অগ্নিকুণ্ড অধিপতিদের ঘটনা
আল্লাহ তাআলা বলেন :
(১) শপথ বুরুজ বিশিষ্ট আকাশের (২) এবং প্রতিশ্রুত দিবসের (৩) শপথ দ্রষ্টা ও দৃষ্টের (৪) ধ্বংস হয়েছিল কুণ্ডের অধিপতিরা (৫) ইন্ধনপূর্ণ যে কুণ্ডে ছিল আগুন (৬) যখন তারা সেটির পাশে উপবিষ্ট ছিল (৭) এবং তারা মুমিনদের সাথে যা করছিল তা প্রত্যক্ষ করছিল (৮) ওরা তাদেরকে নির্যাতন করেছিল শুধু এ কারণে যে, তারা বিশ্বাস করত পরাক্রমশালী ও প্রশংসাৰ্ছ আল্লাহে (৯) আকাশ রাজি ও পৃথিবীর সর্বময় কর্তৃত্ব যার, আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে দ্রষ্টা। (১০) যারা ঈমানদার নর-নারীকে বিপদাপন্ন করেছে এবং পরে তাওবা করেনি তাদের জন্য আছে জাহান্নামের শাস্তি, আছে দহন যন্ত্রণা। (৮৫ বুরুজ : ১-১০)
এ সূরার তফসীর প্রসঙ্গে আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে আমরা ব্যাপক ও বিস্তারিত আলোচনা করেছি, আলহামদুলিল্লাহ। মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক মনে করেন যে, কুণ্ড অধিপতিরা হযরত ঈসা। (আঃ)-এর নবুওত প্ৰাপ্তির পরবর্তী যুগের লোক। পক্ষান্তরে অন্যান্যরা মনে করেন যে, এটি তার পূর্বের যুগের ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা পৃথিবীতে একাধিকবার ঘটেছে। স্বৈরাচারী কাফির রাজা বাদশাহরা বারে বারে ঈমানদার মানুষদের ওপর এ প্রকার নির্যাতন চালিয়েছে। তবে কুরআন মজীদে উল্লেখিত ব্যক্তিদের ব্যাপারে একটি মারফু হাদীছ এবং ইব্ন ইসহাক বর্ণিত একটি বর্ণনা রয়েছে। এ দুটো পরস্পর বিরোধী। পাঠকের জ্ঞাতার্থে আমি উভয় বর্ণনাই উল্লেখ করছি। ইমাম আহমদ সুহায়ব (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, তোমাদের পূর্বের যুগে এক রাজা ছিল। তার ছিল এক যাদুকর। যাদুকর বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার পর রাজাকে বলল, আমি তো বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছি আর আমার মৃত্যুও ঘনিয়ে এসেছে। এখন আমাকে একটি বালক যোগাড় করে দিন, থাকে। আমি যাদু শিখাব। রাজা একটি বালক যোগাড় করে দিলেন।
যাদুকর ওকে যাদু শিখাচ্ছিল। রাজার রাজপ্রাসাদ ও যাদুকরের আখড়ার মধ্যখানে ছিল জনৈক ধর্মযাজকের আস্তানা। বালকটি একদিন ধর্মযাজকের আস্তানায় আসে এবং তার কথা শোনে। তার কথা বালকটির পছন্দ হয়। এ দিকে বালকটি যাদুকরের নিকট গেলে যাদুকর তাকে প্রহার করতো এবং বলতো, বিলম্ব করেছিস কেন? কিসে তোকে আটকে রাখে? নিজের বাড়িতে গেলে পরিবারের লোকজন তাকে প্রহার করতো এবং বলতো দেরী করেছিস কেন? এ বিষয়টি সে যাজককে জানায়। যাজক তাকে পরামর্শ দেয় যে, যাদুকর তোমাকে মারতে গেলে তুমি বলবে আমার ঘরের লোকজন আমাকে আটকে রেখেছিল। আর ঘরের লোকজন মারতে গেলে বলবে যাদুকর আমাকে আটকে রেখেছিল। একদিন যাওয়ার পথে সে পথের ওপর একটি বিশালাকৃতির ভয়ানক জন্তু দেখতে পায়। যেটি লোকজনের পথ আটকে রেখেছিল। পথিকগণ পথ অতিক্রম করতে পারছিল না। বালকটি মনে মনে বলে, আল্লাহ তাআলার নিকট যাদুকরের কোজ বেশি প্রিয়, নাকি ধর্মযাজকের কাজ বেশি প্রিয়, তা আমি আজ পরীক্ষা করব। সে একটি পাথর তুলে নিয়ে এ বলে জন্তুটির দিকে ছুড়ে মারল, হে আল্লাহ! যাজকের কর্ম যদি আপনার বেশি প্রিয় ও পছন্দনীয় হয় তবে এ পাথর দ্বারা জন্তুটিকে বধ করে দিন, যাতে লোকজন পথ অতিক্রম করতে পারে। তার পাথরের আঘাতে জন্তুটি নিহত হয়। যাজকের নিকট গিয়ে সে তা জানায়। যাজক বললেন, প্রিয় বৎস! আল্লাহর নিকট তুমি আমার চেয়ে অধিক প্ৰিয়। তুমি অবশ্যই বিপদে পড়বে, পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। বিপদে পড়লে কাউকে আমার সন্ধান দিবে না।
তারপর বালকটি জন্মান্ধকে দৃষ্টিশক্তি দান করত, কুণ্ঠরোগ নিরাময় করত। তার হাতে আল্লাহ রোগীদেরকে সুস্থ করে দিতেন। রাজার এক পারষদ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বালকের কথা তার কানো যায় তিনি প্রচুর হাদিয়া নিয়ে বালকের নিকট এসে বলেন, তুমি যদি আমাকে সুস্থ করে দিতে পার তবে এসব হাদিয়া তুমি পাবে। বালক বলল, আমি তো কাউকে সুস্থ করতে পারি না। একমাত্র আল্লাহই সুস্থ করেন। আপনি যদি তার প্রতি ঈমান আনেন এবং আমি তার নিকট দোয়া করি তাহলে তিনি আপনাকে সুস্থ করে দিবেন। তিনি ঈমান আনলেন। এবং বালকটি দোয়া করল। আল্লাহ তাকে সুস্থ করে দিলেন।
তারপর উক্ত সভাষদ রাজার নিকট আসলেন এবং ইতিপূর্বে যেভাবে বসতেন সেভাবে বসলেন। রাজা বললেন, তোমাকে দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিল কে? জবাবে তিনি বললেন, আমার প্রতিপালক। রাজা বলল, আমি? তিনি বললেন, না। আমার ও আপনার প্রতিপালক আল্লাহ।
এবং আপনার প্রতিপালক আল্লাহ। তখন রাজা তাকে বিরামহীনভাবে নির্যাতন করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত তিনি বালকটির সম্পদ নিয়ে নিলেন। তখন বালকটিকে রাজ দরবারে নিয়ে আসা হলো। রাজা বলল, বৎস! যাদু বিদ্যায় তুমি এত পারদর্শিতা অর্জন করেছ যে, জন্মািন্ধ ও কুণ্ঠরোগীকে পর্যন্ত নিরাময় করতে পার এবং সকল রোগের চিকিৎসা করতে পোর। বালকটি বলল, আমি তো নিরাময় করি না। নিরাময় করেন আল্লাহ তাআলা। রাজা বলল, আমি? সে বলল, না। রাজা বলল, আমি ছাড়া তোমার কি অন্য কোন প্রতিপালক আছে? জবাবে বালকটি বলল, আমার এবং আপনার প্রতিপালক আল্লাহ।
তখন রাজা তার উপর বিরামহীন নির্যাতন চালাতে লাগল। শেষ পর্যন্ত সে যাজকের নাম প্রকাশ করে দিল। যাজককে রাজ দরবারে ডাকা হল। রাজা তাকে বলল, তোমার ধর্ম ত্যাগ কর। তিনি তাতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁর মাথার মধ্যভাগে করােত চালিয়ে তাকে দুভাগে বিভক্ত করে দেয়া হয়। অন্ধ ব্যক্তিকে রাজা বলল, ঐ ধর্ম ত্যাগ কর। তিনি তাতে অস্বীকৃতি জানালেন। তার মাথায় করাত রেখে তাকে দুভাগে ভাগ করে দেয়া হল। রাজা তখন বালককে বলল, ঐ ধর্ম ত্যাগ কর। সে তাতে অস্বীকৃতি জানাল। অতঃপর একদল নয়া লোক দিয়ে তাকে পাহাড়ের ওপর পাঠানো হয়। রাজা তাদেরকে নির্দেশ দিল যে, তোমরা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দেখবে, সে তার ধর্ম ত্যাগ করে কিনা! যদি সে ধর্ম ত্যাগ করে তো ভাল। নতুবা ধাক্কা মেরে তাকে ওখান থেকে ফেলে দিবে।
তারা বালকটিকে নিয়ে যায়। যখন তারা পাহাড়ের ওপব উঠল, তখন বালকটি বলল, হে আল্লাহ! আপনার ইচ্ছা মুতাবিক তাদের বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য করুন! এ সময় হঠাৎ সবাইকে নিয়ে পর্বত কেঁপে উঠে। সবাই পাথর চাপা পড়ে মারা যায়। বালকটি পথ খুঁজে খুঁজে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে এবং রাজার নিকট উপস্থিত হয়। আর রাজা তাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার সাথে যারা ছিল তাদের খবর কি? বালকটি উত্তর দিল, তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট হয়েছেন। তখন রাজা তাকে তার লোকজন দিয়ে একটি নীেকায় করে সমুদ্রে পাঠিয়ে দিল। রাজা বলল, তোমরা যখন গভীর সমুদ্রে গিয়ে পৌছবে তখন যদি সে তার ধর্ম ত্যাগ করে তবে ভাল কথা। অন্যথায় তাকে সমুদ্রে ডুবিয়ে মারবে। লোকজন তাকে সমুদ্রে নিয়ে গেল। বালকটি বলল, হে আল্লাহ! আপনার যেভাবে ইচ্ছা আমাকে ওদের বিরুদ্ধে সাহায্য করুন। তখন তারা সবাই সমুদ্রে ডুবে মারা গেল। বেঁচে গেল (বালকটি) সে ফিরে এসে রাজার নিকট উপস্থিত হল। তখন রাজা তাকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার সাখী লোকজনের সংবাদ কি? বালকটি উত্তরে জানাল, আল্লাহ তাআলা আমার সাহায্যে ওদের ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছেন।
বালক রাজাকে আরো বলল যে, আমি যে পরামর্শ দিব, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা না নিলে আপনি আমাকে হত্যা করতে পারবেন না। আমার পরামর্শ মানলেই কেবল আমাকে হত্যা করতে পারবেন। তখন রাজা জিজ্ঞেস করল, তোমার পরামর্শটি কি? সে বলল, সকলকে একটি মাঠে সমবেত করবেন। তারপর আমাকে খেজুর গাছের কাণ্ডে শূলে চড়াবেন। এরপর আমার ঝুড়ি থেকে একটি তীর নিয়ে এই বিসমিল্লাহিরাকিবল গোলাম-এই বালকের প্রভু আল্লাহর নামে নিক্ষেপ করছি। বলে তীরটি আমার দিকে নিক্ষেপ করবেন। রাজা তখন তাই করল। তীর গিয়ে বালকের ললাটের উপর পড়ল সে নিজের ক্ষত স্থানে হাত রাখল এবং শহীদ হয়ে গেল। এসব দেখে উপস্থিত লোকজন চীৎকার করে বলে উঠল, আমরা বালকটির প্রতিচালকের প্রতি ঈমান আনলাম। আমরা বালকটির প্রতিচালকের প্রতি ঈমান আনলাম। রাজাকে বলা হল, আপনি যা আশঙ্কা করেছিলেন। তাইতো হল। আল্লাহ। আপনার প্রতি সেই বিপদই তো নাযিল করলেন। লোকজন সকলেই তো ঈমান এনে ফেলেছে। রাজার নির্দেশে প্রত্যেক গলির মুখে গর্ত খনন করা হল। তাতে আগুন জ্বালানো হল। রাজা বলল, যে ব্যক্তি ঐ ধর্ম ত্যাগ করবে তাকে রেহাই দিবে। আর যারা তাতে স্বীকৃতি জানাবে তাদেরকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করবে।
লোকজন ওখান দিয়ে যাচ্ছিল। আর অগ্নিকুণ্ডে পতিত হচ্ছিল। জনৈকা মহিলা তার নিকট উপস্থিত হল। এক দুগ্ধপোষ্য শিশুসহ সেখানে মহিলাটি আগুনে পতিত হতে ইতস্ততঃ করছিল। তার শিশুটি বলে উঠল, মা! তুমি ধৈর্যধারণ কর, কারণ, তুমি সত্যের ওপর রয়েছ। এটি ইমাম আহমদের বর্ণনা। ইমাম মুসলিম ও নাসাঈ প্রমুখ সহীহ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। এগুলো আমি আমার তাফসীর গ্রন্থে বিস্তারিত বর্ণনা করেছি।
মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক এ ঘটনাটি অন্যভাবে বর্ণনা করেছেন; তিনি বলেন, নাজরানের অধিবাসিগণ ছিল মুশরিক। তারা দেব-দেবীর পূজা করত। নাজরানের পার্শ্ববতী একটি গ্রামে (নাজরান নগর হল নাজরান অঞ্চলের কেন্দ্রীয় শহর) এক যাদুকর বসবাস করত। নাজরানের বালকদের সে যাদু বিদ্যা শিক্ষা দিত। ইব্নে মুনাব্বিহ বলেন, ফাইমুন নামক জনৈক ব্যক্তি সেখানে এসে একটি তাবু স্থাপন করে। তার তাবুটি ছিল নাজরান ও যাদুকরের গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে। নাজরানের লোকেরা তাদের ছেলেদেরকে ঐ যাদুকরের নিকট নিয়মিত পাঠাত। সে তাদেরকে যাদু বিদ্যা শিক্ষা দিত। অন্যান্য বালকের সাথে তামূর তার পুত্র আবদুল্লাহকে যাদুকরের নিকট প্রেরণ করে। যাওয়ার পথে আবদুল্লাহ ঐ তাবুওয়ালা লোকটিকে দেখত। তার নামায ও ইবাদত আবদুল্লাহর ভাল লাগত। সে তাঁবু ওয়ালার নিকট-ৰন্সতে এবং তার কথাবার্তা শুনতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত সে মুসলমান হয়ে গেল। আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করে সে তার ইবাদত করতে লাগল। তাঁবু ওয়ালার নিকট থেকে ইসলামের বিধি-বিধান জেনে নিত। অবশেষে ইসলামের বিধি বিধান-সম্পর্কে যখন সে গভীর জ্ঞান অর্জন করে তখন সে তাবুওয়ালার নিকট ইসমে আজম শিখতে চায়। তাবুওয়ালা ইসমে আজম জানতেন বটে, কিন্তু আবদুল্লাহর নিকট তা গোপন রাখতেন। তিনি বললেন, ভাতিজা! তুমি ইসমে আজম সহ্য করতে পারবে না। তোমার দুর্বলতা সম্পর্কে আমি শংকিত। তামুরের ধারণা ছিল যে অন্যান্য বালকের ন্যায় তার পুত্রটিও নিয়মিত যাদুকরের আস্তানায় যাতায়াত করছে!
আবদুল্লাহ যখন বুঝতে পারল যে, ইসমে আজম শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে তার গুরু কার্পণ্য করছেন এবং তার দুর্বলতার আশংকা করছেন তখন সে কয়েকটি তীর সংগ্রহ করে। এরপর তার জানা আল্লাহর প্রত্যেকটি নাম ঐ তীরগুলোতে লিখে। প্ৰত্যেকটিতে একটি করে নাম লিখা শেষ করে সে এক স্থানে আগুন জ্বালায়। এরপর একটি একটি করে তীর আগুনে নিক্ষেপ করতে থাকে। ক্রমে আমি লেখা তীরটি আগুনে ফেলার সাথে সাথে তীরটি লাফিয়ে উঠে এবং আগুন থেকে বেরিয়ে আসে। আগুনে তীরটির সামান্যতমও ক্ষতি হয়নি। ঐ তীরটি নিয়ে আবদুলাহ তার গুরুর নিকট উপস্থিত হয় এবং বলে যে, সে ইসমে আজম জেনে ফেলেছে, যা তার গুরু গোপন রেখেছিলেন। গুরু বললেন, বল তো কোনটি ইসমে আজম? সে বলল, তা এরূপ এরূপ। গুরু বললেন, তুমি কেমন করে জানলে? বালক সকল ঘটনা খুলে বলে। গুরু বললেন, ভাতিজা! তুমি ঠিকই ইসমে আজম জেনে নিয়েছ। তবে নিজেকে সংযত রাখবে। অবশ্য তুমি তা পারবে বলে আমার মনে হয় না।
এরপর থেকে আবদুল্লাহ নাজরানে প্রবেশ করলে এবং কোন দুঃস্থ ও বিপদগ্ৰস্ত লোক দেখলে বলত, হে আল্লাহর বান্দা, তুমি আল্লাহর একত্ববাদ মেনে নাও এবং আমার দীনে প্রবেশ কর। আমি তোমার জন্যে আল্লাহর নিকট দোয়া করব। আল্লাহ তোমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। সংশ্লিষ্ট লোক ঈমান আনলে সে দোয়া করত এবং আল্লাহ ঐ বিপদগ্ৰস্ত লোককে বিপদমুক্ত করতেন। এভাবে তার বিষয়টি নাজরানের রাজার কানে পৌছে। রাজা তাকে তলব করে এবং তাকে অভিযুক্ত করে বলে যে, তুমি আমার প্রজাদের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করেছ। আমার দীন ও আমার পূর্ব পুরুষের দীনের বিরুদ্ধাচরণ করেছ। আমি ওর প্রতিশোধ নেব।
আবদুল্লাহ বলল, আপনি তা পারবেন না। রাজা পাইক পেয়াদা সহকারে তাকে পাঠাল। সুউচ্চ পর্বত শৃঙ্গ থেকে অল্পকে নিচে নিক্ষেপ করা হল। কিন্তু তার কোনই ক্ষতি হল না। তাকে প্রেরণ করা হল নাজরানের সমুদ্রে, সেখানে যাই নিক্ষেপ করা হয় তাই ধ্বংস হয়। বালককে ঐ সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়। সে সমুদ্র থেকে নির্বিবাদে উঠে আসে। আবদুল্লাহ যখন সকল ক্ষেত্রে জয়ী হল তখন সে রাজাকে বলল, আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহতে ঈমান না আনবেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর একত্ববাদ স্বীকার না করবেন, ততক্ষণ আমাকে হত্যা করতে পারবেন। না। আপনি যদি ঈমান আনেন তবে আমার ওপর কর্তৃত্ব পাবেন এবং আমাকে হত্যা করতে পারবেন। অগত্যা রাজা আল্লাহর একত্ববাদ স্বীকার করল এবং আবদুল্লাহ ইব্ন তামুরের ন্যায় কলেমা পাঠ করল। তারপর তার লাঠি দ্বারা আবদুল্লাহকে আঘাত করে রক্ত প্রবাহিত করে দিল। অবশেষে আবদুল্লাহ মারা গেল। রাজারও সেখানে মৃত্যু হল। এবার সকলে আল্লাহর দীন গ্ৰহণ করলেন।
আবদুল্লাহ মূলতঃ হযরত ঈসা (সা)-এর ইনজীলের অনুসারী ছিলেন। এরপর খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীগণের যে পরিণতি হয়েছিল, তাদের পরিণতিও তাই হয়েছিল। নাজরান অঞ্চলে খৃষ্ট ধর্মের প্রসারের এটাই ছিল মূল কারণ। ইব্ন ইসহাক বলেন, আবদুল্লাহ ইব্ন তামুর সম্পর্কে মুহাম্মদ ইব্ন কাব ও কতক নাজরান অধিবাসীর বর্ণনা এরূপই। প্রকৃত ঘটনা যে কোনটি, তা আল্লাহই ভাল জানেন। বর্ণনাকারী আরও বলেন, অতঃপর বাদশাহ যু-নুওয়াস তার সৈন্য সামন্তসহ এ খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। সে তাদেরকে ইয়াহুদী ধর্ম গ্রহণ অথবা মৃত্যু এ দুটোর যে কোন একটি বেছে নিতে বলে। তারা মৃত্যুকেই বছে নেয়। আক্রমণকারীরা বহু গর্ত খনন করে এবং তাতে আগুন জ্বলিয়ে অগ্নিকুণ্ড তৈরি করে। অতঃপর ওদেরকে তরবারীর আঘাতে খণ্ড বিখণ্ড করে হাতপা কেটে ফেলে এবং অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মারে। প্রায় বিশ হাজার খ্ৰীষ্টানকে তারা এভাবে হত্যা করে।
য়ুনুওয়াস ও তাঁর সৈন্যদের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তাআলা তার রাসূলের নিকট এ.আয়াত নাযিল করেন :
ধ্বংস হয়েছিল কুণ্ড আধিপতিরা। ইন্ধনপূর্ণ যে কুণ্ডে ছিল অগ্নি। এতে বুঝা যায় যে, এই ঘটনা আর সহীহ মুসলিমে বর্ণিত ঘটনা এক নয়।
কেউ কেউ বলেন যে, অগ্নিকুণ্ড বিষয়ক ঘটনা পৃথিবীতে একাধিক বার ঘটেছে। যেমন ইব্ন আবী হাতিম আবদুর রহমান ইব্ন জুবায়ের থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ইয়ামানে অগ্নিকুণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল তুব্বা রাজার আমলে। কনষ্টান্টিনোপালে ঘটেছিল রাজা কনষ্টান্টনাইনের আমলে যখন সে খৃষ্টানদেরকে হযরত ঈসা (আ)-এর কিবলা ও তার প্রচারিত একত্ববাদ থেকে ফিরিয়ে নেয়। সে তখন একটি অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করেছিল। যে সকল খৃষ্টান হযরত ঈসা (আ)-এর দীন ও তাঁর একত্ববাদে অবিচল ছিল, সে তাদেরকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মেরেছিল।
ইরাকের ব্যাবিলন শহরে এ ঘটনা ঘটেছিল? সম্রাট oro Rois (Nebuehad Negar)-3 শাসনামলে তিনি একটি মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। লোকজনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ওই মূর্তিকে সিজদা করতে। লোকজন সিজদা করেছিল। কিন্তু দানিয়াল (আঃ) ও তাঁর দুইজন সাখী আযারিয়া ও মাসাইল সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানান। সম্রাট তাদের জন্যে একটি উনুন তৈরি করে। তাতে কাঠ ও আগুন জ্বলিয়ে সেই অগ্নিকুণ্ডে তাদের দুজনকে নিক্ষেপ করে। আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য অগ্নিকুণ্ডকে শীতল ও শান্তিময় করে দেন এবং তাদেরকে আগুন থেকে রক্ষা করেন। এবং অত্যাচারীদেরকে ঐ অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেন। তারা ছিল সংখ্যায় ৯ জন। আগুন তাদেরকে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল। আসবাত বৰ্ণনা করেন যে, এ, ১১ ( ~1 J, এই আয়াতের ব্যাখ্যায় সুদী বলেছেন, অগ্নিকুন্ড ছিল তিনটি। একটি সিরিয়ায়, একটি ইরাকে এবং অপরটি ইয়ামানে। এটি ইব্ন আবী হাতিমের বর্ণনা। সূরা বুরুজের তাফসীরে আমি অগ্নিকুণ্ড অধিপতিদের ঘটনাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সকল প্ৰশংসা একমাত্র আল্লাহর।
বনী ইসরাঈল থেকে ঘটনা বর্ণনায় অনুমতি প্রসঙ্গে ইমাম আহমদ (র) আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেন :
আমার থেকে তোমরা হাদীস বর্ণনা কর। আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করো না। যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, সে যেন জাহান্নামে তার আবাস স্থির করে নেয়। বনী ইসরাঈল থেকে বর্ণনা কর, তাতে কোন দোষ নেই।
আহমদ (র) আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে আরো বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা) ইরশাদ করেছেন আমার থেকে তোমরা কুরআন ব্যতীত অন্যকিছু লিখবে না। আমার থেকে কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু কেউ লিখে থাকলে তা মুছে ফেলবে। তিনি আরও বলেছেন, ইসরাঈলীদের থেকে বর্ণনা করতে পোর, তাতে দোষ নেই। আমার থেকে হাদীস বর্ণনা কর। আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করো না। যে আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে- (বৰ্ণনাকারী হাম্মাম বলেন-আমার মনে হয় রাসূলুল্লাহ (সা) ইচ্ছাকৃত শব্দটি বলেছেন)। সে যেন জাহান্নামকেই তার আবাসস্থলরূপে নির্ধারণ করে নেয়। (মুসলিম, নাসাঈ)।
আবু আওয়ানা —- যায়দ ইব্ন আসলাম সূত্রেও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। আবু দাউদ বলেন, হাম্মাম। এতে ভুল করেছেন। আসলে এ উক্তিটি আবু সাঈদের। তিরমিয়ী (র) সুফিয়ান
8 – 8 8 যায়দ ইব্ন আসলাম সূত্রে এ হাদীসের অংশ বিশেষ মারফু রূপে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহই ভাল জানেন।
ইমাম আহমদ (র) . আবদুল্লাহ ইব্ন আমর ইব্ন আস (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছেন : ধ1, 1, …, 1,
তোমরা একটি আয়াত হলেও আমার থেকে প্রচার কর } বনী ইসরাঈল থেকে বর্ণনা করতে পার, তাতে দোষ নেই। যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করবে, সে তার বাসস্থান জাহান্নামে ধরে নিবে। অনুরূপভাবে ইমাম আহমদ (র) ইমাম বুখারী ও ইমাম তিরমিয়ী (র) ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিরমিয়ী (র) বলেন, হাদীসটি হাসান ও সহীহ পর্যায়ের। ・;
আবৃ বকর বাযযার …… আবদুল্লাহ ইব্ন আমর (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) প্রায়ই রাতের বেলা আমাদের নিকট ইসরাঈলীদের ঘটনাবলী বর্ণনা করতেন। এভাবে ভোর
হয়ে যেত। গুরুত্বপর্ণ নামায ব্যতীত অন্য কোন কাজে আমরা ঐ মজলিস থেকে উঠতাম না! আবু দাউদেও বর্ণনাটি রয়েছে।
বাযযার ……. ইমরান ইব্ন হুসায়ন (রা) সূত্রে অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তবে বাযযারের মতে, হাদীসটি ইমরান ইব্ন হুসায়ন (রা) থেকে নয়। বরং আবদুল্লাহ ইব্ন আমর (রা) থেকেই বর্ণিত।
আহমদ (র) ……. আবু হুরায়রা (রা) থেকে এ মর্মে আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেন এবং তার সনদ সহীহ বলে উল্লেখ করেন।
হাকিম আবু ইয়ালা……. জাবির (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, তোমরা বনী ইসরাঈল সূত্র থেকে বর্ণনা কর, কেননা তাদেরকে উপলক্ষ করে বহু বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) বলতে শুরু করলেন যে, একদা বনী ইসরাইলের একদল লোক পথে বের হয়। তারা এসে একটি গোরস্থানে পৌছে। তারা পরস্পর বলাবলি করে যে, আমরা যদি দুরাকাআত নামায আদায় করে আল্লাহর নিকট দোয়া করি, অতঃপর এ গোরস্থান থেকে একজন মৃত ব্যক্তি বেরিয়ে আসে, তাহলে আমরা তাকে মৃত্যুর অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম। তারা নামায অন্তে দোয়া করে। তখনই একজন লোক কবর থেকে মাথা তোলে। তার দু চক্ষুর মধ্যখানে সিজদার চিহ্ন। সে বলল, আপনারা আমার কাছে কি চান? একশ বছর আগে আমার মৃত্যু হয়েছে। এখনও আমার দেহ থেকে মৃত্যুর তাপ ঠাণ্ডা হয়নি। আপনারা আল্লাহর নিকট দোয়া করুন। আল্লাহ যেন আমাকে আমার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেন। এটি একটি গরীব পর্যায়ে হাদীস। বস্তৃত বনী ইসরাঈল থেকে ঘটনা বর্ণনা জায়েয সাব্যস্ত হলেও তাদ্বারা ঐ ঘটনাবলীর কথাই বুঝাবে, যেগুলোর যথার্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যে সকল ঘটনাও বর্ণনা আমাদের নিকট সুরক্ষিত সত্যের বিপরীত ও বিরোধী হওয়ার প্রেক্ষিতে বাতিল ও অসত্য বলে প্রমাণিত। কিংবা সন্দেহমূলক হবে সেগুলো অবশ্যই পরিত্যাজ্য ও প্রত্যাখ্যাত হবে। ওগুলোর ওপর নির্ভর করা যাবে না।
উপরন্তু ইসরাঈলী কোন বর্ণনা জায়েয হলেও তার বিশুদ্ধতায় বিশ্বাস স্থাপন জরুরী নয়। কেননা, এ প্রসঙ্গে ইমাম বুখারী (র) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, কিতাবীরা হিব্রু ভাষায় তাওরাত পাঠ করে এবং মুসলমানদের নিকট তা আরবী ভাষায় ব্যাখ্যা করে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন :
তোমরা ইয়াহুদী-নাসারাদেরকে সত্যবাদী বা মিথ্যাবাদী প্ৰতিপন্ন করবে না; বরং তোমরা বলবে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি, আমাদের নিকট যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি এবং তোমাদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি, আমাদের ইলাহ এবং তোমাদের ইলাহ এক, অভিন্ন। আমরা তার প্রতি আত্মসমর্পণকারী। ইমাম বুখারী (বা ) এককভাবে হাদীসটি বর্ণনা
করেছেন।
ইমাম আহমদ (র)…… আবু নামলা আনসারীর পিতা সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, একদা তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট উপবিষ্ট ছিলেন। তখন সেখানে একজন ইয়াহুদী উপস্থিত হয়। সে বলে, হে মুহাম্মদ (সা:)! এ লাশটি কি কথা বলতে পারবে? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আল্লাহ ভাল জানেন। ইয়াহুদী বলল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, এ লাশটি কথা বলবে। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আহলি কিতাব তথা ইয়াহুদী- নাসারাগণ তোমাদের নিকট কোন কথা বললে তোমরা তাদেরকে সত্যবাদী বা মিথ্যাবাদী প্ৰতিপন্ন করো না। বরং তোমরা এ কথা বলবে যে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি, তার কিতাব সমূহের প্রতি, এবং তাঁর রাসূলগণের প্ৰতি। এতটুকু বলার ফলে তারা সত্যবাদী হয়ে থাকলে তোমরা তাদেরকে মিথ্যাবাদী বলছি না। আর তারা মিথ্যাবাদী হয়ে থাকলে তোমরা তাদেরকে সত্যবাদী বলছি না। হাদীসটি ইমাম আহমদ (র) এককভাবে বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমদ .জাবির ইব্ন আবদুল্লাহ (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, উমর ইব্ন খাত্তাব (রা) একদা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এলেন। তার হাতে ছিল একটি কিতাব। আহলি কিতাবের জনৈক ব্যক্তি থেকে তিনি তা পেয়েছিলেন। তিনি সেটি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে পাঠ করে শুনান। রাসূলুল্লাহ (সা) ক্রুদ্ধ হলেন এবং বললেন, হে খাত্তাবের পুত্ৰ। তোমরা কি এ শরীয়ত সম্পর্কে সন্দিহান? যে মহান সত্তার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ, আমি তোমাদের নিকট নিয়ে এসেছি সুস্পষ্ট আলোকময় দীন। তোমরা ওদের নিকট কিছু জানতে চাইবে না। তাহলে তারা হয়ত তোমাদেরকে সত্য তথ্য দিবে। কিন্তু তোমরা সেটাকে মিথ্যা গণ্য করবে। আবার তারা হয়ত তোমাদেরকে অসত্য তথ্য দিবে, কিন্তু তোমরা তা সত্য বলে মেনে নেবে।
যে পবিত্র সত্তার হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম, মূসা (আ)-ও যদি এখন জীবিত থাকতেন তাহলে আমার অনুসরণ না করে তার কোন উপায় থাকতো না। এ হাদীসটি ইমাম আহমদ
আল্লাহ তাআলা তো তোমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, ইয়াহুদী-নাসারগণ তাদের কিতাব বিকৃত ও পরিবর্তন করেছে এবং তাদের নিজ হাতে কিতাব লিখে তা আল্লাহর কিতাব বলে চালিয়ে দিয়েছে, স্বল্প মূল্যের পার্থিব স্বাৰ্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে। তোমাদের নিকট যে জ্ঞান এসেছে তা কি তোমাদেরকে ওদের নিকট কিছু জিজ্ঞেস করতে ধারণ করেনি? আল্লাহর কসম, আমি তো ওদের কাউকেই তোমাদের প্রতি নাযিলকৃত কিতাব সম্পর্কে কিছু জানতে চাইতে দেখি না।
ইব্ন জারীর (র) থেকে বর্ণিত, আবদুল্লাহ ইব্ন মাসউদ (রা) বলেছেন, তোমরা ইয়াহুদী নাসারাদের নিকট কিছু জানতে চেয়ে না। কারণ তারা তোমাদেরকে সত্য পথ দেখাবে না। তারা নিজেরাই তো পথভ্রষ্ট হয়েছে। তাদের কথা শুনলে তোমরা হয়ত সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে ধারণা করবে। আল্লাহই ভাল জানেন।
বনী-ইসরাঈলের তাপস জুরায়জের ঘটনা।
ইমাম আহমদ (র). আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, তিনজন ছাড়া মায়ের কোলে থাকা অবস্থায় আর কেউ কথা বলেনি। ১। ঈসা ইব্ন মরিয়ম (আ), ২। বনী ইসরাঈলের একজন ইবাদতগুজার লোক, যার নাম ছিল জুরায়জ। একটি ইবাদতখানা তৈরি করে তিনি ওখানে ইবাদত করতেন। জুরায়জের ইবাদতের কথা বনী ইসরাঈলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তাদেরই একজন ব্যাভিচারিণী বলে যে, তোমরা চাইলে আমি ওকে জব্দ করে দিতে পারি। লোকজন বলল, ঠিক আছে, আমরা তাই চাই। সে তখন জুরায়জের নিকট এসে নিজেকে তার কাছে পেশ করল। জুরায়জ সেদিকে তাকিয়েও দেখলেন না। জুরায়জের ইবাদতখানার পাশে একটি রাখাল তার বকরী চরাতো। সে তার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। তাতে সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। যথাসময়ে সে একটি পুত্ৰ সন্তান প্রসব করে। লোকজন জিজ্ঞেস করল, এটি কার সন্তান? সে বলল, জুরায়জের। তারা তখন জুরায়জের ইবাদতখানায় চড়াও হয়। তারা তাকে টেনে নামায়। এমনকি তারা গালাগালি করে, প্রহার করে তার ইবাদত খানাটি ভেঙ্গে দেয়। তখন জুরায়জ বললেন, ব্যাপার কি? তারা বলল, তুমি এ স্ত্রী লোকটির সাথে ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়েছ। ফলে সে একটি ছেলে প্রসব করেছে। জুরায়জ বললেন, সে ছেলেটি কোথায়? তারা বলল, এই যে। জুরায়জ। তখন উঠে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করেন। আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন। তারপর ছেলেটির নিকট গিয়ে আঙ্গুলে খোচা দিয়ে বললেন, হে বালক!! আল্লাহর কসম, তোমার জন্মদাতা কে? সে বলল, আমি রাখালের পুত্র। এটা শুনে সবাই জুরায়জের দিকে অগ্রসর হয় এবং তাকে চুমো খেতে থাকে। তারা বলে, আমরা সোনা দিয়ে আপনার ইবাদতখানা তৈরি করে দেব। জুরায়জ বললেন, না, তা আমার দরকার নেই। পূর্বে যেমন ছিল তেমন করে মাটি দিয়েই তৈরি করে দাও! রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তৃতীয়জন হল জনৈক মহিলা তার শিশুকে কোলে নিয়ে দুধ পান করাচ্ছিল। সেখান দিয়ে একজন সুসজ্জিত ঘোড় সওয়ার অতিক্রম করছিল। মহিলাটি বলল, হে আল্লাহ! আমার ছেলেকে এ লোকের ন্যায় বানিয়ে দিন! এটা শুনে শিশুটি তার মায়ের স্তন ছেড়ে দেয়
ર૭G:
এবং ঘোড় সওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলে, হে আল্লাহ! আমাকে ওর মত করবেন না। এরপর সে পুনরায় মায়ের স্তনে ফিরে আসে এবং তা চুষতে থাকে। আবু হুরায়রা (রা) বলেন, আমি যেন এখনও দেখছি যে, রাসূলুল্লাহ (সা) শিশুর ঐ কাজটি দেখিয়ে দিচ্ছেন এবং তিনি তাঁর নিজের আঙ্গুল মুখে পুরে তা চুষছেন।
এরপর মহিলাটি একজন ক্রীতদাসীর পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিল। লোকজন তাকে প্রহার করছিল। মহিলাটি বলল, হে আল্লাহ! আমার ছেলেকে ওই ক্রীতদাসীর ন্যায় করবেন না। রাসূলুল্লাহ (সা) বলছিলেন যে, তখনই শিশুটি তার মায়ের স্তন ছেড়ে দেয় এবং ক্রীতদাসীর প্রতি তাকিয়ে বলে, হে আল্লাহ! আমাকে এই ক্রীতদাসীর মত করবেন। তখন মা-ছেলের মধ্যে এরূপ কথোপকথন শুরু হয়।
মা-টি বলে, আমার পেছন দিয়ে সুসজ্জিত অশ্বারোহী যাচ্ছিল, আমি বললাম, হে আল্লাহ! আমার ছেলেকে এই এর মত বানাবেন। তখন তুমি বললে যে, হে আল্লাহ! আমাকে ওর মত বানাবেন না। তারপর আমি এই ক্রীতদাসীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহ! আমার ছেলেকে ঐ ক্রীতদাসীর মত বানাবেন না। তুমি বললে, হে আল্লাহ! আমাকে ওর মত
বানাবেন। এর রহস্য কি? জবাবে শিশুটি বলল, আম্মাজান, অশ্বারোহী সুসজ্জিত ব্যক্তিটি একজন প্ৰতাপশালী ও অত্যাচারী লোক। আর ওই ক্রীতদাসীটি একজন অসহায় মহিলা। তারা তাকে ব্যভিচারের অপবাদ দিচ্ছে। অথচ সে তা করেনি। তারা বলছে, তুই চুরি করেছিস; অথচ সে চুরিও করেনি। সে সর্বাবস্থায় বলছিল—- আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট।
ইমাম বুখারী (র) আম্বিয়া সংক্রান্ত অধ্যায়ে এবং জুলুম সংক্রান্ত অধ্যায়ে এবং ইমাম মুসলিম (র) আদব। অধ্যায়ে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমদ (র)…….. আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেন, জুরায়জ একদা তার ইবাদতখানায় ইবাদত করছিলেন, এমন সময় সেখানে তার মা এসে হাজির হন। তিনি বলেন, হে জুরায়জা! আমি তোমার মা, আমার সঙ্গে কথা বল! হাদীস বর্ণনার সময় রাসূলুল্লাহ (সা) কিভাবে তাঁর ডান ভ্র-এর ওপর হাত রেখেছিলেন আবু হুরায়রা (রা) তা দেখিয়ে দিচ্ছিলেন। জুরায়জের মা যখন হাজির হন তখন জুরায়জ ছিলেন নামাযের মধ্যে। মনে মনে তিনি বললেন, হে আল্লাহ! আমি এখন কি করি, একদিকে মা অপর দিকে নামায! শেষ পর্যন্ত তিনি নামাযকেই প্রাধান্য দেন। তার মা তখন ফিরে চলে যায়। এরপর তার মা পুনরায় তার নিকট আসেন। ঘটনাক্রমে তখনও তিনি নামাযে রত ছিলেন। মা ডেকে বললেন, হে জুরায়জা! আমি তোমার মা। আমার সাথে কথা বল। তিনি মনে মনে বললেন, হে আল্লাহ। একদিকে নামায, অপর দিকে আমার মা। আমি তখন কি করি? শেষ পর্যন্ত তিনি নামাযকেই প্ৰাধান্য দিলেন।
তখন মা বললেন, হে আল্লাহ! এই জুরায়জ, আমার পুত্র। আমি তার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম সে আমার সাথে কথা বলেনি। হে আল্লাহ! কোন ব্যভিচারিণীর হাতে লাঞ্ছিত না করে তার মৃত্যু দিবেন না। কোন ব্যভিচারিণী তাকে ফাঁদে ফেলার জন্যে ডাকলে হে আল্লাহ! আপনি তাকে ফাঁদে ফেলার ব্যবস্থা করে দিবেন।
৩৪—
مامانه
একজন রাখাল জুরায়জের ইবাদতখানার পাশে রাত্রি যাপন করত। এক রাতে এক মহিলা বেরিয়ে আসে। রাখাল তার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। ফলে সে একটি পুত্ৰ সন্তান প্রসব করে। লোকজন বলে এটি কার সন্তান? সে বলল, এই ইবাদতখানার মালিকের সন্তান। লোকজন তাদের কুঠারাদি নিয়ে জুরায়জের ইবাদত খানায় উপস্থিত হয় এবং চীৎকার করে তাকে ডাকতে থাকে। তিনি নিরুত্তর রইলেন। এরপর তারা তার ইবাদতখানাটি ভাঙ্গতে শুরু করে। তিনি বেরিয়ে তাদের নিকট আসেন। তারা বললো, এই মহিলাটির সাথে কথা বল। তিনি বললেন, আমি তো তাকে হাসতে দেখছি। তারপর তিনি শিশুটির মাথায় হোত বুলিয়ে বললেন, তোমার পিতা কে? জবাবে শিশুটি বলল, আমার পিতা বকরীর রাখাল। তখন তারা বলল, হে জুরায়জ! তোমার যে ইবাদতখানাটি আমরা নষ্ট করেছি তা আমরা সোনা-রূপা দিয়ে নির্মাণ করে দিব। তিনি বললেন, না, বরং পূর্বে যেমন ছিল তেমন করে তৈরি করে দাও। তখন তারা তাই করলো। ইমাম মুসলিম (র) অনুমতি প্রার্থনা পর্বে এ হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন।
ইমাম আহমদ (র) আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে এ মর্মে আরেকটি হাদীস, বর্ণনা করেন। তাতে রাখাল পুরুষের স্থলে রাখাল স্ত্রী লোকের উল্লেখ রয়েছে। তাতে বৰ্ণিত হয়েছে যে, এক রাখাল বালিকা নিজেদের বকরী চর্যাত। সে এসে জুরায়জের ইবাদতখানার ছায়ায় বসত। একদিন সে কোন এক লোকের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয় এবং তাতে সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। সে জনতার হাতে ধরা পড়ে যায়। তখনকার বিধান ছিল ব্যভিচারীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হত। লোকজন বলল, এ সন্তানটি কার? রাখাল মহিলাটি বলল, ইবাদতখানার মালিক জুরায়জের। লোকজন তাদের কুঠারাদি নিয়ে ইবাদতখানার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। তারা বললো, হে জুরায়জ, হে ভণ্ড ইবাদতকারী! বেরিয়ে আয়। জুরায়জ নেমে আসতে অস্বীকৃতি জানালো এবং নামাযে রত রইলেন। লোকজন তার ইবাদতখানা ভাঙা শুরু করে। এ অবস্থা দেখে তিনি নিচে নেমে আসেন। তারা জুরায়জ এবং উক্ত মহিলার গলায় রশি বেঁধে দজনকে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরাতে থাকে।
ইত্যবসরে জুরায়জ তাঁর আঙ্গুলী মহিলার পেটে রেখে বলেন, হে শিশু তোমার পিতা কে? গৰ্ভস্থত শিশু বলে ওঠে, আমার পিতা বকরীর রাখাল ওমুক ব্যক্তি। লোকজন তখন জুরায়জকে চুমু খেতে শুরু করে। তারা বলে যে, আপনি যদি অনুমতি দেন তবে আমরা সোনা-রূপা দিয়ে আপনার ইবাদতখানা তৈরি করে দেব। তিনি বললেন, না, দরকার নেই। বরং পূর্বে যেরূপ ছিল সেইরূপেই পুনঃ নিৰ্মাণ করে দাও। এটি একটি গরীব পর্যায়ের হাদীস। এর সনদ ইমাম মুসলিমের শর্ত পূরণ করে।
উল্লেখিত তিনজন ব্যক্তি মায়ের কোলে থাকা অবস্থায় কথা বলেছেন। ঈসা ইব্ন মরিয়ম (আ) তাঁর ঘটনা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। জুরায়জের ইবাদত খানার পার্শ্ববতীর্ণ রাখালের ঔরসে যেনাকারিণীর পুত্র। যা এইমাত্র বর্ণিত হলো। তার নাম ছিল। ইয়াবৃস। ইমাম বুখারী (র) স্পষ্টভাবে এটি উল্লেখ করেছেন। Y
তৃতীয় ব্যক্তি হল দুগ্ধদানকারিণী মহিলার কোলে থাকা পুত্র। মহিলা কামনা করেছিল তার পুত্ৰ যেন সুসজ্জিত অশ্বারোহীর মত হয়। আর পুত্র চেয়েছিল। সে যেন অপবাদ প্রাপ্তা। অথচ নির্দোষ মহিলার ন্যায় হয়। দাসীটি অনবরত বলছিল—আল্লাহই আমার জন্যে যথেষ্ট। তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক। ইতিপূর্বে মুহাম্মদ ইব্ন সীরীন আবু হুরায়রা (রা) থেকে মারফু সনদে এটি বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম আহমদ (র) হাওয়া ….. আবু হুরায়রা (রা) সনদে রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে দুগ্ধপোষ্য এ শিশুর ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন। এ সনদটিও হাসান পর্যায়ের।
ইমাম বুখারী (র) বলেন, আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছেন যে, একজন মহিলা তার পুত্রকে দুধ পান করাচ্ছিল। এমতাবস্থায় সেখান দিয়ে যাচ্ছিল এক অশ্বারোহী। মহিলাটি এ বলে দোয়া করে, হে আল্লাহ! আমার পুত্ৰ ঐ আশ্বরোহীর মত না হওয়া পর্যন্ত তার মৃত্যু দিবেন না। ছেলেটি বলে উঠল, হে আল্লাহ আমাকে ঐ অশ্বারোহীর মত বানাবেন না। তারপর পুনরায় দুধ চুষতে থাকে।
অতঃপর তারা পথে দেখল, একজন মহিলা-তাকে টেনে টেনে নেয়া হচ্ছে। আর তাকে নিয়ে সবাই হাস্য, কৌতুক ও খেলা করছে। শিশুর মাতা বলল, হে আল্লাহ! আমার ছেলেকে ঐ মহিলার মত বানাবেন না। ছেলে বলল, হে আল্লাহ; আমাকে ঐ মহিলার মত বানাবেন। অতঃপর ব্যাখ্যা স্বরূপ ছেলেটি বলল, ওই যে অশ্বারোহী সে তো কাফির। আর ঐ ক্রীতদাসী—লোকজন বলছে, সে যেনা করেছে, আর সে বলছে, আমার জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট। তারা বলছে, সে চুরি করেছে; সে বলছে, আমার জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট। যারা মায়ের কোলে থাকা অবস্থায় কথা বলেছে, তাদের মধ্যে ইউসুফ (আঃ)-এর পক্ষে সাক্ষ্যদাতা শিশুটিও রয়েছে যা ইতিপূর্বেই আলোচিত হয়েছে। তাদের মধ্যে ফিরআওন পরিবারের চুল বিন্যাসকারিণীর শিশুটিও রয়েছে। আল্লাহ ভাল জানেন।