২০. আষাঢ় মাস, বর্ষা নেমে গেছে

আষাঢ় মাস, বর্ষা নেমে গেছে। প্রতিদিন বর্ষা আসছে কেঁপে কেঁপে, এরই মধ্যে চলেছে রাণুর বিয়ের প্রস্তুতি।

কবির আবার ইওরোপ যাবার কথা। ভেবেছিলেন রাণুর বিবাহের দিন থাকতেই পারবেন না, কিন্তু সে যাত্রা পিছিয়ে গেল।

তিনি আশা করেছিলেন, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে থেকেই বিয়ে হবে রাণুর, সে জন্য বাড়ি রং করালেন। কিন্তু পাত্র পক্ষ তাতে রাজি নন, এ বিয়েতে ঠাকুর বাড়ির কোনও ভূমিকা তাঁরা চান না।

রাজেন্দ্রনাথ মধ্য কলকাতায় একটি মস্ত বড় বাড়ি ভাড়া করে দিলেন কন্যাপক্ষের জন্য। সে বাড়িতে বাগান আছে, পুকুর পর্যন্ত আছে। অধিকারীদের সমস্ত আত্মীয়-স্বজনদের স্থান সঙ্কুলান হয়ে যাবে সেখানে।

বিয়ের দিন বৃষ্টি পড়ছে সকাল থেকে। দুপুরেই কবি পুত্রবধূ প্রতিমাকে পাঠিয়ে দিলেন, তার মতন এমন সুন্দর করে সাজাতে আর কেউ পারে না।

এক দঙ্গল মেয়ে ঘিরে বসে আছে, তার মধ্যে সাজানো হচ্ছে রাণুকে। যেন একটু একটু করে গড়া হচ্ছে দেবী প্রতিমা। ডাকের সাজের মতন সোনা-রুপোর গয়নার মুড়ে দেওয়া হল সারা শরীর। যত্নে বাঁধা কবরীতে যূথী ফুলের মালা।

সাজ যখন প্রায় শেষ, তখন বীরেনের এক বোন প্রেমলতা এসে বলল, এ সাজ চলবে না। সব খুলে ফেলতে হবে। সে নিজে সাজাবে।

সবাই বিস্মিত। এত সুন্দর সাজ। খুলে ফেলতে হবে কেন?

বীরেনের মা বলে পাঠিয়েছেন, প্রতিমা একবার বিধবা হয়েছিল। রথীর সঙ্গে তার দ্বিতীয়বার বিয়ে হয়েছে। শুভ কাজে এরকম কোনও রমণীর স্পর্শই অকল্যাণকর।

জল এসে গেল প্রতিমার চোখে। সে সেখান থেকে দৌড়ে চলে গেল। রাণুও উঠে যাচ্ছিল তাকে ধরতে, অন্য সবাই তাকে জোর করে বসিয়ে রাখলেন চেয়ারে। সেও কাঁদতে লাগল নিঃশব্দে।

উপস্থিত সকলকে বলে দেওয়া হল, এ কথা কোনওক্রমেই জানানো হবে না কবিকে। পাত্রপক্ষের প্রবল প্রতিপত্তি, তাদের কোনও নির্দেশই উপেক্ষা করার উপায় নেই। তারা যদি বেঁকে বসে, লগ্নের সময় যদি বর না আসে, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, সারাজীবনে রাণুর আর বিয়ে হবে না। পাত্রের অন্য বিয়েতে অবশ্য কোনও নিষেধের কথা লেখা নেই শাস্ত্রে।

আলোর রোশনাইতে রাতকে দিন করা হয়েছে, চতুর্দিকে ফুলের সমারোহ। রোশনচৌকিতে শানাই বাজাচ্ছে বিখ্যাত বাদকের দল। দ্বারের কাছে আমন্ত্রিতদের গায়ে পিচকিরিতে আতর ও গোলাপজল ছড়াচ্ছে কয়েকটি বালক-বালিকা। বিলি হতে লাগল কাগজে ছাপা অনুরূপা দেবীর লেখা বিয়ের পদ্য।

 

যথা সময়ে পরপর কয়েকটি রোলস রয়েস গাড়িতে চেপে উপস্থিত হল বর ও বরযাত্রীর দল। উলুধ্বনিতে মুখরিত হল অঞ্চল। রাণুর মা গঙ্গাজলে বীরেনের পা ধুইয়ে দিয়ে বরণ করে নামালেন গাড়ি থেকে।

সমস্ত রকম শাস্ত্রীয় আচার মেনে নিষ্পন্ন হল বিবাহ।

শান্তিনিকেতন থেকে গায়ক-গায়িকার দল আনিয়েছেন কবি। শুভদৃষ্টির আগে দণ্ডায়মান বরকে ঘিরে, পিড়িতে বসানো কনেকে যখন সাত পাক ঘোরানো হল, তখন তারা গান ধরল, একটু দুরে বসে সব দেখতে লাগলেন কবি। এক সময় যজ্ঞ শুরু হতেই তিনি উঠে চলে গেলেন।

তারপর বাসর ঘরে নানা রকম গান বাজনা ও রঙ্গ কৌতুক চলল অনেক রাত পর্যন্ত। সেখানে ঠাকুরবাড়ির কেউ উপস্থিত রইলেন না।

পরদিন ভোরে গাড়ি নিয়ে এলেন ভাসুর। এসে গেল বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদের মুহূর্ত। এ সময় চেঁচিয়ে কাঁদতে নেই, মুখে আঁচল চাপা দিতে হয়। ঝাপসা চোখে রাণু কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, বুঝতেই পারল না, কখন পৌঁছে গেল শ্বশুর বাড়ি।

হ্যারিংটন স্ট্রিটে মুখার্জিদের প্রাসাদটি কলকাতার অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান।

সকালে সেখানে হল হিন্দু মতে কুশণ্ডিকা। সন্ধ্যায় বিলিতি কায়দায় রিসেপশান। বাংলার গর্ভনর, বহু ইংরেজ রাজ-পুরুষ এবং অনেক রাজা-মহারাজ, বিখ্যাত ব্যক্তিদের আগমনে ভরে গেল বিশাল হল ঘর। বাজতে লাগল বিলিতি বাজনা। প্রথমে পরিবেশিত হল চা, তারপর শ্যাম্পেন।

বিবাহের পরের রাতটিকে বলে কালরাত্রি। এ রাতে বর ও বধূর এক সঙ্গে থাকতে নেই। রাণুকে নিয়ে যাওয়া হল তার বড় ননদের ঘরে।

তৃতীয় রাত, ফুলশয্যার রাত্রিটিতেই প্রকৃত পক্ষে বর ও বধূর প্রথম মিলন। তাদের জীবনে এটাই দীর্ঘতম রাত। এ রাতে ঘুম জানলার ঝিল্লিতে অপেক্ষা করে বারবার ফিরে যায়। শেষ রাতে পাকাপাকি আসে। তাই পরদিন রোদুর উঠে গেলেও তাদের কেউ জাগায় না।

কিন্তু পরদিন সকাল হতে না হতেই এই নব দম্পতির দরজায় ঘা দিয়ে ডেকে জাগাতে হল। নববধুর সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছে।

এরকম দিনে, এত সকালে কেউ আসে? এমন সৃষ্টিছাড়া ব্যাপার কেউ কখনও দেখেনি। বাড়ির সকলেরই ভুরু কুঞ্চিত হয়ে গেল।

অন্য কেউ হলে ফিরিয়ে দেওয়া যেত, কিন্তু আগন্তুকটি যে সে কেউ নয়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সন্তান, খ্যাতিমান পুরুষ, তাই তাঁকে বসিয়ে রাখা হল বৈঠকখানা ঘরে।

কবি সেখানে বসে রইলেন একা। পরের ট্রেনে তিনি শান্তিনিকেতনে যাবেন, তাই রাণুকে একবার দেখতে এসেছেন। এভাবে, এই সময়ে, আগে থেকে কিছু না জানিয়ে আসাটা যে অসমীচীন, সে কথা তাঁর মনেই আসেনি।

অনাত্মীয় পরপুরুষদের সামনে এ বাড়ির বউদের দেখা করার প্রথা নেই। তবু কর্তারা যখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনুমতি দিয়েছেন, নতুন বউকে পুরোপুরি সাজিয়ে গুজিয়ে পাঠাতে হবে। অনেকটা সময় লাগল।

বেগুনি রঙের ঢাকাই শাড়ি ও অনেক রকম অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে, ননদিনী ও অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে রাণু নেমে এল নীচে। দাঁড়াল ড্রয়িংরুমের দরজার কাছে। তার মাথায় ঘোমটাটানা।

তাকে দেখা মাত্র কবি বুঝতে পারলেন, কী ভুল করেছেন।

এ অন্য রাণু, অন্যের রাণু। এখানে তার সঙ্গে কথা বলতে গেলেও আর সবাই দাঁড়িয়ে থাকবে।

রাণু রাছে এগিয়ে তাঁর পায়ের কাছে বসে প্রণাম করল। এই তার প্রথম প্রণাম। কবি তার মাথায় হাত রেখে অস্ফুট স্বরে আশীর্বাণী উচ্চারণ করে বেরিয়ে গেলেন দ্রুত।

রাণুকে আর চিঠি লেখা কিংবা যোগাযোগ রক্ষা করা উচিত নয়, কবি তা জানেন। তবু এক এক সময় মন মানে না। এক এক সময় এই বিচ্ছেদের শূন্যতা অসহ্য মনে হয়। এক এক সময় যুক্তিহীন হয়ে যান। রাণুকে ডেকে পাঠান।

রাণুর যে এখন বাইরে যাওয়ার অনেক বিধিনিষেধ, তা সে কবিকে কী করে বোঝাবে! বেরোতে হলেই সঙ্গে কেউ থাকে। বিশেষ করে তার ঠাকুরবাড়ি যাওয়া আসা শ্বশুরবাড়ির কেউ পছন্দ করে না। স্পষ্ট আপত্তি জানায় না, কিন্তু অসন্তোষের ভাব স্পষ্ট ফুটে ওঠে। তাই যেতেও চায় না রাণু।

কবি একদিন তোক মারফত চিঠি দিয়ে পাঠালেন। আজ সন্ধেবেলা তিনি একটা থিয়েটার দেখতে যাবেন, সঙ্গে নিয়ে যেতে চান রাণুকে। চিঠির ভাষা যেন আদেশের মতন। তিনি বীরেনকে আসতে বলেননি, শুধু রাণুকে।

শ্বশুর-শাশুড়ির বদলে রাণু অনুমতি চাইল তার স্বামীর কাছে। বীরেন বাংলা গান, কবিতা বা বাংলা সাহিত্যেরই ধার ধারে না। সে ভালবাসে পোলো খেলা। মোটর রেসিং। মাঝে মাঝে স্ত্রীকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাওয়া তার অবসর বিনোদন।

বিয়ের আগেকার উড়ো চিঠির প্রসঙ্গ নিয়ে সে কখনও উচ্চবাচ্য করেনি। তবে জোড়াসাঁকোর কবি কিংবা শান্তিনিকেতনের গুরুদেবের প্রতি যে তার তেমন টান নেই, তা সে হাবেভাবে বুঝিয়ে দেয়।

রাণুর অনুরোধ শুনে সে বলল, আজ কী করে যাওয়া হবে? আজ বাড়িতে একটা পার্টি আছে, তুমি না থাকলে অতিথিরা কী মনে করবে?

রাণু তবু মিনতি করে বলল, যদি ঠিক সময়ে চলে আসি? অনেক। দিন থিয়েটার দেখিনি, আমার খুব ইচ্ছে করছে।

বীরেন নিরেশ গুলায় বলল, যদি আটটার মধ্যে ফিরে আসতে পারো তো যাও!

শুধু তো থিয়েটার দেখা নয়, কবির সঙ্গে বসে থিয়েটার দেখা! বাড়ির গাড়ি ও একজন সরকার মশাইকে নিয়ে গেল রাণু। জোড়াসাঁকোয় গিয়ে সে আর ওপরে উঠল না, খবর পাঠাতে কবি নিজেই নেমে এলেন।

রাণুকে দেখে তিনি ছেলেমানুষের মতন খুশি।

রাণুর জমকালো সাজগোেজ দেখে তিনি বললেন, সেই রাণু! মুখখানি কিন্তু ঠিক একই রকম আছে। মনে হয় যেন কত যুগ দেখিনি তোমাকে।

গাড়িতে সরকার মশাই ও ড্রাইভার আছে বলে কথা বলতে অস্বস্তি হচ্ছে রাণুর।

থিয়েটার আরম্ভ হবার কথা সাড়ে পাঁচটায়। সময় রক্ষা করা বাঙালিদের ধাতে নেই। তা ছাড়া নাটকের আগে ছোটখাটো বক্তৃতা, কবিকে দেওয়া হল পুষ্প স্তবক। শুরুতেই এক ঘণ্টা দেরি।

সাধারণ দর্শকদের থেকে আলাদা করে একেবারে সামনে কবি ও রাণুকে বসানো হয়েছে দুটি সিংহাসনের মতন বড় ভেলভেট মোড়া চেয়ারে। কবি পুষ্প স্তবকটি তুলে দিয়েছেন রাণুর হাতে।

কবির নাটক ‘চিরকুমার সভা প্রথম অভিনীত হচ্ছে পেশাদারি মঞ্চে। চমৎকার সেট। নাট্যকার স্বয়ং উপস্থিত বলে অভিনেতা অভিনেত্রীরা অভিনয় করছে প্রাণ ঢেলে, গানগুলিও জমেছে বেশ।

মাঝখানের বিরতির সময়ই বেজে গেল পৌনে আটটা।

মাঝে মাঝে হাতঘড়ি দেখছে, আর ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে রাণু। নাটকটির প্রতি আকর্ষণও অদম্য, তবু পিছু টান।

একটু আসছি বলে সে উঠে গেল।

হলের ম্যানেজারের ঘরে গিয়ে সে টেলিফোন করল শ্বশুরবাড়িতে। অন্য একজন ধরতে সে চাইল বীরেনের সঙ্গেই কথা বলতে।

অন্য লোকটি কয়েক মুহূর্ত পরে বলল, সাহেব বলছেন, তিনি ব্যস্ত আছেন, আমাকেই বলুন।

রাণু বলল, আমি যে নাটকটি দেখছি, সেটা শেষ হতে খানিকটা দেরি হবে।

রাণু বুঝতে পারল, বীরেন কাছেই দাঁড়িয়ে আছে, তবু সে ফোন ধরবে না, লোকটি রাণুর কথা বীরেনকে রিলে করে শোনাচ্ছে।

একটু পরে লোকটি জানাল, সাহেব বললেন, অতিথিরা সবাই এসে বসে আছেন। মিসেস মুখার্জিকে বলো, উনি না এলে খাবার পরিবেশন করা যাবে না।

আর কোনও কথা নয়।

রাণু পড়ল বিষম দোটানায়। কথা শুনেই বোঝা গেল, এখুনি না ফিরলে বীরেন বিষম রাগ করবে। আর নাটক না দেখে মধ্য পথে চলে গেলে দুঃখিত হবেন কবি। এ নাটক শেষ হতে আরও অন্তত সওয়া ঘণ্টা।

কয়েক মিনিট দ্বিধায় দুলতে লাগল রাণু। কবির অনুমতি নিতেও তার পা সরল না। মনস্থির করে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে উঠে পড়ল গাড়িতে।

মধ্য পথে কী ভেবে সে জানলা দিয়ে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিল। ফুলের স্তবকটি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *