উইলিয়াম আর্ভিন, আই.সি.এস
সংক্ষিপ্ত জীবনী
উইলিয়াম আর্ভিন স্কটল্যান্ড দেশীয় একজন আইন-ব্যবসায়ীর পুত্র। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দের ৫ই জুলাই তারিখে এবার্ডিন সহরে তাহার জন্ম হয়। অতি শৈশবেই তিনি লন্ডন মহানগরীতে উপস্থিত হ’ন। পঞ্চদশবর্ষ বয়ঃক্রমকালে বিদ্যালয় পরিত্যাগ করিয়া তিনি চাকুরীতে প্রবেশ করেন। তাঁহার বয়ক্রম তখন ঊনবিংশ বৎসর, সেই সময়ে তিনি রণপোত সচিবের ভাগে কর্ম্মলাভ করিয়া, এই কৰ্ম্মে প্রায় দুই বৎসরকাল অতিবাহিত করেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি ফরাসী ও জার্মান ভাষা বিশেষভাবে আয়ত্ত করিয়াছিলেন। তৎপর চাকুরী পরিত্যাগ করিয়া তিনি লন্ডনের কিংস্ কলেজে প্রবিষ্ট হইলেন এবং ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া অতি উচ্চস্থান অধিকার করেন।
১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ই ডিসেম্বর তারিখে ভারতে উপনীত হইয়া, পরবর্তী জুন মাসে তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতের সিভিল সার্ব্বিসে শাহারাণপুরের এসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট রূপে নিযুক্ত হন। তথায় এক বৎসর অতিবাহিত করিবার পর তিনি মুজাফরনগরে বদলী হন এবং সেখানে চারি বৎসর কার্য্য করেন (এপ্রিল ১৮৬৫-জুলাই ১৮৬৯।) ইহার পর দীর্ঘ অবকাশ গ্রহণ করিয়া তিনি দুই বৎসরের অধিককাল ইংলন্ডে অবস্থান করেন (১৮৭২-৭৩)। তৎপরে ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের জুন হইতে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি ফারক্কাবাদে কর্ম করেন, এবং জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের পদে উন্নীত হন। ইতঃপূৰ্ব্বেই তিনি ভারতে মুসলমান-রাজত্বের ইতিহাস, ঐকান্তিক নিষ্ঠার সহিত চর্চ্চা করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। ইহার ফলস্বরূপ তাহার ফারাক্কাবাদের বঙ্গাশবংশীয় (পাঠান) নবাবদিগের অমূল্য বিবরণ ১৮৭৮-৭৯ খ্রিস্টাব্দের কলিকাতার এসিয়াটিক্ সোসাইটির পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। Atkins সাহেব সম্পাদিত, গবর্ণমেণ্ট কর্তৃক ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত Gazetteer of the Farukhabad District গ্রন্থেও তাঁহার কয়েকটি মূল্যবান অধ্যায় সন্নিবিষ্ট হইয়াছে।
ঘাজিপুর জেলাতেই তিনি সর্ব্বাধিক অধিক দিন- সাত বৎসরকাল অভিবাহিত করেন। এইস্থানে তিনি প্রথমে সেটলমেন্ট অফিসার ও পরে কালেকটারের কার্য্য করেন। The Settlement Report of Ghazipur District, 1886 নামক সরকারী পুস্তকে (Blue-Book) তিনি তাহার গভীর অনুসন্ধিৎসা ও প্রগাঢ় বিদ্যাবত্তার পরিচয় রাখিয়া গিয়াছেন। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের Calcutta Review পত্রে প্রকাশিত Canal Rates versus Land Revenue নামক প্রবন্ধ এবং The Rent Digest or the Law of Procedure relating to Landlord & Tenant, Bengal Presidency 1869 নামক পুস্তক হইতে রাজস্বকার্য্য বিষয়ে তাহার তীক্ষ্ণদৃষ্টি ও অতিসূক্ষ্ম বিষয়ে অভিনিবেশ করিবার শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়।
সাহিত্য প্রতিষ্ঠা ও রাজস্ব-কর্মচারীর অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তিনি সিভিল- সার্ভিসের কোন বাঞ্ছনীয় উচ্চপদ লাভ করিতে পারেন নাই। তাহার ন্যায় অসামান্য প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি স্বভাবতঃই উচ্চপদের প্রত্যাশা করিতে পারিতেন; কিন্তু সে সৌভাগ্য তাহার হয় নাই। এই কারণে তিনি ‘পেন্সেন্’ লাভ করিবার সময় উপস্থিত হইবামাত্র ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের ২৭-এ মার্চ কৰ্ম্ম হইতে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণকালে তিনি শাহরাণপুরের ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, আশ্চর্য্যের বিষয়, এই জেলাতেই তিনি সৰ্ব্বপ্রথমে কৰ্ম্মে প্রবিষ্ট হন ৷ তিনি যে ২৫ বৎসর রাজকার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন, তাহার প্রায় এক পঞ্চমাংশকাল তিনি ছুটিতে অতিবাহিত করেন ৷
ইংলন্ডে ইতিহাস-সেবা
রাজকার্য্য হইতে অবসর গ্রহণকালে তাহার বয়ঃক্রম ৪৮ বৎসর ছিল, সুতরাং তিনি আশা করিয়াছিলেন যে, বহুদিন নিরাময় থাকিয়া অবসরপ্রাপ্ত জীবন ইতিহাস চর্চ্চায় নিযুক্ত করিতে পারিবেন। ভারতে অবস্থানকালে তিনি ফার্সী ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন এবং সর্ব্বাপেক্ষা সুকঠিন কার্য- ফার্সী পাণ্ডুলিপি-পাঠ, তিনি বিনা আয়াসে শিখিয়াছিলেন। মুঘল শাসনকালের ইতিহাস-সম্বলিত হিন্দী ও উর্দুভাষায় মুদ্রিত ও ‘লিথো’ পুস্তিকাদি ব্যতীত ফার্সী পাণ্ডুলিপি-সংগ্রহ কার্য্যেও তিনি পূর্ব্ব হইতেই ব্যাপৃত ছিলেন। রাজকার্য্যে প্রতিষ্ঠিত থাকিবার কালে, বহু ভারতীয় ভদ্রসন্তান, তাঁহার ভারতীয় ইতিহাস-অনুসন্ধানে বিশেষ অনুরাগের সন্ধান পাইয়া, তাঁহার সন্তোষ বিধানের জন্য তাঁহাকে বহু ফার্সী পাণ্ডুলিপি উপহার দিতেন। ইহা ব্যতীত তিনি বহু পুরাতন পাণ্ডুলিপি স্বীয় অর্থে ভারত ও ইউরোপ হইতে ক্রয় করেন। অধিকন্তু যে সমস্ত ফার্সী পাণ্ডুলিপি অর্থ বিনিময়ে বা অনুরোধে সংগৃহীত হইবার নহে, তাহার সন্ধান করিয়া সেগুলির প্রতিলিপি লইবার জন্য, তিনি খাজিপুর জেলার অন্তর্গত ভিরি সৈয়দপুর-নিবাসী এক লিপিকুশল মৌলবীকে বেতনভোগী কর্ম্মচারী নিযুক্ত করিয়াছিলেন। বার্লিনের Royal Library-তে রক্ষিত, তাহার কার্য্যের সহায়তাকারী যে সমস্ত দুষ্প্রাপ্য ফার্সী পাণ্ডুলিপি ছিল, তাহার প্রতিলিপিও আর্ভিন সংগ্রহ করিয়াছিলেন। এইরূপে তিনি যে বিশেষ যুগের ইতিহাসালোচনায় নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময়ের ইতিহাস-সম্পর্কিত এরূপ মূল পাণ্ডুলিপি সমূহ সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন- যাহা ইউরোপের কোন বিখ্যাত সাধারণ বা রাজকীয় পুস্তকালয়েও একস্থলে পাইবার উপায় নাই ৷
একটি উদাহরণ দিতেছি। হামিদুদ্দীন খাঁ নিচা রচিত আকাম ই-আলমৃগীরি নামক আওরংজীবের কাহিনী সম্বলিত দুইখানি পাণ্ডুলিপি তাহার অধিকারে ছিল। ইহা ভারতের বা ইউরোপের কোনও সরকারী পুস্তকালয়ে দেখিতে পাওয়া যায় না; এমনকি ইহার অস্তিত্ব পর্যন্তও ঐতিহাসিকগণের নিকট অবিদিত ছিল। অথচ সম্রাট আওরংজীবের জীবনের চরিত্র প্রকাশক অনেকগুলি ঘটনা ও মতামত ইহাতে থাকায় ইহা একখানি অমূল্য গ্রন্থ হইয়াছে। সৌভাগ্যক্রমে আমি ইহার অংশবিশেষ প্রাপ্ত হইয়া তাহার নকল তাঁহার নিকট পাঠাইয়াছিলাম। আর একবার, আমি একমাত্র খুদাবক্স লাইব্রেরীতে রক্ষিত, অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত মুঘল সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক বিবরণাদিমূলক চাহার গুলশান নামে একখানি পাণ্ডুলিপি প্রাপ্ত হই- ইহাই আমার ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত India of Aurangzib গ্রন্থের ভিত্তিরূপে ব্যবহৃত হইয়াছিল; কিন্তু আর্ভিনের নিকট চাহার গুলশানের তিনখানি পাণ্ডুলিপি ছিল– ইহার দুই খানি তিনি তাঁহার ভারতীয় বন্ধুগণের নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তাহার সহিত পরিচিত হইবার পর হইতেই যখনই আমি ভারতেতিহাস-সম্পৰ্কীয় কোন দুষ্প্রাপ্য পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাইয়াছি, তখনই তিনি আমার নিকট হইতে তাহার নকল লইয়াছেন। এইরূপে আমি মীর্জ্জা রাজা জয় সিংহের পত্রাবলী ‘হত অঞ্জুমান’, ফয়াজুলকওয়ানীন্ গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট শান্জাহান ও তাঁহার পুত্রগণের পত্র সমূহ; আওরংজীবের খাস-মুনশী এনায়েতুল্লা কর্তৃক সংগৃহীত, আওরংজীবের বৃদ্ধ বয়সের আদেশাদি সম্বলিত আকাম-ই-আলমগীরি এবং পারস্যরাজ দ্বিতীয় শাহ্ আব্বাসের পত্রাদির প্রতিলিপি সংগ্রহ করিয়া দিয়া তাঁহার পাঠাগারের গৌরববৃদ্ধি করিয়াছিলাম। এই সংস্রবে তিনি আমাকে লেখেন :-
“What you tell me about your various finds of Mss. makes my mouth water, and I shall be very grateful if you can engage any one to copy for me Inyatullah Khan’s Ahkam and the various fragments you have of Hamiduddin’s collection. The Half Anjuman seems to be a valuable and most unexpected discovery. I have scolded Abdul Aziz (his retained scribe) whose special hunting ground is Beneras for not having discovered it!!’ (Letter, 13 Nov., 1908)”
“শেষ মুঘল সম্রাটগণ” (Later Mughals)
স্বীয় অধিকারে এইরূপ মূল ফার্সী উপাদান থাকাতে এবং ইউরোপীয় বিভিন্ন ভাষায় ব্যুৎপত্তির ফলে ওলন্দাজ, পর্তুগীজ ও ফরাসীদের East India Records এবং খ্রিস্টীয় ধর্ম্মযাজকগণের পত্রসমূহ (বিশেষত: Society of Jesus-এর পত্রাবলী) পড়িতে সমর্থ হওয়ায়, তিনি মুঘল রাজত্বের অধঃপতন বিষয়ে Later Mughals নাম দিয়া একখানি অতি প্রামাণিক ইতিহাস লিখিবার কল্পনা করেন। ইহাতে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ (আওরংজীবের মৃত্যু) হইতে ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দ (ইংরেজগণ কর্তৃক দিল্লী অধিকার) পর্যন্ত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করিবার তাঁহার ইচ্ছা ছিল। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে ফেব্রুয়ারি আমাকে লেখেন:-
“I have first to finish the history from 1707 to 1803 which I began twelve years ago. At present I have not got beyond 1738, in my draft, though I have materials colleted up to 1759 or even later”
কার্য্য অগ্রসর হইতে লাগিল; কিন্তু তিনি এরূপ ধীর বিবেচনাপূর্ব্বক কাৰ্য্য করিতেন– এরূপ বহুবিধ উপাদান তিনি ব্যবহার করিয়াছিলেন, এবং প্রমাণগুলি (references) এত অধিকবার পরীক্ষা করিতেন যে একশত বৎসরের ইতিহাস রচনার বাসনা করিয়া তিনি জীবদ্দশায় মাত্র চৌদ্দ বৎসরের ইতিহাস সম্পূর্ণ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। Later Mughals-এর অধ্যায়গুলি প্রধানতঃ এসিয়াটিক্ সোসাইটির জার্নালে ও সময়ে সময়ে Indian Antiquaryতে প্রকাশিত হয়। উপরোক্ত পত্র লিখিবার পাঁচবৎসর পরে তিনি তাহার Later Mughals-এর শেষ-প্রকাশিত অংশের পরিশিষ্টে এই বিদায়বাণী (Le’nvoi) লিখিয়াছেন:
“With the disappearance of the Sayyid brothers the story attains a sort of dramatic completeness, and I decide to suspend at this point my contributions on the history of the later Mughals. There is reason to believe that a completion of my original intention is beyond my remaining strength. I planned on too large a scale, and it is hardly likely now that I shall be able to do much more… The first draft for the years 1721 to 1738 is written. I hope soon to undertake the narrative of 1739, including the invasion of Nadir Shah. It remains to be seen whether I shall be able to continue the story for the years which follow Nadir Shah’s departure. But I have read and translated and made notes for another twenty years ending about 1759 or 1760.”
এই কথাগুলি আভিন ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে লিখিয়াছিলেন- ইহা হইতে বুঝা যাইতেছে যে, পূর্ব্ববর্তী পাঁচ বৎসরে অহার কার্য্য্য আদৌ অগ্রসর হয় নাই। একমাত্র নিকোলা মানুচীর মুঘল সাম্রাজ্যে ভ্রমণ কাহিনী বিবরণই তাহাকে Later Mughals রচনাকার্য্য স্থগিত রাখিতে প্রলুব্ধ করিয়াছিল। এই বিরাটগ্রন্থ সম্পূর্ণ করিতে তাঁহাকে সুদীর্ঘ সাত বৎসরকাল বিপুল আয়াস স্বীকার করিতে হইয়াছিল। ফার্সী, তুর্কী ও হিন্দী ভাষায় যুদ্ধ সম্বন্ধীয় পারিভাষিক শব্দের অভিধান Army of the Indian Mughals গ্রন্থরচনা কার্য্যও Later Mughals অসম্পূর্ণ রাখিবার অন্যতম কারণ, জার্মানীর প্রাচ্যবিদ্যাপারদর্শী Dr. Paul Horn ভারতে মুসলমান শাসনকালের প্রারম্ভভাগের ঠিক এই ধরনের একখানি ইতিহাস রচনা করিয়াছিলেন। পাছে পল হর্নের গ্রন্থ তাহার আগে বাহির হয়, এই ভয়ে আর্ভিন অতীব তৎপরতার সহিত নিজ বহু অধ্যয়নের ফল Army of the Indian Mughals-তে একত্র করিয়া ছাপিয়া ফেলেন। আর্ভিন Indian Antiquary, Journal of the Moslem Institute (Calcutta) 4 Journal of the Asiatic Society of Bengal পত্রেও অন্যান্য প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন, যে কাৰ্য্যেই তিনি হস্তক্ষেপ করিতেন, তাহা তিনি পাণ্ডিত্যের চরমসীমায় উপনীত করিতেন– এই জন্যই টিকাটিপ্পনী দেওয়ার মত সামান্য কার্য্যেও তাহার অত্যধিক সময় ব্যয়িত হইত।
কার্য্য অসমাপ্ত রহিল
Storia ও Army of the Indian Mughals পুস্তকদ্বয়ে হস্তক্ষেপ করায়, আর্ভিন ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত Later Mughals-এর বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া যাইতে পারেন নাই; এজন্য ভারতেতিহাস আলোচনাকারিগণ যে আক্ষেপ করিবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। এই ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের পর হইতে ফার্সী উপাদানের আর সেরূপ অধিক মূল্য নাই; কারণ আমরা ইংরাজী পুস্তক, কাগজপত্র হইতে সম্পূৰ্ণ বিবরণ প্রাপ্ত হই। এই সমস্ত ফার্সী উপাদান সংগ্রহ করিতে– সম্পূর্ণরূপে আয়ত্ত করিতে– সুবিন্যাস করিতে, আর্ভিন জীবন অতিবাহিত করিয়াছিলেন। তাহার মৃত্যুতে লোকে তাঁহার সঞ্চিত অভিজ্ঞতার ফল হইতে বঞ্চিত হইল। আর্ভিন যদি অন্য কোন দিকে লক্ষ্য না রাখিয়া, কেবল Later Mughals রচনায় অভিনিবিষ্ট থাকিতেন, তাহা হইলে তিনি তাঁহার জীবনের অবশিষ্ট কালের মধ্যে মুঘল-সাম্রাজ্যের অধঃপতনের ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁহার বহুবর্ষ অধ্যয়নের ফল সাধারণকে দিয়া যাইতে পারিতেন; কিন্তু তিনি তাহা করিয়া যাইতে পারেন নাই, এবং প্রায় ৩০ বৎসরের মধ্যে আর কেহ যে, তাঁহার ন্যায় সত্যনিষ্ঠ ও অক্লান্তকর্মা হইয়া সমস্ত ঐতিহাসিক উপাদান বিশেষভাবে বিচার ও পরীক্ষা করিয়া তাঁহার অসম্পূর্ণ কাজ সমাপ্ত করিতে পারিবেন, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এইজন্য আর্ভিনের মানুচী- সম্পাদনভার গ্রহণ করায়, সাধারণের যথেষ্ট ক্ষতি হইল।
জীবনের শেষ ৮ বৎসর আর্ভিন বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, তাঁহার দেহা বসানের আর অধিক বিলম্ব নাই এবং তাঁহার জীবনের প্রিয়কাৰ্য্য Later Mughals প্রণয়ন অসমাপ্ত রাখিয়াই তাঁহাকে চলিয়া যাইতে হইবে। পত্রের পর পত্রে তিনি আমাকে আমার কার্য্যে অগ্রসর হইতে বারংবার অনুরোধ করিয়াছেন: তাহার মনে হইয়াছিল, হয়ত তিনি জীবদ্দশায় ইহা দেখিয়া যাইতে পারিবেন নাঃ-
“At my age I cannot afford to lose my time, as I fear not surviving to finish the long and heavy tasks I have on hand”. (18th March, 1904). “
“I see every reason to believe that your edition of Alamgir letters will be a through good piece of work, but I trust it will not be too long delayed, for I am getting old and shall not last very much longer”. ( 16 Jan. 1906).
I hope that your first volume of Aurangzib may appear before I leave the scene.” (27 Jan, 1907)
অবশেষে, ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে তিনি দুঃখের সহিত স্বীকার করিয়াছিলেন যে, তাহার কল্পনামত কার্য্য শেষ করিবার সামর্থ্য তাঁহার নাই: এবং তৎপূর্ব্বে যে অধ্যায়টি প্রকাশের জন্য প্রেসে প্রেরিত হইয়াছিল, তাহার অধিক বোধ হয় তিনি আর লিখিয়া উঠিতে পারিবেন না। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্ম ঋতুতে তিনি অপেক্ষাকৃত একটু স্বচ্ছন্দবোধ করেন। তখন আমাকে লেখেন
“Thanks for your enquiries about my health. Decay has not come on so rapidly as I thought it would. The complaint I suffer from is under control and apparently no worse than it was five years ago-and considering I was 70 three days ago, I have a fair amount of activity, bodily and mental, left to me. In fact I am contemplating this next winter writing out my Bahadur Shah chapter (1707-1712 ) and sending it to the Asiatic Society of Bangal.”
কিন্তু এ আশা মরীচিকা মাত্র– ওই বর্ষের শেষ দিনে তিনি আবার একটু অসুস্থ বোধ করিতে লাগিলেন এবং শরীরে যেন অল্প অল্প বল অনুভব করিতে লাগিলেন। ৩রা আগস্ট তারিখে তিনি আমাকে লেখেন :-
“I am coming downstairs once a day for 4 or 5 hours… I am working on quietly and happily. My upper part-heart, lungs and liver, are declared by the specialist to be quite clear and likely to go on (doing their) work so long well that I may reasonably (hope for) a continued life of five to ten years. So it is worth while going on as I shall be able to finish one thing or (another).”
এই অপেক্ষাকৃত সুস্থতা কিন্তু ক্ষণস্থায়ী, শরতের প্রারম্ভে তিনি ক্রমে শয্যাশায়ী হইয়া পড়িলেন এবং বুঝিলেন যে শীত ঋতু পর্যন্ত বোধ হয় আর বাঁচিবেন না, তিনি তাঁহার বহুদিন স্থায়ী পীড়া অম্লানবদনে সহ্য করিয়াছিলেন, এবং ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ৩রা নভেম্বর, শুক্রবার অমরধামে চলিয়া গেলেন।
শেষ মুঘল-সম্রাটগণ অসম্পূর্ণ রহিল। ইতিহাসের ক্ষেত্রে আর একবার এইরূপ শোচনীয় ঘটনা সংঘটিত হইয়াছিল। ষ্টুয়ার্ট রাজকালীন ইংলণ্ডের ইতিহাস রচয়িতা স্যামুয়েল রসন্ গার্ডিনার মৃত্যুশয্যায় “আমার গ্রন্থ! হায়, আমার গ্রন্থ-যে সম্পূর্ণ করিয়া যাইতে পারিলাম না!” বলিয়া আক্ষেপ করিয়াছিলেন; কিন্তু গার্ডিারের এক সান্ত্বনা ছিল যে অধ্যাপক ফার্থের মত দক্ষ ছাত্র তাঁহার গ্রন্থের অবশিষ্টাংশ রচনা করিয়া ইতিহাসটি পূর্ণাঙ্গ করিয়া দিবেন। আর্ভিনের মৃত্যু-নিমীলিত চক্ষে সেরূপ সাহিত্যিক উত্তরাধিকারী দেখা দেয় নাই! এই তাঁহার পরিতাপ।*
আর্ভিনের অন্যান্য গ্রন্থ অপেক্ষা “মানুচীর মুঘল সাম্রাজ্যে ভ্রমণ” Travels of Manucci (Storia do Mogor) পাশ্চাত্য জনগণের নিকট যথেষ্ট সমাদর লাভ করিয়াছিল; বড়ই আশ্চর্য্যের বিষয়, এই পুস্তক হইতেই তিনি বিদ্বান বলিয়া খ্যাতি অর্জ্জন করিয়াছিলেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই নভেম্বর এলাহাবাদের “পাইওনিয়র” পত্রিকায় তাহার মৃত্যু-প্রসঙ্গে যাহা লিখিত হইয়াছিল, তাহা হইতে আমাদের উক্তি সমৰ্থিত হইবে :-
“At home Mr. Irvine’s name outside a small circle of students must have been, as nearly as possible, unknown when first two volumes of his Manucci appeared in 1907 and were at once recognised as the most valuable and important work of the kind that had seen the light since the publication of Col. Yule’s Marco Polo…His reputation as a scholar had been already established, and it stands on an enduring basis… It is not likely that any other English Edition of Manucci’s work will ever be forthcoming to supersede that of Mr. Irvine.”
এই গ্রন্থে আর্ভিনের গভীর বিদ্যাবত্তা ও অধ্যবসায়ের প্রভূত পরিচয় পাওয়া যায়। কেমন করিয়া একা তিনি এতবড় সম্পাদন-কাৰ্য সুসম্পন্ন করিলেন, তাহা ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়। এই জন্যই একজন সমালোচক লিখিয়াছিলেন– “The notes appearing to have been written by a syndicate of scholars instead of by one man only.” আর্ভিনের রচিত পাদটীকা ও পরিশিষ্টগুলি যে মানুচীর মূল অপেক্ষাও অনেক বেশী মূল্যবান, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই; কারণ ইহা হইতে শাহান আওরংজীব ও শাহ্ আলমের রাজত্বকালের একটা বিশুদ্ধ নিখুঁত চিত্র– যাহা পূর্ব্বে কোন ইউরোপীয় ভাষায় পাইবার উপায় ছিল না- তাহা আমরা পাইয়া থাকি! অধিকন্তু, আভিন ইহাতে যথার্থ তারিখ, প্রামাণিক গ্রন্থের পত্রাঙ্ক প্রভৃতি যথাযথ উল্লেখ করিয়াছেন। যিনিই একবার মানুচীর পুস্তকের এই সংস্করণের সহিত পরিচিত হইয়াছেন তিনিই বুঝিতে পারিবেন, ‘আর্ভিন কি অমূল্য কার্য্য করিয়া গিয়াছেন। প্রকৃতপক্ষে আর্ভিন ১৬৫০ হইতে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতেতিহাসের এমন কোন অংশ রাখিয়া যান নাই, যাহাতে তিনি হস্তক্ষেপ না করিয়াছেন। যাহাতেই তিনি একবার হস্তক্ষেপ করিয়াছেন, তাহারই অন্ধকারে তিনি উজ্জ্বল আলোক-সম্পাত করিয়াছেন। যে সমস্ত ভারতেতিহাস লেখক ফার্সী অবগত নহেন, তাহারা যে Storia গ্রন্থে আর্ভিনের পাদটীকা ও Later Mughals পাঠ করিয়া প্রভূত উপকৃত হইবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই; অধিকন্তু আর্ভিনের এই সমস্ত অমূল্য উপাদান হইতে তাঁহারা নিজের লিখিত বিষয়ের ভ্রম-প্রমাদাদি সংশোধন করিয়া লইতে পারিবেন।
আর্ভিন, বার্লিন ও ভিনিসে মানুচীর গ্রন্থের আদি পাণ্ডুলিপির পুনরাবিষ্কার করিবার পূর্ব্বে, এই ইতালীয় ভ্রমণকারী কেবলমাত্র কক্রর (Catrou) চুরিকরা, ভ্রমপূর্ণ, ফরাসী ভাষায় রচিত বিবরণ হইতেই জগতে পরিচিত ছিলেন। মানুচীর গ্রন্থের ভাগ্যবিপর্য্যয় পাঠ করিলে উপন্যাসের ন্যায় বিচিত্র বলিয়া মনে হয়।
[ভারতবর্ষ, বর্ষ ৪, খণ্ড ১, সংখ্যা, আষাঢ়, ১৩২৩।]