২০. অপালা চন্দ্রকান্তা

২০. অপালা চন্দ্রকান্তা

অপালার শরীর ঠিক থাকলে তেমন দুর্ভাবনা এসে জড়ো হয় না। কিন্তু আজকাল প্রায় রাতে জ্বর আসছে। কতদিন পর বিশাখজ্যোতি গৃহে প্রত্যাবর্তন করেছেন। বিশাখজ্যোতির সঙ্গসুখ তেমনভাবে উপভোগ করতে পারছে না সে। যৌন বৈকল্য এসেছে যেন তার। মনোগত অসুখ সঞ্চারিত হয়েছে দাম্পত্য ক্ষেত্রে। অসম্ভব শীতল প্রতিক্রিয়া দেখায় অপালা। গভীরতম অমোচ্য এক দুর্ভাবনা তখনই অধিকার করে নেয় অপালার মন। প্রত্যক্ষ এই তনুই তো সব। তবুও যেন এই দেহের অভ্যন্তরেই অর্থাৎ ভিতর দেহলিতে রয়েছে চিরবর্তমান কোনো অতনু। ক্লেশকাতর তার অধিকার বিশাখজ্যোতির প্রত্যাবর্তনকে তেমন স্মরণীয় করে তুলছে না।

এমনই অসুখী হয়েছিলেন বিশাখজ্যোতিও। তাই তো তিনি এক মুহুর্তিকার কাছে গমন করেছিলেন। অপালাও কি সেই কারণে অন্যমনা? বিশাখজ্যোতি চন্দ্রের জাতক, কর্কট রাশি। চন্দ্র শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল উত্তম, দেদীপ্যমান বা শ্রেষ্ঠ। বিশাখজ্যোতিও অসম্ভব রূপবান, চন্দ্রানন পুরুষ। সাতাশ জন কন্যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল চন্দ্রের। অশ্বিনী থেকে রেবতী সাতাশটি নক্ষত্রের সঙ্গে ঘর করেন চন্দ্র। এই নক্ষত্রমালার মধ্য দিয়ে চলে চন্দ্রের রথ আর এই রথ টেনে নিয়ে চলে দশটি শ্বেত অশ্ব। এই চন্দ্রও একটু বেশি ভালোবাসতেন রোহিণীকে, তাই তিনি রোহিণীরমণ। মহামতি কৃষ্ণ যেমন রাধারমণ। তবে রাধা তাঁর স্বীকৃত পত্নী নয়। স্বপত্নীদের দ্বারা শাপগ্রস্ত হয়েছিলেন চন্দ্র। সে শাপের পরিণতিতে চন্দ্রে এসেছিল ক্ষয়রোগ। মৃত্যুমুখী সেই ক্ষয়রোগ থেকে মুক্তি পেতে চন্দ্র দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন প্রভাসতীর্থে। কৃষ্ণও যেন অজানা ক্ষয়রোগে আক্রান্ত। চিরন্তন মৃত্যু তাঁকেও যেন অধিকৃত ভূমির মধ্যে নিয়ে আসছে। তিনি অরণ্যচারী হয়ে সেই মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছেন। প্রভাসতীর্থে কৃষ্ণ একদা ছিলেন তবে সত্যভামার সঙ্গে।

চন্দ্রমার চন্দ্রাংশু জ্যোৎস্নাকিরণের নাম হল চন্দ্রকান্তা বা চন্দ্রিকা। চকোর পাখি পান করে সেই শুভ্র জ্যোৎস্না। তারপর সেই পানের ফলে একসময় জ্যোৎস্নাশূন্য এবং চন্দ্রহীন হয়ে যায় অমাবস্যার আকাশ। চন্দ্রের এই ক্ষয় প্রভাব ফেলে নারীর ঋতুকালে। সম্পূর্ণ ক্ষয়প্রাপ্ত, বিনষ্ট চাঁদ পক্ষকালের জন্য যান দেবী অনুমতির কাছে। সেই দেবী আবার জড়িয়ে রয়েছেন উন্মত্ততা নামে এক মানসিক অসুখের সঙ্গে।

বিশাখজ্যোতির বারাঙ্গনা গৃহে গমন যেন সে দেবী অনুমতির কাছেই যাওয়া। আর তারই ফলশ্রুতিতে অপালার মধ্যে প্রতিভাত হচ্ছে উন্মত্ততার আভাস। দেবী অনুমতিও যে আসলে সুদর্শন, সুগৌর চন্দ্রের প্রচ্ছন্ন প্রেমিকা। নিজেকে পিতৃত্যাজ্য ভেবে ব্যথিত অসুখী নচিকেতা মরণের দেবতা যমকে প্রশ্ন করেছিলেন, মানুষের মৃত্যু হলে উপস্থিত হয় সংশয়, যেয়ং প্রেতে বিচিকিৎসা মনুষ্যে। আবার কেউ বলেন, হলেও মৃত ‘অস্তি ইতি’ অর্থাৎ সে আছে। অন্যরা বলেন, ‘ন অস্তি ইতি’ অর্থাৎ ‘সে নেই।’

উত্তরে যম বললেন, ‘আমি তোমাকে যথেচ্ছা সম্ভোগক্ষমতা দিচ্ছি, এই যে তোমার সম্মুখেই রয়েছে হস্তে বাদ্যযন্ত্র, রথে সমারূঢ়া অপ্সরীবৃন্দ –এদের সান্নিধ্য কোনো মানুষই পায় না কিন্তু তুমি যদি বলো, মানবের অগম্য অপার সুখদায়িনী বালাগণ তোমার পরিচর্যা করবে, যৌনসুখ দেবে। শুধু এই প্রশ্নটি করে আমায় জ্বালিয়ো না। কিন্তু তিনি নচিকেতা অর্থাৎ ন(অহং) চিকেত, তাঁর সেই অম্বেষণক্ষুধার সঙ্গে যমও এঁটে উঠতে পারলেন না। সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, ‘অজো নিতঃ শাশ্বতে হয়ং পুরানো/ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।’ এই আত্মা জন্মরহিত, ক্ষয়রহিত, বৃদ্ধিরহিত; শরীর নিহত হলেও বিনষ্ট হয় না।’

ঋগবেদের দশম মন্ডলের ৭৯তম সূক্তে চতুর্থ ঋকের অংশে রয়েছে। নচিকেতার কথা। বিশাখজ্যোতি অপালাকে শোনালেন। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও এইভাবে শাশ্বত মানুষের জয়ের ধ্যান। চার্বাক এসব জানেন, গুরুদেব অর্কজ্যোতিও অস্বীকার করেন। তবুও অপালাকে ঋগবেদ থেকে নচিকেতার অংশ পাঠ করে শোনালেন বিশাকজ্যোতি। সারা রাত অনিদ্রায় থেকে এইসব শুনতে শুনতে বিশাখজ্যোতির কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছে অপালা। সূর্য আকাশে উদিত হচ্ছেন। তাঁর অহনা আলো অপালার মুখমন্ডলে এসে পড়েছে। ভালোবাসার চুম্বন করলেন বিশাখজ্যোতি এমনভাবে যেন অপালার বহু কাঙ্ক্ষিত নিদ্রার কোনো ব্যাঘাত না ঘটে।

.

২১. প্রবীণা পৃথিবী

পান্ডুর শ্রাদ্ধ তখন সবে সম্পন্ন হয়েছে, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস জননী সত্যবতীর সমীপে এসে বসলেন। তিনি বললেন, ‘অতিক্রান্ত সুখাঃ কালঃ পৃথিবী গতযৌবনা।’ যৌবনবতী পৃথিবী এখন বৃদ্ধা হয়েছে। তোমার সুখের দিন শেষ, এবার তুমি আমার সঙ্গে এসো। কুরুবংশীয় জাতকদের অন্যায়ে এই পৃথিবী দুঃখাবাস হয়ে উঠবে।’

সত্যবতীর বুকের মধ্যে ভূমিকম্প হচ্ছিল। এই যাওয়া তো খুব সহজ নয়। এই প্রবীণা পৃথিবী তাঁর কাছে কম আকর্ষণের নয় এখনও। আর এই প্রবীণা পৃথিবীর দায়িত্বভার তিনি অর্পণ করে গেলেন পুত্র ভীষ্মকে। অনিবার্য ধ্বংসের মধ্যে দন্ডায়মান থেকেও তিনি রক্ষা করবেন কুরুবংশকে– এই বিশ্বাস তাঁর ছিল। যেমন বিশ্বাস ছিল পাঞ্চালীর যুদ্ধ হবেই। সখা কৃষ্ণ কথা দিয়েছেন, যুদ্ধ হবেই।

কৃষ্ণ অবলোকন করলেন মাথার উপরে অগণ্য নক্ষত্রমালা। মাঘ মাস। বাতাসে শীতের কামড় রয়েছে। অরণ্যের পথ নিস্তব্ধতা ভেঙে শকটের গমনকে শ্রুতিগোচর করছে। ভুলও হতে পারে। ভারতবর্ষ প্রায় মনুষ্যহীন হয়েছে, আর এ তো অরণ্য। আরও নির্জন, প্রেতিনীদের ডাক ক্ষণে ক্ষণেই চরাচরকে গ্রাস করছে। কত মিথ্যাচার করেছেন পান্ডবদের সাধারণ সুখ সুনিশ্চিত করবেন বলে। ভীষ্ম বলেছিলেন, ‘অধর্মেণ চ রাজ্যং ত্বং প্রাপ্তবান্ ভরতৰ্ষভ।’ অধর্ম করে প্রাপ্ত তোমার রাজ্যের অর্ধাংশ পান্ডবদের প্রত্যাবর্তন করো। সেটাই ধর্ম। দুর্যোধন অসম্মত ছিলেন। সমৃদ্ধ, যৌবনবতী পৃথিবী সেই পল থেকেই বিগতযৌবনা হয়েছেন। অন্তঃশত্রুভয়ে কম্পমান কৃষ্ণ প্রায়ই কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধের ঘটনাবলির মধ্যে পড়ে থাকেন। ভোগেচ্ছা অন্তর্হিত হওয়ায় তাঁর পত্নী ও উপপত্নীবৃন্দও অকালবার্ধক্যের শিকার। তাঁরা সকলেই অবিনীত ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কৃষ্ণের অনুপস্থিতিতে হয়তো খুঁজে বেড়াচ্ছেন কোনো যুবক রাজপুরুষকে।

অতি প্রত্যূষে স্নান সারলেন কৃষ্ণ। অনিদ্রার কারণে চোখে জ্বলন হচ্ছে। শরীরে এবং মনে অপার ক্লান্তি। তবুও এই দেহসৌষ্ঠব অত্যন্ত দর্শনীয়। লৌহবর্ম দেহ। পেশিতে তরঙ্গ খলছে। নীলাভ, মসৃণ ত্বক। মাথার চারপাশে কুঞ্চিত কেশ জলকে স্পর্শ করতেই সে এমন ব্যবহার করছে যেন একটি উপরাজ্য ফিরে পেয়েছে বহুকালের অন্তরে। রত্নখচিত মণিফলক সূর্যের প্রভায় বিচ্ছুরিত করছে আলো। কৃষ্ণের এই স্নানপর্ব অবলোকন করে প্রবীণা পৃথিবীও যেন শৃঙ্গারের আকাঙ্ক্ষায় উন্মুখ হয়ে উঠছে। রাজশাস্ত্র এই যুগে সঠিক পথে নিয়ন্ত্রিত হবে বলেই তিনি। রচনা করেছিলেন এক কঠিন, নির্মোহ, বাস্তববোধ সম্পন্ন জীবনদর্শন। সেখানে কোনো হত্যাই হত্যা নয়। সব্যসাচী অর্জুন নিমিত্তমাত্র। সামগ্রিকভাবে তিনি পৃথিবীর কল্যাণ চেয়েছিলেন। স্নান সমাপ্ত করে। তিনি একটু শয়ন করলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল এই কানন ছিন্নবিছিন্ন করে হারিয়ে যাবেন। তাঁর চোখ দুটি আরক্ত হয়ে উঠছে। ঘন ছায়াময় বৃক্ষগুলিও জেগে উঠছে। শীতের নম্র দিবায় বসন্তবাহার ধরলেন কৃষ্ণ। সুরের সেই কম্পাঙ্ক স্পর্শ করে প্রবীণা পৃথিবী শীতকালীন ধূসরতা কাটিয়ে জেগে উঠল। প্রাণ সঞ্চার হল নতুন করে। বর্ষকার নিশ্চয় বললেন, ‘ঋতুর এই আকস্মিক পরিবর্তন কৃষ্ণের সুরের রহস্যেই একমাত্র সম্ভব।’

.

২২. শৃঙ্গার স্মৃতি

শস্ত্রহীন, লগ্ন, অপবর্গ আবেগে মুহ্যমান কিন্তু পরম শক্তিমান রাধারমণ রাধার শরীর-অরণ্যে মৃগয়াযাত্রা শুরু করলেন। ক্রমাগত দংশনক্ষতে ছিন্নভিন্ন করছেন রাধাকে। রাধার চক্ষুদ্বয় আবেগে নিমীলিত, দেহ কামাক্রান্ত। উত্তালভাবে শায়িত রাধা ওর ডান পা বাম উরুর মূলে স্থাপন করল। বিপরীতক্রমে বাম পা ডান উরুর উপর স্থাপন করে তার পদ্মযোনি উন্মুক্ত করল। এভাবে শৃঙ্খলিত রাধার চরণে চুম্বন করে কৃষ্ণ ওর যোনিমধ্যে উদ্যত তরবারিসদৃশ লিঙ্গ প্রবেশ করালেন। বার বার লিঙ্গ আঘাতে রাধাও ক্রমশ উন্মাদিনী হয়ে উঠল। সঙ্গমসুখের যন্ত্রণায় সেও তখন মুহ্যমানা প্রায়। এইভাবে এক বার মিলনের পরও রাধারমণ ক্লান্ত হলেন না। আবার নতুন করে শুরু হল স্তনদ্বয়ের মর্দন। চুম্বনপর্বে রাধার ওষ্ঠ প্রেমিকের দন্তস্ফুটনে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। যন্ত্রণায় শিউরে ওঠে রাধা। এক আবরণহীন লজ্জার প্রকাশ ঘটে। একটু কপট কোপ প্রকাশ করেন কৃষ্ণ। রাধা তখন কৃষ্ণের সুরতক্রিয়ায় অলীক হয়ে ওঠা মুখমন্ডল বক্ষমধ্যে স্থাপন করে। আত্মা ও শক্তির নিতান্ত আবরণ উন্মুক্ত করে পুরুষশ্রেষ্ঠ রাধারমণ লিঙ্গ ও যোনি সংবদ্ধ রেখে রাধার কটিদেশে মৃদু অঙ্গুলি সঞ্চালন অব্যাহত রাখেন। তাঁর বীর্যরস লিঙ্গশীর্ষে এসে স্তব্ধ হয়ে যায় মুহূর্ত, পল অতিবাহিত হয় কিন্তু নিসৃত হয় না। লিঙ্গ-যোনি যুক্ত অবস্থায় তিনি রাধাকে দুই বাহু দিয়ে উত্তোলিত করলেন। রাধার যাবতীয় ধ্বনি তখন স্তব্ধ, হয়তো প্রাণবায়ুও স্তব্ধ রাধারমণের বক্ষমধ্যে আশ্রিত হয়ে। সেই কঠিন নৈঃশ্বব্দ্যের প্রহরে হঠাৎ রাধা আর্তনাদ করে ওঠে, ‘প্রিয়সখা, আমায় ত্যাগ করবে না কোনোদিন –কথা দাও, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হও।’ অশেষ লিপ্সা চরিতার্থ করে রাধারমণের লিঙ্গ রাধার যোনিপথে দ্বিতীয় বার পুনর্গমন করে। সঙ্গমশেষে তিনি বলেন, রাধা, এই আমার জীবনের শেষ সঙ্গম।

পরদিন প্রভাতে নিদ্রাভঙ্গ হলে রাধারমণ কৃষ্ণ দেখেন, লালপাড় শ্বেত রঙের শাড়িতে অদ্ভুত শোভিত লাগছে রাধাকে। কপালে বৃহৎ লাল টিপ দেখে চমকে ওঠেন কৃষ্ণ। বঙ্গদেশীয় বিবাহিতা নারীর সজ্জা নিয়েছে রাধা। এখনও চন্দনচর্চিত মুখমন্ডলে ভাস্বর গত রাতের নখরের দশনক্ষত। রাধার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে গীতার স্তব। এই কাব্য তো বহুসময় পরে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মহারম্ভের প্রাক্কালে তিনি অর্জুনকে বলবেন। অর্থাৎ কাল রাতে সঙ্গমকালে তিনি উচ্চারণ করেছেন নিজেরই অজান্তে এই কাব্যিক সুষমা। রাধা আত্মস্থ করেছে ভালোবাসার গুণে। হঠাৎ কৃষ্ণ বললেন, ‘রাধা, যদি কখনো তুমি চান্দ্রদশায় আক্রান্ত হও!’

-আমি তো এখনও উন্মাদিনী।

–আর তো আমাদের সাক্ষাৎ হওয়ার কথা নয়।

রাধার দুই চোখে অশ্রু সঞ্চারিত হল। তবে কৃষ্ণের কাছ থেকে এই প্রতারণা অনুমানের বাইরে ছিল না। তবুও চোখের জলে স্নাত হচ্ছে মুখমন্ডল। লবণাক্ত সেই জলধারা গন্ডদেশ প্লাবিত করছে। কৃষ্ণের দক্ষিণ কর এই সময় সন্ধান করছে রাধার বাম স্তন। বক্ষবন্ধনী ত্যক্ত খোলসের মতো লুটিয়ে পড়ল। আবার স্তনমর্দন, দীর্ঘ চুম্বন। এটা সত্যি রাধার শরীর ওঁর সঙ্গমে ঋদ্ধ হয়েছে, তবে সেই অলৌকিক স্বাদ এখন লবণাক্ত। চতুর কৃষ্ণ পূর্ণ সম্ভোগের পর বিদায় নিচ্ছেন। আর প্রত্যাবর্তন করবেন না। চকিত, চপল আনন্দের মুহূর্ত হারিয়ে যাচ্ছে। প্রখর দিনে আর বৃষ্টিপাত হবে না। বীর্যবান রাধারমণকে ভালোবাসতে গিয়েও কপটতার জন্য ক্ষমা করা হল না রাধার। প্রেমিকার সেই অভিশাপের কারণেই বোধ হয় এই নির্জন, বিস্তীর্ণ অরণ্যে কৃষ্ণের চান্দ্রদশা শুরু হল।

.

২৩. অগ্নি

অগ্নি জীবনধারণের উপায় বলে এবং চির-অতৃপ্ত বলে তিনি অনল। তাঁর। পক্ষে কোনো খাদ্যগ্রহণই যথেষ্ট নয়। তিনি হব্যভোজী, তাই হুতাশন। তিনি হ্যবাহকও তাই বহ্নি। বিশ্বব্যাপী, তাই বৈশ্বানর। তিনি আলোকঋদ্ধ বলেই তাঁর আরেক নাম বিভাবসু। কাষ্ঠের মাতৃগর্ভে বিকাশমান তিনি। তিনি দেবগণের জিহ্বা ও মঙ্গলকর্মের সাক্ষী। তিনিই ভীষণ বাড়বাগ্নি, যা জগৎ ধ্বংসের জন্য সিন্ধু সলিলে লুক্কায়িত থাকে। আবার সেই তিনি বরদ রূপে গৃহপতি, তাঁকে অনির্বাণ রাখতে না পারলে গৃহস্থের কোনো কল্যাণ হয় না।

সেই অগ্নিদেব মহাভারতের যুদ্ধের শেষে অর্জুনকে বললেন, ‘আমি তোমার জন্য বরুণের ভান্ডার থেকে ধনু-তূণীর সংগ্রহ করেছিলাম, এখন। তুমি বরুণকে তা প্রত্যর্পণ করো।

।অর্জনের বোধশক্তি খুব প্রখর ছিল না, কারণ তিনি তখনও নিজেকে মনে করতেন অপরাজেয়। জীবনীশক্তির বর্ধমান অবক্ষয় তিনি মৌষলপর্ব থেকে অনুভব করেছেন কিন্তু স্বীকার করেন না। সখা কৃষ্ণ বহু পূর্বেই সুদর্শনচক্র ত্যাগ করেছিলেন। গান্ডীবধারণ তাঁর চিরন্তন ক্ষাত্রজীবিকা। কখনো কখনো সারা দেহে এত দহন হয় যে মনে হয় যেন কোনো ভয়ংকর জীবাণুর দল পোষক হিসেবে নির্বাচন করছে তাঁর শরীর। জীবনযাপন স্বাভাবিক হলেও অসম্ভব ক্লান্ত তিনি। তাই অগ্নির আদেশ শুনে হৃদয়দৌর্বল্য উপস্থিত হলেও তিনি অস্বীকার করার সাহস দেখালেন না।

ইতিপূর্বে কপিধ্বজ রথও অগ্নির প্রকোপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অন্তিম দিনের পর যখন পান্ডবদের যাবতীয় বিজয় সম্ভব হয়েছে, উল্লাসে মত্ত হয়েছে ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, দিবাভাগে দুর্লক্ষণ হিসেবেই যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত হল কপিধ্বজ রথ। যদিও পার্থসখা তখন অবরোহণ করেছেন এবং তিনি কূটবাক্যবলে বোঝাতে চাইলেন, এই ধ্বংসগতি তাঁর প্রত্যাশা অনুযায়ী সম্পন্ন হয়েছে। তবুও অর্জুন সতর্ক হননি। অনুতাপের যাবতীয় কৃতকর্ম তিনি রেখে এসেছিলেন মহাযুদ্ধের প্রারম্ভে। একে একে শস্ত্রধারীদের পরাভূত করে তিনি বোধ হয় বিস্মৃতও হয়েছিলেন অগ্নিদেবের কথা। সর্বভুক অগ্নি তাই তাঁকে স্মরণ করালেন, এই ধনু ও তূণীর আর পার্থের আজ্ঞাবহ নয়। তাঁর নিমিত্তকর্ম সমাধা হয়ে গেছে। তিনিও এখন বর্জ্য উপকরণ মাত্র। কেশবের সঙ্গে সাক্ষাৎ দীর্ঘদিন হয়নি। কোনো অরণ্যপ্রান্তরে তিনি নিজেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে রেখেছেন। যা-ই হোক, মহারথী অর্জুন কৃতাঞ্জলিপুটে অগ্নিদেবকে বললেন, ‘হে হুতাশন, হে আলোকঋদ্ধ বিভাবসু, ক্ষাক্রোচিত জীবন থেকে অবসৃত হওয়া আমার কাছে জীবন্বত অবক্ষয়কে স্বীকার করার প্রায় সমার্থক। তবে এই হব্যবাহক বহ্নিতেই আমার চিরনির্বাপণ কি সম্ভব নয়?’

অগ্নিদেব স্মিত হাসলেন। মহামতি কর্ণও বাড়বাগ্নির উপাসক ছিলেন। তবুও তিনি জীবনব্যাপী কোনো পক্ষপাতই পাননি। অথচ বহু নারী সম্ভোগে কামার্ত অর্জুন কৃষ্ণের সখা হওয়ার কারণে শুধু জয়ই দেখে এসেছেন। পরাজয় তাঁর কাছে শুধু অনভিপ্রেত নয়, তদুপরি তিনি এই যন্ত্রণার তাপও কখনোই অনুভব করেননি।

অগ্নিদেব বললেন, ‘পান্ডবদের মৃত্যু নির্বাচনে আত্মহননের কোনো স্থান নেই। এখন এই অবস্থায় তুমি পরিব্রাজকের জীবন গ্রহণ করতে পারো।‘

–নৈসর্গিক হিমালয় দিয়ে এই ভারতবর্ষ আমি বহু বার ভ্রমণ করেছি অগ্নিদেব।

–অর্জুন, তোমার এখনকার ভ্রমণে গান্ডীব থাকবে না। অথচ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মূল নায়ক স্বয়ং তুমি। বহু ভ্রাতৃহত্যা, স্বামীহত্যা ধর্মযুদ্ধের কারণেই তোমাকে করতে হয়েছে। যদিও তুমি ছিলে নিমিত্তমাত্র। তবে মানুষের কৃতকর্মের কিছু উত্তরাধিকার থেকেই যায়।

–হে গৃহপতি, আমি ভ্রমণ বহু করেছি। সত্যি কথা বলতে আমি খুব ক্লান্ত, অবসন্ন। দ্রৌপদীর সঙ্গসুখ আমার একান্ত প্রার্থিত। যজ্ঞাগ্নি থেকে উদ্ভূত যাজ্ঞসেনী আপনাকে নিয়মিত পুজো করেন, মান্যও করেন।

–প্রেম তো কোনো আজ্ঞাবহ কর্ম নয়। সে তো মানবীয় স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। এ ছাড়া তুমি বহু বার পাঞ্চালীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছ। তোমার ব্রহ্মচর্যকালে আকৃষ্ট হয়েছ চিত্রাঙ্গদার প্রেমে। এখন অন্যান্য নারীর প্রেম যখন লুপ্ত হয়েছে তখন তুমি প্রত্যাবর্তন করতে চাইছ পাঞ্চালীর কাছে। তুমি যুধিষ্ঠির বা কৃষ্ণের কাছে গিয়ে তোমার ভবিষ্যৎ কর্ম বিষয়ে অবগত হও।

অর্জুন অগ্নিদেবকে প্রণাম করে বিদায় নিলেন।

আলোকঋদ্ধ অগ্নিদেব অর্জুনের ভবিষ্যৎ জানেন। তিনি সখা কৃষ্ণের আর সাক্ষাৎ পাবেন না। রাধারমণের সঙ্গে যোগাযোগের যাবতীয় সেতু এখন ছিন্ন। অবাচ্য ব্রহ্মের ব্যাখ্যা একদা ভগবান কৃষ্ণ অর্জুনকে শুনিয়েছিলেন। তখন সখার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল নিরন্তর, সহজসাধ্য। আর এখন তৃতীয় পান্ডব যখন নিরন্ধ্র অন্ধকারে বসবাস করছে, কৃষ্ণও পার্থিব ভূমি থেকে বহুদূরে গিয়ে অতি সাধারণ মৃত্যুর তাপ গ্রহণ করছেন। তিনিও নশ্বর, অতৃপ্ত অনলে তাঁরও দহন। সমাপ্ত হবে। তিনি ভস্মীভূত দেহ নিয়ে ভূমিতে লীন হয়ে যাবেন। শমীকাষ্ঠের মাতৃগর্ভে বিকাশমান অগ্নি জগৎকর্তার ধ্বংসে লিপ্ত হবেন। বরুণদেবের আগ্রাসনে বলরাম এবং দ্বারকানগরী অনিবার্য পতনের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যাদবকুলের সংহার প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছে। সভ্যতা এক। চিরনির্বাপণের অভিমুখে যাত্রা করেছে। যদিও এই কালে কৃষ্ণ ছিলেন। বলেই উত্তরার গর্ভে নিক্ষিপ্ত অশ্বত্থামার হন্তারক শল্য ব্যর্থ হয়েছিল। অভিমন্যুপুত্র পরীক্ষিতের মধ্য দিয়ে এই কালের শবযাত্রা হয়তো সম্পূর্ণ হবে। গণচিতার বহ্নিতে সময়ও যেন পুড়ে খাক হয়ে গেছে। কুন্তী, গান্ধারী প্রভৃতি সাধ্বী রমণীরা এই অনিবার্য অনলে আত্মাহুতি দিয়েছেন। অগ্নিদেব সময়ের ধারক রাধারমণের সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। নশ্বর মানুষের কাছে তিনি মাত্র এক বারের জন্য একটু নত হলেন। সঙ্গমঞ্চের অসাধারণ নট কৃষ্ণের কাছে বৈশ্বানরের এই প্রার্থনা সমীপবর্তী হলে তিনি একটু দয়াপরবশ হয়ে সিন্ধুসলিলকে মুহূর্তের জন্যও জলসিঞ্চনের কথা বললেন। বাষ্পরুদ্ধ বরুণদেব, অনল প্রতীক্ষায় কাটাতে থাকলেন স্বয়ংযুগনায়কের প্রস্থানমুহূর্তের।

.

২৪. কৃষ্ণের বিস্মৃতি

সকাল আদিত্যপ্ৰভায় উজ্জ্বল আর অমানিশার সান্দ্র অন্ধকার তার নিস্তারক রূপ। কৃষ্ণ সবটাই অবলোকন করেন। পৃথিবীর মঞ্চে তিনি ‘নট’ হিসেবে অবতীর্ণ, সেই ভূমিকা তিনি যথাযথভাবেই পালন করছেন। অনুগীতার স্তর থেকে তিনিও শিকার হয়েছেন বিস্মৃতি রোগের। ভীষ্মপর্বে তিনি যা বলেছিলেন সবটাই তিনি বিস্মৃত হয়েছেন। দ্বিতীয় বার পার্থকে আবৃত্তি করা আর তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।

এই বিস্মৃত কৃষ্ণের কাছেই এলেন অগ্নি এবং বরুণদেব। মনের ধর্ম বিকল্পনা, বিক্ষিপ্ত ঘটনাগুলি একত্রিত করে একটি অখন্ড ধারণার উদ্ভাস হয়। অগ্নি ও বরুণদেব প্রত্যক্ষ করলেন উর্তুল পূর্ণতার পরিস্পন্দ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে এতদিন তিনি শতধারায় নিঝরিত হয়েছিলেন। ব্যাপক গর্হিত কর্ম তাঁরই প্রত্যক্ষ নির্দেশে সম্পাদিত হয়েছিল। আবার এটাও তো ঠিক তিনি আনন্ত্যের বাহক। আকাশ অপ্রবর্তী কিন্তু আবার সেই আকাশেই সূর্য ওঠে, তার মধ্যে শক্তি ও জ্যোতি পারার মতো টলটল করছে। এ যেন বেদান্তের ব্রহ্মক্ষোভ। ক্ষোভেরই বিসৃষ্টি। অক্ষরের ক্ষরণ। সহস্র রশ্মির পরিকীর্ণতায় বিচ্ছুরণ। সংযোগ-বিয়োগের অপচয়। কৃষ্ণের এই বিস্মৃতির অন্ধকার যেন জিজীবিষার পরম সার্থকতা। প্রেয় আর শ্রেয়ের দ্বন্দ্বের অবসান। বৈবস্বতযোগ কালের প্রভাবে যখন লুপ্ত হচ্ছে, তিনিই একত্রিত করেছিলেন জীবন ও প্রবচনকে। বহিঃপ্রজ্ঞতায় সহস্ৰশীর্ষা সহস্রাক্ষ সহস্রপাভ বিরাট পুরুষ কৃষ্ণকে প্রণাম করলেন বরুণদেব। তারপর প্রণিপাত সহযোগে বললেন, ‘কেশব, আপনি অন্তর্যামী। এই কালকে নিঋতির পরিকীর্ণতায় উদ্দাম হতে না দিয়ে এক ঋতছন্দের মধ্যেই আপনিই আবদ্ধ করে রেখেছিলেন। কিন্তু এর পরে ঈশ্বরের ঈশনার অভাবে কীভাবে এই জগৎ চলবে। আমারও কর্ম কী হবে?’

–আত্মা চতুষ্পদ। প্রথম পাদে জাগরিতস্থান বৈশ্বানর, দ্বিতীয় পদে স্বপ্নস্থান তৈজস, তৃতীয় স্থানে সুষুপ্তস্থান প্রাজ্ঞ, চতুর্থ পাদে শান্ত শৈব এবং অদ্বৈত। চতুর্থ পাদেই অক্ষরের সমাপ্তি। অন্তর্যামীরূপে অক্ষরেরও লক্ষ্য। কিন্তু ঈশ ও জগতীর যুগনদ্ধতা থেকেই জগৎ। প্রত্যেকটি ভূতের পশ্চাতে ভুবন। আদিত্যহৃদয় থেকে রশ্মিজালের যে বিচ্ছুরণ তা স্বতঃস্ফুর্ত। ঈশ্বরও এই বিশ্বাবসুর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রক নন। কাজেই আমার অবর্তমানেও অমৃতজ্যোতির দীপানির উদ্ভাস অবরুদ্ধ হবে না। তবে ভূমার সুখ নিস্পৃহ হয়ে আসছে বলেই আমি বিস্মৃত চেতনার গর্ভে বসবাস করছি। অনুশাসন চিত্তের তটস্থতা লুপ্ত হয়েছে। অর্থাৎ বরুণদেব, তৃষ্ণা তর্পণের যে-সুযোগ আপনি ব্যবহার করে এসেছেন, তা এখনও বর্তমান থাকবে।

অগ্নিদেব তখন কিঞ্চিৎ সাহস করেই বললেন, ‘প্রভু, ভগবন্‌ আপনি কি তবে এখন বারুণী রাত্রির অনালোক শূন্যতার মধ্যে অবস্থায় করছেন?’

–হে অগ্নিদেব, সত্যের মুখ হিরন্ময় পাত্র দিয়ে আবৃত থাকে। আর আপনি অমৃতসন্ধ জীবনের প্রধান উপজীব্য। অনালোক শূন্যতা অব্যক্তের রূপ। তারই অনুভা প্রকাশ দিয়ে সূর্য আকাশে দীপ্তমান হন। তবে এটুকুও ঠিক কিছু অবর্ণ সত্য আলোর আড়ালে থেকে যেতে পারে। সত্ত্বগুণ হিরন্ময় কিন্তু সেও তো সোনার শৃঙ্খল।

–কিন্তু কেশব, পৃথিবীও গুহাহিত একটি পাত্র। ভুজিষ্যং পাত্রং– যা প্রাণীজগতের ভোগের আধার।

–মধ্যরাত্রের গহনে কি আদিত্যের উন্মেষ আছে! অথচ তারও তো প্রেষণা রয়েছে। তমোভাগ যেন কৃষ্ণবর্ণের অশ্ব ছুটে চলেছে আলোর অভিমুখে। তবু অগ্নি, আপনি প্রাণের প্রতীক জলের মতোই। অব্যক্ত যখন হারিয়ে যায় পূষা তাকে ফিরিয়ে আনে।

–হে কৃষ্ণ, আমাদের জন্য কি কোনো আদেশ রয়েছে? আর পুরুষশ্রেষ্ঠ, নির্বিচারে ধ্বংসের বাহক হওয়ার চাইতে আমি যেন কল্যাণতর রূপে অধিক নিয়োজিত থাকতে পারি।

–সর্বভূতের একমাত্র স্বামী হলেন অমৃত, মৃত্যু তার ছায়া। আর অগ্নিদেব, আপনার প্রকোপে আমার এই শরীরও ছাই হয়ে যাবে। কিন্তু সেই ভস্মও গৌরবের, কারণ অগ্নিদেব আমাকে ধারণ করবেন বলে।

–কেশব, আমার এই অনিচ্ছাহেতু কৃত্যের জন্য ক্ষমা করবেন।

–আগুন হয়ে ওঠাই তো দৈনন্দিন যজ্ঞ। এই অমৃততনু অগ্নিচেতনার বিপুলতায় মিশে যাবে। আমার শরীর ভস্মীভূত হলেও চক্ষু যাবে সূর্যে, প্রাণ বায়ুতে। আমার সব কিছু পৃথিবী, অন্তরিক্ষে, দ্যুলোকে মিশে যাবে। এভাবেই আমি হব সর্বময়; বহু শরীরে প্রতিষ্ঠিত। কাজেই পাপের দাহক, অযথা শোক করবেন না। সত্যের প্রোজ্জ্বল দর্শন নিয়ে সূর্যদ্বার ভেদ করে আমি বার বার প্রত্যাবর্তন করি, আবার বিস্মৃতও হই। তবে অগ্নিদেব, আপনার কাছে আমার সবিশেষ অনুরোধ ছিল।

-হ্যাঁ, বলুন কেশব।

–আপনি কি রাধাদেশে যান কখনো!

–প্রভু, আমি সর্বত্রগামী। সে তো পূর্বদেশ, শস্যশ্যামলা। নিত্য পাখির কূজনে ব্যাপ্ত।

–আমি একটি বার্তা প্রেরণ করব। রাধাকে জানাতে হবে।

–হে প্রজ্ঞাবান, আমি বার্তাবাহী হলে রাধা দেবী সে রূপকে সহ্য করতে পারবেন?

–তবে বরুণদেবকে বলবেন। মেঘের গর্ভে তিনি সেই সংবাদ পাঠিয়ে দেবেন প্রেরণের জন্য।

বরুণদেব কাছেই ছিলেন। তিনি সানন্দে সম্মত হলেন।

কৃষ্ণ এবার বললেন, ‘হে বৈশ্বানর ও বরুণদেব এবার আমায় বিদায় দিন। শুধু যে-কেউ হোক রাধাকে গিয়ে বলবেন, আমি জগৎসংসার বিস্মৃত হলেও তাকে ভুলব না কোনো দিন।’

আত্মবিকিরণের প্রেরণা নিয়ে অগ্নিদেব বিদায় নিলেন।

.

২৫. শ্রীরাধিকা

ভাঙ্গিল মান সবহুঁ জন গঞ্জন পিরীতি পিরীতি করু রাধা।
রসিক সনাহ আপনে সুখ পাও এ মঝু মরমে বড়ি সাধা।

আজ আমার অশ্রুর জলের সমুদ্রও শুকিয়ে গিয়েছে। গন্ডদেশে জরার রেখা।

ভালোবাসাকে বৈধতা দেয় বিবাহবন্ধন। আমি শুধুমাত্র তাঁর প্রেমিকা। প্রেমের দাবিতে সম্পূর্ণ নিঃশর্ত আত্মসমর্পন করেছিলাম তাঁর সমীপে। আর এখন প্রাণহীন পালঙ্ক। দর্পণে যে-প্রতিবিম্ব নিত্য দেখতে হয় ওকে আমি ঘৃণা করি।

মন-কেমন-করা আম্র মুকুলের গন্ধ হাওয়ায়। বসন্তের বায়ু মৃদুমন্দ বইছে। অথচ বেল-জুইয়ের মাল্য শুকিয়ে দীর্ণ অবয়ব নিয়ে পড়ে রয়েছে। রাতের পর রাতের উৎকণ্ঠা মিথ্যে। বাসকশয্যাও মিথ্যে। জীবন-আচ্ছন্ন করা বাঁশির ডাক প্রৌঢ়া রাধা এখনও শুনতে পায়। কে বাজায়, কেন বাজায়? সবটাই কি ভ্রম? সেই ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাত, বিদ্যুৎ-ধ্বনি অসম্ভব রৌদ্রালোকেও তাকে দেখতে হয়। বার বার দুলে ওঠে চিরদিনের প্রেমজীবন। দুলে ওঠে অতীত, চতুর-প্রতারক কৃষ্ণের আহ্বানের পরম্পরা। আর্তিভরা, আকৃতিময়ী সেই নারীর যেন মৃত্যু নেই। একে কুল-কামিনী তাহে কুহু যামিনী/ঘোর গহন বহুদূর। জলধরও যেন বরষণ করেই চলেছে, সুচিরসখা রাধার অগম পারে ছাড়া আর কোথাও যাওয়া হয় না। তবে এখন চেনা জীবনের হাত ধরে আবার যেন এক অচেনা। জীবন। অভিসার প্রৌঢ়া রক্তের গভীরেও সুর তোলে, আহ্বানের বাঁশি বাজে। ঘোর গহন পথে অবিরাম বৃষ্টিপতন হতেই থাকে। আর প্রৌঢ়া রাধার সঙ্গী স্বপ্ন। স্বপ্ন দমিত মিলন বাসনার রণাঙ্গন। এক অলৌকিক স্বাধীনতার মধ্যে রাধা লোহিত বর্ণের স্বপ্নই বড়ো ভালোবাসে। কপালে রক্তাভ সিঁদুর, পায়ে আলতা, লালপেড়ে শাড়িতে নববধূর সাজে কৃষ্ণাঙ্গী রাধা। তারপরেই এক নদীর পাড়ের দৃশ্য। যমুনা নয়, বঙ্গভূমির ভাগীরথী। এখানেই রাধার অন্ত্যেষ্টি সম্পন্ন হবে। স্থানীয় ধীবরেরা একদিন ওকে জল থেকে তুলে এনেছিল। ‘কৃষ্ণ, কৃষ্ণ’ আহ্বানে কখন রাধা ভাগীরথীর জলের বুকে ঝাঁপ দিয়েছিল। রাধা তাই প্রেমের ঋত্বিক। এর কয়েক দিন পরেই সে জলভরা স্নানদে সুগন্ধি মিশিয়ে স্নান সারল। চাঁপাফুল রঙের শাড়িটি পরিধান করল। উৎকণ্ঠার আবেগ ত্যাগ করে মুখে এলাচভরা পানের মশলা রেখে কৃষ্ণকে এসএমএস করে বসল। যদিও হাইলি সাসপিশাস ছিল কলির কেষ্ট আদৌ সাড়া দেবে কি না। পুরুষের মন, হয়তো ফোনটা এখন ব্যস্ত। সখীজনবঞ্চিতা প্রৌঢ়া রাধা একটি চতুষ্পঠী খুলেছে। অনার্য, বেদপাঠে অমনোনীত ছাত্ররা এখানে আসে। রাধা ওদের বেদান্ত পড়ায়। উপনিষদের লৌহিত্য বর্ণের পুরুষের কথা শোনায়। ব্যাসদেব সবটাই জানেন। তিনি তো কখনো প্রেম করেননি, তাই কৃষ্ণকেও জানাননি।

ঘরের দেওয়ালের টিকটিকি কখনো রাধার ছায়ার কাছে এসে বসে। তখন আবার স্মৃতি লন্ডভন্ড করে দেয় বর্তমান সময়কে। সম্পূর্ণ বাধ্য, অধীন কৃষ্ণ নারীর বশীকরণ শক্তির কাছে পরাভূত। সব খ্যাতির পথ তখন এসে আশ্রয় খুঁজছিল রাধার স্তনতটে। রাধা তখন ঘাতিকা। কৃষ্ণ মহার্ঘ্য মালিশ মৃদুভাবে লাগিয়ে দিচ্ছেন ওর স্তনে। চুম্বনে চুম্বনে চোখের কাজল লুপ্তপ্রায়। শয্যায় নিজেকে সম্পূর্ণ অনাবৃত করার আগে করজোড়ে নতজানু কৃষ্ণ।

.

২৬. একাকী অরণ্যে রাধারমণ

‘অনুজানীহি মাং কৃষ্ণ’–এবার আমায় অনুমতি দাও কেশব, আমার যাওয়ার সময় হয়েছে। ভীষ্মের যে যে অঙ্গ শরবর্ষায় বিদ্ধ হয়েছিল, ক্রমে ক্রমে প্রাণমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সেই অঙ্গ থেকে বাণগুলি খসে খসে পড়ে যেতে থাকল। ভীষ্মের জীবাত্মা ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে আকাশের দিকে উঠে গেলে দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করলেন। ইচ্ছামৃত্যু সম্পূর্ণ করলেন তিনি।

চন্দনকাঠের চিতায় কালীয়ক এবং কালাগুরুর গুরুগন্ধ ঢেলে দেওয়া। হল। যুথিষ্ঠির এবং বিদুর পট্টবস্ত্র এবং ফুলের মালায় আচ্ছাদিত করলেন ভীষ্মের মৃতদেহ। যুযুৎসু পিতামহের মাথায় ধরলেন অশ্বমৈধিক ছত্র। ভীম, অর্জুন আন্দোলিত করতে থাকলে চামর। নকুল, সহদেব ধরে রইলেন। রাজকীয় উষ্ণীষ। যুধিষ্ঠির ও ধৃতরাষ্ট্র বসেছিলেন ভীষ্মের পদতলে।

দাহ সংস্কার শেষ হলে সকলেই ভীষ্মের তর্পণ করবার কারণে উপস্থিত হলেন ভাগীরথীর তীরে। ভীষ্মের তর্পণকালেই আবির্ভূত হলেন জননী জাহ্নবী। তিনি কৃষ্ণকে প্রশ্ন করলেন, ‘স হতোদ্য শিখণ্ডিনা।‘ মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী কিন্তু তাই বলে প্রবল পরাক্রান্ত পুত্রের মৃত্যু শিখণ্ডীর হাতে!

কৃষ্ণ বললেন, ‘এমন বীরপুরুষ পৃথিবীতে নেই। দেবরাজ ইন্দ্রও তাঁর কাছে পরাভূত হবেন। ‘ন শক্তঃ সংযুগে হন্তং সাক্ষাদপি শতঞতুঃ।’ শিখন্ডীর মতো ক্লীবতি মানুষের হাতে তিনি নিহত হননি। আর মাতা, তোমার পুত্র তো সাধারণ মানুষ নন, অষ্টবসুর একজন। তাই তিনি বসুলোকে প্রত্যাবর্তন করেছেন।’ মাতা জাহ্নবী কৃষ্ণের কথার যাদুতে আশ্বস্ত হয়েছিলেন। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস একবার বলেছিলেন মহাভারতের ইতিহাস ভীষ্মের ইতিহাস।

কৃষ্ণ অরণ্যভূমিতে শয়ন করেছেন। তিনি আহ্বান করছেন যোগনিদ্রা। সেই হন্তারক ‘জরা’ ব্যাধের পদশব্দ শুধুমাত্র শ্রুতিগোচর হচ্ছে। মৃত্যুর কুহকে বার বার বিভ্রান্ত হচ্ছেন তিনি। অরণ্যের সমীপে পোষ্য নদীর জলে হস্ত প্রক্ষালনের জন্য উঠে দাঁড়ালেন কৃষ্ণ। তিনি অগ্নি ও বরুণদেবকে স্মরণ করে মৃত্যুমন্ত্র আহ্বান করলেন। নিষাদের জান্তব শরীরে গন্ধ আরও স্পষ্ট হল। দূরে, বহুদূরে সরে যাচ্ছে রাধাদেশ। অনিদ্রা এখন রাধারমণের সর্বক্ষণের সঙ্গী। বিবর্ধিত পার্থিব অঙ্কুরগুলি একবার গলাধঃকরণের পর যে-ধর্ম মানুষকে ধারণ করে এবং যে-প্রেমে। মৃত্যুও অমৃতময় হয় –তার থেকে কৃষ্ণ লক্ষ যোজন দূরে অবস্থান করছেন।

.

২৭. পাঞ্চালী

মনু ঋষিও বলেছিলেন, ‘যেখানে অনাদৃতা নারীর অভিসম্পাত পড়ে সেই গৃহ নিহতের মতো সর্বতোভাবে বিনষ্ট হয়।’

অশ্বত্থামার মৃত্যু নেই। তিনি অজর, অমর। তাই তাঁর যন্ত্রণারও অবশেষ নেই। পাঞ্চালীর রোদন তখন প্রান্তর দীর্ণ করছে। নিহত পঞ্চপুত্র যে দ্রৌপদীর, অশ্বত্থামা জ্ঞাত ছিলেন না। তিনি প্রতিশোধের উল্লাসে মহারাজ দুর্যোধনের কাছে এসেছিলেন। মনে পড়ছিল পিতার মুখ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ শুনে তিনি অস্ত্রত্যাগ করে বসে পড়েছেন। আত্মরক্ষার স্বাভাবিক প্রবণতাও হারিয়ে ফেলেছেন মিথ্যে মৃত্যুর এক রটনায়। অশ্বত্থামা অরণ্যের নিবিড় অন্ধকারে এই যন্ত্রণাদীর্ণ অবস্থার মধ্যেও যেন ঘ্রাণ পেলেন ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ করার পর কৃপাণে লেপটে থাকা রক্তের উষ্ণ গন্ধ। নিজের ক্ষতস্থান থেকে যে-রক্ত নির্গত হচ্ছিল, কখন স্মৃতির প্রমাদবশে শক্ররক্তের অপূর্ব আস্বাদ মনে করে লেহন করলেন জিহ্বা দিয়ে। পিতা তখন যাবতীয় অস্ত্রত্যাগ করে পরম সাংখ্যে আহিত। দুটি হাত বুকের উপর রেখে জ্যোতির্ভূতো মহাতপাঃ। সেই শোকাহত ধ্যানস্থ মানুষটির মাথা তরবারির এক কোপে কর্তন করল কাপুরুষ ধৃষ্টদ্যুম্ন। অরণ্যের স্তব্ধতা ভেদ করে চিৎকার করে উঠলেন অশ্বত্থামা। পাঞ্চালীর ক্রন্দন যেন আর শ্রুত হচ্ছে না। পাঞ্চাল দেশের রক্তধারা কুরুবংশে অপ্রবাহিত থেকে গেল।

একস্যা বহবা পতয়ঃ দ্রৌপদীর। যুধিষ্ঠির অবশ্য বলেছিলেন, ‘অর্জুন ওর জিত কন্যাকে একাই বিবাহ করুক।‘ পঞ্চস্বামী পাঞ্চালীর। কৃষ্ণ তাঁর সখা। সভাপর্বে দুঃশাসন একবস্ত্রা রজস্বলা দ্রৌপদীকে সভাস্থলে টেনে নিয়ে এলে একমাত্র উত্তেজিত হয়েছিলেন ভীমসেন। বিশাল শাল বৃক্ষকে লতা যেমন বেষ্টন করে, দ্রৌপদী মধ্যম পান্ডবকে দুই বাহুর আলিঙ্গনে প্রলুব্ধ করে এই বঞ্চলে টেনে নিয়ে এসেছেন। অশ্বত্থামার অনিঃশেষ যন্ত্রণা উপভোগ করবেন বলে। হৈমন্তিক ঠান্ডায় তখন অরণ্যে কুয়াশার নদী প্রবাহিত হচ্ছে। নরবৃষ ভীমসেন বললেন, ‘পাঞ্চালী, তুমি তৃপ্ত হয়েছ? অশ্বত্থামা আর্তনাদ করছে।’ কীচক বধের পর গান্ধারস্বনিত বীণার মতো মধুর স্বরে দ্রৌপদী বিজয়ী ভীমসেনকে সম্ভাষিত করেছিলেন। দুঃশাসনের রক্তপানও তাঁকে তৃপিত দিয়েছিল। আর এই হৈমন্তিক অরণ্যের রাত্রিতে অশ্বত্থামার আর্তনাদে তিনি সত্যিই তৃপ্ত হলেন। পুত্রদের মৃত্যুতে যে গন্ডশোণিমা পাংশু হয়ে গিয়েছিল, আবার তা প্রেমিকের সান্নিধ্যে, প্রতিশোধস্পৃহার অগ্নিকে অনির্বাণ রেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

.

২৮. ভক্ত

কৃষ্ণ উদ্ভবকে বলেছিলেন, ‘যে পর্যন্ত আমার লীলাকথা বাশ্রবণ কীর্তনাদিতে সুদৃঢ় বিশ্বাস জন্মাবে না ততক্ষণ সাধক কেবল নিত্যনৈমিত্তিক কর্মেরই অনুষ্ঠান করবে। অর্জুনকেও তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি আমাতে মন অর্পণ করে আমাকে ভজনা করো, আমার অর্চনে নিরত হও এবং আমাকে দণ্ডবৎ প্রণাম করো। তুমি আমার প্রিয়, অতএব আমি শপথ করে বলছি তুমি আমাকে লাভ করবে।’

ভক্তের গুণাগুণ হচ্ছে সে কৃপালু, অকৃতদোহ, সত্যসার, শান্ত, অকাম, অনীহ, স্থির, বিজিত ষড়গুণ, মিতভূক, অপ্রমত্ত, মানদ, অমানী, গম্ভীর, করুণ, মৈত্র, কবি, দক্ষ ও মৌনী।

অপালা নিত্যনৈমিত্তিক কর্মের অনুষ্ঠান করে দেবতার সিংহাসনে বালগোপালের একটি মূর্তিও সম্প্রতি স্থাপন করেছে কিন্তু যাবতীয় আসক্তি পরিত্যাগ করে অকিঞ্চন হয়ে শ্রীকৃষ্ণের চরণে যে মনোগত আশ্রয় নেওয়া তার হয়ে উঠছে না। শরণাগত ভক্তকে ভক্তবৎসল ভগবান আপন করে নেন। জীবের সমস্ত পাপের মোচন ঘটে। কৃষ্ণের প্রেমরূপ মহাধন লাভ হয়। অপালার যৌনমিলন ইচ্ছে আগের চেয়ে কমে গেছে কিন্তু একেবারে অন্তর্হিত হয়নি। বিশাখজ্যোতি কখনো জোর করেন না। তবে তিনি অপালাকে উন্মাদিনী বলেই মনে করেন। ব্রজবাসী ভক্তদের যে রাগস্বরূপা ভক্তি, তাই হচ্ছে মুখ্য ভক্তি। সেই ভক্তি এই ভারতবর্ষের বা আর্যাবর্তের আর কোথাও নেই। একমাত্র ব্রজভূমি বৃন্দাবনেই রয়েছে। বৃন্দাবন থেকে আগত এক সাধুই অপালার ঋত্বিক। তিনিই অপালাকে কৃষ্ণপ্রেমে দীক্ষিত করে তুলেছেন। ইষ্টবস্তুতে গাঢ় তৃষ্ণা ব্যাতীত অপালার আর কোনো লক্ষ্য নেই। ইষ্টবস্তুতে অপালা সর্বদাই আবিষ্ট থাকতে চায়। এরই নাম তন্ময়তা। এই তন্ময়তার ফলে অপালার কখনো মনে হয় ভগবান কৃষ্ণ তার আত্মবৎ প্রিয়, কখনো বা অর্কজ্যোতির মতোই পুত্রবৎ স্নেহাস্পদ। আবার তিনিই সুহৃদতুল্য বিশ্বাসী, সখাতুল্য রহস্যজ্ঞ।

অপালা তেমন সাধুসঙ্গ করতে পারে না। শ্রবণ কীর্তনে অনর্থের নিবৃত্তি হয়। তবুও অপালা বিশাখজ্যোতির সঙ্গেও কৃষ্ণগুণকীর্তন ব্যতীত অন্য কথায় কালক্ষয় করে না। তাঁর কথা বলতে গিয়ে অপালা প্রায় নেত্ৰজলে অভিষিক্ত হয়ে ওঠে। ইক্ষুরস অগ্নিতাপে পাক হতে যেমন গুড়, শর্করা, মিছরিরূপ পরিণত হয়ে ক্রমে পরিষ্কৃত ও মিষ্টির অধিক হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনই কৃষ্ণপ্রেম ঘনীভূত হতে হতেই মহাভাবের উদয় হয়।

যে-সাধুর কাছ থেকে অপালার দীক্ষা হয়েছে তিনি শান্ত রসের অধিকারী। শ্রীকৃষনের সারথি দারুক দাস্য রসের অধিকারী। অর্জুন সখা ও বাৎসল্য রসের অধিকারী।

.

অভিমানিনী শ্রীরাধিকা ওঁর কুঞ্জ থেকে কৃষ্ণকে ভর্ৎসনা করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই মধুর রস মহাভাবে পরিণত হলে, তা থেকে ভক্তের দুটি ভাবের উদয় হয়। একটির নাম রূঢ় অপরটির নাম অধিরূঢ়। দ্বারকাবাসিনী রুক্মিণী প্রভৃতি মহিষীদের রূঢ়ভাব, অপরটির নাম অধিরূঢ়। ব্রজবাসিনী সুন্দরীদের অধিরূঢ় ভাব রয়েছে। এরপরেও আসতে পারে মোহনাক্ষ মহাভাব। এতে ভ্রান্তিময়ী বৈচিত্র্য জন্মায়। একেই দিব্যোন্মাদ দশা বলে। সমস্ত বস্তু, এমনকী নিজেকে পর্যন্ত কৃষ্ণজ্ঞান বলে ভ্রম হয়। আর আছে শৃঙ্গার। সম্ভোগ আর বিপ্রলব্ধ। যুক্ত এবং অযুক্ত আলিঙ্গন। যুক্ত আলিঙ্গন ভাব এলে কৃষ্ণের দিক থেকে আহ্বান আসে। শরীর ও মন শুচি করে অপেক্ষা করতে হয়। অন্য সমস্ত বাসনা, পূজা, কর্ম, জ্ঞান ইত্যাদি সব কিছু বর্জন করে কেবলমাত্র কৃষ্ণের প্রীতি সম্পাদনের যে ভক্তি তারই নাম শুদ্ধভক্তি। প্রেম হৃদয়কে শ্রীকৃষ্ণরসে জারিত করে। সেই রস ঘনীভূত হলেই প্রেম যুক্ত হওয়ার আহ্বান আসে। এখানেই। দ্বিধা অপালার। বিশাখজ্যোতিকে সে এখনও ভালোবাসে। প্রিয়জনের সঙ্গে সঙ্গসুখ এখনও অপালা পরিত্যাগ করতে পারেনি। অথচ শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে প্রেয়সী ভক্তদের যে-সম্বন্ধ তা তাকে টানে। মধুর রতির সম্ভোগস্বপ্ন। এখন অপালা প্রায়ই দেখে। সাধুও বলে গেছেন, সমস্ত রসের শ্রেষ্ঠ মধুর। রস। রসাত্মিকা এই ভক্তির অধিকারী শ্রীরাধিকা। শ্রীরাধিকা মহাভাব স্বরূপিণী এবং ব্রজ গোপিকারা সেই ভাবের সহকারিণী। নায়িকা শিরোমণি হচ্ছেন রাধা। পঁচিশটি কলা বা গুণের অধিকারিণী তিনি। রাধিকার সঙ্গে সাক্ষাৎ অপালার একান্ত প্রয়োজন। রাধার প্রসঙ্গে সাধুর উত্তর অপ্রোজ্জ্বল। তিনি শুধু বলে গেছেন, রাগানুরাগ ভক্তির অনুশীলন করতে গেলে ব্রজবাসিনীদের কাছে যেতে হবে। পূর্ণ নায়িকা রাধার কাছে তবে যাওয়া যাবে না, তিনি কি অগম্য?

.

২৯. জরা ব্যাধ

অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ রটনার পশ্চাতে তিনি ছিলেন উদ্যোক্তা ও কর্মকর্তা। যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে মিথ্যে ভাষণের সর্বশেষ যুক্তিটিও কৃষ্ণের মস্তিষ্কপ্রসূত। জগতে এর চেয়ে গর্হিত কাজ আর কী হতে পারে! কথাগুলি স্মৃতিতে আসতেই স্থানে স্থানে স্ফীত হয়ে ওঠা পচন অঙ্গগুলির যন্ত্রণা আরও তীব্রতর হয়ে উঠল। এই অরণ্যে কিছুটা অংশে বালুকার আধিক্য রয়েছে। রাতে সে বালুকা শীতল হয়ে ওঠে। সমুদ্র বোধ হয় অদূরবর্তী নয়। হতে পারে এ কোনো দক্ষিণ দেশের অরণ্যভূমি। দূরের গ্রাম্য জনপদ থেকে ঘন্টাধ্বনি ভেসে আসছে। মঙ্গলশঙ্খও শ্রুত হচ্ছে। কৃষ্ণ স্বয়ং অভিশাপগ্রস্ত। শোকে ও মনস্তাপে আকুল হয়ে গান্ধারী অভিশাপ দিয়েছিলেন। কুশলী কৃষ্ণ নাকি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘দেবী, আমি যে যদুবংশ ধ্বংস করব তার প্রস্তুতির জন্যই তো এত কিছু করে যাচ্ছি। আমিই লোকক্ষয়কারী বৃদ্ধ কাল। এখন লোকসংহারে প্রবৃত্ত হয়েছি। এই সময় অশ্বত্থামা বৃষস্কন্ধ ‘জরা’ ব্যাধকে আসতে দেখলেন। হৃদয়ে আংশিক প্রসন্নতা ফিরে এল। রক্তগর্ভ চোখ খানিকটা জলপূর্ণ হয়ে উঠল। অভ্যন্তর থেকে কেউ যেন উচ্চারণ করল, ‘হে অভিশপ্ত, এবার তুমি পারবে কৃষ্ণের জীবনের শিখাঁটি নির্বাপিত করতে। সেই আয়ুধ তোমার সম্মুখেই রয়েছে। নিষাদ বোধ হয় কোনো মৎস্য-জাতীয় প্রাণী হত্যা করে সম্প্রতি ভক্ষণ করেছে। কেমন একটা আঁশটে গন্ধ অশ্বত্থামার নাকে এল। দীর্ঘ, ঋজু ভঙ্গিতে জরা ব্যাধ ক্ষরোগাক্রান্ত রাজপুরুষটিকে অবলোকন করতে থাকল। অশ্বত্থামা আশা করেছিলেন জরার উচ্চারণ হবে অসংস্কৃত অনার্য ভাষায়। তবে জরার ভাষা অনার্য হলেও ধীমান এবং জ্ঞানীর মতোই ওর পদক্ষেপ। প্রথম দর্শনেও তেমন বিমুখতা আসে না। জরা বেশ কৌতুক নিয়ে দেখছিল অশ্বত্থামাকে। মানুষটি প্রায় কুন্ডলী পাকিয়ে গেছে। তবে রাজপুরুষের কিছু চিহ্ন এখনও যেন অবশিষ্ট রয়েছে।

অশ্বত্থামা বললেন, ‘তোমাকে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে।’ জরা শব্দটির সঙ্গে অপরিচিত নয়। প্রশ্ন করল, কেন?’ অশ্বত্থামা অভিশপ্ত হয়েও যেন এক কল্প অর্জন করেছিলেন। তিনি অদূরে দন্ডায়মান জরার। গায়ের গন্ধে টের পেলেন এই ব্যাধই বাসুদেব কৃষ্ণের নিধনকারী। অশ্বত্থামা আগুন প্রজ্বলিত করলেন। অগ্নির চারপাশে একটা কূহা তৈরি করে নিয়ে জরাকে আহ্বান করলেন। উপরের নক্ষত্ররাশি তখন হয়তো। কয়েকটা কক্ষপথ অতিক্রম করেছিল। সভ্যতার অন্তিম পর্ব সমাগত। কালের ধারকের হত্যাকারীকে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা দিলেন তিনি। ঈশ্বরের নিয়তি অবশ্যম্ভাবী জেনে অগ্নিদেবও আকাশ থেকে উর্বশীদের বারিধারা। বৃষ্টিধারা হয়ে নেমে এলেও নির্বাপিত হলেন না।

ব্যাধ তখন হাতজোড় করে বললে, ‘হে মহাতপাঃ, আমি অজ্ঞ। এই দীক্ষার হেতু কী?

–আজ পর্যন্ত কত প্রাণী তুমি শিকার করেছ?

–অগণ্য।

–যদি তুমি সম্পদশালী হতে, আমার কথার উত্তরে ছলনা করতে কোনো একটি আনুমানিক সংখ্যা ব্যবহার করতে। অর্থাৎ তুমি কপট নও।

–আমাদের ঠকাবার মতো কিছু নেই।

–আমি তোমাকে দিয়ে একটি প্রায়শ্চিত্ত করাতে চাইছি।

–আমি তো কোনো অপরাধ করিনি, প্রভু। শিকার আমাদের বংশগত প্রবৃত্তি।

–প্ৰাণীহত্যা স্বধর্ম রক্ষায় পাপকর্ম নয়। আমাদের এই পাপ আসলে সমবেত পাপ। এখানে জগতের পিতা যিনি তিনিই সর্বাপেক্ষা পাপী।

ভীত এক প্রতিক্রিয়া হল জরার। সে সম্পূর্ণ নতি স্বীকার করতে পারছে না আবার বিদ্রোহও করতে পারছে না। এ ছাড়া রাজপুরুষটি অর্ধমৃত। যজ্ঞের ক্রিয়াকলাপ দেখে বেশ কৌতূহল হয়েছে জরার। এখন রহস্যময় মনে হচ্ছে।

–কোনো কুপ্রস্তাব ব্যক্ত করলে আমি তোমাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেব।

–তুমি নিশ্চয় আমাকে খুব হীনবল ভাবছ। লয়, ক্ষয়, মৃত্যু অনিবার্য কিন্তু আমি অজর। হয়তো আমার এই কালান্তক ব্যাধির কোনো আরোগ্যলাভের উপায় নেই, অথচ আমার মৃত্যুও নেই।

–তুমি কি তবে নক্ষত্রলোকের জীব, যেখানে মৃত্যু নেই।

–আমি আশীর্বাদপুষ্ট। আমার মৃত্যু নেই। ফলে আমার প্রায়শ্চিত্তেরও শেষ নেই।

–কী পাপ তুমি করেছ?

অনেক্ষণ পূর্বেই জরার অশ্বত্থামাকে সম্বোধনের অর্বাচীনতা ক্ষমা পেয়ে এসেছে। কার্যসিদ্ধির কারণে তিনি কিছু মনে করলেন না।

–আমি দ্রোণাচার্যপুত্র। ঘৃণায় বিষিয়ে উঠল জরার মন। ‘বীর একলব্যের হন্তারক?’ ধনুক তুলে ধরল ব্যাধ।

–পিতার সেই কার্য তোমাদেরই কোনো পূর্বজ একলব্যের প্রতি–আমি নিন্দা করি। তুমি ধৈর্য হারিয়ো না বৎস। আগে আমার কথা শ্রবণ করো।

রাজপুরুষটির কথার মধ্যে বেশ তেজ রয়েছে।

–শোনাই যাক তবে, কী বলছ তুমি!

–এই অরণ্যে কৃষ্ণ এসেছেন। আমি স্বপ্নে তাঁকে দেখেছি। এটাই নির্দিষ্ট যে তুমি কৃষ্ণের হত্যাকারী।

–মহাপাপকর্ম হবে তো। এই বাক্য দ্বিতীয় বার উচ্চারণ করবে না।

অন্ধকারে পাখির ডাক শ্রুত হল। রাত্রিজাগরণের পাখি। প্রভাত প্রকাশিত হচ্ছে। পুবের আকাশে হয়তো খুব দ্রুতই সূর্য প্রতিভাত হবেন। কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরভূমি আবার অশ্বত্থামার মনশ্চক্ষে ভেসে উঠল। অন্যান্য বীরদের পরাভূত করা স্মৃতি। পিতার পরাক্রমে পান্ডব শিবিরে ত্রাহিরব। কিন্তু পরক্ষণেই আবার সেই বিষণ্ণ স্মৃতি। পিতৃরক্তের উষ্ণ লোহিত ধারায় কুরুক্ষেত্রের প্রান্তর যেন প্লাবিত।

হঠাৎ অশ্বত্থামা বল পেলেন। এ যেন তাঁর নতুন করে যুদ্ধযাত্রা। লক্ষ্য কৃষ্ণের নিধন।