দ্বিতীয় খণ্ড – উইনস্টনের দুঃসাহসিক প্রেমকাহিনী
অধ্যায় ১
তখন মধ্য সকাল। কামরা ছেড়ে টয়লেটের দিকে যাচ্ছিলো উইনস্টন।
উজ্জ্বল আলোকিত লম্বা বারান্দা পথের উল্টোদিক থেকে আসছিলো একজন। সেই কালোকেশী মেয়েটি। ভাঙারি দোকানের বাইরে তাদের সেই সন্ধ্যায় দেখা হয়ে যাওয়ার পর চারদিন গত হয়েছে। কাছাকাছি আসতেই দেখা গেলো তার ডানহাতটি ভাঁজ করে স্লিংয়ে ঝুলিয়ে রাখা।
স্লিংয়ের কাপড়টি ওভারঅলের রঙের হওয়ায় দূর থেকে আন্দাজ করা যাচ্ছিলো না। হতে পারে অতিকায় কেলিডোস্কোপে উপন্যাসের খসড়া তৈরির কাজের সময় মেশিনে হাত আটকে গিয়েছিলো, এমনটাই ভাবলো সে। ফিকশন ডিপার্টমেন্টে এমন দুর্ঘটনা প্রায়শঃই ঘটে।
ভাবনার চাকা ঘুরতে ঘুরতে ততক্ষণে তাদের দূরত্ব কমে চার মিটারের কাছাকাছি। আর ঠিক তখনই আচমকা হোঁচট খেয়ে মেয়েটি উপুড় হয়ে পড়লো। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো সে। আহত হাতটাই পড়েছে নিচে। উইনস্টন একটু থমকালো। মেয়েটি ততক্ষণে হাঁটুতে ভর করে শরীরটাকে তুলে নিয়েছে। তার মুখমণ্ডল দুধ-হলুদ রঙ ধরেছে, ওর মুখটা এতটা লাল হয়ে উঠতে এর আগে আর কখনোই দেখেনি সে। চোখ তুলে মেয়েটি তাকালো উইনস্টনের দিকে। আর সে চেহারার অভিব্যক্তি বলছে, ব্যথার চেয়ে যেনো ভয়টাই বেশি পেয়েছে।
হৃদয় মাঝে একটা কৌতুহলের আবেগ বয়ে গেলো উইনস্টনের। তার সামনে এক শত্রু, যাকে সে হত্যা করতে চেয়েছিলো: তার সামনে এমনও একজন, যে আসলে এক মানব সন্তান, ব্যাথাতুর। আর হতে পারে এবার তার হাড্ডিটাও ভেঙ্গেছে। অজান্তেই মেয়েটির দিকে সাহায্যের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে গেলো সে। মেয়েটিকে তারা ভাঙা হাতটির উপর পড়ে যেতে দেখে তার যেনো মনে হচ্ছিলো সে নিজেই ব্যথাটি অনুভব করতে পারছে।
‘ব্যথা পেয়েছো?’ বললো সে।
‘ও কিছু না। হাতে চাপ পেয়েছি। ঠিক হয়ে যাবে এখুনি।’
তার কথায় মনে হচ্ছিলো তার হৃদয় কাঁপছে। আর মুখমণ্ডল তখন পুরোই ফ্যাকাশে।
‘ভেঙ্গে ফেলোনি তো?’
‘না আমি ঠিক আছি। একটু ব্যথা পেয়েছি এই যা।’
মেয়েটি তার অন্য হাতটি এগিয়ে দিলো। আর সে ওকে ধরে দাঁড়াতে সাহায্য করলো। ততক্ষণে মেয়েটি তার নিজের রঙ কিছুটা ফিরে পেয়েছে, আর তাতে তাকে একটু ভালোও দেখাচ্ছিলো।
‘ও কিছু না,’ আবারও বললো মেয়েটি। ‘কব্জির ওপর সামান্য চাপ পড়েছে। ধন্যবাদ কমরেড!’
এই কথা বলে মেয়েটি তার পথে হেঁটে এগিয়ে গেলো, এমন একটা ভঙ্গি করে যেনো কিছুই হয়নি। পুরো ঘটনাটি ঘটতে আধা মিনিটও নেয়নি। অনুভূতিকে চেহারায় ফুটিয়ে না তোলা এখন প্রত্যেকেরই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আর, এ কথা বলা বাহুল্য ঘটনার সময় তারা দুজন টেলিস্ক্রিনের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। তারপরেও ক্ষণিকের বিষ্ময়কে এড়িয়ে যাওয়া ছিলো ভীষণ কঠিন। মাত্র দুই কি তিন সেকেন্ড। যখন মেয়েটির হাত ধরে টেনে তুলছিলো ঠিক তখনই কিছু একটা তার হাতের মধ্যে গুঁজে দেয়। প্রশ্নাতীতভাবেই পুরো ঘটনাটিই ছিলো পরিকল্পিত। ছোট আর চ্যাপ্টা ধরনের কিছু একটা বলেই হাতের মুঠোয় বোধ হচ্ছে। টয়লেটের দরজা দিয়ে ঢুকেই বস্তুটি পকেটে চালান করে দিলো সে। উপর থেকে আঙুলের মাথা আস্তে করে বুলিয়ে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো। ধারনা করলো, ওটি চৌকা করে কয়েক ভাঁজে ভাঁজ করা এক টুকরো কাগজ।
প্রশ্রাবের প্যানে দাঁড়িয়ে আবারও আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে পকেটের ভেতরেই ভাঁজ করা কাগজটি অনুভব করার চেষ্টা করলো সে। ধরেই নিলো এতে নিঃসন্দেহে কোনও একটা বার্তা লেখা রয়েছে। একবার মনেও এসেছিলো কোন একটা টয়লেটের ভেতরে ঢুকে চিরকূটটি পড়ে ফেলে। কিন্তু সেটা হবে সবচেয়ে ভয়াবহতম বোকামি। টেলিস্ক্রিন যখন সারাক্ষণই চোখ পাকিয়ে রয়েছে তখন আপনি কোনও একটি স্থানকেও নিশ্চিত নিরাপদ ভাবতে পারেন না।
কামরায় ফিরলো সে। বসলো। কাগজের টুকরোটি খাপছাড়া একটা বেখেয়ালী ভঙ্গিমায় ডেস্কের অন্য কাগজগুলোর মধ্যে ছুড়ে ফেলে রাখলো। চশমা জোড়া চোখে লাগিয়ে স্পিকরাইটটি কাছে টেনে নিলো। ‘পাঁচ মিনিট,’ নিজেকেই নিজে বললো উইনস্টন, ‘অন্তত পক্ষে পাঁচটি মিনিট!’ তার হৃদযন্ত্র তখন আতঙ্ক ধরিয়ে দেওয়ার মতো করে বুকের ভেতর লাফাচ্ছে। বাঁচোয়া যে, হাতের কাজটি তখন জটিল কিছু ছিলো না। বড় একটি পরিসংখ্যানের তালিকা সংশোধনী, যার জন্য গভীর মনযোগের দরকার নেই।
কাগজের টুকরোটিতে যা কিছুই লেখা থাক, তার একটি রাজনৈতিক অর্থ থাকবেই বলে ধারনা উইনস্টনের। অন্তত দুটি বিষয় তার মনে আসছে। যার মধ্যে একটি হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এত দিনের আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে মেয়েটি যে থট পুলিশেরই এজেন্ট তা নিশ্চিত করা হয়েছে এই কাগজে। তবে তার বোধে ধরছে না, থট পুলিশ কেনই তাদের বার্তা পৌঁছে দিতে এমন একটা পথ বেছে নেবে? হতে পারে তাদের সুনির্দিষ্ট কোনও কারণ অবশ্যই রয়েছে। কাগজটির বার্তায় একটি হুমকিও থাকতে পারে, হতে পারে কোনও তলব নোটিশ, আত্মহত্যা করার নির্দেশ অথবা কোন কিছুর ফাঁদ। তবে আরও একটি, অপেক্ষাকৃত হিংস্র সম্ভাবনা তারা মাথায় জেগে উঠছে, যদিও সর্বোতভাবেই সে চাইছে ভাবনাটি দমন করে রাখতে, আর তা হচ্ছে, এই বার্তা আদৌ থট পুলিশের তরফ থেকে আসে নি, এসেছে কোনও এক গুপ্ত সংগঠনের পক্ষ থেকে। হতে পারে ব্রাদারহুডের পক্ষ থেকে! আর এই মেয়েটি তাদের সঙ্গে রয়েছে! নিঃসন্দেহে এটি একটি ফালতু ভাবনা, তবে এই ভাবনা হাতের তালুতে কাগজের টুকরোটি অনুভূত হওয়ার মূহূর্তেই তার মনের ভেতর লাফিয়ে উঠেছিলো। আর অপর এবং সবচেয়ে সম্ভাবনার ভাবনাটি তার মনে আসে মিনিট কয়েক পরে। যে কারণে, এই বার্তায় তার মৃত্যুঘোষণা লেখা রয়েছে বলে বিবেচনা ও বিশ্বাস সত্বেও, হৃদয়ের ধুকপুকানিতে, সকল জটিলতাকে সঙ্গী করে স্পিকরাইটে পরিসংখ্যানগুলো উচ্চারণের সময় গলার কাঁপুনিতেও একটা অযৌক্তিক প্রত্যাশা তার মধ্যে জাগরুক।
হাতের কাজ শেষ করে কাগজগুলো পেঁচিয়ে নিয়ে নিউমেটিক টিউবে ঢুকিয়ে দিলো। এর মধ্যে আট মিনিট পার হয়ে গেছে। নাকের ওপর চশমাটি নেড়েচেড়ে ভালো করে বসিয়ে নিলো। বড় একটা শ্বাস টেনে পরের কাজের জন্য রাখা কাগজগুলো নিজের দিকে টানলো। আর সেই সঙ্গে কাগজগুলোর উপরে ফেলে রাখা সেই চিরকূটটিও তখন তার সামনে। আলতো করে ওটি তুলে নিলো। ভাঁজ খুললো। যাতে গোটা গোটা হরফে লেখা:
আমি তোমাকে ভালোবাসি।
কয়েক দণ্ডের জন্য সে এতটাই হতবিহ্বল হয়ে থাকলো যে এই অপরাধ সংসৃষ্ট বস্তুটি স্মৃতিগহ্বরে ছুঁড়ে ফেলতেও ভুলে গেলো। যখন সে কাজটি করলো, তার আগে, অতি আগ্রহ দেখানোর সমূহ বিপদের কথা ভালো করে জানা থাকার পরেও, কথাগুলো সত্যিই এতে লেখা রয়েছে এমনটা নিশ্চিত হতে লেখাটি আরেকবার পড়ে নেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারলো না।
সকালের বাকি সময়টা কাজে মন দেওয়া সত্যিই কষ্টকর হয়ে উঠলো। ডেস্কে জমে থাকা জটিল কাজগুলোতে মনোনিবেশের চেয়েও বড় প্রয়োজন হয়ে দেখা দিলো ভেতরের উত্তেজনাকে টেলিস্ক্রিনের চোখ এড়িয়ে রাখা। তখনই তার মনে হলো পেটের ভেতর ক্ষুধার আগুন জ্বলছে।
ভ্যাপসা গরম, ঠাসাঠাসি, চ্যাচামেচিতে আচ্ছন্ন ক্যান্টিন অসহ্য ঠেকছিলো। আশা ছিলো এক কোনে একা বসেই কাটাবে সময়টি কিন্তু বিধি বাম। হাঁদারাম পারসন্স এসে ধপ করে পাশে বসলো, তার ঘামের বোঁটকা গন্ধ স্ট্যুর তামাটে গন্ধকে হার মানিয়ে নাকে ঝাপটা মারলো, আর সঙ্গে সঙ্গে ছুটলো কথার তুবড়ি। বিষয় ঘৃণা সপ্তাহের প্রস্তুতি। কাগজের মণ্ড দিয়ে বিগ ব্রাদারের যে মূর্তি তৈরি হচ্ছে তা নিয়েই তার সবচেয়ে বেশি উৎসাহ। তার মেয়ের স্পাইজ ট্রুপে যোগ দেওয়া উপলক্ষ্যেই তৈরি হচ্ছে দুই মিটার প্রস্থ মাপে বিগ ব্রাদারের মস্তক-মূর্তি। বিরক্তির হচ্ছে, এই শোরগোলের মধ্যে পারসন্স ঠিক কি বলছে তা তার কানেই পৌঁছাচ্ছে না, যে কারণে তার বোকামিভরা মন্তব্যগুলো বার বার জিজ্ঞেস করে করে শুনে নিতে হচ্ছে। মেয়েটিকে এর মধ্যে এক নজর দেখলো সে। এক কোনার একটি টেবিলে অন্য দুটি মেয়ের সঙ্গে বসা। চেহারায় মনে হচ্ছিলো সে তাকে দেখতে পায় নি। তবে এরপর ওইমুখে আর একবার চোখ ফেললো না সে।
বিকেলটা অপেক্ষাকৃত স্বস্তির ছিলো। দুপুরের খাবারের পরপরই ডেস্কে একটা স্পর্শকাতর-জটিল কাজও এলো, যা শেষ করতে কয়েক ঘণ্টা লাগলো, এমনকি অন্যকাজ পাশে ঠেলে রেখেই তা সারতে হলো। দুই বছর আগের কিছু উৎপাদন বিষয়ক রিপোর্টকে মিথ্যায়নের কাজ। এমনভাবে করতে হবে যাতে সে সময়কার ইনারপার্টির এক বিশিষ্ট নেতার সুনামহানি হয়। এই নেতা এখন কোনঠাসাদের একজন। এই কাজে উইনস্টনের হাত পাকা। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় মেয়েটিকে সে সফলভাবে মনের বাইরে রেখে মন লাগিয়ে কাজ করলো সে। এরপর মেয়েটির মুখ ফের যখন মনে এলো তখন তার একা হওয়ার এক জ্বালাধরা অসহনীয় বাসনা হতে লাগলো। বস্তুত, যতক্ষণ না একা হতে পারছে জীবনে নতুন হয়ে আসা বিষয়টি নিয়ে ভালো করে ভাবতেও পারছে না।
আজ রাতে কমিউনিটি সেন্টারে যাওয়ার তারিখ। আরেকবার ক্যান্টিনের বিস্বাদ খাবার গিলে ছুটলো সেন্টারের দিকে, সেখানে নিপাট নির্বোধদের সমন্বয়ে গঠিত একটি আলোচনা চক্রে যোগ দিলো, দুই গেম টেবিল টেনিস খেললো, কয়েক গ্লাস জিন গিললো, আধাঘণ্টা খানেক ‘দাবা খেলায় ইংসকের সম্পর্ক’ বিষয়ক একটি বক্তৃতা শুনলো। বিরক্তিতে আত্মা পর্যন্ত তেঁতো হয়ে উঠেছে, কিন্তু আজ সন্ধ্যায় সেন্টার ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা একেবারেই ভাবছে না সে। ‘আমি তোমায় ভালোবাসি’ কথাগুলো দেখার পর থেকে বেঁচে থাকা তার কাছে বড় হয়ে উঠেছে, আর সে কারণেই ছোট ছোট ঝুঁকি নেওয়া তার কাছে বোকামি বলে মনে হতে লাগলো। রাত এগারোটার আগেই ঘরে ফিরে নিজেকে বিছানায় গলিয়ে দিলো। অন্ধকার কামরা- এখানে টেলিস্ক্রিনের চোখ বাঁচিয়ে আপনি পুরোই নিরাপদ, অন্তত যতক্ষণ নিরবতা বজায় রাখা যাবে ততক্ষণ। আর এটাই তার ভাবনার অফুরান সুযোগ।
মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ করে সরাসরি কথা বলার জন্য সময় ঠিক করে নেওয়া প্রয়োজন। তবে বাহ্যিকভাবে এটি একটি বড় সমস্যা। মেয়েটি তাকে কোনো ফাঁদে ফেলতে যাচ্ছে এমনটা সে আর মনেই করছে না। সে নিশ্চিত করে বুঝতে পারছে- তেমন কিছু নয়। হাতের ভেতর কাগজের টুকরোটি গুঁজে দেওয়ার সময় ভুল করে হলেও যে উত্তেজনাটুকু সে দেখিয়েছে তা থেকেই এটুকু নিশ্চিত হওয়া যায়। বেজায় ভয়াতুর হয়ে পড়েছিলো মেয়েটি। ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা তার মনের মধ্যে একবারও আসছে না। মোটেই পাঁচ রাত আগে সে তাকে পাথরের ঘায়ে মাথা গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো; কিন্তু সে কথা এখন ধর্তব্যের বাইরে। এখন তার চিন্তাজুড়ে মেয়েটির নগ্ন, যৌবনবতী শরীর, সেই রাতে স্বপ্নে যেমনটি দেখেছিলো। সে ভেবেছিলো মেয়েটি বাকিদের মতোই নির্বোধ, তার মস্তিষ্ক জুড়ে রয়েছে মিথ্যা আর ঘৃণা, তার পেটের ভেতরটা দুর্বুদ্ধিতে ভরা। এবার এক ধরনের জ্বরাগ্রস্ততা তাকে পেয়ে বসলো। মনে হলো মেয়েটিকে যে হারাতে চলেছে, ওর যৌবনভরা দেহখানা বুঝি আর তার হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় হয়ে যে ভয় দেখা দিলো তা হচ্ছে, খুব তাড়াতাড়ি সাড়া না দিলে মেয়েটি মন পাল্টে ফেলবে। আর এই সামনাসামনি দেখা হওয়া যে কত জটিল কাজ সেটা তার জানা। দাবার কোটে রাজা যখন চেকে পড়ে তখন একেকটি গুটির চাল যেমন কঠিন হয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি। যে দিকেই মুখ ঘোরান, টেলিস্ক্রিনে মুখ। চিরকূটের লেখাটি পড়ার পরের পাঁচ মিনিটের মধ্যেই যোগাযোগের সবগুলো সম্ভাব্য পথ নিয়ে সে ভেবে রেখেছে। এখন চিন্তার জন্য সময় পেয়ে সেগুলোই আবার একের পর এক সামনে এনে ভাবতে লাগলো। যেভাবে টেবিলের ওপর কোনো সরঞ্জাম থরে থরে সাজিয়ে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখা যায় সেভাবে।
আজ সকালে ঘটনাটি যেভাবে ঘটেছে ঠিক একইভাবে একই ঘটনা আরেকবার ঘটানো একটা অসম্ভব ভাবনা। মেয়েটি যদি রেকর্ডস ডিপার্টমেন্টে কাজ করতো তাহলে কাজটি তুলনামূলক সহজ হতো, কিন্তু এই ভবনে ফিকশন ডিপার্টমেন্টটির অবস্থান নিয়েই খুব সামান্য ধারনা রাখে সে। আর থাকলেও সেখানে যাওয়ার কোনো ওছিলাও তার হাতে নেই। যদি জানা থাকতো মেয়েটি কোথায় থাকে, আর কখন কাজ শেষ করে, তাহলে ওর বাড়ি ফেরার পথে কোথাও মুখোমুখি হওয়ার ফন্দি আঁটা যেতো। কিন্তু বাড়ির পথে ওর পিছু নেওয়া নিরাপদ হবে না, কারণ তার ব্যাখ্যা দাঁড়াবে মন্ত্রণালয়ের বাইরে ইতস্তত ঘোরাঘুরি, আর সহজেই তা নজরে পড়ে যাবে। ডাকে চিঠি পাঠানো যায়। কিন্তু সে প্রশ্নও উঠতে পারে না, কারণ মাঝ পথে সব চিঠিই খুলে পড়াই এখন নিয়ম। কেউ কেউ যে চিঠি লিখেন না তা নয়, তবে তা কেবল প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠানোর জন্য। একটা ছাপানো পোস্টকার্ড রয়েছে তাতে বার্তাগুলো লেখা থাকে। কেউ তার অপ্রয়োজনীয় কথাগুলো কেটে দিয়ে পাঠায়। আরেকটা কথা, ঠিকানাতো দূরের কথা, সেতো মেয়েটির নামই জানে না। অবশেষে সে সিদ্ধান্তে পৌঁছালো ক্যান্টিনই হতে পারে সবচেয়ে নিরাপদ। কোনও একটি টেবিলে যদি সে তাকে একা পেয়ে যায়! রুমের ঠিক মাঝের দিকের কোনও একটি টেবিল হলে ভালো হয় যেখানটা টেলিস্ক্রিন থেকে অপেক্ষাকৃত দূরে, আর তখন চারিদিকে যদি পর্যাপ্ত মাত্রায় চিৎকার চেচামেচি চলতে থাকে- এমন একটি অবস্থায় যদি তাকে পাওয়া যায়, মোটে ত্রিশ সেকেন্ডের জন্যও যদি হয় সে সাক্ষাৎ; হতে পারে, তখন কিছু কথা বলা যাবে।
পরের সপ্তাহটি জীবনের জন্য হয়ে থাকলো কেবলই সপ্নময়। ঘটনার ঠিক পরের দিন যতটা সময় তার ক্যান্টিনে কেটেছে সে সময়ের মধ্যে কালোকেশীর টিকিটিরও দেখা পায়নি। হুইসেল বেজে উঠলে ক্যান্টিন ছাড়লো সে। মনে মনে ভাবলো, হতে পারে মেয়েটি কাজের শিফট পাল্টে ফেলেছে।
সেদিন অবশ্য একবার তারা একে অন্যের সামনে দিয়ে হেঁটে গেছে, কিন্তু কেউ কাউকে দেখতে পায়নি। ঘটনার তৃতীয় দিনে এসে নিয়ম মাফিক লাঞ্চে ক্যান্টিনে দেখা গেলো তাকে। তবে সঙ্গে আরও তিনটি মেয়ে ছিলো। আর বসেছিলো ঠিক টেলিস্ক্রিনের নিচে।
পরের তিনটি দিন গেছে আরও অসহনীয়তায়। এই তিন দিনে একটি বারের জন্যও মেয়েটিকে সে দেখতে পায়নি।
গোটা দেহ আর মন যেনো এক ধরনের অহসহনীয় সংবেদনশীলতায় আক্রান্ত হয়ে থাকলো। সব কিছুই যেনো ফাঁকা ফাঁকা। প্রতিটি চলন, প্রতিটি বলন, প্রতিটি স্পর্শ, প্রতিটি শব্দ যা তার কানে পসছে, সবই যেনো ব্যথা ধরিয়ে দিচ্ছে। ঘুমের মাঝেও মেয়েটির অবয়ব তার চোখ আর মন ছাড়া হয়নি। এই ক’দিনে ডায়রিটা ছুঁয়েও দেখেনি। স্বস্তি যদি কিছুটা পেয়ে থাকে তা ছিলো ঠিক কাজের টেবিলে। এখানেই সে কিছুটা সময় ধরে হলেও মেয়েটিকে ভুলে থাকতে পেরেছে, কাজের চাপে চাপে অন্তত দশ মিনিট মেয়েটির অবয়বমুক্ত থেকেছে তার মন। মেয়েটির যে কি হলো তা নিয়ে ভেবে কোনই কূল-কিনারা করতে পারলো না। খোঁজে নামা নিতান্তই অসম্ভব। হতে পারে, ওকে বাষ্প করে দেওয়া হয়েছে, হতে পারে ও আত্মহত্যা করেছে, হতে পারে ওকে ওশেনিয়ার সীমান্তে বদলি করা হয়েছে, আর সবচেয়ে বাজে ও সবচেয়ে সম্ভাব্য দিকটি হচ্ছে, সে মত পাল্টে ফেলেছে, আর তাকে এড়িয়ে চলছে।
পরের দিন অবশ্য তার চাঁদবদনের দেখা মিললো। বাহুখানি ততক্ষণে স্লিংমুক্ত। তবে এবার কব্জিতে প্ল্যাস্টার প্যাঁচানো। সে যাই হোক, দেখতে যে পেলো সেটাই বড় স্বস্তির। আর সেই দর্শণে সে এতটাই আপ্লুত হয়ে পড়লো যে কয়েক সেকেন্ড তার দিকে দৃষ্টি ফেলে রেখে সেই অভিব্যক্তির প্রকাশ না ঘটিয়ে পারলো না। এর পরের দিন মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ প্রায় এসেই গিয়েছিলো।ক্যান্টিনে পৌঁছে দেখে মেয়েটি টেলিস্ক্রিন থেকে যথেষ্ট দূরেরই একটি টেবিলে বসা, আর পুরোই একা। দুপুরের খাবারে ভীর তখনও পুরোদমে শুরু হয়নি। ক্যান্টিনও ভরে ওঠেনি। কিউতে দাঁড়িয়ে এগুতে এগুতে উইনস্টন যখন প্রায় কাউন্টারের কাছাকাছি, ঠিক তখনই ঝামেলাটা বাঁধলো। তার সামনের জনের অভিযোগ তিনি তার ট্রেতে স্যাকরিনের বড়ি পাননি। সে নিয়ে চিৎকার জুড়ে দিলেন। তাতে কেটে গেলো কিছুটা সময়। মেয়েটি অবশ্য তখনও একাই বসে। যাই হোক ওদের বসচা মিটে গেলে উইনস্টন নিজের ট্রেতে খাবার নিয়ে কিছুটা খাপছাড়া ভঙ্গিতে মেয়েটির টেবিলের দিকেই এগুচ্ছিলো। চোখ ঠিক ওই টেবিলে নয়, দৃষ্টির গতিপথ বলছে- যেনো পেছনের টেবিলে স্থান খুুঁজছে সে। কালোকেশীর টেবিল তখন মোটে তিন মিটার দূরে। দুই সেকেন্ডেই সামনে পৌঁছে যাবে। আর ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ একজন ডেকে উঠলো, ‘স্মিথ!’। প্রথমে সে এমন একটা ভাব করলো যেনো শুনতে পায়নি। ‘স্মিথ!’ আরেকটু জোরে আরেকবার ডেকে উঠলো কণ্ঠটি। এবার নিরুপায়। সে ঘুরলো। এক ঝাঁকড়া-চুলের ফালতু চেহারায় এক যুবক। নাম উইলশার, ভালো করে চেনেও না উইনস্টন, মুখে হাসি ছড়িয়ে সে-ই তাকে আহ্বান জানালো তার টেবিলের ফাঁকা চেয়ারটিতে বসার জন্য। ওকে প্রত্যাখ্যান করা নিরাপদ হবে না। একজন ডাকার পরেও তাকে উপেক্ষা করে আরেকটি মেয়ের টেবিলে বসে পড়া রীতিমতো অসমিচীন, যেখানে মেয়েটি তাকে ডাকেও নি। এমন কিছু করে ফেললে সবারই চোখে পড়ে যাবে। অগত্যা বন্ধুসুলভ হাসি ছড়িয়ে সে বসে পড়লো যুবকটির টেবিলে। ফালতু চেহারার ঝাঁকড়াচুলো তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। উইনস্টনের মনে হচ্ছিলো একটা কুড়োল দিয়ে টেবিলটির মাঝ বরাবর কোপ মেরে দুখান করে দেয়। ভাবতে ভাবতে কয়েক মিনিটেই মেয়েটির টেবিলটাও ভরে গেলো অন্যরা বসে পড়ায়।
সে নিশ্চিত, মেয়েটি বুঝতে পেরেছে যে উইনস্টন তার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলো। আর হতে পারে এর থেকে সে কিছু একটা বুঝেও নিয়েছে। পরের দিন যাতে একটু আগে আগে যেতে পারে সে বিষয়টি মাথায় ছিলো। আর আগের দিনের ভাবনা সঠিক করে দিয়ে এদিনও মেয়েটি সেই একই টেবিলে আর স্রেফ একা বসে। কিউতে তার ঠিক সামনের লোকটি বেটেখাটো আর শুধুই নড়াচড়া করছে। সেই মধুমক্ষী চেহারার লোকটি। চ্যাপ্টা মুখমণ্ডলে ছোট-কুতকুতে দুটি চোখ। উইনস্টন যখন তার ট্রেটি হাতে নিয়ে কাউন্টার থেকে ঘুরলো, সে দেখলো বাটুল ব্যাটা সোজা মেয়েটির টেবিলের দিকেই যাচ্ছে। আশার তরী তবে ডুবলো এবারও। একটু দূরে আরেকটি টেবিলে চেয়ার ফাঁকা, কিন্তু বাটুলের চেহারা দেখে পড়ে নিলো- এই ব্যাটা অপেক্ষাকৃত বেশি ফাঁকা টেবিলটিতেই আরাম করে বসবে। বরফহীম হৃদয় নিয়ে উইনস্টন এগুচ্ছে। ওকে একা টেবিলে না পেলে কোনই ফায়দা নেই। ঠিক সেই মূহূর্তে সশব্দে চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেলো বাটুল লোকটা। চার হাত পা চারদিকে ছড়িয়ে, আর তার ট্রে-খানা উল্টে স্যুপের ও কফির ধারা মেঝেতে গড়ালো। ঘৃণাভরা দৃষ্টি হেনে উইনস্টনের দিকে তাকাতে তাকাতে পরক্ষণেই উঠে দাঁড়ালো। তার সন্দেহমাখা দৃষ্টি বলছে যেনো উইনস্টন তাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু তাতে কিছুই যায় আসে না। হৃদযন্ত্রের ধক ধক ধক ধক শব্দ নিয়ে উইনস্টন বসে পড়লো মেয়েটির টেবিলে।
মেয়েটির দিকে না তাকিয়েই ট্রের খাবারগুলো খোলায় মন দিলো সে। আর দ্রুতই খাওয়াও শুরু করলো। কেউ এসে পড়ার আগে এখুনি কথা সেরে ফেলা খুবই জরুরি, কিন্তু এক ভয়াবহ ভীতি যেনো তাকেজাপ্টে ধরলো। মেয়েটি কথাগুলো বলার পর এক সপ্তাহ পার হয়েছে। এর মধ্যে সে অবশ্যই তার মনও পাল্টে ফেলেছে! এই সম্পর্ক সফলতায় শেষ হবে এমনটা অসম্ভব; এমন ঘটনা বাস্তব জীবনে ঘটেই না। কানভরা পশমওয়ালা সেই কবি অ্যাম্পলফোর্থকে ট্রে হাতে বসার জায়গা খুঁজতে না দেখলে, এখনই কিছু বলবে না এমন একটি সিদ্ধান্ত সে প্রায় নিয়েই ফেলেছিলো। নিজের মতো করেই উইনস্টনের সঙ্গে খাতির রেখে চলে এই অ্যাম্পলফোর্থ, আর নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তাকে দেখে ফেললে ছুটে এসে এই টেবিলেই বসবে। হাতে মোটে এক মিনিট সময়ও নেই। উইনস্টন ও মেয়েটি দুজনই ধীরে ধীরে খাবার মুখে তুলছে। যা খাচ্ছে তা ওই পাতলা স্ট্যু, মূলত শিম-বরবটির স্যুপ। অনেকটা বিরবির করার মতো করে উইনস্টন কথা পারলো। কেউই চোখ তুলে তাকালো না। ধীরে ধীরে চামচে তুলে তরল পদার্থ মুখে দিচ্ছে। আর এর মাঝেই কিছু প্রয়োজনীয় শব্দ বিনিময় হচ্ছে। খুব আস্তে অভিব্যক্তিমুক্ত সে কণ্ঠধ্বনি-
– ‘কাজ শেষ হয় কখন?’
– ‘সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায়।’
-‘কোথায় দেখা হতে পারে?’
– ‘ভিক্টরি স্কয়ার, স্মৃতিস্তম্বের কাছে।’
– ‘ওখানটা তো টেলিস্ক্রিনে ভরা।’
– ‘ভিড় থাকলে ওটা কোনও বিষয় না।’
– ‘কোনও সংকেত?’
– ‘না। আমার আশেপাশে অনেক মানুষের ভীড় না থাকলে কাছে ঘেঁষা যাবে না। আর আমার দিকে তাকানোও যাবে না। তবে আমার আশেপাশেই কোথাও থাকবে।’
– ‘কখন?’
– ‘সন্ধ্যা ৭টা’
– ‘ঠিক আছে’।
উইনস্টনকে দেখতেই পায়নি অ্যাম্পলফোর্থ। এগিয়ে গিয়ে অন্য একটি টেবিলে বসে পড়েছে সে। ওদের দুজনের মধ্যে আর কোনও কথা হলো না। আর যতক্ষণ টেবিলের দুদিকে দুজন বসে ছিলো কেউ কারো দিকে তাকালোও না। মেয়েটি একটু দ্রুত খাবার শেষ করে বেরিয়ে গেলো। উইনস্টন সিগারেট ফুঁকবে বলে আরেকটু বসলো।
নির্ধারিত সময়ের আগেই ভিক্টরি স্কয়ারে পৌঁছে গেলো উইনস্টন। খাঁজকাটা অতিকায় স্তম্ভটির চারিদিকটা একবার ঘুরে দেখলো। এই স্তম্ভের চূড়ায় দখিণমুখো করে বসানো বিগ ব্রাদারের অতিকায় মূর্তি। আকাশের পানে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছেন, ঠিক যেদিকটাতে এয়ারস্ট্রিপ ওয়ান যুদ্ধে তার হাতে পরাভূত হয়েছিলো ইউরেশীয় বিমানগুলো (বছর কয়েক আগে তা অবশ্য ছিলো পূর্ব এশীয় বিমান) সেদিকটাতে মুখ করে। সড়কের সম্মুখভাগে একটি ঘোড়ার পিঠে সওয়ার এক মানবমূর্তি। বলা হয় ওটি ওলিভার কর্মওয়েলের প্রতিরূপ। নির্ধারিত সময়ের পরেও পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেছে। ভয়াবহ সেই ভীতি আবার তাকে পেয়ে বসলো। সে আর আসছে না! মন পাল্টে ফেলেছে! ধীরে হাঁটতে হাঁটতে স্কয়ারের উত্তর দিকটাতে এগিয়ে গেলো সে। ঠিক তখনই সেন্ট মার্টিন’স চার্চটি চোখে পড়ায় একটা ফ্যাকাশে রঙের আনন্দানুভূতি বয়ে গেলো। এই সেই গির্জা, যার ঘণ্টা, যখন ঘণ্টা বলতে কিছু ছিলো, ধ্বনি তুলতো ‘ইউ ও মি থ্রি ফারদিংস।’ এরপর সে মেয়েটিকে দেখতে পেলো স্মৃতিস্তম্ভের বেদীতে দাঁড়িয়ে, স্তম্ভের সাথে ঘূর্ণায়মান একটি পোস্টার হয় পড়ছে, নয়তো পড়ার ভান করছে। কাছে ধারে আরও কিছু মানুষ জড়ো না হলে এখনই মেয়েটির কাছাকাছি যাওয়া অনিরাপদ। চারিদিকে ঝুল ছাদে বসানো রয়েছে বেশ কয়েকটি টেলিস্ক্রিন। ঠিক সেই মুহূর্তে ব্যাপক চিৎকার-চ্যাচামেচি শুরু হলো আর বাম দিক থেকে ভারি ভারি যানবাহন ছুটে আসতে লাগলো একের পর এক।
হঠাৎ সবাই স্কয়ারের চারিদিকে ছোটাছুটি শুরু করলো। মেয়েটি ক্ষীপ্রতার সাথে বেদীর সিংহমূর্তিগুলোর মাঝ থেকে ঘুরে ছুটন্ত মানুষগুলোর সঙ্গে যোগ দিলো। উইনস্টন তাকে অনুসরণ করলো। আর যখন দৌড়াচ্ছিলো তখনই অন্যদের কথা থেকে জানতে পারলো ইউরেশীয় কারাবন্দিদের একটি বহর যাবে এখান দিয়ে। ততক্ষণে স্কয়ারের দক্ষিণ দিকটা লোকে লোকারণ্য। এমন পরিস্থিতে উইনস্টন সাধারণত ভীড়ের বাইরের দিকটাতে থাকে, কিন্তু এখন সে ধাক্কাধাক্কি, ঠেলাঠেলি করে, শরীরখানা আকিয়ে-বাঁকিয়ে তবেই ভীড়ের ঠিক মাঝের দিকে ছুটছে। যখন মেয়েটির বাহুর নাগালে পৌঁছালো তখনই বাধা হয়ে দাঁড়ালো অতিকায় বপুর এক পুরুষ প্রোল, আর একই মাপের আরেক নারী প্রোল। মনে হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীই হবে। থলথলে মাংসের একটি দেয়াল হয়ে সামনে সামনে হাঁটছে এই প্রোল যুগল। একবার তার ইচ্ছা হলো দু’জনের পশ্চাৎদেশের নিচে পায়ের ফাঁক গলিয়ে সামনে চলে যায়, কিন্তু তার প্রয়োজন হলো না, দেয়াল ভেঙ্গে ঘাম ছুটিয়ে তবেই আবিষ্কার করলো তার পাশে এখন আর কেউ নয়, স্রেফ কালোকেশী। দুজনেই পাশাপাশি হাঁটছে, আর দুজনেরই দৃষ্টি সম্মুখে স্থির।
কাঠমুখো প্রহরীরা সাবমেশিনগান হাতে কোনায় কোনায় দাঁড়িয়ে। ট্রাকের একটি দীর্ঘ লাইন ধীরে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। ট্রাকগুলোতে ছোট ছোট হলদেটে চেহারার মানুষগুলো সবুজাভ ইউনিফর্মে উবু হয়ে ঠাসাঠাসি করে বসা। তাদের বিষাদময় মঙ্গোলীয় চোখগুলো আশেপাশে পড়ে আছে তাতে কৌতুহলের চিহ্নও নেই।
মাঝে মাঝে ট্রাকগুলো যখন ঝাঁকি খাচ্ছে তখন কয়েদীদের ধাতব ডান্ডাবেরিগুলো ঝন-ঝন শব্দ তুলছে। করুণ চেহারার কতগুলো মানুষে ঠাসা ট্রাকের পর ট্রাক পার হয়ে যাচ্ছে। উইনস্টন অবশ্য ওদিকটায় খুব একটা তাকালোও না। মেয়েটির কাঁধ ও কনুই কখনো কখনো তার কাঁধে ও হাতে এসে লাগছে। তার গাল এতটাই কাছে যে উষ্ণতা অনুভব করা যায়। তবে খুব দ্রুতই মেয়েটিই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিলো, ঠিক যেমনটি সে নিয়েছিলো ক্যান্টিনেও। একই অভিব্যক্তিশূন্য কণ্ঠে সে কথা শুরু করলো। ঠোঁটদুটি সামান্যই নড়ছে, বিরবির অনুচ্চ কণ্ঠ, শোরগোল আর ট্রাকের শব্দে যা সহজেই হারিয়ে যাচ্ছে।
– ‘তুমি কি আমায় শুনতে পাচ্ছো?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘রোববারের বিকেলটা ছুটি নিতে পারবে?’
– ‘পারবো।’
– ‘তাহলে মন দিয়ে শোনো। মনে রেখো। আমরা প্যাডিংটন স্টেশনের দিকে যাচ্ছি…’
সামরিক এলানের মতো বলে গেলো মেয়েটি। এতে হতবিহ্বল উইনস্টন। মেয়েটিই পথ বাতলে দিচ্ছে, তাকে স্রেফ অনুসরণ করে যেতে হবে।
-‘রেলে আধাঘণ্টা, স্টেশনের বাইরে বায়ে ঘুরলে উঠে যাওয়া একটি সুঁড়িখানার লাগোয়া দরজা, সেখানে ঢুকলেই মাঠের ভেতর দিয়ে একটি পথ বয়ে গেছে, ঘাস গজিয়ে উঠেছে সে পথে, এগুলেই জঙ্গলের মাঝ দিয়ে একটি আরেকটি হাঁটাপথ, সেখানে শ্যাওলা ধরা একটি মরা গাছ।’ বলার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছিলো পুরো মানচিত্র তার মস্তিষ্কে আাঁকা।
‘পুরোটা মনে থাকবে তো?’ জানতে চাইলো মেয়েটি।
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘প্রথমে বায়ে ঘুরবে, এরপর ডানে, এরপর ফের বায়ে। আর মনে রাখবে এখানে উপরের সুঁড়িখানাটি এখন আর নেই।’
– ‘ঠিক আছে। কখন?’
– ‘তিনটার দিকে। তোমাকে একটু অপেক্ষা করতে হতে পারে। আমি ভিন্ন পথে যাবো। তুমি কি নিশ্চিত যে সবকিছু ঠিকঠাক মনে থাকবে?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘তাহলে যত দ্রুত পারো আমার কাছ থেকে সটকে পড়ো।’
তাকে বলতে হতো না। কিন্তু তখনই ভীড়ের মধ্যে আলাদা হয়ে যাওয়াও সম্ভব ছিলো না। ট্রাকগুলো তখনও পার হচ্ছে, মানুষগুলো তখনও হা করে তা দেখছে। গোড়ার দিকে কিছুটা হিস-হাস শব্দ ছিলো, সেগুলো ভীড়ের মধ্যে যারা পার্টির সদস্য তাদের মুখ থেকেই বের হচ্ছিলো, সেটাও দ্রুতই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন যা টিকে আছে তা স্রেফ কৌতুহল। ইউরেশিয়া থেকে হোক কিংবা পূর্ব এশিয়া থেকে, বিদেশি মানেই যেনো অদ্ভুত কোনো জন্তু। এই কয়েদীর সাজ ছাড়া আর কোনো রূপে এদের কেউ কখনো দেখেনি। এমনকি কয়েদীদের দিকে একবারের বেশি দুইবার তাকায়নি। আর, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যাদের ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে তাদের বাইরে অন্যদের কপালে কি ঘটছে তা তারা জানেও না। অন্যরা শুধুই উবে যাচ্ছে। নয়তো স্থান হচ্ছে জবরদস্তিমূলক শ্রমের ক্যাম্পে। গোলাকার চেহারাগুলো ময়লা, শশ্রুমণ্ডিত আর বিপর্যস্ত ইউরোপীয় রূপ নিয়েছে। ভাঙ্গা গালের ওপর গোলগোল বিষ্ফোরিত চোখগুলোর কোনো কোনোটির সাথে উইনস্টনের চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত গভীরতার সে চোখগুলো আবার নিমিষেই সরে যাচ্ছে। বহরটি শেষ হলো। শেষ ট্রাকটিতে তার চোখে পড়লো এক বৃদ্ধের ওপর। ধূসর চুলে তার মুখ ঢাকা, দুই কব্জি সামনের দিকে বাঁধা, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে। মনে হলো লোকটি যেনো এমন হাতবাঁধা অবস্থাতেই অভ্যস্ত। মেয়েটির কাছ থেকে উইনস্টনকে এখনই সরে যেতে হবে। কিন্তু শেষ মূহূর্তে, ভীড় তখনও তাদের ভেতরেই ঠেলছিলো আর সে বুঝতে পারলো তার হাতের ভেতর তখন মেয়েটির হাত। আস্তে আস্তে চাপ দিচ্ছে।
দশ সেকেন্ডের বেশি হবে না, কিন্তু তার মনে হলো কতনা দীর্ঘ সময় ধরেই যেনো তারা দুজন হাত ধরাধরি করে আছে। এরই মধ্যে তার হাতের প্রতিটি বিষয়ই যেনো সে জেনে নিয়েছে। লম্বা আঙুল, লম্বাটে নোখ, কাজের চাপে কিছুটা শক্ত তালু, কিণাঙ্ক, কব্জির নিচে পেলব মাংস।
অনুভূতি থেকে যতটা জেনে নিলো তা যেনো চোখে দেখে জানারই সমান। ঠিক তখনই তার মধ্যে একটা ভাবনা এলো, মেয়েটির চোখের রঙ কেমন তা তার জানা হয়নি। সম্ভবত ওগুলো বাদামী; তবে কালো চুলওয়ালাদের চোখ সাধারণত নীল হয়। মাথা ঘুরিয়ে মেয়েটির চোখ দুটি দেখে নেওয়া হবে ভীষণ বোকামি। এত মানুষের চাপাচাপিতে হাতে হাত ধরার দৃশ্য চোখে পড়বে না, কিন্তু তাকাতে গেলে ধরা পড়বে নিশ্চিত। তখনও তারা দুজনই স্থিরভাবে সামনে তাকিয়ে। তবে ততক্ষণে আর মেয়েটির চোখ নয়, উইনস্টনের মনের গভীরে ভেসে উঠলো সেই কয়েদীর মুখমণ্ডল ঢেকে থাকা চুলের ফাঁকগলিয়ে চোখে পড়া বিষাদময় দুটি চোখ।
অধ্যায় ২
গাছের শাখাতলে ফোঁটা ফোঁটা আলো আর ছায়ামাখা পথ ধরে হাঁটছে উইনস্টন। আর যেখানে শাখাগুলো দুই দিকে ছড়িয়ে সেখানে স্বর্ণসেতুতে পা ফেলে ফেলে এগুচ্ছে। বাঁয়ে বৃক্ষরাজির নিচে ধোঁয়াশা ছড়ানো মাটিতে ফুটে আছে নীলঘণ্টি (ব্লুবেলস) ফুল। মৃদুমন্দ হাওয়া চুমু খেয়ে গায়ে লেগে আছে। মে মাসের দ্বিতীয় দিন। বনের মাঝে আরও গভীর কোথাও থেকে ভেসে আসছে তিলা ঘুঘুর ডাক।
একটু আগেই এসে গেছে সে। পথে এতটুকু ঝামেলা হয়নি। মেয়েটির বর্ণনায় সবকিছু চোখে গাঁথা ছিল, ফলে স্বাভাবিক পথচলায় যেটুকু সংশয় থাকে এই পথে সে সংশয়ও সঙ্গী হয়নি। একটি নিরাপদ স্থানই বেছে নেওয়া হয়েছে সে ব্যাপারে মেয়েটির ওপরে ভরসা তার শতভাগ। লন্ডনের বাইরে গ্রামের দিকে একটু বেশি নিরাপদ, তেমনটা কেউ ভাবে না। টেলিস্ক্রিন নেই সে কথা ঠিক, কিন্তু গুপ্ত মাইক্রোফোন থেকে আপনার কথা রেকর্ড হয়ে যেতে পারে, চিনেও ফেলতে পারে, সে বিপদ পদে পদে। এছাড়াও একা একা যাবেন কিন্তু কারও নজরে পড়বেন না এমনটা হবার নয়। ১০০ কিলোমিটারের কম কোনও পথে যেতে হলে পাসপোর্ট এনডোর্স করা লাগে না, কিন্তু রেল স্টেশনগুলোতে টহলদারদের কড়া চোখ পড়ে থাকে। তারা পার্টি মেম্বারদের দেখে ফেললে আটকে দিতে পারে, ফালতু-অস্বস্তিকর প্রশ্নে জর্জরিতও করতে পারে। সে যাই হোক, উইনস্টনের পথে কোনও টহলদার বাধ সাধে নি, স্টেশন থেকে বের হওয়ার পর থেকেই পিছুপানে সতর্ক দৃষ্টি হেনে বারবারই দেখে নিয়ে নিশ্চিত হয়েছে, কেউ তার পিছুও নেয়নি।
ট্রেনে ঠাঁসাঠাঁসি করে যাচ্ছিল প্রোলরা, গ্রীষ্মের আবহাওয়ার ছোঁয়ায় তাদের মন ছিল ছুটির দিনের মত ফুরফুরে। কাঠের আসন পাতা যে বগিটিতে সে উঠেছিল, ওটি ঠাঁসাঠাঁসি হয়েছিল এক বিশাল পরিবারের সদস্যদের দিয়ে। ফোঁকলাদাঁতের প্রোপিতামহ থেকে শুরু করে এক মাসবয়সী শিশুটিও রয়েছে সে দলে। সবাই মিলে গ্রামে আত্মীয় বাড়ি যাচ্ছে বিকেলটা কাটিয়ে আসতে। আর এই ফাঁকে কালোবাজার থেকে কিছু মাখন নিয়ে আসবে সে কথাও উইনস্টন ওদের কাছ থেকেই জানতে পারে।
রাস্তাটি এখানে একটু চওড়া হয়েছে, এরপর মিনিটখানেক হাঁটতেই পায়ে চলা পথের কথা মেয়েটি বলে দিয়েছিল। দেখে মনে হলো জঙ্গল চিরে তৈরি এই পথে গবাদিরই গতায়ত চলে। তার কাছে ঘড়ি নেই, তবে এখনও তিনটা বাজেনি ধারণা করা যায়। নীলঘণ্টি ফুলেরা এখানে এতটাই ঘন হয়ে পথের মাঝে মাঝে ছড়িয়ে যে, কোনও কোনওটি পায়ের তলায় দলে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে উবু হয়ে ফুল তুলে নিচ্ছিল সে। সময়টাও কাটছে তাতে। তবে এও মনে ছিল, দেখা হলে এর একগোছা ফুল সে মেয়েটিকে দেবে। একসাথে বড় একগুচ্ছ পেয়ে গেল, নাকের কাছে টেনে মনমাতানো মৃদু গন্ধ নিচ্ছিল সে, ঠিক তখনই পেছনে একটি শব্দ পেয়ে শরীর বরফহীম হয়ে উঠল। আসলে উবু হওয়াতে নিজের পায়ের হাঁটু ভাঙার শব্দ সেটি। নীলঘণ্টি ফুল তুলতে তুলতে দুহাত ভরিয়ে ফেলল। মনে হচ্ছিল এতটা আহ্লাদভরে এমন কাজ আর কখনও করেনি। এবার মনে হলো মেয়েটিই বুঝি, অথবা হতে পারে কেউ পিছু নিয়ে পৌঁছে গেছে। মুখে বেচারা গোছের ভাব নিয়ে ঘুরে তাকাতে যাবে ঠিক তখনই কাঁধে একটি হাতের মৃদু স্পর্শ।
মুখ তুলে তাকাল সে। এবার মেয়েটি। মাথা ঝাঁকিয়ে চুপ থাকার জন্য ইশারা করল। জঙ্গল ঝোপঝাড় দুই হাতে দ্রুত দুদিকে সরিয়ে একটি সরুপথে তারা আরও ঘন জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়ছে। অবশ্যই এর আগেও এই পথে এসেছে মেয়েটি। সে কারণেই পায়ের নিচে নরম কাদামাটি এড়িয়ে অভ্যস্ত পায়ে এগুচ্ছিল। আর তার পায়ে পায়ে উইনস্টনও। দুই হাতে ধরে আছে ফুলগুলো। প্রথম অনুভূতিটি ছিল স্বস্তির, কিন্তু যখন সে দেখতে পেল একটি সরু দেহ বল্লরী তুলে সামনে সামনে চলছে, উজ্জ্বল লাল পরিকর কোমরে আঁটো করে বাঁধা থাকায় নিতম্বের ভাঁজ স্পষ্ট, তখন একটা হীনমন্যতা চেপে বসল তার ওপর। বাতাসের মিষ্টতা আর গাছের পাতার শ্যামলিমাই যেন তাকে হতোদ্যম করে দিল।
মে মাসের রৌদ্রে স্টেশন থেকে হেঁটে আসায় আগে থেকেই নিজেকে নোংরা, ঘিনঘিনে লাগছিল। সে যেন ঘরকুণো এক জন্তু, লন্ডনের নোংরা ধুলোয় যার ত্বকে ময়লার স্তর জমে আছে। তার মনে হলো এর আগে মেয়েটি তাকে দিনের প্রকাশ্য আলোয় খোলা আকাশের নিচে কখনওই দেখেনি। ভাবতে ভাবতে তখনই তারা সেই মৃত গাছটির কাছে পৌঁছাল, যেটির কথা মেয়েটি আগেই বলেছিল। গাছ ডিঙ্গিয়ে ঘন জঙ্গল সরিয়ে ঢুকে পড়ল সে, উইনস্টনও তার পিছু পিছু ঢুকল। আর আবিষ্কার করল প্রকৃতি এখানে কত সুচারুভাবে একটি ফাঁকা স্থান করে রেখেছে, যার চারিদিক ঘন জঙ্গলের বেড়া আর মাঝখানে তৃণাবৃত একটা ঢিঁবি। মেয়েটি চলা থামিয়ে ঘুরল।
‘আমরা পৌঁছে গেছি’—বলল সে।
একটু দূরত্বে থেকেই মেয়েটির দিকে তাকাল সে। তখনও কাছে ঘেঁষার সাহস কুলিয়ে উঠতে পারেনি।
‘পথে কথা বলতে চাইনি’—বলল মেয়েটি, ‘জানো তো পথে পথে গোপন মাইক পাতা থাকে। আমার মনে হয় না এখানে আছে, কিন্তু থাকতেও পারে। জঘন্য বস্তুগুলোর কোনও একটি ঠিক তোমার কণ্ঠস্বর চিনে ফেলবে। কিন্তু এখানে আমাদের কোনও সমস্যা নেই। ’
তখনও কাছে যেতে সাহস করছে না সে। ‘এখানে আমাদের কোনও সমস্যা নেই?’ বোকার মত একই উচ্চারণ তার।
‘হ্যাঁ, নেই। চেয়ে দেখ চারিদিকের গাছগুলো। ’
ছোট ছোট ধূসর বাকল আর শক্ত কাঠের অরণ্যবৃক্ষ। একদা এগুলো কেটে ফেলা হয়েছিল যা গুঁড়ি থেকে আবার গজিয়ে উঠেছে। একেকটি গাছ হাতের কব্জিসম মোটা হবে, ওগুলোই চারিদিকে ঘন খুঁটির জঙ্গল হয়ে আছে।
‘এখানে কোনও মাইক লুকিয়ে রাখার সুযোগ নেই, তাছাড়া আমি আগেও এসেছি। ’
একতরফাই কথা চালিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি। ততক্ষণে সে তার কাছাকাছি ঘেঁষার একটু সাহস সঞ্চার করে নিয়েছে। মেয়েটি তখন তার ঠিক সামনে সটান দাঁড়িয়ে, মুখে মৃদুহাসি মেখে নিয়ে যেভাবে তাকিয়ে, তাতে তাকে কিছুটা বিস্মিতই ঠেকছিল, যেন তার জিজ্ঞাসা, এত নিস্তেজ কেন তুমি! মাটিতে মাদুর বিছিয়ে ছড়িয়ে আছে নীলঘণ্টি ফুল। ততক্ষণে ওরা আরও কাছাকাছি। মেয়েটির হাত হাতে তুলে নিল সে।
‘তুমি বিশ্বাস করবে, এ পর্যন্ত আমি তোমার চোখের রঙ কী জানতাম না’—বলল সে। নজরে এলো পিঙ্গল বর্ণের দুটি চোখ। ঠিক পিঙ্গল নয় যেন কালো পাপড়ির মাঝে পিঙ্গলের আবরণমাখা। ‘এবার তাহলে তুমি দেখলে আমি দেখতে ঠিক কেমন। কী মনে হচ্ছে আমার দিকে তাকানো যায়?’
‘হ্যাঁ, সহজেই। ’
‘আমার ৩৯। বিয়ে করেছিলাম, আলাদা থাকি কিন্তু মুক্তি মেলেনি। শরীরের ত্বকজুড়ে শিরাগুলো স্ফীত। গোটা পাঁচেক নকল দাঁত আছে। ’
‘ওতে কিছু আসে যায় না’—বলল মেয়েটি।
এইক্ষণে বলা মুসকিল কে আগে অন্যজনকে কাছে টেনে নিয়েছে, কিন্তু ততক্ষণ মেয়েটি উইনস্টনের বাহুতে। গোড়ার দিকে তার অনুভূতিতে বিস্ময় ছাড়া কিছু ছিল না। যৌবনবতী দেহখানি তার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। ঘন কালোকেশে মুখ ঢাকা পড়েছে। আর হ্যাঁ! মেয়েটি তার মুখখানি উপরের দিকে তুলে রেখেছে, আর সে লাল ঠোঁটদুটো চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটি তার বাহুদুটি দিয়ে তার ঘাড় জড়িয়ে রেখেছে, আর কখনও প্রিয়তম, কখনও জীবনের অমূল্য পাওয়া আর ভালোবাসার পাত্র বলে সম্বোধন করে চলেছে। এবার মেয়েটি মাটিতে শুয়ে, কোনও কিছুতেই বাধা নেই তার, যা চাও নিয়ে নাও এমন অভিব্যক্তি। কিন্তু সত্য বলতে কি, কোনও শারীরিক উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে না উইনস্টনের; কেবল ওই জড়িয়ে রাখার ভালোলাগাটুকু ছাড়া। তার অনুভূতি জুড়ে সন্দেহ আর গর্ববোধের মিশ্রণ। যা কিছু ঘটে চলেছে তাতে সে আনন্দিত, কিন্তু তার শরীরের কোনও চাওয়া নেই। আর আচমকাই মেয়েটির যৌবন আর সৌন্দর্যের মাখামাখি তার ভেতরে ভয় ধরিয়ে দিল—মেয়েদের সান্নিধ্যছাড়া বসবাসেই অভ্যস্ত সে—কিন্তু ভীত হয়ে পড়ার কারণটি বুঝতে পারছে না। মেয়েটি উঠে বসল আর চুলের মধ্যে ঢুকে পড়া একটি নীলঘণ্টি ফুল টেনে বের করে আনল। মুখোমুখি বসে দুই বাহুতে কোমর জড়িয়ে ধরল।
‘কিছু মনে করো না, প্রিয়তম। তাড়াহুড়ার কিছু নেই। গোটা বিকেলটাই যে আজ এখানে কাটাব দুজন। তুমি কী বলো? লুকিয়ে থাকার জন্য অসাধারণ একটি জায়গা না? সেবার কমিউনিটি চাঙ্গা করার এক কর্মসূচিতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। তখন ঘুরতে ঘুরতে দেখা পাই এই জায়গাটির। কেউ যদি এসেও পড়ে তুমি অন্তত একশ’ মিটার দূর থেকেই শুনতে পাবে। ’
‘তোমার নাম কী?’ প্রশ্ন উইনস্টনের।
‘জুলিয়া। আমি কিন্তু তোমার নাম জানি। উইনস্টন… উইনস্টন স্মিথ। ’
‘কী করে জানলে?’
‘আমার ধারণা কোনও কিছু জেনে নিতে তোমার চেয়ে আমি একটু পটুই হব, প্রিয়তম। এবার আমায় বলো, সেদিন ছোট চিরকূটটি দেওয়ার আগে তুমি আমাকে নিয়ে কী ভাবতে?
মিথ্যা বলার কোনও চাপ অনুভব করল না সে। মনে হলো ভালোবাসার শুরুতেই ভয়াবহ কথাগুলো বলে ফেলা যায়।
‘তোমাকে দেখলেই আমার ভেতরে ঘৃণা জাগত’—বলল সে। ‘আমি চাইতাম, তোমাকে ধর্ষণ করে হত্যা করি। মাত্র দুটি সপ্তাহ আগেও আমার ইচ্ছা হচ্ছিল পাথর দিয়ে তোমার মাথাটি থেঁতলে দেই। তুমি যদি সত্যিই জানতে চাও, আমি বলতে পারি কল্পনা জুড়েই ছিল, তুমি আসলে থট পুলিশের কেউ হবে। ’
মেয়েটি হাসল, আনন্দ ছড়িয়ে ছড়িয়ে হাসল, যেন এই কথা বলার মধ্যে তার ছদ্মবেশের প্রতি এক ধরনের স্বীকৃতিই মেলে।
‘না থট পুলিশ না! তুমি আসলে সেটা ভাবতে, না?’
‘হ্যাঁ, সেটা হয়ত নয়। কিন্তু তোমার চেহারায়—বিশেষ করে তুমি যুবতী, ডাগর, আর স্বাস্থ্যবান, বুঝতেই পারো—আমি ভাবতাম সম্ভবত তুমি…’
‘তুমি ভাবতে আমি পার্টির ভালো সদস্যদের একজন। কথায় ও কাজে একদম খাঁটি। ব্যানারে, মিছিলে, স্লোগানে, খেলায়, কমিউনিটি চাঙ্গা করার কর্মসূচিতে সবখানে। আর তুমি এও ভাবতে সামান্য সুযোগ পেলেই আমি তোমাকে চিন্তা অপরাধী বলে নালিশ করে দেব, যাতে তোমাকে হত্যা করা হয়?’
‘হ্যাঁ ঠিক সেরকমই। অনেক যুবতী মেয়েই তো তেমন, তুমি ভালো করেই জানো। ’
‘যারা করে তারা হিংস্র’—বলল জুলিয়া।
আর বলতে বলতে কোমর থেকে জুনিয়র এন্টি সেক্সের লাল পরিকরটি একটি গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখল। এরপর কোমরে হাত রেখে যে মুখোভঙ্গি করল, তাতে মনে হলো কিছু একটা হঠাৎই মনে পড়ে গেছে। আলখেল্লার পকেটে জিনিসটির অস্তিত্ব টের পেল আর দ্রুতই বের করে আনল একটি চকলেট। অর্ধেক করে ভেঙ্গে এক টুকরো এগিয়ে দিল উইনস্টনের দিকে। চকলেটটি হাতে পাওয়ার আগেই এর ঘ্রাণ থেকে সে বুঝে নিল এটি সাধারণ কোনও চকলেট না। কালো চকচকে আর রুপালি কাগজে মোড়ানো। সাধারণ চকলেটগুলো ম্যাড়মেড়ে বাদামি রঙের আর মুখে দিলে ধোঁয়াটে গন্ধ আসে। কোনও এক সময় সেও এমন দারুণ স্বাদের চকলেট চেখে দেখেছে। গন্ধটা নাকে লাগার সাথে সাথেই তার স্মৃতিতে কিছু একটা নাড়া দিয়ে গেল কিন্তু সুনির্দিষ্ট করা গেল না। তবে বুঝল সেটি ছিল বড় কোনও ঘটনা আর ঝামেলারও।
‘পেলে কোথায়?’—প্রশ্ন উইনস্টনের।
‘কালোবাজারে’—উত্তর দিতে সময় নিল না সে। ‘আসলে আমি মেয়েই এমন। খেলাধূলায় ভালো। স্পাইজে আমি ট্রুপ লিডার। সপ্তাহে তিন সন্ধ্যা তুমি আমাকে জুনিয়র অ্যান্টি সেক্স লিগের স্বেচ্ছাসেবী কর্মসূচিগুলোতে পাবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি লন্ডনময় ওদের ফালতু পোস্টার সেঁটে বেড়াই। মিছিলের সামনে ব্যানারের এক কোণা ধরে তুমি আমাকেই পাবে। মুখে হাসি মেখে কোনও কিছুতেই না করি না। ভিড়ের মাঝে চিৎকার করি। আমি বলতে চাই, নিরাপদ থাকার এটাই একমাত্র পথ। ’
চকলেটের প্রথম অংশ উইনস্টনের জিভের ওপরেই গলে গেল। অসাধারণ স্বাদ। স্মৃতিটা এখনও তার চেতনার কিনারায় এসে গা ছুঁইয়ে চলে যাচ্ছে। অনুভব করছে কিন্তু কোনওভাবেই আকার দিতে পারছে না। ঠিক কোনও কিছু দৃষ্টি সীমায় পড়ে আবার যেমন হারিয়ে যায় তেমনই। মন থেকে বিষয়টি ঝেড়ে ফেলল, মাথায় রাখল এটি আসলে কোনও ঘটনার স্মৃতি যা ফিরিয়ে আনা যাবে, কিন্তু পারছে না।
‘তোমার বয়স কম’—বলল উইনস্টন। ‘আমার চেয়ে দশ-পনের বছরের ছোট হবে। আমার মত লোকের মধ্যে এমন কী দেখলে যা তোমাকের আকৃষ্ট করল। ’
‘তোমার চেহারার মধ্যে কিছু একটা আছে। আমার মনে হচ্ছিল একবার চেষ্টা করেই দেখি। যারা ওদের দলের নয় তাদের চিহ্নিত করতে ভীষণ পাকা আমি। তোমাকে প্রথম দেখেই ধরে ফেলি তুমি ওই শুয়োরগুলোর বিরুদ্ধে। ’
ওদের বলতে পার্টিকেই বোঝানো হলো, মোদ্যাকথা ইনার পার্টির সবাইকে। যাদের কথা সে খোলামনে তাকে বলে চলছে—তাতে উইনস্টন অস্বস্তিই বোধ করছে, যদিও সে জানে অন্য যে কোনও স্থানের চেয়ে এখানে তারা নিরাপদেই আছে।
মেয়েটির স্থূল কথাগুলো তাকে কিছুটা বিস্মিত করল। পার্টির সদস্যরা কটু-কাটব্য করে না, উইনস্টনের মুখ থেকেও কদাচই গালাগাল বের হয়। আর উচ্চস্বরে তো নয়ই। কিন্তু জুলিয়া যখনই পার্টির কথা বলছিল, বিশেষ করে ইনার পার্টির কথা, তখনই তার মুখ থেকে এমন সব শব্দ বের হচ্ছিল যা বস্তির গলি-ঘিঞ্জির দেয়ালেই লেখা থাকে কিংবা শোনা যায়।
উইনস্টনের বিষয়টি অপছন্দ হচ্ছে বলা যাবে না, বরং স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্যই মনে হচ্ছিল তার কাছে। পচা খড়কুটোয়ও ঘোড়ার যেমন অনাগ্রহ থাকে না ঠিক তেমনি। ওরা ফাঁকা জায়গাটি থেকে বের হয়ে এলো আগের সেই ঝোঁপঝাড় ভাঙা পথ ধরে। যেখানেই একটু প্রশস্ত পথ পাচ্ছে একে অপরের কোমরে হাত জড়িয়ে রেখে পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি করে এগুচ্ছে। উইনস্টন খেয়াল করল কী নরম কটিদেশ এই মেয়ের, লাল পরিকরটিও তখন আর বাঁধা নেই। তাদের মধ্যে যেভাবে কথা চলছে তাকে ফিসফিসানিই বলা চলে।
ফাঁকা জায়গাটির বাইরে গেলে চুপচাপ থাকাই ভালো, বলল জুলিয়া। একপর্যায়ে জঙ্গলের প্রায় কিনারার দিকে পৌঁছাল তারা। আর উইনস্টনকে থামাল সে।
‘এখনই খোলা মাঠের দিকে যেও না। কেউ নজরদারি করতে পারে। জঙ্গলের ভেতরে যতক্ষণ আছি, নিরাপদ আছি। ’
একটি ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়েছে তারা। সূর্যের আলো পত্র-পল্লবরাজি ভেদ করে চুইয়ে চুইয়ে পড়লেও তাদের গায়ে তা তপ্ত হয়েই লাগছে। উইনস্টন পেছনের খোলা মাঠটির দিকে তাকিয়ে। তার স্মৃতি মৃদু আঘাত হেনে বলছে এ জায়গাটি খুব চেনা চেনা। এবার ঠিক চিনে ফেলল। খরগোশের আঁচড়কাটা পুরোনো চারণভূমি, মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে পায়েচলা পথ। সারা মাঠ জুড়ে এখানে সেখানে ছুছুন্দরীর ছোট ছোট মাটি তোলা ঢিঁবি। মাঠের উল্টোদিকের শীর্ণ বেড়া ঘেঁষে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে দেবদারু গাছের পাতাগুলো মৃদুমন্দ বাতাসে ঝিরিঝিরি নড়ছে। নারীর চুল যেমন বাতাসে ওড়ে দেবদারুর পাতায়ও তেমন নাচন লেগে আছে।
এখান থেকে দেখা না গেলেও নিঃসন্দেহে কাছে ধারে কোথাও ধীর স্রোতে বয়ে চলা নদীর স্বচ্ছ সবুজ পানিতে মাছেরা সাঁতার কাটছে বলেই মনে হলো তার।
‘আশে পাশে কোথাও ছোট নদী বয়ে গেছে, তাই না?’ ফিসফিসিয়ে বলল উইনস্টন।
‘হ্যাঁ, একটি নদী আছে। ওই মাঠের ঠিক ওপার ঘেঁষেই। এতে অনেক মাছ, এত্ত বড় বড় ! উইলো গাছের নিচে গেলেই তুমি দেখতে পাবে মাছগুলো লেজ নেড়ে নেড়ে চলছে। ’
‘এটাই ঠিক সেই সোনালি দেশ’—বিড়বিড় করে বলল সে।
‘সোনালি দেশ?’
‘না কিছু না। প্রায়ই স্বপ্নে আমি এমন একটি ভূদৃশ্য দেখি। ’
‘ওদিকে দ্যাখো!’ ফিসফিসিয়ে উঠল জুলিয়া।
ওদের কাছেই একটি গাছের ডালে উড়ে এসে বসল একটি দোয়েল পাখি, ঠিক ওদের মুখ বরাবর। পাখিটি সম্ভবত ওদের দেখতে পায়নি। ওটির গায়ে হলদেটে রোদ পড়েছে আর ওরা ছায়ায়। একবার পাখা ঝাপটালো পাখিটি। ওরা দুজন তখন আরও নিঃশব্দ। এবার মাথা তুলে যেন সূর্যের আলোকে অভিবাদন জানালো পাখিটি আর অতঃপর মনের সুখে গান ধরল। বিকেলের নিঃশব্দে সে সুর হয়ে উঠল মোহময়। উইনস্টন আর জুলিয়া প্রবল আকর্ষণে নিজেদের আরও ঘন আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিল। গানের সুর একটানা বেজেই চলেছে, মিনিটের পর মিনিট কেটে যাচ্ছে, আর দোয়েলটি তার গলায় ভাঁজছে একের পর এক মোহময় সুর যার একটির সঙ্গে অন্যটির মিল নেই। মনে হচ্ছিল, পাখিটি যেন আজ এই বিকেলে তার সুরের পাণ্ডিত্য ফলাচ্ছে। মাঝে মাঝে ক্ষণিকের বিরতি নিয়ে, পাখা ঝাপটিয়ে, পেলব পশমের বক্ষদেশ ফুলিয়ে শক্ত হয়ে গলায় শান দিয়ে আবার গানের সুরে ফেটে পড়ছে।
একটা অস্পষ্ট শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে পাখিটির গান গাওয়া দেখছিল উইনস্টন। কার জন্য, কেন গাইছে এই পাখি? তার কোনও সঙ্গী নেই, শত্রুও নেই যে দেখবে তার এই উদাস সুরে গাওয়া। কী কারণে এই নিঃসঙ্গ বনের কিনারে বসে অসীম শূন্যতাকে ভরে তুলছে গানে?
তার মনে এলো আশেপাশে কোথাও আদৌ কি লুকিয়ে পাতা রয়েছে কোনও মাইক্রোফোন। জুলিয়ার সঙ্গে তার কথাবার্তা চলছিল আরও মৃদুস্বরে, ফলে তাদের কথা ধরা পড়বে না, তবে দোয়েলের এই গান ঠিকই ধারণ হয়ে যাবে। হয়ত এই যন্ত্রের অন্যপাশে সারাক্ষণ কান পেতে থাকা কোনও এক বেটেখাটো মাছি-সদৃশ ব্যক্তির কানে পৌঁছে যাচ্ছে এই সুর। এই সুরের বন্যায় তার ভেতরের সকল অনুমান ভেসে যাচ্ছে। যেন এই সুর কোনও তরল বস্তুর মত তার গায়ে ঢেলে দেওয়া হচ্ছে আর তা মিশে যাচ্ছে এই পত্র-পল্লবের মাঝ থেকে চুইয়ে পড়া সূর্যালোকের সঙ্গে।
ভাবনা থামালো সে। আর অনুভব করতে লাগল, মেয়েটির যে কটিদেশ তার বাহুতে বন্দি, তা এখন আরও কোমল আরও উষ্ণ। মেয়েটিকে সে ঘুরিয়ে নিল, দুজন তখন বুকের সাথে বুক মিলিয়ে। ওর কোমল দেহটি যেন গলে গলে তার গায়ের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। যেখানেই হাত যায় কোমল পানির অনুভব। মুখ মুখে মিশে আছে তাদের, এর আগে যে কড়া চুম্বন তারা এঁকেছিল একে অপরের ঠোঁটে—এ যেন তার চেয়েও ভিন্ন কিছু। যখন ফের মুখ দুটি আলাদা হলো দুজনই যেন লজ্জা পেল। তখনই পাখিটি ডানা ঝাপটে উড়ে গেল দূরে।
উইনস্টন তার ঠোঁট ওর কানের কাছে নামালো। ‘এখন’—ফিসফিসিয়ে বলল সে।
‘এখানে না’—মেয়েটিও ফিসফিসাল। ‘চলো লুকোনোর জায়গাটিতে ফিরে যাই, ওখানটাই নিরাপদ। ’
দ্রততার সঙ্গে, জঙ্গল সরিয়ে সরিয়ে, সেই ফাঁকা স্থানে ছুটল তারা। আর সেই চারা গাছের চক্রের মধ্যে ঢুকে পড়তেই মেয়েটি ঘুরে তার মুখোমুখি দাঁড়াল। দু’জনেরই ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে, মেয়েটির মুখের কোণে সেই চেনা হাসিটি ফিরে এসেছে। তার চোখে চোখ রেখে সে দাঁড়িয়ে, তা এক লহমার জন্য। এরপর তার হাত আলখেল্লার জিপারে। আর হ্যাঁ! ঠিক এমনটাই ছিল সেই স্বপ্নে। এইক্ষণে দ্রুত যতটুকু স্মরণ করে নেওয়া যায়, মেয়েটি তার শরীর থেকে পরিধান ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলছে, আর যখন সেগুলো দুই দিকে তাচ্ছিল্যভরে ছুঁড়ে ফেলছিল তাতে গোটা সভ্যতাই যেন বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছিল। মেয়েটির নগ্ন শরীর সূর্যের আলোতে উজ্জ্বল রঙ ধরেছে। কিন্তু সেই মুহূর্তে তার চোখ শরীরে নয়; আটকে আছে মেয়েটির মুখের কোণায় লেগে থাকা হাসিতে। মেয়েটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসল সে। ওর হাত দুটো তুলে নিল হাতে।
‘তুমি আগে কখনও করেছো?’
‘অবশ্যই। শতশত বার করেছি—না মানে, অনেকবার করেছি। ’
‘পার্টির সদস্যদের সঙ্গে?’
‘হ্যাঁ, সবসময়ই কোনও না না কোনও পার্টি-সদস্যই ছিল। ’
‘ইনার পার্টির সদস্যদের সঙ্গে?’
‘না এই শুয়োরদের সঙ্গে নয়। তবে সুযোগ দিলে এদের হিড়িক পড়ে যেত। যতটা ভাব করে ততটা পবিত্র আসলে ওরা নয়। ’
তার হৃদযন্ত্র ধক করে উঠল। অনেক অনেকবার সেও এই কাজ করেছে। তারও ইচ্ছা—শত শত কিংবা হাজার হাজারবারই হোক। দুর্নীতির আভাস মেলে এমন কিছু হলেই তার মধ্যে এই এক হিংস্র প্রত্যাশা জাগ্রত হয়। কে জানে, পার্টি হয়ত আসলে তলে তলে পচেই গেছে, এর কষ্টার্জিত প্রথা আর আত্ম অপহ্নব স্রেফ দুর্বলতা আর বদমায়েশি ঢেকে রাখার প্রতারণা মাত্র। সে যদি এদের সবাইকে বা অনেককেই কুষ্ঠ কিংবা যৌনব্যাধিতে সংক্রমণ করে দিতে পারত, তাহলে কতই না খুশি হতো। যা কিছুকে পচিয়ে দেয়া যায়, দুর্বল করে দেয়া যায়, খাটো করা যায়, করে দাও।
জুলিয়ার হাত ধরে টান দিয়ে নামালো; এখন তারা দুজনই হাঁটুভেঙ্গে মুখোমুখি।
‘শোনো যত পুরুষের সঙ্গে তুমি শুয়েছো, ততই বেশি আমি তোমায় ভালোবাসি। তুমি কি বুঝতে পারছো?’
‘হ্যাঁ, পুরোই বুঝে নিয়েছি। ’
‘আমি পবিত্রতায় ঘৃণা করি, আমি ভালোত্বে ঘৃণা করি! আমি চাই না কোন সদ্গুণ কোথাও টিকে থাক। আমি চাই সবাই হাড়ে হাড়ে বজ্জাত হয়ে উঠুক। ’
‘বেশ, তাহলে তোমার সঙ্গেই আমার মিল, প্রিয়তম। আমি এক হাড়ে হাড়ে বজ্জাত। ’
‘তুমি কি কাজটা করতে পছন্দ করো? আমি ঠিক স্রেফ আমার সঙ্গের কথা বলছি না, সার্বিকভাবে কাজটির কথা বলছি। ’
‘আগ্রহ আর ভক্তিভরেই কাজটি করি আমি। ’
ঠিক এমনটাই শুনতে চেয়েছিল সে। কারও সঙ্গে ভালোবাসার টানে নয়, পাশবিক তাড়নায়, স্রেফ অভিন্ন লালসায় কাজটি করবে, আর সেই শক্তিই পার্টিকে খান খান করে দেবে।
মেয়েটিকে চেপে ধরে ঘাসের ওপর শুইয়ে দিল সে, চারিদিকে ছড়িয়ে আছে নীলঘণ্টি ফুল। এবার আর কোনও বাধা নেই। এ পর্যায়ে তাদের বুকের ওঠানামা স্বাভাবিক গতি পেল আর দুজন আলাদা হয়ে শুয়ে পড়ল। সূর্যটা আরও তেজি হয়ে উঠেছে বলেই বোধ হচ্ছিল। ওদের দুজনেরই ঘুম ঘুম লাগছে। ছুঁড়ে ফেলা আলখেল্লাটি তুলে নিয়ে তার কিছু অংশ মেয়েটির গায়ের ওপর মেলে দিল। অনেকটা তখনই দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ল। আর প্রায় আধাঘণ্টা ধরে ঘুমোলো।
প্রথম ঘুম ভাঙল উইনস্টনের। উঠে বসল আর মেছতা পড়া মুখটির দিকে চোখ পড়ল, হাতের তালুতে বালিশ বানিয়ে তখনও শান্তির ঘুম তার। মুখের গড়নটি ছাড়া আর কোনও কিছুতেই তাকে আপনি সুন্দরী বলতে পারবেন না। একটু কাছে থেকে দেখলে চোখে পড়বে তার চোখের চারিদিকে দাগ পড়ে আছে। ছোট কালো চুলগুলো অস্বাভাবিকরকমই মোটা আর নরম। এবার মনে এলো, এখনও ওর ডাকনামটি জানা হয়নি, জানা হয়নি কোথায় থাকে সে।
ঘুমের মাঝে অসহায় যৌবনভরা এই শক্তসামর্থ শরীরখানা তার মধ্যে এক ধরনের করুণা জাগ্রত করল, যেন ওর সুরক্ষার দায়িত্ব তার। কিন্তু ঝোপের পেছনে দোয়েলের গান শুনতে শুনতে যে ভালোলাগাটুকু ছিল তা যেন আর পুরোপুরি ফিরে আসছে না।
পুরোনো দিনগুলোর কথা ভাবল সে, কোনও একটি পুরুষ একটি নারীর শরীরকে কামনার দৃষ্টি থেকেই দেখত, আর একেকটি কাহিনী কামনার তৃপ্তিতেই শেষ হতো। কিন্তু আজকাল আপনি আর নির্ভেজাল ভালোবাসা যেমন পাবেন না, নির্ভেজাল লালসাও তেমনি পাবেন না। এখন আবেগটাই খাঁটি, কারণ সবকিছুই আজ ভয় আর ঘৃণায় একাকার হয়ে গেছে। তাদের আলিঙ্গন ছিল এক যুদ্ধ, সঙ্গম ছিল সে যুদ্ধের জয়। এ ছিল পার্টির মুখে এক চরম আঘাত। আর নিঃসন্দেহে এ এক রাজনৈতিক কাজও বটে।
অধ্যায় ৩
‘আমরা এখানে আবারও আসতে পারি’—বলল জুলিয়া। ‘একেকটি গোপন স্থান দুইবার পর্যন্ত ব্যবহার চলে, তবে অবশ্যই এক-দুই মাসের মধ্যে না। ’
ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে ওর আচরণটাই কেমন পাল্টে গেল। বেশ সতর্ক মনে হচ্ছিল, আর ভাবখানা এমন যেন কাজের কথার বাইরে কোনও কথাই তার পছন্দ নয়। কাপড় গায়ে চরাল, লাল পরিকর কোমরে বেঁধে নিল, আর কথা পাড়ল কিভাবে ফেরা হবে তা নিয়ে। এ দায়িত্ব যেন ওর ওপরই বর্তানো। তার মধ্যে কিছু একটা বাস্তব বুদ্ধিতা আছে, যা উইনস্টনের নেই। আর লন্ডনের আশেপাশের সবকিছু নিয়ে তার জ্ঞানের পরিধি যে বিশাল তাও স্পষ্ট। কমিউনিটি চাঙ্গা করার অসংখ্য কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে এই অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরেছে সে।
যে পথে এসেছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত একটি ফেরার পথ বাতলে দিল তাকে, রেলস্টেশনটিও ভিন্ন। ‘যেই পথে বাইরে কোথাও যাবে সেই একই পথে কখনওই ঘরে ফিরবে না’—কথাটি এমন এক ভঙ্গিমায় বলল সে, যেন বাণী চিরন্তনীর কোনও এক গুরুত্বপূর্ণ নীতিবাক্য আওড়ালো। সে আগে যাবে, আর উইনস্টন ঘণ্টা আধেক অপেক্ষা করে বের হবে।
এই ফাঁকে কাজের শেষে অন্তত চারটি সন্ধ্যায় তাদের ঠিক কোথায় দেখা হতে পারে সেটাও জানিয়ে রাখল। গরীবদের আবাসন এলাকায় রাস্তার পাশের খোলাবাজারটি হবে তাদের পরের দেখা করার স্থান। সাধারণত লোকে লোকারণ্য হয়েই থাকে এই বাজার। বলে রাখল, ওখানে দোকানগুলোতে ঘুরে ঘুরে সে দেখতে থাকবে, যেন জুতোর ফিতে বা সুঁই-সুতো খুঁজছে। যদি তার মনে হয় পরিস্থিতি অনুকূলে, তাহলে উইনস্টন কাছে পৌঁছালেই নাকে শব্দ করবে, আর না করলে উইনস্টন থামবে না, না চেনার ভান করে তাকে অতিক্রম করে চলে যাবে। ভাগ্য সহায় হলে, ওই ভিড়-ভাট্টা আর শোরগোলের মধ্যে মিনিট পনের কথা বলে তারা পরের দেখা কোথায় হবে তা ঠিক করে নিতে পারবে।
‘এখন আমি যাই’—পুরো বিষয়টি উইনস্টন বুঝে নিতেই বলল সে। ‘আমাকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মধ্যে পৌঁছতে হবে। জুনিয়র এন্টি-সেক্স লিগের কাজ আছে। লিফলেট বিতরণসহ আরও কিছু কাজে রাতেই ঘণ্টা দুয়েক সময় দিতে হবে। তুমি আমার চুলগুলো একটু দেখ তো কিছু আটকে আছে কিনা? নিশ্চিত বলছো? তাহলে বিদায়, প্রিয়তম, বিদায়!’
একথা বলেই উইনস্টনের বাহুতে ঝাপিয়ে পড়ল সে, সহিংস একটা চুমু বসাল তার মুখে, আর পরমুহূর্তেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চারাগাছের ভেতর দিয়ে গভীর জঙ্গলে অনেকটা নিঃশব্দে হারিয়ে গেল। এত কিছু হয়ে গেল, কিন্তু মেয়েটির ডাক নামটি জানা হলো না, জানা গেল না তার ঠিকানাও। তাতে অবশ্য কিছু আসে যায় না, কারণ তাদের কখনওই গৃহমাঝে দেখা হবে কিংবা চিঠি লিখে হবে কোনও ভাব বিনিময়—এমনটা হবার নয়।
বাস্তবে যা ঘটল, জঙ্গলের গভীরের ওই ফাঁকাস্থানে তাদের আর যাওয়া হয়নি। গোটা মে মাসে তারা আর মাত্র একবারই ভালোবাসাবাসি করার সুযোগ পেয়েছে। তা অন্য এক গোপন স্থানে, আর সেটিও ছিল জুলিয়ারই চেনা। গ্রামের দিকে অনেক নির্জন এলাকায়, বিধ্বস্ত একটি গীর্জার ঘণ্টিঘরে। বছর ত্রিশেক আগে ওই এলাকায় একটি আনবিক বোমা ফেলা হয়েছিল। গোপন স্থান হিসেবে অসাধারণ, তবে তা কেবল জায়গামত পৌঁছানোর পরেই। কিন্তু পৌঁছানোর পথটি ভয়াবহ বিপদের। এর বাইরে তাদের মাত্র দুই দফা দুটি ভিন্ন সড়কে সন্ধ্যার দিকে দেখা হয়েছে। আর, কোনও দেখাতেই আধাঘণ্টার বেশি সময় একসঙ্গে থাকা সম্ভব হয়নি। রাস্তায় কথা বলা চলে, কিন্তু মন ভরে না। যখন ওরা কোনও ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তখন খুব যে পাশাপাশি থাকা যায়, তাও নয়। আর একজন অন্যজনের দিকে তাকায়ও না।
এরই মধ্যে তাদের কথাবার্তা এগোয় যা বাতিঘরের আলোর মত এই চলে এই বন্ধ হয়ে যায়। দলের ইউনিফর্ম পরা কারও দেখা পেলে কথা বন্ধ, কাছাকাছি টেলিস্ক্রিন থাকলে তো কথাই নেই। আবার যখন কয়েক মিনিট পরে কথার সুযোগ মেলে তখন আগের বাক্য যেখানে শেষ সেখান থেকেই শুরু হয়। আর এভাবে পরের দিন যখন দেখা হয় তখন আগের দিন যেখানে শেষ হয়েছিল সেখান থেকে কথা শুরু হয়। জুলিয়াকে মনে হয় এভাবে কথা বলায় বেশ অভ্যস্ত সে। এর একটা নামও দিয়েছে—‘কিস্তিতে কথা বলা’।
মেয়েটির আরেকটি অদ্ভুত দক্ষতারও পরিচয় মিলল। ঠোঁট না নাড়িয়ে অবিরাম কথা বলতে পারে সে। এভাবেই প্রায় একমাস দেখাদেখির পর স্রেফ একবার তারা একটি চুমু বিনিময় করতে পেরেছিল। সে রাতে ওরা একটি পার্শ্ব-সড়কে নীরবে হাঁটছিল (মূলসড়কে না থাকলে জুলিয়ার মুখ থেকে একটি শব্দও কখনও বের হয় না) তখনই কানে তালা লাগানো ভীষণ গর্জন শোনা গেল। মাটি কেঁপে উঠল, চারিদিক অন্ধকার হয়ে এলো। উইনস্টনের যখন সম্বিত ফিরল দেখল মাটিতে শুয়ে, কুঁকড়ে আছে, গা-ভর্তি আঘাতের ব্যথা। নিকটেই কোথাও রকেট বোমা পড়েছে। ঠিক তখনই কয়েক সেন্টিমিটারের মধ্যেই জুলিয়ার মুখটি দেখতে পেল সে, মৃত-সাদা রঙ ধরে আছে, যেন মুখটিতে চক ঘষে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ওর ঠোঁট দুটোও সাদা। মনে হলো, মেয়েটি কি মরেই গেল! কাছে টেনে আনলো তাকে, আর আবিষ্কার করল সে এক জীবন্ত উষ্ণ ঠোঁটেই চুমু দিচ্ছে। এতে মেয়েটির ঠোঁটেও লেগে গেল সাদা পাউডারের মত কিছু একটা। আসলে তাদের দুজনেরই চেহারা পলেস্তারার ধুলোয় ঢেকে গিয়েছিল।
অনেক সন্ধ্যা গেছে, ওদের দেখা হয়েছে, পাশাপাশি দুজন হেঁটেছে দীর্ঘসময়, কিন্তু টহলদারদের আনাগোনা কিংবা মাথার ওপর হেলিকপ্টারের চক্করের কারণে সংকেতটি পর্যন্ত বিনিময় হয়নি। বিপদ যদি একটু কমও থাকে, দেখা করার সময় মিলিয়ে নেওয়া হয়ে পড়ে ভীষণ কঠিন। উইনস্টনের সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা ষাট, জুলিয়ার আরও বেশি। আজ ওর কাজের চাপ থাকে তো অন্যদিন উইনস্টনের। খুব কমই এমন হয়, একসঙ্গে দুজনের ফুসরত মেলে। বিকেলটা পুরো ফাঁকা, এমনটা জুলিয়ার ক্ষেত্রে প্রায় হয়ই না। বক্তৃতা আর বিক্ষোভের কর্মসূচিগুলোতে বিস্ময়করভাবে বেশি সময় দেয় সে। এছাড়াও জুনিয়র এন্টি-সেক্স লিগের লিফলেট-বইপত্র বিলি, ঘৃণাসপ্তাহের ব্যানার বানানো, সঞ্চয় বিষয়ক প্রচারাভিযানের জন্য চাঁদা তোলা, এমন হাজারো কাজের কাজী সে।
এর একটা মূল্য আছে, বলে সে, বলে এটাই সেরা কপটাবেশ। ছোট ছোট নিয়মগুলো যদি তুমি খুব করে মেনে চল, বড় নিয়মগুলো তখন অনায়াসে ভাঙতে পারবে। উইনস্টনকেও সে একটি সন্ধ্যায় বাড়তি কাজে লেগে পড়তে বাধ্য করেছে। গোলাবারুদের হিসাব রাখার এই কাজ পার্টির হিংসুটে স্বেচ্ছাসেবকরাই কেবল করতে চায়। সুতরাং সপ্তাহের একটি বিকেলের চার ঘণ্টা তাকে নিতান্তই অনিচ্ছায় অকেজো বোমা আর গোলাবারুদের ভাগাড়ে সামান্য আলোর খসখসে পরিবেশে কাজ করতে হয়, যেখানে টেলিস্ক্রিনের সঙ্গীত আর হাতুড়ি পেটার ঠক ঠক শব্দ একাকার হয়ে থাকে।
বিধ্বস্ত গির্জার সেই ঘণ্টাঘরে যেদিন দেখা হলো, সেদিন তারা এই অভিব্যক্তিহীন কথপোকথনের নির্যাস থেকে বুঝে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় যেটুকু ঘাটতি থেকে গেছে তা পূরণ করে নেয়। জ্বলজ্বলে রোদের এক বিকেল ছিল সেটি। ঘণ্টিঘরের বর্গাকার খুঁপড়িতে বাতাস যেন থমকে ছিল, আর ভীষণ তপ্ত। সঙ্গে মিশে ছিল কবুতরের বিষ্ঠার তীব্র গন্ধ। ধূলিমাখা, পাখির বিষ্ঠাভরা মেঝেতে বসে ওরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে কাটিয়ে দেয়। একটু পরপর একেকবার একেক জন মাথা তুলে অ্যারোস্লিটের ছিদ্রপথে চোখ ফেলে দেখে নিচ্ছিল, কেউ এসে যায় কিনা।
জুলিয়ার এখন ২৬। আরও গোটা ত্রিশেক মেয়ের সঙ্গে একটি হোস্টেলে থাকে (সর্বদাই নারীর বোঁটকা গন্ধের মাঝে বাস! নারীকে ঘৃণা করিই কী করে! কথার মাঝে লঘুবন্ধনী দিয়ে টেনে টেনে বলল সে)। আর তার অনুমানই সত্য, ফিকশন ডিপার্টমেন্টে উপন্যাস লেখার মেশিনে কাজ করে সে। নিজের কাজ তার খুব পছন্দ, মজাও পায়। একটি বিশাল বৈদ্যুতিক যন্ত্র চালানো আর ঠিকঠাক করাই তার কাজ। যন্ত্রগুলোর সঙ্গে কাজ করার সময় হাতে কালি-ঝুলি লাগাতে সে ভালোই বোধ করে। একেকটি উপন্যাস কম্পোজ করা থেকে শুরু করে প্ল্যানিং কমিটি যে সাধারণ নির্দেশনাগুলো দেয় তা আর পুনর্লেখক দল যেভাবে তা চূড়ান্ত করে তার প্রতিটি ধাপে ধাপে কাজের ফিরিস্তি তার জানা। তবে এই নিখুঁত পণ্যে তার কোনও আকর্ষণ নেই। এগুলো পড়ার ব্যাপারেও নেই কোনও আগ্রহ। পাউরুটির জ্যাম বা জুতোর ফিতার মত একটি পণ্য ছাড়া বইকে আর কিছুই মনে করে না সে।
ষাটের দশকের গোড়ার দিককার আগের কোনও স্মৃতিই তার নেই। একটি মাত্র লোককে সে বিপ্লবের আগের দিনগুলোর কথা খুব বলতে শুনত, সে তার দাদাভাই। তার যখন আট বছর তখনই দাদু হাপিস হয়ে যান। স্কুলে হকি দলের অধিনায়ক ছিল সে আর পরপর দুবছর শরীর চর্চায় ট্রফি জিতেছিল। স্পাইজে দলনেতা ছিল আর জুনিয়র এন্টি-সেক্স লিগে যোগদানের আগে ইয়ুথ লিগে শাখা-সচিবের পদে ছিল। দক্ষ হিসেবে অত্যন্ত সুনামের কারণে তাকে একবার ফিকশন বিভাগের উপ-বিভাগ পর্নোসেকেও কাজ দেওয়া হয়েছিল। সস্তা পর্নোগ্রাফি বানিয়ে প্রোলদের মাঝে বিতরণই যার কাজ। উপ-বিভাগটিতে যারা কাজ করে ওরা এর নাম দিয়েছে গোবর-ঘর (মাক হাউজ)। ওখানে এক বছর কাজ করেছিল। ‘পাছা চাপড়ানোর গল্প’ ‘মেয়েদের স্কুলে এক রাত’ ধরনের নাম দিয়ে বুকলেট বানিয়ে সিল করা প্যাকেটে ভরে তা যুবক প্রলেতারিয়েতদের জন্য কিনে ফেলার নাগালের মধ্যে পাঠানো নিশ্চিত করাই কাজ। আর যেন অবৈধ কিছু একটা কিনছে এমন একটা মনোভাব নিয়েই তারা এগুলো হরদম কেনে।
‘বইগুলো আদতে কেমন?’—কৌতূহলের প্রশ্ন উইনস্টনের।
‘আরে ভীষণ ফালতু। সত্যিকার অর্থেই বিরক্তিকর। মোটে ছয় পাতার কিন্তু ওগুলোই ওদের বড় বাণিজ্য। আমি কেবল কেলিডোস্কোপে কাজ করতাম। পুনর্লেখকদের দলে ছিলাম না। ওসব পর্নোসাহিত্য আমার আসে না, প্রিয়তম—আর ওজন্য ঠিক আমি নই। ’
বিস্ময়ের সাথে সে আরও জানলো এই পর্নোসেকে যারা কাজ করে তাদের কর্তাব্যক্তিরা ছাড়া সবাই তরুণী। তত্ত্বটা হচ্ছে, নারীদের চেয়ে পুরুষদের যৌনাকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণক্ষমতা কম। আর সে কারণে যে ঘিনঘিনে বিষয় নিয়ে তাদের কাজ করতে হয় তাতে তাদের নিজেদের জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে।
‘ওরা এমনকি বিবাহিত নারীদেরও নিতে চায় না, বলল জুলিয়া। মেয়েদের সবসময় এতটাই খাঁটি হয়ে থাকতে হবে। তবে, এখানে অবশ্য একজন আছে যে মোটেই খাঁটি নয়। ’
ওর প্রথম প্রেম হয় ষোল বছর বয়সে। প্রেমিকটি পার্টির সদস্য ছিল, বয়স ষাট। পরে গ্রেফতার এড়াতে আত্মহত্যা করে সে। ‘ঠিক কাজটিই করেছে’—বলল জুলিয়া, ‘নয়ত ওর স্বীকারোক্তি থেকেই ওরা আমার নামটি জেনে যেত। ’ এরপর আরও বেশ কয়েকটি প্রেম হয়েছে। জীবনটাকে সে সহজ করেই দেখে।
তুমি একটি ভালো সময় কাটাতে চাও তো; ‘ওরা’—মানে পার্টি চাইবে তোমাকে থামিয়ে দিতে; সুতরাং তুমি নিয়মগুলো ভাঙ্গো, যত পার তত ভাঙ্গো। বিষয়টিকে সে স্রেফ এমন করেই ভাবতে চায়, ‘ওরা’ তোমার আনন্দ ছিনিয়ে নিতে চাইছে, অতএব তুমি যা খুশি করে যাও, তবে গ্রেফতার এড়িয়ে। দলকে সে ঘৃণা করে, আর সে ঘৃণার প্রকাশ ঘটাতে সবচেয়ে ঘৃণিত শব্দগুলোই ব্যবহার করে। তবে তার মুখে সস্তা ও সাধারণ সমালোচনাগুলো শোনা যাবে না। তার নিজের জীবনে প্রভাব না ফেললে পার্টির কোনও মতবাদেই তার আপত্তি বা আগ্রহ নেই। উইনস্টন দেখেছে, দৈনন্দিন ব্যবহারে মিশে গেছে এমন কিছু শব্দ ছাড়া নিউস্পিকের ব্যবহার নেই জুলিয়ার কথা-বার্তায়। ব্রাদারহুডের নাম সে কখনওই শোনেনি, আর এর অস্তিত্ব আদৌ আছে বলে বিশ্বাসও করতে চায় না। পার্টির বিরুদ্ধে যে কোনও বিদ্রোহই হোকনা কেন—তা ব্যর্থ হতে বাধ্য, আর তা বোকামি ছাড়া কিছুই হবে না, এমনটাই মনে করে সে। সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে, এই সব নিয়মের মধ্যে থেকেই নিয়ম ভেঙ্গে চলা।
উইনস্টনের জানতে ইচ্ছা করে, এই মেয়েটির মত আরও কতজন আছে এই তরুণ প্রজন্মে যারা বিপ্লবের বিশ্বেই বড় হয়ে উঠেছে, আর পার্টিকে বদলানো যাবে না, আকাশসম পার্টির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাও যাবে না—এমন মনোভাব পোষণ করে অথচ তারাও এর নীতিকে ধোকা দিয়ে চলেছে, ঠিক খরগোশ যেমন কুকুরকে ধোকা দেয়।
দুজনের মধ্যে বিয়ের সম্ভাবনা নিয়ে ওদের কোনও কথা হয়নি। এমন একটি বিষয় তখন ভাবনায় আনার চেয়েও অনেক দূরের। কোনও কাল্পনিক কমিটিও এমন একটি বিয়ে মেনে নেবে না, এমনকি উইনস্টনের স্ত্রী ক্যাথরিন যদি তার থেকে মুক্ত হয়েও যায়, তারপরেও না। দিবাস্বপ্নের মতই অসাড় সে ভাবনা।
‘ও দেখতে কেমন ছিল, তোমার স্ত্রী?’—বলল জুলিয়া।
‘ও ছিল—নিউস্পিকে একটা শব্দ আছে না… গুডথিংকফুল? মানে হচ্ছে প্রকৃতঅর্থেই শুদ্ধাচারী, খারাপ কিছু ভাবতেও পারে না। ’
‘না, শব্দটি আমার জানা নেই, তবে আমি এ ধরনের মানুষদের চিনি, খুব ভালো করেই চিনি। ’
জুলিয়াকে বিবাহিত জীবনের গল্প শোনাতে লাগল উইনস্টন, তবে কৌতূহল উদ্রেক করার মত করে, সেই বরং উল্টো বেশি কথা বলল, এমন সব কিছু বলল যেন আগে থেকে মূল মূল দিকগুলো তারা জানা। জুলিয়াই তাকে বর্ণনা করল, যেন সবই সে দেখেছে কিংবা অনুভব করেছে। তার ছোঁয়া পেলে ক্যাথরিনের শরীরটা কিভাবে শক্ত হয়ে যেত, কিভাবে সে সর্বশক্তি দিয়ে তাকে দূরে ঠেলত—এগুলোই বলে যাচ্ছিল, নিজের দুই বাহু দিয়ে উইনস্টনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেই এসব বলছিল। জুলিয়ার সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলতে কোনও অস্বাভাবিকতা বোধ করছিল না সে, ক্যাথরিন তার জীবনের এক ব্যথাতুর স্মৃতি, আর বিস্বাদময় এক নাম।
‘এরপরও সব মেনে নেওয়া যেত যদি একটি বিষয় সামনে না আসত’—বলল সে। সে তাকে জানালো, প্রতি সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট রাতে ক্যাথরিন যেভাবে তাকে বাধ্য করত কাজটি করতে। ‘ও কাজটি ঘৃণা করত, কিন্তু কোনভাবেই কাজটি না করার কথা মেনে নিত না। ও বলত… তুমি ধারণাও করতে পারবে না কি বলত। ’
‘পার্টির প্রতি আমাদের কর্তব্য’—দ্রুতই বলল জুলিয়া।
‘তুমি কী করে জানলে?’
‘আমিও স্কুলে পড়েছি, প্রিয়তম। ষোল বছরের বেশি বয়সীদের জন্য মাসে একদিন যৌনতা বিষয়ক আলোচনা শুনতে হতো। আর যুব আন্দোলনেও রয়েছে এ বিষয়ক আলোচনা। ওরা বছরের পর বছর ধরে তোমার ভেতরে কথাগুলো ঢুকিয়ে দেয়। আমি বলব অনেক ক্ষেত্রেই এই প্রচেষ্টা সফল হয়। তবে তুমি কখনওই বলতে পারবে না, লোকেরা এতটাই কপট। ’
বিষয়টি নিয়ে কথা টেনে বাড়ালো জুলিয়া। ধীরে ধীরে আলোচনা যৌনাচার নিয়ে তার নিজের ভাবনার দিকে মোড় নিল। আর এ প্রসঙ্গ আসতেই তার কথার ধারও বাড়লো। উইনস্টন না পারলেও, পার্টির যৌনতা বিষয়ক শুদ্ধিবাদের ভেতরের অর্থটা সে ঠিকই ধরতে পারে। যৌনাচার মানুষকে একটি ভিন্ন জগতে নিয়ে যায় যেখানে পার্টির নিয়ন্ত্রণ চলে না, আর সে কারণে যৌনতাকেই বিলুপ্ত করে দিতে হবে, বিষয়টি স্রেফ এমন নয়। এর চেয়েও বড় গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যৌনতার অপ্রাপ্তি এক ধরনের স্নায়ুবৈকল্য সৃষ্টি করে, আর সেটাই কাম্য, কারণ এই বৈকল্যই তখন যুদ্ধ-জ্বর আর নেতৃত্বের স্তুতিতে কাজে লাগে। কথাগুলো ঠিক এভাবে বলল সে:
‘যখন তুমি ভালোবাসাবাসি করছো, তোমার শক্তি খরচ হচ্ছে, আর কাজটি করার পরে এক ধরনের খুশি খুশি বোধ করছো, তখন কোনও কিছুতেই তুমি আর বিক্ষুব্ধ হবে না। কিন্তু তোমার এমন অনুভূতি ওরা ঠিক মেনে নিতে পারে না। ওরা চায় তুমি সবসময়ই তোমার শক্তি ধরে রাখো। এইসব উপর-নিচে ছোটাছুটি, খুশিতে পতাকা ওড়ানোর মধ্য দিয়ে যৌনতা তোমার কাছে টক টক লাগুক। কিন্তু ভালোবেসে তুমি যদি নিজেই ভিতরে ভিতরে খুশি বোধ করতে থাকো তখন বিগ ব্রাদারকে নিয়ে, ত্রি-বার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে, দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচি নিয়ে এবং ওদের এমন আরও সব ফালতু বিষয় নিয়ে তোমার উত্তেজনা বোধ করার ফুসরতই থাকবে কোথায়?
কথাগুলো খুব সত্য, ভাবল সে। কৌমার্য আর রাজনৈতিক শুদ্ধিবাদের মধ্যে সরাসরি একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। কিন্তু প্রশ্ন, এই যে সদস্যদের সঠিক পথে রাখতে তাদের মধ্যে ভীতি, ঘৃণা আর নির্বোধের আনুগত্য চাওয়া হচ্ছে তা পার্টির জন্য কতটাই আর চালিকাশক্তি হয়ে থাকবে? যৌনতায় আগ্রহ দলের জন্য বিপজ্জনক, আর দল তা নিয়ন্ত্রণেও নিতে পেরেছে।
একই ধরনের কৌশল তারা নিয়েছে পিতৃ-মাতৃত্বের অভিব্যক্তিতে, মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কে। পরিবার ব্যবস্থা পুরোপুরি বিলোপ করে দেওয়া হচ্ছে না। বরং চাওয়া হচ্ছে বাবা-মা যেন তাদের সন্তানদের প্রতি স্নেহবাৎসল্যের সেকেলে মনোভাবটাই বহাল রাখেন। আর অন্যদিকে শিশুদেরকে অত্যন্ত প্রক্রিয়াগতভাবে করে তোলা হচ্ছে বাবা-মায়ের বিরোধী। মা-বাবার ওপর চরগিরি করে তাদের গোপন অসন্তোষ বা ব্যত্যয় থাকলে রিপোর্ট করে দেবে, এটাই শিক্ষা তাদের। এতে পরিবারগুলো হয়ে উঠছে থট পুলিশের বর্ধিতাংশ। এ এমন ব্যবস্থা যেখানে প্রতিটি মানুষ দিবা-রাত্রি প্রতিটি ক্ষণই চর পরিবেষ্টিত। যাদের তারা চেনে কিন্তু কিছুই বলতে পারে না।
হঠাৎই তার মনে আবার ভর করল ক্যথরিন। ক্যাথরিন যদি বোকা না হতো, তাহলে তার এসব অশুদ্ধবাদী মতগুলো ধরে ফেলত আর প্রশ্নাতীত ভাবেই তা থট পুলিশে জানিয়ে দিত। তবে এই মুহূর্তে তাকে মনে পড়ার সত্যিকারের কারণ এই বিকেলের খরতাপ, যা তার কপালে জমিয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। যে ঘটনাটি ঘটেছিল, বরং বলা যায় ঘটতে গিয়েও ঘটতে পারেনি, সেটিই এখন জুলিয়াকে বলতে শুরু করেছে সে। এগারো বছর আগে সেটিও ছিল এমনই এক ঘাম ঝড়ানো বিকেল।
বিয়ে হয়েছে তখন মোটে তিন-চার মাস হবে। কেন্টের দিকে কোনও একটি এলাকায় কমিউনিটি চাঙ্গা করার কর্মসূচিতে গিয়ে দুজনই পথ হারিয়ে ফেলে। দলের অন্যদের চেয়ে মিনিট কয়েক পিছিয়ে পড়েছিল। কিন্তু একটা ভুল বাঁক নিয়ে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দুজন। আর এক পর্যায়ে আবিষ্কার করে পুরোনো একটি চুনা পাথরের কোয়ারির পাশে দিয়ে যাচ্ছে তারা। দশ কিংবা বিশ মিটার নিচে বড় বড় পাথর দেখা যাচ্ছে। আশেপাশে কারও দেখা মিলছে না যে পথ জানতে চাইবে।
হারিয়ে গেছে এটা বুঝতে পেরে ক্যাথরিন বেশ অস্বস্তি বোধ করছিল। ভিড়-ভাট্টার বাইরে, এমনকি দলের সদস্যদের জটলার বাইরে গেলেই ওর মধ্যে একটা অপরাধ বোধ কাজ করতে থাকে। কত দ্রুত ফেরা যায় সেই ভাবনায় এদিক সেদিক পথের খোঁজ করছিল। তখনই উইনস্টনের চোখে পড়ল পাথরের ফাটল ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠা গাছে গুচ্ছগুচ্ছ ঘাসফুল ফুটে আছে। একগুচ্ছ ফুলে আবার দুটি রঙের মিশ্রণ, কতকটা টকটকে লাল আর বাকিটা ইটরঙা যা একই মূল থেকে গজিয়ে গাছে ধরে আছে। এমনটা আর কখনওই চোখে পড়েনি তার। সে ক্যাথরিনকে ডাকল ফুলগুলো দেখার জন্য।
‘দ্যাখো ক্যাথরিন! এই ফুলগুলো দ্যাখো। ওগুলো একই মূল থেকে গজিয়ে উঠেছে। তুমি দেখতে পাচ্ছো, ফুলগুলোর যে দুটি ভিন্ন রঙ?’
ততক্ষণে ক্যাথরিন চোখ ঘুরিয়ে ফিরে যেতে ধরেও আবার ঘুরল, তবে চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। তারপরেও সে পাথরের ফাটলটির দিকে তাকাল আর ঝুঁকে পড়ে দেখার চেষ্টা করছিল কী সে দেখাতে চাইছে। উইনস্টন ঠিক তার পেছনটাতে দাঁড়ানো। ক্যাথরিন যাতে পড়ে না যায় সে জন্য দুই হাতে তার কোমর ধরে রাখল। তখনই তার মাথায় এলো, কী দারুণ একা এখানে তারা দুজন। চারিদিকে কোনও মানবসন্তানের অস্তিত্ব নেই, একটি গাছের পাতাও নড়ছে না, এমনকি নেই কোনও পাখির ডাকও। এমন একটি স্থানে গোপন মাইক্রোফোন বসানো থাকার সম্ভাবনাও ক্ষীণ, আর যদি মাইক্রোফোন থাকেও তা শব্দই কেবল ধারণ করবে, আর কিছু নয়। প্রচণ্ডতম গরমে স্থির হয়ে থাকা এক বিকেল। তার মুখমণ্ডলেও জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আর তখনই আরেকটি ভাবনা এসে মনের গহীনে আঘাত হানলো…
ওকে ধরে একটা ধাক্কা দিলে না কেন?’—প্রশ্ন জুলিয়ার। ‘আমি হলে দিতাম। ’
‘হ্যাঁ প্রিয়তমা, তুমি হলে দিতে। আমিও দিতাম, যদি আমি ঠিক এখন যেমন তখনও তেমনটি থাকতাম। অথবা আমি হয়ত দিতামই—আমি ঠিক নিশ্চিত নই। ’
‘কাজটি না করার জন্য এখন কি তোমার দুঃখবোধ হয়?’
‘হ্যাঁ, সবমিলিয়ে আমি কাজটি না করার জন্য দুঃখবোধই করি। ’
ধূলাকীর্ণ মেঝেতে ওরা পাশাপাশি বসে। জুলিয়াকে বাহুর কাছে টেনে আনলো সে। মাথাটি কাঁধের ওপর রাখল, কবুতরের বিষ্ঠার তীব্রতাকে হার মানিয়ে চুলের দারুণ গন্ধ এসে নাকে লাগল। তরুণী এই মেয়ে, ভাবল সে, জীবন থেকে এখনও তার অনেক কিছুই জানার আছে। এই মেয়ে জানে না, ভিন্ন মতের একটি মানুষকে খাদের মধ্যে ফেলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে কিছুই সমাধান হওয়ার নয়।
‘আসলে তাতে কিছু যেয়ে আসত না’—বলল সে।
‘তাহলে কাজটি না করার জন্য এখন তোমার দুঃখবোধ কেন?’
‘একটাই কারণ, আমি নেতিবাচকতার চেয়ে ইতিবাচকতাকেই বেছে নেই। এই যে খেলা আমরা খেলছি, এতে আমরা জয়ী হব না। তারপরেও কিছু কিছু পরাজয় রয়েছে যা অন্য পরাজয়ের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো, এটুকুই, আর কিছু না। ’
ওর কাঁধের ঝাকুনিতে এই কথায় তার দ্বিমতের প্রকাশই টের পেল সে। যখনই সে এ ধরনের কিছু বলে ও তার বিরোধিতা করে। ব্যক্তির হারই প্রকৃতির বিধান, এ কথা সে মানতে চায় না। একভাবে সে বুঝতেও পারে যে, সে নিজেই ভেঙ্গে গেছে, খুব শিগগিরই, নয়ত আরও পরে একদিন থট পুলিশ তাকে ধরে ফেলবে আর হত্যা করবে। কিন্তু তার মনের অপর অংশটি দিয়ে সে প্রাণপনে বিশ্বাস করতে চায়, কোনও না কোনওভাবে একটি গোপন জগত গড়ে তোলা সম্ভব, যেখানে তুমি তোমার মন যা চায় তাই করতে পারবে। মনে করে, এ জন্য প্রয়োজন স্রেফ ভাগ্যের সহায়, চাতুর্য আর দৃঢ়তা। সে বুঝতেই পারে না, সুখ বলে আর কিছু নেই, বিজয় যদি থেকেও থাকে তা এখনও সুদূরে, আপনার-আমার মৃত্যুর অনেক অনেক পরের বিষয়। এখন পার্টির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, কল্পনায় নিজের মৃতদেহ দেখারই সামিল।
‘আমরা সবাই মৃত’—বলল সে।
‘না আমরা এখনো মরি নি’—বিরসবদনে বলল জুলিয়া।
‘শারীরিকভাবে মরিনি। ছয় মাস, এক বছর… পাঁচ বছরেও হয়ত মরব না। আমার মৃত্যুভয় আছে। তোমার বয়স কম, বোধ করি তোমার ভয়টা আমার চেয়েও বেশি। নিঃসন্দেহে আমরা যতক্ষণ সম্ভব আমাদের কসরত চালিয়ে যাব। কিন্তু তাতে পরিবর্তন খুব কমই আসবে। একটি মানব সন্তান ঠিক যতক্ষণ মানব সন্তান হয়ে থাকে, ততক্ষণ তাদের কাছে জীবন আর মৃত্যু সমান কথা। ’
‘আহ, ফালতু! তুমি কি আমার সঙ্গে শুতে চাও নাকি আমার কঙ্কালের সঙ্গে? এই যে আমরা বেঁচে আছি, একে তুমি উপভোগ করো না? এই যে আমাদের অনুভূতিগুলো, ওগুলো তোমার ভালো লাগে না। এই যে এখানে আমি, এই আমার হাত, এই আমার পা, সত্যিকারের আমি, পরিপূর্ণ আমি, এক জীবিত আমি! একি তোমার ভালো লাগে না?’
নিজেকে আরও একটু ঘন করে উইনস্টনের শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে নিল জুলিয়া। আলখেল্লার ভেতর থেকেই তার পীনোন্নত স্তনের চাপ বুকে লাগছে। যৌবন ভরা একটি দেহ ধীরে ধীরে তার শরীরের আরও গভীরে ঢুকে পড়তে লাগল।
‘হ্যাঁ, আমার ভালো লাগে’—বলল সে।
‘তাহলে মৃত্যুর কথা আর মুখেও আনবে না। আর এখন শোনো, আমার প্রিয়তম, আমাদের পরের দেখা কোথায় হবে সেটাও তো ঠিক করতে হবে। আমরা সেই জঙ্গলে আরেকবার যেতে পারি। বড় সড় একটা বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে ঢিবিটিকে। এবার কিন্তু তোমাকে আরেকটি ভিন্ন পথে সেখানে যেতে হবে। ট্রেনে যেতে পারো—কিন্তু, আমিই তোমাকে দেখাচ্ছি কিভাবে যাবে। ’
নিজের অভ্যাসগত ভঙ্গিমায় ধুলো জড়ো করে একটি চৌকার মত স্থান বানিয়ে নিল মেঝেতে। আর কবুতরের একটি পালক দিয়ে সেখানে পথের মানচিত্র আঁকতে শুরু করল জুলিয়া।
অধ্যায় ৪
চ্যারিংটনের দোকানের দোতলার অগোছালো কামরার চারিদিকে একদফা চোখ ঘুরিয়ে নিল উইনস্টন। জানালার পাশে বিশালাকার বিছানাটি পাতা, তাতে একটি ছেঁড়া কম্বল আর কাভারবিহীন কোলবালিশ পড়ে আছে। তাকের ওপর ১২ ঘণ্টা ডায়ালের পুরানা আমলের ঘড়িটি টিক টিক করে চলেছে। অন্য কোণায়, ভাঁজ করে রাখার উপযোগী সেই গেটলেগ টেবিলটি পাতা, যার ওপরে আধো আঁধারেও হালকা ঝিলিক দিচ্ছে স্বচ্ছ কাচের পেপারওয়েট। ফেন্ডারের ভেতরে একটি ভাঙাচোরা তেলের স্টোভ, একটি সসপ্যান, দুটি কাপ। মি. চ্যারিংটন ওগুলো দিয়ে গেছেন। উইনস্টন চুল্লিটি জ্বালাল আর প্যানে করে পানি সিদ্ধ দিল। ইনভেলপ ভরে সঙ্গে করে ভিক্টরি কফি আর কিছু স্যাকারিন ট্যাবলেট নিয়ে এসেছে। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল পাঁচটা বিশ, তবে প্রকৃত সময় সন্ধ্যা সাতটা বিশ মিনিট আর জুলিয়ার পৌঁছার কথা রাত সাড়ে নয়টায়।
স্রেফ বোকামি, তার মন বলে চলেছে, সচেতনভাবে, অকারণে, আত্মঘাতী এক বোকামির সিদ্ধান্তই সে নিয়েছে। পার্টির সদস্যরা যেসব অপরাধ করে ঢেকে রাখতে পারে তার মধ্যে এটি হবে সবচেয়ে অসম্ভবের। গেটলেগ টেবিলের পাটাতনে পেতে রাখা কাচের পেপারওয়েটের ভেতরে ভেসে ওঠা একটি দৃশ্যের প্রতিচ্ছবি চোখে পড়ার পরপরই ভাবনাটা মাথায় খেলে যায় তার। যেমনটা ভেবে রেখেছিল, কামরাটি ভাড়া দিতে একটুও ঝামেলা করেননি মি. চ্যারিংটন। এতে করে যে গোটা কয় ডলার তার পকেটে ঢুকছে তাতেই সে যারপরনাই খুশি। ভালোবাসার মেয়েটিরে নিয়ে এখানে সময় কাটাবে স্রেফ এই কারণেই উইনস্টন কামরাটি ভাড়া নিতে চায়, সে কথায়ও তার আপত্তি কিংবা বিস্ময় কোনওটাই ছিল না। বরং একটু অদূরে দৃষ্টি ফেলে এমনভাবে কথা বলে গেলেন যেন এ জগতেই নেই তিনি। মুখে শুধু বললেন, একান্ততা খুবই দামি একটা বিষয়। প্রত্যেকেই এমন একটি স্থান চায় যেখানে সে মাঝেমধ্যে একান্তে সময় কাটাতে পারে। আর যখন সে স্থানটি মিলে যাবে, তখন অন্য কেউ যদি সে কথা জেনেও থাকে তাকে—তা নিজের মধ্যেই রাখতে হয়। এমনভাবেই তিনি কথাগুলো বলছিলেন যেন তখনই তিনি অনেকটা অস্তিত্বহীন। জানালেন এই বাড়িতে ঢোকার দুটি দরজা আছে, অপরটি পেছনের আঙ্গিনার দিকে, ওদিকটা দিয়ে চলাচলের একটি পথও আছে।
জানালার নিচে বাইরে কেউ একজন গান ধরেছে। মসলিনের পর্দার পেছনে নিজেকে ভালোভাবে আড়াল করে উঁকি দিল উইনস্টন। জুনের আকাশে তখনও উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে সূর্য। আর প্রখর রোদে ভরে থাকা নিচের আঙিনায় এক দৈত্যাকায় নারী, নরম্যানের খাম্বার মতই কঠিন-শক্ত-সামর্থ্য, লালচে বাদামি হাতের ত্বক, মোটা অ্যাপ্রোনের ওপরে ফিতা দিয়ে কোমর বাঁধা। কাপড় ধোয়ার বালতি থেকে একেকবার হাত ভরে নিয়ে একটু দূরে আড়াআড়ি টানিয়ে রাখা কাপড় শুকানোর রশি পর্যন্ত যাচ্ছেন আর ক্লিপ দিয়ে ছোট ছোট বর্গাকার বস্তুগুলো রশিতে লটকিয়ে আবার বালতির কাছে ফিরছেন। উইনস্টন বুঝতে পারল ওগুলো শিশুদের ডায়াপার হবে। আর কাপড়ের ক্লিপ যখন দাঁতে চেপে রাখছেন তখন গান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আবার যখন সরিয়ে নিচ্ছেন চড়া গলায় শুরু হচ্ছে সেই গান—
নিষ্ফল এক অলীক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়,
ফুরিয়ে গেল যেভাবে এপ্রিল ফুরোয়
কিন্তু সেই চাহনি, সেই শব্দ আর স্বপ্ন
হরণ করে নিয়ে যায় আমার হৃদয়।
এই গান গত ক’সপ্তাহ ধরে লন্ডন জুড়ে বাজছে। সঙ্গীত বিভাগের একটি উপবিভাগ প্রোলদের উপকারে যে অসংখ্য গান প্রকাশ করেছে—এটি তার একটি। এই গান রচনায় কোনও মানব সন্তানের যোগসাজশ নেই। ভার্সিফিকেটর নামের একটি যন্ত্রের সম্পূর্ণ নিজস্ব সৃষ্টি এই গান। কিন্তু এই নারী গানটিকে এমন ছন্দময় করে গাইছেন যেন ভয়াবহ ফালতু একটি বিষয় সুমধুর হয়ে ফুটেছে তার কণ্ঠে। সে এই নারীর গান শুনছে আর কানে আসছে তার জুতোর ফটফট শব্দ, রাস্তা থেকে ভেসে আসা শিশুদের চিৎকার, দূরে কোথাও রাস্তায় গাড়ি চলার গর্জন। তবে এতকিছুর পরেও তার কক্ষটি বেশ শান্ত-নীরব। টেলিস্ক্রিনের অনুপস্থিতিই ধন্যবাদার্হ।
নির্বুদ্ধিতা, নির্বুদ্ধিতা, নির্বুদ্ধিতা! আবারও ভাবল সে। এক-দুই সপ্তাহর বেশি সময় এখানে আসা-যাওয়া করবে আর ধরা পড়বে না সেটা অচিন্তনীয়। আর এমনি নাকের ডগায় একেবারে নিজেদের করে একটা গোপন আস্তানা গেড়ে নেওয়া তাদের দুজনের জন্যই ভীষণ রকমের বাড়াবাড়ি। ওই ভাঙ্গা গির্জার ঘণ্টিঘরে দেখা হওয়ার পর আরেকটি মোলাকাত সত্যিই অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। ঘৃণা সপ্তাহ ঘনিয়ে আসার কারণে দিনের কর্মঘণ্টা বেড়ে গেল। এখনও একমাসের বেশি বাকি, তাও প্রস্তুতির বিশাল আর জটিল সব কর্মযজ্ঞ চলছে, ফলে সবারই বেশি সময় ধরে কাজ করতে হছে। অবশেষে একটি বিকেলে তাদের দুজনেরই দেখা করার ফুসরত মিলল। ঠিক করল ওই জঙ্গলেই ফের যাবে। এর ঠিক আগের সন্ধ্যায় রাস্তায় তাদের সংক্ষিপ্ত একটি সাক্ষাতের সুযোগ মিলল। আগের মতই ভিড়ের মধ্যে দুজন হাঁটছে। কিন্তু উইনস্টন জুলিয়ার দিকে তাকাচ্ছে না বললেই চলে। এরই মধ্যে খুবই ছোট্ট একটি চাহনিতে তার মনে হলো মেয়েটি আরও ফ্যাকাশে আরও মলিন হয়ে গেছে।
‘সবকিছুই বাতিল’—কথা বলার প্রথম সুযোগটি পেয়েই বিড়বিড় করে বলল জুলিয়া। ‘আমি বলছি, আগামীকালের কথা। ’
‘মানে?’
‘আগামীকাল বিকেলে। আমি আসতে পারছি না। ’
‘কিন্তু কেন?’
‘কারণ স্বাভাবিক! ব্যাপারটি এবার একটু আগেভাগে শুরু হয়ে গেছে। ’
ক্ষণিকের জন্য হলেও ভীষণ রাগ হলো উইনস্টনের। সে জানে গত একমাসে জুলিয়াকে পাওয়ার ক্ষেত্রে তার চাওয়ার ধরনগুলো পাল্টে গেছে। গোড়ার দিকে একটা ভোগের সুখাশক্তি কাজ করত। ওদের প্রথম দিনের ভালোবাসাবাসি ছিল স্রেফ ইচ্ছাপূরণ। কিন্তু দ্বিতীয়বারের পর বিষয়টি কেমন যেন ভিন্ন কিছু হয়ে উঠেছে। জুলিয়ার চুলের গন্ধ, ঠোঁটের স্বাদ, ত্বকের অনুভূতি সবকিছু যেন তার ভেতরে ঢুকে পড়েছে, অথবা ওগুলোই যেন তাকে ঘিরে থাকে। ও এখন তার জন্য হয়ে উঠেছে বড় প্রয়োজন, ওকে যে সে কেবল চায়, তা-ই নয়, মনে করে ওর ওপরই যেন তার সব অধিকার। তবে ঠিক এই মুহূর্তে ভিড়ের চাপই তাদের ঠেলে কাছাকাছি করে দিল আর দৈবক্রমে তাদের হাতেরও মিলন হলো। জুলিয়া তার আঙ্গুলের ডগায় উইনস্টনের হাতের তালুতে আঁকিবুকি করে যে ছোঁয়া দিল তাতে আহ্বান ছিল কিন্তু সে আহ্বান আকাঙ্ক্ষার নয়, ভালোবাসার।
তার ভেতরে ভাবনা কাজ করছে, যখন কেউ কোনও নারীর সঙ্গে বাস করে তখন এসব হতাশা স্বাভাবিক হয়েই ধরা দেয়, নিত্য ঘটনার অংশ হয়ে ওঠে, আর এখন এক গভীর উষ্ণতার অনুভূতি কাজ করছে, যা জুলিয়াকে নিয়ে তার ভেতরে এর আগে কখনওই হয়নি। তার মনে হচ্ছে অন্তত বছর দশেক ধরেই তাদের দাম্পত্য জীবন। তার মনে হচ্ছে অনেক আগে থেকেই তারা রাস্তায় হাত ধরাধরি করে হেঁটে আসছে, এখনকার মত গোপনে না, প্রকাশ্যে তারা রাস্তায় হাঁটে, দোকানে যায়, ঘর-গৃহস্থালির টুকিটাকি জিনিসপত্র কেনে।
তার আরও মনে হলো, একটি জায়গা যদি থাকত—যেখানে তারা একসঙ্গে থাকতে পারে, যেখানে কোনও বাধা থাকবে না, সংশয় থাকবে না, যখন চাইবে একসঙ্গে কাটাতে পারবে। এসব নিয়ে যখন ভাবছিল ঠিক তখনই নয়, ওর পরের দিন তার মাথায় মি. চ্যারিংটনের দোতলার কামরাটি ভাড়া নেওয়ার আইডিয়াটি এলো। কথাটি জুলিয়ার কাছে পাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে রাজি হয়ে গেল, এতটা সহজে রাজি হবে বলে সে ভাবেও নি। তারা দুজনেই জানে এই সিদ্ধান্ত স্রেফ নির্বোধের পাগলামো। অনেকটা এমন যে, দুজনে মিলেই কবরের দিকে পা বাড়ালো। বিছানার কিনারায় পা ঝুলিয়ে বসে আজ আরও একবার সে ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ের কয়েদখানাগুলোর কথা ভাবল। এমন অবধারিত ভীতি কী করেই কারও সচেতন মনে এমন আসা-যাওয়া করে—সে এক কৌতূহলেরই বিষয়।
এমনটাই। ভবিষ্যৎ এভাবেই নির্ধারিত। ৯৯’র পরে যেমন আসে ১০০ ঠিক তেমন নিশ্চয়তায় নির্ধারিত হয়ে আছে মৃত্যু। কারও পক্ষেই তা এড়িয়ে যাওয়ার নয়, কেউ কেউ চাইলে বড়জোর কিছুটা সময়ের জন্য স্থগিত করে রাখতে পারে। তবে কেউ যখন মৃত্যুর নিশ্চয়তা জেনেই যায় তখন আর এই বিরতিটা বাড়াতে চায় না, বরং যত তাড়াতাড়ি হয়ে যায় সেটাই কাম্য।
নিচের সিঁড়িতে দ্রুত বেয়ে ওঠা পায়ের শব্দ। আর তখনই কক্ষে জুলিয়ার সশব্দ উপস্থিতি। মোটা খাকি রঙের একটি টুলস-ব্যাগ হাতে, মন্ত্রণালয়ে মাঝে মধ্যেই ব্যাগটি ওর হাতে চোখে পড়েছে। একটু এগিয়ে গেল বাহুবন্দি করবে বলে, কিন্তু জুলিয়ার পক্ষ থেকে সমান সাড়া মিলল না, হতে পারে হাতের ব্যাগটিই তার কারণ।
‘আধা সেকেন্ড’—বলল সে। ‘আমি কী এনেছি একটু দেখাতে দাও। তুমি নিশ্চয়ই ওই ঘিনঘিনে ভিক্টরি কফি নিয়ে এসেছো। আমি ভেবেছিলাম তুমি এই কাজই করবে। ওগুলো তুমি এবার ছুঁড়ে ফেলতে পার, কারণ, আমাদের আর ওগুলোর দরকার হচ্ছে না। এগুলো দ্যাখো। ’
হাঁটু গেড়ে বসল জুলিয়া, ঝপ করে ব্যাগটি মেঝেতে রাখল, আর এর উপরের দিকে রাখা কতগুলো স্প্যানার আর স্ক্রু-ড্রাইভার তুলে আনলো। নিচে কতগুলো পরিষ্কার কাগজের প্যাকেট। প্রথম প্যাকেটটি উইনস্টনের দিকে এগিয়ে দিলে এক অদ্ভুত, অস্পষ্ট পরিচিত অনুভূতি বয়ে গেল তার ভেতর। ভেতরে ভারী বালুর মত ঝুরঝুরে কিছু একটা, যেখানেই চাপ পড়ছে, দেবে যাচ্ছে।
‘চিনি নিশ্চয়ই!’—বলল সে।
‘খাঁটি চিনি। স্যাকারিন, চিনি না। আর এখানে এক টুকরো রুটি… খাঁটি সাদা রুটি, আমাদের ওইসব ফালতু রুটি না… এই হলো ছোট এক পট জ্যাম… আর এটা হলো এক টিন দুধ… কিন্তু এটা দ্যাখো… এটা পেয়ে বেশ গর্বই বোধ করছি। বাইরে থেকে একটু পেঁচিয়ে নিতে হয়েছে, কারণ…’
কেন পেঁচিয়ে আনতে হয়েছে সে কারণটা তাকে বলার প্রয়োজন নেই। এর গন্ধ ততক্ষণে গোটা কামরা ভরিয়ে দিয়েছে। কী দারুণ গন্ধ, ছেলে বেলায় নাকে লাগা এমন গন্ধ তার জানা, কিন্তু সে স্মৃতি মাঝে মধ্যে তাকে ধরা দিয়েও হারিয়ে যায়। কোনও একটি পথ জুড়ে গন্ধ উড়ছে, কিন্তু দরজার শব্দে আবার তা উবে যাচ্ছে, অথবা কোনও এক ভিড়ের সড়কে রহস্যজনকভাবে এক লহমার জন্য চোখে পড়ে আবার দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।
‘হুমমম… কফি’—বিড়বিড়িয়ে উঠল সে—‘আসল কফি। ’
‘এটা ইনার পার্টির কফি, এখানে পুরো এক কিলো’—বলল জুলিয়া।
‘পেলে কিভাবে?’
‘এখানে সবই ইনার পার্টির মালামাল। ওই শুয়োরদের কাছে নেই—এমন কিছু নেই, কিছুই না বুঝলে। ওয়েটার আর চাকর-বাকররা চুরি চামারি করে বেচে, ওইগুলোই জোগাড় করেছি। আর দ্যাখো—ছোট এক প্যাকেট চা-ও এনেছি। ’
পায়ের গোড়ালিতে চেপে জুলিয়ার পাশে বসে পড়ল উইনস্টন। প্যাকেটটির এক কোণা আস্তে করে ছিঁড়ে ফেলল।
‘আরে এও তো দেখছি আসল চা, ওইসব জামপাতার চা নয়। ’
‘আজকাল চায়ের বেশ যোগান। ওরা ভারত না যেন কোন দেশ দখল করে নিয়েছে’—অনিশ্চয়তার উচ্চারণ তার। ‘কিন্তু শোন প্রিয়তম। আমি বলছি, এখন উল্টো ঘুরে থাকবে তুমি। তিন মিনিটেও ফিরবে না। যাও বিছানার উল্টো দিকে গিয়ে বসো। কিন্তু জানালার কাছাকাছি যাবে না। আর আমি না বলা পর্যন্ত আমার দিকেও ফিরবে না। ’
মসলিনের পর্দার ভেতর দিয়ে বাইরে ভাবলেশহীন দৃষ্টি ফেলে বসে রইল উইনস্টন। নিচে নরম্যানের খাম্বাকায় সেই নারী তখনও বালতি থেকে কাপড় তুলছে আর শুকোতে দিচ্ছে। তখনই মুখে চেপে রাখা আরও দুটি ক্লিপ বের করে দুটি ডায়াপার ঝুলিয়ে দিল। আর মুখখানা মুক্ত হতেই গানের সুর বেরিয়ে এলো—
বলেছিল ওরা ঠিক হয়ে যাবে
বলেছিল একদিন সবই ভুলে যায়
কিন্তু সেই হাসি, সেই অশ্রুজল আজও
হৃদয়খানি মোর ভেঙ্গে দিয়ে যায়…
মনে হলো পুরো গানটাই হৃদয়ঙ্গম করেছে এই নারী। গ্রীস্মের মিষ্টি হাওয়া তার গান ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দূর থেকে আরও দূরে। দারুণ গলার সুরের সঙ্গে মিশেছে সুখের দুঃখগাথা। কেউ ভাবতেই পারে, জুনের এই বিকেলটা যদি হয়ে ওঠে অনন্ত, আর যদি কাপড়ের যোগান থাকে অফুরান, তাহলে এই নারী ডায়াপার শুকোতে দিতে দিতে আর গান করে কাটিয়ে দিতে পারবে হাজার বছর।
উইনস্টন ভাবল, সে তো কখনওই পার্টির কোনও সদস্যকে এমন একাকীত্বে উদার-উদাস গলায় গান গাইতে শোনেনি। এমনটা প্রথাবিরুদ্ধই কেবল নয় বিপদও ঘটে যেতে পারে। একা একা কথা বললে যে বিপদ—ঠিক তেমনই। হতে পারে মানুষ যখন বুভুক্ষের পর্যায়ে পৌঁছে যায় তখন তাদের কণ্ঠে গান এমন করেই আসে।
‘হ্যাঁ এবার ঘুরতে পার’—বলল জুলিয়া।
ঘুরল উইনস্টন। আর এক সেকেন্ড মোটে চিনতেই পারছিল না তাকে। তার প্রত্যাশা ছিল জুলিয়া নগ্ন হয়ে তাকে আহ্বান জানাবে, কিন্তু সে যা করেছে তা যে নগ্নতার চেয়েও বিস্ময়ের! মুখে রঙ মেখে সেজেছে সে।
নিশ্চয়ই প্রোলেতারিয়েতদের কোনও দোকানে ঢুকে সাজসজ্জার সব উপকরণ কিনে এনেছে এই মেয়ে। ঠোঁটদুটো গাঢ় লাল, গালে রুজ মাখানো, নাকে পাউডার, চোখের নিচেও কিছু একটা লাগিয়েছে—এতে তার চোখদুটো বেশ টানা টানা লাগছে। দক্ষ হাতে হয়নি কোনও কিছুই, কিন্তু উইনস্টনের চোখে তা ধরা পড়ার কথা নয় কারণ এ নিয়ে তার বোধটাও সমৃদ্ধ কিছু নয়। পার্টির কোনও মেয়ের মুখে প্রসাধনি মাখা দেখবে এমনটা এর আগে সে কল্পনাও করেনি। সাজের পর তার মুখটা দেখতে চমৎকার হয়েছে। মুখের কয়েকটি জায়গায় কয়েকটি রঙের ব্যবহার তাকে কেবল আরও সুন্দরীই করেনি, বরং, বলা যায় আরও বেশি নারীসুলভও করে তুলেছে। তার ছোট চুল, ছেলেদের মত আলখেল্লাও সে রূপে সামান্যই প্রভাব ফেলতে পেরেছে। আর যখন সে তাকে বাহুতে তুলে নিল সুগন্ধির একটি ধাক্কা এসে লাগল তার নাসিকা রন্ধ্রে। তার মনে পড়ে গেল আধো-অন্ধকারে ঢাকা সেই নিচতলার রান্নাঘরের কথা, আর প্রকাণ্ড মুখের এক নারীর চেহারা। গন্ধটা একই রকম। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এসব নিয়ে ভাবতে বসার সময় এটা নয়।
‘সুগন্ধীও!’—বলল সে।
‘হ্যাঁ, প্রিয়তম, সুগন্ধীও। আর তুমি কি জানো, এরপর আমি কী করতে যাচ্ছি? আমি সত্যিকারের মেয়েদের একটি ফ্রক জোগাড় করব আর এই ফালতু ট্রাউজার ফেলে সেটা পরব। আমি মখমলের মোজা পরব, হাইহিল জুতো পরব। এই কামরার ভেতরে আমি সত্যিকারের একজন নারী হয়ে উঠব, পার্টির কমরেড হয়ে থাকব না। ’
দুজনেরই শরীর থেকে বসন খসে পড়ল একে একে, আর দুই নগ্ন দেহ মেহগনি কাঠের বিছানায় ঝাপিয়ে পড়ল। এই প্রথমবার জুলিয়ার সামনে পুরোপুরি নগ্ন হলো উইনস্টন। এখনও শরীরের জেগে ওঠা শিরা আর গোড়ালির ওপরের ঘা সহ ফ্যাকাশে কৃশকায় শরীরটি নিয়ে লজ্জায় থাকে সে। বিছানায় কোনও চাদর পাতা নেই, ছেঁড়া হলেও কম্বলটি মসৃণ, তার ওপরই শয্যা রচিত হলো দুজনের। বিছানাটি বড়সড়ো আর বেশ স্প্রিংয়ি। ‘আমি নিশ্চিত এই বিছানা ছারপোকায় ভরা, কিন্তু তাতে কারই পাত্তা?’—বলল জুলিয়া। প্রোলদের ঘরে ছাড়া, আজকাল ডাবল সাইজের বিছানা আর দেখাই যায় না। ছেলেবেলায় উইনস্টন মাঝেমধ্যে এমন একটি বিছানায় ঘুমিয়েছে, কিন্তু যদ্দূর মনে পড়ে জুলিয়া কখনওই এমন বিছানায় গা ছোঁয়ায়নি।
দুজনই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তবে অল্প সময়ের জন্য। উইনস্টনের যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়ির কাঁটা নয়টার কাছাকাছি। নড়ল না, কারণ জুলিয়া তখনও তার বাহুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে। ওর মুখের প্রসাধনীর অনেকটা এখন তারও মুখমণ্ডলে লেগে আছে, তবে রুজমাখা গাল দুটি দারুণ সুন্দর লাগছিল।
ডুবন্ত সূর্যের একটা হলুদ রশ্মি বিছানার পায়ের দিকটাতে পড়ে ফায়ার প্লেসের ওপর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। ওটির ওপর পেতে রাখা কড়াইয়ে তখনও পানি ফুটছে। নিচের আঙ্গিনায় সেই নারীর গান থেমেছে, কিন্তু সড়ক থেকে শিশুদের চিৎকার চেঁচামেচির হালকা শব্দ এসে কানে লাগছে। তার কৌতূহলী মনে প্রশ্ন জাগল, মুছে দেওয়া অতীতেও কি বিছানায় শুয়ে থাকার অনুভূতি এমনটাই ছিল, গ্রীষ্মের শান্ত সন্ধ্যায়, দুই নগ্ন নর-নারী তাদের ইচ্ছামত যেমন খুশি ভালোবাসাবাসি করে, মনে যা আসে তাই নিয়ে কথা বলে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। উঠে যাওয়ার জন্য কোনও চাপ বোধ করবে না, স্রেফ শুয়ে থাকবে আর কানে ভেসে আসবে বাইরের শান্তশব্দগুলো। নিশ্চয়ই এসব কিছু স্বাভাবিক মনে হবে—এমন একটা সময় কখনওই ছিল না। জুলিয়ার ঘুম ভাঙল, চোখ দুটি দুই হাতে ডলে নিয়ে কনুইয়ের ওপর ভর করে মাথা তুলে তেলের স্টোভের দিকে তাকাল।
‘পানির অর্ধেকটাতো সিদ্ধই হয়ে গেল’—বলল সে। ‘একটু পরেই উঠব আর কফি বানাব। আমাদের হাতে আরও এক ঘণ্টা সময় আছে। তোমার ফ্লাটে আলো বন্ধ হয় কখন?’
‘রাত সাড়ে এগারোটায়। ’
হোস্টেলে রাত এগারোটায়। কিন্তু তোমাকে তার আগেই ঢুকে পড়তে হবে, কারণ… আয়হায়! নোংরা জানোয়ার এবার ওঠো!’
হঠাৎই দ্রুত বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে, মেঝে থেকে জুতো কুড়িয়ে নিয়ে ছোট বাচ্চাদের মত তা এক কোণায় ছুড়ে মারল। দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচিতে সেবার টেলিস্ক্রিনে গোল্ডস্টেইনের মুখের উপর ঠিক যেভাবে অভিধানটি ছুড়ে মেরেছিল সেভাবেই।
‘কী হলো!’ বিস্ময় উইনস্টনের কণ্ঠে
‘ইঁদুর। ওই কাঠের দৌড়ের ভেতরে থেকে ওর হিংস্র নাক বের করেছিল। ওখানে নিশ্চয়ই একটা গর্ত আছে। তবে ব্যাটাকে বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছি। ’
‘ইঁদুর!’—বিড়বিড় করে বলল উইনস্টন ‘এই কামরায়!’
‘ওদের বিচরণ সর্বত্র’—বলল জুলিয়া। আর বলতে বলতে আবারও শুয়ে পড়ল। আমাদের হোস্টেলের রান্নাঘরেও দেখি ঘুরঘুর করে। লন্ডনের কোনও কোনও এলাকা ইঁদুরে ছেয়ে গেছে। তুমি কি জানো ওরা শিশুদের ওপর আক্রমণ করে? সত্যিই করে। এইসব সড়কগুলোতে মেয়েরা দুই মিনিটের জন্যও তাদের শিশুদের একা ফেলে রাখতে ভয় পায়। বড় ধূসরবর্ণের ইঁদুরগুলোই কাজটা বেশি করে। আর সবচেয়ে ঘৃণার কাজটি এরা যা করে তা হচ্ছে…’
‘থাক না’—বলল উইনস্টন। চোখদুটো শক্ত করে বন্ধ করে রাখা।
‘আরে প্রিয়তম! তুমি তো পুরো ফ্যাকাশে হয়ে গেছো। ঘটনা কী? ওগুলোর কথা শুনে অসুস্থ বোধ করছো নাকি?’
‘পৃথিবীতে ভয়াবহতমগুলোর একটি হচ্ছে এই ইঁদুর!’
বিছানায় উইনস্টনকে ফের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করল জুলিয়া, যেন সে তার শরীরের উষ্ণতা দিয়ে তাকে ভরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু তখনও চোখ খোলেনি সে। জীবনে বারবার আসা একটি দুঃস্বপ্নের স্মৃতির অনুভবে কয়েকটি দণ্ড নিজেকে আচ্ছন্ন করে রাখতেই মন চাইল তার। প্রায় সবগুলো স্বপ্নই একরকম। অন্ধকারের দেয়াল ঘেঁষে সে দাঁড়িয়ে। উল্টো দিকে কিছু একটা, ঠিক বোঝা যায় না, তবে ভীষণ ভয়ঙ্কর। এই স্বপ্নে বরাবরই তার এক গভীর অনুভূতি হয়, যাকে সে স্রেফ ছলনা ছাড়া কিছু মনে করে না। কারণ সত্যিই সে জানে ওই অন্ধকার দেয়ালের ওপারে কী আছে। সে জানে জোর চেষ্টা করলে, মস্তিষ্ক থেকে টেনে বের করলে, ভয়ঙ্কর বিষয়টিও প্রকাশ্য হয়ে যাবে। প্রতিবারই—কী সেই ভীতিকর বস্তু—তা প্রকাশ্য হওয়ার আগেই তার ঘুম ভাঙ্গে, আর সে জানে জুলিয়াকে যেখানে থামাল, সেখানে না আটকালে ও যা বলত তার সঙ্গে এর একটা যোগসাজশ রয়েছে।
‘দুঃখিত’—বলল সে, ‘কিছুই না। ইঁদুর আমার অসহ্য, এই যা। ’
‘উদ্বেগের কিছু নেই, প্রিয়তম, এই ঘরে ওর আর অস্তিত্ব মিলবে না। যাওয়ার আগেই আমি ওর গর্তটাকে কিছু একটা দিয়ে আটকে দেব। আর এরপর যেদিন আসব কিছু প্ল্যাস্টার নিয়ে আসব যাতে গর্তটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া যায়। ’
তাৎক্ষণিক যে ভীতি ছিল তা এখন অনেকটা কেটে গেছে। কিছুটা লজ্জাও বোধ করছিল উইনস্টন। বিছানার শিথানের দিকে উঠে বসল সে। জুলিয়া বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ল আর আলখেল্লা গায়ে চাপিয়ে কফি বানাতে লেগে গেল। সসপ্যান থেকে যে কড়া, উত্তেজক গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে তাতে তারা জানালা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলো, নইলে কারও নাকে এই ঘ্রাণ গেলে আগ্রহী হয়ে খোঁজ লাগাতে চলে আসতে পারে। এর স্বাদে যতটা, তার চেয়েও বেশি ভালো লাগল চিনি মেশানো কফির রেশমি বর্ণ।
স্যাকারিন খেতে খেতে চিনি নামের বস্তুটার কথা ভুলেই গিয়েছিল উইনস্টন। পকেটে এক হাত ঢুকিয়ে আর অন্যহাতে রুটি আর জ্যাম নিয়ে জুলিয়া কামরাটির এদিক ওদিক পায়চারি করে চলেছে, বইয়ের বাক্সটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, গেইটলেগ টেবিলটিকে কিভাবে সারাই করা যায় তা ঠিক করল, ভাঙ্গা হাতলওয়ালা চেয়ারটিতে একবার বসে দেখল কতটা আরাম তাতে আর খুটে খুটে দেখল ১২ ঘণ্টা ডায়ালের ঘড়িটি। সবকিছুই করে চলল এক ধরনের বিমোহিত ভাব নিয়ে।
কাচের পেপারওয়েটটি হাতে করে বিছানার দিকে এলো যাতে অপেক্ষাকৃত আলোতে এটি ভালো করে দেখা যায়। উইনস্টন তার হাত থেকে ওটি নিয়ে নিল আর এর ভেতরে বৃষ্টির পানির ফোঁটার মত বুদবুদগুলো আবারও মুগ্ধ হয়ে দেখল।
‘জিনিসটা কী, বলো তো?’—বলল জুলিয়া।
‘এটিকে আমার কিছুই মনে হয় না—মানে আমি বলতে চাই, কখনওই কোনও কাজে এটি লেগেছে বলে আমার বোধ হয় না। আর ঠিক সে কারণেই জিনিসটি আমার পছন্দ। এটি স্রেফ এক টুকরো ইতিহাস যা ওরা পাল্টে দিতে ভুলে গেছে। এটি শত বছর আগের একটি বার্তা, তবে সে বার্তা—স্রেফ যে পড়তে পারবে তার জন্যই। ’
‘আর ওই যে ওদিকে টানিয়ে রাখা ছবিটি’—উল্টো দিকের দেয়ালের দিকে দৃষ্টি হেনে বলল জুলিয়া। ‘ওটাও কি শত বছরের পুরোনো?’
‘তারও বেশি। আমি বলতে চাই অন্তত দুইশ’ বছরের পুরোনো। কেউ আসলে বলতেও পারবে না। এখন এই যুগে আর এর জন্ম ইতিহাস জানা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। ’
ছবিটির দিকে এগিয়ে গেল জুলিয়া। ‘এখান থেকেই ইঁদুরটা নাক বের করেছিল’ বলেই ছবিটির ঠিক নিচে গর্তের ওপর লাথি বসাতে লাগল। ‘এটা কোন জায়গা, মনে হচ্ছে আগে কখনও স্থানটি দেখেছি’—এবার ছবির দিকে তাকিয়ে বলল সে।
‘ওটা একটা গির্জা, অন্তত বলা চলে, গির্জাই হবে। নাম ছিল সেইন্ট ক্লেমেন্ট’স ডেনস। ’ মাথায় এলো মি. চ্যারিংটনে ছড়াটি। আর আধেকটা নস্টালজিক হয়ে উচ্চারণ করল:
অরেঞ্জেস অ্যান্ড লেমন্স, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট ক্লেমেন্ট’স!
আর তাকে ভীষণ বিস্মিত করে দিয়ে জুলিয়া আওড়াল:
ইউ ও মি থ্রি ফার্দিংস, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট মার্টিন’স,
হোয়েন উইল ইউ পে মি? সে দ্য বেলস অব ওল্ড বেইলি—
এই লাইনটির পরে কী ছিল মনে করতে পারছি না। তবে মনে আছে ছড়াটি শেষ হয় এভাবে, “হিয়ার কামস অ্যা ক্যান্ডল টু লাইট ইউ টু বেড, হিয়ার কামস অ্যা চপার টু চপ অফ ইওর হেড!”
এটা কোনও গোপন সংকেতের দুটি ভাগ হবে। তবে ‘দ্য বেলস অব ওল্ড বেইলি’র পরে আরেকটি পঙ্ক্তি থাকার কথা। মি. চ্যারিংটনের মগজ থেকে সেটা খুঁড়ে বের করা সম্ভব হলেও হতে পারে। তবে তার জন্য তাকে মওকা মত পেতে হবে।
‘তোমাকে কে শিখিয়েছে?’—প্রশ্ন উইনস্টনের।
‘আমার দাদাভাই। যখন ছোট্ট মেয়েটি ছিলাম দাদাভাই আমাকে এগুলো খুব শোনাতেন। আমার যখন আট বছর বয়স তখন তাকে বাষ্পায়িত করা হয়—অর্থাৎ গুম হয়ে যান। আমি জানি না, এই লেবুটা দেখতে কেমন’—টানা বলেই চলল জুলিয়া। ‘কমলা দেখেছি। হলুদ রঙের গোল এক ধরনের ফল। চামড়া মোটা। কিন্তু লেবু দেখিনি। ’
‘লেবুর কথা আমার স্মরণে আসছে’—বলল উইনস্টন। পঞ্চাশের দশকে বাজারে খুব দেখা যেত। ওগুলো খেতে টক। ঘ্রাণ নিলেও তোমার দাঁত ধরে আসবে। ’
‘আমি বাজি ধরতে পারি, ওই ছবির পেছনে ছারপোকার আখড়া হয়েছে’—বলল জুলিয়া। ‘একদিন নিচে নামিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে দেব। আমার ধারণা এখন আমার চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তবে তার আগে মুখের রঙ ধুয়ে ফেলতে হবে। ফালতু একটা জিনিস! তোমার মুখেও লিপস্টিকের দাগ লেগে আছে। ওগুলোও মুছতে হবে। ’
আরও কয়েক মিনিট বিছানায় পড়ে থাকল উইনস্টন। কামরাটি ধীরে ধীরে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসছে। যেদিকটা দিয়ে আলো আসছে সেদিকে ঘুরল আর শুয়ে শুয়ে তাকিয়ে থাকল কাচের পেপারওয়েটটার দিকে। ভেতরে বসানো কোরালটিতে যতটা না আকর্ষণ তার চেয়ে বেশি আকর্ষণ কাচের অংশে। বলা যায় বাতাসের মত স্বচ্ছ। মনে হবে কাচের উপরিতলটি ঠিক আকাশের মত। একটা ছোট পৃথিবী এই কাচের ভেতরে স্থান করে নিয়েছে। উইনস্টনের মনে হলো, ইস্ যদি এই কাচের ভেতরে ঢুকে পড়া যেত। আর সত্যি বলতে কী, মনে মনে সে আসলে কাচের ভেতরেই ঢুকে পড়ল। তার সঙ্গী হয়ে ভেতরে ঢুকেছে মেহগনির বিছানা, গেটলেগ টেবিল, ঘড়ি, স্টিলের খোঁদাই করা চিত্রকর্ম আর এই কাচের পেপারওয়েটি নিজেও। পেপারওয়েটটিই যেন পুরো কামরা আর সে তার ভেতরে। ওই কোরাল যেন জুলিয়ার জীবন, আর তার নিজেরও, যা স্ফটিকের কেন্দ্রস্থলে চির অবস্থান নিয়ে আছে।
পঞ্চম অধ্যায়
সাইম বাষ্পায়িত হয়ে গেছে। এক সকালে কাজে তার দেখা মিলল না। কতিপয় অবিবেচক সে অনুপস্থিতি নিয়ে কিছু মন্তব্যও করল। পরের দিন অবশ্য কারও মুখে তার নামটিরও উচ্চারণ ছিল না। তৃতীয় দিন উইনস্টন একবার রেকর্ডস ডিপার্টমেন্টের প্রবেশপথটা ঘুরে এলো। সেখানে টাঙিয়ে রাখা নোটিশ বোর্ডে দাবা কমিটির একটা ছাপানো তালিকায় সাইমের নাম ছিল। উইনস্টন দেখল পুরো একই রকম দেখতে একটি তালিকা ঝুলছে। তাতে কোনও নাম কাটা হয়নি—তবে একটি নাম কমে গেছে। ওতেই চলবে। অস্তিত্ব বিরতিতে চলে গেল সাইম; আর হতে পারে তার অস্তিত্ব কোনওকালেই ছিল না।
তাঁতানো গরম আবহাওয়া। গোলকধাঁধার মন্ত্রণালয়ের জানালাবিহীন, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষগুলোতে তাপমাত্রা স্বাভাবিক, কিন্তু বাইরের আঙ্গিনায় পা ফেলতেই ফোস্কা পড়ে যায়। আর ভিড়ের সময়ে টিউবগুলোতে ঘামের বোঁটকা গন্ধ স্রেফ বিভীষিকাময় ঠেকে। ঘৃণা সপ্তাহের প্রস্তুতি পুরোদমেই চলছে, সবগুলো মন্ত্রণালয়ের স্টাফই অতিরিক্ত সময় খাটছে। মিছিল, মিটিং, সামরিক কুচকাওয়াজ, বক্তৃতা, মোমের মূর্তি, সাজসজ্জা, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, টেলিস্ক্রিন প্রোগ্রাম সবকিছুরই আয়োজন থাকছে। খাম্বা গেড়ে কুশপুতুল টাঙানো, স্লোগান লেখা, স্লোগান বাছাই, গুজব ছড়িয়ে দেওয়া, ভুয়া ছবি তৈরি এসবও চলছে সমানে।
জুলিয়ার ফিকশন ডিপার্টমেন্ট উপন্যাস রচনা আপাতত বন্ধ রেখে সহিংসতার প্যামফ্লেট বানাতে ব্যস্ত। উইনস্টন তার নিয়মিত কাজের পাশাপাশি প্রতিদিনই দীর্ঘ সময় ধরে ‘দ্য টাইমস’র পুরোনো ফাইল ঘাঁটছে আর যেসব সংবাদ থেকে বক্তৃতায় উদ্ধৃতি থাকবে সেগুলো পাল্টে সুবিধা মত সাজিয়ে রাখছে। গভীর রাতে, যখন সড়কগুলোতে মাতাল প্রোলদের ঘোরাঘুরি চলতে থাকে, তখন শহরটাতে যেন জ্বর নেমে আসে। আগের চেয়ে একটু ঘনঘনই রকেট বোমা পড়ছে, আর কখনও কখনও দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসে ভীষণ বিস্ফোরণের শব্দ, যার ব্যাখ্যা কারও জানা নেই, তবে এ নিয়ে রয়েছে ভয়াবহ সব গুজব।
ঘৃণা সপ্তাহের প্রতিপাদ্য সঙ্গীতে সুরারোপ করা হয়েছে (নাম দেওয়া হয়েছে ঘৃণাগীত) আর তা অবিরাম বেজে চলছে টেলিস্ক্রিনে। অসভ্য ঘেউ ঘেউ ধ্বনির এই গানকে আর যাই হোক সঙ্গীত বলা চলে না। ড্রাম বাজিয়ে তাই গাওয়া হচ্ছে। সঙ্গে মিশছে কুচকাওয়াজরত শত শত পায়ের ভীতিকর শব্দ। প্রোলরা বিষয়টিকে মজা হিসেবে নিয়েছে। মধ্যরাতের সড়কগুলোতে ‘নিষ্ফল এক অলীক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়’র সঙ্গে জনপ্রিয়তার পাল্লা লেগে গেছে এই গানের। পারসন্সের বাচ্চারা অহর্ণিশ অবিরাম অসহনীয়ভাবে তা বাজিয়ে চলেছে। চুলে চিরুণী চালাতে চালাতে কিংবা টয়লেট পেপার দিয়ে কাজ সারতে সারতে তাদের একই গান।
উইনস্টনের সন্ধ্যাগুলো আগের যেকোন সময়ের চেয়ে এখন পরিপূর্ণ হয়ে থাকে। স্বেচ্ছাসেবক দলগুলো সংগঠিত করছে পারসন্স। এদেরই দায়িত্বে ঘৃণাসপ্তাহের জন্য সড়কগুলো প্রস্তুত হচ্ছে। ব্যানার টাঙানো, পোস্টার আঁকানো, বাড়িগুলোর ছাদে পতাকার খুঁটি বসানো, রাস্তাগুলোর এপাশ থেকে ওপাশে দড়ি টাঙিয়ে কাগজের পতাকা সাজানো চলছে। পারসন্স বলেছিল ভিক্টরি ম্যানসন্সেই লেগে যাবে চারশ মিটার লম্বা পতাকার রশি। আজন্মসিদ্ধ ভাবনা আর খুশিতে গদগদ হয়ে আছে সে। গরম আর কাজের ধরনের কারণে সন্ধ্যার জমায়েতে তার কোঁচকানো শর্টস আর বোতাম খোলা শার্ট মাননসই হয়ে গেছে। হঠাৎ হঠাৎই তার উপস্থিতি, দেখা মিলবে এখানে ওখানে, কিছু ধাক্কাচ্ছে নয়ত টানছে, করাত কাটছে, নয়ত হাতুড়ি পেটাচ্ছে। এসবই করছে তার কমরেডসুলভ অভিব্যক্তি দিয়ে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে করতে। তবে একই সঙ্গে প্রতি পরতে পরতে ছড়িয়ে পড়ছে তার গা থেকে ভুরভুর করে বেরিয়ে আসা ঘামের অসহনীয় কটূগন্ধ।
হঠাৎ একটি পোস্টারে গোটা লন্ডন ছেয়ে গেছে। ক্যাপশন নেই, স্রেফ দৈত্যাকায় বপুর এক ইউরেশীয় সেনা। তিন কিংবা চার মিটার লম্বা, ভাবলেশহীন মঙ্গোলীয় মুখ সম্মুখপানে উদ্ধত। পায়ে মোটা বড় বুট। কোমড়ের নিচে ঝুলে আছে সাবমেশিনগান। যেদিক থেকেই তাকান না কেন পরিপ্রেক্ষিতের বিবর্ধনে মনে হবে, ওটি সোজা আপনার দিকেই তাক করা। প্রতিটি দেয়ালের প্রতিটি ফাঁকা স্থানে সেঁটে দেওয়া হয়েছে এই পোস্টার। ফলে তা বিগ ব্রাদারের পোস্টারকেও ছাপিয়ে গেছে। প্রোলরা যুদ্ধের ব্যাপারে সাধারণত উদাসীন থাকলেও মাঝে মধ্যে তাদের দেশপ্রেমের আতিশয্য দেখা যায়। আর মনে হচ্ছে, সাধারণের এই উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রকেট বোমায় মৃত্যুর সংখ্যাটাও একটু বেড়েছে। একটি পড়েছে স্টেফনির এক জনাকীর্ণ ফিল্ম থিয়েটারে। তাতে ধ্বংসস্তূপের নিচে প্রাণ গেছে কয়েকশ’ জনের। পুরো এলাকার মানুষ লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিল। এতে বড় যে কাজটি হয়ে গেল তা হচ্ছে, ঘৃণা আর ক্ষোভের বিনিময়।
আরেকটি বোমা পড়েছে বর্জ্য ফেলে ফেলে গড়ে তোলা একটি মাঠের ওপর। ওখানে ডজন কয়েক শিশু খেলা করছিল। ওরা সব টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে গেছে। এতে ক্ষোভ আর ঘৃণা প্রতিহিংসায় রূপ নিল। গোল্ডস্টেইনের কুশপুতুল পোড়ানো হলো, ইউরেশীয় সেনার ছবি সম্বলিত সেই পোস্টারের শত শত কপি ছিঁড়ে আগুনে ছুঁড়ে দেয় সহিংস জনতা, হাঙ্গামার মাঝেই বেশ কিছু দোকানপাটে লুটতরাজ চলে; আর অতঃপর গুজব ছড়িয়ে পড়ে, গুপ্তচরেরা এক ধরনের বেতার তরঙ্গ সৃষ্টি করে রকেট বোমার গতি পাল্টে দিয়েই এই বিস্ফোরণগুলো ঘটিয়েছে। সন্দেহভাজন এক বিদেশি বৃদ্ধ দম্পতি এই কাজ ঘটিয়ে নিজেরাই নিজেদের ঘরে আগুন জ্বালিয়ে শ্বাসরোধ হয়ে মারা গেছে—সে খবরও রটিয়ে পড়ে।
মি. চ্যারিংটনের দোকানের উপরের সেই কামরায় যখন যেতে পারে জুলিয়া আর উইনস্টন—কাপড় খুলে রেখে খোলা জানালাপাশের বিছানায় শুয়ে থাকে। শরীর ঠাণ্ডা রাখার জন্যই এই নগ্নতা। ইঁদুরটিকে আর দেখা যায়নি, তবে গরমে ছারপোকা বেড়েছে ভয়াবহ বহুগুনে। তাতে ওদের তোয়াক্কা নেই। নোংরা বা পরিষ্কার যাইহোক, এই কামরা তাদের কাছে স্বর্গ। এখানে পৌঁছেই সবকিছুতে কালোবাজার থেকে কেনা পিপুলের গুঁড়ো ছড়িয়ে দেয় এরপর শরীর থেকে ছুঁড়ে ফেলে সব কাপড়, ঘামজবজবে শরীর দুটো ভালোবাসাবাসির আলিঙ্গনে জড়ায়, সঙ্গম হয়, অতঃপর গভীরঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। আর ঘুম ভাঙলেই উঠে দেখে ছারপোকারা সারি বেঁধে একজোট হয়ে পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
জুন মাসে তারা মিলিত হলো—চার, পাঁচ, ছয় পার করে সাত-সাতবার। সারাক্ষণ জিন পানের যে অভ্যাস ছিল তা ছেড়েছে উইনস্টন। এমনকি মনে হয়, সে যেন এর প্রয়োজনীয়তাই আর বোধ করছে না। কিছুটা মুটিয়েও গেছে সে। পেটের ভেতরে আলসার অনেকটা কম জ্বালাতন করছে, তবে পায়ের গোড়ালির উপরের ঘায়ের স্থানটিতে বাদামি রঙের ঘা এখনও কমেনি। আরও দারুণ বিষয়, প্রতি সকালে নিয়ম করে যে কাশির তোড়ে কাহিল হয়ে যেত—সেটিও বন্ধ হয়েছে। জীবনের অসহনীয় দিকটা থেকে বের হয়ে এসেছে সে। এখন আর টেলিস্ক্রিনের মুখোমুখি হতে হয় না, অথবা চিৎকার দিয়ে ভর্ৎসনা করার তাগিদও বোধ করে না। এখন তাদের একটি নিরাপদ লুকোনোর জায়গা আছে, যা অনেকাংশেই ঘরের মতো। এখানে তাদের দেখা যে ঘন ঘন হয় না, আর দেখা হলেও ঘণ্টা কয়েকের বেশি সেখানে থাকা অসম্ভব, তারপরেও তাদের কোনও অভাববোধ নেই। একটাই ভাবনা, এই ভাঙারির দোকানের উপরের কামরাটিরই অস্তিত্ব থাকবে তো।
কামরাটি অক্ষত থাকবে কি না তা আগেভাগে জানতে পারা স্রেফ অসম্ভব। এই কামরা যেন একটি জগত, একটি অতীতের সংরক্ষিত ভূমি যেখানে বিলুপ্ত প্রাণীরা চড়ে বেড়ায়। উইনস্টন ভাবে, মি. চ্যারিংটন নিজেই যেন এক বিলুপ্ত প্রাণী। সাধারণত এখানে পৌঁছে উপরে ওঠার আগে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে মি. চ্যারিংটনের কথাবার্তা শোনে সে। এই বৃদ্ধ কদাচই ঘরের বাইরে গেছেন কিংবা হতে পারে কখনওই যাননি। আর বুড়োর দোকানে কোনও খদ্দের থাকে না বললেই চলে। এই ছোট্ট অন্ধকার দোকান আর তার চেয়েও ছোট একটি রান্না ঘর, যেখানে নিজেই খাবার তৈরি করেন, এই দুইয়ের মাঝে আটকে আছে তার ভূতুড়ে জীবন যাপন।
রান্নাঘরে অবিশ্বাস্য পুরোনো বিশাল হর্নওয়ালা একটি গ্রামোফোন। কথা বলার কাউকে পেলে বুড়ো খুশিই হন। মূল্যহীন এইসব সংগ্রহ তার। লম্বা নাকের ওপর ভারী কাচের চশমা বসিয়ে ওগুলোই খুটে খুটে দেখে সময় কাটে। সারাক্ষণই ঝুঁকে যাওয়া কাঁধে ঝুলে থাকে মখমলের জ্যাকেট। সবমিলিয়ে বেনে নয়, একজন সংগ্রাহকই মনে হয় তাকে। এক ধরনের অস্পষ্ট আতিশয্যে তার আঙ্গুলগুলো এইসব পুরোনো অপ্রয়োজনীয় বস্তু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে—চীনা বোতলের ছিপি, নস্যির কৌটার কারুকাজ করা ঢাকনা, শংকর ধাতুর লকেট যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক আগে মৃত কোনও শিশুর ক’টি চুল। আর এগুলো উইনস্টন কিনবে কিনা সে প্রশ্ন কখনওই উচ্চারিত হয়নি বুড়োর মুখে। এমনকি এগুলো তার ভালো লাগছে কিনা তাও জানতে চায়নি। বুড়োর সঙ্গে কথা বলার মানেই হচ্ছে কেবল শুনে যাওয়া, নয়ত বলা চলে ভাঙা রেকর্ড চালিয়ে বসে থাকা। স্মৃতির কোণা কোণা ঘেঁটে ভুলে যাওয়া আরও কিছু ছড়া এনে শুনিয়েছেন উইনস্টনকে। তারই একটি এক গণ্ডা আর এক কুড়ি কালোপাখির ছড়া, আরেকটি বাঁকানো শিংয়ের গরুর ছড়া, একটি আছে বোকা মোরগ রবিনের মৃত্যুগাথা। ‘এটি আমার ভালো লাগত, তোমার আগ্রহ থাকলেও থাকতে পারে’—যখনই নতুন কিছু পেয়ে যান একটা ছোট্ট হাসি ছড়িয়ে এই কথাটিই বলেন বুড়ো। তবে কোনওটারই গুটিকয় চরণ ছাড়া বাকিটা মনে করতে পারেন না।
তারা দুজনই জানে—দুজনেরই মনের মধ্যে রয়েছে, জীবনের এই নতুন ব্যবস্থা খুব বেশি দিন টিকে থাকার নয়। একটা সময় ছিল যখন অনাগত মৃত্যুর সত্যটি তাদের কাছে শুয়ে থাকা এই বিছানাটির মতোই সত্য হয়েছিল, আর এক ধরনের হতাশার অনুভূতি নিয়েই তারা একে অন্যকে আলিঙ্গনে জড়াত, ঠিক যেমন করে একটি স্তিমিত হয়ে আসা আত্মা জীবনের শেষ ঘণ্টা বাজার আগের পাঁচটি মিনিট শেষ আনন্দটুকু ভোগ করে নিতে চায়। তবে এমনও হয়েছে, কেবল যে নিরাপদ তাই-ই নয়—এই ব্যবস্থাই তাদের জন্য স্থায়ী হয়ে থাকবে দুজনই এমন বিভ্রমে আপ্লুত হয়ে থেকেছে। যতটা সময় তারা এই কামরায় থাকে, তাদের অনুভব বলে, কোনও ক্ষতিই তাদের হবে না। এখানে পৌঁছানোটা যতটা কঠিন ততটাই বিপজ্জনক; তবে কামরাটি যেন এক অভয়ারণ্য। উইনস্টনের চোখ পেপারওয়েটের হৃদয়ভূমিতে বিচরণ করছে, আর অনুভবে সে ওই কাচের জগতটাতেই ঢুকে পড়তে চাইছে। মনে হচ্ছিল একবার ঢুকে পড়তে পারলে সময়টিকেই বেঁধে ফেলা যাবে।
রেহাই পেয়ে যাবে এমন দিবাস্বপ্নও তারা কম দেখেনি। তাদের ভাগ্য তাদের সহায় হয়ে থাকবে আর প্রাকৃতিক মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এমনই জীবন তারা যাপন করে যাবে। অথবা ক্যাথরিন মারা যাবে আর কিছুটা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে উইনস্টন ও জুলিয়া বিয়ে করে ফেলবে। অথবা তারা দুজনই একসঙ্গে আত্মহত্যা করবে। অথবা তারা একসময় নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে, আর নিজেদের এমনভাবে পাল্টে দেবে যাতে কেউ চিনতেও পারবে না। প্রোলেতারিয়েতদের মতো করে কথা বলা শিখে নেবে, কোনও কারখানায় কাজ করবে আর পেছনের কোনও গলি-ঘিঞ্জিতে আবাস গাড়বে, কেউ জানবে না তারা কারা। এসবই ফালতু ভাবনা। আর তারা দুজনই তা জানে। বাস্তবতা হচ্ছে, রেহাই মেলার কোনও সুযোগ নেই। এমনকি আত্মহত্যার সচরাচর যে চর্চা দেখা যায়—সে পথে তাদের যাওয়ার কোনও ইচ্ছা নেই। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ চেষ্টা করে একটি বর্তমানই বুনন করে চলছে তারা, এর কোনও ভবিষ্যত নেই, এ এক যুদ্ধ, যা জয় করা সম্ভব নয়, ঠিক যেমন—কারও ফুঁসফুঁস ততক্ষণই শ্বাস নিতে পারে যতক্ষণ বায়ু সঞ্চালন থাকে।
কখনও এও হয়েছে, তারা পার্টির বিরুদ্ধে সক্রিয় বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়ার কথা ভেবেছে, কিন্তু এর পয়লা পদক্ষেপটিই কী হবে সে নিয়ে কোনও ধারণা নেই। এমনকি ব্রাদারহুডের যদি আদৌ কোনও অস্তিত্ব থাকে, তার জন্যও কোন পথে এগুতে হবে সে এক কঠিন চিন্তা। এরই মধ্যে ও’ব্রায়েনের সঙ্গে তার যে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, কিংবা রয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায় সে কথাটিও জুলিয়াকে জানিয়েছে উইনস্টন। এছাড়াও কোথাও ও’ব্রায়েনের উপস্থিতিই যে বলে দেয় সে আসলে পার্টির লোক নয়, বরং শত্রু—আর সে তার সহযোগিতা চায়, এমন ভাবনার কথাগুলোও বলেছে।
কৌতূহলের দিক হচ্ছে, এসব কোনও কিছুই তার কাছে ভয়াবহ কোনও কাজ বলে মনে হয়নি। মানুষকে সেও চেহারা দিয়ে বিচার করে, আর সে কারণেই স্রেফ চোখের একটি চাহনির ওপর ভিত্তি করে উইনস্টন যেভাবে ও’ব্রায়েনকে বিশ্বাসযোগ্য বলে ধরে নিয়েছে তা তার কাছে স্বাভাবিকই ঠেকেছে। উপরন্তু সে মনে করে, সকলেই কিংবা প্রায় সকলেই গোপনে পার্টিকে ঘৃণা করে আর যখনই নিরাপদ বোধ করে পার্টির নিয়ম ভাঙে।
তবে সংগঠিত সুবিস্তৃত কোনও বিরোধী শক্তি আছে কিংবা থাকতে পারে এমনটা সে মানতে নারাজ। গোল্ডস্টেইন ও তার গোপন সেনা দল, তার মতে, নিছকই পার্টির সৃষ্ট কিছু ফালতু প্রচারণা। পার্টি নিজের প্রয়োজনে, উদ্দেশ্য হাসিলে এগুলো সৃষ্টি করে আর তোমাকে তা বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ে। অসংখ্যবার পার্টির মিছিলে, তাৎক্ষণিক বিক্ষোভে সে তারস্বরে চিৎকার করে সেইসব মানুষের মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে যাদের নামটিও কখনও শোনেনি, আর তাদের তথাকথিত অপরাধেও তার নেই সামান্য বিশ্বাস।
গণবিচারগুলোতে ইয়ুথ লিগের চ্যালারা যখন সকাল থেকে রাত অবধি আদালত ঘিরে অবস্থান নেয় আর থেমে থেকে চিৎকার করে ‘ষড়যন্ত্রীর ফাঁসি চাই!’ তখন সেও একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচিতে অন্যদের সঙ্গে সেও গোল্ডস্টেইনের অপমানে চিৎকার করে ঠিকই কিন্তু গোল্ডস্টেইন কে আর কোন নীতিরই সে প্রতিনিধিত্ব করছে—সে বিষয়ে তার ধারণা অতীব ক্ষীণ। বিপ্লবের পরেই তার বেড়ে ওঠা আর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যে আদর্শিক সংগ্রাম চলেছে তা মনে রাখার মতো বয়স তার ছিল না।
একটি স্বাধীন রাজনৈতিক অন্দোলনের মতো ঘটনা তার কল্পনারও অতীত; আর যেভাবেই হোক এটাই তার বদ্ধমূল ধারণা যে পার্টি অজেয়। পার্টি থাকবে, আর সদাই একইরকম থাকবে। এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের একটিই পথ তা হচ্ছে গোপন অবজ্ঞা, আর অমান্য করে যাওয়া, অথবা সর্বোচ্চ যা হতে পারে তা হচ্ছে বিচ্ছিন্ন কিছু সহিংসতা ঘটিয়ে চলা, যেমন কাউকে হত্যা করা অথবা কিছু একটা উড়িয়ে বা ধ্বংস দেওয়া।
পার্টির প্রচারণার কোনওটিতে তার অবিশ্বাস উইনস্টনের চেয়ে অনেক তীব্র আবার কোনওটি গ্রহণ করে নিতে উইনস্টনের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে। একদিন ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে কথা হচ্ছিল, সেদিন তাকে চমকে দিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় জুলিয়া বলে ফেলল, তার বিশ্বাস যুদ্ধটা হচ্ছেই না। প্রতিদিন লন্ডনে যেসব রকেট বোমা পড়ছে, ওগুলো যথেষ্ঠই সম্ভব যে ওশেনিয়ার সরকার নিজেই ফেলছে। আর তা স্রেফ মানুষকে আতঙ্কের মধ্যে রাখার জন্যই করছে।
এমন একটি ভাবনা উইনস্টনের মধ্যে কখনওই আসে নি। এছাড়াও তাকে অনেকটা ইর্ষান্বিত করে দিয়ে জুলিয়া বলল, দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচিগুলোতে তার কাছে যা সবচেয়ে কঠিন মনে হয় তা হচ্ছে, এই চিৎকার আর হাসাহাসিতে অংশ না নিয়ে না পারাটা। তবে পার্টির এইসব শিক্ষার বিরুদ্ধে সে তখনই প্রশ্ন তোলে যখন তা তার ব্যক্তিজীবনের ওপর এসে পড়ে।
কখনও কখনও সে সরকারি মিথগুলো মেনে নিতেও রাজি থাকে, কারণ সত্য আর মিথ্যার মধ্যে যে ফারাক তার কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ মনেই হয় না। উদাহরণস্বরূপ, স্কুল থেকেই সে জেনে এসেছে, পার্টি উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেছে, আর তাতেই তার বিশ্বাস। (উইনস্টন স্মরণ করতে পারে, পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে তার নিজের স্কুলের দিনগুলোতে পার্টি দাবি করেছিল, তারা হেলিকপ্টার আবিষ্কার করেছে। তার কয়েক ডজন বছর পেরিয়ে, যখন জুলিয়া স্কুলে যায় তখন পার্টির দাবি উড়োজাহাজ আবিষ্কারের; হতে পারে আরেক প্রজন্ম পার করে কী জানি বাষ্প-ইঞ্জিন আবিষ্কারের কৃতিত্বও পার্টিই নিয়ে নেয় কি না। ) আবার জুলিয়াকে যখন সে জানায় তার জন্মেরও আগে, বিপ্লবের অনেক অনেক পূর্বে উড়োজাহাজ আবিষ্কৃত হয়েছে, তখন সেই সত্য তার কাছে কোনও আগ্রহই তৈরি করে না। এটা ঠিক, কে উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেছে তাতে কী-ই যায় আসে? তবে সত্যিই একটা ঝাঁকুনি লাগে যখন জুলিয়ার কিছু মন্তব্য থেকে বুঝতে পারে, মাত্র চার বছর আগে ওশেনিয়া যে পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল আর ইউরেশিয়ার সঙ্গে ছিল শান্তির সম্পর্ক—সেকথাও সে বেমালুম ভুলে বসে আছে।
এটা সত্য, গোটা যুদ্ধটাকেই সে প্রতারণা বৈ কিছু মনে করে না, এখন মনে হচ্ছে শত্রুপক্ষ যে পাল্টে গেছে সেটার খোঁজও সে রাখে না। ‘আমি ভেবেছিলাম আমরা বরাবরই ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছি’—গুরুত্বহীনভাবেই বলল সে। এতে কিছুটা আতঙ্ক বোধ করল উইনস্টন। উড়োজাহাজ আবিষ্কারের ঘটনা তার জন্মের অনেক বছর আগের, কিন্তু যুদ্ধের বিষয়টি তো ঘটে গেছে মোটেই চার বছর আগে। তখন সে পুরোই বড় হয়ে উঠেছে। উইনস্টন এ নিয়ে তার সঙ্গে প্রায় পনের মিনিট ধরে যুক্তিতর্ক দিল। আর অবশেষে সে সফল হলো তার স্মৃতিতে জোর করে হলেও কিছু ঘটনা টেনে আনতে। আর সে হালকা করে হলেও মেনে নিল একটা ইউরেশিয়া নয়, শত্রুপক্ষ ছিল পূর্ব এশিয়া। তবে তারপরেও এই বিষয় থোরাই গুরুত্ব পেল তার কাছে। ‘কে পাত্তা দেয়?’—অধৈর্যের উচ্চারণ জুলিয়ার। ‘সব সময়ই একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, আর মানুষ জানে এসব খবরই মিথ্যা। ’
রেকর্ড ডিপার্টমেন্টে তার নির্লজ্জ প্রতারণামূলক কাজগুলো নিয়েও জুলিয়ার সঙ্গে মাঝে মধ্যে কথা হয়। এ বিষয়গুলোও তাকে আতঙ্কিত করে না। মিথ্যাগুলোর এমন সত্যায়নের যে বেসাতি চলছে তা নিয়ে তার ভাবান্তর নেই। সে তাকে জোন্স, অ্যারোনসন, আর রাদারফোর্ডের গল্পও শোনালো, তার হাতে পড়ে যাওয়া সেই এক খণ্ড কাগজের কথাও বলল। এসব কিছুতেই তার মধ্যে কোনও অভিব্যক্তি তৈরি হলো না। এমনকি প্রথম শুনে সে বিষয়টির গুরুত্বই অনুধাবন করতে পারে নি।
‘ওরা কি তোমার বন্ধু ছিল?’—বলল জুলিয়া।
‘না আমি ওদের চিনতাম না। ওরা ছিল ইনার পার্টির সদস্য। পাশাপাশি, ওরা আমার চেয়ে বয়সেও অনেক বড় ছিল। ওরা পুরনো দিনের মানুষ, বিপ্লবেরও আগের। ওদের কদাচই সামনাসামনি দেখেছি আমি। ’
‘তাইলে ওদের নিয়ে উদ্বেগের কী আছে? অহরহ মানুষ হত্যা চলছে, বলো চলছে না?’
সে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করল। ‘এটি একটি ভিন্ন বিষয়। এটি স্রেফ কেউ একজনকে হত্যা করা হলো, এমন বিষয় নয়। তুমি বুঝতে পারো, গতকাল থেকে শুরু হয়েছে যে অতীত, তা মূলত বিলুপ্ত? যদি সে অতীত কোথাও টিকে থাকে, তা স্রেফ কিছু খাঁটি বস্তুতে, তার সঙ্গে কোনও বক্তব্য জুড়ে থাকছে না, ঠিক ওই কাচের তৈরি গোলাকার বস্তুটির মতো। এরই মধ্যে বিপ্লব এবং বিপ্লবের আগেকার কথার প্রায় সবটাই আমাদের অজানা হয়ে গেছে। প্রতিটি নথিই হয় ধ্বংস করা হয়েছে নয়ত মিথ্যায়নে সিদ্ধ, প্রতিটি বই নতুন করে রচিত হয়েছে, প্রতিটি ছবি নতুন করে আঁকা হয়েছে, প্রতিটি মূর্তি, প্রতিটি সড়ক, প্রতিটি ভবন নতুন নাম পেয়েছে, প্রতিটি তারিখ বদলে দেওয়া হয়েছে। আর সে প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে দিনের পর দিন, মিনিটের পর মিনিট। ইতিহাস থেমে গেছে। একটি অসীম বর্তমান ছাড়া কোনও কিছুই আর টিকে নেই, আর সেই বর্তমানটাই এমন যেখানে পার্টিই সদা সঠিক।
আমি জানি, অবশ্যই জানি, অতীত মিথ্যা হয়ে গেছে, কিন্তু আমি কখনওই তা প্রমাণ করতে পারব না, এমনকি আমি নিজে এই মিথ্যায়নের সঙ্গে যুক্ত থেকেও না। কোনও বস্তু চলে গেলে তার প্রমাণ আর কখনওই মিলবে না। একমাত্র প্রমাণ আমার নিজের মনের ভিতর বিরাজ করবে, আর কোনও নিশ্চয়তা দিয়েই আমি জানতে পারছি না আর কোনও মানব সন্তানই আমার মতো একই স্মৃতি বহন করছে কি না। আমার গোটা জীবনে মাত্র ওই একটি ঘটনাই ছিল, যা ঘটনার অনেক অনেক বছর পর আমার হাতে তার একটি সত্যিকারের প্রমাণ হিসেবে ধরা দিয়েছিল। ’
‘তাতে হলো টা কী?’
‘কিছুই হলো না, কারণ আমি কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেটি ছুঁড়ে দিয়েছি স্মৃতি গহ্বরে। কিন্তু একই ঘটনা যদি আজ আবারও ঘটে, আমি কিন্তু তা রেখে দেব। ’
‘আমি রাখব না!’—বলল জুলিয়া। ‘আমি এমন একটি ঝুঁকি অবশ্যই নিতে রাজি, কিন্তু তখনই নেব যখন তার একটা গুরুত্ব থাকবে, মূল্য থাকবে, পুরনো সংবাদপত্রের একটি ছেঁড়া অংশের জন্য নিশ্চয়ই নেব না। ধরো কাগজের টুকরোটি যদি এখনও তোমার কাছে থাকত, তুমি কী-ই করতে পারতে?’
‘হয়ত বেশি কিছু করতে পারতাম না। কিন্তু ওটা একটা প্রমাণ হয়ে নিশ্চয়ই থাকত। যদি আমি সাহস করে কাউকে ওটা দেখাতে পারতাম, তাতে এখানে সেখানে কিছু সন্দেহের বীজ বপন করা হয়ে যেত। কল্পনায়ও ভাবি না, আমরা আমাদের জীবদ্দশায় কোনও কিছুই পাল্টে দিতে পারব। কিন্তু ছোট ছোট প্রতিবাদ এখানে সেখানে গড়ে উঠবে সে কথাটুকু ভাবনায় স্থান দেওয়া যায় বৈকি। ছোট ছোট দলে মানুষ জোটভুক্ত হচ্ছে, আর ধীরে ধীরে তা বেড়ে উঠছে, আর এমনকি কিছু কিছু ঘটনা ঘটিয়েও চলছে, যা পরের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাবে এমনটা ভাবা কিন্তু অলীক নয়। ’
‘পরের প্রজন্ম নিয়ে আমার কোনও আগ্রহ নেই প্রিয়তম। আমি স্রেফ আমাদিগেই আগ্রহী। ’
‘তোমার বিদ্রোহ স্রেফ কোমরের নিচেই সীমাবদ্ধ’—উইনস্টন বলল জুলিয়াকে। দারুণ বুদ্ধিতায় আর চতুরতায় সে এটা মেনে নিল আর তাকে দুবাহু বাড়িয়ে গভীর আনন্দ আলিঙ্গনে জড়াল।
পার্টির মতবাদের এসব শাখা-প্রশাখা নিয়ে তার সামান্যতম আগ্রহও নেই। যখনই উইনস্টন ইংসকের নীতি নিয়ে কথা বলে, দ্বৈতচিন্তা, অতীত মুছে দেওয়া, বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতার অস্বীকার, কিংবা নিউস্পিকে ব্যবহৃত শব্দ নিয়ে কথা তোলে—সে বিরক্ত হয়, তালগোল পাকিয়ে ফেলে আর বলে, এসবে তার আগ্রহ বা আকর্ষণ কোনও কালেই ছিল না। সবাই জানে এসব কিছুই ফালতু, তাহলে কেনই কেউ এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হবে? সে জানে কখন আনন্দিত হতে হবে, কখন ধুয়ো তুলতে হবে, আর কারও ঠিক সেটুকু জানলেই চলে। এরপরেও উইনস্টন যদি এসব বিষয় নিয়ে কথা চালিয়ে যেতে থাকে তখন সে আস্তে করে ঘুমিয়ে পড়ে। কিছু মানুষ আছে না, যে কোনও সময় যে কোনও স্থানে ঘুমিয়ে পড়তে পারে—সে তাদেরই একজন।
গোঁড়ামির মানেটা পর্যন্ত না জেনে নিজেকে একজন পাক্কা গোঁড়া হিসেবে সাজিয়ে রাখা যে কত সহজ তা জুলিয়ার সঙ্গে কথা বলেই প্রথম বুঝেছে উইনস্টন। কোনও না কোনওভাবে পার্টি খুব সফলতায় মানুষকে তাদের বোধে অক্ষম করে তুলতে পেরেছে। বাস্তবতার ভয়াবহ লঙ্ঘনটিও তারা মেনে নেয়, কারণ তারা কখনও জানেই না তাদের কাছে কী চাওয়া হচ্ছে, আর সরকার কোথায় কী ঘটিয়ে চলেছে তা নিয়ে তাদের আগ্রহও সামান্যই। স্রেফ নির্বুদ্ধিতার জোরেই ওরা হয়ে থাকে যৌক্তিক। তারা সবকিছু গলধঃকরণ করে, আর যা কিছুই গিলুক তাতে তাদের কোনও ক্ষতি-বৃদ্ধি হয় না, এর কোনও অবশিষ্টাংশ থাকে না। ভুট্টার একটি দানা যেমন পাখির ঠোঁট থেকে পেটে ঢুকে মলের সঙ্গে বেরিয়ে যায় ঠিক তেমন।
অধ্যায় ৬
অবশেষে ঘটনাটি ঘটল। প্রত্যাশিত বার্তাটি পৌঁছুল। গোটা জীবন ধরেই, বলা যায়, এমন কিছুর অপেক্ষা ছিল তার।
মন্ত্রণালয়ের লম্বা কোরিডোর ধরে হেঁটে যাচ্ছে। সেবার জুলিয়া যেখানে হোঁচট খেয়েছিল ঠিক তার কাছাকাছি যখন পৌঁছায় তখনই মনে হলো তার চেয়ে গায়ে-গতরে বড়সড়ো হবে এমন কেউ একজন ঠিক পিছনে। গলা খাকরির শব্দ কানে এলো। মনে হলো যিনি শব্দ করছেন তিনি কথা বলতে চান। উইনস্টন থামল আর ঘুরে তাকাল। ইনি ও’ব্রায়েন।
অবশেষে তারা মুখোমুখি, আর তার চেতনা ততক্ষণে বুঝি পুরোই উবে যাচ্ছে। হৃদযন্ত্রের ধুকপুকানি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মুখে কথা সরছে না। ও’ব্রায়েন অবশ্য যে ভঙ্গি আর গতিতে হাঁটছিলেন সেটাই বজায় রেখে এগিয়ে এলেন। উইনস্টনের বাহুতে তার একটি বন্ধুত্বের হাত এক লহমার জন্য পড়ল আবার সরে গেল। এবার দুজন পাশাপাশি হাঁটছে। তিনিই কথা বলতে শুরু করলেন যাতে মিশে আছে পুরোনো সেই অদ্ভুত সৌজন্যতা, ঠিক যা তাকে পার্টির অন্য সদস্যদের চেয়ে আলাদা করে রাখে।
‘তোমার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ খুঁজছিলাম’—বললেন তিনি। সেদিন ‘দ্য টাইমসে’ তোমার নিউস্পিক নিয়ে আর্টিকেলগুলোর একটি পড়লাম। তখন থেকেই মনে হচ্ছিল তোমার সঙ্গে কথা বলব। আমার ধারণা, নিউস্পিকের বিষয়ে তুমি কিছুটা পাণ্ডিত্যের আগ্রহ নিয়েছো।
উইনস্টন ততক্ষণে কিছুটা নিজেতে ফিরেছে। ‘পাণ্ডিত্যের কিছু নয়’—বলল সে। ‘আমি একজন নবীশ মাত্র। আর ওটি আমার বিষয়ও নয়। ভাষার সত্যিকারের কাঠামো নিয়ে আমার কখনওই কিছু করা হয়নি। ’
‘কিন্তু তুমি অত্যন্ত সুচারুভাবেই বিষয়টি লিখেছো’—বললেন ও’ব্রায়েন। ‘আর সেটা কেবল আমার একার মত না। সম্প্রতি এ নিয়ে তোমার এক বন্ধুর সঙ্গেও আমার কথা হয়, আর সে তো নিঃসন্দেহে একজন বিশেষজ্ঞ। তবে নামটা এখন ঠিক ভুলে গেছি। ’
আবারও ব্যথা ধরিয়ে লাফাতে লাগল উইনস্টনের হৃদযন্ত্র। তার মনে হলো রেফারেন্সের এই নামটি সাইম ছাড়া অন্য কারও হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সাইম তো কেবল মৃতই নয়, পুরোই বিলীন, এই নামে কখনওই কেউ ছিল না। তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনও কিছুর চিহ্নটিও এখন মৃত্যুসম ভয়াবহ। ও’ব্রায়েনের এই মন্তব্য নিঃসন্দেহে একটি সিগন্যাল বা কোড। থটক্রাইমের একটি ছোট্ট কাজের কথা তুলে ধরে তিনি মূলত দুইজনের মধ্যে যোগসাজশ টেনে দিলেন। ধীরে ধীরে তারা কোরিডোরের শেষ দিকটাতে চলে এসেছে। এবার ও’ব্রায়েন থামলেন। কৌতূহলী, চমৎকার বন্ধুত্বের চাহনি দিয়ে, স্বভাবজাত ভঙ্গিমায় চোখের চশমা জোড়া ঠিক করে নাকের ডগায় বসালেন। এবার বললেন:
‘আসলে আমি বলতে চাই, নিবন্ধে তুমি দুটি শব্দের ব্যবহার করেছো যা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে তা খুব সম্প্রতিই। তুমি কি নিউস্পিক অভিধানের দশম সংস্করণটি পড়ো নি?’
‘না’—বলল উইনস্টন। ‘আমি জানতাম না ওটি এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। রেকর্ডস ডিপার্টমেন্টে আমরা এখনও নবম সংস্করণ ব্যবহার করছি। ’
‘কয়েক মাসের মধ্যেই দশম সংস্করণ আসবে। কিছু অগ্রীম কপি বিতরণ করা হয়েছে। আমার কাছেও একটি আছে। আমার ধারণা, তুমি এটি দেখতে চাইবে?’
‘ভীষণভাবে’—অতি আগ্রহের সঙ্গে বলল উইনস্টন।
‘নতুন কিছু অগ্রগতি আছে তবে ভীষণ রকম স্বদেশীপনা তুমি এতে পাবে। ক্রিয়া পদগুলো কমিয়ে ফেলা হয়েছে—আমার ধারণা এটার একটা আবেদন তোমার কাছে থাকবে। দেখি, কেউ একজনকে দিয়ে তোমাকে একটা ডিকশনারি পাঠিয়ে দিতে পারি কি না। তবে নিঃসন্দেহে আমি ভুলে যাব। হতে পারে, সুবিধা মতো সময়ে তুমিই একদিন আমার ফ্ল্যাটে এসে ওটি নিয়ে যেতে পার। দাঁড়াও। তোমাকে ঠিকানাটা দিয়ে দিচ্ছি। ’
ওরা দুজনই টেলিস্ক্রিনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। অন্যমনষ্কতায় ও’ব্রায়েন তার দুই পকেটের ওপর হাত বুলিয়ে অস্তিত্ব বুঝে নিয়ে এবার বের করে আনলেন চামড়ার মলাটের একটা নোটবুক আর সোনালি রঙের একটা ইঙ্ক-পেন্সিল। ঠিক টেলিস্ক্রিনের নিচে এমন একটা স্থানে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন যেখান থেকে এই নোটবুকে যা লেখা হবে তা টেলিস্ক্রিনে চোখ রাখলেই অন্যরাও দেখতে পাবে। একটি পাতায় তিনি ঠিকানাটি লিখলেন আর তা ছিঁড়ে উইনস্টনের হাতে দিলেন।
‘সন্ধ্যায় আমি সাধারণত ঘরেই থাকি’—বললেন তিনি। ‘আর না থাকলে আমার কাজের লোকটি তোমাকে ডিকশনারিটি দিয়ে দেবে। ’
তিনি চলে গেলেন, এক টুকরো কাগজ হাতে ধরে উইনস্টন তখনও দাঁড়িয়ে। এই কাগজের টুকরো লুকিয়ে রাখার কোনও দরকার নেই। বরং খুব সতর্কতার সঙ্গে ওতে যা লেখা আছে তা স্মৃতিতে ধরে নিল, আর ঘণ্টা কয়েক পরে ওটি আরও অনেক কাগজের সঙ্গে স্মৃতি গহ্বরে চালান করে দিল।
মোটে মিনিট কয়ই হবে তারা দুজন কথা বলল। তবে এই ঘটনার একটাই অর্থ দাঁড়ায়; উইনস্টনকে জানিয়ে দেওয়া হলো ও’ব্রায়েনের ঠিকানা। এর দরকার ছিল, কারণ সরাসরি খোঁজ না করলে কারও পক্ষেই জানা সম্ভব নয়, কে কোথায় থাকে। ঠিকানায় কোথা থেকে কোথায় যাবে তার কোনও উল্লেখ নেই। আসলে ও’ব্রায়েন তাকে বলে গেলেন, ‘তুমি যদি কখনও আমার সঙ্গে দেখা করতে চাও তাহলে এই হলো আমার ঠিকানা। ’ হতে পারে ডিকশনারির ভেতরেও কোথাও লুকিয়ে দেওয়া হবে কোনও বার্তা। কিন্তু সে যাই হোক, একটি বিষয় পুরোই নিশ্চিত। যে ষড়যন্ত্র সে স্বপ্নেই শুধু দেখেছে তা বাস্তবে আকার নিচ্ছে। আর সে প্রায় তার কিনারায় পৌঁছে গেছে।
সে জানে, শিগগিরই নয়ত পরে ও’ব্রায়েনের ডাকে সাড়া দেবেই। হতে পারে আগামীকালই, অথবা হতে পারে অনেকদিন পর—কোনওটাই তার কাছে নিশ্চিত নয়। যা কিছু ঘটে চলেছে তা আসলে অনেক বছর আগে শুরু হওয়া একটি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। প্রথম পদক্ষেপটি ছিল গোপন এক অনৈচ্ছিক ভাবনায়, আর দ্বিতীয়টি আকার পায় ডায়রি লিখতে শুরু করার মধ্য দিয়ে। এতে তার ভাবনা রূপ নিল শব্দে আর এখন শব্দগুলো রূপ নিচ্ছে কাজে। আর শেষ পদক্ষেপটি এমন কিছু হবে যা ঘটবে ঠিক ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ের ভেতরেই। এটা সে মেনেই নিয়েছে। শুরুতেই নিহিত রয়েছে এর শেষ। তবে ভীতিকর দিক হচ্ছে; অথবা আরও নির্দিষ্ট করে বলা চলে, এ হচ্ছে মরার আগেই মৃত্যুর স্বাদগ্রহণ। এমনকি যখন ও’ব্রায়েনের সঙ্গে তার কথা চলছিল, তখন শব্দের অর্থগুলো তলিয়ে যাচ্ছিল, আর এক হীমশীতল কম্পন জাপটে ধরেছিল তার শরীর। তার মনে হচ্ছিল স্যাঁতস্যাঁতে কবরের মধ্যে পা ফেলেছে, আর এ যেন সেই কবর যা তার জন্যই অপেক্ষা করে ছিল।
অধ্যায় ৭
কান্নাভরা চোখে ফোঁপাতে ফোঁপাতে ঘুম ভাঙল উইনস্টনের। জুলিয়া গুটিসুটি হয়ে তার পাশে ঘুমিয়ে। ঘুমের ঘোরেই বলে উঠল, ‘কী হয়েছে?’
‘স্বপ্ন দেখেছি—’ বলতে ধরেই থেমে গেল সে। এমন জটিল স্বপ্ন শব্দে তুলে ধরা অসম্ভব। স্বপ্ন তো ছিলই, এর সঙ্গে যুক্ত হয় একটি স্মৃতি, যা ঘুমভাঙ্গার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মনের মাঝে সন্তরণ শুরু করে।
চোখ বন্ধ করে চিৎ হয়ে শুয়ে রইল সে, তখনও যেন স্বপ্নের ঘোরেই আচ্ছন্ন। একটি সুবিস্তৃত উজ্জ্বল স্বপ্ন যা তার গোটা জীবনটাকেই ধারণ করে সামনে তুলে ধরেছে। গ্রীষ্মের বিকেলে বৃষ্টির পর দৃশ্যপট যেমন স্পষ্ট হয়ে ওঠে ঠিক যেন তেমনই। পুরোটাই ঘটে গেছে কাচের পেপারওয়েটের ভেতরে, আর এর উপরিতলটি যেন হয়েছিল আকাশের ছাদ। সেই ছাদের নিচে সবকিছুই যেন স্বচ্ছ মোলায়েম আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে আর সেখানে অতিদূরের বস্তুও স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে চোখে। স্বপ্নমাঝে আরও এলো তার মায়ের ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখা বাহু, আর তার সঙ্গে মিশে গেল ত্রিশ বছর পরে খবরের ভিডিওচিত্রে দেখা সেই ইহুদি নারীর বাহুখানি যা টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে যাওয়ার আগে বুলেটের আঘাত থেকে প্রাণপণে বাঁচাতে চেষ্টা করছিল ছোট্ট শিশুটিরে।
‘তুমি কী জানো’—বলল সে, ‘এখনও আমার মনে হয়, আমিই আমার মাকে হত্যা করেছি?’
‘কেন তুমি হত্যা করলে তোমার মাকে?’ ঘুমের ঘোরেই বলল জুলিয়া।
‘না ঠিক হত্যা নয়! শারীরিকভাবে হত্যা বলা যাবে না!’
স্বপ্নে এসেছিল মায়ের সঙ্গে তার শেষ দেখা হওয়ার দৃশ্যটিও। কিন্তু ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার কয়েক দণ্ডের মধ্যে ছোট ছোট ঘটনাকে ঘিরে সেই স্মৃতি তার মনে এসে পুরো দানা বাঁধলো। এ এমন এক স্মৃতি যা সে ইচ্ছাকৃত সচেতনতায় ঠেলে দূরে সরিয়ে রেখেছে অনেক বছর। তারিখটি ঠিক মনে নেই, তবে তখন তার বয়স দশ বছরের কম হবে না, হতে পারে বারো বছর বয়স তার তখন।
বাবা নিখোঁজ হন তারও কিছু আগে, কতটা আগে তা মনে নেই। তবে ভালো করেই মনে আছে, সে ছিল শোরগোলের এক অস্থির সময়। ভীতিকর বিমান হামলা, আর টিউব স্টেশনে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনা ক’দিন পরপরই ঘটত। এখানে সেখানে ইট-পাথরের ধ্বংসস্তূপ, সড়কের কোণায় কোণায় অবোধ্য সব ঘোষণার পোস্টার সাঁটা, একই রঙের শার্ট পরে যুবকরা বেকারিগুলোর বাইরে বিশাল লাইন ধরে দাঁড়িয়ে, থেকে থেকে দূর থেকে ভেসে আসছে মেশিনগানের গর্জন… সর্বোপরি, এটাই বড় বাস্তবতা যে, পর্যাপ্ত খাবার ছিল না কারও। তার মনে আছে, অনেক দীর্ঘ বিকেল তার কেটেছে আরও ছেলেদের সঙ্গে ডাস্টবিনের ময়লা স্তূপ ঘেঁটে ঘেঁটে বাঁধাকপির পাতা থেকে ডাঁটা আর আলুর ছোবড়া কুড়িয়ে, কখনও পেয়ে যেত এক আধ টুকরো রুটি, সতর্কে ময়লা ছড়িয়ে তা খেত আর পথ দিয়ে কখন আসে কোনও ট্রাক তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। গবাদির খাদ্যবাহী সেসব ট্রাক সড়কের এবড়ো থেবড়ো অংশে ঝাঁকি খেলে তা থেকে পড়ত খৈলের গুঁড়ো।
যখন তার বাবা নিখোঁজ হলেন, মাকে তার এতটুকু বিস্মিত বা বিচলিত মনে হলো না, দেখালেন না কোনও সহিংস শোকেরও প্রকাশ। কিন্তু হঠাৎই যেন পাল্টে গেলেন তিনি। যেন পুরোই এক নিষ্প্রাণ মানবী। উইনস্টনের তখন মনে হতো তার মা যেন কোনও কিছুর অপেক্ষায়, আর তিনি জানতেন নিশ্চিতভাবেই তা ঘটবে।
প্রয়োজনীয় সব কাজই করতেন মা—রান্না, ধোওয়া-মোছা, সারাই, বিছানা পাতা, ঝাড়-মোছ, আগুনের চুল্লি জ্বালানো—এসবই করতেন, কিন্তু অতি ধীর লয়ে, তাতে থাকত না সামান্য প্রাণের ছাপ। যেন চিত্রপটে আঁকা কোনও মানবীর শরীর ধীরে ধীরে নিজের স্থানে থেকেই নড়াচড়া করছে। তার বড় সুডৌল তনুখানি মনে হতো যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে গেছে। কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিছানায় অনড় বসে বসে তার ছোট বোনটির সেবায় কাটিয়ে দিতেন। ক্ষীণকায়, রোগাক্রান্ত অতি নীরব এক শিশু। বয়স দুই কি তিন হবে, শুকনো মুখখানি বানরের মতো দেখতে। কোনও কোনও দিন উইনস্টনকে কাছে টেনে নিতেন আর দীর্ঘ সময় ধরে তাকে বুকে চেপে ধরে রাখতেন, মুখে রা শব্দটিও থাকত না। ছোট হলেও, আর কিছুটা স্বার্থপরতার পরেও সে তখন বুঝত এই বুকে চেপে রাখার সঙ্গে ওই ঘটতে চলা ঘটনাটির সম্পর্ক রয়েছে যা তার মা তাকে মুখ ফুটে বলছেনই না।
তার মনে পড়ে যে কামরায় তারা থাকত সেটি ছিল অন্ধকার, গুমোট গন্ধময় যার অর্ধেকটা জুড়েই ছিল সাদা চাদর পাতা একটি বিছানা। ফেন্ডারের ভেতরে গ্যাসের চুলা বসানো ছিল আর খাবার তুলে রাখার তাক। বাইরের আঙ্গিনায় মাটির পাড়ের একটি কূপ, কয়েকটি পরিবার মিলে পানির ব্যবহার চলত। তার মনে পড়ে মায়ের স্থির অনড় দেহখানি গ্যাসের চুলায় কড়াই বসিয়ে দিয়ে কিছু একটা রান্নায়রত।
সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে সদাই এক ক্ষুধার্ত সে, আর খাবারের বেলা এলেই যে ঘৃণ্য লড়াইয়ে সামিল হতে হতো সে কথাও। মায়ের সঙ্গে সারাক্ষণ ঘ্যান-ঘ্যান, কেন খাবার থাকে না? মাঝে মাঝে চিৎকার-চেঁচামেচিও জুড়ে দিত, মায়ের ওপর ঝাপিয়ে পড়ত (আজ এই সময় নিজের গলার স্বরটিও তার মনে পড়ে, যা কৈশোরের একটু আগেই ভেঙ্গে কর্কশ শোনাত, আর মাঝে মাঝে তা থেকে অদ্ভুত শব্দ বের হতো) অথবা খাবারের ভাগ বেশি পাওয়ার জন্য নাকি-কান্না জুড়ে দিত।
তার মা বরাবরই ভাগে যতটুকু তার চেয়ে বেশিই দিতেন। তিনি মেনেই নিয়েছিলেন, সে ‘ছেলে’ বলে তার ভাগটা সবচেয়ে বড়; কিন্তু মা যত বেশি তাকে দিতেন সে চাইত তার চাইতেও বেশি। প্রতিবেলা খাবারের সময় মা তাকে বোঝাতেন এমন স্বার্থপরের মতো করতে নেই, ছোট্ট বোনটি অসুস্থ, ওর বেশি খাওয়া দরকার, কিন্তু কোনও কথাই গায়ে মাখত না। পাতে তার হাতাভর্তি হয়ে খাবার পড়তে থাকবে, বন্ধ হলেই চিৎকার, কখনও কখনও কড়াই ও চামচ সমেত কেড়ে নিতে চাইত। খাবলা মেরে তুলে নিত বোনের পাতের খাবার।
সে জানত তার কারণেই অন্য দুজন অভুক্ত থাকছে, কিন্তু কাজটি সে না করে পারত না; আর এমনকি তার ভাবনাও ছিল যা সে করছে সে তার অধিকার। পেটের রাক্ষুসে ক্ষুধার কারণেই এসব অসদাচরণ তার কাছে সঠিক বলে মনে হতো। আর দুই বেলা খাবারের মাঝে মা আশেপাশে না থাকলেই তাকে তুলে রাখা খাবারের ওপর হানা দিত সে।
একদিন চকলেটের রেশন জারি হলো। গত কয়েক সপ্তাহ কিংবা মাসে এই প্রথম রেশনে মিলল চকোলেট। তার খুব স্পষ্টই মনে পড়ে, কী দারুণ ছিল ছোট ছোট চকোলেটের টুকরোগুলো। এক ফালিতে দুই-আউন্স (তখনও তাদের আউন্সের হিসাব চলত)। আর তা সমান তিন খণ্ডে ভাগ করা যেত। এটাই হওয়ার কথা, তিন জন এক টুকরো করে পাবে। কিন্তু আজও উইনস্টন যেন কানে শুনতে পায়, পুরো চকোলেট একা খাবে বলে তার সে কি তারস্বরের চিৎকার। টানা ঘ্যানঘ্যান, আর মুখে মুখে কথা চালাল মায়ের সঙ্গে। আর চিৎকার-চেঁচামেচি, অনুযোগ, চোখের পানি, ওজোর-আপত্তি, প্যানপ্যানানি।
তার শীর্ণকায় বোনটি দুই হাতে মাকে আঁকড়ে ধরে আছে, ঠিক যেন বানরশিশু। আর মায়ের ঘাড়ের উপর দিয়ে তার দিকে ড্যাবড্যাবে করুণ চোখে চেয়ে আছে। অবশেষে চকোলেটের চার-ভাগের তিন ভাগ তাকে দিতে বাধ্য হলেন মা আর অপর একভাগ তার বোনকে দিলেন। ছোট্ট মেয়েটি ওটি হাতে ধরে বসে আছে আর ভ্যবলা চোখে তাকিয়ে রয়েছে, মনে হয় বুঝতেই পারছে না বস্তুটি দিয়ে কী করবে। ওই টুকরোটির ওপরও উইনস্টনের লোভী নজর পড়ল। সুযোগ বুঝে ওটি ছোঁ মেরে নিয়ে দরজা ঠেলে দৌড়ে পালাল।
‘উইনস্টন, উইনস্টন!’—পেছনে ডাক জুড়ে দিলেন মা। ‘ফিরে এসো, বোনের চকোলেট ফেরত দাও। ’ সে থামল, কিন্তু ফিরল না। তার মায়ের উদ্বিগ্ন চোখ দুটো তার চোখে স্থির হয়ে থাকল কিছুক্ষণ। আজও সে জানতে পারেনি, কী ছিল সেই ঘটনা যা ঘটতে ধরেছিল, যা নিয়ে ছিল মায়ের এত উদ্বেগ।
বোনটি, তার হাত থেকে কিছু একটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে বুঝতে পারলেও দুর্বল করুণ চাহনি ছাড়া আর কোনও অভিব্যক্তিই দেখাল না। তার মা দুই হাতে কন্যাকে আরও একটু আগলে নিয়ে মুখটি বক্ষমাঝে চেপে ধরলেন। মায়ের ভাবভঙ্গিতে মনে হলো বোনটি বুঝি তার মরেই যাচ্ছে। কিন্তু তোয়াক্কা না করে সে ঘুরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে পালাল, হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে আছে সেই চকোলেট।
এরপর মাকে আর দেখেনি সে। চকোলেট সাবাড় করে তার মধ্যে এক ধরনের লজ্জাবোধ হতে লাগল। কয়েক ঘণ্টা এই রাস্তা, সেই গলি ধরে হাঁটল, এক পর্যায়ে ক্ষুধাই তাকে আবার ঘরে টেনে নিল। যখন ফিরে আসে ততক্ষণে মা নিরুদ্দেশ। হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা তখন অহরহই ঘটছে। কামরার সব কিছুই ঠিকঠাক, কেবল নেই তার মা আর বোনটি। ওরা কোনও কাপড় নিয়ে যায়নি, মায়ের ওভারকোটটিও ঘরে পড়ে আছে।
আজ পর্যন্ত সে কোনও পথেই নিশ্চিত হতে পারেনি, তার মায়ের মৃত্যু হয়েছে। এটা খুবই সম্ভব, তাকে জবরদস্তি শ্রম শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার বোনটির কী হতে পারে? হতে পারে তাকেও উইনস্টনের মতোই বাস্তুহীন শিশুদের কলোনিগুলোর (ওরা বলে পুনরুদ্ধার কেন্দ্র) একটিতে পাঠানো হয়েছিল। এখানকার শিশুরা গৃহযুদ্ধের শিকার শিশু হিসেবেই বড় হয়। অথবা বোনটিকেও শ্রম ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে তার মায়ের সাথে। অথবা অন্য কোথাও ফেলে দেওয়া হয়েছে স্রেফ মরে যাওয়ার জন্য।
স্বপ্নের দৃশ্য মনের মধ্যে এখনও উজ্জ্বল। বিশেষ করে ভাঁজ করা হাতের আড়ালে জীবনকে আশ্রয় দেওয়ার চেষ্টায় রত থাকার সেই অভিব্যক্তি যেন পূর্ণ অর্থবহ হয়েই মনের মাঝে ধরে আছে। তার মনে এলো মাস দুয়েক আগের আরও একটি স্বপ্নের কথা। সাদা-চাদর পাতা নোংরা বিছানার সিথানে তার মা ঠিক যেভাবে বসে শিশুটিরে কোলের মধ্যে আঁকড়ে ধরে রাখতেন, সেভাবেই যেন তিনি বসেছিলেন ডুবন্ত সেই জাহাজের পাটাতনে, তার চেয়ে অনেক গভীরে, আর প্রতি মিনিটেই আরও গভীর থেকে গভীরে ডুবে যাচ্ছিলেন, আর তখনও ক্রমেই অন্ধকার ছেয়ে যাওয়া পানির তলদেশ থেকে উর্ধ্বপানে তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
মায়ের হারিয়ে যাওয়ার গল্পটি জুলিয়াকে শোনাল সে। চোখ না খুলেই জুলিয়া আরও কুঁকড়ে আরও একটু আরাম খুঁজে নিল। ‘আমার ধারণা সেসময়ে পাষণ্ড এক ছোট্ট শুকর বৈ কিছু ছিলে না তুমি’—অস্ফুট স্বরে বলল সে। ‘সবগুলো শিশুই একেকটা শুয়োর। ’
‘হ্যাঁ তা ঠিক। কিন্তু ঘটনার মূল দিকটা হচ্ছে—’
জুলিয়ার ঘন নিঃশ্বাস বলে দিচ্ছে আবারও গভীর ঘুমে ডুবেছে সে। মায়ের কথা আরও বলতে পারলে ভালো লাগত। যতটুকু, যেটুকু স্মরণ হয় তাতে তিনি অসাধারণ কোনও নারী ছিলেন বলে মনে হয় না, বুদ্ধিমতী কেউ ছিলেন এমনটাও কম মনে হয়। তারপরেও বলা যায়, তার মধ্যে এক ধরনের মহত্ব, এক ধরনের খাঁটিত্ব ছিল। যে জীবনমান তিনি মেনে চলতেন তা ছিল স্রেফ তার ব্যক্তিগত, তার নিজের মতো। তার অনুভূতিগুলো ছিল নিজের, বাইরে থেকে কোনওভাবেই তা বদলানো যেত না। অপ্রয়োজনীয় কোনও ঘটনাও তার কাছে অর্থহীন মনে হতো না। তুমি যদি কাউকে ভালোবাসো, তাকে ভালোই বাসো, যখন তাকে দেওয়ার আর কিছুই থাকবে না তখনও তুমি তাকে ভালোবাসা দাও।
চকোলেটের শেষ টুকরোটিও যখন হাতছাড়া হয়ে গেল মা বাহু দিয়েই শিশুটিরে জড়ালেন। এর কোনও মানে তো হয় না, এতে কিছুই পাল্টে যাবে না, চকোলেটও আসবে না, শিশুটির কিংবা তার নিজের জীবন রক্ষাও পাবে না, কিন্তু তিনি সেটাই করলেন। প্রকৃতিগতভাবেই তিনি এমন। নৌকোর সেই উদ্বাস্তু নারী তার বাহু দিয়ে শিশু ছেলেটিরে আগলে ধরেছিলেন, বুলেটের সামনে সে হাত ছিল কাগজের পাতার মতো ঠুনকো। পার্টি যে ভয়াবহ কাজটি নিশ্চিত করেছে তা হচ্ছে—আপনাকে এমনভাবে প্ররোচিত করেছে যাতে আপনার কাছে ইচ্ছা বা অনুভূতিগুলো স্রেফ মূল্যহীন হয়ে যায়। আর একই সাথে এই বাস্তব জগতে আপনার সকল শক্তিই ওরা ডাকাতি করে নিয়ে গেছে। একবার পার্টির আগলে পড়েছেন তো, আপনি কী ভাবলেন কিংবা ভাবলেন না, আপনি কী করলেন বা করা থেকে বিরত থাকলেন তার মধ্যে বাস্তবিক অর্থেই আর কোনও ফারাক থাকল না।
আপনাকে নিয়ে বা আপনার ওপর যা কিছু হয়েছে তা নির্মূল করা হয়ে গেছে, এখন আপনাকে কিংবা আপনার কোনও কাজের কথা কেউ আর শুনতেও পাবে না। ইতিহাসের স্রোত থেকে আপনাকে পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়েছে। আর মাত্র দুই প্রজন্ম আগের মানুষের কাছে এসবের কোনও গুরুত্ব ছিল বলেই মনে হয় না। কারণ তারা ইতিহাস বদলে দিতে চায়নি। তারা ব্যক্তিগত বিশ্বাসবোধেই পরিচালিত হতো, যা নিয়ে তাদের কোনও প্রশ্নও ছিল না। তাদের কাছে ব্যক্তিগত সম্পর্কের মূল্য ছিল, একটি অসহায়ত্বের অভিব্যক্তি, একটি আলিঙ্গন, একটি কান্না, মৃত্যুপথযাত্রীর অন্তিম ইচ্ছা—এ সবকিছুই ছিল মূল্যবান। হঠাৎই তার মাথায় খেলে গেল, মূলত প্রোলরা এখনও সেই অবস্থায় রয়েছে। তারা কোনও পার্টির প্রতি বিশ্বস্ত নয়, কোনও দেশের প্রতি নয়, নয় কোনও আদর্শের প্রতিও, তারা মূলত একে অন্যের প্রতি বিশ্বস্ত।
জীবনে এই প্রথমবার প্রোলদের ব্যাপারে তার ঘৃণাবোধ কাজ করল না অথবা মনে হলো না, ওরা এক সুপ্ত শক্তি যারা একদিন জীবনের টানে উত্থিত হবে, আর বিশ্বকে নতুন করে গড়বে। বরং তার মনে হলো প্রোলরা মানুষ হয়েই থেকে যাবে। তারা ভেতরে ভেতরে কঠিন হয়ে উঠবে না। তারা আদিম অনুভূতিকেই মনের ভেতর ধারণ করে রাখবে, যা তার নিজের পক্ষে স্রেফ সচেতন প্রচেষ্টায় শেখা সম্ভব। এসব ভাবতে ভাবতেই প্রসঙ্গহীনভাবেই তার মনে পড়ে গেল কিভাবে সপ্তাহ কয়েক আগে সে ফুটপাতে পড়ে থাকা রক্তাক্ত একটি বিচ্ছিন্ন হাত স্রেফ বাঁধাকপির ডাঁটার মতো জ্ঞান করে এক লাথিতে নর্দমায় ফেলে দিয়েছিল।
‘প্রোলরাই প্রকৃত মানুষ’—উচ্চৈস্বরে বলল সে। ‘আমরা মানুষই না। ’
‘কেন নই?’—বলল জুলিয়া, ফের ঘুম ভেঙ্গেছে তার।
এক দণ্ড ভাবল সে। ‘তোমার কি কখনও মনে হয়েছে’—বলল সে, ‘আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো কাজটি হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব এই ডেরা ছেড়ে দেওয়া আর দুজন দুজনার সঙ্গে আর কখনও দেখাটি পর্যন্ত না করা?’
‘হ্যাঁ প্রিয়তম বেশ ক’বারই সে কথা ভেবেছি। তবে আমি কিন্তু তা মোটেই করতে যাচ্ছি না, কারণ ওটা করা আর না করা সমান কথা। ’
‘আমরা ভাগ্যবান’—বলল সে, ‘কিন্তু এই পরিস্থিতি বেশিদিন এমন থাকবে না। তুমি তরুণী, তোমাকে সাধারণ আর নিষ্পাপ মনে হয়। আমার মতো মানুষগুলো থেকে দূরে থাকতে পারলে আরও পঞ্চাশটি বছর অনায়াসে বাঁচতে পারবে। ’
‘আরে না। পুরো বিষয়টি আমি ভেবে রেখেছি। তুমি কী করবে, আমি কী করতে যাচ্ছি, তার সবকিছু। এত হতোদ্যম হয়ো না। বেঁচে আমরা থাকবই, ভালো করেই থাকব। ’
‘ধরো আরও ছ’টি মাস আমরা এভাবে একসাথে থাকলাম—হতে পারে এক বছর—কেউ জানবে না। কিন্তু অন্তে বিচ্ছেদ আমাদের অনিবার্য। তুমি কি বুঝতে পারো তখন আমরা কতটা একা হয়ে যাব। যখন ওরা আমাদের ধরে ফেলবে, তখন আর কিছুই থাকবে না, কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তখন আমরা একজনের জন্য অন্যজন কোনও কাজেই আসব না। আমি যদি স্বীকারোক্তি দেই, ওরা তোমাকে গুলি করবে, আর আমি যদি স্বীকারোক্তিতে অস্বীকার করি, তাতেও ওরা তোমাকে গুলিই করবে। আমি কিচ্ছুটি করতেও পারব না, বলতেও পারব না, কিংবা আমাকে বলা থেকে বিরতও রাখতে পারব না, তোমার অনিবার্য মৃত্যুকে আমি বড়জোর মিনিট পাঁচেক পিছিয়ে দিতে পারব মাত্র। আমাদের দুজনের কেউই জানতেও পারব না, অন্যজন বেঁচে আছি, নাকি মৃত। আমাদের সত্যিকার অর্থেই আর কোনও শক্তি অবশিষ্ট থাকবে না। একটি বিষয়ই শুধু এখানে গুরুত্ব পাবে তা হচ্ছে আমরা একজন অন্যজনের সঙ্গে প্রতারণা করছি কি না, অবশ্য তাতেও অতি সামান্য ভিন্নতাও নিশ্চিত হবে না।
‘তুমি যদি স্বীকারোক্তির কথা বলো’—বললো জুলিয়া, ‘আমরা সন্দেহাতীতভাবেই সেটা করব। সবাই সর্বদা স্বীকার করে নেয়। তুমিও তার বাইরে যেতে পারবে না। ওরা তোমাকে নির্যাতন করেই তা করাবে। ’
‘আমি ঠিক স্বীকারোক্তি বলতে চাইনি। স্বীকারোক্তি মানে প্রতারণা বা বিশ্বাসঘাতকতা নয়। তুমি কী বললে বা করলে তাতে কিছু যায় আসে না। এখানে অনুভূতিটিই মুখ্য। ওরা যদি আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার অনুভূতিকে বন্ধ করে দিতে পারে—সেটাই হবে প্রকৃত প্রতারণা।
বিষয়টি জুলিয়াকেও ভাবিয়ে তুলল। ‘ওরা তা করতে পারবে না’—অবশেষে বলল সে। ‘এই একটি কাজ ওরা করতে পারে না। ওরা তোমাকে দিয়ে যা কিছু ইচ্ছা বলিয়ে নিতে পারবে, কিন্তু তা তোমাকে বিশ্বাস করাতে পারবে না। ওরা তোমার ভেতরটাতে ঢুকতে পারবে না। ’
‘না’—কিছুটা আশা জাগানিয়া কণ্ঠে বলল সে, ‘না; এটা বেশ সত্য বলেছো। ওরা তোমার ভেতরটাতে ঢুকতে পারবে না। তুমি যদি অনুভব করো মানুষ হয়ে থাকাটাই ভালো, এমনকি যখন তা কোনও ফল বয়ে আনে না তখনও, তাতে ওদের হারিয়েই দেওয়া হয়।
টেলিস্ক্রিনের সদা-সজাগ কান পেতে রাখার কথা ভাবনায় এলো তার। ওরা আপনার ওপর দিন-রাত চরগিরি করতে পারে, কিন্তু আপনার মাথাটি যদি ঠিক থাকে ওদের ফাঁকি দিতে পারবেন। ওদের সকল চাতুর্য দিয়েও অন্য একটি মানুষ কী ভাবছে তা জানার রহস্য রপ্ত করতে পারেনি। হতে পারে আপনি যখন ওদের কব্জায় চলে যাবেন তখন এগুলো অপেক্ষাকৃত কম সত্য হয়ে উঠবে। ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ের ভেতরে কী ঘটে তা কেউ জানতে পারে না। তবে অনুমান নিশ্চয়ই করা যায়: নির্যাতন, মাদক, কিছু বিশেষ যন্ত্রপাতির ব্যবহার যা আপনার স্নায়বিক প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করবে, অনিদ্রা, একাকীত্ব আর উপর্যুপরি জিজ্ঞাসাবাদে ধীরে ধীরে আপনি কাবু হয়ে যাবেন।
তখন সত্য আর কোনও পথেই লুকিয়ে রাখা যাবে না। তারা তদন্তের মধ্য দিয়ে তা বের করে আনবে, ওরা নির্যাতনে নির্যাতনে আপনাকে কুঁকড়ে দেবে। কিন্তু আপনার উদ্দেশ্য যদি স্রেফ বেঁচে থাকা না হয়ে হয় মানুষ হয়ে থাকা, তখন এসব কিছুই কোনও ভিন্নতা এনে দেবে না। ওরা আপনার অনুভূতিকে বদলে দিতে পারবে না; সে জন্য আপনিও সেগুলো নিজে বদলে ফেলতে পারবেন না, চাইলেও না। ওরা সর্বোচ্চ আপনি যা কিছু করেছেন বা বলে ফেলেছেন তাই উন্মোচন করতে পারবে, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে যা কিছু ঘটে, যা কিছু আপনার নিজের কাছে রহস্যময়, তা অব্যক্তই থেকে যাবে।
অধ্যায় ৮
তারা কাজটা করল! অবশেষে কাজটা তারা করেই ফেলল!
যে কক্ষে তারা দাঁড়িয়ে সেটি লম্বাটে গড়নের, হালকা একটা আলো জ্বলছে। টেলিস্ক্রিনের ভলিউম এতটাই কমানো যে বিড়বিড় শব্দ হচ্ছে। মেঝের ঘন নীল রঙের গালিচায় পা ফেললে মখমলের বিছানার মতো মোলায়েম মনে হবে। কক্ষের অপর প্রান্তে একটি সবুজ ঢাকনাওয়ালা আলোর নিচে পাতা টেবিলে বসে আছেন ও’ব্রায়েন। বাড়ির চাকরটি জুলিয়া আর উইনস্টনকে পথ দেখিয়ে যখন এই ঘরে নিয়ে এলো তখন সামান্য চোখ তুলেও দেখলেন না তিনি।
উইনস্টনের হৃদযন্ত্র এতটাই লাফাচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল কথাই বলতে পারবে না। তারা কাজটা করল! অবশেষে কাজটা তারা করেই ফেলল! কেবল এ কথাই তার মন জুড়ে বিচরণ করছে। এখানে পৌঁছানোই এক গর্হিত কাজ, আর দুজন একসঙ্গে আসা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা, যদিও দুজন দুই ভিন্নপথেই এখানে এসেছে আর ও’ব্রায়েনের দরজার গোড়াতেই তাদের দেখা। এমন একটি স্থানে ঢুকে পড়ার জন্য দরকার শক্ত স্নায়ুশক্তি। ইনার পার্টির কেউ কারও আবাসস্থলের কথা জানতে পারবে এমনটা বিরল ঘটনা, আর কারও ঘরে ঢুকে পড়া তো নিতান্তই অসম্ভব। বড় বড় ফ্ল্যাটবাড়ির ব্লকগুলো মিলিয়ে এই পুরো পরিবেশ সবকিছুর প্রাচুর্য আর প্রকাণ্ডতাই তুলে ধরে। নাকে লাগছে সুখাদ্যের সুঘ্রাণ, সেরা তামাকের গন্ধ। নীরব আর অবিশ্বাস্য দ্রুতগতির লিফটগুলো উপর নিচ করে যাচ্ছে, সাদা পোশাকে চাকরেরা ব্যস্ত-ত্রস্ত হয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে—এই সবকিছুই যেন ভীতিকর ঠেকছে। যদিও এখানে আসার একটা যুতসই অজুহাত তার হাতে আছে, তারপরেও প্রতিটি পা ফেলার সময়ই একটা ভয় কাজ করছিল, ভবনের কোনও কোণা বা ঘুপচি থেকে এই বুঝি কালো উর্দিধারী প্রহরী সামনে লাফিয়ে পড়ছে আর কাগজপত্র চাইছে, নয়ত তাকে বেরিয়ে যাওয়ার হুকুম দিচ্ছে। ও’ব্রায়েনের চাকরটি, অবশ্য, তাদের দুজনকেই কোনও বিপত্তি ছাড়াই এখানে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। সাদা জ্যাকেটে বেটে-খাটো কালো চুলের লোকটির হীরক আকৃতির অভিব্যক্তিবিহিন মুখ, হতে পারে চীনাদের মতো। যেই পথে সে ওদের এগিয়ে নিয়ে এলো সেটিও ছিল গালিচামোড়ানো। ক্রিম-রঙা কাগজে ঢাকা দেয়াল আর ধবধবে সাদা, পরিচ্ছন্ন পর্দা ঝুলছে। ওগুলোও ভয় ধরিয়ে দেওয়ার মতো। উইনস্টনের চোখে বা মনে একটি দেয়ালও ভেসে উঠল না যা মানব শরীরের ঘঁষায়-গন্ধে নোংরা নয়।
হাতের আঙুলে একটি কাগজের টুকরো ধরে রাখা ও’ব্রায়েনের। ধারণা করা যায় ওটাই মনযোগ দিয়ে পড়ছেন তিনি। তার প্রকাণ্ড মুখমণ্ডল একটু ঝোঁকা ফলে তার নাকের পার্শ্বআকৃতিটি চোখে পড়ল, সবমিলিয়ে তাকে ভয়ঙ্কর আর বুদ্ধিমান দুইই মনে হচ্ছিল। বিশ সেকেন্ডের মতো হবে তিনি কোনও ধরনের নড়াচড়া না করেই বসে থাকলেন। এরপর স্পিকরাইটটি নিজের দিকে টেনে নিলেন এবং মন্ত্রণালয়ের শংকর ভাষায় বেশ কাটাকাটা উচ্চারণে একটি বার্তা পড়লেন:
‘আইটেমস ওয়ান কমা ফাইভ কমা সেভেন অ্যাপ্রুভড ফুলওয়াইজ স্টপ সাজেশন কনটেইনড আইটেম সিক্স ডাবলপ্লাস রিডিকুলাস ভারজিং ক্রাইমথিংক ক্যান্সেল স্টপ আনপ্রসিড কনস্ট্রাকশনওয়াইজ অ্যান্টেগেটিং প্লাসফুল এস্টিমেটস মেশিনারি ওভারহেডস স্টপ এন্ড মেসেজ। ’
এবার চেয়ার ছেড়ে উঠলেন আর নিঃশব্দ গালিচায় পা ফেলে ফেলে ওদের দিকে এগুলেন। নিউস্পিকের শব্দগুলোর সাথে সাথে তার ওপর থেকে দাপ্তরিক ভাবটাও কিছুটা ঝড়ে গেল, তবে তার অভিব্যক্তি অন্যান্য সময়ের চেয়ে কিছুটা কর্কশ মনে হলো, যেন কাজের পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ায় অসন্তুষ্ট। একটা সাধারণ অস্বস্তিও ভর করল উইনস্টনের ভীতির ওপর।
তার মনে হতে লাগল স্রেফ একটা অতি নির্বোধের কাজ সে করে ফেলেছে। ও’ব্রায়েন একজন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকারী হবেন এমন কীই প্রমাণ তার কাছে আছে? কিছুই নেই, স্রেফ চোখের দৃষ্টিতে সামান্য সেই ঝলকানিটুকু ছাড়া। আর একটি মাত্র অতি অস্পষ্ট উক্তি। এর বাইরে বাকিটা সবই তার অতি গোপন কল্পনা, আর স্বপ্নে দেখা ঘটনা। ডিকশনারি নিতেই এখানে আসা, সে যুক্তি ধোপে টিকবে না, কারণ তাতে জুলিয়ার উপস্থিতির কোনও ব্যাখ্যা নেই। ও’ব্রায়েন যখন টেলিস্ক্রিনের সামনে দিয়ে এগিয়ে গেলেন তার মনোজগতে এসব ভাবনাই খেলে যাচ্ছিল। ও’ব্রায়েন থামলেন, পাশ ঘুরে দেয়ালের ওপর একটি সুইচ টিপলেন। টেলিস্ক্রিনের শব্দ থেমে গেল।
জুলিয়ার মুখ থেকে একটা ছোট্ট শব্দ বেরিয়ে এলো, বিস্ময় প্রকাশে সে শব্দটুকুই যথেষ্ট। আর এত ভীতির মাঝেও উইনস্টন সে ঘটনায় এতটাই আলোড়িত হলো যে নিজের কণ্ঠকে বশে রাখতে পারল না।
‘আপনি এটা বন্ধ করে দিতে পারেন!’—বলল সে।
‘হ্যাঁ পারি’—বললেন ও’ব্রায়েন। ‘আমরা বন্ধ করে দিতে পারি, আমাদের এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ’
ততক্ষণে ও’ব্রায়েন তাদের সামনাসামনি দাঁড়িয়েছেন। তার দৃঢ়-কঠিন বপুখানি ওদের দুজনেরই মাথা ছাড়িয়ে, আর মুখের অভিব্যক্তি তখনও অনির্ণেয়। মনে হচ্ছিল উইনস্টনের মুখ থেকে কথা শোনার জন্য ভীষণ অপেক্ষায় তিনি, কিন্তু কী কথা তা স্পষ্ট নয়। আবার এও মনে হচ্ছে তিনি স্রেফ ব্যস্ত একটি মানুষ, কাজে ব্যাঘাত ঘটানোর কারণটিই জানতে চান। সব কটি মানুষই চুপ। টেলিস্ক্রিন বন্ধ করে দেওয়ায় গোটা কামরায় কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। প্রতিটি ক্ষণ কাটতেই যেন লেগে যাচ্ছে দীর্ঘ সময়। অনেক কষ্টে উইনস্টন তার চোখ ও’ব্রায়েনের চোখে ধরে রাখতে পারছে। আর তখনই হঠাৎ সেই মুখ ভিন্ন অভিব্যক্তি দেখাল। একটি মৃদু হাসি ফুটে উঠল ও’ব্রায়েনের মুখে। সহজাত ভঙ্গিমায় চশমা জোড়া নেড়েচেড়ে নাকের ডগায় বসিয়ে নিলেন।
‘কথাটি আমিই বলব, নাকি তুমি?’—বললেন তিনি।
‘আমিই বলব’—দ্রুততায় বলল উইনস্টন। ‘বস্তুটি কি আসলেই বন্ধ করা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ সব কিছুই বন্ধ করা হয়েছে, এখানে এখন স্রেফ আমরাই। ’
‘আমাদের এখানে আসার হেতু হচ্ছে…’
থামল সে, এই প্রথম তার মনে হলো, আসলে কী উদ্দেশ্যে আসা তা তার নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়। আর যেহেতু সে জানেই না ঠিক কী ধরনের সাহায্য সে ও’ব্রায়েনের কাছে চায়, সেহেতু কেন এখানে আসা তা বলাও কঠিন। কিন্তু কথা শুরু করল সে, যদিও ভালো করেই জানে এখন সে যা বলবে তা হবে অতি দুর্বল আর আত্মশ্লাঘার উচ্চারণ।
‘আমাদের বিশ্বাস কোথাও কিছু একটা ষড়যন্ত্র চলছে, পার্টির বিরুদ্ধে গোপন কোনও শক্তি কাজ করছে, আর সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আপনি জড়িত রয়েছেন। আমরা পার্টির শত্রু। আমরা ইংসকের নীতিতে বিশ্বাস করি না। আমরা চিন্তা-অপরাধী। আমরা ব্যভিচারীও। আমরা কথাগুলো আপনাকে বলছি, কারণ আমরা আপনার কাছেই নিজেদের সোপর্দ করতে চাই। এখন আপনি যদি আমাদের দোষীও সাব্যস্ত করেন, আমরা তার জন্য প্রস্তুত। ’
থামল সে, আর ও’ব্রায়েনের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল। কেউ একজন দরজা খুলে ঢুকছে। নিশ্চিত, কড়া না নেড়ে ঢুকে পড়া লোকটি বেটেখাটো হলদে মুখো চাকরটি বৈ কেউ না। উইনস্টন দেখল একটি বোতল আর ক’টি গ্লাস সাজানো ট্রে নিয়ে ঢুকছে সে।
‘মার্টিনও আমাদেরই লোক’—নির্বিকারভাবে বললেন ও’ব্রায়েন। ‘ড্রিঙ্কস নিয়ে এখানে আসো, মার্টিন। গোল টেবিলটির ওপর রাখো। পর্যাপ্ত চেয়ার হবে? তাহলে বেশ, চলো আমরা আরাম করে বসে কথা বলি। মার্টিন তোমার নিজের জন্য একটা চেয়ার নিয়ে আসো। এখন কাজের কথা হবে। এখন থেকে দশ মিনিট তুমি আর চাকর নও। ’
স্বাচ্ছন্দেই বসে পড়ল বেটেখাটো লোকটি, তবে অভিব্যক্তিতে চাকরসুলভ ভাবটি রয়ে গেল। মনিবের আস্কারা পেলে যে খুশির ভাবটা থাকে তাই যেন ছড়িয়ে আছে তার মুখে। চোখের কোণায় চেয়ে লোকটিকে একবার অভিবাদন জানিয়ে নিল উইনস্টন। তার ভাবনায় ভর করল, এই লোক গোটা জীবনই একটা খেলার অংশ। আরও মনে হলো, তার জন্য যে ব্যক্তিত্ব নির্ধারিত তা থেকে এক দণ্ডের জন্য সরে যাওয়াও বিপজ্জনক। ও’ব্রায়েন বোতলটির সরু অংশে ধরে তুলে নিলেন আর গ্লাসগুলোতে কড়া লাল রঙের পানীয় ঢাললেন। উইনস্টনের ম্লান স্মৃতিতে জেগে উঠল অনেক অনেক আগে দেখা কিছু একটা, একটি সাইনবোর্ডের ওপর বিশালাকায় একটি বোতল। ইলেক্ট্রিক আলোর খেলায় সে বোতল একবার উপরে উঠছে একবার নামছে আর তা থেকে বের হয়ে আসা তরল পানীয়তে ভরে যাচ্ছে একটি গ্লাস। উপর থেকে দেখলে এই বস্তু পুরোপুরি কালো মনে হয়, কিন্তু বোতলের ভেতরটা দেখতে রুবির রঙ। টক-মিষ্টির একটা ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল। সে দেখল জুলিয়া তার গ্লাসটি তুলে নিয়েছে আর অতি সততার কৌতূহলে তাতে চুমুক বসিয়েছে।
‘এটাকে বলে মদ’—ম্লান একটা হাসি দিয়ে বললেন ও’ব্রায়েন। ‘নিঃসন্দেহে বইয়ে তোমরা এ বিষয়ে পড়েছো। আউটার পার্টিতে এটা খুব একটা পাওয়া যায় না বলেই আমার ধারণা। ’ তার মুখমণ্ডলে আবারও একটা কঠিন ভাব ফিরে এলো, আর তিনি নিজেও নিজের গ্লাসটি তুলে নিলেন। ‘স্বাস্থ্যকর এই পানীয় পানের মধ্য দিয়েই আমাদের শুরু। আমাদের নেতার নামে: গোল্ডস্টেইনের নামে। ’
বিশেষ আগ্রহে নিজের গ্লাসটি তুলে নিল উইনস্টন। মদ এক বস্তু, যা সে কেবল বইয়েই পড়েছে আর স্বপ্নে দেখেছে। গ্লাস পেপারওয়েটটির মতো, কিংবা মি. চ্যারিংটনের আধা-বিস্মৃত কবিতার লাইনগুলোর মতো, এরও এক উবে যাওয়া রোমাঞ্চকর অতীত রয়েছে, পুরনো সময় যাকে সে স্থান দিয়েছে স্রেফ গোপন ভাবনায়। কী কারণে যেন তার ভাবনায় ছিল মদ হবে মিষ্টস্বাদের, ঠিক কালোজামের তৈরি জ্যামের মতো এবং এর একটি উন্মাদক প্রতিক্রিয়া থাকবে। কিন্তু যখন সে বস্তুটি গলায় ঢালালো, রীতিমতো হতাশ হলো। বাস্তবতা হচ্ছে, বছরের পর বছর জিন গিলতে গিলতে এখন আর এসবের স্বাদ বুঝতে পারে না সে। দ্রুতই খালি গ্লাসটি টেবিলে রাখল উইনস্টন।
‘তাহলে গোল্ডস্টেইন বলে কেউ একজন রয়েছেন?’—বলল সে।
‘হ্যাঁ এমন একজন ব্যক্তি রয়েছেন, জ্যান্ত এক মানব সন্তান। তবে কোথায়, তা আমি জানি না। ’
‘আর ষড়যন্ত্র… সংগঠন? এগুলোও কি বাস্তব? এগুলো স্রেফ থট পুলিশের আবিষ্কার নয়?’
‘না, এগুলো বাস্তব। আমরা এর নাম দিয়েছি ব্রাদারহুড। কখনওই তুমি ব্রাদারহুড সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবে না। কেবল এটুকুই জানবে যে, এর অস্তিত্ব আছে আর তুমিও তার সঙ্গে আছো। সে প্রসঙ্গে আসছি। ’—বলেই হাতঘড়িতে একবার সময় দেখে নিলেন তিনি। ‘ইনার পার্টির সদস্য হলেও আধাঘণ্টার বেশি সময় ধরে টেলিস্ক্রিন বন্ধ রাখা ঠিক না। তোমাদের দুজনের একসঙ্গে এখানে আসা উচিত হবে না। আর তোমাদের আলাদা আলাদা ভাবে যেতে হবে। তুমি, কমরেড’—জুলিয়ার দিকে মাথা ঝুকিয়ে নিলেন একবার—‘তুমি প্রথম বের হবে। আমাদের হাতে আর কুড়ি মিনিট সময় আছে। তোমাদের বুঝতে হবে, আমি গোড়াতেই কিছু প্রশ্ন করে নিতে চাই। যেমন ধরো, তোমরা কী কী কাজ করার জন্য প্রস্তুত?’
‘সম্ভব এমন যে কোনও কিছু’—বলল উইনস্টন।
চেয়ারেই নিজেকে কিছুটা ঘুরিয়ে নিয়ে বসলেন ও’ব্রায়েন যাতে ঠিক উইনস্টনের মুখোমুখি হওয়া যায়। জুলিয়াকে একরকম অবজ্ঞাই করলেন তিনি। যেন তার কথাগুলোও উইনস্টনই বলবে। হঠাৎই তার দুই চোখের পাতা পড়ল। দ্রুত তা খুলে ধীর, নির্বিকার কণ্ঠে প্রশ্নগুলো করা শুরু করলেন যেন এ এক নিয়মিত প্রশ্নোত্তর পর্ব, আর প্রশ্নগুলোর অধিকাংশেরই উত্তর তার কাছে আগে থেকে জানা।
‘তোমরা জীবন দিতে প্রস্তুত?’
‘হ্যাঁ। ’
‘তোমরা জীবন নিতে প্রস্তুত?’
‘হ্যাঁ। ’
‘তোমরা এমন নাশকতা ঘটাতে পারবে যাতে শত শত নিরাপরাধ মানুষের প্রাণহানি ঘটবে?’
‘হ্যাঁ। ’
‘বিদেশি কোনও শক্তির হয়ে তোমরা নিজের দেশের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারবে?’
‘হ্যাঁ। ’
‘তোমরা ছলচাতুরি, প্রতারণা, ধোকা, শিশুদের মনকে কলুসিত করে তোলা, মাদকাসক্ত করে তোলা, পতিতাবৃত্তিতে উৎসাহ যোগানো, যৌন রোগ সংক্রমণ বাড়ানো—এমন যে কোনও কিছু করতে প্রস্তুত যা পার্টির নৈতিকতার ভিত ভেঙে দেবে, ক্ষমতাকে খর্ব করবে?’
‘হ্যাঁ। ’
‘ধরো, উদাহরণ স্বরূপ, একটি শিশুর মুখে সালফিউরিক এসিড ছুড়ে দিলে তাতে আমাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ হবে—তোমরা কি তা করতে প্রস্তুত?’
‘হ্যাঁ। ’
‘তোমরা তোমাদের বর্তমান পরিচয় হারিয়ে স্রেফ ওয়েটার বা ডকের শ্রমিক হিসেবে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে প্রস্তুত?’
‘হ্যাঁ। ’
‘তোমরা আত্মহত্যা করতে প্রস্তুত, যদি এবং যখন আমরা নির্দেশ দেব তখনই?’
‘হ্যাঁ। ’
‘তোমরা দুজন দুজনা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হতে প্রস্তুত, আর কখনও একের সঙ্গে অপরের দেখা হবে না?’
‘না!’ চিৎকার করে উঠল জুলিয়া।
উইনস্টনের মুখে কথা সরছিল না। এক মুহূর্তে এও মনে হলো সে আসলে বাক শক্তিই হারিয়ে ফেলেছে। তার জিহ্বা মুখের ভেতর নড়ছে কিন্তু শব্দ উৎপাদন করছে না। একটি শব্দের শুরুর শব্দাংশটি তৈরিতেই জিহ্বার লেগে গেলে বেশ খানিকটা সময়। আর যতক্ষণ না শব্দটি উচ্চারিত হলো, সে জানতও না, ঠিক কোন শব্দটি সে বলতে যাচ্ছে। ‘না’—অবশেষে বলল সে।
‘আমাকে বলে দিয়ে ভালো করেছো’—বললেন ও’ব্রায়েন। ‘আমাদের জন্য সবকিছুই জেনে রাখা প্রয়োজন। ’
এবার তিনি ঘুরে জুলিয়ার মুখোমুখি হলেন এবার আরও একটু অভিব্যক্তি ঝরিয়েই কথাগুলো উচ্চারণ করলেন:
‘তুমি কি বুঝতে পারো, সে যদি টিকেও যায়, তা এক ভিন্ন মানুষ হিসেবেই টিকবে। হতে পারে আমরা তাকে একটি নতুন পরিচয় দিতে বাধ্য হব। তার চেহারা, চলাফেরা, হাতের আকার, চুলের রঙ—এমনকি তার কণ্ঠটিও পাল্টে যাবে। আর তুমি নিজেও হয়ে যেতে পারো ভিন্ন কেউ একজন। আমাদের সার্জনেরা মানুষকে এমনভাবেই পাল্টে দিতে পারেন যে চেনাই যাবে না। কোনও কোনও সময় এটা দরকার হয়ে পড়ে। কখনও কখনও এমনকি শরীরের একটি অঙ্গচ্ছেদ পর্যন্ত করে ফেলি আমরা। ’
মার্টিনের মঙ্গোলীয় চেহারাটির দিকে একবার তাকানো থেকে কোনওভাবেই নিজেকে বিরত রাখতে পারল না উইনস্টন। সেখানে কোনও ধরনের ভীতি সে দেখতে পেল না। জুলিয়ার মুখমণ্ডলে আরও ফ্যাকাশে হয়ে ওঠার ছাপ, এতে তার মেছতাগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তবে ও’ব্রায়েনকে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই মোকাবেলা করল সে। বিড়বিড় শব্দে কিছু একটা উচ্চারণ করল জুলিয়া যা থেকে বুঝে নেওয়া গেল সে বলেছে:
‘বেশ। তাহলে এটাই সাব্যস্ত। ’—টেবিলের ওপর রুপালি রঙের একটি সিগারেট-বাক্স, অনেকটা অন্যমনষ্ক ভঙ্গিমায় ও’ব্রায়েন সেটি ওদের দিকে ঠেলে দিলেন, নিজেও একটি শলাকা তুলে নিলেন। এরপর উঠে দাঁড়ালেন এবং মৃদু পায়চারি করতে লাগলেন, যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবনাটা ভালো জমে তার। সিগারেটগুলো খুব ভালো। মোটা আর সুন্দর প্যাকেটজাত। এর কাগজে এক ধরনের অপরিচিত রেশমিভাব আছে। ও’ব্রায়েন আরও একবার হাতঘড়ির দিকে তাকালেন।
‘মার্টিন, তুমি এবার খাবার ঘরে ফিরে গেলেই ভালো’—বললেন তিনি। ‘১৫ মিনিটের মধ্যে আমি ওটি ফের চালিয়ে দেব। যাওয়ার আগে এই কমরেডদের একবার ভালো করে দেখে নাও। এরপর ওদের সঙ্গে তোমারই দেখা হবে, আমার নাও হতে পারে। ’
‘তোমরা বুঝতে পেরেছো’—বললেন তিনি, ‘তোমাদের আসলে অন্ধকারে থেকে যুদ্ধ করতে হবে। তোমরা অন্ধকারের ভেতরেই থাকবে। তোমরা কেবল নির্দেশ পাবে আর সেগুলো মেনে চলবে, জানতেও পারবে না কেন। পরে আমি তোমাদের একটা বই পাঠাব যা পড়লে তোমরা জানতে পারবে আমরা ঠিক কোন সমাজে বাস করছি, আর এই সমাজকে আমরা কোন কৌশলে ধ্বংস করে দেব তাও জানা যাবে। যখন তোমরা বইটি পড়বে, তোমরা ব্রাদারহুডের পূর্ণাঙ্গ সদস্য হয়ে উঠবে। কিন্তু আমরা যে সাধারণ লক্ষ্যে লড়ছি, আর আমাদের এখুনি যে কাজগুলো করতে হবে এর মাঝে তোমরা কখনওই কিছু জানতে পারবে না। আমি তোমাদের বলতে চাই, ব্রাদারহুড আছে, কিন্তু আমি তোমাদের বলতেই পারব না এর সদস্য এক শত নাকি এক কোটি। এই সংখ্যাটি মোটে এক ডজনও হতে পারে, কিন্তু তোমাদের ব্যক্তিগত জ্ঞান থেকে তোমরা কখনওই তা বলতে পারবে না। গোটা তিন চারেক যোগাযোগের স্থান তোমাদের জানিয়ে দেওয়া হবে, কিন্তু সেগুলোও সময় সময় নবায়ন করা হবে।
আর এটি যেহেতু তোমাদের প্রথম যোগাযোগ এটি সংরক্ষিত থাকবে। যখনই তোমরা কোনও নির্দেশ পাবে, সেগুলো আমার হয়েই আসবে। আমরা যদি বোধ করি ওগুলো তোমাদের জানানো প্রয়োজন, তখন মার্টিনের মাধ্যমে জানিয়ে দেব। আর অবশেষে তোমরা যখন ধরা পড়ে যাবে, তোমরা স্বীকার করে নেবে। এর ব্যত্যয় হতে পারবে না। তবে তোমাদের নিজেদের কাজগুলোর বাইরে স্বীকার করতে হবে খুব অল্প কিছুই। তোমরা গুটিকয় অগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বেশি কাউকে প্রতারণা করতে পারবে না। সম্ভবত তোমরা আমাকেও প্রতারিত করবে না। কিন্তু ততক্ষণে আমি নিজেও মৃত হয়ে যেতে পারি, অথবা আমি হয়ে উঠতে পারি ভিন্ন কেউ একজন, এক ভিন্ন চেহারার মানুষ। ’
মোলায়েম কার্পেটের ওপর মৃদু পা ফেলে তখনও পায়চারি করে চলেছেন তিনি। মোটাসোটা বপু হওয়া সত্ত্বেও তার এই নড়াচড়ার মধ্যে এক ধরনের চমৎকারিত্ব ফুটে উঠছে। এক হাত পকেটে রেখে অন্য হাতে সিগারেট ধরে রাখায় ভঙিমাটি যেন আরও মানানসই। তার শারীরিক শক্তির চেয়ে আস্থার আর বোধগম্যতার ভাবটাই যেন বেশি ফুটে ওঠে।
আন্তরিকতার দিকগুলো তো আছেই, পাশাপাশি একজন চরমপন্থির যেসব একরোখা ভাব থাকার কথা তার কিছুই তার মধ্যে নেই। যখন তিনি হত্যা, আত্মহত্যা, যৌনব্যাধি, অঙ্গচ্ছেদ কিংবা পাল্টে দেওয়া চেহারার কথা বলেন একটা প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গাত্মক অভিব্যক্তি তার চেহারায় ফুটে ওঠে। ‘এর ব্যত্যয় হবার নয়’—এমন উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তার কণ্ঠ যেন বলতে চাইছে; ‘আসলে সাহসের সঙ্গে এটাই আমরা করব। কিন্তু জীবন যখন আবার যাপনযোগ্য হয়ে আসবে তখন আর আমাদের এগুলো করতে হবে না। ’
ও’ব্রায়েনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের, অনেকটা পূজনীয় পর্যায়ের ভালোলাগা কাজ করতে শুরু করল উইনস্টনের মধ্যে। এই মুহূর্তে সে গোল্ডস্টেইনের ছায়ামূর্তিও যেন ভুলে গেছে। আপনি যখন ও’ব্রায়েনের শক্তিশালী স্কন্ধের দিকে তাকাবেন, আর তার দৃঢ়তামাখানো চেহারার দিকে, অতি কুৎসিত আবার অতি সভ্য, তখন আপনার পক্ষে তাকে জেয় বলে ভাবাই অসম্ভব হয়ে উঠবে। এমন কোনও কৌশল নেই যার সমকক্ষ তিনি নন, এমন কোনও বিপদ নেই যা অনুধাবন করতে তিনি অক্ষম। জুলিয়াকেও বেশ নিবেশিত মনে হলো। হাতের সিগারেট নিজে নিজেই পুড়ে যাচ্ছে, আর গভীর মনোযোগে সে শুনে যাচ্ছে। ও’ব্রায়েন বলেই চললেন:
‘ব্রাদারহুডের অস্তিত্ব নিয়ে তোমাদের কানে গুজব আসতেই থাকবে। নিঃসন্দেহেই বলা যায় এরই মধ্যে ব্রাদারহুড নিয়ে তোমরা মনে মনে একটি ধারণা পোষণ করছো, নিজেদের মানসপটে এঁকেছো ছবিও। তোমাদের কল্পনায়, সম্ভবত, যড়যন্ত্রকারীদের এক অতিকায় গোপন শক্তি হিসেবেই রয়েছে এই ব্রাদারহুড, যারা কারাগারগুলোতেও গোপন বৈঠক করে, দেয়ালে দেয়ালে বার্তা লিখে রাখে, একজন আরেকজনকে কোডওয়ার্ডে কিংবা হাতের বিশেষ ভঙ্গিতে চেনে, কথা বলে। বাস্তবে আসলে এমন কিছুই নেই। ব্রাদারহুডের সদস্যদের একে অপরকে চেনার কোনওই পথ নেই, আর একজনের পক্ষে অপর গুটি কয়েক জনের বাইরে কাউকে চিহ্নিত করারও সুযোগ নেই। গোল্ডস্টেইন নিজেও যদি কখনও থট পুলিশের হাতে পড়ে যান, সদস্যদের পূর্ণাঙ্গ তালিকাটি তাদের দিতে পারবেন না।
বস্তুত এমন কোনও তালিকার অস্তিত্বও নেই। ব্রাদারহুডকে সমূলে উৎপাটনও সম্ভব নয় কারণ এটি সাধারণ বোধের কোনও সংগঠন নয়। একটি ধারণা বৈ এটি আর কিছুই নয়, আর সে ধারণা অমোচনীয়। তোমাদের টিকিয়ে রাখার জন্য একটি ধারণার বাইরে আর কিছুই তোমরা পাবে না। কমরেডের স্তুতি কিংবা উৎসাহ কোনওটাই মিলবে না। আর তোমরা যখন ধরা পড়ে যাবে, কারও কোনও সহযোগিতা পাবে না। আমরা সদস্যদের কোনও সহায়তা করি না। সর্বোচ্চ আমরা যখন মনে করি কেউ একজনকে চুপ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন তখন কারাগারে তার হাতে চোরাপথে একটি রেজর ব্লেড পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করি। তোমাদের আসলে কোনও প্রত্যাশা আর কোনও প্রাপ্তি ছাড়াই জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে। তোমরা কিছুদিন কাজ করবে, এরপর ধরা পড়ে যাবে, এরপর স্বীকারোক্তি দেবে, অতঃপর মৃত্যুকে বরণ করে নেবে। আসলে এই মৃত্যুতেই তোমাদের প্রাপ্তি মিলবে। আসলে আমাদের জীবদ্দশায় এর বাইরে আর কোনও কিছু ঘটতে পারে বলে আমরা মনেও করি না।
আসলে আমরা সবাই মৃত। আমাদের একমাত্র সত্যিকারের জীবন আসবে ভবিষ্যতে। যার সুফল পেতে আমাদের হাড়গোড়ের দেহাবশেষই কেবল টিকে থাকবে। কিন্তু সেই ভবিষ্যত কতদূরে হতে পারে, তা কারও জানা নেই। হতে পারে সহস্র বছর। এখন আসলে এই সুস্থ মানবিক বোধের পরিধি অতি স্লথ গতিতে বাড়িয়ে চলার বাইরে আর কিছুই করার নেই। আর সে কাজ যে আমরা দলবেধে একযোগে করতে পারব তাও নয়। আমরা কেবল আমাদের জ্ঞান একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারব, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বিস্তৃত করতে পারব। থট পুলিশের এই যুগে এর বাইরে আর কিছুই করার নেই। ’
থামলেন তিনি আর তৃতীয়বারের মতো হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন।
‘কমরেড, তোমার চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে’—জুলিয়ার উদ্দেশে বললেন তিনি।
‘দাঁড়াও। বোতলের আধেকটা তো এখনও রয়ে গেছে। ’
গ্লাসগুলোতে ফের মদ ঢাললেন, আর নিজের গ্লাসটি তুলে নিলেন।
‘এবার তাহলে কার নামে?’—একই বক্রাঘাতি উচ্চারণ তার। ‘থট পুলিশের বিভ্রান্তির নামে? বিগ ব্রাদারের মৃত্যু কামনার নামে? মানবতার নামে? ভবিষ্যতের নামে?’
‘অতীতের নামে’—বলল উইনস্টন।
‘অতীতটাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ’—সম্মতি ও’ব্রায়েনের।
যে যার গ্লাস শেষ করল তারা, আর পরক্ষণেই জুলিয়া চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। ও’ব্রায়েন কেবিনেটের ওপর থেকে একটি বাক্স নামিয়ে আনলেন আর ভেতর থেকে চ্যাপ্টা সাদা রঙের ট্যাবলেট বের করে তার হাতে দিয়ে বললেন, ‘জিভের ওপর দিয়ে রাখো। এটার দরকার আছে। মদের গন্ধ মুখে নিয়ে বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। লিফটের অ্যাটেন্ডেন্টরা কড়া নজরদারি করে। ’
জুলিয়ার পেছনে দরজা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ও’ব্রায়েনের মুখের ভাবখানা এমন রূপ নিল যেন তার অস্তিত্বই ভুলে গেলেন। আরও দুবার পায়চারি করে থামলেন তিনি।
‘আরও কিছু বিষয় চূড়ান্ত করা প্রয়োজন’—বললেন ও’ব্রায়েন। ‘আমার ধারণা তোমাদের একটা গোপন স্থান আছে?’
মি. চ্যারিংটনের দোকানের উপরের কামরাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানাল উইনস্টন।
‘এই মূহূর্তে ওতেই চলবে। পরে আমি তোমাদের জন্য অন্য কিছু একটা ব্যবস্থা দেব। মাঝে মধ্যেই গোপন স্থান পাল্টে নেওয়া জরুরি। এরমধ্যে আমি তোমাদের “দ্য বুক”-এর একটি কপি পাঠিয়ে দেব’—ও’ব্রায়েন, লক্ষ্য করল উইনস্টন, বইটির নাম এমনভাবে বলেলন যেন উচ্চারণেই মনে হলো তা ইটালিক ফন্টে লেখা—‘গোল্ডস্টেইনের বইটি, আশা করি বুঝতে পারছো। যতটা দ্রুত সম্ভব পাঠিয়ে দেব। একটি কপি আমার হাতে আসতে দিন কয়েক লাগতে পারে। বুঝতেই পারো, আসলে এর কপি খুব বেশি নেই। যত দ্রুত আমরা এর কপি প্রকাশ করতে পারি তার চেয়েও দ্রুততায় থট পুলিশ সেগুলো পাকরাও করে ধ্বংস করে দেয়। অবশ্য তাতে খুব একটা যেয়ে আসে না। এই বই আসলে অবিনাশ্য। শেষ কপিটিও যদি ধ্বংস হয়ে যায়, আমরা আবারও তার প্রতিটি শব্দ প্রকাশ করতে পারব। তুমি কি কাজে যাওয়ার সময় ব্রিফকেস রাখো?’ যোগ করলেন তিনি।
‘নিয়ম বটে, তাই রাখি’
‘কেমন দেখতে ওটা?’
‘কালো, দুই চর্মবন্ধনির ভাঙাচোরা। ’
‘কালো, দুই চর্মবন্ধনির, ভাঙাচোরা—বেশ তো। খুব শিগগিরই, আমি তারিখ জানাতে পারছি না—তোমার সকালের কাজে একটি বার্তা থাকবে যাতে শব্দগুলো হবে আবছা এলোমেলো। তুমি তখন পুনরায় বার্তাটি পাঠানোর জন্য বলবে। পরের দিন, তুমি তোমার ব্রিফকেস ছাড়া কাজে যাবে, পথে কেউ একজন তোমার কাঁধ স্পর্শ করে বলবে, “আমার ধারণা আপনি আপনার ব্রিফকেস ফেলে এসেছেন। ” ওই ব্যক্তি তোমাকে যে ব্রিফকেস দেবেন তাতেই গোল্ডস্টেইনের বইটি থাকবে। তুমি পরবর্তী চৌদ্দ দিনের মধ্যে সেটি ফেরত দেবে। ’
কিছুক্ষণের জন্য দু’জনই চুপ করে থাকল।
‘কয়েক মিনিটের মধ্যেই তোমাকে চলে যেতে হবে’—বললেন ও’ব্রায়েন। ‘আমাদের আবার দেখা হবে—আমরা যদি আবার দেখা করি—’
উইনস্টন তার দিকে তাকাল। ‘এমন এক স্থানে, যেখানে কোনও অন্ধকার থাকবে না?’ ইতস্তত করে বলল সে।
বিস্ময়ের অভিব্যক্তি ছাড়াই সে কথায় সায় দিলেন উইনস্টন। ‘এমন এক স্থানে, যেখানে কোনও আঁধার থাকবে না’—বললেন তিনি, যেন তিনিও বুঝে ফেলেছেন এই কথার মানে। ‘এর মধ্যে, চলে যাওয়ার আগে কি তোমার আর কিছু বলার আছে? কোনও বার্তা? কোন প্রশ্ন?। ’
উইনস্টন ভাবল। তার মনে হলো না, জিজ্ঞাসা করার মতো আর কোনও প্রশ্ন তার আছে। অস্পষ্ট অনির্দিষ্ট কোনও শব্দ উচ্চারণের প্রয়োজন আছে বলেও মনে হলো না। বরং ও’ব্রায়েন বা ব্রাদারহুডের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনও কিছুর পরিবর্তে তার মনে এলো এক অন্ধকার শয়নকক্ষ যেখানে তার মা জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন। আর তার সঙ্গে মনে এলো মি. চ্যারিংটনের দোকানের দোতলার কামরা, এলো গ্লাসের পেপারওয়েট আর গোলাপকাঠের কাঠামোবদ্ধ ইস্পাতের খোদাই করা ছবিটি। অনেকটা দৈবচয়নের মতো বললো সে:
‘আপনি কি কখনও পুরনো একটি ছড়া শুনেছেন তার শুরুটা ছিলো “অরেঞ্জেস অ্যান্ড লেমন্স, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট ক্লেমেন্টস”?’
আবারও মাথা নাড়লেন ও’ব্রায়েন। দারুণ সৌজন্যতার অভিব্যক্তিতে তিনি স্তবকের পরের লাইনগুলো উচ্চারণ করলেন:
অরেঞ্জেস অ্যান্ড লেমন্স, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট ক্লেমেন্ট’স,
ইউ ও মি থ্রি ফার্দিংস, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট মার্টিন’স,
হোয়েন উইল ইউ পে মি? সে দ্য বেলস অব ওল্ড বেইলি,
হোয়েন আই গ্রো রিচ, সে দ্য বেলস অব শোরডিচ। ’
‘শেষের লাইনটিও আপনি জানেন!’—বলল উইনস্টন।
‘হ্যাঁ, আমি শেষের লাইনটিও জানি। তবে এখন আমার মনে হয় তোমার যাওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু একটু অপেক্ষা করো। তোমাকেও ওর একটি ট্যাবলেট দিতে হবে। ’
উইনস্টন উঠে দাঁড়াতেই ও’ব্রায়েন তার একটি হাত চেপে ধরলেন। তার শক্তিশালী পাঞ্জার চাপে উইনস্টনের তালুর হাড়গুলো যেন মুচড়ে গেল। দরজার কাছে গিয়ে উইনস্টন পিছনে ফিরে তাকাল। কিন্তু ও’ব্রায়েন ততক্ষণে তার অস্তিত্ব মন থেকে মুছে ফেলার প্রস্তুতিতে। টেলিস্ক্রিনে সুইচে হাত দিলে তিনি উইনস্টনের প্রস্থানের অপেক্ষায়। উইনস্টনের মন জুড়ে পেছনে ফেলে আসা সবুজ আলোর লেখার টেবিল, স্পিক রাইট আর কাগজ পত্রে ঠাসা কতগুলো বাক্স। এই ঘটনার এখানেই পরিসমাপ্তি। ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যেই তার মনে হতে লাগল, ও’ব্রায়েন এতক্ষণে পার্টির ব্যঘাতঘটে যাওয়া জরুরি কাজে মন দিয়েছেন।
অধ্যায় ৯
থকথকে একটা অবসাদগ্রস্ততা যেন পেয়ে বসেছে উইনস্টনকে। অবসাদগ্রস্ততা শব্দটিই সঠিক হবে। তাৎক্ষণিকভাবে এটিই তার মাথায় এলো। শরীরটা যেন জেলির মতো থকথকে আর স্বচ্ছ লাগছে। তার মনে হচ্ছিল, হাত তুলে দেখলে এ ভেতরটা দেখা যাবে। ভেতরের রক্ত আর রক্ত-পদার্থগুলো গলগল করে বের হয়ে আসবে, পড়ে থাকবে কেবলই শিরা উপশিরা, হাড় আর চামড়ার একটি কাঠামো। ইন্দ্রিয়বোধগুলোও বিবর্ধিত, কাঁধের ওপর আলখেল্লায় অস্বস্তি, মেঝেতে পায়ের তলায় খচখচ। এমনকি সামান্য নড়াচড়ায় হাতের জোড়াগুলো ফট ফট শব্দ করে ফোটে।
পাঁচ দিনে নব্বই ঘণ্টা কাজ করেছে সে। কেবল তার নয়, মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি কর্মীর একই অবস্থা। এখন অবশ্য সব শেষ। বাস্তবিক অর্থে এখন আর তার করার কিছুই নেই। বলার মতো পার্টির কোনও কাজ নেই, অন্তত আগামীকাল সকাল অবধি হাত পুরোই খালি। নির্দ্বিধায় গোপন আস্তানায় ছ’টি ঘণ্টা, আর পরের আরও ন’টি ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারে নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে। ধীরে ধীরে বিকেলের শান্ত রোদে একটা জীর্ণ সড়ক দিয়ে হেঁটে চলেছে। গন্তব্য মি. চ্যারিংটের দোকান। তবে এক চোখ পুরোই খোলা রাখা টহলদারদের গতিবিধিতে। যদিও যুক্তিহীনভাবে সে জানে আজ এই বিকেলে কোথাও কোনও বাধার মুখে পড়তে হবে না তাকে। হাতের ভারী ব্রিফকেসটি প্রতিবার পা ফেলার সাথে হাঁটুতে আঘাত দিচ্ছে। এতে তার পায়ের চামড়ায় এক ধরনের চুলকানির অনুভূতি হচ্ছে। ব্রিফকেসের ভেতরে বইটি। এখন থেকে আরও ছয়দিন ওটি তার দখলে থাকবে। তবে এখনও বইটি খোলা হয়নি, দেখাও হয়নি ওটি দেখতে কেমন।
ঘৃণা সপ্তাহের ষষ্ঠ দিনের কথা। মিছিল হয়ে গেছে, বক্তৃতার পালাও শেষ, চিৎকার চেঁচামেচিও থেমেছে। সঙ্গীত, ব্যানার, পোস্টার, সিনেমা, ভীতিকর ওয়াক্সওয়ার্ক, বাদ্য বাজনা আর কর্কশ শব্দ সম্প্রচার, ভারী বুটের কুচকাওয়াজ, ট্যাংকের সারি, উড়োজাহাজের গর্জন, গুলির ফটাস ফটাস শব্দে কেটেছে টানা ছয়টি দিন। উত্তেজনা যখন তুঙ্গে আর ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে ঘৃণার পারদ সর্বোচ্চ মাত্রায় তখন ভিড়ের মাঝে প্রতিটি মানুষেরই ভাবনা বিচারের শেষ দিনে যে ২,০০০ ইউরেশীয় যুদ্ধাপরাধী তখনও বধের অপেক্ষায় তাদের হাতের নাগালে পেলে ছিন্নভিন্ন করে দেবে—ঠিক তখনই ঘোষণা এলো ওশেনিয়ার যুদ্ধ ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে নয়। ওশেনিয়ার যুদ্ধ চলছে ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধে। ইউরেশিয়া মিত্রপক্ষ।
আর এই ঘোষণা এলো কোনও কিছু পরিবর্তনে সামান্য স্বীকারোক্তি ছাড়াই। সর্বত্র একযোগে একই আকস্মিকতায় সবারই জানা হয়ে গেল ইউরেশিয়া নয় ইস্টেশিয়াই শত্রু। ঘটনাটি যখন ঘটল উইনস্টনও তখন সেন্ট্রাল লন্ডনের একটি চৌরাস্তায় বিক্ষোভ কর্মসূচির মাঝে। তখন রাত নেমে গেছে। সাদা মুখগুলো আর উজ্জ্বল ব্যানারগুলো আলোর বন্যায় ভাসছিল। গোটা চৌরাস্তা জুড়ে তখন কয়েক হাজার জনতা। একটি ব্লকে স্পাইজের ইউনিফর্ম পরে হাজার খানেক শিশু-কিশোরও রয়েছে। উজ্জ্বল আলোর প্রক্ষেপণে জ্বলজ্বলে মঞ্চ থেকে ইনার পার্টির এক বক্তা, খর্বাকায়, কিন্তু খাটো বপুর তুলনায় অপেক্ষাকৃত লম্বা দুটি হাত আর গুটিকয় অবিন্যস্ত চুলে বড় টেকো মাথা নেড়ে নেড়ে জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছিলেন।
রামপেলস্টিলস্কিন (জার্মানি রূপকথার গল্পের এক খর্বাকায় চরিত্র)মার্কা বপুটি ঘৃণায় যেন বেঁকে বেঁকে যাচ্ছিল। এক হাতে মাইক্রোফোনটির গলা টিপে ধরে হাড্ডিসার লম্বা বাহুর শেষে আর হাতটি দিয়ে আক্রোশে মাথার ওপর বাতাস খামচে খামচে ধরছিলেন। তার কণ্ঠস্বর ধ্বনিবিবর্ধকে আরও ধাতব হয়ে ফুটছিল, তাতে ধ্বংসযজ্ঞ, বিতারণ, লুটতরাজ, ধর্ষণ, কয়েদী নির্যাতন, বোমাবাজি, মিথ্যাচার, রটনা, অন্যায় আগ্রাসন, সন্ধিভঙ্গের মতো অগুনতি অপরাধের তালিকা আরও নৃশংসভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। মাতাল চিৎকারে বাস্তবিক অর্থে তখন আর তার কথা কারও কানে পৌঁছার মতো অবস্থা ছিল না।
ক্ষণে ক্ষণে জনতার রোষ আর চিৎকার স্পিকারের শব্দ ছাপিয়ে এক হিংস্র পশুর গোঙানিতে রূপ নিচ্ছিল। যা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে তুঙ্গ থেকে আরও তুঙ্গে উঠে হাজার কণ্ঠে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সবচেয়ে আদিম আর অসভ্যের চিৎকার ভেসে আসছিল স্কুল শিশুদের দিক থেকে। বক্তব্য চলছে তখন প্রায় বিশ মিনিট ধরে। ঠিক তখনই এক বার্তাবাহক হুড়মুড়িয়ে ঢুকলেন মঞ্চে আর বক্তার হাতে গুঁজে দিলেন একটি চিরকূট।
তিনি ওটি খুললেন আর বক্তব্যের গতিতে সামান্য ছেদ না টেনেই চিরকূটের লেখাটি পড়ে গেলেন। তার কণ্ঠেও এলো না সামান্য পরিবর্তন, অথবা যে কথাগুলো তিনি বলে আসছিলেন তার গতিও থেকে গেল অপরিবর্তিত। কেবল পাল্টে গেল কতিপয় নাম। কোনও শব্দ অনুচ্চারণেই জনতার দিক থেকে যে অভিব্যক্তি এলো তা যেন বলে দিল তারা বুঝে নিয়েছে। ওশেনিয়ার যুদ্ধ চলছে ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধে!
পরক্ষণেই ভেসে এলো আরও উচ্চস্বরের শোরগোল। এই চৌরাস্তা যেসব ব্যানার আর পোস্টার দিয়ে সাজানো তার সবই ভুল। অর্ধেকেরও বেশি পোস্টারে ভুল মানুষের মুখ। বলা হলো এটা অন্তর্ঘাতমূলক! গোল্ডস্টেইনের চরেরা এই কাজ করেছে। আর তখন দাঙ্গাময় একটি ছোট বিরতি মিলল যখন পোস্টারগুলো দেয়াল থেকে ছিঁড়ে নামিয়ে ব্যানারগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলে পায়ের নিচে দলাতে শুরু করল বিক্ষুব্ধ জনতা। স্পাইজের সদস্যরা অগ্রভাগে থেকে বাড়ির ছাদগুলো বেয়ে বেয়ে উঠে নিশান টাঙানো রশিগুলো কেটে কেটে চিমনির মধ্যে ফেলল। আর মাত্র দুই কি তিন মিনিটের মধ্যেই সব বিলিন হয়ে গেল।
বক্তা তখনও মাইক্রোফোনের গলা টিপে ধরে, সামনের দিকে কাঁধ ঝুঁকিয়ে মাথার ওপরে বাতাস খামচাতে খামচাতে কথা বলেই চলেছেন। আরও এক মিনিট ধরে ভিড়ের মধ্য থেকে চিৎকার ধ্বনি ভয়াবহ গর্জন তুলে ছড়িয়ে পড়তে থাকল। ঘৃণা ছড়াতে থাকল ঠিক আগের মতোই, কেবল পাল্টে গেল ঘৃণার লক্ষ্যস্থল। উইনস্টন ভীষণ মুগ্ধ হলো বক্তার ভোল পাল্টানোর ঢংটাতে। সামান্য থমকে না গিয়ে, এতটুকু না থেমে এমনকি বলার ভঙ্গিমাটুকুও না পাল্টে তিনি সম্পূর্ণ বিপরীত লক্ষ্যে বাক্যবাণ ছুঁড়তে লাগলেন। তবে ঠিক ওই মুহূর্তে অপর একটি বিষয় তার ভাবনা জুড়ে বিরাজ করছিল।
যখন পোস্টার আর ব্যানার ছেঁড়াছিড়ি চলছিল ঠিক সেই মুহূর্তেই সম্পূর্ণ অপরিচিত চেহারার এক ব্যক্তি তার কাঁধে হাত রাখলেন আর বললেন, ‘মাফ করবেন, আমার ধারণা আপনি আপনার ব্রিফকেসটি ফেলে এসেছেন। ’ বিনা বাক্যব্যয়ে ব্রিফকেসটি হাতে নিল সে। জানত, আগামী দিন কয়েক এটি খুলে দেখারও সুযোগ হবে না তার। বিক্ষোভ শেষ হওয়ার সাথে সাথে সে সরাসরি ছুটল সত্য মন্ত্রণালয়ের দিকে, যদিও তখন রাত প্রায় এগারোটা। মন্ত্রণালয়ের অন্য সব স্টাফও তার মতো ততক্ষণে মন্ত্রণালয়ে। টেলিস্ক্রিন থেকে এরই মধ্যে এতদসংক্রান্ত নির্দেশ এসে গেছে। অতএব তাদের ডেকে ডেকে আনার আর দরকার নেই।
ওশেনিয়ার যুদ্ধ চলছে ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধে: মানে হচ্ছে ওশেনিয়ার যুদ্ধ সবসমই ছিল ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধে। গেল পাঁচ বছরের রাজনৈতিক সাহিত্যের একটি বড় অংশ এখন পুরোই বাতিল। সব ধরনের প্রতিবেদন, নথি, সংবাদপত্র, বই, পুস্তিকা, চলচ্চিত্র, শব্দ-ট্র্যাক, ছবি—সবকিছুই তড়িৎ গতিতে শুদ্ধিকরণ করতে হবে। কোনও নির্দেশনা জারি হয়নি, তারপরেও সবারই জানা সব বিভাগের শীর্ষকর্তাদের এটাই চাওয়া, এক সপ্তাহের মধ্যে ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, কিংবা ইস্টেশিয়ার সঙ্গে মিত্রতা প্রমাণ করে এমন বক্তব্যের অনুমাত্রও থাকা চলবে না। ভারাবনত এক কর্মযজ্ঞ। প্রকৃত চেহারা আরও জটিল কারণ কাজটি যা, তা আবার বলে-কয়ে করার নয়।
রেকর্ডস ডিপার্টমেন্টের প্রত্যেকেই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আঠারো ঘণ্টা করে কাজ করছে। দিনে দুই-তিন ঘণ্টা করে ঘুমিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে বটে তাও মন্ত্রণালয়ের ভেতরেই। কারাগার থেকে তোষক এনে বারান্দায় বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে গড়াগড়ি দিয়ে নেওয়ার জন্য। খাবার মিলছে স্যান্ডউইচ আর ভিক্টরি কফি। বেয়ারারা ক্যান্টিন থেকে ট্রলি ভর্তি করে কামরায় কামরায় ঘুরে বিতরণ করছে ওগুলো। সামান্য বিরতি নিয়ে উইনস্টন বিছানায় গা এলিয়ে আবার যখন ঢুলুঢুলু চোখ ডলতে ডলতে ফিরছে, দেখতে পাচ্ছে আরেক পশলা কাগজের বৃষ্টি এসে স্তূপ হয়ে বরফের মতো ঢেকে দিয়েছে ডেস্ক।
কাগজের স্তূপে অর্ধঢাকা পড়েছে স্পিকরাইট। আর মেঝেতেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক কাগজ-পত্র। তার দায়িত্বই হচ্ছে হাতের কাজ শেষ করে ওদের আরও কাজ দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে এই কাজ পুরোপুরি যন্ত্রনির্ভর নয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে নামটি পাল্টে দিয়েই কাজ শেষ করা যাচ্ছে না। বিস্তারিত অংশে প্রয়োজন হয়ে পড়ছে বাড়তি সতর্কতা, প্রয়োগ ঘটাতে হচ্ছে কল্পনানির্ভর তথ্যের। বিশ্বের একটি অংশ থেকে যুদ্ধকে অন্য অংশের দিকে ঘুরিয়ে দিতে ভৌগলিক জ্ঞান থাকাও জরুরি হয়ে উঠছে।
তৃতীয় দিনে তার চোখে অসহ্য রকমের চুলকানি শুরু হলো, কয়েক মিনিট পরপরই চশমার কাচ পরিষ্কার করতে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল পাথর ভাঙ্গার মতো গতর খাটুনি চলছে তার। যে কাজ প্রত্যাখানের অধিকার যে কারও রয়েছে, খ্যাপাটের মতো সেই কাজই তাকে করে যেতে হচ্ছে। স্পিকরাইটে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ, কালি-পেন্সিলের খোঁচায় লেখা প্রতিটি অক্ষর-চিহ্নই যে ডাহা-মিথ্যা তা মনে করার মতো সময়ও নেই, আর তাতে কাজ বিঘ্নিত করার সুযোগও নেই। বরং ডিপার্টমেন্টের অন্য সকলের মতো সেও একইভাবে উদ্বিগ্ন ছিল এই ভেবে যে, জালিয়াতি যা কিছু চলছে তার মধ্যে যেন এতটুকু খুঁতও না থেকে যায়।
ষষ্ঠদিনে নথি-পত্রে ঠাসা সিলিন্ডার ডেস্কে আসার মাত্রা একটু কমলো। টানা আধাঘণ্টাও কিছুই এসে জমা পড়ল না টিউবে। এরপর আরেকটি সিলিন্ডার এলো। এরপর আর কিছুই এলো না। চারিদিকেই ততক্ষণে কাজ কমে আসছে। গভীর কিন্তু গোপন একটা লম্বা নিঃশ্বাস বয়ে গেল গোটা ডিপার্টমেন্টে। বিশাল একটি কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হয়ে গেল, যার কথা কখনও বলাও হবে না। কোনও মানব সন্তানের পক্ষেই আর নথিভিত্তিক প্রমাণ হাজির করা সম্ভব হবে না, যা দেখিয়ে সে বলতে পারবে কখনও কোনওকালে যুদ্ধ ছিল ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে।
অপ্রত্যাশিতভাবে বেলা ১২টায় ঘোষণা এলো মন্ত্রণালয়ের সকল কর্মীর আগামীকাল সকাল পর্যন্ত ছুটি। বইয়ের যে ব্রিফকেসটি হাতে নিয়ে হাঁটছে উইনস্টন, সেটি যখন কাজ করেছে তখন দুই পায়ের ফাঁকে, আর যখন ঘুমিয়েছে তখন গায়ের নিচে রেখে দিত। মন্ত্রণালয় থেকে সোজা বাসায় ফিরে সেভ করে গোসল সারতে গিয়ে বাথরুমেই তার ঘুমিয়ে পড়ার দশা। পানিটা ছিল ইষদোষ্ণর চেয়ে একটু বেশিই গরম।
হাত-পায়ের জোড়াগুলোতে পটাস পটাস শব্দ তুলেই মি. চ্যারিংটনের দোকানের দোতলার সিড়ি ভাঙল উইনস্টন। ভীষণ ক্লান্ত কিন্তু এখন আর ঘুমে কাতর নয় সে। জানালা খুলে দিয়ে ছোট নোংরা তেলের স্টোভটি জ্বালিয়ে নিয়ে কফির জন্য কড়াইয়ে পানি বসিয়ে দিল। জুলিয়া এসে পড়বে: এর মধ্যে বইটি দেখা শুরু করা যায়। ভাঙা হাতলওয়ালা চেয়ারটিতে বসে ব্রিফকেসের ফিতা-বন্ধনী খুলতে শুরু করল সে।
একটি ভারি কালো মলাটের বিশাল বই, কাচাহাতের বাঁধাই, মলাটে কোন নাম কিংবা শিরোনাম নেই। ছাপাগুলো কিছুটা অবিন্যস্তই মনে হলো। ধারের দিকে পাতাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে গেছে, কোনও কোনওটি ছিঁড়ে ভিন্ন হয়ে গেছে। এমনটা বুঝেই নেওয়া যায় বহু হাত ঘুরেই তার হাতে পড়েছে এই বই। মলাট উল্টে প্রথম পাতায় লেখা রয়েছে
গোষ্ঠীশাসনভিত্তিক যৌথবাদের তত্ত্ব ও চর্চা
– ইমানুয়েল গোল্ডস্টেইন
পড়তে শুরু করলো উইনস্টন:
প্রথম অধ্যায়
অবজ্ঞাই শক্তি
যতদিনের কথা নথিভুক্ত রয়েছে ততদিন ধরে, অথবা বলা যায় নব্যপ্রস্তর যুগের পর থেকেই পৃথিবীতে উচ্চ, মধ্য আর নিম্ন এই তিন শ্রেণির মানুষ বাস করে আসছে। এরা আরও নানাভাবে উপ-বিভক্ত হয়ে, ভিন্ন ভিন্ন অগুনতি নাম পেয়েছে, তাদের আপেক্ষিক সংখ্যা, একের প্রতি অন্যের আচরণ যুগে যুগে পাল্টেছে, কিন্তু সমাজের অপরিহার্য কাঠামোটি থেকে গেছে অপরিবর্তিত। বড় বড় অভ্যুত্থান আর আপাতদৃষ্টিতে অপরবর্ত্য পরিবর্তনের পরেও, এই একই ব্যবস্থা নিজের মতো করেই সমাজ কাঠামোয় আবার স্থান করে নিয়েছে, মাপযন্ত্রের কাটা যেভাবে এদিক-ওদিক করে প্রতিবারই একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় ফিরে আসে ঠিক তেমনি।
এই গোষ্ঠীগুলোর লক্ষ্য পুরোপুরোই পরষ্পর পরাহত…
পড়া থামালো উইনস্টন। প্রধানত, যে কথাগুলো সে পড়ছে অতি স্বাচ্ছন্দ আর নিরাপদে তার যথার্থতার প্রশংসাটুকু করার জন্যই এই থামা। এখানে সে একা, টেলিস্ক্রিন নেই, চাবির ফুটো দিয়ে পাতা নেই কোনও কান, কাঁধের ওপর দিয়ে চেয়ে নেই কোনও সতর্ক চোখ, অথবা তার নিজের হাতেই ঢেকে রেখে পড়তে হচ্ছে না বইয়ের পাতা। গ্রিষ্মের মিষ্টি হাওয়া গালের ওপর খেলা করে যাচ্ছে। দূরে কোথাও থেকে শিশুদের চেচামেচির মিলিয়ে আসা শব্দ কানে আসছে। কক্ষের ভেতরে ঘড়ির টিক টিক ধ্বনি ছাড়া পুরোই নিস্তব্ধ পরিবেশ। হাতলওয়ালা চেয়ারে আরও একটু গেড়ে বসলো, আর পা দুটো তুলে রাখলো ফেন্ডারের উপর। এ যেনো স্বর্গ, এ যেনো অনন্ত সময়। কেউ যখন অন্য কখনো কোনও বইয়ের সবটা, প্রতিটি শব্দ পড়বে বলে ঠিক করে তখন এলোমেলোভাবে পাতা উল্টায়, ঠিক সেভাবেই একটি পাতা খুলে সে দেখলো ওটি তৃতীয় অধ্যায়ের শুরুটা। সে পড়তে শুরু করলো:
তৃতীয় অধ্যায়
যুদ্ধই শান্তি
বিশ্বকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করে ফেলার ঘটনাটি যে ঘটবে তা বিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়েই আন্দাজ করা যাচ্ছিলো। ইউরোপকে রাশিয়ার দখলে নেওয়া, আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দখল যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ায় বর্তমান তিন পরাশক্তির দুই শক্তি ওশেনিয়া আর ইউরেশিয়া ততক্ষণে পুরোদস্তুর কার্যকরভাবে বর্তমান। আর তৃতীয় শক্তি ইস্টেশিয়ার উত্থান আরও দশক খানেক সময়ের বিভ্রান্তিমূলক অন্তর্যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পর। তিন প্রধান শক্তির মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রগুলোর কোনও কোনওটি স্রেফ আবেগনির্ভর। যৌক্তিকতা নেই তাও যুদ্ধ। অন্যস্থানগুলোতে যুদ্ধ নির্ভর করছে যুদ্ধেরই ভাগ্যের ওপর, হলে হয়, নইলে নয়। তবে সাধারণভাবে যুদ্ধটি চলছে ভৌগলিক রেখার অনুসরণে। ইউরোপীয় ও এশিয়াটিক স্থলভাগের গোটা উত্তরাংশ জুড়েই ইউরেশিয়া। পর্তুগাল থেকে শুরু হয়ে বেরিং প্রণালী অব্দি যার বিস্তৃতি। আমেরিকাদ্বয়, ব্রিটিশ দ্বীপমালা আর অস্ট্রেলিয়াসহ আটলান্টিক দ্বীপপুঞ্জ এবং আফ্রিকার দক্ষিণাংশ ওশেনিয়াভুক্ত। পশ্চিমে সীমিত যুদ্ধক্ষেত্র নিয়ে ইস্টেশিয়া অন্য দুই ভু-খ-ের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট, চীন ও তার দক্ষিণের অন্য দেশগুলো, জাপানের দ্বীপমালা, মানচুরিয়া, মঙ্গোলীয়া আর তিব্বত মিলিয়ে বৃহৎ এক ভূ-খ- এর অংশ। তবে ইস্টেশিয়ার এই অংশটি বাড়া-কমার মধ্যেই থাকে।
এভাবে হোক কিংবা অন্যভাবে, এই তিন প্রধান-রাষ্ট্র স্থায়ীভাবেই একে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। আর এমন ধারা চলে আসছে গত পঁচিশ বছর ধরে। এখন আর যুদ্ধ ঠিক ততটা আক্রোশি নয়, বিংশ শতাব্দির গোড়ার দশকগুলোতে যতটা তীব্র আর ভয়াবহ ছিল, এখন তা অনেকটা ধরে এসেছে। যুদ্ধবাজদের মধ্যে যুদ্ধ থেকে অর্জনের দিকগুলো সীমিত হয়ে পড়ায়, একের পক্ষে অন্যকে পুরোপুরি ঘায়েল করার শক্তি না থাকায়, আর মূল আদর্শগত কোনও ভিন্নতা না থাকায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার বাস্তব কোনও কারণ আর নেই। তবে এ কথা বলা যাবে না, যুদ্ধ কিংবা যুদ্ধের প্রতি বিরাজমান এই মনোভাব তাদের রক্তপিপাসা কমিয়েছে কিংবা আরও বেশি শালীন করে তুলেছে। বরং যুদ্ধের উম্মত্ততা চলছেই, বিশ্বজনীন রূপ নিয়েই তা চলছে সব দেশে দেশে।
ধর্ষণ, লুটতরাজ, শিশু হত্যা, গোটা জাতিকে দাসত্বে ঠেলে দেওয়া, কারাবন্দিদের নিষ্পেষণ— যার ভয়াবহতা জীবন্ত সিদ্ধ করা, পুঁতে ফেলা পর্যন্ত গড়ায়, এসবই অনেকটা স্বাভাবিক বলে জ্ঞান করা হয়, আর যখন কাজগুলো কোনও শত্রুপক্ষ নয়, স্রেফ নিজেদের মধ্যেই নিজেরা করে চলে, তখন তা প্রশংসনীয়ই বটে! যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত খুব কম সংখ্যক মানুষই, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ, আর হতাহতের সংখ্যাও অপেক্ষাকৃত কম।
সম্মুখ যুদ্ধ, যদি আদৌ কোথাও ঘটে থাকে, তা ঘটনে অজানা বানোয়াট যুদ্ধক্ষেত্রে, যার অস্তিত্ব সম্পর্কে গড় মানুষ কোনও ধারণাই করতে পারে না, অথবা যে ভাসমান দূর্গের কথা বলা হচ্ছে, যা সমুদ্রে কৌশলগত এলাকাগুলো পাহারা দিচ্ছে, তাও ঠিক কোথায় কেউ জানে না। সাধারণের মাঝে যুদ্ধ মানে ভোগ্যপণ্যের আকাল, মাঝে মধ্যে বিকট শব্দে দু-একটা রকেট বোমার বিস্ফোরণ আর তাতে কয়েক ডজন মানুষের মৃত্যু, এটুকুর বাইরে কিছু নয়। যুদ্ধ আসলে তার চরিত্রই বদলে ফেলেছে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বলা যায়, যে কারণে যুদ্ধ সে কারণটিই এখন তার গুরুত্ব হারিয়েছে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে মহারণগুলোর ধরন-ধারণে যতটুকু স্বল্পবিস্তার টিকে আছে তাও এখন কর্তৃত্বময়তায় রূপ নিয়েছে যা সচেতনভাবেই স্বীকৃত ও অনুসৃত।
যে যুদ্ধটি এখন চলছে তার ধরন, বলা যায়— এই যে বছর কয়েক পরপরই জোট বদলায়, তারপরেও, বরাবরই অভিন্ন। গোড়াতেই যে কেউ বুঝে নেবে কোনও কিছুই চূড়ান্ত হওয়ার নয়, আর তা সম্ভবও নয়। তিনটি প্রধান রাষ্ট্রের কোনওটিকেই আর জয় করা যাবে না। তা যদি অন্য দুটি শক্তি এক জোট হয় তারপরও নয়। ভীষণ বেজোরের জোড়া তাদের, আর প্রত্যেকের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ভীষণ রকম পাকাপোক্ত। ইউরেশিয়া সুবিস্তৃত স্থলভাগ দিয়ে সুরক্ষিত, ওশেনিয়ার সুরক্ষা তার আটলান্টিক ও প্রশান্তমহাসাগরের বিশালতায়। ইস্টএশিয়া তার ভ’মির উর্বরতা আর অধিবাসীদের পরিশ্রম দিয়ে সম্মৃদ্ধ। দ্বিতীয়ত, বাস্তব জ্ঞানে এমন কিছুই আর বাকি নেই, যার জন্য যুদ্ধ করা চলে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ অর্থনীতির ধারা প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে, যেখানে উৎপাদন আর ভোগ পারষ্পরিক সংগতিপূর্ণ। এ অবস্থায় অতীতের যুদ্ধগুলোর প্রধান কারণ ছিল যে বাজার দখল, সেটিও এখন আর বর্তমান নেই। কাঁচামালের প্রতিযোগিতাও এখন আর জীবন-মরণ কোনও বিষয় নয়।
যেকোন পথেই এই তিন প্রধান-রাষ্ট্র এত বিশাল যে প্রত্যেকেই তার সীমারেখার মধ্যেই তার প্রয়োজনের প্রতিটি উপকরণ পেয়ে যাচ্ছে। আর যুদ্ধের যেহেতু সরাসরি একটি অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য থাকেই, বলা যায় এই যুদ্ধ এখন আসলে শ্রম শক্তির যুদ্ধ। প্রধান তিন রাষ্ট্রের সীমান্তের মাঝে যে অংশ তা কারোরই স্থায়ী দখলে নেই সেখানে চতুর্ভূজ আকৃতির একটি অংশ রয়েছে যার কোণায় কোণায় রয়েছে ট্যাঙ্গিয়ার, ব্রাজাভিল, ডারউইন আর হংকং, যার জনসংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ। এই ঘন-বসতির অঞ্চলগুলো আর উত্তরাঞ্চলীয় বরফাচ্ছন্ন ভূ-খণ্ডের দখল নিতেই প্রধান তিন শক্তির যত লড়াই। এই অমীমাংসিত এলাকার পুরো নিয়ন্ত্রণ কেউ কখনোই নিতে পারেনি। এর অংশ বিশেষ সারাক্ষণ হাতবদল হতে থাকে। আকস্মিক প্রতারণামূলক আক্রমণে এখন এটা, তখন সেটা করায়াত্ত্ব করার ফলে এখানকার দখলদারিত্বের সীমারেখা সীমাহীনভাবেই পাল্টাতে থাকে।
এইসব অমিমাংসিত সীমারেখায় রয়েছে মূল্যবান খনিজ, আর কোনো কোনো এলাকায় ফলে রাবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সবজি-পণ্য, অপেক্ষাকৃত শীতের জলবায়ুতে যার উৎপাদন ব্যয়ও অপেক্ষাকৃত বেশি। কিন্তু সর্বোপরি এসব অঞ্চলেরই রয়েছে সস্তা শ্রমের এক তলাহীন ভাণ্ডার। যে শক্তিই বিষুবমণ্ডলীয় আফ্রিকাকে কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে কিংবা দক্ষিণ ভারতকে অথবা ইন্দোনেশীয় দ্বীপমালাকে নিয়ন্ত্রণ করুক, এই অঞ্চলের কোটি কোটি মানব দেহের ওপর তার দখল জন্মায় যারা সস্তায় গায়ে খাটা শ্রমিক-মজদুর। এসব অঞ্চলের অধিবাসীদের প্রকাশ্য এক দাসত্বের জীবন, তারা এক শাসকের হাত বদলে অন্য শাসকের কব্জায় পড়ে। কয়লা বা তেলের ওপর দখলদারিত্বের মতোই এই শ্রমশক্তির ওপর দখলদারিত্ব বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলে যাতে তা থেকে যে অর্থ বেচে যায় তা দিয়ে আরো অস্ত্র কেনা যায় আর তাতেই আরও ভূখণ্ড দখল হয়, কব্জায় আসে আরো শ্রমশক্তি। এ এক সীমাহীন লালসা।
খেয়াল করলে দেখা যাবে যুদ্ধ ওইসব অমীমাংসিত সীমারেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ইউরেশিয়ার সীমান্ত বরাবরই কঙ্গো অববাহিকা থেকে ভূমধ্যসাগরের উত্তর তীর পর্যন্ত আগু-পিছু করে। ভারত সাগর আর প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলো কখনো ওশেনিয়ার আবার কখনো ইস্টেশিয়ার দখলে থাকে। ইস্টেশিয়া আর ইউরেশিয়ার বিভক্তি রেখায় যে মঙ্গোলিয়ার অবস্থান সেখানকার পরিস্থিতি কখনোই স্থিতিশীল থাকেনি। মেরুঅঞ্চলে বিশাল সীমারেখায় তিন প্রধানশক্তিই তাদের দখলদারিত্বের ঘোষণা দিতে থাকে যখন তখন, যেখানে মূলত কারও বসবাস যেমন নেই, যাওয়াও সম্ভব হয়নি কখনো।
তবে শক্তির ভারসাম্য বরাবরই কম-বেশি নিশ্চিত থাকে, আর প্রতিটি প্রধান-রাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড থেকে যায় অক্ষত। অধিকন্তু, বিশ্ব অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার জন্য বিষুবমণ্ডলীয় এই বঞ্চিত মানুষের শ্রমের বাস্তবিক অর্থে কোনো প্রয়োজন নেই। তারা বিশ্বের সম্পদে কোনো মূল্যই যোগ করে না, কারণ তারা যা কিছু উৎপাদন করে তা যুদ্ধের কাজেই ব্যয় হয়ে যায়। আর যা যুদ্ধের উদ্রেক ঘটায় তা তো ভালোভাবে জিইয়ে রাখতেই হবে যাতে আরও একটি যুদ্ধের উদ্রেক ঘটে। এই দাসশ্রেণির মানুষগুলো তাদের শ্রম দিয়ে যুদ্ধকে নতুন নতুন গতি দেয়। কিন্তু তাদের অস্তিত্ব যদি না থাকত, বিশ্ব সমাজের কাঠামো, আর সে কাঠামো ধরে রাখার প্রক্রিয়া খুব বেশি ভিন্ন কিছু হতো না।
আধুনিক যুদ্ধের মূল লক্ষ্য হচ্ছে (দ্বৈতচিন্তার নীতি অনুসারে, ইনার পার্টির মগজওয়ালাদের কাছে যা একইসঙ্গে স্বীকৃত এবং অস্বীকৃত দুইই) যন্ত্রে উৎপাদিত পণ্যের ব্যবহার বাড়বে, কিন্তু সাধারণের জীবন মান বাড়বে না। উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে উদ্বৃত্ত ভোগ্য পণ্য নিয়ে শিল্প সমাজগুলো একটি সুপ্ত সমস্যায় পড়ে আছে। এই সময়ে, যখন খুব কম মানুষই জীবন ধারণের মতো পর্যাপ্ত পায়, তখন এমন সমস্যা নিঃসন্দেহে জরুরি কিছু নয়। আর জরুরি হয়ে উঠবেও না। উদ্বৃত্ত পণ্য ধ্বংস করে দেওয়ার কোন কৃত্রিম পদ্ধতি কাজ না করলেও নয়।
১৯১৪ সালের আগের পরিস্থিতির তুলনায় এখনকার বিশ্ব ভুখা, নাঙ্গাদের এক বিপর্যস্ত ভূমি। আর আমরা যদি একটি কল্পিত ভবিষ্যতের দিকে তাকাই, এহেন পরিস্থিতি আরও বাড়বে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে ভবিষ্যত সমাজের স্বপ্ন ছিলো অভাবনীয় ধন, অফুরান অবসর, নিয়মতান্ত্রিক আর কার্যকর এক সমাজ– কাচ-ইস্পাত আর বরফ-সাদা কংক্রিটের এক ঝকমকে বিশ্ব। প্রায় প্রতিটি শিক্ষিত মানুষের সচেতন ভাবনাই ছিলো এমন। অভাবনীয় গতিতে এগিয়ে চলছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যাত্রা, আর ধরেই নেওয়া যায় এই গতি আরও বাড়বে। তারপরেও প্রত্যাশিত সমাজ গড়ে উঠতে পারেনি, অংশত দীর্ঘ ধারাবাহিক যুদ্ধ আর বিপ্লবের কারণে সৃষ্ট দারিদ্র এর কারণ, আর অংশত এই জন্যে, যে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি উন্নয়ন ঘটছে তা স্রেফ চিন্তার ব্যবহারিক চর্চার ভিত্তিতে, যা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত সমাজে টিকে থাকতে পারছে না।
মোটের ওপর, বিশ্ব আজ পঞ্চাশ বছর আগের বিশ্ব থেকে একটু বেশিই আদিম। পিছিয়ে থাকা কিছু এলাকা এগিয়েছে, কিছু কল-কৌশলও তৈরি হয়েছে যা কোনও না কোনওভাবে যুদ্ধের আর পুলিশের গোয়েন্দাগিরির কাজে লাগছে, কিন্তু পরীক্ষা-নীরিক্ষা বা আবিষ্কার-উদ্ভাবন বন্ধ রয়েছে, আর ১৯৫০ এর দশকে ঘটে যাওয়া আনবিক যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট ধ্বংস আর ক্ষতি পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা কখনোই সম্ভব নয়।
এছাড়াও যন্ত্রের সঙ্গে এর অন্তঃস্থায়ী বিপদ আর ঝুঁকিতো রয়েছেই। প্রথম যখন যন্ত্র এলো তখন সমঝদার মানুষমাত্রের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো, মানুষের কায়িক শ্রমের দিন ফুরিয়েছে। আর আরও একটু বড় পরিসরে বলতে গেলে ধারনা করা হচ্ছিলো মানুষে মানুষে অসমতাও কমবে। যদি সে কারণেই যন্ত্রের ব্যবহার চলে তা আগামী কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই ক্ষুধা, অতিরিক্ত কাজ, অশিক্ষা, রোগ-বালাই আর পুঁতিগন্ধময় জীবন দূর করবে।
তবে বাস্তবতা হলো, এমন কোনও উদ্দেশ্যে নয়, স্বয়ংক্রিয় এক প্রক্রিয়ায় এসব যন্ত্র সম্পদ উৎপাদন করতে থাকলো, যার বণ্টনও কখনো কখনো অসম্ভব হয়ে থাকলো না- আর তাতে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে অর্থাৎ উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার ভাগে এসে গড়-পড়তা মানুষের জীবনের মান ভীষণভাবে বেড়ে গেলো।
কিন্তু এটাও স্পষ্ট, সম্পদের উপচয় সর্বত্র যে ধ্বংসের হুমকি দেয়, অন্য বিবেচনায় সে ধ্বংস আধিপত্যবাদী সমাজেরই। বিশ্বে মানুষ এখন কম খাটে, পর্যাপ্ত খায়, ঘরে থাকে- যার ভেতরেই পায়খানা-গোসলের ব্যবস্থা, ফ্রিজে খাবার তুলে রাখে, মোটরগাড়ি হাঁকায়, অথবা এমনকি উড়োজাহাজেও চেপে যেতে পারে কোথাও। তাতে বলাই যায়, বা বলাটা জরুরিও বটে যে, বৈষম্য দূর হয়েছে। বিষয়টি এখন সাধারণেও বিস্তৃত। সম্পদের বেশি-কমের ফারাকটি আর বড় হয়ে নেই।
ব্যক্তিমালিকানা আর বিলাসিতার বিবেচনায় সম্পদের সমবণ্টণ হবে, কিন্তু ক্ষমতা ছোট্ট একটি প্রাধিকারপ্রাপ্ত শ্রেণির হাতে থাকবে এমন একটা সমাজ কল্পনাও এখন অবাস্তব নয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে এমন একটি সমাজ স্থায়ী রূপ নিতে পারছে না। কাজের পর বিশ্রাম আর নিরাপত্তা যদি সকলের জন্য সমান হয়ে যায় তখন মানব গোষ্ঠীর একটা বড় অংশ, যারা দারিদ্র্যের কারণেই নির্বোধ, তারা শিক্ষিত হয়ে উঠবে, নিজেদের নিয়ে ভাবতে শিখবে। আর যখনই তারা সেটা করবে তখন খুব দ্রুত কিংবা আরও পরে তাদের কাছে ধরা পড়ে যাবে সুবিধাভোগী সংখ্যালঘুদের আসলে কোনো কাজ নেই। আর তখন তারা এদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করবে।
একটি আধিপত্যবাদী সমাজ নিশ্চিত করা কেবল তখনই সম্ভব যখন দারিদ্র্য থাকে, থাকে বঞ্চনা। অতীতের কৃষি সভ্যতায় ফিরে যাওয়া, কোনো কোনো চিন্তাবিদ বিশ শতকের গোড়ার দিকে যেমনটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন, তাও কোনো বাস্তবসম্মত সমাধান নয়। এতে বিরোধ বাঁধে যান্ত্রিকীকরণের সঙ্গে, যা এখন মোটামুটি গোটা বিশ্বেরই প্রবণতা। তবে যেসব দেশ শিল্পে পিছিয়ে তারা সামরিক বিবেচনায় হয়ে পড়ে অসহায়। তখন এরা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে অপেক্ষাকৃত এগিয়ে থাকা শত্রু-দেশের হাতে শাসিত ও শোষিত হতে থাকে।
পণ্যের সুফল থেকে বঞ্চিত রেখে দারিদ্র্য জিইয়ে রাখার মধ্য দিয়ে কোনো সন্তোষজনক ফল পাওয়া গেল না। পুঁজিবাদের চূড়ান্ত দিনগুলোতে, মোটা দাগে ১৯২০ থেকে ১৯৪০ এর মধ্যে, ঘটনাটি ঠিক এমনই ঘটল। অনেক দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে গেল, ভূমি পড়ে থাকল অনাবাদী, মৌলিক যন্ত্রপাতি রয়ে গেল অনেকের কাছেই অধরা, বৃহৎ বৃহৎ চাক ধরে জনগোষ্ঠী বেকার হয়ে থাকল, আর হয়ে পড়ল রাষ্ট্রীয় চ্যারিটির অনুদাননির্ভর। কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হলো না, সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে আসলো, চেপে বসল অকারণ দারিদ্র্য আর তাতে বিরোধী শক্তির দানা বেঁধে ওঠা অনিবার্য হয়ে উঠল। শিল্পের চাকা ঘুরবে কিন্তু বিশ্বের প্রকৃত সম্পদ বাড়বে না এমন একটি পথ বের করা তখন হয়ে পড়ল সত্যিকারের সমস্যা। পণ্য তৈরি হবে কিন্তু তার বণ্টন থাকবে না সেটাই ছিল লক্ষ্য। আর সে লক্ষ্য পূরণের একটাই পথ দাঁড়াল, তা হলো যুদ্ধ জিইয়ে রাখা।
বিনাশই যুদ্ধের অনিবার্য রূপ। এমন নয়, সে বিনাশ হতে হবে কেবলই মানব জীবনের, হতে পারে তা পণ্যের বিনাশ, কিংবা মানব শ্রমেরও। মানবজীবন সহজ করে তুলতে পারত, কিংবা পরিণামে তাদের করে তুলতে পারত আরো বুদ্ধিমান, এমন সব কিছুকে খান-খান করে আকাশে-অন্তরীক্ষে ছড়িয়ে দেয়, অথবা সাগরের অতলান্তে তলিয়ে দেয় এই যুদ্ধ। এমনকি অস্ত্রে অস্ত্রে যখন সয়লাব হয়ে থাকে, ব্যবহার নেই, ধ্বংসও হচ্ছে না তখনো এর প্রস্তুতকরণে নিয়োজিত থাকে বৃহৎ শ্রমশক্তি যারা স্রেফ তাই উৎপাদন করে চলে যার কোনো ভোক্তা নেই।
একটি ভাসমান দূর্গের কথাই ধরা যাক, এই দূর্গে শ্রমিকরা শত শত কার্গো জাহাজ তৈরিতে ন্যস্ত। জানা আছে এসব জাহাজ একসময় পরিণত হবে ভাঙারির সামগ্রীতে, বাস্তবে কোনো কাজেই লাগবে না, কারো জন্য বয়ে আনবে না বস্তুগত কোনো সুবিধাও। কিন্তু তারপরেও আরেকটি অতিকায় ভাসমান দূর্গই তৈরি হবে। নীতিগতভাবে জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলো মিটিয়ে যা উদ্বৃত্ত থাকবে যুদ্ধ পরিকল্পনা হতে হয় তারই ভিত্তিতে, কিন্তু বাস্তবে জনগণের প্রয়োজনকে ঊন জ্ঞান করা হয় আর তার ফলে মানুষের জীবনের জন্য যা প্রয়োজন তার আধাই অপূর্ণ থেকে যায়। আর সেই অপূর্ণতাকেই আবার দেখা হয় বড় ধরনের সুবিধা হিসেবে।
এ এক ইচ্ছানীতি যেখানে অনুগ্রহভাজনদেরও অভাবগ্রস্ততার কিনারায় লটকে রাখা হয় যাতে আকালের দিনে ছোট্ট একটি সুবিধাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ধরা দেয়, আর এভাবেই অনুগ্রহ আর বিরাগভাজনদের মাঝে তফাৎটা বহুগুনে বিবর্ধিত হয়। বিশ শতকের গোড়ার দিকের জীবন-মান বিবেচনায় নিলে বলা যায়, তখন কিন্তু ইনার পার্টির একজন সদস্যেরও একটু বেশিই খাটুনির জীবন ছিল। তবে, গুটিকয় বিলাসিতাও তারা উপভোগ করত, সুসজ্জিত ফ্ল্যাট, মিহি কাপড়ের পোশাক, ভালো মানের খাবার, পানীয় আর তামাক মিলত। জনা দুই কিংবা তিনেক চাকর-বাকর রাখা যেত, ব্যক্তিগত মোটর কার কিংবা হেলিকপ্টার পর্যন্ত ছিল যাতে তাকে আউটার পার্টির একজন সদস্য থেকে খুব সহজেই আলাদা করা যেত। আর আউটার পার্টির সদস্যেরা আবার সাধারণ নিগৃহীত জনগোষ্ঠী, যাদের আমরা ‘প্রোল’ বলছি, তাদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি সুবিধা ভোগ করত। এ এক অবরুদ্ধ নগর সমাজ, যেখানে এক টুকরো ঘোড়ার মাংস থাকা আর না থাকা দিয়ে বিবেচিত হয় ধনী আর গরীবের ফারাক। একইভাবে যুদ্ধাবস্থা বা বিপদগ্রস্ততায় একটি ছোট্ট গোষ্ঠীর হাতে সর্বময় ক্ষমতা তুলে দেওয়াকেই টিকে থাকার স্বাভাবিক, অপরিহার্য শর্ত বলে ভাবতে শেখায়।
যুদ্ধ, যেমনটা দেখা যায়, প্রয়োজনীয় ধ্বংস সাধন করে চলে, আর তা করে মনস্তাত্ত্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য এক প্রক্রিয়ায়। নীতিগতভাবে বিশ্বের অতিরিক্ত শ্রম ধ্বংস করার সহজ পথ হচ্ছে, মঠ-পিরামিড তৈরি করা, গর্ত খুঁড়ে আবার সেই গর্তই ভরাট করা কিংবা বিপুল পণ্য উৎপাদন করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া। কিন্তু এতে আধিপত্যবাদী সমাজের অর্থনৈতিক ভিত দৃঢ় হয়, মনোবলের ভিত নয়। এখানে যে মনোবলের কথা বলা হচ্ছে তা কিন্তু মোটেই সাধারণের মনোবল নয়, সাধারণের ভাবাবেগ গুরুত্বহীন কারণ তাদের কাজই হচ্ছে কাজ করে যাওয়া, এই মনোবল হচ্ছে পার্টির নিজের। এমনকি অতি বিনয়ী পার্টি সদস্যটিকেও হতে হবে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় যোগ্য, পরিশ্রমী আর বুদ্ধিমান, কিন্তু এও প্রয়োজন যে এই সদস্যটি হবেন বিশ্বাসপ্রবণ, অজ্ঞ আর গোঁড়া প্রকৃতির যার মজ্জাগত হয়ে থাকবে ভীতি, ঘৃণা, তোষামোদিতা আর মাত্রাহীন বিজয়োল্লাস। অন্য কথায় তার এমন এক মানসিক গড়ন থাকতে হবে যা যুদ্ধাবদ্ধার সঙ্গে খাপ খায়। যুদ্ধ আদতে হচ্ছে কি হচ্ছে না, তাতে কিছু যায় আসে না, আর, যেহেতু সুনির্দিষ্ট যুদ্ধ জয় অসম্ভব, সেহেতু যুদ্ধ ভালো চলছে নাকি মন্দ সেটাও ধর্তব্যের নয়। যা জরুরি তা হচ্ছে, একটি যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, এটাই নিশ্চিত করা।
গোটা বিশ্বেই পার্টি তার সদস্যদের কাছে গোয়েন্দাগিরি প্রত্যাশা করে, আর যুদ্ধাবস্থায় তা করা অপেক্ষাকৃত সহজও, কিন্তু কোনো সদস্য দলের যত বেশি উচ্চপদে যাবে ততই বেশি চিহ্নিত হয়ে পড়বে। সুনির্দিষ্ট করেই বলা চলে ইনার পার্টির যুদ্ধ-মত্ততা আর শত্রুপক্ষের প্রতি ঘৃণা সবচেয়ে প্রবল। প্রশাসকের যোগ্যতা নিয়ে ইনার পার্টির একজন সদস্যকে প্রায়শই জানতে হবে, যুদ্ধের এই এই খবরগুলো অসত্য, অথবা তাকে কখনো কখনো এও জেনে রাখতে হবে যে গোটা যুদ্ধটিই মেকি, আর হয় তা মোটেই ঘটছে না অথবা কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই এই যুদ্ধের উস্কানি কিংবা হম্বিতম্বি। তবে এই জ্ঞান বা ধারণাকে দ্বৈতচিন্তার এক সহজ পদ্ধতিতে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে হবে। এদিকে, ইনার পার্টির কোনো সদস্য কিন্তু যুদ্ধ নিয়ে এতটুকুও দ্বিধান্বিত নন, এক রহস্যময় বদ্ধমূল বিশ্বাসে তারা মনে করেন এই যুদ্ধ সত্য, জয় দিয়েই তার অবসান ঘটবে, আর ওশেনিয়া একদিন হয়ে উঠবে গোটা বিশ্বের একচ্ছত্র প্রভু।
ইনার পার্টির সব সদস্যের বিশ্বাসের মর্মমূলে গেঁথে আছে এক অনাগত বিজয়। হতে পারে এই বিজয় সুনিশ্চিত হবে একের পর এক নতুন ভূ-খণ্ড দখল করে তার মধ্য দিয়ে এক বিপুল শক্তির অধিকারী হয়ে, অথবা নতুন কোনো অপ্রতিরোধ্য যুদ্ধাস্ত্র আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। নতুন অস্ত্রের এই সন্ধান চলে অবিরাম, নিরবচ্ছিন্ন, আর যে গুটিকয় কাজে উদ্ভাবনী কিংবা অনুধাবনীয় মন নিয়োজিত এটি তারও একটি। বিজ্ঞান বলতে যা বুঝায় ওশেনিয়ায় তা আজ অবর্তমান। নিউস্পিকে ‘বিজ্ঞান’ নামক শব্দটিই উঠে গেছে। চিন্তার প্রায়োগিক পদ্ধতি, যার ভিত্তিতেই অতীতের সব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, তা আজ ইংসকের প্রায় সকল মূলনীতি দ্বারা প্রতিহত। আর কারিগরি অগ্রগতিও কেবল তখনই দেখা যায় যখন এর পণ্য কোনো না কোনো পথে মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করায় ব্যবহৃত হয়।
বিশ্বের সকল প্রয়োজনীয় মূর্ত সুন্দরের সৃজন হয় থমকে আছে, নয়ত পেছনের দিকে যাচ্ছে। জমি চাষ হচ্ছে ঘোড়ায় টানা লাঙ্গলে অথচ বইগুলো রচিত হচ্ছে যন্ত্রে। তবে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে যেমন, অর্থ, প্রভাব, যুদ্ধ আর পুলিশি গোয়েন্দাগিরিতে প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই উৎসাহিত করা হচ্ছে, অথবা অন্তত সহ্য করে যাওয়া হচ্ছে। দলের দুটিই লক্ষ্য—গোটা পৃথিবীর উপরিতল করায়ত্ব করা আর স্বাধীন চিন্তার সকল সম্ভাবনা চিরতরে মিইয়ে দেওয়া। এই পথে দুটো বৃহৎ চাওয়া থেকে যাচ্ছে যার সমাধানের পথ বের করতে না পারায় পার্টি উদ্বিগ্ন। একটি, কিভাবে অন্য কেউ কী ভাবছে তা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই জেনে নেওয়া যায়, আর অন্যটি হচ্ছে, কী করে কয়েক কোটি মানুষকে আগেভাগে সতর্ক না করে, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মেরে ফেলা সম্ভব।
বিজ্ঞান গবেষণা যেহেতু এখনো বর্তমান, তাই এখন এর বিষয়বস্তু এই একটাই। এখনকার বিজ্ঞানী হয় মনস্তত্ত্ববিদ আর অনুসন্ধাতার মিশেল একটি রূপ, যারা চেহারার অভিব্যক্তি, অঙ্গভঙ্গি, কণ্ঠের আওয়াজ থেকে বোঝার চেষ্টা করেন আর ওষুধের ব্যবহার, ছ্যাকা, সংবেশন, শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে সত্য আদায়ের কৌশল পরীক্ষায় সময় পার করেন, নয়ত তারা স্রেফ রসায়নবিদ, পদার্থবিদ বা জৈববিদ যারা যে যার শাখার কোন পথে জীবন নেওয়া যায় সে সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে ব্যস্ত। শান্তি মন্ত্রণালয়ের বিশাল পরীক্ষাগারে, আর ব্রাজিলের জঙ্গলে লুক্কায়িত পরীক্ষণ স্টেশনে, অথবা অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে, নয়ত অ্যানটার্কটিকার হারানো দ্বীপমালায় বিশেষজ্ঞের দলগুলো অতন্দ্রিত কাজ করে যাচ্ছে।
কেউ কেউ ভবিষ্যত যুদ্ধের উপকরণ তৈরি পরিকল্পনায় ন্যস্ত; অন্যরা বড় থেকে আরো বড় রকেট বোমা, আরো বেশি বেশি শক্তিশালী বিস্ফোরক, তৈরি, আরো অভেদ্য সাজোয়া যান নির্মাণের পথ বাতলে দিতে ব্যস্ত; আর অন্যরা আরো ভয়ঙ্কর মরক সৃষ্টিকারী গ্যাসের সন্ধানে, অথবা এমন দ্রবণীয় বিষ আবিষ্কারে যা এতটা পরিমাণে উৎপাদন সম্ভব যা দিয়ে গোটা মহাদেশের গাছ-লতা-পাতা ধ্বংস করে দেওয়া যায়, অথবা সম্ভাব্য সব ধরনের শারীরিক প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অকেজো করে দিয়ে মানব শরীরে সংক্রমিত হতে পারে এমন রোগের জীবাণু প্রজনন; অন্যরা মনোনিবেশ করে আছে এমন যানবাহন আবিষ্কারে যা মাটির গভীরে প্রোথিত হতে পারবে, সাবমেরিনের মতো তলিয়ে যেতে পারবে পানির অতলে, অথবা এমন উড়োজাহাজ যা আকাশে উড়বে আবার পানিতেও ভাসবে; অন্যরা আরো দূরের সম্ভাবনাকে নিয়েও ঘাঁটাঘাঁটি করছে যাতে মহাকাশের হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের সূর্যের রশ্নি লেন্সের সাহায্যে ধরা, অথবা পৃথিবীর কেন্দ্রে তাপ কেন্দ্রীভূত করে কৃত্রিম ভূমিকম্প আর জলোচ্ছাসের সৃষ্টি করা সম্ভব।
এসব প্রকল্পের কোনোটিই কখনো বাস্তবায়নের ধারেকাছেও পৌঁছায় না, আর তিন সুপার স্টেটের কোনোটিই একের চেয়ে অপরে বড় শক্তি হয়ে ওঠে না। আরো বেশি দেখার বিষয় হচ্ছে, তিন শক্তির প্রত্যেকেই আনবিক বোমা নামের একটি অস্ত্রের মালিক হয়ে আছে, যা মূলত এখন তারা যেসব শক্তি অর্জনের চেষ্টায় রত তার চেয়েও অনেক বেশি শক্তিধর। পার্টি অবশ্য তার স্বভাবজাতভাবেই দাবি করে চলছে তারাই এই আনবিক বোমার প্রথম আবিষ্কারক এবং তা আবিষ্কার হয় ১৯৪০’র দশকে আর তার দশ বছর পরে এর ব্যাপকভিত্তিক ব্যবহারেও তারা ছিল প্রথম।
সে সময় প্রধানত ইউরোপীয় রাশিয়া, পশ্চিম ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকার শিল্পকেন্দ্রগুলোতে এমন শত শত বোমা ফেলা হয়। এর প্রভাবে সকল দেশের শাসক শ্রেণি ধরে নিয়েছিল আর গুটি কয় আনবিক বোমার বিস্ফোরণ পুরো বিশ্বের সংগঠিত সমাজব্যবস্থায় ধস আনবে আর এমনকি তাদের নিজেদের শক্তিরও ইতি ঘটবে। এ অবস্থায় কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছাড়া, বিনা সন্ধিতেই ঠিক হয়ে যায় আর কোনো বোমা ফেলা হবে না। তিন শক্তিই তাদের আনবিক বোমা বানানোর কাজ অব্যাহত রাখল আর মজুদ করে রাখল নতুন কোনো মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো শক্তি হিসেবে, তারা মনেই করে আজ নয়ত কাল তেমন কোনো মারণাস্ত্র আসবেই। ইতোমধ্যে কেটে গেছে ত্রিশ কিংবা চল্লিশটি বছর আর সেই যুদ্ধকলা অনেকটা নিশ্চল হয়ে পড়েছে।
আগে যতটা দেখা যেত এখন তার চেয়ে বেশি হারে হেলিকপ্টারের ব্যবহার চলে, বোমারু বিমানকে টেক্কা দিয়ে স্বয়ংচালিত ক্ষেপনাস্ত্র জায়গা করে নিয়েছে, আর ঠুনকো যুদ্ধজাহাজ সরিয়ে দিয়ে তৈরি হয়েছে ভাসমান দুর্গ; এর চেয়ে বিশেষ কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। ট্যাঙ্ক, সাবমেরিন, টর্পেডো, মেশিনগান এমনকি রাইফেল, হ্যান্ড গ্রেনেডের ব্যবহার আজও রয়েছে। সংবাদপত্রে টেলিস্ক্রিনে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের খবর আসে ঠিকই কিন্তু আগের সেসব বেপরোয়া যুদ্ধের মতো, যাতে শত শত, হাজার হাজার এমনকি লাখ লাখ মানুষ কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মারা পড়ত, তেমনটি আর ঘটে না।
তিন প্রধান রাষ্ট্রের কেউই বড় ধরনের ব্যর্থতার ঝুঁকি থাকে এমন কৌশল হাতে নেয় না। বড় কোনো অভিযান বলতে কোনো এক মিত্রপক্ষের ওপর আকস্মিক হামলা। তিন প্রধান শক্তিরই একই কৌশল, অথবা তাদের সকলের বিশ্বাসও একই রকম। যুদ্ধ, দরকষাকষি চালিয়ে যাওয়া আর মোক্ষম সময় বুঝে বিশ্বাসঘাতকতা এই তিনের সমন্বয়ে পরিকল্পনা সাজানো থাকে। উদ্দেশ্য একটাই, নিজের কিংবা শত্রুদেশকে ঘিরে থাকা ঘাঁটিগুলো দখলে আনা, আর অতঃপর শক্রর সঙ্গে সন্ধি কিংবা মিত্রতার চুক্তিতে উপনীত হয়ে শান্তির পতাকা উড়িয়ে বছরের পর বছর সন্দেহকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা। এই সময়ে আনবিক বোমায় ভরা রকেটগুলোকে কৌশলগত অবস্থানে বসানোর কাজ চলতে থাকে আর অবশেষে সেগুলো একযোগে চালিয়ে দেওয়া—যাতে তার প্রভাবে ঘটে যায় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ আর প্রতিঘাত হয়ে ওঠে অসম্ভব।
এরপর সময় এসে যায় বিশ্বের বাকি শক্তিগুলোর সঙ্গে মিত্রতার চুক্তিতে উপনীত হওয়ার আর নতুন একটি হামলার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার। বলাই বাহুল্য, এই ভাবনা বা পরিকল্পনা স্রেফ তাদের দিবাস্বপ্ন, যার বাস্তবায়ন পুরোই অসম্ভব। উপরন্তু, বিষুবরেখাকে ঘিরে থাকা বিতর্কিত এলাকাগুলো আর মেরুঅঞ্চলের দখল ইস্যু ছাড়া আর কোনো যুদ্ধ কোনোকালেই দেখা যায়নি। শত্রুপক্ষের সীমারেখায় হামলার ঘটনা ঘটেনি কখনোই। এর মানে হচ্ছে, বড় শক্তিগুলোর মধ্যে কিছু কিছু সীমান্ত এলাকা নিয়ে বনিবনা হয়ে আছে।
ইউরেশিয়ার কথা বলা যায়, এরা চাইলেই ব্রিটিশ দ্বীপগুলো দখলে নিতে পারে, ভৌগলিকভাবেও ওগুলো ইউরোপের অংশ; অন্যদিকে ওশেনিয়ার পক্ষে তার সীমারেখা চাইলেই রাইন নদী পর্যন্ত এমনকি ভিস্টুলা পর্যন্ত ছড়িয়ে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু তা সাংস্কৃতিক অখণ্ডতার নীতি ভঙ্গ করবে, যদিও এমন নীতি কস্মিনকালেও গঠন করা হয়নি। ফ্রান্স বা জার্মানি নামে পরিচিত অঞ্চলগুলো ওশেনিয়া দখল করতে চাইলে, হয় এর বাসিন্দাদের নিঃশেষ করে দিতে হবে, যা বিশাল এক কঠিন কাজ, নয়ত মোটামুটি কোটি দশেক মানুষের দায়িত্ব নিয়ে নিতে হবে, যারা, কারিগরি উন্নয়ন যতদূর এগিয়েছে তাতে, অনেকাংশেই ওশেনিয়ার সমানে সমান।
এই সমস্যা তিন পরাশক্তির জন্যই একই রকম। তাদের প্রত্যেকের রাষ্ট্র কাঠামোয় যুদ্ধবন্দি আর কালো কৃতদাসদের ছাড়া আর কোনো বিদেশিকে স্বাগত জানানোর সুযোগ নেই। এমনকি এখন যে কাগজে কলমে মিত্রপক্ষ তাদের ওপরও থাকে সার্বক্ষণিক সন্দেহের চোখ। যুদ্ধবন্দিদের বাদ দিলে, ওশেনিয়ার নাগরিকরা ইউরেশিয়া বা ইস্টেশিয়ার কোনো একটি মানুষকেও কোনো দিন চোখেও দেখেনি। আর বিদেশি ভাষা শিক্ষাও তার জন্য বারণ। কেউ যদি কোনো বিদেশি সম্পর্কে জানতে বা যোগাযোগ করতে চায়, তাকে বলা হয় এরা ঠিক তারই মতো এক সৃষ্টি, আর এর বাইরে যা কিছু বলা হবে তার সবটাই মিথ্যা। যে মোহর এঁটে দেওয়া জগতে তার বিচরণ তা একদিন ভাঙবে, আর ভয়, ঘৃণা ও সাধুম্মন্যতার যে মনোভাব পোষণ করে চলছে তাও একদিন উবে যাবে। তাহলে সব দিক বিবেচনায় বোঝাই যাচ্ছে যতবারই পারস্য কিংবা মিসর কিংবা জাভা কিংবা শিলন তাদের হাত বদলাক, বোমা ছাড়া আর কিছুই মূল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওপারে পড়বে না।
এর আড়ালে লুক্কায়িত এক সত্য যা কখনোই উচ্চকিত কণ্ঠে উচ্চারণ হয়নি, কিন্তু নীরবে বোধগম্য আর ইঙ্গিতবহ, তা হচ্ছে তিন প্রধান শক্তিতেই জীবন একইরকম। ওশেনিয়ার বর্তমান দর্শনের নাম ইংসক, ইউরেশিয়ায় এর নাম নব্য-বলশেভিকবাদ, আর ইস্টেশিয়ায় এর রয়েছে একটি চীনা নাম যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায় মৃত্যু-পূজা, তবে সাধারণ অর্থ নিজেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। ওশেনিয়ার কোনো নাগরিকেরই অন্য দুই দর্শনের ব্যাপারে কিছু জানার বা বোঝার অনুমতি নেই, তবে সাধারণভাবে তার মাথায় যা ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তা হচ্ছে এদের ঘৃণা করতে হবে আর তা হতে হবে বর্বরোচিতভাবে।
তিন দর্শনকে কদাচই আলাদা করে নির্দেশ করা যায়, আর তারা যে সমাজ কাঠামো অনুসরণ করছে তা আলাদা করা যাবেই না। সবক্ষেত্রেই একই পিরামিডীয় কাঠামো, নেতার প্রতি একই দেবতাতুল্য পূজা, আর ঘটমান যুদ্ধাবস্থায় একই অর্থনীতি। এতে বলা যায় তিন প্রধান দেশের একের পক্ষে অন্যকে জয় করা সম্ভব নয়, আর করলেও তা থেকে কোনো সুফল আসবে না। বরং তারা সংঘাত জিইয়ে রেখে একে অন্যকে ঠেকনা দিয়ে রাখছে, ভুট্টার তিনটি ছড়া ঠিক যেভাবে থাকে। তিনটি শক্তিরই শাসকেরা যা কিছু করছে তা সম্পর্কে তারা একই সঙ্গে সতর্ক আবার অসতর্কও। তাদের জীবন বিশ্বজয়ে নিয়োজিত, কিন্তু তারা এটাও জানে এই যুদ্ধ চলতে হবে অন্তহীন-অবিরাম যার কোনো বিজয় থাকবে না। যুদ্ধজয়ের বিপদ না ঘটে যাওয়ার এই নিশ্চয়তা শাসকদের সকল বাস্তবতাকে অস্বীকার করার সুযোগ করে দেয়। আর সেটাই মূলত ইংসক বা এর শত্রুপক্ষগুলোর চিন্তা প্রক্রিয়ার বিশেষ দিক। এখানে আবারও বলতে হয়, আগেও বলা হয়েছে, টানা এক যুদ্ধাবস্থা মূলত যুদ্ধের চরিত্রটিই পাল্টে দিয়েছে।
অতীতে যুগে যুগে, কোনো যুদ্ধ, সংজ্ঞায়িতভাবেই এমন কিছু ছিল যা শিগগিরই নয়ত দেরিতে হলেও একদিন শেষ হতো, নির্ভুলভাবেই হয় জয় নয়ত পরাজয়ে ঘটত সে পরিণতি। অতীতে এও হতো, যুদ্ধই ছিল মানব সমাজকে কাঠামোগত বাস্তবতার স্পর্শে রাখার মূল হাতিয়ার। যুগে যুগে সকল শাসকই তাদের অনুসারীদের বৈশ্বিক কাঠামো নিয়ে একটি মিথ্যা ধারণা চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে আসছে কিন্তু সামরিক দাপট নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ রাখা হয়নি কখনোই। আর যতদিন পরাজয় মানেই ছিল পরাধীনতা অথবা অন্য কোনো অপ্রত্যাশিত পরিণতি ততদিন পরাজয় ঠেকানোর পূর্বসতর্কতাও ছিল প্রকট।
বাস্তব সত্যগুলোকে অবজ্ঞার সুযোগ নেই। দর্শন, ধর্ম, কিংবা নীতি বা রাজনীতিতে দুই আর দুইয়ে পাঁচ হলেও হতে পারে, কিন্তু যখন কেউ একটি বন্দুকের কিংবা উড়োজাহাজের নকশা বানাবে তখন তাকে দুই আর দুইয়ে চার মেলাতেই হবে। অকার্যকর জাতিগুলো বরাবরই দ্রুত কিংবা দেরিতে হলেও জয় করে নেওয়া হতো, তাদের কার্যকর হয়ে ওঠার সংগ্রাম তখন আরো প্রতিকূল হয়ে উঠত। কার্যকর রাষ্ট্র হতে হলে অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি, কিন্তু তার জন্য অতীতে কী ঘটেছে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। সংবাদপত্র, ইতিহাসের বই—এসবই তো বরাবর থেকে গেছে পক্ষপাতমূলক, রং চড়ানো। কিন্তু আজ যেভাবে মিথ্যায়নে সিদ্ধ করা হচ্ছে তা ছিল অসম্ভব। যুদ্ধ ছিল সুবিবেচনার এক সুনিশ্চিত রক্ষাকবচ, আর শাসক শ্রেণির ক্ষেত্রে সম্ভবত তা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঢাল। যুদ্ধে যেহেতু জয়-পরাজয় দুই-ই ছিল সেহেতু কোনো শাসকশ্রেণি পুরোপুরি অবিবেচক হতে পারত না।
কিন্তু যুদ্ধ যখন আক্ষরিক অর্থেই এক অবিরাম অনন্ত রূপ নিল, তখন তা ভয়াবহতা হারাল। যুদ্ধ যখন টানা চলতে থাকে তখন সামরিক জরুরৎ বলে কোনো কথা আর থাকে না। কারিগরি অগ্রগতি থেমে যায়, আর ধ্রুব সত্যটিকেও করা হয় অস্বীকার কিংবা অবজ্ঞা। আমরা দেখছি বিজ্ঞান গবেষণা বলতে এখন যা চলছে তা স্রেফ যুদ্ধের জন্যই, কিন্তু সেগুলো অবধারিতভাবেই এক দিবাস্বপ্ন, ফলে কোনো ফল বয়ে আনতে না পারার যে ব্যর্থতা তাও গুরুত্ব হারাচ্ছে। দক্ষতা, এমনকি সামরিক দক্ষতারও আজ আর প্রয়োজন নেই। ওশেনিয়ায় থট পুলিশ ছাড়া আর কোনো কিছুই কার্যকর নয়। তিন প্রধান শক্তির প্রতিটিই যখন অজেয়, প্রতিটিই কার্যত একটি ভিন্ন ব্রহ্মাণ্ড যার অভ্যন্তরে চিন্তার যে কোনো বিচ্যুতিকে সহজেই চালিয়ে দেওয়া যায়। বাস্তবতার বাস কেবল প্রাত্যহিক জীবনের চাহিদার যে চাপ তার মাঝে—খেতে হবে, পান করতে হবে, মাথার ওপর চাই আচ্ছ্বাদন, চাই পরনের বসন, চাই না গলায় গরল ঢেলে কিংবা বহুতলের জানালা দিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে কিংবা এমন আরো নানা উপায়ের মৃত্যুবরণ।
জীবন আর মরণের মাঝে, আনন্দ আর বেদনার মাঝে এখনও একটি সুস্পষ্ট ফারাক রয়ে গেছে, কিন্তু সেটুকুই সব। বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, অতীত বিস্মৃত হয়ে ওশেনিয়ার নাগরিকেরা মহাকাশের তারকামণ্ডলের বাসিন্দা হয়ে উঠেছে, যাদের একটু জানারও সুযোগ নেই, কোন দিকে উপর আর কোন দিকে নিচ। এমন রাষ্ট্রে শাসক অসীম ক্ষমতাধর, ফারাও কিংবা সিজাররাও যতটা ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেনি। দেশের নাগরিক দুর্ভিক্ষে যাতে বিপুল সংখ্যায় মারা না পড়ে তা নিশ্চিত করা তাদের দায়, আর সামরিক কৌশলে শত্রুদের সমতুল্যে একই নিচু স্তরে থেকে যাওয়াও তাদের কাজ, কিন্তু একবার এর ন্যুনতম অর্জন নিশ্চিত হয়ে গেলেই, সত্যকে তারা যেমন ইচ্ছা তেমন রূপ-আকার দিতে পারে।
তাহলে যুদ্ধ, পুরাতন যুদ্ধের মানে বিচার করা হলে, স্রেফ এক ছলচাতুরি। এই যুদ্ধ এক ধরনের জাবরকাটা প্রাণির মধ্যে সংগ্রামের সামিল, যার সিংগুলো এমন কৌণিকভাবে বাঁকানো যে একে অন্যকে গুঁতোটি পর্যন্ত বসাতে পারে না। তবে এ যুদ্ধ যেহেতু অবাস্তব নয়, সেহেতু তা অর্থহীনও নয়। এই যুদ্ধ ভোগ্যপণ্যের উদ্বৃত্ত খেয়ে ফেলছে, আর এক বিশেষ মানসিক ভাবনা সংরক্ষণ করে চলছে যে, আধিপাত্যবাদী সমাজের প্রয়োজন রয়েছে। যুদ্ধ, দেখা যাবে, আজ পুরোপুরিই এক অভ্যন্তরীণ বিষয়। অতীতে সকল দেশের শাসক গোষ্ঠী একে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় সাধারণ স্বার্থের দিকগুলোর ওপর খেয়াল রাখত আর প্রতিপক্ষের ক্ষয়ক্ষতিরও একটি মাত্রা বজায় রাখত। বিজয়ীরা সর্বদাই পরাস্তদের ওপর লুটতরাজ চালাত। আমাদের নিজেদের দিনগুলোতে তারা কিন্তু আদৌ একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে না। এখন প্রতিটি শাসকদল নিজেদের প্রজাকুলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে, আর সে লড়াইয়ের উদ্দেশ্য কোনো সীমান্ত রক্ষা বা জয় করা নয়, বরং সমাজ কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রাখাই এর উদ্দেশ্য।
‘যুদ্ধ’ নামের শব্দটি তাহলে নিজেই হয়ে পড়েছে বিভ্রান্তিকর। এটা বলা যথার্থ হতে পারে যে, টানা যুদ্ধের মানেই হচ্ছে যুদ্ধহীনতা। সেই নব্যপ্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে বিংশ শতকের গোড়ার দিকটা পর্যন্ত যে অদ্ভুত চাপ মানব সন্তানের ওপর ফেলেছিল এই যুদ্ধ, তা আজ অতি ভিন্ন কিছু দিয়ে প্রতিস্থাপিত। তিন প্রধান রাষ্ট্র আজ যদি একে অন্যের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধ না করে তার পরিবর্তে অন্তহীন শান্তির সম্পর্কের দিকে যায়, প্রত্যেকেই যদি নিজেদের সীমারেখার ভেতরেও থাকে অলঙ্ঘিত তার প্রভাবও অনেকটা অভিন্ন হবে। তাহলেও প্রত্যেকেই হয়ে থাকবে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ শক্তির বলয়, বাহ্যিক বিপদের পরিমিত প্রভাব থেকেও থাকবে সম্পূর্ণ মুক্ত। একটি সত্যিকারের স্থায়ী শান্তি প্রক্রিয়াও হবে স্থায়ী যুদ্ধের সম। এটাই—যদিও পার্টির অধিকাংশ সদস্য কেবল ভাসা ভাসা বুঝতে পারে—তারপরেও এটাই ইনার পার্টির স্লোগান: ‘যুদ্ধই শান্তি’র প্রকৃত অর্থ।
এক দণ্ডের জন্য পড়া থামাল উইনস্টন। ঠিক তখনই অনেক দূরে কোথাও সশব্দে রকেট বোমা পড়েছে। টেলিস্ক্রিনবিহীন একটি কক্ষে নিষিদ্ধ বই হাতে একাকীত্বের এই স্বর্গীয় অনুভূতিতে তা চিড় ধরাতে পারল না। একাকীত্ব আর নিরাপত্তার বোধ তার শরীর জুড়ে, তার সঙ্গে মিশে আছে শরীরের ক্লান্তি, কেদারার আরাম, জানালা বেয়ে আসা মৃদুমন্দ বাতাসের ছোঁয়া, যা খেলে যাচ্ছে তার গালের ওপর। বইটি তার মন কেড়েছে, অথবা আরো নির্দিষ্ট করে বলা চলে, দিয়েছে দৃঢ় আশ্বাস। এক অর্থে এ থেকে সে যা জানল তা তার কাছে নতুন কিছু নয়, কিন্তু আকর্ষণ করেছে ভীষণভাবেই। এখানে তাই বলা হয়েছে যা সেও বলে আসছে, তার বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলো একসঙ্গে করে সাজিয়ে বলতে পারলে তা হবে এই কথাগুলোই।
এও বলা চলে, যিনি লিখেছেন তিনিও তার মতোই এক অভিন্ন মননশীলতা ধারণ করেন, কিন্তু নিঃসন্দেহে লেখকের মনটি অনেক বেশি ক্ষমতাধর, অনেক বেশি গোছানো, অনেক কম ভীত-সন্ত্রস্ত। তার মনে হলো, সেরা বইগুলোতে আসলে তাই থাকে যা আপনি আগে থেকেই জানেন। পাতা উল্টে আবারও সে প্রথম অধ্যায়ে ফিরে গেল, ঠিক তখনই সিঁড়িতে শুনতে পেল জুলিয়ার পায়ের শব্দ। আর চেয়ার থেকে উঠে তাকে দেখার উদ্দেশে এগোলো। ঘরে ঢুকেই খাকি রঙের টুলব্যাগটি মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল জুলিয়া আর নিজেকে উজিয়ে দিলে উইনস্টনের বাহুতে। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় পর যে দেখা হলো দুজনায়!
‘বইটি আমি হাতে পেয়ে গেছি’—প্রগাঢ় আলিঙ্গনে জড়াজড়ি করা অবস্থায় বলল উইনস্টন।
‘ও! পেয়ে গ্যাছো? খুব ভালো’—জুলিয়ার কণ্ঠে অনুচ্ছ্বাসের অভিব্যক্তি, আর দ্রুতই সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল তেলস্টোভে কফি বানাবে বলে।
বিছানায় তাদের আধাঘণ্টা কেটেছে এর মধ্যে আর বইয়ের বিষয়ে ফেরেনি কেউ। চাদর গায়ে জড়িয়ে শুয়ে থাকার জন্য যথেষ্টই ঠাণ্ডাময় এক সন্ধ্যা। নিচ থেকে ভেসে আসছে পরিচিত গান আর পাথুরে মেঝেতে বুটের শব্দ। সেই বাদামি রঙা লালবাহুর নারীটি যেন এই আঙিনার এক স্থায়ী চলমান মূর্তি। প্রথম যেদিন এসেছিল সেদিনই নারীটিকে দেখেছে উইনস্টন। মনে হয়, দিনের আলো যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই কাপড় কাচার পাত্র থেকে শুকানোর রজ্জুর মাঝে চলে তার আসা-যাওয়া। কাপড় লটকানোর পেগগুলো মুখে নিলে মাঝে মাঝে থেমে যায় তার জোরালো গানের সুর।
জুলিয়া ততক্ষণে পাশ ফিরে ঘুমের প্রস্তুতিতে। মেঝেতে পড়ে থাকা বইটি হাতের নাগালে পেল উইনস্টন। সেটি তুলে নিয়ে শিথানের দিকে হেলান দিয়ে বসল সে।
‘আমাদের অবশ্যই এটা পড়া উচিত’—বলল সে। ‘তোমারও। ব্রাদারহুডের সকল সদস্যেরই এটা পড়া উচিত। ’
‘তুমি পড়ো’—বলল সে। ততক্ষণে তার দুচোখ বোজা। ‘একটু জোরে শব্দ করে পড়ো। সেটাই সবচেয়ে ভালো। পড়তে পড়তে তুমি আমাকে ব্যাখ্যা করেও বলতে পারবে। ’
ঘড়ির কাটা ছয়টার ঘরে, মানে সন্ধ্যা ছয়টা। তাদের হাতে তিন কিংবা চার ঘণ্টা সময় আছে। বইটি হাঁটুর ওপর রাখল সে আর পড়তে শুরু করল:
অধ্যায় ১
অবজ্ঞাই শক্তি
যতদিনের কথা নথিভুক্ত রয়েছে ততদিন ধরে, অথবা বলা যায় নব্যপ্রস্তর যুগের পর থেকেই পৃথিবীতে উচ্চ, মধ্য আর নিম্ন এই তিন শ্রেণির মানুষ বাস করে আসছে। এরা আরো নানাভাবে উপ-বিভক্ত হয়ে, ভিন্ন ভিন্ন অগুনতি নাম পেয়েছে, তাদের আপেক্ষিক সংখ্যা, একের প্রতি অন্যের আচরণ যুগে যুগে পাল্টেছে, কিন্তু সমাজের অপরিহার্য কাঠামোটি থেকে গেছে অপরিবর্তিত। বড় বড় অভ্যুত্থান আর আপাতদৃষ্টিতে অপরবর্ত্য পরিবর্তনের পরেও, এই একই ব্যবস্থা নিজের মতো করেই সমাজ কাঠামোয় আবার স্থান করে নিয়েছে, মাপযন্ত্রের কাটা যেভাবে এদিক-ওদিক করে প্রতিবারই একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় ফিরে আসে ঠিক তেমনি…
‘জুলিয়া জেগে আছো?’—বলল উইনস্টন।
‘হ্যাঁ, প্রিয়তম, আমি শুনছি। তুমি পড়তে থাকো। অসাধারণ এই লেখা। ’
সে পড়তে থাকল:
এই গোষ্ঠীগুলোর লক্ষ্য পুরোপুরোই পরস্পর পরাহত। উচ্চশ্রেণির লক্ষ্য হচ্ছে তারা যেমন আছে তেমনই থাকবে। মধ্য শ্রেণির লক্ষ্য উচ্চ শ্রেণিতে রূপান্তর। আর নিম্ন শ্রেণির লক্ষ্য হচ্ছে, যখন তাদের লক্ষ্য কিছু থাকে—কারণ নিম্ন শ্রেণির একটি বশ্যতার চরিত্র রয়েছে, তা দিয়ে তারা বোঝে শ্রম দিয়ে যাওয়াই তাদের কাজ ফলে নিজেদের জীবনের বাইরে কোনো কিছু আছে বলে যখন তখন ভুলে যায়—সকল ভেদাভেদ ভেঙ্গে দিয়ে এমন এক সমাজ নির্মাণ যেখানে সব মানুষই হবে সমান। এভাবেই ইতিহাসের ভাঁজে ভাঁজে একটি সংগ্রাম চলে এসেছে যার বাহ্যিক কাঠামোটি বারবার ছিল একই রকম। দীর্ঘকাল উচ্চ শ্রেণি নির্বিঘ্নভাবে ক্ষমতার একক ভাগীদার হয়ে থাক, কিন্তু খুব দ্রুত নতুবা কিছু পরে হলেও একটি সময় এসে যায় যখন এরা নিজেরাই নিজেদের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে অথবা হারিয়ে যায় তাদের শাসন পরিচালনার ক্ষমতা, অথবা উভয়ই। তখন মধ্যশ্রেণি তাদের হটিয়ে দেয়, আর নিম্নবিত্তদের পাশে টানে আর বলতে শুরু করে, তাদের সংগ্রামটিও স্বাধীনতা আর ন্যয় বিচারের জন্যে। আর মধ্যবিত্তরা যখন তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে ফেলে তখনই তারা নিম্নবিত্তকে ফের তাদের পুরনো দাসত্বের অবস্থানে ঠেলে দেয়, আর তারা নিজেরা হয়ে ওঠে উচ্চবিত্ত।
বর্তমানে অন্য দুটি গোষ্ঠীর যেকোনো একটি থেকে অথবা উভয় গোষ্ঠী থেকে ছিটকে পড়ে একটি নব্য মধ্যবিত্ত গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। তিন শ্রেণির মধ্যে কেবল নিম্নবিত্তরাই কখনো এমনকি সাময়িক সময়ের জন্যও তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। বলা বাহুল্য, গোটা ইতিহাস জুড়ে বাস্তবিক অর্থে তাদের অবস্থার কোনো অগ্রগতি হয়নি। এমনকি আজ এই অবক্ষয়ের যুগেও, কয়েক শতক আগে মানুষ যেমন ছিল তার চেয়ে গড়পড়তা ভালো আছে। কিন্তু সম্পদ বাড়েনি, মানুষের আচরণ পাল্টায়নি, কোনো সংস্কার বা বিপ্লব ঘটেনি যা থেকে মানুষের সাম্য এক মিলিমিটারও কাছাকাছি আসতে পেরেছে। নিম্নবিত্তের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আসলে তাদের প্রভুদের নামগুলো পাল্টে যাওয়া ছাড়া ঐতিহাসিক পরিবর্তনগুলো তাদের জীবনে আর কোনো অর্থই বহন করে আনতে পারেনি।
উনিশ শতকের শেষভাগে সমাজে এই অবস্থা ফিরে এলে তা অনেক পর্যবেক্ষকেরই চোখে ধরা পড়ে। তখন গড়ে ওঠে চিন্তাবিদদের বিদ্যালয় যারা ইতিহাসের চক্রকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিল এই অসমতা মানব জীবনের এক অমোঘ বিধান। এই মতবাদ নিঃসন্দেহে বরাবরই সমর্থন পেয়ে আসছে, কিন্তু আজ মতবাদটি যেভাবে সামনে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে তাতে রয়েছে উল্লেখযোগ্য এক ভিন্নতা। অতীতে আধিপত্যবাদী সমাজের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে যে মতবাদ, তা কেবল উচ্চবিত্তদের মাঝেই বিদ্যমান ছিল। রাজা-রাজরাদের, অভিজাতদের, ধর্মগুরু, আইনজীবীদের আর তাদের তোষামোদকারীদের মুখেই কেবল এ কথা শোভা পেত। তখন কবরের পরের এক কল্পিত জগতে ক্ষতিপূরণ মিলবে এমন অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে সুরও কিছুটা নরম থাকত তাদের।
মধ্যবিত্তরা, যতক্ষণ ক্ষমতার জন্য লড়াইয়ে সামিল, ততক্ষণই স্বাধীনতা, ন্যয়বিচার আর ভ্রাতৃত্বের বাণী কপচাত। আজ, অবশ্য মানব ভ্রাতৃত্বের এই ধারণাটি সেই সব মানুষের হাতে জর্জরিত হতে শুরু করেছে যারা এখনো কোনো কথা বলতে পারছে না, তবে অনেক আগে থেকেই তারা কথা বলতে চায়। অতীতে মধ্যবিত্তরা সাম্যের ব্যানারে তাদের সব অভ্যুত্থান ঘটায়, আর অতঃপর পুরনো শাসকদের হটিয়ে দিয়ে নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। নব্য মধ্যবিত্ত গোষ্ঠীগুলো তাদের জুলুমশাহী ঘোষণা করে নতুন অত্যাচারে নেমে পড়ে। সমাজতন্ত্র, তত্ত্বটি আসে ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে চিন্তামালার শেষ সংযুক্তি হয়ে যা প্রাচীন দাসবিদ্রোহ পর্যন্ত আলোচনায় টেনে আনে, কিন্তু তাও গভীরভাবে সংক্রমিত হয়ে থাকে অতীতের যুগ-যুগের সব কাল্পনিকতায়। ১৯০০ সালের পর থেকে আসা সমাজতন্ত্রের প্রতিটি রূপভেদে স্বাধীনতা ও সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ক্রমেই আরো আরো প্রকাশ্য পরিত্যক্ত হতে দেখা যায়।
শতাব্দীর মাঝামাঝিতে এসে ওশেনিয়ায় ইংসক, ইউরেশিয়ায় নব্য-বলশেভিক আর ইস্টেশিয়ায় মৃত্যু-পূজা ডাক নামে যেসব নব্য আন্দোলনের সূচনা হলো তার সবগুলোরই অতি সচেতন উদ্দেশ্যই ছিল স্বাধীনতাহীনতা আর অসাম্যকে স্থায়ী রূপ দেয়া। এসব নব্য আন্দোলন, নিঃসন্দেহে, পুরনো আন্দোলনের নির্যাস থেকে এসেছে, পুরনো নাম ধারণ করে রাখতে চেয়েছে আর আদর্শ স্থান পেয়েছে স্রেফ মুখের ভাষায়। এদের সকলেরই উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনো এক পছন্দসই সময়ে উন্নয়নকে থমকে দেওয়া আর ইতিহাসকে হিমাগারে পাঠানো। একই পরিচিত পেণ্ডুলাম দুলিয়ে ঘোর সৃষ্টি করে আবার থামিয়ে দেওয়া। আগে স্বাভাবিক পন্থায় উচ্চবিত্তদের হটিয়ে মধ্যবিত্তরা হয়ে উঠত নব্য উচ্চবিত্ত, কিন্তু এবার, এক সচেতন কৌশলে উচ্চবিত্তরা তাদের অবস্থানকে অনেকটা পাকাপোক্ত করে নিয়েছে।
পুঞ্জিভূত ইতিহাস জ্ঞান, আর ঐতিহাসিক ধারণায় অগ্রসরতার কারণে নতুন মতবাদ এবার আংশিক মুখ দেখাল, ঊনিশ শতকের আগে যা কখনোই ঘটেনি। ইতিহাসের চক্রাকার আন্দোলন এখন বুদ্ধিগ্রাহ্য, নয়ত তার কাছাকাছি, আর যখন তা বুদ্ধিগ্রাহ্য তখন তা পরিবর্তনীয়ও বটে। কিন্তু নীতিগতভাবে, মূলগত কারণটি হচ্ছে বিশ শতকের গোড়ার দিকেই মানব সাম্য কৌশলগতভাবে সম্ভবপর হয়ে ওঠে। এটা সত্য যে মানুষ এখনো তার বুদ্ধিমত্তা, মেধায় সমান নয়, আর সে কারণে একজন অন্যজন থেকে বিশেষভাবে এগিয়ে কিংবা পিছিয়ে, কিন্তু শ্রেণি বিভেদ কিংবা সম্পদের বিশাল ব্যবধান টিকিয়ে রাখার কোনো বাস্তবসম্মত প্রয়োজন এখন আর নেই। আগে যুগে যুগে, শ্রেণি বৈষম্য কেবল যে অবশ্যম্ভাবী ছিল তাই নয়, প্রত্যাশিতও ছিল। সভ্যতারই দান এই অসাম্য। যন্ত্রে উৎপাদন উন্নয়নের মধ্য দিয়ে এই শ্রেণি পাল্টেছে। এমনকি এখনো, মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কাজই করতে হলেও তাদের আর ভিন্ন ভিন্ন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাস করতে হয় না।
সেক্ষেত্রে, ক্ষমতালিপ্সু নতুন গোষ্ঠীগুলোর দৃষ্টিভঙ্গী থেকে, মানব সাম্য আর এমন কোনো আদর্শ হয়ে নেই যার জন্য লড়াই করে যেতে হবে, কিন্তু এর বিপদমুক্ত অবশ্যই থাকতে হবে। আরো আদিম যুগে, যখন একটি যথার্থ শান্তির সমাজ বাস্তবিকই ছিল অসম্ভব, তখন তা বিশ্বাসে নেওয়াও যেত সহজে। সৌভ্রাতৃত্বের আবহে বাস করবে, নিয়ম-কানুনের বেড়াজাল থাকবে না, পশুর মতো খাটতে হবে না এমন এক পার্থিব স্বর্গরাজ্যের বাসনা মানুষের মনে বিরাজ করছে হাজার হাজার বছর ধরে। প্রতিটি ঐতিহাসিক ক্রান্তিকালে যারা সুবিধাভোগী ছিল তাদের মাঝেও এই স্বপ্ন ছিল। ফরাসি, ব্রিটিশ ও আমেরিকান বিপ্লবের উত্তরাধিকাররা মানুষের অধিকার, বাক স্বাধীনতা, আইনের চোখে সবাই সমান, এমন সব বিষয়ে তাদের নিজেদের দেওয়া সংজ্ঞার মধ্যে থেকে আংশিক বিশ্বাসও রাখতেন, আর একটা মাত্রায় তাদের কাজে-কর্মে এর প্রভাবও পরিলক্ষিত হতো। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকের মধ্যেই রাজনৈতিক চিন্তার সকল মূল স্রোতই হয়ে উঠল কর্তৃত্ববাদী।
পার্থিব স্বর্গ যখন বাস্তবায়নযোগ্য হয়ে উঠল ঠিক তখনই তা বানচাল করে দেওয়া হলো। প্রতিটি নতুন রাজনৈতিক তত্ত্ব, যে নামেই তাকে ডাকা হোক না কেন, সমাজকে আধিপত্যবাদ আর নিয়ন্ত্রণবাদের দিকেই নিয়ে গেছে। আর ১৯৩০ এর কাছাকাছিতে এটা একটা কঠোরতার রূপ পেয়েছে। অনেক আগে যেসব চর্চা সমাজ থেকে উঠে গেছে—বিচার ছাড়াই কারান্তরীণ রাখা, যুদ্ধবন্দীদের কৃতদাস হিসেবে ব্যবহার, জনসম্মুখে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, স্বীকারোক্তির জন্য নির্যাতন, জিম্মিদশা, পুরো জনসংখ্যার বিতাড়ন—এ সবকিছুই আবার স্বাভাবিকই কেবল হলো না, যারা নিজেদের আলোকিত কিংবা প্রগতিশীল বলে মনে করে তাদের কাছেও সহনীয় এবং এমনকি সমর্থন পেয়ে গেল।
বিশ্বের সকল অংশে জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব ঘটে যাওয়ারও এক দশক পর ওশেনিয়ার ইংসকসহ অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী নীতিগুলো পুরোপুরি হিসাব কষে নেওয়া রাজনৈতিক তত্ত্ব হিসেবে আবির্ভূত হলো। তবে এগুলোর ওপরে আগে থেকেই ছায়া ফেলে ছিল বেশকিছু পদ্ধতি যাকে সাধারণভাবে সমগ্রতাবাদী নামে ডাকা হয়, যা এই শতকের গোড়ার দিকেও একবার দেখা দিয়েছিল। আর এই জটলা থেকে যে পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে তার মূল রূপরেখা বহু আগে থেকেই প্রতীয়মান। কোন ধরনের মানুষের হাতে এই পৃথিবী নিয়ন্ত্রিত হবে তাও হয়েছিল একইভাবে পরিষ্কার।
আমলা, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক, প্রচার বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী, শিক্ষক, সাংবাদিক আর পেশাদার রাজনীতিকদের নিয়ে নতুন এই আভিজাত সমাজ গড়ে উঠল। এই মানুষগুলো, উঠে এসেছে বেতনভোগী মধ্যমশ্রেণি, ও শ্রমজীবী শ্রেণির উচ্চ গ্রেড থেকে, আকার পেয়েছে ও একসঙ্গে লালিত হয়েছে একচেটে শিল্প জগত আর কেন্দ্রীভূত সরকার ব্যবস্থায়। অতীতের যুগে যুগে এমন মানুষের সঙ্গে তুলনা করলে বলা যাবে তারা ছিল আরো কম লোভী, কম ভোগবিলাসি, ক্ষমতার জন্য তাদের ক্ষুধাটিও ছিল খাঁটি, আর, সর্বোপরি, তারা তাদের নিজেদের কৃতকর্মের বিষয়ে বেশি সচেতন ছিল, আর বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করার ইচ্ছাটিও ছিল প্রবল।
এই শেষ পার্থক্যটি মৌলিক। আজ যেমনটা তার তুলনায় অতীতের জুলুমবাজি শক্তিগুলো ছিল ক্ষীণ উদ্যমী আর অপটু। শাসক গোষ্ঠীগুলো বরাবরই কোনো একটা মাত্রায় উদারপন্থায় আক্রান্ত ছিল, সর্বত্রই একটা বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে রাখতে পছন্দ করত, প্রকাশ্য কিছু কর্মকাণ্ড ছাড়া প্রজারা কী ভাবছে তা নিয়ে তাদের আগ্রহই ছিল না। এমনকি মধ্যযুগের ক্যাথলিক চার্চগুলোও আধুনিক মানের ব্যাপারে সহনশীল ছিল। অংশত এর কারণ হচ্ছে, অতীতের কোনো সরকারের হাতেই প্রজাদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখার ক্ষমতা ছিল না।
ছাপাখানা আবিষ্কারের ফলে জনমতকে নিজ উদ্দেশ্য সাধনে কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি হয়, এরপর চলচ্চিত্র ও রেডিও এসে সে প্রক্রিয়া আরো জোরদার করে। টেলিভিশন তৈরির ফলে আরেক কারিগরি অগ্রগতি সাধিত হলো যেখানে একই যন্ত্র একই সঙ্গে তথ্য গ্রহণ ও সম্প্রচার দুই-ই করতে পারে, আর তার মধ্য দিয়ে ঘটে গেল ব্যক্তিগত জীবনের অবসান। প্রতিটি নাগরিক, অথবা প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিককে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা পুলিশের চোখে চোখে রাখা সম্ভব হলো, আর সরকারি কচকচানি দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হলো যোগাযোগের আর সব চ্যানেল।
এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের ইচ্ছার প্রতি পূর্ণাঙ্গ আনুগত্যই কেবল নিশ্চিত করা হলো না, সকল প্রজারই এক মত, প্রথমবারের মতো তারও নিশ্চয়তা বিধান করা হলো। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বিপ্লব পরবর্তী সময়ে, নিজে নিজেই ফের গোষ্ঠীবদ্ধ হলো সমাজ, যেমনটা অতীতেও হয়েছে, সেই একই শ্রেণিভেদ—উচ্চ, মধ্য আর নিম্ন। কিন্তু নব্য উচ্চবিত্ত শ্রেণি সকল পূর্বসূরীদের থেকে ব্যতিক্রম হয়ে এই প্রথম নিজ চরিত্রে আবির্ভাব হলো না, বরং এবার অনেক বেশি জোর দিল নিজেদের অবস্থানকে দৃঢ় করার লক্ষ্যে। আর সে জন্য যা যা দরকার তার সব করতে শুরু করল। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার উপলব্ধি এই যে, যৌথবাদিতাই গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের সবচেয়ে নিরাপদ ভিত। সম্পদ ও সুবিধা দুই-ই খুব সহজে সংরক্ষণ সম্ভব যদি তা থাকে যৌথ অধিকারে।
‘ব্যক্তি সম্পদের বিলোপ’ নামের যে তথাকথিত ধারা শতাব্দীর মাঝের দিককার বছরগুলোতে তৈরি হয়েছিল, তার প্রায়োগিক মানে ছিল অতীতের চেয়েও আরো কম মানুষের হাতে সম্পদ ঘনিয়ে আনা। পার্থক্য এই যে, নব্য মালিকরা অনেক ব্যক্তির সমারোহ নন বরং তারা গুটি কয় ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত গোষ্ঠী। ব্যক্তিগতভাবে পার্টির কোনো সদস্যই কোনো কিছুর মালিক নন, স্রেফ গুটিকয় ব্যক্তিসম্পত্তি ছাড়া। ওশেনিয়ায় সামগ্রিকভাবে সব কিছুই পার্টির মালিকানায়, কারণ পার্টিই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, আর যখন যেটুকু প্রয়োজন বোধ করে সেটুকু করে পণ্য ছাড়ে। বিপ্লবের পরের বছরগুলোতে পার্টি বিনা বাধায় হুকুমদাতার আসনে আসীন হয়, কারণ তখন পুরো প্রক্রিয়াটিই সাধন করা হয় যৌথবাদিতার নামে।
বরাবরের ধারণা ছিল, পুঁজিবাদীদের দখলচ্যুত করা হলে সমাজতন্ত্র আসবে; আর প্রশ্নাতীতভাবেই পুঁজিপতিদের দখলচ্যুত করা হয়েছে। কারখানা, খনি, ভূমি, আবাসন, পরিবহন—এই সবকিছুই তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো: আর যেহেতু এসবের কোনো কিছুই ব্যক্তি সম্পত্তি হিসেবে থাকল না, বলাই বাহুল্য এগুলো হয়ে উঠল সরকারি সম্পত্তি। অপেক্ষাকৃত অতীতের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয় ইংসক, আর এর নামেও রয়েছে সমাজবাদিতার গন্ধ, সুতরাং ইংসকই সমাজতন্ত্রের ধারক। যার ফল দাঁড়াল তা-ই যা আগেই ধারণা বা প্রত্যাশিত ছিল। তা হচ্ছে এর মধ্য দিয়ে, অর্থনৈতিক বৈষম্য একটি স্থায়ী রূপ পেল। তবে আধিপত্যবাদী সমাজকে একটি স্থায়ী রূপদানের সমস্যাটি আরো গভীরে প্রোথিত হলো।
মাত্র চারটি উপায়েই ক্ষমতাসীন পার্টিকে গদিচ্যুত করার সুযোগ থাকে। হয় বাইরের কোনো শক্তি এসে দখল করে নেবে, নয়ত এর সরকার পরিচালনায় অদক্ষতায় সাধারণ মানুষ বিদ্রোহ করবে, অথবা একটি শক্তিশালী, অতৃপ্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠার সুযোগ করে দেবে, অথবা নিজেই নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দেবে। এই কারণগুলোর একেকটি আলাদাভাবে ঘটলে খুব একটা ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না, আর বলা যায় কোনো একটি শাসন ব্যবস্থায় এই চারটি কারণই কোনো মাত্রাভেদে বজায় থাকে। কোনো ক্ষমতাসীন শ্রেণি যদি এই চারটি দিক থেকেই নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে তার ক্ষমতা হয়ে উঠবে পাকাপোক্তভাবে স্থায়ী। আসলে বলা যায়, এখানে নির্ণয়ক একটাই, তা হচ্ছে, শাসক শ্রেণি নিজে কী ভাবছে।
এই শতকের মাঝামাঝিতে এসে প্রথম বিপদটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। তিন শক্তির প্রত্যেকেই বিশ্বকে বাস্তবিক অর্থেই অজেয় করে দিয়ে যে যার অংশ ভাগ করে নেয়, যা কেবল একটি পথেই পাল্টে যেতে পারে, তা হচ্ছে ধীরে ধীরে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পরিবর্তন, যা আবার খুব সহজেই এড়ানোও সম্ভব। দ্বিতীয় বিপদটি স্রেফ তাত্ত্বিক। জনগণ কখনোই নিজেরা বিদ্রোহ করবে না, আর তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠবে না কারণ তারা শোষিত। আর যতদিন তারা তুলনা করে দেখার জন্য জীবন যাপনের অন্য কোনো মানের কথা জানতেও পারবে না, ততদিন তারা বুঝবে না যে তারা শোষিত। অতীতে সবগুলো অর্থনৈতিক সঙ্কট খামোখাই ঘটেছিল, আর এই যুগে তেমনটি আর ঘটতে দেওয়া হবে না। অন্য এবং সমবৃহৎ অব্যবস্থাপনা কিছু ঘটতে পারে, তবে তাতে কোনো রাজনৈতিক ফল মিলবে না, কারণ কোনো পথেই অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠার সুযোগ নেই।
যন্ত্র কৌশল আবিষ্কারের পর থেকে অতিউৎপাদন সমাজে এক সুপ্ত সমস্যা হিসেবে বিরাজ করছে, যা আবার সমাধান করা হয়েছে যুদ্ধাস্ত্র ও সরঞ্জামের অব্যাহত আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই (তৃতীয় অধ্যায় দেখুন), প্রয়োজনীয় মাত্রায় জনগণের নৈতিকতাবোধ ধরে রাখতেও রয়েছে এর উপযোগিতা। আমাদের আজকের শাসকদের সামনে সেক্ষেত্রে একমাত্র খাঁটি বিপদ হয়ে থাকছে—একটি যোগ্য, উননিয়োজিত, ক্ষমতাকামী নতুন গোষ্ঠীর জন্মলাভ, আর তাদের নিজেদের মধ্যে উদারপন্থা ও সংশয়বাদীতার সৃষ্টি। এখানে যে সমস্যাটির কথা বলতে হয়, সেটি শিক্ষাগত। যা পরিচালক দল ও তার অব্যবহিত নিচের নির্বাহী গ্রুপকে সচেতনতায় অব্যাহত ছাঁচ দিয়ে চলেছে। জনগণের সচেতনতাই একমাত্র প্রভাবিত হচ্ছে একটি নেতিবাচক পথে।
এই পটভূমিকায়, আগেভাগে জেনে না থাকলেও, যে কেউ ওশেনীয় সমাজের সাধারণ কাঠামোটি সম্পর্কে ধারণা নিতে পারবেন। পিরামিডের চূড়ায় যিনি বসে তিনি বিগ ব্রাদার। তিনি সকল ভুল-ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। প্রতিটি সাফল্য, প্রতি অর্জন, প্রতিটি জয়, প্রতিটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, সকল জ্ঞান, সকল বুদ্ধি, সকল খুশি, সকল সদ্গুণ সবই তার নেতৃত্ব আর অনুপ্রেরণার ফল। বিগ ব্রাদারকে কেউ কখনো দেখেনি। তিনি স্রেফ বিজ্ঞাপনমঞ্চে দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে থাকা একটি মুখ, টেলিস্ক্রিনের এক কণ্ঠস্বর। আমরা অনেকটা যৌক্তিকভাবেই নিশ্চিত, তার কোনোদিন মৃত্যু হবে না, আর ইতোমধ্যেই তার জন্মদিনটি নিয়েও তৈরি হয়েছে ধর্তব্যে নেওয়ার মতো অনিশ্চয়তা। বিগ ব্রাদার একটি বেশ, পার্টি তাকে ঠিক যেমনটি বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করতে চায় এই বেশ তেমনই। তার কাজ হচ্ছে ভালোবাসা, ভয়, শ্রদ্ধা ও আবেগের মূল কেন্দ্রে ভূমিকা পালন করে যাওয়া, যা সবাইকে একটি সংগঠনের দিকে নয় একজন ব্যক্তির দিকে টেনে নেয়।
বিগ ব্রাদারের পরেই আসে ইনার পার্টি। এর সদস্য সংখ্যা ছয় মিলিয়নে সীমিত যা ওশেনিয়ার মোট জনসংখ্যার দুই শতাংশেরও কম। ইনার পার্টির পরে আসে আউটার পার্টি, যাকে, ইনার পার্টিকে যদি রাষ্ট্রের মস্তিষ্ক বলা হয়, বলা যাবে দুই হস্ত। এদের পরে রয়েছে নির্বোধ সাধারণ, যাদের আমরা ‘দ্য প্রোল’ বলেই অভ্যস্ত, আর এদের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর ৮৫ শতাংশ। আগের শ্রেণি বিণ্যাসে প্রোলরা ছিল নিম্নশ্রেণি: বিষূবমণ্ডলীয় ভূমির এ এক দাস জনগোষ্ঠী যারা দখলদারদের হাতে হাতে বদলেছে, যারা পুরো কাঠামোর স্থায়ী কিংবা প্রয়োজনীয় কোনো অংশ নয়।
নীতিগতভাবে এই গ্রুপগুলোর সদস্যপদ বংশানুক্রমিক নয়। তত্ত্বমতে ইনারপার্টির বাবা-মায়ের সন্তান জন্মগতভাবে ইনার পার্টির হবে না। বয়স ষোল হলে পরীক্ষা দিয়ে তবেই এই পার্টির কোনো না কোনো শাখায় ভর্তি হতে হবে। এছাড়াও নেই কোনো বর্ণগত বৈষম্য, এক প্রদেশের ওপর অন্য প্রদেশের দাদাগিরিও নেই। ইহুদি, নিগ্রো, খাঁটি ভারতীয় রক্তবহনকারী দক্ষিণ আফ্রিকানরা পার্টির উচ্চসারিতে আসীন, আর প্রতিটি অঞ্চলের প্রশাসক নেওয়া হচ্ছে সেই অঞ্চলেরই বাসিন্দাদের মধ্য থেকেই। ওশেনিয়ার কোনো অংশেই বাসিন্দাদের এমন ভাবনার সুযোগ নেই যে তারা দূর রাজধানীর শাসনে এক উপনিবেশিক জনগোষ্ঠী। ওশেনিয়ার কোনো রাজধানী নেই, আর এর খেতাবি প্রধান এমন এক ব্যক্তি যার অস্তিত্ব কোথায় কেউ জানে না। এছাড়াও ইংরেজি এর মূল যোগাযোগের ভাষা, আর নিউস্পিক দাপ্তরিক ভাষা, তাও আবার কোনোভাবেই কেন্দ্রীভূত নয়। এর শাসকদের মধ্যে কোনো রক্ত-সম্পর্ক নেই, তবে তারা সবাই একই সাধারণ মতবাদের প্রতি অনুগত।
এটা সত্য আমাদের সমাজ স্তরে স্তরে বিন্যস্ত, আর সেই স্তরবিন্যাস অত্যন্ত অনমনীয়, প্রথম দর্শনে যা বংশানুক্রমিক বলেই মনে হবে। আন্তঃগোষ্ঠী যোগাযোগ পুঁজিবাদী সমাজে কিংবা প্রাক-শিল্পযুগে যেমনটা দেখা গেছে তেমনটা এখন খুব দেখা যায় না। পার্টির দুটি শাখার মধ্যে বিশেষ কিছু আন্তঃপরিবর্তন ঘটে কিন্তু তা ইনার পার্টির দুর্বলদের বের করে দেওয়া আর আউটার পার্টির উচ্চাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে যারা ক্ষতিকর নয় তাদের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রলেতারিয়েতদের পার্টিতে অন্তর্ভূক্তির সুযোগ দেওয়ার চর্চা নেই। এদের মধ্যে যারা অতি অগ্রসরমান, যাদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে অসন্তোষ তাদের স্রেফ থট পুলিশের সহায়তায় চিহ্নিত করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। তবে এই ব্যবস্থা স্থায়ী কিছু নয়, নয় কোনো নীতিগত বিষয়ও। পুরোনো বিশ্বের ধ্যান ধারণায় পার্টি চলে না। নিজেদের সন্তানদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার ইচ্ছাও পার্টির নেই, এমনকি যদি কখনো পার্টি পরিচালনার মতো দক্ষ হাত আর না থাকে তখন প্রলেতারিয়েতদের মধ্য থেকে পুরোপুরি নতুন একটি প্রজন্ম তুলে এনে নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারেও পার্টি প্রস্তুত থাকবে। সঙ্কটের বছরগুলোতে, পার্টির এই বংশানুক্রমিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতির ভাবমূর্তি বিরোধী শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
সমাজতন্ত্রের অতীত ধারায় যখন ‘শ্রেণি সুবিধা’ নামের একটি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়তে হতো তখন এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে ওঠে যে, বংশানুক্রমিক না হলে কোনো কিছুকে স্থায়ীরূপ দেওয়া যায় না। তারা তখন বুঝতে পারেনি গোষ্ঠী শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য কোনো বাহ্যিক কাঠামো দেওয়ার প্রয়োজন নেই, তারা এও বুঝতে চায়নি বংশানুক্রমিক আভিজাত্য বেশি দিন টেকে না, বরং ক্যাথলিক চার্চের মতো সবকিছুকে গ্রহণ করে নেওয়া সংগঠনগুলো শত শত কিংবা হাজার হাজার বছর ধরে টিকে থাকে। গোষ্ঠীবদ্ধ শাসনের সারমর্ম এই নয় যে পিতার ক্ষমতা যাবে পুত্রের হাতে, তবে বিশ্বজুড়ে ধারণাটি এমন যে, মৃত্যুর পর জীবিতের হাতে তুলে দেওয়া হবে ক্ষমতা। এটা একটা বিশেষ জীবনধারাও। একটি শাসক গোষ্ঠী যতক্ষণ তার উত্তরাধিকার মনোনয়ন করে যেতে পারবে ততক্ষণই শাসক গোষ্ঠী হয়ে থাকবে। আর রক্তের ধারার অক্ষুণ্ণতা নিয়ে পার্টি চিন্তিত নয়, পার্টি চায় তাকে নিজেকেই চিরস্থায়ী করে রাখতে। এখানে কার হাতে ক্ষমতা তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত ক্রমাধিকারতন্ত্রের কাঠামোটি ঠিক থাকে ততক্ষণ তো নয়ই।
যে সকল বিশ্বাস, অভ্যাস, পছন্দ, আবেগ, অনুভব, মানসিকতা আমাদের সময়কে বৈশিষ্টমণ্ডিত করে তার সবই আসলে পার্টির রহস্যময়তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য, আর এখনকার সমাজের বাস্তবিক প্রকৃতিকে হৃদয়াঙ্গমে বাধা সৃষ্টির জন্য তৈরি। বিদ্রোহ কিংবা প্রাক-বিদ্রোহের নামে সামান্য নড়াচড়াটিও আজ অসম্ভব। প্রলেতারিয়েতদের নিয়ে ভয়ের কিছুই নেই। স্রেফ কাজ করে, সন্তান জন্ম দিয়ে, আর মৃত্যুকে বরণ করে নিয়ে তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম, শতাব্দীর পর শতাব্দী পার করে দেবে, তাদের মধ্যে বিদ্রোহের ছিটেফোঁটাও থাকবে না। আর কেবল তাই নয় তাদের এটুকু বোঝার ক্ষমতাও তৈরি হবে না যে বিশ্বটি হতে পারত এখন যেমন তার চেয়ে ভিন্ন কিছু।
তারা কেবল তখনই বিপজ্জনক হয়ে উঠবে যখন শিল্পায়নের কারিগরি অগ্রসরতা এমন মানে পৌঁছে যাবে যেখানে তাদের আরো শিক্ষিত হয়ে ওঠা দরকারি হয়ে পড়বে। কিন্তু, যেহেতু সামরিক ও বাণিজ্যিক বিভেদ এখন আর গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, সেহেতু জনপ্রিয় শিক্ষার হার ও মান দিন দিন কমছে। জনগণ যে মত ধারণ করে, কিংবা করে না, তাকে ঔদাসীন্যের বিষয় হিসেবেই দেখা হয়। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা দেওয়া যায় অনায়াসেই, কারণ তারা বুদ্ধিই ধারণ করে না। অন্যদিকে পার্টির কোনো সদস্যের বেলায় অতি তুচ্ছ বিষয়েও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভিন্নমত্যতাও সহ্য করা হয় না।
পার্টির একজন সদস্য তার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত থট পুলিশের চোখে চোখে থাকে। এমনকি যখন যে একা থাকে তখনও কখনোই নিশ্চিত হতে পারে না যে, সে একা। যে কোনো সময়ে, হতে পারে ঘুমিয়ে কিংবা জেগে, কাজে কিংবা বিশ্রামে, গোসলে কিংবা বিছানায়, তাকে তল্লাশি করা যাবে তার জন্য সংকেত কিংবা সতর্কতা পর্যন্ত জারি করতে হবে না, আর এমনকি সে জানতেও পারবে না তার ওপর তল্লাশি চলছে। যা কিছু সে করে তার কোনোটিই তুচ্ছজ্ঞান করার সুযোগ নেই। তার বন্ধুত্ব, বিশ্রাম যাপন, স্ত্রী-সন্তানের প্রতি আচরণ, একাকীত্বের অভিব্যক্তি, ঘুমের মাঝে বিড়বিড়ানি, এমনকি হাঁটাচলার ভঙ্গি, শরীরের নড়াচড়ার বৈশিষ্ট্য, এ সবকিছুতেই অতিসন্দেহের দৃষ্টিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে।
বাস্তবিক দুষ্টাচরণই কেবল নয়, কোনো খামখেয়ালিপনা, হোক সে ছোটখাটো, কোনো অভ্যাসের পরিবর্তন, কোনো স্নায়ুবিক আচরণ যা ভেতরগত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার লক্ষণ তুলে ধরে এসব কিছুই নিশ্চিত ধরা পড়ে যাবে। কোনো পথেই তার পছন্দের কোনো স্বাধীনতা নেই। অন্যদিকে, তার কাজগুলো আইন দিয়ে কিংবা কোনো বিশেষ আচরণবিধি দিয়ে নিয়ন্ত্রিতও নয়। ওশেনিয়ায় কোনো আইন নেই। কিছু চিন্তা কিংবা কাজ ধরা পড়ে গেলে মৃত্যু অনিবার্য, অথচ তা নিষিদ্ধ নয়। আর নিরন্তর শুদ্ধিকরণ, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, কারাবাস আর বাষ্পকরণ যে চলে তা কিন্তু কোনো কৃত অপরাধের সাজা নয় বরং স্রেফ ভবিষ্যতে অপরাধী হয়ে উঠতে পারে এমন মানুষগুলোকে উবে দেওয়াই কাজ।
দলের কোনো সদস্যের কাছে, সঠিক মতামতের অধিকারী হবে কেবল সেটাই চাওয়া হয় না, তার থাকতে হবে সঠিক সহজাত প্রবর্তনাও। তার কাছ থেকে প্রত্যাশিত এসব বিশ্বাস ও আচরণের অনেকগুলোরই কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই, ইংসকের অন্তঃস্থায়ী অসংগতিগুলোর নগ্ন উপস্থাপন ছাড়া তার ব্যাখ্যা দেওয়াও যাবে না। সে যদি প্রকৃতিতে নীতিসিদ্ধ (নিউস্পিকে বলে সুচিন্তক) কেউ হয়, তাহলে চিন্তা ব্যাতিরেকেই সকল পারিপার্শ্বিকতায় সে জেনে যাবে কোনটি সত্যিকারের বিশ্বাস অথবা প্রত্যাশিত আবেগ।
কিন্তু কোনো না কোনোভাবে শৈশবেই যেসব প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে সে যাচ্ছে আর নিউস্পিকের ক্রাইমস্টপ, ব্ল্যাকহোয়াইট ও ডাবলথিঙ্কের মতো শব্দগুলোর মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে তাতে যে কোনো বিষয়ই হোক না কেন তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার ইচ্ছা কিংবা সক্ষমতা দুইই হারিয়ে ফেলবে।
দলের কোনো সদস্যের ব্যক্তি আবেগ প্রত্যাশিত নয় আবার প্রবল উচ্ছ্বাস দেখানো থেকেও নেই নিবৃতি। তাকে বিদেশি শত্রুর প্রতি অবিরাম উম্মত্ততায় ঘৃণা দেখিয়ে যেতে হবে, এবং পার্টির ক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তার সামনে নিচের নীচতা বজায় রাখতে হবে। তার নগ্ন, অসন্তুষ্টির জীবন থেকে সৃষ্ট হতাশাগুলো ইচ্ছাকৃতভাবেই বাইরে ঠেলে দেওয়া হয় আর ‘দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচি’র মতো প্রক্রিয়া দিয়ে তা দূর করা হয়। শিশুবেলায় স্রেফ কিছু অভ্যন্তরীণ নিয়ম-শৃঙ্খলা আয়ত্ব করিয়ে ভেতরে ভেতরে সংশয়বাদী বা বিদ্রোহী মনোভাব তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাগুলো হত্যা করা হয়।
এই নিয়ম শৃঙ্খলার প্রথম ও সহজতম স্তরকে, যা ছোট্ট শিশুটিও শিখতে পারে, নিউস্পিকের ভাষায় বলে ক্রাইমস্টপ। এর মানে হচ্ছে থামিয়ে দেওয়া, সহজাতভাবেই থামিয়ে রাখা, কোনও বিপজ্জনক চিন্তা গজিয়ে ওঠার আগেই দ্বারপ্রান্তে আটকে দেওয়া। সাযুজ্য খুঁজতে না যাওয়া, যৌক্তিক ভ্রমগুলোও মেনে নিতে পারা, ইংসক বিরুদ্ধ ক্ষুদ্রতম বিষয়টিতেও অবুঝ হয়ে থাকা আর প্রথাবিরোধী কোনও পথে টেনে নিতে পারে এমন চিন্তা বা বক্তব্যে বিরক্ত হওয়ার ক্ষমতা এর অন্তভর্’ক্ত। সংক্ষেপে ক্রাইমস্টপ মানে সংরক্ষণমূলক নির্বুদ্ধিতা। তবে স্রেফ নির্বুদ্ধিতাই যথেষ্ট নয়। পক্ষান্তরে, প্রথাপন্থিদের পূর্ণ প্রত্যাশাটি হচ্ছে কারো নিজস্ব মানসিক প্রক্রিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ, এই নিয়ন্ত্রণ হতে হবে পুরোদস্তুর, ঠিক যেমনটা থাকে শারীরিক কসরত দেখানো ব্যক্তিটির নিজের শরীরের ওপর। বিগ ব্রাদার ইশ্বর, আর পার্টি সকল ভুলভ্রান্তির উর্ধ্বে, এই বিশ্বাসের ওপরেই বসে আছে ওশেনীয় সমাজ।
কিন্তু বাস্তবে যেহেতু বিগ ব্রাদার ইশ্বর নন আর পার্টিও ভুলভ্রান্তির উর্ধে¦ নয়, সেহেতু প্রতিটি ঘটনার ওপরই ক্লান্তিহীনভাবে মূহূর্তে মূহূর্তে বাস্তবের লেবাস লাগিয়ে যেতে হয়। এর নাম ব্ল্যাকহোয়াইট। নিউস্পিকের অন্য অনেক শব্দের মতো এই শব্দেরও রয়েছে দুটি পারস্পরিক স্ব-বিরোধী অর্থ। প্রতিপক্ষের ওপর প্রযোজ্য হলে এর মানে হচ্ছে কালোকে সাদা বলে চালিয়ে দেওয়া, অর্থাৎ সাদামাটা সত্যটিরও বিরোধীতা। আর পার্টির সদস্যের ওপর প্রযোজ্য হলে এর মানে হচ্ছে পার্টির শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কালোকেও সাদা বলতে পারার আনুগত্যমাখা সদিচ্ছা। তবে এর মানে এও যে কালোই সাদা তা বিশ্বাস করে নেওয়ার যোগ্যতা, অধিকন্তু এও জেনে নেওয়া যে কালোই সাদা, সঙ্গে সঙ্গে এর বিপরীত বিশ্বাসটিকে মন থেকে মুছে ফেলতে হবে। আর এ জন্যই অতীতের সবকিছুকে সার্বক্ষণিকভাবে পাল্টে দেওয়ার প্রয়োজন হয়, যা সম্ভব করে তোলা যায় চিন্তা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। যা সত্যিকার অর্থেই অবশিষ্ট সবকিছুকে বিব্রত করে, আর নিউস্পিকে এটাই দ্বৈতচিন্তা বা ডাবলথিংক বলে পরিচিত।
পাল্টে দেওয়াটা দুই কারণে জরুরি, যার আবার একটি কারণ সম্পূরক, যেমনটা বলা হয়, পূর্বসতর্কতামূলক। সম্পূরক কারণটি হচ্ছে পার্টির একজন সদস্য, প্রোলেতারিয়েতের মতোই, দিনকালের পরিস্থিতিটি মেনে নেবে, অংশত এই জন্য যে তার সামনে তুলনা করার মতো আর কোনও মান থাকবে না। তাকে অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে, ঠিক যেভাবে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় সীমারেখার ওপারের দেশগুলো থেকে, কারণ তার এই বিশ্বাস স্থাপন জরুরি যে সে তার পিতৃপুরুষের চেয়ে ভালো আছে, আর দিন দিন তার আরাম আয়েশের মাত্রা বাড়ছে। কিন্তু তারও চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হচ্ছে পার্টির ভ্রান্তিহীনতা টিকিয়ে রাখতে অতীতের ঘটনাকে ফের সামঞ্জস্যপূর্ণ করা প্রয়োজন। এটা কেবল এই জন্য নয় যে, বক্তব্য, পরিসংখ্যান আর নথিগুলো সারাক্ষণ আপ টু ডেট করে রাখতে হবে যাতে দেখা যায় পার্টি যা কিছু বলেছে তার সবটাই ঠিক ঠিক ফলে গেছে। এটা এই জন্যও যে, মতবাদে কিংবা রাজনৈতিক সরলরেখায় কোনও পরিবর্তন আনা হয়েছে এমনটা কেউ কখনো বলতেও পারবে না। কারণ কারো মনের পরিবর্তন কিংবা কারো নীতির পরিবর্তন দুর্বলতা স্বীকার করে নেওয়ারই সামিল। উদাহরণস্বরূপ, যদি ইউরেশিয়া কিংবা ইস্টেশিয়া (যেকোনওটাই হতে পারে) আজকের শত্রু হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে সেই দেশ ভুত ও ভবিষ্যতের উভয় কালের শত্রু। বাস্তবতা যদি অন্য কিছু বলে, তাহলে বাস্তবতাকেই পাল্টে দিতে হবে। এভাবেই ইতিহাস অবিরাম পুনর্লিখন চলছে। সত্য মন্ত্রণালয়ের অতীতকে মিথ্যায়নের এই প্রাত্যহিক কাজটি শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য যেমন দরকারি, তেমনি দরকারি ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ের দমননীতি আর গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়ে যাওয়ার জন্যও।
অতীতকে মুছে দেওয়াই ইংসকের মূল নীতি। অতীতের ঘটনার, যেমনটি বলা হয়, কোনো বস্তুগত অস্তিত্ব নেই, স্রেফ টিকে থাকে লিখিত নথিতে আর মানুষের স্মৃতিতে। অতএব, অতীত তাই যা নথিতে পাওয়া যায় কিংবা স্মৃতি স্বীকার করে নেয়। আর পার্টি যেহেতু সকল নথিপত্রের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখে, আর একই সঙ্গে তার সদস্যদের মনেরও ওপরেও রয়েছে পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ, তাহলে বলাই যায় অতীত তাই, ঠিক যেভাবে পার্টি তা তৈরি করবে। এরই ধারাবাহিকতায় বলা যায়, অতীত পরিবর্তনযোগ্য হলেও, তা কখনোই কেবল কিছু নির্দিষ্ট ঘটনায় পাল্টাবে না। যখন তা নতুন করে সৃষ্টি হয়, তা যে কোনো আকারই পাক না কেন, তখন সেই নতুন আকারটিই হয়ে ওঠে অতীত, এর চেয়ে ভিন্ন কোনো অতীতের অস্তিত্ব কখনোই ছিল না।
এক বছরের মধ্যে যখন এই অতীতকে বারবার পাল্টাতে হয় তখনও প্রতিবারই একই কাজ করতে হয়। সর্বদাই ক্ষমতাসীন পার্টিই চূড়ান্ত সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, আর এটাও তো স্পষ্ট যে চূড়ান্ত কোনো কিছু আজ যা, তার চেয়ে ভিন্ন কিছু কোনো কালেই ছিল না। অতীতের ওপর নিয়ন্ত্রণ নির্ভর করে স্মৃতির ওপর শাসনে। এই সময়ের প্রথা ও রীতি পদ্ধতিতে সম্মতি রেখে সকল নথি লিখিত রাখা নিশ্চিত করার কাজটি স্রেফ যান্ত্রিক। কিন্তু এও মনে রাখতে হবে যে, যা কিছু ঘটেছে তা ইচ্ছাকৃতভাবেই ঘটেছে। আর যদি কারো স্মৃতিকে পুনরায় সাজিয়ে নিতে হয়, অথবা লিখিত রেকর্ডের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয় তাহলে কেউ তা করলে অতীতকে স্রেফ ভুলে যেতে হবে। এর কৌশলটিও অন্য যেকোনো মানসিক কৌশলের মতোই শিখে নেওয়া সহজ। পার্টির অধিকাংশ সদস্যই বিষয়টি শিখে নিয়েছে, আর নিশ্চিতভাবে যারা বুদ্ধিমান ও একই সঙ্গে প্রথাপন্থি তারা তো শিখেছেই। পুরোনো ভাষায় একে বলে, সত্যি কথা বলতে কি এটাই আসলে, ‘বাস্তবতার নিয়ন্ত্রণ’। নিউস্পিকে এরই নাম দ্বৈতচিন্তা, যদিও দ্বৈতচিন্তার এর বাইরেও কিছু অর্থ রয়েছে।
দ্বৈতচিন্তা মানে কারো মনে একইসঙ্গে স্ববিরোধী দুটি বিশ্বাসকে ধারণ ও গ্রহণ। পার্টির একজন বোদ্ধা জানেন কোন পথে স্মৃতি পাল্টে দিতে হবে; আর তিনি এও জানেন যে, বাস্তবতার সাথে কৌশলী এক খেলা তিনি খেলছেন; আবার দ্বৈতচিন্তার চর্চায় তিনি নিজেকে সন্তুষ্ট করে রাখছেন এই ভেবে যে সত্যের কোনো লঙ্ঘন এখানে ঘটেনি। প্রক্রিয়াটি হতে হবে সচেতনতায়, কিন্তু পর্যাপ্ত শুদ্ধতায় নয়, আর যদি তা ঘটে যায় অসচেতনতায়ও, তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকবে এক মিথ্যার অনুভূতি ও অপরাধবোধ। ইংসকের কেন্দ্রেই রয়েছে এই দ্বৈতচিন্তা। পার্টির অন্যতম প্রয়োজনীয় কাজটি হচ্ছে সচেতন প্রতারণা, কিন্তু সে প্রতারণার কাজটি হতে হবে চূড়ান্ত সততায়। সত্য বিশ্বাসে স্বেচ্ছা মিথ্যাচার করে যাওয়া, পীড়াদায়ক যে সত্য তা বেমালুম ভুলে যাওয়া, আর অতঃপর, যখন ফের হয়ে উঠবে দরকারি তখন বিস্মরণ থেকে তা তুলে আনা ঠিক যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণের জন্য, বস্তুগত বাস্তবতার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা, আর সারাক্ষণ অস্বীকৃত বাস্তবতার হিসাব কষে যাওয়া—এসবই অপরিহার্য আবশ্যিকতা। এমনকি দ্বৈতচিন্তা কথাটির ব্যবহারেও চলে দ্বৈতচিন্তার চর্চা। এই শব্দের ব্যবহারের মধ্য দিয়েই যে কেউ স্বীকার করে নেয়, বাস্তবতার ব্যত্যয় ঘটছে; একটি আনকোরা দ্বৈতচিন্তার ঘটনা দিয়ে কেউ তার জ্ঞানকেই অস্বীকার করে; আর এভাবে অনির্দিষ্ট সময় ধরে মিথ্যায় ভর করে সে সত্যের সামনে সামনে দাবড়ে বেড়ায়। আর অবশেষে এই দ্বৈতচিন্তার মাধ্যমে দল ইতিহাসের গতিপথ আটকে রাখতে সক্ষম হয়, এবং আমরা সকলে যেমনটা জানি, হাজার বছর ধরে টিকে থাকে সে সক্ষমতা।
অতীতের সকল গোষ্ঠী শাসনের পতন হয়েছে হয় তাদের অতি কঠোর নীতির কারণে নয়ত ধীরে ধীরে নিজেই নাজুক হয়ে পড়ায়। হয় তারা নির্বোধ আক্রোশি হয়ে উঠে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাল হারিয়ে ফেলে নিক্ষিপ্ত হয়েছে; নয়ত নিজেরাই ধীরে ধীরে এমনই উদার এবং ভীত হয়ে উঠেছে যে যখন সৈন্য চালনা দরকার ছিল তখন সন্ধি করে বসেছে; আর অতঃপর কোনো এক নাজুক পরিস্থিতিতে নিক্ষিপ্ত হয়েছে ক্ষমতার বাইরে। তাদের এসব পতন বলা যায়, হয় সচেতনতায় নয়ত অসচেতনতায়। আর পার্টির সাফল্য হচ্ছে তারা চিন্তার এমন এক পদ্ধতি বানিয়েছে যাতে উভয় অবস্থাই একইসঙ্গে বিরাজ করতে পারে। এইটি ছাড়া আর কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ভিতই পার্টির আধিপত্যকে স্থায়ী করতে পারেনি। কেউ যখন শাসন করতে চায়, আর সে শাসন অক্ষুণ্ণ রাখতে চায়, তাকে তখন বাস্তবতার ধারণাটিকেই বিক্ষিপ্ত করে দিতে হবে। শাসকের গোপন শক্তিই হচ্ছে, সে সকল ভুলের উর্ধ্বে এমন বিশ্বাস তৈরি করা এবং অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া।
দ্বৈতচিন্তার যারা উদ্ভাবক, আর যারা জানে মানসিক প্রতারণার এ এক ব্যাপৃত ব্যবস্থা, তারাই যে দ্বৈতচিন্তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম চর্চাকারী তেমনটা বলা যাবে না। আমাদের সমাজে যারা কোথায় কী ঘটছে তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি জ্ঞান রাখেন তারা আসলে বিশ্বটি ঠিক যেমন, তেমনটি করে দেখেন না। সাধারণভাবে যে যত বেশি বুঝদার, মতিভ্রমও তার তত বেশি, যে যত বেশি বুদ্ধিমান, সে ততই কম প্রকৃতিস্থ। এই বাস্তবতার একটি স্পষ্ট উদাহরণ হচ্ছে—কেউ যখন সামাজিক মাপকাঠিতে উপরে ওঠে তার মধ্যে যুদ্ধের বাতিকও ততবেশি ভর করে। যুদ্ধের প্রতি যাদের মনোভাব যৌক্তিকতার অনেকটা কাছাকাছি তারা বিতর্কিত সীমান্ত এলাকার সাধারণ মানুষ। এই মানুষগুলোর কাছে যুদ্ধ স্রেফ এক অশেষ দুর্যোগ যা প্রায়শই তাদের শরীরের ওপর দিয়ে জলোচ্ছ্বাসের মতো বয়ে যায়। কোন দল জয়ী হলো তা তাদের কাছে পুরোপুরিই অপ্রয়োজনীয় একটি বিষয়। এরা সচেতনভাবেই জানে প্রভুত্বের পরিবর্তন মানেই হচ্ছে নতুন প্রভুর জন্য তাই করতে হবে যা আগের প্রভুর জন্যও তারা করেছে।
অতীতের প্রভুর আচরণই তারা পাবে নতুন প্রভুর তরফে। খানিকটা বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত, যাদের আমরা ‘প্রোল’ বলি, তারাই হচ্ছে একমাত্র যুদ্ধ সচেতন। প্রয়োজন হলে তারা ভয় আর ঘৃণার উন্মত্ততায় সামিল হতে পারে, আবার যখন তাদের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন যুদ্ধ যে চলছে সে কথাটিই তারা দীর্ঘসময় ধরে ভুলে বসে থাকতে পারে। পার্টির উচ্চ পর্যায়ে, সর্বপোরি ইনার পার্টিতেই বাস্তব যুদ্ধ নিয়ে উৎসাহটা দেখা যায়। বিশ্বজয় কথাটিতে বিশ্বাস তাদের মধ্যেই সবচেয়ে দৃঢ়, আবার তারাই জানে এই জয় অসম্ভব। বৈপরীত্যের এই অদ্ভুত একীকরণ—জ্ঞানের সঙ্গে অবজ্ঞার, হতাশাবাদের সঙ্গে উগ্রবাদের—এটাই ওশেনীয় সমাজের অন্যতম প্রধান সাতন্ত্র্যচিহ্ন। আনুষ্ঠানিক আদর্শ অজস্র স্ববিরোধীতায় পূর্ণ, এমনকি যখন কোনো বাস্তবিক কারণ থাকে না তখনও। এভাবেই, পার্টি সমাজবাদী আন্দোলনের প্রতিটি নীতিকে প্রত্যাখ্যান ও পরিবাদ করে চলে, আর তা করে সমাজতন্ত্রেরই নামে। পার্টি শ্রমজীবী শ্রেণির বিরুদ্ধে এক ঘৃণার প্রচার ঘটিয়ে চলে যার উদাহরণ কয়েক শতক আগে মিলবেই না, আর এর সদস্যদের গায়ে চড়িয়ে দেয় বিশেষ উর্দি যা এক সময় গতরখাটা শ্রমিকদের কাছেও অদ্ভুত ঠেকত আর সে কারণেই ছিল এর পরিগ্রহণ।
প্রক্রিয়াগতভাবে পার্টি পরিবারের সৌহার্দ্যের ভিতকে দুর্বল করে দেয় আর এর প্রধানকে একটি নামে ডাকে যা পারিবারিক আনুগত্যের মনোভাবকেই সরাসরি তুলে ধরে। এমনকি আমাদের যে চারটি মন্ত্রণালয়, যার হাতে আমরা পরিচালিত, তার নামগুলোও কিন্তু বাস্তবের প্রতি তাদের ইচ্ছাকৃত উল্টোনীতি গ্রহণের ধৃষ্টতাকেই তুলে ধরে। শান্তি মন্ত্রণালয়ের কাজ যুদ্ধ নিয়ে, সত্য মন্ত্রণালয় মিথ্যাচারে সামিল, ভালোবাসা মন্ত্রণালয় চালাচ্ছে দমন-নির্যাতন আর প্রাচুর্য মন্ত্রণালয় ক্ষুধামন্দা টিকিয়ে রাখতে ব্যস্ত। এসব স্ব-বিরোধিতা দ্বৈবাৎ ঘটে যাওয়া কিছু নয়, নয় তা সাধারণ কিছু কপটতার ফলও, এসবই স্রেফ দ্বৈতচিন্তার ইচ্ছাচর্চা। আর এই যে স্ববিরোধিতার সামঞ্জস্যতা বিধান কেবল এই ভেবে যে, এতেই ক্ষমতা টিকে থাকবে অনির্দিষ্টকাল। আর কোনো পথে প্রাচীন চক্র ভাঙ্গা যাবে না। মানব সাম্য যদি চিরতরে ব্যাহত করতে হয়—যদি উচ্চশ্রেণিকে, যে নামে আমরা তাদের ডাকি, তাদের নিজ স্থানে স্থায়ী করতে হয়—তার জন্য বিরাজমান মননশীলতাকে বুদ্ধিভ্রংশে নিয়ন্ত্রণ করাই হবে সেরা কার্যকর পথ।
একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, যা এখন অবধি আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি। প্রশ্নটি হচ্ছে—এই যে মানুষের সাম্যকে ব্যহত করার অব্যাহত প্রচেষ্টা, তা কেন? প্রক্রিয়ার বলবিদ্যার বর্ণনাও যখন হয়ে যায় ঠিক ঠিক, তখন এই যেকোন এক বিশেষ মুহূর্তে ইতিহাসকে হিমাগারে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যাপৃত প্রচেষ্টা, তাও কেন?
এখানেই আমরা পৌঁছে যাই গোপনীয়তার কেন্দ্রে। যেমনটা আমরা দেখছি, পার্টির, সর্বোপরি ইনার, পার্টির বোধাতীত শক্তি ভর করে আছে দ্বৈতচিন্তার প্রক্রিয়ায়। কিন্তু তারও গভীরে লুক্কায়িত রয়েছে আসল অভিসন্ধি, এক সহজাত প্রবর্তনা যা নিয়ে কখনোই প্রশ্ন তোলা হয় নি, যা প্রথমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে এরপর ফেলে দেয় দ্বৈতচিন্তার প্রক্রিয়ায়, চিন্তা পুলিশ, যুদ্ধ অবিরাম, আর টিকে থাকার অন্যসব প্রয়োজনীয় কলা-কৌশল নিয়ে আসতে থাকে। এই অভিসন্ধিতে বাস্তবেই রয়েছে…
নৈঃশব্দ্যেই সতর্ক হয়ে উঠল উইনস্টন, ঠিক যেভাবে একটি শব্দ কাউকে সতর্ক করে দেয়। তার মনে হলো কিছু সময় ধরে জুলিয়া পুরোই শক্ত হয়ে আছে। তার পাশেই শুয়ে আছে সে, কোমরের উপর থেকে অনাবৃত শরীর, হাতের বালিশে ঠেসে রাখা গাল, একটি কালচে দাগ তার দুচোখ ঘিরে রেখেছে। বক্ষদেশ ওঠানামা করছে ধীর-শান্ত লয়ে।
‘জুলিয়া’
কোনো সাড়া নেই।
‘জুলিয়া, জেগে আছো?’
সাড়া নেই। ঘুমিয়ে পড়েছে। উইনস্টন বইটি বন্ধ করল, সাবধানে মেঝের ওপর রাখল, শুয়ে পড়ল আর চাদরটি দুজনেরই গায়ের ওপর টেনে দিল।
তার মনে হলো, এখনো মূল গোপনীয়তাটি জানতে পারেনি। বুঝতে পারছে কিভাবে; কিন্তু এটা বুঝতে পারেনি, কেন। অধ্যায় তিনের মতো অধ্যায় একও তাকে সত্যিকার অর্থে এমন কিছুই বলতে পারেনি যা তার কাছে ছিল অজানা, এই অধ্যায়ও স্রেফ তার কিছু পূর্ব-অর্জিত জ্ঞানকে প্রক্রিয়াগত রূপ দিয়েছে। কিন্তু এটি পড়ে, অতীতের চেয়ে আরো ভালো করে বুঝতে পারল, তার মাথা খারাপ হয়ে যায়নি। সংখ্যা লঘু হয়ে, এমনকি স্রেফ একজনের সংখ্যালঘু হওয়ার পরেও সে পাগল হয়ে যায়নি। এখানে সত্য আছে, আছে অসত্যও, আর আপনি যদি গোটা বিশ্বের বিপরীতে দাঁড়িয়েও সত্যকে ধারণ করতে চান, আপনি পাগল হয়ে যাবেন না। অস্তগামী সূর্যের একটি হলুদ রশ্মি জানালার পথ ধরে সোজা বালিশের ওপর পড়েছে। চোখ বন্ধ করল সে। মুখমণ্ডলে আর গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকা মেয়েটির শরীরে ছড়িয়ে পড়া সূর্যালোক তাকে শক্তি দিল, ঘুম এনে দিল, আরো দিল এক দৃঢ়তার অনুভূতি। সে নিরাপদে আছে, সবকিছুই আছে ঠিকঠাক। বিড়বিড় শব্দে, ‘সুস্থ বিচারবুদ্ধিতা অংক কষে বলার নয়’ একথা বলতে বলতে, আর এই কথায় যে রয়েছে গভীর বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ সে কথা ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
অধ্যায় ১০
দীর্ঘ ঘুম হয়েছে, ঘুম ভেঙ্গে এমন একটা অনুভূতিই হচ্ছিল তার। কিন্তু নজর পড়তেই পুরোনো আমলের ঘড়িটি বলে দিল রাত মোটে সাড়ে আটটা। মটকা মেরে আরো কিছুক্ষণ পড়ে থাকল সে; তখনই নিচের আঙ্গিনা থেকে ভেসে আসলো দরাজ গলায় গাওয়া গানের কলি:
নিষ্ফল এক অলীক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়,
ফুরিয়ে গেল যেভাবে এপ্রিল ফুরোয়
কিন্তু সেই চাহনি, সেই শব্দ আর স্বপ্ন
হরণ করে নিয়ে যায় আমার হৃদয়।
এই অর্থহীন সঙ্গীত বুঝি তার জনপ্রিয়তা ধরেই রেখেছে। এখনো আপনি এখানে সেখানে শুনতে পাবেন। ঘৃণাগীতকেও ছাপিয়ে গেছে এই গান। গানের শব্দেই ঘুম ভাঙল জুলিয়ারও। লম্বা হাই তুলে মনের সুখে হাত পা ছুঁড়ে বিছানা ছাড়ল সে।
‘খিদে লেগেছে’—বলল সে। ‘চলো আরেকটু কফি বানাই। এই যা! স্টোভতো নিভে গেছে আর পানিও পুরো ঠাণ্ডা। ’ স্টোভটি তুলে ঝাকি দিল। ‘আরে এর তেলও তো ফুরিয়ে গেছে দেখছি!’
‘বুড়ো চ্যারিংটনের কাছ থেকে একটু ধার পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই, না কি?’
‘অদ্ভুত লাগছে, পুরো তেলভর্তি ছিল স্টোভটি! যাক কাপড় তো পরি’—বলেই চলল জুলিয়া। ‘মনে হচ্ছে একটু ঠাণ্ডা পড়েছে। ’
উইনস্টনও বিছানা ছাড়ল, আর কাপড় পরে নিল। নিচে শ্রান্তিহীন কণ্ঠ তখনও গেয়ে চলছে:
তারা বলেছিল সবই হবে ঠিক
বলেছিল, তুমিও ভুলে যাবে সব
কিন্তু যে হাসি আর কান্না কেঁদেছি এতটা বছর
আমার হৃদয় আজো বিদীর্ণ হয় তাতে…
জানালায় ঝুলিয়ে রাখা আলখেল্লার বেল্ট তুলে বাঁধল সে। বাড়িগুলোর ওপারে সূর্য হেলে পড়েছে, আঙ্গিনায় আর নেই ঝলকানো রোদ। পাথুরে মেঝেটা ভেজা, যেন কিছুক্ষণ আগেই ধুয়ে রাখা হয়েছে। তার মনে হলো, ধুয়ে দেওয়া হয়েছে যেন আকাশটাকেও। পরিচ্ছন্ন হালকা নীল আকাশটা চিমনিগুলোর মাঝ দিয়ে উঁকি মারছে। শ্রান্তিহীন অবিরাম যাওয়া আর আসার মাঝে নারীটি মুখে একবার ছিপি পরছে একবার খুলছে আর তাতে থেমে থেমে ভেসে আসছে গানের সুর, সাথে একের পর এক ডায়াপার ঝুলছে শুকোনোর রশিতে। উইনস্টনের মনে প্রশ্ন জাগে, ধোপার কাজেই কি জীবিকা এই নারীর? নাকি বিশ-ত্রিশটা নাতি-নাতনির কোনো সংসারের কৃতদাস সে? জুলিয়া এসে পাশে দাঁড়াল, দুজনই অনেকটা মুগ্ধ হয়ে নিচের শক্ত-সামর্থ নারীটির দিকে তাকিয়ে। মহিলাটির চারিত্রিক ধরন ধারণ, মোটা বাহুদ্বয়ের ওঠানামা, মাদী ঘোড়ার মতো শক্ত-নধর নিতম্বদ্বয়ের বল্লরী দেখতে দেখতে প্রথমবারের মতো তার মনে হলো, বেশ তো সুন্দরী এই নারী! সন্তান জন্ম দিয়ে দিয়ে ফুলে যাওয়া বিশাল বপু কাজ আর শ্রমে শক্ত সুঠাম হয়ে বুড়ো শালগমে রূপ নেওয়া পঞ্চাশোর্ধ এক নারীকে সুন্দরী মনে করার মতো ঘটনাটিও তার জীবনে প্রথমই ঘটল। কিন্তু ব্যাপারটা এমনই, অন্তত তার মন তাই-ই বলছে। আর কেনই নয়? গ্রানাইটের মতো পেটানো শরীর, আঁচড়কাটা লাল ত্বক মিলিয়ে যেন তরুণীর দেহ বল্লরীই তুলছে সে। গোলাপের গাছে তো গোলাপের ফলও ধরে। ফুলের চেয়ে ফলকে কেনই ছোট করে দেখা?
‘নারীটি সুন্দরী’—অস্ফুট শব্দে উচ্চারণ তার।
‘নিতম্বের ঘের এক মিটার হবে, আমার বিশ্বাস’—বলল জুলিয়া।
‘ওতেই সৌন্দর্যটা ফুটে উঠেছে’—বলল উইনস্টন।
জুলিয়ার কোমল কটিদেশ দুবাহুতে জড়াল সে। নিতম্ব থেকে হাঁটু অবধি তারও বেশ মাংসল। কোনো সন্তান জন্ম নেবে না তাদের এই সব মিলন থেকে। এই একটি কাজ তারা কখনোই করতে পারবে না। কেবল মুখের বুলি আওড়িয়ে, মন দেওয়া নেওয়া করে, গোপন ইচ্ছাটি বাঁচিয়ে রেখে সময় পার করে দেবে তারা। নিচে কর্মরত ওই নারীর কোনো মন নেই, তার কেবল আছে দুই শক্ত-সামর্থ্য বাহু, উষ্ণতায় ভরা হৃদয়, আর অতি উর্বরা এক গর্ভ। তার কৌতূহল হলো জানার, ক’টি সন্তানের জন্ম দিয়েছে এই নারী! খুব সহজেই বলে ফেলা যায় অন্তত পনেরটি।
আশা যদি কিছু থেকে থাকে তা ওই প্রোলদের মাঝেই প্রোথিত!
তারও ছিল ক্ষণকালের ফুটন্ত সময়, হতে পারে বছর খানেক বন্য গোলাপের মতোই ফুটেছিল সে, এরপর হঠাৎ তার ফুলে পড়েছে পরাগ রেণু তাতে ফল এসেছে, এরপর ধীরে ধীরে দেহখানি হয়ে উঠেছে আরো শক্ত, লাল আর মোটা, এরপর তার জীবন জড়িয়ে গেছে ধোলাই, সারাই, সেলাই, রান্নাবান্না আর ঝাড়ামোছার কাজে, প্রথমে নিজের সন্তানদের জন্য পরে নাতি-নাতনীদের জন্য টানা ত্রিশটি বছর, অবিরাম। আর এত কিছুর পরেও সে এখনো গান করেই চলেছে। নারীটির জন্য রহস্যময় এক শ্রদ্ধাবোধ সে অনুভব করল, যা মিশে একাকার হয়ে গেল চিমনির পাত্রগুলোর পেছনে অসীম দূরত্বে ক্রমেই প্রলম্বিত হয়ে পড়া ফ্যাকাশে মেঘহীন আকাশের পথে। এবার তার ভাবনায় এলো—সবার জন্যই আকাশটি এক, ইউরেশিয়া কিংবা ইস্টেশিয়ার আকাশও ঠিক একই রকম যেমনটি এখানে এই ওশেনিয়ায়। আর এই আকাশের নিচের মানুষগুলোও একই রকম—সর্বত্র, সারা বিশ্বে, শত কোটি মানুষ ঠিক এমনই, এভাবেই তারা একে অন্যের অস্তিত্বের বিষয়েও অজ্ঞ, ঘৃণা আর মিথ্যার দেয়াল দিয়ে তারা বিচ্ছিন্ন, আর সর্বত্রই একই রকম—মানুষ কখনোই ভাবতে শেখেনি, কিন্তু তারা তাদের হৃদয়ে, পেটে আর পেশিতে পুঞ্জিভূত শক্তি ধারণ করে চলেছে যা একদিন গোটা বিশ্বটিকেই উল্টে দেবে। আশা যদি কিছু থেকে থাকে তা ওই প্রোলদের মাঝেই প্রোথিত!
এই বইটির শেষাবধি না পড়েই সে জেনে গেছে, এটাই হতে চলেছে গোল্ডস্টেইনের চূড়ান্ত বাণী। ভবিষ্যতের মালিক এই প্রোলরা। আর সে কতটাই বা নিশ্চিত করে বলতে পারে, যখন তাদের সময় আসবে তখন এই যে পার্টির বিশ্ব হিসেবে যে বিশ্ব তারা গড়েছে তাতে সে, উইনস্টন স্মিথ, নিজেই হয়ে উঠবে না এক ভিন গ্রহের মানুষ? হ্যাঁ, তাই হবে কারণ একদিন এই বিশ্ব যাবে সুস্থ মানসিকতার মানুষদের দখলে। যেখানে সাম্য সেখানেই সুস্থতা। খুব দ্রুত কিংবা আরও পরে একদিন সেটাই ঘটবে, শক্তি পরিবর্তিত হবে সচেতনতায়। প্রোলরা অবিনশ্বর, আঙ্গিনায় ওই বলশালী তনুখানি একবার যে দেখবে তার আর এ কথা অস্বীকার করার জো থাকবে না। একদিন অবশেষ তারা জেগে উঠবে। আর যতদিন না সেটা ঘটবে, হতে পারে হাজার হাজার বছর লেগে যাবে, তারা সকল জঞ্জালের বিরুদ্ধে পাখিদের মতো সারাবেলা জেগে থাকবে, শরীর থেকে শরীরে পার করে দেবে সেই সচেতনতার শক্তি যা পার্টি কখনোই করেনি আর যে শক্তিকে পার্টি মেরে ফেলতেও পারেনি।
‘তোমার মনে আছে’—বলল সে, ‘সেই যে প্রথম দিন জঙ্গলের কিনারে আমাদের জন্য পাখিটি গাইছিল?’
‘ওর সেই গান আমাদের জন্য ছিল না’—বলল জুলিয়া। নিজের মনে নিজেকে তৃপ্ত করতেই গাইছিল সে। কেবল তাই নয়, ওটা ছিল পাখিটির স্রেফ গেয়ে যাওয়া। ’
পাখিরা গায়, প্রোলরাও গায়, কিন্তু পার্টির নেই কোনো গান গাওয়া। সারা বিশ্ব জুড়ে, এই লন্ডনে, নিউইয়র্কে, আফ্রিকায়-ব্রাজিলে, যুদ্ধক্ষেত্রের ওপারের সেই রহস্যঘেরা নিষিদ্ধ ভূমিতে, প্যারিস ও বার্লিনের রাস্তায়, রাশিয়ার বিস্তীর্ণভূমির গ্রামে গ্রামে, চীন ও জাপানের বাজারে বাজারে—সর্বত্রই একই অজেয় পেটানো শরীর দাঁড়িয়ে আছে, সন্তান জন্ম দিতে দিতে আর কাজ করতে করতে যা আরও দৈত্যাকায় রূপ নিয়েছে কিন্তু এখনও গেয়ে চলেছে গান। ওই শক্ত-সামর্থ নিতম্বের দোলা থেকেই সচেতনতার এক দৌড় একদিন শুরু হবে। তখন তোমরা হবে মৃত, ওদেরটাই হবে ভবিষ্যত। তুমিও হতে পারবে সেই ভবিষ্যতের ভাগীদার যদি তুমি তোমার মনকে বাঁচিয়ে রাখতে পারো ঠিক যেভাবে তারা বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের শরীর আর সময় পার করে দিচ্ছে সেই মতবাদে অতি গোপনে দৃঢ় বিশ্বাস রেখে যে, দুই আর দুই মিলে চার হয়।
‘আমরা মৃত’—বলল সে।
‘আমরা মৃত’—পাশে দাঁড়িয়ে তাই দায়িত্বের অংশ হিসেবে একই উচ্চারণ জুলিয়ার।
‘হ্যাঁ তোমরা মৃত’—ঠিক তখনই পেছন থেকে ভেসে এলো এক লৌহ কঠিন কণ্ঠ।
ছিটকে আলাদা হলো দুজন। উইনস্টনের অন্ত্র অবধি বরফ হিম হয়ে গেছে। জুলিয়ার চোখের কনীনিকা স্রেফ সাদাই দেখতে পেল সে। তার মুখমণ্ডল দুধহলুদ রঙ নিয়েছে। দুই গালে মাখানো রুজের প্রলেপ আরও কড়া হয়ে উঠেছে যেন ত্বকের নিচের সজীবতা থেকে তা পুরোই বিচ্ছিন্ন।
‘তোমরা মৃত’—লৌহকণ্ঠে ফের উচ্চারণ।
‘ছবিটির পিছন থেকে আসছে শব্দ’—শ্বাস ফেলে বলল জুলিয়া।
‘ছবির পেছন থেকেই’—বলল কণ্ঠটিও। ‘ঠিক যেভাবে রয়েছে সেভাবেই থাকো, আদেশ দেওয়ার আগে আর কোনো নড়াচড়া নয়। ’
শুরু হয়ে যাচ্ছে, অবশেষে তা শুরু হয়ে যাচ্ছে! একজন আরেকজনের দিকে নির্লিপ্ত তাকিয়ে থাকা ছাড়া তারা আর কিছুই করতে পারল না। জীবন নিয়ে পালিয়ে যাওয়া, দেরি হওয়ার আগেই এই ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাওয়া—এসবের কিছুই তাদের মনে এলো না। দেয়াল থেকে ভেসে আসা কণ্ঠটিকে অমান্য করা স্রেফ অচিন্তনীয়। মট করে একটি শব্দ হলো এরপর খান খান করে ভাঙল কাচ। ছবিটি মেঝেতে পড়তেই তার পেছনে ঢেকে থাকা টেলিস্ক্রিনটি চোখে পড়ল।
‘এখন ওরা আমাদের দেখতে পাচ্ছে’—বলল জুলিয়া।
‘এখন আমরা তোমাদের দেখতে পাচ্ছি’—বলল কণ্ঠটি। ‘কামরার ঠিক মাঝখানটায় এসে দাঁড়াও। পীঠে পীঠ দিয়ে। তবে কোনো ছোঁয়াছুঁয়ি নয়। ’
তারা কেউ কাউকে ছুঁয়ে নেই কিন্তু তার মনে হচ্ছিল অনুভব করতে পারছে জুলিয়া শরীর থরথর করে কাঁপছে। অথবা হতে পারে আসলে তার নিজের শরীরই কাঁপছে। দাঁতের ঠক ঠক শব্দই কেবল আটকে রাখতে পারছে সে, কিন্তু হাঁটু একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। নিচে থেকে আসছে বুটের ভারী শব্দ, ঘরের ভিতরে এবং বাইরেও। মনে হচ্ছে আঙিনা ভরে গেছে মানুষে। পাথরের ওপর দিয়ে কিছু একটা টেনে নিয়ে যাওয়ার শব্দ পেল। নারী কণ্ঠের সেই গান থেমে গেছে অবধারিতভাবে, আগেই। দীর্ঘ একটা ঝন ঝন শব্দ এলো, বোঝা গেল কাপড় কাচার বালতিটি ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে আঙিনার ওপারে। এরপর একটি রাগান্বিত চিৎকার বেজে উঠল ঠিকই, কিন্তু শেষ হলো ব্যাথাতুর গোঙানির মধ্যদিয়ে।
‘বাড়িটি ঘিরে ফেলা হয়েছে’—বলল উইনস্টন।
‘বাড়ি ঘিরে ফেলা হয়েছে’—বলল লৌহ কঠিন কণ্ঠটিও।
জুলিয়ার দাঁত ঠকঠকানি তার কানে আসছে। ‘আমার মনে হয়, আমরা দুজন দুজনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিতে পারি’—বলল সে।
‘তোমরা বিদায় চেয়ে নিতে পারো’—বলল কণ্ঠটি। আর এরপর সম্পূর্ণ এক ভিন্ন কণ্ঠ ভেসে এলো, চিকন জোরালো সে কণ্ঠ, উইনস্টনের মনে হলো আগেও শুনেছে, কানে যেন লেগেই আছে।
‘আর এখন, যখন আমরা নিজেরাই বিষয়ে উপনীত, “হিয়ার কামস অ্যা ক্যান্ডল টু লাইট ইউ টু বেড, হিয়ার কামস অ্যা চপার টু চপ অফ ইওর হেড”!’
উইনস্টনের পেছনে বিছানার ওপর কিছু একটা এসে পড়ল। একটি মইয়ের মাথা জানালা ভেঙ্গে ঢোকানো হয়েছে, তাতে কাঠামোটি ভেঙ্গে পড়ল। কেউ একজন জানালা পথে উঠে আসছে। ওদিকে সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে ওঠা বুটের মচ মচ শব্দ। এক নিমেষে গোটা কক্ষ কালো উর্দি পরা কঠোরমুখো মানুষে ভরে গেল। তাদের পায়ে লোহার পাত লাগানো বুট, হাতে হাতে মোটা লাঠি।
ভয়ে আর কাঁপছে না উইনস্টন। তার চোখও নড়ছে না। একটিই কাজ, সোজা হয়ে থাকা, সোজা হয়ে থাকো, যাতে আঘাত করার জন্য একটি অজুহাতও ওরা না পেয়ে যায়, নিজেকে নিজে বলছে সে। লড়াকু চোয়ালের একজন, চেহারায় মুখখানি ছাড়া সবই যেন লেপ্টে আছে, ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে হাতের মুঠোয় লাঠির গোড়াটি শক্ত করে ধরে নিচ্ছিল। উইনস্টন চোখের দিকে তাকাল তার। মস্তিষ্ক, মুখমণ্ডল আর শরীরের চেয়ে হাতের নগ্ন চেহারাটিই অসহনীয় ঠেকল তার কাছে। লোকটি তার সাদা জিভের মাথাটি ঠিক যেখানে দুটি ঠোঁট থাকার কথা সেখান থেকে বের করে ওর সামনে দিয়ে এগিয়ে গেল। ঠিক তখনই আরেকটি ঝনঝন শব্দ। কেউ একজন কাচের পেপারওয়েটটি টেবিল থেকে তুলে নিয়ে আগুনে চুল্লির ওপর সজোরে মেরেছে। এতে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল ওটি।
কোরালের একটি খণ্ড, কেকের ওপর চিনির গোলাপী অঙ্কুরটি ঠিক যেমন হয়, তেমনি গোলাপী রঙের সামান্য একটি টুকরো ছিটকে এসে বিছানার ওপর পড়ল। কী ছোট! ভাবল উইনস্টন, কত ছোট ছিল এটি! অথচ কাচের ওপর থেকে কত বড় দেখাত! একটা থাবা তার পেছনে প্রস্তুত ছিল, আর ঠিক তখনই ভয়াবহ একটি লাথি এসে পড়ল তার গোঁড়ালির ওপর, এতে অনেকটাই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। একজন এসে ঘুষি বসাল জুলিয়ার নাভীমূলে, কাঠপেন্সিলের মতো ছিটকে মেঝেতে পড়ে গিয়ে নিঃশ্বাস ফিরে পাওয়ার যুদ্ধে রত সে। উইনস্টন তার মাথাটি এক মিলিমিটারও ঘোরানোর সাহস করল না, তবে কৌণিকভাবে জুলিয়ার নীল-ধূসর ভয়ার্ত মুখখানি ঠেরে ঠেরে নজরে আসছে তার। এত ভয়ের মাঝেও নিজের শরীরের ব্যথা ছাপিয়ে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে জুলিয়ার নিঃশ্বাস ফিরে পাওয়ার বিষয়টি। নিজের ক্ষেত্রে না হলেও সে বুঝতে পারে কী ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে এই আঘাত। কিন্তু এ সব ভাবনার চেয়ে জুলিয়ার শ্বাস নিতে পারাটাই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এরপর দুজন মিলে জুলিয়ার হাঁটু আর কাঁধের কাছে ধরে চ্যাংদোলা করে তুলল আর বস্তার মতো ঝুলিয়ে বাইরে নিয়ে গেল। তার নিচের দিকে ঝুলে থাকা হলদেটে দুমড়ে যাওয়া মুখখানি এক নজর দেখতে পেল উইনস্টন। নির্মিলিত চোখ, গালের গোলাপী রুজের আভা তখনও জ্বলজ্বলে। আর সেটাই ছিল তাকে তার শেষ দেখা।
তখনও সটান দাঁড়িয়ে সে। ততক্ষণেও কেউ তার ওপর চড়াও হয়নি। বরং চিন্তাগুলোই নিজে নিজে এসে চড়াও হচ্ছে আর অনিচ্ছাতেও তা মনের মাঝে বিচরণ করে চলেছে। কৌতূহল হলো, ওরা কি মি. চ্যারিংটনকেও ধরে ফেলেছে। তার জানতে ইচ্ছা হলো আঙিনার ওই নারীটিরে তারা কী করেছে। বুঝতে পারছে ভীষণ প্রস্রাবের বেগ চেপেছে, এক ধরনের বিস্ময়বোধও হচ্ছিল, কারণ মোটেই ঘণ্টা দুই কিংবা তিনেক আগে সে কাজটি করেছে। দেখল চুল্লির ওপর রাখা ঘড়িটিতে নয়টা বাজে, মানে একুশ ঘণ্টা। কিন্তু তখনও দিনের আলো রয়েছে। আগস্টের সন্ধ্যাগুলোতে একুশ ঘণ্টায়ও আলো নিভে আসে না? প্রশ্ন জাগল তার মনে। তার মনে হলো সে আর জুলিয়া কি এতদিন সময় গণনায় ভুল করেছে—তারা যে সময়টিকে বিশ ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট বলে জেনেছে সেটি আসলে ছিল পরের দিনে সকাল সাড়ে আটটা। ভাবনাটিকে আর সামনে এগুতে দিল না সে। কারণ এই ভাবনায় মজার কিছু নেই।
আরেকটা অপেক্ষাকৃত হালকা পদশব্দ পাওয়া যাচ্ছে সিঁড়িতে। মি. চ্যারিংটনের কক্ষে প্রবেশ। কালো উর্দিধারীদের আচরণে কিছুটা নমনীয়তা লক্ষ্য করা গেল। মি. চ্যারিংটনের চেহারায়ও কিছু একটা পরিবর্তন পরিলক্ষিত। তার চোখ পড়ে আছে কাচের ভাঙা টুকরোগুলোর ওপর।
‘টুকরোগুলো ওঠাও’—কড়া গলায় উচ্চারণ তার।
একজন ঝুকে পড়ে তার কথা মতো কাজ শুরু করল। খাস লন্ডনি ভাষার ধরণটি আর নেই; উইনস্টন তখনই বুঝে ফেলল কিছুক্ষণ আগে টেলিস্ক্রিনে সে ঠিক কার কণ্ঠটি শুনেছিল। পুরোনো মখমলের জ্যাকেটটি তখনো পরে আছেন মি. চ্যারিংটন, কিন্তু তার চুল যা অনেকটা সাদাই ছিল তা এখন কালো। চোখে চশমাও নেই। উইনস্টনের দিকে এক ঝলক কড়া দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি, যেন সে-ই কিনা তা দেখে নিলেন, এরপর আর তার দিকে ফিরেও তাকালেন না। এখনো তাকে মি. চ্যারিংটন বলেই মনে হয়, কিন্তু তিনি আর সেই একই ব্যক্তিটি নন। তার টানটান শরীর, আর মনে হচ্ছে আরো বেশি লম্বা-চওড়া। মুখে সামান্য কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল তাতেই তাকে পুরোপুরি ভিন্ন মানুষ মনে হয়েছিল। কালো ভুরু যুগল এখন কম ঘন আর মুখের দাগগুলো নেই, মুখের সবগুলো দাগই বদলে দেওয়া হয়েছে, নাকটাও অপেক্ষাকৃত ছোট মনে হচ্ছে। এখন তাকে পয়ত্রিশের এক শীতল চেহারার মানুষই মনে হয়। উইনস্টনের মনে হলো, জীবনে এই প্রথম থট পুলিশের একজন সদস্যকে সে দেখল, যে মূলত জ্ঞানী।