২. প্রাচীন আরব জাতি
কতকগুলো প্রাচীন গ্রন্থ হারিয়ে যাওয়া (Lost Arabs) আরব আধিবাসীদের কথা বলেছে- আরবিতে এদের বলা হতো আরব আল বাইদা। এরা মিশ্র হ্যামিটো সেমোটিক আদিম গোত্রের বংশধর। এদের মধ্যে কিছু গুহাবাসীও ছিল। এদের মধ্যে ছিল জাদিস (ক্ল্যাসিকেল লেখকরা এদের জোডিকটা বলত) আর ছিল উইবার (Wibar) জোবারিটা; এছাড়া ছিল তাসাম ও রাহম। এদের কথা প্রাচীন কবিরা তাদের কবিতায় উল্লেখ করেছে; আর ছিল রাআস, আদ ও ছামুদ, কোরানে এদের কথা উল্লেখ আছে (২৫:৪১)। এই গোত্র সম্বন্ধে অতি অল্পই জানা গেছে। এখন তাদের কোনো চিহ্ন নেই, সম্ভবত তাদের নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে কিংবা তারা আন্তঃবিবাহের (Inter marriage) কারণে আরবের অন্য গোত্রের সাথে মিশে গেছে।
ঐতিহাসিক যুগের আরবরা, ইহুদিদের মতো সেমেটিক জাতি নূহের পুত্র শেমের বংশধর। তারা দুটি প্রধান জাতিতে বিভক্ত কাহতান বা দক্ষিণ আরব বাইবেলের জোকতানের বংশধর এবং আদনান বা উত্তর আরব, ইব্রাহিম ও হ্যাগারের (হাজেরা) পুত্র ইসমাইলের বংশধর।
বিভিন্ন সময়ে আরবদের বেদুইন বা মরুবাসী বলা হয়েছে। তারা ভবঘুরে, উটের লোম দিয়ে তৈরি তাঁবুতে বাস করত (Houses of hair); স্কেনাইটস (গ্রিক ভাষায় তাঁবুবাসী) ইসমাইলটস ইসমাইলের বংশধর; হ্যাগারাইটস হ্যাগারের বংশধর এবং পরে স্যারাসেন বা মরুজাতি (desert folk)।
আরাবিয়ান পেনিনসুলার বাইরেও অনেক আরব গোত্র বাস করত। কিছু ছিল ভবঘুরে, ভেড়া-ছাগল চরিয়ে তাঁবুতে বাস করত। অন্যরা ছিল দল বেঁধে এক স্থানে, পরে যা শহরে পরিণত হয়েছে। এই শহরবাসীরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে কালাতিপাত করত। অন্যান্য পার্শ্ববর্তী জাতির দ্বারা যদিও প্রভাবিত ছিল তবু নিজেদের একটা সংস্কৃতি গড়ে রক্ষণশীল জীবন ধারায় তাদের নিজস্ব ভুবন তৈরি করেছিল।
আরবদের বিভিন্ন দল বা গোত্র ছিল এবং প্রত্যেক গোত্রের আবার ক্ষুদ্র শাখা গোত্র বা ক্ল্যান থাকত। আরব সমাজ গোত্র বা ক্ল্যান দ্বন্দ্বে জর্জরিত ছিল এবং এই গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ (গাজওয়া বা রাজিয়া) সাধারণ ব্যাপার বা ঘটনা ছিল। এছাড়া এক গোত্র আর এক গোত্রের তাঁবু বা ক্যাম্প ও বাণিজ্য ক্যারাভান আক্রমণ করে লুটপাট করে নিত। গোত্রীয় ট্র্যাডিশন প্রায় গোত্রীয় দ্বন্দ্বে চিহ্নিত ছিল এবং এ অবস্থা ইসলামের আবির্ভাবের শতাব্দি পূর্ব অবস্থা। যার পরবর্তী আরবীয় এমনকি ইসলাম আবির্ভাবের পরেও সমাজে ও জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
আরবে মানুষের নামের আগে যেমন ইবনে অর্থাৎ বাপের নাম জোড়া থাকত তেমনি গোত্রের আগে বানু শব্দটি লেগে থাকত। যেমন বানু কিন্দা অর্থাৎ কিন্দা গোত্র।
২.১ কাহতান আরব
আরবে কাহতান বংশ অতি প্রাচীন। ট্রাডিশন মতে এরা আব্রাহামের বংশধর নয়, কাহতানের। বাইবেলে বলা হতো নূহের বংশধর জোকতানের (আদিপুস্তক ১০:২৫)। কাহতানদের মূল আরাবি-আরাবা-আল-আরিবা বা মুতারিবা বলা হয়।
কাহতানিরা মেসোপটেমিয়া থেকে দক্ষিণ আরবে উঠে আসে যাদের দক্ষিণ আরববাসী বলা হতো। এরা সাচ্চা সেমিটিক মূলধারা জাত এবং উত্তর আরবদের চেয়ে বর্ণে কালো। এই প্রজাতির আব্বাসিডিদের সুসময় পর্যন্ত (প্রায় ৮৫০ খ্রিঃ) আরব বংশধারায় নীতি বজায় ছিল এবং দক্ষিণ আরবের পরিবারভুক্ত বলে চিহ্নিত করা যেত।
বাইবেল বলে (আদিপুস্তক ১০:৩০) যে জোকতান (কাহতান)-এর পুত্রেরা দক্ষিণ-পশ্চিমের মেশা (মেইন) এবং দক্ষিণ-পূর্বের সেফার (হিশিয়ার)-এর মধ্যেই বাস করত। সময়ের ব্যবধানে পরে তাদের বসতি লোহিত সাগরের তীরে ইয়েমেন থেকে ভারত মহাসাগরের ওমান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।
সাধারণভাবে তারা একটা ভাষা ব্যবহার করত যাকে হিমিয়ারাইট বলা হয়। এই ভাষা আক্কাদিয়ান ইথিওপিয়ান (আবিসিনিয়ান) এবং সার্বিয়েনের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল। এই লিপি দক্ষিণ আরাবিয়াতে উৎকীর্ণ পাওয়া যায়, যা ঊনবিংশ শতাব্দিতে ইয়োরোপিয়ান পণ্ডিতরা বোধগম্য ভাষায় রূপান্তর করছে। দক্ষিণ আরবের গোত্ররা সাধারণত চাষাবাদ করলেও শহরবাসী ছিল। তারা শস্য উৎপাদন ও গোধন পালন করে জীবিকা নির্বাহ করত। দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের পর্বত শ্রেণী থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত হতো। যাতে চাষাবাদের বেশ ফলন ঘটতো। দক্ষিণ আরবের এই অর্থনৈতিক বৃদ্ধির কারণে রোমান লেখকরা এই অঞ্চলকে উর্বর আরব ভূমি-আরাবিয়া ফেলিক্স বলত।
প্রাচীন মিশরের সময় থেকে এ অঞ্চল মশলাপাতি ও সুগন্ধি দ্রব্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। ঐতিহাসিক হেরোডোটাসও এ সম্বন্ধে বলে গেছেন। রোমানরাও এই অঞ্চলকে সুবাসিত অঞ্চল বলে অভিহিত করত।
শতাব্দি ধরে কাহতান অঞ্চল আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য কেন্দ্রভূমি ও ট্রানজিট অঞ্চল ছিল। রোমান (সিরিয়ান) ঐতিহাসিক আম্পিয়ানাস মার্সেলিনাস (মৃত ৩৯০ খ্রিঃ)-এর মতে এই অঞ্চলের উপকূলে অনেক জাহাজের নোঙ্গর করার ব্যবস্থা ও পোতাশ্রয় ছিল। নিরাপত্তার দিক থেকে এসব নোঙ্গর স্থল ও পোতাশ্রয় খুব নিরাপদ ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে মিশর, মেসোপটেমিয়া, পারস্য, ভারত ইত্যাদি দেশ জড়িত ছিল। অধুনা প্রকাশ পেয়েছে যে দক্ষিণ আরাবিয়ার সভ্যতার সাথে গ্রিক হেলেস্টিক ও রোমান বিশ্বের সাথে নিকট সম্পর্ক ছিল। ফিলবি (Philby) বলেন, প্রফেট মোহাম্মদের জন্মের দুই মিলিয়ান বর্ষ পূর্বে আরবের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সৌকর্য তুঙ্গে ছিল। শুরু থেকেই কাহতানিদের দক্ষিণ আরবে উচ্চ শ্রেণীর সংগঠিত আরব রাজ্য বিদ্যমান ছিল এবং গড়ে উঠেছিল। এসব রাজ্যের নাম বাইবেলে, মিশরীয়, মেসোপটেমীয় ও দক্ষিণ আরবীয় উৎকীর্ণ লিপিতে উল্লেখ আছে। এছাড়া রোমান ও গ্রিক দেশীয় বই-পুস্তকেও উল্লেখ আছে। কিন্তু ইসলাম-পূর্ব আরবের এই উৎকর্ষতার নিদর্শন ইসলাম আবির্ভাবের পর আর পাওয়া যায়নি।
প্রত্যেক নগর রাজ্য (City states) মুকাররিব (dignatary) দ্বারা শাসিত ছিল। এই শাসকরা একাধারে রাজা, বিচারক ও পুরোহিতের কাজ করত। এরা ছাড়া আরও আলাদা পুরোহিত ছিল যারা বিভিন্ন ধর্মস্থান ও মাজার (Shrines) তদারক করত। কোষাধ্যক্ষ (ট্রেজারার) পদ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এরা ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর (Taxes) তদারক করত। আলোকিত কাজতান সমাজে নারীরা যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করতে পারত।
এই সব রাজ্যের রাজনৈতিক সম্পর্ক (একের সাথে অন্যের) পরিষ্কার ছিল না। তবে শতাব্দিকাল ধরে এই সব কাজের মধ্যে একচেটে বাণিজ্যাধিকার, বন্দর দখল ও ধর্মীয় কেন্দ্রের অধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষও হয়েছে। শাসক পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিবাহের প্রচলন ছিল; আর এক রাজ্য অন্য রাজ্যের স্থান অধিকার করলে রাজধানী ও সীমানার পরিবর্তন ঘটতো।
বর্তমানে প্রাপ্ত দলিল-দস্তাবেজ থেকে প্রাচীনকালের ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। তবে নিদর্শন পাওয়া যায় যে খ্রিঃপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দি থেকে কাহতান গোত্রের সাংস্কৃতিক ধারা চলে এসেছে। প্রধান নগর রাজ্যের (City state) মধ্যে কয়েকটির নাম হলো :
মাইইন, বাইবেলে মেশা (আদি পুস্তক ১০ : ৩০); ক্লাসিক্যাল লেখকদের মতে লোহিত সাগরের কাছে অবস্থিত মিনিয়া রাজ্য; উত্তরের প্রত্যন্ত অঞ্চল এই রাজ্য তার রাজধানী ছিল কর্ন (Karna)। সীমিত কালের জন্য এসব রাজ্যের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্যবন্ধন থাকলেও (খ্রিঃপূঃ ১২০০ থেকে ৭০০ পর্যন্ত) পরে তারা ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে।
সাবা (বাইবেলে শেবা-আদিপুস্তক ১০:২৮) তার বাণীর জন্য বিখ্যাত ছিল। এই রানী কিং সলেমনের রাজ্যে আমন্ত্রিত হন এবং দর্শন করেন, এ ঘটনার উল্লেখ হয়েছে খ্রিঃপূর্ব ১২০০ অব্দে। সাবা রাজ্য তার রাজত্ব বজায় রেখেছিল খ্রিঃপূর্ব ৭৫ পর্যন্ত। এর রাজধানী ছিল প্রথমে মারিক (গ্রিকদের মারিয়ারা) এবং পরে রাজধানী ছিল সানা (Sanaa); গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল সিরওয়া (Sirwa)। প্রায় ৬৫০ খ্রিঃপূর্বাব্দে সাবার এক যুবরাজ পুরানো সেচ ব্যবস্থার পরিবর্তে মিশরীয় ও ব্যাবিলনীয় ইঞ্জিনিয়ারদের সাহায্যে মারিবে এক বিশাল ড্যাম (dam) তৈরি করেন সেচকার্যের সুবিধার জন্য। এর ফ্লুইস গেট ও জলাধার ছিল আদানা (ডানা) নদীর গতিকে বর্ষা মৌসুমে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য।
বংশানুক্রমে সাবিয়েন ও হিমিয়ারাইট শাসকরা এই damকে উন্নত করেন ও এর গতি বাড়িয়ে দেন সেচ কাজের জন্য। এটা আরবে কিংবদন্তি হয়ে আছে।
জোকতানের পুত্র থেকে ওফির (Ophir) নাম এসেছে (আদিপুস্তক ১০:২৯)। যদিও আরবে বিশেষ করে ওফির নামে কোনো রাজ্য ছিল না। বাইবেলে এর উল্লেখ আছে এবং এখান থেকে কিং সলেমন সোনা ও মূল্যবান পাথর সংগ্রহ করতেন (১ কিং ১০ : ১১)। ভারত, আফ্রিকা, পারস্য উপসাগর বিশেষ করে দক্ষিণ আরাবিয়ান স্থানসমূহের মধ্য থেকে এর অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। এদেশের বন্দরসমূহের মধ্য দিয়ে স্বর্ণ উৎপাদন বিভিন্ন দেশে পৌঁছানো যেত।
ওফির নামটা জোফার নামের সাথে জড়িত মনে করা হয় দক্ষিণ আরবের অনেকগুলো শহরের মধ্যে থেকে। যেমন, দোফর (বা জোফর বা শেফার) তাফার, তাফর, সাপ্পার, জাফির, শেফির ইত্যাদি। অনেকে মনে করেন শব্দগতভাবে এটা সেমেটিক শব্দ সেফারের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তুলনীয় কিরজাত সেফার (Kirgath Sepher), পুস্তকের নগরী (City of books), প্রাচীন কেনান (জোশ ১৫:১৫)। সাবার দক্ষিণে কাতাবানের রাজধানী ছিল জোফার (Zofar)। তিমনা (Timna) ধর্মীয় কেন্দ্রে ৬৫টি মন্দির ছিল; মূর্তি ছিল হেলোনস্টিক স্টাইলে। সাবা ও হিমিয়ারের সাথে কাতাবানের ঘন ঘন সংঘর্ষ বেধেছে।
প্লিনির আট্রামিটা হাদ্রামাত (বাইবেলে হাজার মাভেত-আদিপুস্তক ১০ : ২৬) প্রথমে রাইদান বলে পরিচিত ছিল। এর রাজধানী ছিল সাবওয়া (Shabwa)। মাহরাব উপকূলে প্রধান বন্দর ছিল কেন (Kene)।
দোফার বা জোফার (বাইবেলে সেফর আদিপুস্তক ১০:৩০)-এ ১২০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দে বেশ কয়েকটি স্থাপনা ছিল। কিছু সময়ের জন্য এটা হাদ্রামাতের কলোনি ছিল, তবে ইতিহাসে বেশ ভালো করে উল্লেখ নেই; কিন্তু ১২০০ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চল ওমানের রাজনৈতিক সীমানার অন্তর্ভুক্ত হয়।
হিমিয়ার (ক্ল্যাসিকেল লেখকদের কাছে হেমোরিটা) খ্রিঃপূর্ব প্রথম শতাব্দি থেকে কাহতান নামে পরিচিত হয় এবং সময় সময় কাতাবান, হাদ্রামাত ও সাবার ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। এর রাজধানী ছিল জোফার যা কাতাবান থেকে কেড়ে নেওয়া হয়। এডেনের কাছে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল অসান (Ausan)। ক্ল্যাসিকেল ও আরব লেখক উভয়েই প্রায় হিমিয়ার বলে দক্ষিণ আরবকে সাধারণত উল্লেখ করেছে এবং আরব ট্র্যাডিশন হিমিয়ারকে ‘আরবের দোলনা’ (The cradle of Arab) বলে বিবেচনা করত। ৫২৫ খ্রিস্টাব্দে আবিসিনিয়ানরা এটা দখল করে এবং ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে দখল করে পার্সিয়ানরা।
অধুনা ইতিহাসে নগর রাজ্য (City State) থেকে গুরুত্ব তুলে নিয়ে কাহতান গোত্রের ওপর চাপানো হয়েছে। দক্ষিণ আরবীয় গোত্রদের একটা উপনাম ছিল, তাদের বলা হতো জেরাহ (আদি পুস্তক ১০ : ২৬) জোকতানের পুত্র। আরবদের কাছে প্রথা মতে ইয়েরেব (Yereb) নামে পরিচিত। যে দেশে তারা বাস করত,
গ্রিকদের কাছে আরাবিয়া বলে চিহ্নিত হয়েছে (Irivine, in Wiseman, 1971 P 290).
ইয়েরেবের এক বংশধরের নাম ছিল ইয়েশদ মারিবের প্রতিষ্ঠাতা। এই শহর ছিল সেই বিখ্যাত ড্যামের (Dam) কাছে। ইয়েশেদের পুত্র আব্দ শামস্ সাবার দুই পুত্ৰ কুহলাম ও হিমিয়ার যাদের বংশধররা একের পর এক রাজত্ব করে গেছে। এরাই কাহতান গোত্রদের পূর্বপুরুষ (Progenitors)।
খ্রিস্টাব্দের প্রথম শতাব্দি থেকে মারিব ড্যামের দেয়ালে ফাটল ধরতে শুরু করে। ফলে এই ড্যাম নষ্ট হতে থাকে। কারণ ভালো মেরামত ও নজরদারি হয়নি। এই কারণে আবাদি জমি কমতে থাকে এবং পরবর্তীতে লোকজন মধ্য আরবে ও আরও উত্তর-পূর্বে উঠে যেতে শুরু করে। এই অভিবাসন চলতে থাকায় মেসোপটেমিয়া সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনে দক্ষিণ অঞ্চলের বহু গোত্র বসবাস শুরু করে। দক্ষিণ অঞ্চলের লোকজন কমে যাওয়ায় লোহিত সাগরে রোমানদের বাণিজ্য জাহাজের যাতায়াত কমে যায় ও ব্যবসা মন্দা হয়।
প্রায় ৩৫০ খ্রিস্টাব্দে (এই তারিখ সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মতভেদ আছে) সেই ড্যাম (dam) শেষ পর্যন্ত ধসে যাওয়ায় প্রবল বন্যা দেখা দেয়। এই বন্যার কথা কোরানে ‘ইরিমের বন্যা’ বলে উল্লেখ আছে (৩৪ : ১৫)। এর ফলে দক্ষিণের রাজ্য ও সিটি স্টেটসে ভাঙ্গন ধরে, কারণ গোত্ররা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে যায়। আর এর জন্য ঐ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়।
২.২ আদনান আরব
আরাবিয়ান পোনিনসুলাতে আদনান গোত্র, ভবঘুরে বেদুইন গোত্র, মূলত প্যালেস্টাইন থেকে আগত। এই উত্তরবাসী আরব মিশরির ইহুদি ইসমাইলের বংশধর। এদের সাথে আরব ও অ-আরব উভয়ের সংমিশ্রণ ছিল; কিন্তু এদের মধ্যে বিয়েশাদিও হতো। কাহতান গোত্রদের চেয়ে এরা বর্ণে হালকা মিশ্র-আরব গোত্র (মুস্তারিবা)।
তাদের ভাষার সাথে ক্যানানাইট হিব্রু, আরামাইক ও সিরিয়াক ভাষার সম্পর্ক ছিল। বাইবেল অনুযায়ী (আদি পুস্তক ২৫:১৮) তারা হাবিলা (নাজরেন) ও শুর (সিরিয়ান মরুর)-এর মধ্যে বসবাস করত এবং মধ্য আরব ও উত্তর আরব জুড়ে তারা দখল করেছিল বসবাসের জন্য। ইয়ামামা ও নেজজের কিছু অংশও তাদের দখলে ছিল। এই গোত্রের শাখা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল মধ্যপ্রাচ্যে, মিশর, সিরিয়া প্যালেস্টাইন ও মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে; তাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল প্যালেস্টাইন ও সিরিয়ার সাথে। পরে বাইজনাটিয়ামের সাথেও সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
আরব লোক কাহিনীতে আদনান গোত্রের উৎস বা গোড়ার কথা (Origin) লিপিবদ্ধ আছে। বলা হয় যে আব্রাহাম হেজাজের মক্কার আশপাশে এসেছিলেন এবং হ্যাগার (হাজেরা) ও ইসমাইলকে রেখে চলে যান। এই রূপে প্রাচীনকাল থেকে আদনান গোত্র মক্কা ও কাবা ঘরের সাথে জড়িত।
হ্যাগারের মৃত্যুর পর ইসমাইলকে লালনপালন করে বড় করে তোলে জুরহাম গোত্র। জুরহাম গোত্র জোকতান পুত্র হেদোরাম (জুরহাম)-এর বংশধর (আদি পুস্তক ১০ : ২৭)। এই গোত্র মক্কার আশপাশে বসবাস শুরু করে।
ইসমাইল রিলাহকে বিবাহ করেন। রিলাহ জুরহাম গোত্রের একটি শাখা আমর ইবনে আদি-র প্রধান, মুদাদের কন্যা ছিলেন।
বাইবেলে এবং পরে ইসলামী ট্রাডিশনে বর্ণিত যে ইসমাইলের বারোজন পুত্র ছিল এবং এই বারো জন পুত্র আদনান গোত্রের বারোটি শাখার পূর্বপুরুষ, যদিও এই গোত্রগুলোর নাম সম্বন্ধে দুটো মত প্রচলিত আছে এবং তাদের ইতিহাসও খুব পরিষ্কার নয়।
ইসমাইলের পুত্রদের মধ্যে (আদি পুস্তক ২৫ : ১৩-১৫) একজন ছিলেন নাবাজোত নাবাতিয়ানদের পূর্বপুরুষ আর হাদার নাকি ছিলেন প্রফেট হুদ; তেমা ছিলেন উত্তর হেজাজে তাইমা গোত্রের প্রতিষ্ঠাতা পরে তাঈ গোত্র দখল করে নেয়; দুমাহর নাম কালব গোত্রের রাজধানী দুমার সাথে জড়িত; জেতুর ছিলেন ইতরাইমের পূর্বপুরুষ, এই গোত্র উত্তর প্যালেস্টাইনে তাদের আস্তানা গাড়ে। প্রধান আদনান গোত্রের পূর্বপুরুষ ছিলেন কেদার।
আদনান (প্রায় ৫৮০ খ্রিঃপূঃ) তার নামে আদনান জাতি (race) চালু করেন। ইনি কেদারের প্রত্যক্ষ বংশধর (direct discendant)। আদনানের পুত্র মাআদ দ্বিতীয় নেবুচেদনজরের হত্যাযজ্ঞ থেকে কোনো প্রকারে পালিয়ে হেজাজের কাছে মক্কাতে বসতি স্থাপন করেন। মাআদের পুত্র নিজারের মা ছিলেন জুরহাম রমণী।
মক্কার ওপর প্রাধান্য বিস্তার ও কাবাঘরের অভিভাবকত্ব নিয়ে শতাব্দি ধরে যে যুদ্ধ হয় নিজারের বংশধরেরা এই যুদ্ধে শামিল ছিল। এই যুদ্ধে প্রথমে যারা জয়ী হয়, কিছু সময়ের জন্য, তারা ছিল আমিলা গোত্র। এরপরে সিনাইয়ের বসতি স্থাপন করে। এদের সরিয়ে জুরহাম গোত্র মক্কায় ও কাবাঘরের ওপর প্রাধান্য পায় এবং অনেক দিন ধরে তারা ক্ষমতা ধরে রাখে।
নিজার এবং দক্ষিণের জুরহাম গোত্রের সাথে মিলে উত্তরের আদনান গোত্র কিননা (কোরেশ) গোত্রসহ— খাঁটি আরব রক্তের দাবিদার— নতুবা তারা ছিল ইহুদি গোত্র ও সম্প্রদায়ের সাথে আত্মীয়তায় সম্পৃক্ত। সত্যি বলতি কি, প্রাচীন বেদুইন ভবঘুরেরা তাদের গোত্র দাবি করত কেদার ও থাকিফ (Thakif) গোত্রকে যারা ইহুদি বলে পরিচিত ছিল।
যেহেতু ইসমাইল গোত্রভুক্তদের সাথে এই গোত্র (আদনান) সদস্যদের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল, সেই কারণে জুরহাম গোত্র কাবাঘরে উপযুক্ত অভিভাবকত্বের দাবিদার। তারা কাবাঘর আমিলা গোত্রের কাছ থেকে দখল করে নেয় এবং একে পুনঃনির্মাণ করে। ট্রাডিশন বলে যে জুরহাম গোত্র কয়েক শতাব্দি ধরে কাবাঘরের অভিভাবক ছিল। কিন্তু পরে তারা এই ঘরের পবিত্রতা রক্ষায় শিথিল ভাব দেখায়। তারা কাবাঘর থেকে কালো পাথর তুলে নিয়ে জমজম কূপে নিক্ষেপ করে কাবাঘরের তৈজসপত্র দিয়ে কূপটি বন্ধ করে দেয়।
শেষমেশ জুরহাম গোত্র মক্কা থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। অন্য একটি কাহিনী মতে ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে খোজা গোত্র জুরহামদের তাড়িয়ে মক্কা ও কাবাঘর দখল করে। জুরহাম গোত্র উত্তর দিকে সরে গিয়ে কোদা উপজাতির সাথে মিলে যায় এবং দক্ষিণ প্যালেস্টাইন ও সিনানে বসতি স্থাপন করে। পরে জুদহাম গোত্রের সাথে মিশে সম গোত্রে পরিণত হয়।
জুরহাম গোত্রকে যারা তাড়িয়েছিল সেই খোজা গোত্র কাহতান জাতিভুক্ত ছিল I খোজা গোত্রের নেতা ছিলেন লুহে ইবন আমর; তিনি মক্কা নগরী অবরোধ করে কাবাঘরের চার্জ গ্রহণ করেন। কাবাতে যেসব মূর্তি ছিল তার সাথে লুহে আরো কিছু বিদেশী দেবতার মূর্তি কাবাঘরে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কিংবা তার পুত্র নাবিতিয়ান থেকে হুবাল দেবতার মূর্তি এনে কাবা ঘরের প্রধান দেবতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন।
এরপর কিভাবে খোজারা কোরেশ গোত্র দ্বারা বিতাড়িত সেকথা পরবর্তী পর্যায়ে আলোচিত হবে।
২.৩ গোত্র-কলহ
খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দিতে মারিবের বাঁধ (dam) ধসে যাওয়ার পর এ অঞ্চল থেকে সে অঞ্চলে গোত্রদের চলাচল ও বসতি বদল শুরু হয় হেজাজে; আর এই কারণে কোরেশ গোত্রের প্রাধান্য দেখা দেয়। এই স্থান বদলের কারণে উপজাতি ব্যবস্থার (সিসটেমে) একটা মৌলিক পরিবর্তন এনে দেয় আরবে এবং তার বাইরের অঞ্চলের উপজাতি কাঠামোতে। আরব গোত্রের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায় বেদুইন ভবঘুরে ও স্থানীয় অবস্থানকারী আরববাসী উভয়ের জন্য। এই পরিবর্তন প্যাগন, আরব; খ্রিস্টান ও ইহুদি সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল।
মারিবের বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার পর অর্ধশতাব্দি ধরে একটা তুলনামূলক স্টাডি করলে দেখা যাবে এই লাগাতার স্থান বদলের কারণে গোত্রদের বাসস্থানের সীমানা মুছে গেছে, তাদের পূর্বের বন্ধনও টুটে গেছে, পরিবর্তে নতুন সীমানা ও গোত্র বন্ধন দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এই ডামাডোলের মাঝে দক্ষিণ আরবের কাহতান ও উত্তর আরবের আদনান—এই দুই প্রধান আরব গোত্রের মধ্যে যে পার্থক্য ছিল সেই পার্থক্যের ঠিকানাও গোলযোগ হয়ে গেছে।
কোনো কোনো আঞ্চলিক আচার-ব্যবহার যেমন পোশাক-আশাক, খাওয়া- দাওয়া ও ভাষারও এলোমেলো মিশ্রণ হয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ উত্তরের কোইস ও দক্ষিণের কিন্দা গোত্রে এই স্থান বদলের কারণে নিকট সম্পর্ক হওয়ায় তাদের আগেকার আচার-ব্যবহারের সমন্বয় ঘটে একটা মিশ্রিত উপজাতীয় পরিচিতি এনে দিয়েছে অর্থাৎ দুই ভিন্ন গোত্রের সংমিশ্রণে তাদের আচার-ব্যবহার ও সংস্কৃতির মিশ্র- সংস্কৃতির ও ব্যবহারিক পদ্ধতিতে নতুনত্ব এসেছে। এর ফলে গোত্রের পরিসর ও লোকসংখ্যা বেড়ে গিয়ে একক স্বার্থের কারণে এক নতুন কনফেডারেশনের (হিলফ) আবির্ভাব হয়।
উত্তর আরব গোত্রের মাআদ নাম দক্ষিণ আরবের সাথে মিশে এক হয়েছে। অনুরূপভাবে, কোদা ও খোজা গোত্র উত্তর ও দক্ষিণ যে দিকেই গেছে সেখানকার কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সাথে মিশেছে। সুতরাং গোত্র শুধু সাধারণ বংশজাত নয়। সাধারণ বসতির কারণে নতুন ভাবে দেখা দিল এবং গোত্র দ্বন্দ্ব এই স্থান পরিবর্তনের কারণে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শত্রুতা ভুলে বন্ধুত্বের বন্ধনে পরিণত হয়েছে। যেমন পূর্বে আদনান গোত্রের লোক পরে কাহতান গোত্রের সাথে মিশে দক্ষিণের কাহতানে পরিণত হয়েছে। এই সব কারণে আরব গোত্রের পূর্ব পরিচিতি (identity) ও আত্মীয়তা থাকেনি, একের সাথে অন্যে মিশে বংশ পরিচয় নির্ভুলভাবে গঠন করা তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব হয়নি।
এর মাঝেই কোরেশ গোত্র প্রাধান্য পেয়ে, খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দির শেষের দিকে মক্কা নগরী নিয়ন্ত্রণে আনে এবং আরবে শুধু মক্কার কাবাঘরের অভিভাবক হিসাবে ধর্মীয় কারণ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নেয়। ক্রমে ক্রমে মক্কা নগরীর গুরুত্ব বেড়ে যায়- বাণিজ্য কেন্দ্র হয়ে ওঠে ও ব্যবসার খাতিরে বহু বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে জড়িয়ে পড়ে।
২.৪ কোরেশ
আনুমানিক ৩৫০ খ্রিস্টাব্দে আদনান গোত্রের এক প্রভাবশালী কনফেডারেসি কিনানা হেজাজে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। এই কনফেডারেসির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষমতাশালী গোত্র ছিল কোরেশ। নামের সাথে সমুদ্রের ভয়ঙ্কর জাতের প্রাণী শার্ক শ্রেণীর প্রাণী বোঝায়; সম্ভবত গোত্রের প্রতীক চিহ্ন থেকে এই নামের উদ্ভব হয়েছে। কেউ কেউ বলে পার্সিয়ান নাম সাইরাস (কুরাশ) থেকে এই নাম গ্রহণ করা হয়েছে।
এক শতাব্দি পরে অর্থাৎ প্রায় ৪৫০ খ্রিস্টাব্দে কোরেশী কিলাব ও ফাতেমার পুত্র কোসেই মক্কা ও কাবার ঘরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার মনস্থ করেন। কোসেই-এর মা ফাতেমা ছিলেন জাদারা গোত্রের রমণী। কাবাঘর শুরুতে ইসমাইলের বংশধরদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু আনুমানিক চতুর্থ খ্রিঃ পূর্বাব্দ থেকে এই পবিত্র ঘর পর পর কাহতান, আমিলা, জুরহাম ও খোজা গোত্রের অধীনে চলে যায়।
কোসেই মক্কাতে জন্মগ্রহণ করেন কিন্তু নাবাতিয়ানদের মধ্যে বড় হয়ে ওঠেন। যৌবন ও বয়ঃপ্রাপ্তির সাথে তিনি মক্কা নগরী ও কাবাঘর উদ্ধারের পরিকল্পনা করেন যাতে এই নগরী ও পবিত্র ঘর আদনান জাতির নিয়ন্ত্রণে আসে। এই উদ্দেশ্যে তিনি নাবাতিয়া এবং কোদা গোত্রের কাছ থেকে সাহায্য ও সহযোগিতার আশ্বাস পান। কোদা গোত্র তখন সেখানে বাইজানটাইন সম্রাটের পক্ষে কাজ করছিল। এই সম্মিলিত শক্তি সহজেই খোজাদের মক্কা ও কাবা থেকে বিতাড়িত করে দখল করে নেয়। পরে মক্কা ও কাবাঘরে কোরেশ গোত্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
মক্কা ও কাবাঘরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্বন্ধে কোসেই বেশ কিছু নিয়মকানুন প্রবর্তন করেন। তিনি নাবাতিয়ানদের কাছ থেকে লাত, মানাত ও উজ্জা দেবীদের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জুরহাম গোত্র কাবাঘরের সংস্কার না করায় জরাজীর্ণ অবস্থা হয়ে ছিল। কোসেই পুরানো ঘর ভেঙ্গে নতুন করে, বেশ জাঁকজমকভাবে ভবনটি পুনঃনির্মাণ করেন।
কোসেই-এর পুত্র ও উত্তরাধিকারী আব্দুল মনাফ বিদেশীদের সাথে ব্যবসা- বাণিজ্যের সম্প্রসারণ করেন, ফলে মক্কা নগরী বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়। আব্দুল মনাফের বংশধরেরা মক্কাতে ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে এবং এরাই ইসলামের প্রচার ও প্রসারে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
ঠিক এই সময়ে বাইজানটাইন ও সাসানিয়ান সম্রাটরা আরব গোত্রের সাথে সম্পর্ক উন্নত করার জন্য রাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। যেহেতু বাইজানটিয়ানরা মক্কা নগরী দখল করতে কোরেশদের সাহায্য করেছিল, সেই কারণে আবদুল মনাফ বাইজানটিয়ানদের সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
এই সময়ে সাসানিয়ান সম্রাট ছিলেন প্রথম কোবাদ; তার আরব বন্ধু ছিল ইউফ্রেটিস উপত্যকায় হিরার রাজা তৃতীয় মুনধির। কোবাদ পার্সিয়ান মাজদাক-এর সাম্যবাদ নীতির সমর্থক ছিলেন; তাই তিনি মুনধিরকে তার আরব রাজ্যে মাজদাকের সাম্যবাদনীতি প্রচার করতে বলেন এবং এ-ও বলেন যে এই নীতি প্রবর্তন করতে প্রয়োজনবোধে মক্কা দখল করো, কাবাঘরও ধ্বংস করো এবং আব্দুল মনাফকে হত্যা করো। কিন্তু কোবাদ এই সময়ে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যায় জড়িত হয়ে পড়লে তার মক্কা দখল ও কাবাঘর ধ্বংস করা হয়ে ওঠেনি। মক্কা বিদেশী আক্রমণ থেকে অব্যাহতি পেয়ে শান্তিপূর্ণভাবে তার বাণিজ্যকর্ম চালিয়ে গেছে।
২.৫ মক্কা
উন্নয়নশীল মক্কা নগরী দুইটি প্রধান বাণিজ্য পথের মিলন কেন্দ্রে একটি উপত্যকার ওপর অবস্থিত এবং উত্তর-দক্ষিণে হেজাজ হয়ে রাস্তা চলে গেছে লোহিত সাগরের উপকূল পর্যন্ত। এই পথের ওপর পড়ে হিমিয়ার, প্যালেস্টাইন ও সিরিয়া। অন্যদিকে পূর্ব-পশ্চিমে নেজদ সড়ক, সাথে যোগ হয়েছে ইয়েমেন, পারস্য উপসাগর ও ইরাক। এই নগরী ব্যস্ত বাণিজ্যকেন্দ্র এবং কারাভানদের আড্ডাস্থল, প্রচুর পানি সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। ভারত মহাসাগর, পূর্ব আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরের ট্রানজিট বাণিজ্য মক্কায় একচেটে ছিল। এই শহরের মধ্য দিয়ে প্রভূত পরিমাণে মিশর, সিরিয়া, রোম বাইজানটাইন, পারস্য ও ভারতীয় পণ্যদ্রব্য চলাচল করত।
চামড়া, আঠা, সুগন্ধি দ্রব্য, মশলাপাতি ও মূল্যবান পদার্থ মক্কা থেকে রপ্তানি হতো। ইথরেবের (মদিনা) মধ্য দিয়ে পারস্য ও ইরাকে পণ্যদ্রব্য – বিশেষ করে পারফিউম, চামড়া ও বস্ত্রাদির ট্রাফিক চলাচল হতো; মক্কার মধ্য দিয়েও এই সব দ্রব্যের যাতায়াত ছিল।
খ্রিঃ ৬ষ্ঠ শতাব্দিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর বাণিজ্য ডিপো মক্কাতে ছিল। একটি মিশরীয় কেন্দ্র (দার মিসর) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৫০০ খ্রিস্টাব্দে; তারপরেই বাইজানটাইন ট্রেড এজেন্সি খোলা হয়। আব্দুল মনাফের শাসনামলে খ্রিস্টান অধিকৃত এলাকা ঘাসান-এর সাথেও মক্কার নিকট বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ঘাসানের স্থানীয় এজেন্টকে মক্কাতে কেন্দ্ৰীয় স্থানে ব্যবসা কেন্দ্র ও বাসস্থান বরাদ্দ করা হয়।
২.৬ কাবা
প্রাক-ইসলাম যুগে প্যাগন আরবদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ড কাবাঘরকে ঘিরেই আবর্তিত হতো। কথিত আছে এই কাবাঘর আদম কর্তৃক নির্মিত, পরে নূহের প্লাবনের সময় এ ঘর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তারপর পুনঃনির্মিত হয় আব্রাহাম ও তার পুত্র ইসমাইল দ্বারা। কাবার সাথে আব্রাহামের যোগসূত্র হয় ইসলাম আবির্ভাবের পর।
বলা হয় যে কাবাঘর প্রথমে তৈরি হয় পবিত্র কালো পাথরকে স্থান দেওয়ার জন্য। এই স্থান প্রাথমিকভাবে আরব গোত্রদের পূজা করার কেন্দ্র ভূমিরূপে পরিগণিত হয় এবং এই সব গোত্রই তাদের দেব-দেবীদের মূর্তি এই মন্দিরের চারদিকে প্রতিষ্ঠা করে। প্যাগন আরবদের এই পবিত্র ঘরে প্রধান দেবতা ছিল আল্লাহ এবং ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে এই পবিত্র ঘরকে আল্লাহর ঘর (House of Allah) বলা হতো।
কাবাঘর ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্যাগন (ইহুদি, খ্রিস্টীয় ও ইসলাম ধর্মের লোক ছাড়া অন্য ধর্মের লোককে প্যাগন বা হিদেন বলা হতো) আরবদের ধর্মীয় কেন্দ্রভূমি ছিল। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রফেট মোহাম্মদ মক্কা অধিকার করলে কাবাঘরের সব মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয়, কিন্তু তারপরেও এই কাবাঘর মুসলিম জনগোষ্ঠীর পবিত্র ধর্মকেন্দ্র এবং মুসলিম বিশ্বের মুসলমানরা এই কাবাঘরের দিকে মুখ করে তাদের উপাসনা করে।
মক্কা উপত্যকা বেষ্টন করে এক প্রাচীন নদী বয়ে যায়, ফলে মাঝে মাঝে ঝড় বৃষ্টির কারণে শহরে ও কাবাঘরে বন্যা দেখা দেয়। এ ধরনের একটা বন্যা হয়েছিল ১৯৫০ সালে যখন হাজীদের বন্যার পানি মাড়াতে হয়েছিল।
৩০০ খ্রিস্টাব্দে এই ধরনের একটা বন্যায় কাবাঘরের ক্ষতি হয় এবং এর মেরামত করেন ওমর আল জারুদ। পরে তার বংশধরেরা জাদারা বা রাজমিস্ত্রি বলে পরিচিতি পায়।
কাবাঘরে শুধু বন্যায় ক্ষতি করেনি, মন্দিরের মধ্যে কুপি জ্বালানোর কারণে আগুনও লেগেছে। কাবাঘরের লম্বা ইতিহাসকালে অনেক বার বন্যায় ও অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি হয়েছিল এবং এই কারণে প্রায় একে ঢেলে পুনঃনির্মাণ করতে হয়েছে। এই পবিত্র ঘরের অনেক বার পুনঃনির্মাণের কারণে এর কাঠামো ও সাইজের পরিবর্তন ঘটেছে প্রাক-ইসলাম যুগে ও ইসলাম আবির্ভাবের পরে।
কাবাঘরকে মূল্যবান চাঁদোয়া (Canopy) (কিসওয়া) দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে, যা প্রতি বছর (নতুন করে) নবায়ন করা হয়। এই অলঙ্কাবরণ শুরু হয় প্রফেট মোহাম্মদের জন্মের তিন শতাব্দি পূর্বে আসাদ আবু কারির দ্বারা (আনুমানিক ৪১৫ খ্রিস্টাব্দ)। আসাদ এটা করেন গ্যাপন ধর্ম থেকে ইহুদি ধর্ম গ্রহণের পর।
প্রথমে যখন এই গৃহ নির্মাণ করা হয় এর দেয়াল ছিল সাড়ে তিন ফুট উঁচু এবং ছাদ ছিল না, এখন কাবাঘর প্রায় ৪০ ফিট উঁচু, লম্বা ও প্রশস্ত। বর্তমান নির্মাণ কাঠামো সপ্তম শতাব্দিতে তৈরি হয় (O’ Leary, 1927, P 197)
২.৭ কালো পাথর
ইবনে আব্বাসের (মৃ. ৬৮৭) বর্ণনা মতে প্রফেট মোহাম্মদ বলেছেন; কালো পাথর স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে এবং নেমে আসার সময় এটা দুধের মতো সাদা ছিল, কিন্তু পাপী মানুষের স্পর্শে এবং চুম্বনে এটা কালো হয়ে গেছে। প্রাচীন পারস্য ট্রাডিশনের মতে, এই পাথর শনির প্রতীক ছিল এবং সে দেশের নায়ক মহাবাদের কাবাতে ফেলে যাওয়া একটা নিদর্শনের অংশ (Hughes 1977 P. 155)।
পাশ্চাত্য পণ্ডিতরা বিশ্বাস করেন কালো পাথর একটা উল্কাপিণ্ড (meteorite) প্রাগৈতিহাসিক যুগে যা আকাশ থেকে কক্ষচ্যুত হয়েছিল এবং কাবা নির্মাণ করা হয়েছিল এই পাথরকে সংরক্ষণ করার জন্য। প্রাচীন আরবরা এটাকে পূজো করত এবং এখনো পর্যন্ত মুসলিম জাতি এ পাথরকে শ্রদ্ধাভক্তি করে। মক্কাতে হজের সময় মুসলিমরা এই পাথরকে প্রদক্ষিণ করে ভক্তিসহকারে। কাবাঘরের পূর্ব কোণে এই পাথর ভূমি হতে পাঁচ ফুট ওপরে গাঁথা আছে।
এটা আসল উল্কাপিণ্ড নাও হতে পারে। তৃতীয় শতাব্দি খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময় জুরহাম অভিভাবকরা এটাকে সরিয়ে জমজম কূপের মাঝে ফেলে দিয়েছিল। ৬০৩ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া সেনাবাহিনীর কাবাঘর আক্রমণের সময় এ পাথর ভেঙ্গে তিন টুকরো হয় এবং পরে কারমাতিয়ানরা এই পাথর কাবাঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।
বর্তমানে এই পাথর কিছুটা ডিম্বাকার, বেড়ে সাত ইঞ্চি (diametre) আর এর উপরটা অসমতল। ডজন খানেক ছোট বিভিন্ন আকার ও সাইজের পাথর সিমেন্ট দিয়ে জোড়া লাগানো এবং খুব মসৃণ সমস্ত পাথরটা রুপা দিয়ে বাঁধানো।
কালো পাথর খুব পবিত্র এবং কাবার একমাত্র পবিত্র পাথর নয়। ঘরের পশ্চিম কোণে আর একটি পাথর আছে সৌভাগ্য (আসাদ) পাথর-দেয়ালের সাথে গাঁথা। এই পাথরকে স্পর্শ করে হাজীরা; কিন্তু চুম্বন করে না। তবুও আরও একটা পাথর আছে, তাকে বলা হয় আব্রাহামের স্থান (মোকামে ইব্রাহিম)। কাবাঘর নির্মাণ করার সময় আব্রাহাম নাকি এই পাথরের উপর দাঁড়িয়েছিলেন। এটা এখন গিল্টি করা খাঁচায় আবদ্ধ, রাখা আছে বাইরের ছোট একটি কোটায়।
প্রফেট মোহাম্মদ সব ধরনের মূর্তি পূজার নিন্দা করেছেন এবং কালো পাথরকে ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখানো হজের অংশ নয়। সুতরাং এই পাথর স্পর্শ করা এবং চুম্বন করা উপাসনা বা হজের অঙ্গ বলে গণ্য নয়। খলিফা ওমর (মৃত ৬৪৪) কালো পাথর সম্বন্ধে বলেছিলেন; আমি জানি তুমি একটা পাথর ছাড়া কিছুই নও, মানুষকে সাহায্য করা বা ক্ষতি করার তোমার কোনো ক্ষমতা নেই। যদি আমি আল্লাহর রসূলকে না দেখতাম তোমায় চুম্বন করতে, আমি তোমাকে কখনও চুম্বন করতাম না।
২.৮ প্যাগনদের হজ (তীর্থক্ষেত্র)
মক্কাতে বছরে একবার তীর্থযাত্রীদের আগমন হতো (হজ করতে) এবং কাবাঘর ছিল তীর্থ ক্ষেত্রের মণিকেন্দ্র বা ধর্মীয় কেন্দ্র। এই হজ হতো দশ দিনের জন্য এবং হরেক রকমের আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হতো। ইসলামের আবির্ভাবের পর সামান্য পরিবর্তন করে এই হজ ও আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়। বর্তমানে মুসলমানরা হজের সময় যে আনুষ্ঠানিকতা (rituals) পালন করেন তার অনেক কিছু প্রাক-ইসলামী যুগে চালু ছিল। প্রাক-ইসলামী যুগে অপবিত্র পুরনো কাপড় পরে কাবা মন্দিরের ধারে-কাছে যাওয়া নিষেধ ছিল। তীর্থযাত্রীরা স্নান করার পর সাদা কাপড়ে দেহ ঢেকে দিত; এই আচ্ছাদনকে ইহরাম বলা হতো। এই কাপড় বদলানো পর্ব সারা হতো দেবী মানতের পীঠস্থানে। যারা নতুন কাপড় কিনে ইহরাম বাঁধতে না পারত তারা কাবাঘরে উদোম হয়ে প্রদক্ষিণ করত (Hughes, 1977 P 630)।
মন্দিরে প্রবেশের পূর্বে তীর্থযাত্রীরা তাদের আল্লাহর কাছে প্রস্তুতির ঘোষণা দিত (তালবিয়া) এবং স্পষ্ট করে মন্ত্র উচ্চারণ করত— হে আল্লাহ, আমি আমার ধর্মীয় কর্তব্য পালন করতে এসেছি; তুমি এক ও অদ্বিতীয়। এই ফরমুলা বহু প্রাচীন, একে বলা হতো ‘লাব্বাইকা। এখনোও লাব্বাইকা বলা হয় হজের সময়।
পবিত্র ঘরে প্রবেশ করে প্রধান অনুষ্ঠান (rite) হলো কাবাকে বাঁ দিকে রেখে ডাইনে থেকে বাঁয়ে সাত বার প্রদক্ষিণ করা অর্থাৎ তাওয়াফ করা। প্রতিবার ঘোরার সময় কালো পাথরকে চুম্বন করতে হয় বা মাথা নোয়াতে হয়।
তাওয়াফের পর সেই সব গোত্র তাদের দেব-দেবীদের কাছে অর্ঘ্য ও উৎসর্গ করবে যেসব দেব-দেবী কাবার চারদিক ঘিরে প্রতিষ্ঠিত; প্যাগন কোরেশরা তাদের প্রধান দেবী লাত, উজ্জা আর মানাতকে অর্ঘ্য দিয়ে আহ্বান (invoke) করবে।
এই সব অনুষ্ঠান করতে পাঁচ দিন চলে যাবে। ৬ষ্ঠ দিনে তারা মক্কার দুই পর্বত সাফা ও মারওয়ার মধ্যে সাত বার ছুটাছুটি করে (সাঈ)। এই দুই পাহাড় কাবা থেকে কয়েকশো গজ দূরে। মুসলিম ট্রাডিশন অনুযায়ী কথিত যে আব্রাহাম হ্যাগার (হাজেরা) ও ইসমাইলকে এই পর্বতের কাছে ছেড়ে গেলে হ্যাগার তৃষ্ণায় পানির জন্য এখানে ছুটোছুটি করেছিলেন।
প্যাগানদের সময়ে এই দুই পাহাড়ের চূড়ায় পাথর বা তামার দুটো মূর্তি থাকত— একটি পুরুষ, আর একটি নারী। এই মূর্তিদ্বয়কে মক্কার লোকেরা পূজো করত। প্যাগন আরবরা, কোরেশ ও খোজা গোত্রসহ এই মূর্তিদের অর্ঘ্য নিবেদন করত এবং তাদের ছুঁয়ে আশীর্বাদ চাইত।
লোককাহিনী বলে যে, প্রাচীনকালে একটি রমণী নাইলা তার প্রেমিক ইসাফ-এর সাথে কাবাঘরের সীমার মধ্যে প্রেম করাতে তারা পাথরে পরিণত হয়। মক্কার শাসকের আদেশক্রমে তাদের পাথর দেহ সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের উপর প্রতিষ্ঠিত করে এই উদ্দেশ্যে যে, এই দৃষ্টান্ত থেকে মানুষরা সাবধান হবে এবং কাবাঘরের চত্বরে কোনো দুষ্কর্ম করবে না। এই ঘটনার সূত্র পরোক্ষভাবে কোরানে উল্লেখ আছে (৭:২৭)। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে প্যাগন আরবদের কালে কাবাঘরের মধ্যে উদোম হয়ে সাত পাক ঘোরার ব্যবস্থা ছিল। ইসলামের আবির্ভাবের পর কাবাঘরে তাওয়াফ নারী-পুরুষে একসাথে করে না, আলাদা করা হয় এবং আচ্ছাদিত অবস্থায়।
তীর্থের অষ্টম দিনে তীর্থযাত্রীরা মক্কার উত্তরে মীনা উপত্যকায় যায় এবং সেখানে তারা রাত্রি যাপন করে। নবম দিনের সকালে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রওয়ানা হয় আরাফাত পাহাড়ে। এখানে তারা মধ্যাহ্নকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে। আরাফাত পর্বত মক্কা থেকে পূর্ব দিকে প্রায় তের মাইল। প্রাক-ইসলামী সময়ে এখানে দেবতা ইলালের আস্তানা ছিল। আরবরা একে পূজা করত। আরাফাতে এই দাঁড়িয়ে থাকা (উকুফ) পর্বটি তীর্থের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আরাফাতে সূর্যাস্তের পর পরবর্তী পর্ব মুজদালিফা পর্বতে ছুটে চলা (ইফাদা) এ স্থানটি মীনা থেকে তিন মাইল দূরে। মুজদালিফা গোল টাওয়ার দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং বজ্র দেবতা কুজার পবিত্র খনি (এ. জে. ওয়েন সিঙ্ক, SEI 1974, P/124)। এখানে তীর্থযাত্রীরা আগুন জ্বালিয়ে রাতে পাহারা দেয় এবং মাঝে মাঝে চৌকিদারের মতো হাঁক দেয়। মুজদালিফায় আগুন জ্বালানো এই প্যাগন রীতি প্রফেট মোহাম্মদের বিদায় হজের সময় পালিত হয় এবং খলিফা হারুন-অর-রশীদের সময় পর্যন্ত চলেছে অর্থাৎ ৮০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
তীর্থ পালনের দশ বা শেষ দিনের পর্ব মীনা উপত্যকায় পালিত হয়। মুজদালিফার সংগৃহীত সাত খণ্ড পাথর এখানে প্রত্যেক তীর্থযাত্রী ছোড়ে। এই পাথর ছোড়ার উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয়, তবে মুসলিম ট্রাডিশন মতে বলা হয় এখানে আব্রাহাম শয়তানকে পাথর মেরে তাড়িয়েছিলেন।
মীনাতে পাথর মারার (রজম) পর তীর্থযাত্রীদের দেহ থেকে পবিত্রতা সরে যায় এবং তারা সাধারণ জীবনে ফিরে আসে। মীনাতে পর্বের চূড়ান্ত হয় ছাগল, ভেড়া বা উট উৎসর্গের (বধের) মধ্য দিয়ে। এই উৎসর্গ করা হতো দেবতাদের সন্তুষ্টি লাভের জন্য। থাবির (Thabir) পাহাড়ের গায়ে যেখানে আব্রাহাম তার পুত্রকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন, সেই স্থানেও পশু উৎসর্গ করার রীতি পালন করতে হয়। এই ধারাকে প্রায় বজায় রেখেছে হজ পর্ব ও কোরবানি।
মীনা পর্বের পরের তিন দিন অর্থাৎ ১১ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত তসরিক পর্ব অর্থাৎ উৎসর্গকৃত পশুদের রক্ত-মাংস পরিষ্কার করে স্থানটিকে শুকনো করা হয়। তারপর বিশ্রাম। A.J. Wensinek বলেন : From references in early Arab poetry, it seems that occasion provided an opportunity for amorous encounters between the young men and women of diffrent tribes. Muhammad was to refer to this period as ‘days eating, drinking and sensual pleasure’ (SEI 1974 P/124).
২.৯ আল্লাহ
আরব গোত্ররা যারা হেজাজে বাস করত তাদের প্রধান দেবতা ছিল আল্লাহ (২৯ : ৬১)। আল্লাহ শব্দের মূল (root) হচ্ছে ‘আল’ অর্থ ‘গড’। এর ভিত্তি হচ্ছে ‘এল’ সেমেটিক ভাষার স্বর্গীয় নামের কেন্দ্র (nucleus of the divine name)। আল্লাহ শব্দটি গড়ের (God) সাথে জড়িত; যেমন ব্যাবিলিয়ন ও এসিরিয়নে ‘ইলু’; ক্যানানাইটে এল; হিব্রু ইলোহিম; আর্মেনিয়ানে আলাহা; নাবাতিয়ানে এলহ বা আলহ; মধ্য আরবে ইলাহ।
এই প্রধান দেবতার কোনো মূর্তি ছিল না; ছিল একটা ছায়া ছায়া ভাব। এই ছায়া ছায়া ভাবের আল্লাহ’র ছোটখাটো দেব-দেবীদের মতো জনপ্রিয়তা ছিল না। অন্যান্য দেব-দেবী থেকে আল্লাহকে আলাদা করে রাখার জন্য নাম দেয়া হয়েছিল আল্লাহ God Most High। প্রাক-ইসলামী আরব এই ছায়া ছায়া প্রধান দেবতা আল্লাহকে একেশ্বর- বাদিত্বের প্রতীক বলে ধরে মান্য করত এবং এইসব আরবরা ছোটখাটো দেব-দেবীর বহুবাদিত্বে বিশ্বাসী ছিল না। এমনকি ইহুদি ও খ্রিস্টানরা ঐ সময়ে এই দেবতাকে আল্লাহ বলে শ্রদ্ধা করত। এই নামের কারণে প্রাক-ইসলামী আরবে বহু মানুষের নামকরণ করা হয়েছিল। যেমন প্রফেট মোহাম্মদের বাবার নাম ছিল আবদুল্লাহ- আল্লাহর দাস। তিনি ছিলেন প্যাগন আরব, মুসলিম নয়। খ্রিস্টানদের মাঝে নাম ছিল আবেদেল্লাস (Abdellas)। একজন বিশপের গ্রিক নাম ছিল আবদুল্লা (Abdulla)।
কাবাঘরে আল্লাহর পূজা করা হতো, এই কারণে এই ঘরের নাম ছিল বায়তুল্লাহ House of Allah। প্রাক-ইসলামী কবিতায় আল্লাহকে কাবার প্রভু Lord of the Kaaba বলা হয়েছে। তীর্থযাত্রীরা তাওয়াফ-এর সময় উচ্চারণ করত ‘লাব্বাইকা’ বলে।
আল্লাহর কাছে ও মাধ্যমিক দেব-দেবী, যাদের আল্লাহর সাথী-সঙ্গী বলা হয়, তাদের কাছে প্যাগান আরবদের অর্ঘ্য প্রণালীর কথা কোরানে উল্লেখ আছে (৬:১৩৭)। মক্কাবাসীরা যেমন উল্লেখ করেছিল যে, এ ধরনের পূজা প্রণালী আল্লাহ বারণ করেননি (৬ : ১৪৯)।
মক্কায় ইসলামের প্রাথমিক সময়ে প্রফেট মোহাম্মদ ‘আল্লাহ’ দেবতার সাথে প্যাগন আরবের পূজা প্রণালীর কথা ভালোভাবেই জানতেন, তাই ‘গড’কে নির্দিষ্ট করতে আল্লাহ নাম গ্রহণ করতে ইতস্তত করেন, পরিবর্তে রহমান নাম দেবার চেষ্টা করেন।
আল্লাহকে আরও একটি নামে পরিচিত করা হয়েছিল দেবতা হুবাল-এর সাথে, যার মূর্তি অন্যান্য দেব-দেবীর সাথে কাবাঘরে ছিল। এই নাম সেমেটিক শব্দ ‘হু’ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। যার অর্থ তিনি (He) অথবা তিনি হন (He is) (দেখুন ৩
: ১), সাথে এল শব্দ অর্থাৎ God জোড়া ছিল। সম্ভবত তিনি আল্লাহ শব্দের প্রাচীন ব্যবহারিক শব্দ। হুবালের নাম নিয়ে মক্কাবাসীরা যুদ্ধ যাত্রা করত। নাবাতিয়েন ও অন্যান্য উত্তর আরবীয় গোত্র হুবালের পূজা করত, কিন্তু কোরানে এ শব্দ ব্যবহৃত হয়নি। বলা হয় যে, মোহাম্মদ যৌবনে কাবাঘরে হুবাল মূর্তি স্থাপনের অনুষ্ঠানে সাহায্য করেছিলেন।
২.১০ ঈশ্বরের উপাধি
কোরানে বলা হয়েছে (৭:১৭৯), আল্লাহর উৎকৃষ্ট নামাবলি (আসমা-উল-হুসনা) আছে। এখান থেকে মুসলিমরা আল্লাহর ৯৯ নাম আহরণ করেছে যা আল্লাহর পদবি বা উপাধি। উদাহরণস্বরূপ আল মজিদ (The Glorious), আল-গফুর (The Forgiving), আল রাজ্জাক (The Provider), আল হাকিম (The Judge), আল খালিক (The creator), আল আওয়াল (The First), আল আখির (The Last)। এই নামের মধ্যে এমন কতকগুলি নাম আছে যার সাথে প্যাগন দেবতাদের সাথে নিকট সম্বন্ধ আছে; কিন্তু বলা হয়েছে যে প্যাগনরা বিকৃতভাবে প্রথম থেকে সত্যকার ঈশ্বরের নাম তাদের দেব-দেবীর ওপর অর্পণ করেছিল (সেল ১৮৮৯ পুঃ ১২৭)। এই রূপে আল লাত নেয়া হয়েছে আল্লাহ থেকে; মানাত করা হয়েছে মান্নান (Beauntiful) থেকে, জিরত নেয়া হয়েছে জব্বার (Preserver) থেকে ইত্যাদি।
অন্য দিকে এটা বলা যায় যে প্রথম দিকে মুসলিমরা তাদের পূর্বপুরুষদের দেব- দেবীর নামকে আল্লাহকে দেয়া ৯৯টি নামের সাথে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল এবং তার কিছু আভাসও এর মধ্যে পাওয়া গেছে। এই ভাবে ওয়াদ (Moongod)-এর ওদুদ (The loving)-এর সাথে সাদৃশ্য আছে; মুনিম, যা উত্তর আরবে পূজিত হতো, সাদৃশ্য রয়েছে আলমানি (The with holder)-এর সাথে; সাস তাইমাদের দেবতার নাম মিশে আছে আল-সালাম (The peace) -এর সাথে; কাউস বা কাইস যাকে আল- মানাতের সাথী বলে বিবেচনা করা হতো তার নাম মিশে আছে আল-কাবী (The strong)-এর সাথে; উত্তর আরবের দেবতা আজিজ আল-আজিজ (The Mighty)-এর সাথে অপরিবর্তনীয় রয়েছে; ঈশ্বরের (God) প্রাক-ইসলামী পদবি আল-রহমান (The merciful) এবং আল রহিম (The compassionate) পরিবর্তন ছাড়াই রয়ে গেছে।
এটা ঐতিহাসিক সত্য যে কোরানের সূরার (chapter) নামকরণও বর্তমান আকারে সাজানো হয়েছে প্রফেট মোহাম্মদের মৃতুর পর এবং যারা সংকলন করেছেন এবং এই সংকলনে সাহায্য করেছেন তারা বেশ কয়েকটি সূরার নাম দিয়েছেন প্যাগন দেবতার। যেমন তারিকা (সূরা ৮৬) নক্ষত্র দেবতার নাম; হিমিয়ারদের দেবতার নাম নসর ১১০ সূরার নাম। শামস্ সৌর দেবীর নাম (মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপকভাবে পূজিত) দেয়া হয়েছে সূরা ৯১-এ।
২.১১ আল্লাহর কন্যা (বানাতাল্লাহ)
তিনজন নারীদেবতার নাম উল্লেখ আছে কোরানে (৫৩:১৯) আল্লাত, উজ্জা এবং মানাত। হেজাজের এই তিন দেবী গ্রহমণ্ডলীর সভানেত্রী। এদের আল্লাহ কন্যা (বানাতাল্লাহ্) বলা হয়।
কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন যে আল-লাত-এর নাম টানা হয়েছে আল্লাহর নাম থেকে কেননা আল শব্দটা পুরুষ প্রকৃতি। নাবাতিয়ানরা একে যুদ্ধের দেবী বলে মানত। হেরোডোটাস আললাতকে আরবদের মহান দেবী বলে উল্লেখ করেছেন। এর সাথে অন্য দুটি দেবী উজ্জাকে বলা হয় আরবের প্রেমের দেবী, তার থানে বলির ব্যবস্থা ছিল এবং মানাত ছিলেন ভাগ্যের দেবী। নাবাতিয়ানদের কাছে এই দুই দেবী অজানা ছিল না। কাবাঘরে তাওয়াফের সময় প্যাগন কোরাইশরা এই দেবীদের নাম উচ্চারণ করত।
মক্কা থেকে চল্লিশ মাইল দূরে দক্ষিণ-পূর্বে তায়েফে আল-লাতের বিশেষভাবে পূজা হতো; মক্কা থেকে চল্লিশ মাইল দূরে পূর্বে নাখালাতে উজ্জা দেবীর পূজা চলত, আর মানাতের হতো কোদইদে, মক্কার অনতিদূরে মদিনার পথে। এখানেও অন্যান্য স্থানে তারা নারী রূপে পূজিত হতো কিংবা চার কোণা পাথর বা কালোপাথর রূপে।
৬১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রফেট মোহাম্মদ তার বিরুদ্ধবাদীদের খুশি করার জন্য এই তিন দেবীর পক্ষে বলেছিলেন, কিন্তু কিছু সময় পরেই তিনি তার বাণী প্রত্যাহার করেন। আরবে প্যাগনদের উপাসনার কেন্দ্রভূমি ছিল তায়েফ, এখানে এই তিন দেবীর থান ছিল এবং আল-লাতের বিশাল এক মূর্তি ছিল। ৬৩০ সালে প্রফেট মোহাম্মদ এই সব আস্তানা ও মূর্তি ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দেন।
২.১২ প্যাগন দেব-দেবী
প্রাক-ইসলামী আরবের দশটি দেব-দেবীর কথা কোরানে লিপিবদ্ধ আছে। আল্লাত, উজ্জা ও মানাত (৫৩:১৯) জিবত ও তাগুত (৪:৫৪) ঈগলের মতো নসর; সিংহের মতো ইয়াগুত; ঘোড়ার মতো ইয়াহুক; নারীর মতো সোয়া এবং পুরুষের মতো ওয়াদ (৭১:২৩)
আরব ঐতিহাসিক ও বংশতালিকার হিশাম আল কালবি (মৃত ৮২০) তার পুস্তক কিতাবুল আসনাম (Book of idols) -এ মূর্তিদের একটা পরিপূর্ণ লিস্ট দিয়েছেন। এ ধরনের পুস্তক অন্য লেখকরাও লিখেছেন। আধুনিক গ্রন্থকাররা বলেছেন প্রাক-ইসলামী আরব গোত্রের মধ্যে সত্তরের বেশি মূর্তির পূজা হতো।
কারাঘরে ও আশপাশে যেসব মূর্তি ছিল তাদের পূজা করত দক্ষিণ আরববাসী, মেসোপটেমিয়ান, প্যালেস্টানিয়ান, সিরিয়ান ও অন্যান্য প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোক। আহমদ বে কামাল নামে এক লেখক দেব-দেবীদের একটা বড় লিস্ট তৈরি করেছেন। তাদের সাথে প্রাচীন মিশর ও আরবে পূজিত দেব-দেবীদের সাদৃশ্য আছে। বিশ্বাস করা হয় যে এই সব প্রাচীন মূর্তিকে নিয়ে তিনশো ষাটটি মূর্তি কাবাঘরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এর মধ্যে কতগুলো ছিল লম্বা খাড়া পাথর, কতক ছিল অমার্জিত মনুষ্য ও পশু আকৃতি। আর কতকগুলো ছিল প্রাগৈতিহাসিককালের নূহের প্লাবনের সময়কালের।
অনেকে মনে করেন যে, এখন কাবাঘরে যেসব থাম বা পিলার আছে, সেগুলোর মধ্যে অনেক থাম বা পিলার সেই অরিজিনাল লম্বা খাড়া পাথরের উপর নির্মিত। প্ৰাক- ইসলামী যুগে মক্কায় যে বাৎসরিক তীর্থ মেলার রেওয়াজ ছিল, তখন পশু বলি হতো এই সব দেবী-দেবতার বেদীমূলে। (ইসলাম আগমনের পর কাবাঘরের চত্বরে রক্তপাত বন্ধ করা হয়।) প্রফেট মোহাম্মদের জন্মের বহু পূর্বে এখান থেকে এক খণ্ড লম্বা পাথর, কথিত আছে, পশ্চিম ইন্ডিয়ার সোমনাথ মন্দিরে শিবলিঙ্গ রূপে প্রতিষ্ঠা করে পূজা করা হতো। ১০২৪ খ্রিস্টাব্দে গজনীর সুলতান মাহমুদ কর্তৃক এই মন্দির আক্রমিত হয় ও মূর্তি ধ্বংস হয়।
আরব গোত্রে অন্যান্য দেব-দেবী যারা পূজিত হতো তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :
দেদানে ভাগ্যের দেবতা ছিল গাদ্দ। রাবিয়া গোত্রের দেবতা ছিল রোধা; এর প্রতীক ছিল সন্ধ্যাতারা। কিনানা গোত্রের দেবতা ছিল সাদ। এর আকৃতি ছিল লম্বা পাথর। এই পাথরের পদতলে রক্ত বলির ব্যবস্থা ছিল। কোদা গোত্র পূজা করত অমার্জিত চার কোণা কালো পাথর- নাম ছিল ওকাইসির।
মুনহিব ইবন দাউস গোত্র পূজা করত জুল কাসাইনকে। এর প্রতীক ছিল হাতের দুই চেটোর মতো (Two palms of hand)।
প্যাগন তাঈ গোত্রের মনুষ্যাকৃতির মূর্তি পূজা পেত; এর নাম ছিল ফলস। প্রফেট মোহাম্মদ আলীকে কাবাঘরের মূর্তিগুলো ভাঙ্গতে পাঠান; আলী মূর্তি ভেঙ্গে ফিরে আসেন কাবাঘরে উৎসর্গীকৃত এক বিশেষ তরবারি হাতে করে। এই তরবারি জুলফিকার রূপে আলীর ব্যক্তিগত তরবারি হিসাবে রয়ে যায়। অন্য একটি বিখ্যাত মূর্তি জুলখালাসা মক্কা ও সানার মধ্যে অবস্থিত ছিল। এই জুলখালাসার আস্তানায় তীর দিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করা হতো। প্রফেট মোহাম্মদ বলেছিলেন রোজ কিয়ামতের আগে আবার জুলখালাসার বন্দনা শুরু হবে।
দক্ষিণ আরবের দেবতাগুলোর মধ্যে ছিল চন্দ্র-দেবতা হত্তবাস; চন্দ্র-দেবী আত্তার (ইস্তার), আকাশ-দেবতা সামাবি, সৌরদেবী দরবা আদান। এসব দেব-দেবী ছিল হিমিয়ার গোত্রের। তালাব ও রাইআম ছিল দুটি বৃক্ষ-দেবতা। এদের আস্তানায় গায়েবি খবরাখবর পাওয়া যেত। সানাতে যখন লোকজন ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করে তখন সেখানকার মূর্তি পূজা উঠে যায় ৪১০ খ্রিস্টাব্দে। (ফারিস, ১৯৫২, পৃঃ ১০)।
মাইন শহর-রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষক বা দেবতা ছিল নাকরা। আদেন অঞ্চলে অসানি শহর রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষক দেবতা ছিল ওয়াদ। সাবার প্রধান দেবতা ছিল আলমাকা, যার বেদিতে ধূপ-ধুনা ও সুগন্ধিদ্রব্য জ্বালানো হতো! আম্মি (আংকেল) হলো চন্দ্র দেবতা। কাতাবানের দেবতা; এর আস্তানা ছিল মারিবের নিকটে।
অশুভ বা অমঙ্গলের প্রধান ছিল স্যাটান (শয়তান)। একে ইবলিসও বলা হতো। গ্রিক শব্দ ডায়াবোলস থেকে ইবলিস শব্দটি এসেছে। তার অধীনে কাজ করত ছোট ছোট শয়তান। এছাড়াও অশুভ অস্তিত্বের আর একটা শ্রেণী ছিল যাদের ইফারিত বলা হতো। এরা আকারে দৈত্যের মতো। তারা সব সময় মানুষের অমঙ্গল চিন্তা করত ও ভয় দেখাত।
জিন জাতির নাম-ডাক ছিল। এক বচনে জিনি। ইরানের আবেস্তাতে জাইনি। ‘জাইনি’ অর্থ দুষ্ট আত্মা (wicked spirit)। এই জাইনি বা জিনি আরামাইক ভাষায় ঢুকে যায়; পরে আরামাইকভাষী খ্রিস্টানরা প্যাগন গডদের জিনি বলতে শুরু করলেও শেষে দৈত্যদানোর পর্যায় নেমে আসে। স্যাটানের মতো জিনিদের আগুনের শিখা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এরা মানুষ বা পশুর রূপ ধরে বাতাসে, পাহাড়ে, গাছে এবং অন্ধকারে ও মরুভূমির প্রান্তরে মিশে থাকে। সাধারণত তারা গায়ে পড়ে কারো ক্ষতি করে না, তবে মাঝে মাঝে মানুষদের হয়রানি করে ছাড়ে।
কোরানে জিন নামে একটা সূরা আছে, যেখানে বলা হয়েছে যে একদল জিন কোরান শুনে মুসলমান (বিশ্বাসী) হয়ে যায় (৭২ : ১)
২.১৩ প্রকৃতি পূজা
প্রাচীন বিশ্বের অন্যান্য মানুষের মতো আরবরাও প্রাকৃতিক বস্তু— যেমন গ্রহ, নক্ষত্র, পাথর, বৃক্ষ ও কূপের পূজা করত। সার্বিয়েনরা ছিল নক্ষত্র পূজারী, হিমিয়ার বাসীরা সূর্যের আরাধনা করত; আসাদ ও কিয়ানা গোত্রের লোকেরা চন্দ্রের পূজা করত, এছাড়া পূজা করত ভেনাসের ও সাইরিয়াসের (লুব্ধক নক্ষত্র)। বলা হয় যে, কাবা ঘরকে উৎসর্গ করা হয়েছিল মহান দেবীকে বা চন্দ্র দেবতাকে।
শাহরাস্তানির মতে (মৃ. ১১৫৩) আরাবিয়ানদের মধ্যে প্রচলিত যে, কাবাতে তাওয়াফ করাটা মূলত গ্রহের কক্ষপথে ঘোরার প্রতীক (রডওয়েল, ১৯১৫, পৃঃ ৪৫৫)। তিনজন দেবী লাত, মানাত আর উজ্জা, চন্দ্র, ভেনাস গ্রহ, সাইরিয়াস (লুব্ধক নক্ষত্র)-এর ওপর সভানেত্রিত্ব করে। কোরান বলে আল্লাহ সাইরিয়াসের প্রভু (৫৩:৫০)।
বহু প্যাগন গোত্রের পৃষ্ঠপোষক দেবতাদের সাথে পাথরের সম্পর্ক আছে। আরবরা কালো পাথরকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করেছে এবং এখনো করছে। বলতে কি, পাথর পূজা পৃথিবীব্যাপী ধর্মীয় আচরণ। বিভিন্ন আকারের, ঢঙের ও রঙের পাথরকে মানুষ ভক্তি-শ্রদ্ধা করেছে, অর্ঘ্য চড়িয়েছে। এইসব পাথরকে স্পর্শ করা, চুম্বন করা এবং ঘরে ও আস্তানায় প্রতিষ্ঠা করা একটা রেওয়াজে দাঁড়িয়েছিল। পাথরে পবিত্রতা আছে এটাই প্রমাণ করেছে।
নাবাতিয়ানদের দেবতা ধুশারা এবং এমেসার (এখন সিরিয়ার হোমস্) এলোগাবাল, উভয়ের আকার ও প্রতীক কালো পাথর। (এমেসার কালো পাথরটি ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম দখলের পর ধ্বংস করা হয়েছে, পাছে এটা মক্কার কাবাঘরের সাথে প্রতিযোগিতা না করে এর জন্য; আর এখানকার প্রধান খ্রিস্টান গোত্রদের নির্বাসনে পাঠানো হয়।)
অনেক রকমের বৃক্ষ ও দেব-দেবীর রূপ পরে পূজা পেয়েছিল। কোনো কোনো সময় আসল বৃক্ষও পবিত্রতা অর্জন করেছে, যেমন মেসোপটেমিয়ার খেজুর গাছ এবং অন্য ক্ষেত্রে বৃক্ষকে পাথর ভেবে শ্রদ্ধাভক্তি করেছে সেমেটিকেরা। আরবরা বিশেষভাবে আকাসিয়া বৃক্ষকে পবিত্র জ্ঞানে শ্রদ্ধা করত। বাইবেলের শিতিম (ছাতিম?) বৃক্ষ যা দিয়ে আর্ক (জাহাজ) তৈরি করা হয়েছিল, সে গাছ ছিল আকাসিয়া। আকাসিয়া বৃক্ষ উজ্জা দেবীর আস্তানার প্রতীক। মক্কার পশ্চিমে তিহানা উপকূলে একটা বিখ্যাত আকাসিয়া গাছ জন্মেছিল।
প্রফেট মোহাম্মদ ও তার অনুসারীগণ যখন হোদায়বিয়ায় শপথ গ্রহণ করেন, তখন একটি আকাসিয়া বৃক্ষের নিচে করেছিলেন। এই বৃক্ষটি পরে হাজীদের জন্য পবিত্র স্থান হয়ে ওঠে এবং তারা দর্শন দিতে শুরু করেন; তাই খলিফা ওমর এই গাছটি কেটে ফেলেন।
কাবার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সর্বজনজ্ঞাত আরবের জমজম কূপটি বড় পবিত্র। একজন দেবদূত এই কূপটির ঠিকানা হ্যাগার (হাজেরা)কে বলে দেন, যখন হ্যাগার ও তার পুত্র ইসমাইল ছাতি ফাটা তৃষ্ণায় কাতর হয়েছিলেন। জোরাস্ত্রিয়ানদের কাছেও এই কূপটি খুব পবিত্র ছিল। অনেক পুরানো আরবি কবিতার একটি চরণে এই কূপটির নাম উল্লেখ করে বলেছে যে, এখানে প্রাচীন পারস্যবাসীরা গুনগুন করে নিচু স্বরে মন্ত্র পড়ে প্রার্থনা করত, তাই এর নাম জমজম। প্রফেট মোহাম্মদ-এর আবির্ভাবের এক শতাব্দি পূর্বে এই কূপটি মজে গিয়েছিল এবং কূপের এ বদ্ধাবস্থা সংস্কার করেন প্রফেটের দাদা আব্দুল মোত্তালেব।
হাজীরা এই কূপটিকে খুব তাজিম ও শ্রদ্ধা করে, এর পানি পান করে এবং বোতলে ভরে নিয়ে দেশের বাড়িতে চলে যায়। মরণোন্মুখ রোগীরা এই বোতলের পানি চুমুক দেয় স্বর্গীয় আশীর্বাদ লাভের আশায়।
২.১৪ নারীপ্রীতি
এটা বেশ মজার ব্যাপার ও কৌতূহলোদ্দীপক, কেমন করে নারীদের জন্য এই দুর্বোধ্য ধারণা (esoteric concept) জন্মেছিল এবং তা সারা আরব জীবন মূলে প্রোথিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য ধর্মের মতো, প্রাচীন আরব ধর্মে নারীপ্রীতি প্রবল ছিল। ধর্মকর্মে ও আরাধনায় নারীপ্রীতি প্রাধান্য পেয়েছে, তাই প্রাচীন মিথোলজিতে মহান দেবীদের আবির্ভাব বেশ ‘কমন’।
নারী-দেবতা, যেমন আল্লাত, উজ্জা ও মানাত আরবে পুরুষের ওপর গুরুত্বপূর্ণরূপে আধিপত্য বিস্তার করেছে। এমনকি সৌর দেবতাকে আরব গোত্র মহিলা- রূপ দিয়ে শামস বলেছে, যদিও চন্দ্রকে দেবতারা শাসন করেছে কিন্তু এই দেবতাকে অতি উত্তম নারীর রূপ দেয়া হয়েছে।
কাবাঘরকে প্রথমে তৈরি করা হয় কালো পাথরের যোগ্য পীঠস্থান রূপে। এই কালো পাথরকেও মহান দেবীর প্রতীকরূপে বিশ্বাস করা হয়। কাবাঘরের নাম প্রথাগতভাবে নেয়া হয় কিউব (Cube) শব্দ থেকে। সঠিকভাবে এর উৎস খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবে এক প্রাচীন শব্দ ‘কাআব’ (Kaab), যার অর্থ কুমারী (Virgin)। এই ভার্জিন শব্দের সাথে মিল রয়েছে পুরাতন সেমেটিক শব্দ-মূল QBA-এতে; এই QBA-এর অর্থ হচ্ছে স্ত্রী-অঙ্গ (Pudenda), এমনকি আজও কালো পাথর ঘিরে কিনারার আকৃতি গমের মতো (Vulva) এবং সমস্ত পীঠস্থান (Shrine) একটি ডিম্বাকৃতি স্থানের ওপর প্রতিষ্ঠিত। দামস্কের জন (John of Damascus)—মৃত ৭৪৯- কাবা শব্দটিকে কুবার অর্থাৎ প্রেমের নক্ষত্রের সাথে সমন্বয় করেন।
মহান দেবীর অন্য আর একটি প্রতীক হলো পূর্ণচন্দ্র এবং কাবাকে এই চন্দ্রদেবীর কাছে উৎসর্গ করা হয়। আসলে আরববাসীদের রহস্যজনক সম্পর্ক হলো চন্দ্রের সাথে এবং আরবদের ভাগ্যই নির্ধারণ করে এই চন্দ্রদেবী। এমনকি আরবের মাস ও বৎসর চন্দ্রের সাথে জড়িত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় প্রফেট মোহাম্মদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ঘটেছিল বদর নামক স্থানে আর বদর অর্থ ‘পূর্ণ-চন্দ্র’ (Frieling, 1978, P, 48)।
চান্দ্র মাসের ১/৪ অংশ হচ্ছে সাত এবং সাত সংখ্যা হচ্ছে চান্দ্র নম্বর। হেরোডেটাস উল্লেখ করেছেন যে, আরবগণ শপথ গ্রহণের সময় সাতটা পাথর ব্যবহার করে। ঐতিহাসিক মাসুদী (মৃ. ৯৫৬) লিপিবদ্ধ করে গেছেন যে, এক পুরানো বিশ্বাস মতে কাবাঘরকে উৎসর্গ করা হয়েছে সাতটি স্বর্গীয় বস্তুর ওপর। প্রাক-ইসলামী যুগে কাবাকে বাঁ দিকে রেখে সাত বার প্রদক্ষিণ করা হতো। বাঁ দিকে রাখার অর্থ হচ্ছে যে মেয়েদের স্থান পুরুষের বাঁ দিকে। সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে হাজীদের সাত বার দৌড় দিতে হয়। মীনাতে সাতটা পাথর ছুড়তে হয় ইত্যাদি। পুরানো কালের কিছু রীতিনীতি এখনও পালিত হচ্ছে।
ইসলামে অন্য কোনো ধাতুর, রৌপ্য বাদে, অলঙ্কার পরিধান করা নিষিদ্ধ তাই অনেক পুরুষ ও নারী রৌপ্যের আংটি ও অলঙ্কার পরিধান করে, কেননা রুপার রঙ চাঁদের মতো। মহান দেবীর পাখি হচ্ছে কবুতর ও ঘুঘু। এই জাতীয় পাখি কাবাঘরের চত্বরে ঘুরে বেড়ায়। সেখানে বা পবিত্র শহরের কোনো অংশে এই পাখি কেউ মারতে পারে না।
মুসলিমদের পছন্দের রঙ হচ্ছে সবুজ, এই রঙ তাজা সবজির এবং মহান দেবীর পছন্দের রঙ। মুসলিম সেনাবাহিনীর পতাকা সবুজ ছিল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ত্রিকোণা বিশিষ্ট (Hughes, 1977, P. 607)। এই সবুজ রঙ মেয়েদের বোঝায়। উমাইয়াদের রঙ ছিল সাদা, আব্বাসীদের কালো; কিন্তু ফাতিমিদের (প্রফেটের বংশধর) রঙ ছিল সবুজ।
আল্লাহকে আহ্বান করার রীতি হলো তাসমিয়া যাতে আল্লাহকে দয়ালু ও করুণাময় বলা হয়- এই উভয় গুণাবলি নারীদের। প্রথাগতভাবে বলা হয় যে কোরানের বাণী বহন করে এনেছিলেন গ্যাব্রিয়েল (জিব্রাইল), যিনি আধ্যাত্মিকভাবে চন্দ্রের সাথে জড়িত। প্রফেট মোহাম্মদও কোরানের কিছু আয়াত পেয়েছিলেন সাকিনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে; সাকিনা হলো আল্লাহর আত্মার নারী অংশ বিশেষ।
উল্লেখ্য যে, ক্রিসেন্ট বা নতুন চাঁদের অবয়ব মূলত ভেনাস গ্রহের প্রতীক এবং ইস্তারেরও; পরবর্তীতে কুমারী মেরির প্রতীক রূপে খ্রিস্টানরা গ্রহণ করেছে। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দির পর থেকে ভিনিস, নেপলস, কনস্ট্যান্টিনোপল এবং অন্যান্য স্থানে খ্রিস্টান যুদ্ধবাজগণ ও সামন্তগণ ব্যাপকহারে মাতা মেরির নামে ক্রিসেন্ট ব্যবহার করেছে। ১৪৫৩ খ্রিঃ যখন কনস্ট্যান্টিনোপল অটোমেন তুর্কিরা দখল করে তখন বিজয়ের চিহ্ন স্বরূপ তুর্কিরা বাইজানটাইন প্রচলিত শাসন ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে নেয়। এই তুর্কি থেকেই মুসলিম বিশ্বে তাদের পতাকায় ক্রিসেন্ট (অর্ধচন্দ্র) ব্যবহার করতে শুরু করে।
প্রাক-ইসলামী আরব গোত্রে প্রায় সকলেই চান্দ্র বৎসর অনুসরণ করত এবং প্রফেট মোহাম্মদ তাই চালু রাখেন এবং মুসলিম পালা-পার্বণ এখনো এই চান্দ্ৰ বৎসরেই পালিত হয়। প্রাচীন আরবে প্যাগন কমিউনিটি গণসম্মেলনের (জুমা) জন্য শুক্রবারকে গ্রহণ করেছিল, কারণ শুক্রবার চন্দ্রের কাছে উৎসর্গীকৃত এবং পরবর্তীতে মুসলিমরা ‘সাবাত’ হিসাবে এই শুক্রবারকেই বেছে নেয়। মুসলিম সনের প্রথম দিন ছিল শুক্রবার।
ইসলামী যুগে বড় বড় মসজিদে (জুমা মসজিদ) পরিচর্যাকারীরা ছিল খোজা (eunuchs)। চতুর্দশ শতাব্দির শেষের দিকে মরোক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা বলেছেন যে, মদিনার মসজিদ-ই-নববীতে পরিচর্যাকারীরা ছিল খোজা এবং তাদের প্রধান ছিলেন একজন আবিসিনিয়ান যার মর্যাদা ছিল একজন আমিরের মতো। খোজাদের এই সূত্র খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবে ফ্রিজিয়া (Phrygia), ইফেসাস (Ephesus) এবং অন্যান্য স্থানের মহান মাতার মন্দিরগুলোতে।
মৃত্যু, শেষকৃত্য এবং এর সংশ্লিষ্ট সব অনুষ্ঠান হতো মহান দেবীর আস্তানাতে (in the shrines of the Great Godess)। এমনি আনুষ্ঠানিক কৃত্যকর্ম সংঘটিত হতো আরাবিয়ান মন্দিরে। কাবাঘরের আশপাশে বহু মহাপুরুষের সমাধি আছে বলে কথিত (A.J. Wensinck, in SEL 1974 P. 197) এবং জানা যায় যে মৃতদেহ নষ্ট হবার পূর্বে শোভাযাত্রাসহকারে এই সব পীঠস্থানে নিয়ে আসা হয়।
পৌত্তলিক যুগে নারী-পুরুষের সঙ্গম প্রক্রিয়া, বেশ্যাবৃত্তি, সমকামিতা, অন্যান্য যৌন আচরণের কর্মকাণ্ড এই মহান দেবীর মন্দিরের চত্বরেই অনুষ্ঠিত হতো। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে এই ধরনের আচরণ কাবাঘরের আশপাশ ঘিরে ঘটত। পরবর্তীতে এসব ঘটনা মাঝে মাঝে ঘটেছে এবং অর্থোডক্স ও হাজীদের দ্বারা এর নিন্দাবাদও হয়েছে। মাঝে মাঝে এ ধরনের রিপোর্ট পাওয়া গেছে ঊনবিংশ শতাব্দি পর্যন্ত এবং এই রিপোর্ট দিয়েছেন মুসলিম ও নন-মুসলিম উভয় পরিব্রাজকরা।
জন লুই বারখারর্ড (John Lewis Burkhardt) মক্কাতে গিয়েছিলেন ১৮১৪ সালে। তিনি লিখেছেন : The Holy Kaaba is rendered the scene of such indecencies as cannot with propriety be more particularly noticed. They were not only practised here with impunity, but almost publicly” ভাষায় বলতে গেলে বলা যায় যে, পবিত্র কাবাঘরে যেসব কর্মকাণ্ড ঘটে তা দেখার মতো নয়। এসব কাণ্ড লুকিয়ে চুরিয়ে হয় না, হয় প্রায় জনসম্মুখে।
১৮৮২ সালে মদিনা সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে চার্লস মন্টেগু ডাফটি (Charles Montagu Doughty) বলেছেন- তাস খেলা, রকবাজি করা, গাঁজা খাওয়া ও মাস্তানি সম্বন্ধে। এই সব যথেচ্ছাচার শুধু সৌদি শাসনের ‘পিউরিটানিক’ শক্ত হাতে দমন করা সম্ভব।
২.১৫ ইসলাম-পূর্ব নারী
মধ্যপ্রাচ্যে প্রখ্যাত রানী ও অদম্য বীরাঙ্গনাদের কথা অজানা নেই। নিনেভের কিংবদন্তিসম সেমিরামিস শেবার রানী এবং মিশরের ক্লিওপেট্রার নাম উল্লেখযোগ্য।
আরবেও নারী প্রশাসক এবং নারী গোত্র প্রধানদের বম্বা ইতিহাস আছে যেমন রানী জাজিবা, রানী শামসি, ইয়াতি তাঈল খুনু, তুবা এবং আদিয়া। এই সব রানী ও গোত্র প্রধানরা এসিরিয়ান রাজাদের প্রতিরোধ করেছিল। লিহিয়ানাইট রাজ্যেও রানী ছিল, তারপর ছিল নাইলা যাকে যাব্বা বলা হতো, কোদাআ কনফেডারেসির রানী, যিনি ২৭০ খ্রিস্টাব্দে ব্যাবিলনের উত্তর ইউফ্রেটিস নদীর তীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। পালামিরাতে ছিলেন জেনোবিয়া। উল্লেখ্য যে জেনোবিয়া ও জাব্বা দুইজন আলাদা রমণী। জাব্বার বোন জুবাইবা নদীর অন্যদিকে একটি শহর শাসন করতেন। কোদাআ গোত্রের একটি শাখা তানুখ গোত্রের নেতা জাদিমা ইবন ফাহম যখন জুবাইবার এলাকা আক্রমণ করার চেষ্টা করে তখন জাব্বা একটি যুদ্ধে তাকে সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত ও নিহত করেন! এই রানীর কীর্তিকথা প্রথম দিকের আরবি কবিতায় উল্লেখ আছে।
প্রাক-ইসলামী আরবের কবিতা ও কাহিনী থেকে এটা প্রমাণিত যে সেই সব দিনে আরব রমণীরা উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ছিল এবং তাদের যৌন স্বাধীনতা সামাজিকভাবে অনুমোদিত ছিল। প্রাক-ইসলামী আরব সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক এবং মাতৃ ধারায় সন্তানগণ পরিচিত ছিল। এটা জানা জরুরি ছিল একটি শিশুর পিতার চেয়ে মাতার পরিচয় জানার।
প্রাচীন আরব সমাজে শিশুরা মায়ের পরিবারে বাস করত এবং সেই পরিবারভুক্ত ছিল। আরবে, শহরে এবং বেদুইনদের মধ্যে বংশ তালিকা খোঁজা হতো মায়ের বা নারীর পূর্ব মাতৃগোত্রে এবং নারী ও পুরুষ উভয়ের মায়ের গোত্রভুক্ত বলে বিবেচিত হতো। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে পরিবার প্রধান ছিল মা এবং তার মৃত্যুতে নেতৃত্ব চলে যেত অন্য নারীতে। সম্পত্তি, উত্তরাধিকার, সাম্প্রদায়িক প্রশাসন এবং সামাজিক মর্যাদা সবই দেখাশোনা করত মা, বোন, কন্যা, খালা বা অন্য আত্মীয়।
আল-বোখারী (মৃ. ৮৭০) বলেন যে প্রফেট মোহাম্মদকে এক ব্যক্তি তিন বার জিজ্ঞাসা করেছিল বাপ-মা-এর মধ্যে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি কে? তিনি জবাব দিয়েছিলেন তিন বারই মা। এর পর চতুর্থ বার জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেন বাপের অবশ্য একটা দাবি আছে তবে মায়ের বেশি।
সমাজে নারীদের মর্যাদা ছিল এবং তারা ছিল ঘোমটাবিহীন, কোনো পর্দা ছিল না। তারা পর্দা ব্যবহার করত লজ্জা ধারণ করার জন্য কিংবা নিজেদের পরিচয় গোপন করার জন্য; এছাড়া তারা পর্দা না করেই মুক্তভাবে সমাজে চলাফেরা করতে পারত। নারী-পুরুষের মেলামেশা ও প্রেম সমাজে স্বীকৃত ছিল। ব্যভিচার পাপ বলে গণ্য হতো না, তবে পারিবারিক সম্পত্তির অধিকার থেকে আইনগতভাবে বঞ্চিত হবার কারণ হতো। (J.Schacht in SEI, 1974, P. 658)
যদিও অবিবাহিত যুবতী মেয়েদের স্বামী বাছাই করার অধিকার ছিল না তবে মনোনীত স্বামীকে প্রত্যাখ্যান করার অধিকার ছিল এবং প্রস্তাব করতে পারত। তারা স্বামীর ঘরে নির্যাতিত হলে কিংবা অসুখী হলে বাপের বাড়ি ফিরে আসতে পারত। এটাও সত্য যে বিয়ের পর মেয়েরা সাধারণত বাপের বাড়িতেই থাকত। স্বামীরা মাঝে মাঝে আসত স্ত্রীদের কাছে।
আরবে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ সাধারণ ব্যাপার; হরহামেশাই হতো এবং পুরুষের সাথে নারীর সমঅধিকার ছিল এ ব্যাপারে। বেদুইন যুবতী বিধবা কিংবা তালাকী নারী নিজের তাঁবুতে বাস করতে পারত এবং সেখানে ইচ্ছা করলে পুরুষ সঙ্গী রাখতে পারত (Glubb, 1717, P/28)। তারা তাদের পরবর্তী স্বামী বেছে নিতে পারত, কারো সাহায্যের প্রয়োজন হতো না। যেমন যুবক মোহাম্মদের কাছে বিধবা খাদিজা নিজেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠান
সাধারণত একটি নারী কেবলমাত্র কোনো সময়ে একজন স্বামী নিয়েই থাকত, তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পলিয়ান্দ্রি (মেয়েদের একাধিক স্বামী) নিয়মস্বীকৃত থাকলে মেয়েরা একাধিক স্বামীর ঘর করত একই সময়ে। মেয়েরা ঘন ঘন বিয়ে করতে পারত ও করত এবং এই নিয়ম এমনভাবে শিকড় গেড়েছিল যে পরবর্তীতে একে উচ্ছেদ করা যায়নি। বিংশ শতাব্দির শুরুতে রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে ভূপালের বেগম বলেছিলেন যে, মক্কার নারীরা কমপক্ষে দশ দশটা বিয়ে করে এবং দুটো-তিনটে সংখ্যা খুবই কম। স্বামীর বয়স হলেই মেয়েরা তাকে ছেড়ে সুন্দর, স্বাস্থ্যবান ও ধনী যুবক বিয়ে করত (Muir 1912, P. 294)।
সিরিয়ার রোমান ঐতিহাসিক এমিয়ানাস মার্সেলেনাস (মৃত ৯০ খ্রিঃ) ব্যাপকভাবে মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণ করে তার সময়ে আরবের রীতি-নীতি বিশেষ করে সাময়িক বিবাহের (মুতা) কথা লিখেছেন। এই মুতা বিবাহ এখনও কোনো কোনো মুসলিম দেশে চালু আছে। বার্কহার্ড (Burck hardt) বলেছেন— প্রথমদিকে আরবে রীতি ছিল পরিবারের মেয়েকে, সাধারণত গৃহকর্তার স্ত্রীকে, পরিব্রাজক অতিথির কাছে রাত্রি যাপনের জন্য দেয়া হতো। এই রীতি অনেক দিন ধরে মরুগোত্র মাঝে বিরাজ করেছে। এই শিথিল সামাজিক অবস্থার কারণে আরবদের অদমিত যৌন ক্ষুধা জেগেছিল এবং সেইভাবে পার্শ্ববর্তী দেশ সিরিয়া ও মিশরবাসীদের কাছে পরিচিত ছিল।
এমিয়ানাস মার্সেলিনাস মন্তব্য করেছেন— এই যৌন ক্ষুধার কারণে আরবে নারী-পুরুষে ব্যভিচারের ঘটনা অত্যধিক বেড়েছিল। এক তালমুদিক চিকিৎসক রাব্বী নাথান লিখেছেন যে, আরবে যে পরিমাণে ব্যভিচারের ঘটনা ঘটে, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এ ধরনের দৃষ্টান্ত নেই।
আরবে শিক্ষিত নারীর প্রসার ছিল এবং এদের মধ্যে কেউ কেউ বিতর্ক প্রতিযোগিতা, কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে, বিশেষ করে মক্কার নিকট ওকাজের বাৎসরিক মেলাতে। নামকরা মহিলা কবিদের মধ্যে ছিলেন খানসা (আসল নাম তোমাদির)। ইনি মারা যান ৬১৬ সালে যখন প্রফেট মোহাম্মদ ইসলাম প্রচার শুরু করেন। সক্রিয় ব্যবসা-বাণিজ্যেও মহিলারা অংশগ্রহণ করে প্যালেস্টাইন, সিরিয়া ও পারস্যে তাদের পণ্যদ্রব্য পাঠিয়েছে উটের বহরে। প্রফেট মোহাম্মদের প্রপিতামহ সালিমা মদিনার একজন ধনী মার্চেন্ট ছিলেন এবং তিনি নিজেই তার ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতেন। ইনি মক্কার হাশিমকে এই শর্তে বিবাহ করেন যে তিনি তার ব্যবসার মালিকানা বজায় রাখতে এবং তার তালাক দেয়ার অধিকার থাকবে। প্রফেট মোহাম্মদের স্ত্রী খোদেজা বিশাল ব্যবসা-বাণিজ্য নিজেই পরিচালনা করেছেন। আবু জাহিলের মাতা পরিচালনা করতেন একটি লাভজনক পরিফিউমের ব্যবসা। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ সিরিয়ান বর্ডারে খ্রিস্টানদের কাছে তার পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করেছেন।
মোট কথা আরব মহিলারা নির্ভীক, স্বাধীন চেতা ও সাহসী ছিলেন। তারা প্রায় স্বামীদের সাথে যুদ্ধে গিয়েছেন এবং পেছনে থেকে সৈন্যদের ও পরিবারের সদস্যদের উৎসাহিত করেছেন শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য। নিজের দল পিছু হটলে বা পরাজিত হলে তারা গালি দিয়েছেন, ধিক্কার দিয়েছেন এবং সময়ে সময়ে নিজেরাই তেড়ে গেছেন শত্রুদের সামনে। এই মহিলা যোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের যে ট্রাডিশন তা প্রফেটের আমল পর্যন্ত চলেছিল এবং এটা জানা কথা যে কিছু কিছু মহিলা যেমন নোসাইবা প্রফেট মোহাম্মদের পক্ষে যুদ্ধে শামিলও ছিলেন।
২.১৬ প্যাগন রীতি রয়ে গেছে (Pagan survivals)
আব্রাহাম যে একেশ্বরবাদ প্রচার করে গেছেন মূলত প্রফেট মোহাম্মদ সেই একেশ্বরবাদই প্রচার করলেন এবং যেখানে পৌত্তলিকতা বা বহুঈশ্বরবাদ সেখানকার স্থানীয় প্যাগানিজম-এ হস্তক্ষেপ করেননি। তিনি মূল আরব বিশ্বাসের ভিত্তিকে নড়বড়ে না করার জন্য সতর্ক ছিলেন; তাঁর সমসাময়িক প্যাগনদের যথেষ্ট ছাড় দিয়েছিলেন। যেখানে কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল না, সেখানে কোনো পরিবর্তন করেননি।
তিনি প্রাক-ইসলামী পঞ্জিকা পদ্ধতির পরিবতর্ন করেননি অথবা প্যাগনদের মাসগুলোর কোনো সংশোধনও করেননি, সেগুলো রয়ে গেছে (৯:৫)। প্যাগনদের পবিত্র উপাসনালয় মক্কা মাতৃনগরী (Mother city) রূপে পরিচিতি পেয়েছে (৪২:৫) এবং প্রার্থনার কেন্দ্রভূমি ও বিশ্ব মুসলিমের তীর্থ ক্ষেত্র রূপে পরিগণিত হয়েছে।
প্রফেট মোহাম্মদ যে ঈশ্বরকে বেছে নিলেন তার স্থানীয় নাম ‘আল্লাহ’ বলে ঘোষণা করলেন, যে নাম আরবদের প্যাগন ও নন-প্যাগন উভয়ের প্রধান দেবতা ছিল ইসলামের পূর্বে। কাবাতেই তার স্থান হলো। কোরান মুসলিমদের নির্দেশ দিচ্ছে এই ঘরে প্রভুর পূজা করো (১০৬:৩)। ‘ঘর’ অর্থ কাবা। প্যাগনদের এই পবিত্র ভূমির কোনো পরিবর্তন হলো না।
পুরানো প্যাগন অনুষ্ঠান (ceremonies) গুলো প্রায় সবই রাখা হলো এবং আজো পর্যন্ত সেই সব প্রচ্ছন্ন অনুষ্ঠানগুলো মুসলিম বিশ্বাসে জেগে রইল, এমনকি যে কালো পাথরকে প্রাচীন আরবরা পূজো করে গেছে সেই কালো পাথর হজের কেন্দ্রীয় আনুষ্ঠানিক বস্তু (the central rite of the muslim pilgrimage)।
হিজরার পূর্বে মক্কাতে এবং পরে মদিনাতে প্রফেটের প্রধান প্রধান অনুসারীদের অনেকের বিশ্বাস নড়বড়ে ছিল। এরা ছাড়া অন্যেরা ছিলেন গোঁড়া একেশ্বরবাদী, তবু তারা মনে করতেন ইসলাম গ্রহণ করার অর্থ এই নয় যে তাদের পুরানো বিশ্বাস একেবারেই পরিত্যাগ করতে হবে। আমরা দেখেছি প্রফেটের সময় একেশ্বরবাদ এমন কিছু নতুন আবিষ্কার নয়, আদর্শও নয়। শতাব্দি ধরে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সাথে ও হানিফদের সংস্পর্শে এসে একেশ্বরবাদের সাথে পূর্ব পরিচয় ছিল এবং এও জানা ছিল যে ঈশ্বর একজনই। একই সময়ে আরবদের এ-ও মনে হয়েছে যে একেশ্বরবাদের সাথে আরও ছোট ছোট দেব-দেবীদের শ্রদ্ধা মান্য করা দোষের কিছু ছিল না। অনেক আরব মক্কার প্যাগনসহ, আল্লাহকে প্রধান ঈশ্বর, স্বর্গ ও মর্তের সৃষ্টিকর্তা বলে বিশ্বাস করত (২৯:৬১) এবং কোনো মন্দিরে এর প্রতিমূর্তি ছিল না। তবুও তারা অবাস্তব দেব-দেবীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেছে যাদের আল্লাহর সঙ্গী বা বানাতাল্লাহ-আল্লাহর কন্যা বলে বিবেচনা করা হয়েছে। এদের নিজস্ব স্থানে মূর্তি গড়ে পূজা করা হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজন প্রধান দেবতার সাথে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে পরিচিত ছিল এবং এরা পূজারীদের আল্লাহর নৈকট্য লাভে সাহায্য করত (৩৯:৪)। পূজারীগণ তাদের উৎপাদিত দ্রব্যাদির একাংশ আল্লাহর জন্য এবং আর এক অংশ অধঃস্তন দেব-দেবীদের জন্য তুলে রাখত।
ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে শিথিল বিশ্বাসের কিছু মুসলিমকে কোরানের বাণী লেখার জন্য কিংবা কোরান সংকলনের কাজে নিযুক্ত করা হয় যখন কোরান সংকলিত হয়। এটা সত্য যে, ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে অনেকেই তাদের পুরানো দেব- দেবীদের কথা বাহ্যিকভাবে উচ্চারণ না করলেও স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি।
এ ধরনের চিন্তাধারা ইহুদিদের মধ্যেও দেখা দিয়েছিল যখন তারা কেনানে প্রবেশ করে কেননা সেখানে প্রাচীন দেব-দেবীদের কেউ মুছে ফেলতে পারেনি। তেমনি মিশরীয় দেব-দেবীদের স্মৃতি জড়িয়ে কপ্টিক খ্রিস্টানটির সাধুদের উদ্ভব হয়েছিল। ৫৯৬ খ্রিস্টাব্দে যখন পোপ প্রথম গ্রেগরি দ্য গ্রেট সেন্ট অগাস্টাইনের সাথে নিগ্রো হাড্রিয়ান ও অন্য সাধুদের ইংল্যান্ডে পাঠান ইংলিশদের খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষা দিতে, তিনি তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্যাগন মূর্তিগুলো ভেঙ্গে দিতে, কিন্তু তাদের মন্দিরগুলো রক্ষা করে খ্রিস্টানদের ভজনালয় তৈরি করতে। খ্রিস্টান সাধুদের মধ্যে প্যাগন দেব- দেবীদের স্মৃতি রক্ষায় প্যাগন, খ্রিস্টান চার্চে প্যাগন মন্দির কাঠামো ধরে রাখার, খ্রিস্টান উৎসবাদিতে প্যাগন আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম রক্ষা করার কাহিনী সারা ইউরোপের সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য বিষয়।
প্যাগন আরবীয়া তাদের পুরানো দেব-দেবীদের পরিত্যাগ করেনি, মনে ও মগজে ধরে রেখেছিল। তায়েফবাসীদের যখন তাদের বিশ্বাসকে পরিত্যাগ করতে চাপ সৃষ্টি করা হয়, তারাও দৃঢ়ভাবে চাপ দেয় তাদের দেবতাদের ধরে রাখার জন্য। সত্যি বলতে কি, প্রফেট মোহাম্মদের মৃত্যুর পর যখন মালে গণিমতের অংশ থেকে বঞ্চিত করে তাদের ওপর আক্রমণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়, তখন ইসলামের মিত্রদের প্রায় সকলেই দ্রুতভাবে ইসলাম থেকে আনুগত্য উঠিয়ে নিয়ে তাদের পূর্বপুরুষের বিশ্বাসে প্রত্যাবর্তন করে। প্রাথমিক ইসলামের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি কেমন করে এই সব আরব গোত্র তাদের পূর্ব স্মৃতিচারণ করে প্রাক-ইসলামী যুগের কথাবার্তা বলতে শুরু করে, যে সময়ে তারা ইচ্ছামতো সুরা পান করতে পারত, গান ও কবিতা শুনতে পারত।
বর্তমানকালে উত্তর আফ্রিকা ও ইন্ডিয়ার তীর্থযাত্রীরা (হজযাত্রী) এমন সব মুসলিম সাধুদের মাজার জিয়ারত করতে যান, সে সবের অনেক স্থানই প্রাচীন প্যাগন তীর্থ ক্ষেত্র। ইংলিশ পরিব্রাজক C.M. Doughty ১৮৮৮ সালে লিখতে গিয়ে বলেছেন যে তখনও পর্যন্ত তায়েফে আল্লাত, উজ্জা, মানত, এমনকি হুবালের প্রস্তর খণ্ডের দেবীমূলে গোপনভাবে অসুখ-বিসুখের জন্য আরোগ্য লাভের প্রার্থনা করেছে।
পরিশেষে, প্রফেট মোহাম্মদ আরব প্যাগনদের প্রচলিত আইনের (Customary Law) বেশির ভাগ মুসলিম শরিয়া আইনের অন্তর্ভুক্ত করে গেছেন।
২.১৭ প্রচলিত আইন (Customary law)
সব আইনের মূলে মৌলিক নীতিকে বলা হয়েছে প্রাক-ইসলামিক। এটাই শরিয়া অর্থাৎ সরল পক্ষ right way (৪৫:১৭)। শরিয়া কথাটা এমন শব্দ থেকে আহরিত যার অর্থ নির্দেশিত পথ বা যে পথ দিয়ে সকলেই চলে (beatentrack) (৫:৫২)। জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য, রেগুলেট করার জন্য মানুষদের এই পথ দিয়েই চলতে হবে, সমাজের ব্যক্তি জীবন ও সমষ্টি জীবন উভয়কেই।
শরিয়া সাধারণ নীতি থেকে উৎসারিত হয় সুন্নাহ, ‘কাস্টম’ যা প্রাক-ইসলামী সময়ে পূর্বপুরুষরা মডেল হিসাবে ব্যবহারিক জীবনে গোত্র প্রধানরা প্রতিষ্ঠা করে গেছে (Rahman, ১৯৬৬, পৃ-৪৪) এবং গোত্র সংসদের একমত দ্বারা নির্ধারিত নিয়ম (ইজমা)। এইভাবে সারা কমিউনিটিতে বিশ্বাস ও অভ্যাস গড়ে উঠেছে।
এই জ্ঞান (lore) লিপিবদ্ধ করা হয়েছে বংশানুক্রমে যা এক হাত থেকে অন্য হাতে গড়িয়েছে—একেই বলা হয়েছে ‘হাদিস’। ওই ‘হাদিস’ শব্দটি প্রাক-ইসলামিক শব্দ (usage) যার অর্থ কাহিনী বা প্রতিবেদন (story or report); সাধারণভাবে একেই ট্রাডিশন’ বলা হয়।
প্রচলিত আইন (Customary law) সব আরব গোত্রের মধ্যে সমভাবে প্রযোজ্য এবং সর্বক্ষেত্রে পালিত, দু’একটা যে ব্যতিক্রম ছিল না তা নয় এবং তা ছিল পরিস্থিতিনির্ভর। এর নির্দেশগুলো (Precepts) বাস্তবায়ন করা হতো সুশীল সমাজে মূল্যবোধ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে, (মুরুবা), বিশ্বস্ততা, সাহস, প্রত্যাহার, আত্মসম্মান, নিজের আত্মীয়দের প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্য, দান ও সহনীয় মনোভাবকে জাগিয়ে তোলা। এসবের পূর্ব প্রকাশ পেয়েছে প্রাথমিক ট্রাডিশনে এবং প্রাচীন আরাবিক কাব্যে।
প্রচলিত আইন সাধারণত মানুষের প্রকৃতির প্রয়োজনে পালিত হতো যেমন ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষা, হস্ত-মুখ প্রক্ষালন (ব্যক্তিগত, ধর্মীয় বা অশুচি অবস্থায়), চুলের যত্ন, দাড়ি ও গোঁফের বৈচিত্র্য, দাঁত ও নখের পরিচর্যা, অসুস্থ অবস্থায় যত্নবান হওয়া, এবং মৃত্যু ও সমাধিকরণ ব্যবস্থায়।
সামাজিক আচরণের ওপরও এই ট্রাডিশনের রীতি ছিল, যেমন আতিথিয়েতার আচরণ। শ্রদ্ধা, সম্ভাষণ, সালাম বা অভিনন্দন, কথাবার্তা আদান-প্রদান ও পরমত সহিষ্ণুতা, খাদ্য ও পানীয় অনুমোদিত পোশাক-পরিচ্ছদ, আনন্দদানের ব্যবস্থা (গান বাজনা, জলসা, কবিতা পাঠ ইত্যাদি) জুয়া খেলা, তীর বা অন্য উপায়ে ভাগ্য নির্ণয়, ভোজ উৎসব, চান্দ্রমাস প্রতিপালনের অনুষ্ঠান। তীর্থযাত্রা, রোজার মাসে আহার গ্রহণ না করা [সকাল থেকে সন্ধ্যা যেমন কোরানে বলা হয়েছে (২:১৭৯)] ইত্যাদি।
মহিলাদের সম্বন্ধে বিশেষ আইন; যেমন বয়ঃপ্রাপ্তি ও ঋতুমতি হওয়া; ব্যভিচার বিবাহ; পণপ্রথা, তালাক, বহুবিবাহ, উপপত্নী ব্যবহার; সন্তান-সন্ততি, দত্তক গ্রহণ এবং খাৎনা করা ইত্যাদি। গোত্র কমিউনিটিতে আইনের সমব্যবহার (উম্মাহর ব্যাপারে)— গোত্রে গোত্রে সমঝোতা জুরিসপ্রুডেন্স (ফিক্হ); শপথ গ্রহণ; সাক্ষ্য; রাজনীতি, সভা-সমিতি, কর ধার্য; সম্পত্তি ও উত্তরাধিকার, দান ও ওসিয়াত; খুন- খারাবি; চুরি, আহত করা বা অযথা নিন্দাবাদ, অর্থনৈতিক সম্বন্ধীয় যেমন— ক্রয়- বিক্রয় বস্তুর বদলে বস্তু (বার্টার) বাণিজ্যিক সংযোগ; সুদ গ্রহণ ও সুদ।
সামরিক বিষয়ে অতিরিক্ত আইন; তীর ধনুকের উপযুক্ত প্রয়োগ এবং তরবারির ব্যবহার; প্রতিভূ (hostage) গ্রহণ; পুরুষ, নারী ও শিশুবন্দিদের ওপর আচরণ; শান্তি সন্ধিকরণ; আক্রমণ রক্ত-দ্বন্দ্ব বা যুদ্ধ; প্রতি আক্রমণ ও প্রতিশোধ গ্রহণ, পবিত্র মাসে যুদ্ধ, দাস-দাসীদের প্রতি ব্যবহার; সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও দাসদাসী ক্রয়-বিক্রয়; তাদের (প্রতি) আচরণ ও মুক্তি।
ঐতিহাসিক আবুল ফিদা (মৃত ১৩৩১ খ্রি) লিখেছেন : জালেহিয়া সময়ে (প্রাক- ইসলামী) আরবগণ যেসব জিনিস করেছে, ইসলাম ধর্ম সেসব গ্রহণ করেছে। এসব হওয়ারই কথা, কারণ ইসলাম গভীরভাবে অতীতেই প্রোথিত এবং নতুন বাণী আগমনের সাথে প্রচলিত ধারণার কাঠামোকে, প্রাচীন শব্দ সম্ভারসহ কিছুটা সংশোধিত করে, নতুন ধর্মে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে (incorporated into the new order) এবং সেখানে এগুলোর স্থির অবস্থান হয়েছে। কিছু কিছু বিষয়ে কোরানে গ্রন্থিত হয়েছে এবং বেশির ভাগই হাদিসে জুড়ে বসেছে।