন্য চূড়ান্ত অপমানের। এর চেয়ে অপমানের আর কিছু হয় না। আজ যদি সে কোনো অন্যায় করে, পাগলামি করে, ভুল করে তাহলে সেসব করতে তুই আর তোর বাবাই বাধ্য করেছিস।
প্রিয় তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘নিকিতার সাপোর্ট নিচ্ছিস?’।
‘নিকিতা কি আমার নিজের পেটের মেয়ে নাকি মায়ের পেটের বোন নাকি আমার প্রিয় বন্ধু যে ওর সাপোর্ট নেব? আমি একজন মানুষ হিসেবে, একজন মেয়ে হিসেবে নিরপেক্ষ কথা বলেছি। পরে একা হলে মাথা ঠান্ডা রেখে ভেবে দেখিস ভুল কিছু বলেছি কি না।
প্রিয় আর কিছু বলল না। পেটা আবার বলল, ‘তই কী করবি সেটা অবশ্যই তোর সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমার ছেলের কিছু হলে আমি তোকে ছাড়ব না। আমার ছেলে যেন আজীবন ভালো থাকে সেই দায়িত্ব তোকে নিতে হবে, নাহয় আমাকে দিতে হবে।
‘সবাই মিলে আমাকে থ্রেট দিতে লেগে গেছিস? তোকে ফোন করাটাই ভুল ছিল আমার!
‘আমি কোনো থ্রেট দিচ্ছি না…’
পেট্রাকে কথা শেষ করতে দিল না প্রিয়। লাইন কেটে দিল। পেট্রা আবার ডায়াল করতেই নম্বরটা বন্ধ পেল।
২৮
স্মরণ পেট্রাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় পৌঁছে দিল। সঙ্গে রায়ানও ছিল। এরপর বিদায় নিতে চাইলে পেট্রা বলল, ‘অফিস তো নেই আজ। এত তাড়া কিসের? চা খেয়ে যাও।’
স্মরণ সুযোগ হাতছাড়া করল না। চা খাওয়া মানে কিছুক্ষণ গল্প করা। স্মরণ বলল, তা ঠিক। কিন্তু তুমি তো অসুস্থ। চা আমি বানাই?
‘আরে না, এমন কিছুই হয় নি আমার। তুমি বসো। আমি চা বানাচ্ছি।’
স্মরণ বসল। পেট্রা শুধু ফরমালিটি করেই চায়ের কথা বলেছিল। স্মরণ সত্যিই বসে যাবে তা বোঝে নি। তিন কাপ চা আর টোস্ট বানিয়ে রায়ানের ঘরে এক কাপ দিয়ে স্মরণের সঙ্গে ড্রইংরুমে বসল পেট্রা। স্মরণ বলল, নিজের কোনো খেয়াল রাখো না তুমি। সেদিন আমি ওখানে না পৌঁছালে কী হতো?’
কিছুই হতো না। অন্য কেউ দেখত। আর আমাকে হাসপাতালে নেওয়ার মতো কিছুই হয় নি। তাও তোমার জন্য হাসপাতাল ঘুরে এলাম। কারণ সুস্থ রোগীকে প্রাইভেট হাসপাতালে নিলেও অসুস্থ হওয়ার দায়িত্বটা তারা নিয়ে নেয়।
‘হাসপাতালে নিয়েছি বলে রাগ করেছ? শুনলে তো ডক্টর বলেছে অতিরিক্ত স্ট্রেস যাচ্ছে তোমার ওপর দিয়ে?
‘না, রাগ করি নি। শুধু বললাম যে দরকার ছিল না। আর তোমার এভাবে রাত জেগে থাকারও কোনো দরকার ছিল না। শুধু শুধু ঋণী করলে।
‘ঋণ শোধ করে দাও।’
পেট্রা হাসল। তারপর বলল, ‘স্মরণ, পাগলামি কোরো না। আর কতবার বলব তোমাকে আমি ভালোবাসি না।
‘ভালোবাসতে কে বলেছে? শুধু বিয়ে করো।’
‘সম্ভব না।’
‘কেন? এখন তো বাধা দেওয়ার মতো কেউ নেই।
‘স্মরণ, আমার মা মারা গেছে দুই মাসও হয় নি। এখন তুমি আমাকে বিয়ের কথা বলছ?
‘সরি পেট্রা। কথায় কথা উঠল। আমি এক্ষুনি বিয়ে করার কথাও বলছি না। আসলে তোমার এমন অবস্থা দেখতে পারছি না আমি। তুমি নিজের প্রতি এতটাই কেয়ারলেস যে দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছ। তোমার দিকে খেয়াল রাখার, তোমাকে একটু শাসন করারও কেউ নেই। তাই তোমাকে আগলে রাখার দায়িত্বটা নিতে চাচ্ছিলাম।’
‘তুমি কি আমাকে অসহায় ভাবো স্মরণ?
‘তা কেন ভাবব?
পেট্রা দৃঢ় গলায় বলল, আমার মায়ের জন্য, তাকে খুশি করার জন্য, আমি আবার বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এখন মা নেই, তাই আমি আর বিয়েও করব না।’
‘সারা জীবন এভাবেই কাটিয়ে দেবে তুমি?
‘এটা আমার জীবন। আমি কীভাবে কাটাব সেই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ আমার। এ ব্যাপারে কথা বলার অধিকার আমি কাউকে দিই নি।’
‘একজনের জন্য কষ্ট পেয়ে নিজের জীবন নষ্ট করবে কেন? নতুন করে সাজানো উচিত সবকিছু।
পেট্রা শীতল গলায় বলল, আমার জীবন সাজানোই আছে। বিয়ে করে সংসার করলে জীবন সাজানো হয়, আর না করলে বুঝি জীবন নষ্ট হয়, স্মরণ? বিয়ে আর সংসারই কি একটা মেয়ের জীবনের সব? একটা মেয়ে কি অন্যভাবে সুখী হতে পারে না? তোমার মতো আধুনিক একটা ছেলেও এমন টিপিক্যাল চিন্তা করে তাহলে?
‘পেট্রা, তুমি যার কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছ, সে কিন্তু বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখে আছে।
‘কতটুকু জানো তুমি প্রিয় সম্পর্কে?
‘তোমাকে তো বলেছি আমরা একই এলাকাতে থাকি, একই সাথে জিম করি। অনেকটাই জানি তাকে। অনেক সুখী সে।
পেট্রার মেজাজ খারাপ হলো। সে এবার একটু কঠিন স্বরেই বলল, ‘প্রিয় সম্পর্কে কিছুই জানো না তুমি। আর যা জানো না তা নিয়ে আমার সাথে কথা বলতে এসো না প্লিজ। যে বাচ্চা নিয়ে ওর সুখে থাকার গল্প শোনাচ্ছ আমাকে, সে আমারই বাচ্চা।
স্মরণ চুপ করে রইল। পেট্রা বলল, একটা অনুরোধ রাখবে স্মরণ?
‘বলো।’
‘ভালোবাসা, বিয়েশাদি এসব নিয়ে আমার সাথে আর কথা বোলোনা প্লিজ। এই চাকরিটা ছাড়লে এই মুহূর্তেই আরেকটা চাকরি পাওয়া আমার
জন্য মুশকিল হবে।’
বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। স্মরণ বলল, ‘ঠিকাছে পেট্রা। চা-টা ভালো ছিল। আজ উঠি?
পেট্রা হেসে বলল, ‘আচ্ছা।’
দরজার বাইরে গিয়ে স্মরণ বলল, আজকের পর থেকে আমি কি তোমার সাথে সাধারণ কথাবার্তাও বলতে পারব না? অন্যকোনো বিষয়ে?
পেট্রা হেসে বলল, ‘অবশ্যই বলবে।
.
বাজারের একটা দোকানে টিভিতে খবর চলছিল। প্রিয় বাজার করছিল। টিভির দিকে চোখ পড়তেই দেখল, চট্টগ্রাম পোর্ট থেকে কয়েকশত অবৈধ অস্ত্র ধরা পড়েছে। অস্ত্রের সঙ্গে যারা ধরা পড়েছে তাদের মধ্যে একজনকে চিনতে পারল সে। বাবর খানের কাছে প্রায়ই আসত সে। কর্মচারী বলেই জানত। ছেলেটা তাদের সাভারেরই। তার মানে এই অস্ত্রগুলো বাবর খান পাঠাচ্ছিলেন কোথাও। তার অবৈধ কিছু ব্যবসা আছে তা প্রিয় জানে। অনেকবার ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রমাণের অভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মন্ত্রীসাহেবের সঙ্গে পারবে এমন সাধ্য কোথায় তার? হয়তো এবারও তিনি ধরা খাবেন না। কিন্তু বিশাল লসে পড়ে যাবেন। এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তাকে খোঁজার দিকে সেভাবে মনোযোগ দিতে পারবেন না। আর ধরা খেলে তো আলহামদুলিল্লাহ।
রাতে স্টিমারের ডেকের ওপর শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল প্রিয়। শুদ্ধ ঘুমিয়ে পড়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। ওকে অবশ্য ভেতরের কেবিনে শুইয়ে দিয়েছে। আকাশে আধ ফালি চাঁদ, ঝিরিঝিরি বাতাস শরীরে শীতল অনুভূতি এনে দিচ্ছে। খুব আরাম লাগছে। ঘুম আসি আসি করছে। ঠিক এই মুহূর্তে পেট্রা যদি পাশে থাকত! বুকে জড়িয়ে ধরে থাকত শুধু, একটা কথাও বলত না। পেট্রার কথা ভাবতে ভাবতে ওখানেই খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে পড়ল প্রিয়।
ঠিক সেই মুহূর্তে নিকিতা প্রিয়র ঘরে বসে কাঁদছিল। এতদিন হয়ে গেল প্রিয় চলে গেছে। শ্বশুর সাহেব বলেছেন খুঁজে আনবেন, কিন্তু তিনি তো কিছুই করতে পারছেন না। প্রিয় কি আর কখনো ফিরে আসবে না? আর কখনো দেখা হবে না তার সঙ্গে? ইশ, কেন সে এমন পাগলের মতো করল? কিছু না পাক, প্রিয় চোখের সামনে তো ছিল। প্রতিদিন দেখতে তো পেত! নিজের চুল নিজেই টেনে ছিঁড়তে মন চাইছে। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। কেন এমন করতে গেল? এত বোকা কেন সে? আল্লাহ কি একটু বুদ্ধি দিতে পারল না তাকে?
মাঝরাতে প্রিয় ঘুম ভেঙে লাফিয়ে উঠল। পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে, ঘেমে একাকার অবস্থা। হাঁপাতে হাঁপাতে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করতে লাগল যে এটা সত্যি নয়, স্বপ্ন ছিল। এত বাজে স্বপ্ন সে দেখল কী করে? পেট্রার কথা ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়েছিল, আর স্বপ্নে কিনা নিকিতার সঙ্গে…ছি ছি। এমনটা হওয়ার আগে যেন তার মরণ হয়। সে জানে পেট্রা যা বলেছে ঠিকই বলেছে। অযৌক্তিক কিছুই বলে নি। কিন্তু তার পক্ষে নিকিতার সঙ্গে এসব করা অসম্ভব। পেট্রা ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে আজও ভাবতে পারে না সে। দোয়া পড়ে নিজের বুকে ফুঁ দিল প্রিয়। শয়তান দেখাচ্ছে এসব স্বপ্ন। নিজেকে বড় অশুচি লাগছে।
.
নিকিতা জানে না পেট্রা কেন তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে। কিন্তু দেখা করতে চাওয়ায় সে এককথায় রাজি হয়েছে। কফিশপে দুজন মুখোমুখি বসে আছে। আজ নিকিতা মনস্থির করেই এসেছে মাথা ঠান্ডা রাখবে বলে। পেট্রার সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করবে না। পেট্রাকে দেখে তার মনে হচ্ছে সে বেশ হাসিখুশি মিশুক একটা মেয়ে। আসার পর থেকে খুব স্বাভাবিকভাবে এটা-সেটা অনেক কথাই বলছে। যেন নিকিতা তার অনেক দিনের চেনা। নিকিতা অবশ্য কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। শুধু একবার বলেছে, আপনি আমাকে আপনি আপনি কেন বলছেন? তুমি করে বলুন, আমি আপনার চেয়ে অনেক ছোট। পেট্রা তারপর থেকে ‘তুমি’ করেই বলছে। একসময় বলল, ‘নিকিতা, আমি আসলে তোমাকে যে কথা বলার জন্য ডেকেছি তা এখনো বলি নি। আসলে ভাবছি কথাগুলো তুমি কীভাবে নেবে বা বিশ্বাস করবে কি না। কিন্তু এটা বললে তোমার কাছে একটা জিনিস অন্তত ক্লিয়ার হবে।’
‘আপনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন আপু।
‘আমার বাবা হরতালের দিন অফিসে গিয়েছিলেন। ফিরেছিলেন লাশ হয়ে। সবাই জানে ক্রসফায়ারে পড়ে মারা গেছেন। শুধু আমি জানি বাবাকে খুন করিয়েছেন তোমার শ্বশুর। তিনি নিজেই আমাকে জানিয়েছেন। আমার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন। কিছুই করতে পারি নি আমি।
নিকিতা বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে পড়েছে। পেট্রা বলতে লাগল, উনি আমাকে আগেও থ্রেট দিয়েছিলেন প্রিয়র সাথে সম্পর্ক রাখলে উনি আমার পরিবারের ক্ষতি করবেন। যদিও তখন আমি বা প্রিয় কেউ গায়ে মাখি নি। আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেলেও সম্পর্ক ছিল। আসলে বুঝতে পারি নি উনি সত্যিই এতটা নির্দয় হবেন।
নিকিতা চুপ। পেট্রা আবার বলল, ওই ঘটনার পর আমার আর প্রিয়র আসল বিচ্ছেদটা হয়। প্রিয় চাচ্ছিল সম্পর্ক রাখতে, আমি রাখি নি। হ্যাঁ, আমি প্রিয়কে ভালোবাসি। ভালোবাসা বোঝার আগে থেকে আমি এই ছেলেটাকে ভালোবাসি। তাই এখন অন্য কাউকে ভালোবাসার কথা ভাবতে পারি না। কিন্তু নিজের বাবার খুনির ছেলের সাথে সম্পর্ক রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার ভুলের জন্য আমার বাবা মারা গেছেন। আমার মাও পরোক্ষভাবে আমার ভুলের জন্যই চলে গেছেন। এই অপরাধবোধ থেকে আমি কখনো বের হতে পারব না। এরপর যদি সবকিছু ঠিকও হয়ে যায়, প্রিয়র বাবা যদি কখনো নিজে এসে আমার কাছে অনুরোধও করে প্রিয়র সাথে সংসার করতে, তবুও আমি তা পারব না। প্রিয় নিজেও জানে সেটা। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমাকে নিয়ে জেলাস হওয়ার কোনো কারণ নেই?
পেট্রার চোখ ভিজে আসছে। মুখটা লাল হয়ে গেছে। কেন জানি পেট্রার মুখ দেখে নিকিতার কান্না পাচ্ছে। নিকিতা পেট্রার একটা হাত ধরে বলল, ‘সরি আপু।’
পেট্রার চোখে জল কিন্তু সে হেসে ফেলল। তারপর বলল, ‘শুদ্ধর মা মারা যাওয়ায়, জন্মের দিন থেকেই শুদ্ধকে আমি নিজের ছেলের মতো পেলেছি। জন্ম না দিয়েও ওর মা হয়েছি। মা যেমন সন্তানকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, আমিও ওকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। প্রিয়কে হারিয়েও শুদ্ধকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যেদিন তোমার শ্বশুর জানতে পারলেন শুদ্ধ ভাইজানের ছেলে, সেদিনই আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেছেন ওকে। এই লোকটাকে আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি।
নিকিতা চুপ করে রইল। পেট্রা আবার বলল, তোমার কাছে আমি অনুরোধ করছি, আমার শুদ্ধকে তুমি কখনো জানতে দিয়ো না আমরা ওর বাবা-মা নই। ও খুব অভিমানী ছেলে। কী থেকে কী করে বসবে ঠিক নেই। তুমি ওকে মায়ের আদর দিয়ো প্লিজ।
‘আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আপু, শুদ্ধ কখনো জানবে না। আমি আর পাগলামি করব না।’
পেট্রা দুহাতে নিকিতার দুই হাত ধরে বলল, ‘আর প্রিয়কে কষ্ট দিয়ে। ও খুব অসহায়। ওকে একটু বোঝো, ভরসা দিয়ে আর অনেকটুকু ভালোবেসো। ভালোবেসে তুমি ওর ভেতর জমে থাকা সব কষ্ট, অভিমান আর অপরাগতাগুলোকে মুছে দিয়ো।
২৯
প্রিয়র যখন জ্ঞান ফিরল, চোখ মেলে নিজেকে আবিষ্কার করল নিজের বিছানায় শুদ্ধও পাশেই ঘুমিয়ে আছে। খুব বেশি অবাক হলো না, এমনটা তো হওয়ারই কথা ছিল।
প্রিয়র নদীতে খুব ভালো লাগছিল। কিন্তু শুদ্ধর ভয়ংকর রকম ঠান্ডা লেগে যাওয়ার খুলনা শহরে চলে এল। হাসপাতালে নেওয়ার পর জানা গেল নিউমোনিয়া হয়েছে। ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালেই পড়ে রইল প্রিয়। প্রতিমুহূর্ত কেটেছে আতঙ্কে। বাবর খান কখন টের পেয়ে এসে যাবে সেই আতঙ্ক। অবশ্য তার টের পাওয়ার কোনো পথ রাখে নি প্রিয়। এর মধ্যে আর টাকাও তোলে নি। পেট্রা যদি বাবর খানকে ফোন নম্বর দিয়েও দেয় বা পেট্রার ফোন ট্রেস করে থাকে তবুও তাকে খুঁজে পাওয়ার কথা নয়, কারণ সে ফোনটা আর খোলে নি।
ঘটনাটা ঘটল হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পর। হাতে টাকা ছিল, হাসপাতালের বিল কার্ডের মাধ্যমে শোধ করতে হবে। তাই আগেই খুলনা ছাড়ার জন্য গাড়ি ঠিক করে আনল। তারপর কেবিনে গিয়ে শুদ্ধকে নিয়ে এসে বিল শোধ করল।
খুলনা ছাড়ার আগেই গাড়ি জ্যামে পড়ে ছিল। একটা মহিলা এসে বেলি ফুলের মালা সাধল। তার এখন মালা দেওয়ার মতো কেউ নেই, তবুও মালা দেখে কিনল। আগে প্রায়ই পেট্রাকে বেলি ফুলের মালা কিনে দিত। পেট্রা এই সামান্য জিনিস পেয়ে কী যে খুশি হতো! কত স্মৃতি। এসব স্মৃতি ভেতরটা জ্বালিয়ে দেয়। এসব ভাবতে ভাবতে প্রিয় টাকা বের করছিল, মহিলা ফুলের মালা দেওয়ার সময় মালাটা খুব দ্রুত তার নাকের সামনে ধরল, আর কিছু মনে নেই প্রিয়র।
শুদ্ধকে ডেকে তুলল প্রিয়। শুদ্ধ চোখ মেলে বলল, বাবা, আমি আরেকটু ঘুমাই?
‘আচ্ছা বাবা ঘুমা।
শুদ্ধকে সুস্থ দেখে প্রিয় স্বস্তি পেল। ঘর থেকে বের হতেই বাবর খান বললেন, ‘ওয়েলকাম মাই সান।
কিছুই হয় নি এমন ভান করে প্রিয় খেতে বসল। বাবর খান টেবিলে এসে বসলেন। তারপর বললেন, তোমার মতো বোকা ছেলে আমি আর একটাও দেখি নি জানো প্রিয়?
প্রিয় পাত্তা দিল না। নিকিতা খাবার তুলে দিতে যাচ্ছিল, প্রিয় হাতের ইশারায় তাকে বাধা দিল, তারপর নিজেই তুলে নিল। বাবর খান বললেন, ‘তুমি ভাবলে কী করে আমি তোমাকে খুঁজে পাব না? তুমি জানো না বাংলাদেশের সব জেলায় আমার লোক আছে?
প্রিয় নির্বিকারভাবে খেতে লাগল। উনি আবার বললেন, ‘প্রথমদিকে আমি কিছু ঝামেলায় পড়ে তোমাকে নিয়ে মাথা ঘামাই নি।
প্রিয় এবার হেসে ফেলল। বাবার দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘হ্যাঁ, দেখেছি তোমার কয়েক শ অবৈধ অস্ত্র চট্টগ্রাম পোর্টে ধরা পড়েছে। আহারে, কত টাকা লস হলো?
নিকিতা চমকে উঠল। একবার শ্বশুর আরেকবার ছেলের দিকে তাকাল। নিকিতার সামনে এ কথা বলায় বাবর খান একটু বিব্রত বোধ করলেন। প্রিয়কে ধমকে বললেন, ‘কী যা তা বলছ? মাথা ঠিক আছে তোমার?
প্রিয় নিঃশব্দে হাসল। বাবর খান আর কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ পর নিকিতা রান্নাঘরে গেল চা বানাতে। বাবর খান প্রিয়কে একা পেয়ে বলল, ‘আরেকবার এসব কথা সবার সামনে বললে পেট্রার ভাইবোন দুটোকেও উপরে পাঠিয়ে দেব। প্রয়োজনে পেট্রাকেও। তুমি ভালো করেই জানেনা তোমার অপরাধের শাস্তি আমি বরাবরই তোমার প্রিয়জনদের দিয়ে থাকি।
বাবর খান বেরিয়ে গেলেন। প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তার চলে যাওয়া পথের দিকে।
.
প্রিয় নাস্তা খেয়ে ঘরে ফিরে এল। প্রিয়র পিছু পিছু নিকিতা এল। প্রিয় না দেখার ভান করল। কিন্তু নিকিতা হঠাৎ করেই প্রিয়কে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিল। প্রিয় নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল, তোমার সাহস তো কম না, ছাড়ো।’
‘প্লিজ একটু থাকতে দাও। এরপর মেরে ফেললো, আপত্তি নেই।
প্রিয় নিকিতাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। নিকিতা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমাকে মাফ করে দাও প্রিয়।
প্রিয় কড়া গলায় বলল, ‘তুমি এর আগেও মাফ চেয়েছ, বলেছ আর কখনো ভুল করবে না। তারপর তুমি সর্বোচ্চ ভুলটা করেছ, যার কোনো মাফ হয় না। প্লিজ নিকিতা, আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও, তোমাকে আমার অসহ্য লাগছে। তুমি আপাদমস্তক একটা বিষ।
‘এবার শেষবারের মতো মাফ করে দাও। এতদিন তোমাকে ছাড়া থেকে আরও ভালোভাবে বুঝেছি আমি আসলে তোমাকে কতটা ভালোবাসি। পাগল হয়ে গিয়েছিলাম তোমার জন্য। একটা রাত ঘুমাতে পারি নি, খেতে পারি নি। তোমাকে ছাড়া আমি মরে যাব। প্লিজ মাফ করো।’
প্রিয় যেন সেসব শুনেও শুনল না। পত্রিকা নিয়ে বসল। নিকিতা প্রিয়র পাশে বসে তার হাত ধরে বলল, আমি পেট্রা আপুর চিঠিসহ সব জিনিস সরিয়ে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম পরের দিন সুযোগ বুঝে পুড়িয়ে দেব। তার আগেই তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে। কিছু বলারও সুযোগ পেলাম না।
প্রিয় বিস্ময়ে হতবাক। নিকিতা কি সত্যি বলছে? প্রিয়র ভয় হতে লাগল। এসব যদি সত্যিই অক্ষত থাকে আর তা নিয়ে যদি নিকিতা এখন তাকে ব্ল্যাকমেইল করে! নিকিতা আবার বলল, বাবা বলেছেন তুমি নাকি প্রায়ই এমন করো, বাবা যেভাবেই হোক তোমাকে ফিরিয়ে আনবেন। ছোট একটা আশা মনে নিয়ে আমি সব যত্ন করে রেখে দিয়েছি। আমি এক্ষুনি সব ফেরত দিয়ে দেব। একটা জিনিসও আমি নষ্ট করি নি। তুমি শুধু আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ।
‘কোথায় রেখেছ ওগুলো? এক্ষুনি ফেরত দাও।’
যেখানে যেটা ছিল আবার সেখানে সেটা রেখে দিয়েছি। শুধু ল্যাপটপ, মোবাইলের জিনিসগুলো দিতে পারব না। ওগুলো ডিলিট করার আগে কোথাও রাখি নি। মাফ করে দাও আমাকে প্লিজ।
প্রিয় নিকিতার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে চাবি বের করল, তারপর ওয়ারড্রবের ড্রয়ার খুলল। প্রত্যেকটা ড্রয়ার খুলে সব ঠিকমতো আছে দেখতে পেয়ে অদ্ভুত একটা আনন্দ হলো। চোখে জল এসে গেল। এই আনন্দের অনুভূতি ভীষণ অদ্ভুত। সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল, অসাড় হয়ে এল হাত-পা, চোখ দুটো বুজে এল। নিকিতা এখনো পাগলের মতো কাঁদছে। প্রিয়র পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর হাতের বাহু ধরে বলল, বলো না মাফ করেছো তো? কিছু নষ্ট করি নি, একটা চিঠিও না।
প্রিয় নিকিতাকে দুহাতে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘থ্যাংক ইউ নিকিতা। থ্যাংকস আ লট।
নিকিতা অবাক। এটা কী হলো? প্রিয় নিজে তাকে জড়িয়ে ধরেছে। প্রিয়র বুকে মাথা রেখে সে কাঁদতেও ভুলে গেল।
.
ফিরে এসেছে এই খবরটা দেওয়ার জন্য পেট্রাকে ফোন করবে ভেবেও করল না প্রিয়। ফোন করে কী-ইবা হবে, কয়েকটা নীতিবাক্য শুনিয়ে দেবে। তখন মেজাজ ভীষণ খারাপ হবে। যোগাযোগ রাখবে না বলেই তো ফোন নম্বর বদলেছে। প্রিয় চেষ্টা করলে নতুন নম্বর জোগাড় করতে পারবে কিন্তু সেটা করলে মেয়েটা রেগে যাবে। পেট্রার বাবার মৃত্যুর পর থেকেই সে অনেক দূরের মানুষ হয়ে গেছে। কোনোকিছু দিয়েই তাকে গলানো সম্ভব হয় না। কিন্তু এই মৃত্যুর পেছনে প্রিয়র তো কোনো হাত নেই, এটা পেট্রা বোঝে না কেন? তার বাবার শাস্তি তাকে কেন দিচ্ছে? পেট্রা যদি প্রিয়কে না বোঝে তাহলে পৃথিবীর কেউ বুঝবে না। সে-ই তো ছিল প্রিয়র জীবনের সবকিছু বোঝার মানুষ।
নিকিতা প্রিয়র দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল, প্রিয় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। ইশ কত দিন পর আবার প্রিয় তার চোখের সামনে। একই বিছানায়। শুদ্ধকে সরিয়ে এপাশে এনে প্রিয়র পাশে গিয়ে শুতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সাহস হচ্ছে না। আজ প্রিয় নিজে তাকে বুকে টেনে নিয়েছে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও এত বছর পর আজ প্রিয়র বুকে জায়গা পেয়েছে। সে। এরচেয়ে সুখের বিষয় আর কী হতে পারে? প্রিয় যে ভালোবাসা থেকে জড়িয়ে ধরে নি তা সে জানে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে ধরেছে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ছিল এটা। কিন্তু তার জন্য ছিল স্বর্গীয় অনুভূতি। প্রচণ্ড আবেগময় একটা মুহূর্ত। আজ আর কোনো অকাজ করে প্রিয়র বকা শুনতে চায় না সে। আজ সেই স্বর্গীয় অনুভূতি বুকে আঁকড়ে থাকতে চায়। এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল।
.
সারা দিন বাসায় বসে থাকতে ভালো লাগে না প্রিয়র। আবার নতুন চাকরির চেষ্টা করতে লাগল। কয়েক মাসের মধ্যে পেয়েও গেল। নিকিতারও কিছুটা মাথা ঠান্ডা হয়েছে। এখন আর উল্টোপাল্টা কোনো কাজ করে না। প্রথম প্রথম নিকিতার সঙ্গে কথা বলত না শুদ্ধ। কিন্তু যখন জানতে পেরেছে নিকিতা তার মায়ের কোনো জিনিস নষ্ট করে নি, ফেরত দিয়ে দিয়েছে, তখন থেকে আবার সব ঠিক। তবে শুদ্ধ এখন আর তাকে ‘মা’ বলে ডাকে না, ‘আন্টি ডাকে।
.
পেট্রা অফিস থেকে ফিরে রান্নাবান্না করে রায়ানের ঘরে ঢুকল। একটা জরুরি বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। ছেলেটা এতক্ষণ বাসায় ছিল না, কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছে। ঘরে ঢুকে দেখল রায়ান বাথরুমে গেছে। বিছানাটা একদম অগোছালো করে রেখেছে। পেট্রা বিছানাটা গুছিয়ে দিল। বিছানা গোছাতে গিয়ে সে একটা কানের দুল খুঁজে পেল। কানের দুলটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে রইল সেটার দিকে। তাহলে কি…? রায়ান তো এখন বড় হয়েছে, এসব খুব অস্বাভাবিক কিছু না। মনে মনে হাসল পেট্রা, ভাইটা এত বড় হয়ে গেছে অথচ সে টেরই পায় নি এতদিন! রায়ান বের হওয়ার আগেই পেট্রা কানের দুলটা নিয়ে চলে গেল।
রাতে খাওয়ার সময় পেট্রা বিষয়টা তুলল।
‘রায়ান, তোর সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল।
‘হ্যাঁ, বল।’
একটা ভালো খবর আছে।’
‘তোর প্রোমোশনটা হয়ে গেছে দি?
‘না, সেটা হয়তো হতো। কিন্তু এখন একটা ভিন্ন ব্যাপার হয়েছে। আমি মালয়েশিয়াতে একটা চাকরির চেষ্টা করেছিলাম। সেটা হয়ে গেছে।
‘দি, তুই চলে যাবি আমাকে রেখে?
‘তোকে রেখে যাব কেন? তুইও আমার সাথে যাবি। ওখানকার মেডিকেলে ভর্তি হবি।’
‘যদি চান্স না পাই!’
‘তুই পাবি আমি জানি। এখনো কয়েকমাস সময় আছে, এখন থেকেই ঘাটাঘাটি শুরু করে দে। কোন মেডিকেল কলেজ ভালো খোঁজ লাগা। আচ্ছা আমিই খোঁজ নেব। আর তোর ভিসার ব্যবস্থাও আমি করছি দাঁড়া।
তারপর হঠাৎ কানের দুলটার কথা মনে হতেই বলল, ‘তুই কি কোনো কারণে দেশ ছেড়ে যেতে চাচ্ছিস না? না চাইলে তুই প্রিয়াঙ্কার কাছে। থাকতে পারিস। আমি একা যাব। ওখানে আমার ইনকাম আরও বাড়বে। আরও ভালো থাকতে পারব আমরা সবাই।
‘না দি, এমন কিছু না। তুই যেখানে থাকবি আমিও সেখানেই থাকব। তোকে কখনো একা থাকতে দেব না। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়।
‘কী সমস্যা?
রায়ান আমতা আমতা করতে লাগল। পেট্রা বলল, ‘গার্লফ্রেন্ড?
রায়ান হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। পেট্রা বলল, এত সংকোচ করছিস কেন? আমি-প্রিয়াঙ্কা দুজনই স্কুলে থাকতে প্রেম করেছি। তুই তো বেশ বড় হয়েই করেছিস।
‘সেজন্য সংকোচ করছি না। আসলে…’
পেট্রাকে চিন্তিত দেখাল। জিজ্ঞেস করল, ‘আসলে কী?
‘ও মুসলিম!
‘সর্বনাশ! আমাকে দেখেও শিক্ষা হয় নি তোর?
রায়ান মাথা নিচু করে রইল। পেট্রা বলল, ‘সিরিয়াস রিলেশনশিপ? বিয়ে করবি ওকে?
‘হ্যাঁ।’
‘দেখ, আমাদের তো কোনো সমস্যা নেই। বাবা-মা থাকলে হয়তো মানত না। তবে আমাদের দুই বোনের কোনো আপত্তি থাকবে না। কিন্তু মেয়ের পরিবার?
‘কোনোদিনও মানবে না। অনেক কনজারভেটিভ ফ্যামিলি।
পেট্রা চিন্তায় পড়ে গেল। বলল, তাহলে কীভাবে বিয়ে করবি? প্ল্যান কী তোদের?
‘ও বাসায় মানাতে চাইবে, না মানলে একাই চলে আসবে, এরকমই প্ল্যান ছিল।
‘মেয়ে কতটুকু?
‘কলেজে পড়ে, ফার্স্ট ইয়ার। মেয়েটাকে তুই চিনিস।
‘আচ্ছা! কে?
‘আনিসা।
‘আনিসা? ও না তোর সাথেই পড়ে? তোর সব বন্ধুরা যখন বাসায় আসত, তখন আনিসাও তো আসত।
রায়ান মাথা চুলকে খানিকটা ভয়ে ভয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, বাসায় আনার জন্য মিথ্যা বলেছিলাম। আসলে আমার জুনিয়র।
পেট্রা হেসে দিল। বলল, ‘আচ্ছা, অসুবিধা নাই। তোরা এখনো ছোট, নিজেদের মতো পড়াশোনা করতে থাক। বিয়ের এখনো বহু দেরি।
‘হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই। কিন্তু দি, যদি পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই জোর করে আনিসাকে বিয়ে দিতে চায়?
‘আনিসা তখন আমাদের জানাবে, আমরা একটা ব্যবস্থা নেব।’
কিন্তু দেশে না থাকলে হুট করে এটা কীভাবে সম্ভব?
‘তুই ভাবছিস কেন? আমরা না থাকলেও প্রিয়াঙ্কা থাকবে, প্রিয়াঙ্কার বর থাকবে। ওরা হেল্প করবে।’
রায়ান এবার হুট করেই বলল, ‘দি, তুই কি প্রিয়দাকে তোর জীবন থেকে একেবারেই মুছে ফেলতে চাস? সেজন্যই পালাচ্ছিস?
পেট্রা রায়ানের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ চাই। আমি যতদিন ওর ত্রিসীমানায় থাকব ততদিন ও বাঁচতে পারবে না। আমি তার হাতের নাগালের বাইরে গেলে হয়তো সে আমার মধ্য থেকে বের হতে পারবে।
রায়ান অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইল। পেট্রা হেসে কথা ঘুরিয়ে ফেলল। খাওয়া শেষ করে টেবিল থেকে ওঠার সময় কানের দুলটা রায়ানের সামনে রেখে বলল, এটা বোধহয় আনিসার, ওকে দিয়ে দিস।
রায়ান এবার ঘাবড়ে গেল। পেট্রা উঠে বেসিনে হাত ধুতে লাগল। তার খুব হাসি পাচ্ছিল। কারণ রায়ানের চেহারাটা এখন দেখার মতো হয়েছে!