২০. একজন অভিনেত্রীর জীবন
ব্রিক লেনের সেই ফ্ল্যাটে আর ফিরে আসেনি গ্রেস লোভেল এবং সেজন্য তাকে দোষও দিচ্ছি না আমি। সেখানে যে-পরিমাণ রক্তপাত হয়েছে, সেসব মুছে ফেলতে অনেক সময় লাগবে। হিংসাত্মক যে-ঘটনা ঘটেছে সেখানে, সেটা মুছে ফেলতে সময় লাগবে আরও বেশি।
আপাতত হাউনস্লো-তে, নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে, অ্যাশলিইকে নিয়ে থাকছে লোভেল। জায়গাটা হিথ্রো এয়ারপোর্টের কাছে। ওই বিমানবন্দরে সিনিয়র কমার্শিয়াল ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন লোভেলের বাবা। তাঁর নাম মার্টিন লোভেল। আজ ছুটি নিয়েছেন তিনি। ভদ্রলোক বিশালদেহী, তাঁকে দেখলেই ভয় লাগে মনে। যে-পোলো শার্ট পরে আছেন, সেটা তাঁর শরীরে কেমন ছোট হয়ে গেছে। সে-শার্টের হাতা যেন ছিঁড়ে বেরিয়ে আছে কসাইদের-হাতের মতো শক্তিশালী দুটো বাহু। মাথা কামিয়ে রেখেছেন তিনি, ফলে তাঁর বয়স অনুমান করা মুশকিল। তবে আপাতত ধারণা করে নিলাম ষাটের কাছাকাছি হবে। তাঁর সঙ্গে আদৌ কোনো মিল নেই গ্রেসের। অ্যাশলিইকে কোলে নিয়েছেন তিনি, এবং আমার ধারণা কী করছেন তিনি সে-ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক আছেন। কারণ তিনি যদি তা না- থাকেন, তা হলে তাঁর সেই ভালুকের মতো আলিঙ্গনে হয়তো দম আটকে যেতে পারে ছোট্ট মেয়েটার। দুনিয়ার কোথায় কী হচ্ছে না-হচ্ছে সে-ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই ওই মেয়ের, ডুবে আছে একটা র্যাগ বুকের পাতায়
বাড়িটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আধুনিক। বিমানবন্দরের মেইন রানওয়ে থেকে বেশি দূরে না। কয়েক মিনিট পর পরই একটা করে প্লেন টেকঅফ করছে, আর তখন প্রচণ্ড শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে আমাদের। কিন্তু এই একই শব্দে গ্রেস আর তার বাবার কোনো বিকার হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। অ্যাশলিই রীতিমতো উপভোগ করছে শব্দটা… যখনই কোনো প্লেন উড়ে যাচ্ছে তখনই মুখ টিপে হেসে উঠছে। গ্রেস আমাদেরকে বলেছে, তার মা রোযমেরি লোভেল কাজে গেছেন। স্থানীয় একটা সেকেন্ডারি স্কুলে অঙ্ক শেখান তিনি। ফলে আমরা পাঁচজন এখন বলতে গেলে গায়ে গা ঘেঁষে বসে আছি সোফা আর আর্মচেয়ারে। এসব সোফা আর আর্মচেয়ার এই-ঘরের-তুলনায় বড় হয়ে গেছে আসলে। আমাদেরকে কফি অফার করেছিলেন মার্টিন, কিন্তু আমরা মানা করে দিয়েছি। কথা যা বলার গ্রেসই বলছে, তার বাবা বলতে গেলে চুপ করে আছেন। খেয়াল করলাম, থেকে থেকে লক্ষ করছেন তিনি আমাকে আর হোথর্নকে। তখন অদ্ভুত একজাতের ধিকিধিকি ক্রোধ দেখা যাচ্ছে তাঁর চোখে।
ড্যামিয়েন ক্যুপারের সঙ্গে কাটানো নিজের-জীবনের বর্ণনা দিল গ্রেস বিশ- মিনিট-ধরে… কীভাবে দেখা হলো তাদের, কীভাবে একটা সম্পর্কে জড়িয়ে গেল তারা, কীভাবে সময় কাটাল আমেরিকাতে। শেষ যে-ক’বার এই মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে আমাদের, তখন যে-রকম দেখেছি তাকে, তার চেয়ে কেন যেন সম্পূর্ণ অন্যরকম মনে হচ্ছে আজ। মনে হচ্ছে, ড্যামিয়েনের মৃত্যুতে কোনো একজাতের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি পেয়ে গেছে যেন। তার কথা শুনতে শুনতে আমার মনে হলো, ড্যামিয়েনের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্কটা শেষ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। মনে পড়ে গেল, হোথর্ন একবার ব্যঙ্গ করে এই মেয়েকে বিষাদাক্রান্ত বিধবা বলেছিল। আসলে… ঠিকই বলেছিল হোথর্ন। আমাদের সামনে সব সময়ই অভিনয় করে গেছে মেয়েটা। আমার কথাটা হয়তো নিষ্ঠুর শোনাচ্ছে… কিন্তু… মেয়েটাকে আমি পছন্দ করি, সে যুবতী এবং সহজাত একজাতের দক্ষতাও আছে তার মধ্যে… তারপরও আমার মনে হয় নিজের জীবনটা চুরি হতে দিয়েছে সে নিজেরই কাছ থেকে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ড্যামিয়েনের মৃত্যুতে জীবনটা নতুন করে শুরু করার একটা সুযোগ পেয়ে গেছে সে … যদিও এ-ব্যাপারে মুখ ফুটে কিছুই বলেনি।
‘আমি সব সময়ই একজন অভিনেত্রী হতে চেয়েছিলাম। যখন স্কুলে পড়তাম, নাটকের ক্লাসগুলো খুব ভালো লাগত আমার। যখনই সময়-সুযোগ করতে পারতাম, থিয়েটারে চলে যেতাম। স্কুলে যখন ছুটিছাটা থাকত, একটা হেয়ারড্রেসিং সেলুনে পার্টটাইম কাজ করতাম, যাতে টাকা জমাতে পারি, আর সে-টাকা দিয়ে কিনতে পারি থিয়েটারের টিকিট। মা আর বাবাও সব সময় সাহায্য করেছেন আমাকে, সমর্থন করেছেন। তাঁদেরকে যখন বললাম রাডা-তে (RADA = রয়্যাল অ্যাকাডেমি অভ ড্রামাটিক আর্ট… লন্ডনে অবস্থিত নাটকের একটা স্কুল; সিনেমা, টেলিভিশন আর মঞ্চের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এখানে। সারা যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে-পুরনো নাট্যবিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এটি একটি, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯০৪ সালে) অ্যাপ্লিই করবো, আমাকে শতভাগ সমর্থন দিলেন তাঁরা।
‘যা-হোক, আপনারা আসলে এসেছেন ড্যামিয়েনের ব্যাপারে জানতে। রাডা- তে ছিল সে-ও। বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল আমাদের গ্রুপের সব সদস্যের মধ্যে। আমরা একজন আরেকজনকে ভালোবাসতাম। এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলতে কিছু ছিল না আমাদের কারও মধ্যে। উত্তর ইংল্যান্ডের তিনজন মেয়ে ছিল আমাদের সঙ্গে। তাদেরকে কিছুটা ভয় পেতাম আমরা। সমকামী দুটো লোকও ছিল। কোনো কোনো ছাত্রছাত্রীর বয়স ছিল আমাদের চেয়ে বেশি… ত্রিশের কাছাকাছি। আমাদের সঙ্গে খুব একটা মিশতে চাইত না তারা, নিজেদের মধ্যেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করত। আর আমি ছিলাম বলতে গেলে একা।
‘কিন্তু আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে লাগল আমাদের মধ্যে। আর ড্যামিয়েন… সবাই চিনত ওকে, সবাই ওর প্রশংসা করত। ওর বয়স আর আমার বয়স প্রায় এক। রাডা-য় ভর্তি হওয়ার আগে বলতে গেলে কখনও আসেনি সে লন্ডনে … কেন্টে থাকত, অথচ অস্বাভাবিক আত্মবিশ্বাস ছিল ওর। আমাদের শিক্ষকরাও খুব ভালো জানতেন ওকে। সবাই ওর বেস্ট-ফ্রেন্ড হতে চাইত। ঘটনাক্রমে আমিই হয়ে গেলাম সেটা। তখনও একসঙ্গে বিছানায় যাইনি আমরা… না, একটু ভুল হলো… একবার গিয়েছিলাম। আর পাকাপাকিভাবে একসঙ্গে থাকতে শুরু করলাম রাডা থেকে বেরিয়ে আসার কয়েক বছর পর
‘ড্যামিয়েনের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল আমার। তবে… আরেকটা মেয়ে ছিল আমাদের দু’জনের মাঝখানে… আমান্ডা লেই। অবশ্য… ড্যামিয়েন সব সময় বলত ওটা নাকি ওই মেয়ের আসল নাম না। বিখ্যাত অভিনেত্রী ভিভিয়ান লেইয়ের নাম শুনেছেন না? মেয়েটা ওই অভিনেত্রীর নামে বলতে গেলে পাগল ছিল, এবং কেউ কেউ বলে ওই অভিনেত্রীর মতো হওয়ার উদ্দেশ্যেই পাল্টে নিয়েছিল নিজের নামটা। মেয়েটার ব্যাপারে পরে আরও কিছু কথা বলবো আপনাদেরকে। আগে ড্যামিয়েনের কথা শেষ করি। যা বলছিলাম… আমার আর ড্যামিয়েনের মাঝখানে আমান্ডা ছিল, ছিল আরেকটা ছেলেও… ড্যান রবার্টস। চমৎকার একজন অভিনেতা ছিল সে। অনেকেই মনে করে, ড্যামিয়েন আর ড্যান লেগে ছিল একজন আরেকজনের পেছনে, কিন্তু কথাটা আসলে সত্যি না। আসলে আমরা চারজন ছিলাম খুব ভালো বন্ধু। রাডা-তে যে-ক’বছর ছিলাম, চারজন বলতে-গেলে একসঙ্গেই ছিলাম সব সময়। সেখান থেকে বের হয়ে আমরা যার যার রাস্তায় চলে যাই। গ্লাসগো-তে সিটিযেন থিয়েটারে প্রথম একটা কাজ পেয়ে যাই আমি। ড্যামিয়েন গিয়ে যোগ দেয় আর.এস.সি.-তে। আর ড্যান ছিল ব্রিস্টলে, টুয়েল্ফথ্ নাইট-এ। তবে আমান্ডা কোথায় গিয়েছিল সেটা এখন আর মনে নেই আমার, কিন্তু এটা মনে আছে, আমরা আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম।
‘ড্যামিয়েনের ব্যাপারে যদি কিছু বলতে হয়, তা হলে হ্যামলেট-এর তৃতীয় বছরের প্রোডাকশনের কথাটা বলতেই হবে। কারণ ওই প্রোডাকশনটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম কথা, নাটকটা ছিল হ্যামলেট, আর দ্বিতীয় কথা, বিশেষ ওই চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পাবে যে, তার অভিনয়-জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়ার সুযোগ ছিল। নাটকটা দেখতে আসার কথা ছিল শত শত এজেন্টের। ওটা পরিচালনা করছিলেন লিন্ডসে পযনার, রয়্যাল কোর্টে দারুণ কিছু কাজ করেছিলেন তিনি। নাটক পরিচালনার কাজে তিনি যে অদ্বিতীয়, ইয়ং ভিক-এ আমেরিকান বাফেলো পরিচালনার মাধ্যমে সেটা প্রমাণ করেছেন। যা-হোক, কথা ছিল ওই নাটকে নাম-ভূমিকায়, মানে হ্যামলেটের চরিত্রে অভিনয় করবে ড্যান। আগের দুটো নাটকে ছোট ছোট দুটো চরিত্রে অভিনয় করেছিল সে। আমাদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, ও-রকম চরিত্রগুলোতে ওকে দিয়ে অভিনয় করানো হয়েছিল আসলে, কারণ হ্যামলেট নাটকে হ্যামলেটের চরিত্রে অভিনয় করতে দেয়া হবে ওকে।
‘এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশ উত্তেজিত ছিলাম আমরা। কিছুটা নার্ভাসও হয়ে পড়েছিলাম। রাডা ছেড়ে চলে যেতে হবে, অথচ কোনো এজেন্ট পাওয়া যাবে না… এর চেয়ে খারাপ আর কিছু হতে পারে না একজন অভিনয়শিল্পীর জন্য। কাজেই আমাদের জন্য হ্যামলেটের গুরুত্ব ছিল অসীম।
‘কিন্তু শেষপর্যন্ত কী হলো, জানেন? শেষপর্যন্ত বিশেষ ওই চরিত্রের জন্য মনোনীত করা হলো ড্যামিয়েনকে। আর আমি পেলাম অফেলিয়ার চরিত্রটা। আমান্ডা পেল ছোট একটা চরিত্র… অসরিচ।
‘টানা পাঁচ সপ্তাহ ধরে রিহার্সেল করতে হলো আমাদেরকে। আর তখনই এমন একটা ঘটনা ঘটল, যার ফলে বদলে গেল সব কিছু। বদলে গেল আমার জীবনটাও। সপ্তাহখানেক রিহার্সেল করার পর জ্বরে অসুস্থ হয়ে পড়ল ড্যান, ওর চরিত্রে রিহার্সেলের দায়িত্ব তখন ন্যস্ত হলো ড্যামিয়েনের কাঁধে। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে একসঙ্গে কাজ করতে লাগলাম আমি আর ড্যামিয়েন। ফিরে তাকিয়ে যখন দেখি ওসব, বুঝতে পারি, আমি আসলে ওই সময়েই প্রেমে পড়েছিলাম ওর।
‘আজও সেই হ্যামলেট নাটকের প্রোডাকশন নিয়ে কথা বলে লোকে। সেটাতে কাজ করার সুবাদে এজেন্ট পেয়ে যাই আমি, ড্যামিয়েন আর ড্যান। ড্যামিয়েন যে চমৎকার কাজ দেখিয়েছিল ওই নাটকে, সে-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই… বলতে গেলে বাজিমাত করে দিয়েছিল একাই। ভালো কাজ দেখিয়েছিল ড্যানও। যা-হোক, আমি যা বলতে চাইছি তা হলো, ড্যামিয়েনকে মানুষ হিসেবে যতটা না ভালোবেসেছিলাম, তার চেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলাম অভিনেতা হিসেবে। সে আসলে… মানুষ হিসেবে…’
উপযুক্ত শব্দটা খুঁজে পাচ্ছে না গ্রেস, তাই সাহায্যের আশায় তাকাল তার বাবার দিকে।
‘একটা বেজন্মা!’ শব্দটা জোগান দিলেন মিস্টার লোভেল।
‘বাবা!’
‘শয়তানটা তোমার সঙ্গে যে-রকম ব্যবহার করেছে, তোমাকে যেভাবে কাজে লাগিয়েছে…’
‘সব সময় ও-রকম করেনি সে।’
‘শুরু থেকেই ওই শয়তান আর তার মা ও-রকমই ছিল। ওরা দু’জন কেউ কারও চেয়ে কম খারাপ না।
এমন এক দৃষ্টিতে মিস্টার লোভেলের দিকে তাকিয়ে আছে গ্রেস যে, দেখে মনে হচ্ছে, বাবার কথাটা মেনে নিতে পারছে না। তবে এই কথা নিয়ে তাঁর সঙ্গে তর্কে গেল না। আমাদের, মানে আমার আর হোথর্নের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট ট্যালেন্টের সঙ্গে একটা চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করলাম আমি… কাজ করবো জনাথন ক্রীক নামের একটা টিভি শো-তে। তবে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না চরিত্রটা… একজন ম্যাজিশিয়ানের অ্যাসিস্টেন্ট। তারপরও… আমার বায়োডাটার জন্য কিছু তো ছিল! এরপর টিভিতে আরও কয়েকটা কাজ পেয়ে গেলাম: ক্যাযুয়ালটি, হলবি সিটি, দ্য বিল। স্টেলা আরটিয়োসের জন্য একটা বিজ্ঞাপনও করে ফেললাম। আর সেটার জন্য বুয়েন্স আয়ার্সে একটা সপ্তাহ থাকতে হয়েছিল আমাকে। দ্য কান্ট্রি ওয়াইফ আর দ্য সী নামের নাটকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগও পেয়ে গেলাম।
‘তারপর একদিন হুট করেই আবার দেখা হয়ে গেল ড্যামিয়েনের সঙ্গে। ঘটনাক্রমে দ্য কান্ট্রি ওয়াইফ নাটকটা দেখতে এসেছিল সে। আমি যে ছিলাম ওই নাটকে, জানত না সেটা। যা-হোক, ব্যাকস্টেজে ওর সঙ্গে দেখা হলো আমার। গলা ভেজানোর জন্য বাইরে একজায়গায় গেলাম আমরা। ওকে যে চোখের সামনে দেখছি, সেটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছিল তখন। মানে… আমি যা বলতে চাইছি তা হলো, আমরা একজন আরেকজনকে এত ভালোমতো চিনি, আমরা একজন আরেকজনের এত ঘনিষ্ঠ ছিলাম, তারপরও বছরের-পর-বছর দেখা হয়নি আমাদের দু’জনের মধ্যে।’
খেলতে খেলতে মার্টিন লোভেলের কোলেই ঘুমিয়ে গেছে অ্যাশলিই; বাচ্চাটাকে সাবধানে সোফায় শুইয়ে দিলেন তিনি। ‘ড্যামিয়েন নামের ওই শয়তান শুধু নিজের ক্যারিয়ারের দিকে খেয়াল রেখেছে। বন্ধু বলতে কেউ ছিল না তার কোনোকালে। তোমাকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে সে।
বাবার দিকে তাকাল গ্রেস। ‘এভাবে বোলো না, বাবা,’ এখনও একমত হতে পারছে না মিস্টার মার্টিনের সঙ্গে। আবারও তাকাল আমাদের দিকে। ‘আমার সঙ্গে যখন আবার দেখা হলো ড্যামিয়েনের, ততদিনে বিখ্যাত হয়ে গেছে সে। লোকে যদি ওর অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য ভিড় না-ও করত, তবুও ওকে দূর থেকে দেখে চিনতে পারত। বড় বড় বেশ কয়েকটা ছবি আর টিভি শো-তে অভিনয় করা হয়ে গিয়েছিল ওর। ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড থেকে একটা পুরস্কারও পেয়েছিল। ততদিনে সে কাজ শুরু করে দিয়েছিল হলিউডে। স্টার ট্রেক-এর শুটিং শুরু করার কথা ছিল ওর। তবে… ওর সঙ্গে দ্বিতীয়বার যখন দেখা হলো, তখন বুঝতে পারলাম, আগের চেয়ে বদলে গেছে সে… কিছুটা যেন কঠোর হয়ে গেছে। অত পয়সা কামাই করতে পারলে, অত সাফল্য পেলে যে-কেউ ও-রকম হয়ে যায় সম্ভবত। ব্রিক লেনের ফ্ল্যাটটা তখন মাত্র কিনে নিয়েছে সে।
‘যা-হোক, সেদিনের সেই সন্ধ্যাটা চমৎকার কাটল আমাদের। একটু বেশিই গিলে ফেলেছিলাম আমরা। কথা বলছিলাম রাডা-য় একসঙ্গে কাটানো দিনগুলো নিয়ে। আর তখনই ওর কাছ থেকে জানতে পারলাম, অভিনয় ছেড়ে দিয়েছে ড্যান। লজ্জাজনক ছিল ব্যাপারটা, কারণ ড্যান ছিল খুব মেধাবী। কিন্তু… কখনও কখনও হয় এ-রকম। প্রতিভার অবমূল্যায়ন হলে একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি সে-কাজে লেগে থাকবে কেন? জানেন, পাইরেট্স অভ দ্য ক্যারিবিয়ান-এর প্রধান চরিত্রটা আরেকটু হলে পেয়ে গিয়েছিল ড্যান। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেটা চলে যায় ওরল্যান্ডো ক্লুমের কাছে। আইটিভি’র জন্য ডক্টর যিভাগো নাটকটা করার কথা ছিল ওর, সে-সুযোগও হাতছাড়া হয় ওর।
‘ড্যামিয়েনের কাছ থেকে সেদিন আরও জানতে পারলাম, আমান্ডা স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে। নিজের ব্যাপারে সেদিন অনেক কথা বলেছিল ড্যামিয়েন আমাকে। বলেছিল, স্টার ট্রেক থেকে যে-পরিমাণ টাকা পেয়েছিল, লস অ্যাঞ্জেলসে একটা বাসা কেনার কাজে ব্যবহার করতে পারবে সেটা। ওই বাসায় পাকাপাকিভাবে থাকার কথাও ভাবছিল সে।
‘সপ্তাহ তিনেকের জন্য এসেছিল ড্যামিয়েন ইংল্যান্ডে। কাজ করছিল একটা মিনি সিরিযে। ওই পুরোটা সময় একসঙ্গে সময় কাটিয়েছি আমরা দু’জন। ওর সেই ব্রিক লেনের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম আমি, সেটা বিস্ময়কর মনে হয়েছে আমার। কারণ আমি তখন থাকি ক্ল্যাপহ্যামের ছোট্ট একটা বাসায়, আমার সঙ্গে থাকে আরও দু’জন অভিনেত্রী। কাজেই ড্যামিয়েনের সেই ফ্ল্যাট আমার জন্য ছিল অন্য একটা জগৎ। একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম তখন… ওর ফোন ক্রমাগত বেজেই চলেছে। ওর এজেন্ট, ওর ম্যানেজার, ওর হয়ে যারা পাবলিসিটি চালায় তারা… এমনকী খবরের কাগজ আর রেডিও স্টেশন থেকে সমানে ফোন দেয়া হচ্ছে ওকে। আমি তখন বুঝতে পারি, যখন রাডা-য় ভর্তি হয়েছিলাম, তখন এ-রকম কিছুরই স্বপ্ন দেখেছিলাম।’
‘ওই স্বপ্ন এখন তোমার জন্যও সত্যি হবে, গ্রেস,’ বলে উঠলেন মার্টিন লোভেল, ‘কারণ চিরবিদায় নিয়েছে লোকটা।’
‘কথাটা ঠিক বললে না, বাবা। ড্যামিয়েন কখনও আমার রাস্তায় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়নি।
‘তোমার ক্যারিয়ার যেইমাত্র বিকশিত হতে শুরু করেছে, তখনই তোমাকে প্রেগন্যান্ট বানিয়ে দিয়েছে সে।’
‘এমন না যে আমাদের দু’জনের মধ্যে যা ঘটেছে তা একতরফাভাবে ড্যামিয়েনের ইচ্ছাতেই ঘটেছে। বরং আমার প্রেগন্যান্ট হওয়ার ঘটনায় আমারও সম্মতি ছিল। ড্যামিয়েন বলেছিল, আমার মাধ্যমে একটা বাচ্চার বাবা হতে চায় সে। চেয়েছিল, আমি যেন চলে যাই ওর সঙ্গে… যেন থাকি ওর সঙ্গে। বলেছিল, আমাদের দু’জনের জন্য, এমনকী অনাগত বাচ্চাটার জন্যও যথেষ্ট টাকা আছে ওর কাছে। পরের ফ্লাইটেই আমাকে লস অ্যাঞ্জেলসে যাওয়ার কথা বলেছিল সে।’
‘আপনারা দু’জন কি বিয়ে করেছিলেন?’ জিজ্ঞেস করল হোথর্ন। অস্বাভাবিক হলেও সত্যি, এই যে এতক্ষণ ধরে কথা বলল গ্রেস, একটাবারের জন্যও কিছু বলেনি সে… কিছু জিজ্ঞেসও করেনি, বরং চুপ করে ছিল সারাটা সময়। মনোযোগ দিয়ে শুনেছে গ্রেসের কথা।
‘না, করিনি। বিয়ে করার পেছনে কোনো যুক্তি থাকতে পারে বলে মনে করেনি ড্যামিয়েন।’
‘মনে করবে কী করে?’ খেঁকিয়ে উঠলেন মার্টিন লোভেল। ‘ওই শয়তান তো সারাটা সময় ব্যস্ত ছিল নিজেকে নিয়েই… শুধু নিজের কথাই ভেবেছে। শয়তানটা আসলে কোনো বাঁধনে জড়াতে চায়নি। আর ওর মা-টাও ছিল একই রকম খারাপ। ছেলেকে মহামূল্যবান ভাবত, ছেলেই ছিল তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। তোমাকে একটুও সময় দেয়নি ওই মহিলা কখনও।’
‘তুমি যতটা বলছ, ডায়ানা আসলে ততটা খারাপ ছিলেন না। তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। কিছুটা হলেও দুঃখ ছিল তাঁর মনে। আর… মা হিসেবে তিনি তো তাঁর ছেলের ভালো চাইতেই পারেন, তা-ই না?’ অ্যাশলিইয়ের দিকে এগিয়ে গেল গ্রেস; মেয়েটার চোখের উপর নেমে এসেছে কিছু চুল, সরিয়ে দিল ওগুলো। ‘আমাকে যা করতে বলেছিল ড্যামিয়েন, ঠিক তা-ই করেছিলাম আমি। প্লেনের টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছিল সে আমার কাছে…’
‘প্রিমিয়াম ইকোনোমি ক্লাস,’ আবারও বাগড়া দিলেন মার্টিন লোভেল। ‘তোমার জন্য এমনকী বিযনেস ক্লাসের টিকিটও পাঠায়নি লোকটা।
‘…আমি গিয়ে উঠলাম ওর কাছে,’ বলছে গ্রেস। ‘ওর এজেন্ট ভিসার ব্যবস্থা করে দিল। অ্যাশলিই জন্ম নিল আমেরিকায়, ওই দেশের নাগরিকত্ব আছে ওর। ড্যামিয়েন ততদিনে স্টার ট্রেকের শুটিং শুরু করে দিয়েছে। তাই ওর সঙ্গে খুব একটা দেখা হতো না আমার। তবে আমি কিছু মনে করতাম না ওই ব্যাপারে। বরং যে-বাসা সে কিনেছিল লস অ্যাঞ্জেলসে, সেটা কেনার কাজে ওকে সাহায্য করেছিলাম। দুটো মাত্র বেডরুম ছিল ওই বাসায়, তারপরও বাসাটা ছিল চমৎকার… একটা পাহাড়ের উপরে অবস্থিত, দারুণ সব দৃশ্য দেখা যেত সেখান থেকে, ছোট্ট একটা পুলও ছিল সেখানে। আমি রীতিমতো প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম ওই বাসার। যেভাবে সাজাতে চেয়েছিলাম ওই বাসা, ওটা আমাকে সেভাবে সাজাতে দিয়েছিল ড্যামিয়েন। অ্যাশলিইয়ের জন্য একটা বেবি রুম সাজিয়ে নিয়েছিলাম আমি। যখন বাজার করার দরকার হতো, তখন কোথায় যেতাম, জানেন? ওয়েস্ট হলিউড আর রডিয়ো ড্রাইভে। বাসায় ফিরতে কখনও কখনও বেশ রাত হয়ে যেত ড্যামিয়েনের, তবে উইকএন্ডটা একসঙ্গেই কাটাতাম আমরা। ওর সব বন্ধুর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সে। আমি তখন ভেবেছিলাম, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।’
নিচের দিকে তাকাল গ্রেস। বিষাদ দেখতে পাচ্ছি তার চোখে।
‘কিন্তু সব কিছু ঠিক হয়নি শেষপর্যন্ত। দোষ আসলে আমার। চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু লস অ্যাঞ্জেলস ভালো লাগেনি। কারণটা হলো, ওটা আসলে কোনো শহরই না। সেখানে যদি কোথাও যেতে চান আপনি, গাড়িতে চড়তে হবে, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই সেখানে। মানে… সারি সারি দোকান আছে, রেস্টুরেন্ট আছে, সমুদ্রসৈকত আছে, তারপরও কেমন যেন খালি-খালি লাগে সব কিছু। আর সেখানে গরমও অনেক বেশি… বিশেষ করে আমি যখন প্রেগন্যান্ট ছিলাম, তখন। একসময় খেয়াল করতে শুরু করলাম, বাইরে যতটা না যাচ্ছি, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় একা-একা কাটিয়ে দিচ্ছি আমাদের সেই বাসায়। একটু আগে বলেছি, ড্যামিয়েন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ওর বন্ধুদের সঙ্গে, কিন্তু আসলে অত বেশি বন্ধু ছিল না ওর। আর ওরা সব সময় ওদের কাজ নিয়েই গল্পগুজব করত। ফলে আমার অবস্থা হলো দলছুটের মতো। তখন মনে হতো লাগল, মা আর বাবাকে মিস করছি অনেক। মনে হতে লাগল, মিস করছি লন্ডনকে, আমার ক্যারিয়ারকে।
‘ড্যামিয়েনের সঙ্গে আমার কখনও ঝগড়াঝাঁটি হতো না। তারপরও সুখী ছিলাম না আমরা। কারণ আমার মনে হতো, রাডা-য় যে-ড্যামিয়েনকে চিনেছিলাম, আসলে সে-রকম ছিল না সে। মনে হতো, বদলে গেছে অনেকখানি। হতে পারে, বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল সে… আর সেজন্যই ও-রকম মনে হতো আমার। কখনও কখনও আমার মনে হতো, আমার সঙ্গে অভিনয় করছে লোকটা। বিখ্যাত যেসব ব্যক্তির কথা শোনাত আমাকে, তাঁদের কথা শুনে মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতাম… একেকজন কোত্থেকে কোথায় চলে গেল, আর আমি কিনা হাত-পা গুটিয়ে বসে আছি বাসায়! অস্বীকার করছি না, মা হতে চেয়েছিলাম আমি, কিন্তু তার চেয়ে বেশি কিছুও হতে চেয়েছিলাম।
‘যা-হোক, একসময় জন্ম নিল অ্যাশলিই। ব্যাপারটা জাদুকরী কিছু-একটা ছিল আমাদের জন্য। ওই উপলক্ষে বেশ বড় একটা পার্টি দিল ড্যামিয়েন। আমি বলবো, একজন গর্বিত পিতা ছিল সে। কিন্তু তারপর টের পেলাম, আস্তে আস্তে দূরে… আরও দূরে সরে যাচ্ছে সে যেন। আমি যখন বাসায় বসে অ্যাশলিইকে দুধ খাওয়াচ্ছি, অথবা ওর ন্যাপি বা ডায়াপার বদল করছি, তখন পার্টি, প্রিমিয়ার, দামি- দামি দ্রুত গতির গাড়ি আর নিত্য নতুন নারী মডেল যেন ভরিয়ে তুলছে ড্যামিয়েনের জীবনটা। এত টাকা কামাই করত সে, তারপরও কখনও কখনও আমাদের মালির বেতন আর মুদি দোকানের বিল দেয়ার মতো টাকা থাকত না আমার হাতে।’
‘ড্রাগসের ব্যাপারটা বলছ না কেন এঁদেরকে?’ বললেন মার্টিন লোভেল।
‘কোকেইন এবং হাবিজাবি আরও কিছু খেত ড্যামিয়েন। তবে সেটা বিশেষ কিছু না… হলিউডের অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীই খায় ওসব। শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে পার্টিতে যাওয়া ছেড়ে দিলাম আমি। কখনও ড্রাগস খাইনি, ওসব ভালো লাগত না আমার। আমার গায়ে কখনও হাত তোলেনি ড্যামিয়েন। খারাপ মানুষ ছিল না সে। কিন্তু সে আসলে…’
‘স্বার্থপর একটা মানুষ ছিল,’ বাক্যটা শেষ করে দিলেন মার্টিন লোভেল।
‘বরং আমি বলবো সফল একজন মানুষ ছিল সে,’ দ্বিমত পোষণ করল গ্রেস। ‘আর ওর সেই সফলতাই গিলে খেয়েছিল ওকে।’
শূন্য দৃষ্টিতে গ্রেসের দিকে তাকিয়ে আছে হোথর্ন। ‘তার মানে… ড্যামিয়েন যে খুন হয়েছেন… তাঁর খুন হওয়ার জন্য এরচেয়ে ভালো সময় আর ছিল না?’
‘আপনার কথা বুঝতে পারছি না আমি,’ কিছুটা হলেও রেগে গেছে গ্রেস। ‘ও- রকম কিছু বলিনি আমি, বলবোও না কখনও। ড্যামিয়েন ছিল অ্যাশলিইয়ের বাবা। মেয়েটা বড় হয়ে উঠবে একসময়, অথচ বাবার অভাবটা সব সময় রয়ে যাবে ওর ভিতরে।’
‘ড্যামিয়েন কি কোনো উইল রেখে গেছেন?’
একটুখানি যেন থতমত খেয়ে গেল গ্রেস। ‘হ্যাঁ।’
‘সেটা কী, জানেন আপনি?’
‘হ্যাঁ। ড্যামিয়েনের উকিল চার্লস কেনওয়ার্দি উপস্থিত ছিলেন শেষকৃত্যানুষ্ঠানে, তাঁকে তখন জিজ্ঞেস করেছি ওই উইলের ব্যাপারে। আসলে অ্যাশলিইয়ের খাতিরে নিজেদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে জানাটা জরুরি হয়ে পড়েছিল।’
‘তা… কী জানতে পেরেছেন?’
‘জানতে পেরেছি, চিন্তা করার কোনো কারণ নেই আমার। নিজের সব কিছু আমাকে আর অ্যাশলিইকে দিয়ে গেছে ড্যামিয়েন।’
‘একটা জীবনবীমা ছিল তাঁর।’
‘ওই ব্যাপারে কিছু জানি না আমি।’
‘কিন্তু আমি জানি,’ পায়ের উপর পা তুলে বসেছে হোথর্ন, দুই হাত ভাঁজ করে রেখেছে বুকের উপর। ওকে দেখে এই পৃথিবীর সবচেয়ে নিশ্চিন্ত মানুষ বলে মনে হচ্ছে। একইসঙ্গে সবচেয়ে পাষাণহৃদয়ও মনে হচ্ছে। কালো চোখ জোড়া যেন স্থির হয়ে আছে গ্রেসের উপর… যেন দৃষ্টি দিয়েই গেঁথে ফেলতে চাইছে মেয়েটাকে। ‘মাস ছয়েক আগে একটা পলিসি নিয়েছিলেন ড্যামিয়েন। এবং সেটার ফলে প্রায় এক মিলিয়ন পাউন্ড পেতে যাচ্ছেন আপনি। ব্রিক লেনের ওই ফ্ল্যাট, হলিউড হিলসের সেই বাড়ি, আর আলফা রোমিও স্পাইডারটার কথা না-হয় বাদই দিলাম…
‘কী বলতে চাইছেন আপনি, মিস্টার হোথর্ন?’ দাবি জানানোর সুরে বলে উঠলেন মার্টিন লোভেল। ‘আপনার কি ধারণা আমার মেয়ে খুন করেছে ড্যামিয়েনকে?
‘কেন নয়?’ গ্রেসের দিকে তাকাল হোথর্ন। ‘ড্যামিয়েনের মা যেদিন খুন হলেন, তার আগের দিন ইংল্যান্ডে এসেছেন আপনি। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, মিসেস ক্যুপারের সঙ্গে কি দেখা হয়েছিল আপনার?
‘ডায়ানার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা ছিল আমার। কিন্তু সেই আমেরিকা থেকে লন্ডন… এতটা পথ যাত্রা করে সাংঘাতিক ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল অ্যাশলিই।’
‘তার মানে মিসেস ক্যুপারের সঙ্গে দেখা করেননি আপনি?’
‘না!’
গ্রেস আমার সঙ্গে এখানেই ছিল,’ বললেন মার্টিন লোভেল। ‘এবং যদি দরকার হয়, এই কথা শপথ করে বলতে পারবো আদালতে। আরেকটা কথা। ড্যামিয়েনকে যখন খুন করা হলো, তখন গ্রেস ছিল ওই লোকের মায়ের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে।
‘আর আপনি ওই শেষকৃত্যের সময় কোথায় ছিলেন, মিস্টার লোভেল?’
‘আমি অ্যাশলিইকে নিয়ে গিয়েছিলাম রিচমন্ড পার্কে… হরিণ দেখাতে।’
গ্রেসের দিকে তাকাল হোথর্ন। ‘রাডা’র ব্যাপারে যখন বলছিলেন আপনি আমাদেরকে, তখন বলেছেন, আমান্ডা লেই নামের মেয়েটার ব্যাপারে নাকি আরও কিছু কথা বলবেন। কী কথা?’
‘ওই মেয়ে ছিল ড্যামিয়েনের প্রথম গার্লফ্রেন্ড। তবে শেষপর্যন্ত ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় ওদের। সত্যি বলতে কী, আমার মনে হয় ড্যান রবার্টসের খাতিরে ড্যামিয়েনকে ছেড়ে দিয়েছিল মেয়েটা।’ দেখে মনে হলো, কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে ভুগছে গ্রেস। ‘হ্যামলেটের রিহার্সেল শুরু করার আগে একদিন ড্যান আর ওই মেয়েকে চুমু খেতে দেখেছি আমি। খুবই আবেগঘন হয়ে পড়েছিল ওরা… বলতে গেলে ডুবে গিয়েছিল একজন আরেকজনের মধ্যে। ওই নাটকে… আগেও বলেছি হয়তো… অসরিচের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল লেই। পরে বড় বড় গোটা দুয়েক গীতিনাট্যেও কাজ করেছিল। কিন্তু তারপর হুট করেই গায়েব হয়ে যায় কোথায় যেন।’
‘মানে… আপনি বলতে চাইছেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি?’ এতক্ষণে মুখ খুললাম আমি।
‘না। গায়েব হয়ে যাওয়া মানে লাপাত্তা হয়ে যাওয়া। একদিন একটু বেড়াতে বের হয়েছিল, কিন্তু তারপর ফিরে আসেনি কখনও। সব পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল খবরটা। যথেষ্ট খোঁজখবরও হয়েছিল ওর ব্যাপারে। কিন্তু কী হয়েছে ওর, সেটা কেউ জানতে পারেনি কোনো দিন।’
মার্টিন লোভেলের বাসা থেকে বের হয়েই নিজের আইফোনটা হাতে নিলাম আমি। চট করে সেরে নিলাম গুগল সার্চ।
পেয়ে গেলাম আট বছর আগের একটা নিউযপেপার রিপোর্ট:
সাউথ লন্ডন প্রেস
১৮ অক্টোবর ২০০৩
অভিনেত্রী নিখোঁজ, আবেদন করলেন তাঁর বাবা-মা
স্ট্রেটহ্যামে নিজের বাসা থেকে নিখোঁজ হয়েছেন ২৬ বছর বয়সী এক নারী। তাঁকে খুঁজতে শুরু করেছে পুলিশ।
জানা গেছে, তাঁর নাম আমান্ডা লেই। তিনি একজন অভিনেত্রী। ওয়েস্ট এন্ডের দুটো গীতিনাট্যে অভিনয় করেছেন তিনি… দ্য লায়ন কিং আর শিকাগো। বর্ণনায় বলা হচ্ছে, তিনি হালকাঁপাতলা দেহের অধিকারিণী, মাথায় লম্বা সাদা চুল। চোখের মণি হালকা বাদামি রঙের। চেহারায় ছুলীর দাগ আছে।
রোববার বিকেলে নিজের বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন মিস লেই। তখন তাঁর পরনে ছিল ফিটফাট পোশাক… সিল্কের ধূসর একটা ট্রাউজার স্যুট পরে ছিলেন, গাঢ় নীল রঙের একটা হার্মিস কেলি হ্যান্ডব্যাগ বহন করছিলেন। লাইসিয়াম থিয়েটারে সোমবার সন্ধ্যায় একটা নাটকে অভিনয় করার কথা ছিল তাঁর, কিন্তু তিনি সময়মতো সেখানে উপস্থিত হতে না-পারায় খবর দেয়া হয় পুলিশে। তারপর থেকে আজ ছ’দিন ধরে তিনি নিখোঁজ।
ইন্টারনেট ভিত্তিক কয়েকটা ডেটিং এজেন্সির সঙ্গে কথা বলেছে পুলিশ। জানা গেছে, বিয়ে করেননি ওই অভিনেত্রী, এবং অনলাইনে পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা করার অভ্যাস ছিল তাঁর। ধারণা করা হচ্ছে, ও-রকম কারও সঙ্গেই সাক্ষাৎ করতে গেছেন তিনি। তাঁকে সেদিন সন্ধ্যায় দেখেছেন, এ-রকম যে-কাউকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসার ব্যাপারে আহ্বান জানিয়েছেন তাঁর বাবা-মা।
রিপোর্টটা দেখালাম আমি হোথর্নকে। ওটা পড়ে এমন ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল সে যে, মনে হলো, ও-রকম কিছু পড়বে বলেই আশা করছিল যেন।
‘আপনি তা হলে আমান্ডা লেইয়ের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন?’ বললাম আমি!
জবাব দিল না হোথৰ্ন।
আমরা তখনও দাঁড়িয়ে আছি মার্টিন লোভেলের বাড়ির বাইরে। আমাদের মাথার উপর দিয়ে গর্জন করতে করতে উড়ে গেল আরেকটা প্লেন।
ওটা চলে যেতে দিলাম আমি। তারপর বললাম, ‘আপনি কি বলতে চান আমান্ডা লেইকেও খুন করা হয়েছে? কিন্তু কেন? এসবের সঙ্গে তো কোনো যোগাযোগ ছিল না ওই মেয়ের? এমনকী আজকের আগে মেয়েটার নামও শুনিনি আমরা।
বেজে উঠল হোথর্নের ফোন।
ওটা পকেট থেকে বের করল সে, কল রিসিভ করে কথা বলল মিনিটখানেক। কথা বলল মানে… ‘হ্যাঁ’ শব্দটা উচ্চারণ করল দুই কি তিনবার, তারপর বলল ‘ঠিক’ এবং সবশেষে ‘ঠিক আছে।’ এরপর লাইন কেটে দিল। খেয়াল করলাম, কঠোর হয়ে উঠেছে ওর চেহারা।
বলল, ‘মিডোস ফোন করেছিলেন।’
‘কী হয়েছে?’
‘ক্যান্টেব্রিতে ফিরে যেতে হবে আমাকে। আমার সঙ্গে কথা বলতে চান তিনি।’
‘কেন?’
এমন এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল হোথর্ন যে, অস্বস্তিতে ভুগতে লাগলাম। বলল, ‘কেউ একজন গতকাল রাতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে নাইজেল ওয়েস্টনের বাড়িতে। লেটার বক্সের ভিতর দিয়ে পেট্রোল ঢেলে দিয়েছিল, তারপর আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল সেখানে।’
‘মাই গড! নাইজেল ওয়েস্টন কি মারা গেছেন?’
‘না। তিনি আর তাঁর সেই বয়ফ্রেন্ড সময়মতো বেরিয়ে যেতে পেরেছিলেন। আপাতত হাসপাতালে আছেন তিনি। নিঃশ্বাসের সঙ্গে ধোঁয়া ঢুকে গিয়ে কিছু ক্ষতি হয়েছে তাঁর, তবে সেটা তেমন গুরুতর কিছু না। ডাক্তাররা আশা করছেন সেরে উঠবেন তিনি।’ হাতঘড়ি দেখল হোথর্ন। ‘ট্রেন ধরতে হবে আমাকে।’
‘আমিও যাবো আপনার সঙ্গে।’
মাথা নাড়ল হোথর্ন। ‘না। আমার মনে হয় না আপনার যাওয়াটা উচিত হবে। একাই যাবো আমি সেখানে।’
‘কেন?’
প্রশ্নটার জবাব দিল না হোথর্ন।
‘আপনি জানেন কে আগুন লাগিয়েছে নাইজেল ওয়েস্টনের বাড়িতে, তা-ই না?’ চ্যালেঞ্জ জানানোর সুরে বললাম আমি।
আবারও সেই শূন্যতা ফিরে এসেছে হোথর্নের চোখে। এই শূন্যতা সম্পর্কে ভালোমতো জানা আছে আমার। এই শূন্যতা আমাকে সব সময় জানিয়ে দেয়, পৃথিবীকে যেভাবে দেখি আমি, তার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দৃষ্টিতে দেখে হোথর্ন। আরও জানিয়ে দেয়, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কখনও কাছাকাছি হতে পারবে না।
‘হ্যাঁ,’ আমার প্রশ্নের জবাবে বলল সে। ‘আপনি।’
২১. রাডা
হোথর্ন কী বোঝাতে চেয়েছে, সে-ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই আমার। কিন্তু ওটা নিয়ে যত ভাবছি, তত খারাপ হয়ে যাচ্ছে মনটা। কেউ একজন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে নাইজেল ওয়েস্টনের বাড়িতে… আমি কীভাবে দায়ী হতে পারি ওই হামলার জন্য? এমনকী ওই জায়গায় যাওয়ার আগপর্যন্ত জানতামও না কোথায় থাকেন ওই জাজ। হোথর্ন যখন কথা বলছিল বুড়ো লোকটার সঙ্গে, তখন নিজের মুখ একেবারে বন্ধ করে রেখেছিলাম। এমনকী আমি আর হোথর্ন যে যাবো সেখানে, সে-কথা ও বলিনি কাউকে। না, একটু ভুল হলো বোধহয়… বলেছিলাম… আমার স্ত্রীকে, আমার অ্যাসিস্টেন্টকে, আর সম্ভবত আমার দুই ছেলের কোনো একজনকে। এখন কথা হচ্ছে, হোথর্ন কি আমার উপর ইচ্ছাকৃতভাবে ওর ঝাল মিটাচ্ছে? সে-রকম কোনো ইচ্ছা যদি থাকে ওর, আশ্চর্য হবো না। খুব সম্ভব এমন কিছু একটা ঘটেছে যা আসলে আশা করেনি সে, আর সেজন্য হাতের কাছে যাকে পাচ্ছে তার সঙ্গেই দুর্ব্যবহার করছে।
আমাদের তদন্তের বর্তমান অবস্থাটা আসলে কী, ভাবতে লাগলাম। যতদূর বুঝতে পারছি, নিজের সন্দেহের তালিকা থেকে অ্যালান গডউইনকে কমবেশি বাদ দিয়ে ফেলেছে হোথর্ন। আবার একইসঙ্গে এ-কথাও সত্যি, ডায়ানা ক্যুপারকে বেকসুর খালাস দিয়ে পুরো ব্যাপারটা ঘোলাটে করে ফেলেছেন নাইজেল ওয়েস্টন, কিন্তু কেউ প্রমাণ করতে পারবে না, ওই কাজ করে কোনো অপরাধ করেছেন তিনি। আর এখন প্রাণঘাতী হামলা হলো তাঁর উপরই। মুশকিল হচ্ছে, আমি যখন ভাবতে শুরু করেছি বিশেষ ওই গাড়ি-দুর্ঘটনার সঙ্গে এখনকার খুন দুটোর কোনো সম্পর্কই নেই, তখনই এমন এক ঘটনা ঘটল, যার ফলে আমার সেই অনুমানের উল্টোটাই সত্যি বলে মনে হচ্ছে।
গাড়িটা চালাচ্ছিলেন ডায়ানা ক্যুপার। সে-গাড়ির নিচে পড়ে মারা গেল টিমোথি গডউইন, গুরুতর আহত হলো ওর ভাই। ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে গেলেন তিনি। সবাই জানতে পারল, ছেলে ড্যামিয়েন ক্যুপারকে বাঁচাতে পালিয়েছিলেন ওই মহিলা। তাঁর নামে মামলা দেয়া হলো, বিচার হলো আদালতে, কিন্তু তাঁকে বেকসুর খালাস দিলেন নাইজেল ওয়েস্টন… নামকাওয়াস্তের কিছু সাজার কথা যদি বাদ দিয়ে বলি। এখন কথা হচ্ছে, ডায়ানা ক্যুপার, ড্যামিয়েন ক্যুপার আর নাইজেল ওয়েস্টন… তাঁদের তিনজনের উপরই কিন্তু হামলা হয়েছে। প্রাণে মারা পড়ল প্রথম দু’জন।
এসব নিশ্চয়ই কাকতালীয় হতে পারে না?
আরও একটা প্রশ্ন চলে আসছে আমাদের সামনে।
আমান্ডা লেই… মানে, যে-মেয়ে ড্যামিয়েন ক্যুপারের সঙ্গে রাডা-তে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল, এবং পরে যে-মেয়ে গায়েব হয়ে গিয়েছিল রহস্যজনকভাবে… পুরো ব্যাপারটাতে তার ভূমিকা কী? হতে পারে, আসলে ওই মেয়ের কোনো ভূমিকাই নেই। গ্রেস লোভেলদের বাসা থেকে বের হয়ে আমি আমার আইফোনে আমান্ডা- লেইকে-নিয়ে-লেখা একটা আর্টিকেল বের করেছিলাম এবং সেটা দেখিয়েছিলাম হোথর্নকে। কিন্তু ওই ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি সে। কাজেই আমি আসলে এখনও নিশ্চিত হতে পারছি না, পুরো ব্যাপারটার সঙ্গে রহস্যময়ী সেই অভিনেত্রীর কোনো যোগসূত্র আছে কি না।
হঠাৎ করেই টের পেলাম, প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে নিজের উপরই।
এখন মাঝবিকেল, হাউনস্লো ইস্ট টিউব স্টেশনের পাশে সস্তা কিন্তু চটকদার একটা ক্যাফেতে একা বসে আছি। হোথর্ন চলে যাওয়ার পর এখানে এসে ঢুকেছি। টিউব ট্রেনে চেপে চলে গেছে সে। আমার চারদিকে এখন আয়না এবং চকচকে সব মেন্যুর রাজত্ব। একদিকের দেয়ালে একটা ওয়াইড স্ক্রীন টিভি লাগানো আছে, ওটাতে একটা অ্যান্টিক শো চলছে। দুই পিস টোস্ট আর এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়েছি। কিন্তু আসলে এসব খেতে চাইনি। আপনমনে নিজেকেই জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে আমার? হোথর্নের সঙ্গে যখন প্রথমবার দেখা হলো, আমি ততদিনে একজন সফল ও প্রতিষ্ঠিত লেখক। এমনকী একটা টিভি শো’র ক্রিয়েটর… সেই শো কম করে হলেও পঞ্চাশটা দেশে দেখানো হয়েছে। শুধু তা-ই না, সেই শো’র প্রোডিউসারকে বিয়েও করেছি। আমাদের হয়ে তখন কাজ করত হোথর্ন। ঘণ্টাপ্রতি দশ কি বিশ পাউন্ড করে দেয়া হতো ওকে… বিনিময়ে কিছু তথ্য সরবরাহ করত সে, আর সেসব তথ্য আমার চিত্রনাট্যে ব্যবহার করতাম আমি।
কিন্তু গত দু’সপ্তাহের মধ্যে বদলে গেছে সব কিছু। আমাকে একজন মৌন সহযোগীতে পরিণত করে ফেলেছে হোথর্ন। আমি আমার নিজের বইয়েই পরিণত হয়েছি গৌণ একটা চরিত্রে। তার চেয়েও খারাপ কথা, কী ঘটছে, সেটা হোথর্ন বলে না-দেয়া পর্যন্ত এই কেসের কোনো একটা ক্লু নিয়ে কাজ করার স্বাধীনতা নেই আমার। সে কি আমাকে বোকা ভাবে? কিন্তু আমি আসলে যথেষ্ট চালাক।
একটা চিন্তা খেলে গেল আমার মাথায়। অনেকদিন হয়ে গেল হোথর্নের পদাঙ্ক অনুসরণ করছি। আজ এক কাজ করলে কেমন হয়? হোথর্ন যেহেতু লন্ডনে নেই, আমি নিজে যদি উদ্যোগী হয়ে কিছু তদন্তকাজ পরিচালনা করি, তা হলে এগিয়ে যেতে পারবো ওর চেয়ে।
আমার চা আর টোস্ট পরিবেশন করা হলো। চায়ের উপরিতলে তেলতেলে একজাতের দীপ্তি দেখতে পাচ্ছি। টোস্ট দুটো ছেয়ে আছে কিছু-একটাতে, সেগুলো আবার গলে গেছে। গা কেমন ঘিনঘিন করে উঠল আমার। ঠেলে সরিয়ে দিলাম প্লেটটা। পকেট থেকে বের করলাম আমার ফোন। আজ সারাদিনের জন্য লন্ডনে থাকছে না হোথর্ন। তার মানে রহস্যময়ী সেই আমান্ডা লেইকে নিয়ে তদন্ত করার সুবর্ণ সুযোগ চলে এসেছে আমার হাতে।
একটু অদ্ভুত হলেও সত্যি, সাউথ লন্ডন প্রেসের যে-আর্টিকেল পড়েছিলাম, সেটাতে ওই মেয়ের কোনো ছবি ছিল না। মেয়েটা দেখতে কেমন, ভাবলাম। নেট ঘাঁটলাম কিছুক্ষণ, কিন্তু কোনো ছবি পেলাম না।
মেয়েটা গায়েব হয়ে গেছে এবং তাকে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার বাবা-মা হয়তো আজও হা-হুঁতাশ করছে ওই মেয়ের জন্য, কিন্তু সাধারণ জনগণের কৌতূহল উবে গেছে।
আমান্ডা লেইয়ের ব্যাপারে আরও জানতে চাই আমি। রাডা-তে এমন কী ঘটেছিল, যার ফলে গায়েব হয়ে যেতে হবে একজন অভিনেত্রীকে, খুন হবে একজন অভিনেতার মা এবং খুন হবে সেই অভিনেতা নিজে?
কিন্তু… রাডা-তে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করাও তো মুখের কথা না।
কিছুক্ষণ ভাবলাম ব্যাপারটা নিয়ে। একসময় আমার মনে হতে লাগল, একটা উপায় বোধহয় আছে। রাডা মাঝেমধ্যে অভিনেতা-অভিনেত্রী, পরিচালক আর চিত্রনাট্যকারদের আমন্ত্রণ জানায়… ওখানে গিয়ে দেখা করতে বলে ওদের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে। গত বছর আমি গিয়েছিলাম সেখানে, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমার সেই সেশন থেকে কতখানি উপকৃত হয়েছে, সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত না। তবে আমি ওই সেশন খুব উপভোগ করেছি।
আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন একজন সহযোগী পরিচালক। ওই ভদ্রমহিলা চান না পরিচয় ফাঁস হয়ে যাক তাঁর, তাই আপাতত তাঁকে লিয নামেই ডাকছি। ক্যাফেতে বসেই ফোন করলাম তাঁকে। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন বিকেলে তিনি রাডা- তেই ছিলেন। তিনটার সময় এক ঘণ্টার জন্য আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলেন। চালচলনে লিয স্মার্ট, ব্যবহারে ঐকান্তিক। বয়সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়। অভিনেত্রী হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত হতে পেরেছেন লেখিকা। এবং পরিচালনার এবং পরিচালনার দায়িত্বটাও গ্রহণ করতে পেরেছেন সফলভাবে।
রাডার মেইন বিল্ডিংটা গাওয়ার স্ট্রীটে। নিচতলার একটা চটকদার ক্যাফেতে দেখা হলো লিযের সঙ্গে।
‘ড্যামিয়েন ক্যুপারের কথা খুব ভালোমতো মনে আছে আমার,’ বললেন তিনি ‘কাঁপাচিনো নিয়ে বসে পড়তাম আমরা, আমাদের আশপাশে থাকত সাদা-কালো অনেক ছবি। আমাদের সঙ্গে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীও থাকত… নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করত তারা, অথবা নাটকের স্ক্রিপ্ট পড়ত।’ কণ্ঠ নিচু করলেন। ‘একটা কথা সব সময় মনে হতো আমার… ড্যামিয়েন ক্যুপারের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। ওর বয়স ছিল কম, তবে নিজের উপর বিশ্বাস ছিল, আর… মাঝেমধ্যে একটু খারাপ ব্যবহার করত।’
‘আপনি যে তখনও শিক্ষকতা করতেন এখানে, বুঝতে পারিনি।’
‘১৯৯৭ সালের কথা বলছি আমি। তখন কেবল যোগ দিয়েছি এখানে। ড্যামিয়েন তখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।’
‘তাকে মনে হয় তেমন একটা পছন্দ করতেন না আপনি।
‘না, সে-রকম কিছু না। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি আমার ব্যক্তিগত যে-আবেগ, সেটা সব সময় লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম। যা-হোক, যা বলছিলাম… ড্যামিয়েন ছিল খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কাস্টিং পাওয়ার জন্য দরকার হলে নিজের মাকেও ছুরি মারতে পারত সে, এমন অবস্থা।’ বলতে গিয়ে কী বলে ফেলেছেন, সেটা কিছুক্ষণ ভাবলেন লিয। তারপর বললেন, ‘আমি কী বোঝাতে চেয়েছি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন।’
‘হ্যামলেট নাটকে অভিনয় করেছিল সে। সেটা কি দেখেছিলেন?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু কথাটা স্বীকার করতে রীতিমতো ঘৃণা হচ্ছে আমার। কারণ ওই চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল না ড্যামিয়েনের। যার অভিনয় করার কথা ছিল, সে গ্রান্ডুলার ফিভারে আক্রান্ত হয়ে পড়ায় সুযোগটা পেয়ে গিয়েছিল ড্যামিয়েন। সে- বছর ওই অসুখ মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। একবার ভয়াবহ প্লেগ ছড়িয়ে পড়েছিল লন্ডনে, তখনকার মতো হয়েছিল অবস্থাটা। আসলে… একটা কথা ঠিকই বলেছেন আপনি… ড্যামিয়েনকে ঠিক পছন্দ হতো না আমার। কারণ অন্যদেরকে নিজের কাজে লাগানোর একটা বাজে স্বভাব ছিল তার। তা ছাড়া ডিলের ঘটনাটা…’
‘ডিলের কোন্ ঘটনা?’ হঠাৎ করেই আগ্রহী হয়ে উঠেছি আমি। নাটকের এই স্কুল আর সেই গাড়ি দুর্ঘটনার মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক আছে? এবং এই সম্পর্কের ব্যাপারটা কি জানা নেই হোথর্নের? আমিও কি মিস করেছি এটা?
‘ঘটনাটা বলার আগে একটা কথা বলে নিই আপনাকে,’ বলছেন লিয। ‘আমাদের ক্লাসগুলোতে একটা নিয়ম চালু ছিল। ছাত্র-ছাত্রীদের সবাইকে একটা করে জিনিস নিয়ে আসতে হতো, এবং সেটা নিয়ে কথা বলতে হতো সহপাঠীদের সামনে। তো… একবার প্লাস্টিকের একটা খেলনা নিয়ে এল ড্যামিয়েন… লন্ডনের একটা বাস। তখন একটা নার্সারি রাইমের রেকর্ডিংও বাজিয়ে শুনিয়েছিল সে আমাদেরকে… দ্য হুইলস অন দ্য বাস গো রাউন্ড অ্যান্ড রাউন্ড। সে বলেছিল, ওই ছড়া নাকি বাজানো হয়েছিল একটা ছেলের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে… ছেলেটা মারা পড়েছিল বিশেষ সেই গাড়ি-দুর্ঘটনায়। আর গাড়িটা চালাচ্ছিল ওর মা।’
‘এই ঘটনার ঠিক কোন্ ব্যাপারটা রোমাঞ্চকর বলে মনে হচ্ছে আপনার কাছে?’
‘এই ব্যাপারটা নিয়ে পরে তার সঙ্গে একটু মন কষাকষি হয়েছিল আমার। এই ব্যাপারে খুব আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিল সে। বলেছিল, ওই ছড়াগান নাকি ওর ভিতরটাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল। ওটা নাকি কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছিল না সে মাথা থেকে। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, আমার মনে হয় না ওই গাড়ি দুর্ঘটনার সঙ্গে আদৌ কোনো সম্পর্ক ছিল তার। বরং আমার মনে হয়, ঘটনাটা ব্যবহার করতে চাইছিল সে আসলে… ওটা উপজীব্য করে কোনো একটা ফায়দা লুটতে চাইছিল। তার সেই ভান ছিল খুবই আত্মকেন্দ্রিক। ড্যামিয়েনের মা হয়তো সেই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ছিলেন না, কিন্তু তাঁর কারণেই যে মারা গিয়েছিল আট বছর বয়সী ওই ছেলেটা, সে-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আমার মনে হয় না, এই ব্যাপারটা ক্লাসে সবার সামনে উপস্থাপন করে ঠিক কাজ করেছে ড্যামিয়েন। এবং সেটা তাকে বলেছিলামও।
‘আমান্ডা লেইয়ের ব্যাপারে কিছু বলতে পারেন?’
‘তার কথা তেমন একটা মনে নেই আমার। তবে এটা মনে আছে, মেয়েটা মেধাবী আর চুপচাপ প্রকৃতির ছিল। ড্যামিয়েনের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কোথায় কোথায় যেন যেত। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তাদের দু’জনের মধ্যে। বলতে খারাপই লাগছে… রাডা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মেয়েটা তার ক্যারিয়ার বেশিদূর টেনে নিতে পারেনি। দুটো গীতিনাট্যে অভিনয় করেছিল, কিন্তু তার বেশি কিছু না।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন লিয। ‘মাঝেমধ্যে হয় এ-রকম। কোথাকার জল গড়িয়ে কোন্ পর্যন্ত যাবে, সেটা আগেভাগে অনুমান করা যায় না।
‘মেয়েটা একদিন হঠাৎ করেই গায়েব হয়ে গিয়েছিল, না?’
‘পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল খবরটা। আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য এখানেও এসেছিল পুলিশ, অথচ রাডা থেকে চলে যাওয়ার চার কি পাঁচ বছর পর হারিয়ে যায় মেয়েটা। একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল তখন… ওই মেয়ে নাকি তার এক ভক্ত বা উত্যক্তকারীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। কিন্তু এই ব্যাপারে পরে নিজেদের মত বদল করে পুলিশ। বলে, মেয়েটা নাকি কারও সঙ্গে ডেট করার জন্য গিয়েছিল সম্ভবত। কারণ তার পরনে তখন ছিল স্মার্ট পোশাক। একটা ফ্ল্যাটে থাকত সে, সেখানে তার সঙ্গে আরও কয়েকটা মেয়ে থাকত… তারা বলেছে, বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সে নাকি খোশমেজাজে ছিল। যা-হোক, সেই যে গেল মেয়েটা… তার দেখা পাওয়া গেল না আর কখনও। সে যদি আরও বিখ্যাত কেউ হতো, তা হলে এই ব্যাপারটা আরও বেশি হইচই হতো। অথবা কেউ যদি ড্যামিয়েন ক্যুপারের সঙ্গে ওই মেয়ের কোনো একটা সম্পর্ক জুড়ে দিতে পারত, তা হলেও আলোড়ন তৈরি হতো ব্যাপারটা নিয়ে। কারণ ক্যুপার ততদিনে নিজের জন্য নাম কামাতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, লন্ডনের বাসিন্দা অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছে হরহামেশা… ওই মেয়েও হয়তো তাদের মতোই একজন।’
‘আপনি বলেছিলেন আপনার কাছে নাকি ওই মেয়ের একটা ছবি আছে।’
‘হ্যাঁ। আপনি আসলে সৌভাগ্যবান। কারণ ওই সময়ে যারা ছিল রাডা-য়, তাদের কারও তেমন কোনো ছবি নেই আমাদের কাছে। এখনকার দিনে তো সবারই মোবাইল ফোন থাকে। যা-হোক, আমরা ছবিটা রেখেছিলাম সেই হ্যামলেট নাটকের কারণে।’ সঙ্গে করে বড় একটা ক্যানভাসের ব্যাগ নিয়ে এসেছেন লিয, ওটা তুলে রাখলেন টেবিলের উপর। ‘আমাদের অফিসে খুঁজে পেয়েছি ছবিটা।’
ফ্রেমে বাঁধাই-করা সাদা-কালো একটা ছবি বের করলেন তিনি। আমাদের দু’জনের কফির কাপ দুটোর মাঝখানে রাখলেন ওটা। তাকালাম ছবিটার দিকে। হঠাৎ করেই টের পেলাম, যেন কোনো জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি ১৯৯৯ সালের দিকে।
কম-বয়সী পাঁচজন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে দেখা যাচ্ছে। খালি একটা স্টেজের উপর আছে তারা সবাই, তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে, ভাবভঙ্গিতে অতিরিক্ত সিরিয়াসনেস। ছবিটা দেখামাত্র চিনতে পারলাম ড্যামিয়েন ক্যুপারকে। গত বারো বছরে খুব একটা বদলায়নি সে। তবে ওই সময়ে আরও হালকাঁপাতলা ছিল, আরও সুন্দর ছিল। কিন্তু ছবিটা দেখামাত্র মনে হয়, ধৃষ্টতা যেন লেপ্টে আছে তার চেহারায়। সোজা তাকিয়ে আছে লেন্সের দিকে, পারলে তাকে উপেক্ষা করার নিঃশব্দ চ্যালেঞ্জ যেন জানাচ্ছে চোখ দুটো। পরনে কালো জিন্স আর খোলা গলার কালো শার্ট। হাতে একটা জাপানিয মুখোশ। গ্রেস লোভেল দাঁড়িয়ে আছে ড্যামিয়েনের এক পাশে। আরেক পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা ছেলে।
এদের পেছনে দাঁড়িয়ে-থাকা আরেকটা মেয়েকে দেখিয়ে দিলেন লিয। ‘এই যে… এটাই আমান্ডা।
মেয়েটার মাথায় লম্বা চুল। ওই নাটকে একটা পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করেছিল সে, আর তাই ড্যামিয়েন যে-রকম কাপড় পরেছে সে-ও সে-রকম কাপড় পরেছে।
বলতে বাধ্য হচ্ছি, মেয়েটা হতাশ করল আমাকে। কী আশা করছিলাম, সে- ব্যাপারে আসলে নিশ্চিত না আমি, কিন্তু এই মেয়েকে কেন যেন খুব সাধারণ বলে মনে হলো আমর কাছে। চেহারানকশা এমনিতে সুন্দর, কিন্তু ছুলীতে ভরা। দলটার একেবারে কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে একটা লোকের দিকে… অন্য এক দিক থেকে ওই দলের উদ্দেশে এগিয়ে যাচ্ছে লোকটা।
‘এটা কে?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
অপরিচিত ওই লোক ছবির ফ্রেমে নেই বললেই চলে। ফলে তার চেহারাটা ভালোমতো দেখতেও পাচ্ছি না, তাকে চিনতেও পারছি না। তবে এটুকু বোঝা যাচ্ছে… লোকটা কৃষ্ণাঙ্গ, চশমা পরে আছে, হাতে একগুচ্ছ ফুল, বিশেষ সেই দলের সবার চেয়ে বয়সে যথেষ্ট বড় এবং স্পষ্ট ঠাহর করা যায় ব্যাপারটা।
‘আমার কোনো ধারণা নেই,’ বললেন লিয। ‘ওই দলের কোনো একজনের বাবা হবেন হয়তো। নাটকটা প্রথমবার মঞ্চস্থ হওয়ার পর তোলা হয়েছিল এই ছবি।’
‘আপনি কি কখনও…
প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও জিজ্ঞেস করা হলো না আমার। জানতে চাইছিলাম, ড্যামিয়েনের সঙ্গে আমান্ডার সম্পর্কের ব্যাপারে কিছু জানেন কি না লিয। কিন্তু ঠিক তখনই এমন কিছু একটা দেখতে পেলাম, যার ফলে বাক্যের মাঝখানে থেমে যেতে হলো আমাকে। ছবিতে যে-দলটা দেখা যাচ্ছে, তাদের বিশেষ একজনের দিকে তাকিয়ে আছি, এবং হঠাৎ করেই চিনতে পেরেছি তাকে। ওই মানুষটার পরিচয়ের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই আমার মনে। উত্তেজনার মাথায় হঠাৎ করেই অনুধাবন করতে পারলাম, এমন কিছু একটা আবিষ্কার করে ফেলেছি, যেটা এই কেসের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। অনুধাবন করতে পারলাম, আমি অন্তত একটাবারের জন্য হলেও এক ধাপ এগিয়ে গেছি হোথর্নের চেয়ে। এমন কিছু একটা জেনে গেছি, যা সে জানে না। গ্রেস লোভেলদের বাসা থেকে যখন বের হয়েছিলাম, তখন জেনে-বুঝে উপহাস করেছে সে আমাকে। উপহাস বলছি কেন… রীতিমতো অবজ্ঞা করেছে আমাকে, অপমান করেছে। এখন কথা হচ্ছে, সে ক্যান্টাব্রি থেকে ফেরার পর আমি যদি তাকে বলি কোন্ বিষয়টা মিস করেছে, তা হলে কেমন হবে? একটুখানি না-হেসে পারলাম না। লন্ডনের পথেঘাটে আমাকে ঘুরিয়েছে সে… সাইডলাইনে বসে-থাকা খেলোয়াড়দের মতো নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করেছে ওর দিকে… কাজেই সে ফেরার পর যদি এই কথা বলি তাকে, এক হাত নিতে পারবো আমি ওকে।
‘লিয, আপনার কোনো জবাব নেই,’ বললাম আমি। ইঙ্গিতে দেখালাম ছবিটা। ‘এটা কি ধার নিতে পারি আমি?’
‘দুঃখিত। ছবিটা এই প্রতিষ্ঠানের… এটাকে এই বিল্ডিঙের বাইরে যেতে দেয়াটা উচিত হবে না। তবে আপনি চাইলে আপনার মোবাইল দিয়ে ছবি তুলে নিতে পারেন।
‘চমৎকার!’ আইফোনটা টেবিলের উপরই আছে… এতক্ষণ ধরে আমাদের কথোপকথন রেকর্ড করেছি। ওটা তুলে নিলাম, একটা ছবি তুললাম বিশেষ সেই ফটোগ্রাফের। তারপর উঠে দাঁড়ালাম। ‘অনেক ধন্যবাদ।
রাডা’র বাইরে এসে যোগাযোগ করলাম আলাদা আলাদা তিন জায়গায়।
প্রথমে আয়োজন করলাম একটা মিটিং।
তারপর ফোন করলাম আমার অ্যাসিস্টেন্টকে… আমার জন্য অপেক্ষা করছে সে। মেয়েটাকে বললাম, আজ বিকেলে আর ফিরতে পারছি না।
সবশেষে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম আমার স্ত্রীর কাছে, জানিয়ে দিলাম আজ ডিনারে যোগ দিতে হয়তো একটু দেরি হবে।
জানা ছিল না, সে-রাতে ডিনারই জুটবে না আমার কপালে।
২২. মুখোশের আড়ালে
গাওয়ার স্ট্রীট থেকে টিউব ট্রেনে চেপে চলে এলাম পশ্চিম লন্ডনে। মিনিট পাঁচেক হেঁটে হাজির হলাম লাল-ইটে-বানানো চৌকোনা একটা বিল্ডিঙের সামনে। এটার জানালাগুলোয় ফ্রস্টেড কাঁচ লাগানো। বিজ্ঞাপনমূলক কোনো কিছু নেই কোথাও। চাপ দিলাম ডোরবেলে। ঘণ্টার আওয়াজটা কেমন যেন ক্রুদ্ধ বলে মনে হলো আমার। ভিতরের কোনো এক জায়গা থেকে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে খুলে দেয়া হলো তালা, ক্লিক করে শব্দ হলো। ঢোকার সময় খেয়াল করলাম, একটা সিসিটিভি ক্যামেরা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হাজির হলাম শূন্য একটা রিসিপশন এরিয়ায়। দেয়ালগুলো খালি, মেঝেতে টাইলস করা। আশপাশ দেখে কোনো ক্লিনিক অথবা কোনো একটা হাসপাতালের অন্ধকারাচ্ছন্ন কোনো ডিপার্টমেন্টের কথা মনে পড়ে গেল আমার। প্রথমে মনে হলো, আমি বুঝি একা এখানে। কিন্তু একটা ডাক শুনতে পেলাম হঠাৎ। এগিয়ে গেলাম একটা অফিসের দিকে। সেখানে দু’কাপ কফি বানাচ্ছে ফিউনারেল ডিরেক্টর রবার্ট কর্নওয়ালিস। এই বিল্ডিঙের অন্যান্য জায়গার মতো এই অফিসেও উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু নেই। একটামাত্র ডেস্ক আছে এখানে, আর আছে কাজ চালানোর মতো অল্প কয়েকটা চেয়ার। তুলার আবরণ দেখতে পাচ্ছি সেসব চেয়ারে, কিন্তু একইসঙ্গে এ-ও বুঝতে পারছি, খুব একটা আরামদায়ক না সেগুলো। একদিকে কাঠের-পায়াওয়ালা একটা টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে আছে একটা কফি মেশিন। আরেকদিকের দেয়ালে ঝুলছে একটা ক্যালেন্ডার।
কর্নওয়ালিসের সঙ্গে যখন প্রথমবার দেখা হয়েছিল আমার, তখন এই জায়গার কথা আমাকে বলেছিল সে। আলাপ-আলোচনার জন্য তার খদ্দেররা যায় দক্ষিণ কেনসিংটনে, কিন্তু লাশগুলো নিয়ে আসা হয় এখানে। এই জায়গার ধারেকাছে ছোট একটা গির্জা আছে। অন্য কেউ আছে কি না কাছেপিঠে, জানার জন্য কান পাতলাম। আমরা দু’জন ছাড়া আর কেউ যে নেই, সে-কথা একবারও মনে হয়নি আমার। এখন পড়ন্ত বিকেল, কাজ শেষে সবাই বোধহয় ফিরে গেছে যার যার বাসায়। কর্নওয়ালিসকে তার অফিসে ফোন করেছিলাম আমি, কিন্তু এখানে দেখা করার ব্যাপারে জোরাজুরি করেছে সে।
নাম ধরে আমাকে সম্ভাষণ জানাল লোকটা। শেষ দু’বার যখন দেখা হয়েছে তার সঙ্গে, তখন তাকে যতটা আন্তরিক আর নিরুদ্বেগ বলে মনে হয়েছে, এখন তার চেয়েও বেশি বলে মনে হচ্ছে। স্যুট পরে আছে, তবে টাই খুলে ফেলেছে। শার্টের উপরের দিকের দুটো বোতামও খুলে রেখেছে।
‘আপনি কে সে-ব্যাপারে কোনো ধারণাই ছিল না আমার,’ বলল সে। কফির একটা কাপ বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। ফোনে নিজের নামটা বলেছি আমি তাকে। ‘আপনি একজন লেখক! বলতেই হয়… পুরোপুরি বিস্মিত হয়েছি আমি। কারণ আপনি যখন আমার অফিসে আর বাসায় গিয়েছিলেন, আমি ধরেই নিয়েছিলাম আপনিও পুলিশে আছেন।’
‘একদিক দিয়ে চিন্তা করলে আছি বটে,’ বললাম আমি।
‘না… আসলে বোঝাতে চেয়েছি, আপনাকেও একজন গোয়েন্দা ভেবেছিলাম আমি। ….মিস্টার হোথর্ন কোথায়?’
কফির কাপে চুমুক দিলাম। আমাকে জিজ্ঞেস না করেই কফিতে চিনি দিয়ে ফেলেছেন কর্নওয়ালিস। ‘এই মুহূর্তে একটা কাজে লন্ডনের বাইরে আছে।’
‘তিনিই কি পাঠিয়েছেন আপনাকে?’
‘না। সত্যি বলতে কী… আমি যে দেখা করতে এসেছি আপনার সঙ্গে, জানে না সে সেটা
কথাটা ভেবে দেখল কর্নওয়ারিস। দেখে মনে হচ্ছে, থতমত খেয়ে গেছে। ‘ফোনে তখন বললেন, আপনি নাকি একটা বই নিয়ে কাজ করছেন…’
‘হ্যাঁ।’
‘ব্যাপারটা একটু… কী বলবো… বেখাপ্পা হয়ে গেল না? কারণ আমি জানতাম পুলিশি কোনো তদন্ত… খুনের কোনো তদন্ত… গোপনেই করা হয়। আচ্ছা, আপনার সেই বইয়ে কি আমার কথাও থাকবে?’
‘মনে হয়।
‘কিছু মনে করবেন না… সে-রকম কিছু চাই না আমি আসলে। ডায়ানা ক্যুপার আর তাঁর ছেলের ব্যাপারটা নিয়ে আমি খুবই আপসেট। এসবের সঙ্গে আর জড়িত থাকতে চাই না।’
‘বইটা যেহেতু এখনও লেখাই হয়নি, কাজেই কারও যদি আপত্তি থাকে তা হলে তার নাম বদলে দিতে পারি আমি। আপনি কি চান আপনার পরিচয় বদলে দিই?’
‘সরাসরিই বলি… যদি তা করেন তা হলে ভালো হয়।
সেক্ষেত্রে… আপনার নাম যদি দিই ড্যান রবার্টস, তা হলে কেমন হয়?’
কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কর্নওয়ালিস। হাসি দেখা দিয়েছে তার চেহারায়। ‘অনেক বছর হয়ে গেল ওই নাম ব্যবহার করিনি আমি।’
‘জানি।’
সিগারেটের একটা প্যাকেট বের করল কর্নওয়ালিস। সে যে সিগারেট খায়, জানা ছিল না আমার। মনে পড়ে গেল, তার দক্ষিণ কেনসিংটনের অফিসে কোনো একজাতের একটা অ্যাশট্রে দেখেছিলাম। একটা সিগারেট ধরাল সে, হাত ঝাঁকুনি দিয়ে নেভাল জ্বলন্ত ম্যাচকাঠি। ভঙ্গিটা কেমন যেন ক্রুদ্ধ বলে মনে হলো আমার। ‘ফোনে বলেছিলেন, আপনি নাকি রাডা থেকে কথা বলছেন
‘হ্যাঁ, ঠিক। আজ বিকেলে সেখানে গিয়েছিলাম আমি। দেখা করতে গিয়েছিলাম… ‘ সহযোগী সেই পরিচালকের নাম বললাম। কিন্তু দেখে মনে হলো না, লিয়কে চিনতে পেরেছে কর্নওয়ালিস। ‘আপনি যে এককালে রাডা’র ছাত্র ছিলেন, কখনও বলেননি।’ অর্ধেকটা কফি শেষ করলাম। নামিয়ে রাখলাম মগটা।
‘না… আমি নিশ্চিত কথাটা বলেছিলাম
‘না, বলেননি। আপনার সঙ্গে দু’বার কথা বলেছে হোথর্ন, দু’বারই উপস্থিত ছিলাম আমি। যা-হোক, আপনি যে শুধু রাডা-য় ছিলেন তা-ই না, ড্যামিয়েন ক্যুপার যে-সময়ে ছিল সেই একই সময়েও ছিলেন। তার সঙ্গে অভিনয় করেছেন।
নিশ্চিত ছিলাম, কথাটা অস্বীকার করবে কর্নওয়ালিস। কিন্তু চোখের পলক পড়ছে না তার। বলল, ‘রাডা ছেড়ে চলে আসার পর ওই প্রতিষ্ঠান নিয়ে আর কথা বলি না আমি। যা-হোক, দক্ষিণ কেনসিংটনে আমার অফিসে যেদিন গিয়েছিলেন, সেদিন কিন্তু আপনাদের কথা শুনে মনে হয়েছিল ডিলের সেই গাড়ি-দুর্ঘটনার ব্যাপারে আপনারা আগ্রহী বেশি।
‘ওই দুর্ঘটনার সঙ্গে হত্যাকাণ্ড দুটোর সম্পর্ক থাকতে পারে… অস্বীকার করছি না। দুর্ঘটনাটা নিয়ে ক্লাসে মাঝেমধ্যে কথা বলতেন ড্যামিয়েন। আপনি কি ছিলেন সেসব ক্লাসে?’
‘ছিলাম। ঘটনাটা অনেক বছর আগের। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, আপনি সব মনে করিয়ে দিলেন।’ ঘরের ভিতরে অত্যুজ্জ্বল একটা নিয়ন লাইট জ্বলছে, সেটার আলো প্রতিফলিত হচ্ছে কর্নওয়ালিসের চশমায়। ‘একবার লাল রঙের একটা ছোট্ট বাস নিয়ে এসেছিল ড্যামিয়েন। একটা মিউযিকও বাজিয়েছিল তখন। কী ঘটেছিল ডিলে, সেটা জানিয়েছিল আমাদের সবাইকে। ওই ঘটনা কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল তার মনে, বলেছিল সে-কথাও।’ কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। ‘জানেন কি না জানি না… ওই দুর্ঘটনায় বাচ্চা একটা ছেলে মারা যাওয়ার পরও ড্যামিয়েন এবং তার ক্যারিয়ার নিয়ে যে ভেবেছে তার মা, বিশেষ এই ব্যাপারে কিন্তু বেশ গর্বিত ছিল সে। বলাই বাহুল্য, মা আর ছেলে দু’জনই ছিল উল্লেখ করার মতো দুটো চরিত্র। …আপনি কি একমত?’
‘ড্যামিয়েনের সঙ্গে অভিনয় করেছেন আপনি,’ জবাব দিলাম না কর্নওয়ালিসের প্রশ্নটার। ‘হ্যামলেট নাটকে ছিলেন আপনারা দু’জন।’
‘ছিলাম। তবে এখন ওসব পাগলামি বলে মনে হয় আমার। আসলে আমাদের বয়স তখন ছিল অল্প… বাচ্চাই বলা চলে। অথচ বড় বড় অনেক চিন্তাভাবনা খেলা করত আমাদের মাথায়।
‘আপনি প্রতিভাবান একজন অভিনেতা ছিলেন,’ বললাম আমি।
অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল কর্নওয়ালিস। ‘একটা সময় ছিল যখন অভিনেতা হতে চাইতাম আমি।’
‘কিন্তু শেষপর্যন্ত হয়েছেন একজন আন্ডারটেকার।’
‘আমার বাসায় যখন গিয়েছিলেন আপনারা, তখন এসব নিয়ে কথা বলেছি। .এই ব্যবসা আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। আমার বাবা, দাদা… মনে আছে কী বলেছিলাম?’ চেহারা বদলে গেল কর্নওয়ালিসের… দেখে মনে হলো, কিছু একটা স্মরণে এসেছে তার। ‘কিছু একটা দেখাতে চাই আমি আপনাকে। ওটা হয়তো ইন্টারেস্টিং লাগবে আপনার।’
‘কী?’
‘এখানে না। পাশের ঘরে…’
উঠে দাঁড়াল কর্নওয়ালিস, আশা করছে তাকে অনুসরণ করবো আমি। তা-ই করতে চেয়েছিলাম আমিও। কিন্তু যখন উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম, টের পেলাম, পারছি না কাজটা করতে।
প্রচণ্ড আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম… এত আতঙ্কিত কখনও হইনি এই জীবনে। নড়তে পারছি না আমি। আমার মস্তিষ্ক উঠে দাঁড়ানোর সিগনাল পাঠাচ্ছে আমার দুই পায়ে, কিন্তু পা-দুটো শুনছে না সে-আদেশ। আর আমার হাত দুটো ভিনদেশী কোনো কিছু বলে মনে হচ্ছে… সংযুক্ত আছে আমার শরীরের সঙ্গে, কিন্তু কোনো সাড়া নেই। আমার পুরো শরীরটা পরিণত হয়েছে পেশী আর হাড়ের একটা অকেজো স্তূপে। আতঙ্কে বুকের ভিতরে… ঠিক হৃৎপিণ্ডে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে যেন। মনে হচ্ছে, পাঁজরা ভেঙে বেরিয়ে আসবে ওটা। বুঝতে পারছি, কোনো একজাতের ড্রাগ খাইয়ে দেয়া হয়েছে আমাকে। আরও বুঝতে পারছি, ভীষণ বিপদে পড়েছি আমি।
‘আপনি ঠিক আছেন?’ জানতে চাইল কর্নওয়ালিস, চেহারায় রাজ্যের উদ্বেগ। অভিনয়।
‘কী করেছেন আপনি?’ নিজের কণ্ঠ নিজের কানেই অপরিচিত বলে মনে হলো আমার। প্রতিটা শব্দ উচ্চারণ করতে দু’বার চেষ্টা করতে হয়েছে আমাকে।
‘উঠে দাঁড়ান…’
‘পারছি না!’
হাসল কর্নওয়ালিস। হাসিটা ভয়ঙ্কর।
ধীরেসুস্থে হেঁটে আমার কাছে হাজির হলো শয়তান লোকটা। পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে গুঁজে দিল আমার মুখে, আঁতকে উঠলাম। অর্থাৎ কার্যত বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। রুমালটা আমার মুখের ভিতরে ঢোকার আগপর্যন্ত একটাবারের জন্যও মনে হয়নি, চেঁচানো উচিত আমার। তা ছাড়া চেঁচালে খুব একটা লাভ হতো বলে মনেও হয় না। কেউ বলে না-দিলেও জানি, আমরা দু’জন ছাড়া আর কেউ যাতে না-থাকে এই জায়গায়, সেটা আগেই নিশ্চিত করেছে কর্নওয়ালিস।
‘একটা জিনিস নিয়ে আসি,’ বলল শয়তানটা। ‘এক মিনিটও লাগবে না।’
হেঁটে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে, দরজাটা খুলে রেখে গেছে। বসে আছি আমি আগের মতোই, নতুন এই অনুভূতি টের পাওয়ার চেষ্টা করছি… বলা ভালো, শরীরের অসাড়তা অনুভব করছি। প্রকৃতপক্ষে ভয় ছাড়া আর কোনো কিছু টের পাচ্ছি না। শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে, সেটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। এখনও হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে বুকে। রুমালটা যেন একটু একটু করে ঢুকে যাচ্ছে গলায়… একটু একটু করে দম আটকে আসছে আমার। যা বুঝতে পারাটা সহজ ছিল, প্রচণ্ড আতঙ্কিত থাকার কারণে সেটা বুঝতে যেন কষ্ট হচ্ছে আমার: আমি খুশিমনে হাজির হয়ে গেছি কোনো এক মরার জায়গায়। এবং এর ফলাফল আমারই নিশ্চিত মৃত্যু।
একটা হুইলচেয়ার ঠেলতে ঠেলতে হাজির হলো কর্নওয়ালিস। লাশ ঠেলার কাজে কি ওটা ব্যবহার করে সে? মনে হয় না। বরং যেসব অতি-বৃদ্ধ মানুষ শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে আসে কোনো মরদেহকে, সম্ভবত তাদের জন্য ব্যবহৃত হয় ওই চেয়ার।
নিচু সুরে শিস বাজাচ্ছে কর্নওয়ালিস। আমি যেন একইসঙ্গে কৌতূহল আর ভাবলেশহীনতা দেখতে পাচ্ছি শয়তানটার চেহারায়। টিন্টেড সেই চশমা আর পরে নেই সে। পিটপিট করছে দুই চোখ, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি সে-দুটো। দেখছি তার ছোট ছোট কিন্তু পরিপাটি দাড়ি, পাতলা হয়ে আসা চুল, বুঝতে পারছি এসব আসলে শয়তানটার মুখোশ ছাড়া আর কিছু না। বুঝতে পারছি, সে-মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে দানবীয় কিছু-একটা। এবং এখন ওই মুখোশ ভেদ করে যেন দেখা যাচ্ছে দানবটাকে। সে জানে আমি নড়তে পারছি না। আমার কফিতে নিশ্চয়ই কিছু-একটা মিশিয়েছে সে। আর আমিও এমন বোকা… খেয়ে নিয়েছি ওই কফি। বাস্তবে চেঁচাতে পারছি না, কিন্তু মনে মনে ঠিকই চিৎকার করছি নিজের উদ্দেশে…. কর্নওয়ালিসই শ্বাসরোধ করেছে হত্যা করেছে ডায়ানা ক্যুপারকে, পরে টুকরো টুকরো করেছে ওই মহিলার ছেলেকে। কিন্তু কেন? এবং আরও বড় কথা হচ্ছে, এখানে এসে শয়তানটার ফাঁদে ধরা পড়ার আগে কথাটা কেন বোধগম্য হলো না আমার?
আমার উপর ঝুঁকে পড়ল সে, একটা মুহূর্তের জন্য মনে হলো আমাকে বুঝি চুমু খেতে চলেছে। প্রচণ্ড ঘৃণায় কুঁকড়ে গেলাম, কিন্তু অবলীলায় আমাকে তুলে নিল শয়তানটা, লোকে যেভাবে ময়লা ছুঁড়ে ফেলে সেভাবে আমাকে ছুঁড়ে ফেলল হুইলচেয়ারে। আমার ওজন প্রায় পঁচাশি কেজি, কাজ শেষ করে দম নিতে হলো কর্নওয়ালিসকে। তারপর ঠিক করে দিল আমার পা দুটো, এখনও শিস বাজাচ্ছে। ঠেলতে শুরু করল হুইলচেয়ারটা, অফিসের বাইরে নিয়ে এল আমাকে।
খোলা একটা দরজা পার হলাম আমরা। এবার একদিকে একটা গির্জা দেখতে পাচ্ছি। একঝলক তাকালাম সেদিকে। চোখে পড়ল মোমবাতি, কাঠের প্যানেল, একটা বেদি… সেখানে সম্ভবত একটা ক্রুশ বা মেনোরাহ অথবা অন্য কোনো উপযুক্ত ধর্মীয় প্রতীক রাখা আছে। করিডরের শেষমাথায় আছে একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল লিফট। ওটা এত বড় যে, ভিতরে একটা কফিন এঁটে যাবে। হুইলচেয়ার ঠেলতে ঠেলতে আমাকে ওই লিফটের কাছে নিয়ে গেল কর্নওয়ালিস, ঢুকিয়ে দিল ভিতরে। তারপর খোঁচা মারল একটা বাটনে। দরজাটা যখন লেগে যাচ্ছে, তখন টের পেলাম, আমার জীবনটাও বুঝি শেষ হয়ে গেল। একটা ঝাঁকুনি অনুভব করলাম, নামতে শুরু করলাম নিচে।
লিফটটা হাজির হলো নিচু ছাদওয়ালা বড়সড় একটা ওয়ার্করুমে। আরও নিয়ন লাইট আছে এখানে। নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর বসানো আছে সেগুলো। যা-কিছু দেখছি, তাতেই নতুন নতুন ভয়ে ছেয়ে যাচ্ছে আমার মন। আমি যে অসহায়, সে-অনুভূতি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে আমার ভিতরে। দূরের এক কোনায় দেখা যাচ্ছে রূপার ছ’টা কেবিনেট… ওগুলো আসলে রেফ্রিজারেটেড কম্পার্টমেন্ট, দুই সেটে তিনটা তিনটা করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষকে অনায়াসে ঢুকিয়ে রাখা যাবে যে-কোনো কেবিনেটে। ঘরের বাকি অংশ দেখলে মনে পড়ে যায় কোনো সার্জারির কথা। একধারে আছে ধাতব একটা গার্নি। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা শেল্ফ, গাঢ় রঙের কিছু তরলে ভর্তি কতগুলো বোতল আর শিশি দেখা যাচ্ছে সেগুলোতে। একটা টেবিলের উপর থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে স্কালপেল, সুঁই আর ছুরি। হুইলচেয়ারটা ঠেলতে ঠেলতে ওসব জিনিসের সামনে নিয়ে রাখল কর্নওয়ালিস, যাতে আমার মুখোমুখি থাকে ওগুলো। একটু আগে যে- লিফট থেকে বের হয়েছি, আমার পিঠটা এখন সেদিকে। চারদিকের দেয়ালে সাদা চুনকাম করা। ধূসর শিট ভিনাইলে আচ্ছাদিত পুরো মেঝে। এককোনায় একটা বালতি আর একটা মপ আছে।
‘আপনি যদি এখানে না-আসতেন, তা হলেই ভালো হতো,’ বলল কর্নওয়ালিস। শয়তানটার কথাবার্তায় এখনও ভদ্রতা আছে। আমার ধারণা, বছরের পর বছর ধরে চর্চা করে এ-রকম কথাবার্তা রপ্ত করেছে সে। সে যে-ভূমিকা পালন করছে, সেটার জন্য এ-রকম আচরণেরও দরকার আছে। কথাটা বললাম, কারণ আমি এখন জেনে গেছি, আসলেই বিশেষ একটা ভূমিকা পালন করছে সে। একটা একটা করে মুহূর্ত পার হচ্ছে, আর আসল রবার্ট কর্নওয়ালিস যেন একটু একটু করে উদ্ভাসিত হচ্ছে আমার সামনে।
‘আপনার সঙ্গে আসলে কোনো রেষারেষি নেই আমার,’ বলল শয়তানটা! ‘আপনার কোনো ক্ষতিও করতে চাইনি কখনও। কিন্তু আপনি নিজেই স্বেচ্ছায়- সজ্ঞানে এসেছেন এখানে। স্বেচ্ছায় নাক গলিয়েছেন আমার ব্যবসায়।’ বলতে বলতে গলা চড়ে গিয়েছিল তার, নিজেকে সামলে নিল একটুখানি। ‘রাডা’র ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞেস করতে গেলেন কেন? কেন খুঁড়ে বের করতে গেলেন আমার অতীত? এখানে হাজির হয়ে বোকার মতো সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, ফলে আমাকে বাধ্য হয়ে…। এই কাজটা আসলেই করতে চাইনি আমি।’
কথা বলতে চাইলাম, কিন্তু মুখের ভিতরে ঢুকে-থাকা রুমালটা সে-কাজ করতে দিল না আমাকে। ওটা আমার মুখের ভিতর থেকে টেনে বের করল কর্নওয়ালিস। ওটা বেরিয়ে যাওয়ামাত্র কথা বলতে পারলাম।
‘আমি যে এখানে এসেছি, আসার আগে সেটা বলে এসেছি আমার স্ত্রীকে। আমার অ্যাসিস্টেন্টকেও বলেছি। এখন আপনি যদি কিছু করেন আমাকে, ওরা জেনে যাবে।’
‘হ্যাঁ, তা যাবে বটে… যদি তাঁরা আপনাকে খুঁজে পান।’ বলল কর্নওয়ালিস, আবেগের ছিটেফোঁটাও নেই কণ্ঠে। আবারও কথা বলতে চাইলাম আমি কিন্তু হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিল শয়তানটা। ‘পরোয়া করি না। আপনার কাছ থেকে আর কিছু শুনতেও চাই না। এখন আর এসবে আমার তেমন কিছু আসে-যায়ও না। আমি শুধু এখন কিছু কথা বুঝিয়ে বলতে চাই।’
আঙুল তুলে কপালের একটা পাশ স্পর্শ করল সে, তাকিয়ে আছে অনতিদূরের কোনো এক জায়গার দিকে। কী বলবে, তা মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে বোধহয়। অবশের মতো বসেই আছি আমি, নিঃশব্দে চিৎকার করছি। মনে মনে বলছি, আমি একজন লেখক। এসব ঘটতে পারে না আমার সঙ্গে। আমি চাইনি এসব ঘটুক।
‘আমার জীবনটা আসলে কী-রকম, সে-ব্যাপারে আদৌ কি কোনো ধারণা আছে আপনার?’ শেষপর্যন্ত বলল কর্নওয়ালিস। ‘আপনি কি মনে করেন জীবিকার জন্য যা করি আমি সেটা উপভোগ করি? দিনের পর দিন ঠায় বসে থেকে দুঃস্থ কিছু লোকের মরা বাপ-মা-দাদা-দাদী-নানা-নানীর করুণ গল্প শুনতে কেমন লাগে, বলুন তো? মাথার উপর যখন গনগন করছে দুপুরের সূর্যটা, তখন ওসব মরা মানুষের শেষকৃত্যানুষ্ঠান বা শবদাহের আয়োজন করতে কেমন লাগে? তাদের কফিন বা সমাধিফলক বয়ে বেড়াতে কেমন লাগে? লোকে আমার দিকে তাকায়, আর দেখে, স্যুট-কোট পরে বসে আছে বিরক্তিকর একটা মানুষ, যার মুখে কখনও হাসি নেই, যে সব সময় সান্ত্বনার বাণী শোনায় তার খদ্দেরদের, কখনও কখনও আবার ক্রন্দনরত কারও দিকে বাড়িয়ে দেয় টিস্যু। অথচ ভিতরে ভিতরে আমি সব সময় চেয়েছি তাদের চেহারায় সজোরে ঘুসি হাঁকাতে। কারণ এ-রকম কিছু হতে চাইনি আমি কখনও।
‘কর্নওয়ালিস অ্যান্ড সন্স। এই পরিবারেই আমার জন্ম। আমার বাবা ছিলেন একজন আন্ডারটেকার। আমার দাদাও ছিলেন তা-ই। তাঁর বাবাও তা-ই ছিলেন। আমার চাচা-ফুফুরাও একই কাজ করতেন। আমি যখন নেহাৎই একজন বালক, তখন থেকেই যাঁদেরকে দেখেছি আমার আশপাশে, তাঁরা সব সময় কালো কাপড় পরে থাকতেন। কতগুলো ঘোড়া টেনে নিয়ে চলেছে একটা শবযান… এই দৃশ্য দেখানোর জন্য বার বার রাস্তায় নিয়ে যাওয়া হতো আমাকে। ওটাই ছিল আমার শৈশবের শিক্ষা। রাতে যখনই আমার বাবাকে ডিনার খেতে দেখতাম, আমার মনে পড়ে যেত, সারাটা দিন কাটিয়েছেন তিনি মরা মানুষদের সঙ্গে। মনে পড়ে যেত, যে-দুই হাতে আমাকে আলিঙ্গন করতেন তিনি, সে-হাতেই সারাদিনে ঘেঁটেছেন মানুষের লাশ। মৃত্যু যেন তাঁর পিছু নিয়ে হাজির হতো আমাদের সেই বাড়িতে, সেই ডাইনিংরুমে। আমার ধারণা, আমাদের পুরো পরিবার সংক্রমিত হয়েছিল এই চিন্তায়। মৃত্যুই ছিল আমাদের জন্য জীবন। যখনই ভাবতাম একদিন আমাকেও হতে হবে ও-রকম, কারণ আমার জন্যও ভেবে রাখা হয়েছে এসব, তখনই খারাপটা লাগত সবচেয়ে বেশি। কিন্তু কিছু করার নেই… আমরা কর্নওয়ালিস অ্যান্ড সন্স… এবং আমি ওই পরিবারের একজন পুত্রসন্তান।
‘এই ব্যাপারটা নিয়ে স্কুলে আমার বন্ধুরা প্রায়ই খেপাত আমাকে। আমাদের পারিবারিক নামটা জানা ছিল সবারই… কর্নওয়ালিস। তাদের কাউকে কাউকে আবার স্কুলের বাসে গিয়ে ওঠার জন্য আমাদের দোকানের সামনে দিয়েই যেতে হতো। এমনকী স্কুলে আমার নাম হয়ে গিয়েছিল ‘ফিউনারেল বয়’। কেউ কেউ আবার ডাকত ‘ডেড বয়’। আমার কাছে জানতে চাইত, মরা মানুষের গায়ে যখন কাপড় থাকে না, তখন তাদেরকে দেখতে কেমন লাগে। জানতে চাইত, পুরুষ মানুষ মরে গেলেও কি তাদের লিঙ্গ উত্থিত হয়? মরা মানুষের কি নখ বাড়ে? স্কুলে যেসব শিক্ষক-শিক্ষিকা পড়াতেন আমাদেরকে, তাঁদের অর্ধেক মনে করতেন, আমি বোধহয় রোমাঞ্চকর কোনো কিছু… কারণটা আর কিছুই না, আমাদের সেই পারিবারিক কর্মযজ্ঞ। আরেকটু বড় ক্লাসে যখন উঠলাম, বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কথা বলত, যার যার ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলত। স্বপ্ন ছিল তাদের। ভবিষ্যৎ ছিল। কিন্তু আমার ওসব কিছুই ছিল না। স্বপ্ন বা ভবিষ্যৎ যা-ই বলুন, সব মরে গিয়েছিল আমার সেই ছেলেবেলাতেই।
‘তারপরও… বলতে মজাই লাগছে এখন… একটা স্বপ্ন ছিল আমার। একবার স্কুলের একটা নাটকে একটা চরিত্রে অভিনয় করতে দেয়া হলো আমাকে। তেমন বড় কোনো চরিত্র না… দ্য টেমিং অভ দ্য শ্রু নাটকের হর্টেনশিয়ো। কিন্তু কথা হচ্ছে, চরিত্রটা দারুণ ভালো লেগে গিয়েছিল আমার। শেক্সপিয়ার বেশ ভালো লাগত তখন। কারণ তাঁর ভাষা ছিল সমৃদ্ধ, যেভাবে তিনি তৈরি করতেন তাঁর নাটকের জগৎটা সেটা ছিল এককথায় দারুণ। কস্টিউম পরে, নিজের উপর লাইটের আলো নিয়ে যখন মঞ্চে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, খুব উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। হতে পারে, তখন হয়তো বুঝতে পেরেছিলাম, আমি অন্য কেউ… সেই আন্ডারটেকার পরিবারের সন্তান না। যা-হোক, আমার বয়স যখন পনেরো, তখন একদিন উপলব্ধি করতে পারলাম, অভিনেতা হতে চাই। সেই থেকে চিন্তাটা ধীরে ধীরে যেন গ্রাস করে নিল আমাকে। ভাবতে লাগলাম, শুধু অভিনেতা হলে চলবে না আমার, বিখ্যাত কোনো অভিনেতা হতে হবে। রবার্ট কর্নওয়ালিস হওয়া চলবে না কিছুতেই। হতে হবে অন্য কেউ একজন। উপলব্ধি করতে পারলাম, সেই ‘অন্য কেউ একজনের’ জন্যই যেন জন্ম হয়েছে আমার।
‘রাডা-তে অডিশন দিতে চাই, কথাটা যখন শুনেছিলেন আমার বাবা-মা, নাখোশ হয়েছিলেন। কিন্তু একটা কথা কী জানেন… আমাকে সেখানে যেতে দিয়েছিলেন তাঁরা, কারণ ধরেই নিয়েছিলেন ভাগ্যে কোনো সুযোগ জুটবে না আমার শেষপর্যন্ত। গোপনে গোপনে হয়তো হেসেছিলেন আমাকে নিয়ে। যা-হোক, অ্যাপ্লাই করলাম রাডা-তে। এবং বাবা-মাকে না-জানিয়ে আরও অ্যাপ্লাই করেছিলাম ওয়েবার ডগলাস এবং দ্য সেন্ট্রাল স্কুল অভ ড্রামা-তে। এমনকী আবেদন করেছিলাম ব্রিস্টলের ওল্ড ভিক-এও। বাড়িয়ে বলছি না, আমি আসলেই ভালো অভিনেতা ছিলাম। যখন অভিনয় করতাম, চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলতে পারতাম।
‘সুযোগ পেয়ে গেলাম রাডা-য়। যে-মুহূর্তে অডিশন দিয়েছিলাম, তখনই জানতাম, আমাকে ফেরাতে পারবে না ওরা।
কিছু-একটা বললাম আমি। কিন্তু অসংলগ্ন প্রলাপ ছাড়া আর কিছু হলো না সেটা, কারণ যে-ওষুধ প্রয়োগ করেছে কর্নওয়ালিস, তা কাজ করতে শুরু করেছে আমার ভোকাল কর্ডের উপর, ফলে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হয় আমাকে ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে মিনতি জানিয়েছিলাম শয়তানটার কাছে, কিন্তু তাকে ও-রকম কিছু বলা আর সময়ের অপচয় করা সমান কথা।
ভ্রূ কোঁচকাল কর্নওয়ালিস। এগিয়ে গেল টেবিলটার কাছে, একটা স্কালপেল তুলে নিল। একদৃষ্টিতে দেখছি শয়তানটাকে। আমার দিকে এগিয়ে এল সে। দেখতে পেলাম, রূপার ব্লেডের উপর প্রতিফলিত হয়ে চকচক করে উঠল নিয়ন লাইটের আলো। তারপর, একটুও দ্বিধা না-করে, স্কালপেলটা আবার বুকের ভিতরে ঢুকিয়ে দিল কর্নওয়ালিস।
গভীর বিস্ময়ে এখনও তাকিয়ে আছি আমি। দেখছি, স্কালপেলটার হাতল বেরিয়ে আছে আমার বুক থেকে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, খুব বেশি ব্যথা পাইনি। খুব বেশি রক্তও বের হচ্ছে না। আমি শুধু বিশ্বাস করতে পারছি না, এ-রকম একটা কাজ করে ফেলেছে কর্নওয়ালিস।
‘আপনাকে বলেছিলাম আপনার কাছ থেকে একটা কথাও শুনতে চাই না আমি,’ ব্যাখ্যা করার কায়দায় বলল কর্নওয়ালিস। অভিযোগ জানানোর কায়দায় আবারও চড়ে গেছে তার কণ্ঠ। ‘আমাকে শোনানোর মতো কিছুই নেই আপনার। আমি কিছু শুনতে চাইও না। কাজেই চুপ থাকুন! বুঝতে পেরেছেন? চুপ থাকুন!’
নিজেকে শান্ত করল শয়তানটা। তারপর এমন ভঙ্গিতে আবার কথা বলতে লাগল, যেন কিছুই হয়নি।
‘যেদিন রাডা-য় ঢুকেছি, আমি যা, তার জন্য আমাকে গ্রহণ করে নেয়া হয়েছিল সেদিন থেকেই। আমি যা দিতে পারবো, সেটার জন্যও সাদরে বরণ করে নেয়া হয়েছিল আমাকে। সে-সময় আমি নিজের আসল নাম, মানে রবার্ট কর্নওয়ালিস ব্যবহার করতাম না। নিজের পরিবারের ব্যাপারেও কথা বলতাম না কারও সঙ্গে। ড্যান রবার্টস নামে নিজের পরিচয় দিতাম। অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামাত না কেউ। যত যা-ই হোক, ওই নাম ছিল আমার স্টেজ-নেম… কাজেই সেটা ঠিক নাকি বেঠিক তাতে তেমন কিছু যায় আসে না। সবচেয়ে বড় কথা, আমি আর তখন কোনো ‘ফিউনারেল বয়’ ছিলাম না। বরং আমি ছিলাম অ্যান্টনি হপকিন্স বা কেনেথ ব্রানাহ। অথবা ডেরেক জ্যাকোবি। আয়ান হোম। সেসব নাম তখন সুপরিচিত। ভাবতাম, আমিও একদিন ও-রকম কেউ হবো। যতবার ওই বিল্ডিঙের ভিতরে ঢুকতাম, ততবার মনে হতো, নিজেকে যেন খুঁজে পেয়েছি। একটা কথা বলে রাখি… ওই তিনটা বছর ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের সময়। মাত্র ওই তিনটা বছরই সুখে-শান্তিতে কাটাতে পেরেছি আমি!
‘আমার সঙ্গে রাডা-য় ড্যামিয়েন ক্যুপারও ছিল। ভুল বুঝবেন না… ওকে ভালো লাগত আমার। ওর প্রশংসা করতাম। কিন্তু কাজটা করতাম, কারণ আমি আসলে তখনও ঠিকমতো চিনতাম না ওকে। ভেবেছিলাম সে আমার বন্ধু … সবচেয়ে ভালো বন্ধু। কিন্তু তখনও আসলে ওকে চেনা হয়ে ওঠেনি আমার। তখনও বুঝিনি, সে আসলে ঠাণ্ডা-মাথার, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, ধান্দাবাজ একটা শুয়োর।’
দৃষ্টি নামিয়ে তাকালাম স্কালপেলটার দিকে। ওটা এখনও কুৎসিত এক কায়দায় বেরিয়ে আছে আমার বুকের ভিতর থেকে। রক্তের ছোট্ট একটা পুকুর তৈরি হচ্ছে ওটার আশপাশে… আকৃতিতে ওই পুকুর আমার হাতের তালুর চেয়ে বড় না। দপদপ করতে শুরু করেছে ক্ষতস্থানটা। অসুস্থ বোধ করছি আমি।
‘আমরা যখন থার্ড ইয়ারে,’ বলছে কর্নওয়ালিস, ‘ঝামেলা শুরু হয়ে গেল তখন। সব কিছু খুব প্রতিযোগিতামূলক একটা অবস্থায় এসে পৌঁছেছে ততদিনে। আমরা সবাই এমন ভান করছি, যেন আমরা একজন আরেকজনের খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু যখনই কোনো নাটকের প্রদর্শনীর সময় হতো, একেকজনের মুখোশটা খুলে যেত তখনই। একটা কথা বলি, বিশ্বাস করবেন কি না জানি না… সবচেয়ে ভালো বন্ধুটাকে ফায়ার এস্কেপের সিঁড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলে একজন এজেন্ট পাওয়া যাবে, এ-ব্যাপারে যদি নিশ্চয়তা পেতাম আমরা, তা হলে হয়তো তা-ই করতাম সবাই। সে-সময় ড্যামিয়েনের ভূমিকা কী ছিল, জানেন? সেরা পুরস্কারটা যেভাবেই হোক সব সময় লুফে নিত নিজের জন্য। এবং শেষপর্যন্ত কী করল সে, জানেন? অনুমান করতে পারেন?’
থামল কর্নওয়ালিস, কিন্তু টু শব্দটা করারও সাহস হচ্ছে না আমার। আমার দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা, হঠাৎ ছোঁ মেরে তুলে নিল দ্বিতীয় একটা স্কালপেল, সেটা ধাঁ করে বসিয়ে দিল আমার একদিকের কাঁধে।
ব্যথায় চিৎকার করে উঠলাম।
স্কালপেলটা বের করে নিল না কর্নওয়ালিস। চিৎকার করে বলল, ‘অনুমান করে বলুন শেষপর্যন্ত কী করেছিল ড্যামিয়েন!’
‘আপনাকে ঠকিয়েছিল!’ কীভাবে জানি না, কিন্তু যেভাবেই হোক উচ্চারণ করতে পারলাম কথাগুলো। কী বলেছি তা ঠিকমতো জানি না নিজেই। কিছু-একটা বলার দরকার ছিল, তাই বলেছি।
‘ঠকানোর চেয়েও বেশি কিছু করেছিল সে। হ্যামলেট নাটকে যখন হ্যামলেটের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য প্রস্তাব করা হলো আমার নাম, রীতিমতো মারমুখী হয়ে উঠল সে। ধরেই নিয়েছিল ওই চরিত্রে অভিনয় করার জন্য একমাত্র উপযুক্ত ব্যক্তি সে-ই। অভিনয়ে কতখানি দক্ষ সে, আসলে সেটা দেখিয়ে দিতে চাইছিল সবাইকে। কিন্তু আমিই বা এত সহজে ছেড়ে দেবো কেন? কারণ ওই চরিত্র ছিল আমার। আমি কী করতে পারি, সারা পৃথিবীকে তা দেখিয়ে দেয়ার জন্য ওই নাটকের ওই চরিত্রই ছিল আমার শেষ সুযোগ। ড্যামিয়েন তখন ওর সেই কুত্তী গার্লফ্রেন্ডটাকে সঙ্গে নিয়ে জঘন্য এক চাল চালল আমার বিরুদ্ধে। ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে অসুস্থ বানিয়ে দিল তারা… যাতে আমি গিয়ে যোগ দিতে না-পারি রিহার্সেলে, এবং যাতে বিশেষ ওই চরিত্র হাতছাড়া হয়ে যায় আমার।’
কর্নওয়ালিস এসব কী বলছে, কেনই বা বলছে… কিছুই বুঝতে পারছি না। কিন্তু বুঝতে না-পারলেও পরোয়া করছি না। ষাঁড়ের লড়াইয়ে আহত ষাঁড় যেভাবে রিঙের ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকে, সেভাবে বসে আছি আমি। দুটো স্কালপেল গেঁথে আছে আমার শরীরে। যত সময় যাচ্ছে, ক্ষতস্থান দুটোর ব্যথা তত বাড়ছে। আমি নিশ্চিত, আর কিছুক্ষণ পর খুন করে ফেলা হবে আমাকে। কর্নওয়ালিস অপেক্ষা করছে, কখন মুখ খুলবো আমি… কখন মরণআঘাতটা হানবে সে।
আমি চুপ করে আছি দেখে লোকটা আরও রেগে যাবে ভেবে বিড়বিড় করে কোনো রকমে বললাম, ‘আমান্ডা লেই…’
‘আমান্ডা লেই। ঠিকই বলেছেন। আমাকে পাকড়াও করার জন্য ওই মেয়েকে ব্যবহার করেছিল ড্যামিয়েন। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমিই পাকড়াও করেছি মেয়েটাকে। এবং তার কাজের জন্য মূল্য দিতে বাধ্য করেছি।’ মুখ টিপে হাসল কর্নওয়ালিস
আমার মনে হচ্ছে, মাথা খারাপ হয়ে গেছে লোকটার। আরও মনে হচ্ছে, এত বড় কোনো পাগল কোনোকালে দেখিনি।
‘তিলে তিলে কষ্ট দিয়েছি আমি ওই মেয়েকে, শেষপর্যন্ত গায়েব হয়ে গেছে সে। কোথায় গেছে হারামজাদীটা, জানেন? আপনি চাইলে বলতে পারি… কিন্তু কুত্তীটাকে যদি খুঁজে বের করতে চান, তা হলে একটা না দুটো না… সাত সাতটা কবর খুঁড়তে হবে আপনাকে।’
‘ড্যামিয়েনকে খুন করেছেন আপনি,’ কোনো রকমে বললাম, নিজের কণ্ঠ অপরিচিত ঠেকল নিজের কাছেই। হৃৎপিণ্ডটা এত জোরে ধুকপুক করছে যে, মনে হচ্ছে বিস্ফোরিত হবে কিছুক্ষণের মধ্যে।
‘হ্যাঁ। লোকে তখন বলেছিল, হ্যামলেট চরিত্রটার জন্য আমিই উপযুক্ত। হ্যামলেট হওয়া উচিত ছিল আমারই। হতে পারিনি, কারণ তখন আমি অসুস্থ ছিলাম, ফলে অভিনয় করতে হলো অন্য একটা চরিত্রে… যে-চরিত্র মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছিল সব মিলিয়ে মাত্র ছ’বার। বেশিরভাগ সময় মঞ্চের বাইরেই থাকতে হয়েছিল আমাকে। বেশি হলে মাত্র ষাটটা লাইন আউড়াতে পেরেছি আমি দর্শকদের সামনে। ফলে কী হলো? একজন এজেন্টও জুটল না আমার কপালে। রাডা ছেড়ে চলে আসতে হলো আমাকে, অথচ যে-ক্যারিয়ারের জন্য স্বপ্ন দেখেছিলাম, যে- ক্যারিয়ারের জন্য এত চেষ্টা করলাম, সেটাও অর্জন করতে পারলাম না। তারপরও চেষ্টা করে গেছি। গিয়ে যোগ দিয়েছি অভিনয়ের বিভিন্ন ক্লাসে। জায়গায় জায়গায় অডিশন দিয়েছি। কিন্তু বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি।
‘অবশ্য… দু’-এক জায়গায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম বটে, কিন্তু সেসব শেষপর্যন্ত কোনো উপকারেই আসেনি আমার। জানেন, পাইরেটস অভ দ্য ক্যারিবিয়ানের জন্য তিন-তিনবার ফোন করা হয়েছিল আমাকে, তারপর ওই চরিত্র দিয়ে দেয়া হয়েছে অন্য কাউকে। বয়সও ক্রমেই বেড়ে চলেছিল আমার, ফুরিয়ে আসছিল পকেটের টাকাও। মাসের পর মাস গড়িয়ে গড়িয়ে কেটে যাচ্ছিল বছরের পর বছর। টের পাচ্ছিলাম, কিছু-একটা ভেঙে পড়েছে আমার ভিতরে। টের পাচ্ছিলাম, সেই কিছু-একটা ভেঙে পড়ার জন্য আমান্ডা আর ড্যামিয়েনই দায়ী। জানেন কি না জানি না… অভিনেতাদের জন্য বেকারত্ব কিন্তু ক্যান্সারের মতো। এই অসুখ নিয়ে যতদিন বসে থাকবেন আপনি, আপনার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা তত কমে যাবে। ওদিকে আমার পরিবারও যেন সাইডলাইনে বসে নজর রাখছিল আমার উপর… কবে ব্যর্থ হবো আমি, কবে আবার ফিরে যাবো তাদের সেই গোরখোদকারির ব্যবসায়। তারা হয়তো মনেপ্রাণে আশাও করছিল ব্যর্থ হই আমি।
‘খারাপ ঘটনা ঘটতে শুরু করল একটার পর একটা… আমাকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল আমার এজেন্ট। কারণ একটাই… তখন মনের দুঃখে দেদারসে মদ গিলতে শুরু করে দিয়েছিলাম। তারপর একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম একটা টাকাও নেই আমার পকেটে। উপলব্ধি করলাম, আমি আর ড্যান রবার্টস না। উপলব্ধি করলাম, আবার সেই রবার্ট কর্নওয়ালিস হয়ে গেছি। তারপর আর কী… কালো রঙের একটা স্যুট পরে আমার কাযিন আইরিনের সঙ্গে যোগ দিলাম দক্ষিণ কেনসিংটনে… কাহিনিও শেষ হয়ে গেল আমার। খেল খতম।’
থামল কর্নওয়ালিস। শিউরে উঠলাম আমি। ভাবলাম, আবারও বুঝি একটা স্কালপেল তুলে নেবে লোকটা। আমার মনে হচ্ছে, আগের দুই ক্ষতস্থানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। কিন্তু কর্নওয়ালিস আসলে এত নিমগ্ন হয়ে আছে নিজের কাহিনিতে যে, আমাকে আর আঘাত করল না।
‘এই কাজে আমি আসলে খুবই ভালো,’ বলছে শয়তানটা। ‘বলতে পারেন, এই কাজ মিশে আছে আমার রক্তে। কিন্তু এ-কাজে যতক্ষণ ব্যয় করি, তার প্রতিটা মিনিট ঘৃণা করি। যা-হোক, আমার স্ত্রী বারবারার সঙ্গে কোথায় পরিচিত হয়েছিলাম, জানেন? ওর এক চাচার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে। ব্যাপারটা রোমান্টিক, না? তারপর বিয়ে করে ফেললাম আমরা। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, বারবারাকে কখনোই সেভাবে ভালোবাসিনি আমি। বিয়ে করতে হতো, তাই করেছি আর কী। তারপর দেখতে দেখতে তিন তিনটা ছেলে হলো আমাদের। ভালো একজন বাবা হওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে, বারবারা আর আমাদের তিন ছেলে আমার কাছে বিদেশি কোনো বস্তুর মতোই রয়ে গেছে। ওদেরকে আসলে কখনোই চাইনি আমি। এসব কোনো কিছুই চাইনি আমি কখনও।’ একটুখানি হাসল। ‘অ্যান্ড্রিউ যখন বলল অভিনেতা হতে চায় সে, মজা পেয়েছিলাম। আচ্ছা, বলুন তো, ওই চিন্তা ওর মাথায় এল কোত্থেকে? যেখান থেকেই আসুক, ওকে শেষপর্যন্ত অভিনেতা হতে দেবো না আমি। ওই নরক থেকে ওকে রক্ষা করার চেষ্টা করে যাবো শেষপর্যন্ত।
‘যা-হোক, একদিন খোঁজ পেলাম আমান্ডার। একদিন… যখন আর সহ্য করতে পারছিলাম না আমার ব্যর্থতা… খুঁজে বের করলাম ওকে, আমার সঙ্গে ডিনার করার আমন্ত্রণ জানালাম। আর তারপর… সময় ও সুযোগ বুঝে খুন করে ফেললাম ওকে। ওকেই প্রথম হত্যা করলাম আমি। এবং স্বীকার করে নিচ্ছি, কাজটা করে যারপরনাই তৃপ্তি পেয়েছি। আমার কথা শুনে আমাকে হয়তো পাগল বলে মনে হচ্ছে আপনার। কিন্তু আমার কত বড় ক্ষতি করে দিয়েছে ওই মেয়ে আর ড্যামিয়েন, সেটা হয়তো কোনো দিনও বুঝতে পারবেন না আপনি। আমার ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়ে পুরস্কারের পর পুরস্কার জিতে নিয়েছে ধান্দাবাজ লোকটা, বিখ্যাত থেকে আরও বিখ্যাত হয়েছে। এমনকী সিনেমা করতে চলে গেছে সুদূর আমেরিকায়। কিন্তু তার মানে এই না, আমার প্রতিশোধস্পৃহা শেষ হয়ে গিয়েছিল। শুধু আমার নাগালের বাইরে ছিল সে… এ-ই যা। তখন ভাবলাম, কী করে মুঠোর ভিতরে আনা যায় ওকে?
‘কাজেই… যেদিন ওই শয়তানটার মা স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে হেঁটে এসে ঢুকল আমার ফিউনারেল পার্লারে, সেদিন কী যে আনন্দ পেয়েছিলাম… নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। মনে হচ্ছিল, আমি যেন একটা মাকড়সা, আর আমার জালে আটকা পড়েছে কোনো মাছি। দেখামাত্র চিনতে পেরেছিলাম ওই মহিলাকে। বেশ কয়েকবার রাডায় গিয়েছিল সে। হ্যামলেট নাটকটাও দেখতে গিয়েছিল। এমনকী আমার অভিনয় দেখে আমার প্রশংসাও করেছিল। যা-হোক, সেদিন আমার সামনেই বসে ছিল ওই মহিলা… নিজের শেষকৃত্যের পরিকল্পনা করছিল। আমাকে চিনতে পারেনি… পারবেই বা কেন? নাটকের ওই স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর অনেক বদলে গেছি আমি। চুল পাতলা হয়ে গেছে আমার, দাড়িও রেখেছি। চশমা ব্যবহার করি নিয়মিত। সবচেয়ে বড় কথা, একজন আন্ডারটেকারের দিকে ক’জনই বা ভালোমতো তাকায়? মরা মানুষদের নিয়ে যারা ঘাঁটাঘাঁটি করে তারা আসলে বাস করে ছায়ায়… আমরা যে আসলেই মানুষ, আমরাও যে কোনো-কাজ করি, সেটারই তো স্বীকৃতি দিতে চায় না কেউ! যা-হোক, আমার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল ড্যামিয়েনের মা, উইলো কফিন বাছাই করে নিল নিজের জন্য, কোন মিউযিকটা বাজানো হবে তা-ও ঠিক করে দিল। একটাবারের জন্যও বুঝতে পারল না, স্তম্ভিত হয়ে বসে ছিলাম আমি সারাটা সময়।
‘তখন দারুণ একটা চিন্তা খেলে গেল আমার মাথায়… যদি খুন করতে পারি ড্যামিয়েনের মাকে, তা হলে ওই মহিলার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে অবশ্যই আসবে শয়তানটা, এবং তখন তাকেও শেষ করে দিতে পারবো। মাত্র এক মিনিটের মধ্যে এই চিন্তা খেলে গেল আমার মগজে, এবং শেষপর্যন্ত সেটাই করেছি। ড্যামিয়েনের মা তার ঠিকানাটা দিল আমাকে, সময়-সুযোগমতো গিয়ে হাজির হলাম সেখানে, শ্বাসরোধ করে হত্যা করলাম তাকে। তারপর… সপ্তাহ দু’-এক বাদে, উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে শেষ করে দিলাম ড্যামিয়েনকে। নিজের সেই শৌখিন ফ্ল্যাটেই মরল সে আমার হাতে। ওকে খুন করতে যে কী মজা লেগেছে আমার, কল্পনাও করতে পারবেন না। খেয়াল রেখেছিলাম, ওর মায়ের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যাতে দেখা না-হয় ওর সঙ্গে। এবং সেজন্য সব কিছু বুঝিয়েও দিয়েছিলাম আইরিনকে।
‘ড্যামিয়েনকে খুন করার আগে নিজের পরিচয়টা যখন জানালাম ওকে, তখন ওর চেহারাটা যদি দেখতেন একবার! আমার কথা শুনেই বুঝে গিয়েছিল, আমি খুন করতে চলেছি ওকে। এমনকী আমি ছুরিটা বের করার আগেই বুঝে গিয়েছিল ব্যাপারটা। এবং কেন খুন করতে গিয়েছিলাম ওকে, বুঝতে পেরেছিল সেটাও। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম আরও কষ্ট দিয়ে ওকে মারতে।’
অপেক্ষা করছি আমি… হয়তো আরও কিছু বলবে কর্নওয়ালিস। অনেক কিছুই বুঝিয়ে বলেছে সে, এবং যতক্ষণ কথা বলেছে ততক্ষণ আঘাত করেনি আমাকে। এখন থেমে গেছে হঠাৎ করেই… আমরা দু’জনই বুঝতে পারছি আর কিছু বলার নেই তার।
আমার হাত-পায়ে কোনো সাড়া নেই এখনও। কী ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছে আমার উপর, ভাবলাম। পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো হয়ে গেছি, কিন্তু অনুভূতিহীন হয়ে যাইনি। বুক আর কাঁধের ব্যথাটা ছড়িয়ে পড়ছে, রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে আমার শার্ট।
কোনোরকমে বললাম, ‘এখন আমাকে নিয়ে কী করবেন?’
ভোঁতা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল কর্নওয়ালিস, কিছু বলল না।
‘এই ব্যাপারে তো কিছুই করার নেই আমার,’ বলে চললাম। ‘আমি একজন লেখক মাত্র। এই কেসের সঙ্গে জড়ানোর কোনো ইচ্ছাই ছিল না, তারপরও জড়িয়ে গেছি, কারণ হোথর্ন বলেছিল ওকে নিয়ে একটা বই লিখতে। আপনি যদি আমাকে খুন করে ফেলেন, সে বুঝে যাবে কাজটা কার। আমার ধারণা ইতোমধ্যেই সব জেনে গেছে সে।’ কেন যেন মনে হচ্ছে, যত বেশি কথা বলতে পারবো কর্নওয়ালিসের সঙ্গে, আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা তত বাড়বে। ‘দেখুন, আমার স্ত্রী আছে, দুটো ছেলে আছে। ড্যামিয়েন ক্যুপারকে কেন খুন করেছেন আপনি, বুঝতে পারছি। লোকটা আসলেই ধান্দাবাজ ছিল… আমিও তা-ই ভেবেছিলাম। কিন্তু আমাকে যদি খুন করে ফেলেন, তা হলে সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে যাবে সব কিছু। আপনার যে-ক্ষতি হয়েছে, সে-ব্যাপারে আসলে কিছুই করার ছিল না আমার।’
‘অবশ্যই আপনাকে খুন করবো আমি!’
কথাটা শোনামাত্র, মনে হলো, আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন ঢুকে গেলনাড়িভুঁড়ির ভিতরে। ছোঁ মেরে তৃতীয় আরেকটা স্কালপেল তুলে নিল কর্নওয়ালিস টেবিলের উপর থেকে। কেউ না-বলে দিলেও জানি, এই অস্ত্রটাই ব্যবহার করতে চলেছে সে আমাকে-খুন-করার-কাজে। উন্মত্ত হয়ে উঠেছে কিছুটা, কেমন কালচে-নীল বর্ণ ধারণ করেছে ওর চেহারা, চঞ্চল দৃষ্টিতে বার বার তাকাচ্ছে এদিকে-সেদিকে।
‘কী ভেবেছিলেন… এত কথা বলার পরও ছেড়ে দেবো আপনাকে? প্রাণে মারবো না? দোষ আপনারও আছে!’ স্কালপেলটা চালাল কর্নওয়ালিস বাতাসে। ‘রাডা’র ব্যাপারে কিছু জানা ছিল না কারও… ‘
‘আমি অনেককেই বলেছি কথাটা!’
‘আপনার কথা বিশ্বাস করি না আমি। আর… এখন এসবে কিছু আসে-যায়ও না। বাচ্চাদের জন্য যেসব ফালতু বই লেখেন আপনি, সেগুলো নিয়েই থাকা উচিত ছিল আপনার… এসব ব্যাপারে নাক গলানো উচিত হয়নি।
আমার দিকে এগিয়ে আসছে কর্নওয়ালিস। মেপে মেপে পা ফেলছে যেন। ‘আমি আসলেই দুঃখিত। কিন্তু নিজের খারাপি নিজেই ডেকে এনেছেন আপনি।’
নতুন কোনো খদ্দেরের দিকে যে-প্রফেশনাল দৃষ্টিতে তাকায় একজন আন্ডারটেকার, শেষ-মুহূর্তটাতে আমার দিকে সে-দৃষ্টিতে তাকাল কর্নওয়ালিস। স্কালপেলটা হাতে ধরে রেখেছে এখনও, আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে সেটা। নজর বোলাচ্ছে আমার সারা শরীরের উপর… কোথায় আঘাত করা যায় ভাবছে বোধহয়।
ঠিক তখনই যেন বিস্ফোরিত হলো একদিকের একটা দরজা… ওটা আগে খেয়ালই করিনি আমি। চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেলাম, ছুটে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল কেউ একজন। ঘাড়টা ঘুরাতে সক্ষম হলাম।
হোথর্ন।
নিজের রেইনকোটটা সামনের দিকে বাড়িয়ে ধরে রেখেছে সে… যেন ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে ওটা। এখানে এই সময়ে কীভাবে হাজির হলো, সে- ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই আমার। কিন্তু এত খুশি হলাম ওকে দেখে যে, অত খুশি আর হইনি কখনও।
‘ওটা নামিয়ে রাখুন,’ বলতে শুনলাম ওকে। ‘খেলা শেষ আপনার।‘
আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কর্নওয়ালিস… বড়জোর দু’মিটার দূরে। হোথর্নের দিকে তাকিয়ে ছিল, দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে তাকাল আমার দিকে। কী করতে যাচ্ছে লোকটা, ভাবলাম। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল হঠাৎ, এবং সেটাও টের পেলাম আমি। নামিয়ে রাখল না স্কালপেলটা, বরং ওটা নিয়ে গেল নিজের গলার কাছে। অনুভূমিকভাবে একবার মাত্র পোঁচ দিল গলায়।
ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে লোকটার গলা থেকে। তার গলা আর বুক বেয়ে নামছে রক্ত… রক্তের ছোটখাটো একটা পুকুর তৈরি হচ্ছে তার পায়ের কাছে। এখনও দাঁড়িয়ে আছে সে; এমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে যে, আজকের এই দিনটা দুঃস্বপ্ন হয়ে থাকবে আমার জন্য। আনন্দিত দেখাচ্ছে তাকে… বলা ভালো, বিজয়ের উল্লাস দেখতে পাচ্ছি যেন তার চেহারায়। তারপর একসময় ধপাস করে পড়ে গেল। মাংসপেশীর অনৈচ্ছিক আক্ষেপে সমানে ঝাঁকি খাচ্ছে শরীরটা। আরও রক্ত ছিটকে-ছিটকে পড়ছে তার আশপাশে।
আর কিছু দেখতে পেলাম না। ছুটে এসে হুইলচেয়ারটা আঁকড়ে ধরল হোথর্ন, ঘুরিয়ে দিল আমাকে। ঠিক তখনই শুনতে পেলাম সাইরেনের স্বস্তিদায়ক প্যাঁ-পোঁ আওয়াজ। বুঝতে পারলাম, পুলিশের গাড়ি হাজির হয়েছে বাইরে।
‘আপনি এখানে কী করছেন?’
হাঁটু গেড়ে আমার পাশে বসে পড়ল হোথর্ন, বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে স্কালপেল দুটোর দিকে। হয়তো ভাবছে, কেন উঠে দাঁড়াতে পারছি না আমি।
ওর প্রতি ওই মুহূর্তে যে-ভালোবাসা জন্ম নিল আমার মনে, জোর গলায় বলতে পারি, শার্লক হোমসের প্রতি ওয়াটসনের, অথবা পোয়ারোর প্রতি হেস্টিংসের সে- রকম কোনো আবেগ জন্মায়নি কখনও।
জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগে ভাবলাম, আমি কতই না সৌভাগ্যবান… শেষমুহূর্তে পাশে পেয়েছি হোথর্নকে।
২৩. ভিযিটিং আওয়ার্স
পুরো ঘটনা পর্যালোচনা করে যদি বলি… প্রথম পুরুষে এই উপন্যাস লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বলে এখন খারাপই লাগছে আমার। কারণ প্রথম পুরুষে কোনো কিছু লেখার মানেই হলো, কাহিনির বর্ণনাকারী শেষপর্যন্ত জীবিত থাকবে… সে-ই যদি মারা যায়, তা হলে বাকি কথা বলবে কে?
যা-হোক, চ্যারিং ক্রস হাসপাতালের অ্যাক্সিডেন্ট অ্যান্ড ইমার্জেন্সি ইউনিটে জ্ঞান ফিরল আমার। ফুলহ্যাম প্যালেস রোড ধরে কিছুদূর এলেই এই হাসপাতাল।
কিছুটা বিব্রত বোধ করছি। এই কেসে এই নিয়ে দু’বার জ্ঞান হারাতে হয়েছে আমাকে। তবে ডাক্তাররা ইতোমধ্যে আমাকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, জ্ঞান হারানোর এই ব্যাপারটা যতটা না আমার কাপুরুষত্বের জন্য, তার চেয়ে বেশি আমার উপর যে-ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছিল সেটার জন্য। ওই ওষুধ কোত্থেকে জোগাড় করেছিল কর্নওয়ালিস, তা আর জানা হবে না কখনও। তবে তার স্ত্রী বারবারা একজন ফার্মাসিস্ট, কাজেই ধারণা করে নেয়া যায় ওষুধটা ওই মহিলার মাধ্যমেই জোগাড় করে নিয়েছিল সে। পরে বারবারা আর তার তিন ছেলের কী হয়েছিল, তা আর জানতে পারিনি আমি। মানসিক বিকারগ্রস্ত এক লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বেচারী মহিলার, সেটা জানতে পারাটা খুব সুখকর কিছু না।
যা-হোক, অবযার্ভেশনে রাখা হয়েছে আমাকে, কিন্তু আমার অবস্থা যে খুব খারাপ, তা কিন্তু না। আমার বুক আর কাঁধের যে-দুই জায়গায় স্কালপেল ঢুকিয়ে দিয়েছিল কর্নওয়ালিস, এখনও প্রচণ্ড ব্যথা করছে জায়গা দুটো। কিন্তু ওই দুই জায়গায় কেবল দুটো করে সেলাই পড়েছে… তার বেশি কিছু না। আমি আসলে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম সাংঘাতিক। আমার উপর যে-ওষুধ প্রয়োগ করেছিল কর্নওয়ালিস, সেটার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে আট থেকে বারো ঘণ্টার মতো লেগে গেছে।
লোকে দেখা করতে আসছে আমার সঙ্গে। সবার আগে এসেছে আমার স্ত্রী। এবং আমাকে এই অবস্থায় দেখে মোটেও খুশি হয়নি সে। ‘কী করতে গিয়েছিলে তুমি সেখানে?’ দাবি জানানোর সুরে বলল। ‘আরেকটু হলে তো মারাই পড়তে!’
‘জানি।’
‘এসব নিয়ে আবার লেখালেখি শুরু করবে নাকি? আমি বুঝলাম না… তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল? ওই বিল্ডিঙে গিয়ে ঢুকলে কী কাজে? তুমি যদি আগে থেকেই জানতে লোকটা খুনি…’
‘ওই বিল্ডিং যে খালি ছিল ওই সময়ে, জানা ছিল না আমার। আর কর্নওয়ালিসই যে খুনি, সেটাও ভাবিনি। ভেবেছিলাম, সে যা বলছিল, তার চেয়ে বেশি জানা ছিল তার।’
কথাটা সত্যি। লিখ আমাকে যে-ফটোগ্রাফ দেখিয়েছিলেন, সেটাতে কর্নওয়ালিসকে চিনতে পেরেছিলাম আমি। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, আমি ততক্ষণে ধরেই নিয়েছিলাম, অ্যালান গডউইন যদি খুন না-করে থাকে ড্যামিয়েন আর তার মাকে, তা হলে গ্রেসের বাবা মার্টিন লোভেলই দায়ী ওই হত্যাকাণ্ড দুটোর জন্য। কারণ বিশেষ ওই ফটোগ্রাফে তিনিও ছিলেন… ফ্রেমের কোনায় ফুল-সহ যাঁকে দেখেছিলাম আমি। ড্যামিয়েন ক্যুপারের মৃত্যু কামনা করার যথোপযুক্ত কারণ ছিল তাঁর। মেয়েকে রক্ষা করতে এবং তাকে তার ক্যারিয়ারটা নতুনভাবে শুরু করতে দিতে প্রয়োজনে যে-কোনো কিছু করে ফেলতে পারতেন তিনি। নিজের এই ধারণার ব্যাপারে আসলে এতটাই নিশ্চিত ছিলাম আমি যে, আরেকটু হলে মরতে বসেছিলাম।
‘তুমি যে এ-বই লিখছ, আমাকে বলোনি কেন?’ জিজ্ঞেস করল আমার স্ত্রী। ‘তুমি তো সাধারণত কোনো কিছু গোপন করো না আমার কাছ থেকে!
‘জানি। আমি দুঃখিত।’ নিজেকে হতভাগা মনে হচ্ছে আমার। ‘জানতাম সব শুনলে তুমি বলবে, আমার আইডিয়াটা মোটেও ভালো কিছু ছিল না।’
‘নিজেকে যে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছ, সেটাই ভালো লাগেনি আমার। দেখ তোমার এই কাজ তোমাকে কোথায় এনে হাজির করেছে… ইন্টেনসিভ কেয়ারে।’
‘না… তেমন কিছু না… মাত্র চারটা সেলাই পড়েছে আমার শরীরে।’
‘তোমার কপালটা আসলে খুব ভালো,’ মোবাইল ফোন বেজে উঠল আমার স্ত্রীর। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। ‘একটা জিনিস নিয়ে এসেছি তোমার জন্য।’
একটা বই নিয়ে এসেছে সে… ওটা নামিয়ে রাখল বিছানায়। রেবেকা ওয়েস্টের দ্য মিনিং অভ ট্রিন। বইটা পড়ছিলাম আমি।
‘নতুন সিরিযটার জন্য তোমার কাছ থেকে কিছু শুনবার অপেক্ষায় আছে আইটিভি,’ আমাকে মনে করিয়ে দিল আমার স্ত্রী।
‘হাতের কাজটা শেষ করেই ওটা শুরু করবো আমি,’ কথা দিলাম।
আমার দুই ছেলে আমাকে চমৎকার দুটো টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছে, কিন্তু দেখা করতে আসেনি হাসপাতালে। গত বছর গ্রীসে মোটরবাইক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলাম আমি, তখনও এই কাজ করেছিল ওরা। আসলে আমাকে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখার ব্যাপারে ওরা বোধহয় একটু খুঁতখুঁতে।
আমার স্ত্রী চলে যাওয়ার পর ঝড়ের বেগে ভিতরে ঢুকল আমার এজেন্ট হিলডা স্টার্ক। ধপাস করে বসে পড়ল একটা চেয়ারে, আপাদমস্তক দেখছে আমাকে। ‘কেমন আছেন?’
‘ঠিক আছি। আমাকে শুধু পরীক্ষানিরীক্ষা করার জন্য রাখা হয়েছে এখানে।’
সন্দেহ দেখা দিল হিলডার চেহারায়।
‘ওষুধ খাইয়ে অবশ করে দেয়া হয়েছিল আমাকে,’ বুঝিয়ে বললাম।
‘রবার্ট কর্নওয়ালিস হামলা চালিয়েছিল আপনার উপর?’
‘হ্যাঁ। তারপর আত্মহত্যা করেছে সে।’
মাথা ঝাঁকাল হিলডা। ‘সেক্ষেত্রে বলতেই হয়, ভয়ঙ্কর একটা পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে আপনার বইয়ে। যা-হোক, ভালো-খারাপ দু’রকম খবরই আছে আপনার জন্য। ওরিয়ন বুকসের সঙ্গে কথা বলেছিলাম আপনার এ-বইয়ের ব্যাপারে। আগ্রহ দেখায়নি তারা। বরং তারা চায়, তিনটা বই লিখে দেয়ার ব্যাপারে যে-চুক্তি করেছিলেন আপনি তাদের সঙ্গে, সেগুলো লিখে শেষ করুন।
‘ভালো খবরটা কী?
‘হারপার কলিন্সের এক সম্পাদক… সেলিনা ওয়াকার নাম… আপনার কাজ এত পছন্দ হয়েছে তাঁর যে, অপেক্ষা করতে রাজি আছেন। আমার সঙ্গে কোনো একটা চুক্তি করে ফেলবেন তিনি শীঘ্রই। পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলাম। কর্নওয়ালিস যে-কাণ্ড ঘটিয়েছে, সেসবের কিছু-না-কিছু তো পত্রপত্রিকায় ছাপা হবেই। তবে আপনার নামটা যাতে ছাপা না হয়, সে- ব্যাপারে চেষ্টাচরিত্র করছি আমরা। আপনি যে এসবের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন, সেজন্য পুলিশ রীতিমতো বিরক্ত; কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হলো, আমরা চাই না আপনি কিছু লিখে শেষ করার আগেই সব ঘটনা জেনে ফেলুক সাধারণ লোকজন।’ উঠে দাঁড়াল হিলডা, চলে যাবে। ‘মিস্টার হোথর্নের সঙ্গেও কথা হয়েছে আমার। বইয়ের নাম ঠিক করা হয়েছে ‘হোথর্ন ইনভেস্টিগেটস’। বখরা আধাআধি।’
‘এক মিনিট!’ থতমত খেয়ে গেছি আমি। ‘ওই নামটা মোটেও পছন্দ না আমার। আর… যতদূর মনে পড়ে, আধাআধি বখরার ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু আপনিই আপত্তি করেছিলেন প্রথমে।’
কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল হিলডা। মনে করিয়ে দেয়ার কায়দায় বলল, ‘আমি আপত্তি করলে কী হবে… রাজি তো হয়েছিলেন আপনি। তা ছাড়া মিস্টার হোথর্ন এই চুক্তির বাইরে অন্য কোনো কিছুতে রাজিও না।’
কেন যেন নার্ভাস দেখাচ্ছে হিলডাকে। ভাবলাম, ওর ব্যাপারে কিছু জানে নাকি হোথর্ন?
‘সেলিনার সঙ্গে আবার কথা বলার পর এসব নিয়ে না-হয় আলাপ করা যাবে,’ বলল হিলডা। ‘আপনার কিছু লাগবে?’
‘না! আগামীকাল নাগাদ বাসায় চলে যাবো আমি।’
‘ঠিক আছে, তখন তা হলে ফোন করবো আপনাকে।’
আমি আর কিছু বলার আগেই চলে গেল হিলডা।
সেদিন সন্ধ্যায় হাজির হলো আমার শেষ ভিটির। অনেকক্ষণ আগেই ভিযিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেছে… তবুও। শুনতে পেলাম, তাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে একজন নার্স। আরও শুনতে পেলাম, কড়া গলায় নার্সকে বলছে লোকটা, ‘কোনো অসুবিধা নেই। আমি একজন পুলিশ অফিসার।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বিছানার পায়ের কাছে হাজির হলো হোথর্ন। হাতে ধরে রেখেছে বাদামি কাগজের কুঁচকে যাওয়া একটা ব্যাগ।
‘হ্যালো, টনি,’ বলল সে।
‘হ্যালো, হোথর্ন।’ ব্যাপারটা অদ্ভুত, কিন্তু ওকে দেখে খুব খুশি লাগছে আমার। অনুভব করতে পারছি, এই মুহূর্তে ওর চেয়ে বেশি আর কারও সঙ্গে দেখা করতে চাই না আমি।
হিলডা যে-চেয়ারে বসে ছিল, সেই একই চেয়ারে বসে পড়ল সে। ‘কেমন লাগছে এখন?’
‘আগের চেয়ে অনেক ভালো।’
‘আপনার জন্য এটা নিয়ে এসেছি আমি,’ আমার হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দিল হোথৰ্ন।
খুললাম ওটা। বড় এক থোকা আঙুর।
‘অনেক ধন্যবাদ।’
‘ভাবলাম আপনার হয়তো আঙুর খেতে ভালো লাগবে।’
‘খুব খুশি হলাম। সহানুভূতিশীল একটা মন আছে আপনার আসলে।’ একপাশে সরিয়ে রাখলাম আঙুরগুলো। প্রাইভেট একটা রুম দেয়া হয়েছে আমাকে, কারণ পুলিশি তদন্তের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি আমি। আলো কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এই ঘরে এখন শুধু আমি আর হোথর্ন। আর আছে আমার বিছানাটা এবং একটা চেয়ার। ‘হ্যামারস্মিথে… আপনি যে তখন হুট করেই হাজির হয়েছিলেন… খুব খুশি হয়েছি। আরেকটু হলে আমাকে খুন করে ফেলত রবার্ট কর্নওয়ালিস।’
‘লোকটা আসলে বদ্ধ পাগল। ওখানে একা যাওয়াটা মোটেও ঠিক হয়নি আপনার। যাওয়ার আগে আমাকে ফোন দেয়া উচিত ছিল।
‘আপনি কি জানতেন কর্নওয়ালিসই খুনি?’
মাথা ঝাঁকাল হোথর্ন। ‘ওকে গ্রেপ্তার করতাম আমি। কিন্তু তার আগে নাইজেল ওয়েস্টের ব্যাপারটা মীমাংসা করা দরকার ছিল।’
‘কেমন আছেন তিনি?’
‘তাঁর বাড়ি যে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, সেটা নিয়ে তিনি হতাশ। এমনিতে ভালোই আছেন।’
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ‘আমি আসলে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি। কর্নওয়ালিসই যে খুনি, সেটা কখন ধরতে পারলেন?’
‘এত কথা শোনার মতো সময় হবে আপনার? ঘুমাবেন না?’
‘আপনি আমাকে কিছু না-বলার আগপর্যন্ত ঘুমই হবে না আমার। এক মিনিট!’ আমার আইফোনটা বের করলাম। টান লাগল বুক আর কাঁধের পেশীতে, চোখমুখ কুঁচকে উঠল আমার। কিন্তু যত যা-ই হোক রেকর্ড করতে হবে হোথর্নের কথাগুলো। ‘একেবারে প্রথম থেকে শুরু করুন। কিছুই বাদ দেবেন না।’
মাথা ঝাঁকাল হোথর্ন। ‘ঠিক আছে। আমি আপনাকে বলেছিলাম… আপনার মনে আছে কি না জানি না… জটিল একটা সমস্যা হাজির হয়েছে আমাদের সামনে। মিডোস আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা ধরতে পারেননি ব্যাপারটা… তাঁরা ভেবে নিয়েছিলেন এই কেস খুব সহজ। একজন মহিলা নিজের শেষকৃত্যের আয়োজন করার জন্য গিয়ে হাজির হলেন জনৈক আন্ডারটেকারের অফিসে, আর তার ছ’ঘণ্টার মধ্যেই মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল ওই মহিলাকে… এই ব্যাপারটা মিডোস আর তার চ্যালাদের নজর এড়িয়ে গেছে পুরোপুরি। কিন্তু এই কেসে ওই ব্যাপারটাই ছিল আসল কথা। কারণ আপনি যদি আন্ডারটেকারের কাছে যাওয়ার ব্যাপারটা বাদ দেন, তা হলে এই কেসে অদ্ভুত বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে কিছু থাকে না। সেক্ষেত্রে মিডোস যে-অবাস্তব চোরের পেছনে লেগেছিল, আমাকেও হয়তো সেই একই লোকের পেছনে লাগতে হতো। অথচ অদ্ভুত দুটো ঘটনা ছিল এই কেসে, এবং শুরুতে সে-ঘটনা দুটোর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারছিলাম না আমরা।
‘আমি তখন ভাবতে শুরু করি, কেন কর্নওয়ালিস অ্যান্ড সন্সের দ্বারস্থ হয়েছিলেন ডায়ানা ক্যুপার এবং একসময় বুঝতেও পারি সেটা। ট্রেনে কথাটা বলেছিলাম আপনাকে… আপনার খেয়াল আছে কি না জানি। ওই মহিলা তাঁর সারাটা জীবন বলতে গেলে নিঃসঙ্গই কাটিয়েছেন। তিনি মরার আগেও তাঁর স্বামীকে এত বেশি মিস করতেন যে, স্বামীর জন্য যে-মেমোরিয়াল গার্ডেন বানিয়েছিলেন, সেখানে যেতেন মাঝেমধ্যেই। কাউকে বিশ্বাস করতেন না তিনি। তাঁকে ঠকিয়েছে রেমন্ড কুন্স। তাঁর একমাত্র ছেলে চলে গেছে আমেরিকায়। বন্ধু বলতে এত কম মানুষ ছিল তাঁর জীবনে যে, তিনি খুন হওয়ার পর, তিনি যে মারা গেছেন সেটা জানতেই দুটো দিন লেগে গেছে। তা-ও কথাটা কে জেনেছে… তাঁর বাড়ির ক্লিনার। তাই এই কেসের শুরু থেকেই একটা চিন্তা খেলে যায় আমার মাথায়… করুণ একটা জীবন যাপন করছিলেন ডায়ানা ক্যুপার। আর তাই তিনি শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন… ‘
লম্বা করে দম নিলাম আমি। ‘আত্মহত্যা করার?’
‘একদম ঠিক। তাঁর বাথরুমে কী পেয়েছিলাম আমরা, মনে আছে? তিন প্যাকেট টেমাযেপাম। আত্মহত্যা করার জন্য ওগুলো ছিল যথেষ্টের চেয়েও বেশি।’
‘তাঁর ডাক্তারের সঙ্গেও দেখা করেছিলাম আমরা। তিনি বলেছেন, মিসেস ক্যুপার নাকি ঘুমাতে পারতেন না।’
‘সে-কথা মিসেস ক্যুপার বলেছিলেন ডাক্তারকে। কিন্তু তিনি আসলে জমা করছিলেন ওষুধগুলো… পরে কোনো একসময় একবারে কাজে লাগাবেন ভেবে নিয়ে। তিনি হয়তো ধরেই নিয়েছিলেন, অনেক হয়েছে… আর না। তারপর… একদিন হুট করেই হারিয়ে গেল তাঁর অতি আদরের বিড়ালটা। আমার ধারণা, ওই ঘটনাই কাল হলো মিসেস ক্যুপারের জন্য। ততদিনে তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছেন অ্যালান গডউইন, হুমকি দিয়ে এসেছেন। তাঁকে একটা চিঠিও পাঠিয়েছিলেন অ্যালান এবং সেটা পড়েছিলেন তিনি। তখন তিনি হয়তো ধরে নিয়েছিলেন, অ্যালানই হত্যা করেছে তাঁর আদরের পোষা বিড়ালটাকে। মনে পড়ে, কী লিখেছিলেন অ্যালান তাঁর সেই চিঠিতে? আপনার উপর নজর রেখেছি আমি, জানি কোন্ কোন্ জিনিস খুব প্রিয় আপনার কাছে। যা-হোক, মিসেস ক্যুপার ছিলেন গোছানো স্বভাবের মহিলা, সব কিছুই গুছিয়ে রাখাটা তাঁর স্বভাব ছিল। আর তাই যেদিন তিনি পদত্যাগ করলেন গ্লোব থিয়েটারের বোর্ড থেকে, সেদিনই গিয়ে হাজির হলেন কর্নওয়ালিস অ্যান্ড সন্সে।
আমি বললাম, ‘কারণ তাঁর জানা ছিল, তিনি মরতে চলেছেন। আজ নয়তো কাল আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলেন তিনি।’
‘একদম ঠিক।’
‘তবে সুইসাইড নোট অথবা ওই জাতের কোনো কিছু লিখে রেখে যাননি তিনি।’
‘একদিক দিয়ে চিন্তা করলে লিখে রেখে গেছেন। নিজের শেষকৃত্যের জন্য কী কী বেছে নিয়েছিলেন তিনি, দেখেছেন আপনি। প্রথমেই আসুন ‘এলিনর রিগবি’-র কথায়। অল দ্য লোনলি পিপল, হোয়ার ডু দে অল কাম ফ্রম? আমি বলবো, এটা আসলে সাহায্যের জন্য আকুল আবেদন। তারপর আসুন সিলভিয়া প্লাথ নামের সেই কবির কথায়। আসুন সেই সুরকার জেরমিয়া ক্লার্কের কথায়। এঁদেরকে যে বেছে নিয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার, আমার মনে হয় না ঘটনাটা কাকতালীয়।’
‘আর সেই ধর্মসঙ্গীত?’
‘সাম থার্টি ফোর (Psalm 34)। ঈশ্বরভক্ত লোকদের অনেক কষ্ট হয়, কিন্তু প্রভু তাদেরকে সব কিছু থেকে রক্ষা করেন। যে বা যারা আত্মহত্যা করে, এই স্তব তাদের জন্য। যে-কোনো একজন ভিকারের সঙ্গে কথা বলে দেখুন, আপনি নিজেই জানতে পারবেন।
‘আমার মনে হয় আপনি কারও সঙ্গে কথা বলেছিলেন এই ব্যাপারে।’
‘অবশ্যই।’
‘ডায়ানা ক্যুপার যখন গিয়েছিলেন কর্নওয়ালিস অ্যান্ড সন্সে, তখন প্রথমে কী দেখতে পেয়েছিলেন?’ জানতে চাইলাম আমি। ‘আপনি বলেছিলেন ব্যাপারটা নাকি গুরুত্বপূর্ণ।’
‘ঠিক। জানালার গোবরাটে একটা মার্বেল বুক ( marble book) রাখা ছিল, ওটাই দেখেছিলেন তিনি। এবং সেই বইয়ে বিশেষ একটা কথা লেখা ছিল।’
কথাটা মুখস্ত হয়ে গেছে আমার, তাই মনে করতে কোনো সমস্যা হলো নাঃ মানুষের জীবনে দুঃখ যখন আসে, একাকী কোনো গুপ্তচরের মতো আসে না, বরং বিশাল এক বাহিনীর মতো আসে।
‘হ্যামলেট নাটকে বলা আছে কথাটা। শেক্সপিয়ার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা নেই আমার… তবে এই কেসে মহান সেই সাহিত্যিকের ভূমিকা আছে অনেক। ডায়ানা ক্যুপারের বাসায় ফ্রিজের গায়ে শেক্সপিয়ারের উক্তি দেখেছি আমরা। তাঁর বেশিরভাগ মঞ্চনাটকের বিষয়বস্তু ছিল শেক্সপিয়ার। এমনকী ডিলে সেই ফোয়ারার গায়েও শেক্সপিয়ারের একটা উক্তি দেখেছি আমরা।
‘টু স্লিপ, বিড়বিড় করে বললাম আমি, ‘পারচ্যান্স টু ড্রিম। এটাও নেয়া হয়েছে হ্যামলেট থেকে।
‘হুঁ। সেই ফিউনারেল পার্লারে যখন গিয়েছিলেন ডায়ানা ক্যুপার, তখন তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল হ্যামলেট। কিন্তু ঘটনা ঘটে গেল অন্যরকম। তাঁকে চিনে ফেলল রবার্ট কর্নওয়ালিস। তিনি নিজেই মোটামুটি বিখ্যাত, তবে আমার ধারণা বড়াই করে ড্যামিয়েনের পরিচয়ও দিয়েছিলেন তিনি। ফলে মাথাটা বিগড়ে যায় কর্নওয়ালিসের। আসলে ওই লোকের মাথাটা সেই শুরু থেকেই বিগড়ানো ছিল।
‘আপনি জেনে গেছেন, ড্যামিয়েন ক্যুপারের সঙ্গে রাডায় ছিল কর্নওয়ালিস।’ চেয়ারে আরাম করে বসেছে হোথর্ন, যা বলছে তা উপভোগ করছে। ‘আমরা যেদিন প্রথমবার দেখা করতে গিয়েছিলাম কর্নওয়ালিসের সঙ্গে, সেদিন লোকটার অফিসে একটা অ্যাশট্রে দেখতে পেয়েছিলাম… মনে আছে? আন্ডারটেকার অভ দ্য ইয়ার হিসেবে ওটা উপহার দেয়া হয়েছিল রবার্ট ড্যানিয়েল কর্নওয়ালিসকে। নামের শেষের অংশটা বাদ দিয়ে, প্রথম আর দ্বিতীয় অংশটা এদিক-ওদিক করে নিজের জন্য নতুন একটা নাম বানিয়ে নেয় সে… ড্যান রবার্টস।’
‘হ্যাঁ… আমাকে বলেছিল লোকটা। সে চায়নি লোকে জেনে যাক, তার বাপ- দাদার সবাই গোরখোদকারির ব্যবসা করে।’
‘কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, গ্রেস লোভেল ভেবেছিল, আমান্ডা লেইয়ের নামটা বানোয়াট। যা-হোক, কর্নওয়ালিস যে অভিনেতা হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে, সেটা আমাদেরকে জানতে দিতে চায়নি সে। এমনকী রাডা’র সঙ্গে যে যোগাযোগ ছিল তার, সেটাও বুঝতে দিতে চায়নি আমাদেরকে।’
কিন্তু আমি সেই যোগসূত্রটা বের করে ফেলেছিলাম, ভাবলাম। কত ভালোই না হতো যদি সেই মুহূর্তে ফোন করতাম হোথর্নকে, সব কথা জানিয়ে দিতাম ওকে!
‘আমরা যেদিন গিয়েছিলাম কর্নওয়ালিসের বাড়িতে,’ বলে চলল হোথর্ন, ‘সেদিন নিজের ব্যাপারে অনেক কথাই বলেছে লোকটা, কিন্তু তার বয়স যখন বিশের কোঠায় ছিল তখন কী করেছে তা চেপে গেছে। যখন আত্মহত্যা করল তখন তার বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ ছিল। আমাদেরকে সে বলেছে, গোরখোদকারির এই ব্যবসা নাকি গত দশ বছর ধরে করছে। তার মানে এই কাজ শুরু করার আগে আরও অন্তত পাঁচটা বছর ছিল তার হাতে। এবং সে-সময়ে অন্য কিছু-একটা করেছে সে। আরেকটা কথা। আমরা যখন ছিলাম সেখানে, তার ছেলে অ্যান্ড্রিউ আমাদের সামনে হাজির হয়ে কী বলল? সে নাকি অভিনেতা হতে চায়। বারবারা কর্নওয়ালিসও বলেছিলেন আমাদেরকে কথাটা: অভিনয় মিশে আছে ওই ছেলের রক্তে। তিনি আসলে বলতে চেয়েছিলেন, বাবার কাছ থেকে অভিনয়ের নেশা পেয়েছে ছেলেটা। কিন্তু আমাদের সামনে হাজির হয়ে অ্যান্ড্রিউ যখনই বলতে চেয়েছিল কথাটা, সঙ্গে সঙ্গে তাকে থামিয়ে দিয়ে কর্নওয়ালিস বলে উঠেছিল, এখন এসব নিয়ে কথা বলার সময় না। অ্যান্ড্রিউ জানত, তার বাবা একসময় একটা ড্রামা স্কুলে ছিল। কিন্তু কর্নওয়ালিস সেদিন ঘাবড়ে গিয়েছিল… কথাটা যদি ফাঁস হয়ে যায়, তা হলে ড্যামিয়েন আর তার মায়ের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার যোগসূত্রটাও ফাঁস হয়ে যেতে পারে।
‘পুরো ব্যাপারটা তা হলে এ-ই,’ বললাম আমি। সব খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে এখন। ‘হ্যামলেট নাটকের প্রোডাকশন নিয়েই যত গণ্ডগোল! ওই নাটকের মাধ্যমে পাদপ্রদীপের আলোয় আসার কথা ছিল রবার্ট কর্নওয়ালিস ওরফে ড্যান রবার্টসের। এবং মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগও পেয়ে গিয়েছিল সে। বড় বড় সব এজেন্টদের দেখতে আসার কথা ছিল নাটকটা। কিন্তু ওর কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটাই বলতে গেলে চুরি করে নিয়েছিল ড্যামিয়েন।’
‘কীভাবে করা হয়েছিল কাজটা, সে-ব্যাপারে আপনাকে কিছু বলেছে কর্নওয়ালিস?’
‘না।’ কিছুক্ষণ ভাবলাম আমি। ‘আমান্ডা লেইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ড্যামিয়েনের। কিন্তু গ্রেস আমাদেরকে বলেছে, ওই দু’জনের মধ্যে নাকি ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। এবং সেটা সেই হ্যামলেট নাটকের রিহার্সেল শুরু হওয়ার ঠিক আগে। তখনই কোনো এক সময় ড্যানের সঙ্গে আমান্ডাকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলে গ্রেস।’ হঠাৎ করেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে। ‘কথাটা আসলে ঠিক না!’ চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। ‘কর্নওয়ালিসের সঙ্গে যাতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে, সেজন্য ড্যামিয়েনই হয়তো বলেকয়ে রাজি করিয়েছিল আমান্ডাকে। ‘ আরেকটা কথা মনে পড়ে গেল আমার। ‘আমার এক বন্ধু আছে রাডায়… লিয নাম… তিনি বলেছেন সে-সময় নাকি রাডা’র অনেকেই গ্রান্ডুলার ফিভারে আক্রান্ত হয়ে পড়ছিল…’
‘গ্রান্ডুলার ফিভারের আরেকটা নাম আছে… কিসিং ডিযিয,’ বলল হোথর্ন। ‘আমান্ডা ইচ্ছাকৃতভাবে ওই ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে ড্যানের মধ্যে। ফলে কী হলো? ড্যানকে বাদ দেয়া হলো হ্যামলেট নাটকের মুখ্য চরিত্র থেকে। সেই চরিত্র পেয়ে গেল ড্যামিয়েন, বাকিটা ইতিহাস। যা-হোক, ড্যামিয়েনের এই চালাকি ধরে ফেলেছিল কর্নওয়ালিস এবং কোনো দিনও ক্ষমা করেনি সে ধান্দাবাজ ওই লোককে। ক্ষমা করেনি আমান্ডাকেও। বছর চারেক পর খুঁজে বের করে সে মেয়েটাকে, এবং খুন করে।’
‘ওই মেয়েকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল সে। পরে নিজের সাতটা লাশের সঙ্গে দাফন করেছিল একেকটা টুকরো।’ মনে পড়ে গেল কর্নওয়ালিস কী বলেছিল আমাকে।
মাথা ঝাঁকাল হোথর্ন। ‘খুন করে কারও লাশ গুম করে ফেলতে চাইলে গোরখোদকারির কাজটা অনেক উপকারে আসতে পারে।’
‘কিন্তু কর্নওয়ালিসের স্ত্রী কিছু টের পেল না কেন? সে কেন বুঝতে পারল না কোথাও কিছু-একটা ঘাপলা আছে? ব্যাপারটা আশ্চর্য লাগছে আমার।’
‘কারণ ওই মহিলা আসলে কিছু বুঝতেই পারেনি,’ বলল হোথর্ন। ‘একটু মনে করে দেখুন আমাদেরকে কী বলেছিল সে। বলেছিল, কর্নওয়ালিস নাকি ড্যামিয়েনের একজন ভক্ত। কিন্তু আসলে বুঝতে পারেনি, ড্যামিয়েনের অভিনীত প্রতিটা নাটক আর সিনেমা কী সাংঘাতিক প্রভাব বিস্তার করেছে তার স্বামীর মনে। ড্যামিয়েনের প্রতিটা অভিনয় দেখেছে কর্নওয়ালিস, আর স্মরণ করেছে নিজের ব্যর্থ অভিনয়- ক্যারিয়ারের কথা। অভিনয়-জীবনে একটাই মাত্র সাফল্য ছিল ওই লোকের, আর সে-সাফল্য অনুযায়ীই নিজের তিন ছেলের নাম রেখেছিল সে।’
‘টনি, সেবাস্টিয়ান আর অ্যান্ড্রিউ। সবগুলো চরিত্র টুয়েল্থ নাইট-এর। এটা আমার চোখে আগে ধরা পড়ল না কেন?’
‘নাটকের ওই স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর এই একটা মাত্র নাটকে অভিনয় করেছিল কর্নওয়ালিস। বেচারা মনে হয় ওই স্কুল ছেড়ে বের হওয়ার পর প্রতিটা দিনই ভেবেছে ড্যামিয়েনকে খুন করার কথা। ভুলভ্রান্তি যা-যা ঘটেছে তার সঙ্গে, সব কিছুর জন্য ড্যামিয়েনকেই দোষ দিয়ে গেছে সে।’
‘আর তারপর একদিন সকালে হুট করেই তার অফিসে হাজির হয়ে গেলেন ডায়ানা ক্যুপার।’
‘ঠিক। ড্যামিয়েনের নাগাল পাওয়া সম্ভব ছিল না কর্নওয়ালিসের পক্ষে। কারণ ড্যামিয়েন ছিল আমেরিকায়। সে ছিল বিখ্যাত একজন মানুষ। কাছের লোকজন সব সময় ঘিরে রাখত তাকে। কিন্তু যদি কোনো শেষকৃত্যানুষ্ঠানে হাজির করা যায় ড্যামিয়েনকে, তা হলে তাকে শেষ করে দেয়ার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও যেতে পারে কর্নওয়ালিস। এবং সে-রকম কোনো সুযোগের জন্য বছরের-পর-বছর ধরে অপেক্ষা করছিল সে। আর সে-কারণেই শেষ করে দিল ডায়ানা ক্যুপারকে… উদ্দেশ্য একটাই: ড্যামিয়েনকে হাতের নাগালে পাওয়া।’
‘কথাটা আমাকে বলেছে কর্নওয়ালিস।’
দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসল হোথর্ন… এ-রকম কিছু করে বসবে সে, আশা করিনি। ‘কফিনের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল একটা মিউযিক প্লেয়ার… কর্নওয়ালিস অ্যান্ড সন্সের ভিতরের কেউ যদি না-করে থাকে কাজটা, তা হলে অন্য কারও পক্ষে সম্ভব না সেটা। কারণ কফিনটা কী রকম, সেটা জানা জরুরি ছিল ওই কাজ করার জন্য… যে বা যারাই ওই মিউযিক প্লেয়ার চালান করে দিয়েছিল কফিনের ভিতরে, তাদের হাতে ছিল মাত্র কয়েকটা সেকেন্ড। সবচেয়ে বড় কথা, ওই কফিনের কাছে যে-কোনো সময় একা থাকার একমাত্র সুযোগ ছিল কর্নওয়ালিসের। এবং এটাও জানা ছিল তার, নার্সারি রাইমটা শুনলে সেটার কী প্রভাব পড়তে পারে ড্যামিয়েনের উপর– অভিনয়ের ক্লাসে ড্যামিয়েনের কাছ থেকেই জানতে পেরেছে কথাটা। সে নিশ্চয়ই ঘাপটি মেরে ছিল ওই কবরস্থানের কোনো এক জায়গায়, নজর রাখছিল সব কিছুর উপর। তার পরিকল্পনাটা ছিল, ড্যামিয়েন যদি ফ্ল্যাটে ফিরে যায় তা হলে তাকে খুন করবে সেখানেই। পরিকল্পনাটা কাজে লেগে গেছে। শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পর আমি যখন ফোন করেছিলাম লোকটাকে, তখন হয়তো সে দাঁড়িয়ে আছে ড্যামিয়েনের টেরেসে… অপেক্ষা করছে। তারপর যখন ড্যামিয়েন এল…’ অদৃশ্য কোনো এক ছুরি বাতাসে সাঁই সাঁই করে চালাল হোথর্ন, … সুযোগমতো ঝাঁপিয়ে পড়ল পাগলটা!’
‘কিন্তু ওই ফ্ল্যাটে এত জলদি গেল কী করে সে?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘তার একটা মোটরবাইক ছিল। কেন, গ্যারেজে পার্ক করে রাখা অবস্থায় দেখেননি ওটা? মোটরসাইক্লিস্টরা যে-রকম চামড়ার-কাপড় পরে, আমার ধারণা সে-রকম কাপড় পরে ছিল সে, ফলে ড্যামিয়েনকে খুন করার সময় রক্তের ছিটা লেগে যায়নি তার শরীরে বা কাপড়ে। হত্যাকাণ্ডের পর ওই কাপড় খুলে ফেলে সে। তারপর সেগুলো হয় ফেলে দেয় নয়তো সঙ্গে করে বাসায় নিয়ে যায়। লোকটা আসলে চতুর প্রকৃতির। সেদিন যখন দেখা করতে গিয়েছিলাম তার সঙ্গে, তার স্ত্রী জানতে চেয়েছিল, সে তখনও স্যুট পরে ছিল কেন। সে তখনও স্যুট পরে ছিল, কারণ সে জানত আমরা দেখা করতে যাবো তার সঙ্গে। সে আমাদেরকে দেখাতে চেয়েছিল, স্যুটটা একেবারে পরিষ্কার… কোথাও রক্তের দাগমাত্র নেই। বলেছিল, সে নাকি ছেলের স্কুলে নাটক দেখতে গিয়েছিল। তারপর ফিরে এসেছিল বাসায়। এরপর চা খেয়েছে। যেদিন সে খুন করেছে ড্যামিয়েনকে, সেদিনই এতগুলো কাজ করেছে।’
বিছানায় শুয়ে আছি আমি, ভাবছি হোথর্নের কথাগুলো। এখন সব কিছু পরিষ্কার হয়ে আসছে আমার কাছে। তারপরও মনে হচ্ছে, কোথাও বুঝি কিছু- একটা ছুটে যাচ্ছে। জানতে চাইলাম, ‘তার মানে… ডিলের সেই ঘটনার সঙ্গে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই?’
‘না।’
‘তা হলে নাইজেল ওয়েস্টনের উপর হামলা চালিয়েছিল কে? আর… আপনিই বা কেন বলেছিলেন ওই ঘটনার জন্য দোষ আমারই?’
‘বলেছিলাম, কারণ আসলেই দোষ ছিল আপনার।’ সিগারেটের একটা প্যাকেট বের করল হোথর্ন, কিন্তু মনে পড়ে গেল হাসপাতালে আছে সে, কাজেই পকেটে ঢুকিয়ে রাখল সেটা। ‘রবার্ট কর্নওয়ালিসের সঙ্গে যেদিন প্রথমবার কথা বলেছিলাম আমরা, আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন লোকটাকে, টিমোথি গডউইনের ব্যাপারে কিছু বলেছিলেন কি না ডায়ানা ক্যুপার।’
‘এবং আমার মুখ থেকে সে-কথা শুনে রেগে গিয়েছিলেন আপনি।’
‘সেনাবাহিনীতে যেসব সৈন্য ভর্তি হয়, তারা প্রায়ই কিছু ভুলভ্রান্তি করে ফেলে; ওই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে আপনি সে-রকম একটা ভুল করেছিলেন। ভুলটা কী ছিল তা-ও বলে দিই। আপনি কর্নওয়ালিসকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ডিলে যে-দুর্ঘটনা ঘটেছিল, আমরা সেটার ব্যাপারে আগ্রহী। সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিল সে সুযোগটা, আমাদেরকে ভুল পথে ঠেলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। শুধু তা-ই না, আমার মনে হয় ‘দ্য হুইলস অন দ্য বাস গো রাউন্ড অ্যান্ড রাউন্ড’-এর ধারণাটাও ঢুকেছিল তার মাথায় তখনই। সে জানত, ওই রাইম আপসেট করে দেবে ড্যামিয়েনকে। .নাইজেল ওয়েস্টনের বাড়িতে আগুন লাগিয়েছে সে-ই, এবং আমি বলবো কাজটা করে প্রতিভার পরিচয় দিয়েছে সে। ডায়ানা ক্যুপারকে খালাস দিয়েছিলেন ওয়েস্টন। কাজেই গডউইনের দৃষ্টিভঙ্গিতে যদি বিচার করা হয়, তা হলে ওয়েস্টনও কিন্তু একজন টার্গেট। কিন্তু এই কেসে একটা কথা বার বার বলতে চেয়েছি আমি আপনাকে… দশ বছর পর কেন? দুর্ঘটনাটা যখন ঘটেছিল, চাইলে তার পরই শোধ নিতে পারতেন অ্যালান গডউইন অথবা তাঁর স্ত্রী; কিন্তু তা না-করে ন’ বছর এগারো মাস পর ফণা তুলতে হলো কেন তাঁদেরকে?’
‘আচ্ছা, বুঝতে পারলাম। এবার বলুন ওই টেক্সট মেসেজের কথা… ডায়ানা ক্যুপার যেটা পাঠিয়েছিলেন।’
ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকাল হোথর্ন। ‘চলুন ফিরে যাই প্রথম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। বলা যায় ওটা অপরিকল্পিত ছিল… অনেকটা ঝোঁকের মাথায় কাজটা করে ফেলেছিল কর্নওয়ালিস। মিসেস ক্যুপার গিয়ে হাজির হয়েছিলেন কর্নওয়ালিসের অফিসে। তাঁর বাসার ঠিকানা জানা হয়ে গিয়েছিল লোকটার। হতে পারে, মিসেস ক্যুপার যে একা থাকতেন, সেটা তিনি নিজেই জানিয়ে দিয়েছিলেন কর্নওয়ালিসকে। আবার এমনও হতে পারে, ইনফর্মেশন যা-যা লাগে সব জেনে নিয়েছিল লোকটা মিসেস ক্যুপারের কাছ থেকে। এখন একটু ভেবে দেখুন… মিসেস ক্যুপারকে খুন করতে হলে তাঁর সঙ্গে তাঁর বাসায় একা দেখা করাটা কিন্তু খুব জরুরি কর্নওয়ালিসের জন্য। এবং সেজন্য যে-কোনো ছুতো দরকার তার। এবং সেই ছুতোটা কী, তা-ও বোধহয় অনুমান করতে পেরেছি আমি… ক্রেডিট কার্ড। ওটা ভুলে কর্নওয়ালিসের অফিসে ফেলে এসেছিলেন মিসেস ক্যুপার। আমার ধারণা, ওই জিনিস ফিরিয়ে দেয়ার বাহানাতেই ওই মহিলার বাসায় গিয়ে ঢোকে লোকটা।
‘আপনার মনে আছে হয়তো… মিসেস ক্যুপারের লিভিংরুমে সাইডবোর্ডের উপর পাওয়া গিয়েছিল তাঁর ক্রেডিট কার্ডটা। ওই জিনিস কেন এবং কী-করে গেল সেখানে, ভাবছিলাম আমি এই কেসের শুরু থেকে। আচ্ছা… আগে আরেকটা কথা বলি… কর্নওয়ালিস যেদিন খুন করেছে মিসেস ক্যুপারকে, সেদিন যে সে দুপুর দুটোর দিকে ফোন করেছিল ওই মহিলাকে, জানি আমরা। তখন গ্লোব থিয়েটারে ছিলেন মিসেস ক্যুপার। তাঁকে কেন ফোন করেছিল কর্নওয়ালিস, জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি তাকে। জবাবে বানোয়াট একটা কথা শুনিয়ে দিয়েছে সে… যেখানে দাফন করা হয়েছে মিস্টার ক্যুপারকে, সে-জায়গার প্লট নাম্বার কত, সেটা নাকি জানা দরকার ছিল তার। আপনিই বলুন, ওই তথ্য জেনে কী করবে লোকটা? আর যদি কিছু করার ছিলই, তা হলে চ্যাপেল অফিসে ফোন করে জেনে নিল না কেন? তখনই বুঝে গিয়েছিলাম, আমাদের সঙ্গে আসলে মিথ্যা কথা বলছে সে। কেন ফোন করেছিল সে মিসেস ক্যুপারকে, তা-ও অনুমান করে নিয়েছি… বলেছিল, মিসেস ক্যুপার তাঁর ক্রেডিট কার্ডটা ভুলে ফেলে গেছেন, তিনি যদি রাজি থাকেন তা হলে তাঁর বাসায় হাজির হয়ে কার্ডটা ফিরিয়ে দিতে পারবে কর্নওয়ালিস।
‘সুতরাং সেদিন সন্ধ্যায় শয়তানটা ঠিক ঠিকই হাজির হয়ে গেল মিসেস ক্যুপারের বাসায়। ততক্ষণে অন্ধকার ঘনাতে শুরু করেছে বাইরে। বাসায় মিসেস ক্যুপার সম্পূর্ণ একা। কর্নওয়ালিসকে ভিতরে ঢুকতে দিলেন তিনি। কার্ডটা লিভিংরুমের সাইডবোর্ডের উপর নামিয়ে রাখল শয়তানটা। তারপর এটা-সেটা নিয়ে কথা বলতে লাগল মিসেস ক্যুপারের সঙ্গে… কালক্ষেপণ করতে চাইছিল আসলে, সুযোগ খুঁজছিল। এবং তখন, হঠাৎ করেই, রবার্ট কর্নওয়ালিসকে চিনে ফেলেন মিসেস ক্যুপার। বুঝতে পারেন, লোকটাকে আগেও কোথাও দেখেছেন। কোথায় দেখেছেন তা-ও মনে পড়ে যায় তাঁর… রাডায়। কর্নওয়ালিসের কথায় তখন গা ছমছম করে ওঠে তাঁর, ঘাবড়ে যান তিনি। বুঝতে পারেন, তাঁর ক্ষতি করার উদ্দেশ্য নিয়েই হাজির হয়েছে লোকটা।
‘তখন কী করার ছিল মিসেস ক্যুপারের? যদি অ্যালার্ম বাজিয়ে দিতেন, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে আক্রমণ করত কর্নওয়ালিস। লোকটা যে আসলে খেপাটে, সেটা হয়তো বোঝা হয়ে গিয়েছিল তাঁর। তাই তিনি ড্রিঙ্ক অফার করলেন কর্নওয়ালিসকে। কর্নওয়ালিস তখন পানি খেতে চাইল। কিচেনে গিয়ে ঢুকলেন মিসেস ক্যুপার, সঙ্গে সঙ্গে পর্দা বাঁধার দড়ি আলগা করে নিল শয়তানটা। পানি নিয়ে ফিরে আসার আগে ছেলের উদ্দেশে একটা টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে দিলেন ডায়ানা ক্যুপার।’
একটু থামল হোথর্ন, সে বাকি কথা বলার আগেই বুঝে গেলাম কী বলতে চলেছে। ‘টেক্সট মেসেজটা অটো কারেক্ট করে নিয়েছিল মিসেস ক্যুপারের মোবাইল ফোন!’
‘ঠিক। মিসেস ক্যুপার আসলে লিখতে চেয়েছিলেন, I have seen the boy who was Laertes and I’m afraid। আসলে রাডায় থাকতে নিজের জন্য যে-নাম বেছে নিয়েছিল কর্নওয়াসিল… মানে, ড্যান রবার্টস, সেটা মনে করতে পারছিলেন না মিসেস ক্যুপার। কিন্তু তিনি চাইছিলেন, তাঁর লিভিংরুমে হাজির হয়েছিল কে, সেটা ড্যামিয়েনকে জানাতে। খুব দ্রুত টেক্সট করছিলেন তিনি… নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন আসলে। এমনকী বাক্যের শেষে ফুলস্টপ দেয়ার মতো সময়ও পাননি।
‘আর সে-কারণেই খেয়াল করেননি, তাঁর মোবাইলের অটো কারেক্ট অপশন সংশোধন করে নিয়েছে তাঁর টেক্সট মেসেজটা … I have seen the boy who was lacerated। যে-বাক্যের সোজাসাপ্টা অর্থ: ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া ছেলেটাকে দেখেছি আমি। ডিলের সেই দুর্ঘটনায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল জেরেমি গডউইন… কিন্তু তার দেখা কিছুতেই পেতে পারেন না মিসেস ক্যুপার। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে… মিসেস ক্যুপার কিন্তু তখন সাংঘাতিক তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিলেন। কাজেই I have seen the boy who was lacerated… এত কথা লেখার মতো সময় পাওয়ার কথা না তাঁর। বরং তিনি যদি লিখতেন The boy who was injuredঅথবা যদি লিখতেন The boy who was hurt তা হলে কিন্তু নয়টি অক্ষরের বদলে সাতটি বা মাত্র চারটি অক্ষর লিখতে হতো তাঁকে। সেই অটো কারেকশনের কারণে ধোঁকা খেয়ে গিয়েছিলাম আমরা।
‘যা-হোক, টেক্সট মেসেজটা পাঠানোর পর লিভিংরুমে গিয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার, সঙ্গে ছিল পানির গ্লাসটা। হয়তো পানি খাওয়া শেষ হলে কর্নওয়ালিসকে চলে যেতে বলতেন তিনি তাঁর বাসা থেকে। কিন্তু তাঁকে সে-সুযোগ দেয়নি কর্নওয়ালিস… খুব দ্রুত ছোবল হেনেছে। পানির গ্লাসটা মাত্র নামিয়ে রেখেছেন মিসেস ক্যুপার, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গলায় ফাঁস এঁটে দিয়েছে লোকটা, মুহূর্তের মধ্যেই শ্বাসরোধ করে দিয়েছে তাঁর। যখন বুঝতে পেরেছে মরে গেছেন মিসেস ক্যুপার, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর লাশটা ফেলে রেখে ঘুরে বেরিয়েছে বাসার ভিতরে এদিকে-সেদিকে, এটা-সেটা তছনছ করেছে, কিছু জিনিস আবার সঙ্গে করে নিয়েও গেছে… বোঝাতে চেয়েছে কোনো একটা চোর ঢুকেছিল ওই বাড়িতে। তারপর ওই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে সে। এবং চলে যাওয়ার আগে খুব দক্ষতার সঙ্গে মুছে ফেলেছে নিজের সমস্ত ফিঙ্গারপ্রিন্ট।’
হাসপাতাল আসলে অদ্ভুত একটা জায়গা। চ্যারিং ক্রসে যখন নিয়ে আসা হলো আমাকে, পুরো জায়গাটা ছিল আলো ঝলমলে, ব্যস্ত আর কোলাহলে পূর্ণ। কিন্তু হঠাৎ করেই, বিশেষ করে ভিযিটিং আওয়ারের পর, সব কিছু যেন থমকে গেছে… কেউ যেন হুট করেই চাপ দিয়েছে কোনো একটা সুইচে। নিভিয়ে দেয়া হয়েছে বেশিরভাগ লাইট। নীরব হয়ে গেছে করিডরগুলো। একরকমের স্তব্ধতা বিরাজ করছে এখন পুরো হাসপাতালে… অস্বস্তি লাগছে আমার। একইসঙ্গে ক্লান্তিও অনুভব করছি। সেলাই দেয়া হয়েছে যেসব জায়গায়, সেগুলো ব্যথা করছে। হাত- পা নাড়াতে পারছি, কিন্তু সে-রকম কোনো কাজ করতে ইচ্ছা করছে না কেন যেন। একরকমের অসাড়তা পেয়ে বসছে আমাকে… মানসিক যে-ধাক্কা খেয়েছি, হতে পারে সে-কারণেই হচ্ছে এ-রকম।
হোথর্ন বুঝতে পারল, চলে যাওয়ার সময় হয়েছে।
জানতে চাইল, ‘আপনাকে আর ক’দিন রাখা হবে এখানে?’
‘বলেছে আগামীকাল নাকি বাসায় যেতে পারবো।’
মাথা ঝাঁকাল হোথর্ন। ‘আপনার কপাল ভালো… সময়মতো হাজির হতে পেরেছিলাম আমি।’
‘ওখানে যে যেতে হবে, জানলেন কী করে?’
‘আপনার খোঁজ পাওয়ার জন্য ফোন করেছিলাম আপনার অ্যাসিস্টেন্টকে। কোথায় গেছেন আপনি, সেটা জানিয়ে দিল সে আমাকে। কথাটা শুনে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। দুশ্চিন্তা হচ্ছিল আপনাকে নিয়ে।’
‘ধন্যবাদ।’
‘হাজার হোক যদি কিছু হয়ে যেত আপনার, তা হলে বইটা লিখত কে?’ দেখে মনে হচ্ছে, হঠাৎ করেই যেন অপ্রতিভ হয়ে গেছে হোথর্ন। ‘দেখুন… একটা কথা বলি আপনাকে… সেদিন আপনার সঙ্গে মিথ্যা বলেছিলাম আমি।’
‘কবে?’
‘ক্যান্টেব্রিতে। মুখের উপর আমার সমালোচনা করছিলেন আপনি, আর আমিও খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম আপনাকে নিয়ে। তাই বলেছিলাম, এই বইয়ের ব্যাপারে কথা বলেছি অন্য লেখকদের সঙ্গে। আসলে… আপনি ছাড়া আর কারও কাছে যাইনি আমি এই বইয়ের ব্যাপারে।’
লম্বা নীরবতা।
কী বলবো, জানি না আসলে।
‘ধন্যবাদ,’ বিড়বিড় করে বললাম শেষপর্যন্ত।
উঠে দাঁড়াল হোথর্ন। ‘আপনার সেই এজেন্টের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাকে পছন্দ হয়েছে আমার। সে বলেছে, সে নাকি আমাদের জন্য মোটা অঙ্কের অগ্রীম- টাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে।’ হাসল। ‘আর কিছু হোক না-হোক, অন্তত লেখালেখি করার মতো কিছু-একটা পেয়ে গেলেন আপনি। আমার মনে হয় ভালোই হবে ব্যাপারটা।
চলে গেল সে।
শুয়ে আছি আমি। এইমাত্র যা বলে গেল হোথর্ন, ভাবছি সেটা।
ভালোই হবে ব্যাপারটা।
ঠিকই বলেছে সে।
সম্ভবত এই প্রথমবারের মতো সে-রকম কোনো সুযোগ দেখা দিয়েছে।
২৪. রিভার কোর্ট
বাসায় ফিরে এসেছি আমি। কাজ শুরু করে দিয়েছি।
খেয়াল করছি, কাজের যে-পদ্ধতি এবার অনুসরণ করতে হচ্ছে আমাকে, সেটা, সব সময় যেভাবে কাজ করি তার চেয়ে অনেক আলাদা। সাধারণত আমার মাথায় যখন কোনো বইয়ের চিন্তা ঢোকে, ওটা মাথায় নিয়েই বছরখানেক সময় পার করে দিই, তারপর ধীরেসুস্থে লিখতে বসি। কাহিনিটা যদি কোনো হত্যারহস্য হয়, তা হলে স্টার্টিং পয়েন্টটা হয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটাই। কেউ একজন অন্য কোনো একজনকে কোনো একটা কারণে খুন করে ফেলল। এরপর চরিত্রগুলো তৈরি করি আমি, তৈরি করি তাদের আশপাশের জগৎটা। বিভিন্ন সন্দেহভাজনের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করি। অতীতে তাদের সঙ্গে ঘটে গেছে এ-রকম কিছু বিশেষ ঘটনা উল্লেখ করি। তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করি। বাইরে যখন হাঁটতে যাই, ওই চরিত্রগুলো নিয়ে ভাবি… বিছানায় যখন শুয়ে থাকি, তখনও একই কাজ করি। এমনকী যখন বসে থাকি বাথরুমে, তখনও। মোদ্দা কথা হচ্ছে, পুরো কাহিনিটা যতক্ষণ-পর্যন্ত-না ভালো একটা আকৃতি লাভ করে আমার মাথার ভিতরে, ততক্ষণ পর্যন্ত লিখতে শুরু করি না। বই নিয়ে আলোচনা-অনুষ্ঠানে প্রায়ই একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয় আমাকে… শেষটা কী হবে তা না-জেনেই কোনো উপন্যাস লিখতে শুরু করি কি না আমি। না, সে-রকম কিছু করি না, কারণ আমার দৃষ্টিতে সে-রকম কোনো কাজের মানে হচ্ছে এমন কোনো ব্রিজ বানানো, যেটা শেষপর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা জানা থাকে না।
কিন্তু এবার আর ভাবাভাবির কিছু নেই আমার। কারণ এবার মালমশলা বলতে যা-কিছু আছে, সব আগেই দিয়ে দেয়া হয়েছে আমাকে। কাজেই বিশেষ এই বই লেখার ব্যাপারটা এখন আমার জন্য যতটা না সৃষ্টিনৈপুণ্যের, তার চেয়ে বেশি কাহিনিটাকে একটা উপযুক্ত কাঠামো দেয়ার। আরও বড় কথা হচ্ছে, এই কাহিনির কোনো কোনো মালমশলা নিয়ে আমি মোটেও খুশি না। সত্যি বলতে কী, ধান্দাবাজ কোনো হলিউড-অভিনেতাকে নিয়ে কিছু লিখতে চাইনি আমি। কারণ হলিউডের অনেকের সঙ্গে পরিচয় আছে আমার, তাদের কারও কারও সঙ্গে কাজও করেছি। আবার রেমন্ড কুন্স, ব্রুনো ওয়াং, ডক্টর বাটিমোর-সহ আরও অনেকে এই কাহিনিতে তেমন কোনো ভূমিকাই পালন করেননি। তাঁদের সঙ্গে কথা বলার দরকার ছিল বলে তাঁদের কাছে গেছে হোথর্ন, কিন্তু শেষপর্যন্ত তাঁদের ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে।
একটা প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আমার মনের ভিতরে… সত্যির কতখানি কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবো? জানি কিছু কিছু নাম বদল করতে হবে আমাকে… কাজেই কোনো কোনো ঘটনাও যদি বদল করে দিই, অসুবিধা কী?
নিজের নোট আর আইফোনের রেকর্ড ঘেঁটে দেখলাম, আসলে পুরোপুরি ভোঁতা না আমি। রবার্ট কর্নওয়ালিসের সঙ্গে যখন প্রথমবার দেখা হয়েছিল তখন একজায়গায় লিখেছিলাম ‘এই কেসে এই লোকের কোনো ভূমিকা থাকতেও পারে’… সঠিক প্রমাণিত হয়েছে আমার অনুমান। গোরখোদকারির কাজটা তার ভালো লাগত কি না সেটা জানতে চেয়েছিলাম আমি তার কাছে, শেষপর্যন্ত ওই প্রশ্নের জবাবই পরিণত হলো হত্যাকাণ্ডের মোটিভে। তার মানে খুব একটা খারাপ কাজ দেখাইনি আমি এই কেসে। কর্নওয়ালিসের গ্যারেজে একটা মোটরবাইক পার্ক করে রাখা ছিল, উল্লেখ করেছি সেটাও। হলে রাখা ছিল তার মোটরবাইকের হেলমেট… টুকে নিয়েছি সে-কথাও। ফ্রিজের ম্যাগনেট, পানিভর্তি গ্লাস, কী-হোল্ডার… নাহ্, মোটামুটি পঁচাত্তর শতাংশ ক্লু-ই আমি টুকে নিয়েছি আমার নোটবুকে। তবে মুশকিলটা হচ্ছে, এসব কুর গুরুত্ব বুঝতে পারিনি সময়মতো।
পরের দুই দিনে লিখে ফেললাম বইয়ের প্রথম দুই অধ্যায়। খেয়াল করলাম, হোথর্ন নিজেই বড় একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার লেখায়। সে দেখতে কেমন অথবা কীভাবে কথা বলে সেসব তেমন কোনো কঠিন ব্যাপার না, কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, ওর ব্যাপারে ঠিক কতখানি জানি নামি?
- স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে ওর। তখন গ্র্যান্টস হিলে থাকত ওরা।
- এগারো বছর বয়সী একটা ছেলে আছে হোথর্নের।
- এককথায় বলতে গেলে, গোয়েন্দা হিসেবে হোথর্ন দুর্দান্ত। এই ব্যাপারে স্বতঃস্ফূর্ত কিছু-একটা আছে ওর ভিতরে। কিন্তু একইসঙ্গে এই কথাও ঠিক, কোথাও কোনো জনপ্রিয়তা নেই ওর।
- মদ একেবারেই খায় না সে।
- পুলিশের মার্ডার স্কোয়াড থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে ওকে। অভিযোগ ছিল, কুখ্যাত এক যৌন-নিপীড়নকারীকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল সে সিঁড়ি থেকে।
- সমকাম নিয়ে কোনো একজাতের ভীতি কাজ করে ওর মনে সম্ভবত।
- একটা রিডিং গ্রুপের সদস্য সে।
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমলের যুদ্ধবিমান সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে ওর।
- থেমস নদীর ধারে বিলাসবহুল আর দামি একটা জায়গার একটা ফ্ল্যাটে থাকে সে।
নাহ্, যথেষ্ট না। যখনই দেখা হয়েছে ওর সঙ্গে, যখনই ওর সঙ্গে কোথাও গিয়েছি, হাতে যে-কাজ ছিল সেটা ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলার তেমন কোনো সুযোগই পাইনি। একসঙ্গে ড্রিঙ্ক করিনি আমরা। হ্যাঁরো-অন-দ্য-হিলের সেই ক্যাফের ব্রেকফাস্টের কথা বাদ দিয়ে বললে কোথাও একসঙ্গে কিছু খাইনি। আমার সঙ্গে কখনও ভালো ব্যবহার করেনি সে… অবশ্য হাসপাতালে যে দেখা করতে গিয়েছিল, সে-কথা আলাদা। সে কোথায় এবং কীভাবে থাকে সেটাই যদি জানা না-থাকে আমার, তা হলে ওকে নিয়ে কীভাবে লিখবো? বসতবাড়ি আমাদের ব্যক্তিত্বের প্রথম এবং সবচেয়ে স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি, কিন্তু এখন পর্যন্ত নিজের বাসায় আমাকে দাওয়াত করেনি হোথর্ন।
টেলিফোন করবো কি না হোথর্নকে, ভাবলাম। ঠিক তখনই একটা চিন্তা খেলে গেল আমার মাথায়। হোথর্নের সেই রিভার কোর্টের ঠিকানাটা আমাকে দিয়েছিল মিডোস। কাজেই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার সপ্তাহখানেক পর, একদিন বিকেলে, ইনডেক্স কার্ড-দলা পাকানো কাগজ-পোস্ট ইট নোট ইত্যাদি সব ডেস্কের উপর ফেলে বেরিয়ে পড়লাম আমি।
দিনটা মনোরম। শার্টের নিচে একটু টান লাগছে আমার সেলাইয়ের জায়গাগুলোয়, তারপরও বাসন্তি উষ্ণ বাতাসে হাঁটতে ভালো লাগছে। ফ্যারিংডন রোড ধরে পৌঁছে গেলাম ব্ল্যাকফ্লায়ার্স ব্রিজের কাছে। আমার সামনে এখন নদীটা, ওই পাড়ে সারি সারি ফ্ল্যাট। বিলাসবহুল এই জায়গায় হোথর্নের মতো একজন মানুষ কী করে থাকে, ভাবতে গিয়ে আশ্চর্য না-হয়ে পারলাম না আরও একবার। এখানে থাকার মতো টাকা পায় কোত্থেকে সে?
যে-বিল্ডিঙে থাকে হোথর্ন, সেটার নাম আমাকে জানিয়েছে মিডোস, কিন্তু ফ্ল্যাটের নম্বরটা বলেনি। জায়গামতো পৌঁছে দেখলাম, খোলা একটা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন কুলি। এগিয়ে গেলাম তার দিকে। বুদ্ধি করে সঙ্গে করে একটা খাম নিয়ে এসেছি, ওটা বের করলাম পকেট থেকে
বললাম, ‘ড্যানিয়েল হোথর্ন নামের এক ভদ্রলোকের জন্য একটা চিঠি আছে আমার কাছে। চিঠিটা যে পৌঁছে দেয়া হবে তাঁর কাছে সেটা জানেন তিনি। কিন্তু চাপ দিলাম তাঁর ডোরবেলে, অথচ ভিতর থেকে সাড়া দিল না কেউ।’
কুলি লোকটা বয়স্ক, রোদে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে… মনে হয় উপভোগ করছে ব্যাপারটা। ‘হোথর্ন?’ খুঁতনি চুলকাল সে। ‘তিনি তো থাকেন পেন্টহাউসে। ভুল জায়গায় ডোরবেল বাজিয়েছেন আপনি।’
পেন্টহাউস?
উত্তরোত্তর আশ্চর্য হচ্ছি আমি।
এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে, কিন্তু এবার আর বেল বাজালাম না। কারণ আমি চাই না আমাকে ভিতরে ঢুকতে না-দেয়ার মতো কোনো অজুহাত খুঁজে পাক সে। টানা বিশ মিনিট অপেক্ষা করলাম দরজার বাইরে, তারপর ভিতর থেকে বেরিয়ে এল সেখানকার একজন বাসিন্দা। ঠিক তখন ভিতরে পা রাখলাম আমি, পকেট থেকে একগোছা চাবি বের করে সেগুলো হাতড়াচ্ছি… এমন ভান করছি যেন ওই দরজা খুলে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছিলাম আমি নিজেই। আমার দিকে দ্বিতীয়বার তাকানোর প্রয়োজন বোধ করল না ওই বাসিন্দা।
লিফট ধরে পৌঁছে গেলাম টপ ফ্লোরে। তিনটা দরজা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমার মন বলছে, যে-ফ্ল্যাট থেকে নদী দেখা যায় সেটাতেই থাকে হোথৰ্ন। এগিয়ে গিয়ে চাপ দিলাম ডোরবেলে।
লম্বা নীরবতা।
বিরক্ত হয়ে ভাবছি হোথর্ন হয়তো বাইরে গেছে, এমন সময় খুলে গেল দরজাটা।
গোবরাটে দাঁড়িয়ে আছে হোথর্ন স্বয়ং।
পুরোপুরি হতবুদ্ধি হয়ে গেছে সে। সব সময় যে-স্যুট পরে, সেটাই পরে আছে, তবে কোটটা খুলে রেখেছে। হাতা গুটিয়ে রেখেছে শার্টের। আঙুলে ধূসর রঙ লেগে আছে।
‘টনি!’ চেঁচিয়ে উঠল সে। ‘আমাকে খুঁজে বের করলেন কী করে?’
‘আমারও নিজস্ব কিছু কায়দাকানুন আছে,’ ডাঁটের সঙ্গে বললাম আমি।
‘কায়দাকানুন না ছাই! মিডোসের সঙ্গে দেখা করেছেন আসলে। ঠিকানাটা তিনিই দিয়েছেন আপনাকে।’ চিন্তিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে হোথর্ন। ‘নিচের গেটের বেল বাজাননি আপনি। ‘
‘ভেবেছিলাম চমকে দেবো আপনাকে।’
‘দরকার ছিল না। কারণ আপনাকে এমনিতেই নিমন্ত্রণ জানাতাম আমার এখানে। কিন্তু… এখন তো একটা কাজে একটু বাইরে যেতে হবে আমাকে।’
‘ঠিক আছে, যাবেন, বেশি সময় নেবো না আমি।’
আমার আর হোথর্নের মধ্যে যেন কোনো চালমাত অবস্থা হয়েছে… দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াচ্ছে না হোথর্ন, আমিও চলে যেতে চাইছি না।
‘বইটার ব্যাপারে কথা বলতে চাইছি আপনার সঙ্গে,’ বললাম আমি।
মনস্থির করতে আরও কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল হোথর্নের। তারপর সরে দাঁড়াল, পুরোপুরি খুলে দিল দরজাটা। ‘ভিতরে আসুন!’ এমনভাবে বলল, যেন এতক্ষণে খুশি হয়েছে আমাকে দেখে।
হোথর্নের ফ্ল্যাটটা বেশ বড়… দুই হাজার বর্গফুটের মতো। মেইন রুমগুলো ভেঙে বেশ বড় একটা লিভিংরুম তৈরি করা হয়েছে। রান্নাঘর আর স্টাডিরুমে যাওয়ার আলাদা আলাদা দরজা আছে। জানালা দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি নদীটা। ফ্ল্যাটের ছাদ খুবই নিচু, জানালাগুলোও সরু সরু। কেমন একটা ধূসর ভাব আছে আশপাশের সব কিছুতে। পায়ের নিচের কার্পেটটা একেবারে নতুন। লিভিংরুমের কোনো দেয়ালেই ঝুলছে না কোনো পেইন্টিং। বলতে গেলে কোথাও কোনো আসবাব নেই… শুধু আছে একটা সোফা, একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার। আর আছে দুটো শেল্ফ। স্টাডিরুমের ডেস্কে একটা না, বরং দু’- দুটো কম্পিউটার দেখা যাচ্ছে। সেগুলোর সঙ্গে তারের জটের মাধ্যমে যুক্ত আছে কিছু হার্ডওয়্যার।
একধারের একটা টেবিলের উপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু বই। আলবেয়ার কামু’র দ্য আউটসাইডার নজরে পড়ল সবার আগে। বইগুলোর পাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে কিছু ম্যাগাযিন… সংখ্যায় পঞ্চাশের মতো হবে… এয়ারফিক্স মডেল ওয়ার্ল্ড, মডেল ইঞ্জিনিয়ার, মেরিন মডেলিং ইন্টারন্যাশনাল। তার মানে ঐতিহাসিক জিনিসপত্রে হোথর্নের যতটা না আগ্রহ, তার চেয়ে বেশি আগ্রহ ওসব জিনিস বানানোতে। এদিক-ওদিক তাকানোমাত্র বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা। ডজন ডজন প্লেন, ট্রেন, নৌকা, ট্যাঙ্ক, জিপ দেখতে পাচ্ছি। সেগুলোর কোনোটা ঠাঁই পেয়েছে শেল্ফে, কোনোটা আবার নিথর দাঁড়িয়ে আছে কার্পেটের উপর। কোনোটা ঝুলছে তার থেকে, কোনোটা আবার অর্ধেক বানিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে টেবিলের উপর। আমি যখন বেল বাজালাম, তখন একটা ব্যাটলট্যাঙ্ক জোড়া লাগাচ্ছিল হোথর্ন। হয়তো সে-কারণেই দরজা খুলতে দেরি হয়েছিল ওর।
আমি যে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি এসব, খেয়াল করল হোথর্ন। বলল, ‘এসব আমার শখ।’
‘মডেল মেকিং।’
‘হুঁ।’ একটা চেয়ারের পিঠের উপর দেখতে পাচ্ছি হোথর্নের কোটটা। কাজ করার আগে ওটা খুলে রেখেছিল সে। তুলে নিয়ে জিনিসটা গায়ে দিল।
হোথর্নের শখ পুরোপুরি অন্যরকম। যা-যা বানিয়েছে সে, নিখুঁতভাবে বানিয়েছে। খুব যত্ন নিয়ে বানিয়েছে, সাংঘাতিক ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছে। প্রতিটা জিনিস বানানোর পর চমৎকারভাবে রঙ করেছে সবগুলো। এই কাজের পেছনে শত শত ঘণ্টা পার করে দিয়েছে।
কম্পিউটার দেখতে পেয়েছি ওর ফ্ল্যাটে, কিন্তু কোথাও কোনো টেলিভিশন দেখতে পাচ্ছি না।
‘এটা কী?’ বিশেষ একটা ট্যাঙ্ক মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে আমার।
‘চিফটিয়ান ট্যাঙ্ক… ব্রিটিশ। ষাটের দশকে নেটো-তে সরবরাহ করা হয়েছিল এসব ট্যাঙ্ক।’
‘জটিল ব্যাপারস্যাপার। কতদিন ধরে করছেন এসব?’
দ্বিধা ফুটল হোথর্নের চেহারায়। এখনও নিজের ব্যাপারে কিছু বলতে চায় না আমাকে। এখনও গুটিয়ে রাখতে চায় নিজেকে। কিন্তু শেষপর্যন্ত মুখ খুলল। ‘অনেক বছর। ছোটবেলা থেকেই এসব আমার শখ।’
‘ভাই-বোন কেউ ছিল আপনার?’
‘একটা সৎ ভাই ছিল। জমি আর বাড়ির দালাল হিসেবে কাজ করছে সে এখন।’
তার মানে কোত্থেকে এই ফ্ল্যাটের সন্ধান পেল হোথর্ন, বোঝা গেল। বললাম, ‘তা হলে এই ফ্ল্যাটেই থাকেন আপনি।’
‘আপাতত। মানে… পাকাপাকি কোনো কিছু না।’
‘কী বলতে চাইছেন? আপনি এই ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার?’
‘এই ফ্ল্যাটের বর্তমান মালিক থাকে সিঙ্গাপুরে। এখানে কখনও থাকেনি তারা। তবে তারা চায়, এখানে যেন কেউ থাকে… যেন একেবারে খালি পড়ে না- থাকে এই ফ্ল্যাট।
‘তার মানে আপনার সৎ ভাই এই জায়গার সন্ধান দিয়েছে আপনাকে?’
‘ঠিক।’ টেবিলের উপর এক প্যাকেট সিগারেট আছে, ছোঁ মেরে ওটা তুলে নিল হোথর্ন। কিন্তু খেয়াল করলাম, ঘরের ভিতরে কোথাও সিগারেটের গন্ধ নেই। তার মানে যখন ধোঁয়া গেলে, ফ্ল্যাটের বাইরে গিয়ে করে কাজটা। ‘আপনি বলেছিলেন বইটার ব্যাপারে কী যেন কথা আছে।’
‘আমার মনে হয় উপযুক্ত একটা নাম পেয়ে গেছি আমি এই বইয়ের।
‘কেন? ‘হোথর্ন ইনভেস্টিগেটস’ কী সমস্যা করল?’
‘ওই নাম নিয়ে ইতোমধ্যে আলোচনা হয়েছে আমাদের মধ্যে।’
‘তা হলে?’
‘আজ সকালে আমার নোটগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম। আপনার সঙ্গে যখন প্রথমবার দেখা হলো… মানে, ক্লার্কেনওয়েলের কথা বলছি… আপনি যখন বইটা লেখার কথা বললেন আমাকে, সেদিন একটা কথা বলেছিলেন… দ্য ওয়ার্ড ইয মার্ডার ‘
‘তো?’
‘আমার ধারণা দ্য ওয়ার্ড ইয মার্ডার-ই এই বইয়ের সবচেয়ে ভালো নাম হতে পারে। যত যা-ই হোক আমি একজন লেখক, আর আপনি একজন গোয়েন্দা। কাজেই ….
কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল হোথর্ন, তারপর কাঁধ ঝাঁকাল অনিশ্চিত ভঙ্গিতে। ‘ঠিক আছে, কাজ চলে যাবে মনে হচ্ছে।’
‘আপনি মনে হয় খুব একটা আশ্বস্ত হননি আমার কথায়।’
‘আসলে… নামটা আহামরি কিছু-একটা মনে হচ্ছে না আমার। আর এই বইও এমন কিছু না, যেটা নিয়ে সাগরসৈকতে গিয়ে আরাম করে শুয়ে পড়া যাবে।
‘আপনি কি এই জীবনে কখনও সাগরসৈকতে গেছেন?’
জবাব দিল না হোথর্ন।
বইয়ের স্তূপগুলো দেখিয়ে দিলাম আমি ইঙ্গিতে। ‘দ্য আউটসাইডার কেমন লাগছে?’
‘শেষ করেছি। শেষটা বেশ ভালো লেগেছে। কীভাবে লিখতে হয়, জানতেন আলবেয়ার কামু।’
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি আমরা দু’জন। এখানে এসে কোনো ভুল করেছি কি না, ভাবছি। যা জানা দরকার ছিল আমার, এখানে এসে সেটা জানা হয়ে গেছে। কিন্তু একইসঙ্গে অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি হচ্ছে… বিশ্বাস ভেঙেছি আমি, হোথর্নের অজান্তে গিয়ে হাজির হয়েছি মিডোসের কাছে, ওর অনুমতি না-নিয়েই উপস্থিত হয়ে গেছি এখানে।
বললাম, ‘আগামী সপ্তাহে একসঙ্গে ডিনার করলে কেমন হয়? ততদিনে আপনাকে দেখানোর মতো দুটো চ্যাপ্টার লেখা হয়ে যাবে আমার হয়তো।’
মাথা ঝাঁকাল হোথর্ন। ‘হয়তো।’
দেখা হবে তা হলে।
আমাদের সেদিনের সেই সাক্ষাৎ শেষ হয়ে যেতে পারত এখানেই। মনে একটা অনুশোচনাবোধ নিয়ে হয়তো চলে আসতাম আমি। কিন্তু চলে আসার উদ্দেশ্যে যেইমাত্র ঘুরেছি, একটা শেল্ফের উপর রাখা ফ্রেমে বাঁধাই একটা ছবিতে দৃষ্টি আটকে গেল আমার।
রূপালি চুলের এক মহিলাকে দেখা যাচ্ছে ওই ছবিতে। ছোট একটা ছেলের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে সে। কাউকে বলে দিতে হলো না… সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম, ওটা হোথর্নের স্ত্রী আর ওর ছেলের ছবি।
স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, তারপরও এই ছবি রেখে দিয়েছে হোথর্ন। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় টের পেলাম, ছবির ওই মহিলাকে চিনি আমি। আগে কোথাও দেখেছি আমি তাকে।
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল কোথায় দেখেছি আমি ওই মহিলাকে।
‘বেজন্মা কোথাকার!’ চেঁচিয়ে উঠলাম হোথর্নের উদ্দেশে।
‘কী?’
‘ওই ছবি আপনার স্ত্রীর?’
‘হ্যাঁ।’
‘তার সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার।
‘না… মনে হয় না।’
‘হে-অন-ওয়াই… সব মনে পড়ে গেছে আমার, ‘সাহিত্য বিষয়ক একটা উৎসব চলছিল সেখানে। আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার দু’দিন পর। আমার উপর গুরুতর অভিযোগ এনেছিল ওই মহিলা… বলেছিল, আমার বেশিরভাগ বইয়ের কাহিনি নাকি অবাস্তব আর অপ্রাসঙ্গিক। তার সেই কথা শুনেই আমি…’ থেমে গেলাম। ‘আপনি ইচ্ছাকৃতভাবে আপনার স্ত্রীকে লাগিয়েছিলেন আমার পেছনে!’
‘আপনি এসব কী বলছেন, কিছুই বুঝতে পারছি না।’
শিশুসুলভ নিষ্পাপ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে হোথর্ন, কিন্তু এসবে গলছি না আমি। একটা লোক এত সহজে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানাল কী করে আমাকে?
মিসেস ডায়ানা ক্যুপার তাঁর স্বামীর ছবি রেখেছিলেন নিজের কাছে। হোথর্ন নিজে আমাকে বলেছে, ওই দু’জনের মধ্যে যদি ছাড়াছাড়িই হয়ে যাবে, তা হলে স্বামীর ছবি নিজের কাছে কেন রাখবেন মিসেস ক্যুপার?
হোথর্ন আর তার স্ত্রীর মধ্যেও যদি ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়ে থাকবে, তা হলে ওই মহিলার ছবি কেন নিজের কাছে রাখবে সে? তার মানে আমাকে মিথ্যা কথা বলেছে সে।
মাথায় রক্ত উঠে গেল আমার। ‘মিথ্যা কথা বলবেন না আমার সঙ্গে!’ চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘আপনিই পাঠিয়েছিলেন আপনার স্ত্রীকে। কী করতে যাচ্ছিলেন আপনি, সে-ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা ছিল আপনার।’
‘টনি…’
‘ওটা আমার নাম না! আমি অ্যান্টনি। কেউ আমাকে টনি বলে ডাকে না। ..বই লিখবো, না? পুরো ব্যাপারটা ভুলে যেতে পারেন আপনি। আইডিয়াটা সাংঘাতিক খারাপ ছিল, আরেকটু হলে মরতে বসেছিলাম আমি। আপনার কথা শোনাটাই উচিত হয়নি আমার। এই বই লিখবো না আমি!’
ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এলাম।
লিফটের কাছেও গেলাম না। সিঁড়ি বেয়ে নামলাম বারো তলা থেকে এক তলায়। তারপর হাজির হলাম তাজা বাতাসে। ব্ল্যাকফ্লায়ার্স ব্রিজ অর্ধেক পার হওয়ার আগে থামলাম না।
পকেট থেকে বের করলাম আমার মোবাইল ফোনটা।
আমার এজেন্টকে ফোন করবো এখন। বলবো, চুক্তি শেষ। এখনও ওরিয়ন বুকসের জন্য দুটো বই লেখার কথা আছে আমার, জানিয়ে দেবো সে-দুটোর কাজ শুরু করতে যাচ্ছি আমি। ফয়েল’স ওয়ারের নতুন একটা সিরিযও আছে আমার হাতে। মোদ্দাকথা কাজের কোনো অভাব নেই আমার।
তারপরও…
আমি যদি সব ছেড়েছুঁড়ে চলে যাই এভাবে, হোথর্ন হয়তো গিয়ে হাজির হবে অন্য কোনো লেখকের কাছে। ফলে কী হবে? নিজের বইয়ে আমি হতাম মুখ্য একটা চরিত্র, অন্যের বইয়ে পরিণত হবো গৌণ কোনো চরিত্রে। ব্যাপারটা মোটেও ভালো কিছু হবে না আমার জন্য। অন্য কেউ তার বইয়ে যা খুশি তা-ই লিখতে পারে আমাকে নিয়ে। এমনকী আমাকে আস্ত একটা আহাম্মকও বানিয়ে দিতে পারে।
অপরপক্ষে আমি যদি লিখি বইটা, নিয়ন্ত্রণ থাকবে আমার হাতে। হোথর্ন স্বীকার করেছে অন্য কোনো লেখকের কাছে যায়নি সে। কাজেই এই কাহিনি এখন পর্যন্ত আমার। ওদিকে হিলডা কোনো একজন প্রকাশকের সঙ্গে কথাও বলে ফেলেছে। তার মানে আমার অর্ধেক কাজ হয়ে গেছে।
মোবাইল ফোনটা এখনও হাতে ধরে রেখেছি আমি।
স্পিড ডায়ালের উপর ঘুরপাক খাচ্ছে আমার বুড়ো আঙুল।
যতক্ষণে গিয়ে পৌঁছালাম নদীর অন্য তীরে, ততক্ষণে জানা হয়ে গেছে আমার, কী করতে চলেছি।
***
অসাধারণ