একে এক। দুয়ে দুই, দুই দুই। তিনে তিন, তিন তিন। চারে চার, চার চার।
মণ্ডলবাড়ির বাইরের উঠানে বসে ধান মাপে হামিদ সাকিদার। কয়েক হাত তফাতে। শরাফত মণ্ডল বসে রয়েছে ইজি চেয়ারে। আবদুল আজিজ ঘুমে-কাতর চোখজোড়া জোর করে খুলে রেখে নজর রাখছিলো দাঁড়িপাল্লার কাঁটার দিকে, ঘুম তাড়াতে তাকে মাঝে মাঝে উঠে দাড়াতে হচ্ছিলো কাঠের চেয়ার ছেড়ে। এই ধান তোলার সময়টা তাকে ঘন ঘন বাড়ি আসতেই হয়। কিন্তু এতো ছুটি তাকে দেবে কে? শনিবার বিকালে জয়পুরে ট্রেনে চেপে টাউনে নেমে টমটমে বাড়ি আসে রাত সাড়ে নটা দশটার দিকে। কাল মিনিট তিনেকের জন্যে শান্তহারে কানেকটিং ট্রেন মিস করায় বাড়ি পৌঁছুতে পৌঁছুতে ভোররাত হয়ে গিয়েছিলো, ঘণ্টাখানেকের বেশি ঘুমাতে পারে নি। যাক, এইতো কটা দিন। বর্গাদারদের ওপর সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকা যায় না। বাপজান বুড়া মানুষ, তার ওপর আর কতো চাপ দেবে?
দাঁড়িপাল্লার দিকে শরাফতের অতো নজর নাই, হামিদ সাকিদারের ওপর ভরসা করা যায়। শরাফত বেশিরভাগ সময়েই দেখছিলো শিমুলগাছের মাথার দিকে। বকগুলো ভোরবেলায় চলে গিয়েছিলো বিলের ওপর। ছোটো ছোটো আঁকে তাদের অনেকেই ফিরে এসে বসছে নিজেদের পছন্দসই ডালে। তাদের নজর উঠানের ধানের ওপর।
হাতের ভাপা পিঠায় আনমনে কামড় দিতে দিতে বারবার বিলের দিকে চলে যাচ্ছিলো আজিজের বড়ো ছেলে বাবর। শরাফত তাকে কয়েকবার কাছে ডেকে তার হাত ধরে বসিয়েছিলো ইজি চেয়ারের হাতলে। ছেলেটা বসে না, পিছলে পিছলে সরে পড়ে। এমনিতে শান্ত ছেলে, পড়ুয়া ছেলে, একমাত্র ভাইটা মরে যাবার পর কথাবার্তা তার যেন একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ধান মাপার দিকে শরাফত মন দিতে পারে না। চোখ দুটো তার ঝাপসা হয়ে আসে। বকের ঝাঁক পালা করে করে ধানের ক্রুপের ওপর দিয়ে ছোট্টো উড়াল দেয়। নিশ্চিন্ত শরাফতের চোখে মৃত নাতির শোকে ও জ্যান্ত নাতির বিষণ্ণতায় বাষ্প জমে ঘন হয়ে।
শিমুলগাছের নিচে বসেছিলো হুরমতুল্লা, আর ছিলো শমশের পরামাণিক, যুধিষ্ঠির কর্মকার। তাদের সবার সামনে মাটির খোরা ভরা দুধপিঠা, তাদের কোঁচড়ে কোঁচড়ে মুড়ি। তমিজ ছিলো হামিদ সাকিদারের গা ঘেঁষে। পিঠা কি মুড়িতে তার মনোযোগ নাই, শরীরের সমস্ত শক্তি দুই চোখে নিযুক্ত করে সে দেখে দাঁড়িপাল্লার ওঠানামা। দেখতে দেখতে ধানের স্থূপ উঁচু হয়ে ওঠে। ২ বিঘা ৭ শতাংশ জমির পাকির ১৮ মণ ১২ সের ধানের দিকে শমশের ও যুধিষ্ঠির তো বটেই, হুরমুতুল্লা পর্যন্ত তাকিয়ে থাকে মুগ্ধ চোখে। দাঁড়িপাল্লায় তমিজের নজর সেঁটে গেছে জিগার আঠার মতো, সেই নজর ছিড়তে গেলে চোখ দিয়ে তার রক্ত বেরুতে পারে। ফুলজানকে এই সাজানো ধান একবার দেখাতে পারলে হতো।–মাঝির বেটা, মাঝির বেটা বলে রাতদিন খোঁটা দিস, কোনো শালা চাষার বেটা এই পরিমাণ জমিতে এতো ধান ফলাতে পারবে? একবার দেখে যা মাগী, চোখ দুইটা দিয়্যা লয়ন ভরা দেখ।
পিঠা কয়টা খায়া সুস্থির মতো ভাগ করো। হামিদ সাকিদারের প্রতি শরাফতের এই নির্দেশ ছিনিয়ে নেয় তমিজের চোখের অর্ধেক জোর। ধানের এমন সোন্দর পালাটা মনে হচ্ছে কুড়াল দিয়ে টুকরা করে ফেলবে। বেশি লয়, আর একটা দিন কি এই ধানের পালাটা আমান রাখা যায় না? ফুলজানটাকে একবার দেখানো যায়। মণ্ডলের নোকসানটা কী? কাল আবদুল কাদেরের সামনে ভাগাভাগিটা করলে তমিজ একটু বল পায়।কিন্তু এতোগুলো মানুষের সামনে তমিজ কথাগুলো বলে কী করে?
হামিদ সাকিদারের পিঠা খাওয়া শেষ হলে শরাফত জারি করে পরবর্তী আদেশ, ভাগ করার আগে হাল, গোরু, লাঙল, মই আর কামলাপাট,জমির কামলা, হুরমতুল্লার বাড়িত কামকাজের মজুরি—ব্যামাক হিসাব করা লাগে।
হিসাব তো শরাফতের সবই মুখস্থ। তবু হাল, গোরু, লাঙল, মই আর কামলাপাটের কোনটা কতো দিন এবং কীভাবে খাটানো হয়েছে মুখে মুখে সে গুনতে থাকে। যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ করে এবং হিসাব মোতাবেক কয়েক মণ প্রথমেই আলাদা করে তার নিজের ভাগে রাখতে বলে। হামিদ সাকিদার ফের পাল্লা ধরলে নিংড়ানো বুকে ও চোপসানো মুখে তমিজ মিনমিন করে, হাল, গোরু ইগলানের হিসাব আর এ্যানা কম কর্যা ধরলে হয়। আর—
শরাফত সঙ্গে সঙ্গে মেনে নেয়, তাই সই। তুই আমার লয়া আধিয়ার, খন্দ করলু ভালো। হামিদ, এটি থাকা পাঁচ সের ধান অর ভাগোত দাও। দাও না বাপু, হামি কচ্ছি, দাও।
তমিজ তবু উসখুস করে। তার কালো মুখ লাল হতে হতে বেগুনির ওদিকে আর যেতে পারে না, এই কয়টা ধান দিলে হামাক আর কি দেওয়া হলো কন? আর। কামলাপাটের হিসাব ধরেনঃ কামলা তো আপনে লিজেই নিলেন। না হলে হামরা বাপবেটায় কয় দিনে ব্যামাক ধানই তুল্যা ফেলবার পারি না?
একটা খড় ধরে টানতে টানতে তমিজ আড়চোখে যুধিষ্ঠিরকে দেখে। তার চোখে কোনো ইশারা ছিলো কি-না বোঝা যায় না, থাকলেও কামারের বেটা তাকিয়ে ছিলো অন্যদিকে। তমিজের দিকে এখন শরাফতের চোখ, সেই চোখে খানিক আগের বাষ্পের লেশমাত্র নাই। চোখের তুলনায় গলা অনেক নরম করে সে বলে, লেয্য যা পাস তার চায়া তো অনেক বেশি দিলাম। হিসাব করা দেখিস?
আবদুল আজিজের চোখ থেকে ঘুম তখন একেবারে কেটে গিয়েছে, বাবাকে সে মনে করিয়ে দেয়, বাপজান, পানির বাবদ তো কিছু ধরা লাগে। ওইটা কিছু কলেন না।।
পানির জন্যে ফের কিছু ধান ধার্য করার কথায় তমিজের গলায় কারবালা ঢুকতে শুরু করে, এক গলা কারবালা নিয়ে সে হাঁসফাস করে। আবদুল আজিজ ব্যাপারটা। ব্যাখ্যা করে এইভাবে।কাল্লাহার বিল থেকে নালা কেটে জমিতে পানি দেওয়া হয়েছিলো, নইলে ওই জমিতে এতো ধান হয় কী করে? তো পানির খরচ ধরতে হবে। বিলের মালিককে দাম ধরে দিলে তার অর্ধেক দেবে জোতদার আর অর্ধেক বর্গাচাষী। বিলের মালিক হিসাবে পানির দাম পাবে শরাফত মণ্ডল, আবার জোতদার হিসাবে সে দেবে এর অর্ধেক, বাকি অর্ধেক দেবে তমিজ।
সবাই অবাক হয়ে আজিজের ব্যাখ্যা শোনে। তাদের বিস্ময় মোচনের দায়িত্বও আজিজের।-মোষের দিঘি থেকে নালা কাটার অনুমতি পেলে নায়েববাবুকে তো কিছু ধরে দিতেই হতো। তোমরা নায়েববাবুকে পয়সা দিতে পারো, আর মুসলমান জোতদারকে ন্যায্য পাওনা দিতে তোমাদের বুক টাটায়। এটা কী?
কিন্তু যুধিষ্ঠির বলে ওঠে, বাবু, জলের দামই যদি ধরেন তো হামার কথাটা বিবেচনা করা লাগে। কেন, তার কথা আসে কেন? – আপনের জমিত হামি লিজে জল দিছি কামারপাড়ার খাল থ্যাকা। খাটনি ষোলো আনা হামার, জলও হামাগোরে কামারপাড়ার খালের। সেটার খরচ ধরলে হামার কিছু পাওনা হয় না বাবু?
আবদুল আজিজের এই পানির ব্যাপারটা ভোলা শরাফত অনুমোদন করতে পারে।। মাঝিদের সামনে কাৎলাহার বিল নিয়ে এতো কথা ওঠাবার দরকার কী? তা এখন তো আর কিছু হটার জো নাই। হালটা ধরতে হয় শরাফতকেই। প্রথমে সামলাতে হবে যুধিষ্ঠিরকে, কামারপাড়ার খাল গেছে ওই জমির পাঁজরা দিয়া। খালের মধ্যে সেঁউতি ড়ুবালু আর জমিত পানি সেঁচলু, লয়? এর মধ্যে খাটনি কিসের? খাল কি তোর একলার? খালের দুই পাশের ছয় আনি সাড়ে ছয় আনি জমি তো হামার। পয়সা ধরার কথা আর কস না, ধরলে তোরই নোকসান।
আজিজ কিন্তু ওই খালের পানি নিয়ে যুধিষ্ঠিরের আর্জি বিবেচনা করার পক্ষে। সরকারি কর্মচারীদের কাছে আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। বৃটিশ রাজত্বে সূর্য যেমন অস্ত যায় না, তেমনি সেই সূর্যের কিরণ যাতে সব জায়গায় সমানভাবে পড়ে সেদিকে দৃষ্টি রাখাও বৃটিশ সরক র বাহাদুরের পবিত্র দায়িত্ব। এরকম একটি জুতের উপমা প্রয়োগ করে তৃপ্তি পেয়ে আজিজ যুধিষ্ঠিরকে আশ্বাস দেয়, হিসাবনিকাশ করে। তার যদি প্রাপ্য বেয়োয় তো তাকে কড়ায়গায় বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু আবদুল আজিজের এসব হাকিম কিসিমের কথাবার্তা তমিজের কানে ঢোকে কি-না সন্দেহ। সে বলে, নালা কাটনু তো হামি একলা। একদিন খালি কোদাল ধরিছিলো বুলুর বেটা। হামি কনু, তুই চ্যাংড়া মানুষ, পারবু না। হামি একলাই তো কাটনু। পানির দাম কী কচ্ছেন হামি বুঝিচ্ছি না।
বুলুক তো হামি নিয়োগ করনু। বুলু ওই কয়টা দিন হামার গোরুবাছুর দেখলো না। এখন তুই তাক দিয়া কি করিছু তুই জানিস। বলে আর শরাফত তার বাম্প-শুকিয়ে যাওয়া চোখ মোছে। করকর-করা চোখ নিয়েই সে বলে, তমিজ, তুই বেশি কথা কস। তখন হাতেপায়ে ধরলু, তোক জমি দিলাম। বর্গা করা তোর আরম্ভ হলো। লে, আরো কর। হাল কর, গোরু কর, লিজের হালগোরু লিয়া জমিত নাম। তোেক মানা করিছে কেটা? এংকা ক্যাচাল করিস না বাপু।
হালগোরুর কথায় তমিজ চুপসে যায়, শরাফত হুমকি দিচ্ছে। ওই জমিতে পেঁয়াজ রসুনের আবাদ করার সুযোগ হারাবার ভয়ে সে চুপ করে থাকে।
অর উকিল আজ গরহাজির, কথা না কয়া আসামির আর উপায় আছে? আবদুল আজিজ তমিজের দিকে কাদেরের পক্ষপাতিত্বের ইঙ্গিত করলে তমিজের রাগ হয় কাদেরের ওপর। কাদের আজ বেরিয়ে গেছে খুব ভোরে, সন্ধ্যার আগে ফিরবে না। আজ কি তার টাউনে না গেলেই হতো না।
পানি বাবদ আরো কিছু ধান মণ্ডলের ভাগে সরে গেলে নিজের ধান বস্তায় ভরতে তমিজের হাত আর সরে না। আজিজ এবার মনোযোগ দেবে অন্য বর্গাদারের ধান নিয়ে কেবল এসেছে যে গোরুর গাড়িটি সেই দিকে। আফজাল গাড়িয়াল বস্তা নামাচ্ছে তার গাড়ি থেকে। তমিজের দিকে তাকিয়ে সে জানতে চায়, গাড়ি লাগবি? চলো দিয়া। আসি। তমিজ বলে, এইকোনা ধান। তার আবার গাড়ি লাগবি? তমিজ ভারের ওপর তার ধানের বস্তা সাজায়।
আফজাল গাড়ি থেকে ধান নামানো শেষ করে শিমুলগাছের তলায় বসলে আবদুল ক আজিজ যুধিষ্ঠিরকে বলে, পৌষ মাস গেলো না, তুই আসিছিস ধান কর্জ লিবার। সোমাচারটা কী বাপু?
আপনাগোরে জমি বর্গা করা ধান যা পানু তাত তো দুই মাসের খোরাক হবি না। বাবা কচ্ছে, কয় মণ ধান কর্জ লিয়া আয়, জষ্টি মাসত পদুমশহরে লিশানের মেলার পরে।
হয় লগদ টাকা দিয়া শোধ করমু।
বুঝিছি। আবদুল আজিজের সঙ্গে আর সবাই বোঝে। নিশানের মেলায় লাঙলের ফলা, কোদাল, কুড়াল, কাস্তে, বঁটি এসব খুব ওঠে। অনেক দূরদূরান্ত থেকে চাষীরা আসে। করতোয়ার পুব থেকে যমুনার পশ্চিম পর্যন্ত কর্মকারদের থোক রোজগার হয় ওই মেলাতেই। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের কথায় শরাফত আমল দেয় না, যে ধান পাছু তাই আগে খায়া শ্যাষ কর। পরে আসিস।
না বাবু। ধান হামার এখনি দরকার। ধান নেওয়ার কারণ গোপন করতে যুধিষ্ঠির হিমসিম খায়, বাবার হাঁপরের মাল কেনা লাগবি।
খোয়াবনামা মিছা কথা কস কিসক? গণেশ কর্মকারের জমির বায়না দিবু, তোর তো মেলা পয়সার দরকার। ধরা পড়ে গিয়ে যুধিষ্ঠির চুপ করে থাকে। আবদুল আজিজ তাকে পরামর্শ দেয়, জগদীশের কাছে যাস না কিসক? তোর জাতের মানুষ, যায়াই দেখ।
যুধিষ্ঠির জিভ কাটে, কি যে কন বাবু, উনিরা কতো বড়ো জাত। হামরা এক জাতের মানুষ হই ক্যাংকা করা?
শাল সাহা হলো বড়ো জাতের মানুষ? আর আমরা আর তোরা একই জাতের পয়দা? কী কস? শুনে যুধিষ্ঠির দ্বিতীয়বার জিভ কাটে, কী যে কন? কী যে কন? কিন্তু তার মুখে আর কিছু আসে না। তাকে আর জেরার মধ্যে না ফেলে শরাফত বলে, কয়দিন বাদে আয় বাবা। হামার ধান সব আসুক। যুধিষ্ঠির তমিজের পিছে পিছে চলে গেলে শরাফত আজিজকে আস্তে করে ধমকায়, অতো জগদীশ জগদীশ করো কিসক? ট্যাকাটা হাতোত পালেই যুধিষ্ঠির গণেশ কর্মকারের জমি বায়না দিবি, বোঝো না? কয়টা দিন এটি ঘুরুক, গণেশ লিজেই হামার কাছে হাজির হবি।
ওদিকে বাড়ির খুলিতে ভার নামিয়ে তমিজ কাঁধের বাকটা বেড়ার সঙ্গে ঠেকিয়ে রাখতে না রাখতে ছুটে আসে কুলসুম। নিজেদের ধান ঘরে এলে কী করতে হয় বুঝতে পেরে সে দুই হাতই ঢুকিয়ে দেয় ধানের বস্তার ভেতরে, ধান তোমার কি সোন্দর হছে গো। এই ধানেত বছরের খোরাক হয়াও আরো থাকবি। এই ধানের বরকত আছে। গো।—কুলসুম প্রলাপ বকার মতো অবিরাম বলেই চলে। তমিজ তখন মাটিতে বসে পড়েছে হাঁটু ভেঙে, ডোবার ওপারে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে কথা বলছে যুধিষ্ঠির। কিছুক্ষণ কুলসুমের প্রলাপ শুনে তমিজ বলে, লাও, হছে। ভার আর ছালা আজাড় করা দাও। ধান লিয়া আসি।
বস্তা খালি করে ভারে রেখে কুলসুম এসে দাঁড়ায় তমিজের পাশে। শীতের দুপুরে তার ঘাড় ঘামে ভিজে গেছে। বাক বয়ে বয়ে তার ঘাড়ের ওপরে খানিকটা জায়গা একটু শক্ত, সেখানেও ঘামের বুদবুদ। কুলসুম তার শাড়ির আঁচলে তমিজের ঘাড় মুছতে মুছতে বলে, খুব ঘামিছো গো। খানিকক্ষণ জিরাও।
তমিজের বাপ ঘর থেকে বেরিয়েই বেড়া থেকে বাঁক ও মাটি থেকে ভার তুলে নিয়ে রওয়ানা হয় মণ্ডলবাড়ির দিকে, বলে, তুই জিরায়া লে। হামি না হয় কয় ভার লিয়া আসি।
কুলসুমের শাড়ির আঁচল ফিরে আসে তার নিজের হাতে, তমিজ সটান উঠে দাঁড়ায়। মণ্ডলবাড়িতে তমিজের ধানের পরিমাণ দেখে তার বাপের মেজাজটা আবার বিগড়ে যাবে, মণ্ডলকে কী বলতে ফের কী বলে ফেলবে, তার ঠিক নাই। শরাফত কি আজিজ যদি রেগে যায় তো জমিটা এবার তমিজ পাবে না। না, বাপকে যেতে না দেওয়াই ভালো। পা চালিয়ে ডোবার ওপারে গিয়ে তমিজ বাপকে ধরে ফেলে। বুড়া এতো জোরে জোরে পা ফেলছিলো কি ধানের খুশিতে? না-কি কারো ওপর জেদ করে? তমিজ আরো বেশি জেদ করে, তুমি ইগলান ধান ব্যামাক খুলির মধ্যে মেল্যা দাও। আর একটা গুদ দেওয়া লাগবি। বাকি ধান হামি লিয়া আসিচ্ছি। যুধিষ্ঠির আছে হামার সাথে।
শেষ কয়েক ভারে আসে খড়। যুধিষ্ঠির আর শমশেরও কয়েকবার বাঁক কাঁধে নিয়েছিলো। এই করতে করতে শীতের দুপুর একেবারে শেষ হয়ে আসে। তিন জনে ডোবায় নেমে গোসল করে হি হি করে কাঁপে। অল্প পানিতে ভালো করে গোসল হলো, মাঝখান থেকে হাত পা সব জমে যায় ঠাণ্ডায়। গতরে হিমের কামড়ে কাঁপতেও ওদের মহা আমোদ, ওরা চলে গেলেও আমোদর রেশ থেকেই যায়। এই ছোটো অনিয়মটাকেই ধান তোলার উৎসব গণ্য করে তমিজের বাপ কিছুক্ষণ গুড়ুর গুড়ুর করে হুঁকা টেনে ওটা রেখে দেয় ছেলের পেছনে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, ধান তো কিছুই দেয় নাই মণ্ডল। ধান কাটনু, তখন মনে হলো—
গোরু বেচ্যা দিছো, নাঙল হাল কিছুই তো ঘরত থোও নাই। ধান আর পাবা কতো? তমিজ রাগ করে প্রথমে বাপের ওপর, পরে কুলসুমকেও শাসায়, ও ফকিরের বেটি, আগে গোরু কেনা লাগবি, হাল নাঙল ইগলান করার পরে খাওয়া দাওয়া, বুঝিছো?
কী সোন্দর বাসনা গো তোমার ধানের। বুক ভরে ধানের গন্ধ নেয় কুলসুম, তামান ঘর, খুলি, আইঙনা ধানের বাসনাত ভুরভুর করিচ্ছে গো। পাগারের গোন্দ কুটি পলাছে দিশা পায় নাই।
ধানের সৌরভে ডোবার দুর্গন্ধ পালিয়ে গেছে এই তথ্যে কিছুমাত্র বিহ্বল না হয়ে তমিজের বাপ খেকিয়ে ওঠে, খালি বাসনা শুকলেই হবি? এই চাউলের ভাত লিত্যি খাওয়া যায়? এই ধান বেচা আউশ কেনা লাগবি।
এদের কারো কথাই গ্রাহ্য করে না তমিজ, ধান লয়, ধান লয়। ধান কেনা হবি। এই ধান সেদ্ধ করা চাউল বেচ্যা দিয়া আসমু গোকুলের হাটত, বুঝিছো? কিন্তু বাপ কি সত্য কারো গায়েই তার কথাগুলো লাগলো না দেখে তমিজ ফের বলে, খালি খাওয়ার চিন্তা! ফকিরের বেটি, জিভখানা এ্যানা খাটো করো গো, খাটো করো! চাউল হামি এক হাটোত বেচমু, আবার ওই দিনই পাঁচ কোশ উত্তরে দশটিকার গোরুর হাটত যায়া গোরু লিয়া আসমু।
ধানের খুশিতে কুলসুম খিলখিল করে হাসে, তোমার জিভখান এখন থামাও তো বাপু।
তার বাক্য মেনে তমিজ চুপ করে। ওখানে বসেই গোয়ালঘর করার একটা জায়গা খোজে। আকালের আগে যেখানে গোরু থাকতো সেখানে এখন তমিজের ঘর। ওই ঘরের উত্তর পশ্চিমে একটুখানি জায়গায় ছোটো একটা একচালা করে দিলেই দুটো গোরু থাকতে পারে। দুটো গোরু, হাল, লাঙল, জোয়াল, মই,—সবই সে করে ফেলবে সামনের খন্দ তোলার পরেই। তার বাপের খোরাকটা বড়ো বেশি। কুলসুমটাও বেশি। খলবল করে—এই যে পঁচসেরি ধামায় ধান নিয়ে কালাম চাচার টেকিত যাই। আজই তোমাগোরে পিঠা খাওয়ামু। ধান ঘরত তুল্যাই পিঠা খির না হলে ওই ধান বরকত দিবি
গো। বলতে বলতে সে চলে যায় চেঁকির আওয়াজ মুখরিত কালাম মাঝির বাড়ির দিকে। তার খিলখিল হাসির কুচি পড়ে থাকে সারা বাড়ি জুড়ে, সেই আওয়াজে মিশেল ছিলো জোড়া গোরুর মিষ্টি নিশ্বাস। আর ছিলো ধানের পালার চূড়ায় আরো ধান রাখার ঝরঝর ঝরঝর আওয়াজ।-আবদুল কাদেরকে বলে মণ্ডলের কাছ থেকে আরো কিছু ধান নেওয়া যায় না? বিলের পানি বাবদ ধান কেটে নেওয়ার ইচ্ছা শরাফতের তো ছিলোই না। বড়ো বেটার কথায় মেনে নিয়েছে। এখন কাদের যদি বাপকে ভালো করে বোঝায় তো মণ্ডল কি তার কথা শুনবে না? সন্ধ্যা তো হয়েই এসেছে, গোলাবাড়ি গেলে।
এখন কাদেরকে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
ক্যা গো, আজ না হাটবার। যাই দেখি, মাছ টাছ কিছু পাই যদি। তমিজের হাঁকে সাড়া দেবে কে? কুলসুম তো এখন কালাম মাঝির বাড়িতে। তমিজ নিজেই ঘরে ঢুকে মাছের খলুই নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ফের ঘরে ঢুকে সর্ষের তেলের শিশিটা ঝুলিয়ে নিলো আঙুলের মাথায়।
গোলাবাড়ি হাটের কাছাকাছি পৌঁছুলে বোঝা যায, হাট এখন ভাঙার পথে। সন্ধ্যা নামছে গাঢ় হয়ে। হাটুরেরা সব বাড়ি ফিরে যাচ্ছে; তাদের বেশিরভাগের হাতে একটা ঝোলা কি মাছের খলুই। আরেক হাতে ঝোলানো তেলের শিশি। কারো শিশি দুটো, একটায় সর্ষের তেল, আরেকটায় কেরোসিন। তারা সব মাছের দাম নিয়ে চালের দর। নিয়ে আলাপ করে। সামনে যে হাটুরেকেই পায় তমিজ তাকেই চালের দর জিগ্যেস করে, শুনে বলে, চালের দর মনে হয় এবার আর উঠবি না। নোকসান হবি। গলায় সে। জোতদারদের মতো এক ধরনের হতাশা তৈরির চেষ্টা করে।
কাদেরের দোকানে হ্যাজাক জ্বলছে, তার মানে এখনো মেলা মানুষ আছে। ভেতরটা লোকে ভর্তি। ক্যাশবাকসের পাশে নতুন একটা বড়ো জলচৌকি, একটু উঁচু এই জলচৌকিতে সাজানো আয়না, চিরুনি, কাঁকই, আলতা, সিঁদুর কৌটা, পাউডার। আরো অনেক কিছু আছে, তমিজ ওগুলো চেনে না। জলচৌকির পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে গফুর কলু। এখন বেচাকেনা বন্ধ হয়ে গেছে। তা হলে ওই শালা কলুর বেটা ওখানে। করে কী? সে বোধহয় জিনিসপত্র পাহারা দিচ্ছে। কর শালা চৌকিদারের কামই কর। টাউনে এইসবের দোকান তমিজ কয়েকটা দেখেছে, তবে ওখানে যারা বিক্রিবাটার কাজ করে তারা কি আর কলুর বেটার মতো লুঙি পরে নাকি? ধুতিপরা সেসব মানুষের চেহারা আলাদা। তবে কেরোসিনের সঙ্গে এখানে হালকা মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, এই গন্ধ টাউনের ওই দোকানগুলোর সামনে দিয়ে যাবার সময় সে পেয়েছে।
ঘরের মানুষগুলির মধ্যে খদ্দের কেউ নাই, এরা সব কাদেরের পাট্টির মানুষ। কয়েকটা ছেলেকে কাদের বোঝাচ্ছে, তোমরা সবাইকে বলবো, মোসলমানের মধ্যে তো চাষাই বেশি। অবস্থা ভালো আর কয় জনের? মোসলমানের দল চাষার স্বার্থ না দেখলে আর কে দেখবে? বুঝিছো? এটা তো ঠিক কথাই যে, হক সাহেব খুব বড়ো নেতা। মোসলমান একদিন একবাক্যে তাকে ইমাম মানিছে, তার কথায় ওঠাবসা করিছে। কিন্তু তিনি তো গেলেন হিন্দু মহাসভার সাথে। যে হিন্দু মোসলমানের হাতে পানি খায় না, মোসলমান দেখলে ঘিননা করে, দেখো না নায়েববাবু বুড়া বুড়া মুরুব্বি মানুষের সাথে। তুই তোকারি করে কথা কয়, সেই হিন্দু জাতের সাথে হাত মেলালে হক সাহেবকে নেতা মানি কীভাবে? ভালো করা বুঝায়া কবা, বুঝিছো?
রানীরপাড়া স্কুলের একটি ছেলে কী জিগ্যেস করলে কাদের কয়েক পলকের জন্যে চুপ করে কী একটা ভেবে নেয়। তারপর দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে শুরু করে, আরে গরিবের জন্যেই তো পাকিস্তান দাবি করা হচ্ছে, এটা বোঝাবার পারো না? পাকিস্তানে ধনীরা জাকাত ফান্ডে টাকা না দিলে পুলিস ওই ধনী লোককে এ্যারেস্ট করবে। আইন পাস হবে। গরিব না খেয়ে থাকবে না, জাকাতের টাকায় হক থাকবে গরিবের।
জাকাতের কথা ওঠে কেন বাপু? চাষাক ভিক্ষা দেওয়ার কথা ওঠে কেন? চাষার পাওনাটা দিয়া দিলেই তো মিট্যা যায়। চাষার যা খাটনি, আদ্দেক ফসলে তার পোষায়, তুমিই কও তো বাপু?
পেছনের বেঞ্চ থেকে আলিম মাস্টারকে হঠাৎ কথা বলতে দেখে কাদের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়, আরে মাস্টার সাহেব, আসেন, এখানে আসেন। আপনে চ্যাংড়াপ্যাংড়ার সাথে পেছনে বসিছেন কেন? আলিম মাস্টার সামনে গিয়ে আরেকটি বেঞ্চে বসে বলে, বাবাজি, আমার কথাটার জবাব দিলা না? গরিবের দেশ হলে জাকাতের দরকার কী?
না। মানে, দুই চারটা বড়োলোক যারা আছে তাদের টাকা আদায় করা গরিব মানুষের মধ্যে দেওয়া হবে। পাকিস্তান হলে চাষার হক আদায় করার আইন পাস হবে। জমিদারি প্রথা উঠায়া দেওয়া হবে। তাহলে জমির মালিক হবে কে? আপনি বলেন।
মোসলমান জোতদাররাই তখন জমিদারের কামগুলান করবি। চাষার লাভ কী?
কী যে কন? তেভাগা পাস হলেই চাষার হক কায়েম হয়। কিন্তু মাস্টারের জবাব এখনো দেওয়া হয় নি বুঝতে পেরে কাদের নতুন প্রসঙ্গ তোলে, দাঁড়ান, একটা বই দেই। আপনাকে। দেখেন, প্রাইমারি শিক্ষা ফ্রি করা হবে, কম্পালসারি ফ্রি এড়ুকেশন। তাতে তো লাভ চাষীদের, না কী?
বুঝলাম। কম্পালসারি করো, আর ফ্রি করো, আধিয়ার চাষা কোনোদিন বেটাক ইস্কুলে দিবার পারবি না। চাষার উপযুক্ত হিস্যা দাও, তার অবস্থা ভালো হলে পয়সা খরচ করা ইস্কুলে ভর্তি করা দিবি। এই ন্যায্য হিস্যার কথা তুললে জোতদাররা পুলিস ডাকে, এটা কেমন কথা বাপু?
কাদেরের সন্দেহ হয়, এই আলিম মাস্টার লোকটা কোন পক্ষের মানুষ একটু গম্ভীর হয়ে সে বলে, মাস্টার সাহেব, খিয়ার এলাকায় আধিয়াররা যা করতিছে, তাতে মোসলমানের একতা নষ্ট হচ্ছে না?
কিন্তু জোতদার তো মোসলমান কম নাই। মোসলমান চাষা হিস্যা চাইলে তারা পুলিস ডাকে কিসক?।
এবার কাদের চূড়ান্ত সমাধানের কথার পুনরাবৃত্তি করে, পাকিস্তান হোক, চাষার হিস্যা খোললা আনাই পাওয়া যাবি। এখন গোলমাল করলে সবারই লোকসান।
এই তর্কের যেটুকু তমিজ বুঝেছে তাতেই সে বেশ উত্তেজিত। এইবার কাদেরকে বলে তার বাপের কাছ থেকে মণখানেক ধানও যদি নেওয়া যায়। উত্তেজনায় ওখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকাও মুশকিল। এদিকে কাদেরের দোকান থেকে ছেলেপিলে কখন যে চলে যাবে তারও ঠিক নাই। বাইরে বেরিয়ে দেখে, কালাম মাঝির দোকানে কুপি জ্বলছে। কালাম কয়েকদিন বাড়িতেই ধান তোলা নিয়ে ব্যস্ত, দোকানে বসেছে লালু, কালাম মাঝির সম্পর্কে ভাস্তে। মাছ তো আজ কেনাই হলো না। লালুর কাছ থেকে সর্ষের তেল আর বুটের ডাল নেওয়া যায়। বুটের ডাল অনেক দিন খাওয়া হয় না। কুলসুম চিতই পিঠা করলে বুটের ডাল দিয়ে খাওয়া যাবে। কিন্তু কালাম মাঝির দোকানে পৌঁছুবার আগেই ডাক দেয় বৈকুণ্ঠ।
বটতলায় বাঁধানো চাতালে একটা কুপি জ্বলছে, পাশে একটা নকুলদানার ডালা। নকুলদানাওয়ালা বোধহয় ডালাটা বৈকুণ্ঠের হেফাজতে রেখে কোথায় গিয়েছে; কিন্তু এ যেভাবে একটু একটু করে মুখে তুলছে তাতে লোকটা ফিরে এসে শুধু ডালাটাই পাবে।। আর খায়ো না বলে ডালার দিকে একটু এগোতে তমিজের মাথা টলে যায় : এ কী? চেরাগ আলি? কুয়াশা ও অন্ধকারে লোকটার কালো মুখ লম্বাটে হয়ে মিশে গেছে আরো ঘন অন্ধকারে, তার বাবরি চুলও হাটের অন্ধকার এই জায়গাটির অংশ ছাড়া আর কিছুই নয়। তমিজের সামনে অন্ধকার দোলে, কয়েকটা দোকান পরে মুকুন্দ সাহার আড়ত, আড়তের মশলার গন্ধ বটতলার কুপির আলো উস্কে দেয়, সেই কালো আলোতে ভর করে বটতলা সরে যায় অনেক দিন আগে এবং এই অন্ধকার লোকটির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গলা মেলায় কালো ছিপছিপে একটি বালিকা। কালো আলোয় এর হাতের দোতারা দেখা যাচ্ছে না, সেটা কি সে লুকিয়ে রেখেছে তার মস্ত লালকালো তালি দেওয়া আলখাল্লার ভেতরে? তার হাতের সেই লোহার লাঠিটা তবে কোথায়? গান করার ফাঁকে ফাঁকে চেরাগ আলি ফকির হঠাৎ হঠাৎ করে থেমে দম নিচ্ছিলো আর তখন ওই কথাগুলো গাইছিলো ওই কালো মেয়েটি, খোয়াবে কান্দিল বেটা না থাকে উদ্দিশ। গাইতে দিয়ে চেরাগ আলির মুখের হাঁ খুব বড়ো হয়ে গেলে তমিজ হেসে কুটি কুটি হচ্ছিলো, কে যেন তাকে ধমকে দেয়। কে সে? তবে রাগে ও কষ্টে ছলছল চোখ করে মেয়েটি তার দিকে তাকিয়েছিলো, সেটা কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে। অনেক বছর উজিয়ে সেই মেয়েটিকে নিয়ে চেরাগ আলি কি ফের প্রথম থেকে হাজির হলো এখানে?
তোর বাপ কুটি রে? বৈকুণ্ঠ গিরি জিগ্যেস করলেও আন্ধারে ওই ছবি চট করে। নিভে যায় না। তবে তার রঙ ফিকে হয়ে আসে। হামি কনু, তমিজের বাপ হাটোত আসেই না আজকাল। তাইও একরকমের ফকিরই হয়া গেছে এখন। মানষে কয়, তমিজের বাপে ঘরত বস্যা খালি টোপ পাড়ে আর রাত হলে নিন্দের মধ্যে পাকুড়তলা যায়া ঘোরে। মানষে তো আসল কথা জানে না। বৈকুণ্ঠ অবিরাম কথা বলে, ক্যারে তমিজ, চিনিস? চেরাগ আলির পরিচয় দেয়, চিনিস না, না? চেরাগ আলি ফকিরের শিষ্য আছিলো, সাগরেদ, সাগরেদ। এটিকার মানুষ লয়। ফকিরের সাথে চেনা আছিলো অনেক আগে, কিন্তু মেলামেশা হছে খিয়ারেত গেলে। লয় ফকির?
লোকটা যে চেরাগ আলি ফকির নয় বোঝার সঙ্গে সঙ্গে চেরাগ আলি এবং ছিপছিপে বালিকা তমিজের সামনে থেকে মুছে যায় এবং ওই সাথে উড়াল দেয় সেই অনেক আগেকার মেঘলা বিকালবেলাটিও। বৈকুণ্ঠ এলোমেলোভাবে তার সম্বন্ধে অনেক কথা বলে। চেরাগ আলি নাকি লোকটিকে বলে দিয়েছে, সে যেন গিরিরডাঙা গ্রামে গিয়ে তার নাতনি আর নাতজামাইয়ের সঙ্গে দেখা করে। তমিজের বাপকে সে অনেক গোপন কথা বলবে, সেসব তত্ত্বকথা, এখানে কি সেই কথা বলা যায়?
তমিজ জিগ্যেস করে, আপনের বাড়ি?
বাড়ি আমার পুবে। তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বৈকুণ্ঠই তার পরিচয় দেয়। আকালের সময় এই কাছেই, নিজগিরিরডাঙা গ্রামে তার বৌবাচ্চা রেখে সে চলে যায় খিয়ারে। তার হলো গান গাওয়ার নেশা। খিয়ারের মানুষের মধ্যে তার গান খুব চলে, টাউনেও তার গানের চাহিদা খুব। এখন শুধু গানই করে বেড়ায়।
তমিজের সন্দেহ হয়, এই হলো ফুলজানের হারিয়ে-যাওয়া স্বামী। এখন তমিজের সামনে এই অন্ধকারে কুপির আলো থেকে হলদে জ্যোৎস্না ঝরতে শুরু করে। সেই জ্যোৎস্নায় ড়ুবুড়ুবু ধানখেতের পাশে সরু আল, সরু আলের ওপর দাঁড়িয়ে-থাকা জমাট-বাঁধা জ্যোৎস্নাকে ছুঁতে গেলে সে সরে যায় মোষের দিঘির ওদিকে, তমিজ তাকে ধরতে সেদিকে যেতেই সেই জুমাননা জ্যোৎস্না উড়াল দেয় মোষের দিঘির ওপর, দিঘির গোলাপি পানির আভায় তার কালো মুখের ছায়া। কালো ছায়ায় চিবুকের নিচে ঘ্যাগের আবছা আকার নিয়ে ছোট্টো একটি বিন্দুতে ঢুকে পড়ে সে মিশে যায় কুয়াশার খাপের ভেতর। আর আকাশ জুড়ে ওড়ে তমিজেরই দেওয়া রেড ক্রসের র্যাপার। কেরামত আলির গায়ের চাদর কি ওটাই নাকি? তমিজ বারবার তাকে দেখে। এতে লোকটা একটু উসখুস করে। হয়তো অস্বস্তি কাটাতেই সে বলে, তোমার নাম তমিজ? তোমার বাপের সাথে মেলা কথা ছিলো গো। ফকিরের বেটিকও অনেক কথা কওয়ার আছে। কাল পরশু তোমাদের বাড়ি যাবো।
লিচ্চয়। হামার সাথে যাবা। ঘাটা চিনায় লিয়া যামু। বৈকুণ্ঠ তার সঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব করেই অনুরোধ করে, ওই গানটা আর একবার গাও তো। তোমার গলাখান বড়ো মিঠা।
এর মধ্যে ১৫/১৬ বছরের একটি ছেলে এসে তার নকুলদানার ডালা তুলে নেয়, বলে, ও বৈকুণ্ঠদা, তুমি ব্যামাক খায়া ফালাছো গো। পয়সা দিবা না?
বৈকুণ্ঠের হাতে তখনো কয়েকটা নকুলদানা। ছেলেটিকে সে ধমক দেয়, আরে ফকির মানুষ তোর নকুলদানা খাছে, তোর ভাগ্য। দে তো তমিজ, চারটা পয়সা দে তো এই ছোঁড়াক।
কেরামত একটা দুয়ানি ছেলেটির হাতে দিলে বৈকুণ্ঠ একটুখানি ক্ষোভ জানায়, আরে, জগদ্বন্ধুর বেটা, তোর বাপ কতো মানষেক বাদাম খিলাছে মাগনে, আর তুই আজ পয়সা লিলু ফকির মানষের কাছ থ্যাকা?
আমরা ফকির নই। কেরামত আলি প্রতিবাদ করে, ফকির হওয়া কি মুখের কথা? আমরা গান বান্দি, শায়েরি করি। গান লিখি, গান ছাপায়া বেচি। আমরা ফকির নই। এই কথা থেকে তার বিনয় বা অহংকার বোঝা কঠিন।
ওই তো হলো। বলে বৈকুণ্ঠ কেরামত আলির হাত ধরে টানে, চলো, ওই ঘরত চলো। ওটি লিত্যি সভা হয়। মেলা মানুষ পাবা। একটা গান করা যাও।
কাদেরের ঘরের আলোচনাকে অগ্রাহ্য করে দরজায় দাঁড়িয়ে বৈকুণ্ঠ হাঁক দেয়, ও দাদা, দেখো। কোন মানষেক ধরা লিয়া আসিছি, দেখো। গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তার মাঝখানে এরকম উটকো কথায় কাদের বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকালে সে ফের প্রায় চেঁচিয়েই বলে, দাদা, হামাগারে লিজগিরিরডাঙার জামাই গো। তারপর কেরামতের। দিকে মুখ ফিরিয়ে সে একই স্বরে জানতে চায়, ও, সেই বৌয়ের সাথে তোমার তালাক হয়া গেছে না? তোমাগোরে জাতেত তো আবার মুখের কথাতই তালাক, মুখের কথাই লিকা।
জাত তোলায় লীগের কর্মীদের রাগ করার কথা। কিন্তু কাদের ভায়ের কাছে এই লোকটার সাত খুন মাফ। তবে বিরক্ত হয়েছে সবাই। বৈকুণ্ঠ তার শ্বশুরবাড়ির কথা বলায় কেরামত আলিও ভুরু কোঁচকায়। সে নিজেই এবার সবার কাছে নিজের পরিচয় নিবেদন করে, জে, আমার নাম কেরামত আলি, নিবাস পুবে, যমুনার পশ্চিমে, গায়ের নাম আতামারি!
কে যেন বলে, আতামারি? চরের মানুষ?
জে না। আমরা কায়েমি জায়গার মানুষ ছিলাম। আকালের সময় আমাদের এলাকার মানুষ সব মরলো, দশ আনা মানুষই শ্যাষ হলো। আকালে মানুষ খালো তো। ফাঁকা গাঁওখান গিললো যমুনা। আমাকে চরুয়া বলে হেলা করবেন না। মান্যজনের নিকট এই আমার নিবেদন।
তার হাত জোড় করে কথা বলা দেখে সবাই হাসে। সবচেয়ে বেশি হাসে বৈকুণ্ঠ, কেরামত আলির যাবতীয় কৃতিত্বে সে গর্বিত। বলে, যি সি মানুষ লয়, ফকির চেরাগ আলির সাগরেদ। নামেই চেনা যায়, গুরুর নাম চেরাগ আলি, শিষ্য হলো কেরামত আলি। শিষ্য এখন লিজেই ফকির হয়া দ্যাশ জুড়া গান কর্যা বেড়ায়।
জে না। আমরা ফকির নই। ফকিরি গান করি না। আমরা গান বান্দি, নিজে গান বান্দি, নিজে গান লেখি, হাটে হাটে গান করি, গানের বই বেচি।
কাদের বলে, গান লেখো? বাঃ গানের বই আছে তোমার?
জে। চারখান বই আমার বাজারে চালু। তবে উপস্থিত নাই, বই তো মজুত রাখবার পারি না। পাইকাররা একেক হাটে পঞ্চাশ ষাটখান বই লিয়া যায়। আপনাদের বাপমায়ের দোয়ায় আর তেনার রহমতে বই আমার পড়ে থাকে না।
ভালো ভালো। কাদের এই কবিকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে চায়, ভালো। কাল বিকালে আসো তোমার গান শোনা হবে। ভালো হলে পাকিস্তানের দাবি লিয়া একটা গান লেখায়া নেবো। দেখি ইসমাইল সাহেবকে দিয়ে তোমার গান তেমন হলে নাহয় ছাপাবার বন্দোবস্ত করা যাবে।
আলিমুদ্দিন মাস্টার অনুরোধ করে, এখন একটা গান শোনাও তো দেখি।
আলিম মাস্টারের এই নির্দেশ কাদেরের কাছে অনধিকারচর্চা মনে হলেও তার পক্ষে প্রতিবাদ করাও মুশকিল। লোকটিকে তার পছন্দ হলেও নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে তাকে জোরে হুকুম দিতে হয়, কও। দুই লাইন শুনি।
বৈকুণ্ঠ উৎসাহ দেয়, গাও, ওইটা গাও। হামাক শোনালা না? ওইটা গাও।
কেরামত আলি চাঁদরের নিচে একটা ঝোলায় হাত ঢুকিয়ে পৃষ্ঠা চারেকের রোগা একটা ছাপানো বই বের করে চোখের সামনে মেলে ধরে মাথা ঝাঁকিয়ে বাবরি চুল পেছনে ঠেলে দেয়। তারপর গুণগুণ করে,
বিসমিল্লা বলিয়া শুরু করে কেরামত।
ভারতবাসীর উপরে আল্লা কর রহমত–শুন সব্রজনে।
শুন ব্ৰজনে শুধু মনে হিন্দু মোসলমান।
সোনার বাঙলার চাষীর দুস্কে ফাড়িবে পরাণ রক্ত করি জল
রক্ত করি জল সোনার ফসল চাষা ফলায় মাঠে।
অনাহারে উপর্বাসে জেবন তাহার কাটে।।
চাষার গান? গান থামিয়ে কাদের বলে, বাঃ বাঃ। কাল তুমি একবার আসো। দেখি তোমাক দিয়া ভালো একটা গান লেখানো যায় কি-না। হাই তুলতে তুলতে বলে, রাত হলো। কামের কাম কিছুই হলো না। কর্মীদের বলে, তোমরা কাল সকাল সকাল আসো, সন্ধার আগেই আসো। রাত হলে এর গানও শোনা যাবে। না কি কও হে কবিঃ এসব কথায় কেরামতের গানের প্রতি তার অনুরাগ বা উদাসীনতা কিছুই বোঝা যায় না। কেরামত আলি গাইতে শুরু করতে না করতেই তাকে থামিয়ে দিয়ে আলিম মাস্টারের নির্দেশটি অকার্যকর করার তৃপ্তিতে খালি পেটের দরুন ঢেকুর তুলতে না পেরে সে আরেকবার সশব্দ ও লম্বা হাই তোলে।
গানটি ভালোভাবে গাইতে না পারলেও এরই মধ্যে কেরামতের বাবরি চুলের ওঠানামা সবচেয়ে বেশি মনোযোগ পেয়েছে তমিজের। এক লাইনে কেরামত তার বাবরি চুল মাথার এক ঝাকুনিতে নিয়ে আসে সামনে, চোখমুখ ঢেকে তার মুখ অন্ধকার হয়ে যায় এবং পরের লাইনে এসে আরেকটি ঝাকিতে মেঘ কাটালে হ্যাজাকের আলোয় জ্বলজ্বল করে তার চোখ দুটি। বাবরিতে কী যে আছে যে একেকটা ঝাকির সঙ্গে চুলগুলো একেবারে কুঁসে ফুঁসে ওঠে। মাত্র কয়েকটা কথাই সে গাইলো, তার গান শোনার পিপাসায় তমিজের বুকটা খা খা করতে থাকে। গানের সব কথা সে ধরতে পারে নি। গায়কের চুলের ঢেউ খেলানোর দিকে বেশি মন দেওয়ায় গানের কথার অনেকটাই তার কান পিছলে গেছে। কিন্তু এর মধ্যেই কানের ভেতরে ঢোকা, কথাগুলো তার মাথায় কুটকুট করে কামড়ায়। আরো শুনতে পারলে কামড়ানিটা হয়তো সারতো।