২০. একটা বেতের মোড়া

২০

বিছানা থেকে উঠে একটা বেতের মোড়ায় বসেছিল সুজাতা দাস। অকারণে এতোটা ঝিমিয়ে পড়ার কোনো যুক্ত নেই। যা হবার তা তো হয়েছে। এখন শুধু ফলাফলের জন্যে অপেক্ষা। শরীর ও মন তবু বুঝতে চায় না ।

শিশি থেকে ভারমুথ বার করে সুজাতা কিছুটা খেয়ে নিলো । বোতলটা ম্যাক্স দিয়েছিল– এতে নাকি নার্ভ শক্ত হয় ।

ম্যাক্সের কাছে মাথা নিচু করেনি সুজাতা। সোজা বলেই দিয়েছে, সে নাবালিকা নয় । বুঝে-সুঝেই যা করবার করেছে। অবাঞ্ছিত কিছু ঘটে থাকলে তার দায়-দায়িত্ব সে শীলারের ওপর চাপাবে না। কিন্তু ম্যাক্স অসভ্য নয়। সে বুঝতে পারছে, দুটো সপ্তাহ থাকতে পারলে সুজাতা ভরসা পেতো। একবার জার্মানিতে পৌঁছলে কোথায় সে হারিয়ে যাবে। হয়তো সেখানেও থাকবে না, থাইল্যান্ড কিংবা ভেনেজুয়েলাতে পাঠিয়ে দেবে।

নিজের এই বিপদে পরামর্শ করবার মতো আপনজন কেউ নেই । পুরানো পরিচিতের মধ্যে মল্লিকা। কিন্তু সে তো অফিসারের বউ। সে তো দূরত্ব কমায়নি; সুজাতা অসুস্থ জেনেও একবার খবর নেয়নি। স্বামীর আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়েই সে বুঁদ হয়ে আছে–তার বাইরে তাকাবার মতো উদারতা কোথায়?

বাইরে জিপগাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেলো । কলিং বেল বেজে উঠলো এবার। ম্যাক্স আবার ফিরে এলো নাকি? কাল সকালেই তো চলে যাবে বেচারা ।

ম্যাক্স নয় । পরিবর্তে সুদর্শনবাবুকে দেখে চমকে উঠলো সুজাতা ।

সুদর্শন সেন রীতিমতো উদ্বিগ্ন। মাথার টাকে ফোঁটা-ফোঁটা ঘাম জমা হয়েছে ।

হাঁপাতে-হাঁপাতে বললেন, “কিছু মনে কোরো না, বিনা নোটিশেই চলে আসতে বাধ্য হলাম । আমাদের প্রোজেক্ট ম্যানেজারের কোনো খবর রাখো?”

“আজ তো আমি অফিসেই যাইনি,” সুজাতা উদ্বিগ্ন হয়ে উত্তর দিলো ।

সুদর্শনবাবু মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “ভদ্রলোক তো খবর না দিয়ে কোথাও যান না । অথচ যেখানে বাঘের ভয় সেইখানেই সন্ধে হয়।”

কমলেশ রায়চৌধুরীকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন সুদর্শনবাবু এবং প্রোজেক্টের লোকেরা । ওঁরা বাড়িতে ফোন করেছিলেন। সেখানে কেউ ফোন ধরে না। সুদর্শনবাবু নিজেই ছুটেছিলেন বাড়িতে–কিন্তু নো পাত্তা। অফিসে, কারখানার সেকশনে সেকশনে কমলেশ রায়চৌধুরীকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন সুদর্শন সেন ।

শেষ পর্যন্ত সুজাতার কাছে চলে এসেছে। ধর্মপুরে ওঁর কে এক ভায়রাভাই আছে, সেখানকার টেলিফোন নাম্বার যদি জানা থাকে । অফিসে যদি কোথাও লেখা থাকে, তাহলে সুজাতাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে অফিস খোলাবেন সুদর্শনবাবু। না অফিসে নেই–নাম্বারটা কমলেশ রায়চৌধুরীর পকেট-ডাইরিতে লেখা থাকে ।

“ভায়রাভাই ধর্মপুরে কি করেন?” সুদর্শনবাবু জানতে চান । ভদ্রলোককে সুদর্শনবাবু দেখেছেন, কিন্তু নামধাম চাকরি কিছুই খোঁজ করেননি ।

সুজাতাও ঠিক মনে করতে পারছে না। “বোধহয় ব্রিটিশ এক্সপ্লোসিভে কাজ করেন । বউয়ের নাম বোধহয় রিংকি । “

ঐ নাম নিয়ে কি করবেন সুদর্শনবাবু? “বউয়ের ডাকনাম তো টেলিফোন এনকোয়ারিতে জানানো থাকে না । ভদ্রলোকের নামটা একটু মনে করবার চেষ্টা করো না।” সুজাতাকে অনুরোধ করলেন সুদর্শনবাবু।

সুদর্শন সেন শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে বললেন, “দেখি, ওঁর বাড়ির এ-মাসের ট্রাঙ্ক টেলিফোন বিলটা অফিসে আছে কিনা। ওখানে নিশ্চয় দু-একটা ধর্মপুর কল থাকবে।

“ব্যাপারটা কী? ভদ্রলোক যদি একদিন বেরিয়েই থাকেন?” সুজাতা জিজ্ঞেস করে ৷

“খুব সিরিয়াস ব্যাপার মা। প্রিলিং টাওয়ারে অ্যাক্সিডেন্ট।” সুদর্শনবাবু গভীর উদ্বেগের সঙ্গে জানালেন ৷

“অ্যাক্সিডেন্ট! কেউ খুন-জখম হয়েছে নাকি?”

“খুন-জখম হতে হতে বেঁচে গেছে। এখন বোঝা যাচ্ছে না, দিগম্বর বনার্জির ডিজাইনের দোষ, না অন্য কিছু হয়েছে। রায়চৌধুরী সায়েবকে না পেলে খুব মুশকিল,” এই বলে হন্তদন্ত হয়ে সুদর্শনবাবু বেরিয়ে গেলেন ।

ম্যাক্স কোথায়? সুজাতার একবার ইচ্ছে হয়েছিল জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু সাহস হলো না তার; একটু ভয়ও লাগছিল সুজাতার।

ভয়টা হঠাৎ ভালো লাগায় রূপান্তরিত হলো। ম্যাক্সকে অকস্মাৎ ভীষণ ভালো লাগছে সুজাতার। মনে হচ্ছে ম্যাক্সের দায়িত্ববোধ আছে, ম্যাক্সের ওপর নির্ভর করা যায়।

২১

ধর্মপুরে ব্রিটিশ এক্সপ্লোসিভ কোম্পানির অফিসারের ঘরে-ঘরে তখন সুন্দরী মহিলাদের সযত্ন প্রসাধন পর্ব চলেছে। রিংকি এবং ঝুমু ড্রেসিং টেবিলের সামনে রীতিমতো ব্যস্ত রয়েছে। স্বামীরা স্নান সেরে নিচ্ছেন দুটো বাথরুমে ।

ফাউন্ডেশন ক্রিমে মুখ-সৌন্দর্যের ভিত্তি স্থাপন করতে-করতে মল্লিকা বললো, “যে কষ্ট করে আজ কৃষিনগর থেকে বেরিয়ে এসেছি। শেষ পর্যন্ত বাংলোর টেলিফোনটা নামিয়ে রাখলাম।” কেন জানি না টেলিফোন নামিয়ে রাখার দায়িত্বটা স্বামীর ঘাড়ে দিতে সংকোচ বোধ করলো মল্লিকা । ওর মনে হচ্ছে কমলেশ তাতে ছোট হয়ে যাবে ।

মুখে গরম জলের ভেপার লাগিয়ে, ফরাসি লোশনের সাহায্যে লোমকূপের অদৃশ্য পথগুলো পরিষ্কার করতে-করতে রিংকি বললো, “বেশ করেছিস। এইভাবেই বরকে কন্ট্রোল করতে হয়। ওঁদেরও তো একটু আনন্দ প্রয়োজন। না হলে খাটবে কী করে?”

মল্লিকা বললো, “নির্দিষ্ট দিনে কারখানা চালু করার জন্যে বেচারা ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছে। দেশের উপকার হবে তো।”

রিংকি বিশ্বাস করলো না। নিজের প্রসাধন সারতে সারতে বললো, “বরকে বোঝাবি, দুশ আড়াই’শ বছর ধরে যে দেশে গয়ংগচ্ছ করে কাজ চলেছে, সেখানে এক সপ্তাহ দেরি হলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।”

টেলিফোনটা বেজে উঠতেই রিংকি বললো, “ধর তো একটু। নিশ্চয় মিসেস সাহা । ম্যাচিং রঙ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন । বুড়োধাড়ি মহিলা! এখনও কোন রঙের শাড়ির সঙ্গে কোন রঙের ব্লাউজ চলে বুঝতে পারে না! আমাকে টেলিফোনে জ্বালাতন করেন। বলে দে, আমি কলঘরে রয়েছি।”

মিসেস সাহা নয় । মল্লিকার মনে হচ্ছে কৃষিনগর থেকেই কেউ কথা বলছে। “হ্যালো, হ্যালো, ধর্মপুর? আচ্ছা, আমাদের প্রোজেক্ট ম্যানেজার ড. কমলেশ রায়চৌধুরীকে খুঁজছি আমরা। উনি কি ধর্মপুরে আছেন?”

বেশ বিরক্ত হয়ে উঠলো মল্লিকা । এখানেও ধাওয়া করেছে লোকগুলো । এক মিনিট সায়েব ছাড়া কাজ করতে পারে না । মল্লিকা দ্বিধা করলো না, শান্তভাবে বলে দিলো, “উনি এখানে নেই ।”

“হ্যালো, হ্যালো…” লোকটা আরও কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই মল্লিকা ফোন কেটে দিলো ।

.

“খুব স্ট্যান্ট দিলেন! সমরেন্দ্রবাবুকে ধুতি, পাঞ্জাবি এবং চাদরে জামাই সাজিয়ে দম্পতি প্রতিযোগিতায় চললেন,” কমলেশ গাড়িতে বসে শ্যালিকার সঙ্গে রসিকতা করলো!

“এখানে যে সবাই প্রচণ্ড সায়েব নয় তা ক্লাবে গিয়েই বুঝবেন,” রিংকি আলতোভাবে নাকের ওপর রুমালটা পাফ করতে-করতে ভগ্নীপতিকে জানালো ।

“আমাদের একটু স্বদেশিয়ানা থাকা ভালো,” ড্রাইভ করতে-করতে ভায়রাভাইকে সমরেন্দ্রবাবু যখন নিজের মতামত জানালেন তখন দুইবোনের দেহ-নিষ্ক্রান্ত দুষ্প্রাপ্য বিদেশি সেন্টের গন্ধে চারিদিকে ভরপুর ।

জাপানি হাতপাখাটা একটু নেড়ে রিংকি বললো, “ফর্মাল পার্টিতেও আমার কর্তা ডিনার জ্যাকেটের বদলে গলাবন্ধ প্রিন্সকোট পরে যায়। অফিসের অনেকে তো শুনেই আঁতকে উঠেছিল । কিন্তু সায়েবদের আন্তর্জাতিক ভদ্রতাবোধ আছে। ওরা কিছুই মনে করলো না । “ রিংকি তারপর বোনকে নিয়ে পড়লো। “ঝুমু, তোর বরকে যা সাজিয়েছিস না! লোভ হচ্ছে, কমলেশবাবুর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ি ।“

“তোদের ক্লাবের প্রতিযোগিতার আইনে না আটকালে আমার কোনো আপত্তি নেই,” মল্লিকা ঢালা অনুমতি দিয়ে দিলো।

একটু পরে রিংকি জিজ্ঞেস করলো, “কীরে, তোর কী হলো? ওরকম গোমড়ামুখীকে কে প্রাইজ দেবে?”

মল্লিকা কিছুই বললো না । শুধু হাসলো । ওর মনটা ঠিক নেই । স্বামী যে এসব ন্যাকা-ন্যাকা প্রতিযোগিতা পছন্দ করবে না, তা সে আন্দাজ করতে পারছে। কিছুক্ষণের জন্যে ছেলেমানুষী করতে মল্লিকার যে আপত্তি আছে তা নয়, কিন্তু ওই টেলিফোনটা এসেই ছন্দ কেটে দিলো।

সমরেন্দ্রবাবু বললেন, “সমস্ত ব্যাপারটাই ছেলেমানুষী । ফিল্টার এবং তামাকের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের তুলনা দেওয়াটা অবাস্তব। কিন্তু জীবনে এতো দুঃখ রয়েছে যে, বিজ্ঞাপনের দৌলতে কিছুক্ষণের জন্যে ছেলেমানুষ হতে পারলে মন্দ কী?”

অবাস্তব হিন্দী সিনেমা সম্পর্কেও লোকে ঐরকম কথা বলে, মল্লিকার মনে পড়ে। কিন্তু এখন তর্ক করতে ইচ্ছে করছে না। কম্পিটিশন সেরে স্বামীকে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কৃষিনগরে যেতে চায় সে।

গাড়ি চালাতে-চালাতে সমরেন্দ্রবাবু বললেন, “আসলে এও এক ধরনের আধুনিক পুতুলখেলা । ক্যাপিটালিস্ট সমাজে বিজ্ঞাপনদাতারা নরনারীর আশা-আকাঙ্ক্ষাকে স্বপ্নের মোহজালে ধরতে চাইছেন। প্রত্যেকটি স্বামী-স্ত্রী বিশ্বাস করতে চায় যে, তারা মেড-ফর ইচ-আদার ।

“তোমার কর্তা যেন কী বলেন?” মল্লিকা এবার স্বামীকে প্রশ্ন করলো ।

কমলেশ তার স্তব্ধতা ভঙ্গ করে বললো, “দিগম্বর বনার্জির ধারণা, ভারতবর্ষের শিক্ষিত লোকেরা নির্লজ্জ স্বার্থপরের মতো মেড-ফর-ইচ-আদার হয়ে আছে! তারা মেড-ফর ওয়ান-অ্যানাদার না হলে দেশ বাঁচবে না ।”

“এও আর এক ধরনের পাগলামি,” এই বলে রিংকি হেসে উঠলো ।

দিগম্বর বনার্জির ওপর নিজের রাগ মেটাবার এমন সুবর্ণ সুযোগ মল্লিকা ছাড়তে পারলো না । সোজা বললো, “নিজের বউ পালিয়েছে । তাই বেঁড়ে শিয়ালের মতো ভদ্রলোক সব শেয়ালের লেজ কাটতে চাইছেন।’

কমলেশ গম্ভীর হয়ে রইলো, কোনো উত্তর দিলো না ।

.

প্রতিযোগিতা পুরোদমে চলেছে। মূল্যবান পুরস্কার আছে, কিন্তু সেই লোভে অহেতুক উত্তেজনা নেই ধর্মপুর ক্লাবে। একটা পাইকিরি বাসরঘর বসেছে যেন ক্লাবহলে। নিজেদের খুশি মতো স্বামী-স্ত্রী জোড়ে জোড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সিগারেট খাচ্ছেন, নাচছেন, গল্প করছেন। আলোয় আলো হয়ে রয়েছে হলঘরটা। রেকর্ডে মিউজিক বাজছে। শুধু ওয়েস্টার্ন নয়, কিছুক্ষণ সানাইয়ে বিবাহের সুরও শোনা গেলো ।

প্রত্যেক দম্পতির জন্যে আলাদা টেবিল । সমরেন্দ্রবাবু একবার নিজের টেবিল থেকে উঠে এসে কমলেশকে বলে গেলেন, “দ্যাখো ব্রাদার, মেয়েদের ব্লাউজের কাট–শ্রীমতীরা কীরকম দ্রুতগতিতে টপলেসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। মিসেস সান্যালের পিঠটা দ্যাখো– ঘাড় এবং কোমর থেকে ব্লাউজের কাপড় ছেঁটে বাদ দিতে-দিতে প্রায় ক্রাইসিস পয়েন্টে এসে গিয়েছে। গভীর নিঃশ্বাসে সামান্য বক্ষস্ফীতি ঘটলেই জামা ছিঁড়ে বিপদ ঘটতে পারে!”

কমলেশ হাসলো । বউয়ের মন্তব্য আশা করলো। কিন্তু মল্লিকা কিছু বললো না । কমলেশ বললো, “বিখ্যাত লেখক অমিতাভ চৌধুরী এই ধরনের মিনি ব্লাউজের নতুন নাম রেখেছেন ব্রা-উজ!”

রসিক সমরেন্দ্রবাবু উৎফুল্ল হয়ে বললেন, “চমৎকার! ইংরিজি এবং বাংলা ভাষায় একটা নতুন শব্দ সংযোজন হলো।”

কমলেশ এবার বউকে জিজ্ঞেস করলো, “কী খাবে?” কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না মল্লিকার। স্বামী আজ তাকে সব দিতে চাইছে, কিন্তু সে প্রাণভরে গ্রহণ করতে পারছে না ।

বৈজ্ঞানিক কমলেশ কেন অন্যমনস্ক হচ্ছে না? মল্লিকা চাইছে সে বউয়ের দিকে অত নজর না দিয়ে কাজকর্ম সম্পর্কে একটু ভাবুক। কিন্তু স্বামীর তপোভঙ্গ হোক, সে তো চায়নি। কমলেশ নিজের নেশাতেই বিভোর হয়ে থাক, দূরদূরান্তে তার প্রতিভার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ুক, দেশের ইতিহাসে তার নাম থাকুক, এই তো মল্লিকার আকাঙ্ক্ষা ৷

এইসব কথা কিছুক্ষণের জন্যে ভুলে গিয়ে সুখী দম্পতিদের হাটে সম্পূর্ণ হারিয়ে যেতে পারলে মন্দ হতো না । কিন্তু পারছে কই মল্লিকা? কৃষিনগর থেকে আসা ওই টেলিফোনটা আবার মল্লিকার কানের কাছে বাজছে ।

“তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?” কমলেশ জিজ্ঞেস করে।

মল্লিকা বললো, “না শরীর খারাপ নয়।”

“তাহলে?”

মল্লিকা আর চেপে রাখতে পারলো না । ভয় পেয়ে স্বামীর হাতে হাত রেখে বললো, “জানো, আমরা যখন রিংকিদের বাড়িতে সাজগোজ করছি, তখন যেন মনে হলো কৃষিনগর থেকে কে তোমাকে খুঁজছে। বুঝতে পারলাম না, লাইনটা কেটে গেলো ।”

কমলেশ মুহূর্তের জন্যে চমকে উঠলো । ওর চোখ দুটো আবার সেই পুরানো উজ্জ্বলতা ফিরে পাচ্ছে। নিজের স্বামীর মধ্যে আবার সেই কাজ-পাগলা বিজ্ঞানীকে দেখতে পাচ্ছে মল্লিকা। অরেঞ্জ স্কোয়াশের গেলাসটা সরিয়ে দিয়ে কমলেশ ছিটকে বেরিয়ে গেলো । বউকে যেন দেখতেই পেলো না । তারপর কোথা থেকে টেলিফোন সেরে এসে, ফিসফিস করে বললো, “একটুও সময় নেই মল্লিকা, এখনই চলো।”

বোন এবং সমরেন্দ্রবাবুর কথা তুলতে যাচ্ছিল মল্লিকা। বলতে যাচ্ছিল, আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই তো ফলাফল ঘোষণা হবে। কমলেশ ওসব শুনতে রাজি নয় । সমরেন্দ্রবাবুকে সে জানিয়ে দিয়েছে তারা চলে যাচ্ছে, জরুরি ফোন এসেছে।

২২

রাতের অন্ধকারে ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে কমলেশ রায়চৌধুরীর জিপটা যেন উড়ে চলেছে। মল্লিকার একটু ভয়-ভয় করছে। কোথাও না অ্যাকসিডেন্ট বাধিয়ে বসে। কমলেশের খেয়াল নেই । সময়ের বিরুদ্ধে সাঁতার কেটে যেতে কমলেশ আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ।

বাড়িতে মল্লিকাকে ঢুকিয়ে দিয়েই এক লাফে কমলেশ আবার জিপে এসে চড়লো এবং মুহূর্তে রাত্রির অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলো ।

কারখানার প্রিলিং টাওয়ারের কাছে তখন অনেক লোকের ভিড়। সুদর্শনবাবুও মাথায় হেলমেট লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ।

কমলেশ আসতেই সকলে সরে দাঁড়ালো। তাদের চোখে প্রচণ্ড উদ্বেগের চিহ্ন, মুখে কোনো কথা নেই। আর সমস্ত যন্ত্রটা তখনও মাঝে-মাঝে আহত পশুর মতো ধোঁয়া ছাড়ছে।

ইঞ্জিনিয়ার হাজরা বললেন, “আজব ব্যাপার। দুপুরে আমরা সব ঠিকঠাক দেখে গেলাম। মিস্টার শীলারের কাছে আমরা দায়িত্ব বুঝে নিলাম। বিকেলে আমাদের পঁচাত্তর পার্সেন্ট ইউরিয়া মিক্‌সচার ইনজেকশন করে মেশিনকে কাজ করাবার কথা। মেশিনের মধ্যে ইউরিয়া ফিড করে যেমনি সুইচ টেপা অমনি একটা ছোটখাট বিস্ফোরণ হলো। টাওয়ারটা থরথর করে নড়ছেও।”

অ্যাকসিডেন্ট মনে করে ছোটাছুটি হয়েছিল। কমলেশকে কোথাও না পেয়ে ওরা সুইচ অফ্ করেছে। কিন্তু ইউরিয়া মিকচার যে ভিতরে জমে শুকিয়ে সমস্ত মেশিনের সর্বনাশ করে দেবে। কমলেশ চিৎকার করে উঠলো, “এখনই হোস পাইপ দিয়ে ভিতরে জল চালাবার ব্যবস্থা করুন। এমনিতেই দেরি হয়ে গিয়েছে মনে হয় । স্প্রে ড্রাইং মেশিনটা একবার অকেজো হয়ে গেলে অন্তত তিন মাসের ধাক্কা।

এখন পর্যন্ত কেউ ওপরে ওঠেনি। কারও কথা শুনলো না কমলেশ । নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে, সরু সিঁড়ি দিয়ে পাক খেতে-খেতে ওই উঁচু টাওয়ারে উঠতে লাগলো । তার পিছন-পিছন অন্য কিছু লোকও যন্ত্রপাতি নিয়ে পিঁপড়ের মতো উঠতে আরম্ভ করলো । মিস্টার দাস ফ্লাড লাইটগুলো একটু বেঁকিয়ে দিলেন ।

এদিকে মল্লিকা জেগে বসে রয়েছে। লন থেকে সে মার্কারি ল্যাম্পের নীলাভ আলোয় উজ্জ্বল প্রিলিং টাওয়ারটা দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু সেখানে যে কী নাটক অভিনীত হচ্ছে জানতে পারলো না।

আর কমলেশ তখন সব ভুলে গিয়ে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে অবজ্ঞা করে উপরে উঠে যাচ্ছে।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন এক অস্বস্তিকর অগ্নিপরীক্ষার সময় গুণছে মল্লিকা ।

রাত চারটের সময় কমলেশ যখন ফিরলো তখন তাকে চিনতে পারছে না মল্লিকা । দামি নতুন জামা-প্যান্ট কালি-ঝুলিতে বোঝাই। মুখে চোখে কপালে হাতে তেলকালি লেগেছে প্রচুর। চুলগুলো সাদা ইউরিয়ার গুঁড়োতে বুড়োদের মতো শাদা দেখাচ্ছে।

বড় দেরি হয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে কমলেশের। স্প্রে ড্রাইং মেশিনটাকে বোধহয় রক্ষা করা গেলো না । কিন্তু এখনও স্থিরতা নেই। এখনই জার্মান সায়েবটাকে ডেকে পাঠাতে হবে। ভাগ্যে ম্যাক্স শীলার এখনও কৃষিনগরে রয়েছে।

“কী ভাবছো?” স্বামীর দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে মল্লিকা জিজ্ঞেস করলো।

“কিছু ভাবছি না, ঝুমু।” কমলেশ বরফের মতো ঠাণ্ডা সুরে বললো ।

স্বামীর কথা মল্লিকা কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছে না । কমলেশ ভাবছে, আরও কয়েক ঘণ্টা আগে এসে পড়তে পারলে এমন সংকটে পড়তে হতো না ।

মল্লিকার মনে পড়লো, অনেক দিন আগে বাবাকে ঐরকম হতভম্ব অবস্থায় সে বাড়িতে বসে থাকতে দেখেছিল। দিদির অপারেশন দেরি হয়ে গিয়েছিল; অপারেশন শেষ করে মেডিক্যাল কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে রাত তিনটের সময় বাবা ওইভাবেই বলেছিলেন, “ঝুমু, একটু চা কর ।”

নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে মল্লিকার । নিজের আচরণের জন্য ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে। সে এবার স্বামীর হাত ধরলো। বললো, “চলো তোমার হাতে সাবান লাগিয়ে দিই! তেলগুলো না হলে উঠবে না।”

কমলেশ চুপচাপ বসে রইলো। কিছু বললো না ।

মল্লিকা স্বামীর খুব কাছে সরে এলো । গায়ে হাত দিয়ে বললো, “ভেবো না, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“সবই তো এক সময় ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সময় তো অপেক্ষা করে না,” কমলেশ নিজের মনেই ভাবলো ।

স্বীকার করছে না কমলেশ, কিন্তু মল্লিকা বুঝতে পারছে, নিদারুণ আত্মগ্লানিতে ভুগছে সে। এবার নিজের মনেই কমলেশ বললো, “হোস পাইপ দিয়ে ওপর থেকে জল ঢালবার সামান্য বুদ্ধিটা কারও মাথায় এলো না ।“

মল্লিকা বললো, “ওরা নতুন লোক, অনেক টাকা দামের যন্ত্রপাতি । তোমার মতো সাহস নেই ওদের।”

আরও অনেকক্ষণ কেটে গিয়েছে। চিন্তাক্লিষ্ট কমলেশ এখনও পাথরের মতো বসে রয়েছে। মল্লিকা তার নরম হাত দুটো দিয়ে স্বামীর হাত জড়িয়ে ধরলো ।

“চলো, এখন শুতে চলো,” মল্লিকা এবার স্বামীকে বিছানায় টেনে নিয়ে এলো । কমলেশের গা দিয়ে বিভিন্ন কেমিক্যালের একটা অপরিচিত কড়া গন্ধ তখনও বের হচ্ছে। সাবানেও গন্ধ যায়নি। মল্লিকা জিজ্ঞেস করলো, “তোমার গায়ে একটু সেন্ট ছড়িয়ে দেবো?”

“দরকার নেই,” এই বলে কমলেশ এসে খাটের ধারে বসলো ।

স্বামী কি ভাবছে, তা মল্লিকা নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারে । ভাবছে, ধর্মপুরে না গেলেই হতো। কিন্তু যা হবার তা তো হয়ে গিয়েছে।

কান্না আসছে মল্লিকার। নিজেকে অপরাধিনী মনে করছে সে। স্বামীর কাঁধে মুখ লুকিয়ে সত্যিইি সে এবার কান্নায় ভেঙে পড়লো। বললো, “আমি আর কখনও অবুঝ হবো না ।

স্ত্রীর পিঠে গম্ভীর কমলেশ আলতো চাপড় দিলো । ভরসা দিয়ে বললো, “তুমি ভাবছো কেন? তোমার তো কোনো অপরাধ নেই!”

স্ত্রীকে শান্ত করে কমলেশ আবার ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাচ্ছে। বড় আশা ছিল, বনার্জি সায়েবকে অবাক করে দেবে। ত্রিশে নভেম্বর ভোরবেলায় হঠাৎ টেলিফোন করে দিগম্বর বনার্জিকে জানিয়ে দেবে, “আপনার কথা রেখেছি স্যার।”

টেলিফোনটা বাজছে। এই রাতদুপুরে কে আবার ফোন করছে? কমলেশ ফোন ধরলো। মল্লিকার ঘুমের যাতে অনসুবিধা না হয়, তার জন্যে যথাসম্ভব নিচু গলায় সে কথা বলছে। মল্লিকা এখন কাছে না গিয়েও বলে দিতে পারে দিগম্বর বনার্জি ফোন করেছেন ।

কমলেশ লজ্জিতভাবে বলছে, “খবর পাওয়া মাত্রই ছুটে এসেছি স্যার। হ্যাঁ স্যার, ঠিকই শুনেছেন, আজ ওখানে পার্টি ছিল।” দিগম্বর বনার্জি বোধহয় কোনো কড়া মন্তব্য করলেন । কমলেশ বললো, “সাড়ে-চার ঘণ্টা যুদ্ধ করে এই ফিরেছি, স্যার। কাল সকালে আপনাকে খবর দেবো।

কমলেশ সন্তর্পণে বিছানায় ফিরে এলো। দেখলো স্ত্রী ঘুমোচ্ছে কি না। তারপর বেডসুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিলো ।

২৩

কালিঝুলি মাখা অবস্থায় এমনভাবে প্রোজেক্ট ম্যানেজারকে সুজাতা দাস কখনও অফিসে আসতে দেখেনি। বোঝা যাচ্ছে অনেকক্ষণ সাইটে থেকে কমলেশ রায়চৌধুরী অফিসে ফিরছেন ।

সুদর্শন সেনও হন্তদন্ত হয়ে সায়েবের ঘরে ঢুকে গোপন পরামর্শ আরম্ভ করলেন। তারপর সুজাতাকে ডাকলো কমলেশ । সুজাতা লক্ষ্য করলো এতো দুশ্চিন্তার মধ্যেও কমলেশ তার স্বাভাবিক সৌজন্যবোধ হারায়নি । আন্তরিকভাবে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছেন মিস দাস? কাল তো আপনার শরীর খারাপ ছিল ।

কমলেশের চোখের দিকে সুজাতা তাকাতে পারছে না । ভদ্রলোক এক রাত্রেই যেন দশ বছর বয়স বাড়িয়ে ফেলেছেন। কমলেশ বললো, “মিস দাস, আপনি এক্ষুণি মিস্টার শীলারকে খবর পাঠান। ওর যাওয়া বন্ধ করুন। প্রিলিং টাওয়ারের যা অবস্থা তা ঠিকঠাক করতে কতদিন লাগবে কে জানে। অন্তত পনেরো দিন তো বটে?”

“আমাদের হাতে আর কত দিন সময় আছে?” সুজাতা জিজ্ঞেস করে ।

“আমাকে আর লজ্জা দেবেন না, মিস দাস। ত্রিশে নভেম্বর মাত্র তিন দিন দূরে,” কমলেশ বললো ।

“চিন্তা করবেন না, ডক্টর রায়চৌধুরী,” সুজাতা শান্তভাবে বললো ।

হাসলো কমলেশ, “আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন মিস দাস? আমি এখন সান্ত্বনারই যোগ্য। কী যে দুর্মতি হলো, কালই চলে গেলাম কৃষিনগরের বাইরে।”

সুজাতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো কমলেশের দিকে তাকিয়ে আছে। কমলেশ বললো, “যার যা-খুশি রটাচ্ছে । কেউ ভাবছে, প্রিলিং টাওয়ারের ডিজাইনে গোলমাল ছিল । বলবার কিছু নেই, দিগম্বর বনার্জি নিজে ডিজাইন করেছেন। সুদর্শনবাবু এইমাত্র আবার সাবোটাজের আষাঢ়ে গল্প ফাঁদছিলেন। কাল বিকেলে মিস্টার শীলারকে নাকি একা-একা টাওয়ারের কাছে যেতে দেখা গিয়েছে। ওঁর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। শীলারের কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে আমাদের মেশিন বিগড়ে দেবার? কিছু খারাপ হলেই বরং ওঁর অসুবিধে, বেশিদিন থেকে যেতে হবে; অথচ জার্মান কোম্পানি বাড়তি টাকা দেবে না । আমার মাথা খারাপ হয়নি যে এই কেস সিবিআইকে পাঠাবো।’

কমলেশ কী ভাবলো তারপর বললো, “আমাদের ডিজাইনে যে কোনো ভুল নেই তা নিঃসন্দেহ হয়েছি। এখন শীলার সায়েবকে ধরি, যদি বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন।”

২৪

শীলার সায়েব ক’দিন পুরোদমে প্রিলিং টাওয়ারে মেরামতি কাজ করে চলেছেন। আকস্মিক বিস্ফোরণের কারণ খুঁজে পাওয়া গেলো না। কোথাও হয়তো গ্যাস জমা হয়েছিল। উনি বলেছেন, চালু হতে ঠিক কত দিন লাগবে, তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না ।

কমলেশ অফিসে গম্ভীর হয়ে বসেছিল । সুজাতা দাস জিজ্ঞেস করলেন, “এতো কি ভাবছেন?”

কমলেশ মুখ তুলে তাকালো । বেচারা সুজাতা দাসও অফিসের অবস্থায় বেশ মুষড়ে পড়েছে । লজ্জা হলো কমলেশের । ক্লান্ত মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো, “মিস দাস, আপনারা ভাববেন না। নিজের কাজ করে যান। যুদ্ধে, রাজনীতিতে, কলকারখানায় যারা দায়িত্ব নেয়, তাদের মাঝে-মাঝে একটু বাড়তি কষ্ট ভোগ করতে হয় মিস দাস ।“

সুজাতা কোনো কথা শুনলো না। আবার বললো, “চিন্তা করবেন না ।”

কমলেশ বললো, “স্প্রে-ড্রায়ারটা একেবারে অকেজো হয়ে যায়নি। তবে ক্যাপাসিটি কমে গিয়েছে। প্রিলিং টাওয়ারের তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি। কিন্তু সারাতে জার্মানদের কতদিন লাগবে কে জানে।”

সুজাতার মাথাটা মুহূর্তের জন্যে ঘুরে উঠলো। এর সঠিক উত্তর যদি কারুর জানা থাকে তার নাম সুজাতা দাস। জার্মান শীলার আজও গোপনে খোঁজ করে গিয়েছে। সুজাতা কোনো উত্তর দেয়নি ।

.

অফিসের বাথরুমে দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে আয়না বার করলো সুজাতা। তারপর খিলখিল করে হাসলো । পুরো কৃষিনগরকে কাঁপিয়ে আরও জোরে হাসতে ইচ্ছে করছে সুজাতার। সুজাতা কি পাগল হয়ে যাবে।

সুজাতা আবার আয়নার দিকে তাকালো। আয়নার মেয়েটা ওকে বকুনি লাগাচ্ছে, আর বলছে, “লজ্জা করে না। লজ্জা করে না রাক্ষসী?”

উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে সুজাতা দাস । এই ধরনের হাঁপানিকে সে ভয় পায়। অনেক সময় বুকের ব্যথাটা এর থেকেই দেখা দেয় । সুজাতা দাস এই মুহূর্তে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে গর্বিত মহিলা মনে করছে। সীতা, হেলেন, ক্লিওপেট্রা ইত্যাদি ইতিহাস সৃষ্টিকারিণীর তালিকায় এইমাত্র আর এক নতুন নাম সংযোজিত হয়েছে। সে নামটি সুজাতা দাস, যার ইচ্ছা বিরাট এই কৃষিনগর অকস্মাৎ গতিহীন হয়ে পড়েছে। বিজয়িনী সুজাতার ইচ্ছে করছে চুম্বনে চুম্বনে জার্মান ম্যাক্স শীলারের ওষ্ঠ ভরিয়ে দেয়। সুজাতার ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে ওঠে । দর্পভরে বলে, “তোমরা যারা এতোবছর ধরে কুরূপা সুজাতা দাসকে অপমান এবং অবহেলা করে এসেছো তারা দেখো, সুজাতা কী পেয়েছে? ম্যাক্স শীলার তার পাশে থাকবার জন্যে কী বিরাট ঝুঁকি নিয়েছে।”

আরও কিছুক্ষণ একলা থাকলে সুজাতা সত্যিই হয়তো পাগল হয়ে গিয়ে চিৎকার করবে। সুজাতা সভয়ে মহিলাদের টয়লেট থেকে বেরিয়ে এলো ।

সুজাতা নিজের ঘরে এসে বসলো। দেখলো, কমলেশ টেলিফোন নামিয়ে রাখলো । “মিস দাস,” কমলেশ ডাকলো। তারপর গম্ভীরভাবে বললো, “ডক্টর বনার্জি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এসে পৌঁছবেন। লাইন খারাপ ছিল বলে আগে খবর দিতে পারেননি । আপনি গেস্টহাউসে ফোন করে দিন। শরীরটা ওঁর মোটেই ভালো নয়। ডিনারে শুধু একটু দুধ খাবেন!”

গেস্টহাউসের ব্যবস্থা করে ফিরে এসে সুজাতা দেখলো কমলেশ তখনও চিন্তা করছে। বিপদের মুহূর্তে দিগম্বর বনার্জি এলেন না। অথচ আজ ৩০শে নভেম্বর, ঠিক সময়েই আসছেন তিনি কৃষিনগর দেখতে। দায়িত্বহীন এবং ব্যর্থ কমলেশকে বিদ্রূপ করবার জন্যেই দিগম্বর বনার্জি নিশ্চয় কৃষিনগর পরিদর্শনে আসছেন ।

“কিছু বলবেন?” সুজাতা জিজ্ঞেস করলো কমলেশকে ৷

“হ্যাঁ।” থামলো কমলেশ । “একটা চিঠি টাইপ করে দেবেন? খুব জরুরি?”

শর্টহ্যান্ডের খাতাটা খুলে সুজাতা জানালো, “বলুন।”

একটা পেন্সিল নিয়ে কাগজে আঁচড় কাটতে কাটতে কমলেশ বললো, “হ্যাঁ, লিখে নিন: আমার পদত্যাগপত্র। আর হিয়ারবাই রিজাইন ফ্রম…”

সুজাতা দাসকে কেউ হঠাৎ ঠেলে ফেলে দিলেও সে এমনভাবে চমকে উঠতো না । “ডক্টর রায়চৌধুরী! আমি আপনার ডিকটেশন নেবো না। এসব কী বলছেন?”

কমলেশ সস্নেহে একবার তার সেক্রেটারির দিকে মুখ তুলে তাকালো। তারপর নিজের মনেই বললো, “আমাদের ডিরেক্টর একটা মাত্র অনুরোধ করেছিলেন। তা তো রাখতে পারলাম না। ত্রিশে নভেম্বর মধ্যে কারখানা চালু হলো না, এখন মাসখানেকের মধ্যে কাজ শুরু করিয়ে দিয়ে আমি চলে যেতে চাই।”

“কী বলছেন আপনি?” সুজাতা বাধা দিয়েছিল। “কেউ তো আপনাকে কিছু বলেনি।” কমলেশ হাসলো । তারপর বললো, “রাত চারটের সময় ডক্টর বনার্জি ট্রাঙ্ক টেলিফোনে জিজ্ঞেস করলেন, মেড-ফর-ইচ-আদার প্রতিযোগিতায় প্রাইজ পেয়েছি কিনা।”

মেয়েরা বোধহয় একটু বেশি নরম হয়। কমলেশ দেখলো তার সেক্রেটারি সুজাতা দাসের চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। কমলেশের পরাজয় ও প্রস্থান এই অফিসের কেউ–কেউ তাহলে অনুভব করবে। সুজাতা দাস মেয়েটার মন এখনও নরম রয়েছে।

অফিসারকে অমান্য করার সাহস নেই সুজাতার । এই চিঠি টাইপ করে এগিয়ে দিতে হলো । কিন্তু কান্নায় ভেঙে পড়ে, সে আবার কমলেশকে বারণ করলো । বললো, “আপনি কেন নিজের জীবন নষ্ট করবেন? আপনি তো কোনো দোষ করেননি; আপনার চাকরি ছাড়বার কোনো কারণ নেই।”

বিষণ্ন কমলেশ পদত্যাগের চিঠিটা পকেটে পুরতে-পুরতে কৃতজ্ঞ কণ্ঠে বললো, “আপনার সহানুভূতির কথা আমি চিরদিন মনে রাখবো, মিস দাস।”

কমলেশ বেরিয়ে যেতেই সুজাতা দাস অকস্মাৎ নিজের কপাল টিপে চেয়ারে বসে পড়লো। তার ভুলের জন্যে কৃষিনগরে যে এমন দুর্যোগ হাজির হতে পারে তা সুজাতা এখনও ভাবতে পারছে না ।

টেলিফোন বেজে উঠলো। ওদিক থেকে মল্লিকা কথা বলছে। “হ্যালো সুজাতাদি, আপনি কেমন আছেন। সেদিন আপনার বাড়িতে যাবার জন্যে বার বার বলেছিলেন । অনেকদিন আপনার সঙ্গে দেখা হয় না, সুজাতাদি । ওঁকে বলুন, গাড়িটা পাঠিয়ে দিতে; আপনার বাড়ি ঘুরে আসবো।”

সুজাতার মাথা ঘুরছে। বেচারা মল্লিকা এখনো জানে না, তার স্বামী চাকরিতে ইস্তফা দিতে গিয়েছেন । মল্লিকাকে আজ বাড়িতে না আসবার জন্যে অনুরোধ করলো সুজাতা । মল্লিকার ওপর সব অভিমান হারিয়ে ফেললো সে ।

নিজের ঘরে বসে চোখের জলকে বাধা দিতে পারছে না সুজাতা। হঠাৎ মনে হচ্ছে, পৃথিবীতে তার মতো স্বার্থপর ডাইনী আর একটাও জন্মায়নি! নিজের সুখের জন্যে, একটা নিরপরাধ নবদম্পতির সর্বনাশ করতে চলেছে সে।

অকস্মাৎ ক্যালেন্ডারের দিকে নজর পড়লো সুজাতার। আজই সেই বহু প্রতীক্ষিত ৩০শে নভেম্বর। কমলেশ রায়চৌধুরীর সাধনায় যেদিনটি উজ্জ্বল হতে পারতো, সুজাতা দাসের কলঙ্কে তাই বিষাক্ত হয়ে উঠেছে।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো সুজাতা। ম্যাক্সের সঙ্গে একবার দেখা করতে চায় সে।

বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে । বনার্জি সায়েবের গাড়ির জন্যে কমলেশ গেস্টহাউসের বারান্দায় অপেক্ষা করছে। গাড়িটা দেরি করছে । অভিমান ও আত্মগ্লানির মিশ্রণে মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে কমলেশের।

দিগম্বর বনার্জির গাড়ি এসে দাঁড়ালো পোর্টিকোতে । প্রায় দু-মিনিট পরে বেরিয়ে এলেন বনার্জি সায়েব ।

একি! এমন চেহারা হলো কবে ওঁর? কমলেশ অবাক হয়ে গেলো। শুকিয়ে প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছেন দিগম্বর বনার্জি।

মন্থর অনিশ্চিত পদক্ষেপে নিজের ঘরে গিয়ে বসলেন নোয়েল দিগম্বর বনার্জি । তারপর কমলেশকে বললেন, “প্ল্যান্ট বেঁচেছে?”

মাথা নিচু করে কমলেশ বললো, “তা বেঁচেছে। তবে চালু হতে দেরি হতে পারে । আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে ।

বনার্জি সায়েব এরপর যে শিষ্যকে তার অহেতুক স্ত্রী-ভক্তির জন্যে ব্যঙ্গ করবেন তা কমলেশ আন্দাজ করে রেখেছে। তার জন্যে সে প্রস্তুত হয়েই এসেছে। সঙ্গে-সঙ্গে পদত্যাগের চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে বনার্জিকে মনে করিয়ে দেবে, মানুষের সাধ্যের সীমা আছে। তবে সেদিন সন্ধ্যায় কৃষিনগর থেকে অনুপস্থিত থাকার দোষটা সে স্বীকার করে নেবে। তার জন্যে ক্ষমা ভিক্ষা করবে।

কমলেশ তৈরি হয়েই আছে বনার্জির উত্তরের অপেক্ষায়। কিন্তু একি হলো আজ? বনার্জি মোটেই ব্যঙ্গ করলেন না। কমলেশের গায়ে হাত দিয়ে বললেন, “কমলেশ, ৩০শে নভেম্বরের পরে তোমরা অপেক্ষা করতে পারবে। তোমাদের সময় আছে । আমার নেই। আমি ১লা ডিসেম্বর কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছি–পেট কেটে ওরা ক্যান্সারটার অবস্থা কী রকম দেখতে চায়। গতবার লন্ডন গিয়েই ব্যাপারটা জানতে পেরেছিলাম । তোমাদের বলিনি । এই কাজটার জন্যে ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত সময় ভিক্ষে করে এনেছিলাম।’

কমলেশ অকস্মাৎ আবিষ্কার করলো সে কাঁদছে। সবার যে অপেক্ষা করার সময় থাকে না, এই সামান্য কথাটুকু সে এতোদিনে বুঝতে পারছে। অথচ না জেনে স্যারকে ভুল বুঝেছে সে। ছোট ছেলের মতো কান্না এসে তার কথা বলার ক্ষমতা, এমনকি ক্ষমা চাওয়ার সামর্থ্যও কেড়ে নিচ্ছে। বনার্জির শীর্ণ হাত দুটো জড়িয়ে সজল চোখে কমলেশ বললো, “আর কখনও দেরি করবো না স্যার ।“

কমলেশের কাঁধে ভর করে দিগম্বর বনার্জি গেস্টহাউসের মাঠে বেরিয়ে এলেন। দূর থেকে অনেকক্ষণ ধরে তাঁর অসমাপ্ত তাজমহল প্রাণভরে দেখলেন । তারপর বিষণ্ন মন্থর গতিতে ঘরে ফিরে এলেন ।

অপেক্ষা করার সময় নেই স্যারের। একটু দুধ খেয়ে আবার গাড়িতে গিয়ে বালিশে মাথা রেখে পা মুড়ে শুয়ে পড়লেন। গাড়ি চন্দনপুরের দিকে ফিরে চললো ।

২৫

আর কমলেশ! দিগম্বর বনার্জিকে এইমাত্র বিদায় জানিয়ে বিজ্ঞানী কমলেশ রায়চৌধুরীর যেন নবজন্ম হচ্ছে । অন্ধকার নির্জন নিঃশব্দ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। কিন্তু অসংখ্য অশ্রুতকণ্ঠ যেন তাকে উদ্দেশ্য করেই বলছে, অপেক্ষা করার মতো সময় নেই–নেই ৷ অর্ধচেতন কমলেশ চোখের সামনে নানা অদ্ভুত দৃশ্য দেখছে–সময়ের সীমা ছাড়িয়ে আকাশের তারার দল সময়হীন মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়ছে। আবার মনে হচ্ছে, সীমাহীন সময় নিজেই অসুস্থ, দিগম্বর বনার্জির মতোই দুরারোগ্য ক্যান্সারে ভুগছে।

অনুতাপদগ্ধ কমলেশ অবসন্ন দেহে গাড়িতে স্টার্ট দিতে যাচ্ছিল । এমন সময় উল্টো দিক দিয়ে সুদর্শন সেনের গাড়ি দেখা গেলো। কাছাকাছি এসে তিনি চিৎকার করে বললেন, “আপনাকে স্যার সর্বত্র খুঁজে বেড়াচ্ছি। অথচ আপনি মাঝে-মাঝে কোথায় যে উবে যান ।” সুদর্শন সেন এবার কমলেশর কাছে এগিয়ে এসে বললেন, “শুনুন স্যার, তাজ্জব ব্যাপার? ওই জার্মান সায়েব মি. শীলার আপনাকে খুঁজছেন। একেবারে ম্যাজিক-প্রিলিং টাওয়ারে যে গোলমাল হয়েছিল তা সায়েব ম্যাজিকের মতো সেরে ফেলেছেন । ইচ্ছে করলে আজ রাত্রেই কল চালু করতে পারেন। লোকজন সব রেডি।

সুদর্শনবাবুকে নিয়েই কমলেশ সাইটে যেতে চাইছিল। কিন্তু তিনি বললেন, “তার কি উপায় আছে? আমাকে এখনই হাসপাতালে ছুটতে হবে । আপনার সেক্রেটারি সুজাতা হঠাৎ সিরিয়াস বুকের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।” গভীর দুঃখের সঙ্গে সুদর্শন বললেন, “কৃষিনগরে কী যে হচ্ছে বুঝতে পারছি না! তিন-চার ঘণ্টা আগেও মেয়েটা বেশ ভালো ছিল । আপনি অফিস থেকে বেরিয়ে যাবার পর সুজাতার কী দুর্বুদ্ধি হলো । নিজে নাকি প্রিলিং টাওয়ারে জার্মান সায়েবের কাজ দেখতে এসেছিল । সায়েব তখন ত্রিশ ফুট ওপরে ওয়েল্ডিং করছিল। এমন ডানপিটে মেয়ে যে, একলা মই বেয়ে সেখানে উঠে সায়েবের সঙ্গে কী সব কথা বলেছে। তার একটু পরেই সায়েব মেশিন সারিয়ে ফেললো ।”

অন্য সময়ে কমলেশ নিজেই তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে যেতো । কিন্তু এখন সময় নেই । সে শুধু বললো, “আশ্চর্য ব্যাপার তো, একটু আগেই আমার চিঠি টাইপ করলো। কাল আমি হাসপাতালে যাবো, আজকে আপনি মল্লিকাকে সঙ্গে নিয়ে যান।”

সুদর্শনবাবু বললেন, “এখানকার হাল-চাল দেখে সুজাতা একেবারে ঘাবড়ে গিয়েছে। হাসপাতালে অজ্ঞান অবস্থায় ভুল বকছে। আপনাকে বলছে, প্লিজ চাকরি ছাড়বেন না । যত দোষ সব আমার!”

কিছুক্ষণ পরে অফিস থেকে কমলেশ বাড়িতে টেলিফোন করেছিল। “মল্লিকা, তুমি খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো না ।

হাসপাতাল থেকে সদ্য-ফেরা মল্লিকার গলা কান্নায় ধরে রয়েছে। সুজাতা দাস বাঁচবে কিনা সন্দেহ । এরই মধ্যে সে মাঝে-মাঝে সমস্ত দোষের জন্য ক্ষমা চাইছে । মল্লিকা বললো, “আমারও কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বেচারা জানে না, তোমাকে সেদিন দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে দায়ী কে । “

অযথা কষ্ট না পাবার জন্যে স্ত্রীকে সাহস দিলো কমলেশ । মল্লিকা বললো, “ভবিষ্যতে কোনোদিন তোমার অবাধ্য হবো না । কোনোদিন তোমার কাজে বাধা দেবো না!”

টেলিফোন নামিয়ে কমলেশ আবার প্রিলিং টাওয়ারের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। জার্মান সায়েবটা সত্যি জাদু জানে–প্রিলিং টাওয়ারের যন্ত্রপাতি ঠিক করে ফেলেছে।

সমস্ত ইউরিয়া প্লান্টের কোথাও কোনো গোলমাল নেই । প্রোডাকশন সুপারভাইজার জেকব বললেন, “ঈশ্বরের আশীর্বাদে তাহলে কাজ শুরু করা যাক ।”

কমলেশ সম্মতি দিলো। হুইসল বাজলো, জেকব টেলিফোনে কাকে নির্দেশ দিলেন । এবং প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে স্তব্ধ যন্ত্রদানবের গহ্বরে ফিড অ্যামোনিয়া এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড ঢুকিয়ে দেওয়া হলো । রাতের নিস্তব্ধতা চূর্ণবিচূর্ণ করে প্রচণ্ড গর্জনে দানব তার কুম্ভকর্ণ নিদ্রা থেকে জেগে উঠলো । কমলেশ এবং সবাই অবাক বিস্ময়ে খোলা মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে সেই গর্জন শুনতে লাগলো ।

নানা পথ ঘুরে কখনও উত্তাপে, কখনও শৈত্যে, বিচিত্র অনুঘটনে বহু জন্ম-জন্মান্তর পেরিয়ে অবশেষে প্রিলিং টাওয়ারে পরম আকাঙ্ক্ষিত ইউরিয়ার জন্ম হলো । যন্ত্রের কাছে এগিয়ে এসে কমলেশ দেখলো, শীতের রাতে বরফ পড়ার মতো ইউরিয়ার শাদা গুঁড়ো প্রিলিং টাওয়ারের ওপর থেকে চেম্বারের মধ্যে ঝরে পড়ছে। দিগম্বর বনার্জির আবিষ্কার সফল হয়েছে।

যারা দাঁড়িয়েছিল তারা সকলে জয়ধ্বনি করে উঠলো । খ্রিস্টান জেকব নতজানু হয়ে পরম করুণাময়কে কৃতজ্ঞতা জানালেন। আনন্দে আত্মহারা সুদর্শনবাবু বললেন, “জয় বাবা তারকনাথের জয়।” আর কমলেশের মনে হলো সে যেন আপন সন্তানের জন্মমুহূর্তে উপস্থিত রয়েছে। পৃথিবীতে এই যেন প্রথম ইউরিয়া সৃষ্টি হলো। আদিম মানুষ প্রথম দিনের সূর্য ওঠা দেখেও বোধহয় এমন বিস্মিত হয়নি। তীর্থরেণুর মতো পবিত্র একমুঠো শাদা গুঁড়ো হাতের মধ্যে তুলে নিলো কমলেশ রায়চৌধুরী। সার্থক হয়েছে দিগম্বরের সাধনা। বিজ্ঞানের জয় হয়েছে। তারপর হাঁটতে শুরু করলো কমলেশ।

এখনও পুরোপুরি ভোর হয়নি। বাড়িতে মল্লিকাকে সুখবরটা দিয়েই কমলেশ ছুটবে চন্দনপুরে । আজ সকাল দশটায় দিগম্বর বনার্জি হাসপাতালে ভর্তি হবার জন্যে কলকাতার ট্রেনে চড়ে বসবেন । চন্দনপুর স্টেশনেই তাঁকে ধরবে কমলেশ ।

গাড়ি চালিয়ে টিলার উপর উঠে কমলেশ পরম বিস্ময়ে মানুষের সৃষ্টি এই আশ্চর্য জগতের দিকে তাকিয়ে রইলো । বিচিত্র এক অনুভূতিতে তার মন ভরে উঠলো । অকস্মাৎ মনে হলো, অনাগত কালে ট্রেনে যেতে-যেতে দূর থেকে রাতের অন্ধকারে কত যাত্রী এই আলোকিত নগরী এবং কারখানা দেখবে। কিন্তু আজকের মানুষগুলোর সুখ-দুঃখ হাসি কান্নাভরা আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা তারা জানতে পারবে না। তরা শুধু দেখবে এখানে একটা কারখানা আছে এবং সেখানে সার তৈরি হয় ।

1 Comment
Collapse Comments

Very good. I was posted in Durgapur (WB) year 1992/3 serving for Air India GSA. The DSP and ASP modernization process was going on those days. German company Mans Mag Demag/Kurrup etc company was doing the job. This story took me back to those days. Thank you for giving me opportunity to read this book.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *