বিংশ পরিচ্ছেদ
আরও এক বৎসর কাটিয়া গিযাছে। চৈত্র মাস যায়-যায়।
অপু অনেকদিন পরে দেশে ফিরিতেছিল। গাড়ির মধ্যে একজন মুসলমান ভদ্রলোক লক্ষ্ণৌ-এর খরমুজার গুণবর্ধনা করিতেছিলেন, অনেকে মন দিয়া শুনিতেছিল—অপু অন্যনস্কভাবে জানালার বাহিরে চাহিয়া ছিল। কতক্ষণে গাড়ি বাংলা দেশে আসিবে? সাতসমুদ্র তেরো নদী পারের রুপকথার রাজ্য বাংলা! আজ দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বৎসর সে বাংলার শান্ত, কমনীয় রূপ দেখে নাই, এই বৈশাখে বাঁশের বনে বনে শুকনো বাঁশখোলার তলা-বিছাইয়া পড়িয়া-থাকা, কাঞ্চনফুলে-ভরা সানবাঁধানো পুকুরের ঘাটে সদ্যস্নাত নতমুখী তরুণীর মূর্তি কলিকাতার মেস-বাটী, দালানের রেলিং-এ কাপড় মেলিয়া দেওয়া, বাবুরা সব আপিসে, নিচের বালতিতে বৈকাল তিনটার সময় কলের মুখ হইতে জল পড়িতেছে—এসব সুপরিচিত এই প্রিয় দৃশ্যগুলি আর একবার দেখিবার জন্য—উঃ, মন কি ছটফটই না করিয়াছে গত ছবছর! বাংলা ছাড়িয়া সে ভালো করিয়া বাংলা চিনিয়াছে, বুঝিয়াছে। বাংলাকে দেখা যাইবে আজ। সন্ধ্যা ঠিক সাতটার সময়।
রানীগঞ্জ ছাড়িয়া অনেক দূর আসিবার পরে, বালুময় মাঠের মধ্যে সিঙ্গারণ নদীর গ্রীষ্মের জল খররৌদ্রে শুকাইয়া গিয়াছেদূর গ্রামের মেয়েরা আসিয়া নদীখাতের বালু খুঁড়িয়া সেই জলে সী ভর্তি করিয়া লইতেছে—একটি কৃষক-বধূ জলভরা কলসি কাঁখে রেলের ফটকের কাছে দাঁড়াইয়া গাড়ি দেখিতেছে—অপু দৃশ্যটা দেখিয়া পুলকিত হইয়া উঠিল-সাবা শরীরে একটা অপূর্ব আনন্দশিহরণ! কতদিন বাংলার মেয়ের এ পরিচিত ভঙ্গিটি সে দেখে নাই! চোখ, মন জুড়াইয়া গেল।
বর্ধমান ছাড়াইয়া নিদাঘ অপরাহের ঘন ছায়ায় একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়িল। একটা ছোট পুকুর ফুটন্ত পদ্মফুলে একেবারে ভরা, ফুলে পাতায় জল দেখা যায় না—ওপারে বিচালি-ছাওয়া গৃহস্থের বাটী, একটা প্রাচীন সজিনা গাছ জলের ধারে ভাঙিয়া পড়িয়া গলিয়া খসিয়া যাইতেছে, একটা গোবরগাদা–আজ সারাদিনের আগুনবৃষ্টির পরে, বিহার ও সাঁওতাল পরগণার বন্ধুর, আগুনরাঙা ভূমিশ্রীর পরে, ছায়াভরা পদ্মপুকুরটা যেন সারা বাংলার কমনীয় রূপের প্রতীক হইয়া তাহার চোখে দেখা দিল।
হাওড়া স্টেশনে ট্রেনটা আসিয়া দাঁড়াইতেই সে যেন খানিকটা অবাক হইয়া চারিদিকে চাহিয়া দেখিল-এত আলো, এত লোকজন, এত ব্যস্ততা, এত গাড়ি-ঘোড়া জীবনে যেন সে এই প্রথম দেখিতেছে, হাওড়া পুল পার হইবার সময় ওপারের আলোকোজ্জ্বল মহানগরীর দৃশ্যে সে যেন মুগ্ধ হইয়া গেল—ওগুলো কি? মোটর বাস? কই আগে তো ছিল না কখনও? কি বড়ো বড়ো বাড়ি কলিকাতায়, ফুটপাতে কি লোকজনের ভিড়! বাড়ির মাথায় একটা কিসের বিজ্ঞাপনের বিজলী আলোর রঙিন হরপ একবার জ্বলিতেছে, আবার নিভিতেছে–উঃ, কী কাণ্ড!
হ্যারিসন রোডের একটা বোর্ডিং-এ উঠিয়া একা একটা ঘর লইল-স্নানের ঘর হইতে সাবান মাখিয়া স্নান সারিয়া সারাদিনের ধুম-ধূলি ও গরমের পর ভারি আরাম পাইল। ঘরের আলোর সুইচ টিপিয়া ছেলেমানুষের মতো আনন্দে আলোটাকে একবার জ্বালাইতে একবার নিভাইতে লাগিল–সবই নতুন মনে হয়। সবই অদ্ভুত লাগে।
পরদিন সে কলিকাতার সর্বত্র ঘুরিল—কোন পরিচিত বন্ধু-বান্ধবের সহিত দেখা হইল না। বৌবাজারের সেই কবিরাজ বন্ধুটি বাসা উঠাইয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে, পূর্বপরিচিত মেসগুলিতে নতুন লোকেরা আসিয়াছে, কলেজ স্কোয়ারের সেই পুরাতন চায়ের দোকানটি উঠিয়া গিয়াছে।
সন্ধ্যার সময় সে একটা নতুন বাংলা থিয়েটারে গেল শুধু বাংলা গান শোনার লোভে। বেশি দামের টিকিট কিনিয়া রঙ্গমঞ্চের ঠিক সম্মুখের সারির আসনে বসিয়া পুলকিত ও উৎসুক চোখে সে চারিদিকের দর্শকের ভিড়টা দেখিতেছিল। একটা অঙ্কের শেষে সে বাহিরে আসিল, ফুটপাতে একজন বুড়ি পান বিক্রি করিতেছে, অপুকে বলিল, বাবু, পান নেবেন না? নেন না! অপু ভাবিল, সবাই মিঠে পান কিনছে বড়ো আয়নাওয়ালার দোকান থেকে। এ বুড়ির পান বোধ হয় কেউ কেনে না-আহা, নিই এর কাছ থেকে।
সকলেরই উপর কেমন একটা করুণার ভাব, সবারই উপর কেমন একটা ভালোবাসা, সহানুভূতির ভাব-অপুর মনের বর্তমান অবস্থায় বুড়ি পানওয়ালী হাত পাতিয়া দশটা টাকা চাহিয়া বসিলেও সে তৎক্ষণাৎ তাহা দিতে পারিত।
দ্বিতীয় অঙ্কের শেষে সে বাহির হইয়া বুড়িটার কাছে পান কিনিতে যাইতেছে, এমন সময় পিছনের আসনের দিকে তাহার নজর পড়িল।
সে একটু আগাইয়া গিয়া কাঁধে হাত দিয়া বলিল—সুরেশ্বরদা, চিনতে পারেন?
কলিকাতায় প্রথম ছাত্র-জীবনের সেই উপকারী বন্ধু সুরেশ্বরদা, সঙ্গে একটি তরুণী মহিলা। সুরেশর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল-গুডনে গ্রেসাদ। আমাদের সেই অপূর্ব না?
অপূর্ব হাসিয়া বলিল—কেন, সন্দেহ হচ্ছে নাকি? ওঃ, কত দিন পরে আপনার সঙ্গে, ওঃ?
—দেখে সন্দেহ হবার কথা বটে। মুখের চেহারা বদলেছে, রঙটা একটু তামাটে—যদিও you are as handsome as ever—ও, তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিইনি আমার বেটার-হাফআর ইনি আমার বন্ধু অপূর্ববাবু–কবি, ভাবুক, লেখক, ভবঘুরে অ্যান্ড হোয়াট নট-তারপর, কোথায় ছিলে এতদিন?
-কোথায় ছিলুম না তা বরং জিজ্ঞেস করুন—in all sorts of places—তবে সভ্যজগৎ থেকে দুরে দুবছর পর কাল কলকাতায় এসেছি। ও ড্রপ উঠল বুঝি, এখন থাক, বলব এখন।
-মোস্ট বাজে প্লে। তার চেয়ে চলল, তোমার সঙ্গে বাইরে যাই
অপু বন্ধুকে সিগারেট দিয়া নিজে সিগারেট ধরাইতে ধরাইতে বলিল—আপনার এ-সব দেখে একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে, তাই ভালো লাগছে না বোধ হয়। আমার চোখ নিয়ে যদি দেখতেন, তবে ছবছর বনবাসের পর উড়িয়াদের রামযাত্রাও ভালো লাগত। জানেন সুরেশ্বরদা, সেখানে আমার ঘর থেকে কিছু দূরে এক জায়গায় একটা গিরগিটি থাকত—সেটা এবেলা-ওবেলা রঙ বদলাত, দুটি বেলা তাই শখ করে দেখতে যেতুম—তাই ছিল একমাত্র তামাশা, তাই দেখে আনন্দ পেতুম।
রাত সাড়ে নটায় থিয়েটার ভাঙিল। তারপর সে থিয়েটার-ঘর হইতে নিঃসৃত সুবেশ নরনাবীব স্রোতের দিকে চাহিয়া রহিল—এই আলো, লোকজন, সাজানো দোকান-পসার—এসব সে ছেলেমানুষের মতো আনন্দে চাহিয়া চাহিয়া দেখিতেছিল।
স্ত্রীকে মানিকতলায় শ্বশুরবাড়িতে নামাইয়া দিয়া সুরেশ্বর অপুর সহিত কর্পোরেশন স্ট্রীটের এক রেস্তোরাঁয় গিয়া উঠিল। অপুর কথা সব শুনিয়া বলিল—এই পাঁচ বছর ওখানে ছিলে? মন-কেমন করত না দেশের জন্য?
-Oh, at times। felt so terribly homesick-homesick for Bengal–শেষ দু-বছর দেশ দেখবার জন্য পাগল হয়েছিলুম।
ফুটপাত বাহিয়া কয়েকটি ফিরিঙ্গি মেয়ে হাসি কলরব করিতে করিতে পথ চলিতেছে, অপু সাগ্রহে সেদিকে চাহিয়া রহিল। মানুষের গলার সুর মানুষের কাছে এত কাম্যও হয়। রাস্তাভরা লোকজন, মোটর গাড়ি, পাশের একটি একতলা বাড়িতে সাজানো ােেনো ছোট্ট ঘরে কয়েকটি সাহেবের ছেলেমেয়ে দুটোছুটি করিয়া খেলা করিতেছে—সবই অদ্ভুত, সবই সুন্দর বলিয়া মনে হয়। আলোকোজ্জ্বল রেস্তোরাঁটায় অনবরত লোকজন ঢুকিতেছে, বাহির হইতেছে, মোটর হর্নের আওয়াজ, মোটর বাইকের শব্দ, একখানা রিকশা গাড়ি ঠুং ঠুং করিতে করিতে চলিয়া গেল—অপু চাহিয়া চাহিয়া দেখিতেছিল—যেন এসব সে কখনও দেখে নাই।
সুরেশ্বরকে বলিল—দেখুন জানলার ধারে এসে-ওই যে নক্ষত্রটা দেখছেন, আজ কবছর ধরে ওটাকে উঠতে দেখেছি ঘন বন-জঙ্গল-ভরা পাহাড়ের মাথার ওপরে। আজ ওটাকে হোয়াইটওয়ে লললর বাড়ির মাথার ওপরে উঠতে দেখে কেমন নতুন নতুন ঠেকছে। এই তো পৌনে দশটা রাত? এ সময় গত পাঁচ বৎসর শুধু আমি জঙ্গল পাহাড়—আর ভেড়িয়ার ডাক, কখনও কখনও বাঘের ডাকও। আর কি loneliness! শহরে বসে সে সব বোঝা যাবে না।
সুরেশ্বরও নিজের কথা বলিল। চট্টগ্রাম অঞ্চলে কোন কলেজের অধ্যাপক, বিবাহ করিয়াছে কলিকাতায়। সম্প্রতি শালীর বিবাহ উপলক্ষে আসিয়াছে। বলিল—দ্যাখো ভাই, তোমার ও জীবন একবার আস্বাদ করতে ইচ্ছে হয় কিন্তু তখন কি জানতুম বিয়ে এমন জিনিস হয়ে দাঁড়াবে? যদি কিছু করতে চাও জীবনে, বিয়ে কোরো না কখনও, বলে দিলুম। বিয়ে করো নি তো?
অপু হাসিয়া বলিল-ওঃ, আমি ভাবছি আপনার এ লেকচার যদি বউদি শুনতেন!…
-না না, শোনো। সত্যি বলছি, সে উনিশ-শো পনেরো সালের সুরেশ্বর আর নই আমি। সংসারের হাড়িকাঠে যৌবন গিয়েছে, শক্তি গিয়েছে, স্বপ্ন গিয়েছে, জীবনটা বৃথা খুইয়েছি কত কি করবার ইচ্ছে ছিল—ওঃ, যেদিন এম.এ. ডিপ্লোমাটা নিয়ে কনভোকেশন হল থেকে বেরুলাম, মনে আছে মাঘের শেষ, গোলদিঘির দেবদারু গাছে নতুন পাতা গজিয়েছে, সবে দখিনা হাওয়া শুরু হয়েছে, গাউন সমেত এক দোকানে গিয়ে ফটো ওঠালুম, কি খুশি! মনে হল, সারা পৃথিবীটা আমার পায়ের তলায়! ফটোখানা আজও আছে—চেয়ে দেখে ভাবি, কি ছিলুম, কি হয়ে দাঁড়িয়েছি! পাড়াগাঁয়ের কলেজে তিনশো চব্বিশ দিন একই কথা আওড়াই, দলাদলি করি, প্রিন্সিপালের মন জোগাই, স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করি, ছেলেদের ডাক্তার দেখাই, এর মধ্যে মেয়ের বিয়ের ভাবনাও ভাবি না না, তুমি হেসো না, এসব ঠাট্টা নয়।
অপু বলিল—এত সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়লেন কেন হঠাৎ সুরেশ্বরদা—এক পেয়ালা কফি
-না না, তোমাকে পেয়ে সব বললুম, কারুর কাছে বলি নে, কে বুঝবে, তারা সবাই দেখছে, দিব্যি চাকরি করছি, মাইনে বাড়ছে, তবে তত বেশই আছি। আমি যে মরে যাচ্ছি, তা কেউ বুঝবে না।
রেস্তোরাঁ হইতে বাহির হইয়া পরস্পর বিদায় লইল। অপু বলিল—জানেন তো বলেছে— In each of child has lived and child has de-a child of prome, who never grew up-কিন্তু জীবনটা অদ্ভুত জিনিস সুরেশ্বরদা-অত সহজে তাকে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। আচ্ছা আসি, বড়ো আনন্দ পেলুম আজ। যখন প্রথম কলকাতায় পড়তে আসি, জায়গা ছিল না, তখন আপনারা জায়গা দিয়েছিলেন, সে কথা ভুলি নি এখনও।
পরদিন দুপুর পর্যন্ত সে ঘুমাইয়া কাটাইল। বৈকালের দিকে ভবানীপুরে লীলার মামার বাড়ি গেল। অনেক দিন সে লীলার কোন সংবাদ জানে না—দূর হইতে লাল ইটের বাড়িটা চোখে পড়িতেই একটা আশা ও উদ্বেগে বুক ঢিপ ঢিপ করিয়া উঠিল, লীলা এখানে আছে, না নাই যদি গিয়া দেখে সে আছে! সেই একদিন দেখা হইয়াছিল অপর্ণার মৃত্যুর পূর্বে! আজ আট বৎসর হইতে চলিল—এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে আর কোন দিন দেখা হয় নাই।
প্রথমেই দেখা হইল লীলার ভাই বিমলেন্দুর সঙ্গে। সে আর বালক নাই, খুব লম্বা হইয়া পড়িয়াছে, মুখের চেহারা অন্য রকম দাঁড়াইয়াছে। বিমলেন্দু প্রথমটা যেন অপুকে চিনিতে পারিল না, পরে চিনিয়া বৈঠকখানার পাশের ঘরে লইয়া বসাইল। দু-পাঁচ মিনিট এ কথা ওকথার পরে অপু যতদূর সম্ভব সহজ স্বরে বলিল-তারপর তোমার দিদির খবর কি—এখানে, না শ্বশুরবাড়ি?
বিমলেন্দু কেমন একটা আশ্চর্য সুরে বলিল—ও, ইয়ে আসুন আমার সঙ্গে—চলুন।
কেমন একটা অজানা আশঙ্কায় অপুর মন ভরিয়া উঠিল, ব্যাপার কি? একটু পরে গিয়া বিমলেন্দু রাস্তার মোড়ে দাঁড়াইয়া নিচু সুরে বলিল—দিদির কথা কিছু শোনেন নি আপনি?
অপু উদ্বিগ্নমুখে বলিল—না—কি? লীলা আছে তো?
—আছেও বটে, নেইও বটে। সে সব অনেক কথা, আপনি ফ্যামিলির ফ্রেন্ড বলে বলছি। দিদি ঘর ছেড়েছে। স্বামী গোড়া থেকেই ঘোর মাতাল—অতি কু-চরিত্র। বেষ্টিক স্ট্রীটের এক ইহুদি মেয়েকে নিয়ে বাড়াবাড়ি আরম্ভ করে দিলে—তাকে নিজের বাসাতে রাত্রে নিয়ে যেতে শুরু করলে। দিদিকে জানেন তো? তেজী মেয়ে, এ সব সহ্য করার পাত্রী নয়—সেই রাত্রেই ট্যাক্সি ডাকিয়ে পদ্মপুকুরে চলে আসে নিজের ছোট মেয়েটাকে নিয়ে। মাস দুই পর একদিন দাদাবাবু এল, মেয়েকে সিনেমা দেখাবার ছুত করে নিয়ে গেল জব্বলপুরে—আর দিদির কাছে পাঠায় না। তারপর দিদি যা করেছে—সে যে আবার দিদি করতে পারত তা কখনও কেউ ভাবে নি। হীরক সেনকে মনে আছে? সেই যে ব্যারিস্টার হীরক সেন, আমাদের এখানে পার্টিতে দেখেছেন অনেকবার। সেই হীরক সেনের সঙ্গে দিদি একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। এক বৎসর কোথায় রইল—আজকাল ফিরে এসেছে, কিন্তু হীরক সেনকে ছেড়েছে। একা আলিপুরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে। এ বাড়িতে তার নাম আর করার উপায় নেই। মা কাশীবাসিনী হয়েছেন, আর আসবেন না।
কথা শেষ করিয়া বিমলেন্দু নিজেকে একটু সংযত করার জন্য বোধ হয় একটু চুপ করিয়া রহিল। পরে বলিল,-হীরক সেন কিছু না-এ শুধু তার একটা শোধ তোলা মাত্র, সেন তো শুধু উপলক্ষ। আচ্ছা, তবে আসি অপূর্ববাবু, এখন কিছু দিন থাকবেন তো এখানে?
বিমলেন্দু চলিয়া যায় দেখিয়া অপু কথা খুঁজিয়া পাইল, তাড়াতাড়ি তাহার হাতখানা ধরিয়া অকারণে বলিল,-শোনো, শোনো, লীলা আলিপুরে আছে তা হলে?
এ প্রশ্ন সে করিতে চাহে নাই, সে জানে এ প্রশ্নের কোন অর্থ নাই। কিন্তু একসঙ্গে এত কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা হইতেছিল—কোটা সে জিজ্ঞাসা করিবে?
বিমলেন্দু বলিল,-এতে আমাদের যে কি মর্মান্তিক–বর্ধমানে আমাদের বাড়ির সেই নিস্তারিণী ঝিকে মনে আছে? সে দিদিকে ছেলেবেলায় মানুষ করেছে, পুজোর সময় বাড়ি গেলুম, সে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল। সে-বাড়িতে দিদির নাম পর্যন্ত করার জো নেই। রমেনদা আজকাল বাড়ির মালিক, বুঝলেন না? দিদিও সুখে নেই, বলবেন না কাউকে, আমি লুকিয়ে যাই, এত কাদে মেয়ের জন্যে! হীরক সেন দিদির টাকাগুলো দু হাতে উড়িয়েছে, আবার বলেছিল বিলেতে বেড়াতে নিয়ে যাবে। সেই লোভ দেখিয়েই নাকি টানে দিদি আবার তাই বিশ্বাস করত। জানেন তো দিদিরও ঝোঁক আছে, চিরকাল।
বিমলেন্দু চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলে, অপু আবার গিয়া তাহার হাত ধরিয়া বলিল—তুমি মাঝে মাঝে কোন সময়ে যাও—বিমলেন্দু বলিল,–রোজ যে যাই তা নয়, বিকেলে দিদি মোটরে বেড়াতে আসে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনের মাঠে, ওইখানে দেখা করি।
বিমলেন্দু চলিয়া গেলে অপু অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটিতে হাঁটিতে রসা রোডে আসিয়া পড়িল–কি ভাবিতে ভাবিতে সে শুধুই হাঁটিতে লাগিল। পথের ধারে একটা পার্ক, ছেলেমেয়েরা খেলা করিতেছে। দড়ি ঘুরাইয়া ছোট মেয়েরা লাফাইতেছে, সে পার্কটায় ঢুকিয়া একটা বেঞ্চের উপর বসিল। লীলার উপর রাগ অভিমান কোনটাই হইল না, সে অনুভব করিল, এত ভালোবাসে নাই সে কোনদিনই লীলাকে। এই আট বৎসরে লীলা তো তাহার কাছে অবাস্তব হইয়া পড়িয়াছে, তাহার মুখ পর্যন্ত ভালো মনে হয় না, অথচ মনের কোন গোপন অন্ধকার কোণে এত ভালোবাসা সঞ্চিত হইয়াছিল তাহার জন্য! ভাবিল, ওর দাদামশায়েরই যত দোষ, কে এ বিয়ে দিতে মাথার দিব্যি দিয়েছিল তাকে। বেচারি লীলা! সবাই মিলে ওর জীবনটা নষ্ট করে দিলে।
কিছুদিন কলিকাতায় থাকিবার পরে সে বাসা বদলাইয়া অন্য এক বোর্ডিং-এ গিয়া উঠিল। পুরানো দিনের কষ্টগুলো আবার সবই আসিয়া জুটিয়াছে—একা একঘরে থাকিবার মতো পয়সা হাতে নাই, অথচ দুই-তিনটি কেরানীবাবুর সঙ্গে একঘরে থাকা আজকাল তাহার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব মনে হয়। লোক তাঁহারা ভালোই, অপুর চেয়ে বয়স অনেক বেশি, সংসারী, ছেলেমেয়ের বাপ। ব্যবহারও তাহাদের ভালো। কিন্তু হইলে কি হয়, তাহাদের মনের ধারা যে-পথ অবলম্বনে গড়িয়া উঠিয়াছে অপু তাহার সহিত আদৌ পরিচিত নয়। সে নির্জনতাপ্রিয়, একা চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে চায়, সেইটাই এখানে হইবার জো নাই। হয়তো সে বৈকালের দিকে বারান্দাটাতে সবে আসিয়া বসিয়াছে—কেশববাবু হুঁকা হাতে পিছন হইতে বলিয়া উঠিলেন–এই যে অপূর্বাবু, একাটি বসে আছেন? চৌধুরী ব্রাদার্স বুঝি এখনও আপিস থেকে ফেরেন নি? আজ শোনেন নি বুঝি মোহনবাগানের কাণ্ডটা? আরে রামোঃ-শুনুন তবে
কলিকাতা তাহার পুরাতন রূপে আবার ফিরিয়া আসিয়াছে। সেই ধুলা, ধোঁয়া, গোলমাল, একঘেয়েমি, সংকীর্ণতা, সব দিনগুলা এক রকমের হওয়া—সেই সব।
সে চলিয়া আসিত না, কিংবা হয়তো আবার এতদিনে চলিয়া যাইত, মুশকিল এই যে, মিঃ রায়চৌধুরীও ওখানকার কাজ শেষ করিয়া কলিকাতায় ফিরিয়া একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি গড়িবার চেষ্টায় আছেন, অপুকে তাহার আপিসে কাজ দিতে রাজি হইয়াছেন। কিন্তু অপু বসিয়া বসিয়া ভাবিতেছিল, গত ছবছরের জীবনের পরে আবার কি সে আপিসের ডেস্কে বসিয়া কেরানীগিরি করিতে পারিবে? এদিকে পয়সা ফুরাইয়া আসিল যে! না করিলেই বা চলে কিসে?
সেখানে থাকিতে এই ছয় বৎসরে যা হইয়াছিল, অপু বোঝে এখানে তা চব্বিশ বৎসরেও হইত না। আর্টের নতুন স্বপ্ন সেখানে সে দেখিয়াছে।
ওখানকার সূর্যাস্তের শেষ আলোয়, জনহীন প্রান্তরে, নিস্তব্ধ আরণ্যভূমির মায়ায়, অন্ধকারভরা নিশীথ রাত্রির আকাশের নিচে, শালমঞ্জরীর ঘন সুবাসভরা দুপুরের রোদে সে জীবনেব গভীর রহস্যময় সৌন্দর্যকে জানিয়াছে।
কিন্তু কলিকাতার মেসে তাহা তো মনে আসে না—সে ছবিকে চিন্তা ও কল্পনায় গড়িয়া তুলিতে গভীরভাবে নির্জন চিন্তার দরকার হয়—সেইটাই তাহার হয় না এখানকার মেস-জীবনে। সেখানে তাহার নির্জন প্রাণের গভীর, গোপন আকাশে সত্যের যে নক্ষত্রগুলি স্বতঃস্ফূর্ত জ্যোতির্মান হইয়া দেখা দিয়াছিল, এখানকার তরল জীবনানন্দের পূর্ণ জ্যোৎস্নায় হয়তো তাহারা চিরদিনই অপ্রকাশ রহিয়া যাইত।
মনে আছে সে ভাবিয়াছিল, ওই সৌন্দর্যকে, জীবনের ওই অপূর্ব রূপকে সে যতদিন কালিকলমে বন্দী করিয়া দশজনের চোখের সামনে না ফুটাইতে পারিবে ততদিন সে কিছুতেই ক্ষান্ত হইবে না।
আর একদিন সেখানে সে কি অদ্ভুত শিক্ষাই না পাইয়াছিল।
ঘোড়া করিয়া বেড়াইতেছিল। এক জায়গায় বনের ধারে ঝোপের মধ্যে অনেক লতাগাছে গা লুকাইয়া একটা তেলাকুচা গাছ। তেলাকুচা বাংলার ফল—অপরিচিত মহলে একমাত্র পরিচিত বন্ধু, সেখানে দাঁড়াইয়া গাছটাকে দেখিতে বড়ো ভালো লাগিতেছিল।…তেলাকুচা লতার পাতাগুলা সব শুকাইয়া গিয়াছে, কেবল অগ্রভাগে ঝুলিতেছিল একটা আধ-পাকা ফল। তারপর দিনের পর দিন সে ওই লতাটার মৃত্যু-যন্ত্রণা লক্ষ করিয়াছে। ফলটা যতই পাকিয়া উঠিতেছে, বোঁটার গোড়ায় যে অংশ সবুজ ছিল, সেটুকু যতই রাঙা সিঁদুরের রং হইয়া উঠিতেছে, লতাটা ততই দিন দিন হলদে শীর্ণ হইয়া শুকাইয়া আসিতেছে।
একদিন দেখিল, গাছটা সব শুকাইয়া গিয়াছে, ফলটা বোঁটা শুকাইয়া গাছে ঝুলিতেছে, তুলতুলে পাকা, সিঁদুরের মতো টুকটুকে রাঙা—যে কোন পাখি, বনের বানর কি কাঠবেড়ালীর অতি লোভনীয় আহার্য। যে লতাটা এতদিন ধরিয়া ন কোটি মাইল দূরের সূর্য হইতে তাপ সংগ্রহ করিয়া, চারিপাশের বায়ুমণ্ডল হইতে উপাদান লইয়া মৃত, জড়পদার্থ হইতে এ উপাদেয় খাবার তৈয়ারি করিয়াছিল, তাহার জীবনের উদ্দেশ্য শেষ হইয়া গিয়াছে-ওই পাকা টুকটুকে ফলটাই তাহার জীবনের চরম পরিণতি! ফলটা পাখিতে কাঠবেড়ালীতে খাইবে, এজন্য গাছটাকে তাহারা ধন্যবাদ দিবে না; তেলাকুচা লতাটা অজ্ঞাত, অখ্যাতই থাকিয়া যাইবে। তবুও জীবন তাহার সার্থক হইয়াছে,ওই টুকটুকে ফলটাতে ওর জীবন সার্থক হইয়াছে। যদি ফলটা কেউ না-ই খায় তাহাতেও ক্ষতি নাই, মাটিতে ঝরিয়া পড়িয়া আরও কত তেলাকুচার জন্ম ঘোষণা করিবে, আরও কত লতা কত ফুল-ফল কত পাখির আহার্য।
মন তখন ছিল অদ্ভুত রকমের তাজা, সবল, গ্রহণশীল, সহজ আনন্দময়। তেলাকুচালতার এই ঘটনাটা তাহার মনে বড়ো ধাক্কা দিয়াছিল—সে কি ওই সামান্য বন-ঝোপের তেলাকুচা-লতাটার চেয়েও হীন হইবে? তাহার জীবনের কি উদ্দেশ্য নাই? সে জগতে কি কিছু দিবে না?
সেখানে কতদিন শালবনের ছায়ায় পাথরের উপর বসিয়া দুপুরে এ প্রশ্ন মনে জাগিয়াছে।…কত নিস্তব্ধ তারাভরা রাত্রে গভীর বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাঁবুর বাহিরের ঘন নৈশ অন্ধকারের দিকে চাহিয়া চাহিয়া এই সব স্বপ্নই মনে জাগিত। বহু দূর, দূর ভবিষ্যতের শিরীষফুলের পাপড়ির মতো নরম ও কচি মুখ কত শত অনাগত বংশধরদের কথা মনে পড়িত, খোকার মুখখানা কি অপূর্ব প্রেরণা দিত সে সময়!—ওদেরও জীবনে কত দুঃখরাত্রের বিপদ আসিবে, কত সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাইবে—তখন যুগান্তের এপার হইতে দৃঢ়হস্ত বাড়াইয়া দিতে হইবে তোমাকে তোমার কত শত বিনিদ্র রজনীর মৌন জনসেবা, হে বিস্মৃত পথের মহাজন পথিক, একদিন সার্থক হইবে—অপরের জীবনে।
দুঃখের নিশীথে তাহার প্রাণের আকাশে সত্যের যে নক্ষত্ররাজি উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়াছে—তা সে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়া যাইবে, জীবনকে সে কি ভাবে দেখিল তাহা লিখিয়া রাখিয়া যাইবে।
নিজের প্রথম বইখানির দিনে দিনে প্রবর্ধমান পাণ্ডুলিপিকে সে সস্নেহ প্রতীক্ষার চোখে দেখে বইয়ের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কত কথা তাহার আগ্রহভরা বক্ষস্পন্দনে আশা, আনন্দের সংগীত জাগায়— মা যেমন শিশুকে চোখের সম্মুখে কান্নাহাসির মধ্য দিয়া বাড়িতে দেখেন, দুরুদুরু বক্ষে তাহার ভবিষ্যতের কথা ভাবেন—তেমনি।
বই-লেখার কষ্টটুকু করার চেয়ে বইয়ের কথা ভাবিতে ভালো লাগে। কাদের কথা বইয়ে লেখা থাকিবে?কত লোকের কথা। গরিবদের কথা। ওদের কথা ছাড়া লিখিতে ইচ্ছা হয় না।
পথে-ঘাটে, হাটে, গ্রামে, শহরে, রেলে কত অদ্ভুত ধরনের লোকের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়াছে জীবনে-কত সাধু-সন্ন্যাসী, দোকানী, মাস্টার, ভিখারি, গায়ক, পুতুল নাচওয়ালা, আম-পাড়ানি, ফেরিওয়ালা, লেখক, কবি, ছেলেমেয়ে—এদের কথা।
আজিকাব দিন হইতে অনেক দিন পরে হয়তো শত শত বৎসব পরে তাহার নাম যখন এ বছরের-ফোটা-শালফুলের মঞ্জরীর মতো—কিংবা তাহার ঘরের কোণের মাকড়সার জালের মতো কোথায় মিলাইয়া যাইবে, তখন তাহার কত অনাগত বংশধর কত সকালে সন্ধ্যায়, মাঠে, গ্রাম্য নদীতীরে, দুঃখের দিনে, শীতের সন্ধ্যায় অথবা অন্ধকার গহন নিস্তব্ধ দুপুর-রাত্রে, শিশিরভেজা ঘাসের উপর তারার আলোর নিচে শুইয়া শুইয়া তাহার বই পড়িবে কিংবা বইয়ের কথা ভাবিবে!
ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কত আশঙ্কাও জাগে। যদি কেউ না পড়ে? আবার ভাবে, পৃথিবীর কোন্ অতীতে আদিম যুগের শিল্পীদল দুর্গম গিরিগুহার অন্ধকারে বৃষ, বাইসন, ম্যামথ আঁকিয়া গিয়াছিল— প্রাচীনদিনের বিস্মৃত প্রতিভা এতকাল পর তাহার দাবি আদায় করিতেছেমতুবা ক্যান্টাব্রিয়া, দর্দ ও পিরেনিজের পর্বতগুহাগুলায় দেশবিদেশের মনীষী ও ভ্রমণকারীদের এত ভিড় কিসেব? তেলাকুচা লতাটা শুকাইয়া গিয়াছে; কিন্তু সে জীবন দিয়া ফলটাকে মানুষ করিয়া গিয়াছে যে! আত্মদানের ফল বৃথা যাইবে না। কত গাছ গজাইবে ওর বীজে
নিজের প্রথম বইখানি—মনে কত চিন্তাই আসে। অনভিজ্ঞ মন সবতাতেই অবাক হইয়া যায়, সবতাতেই গাঢ় পুলক অনুভব করে।
এই তাহার বই লেখার ইতিহাস।
কিন্তু প্রথম ধাক্কা খাইল বইখানার পাণ্ডুলিপি হাতে দোকানে দোকানে ঘুরিয়া। অজ্ঞাতনামা লেখকের বই কেহ লওয়া দূরে থাকুক, ভালো করিয়া কথাও বলে না। একটা দোকানে খাতা রাখিয়া যাইতে বলিল। দিন পাঁচেক পরে তাহাদের একখানা পোস্টকার্ড পাইয়া অপু ভালো কাপড় পরিয়া, জুতা বুরুশ করিয়া বন্ধুর চশমা ধার করিয়া দুরুদুরু বক্ষে সেখানে গিয়া হাজির হইল। অত ভাল বই তাহার—পড়িয়া হয়তো উহারা অবাক হইয়া গিয়াছে।
দোকানের মালিক প্রথমে তাহাকে চিনিতে পারিল না, পরে চিনিয়া বলিল—ও! ওহে সতীশ, এর সেই খাতাখানা ওঁকে দিয়ে দাও তো-বড়ো আলমারির দেরাজে দেখো।
অপুর কপাল ঘামিয়া উঠিল। খাতা ফেরত দিতে চায় কেন? সে বিবর্ণ মুখে বলিল—আমার বইখানা কি–
না। নতুন লেখকের বই নিজের খরচে তাহারা ছাপাইবে না। তবে যদি সে পাঁচশত টাকা খরচ দেয়, তবে সে অন্য কথা। অপু অত টাকা কখনও এক জায়গায় দেখে নাই।
পরদিন সকালে বিমলেন্দু অপুর বাসায় আসিয়া হাজির। বৈকালে পাঁচটার সময় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনের মাঠে লীলা আসিবে, বিশেষ করিয়া বলিয়া দিয়াছে তাহাকে লইয়া যাইতে।
বৈকালে বিমলেন্দু আবার আসিল। দু-জনে মাঠে গিয়া ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করিবার পর বিমলেন্দু একটা হলদে রঙের মোটর দেখাইয়া বলিল, ওই দিদি আসছে—আসুন, গাছতলায় গাড়ি পার্ক করবে, এখানে ট্রাফিক পুলিশে আজকাল বড়ো কড়াকড়ি করে।
অপুর বুক ঢিপ ঢিপ করিতেছিল। কি বলিবে, কি বলিবে সে লীলাকে?
বিমলেন্দু আগে আগে, অপু পিছনে পিছনে। লীলা গাড়ি হইতে নামে নাই, বিমলেন্দু গাড়ির জানালার কাছে গিয়া বলিল,-দিদি, অপূর্ববাবু এসেছেন, এই যে—পরক্ষণেই অপু গাড়ির পাশে দাঁড়াইয়া হাসিমুখে বলিল—এই যে, কেমন আছ, লীলা?
সত্যই অপূর্ব সুন্দরী! অপুর মনে হইল, যে-কবি বলিযাছেন, সৌন্দর্যই একটা মহৎ গুণ, যে সুন্দর তাহার আর কোন গুণের দরকার করে না, তিনি সত্যদর্শী, অক্ষরে অক্ষরে তাহার উক্তি সত্য।
তবুও আগের লীলা নাই, একটু মোটা হইয়া পড়িয়াছে, মুখের সে তরুণ লাবণ্য আর কই? মুখের পরিণত সৌন্দর্য ঠিক তাহার মা মেজবৌরানীর এ বয়সে যাহা ছিল তাই, সেই ছেলেবেলায় বর্ধমানের বাটীতে দেখা মেজবৌরানীর মুখের মতো। উদ্দাম লালসামাখা সৌন্দর্য নয়—শান্ত, বরং যেন কিছু বিষয়।
বাড়ির বাহির হইয়া গিয়াছে যে-মেয়ে, তাহার ছবির সঙ্গে অপু কিছুতেই এই বিষ নয়না দেবীমূর্তিকে খাপ খাওয়াইতে পারিল না। লীলা ব্যস্ত হইয়া হাসিমুখে বলিল—এসো, অপূর্ব এসো। তুমি তো আমাদের ভুলেই গিয়েচ একেবারে। উঠে এসে বসো। চলো, তোমাকে একটু বেড়িয়ে নিয়ে আসি। শোভা সিং, লেক
লীলা মধ্যে বসিল, ও-পাশে বিমলেন্দু, এ-পাশে অপু, অপুর মনে পড়িল বাল্যকাল ছাড়া লীলার এত কাছে সে আর কখনও বসে নাই। বার বার লীলার মুখের দিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিতেছিল। এতকাল পরে লীলাকে আবার এত কাছে পাইয়াছে—বার বার দেখিয়াও যেন তৃপ্তি হইতেছিল না। লীলা অনর্গল বকিতেছিল, নানা রকম মোটরগাড়ির তুলনামূলক সমালোচনা করিতেছিল, মাঝে মাঝে অপুর সম্বন্ধে এটা-ওটা প্রশ্ন করিতেছিল। লেক দেখিয়া অপু কিন্তু নিরাশ হইল। সে মনে মনে ভাবিল—এই লেক! এরই এত নাম! এ কলকাতার বাবুদের ভালো লাগতে পারে-ভারি তো। লীলা আবার এরই এত সুখ্যাতি করছিনা-আহা, বেচারি কলকাতা ছেড়ে বিশেষ কোথাও তো যায়, নি!-লীলা পাছে অপ্রতিভ হয় এই ভয়ে সে নিজের মতটা আর ব্যক্ত করিল না। একটা নারিকেল গাছের তলায় বেঞ্চ পাতা–সেখানে দু-জনে বসিল। বিমলেন্দু মোটর লইয়া লেক ঘুরিতে গেল। লীলা হাসিমুখে বলিল—তারপর, তুমি নাকি দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছিলে?
–তোমার শ্বশুরবাড়ির দেশে গিয়েছিলুম-জব্বলপুরের কাছে।-বলিয়া ফেলিয়া অপু ভাবিল-কথাটা বলা ভালো হয় নাই, হয়তো লীলার মনে কষ্ট হইবে—ছিঃ–
কথাটা ঘুরাইয়া ফেলিয়া বলিল—আচ্ছা ওই দ্বীপ-মতন ব্যাপারগুলো–ওতে যাবার পথ নেই…।
–সাঁতার দিয়ে যাওয়া যায়। তুমি তো ভালো সাঁতার জানোনা? ওসব কথা যাক— এতদিন কোথায় ছিলে, কি করছিলে বলল। তোমাকে দেখে আজ এত খুশি হয়েছি!…আমার বাসায় এসো আলিপুরে—চা খাবে। একটু তামাটে রঙ হয়েছে কেন?…রোদে ঘুরে-ঘুরে বুঝি-আচ্ছা, আমার কথা তোমার মনে ছিল?
অপু একটু হাসিল। কোন নাটুকে ধরনের কথা সে মুখে বলিতে পারে না। আর এই সময়েই যত মুখচোরা রোগ আসিয়া জোটে! কতকাল পরে তো লীলাকে একা কাছে পাইয়াছে-কিন্তু মুখে কথা জোগায় কই?…কত কথা লীলাকে বলিবে ভাবিয়াছিল—এখন লীলাকে কাছে পাইয়া সে-সব কথা মুখ দিয়া তত বাহির হয়ই না–বরং নিতান্ত হাস্যকর বলিয়া মনে হয়।
হঠাৎ লীলা বলিল—হ্যাঁ ভালো কথা, তুমি নাকি বই লিখেছ? একদিন আমাকে দেখাবে না, কি লিখলে? আমি জানি তুমি একদিন বড় লেখক হবে, তোমার সেই ছেলেবেলার গল্প লেখাব কথা মনে আছে? তখন থেকেই জানি।
পরে সে একটা প্রস্তাব করিল। বিমলেন্দুর মুখে সে সব শুনিয়াছে, বইওয়ালারা বই লইতে চায় —ছাপাইতে কত খরচ পড়ে? এ বই ছাপাইয়া বাহির করিবার সমুদয় খবচ দিতে সে রাজি।
অপ্রত্যাশিত আনন্দে অপুর সারা শরীরে যেন একটা বিদ্যুতের ঢেউ খেলিয়া গেল। সব খরচ। যত লাগে! তবুও আজ সে মুখে কিছু বলিল না।
অপুর মনে লীলার জন্য একটা করুণা ও অনুকম্পা জাগিয়া উঠিল, ঠিক পুরাতন দিনেব মতো। লীলাবও কত আশা ছিল আর্টিস্ট হইবে, ছবি আঁকিবে, অনভিজ্ঞ তরুণ বয়সে তাহারই মতো কি স্বপ্নের জাল বুনিত! এখন শুধু নতুন নতুন মোট গাড়ি কিনিতেছে, সাহেবি দোকানে লেস কিনিয়া বেড়াইতেছে—পুরাতন দিনের যজ্ঞবেদীতে আগুন কই, নিভিয়া গিয়াছে। যজ্ঞ কিন্তু অসমাপ্ত। কৃপার পাত্র লীলা। অভাগিনী লীলা!
ঠিক সেই পুরাতন দিনের মতো মনটি আছে কিন্তু তাহাকে সাহায্য করিতে মায়ের পেটের মমতামযী-বোনেব মতোই হাত বাড়াইয়া দিয়াছে অমনি। আশৈশব তাহার বন্ধু…তাহার সম্বন্ধে অন্তত ওর মনের তারটি খাঁটি সুরেই বাজিল চিবদিন। এখানেও হয়তো করুণা, মমতা, অনুকম্পা—ওদেরই বাড়িতে না তাহার মা ছিল রাঁধুনী, কে জানে হয়তো কোন্ শুভ মুহূর্তে তাহার হীনতা, দৈন্য, অসহায় বাল্যজীবন বড়োলোকের মেয়ে লীলার কোমল বাল্যমনে ঘা দিয়াছিল, সহানুভূতি, করুণা, মমতা জাগাইয়াছিল। সকল সত্যকার ভালোবাসার মশলা এরাই—এরা যেখানে নাই, ভালোবাসা সেখানে মাদকতা আনিতে পারে, মোহ আনিতে পারে, কিন্তু চিরস্থায়িত্বের স্নিগ্ধতা আনে না।
সে ভাবিল, লীলার মনটা ভালো বলে সেই সুযোগে সবাই ওর টাকা নিচ্ছে। ও বেচারি এখনও মনে সেই ছেলেমানুষটি আছে—আমি ওকে exploit করতে পারব না। দরকার নেই,আমার বই ছাপানোয়।
এদিকে মুশকিল। হাতের টাকা ফুরাইল। চাকুরিও জোটে না।
মিঃ রায়চৌধুরী অনবরত ঘুরাইতে ও হাঁটাইতে লাগিলেন। অপু যেখানে ছিল সেখানে আবার এঁরা ম্যাঙ্গানিজের কাজ আরম্ভ করিয়াছেন, অপু ধরিয়া পড়িল তাহাকে আবার সেখানে পাঠানো হউক। অনেকদিন ঘোরানোর পর মিঃ রায়চৌধুরী একদিন প্রস্তাব করিলেন, সে আরও কম টাকার বেতনে সেখানে যাইতে রাজি আছে কি না? অপমানে অপুর চোখে জল আসিল, মুখ রাখা হইয়া উঠিল। একথা বলিতে উহারা আজ সাহস করিল শুধু এইজন্য যে, উহারা জানে যতই কম হউক না কেন সে সেখানে ফিরিয়া যাইতে রাজি হইবে, অর্থের জন্য নয়—অর্থের জন্য এ অপমান সে সহ্য করিবে না নিশ্চয়।
কিন্তু…
শরতের প্রথম নিচের অধিত্যকায় প্রথম আবলুস ফল পাকিতে শুরু করিয়াছে বটে, কিন্তু মাথার উপরে পর্বতসানুর উচ্চস্থানে এখনও বর্ষা শেষ হয় নাই। টেপারি বনে এখন ফল পাকিয়া হলদে হইয়া আছে, ভালুকদল এখনও সন্ধ্যার পরে টেপারি খাইতে নামে, টিয়াপাখির ঝাক সারাদিন কলরব করে, আরও উপরে যেখান হইতে বাদাম ও সেগুন বনের শুরু, সেখানে অজস্র সাদা মাজু ফল, আরও উপরে রিঠাগাছে থোলোথোলো ফল ধরিয়াছে, এমন কি ভালো করিয়া খুঁজিয়া দেখিলে, দু-একটা রিঠাগাছে এখনও দু-এক ঝাড় দেরিতে ফোটা রিঠা ফুলও পাওয়া যাইতে পারে।
সেখানকার সেই বিরাট বুক্ষ আরণ্যভূমি, নক্ষত্রালোকিত আলো-আঁধার, উদার জনহীন বিশাল তৃণভূমি, সেই টানা একঘেয়ে পশ্চিমে হাওয়া, সেই অবাধ জ্যোৎস্না, স্বাধীনতা, প্রসারতা, সেই বিরাট নির্জনতা তাহাকে আবার ডাকিতেছে।
এক এক সময় তাহার মনে হয় কানাডায়, অস্ট্রেলিয়ায়, নিউজিল্যান্ডে, আফ্রিকায় মানুষ প্রকৃতির এই মুক্ত সৌন্দর্যকে ধ্বংস করিতেছে সত্য, গাছপালাকে দূর করিয়া দিতেছে বটে, কিন্তু প্রকৃতি একদিন প্রতিশোধ লইবে। ট্রপিস্-এর অরণ্য আবার জাগিবে, মানুষকে তাহারা তাড়াইবে, আদিম অরণ্যানী আবার ফিরিবে। ধরাবিদ্রাবণকারী সভ্যতাদর্পী মানুষ যে স্থানে সাম্রাজ্য স্থাপন করিয়াছে, পর্বতমালার নাম দিয়াছে নিজের দেশের রাজার নামে, হ্রদের নাম দিয়াছে রাজমন্ত্রীর নামে; ওর শুশুক, পাখি, শিল, বগা হরিণ, ভালুককে খুন করিয়াছে—তেল ব্যবসা, চামড়ার লোভে, ওর মহিমময় পাইন অরণ্য ধূলিসাৎ করিয়া কাঠের কারখানা খুলিয়াছে, এ সবের প্রতিশোধ একদিন আসিবে।
এ যেন এমন একটা শক্তি যা বিপুল, বিশাল, বিরাট। অসীম ধৈর্যের ও গাম্ভীর্যের সহিত সে সংহত শক্তিতে চুপ করিয়া অপেক্ষা করিতেছে, কারণ সে জানে তাহার নিজ শক্তির বিপুলতা। অপু একবার ছিলওয়ারার জঙ্গলে একটা খনির সাইডিং লাইন তৈরি হওয়ার সময়ে অরণ্যভূমির তপস্যাস্তব্ধ, দূরদর্শী, রুদ্রদেবের মতো এই মৌন গম্ভীর ভাব লক্ষ করিয়াছিল। ওই শক্তিটা ধীরভাবে শুধু সুযোগ প্রতীক্ষা করিতেছে মাত্র।
অপুর কিন্তু চাকরি হইল না। এবার একা মিঃ রায়চৌধুরীর হাত নয়। জয়েন্ট স্টক কোম্পানির অন্যান্য ডাইরেক্টররা নাকি রাজি হইল না। হয়তো বা তাহারা ভাবিল, এ লোকটার সেখানে ফিরিবার এত আগ্রহ কেন? পুরানোলোক, চুরির সুলুকসন্ধান জানে, সেই লোভেই যাইতেছে। তা ছাড়া ডাইরেক্টররাও মানুষ, তাহাদেরও প্রত্যেকেরই বেকার ভাগনে, ভাইপো, শালীর ছেলে আছে।
সে ভাবিল চাকরি না হয় বইখানা বাহির করিয়া দেখিবে চলে কিনা। মাসিক পত্রিকায় দুএকটা গল্পও দিল, একটা গল্পের বেশ নাম হইল, কিন্তু টাকা কেহ দিল না। হঠাৎ তাহার মনে হইল—অপর্ণার গহনাগুলি শ্বশুরবাড়িতে আছে, সেগুলি সেখান হইতে এই সাত-আট বৎসর সে আনে নাই। সেগুলি বেঁচিয়া তো বই বাহির করার খরচ জোগাড় হইতে পারে। এই সহজ উপায়টা কেন এতদিন মাথায় আসে নাই?
সে লীলার কাছে আরও কয়েকবার গেল, কিন্তু কথাটা প্রকাশ করিল না। উপন্যাসের খাতাখানা লইয়া গিয়া পড়িয়া শোনাইল। লীলা খুব উৎসাহ দেয়। একদিন লীলা হিসাব করিতে বসিল বই ছাপাইতে কত লাগিবে। অপু ভাবিল-—অন্য কেউ যদি দিত হয়তো নিতুম, কিন্তু লীলা। বেচারির ঢাকা নেব না।
একদিন সে হঠাৎ খবরের কাগজে তাহার সেই কবিরাজ বন্ধুটির ঔষধের দোকানের বিজ্ঞাপন দেখিতে পাইল। সেইদিনই সন্ধ্যার পর সে ঠিকানা খুঁজিয়া সেখানে গেল, সুকিয়া স্ট্রীটের একটা গলিতে দোকান। বন্ধুটি বাহিরেই বসিয়া ছিল, দেখিয়া বলিয়া উঠিল-বাঃ–তুমি! তুমি বেঁচে আছ দাদা?
অপু হাসিয়া বলিল—উঃ, কম খুঁজি নি তোমায়! ভাগ্যিস আজ তোমার শিল্পাশ্রমের বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ল, তাই তো এলুম। তারপর কি খবর বলো? দোকানের আসবাবপত্র দেখে মনে হচ্ছে, অবস্থা ফিরিয়ে ফেলেছ!
বন্ধু খানিকটা চুপ করিয়া রহিল। খানিকটা এ-গল্প ও-গল্প করিল। পরে বলিল—এসো, বাসায় এসো।
ছোট সাদা রঙের দোতলা বাড়ি, নিচের উঠানে একটা টিনের শেডের তলায় আট-দশটি লোক কি সব জিনিস প্যাক করিতেছে, লেবেল আঁটিতেছে, অন্যদিকে একটা কল ও চৌবাচ্চা, আর একটা টিনের শেডে গুদাম। উপরে উঠিয়াই একটা মাঝাবি হলঘব, দু-পাশে দুটো ছোট ছোট ঘর, বেশ সাজানো। একটা সেঠ্ টমাসের বড়ো ক্লক ঘড়ি দালানে টকটক করিতেছে। বন্ধু ডাকিয়া বলিল–ওরে বিন্দু, শোন, তোর মাকে বল, এক্ষুনি দু-পেয়ালা চা দিতে।
অপু উৎসুকভাবে বলিল—তার আগে একবার বৌঠাকরুনের সঙ্গে দেখাটা করি–বিন্দুকে বলো তাকে এদিকে একবার আসতে বলতে? না কি, এখন অবস্থা ফিবেছে বলে তিনি আব আমার সঙ্গে দেখা করবেন না?
কবিরাজ বন্ধু ম্লানমুখে চুপ করিয়া রহিলফের নিম্নসুরে অনেকটা যেন আপন মনেই বলিল—সে আব তোমার সঙ্গে দেখা করবে না ভাই। তাকে আর কোথায় পাবে? রমলা আব সে দুজনেই ফাঁকি দিয়েছে।
অপু অবাক মুখে তাহার দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল।
–এক মাঘে রমলা গেল, পবেব শ্রাবণ সে গেল। ওঃ, সে কি সোজা কষ্ট গিয়েছে ভাই? তখন ওদিকে কাবুলীর দেনা, এদিকে মহাজনের দেনা-যমে-মানুষে টানাটানি চলছে। তোমার কথা কত বলত। এই শ্রাবণে পাঁচ বচ্ছর হয়ে গিয়েছে। তারপরে বিয়ে করব না, করব না,–আজ বছর তিনেক হল বদ্যিবাটীতে–
তারপর বন্ধুর কথায় নতুন-বৌ চা ও খাবার লইয়া অপুর সামনেই আসিল। শ্যামবর্ণ, স্বাস্থ্যবতী, কিশোরী মেয়েটি, চোখ মুখ দেখিয়া মনে হয় খুব চটপটে, চতুর। খাবার খাইতে গিয়া খাবারের দলা যেন অপুর গলায় আটকাইয়া যায়। বন্ধুটি নিজের কোন কালির বড়ি ও পাতা চায়ের প্যাকেটের খুব বিক্রি ও ব্যবসায়ের দিক হইতে এ-দুটি দ্রব্যের সাফল্যের গল্প কবিতেছিল।
উঠিবার সময় বাহিরে আসিয়া অপু জিজ্ঞাসা করিল–নতুন বৌটি দেখতে তো বেশ, এ দিকেও বেশ গুণবতী, ন.?
–মন্দ না। কিন্তু বড়ো মুখ ভাই। আগের তাকে তো জানতে? সে ছিল ভালো মানুষ। এর পান থেকে চুন খসলেই কি কবি ভাই, আমার ইচ্ছে ছিল না যে আবার–
ফুটপাথে একা পড়িয়াই অপুর মনে পড়িল, পটুয়াটোলার সেই খোলার বাড়ির দরজার প্রদীপহাতে হাস্যমুখী, নিরাভরণা, দরিদ্র গৃহলক্ষ্মীকে—আজ ছবছর কাটিয়া গেলেও মনে হয় যেন কালকার কথা!