অভিনব আলোর ঝলক
আসে উনিশশতক। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের দিকেদিকে সাড়া পড়ে যায়। উনিশশতকে সূচনা হয় বাঙলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের। এ-আধুনিকতা, যাকে বলেছি অভিনব আলো, তার কিরণ পড়ে সাহিত্যের সমগ্র ভুবনে। মধ্যযুগে বাঙলা সাহিত্য ছিলো সংকীর্ণ; সবগুলো শাখা বিকশিত হয় নি তাতে। উনিশশতকে বিকশিত হয় তার সব শাখা, বাঙলা সাহিত্য হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ সাহিত্য। আধুনিকতা কাকে বলে? মানুষ যখন যুক্তিতে আস্থা আনে, যখন সে আবেগকে নিয়ন্ত্রিত করে, যখন সে মানুষকে মানুষ বলে মূল্য দেয়, তখন সে হয়ে ওঠে আধুনিক। আধুনিকতার আছে আরো অনেক বৈশিষ্ট্য। মধ্যযুগেও আমরা দেখেছি মাঝেমাঝে এসব বৈশিষ্ট্য, কিন্তু তা জীবনের সকল প্রান্তকে ছোয় নি। উনিশশতকে এবৈশিষ্ট্যগুলো দেখা দেয় প্রধান হয়ে। সাহিত্যের রূপও যায় বদলে। উনিশশতকের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা বাঙলা গদ্যের বিকাশ। প্রাচীন যুগে, মধ্যযুগে বাঙলা সাহিত্যে গদ্যের বিশেষ স্থান ছিলো না। তখন যা কিছু রচিত হয়েছে সবই হয়েছে পদ্যে, ছন্দ মিলিয়ে। কিন্তু পদ্যে কি সব কথা বলা যায়?
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ স্থাপিত হয় ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের লেখকেরা নতুন করে গড়ে তোলেন বাঙলা গদ্য। এ-গদ্য বাঙলা সাহিত্যের আধুনিকতার পথকে করেছে অনেকখানি পরিষ্কার। মধ্যযুগে হৃদয়ের আবেগ, কল্পিত কাহিনী, জীবনকাহিনী সবকিছু রচিত হয়েছে ছন্দে, পয়ারে। তাই তাতে জীবনের সবকিছু তুলে ধরা সম্ভব ছিলো না। এর ফলে তখনকার বাঙলা সাহিত্য থেকেছে সীমাবদ্ধ। গদ্যের বিকাশের ফলে সাহিত্য লাভ করে বিস্তৃতি। সাহিত্যজগতে দেখা দেয় নানা বৈচিত্র্য। মুদ্রাযন্ত্রের অর্থাৎ ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা সাহিত্যকে সাহায্য করে। আগে সাহিত্য সীমিত থাকতো বিশেষ কিছু মানুষের বৃত্তে; কেননা কোনো বইয়ের অনেকগুলো কপি করা ছিলো কষ্টকর। কিন্তু উনিশশতকে প্রতিষ্ঠিত হয় ছাপাখানা। লেখকেরা আর গুটিকয় শ্রোতার উদ্দেশে কবিতা বা গল্প বা প্রবন্ধ রচনা করেন নি। তাঁরা সাহিত্য সৃষ্টি করতে থাকেন অসংখ্য অদৃশ্য পাঠককে লক্ষ্য করে। আগে এটি সম্ভব ছিলো না। আগে কবিরা মনে রাখতেন না শুধু, একেবারে চোখের সামনে দেখতে পেতেন তাঁদের শ্রোতাদের। তাঁরা জানতেন কোন রসে তাঁদের শ্রোতারা মোহিত হয়। কিন্তু মুদ্রাযন্ত্র লেখক ও পাঠকের মধ্যে আনে দূরত্ব, আনে বিস্তৃতি। লেখকের মনের সামনে তখন ভাসতে থাকে বিশাল পাঠকশ্রেণীর মুখ, তাই তাঁরা হন আরো যত্নশীল। মধ্যযুগের সাহিত্যে বৈচিত্র্যের বেশ অভাব। নবযুগে আসে বৈচিত্র্য। গদ্যসাহিত্য সৃষ্টি করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)। প্রথম উপন্যাস রচনা করেন প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩)। ব্যঙ্গবিদ্রুপে ভরা মজার কাহিনী লেখেন কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৪০-১৮৭০)। কবিতায় নবযুগ আনেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)। তিনি রচনা করেন মহাকাব্য। বাঙলা সাহিত্যে মহাকাব্য ছিলো না, কবি মধুসূদন মহাকাব্য রচনা করেন। শুধু তাই নয়, তিনি কবিতাকে করে তোলেন আধুনিক। তিনি কবিতাকে সুরের আওতা থেকে মুক্ত করে তাকে করে তোলেন পাঠ্য। কথাটিকে আরো একটু বিশদ করে বলা যাক। মধ্যযুগে রচিত হয়েছে অনেক কবিতা। সেগুলো কিন্তু পাঠের জন্যে লেখা হয় নি, লেখা হয়েছিলো গান করার জন্যে। কবিরা তখন সুর করে গান করতেন তাঁদের কাব্য। মধুসূদন কবিতা লেখেন পাঠেরই জন্যে, গানের জন্যে নয়। এজন্যে তাঁর কবিতা সুরের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়। তাছাড়া তিনি পয়ারকে দেন নতুন রূপ। সৃষ্টি করেন অমিত্রাক্ষর বা প্রবহমাণ অক্ষরবৃত্ত ছন্দ।
মধুসূদন একাই বাঙলা সাহিত্যকে পাঁচশো বছর এগিয়ে দিয়েছিলেন। মধুসূদন লেখেন বাঙলা ভাষার প্রথম ট্রাজেডি, লেখেন প্রহসন, সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা। তিনি আমাদের চেতনায় সঞ্চার করে দেন আধুনিকতা। বাঙলা ভাষায় যথার্থ উপন্যাস সৃষ্টি হয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪) হাতে। তিনি তাঁর উপন্যাস, সমালোচনা, বিদ্রুপাত্মক প্রবন্ধ, এবং আরো অনেক রকম রচনার দ্বারা বাঙলা সাহিত্যকে এগিয়ে দেন। এছাড়া উনিশশতকে রচিত হয় প্রবন্ধ, লেখা হয় বাঙলা ভাষার ব্যাকরণ, রচিত হয় আত্মজীবনী, নাটক, গল্প, সাহিত্য সমালোচনা, বিজ্ঞান, দর্শন। প্রতিষ্ঠিত হয় দৈনিক সংবাদপত্র, সাহিত্যসাময়িকী। এসব নির্ভর করে বাঙলা সাহিত্যের আধুনিক কাল প্রতিষ্ঠিত হয় উনিশশতকে। উনিশশতকে বাঙলা সাহিত্য হয়ে ওঠে অভিনব সাহিত্য। যেমন তার বিস্তার, তেমনি তার গভীরতা। মধ্যযুগে একশো বছরে যা রচিত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি রচিত হয়েছে উনিশশতকের একেকটি দশকে। এক-একজন লেখক লিখেছেন আগের যুগের দশজন লেখকের সমান। কিছু সংবাদ জানিয়ে দিচ্ছি।
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে সৃষ্টি না হলেও বিকশিত হয় বাঙলা গদ্য। তখন ওই কলেজের প্রধান ছিলেন পাদ্রি উইলিয়ম কেরি [১৭৬১-১৮৩৪]। তাঁকে গদ্য রচনায় সাহায্য করেন এদেশের পণ্ডিতেরা। এক পণ্ডিত রামরাম বসুর [১৭৫৭-১৮১৩] লেখা প্রতাপাদিত্যচরিত্র এখান থেকে প্রকাশিত প্রথম বাঙলা গদ্যগ্রন্থ। বইটি ছাপা হয় ১৮০১ অব্দে। রামরাম বসু আরো একটি বই লেখেন; তার নাম লিপিমালা। পাদ্রি কেরি লেখেন কথোপকথন নামে একটি বই। গোলকনাথ শর্মা লেখেন হিতোপদেশ, চণ্ডীচরণ মুনশি লেখেন তোতা ইতিহাস, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার লেখেন রাজাবলি, হিতোপদেশ, প্রবোধচন্দ্রিকা, বত্রিশ সিংহাসন এবং আরো কয়েকজন লেখক কয়েকটি গদ্যগ্রন্থ রচনা করেন। এগুলো সবই প্রকাশ করে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ কর্তৃপক্ষ। এ-বইগুলো বাঙলা গদ্যকে অনেকটা আকার দান করে। এরপরে বাঙলা গদ্যের বিকাশে সহায়তা করেন কয়েকজন অতি বিখ্যাত বাঙালি। তাঁদের মধ্যে আছেন রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, তারাশঙ্কর তর্করত্ন, ভূদেব মুখখাপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু। তাঁদের পরে আসেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র দত্ত।
রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩] লিখেছিলেন বেশ কয়েকটি বই। তাঁর বইগুলোর মধ্যে আছে বেদান্তগ্রন্থ (১৮১৫), ভট্টাচার্যের সহিত বিচার (১৮১৭), গোস্বামীর সহিত বিচার (১৮১৮), গৌড়ীয় ব্যাকরণ (১৮৩৩)। রামমোহন রায়ের লেখায় বিকাশ ঘটে বাঙালির চিন্তার। বিদ্যাসাগরের হাতে বাঙলা গদ্য লাভ করে সুস্থ রূপ। বিদ্যাসাগরের বইগুলোর মধ্যে আছে বেতালপঞ্চবিংশতি (১৮৪৭), শকুন্তলা (১৮৫৪), সীতার বনবাস (১৮৬০), প্রভাবতী সম্ভাষণ (১৮৬৩), ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯), অতি অল্প হইল (১৮৭৩), আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩), স্বরচিত জীবনচরিত (১৮৯১), এবং আরো কয়েকটি বই। বিদ্যাসাগর বাঙলা গদ্যের স্থপতি। তারাশঙ্কর তর্করত্ন লিখেছেন কাদম্বরী (১৮৫৪), রাসেলাস (১৮৫৭)। এ-শতকে আছেন আরো অনেকে। ধীরে ধীরে বলা হবে তাঁদের কথা।