২০. ইন্টারভিউ কেমন হল

ইন্টারভিউ কেমন হল নিজেই ঠাওর করতে পারল না দীপাবলী। দেশ-বিদেশের তথ্য জানতে চাওয়া অথবা তার পঠিত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করলে সে বুঝতে পারত সঠিক উত্তর দিতে পেরেছে কিনা। এ একরকম ব্যক্তিগত আলোচনা এবং সেটা করতে গিয়ে সে একজন প্রকতাকে নিশ্চয়ই বিরূপ করেছে। এক্ষেত্রে তার পক্ষে নির্বাচিত হওয়া অসম্ভব। কিংবা এমনও হতে পারে বোর্ড স্থির করেছিলেন যে কোন মেয়েকে নির্বাচিত করবেন না এবং সেই কারণেই সিরিয়াস প্রশ্ন করার প্রয়োজন বোধ করেননি।

দীপাবলী কালীবাড়িতে ফিরে এল বেশ হতাশ হয়েই। আসবার পথে দিল্লীর রাজপথে লাগানো বড় বড় হোর্ডং দেখতে দেখতে ওর শ্ৰীবাস্তব সাহেবের কথা মনে পড়ে গেল। নেখালি গ্রামে শুটিং-এর সময় ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সারা ভারতবর্ষের একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনসংস্থার তিনি মালিক। কিছুই যখন হল না তখন ওঁর কাছে গেলে কেমন হয়? বেঁচে থাকতে গেলে তার এখনই একটা চাকরি দরকার। কিন্তু সরকারি চাকরি করাকালীন ভদ্রলোকের সঙ্গে যোগাযোগর যে সুবিধে পাওয়া গিয়েছিল এখন একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে সেটা পাবে কি?

কালীবাড়িতে পৌঁছে অফিসঘরে ঢুকেই দীপাবলী দেখতে পেল সেই কিশোরীটি বসে আছে। তার সঙ্গে মধ্যবয়সী একজন পরিচারিকা। তাকে দেখে মেয়েটি বলল, ঠাকুমা আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে।

আজ সকাল থেকে একটা উত্তেজনায় কেটেছে। গতরাত্রের প্রস্তাব নিয়ে ভাবার অবকাশ পায়নি। এবং এই মুহূর্তে দীপাবলীর একদমই যেতে ইচ্ছে করছিল না। সে মাথা নাড়ল, এবার থাক। তুমি তোমার ঠাকুমাকে বুঝিয়ে বল, আবার যদি কখনও দিল্লীতে আসি নিশ্চয়ই ওঁর সঙ্গে দেখা করব।

মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে হাত ধরল, না, না। আমি কোন কথা শুনব না। আপনি না গেলে আমি হেরে যাব। ঠাকুমাই আসছিল আমি জোর দিয়ে বলে এসেছি আপনাকে নিয়ে যাবই। প্লিজ, চলুন।

অফিসে যাঁরা বসেছিলেন তারা কৌতূহল নিয়ে দৃশ্যটি দেখছিলেন। অগত্যা দীপাবলীকে মত পাল্টাতে হল। কালীবাড়ির পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে সে গাড়িতে উঠল মেয়েটির সামনে। পরিচারিকা বসল ড্রাইভারের পাশে।

দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের বাড়ি এখান থেকে কত দূরে?

কুড়ি পঁচিশ মাইল।

এত দূরে।

ওমা, দূর কোথায়? এক্ষুণি পৌঁছে যাব।

দীপাবলী সেটা বুঝল। চওড়া ফাঁকা রাস্তা। কলকাতার মত বিভিন্নরকমের যানবাহন বা মানুষ পথে নেই। দিল্লীটাকে মাঝেমাঝেই বিদেশ বলে মনে হচ্ছিল।

গাড়ি থেকে নামতেই মুখার্জিগিন্নী দরজা ছেড়ে এগিয়ে এসে গেট খুলে দাঁড়ালেন, এসো, এসো। আমি তো ভাবছিলাম নাতনির কথায় তুমি এলে হয়।

নাতনি বলে উঠল, আসতে চাইছিলেন না, আমি জোর করে নিয়ে এলাম।

দীপাবলীকে বলতে হল, না, মানে, আপনাদের ঝামেলায় ফেলতে চাইছিলাম না।

ওমা! মুখার্জিগিন্নী চোখ বড় করলেন, গায়ে পড়ে গিয়ে আলাপ করে নিয়ে আসতে নাতনিকে পাঠালাম যখন তখন ঝামেলা তো আমরাই চাইছি। তিনি দীপাবলীকে হাত ধরে বারান্দায় তুলতেই আর একজন মধ্যবয়সিনী বেরিয়ে এসে মিষ্টি গলায় বললেন, আসুন।

আমার বউমা। শকুন্তলা। ওর মা। আর এই হচ্ছে দীপাবলী।

দীপাবলী নমস্কার করতেই শকুন্তলা সেটা ফিরিয়ে দিল। মুখার্জিগিন্নী তাকে ভেতরের ঘরে নিয়ে আসতেই পরেশবাবুর দেখা পাওয়া গেল। সোফার ওপর সোজা হয়ে বসেছিলেন, এসো, এসো। কেমন ইন্টারভিউ হল?

দীপাবলী দাঁড়িয়ে পড়েছিল, বলল, বুঝতে পারলাম না। ইন্টারভিউ-এর মত ক্ৰমাগত। প্রশ্নের তীর কেউ ছোঁড়েননি। আমার কতটা বিশ্বজ্ঞান আছে সেই পরীক্ষাও করলেন না।

মুখার্জিগিন্নী ধমকে উঠলেন, মেয়েটা ঘরে ঢোকামাত্র প্রশ্ন করতে শুরু করলে! তোমার স্বভাব আর এ জীবনে পাল্টাবে না। বোসো তো তুমি।

দীপাবলী উল্টোদিকের সোফায় বসতেই পরশেবাবু বললেন, ওরকম স্টিরিওটাইপ প্রশ্ন তো এরা করে না। দেখতে চায় তুমি যেটা জানো সেটা কত ভালভাবে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে পার। কথা বলার সময় ইতস্তত করোনি তো?

না। তা করিনি। কিন্তু মনে হয়েছে সবই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

হঠাৎ মুখার্জিগিন্নী জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এই চাকরি করবেই?

ঠিক কি চাকরি পাই তার ওপর নির্ভর করছে।

পরেশবাবু জানতে চাইলেন, তোমার প্ৰেফারেন্স লিস্টে কি আছে?

দীপাবলীর উত্তর দিতে ভাল লাগছিল। ফৰ্ম জমা দেবার পর থেকে কেউ তার সঙ্গে এ বিষয়ে নিয়ে এমন অন্তরঙ্গ আলাপ করেনি। এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছিল ইন্টারভিউ দিয়ে সে নিজের বাড়িতেই ফিরে এসেছে। সে বলল, প্রথম অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, তারপর ফরেন সার্ভিস, পুলিশ সার্ভিস এবং সবশেষে রেভিন্যু সার্ভিস। তবে এ নিয়ে ভেবে কিছু লাভ নেই, একজন ইন্টারভিউয়ার খুব চটেছেন আমার ওপর। অতএব হবে না।

মুখার্জিগিন্নী যেন খুশী হলেন মন্তব্য শুনে। তিনি তাঁর বউমাকে ইঙ্গিত করতে ভদ্রমহিলা ভেতরে চলে গেলেন। মেয়েটিও তাঁকে অনুসরণ করল। মুখার্জিগিন্নী এবার মাঝখানের সোফায় বসে বললেন, তা তোমাকে আজই চলে যেতে হবে?

হ্যাঁ। সেইমত টিকিট করে রেখেছি।

মুখার্জিগিন্নী জিজ্ঞাসা করলেন! তুমি এর আগে দিল্লীতে আসোনি তো! এবারে শহরটার কিছু দেখে যাও। কুতুবমিনার না দেখে দিল্লী ছাড়বে?

পরেশবাবু হাসলেন শব্দ করে, তোমার মাসীমার ওই এক বাতিক। এখানে এত ভাল ভাল জিনিস থাকতে যে কেউ এলে তাকে কুতুব না দেখিয়ে ছাড়বে না। অবশ্য কথাটা ঠিকই, দিল্লীতে দেখার জিনিস অনেক। আগ্রাও বেশি দূরে নয়। কটা দিন থেকে সব দেখে যেতে পার। আমি অবশ্য জানি না কলকাতায় তোমার কোন জরুরি কাজ আছে কিনা!

দীপাবলীর মনে লোভ আসছিল। কিন্তু সেইসঙ্গে সদ্য পরিচিত একটি পরিবারের আতিথ্য নিয়ে দিল্লী দেখার সঙ্কোচ কাজ করছিল। শেষ পর্যন্ত লোভটাকে সরাতে পারল সে, এবং বাধ্য হল একটা অর্ধসত্য বলতে, আসলে কলকাতায় ফিরেই আমি একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করব। তিনি কলকাতার এক বিখ্যাত অ্যাড এজেন্সির মালিক।

ও। পরেশবাবু মাথা নাড়লেন, চাকরির চেষ্টা করছ বুঝি খুব?

হ্যাঁ। আমার চাকরির খুব প্রয়োজন।

এই সময় চা-জলখাবার এল। পরিমাণে প্রচুর। অনেক আপত্তি সত্ত্বেও দীপাবলীকে তার সিংহভাগ খেতে হল। এবার মুখার্জি গিন্নী তাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। সুন্দর সাজানো বাড়ি। বাড়ি দেখিয়ে নিজের শোওয়ার ঘরে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার চাকরি করা কি খুব প্রয়োজন?

দীপাবলী মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।

কলকাতায় তোমার সঙ্গে কারা থাকেন?

কেউ না। আমি একা!

সে কি?

এঁদের সঙ্গ খুব ভাল লাগছিল দীপাবলীর। এমন পারিবারিক উত্তাপ সে অনেকদিন পায়নি। অতএব অকপটে সে নিজের কথা বলে গেল। বলতে বলতে নিজে এমন একমুখী হয়ে গিয়েছিল যে সে ভুলে গিয়েছিল ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে এতদিন কারো সঙ্গে কথা বলতে অপছন্দ করছে। কিন্তু আজ যতদূর সংক্ষেপে নিজের কথা বলে দেখলো অনেকটা হালকা লাগছে। সব শুনে মুখার্জি গিন্নী বললেন, কিন্তু তুমি তো রক্ত মাংসের মানুষ, তাই না?

তার মানে।

তুমি এমনভাবে জীবনযাপন করছ যা খুবই অস্বাভাবিক। লেখকরা তোমার মত চরিত্র গল্পে লিখলে আমরা পড়ে বলব বানানো।

দীপাবলী কি বলবে বুঝে পেল না। মুখার্জিগিন্নী সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলে, আচ্ছা, এতদিন তো কলকাতায় একা আছে, কারো প্রেমে পড়নি?

মুখে রক্ত জমল দীপাবলীর, ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝতে পারি না।

ওমা, একি কথা! এত জানো এত পড়াশুনা করছে আর এটা জানো না! কথাগুলো বলেই হেসে ফেললেন তিনি, ভালই হয়েছে। তোমাকে একা পাওয়া গেল।

গল্পে গল্পে সময় এগোল। পরেশবাবুর পুত্রবধূ এবং নাতনির সঙ্গেও জমে গেল সে। পুত্ৰবধু দিল্লীরই মেয়ে। কথায় একটা অবাঙালি টান আছে। মাঝে মাঝে হিন্দী শব্দ স্বচ্ছন্দে জুড়ে দিচ্ছে সে। কিন্তু ব্যবহার খুবই আন্তরিক। দীপাবলীর খুব ভাল লাগছিল। এই পরিবেশ তার মনে মলমের কাজ করছিল। বিকেল শেষ হলে মুখার্জি পরিবারের বড় পুত্র এলেন। সুখী সুখী চেহারা। আলাপ করিয়ে দেওয়া হল। দেখা গেল তিনিও ইন্টারভিউ-এর কথা জানেন। সে ব্যাপারে কিছু কথা বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন। দীপাবলীর খুব মজা লাগছিল। এঁরা কেউই জানেন না সে সত্যি কথা বলেছে কি না। তার অতীত এবং বর্তমানের সঙ্গে সম্পর্কিত কোন মানুষের সঙ্গে এঁদের বিন্দুমাত্র যোগাযোগ নেই। শুধুমাত্র মৌখিক পরিচয়ে ভাললাগা তৈরী হওয়ায় এঁরা তাকে এত আদর যত্ন করছেন। কথাটা সে মুখার্জিগিন্নীকে বলেই ফেলল। তিনি হতভম্ব। কিন্তু তার পুত্রবধূ বললেন, ভাই দীপাবলী, তুমি যদি ফালতু লোক হবে তবে আই এ এস ইন্টারভিউ কি করে দিতে পারবে? গভর্নমেন্ট তো তোমার আইডেন্টিটি ভেরিফাই করবে।

মুখার্জিগিন্নী বললেন, ঠিক কথা। এ কি মেয়েরে বাবা! নিজের বিরুদ্ধে কথা বলে। আর বউমা, এতদিনেও তোমার বাংলা আমাদের মত হল না! কানে বড় লাগে।

আমি তো কৌশিস করি! পুত্ৰবধুর মুখ থেকে শব্দটি বের হতেই সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ল। এমন কি দীপাবলীও। পরেশবাবু তখন ঘরে ঢুকছিলেন। হাসির কারণ জানার পর তিনি দীপাবলীকে দেখিয়ে স্ত্রীকে বললেন, কি গো! খুব তো বলছিলে, আই এ এস দিচ্ছে।

যে মেয়ে সে গোমড়া মুখের হবে। তুমিও ওই বয়সে এভাবে হাসতে পারতো না!

সন্ধে সাড়ে ছটায় মুখার্জিদের ছোটপুত্র এলেন। লম্বা, ছিপছিপে এবং সপ্রতিভ। মুখার্জি গিন্নী তাকে ডাকলেন, অলোক এদিকে আয়। এর সঙ্গে আলাপ কর।

অলোক মুখার্জি এগিয়ে এসে চেয়ারে বসল, আমার নাম তো শুনলেন। কাল রাত্রে বাবার কাছে আপনার নাম শুনেছি। ইন্টারভিউ কেমন হল?

যেমন হয়। রেজাল্ট না দেখলে বোঝা যায় না।

কলকাতার মেয়েরা আই এ এস দিচ্ছে এমন ঘটনা খুব কম ঘটে।

এর আগেও ঘটেছে। হয়তো এখন থেকে বেশি সংখ্যায় ঘটবে।

আপনি কোন সার্ভিসে যেতে চাইছেন?

প্রথমটাকেই প্রেফার করেছি।

এই চাকরিতে তো আপনাকে অনেক জায়গায় ঘুরতে হবে। একটা জায়গায় স্থির হয়ে বসার সুযোগ পাবেন না। অসুবিধে হবে না?

এক জায়গায় স্থির না হয়ে বসা এতদিনে অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। অলোক বলল, ঠিক বুঝলাম না।

দীপাবলী হেসে মাথা নাড়ল, এটা আপনার বোঝার কথা নয়।

সবাই মিলে কথা হচ্ছিল। দীপাবলী দেখলঅলোক প্রায় প্রতিটি ব্যাপারেই স্বচ্ছন্দ। এবং কখনই সে নিজেকে জাহির করতে চায় না। খঙ্গপুর থেকে বি ই করে একটা বড় কোম্পানিতে ওপরতলার চাকরিতে আছে তা নিজের মুখে প্রকাশ করতে ইচ্ছুক ছিল না। তার বউদির কাছে জানা গেল।অলোকবলল, এটা এমন কিছু নয়। টাকা রোজগার করার জন্যে পড়াশুনা করেছিলাম। একটু বুদ্ধি আর পরিশ্রম করলে ডিগ্রিটা ভালভাবে পাওয়া যায়। তারপর তারই দৌলতে যে চাকরি পেলাম সেখানে আর যাই লাক ওই পড়াশুনাটা কাজে লাগছে না। আমার যা কিছু ব্যাপার তা নিজের স্বার্থ জড়িয়ে। কিন্তু আপনারা চাকরি করত্র যাচ্ছেন দেশের জন্যে। আপনাদের কাজকর্মের ওপরে দেশের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে থাকবে।

কথাগুলো শুনতে খুব ভাল লাগছিল। এবংসেইসঙ্গে অলোককে প্রতি শ্রদ্ধাও জমছিল। দিল্লীতে থেকে এখানকার জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়েও একটা লোক দীপেন্দ্রনাথ। বন্দ্যোপাধ্যায়ের অশ্বমেধের ঘোড়া পড়ে উৎফুল্ল হয় যখন তখন তাকে শ্ৰদ্ধা না করে পারা যায় না। বোধহয় এই জন্যেই ঋত্বিক ঘটক ওর খুব প্রিয় পরিচালক।

আজ মুখুজ্যে বাড়িতে তারই কারণে তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সারা হল। এখান থেকেই স্টেশন চলে যাবে দীপাবলী। সে চাইছিল একাই অটো নিয়ে যাবে। কিন্তু মুখার্জিগিন্নী তীব্র আপত্তি করলেন, পাগলামি করো না এটা দিল্পী। সন্ধের পর মেয়েরা একা বিপদে না পড়লে রাস্তায় বের হয় না।অলোক তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। এখান থেকে বেশি সময় লাগবে না।

বেরুবার আগে ভদ্রমহিলা আচমকা তাকে ডেকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। একটু কিন্তু কিন্তু করে শেষপর্যন্ত বলেই ফেললেন কথাগুলো, গতকাল উনি তোমার সঙ্গে কথা বলে এসে আমাকে পাঠিয়েছিলেন। তোমার বাড়ি সম্পর্কে কিছুই জানি না। কিন্তু আজ এতক্ষণ কথা বলে আর আমার কোন দ্বিধা নেই। আমি যদি তোমাকে আমার বাড়ির বউ করে আনতে চাই তুমি আসবে?

দীপাবলী কেঁপে উঠল। আজ পর্যন্ত কোন নারী তাকে এমন প্রস্তাব দেয়নি। সে মুখ নিচু করল। এতগুলো বছরের যন্ত্রণা এবং তার সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধ করতে করতে ভেতরে যে ক্ষয় শুরু হয়েছিল আচমকা তার ওপর প্রলেপ পড়ল যেন। এই প্রস্তাব গ্রহণ করা মানে সমস্ত যন্ত্রণার অবসান। মুখার্জিগিন্নী তার হাত ধরে আছে। হঠাৎ ভয় এল মনে। সে মুখ তুলল, কিন্তু আমি তো আই এ সার্ভিস করব ঠিক করেছি।

তা করেছ। কিন্তু এই চাকরি যারা করে তারাও তো অবিবাহিত থাকে না।

আমাকে একটু ভাবতে সময় দিন।

সে তো নিশ্চয়ই। আমরা চাইছি মানেই তুমি আমাদের পছন্দ করবে এমন তো নাও হতে পারে। তবে আমাদের সংসার তো দেখে গেলে এর বাইরে কিছু নেই।

আপনারা তো আমার মুখ থেকে সব শুনেছেন। কিন্তু–

হ্যাঁ। সে কথা বলতে পারো। এভাবে ধরে এনে দুম করে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়তো ঠিক নয়। তবে কি জানো সম্বন্ধ করে যখন লোকে ছেলেমেয়ের বিয়ে দেয় তখন কারো না। কারো মুখে শুনেই দেয়। সত্যমিথ্যে যাচাই করার অবকাশ কজন পায়! ছেলের বা মেয়ের চরিত্র কেমন তা সে ছাড়া তো অন্য কেউ পুরোটা জানতে পারে না। এ ক্ষেত্রে তুমি নিজের মুখে বলেছ। অন্যের মুখে আমাদের শুনতে হয়নি। মিথ্যে বললে পরে তোমাকেই জবাবদিহি করতে হবে। তাই না?

আমার বৈধব্য নিয়ে আপনার ছেলের আপত্তি থাকতে পারে।

ও আমাদের মানসিকতাই পেয়েছে। ব্যাপারটা শুনে যখন আমাদের কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি ওরও হবে না।

হঠাৎ কেঁপে উঠল দীপাবলী। ভিজে গলায় বলল, আপনি আমাকে লোভ দেখবেন না। আমি— আমি–। তার গলা রুদ্ধ হল।

মুখার্জিগিন্নী বললেন, ঠিক আছে। এখন কিছু বলতে হবে না। তুমি কি ঠিক লে তা আমাদের জানিও। জানার পর তোমার মা ঠাকুমার সঙ্গে উনি গিয়ে দেখা করবেন। হাজার হোক এখনও বেঁচে আছেন।

নিজেকে স্থির করতে একটু সময় নিল দীপাবলী। মুখার্জিগিন্নী তাকে বাইরের ঘরে নিয়ে এলেন। তার জিনিসপত্র ইমিধ্যেই গাড়িতে তোলা হয়ে গিয়েছে। কিছুতেই আর আগের মত স্বচ্ছন্দ হতে পারছিল না সে। এখন এই বাড়ির প্রত্যেকে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। পরেশবাবু বললেন, একা যাচ্ছ, সাবধানে যাবে। এই কাগজটা রাখো। আমার ঠিকানা লেখা রয়েছে। গিয়েই চিঠি দেবে। অলোক, ওকে ট্রেনের ভেতর বসিয়ে দিয়ে তবে আসবি।

মুখার্জিগিন্নী হাসলেন, দীপাবলী কি আমাদের মতন? ও একা যেভাবে এসেছে তাতে ফিরে যেতে কোন অসুবিধে হবে না।

পরেশবাবু বললেন, ঠিক আছে। তবু সাবধানের মার নেই।

দীপাবলীর মনে হল যাওয়ার আগে এদের প্রণাম করা উচিত। অন্তত এই অল্প সময়ের মধ্যেই যে স্নেহ ভালবাসা সে পেল তা কত বছর কেউ দেয়নি। এটুকুর জন্যেই মাথা নোয়ানো যায়। তার পরেই মনে হল প্রণাম করলে এরা ভাববেন যে প্রস্তাবে আপ্লুত হয়ে গেছে। একটা দ্বিধা মাঝখানে এসে দাঁড়াল। সে মুখ নামিয়েই বলল, চলি। তারপর ধীরে ধীরে গেট পেরিয়ে গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। অলোক দরজা খুলে দিতে সে একবার মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে গাড়িতে উঠে বসল।

গাড়ি চলতে শুরু করামাত্র দীপাবলী আড়ষ্ট হল। সে বাঁদিকে মুখ ঘুরিয়ে বাইরে তাকাল। এমন অস্বস্তি এবং সঙ্কোচ সে জীবনে বোধ করেনি। হাত-পা ভারি হয়ে আসছে। কিছুতেই সহজ হতে পারছে না। দীপাবলী সোজা হয়ে বসল। নিজের একি চেহারা দেখছে। সে? এমন তো কখনও হয়নি! বড় রাস্তায় গাড়ি এনে অলোক জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার? এত চুপচাপ কেন?

দীপাবলী মুখ ফেরাল না। কি জবাব দেবে? তাকে মুখার্জি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া। হয়েছিল যে কারণে তা অবশ্যই ওই ভদ্রলোক জানেন। এই যে স্টেশনে পৌঁছে দেবার জন্যে এমন ব্যবস্থা করা সেটাও নিশ্চয়ই আগে থেকে ভেবে নেওয়া। আচমকা হেসে ফেলল সে। তার মত মেয়ের এমন বিড়ম্বিত হওয়া মোটেই মানায় না।

অলোক বলল, যাক, তবু শেষ পর্যন্ত হাসলেন। কিন্তু ব্যাপারটা কি?

কিছুই না। দিল্লীর রাত দেখছি। গলা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল দীপাবলী।

ও। এখন তো শূন্য রাজপথ।

আমার শূন্যতাই ভাল লাগে। চার ধার শূন্য হয়ে গেলে নিজেকে মূল্যবান মনে হয়।

যাচ্চলে! এ তো স্বাৰ্থপরের মত কথা হয়ে গেল।

আমরা কে স্বার্থপর নই বলুন? কেউ কম কেউ বেশী।

হয়তো। কিন্তু কেউই নিজেকে স্বার্থপর ভাবতে চাই না।

এটাই তো মুশকিল।

ফের দিল্লীতে কবে আসছেন?

ঠোঁট কামড়েই আবার স্বাভাবিক হল দীপাবলী, যদি কপালে লেখা থাকে তাহলে ডাক পাব। আর তখন এদিকে আসতেই হবে।

তার মানে সরকারি ডাক ছাড়া আসছেন না। তা কলকাতায় গেলে যদি আপনার সঙ্গে। দেখা করতে যাই তাহলে দেখা করবেন তো?

নিশ্চয়ই। বলামাত্র দীপাবলীর খেয়াল হল মুখার্জি পরিবারের কেউ তার ঠিকানা চেয়ে নেয়নি। মুখার্জিগিন্নী অমন উৎসাহ দেখালেন অথচ যোগাযোগের কোন ব্যবস্থা রাখেননি। নাকি উনি ভেবেছেন সে নিজেই চিঠি লিখে জানাবে বিয়ে করতে রাজী এবং সেই চিঠিতে ঠিকানাটা জানিয়ে দেবে! অদ্ভুত ব্যাপার তো!

অলোক জিজ্ঞাসা করল, আবার চিন্তায় ডুবে গেলেন। ঠিক আছে, গিয়ে বিরক্ত করব না।

দীপাবলী মুখ ফেরাল, দেখা যে করবেন ঠিকানা পাবেন কোথায়? আপনারা কেউ আমার ঠিকানা জানেন না। তাই না?

জানি। বাবা গতকালই আপনার ঠিকানা পেয়েছেন।

সেকি? কি করে?

কাল রাত্রে যেখানে ছিলেন সেখানে আপনাকে ঠিকানা লিখতে হয়েছিল।

দারুণ লজ্জা পেল দীপাবলী। এবং খুব খারাপ লাগল। আজকাল অল্পে সে মানুষকে সন্দেহ এবং অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে। আগে কখনই এমন ভাবনা মাথায় আসত না। ওই চাকরিজীবন কি তার মানসিকতাই পাল্টে দিল? যদি এখন মুখার্জিগিন্নী তার মনের চেহারাটা দেখতে পেতেন তাহলে! সে চুপ করে রইল। ভাগ্যিস অলোকআর কথা বাড়ায়নি।

প্ল্যাটফর্মে তখনও ট্রেন আসেনি। অলোক জিজ্ঞাসা করল, আপনি ভাল বলতে পারবেন? ট্রেনে ভাল খাবার পাওয়া যায় আজকাল?

যা যায় তাতেই ম্যানেজ করে নিতে পারি।

যাত্রীর ব্যস্ততা, মাইকের আওয়াজ, কে বলবে এখন বেশ রাত। দীপাবলীর মনে পড়ল, আসার সময় এই স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে কিরকম একলা লেগেছিল। তখন দিল্লীটাকে। একটুও সহজ জায়গা বলে মনে হয়নি। এখন অলোকপাশে দাঁড়াতে সেসব অনুভূতি আর হচ্ছে না। অলোক অনেকক্ষণ কথা বলছে না, এবং বলছে না বলেই তার ভাল লাগছে। হঠাৎ সে বলল, রাত হয়ে গেছে। আপনাকে ফিরতেও হবে অনেকটা।

অলোক ঘাড় নাড়ল, অসম্ভব। মায়ের আদেশ, আপনাকে শেষপর্যন্ত দেখে যেতে হবে।

বাবাঃ, আপনি দেখছি খুব মাতৃভক্ত!

সময় বিশেষে। বলেই হেসে উঠল অলোক, আমার উপস্থিতি আপনার পছন্দ হচ্ছে না।

এ মা! আমি তাই বলেছি? দীপাবলী প্রতিবাদ করল।

কলকাতায় গিয়ে কি করবেন? মানে এখনকার পরিকল্পনা কি?

অপেক্ষা করা!

অপেক্ষা? কিসের?

ডাকের। যার পরীক্ষা দিয়ে গেলাম।

ও। তাই বলুন।

গাড়ি এল। দীপাবলীকে তার জায়গায় বসিয়ে অলোক বলল, পৌঁছানো সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত মাবাবা অস্বস্তিতে থাকবেন। ওটা দয়া করে দেবেন।

দীপাবলী ঘাড় নাড়ল। অলোককামরা থেকে নেমে জানলার গায়ে এল, প্রার্থনা করছি। সরকার আপনাকে ডাকবেন এবং আমরা একজন ভাল প্রশাসক পাব।

দীপাবলী হেসে ফেলল। খানিকটা দূরে সরে দাঁড়াল অলোক। এবং শেষ পর্যন্ত ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ বুক খালি করে স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। অদ্ভুত ভদ্রতা দিয়ে নিজেকে মুড়ে রাখতে পারল অলোক।একবারের জন্যেও এমন কথা বলেনি যার জবাব দিতে সে অস্বস্তিতে পড়ত। অন্তত, এই একটি পরিবারের প্রতিটি মানুষ তার দেখা অনেক চরিত্র থেকে ব্যতিক্রম। এই রকম সম্রম রেখে যাঁরা মেলামেশা করতে পারেন, আচমকা অর্জুন নায়কের কথা মনে পড়ে গেল তার। লোকটার যত দুনামই থাকুক কোনদিন তাকে অসম্মান করেনি। তবু অলোকের সঙ্গে লোকটার কত তফাত অলোককেবন্ধু ভাবতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় না।

কলকাতায় দিন কাটছিল একই তালে। কোনও বৈচিত্র্য নেই। শুধু বিজ্ঞাপন দেখে যাওয়া। মাঝে মাঝে মনের মত কিছু পেলে দরখাস্ত। ফিরে এসে সে মিসেস মুখার্জিকে পৌছসংবাদ জানিয়েছে। তার উত্তরও লিখেছিলেন তিনি। এবং সেই চিঠিতে প্রস্তাব-বিষয়ক কোন কথাবার্তা নেই। খুব স্নেহমাখানো ছিল সেটা। দীপাবলীর ভাল লেগেছিল। কিন্তু কি উত্তর লিখবে ভেবে না পাওয়ায় রেখে দিয়েছিল। তারপরে সময় গিয়েছে কিছুটা।

সর্বভারতীয় পরীক্ষায় কৃতকার্য হবেই ধরে নিয়ে বসে থাকা নিতান্ত বোকামি তা বুঝতে দীপাবলীর অসুবিধে হয়নি। তার বিশ্বাস ছিল ডাক আসবেই কিন্তু বিশ্বাস থাকা এবং সেটা বাস্তবে হওয়া এক নাও হতে পারে। অতএব অন্য চাকরি দরকার। তার মনে পড়ল সুবিনয় সেনের কথা। ভদ্রলোক দীননাথ শ্ৰীবাস্তবের সঙ্গে একদিন আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। ইংরেজি বাংলা যে-কোন কাগজের বড় বড় বিজ্ঞাপনগুলোর নিচে দীননাথজীর বিজ্ঞাপনসংস্থার নাম সংক্ষেপে ছাপা হতে দেখেছে সে। ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করলে কি রকম হয়! যদিও সে বিজ্ঞাপনের কাজকর্ম সম্পর্কে কিছুই জানে না তবু সুযোগ পেলে শিখে নিতে নিশ্চয়ই পারবে। একটা ব্যাপার সে প্রায়ই ভাবে। এতগুলো বছর কেটে গেল, ঠিকঠাক পড়াশুনা করল কিন্তু কোন বিষয়েই নিজেকে যোগ্য করতে পারল না। সে গলা তুলে বলতে পারবে না এই বিষয়টা আমি জানি এবং তা থেকে আমি অর্থ রোজগার করতে পারব। একজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি বা ট্যাক্সি ড্রাইভারের যে যোগ্যতা আছে এবং তা নিয়ে যে-কোন জায়গায় যে দাবি সে করতে পারে তার বিন্দুমাত্র সে এতদিন অর্জন করেনি। শুধু সে নয়, পশ্চিমবাংলার নব্বইভাগ ছেলেমেয়ে একই অপরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থার ফসল। ফলে ভিক্ষে চেয়ে কাটাতে হবে জীবন, দাবি করার জোর থাকবে না।

মায়া কলকাতায় নেই। এক তরুণ পরিচালকের ছবিতে অভিনয় করতে দার্জিলিং-এ গিয়েছে। মাসীমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু তিনি রাজী হননি। মেয়েটা ক্রমশ ফিল্ম লাইনে জায়গা করে নিতে পারবে বলেই মনে হয়। নায়িকা নয়, পার্শ্বচরিত্রে এর মধ্যে অনেকগুলো কাজ পেয়ে গিয়েছে।

সকাল দশটায় মোটামুটি ভদ্র হয়ে দীননাথ শ্ৰীবাস্তবের সঙ্গে দেখা করবে বলে দীপাবলী বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল। দরজা থেকে নামতেই সে একটা পুলিশভ্যান দেখতে পেল। ভ্যান থেকে একজন পুলিশ অফিসার কাউকে যে ঠিকানা জিজ্ঞাসা করছেন সেটা তাদেরই। দীপাবলী এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কাকে খুঁজছেন?

ভদ্রলোক নেমে এলেন গাড়ি থেকে, মায়াদেবী আপনার কেউ হন?

কেন বলুন তো?

একটা দরকারী খবর দেওয়ার আছে।

আমাকে বলতে পারেন। আমরা এক বাড়িতেই থাকি।

ও। আমরা একটু আগে দার্জিলিং থেকে খবর পেয়েছি। কাল রাত্রে শুটিং-এর সময় ওঁর অ্যাকসিডেন্ট হয়। কন্ডিশন খুব খারাপ।

কি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে?

তা আমাদের জানানো হয়নি। ঠিক আছে, চলি।

ভ্যানটা বেরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নড়তে পারল না দীপাবলী। মায়ার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। সে কি করবে বুঝতে পারছিল না। এর মধ্যে পুলিশ দেখে যে ভিড় জমে গিয়েছিল তার এক অংশ খবরটা ছড়িয়ে দিয়েছে। সে ভেতরে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে মাসীমা তীরের মত ছুটে এলেন, হ্যাঁরে, যা শুনছি তা সত্যি?

মাথা নাড়ল দীপাবলী, হ্যাঁ। মাসীমা মুখে আঁচল চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। দীপাবলী তাঁকে জড়িয়ে ধরল। ভিড় জমে গেল দরজা খোলা থাকায়। মায়াকে সবাই চেনেন। এ পাড়ার ডানপিটে মেয়ে হিসেবে তার প্রচার ছিল ছেলেবেলায়।

দীপাবলী কোনমতে মাসীমাকে ভেতরে নিয়ে এসে বলল, আপনি ভেঙে পড়বেন না মাসীমা। অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে কিন্তু ও এখনও বেঁচে আছে। আমাদের এখনই দার্জিলিং-এ যাওয়া উচিত। আপনি তৈরি হন আমি ব্যবস্থা করছি সব।

মাসীমা মাথা নাড়লেন কাঁদতে কাঁদতে, আমি যাব না। যাওয়ার সময় যেতে বলেছিল তবু যাইনি। গেলে হয়তো এমন হত না। আশ্চর্য, যাননি বলে বিপদের সময় যাবেন না?

দীপাবলী বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমে সুদীপকে খুর দিল। সুদীপ তখনও বাড়িতে ছিল। খবরটা শুনে ঠোঁট কামড়ালো। দীপাবলী তাকে বলল, আজ সন্ধের ট্রেনে মাসীমাকে নিয়ে আমাদের যাওয়া উচিত সুদীপ।

ভিড় বাড়িয়ে কি হবে? আমি একাই যাচ্ছি। সুনীল গম্ভীর গলায় বলল।

তুমি একা ম্যানেজ করতে পারবে?

হসপিটালে ম্যানেজ করার কিছু নেই। তা ছাড়া একে দেখাশোনা করার জন্যে শমিত আছে। ওই শ্যুটিং পার্টিতে সে-ও ছিল।

শমিত একই ছবিতে অ্যাক্টিং করছে?

হ্যাঁ। ঠিক আছে। তুমি মাসীমাকে বলো তৈরী হতে, আমি বিকেলে স্টেশনে যাওয়ার সময় ওঁকে তুলে নেব।

দীপাবলীর কিছু ভাল লাগছিল না। আজ দীপাবলীর ওখানে যাওয়ার মনটাও নেই। কেবলই মায়ার মুখ মনে পড়ছিল। অন্যরকম হয়ে বেঁচে থাকার উৎসাহ পেয়েছিল সে মায়াকে দেখে, কলকাতায় পড়তে এসে। সেই মায়া এখন হাসপাতালে! কিন্তু শমিত সঙ্গে আছে। এ কথা যাওয়ার আগে মায়া তাকে বলে যায়নি। সুদীপ জানত। আর সুদীপ এখন বলল না তাকে সঙ্গী হতে। সত্যি তো, অনর্থক ভিড় বাড়িয়ে লাভ কি! ক্লান্ত পায়ে বাড়িতে ফিরতেই সে ডাক পিনের দেখা পেল। তার চিঠি এসেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *