২০ আগস্ট শুক্রবার ১৯৭১
রাত প্রায় দুটো। ঘুম আসছে না। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। এবারের বর্ষাটা একেবারে পচিয়ে দিল। ঢাকার কতকগুলো নিচু এলাকা আবার পানিতে ডুবে গেছে। বুড়িগঙ্গার পানি বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় খুব বন্যা হচ্ছে। বিশেষ করে পাবনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর আর রাজশাহী জেলার অবস্থা খুব খারাপ। রোজই কাগজে বেরোচ্ছে কোন্ কোন্ নদীর পানি বাড়ছে, কোন্ কোন্ জেলার কতগুলো থানা বন্যায় ডুবে গেছে।
অতিরিক্ত বর্ষা আর বন্যা নিয়ে সামরিকজান্তা খুব উদ্বিগ্ন, বিব্রত আর আতঙ্কিত। শুকনো এলাকার পাকিস্তানি সৈন্যরা এই রকম বৃষ্টি, বন্যা, কাদার মধ্যে একেবারে লেজেগোবরে হয়ে পড়েছে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর জন্য সুবিধে। নদী-হাওড়-বিলের সাঁতার জানা দামাল ছেলেরা পাকসেনাদের খুব জব্দ করেছে। সবাই বলছে আল্লার রহমত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। তাই এ বছর এই রকম অতিরিক্ত বর্ষা আর বন্যা।
রুমী গতকাল দুপুরেই চলে গেছে বাড়ি থেকে, বলেছে দুদিন পরে আসবে। ঢাকা আসার পর থেকেই দেখছিলাম কি অস্থিরতায় ভুগছে রুমী। এতদিনে কারণটা একটুখানি বলেছে। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন ওড়াবার দায়িত্ব নিয়ে ওদের দলটা ঢাকা এসেছে। কিন্তু এসে দেখে সে পাওয়ার স্টেশন একেবারে দুর্ভেদ্য দুর্গ। আগে যেখানে স্টেশনের ভেতরে এক প্লাটুনের মতো সৈন্য পাহারা দিত, এখন সেখানে এক কোম্পানির মতো সৈন্য। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রোডে মিলিটারি সৈন্য রিকয়েললেস রাইফেল নিয়ে এমুড়ো থেকে ওমুড়ো পর্যন্ত টহল দিচ্ছে। টহল দিচ্ছে নদীর বুকেও। নৌকায় চেপে। উলান, গুলবাগ, ধানমন্ডির অ্যাকশানের পর থেকে পাকিস্তান আর্মি ইনটেলিজেন্স দারুণ সতর্ক হয়ে গেছে। ফার্মগেট, ইন্টারকন অ্যাকশানের পর সামরিকজান্তা একেবারে ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো হয়ে রয়েছে। বস্তুত সারা ঢাকা শহরেই এখন সিকিউরিটির ভয়ানক রকম কড়াকড়ি। সুতরাং সিদ্ধিরগঞ্জের ব্যাপারে ওদের সময় নিতে হচ্ছে, নতুন করে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সিদ্ধিরগঞ্জ ছাড়াও অন্য যেসব অ্যাকশানের নির্দেশ ওদের ওপর আছে, সেইগুলোর দিকে ওরা এখন মনোেযোগ দিচ্ছে।
গেরিলাদের অনেক কটা দল এখন ঢাকায়। তারা প্রতিদিনই সর্বত্র কিছু না কিছু অ্যাকশান করেই চলেছে। ওদের ওপর নির্দেশই আছে : প্রতিনিয়ত ছোটবড় নানা ধরনের অ্যাকশান করে সামরিক জান্তা এবং পাক আর্মিকে সদাসর্বদা ব্যতিব্যস্ত, বিব্রত ও আতঙ্কিত রাখতে হবে। শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত এমনভাবে অ্যাকশান করবে, যাতে পাক আর্মি মনে করে সারা শহর জুড়ে হাজার হাজার বিচ্ছু কিলবিল করছে।
এবং ওরা করছেও তাই।
এখন রুমীরা কোথায় কি করছে, কে জানে। কোনো বাড়িতে ঘুমিয়ে আছে? নাকি এই বৃষ্টিতেই কোথাও বেরিয়েছে কারফিউর মধ্যে? রাস্তায় গাড়িতে? না, নদীতে নৌকায়? কে জানে।
সাত সতেরো ভেবে ভেবে বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে যাচ্ছে। শুয়ে থাকতে পারলাম। উঠে রুমীদের ঘরে গেলাম। বাবার ঘরে বাবা আর মাসুম দুটো খাটে। রুমীর ঘরে জামীর খাটে জামী ঘুমে অচেতন। রুমীর খাটের ওপর নিঃশব্দে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম।
মেলাঘরেও কি এখন বৃষ্টি হচ্ছে? বেড়ার ঘরের ফোকর দিয়ে, তাঁবুর নিচ দিয়ে পানি ঢুকে মেঝে ভিজিয়ে দিচ্ছে? পরশুদিন কাজী আর আলমের মুখে মেলাঘরের অনেক গল্প শুনেছি। ওরা প্রথম বর্ডার ক্রস করে এপ্রিলের মাঝামাঝি। মেলাঘরে সেক্টর টুর হেডকোয়ার্টার হয়েছে জুনের প্রথম দিকে। তার আগে ওরা ছিল মতিনগরে। প্রথমদিকে ওদের অনেক বেশি কষ্ট করতে হয়েছে। প্রায় কিছুই ছিল না। একেবারে শুরুতে গিয়ে উন্মুক্ত আকাশের নিচে ঘাসের ওপর শুয়েছে কতোদিন। গায়ের ওপর দিয়ে কেঁচো, বিছে, কত কি চলে গেছে। তারপর তাঁবু যোগাড় হয়েছে, তার মধ্যে স্রেফ চাটাই পেতে। ভাত খেয়েছে মাটির সানকিতে, গ্রেনেডের খালি বাকস আড়াআড়ি কেটে তার মধ্যে। ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার পান্ডে যখন ওদের ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন, তখন সানকি আর গ্রেনেডের বাক্স দেখে, ওদেরকে বাসন-প্লেট দেবার হুকুম দেন। ছেলেরা বলে আমরা বাসন প্লেট চাই না, তার বদলে আমাদের বুলেট দিতে বলুন। কি ধাতুতে গড়া এই ছেলেগুলো বাসনের বদলে বুলেট চায়। আর খাওয়া? কতোদিন শুধু ডাল আর ভাত, মাঝে মাঝে তরকারির ঘাট, কখনো সখনো মাছ। তাও নুন ছিল না বহুদিন, প্রথম যেদিন ডাল, তরকারিতে নুন দেওয়া হয়েছিল সেদিন খাবার কম পড়ে গিয়েছিল। আলম বলছিল হেসে হেসে, আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। খাওয়ার পানির অভাব ছিল, ছোট একটা খালমতো ছিল, সেই খালের পানি দিয়েই সব কাজ হত, খাওয়া পর্যন্ত।
মতিনগর থেকে মেলাঘর যাত্রা–ক্যাপ্টেন হায়দারের হুকুমে ক্যাম্প ভেঙে সব গুছিয়ে ঘাড়ে তুলে একরাতে রওনা–সারারাত হেঁটে ভোরবেলা যেখানে থামল, সেটাই মেলাঘর। মতিনগর থেকে ১০/১২ মাইল দূরে। আগের রাতে কোন খাবার জোটে নি, ঘাড়ে মাথায় বিরাট বোঝা নিয়ে রাতভর হাঁটা, সকালে গাছের কাঁঠাল পেড়ে তাই দিয়ে নাস্তা!তারপর টিলার ওপর ক্যাম্পতৈরি, সবকাজ নিজের হাতে। দোতলা সমান টিলা নিচে থেকে মাটি কেটে কেটে সিঁড়ি বানানো, সঙ্গে সঙ্গে গাছের ডাল কেটে পুঁতে দেওয়া, যাতে মাটিটা ভেঙে পড়ে না যায়।
রাতের বেলা ঘুম না এলে ভাবনাচিন্তাগুলো খুব তীক্ষ্ণরূপ নেয়। মনে হচ্ছে, মেলাঘর এখন আমার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে। তিন-চারদিন আগে এক দুপুরে খাওয়ার পর রুমী বলছিল মেলাঘরের জীবনের কথা। রুমী যখন যায়, তখন ক্যাম্পের জীবনযাপনের মান অনেকখানি উন্নত হয়েছে। অনেক তাবু, বেড়ার তৈরি লম্বা ব্যারাক, বাঁশের মাচায় খড়ের গদিতে চাদর, বালিশ। ট্রেনিং ও অ্যাকশানের জন্য অনেক অস্ত্র, গুলি, গ্রেনেড, বিস্ফোরক।
একরাতে রুমীর সেন্ট্রি ডিউটি পড়েছিল কয়েকজন সহযোদ্ধার সঙ্গে। অনেক রাতে টিলার মাথায় রুমী দাঁড়িয়েছিল। চারধারে ছোটবড় আরো কয়েকটা টিলা, এদিক-ওদিক বড় বড় গাছ।
রুমী বলছিল, জানো আম্মা, ওখানে তো সন্ধ্যে সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যেই খাওয়া-দাওয়া হয়ে যায়। সারা দিনের প্রচণ্ড খাটনিতে সবাই এ্যাতো টায়ার্ড থাকে যে আটটানটার মধ্যে বেশির ভাগ ছেলে ঘুমিয়ে যায়। দুএকটা তাবুতে হয়ত কেউ কেউ আরো খানিকক্ষণ জেগে গানটান গায় কিংবা আড্ডা দেয়। সে রাতে টিলার মাথায় দাড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি কি, একটা তাবুতে আলো জ্বলছে, আর সেখান থেকে ভেসে আসছে গানের সুর :
হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ।
বুঝলাম আজম খান গাইছে। আজম খানের সুন্দর গানের গলা। আবার অন্যদিকে ভীষণ সাহসী গেরিলা, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। সেদিন সেই রাতে চারদিক ভীষণ অন্ধকার, অন্যসব ব্যারাক আর তার সবাই বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে গেছে। নটা-দশটাতেই মনে হচ্ছে নিশুতি রাত। ঐ একটা তাঁবুর ভেতর হারিকেনের আলো ছড়িয়ে সাদা রঙের পুরো তাবুটা যেন ফসফরাসের মতো জ্বলছে। উঁচু থেকে দেখে মনে হচ্ছিল বিশাল অন্ধকার সমুদ্রে যেন একটা আলোকিত জাহাজ। আর আজম খানের গানের সুর, মনে হচ্ছিল যেন চারদিকের ইথারে ভেসে ভেসে হাজার হাজার মাইল ছড়িয়ে পড়ছে। তখন আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল।
এখন এই বৃষ্টি ঝরা গভীর রাতের অন্ধকারে আমিও যেন চোখের সামনে দেখতে পেলাম নির্জন পিলার মাথায় কয়েকটি মুক্তিযোদ্ধা ৩০৩ রাইফেল হাতে সেন্ট্রি ডিউটিতে সমস্ত ইন্দ্রিয় টান করে দাঁড়িয়ে আছে, আর তাদের চারপাশ দিয়ে বায়ুমণ্ডলে ভেসে ভেসে যাচ্ছে আজম খানের উদাত্ত গলার গান :
হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ
কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে,
যে কোলাহলের রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ
জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে।
হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন
জন্ম নিয়েছে সচেতনতার ধান
গত আকালের মৃত্যুকে মুছে
আবার এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ।
… … … …
শাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয়!
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।